৬.২ মাদারির মা কতবার মা

২০১.

মাদারির মা কতবার মা

 মাদারির মা এখন মাদারির মা, বড় জোর আট-দশ বছর, তার আগে সে আরো অনেকবার আরো অনেকের মা হয়েছে। কতবার কত মাদারির মা, তা এখন হিশেব কষে বের করতে পারবে না। এখানে, এই শ্যাওড়াঝোরায় মাদারির মা কত বছর আছে সে হিশেবও তার জানা নেই। কিন্তু মাদারির জন্মের আগে থেকে মাদারির মাকে চেনে এমন লোকজন মাদারিহাটে এখনো অনেকেই আছে। চেনে, মানে, মুখটা চেনা–এই পর্যন্তই। তাই চাইতে গভীর ভাবে আর মাদারির মাকে কেউবা চিনবে। যাদের তার মুখটা মনে আছে, তারাও এই হিশেব দিতে পারবে না, কতদিন থেকে চেনা। মাদারির মার মুখ এমন নয় যার সঙ্গে চেনা-পরিচয়ের ইতিহাস মনে থেকে যায়, দরকার হলে মনে পড়াবার জন্যে মনে থেকে যায়। দেখলে চেনা লাগে-বড় জোর এই পর্যন্ত। তারাও এখন মনে করতে পারবে না, মাদারির মা, মাদারি হওয়ার আগে আর কার কার মা ছিল। অথবা, তাদের পক্ষে মনে করা সম্ভবই নয়। কারণ, তারা জানবে কী করে যে মাদারির মার সঙ্গে যে-মাদারি এখন ঘোরাফেরা করে, বা, একা-একা হাটে আসে, সে, সেই ছেলেটিই নয়, যে, মাদারির জন্মের আগে তার মার সঙ্গে চলাফেরা করত? তা হলে ত শুধু। মাদারির মাকে চিনলেই হয় না, তার ছেলেপুলে ইত্যাদিও সবাইকেই জানতে হয়। তেমন জানা কি সম্ভব?

কিন্তু মাদারির মার ত সব সময়ই একটা না একটা ছেলে দরকার। একটা প্রমাণ সাইজের পুরুষমানুষ তার সব সময় দরকার কী না সেটা কখনোই তার মনে আসেনি। কিন্তু একটা ছেলে তার নেহাতই প্রয়োজন। আর, মায়ের ওপরই সম্পূর্ণ নির্ভরশীল এমন ছেলে ছাড়া কে তার সঙ্গে থাকবে?

মাদারির মায়ের একটা মাপ আছে। সে জানে ঐ মোটামুটি যখন চায়ের দোকানের টেবিলের সমান মাথা হয়, বা নিজে থেকেই ট্রাকের চাকার ওপর ভর দিয়ে ট্রাকের পেছনে উঠতে পারে, বা, যা পয়সা পায় তার সবটা মাকে আর দেয় না তার কিছুদিনের মধ্যেই সে-ছেলে এই শ্যাওড়াঝোরা ছেড়ে চলে যায়। কোথায় যায় তা খুব ঠিক করে মাদারির মা জানে না। কিন্তু আন্দাজে জানে যে তারা মাদারিহাট থেকে বীরপাড়া বা হাসিমারায় যায়। সেখানে বাসট্রাকের ডিপো বা অন্য কোনো কাজ একটু-আধটু শিখতেও পারে। মিলিটারির বিরাট ছাউনি আছে এ-সব জায়গায়। সেখানে চোরাই মালের আড়তে এমন অনেক ছেলেরই নাকি কোনোনা-কোনো কাজ জুটে যায়। সেখান থেকে সেই ছেলেরা একই পদ্ধতিতে শিলিগুড়ি পৌঁছয়। সেখানে আরো বড় চোরাই চালানের আড়ত হয়ত আছে। আরো বড় বড় ট্রাকে আরো বেশি-বেশি মাল হয়ত আসে। তা ছাড়াও আছে রেলের ইয়ার্ড, ওয়াগন–এই সব। সেখানে ছেলেগুলো হয়ত ছড়িয়ে-ছিটিয়ে যায়। কেউ-কেউ নাকি, এমন-কি, নেপালে চলে যায়, সেখান থেকে অনেক নতুন মাল এনে অনেক-অনেক টাকায় বেচে। সে-সব মাল ভদ্রলোকরাও কেনে। তার কিছু কিছু জিনিশ, এই যেমন গায়ে দেয়ার জামা, ছাতা এই সব, মাদারিহাটেও ওঠে।

মাদারির আগে তার কটা ছেলে এরকম মাথায় একটু টান দিতেই, বা, ট্রাকে একা-একা চড়তে পেরেই চলে গেছে, তা তার মনে নেই। তবে, তেমন চলে যাওয়ার আগে ছেলেগুলো রোজ ফেরা ছেড়ে দেয়। প্রথমে ছাড়ে খাবার খুঁজে বেড়ানো। তারপর, হাটখোলাতেই সারা দিন-রাত থাকতে শুরু করে দেয়। অনেক দিন না ফিরলে মাদারির মা বুঝে নেয়, চলে গেছে।

কিন্তু তার ত ছেলে ছাড়া চলবে না। তাই এক ছেলে লম্বা হওয়া শুরু করতেই সে আর-এক ছেলে আনে, যাতে, আগের ছেলে খাবার খুঁজে বেড়ানো বা ঝোরায় আচমকা দাঁড়ানো ট্রাকের কাছে হাত পেতে দাঁড়ানো বন্ধ করার সঙ্গে-গেই পরের ছেলে একটা বয়সে পৌঁছে যেতে পারে।

এত হিশেব-নিকেশ করে ছেলে পেটে ধরতে হেলে ছেলের একটা বাপ ত মাদারির মার হাতের কাছে সব সময় বহাল থাকা দরকার।

প্রথম দিকে তার কোনো অসুবিধে হয়নি। আর, তখন সে ত এই শ্যাওড়াঝোরা পর্যন্ত পৌঁছয়ও নি। প্রথম ছেলেটার কথা তার সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন মনে আছে, কারণ, তখনো তার জানা হয়ন যে ছেলেও চলে যায়, ছেলের বাপও চলে যায়। এক নেপালি আধবুড়োর একটা মুদিখানা দোকান ছিল হাটের ঠিক উল্টো দিকে। তার কোনো বউবাচ্চা ছিল না। সেই দোকানের লম্বা বারান্দায় তখন মাদারির মা পৌঁছে গেছে। নিজে থেকেই বারান্দা-টারান্দা ঝাড় দিত। দোকানি তাকে দোকানের ভেতরটাও একদিন ঝাড় দিতে বলল। আরো একদিন একটা সাবান দিয়ে বলল, ভেতরের কুয়োপাড়ে গিয়ে ভাল করে স্নান করতে। তার পরেও তাকে সাবান মাখতে হয়েছে বটে, কিন্তু, সেসব সেই দিনের সাবান মাখাটার মত রোমাঞ্চকর ঠেকেনি। স্নানের পর সে শাড়িজামাও পেয়েছিল। সেই রাত থেকেই দোকানি তাকে নিয়ে প্রথম রাতে বিছানায় শুত। পরে, তাকে দোকানির বিছানা ছেড়ে নিজের বিছানায় চলে আসতে হত। অত ছোট বিছানায় দোকানির ঘুম আসত না–আর-এক জনের সঙ্গে শুলে। কিন্তু তার প্রথম বাচ্চা হওয়ার পর দোকানি নিজেই একটা বড় চৌকি এনে জোড়া লাগিয়ে নেয়। বাচ্চা নিয়ে দোকানির সঙ্গে তখন সে অনেকগুলি দিন ও কিছু বছর কাটল। দোকানিটাও ছেলেটাকে এত ভালবাসত যে দোকানে গদির ওপর বসিয়ে রাখত। মাদারির মার সময়ের বোধের সঙ্গে ত আর দিন-মাস-বছরের হিশেব মেলে না। কত দিন পর কে জানে দোকানি দোকানটোকান বেচে, একটা বাক্স নিয়ে বলল, চললাম রে। ছেলেটাকে একটু আদর করে গিয়ে বাসে উঠল। আর-সব লোকজন গিয়ে তাকে হেসে-হেসে বিদায় জানাল। মাদারির মা বুঝেছিলবাস পর্যন্ত তার যাওয়া চলে না।

কিন্তু সে এটা বোঝেনি, দোকানের সঙ্গে তার ব্যবস্থাও নতুন মালিকের হাতে গেল কি না। বুঝতে অবিশ্যি বেশিক্ষণ লাগেনি। নতুন মালিকের নোক এসে সে রাত্রিতেই দোকানে তালা লাগিয়ে তাকে বলে গেল, আজ রাত্রিটা থাকো, কাল সকালে জিনিশপত্র বাচ্চা নিয়ে চলে যেও।

অতদিন বাড়ির খেয়ে, বাড়িতে থেকে, তার চেহারা ভাল হয়ে গিয়েছিল। নতুন মালিকের যে-লোকজন তাকে আগের রাত্রিতে বলে গিয়েছিল সকালে চলে যেতে, তাদেরই একজন, সহরাই উরাও, পরদিন কাক না-ডাকতে তাকে এসে বলে চল, আমার সঙ্গে বাচ্চা নিয়ে থাকবি।

লোকটার ঘর গিয়ে ওঠার দুদিন পর সে বুঝতে পারে লোকটি স-মিলে কাজ করে, স-মিলের মালিকই দোকানটার নতুন মালিক হয়েছে। লোকটি আগে কাজ করত চা বাগানে। সেখান থেকে ঘাটাই হয়ে স-মিলে এসেছে। লোকটার ঘর ছিল শাল বাকলা দিয়ে তৈরি। শীতকালে হাওয়া দিত। আর-একটা বাচ্চা হওয়ার পর লোকটা কাঠের ছোট-ছোট টুকরো দিয়ে ফাঁকগুলো বন্ধ করে দিয়েছিল।

সহরাই আগে চলে গেল, নাকি, তার প্রথম ছেলেটি–সে আর তার মনে পড়ে না।

সেই ঘরটাতে কিন্তু সে অনেক দিন থেকে গিয়েছিল। স-মিলের মালিক তাকে উঠে যেতে বলেনি। অনেক বৃষ্টিতে, রোদে, শীতে সেই কাঠগুলো পচে যেতে লাগল; যে-পাতলা কাঠগুলো ঘরের চাল হিশেবে ছিল তার কিছু পচে খসে গেল, কিছু উড়ে গেল; ঘরের পাটাতন নিজে থেকেই একে-একে খুলে গেল। এই সব হতে-হতে ত কয়েক বছরই যায়। এই ঘরটায় শেষ পর্যন্ত যতদিন সে থাকতে পেরেছে তাতে এক রাজবংশী বুড়ো জোতদার সপ্তাহে একদিন সন্ধ্যাবেলায় আসত, এক চা বাগানের বাঙালিবাবুও কয়েক দিন এসেছিল, এক মিলিটারি এসেছিল এক দিন, আর তার বাচ্চারা তখন নিয়মিতই হয়ে যাচ্ছে আর চলে যাচ্ছে। ততদিনে সে-ঘর কবে যে ভেঙে গেছে।

.

২০২.

মাদারির মা-র ও মাদারির ঘুম ভাঙে

মাদারির মার ঘরে মাদারির আর তার মার ঘুম ভাঙে সাত-সকালে মুরগির ডাকে আর ময়ূরের ডাকে। ঠিক শ্যাওড়া গাছটা বরাবর ঝোরার ওপর দিকে একটা শুকনো খটখটে গাছে ময়ূরটা রাত কাটায় আর সকালবেলা ওদের ঘুম ভাঙিয়ে চলে যায়। গরমের সময় কোনো-কোনো সন্ধ্যায় দেখা যায় ময়ূরটা সন্ধ্যা হওয়ার একটু আগে ঐ মরা গাছটাতে এসে বসে আছে। মরা গাছটারও অনেক দিন আগেই মরার কথা, কিন্তু, ময়ুরটার জন্যেই যেন মরে না, বছরের পর বছর বেঁচেই থাকে।

আর বনমোরগবনমুরগি ত প্রায় তাদের ঘরের মধ্যেই এসে ডাক দিয়ে যায়।

শীতকালে কষ্ট হয়। ঐ পাতার ঘরের ভেতর কাঠকুটো দিয়ে আগুন জ্বালানো যদি সম্ভব হয়, সম্ভব কবতেই হয়, তা হলেও সেল-আগুন শেষ রাতে নিবে আসে। সূর্যের আলো এই ফরেস্টের মধ্যে সোজাসুজি কোথাও ত ছড়িয়ে পড়ে না। কিন্তু কোনো একটা ফাঁকফোকর দিয়ে রাস্তার উল্টোদিকের ঢালটাতে রোদ আসে। সে-রোদ না-আসা পর্যন্ত তারা ঐ পাতার ঘর ছেড়েও বেরতে পারে না, পাথরের মত যেখানে পড়ে থাকার সেখানেই পড়ে থাকে।

এখন বর্ষা শেষ হয়ে গেছে প্রায়, শীত আসেনি। আকাশ শাদা হয়েই আসছে কিন্তু আচমকা বৃষ্টিপাত ঘটে যাচ্ছে যখন-তখন। দুপুরবেলায় ফরেস্টের ভেতর থেকে পচা জলের বাতাসে দম বন্ধ হয়ে আসে। এই সময় শরীর খুব গরম হয়ে যায়। আর, সকালে, সমস্ত গাছপালা যেন বৃষ্টিভেজা হয়ে থাকে, হিমে। সেই হিমেল সকালে মাদারি জেগে ওঠে, হে মা, চল্ যাবি কেনে, জলুশে।

মাদারি এখনো জানে, মা গেলেই তার যাওয়া হবে। মাদারির মা একবার ভাবে, বলে দেয়, তুই যা কেনে, মুই না যাও। কিন্তু, তা হলে ত মাদারি তার মায়ের কাছ থেকেই প্রথম জেনে যাবে যে এখন মা। ছাড়া জলুশে, এত বড় জলুশে যেতে পারে। যতদিন মাদারি সেটা নিজের থেকে না বোঝে ততদিন মাদারির মা তাকে বোঝাতে চায় না, এখন। এইবার বোধহয় তার হিশেবের গোলমাল হল। আর একটা ছেলে পেটে না-আসতেই, এই ছেলেটা চলে যাবার মত লম্বা হয়ে গেল। কিন্তু পেট ত তার আছে, সে এখন এই শ্যাওড়াঝোরায় ছেলে পেটে আনার জন্যে ছেলের বাপ পায় কোথায়? গাছ থেকে, বনমোরগ থেকে, ময়ূর থেকে ত আর মানুষের পেটে বাচ্চা হয় না। কিন্তু, এমন ত হতেও পারে যে তার আর বাচ্চার দরকার হল না। মাদারিকে বাহাদুর চা বানানো শিখিয়ে দিলে ঘোমশাইয়ের দোকানে সে একটা চাকরি পেয়ে গেল–চা বানানোর চাকরি। বা, ট্রাক মোছামুছিটা তার আরো খানিকটা বাড়ল, এই হাটেই।

এতগুলো কথা এতটা পরপর সাজিয়ে যে সে ভেবে উঠতে পারে তা নয়, কিন্তু, এমন ভাবনা তার মাথা বা মনের চারপাশে জমা হয়েই থাকে।

তাই মাদারি ডাক দিতেই সে সাড়া দেয়, যাবু নাকি তুই, সত্যিই?

মাদারি শুয়ে-শুয়েই তার মাকে ডেকেছিল! মার এই জিজ্ঞাসাতে ধড়ফড় করে উঠে বসে, কহিছিস কী মাই গে? কালি হাটত কতবার মারামারি আর কতখান ঢোলাই। তিনচারি ট্রাক যাবার ধরিবে। এ্যালায় নাকি সগায় যাবার ধরিবে, মারামারি হবে।

মাদারির মাও উঠে বসে, একটু হেসে বলে, তুই কি মারামারি করবু না মার খাবু? কায় মারে? মোক? ঘোষমশাইঅক ছাড়ি দাও, কায়ও মারিবার পারিবেন না, চল চল, ট্রাক চলি যাবে। মাদারি ঘরের ভেতর দাঁড়ায় আর মাদারির মা সেই আবছায়ায় দেখে স্বস্তি পায় মাদারি দাঁড়ালে এখনো এই ঘরে এটে যায়। মাদারির মা শুয়ে থাকে আর মাদারি বাইরে গিয়ে পেচ্ছাপ করে। করতে করতেই চিৎকার করে–মা গে।

অয়

কুয়া (কুয়াশা) দিছে, ঘন কুয়া।

ত চলি আয় ভিতরত—

এই কুয়ার ভিতরত ট্রাক আসিবা পারিবে? মাদারি দুই হাত বুকের ওপর আড়াআড়ি রেখে বা হাতে ডান কাধ ধরে, ডান হাতে বা কাধ ধরে একটু কেঁপে নেয়। মাদারির মা মনে-মনে ততক্ষণে জলুশে যাবার জন্যেই তৈরি হয়ে গেছে। কিন্তু, সে এটা বুঝতে পারে তাদের আগে-আগেই রওনা হতে হলেও–এতগুলো মাইল হেঁটে ত তাদের হাটখোলায় পৌঁছতে হবে–এত আগে নিশ্চয়ই নয়। সেও জলুশে যাবে–এটাতে তারও মনে একটু ফুর্তি আসছে বটে, কোথাও যাওয়ার ফুর্তি। কিন্তু, সেই যাওয়ার প্রস্তুতির জন্যে সে এখনি ব্যস্ত হতে রাজি নয়। নিজেকে ব্যস্ত করে তোলার পক্ষে এখনো কিছু সময় তার হাতে আছে।

মাদারি, এইঠে শুই থাক্‌ কেনে, এ্যালায় দেরি আছে।

মুই চলি যাও, তুই আয় কেনে পাছত, পেছন ফিরে ঘরের প্রবেশপথের দিকে তাকিয়ে, আরো একবার কেঁপে উঠে মাদারি বলে।

তয় মুই না যাও, মাদারির মা বলে।

মাদারি তার মায়ের কাছে চলে এসে বলে, আচ্ছা, আচ্ছা, মুই এইঠে আসিছু, যাবি ত মাই?

মাদারির মা কোনো জবাব দেয় না।

মাই গে-এ

অয়

কখন যাবু?

 খাড়া কেনে, এ্যালায় ত রাতি পোহায় নাই। তোর জলুশ কি আন্ধারত হবে?

না। রাতি পোহাইছে। কুঁয়া। চারিপুহে কুঁয়া।

কনেক আলো ধরুক। না-হয় ত ঐঠে হাট বসি থাকা নাগিবে।

কালি মুই শুনি আসিছু এইঠে ট্রাকগিলা আগত ছাড়ি দিবে, অনেক-অনেক দূর যারা নাগিবে ত! এইঠে দেরি বা ধরিলে আর পৌঁছিবে কখন?

কোটত যাবা নাগিবে? তুই চিনিস?

 মুই ক্যানং করি চিনিম? স্যাই তিস্তা নদীর মুখত, বান্ধ বান্ধিবার তানে সব মন্ত্রী মানষিলা আসিবে। তা এইঠে তাড়াতাড়ি রওনা না ধরিলে পৌঁছিম ক্যানং করি।

পৌঁছিবে, পৌঁছিবে, ট্রাকগাড়ি কত জোরত যায় দেখিস না?

 হয়। ট্রাকগাড়ি জোরত- যায়। দেখিছু।

মাদারি চুপ করে যায়। ট্রাক গাড়ির সঙ্গে মায়ের চাইতে তার সম্পর্কই ত বেশি। সে এখন চুপ করে সেই ট্রাকগাড়ির গতি কল্পনা করে। তার এই ঘর থেকে, তার ঘরের সামনের রাস্তা থেকে, হাটের সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সে ত এই ট্রাকগাড়ি কত জোরে ছোটে তা দেখে। পাশ দিয়ে চলে গেলে, গায়ে বাতাসের একটা ঝাপটা লাগে। অনেক সময় ঘাড় ঘুরিয়ে ঝাঁপট সামলাতে হয়। মাদারি তার মায়ের পাশে, রাশি রাশি শুকনো পাতার ওপর ফেলে দেয়া চটের ওপর, যেন ট্রাকের ঝাপটা সামলাতে ঘাড় ঘোরায়। ঘোরাতেই সে পাতার নরম শয্যায় ডুবে যায়। এইটি এ-ঘরের গোপন এক বিলাসিতা। শুকনো পাতা এনে গদি বানানো। পাতাগুলো যখন ভেঙে যায় তখন কিছুটা ফেলে দিয়ে আবার নতুন শুকনো পাতা ছড়িয়ে দেয়া হয়। তাহলে মাটি থেকে শীতের ঠাণ্ডা ওঠে না। বর্ষার জলও মাটি থেকে ভেজায় না।

পাশ ফিরে মাদারি বোধহয় তার ট্রাকের কথা ভাবতে-ভাবতেই একটু ঝিমিয়ে পড়ে। কিন্তু তার মার যেন আরো কিছু জানার ছিল। সে একবার ডাকে, আস্তে, হে মাদারি। কিন্তু মাদারি জবাব না দেয়ায় চুপ করে যায়। চুপ করে বাইরের আওয়াজ শোনে। জোর বৃষ্টি থেমে যাওয়ার পর জঙ্গলের ভেতর। থেকে টুপটাপ আওয়াজটা অনেকক্ষণ ধরে শোনা যায়। যে এই আওয়াজ জানে না, তার মনে হতে পারে বৃষ্টিরই আর-এক ছন্দ। সেই আওয়াজের নানা আয়তন আছে–কত ওপর থেকে কোন গাছ বা পাতার ওপর পড়ছে তার ওপর সেই আয়তন নির্ভর করে। মাদারির মা শোনে-জঙ্গলের ভেতর থেকে সেই টুপটাপ আওয়াজ উঠছে, ছড়িয়ে যাচ্ছে, এগিয়ে আসছে। হিম পড়ছে। সে আরো দুটো-একটা আওয়াজের অপেক্ষা করে রওনা হওয়ার জন্যে।

.

২০৩.

মাদারি প্রথম চা বানায়

কিন্তু এত করেও মাদারি আর মাদারির মা এতগুলো মাইল হেঁটে যখন হাটখোলায় পৌঁছয় তখন হাটখোলাতে একটা বড় ট্রাক শিশিরে ভিজে দাঁড়িয়ে আছে বটে, আর-কোনো জনমনিষি নেই। এতটা খালি দেখে মাদারি দূর থেকেই বলে ওঠে, হেই মাই গে, জলুশ চলি গেইসে।

মাদারির মা বলে, একখান মানষিও নাই আর তোর জলুশ চলি গেইল, ক্যানং তোর জলুশখান? ঐ ত ঐঠে একখানা ট্রাক কুঁয়াত ভিজি খাড়া হয়্যা আছে।

মাদারি তার মাকে ধমকে ওঠে, তুই চুপ কর, ঐখান ত এইঠেই থাকে, সিঙ্গিবাবুর ট্রাক, কাঠ নিগায়।

মাদারির মা বলে, চল, কনেক বসি; দেখিবু, মানষি আসিবার ধরিবে। তোক বারবার কহিছু এ্যালায়ও টাইম হয় নাই, টাইম হয় নাই।

এরকম কথা বলতে বলতে ওরা হাটখোলায় ঢোকে। ঢুকতেই দেখে ঘোমশাইয়ের দোকানের ঝাপটা আধখোলা। মাদারি দৌড়ে উল্টো দিকে গিয়ে দেখে বাহাদুর টিউবওয়েলের সামনে উবু হয়ে বসে আঙুল দিয়ে দাঁত ঘষছে।

হেই গে বাহাদুর দাদা, জলুশ কখন যাবা ধরিবে?

মুখের ভেতর থেকে আঙুল বের করে বাহাদুর মাদারিকে চোখের ইশারায় টিউবওয়েল টিপতে বলে। এই টিউবওয়েলের হ্যান্ডেলটা শক্ত, ওপরেই থাকে, একবার নামালে ধাক্কা মেরে উঠে আসতে চায়। বাহাদুরের ইঙ্গিত পাওয়া মাত্র মাদারি দৌড়ে এসে হ্যান্ডেলটা ধরে। হ্যান্ডেলটা একটু লম্বা ও একটু উঁচু। লোকের হাত যে-জায়গাটায় পড়ে, সেটুকু বাদে বাকিটুকুর রং কালচে-ব্যবহারের উজ্জ্বলতাসহ কালচে। লোকের হাত যতটা জায়গাকে ইস্পাতের মত রুপালি করে রেখেছে, মাদারির হাত, তার একটা খুব ছোট অংশেরই ওপর পড়ে।

মাদারি হ্যান্ডেলটাকে তার মাথার ওপর থেকে নামানোর জন্যে একটা হ্যাঁচকা টান দেয়। কিন্তু প্রথম টানে হ্যান্ডেলটা নামে না। তখন মাদারি আর-একটা টান দিতেই হ্যান্ডেলটা কিছুটা নেমে আসে আর মাদারি তার পেট দিয়ে হ্যান্ডেলটার ওপর ঝুলে পড়ে, তার বা পায়ের আঙুলগুলো মাটিতে ছোঁয়ানো থাকে, ডান পাটা শূন্যে উঠে যায়, তার প্যান্টটাও কোমর থেকে নেমে যায়, হ্যান্ডেলটা নেমে আসে আর টিউবওয়েলের বড় মুখ দিয়ে হড়হড় করে জল পড়ে। এই টিউবওয়েলটার এটাই মজা। হ্যান্ডেল একবার চালাতে পারলেই প্রায় এক বালতি জল হয়ে যায়। বাহাদুর জলের কাছে এগিয়ে যায়, তারপর দু-আঁজলা মিলিয়ে জল নিয়ে সারা মুখে ছড়ায়, মুখের ভেতরে টানে, জোরে-জোরে কুলকুচি করে, হ্যাঁক থুঃ বলে জোরে-জোরে গলা ঝাড়ে আর মাদারির হাতের হ্যান্ডেলটা খটাস করে ওপরে উঠে যায়।

মাদারি আবার দুই হাতের এক হ্যাঁচকা টানে হ্যান্ডেলটাকে নামায়, এবার এক টানেই হ্যান্ডেলটা নেমে আসে, আবার পেটের ভর দিয়ে হ্যান্ডেলটার ওপর ঝোলে আর শরীরের ভর দিয়ে হ্যান্ডেলটাকে নামিয়ে এনে নামিয়ে রাখে। হড়হড় করে জল পড়তে শুরু করলে বাহাদুর মুখপোয়া শেষ করে হাতেরও কিছুটা ধুয়ে ফেলে উঠে দাঁড়ায়, কলপাড় থেকে সরে আসে। মাদারি হ্যান্ডেলটা ছেড়ে দিলে একটা আওয়াজ করে সেটা ওপরে উঠে যায়। আনাড়ি লোক এই কল চালাতে গিয়ে থুতনিতে, বা কপালে, হ্যাঁন্ডেলের ধাক্কা খায়।

মাদারির মা ততক্ষণে পায়ে-পায়ে রাস্তার ওপরেই এদিকে সরে এসে দাঁড়িয়েছে যেখান থেকে এই কলতলাটা সোজা দেখা যায়। মাদারির মা এদিকে তাকিয়ে ছিল না–সে তার বাঁ দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে ছিল। ঐ দিক থেকেই তারা এসেছে। ঐ রাস্তাটাই তার বেশি চেনা।

বাহাদুর দোকান ঘরের ভেতর ঢুকে যায়; পেছন-পেছন মাদারি। আর, মাদারির মা রাস্তা ধরে আবার খানিকটা আনমনা হেঁটে আড়ালে সরে যায়। মাদারি বাহাদুরকে জিজ্ঞাসা করে, হে-এ বাহাদুরদা, জলুশ কখন যাবে?

বাহাদুর একটা ছোট তোয়ালে দিয়ে হাত মুছতে-মুছতে বলে, যাবে, যাবে তর জলুশখান কি পাখা মেলি উড়ি যাবে? মানষিলা উঠিবে, চা-পানি খাবে, খোয়াদোয়া করিবে, স্নান করিবে, চুলখানা বান্ধিবে এ্যানং-এ্যানং করি, তারপর ত জলুশ ধরিবার তানে হাটত আসিবে। নাকি তোর নাখান ঘুম থিকা উঠি দৌড় ধরিবে, এ্যা? এই সব বলতে বলতে বেড়ায় গোজা একটা ছোট আয়নার সামনে বাহাদুর অনেকক্ষণ ধরে চুল আঁচড়ায়, চিরুনিটাতে বুড়ো আঙুল চালিয়ে একটা আওয়াজ তোলে, তারপর চিরুনিটা তার ছোট হাফপ্যান্টের পেছনের পকেটে খুঁজে দেয়।

হে-এ মাদারি, ঐঠে দেখ, চুল্লির উপর, গরম জল ফুটিবার ধরিছে, চা বানিবার ধর, তিন কাপ, তর মায়ের তানে একখান বলে দোকানের আর-এক জায়গায় গেঁজা একটা পোটলা নামিয়ে বাহাদুর একটা রঙচঙে কাপড় বের করে। সেটা ফাঁক করে গলায় ঢুকিয়ে দেয় এমন কায়দায় যে তার চুলে স্পর্শ লাগে না। তারপর হাত ঢোকায়। কোমর পর্যন্ত নামিয়ে নেয়ার পর বোঝা যায় এটা একটা খুব রঙচঙে ছবি আঁকা গোল গলার গেঞ্জি।

আবার সেই আয়নাটার সামনে এসে মাথাটা নিচু করে বাহাদুর নিজেকে একটু দেখে।

 জল ত ফুটি গেইছে, হে-এ বাহাদুরদা–মাদারি নিবন্ত আঁচের যে-চুল্লিতে রাতভর জল ফুটছে তার পাশ থেকে জিজ্ঞাসা করে।

টেবিলের উপর দেখ, কেনে মখগান আছে, ঐঠে জল ঢাল আধাআধি, বলে বাহাদুর দোকানের আর-এক কোনায় গিয়ে ওপরের বাতায় গেঁজা একটা ফুলপ্যান্ট নামায়, তারপর সেখানে দাঁড়িয়েই ফুলপ্যান্টটা পরতে থাকে। প্রথমে টেনে তোলে কোমর পর্যন্ত, তারপর ফুলপ্যান্টটাকে শরীরের সঙ্গে মিলিয়ে নেবার জন্যে কোমরটা একবার ডাইনে বেঁকায়, একবার বয়ে বেঁকায়, একবার সামনে এগিয়ে আনে। চিরুনিটা হাফপ্যান্টের পকেট থেকে বের করে হাতে রাখে। তারপর সে কোমরে বোতামটা আটকে চেনটা টানতে পারে ও চিরুনিটা পেছনের পকেটে খুঁজতে পারে। সেই সময় মাদারি তার পায়ের আঙুলের ওপর ভর দিয়ে টেবিল থেকে মগটা আনে। সেই হাঁড়ি থেকে আধ মগ জল সে তুলতে পারে একটা এলুমিনিয়ামের গ্লাশের সাহায্যে। দুই গ্লাশ ঢালতেই তার মনে হল আধাআধি হয়ে গেছে। সেই মগটার সামনে থেকে ঘাড় ঘুরিয়ে দোকানের ভেতর দিকে তাকিয়ে সে বলে, হে-এ বাহাদুরদা, এ্যালায় কী করবু?

বাহাদুর তখন তার কোমরে একটা চকচকে চওড়া বেল্ট লাগাচ্ছিল। সেই বেল্টটা টাইট দিতে-দিতে সে বলে, খাড়া, আইচছু। তারপর বেল্টটা আটতে-আঁটতেই চুল্লির দিকে এগিয়ে আসে। তাকে দেখে মাদারি চিৎকার করে, হে এ বাহাদুর দাদা, তোমাক ত মিলিটারির নাখান দেখাছে।

বাহাদুর একটা কৌটো তুলে এনে একটু নিচু হয়ে মগটার মধ্যে তিন-চার চামচ চিনি ফেলে দেয়, তারপর একটা কড়াই থেকে একটা ছোট হাতভর্তি দুধ তুলে মাদারির পাশ দিয়ে মগটাতে ঢালে। হাতটা কড়াইয়ের ভেতর রেখে দিয়ে বাহাদুর একটা চায়ে ভেজা মরচে রঙের ন্যাকড়ার ভেতরে একটা কৌটো থেকে খানিকটা ডাস্ট চা ঢেলে পোটলা করে মাদারির হাতে দেয়–এটা নিয়া নাড়া কেনে। চায়ের রঙ যেইলা ধরিবে স্যালায় তুলি ফেলি চামচ নাড়াবি।

চামচা কোটত?

টেবিলের উপর, বলে বাহাদুর আবার দোকানের ভেতর দিকে চলে যায়। মাদারি চায়ের পোটলা হাতে আবার টেবিলের কাছে যায়, আঙুলে ভর দিয়ে এলুমিনিয়ামের একটা চামচ নিয়ে আসে। তার কাছে চামচটা খুবই জরুরি। মগে ঐ চামচের আওয়াজ তুলেই বাহাদুর তার কাছে এমন মাহাত্ম্য পেয়েছে। আজ জলুশের সুযোগে এই প্রথম সে চামচ নাড়ার অধিকার পেল।

চায়ের পোটলা সেই দুধ-চিনি ভেজানো গরম জলে মেশানো হল কি হল না, মাদারি চামচের আওয়াজ তোলা শুরু করে। বাহাদুর যে-রকম দ্রুত ও উচ্চ শব্দ তোলে, সেরকম। তাতে মগ নড়ে গিয়ে খানিকটা চা মাটিতে পড়ে যায়। তখন সে মগটাকে বা হাতে আরো জোরে চেপে ধরে।

.

২০৪.

বাহাদুরের সাজসজ্জা ও সমবেত চা পান

হে-এ বাহাদুরদা, গেলাসে ঢালিম? চা? তার চামচ নাড়ানোর তৃপ্তির পর মাদারি জিজ্ঞাসা করে।

খাড়া কেনে, না ঢালিস, মুই যাছ, বাহাদুর চিৎকার করে বলে।

 মাদারি একটু চুপ করে থাকে, মগে তার তৈরি চায়ের দিকে তাকায়, সত্যিই বাহাদুরদার তৈরি চায়ের মতই রঙ হয়েছে। সে বাহাদুরের দিকে তাকায়, তারপর আবার চিৎকার করে, টেবিলের উপর রাখি দিম? মগখান?

দে, রাখি দে, বাহাদুর আস্তেই বলে।

ঘোষমশাইয়ের দোকানটা একটু বড়। খড়ের দোচালা, মাটির ভিটে, শুধু চুল্লি আর এই আলমারি রাখার জায়গাটা বাধানো। বাঁধানো বটে, কিন্তু মাটিতে-মাটিতে এখনই এমন ময়লা যে সিমেন্ট আর দেখা যায় না। দোকানে সারি-সারি বেঞ্চি পাতা, একটা উঁচু বেঞ্চি, একটা নিচু–ইস্কুলের ক্লাশের মত। সেই চালের বাতার এক-এক জায়গায় এক-একটি জিনিশ গোজা। নামিয়ে নামিয়ে বাহাদুর সাজগোছ করছি। ঘরের ঐ দিকগুলোতেও ঝাঁপ আছে। সেগুলো খুলে দিলে মনে হয় যেন মাথার ওপরেও কোনো চাল নেই। শুধু পেছনের ঝাপটা হাটের দিন খেলা হয় না–পাছে কেউ পয়সা না দিয়ে পেছন থেকেই কেটে পড়ে। এখন ঝাঁপগুলো সব নামানো। শুধু এই চুল্লির পাশের ছোট ঝাপটা ভোলা! ফলে, এত বড় দোকানের ভেতরটা অন্ধকারই লাগছে। সেই কারণেই বাহাদুর আর মাদারি এমন চিৎকার করে কথা বলছে।

অথবা, হাটের দিন দোকানের ভেতর এরকম চিৎকার করে কথা বলার অভ্যেস থেকেই এখনো। বলে যাচ্ছে।

মাদারি মগটা দুই হাতে তোলে। তারপর, আবার নামিয়ে রাখে–মগটা নিয়ে উঠতে গেলে যদি চলকে পড়ে যায়। মাদারি দাঁড়িয়ে মগটার ওপর নিচু হয়ে তার কানায় দুহাত লাগিয়ে তোলে। কিন্তু, সোজা হওয়ার আগেই আবার নিচু হয়ে মগটা রেখে দিল। কানা ধরে এরকম করে তুলে সে ত টেবিলের ওপর রাখতে পারবে না। সেখানে ত তাকে আবার আঙুল উঁচু করতে হবে। এবার নিচু হয়ে সে মগটার দুটো পাশ বাইরে থেকে চাপ দিয়ে ধরে, তারপর তোলে। গরম আছে, তবে চা ত আধা-আধি, হাতে অত লাগছে না। ডান হাতটা একটু পিছলে নেমে যায় বটে কিন্তু ঐ ভাবেই মাদারি কয়েক পা হেঁটে টেবিলের কাছ পর্যন্ত যেতে পারে। সেখানে গিয়ে সে একটু দাঁড়ায়, তারপর মগসহ হাত দুটো নিজের মাথার ওপর তুলে ঠক করে মগটা টেবিলের ওপর নামায়।

নিজের হাত দুটো নিজের শরীরের দুপাশে ঝুলিয়ে মাদারি বয়স্ক লোকের মত একটা শ্বাস ফেলে। তারপর নাক টেনে আবার চেঁচায়, হে-এ বাহাদুরদা

বাহাদুর এবার যেন খুব কাছ থেকে বলছে এমন স্বরে বলে, ক কেনে।

রাখিছু। মগখান টেবিলত রাখিছু।

খাড়া। আসিছু–

মাদারি, যেখানে বসে চা বানিয়েছিল সেই জায়গাটার দিকে তাকায়। দেখে, চামচটা পড়ে আছে। চামচটা তুলে এনে টেবিলের ওপর রাখতেই গটগট আওয়াজ তুলে বাহাদুর এসে হাজির। মাদারি যেন তার এত সাধনায় তৈরি চা ভুলে যায় মুগ্ধ হয়ে দেখে বাহাদুরের টেরি, গোল ছবি-আঁকা গেঞ্জি, লোহার নাল লাগানো চওড়া বেল্ট, নীল রঙের সরু প্যান্ট ও পায়ে একটা বড় জুতো। বড়, মানে, জুতোটা যেন গোড়ালি থেকে অনেকটা উঁচু পর্যন্ত পা ঢেকে রেখেছে। এর মধ্যে বাহাদুরের টেরিটাই একমাত্র তার চেনা। বাহাদুরকে এত অচেনা লাগে মাদারির যে দু-এক পা পেছনে সরে গিয়ে বাহাদুরকে দেখে।

বাহাদুর এসে তিনটে কাঁচের গ্লাশ সাজিয়ে মগ থেকে চা ঢেলে ভর্তি করে দেয়। একটা গ্লাশ শুধু হাত বাড়িয়ে, শরীর না ঘুরিয়ে, মাদারির দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে, তোর মাক দিয়া আয়

মাদারি পাশ দিয়ে বেরতে গেলে বাহাদুর বলে, খাড়া কেনে।

তারপর মিষ্টির আলমারির তালাটা খুলে ঘোমশাইয়ের চৌকির ওপর রেখে, তালাটার চাবি ছিল না, ভেতর থেকে একটা প্লাস্টিকের বয়ম বের করে, খুলে, একটা লম্বা কুকিস বিস্কুট মাদারির হাতে দিয়ে বলে, যা, মাক দিয়া আয়।

গ্লাশ আর বিস্কুটটা নিয়ে দুপা গিয়ে মাদারির কেমন সন্দেহ হয় যেন, সে দাঁড়িয়ে পড়ে, না ঘুরে, মাথাটা একটু হেলিয়ে বলে, চা আর বিস্কুট দুইখানই মাইঅক দিম?

হয়, হয়। আর তোরটা এইঠে থাকি, বলে বাহাদুর তার চায়ের গ্লাশ আর বিস্কুট নিয়ে সেই ছোট ঝাপটা দিয়ে বাইরে বেরয়।

ঘোষমশাইয়ের দোকানটা হাটখোলার একেবারে দক্ষিণ সীমায়, বড় রাস্তার প্রায় গা ঘেঁষে। বলা উচিত দক্ষিণ-পশ্চিম কোনায়। কিন্তু টিউবওয়েলটা দোকানেরও দক্ষিণে। এই দক্ষিণ দিকটা দোকানের পেছন দিক হয়ে যেত টিউবওয়েলটা না থাকলে। এখন সেদিকের ঝাপটা দিয়ে বেরিয়ে দোকানটা ঘুরে ওদের হাটখোলা রাস্তা এ-সবের ভেতরে পড়তে হয়।

সেই বাইরে এসে বোঝা যায়–হঠাৎ যেন সকালটা অনেক বেড়ে গেছে। কোথাও কুয়াশা নেই। রোদ এসে পড়েছে হাটখোলার নানা ভাঙা চালে, নানা খোলা ভিটেয়, রাস্তায়। হাটের অসমতল ধুলো, মানুষের পায়ে-পায়ে এলোমেলো ধুলো, হিমে ভিজে নেতিয়ে। মাদারির মা রাস্তায়, একটু রোদে বসে। রাস্তাতেই আরো দু-চারজন লোক ঘোরাফেরা করছে। হাটখোলার একটা ভিটের ওপর জনাদশবার লোকের একটা ভিড় দাঁড়িয়ে আছে, রোদেই।

এই রকম প্রকাশ্য জায়গা দিয়ে, এত লোক পেরিয়ে, এতটা হেঁটে মাদারি তার মাকে চা-বিস্কুট দিচ্ছে–এটা যেন মানায় না। মানায় কি না-মানায় সেটা না-জেনেই মাদারি ঘোমশাইয়ের দোকান ঘুরে এদিকে এসে তার মাকে খুঁজতে এদিক-ওদিক তাকিয়ে কেমন অপ্রস্তুত বোধ করে। কেন অপ্রস্তুত বোধ করে সেটা ত সে বোঝে না। তাই মাকে খুঁজে পেয়ে চায়ের গ্লাশ আর বিস্কুট নিয়ে তার দিকে এগিয়ে যায়।

মাকে চা দিয়ে মাদারি বলে, মুই বানাইছু, বাহাদুরদা মোক শিখাইছে।

চা নিয়ে মাদারির মা বলে, টেবিল? যেন এটা জানা তার পক্ষে সবচেয়ে জরুরি যে হঠাৎ আজ জলুশের সকালে মাদারি মাথায় চা বানানোর টেবিলের সমান উঁচু হয়ে গেল নাকি?

মাদারি হেসে বলে, না। মাটি। এইঠে ত চুল্লিটা, তার সমুখত, মাটিত- সে যেন তার মাকে ঘরের অবস্থানটা খুব ঠিক করে বোঝাতে চায়।

মাদারির মা বিস্কুটটা তাকে এগিয়ে দেয়। মাদারি কোমরে দুহাত দিয়ে বলে, এইটা তোর, বাহাদুরদা দিছে, তুই খা কেনে, মাই, খা, বাহাদুরদা দিছে, বিস্কুট, আর মুই বানাইছু চা, খা। মায়ের চা খাওয়া দেখাটাই যেন তার প্রধান কাজ এমন অনড় হয়ে থাকে সে।

মাদারির মা চায়ে বিস্কুট ভিজিয়ে একটা কামড় দেয় আর তার মুখটা চায়ের ঈষদুষ্ণ তরল স্বাদে ভরে যায়, সহজে শূন্য হয়ে যায় না। মুখের সেই বিবর ভরে থাকে বিস্কুটের নরম অথচ তখনো অখণ্ড টুকরোয়। সে চিবয় না। মুখের ভেতরের সব অঙ্গ দিয়ে–তালু, মাড়ি, দাঁত, জিভের পাশ, মাথা দিয়ে সেই নরম অখণ্ড টুকরোটা আস্বাদ করতে থাকে। বাহাদুর হক দেয়, হে-এ মাদারি, তোর চা নিগা।

সেই ভিড়টা থেকে একজন জিজ্ঞাসা করে, চা পাওয়া যাবু নাকি?

 বাহাদুর তার হাত তুলে ঘোষণা করে দেয়, আজ জলুশ, আজ দোকান বন্ধ।

.

২০৫.

হাটখোলায় নাচ গান

সকাল আটটা-সাড়ে আটটা নাগাদ পুরো হাটখোলার কম্যান্ড যেন বাহাদুরের হাতে চলে যায়।

তখন থেকেই লোক জুটতে শুরু করেছে। রাস্তা জুড়ে সারি দিয়ে ত লোক আসছেই, রাস্তা ছাড়াও নানা দিক থেকে লোক উঠে আসে। হাটখোলার উত্তরের রাস্তা দিয়ে গান গাইতে-গাইতে দেবপাড়া বাগানের মেয়ে-মজুররা ফরেস্ট উতরে আসে। তাদের পেছনে ঢোল বাজাতে বাজাতে মরদরা। প্রায় প্রত্যেকেই স্নান করেছে, অন্তত তেল মেখেছে প্রচুর। মেয়েরা মাথার চুলে ফুল গুঁজেছে–হাতের কাছে যে-ফুল পেয়েছে তাই। কিন্তু হাতের কাছেও সবাই ফুল পায়নি, তখন পাতা গুঁজেছে-হাতের কাছে যে-পাতা পেয়েছে তাই। দু-একজনের মাথায় চা পাতার তোড়া। তারা নদী, টিলা আর ফরেস্ট পেরিয়ে যে এল সেটা বোঝা যায় পায়ের দিকে তাকালে। কিন্তু হাটখোলায় এসেও তাদের নাচ থামে না বরং এতক্ষণ যেন ফরেস্টের ভেতর দিয়ে আসতে-আসতে তারা নাচার ঠিক জায়গা পায়নি। তা ছাড়া, সময় মত হাটখোলায় পৌঁছবার তাড়াও ছিল। এখন এখানে এসে যখন দেখছে, হাতে সময় আছে, হাটখোলায় জায়গাও আছে প্রচুর, আর তাদের পায়ে নাচও জমা আছে–তারা গাইতে-গাইতে নাচতে শুরু করে দেয়। আর, তাদের পেছনে-পেছনে মরদরা ঢোল বাজায় আর দোলে, দোলে আর ঢোল বাজায়। একজন একটা বাঁশিও এনেছে। কিন্তু এতটাই হাড়িয়া খেয়েছে যে কিছুতেই বাঁশিটা ঠোঁটে লাগাতে পারে না। সে ঠোঁটে লাগাতে গিয়ে একবার থুতনিতে, একবার গালে, এমন-কি একবার গলায় লাগায়। লাগিয়ে ফুও দেয়। যখন বাজে না, তখন বাঁশিটা তুলে এনে তাকিয়ে পরীক্ষা করে। আবার বাঁশি ঠোঁটে লাগাতে চায়।

দেবপাড়ার দলের সঙ্গে কখন যে মিরপাড়া, খয়েরবাড়ি, মুমবাড়ির মজুররা মিশে যায় তা কেউ টেরও পায় না। একটা দল বেশি বড় হয়ে গেলে আর একটা দল তৈরি হয়ে যায়। তাদের ঢোল বাজতে থাকে, বাজতেই থাকে। বুড়িহোরসার চর থেকে একদল সাঁওতাল এসেছে, তারা চা-বাগানের এদের কাউকে চেনে না, কিন্তু ওদের নাচ আর ঢোল বোঝে-তারাও এদের সঙ্গে নাচতে শুরু করেছে। মনে হয়, আজ হাটখোলায় নাচ হবে–এটাই কথা ছিল।

পাশাপাশি গ্রাম থেকে রাজবংশীরাও উঠে এসেছে। তারাও তাদের সবচেয়ে পরিষ্কার জামা কাপড় পরে সেজেছে। মেয়েরা আর বয়স্ক পুররুষরা, মনে হয়, মান করেই এসেছে-নইলে মাথায় মুখে তেল মেখেছে। তাদের নাচ নেই–তারা গোল হয়ে দাঁড়িয়ে এই নাচ দেখে যাচ্ছে।

বাহাদুর একটা ব্যাটনও জোগাড় করেছে।

সে সেই ব্যাটন নিয়ে নাচ যারা দেখছে তাদের লাইন রাখতে ব্যস্ত। লম্বা-লম্বা পা ফেলে মিলিটারির, মত হাঁটছে। আর বাচ্চাদের বসিয়ে দিচ্ছে, মেয়েদের এক পাশে সরিয়ে দিচ্ছে, অকারণে এই পাছত যাও, পাছত যাও বলে চেঁচিয়ে উঠছে। বাহাদুরকে এরা প্রায় প্রত্যেকেই চেনে। তাই তার এই পরিবর্তনকেই সবচেয়ে নাটকীয় লাগে–নাচ আর ঢোল ত তারা প্রায়ই দেখে থাকে।

 ভিড়ের ভেতর থেকে কে চিৎকার করে, হে-এ বাহাদুর, ঘোমশাই ডাকোছে।

বাহাদুর তার দিকে ব্যাটন উঁচিয়ে বলে, আইজ দুকান বন্ধু, আইজ জলুশ।

হঠাৎ একটা হৈ-হৈ আওয়াজে সবাই পেছনে তাকিয়ে দেখে তিনটি ট্রাক দাঁড়িয়ে আছে, রাস্তার ওপর, ভর্তি মেয়ে-পুরুষ, একটা ঝাণ্ডা-মতও কী আছে, তারা নাচ আর ঢোলের আওয়াজ পেয়ে ট্রাকের ভেতরই যেন নেচে উঠতে চায়। বাহাদুর দৌড়ে তাদের কাছে যায়। একজন ড্রাইভারের পাশের আসন থেকে গলা বাড়িয়ে কী জিজ্ঞাসা করে, বাহাদুর তাকে জবাব দেয়, ট্রাক ত এ্যালায়ও আসে নাই, আসিবার টাইম হই গিছে। সেই ট্রাক একটু আওয়াজ তুলে চলে যায়। বাহাদুর পেছনে ট্রাকটার পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। আর ড্রাইভারকে উদ্দেশ্য করে যেন বলে–চলি যান, মোরা যাছি। তৃতীয় ট্রাকটাকে সে হাত তুলে চালাতে নিষেধ করে, তারপর রাস্তাটা পেরিয়ে গিয়ে ব্যাটনটা তুলে চালাবার নির্দেশ দেয়। সেই ট্রাকটা চলে গেলে বাহাদুর চিৎকার করে ওঠে, হাপাড়া টি এস্টেট চলি গেইছে, এ্যালায় লঙ্কাপাড়া আসিবার ধরিছে–

তা তোমারখান কখন আসিবার ধরিবে হে বাহাদুর? বুড়োমত ছোটখাট একজন এসে বাহাদুরকে জিজ্ঞাসা করে।

উমারায় সব বাগানের মানষি, নিজের ট্রাক, উঠি বসিছে, স্টার্ট দিছে, আর তোমার এ্যালায় কুন কনট্রাকটর আসি ট্রাকগাড়ি দিবে, ছাড়িবে, তার বাদে তোমরালা জলুশত যাবেন। স্যালায় জলুশ ফরসা। হ-য়, পক পক করি মুখ্যমন্ত্রী আসিবেন মোর বনমন্ত্রীখানও থাকিবে। আর হামরালা য্যালায় যাম, দেখিম বাশ গিলান খাড়া আছে–মন্ত্রীও নাই, তিস্তাও নাই। তোর্সর মানষির তিস্তা নাই রো, তিস্তা নাই-বাহাদুর আবার সেই নাচের দলটার দিকে চলে যায়। যারা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিল তাদের ভিড়টাও একটু আলগা হয়ে গেছে। পেছন থেকে বাহাদুর চিৎকার করে ওঠে, হে-ই, লাইন ঠিক রাখো কেনে, লাইন ঠিক বানাও, এই ছাওয়া-ছোটর দল, মারিব একখান, ব্যাস, ট্রাক আসি গেলে সব লাইন দিয়া উঠিবেন, ওয়ান-টু-থ্রি।

এখন এই ভিড় দেখে মনে হতে পারে, জলুশ বোধহয় একটাই হচ্ছে আর এর মধ্যে কামতাপুর, উত্তরখণ্ড, গোৰ্খাল্যান্ড, নমশূদ্র সমিতি–এই সব ভাগাভাগিও যেন কিছু নেই। সরকার ও সরকারের দলগুলি যে-ভাবে তিস্তা ব্যারেজের উদ্বোধন অনুষ্ঠানকে আগামী নির্বাচনের প্রথম মিটিঙে পরিণত করতে চাইছে তাতে ঐ সব খুচরো দলের পাত্তা পাওয়াই মুশকিল। তার ওপর, ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের, এগ্রো ইন্ড্রাস্ট্রিজের আর চা বাগানের ট্রাক সারা জেলা থেকে লোকগুলোকে তুলে নিয়ে সেই ব্যারেজ ফেলবে। সকাল হতে না-হতেই সে কাজ শুরু হয়েছে। লোক জড়ো করাই যদি সরকারের ও সরকারের দলগুলির একমাত্র উদ্দেশ্য হত তা হলে তিস্তা ব্যারেজের কাছাকাছি জায়গাগুলো থেকেই ত যথেষ্ট লোক আনতে পারত। কিন্তু সরকার ও সরকারের দলগুলি চায়, এই সমাবেশ থেকে সবাই যেন নিশ্চিত হয়ে যায় যে এই জেলায় ঐসব খুচরো দলের কোনো অস্তিত্ব ত নেইই, এমন-কি কংগ্রেসও নেই। সেই জন্যেই এত দূর-দূর থেকেও তোক নিয়ে যাওয়া।

কিন্তু এই সব ট্রাকে করে যারা যাচ্ছে তাদের ভেতর কামতাপুর, উত্তরখণ্ড, নমশূদ্র সমিতি বা গোর্খাল্যান্ডের লোকজনও দু-চারজন ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকতে পারে। এভাবে ত তাদের বাছাও যাবে না। এমন-কি উত্তরখণ্ড বা গোখাল্যান্ডের লোকজনের সরকারি ব্যবস্থায় যাওয়া অনেক বেশি নিরাপদ বোধ হতে পারে। এখানে, এই হাটখোলায় সেই ভাগাভাগি নিয়ে কোনো উত্তেজনা নেই, বা, পরস্পরের কোনো সন্দেহও নেই-যে-উত্তেজনা ও সন্দেহ থাকে তোটের দিন, সে পঞ্চায়েতের ভোটই হোক আর লোকসভার ভোটই হোক। দুটো আলাদা অফিসই যে তৈরি হয়ে যায় গাছতলায়, তাই নয়। এক-একটা ভোটকেন্দ্রে মাত্র সাতশ-আটশ ভোটারের মধ্যে হয়ত ভোট দেয়, বড় জোর সাড়ে তিনশ-চারশ জন; কিন্তু সেই ক-জন ভোটারের পছন্দ-অপছন্দ নিয়ন্ত্রণ করার জন্যে পুরো এলাকাটাতেই একটা উদ্বেগ-উত্তেজনা, কোনো সময় বা হিংস্রতা ছড়িয়ে পড়ে। তা সব সময় চাপাও থাকে না, বিশেষত চা বাগান এলাকায় প্রকাশ্য হয়েও যায়।

তাছাড়া, কামতাপুর-গোর্খাল্যান্ড-উত্তরখণ্ডনমশূদ্র সমিতি এই সবের সঙ্গে তিস্তা ব্যারেজের উদ্বোধনের ঘটনার ভেতরের সংযোগ কোথায়, তা ত এদের জানার কথাও নয়, এরা জানেও না। কিন্তু, না-জানলেও, চা বাগানের আন্দোলন বা জমি-জিরেতের নানা গোলমালে সরকার ও সরকারের দলগুলি সম্পর্কে যে-মনোভার তৈরি হয়ে আছে, তা থেকেই ত এরা নিজেদের ভূমিকা যথাস্থানে ঠিক করে নিতে পারবে।

আটটা বেজে যাওয়ার পর ধূপগুড়ির ভটচাজদের দুটো হাটবাস আর সিংজির একটা বিরাট বড় ট্রাক এসে দাঁড়ায়।

.

২০৬.

বাসে-ট্রাকে মিছিল ওঠে ট্রাকটা আর বাস দুটো প্রথমে এসে রাস্তার ওপর দাঁড়িয়ে পড়ে। ড্রাইভার মুখ বাড়িয়ে লোকজনকে কী জিজ্ঞাসা করে।

বাহাদুর তখন ছিল নাচের ওখানে, ভিড়ের পেছনে। বোধহয়, তারও একটু ক্লান্তি লেগেছিল। সে বাস আর ট্রাক দাঁড়াতে দেখে ছুটে রাস্তার দিকে যায়, ডান হাতে ব্যাটনটা তুলে। তার পেছন-পেছন বাচ্চাকাচ্চাদের একটা দলও ছোটে। ততক্ষণে বাসদুটোর ছোকরা দুজন রাস্তায় নেমে পেছনের ট্রাকটাকে একটু পেছিয়ে যেতে ইশারা করছে, আর বাসের গায়ে চড় মারছে একটা করে। পেছনের ট্রাকের ছোকরাটা ট্রাকের ওপর থেকেই ড্রাইভারের মাথার টিনে একটা চড় মারে, তারপর আস্তে-আস্তে চড় মারতেই থাকে। ট্রাকটা একটু পেছয়, তারপর রাস্তার উল্টোদিকে পেছনের চাকা চালায়। এর মধ্যে দ্বিতীয় বাসটাও একটু পেছিয়ে যায়।

বাহাদুর এসে রাস্তা আর হাটখোলার মধ্যে দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে ব্যাটনটা তুলে চিৎকার করে, এইঠে, এইঠে, ব্যাস, ঠিক আছে, সিধা, সিধা, সিধা

ট্রাক ও বাস দুটো ততক্ষণে রাস্তার ওপর পেছন ঘুরিয়ে এমন ভাবে দাঁড়িয়েছে যে একে-একে হাটখোলার সামনের জায়গাটুকুতে এসে ঢুকবে। বাহাদুর ব্যাটন উঁচু করে বাচ্চাদের দলটাকে তাড়া করে–এই হট, হট, বাস ঢুকিবার রাস্তা দে কেনে, সরি যাও, সরি যাও।

ট্রাক আর বাসগুলো সত্যিই যেন বাহাদুরের নির্দেশ মেনে-মেনেই নিজেদের মুখ ঠিক করে। তারপর রাস্তার ঢালে এসে দাঁড়ায় আর প্রথম বাসটা ধীরে ধীরে হাটখোলায় নেমে আসে, ধীরে-ধীরে খানিকটা এসে দাঁড়ায়, ড্রাইভার জানলা দিয়ে মাথা গলিয়ে পেছনে কী দেখে আবার খানিকটা এগিয়ে নিয়ে যায়।

পেছনের বাসটা ততক্ষণে, প্রথম বাসটার চাকার দাগ ধরে-ধরেই যেন, ঢাল থেকে হাটখোলায় নামে। প্রথম বাসটার পেছনে দাঁড়িয়ে বাহাদুর দুহাত উঁচু করে তাকে নির্দেশ দিতে থাকে–তার ডান হাতে ব্যাটন।

ট্রাকটা একটু তফাতে ছিল। সেটা একটা বেশ বড় ধরনের আওয়াজ করে বাঁ দিকে নেমে যায়, এই বাসগুলোর সঙ্গে ট্র্যাক রেখে বা দিকে। তারপর আরো একটা আওয়াজ তুলে থেমে যায়।

বাস আর ট্রাক যতক্ষণ রাস্তা থেকে মাঠে নামছিল ততক্ষণ এই ভিড়া নাচগুলোর দিকে পেছন ফিরে স্থির হয়ে দেখছিল। এক নাচের দলগুলোই যেন নেশায় নেচে চলে, যেন এই বাস-ট্রাক ইত্যাদির সঙ্গে তাদের কোনো সম্পর্ক নেই, যেন এই ভিড় চলে গেলে যে-নির্জনতা পড়ে থাকবে তাতে তারা নাচের আরো গভীরে চলে যেতে পারবে।–

কিন্তু বাস আর ট্রাকগুলো যেই দাঁড়িয়ে গেল, সবগুলো নাচের দল পরস্পরের বাধা হাত মুহূর্তে খুলে ফেলে এই বাস আর ট্রাকগুলোর দিকে ছুটে গেল। গ্রামের রাজবংশীদের ভিড়টা ত নাচের বাইরে, এই বাস-ট্রাকগুলোর চারপাশেই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল। তারা কিছু বুঝে উঠবার আগেই নাচের মেয়েরা তাদের ফাঁক দিয়ে দৌড়ে বাস আর ট্রাকে উঠে পড়ে। তারপর তারা নিজেরা এক-একটা জায়গায় বসে পড়ার আনন্দে হেসে ওঠে। যে যখন জায়গা পাচ্ছে তখন হেসে উঠছে। একলা নয়, কয়েক জন। এক সঙ্গে ত আর তারা জায়গা পায় না। তাই কিছুক্ষণ শুধু হাসি ওঠে আর থামে। এত মাইল-মাইল হেঁটে এসে, এত ঘণ্টা-ঘণ্টা নেচে, এমন দৌড়ে বাসে-ট্রাকে ওঠায় তাদের হাসির মধ্যে একটু হাফছাড়া শ্বাসও ছিল।

এই মেয়েরা বাসে-ট্রাকে উঠে যাবার পর বাকিরা বুঝতে পারে ওরা তাড়াতাড়ি ভাল জায়গা নিয়ে নিল। তখন গ্রামের লোকজন, ছেলেপিলে, বেউবুড়িরাও দৌড়ে বাস আর ট্রাকের ভেতর উঠতে শুরু করে। উঠতে গিয়ে একজনের সঙ্গে আর-একজনের ধাক্কা লেগে যায়, একজনের ছাতা আর-এক জনের পেটে লাগে, কারো হাত থেকে বাচ্চাছেলে খসে গেছে বাচ্চাটা তারস্বরে কাঁদে।

আর, বাহাদুর তার ব্যাটন উঁচিয়ে একবার প্রথম বাসটার সামনে দাঁড়ায়-এই খবরদার, সাবোধান, লাইন লাগাও,–আর এই একই কথা বলতে বলতে একবার দ্বিতীয় বাসটার সামনে, আর-একবার ট্রাকটার সামনে গিয়ে, লাফায়।

ততক্ষণে পুরুষমানুষরা বাসের ছাদে ও ট্রাকের ভেতরে ওঠা শুরু করেছে-ট্রাকের ভেতরে তখনো কিছু জায়গা ছিল।

এর মধ্যে আবার বাসের ও ট্রাকের ভেতর থেকে ডাকাডাকি শুরু হয়েছে। যে যার নিজের লোকদের জন্যে জায়গা রেখে ডাকছে। এক বাড়ির লোক এক জায়গায় গায়ে গা লাগিয়ে বসতে চায়, এক পাড়ার লোকও এক জায়গাতেই থাকতে চায়।

কিন্তু গাড়িতে ওঠার সময় ত আর কেউ পেছনে ফিরে তাকায় নি–তখন যে যার মত আগেভাগে জায়গা নিতে চেয়েছে। এখন তাই বাসের ভেতর-বাহিরে এরকম সব আওয়াজ উঠছে–

হে-এ-ই মাই গে, এইঠে আয় কেনে

কাকা গেই, হে-এ-ও কাকা, কাকা গেই

 হে-এ বাহাদুর, বাহাদুর, মোর বিটিখান কোটত উঠিল এটু দেখি দে।

 চাপি বসেন, চাপি বসেন, আরো লোক সিন্ধাবার নাগিবে।

এইঠে উঠিলেন আবার এইঠে নামি যাছেন?

আরে উঠিবার দেন, উঠিবার দেন, মোর বহিন নাগে, উঠিবার দেন।

 যায় যেইঠে আছেন, নড়িবেন না, স্যালায় ব্যারাজত গিয়া বাছি নিবেন।

ছাদের উপর সাবধান, ডালত ধাক্কা না খান।

কিন্তু, এত কিছু সত্ত্বেও দুটি বাসে আর একটি ট্রাকে, জায়গা কুলোয় না। তখনো অনেকে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকে–তার মধ্যে বাচ্চা আছে, বুড়ি আছে, কয়েকজন ধুতি-শার্ট পরা, ছাতা হাতে, দেউনিয়া মানুষ আছে যাদের পক্ষে বাসের ছাদে ওঠা সম্ভব নয়।

রাস্তার ওপর দুজন শহরের ছেলে যে এতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল, তা কারো যেন খেয়ালেই পড়েনি। এখন তারা এগিয়ে আসতে বোঝা যায়, তারা এই বাস-ট্রাকের সঙ্গে এসেছে। তারা এসে ট্রাকের কাছে দাঁড়ায়। একটি ছেলে চাকা বেয়ে ওপরে উঠে যায়। উঠেই ধমকাতে শুরু করে- কী, নিজেরা বসলেই হবে, আর কাউকে উঠতে দিতে হবে না? নিন, সরে বসুন, এগিয়ে যান, এগিয়ে যান। দেখি, এই যে বুড়িমা, আপনি এই কোনায়, হ্যাঁ এই কোণে বসুন, তা হলে আর লোকের চাপ লাগবে না।

ছেলেটি বুড়িমাকে পেছন থেকে ধরে একটু উঁচু করে কোনাকুনি বসিয়ে দেয়। তাতে একটু হাসির রোল ওঠে। ছেলেটি বলে, হ্যাঁ, হাসতে-হাসতে এগিয়ে যান, এগিয়ে যান।

মেয়েদের সম্পর্কে তার স্বাভাবিক সমবোধ থেকে সে তাদের হাত দিয়ে ঠেলতে পারে না, কিন্তু সরে যান, সরে যান বলতে বলতে সে যে-ভাবে এগিয়ে যায় তাতে তার হাটুর খোঁচায় অনেকে সত্যি একটু সরে বসে।

ছেলেটি হঠাৎ মুখ বাড়িয়ে নীচের ছেলেটাকে বলে, বাসের ভেতর বাচ্চাদের কোলে নিয়ে বসা ত, দেখবি জায়গা হয়ে যাবে।

এই ছেলেটি ট্রাকের ওপর এক-একটা বাচ্চাকে তুলে ধরে বলে, এ কার বাচ্চা।

বাচ্চার মা এই-যে, এই-যে করতেই সবাই হেসে ওঠে। বিশেষত বাগানের মেয়েরা। তারা ত হেসেই আছে। বাগানে আজ করার সূত্রেই তারা ভদ্রলোকের ছেলেদের কথার ধারধোর ধরতে পারে কিছুটা।

এদিকে অন্য ছেলেটি বাসদুটোর জানলা দিয়ে চেঁচায়–বাচ্চাদের কোলে বসান, বাচ্চাদের কোলে বসান। তারপর বাহাদুরকে ডেকে বলে, বাচ্চাদের কোলে বসাতে বলুন, আর, এই বাচ্চাদের বাসে তুলে দিন কয়েকটি বাচ্চাকে মাঠ থেকে টেনে এনে সে বাহাদুরের সামনে দেয়। কিন্তু সে সরে যেতেই বাচ্চাগুলো তাদের বাবা কাকা মা-মাসির কাছে ছুটে চলে যায়। বাহাদুর অবিশ্যি ততক্ষণে বাসের জানলা দিয়ে তার ব্যাটন চালাচ্ছে-হেই ছোঁয়া, সিট ছাড়, তর মায়ের কোলত বস্।

ট্রাকের পেছন দিকে তখন খানিকটা জায়গা বেরিয়েছে। সেই দেউনিয়া চেহারার কয়েকজন এবং মেয়েরা ট্রাকে উঠে যেতে পারে।

.

২০৭.

মাদারির মায়ের ট্রাকারোহণ

 মাদারির মা কোথাওই উঠতে পারে না। মাদারি যে-কোনো জায়গাতেই উঠতে পারত, কিন্তু মাকে ছাড়া। ওঠে কী করে।

জলুশ মানেই ত দল বেঁধে যাওয়া। বাড়ির লোকরা দল বাধে, টাড়ির লোকরা দল বাধে, বস্তির। লোকরা দল বাধে, বাগানের লোকরা দল বাধে। কেউ ছুটে গেলে দলের লোকরাই তাকে ডেকেডুকে নিয়ে নেয়।

কিন্তু মাদারির মার দল বাধা ত তার এইটুকু ছেলের সঙ্গে। তার ত আর কোনো টাড়ি নেই যে মাদারির মা বলে কেউ ডাকবে। সে বাসটার দিকে না গিয়ে যদি ট্রাকটার দিকে ছুটত তা হলে হয়ত একটা জায়গা পেয়ে যেত। কিন্তু বাসটাতে ত সে একটা বসার জায়গা পেয়েছিলও। একটা মোটামত বেটিছোয়া এসে তাকে ধমকে বলে, এইটা ত ধূপগুড়ির ভটচাজদের বাস, আমাদের জন্যে পাঠাইছে, তোমরা কেন উঠছ, নামো, নামো।

মাদারির মা তার কথাকে সত্য বলে মানে বটে কিন্তু নামে না।

সে-মহিলা একটু পেছিয়ে চেঁচাতে শুরু করে, এ-এ-ই বিশ্বাস, দেখ ত এইখানে কে বসে আছে? তারপর, আবার মুখটা মাদারির মার দিকে ঘুরিয়ে এনে বলে, নামো, নামা সিট থিকে, এবার সে মাদারির মায়ের হাত ধরে টানও দেয়।

এই উঠো না কেনে, তোমরালা যেইঠে আসিছেন সেই বাসত যান, হামরালার বাসত উঠিছেন কেনে। এই ওঠো, নামো–মাদারির মায়ের দুপাশ থেকে এই কথা শুরু হলেও মাদারির মা নড়েনি। কিন্তু এই সমর্থন পেয়েই মহিলা মাদারির মার একটা হাত ধরে এমন হ্যাঁচকা টান দিল যে মাদারির মা উঠে পড়ে। মহিলার এটা হিশেবে ছিল না। আরো গোটা কয়েক টান দিলে মাদারির মা উঠবে, এরকম ভেবেই তার টানাটানি শুরু। কিন্তু তার প্রথম টানের মাঝামাঝিই মাদারির মা উঠে পড়ে। মহিলা হঠাৎ হুড়মুড় করে পেছনে পড়ে যায়। তবে বাসে এতই গাদাগাদি ভিড় যে কাউকে পড়ে যেতে হলেও বাচ্চাকাচ্চার ওপর, বা, উল্টো দিকের বেঞ্চে যারা বসে আছে, তাদের ওপর পড়তে হবে। মহিলা পড়ে যাওয়া মাত্রই হে-ই মাই গে বলে কান্নাকাটির একটা আভাস তৈরি হতেই, মাদারির মা বাস থেকে নেমে যেতে পারে, আর মহিলাকে পেছনের মেয়েরা ঠেলে সোজা করে বাসের ভেতর দাঁড় করিয়ে দেয়। বাসের ভেতর ত আর দাঁড়ানো যায় না। মহিলার মাথাটা কাঠে একটু ঠক করে লাগতেই মাথায় হাত দিয়ে নিজের পায়ের ওপর সোজা হয়ে গিয়ে, ঘুরে, মাদারির মায়ের ফাঁকা জায়গাটাতে বসে পড়ে।

মাদারি বাসের বাইরে মাকে জিজ্ঞাসা করে মাই গে, নামিবার ধরিছিস কেনে?

মাদারির মা খুব আস্তে বলে, মোক নিছে না, নামি দিছে।

কায় নামি দিছে? মাদারি তার মায়ের সামনে এসে, তার পেটে হাত রেখে জিজ্ঞেস করে।

 সগায় ত নামি দিছে–কহিছে এ-বাসত হামরালাক নিবে না, মাদারির মা নিরাসক্ত ভাবে তার ছেলের দিকে তাকিয়ে বলে, যেন সে তাকে নামিয়ে দেয়ার যুক্তিটা বোঝে। জলুশ মানে ত সবাই মিলে একসঙ্গে যাওয়া। মাদারির মা ত সেখানে সত্যি একা, তার ত আর কোনো দল নেই। যাদের দল আছে, তারা ত তাকে নাও নিতে পারে। মাদারির মা ত আর কোনো বস্তিতে থাকে না–তাকে বস্তির লোকরা দেখেই ভাবে কোনো বাগানের লোক। কেউ যদি তার সঙ্গে কোনো কথা বলত, তা হলেও কি তারা, গ্রামের লোকরা, বুঝতে পারত সে তাদেরই লোক? শুধু কথা শুনেই কি আর তারা মেনে নিত?

মাদারি ব্যস্ত হয়ে ওঠে, তুই জলুশত যাবু না?

মাদারির মা একটু হেসে বলে, ক্যানং করি যাম? কোনো বাস নাই রে।

মাদারি হঠাৎ ব্যস্ত হয়ে তার হাত ধরে টানে, চ, মোরা ঐ বাসঠে যাই—

মাদারির মা তার সঙ্গে-সঙ্গে যায়। কিন্তু সেই বাসের পেছনের দরজায় মানুষ ঝুলে আছে, বাস ছাড়ার আগেই! জানলা দিয়ে বাগানের মেয়েরা কিছুটা মুখ বাড়িয়ে আছে। মাদারি তাদের দিকে তাকিয়ে বলে, হে-এ দিদি, মোর মাইটা আর হামাক নে কেনে, হে দিদি, মোক নে কেনে, মোর মাইটা নে কেনে।

এত চেঁচামেচির ভেতর মাদারির কথা কারো কানে ঢোকে না। কিন্তু একটা মেয়ে হাত বাড়িয়ে বলেই ত বাগানকা বাস হলেক, ঐ ট্রাকমে চড়ি যা, সে আঙুল দিয়ে ট্রাকটা দেখায়ও।

মাদারির মাকে দেখে বাগানের মেয়েরা ভেবেছে, গ্রামের থেকে এসেছে। মায়ের হাত ধরে টানতে-টানতে মাদারি তখন ট্রাকের দিকে ছোটে। সে ছোটে বলেই তার মাকেও একটু ছুটেই হাঁটতে হয়। আবার প্রথম বাসটা পেরিয়ে ট্রাকটার কাছে যেতেই মাদারি দেখে বাহাদুর। ব্যাটন হাতে বাসের ওপরে লোক তুলছে।

হে-এ বাহাদুরদা, এক হাতে মার হাত ধরা, আর এক হাতে বাহাদুরের বেল্ট ধরে মাদারি টানে, হে-এ বাহাদুরদা, হে-এ

বাহাদুর মাথা না ঘুরিয়ে চিৎকার করে, চোপ যাও, তারপর বাসের সিঁড়ির মাঝামাঝি পর্যন্ত যে-লোকটা উঠেছে, কিন্তু, বাসের ছাদে আর পা রাখার জায়গা পাচ্ছে না, তার পেছনে ব্যাটনের খোঁচা দিয়ে বলে, উঠো, উঠো কেনে, উঠো।

লোকটি বিপদে পড়ে। সে সত্যিই পেছনে ব্যাটনের খোঁচা খেয়ে বাসের ছাদে একটা পা রাখে তাড়াতাড়ি। পাটা একজনের গায়ের ওপর পড়ে, সে কায় রে বলে পাটা সরিয়ে দেয়, কিন্তু পাটা পড়ে ছাদের ওপরই। লোকটা তাড়াতাড়ি হামাগুড়ি দিয়ে উঠে পেছন ফিরে বাহাদুরকে বলে, পাছত কাঠি সিন্ধাইছেন কেনে?

বাহাদুর নীচে থেকেই চিৎকার করে, যান, ভিতরত যান।

লোকটার তখন হামাগুড়ি-দেয়া অবস্থা, সে পায়ের ওপরে বসতে গেলে গড়িয়ে পড়ে যাবে, কিন্তু সামনেও বসার জায়গা নেই।

বাহাদুর উঠো উঠো করে ব্যাটন ঘুরিয়ে পেছন ফিরেই দেখে, মাদারি। দেখে সে চিৎকার করে ওঠে, হেই গে, এ্যালায়ও উঠিস নাই গে।

মাদারি বাহাদুরের দিকে মুখ তুলে বলে, মোক নামি দিছে, মাঅক নামি দিছে, মোর যাইবার বাস নাই রো

কায় নামি দিছে? বাহাদুর চিৎকার করে ওঠে। কিন্তু ততক্ষণে ওদিককার বাসটা স্টার্ট দিয়েছে। এই বাসের ক্লিনার গাড়ির গায়ে জোরে-জোরে চড় মারে। বাহাদুর হঠাৎ সচকিত হয়ে বলে, খাইছে, খাইছে, সব স্টার্ট নিবার ধরিছে, চল কেনে, চল্।

বলেই বাহাদুর ব্যাটনটা বা হাতে নিয়ে, ডান হাতে মাদারির হাত ধরে টানে আর মাদারি তার মার হাত ধরে টানে। বাহাদুরের টানে তাদের, মাদারি ও তার মাকে, দৌড়তে-দৌড়তেই ট্রাকের কাছে গিয়ে দাঁড়াতে হয়।

ট্রাকের পেছনের ডালা তখন উঠে গেছে। বাহাদুর সেই ডালার ওপর তার ব্যাটন মেরে চিৎকার করে, হে-ই খুলি দাও কেনে, মানষি পড়ি আছে, খুলি দাও, খুলি দাও।

ট্রাকটায় তখন অনেকে দাঁড়িয়ে, বাগানের অনেক ছোকরা তিনটি ডার্লর ওপর বসে। নীচে থেকে। কে চেঁচাচ্ছে, সেটা শোনার মত অবস্থাও কারো নেই। বাহাদুর আবার মাদারির হাত ধরে সামনে চলে আসে, ড্রাইভারের দরজায় ধাক্কা দিয়ে বলে, আরে মানষি পড়ি আছে, তুলি নেন কেনে।

ওদিকের প্রথম বাসটা ততক্ষণে পেছনে চলতে-চলতে রাস্তায় উঠে দাঁড়িয়ে আছে। স্টার্ট চালুইবোঝা যাচ্ছে না, বাকি বাসটা ও ট্রাকটার জন্যে অপেক্ষা করছে, নাকি এখনি ছেড়ে দেবে। বাকি বাসটা আর পেছচ্ছে না, মাঠের মধ্যেই একটু-একটু করে গাড়িটা রাস্তার দিকে মুখ করে নিচ্ছে। ট্রাকের ড্রাইভার সিটে বসে স্টিয়ারিঙে হাত দিয়েছে—বাসটা রাস্তাতে উঠলেই সে স্টার্ট দেবে।

ড্রাইভার বাহাদুরকে ওপর দিকে হাত দেখায় আর তখনই ওপর থেকে সেই ছেলেটি গলা বাড়িয়ে ধমকে ওঠে, কী ব্যাপার, চেঁচাচ্ছেন কেন?

ঘাড় হেলিয়ে বাহাদুর বলে, ইমরাক ফেলি যাছেন, কায়ও উঠিবার দিছে না।

এতক্ষণে সময় হল? দিন, ছেলেটিকে তুলে দিন–ছেলেটি হাত বাড়ায়। বাহাদুর ব্যাটনটা মাটিতে ফেলে মাদারিকে মাথার ওপর তুলতেই মাদারি পায়ের এক দুলুনিতে পায়ের ট্রাকের তলায় ডালা পেয়ে যায়। ওঁকে এখান দিয়ে তুলুন, ড্রাইভারের দরজার পাশে লোহার ধাপ দেখিয়ে দেয় ছেলেটি।

.

২০৮.

ট্রাকে শ্লোগান ও নির্জনতা

রাস্তার ওপর উঠে রওনা হতেই ছেলেটি ট্রাকের ওপর শ্লোগান দেয়–ইনকিলাব জিন্দাবাদ। এই শ্লোগানটার জবাবে সবাই-ই জিন্দাবাদ দিতে পারে, বেশ জোরেই। তার পরেও চেনাজানা শ্লোগানই ওঠে, বামফ্রন্ট জিন্দাবাদ। গরিবের সরকার বামফ্রন্ট সরকার। পঞ্চায়েত আইন করল কে, বামফ্রন্ট সরকার আবার কে? গ্রামের মানুষের বন্ধু সরকার, বামফ্রন্ট সরকার।

বেশ খানিকক্ষণ ট্রাকের ওপর থেকে উৎসাহের সঙ্গে হাত নাড়িয়ে নাচিয়ে শ্লোগান চলে। যারা শ্লোগানগুলো জানে না, কয়েকবারের পর তারাও শ্লোগান ধরতে পারে। ট্রাকটা জোরে চলছে, মাথার ওপর দিয়ে বাতাস বইছে, দুপাশের ফরেস্টের গাছ-গাছড়া কোথাও-কোথাও মাথার ওপরই প্রায় ঝুঁকে আসে। বিশেষত বাশগাছের হাত থেকে বাঁচার জন্যে বাসের মাথার লোকজনকে পরস্পরের পিঠের ওপর মাথা রাখতে হয়। শ্লোগান দিতে খুব ভাল লাগে। আর এত মানুষের গলায় শ্লোগানও এত, বাতাসে যেন মুহূর্তে উড়ে চলে যায়, ভারী হয়ে আটকে থাকে না।

সেই ছেলেটি শ্লোগানগুলোকে ধীরে-ধীরে সাধারণ থেকে নির্দিষ্টে নিয়ে আসে। এই শ্লোগানগুলি নতুন, তিস্তা ব্যারেজের উদ্বোধন উপলক্ষেই তৈরি। সরকারি দলগুলো টাড়িতে-টাড়িতে, বাগানে-বাগানে, বস্তিতে বস্তিতে গত মাসখানেক ছোট-ছোট মিটিং করেছে, স্কোয়াড তুলেছে, ইউনিয়নের সভা, হাট মিটিং, হাট স্কোয়াড করেছে। ফলে, এই নতুন শ্লোগানগুলিও কিছু লোকের জানা হয়ে গেছে। কিন্তু স্থায়ী শ্লোগানগুলি যেমন না-জানলেও বলা হয়ে যায়, এই শ্লোগানগুলি তেমন নয়। এগুলো মনে রেখে বলতে হয়। আর, মনে যদিবা রাখা যায়, বলতে গেলেই একটার পিছে আর-একটা চলে আসে।

ছেলেটি এই সব শ্লোগান প্রথমে পুরোটাই নিজে নিজে দিচ্ছিল। একটা-একটা করে। প্রথমবার দিয়ে হাতের ইশারা করছিল, পরের বার সবাই যেন একসঙ্গে দেয়। তারপর খানিকক্ষণ সেই শ্লোগানটিই পর পর চলে মুখস্থ করানোর মত। তারপর আবার সেই বামফ্রন্ট সরকার জিন্দাবাদ,…আবার কে এই সব স্থায়ী শ্লোগানের পর আবার নতুন শ্লোগান।

ছেলেটি বলে, উত্তরাখণ্ড-গোখাল্যান্ড নাহি চলে গা নাহি চলে গা। হিন্দি শ্লোগান বলেই বাগানের লোকজন আগে গলা মেলায়। গ্রামের লোকজন প্রথমে একটু ইতস্তত করে এটা তাদের শ্লোগান কিনা বুঝে নিতে। তা ছাড়া, এই একই শ্লোগান গ্রামে দেয়া হয়েছে, উত্তরাখণ্ড-গোর্খাল্যান্ড চলবে না চলবে না। যারা সেটা জানে তারা বাংলাতেই জবাব দেয়। ছেলেটি এই শ্লোগান খানিকক্ষণ চালানোর পর এই একই বিষয় নিয়ে নতুন শ্লোগানে যায়, উত্তরবঙ্গে বিচ্ছিন্নতাবাদ রুখবোই রুখবো। একই ছন্দে এই শ্লোগানের একটা হিন্দি চেহারাও আছে রুখনে হোগা, রুখনে হোগা।

কিন্তু বিচ্ছিন্নতাবাদ এই একটি আওয়াজের জন্যে শ্লোগানটা যেন জমে না। পরের শ্লোগানটা হিন্দিতে-বাংলায় দুটোতেই জমে যায়, বাংলাকো পাঞ্জাব বানানা রোখনা হি রোখনা। রুখবই রুখব।

এদের শ্লোগান বলার নিজস্ব একটা ধরন আছে–সে গ্রামেরই লোক হোক আর বাগানেরই হোক। প্রথমে কিছুক্ষণ চেঁচামেচি করে গরম-গরম ভাব হয়ত কিছু ছেলেছোকরা এনে দেয়। কিন্তু যখনই দরকার হয়ে পড়ে অনেকক্ষণ ধরে টানা শ্লোগানের, তখনই এদের গলা একটা অদ্ভুত খাদে নেমে আসে, আর প্রায় গুনগুনের চাইতে সামান্য একটু উঁচু গ্রামে শ্লোগান চলতেই থাকে, চলতেই থাকে, কখনো না-থামার মত করে চলতে থাকে। এক দিকে যেমন সেই স্বরগ্রামকে কিছুতেই উঁচু করা যায় না, তেমনি, যেন এদের শ্লোগান দেয়া থামানোও যায় না।

ছেলেটি এবার তার শ্লোগানগুলোকে আরো নির্দিষ্টতায় আনতে চায়। সে সেই স্থায়ী শ্লোগানগুলি আউড়ে এবার বলে, তিস্তা ব্যারেজ করল কে, বামফ্রন্ট সরকার আবার কে? তিস্তা ব্যারেজকা পানিলেক নয়া দিন আগেলাক, পাহাড় ও সমতলের ঐক্য জিন্দাবাদ, গোখা-রাজবংশী ভাই ভাই জিন্দাবাদ জিন্দাবাদ, গোখা-দেশিয়া-মদেশি একাই, জিন্দাবাদ জিন্দাবাদ, চা বাগিচা কা মজদুর বস্তিলোককা দোস্ত ভুলো মত, ভুলো মত।

কিন্তু এই শ্লোগানগুলির মধ্যে এমন রাজনীতি নিহিত আছে যে কিছুতেই স্বচ্ছন্দ হতে চায় না। বেশ খানিকক্ষণ শ্লোগান চালানোর পর ছেলেটি থামে, পকেট থেকে রুমাল বের করে মুখ মোছে। সে থেমে যাওয়ার পরও কিন্তু ট্রাকের ভেতর থেকে শ্লোগানের দোহারকির গুঞ্জন উঠতেই থাকে–সে যে থেমে গেছে ওটা টের না পেয়ে কেউ-কেউ জিন্দাবাদ জিন্দাবাদ নাহি চলেগা নাহি চলেগা বলেই যায়। এ-রকম দু-চারবার বলবার পর তারা বোঝে শ্লোগান থেমে গেছে।

সেই নাচার দলের বাঁশিওয়ালা এই ট্রাকেই উঠেছিল। সে এই শ্লোগান পরবর্তী নীরবতার সুযোগে হঠাৎ হাত উঁচু করে বলে ওঠে, জিন্দাবাদ, জিন্দাবাদ, তারপর আবার চুপ করে যায়। কিন্তু, সে হয়ত আশা করেছিল আবার কিছুক্ষণ শ্লোগান চলবে। তেমন শ্লোগান চলছে না দেখে সে যেন কিছু করার উৎসাহ পায়। সে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে কিন্তু পা দুটো এক করতেই বসে বসে টলে যায়। সে বসে ছিল মেয়েদের কাছে–টলে পড়তেই বাগানের এক বুড়ি তার পিঠ ধরে সোজা করে দিয়ে বলে, বাঁশি বাজাগে, বাজা। আর মেয়ের দল খিলখিল হেসে ওঠে। বুড়ি পেছন থেকে লোকটার বাঁশি ধরা হাতটি তার ঠোঁটের কাছে তুলে বলে, হে-ই আওয়ারা বাঁশি বাজাগে, বাজা, হামরামন নাচ করবেক, বাজা।

লোকটি বাঁশি ধরা হাতটি সরিয়ে নিয়ে বলে, হাম বাঁশি নাহি বাজায়গা, হাম লেকচার দেগা, বড়া লেকচার।

তো দে কেনে, লেকচার দে, বৈঠকে দে ঝুবরু, বৈঠকে দে, বুড়ি পেছন থেকে আস্তে-আস্তে তাকে সমর্থন দেয়।

হ দেগা। হামরামন ইউনিয়ন তোেড় দেগা। কাহে? না, হামরামন আউর ই লাল ইউনিয়ন নাহি করেগা। হামরামন আদিবাসী হ্যায়। আদিবাসীরাজ কায়েম করনে হোগা। হামরামন ঝাড়খণ্ড পাটিকা মদত করেগা। বুঝলেক? দেবপাড়া বাগানমে সব কোই ঝাড়খণ্ড হো গেলাক। হলেক কি না-হলেক, কহ, কহ, হলেক কি না-হলেক?

সেই বুড়ি পেছন থেকে বলে, হলেক, হলেক, ব্যাস, লেকচার খতম কর দে।

একটা মেয়ে বলে ওঠে, হে ঝুবরু, খাড়া হোকে লেকচার লাগা দে।

ঝুবরু তার বাঁশিসহ হাত বাতাসে খেলিয়ে বলে, নাহি, হাম আউর লেকচার নেহি দেগা, আভি হাম প্রেসিডেন্ট হোগেলাক, অউর ইউনিয়ন বাবু লেকচার দেগা। ইউনিয়ন বাবু, বোল দেও, লেকচার দেও। বলতে বলতে কুবরু নেতিয়ে পড়ে। পেছনের বুড়ি একটু সরে গিয়ে তাকে আরো নেতিয়ে পড়ার কিছুটা জায়গা দেয়। ঝুবরু পুরো শোয়ার জায়গা পায় না বটে কিন্তু এর হাতের ফাঁক দিয়ে, ওর পায়ের ফাঁক দিয়ে নিজের শরীরটাকে এলিয়ে দিতে পারে। সকালের হাড়িয়ার নেশা এই আধো ঘুমে কেটে যাবে, বিশেষত ট্রাকের ওপরের এই বাতাসে, যদি যেখানে নামবে সেখানে পৌঁছেই আবার হাড়িয়া না খায়।

শ্লোগান থেমে যাওয়াতেই খানিকটা যেন দূরযাত্রার একঘেয়েমি ট্রাকটার মধ্যে এসে গিয়েছিল। অনেক দূর যেতে হবে, তাই কারো কোনো উত্তেজনা নেই। বুবরুর বক্তৃতার আয়োজনে একটু বদল আসতে না-আসতেই শেষ হয়ে যায়, কুবরু যে এত তাড়াতাড়ি তার বক্তৃতা শেষ করে দেবে, তা যেন ঠিক প্রত্যাশিত ছিল না। এখন এই ট্রাকের ভেতরকার ঝাঁকি, ট্রাকের ওপরের ঝোড়ো বাতাস, মাঝে-মাঝে ডালপালা থেকে বাঁচাতে মাথা নুইয়ে ফেলা–বিশেষত তাদের যারা ড্রাইভারের ছাদে বসেছে, এমন-কি বাগানের মেয়েদের একটু-আধটু হেসে ফেলাও, যেন একঘেয়ে হয়ে এসেছে, এরই মধ্যে।

 প্রথম প্রথম বাস দুটোর পেছন-পেছন ট্রাকটা যাচ্ছিল, আস্তে-আস্তেই। কিছু দূর চলার পরই বোঝা গেল-বাসদুটোর পক্ষে আর-গতি বাড়ানো সম্ভবই নয়, আর ঐ গতিতে গেলে তিস্তা ব্যারেজে পৌঁছবে যখন, তখন, সবাই ফেরার ট্রাকে বাসে উঠছে। এটা বুঝে ফেলার পর ট্রাক ড্রাইভার কয়েকবার হর্ন দিয়ে বাসদুটোকে পেরিয়ে এগিয়ে যায়। তখন দুই বাস থেকেই আবার আওয়াজ ওঠে, হাত দেখানো হয়, বিশেষত বাসের ছাদে যারা বসে আছে তারা হাত নাড়ায়। তারপর থেকে এই ট্রাকটা একাই যাচ্ছে।

দলগাঁও পেরিয়ে গেল।

.

২০৯.

চা বাগান ঘিরে মিলিটারি

 গয়েরকাটার কাছাকাছি এসে ডান দিকে মোড় নিয়ে ন্যাশন্যাল হাইওয়ে ছাড়তে হল। এটা চামুর্চির রাস্তা–বিন্নাগুড়ি-বানারহাট হয়ে চামুর্চি গেছে। এই রাস্তা ধরে অনেকখানি গিয়ে ট্রাক বায়ে ঘুরবে। আবার কিছুটা গিয়ে ল্যাটার্যাল রোড ধরবে–দুই ন্যাশন্যাল হাইওয়েকে যুক্ত করেছে যে-ল্যাটার্যাল রোড।

এই রাস্তাটা সরু, বোধহয় গর্তটৰ্তও একটু বেশি। তাই ট্রাকটাও আস্তে-আস্তে চলে, ঝাঁকি আর। দুলুনিও একটু বেশি লাগে। কিন্তু একেবারে ফাঁকা। যতদূর চোখ যায় ঝকঝকে রাস্তা চলে গেছে, সামনে কিছুই নেই। মাঝেমধ্যে উল্টো দিক থেকে দুটো-একটা ফাঁকা ট্রাক আসে–বাগানের। সেই ট্রাকের দু-একজন কুলি মাথা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে এই লোকভর্তি ট্রাকটাকে দেখে। কোনো বিস্ময় নেই। কিন্তু এত প্রাকৃতিক দৃশ্যের বিস্তৃতির মধ্যে মানুষকে নিয়ে দৃশ্য বড়,কম। তাই, কোথাও একজন মানুষ দেখলেও তাকাতে হয়।

রাস্তার পাশ দিয়ে গয়েরকাটা নদী অনেক দূর পর্যন্ত চলে। নদী বলে বোঝা যায় না, তা ছাড়া ঝোপঝাড়ে ঢাকাও থাকে অনেকখানি। হঠাৎ এক-একটা জায়গায় ঝোপঝাড়হীন, খোলা, ছোট নালার মত নদীটাকে দেখা যায়, একটু উঁচু জায়গা থেকে বেশ মোটা ধারায় নীচে ঝরে পড়ছে, আর সেখান থেকে জল নিয়ে কেউ-কেউ কোথাও-কোথাও যাচ্ছে। খানিকটা এমন খোলামেলা বয়ে গিয়ে নদীটা আবার ঝোপঝাড়ে ঢেকে যায়।

কিন্তু নদীর ঐ খাতটা মাঝেমধ্যে দেখেই চমকে বুঝতে হয়, গাড়িটা একটু ওপর দিকে উঠছে, ঠিক পাহাড়ে না হলেও পাহাড়ের তলার দিকে যেন। নদীটার উল্টো দিকে ট্রাকটা চলেছে, তাই যেন আরো বিশেষ করে বোঝা যায় কী ভাবে জমির একটু পাথুরে ঢাল বেয়ে নদীটা অত কম জল নিয়েও, অত সরু খাত দিয়েও লাফিয়ে লাফিয়ে চলেছে, আয়তনের চাইতে একটু বেশি খর বেগে।

মাদারি বসে ছিল ড্রাইভারের চালের ওপরে আরো অনেকের সঙ্গে। সে বাচ্চা বলে, তাকে একটু পেছনে সকলের মাঝখানে বসানো হয়েছে, যাতে আচমকা ধাক্কায় সামনের দিকে হোঁচট না খায়, বা ট্রাকটা গর্তটর্তের মধ্যে পড়ে দুলে উঠলে পিছলে না যায়। পেছন দিকে গেলে ত লোকের মাথায় পড়বে, কিন্তু সাইডে হড়কালে ত রাস্তায়।

ট্রাকে বাসে যেমন হয়-চলার আগে মনে হয় আর-একটা লোকও আটবে না, আর চলা শুরু করলে দেখা যায় প্রত্যেকেই একটু না-একটু জায়গা পেয়েই গেছে আর কিছুটা জায়গা যেন ফাঁকা থেকে যায়। কিন্তু সবটাই ঘটে, একটা সীমার মধ্যে। যেমন, যারা ট্রাকে ডালার ওপর বসে আছে লাইন দিয়ে, তারা ডালাটাকে দুই হাতে চেপে, সামনে ঝুঁকে ট্রাকের ঝাঁকুনি সামলাচ্ছে। সে-ভাবে খানিকটা যাওয়া যায় কিন্তু এরকম মাইলের পর মাইল কি আসা যায়? গয়েরকাটা পর্যন্তই ত প্রায় বিশ মাইল, তার পর এই রাস্তা আরো কত মাইল কে জানে। ডালার ওপর বসে থাকতে-থাকতে ব্যথা লাগে। তখন পা-দুটো ছড়িয়ে দিতে ইচ্ছে হয়। ছড়িয়ে দেয়ার জায়গাও আছে। কিন্তু তারপরই ট্রাক এমন ঝাঁকি খায় যে পা গুটিয়ে এনে শরীরের ভার সামলাতে হয়। এর মধ্যে দু-একজন ডালার ওপর থেকে পিছলে পাটাতনের ওপর বসে পড়েছে। জায়গাও হয়ে গেছে। অনেকে দাঁড়িয়ে পড়েছে–সামনের কারো ঘাড় ধরে টাল সামলাতে-সামলাতে। কিন্তু ট্রাকের ওপর দাঁড়িয়ে টাল সামলানো মুশকিল–একটা লোহার শক্ত কিছু থাকলে ভাল হয়। ড্রাইভারের কেবিনটার পেছনের দেয়ালে হেলান দিয়ে যারা ট্রাকের মাথার দিকে বসেছে তারা ঐ লোহার রডগুলো ধরতে পারে, যা দিয়ে ট্রাকের ডালাগুলো এটে রাখা।

 রাস্তায় এমনি ট্রাক বাসের চাইতে মিলিটারির গাড়ি যেন বেশি। খাকি রঙের মিলিটারি ট্রাকগুলো ছুটতে-ছুটতে ফাঁকা চলে যাচ্ছে। একটা জায়গায় মিলিটারির তাঁবু পড়েছে, অনেকগুলো ট্রাক মাঠটার একপাশে লাইন দিয়ে; এক জায়গায় মিলিটারিরা গোল হয়ে বসে, আর একটা মিলিটারি কিছু বলছে।

বিন্নাগুড়ির কাছাকাছি আসতেই রাস্তার চেহারা বদলে যায়, আরো ঝকঝকে আর চওড়া। রাস্তার মুখে-মুখে চায়ের বড় বড় পেটির মত কাঠের বাক্স উপুড় করা, তার ওপর আবার একটা তেকোনা কাঠের ফলকে কী সব লেখা। এই সব বাক্স আর লেখা প্রায়ই দেখা যায়, ঘন-ঘন। বেশ খানিকটা মাঠ পরিষ্কার ঝকঝক করছে, তাতে রঙিন খুঁটি পোতা–এক-একটাতে এক-একভাবে। রঙ যেন সদ্য লাগানো হয়েছে এতই জ্বলজ্বলে। এরকম মাঠ প্রায়ই দেখা যায়।

বিন্নাগুড়ির মোড়েই আর-একটা রাস্তা পুবে বেরিয়ে এসেছে, যে-মাদারিহাট থেকে এই ট্রাক এল সেই মাদারিহাটেরই দিকে, কিন্তু নিশ্চয়ই মাদারিহাট থেকে খানিকটা উত্তরে। এই রাস্তাটি অনেক প্রাচীন। জলুশ ছাড়া, বাস ছাড়া, এমন-কি হাটবার ছাড়াও যাদের বন-নদী এই সব পেরিয়ে-পেরিয়ে এই সব জায়গায় ঘুরতে হয়েছে কখনো পায়ে হেঁটে, কখনো সাইকেল ঠেলে, তারা জানে, এই রাস্তা গেছে দেওবুড়াপাড়া, শোভারাম দিয়ে, তিনি নদী, বানগুড়ি নদী পেরিয়ে টোপাভাসা। এখন এখানে নেমে গেলে এই রাস্তা দিয়ে হেঁটে-হেঁটে মাদারিহাট পৌঁছে যাওয়া যাবে। এই পথে মাদারিহাট থেকে নিয়মিত যাতায়াত করেছে এমন লোক এই ট্রাকে দু-চারজন আছে। আজকাল এ রকম যাতায়াত লোকজনের কমে আসছে। এখন বাসরাস্তা অনেক বেড়েছে। এক বাস থেকে আর-এক বাস ধরে লোকে যাতায়াত করতে চায়।

কিন্তু অনেক দিন ধরেই নাকি এই রাস্তাটা পিচ ঢেলে বড় করার কথা চলছে। তা হলে বিন্নাগুড়ির সঙ্গে হাসিমারার একটা সরাসরি আলাদা রাস্তা চালু হতে পারে–আরো ফাঁকায়-ফাঁকায়, আরো গোপন। বিন্নাগুড়িতে, হাসিমারাতে–দুই জায়গাতেই দরকারে এমন-কি প্লেনও নামে। যদি এই রাস্তাটা তৈরি হয়ে যায় তা হলে আর ন্যাশন্যাল হাইওয়ে দিয়ে সেই সব দরকারে চলাচল করতে হয় না। বরং সকলের চোখের আড়ালে সহজেই এই রাস্তাটা ব্যবহার করা যায়।

আর, তাতে ত শুধু বিন্নাগুড়ি-হাসিমারা সংযোগই হবে না। আসলে সেই চালসার মোড় থেকে ল্যাটারাল রোড ধরে বিন্নাগুড়ি পর্যন্ত এসে যেসব কনভয়ের যাবার দরকার, সোজা হাসিমারা চলে যেতে পারে কারো চোখে না পড়ে। শিবক পাহাড়ের পরে তিস্তার পশ্চিম পারে ফরেস্টের মধ্যে বিরাট ক্যাম্প ফরেস্টের ভেতর দিয়ে-দিয়ে সেই বাগডোগরা প্লেন ঘাটির কাছে ব্যাঙডুবি পর্যন্ত গেছে। পশ্চিমে ব্যাঙডুবি আর পুবে হাসিমারা–শিলিগুড়ির কাছ থেকে জলপাইগুড়ির প্রায় পুব সীমার কাছাকাছি পর্যন্ত সেনাবাহিনীর কর্তৃত্বাধীন অঞ্চলটা তাহলে নিজেদের রাস্তাঘাট ও যানবাহন নিয়ে স্বাবলম্বী হয়ে যেতে পারে। এখন বিন্নাগুড়ি পর্যন্ত সেই স্বাবলম্বন ঘটেছে কিন্তু তার পুরে আর এগতে পারছে না। বা, হয়ত ইচ্ছে করেই এগচ্ছে না। শোনা যায়, কয়েকটা নদীর ওপর ব্রিজের জন্যে নাকি রাস্তাটা আটকে আছে। এদিকের কোনো রাস্তাই ত ব্রিজ ছাড়া, ক্যালভার্ট ছাড়া তৈরি করা যায় না। মিলিটারি ইচ্ছে করলে ডাবড়ব আর শুখাতিতির মত নদীর ক্যালভার্ট বানাতে কতক্ষণ?

বিন্নাগুড়ি দেখলে চোখ একটু জুড়োয় সত্যি। কিন্তু এদিককার ফরেস্টে-ফরেস্টে বা বাগানে-বাগানে যারা ঘোরে, কাজ করে, এই ফরেস্ট আর বাগানই যাদের জীবিকা জোগায়, তাদের কাছে নতুনত্ব যা তা মিলিটারির খাকি রঙে। বাকিটা অনেকখানিই চেনা। ফরেস্টের রেঞ্জ অফিস, রেঞ্জার ও অন্যান্যদের কোয়ার্টারগুলো ত এরকমই দেখতে ঝকঝকে। এগুলো ইটের, সিমেন্টের, ওগুলো কাঠের। কিন্তু প্রত্যেকটিরই সামনে তারের বেড়া, কাঠের দেয়ালে বছর বছর রঙ পড়ে, টিনে লাল রঙ।

বরং মিলিটারি ক্যাম্পগুলো যেন অনেকটা চা বাগানের মতই দেখতে, ফরেস্টের মত ততটা নয়। চা বাগানগুলোতে দেয়াল ইটের আর সিমেন্টের, চালের টিন লাল রঙের। স্কুল, হাসপাতাল, ফ্যাক্টরি অফিস, ওজনের জায়গা–এই সবের সামনেই অনেকখানি করে সবুজ মাঠ, তার দিয়ে ঘেরা। দু-একটা জায়গায় ফুলবাগানও। রাস্তাগুলোও পিচ ঢালা, বা অন্তত কাঁকর ঢালা।

একই রকম দেখতে এই চাবাগানগুলোই মিলিটারি ক্যাম্পগুলোকে ঘিরে রেখেছে, নাকি, মিলিটারি ক্যাম্পগুলোই চা বাগানগুলোকে ঘিরে রেখেছে?

.

২১০.

ট্রাকের ভেতরে নির্জনতার গান

 গয়েরকাটা থেকে ডান দিকে ঘুরে এই রাস্তাটা ধরতেই কিছুক্ষণের মধ্যে যেন ট্রাকটার ওপর নির্জনতা। চেপে বসে–যে-নির্জনতা থাকে দূরযাত্রী ট্রেনের কামরায়। ন্যাশন্যাল হাইওয়ে দিয়ে, আসতে-আসতে নানা গাড়ির পাশ কাটাতে হয়, তাদের পাশ কাটিয়ে নানা গাড়ি যায়, উল্টো দিক থেকে কত গাড়ি গায়ে বাতাস ছুঁড়ে দিয়ে চলে যায়। কিন্তু এ রাস্তায় তেমন কিছুই নেই, প্রায় একা-একা মাইলের পর মাইল যাওয়া, মাইলের পর মাইল। কখনো কখনো পাওয়া বাগানের ট্রাক আর মিলিটারির ট্রাকে সেই একাকিত্ব ঘোচে না। বরং মনে হতে থাকে যে তারা এই নির্জনতা দিয়ে আরো নির্জনতায় যাবে। ফরেস্টের ভেতর দিয়ে একা-একা মাইলের পর মাইল হাঁটতে এরকম নির্জন লাগে, বা পাহাড়ের গা বেয়ে নেমে আসতে, বা, এমন-কি চা-বাগানের ভেতর দিয়ে ভেতর দিয়ে কোথাও যেতে, বা বর্ষায় জল এসে ভাসায় এমন এক শুখা নদীর খাত ধরে-ধরে নিধুয়া কোনো পাথার পার হতে। এই ট্রাকে উঠে। যারা এখন দল বেঁধে তিস্তা ব্যারেজে যাচ্ছে, তাদের সবাইই এমন নির্জনতায় আজন্ম অভ্যস্ত। তারা নিজের নিজের মত করে জানে, এই নির্জনতা কেমন করে কাটাতে হয়। যে-মেয়েগুলো হাটখোলাতে নাচছিল, তারা এখন পরস্পরের কাঁধে মাথা দিয়ে হেলে থাকে। কেউ-কেউ আবার পরস্পরকে জড়িয়ে.. ধরে ট্রাকের টাল সামলায়। চোখ খোলা রাখে যেখানে চোখ যায় সেখানে। সেরকম ভাবেই কেউ একজন গান ধরে কেমন গুনগুন কান্নার মতন সুরে। কে গায় বোঝা যায় না, কিন্তু সুরটা বোঝা যায়। সেই সুরটা যেন দীর্ঘ একা যাত্রার সঙ্গ দেয়।

এই ট্রাকের ঝাঁকানিতে গানের সুর কেটে যায়, হঠাৎ একটা জায়গা উঁচু হয়ে যায়, আর একটা জায়গা পড়ে যায়, কিন্তু তা সত্ত্বেও সুরটা সুরই থাকে। যে গানটা শুরু করেছিল, তার গলা থেকে কখন আর-একজন সুরটা নিয়ে নিয়েছে বোঝাই যায় না–গুনগুনানি কান্নার সুরের পার্থক্য এতই কম। কিন্তু, তারও পরে, কখন, দেবপাড়া চা বাগানের এই সব মেয়েরাই একে অন্যের পিঠে বা ঘাড়ে মাথা হেলিয়ে ট্রাকের ওপর দুলতে-দুলতে একসঙ্গে কান্নার সুরে সেই গানটা গেয়ে যায়।

মাসি, তুই আর ভাল কম্বল খুঁজিস না,
 সব কম্বলে–একই লোম,
সব লোমে একই উকুন,
সারা রাত জেগে থাকি আর উকুন কুটুস কুটুস করে কামড়ায়,
নাকি উকুন কামড়ায় বলেই সারা রাত জেগে থাকি।
 মাসি তুই আর হাট থেকে।
 উকুন মারা তেল আনিস না।
নইলে, সারা রাত আমাকে কামড়াবে,
 এমন উকুন আর আমি কোথায় পাব?
এমন উকুন আর আমি কোথায় পাব?

এই গান অনেকক্ষণ ইনিয়ে-বিনিয়ে চলে। কখনো দশজন গলা দেয়, কখনোবা দশজনই এক সঙ্গে থেমে যায়, নতুন দুজন নতুন লাইনটা গেয়ে ছেড়ে দেয়; আবার হঠাৎ সবাই মিলে পুরনো লাইনটাতেই ফিরে যায়–সবাই যেন ডুকরে ওঠে উকুনের শোকে, আবার সবাই একজনের কাছে গানের সুতো ছেড়ে দেয়। এ যেন তাদের অলস সময়ের খেলা–দীর্ঘপথ হাঁটতে-হাঁটতে যে-আলস্য আসে।

হঠাৎ একটা মেয়ে সোজা হয়ে বসে বলে, চা বাগানের গ্যামাক্সিন এখন আবার উকুনও খেয়েইছে, থাকার জন্যে পোকারা এখন গাছের পাতাও পায় না, হায় রে এর পর পোকাগুলো থাকবে কোথায়?

মেয়েটি কথা বলার মত করেই বলে, বলেই তার মাতৃভাষায় সে গানটি গায়। কিন্তু সে-ভাষা শোনা যেতে পারে মাত্র, তার অর্থ ত বুঝতে হবে এই বৃত্তান্তপাঠকের নিজের ভাষায়। হায়, সেই মেয়েটি ত এ বৃত্তান্তের পাঠক নয়। মেয়েটির মুখের কথার মানেটা গানের মানের সঙ্গে এমনই এক হয়ে যায় যেন মনে হয় মেয়েটা তার মা-ঠাকুমা, ঠাকুমার ঠাকুমার কাছে মধ্যপ্রদেশ থেকে বিহার পর্যন্ত অরণ্য-পাহাড়ে ছড়ানো এই যে-গানটি পেয়েছিল সেটাতে নতুন লাইন যোগ করে দিচ্ছে। অথবা হয়ত এই ট্রাকে সেই প্রাচীন গানটাও একঘেয়ে লাগছে, সেই গান গেয়েও আর একঘেয়েমিটা কাটছে না। তাই সে আসলে ঐ পুরনো গানটাকেই বাতিল করছে এই কথাগুলো বলে। গানের সম্প্রসারণ, না, বর্জন, তা বুঝতে না-দিয়ে, বা নিজেরাও না বুঝে, মেয়েদর দলটা একসঙ্গে হেসে ওঠে, হেসে উঠতে-উঠতে সোজা হয়ে বসে, আবার হাসে, তাদের গায়ে গা ঘষা একাকিত্বেই।

কিছুক্ষণ দল বেঁধে হেসে মেয়েরা গানটা ছেড়ে-ছেড়ে দেয়। এখন, তারা গানের চাইতে হাসতে যেন আনন্দ পায় বেশি। তারপর এক সময়ে সেই হাসিটাও থামে। ট্রাকটার ভেতরে কিছুক্ষণের জন্যে যে-পরিবর্তন এসেছিল, তা বাতাসে বাতাসে ঝাঁকুনিতে ঝাঁকুনিতে শেষ হয়ে যেতে থাকে। আবার সেই দোলা, পা ছড়ানো, পা গুটানো, কিছু ধরে নিজের শরীর সামলানো। আবার সেই নির্জনতার ভেতর ট্রাকটা ঢুকে যায়।

রাজবংশী মেয়েরা বসে ছিল ট্রাকের পেছন দিকটাতে। সেখান থেকে সেই একক গুনগুনে একটা গানের মত আওয়াজ ওঠে। গানের সুরে সবাই ভাবে, দেবপাড়ার মেয়েরাই বুঝি আবার গান ধরল। কিন্তু সুরটা একটু এগতে-পেছতেই বোঝা যায় না, এখন গাইছে রাজবংশী মেয়েরা। গলার কী একটা খাজে তারা ধরা পড়ে যায়। দেখতে-দেখতে সে-গানটাতেও সুরের পর সুর এসে জড়ো হয়। মাথা নিচু করা, মাথায় ঘোমটা দেয়া ঐ ভিড়টা থেকে গানটা যেন ওপরে উঠে আসে। একটা মেয়ে মার কোলে শুয়ে পড়েছিল, সেও উঠে গান ধরে।

আকাশ ত পরিষ্কার হয়ে গেল,
কাল মুরগিটা শাদা হয়ে গেল,
নাকি কাল মুরগিটাকে ঢাকা দিয়ে।
শাদা মোরগটা তার পাখনা মেলে দিল
আর ঝুঁটিটা ফোলাল।
 আর সারা রাতের পর তোর সময় হল রে বিদেশিয়া বন্ধু,
পান-সুপুরি নিয়ে আমার গোসা ভাঙানোর?

 চাপা কান্নার সুরে এই গোসা-ভাঙানো চলতেই থাকে ট্রাকে আঁকি-দুলুনির সঙ্গে-সঙ্গে। কিন্তু বানারহাট আসতেই গোসা ভেঙে যায়। ডান দিক দিয়ে সোজা চামুর্চির রাস্তা চলে গেছে, সামনে বানারহাট বাজার, রেল স্টেশনের ইশারা পাওয়া যায়, প্যাক প্যাক করে কিছু রিক্সা যায়, তারপরই খোলা মাঠে তিনটি ট্রাক আর অনেক লোক, ঝাণ্ডা, ফেস্টুন। এই ট্রাকটাকে দেখেই মাঠের লোকরা দৌড়ে রাস্তার পাশে আসে, চিৎকার করে হাত নাড়াতে থাকে-এই ট্রাকটার গতি একটু কমে আসে। এতটাই কমে যে ট্রাকের আর মাঠের লোকজনের মনে হয়, ট্রাকটা বোধহয় থেমেই যাবে। ট্রাকের লোকজনও দাঁড়িয়ে পড়ে মাঠের লোকজনের দিকে হাত নাড়ায়।

মাঠে ঢোকার ক্যালভার্টটা পেরিয়ে যেতেই বোঝা গেল ট্রাকটা দাঁড়াবে না। তখন মাঠের লোকজন আবার দৌড়ে এগিয়ে এসে হাত নাড়ে। মাঠের ভেতর থেকে হঠাৎ শ্লোগান ওঠে, বামফ্রন্ট সরকার জিন্দাবাদ, চলো, চলো, ব্যারেজ চলো, ব্যারেজমে আজ কিয়া হোগা, লহর লহর লহর দেগা।

ট্রাকের লোকজনও দাঁড়িয়ে উঠে শ্লোগান দিতে থাকে। কে কোন শ্লোগান দিচ্ছে বোঝা যায় না, কিন্তু অতগুলো মানুষের সমবেত গলার আওয়াজে এতক্ষণকার নির্জনতা ভেঙে যায়। একে বানারহাটের আধা-শহুরে চেহারা, তার ওপর সারি দিয়ে উঁড়ানো একই মিছিলের ট্রাক, মাঠভর্তি লোক–সব মিলিয়ে হাটখোলার সকালের অবস্থাটা যেন ফিরে আসে-সবাই মিলে যেন কোথাও যাওয়া হচ্ছে, কিছু করা হচ্ছে। এই ট্রাকের এতগুলো মানুষ এতক্ষণ যেন বড় একলা ছিল, এখন তাদের সেই একলা ভাবটা কেটে যায়। বানারহাটটা পেরনোর পর আবার চা-বাগান শুরু হয়। সেই চা বাগানের পাশ দিয়ে একটা ট্রাক রঙে ঝলমল করতে করতে এগিয়ে যাচ্ছে। যেমন নদীতে হয়, পেছনের নৌকো সামনের নৌকোর সঙ্গ নিতে চায়, এই ট্রাকটা গতি বাড়ায়। আর ট্রাকের ওপরের লোকজন শ্লোগান ধরে—…জিন্দাবাদ জিন্দাবাদ। কিন্তু বাতাস ত ট্রাকের শ্লোগান পেছনে উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *