৫.৪ শ্রীদেবী ও বাঘারু

১৮১. শ্রীদেবী ও বাঘারু

বাঘারুকে নিয়ে দলটা প্যান্ডেলের প্রায় মাঝামাঝি চলে আসে। আরো অনেকে অনেক জায়গাতেই নাচছিল বলে এই দলটার এগিয়ে আসায় তেমন কোনো বিশৃঙ্খলাও দেখা যায় না, যেন এদের এতটা চলে আসার জন্যে জায়গা প্রস্তুতই ছিল।

কিন্তু বাঘারু কী করবে বুঝে উঠতে পারে না। এই দলটা ত তাকে টেনে হিঁচড়ে নিজেদের মাঝখানে নিয়ে আসে নি। এমনকি দলটা যেন জানেও না বাঘারু তাদের মধ্যে আছে–এমনই তাদের মাতাল পা ফেলা। তারা কোনো চিৎকার চেঁচামেচিও করছে না। বাঘারু তার শরীর নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে একটা খুঁটির মত আর সেই খুঁটি ঘিরে এই ছেলেরা ঘুরে-ঘুরে নেচে চলেছে।

বাঘারু দেখে, মঞ্চে তখন চিকুরের নাখান (বিদ্যুতের মত) আলো চলকাছে। আর সেই চিকুরের আলোত বেটিছোয়াখান (মেয়ে) শুই পড়িছে। শুই পড়ি উমরার শরীলখান আথাল-পাথাল করিবার ধইচছে। আথাল-পাথাল করিছে আর বেটিছোয়াখান ঘুরপাক খাছে। ঘুরপাক খাছে আর উমরার তলপেটখান মাটিথে উপরত উঠি আসিবার চাছে। থাকা-থাকা ট্রি-ইম, থাকা থাকা ট্রি-ইম। মাইকের চাপা শীৎকার দ্রুততায় এখন এমন চরমে উঠেছে যে বোঝা যায় স্বরটা যে-কোনো মুহূর্তে থেমে যেতে পারে। মঞ্চে শ্রীদেবী তখন শুয়ে-শুয়ে ঘুরপাক খাচ্ছেন। তার তলপেটের ওপর আলোর ঝিলিক–সেই তলপেট সঙ্গমের কাল্পনিক আশ্লেষে উঠছে-পড়ছে। যে-কোনো মুহূর্তে ঐ শরীর থেমে যেতে পারে। থেমে যেতে পারে, কিন্তু যাচ্ছে না। ঐ মাইকের শীৎকারও থেমে যেতে পারে। ফলে প্যান্ডেলের ভেতরের সেই রাজবংশী-মদেশিয়া-নেপালি ও বর্ণহিন্দু বাঙালি ভিড়ের কিছু অংশ উত্তেজনার চরম বিন্দুতে বসে বসে শক্ত হয়ে যাচ্ছে, আর-এক অংশ নাচকে উত্তাল করে দিচ্ছে।

বাঘারু ঐখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শ্রীদেবীকে দেখতে-দেখতে ভুলে যায় তাকে খুঁটির মত দাঁড় করিয়ে রেখে একদল ছেলে নাচছে–যেন ঐখানে দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে তার শ্রীদেবীর ঐ আক্ষেপ দেখারই কথা। বাঘারু ও-রকম দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তাকে ঘিরে ছেলেদের নাচ ভেদ করে মঞ্চে শ্রীদেবীকেই যেন শুধু দেখে। দেখে, বেটিছোয়াখান ক্যানং তলপ্যাটখান উঠাছে-নামাছে, উঠাছে-নামাছে। এই ভঙ্গির একটা অর্থ যেন বাঘারুর আপাদমস্তক প্রায় নগ্ন রাজবংশী শরীরে ঢুকতে চায় কিন্তু মঞ্চের ঐ শরীরের ওপর আলোর খেলা, মাইকে আরো চাপা ও আরো দ্রুত শীৎকার আর চারপাশে নীরব শরীরমন্থন সেই অর্থটা তার শরীরে সঞ্চারিত হতে বাধা দিচ্ছে। তাই বাঘারু মেয়েটির শরীরের আর্তনাদ দেখতে-দেখতে কেমন বিমূঢ় বোধ করতে থাকে। সেই বিমূঢ়তায় সে তার শরীরের ভেতর যেন এমন-কি ঐ মঞ্চের আহ্বানও বোধ করে ফেলতে চায়। বাঘারুর ঐ শালপ্রাংশু রাজবংশী শরীরের নগ্নতার সঙ্গে মঞ্চে বম্বে ফিল্মের যৌন প্রতীক নায়িকা শ্রীদেবীর জ্যান্ত শরীরের একটা অর্থগত সংযোগ প্রতিষ্ঠা হওয়ার মুহূর্তে গানটা হঠাৎ থেমে যায়, অনেকক্ষণ আগেও যেমন থামতে পারত। শ্রীদেবী এতক্ষণে মঞ্চের ওপর সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে, হেঁটে মঞ্চ থেকে চলে যান, মঞ্চের আলো জ্বলে ওঠে, একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে দর্শকরা উত্তেজনা মোচন করে অথচ বাঘারু যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকে। এখন মঞ্চের আলোতে ও প্যান্ডেলের বাইরে থেকে আসা আলোতে দেখা যায়-বাঘারু প্যান্ডেলে ঐ লক্ষ লোকের মাঝখানে তার উদোম শরীর নিয়ে দাঁড়িয়ে, পরনের নেংটিটুকু যেন থেকেও নেই। বাঘারুই যখন দৃশ্য হয়ে ওঠে, তখন অনেকে তাকে দেখেও দেখে না। কিন্তু দেখেও না দেখে থাকার সময়টা পেরিয়ে যায়–সকলে বসে আছে যেখানে সেখানে নিজের নগ্নতা নিয়ে বাঘারু এমনই বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে। যে-কোনো মুহূর্তে পরের কর্মসূচি ঘোষিত হবে, তখন বাঘারু অবান্তর হয়ে যাবে–এই সময়টাও পার হয়ে যায়। তখন শ্রীদেবীহীন মঞ্চের শূন্যতাটাও যেন বাঘারুর এই নির্লজ্জ নগ্নতায় অপমানিত হতে শুরু করে। এই মাত্র যে-নাচটি শেষ হল, সেনাচে ত পুরো প্যান্ডেলটাই মঞ্চ হয়ে উঠেছিল। বাঘারুর ঐ নগ্নতা যেন তাই দর্শকদেরও অপমান। বাঘারু নিজের ঐ নগ্নতা নিয়ে মঞ্চের দিকে এমনই অনড়, যেন ঐ দাঁড়িয়ে থাকাটাই একটা বিদ্রোহ। শেষ পর্যন্ত যখন মনে হতে শুরু করে যে ঐ নির্লজ্জ রাজবংশী নগ্নতার জন্যেই মঞ্চটা এমন শূন্য পড়ে আছে, শ্রীদেবী ঢুকছেন না, যেন ঐ নগ্নতার সামনে শ্রীদেবীর পক্ষে মঞ্চে প্রবেশ সম্ভব নয়–তখন ডি-এস-পি সাহেব পেছন থেকে এসে বাঘারুর কাঁধে দূর থেকেই তার ব্যাটনটা ছুঁইয়ে বলেন, বসসা, বসো। কিন্তু বাঘারু সে-ইঙ্গিতও না বোঝয় ডি-এস-পি সাহেবকে অগত্যা হাত ধরে বাঘারুকে টেনে আনতে হয়, পেছনে। টুপি থেকে বুট পর্যন্ত পুরো ইউনিফর্মের ডি-এস-পি সাহেবের পাশে-পাশে হাঁটতে হাঁটতে ঐ চিড়ের ভেতর দিয়ে বাঘারু প্যান্ডেলের বাইরে চলে যায়।

মাইকে শোনা যায়, এইবার আজকের সন্ধ্যার শেষ অনুষ্ঠান পরিবেশন করবেন বম্বের প্রখ্যাত চিত্রতারকা শ্রীদেবী। তার সঙ্গে-সঙ্গে আমাদের উত্তরখণ্ড সম্মিলনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও শেষ হবে। আগামীকাল সকালে জল্পেশ্বর শিবমন্দির অভিযান। আপনাদের কাছে সনির্বন্ধ অনুরোধ যে আপনারা এই শোভাযাত্রায় দলেদলে যোগ দিয়ে উত্তরবঙ্গের পবিত্রতম তীর্থ জমেশ্বর মন্দিরে যাবেন ও জলের শিবের পূজা দিবেন। আমাদের অনুরোধে শ্রীদেবী তার এই শেষ অনুষ্ঠানে নাগিনা সিনেমার শেষ দৃশ্যে তিনি শিবলিঙ্গের সামনে যে-নৃত্য পরিবেষন, করেছিলেন সেই নৃত্যটি পরিবেষন করবেন। পুলিশ কর্তৃপক্ষ অনুরোধ করেছেন যে-ভাবে আপনারা প্যান্ডেলে ঢুকেছেন সেভাবেই লাইন করে অনুষ্ঠানের শেষে বাইরে যাবেন।

ঘোষণার সঙ্গে-সঙ্গেই মাইকে গান বেজে ওঠে, ম্যায় তেরি দুষমন, দুষমন তু মেরা। ম্যায় হ্যায় নাগিন, তু সাপেরা। গানের মুখটা দুবার হয়ে যাওয়ার পর শ্রীদেবী মঞ্চে ঢোকেন। এখন মঞ্চভর্তি আলো। শ্রীদেবীর পরনে ফিল্মের সেই সাপের খোলশের মত টাইট পোশাক নেই–একটা আলখাল্লা-মত পরা, তাতে খোপ-খোপ ঘর আঁকা। শ্রীদেবী ফিল্মের নাচটাও পুরো নাচেন না, বরং একটু ভজনের মত নাচতে থাকেন। মাঝে-মাঝে হাততালি দিয়ে ওঠেন। মাঝে-মাঝে দুলে-দুলে গান। এই গানটির সুরের ভেতরও সেই উপাদান ছিল। মঞ্চে কিছুক্ষণ এ রকম ঘোরাফেরা করার পর শ্রীদেবী সামনের দিকে মাঝামাঝি বসেই পড়েন–জোড়াসনে, তারপর মাথা দুলিয়ে গানের তালে-তালে শুধু হাততালিই দিয়ে যান। সেই সময়ই একটি মেয়ে মাথায় একটা থালা নিয়ে ঢোকে। শ্রীদেবীর সামনে হাঁটু গেড়ে বসে সে-থালাটা খুব ভক্তিভরে তার সামনে নামিয়ে রাখে। তখন দেখা যায়, থালাটির ওপর একটি বড় শিবলিঙ্গ, একটি সাপ শিবলিঙ্গের ওপর ফনা মেলে আছে। সম্ভবত টিন বা ও-রকম কিছু কেটে করা। নগিনা ফিল্মটিতেও শিবলিঙ্গ ছিল। মেয়েটি আবার প্রণাম করে উঠে যেতেই ধীর গম্ভীর একটি আওয়াজ ওঠে, জয় বাবা জল্পেশ্বর। দর্শকরা করজোড় কপালে তোলে। এর মধ্যেও গানটা হয়ে যেতে থাকে–ম্যায় তেরি দুষমন দুষমন তু মেরা। ম্যায় হ্যায় নাগিন তু, সাপেরা। সেই গানের তালে-তালে শিবলিঙ্গের সামনে শ্রীদেবী হাততালি দিয়ে যান, চোখ বুজে, মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে, যেন ঐ গানটি জল্পেশ্বরের ভজন–এরকম ভাবে দর্শকরাও চোখ বুজে হাততালি দিয়ে যেতে থাকে। কিন্তু গানটার সঙ্গে তেমন কেউ গলা মেলাতে পারে না। গানের নিয়মে গান শেষ হয়। কিন্তু শ্রীদেবী মঞ্চ ছেড়ে যান না। তিনি শিবলিঙ্গের সামনে নত হয়ে প্রণাম করেন, তারপর উঠে দাঁড়ান। একটু কৃতজ্ঞ হাসি ঠোঁটে রেখে শ্রীদেবী দাঁড়িয়ে বায়ে, ডাইনে, সামনে, আবার বায়ে, আবার ডাইনে নমস্কার করেন। দর্শকরা তুমুল হাততালি দিয়ে ওঠে। শ্রীদেবী আবার ঘুরে-ঘুরে নমস্কার করেন। দর্শকরা আবার হাততালি দিতে-দিতে উঠে দাঁড়ায়। শ্রীদেবী এবার নত হয়ে শিবলিঙ্গটা মাথায় তুলে উইঙের দিকে হাঁটা দিতেই জয় বাবা জল্পেশ্বর ধ্বনিতে প্যান্ডেল ভরে যায়। শূন্য, আলোকিত মঞ্চের ওপর পর্দা নেমে আসে।

.

১৮২. জল্পেশ অভিযানের কিছু অসুবিধে

পরদিন শুক্রবার সকালে জল্পেশ অভিযানের জন্যে জনসমাবেশ শুরু হয়ে যায় সকাল সাতটা নাগাদ। বৃহস্পতিবার রাতে শ্রীদেবীর অনুষ্ঠান শুনতে স্থানীয় যারা এসেছিল তাদের একটা অংশ এই দুটো কার্যসূচিই মাথায় রেখে এসেছিল, বা, এই দুটো কাৰ্যসূচির জন্যেই তাদের অনেককে আনা হয়েছিল। তারা অনুষ্ঠানের শেষে বাইরে এসে খাওয়া-দাওয়া সেরে আবার ঐ প্যান্ডেলে গিয়েই ঘুমিয়ে থাকে। সকালে উঠে এখন জমা হচ্ছে জল্পেশ অভিযানের জন্যে।

জল্পেশ অভিযানের জন্যে যারা থেকে গেছে তাদের প্রায় সবাই উত্তরখণ্ডের নেতাদের প্রভাবিত এলাকার লোকজন। উত্তরখণ্ডের নেতাদের প্রায় প্রত্যেকেই কিছু-কিছু জমি-জিরেতের মালিককারোকারো ত এক-এক অঞ্চলে জোতদার বলে প্রতিষ্ঠাই আছে। বিশেষত গয়ানাথ জোতদার ও তার জামাই আসিন্দির উত্তরখণ্ডে যোগ দেয়ায় সম্মিলনের ঠিক মুখেমুখে ডুয়ার্সে উত্তরখণ্ডীদের প্রতিপত্তি বেশ বেড়ে যায়। কিন্তু ফালাকাটা, আলিপুরদুয়ার, সাঁওতালপুর ব কোচবিহার পর্যন্ত নানা জায়গাতে উত্তরখণ্ডের বড় বড় নেতারা যতই থাকুন, সেখান থেকে ত তার জলেশ অভিযানের জন্যে বেশি লোক নিয়ে আসা সম্ভব নয়। নকশালবাড়ির সম্পৎ রায় ত বড় নেতা, কিন্তু জল্পেশ অভিযানের জন্যে নকশালবাড়ি থেকে সব মিলিয়ে জনা পঁচিশ-তিরিশের বেশি আসে নি। তাও আসত না–যদি কাল শ্রীদেবীর অনুষ্ঠান না থাকত।

এটা অবিশ্যি উত্তরখণ্ড নেতাদের খানিকটা জানাই ছিল। তাই তারা বিশেষ জোর দিয়েছিলেন ময়নাগুড়ি, বাকালি, পদমতী, জোড়পাকুড়ি, বানেশ এই সব জায়গা থেকে এই অভিযানের লোকসংগ্রহ করতে। সাংগঠনিক দিক থেকেও ময়নাগুড়িই উত্তরখণ্ড আন্দোলনের কেন্দ্র। ময়নাগুড়িকে কেন্দ্র করে লোকসংগ্রহ করা তাই সহজও।

প্রচারের সময়ও এই কথাই বেশি বলা হয়েছিল–শ্রীদেবীর নাচ দেখি প্যান্ডেলত থাকি যাবেন, জল্পেশ করি ঘরত ঘুরিবেন। কথাটা ধরেওছিল ভাল। এই পাশাপাশি এলাকার লোকজনের পক্ষে আজ বাড়ি থেকে বেরিয়ে কাল দুপুরে ফিরে আসা বেশ লোভনীয়, বিশেষত, ময়নাগুড়িতে থাকার জন্যে প্যান্ডেলটা যখন পাওয়াই যাচ্ছে।

শুধু যে সুবিধে তাই নয়। যদি পরদিন জল্পেশ অভিযান নাও হত তা হলেও এরা সবাই ত আর রাত্রিতেই ফিরতে পারত না রাতটুকু তাদের ময়নাগুড়িতে কাটাতেই হত। জল্পেশ অভিযানের কর্মসূচি ঘোষিত থাকায়–প্যান্ডেলটাতে রাত কাটানো, তারপর দল বেঁধে জল্পেশে যাওয়া এটা ব্যবস্থার মধ্যেই চলে আসে। কে আর এখানে এমন আছে যে জল্পেশ যাওয়ার সুযোগ পেলে যাবে না।

উত্তরখণ্ডের নেতারা চেষ্টা করলে যে দূর-দূর জায়গা থেকেও কিছু-কিছু লোক আনতে পারতেন না, তা নয়। প্রথম দিকে তারা হয়ত সেরকম ভেবেও থাকবেন। কিন্তু গয়ানাথ জোতদার যোগ দেয়ার পর তিস্তা ব্যারেজ উদ্বোধনের দিন বিক্ষোভ মিছিল সংগঠনের দায়দায়িত্ব অনেক বেড়ে যায়। জল্পেশ অভিযানের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল-উত্তরবঙ্গের প্রাচীনতম ও পবিত্রতম তীর্থের নাম আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত করে উত্তরখণ্ডের দিকে সবাইকে টেনে আনা। সেই প্রচারের জন্যে শ্রীদেবীকেও আনা। যদিও শ্রীদেবীকে আনাটা ব্যবসার মত করেই হয়েছে কিন্তু উত্তরখণ্ড সম্মিলনের সঙ্গে যুক্ত করেই ত তাকে আনা। মাসখানেকের মাথায় পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী তিস্তা ব্যারেজ যখন উদ্বোধন করবেন, তখন নানা জায়গা থেকে ট্রাকে করে, বাসে করে মিছিল নিয়ে আসা হবে–এটা স্থির হয়ে যাওয়ার পর জল্পেশ অভিযানের জন্যেও বাইরে থেকে তোক নিয়ে আসার কথা আর-কেউ ভাবে না। মাত্র মাসখানেকের মধ্যে দু-দুটো মিছিল ত আর করা সম্ভব নয়।

সরকারি মিটিঙে উত্তরখণ্ডের পক্ষ থেকে যুক্তি হিশেবে যেটা বলা হয়েছিল, পুলিশ সেটা অক্ষরে-অক্ষরে পালন করে। অর্থাৎ অনুষ্ঠান শেষ হওয়ামাত্র বাইরের সমস্ত ট্রাক ও বাসকে ময়নাগুড়ি ছাড়তে হয়। তাদের রাখাই ত হয়েছিল এমনভাবে যাতে উত্তরখণ্ড সম্মিলমের সঙ্গে তাদের কোনো সম্পর্ক তৈরি না হয়। শ্রীদেবীর নাচের জন্যে এসেছ, শ্রীদেবীর নাচ দেখে চলে যাও। রাত তিনটের মধ্যে ময়নাগুড়ি প্রায় খালি করে দেয়া হয়। উত্তরখণ্ড সম্মিলনের নেতারা আশা করেছিল যে আসাম ও বিহারের দিক থেকে যারা এসেছে, তাদের একটা অংশ এই সুযোগে জল্পেশ পুজো দেয়ার জন্যে জল্পেশ অভিযানে যোগ দিতে শ্রীদেবীর নাচের পর থেকে যাবে। থাকতও হয়ত। কিন্তু জল্পেশ অভিযানের প্রচারের সেরকম কোনো সুযোগ বৃহস্পতিবার উত্তরখণ্ড পেলই না।

সবটা যে পুলিশের দোষ তাও নয়। শ্রীদেবীর অনুষ্ঠানে হাজার-হাজার লোক আসবে–এটা জানা কথাই। কিন্তু কথাটা জানা এক ব্যাপার আর সেই হাজার-হাজার লোক দেখা আর-এক ব্যাপার। বৃহস্পতিবার সারাদিন ও সারা রাত ময়নাগুড়ির মত ছোট শহরের যে-অবস্থা তাতে উত্তরখণ্ডের নেতারাও পরস্পরের সঙ্গে তেমন কথাবার্তা বলতে পারে নি। বরং অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার পর, প্যান্ডেলের ভেতর ও বাইরে নেতারা নিজেদের মধ্যে কিছুটা কথা বলতে পেরেছে। তারা যদি প্যান্ডেলের ভেতরে বা রাস্তায় জল্পেশ্বর অভিযানের কথা বলতে চাইত তা হলে নিশ্চয়ই পুলিশ বাধা দিতে আসত না। আসলে, এই জনসমুদ্র দেখে নেতারাও এমন অভিভূত হয়ে পড়ে যে তারা আর-কোনো কথা মনে করতেই পারে নি।

জল্পেশে যাবার জন্যে যারা তৈরি ছিল তারা ভোর না-হতেই মিছিলের জায়গায় এসে জমা হয়ে গিয়েছিল। সাতটা নাগাদ মিছিল সাজানো শুরু হয়। তখন দেখা যায়, এর মধ্যে অনেকে আবার বাসে জল্পেশে গিয়ে সেখানে মিছিলে যোগ দেয়ার কথা ভাবছে। ময়নাগুড়ি থেকে জল্পেশ বাসে যাওয়ার কথা আগে ভাবাই যেত না, বাসও ছিল না। আজকালও বাস খুব বেশি নয়। কিন্তু একটা লাইনের বাস এই সকালেই ছাড়ে। আর, ময়নাগুড়িতে কালকের ফাংশন উপলক্ষে কিছু মিনিবাস এসে জুটেছিল, তারা দুটো-একটা সাটল ট্রিপের আশায় জল্পেশ-জল্পেশ বলে চেঁচাচ্ছিল।

একটা গেরুয়া ফেস্টুন মাটিতে পোতা ছিল–তাতে লেখা, নিখিল বঙ্গ উত্তরখণ্ড সমিতি। উত্তরখণ্ড দলের একটা বড় তেকোনা নিশান পোতা আছে–একটা বড় বাঁশের মাথায় পতাকাটা দুলছে। আরো কিছু ছোট-ছোট পতাকা আশেপাশে মাটিতে পোঁতা।

মনে হচ্ছিল, সবাই যেন কোনো কিছুর জন্যে অপেক্ষা করছে। সেই আলগা-আলগা জোটের মধ্যে আগের রাতের অনুষ্ঠান নিয়েই কথা হচ্ছিল বেশি। এক জায়গায় একজন বেশ রেগেই ওঠে, আরে তোমরালা না-হয় সিনেমাখান দেখিছেন, মুই ত দেখো নাই, স্যালায় কি করি বুঝিম কোন ফিল্মের কোনখান গান আর কোনখান নাচ!

তোমার খেপিবার কী আছে ভাই! তোমরালা সিনেমা দেখে নাই ত দেখেন নাই, এ্যালায় নাচোখান দেখো।

কী দেখিম? মাটিত পড়ি গড়াগড়ি যাছে, য্যান্ দেও ধরিছে। তোময়ালা কহিছেন–আহা-হা, মুই ত বুঝিবারই পারো না।

যাকে বলা সে হো হো করে হেসে ওঠে, আরে, মাটি পড়ি একখান জোয়ান বেটিছোঁয়া ঐনং আলাংপালাং করিছেন কেনে, বুঝো না ত চুপ করি থাকো কেনে। বুঝিবার কী আছেন হে। দেখিবার জিনিশ দেখো কেনে। কী? দেখিবার কি খারাপ নাগিছে? হ্যাঁ। উত্তরখণ্ড পার্টির এ্যালায় এক্কেরে জয়জয়। কংগ্রেসের ঘর পারো নাই, কমুনিশের ঘর পারো নাই, এই উত্তরখণ্ডটা পারিছে–স্যালায় বম্বাইঠে শ্রীদেবীক এইঠে ময়নাগুড়িত আনিবার। উত্তরখণ্ড পার্টিটা শ্রীদেবীর পার্টি হয়্যা গেইছে। লোকটি হঠাৎ দাঁড়িয়ে উঠে চিৎকার করে শ্রীদেবীর পার্টি জিন্দাবাদ।

কেউ সাড়া দেয় না–সাড়া দেয়ার জন্যে কেউ তৈরি ছিল না বলে। কিন্তু সেই অপ্রস্তুতির কারণেই সবাই হেসে ওঠে, হাততালি দেয়, যেন লোকটি আর-একবার চিৎকার করলে সবাই সাড়া দিত।

.

১৮৩. বাঘারুর হাতে ঝাণ্ডা দিতে সুস্থিরের দ্বিধা

একটু পরেই দূর থেকে একটা আওয়াজ ভেসে আসে, সবাই উঠে দাঁড়িয়ে তাকায় আওয়াজটা কোত্থেকে আসছে দেখতে। কয়েকটা মোটর সাইকেল ও সাইকেল নিয়ে সুস্থির এগিয়ে আসছে–উত্তরখণ্ড পার্টি জিন্দাবাদ।

সুস্থিরের দলটা এসে পড়া মাত্রই সাজো-সাজো পড়ে যায়। সুস্থিরে দলে গোটা পঞ্চাশেক সাইকেল, মোটর সাইকেল খানদশেক-মোপেড-স্কুটারসহ। দলটা এসে রাস্তার ওপর দিয়ে চলে গিয়ে সেই ফেস্টুনটা পেরিয়ে থামে, কিন্তু স্টার্ট বন্ধ করে না, থামেও না। একটা মোপেডের পেছন থেকে সুস্থির নেমে চিৎকার করতে করতে আসে, মিছিল সাজান, মিছিল সাজান।

সুস্থির বড় ফ্ল্যাগটা মাটি থেকে তুলে নিয়ে দাঁড়ায়, আসেন আসেন, কায়ো জোয়ান মানষি আসি ধরেন ঝাণ্ডাখান। পঞ্চাননবাবু আর গয়ানাথ জোতদার এসে সুস্থিরের পাশে দাঁড়ান। সুস্থির চেঁচিয়ে ওঠে, হে ই নবীন, ফেস্টুনখান ধরি খাড়া কেনে, মিছিল সাজো, মিছিল সাজো।

নবীন আর তিলক ফেস্টুনটা মাটি থেকে তুলে এনে রাস্তার ওপর আড়াআড়ি দাঁড়ায়। সুস্থির চিৎকার করে, আরে, তোমরালা ধরিলেন কেনে, দুইখান বেটিছোঁয়াক ধরি দেন, এই, দুইখান বেটিছোঁয়াক ডাকেন কেনে। পঞ্চাননবাবু এগিয়ে যান। সুস্থির এবার গয়ানাথকে বলে, আরে একখান জোয়ান মানষিক আসিবার কহেন না, ঝাণ্ডাখান ধরিবে।

গয়ানাথ তাড়াতাড়ি মিছিলের জন্যে দাঁড়িয়ে থাকা লোকজনের দিকে গিয়ে চিৎকার করতে থাকে, হে-এ বাঘারু, বাঘারু হে-এ। কিন্তু বাঘারুকে কাছাকাছি কোথাও দেখা যায় না। গয়ানাথকে তখন আরো খানিকটা যেতে হয়, হে-এ বাঘারু, বাঘারু হে-এ।

এখানে বেশির ভাগই এদিককার লোকজন। তারাও গয়ানাথকে চেনে না, নাম হয়ত জানে আর গয়ানাথও এদের মুখ চেনে না। ফলে, গয়ানাথের ডাক শুনেও কেউ বাঘারুকে খুঁজে দিতে এগতে পারে না। গয়ানাথকেই রাস্তাটা ধরে হে-এ বাঘারু, বাঘারু হে-এ ডাকতে-ডাকতে এগিয়ে আবিষ্কার করতে হয় যে বাঘারু সব জায়গাতেই যেমন একা দাঁড়িয়ে থাকে, এখানেও তেমনি বলদের নাখান দাঁড়িয়ে আছে। গয়ানাথের ডাক সে শুনতে পায় না, বা, শুনলেও বুঝতে পারে না তাকে ডাকা হচ্ছে। গতকাল গয়ানাথের বাড়ির লোকজনকে নিয়ে এখানে আসার পর থেকেই বাঘারু খানিকটা অলসভাবে ঘোরাঘুরি করছে। এখানে তার ত কোথাও নির্দিষ্ট কোনো কাজ নেই। তাই সে স্রোতে ফেলে দেয়া কাঠের মত যেখানে-সেখানে পড়ে থাকছে।

বাঘারুকে দেখে গয়ানাথ একটু দূরেই দাঁড়িয়ে পড়ে অভ্যেসে। বাঘারু তার চাইতে এত লম্বা যে সামনে গেলে গয়ানাথকে ঘাড় বেঁকিয়ে কথা বলতে হয়।

হে–এ বাঘারু, এইঠে খাড়ি-খাড়ি কী করিবার ধইচছিস? বাঘারু চমকে তাকাতেই বলে, চলি আয় হিপাখে, গয়ানাথ এবার একেবারে দ্রুত পা ফেলে মিছিলের মাথার দিকে এগিয়ে যায় আর গয়ানাথের ডাকে চমকে বাঘারু গয়ানাথের পেছনে-পেছনে হাঁটতে শুরু করে।

এতক্ষণে মিছিলের মাথায় সুস্থিরের মোটর সাইকেল বাহিনী রাস্তায় গাড়ি দাঁড় করিয়ে একটু ছড়িয়ে-ছিটিয়ে গেছে। সামনে দুইটি ফোতাপরা মেয়ে ফেস্টুনটা ধরে আছে–সেই দুজনের পেছনে-পেছনে সবাইকে লাইন করে দাঁড় করাচ্ছে নবীন আর তিলক। মেয়েরা প্রথমে, ছেলেরা তার পরে।

সুস্থির বড় ঝাণ্ডাটি তুলে, মাটিতে দাঁড় করিয়ে ডান হাতে ধরে রেখেছিল। তার সামনে গিয়ে গয়ানাথ আঙুল দিয়ে বাঘারুকে দেখিয়ে বলে, ইমরাক নিশানখান দেন। সুস্থির তখন ডাইনে ঘাড় ঘুরিয়ে কথা বলছিল। গয়ানাথের কথা শুনতে পায় না। গয়ানাথকে দাঁড়াতে হয় সুস্থিরের কথা শেষ হওয়া পর্যন্ত। সুস্থির ঘাড় সোজা করলে বলে, ইমরাক দিয়া দেন নিশানখান।

.

হ্যাঁ? বলে সুস্থির বাঘারুর নেংটিপরা বিশাল চেহারাটা দেখে। দেখবার জন্যে তাকে বাঘারুর মাথা থেকে পা আর পা থেকে মাথা পর্যন্ত চোখ বোলাতে হয়। সে রকম দেখার পরও সুস্থির ঝাণ্ডাটা দেয়, যেন কিছু ভাবে। বাঘারুর এমন লম্বা পেশল নগ্ন চেহারা রাজবংশী সমাজে এত দুর্লভ নয় যে সুস্থিরকে এমন দেখে যেতে হবে। এই রাজবংশী মিছিলটা রাজবংশী সমাজে এখন নতুন। রাজবংশী বলেই এই মিছিলটাতে এরা এসেছে এবং এখানে এসে এমন কিছু শ্লোগান দেবে যা অন্য মিছিলে দেয়া যায় না। সুতরাং রাজবংশী সমাজের এমন নিজস্ব মিছিলটাকেও সুস্থির সাজাতে চায় শহরের অন্যান্য পার্টির বড় বড় মিছিলের মত করে। অন্যান্য পার্টির মত মিছিল সাজাতে পারলেই উত্তরখণ্ড একটা পার্টি হয়ে উঠতে পারবে যেন। অন্য কোনো পার্টি কি এই রকম মিছিলে বাঘারুর সাইজের নেংটিপরা একটা লোককে মিছিলের শুরুতে প্রধান ঝাণ্ডা দিয়ে দাঁড় করাত? বাঘারু নেংটিপরা বলে সুস্থিরের কিছু মনেই হয় নি। বাঘারুর এত বড় শরীরটা দেখেও সুস্থিরের কিছু মনে হয় না। কিন্তু মিছিলের শুরুতে বাঘারুকে কতটা মানাবে এটা নিয়ে আরো যেন একটা গোপন বিচার করতে হয়। যদি উত্তরখণ্ড পার্টির এরকম মিছিল করা অভ্যেস থাকত তাহলে সুস্থির ভাবত না। কিন্তু সেই অভ্যেসটা এই মিছিলগুলি থেকে তৈরি হবে বলেই সুস্থিরের ভাবনা। সুস্থির যতক্ষণ ভাবে, তার মধ্যে মিছিলটা বেশ তাড়াতাড়ি সাজানো হয়ে যায়। সবাই যখন বোঝে কী ভাবে দাঁড়াতে হবে, তখন সবাই নিজের মত করে দাঁড়িয়ে যায়।

গয়ানাথ বলে, নিশানখান ইমরাক দেন কেনে, এ ধবিবার পারিবে। সুস্থির বাশটা বাঘারুর দিকে এগিয়ে দেয়। বাঘারু ধরে না। সুস্থির বলে, ধরেন কেনে। বাঘারু যেখানে দাঁড়িয়েছিল, সেখানে দাঁড়িয়ে থেকেই বাশটা ডান হাতে ধরে। সে ঘাড় তুলে দেখেও না সেই বাঁশের মাথায় কোন ঝাণ্ডা ঝুলছে।

বাঘারুকে বাঁশটা ধরিয়ে সুহির নেতাদের ডাকতে শুরু করে, এই কাকা, কাকা, অমনী কাকা, এইঠে আসেন। সুস্থিরকে গিয়ে হাত ধরে নেতাদের টেনে-টেনে এনে সেই ফেস্টুনের সামনে দাঁড় করাতে হয়। নেতারাও লাইন দিয়ে দাঁড়ান। তখন মিছিলের একটা চেহারা এসে যায়। সামনে মোটর সাইকেল বাহিনী। তার পর নেতারা। তারপর ফেস্টুন। তারপর মেয়েরা। তারপর পুরুষরা। সুস্থির যেন এখানো ঠিক করতে পারে না, ঐ অত উঁচু বাঁশের মাথায় নিশানটা কোথায় থাকবে, নিশানটা বাঘারুর হাতেই থাকবে কিনা, যদি থাকেই তা হলেই বা বাঘারু কোথায় দাঁড়াবে। সুস্থির চিৎকার করে বলে, মোটর সাইকেল সগায় খানিকখন আস্তে-আস্তে চলিবে। তার বাদে-সাইকেল মিছিলখান আগত চলি যাবে শ্লোগান তুলি-তুলি আর হাঁটা মিছিলখান পাছত-পাছত যাবা ধরিবে। জল্পেশত হামরালা শপথ নিম আর তিস্তাবুড়ির একখান পূজা করিম। থেমে সুস্থির মিছিলটা একবার দেখে ও কিছুটা অন্যমনস্ক ভাবেই বাঘারুকে হাত ধরে টেনে মিছিলের সামনে, নেতাদেরও সামনে দাঁড় করিয়ে দেয়। নিশানটির ত ঐখানেই থাকার কথা, মিছিলের মাথায়। মোটর সাইকেলগুলো চলে গেলে বাঘারুই থাকবে এই এত বড় ঝাণ্ডা হাতে মিছিলের শুরুতে, তারপর নেতারা, তারপর ফেস্টুন, তারপর মেয়েরা, তারপর পুরুষরা।

সুস্থির আওয়াজ তোলে–উত্তরখণ্ড পার্টি জিন্দাবাদ। কোন শ্লোগানের কী উত্তর হবে সেটা যারা, জানে তারা মিছিলের নানা জায়গায় ছড়িয়ে আছে বলে মিছিল থেকে শ্লোগানটা তত জোরে ওঠে না। কিন্তু সাইকেল আর মোটর সাইকেলের লোকজন শ্লোগান খুব ভাল জানে। তারা চিৎকারে-চিৎকারে শ্লোগানগুলো জমিয়ে দেয়। কামতাপুর রাজ্য, কায়েম করো, কায়েম করো। উত্তরখণ্ড দিচ্ছে ডাক, ভোটের বাক্স খালি যাক। কৃষকের জমি কাড়ি তিস্তা ব্যারেজ চলিবে না। তিস্তা ব্যারেজের মিছিলে, যোগ দিন, যোগ দিন।

.

১৮৪. মিছিলের মাথায় বাঘারু

 ময়নাগুড়ি ছাড়াতে না-ছাড়াতেই মিছিলটা তিন টুকরো হয়ে যায়। শ্লোগান দিতে-দিতে মোটর সাইকেলওয়ালারা আগে-আগে ছুটে যায়। সাইকেলওয়ালারা প্রাণপণে সাইকেল চালিয়ে মোটর সাইকেলওয়ালাদের সঙ্গে থাকতে চায়। কিন্তু তাদের সবার পক্ষে অত জোরে সাইকেল চালানো সম্ভব হয় না। ফলে তারা মোটর সাইকেল আর পায়ে হাঁটা মিছিলের মধ্যে ভাঙা সাঁকোর মত ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকে। তিস্তা, তোর্সা, জলঢাকার অনেক জায়গায় বর্ষার শুরুতে এরকম ভাঙা সঁকো দেখা যায়। কনট্রাক্টারদের ভাষায় যাকে বলে ফেয়ার ওয়েদার ব্রিজ, বর্ষার প্রথম চোটেই তা ভেঙে নদীর বুক জুড়ে এরকমই ছড়িয়ে থাকে।

কিন্তু ময়নাগুড়ির বাইরে জল্পেশের দিকের এখনকার পাকা রাস্তায় মিছিলটাকে অতটা টুকরো-টুকরো দেখায়ও না যেন। রাস্তার দুপাশে খেতবাড়ি, মাঠ, চাষের কাজ একটু-আধটু শুরু হয়েছে, কিন্তু বেশির ভাগ জমিই ফাঁকা। রাস্তাটা একেবেঁকে যেভাবে গেছে তাতে বহুদূর পর্যন্ত ফাঁকা রাস্তাটা একসঙ্গে দেখা যায়। যদি বা কোথাও কোনো টাড়ির বাড়িঘরে বা গাছপালায় রাস্তাটা আড়ালে পড়ে তা হলেও, সেটুকু বাদ দিয়ে তার পরের অংশটা দেখা যায়। এই এত দীর্ঘ, প্রায় পুরো রাস্তাটা একবারে দেখা যায় এই মিছিলের গোটাটাসহই। এতবড় রাস্তাটা একসঙ্গে যে দেখা যাচ্ছে তাতেই মিছিলের টুকরোগুলো জোড়া লেগে যায় কারণ রাস্তায় আর-কোনো গাড়ি নেই, আর-কোনো লোকও নেই। এতগুলো মোটর সাইকেলের আওয়াজে কোথাও-কোথাও কিছু-কিছু লোক বেরিয়ে আসে কিন্তু তারা রাস্তায় ওঠে না। নানা পাড়ার কুকুরগুলো মোটরসাইকেলের আওয়াজে সেই আওয়াজ ছাপিয়ে চিৎকার করতে করতে ছোটে তাদের স্বনির্ধারিত সীমানা পর্যন্ত। কিন্তু তারপর নতুন এলাকার কুকুর চেঁচাতে শুরু করে। পুরনো এলাকার কুকুর তখন ফিরে আসতে-আসতে সাইকেলওয়ালাদের দিকেই ঘাড় উঁচু করে চেঁচায়। কিন্তু সাইকেলওয়ালারা এতটা রাস্তা জুড়ে এতটাই ছড়ানো যে কুকুরগুলো ঘাড় নিচু করে ফেলে দাঁড়িয়ে পড়ে, মূল মিছিলটা পৌঁছুবার আগেই পাড়ায় ফিরে যায়।

মূল মিছিলটা কিন্তু ভাঙে না। ঠিক যেভাবে ময়নাগুড়ি থেকে বেরিয়ে জল্পেশের রাস্তায় উঠেছে, সেভাবেই জল্পেশের রাস্তা ধরে এগিয়ে যায়। মিছিলের হাঁটার যেন একটাই ছন্দ তৈরি হয়ে যায়। সে-ছন্দটা কেউ ভাঙে না। এরকম ছন্দ অবিশ্যি দূরের রাস্তার মানুষদের ভেতর তৈরি হয়ে যায় রাস্তার নিয়মে বা হাঁটার নিয়মে। হাট বা মেলায় যাওয়ার সময় বা হাট বা মেলা থেকে ফেরার সময় বড় আলপথে মানুষের চলার এই ছন্দ দেখা যায় প্রত্যেকেই নিজের মত করে হাঁটছে কিন্তু মনে হয় সবই মিলে হাঁটছে। ময়নাগুড়ি থেকে জল্পেশের এই রাস্তাটাও প্রায় বড় একটা আলের মতই। এই রাস্তাটা বাধানো-আলের সঙ্গে এইটুকু তফাত। কিন্তু আলের ওপর দিয়ে যেমন গাড়িঘোড় গিয়ে মানুষের চলমান সারিকে ভাঙতে পারে না, এই রাস্তাতেও কোনো গাড়ি ত আর মিছিলের ভেতর দিয়ে যায় না। অনেক মানুষ অনেক দূরের পথ একসঙ্গে বাধাহীন পার হতে পারলে এরকম মিছিলেরই মত দেখায়।

এই রাস্তাটাতে মিছিলটা কীরকম মানিয়েও যায়।

পুরো রাস্তাটা না-হলেও তার অনেকখানিই যে দেখা যায় তাতেই এই এতগুলো মানুষের একসঙ্গে হেঁটে আসার যেন একটা মানে আসে। এরা কতটা দূরত্ব হবে তা সকলে দেখতে পায়। যে-বেটিছোঁয়া-দুজন ফেস্টুন ধরেছিল তারা ফেস্টুনটা টান-টান রাখতে পারে না। কিছুক্ষণ পরই তাদের হাত পরস্পরের দিকে নেতিয়ে যায়। কেউ কিছু না বলায় হাত দুটো আরো নেতিয়ে পড়ে। ফেস্টুনের কাপড়টা পেছনের দুই সারির মাঝখানে প্রায় গড়িয়েই পড়ে কিন্তু বাতাসের জন্যে পুরো গড়িয়ে যায় না। ফেস্টুনটা ওভাবেই চলে। তাতেও একটা দৃশ্য তৈরি হয়। ফেস্টুনটা যদি ঝাণ্ডার মত একজনের হাতে থাকত তাহলে এতটা বাতাসে সেটা সেই একজনের হাত থেকে পুরো মিছিলের মাথার হাতখানেক উঁচুতে স্রোতের মত উড়ত।

বাঘারুর হাতেই ঝাণ্ডাটা শুরুতে যেমন, শেষেও তেমন। ঐ লম্বা বাঁশের মাথায় তেকোনা ঝাণ্ডা আর বাঘারু বাঁশের গোড়াটা ধরে আছে দুই হাতে, কাঁধের ঠেকনো দিয়ে। যেরকম বাতাস, এমন খোলা মাঠে এমনই বাতাস ওঠে অবিশ্যি, তাতে বাঘারুর চাইতে কম জোরালো কেউ ঝাণ্ডাটা এমনি সোজা রেখে ময়নাগুড়ি থেকে জল্পেশ নিয়ে আসতে পারত না। এই মিছিলটার কাজ ত হেঁটে-হেঁটে জল্পেশ পৌঁছানো। এক বাঘারুরই কাজ এই বাঁশটাকে এত বাতাসের মুখে খাড়া রাখা। ফলে মিছিলের মাথায় তার নেংটিপরা শরীরটা এমনই প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে যে সেই সূত্রে বাকি মিছিলটা অর্থ পায়। বাঘারুর শরীরের এই অর্থটা বুঝে ওঠা, অন্তত দেখে ওঠাও, সুস্থিরের হয় না, কারণ, সুস্থির মোটর সাইকেলে আগে জল্পেশে চলে গেছে–শপথ গ্রহণ ও তিস্তাবুড়ির পূজা অনুষ্ঠানের ব্যবস্থাদির জন্যে। মিছিলটা বাঘারুর শরীর থেকেই বেরচ্ছিল। বাঘারুর পেছনে আর ফেস্টুনের সামনে ছিলেন পঞ্চানন মল্লিক, বীরেন বসুনিয়া, গয়ানাথ জোতদার, দেবমোহনবাবু, নবীন, তিলক, ধৈৰ্যমোহনবাবু, সম্পৎ রায়। এরা ছাড়াও আরো জনা ছয়-সাত। এদের সঙ্গে মিছিলের বাকি অংশের তফাতটা পোশাকেই ধরা পড়ছিল। জামা-পরা বা জুতা-পরা আরো অনেক ছিল বটে কিন্তু যাদের জামা আছে তাদের অনেকেরই ধুতি নেই, যাদের ধুতি আছে তাদের অনেকেরই জামা নেই। ময়নাগুড়ি ছাড়িয়ে এই রাস্তায় পড়তেই মিছিলটার পোশাক অনুযায়ী এই দুই ভাগ ধরা পড়ে যায়।

বাঘারুটা মিছিলের মাথায় থাকে বলে ও তার পেছনে-পেছনে এমন-কি এই জোতদার-দেউনিয়া। লোকজনও যাচ্ছে বলে মিছিলটাকে যেন রীতিনীতি মেনে চলা একটা পুজোটুজোর মতই ঠেকে। নইলে বাঘারু অতটা আগে থাকে কী করে? বাঁশের ওজনটা আন্দাজ করলে এর একটা সহজ জবাব পাওয়া যায় বটে, কিন্তু ঐ অত জন জোতদার আর দেউনিয়া যেরকম পায়ে-পায়ে বাঘারুর নেতৃত্ব মেনে নেয় তাতে ঐ সঙ্গে জবাবটাও জটিল হয়ে যায়। কোনো-কোনো পূজা যেমন শুধুই মেয়েদের–মেচেনি খেলা বা হুমার নাচ, কোনো-কোনো পূজা যেমন শুধু চ্যাংড়াদের-দোলখেলার দ্বিতীয় দিন কাদাখেলা, তেমনি যেন এই মিছিলের আচারই এই যে বাঘারুর তার বাহু, কব্জি, বুকপিঠের পেশিগুলোকে এই রকম স্পষ্ট করে এই ঝাণ্ডা বইবে আর তার পেছনে-পেছনে এই বড় বড় মানষির ঘর চলে।

বাঘারু ত কোনদিন মিছিলে চলে নি। কিন্তু তাকে ডেকে এনে তার গিরি জোতদার এই বাশটা তার হাতে ধরিয়ে দিতেই সে মিছিলের লোক হয়ে যায়। এখন দুপাশে এই নাড়া খেতের মাঝখান দিয়ে পড়ে থাকা এই রাস্তাটায় বাঘারু মিছিলের পরিচালক। পরিচালনার জন্যে তার কোনো বিশেষ ভূমিকা নেই–যদি না এই ঝাণ্ডা ধরে রাখাঁটি বিশেষ ভূমিকা হয়। কিন্তু এই মিছিলের পরিচালক হওয়ার জন্যে তার কোনো বিশেষ ভূমিকার তত প্রয়োজনও ছিল না–প্রয়োজন ছিল, যারা তার পেছন-পেছন আসছে তাদের বিশেষ বিশেষ ভূমিকা। বাঘারুর ঠিক পেছন-পেছন যারা আসছে তারা ঠিক করেছে বলেই বাঘারু তাদের সামনে হাঁটছে, বাঘারু এই মিছিলের পরিচালকই হয়ে উঠেছে। কিন্তু তাদের মধ্যে, একজনও যদি ইচ্ছে করে তাহলে যে-কোনো মুহূর্তে সে বা তারা বাঘারুর আগে এসে দাঁড়াতে পারে। সেই এগিয়ে দাঁড়ানোর জন্যে তাদের এক পাও নড়তে হবে না। বাঘারুকে পেছনে চলে যেতে বললেই তারা সামনে পড়ে যাবে।

কিন্তু তা ত এখন আর বলা যায় না। এখন এই মিছিল যে-অর্থে নিজেকে অর্থবান করে তুলতে চায় তার সঙ্গে বাঘারুর এই সবার আগে থাকাটা মিশে গেছে। সেই মিশ্রণটা এই মিছিলের পক্ষে খুব দরকারি। সেই মিশ্রণটাকে এখন আর নষ্ট করা যায় না। তাই, বাঘারু না-জেনেও এই মিছিলের প্রতীক হয়ে ওঠে, প্রতিনিধি হয়ে ওঠে। জল্পেশ পর্যন্ত দূরত্বটুকু সেই প্রতীক ও প্রতিনিধিকে রক্ষা করতে হয়।

বাঘারুর হাঁটার মধ্যে কোনো নতুনত্ব ছিল না। তাকে যে এরকম মিছিলে জীবনে কখনো হাঁটতে হয় নি; মিছিলের একেবারে মাথায় হাঁটা ত দূরের কথা, তা তার হাঁটার স্বাচ্ছন্দ্য থেকে বোঝা যায় না। একটু অসুবিধে তার হয় না, তা নয়। পিচ রাস্তার ওপর দিয়ে হাঁটা ত তার অভ্যেস নেই, ফলে পায়ের তলায় লাগছিল। মাইল-মাইল বিস্তার যে এক-একদিনে পায়ে হাঁটে তার পায়ের তলায় ঐ কাকর, ছোটখাট পাথর, ফুটে যাচ্ছিল। কিন্তু বাঘারুকে বাঁচিয়ে দেয় ঐ নিশানের বাশটাই। শুধু তার নিজের শরীরটার ভার বইতে হত যদি বাঘারুকে এখানে এই আলের মত ফাঁকা পিচ রাস্তায়, তা হলে অনেক বেশি পাথর ফুটত তার পায়ে। একে অনভ্যস্ত বাধানো রাস্তা, তায় অনভ্যস্ত ভারহীনতা। বাঁশের ভারটা থাকায় ও এত লম্বা বাশটাকে সোজা রাখতে বলপ্রয়োগ করতে হয় বলে, বাঘারু কিছুক্ষণের মধ্যেই এই পথটাকে অভ্যস্ত ভঙ্গিতে দলতে পারে, এই নিশানও অভ্যস্ত ভঙ্গিতে ওড়াতে পারে। তার মানে, এমন মিছিলের নেতৃত্ব দেয়ার অভূতপূর্ব ব্যাপারটাকেও বাঘারু তার অভ্যাসের মধ্যে নিয়ে নিতে পারে। তার পেছনে যে তারই জোতদার, আর অনেক জোতদারের সঙ্গে তাকে অনুসরণ করে আসছে–এটা তার মগজেই ঢোকে না।

বাঘারুকে নেতা সাজিয়ে যে-নেতারা তাকে অনুসরণের ভঙ্গিতে হাটছিল তারাও কেউ হাঁটায় কম যায় না। তাদের প্রায় প্রত্যেককেই মাইল-মাইল হাঁটতে হয় রোজ। তাদেরও বরং অসুবিধে এই পিচের রাস্তা বলেই। তাদের সবারই পায়ে এখন জুতোক্যামবিসের, রবারের, চায়নিজ। একটু কমবয়েসিদের পায়ে স্যান্ডেলও আছে। তাই কাকর লাগে না। কিন্তু তারা মাঠ দিয়ে, আল দিয়ে মাইল-মাইল হাটে যখন, তখন মাটিতে পা ফেললে বোঝা যায় মাটিতে পা ফেলছে। মাটিটা একটু দেবে যায়, বা বালিটা একটু সরে যায়, বা ঘাসগুলো নুয়ে পড়ে। কিন্তু এই পিচের রাস্তায় পা ফেললে পা-টা সেরকম কোনো সাড়া পায় না। নিজের পায়ের আন্দাজে বোঝা যায় না–তারা হাঁটছে। ……

তবু ত হাটছেই। হাঁটছে বাঘারুর পেছনে-পেছনে, বা বাঘারুবাহিত নিশানের নির্দেশ অনুসারে। বাঘারুর নিশানটা যে কত উঁচুতে উঠে আকাশে পতপত করে সেটা এই নেতারা খুব ভাল দেখতে পায় ও দেখে। তাতে তাদের একটা বেশ গর্বও হয়। রাজবংশী সমাজের ভেতরে কয়েক শ বছর ধরে জমা হয়ে আছে বর্ণহিন্দু সমাজের সঙ্গে তুলনা থেকে আসা এক হীনম্মন্যতা। এখন এই বাঘারুর হাতে ধরা নিশানাটার পেছনে সেই তরাইয়ের সম্পৎ রায় থেকে পুণ্ডিবাড়ির কালিপ্রসন্নর বড় ছেলে পর্যন্ত যে এমন ফাঁকা মাঠের ভেতর দিয়ে এমন একসঙ্গে হেঁটে যাচ্ছে তাতেই যেন তাদের অভীষ্ট অনেকটা সিদ্ধ হয়ে যায়। অন্তত এখানে ত তাদের রাজবংশী পরিচয় ছাড়া আর কোনো পরিচয় নেই। এই পরিচয়টুকু নিয়ে ত তারা গত কয়েকদিন ধরে সম্মিলন করে আসতে পারল, কাল রাত্রিতে ঐ রকম এক শ্রীদেবীকে এনে এমন অনুষ্ঠান করে ফেলতে পারল ও এখন এতটা রাস্তায় মিছিল করে জমেশে যেতে পারছে।

.

১৮৫. মিছিলহারা ঝাণ্ডা নিয়ে তিস্তাবুড়ির পূজা দেখতে-দেখতে বিব্রত বাঘারু

 কিন্তু জল্পেশে শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান ও তিস্তাবুড়ির পুজো তেমন জমল না।

মিছিলে বেশির ভাগই ছিল এদিককার লোক। যাদের গা বা টাড়ি রাস্তায় পড়েছে তারা মিছিল থেকে সরে গেছে। গা টাড়িপিছু হয়ত দু-একজন করে থেকে গেছে। জল্পেশ পার হয়ে যে-সব গা বা টাড়িতে যেতে হয় সে-সবের লোকজন অবিশ্যি জল্পেশ মন্দিরে বসে, চলে যায় না। সুস্থিরের মোটর সাইকেলের দলটারও অনেকে মোটর সাইকেল চালানোর আনন্দে জল্পেশ ছাড়িয়ে আরো দূরে চলে গেছে। তাদের কেউ-কেউ ফিরে আসে বটে কিন্তু তাদের সঙ্গে ত এই মিছিল বা অনুষ্ঠানের কোনো সম্পর্কই তৈরি হয় না। এক সাইকেলওয়ালারা সবাই এতটা এসে হাঁফিয়ে পড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বিশ্রাম নেয়। যখন মূল মিছিলটা বাঘারু ও নেতৃবৃন্দসহ জল্পেশ পৌঁছয় তখন মনে হয় এখানে এসে পড়াটাই তাদের উদ্দেশ্য ছিল, এর পর আর-কোনো অনুষ্ঠান নেই।

কিন্তু সুস্থির সমস্ত ব্যবস্থা করে রেখেছিল। মিছিলটা সোজা জল্পেশের মন্দিরের দিকেই হাঁটে, তার জন্যে সুস্থির বাঘারুকে প্রায় হাত ধরে পথ দেখায়। বাঘারু এর আগেও জল্পেশ্বর মন্দিরে হয়ত এসেছে গয়ানাথের দরকারে কিন্তু সে যে শিবলিঙ্গ পর্যন্ত যেতে পারে এটা তার ধারণাই ছিল না। অথচ তার বাহু ধরে টানতে-টানতে সুস্থির একেবারে মন্দিরের সিঁড়ি পর্যন্ত নিয়ে যায়। মন্দিরের সিঁড়ির গোড়ায় যখন বাঘারু প্রায় পৌঁছে গেছে, তখন তার মনে হতে শুরু করেছে শেষ পর্যন্ত সুস্থির কি তাকে সিঁড়িগুলো দিয়ে ওপরেও তুলবে নাকি? যদি তোলে তা হলে ঝাণ্ডাটা কী করবে, একথাটা যেমন সে ভাবে, তেমনিভাবে, সে উঠবে না। কিন্তু ঐ সিঁড়ির গোড়াতে এসেই সুস্থির তাকে ছেড়ে দেয়, সঙ্গে-সঙ্গে জয় বাবা জল্পেশ্বর আওয়াজ ওঠে। বাঘারু দুই হাতে বাশটা ধরে সেই বাঁশের গোগাড়াতেই নত হয়ে ভক্তিভরে কপাল ঠেকায়। বাঘারুকে হামেশা এমন কপাল ঠেকাতে হয় না বলে সে বোঝেও না কতক্ষণ কপাল ঠেকিয়ে রাখবে। বুঝলেও যে খুব সুবিধে হত তা নয়, কারণ, তার সময়ের বোধ অত সঠিক নয়। কিন্তু এতটা পথ এত বড় মিছিলের আগে-আগে ঝাণ্ডা বয়ে আনার প্রতিক্রিয়াতেই হয়ত তার মনে হতে শুরু করে যে তার বোধহয় একটু বেশি সময়ই প্রণাম করা উচিত। একে বাবা জল্পেশ্বর, তাতে মিছিল, তাতে মিছিলের নিশান। তা ছাড়া জল্পেশ্বর মন্দিরে এমন একটা মাথা নোয়ানোর সুযোগ ত সারা জীবনে তার আর নাও আসতে পারে। বাঘারু যে মাথা নিচু করে তার গত ও আগামী জীবনের পরিপ্রেক্ষিত ভেবে ফেলে তা নয়–সে বেশ অনেকক্ষণ ঝাণ্ডার বাশটা দুই শক্ত হাতে ধরে বাঁশের গোড়ায় মাথাটা নুইয়ে রাখে। যখন সে মাথাটা তোলে তখন পাশাপাশি কাউকে দেখতে পায় না, পেছনেও কাউকে দেখতে পায় না। এতক্ষণ চোখ বুজে থাকায় চোখটা আঠা-আঠা লাগে। সে একটা হাত আলগা করো চোখটা একটু কচলে নেয়। কিন্তু তারপরও পাশে বা পেছনে কাউকে পায় না।

বাঘায়ু এবার তার মিছিলের ঐ অত লম্বা বাঁশের মাথায় নিশান নিয়ে একা-একা, যেন মিছিলটা খোঁজে। পেছনে তোক নেই অথচ নিশানটা এমন পতপত করে উড়ছে এটা খুব বেমানান ঠেকে। বাঘারুর কাছে। এই বাশ আর ঝাঙাটা থাকায় সেও একা-একা হাঁটার মত করে হাঁটতে পারছে না। মিছিলের বাশ আর ঝাণ্ডাখান মোর কাঁধত রাখি কোটত গেইল হে গয়ানাথের মিছিল? মন্দিরের প্রধান এলাকা থেকে বাঘারু বাইরে বেরয়।

বেরতেই দেখে মিছিল বলে আর চেনার উপায় নেই, পুকুরের পাড়ে এমনই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বসে আছে সব। বাবারু ত ঐ মিছিলের কারোই মুখ দেখে নি। সে শুধু মিছিলটাকেই দেখেছে। মিছিলে যে-মুখগুলি ছিল সেগুলিকে সে মিছিলের বাইরে চিনবে কী করে? কিন্তু তবু যে বাঘারু আন্দাজ করতে পারে যে পুকুরের পাড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বসে থাকা এই মানুষগুলি মিছিলেরই লোক তার কারণ মন্দিরের মাঠে মিছিল ছাড়া আর-কোনো লোক ছিল না। . বাঘাক ঐ বাশটা ধরে কোনদিকে যাবে বুঝতে না পেরে দাঁড়িয়ে থাকে, বাশটা ধরেই। সেখানে দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়েই সে দেখে ও শোনে একটু দূরে একটা জায়গায় গয়ানাথ, আসিন্দির, আরো সগায় দেউনিয়ার ঘর খাড়ি আছে, আর একদল মেয়ে, বেটিছছায়ার ঘর ঘুরি-ঘুরি গান গাবার ধরিছে। একটু দাঁড়িয়ে শুনতেই বাঘারু বোঝে, তিস্তাবুড়ির পুজো হচ্ছে। ওখানে নিশ্চয়ই পাটকাঠি দিয়ে তিস্তাবুড়িও একটা বানানো হয়েছে। গানগুলো খুব মন দিয়ে যে শোনে বাঘারু তা নয়, কিন্তু জন্ম থেকে শুনতে-শুনতে এ গান এতই জানা যে শুনতে না-চাইলেও শোনা হয়ে যায়।

সঙ্গ হতে নামি তিস্তাবুড়ি
মনচে দিয়া পাওঁ।
মনচ হতে নামি তিস্তাবুড়ি
 চ্যাতন করি গাও
কাঁচা দুধ আলোয়া ক্যালো
ভইক্ষণ করো।

দেখতে-দেখতে তিস্তাবুড়ির পুজো শেষ হয়ে যায়। এসব পুজো যেমন চলতেই থাকে, চলতেই থাকে, তেমন কিছুই হয় না। পঞ্চানন মল্লিক উঠে বলেন, তিস্তাবুড়ি আমাদের দেবতা হন। সেই তিস্তাবুড়িকে বান্ধা আমরা সহ্য করিব না। আর এক মাস পরে তিস্তা ব্যারেজের উদ্বোধনের দিন আমরা প্রতিবাদের মিছিল নিয়া ঐ তিস্তা ব্যারেজের কাছে যাইব Fআপনারা সব জায়গা হইতে সেদিন মিছিল লইয়া তিস্তা ব্যারেজে যাইবেন। তিস্তা ব্যারেজে প্রতিবাদ করার জন্যে আপনারা আজি হইতে এক মাস নিজের নিজের টাড়িতে, হাটে, গায়ে, গঞ্জে প্রচার করিবেন ও সেদিন সব জায়গা হইতে মিছিল লইয়া যাইবেন। এখন শপথপত্র পাঠ হইবে। আমি পড়িব, আপনারা সঙ্গে সঙ্গে পড়িবেন। জয় বাবা জল্পেশ্বর। জয় তিস্তাবুড়ির জয়।

এখানে মিটিঙের মত সবাই এক জায়গায় জড়ো হয়ে নেই। যে যার মত ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। মাইকও নেই। ফলে কী বলা হচ্ছে, কী পড়া হচ্ছে সেটা কেউ একটা খুব খেয়ালও করে না। যেখানে তিস্তাবুড়ির পুজো হচ্ছিল সেখানে নেতারা যে কয়েকজন ছিল, গয়ানাথও ছিল, তারা একসঙ্গে কিছু পড়ে বা বলে। তবে যখনই একটু উঁচু গলায় জয় বাবা জল্পেশ্বর আর জয় তিস্তাবুড়ির জয় ধ্বনি উঠছিল তখন যে যেখানেই থাকুক সাড়া দিচ্ছিল। সে-সাড়া খুব জোরে না উঠলেও, উঠছিল।

উত্তরখণ্ড সম্মিলনের সবাই যে-নাটকীয় পরম্পরায় এই কর্মসূচিটি ভেবেছিল, সেটি ঘটে উঠল না। পরপর ক-দিন সম্মিলন, তাতে নানারকম আলোচনা। পর-পর কদিন অনুষ্ঠান, তাতে নানারকম প্রোগ্রাম। শেষের দিন শ্রীদেবীর নাচে একটা চূড়ান্ত নাটক। তার পরদিন জল্পেশ্বর অভিযানে উত্তরখণ্ডের আরো চূড়ান্ত নাটক।

কিন্তু জল্পেশ্বর অভিযান, শপথগ্রহণ, তিস্তাবুড়ির পূজা, এসব কথা কাগজে ছাপার হরফে যেরকম দেখায় বা বক্তৃতায় মুখের কথায় যেরকম শোনায়, বাস্তবে সে-রকম দেখায় না বা শোনায় না। শ্রীদেবীর নাচটুকু ছিল বলে, তাতে এদিক থেকে এত লোক গিয়েছিল বলে, আর তাদের প্যান্ডেলে থাকার জায়গা দেয়া হয়েছিল বলে–এই মিছিলটা ময়নাগুড়ি থেকে জল্পেশ পর্যন্ত হেঁটে আসতে পারল। নইলে তাও হত না। তাহলে সুস্থিরের সাইকেল বা মোটর সাইকেল মিছিল পর্যন্ত হয়ত হত। কিন্তু সাইকেল বা মোটর সাইকেলে মিছিল করে এসে ত আর তিস্তাবুড়ির পূজা, জল্পেশ্বরের পূজা, শপথবাক্য পাঠ এসব করা যায় না। করা যাবে না কেন, যায়, কিন্তু সেটা যারা করল তাদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে, আর-দশজনের মধ্যে প্রচারিত হবে না। কিন্তু এখানে এই জল্পেশ্বর অভিযান আর তিস্তাবুড়ির পূজা আর শপথবাক্য পাঠ যাই হোক না কেন, খবরের কাগজের রিপোর্টারদের কাছে এগুলো বললে এর চেহারাই অন্যরকম হয়ে যাবে।

উত্তরখণ্ডের নেতারা এখানে জল্পেশ্বর মন্দিরের নিভৃতিতে খবরের কাগজের জন্যে একটি খবর তৈরি করছিলেন মাত্র।

সব যখন শেষ হয়ে যায় তখন বাঘারু বোঝে না যে এখন এই বঁশ ও বাঁশের মাথায় ঝাণ্ডা নিয়ে কী করে। নিজের ভেতর সে একটা যুক্তি পায়–মিছিল না থাকিলে ঝাণ্ডাখান কেনে থাকিবে? মিছিল নাই ত ঝাণ্ডা নাই। সে জল্পেশ মন্দিরের একটা গাছের গায়ে ঐ বাশটা হেলান দিয়ে রেখে দেয়।

.

১৮৬. উত্তরখণ্ডের হাটমিছিল

 বাঘারু যদিও জল্পেশ মন্দিরের গায়ে উত্তরখণ্ডের লম্বা ঝাণ্ডাটা রেখে দিয়েছিল কিন্তু পরের এক মাস ঐ ঝাণ্ডা তাকে ছাড়ে না।

তিস্তা ব্যারেজ উদ্বোধন উপলক্ষে বিক্ষোভ দেখানোর জন্যে উত্তরখণ্ড দলের মিছিল সাজামোর সব দায়দায়িত্ব যেন গয়ানাথ আর আসিন্দিরের ওপরই এসে পড়ে। অথবা, তারা নিজেরাই সে দায় মেনে নেয়। অন্যদের কাছে তিস্তা ব্যারেজ ত খবর, বিক্ষোভ দেখাতে এসেও নদীর ভেতরে অত বড় কাণ্ডকারখানার দিকে হা করে তাকিয়ে না-থেকে পারবে না। কিন্তু গয়ানাথ-আসিন্দিরের কাছে ত তিস্তা ব্যারেজ সেরকম ব্যাপার না–সেই বছর দশ-বারর আগের সেটলমেন্ট থেকে শুরু করে এই বছর দশ বারর নানা মামলা-মোকদ্দমা পর্যন্ত এই ব্যারেজটা ত তাদের চোখের সামনেই ঘটে গেছে আর যত ঘটে গেছে ততই যেন সেটা তাদের উল্টো দিকে ঠেলে দিয়েছে। সেই উল্টো ঠেলায় এতদিন পর্যন্ত মামলা-মোকদ্দমাই চলছিল, এখন এই উত্তরখণ্ডের সুযোগে আর তিস্তা ব্যারেজের উদ্বোধনের উপলক্ষে তারা যেন হাতের কাছে নতুন একটা উপায়ই পেয়ে যায় তিস্তা ব্যারেজকে ঠেকানোর জন্যে। তিস্তা ব্যারেজ যে ঠেকানো যাবে না, সেটা গয়ানাথ-আসিন্দির তাদের নিজেদের বৈষয়িক বুদ্ধিতেই বুঝে ফেলে। তিস্তা ব্যারেজ যে ঠেকানো গেল না, এটা ত তারা নিজেদের চোখেই দেখতে পায়। তিস্তা ব্যারেজ ঠেকিয়ে যে মামলাগুলি জেতা যায় না–সেটা বুঝতে ত আর বেশি বুদ্ধির দরকার হয় না। তবু তিস্তা ব্যারেজের উদ্বোধন নিয়ে গয়ানাথ আর আসিন্দির যে এতটাই মেতে ওঠে তার একটা কারণ হয়ত এই যে উত্তরখণ্ড সম্মিলনে এই প্রথম তারা, বিশেষত গয়ানাথ, একটা স্বাদ পেল যে অনেক মানুষকে জড়ো করতে পারলে একটা কাজ আদায় করে নেয়া যায়।

এতদিন এই মানুষকে একসঙ্গে মেলানোর ব্যাপারটাকে গয়ানাথ সন্দেহ করেই এসেছে। এমন-কি, কংগ্রেস ছাড়া ভোট দেয়ার কেউ না-থাকলেও গয়ানাথ এই মানুষজনকে নিয়ে হৈ-হৈ করার ব্যাপারে কংগ্রেসকেও বিশ্বাস করে না, অন্য পাটিদের ত করেই না। কিন্তু এখন, এই মানুষগুলোকে একসঙ্গে করে আন্দোলনের ব্যাপারটা সে বুঝে ফেলে নতুন ধরনের পদ্মা, আই আর এইসব বিছন দিয়ে ধান চাষ করার নিয়মে। গয়ানাথ ত আর সরকারের হাতে তামাক খেতে যায় নি। সে যখন চোখের সামনে দেখেছে যে এই সব হাইইল চাষে সময় কম লাগে, ফলন বেশি হয়, তখন সে তার জমিতে এই বিছানে; চাষ লাগিয়েছে। সে যখন বুঝেছে মানুষ ছাড়া তার উপায় নেই তখনই উত্তরখণ্ডে যোগ দিয়েছে আর তিস্তা ব্যারেজ বন্ধ করো, বন্ধ করো, শুরু করেছে।

কিন্তু শুরু করলেও এই সব মিছিল-মিটিঙের নিয়মকানুন ত আর গয়ানাথের জানা নেই। উত্তরখণ্ডের চ্যাংড়া নেতারা তার এই বাড়িতে বসে মিটিঙ করে তাকে বলে গেছে, অন্তত কাছাকাছি প্রত্যেকটা হাটে হাটের দিন যেন মিছিল ভোলা হয়। তার একটা লিস্টিও করা হয়। আজকাল যেখানে-সেখানে হাট, বসে যাচ্ছে। কোন হাটে মিছিল তোলা যাবে আর কোন হাটে যাবে না তা ঠিক করতেই সময় যায়। গোচিমারির হাটটা পুরনো আবার কুমারপাড়ার হাটটা নতুন হলেও বড়। শেষ পর্যন্ত দেখা যায় সবসুদ্ধ প্রায় বিশটা হাটে মিছিল তুলতে হবে।

 মিছিল ত তুলিবেন, নেকচার করিবেন কায়? গয়ানাথের এমন প্রশ্নের জবাবে সেই চ্যাংড়া নেতারা কথাবার্তা বলে ঠিক করে যে অন্তত সাতটা হাটে তারা কেউ এসে বক্তব্য রাখিবেন। আখিবেন ত আখিবেন আর তেরডা হাটত কি বলদ দিয়া হাম্বা ডাকাম? গয়ানাথের এমন চড়া প্রশ্নে আবার এক দফা আলাপ-আলোচনার পর ঠিক হয় যে এই এলাকার দু-জনকে জোগাড় করা হবে। কিন্তু তাতেও গয়ানাথের প্রশ্ন ছিল-ঐ সব কাথা তিস্তাপাড়ত্ ফেলান! একখান মাস্টার মানষি দ্যাও, সাইকেলআলা। স্যালায় এই দিন গিলা হাটত মিছিল তুলিবেন, নেকচার করিবেন আর স্যালায় ঐ মিটিঙের দিন মিছিল নিগাবেন। হামরালা তোমা মানষি দিবা পারি, সেই মানষিগিলার মিছিল বানিবার না পারি। মোর মানষি নিয়া মিছিল, বানিবার নাগিবে তোমরালাক।

গয়ানাথের বাড়ির এই মিটিঙে সুস্থির ছিল। শেষ পর্যন্ত তার কথামতই ঠিক হয় প্রথম কয়েক দিন তিলক রায়বর্মন গয়ানাথের বাড়িতে থেকে কয়েকটা হাটে মিছিল তুলবে, তারপর সুস্থির নিজেই এসে থাকবে, সঙ্গে আরো দু-একজন আসতে পারে–একেবারে উদ্বোধনের দিন বিক্ষোভ মিছিল তোলার পর সুস্থির ফিরে যাবে, তার আগে নয়।

তিস্তা ব্যারেজের বিক্ষোভ মিছিলে লোক প্রধানত গয়ানাথের এলাকা থেকেই জড়ো করতে হবে–এটা সুস্থির ও তার দলবল বুঝে গিয়েছিল।

তারপর থেকেই শুরু হল তিলক রায়বর্মনের নেতৃত্বে কাছাকাছি সব হাটে গয়ানাথের মানষিলার মিছিল তোলা।

আর গয়ানাথের মানষিলা মানেই ত সর্বপ্রথম বাঘারু। নেওড়াবস্তির হাটের দিন তিলক তার সাইকেল নিয়ে আর বাঘারু তার ঝাণ্ডা নিয়ে গয়ানাথের বাড়ি থেকে বেরয় বেলা একটা নাগাদ। গয়ানাথের নির্দেশ অনুযায়ী বাঘারু তিলককে এক-এক পাড়ার ভেতর দিয়ে-দিয়ে নিয়ে যায়। সে-সব পাড়ায়, টাড়িতে বাঘারু সরু বাঁশের, বা মোটা কঞ্চি বলাই ভাল, মাথায় তিনকোনা এক লম্বা নিশান ধরে দাঁড়িয়ে থাকে আর তিলক সাইকেলটা এক জায়গায় হেলান দিয়ে রেখে এক-এক ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে ডাকে। নতুন গলার এরকম ডাকাডাকিতে সবই বেরিয়ে আসে। তখন তিলক তাদের প্রায় নির্দেশের মত করেই বলে, যে, হাটে গিয়ে সবাই যেন বাঘারুর হাতে ধরা ঝাণ্ডাটার কাছে জড়ো হয়। তারপর, হাটমিছিল হবে।

তিলককে প্রায় কেউই চেনে না কিন্তু বাঘারুকে ত সবাই চেনে। সুতরাং গয়ানাথের নির্দেশ বুঝতে কারো কোনো অসুবিধে হয় না। বাচ্চারা ত চলবে না, চলবে না শুরুই করে দেয়। কিন্তু হাটে বাঘারুর ঝাণ্ডার কাছে কেউ জড়ো হয়ে থাকে না, তিলকও কাউকে চেনে না যে হাট ঘুরে ডেকে-ডেকে আনবে। তাই খানিকক্ষণ অপেক্ষার পর তিলককে তার সাইকেল নিয়ে বাঘারুর সঙ্গে হেঁটে-হেঁটেই হাটে ঘুরতে হয়।

বাঘারুর কাঁধে ঝাণ্ডা। সুতরাং তাকে আগে যেতে হয়। আর, তার পেছনে-পেছনে সাইকেল ঠেলতে-ঠেলতে তিলক। তিলক শ্লোগান দেয়–তিস্তা ব্যারেজ চালু করা, কিন্তু বাঘারু তার জবাবে কিছু বলে না। প্রথম হাটে দু-একবার বাঘারুকে বলা সত্ত্বেও বাঘারু বলতে না-পারায় তিলক একাই পুরো শ্লোগান দিতে থাকে–তিস্তা ব্যারেজ চালু করা চলবে না, চলবে না, তিস্তা ব্যারেজ উদ্বোধনের বিক্ষোভ মিছিলে যোগ দেন, যোগ দেন। এরকম ঝাণ্ডাসহ একজনের মিছিল বেরলেও হাটে লোক জুটে যায়। সে রকম লোক তিলক বাঘারুর যুগ্ম মিছিলেও জোটে। সন্ধ্যা হওয়ার মুখে বাঘারু ও তিলকের এই গোটা মিছিলটাই একা-একা গয়ানাথের বাড়িতে ফেরে। বেলা একটা-দেড়টায় বাঘারুর হাতে যে ঝাণ্ডাটা জ্বলজ্বল ও পতপত করে, সন্ধ্যার পর সেটা কলাপাতার মত নেতিয়ে যায়। কিন্তু আলে-আলে বহুদূর পর্যন্ত দেখা যায়–সেই ঝাণ্ডাটা আরো দূরে চলে যাচ্ছে। গোলাবাড়ির ঢাল বৈয়ে ওপরের বরমতলে ওরা উঠলে তিলকের সাইকেলের স্পোকগুলোও ছায়ার মত দেখায়, বাঘারুর পুরো শরীরটাকে আকাশে খোদাই করা মনে হয়।

এরকম প্রথম দু-চারটি হাট থেকে ফিরতে-ফিরতে তিলক ও বাঘারুর কিছু কথাবার্তা হয়। কোনো এক সন্ধ্যাতেই যে সামান্য এই কটি কথা হয়েছিল তা নয়। ঐ–চার সন্ধ্যা জুড়েই নানা সময়ে কথাগুলি হয়ে থাকবে। কিন্তু সেরকম টুকরো-টুকরো উপলক্ষের মধ্যে কথাগুলি ছড়িয়ে দেওয়ার সুযোগ এখন আর এ বৃত্তান্তের নেই। তাই একসঙ্গেই সবটুকু দেয়া হল। তাতে এই কথোপকথনের মধ্যে থেকে কোনো নতুন অর্থ তৈরি হয়ে উঠবে না, আশা করা যায়। এই কথোপকথন বাদ দিলেও হত, কিন্তু তা হলে, এই দু-চার হাটের অভিজ্ঞতার পর গয়ানাথ ক্রান্তিহাটে কী করল বোঝা যেত না।

.

১৮৭. বাঘারুর তৃতীয় সংলাপ

তোমরালার মানষিলা আসিছেন না কেনে হে? তিলক জিজ্ঞাসা করে।

হামরালার কুনো মানষি নাই, বাঘারু জবাব দেয়।

এই জিজ্ঞাসা ও জাবাবের ভেতর কোনো নাটকীয় অবস্থান নেই। আলপথে-পথেই তাদের ফিরতে হয়। আলপথে একবার যে আগে যায় তাকে আগেই যেতে হয়। বাঘারুর হাতে ঝাণ্ডা আছে বলেই হয়ত বেশির ভাগ সময় বাঘারুকে আগেই থাকতে হয়। তাছাড়া, তিলক ত এই জায়গার নোক নয়, তাই কোন-কোন আল দিয়ে গেলে তাড়াতাড়ি হবে সেটা বাঘারুই ভাল জানে। কথাবার্তা যখন হয় তখন সব সময় প্রশ্নোত্তরের ভঙ্গিতেই হয়, তাও নয়। একজনের কথার জবাবে আর-একজন হয়ত নীরবই থাকে। পরস্পর কথাবার্তা বলতে বলতে যে এরা প্রায় একটা আলোচনা করে ফেলে, তাও নয়। অনেক সময়ই কথাগুলো পরস্পর নিরপেক্ষ ও স্বাধীন।

এইঠেকার মানষিলা গয়ানাথবাবুর কথা না-শোনে?

 হামরালার কুনো মানষি নাই।

 গয়ানাথবাবুর ত মানষি আছে? এ্যানং বড় জোতদার!

আছে, গয়ানাথের মানষি আছে।

 তোমরালা ত গয়ানাথের মানষি।

হয়। হামরালা গয়ানাথের মানষি।

তোমরালা একা-একা ঝাণ্ডাখান খাড়ি করি এ্যালায় টারিঠে বাহির হবা ধরছু, আর এ্যালায় হাট শেষ করি টারিত ফিরিবার ধই একা-একা। তোমরালার আর কুনো মানষি নাই?

মোর আর কুনো মানষি নাই। মোর একেলা মুই আছো।

তোমরালা কি উত্তরখণ্ডিত জয়েন দিছেন?

হামরালার কুনো খণ্ড নাই, কুনো জয়েন নাই।

 না, না, কহিছু, তোমরালার জোতদারখান ত জয়েন দিবার ধইচছে।

না জানো।

 না জানোত ঝাণ্ডাখান কান্ধত করি একেলা-একেলা হাট-হাট ঘুরিবার ধরিছেন কেনে?

মোর গয়ানাথ কহিছে তাই ঘুরিবার ধরিছু। মোক ত আগতও ঝাণ্ডা দিচ্ছে গয়ানাথ।

আগতও ঝাণ্ডা দিছে? কোটত?

স্যালায় জল্পেশত—

 তোমরালা জল্পেশত গেইছু হে? স্যালায় ত তোমরালা পুরাপরি উত্তরখণ্ড পার্টি হে।

 নাই রো। মোর খণ্ডটণ্ড নাই, মোর পার্টি-টার্টি নাই।

নাই, ত ধরিলেন কেন ঝাণ্ডা জল্পেশত?

 গয়ানাথ দিছে।

আরে, গয়ানাথ ত দিছে, ধরিছেন ত আপনি, স্যালায় ঝাণ্ডাখান ত আপনার।

 না-হয়। মোর ঝাণ্ডা নাই।

ত ছাড়ি দে ঝাণ্ডার কাথা। ক কেনে, চ্যানং করি মানষি জুটাবার যায়। মিছিল তুলিবার নাগে। তিস্তা ব্যারেজ খুলিবার দিন মিছিল নিগিবার নাগে।

গয়ানাথক কহেন। মিছিল নিগিবার কহিলে গয়ানাথ নিগাবে।

 ত গয়ানাথ তোমাক ছাড়ি আর কাহাকও কহে না?

 না জানো।

 গয়ানাথ কহিলে সব মানুষ মিছিল ধরিবে–হাটত?

 ধরিবে।

গয়ানাথ কহিলে সব মানুষ মিছিল ধরিবেতিস্তা ব্যারেজের দিন?

ধরিবে।

এর বাদে কুন হাট বড় হাট?

ক্রান্তির হাট।

 মুই কম গয়ানাথক ঐ হাটত থাকিবার?

কহেন।

 গয়ানাথ ঐ তিস্তা ব্যারেজের দিন মিছিলত থাকিলে মানষিলা আসিবে?

আসিবা পারে।

ত কহিম গয়ানাথক। কিন্তু তোমরালা জয়েন দিবেন না উত্তরখণ্ড পার্টিত?

মোর জয়েন নাই।

আরে তোমরালাও ত একটা আলাদা মানষি। রাজবংশী মানষি।

 মুই রাজবংশী না হও।

 ধূৎ বোকা! এইঠে হামরালা যত মানষি আছি, এইঠেকার আদিবাসী আছি

মুই এইঠেকার না হয়।

ধুৎ বোকা। তুই এইঠেকার না হন, কি বিলাতের মানষি হবার ধরিছেন?

না হই, মুই বিলাতের না হয়।

বিলাতের না হন ত এইঠেকার হন ত? এইঠেকার রাজবংশী?

 মুই রাজবংশী না হও।

ধুৎ বোকা, রাজবংশী না হবি ত তুই কি ভাটিয়া হবা ধইচছিস?

না হও। মুই ভাটিয়া না হও।

 ধুৎ বোকা–একখান ত তোর হবা নাগিবেই, হয় রাজবংশী, না-হয় ভাটিয়ার ঘর।

না হও। মুই রাজবংশী না হও। মুই ভাটিয়া না হও।

হয়, হয়। তুই একো একো পার্টি? রাজবংশী না হন, ভাটিয়া না হন! আর ঘাড় করি। উত্তরখণ্ডের ঝাণ্ডাখান ধরি জল্পেশ যাবার ধরিছেন! ঝাণ্ডাখান ধরি ধরি হাট-হাট ঘূরিবার ধরিছেন। এইঠে ত সগায় জানে তোমরালাই উত্তরখণ্ড পার্টি!

না জানে। মোর কুনো পাটি নাই। মোর কুনো মানষি নাই।

 হ-অ-য়। ঠিকেই কহছেন, তোর শুধু একখান ঝাণ্ডা আছে হে।

 না হয়। মোর কুনো ঝাণ্ডা নাই।

হ-অ-য়! ঠিকেই কহছেন, তোর শুধু একখান ঝাণ্ডা আছে হে।

না হয়! মোর কুনো ঝাণ্ডা নাই।

 হ-অ-য়! ঝাণ্ডাখানের তুই আছিস।

এ-সংলাপ এভাবে আরো কিছু নিশ্চয় হয়ে চলতে পারে। কিন্তু, এটুকুতেই ত তিলক আর বাঘারুর নানা হাটে ঘোরাফেরার ঘটনা বোঝা যাচ্ছে। সে-বোঝার চাইতেও বেশিবাঘারুকে গত দশ বার বছরে মাত্র এই তৃতীয়বার আত্মপরিচয় সংক্রান্ত সংলাপে বাধ্যত অংশ নিতে হল। দশবার বছর আগে এক এম-এল-একে নদী পার করাবার সূত্রে বাঘারু স্বেচ্ছাপ্রণোদিত এক দীর্ঘ-দীর্ঘ আত্মপরিচয় দিয়েছিল। তখন তার একটা ছোট দাবিও ছিল, এম-এল-এ যেন তার নামটা ছোট করে দেয়। কিন্তু এম এল-এ সে-বিষয়ে কিছু করতে পারে নি। আর বাঘারুর নামটা আরো-আরো বদলেছে। তিস্তার এক বন্যার সময় চার-চারটে গাছ নিয়ে বাঘারু যখন রংধামালির কাছে বাধে গিয়ে ওঠেন, তখন তাকে এক অফিসারের সঙ্গে জিজ্ঞাসাবাদে ঢুকতে হয়। সেখানে অফিসার শুধু তার নাম-ঠিকানা জানতে চেয়েছিল। কিন্তু বাঘারু সেটুকুও দিতে পারে না। আবার এখন উত্তরখণ্ড পার্টির সময় উত্তরখণ্ডের নেতাদের সঙ্গে তাকে এরকম একটা কথাবার্তায় ঢুকতে হয়। এবার বাঘারু যেন তার নিজের সম্পর্কে কিছু আরো বলতে পারে না। এখন সে শুধু বলতে পারে সে কী কী নয়, তার কী কী নেই। দশবার বছরে মাত্র তিন-তিনটি সংলাপ–তাও ক্রমসংক্ষিপ্ত! দশ বার বছরে মাত্র তিন-তিনটি সংলাপ-তাও ক্রমেই নেতিবাচক। বাঘারু কি তার জীবনে ক্রমেই নিজের কাছে নিজে অবান্তর হয়ে পড়ছে–ধারাবাহিকভাবে?

.

১৮৮. আবার ক্রান্তিহাট, আবার গয়ানাথ

ক্রান্তিহাটে গয়ানাথ নিজে হাজির ছিল। সে আসার আগেই ঝাণ্ডা কাঁধে বাঘারুকে হাটের নিমগাছতলায় দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছিল। পরে, তিলকও এসে সেখানে দাঁড়ায়। হাট শুরু হয়ে যায় অনেকক্ষণ আগে–বাঘারু দাঁড়িয়েই থাকে, তিলকও। নিমগাছটা হাটের একদিকে–সেই হাট কমিটির ঘরের লাগোয়া মাঠ আর হাটের সীমান্তে–যেখানে হাড়িয়া বিক্রি হয়। বাঘারুর দিকে তাকিয়ে হাটের লোকজন হাটে চলে যায়। এমন-কি, তিলকও মুদিখানা দোকানের পাশে তার সাইকেলটা তালা আটকে রেখে বাঘারু থেকে অনেক দূরে মিষ্টির দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে থাকে। বাঘারুর সঙ্গে যেন এই হাটের, এই হাটের মানুষজনের কোনো সম্পর্ক নেই। সে নিমগাছের তলায় আর-একটা গাছের মতই দাঁড়িয়ে থাকে। তার ঝাণ্ডা নারকেল গাছের ডালের মত বাতাসে দুলতে থাকে।

গয়ানাথ ঐ মিষ্টির দোকানের সামনের রাস্তা দিয়ে হনহন করে এগিয়ে এসে বাঘারুকে বলে, মানষিলা কই, যেইলা মিছিল তুলিবে?

বাঘারু তার ভঙ্গি অপরিবর্তিত রেখে বলে, কায়ও না আসে।

কায়ও না আসে? শালো বলদের দল! তোর সেই উত্তরখণ্ডের চ্যাংড়াখান কোটৎ!

গয়ানাথকে দেখে তিলক ততক্ষণে এগিয়ে এসেছে। তাকে দেখে গয়ানাথ চিৎকার করে, এইঠে আসিছেন কি খাড়ি থাকিবার তানে? মিছিল তুলিবে কায়? মুই? আর আপনি লিডার হবার ধরিবেন?

তিলক বলে, আমি ত কাউকে চিনি না। কায়ও ত আসে না!

আসে না? শালো বলদের দল! গয়ানাথ এসে পড়ায় ও চিৎকার-চেঁচামেচি শুরু করায় ছোট একটা ভিড় জমে যায়। সেদিকে তাকিয়ে গয়ানাথ চিৎকার করে একজনকে ডাকে, এই কানকাটু, যা কেনে, হাটত য্যায়লা আসিছে সগাক ডাকি নিয়া আয়, শালো বলদের দল!

কানকাটু হাটের দিকে দৌড়ায়। গয়ানাথ বলতে চেয়েছে, তার যে সব লোক হাটে আছে তাদের ডেকে আনতে। কিন্তু পেছন থেকে একজন মুখ লুকিয়ে চিৎকার করে ওঠে, হাট ভাঙি সগায় চলি আইসেন, ভটভটি জোতদারের মিছিল নাগিবে।

শালো, তোর বাপের বলহরির মিছিল নাগিবে, গয়ানাথ ভিড়টার দিকে চিৎকার করে বলে।

তিলক বাঘারুকে হাত ধরে এগিয়ে এনে এক জায়গায় দাঁড় করিয়ে দেয়, তারপর ভিড়টার দিকে তাকিয়ে বলে, লাইন নাগান, লাইন নাগান, মিছিল করিবার নাগিবে।

তিলক একটা ভুল করেছিল। সে ভেবেছে এই ভিড়টার সবাই মিছিলে যাবে। কিন্তু ভিড়টা জমা হয়েছিল গয়ানাথকে দেখে, গয়ানাথের চেঁচামেচিতে। তা ছাড়া ক্রান্তি হাটে উত্তরখণ্ডের মিছিল উঠবে–এর ভেতর একটা উত্তেজনাও ছিল। সেই ভিড়ের দু-একজন এসে বাঘারুর পেছনে দাঁড়ায় বটে, কিন্তু বাকিরা একটু-আধটু সরে যায়। তা ছাড়া, যারা ছিল তাদের তিলক যখন আবার ডাকে, আসেন আসেন, মিছিল করিবার নাগিবে, তখন তাদের একজন ঠাণ্ডা গলায় বলে দেয়, হামলা উত্তরখণ্ড না হই। বামফ্রন্ট।

গয়ানাথ ভিড়টার দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে, শালো, ফন্ট? কাম নাই কুত্তার নহরে সার। বামফ্রন্ট। ত এইঠে কী? শালো, বাম? পাছাত বাশ সিন্ধাইছে–স্যালায় বান?

যে নিজেকে বামফ্রন্ট বলে পরিচয় দিয়েছিল সে একই রকম ঠাণ্ডা গলায় বলে, এ্যাল্যাং-প্যাল্যাং কথা না কহেন দেউনিয়া। তার এই প্রতিবাদে দৃঢ়তা ছিল বটে কিন্তু একটু যেন দ্বিধাও ছিল, গয়ানাথ জোতদারের একেবারে মুখোমুখি তাকে অপমানকর কিছু বলার দ্বিধা।

এর মধ্যে হাটের ভেতর থেকে কিছু লোক বেরিয়ে গয়ানাথের দিকে আসতে শুরু করেছে। তাদের প্রায় প্রত্যেকের হাতেই বাজারের থলি বা ঝুড়ি। তারা আসে বটে, কিন্তু কেউই এসে বাঘারুর পেছনে লাইনে দাঁড়ায় না, একটু ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকে। কেউ-কেউ বসে পড়ে।গয়ানাথ বা থেকে ডাইনে মাথাটা ঘুরিয়ে তাদের সবাইকেই বলে, শালো, বলদের ঘর, সব এইঠে আসিছেন বাপের বিয়া দেখিবার তানে? লাগা কেনে, মিছিল লাগা, লাগা। গয়ানাথ একদিকে মারমুখো হয়ে এগিয়েই যায় কিন্তু লোজন ছড়িয়ে ছিল বলে দিকটা ঠিক করতে পারে না।

গয়ানাথের এ-চিৎকারে যারা বসেছিল তারা শুধু উঠে দাঁড়ায়, আর যারা দাঁড়িয়ে ছিল তারা মুখটা ঘুরিয়ে বাঘারুর দিকে দু-এক পা আসে কি আসে না।

গয়ানাথ এবার তিলককে বলে, এইঠে খাড়ি-খাড়ি করিছেনটা কী? সগাক দাড়ি করি ধরেন মিছিল।

তিলক আগে একবার অপ্রস্তুত হয়েছে। কিছুটা সঙ্কোচের সঙ্গেই একজন আলগা দাঁড়ানো লোককে গিয়ে বলে, খাড়ি যান, লাইন নাগান। সে লোকটি তিলকের নির্দেশ অনুযায়ী গিয়ে লাইনে দাঁড়ালে, আরো কয়েকজন তার পাশে ও পেছনে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে।

হেই ভাদই, হেই কাতুরা, ঐঠে কি বাংকুয়াখান ধরি, তোর ধোকর বাপের সম্পত্তি বেচিবার ধরিছিস? ভাদই ও কাতুরা একটু অন্যমনস্ক পায়ে এসে লাইনে দাঁড়ায়। তাদের হাতে বাক। হয়ত কিছু বেচার জন্যে বাকে করে নিয়ে এসেছিল–নয়ত কিছু কিনে বঁকে বয়ে নিয়ে যাবে। এখন বাকটা তারা হাতে ঝুলিয়েই রাখে।

গয়ানাথ হুকুম দেয়, চিৎকার ধরেন, মিছিল শুরু করি দেন, আর য্যালায় আছে স্যালায় সব হাটের ভিতর যোগদান দিবে।

তিলক খুব জোরে শ্লোগান দেয়, উত্তরখণ্ড পার্টি। তার উত্তরে কেউ কোনো সাড়া দেয় না। গয়ানাথ চিৎকার করে লাইনাধা ঐ কটি মানুষের মধ্যে ঢুকে পড়ে, শালো, বামের নামে ত জিন্দাবাদ করিবার ধরিস, এ্যালায় মূক-উঁদরার (বোবার মত) নাখান চুপ করি আছিস। গয়ানাথের এই পুরো বাক্যটাই যেন শ্লোগানের প্রথমাংশ, এমন ভাবে এই লোকগুলি ক্ষীণ এক সমবেত স্বর তোলে–জিন্দাবাদ।

তিলক আবার চিৎকার করে, উত্তরখণ্ড পার্টি। কিন্তু যেন তারই জবাবে যে-ভিড়টা এতক্ষণ এই মিছিলের প্রস্তুতির পাশে জমা হয়ে উঠেছে তার ভেতর থেকে একজন দক্ষ উঁচু নিশ্চিত গলায় হেঁকে ওঠে, বামফ্রন্ট জিন্দাবাদ। সেই জিন্দাবাদ-এর সঙ্গে আরো দু-একটি গলা মিশে যায়।

গয়ানাথ তিলককে বলে, মিছিল হাটের ভিতর নিগান। হে-ই বাঘারু হেট, হেট– বামফ্রন্ট জিন্দাবাদ, চিৎকারে মিছিলটা তাড়াতাড়ি চলতে শুরু করতেই পেছনের সেই ভিড়টা থেকে নেতৃত্বের আত্মবিশ্বাসে কেউ আহ্বান দেয়, হে-ই সগায় বামফ্রন্টের মিছিল সাজাও, মিছিল সাজাও। উত্তরখণ্ড পার্টির মিছিল চলিবে না, চলিবে না। সেই আহ্বানের সঙ্গে সঙ্গে ঐ ভিড়টার অনেকে দৌড়ে সেই মিষ্টির দোকান আর মুদির দোকানের মাঝখানে, হাটের পাকা রাস্তাটার দিকে ছোটে।

গয়ানাথ মিছিলটা থেকে একটু দূরে মিছিলের পেছনে হাটে ঢোকে। মিছিলটাতে আরো কিছু লোক ঢুকিয়ে সে কোনো দোকানে বসবে। কিন্তু হাটের ভেতরে ঢোকার পর মিছিলটার গলা যেন শোনাই যায় না-এক বাঘারুর লম্বা ঝাণ্ডাটার জন্যে এটা যে মিছিল সেটা তাকিয়ে অনুমান করতে হয়। উত্তরখণ্ড পার্টি জিন্দাবাদ, তিস্তা ব্যারেজ বন্ধ করো, ব্যারেজ বিরোধী মিছিলে যোগ দিন–এ সমস্ত নির্দিষ্ট ও পরিকল্পিত শ্লোগান মিছিলটা থেকে কেমন অর্থহীন হয়ে ঝরে যায়।

.

১৮৯. সেই ক্রান্তি হাট, সেই রাধাবল্লভ

 এদিকে সারা হাটে মুহূর্তের মধ্যে রটে যায় যে উত্তরখণ্ড মিছিল বের করেছে, এইবার বামফ্রন্ট মিছিল করবে। রটে যাওয়ায় হাটের ঐ চেঁচামেচির ভেতবেও এক-একদিকে দৌড়োদৌড়ি শুরু হয়ে যায়। কিন্তু কেউই ঠিক বুঝে উঠতে পারে না–উত্তরখণ্ডের মিছিলটা কোথায়। সেই অনিশ্চয়তার ভেতরই হাটের এক কোণ থেকে হৃষিকেশ চিৎকার করে, তিস্তা ব্যারেজ জিন্দাবাদ-জিন্দাবাদ আর দেখতে-দেখতে কাছাকাছি জায়গা থেকে অনেক লোক দৌড়ে এসে হৃষিকেশের পেছনে দাঁড়িয়ে হাঁটতে শুরু করে দেয়। বেঁটে একটা লাঠিতে একটা লাল ঝাণ্ডাও কোথা থেকে এসে যায়। রাধাবল্লভ আর আলবিশ ভগৎ রাস্তার পাশে এক পান-সিগারেটের দোকানের বেঞ্চিতে বসে ছিল। একজন দৌড়ে এসে তাদের বলে, মিছিল, মিছিল, উত্তরখণ্ড মিছিল দিবার নাগিছে। রাধাবল্লভ আর আলবিশ চকিতে উঠে দাঁড়িয়ে চার পাশে তাকায়। বামফ্রন্টের আর-একটা ছোট মিছিল সুধন সাহারা বের করে ফেলেছে। রাধাবল্লভ আর আলবিশ প্রায় দৌড়ে সেই মিছিলের সামনে চলে যায়। মিছিলের সামনে গিয়েই রাধাবল্লভ তার ছাতাটা বা বগলে নিয়ে ডান হাতের কনুই ভেঙে আঙুলগুলো মাথার ওপর দিয়ে পেছনে নিয়ে চিৎকার করে বসে, বন্ধুগণ। সুধন সাহা তাকে টেনে মিছিলের ভেতর এনে বলে, বন্ধুগণ পরে, এখন মিছিল তোলেন, মিছিল তোলেন। রাধাবল্লভ মুঠি আকাশে তুলে হাঁক দেয়, ক্রান্তি হাটে উত্তরখণ্ড চলবে না চলবে না। শ্লোগানটা মুহূর্তে ধরে যায়, যেন, মিছিলটা এই মুহূর্তে এরকম একটা কথাই বলতে চাইছিল। রাধাবল্লভ দ্বিতীয় শ্লোগান তোলে, গয়ানাথ জোতদারের বামফ্রন্ট-বিরোধী চক্রান্ত খতম করো, খতম করো।

এর মধ্যে হাটের আরো কয়েকটি জায়গা থেকে চা বাগানের শ্রমিকরা, ফুলবাড়ি বস্তির লোকজন ইত্যাদি আরো সবাই যে যেখানে ছিল বামফ্রন্টের মিছিল বের করে দিয়েছে। সেসব মিছিলের ক্ষিপ্রতা, দক্ষতা ও নিশ্চয়তা এত বেশি, সে-সব মিছিলের শ্লোগানগুলি রাজনৈতিক ভাবে এত নির্দিষ্ট যে অত বড় ক্রান্তি হাট জুড়ে শুধুই বামফ্রন্টের মিছিল উঠেছে, মনে হয়।

উত্তরখণ্ডের মিছিলটাকে খুঁজে পাওয়া যায় না। এমনিতেই গয়ানাথের চিৎকার-চেঁচামেচিতে যেকটি লোক জুটেছিল, বামফ্রন্টের এতগুলো মিছিলের এত হৈ চৈ-এ তারা ভয় পেয়ে সরে যায়। ভয় পাওয়া সত্ত্বেও তারা হয়ত সরতে পারত না যদি গয়ানাথ তাদের পাশে থাকত। কিন্তু গয়ানাথ তাদের একটু পেছনে ছিল–তার পক্ষে ত আর মিছিলে হাটা সম্ভব না। কিন্তু সে একে-ওকে ডেকে মিছিলে পাঠাচ্ছিল, তারা গিয়ে মিছিলে পাড়াচ্ছিলও। এর মধ্যে বামফ্রন্টের এতগুলো মিছিল যে হাটে নেমে পড়েছে তা গয়ানাথ, তিলক বা তাদের লোকজন টেরও পায় নি। কারণ, তারা এই মিছিলটা নিয়েই ব্যস্ত ছিল–শ্লোগান কী দিতে হবে কেউ জানে না, হাঁটতেও ঠিকমত পারে না, শুধু বাঘারুর ঘাড়ের ঝাণ্ডাটার জন্যে তাও মিছিলটাকে মিছিল বলে তারা নিজেরা চিনতে পারছিল। কিন্তু সেই সরু লম্বা বাঁশের মাথার লম্বা তিনকোনা ঝাণ্ডাটাও কম ঝামেলা করে না। হাটের দোকানগুলোর মাথার প্লাস্টিক যা চটের ছাউনির দড়ি এদিক-ওদিক করে বাধা। তার তলা দিয়ে বস্তা মাথায় মানুষ না-হয় যেতে পারে, কিন্তু এত বড় ঝাণ্ডা কাঁধে কারো পক্ষে যাওয়া অসম্ভব। হাট মিছিলের জন্যে দরকার ছোট ঝাণ্ডা। আর, বাঘারুর কাঁধের ঐ লম্বা ঝাণ্ডা মাঝে-মাঝেই নামিয়ে মাটির সমান্তরালে ঝুলিয়ে এক-একটা বাধা পার হতে হয়। আর, দু-পা ফেলতে না-ফেলতেই ত সেরকম আরো সব বাধা আসে। এই সবের ফলে উত্তরখণ্ডের মিছিল বা গয়ানাথের মিছিল কখন শুরু হয় আর কখন ভেঙে যায় সেটা বোঝাই যায় না। বামফ্রন্টের নানা মিছিল যখন সেই গোহাটা থেকে এই হাড়িয়াহাটা পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে আর আত্মবিশ্বাসে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে তখন তামাকহাটি আর গামছাহাটির মাঝখানের মোড়টায় বাঘারু একা ঝাণ্ডাটা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, যেমন সে নিমগাছের তলায় ছিল। এখানে ঝাণ্ডাটা অবিশ্যি খাড়াই ছিল। তার একটু দূরে তিলক দাঁড়িয়ে। আরো একটু দূরে গয়ানাথ দাঁড়িয়ে। এই তিনজনের দাঁড়ানোর মধ্যে কেনো যোগসূত্রও থাকে না–এটুকু ছাড়া যে তিনজনের দাঁড়ানোর জায়গা একটু অদ্ভুত। বামফ্রন্টের কোনো-কোনো মিছিল উত্তরখণ্ডের ঝাণ্ডাটার দিকে প্রায় ছুটতে-ছুটতে এসে দেখে-কোমরে দেড়হাতি ত্যানা জড়ানো একটা লোক ঝাণ্ডা নিয়ে খাড়া দাঁড়িয়ে। যেন, কোনো বটগাছের উঁচু ডালে কেউ মানতের ঝাণ্ডা বেঁধে গিয়েছে। দু-একজন যে বাঘারুকে দুটো-একটা ধাক্কা দেয় না, তা নয়, কিন্তু বাঘারু দৃশ্যতই এত অবান্তর যে সে-ধাক্কাতেও কোনো জোর ছিল না। তার চাইতে গয়ানাথ জোতদারকে, দেখে সেদিকে মিছিলটা নিয়ে যাওয়া অনেক লোভনীয় ঠেকে। গয়ানাথ কিন্তু দাঁড়িয়েই থাকে।

.

১৯০. বাঘারুর মিছিলমুক্তি ও মিছিলপর্বের শেষঅধ্যায়

তিস্তা ব্যারেজ উদ্বোধনের দিন উত্তরখণ্ড চ্যাংমারি ব্যারেজের রাস্তাটাই বেছে নেয়, কারণ, ক্রান্তি হাটের পাকা রাস্তা সেদিন বামফ্রন্ট ও সরকারের দখলে। গয়ানাথের যা লোজন তা ত প্রধানত এই রাস্তাটারই এদিক-ওদিক। এর বাইরে দূরে-দূরে গয়ানাথের জোতজমির লোকজনের সঙ্গে ত আর তার রোজ দেখা হয় না, তাই, সেসব লোক আর গয়ানাথের মানষি নেই।

সুস্থিররা নানা জায়গা থেকে ছেলেপিলে জোগাড় করে একটা সাইকেল মিছিল নিয়ে আসে। খান পঞ্চাশেক সাইকেল দেখতে বেশ লম্বাই হয়। সেই মিছিলটা চ্যাংমারি হাটের পাকা রাস্তা ধরে, চ্যাংমারি ফরেস্টের পাশ দিয়ে, গোলাবাড়ি আর পশ্চিম দোলাইগাওয়ের মাঝখান দিয়ে, নেওড়াবস্তির ওপর দিয়ে, সোজা ব্যারেজের দিকে যায়।

আর শ-খানেক লোকের একটা মিছিল পায়ে হেঁটে এই দিকেই চলে, কিন্তু তারা পায়ে হেঁটে যাচ্ছে বলে পাকা রাস্তা অনুসরণ করার কোনো বাধ্যতা তাদের নেই। তারা পাকা রাস্তা ছেড়ে মাঠের মধ্যে দিয়ে পশ্চিম দোলাইগাও থেকে বায়ে ঘুরে নেওড়াবস্তিতে গিয়ে ওঠে। নেওড়াবস্তিতে সাইকেল মিছিল আর পায়ে হাঁটা মিছিল মিলে খানিকটা যায়। কিন্তু তার পর সাইকেল মিছিলটাকে সোজাই যেতে হয়, আর পায়ে হাঁটা মিছিলটা ব্যয়ে সোজা তিস্তার দিকে পুরনো সিদাবাড়ির মুখে চলে যায়। সেখান থেকে তিস্তার পাড় দিয়ে-দিয়ে হেঁটে আপলাদের মুখে পৌঁছয়। সেখানে আবার সাইকেল মিছিল আর পায়ে হঁটা মিছিলটা মেলে। তারপর আপলাদের ভেতর দিয়ে একসঙ্গে গাজোলভোবা-তিস্তা ব্যারেজের দিকে চলে।

মিছিলের কাহিনী ত এক কথাতেই শেষ করে দেয়া যায়, কারণ, শেষ পর্যন্ত ত কেউ জানলই না উত্তরখণ্ডের মিছিল একটা এরকম হয়েছে। আর, তা ছাড়া এই মিছিলটা যাচ্ছিলই প্রায় চুরি করে। সারা জেলা আজ মেতে উঠেছে। ন্যাশনাল হাইওয়ে ল্যাটার্যাল রোড, ক্রান্তি মোড়-ওদলাবাড়ির রাস্তা ধরে ট্রাকে-ট্রাকে মানুষ যাচ্ছে। আর এরা সেখানে যেন সবচেয়ে গোপন রাস্তা দিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে কোনো রকমে বিক্ষোভ দেখাতে যাচ্ছে। কিন্তু মিছিলপর্বের শেষ অধ্যায়ে আমাদের জানা দরকার বাঘারু কোথায় ছিল? এই মিছিলেও উত্তরখণ্ডের সেই বিরাট তেকোনা ঝাণ্ডা লম্বা বাঁশের মাথায় বাঘারুর কাঁধেই ছিল।

মাত্র শ-খানেক লোককে ঐ নেওড়াবস্তির বরমতলে বা সিদাবাড়ির তিস্তাপাড়ে কী তুচ্ছ মনে হয়। আর তাও ত এরা কোনো লাইন করে যাচ্ছিল না। একমাত্র বাঘারু ও তার সেই লম্বা ঝাণ্ডাটাই ঐ বিশাল ছড়ানো প্রকৃতিতে এই লোকগুলিকে একটা অর্থে গেঁথে দিচ্ছিল।

আপলচাঁদের ভেতরে ঢুকে দুই মিছিল এক হয়ে যায়। এরাও নিজেদের একটু মিছিলের মত সাজিয়ে নেয়। সবচেয়ে আগে বাঘারু ঝাণ্ডাসহ। তারপর পায়েহাটা মিছিল। শেষে সাইকেল। সাইকেলের অনেকে নেমে সাইকেল হটিয়েও নেয়।

আপলচাঁদ বাঘারুর। বাঘারু আপলচাঁদের। তার পায়ের চাপে এর শুকনো পাতা ভেঙে যায়। তার হাত নাড়ালে এ-ফরেস্টের আপাতদুর্ভেদ্য বাধা দূর হয়ে যায়। এই ফরেস্টের ভেতরই কোথাও তার জন্ম হয়েছিল। এই ফরেস্টের ভেতরই কোথাও বাঘ তার পিঠে ও উরুতে সিল মেরে দিয়েছে যে সে আপলচাঁদের। এতগুলো লোক তার পেছনে থাকা সত্ত্বেও বাঘারু আপলচাঁদে যেন একা-একাই হাঁটে। শুধু কাঁধের অত বড় ঝাণ্ডাটার জন্যে তার চলার ছন্দটা একটু আলাদা হয়ে যাচ্ছে।

তিস্তার পাড় দিয়ে দিয়েই ত বাঘারু অনেকটা এল-এখন তিস্তা দুপাড় থেকেই অনেকটা সরে গেছে। বালি চমকায়, জল চমকায়, আর বাতাস তিস্তার মতই ধীরে বয়ে আসে। আপলাদের ভেতর থেকে এক-একটা ফাঁক দিয়ে কখনো কখনো সেই তিস্তাই দেখা যাচ্ছিল। আবার তিস্তা ঢেকে যাচ্ছিল। কিন্তু তিস্তার ওপর দিয়ে বাতাস অব্যাহত বইছিল।

এরকম যেতে-যেতে–বাঘারুর জন্মস্থান, বা দেশ, বা বাঘারুর পৃথিবীই বলা যায় যে-আপলচাঁদকে,  তার ভেতর দিয়ে যেতে-যেতে-বাঘারুর চোখে পড়ে যায় তিস্তা ব্যারেজ। বাঘারু আপলাদের সব, দৃশ্যই ত চেনে। কিন্তু এ দৃশ্য তার চেনা নয়। একবার দেখা যাবার পর থেকে সে-দৃশ্যও মাঝে-মধ্যে ঢাকা পড়ে যাচ্ছিল কিন্তু ক্রমশই বেশি স্পষ্ট হচ্ছিল। তারপর, সেটা চোখের সামনেই থাকে–তিস্তার ভেতরে আড়াআড়ি বিরাট প্রাচীর, তিস্তার নতুন একটা পাড়ই যেন, তাতে নানা রঙের গেট, নানা রঙের নিশানের মত কিছু উড়ছে।

এমন দৃশ্যে বাঘারু থমকায় না। আপলাদের ভেতরে কোনো নতুন দৃশ্যই বাঘারুকে থমকে দিতে পারে না। তার শুধু একটু সময় দরকার–দৃশ্যটাকে আপনাদেরই অংশ হিশেবে গেথে নেয়ার। শরীর.. ছাড়া ত কিছু নেই বাঘারুর। সেই শরীর দিয়ে যে আপলচাঁদ আর ঐ তিস্তা ব্যারেজটাকে মিলিয়ে নিতে চায়। বাঘারুর কাছে কোনো দৃশ্যই আপাদে অসংলগ্ন থাকতে পারে না। সে ব্যারেজকে। আপলাদের ও নিজের সংলগ্ন করে নিতে চায়।

এই প্রক্রিয়াটা কিছুক্ষণ ধরে চলছে আর বাঘারু মিছিলটা নিয়ে ঐ নতুন প্রাচীর, নানা রঙের ঝাতা, নানা রঙের মঞ্চের দিকেই এগচ্ছে। এগতে-এগতে রাস্তাটা প্রায় শেষ হয়ে আসে, সামনে যদিও। ফরেস্টের গাছ-গাছালি আরো একটু ছড়ানো, তবু ওখান থেকে স্পষ্ট দেখা যায় তিস্তা ব্যারেজ। একটু ডাইনে। পাহাড়ের মত প্রাচীর। তার ওপর প্রায় আকাশের কাছাকাছি মঞ্চ। লাল-নীল কত রং। কত গেট। মানুষজন ততটা এখান থেকে দেখা যাচ্ছে না কারণ এটা ত প্রায় পেছন দিক। নিশ্চয়ই সামনে মানুষজন থৈ থৈ করছে। এত বড় গেট আর মঞ্চ দেখলেই ত বোঝা যায়, তার সামনে কত লোক থাকতে পারে।

সুস্থির পেছন থেকে চেঁচায়, এইঠে খাড়ান। তারপর সাইকেলটাতে দুবার প্যাডল করে মিছিলে সামনে আসতে-আসতে বলে, ভাল করি খাড়িবেন আর শ্লোগানগিলা একটু প্র্যাকটিস করি নেন। সাইকেলটা বা হাতে ধরে সুস্থির ডান হাত আকাশে তুলে শ্লোগান দেয়, উত্তরখণ্ড পাটি, জিন্দাবাদ।

সুস্থির বলে ওঠে, দেখিলেন না ক্যানং বড় মিটিং হবা ধরিছে? আরো বড় করি কহেন–উত্তরখণ্ড। ঐ মঞ্চ, নিশান এইসব এদের উৎসাহিত করে থাকবে। বেশ জোর গলায় তারা জবাব দেয়, জিন্দাবাদ।

তিস্তা ব্যারেজ বন্ধ করো, বন্ধ করো।

 বামফ্রন্টের পৌষ মাস, রাজবংশীদের সর্বনাশ।

 তিস্তা ব্যারেজের জলে ভাসিবে কায়, রাজবংশী সমাজ হায়-হায়।

তোমার আমার সর্বনাশ, তিস্তা ব্যারেজ নিপাত যাক।

সবগুলো শ্লোগান যখন তারা বেশ রপ্ত করে নিচ্ছে এরকম ভাবে, তখন ঐ মঞ্চের দিক থেকে একটা জিপ ছুটে আসে। এরা নিজেদের শ্লোগানের আওয়াজ শুনছিল বলে হয়ত গাড়ির আওয়াজ শুনতে পায়নি। তিস্তার এমন আরণ্যক পাড়ে গাড়ির আওয়াজ-টাওয়াজ তেমন বোঝাও যায় না।

গাড়িটা একেবারে বাঘারুর সামনে এসে দাঁড়ায়। সুস্থির বাঘারুর একটু পেছনে দাঁড়িয়ে মিছিলকে শ্লোগান দেয়াচ্ছিল। গাড়িটা থামামাত্রই গাড়ির পেছন থেকে লাঠি ও বন্দুক হাতে কয়েকজন পুলিশ নেমে এগিয়ে আসে আর ড্রাইভারের পাশ থেকে এক অফিসার নেমে ড্রাইভারকে পেছিয়ে খোলা জায়গায় গিয়ে দাঁড়াতে বলে ব্যারেজের দিকে আঙুল তুলে। জিপগাড়িটা পেছিয়ে গিয়ে তিস্তার পাড়ে ডাইনে ঘোরে, ঘুরে আবার একটু পেছিয়ে তিস্তা ব্যারেজের দিকে মুখ করে দাঁড়ায়, স্টার্ট বন্ধ করে কিনা বোঝা যায় না। আর, সেই অফিসার এসে বাঘারুর সামনে কিন্তু একটু বয়ে সরে দাঁড়িয়ে সুস্থিরকে বলে, মিছিল এখনই ভেঙে দিন, শ্লোগান দেবেন না।

এমন আচমকা পুলিশ, লাঠি, বন্দুক দেখে মিছিলটা কেমন নড়ে ওঠে। সুস্থির পুলিশ অফিসারের দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে মুঠো পাকানো ডান হাত তুলে চিৎকার করে ওঠে, উত্তরখণ্ড পাটি। মিছিলের মাত্র কয়েকজন যেন অভ্যেসে জিন্দাবাদ বলতেই পুলিশ অফিসার দুপা পেছিয়ে গিয়ে বা হাতের আঙুল নেড়ে পুলিশদের নির্দেশ দেয়।  বন্দুক হাতে পুলিশ দাঁড়িয়ে থাকে কিন্তু দুপা এগিয়ে আসে। আর লাঠি হাতে পুলিশ দুটে আসে–লাঠি উঁচিয়ে নয়, বরং লাঠি নামিয়ে। মিছিলের দু-এক জন দৌড়ে পালাতে হবে বুঝতে না বুঝতেই পুলিশরা মিছিলের দুপাশে দাঁড়িয়ে পড়ে লাঠি মাথার ওপর তুলে মিছিলের দাঁড়িয়ে থাকা লোকগুলোকে পিটুতে থাকে। মুহূর্তের মধ্যে মিছিলটা ছত্রখান হয়ে যায়–যে যেদিকে পারে দৌড়ায়, সাইকেলওয়ালারা সাইকেল ফেলে দৌড়য়। আর, পুলিশরা বেশি ছোটাছুটি করে না বটে কিন্তু প্রায় সবাইকেই লাঠির নাগালে টেনে আনে আর এক-এক মারে মাটিতে শুইয়ে দেয়। সেই অফিসার এক পুলিশকে ডেকে সুস্থিরকে দেখায়। সে বেশ তাগ করে সুস্থিরের পিঠের মাঝখানে লাঠিটা মারে। সুস্থির উপুড় হয়ে পড়ে গেলে পুলিশটা লাঠি দিয়েই তাকে চিৎ করে নিয়ে লাঠিটা মাথার ওপর তুলে সুস্থিরের হাঁটুটাতে প্রচণ্ড জোরে মারে। মাত্র মিনিট কয়েকের মধ্যে ফরেস্টের ঐ জায়গায়, তিস্তা ব্যারেজের অত কাছে, উদ্বোধন মঞ্চের পেছনে অতগুলো মানুষ কেমন ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে থাকে। কোনো চিৎকার চেঁচামেচি পর্যন্ত হয় না। একটা জিপে আর কটা পুলিশ আঁটে? সেকটাও ছিল কিনা সন্দেহ! তারা মাত্র কয়েক মিনিটে উত্তরখণ্ডের স্বতন্ত্র রাজ্যের দাবি আপলৰ্চাদের এক টুকরো জমির ওপর মেরে, ভেঙে, থেঁতলে ফেলে দিয়ে চলে যায়।

.

বাঘারু যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল, সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকে। ঝাণ্ডাটা তার কাঁধেই থাকে। সে পালাতে পারে না, বা, পালাতে পারেনি, বা, পালায়নি, বা, পুলিশের সামনে তার শরীরের পালানোর প্রতিক্রিয়া ঘটেনি। জিপটা তার একেবারে সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল। অফিসারও তার সামনে তার একটু বায়ে দাঁড়িয়েছিল। পুলিশ তাকে এড়িয়ে পেছনের মিছিলটাকে ধরেছে, যেমন, পেছনের মিছিলটাকে ধরতে একটা বা দুটো গাছও এড়াতে হয়েছে। এড়িয়ে যেতে-যেতেও তারা বাঘারুকে লাঠি দিয়ে মেরে গেছে। কিন্তু কখনোই বাঘারুকে প্রধান লক্ষ্য করে নি। হয়ত, বাঘারু, অত লম্বা বলেই পুলিশদের লাঠি তার শরীরের তেমন কোনো লোভনীয় অংশকে লাঠির আওতায় আনতে পারে নি। হয়ত, বাঘারু, তার ঐ অত লম্বা একটা ন্যাংটো শরীরে, এমনকি পুলিশের পক্ষেও অযোগ্য ঠেকেছে। মিছিল উপলক্ষে গয়ানাথ তাকে অন্তত একটা জামা আর খাটো ধুতি দিলেও পুলিশ হয়ত, তাকে চিনে নিতে পারত।

পুলিশ বাঘারুকে মারেনি বা মারের প্রধান লক্ষ্য করেনি। বাঘারুও পুলিশের লাঠিবন্দুক-গাড়ি দেখে পালায়নি। হয়ত এটা আপলচাঁদ বলেই পালায়নি। এই আপলাদের, এই জংলাজমির, এই গাছ-গাছালির সবটুকু তার এত বেশি চেনা যে সে বুঝেই উঠতে পারে না এখানে সে কোথার আত্মগোপন করতে পারে। একটা মানুষ ত তার বাড়িতেই লুকনোর কোনো জায়গা পায় না–সমস্তটাই তার কাছে এত প্রকাশ্য। তাই তাকে পুলিশ আর মিছিল সব মিশিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। গয়ানাথ তাকে ঝাণ্ডা দিয়ে দাঁড় করিয়েছে। ঝাণ্ডার পেছনে মিছিল। সে-মিছিল এমন তছনছ হয়ে গেলেও বাঘারু দাঁড়িয়েই থাকে।

মিছিলপর্ব এখানেই শেষ হোক। এর পরের পর্বে পুলিশদের পেছন-পেছন যাওয়া যাবে–পুলিশ কেন আসে, কোত্থেকে আসে।

মিছিলের লোকজন যে-যার মত ফিরে গিয়েছে। সাইকেলওয়ালারা সাইকেল নিয়েই ফিরে গেছে। কেউ বাঘারুকে কিছু জিজ্ঞাসা করে নি। কিন্তু এই সব প্রস্থান ঘটে যাওয়ার পর এই আপলচাঁদ, গাছ-গাছালি, জংলাজমি, সামনের তিস্তা আবার বাঘারুর কাছে পুরোপুরি ফিরে আসে। শুধু তিস্তার ভেতরে ঐ বিরাট প্রাচীর, প্রাচীরের ওপর অত গেট আর মঞ্চ, গেটে আর মঞ্চে এত ঝাণ্ডা–এই সব ঐ তার স্বদেশের সঙ্গে ঠিক মেলে না।

কিন্তু মেলাতে ত হবে। বাঘারুকেই মেলাতে হবে। এখানে এই আপাদে বাঘারু না-দেখলে একটা বিরাট লাম্পাতি গাছের বাড় আটকে যায়। কী লাভ বেড়ে যদি বাঘারুই না দেখে? এখানে এই আপাদে একটা লতার কুঁড়ির ফুল হওয়া আটকে যায় বাঘারু না-দেখলে। কী লাভ বেড়ে যদি বাঘারুই না দেখে? এখানে এই তিস্তার একটা স্রোতের একটু উদাসীন সরে যাওয়াও থমকে যায় বাঘারু না-দেখলে। কী লাভ সরে গিয়ে যদি বাঘারুই না দেখে? আর, এই আপলাদের পাশে এই তিস্তা নদীর ভেতর এমন একটা আড়াআড়ি পাহাড় পুঁতে দিয়ে উত্তর আর দক্ষিণের নদীটাকে আলাদা করে দেয়া হবে বাঘারু না-দেখতেই? সেই পাহাড়ের গায়ে এত গেট আর এত মঞ্চ আর এত স্টেজ হবে বাঘারুকে না-দেখিয়েই? এই আপলচাঁদ ফরেস্ট আর তিস্তা দিয়ে তৈরি তার স্বদেশে ঐ তিস্তা ব্যারেজটাকে অন্তর্ভুক্ত করে নিতে বাঘারু সেই উদ্বোধন মঞ্চের দিকে এগিয়ে যায়। দুপা গিয়েই বোঝে কাঁধে তার ঝাণ্ডাটা তখনো আছে। সে বা হাত বাশটা থেকে সরিয়ে নেয় আর বা কাঁধে একটা ঝাঁকি দেয়। ঝাণ্ডাটা মাটিতে পড়ে যায়, বাঁশের গোড়াটা পড়ে বাঘারুর পরবর্তী পদক্ষেপের নীচে। সেটা মাড়িয়ে বাঘারু এগিয়ে যায়।

এবার বাঘারুর দুই হাত খালি, কাধ খালি, সারা শরীর হাল্কা। একটুকরো নেংটি ছাড়া তার আর-কোনো আবরণ নেই। এখানে, আপলচাদে, তিস্তার পাড়ে, যেমন পা ফেলতে সে আজন্ম অভ্যন্ত সেই ছন্দে তার শরীরটা দুলে ওঠে। দোলে। বাতাসে দুলতে-দুলতে বাঘারু তিস্তা ব্যারেজ উদ্বোধনের ঐ রঙচঙে স্টেজ আর প্যান্ডেলের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে–দেখিবার নাগে ঐঠে কি সত্যিই একখান নতুন নদী বানিবার ধরিছে, নাকি, ময়নাগুড়ির ঐ বেটিছোয়াখানের নাখান নাচানাচি নাগাবার ধরিছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *