৮. ষষ্ঠ দিন

৭১. ষষ্ঠ দিন

অনুসন্ধানের কেন্দ্রস্থল

খোলা ফটকের ওপাশে কেবলই শূন্যতা; ছোট্ট চেম্বারটাকেও মনে হচ্ছে জড়িয়ে ধরার হুমকি দিচ্ছে সেই আঁধার।

পাথুরে দরজার ওপাশে গোপন গুহাকক্ষে অন্ধকারের দুর্ভেদ্য দুর্গ ছিন্ন করার জন্য একসাথে ঝাঁপিয়ে পড়ল সবকটা সার্চলাইট। ভেতরের দৃশ্য দেখে তো স্তম্ভিত হবার যোগাড়।

গুহাকক্ষের মেঝেতে কুন্ডলি পাকিয়ে শুয়ে আছে বিভিন্ন সাইজের সব ধরনের সাপ। কোবরা আর বিষধর সাপগুলোকে সহজেই চেনা গেল। আবার এমন কিছু আছে যেগুলো খুব বেশি হলে এক ফুট লম্বা। সবুজ, মরিচা আর ছাই রঙা ছাড়াও কালো কতগুলো সাপও আছে।

শুধু ভ্যান ক্লক স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কুকের দিকে তাকিয়ে ইউরোপীয় লোকটার আত্মতৃপ্ত চেহারা দেখে বিস্মিত হয়ে গেল বিজয়। মনে হচ্ছে ক্লক যেন এরকমই কিছু আশা করেছিল।

“সবকটিকে তুলে নাও।’ আদেশ দিল ভ্যান, প্রতিটি ধরন থেকে দু’টো করে সাপ চাই। যতগুলো সম্ভব দ্রুত ভরে ফেল।”

দ্বিধায় পড়ে গেল কুপারের বাহিনি। হতে পারে কিছু কিছু কম-বিষধর সাপ আছে; তবে বেশিরভাগই বিষাক্ত।

অবস্থা দেখে গর্জন করে একের পর এক অর্ডার দিল কুপার; হাতে অস্ত্র নিয়েও প্রস্তুত রাখল। “আমি চাই সবাই এক্ষুনি কাজে লেগে পড়! তোমাদের কাছে অস্ত্র আছে। গিয়ে নমুনা তুলে আনো, যাও! প্রচুর পরিমাণে আছে; প্রয়োজন হলে গুলি করবে! দুজনে মিলে দল বানিয়ে একে অন্যের দিকে খেয়াল রাখবে।”

পরস্পরের দিকে দ্বিধান্বিত চোখে তাকালেও আস্তে আস্তে এগিয়ে গেল সবাই। দরজার কাছে দশজন দাঁড়িয়ে কমরেডদের সুবিধার্তে সার্চলাইটের আলোয় ভাসিয়ে দিল পুরো কক্ষ।

কিন্তু মানুষ দেখে সাপগুলো যেন আরো বেশি করে কুন্ডলি পাকিয়ে গেল। সাপের উপর যেন পা না পড়ে তাই সাবধানে এক হাতে ব্যাগ আর আরেক হাতে অস্ত্র নিয়ে কাজে লেগে পড়ল কুপারের বাহিনি।

তবে সাথে সাথে একটা দুর্ঘটনা ঘটে গেল। একজন কোবরার উপর পা দিতেই চোখের পলকে আঘাত হানল সাপ। মেঝেতে পড়ে গেল আক্রান্ত ব্যক্তি। কিন্তু বাকিরা যে যার কাজে ব্যস্ত। আরেক দুর্ভাগা, কোবরাকে এড়াতে গিয়ে সাপের স্তূপের ভেতর হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল। হিসহিস করতে করতে তার গায়ের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল কুন্ডলি পাকানো একগাদা সাপ। মুহুর্মুহু কামড়ে আর্তচিৎকার করা ছাড়া তার আর কিছুই করার রইল না।

সহকর্মীদের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে অন্যরা এবার আরো সতর্ক হয়ে গেল। দুইজন দুইজন করে ভাগ হয়ে রাইফেলের ব্যারেল ব্যবহার করে অতি সপ্তর্পণে সাপ তুলে ব্যাগে ভরে ফেলল। কাজের গতি অত্যন্ত ধীর হয়ে গেলেও আর কাউকে হারাতে হল না।

উদ্বিগ্ন মুখে দাঁড়িয়ে আছে বিজয়। গুহাকক্ষের লোকগুলোর ভাগ্য নিয়ে চিন্তিত নয়। বরঞ্চ ভাবছে না জানি এরপর কী ঘটবে। কী আছে রাধা আর ওর ভাগ্যে?

চোখ তুলে তাকাতেই দেখল ফিরতে শুরু করেছে কুপারের বাহিনি। খেয়াল করে দেখল যে যতক্ষণ পর্যন্ত সাপেদের উপর কারো পা পড়েনি, ততক্ষণ পর্যন্ত কারো কোনো ক্ষতি করেনি বিষধর জন্তুগুলো। মোটের উপর বলতে গেলে মানুষের অনধিকার প্রবেশ দেখে ক্ষেপে গেলেও মানুষগুলোকে সাপেরা তেমন কিছুই করেনি।

অবশেষে একেবারে শেষ জোড়াও ভাঙ্গা দরজা দিয়ে মেইন চেম্বারে চলে এলো। সবার কপালে ঘাম আর ভিজে গায়ের সাথে লেপ্টে গেছে জামা। মাটির এতটা নিচে অসম্ভব ঠাণ্ডা অনুভূত হলেও কাজ করতে গিয়ে সবাই ঘেমে নেয়ে উঠেছে।

“গুড।” খুশি হল ভ্যান ক্লক। “আমরা ভাইরাসও পেয়ে গেছি। তার মানে এখানকার অপারেশনও শেষ।”

ভ্রু-কুঁচকে তাকাল বিজয়। ভ্যান কুকের কথার অর্থ কিছুই বুঝছে না। তারা তো কেবল সাপ সংগ্রহ করেছে। তাহলে ভাইরাস কোথায় পেল?

“যাই হোক” ব্যাখ্যা করে জানাল ভ্যান, “চলো তাহলে যাই।” তারপর পাথরের মত চোখ করে একদৃষ্টে বিজয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, “আর এবার আমার মনে হচ্ছে আমেরিকানরা যেটা বলে সেই “মূল্য পরিশোধের সময় হয়েছে। গত বছর তুমি আমাদেরকে অনেক ভুগিয়েছ। আর এখন আমার মনে হয় তার ইতি টানার সুযোগ এসেছে। তুমি আমাদের সম্পর্কে আর এই অপারেশনের ব্যাপারে অনেক কিছু জেনে গেছ। তাই বুঝতেই পারছ যে তোমাকে আমরা সাথে নিতে পারছি না। তুমি এখানেই থাকবে।”

হতাশায় ডুবে গেল বিজয়। যদিও এই সম্ভাবনার কথা সবসময় মাথায় ছিল; তারপরেও ক্ষীণ আশা করেছিল হয়ত ইউরোপীয় লোকটা তার প্রতিজ্ঞা রাখবে। আরো একটু ভেবে কাজ করা উচিত ছিল। বিশেষ করে বিজয় যখন

ওদের লক্ষ্যের কথা জেনেই ফেলেছে।

তবে এখনো আরেকটা আশা আঁকড়ে ধরে আছে মন। আর সেটা নিজের জন্য নয়।

“কিন্তু রাধাকে তো ছেড়ে দেবে, নাকি?” জিজ্ঞেস করল বিজয়।

অট্টহাসি দিল কুপার, “পারলে তাই করতাম।”

“ও মারা গেছে।” যেন কিছুই হয়নি এমন ভঙ্গিতে খবরটা দিল ভ্যান কুক। “পালানোর চেষ্টা করেছিল; তাই গার্ডেরা গুলি করেছে।” তারপর নিজের লোকদের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে আদেশ দিল, “চলো সবাই!”

নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে জমে গেল বিজয়। মনে হচ্ছে শরীরের সব শক্তি যেন কেউ শুষে নিয়েছে। এতটা কাহিল লাগছে। মাথার মাঝেও শূন্যতা ছাড়া আর কিছু নেই! ধুয়ে, মুছে গেছে সব বোধ বুদ্ধি। দেহের ভার রাখতে না পেরে হাল ছেড়ে দিল দুটো পা। ধপ করে মেঝেতে বসেই হাত দিয়ে মুখ ঢাকল বিজয়।

ভালোবাসার মানুষকে হারাবার বেদনা তার অজানা নয়। পিতা-মাতাকে হারিয়েছে। আঙ্কেলও চলে গেছেন। কিন্তু কোনো ব্যথাই রাধাকে হারাবার মত তীব্র হয়নি। পাটারসন তাকে আগেই বলেছিল সেকথা। কিন্তু নিজের জীবনের চেয়েও যাকে বেশি ভালোবাসে তাকে হারাবার প্রস্তুতি কেউ কিভাবে নেবে?

অস্পষ্টভাবে যে কুয়াশার চাদর ভেদ করে শোনার চেয়েও বলা যায় অনুভব করল যে সবাই চলে যাচ্ছে। কেউ একজন যেন কিছু বলল। ওর হাতে কে যেন একটা সার্চলাইট ধরিয়ে দিল। কিন্তু গম্ভীর হতাশায় ডুবে গেছে পুরো হৃদয়। নিশ্চল হয়ে পড়েছে মন আর মাথা। দুঃসহ এই ক্ষতির বোঝার কাছে সবকিছুই তুচ্ছ।

সিঁড়ি বেয়ে উঠে চলে গেল কুপারের বাহিনি। বিজয়ের হাতে সার্চলাইট দিয়ে গেল কুপার। “আমরা ততটা নিষ্ঠুর নই” দাঁত দেখিয়ে বলল, “তোমার কাছে খানিকটা আলো রেখে যাচ্ছি; অন্তত যতক্ষণ ব্যাটারিটা আছে।”

শূন্য চোখে সামনের দিকে তাকিয়ে কুঁজো হয়ে বসে আছে বিজয়। সিঁড়ি বেয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল ভ্যান কুক আর কুপার।

এতটা শোকাভিভূত হয়ে পড়েছে যে মাথায় কিছুই ঢুকছে না। তাই এ প্রশ্নটাও বুঝতে পারছে না যে, সাপগুলো কখন ভাঙ্গা দরজা আবিষ্কার করে চেম্বারে ঢুকে পড়বে?

.

কোথাও যাবার নেই

বিজয় জানে না যে সংজ্ঞাহীনের মত এক জায়গায় কতক্ষণ ধরে বসে ছিল। কিন্তু প্রচন্ড শব্দে, চেম্বার নড়ে উঠতেই কেঁপে উঠল বিজয়। ভাঙ্গা দরজার পাথরের টুকরোগুলো এসে ভরে গেল মেঝে।

এক মুহূর্তের জন্য কেমন দিশেহারা লাগল। তারপরই বুঝতে পারল যে কী ঘটেছে, কোথায় আছে। ফিরে এলো বোধ বুদ্ধি।

সার্চলাইটের আলোয় চোখে পড়ল সিঁড়ি বেয়ে জলপ্রপাতের মত করে নেমে আসছে ধুলা। বুঝতে পারল কী হচ্ছে। উপরে উঠে টানেলের প্রবেশ মুখ উড়িয়ে দিয়েছে ভ্যান ক্লকের দল। বড় বড় পাথরের চাই দিয়ে মুখটা বন্ধ করে দেবার সময় সিঁড়ি দিয়ে গড়িয়ে পড়েছে ধুলা।

ফাঁদে আটকে গেছে বিজয়।

কিন্তু তারচেয়েও বেশি দুঃসংবাদ হল চারপাশে কিছু ঘষা খাওয়ার আওয়াজ হচ্ছে। সার্চলাইটের কিনারে শোনা যাচ্ছে হিসহিস শব্দ। যেটার উৎস অন্ধকারের জগৎ।

চেম্বারের মেঝেতে সার্চলাইটের আলো ফেলতেই আতঙ্কে জমে গেল বিজয়।

এতক্ষণ চেম্বারটাকে খুঁজে পেয়েছে সাপের দল। একের পর এক এদিকেই আসছে।

.

৭২. আক্রমণের ক্ষমতা

কপিকল বেয়ে দলের সবশেষ লোকটাও নেমে এলো নিচে। এরই মাঝে নিচে থেকে তুলে আনা মটকা আর সাপগুলোকে হেলিকপ্টারে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। পুরো দল এবারে ব্যস্ত হয়ে পড়ল উঠা-নামার যন্ত্রপাতি নিয়ে। সবকিছুকে ট্রাঙ্কে ভরে আবার হেলিকপ্টারে লোড করা হল। চারপাশে নজর রেখেছে ভ্যান ক্লুক।

“দিগন্তে পাখি দেখা যাচ্ছে।” হঠাৎ করেই বলে উঠল দলের একজন।

সবকটা চোখ ঘুরে গেল সেদিকে। থেমে গেল হাতের কাজ। পড়ে রইল ট্রাঙ্ক আর যন্ত্রপাতি।

বহুদূরে পশ্চিম দিক থেকে উড়ে আসছে ছোট্ট দুটো বিন্দু। ক্রমেই অবশ্য বড় হচ্ছে আকার।

হেলিকপ্টার। এদিকেই আসছে।

নিজের বাহিনিকে তাড়া দিল কুপার। ওইসব হেলিকপ্টারে কে আছে না জানলেও এটা ঠিক যে বন্ধুরা নয়। মিশনের এই অংশ সম্পর্কে তাদের মিত্ররা কেউ কিছুই জানে না। তার মানে হেলিকপ্টারের আগমন কোনো সুসংবাদ নয়।

“যাও, যাও, তাড়াতাড়ি!” আরো দ্রুত কাজ সারার জন্য চোটপাট শুরু করল কুপার। লিডারের কণ্ঠের ব্যগ্রতা অনুভব করে হাত চালাল পুরো বাহিনি। সাবধানে প্যাকিংয়ের পরিবর্তে ধুপধাপ করে যন্ত্রগুলো তুলে তুলে ট্রাঙ্কে ভরতে লাগল যেন তাড়াতাড়ি করা যায়।

চপারগুলোর আকার বড় হতেই কানে এলো রোটরের কটকট আওয়াজ। দ্রুতগতি সম্পন্ন হেলিকপ্টার দুটো চোখের পলকে পেরিয়ে আসছে সবটুকু দূরত্ব।

কুপার বুঝতে পারল যে এত ট্রাঙ্ক লোড করার আর সময় নেই হাতে। “কিছু জিনিস এখানে ফেলে যেতে হবে।” ভ্যান ক্লককে জানাতেই সেও সম্মত হল।

মাল লোডিং বাদ দিয়ে চটপট নিজের হেলিকপ্টারের উদ্দেশ্যে দৌড় দিল সবাই।

চোখ কুঁচকে দিগন্তের দিকে তাকাল কুপার। হেলিকপ্টারগুলো এত কাছে চলে এসেছে যে খালি চোখেও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।

“দুঃসংবাদ আছে।” ভ্যান কুককে জানাল কুপার, “কাজাক এয়ারফোর্স; ইউরোকপ্টার ইসি সেভেন্টি টু ফাইভ এস।”

মাথা নাড়ল ক্লক, “চলো, ফ্লাই করতে হবে। আশা করি তাদের কাছে কেবল মেশিন গান আর কামান আছে। কোনো রকেট লঞ্চার নেই।”

লাফ দিয়ে হেলিকপ্টারে চড়ে বসল কুপার। আস্তে আস্তে উপরে উঠে গেল দুটো হেলিকপ্টার।

দ্রুত কাছে এগিয়ে আসছে কাজাক বিমান বাহিনি। কিন্তু এতটা গতিতে ছোটার জন্য তৈরি হয়নি ভ্যান কুকের হেলিকপ্টার। একটা এম আই-২৬, পৃথিবীর সবচেয়ে ভারি মালবহনকারী হেলিকপ্টারে চড়ে বসেছে তার পুরো বাহিনি। এই চপারে বিরাশি জন মানুষ বসার বন্দোবস্ত থাকলেও কুকের ষাট জনের মিশনের জন্য দিব্যি উপযুক্ত হয়ে গেছে। এছাড়া মিশনের ভ্রমণ দূরত্ব অতিক্রম করার জন্য চারশ বত্রিশ নটিক্যাল মাইল রেঞ্জও খারাপ না। আর তার নিজের হেলিকপ্টার হল অগাস্তা ওয়েস্টল্যান্ড এডব্লিউ থারটিন নাইন এম। পনের জন প্যাসেঞ্জারের জন্য তৈরি আর রেঞ্জ পাঁচশ সাইত্রিশ নটিক্যাল মাইল।

অন্যদিকে কাজাক হেলিকপ্টারগুলো একেবারে ছোট। তাদের গতি ঘণ্টায় খুব বেশি হলে ৩২৪ কি. মি.। তারপরেও প্রতি ঘণ্টায় ৩০৬ কি. মি, অগাস্তা আর পেটমোটা এম আই-২৬’র প্রতি ঘণ্টায় ২৯৫ কি, মি’র চেয়ে বেশি। তাছাড়া কাজাক চপার দুটো নিশ্চয় অর্ডারের হেলিকপ্টারের মত এত বড় বাহিনি বহন করছে না। তার মানে কাজাক হেলিকপ্টার দুটোই বেশি হালকা আর দ্রুত।

“মনে হয় না পার পাবো।” তিক্ত হয়ে গেল কুপারের চেহারা।

“রকেট লঞ্চার বের করো।” আদেশ দিল ভ্যান কুক। “সশস্ত্র প্রতিরোধ নিশ্চয় আশা করছে না। তবে লেজ থেকে তো খসাতেই হবে।”

ক্লকের আদেশ বাকিদেরকে জানিয়ে দিল কুপার। আগাস্তা চপারের মাঝখানের কেবিনে শুয়ে আছে দুটো রকেট লঞ্চার। তাড়াহুড়া করে প্যাকেট খুলতেই আঘাত হানার জন্য প্রস্তুত হয়ে গেল। ছুঁড়ে মারার অপেক্ষায় আছে কুপারের দুই লোক। এদিকে নির্দ্বিধায় উড়ে আসছে দুই কাজাক হেলিকপ্টার।

“দাঁড়াও।” নির্দেশ দিল ভ্যান ক্লক, “আমরা জানি না যে ওদেরও রকেট লঞ্চার আছে কিনা। আগে রেঞ্জের মধ্যে আসতে দাও। আমরা কেবল একটাই সুযোগ পাবো সেটাও মাথায় রেখ।”

.

জ্ঞান আহরণ

সতর্কভাবে উঠে দাঁড়াল বিজয়। ভাবছে এখন তার কী করা উচিত। শত শত সাপের সাথে এখানে ফাঁদে আটকা পড়েছে। বেরোবার একমাত্র রাস্তাও ভ্যান ক্লক ধ্বংস করে গেছে।

হঠাৎ করেই কথাটা মাথায় এলো। তেমন কোনো আশা না থাকলেও অন্তত চেষ্টা তো করে দেখা যায়। এই চেম্বারটা যদি মহাভারতের সাথে সম্পৃক্ত হয় তাহলে নিশ্চয় হাজার হাজার বছর আগে তৈরি হয়েছে। সাপগুলোর বয়স তো ততবেশি বলে মনে হল না। বেঁচে থাকা আর বংশবৃদ্ধির জন্য এগুলোরও খাবার দরকার।

তার মানে উপরে যাবার নিশ্চয় আরো কোনো রাস্তা আছে। পাথরের মাঝখানে এমন কোনো প্রবেশ পথ যেখান দিয়ে হামাগুড়ি মেরে বাইরে গিয়ে সাপগুলো মালভূমির প্রাণ খেয়ে ফিরে আসতে পারে।

এত শত বছর ধরে বন্ধ থাকার পরেও নিচের বাতাস পুরোপুরি বিশুদ্ধ। তাহলে হয়ত সেসব প্রবেশমুখের কোনো একটা দিয়ে বিজয়ও বাইরে যেতে পারবে? ব্যাপারটা একবার দেখতেই হচ্ছে। নয়তো বেঁচে থাকার আর কোনো আশা নেই।

কিন্তু তার আগে আরেকটা ব্যাপার যেটা মাথায় ঘুরছে সে কাজটা পুরো করতে হবে। ভ্যান আর তার দল থাকায় আগে করতে পারেনি। যে রুমের দেয়ালে খোদাই করা লেখা ছিল সেখানে ঢুকে সার্চলাইটের আলো ফেলল বিজয়। এই অদ্ভুত ধাঁচের লেখাটা আগে আর কখনোই দেখেনি। এক হাতে সার্চলাইট ধরে আরেক হাতে নিজের স্মার্ট ফোন বের করে নিল। তারপর পটাপট কয়টা ছবি তুলে আবার মেইন চেম্বারে ফিরে এলো।

এবার এই নরক থেকে উদ্ধার পাবার রাস্তা খুঁজতে হবে।

মেঝেতে পড়ে থাকা কয়েকটা কোদাল, খন্তা আর কুড়ালের মধ্যে থেকে একটা বেলচা তুলে নিল। এগুলো কুপারের বাহিনি সাথে করে নিয়ে এলেও যাবার সময় ফেলে রেখে গেছে। কাজে লাগতে পারে ভেবে সাথে নিল বিজয়।

এখন কেবল একটাই সমস্যা। চারপাশে বিস্তৃত সাপের সমুদ্র পার হতে হবে।

.

৭৩. নেইলবিটিং চিন্তা

“ওরা হেলিকপ্টার দুটোকে আক্রমণ করতে যাচ্ছে।” ঘোষণা করলেন প্যাটারসন। ইমরানের সাথে টেলিফোনে কথা বলছেন আইবি স্পেশাল ডিরেক্টর। বিছানায় শুয়ে থাকলেও হাসপাতালের রুমে জড়ো করা একগাদা যন্ত্রপাতির মাধ্যমে সারা দুনিয়ার সাথে যোগাযোগ ঠিকই অক্ষুণ্ণ রেখেছেন।

ওয়াশিংটনের টেলিফোন লাইনকে ব্যতিব্যস্ত করে ডিফেন্স ফোর্স আর কংগ্রেসে কথা বলেছেন। এমনকি খোদ ইউএস প্রেসিডেন্টের সাথেও।

নিজ দলের এক সদস্য মাঠপর্যায়ে কাজ করতে গিয়ে বিপদে পড়েছে। এমন সময় প্যাটারসন তো তাকে ত্যাগ করতে পারেন না। তিনি তেমন নন।

অবশেষে সামরিক আর কূটনৈতিক প্রভাব খাঁটিয়ে কাজাক প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে পৌঁছে পরিস্থিতির গুরুত্ব বোঝাতেও সক্ষম হয়েছেন। তবে একটা কথা ভোলেননি যে তার পাওয়া তথ্য মতে এ মিশন অত্যন্ত গোপনীয় হওয়ায় সকল কথা প্রাক্তন সোভিয়েত দেশটাকে খুলে বলাও যাবে না। অথচ কাজাকদেরকে উসিয়র্ত মালভূমিতে সেনাবাহিনি কিংবা কমান্ডো দল পাঠানোর জন্য রাজি করানোও বেশ দুরূহ ব্যাপার, যাক সবশেষে তারা অন্তত দুটো হেলিকপ্টার পাঠিয়ে মালভূমি পরিভ্রমণ করে শত্রুপক্ষের অবস্থান ও শক্তি সামর্থ্য সম্পর্কে রিপোর্ট করতে রাজি হয়েছে।

পুরো অপারেশন মনিটর করছে কাজাক বিমান বাহিনি। তবে প্যাটারসন আর ইমরানের সাথে ভিডিও লিঙ্ক শেয়ার করছে।

কাজাক হেলিকপ্টারে লাগানো ক্যামেরা মাটিতে জুম করতেই স্পষ্ট দেখা গেল যে, কাজাক বিমান বাহিনির চপার দেখে প্রতিক্রিয়া হিসেবে কুপার বাহিনি প্রথমে দ্রুত হাতে মাল লোডিং করলেও একটু পরেই সে চেষ্টা বাদ দিয়ে টপাটপ ফ্লাইটে চড়ে বসল।

আর তারপরেই দেখা গেল দৃশ্য থেকে পালানোর উদ্দেশ্যে একটা হেলিকপ্টার পূর্বদিকে ছুটলেও, আরেকটা সিদ্ধান্তহীনভাবে আকাশে চক্কর দিচ্ছে। যেন কী করবে বুঝতে পারছে না।

তখনই প্যাটারসন উপলব্ধি করলেন অগাস্তা ওয়েস্টল্যান্ড এর ডব্লিউ ওয়ান থ্রি নাইন এম হেলিকপ্টার কাজাক চপারের উপর আক্রমণের পরিকল্পনা করছে। কিন্তু অগাস্তা শুধু মেশিন গানের জন্য উপযুক্ত হলেও যেহেতু অপেক্ষা করছে তার মানে তাদের কাছে রকেট লঞ্চার আছে।

কাজাক বিমান বাহিনিও ব্যাপারটা ঠিকই টের পেয়েছে। পাইলটদ্বয়কে সতর্ক করে দিয়ে পরবর্তী করণীয় জানানোর জন্য উত্তেজিত সব আদেশ প্যাটারসন আর ইমরানের কানে এলো। সশস্ত্র প্রতিরক্ষা আশা করেনি কাজাক বাহিনি। এই লোকগুলো সম্পর্কে কেউই সঠিক কোনো তথ্য না জানায় তাদের আক্রমণের ক্ষমতা সম্পর্কেও ধারণা করতে পারেনি। অন্যদিকে ইসি টু সেভেন ফাইভ হেলিকপ্টারের কাছে কেবল মেশিন গান আর টুয়েন্টি এম এম কামান আছে।

এ ডব্লিউ ওয়ান থ্রি নাইন এমের একটা বিশাল স্লাইডিং কেবিন ডোর খুলতেই দুটো রকেট লাঞ্চারের মাজল দেখেই আতঙ্কে জমে গেলেন প্যাটারসন আর ইমরান।

.

জঙ্গি বিমানের এলোমেলো লড়াই

রকেট লঞ্চার ছোঁড়া হলেও এয়ার কমান্ডের সতর্কবাণী পেয়ে আক্রমণ ঠেকানোর জন্য এড়িয়ে যাবার সিদ্ধান্ত নিল দুই কাজাক পাইলট। স্বয়ংক্রিয় ক্ষেপণাস্ত্র খোলা আকাশ পেরিয়ে নিচের দিকে নেমে সোজা তিন ভ্রাতার দিকে এগিয়ে গেল।

পাথুরে বিন্যাসের মাঝখানে আঘাত করে বড় দুটো চূড়া উড়িয়ে দেয়ার পর আবার রকেট লঞ্চার রিলোড করে ফেলল ভ্যান কুকের দল। কান ফাটানো আওয়াজ হলেও নিচে কী হচ্ছে তাই নিয়ে অগাস্তা চপারের যেন কোনো মাথা ব্যথ্যা নেই।

তারা কেবল কাজাক হেলিকপ্টারকেই আঘাত করতে ব্যস্ত।

তাই আবারো ছুড়ল রকেট লঞ্চার।

.

এক আবিষ্কার

গুহাটার যেন কোনো সীমানা নেই। পা টিপে টিপে সাপদের পাশ দিয়ে চলতে গিয়ে চারপাশে কেবল অন্ধকারই চোখে পড়ছে। বিজয়ের মনে পড়ে গেল গত বছরের একই রকম একটা গুহাকক্ষের কথা। পার্থক্য কেবল সেখানে এত সাপ ছিল না।

বেশ দুশ্চিন্তায় পড়ে গিয়েছিল বিজয়। তবে এখন পর্যন্ত পাশ দিয়ে হেঁটে, লাফিয়ে পার হয়ে এসেছে সব সাপ। মোটের উপর প্রাণীগুলো বিজয়কে উপেক্ষা করলেও মাঝে মাঝে হিসহিস সতর্কবার্তা যে শোনেনি তা নয়। জানে না এভাবে ভাগ্য কতক্ষণ তার সহায় হবে?

চারপাশে সার্চলাইটের আলো ফেলে অবাক হয়ে ভাবছে যে কতদূর এলো। কালো একটা পর্দার মত গুহাকক্ষের প্রবেশ মুখকে ঢেকে রেখেছে অন্ধকার। যেন সূর্যের আলো ভেতরে ঢুকতে দিতে চায় না। আরেকটা প্রশ্নও খুব জ্বালাচ্ছে; সার্চলাইট আর কতক্ষণ জ্বলবে?

কিন্তু সামনে এগোনো ছাড়া উপায় নেই। এখন থামা মানে হল আত্মহত্যা করা।

হঠাৎ করেই কেঁপে উঠল পায়ের নিচের মাটি। আর গুহাকক্ষ জুড়ে বয়ে গেল সেই কম্পন। গুঙ্গিয়ে উঠল অদৃশ্য দেয়াল আর ছাদ।

একেবারে নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে রইল বিজয়। কিছু একটা ঘটছে। থর থর করে অনবরত কাঁপছে নিচের মাটি। সাপগুলোও এলোমেলো দৌড় শুরু করেছে। এত দ্রুত সরে যাচ্ছে যে এতটা গতি বিজয়ও আশা করেনি।

মনে হচ্ছে যেন কিছুর হাত থেকে পালাতে চাইছে। কী?

তারপরেই মনে হল যদি সাপগুলোকে অনুসরণ করে তাহলে হয়ত পালাবার রাস্তা পাওয়া যাবে। যদি না এগুলো যেটার ভয়ে ছুটছে সেটা তাকেই আগে ধরে ফেলে।

সাপের পিছু নিল বিজয়। সর্বত্র কেবল সাপ আর সাপ। পাশ দিয়ে যাচ্ছে; দু’পায়ের ফাঁক দিয়ে যাচ্ছে; কখনো এমনকি পায়ের উপর দিয়েও যাচ্ছে। মনে হল বিষধর প্রাণীগুলো বিজয়ের উপস্থিতি পুরোপুরি ভুলে গেছে। তাদের এখন একটাই লক্ষ্য যত দ্রুত সম্ভব সরে যাওয়া।

দ্রুত সামনে এগোচ্ছে বিজয়। ওর আগেই সামনের অন্ধকারে হাওয়া হয়ে গেল সব সাপ।

হঠাৎ করেই থেমে যেতে হল। যা দেখছে তা কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছে না। ডানদিকে পনের থেকে বিশ ফুট সামনেই পাথরের এক ধাপ সিঁড়ি। বেড়ে গেল আশা। সিঁড়িতে উঠার জন্য আর তর সইছে না।

কিন্তু সময়ের হিসেবে গন্ডগোল হয়ে গেল। ঠিক সে সময়েই সামনে দিয়ে যাচ্ছিল দুটো কোবরা। একটার উপর বিজয়ের পা পড়ায় সাথে সাথে আঘাত করার জন্য ফণা তুলল।

দেখা মাত্রই লাফ দিয়ে পিছিয়ে এলো বিজয়। মাত্র মিলিমিটারের জন্য ওকে মিস করে গেল কোবরা। কিন্তু এবারও একই দিকে যেতে উদ্যত আরেকটা কোবরার উপর পড়ল। কুণ্ডলি পাকিয়ে ফণা তোলার জন্য প্রস্তুত হয়ে গেল দ্বিতীয় কোবরা।

সার্চলাইটের উপর কিছু পড়ে ভেঙে গেল নাকি দায়িত্ব শেষ করার জন্য ব্যাটারিটা এই মুহূর্তটাকেই বেছে নিল জানে না বিজয়। বাতি নিভে যেতেই গাঢ় অন্ধকার গ্রাস করে নিল চারপাশ।

আশে-পাশে কেবল সাপেদের পিছলে যাওয়ার শব্দ শোনা যাচ্ছে। অথচ পাথরের সিঁড়িটা যে কোনদিকে সে সম্পর্কে কোনো ধারণাই নেই।

.

৭৪. স্ট্রাইক ওয়ান

দ্বিতীয় রাউন্ড রকেটের ভাগ্যও প্রথম রাউন্ডের মতই হল। আরো একবার উপস্থিত বুদ্ধি খাঁটিয়ে পালিয়ে যেতে সক্ষম হল কাজাক গেলিকপ্টারদ্বয়।

এবারে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল ভ্যান ক্লক। “ধুত্তোরি, তোমরা কি চোখের মাথা খেয়েছ নাকি?” নিজের গোলন্দাজদের উদ্দেশ্যে চিৎকার করে বলল, “এ দুটোকে লেজ থেকে না খসানো পর্যন্ত তো আমরাও বের হতে পারব না।” পূর্বদিকে তাকিয়ে দেখে এরই মাঝে বিন্দুতে পরিণত হয়েছে তাদের দ্বিতীয় হেলিকপ্টার।

এমন সময়ে মেশিনগানের গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে সোজা তাদের দিকে ধেয়ে এলো একটা কাজাক হেলিকপ্টার। এরপরে কী ঘটবে কুক তাও জানে। টুয়েন্টি এম এম কামান কিংবা সিক্সটি এইট এম এম রকেট লঞ্চার; যদি অবশ্য হেলিকপ্টারে কোনো এক্সিয়াল পড় থাকে, তো।

“এবার।” চিৎকার করে উঠল ভ্যান।

তৃতীয় বারের মত নিশানা ঠিক করে রকেট লঞ্চার ছুড়ল এক গোলন্দাজ।

এইবারে লেগে গেল রকেট।

আগুনে বলের মত বিস্ফোরিত হয়ে তিন ভ্রাতার দিকে ছুটল চপার। সবচেয়ে ছোট চূড়াটাকে আঘাত করে ঢালু বেয়ে গড়িয়ে নেমে মালভূমিতে এসে স্থির হল উত্তপ্ত আর্বজনা।

.

ফাঁদ

কয়েক মুহূর্ত চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল বিজয়। কী করবে বুঝতে পারছে না। বাতি নিভে যাবার পর থেকে যেন বেড়ে গেছে চারপাশের হিসহিসানি। বুঝতে পারছে না কান কি দৃষ্টিশক্তির অক্ষমতা ঢাকার জন্য বেশি সক্রিয় হয়ে উঠল নাকি সাপেরাই সংখ্যায় বেড়ে গেল। কিন্তু যাই হোক না কেন প্রচন্ড ভয় লাগছে। আতঙ্কের চোটে মনে হচ্ছে দিশেহারা হয়ে যাবে।

জোর করে শান্ত করল নিজেকে। কয়েক কদম এগিয়ে অন্ধকারে কান পেতে রইল।

না কিছু নেই।

আগের জায়গাতে ফিরে যাওয়ার চেষ্টা করল। তাও কাজ হল না।

আস্তে আস্তে হতাশায় পেয়ে বসছে। সিঁড়ি দেখে মনে হয়েছিল বেরোবার বুঝি একটা সুযোগ পাওয়া গেল।

ভেতরের ভয় আর আতঙ্ককে চাপা দিয়ে ঠিক করল মনোযোগ দিয়ে সাপেদের আওয়াজ অনুসরণ করতে হবে। ওরা যেদিকে যাচ্ছে সে-ও কি পারবে?

.

বড় ভাই

“মিসাইল ওয়ার্নিং!” চিৎকার করে জানাল পাইলট, “ইনকামিং! ইসি এম ছুঁড়েছে।”

“পিনাকলস্!” তীক্ষ্ণ কণ্ঠে চেঁচিয়ে উঠল ভ্যান ক্লক, “পিনাকলস্ ব্যবহার করো। আর তারপর এটাকে এখান থেকে বিদায় করো।” বুঝতে পারল কী ঘটেছে। কাজাক এয়ারফোর্স নিশ্চয় তাদের হেলিকপ্টারকে মনিটর করছে। এতটা দ্রুত প্রতিক্রিয়া হবে বলে ভাবেনি। তার মানে একেবারে ঠিক সময়ে কুকের আক্রমণের মনোবাঞ্ছা টের পেয়েছে। নতুবা এত দ্রুত ফাইটার প্লেন পাঠাবার পেছনে আর কোনো কারণ নেই।

“মিগ-টুয়েন্টিনাইন!” দ্রুত গতিতে ধেয়ে আসা এয়ার-টু-এয়ার হিট সিকিং মিসাইলকে ধোঁকা দেবার জন্য হেলিকপ্টার নিয়ে তিন ভাতার গভীরে ডাইভ দিয়ে সতর্ক করে দিল পাইলট। অগাস্তাতে আগে থেকেই মিসাইলের আক্রমণ টের পাবার ব্যবস্থা থাকায় সাবধান হয়ে গেল পাইলট। তবে চপারের মধ্যে কাউন্টার মেজার ডিসপেন্সিং সিস্টেমও আছে। যার মাধ্যমে ইলেকট্রনিক কাউন্টার মেজার ব্যবহার করে মিসাইল ছোঁড়া যায়।

তিন ভ্রাতার উপরে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলে উঠতেই বুঝতে পারল যে তার পাইলট কোনো সুযোগ নিতে চায়নি। এর পাশাপাশি বিশেষ ক্ষমতা সম্পন্ন ফ্লোয়ার ডিকয় সক্রিয় করে দিল। যা বাতাসের সংস্পর্শে এসে এমন

এক ইনফ্রারেড রশ্মি উৎপন্ন করে যেন মিসাইল তার সগৃহে ফিরে যায়।

তিন ভ্রাতার ছায়ায় থেকে খানিকটা নিচে নেমে এলো হেলিকপ্টার। তারপর পূর্ণ বেগে পূর্ব দিকে ছুটল। এখান থেকে উজবেকিস্তানের সীমান্ত তেমন দূরে নয়। আর কাজাক জেট নিশ্চয় সীমান্তে কোনো ধরনের উত্তেজনা চাইবে না।

তার মানে মিশনের সফলতা আর কেউ ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না।

.

স্বর্গের সিঁড়ি

উপুড় হয়ে চোখ দুটোকে বন্ধ করে একমনে কেবল সাপেদের আওয়াজ শোনার চেষ্টা করছে বিজয়। এমনকি নিশ্বাসও বলতে গেলে বন্ধ করে রেখেছে; যেন তাতেও টাকা না পড়ে বাকি শব্দ।

একেবারে পাশ দিয়ে একের পর এক সাপ পার হয়ে যাচ্ছে। কোনো কোনোটা তো পা পর্যন্ত ছুঁয়ে যাচ্ছে। শ্রবণ আর স্পর্শ ইন্দ্রিয় সজাগ করে বিজয় তাদের গন্তব্য নির্ণয় করতে চাইল। কয়েক মিনিট পার হবার পরে ঠিক করল সামনে এগোবে। প্রথমে এক পা মেঝেতে রেখে তারপর আরেকটা পা ফেলল। যেন আগের বারের মত হুমড়ি খেতে না হয়। মাথায় এলো আরেকটা চিন্তা। সিঁড়িটা কোথায় গেছে? মাথা ঝাঁকিয়ে বাদ দিল এসব ভাবনা। আগেই ভাবা উচিত ছিল। উপরের দিকে তাকাল। অনেক উপরে, অন্ধকার ভেদ করে চোখে পড়ছে উজ্জ্বল আলোর একটা বিন্দু। বাইরের দুনিয়ায় যাবার মুখ।

আশা ফিরে পেতেই, ধৈর্য সহকারে, দু’হাত ছড়িয়ে চোখ বন্ধ করে সামনে এগোল বিজয়। গাঢ় অন্ধকার সত্ত্বেও কিছুতেই চোখ বন্ধ করে থাকতে মন চাইছে না। কেমন অদ্ভুত একটা অনুভূতি।

হঠাৎ করেই কিছুর সাথে ধাক্কা খেল হাতের বেলচা। তাড়াতাড়ি সামনে এগোতেই পাথরে হাত আটকে গেল। অন্ধকারেই হাতড়ে বুঝতে পারল একটা সিঁড়ি। তারপর আরেকটা। আনন্দে মনে হচ্ছে কেঁদে ফেলবে। পেরেছে, ও পেরেছে। কিন্তু এখন আনন্দ উদযাপনের সময় নয়। এখান থেকে আগে বেরোতে হবে। সাপেদের তীব্র ভয়ের উৎস যাই হোক না কেন সেটার জন্য বসে থাকলে চলবে না।

বেলচা নামিয়ে নিচের সিঁড়িতে লাফ দিয়ে উঠে একের পর এক সিঁড়ি টপকাতে শুরু করল বিজয়। মনে হচ্ছে বেলচাটাকে ফেলে যেতে হবে। পথ ক্রমেই বিপজ্জনক হয়ে উঠছে। সিঁড়িগুলো পাথর কেটে তৈরি হওয়ায়, চওড়াতে তিন ফুটের বেশি হবে না। বামদিকে গুহাকক্ষের দেয়াল। ডানদিক একেবারে খালি। নিচে গুহাকক্ষের মেঝে। একবার পা হড়কালেই সব শেষ। ভাবতেই গায়ে কাটা দিয়ে উঠল। তাড়াতাড়ি তাই বাম দিকের দেয়াল ধরে উঠতে শুরু করল।

কিন্তু সিঁড়ি যেন কিছুতেই শেষ হচ্ছে না। মনে হচ্ছে অনন্তকাল ধরেই কেবল উপরে উঠে যাচ্ছে। ঘামে ভিজে গেজে গায়ের জামা। অন্ধের মত পাথুরে দেয়াল ধরে উঠতে ঘষা খাচ্ছে হাতের চামড়া। ধীরে ধীরে এত উপরে আসায় ব্যথা করছে উরুদ্বয়। কিন্তু সে এত সহজে হাল ছাড়বে না।

বুঝতে পারল সে কোথায় আছে। তিন ভ্রাতার একটার ভেতরে। পাথুরে বিন্যাসের ঢালু জমি থেকে ঊর্ধ্বে উঠে যাওয়া সুউচ্চ চূড়াগুলোর একটার মধ্যে পাথর কেটে তৈরি হয়েছে এ সিঁড়ি। কোনটা সেটা অনুমান করতে পারছে না–তবে ছোটটা নিশ্চয় নয়। কারণ সেটার প্রবেশ মুখ তো নিচে রয়ে গেছে। তবে অতশত ভেবে কোনো লাভ নেই। উপরে পৌঁছে কী করবে সেটা নিয়েও ভাবছে না। এখন কেবল একটাই চিন্তা। এই অন্ধকারময় গুহা থেকে বেরিয়ে বাইরে যেতে হবে।

আস্তে আস্তে বড় হয়ে উঠছে খোলা মুখ। উজ্জ্বল আলোও দেখা যাচ্ছে। গতি বাড়াবার চেষ্টা করল বিজয়। ও কাছে চলে এসেছে। একদম কাছে।

খোলা মুখ দিয়ে ভেতরে আসা আলোতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল সিঁড়ি। ঝাপসা হলেও প্রতিটা সিঁড়ির আকার দেখা যাচ্ছে।

নব আশায় উজ্জীবিত হয়ে উঠল শরীর আর মন। আর বেশি হলে চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ ফুট যেতে হবে। পেরেছে, ও পেরেছে।

পরবর্তী কয়েকটা ধাপ স্তপায়ে পেরিয়ে এলো বিজয়।

আর ঠিক তখনি চারপাশে যেন নরক ভেঙে পড়ল। বজ্রকঠিন আওয়াজ করে বিস্ফোরিত হল উপরের শীর্ষচূড়া। উজ্জ্বল আলোয় ভেসে গেল পুরো সিঁড়ি। বৃষ্টির মত ঝড়ে পড়ল পাথরের টুকরো।

মুখ বাঁচানোর জন্য মাথার উপর হাত তুলতে গিয়ে ভুলে গেল দেয়াল ধরে নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার কথা। একেকটা ছুটন্ত পাথরের টুকরার আকার একেবারে ফুটবলের মত। হাতে, বুকে, পায়ে সর্বত্র আঘাত করছে পাথর। সিঁড়ি দিয়ে গড়িয়ে নেমে যাচ্ছে নিচের গহ্বরে।

এর প্রায় সাথে সাথে আরেকটা বিস্ফোরণের আওয়াজ হল। মনে হল কোনো এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস সক্রিয় হয়ে গেছে। সিঁড়ির কাছে থাকা পাথরের চূড়া যেন থর থর করে কেঁপে উঠল। ছুটন্ত পাথরের হাত থেকে বাঁচতে হিমশিম খাচ্ছে বিজয়। বড় বড় কয়েকটা পাথর বুকে আর উরুতে লাগতেই দরদর করে রক্ত ঝড়তে লাগল। পায়ে আরেকটা পাথরের আঘাত লাগতেই যেন আগুন ধরে গেল পুরো শরীরে। তীব্র ব্যথার চোটে দিশেহারা অবস্থা।

মাথার উপরে শোনা যাচ্ছে জেট বিমানের গর্জন আর হেলিকপ্টারের রোটরের আওয়াজ। হঠাৎ করেই সিঁড়ি থেকে পিছলে গেল ডান পা। হাত বাড়িয়ে ভারসাম্য রক্ষার চেষ্টা করলেও মুহূর্তখানেকের জন্য সফল হল। সিঁড়িতে আটকে গেল। মরিয়া হয়ে দেয়াল ধরে টিকে থাকতে চাইছে।

কিন্তু মাধ্যাকর্ষণ শক্তি টেনে নিয়ে ভাসিয়ে দিল বাতাসে আর অতঃপর নিচের খাদে।

.

৭৫. ব্যর্থতা আর হতাশা

মনিটরে সম্পূর্ণ দৃশ্য দেখলেন প্যাটারসন আর ইমরান। আতঙ্কিত হলেও প্রথম হেলিকপ্টারের পতন দৃশ্য দেখে কিছুই করার রইল না। দ্বিতীয় হেলিকপ্টার পিছু হঠতেই হারিয়ে গেল অগাস্তা। কিন্তু সেকেন্ডের মাঝেই আকাশ চিরে উদয় হল মিসাইল। পূর্বদিকে ছুটে ইনফ্রারেড হোমিং ডিভাইস অগাস্তাকে খুঁজছে।

অগাস্তার রকেট লঞ্চার দেখার সাথে সাথে নিজেদের হেলিকপ্টারকে সাহায্যের জন্য কয়েকটা মিগ-২৯ পাঠিয়ে দিয়েছে কাজাক বিমান বাহিনি।

কাজাক জেটের আগমনে সাহস পেয়ে বাকি কাজাক চপারটা আবার আকাশে উঠতেই দেখা গেল লেজ গুটিয়ে পালাচ্ছে অগাস্তা। পূর্বদিকে ছুটলেও পেছনে ফ্লেয়ারের চিহ্ন রেখা রেখে গেছে।

একের পর এক গালির তুবড়ি ছোটালেন প্যাটারসন। “বেজন্মা বেকুবের দল! আমি তখনই বলেছিলাম যে বিমান বাহিনি সহযোগে সৈন্যদের পাঠাতে। আমার কথা শুনল না। শয়তানের দলটা তো একেবারে সব প্রস্তুতি নিয়ে এসেছে। তাদের কাছে ইসিএম আছে। মিসাইলকে প্রতিহত করার ব্যবস্থা আছে।”

এরপরেই একটা মিসাইল একেবারে মাঝখানের চূড়ার উপর আঘাত করতেই ঢালু বেয়ে গড়িয়ে নামল ভাঙ্গা পাথরের টুকরা। থামতেই দেখা গেল আগের চেয়ে চূড়াটা পঞ্চাশ ফুট খাটো হয়ে গেছে।

শীর্ষচূড়ার নিচের পাথুরে বিন্যাসের উপর পড়ে চুরমার হয়ে গেল দ্বিতীয় মিসাইল। মালভূমির উপরিতল থেকে একশ ফুট উপরে আঁছড়ে পড়ল মিসাইল।

অগাস্তার পরিকল্পনা সফল হয়েছে দেখে নিশ্চুপ হয়ে গেলেন দুই দর্শক। জেটের তীব্র গর্জন শোনা গেলেও শত্রু যে পালিয়ে গেছে তাতে কোনো সন্দেহই নেই।

.

মরণের ছোঁবল

সিঁড়ির কিনারে হোঁচট খাওয়ার সময় মরিয়া হয়ে দুই হাত দিয়েই সিঁড়ি আঁকড়ে ধরল বিজয়। এক হাত খানিকক্ষণের জন্য কিছু পেলেও আরেকবার চেষ্টার সাথে সাথে পিছলে গেল।

তবে এবার এক হাত দিয়েও শক্ত করে ধরে আরেক হাত দিয়ে হন্যে হয়ে পাথর ধরার চেষ্টা করল।

কিন্তু জানে এভাবে বেশিক্ষণ টিকতে পারবে না। সিঁড়ি বেয়ে উঠার সময় পাথরে ঘসা খাওয়ায় জ্বালা করছে আঙুলের চামড়া। বড়সড় একটা পাথরের টুকরা আঘাত করায় কোমরে গভীর ঘা হয়ে গেছে আর উরুতেও তীব্র ব্যথা।

তাই অনিচ্ছা সত্ত্বেও কয়েক মুহূর্ত থামতেই হল।

কিন্তু যেন ওকে সচল করে ভোলার জন্যই থর থর করে কেঁপে উঠল সিঁড়ি আর কানে এলো একের পর এক চিড় ধরার গুরুগম্ভীর আওয়াজ।

নিচের অন্ধকার গহ্বরের দিকে তাকাল বিজয়। ওখানে কিছু একটা ঘটছে। কম্পন আগের চেয়েও বেড়ে সিঁড়ি পর্যন্ত চলে এলো ফাটল।

এবারে বুঝতে পেরেছে কেন সাপগুলো ওভাবে পড়িমড়ি করে ছুটছিল। ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের অনুসরণ করেছে। মানুষের যা নেই প্রতিটি জন্তুর আছে বিপর্যয় বোঝার মৌলিক সেই ক্ষমতা। আর সে সময়ে বিজয় যেটা টের পায়নি সাপগুলো সেটাই বুঝে গেছে।

মাথার উপর ভেঙে পড়ছে উপরের চূড়া।

.

দুই ভ্রাতা

হেলিকপ্টার নিয়ে পাথরের উপর দিয়ে উড়ে বেড়াচ্ছে কাজাক পাইলট। দলটার হাতে বন্দী ছিল টাস্ক ফোর্সের এক সদস্য। শয়তানগুলো তার কমরেডর্কেও গুলিকরে মেরে ফেলেছে। তবে পালিয়ে যাওয়া দুটো হেলিকপ্টারের যে কোনো একটাতে লোকটার বন্দী থাকার জোর সম্ভাবনা হলেও তাকে উদ্ধারের আশায় হেলিকপ্টার নিয়ে পুরো এলাকা চক্কর মারার সিদ্ধান্ত নিল পাইলট।

কিন্তু ভূপাতিত কাজাক হেলিকপ্টার আর শীর্ষ চূড়ার উপর ভেঙে পড়া মিসাইলের কালো ধোয়ার পুচ্ছ ছাড়া চারপাশে আর কিছুই দেখা যাচ্ছে না।

অনর্থক কষ্ট করছে। লোকটা হয় মারা গেছে; কিংবা চলে গেছে। যাই হোক না কেন তার মিশন ভেস্তে গেছে। সাথে দুজন কমরেডকেও হারিয়েছে। ওরা আসলেই ভাল লোক ছিল।

দীর্ঘশ্বাস ফেলে হেলিকপ্টার ঘুরিয়ে পশ্চিমে বিমান বাহিনির ঘাঁটির দিকে রওনা হল পাইলট।

হঠাৎ করেই চিৎকার দিয়ে উঠল তার কো-পাইলট। কৌতূহল মেটাতে শীর্ষচূড়ার ভগ্নাংশের মধ্যে উঁকি দিতেই দেখল পাথরের কিনারে ঝুলছে একজন লোক।

পবর্তচূড়ার ঠিক মাথার উপর দাঁড়িয়েই বাইরের হাইড্রলিক হয়েস্ট সিস্টেম চালু করে দিল পাইলট।

.

সে কি পারবে?

পর্বত শিখরের পাথুরে দেয়াল আর সিঁড়িটা যখন ছোট টুকরায় পরিণত হল তখন ঠিক মাথার উপরেই হেলিকপ্টারের রোটরের আওয়াজ শুনতে পেল বিজয়।

চোখ তুলে তাকাতেই দেখে যে একটা দড়ি নেমে এসেছে ওকে নিয়ে যাবার জন্য।

এদিকে আরেকটু হলেই ভেঙে পড়বে গোটা সিঁড়ি।

দড়িটা আরেক ইঞ্চি নিচে নেমে এলো। তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে আছে বিজয়।

আর মাত্র কয়েক ইঞ্চি।

প্রায় পৌঁছে গেছে।

এখনই।

বজ্রগর্জনে ভেঙে পড়ল পুরো পবর্তশিখর। চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে গেল সিঁড়ি। বড় একটা পাথর ধরে যেন মাঝ আকাশে ভেসে রইল বিজয়।

ঠিক সে সময়ে কাঁধের কাছে কপিকলের রশির স্পর্শ পেল। টান দিয়ে ধরে ফেলল বিজয়। বিশাল এক ধুলার মেঘ ছড়িয়ে ভেঙে পড়ল পুরো চূড়া। কপিকল ধরে রাখতে গিয়ে কাশতে কাশতে দম বন্ধ হবার জোগাড়। ধুলা পড়ে চোখও জ্বালাতন করছে।

একটু পরেই কপিকল তাকে উপরে নিয়ে এলে হেলিকপ্টারের ভেতরে টেনে নিল দুটো শক্ত হাত। কেবিনের দরজা বন্ধ হতেই বিজয়কে নিয়ে নিরাপদে উপরে উঠে গেল হেলিকপ্টার।

.

৭৬. ইন্টেলিজেন্স ব্যুরো হেডকোয়ার্টাস, নিউ দিল্লি

“এর মানে হচ্ছে শত্রুপক্ষের ক্ষমতা সম্পর্কে আমাদের কোনো ধারণাই নেই।” সূচনা টানলেন প্যাটারসন। উসিয়র্ত মালভূমিতে অপারেশন আর মৃত্যুর হাত থেকে বিজয়ের কোনো মতে বেঁচে যাওয়ার ঘটনাগুলো খতিয়ে দেখছে টাস্ক ফোর্স।

কাজাক বিমান বাহিনির ঘাঁটিতে চিকিৎসা শেষে মাত্র গতকালই ভারতে ফিরে এসেছে বিজয়। ভাগ্য ভাল যে বড় ধরনের কোনো ক্ষত কিংবা হাড়গোড় ভাঙ্গা ছাড়াই পালিয়ে আসতে পেরেছে। খানিকক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে আবার দিল্লি ছুটল। উদ্দেশ্য কলিন আর ডা. শুক্লাকে নিয়ে প্যাটারসনের সাথে মিটিং করা। যদিও যাত্রার একেবারে আগ মুহূর্ত পর্যন্ত যার যার কামরায় বন্দী হয়েছিলেন বিজয় আর ডা. শুক্লা; কেউ কারো সাথে দেখা করতে আগ্রহী ছিলেন না।

ইন্টেলিজেন্স ব্যুরোর কনফারেন্স রুমে বসে একেবারে গোড়া থেকে সবকিছু আলোচনা করা হল। সেই গ্রিসের খননকাজ থেকে শুরু করে কাজাকাস্তান আর রাধাকে উদ্ধারের বিফল মিশনসহ সবকিছু। সর্বশেষ আলোচনার পর কয়েক মুহূর্ত চুপচাপ বসে রইল সবাই। দল একজন সদস্য হারিয়েছে। নিজ জীবনের পরিবর্তে টাস্ক ফোর্সের উদ্দেশ্য পূরণের জন্য সাহস আর সংকল্প দেখাতে গিয়ে চলে গেছে রাধা।

এই মিটিঙে যোগদানের জন্য হাসপাতালের বিছানা ছেড়ে এসেছেন ইমরান। ব্যক্তিগতভাবে উপস্থিত থাকার জন্য অবশ্য তিনিই জেদ করেছেন। ইউ এসের পক্ষে রয়সনের সাথে এসেছেন টাস্ক ফোর্সের জিনবিদ্যা বিশেষজ্ঞ পার্সি গ্যালিপস।

প্যাটারসনকে বেশ নিস্পৃহ দেখাচ্ছে। গত চব্বিশ ঘন্টা তাদের সবার জন্যই অত্যন্ত আতঙ্কজনক ছিল। আর শত চেষ্টা সত্ত্বেও পার পেয়ে গেছে শত্রু।

“কাজাকাস্তানে তারা যে ধরনের আক্রমণ ক্ষমতা দেখিয়েছে তা সত্যিই অভূতপূর্ব।” বললেন প্যাটারসন, “আর বিজয় তো বলেছে যে আফগানিস্তানে তারা নাকি মিশন শেষ না হওয়া পর্যন্ত তালিবানকেও ঠেকিয়ে রেখেছে। তার মানে অর্ডার আর আমাদের টাস্ক ফোর্স গঠনের মাঝে একটা যোগসূত্র আছে। গত বছরের মহাভারত সিক্রেট। যদিও যোগসূত্রটা এখনো জানি না। এমনকি অর্ডার কিংবা তাদের সদস্য সম্পর্কেও জানি না। ইতিহাসের পাতায়ও তাদের সম্পর্কে কোথাও কোনো রেকর্ড নেই। কোনো একভাবে শত শত বছর ধরে লুকিয়ে রেখেছে তাদের অস্তিত্ব। আমাদের কাছে কেবল কয়েকটা নাম আছে। আর কিছু নেই। তবে একটা ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই যে তাদের ক্ষমতা আর প্রতিপত্তি অত্যন্ত শক্তিশালী। সরকারের একেবারে উচ্চ পর্যায় থেকে শুরু করে আপনার আমার দেশসহ বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে আছে তাদের সতীর্থ।”

“আর বয়স হিসেবেও তারা বেশ প্রাচীন।” যোগ দিল বিজয়, “খুব, খুব প্রাচীন। ভ্যান কুকের কথা যদি সত্যি হয় তাহলে হাজার হাজার বছর আগে অর্ডারই এই গুহাটা বানিয়ে রেখে গেছে। আর অমৃতের প্রস্তুতপ্রণালি নিয়ে অর্ডারের কোনো একটা লক্ষ্য ছিল।” হঠাৎ করেই মাথায় উদয় হল একটা চিন্তা, “উইল ইউ এক্সকিউজ মি? আমি একটা ফোন করতে চাই। এইমাত্রই একটা কথা মনে পড়ল।”

প্যাটারসন মাথা নেড়ে সম্মতি দিতেই রুম থেকে বেরিয়ে গেল বিজয়। আবার কয়েক মিনিট পরে ফিরেও এলো। উত্তেজনায় জ্বলজ্বল করছে পুরো চেহারা।

অন্যেরা উৎসুক দৃষ্টিতে তাকাল। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে যে সে কিছু বলতে চায়।

“আপনি যা বললেন প্যাটারসনকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠল বিজয়, “মানে ওদেরকে শত্রু হিসেবে উল্লেখ করেছেন; তখনই মাথার মধ্যে চিন্তাটা এলো, ইতিহাসে তাদের রেকর্ড অবশ্যই আছে। গত বছরের আবিষ্কৃত মহাভারতের রহস্যের সাথে তাদের যোগসূত্র।” ছোট্ট একটা নোটবই বের করল বিজয়। “এই মাত্র এলিসকে ফোন করে একটা ডায়েরি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলাম। এটা গত বছর পেয়েছিলাম। ব্রুনো বেগার নামে একজন জার্মানের ডায়েরি। গল্পটা আপনারা সবাই জানেন।”

সকলেই একযোগে মাথা নেড়ে সম্মতি প্রকাশ করল। আর যারা ওই অভিযানের অংশ ছিল না তাদেরকে সংক্ষেপে জানানো হল।

“ওয়েল, এই ডায়েরিতে, মহান সম্রাট অশোকের একজন সভাসদ সুরসেনের ডকুমেন্টের অনুবাদ পাওয়া গেছে। প্রথম প্যারাগ্রাফটা আপনাদেরকে পড়ে শোনাচ্ছি :

“আমি সুরসেন, আমাদের প্রিয়তম মহান সম্রাট অশোক, দেবনামপ্রিয় পিয়দাসীর সৃষ্ট গৌরবময় ভ্রাতৃসংঘ, নয়জন অজানা ব্যক্তির গোপন গ্রন্থাগার আবিষ্কারের অংশ হিসেবে এই রেকর্ড রেখে যাচ্ছি। শহস্তে সমর্পিত হবার আশঙ্কায় সম্রাটের নির্দেশ মান্য করতে গিয়ে এই আবিষ্কার কিংবা কী পেয়েছি সে সম্পর্কে আমি কিছুই লিখব না। কেননা নয়জনের ভ্রাতৃসংঘ সৃষ্টির এটাই ছিল মূল কারণ।”

নোটবুক বন্ধ করে অন্যদের দিকে তাকাল বিজয়। “আমার বিশ্বাস অর্ডার’-ই এই ‘শত্রু’ যাদের হাত থেকে নিজ আবিষ্কারকে অশোক গোপন করতে চেয়েছেন। আর দুই হাজার বছর ধরে তাতে সফলও হয়েছেন। তাই এদের সম্পর্কে জানতে হলে পৌরাণিক আখ্যানের মাঝেই অনুসন্ধান করতে হবে। তবে এটা স্পষ্ট যে ভারত ভ্রাতৃসংঘ থেকে উৎপত্তি হয়ে অতঃপর বৈশ্বিক একটা প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে।”

“তোমার কাছে সুরসেনের কথা শুনে ব্লেকের ফোন টেপের কথা মনে পড়ে গেল। সেখানেও বলা হয়েছিল যে মারফি ভারতেই অর্ডারের এক সদস্যের কাছে রিপোর্ট করবে।” স্মরণ করে জানালেন ইমরান। “আমরা আসলে এক অদৃশ্য দানবের সাথে লড়ছি। পৃথিবীর কোনো গোয়েন্দা সংস্থাই অর্ডারের অস্তিত্ব সম্পর্কে জানে না। তারপরেও অর্ডারের ক্ষমতা আর প্রতিপত্তির নজির তো চোখের সামনেই দেখলাম।”

“আর এখন তো তারা আদা-জল খেয়ে আমাদের পিছনে লাগবে।” শান্তভাবে জানালেন ডা. শুক্লা। “ওরা আমাদের পরিচয় জানে। জানে কোথায় থাকি। কী করি। এত সহজে ছাড়বে না। নিজেদেরকেও আমাদের সামনে প্রকাশ করে ফেলেছে। এই ভুল শোধরানোর জন্য নিশ্চয় চেষ্টা করবে। তার মানে আমরা কেউই নিরাপদ নই।”

“সত্যিই তাই।” স্বীকার করলেন প্যাটারসন। “কিন্তু ওরা তো টাস্ক ফোর্স সম্পর্কে জানে না। তাই ভুলে যাবেন না যে আমাদের ক্ষমতা আর প্রভাবও কম নয়। হয়ত এ লড়াইটা হেরে গেছি; কিন্তু যুদ্ধ তো কেবল শুরু হল। এবার আমরা অপ্রস্তুত ছিলাম। এখন যেহেতু তাদের সম্পর্কে খানিকটা জানতে পেরেছি, তাহলে প্রস্তুতি নিতে সুবিধা হবে।”

বিজয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, “আর তোমার কথা অনুযায়ী মহাভারতের একটা পৌরাণিক কাহিনির উপর ভিত্তি করেই অর্ডার এই মিশন পরিচালনা করেছে?”

মাথা নাড়ল বিজয়। তাহলে আমাদেরকে খুলে বলো।”

কোথা থেকে শুরু করবে ভাবতে গিয়ে খানিক চুপ করে রইল বিজয়। “মহাভারতের যেসব শ্লোক কাহিনিটাকে ব্যাখ্যা করেছে আমি সেগুলোর বিস্তারিত বর্ণনায় যাবো না। কিন্তু ভ্যান কুক আমাকে কয়েকটা শ্লোক অনুবাদ করে শুনিয়েছে। কাহিনির নাম সমুদ্রমন্থন।” তারপর ডা. শুক্লার দিকে তাকাল, “আমার মনে হয় এ সম্পর্কে আপনিই ভালো বলতে পারবেন।”

খানিকটা দ্বিধা করলেও মাথা নেড়ে সম্মতি দিলেন ডা. শুক্লা, “আমার মনে হয় এদেশের আমার বন্ধুরা সবাই এটা জানে। আমি তাহলে ইউ এস বন্ধুদের উদ্দেশ্যে বলছি; মহাভারত অনুযায়ী, দেবতারা-ঈশ্বর-আর-দানব কিংবা অসুর-শয়তানেরা মিলিত হয়ে অমৃতের জন্য সবেগে ঘুরিয়েছিল দুধেল মহাসমুদ্র-এমন এক তরল যা পান করলে অমরত্ব প্রাপ্তি লাভ ঘটবে। দড়ি হিসেবে ব্যবহার করে ভাসুকী অর্থাৎ সাপ আর লাঠি হিসেবে মাউন্ট মান্দারা। কয়েক বছর সবেগে ঘোরানোর পর দুধেল মহাসমুদ্র অন্যান্য জিনিসের সাথে অমৃতও উৎপন্ন করে দেয়।

ভ্রুকুটি করলেন গ্যালিপস! “এই কাহিনি আমিও শুনেছি। এর সাথে ব্যাকটেরিয়া আর ভাইরাসের কী সম্পর্ক?”

“ভ্যান ক্লকের কাছ থেকে শোনা অনুবাদ অনুযায়ী” উত্তরে বিজয় জানাল, “পদ্যগুলোর ঐতিহাসিক ব্যাখ্যার চেয়ে শ্লোকের কাহিনি একেবারে ভিন্ন। হাজার হাজার বছর আগে এমন এক তরল ওষুধের সন্ধান করা হয় যা অমরত্ব দান করতে পারবে। হিন্দুকুশের গুহাকক্ষে ভূগর্ভস্থ এক বিশাল লেক আছে যা আর্য ল্যাবরেটরিতে পাওয়া ব্যাকটেরিয়ার আবাসস্থল। এ ধরনের জীবাণু অত্যন্ত লবণাক্ত পরিবেশে বেঁচে থাকতেও সক্ষম। লেকের পানি দুনিয়ার সমস্ত মহাসমুদ্রের চেয়েও বেশি লবণাক্ত। আর ব্যাকটেরিয়ার কলোনির কারণে লেকের পানি রূপালি সাদা রঙ ধারণ করেছে। যার কারণে পানিটা দুধের মত দেখায়। তার মানে এই দুধেল মহাসমুদ্রের কথাই পৌরাণিক কাহিনিতে বলা হয়েছে।”

“যেমন হালোফিলিক আর্চাইয়া।” বিড়বিড় করলেন রয়সন। কিন্তু প্যাটারসনের কোঁচকানো ভ্রু দেখে তাড়াহুড়ো করে বললেন, “ডেডসী’র লাল ফুল।”

“তো প্রাকৃতিকভাবে এসব ব্যাকটেরিয়ার উৎপন্ন বিষ মানবদেহের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর।” আবার শুরু করল বিজয়। “কিন্তু, অতশত বছর আগেও কেউ একজন এমন এক রেট্রোভাইরাস আবিষ্কার করে যা ব্যাকটেরিয়াকে সংক্রমণ করে।”

“একটা ব্যাকটেরিওফেজ।” বাধা দিলেন রয়সন।

“ঠিক তাই। ধন্যবাদ ডাক্তার। এই শব্দটাই ভুলে গিয়েছিলাম। রেট্রোভাইরাস সম্পর্কে মজার ব্যাপার হল এটি লবণাক্ত পানিতে জন্মানো ব্যাকটেরিয়ার মাঝে সংক্রামিত হয়ে এগুলোর ডিএনএ ও উৎপাদিত প্রোটিনকেও বদলে ফেলে। তার মানে বিষাক্ত উপাদানের জায়গায় প্রোটিন বসে যায় যা মানুষের জন্য হিতকর। যাই হোক, ভাইরাস লবণাক্ত পানিতে টিকতে পারে না আর ব্যাকটেরিয়া লবণ পানি ছাড়া বাঁচতে পারে না। তাই নির্দিষ্ট কিছু লতাপাতা, ঔষধি গাছ ও খানিকটা রত্নপাথরের গুঁড়া মিশিয়ে এই সংক্রমণ তৈরি করতে হয়। আমি জানিনা কিভাবে কিন্তু তাতে করে ভাইরাসের উপর লবণ পানি আর কোনো খারাপ প্রভাব ফেলতে পারে না। এই মন্থনের কথাই মহাভারতে লেখা আছে। এটা সবেগে ঘোরানো নয় বরঞ্চ সব উপকরণ একসাথে মেশানো। একবার এই প্রক্রিয়া শেষ হলেই অমৃত পান করার জন্য উপযুক্ত হয়ে যায়।”

“তুমি বলেছিলে যে গুহাকক্ষ থেকে নমুনা হিসেবে অর্ডার সাপ সংগ্রহ করেছিল।” মন্তব্যে জানালেন প্যাটারসন, “আমার ধারণা তাদের বিশ্বাস সাপের দেহে এই ভাইরাসের সংক্রমণ আছে।”

কাঁধ ঝাঁকিয়ে বিজয় জানাল, “এই ব্যাপারে আমার কোনো ধারণাই নেই। ওরা আমাকে কিছুই বলেনি। তবে সেসময় আমারও একই কথাই মনে হয়েছিল। যদিও আমিও বুঝতে পারিনি। মানুষকে সংক্রমণ করে এমন একটা ভাইরাস সাপ কিভাবে বহন করবে?”

“এটার সম্ভাবনা কিন্তু আছে।” আর কেউ কোনো মন্তব্য করার আগে কথা বললেন রয়সন, “অন্তত এক কথায় উড়িয়ে দেবার উপায় নেই। কয়েক বছর আগে, ক্যালিফোনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণায় সান ফ্রান্সিকো এরেনাভাইরাসেস নামক গোষ্ঠীর ভাইরাস আবিষ্কার করেছে। এগুলো স্তন্যপায়ী বিশেষ করে। তীক্ষ্ণদন্ত প্রাণীদেহে সংক্রামিত হতে পারে। এই ভাইরাসের সাপ থেকে মানবদেহে প্রবেশের কোনো প্রমাণ না থাকলেও ভাইরাসের একটা জিনের সাথে ইবোলা ভাইরাস পরিবারের বেশ সামঞ্জস্য আছে। মেহরোজিকে এই ভাইরাস মানুষকে সংক্রামিত করতে পারে। অভূতপূর্ব দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে এই আবিষ্কার। কে বলতে পারে যে আর কোনো ভাইরাস নেই যা মানুষ আর সাপকে একত্রে সংক্রামিত করতে পারে? আর হাজার হাজার বছর ধরে একটা ভাইরাসকে সংরক্ষণ করার জন্য এরচেয়ে আর ভালো কোনো উপায় নেই। জীবন্ত এক আশ্রয় দাতা।

“আর পদ্যের উল্লেখিত গাছগুলো?” জানতে চাইলেন ইমরান।

মাথা নেড়ে বিজয় জানাল, “কাজাকাস্তানে পৌঁছানোর পর ভ্যান ক্লক আমাকে বলেছিল যে তার দল ঔষধি গাছগুলোকেও খুঁজে পেয়েছে। কয়েকটা নাম মনে থাকায় আজ সকালে কেল্লা থেকে বেরোবার আগে দেখেও নিয়েছি। বেগুনি ফলঅলা গাছটা হল- আরো একবার নোটবুক দেখে জানাল, “প্রাণগোস পাবুলারিয়া লিন্ডি। এটা একটা ল্যাটিন নাম। কিন্তু কেন যেন উজবেকিস্তানকে নিজের আবাসস্থল হিসেবে বেছে নেয়ায় ফুলটার কোনো ইংরেজি নামও নেই। অন্য গাছ, গাঢ় বেগুনি ফল হল প্রভনাস স্যাডিয়ানা ভেসিলেজ। ইংরেজিতে স্যাডিয়ান আলুবোখরা। এই গাছের বয়স্ক শাখাগুলোর রঙ হয় গাঢ় ধূসর আর কাঁচা শাখাগুলোর রঙ বাদামি সবুজ, ফুলগুলো সাদা কিংবা সঙ্গে বেগুনি ছাপ থাকে- মানে “ধূসর কিংবা সাদা আর সবুজ কিংবা বাদামি পোশাক।” এ ফুলটাও উজবেকিস্তান আর কিরগিজস্তানের নির্দিষ্ট কিছু প্রদেশেই পাওয়া যায়। আর ইন্টারনেটে গবেষণা করে দেখেছি উভয় ফুলই কেবল উজবেকিস্তানের দুটো প্রদেশে একসাথে পাওয়া যায়: তাসকান্দ আর সুরখন্ডারিয়ো। আর বিশ্বাস হোক বা না হোক সুরখন্ডারিয়ো সগডিয়ান রক যেখানে ছিল তার প্রায় কাছাকাছি। যদিও রক’টাকেই কখনো পাওয়া যায়নি। কিন্তু দক্ষিণে যাত্রা করার আগে আলেকজান্ডার এদিকেও এসেছিলেন।”

“আর এই ওষুধ অমরত্ব দান করে?” জানতে চাইলেন রয়সন।

“পৌরাণিক কাহিনি অনুযায়ী উত্তরটা হল, হ্যাঁ।”

“অমৃত সম্পর্কে আরো কিছু বলতে পারবে?” আবারো জানতে চাইলেন রয়সন। “বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যা। আমি জানি, তুমি আমাকে বলেছ যে, এই অভিযানের উদ্দেশ্য ছিল প্রকৃত ব্যাকটেরিয়া আর রেট্রোভাইরাসকে খুঁজে বের করা। যে প্রোফেজটা আমরা ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের সাবজেক্টদের শরীরে পেয়েছি। কিন্তু ওষুধটা খেলে আসলেই কী হয় তা জানতেই আমার বেশি কৌতূহল হচ্ছে। ওরা তোমাকে একথা বলেছে?”

মাথা নাড়ল বিজয়, “বৈজ্ঞানিক শব্দগুলোর সবকয়টা মনে নেই।” স্বীকার করে জানাল, “কিন্তু যেটুকু মনে আছে বলছি। বস্তুত মানব শরীরে প্রবেশ করার পর রেট্রোভাইরাস পরিবর্তনের হোস্ট পেয়ে যায়। আর তখনই মানুষের জিনে নিজের ডিএনএ ঢুকিয়ে দেয়। আর এভাবেই নির্দিষ্ট কিছু জিনে স্থানান্তরিত হয়ে এমন সব প্রোটিন উৎপন্ন করে যা বয়স বাড়ার সাথে সাথে বৃদ্ধ হবার প্রক্রিয়া আর রোগ-বালাইয়ের সাথে লড়াই করতে সক্ষম।”

“মজার তো।” মন্তব্য করলেন গ্যালিপস, “এই জেনেটিকস আর প্রোটিন সম্পর্কে আর কোনো বিস্তারিত ব্যাখ্যা মনে আছে?”

চেষ্টা করতে গিয়ে ভ্রু-কুঁচকে ফেলল বিজয়। “ভ্যান ক্লক বলেছে যে বৃদ্ধ হবার পেছনে বেশ কিছু কারণ আছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় টেলোমারেস কমে যাওয়া। যার কারণে কোষ মরে যায় আর টিস্যু কুঁচকে যায়। আরো বলেছিল, টেলোমারেস ক্রোমোজমের তথ্য সরবরাহ করে।”

মাঝখানে বাধা দিলেন, গ্যালিপস, “ডিএনএ অণুর এক বিশাল কুন্ডলি হল ক্রোমোজোম। প্রতিটা ক্রোমোজোমের শেষে পুনরাবৃত্তি ঘটে যা জিনগত দিক থেকে অর্থহীন বলে মনে হয়। এটাই হল টেলোমার। যেমন প্রতিটা জুতার ফিতার শেষে অ্যাথলেট থাকে যেন তন্তুটার ক্ষয় রোধ হয়। কিন্তু প্রতিবার ক্রোমোজোমের নকল হবার সময় খানিকটা করে টেলোমার ঝরে পড়ে। তারমানে এরকম বহুবার ঘটার পর টেলোমার এত কমে যায় যে অর্থহীন সব জিন কেবল টিকে থাকে। আর তখনই ঘটে যখন কোষ বিভক্ত হওয়া থেমে যায়। মজার ব্যাপার হল, বৃদ্ধ হওয়া আর কোষ হারানো ছাড়াও যেসব কোষ বিভক্ত হওয়া থামিয়ে দিলেও মৃত্যুবরণ করে না সেগুলোই সুস্থ দেহী কোষের উপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে।”

“ইয়েস।” বিজয়ও সম্মত হয়ে জানাল, “তো, যে জিনটা স্থানান্তরিত হয় সেটাই আবার টেলোমারেসের উৎপাদনকে নিয়ন্ত্রণ করে যা টেলোমারেসের মেরামত করতেও সক্ষম। তার ফলে কোষের পুনরাবৃত্তি প্রক্রিয়া বন্ধ না হয়ে সচল থাকে অর্থাৎ কোষ না হারানোর ফলে বৃদ্ধ হবার প্রক্রিয়াও থেমে যায়।” এবার মাথা নেড়ে গ্যালিপস জানালেন, “ইন্টারেস্টিং। কিন্তু টেলোমারেসের উৎপাদন তো আরো অসংখ্য কোষ বিভক্তি আর পুনরাবৃত্তির প্রক্রিয়াকে বাড়িয়ে দেবে, বিশেষ করে টিউমার। অথবা এটার আরেকটা নাম হল ক্যাসার। তখন কী হবে?”

“এই অংশটাই হচ্ছে সবচেয়ে মজার। ভাইরাস প্রোটিন উৎপাদনের উপর এমন এক প্রভাব ফেলে যাতে কোষগুলো আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়। এই প্রোটিন ক্ষতিকর কোষসমূহ আর সেন্সসেন্টকে নিশানা করে। অর্থাৎ শরীরে ক্যান্সারের বৃদ্ধি নষ্ট হয়ে যায়।”

শিষ দিয়ে উঠলেন, গ্যালিপস, “শুনে তত মনে হচ্ছে পিফিফটি থ্রি। এমন এক প্রোটিন যা কোষের চক্রকে থামিয়ে স্থবির করে দেয় অথবা আত্মহত্যার জন্য কোষকে ইশারা দেয়। জিনগত ক্ষতসমৃদ্ধ কোষগুলোকে টার্গেট করে যার বেশির ভাগই ক্যান্সার আর সেসব কোষকে স্থবির করে দেয়। তার মানে এই ভাইরাস কোষের বহির্গমন প্রক্রিয়াকেও নিয়ন্ত্রণ করে। বেশ মজা তো।”

“এছাড়াও কুক আরো কিছু জিনের কথা বলেছিল যেগুলোর উৎপাদিত প্রোটিন কার্ডিওভাসকুলার রোগ-বালাই, ডায়াবেটিস, হাইপারটেনশন আর অ্যালজেইমারকেও প্রতিরোধ করে। এসব জিন শরীরের পেশিসমূহের কার্যক্রমকে সচল রাখে আর টিস্যুর পুনর্গঠনকে বাড়িয়ে তোলে। আর এ সমস্ত কিছুই ঘটে রেট্রোভাইরাসের কারণে। কিন্তু সেগুলোর নামগুলো স্মরণ করতে পারছি না। এছাড়া ভ্যান কুক আরো বলেছে যে তাদের ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালগুলোর কারণ হল ভাইরাসের কার্যক্রম সম্পর্কে আরো ভালোভাবে জানা। এ কারণেই প্রকৃত ভাইরাসটা এত বেশি জরুরি। প্রোফেজটা একই কাজ না করলেও ফলাফল নিয়ে সে খুবই আশাবাদী।”

“মনে হচ্ছে একেবারে কাকতালীয় কিছু ঘটবে।” এতক্ষণে কথা বলল কলিন।

“সত্যিই তাই।” সমবেদনার স্বরে জানালেন রয়সন। এই কারণেই তারা এত মরিয়া হয়ে চাইছে…এই মিশ্রণ।” তারপর এমনভাবে মাথা ঝাঁকালেন যেন কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছেন না।

“আমার কথায় প্লিজ কেউ রাগ করবেন না।” বলে উঠল কলিন, “আমি জানি এ রুমে কয়েকজন শ্রদ্ধাভাজন বিজ্ঞানী আছেন আর এ সবকিছু বিচার করার জন্য আমার কোনো দক্ষতাও নেই। কিন্তু সত্যি কথা বলতে, বামন হয়ে আকাশের চাঁদে হাত বাড়াবার মত মনে হচ্ছে। মানে অত্যাশ্চর্য এক ভাইরাস যা বয়স বৃদ্ধির প্রক্রিয়াকে থামিয়ে দেয়ার মত প্রোটিন উৎপাদন করবে আর ব্যাকটেরিয়ার প্রকৃতি পরিবর্তনের পাশাপাশি ক্যানসারের কোষগুলোকেও টার্গেট করবে। বিশ্বাস করাটা একটু শক্ত বৈকি। অনেকটা যেন বৈজ্ঞানিক কল্প-কাহিনির মতন!”

 “না, তা না।” কেউ আশাই করেনি এমন একজন এবার আলোচনার খেই ধরলেন। প্যাটারসন। “মানুষের জিন আর ভাইরাস সংক্রান্ত এখনো এমন অনেক তথ্য আছে যা আমরা আবিষ্কার করতে পারিনি। প্রতিদিনই কোনো না কোনো নতুন আবিষ্কার হচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ ধরো এডেনো অ্যাসোসিয়েটেড ভাইরাস টাইপ টু কিংবা এএভিটু যা মানুষকে আক্রমণ করলেও কোনো

অসুস্থতা ছড়ায় না। ইঁদুরের উপর এক পরীক্ষায় দেখা গেছে ল্যাবরেটরিতে কাসপাসেস নামক প্রোটিন ১০০ শতাংশ পর্যন্ত ব্রেস্ট ক্যান্সারের কোষকে মেরে ফেলতে পারে এএভিটু, যা কোষের প্রাকৃতিকভাবে মৃত্যুর জন্য অত্যন্ত প্রয়োজন। এছাড়াও এএভিটু সংক্রামিত ক্যান্সার কোষ আরো বেশি মাত্রায় কি-সিক্সটি সেভেন উৎপন্ন করে; এমন এক প্রোটিন; যা প্রতিষেধক প্রক্রিয়াকে সক্রিয় করে তোলে আর সি-মিক নামক আরেকটা প্রোটিন যা কোষ বৃদ্ধির হার বাড়াবার পাশাপাশি স্থবির হয়ে যাওয়া রোধ করে।”

“এছাড়াও যোগ করলেন রয়সন, “মানুষের জিনের আট শতাংশই হল ভাইরাস জিন আর তাদের অবশিষ্টাংশ। হাজার হাজার বছর আগে রেট্রোভাইরাসে সংক্রামিত সৃষ্টির শুরু থেকে সর্বোচ্চ শ্রেণির স্তন্যপায়ী প্রাণীর দেহাবশেষ পর্যন্ত। তাছাড়াও আমরা এমন কিছু ভাইরাসের কথা জানি যা আশ্রয়দাতা ব্যক্তির ডিএনএ’তে পরিণত হয়। যেমন এইচ আই ভি ভাইরাস। তাই রেট্রোভাইরাস ডিএনএ’র সাথে সম্পর্কিত এমন এক প্রোটিন উৎপন্ন করবে যা স্থানাস্তরিত হতে পারে; এর সম্ভাবনাকে একেবারে উড়িয়ে দেয়া যায় না। মানব জিন এখনো এক মহা রহস্য। এর মানচিত্র পাওয়া গেলেও কোন অংশটা যে বেশি কাজ করে তা এখনো অনাবিষ্কৃত। অনেক দিন ধরেই জিনের বেশ বড় একটা অংশকে, ৯০ শতাংশেরও উপরে, বলা হত “জাঙ্ক ডিএনএ।” কারণ এটা প্রোটিনের জন্য তৈরি নয়। আজ অবশ্য নব নব আবিষ্কারের আলোর মুখ দেখায় মুছে গেছে এ তকমা।”

এবার শুরু করলেন গ্যালিপস, “ঠিক তাই। দ্য এনকোড প্রজেক্টের মতে, প্রায় সত্তর শতাংশ ডিএনএ’কে আর এনএ’তে নকল করা যায় যা পূর্বে হত না। তাই জোর সম্ভাবনা আছে যে আরো মিলিয়ন মিলিয়ন জিনও রয়ে গেছে। আমরা যা এখনো জানি না। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, এক ধরনের জিনগত শ্রেণিতে লিঙ্ক আরএনএ’র তিরাশি শতাংশই হল স্থানবিন্যাসে সক্ষম উপাদান। এগুলোকে “জাম্পিং জিন” বলা হয়; কারণ তারা জিনের মধ্যেই লাফিয়ে বেড়াতে সক্ষম। আর এগুলোর বেশির ভাগই হল প্রাচীন রেট্রোভাইরাসের বংশধর। যা অন্যান্য জিনের সাথে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে প্রবাহিত হয়ে আসছে। ধারণা করা হচ্ছে রেট্রোভাইরাসের অবশিষ্টাংশের মধ্যে স্থানান্তরে সক্ষম জিনও থাকতে পারে। তাই মানব দেহে রেট্রোভাইরাসের প্রবেশ করিয়ে জিন স্থানান্তরের ধারণা একেবারে অমূলক নয়।”

“তাহলে অমৃত পান করার পরেও আলেকজান্ডার মারা গেলেন কেন?” জানতে চাইল কলিন, “যদি এই অলৌকিক ওষুধটা সত্যিই পান করে থাকেন তাহলে তো চিরকাল বেঁচে থাকার কথা।” তারপরই অবশ্য কেঁপে উঠে বলল, “অবশ্য ঈশ্বরকে ধন্যবাদ যে তিনি বাঁচেন নি।”

“আমি বলছি, কেন।” উত্তর দিল বিজয়, “ক্যালিসথিনসের কারণে।”

“মানে?” গ্যালিপস অবাক হয়ে গেলেন।

মিটিমিটি হাসছে কলিন, “গ্রিক ইতিহাসবিদ যাকে আলেকজান্ডার হত্যার আদেশ দিয়েছিলেন। তারপর বিজয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, “তো ক্যালিসথিনস কী করেছিল?”

মাথা ঝাঁকাল বিজয়, “উনি কিছু করেন নি। ঘটনা হল যা করেন নি, সেই কারণেই আলেকজান্ডার মারা গেছেন। আমরা তিন ভ্রাতার কাছে পৌঁছানোর পর সাপের সিলটাকে ভেঙে ফেলা হয়। প্রথমবার তৈরির পর থেকেই এভাবে আছে চেম্বার। ক্যালিসথিনস কখনো আসলে চেম্বারে যান নি। আর চূড়ায় উঠে পাথর ভেঙে ভেতরে গেলেও গুহাকক্ষের দরজা দিয়ে যান নি। প্রয়োজনমত ফল আর ঔষধি গাছ নিয়ে গেছেন। ভাইরাস নয়।”

শিস দিয়ে উঠল কলিন, “তার মানে আলেকজান্ডারকে মেরে ফেলাই উদ্দেশ্য ছিল? মানে পদ্যগুলো তো খুব স্পষ্ট। নির্দেশ না মানলে কোনো সুযোগই পাবে না। ভাইরাস সম্পর্কে এখন যতটুকু জানি এতে তো অবাক হবার কিছু নেই।”

“আসলে তা না।” উত্তরে জানাল বিজয়। আমার মনে হয় এটা ক্যালিসথিনসের পরিকল্পনা ছিল না। মনে হয় শুধু ভেবেছিল যে এত উপরে উঠে সিল ভাঙ্গা সম্ভব নয়। হয়ত ভেবেছিল সিলের আড়ালে থাকা জিনিসটা তত বেশি গুরুত্বপূর্ণ নয়। কিন্তু সে সম্পর্কে আলেকজান্ডারকে কিছু বলেন নি। কেননা ততদিনে নিজের বিরুদ্ধ মতকে একেবারেই স্বীকার করতে পারতেন না জেদি আলেকজান্ডার।”

কথাটা শুনে বিস্ময়ে সবাই চুপ মেরে গেল। মহাভারতের এক পৌরাণিক কাহিনি এক দিগ্বিজয়ীকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছে। তেত্রিশ বছর জন্মদিনের কয়েকদিন পরেই যদি আলেকজান্ডার মারা না যেতেন তাহলে পৃথিবীর ইতিহাস ভিন্নভাবে লেখা হত।

“টাইটানের অবস্থা কী?” জানতে চাইল বিজয়। ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের আবদ্ধ রোগীসহ আটটা গোপন ফ্লোর আবিষ্কারের সাথে সাথে তাদেরকে জয়পুরে নিয়ে। আসার ব্যবস্থা করেছেন ইমরান। তারপর জয়পুর থেকেই প্যাটারসনকে ফোন করে সমস্ত কিছু জানিয়েছেন।

“আমরা ওয়ালেসের সাথেও কথা বলেছি।” তীব্র কণ্ঠে উত্তর দিলেন প্যাটারসন, “মেডিকেল ফ্যাসিলিটির কথা শুনে তো একেবারে চমকে উঠেছেন। কিন্তু একই সাথে এটা যে টাইটানের নয় তাও জানিয়েছেন। জয়পুর ফ্যাসিলিটিও টাইটানের সাথে জড়িত নয়। যাই হোক এ ব্যাপারে কিরবাঈ কাজ শুরু করেছে।”

“মালিকেরা সবাই আত্মগোপন করে আছে।” রিপোর্ট করলেন ইমরান। “আমরা রেড অ্যালার্ট জারি করলেও লোকগুলো অত্যন্ত চতুরতার সাথে নিজেদেরকে ঢেকে রেখেছে। বেশ ভালো রকম পরিকল্পনা করেই নামা হয়েছে এ কাজে। ধরা পড়ে গেলে কী করবে সেটাও আগে থেকেই প্ল্যান করা আছে।”

“ওয়ালেসকে আপনি বিশ্বাস করেন?” জানতে চাইল কলিন। “অদ্ভুত সব জায়গায় তাকে ছড়ি ঘোরাতে দেখা গেছে। এতগুলো ব্যাপার কাকতালীয় হতে পারে না। অলিম্পিয়াসের সমাধি খননকাজে অর্থ সাহায্য করেছেন। উনার ট্রাস্ট পিটার আর স্ট্যাভরসকে নিয়োগ দিয়েছে। যারা ডাকাত আর বদমাশ ছাড়া কিছু নয়। টাইটান ফার্মার চেয়ারম্যানও তিনিই। আর তার কোম্পানির সাথে যুক্ত মেডিকেল সেন্টারেই এসব ধোয়াটে এক্সপেরিমেন্ট চলছিল। সেন্টার ভাড়া নেয়া হলেও যোগসূত্র অবশ্যই আছে।”

কয়েক মুহূর্ত সবাই নীরব হয়ে থাকল। তারপর প্যাটারসন জানাল, “তোমার কথাগুলোকে একেবারে অগ্রাহ্য করছি না। কিন্তু কোনো প্রমাণও নেই হাতে। ওয়ালেস টাইটানের নন-এক্সিকিউটিভ চেয়ারম্যান। যার মানে কোম্পানির সব সিদ্ধান্তে নাক গলানোটা তার এক্তিয়ারে পড়ে না। এমনকি এর মাঝে ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের জন্য বাড়ি ভাড়া নেয়ার সিদ্ধান্তও আছে। তাই সম্ভাবনা আছে যে অর্ডারের কাজে দিল্লির ফ্যাসিলিটি ব্যবহার সম্পর্কে সে সত্যিই ওয়াকিবহাল নয়। আর জয়পুর তো টাইটানের নয়ই। তাই টাইটানের সাথে যে দুই ফ্যাসিলিটির সম্পর্ক নেই ওয়ালেস সে দাবি করতেই পারে।”

“আর খনন কাজ?” কলিন হার মানতে নারাজ। রাধার অকাল মৃত্যু এখনো মেনে নিতে পারেনি। তাই মেয়েটার মৃত্যুর জন্য কাউকে না কাউকে তো দায়ী হতেই হবে।

প্যাটারসন মাথা নেড়ে জানালেন, “এবারও না বলব। ওয়ালেসের ট্রাস্টের পরিচালক হলো সিমার পার্কার। সমস্ত নিয়োগ সেই দেয়। ওয়ালেস নয়। স্ট্যাভরস আর কুপারের কথা কখনো শোনেইনি। আমরা পার্কারের ব্যাকগ্রাউন্ডও চেক করেছি। একেবারে পরিষ্কার। কুপারের কাগজপত্র জাল ধরা পড়েছে। নিখুঁতভাবে জাল করা হয়েছে। একেবারে সিআইএ’র মত। ওরা সত্যিই পেশাদার। তোমার কথামত যদি পার্কারকেও সন্দেহ করতে চাই; হাতে কোনো প্রমাণই নেই।”

“কিন্তু, অন্তত নজর রাখার ব্যবস্থা তো করা যায়, তাই না?” নিরাশ হতে চায় না কলিন।

“এখানে খুব সাবধানে পা ফেলতে হবে।” উত্তরে জানালেন প্যাটারসন, “সম্মিলিত বাহিনি হিসেবে আমাদের কেসের জন্য এখনো ততটা বিশ্বাসযোগ্যতা তৈরি করতে পারিনি। প্রথমবার অ্যাকশনে গিয়েও ব্যর্থ হয়েছি। ঠিক তাই; ব্যর্থই হয়েছি। যা ঘটেছে তাকে আর অন্য কোনোভাবে ব্যাখ্যা করার উপায় নেই। কারণ যাই হোক না কেন ফলাফলকে মেনে নিতেই হচ্ছে। অন্য কারো উপর যদি অভিযোগ চাপাতে চাই, কে বিশ্বাস করবে আমাদেরকে? আমরা যাদের কথা বলছি তাদের উপর নজরদারির জন্য কে রাজি হবে?”

“কিন্তু এভাবে তো ওদেরকে পার পেতে দেয়া যায় না।” রুখে দাঁড়াল কলিন।

“তুমি কি আবেগের বশবর্তী হয়ে বলছ নাকি কোনো শক্ত কারণ আছে?” পাল্টা প্রশ্ন ছুড়লেন প্যাটারসন। “আমরাও তোমার মতই ভাবছি। আমার জন্য টাস্ক ফোর্সের প্রতিজন সদস্যই সমান গুরুত্বপূর্ণ। আবেগপ্রবণ হয়ে লাভ নেই। আর যুক্তি বলছে যে এখন কারো উপর আঙুল তোলার উপায় নেই। যদি প্রমাণ মিলে যায় আমিই সবার আগে সবকটার রক্ত শুষে নেব। কিন্তু তার আগে আমার হাত বাঁধা।”

সবাই আবারো একেবারে নিশ্চুপ হয়ে গেল। কিন্তু কলিনকে মানতেই হল যে প্যাটারসন সত্যি কথা বলছেন। তিক্ত হলেও সত্য। এর সাথে আর কোনো তর্ক চলে না।

“সাক্সেনার খবর কী?” জানতে চাইল বিজয়।

“একেবারে লাপাত্তা।” উত্তরে জানালেন প্যাটারসন, “সাক্সেনাকেও সেন্টারের সাথে জড়ানো যাচ্ছে না। প্রমাণ করার জন্য কোনো প্রত্যক্ষদর্শীও নেই।”

“তার মানে লোকটার কিছুই হবে না?” বিজয় যেন কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছে না, “গুপ্ত ঘাতকের হাত থেকে ইমরান কোনোমতে বেঁচে ফিরেছে আর রাধাতো মারাই গেছে।” রাধার নাম উচ্চারণ করতেই ধরে এলো গলা, “তাতেও কি লোকটার সংশ্লিষ্টতা প্রমাণিত হয় না?”

“আমরা তাকে গ্রেফতার করতে পারি।” ভদ্রভাবে জানালেন ইমরান, “তুমি আর আমি তাকে শুধু সন্দেহ করছি; কিন্তু কোনো প্রমাণ নেই। যাই হোক শকুনের মত খুঁজছি। আগে হোক পরে তোক ধরা তাকে পড়তেই হবে। তারপর দেখাবো মজা।”

“আমাদেরকে আসলে যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করেই এগোতে হবে। যাই করি না কেন, যার বিরুদ্ধেই অভিযোগ তুলি না কেন; আইনের মধ্যেই থাকতে হবে।”

চুপ করে আছে বিজয়। চেহারায় ক্ষোভের স্পষ্ট চিহ্ন ফুটে উঠেছে।

“তো ঠিক আছে। আমার মনে হয় যুক্তরাষ্ট্র আর ভারতীয় সরকারকে রিপোর্ট করার জন্য যা যা প্রয়োজন, আমি পেয়ে গেছি।” সংক্ষেপে জানালেন প্যাটারসন, “টাস্ক ফোর্সের জন্য শুরুটা তেমন ভালো হল না। শত্রু পালিয়ে গেছে। সাথে ভাইরাস। তাই অনেক কাজ করতে হবে। ভাইরাসকে পৃথক করে কাঙ্ক্ষিত দ্রবণ প্রস্তুতে নিশ্চয় খুব বেশি সময় নেবে না। তার আগেই তাদেরকে থামাতে হবে। অথচ হাতে তেমন কোনো প্রমাণও নেই। তাই চলো কাজে লেগে পড়ি। দেখা যাক কী করা যায়। নিশ্চয় কোনো না কোনো রাস্তা বের হবে। ইতিহাস অর্ডারকে উপেক্ষা করলেও একেবারে অবহেলা নিশ্চয় করেনি।”

সম্মতি দিয়ে মাথা নাড়ল পুরো দল। সামনে অনেক কাজ। অর্ডারকে খুঁজে বের করতেই হবে। তাদেরকে থামাতেই হবে। আর বেশি দেরি হবার আগেই করতে হবে এ কাজ।

প্যাটারসন মাথা নাড়তেই সবাই যাবার জন্য উঠে দাঁড়াল। কিন্তু বিজয়ের দিকে তাকিয়ে বলে উঠল, “তুমি বসো।”

অন্যেরা বেরিয়ে যেতেই একা হয়ে পড়ল বিজয়। ওদিকে প্যাটারসনও একা। বড়সড় মানুষটা কিছুক্ষণ চোখ নামিয়ে রেখে অবশেষে বিজয়ের দিকে তাকালেন।

“এমন ভান করব না যে তোমার মনের অবস্থা বুঝতে পারছি। কিন্তু বিশ্বাস করো আমি সত্যিই অসম্ভব কষ্ট পেয়েছি। যুদ্ধক্ষেত্রে আমিও অসংখ্য বন্ধু হারিয়েছি। শৈশব থেকে যেসব ছেলেদের সাথে বেড়ে উঠেছি, খেলেছি, বিয়ার খেয়েছি গব গব করে…” মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন, “যুদ্ধ সম্পর্কে যদি কিছু শিখে থাকি তা হল আশা করো না। যুদ্ধ কখনো আশা বয়ে আনে না। বরঞ্চ আশাকে কেড়ে নেয়। একমাত্র শান্তিই কেবল আশা নিয়ে আসে। রাধার ব্যাপারে আমি অত্যন্ত দুঃখিত। কিন্তু তোমাকে থেমে থাকলে চলবে না। জানি মনে মনে ওর মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে চাইছ। সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আমি চাই সেসব চিন্তা হঠিয়ে দাও। এখন আমাদের কাজ হল অর্ডারকে পরাজিত করা। যদি তা না পারি তো অরাজকতায় ছেয়ে যাবে সবকিছু। এটা একটা যুদ্ধ মাই বয়। তাই রাধা নয়। পৃথিবীর ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবতে হবে। এটাই হল লক্ষ্য।”

নীরবে খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল বিজয়। তারপর বলল, “বুঝতে পেরেছি।” প্যাটারসনের চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, “হাতে কোনো প্রমাণ নেই বলেই যে সাক্সেনা, ভ্যান ক্লক আর বাকিদেরকে ছেড়ে দিতে হবে সেটারও কোনো মানে নেই। যদি হাতে কোনো প্রমাণ না থাকে, তাহলে খুঁজে বের করতে হবে। আর অর্ডারকে খুঁজে বের করার জন্য যা যা করতে হয় আমি করব। এমন নয় যে আমি কেবল প্রতিশোধের কথা বলছি। অন্যদেরকে যাতে আর প্রিয়জন হারাতে না হয় সে কারণেও করতে হবে। যেমন ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের সাবজেক্ট হিসেবে ব্যবহৃত সেসব লোক। আমরা অর্ডারকে থামাবোই। ঈশ্বর জানেন কিভাবে করব; আমি একটা না একটা রাস্তা ঠিকই খুঁজে বের করব। তার জন্য আমাকে যাই করতে হোক না কেন আমি রাজি আছি।”

প্যাটারসন মাথা নাড়লেন, “ঠিক তাই। যাই করতে হোক না কেন। না জানি এরই মাঝে কত প্রাণ কেড়ে নেয়া হয়েছে? আর শেষ হবার আগে আরো কত প্রাণ ঝরবে?”

.

প্রতিশোধের চিন্তা

কনফারেন্স রুম থেকে বেরিয়ে এল বিজয়। পথের মাঝখানে ডা. শুক্লাকে দেখে তো রীতিমত অবাক হয়ে গেল। প্রৌঢ় ভাষাবিদের উজ্জ্বল চোখ দুটোতে এমন এক দৃঢ়-সংকল্প দেখা যাচ্ছে যা কিছুতেই অবহেলা করা যাবে না।

ডা. শুক্লার মুখোমুখি হয়ে নীরবে দাঁড়িয়ে রইল বিজয়। জানে উনি তার সাথে একান্তে কথা বলতে চাইছেন। অন্যরা চলে গেছে। রয়ে গেছেন কেবল তারা দু’জন।

খানিক অপেক্ষা করে ডা. শুক্লা এমনভাবে কথা শুরু করলেন যেন বহুকষ্টে নিজের আবেগ দমন করতে চাইছেন,

“আমি আমার মেয়েটার মৃতদেহও দেখিনি। প্রতিটা শব্দের উপর জোর দিয়ে অবশেষে বললেন, “তুমি জানো একজন পিতার কাছে তাঁর মেয়ে কতটা মূল্যবান?” বিজয় স্পষ্ট বুঝতে পারল যে কান্না আটকাতে গিয়ে ডা. শুক্লার গলা ধরে এল। কেমন এক অদ্ভুত অনুভূতিতে ভরে গেল ছেলেটার অন্তর। “একজন পিতার জীবন নিহিত থাকে তার কন্যার মাঝে। মেয়ে কষ্ট পেলে বাবাও কষ্ট পায়। মেয়ের চোখে জল দেখলে বাবা নিজেও কেঁদে ফেলে। ক্ষমতা থাকুক বা না থাকুক মেয়ের পছন্দের সবটুকু খুশি এনে দেয়ার জন্য প্রাণান্তকর চেষ্টা করে সেই পিতা।” নিজেকে সামলানোর জন্য হিমশিম খাচ্ছেন ডা. শুক্লা, “ও-ই ছিল আমার বেঁচে থাকার উদ্দেশ্য। আর এখন…এখন তো সেই চলে গেছে।”

ভেঙে পড়লেন ডা. শুক্লা। গাল বেয়ে দরদর করে ঝরে পড়ল অশ্রুবিন্দু। নিজের আবেগকে আর ধরে রাখতে পারছেন না।

উথাল-পাথাল হৃদয় নিয়েও কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে বিজয়। ডা. শুক্লা শব্দগুলো স্মরণ করিয়ে দিল যে সে কী হারিয়েছে। বিজয় যেমন, মেয়েটা নিঃস্বার্থভাবে ঠিক সেভাবেই তাকে গ্রহণ করেছিল; ভালোবেসেছিল।

ডা. শুক্লার হাত ধরে চোখে চোখ রেখে বিজয় বলল, “আমি ওকে ফিরিয়ে আনব।” ডা. শুক্লাকে আশ্বস্ত করে জানাল, “ওকে সাহায্য করার জন্য আমি কিছুই করতে পারিনি। ওকে বাঁচাতে পারিনি।” গলা কেঁপে উঠতেই বুঝতে পারল আবেগ ওকে গ্রাস করছে; কিন্তু নিজেকে এখন আর সামলানোর কোনো ইচ্ছেই নেই। “কথা দিচ্ছি আপনি ওকে আবার দেখতে পাবেন। আমি ওকে ফিরিয়ে আনবোই। জানিনা কিভাবে কিন্তু ওদেরকে খুঁজে বের করে আমি ওকে নিয়ে আসবোই। আর যা করেছে তার জন্য ওদেরকে যথাযথ মূল্য চুকাতে বাধ্যও করব।”

সজ্ঞানে একটু আগে প্যাটারসনের সামনে উচ্চারিত প্রতিটা কথার বিরোধিতা করল বিজয়। কিন্তু সেটা নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই। পরোয়া করতে চায়ও না। ওতো কোনো হিরো নয়। ও দুনিয়াকে বাঁচাতে আসেনি। মহামানবের মত বলে এসেছে যে আর কাউকে যেন প্রিয়জন হারাতে না হয় তার জন্য কাজ করবে। কিন্তু ওর কী হবে? ও কেন রাধাকে হারাল? বিজয় তো আর তার ভালোবাসার মানুষটাকে ফিরে পাবে না!

কন্যার শোকে মূহ্যমান পিতাকে জড়িয়ে ধরল বিজয়।

পরস্পরের দুঃখ ভাগ করে নেয়ার জন্য কনফারেন্স হলের আধো-অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আছে দুই পুরুষ। ঠিক সেই মুহূর্তে একই দিকে ছুটল নিজেদের অনুভূতি আর ভাবনার গতি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *