৬.১ অন্ত্যপর্ব – মাদারির মায়ের স্বতন্ত্র রাষ্ট্র

অন্ত্যপর্ব মাদারির মায়ের স্বতন্ত্র রাষ্ট্র

১৯১.

 মাদারির মায়ের স্বতন্ত্র রাষ্ট্র

হাট থেকে ফিরে মাদারি বলে, মা, কাল জলুশ হবে, হাটত ট্রাক আসিবে।

জলুশ, বা মিছিল হতে পারে, আর মিছিল হলে তা ট্রাক আসেই। লোজন, না-হলে, যাবে কী, করে? মাদারির মার তাই আর-কিছু জিজ্ঞাসার থাকে না। মাদারির আর-কিছু বলারও থাকে না।

হাটের দিন তাদের ঘুমিয়ে পড়তে বোধহয় একটু দেরিই হয়। হাটফেরতা গরুর গাড়িগুলো কঁকাতে কঁকাতে রাস্তা দিয়ে যায়। তাদের যাওয়াও যেন ফুরয় না, কঁকানিও যেন ফুরয় না। সন্ধে থেকে কঁকানি শুরু করে, কতক্ষণ চলে তা মেপে দেখে কে?

মাদারির মার ঘর ফরেস্টের সীমায় রাস্তা থেকে দেখলে ওটাকে ফরেস্টের সীমা মনে হতেই পারে। ন্যাশন্যাল হাইওয়ের পরে খানিকটা জমি তারপর ফরেস্ট। ফরেস্ট ত আর এরকম নদীর মত পাড় মেনে চলে না। কিন্তু সে যা-হোক, এখানে ঐ চাষের জমিটুকুরছাড় থাকায় ফরেস্টটা হাইওয়ের ওপর একেবারে উঠে আসে নি। ঠিক এই জায়গাটাতে মনে হয়, ফরেস্টের সঙ্গে ন্যাশন্যাল হাইওয়ের একটা ভদ্রগোছের দূরত্ব আছে। কিন্তু এর দুদিকেই ফরেস্টের জঙ্গল রাস্তার ওপর এমন উঠে এসেছে যে ভয় হয় সেই জঙ্গল থেকে একটা বাঘ, লাফিয়ে পড়তে পারে, বা, হাতির একটা শুড় এগিয়ে আসতে পারে, বা, গণ্ডার ঠিক ঐ মুহূর্তেই ছুট লাগাতে পারে। এমন গা ছমছম অবস্থা থেকে একটু স্বস্তি জোটে মাদারির মার ঘরের সামনেই, এই জায়গাটিতে। মনে হয়, বা, ভুল হয়, ফরেস্টের হাত থেকে বাঁচা গেল। কিন্তু এই ঢালটা পেরিয়ে একটু উঁচুতে উঠে খানিকটা এগলেই ফরেস্ট আবার রাস্তায় উঠে আসে।

এই ঢালের জন্যেই বোধহয় এই ফাঁকাটা তৈরি হয়েছে। জমির ঢাল ত বোঝা যায় না, রাস্তার ঢাল বোঝা যায়। ঠিক ঐ-জায়গাটিতেই রাস্তাটা বেশ ঢালু হয়ে অনেকখানি নেমে আবার অনেকখানি উঠে, রাস্তার স্বাভাবিক উচ্চতায় পৌঁছেছে। এই জায়গার পুরো জমির ঢালটাই রাস্তায় ধরা পড়েছে। জমি-জঙ্গল, শালগাছ-খয়েরগাছসহ পুরো জমিটাই এখানে ঢালে নেমে গেছে। তার একটা কারণও আছে। ফরেস্টের ভেতর থেকে একটা ছোট ঝোরা বয়ে এসে এখানে রাস্তা পেরিয়েছে। সারা বছর ঝোরার খাত থাকে, শুধু বর্ষাকালে জল থাকে, বা জল আসে। রাস্তাটা তাই এমন করা যাতে বর্ষার জল ফরেস্টের ভেতর দিয়ে বয়ে এসে রাস্তার ওপর দিয়ে চলে যেতে পারে। রাস্তার অপর দিকে আবার ঝোরার খাত, তাই রাস্তার ওপর কোনো সময়ই জল জমে থাকে না, কিন্তু রাস্তাটা সব সময়ই ভেজা থাকে, শুধু ভেজাই নয়, রাস্তার ওপর দিয়ে সারাটা বর্ষাই তিরতির করে স্রোত বয়ে যায়। ফরেস্টের ভেতর দিয়ে কিছু রোদ মাটিতে এসে পড়লে, বা, রাতে ট্রাকের হেডলাইটে, সেই স্রোতের ছোট-ছোট রেখা বেশ দূর থেকে দেখা যায়। বেশ লোভনীয় দেখা যায়। রাস্তাটাও এই জায়গায় চওড়া, বেশ চওড়া। একটা ট্রাক সাইড করে রাখলেও বাকি রাস্তাটায় দুটো ট্রাক পরস্পরকে সাইড দিতে পারে। অনেক সময় অনেক ড্রাইভার সেরকম করেও। গাড়ি থামায়। গাড়িতে একটু জল ভরে। নিজেরাও নেমে ঝোরার জল একটু চোখেমুখে দেয়, তারপর চলে যায়। স্টার্ট বন্ধ করার মত বেশি সময় নয়, ঐ একটুখানি দাঁড়ানো, তাও ক্কচিৎ।

তবে, শুধু বর্ষাকাল মানেই ত ছমাস থেকে আটমাস। আসলে, জল থাকে না, বা রাস্তাটা ভেজা থাকে না–খুব শীতের ঐ মাস চার-পাঁচ মাত্র। মাদারির মা, রাস্তার ঠিক পাশে, ঝোরার ভেতর থেকে ওঠা একটা শ্যাওড়া গাছের তলায় কয়েকটা পাথর বসিয়ে একটা বেদিমত বানিয়েছে। গাছটা উঠেছে ঝোরাটা যেখানে ফরেস্টের জমি ছেড়ে রাস্তায় পড়েছে ঠিক সেই জায়গাটায়। সাধারণভাবে গাছটা ওখানে থাকার কথা নয়, বা, মাটি ক্ষয়ে গিয়ে অমন সীমান্তে গাছটার চলে যাওয়ার কথা নয়। এমন হতে পারে, ওখানে হয়েছে বলেই গাছটা ওখানে আছে, এর বেশি কোনো কারণ নেই। আর-এক হতে পারে রাস্তা তৈরির সময়ই গাছটা ওখানে ছিল; যারা রাস্তা তৈরি করেছে, তারা ওর গায়ে হাত দেয়নি। শ্যাওড়া গাছ কাটতে নেই। আর, এখানে, রাস্তাটাকে এতটা ঢালু করতে এতটা চওড়া করতে, ঝোরার মুখ আর ঐদিকে ঝোরা যেখানে নতুন ঢালুতে গেছে রাস্তার সেই মুখটিকে, সিমেন্ট বাধাই করতে–রাস্তা-তৈরির লোকজনকে বেশ কিছু দিন এখানে থাকতে হয়েছে। হয়ত সেই কারণেই সামনে এতটা জমি ফাঁকা–হয়ত ওখানে রাস্তা-তৈরির লোকজনের তাবু গাড়া হয়েছিল। এত পোড়া গাছের গুঁড়িও হয়ত সে কারণেই–জ্বালিয়ে রাখা হত, রাতে, হাতির দল যাতে না আসে। রাস্তার উল্টোদিকে পিচ গলানোর জন্যে দুদিকে হাড়িকাঠের মত পোতা দুটো গাছের পোড়া ডাল এখনো পোতাই আছে, তাদের মাঝখানে গর্তের মধ্যে এককালে জ্বালানো আগুনের ভস্মাবশেষ, বা অঙ্গারাবশেষ, চিরকালীন।

মাদারির মা তখন কোথায় ছিল সেটা মাদারির মা-ই জানে না। কিন্তু সে যখন এখানে এসে। ডালপালা পাতা দিয়ে ঘর ছেয়ে বসবাস শুরু করে, তখন তার কাছে, আর, যে কারো কাছেই, জায়গাটা। শ্যাওড়াঝোরা বলেই পরিচিত হয়ে যেতে পারে; ঝোরার মুখে শ্যাওড়া গাছটার একাকিত্ব ঐ নির্জনেও এতই একাকী।

শ্যাওড়া গাছের বয়স বোঝা যায় না-যে-গাছ দেখে মনে হয় চারা, সেটা আসলে কয়েক দশকের পুরনো। এ-গাছটা মোটেই তত তরুণ ছিল না। বরং ফরেস্ট থেকে অতটা আলগা, রাস্তা থেকেও একটু বিচ্ছিন্ন ঐ গাছটাকে চোখে পড়ে যায়, তার অবস্থানের জন্যে ত বটেই, কিন্তু অনেকখানিই তার অবয়বের জন্যে। নইলে, ঐ অবস্থানে গাছটা হারিয়ে যেতে পারত। গাছটা যে শুধু বেড়েই উঠেছে, তা নয়, তার একটা শাখা রাস্তার দিকে এগিয়ে এসেছে। এগিয়ে আসার পর আবার সেখান থেকে একটা শাখা ওপরের দিকে বেড়ে গেছে, একটা মাত্র সরল রেখায়। আর-একটা শাখা নীচের দিকে বেড়ে গেছে, আর-একটু ঝাপটা হয়ে, জলের দিকে। সেটার মাথাটা জলের ওপর দোলে, হয়ত কোনো-কোনো সময় জল ঘেঁয়ও। আর ওপরের ডালের মাথাটা বাতাসে দোলে। এই ফরেস্টে, এই রাস্তায়, এমন একটা কোণে, আকাশে বেড়ে ওঠা কোনো দোলা দেখলেই হাতির কথা মনে না হয়েই পারে না। আবছায়ায়, পেছনে ফরেস্টের একীভূত আঁধার, আর মাথার ওপরে পাতাচেরা আকাশের নীল-ঐ একাকী গাছের শাখার অমন নিঃসঙ্গ আন্দোলন দেখলে হাতি বলে ভয়ও হতে পারে আচমকা। জল, জলে ছায়া, বিচ্ছিন্নতা আর অবয়ব নিয়ে শ্যাওড়া গাছটা যেন বৃক্ষদেবতা বা পথদেবতা হওয়ার জন্যে তৈরি হয়েই ছিল-কে চিনতে পারে, তার অপেক্ষায়।

মাদারির মা চিনতে পেরেছিল–কতটা গাছটাকে দেখে, আর কতটা ওখানে মাঝে-মাঝে ট্রাক দাঁড়ায় বলে, তা নির্ণয় করা যাবে না। কিন্তু সে দুহাতে তোলা যায় এমন সব পাথর এনে-এনে জলের ভেতর গাছের গোড়ার কাছে পেতে দিয়েছে। সেই পাথরের স্তর জলের ওপরও উঠে এসেছে-পর-পর বসানো, গোল করে সাজানো, যে-ভাবে প্রাচীন মিশরীয়রা ওবেলিস্ক বানাত, বা এখনো এদিককার পাহাড়ের লোকরা মহাযানী বৌদ্ধচৈত্য বানায়। জলে-জলে সেই পাথরের তূপের তলার দিকটা পুরু শ্যাওলায় ছেয়ে গেছে। শীতেও সে-শ্যাওলা ঘোচে না।

.

১৯২.

শ্যাওড়াঝোরা-রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য

মাদারির মা ভেবেছিল, এরকম দেবতার মত দেখতে শ্যাওড়া গাছটাকে যদি পাথর দিয়ে ঘিরে সত্যি দেবতা বানানো যায়, তা হলে চলতি ট্রাক-বাস থেকে ড্রাইভাররা দু-চার পয়সা ছুঁড়ে দেবে। সে দেখেছে, ড্রাইভাররা এরকম ছোড়ে, বাসের লোকজনও ছোড়ে। এ রাস্তায় বাস যায় বটে কিন্তু তারা হয়ত নতুন করে একটা পয়সা দেয়ার জায়গা বাড়াতে চাইবে না, তবে এত যে ট্রাক যায় এদিক থেকে ওদিক ওদিক থেকে এদিক, মাদারির মা এটাও জানে আসাম থেকে কলকাতা আর কলকাতা থেকে আসাম, তারা ত এখানকার সব কিছু জানে না, তা হলে, এরকম দেবতার মত দেখতে গাছটাকে দু-দশ পয়সা তারা ছুঁড়ে দেবে না কেন?

এমন একটা ফরেস্টের কিনারায়, শ্যাওড়া গাছটার মতই, মাদারির মা কেন থাকে, তার কোনো ইতিহাস নেই। আর-কোথাও থাকার জায়গা নেই, তাই থাকে। কিন্তু এখানে এসে বসবাস শুরু করার পর সে এই শ্যাওড়া গাছটাকে দেবতা বানাবার কাজে সর্বক্ষণ ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল। তখন মাদারি হয়নি। মাদারির আগের ভাই, কিংবা তার আগের ভাই, কে তখন মাদারির মার সঙ্গে, সেটা মনে করে ওঠা খুব কঠিন। কিন্তু সেই ছেলেকে মাদারির মা খুব শিখিয়েছিল কয়েক মাইল দূরের গণেশমোড় থেকে গণেশের মূর্তিটা চুরি করে আনতে। মাদারির মা তখন তার যে-ছেলের নামে পরিচিত ছিল, সে, প্রায় করেই ফেলেছিল। কিন্তু পরে তার মাথায় বুদ্ধি গজায় যে মাত্র কয়েক মাইল দূরের গণেশমোড় থেকে মূর্তি আনলে ত সবাই টেরই পেয়ে যাবে।

তা হলে? আর-কোনো উপায় মাদারির মার হাতে বা মাথায় ছিল না। পরপর কয়েক বছর গণেশের মোড়ে হাতির পাল রাস্তা আটকানোয় ওখানে মাটির গণেশ মূর্তি বসিয়ে পুজো হল, এখন ট্রাক-বাস সব কিছু থেকেই ওখানে পয়সা ঘেঁড়ে। মাদারির মা ত আর ফরেস্টের হাতির পালকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে বলতে পারে না, তোমরা এখানে এসেও রাস্তা আটকাও। অন্তত এই ঢালটাতে যদি দুটো-একটা ট্রাক ওল্টাত তা হলেও তোকজনের একটু ভয়-ভক্তি হত, তা হলে তারা হয়ত দেবতার মত দেখতে শ্যাওড়া গাছটাকে পয়সাও ছুঁড়ত। কিন্তু মাদারির মা অত, বড়বড় ট্রাক ওল্টায় কিসে, তা কী করে জানবে? সেগুলো রাস্তা দিয়ে গেলে তার ঘরের মাটি থরথরিয়ে কাপে।

কিন্তু খুব ভ্যাপসা গরমের বিকেলে মাদারির মা যখন পথে এসে বসে, দেখে-আসন্ন গোধূলিতে শ্যাওড়া গাছের ওপরের শাখাটা হাতির গুঁড়ের মতই নড়ে। নিশ্চিত নড়ে। কায়ও দেখিবার না পায় রো, কায়ও দেখিবার না পায়।

মাদারির মা কী ভেবেছিল, সেটা মাদারির মা-ই জানে। কিন্তু তার ভাবনারও ত একটা সীমা আছে। সারা দুনিয়ায় এত জায়গা ছেড়ে যাকে এসে থাকতে হয় এই ফরেস্টের কাছে, বাঁ, ভেতরেই, এমন একটা অস্পষ্ট ঝোরার পাশে, ন্যাশন্যাল হাইওয়ে বানানোর সময় ফাঁকা করা খানিকটা জমিতে, তার ভাবনার জোর নিশ্চয়ই খুব বেশি নয়।

কিন্তু ঐ ঝোরা, ঐ শ্যাওড়া গাছ আর এই মাদারির মা–এই তিনটির কোনটির সুবাদে এই ফরেস্টের মধ্যে মাইল-মাইল চলা ন্যাশন্যাল হাইওয়েটার এখানকার নাম হয়ে যায় শ্যাওড়াঝোরা?

শ্যাওড়া গাছটা ত আছেই, ঝোরাটাও আছে, কিন্তু, এখানে এই একটু ফাঁকাতে, নানা পাতায় ছাওয়া মাদারির মার ঐ ঘরটা না-থাকলে, সেই ঘরের সামনে একটু জমিতে গাছের ডালপালায় বেড়া-মত দেয়া না থাকলে, কি এই ঝোরার বা এই শ্যাওড়া গাছের নামকরণ প্রয়োজন হত? ঐ ঘরটাকে যারা হঠাৎ ঘর বলে চিনতে পারে, তারাই হয়ত এখানে ট্রাক গাড়ি থামায়, গাড়িকে একটু জল খাওয়ায়, নিজেও একটু হাতেমুখে জল দেয়। তাদেরই মুখে-মুখে হয়ত এই জায়গার একটা নামকরণের দরকার হয়েছিল।

কিন্তু এত কিছু সত্ত্বেও, মাদারির মা যা চেয়েছিল সেটা কিছুতেই ঘটে ওঠে না। বেদিসহ শ্যাওড়া গাছটাকে দেবতার জায়গা বলে মনে হয় না। যদি এক নজরেই মনে হত, তা হলে দশ-বিশ পয়সা ছুঁড়ে দিতে তাদের কারো আপত্তি হওয়ার কথা নয়, যারা হাজার-হাজার মণ মাল নিয়ে দেশের এক প্রান্ত থেকে আর-এক প্রান্তে এমন নদীর মত ছুটে যাচ্ছে। কিন্তু মাদারির মা কিছুতেই এই জায়গাটিকে দেবতার জায়গা বলে চিনিয়ে দিতে পারে নি।

অগত্যা, গাড়ি থামলে মাদারিকেই দৌড়ে যেতে হয়। পাহাড়ের মত গাড়িটার চাকার মাঝখান থেকে সে আকাশের দিকে ঘাড় হেলিয়ে হাত পাতে, প্রার্থীর সনির্বন্ধ হাত। ঐটুকু এক শিশুকে ঐ বনের মধ্যে কেমন অনৈসর্গিক বোধ হয়, যেন, আকাশে ডানা মেলে নেমে এল বা মাটি ফুটে উঠে এল। তার ঐ ছুটে আসাটুকুকেই, মাদারির মায়ের ঘর থেকে সেই ছোট্ট ঢাল পেরিয়ে এই রাস্তায় নেমে আবার রাস্তার ঢাল দিয়ে এই ট্রাকের কাছে ছুটে আসা–কেমন অপ্রাকৃত ঠেকে। কিন্তু তারপর, ট্রাকের, পাহাড়প্রমাণ মালবোঝাই ট্রাকের প্রায় চাকার তলা থেকে তার বাড়িয়ে দেয়া সনির্বন্ধ একজোড়া কাঠির মত হাত দেখলেই সে বড় বেশি চেনা ঠেকে, বড় বেশি চেনা, বিশেষত তাদের কাছে যারা সারা দেশের এমন বন, নদী, পাহাড় সমুদ্রপার চিরে-চিরে ছুটছে। হাতমুখ ধোয়ার পর, ট্রাককে জল খাওয়ানোর পর, ড্রাইভার। তার বিরাট বুকপকেট থেকে কিছু খুচরো পয়সা মাদারির হাতে দেয়। তারপর, আবার গাড়িতে উঠে স্টার্ট দেয়ার আগে তাকিয়ে দেখে, ফিরবার সময় মাদারি রাস্তার চড়াইটা বা মাঠের উঁচুটা দৌড়ে উঠতে পারে না, তেঁ ই ওঠে, ধীরে-ধীরে। মাদারির মায়ের ঘরটার সামনে মাদারির মাকেও দু-এক সময় দেখা যায়। সারা দেশের নানা দৃশ্য দেখতে-দেখতে যে-ড্রাইভার বন, নদী, সমুদ্রপার চিরে-চিরে ছুটছে, তার পক্ষেও এই দৃশ্যটা সম্পূর্ণ না দেখে গাড়ি ছেড়ে দেয়া সম্ভব হয় না–মাদারি গাড়ির তলা ছেড়ে এই ন্যাশন্যাল হাইওয়ের দীর্ঘতায়, এই ঘন ফরেস্টের বনস্পতিগুলির নীচে কেমন সাবালক পদক্ষেপে ধীরে-ধীরে চড়াই ভেঙে, মাঠের ডাঙা ভেঙে উঠে যাচ্ছে, উঠে যাচ্ছে।

কিন্তু এমন ট্রাক থামা, এখানে, এই শ্যাওড়াঝোরাতে, এতই অনিশ্চিত। যদি আরো একটু নিয়মিত, থাকত, যাতে মাদারি পয়সাটাও আর-একটু নিয়মিত পেতে পারত!

কিন্তু, তা হলে ত আর মাদারিকে চাকার তলায় দাঁড়িয়ে হাত বাড়িয়ে পয়সা চাইতে হত না। মাদারি এখন ত হাটের দিন, মিষ্টির দোকান থেকে একটা ন্যাকড়া চেয়ে নিয়ে দাঁড়ানো ট্রাকগুলোর অত বড় শরীরে কিলবিল করে। ট্রাকটার অত বড় বনেট দুহাতে রগড়েরগড়ে মোছে, বনেটের ওপর উঠে ট্রাকের মাথার নকশা মোছে, কাঁচ মোছে, ড্রাইভারের দরজা মোছে, চাকার ওপর দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ট্রাকের গা মোছে। প্রথম দিকে ট্রাকের ক্লিনার তাকে তাড়িয়ে দিত। কিন্তু ধীরে-ধীরে, মাদারি এই কাজটা প্রায় আদায় করে নিয়েছে। দুই হাটেই আসে এক চা-বাগানের ট্রাকগুলো। চা বাগানে ট্রাকে মাল আসে না, মানুষ আসে। সেগুলো মুছলে কেউ পয়সা দেয় না। সেগুলোকে বাদ দিলেও মাদারির ট্রাকের সংখ্যা নেহাত কম নয়। এক-একটা হাটে সে চার-পাঁচ টাকা পর্যন্ত পেয়ে যায়। তার মধ্যে কতকগুলি ট্রাক ত যেন তার নিজের–এম-পি-সিং-এর ট্রাক, হরিয়ানার ট্রাক, জনের ট্রাকজন ক্লিনার। শ্যাওড়াঝোরায় নিয়মিত ট্রাক দাঁড়ালে মাদারি ত সেগুলোও মুছতে পারত।

.

১৯৩.

মাদারিহাটে জলুশের ঢোলাই

 জলুশের কথা হাটেই শুনেছিল মাদারি। টিন পিটিয়ে-পিটিয়ে হাটে ঢোলাই দিচ্ছিল লাল শুকরা। হাট তখনো বসে নি। মাদারি তার পেছন-পেছন খানিকটা ঘোরে। লাল শুকরা টিন পেটাচ্ছিল আর বলছিল-কাল তিস্তা ব্যারাজ যাবার লাগেক, জলুশ হবে।

শুকরার গলা কফে ঘরঘর করে আর এই কথাগুলো লোকজনকে শোনানোর জন্যে সে গলা তুলছিলও না। ফলে কী যে সে বলছে সেটা কিছুটা শোনা গেলেও, বোঝা যায় না। হাটের লোকজনের অবিশ্যি তা নিয়ে কোনো দুশ্চিন্তা ছিল না হয় তারা সব কিছুই জানে, নইলে তারা কোনো কিছুই জানতে চায় না।

কিন্তু জলুশ শব্দটি শুনে মাদারি আর শুকরার পেছন ছাড়তে পারে না। সে জানে জলুশ-এর নানা রকম আছে। শুধু হাটের মধ্যে ছোট জলুশ ওঠে। চা বাগানের জলুশ ওঠে–সেখানে মাদারির কিছু করার থাকে না। আর বড়বড় জলুশ মাঝে-মাঝে হয়–তখন ট্রাকে করে শহরে নিয়ে যায়, কখনো আলিপুরদুয়ার, কখনো জলপাইগুড়ি। গতবছর মাদারি একবার আলিপুরদুয়ার শহরে, এরকম জলুশ-এর সঙ্গে গিয়ে, জলুশ-এর সঙ্গেই ফিরে এসেছিল। জলপাইগুড়ি শহর তার দেখা হয়নি।

লাল শুকরা খুব রোগা, মনে হয় যেন হাঁটতে গেলে পড়ে যাবে। তার ওপর সকালেই হাড়িয়া খেয়েছে। নেশা বা শরীরের জন্যেই তার পা ঠিকমত পড়ছিল না। কিন্তু সেই টলমলে পায়ে ঘড়ঘড় গলায় সে বলে যাচ্ছিল, জলুশ হবেক, জলুশ হবে। দেখে মনে হতে পারে, জলুশের কথাটা তার নেশার কথা।

লাল শুকরার পেছনে-পেছনে ঘুরতে-ঘুরতে মাদারি তার সামনে গিয়ে জিজ্ঞাসা করে, বড় জলুশ না ছোট জলুশ? আর-একবার সামনে গিয়ে বলে, ট্রাক আসিবে, ট্রাক?

এসব জিজ্ঞাসার সময় সে খানিকটা দূরত্ব রাখে, অভ্যাসেই। কারণ, উত্তরের বদলে শুকরার হাতের কাঠি তার পিঠে পড়তে পারে। শুকরা এমনিতেই আধা পাগলা, আধা মাতালকী যে করবে, কেউ বলতে পারে না।

কিন্তু দ্বিতীয়বার জিজ্ঞাসার পরই শুকরা একটা অদ্ভুত কাজ করেছিল। সে টিনটা আর কাঠিটা মাদারির দিকে বাড়িয়ে দেয়। মাদারি আরো খানিকটা পেছিয়ে যায়। লে লে বলতে-বলতে টলটলায়মান শুকরা তার পেছনে দু-এক পা আসতে-আসতেই কেশে ফেলে। তারপর টিন আর কাঠি-ধরা বাড়িয়ে রাখা হাতেই দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে কাশে, কেশে যায়। তার ঠোঁট বেয়ে লালা গড়াতে থাকে, চোখ দুটো যেন বেরিয়ে আসবে এতটাই বড় হয়ে যায়।

শুকরার হাত থেকে টিনটা আর কাঠিটা নিলে সে অন্তত একটু স্বস্তি পেতে পারে এই আশায় মারি এগিয়ে গিয়ে টিন আর কাঠিটা নিয়ে নেয়, কিন্তু, তাতেও শুকরা তার দুই বাড়ানো হাত শরীরের পাশে নামিয়ে নিতে পারে না–এমনই তার দুর্দম কাশি।

সেটা থামলে, ঢোঁক গিলে, হাত দুটো নামিয়ে, বা হাতের পাঞ্জা দিয়ে মুখের ঘাম একবার মুছে ফেলে, ডান হাতটা তুলে সারা হাটের ওপর বুলিয়ে শুকরা বলে, যা হে মাদারি, ঢোলাই দে, কালি তিস্তা ব্যারাজমে জলুশ হবেক, মিনিস্টার আবেক, ট্রাক আবেক–।

ট্রাক আসিবে? মাদারি জিজ্ঞাসা করে।

 জরুর আবেক। ট্রাক জরুর আবেক। সব কোইকো যাবার লাগেক। যাও, ঢোলাই লাগাও মাদারি। বলে শুকরা ডান দিকে ঘুরে মাটির হাঁড়ির দোকানগুলোর পেছনে গাছতলায় প্রথমে গা এলায়, তারপর শুয়ে পড়ে।

আর, মাদারি লাফাতে লাফাতে টিন বগলে নিয়ে কাঠি পেটায়–জলুশ জলুশ, কালি জলুশ, ট্রাক আসিবে, সগায় যাবেন, সগায় যাবেন।

মাদারির বগলে টিনটা আঁটছিল না। তাকে বারবার হাত বাড়িয়ে টিনটা তার শরীরের সঙ্গে চেপে রাখতে হচ্ছিল। আর সেই বাকা অবস্থায় কাঠি দিয়ে পিটতে হচ্ছিল। কিন্তু সে এত তাড়াতাড়ি দৌড়ে-দৌড়ে, সারা হাটে ঘুরছিল যে মনে হচ্ছিল সে কোথাও থেকে টিন পেয়ে শখ করে পিটিয়ে বেড়াচ্ছে। তার কচি গলার চিৎকারে জলুশ, জলুশ আওয়াজটা তখনো নাবসা হাটের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ছিল–পাখির চিৎকারের মতন।

হাট তখনো বসেনি, তাই দোকানের সারির ভেতর দিয়ে দৌড়োদৌড়ি করা সম্ভব হচ্ছিল। দোকানিদের সামনে সাজানো দোকানে তখনো প্রায় হাত পড়েনি। তারাও মাদারির এই ঢোলাইয়ে অংশ নিতে পারে। ফলে, মাদারি একটু মজাই পাচ্ছিল।

কিন্তু মজা পেতে-পেতে ঘোমশাইয়ের মিষ্টির দোকানের সামনে আসতেই ঘোমশাই চিৎকার করে ডাকেন, এ-ই মাদারি। নিজের টিনের আওয়াজে মাদারি সে-ডাক শুনতেই পায় না। ফলে ঘোষমশাইকে আরো জোরে হাঁক দিতে হয়, এ-ই মাদারি।

সে-হাঁক শুনে মাদারি চমকে, থেমে, ঘুরে, মিষ্টির দোকানের দিকে তাকায়। দেখে, ঘোমশাই চোখ গরম করে তার দিকে তাকিয়ে। সে বগল থেকে টিন নামিয়ে দুই হাতে টিনটা সামনে ধরে, পায়ে-পায়ে ঘোষমশাইয়ের সামনে যায়।

ঘোষমশাই ধমকে ওঠেন, কে দিয়েছে তোকে, ঢোলাই দিতে?

শুকরা।

কোন শুকরা?

লাল শুকরা।

যা, এখনই দিয়ে আয় তার টিন। ঢোলাই দিচ্ছে! জলুশ হবে কি না-হবে তাতে তোর কী? যা, টিন  দিয়ে এসে কাপ ধুয়ে রাখ–

মাদারি চড় খাবে–ভয় পেয়েছিল। না-খাওয়ায় দৌড়ে লাল শুকরার খোঁজে গিয়েছিল। গিয়ে অবিশ্যি তাকে বেশি খুঁজতে হয় না। লাল শুকরা সেই গাছটার তলাতেই শুয়ে আছে আর হাপরের মত শ্বাস ফেলছে।

মাদারি আস্তে-আস্তে পা ফেলে শুকরার কাছে যায়। একটু দাঁড়িয়ে থাকে। তারপর লাল শুকরা আর গাছটার মাঝখানের একটা ফাঁক দেখে সেইখানে টিনটাকে রেখে দেয়, সাবধানে, যাতে, কোনো আওয়াজ না-হয়, যাতে, লাল শুকরার গায়ে ধাক্কা না লাগে, যাতে, লাল শুকরা জেগে না ওঠে। টিনটা সে ঠিকমত রাখতে পেরেছিল। তারপর কাঠিটা টিনের ওপর রেখেছিল। কিন্তু কাঠিটা টিনের ঠিক মাঝখানটাতে রাখতে পারে না। খানিকটা বেরিয়ে থাকে। সে কাঠিটা ঠিকমত রাখতে আবার হাত বাড়াতেই কাঠিটা গড়িয়ে লাল শুকরার পেটের ওপর পড়ে তার শ্বাসের সঙ্গে ওঠানামা করে। ততক্ষণে মাদারি দৌড়ে আবার ঘোমশাইয়ের দোকানে।

ঘোষমশাইয়ের দোকানে মাদারি দুই হাটবারে দরকারের সময় কাপডিশ ধুয়ে দেয়। দু-এক সময় চাও, দেয়, খদ্দেরদের। চা বানায় বাহাদুর–সে বলেছে, মাদারিকে চা বানানো শিখিয়ে দেবে। ঘোষমশাই তাকে সব সময়ই দু-চার পয়সা দেন। যদি বাহাদুর সত্যি মাদারিকে চা বানানো শিখিয়ে দেয়, তা হলে, সে ঘোমশাইয়ের দোকানে চাকরিও পেতে পারে। কিন্তু চা বানানোর টেবিলটা এখনো তার থুতনি পর্যন্ত। চা বানানো শেখার আগে তাকে আরো লম্বা হতে হবে।

হাট শেষ হওয়ার আগে দেখা গেল–জলুশ একটা না, অন্তত দু-তিনটি। হাতুড়িপার্টি বাগানের লোকজন এনে মিছিল তুলে দিল, আর পাহাড়িরা ফরেস্ট থেকে লোকজন এনে মিছিল সাজাল। দেশি মানষিরও একটা মিছিল উঠল। সবাইই বলে–কাল তিস্তা ব্যারেজে জলুশ।

.

১৯৪.

 তিস্তা ব্যারেজ কী করে হল

এ গল্পটা জলুশের সঙ্গে তিস্তা ব্যারেজেই যাবে। তাই, তিস্তা ব্যারেজের কথাটা এখানে সেরে নেয়াই ভাল।

তিস্তা ব্যারেজের পরিকল্পনা কী, কবে থেকে তার কাজ শুরু হয়েছে, কাজ শুরুর আগে কী গোলমাল হয়েছে, রাজ্যের কোন সরকার আর কেন্দ্রের কোন সরকার কী করেছে–সে-সব ত সাতকাহন কথা। তিস্তার জল কোথাও আটকে সেখান থেকে জলবিদ্যুৎ বানানো যায় কিনা-এ নিয়ে নানারকম কথাবার্তা নানা সময়ই হয়েছে। সরকারের ঘরে কাগজপত্রও কিছু কম জমা হয় নি, সে-সুবাদে। কিন্তু জলঢাকা জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের হালের পর কারো ঘাড়ে আর দুটো মাথা ছিল না যে উত্তরবঙ্গের এই সব পাহাড়ি নদী নিয়ে কোনো কথা জোর দিয়ে বলে।

কিংবা, তাও হয়ত নয়। কারণ, জলঢাকা জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের বিপর্যয়ের পর কারো গর্দানই কাটা, যায়নি। সরকারি কোনো প্রকল্পেই কোনো একজনকে দায়ী করা যায় না। এত নানা স্তর দিয়ে, এত নানা লোক, এত বিভিন্ন পর্যায়ে একটা প্রকল্পের রূপ দেয় যে কোনো এক স্তরের কোনো একজনকে কোন একটি কাজের জন্যে দায়ী করা যায় না। জলঢাকায় সব হিশেবই ঠিক ছিল–জল বছরে কোন-কোন সময় কত পরিমাণ আছে, জলের বেগ কত থাকে, সেই বেগের আঘাতে টারবাইন কত জোরে ঘুরতে পারে, তাতে কতটা শক্তি তৈরি হতে পারে–এ-সব হিশেবের কোনো জায়গায় কোনো ভুল ছিল না। পৃথিবীর সব জায়গায় যে-অঙ্ক মিলিয়ে বিখ্যাত-বিখ্যাত সব জলবিদ্যুৎ প্রকল্প তৈরি হয়েছে, জলঢাকাতেও সেই অঙ্ক ছিল নির্ভুল। কিন্তু পৃথিবীর বিখ্যাত বিখ্যাত জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের অঙ্ককষা বইগুলিতে শুধু ছিল না এখানকার পাহাড়ের বৈশিষ্ট্যের লোকাল ফ্যাক্টার। তাই সেই স্থানিক উপাদান অঙ্কের হিশেবে ধরা হয়নি। এখানকার পাহাড়ে পাথরের চাইতে মাটি অনেক বেশি। জল যখন পাহাড় বেয়ে নীচে নামে, স্বাভাবিক খাতে বা ঢলে, তখন জলের সঙ্গে সঙ্গে নামে পাহাড়ের মাটিও। পাহাড় থেকে মাটি অত খসে যায় বলেই এদিকের পাহাড়ে এত ধস নামে। আর সেই মাটি, জলে গোলা মাটি টারবাইনের ঘূর্ণন যে থামিয়ে দিতে পারে, তা জানা গেল যখন টারবাইন থেমে গেল, তখনই।

জলঢাকার এই অভিজ্ঞতার ফলে উত্তরবঙ্গের পাহাড়ি নদী সম্পর্কে সবাই একটু অনিশ্চিত হয়ে যায়। এরা ঠিক চেনা নদী নয়। এদের স্বভাবও সব সময় বই-পড়া নদীবিজ্ঞানের সঙ্গে মেলে না। বা, এই ধরনের ভৌগোলিক অবস্থানের নদীর বৈশিষ্ট্য নিয়ে তেমন কোনো বইপত্র এখনো লেখা হয়ে ওঠেনি। সুতরাং যতদিন তা না হয়, অর্থাৎ এই সব নদীর ধর্ম পাকাপাকি জানা না যায়, ততদিন নদীগুলো নদীগুলোর মতই থাকুক। মে থেকে অক্টোবর, মৌসুমি বাতাসের প্রথম অভিঘাত থেকে সে-বাতাসের প্রত্যাবর্তন পর্যন্ত ছয়-ছয়টি মাস, নদীগুলি নানা খাতে বয়ে যাক, নানা ধরনের বন্যায় নানা জায়গা ভাসাক, একই নদীতে ছোট-বড় নানা বন্যা আসুক। বরং, বন্যার হাত থেকে মানুষজনকে বাঁচানোর চেষ্টা করা ভাল, বন্যার মানুষজনের যা ক্ষতি তা পূরণ করে দেওয়া নিরাপদ, কিন্তু, নদীর গায়ে হাত দেয়ার দরকার নেই।

এই সংস্কার কবে কাটল তার সাল-তারিখ খোঁজার দরকার নেই। মোটামুটি বলা যায় ১৯৬৮ সালে তিস্তার সব চাইতে বড় বন্যার পর, ৬৯ সালের দ্বিতীয় যুক্তফ্রন্ট সরকারের সময় তিস্তাপ্রকল্প কথাটা প্রথম খবরের কাগজের পাতায় আসে। তিস্তা-মহানন্দা মাস্টার প্ল্যান কথাটিও সেই সময়ের। কিন্তু তখন এ-সব কথা কাগজে উঠতে-উঠতেই যুক্তফ্রন্টের সরকার চলে যায়। তারপর, আর এ-নিয়ে বিশেষ সাড়াশব্দ হয় নি।

তারপর, আবার উঠল বছরছয়েক পরে। তিস্তা ব্যারেজ প্রকল্পের কাজে প্রথম হাত দেয়া হবে, তিস্তা-মহানন্দা মাস্টার প্ল্যান এক-একটা পর্যায় ধরে রূপায়িত হবে, তিস্তা ব্যারেজ ডিভিশন তৈরি হয়ে গেল–এই সব খবর খুব ঘন-ঘন কাগজে তখন বেরতে শুরু করে এক কেচ্ছার সূত্রে। মালদার এক মন্ত্রী ছিলেন এই সবের দায়িত্বে। তিনি নিউ জলপাইগুড়িতে তিস্তা ব্যারেজের এক অফিস আর কোয়ার্টার খুললেন আর তিস্তা ব্যারেজের প্রধান অফিস খুললেন মালদায়।

এই নিয়ে কেচ্ছা তখন বেশ জমে উঠেছিল, কারণ, নিউ জলপাইগুড়ি বা মালদা কোথাওই তিস্তা নেই! যেখানে তিস্তা নদীর নামগন্ধ নেই, সেখানে প্রকল্পের মূল অফিস খোলার একটাই উদ্দেশ্য, যাতে, মন্ত্রীর জায়গার লোক এই প্রকল্পে বেশি চাকরি পায়। সুতরাং জলপাইগুড়ি-কোচবিহার থেকে প্রতিবাদ শুরু হল যে ব্যারেজের অফিস নদীগুলির জেলাতে করতে হবে।

কিন্তু মন্ত্রীর যদি ইচ্ছাই হবে যে তার জেলার বা শহরের লোকরা কাজ পাক, তা হলে ত তিনি মহানন্দা ব্যারেজের কাজেই আগে হাত দিতে পারতেন। তা ত তিনি দেননি। আসলে, মালদায় মূল অফিস হলে তিনি নিয়মিত দেখাশুনা করতে পারবেন। তার প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে উত্তরবঙ্গের, তথা, পশ্চিমবঙ্গের অন্যতম বৃহৎ নদী তিস্তার প্রকল্পটি যাতে দ্রুততম বেগে ও অল্পতম সময়ে সম্পূর্ণ হয়–তাই তিনি প্রকল্পের মূল অফিসটি মালদা শহরে বসিয়েছেন। তা ছাড়া অফিসে আর ক-জন লোক কাজ করে? নতুন লোক ত নেয়া হবে ব্যারেজ যেখানে হবে, সেখানে। আর লোক ত নেবে, কনট্রাকটাররা। তাতে মন্ত্রীর কী করার আছে?

এই দুই মতের মাঝখানে একটা তৃতীয় মতও ছিল। তারা বোধহয় বিশ্বাস করে না যে কোনো কিছু নিজ অধিকারে পাওয়া যায়। তাই তারা বলে–যেখানে খুশি সেখানে অফিস হোক, ব্যারেজটা ত তিস্তাতেই হচ্ছে। তিস্তায় ব্যারেজ করে মন্ত্রীর কী লাভ? সে তাই অফিসটুকু মালদায় নিয়ে গেছে। মন্ত্রীর এইটুকু লাভ মেনে নিলে ব্যারেজটা হয়ত হত। আর, তা না হলে, মন্ত্রী হয়ত ব্যারেজটাই তুলে নেবে, রাগ করে আর কাজে হাত দেবে না।

কিন্তু এ-সব ঝগড়াঝাটি, তর্কবিতর্ক শেষ হওয়ার আগেই জরুরি অবস্থা, ৭৭-এর ভোট ও ইন্দিরা গান্ধীর হার। কংগ্রেসই যদি কেন্দ্রে হেরে যেতে পারে, প্রধানমন্ত্রী যদি ভোটে গড়াগড়ি খায়-তা হলে তিস্তা ব্যারেজই বা কী? মহানন্দা ব্যারেজই বা কী? ১৯৭৭ সালের ভোটে রাজ্যে বামফ্রন্টের সরকার হল। ৬৭ আর ৬৯-এর রাজনীতির ধারাবাহিকতা যেন আবার ফিরে এলমাঝখানের দুটো-একটা ভোট আর দুটো-একটা সরকার যেন এলেবেলে হয়ে গেল, যদিও এলেবেলে হতে বছর দশেক লেগেছে।

স্পেশ্যাল সেটলমেন্টের জরিপের কাজ শুরু হল ৭৭-সাল নাগাদই। মালদায় ব্যারেজ-অফিস হওয়ার কোনো প্রশ্নই আর ওঠে না। কিন্তু একটা অফিস নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনের কাছে থাকল, কোয়ার্টার-টোয়ার্টারও হল। সংযোগ রাখা, জিনিশপত্র আনা, কলকাতায় ছোটাছুটি, এ-সবের জন্যে এরকম একটা জায়গায় এরকম একটা ক্যাম্পাস দরকার বোধ করল সবাই। বিশেষত ব্যারেজ শেষ হলে তার রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বও ত আছে।

এ-সবের মধ্য দিয়ে তিস্তা-মহানন্দা মাস্টার প্ল্যানের একটা পর্যায় হিশেবে তিস্তা ব্যারেজের কাজটা কিন্তু খুব তাড়াতাড়িই হতে লাগল। গাজোলডোবা গ্রাম হয়ে উঠল প্রধান কর্মকেন্দ্র। দেখতে-দেখতে, এপারে গাজোলডোবা আর ওপারে বৈকুণ্ঠপুর ফরেস্টের মাঝখানে, চওড়া-চওড়ি, তিস্তার মাঝখান দিয়ে ব্যারেজ তৈরি শুরু হয়ে যায়। স্লুইস গেট, রিজার্ভেয়ার সহ, তিস্তা ব্যারেজ। সেকাজ এখনো শেষ হয় নি। কিন্তু তার উদ্বোধন এখনই করা হচ্ছে, অন্তত আংশিক উদ্বোধন। সেই উদ্বোধনেই এত জলুশ যাচ্ছে।

.

১৯৫.

শেষ-না হতেই উদ্বোধন

কিন্তু অসম্পূর্ণ ব্যারেজ উদ্বোধনের দরকারটাই-বা পড়ল কেন?

সেটাই সাম্প্রতিক ইতিহাসের ব্যাপার এবং এ গল্পের পক্ষে জরুরি।

এত বড় একটা কর্মযজ্ঞে স্থানীয় লোকজন কিছু সুযোগ-সুবিধে পেয়েই থাকে। কিন্তু সেই সুযোগ-সুবিধের ব্যাপারেই প্রথম থেকে গণ্ডগোল। কাজটা হচ্ছে নদীর ভেতরে চওড়া-চওড়ি। এই ব্যারেজের ফলে তিস্তার জলকে তার মূলখাতে শাসনে রাখা যাবে। এ বর্ষায় এক খাত, পরের বর্ষায় অন্য খাত, বা, একই বর্ষায় প্রথম দিকে বাঁ-পাড় ঘেঁষে, শেষ দিকে ডান-পাড় ঘেঁষে–এই সব আর চলবে না।

কিন্তু ফলে, তিস্তার এই স্বভাবের ফলে, তিস্তার যে-খাত বিরাট হয়ে গেছে, তার মাঝখানে-মাঝখানে অনেক চর তৈরি হয়েছে। সে-সব চর প্রায় ডাঙার মত উঁচুও হয়ে গেছে। তিস্তা ব্যারেজের ফলে নদীখাতের এই সব চরে ত আর বসতি বা চাষবাস চলবে না কারণ, তিস্তাকে তার মূলখাতেই রাখা হবে। সঞ্চিত জল যখন ছাড়া হবে, তখন সেই জলস্রোতের ধাক্কায় এই মধ্যবর্তী চরগুলো ভেসে যাবে।

এই সব চরে প্রধানত পূর্ববঙ্গের নমশূদ্র চাষিরা বসতি করেছে, আবাদ করেছে। কোনো-কোনো জায়গায়, যেমন মউয়ামারির চরে, তাদের কোঅপারেটিভ পর্যন্ত আছে। তিস্তা ব্যারেজের জল কবে ছাড়া যাবে সে-হিশেব এখনো কেউ কষছে না বটে কিন্তু যখনই ছাড়া হোক, এসব চরবসতি তার আগে উঠে যাবে। ইতিমধ্যেই এরা হয়ত অন্যকোনো জায়গায় খোঁজ-খবর করছে। সরকারের সঙ্গেও কথাবার্তা চলছে–এদের আর-কোথাও পুনর্বাসন দেয়া যায় কিনা।

ভবিষ্যতের ব্যবস্থা কী হবে, সেই সব নিয়ে নানা চেষ্টার মধ্যেও ত এরা বর্তমানকে ছেড়ে দিতে পারে না। তাই তিস্তা ব্যারেজের শুরুতেই তাদের দাবি হল–যে ব্যারেজের ফলে তাদের উচ্ছেদ হতে হবে, সেই ব্যারেজের কাজে তাদেরই নিতে হবে। বিশেষ করে মাটিকাটার প্রাথমিক কাজে।

ব্যারেজ কর্তৃপক্ষের এ নিয়ে কিছু বলার নেই। কারণ, কাজ করাবে কনট্রাকটার। সে কোথা থেকে লোক এনে কাজ করাবে, এটা সম্পূর্ণতই তার ব্যাপার। কিন্তু তবু যাতে কাজের শুরুতেই কোনো গোলমাল না বাধে সেইজন্যে সরকারি ইনজিনিয়াররা একটা আপসের চেষ্টা করে।

আপসের পথে বাধা ছিল। কারণ একনস্ট্রাকশন কোম্পানির সারা ভারত জুড়ে কাজ। তাদের সাবকনট্রাকটার, লেবার, এ-সব বাধা। এমনকি তারা এসে গাজোলডোবার জঙ্গল পরিষ্কার করে তাবু গেড়ে ফেলেছে, ইলেকট্রিক লাইন টানবার জন্যে শালগাছের ডালপালা ঘেঁটে দিয়েছে। এই অবস্থায় তাদের অভ্যস্ত ব্যবস্থা বদলাতে কোম্পানি কেন রাজি হবে? একথা আগে ওঠেনি। ফলে, কোম্পানির সাবকনট্রাকটাররা তাদের লোকজনকে আনতে টাকা-পয়সা নিয়ে নানা জায়গায় চলে গেছে। প্রতিদিনই বেশ কিছু মজুর এসে পৌঁছচ্ছে। আপলচাঁদ ফরেস্টের মধ্যে তাদের অস্থায়ী আস্তানার সীমা প্রতিদিনই বেড়ে চলেছে। এমন-কি, ট্রাক আসার জন্যে যে রাস্তাটা এখন কিছুটা মাত্র তৈরি হয়েছে, তার পাশে, খানিকটা জায়গা জুড়ে ছোটখাট একটা বাজারও কিছুদিন থেকে বসতে শুরু করেছে। এই অবস্থায় এই সব লোককে বসিয়ে রেখে কোম্পানি কি চরের লোকদের কাজ দিতে যাবে?

আসলে, কোম্পানি একটা গোপন হিশেব করে ফেলেছিল। ব্যারেজের কাজে আসতে পারে কাছাকাছি চরের বাড়তি লোজন, যারা কৃষিকাজে খাটে না। দূরের চর থেকে কেউ এ কাজে আসবে না। আর, এই কাছাকাছির চরগুলো থেকে যত সংখ্যক লোক ব্যারেজের কাজে আসতে পারে, অন্য জেলা থেকে সাবকনট্রাকটারদের সূত্রে তার চাইতে অনেক বেশি লোক কোম্পানির নিজের হাতেই চলে আসবে। এই সব চরের লোকরা যদি বাধা দিতে চায়, শুধু সংখ্যাতেই তারা হেরে যাবে। এই পরিস্থিতির জন্যে কোম্পানির আরো কিছু দিন সময় দরকার ছিল। ইনজিনিয়ারদের সঙ্গে কথা বলে, চরের লোকদের সঙ্গে কথা বলে, পরে কথা বলার দিন ঠিক করে–কোম্পানি এই সময়টা নিচ্ছিল।

এই কোম্পানি ভারতবর্ষের বিভিন্ন জায়গায় এই রকম বিরাট-বিরাট কাজ বছরের পর বছর ধরে করে থাকে। এরকম সমস্যা মেটানোর ব্যাপারে তাদের অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা দুইই যথেষ্ট আছে।

সেই অভিজ্ঞতা ও দক্ষতাও তারা কাজে লাগায় সাবকনট্রাকটারদেরও নীচের স্তরে।

 সাব-কনট্রাকটারদের কাজের জন্যে আবার কিছু সাবকনট্রাকটার দরকার, বা, বলা ভাল, এক-একটি কাজের জন্যে এক-একজন সাপ্লায়ার দরকার হয়। এসব সাপ্লায়ার লোক্যাল লোক হওয়া ভাল ও নিরাপদ। কারণ স্থানীয় ভাবে কোথায় কোন জিনিশ পাওয়া যায়, তারা ভাল জানে, জোগাড়-করে নিয়েও আসতে পারে, একজন না পারলে আর-একজন সাহায্যও করে।

স্থানীয় ছোটখাট কনট্রাকটারদের হদিশ করে তাদের সঙ্গে কথাবার্তা বলার কাজে কোম্পানি সাবকনট্রাকটারদের লাগিয়ে দেয়। মাটিকাটার কাজের শুরুতেই বাশ লাগবে গাড়ি-গাড়ি। শালবরগা লাগবেকত তার শেষ নেই। পাথর ফেলতে হবে পাহাড়-পাহাড় জলের স্রোতের ধার ভাঙতে। এই রকম একটা ব্যারেজের কাজের একটা অংশেরও অংশে শুধু বাশ, বা শাল-বরগা, বা পাথর সরবরাহের কাজ যদি স্থানীয় কোনো কনট্রাকটার পায় সে ত হাতে চাঁদ পেয়ে যাবে।

সাবকনট্রাকটাররা সেই মালবাজার, ওদলাবাড়ি, জলপাইগুড়ির সব কনট্রাকটারদের সঙ্গে এই নিয়ে কথাবার্তা বলে। আর, তাদের প্রত্যেকেই জেনে যায়, ব্যারেজের কাজ শুরু করতে দিচ্ছে না চরের লোজন। কোম্পানির এহিশেবটা পাকা ছিল যে এসব জায়গার জনাপঞ্চাশ, বা শ-খানেক, বা শ-দেড়েক কনট্রাকটারকে সাপ্লাইয়ের কাজ দেয়া যাবেই।

এই সব কথাবার্তার সূত্রে জেলার এই কনট্রাকটাররাও কোম্পানির সমর্থনে এসে দাঁড়ায়। তাদের মধ্যে যাদের রাজনৈতিক ক্ষমতাও কিছুটা আছে, তারা চরের লোকজনের ওপর রাজনৈতিক প্রভাবও খাটাতে থাকে যে এত বড় একটা কাজে ওরকম বাধা দেয়া ঠিক হচ্ছে না।

কিন্তু কোম্পানি সবচেয়ে দক্ষতা দেখায় স্থানীয় গ্রামাঞ্চলে বাজবংশীদের একটা সংগঠন প্রায় তৈরি করে ফেলায়। চরের নমশূদ্রদের সঙ্গে রাজবংশীদের সম্পর্ক কোনোদিনই খুব ভাল নয়। কী করে একথা কাছাকাছি সব গ্রামে রটে যায়–সেই ক্রান্তির হাট ছাড়িয়ে, সেই ওদলাবাড়ি ছাড়িয়ে যে চরের লোকরা কোম্পানিকে বলেছে তাদের কাজে নিতে হবে, রাজবংশীদের কাজে নেয়া চলবে না।

ব্যাপারটা আইন-শৃঙ্খলার মধ্যে গিয়ে পড়ে।

কোম্পানি পরিষ্কার জানায় যে—চরের লোকদের কাজ দিলে রাজবংশীরা দাঙ্গা বাধাবে। রাজবংশীদের কাজ দিলে চরের লোকরা দাঙ্গা বাধাবে। দু-দলকে কাজ দিলে কাজের জায়গায় দাঙ্গা বাধবে। সুতরাং কোম্পানি সরকারের অনুমতি অনুসারে নিজের লোকদের দিয়ে কাজ শুরু করে দেয়।

.

১৯৬.

ব্যারেজের আগেও ইতিহাস আছে

 কিন্তু সে ত কাজ শুরুর ব্যাপার। তার সঙ্গে এই এখনকার উদ্বোধনের সম্পর্ক কী। উদ্বোধন মানে ত কাজ শেষ। আংশিক উদ্বোধন মানে অন্তত আংশিক কাজ শেষ। কিন্তু এই ব্যারেজ ছাড়াও ইতিহাস আছে। সে-ইতিহাস ত প্রতিদিন, প্রতি বছরের নানা ঘটনার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। এখন যেমন তিস্তায় ব্যারেজ বেঁধে তিস্তার খাত পাকাপাকি স্থির করা হচ্ছে, সেভাবে ত আর ইতিহাসে ব্যারেজ বেধে ইতিহাসের খাত ঠিক করা যায় না। ইতিহাসের খাত সব সময়ই মুক্ত তিস্তার মতন। কখনো সে ডাইনে পাড় ভাঙে, কখনো বয়ে। একই বর্ষার শুরুতে সে তার পুরনো চর উৎখাত করে বয়ে চলে। সে বর্ষার শেষে নতুন চর ফেলে সরে যায়। সে-ইতিহাস এই গোটা ভারতেরই হোক, বা, এই তার এক রাজ্য পশ্চিমবঙ্গেরই হোক, অথবা, পশ্চিমবঙ্গেরই একটা অংশ এই উত্তরবঙ্গেরই হোক। খবরের কাগজ, বা রেডিও, বা টিভি পড়ে শুনে দেখে মনে এই ধারণা প্রায় অনড় হয়ে ওঠে যে ইতিহাসের মত বড় ব্যাপার দিল্লি-বম্বের মত বড় শহরে, বা কলকাতার মত রাজধানীতেই ঘটে উঠতে পারে, তারপর সেখান থেকে অন্যত্র ছড়াতে পারে। কিন্তু কোনো-কোনো সময় দেখা যায় উত্তরবঙ্গের মত এক অনির্দিষ্ট ভূখণ্ডেও ইতিহাস একটা নির্দিষ্ট আকার পেতে চায়। বা হয়ত সব খণ্ড অংশেরই একটা নিজস্ব ইতিহাসের গতি আছে। বড় ইতিহাসের গতির সেটা অনুকূলও হতে পারে, প্রতিকূলও হতে পারে। বড় ইতিহাস নিজের বড়ত্বের চাপে কখনো বা সেই প্রতিকূলতাকে দুমড়ে-মুচড়ে দিতে পারে, কখনো বা সেই প্রতিকূলতাকে নানা মোড়ে ঘুরিয়ে-ঘুরিয়ে অনুকূলতার স্রোতে মিশিয়ে দিতে পারে। কিন্তু কখনো কখনো দেখা যায় সেই আঞ্চলিক খণ্ডের ইতিহাসের বাকা পথ কিছুতেই আর সোজা হচ্ছে না, শেষ পর্যন্ত তা হয়ে দাঁড়ায় মূল ইতিহাসের অসম কিন্তু প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী। তিরিশের দশকের মাঝামাঝির আগে কেউ কখনো ভাবতেও পারে নি যে ভারতীয় ইতিহাসের মূল ধারার বিরুদ্ধে মুসলমানের একটা বিচ্ছিন্ন ধারা কোথাও কোনো স্বীকৃতি পেতে পারে। ১৯৩৫-এর ভারত শাসন আইনে সেই বিচ্ছিন্নতার ধারাকে আরো বড় প্রবাহপথ দেওয়া হল। আর তারই ফলে মাত্র দশ বছরের মধ্যে পাকিস্তানের দাবি হয়ে উঠল স্বাধীনতার দাবিরই সমতুল্য। ১৯৪৭-এ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগে পাকিস্তানের সেই দাবির বয়স মাত্র সাত বছর–১৯৪০-এর মার্চে লাহোরের সম্মিলনে পাকিস্তানের দাবি প্রথম তোলা হয়–অথচ তা মাত্র এই সাত বছরেই অখণ্ড ভারতের অখণ্ড স্বাধীনতার প্রায় একশ বছরের স্বপ্ন, কল্পনা ও প্রয়াসের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠতে পেরেছিল।

তিস্তা ব্যারেজ সেরকম একটা আঞ্চলিক খণ্ড ইতিহাসের সঙ্গে যুক্ত হয়ে গিয়েছে। সেই আঞ্চলিক ইতিহাসের চেহারাটাও এক রকমের নয় কিন্তু সব চেহারাতেই তার আঞ্চলিকতার চরিত্র অত্যন্ত স্পষ্ট।

যেমন, মালদহ-দিনাজপুরের পোলিয়া রাজবংশী থেকে শুরু করে কোচবিহার-জলপাইগুড়ির রাজবংশী পর্যন্ত মিলিত ভাবে নিজেদের আদিবাসীসত্তার প্রাধান্য চেয়ে বাস মাঝে-মাঝেই।

সেই উত্তরখণ্ড পার্টি বা, পার্টি, না বলে উত্তরখণ্ড আন্দোলনের কিছুটা বিবরণ ত আমরা এর আগের পর্বেই পেয়েছি। সেই উত্তরখণ্ড আন্দোলন বা পার্টি কখনোই খুব বড় হয়ে উঠতে পারবে কিনা সেটা আলাদা প্রশ্ন। বরং সে-আন্দোলনের ভেতর এত নানা ধরনের স্বার্থ ও উদ্দেশ্য এসে মিশেছে তাদের সব নেতার একসঙ্গে কাজ করাই মুশকিল। কিন্তু যত মুশকিলই হোক, তেমন দরকারে ত বষের ফিল্ম-আর্টিস্ট শ্রীদেবী আর জল্পেশ মন্দিরের শিবলিঙ্গ–একাকার করে দিয়ে এরা এমন একটা অবস্থা তৈরি করে তুলতে পারে যাতে মনে হয় সত্যি বুঝি এদের পেছনে অনেক লোক আছে। লোকবল, বা, জমায়েতই যদি শক্তি দেখানোর প্রধান উপায় হয়, সে-উপায় ত নানা ভাবেই ব্যবহৃত হতে পারে।

প্রাচীন ইতিহাস, জনবৈশিষ্ট্য এই সব নিয়ে একটি অঞ্চলের বিশিষ্টতা যখন তার বিচ্ছিন্নতার উপাদান হয়ে ওঠে, তখন, ইতিহাসের কোনো উপাদানই অব্যবহৃত থাকে না। উত্তরবঙ্গ শুধু সমতল নয়–তার বিস্তৃত পার্বত্য অঞ্চল পশ্চিমবঙ্গেরই অংশ। সেই পার্বত্য অঞ্চল প্রধানত দার্জিলিং জেলার মধ্যেই ছড়িয়ে, আর-একটা অংশ জলপাইগুড়ি জেলার উত্তরভাগ দিয়ে অনেকখানি নেমে এসেছে। প্রকৃতপক্ষে, জলপাইগুড়ি জেলা যত উত্তরে গেছে ততই তার জনমণ্ডলীর চেহারা বদলে যায়। প্রায় মাঝখান দিয়ে যদি পূর্ব-পশ্চিমে একটা রেখা টেনে জলপাইগুড়ি জেলাকে দুভাগ করা যায়, তা হলে ওপরের ভাগের তিন ভাগের দুই ভাগ রাজবংশী এলাকার বাইরে। এই ভাগে প্রধানত চাবাগান–সেই সূত্রে কোল-মুন্ডা-সাঁওতালরাই প্রধান অধিবাসী। আরো একটু উত্তরে গেলে, নেপালি অধিবাসীরাই প্রধান। এই উত্তরের জলপাইগুড়ির সঙ্গে জলপাইগুড়ির জনবসতিগত পার্থক্য নির্বাচন কমিশনও পরোক্ষে মেনে নিয়েছেন। দার্জিলিঙের লোকসভা আসন বলে যা পরিচিত, তার মধ্যে জলপাইগুড়ি জেলার উত্তরাঞ্চলের অনেকটা পড়ে। অর্থাৎ জলপাইগুড়ি জেলার উত্তরের নেপালিরা, কোল-মুন্ডা-সাঁওতালরা দার্জিলিং লোকসভা আসনের ভোটার। এ ব্যবস্থা দু-তিনটে ভোট ধরে চালু হয়েছে। ফলে পার্বত্য এলাকার সঙ্গে জলপাইগুড়ির একটা সম্পর্ক প্রায় স্থায়ী হয়ে গেছে।

.

১৯৭.

পাহাড় থেকে সমতল

ভৌগোলিক আরো একটা কারণ আছে জলপাইগুড়ির মধ্য দিয়ে পাহাড় আর সমতলের এই সংযোগের।

দার্জিলিঙের সঙ্গে শিলিগুড়ির সমতলভূমির সম্পর্কটাই চোখে পড়ে বেশি, সেই সম্পর্কটাতেই অভ্যস্ততাও বেশি। শিলিগুড়ি থেকে হিলকার্ট রোড দিয়েই দার্জিলিঙের সঙ্গে প্রধান সংযোগ। কিন্তু সেটাই পাহাড়ের সঙ্গে সমতলের একমাত্র সংযোগ নয়। জলপাইগুড়ি জেলার ওদলাবাড়ি থেকে গরুবাথানের রাস্তা সোজা উঠে গেছে লাভা-আলগাড়া হয়ে কালিম্পং। দার্জিলিং পাহাড় থেকে কালিম্পং পাহাড় আলাদা। আর, এই কালিম্পং পাহাড়ের সঙ্গে জলপাইগুড়ির সংযোগ অনেক প্রাচীন। এই গরুবাথানের রাস্তায়, বা লাভা-আলগাড়ার রাস্তায়, বা সরকারি ভাষায় ওল্ড মিলিটারি রোডে জলপাইগুড়ির অনেক চা-বাগান ধীরে-ধীরে ধাপে-ধাপে পাহাড়ে উঠে গেছে, পাহাড়ের আনাচে-কানাচে ঢুকে গেছে, পাহাড়ের আড়াল থেকে গড়িয়ে নেমে এসেছে। পাথরঝোরা, শুড়িবাড়ি, ছোট ফাগু, বড় ফাগু। আবার, এই সব পাহাড় জুড়েই উঠে গেছে জলপাইগুড়ি ডিভিশনের অধীনে ফরেস্টের নানা রেঞ্জ। কোনো একটা জায়গায় জলপাইগুড়ির জেলা শেষ হয়ে দার্জিলিং জেলা শুরু হয়ে যায় বটে, কিন্তু বাইরে থেকে তা বোঝাই যায় না। সর্বত্রই নেপালি শ্রমিক, নেপালি অধিবাসী। মানুষের মুখ আর মুখের ভাষায় কোনো ছেদ ধরা পড়ে না।

সেই নিরবচ্ছিন্ন মুখ আর ভাষার সূত্রেই সম্প্রতিকালে পাহাড়ি মানুষদের এক স্বাতন্ত্রের দাবি পাহাড়, থেকে জলপাইগুড়ির এই সমতলে নেমে এসেছে। সে-দাবিকে কাগজে কাগজে গোখাল্যান্ডই বলা হচ্ছে। বটে যেহেতু পাকিস্তান, খালিস্তান, ঝাড়খণ্ড ইত্যাদির পর যে-কোনো স্বাতন্ত্রের দাবিকেই–স্তান বা ল্যান্ড দিয়ে বোঝানোনা সহজ, কিন্তু আসলে সেই স্বাতন্ত্রের দাবির ভেতর নিহিত আছে–পশ্চিমবঙ্গের এই পার্বত্য এলাকার প্রতি দীর্ঘ-দীর্ঘ দিনের উপেক্ষা, পশ্চিমবঙ্গের বৃহত্তর সমাজে পাহাড়ের মানুষদের যোগ্য ভূমিকার অভাব, নিজেদের মাতৃভাষার অস্বীকৃতি আর, সবচেয়ে বড় কথা, আহত আত্মসম্মানবোধ।

আত্মসম্মান একবার আঘাত পেলে তার নানা বিকার দেখা দিতে পারে যেমন তেমনি আবার সেই আহত আত্মসম্মানবোধ থেকেই আত্মপরিচয় লাভের সুযোগও খুলে যেতে পারে।

পাহাড়ের মানুষ যখন হিশেব দাখিল করে যে পার্বত্য এলাকা থেকে কত কাঠ, কত চা, নীচে যায় আর সেই বাবদ সরকার কত টাকা আয় করে অথচ পাহাড়ের মানুষজনের জন্যে মাথা পিছু কত কম ব্যয় করে–তখন তার ভেতর নিহিত থাকে রাজ্যের সরকারেরই ভাষা ও বচন।

রাজ্যের সরকারও ত প্রায় একই ভাষায় হিশেব দিয়েছে, পশ্চিমবঙ্গ থেকে কত টাকা সরকার, কেন্দ্রীয় সরকার, পায়, অথচ পশ্চিমবঙ্গকে কত কম ফিরিয়ে দেয়। রাজ্যের সরকার যখন মাতৃভাষার গৌরব প্রচার করে, মাতৃভাষাকে এ রাজ্যের সব কাজের ভাষা হিশেবে গড়ে তোলার প্রতিশ্রুতি স্মরণ করে, মাতৃভাষাকে উচ্চতম শিক্ষার বাহন করতে চায়, তখন, এই রাজ্যের একটি অঞ্চলের প্রধান যে-অধিবাসীদের ভাষা বাংলা নয়, তারা ত নিজের উপেক্ষিত ভাষার জন্যে দুঃখ বোধ করতেই পারে।

আর, এরকম উদ্ভট সময়ে পাহাড় অঞ্চল থেকে কথা ওঠে–তিস্তা ব্যারেজের আসল মতলব পাহাড়ের নদীর জল সমতলের জন্যে টেনে নেয়া।

একথার কোনো যুক্তি নেই কারণ পুরো পাহাড় এলাকা পেরিয়েই ত ব্যারেজের জায়গায় জল আসছে। একথা ইতিহাসের দিক থেকেও ঠিক নয় কারণ উত্তরবঙ্গে সবচেয়ে বেশি নদী নিয়ে প্রকল্প তৈরি হয়েছে দার্জিলিং জেলাতেই। একথা পাহাড়ের স্বার্থেও ঠিক নয় কারণ তিস্তা প্রকল্পে ত পাহাড়ি অঞ্চলও উপকৃত হবে।

কিন্তু কথাটা রাজনীতির দিক থেকে বড় বেশি লাগসই কথা।

চোখের সামনে দেখা যাচ্ছে, নীচে তিস্তার জলকে এক জায়গায় আটকে, তিস্তাকে একটা মূলখাতে বইয়ে দেয়ার কাজ চলছে, কাজ এগচ্ছে। দেখতে দেখতে ফরেস্টের ভেতর, এক নির্জন জায়গার চেহারা বদলে গেল সেই কাজের বেগে। দেখতে-দেখতে তিস্তার বুকে অন্ধকার রাত্রিতে আলো জ্বলে উঠল–রাতেও কাজ চলছে। সেদিকে আঙুল দেখিয়ে বলা যায়–ঐ দেখো, তিস্তা ব্যারেজের কাজ চলছে; তিস্তা ত পাহাড়ের নদী, কালিম্পঙের নদী, আমাদের নদী; কিন্তু এই যে আমাদের নদী সে যতক্ষণ পাহাড়ের ভেতর বয়ে যাচ্ছে ততক্ষণ তার দিকে রাজ্য সরকারের নজর নেই; এমন-কি সেই ইংরেজরা তিস্তার ওপর যেকটা সঁকো পাহাড়ে তৈরি করেছিল তারপর দেশী সরকার একটি কোও তৈরি করে নি; অথচ দেখো, নীচে, সমতলে কত বড় তিস্তা ব্রিজ তৈরি হল; ওরা আমাদের নদীও লুটে নিচ্ছে; আমরা এ হতে দেব না; তিস্তা ব্যারেজ ভাঙতে হবে।

এই সব যুক্তি বড় তাড়াতাড়ি লোকের মনে ধরে। বঞ্চিত মানুষ বড় তাড়াতাড়ি হিংসুটে হয়ে উঠতে চায়, তাতে তার মনে একটা সান্ত্বনা অন্তত পায়। আর, চোখের সামনে গড়ে ওঠা একটা জিনিশকে ভাঙার আহ্বান দিলে লড়াইটা একটা প্রত্যক্ষতা পায়। তাই পাহাড় থেকে পাহাড়ি মানুষের আওয়াজ উঠেছে–তিস্তা ব্যারেজ ভাঙতে হবে। সে আওয়াজ হাজার-হাজার বছরের প্রাচীন রাস্তা বেয়ে জলপাইগুড়ির সমতলে যে-পাহাড়ি মানুষ আছে তাদেরও মুখে উঠে এল–তিস্তা ব্যারেজ ভাঙতে হবে।

উত্তরখণ্ড, কামতাপুর, গোর্খাল্যান্ড ও পুরনো চরের নমশূদ্রদের সংগঠন–এই এতগুলো আন্দোলনের বিরোধিতার সামনে সরকার তিস্তা ব্যারেজের কাজের গতি বাড়িয়ে দিল। প্রথমত, এই এতগুলো বিরোধিতার মধ্যে কোনো ঐক্য নেই। প্রত্যেকেরই আলাদা-আলাদা কারণ আছে এবং সে কারণগুলি পরস্পরের বিরোধী। উত্তরখণ্ড চায় ভাটিয়া তাড়াতে। নমশূদ্ররা চায় উপযুক্ত পুনর্বাসন। উত্তরখণ্ড চায় স্বতন্ত্র রাজ্য। কামতাপুর চায় আসামের একটা অংশের সঙ্গে মিলন। গোর্খাল্যান্ড চায় স্বাতন্ত্র-আলাদা রাজ্য হিশেবে হলেই ভাল হয়।

প্রতিপক্ষদের ঐক্যবদ্ধ হওয়া অসম্ভব, সুতরাং রাজ্য সরকার তার নিজের রাজনৈতিক শক্তিকে সংহত করতে পারে। বামফ্রন্টের ভেতরকার পার্টিগুলো ত আছেই, বাইরের পার্টির মধ্যে কংগ্রেস-এর পক্ষে রাজনীতিগত ভাবে এই সব দলের কোনোটিকে প্রকাশ্যে সমর্থন দেয়া অসম্ভব। সুতরাং. এই অভূতপূর্ব রাজনৈতিক ঐক্যের সঙ্গে তিস্তা ব্যারেজের আংশিক কাজ সম্পূর্ণ করে যদি উদ্বোধন ঘটানো যায়, তা হলে উত্তরবঙ্গের লোক হাতেনাতে প্রমাণ পাবে যে এই সরকার তাদের কথা কতটাই ভাবছে।

এরই সঙ্গে-সঙ্গে সরকার, দার্জিলিং ও জলপাইগুড়ি জেলার চা বাগানগুলিতে, যেখানে-যেখানে তাদের ইউনিয়ন আছে সেখান থেকে, প্রধানত পাহাড়ি মানুষদের একত্রিত করেছে। জলপাইগুড়ি-কোচবিহারে তাদের কৃষক সংগঠনগুলিকে প্রচারে নামিয়েছে। তারা রাজনীতির দিক থেকে অনেক সুসংহত। তারা পাহাড়ের মানুষজনের ও রাজবংশীদের মধ্যে প্রায় এক বছর ধরে বিচ্ছিন্নতাবাদ-এর বিরুদ্ধে প্রচার করে আসছে। এবং সংখ্যার দিক থেকে তারাই গরিষ্ঠ।

তাই, তিস্তা ব্যারেজের উদ্বোধন উপলক্ষে–উত্তরখণ্ড, কামতাপুর, গোর্খাল্যান্ডের দল আজ বিক্ষোভ করছে বটে কিন্তু সে-বিক্ষোভ তিস্তা ব্যারেজ পর্যন্ত পৌঁছবে না, পৌঁছতে দেওয়া হবে না। সরকারের দলগুলিও সারা জেলা থেকে মিছিল নিয়ে ব্যারেজে যাচ্ছে সমর্থন জানাতে। কেন্দ্রীয় সরকারের জলবিষয়ক রাষ্ট্রমন্ত্রী, রাজ্য সরকারের সেচমন্ত্রী, মুখ্যমন্ত্রী স্বয়ং আসছেন উদ্বোধন করতে। আর এরই ফলে ব্যারেজ ঘিরে, পুলিশ, সি-আর-পি, বিএসএফের পাকের পর পাক, পাকের পর পাক।

.

১৯৮.

নির্বাচন ও উদ্বোধন তিস্তা ব্যারেজের উদ্বোধন তাই একটা সরকারি প্রকল্পের উদ্বোধনমাত্র নয়, হয়ে উঠেছে একটা রাজনৈতিক ঘটনা।

সরকার ও সরকারের অন্তর্ভুক্ত দলগুলি পরিষ্কার শক্তিপরীক্ষায় নেমেছে। তারা এটা প্রমাণ করে দিতে চায় যে এই সব কামতাপুর, উত্তরখণ্ড, নমশূদ্র সমিতি, গোখাল্যান্ড ইত্যাদির কোনো রাজনৈতিক ভিত্তিই নেই। নেহাত, সরকারে পক্ষে এদের দমন করাটা একটা কৌশলগত প্রশ্ন, তাই, দু-পাঁচজন লোক এক হয়েই একটা স্তন বা ল্যান্ডের শ্লোগান দিতে পারে। তারা ত শ্লোগান দিয়েই খালাশ। সরকারের পক্ষে ত আর সব সময় তাদের জেলে ভরা সম্ভব নয়। জেলে ভরলে ত তাদের নেতা বানিয়ে দয়া হবে। আর-এক হয়, হাঠে-মাঠে যেখানেই তারা মিটিং-মিছিল করবে–সেখানেই পুলিশ দিয়ে মেরে ছাতু করে দেয়া। পুলিশের মারের অনেক সুফল আছে। কিন্তু মার দিতে বললে পুলিশ ত আর রয়ে-সয়ে মার দেবে না। তাতে যদি দু-একটা মারা যায়, তা হলে তাই নিয়ে সারা দেশে গোলমাল বাধবে। মারা না গেলেও, পুলিশের মারের খবর কাগজে-পত্রে এমন ফলাও হয়ে বেরবে যে আন্দোলন থামার বদলে চাগিয়ে উঠবে।

তার চাইতে বরং এরকম কর্মসূচিই ভাল। দীর্ঘদিন ধরে সরকারের দলগুলি প্রচার করেছে, নিজেদের কথা লোকজনকে বুঝিয়ে বলেছে, সরকারের দলগুলির নানা নেতা নানা জায়গায় নানা দফায় মিটিং করেছে। একই সঙ্গে তিস্তা ব্যারেজের পর্যায়ক্রমিক কাজের মধ্যে অদলবদল ঘটানো হয়েছে, চিফ ইনজিনিয়ার ও মন্ত্রীর সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রীর বৈঠক হয়েছে–এক বছরের মধ্যে উদ্বোধন করা হবে সাব্যস্ত হয়েছে। রাজ্য সরকার কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে এই নিয়ে কথা বলেছে। সরকারের দলগুলির প্রথমে ইচ্ছে ছিল প্রধানমন্ত্রীকে দিয়ে উদ্বোধন করানো। তা হলে কামতাপুর, উত্তরখণ্ড, নমশূদ্র সমিতি, গোর্খাল্যান্ডের পেছনে যে কংগ্রেসি জনসাধারণের সমর্থন আছে, তারা দ্বিধায় পড়বে। কারণ ঐ মঞ্চ থেকে প্রধানমন্ত্রীকে বিচ্ছিন্নতাবাদের বিরুদ্ধে বলতেই হবে। প্রধানমন্ত্রী ও মুখ্যমন্ত্রী রাজনীতিগত ভাবে একই কথা বললে, তার একটা অন্য ধরনের প্রভাব পড়বেই। কিন্তু এই প্রস্তাবে বাদ সাধেন রাজ্যের বড়বড় অফিসাররা দু-চারজন। তারা প্রথমে বলেছিলেন–এরকম সময়ে প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তার দায়িত্ব ও-রকম ভৌগোলিক অবস্থানে রাজ্য সরকারের পক্ষে পালন করা সম্ভব হবে না। বা, সে দায়িত্ব, নেয়া উচিত হবে না। আর, প্রধানমন্ত্রীকে দিয়ে উদ্বোধন করালে এই ঘটনা একটা জাতীয় গুরুত্ব পাবে। সেই গুরুত্বের কারণেই আন্দোলনকারীরা নতুন ভাবে উৎসাহিত হতে পারে। সেই সুবাদে তারা হয়ত সত্যি একটা সক্রিয় বিক্ষোভ দেখিয়ে বসতে পারে। বিশেষত, গোখারা। পরন্তু হাসিমারায় সেনাবাহিনীর এয়ারস্ট্রিপেই নামুন আর বাগডোগরা এয়ারপোর্টেই নামুন–প্রধানমন্ত্রীকে গাড়িতে করে এতটা পথ জঙ্গল ও পাহাড়ের মধ্য দিয়ে যেতে হবে, সেসব পাহাড় ও জঙ্গলের গাছে কোনো গোপন আততায়ীর লুকিয়ে থাকা অসম্ভব নয়।

কিন্তু প্রধানমন্ত্রী ত হ্যাঁলিকপ্টারে চড়ে একেবারে তিস্তা ব্যারেজের ওপরেই নামতে পারেন।

এতখানি আলোচনার পর দু-চার জন অফিসার তাদের আসল বক্তব্য পরস্পরের আড়ালে মুখ্যমন্ত্রীকে জানান–তিস্তা ব্যারেজের মত এত গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পের কৃতিত্বের ভাগ কেন্দ্রকে দেয়া রাজনীতিগত ভাবে ঠিক নাও হতে পারে। কারণ, প্রধানমন্ত্রী উদ্বোধন করলে তার ওপরই মিডিয়া নজর দেবে বেশি। এখন, বিশেষত নির্বাচনের যখন মাত্র কয়েক মাস বাকি, এরকম কিছু করা অনুচিত হবে।

নির্বাচনটা এসে যাচ্ছে বলেই, তিস্তা ব্যারেজের উদ্বোধন, সেই উদ্বোধন নিয়ে জনসমাবেশ, বিচ্ছিন্নতাবাদীদের আলাদা-আলাদা সমাবেশের মিলিত সংখ্যার চাইতেও বড় সমাবেশ করে সরকারের ও সরকারি দলগুলির প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা–এগুলো এতই জরুরি। সরকারি দলগুলি স্থির করেছে যে তিস্তা ব্যারেজ উদ্বোধন আসলে হবে নির্বাচনী অভিযানের শুরু। এই সমাবেশের শক্তিকে, তিস্তা ব্যারেজের সাফল্যকে এমন ভাবে সেদিন তুলে ধরতে হবে যে সেই ধাক্কায় সামনের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চলবে। উত্তরবঙ্গের মোট আসন সংখ্যা যদি সরকারি দলগুলি রাখতে পারে–দুটো-একটা সিটের অদলবদলের দুর্ঘটনা সত্ত্বেও–তা হলেই যথেষ্ট। আর, যদি সেই সিটের সংখ্যা দুটো-একটাও বাড়াতে পারে, তা হলে ত কথাই নেই। সেটা একমাত্র সম্ভব যদি সরকার ও সরকারি দলের রাজনৈতিক অভিযান তীব্র করে তুলে, কংগ্রেসের সঙ্গে এই সব বিচ্ছিন্নতাবাদীদের প্রকাশ্য বা অপ্রকাশ্য কোনো আপস-সমঝাওতা অসম্ভব করে তোলা যায়। নির্বাচনী কৌশলের দিক থেকে, এই সব উটকো দলগুলির ফলে, তা হলে, বামফ্রন্ট ও তার অন্তর্গত দলগুলির উপকারই হবে। কংগ্রেস-সমর্থক ভোট যদি সরকারি কংগ্রেস প্রার্থী ও এই সব উটকো দলের প্রার্থীদের মধ্যে ভাগ হয়ে যায়, তা হলে, বামফ্রন্ট গতবারের চাইতেও বেশি আসন পাবে–উত্তরবঙ্গে। সুতরাং, তিস্তা ব্যারেজ উদ্বোধন উপলক্ষে বামফ্রন্ট তার দলগুলির ও তার সরকারের সমস্ত শক্তি বিনিয়োগ করেছে।

কোথায় ভুটান সীমান্তের চা-বাগানের কোল-মুন্ডা সাঁওতাল শ্রমিক–সেই সাঁওতালপুর, কালচিনি, রাঙ্গালিবাজানা, রাজভাতখাওয়া থেকে তারা রাজবংশীদের সঙ্গে ট্রাকে-ট্রাকে মিছিল করে আসবে। একটা মস্ত বড় সুবিধে হয়েছে, চা-বাগানগুলি নিজেরাই ট্রাক দিয়েছে। অন্য দিকে জয়ন্তীর রাস্তা ও বিন্নাগুড়ি থেকে শুরু করে ঐ তল্লাটের সব উজাড় করে আনা হবে। ময়নাগুড়ি থেকে শুরু করে একদিকে লাটাগুড়ি পর্যন্ত লোকজন ত মিছিল করেই আসবে–তাদের ত ঘরের ব্যাপার। মাদারিহাট-বীরপাড়া-হাসিমারা থেকে ট্রাক আসবে ল্যাটারাল রোড ধরে। মেটেলি থেকে শুরু করে মেটেলির পেছন দিয়ে সেই মাইল-মাইল দূরের গরুবাথান রোডের চা-বাগানগুলির ভেতর থেকে নেপালি শ্রমিকদের খুব সংগঠিত ভাবে আনা হবে।

রাজবংশী বা মদেশিয়া জনসাধারণ জুটে যাবে, কিন্তু নেপালিদের সংগঠিত ভাবে নিয়ে না-এলে নিজে থেকে জুটে নাও যেতে পারে। ওদিককার পাহাড়ি চা বাগানগুলির আয়তন ছোট-ফলে নেপালি শ্রমিক থাকলেও সংখ্যা খুব বেশি নয়। সেই জন্যে সরকার ও সরকারি দলগুলি অন্য ব্যবস্থাও নিয়েছে। কয়েক বছর আগে ফরেস্টের পতিত জমি দখল করার জন্যে নেপালিরা প্রায় মিছিল করে এক-একটা ফরেস্টে ঢুকেছিল। তখন এ নিয়ে খুব হৈ-হৈও হয়েছিল। পরে, সরকার চুপ করে যায়–ভাবখানা যেন এদের জবরদখল মেনেই নিল। আসলে, ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টকে নির্দেশ দেয়া হয়, মাস তিন-চার পর থেকে নতুন গাছ লাগানোর কর্মসূচি হিশেবে জবরদখলকারীদের তারা তুলে দেবে। সব জায়গায় একসঙ্গে নয়। বড় জবরদখল কলোনিতে আগে নয়। এমনকি পর-পরও নয়। যেন জবরদখলকারীরা মনে করে যেন গোলমালে দরকার নেই বরং একই ফরেস্টের নতুন জায়গায় বসতি করা নিরাপদ। ফরেস্ট ডিপার্টমেন্ট দরকার হলে পুলিশের সক্রিয় সাহায্য নেবে। এই পদ্ধতিতে নতুন জবরদখল ঠেকানো গেছে, কিন্তু পুরনো জবরদখলকারীদের সব জায়গা থেকে তুলে দেয়া এখনো শেষ হয়নি। নির্বাচনের আগে একাজ আর করাও হবে না। এমন জবরদখলকারীর সংখ্যা এখনো কয়েক হাজার। ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের ও ফরেস্টের কনট্রাকটারদের অসংখ্য ট্রাকে এই জবরদখলকারীদের ব্যারেজে নিয়ে আসা হচ্ছে। তাদের আশা, সরকারকে সমর্থন করলে স্থায়ী বসবাসের পাট্টা মিলতে পারে।

সরকার ও সরকারি দলগুলি এই অভিযানে বিচ্ছিন্নতাবাদীরা যেন কোনো বিক্ষোভ প্রদর্শনের মত সাহসও না পায়।

.

১৯৯.

মাদারির মা জলুশে যায় কেন

কিন্তু যার জলুশ যেখানেই যাক, মাদারির মা জলুশে যায় কেন? মাদারি হাট থেকে জুলুশের খবর নিয়ে এসেছে বলেই ত আর মাদারির মা জলুশে যেতে পারে না? যে-জুলুশে লোক দরকার, লোক বাড়ানোর দরকার, সে-জলুশের মাতব্বরদেরও ত মাদারির মাকে মনে পড়বে না। এই এত-এত বাড়ি-টাড়ির মধ্যে মাথা গোজার একটা ঠাই জোগাড় করার ক্ষমতা যার নেই, এই এত ঘন এত বড় ফরেস্টের মধ্যে কোন এক জায়গায় কোনো ঝোরার পাশে যাকে একটা শ্যাওড়াঝোরা বানাতে হয়, তার কোনো জলুশ থাকে না। এক দিন জলুশে যাবার অর্থ ত তার কাছে একটি দিন না-খেয়ে থাকা। একটি দিন না-খেতে পাওয়া বা না-খেয়ে থাকা মাদারির মায়ের কাছে কোনো অদ্ভুত ব্যাপার নয়। এমনও নয় যে সে তার একটা পুরো দিন নষ্ট হওয়াটা মাপতে পারে হাজিরা কত নষ্ট হল তার হিশেব দিয়ে। পেটের খিদে বা শ্রমের পয়সা–এর কোনোটাই মাদারির মায়ের দিনযাপনের মাপ নয়। তাহলে তার দিন নষ্ট হল কি হল না সেটা মাপা যায় কী করে?

এই ফরেস্টে, এই শ্যাওরাঝোরায় তাকে প্রতিদিন, প্রতিটি দিন, নিজের খাবার জোগাড়ে বেরতে হয়–যেভাবে ফরেস্টের মুরগি বেরয়, পাখি বেরয়, বড় বড় জীবজন্তু–যেমন হাতি, গণ্ডার–এরাও, বরয়। আর, তার নিজের খাবারের পরিমাণটা ত ঠিক করা নেই যে সেইটুকু সংগ্রহ হয়ে গেলেই তার কাজ ফুরিয়ে যাবে। সারা দিন ফরেস্টের ভেতরে-ভেতরে তাকে ঘুরে বেড়াতে হয়–ঘুরে বেড়াতে হয় মাটিতে চোখ রেখেই। ফরেস্টের ভেতরে ত আর মাটি দেখা যায় না, শুধু বুনো লতা-পাতা আর ঘাস। কখনো সে-লতা-পাতা আর ঘাসে মানুষ ডুবে যেতে পারে, ঠেলে এগনো যায় না। কখনো আবার, ছোট-ছোট খোলা রাস্তা পাওয়া যায়। এসব ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের বানানো রাস্তা–জীবজন্তুদের যাতায়াতের সুবিধের জন্যে,, ভেতরের গাছ কেটে জমা রাখার সুবিধের জন্যে। এরকম বেশ মাঠের মত চওড়া বড় রাস্তাও ফরেস্টের ভেতরে-ভেতরে আছে। সেই সব রাস্তা দিয়ে ট্রাক ঢোকে, হাতির পালদেরও অভ্যেস হয়ে যায় এরকম রাস্তা দিয়ে হাঁটা। মাঝে-মাঝে আবার মাটির ছোট-ছোট ঢিবলি লবণ দিয়ে মুড়ে দেয়া হয়। জীবজন্তুরা এসে সেগুলো চাটে।

মাদারির মায়ের তাই দুটো জিনিসের কখনো অভাব হয় না–উনুন জ্বালাবার জন্যে শুকনো, পাতলা, ছোটখড়িকাঠের, আর লবণের। কিন্তু সেই শুকনো খড়িকাঠে আগুন দেবার জন্যে তার কাছে কোনো দেশলাই থাকে না, সেই আগুনের ওপর দেবার জন্যে একটা ভাঙা পাত্র তার কাছে আছে বটে কিন্তু সেই পাত্রের ভেতর দেয়ার কিছু থাকে না। এত নুন পেতে পারে মাদারির মা, কিন্তু নুন নিয়ে মাখবে এমন কিছু সে রোজ পায় কোথা থেকে?

সকাল থেকে ফরেস্টের ভেতর মাটির দিকে তাকিয়ে ঘুরে বেড়ানোরও ত একটা মানচিত্র আছে। বেশি বনবাদাড়ের মধ্যে ঢুকলে খোঁজা যায় না, জঙ্গল চারদিক থেকে এমন চেপে ধরে যে জলের মধ্যে শাস নেয়ার জন্যে যেমন নাক উঁচু করে রাখতে হয় তেমনি নাক উঁচু করে চলতে হয়। তা হলে আর মাটির দিকে তাকাবে কী করে? ঐ সব বনবাদাড়ের ভেতরই কিছু চট করে পেয়ে যাওয়ার আশা থাকেবনমুরগির ডিম, বা বনমুরগির ডিম থেকে বেরনো অথচ দৌড়তে না-শেখা ছোট ছানাই গোটা একটা, মেটে ইঁদুরের গর্তের ভেতর হাত ঢুকিয়ে ইঁদুরের ছোট-ছোট বাচ্চাও জুটে যেতে পারে। সুতরাং বনবাদাড়ের ভেতর না ঢুকে ত মাদারির মায়ের কোনো উপায় নেই। তার শরীরের অভ্যাসও কেমন এই বনবাদাড়ের সঙ্গে মানিয়ে গেছে। মুখটা একটু উঁচুতে রাখলেও সে ঠিক জঙ্গলের মাটি দেখতে পায়, দেখতে-দেখতে খুঁজতেও পারে। মাদারির মার চোখদুটো থুতনির নীচে থাকলে ভাল হত।

এটাই ত তার সারা দিনের কাজ। হাতে একটা শক্ত লাঠি থাকে, বেশ ভারী, শালগাছের ডাল–ভেঙে নেয়া। খুব খিদের সময় লাঠিটাকে তার ভার মনে হয়। তা ছাড়া ঐ লাঠিটাই ত অস্ত্র। লাঠিটার তলার দিকটায় একটা কোণ আছে। ঐ কোণটুকু রেখেই লাঠিটা ভাঙা হয়েছে। ফলে, লাঠির আওতায় যদি কোনো ছোট প্রাণী পড়ে যা মাদারির মার খাদ্য হতে পারে, তা হলে ঐ লাঠি নিশ্চিত তার ঘাড়ে গিয়ে পড়ে। কোনো-কোনো সময় চলতে-চলতেই লাঠিটাকে বর্শার মত বিধিয়ে দেয়–যেভাবে মাছ মারে। আর কোনো-কোনো সময় মুহূর্তে লাঠিটাকে মাথার ওপর তুলে এনে শরীরের সমস্ত জোর দিয়ে সেটাকে নামিয়ে নিয়ে আসেকুড়ুলের মত। সেই সমস্ত সময় মাদারির মায়ের পুরো শরীরটা + জেগে ওঠে। ফরেস্টের ঐ আবছায়ায়–শাল-সেগুন-খয়ের-অর্জুনের পরিপ্রেক্ষিতে মাদারির মাও যেন একটা গাছই হয়ে ওঠে এমনই তার হাত দুটো ঋজু উঠে যায় মাথার ওপরে আর খর নেমে আসে, যেন, ঝড়ে কোনো গাছ হঠাৎ প্রাণ পেয়েছে। সেই দাঁড়িয়ে ওঠায় আর নেমে আসায় মাদারির মার এই শরীর ক্ষোদিত হয়ে যায়, যে-শরীর শুধু শরীরের জোরেই বেঁচে আছে, যে-শরীর শুধু শরীরের জোরেই আটটা না-দশটা সন্তানের জন্ম দিয়েছে।

আসলে এই ফরেস্টে খুব ভাল সাপ পাওয়া যায়। সাপের মাংসে তেল খুব আর ঝলসে নিতে আগুনের তাপও লাগে কম। চার পেয়ে মুখ-উঁচু সাপ পেলে ত কথাই নেই–অমৃত। কিন্তু ছোটখাট সাপও ত নেহাত কম নেই। মাদারির মা বিষধর সাপ চেনে। তাই চোখের সামনে পিঁপড়ে না-ধরা কোনো টাটকা মরা খরগোশ বা ধেড়ে ইঁদুর পেলেও সে ঘেঁয় না, এমন-কি লাঠি দিয়ে উল্টেও দেখে না। ফরেস্টে যা মরে তাকে মাটির সঙ্গে মিশে যেতে দিতে হয়। মরা জীবজন্তু খেয়েই বেঁচে থাকে এমন পাখি-পোকামাকড়ও ত ফরেস্টে থাকে।

ট্রাকমোছা আর ঘোমশাইয়ের দোকানে কাপডিশধধায়া বাবদ মাদারি ত আজকাল ভাজ করা টাকাও আনে, মাঝে-মাঝেই, প্রায় এক হাট বাদে বাদে ত বটেই। মাদারির মা তাই কোনো-কোনো হাটে চাল কিনতে পারে–চা বাগানের যে-মজুররা রেশনের চাল এনে হাটে বেচে দিয়ে হাড়িয়া খেয়ে গান। গাইতে-গাইতে বাগানে ফিরে যায়, তাদের কাছ থেকে।

কিন্তু চাল কেনা যত সহজ, আগুন কেনা তত সহজ নয়। একটা আস্ত দেশলাই কেনা আর একটা আস্ত আগ্নেয়গিরি কেনা ত মাদারির মার কাছে একই কথা। চাল সে পেতে পারে, কিন্তু আগুন সে পাবে কোথায়?

মাদারির মাকে তার জন্যে কত কৌশল করতে হয়।

হাটে কোনো একটা জায়গায় সে চুপচাপ ঠেস দিয়ে থাকে। সাধারণত, একটা বড় গাছের তলায় ছোটখাট দু-তিনটে দোকান বসে। তৎসত্ত্বেও সেখানে, সেই গাছের গুঁড়িতে, মাদারির মায়ের ঠেস দেবার মত জায়গা বাকি থাকে। মাদারির মা সেখানে ঠেস দিয়ে বসে। বসেই থাকে। ঠিক বসা নয়, আধশোয়া হয়ে থাকে। ফরেস্টের ভেতর রোজ সারাদিন যে মুরগির মত সাবধানী, গুইসাপের মত নিভৃতচারী, গোখরোর মত কালান্তক, সে কিনা এখানে, এই হাটে তিনকাল-পেরনো এক বুড়ির মত শিথিল শরীর এলিয়ে দেয়।

মানুষের সঙ্গে মানুষের আত্মীয়তা তৈরি হয় বা ঘুচে যায় রহস্যময় সব কারণে। মানুষের সমাজ থেকে সরতে সরতে যে এখন ফরেস্টের ভেতর সেঁদিয়ে গেছে, সে এতক্ষণ একই গাছের গুঁড়িতে ঠেস দিয়ে আছে এই সুবাদে দোকানির আত্মীয় হয়ে যায় আর দোকানি, তার দিকে না-তাকিয়েই, একটা বিড়ি বাড়িয়ে দেয়–হাতটা পেছনে ছড়িয়ে। দেশলাইয়ের কাঠি জ্বালিয়ে নিজেরটা ধরিয়ে একটু কোমর বেঁকিয়ে মাদারির মারটাও ধরিয়ে দেয়। কাঠি নিবে গেলে, নিজের জ্বালানো বিড়িটাই এগিয়ে দেয়। এরকম বার-দুই বিড়ি খেয়ে মাদারির মা তার কাছ থেকে দেশলাইয়ের বাক্সের গায়ে বারুদের ভাঙা একটা টুকরো আর দুটো কাঠি চেয়ে নিতে পারে। এরকম চাওয়ার ফলে পঁচ-সাতটা কাঠিসমেত একটা আস্ত বাক্সই কেউ-কেউ দিলে তখন দুশ্চিন্তা আসে এই কাঠিগুলো সতেজ থাকতে-থাকতে ব্যবহার করার সুযোগ পাবে ত? কেউ তার প্রথম বিড়িটা লাইটারে জ্বালিয়ে দিলে মাদারির মা তার ঠেস দেয়ার গাছ বদলায়। আর, নেহাত যদি দেশলাই না পায় সেদিন মাদারি ঘোমশাইয়ের দোকান থেকে বেশ খানিকটা আগুন নিয়ে যায়।

.

২০০.

মাদারি কী করে আগুন নিয়ে যায়

 এই আগুন নিয়ে যাওয়ার বিশেষ একটা পদ্ধতি আছে মাদারির।

কলাপাতা বা কচুপাতায় সে ছোট-ছোট কয়লার কুচি প্রথমে ছড়িয়ে দেয়। তারপর কয়লার কুচি দিয়ে গতি মত বানায়। তার ওপর গনগনে দুটো কয়লা বসিয়ে, আবার গুড় কয়লায় ঢেকে কুচো কয়লা ছড়িয়ে দেয়। দুই হাতে সেই কলাপাতার কয়েকটি টুকরো বা কচুপাতার ওপরে আগুন নিয়ে তারা মা-ছেলে হাটখোলা থেকে শ্যাওড়াঝোরার দিকে রওনা হয়।

এটা তাকে করতে হয় ঘোমশাই দোকান ছেড়ে চলে যাবার পরে অর্থাৎ হাট ভেঙে গেলেই শুধু নয়, হাট খালি হয়ে গেল। বাহাদুর উনুনের আঁচ ফেলে দেয়। তারপর, বাহাদুরই একটু সাহায্য করে গনগনে কয়লাটা বাছতে।

কিন্তু আগুনটা এমন দুই হাতের পাজায় এতগুলো মাইল নিয়ে যাওয়া বেশ কষ্টকর। হাত ধরে আসে–সেটা বড় কথা নয়। আসলে বিপদ আগুনটাকে বাঁচিয়ে রাখা। বৃষ্টিবাদল হলে ত গেল। তবু কচুপাতার ঢাকনার নীচে আগুনটাকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা চলে। যদি একটু বাতাস থাকে, বা এমনকি পাশ দিয়ে একটা ট্রাক চলে যাওয়ার ফলেও যদি বাতাস লাগে, কয়লার কুচি উড়ে যায়, গায়ে পড়ে, চোখে লাগে, আগুন বেরিয়ে পড়ে। তাই তখন মাদারিকে বাতাসের দিকে পিঠ ফেরাতে হয়, বা, সামনের ট্রাকের দিকে। ট্রাক চলে গেলে আবার সোজা হওয়া যায় কিন্তু বাতাসের দিকে পিঠ ফেরালে ত সেই সারা রাস্তাটাই আগুন বাঁচাবার জন্যে পেছন ফিরে হাঁটতে হয়। তাতে সময় অনেক বেশি লাগে। এক ঘুম পাওয়া ছাড়া তাতে আর মাদারির আপত্তি কী? তার কাছে ঘরে গিয়ে আগুনটাকে বাঁচানোর কাজ যেমন কঠিন, রাস্তাতে আগুনটাকে বাঁচিয়ে রাখার কাজও ততটাই কঠিন। এরকম করে বয়ে নিয়ে যাওয়া আগুনের পরিণতি নানারকম হতে পারে–নিভে ছাই হয়ে যাওয়া ছাড়াও। বাতাসের কী ট্রাকের আসা-যাওয়ায় ওপরের কয়লায় তাড়াতাড়ি আগুন লেগে যেতে পারে। তাড়াতাড়ি আগুন লাগা মানেই তাড়াতাড়ি ছাই হওয়া। আর আগুন যদি একবার ভেতর থেকে এরকম ওপরে উঠে আসে, তা হলে জ্বলন্ত কুচি কয়লা আর গুড়ো কয়লা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ওড়া শুরু করে, তখন ফেলে দেয়া ছাড়া কোনো উপায় থাকে না। আর-এক বিপদ হতে পারে, ঠিক এর বিপরীত পদ্ধতিতে। আগুন তাড়াতাড়ি নীচের দিকে নেমে গেল আর নীচের গুঁড়ো কয়লা আর কুচি কয়লায় লেগে আগুন ত পাতার ওপরে চলে আসে। তখন অবিশ্যি মাদারি তার মাকে বলে, রাস্তার ধার থেকে কিছু পাতা ছিঁড়ে আনতে। নীচে পাতার পলেস্তারা আরো বাড়িয়ে দিলে হাতে আগুনের আঁচ লাগে না।

যে-ন্যাশন্যাল হাইওয়ের ওপর দিয়ে এই দেশ ভারতবর্ষের কোনো এক রাজ্য থেকে আর-এক রাজ্যে মাল নিয়ে দিনরাত ট্রাক চলে–কত নতুন-নতুন সঁকো পেরিয়ে, কত নতুন-নতুন রাস্তা দিয়ে পথ ছোট করে করে, কত নতুন-নতুন পদ্ধতিতে গতি বাড়িয়ে বাড়িয়ে–সেই ন্যাশনাল হাইওয়ের স্বাদেশিক বিস্তারের অতি ক্ষুদ্র বা আণবিক এক ভগ্নাংশে পূর্ব গোলার্ধের এই রাত্রির কয়েকটি মাত্র ঘণ্টা জুড়ে এক মা তার সন্তানের সঙ্গে আগুন দিয়ে পথ হাঁটে, বা এক অগ্নিবহ বালক মায়ের সঙ্গে তার অরণ্যনিবাসে ফিরে চলে। কাল ন্যাশন্যাল হাইওয়ে কালই থাকে কিন্তু চারপাশের অন্ধকারে সেই রাস্তাটা আর দেখা যায় না, কেবল পায়ের তলায় অনুভব করা যায়-জলের ভেতর দিয়ে হাঁটলে যেমন জলের ভেতরের মাটিটুকু শুধু পা দিয়ে অনুভব করতে হয়। মাটিতে এমন অন্ধকার থাকলে সাধারণত আকাশের নক্ষত্রের দীপ্তি বেড়ে যায়, এতই বেড়ে যায় যে মনে হয়, নক্ষত্রের আলো পৃথিবীর মাটি পর্যন্ত পৌঁছতে পারে। এক্ষেত্রে, সে সুবিধাটাও থাকে না। কারণ ভারতবর্ষের গভীরতম এক অরণ্য দিয়ে ভারতবর্ষের জাতীয়– এই পথ গেছে। ঠিক সেই পথটুকুতেই এই রাত্রিতে মা ও ছেলে হাঁটছে। দুপাশের আকাশ-ঢাকা গাছ থেকে অন্ধকার পড়ছে। সেই গাছের পাতার ঘন বুনটের ভেতর দিয়ে আকাশটাকে কোথাও কোথাও আলোয়-আলোয় বুটিদার দেখায় বটে কিন্তু সে যেন নদীর অন্য পারের মত, যার বাস্তবতার সঙ্গে এই বাস্তবতার কোনো সম্পর্ক নেই, একেবারে কোনো সম্পর্কই নেই। বরং এই সময় আকাশের দিকে দু-একবার চোখ তুলে তাকানো বিপজ্জনক। পরে, চোখ নামালে এই অন্ধকারে আর-কিছুই দেখা যায় না। রাস্তার দুপাশ থেকে, ফরেস্টের গাছ-গাছালির ভেতর থেকে যে-অন্ধকার আড়াআড়ি উঠে আসছে সেটা বরং এদের কাছে কিছুটা পরিচিত। এই নিশ্চিদ্র কালর মধ্যে এই মাদারির হাতে শুধু কমলা রঙের একটা চাপা আগুন। এই আগুনটা যদি শ্যাওড়াঝোরা পর্যন্ত পৌঁছয় তা হলে মাদারির মায়ের আনা • শুকনো খড়িকাঠ লেলিহান জ্বলে উঠবে আর ঘরের সেই একটি মাত্র পাত্রটি নিয়ে মাদারি ঝোরা থেকে জল নিয়ে আসবে। সেই আগুনে, ধোয়ায়, চাল সেদ্ধ হওয়ার এক আদিম মানবিক গন্ধ ঐ আরণ্যক রাত্রিকে হঠাৎ কোমল করে তুলবে, অন্ধকার তত আর অন্ধকার থাকবে না। সেই আগুনের শিখার পাশে ছেলের সঙ্গে মায়ের আর-এক সংলাপ শুরু হতে পারে। কিন্তু সেই আর-এক সংলাপের কাছে পৌঁছনোর জন্যে এই রাস্তার কয়েক মাইল তাদের দুজনের সহযাত্রিক নীরবতা এই রকম নানা কথা দিয়ে দিয়েই খচিত হতে থাকে, নইলে, তাদের নীরবতাও ত প্রাকৃতিক হয়ে যেত।

মাই গে।

 হয়

হে-এ মাদারি

হয়।

মাই গে

হয়,

মুই ভুলি গেইছু রে–

কী ভুলিছিস?

 লড্ডু আর নিমকি–

কায় দিছে তোক?

ঘোষমশাই কইছিল দোকান বন্ধ করিবার আগত একখান লাড়ু আর একখান নিমকি নিবার তানে। কইছিল। মুই নিবার ভুলি গেইছু।

 কেনে? ভুলি গেইছিস কেনে?

তোর এই আগুনটার তানে—

আগুনটার তানে লাড্ড খোয়র কথা ভুলি গেছিস? লাড্ডু ত মিঠা লাগে।

হয়। খুব মিঠা। তক খোয়াম মুই সামনের হাটবার।

সব হাটবারত তক লাড়ু দেয়, খোয়ার তানে?

না দেয়, শুধু একখান হাটত দেয়। তোক খোয়ব সামনের হাটবার।

 মাদারির মা তার জিভের স্বাদের স্মৃতিতে মিষ্টি কাকে বলে তার এক সন্ধান চালায়।

মাই গে

হয়।

বাহাদুরদাখান কইছে মোক চা বানিবার শিখাবে।

কী হবে তার বাদে?

মোক চাকরি দিবে, চায়ের দোকানত—

 ত শিখায় না কেনে?

টেবিলখান এ্যালায়ও মোর মাথার উপরত।

মাদারির মা সেই অন্ধকারে ছেলের দৈর্ঘ্যের মাপ যেন প্রথম পায়। টেবিলের উচ্চতা পর্যন্ত গেলে মাদারি এখানে থাকবে না। মাদারির দাদারা, মাদারির মায়ের আরো আট-না দশ সন্তান কেউ থাকেনি। থাকে না। তা হলে মাদারির মা জলুশে যাবে কেন?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *