৫.২ উত্তরখণ্ডের ফাংশনের আলোচনা

১৬১. উত্তরখণ্ডের ফাংশনের আলোচনা–দুই

বীরেনবাবুর বাড়িতে রাত সাড়ে নটা নাগাদ নকুল, জগদীশ, সুরেন, নবীন, তিলক, তরণীবাবু আসতে পারলেন।

বীরেনবাবু মাঝের ঘরটাই তার কাছারি ঘর। সে-ঘরে ওকালতির কাগজপত্রে ভর্তি টেবিলের সামনে গোটা চারেক কাঠের চেয়ার, আর এক পাশে একটা লম্বা কাঠের বেঞ্চি–হেলান দেয়া ও হ্যান্ডেলওয়ালা। বীরেনবাবু আলো জ্বেলে পড়ছিলেন, এরা ঘরে ঢোকার পরও চোখ তোলেন না। কিন্তু চেয়ার-বেঞ্চে এরা বসে যাবার পর বইটার ভেতরে একস্টা কাগজ দিয়ে পাশে সরিয়ে রেখে তিনি বেঞ্চ ও চেয়ারে যারা বসে আছে তাদের সবাইকে দেখে নেন।

নকুল বলল, বেণীবাবুর শরীরটা খারাপ বলে আসতে পারলেন না, কাল প্যান্ডেলের মিটিঙে নিশ্চয়ই আসবেন।

বীরেনবাবু কোনো কথা বলেন না, সামনে তাকিয়ে থাকেন।

সুরেন বলল, বীরেনকাকা, এখন এত রাতে আপনাকেও ত বেশিক্ষণ বসিয়ে রাখা যাবে না। আমরা মেটামুটি কথাবার্তা বলতে বলতে এলাম। একটা জিনিশ আমরা ঠিক করেছি–উত্তরখণ্ড সম্মিলন আর আমাদের অনুষ্ঠানটাকে যদি আলাদা করে চায় আমরা তাতে রাজি হব না।

কথাটা শুনে বীরেনবাবু আবার সকলের মুখ দেখেন যেন যাচাই করতে যে যারা এসেছে তাদের মধ্যে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের প্রধান উদ্যোক্তা ক-জন, আছেন। সম্মিলন আর অনুষ্ঠানকে আলাদা করার ব্যাপারে অনুষ্ঠানেই যারা টাকা খাঁটিয়েছে তাদের সমর্থন থাকতে পারে কিন্তু উত্তরখণ্ডী কারো সমর্থন ত থাকবে না। বীরেনবাবু এটাতে আশ্বস্ত হন যে যারা এসেছে অনুষ্ঠানের সঙ্গেই তাদের সম্পর্ক বেশি।

সুস্থিরকে ত দেখছি না, বীরেনবাবু জিজ্ঞাসা করেন।

ও ত সম্মিলনের কাজেই সব জায়গায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। রাতেই ফিরে আসবে। কালকের মিটিঙে থাকবে। নকুল জানায়।

রামকিশোরের ময়নাগুড়ি বাজারে ব্যবসা আছে। সে বলল, স্যার, আমরা একটা কথা ভাবছিলাম। এই সরকারের মিটিঙে যদি বিলকুল সব লোগ আমরা গিয়ে হাজির হই ত কাজের কথা কেইসে হবে। আর আমরা ব্যবসায়ী লোগ। এই সব পাটিটাটির মিটিঙে গেলে কে গুসা হবে, কে খুশ হবে–আমাদের এই সব করা চবে না। আমাদের ছেড়ে দেন স্যার।

বীরেনবাবু কথাগুলো শুনছিলেন টেবিলের দিকে তাকিয়ে। শেষ কথাটা শোনার পর চোখ তুলে রামকিশোরকে দেখেন, তুমি ত ঐ তেরজন পার্টনারের মধ্যে নেই।

না স্যার, তা নাই, লেকিন কমিটিতে আছি।

মানে, তুমি কমিটি ছেড়ে দিতে চাচ্ছ?

 না, না, স্যার, কমিটিতে আমি থাকব, আছি রামকিশোর তাড়াতাড়ি বলে। তাকে থামিয়ে দিয়ে তরণীবাবু বলে ওঠেন, আমরা বলছিলাম বীরেনদা, আমরা যেমন আছি, থাকব, আপনারা যা ঠিক করবেন আমরা তাই মেনে নেব, আপনারা যে মিটিং-টিটিং ডাকবেন তাতেও থাকব, মানে যেমন ছিলাম থাকব। কিন্তু এই সরকারি মিটিঙে আমরা যেতে চাই না। আমরা ত কথাও বলতে পারব না, মাঝখান থেকে ভিড় বাড়বে আর ঐসব পার্টির লোকজন আমাদের ওপর খেপবে। আমাদের ত ব্যবসা করেই খেতে হয়। 

ময়নাগুড়ি বাজারে তরণীবাবুর বড় সাইকেলের দোকান। আরো নানা রকম জিনিশের এজেন্সি আছে। তরণীবাবুর কথা শুনে বীরেনবাবু রঘুনাথের দিকে তাকান–তারও দোকান আছে, তারও নিশ্চয়ই একই মত।

কাকা, আমরা কথা বলে এটা বুঝে গেছি যে সরকারের প্রস্তাবে কেউ রাজি হবে না, কেউ ভয়ও পাবে না। আমাদের তের জন পার্টনারের পাঁচজনকে আপনি কোনো সময়েই পাবেন না। তারা টাকা দিয়ে খালাশ আর টাকা পেলেই খুশি। আর, ঐ পঁচজনের কেউ-কেউ কেটেও পড়তে পারে হাঙ্গামার ভয়ে। কিন্তু সেসব দু-একজনের জন্যে ত আর আমরা পেছিয়ে যেতে পারি না। তাই আপনি বরং ঠিক করুন কাকে কাকে নিয়ে ঐ মিটিঙে যাবেন, নকুল বলে।

তোমাদের তেরজনকেই কিন্তু মিটিঙে ডেকেছে। আমাকে সেক্রেটারি হিশেবে চিঠি দিয়েছে। ঐ তেরজনকে খবর দিয়ে এই চিঠিতে তাদের সই নিয়ে রাখবে। কিন্তু ঐ তেরজনকে মিটিঙে অন্তত একবার মুখ দেখাতে হবে। সেটা দেখো তোমরা। আর উত্তরখণ্ডের পক্ষে যারা ভাল করে কথা বলতে পারবে শুধু তাদের পাঠাও, বীরেনবাবু বলেন।

আমিও সেই বলছিলাম কাকা, জগদীশ বলে, তা হলে, আপনি ত আছেনই, কিন্তু আপনি একা-একা কত কথা কহিবেন। স্যালায় জুনিয়ার উকিল দুই-একটা যদি নিগি যাওয়া যায় ত ভাল হয়। জুনিয়াররা চিল্লামিল্লি করিবার পারিবে–আপনি শ্যাষ কথাটা কহি দিবেন।

নকুল হেসে উঠে বলে, আরে কাকার ত মুখ তুলতে হবে, হাত তুলতে হবে, গলা পরিষ্কার করতে হবে–তার পরে কথাটা বলবেন। তার মধ্যে ত সরকারি পার্টির লোকরা জিন্দাবাদ জিন্দাবাদ করে দেবে। সকলে হেসে ওঠে। একটু মৃদু হেসে বীরেনবাবু বলেন, তোমরা কি কারো কথা ভেবেছ? রাজি হবে?

ভাবছিলাম দেবনাথ মাস্টারের কথা আর শিলিগুড়ির উমা উকিলের কথা, নকুল বলে বীরেনবাবুর দিকে তাকিয়ে থাকে। বীরেনবাবু একটু ভাবেন। তারপর চোখটা নামিয়ে বলেন, ওরা রাজি হবে?

শুনে ওরা চুপ করে থাকে।

বীরেনবাবু যোগ করেন, দেবনাথ উপস্থিত থাকলে খুব ভাল হয়। রাজবংশী সমাজের একমাত্র পি-এইচ-ডি। কিন্তু সে ত ইউনিভার্সিটিতে চাকরির চেষ্টা করছে, সে কি এ-সবে জড়িয়ে পড়তে চাইবে? আর উমাপদও খুব ভাল কিন্তু ওরা ত কংগ্রেসের ছিল।

কংগ্রেস ত কাকা, উত্তরখণ্ডের বেশির ভাগই। জগদীশ বলে।

 না, কিন্তু তাদের ত সবাই চেনে না। উমাপদ শিলিগুড়ি কোর্টে অনেক দিন ধরে প্র্যাকটিশ করছে। এখন সরকার যদি প্রমাণ করে দেয় যে উত্তরখণ্ডের পেছনে কংগ্রেস আছে তা হলে ত সেটা এমন প্রচার করবে যে তোমরা আর কথা বলতে পারবে না। বীরেনবাবুর কথার পরে সবাই চুপ করে থাকে।

বীরেনবাবু আবার বলেন, কিন্তু তোমরা এটা ভাল ভেবেছ। এক কাজ করো, দেবনাথকে রাজি করাও, তাকে কোনো কথা বলতে হবে না। কিন্তু আমরা দরকার হলে তার কথা বলব। বীরেনবাবু একটু থেমে যান, তারপর বলেন, দেবনাথকে বলো, এতে তার চাকরির সুবিধেই হবে। আর কোচবিহারের সন্তোষকে আনো।

সন্তোষ মানে সন্তোষ মোক্তার? সুরেন জিজ্ঞাসা করে।

এখন এ্যাডভোকেট। কিন্তু সন্তোষের সঙ্গে তোমাদের কি আগে কথাবার্তা হয় নি? আমি ত যতদূর জানি ও এব্যাপারে সাপোর্টই করবে। সন্তোষ যদি সবটা না জানে, তা হলে ও রাজি নাও হতে পারে। ও এলে তোমরা যেটা চাইছ সেটা খুব ভাল হত–খুব স্ট্রংলি আরগু করতে পারত। তোমরা কালই চলে যাও। আমার নাম করে বলো। ওকে আনো। বীরেনবাবু থেমে যান। সবাই একটু চুপচাপ থাকে। তারপর তরণীবাবু বলেন, যেন বসে আছেন বলেই বলেন, নইলে বলতেন না–একটা কিছু উপায় ভেবে গেলে হত না?

উপায় মানে? সুরেন জিজ্ঞাসা করে।

ধরেন, সরকার বলল–উত্তরখণ্ড করা চলবে না আর আপনারা বললেন উত্তরখণ্ড আর ফাংশন দুটোই করতে হবে এতে ত আর সমাধান হবে না। আমি বলছিলাম–শেষদিনের মিছিলটা শুরু হওয়ার জায়গাটা যদি বদলাতে রাজি থাকেন তা হলে সরকার হয়ত আর-কিছু বলতে পারবে না, মানে ইচ্ছে থাকলেও বলতে পারবে না।

মিছিল মানে জল্পেশ্বর অভিযান? তিলক জিজ্ঞাসা করে।

হ্যাঁ, তরণীবাবু বলেন।

 মানে, মিছিল হবে না? তিলক জিজ্ঞাসা করে।

না, না, মিছিল হবে। ধরেন, আপনারা রাজি হলেন যে ঐ শ্রীদেবীর নাচ থেকে মিছিল বের না হয়ে চৌপত্তি থেকে হবে, তাতে ত আর-কোনো ক্ষতি নেই। তরণীবাবু বলেন।

সে রকম আপোশের কথা ভাবতে হবে বৈকি। তা হলে তোমরা এসো, কালকে ঘোরাঘুরি করে কী হয় জানিও, বীরেনবাবু উঠে দাঁড়ান।

.

১৬২. জলপাইগুড়ি সার্কিট হাউসের স্থাপত্য

জলপাইগুড়ি সার্কিট হাউসে মিটিঙের ঘরটা খুব ছোট। আসলে এটা মিটিঙের ঘরই নয়, খাওয়ার ঘর। একটা ছোট্ট পার্টিশন দিয়ে বসার জায়গা আলাদা করা। সেই ইংরেজ আমলে টুরে আসা গরমেন্ট অফিসারদের জন্যে এরকম বাংলো ধরনের সার্কিট হাউসটা তৈরি হয়েছিল। জলপাইগুড়ি শহর জেলার সদর, তদুপুরি কমিশনার জলপাইগুড়িতেই থাকেন। সুতরাং জেলার অফিসারদের টুরে আসার। কোনো সুযোগই ছিল না। এক আসতেন কলকাতা থেকে গবর্মেন্টের সবচেয়ে বড় কর্তারা। অন্য জেলা থেকে অফিসাররা কমিশনারের সঙ্গে দেখা করতে বা জেলা কোর্টে সাক্ষী দিতে আসতেন। ভারতীয় অফিসাররা স্বাধীনতার আগে এই সার্কিট হাউসে বোধ হয় খুব একটা উঠতেন না–তাঁরা বরং স্টেশনের কাছে ডাকবাংলোটা পছন্দ করতেন। সার্কিট হাউস প্রধানত ছিল সাহেবদেরই জন্যে। সাহেবদের কথা ভেবেই জায়গাটা বাছা হয়েছিল। এখন এই রাস্তার পুবে, তিস্তার পাড়ে কমিশনারের, ডিস্ট্রিক্ট জজের, ডেপুটি কমিশনারের ও ডিভিশন্যাল ফরেস্ট অফিসারের বিরাট-বিরাট বাংলো–লাল ইট, ঢালু ছাদ আর বিঘে-বিঘে বাগান। রাস্তার পশ্চিমে বিরাট জামবাগানের মাঠ, তার পাশে করলা নদী। এই করলা নদীর পাড়ে, জামবাগানের মাঠের দক্ষিণ সীমায়, একতলা ছিমছাম এই একটেরে সার্কিট হাউস।

এর স্থাপত্যও বাংলোগুলো থেকে আলাদা। তিনদিকে–সামনে, বয়ে ও ডাইনে চওড়া বারান্দা, খিলান দেয়া। নিচু মেঝে–এতটা নিচু মেঝে এদিকে দেখাই যায় না। সামনের বারান্দা দিয়ে ঢুকে বসার জায়গা আর পার্টিশন দিয়ে ভাগ করা খাবার জায়গা। সেই ঘরটার দিকে মুখ করে পেছনে তিনটি মাত্র বড় শোয়ার ঘর। খিলানের সঙ্গে মিল রেখেই, ছাদটা একঢালাইয়ের নয়, বারান্দাগুলোর ওপর একটা ছাদ আর তার এক ধাপ ওপরে ঘরগুলোর ওপর আর-একটা ছাদ। ওপরের ছাদের মাঝখান দিয়ে একটা চিমনির বাধানো নল। সেটা এখন আর কোনো কাজে আসে না–শীত কমেছে বলে নয়, শীতে কাঠের আগুন জালানোর লোক আর-নেই বলে। কিন্তু রাস্তার বিপরীতের বাংলোগুলো ও এই সার্কিট হাউসের সারিতেই পরে, কোর্ট বিল্ডিঙের ইন্ডিয়ান রেড রঙের বিপরীতে এই ছিমছাম বাড়িটির আবছা হলদে রঙ এখনো যখন ফেরানো হয়, তখন এই চিমনির রঙও বদলায়।

সার্কিট হাউস এখনো সার্কিট হাউসই। মন্ত্রীরা, বড়বড় অফিসাররাত এখানে এসে ওঠেন। কিন্তু মন্ত্রীদের আসার সুবাদেই সার্কিট হাউসের ব্যবহার একটু বদলেছেও। মন্ত্রীদের সঙ্গে মিটিঙগুলো সার্কিট হাউসেই হয়–সে-মিটিং অফিসারদের সঙ্গেও হতে পারে, তা সর্বদলীয় মিটিঙও হতে পারে। মিটিঙের জন্যে কোনো হল না থাকায় খাওয়ার জায়গায়, খাওয়ার লম্বা টেবিলটাকে ঘিরেই মিটিং বসে। অনেক সময়ই তাতে জায়গা কুলোয় না–তখন দ্বিতীয় সারি চেয়ার সাজাতে হয়। কিন্তু এই খাবার ঘরটার টেবিল ও এক সারি চেয়ারের পেছনে দ্বিতীয় সারি চেয়ার সাজালে নড়াচড়ার আর-জাগয়া থাকে না। ভেতর থেকে কেউ বাইরে বেরতে গেলে স্টিলের চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে চেয়ার ভাজ করে জায়গা দিতে হয়। তাই বেশির ভাগ সময়ই তেমন বড় মিটিঙের ভিড়টা ঘর থেকে বারান্দায় উপছে আসে। বারান্দার দরজায় লোজন ভিড় করে থাকে। তা ছাড়াও বসার জায়গা ও খাওয়ার জায়গাটা ভাগ করে যে-পার্টিশন আছে, সেই পার্টিশনের কাছেও লোকে ভিড় করে আসে।

সেদিনের মিটিঙে ভিড় অতটা হয় নি কারণ বিষয়টা শহর নিয়ে নয়, ময়নাগুড়ি নিয়ে। কিন্তু শ্রীদেবীর ফাংশন বাতিল হতে পারে এরকম একটা কথা মাত্র একদিনের মধ্যে জলপাইগুড়ি শহরে সামান্য একটু রটেছিল। ফলে, ব্যাপারটা কী জানতে কেউ-কেউ এসেছিল। কিন্তু মিটিঙের ভেতরে যাবে না অথচ মিটিঙে কী হচ্ছে সে ব্যাপারে উদ্বিগ্ন ময়নাগুড়ির লোকজন অনেকেই চলে এসেছে। যারা এসেছে তাদের মধ্যে এই উত্তরখণ্ড সম্মেলন ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের নানা ধরনের কর্মী ত আছেই, তা ছাড়াও যারা টিকিট কিনেছে–ফাংশন দেখতে যাবে, তাদেরও একটা বড় অংশ আছে।

কর্মীদের মধ্যে যারা মিটিঙে ঢুকতে পারে নি তারাই যে শুধু বাইরে আছে, তা নয়। এমন অনেকেই বাইরে বারান্দায় ঘোরাফেরা করছে বা বারান্দার কিনারে মাটিতে পা ঝুলিয়ে বসে আছে, যারা এই সম্মেলন অনুষ্ঠানের কর্মকর্তা ও তাদের সঙ্গে আলোচনার জন্যেই এই মিটিঙ ডাকা হয়েছে। কিন্তু এই কর্মকর্তারা যেন মিটিঙের দায়িত্ব অন্যদের ওপর ছেড়ে দিয়ে নিজেরা বাইরে দাঁড়িয়ে আছে–মামলা-মোকদ্দমার সময় যেমন এজলাশের বাইরে থাকে, উকিল-মোক্তাররা ভেতরে মামলা লড়ে।

যারা বাইরে বসে ছিল ও ঘোরাঘুরি করছিল, তাদের চোখের ওপর দিয়েই সম্মিলন ও অনুষ্ঠানের পোস্টারমারা বাস কোর্টের দিকে যাচ্ছিল, কোর্ট থেকে ফিরছিল। এমন-কি, একটা মিনি বাসের পেছনে মিস্টার ইন্ডিয়া ফিল্মে শ্রীদেবীর একটা নীচের রঙিন ছবি টাঙানো।

জলপাইগুড়ির এম-এল-এ আর কোচবিহারের নাটাবাড়ির এম-এল-এ মন্ত্রী। ডুয়ার্সের আর-এক এম-এল-এ বনবিভাগের রাষ্ট্রমন্ত্রী। এদের কাউকে বাইরে দেখা যাচ্ছে না, কিন্তু ময়নাগুড়ির এম-এল-এ বাইরে এসে অনেকের সঙ্গেই কথা বলছিলেন। এম-এল-এ যখন প্রথম বাইরে এসেছিলেন তখন তার হাতে একজন নিজের কাজের কথা বলেই তিনটি কাগজ ধরিয়ে দেয়। সেই কাগজগুলি পাকিয়ে এম-এল-এ ডানমুঠোতে আলগা করে ধরে রেখেছিলেন। কিন্তু সেই ডান হাতটাই তিনি এত নাড়াচ্ছিলেন কখনো মাথার পেছনে নিয়ে যাচ্ছিলেন, কখনো কারো পিঠে আলতো করে রাখছিলেন, কখনো কাউকে ছোট কিল মারছিলেন যে মনে হচ্ছিল, ঐ কাগজগুলো পাকিয়ে হাতের মুঠোয় না রাখলে তিনি হাতটা অত ব্যবহার করতে পারতেন না। এম-এল-এর জামাকাপড়ের রঙটা আধ-ময়লা, গলায় একটা চাদর জড়ানো। তাকে দেখে মনে হচ্ছিল, এ-মিটিঙের সঙ্গে তার সম্পর্ক সবচেয়ে দূরের। অথচ আসলে, এ-মিটিঙের সঙ্গে তার সম্পর্ক দুদিক থেকে নিবিড়। ঘটনাটা ঘটছে ময়নাগুড়িতে। সুতরাং সরকার পক্ষের আশা, যে, তিনি আগে কথাবার্তা বলে কোনো সমাধান ঠিক করে রাখবেন। আবার, অনুষ্ঠানকর্তাদেরও আশা যে তিনি একটা উপায় বালাতে পারবেন। কিন্তু এম-এল-এর কথাবার্তায় ও চলনবলনে কোনো উদ্বেগই ধরা পড়ছিল না।

এম-এল-এ বারান্দার ওপরে কিন্তু সিঁড়ির কাছাকাছি দাঁড়িয়ে ছিলেন, ফলে সবাই তাকে ঘিরেই গোল হয়ে কথা বলছিল। এম-এল-এ একটি পঁচিশ-ছাব্বিশ বছরের ছেলের কাঁধে হাত দিয়ে তাকে বলেন, এ ক্যানং কথা কহিছিস তুই? উত্তরখণ্ড পার্টি করিবারও ধরবু আবার মোর পার্টিও করিবার ধরব? ছেলেটা হেসে বলে, কেনে ধরবু না, কহেন?

বোঝা যায় এরা একটু রসিকতা করেই রাজবংশী ভাষায় পরস্পরের সঙ্গে কথা বলছে।

এম-এল-এ হেসে উঠে বলেন, মোক ধাঁধা ধইচছিস? টিভির কুইজ? আচ্ছা, মুই তোক ধরছু, তুই ককেনে। হামরালার কমিউনিস্ট পার্টি চাহে এই সারা দুনিয়ার বদল, আর তোর এই উত্তরখণ্ডটা চাহে এই তোর তিস্তা পারের বদল। ত, দুনিয়াটা বদলি গেলে ত তিস্তাপারটাও বদলিবে। কিন্তু তিস্তাপারটা বদলি গেলে কি দুনিয়াটা বদলিবে, ক কেনে, ক।

ছেলেটি দুটো হাত মুখের কাছে এনে একটু-একটু হাসছিল। তার হাসির লজ্জায় অথচ তার সপ্রতিভার ঔজ্জ্বল্যে তাকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছিল। কোথায় যেন একটা মিল ছিল–ঐ এম-এল-এর জামাকাপড়ের মলিনতা আর পরিশ্রমী শরীরের স্বাচ্ছন্দ্যের সঙ্গে এই যুবকের সৌন্দর্যের। কিন্তু কোথাও একটা অমিলও যেন ছিল–এম-এল-এর মুখমণ্ডলের নিশ্চয়তাবোধের সঙ্গে এই যুবকের সলজ্জ অনিশ্চয়তাবোধের। এমএল-এর কথার শেষে একটু হাসির গমক ওঠে। সেটা শেষ হয়ে গেলে, যুবকটি বলে ওঠে, সেই তানে ত দুনিয়া বদলিবার কাজে লালঝাণ্ডা করি তোমাক এম-এল-এ বানাছু, আর উত্তরবঙ্গের কাজে উত্তরখণ্ড পাকড়িছু। একথায় হাসিটা আরো বেড়ে যায়–এম-এল-এ ছেলেটির কাধ থেকে হাত নামিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়ে তার পেছনে একটা ঘুসি মারেন। যুবকটি নাচের ভঙ্গিতে সরে যায়। ভিড়টা বদলে যায়।

পেছন থেকে একজন এগিয়ে এসে বলে, হে হেমেন দাদা, আজেবাজে কথা বাদ দাও। এই ফাংশন বাতিল করা ধরিলে কিন্তুক কুরুক্ষেত্র হবা ধরিবে। একখান বুদ্ধি করেন।

এম-এল-এ হেমেনদা হেসে বলেন, আরে, কুরুক্ষেত্ৰখান বন্ধ করিবার তানেই ত মিটিংখা ডাকাছি। তা তোমরালা করিছেন উত্তরখণ্ড আর আনিবার ধইচছেন সেই বোম্বাইঠে শ্রীদেবীক।

স্যালায় আবার মাদ্রাজের বেটিছোঁয়া। এ ক্যানং উত্তরখণ্ড তোমরালার-ময়নাগুড়ি-মাদ্রাজ-বোম্বাই?

পেছন থেকে একটা লুকনো গলা শোনা যায়, তোমরালা যা শিখাছেন–দুনিয়ার মজদুর এক হো।

কায় রে? বলে এমএল-এ সমবেত হাসির মধ্যে মাথা নিচু করে লুকনো গলাটিকে খোঁজেন।

এই কায় রে? যে প্রথম কথাটা তুলেছিল সে ঘাড় ঘুরিয়ে ধমক দিয়ে আবার এম-এল-একে বলে,  এখন আপনি মিটিঙের আগত একখান বুদ্ধি করি দেন, তারপর মিটিঙে যান।

বুদ্ধি আর আমারঠে কোটত। কংগ্রেসের তামান মানষিলা ত উত্তরখণ্ড করিবার ধরিছেন। য্যালায় বুঝি গেইছে পশ্চিমবঙ্গত আর কংগ্রেসের সরকার হওয়ার কুনো আশা নাই, স্যালায় এইঠে উত্তরখণ্ড বানি, ঐঠে গোখাল্যান্ড বানি, ঐঠে ঝাড়খণ্ড বানি বামফ্রন্টের সরকারক বাশ দিবার ধইচছে। বুদ্ধি ন্যান কেনে কংগ্রেসের দেউনিয়ারঠে। হামারঠে বুদ্ধি কোটত? এম-এল-এ হাসতে-হাসতেই কথা শুরু করেছিলেন, কিন্তু কথাটা শেষ করেন একটু রাগ মিশিয়েই। যে-লোকটি কথা শুরু করেছিল, সে বলে–আচ্ছা ধরেন কেনে, কংগ্রেসই সম্মিলনও করিছে, শ্রীদেবীকও নাচাছে। স্যালায় ত তোমরালা কিছু করিতেন না। এই হেমেনদা, একখান বুদ্ধি করো।

ঘরের ভেতর থেকে ডাক আসে, হেমেন, এসো।

এতক্ষণ পর্যটনমন্ত্রী তৈরি হচ্ছিলেন। সকালে তৈরি হতে ওঁর কিছুটা সময় লাগে। তার ডাক আসতেই এম-এল-এ ঘরের দিকে ঘোরেন, ভিড়টা ছড়িয়ে যায়, অনেকে এম-এল-এর সঙ্গে-সঙ্গেই ঘরের ভেতরে ঢোকে। কেউ-কেউ আবার বারান্দা থেকে মাঠে নেমে যায়। দু-একজন মিটিঙের ঘরের জানলার কাছে দাঁড়ায়।

.

১৬৩. সম্মিলন ও অনুষ্ঠানিয়ে সরকারি আলোচনা

 টেবিলটা ঘিরে সকলের বসতে একটু সময় যায়। ডেপুটি কমিশনার, এ্যাডিশন্যাল ডি-সি, এ্যাডিশন্যাল এস-পি, সদর এস-ডি-ও, ডি-এস-পি, এরা বসার জায়গার সোফাতে, ও ময়নাগুড়ির ও-সি, ভেতরে যাবার দরজার পাশে একটা কাঠের চেয়ারে বসে ছিলেন। পর্যটনমন্ত্রী বেরন নি বলে মিটিঙটা শুরু হচ্ছিল না বটে কিন্তু তার আগেই শিল্পমন্ত্রী বেরিয়ে এসে, কই, সুবিমলদার হল, বলে দাঁড়াতেই অফিসাররা সবাই উঠে দাঁড়িয়ে ছিলেন। শিল্পমন্ত্রী তাঁদের বসুন বললেও তাঁরা বসেন না। কিন্তু তার লোকজন তাকে খাবার জায়গার ওদিকে মিটিঙের জায়গার দিকে ডেকে নিয়ে যেতেই অফিসাররা আবার বসে পড়েন। এর কিছুক্ষণ পর বনবিভাগের রাষ্ট্রমন্ত্রী বেরিয়ে এসে দরজায় দাঁড়িয়ে একটু এদিক-ওদিক তাকান। ময়নাগুড়ি থানার ওসি দাঁড়িয়ে পড়েন। একটু পরে এস-ডি-ও। কিন্তু ডি-সি আর এ-ডি-সি ওঠার ভঙ্গিমাত্র করেন।

কিছু একটা মনে পড়ায় এস-ডি-ও, তাঁর কাছে গিয়ে বলেন, স্যার, এটা একেবারেই অন্য মিটিঙ বলে ডি-এফ-ও আসেন নি। কিন্তু উনি ওঁর অফিসে আছেন। আপনার সময় হলে বলবেন। আমি ওঁকে ফোন করে দেব।

সময় ত আপনাদের হাতে। মিটিঙ যখন শেষ করবেন, তখন। আচ্ছা, বলে তিনি আবার ভেতরে চলে যান।

আরো কিছুক্ষণ পর পর্যটনমন্ত্রী বেরন। ওঁর একটু হাঁফানির কষ্ট আছে। খুব পাতলা ধুতির ওপর মোটা গরম পাঞ্জাবি, তার ওপর শাদা গরম চাদর-তুষ। তবু যেন মুখচোখ একটু ফোলা ফোলা লাগছিল! তিনি এসে দাঁড়াতেই সবাই উঠে দাঁড়ান, অফিসাররা বেরিয়ে আসেন, এবার মিটিং শুরু হবে। পর্যটনমন্ত্রী মিটিঙের জায়গার দিকে যেতে গিয়ে ঘুরে জিজ্ঞাসা করেন, হেমেন কোথায়? তারই ত ব্যাপার।

এস-ডি-ও বলেন, উনি বাইরেই আছেন স্যার।

পর্যটনমন্ত্রী বাইরের দরজার দিকে দুপা গিয়ে জোরে ডাকেন, হেমেন, এসো। তারপর তিনি মিটিঙের জায়গায় গিয়ে টেবিলের মাথার চেয়ারটিতে বসে পড়েন। তার পেছনে-পেছনে অফিসাররা এসে পর্যটনমন্ত্রীর বা দিকের চেয়ারগুলোতে বসেন–একটা চেয়ার শিল্পমন্ত্রীর জন্যে খালি রেখে। প্রথমে ডি-সি, তারপর এ-ডি-সি, এ-ডি-সির পাশে এ-এস-পি, তার পাশে এস-ডি-ও, ডি-এস-পি। ময়নাগুড়ি থানার ওসি, ডি-এস-পিকে জিজ্ঞাসা করেন, স্যার, আমি তাহলে ওদিকে অপেক্ষা করি, দরকার হলে ডাকবেন।

না, না, আপনাকেই ত ব্রিফ করতে হবে, এখানে বসুন বলে নিজের পাশের চেয়ারটি দেখান। ও-সি চেয়ারটা একটু সরিয়ে ভেতরে ঢোকেন, আরো একটু সরিয়ে বসেন। কিন্তু চেয়ারটা টেবিলের প্রায় শেষ প্রান্তে বলে বোঝা যায় না তিনি চেয়ারটা একটু সরিয়ে বসলেন। মনে হতে পারে, তিনি পর্যটনমন্ত্রীর মুখোমুখি হওয়ার জন্যে একটু কোনাচে হলেন মাত্র।

এরা সব বসতে বসতেই বাইরে যারা ছিল, তারা ভেতরে ঢুকতে থাকেন। শিল্পমন্ত্রী ঢোকেন। শিল্পমন্ত্রী জলপাইগুড়ির এম-এল-এ। তাঁকে অফিসারদের পেছন দিয়ে এসে টেবিলের মাথায় গিয়ে দাঁড়াতে হয়। তিনি দেখেন, তার জন্যে একটা চেয়ার খালি রাখা হয়েছে। সে-চেয়ারটাকে টেনে তিনি একটু সরিয়ে এনে টেবিল থেকে একটু দূরে কিন্তু পর্যটনমন্ত্রীর প্রায় পাশে নিয়ে যান। তাতে ওদিক দিয়ে যাতায়াতের একটু অসুবিধা হবে কিন্তু তিনি ওখানেই বসে পড়েন। সাধারণত রীতি আছে, জেলায় এ-ধরনের মিটিঙে জেলার কেবিনেট মন্ত্রী কেউ থাকলে তিনিই সভাপতিত্ব করেন। শিল্পমন্ত্রীরই সেক্ষেত্রে সভাপতিত্ব করার কথা। কিন্তু সুবিমলবাবু যে-কোনো মিটিঙেই প্রধান আসনটিতে গিয়ে বসেন। সেটা তার বয়সের জন্যেও বটে আবার হয়ত পার্টির সুবাদেও অনেকটা। অবিশ্যি এক্ষেত্রে ত আর সভাপতির নাম কেউ প্রস্তাব করে না। বিবরণ যদি লেখা হয়, তাতে মন্ত্রীদের নাম পরপর থাকবে। কিন্তু তবু সভা পরিচালনার একটা নিয়ম থাকেই। তা ছাড়া, এই ঘটনাটার সঙ্গে সুবিমলবাবু জড়িতও নন। ঐ চেয়ারটা যে সভাপতির চেয়ার তাও ঠিক করা নেই। তবু শিল্পমন্ত্রীরই ঐ চেয়ারে বসার কথা। তিনি যদি আগে এই জায়গাটিতে আসতেন তা হলে ঐ চেয়ারটাতেই বসতেন। কিন্তু এখন সুবিমলবাবু ঐ চেয়ারটাতে বসে যাওয়ায় তিনি তার চেয়ারটাকে একটু সরিয়ে এনে নিজের বসার জায়গাটাকে বিশিষ্ট করতে চাইলেন।

সুবিমলবাবুর ডান দিকের প্রথম চেয়ারে বনবিভাগের রাষ্ট্রমন্ত্রী ভুবনমোহন রায়–উনিই একমাত্র রাজবংশী মন্ত্রী। তাঁর পাশে ময়নাগুড়ির এম-এল-এ হেমেনবাবু। তারপর থেকে উত্তরখণ্ড ও অনুষ্ঠানের লোকজন বসেছেন। কিন্তু তাদের সবার জায়গা হয় না, তখন প্রথম সারির পেছনে স্টিলের চেয়ার পাততে হয়। সেই দ্বিতীয় সারির সবার বসা শেষ হওয়ার আগেই সুবিমলবাবু একবার ডাইনে-বাঁয়ে তাকিয়ে বলেন, নিন শুরু করুন, বেশিক্ষণ মিটিঙ করা যাবে না, আপনাদের যা সমস্যা সেগুলো প্রথমে বলুন।

কথাটা কে শুরু করবে তা নিয়ে একটু ইতস্তত দেখা যায়। ডি-সি তাকান ডি-এস-পির দিকে, ডি-এস-পি তাকান ওসির দিকে। সেটা ও-সি দেখতে পান না, কারণ তিনি ভেবেছেন উত্তরখণ্ডীরাই কথা আগে শুরু করবে, সেই জন্যে বীরেনবাবুর দিকে তাকান। বীরেনবাবু টেবিলের দিকে তাকিয়ে ছিলেন বলে ওসির তাকানো দেখতে পান না। কিন্তু নকুল সবার দিকেই তাকাচ্ছিল বলে বুঝে ফেলে ও-সি বীরেনবাবুকে শুরু করতে বলছেন। নকু বীরেনবাবুর পাশে, সন্তোষবাবুর পরে। সন্তোষবাবুর পেছন দিয়ে বীরেনবাবুর পিঠে একটা ছোেট খোঁচা দিতেই বীরেনবাবু ধীরে মাথা ঘোরান। নকুল মাথার ইশারায় শুরু করতে বলে। বীরেনবাবু খুব ধীরে সন্তোষবাবুকে বলেন, সন্তোষ, বলো।

সন্তোষবাবুকে কোচবিহার থেকে আনা হয়েছে। তিনি গলা খাকারি দিয়ে বলেন, অনারেবল মিনিস্টারস, আমরা ত প্রপার পারমিশন নিয়ে ফাংশন করছি। আজ বুধবার। শনিবার আমাদের ফাংশন শুরু। শুধু যে লাখ-লাখ টাকা ইনভলভড তাই না, হাজার-হাজার লোক আসবে। এখন এই মিটিং ডাকা হল কেন আমরা বুঝতে পারছি না। সন্তোষবাবুর গলার জোর আছে। সে-জোরটা এতই বেশি যে এইটুকু ঘরে এই ক-জনের মিটিঙে বেখাপ্পা শোনায়। এ-মিটিঙে পরে ওরকম চড়া গলায় কথা হতে পারে বটে কিন্তু শুরু হওয়ার কথা ছিল যেন আরো অন্য রকম ভাবে।

সুবিমলবাবু শাদা চাদরে মুখ ঢেকে ছিলেন। মুখ থেকে চাদরটা নামান না কিন্তু চাদরের ভেতর থেকে হাতটা সরান যাতে তার কথাটা স্পষ্ট বোঝা যায়। তিনি তার স্বাভাবিক স্বরেই কথা বলেন কিন্তু তার স্বাভাবিক স্বরটাই খুব ভারী। তাই সন্তোষবাবুর চড়া কথার জবাবে তার কথাটা চড়া শোনাল না বটে কিন্তু কঠিন শোনাল, তোমাদের ত কিছু বলা হয় নি। তোমরা যে-ফাংশনের জন্যে পারমিশন নিয়েছ সেই ফাংশনটাই করবে। কিন্তু যারা পারমিশন নেন নি তারা তোমাদের ফাংশনের সঙ্গে মিশে কোনো ফাংশন বা কনফারেন্স করতে পারবে না।

সন্তোষবাবুর কথা ও সুবিমলবাবুর জবাবের পর সবাই হঠাৎ চুপ করে যায়। কেউই বোঝেন না কোন কথা দিয়ে সভাটা আবার চালু হবে। সুবিমলবাবু চাদরের ভেতরে তার হাতটা আবার মুখের কাছে নিয়ে এসেছেন।

সুস্থির একটু পরে বলে ওঠে, আমাদের একটা কথা বলার ছিল। যেন কেউ তাকে অনুমতি দেবে। সুস্থির এমন একটু অপেক্ষা করে। তারপর বলে, তা হলে আমাদের এই মিটিঙে ডাকার কোনো দরকার। ছিল না। সরকার আমাদের জানিবার পারিতেন যে উত্তরখণ্ড সম্মিলনের পারমিশন নাই। আমরা স্থির করি নিতাম সরকারের নিষেধ সত্ত্বেও আমরা সম্মিলন করিব কি না করিব। সুস্থিরের কথার সমর্থনে পেছনের সারি থেকে গুঞ্জন ওঠে। গুঞ্জনটা ওঠে এমন স্বরে যেন মনে হয় সেটাকে থামিয়ে দেয়া হবে। কিন্তু অফিসাররা ও সুবিমলবাবু শুধু সেদিকে তাকিয়ে থাকেন। ফলে গুঞ্জনটা আরো একটু ওঠে। তারপর থেমে যায়।

তারও একটু পরে সুবিমলবাবু বলেন, এবার চাদরটা মুখ থেকে সরিয়ে, উত্তর খণ্ড কি কোন্ খণ্ড কোথায় কী সম্মিলন করবে তা নিয়ে সরকারের মাথাব্যথা নেই। যদিও আইন অনুযায়ী এই সম্মিলনের জন্যেও পুলিশের পারমিশন নিতে হয়। কিন্তু ফাংশনের জন্যে যে-জায়গার অনুমতি দেয়া হয়েছে, সেখানে ও-ধরনের কোনো রাজনৈতিক সম্মেলন হলে আইনশৃঙ্খলার পরিস্থিতি খারাপ হতে পারে। সেই জন্যেই সরকার বলছে, ফাংশনের জায়গায় ফাংশনই হবে, কোনো সম্মিলন-টম্মিলন করা চলবে না। এটাই সোজা কথা।

.

১৬৪. শ্রীদেবীর নাচ ও জল্পেশ অভিযান নিয়ে আরগুমেন্ট

মিটিঙটা আবার চুপ করে যায়। কিছুক্ষণ পর ডি-সি ডাকেন, স্যার। সুবিমলবাবু ডি-সির দিকে তাকান। এই সব কালচারাল ফাংশনের ব্যাপার বলে আমরা দুজনকে বিশেষভাবে অনুরোধ করেছি আসতে–উপেনবাবু আর সমীরবাবু। উপেনবাবুর শরীরটা খারাপ

পেছন থেকে শিল্পমন্ত্রী বলেন, উপেনবাবু মানে উপেনদা? মানে, উপেন বর্মন মশাই?

ডি-সি সেদিকে ঘাড় ঘুরিয়ে বলেন, হ্যাঁ, স্যার।

তিনি কি এসবের মধ্যে আছেন নাকি?

 না স্যার। কিন্তু জেলার ওল্ড সিটিজেন হিশেবে তার কথার ত একটা বিশেষ মূল্য থাকতে পারে। তিনি দুপুরের দিকে একবার আসার চেষ্টা করবেন বলেছেন। কিন্তু আমাদের কাছে বলেছেন, এই সব কালচারাল ফাংশনের সঙ্গে কোনো পলিটিক্যাল ব্যাপার যুক্ত করা উচিত নয়। ডি-সি ঘাড় ঘুরিয়ে কথাটি শিল্পমন্ত্রীকে বলেন বলে মিটিঙে সবাই সেটা শুনতে পায় না। কিন্তু কথাটা শুনে শিল্পমন্ত্রী সোজা হয়ে বলেন, সেটা মিটিঙে বলুন যে উপেন্দ্রনাথ বর্মনের মত সিনিয়ার লোকও বলেছেন যে ফাংশন হোক কিন্তু সম্মিলন-টম্মিলন যেন না হয়। শিল্পমন্ত্রী এত জোরে বলেন যে মিটিঙের সবাই নড়েচড়ে বসে। যেন উপেনবাবুর কথার পর এ নিয়ে আর-কোনো কথা হতেই পারে না, মিটিঙ যেন শেষ হয়ে গেল। উপেন্দ্রনাথ বর্মনের নামের একটা প্রতিক্রিয়া বিশেষত উত্তরখণ্ডীদের মধ্যে হয়। রাজবংশী সমাজে আর-কোনো লোক সারা দেশে এত সম্মানিত নন। কিন্তু তার জীবনের এই সাফল্য সত্ত্বেও তিনি কখনো নিজের রাজবংশী পরিচয়কে ছোট করে দেখেন নি। রাজবংশী সমাজের আর-যারা দেশের নানা জায়গায় নানা ভাবে কিছু কিছু সম্মান পেয়েছেন তারা হয় আর রাজবংশী নেই, বা, রাজা প্রসন্নদেব রায়কতের মত জমিদার। উপেন্দ্রনাথকে অস্বীকার করার কোনো উপায় উত্তরখণ্ডীদেরও নেই, সরকারেরও নেই।

সন্তোষবাবু বীরেনবাবুর সঙ্গে কানে কানে কথা বলে নিয়ে তার পক্ষে যতটা আস্তে সম্ভব ততটা আস্তে বলে দেন, তা হলে অন্তত এটুকু প্রমাণ হল যে কংগ্রেসিরা উত্তরখণ্ড করছে না। কারণ, উপেনবাবু চিরকাল কংগ্রেসি।

সন্তোষবাবুর কথাটা সবাই শুনতে পায়, সবাইকে শোনানোর জন্যেই তিনি বলেছেন। হয়ত তার আসল উদেশ্য ছিল–উপেনবাবুর নাম করায় মিটিঙে সরকারের বক্তব্যের পক্ষে যে-সমর্থন তৈরি হয়ে যাচ্ছিল সেটা নষ্ট করে দেয়া।

শিল্পমন্ত্রী মাথা ঝাঁকিয়ে বলে ওঠেন, সন্তোষবাবু, উপেনদাকে এ-সব কথার মধ্যে টানবেন না। আফটার অল হি ইজ অ্যাবাভ পেটি পলিটিক্স। আমাদের সকলেরই শ্রদ্ধেয়। উনি যদি আসেন খুব ভাল

সন্তোষবাবু বলে ওঠেন, আরে, আমরা কখন উপেনদার নাম করলাম, আপনারাই ত করলেন। উনি ত এ-সবের কিছু জানেনই না। আপনারা কী ব্রিফ করেছেন তা আপনারাই জানান। এখন আপনারা তার নাম করে একটা ডিসিশন আমাদের ওপর চাপিয়ে দিচ্ছেন।

সুবিমলবাবু একটু হেসে, তোমার মত এ্যাডভোকেটকে কুচবিহার থেকে ধরে এনেছে ডিসিশন কি আর সহজে হবে?

সন্তোষবাবুও একটু হেসে বলেন, সে ত তোমাকেও ভাই কুচবিহার থেকেই ধরে এনেছে। তা হলে তুমিও কথা বলো না, আমিও বলব না–এরা জলপাইগুড়ির ব্যাপার এখানে বসেই মিটিয়ে নিক।

ময়নাগুড়ির এম-এল-এ হো হো করে হেসে ওঠেন। অফিসাররাও হেসে ফেলেন। সম্মিলন ও অনুষ্ঠানের লোকজনের মধ্যেও একটা গুঞ্জন ওঠে–সমর্থনের। এই হাসাহাসির ফলে মিটিঙে যে-একটা তাপ জমেছিল সেটা কেটে যায়।

সেই হাসাহাসিটা থামলে বীরেনবাবু গলা পরিষ্কার করেন কিন্তু কেউ খেয়াল করে না। তিনি একটা হাত তোলেন। সেটাও কেউ খেয়াল করে না। হঠাৎ সন্তোষবাবু ইংরেজিতে বলে ওঠেন, মিস্টার মিনিস্টার্স, দয়া করে একটু মনোযোগ দিন, বীরেন্দ্রনাথ বসুনিয়া, এই জেলার একজন প্রথম শ্রেণীর উকিল, কলকাতা হাইকোর্টও যার দ্বারা উপকৃত হতে পারত এবং শ্রদ্ধেয় উপেনবাবুর মতই যিনি শ্রদ্ধেয়, যদিও আপনাদের কাছে এখনো সম্ভবত অজ্ঞাত, কিছু কথা বলতে চান। এবং আপনাদের অবগতির জন্যে এই সুযোগে জানিয়ে রাখি যে আজ আমাদের মধ্যে দেবনাথ রায়ও আছেন-রাজবংশী সমাজের প্রথম পি-এইচ-ডি।

ময়নাগুড়ির এম-এল-এ হেমেনবাবু ও বনবিভাগের রাষ্ট্রমন্ত্রী ভুবনমোহনবাবু টেবিলের ওপর হুমড়ি খেয়ে বীরেনবাবুর দিকে তাকান। বীরেনবাবু টেবিলের দিকে তাকিয়ে ছিলেন তিনি হয়ত ওঁদের দেখতে পান না। হেমেনবাবু বলেন, কাকা, বলেন। ভুবনমোহনবাবুও বলে ওঠেন, দাদা, বলেন, বলেন। সবাই চুপ করে যায়। বীরেনবাবু গলাটা আবার পরিষ্কার করে বলেন, আমার একটা কথা জানার আছে–এটাকে কি আমরা আইনের দিক থেকে দেখছি, নাকি রাজনীতির দিকে থেকে দেখছি, নাকি প্রশাসনিক আইন-শৃঙ্খলার দিক থেকে দেখছি।

বীরেনবাবু থেমে যান। তার নিচু স্বরের কথা শোনার জন্যে অফিসাররা টেবিলের ওপর এগিয়ে আসেন, সম্মিলন ও অনুষ্ঠানের লোকরাও মাথা এগিয়ে দেয়, শিল্পমন্ত্রী তার চেয়ারে বসে থেকেই এগিয়ে আসেন। সন্তোষবাবুই একমাত্র চেয়ারে হেলান দিয়ে হাসিমুখে সকলের মুখের দিকে তাকান। যেন, তিনি জানেন বীরেনবাবু কী বলবেন ও তা বলার ফলে অবস্থাটা কী রকম বদলে যাবে। বা, বীরেনবাবুর একেবারে পাশে বসে তিনি কথাগুলো সবচেয়ে ভাল শুনতে পাচ্ছিলেন আর সেই কারণেই শোনার জন্যে তাকে কোনো অতিরিক্ত চেষ্টা করতে হচ্ছিল না। বীরেনবাবু যেন একটু সময় দেন তার প্রশ্নের জবাবের জন্যে, তারপর আবার শুরু করেন।

মানমীয় পর্যটনমন্ত্রী এই মিটিঙের শুরুতে বলেছেন যারা অনুমতি নিয়েছেন তারা ফাংশন করতে পারবেন। তার সঙ্গে সম্মেলন করা যাবে না। তা হলে এটা আইনের প্রশ্ন। আর, তারপরে আবার নানা কথায় মনে হল, সরকার সম্মিলন ও অনুষ্ঠান এক জায়গায় হলে আইনশৃঙ্খলা নিয়ে আশঙ্কা করছেন। আমরা সম্মিলনই করি আর অনুষ্ঠানই করি শান্তিপূর্ণ ভাবে করতে চাই। তা ছাড়াও, এখানে কংগ্রেস ও উত্তরখণ্ডের কথা উঠেছে। সেটা রাজনীতির প্রশ্ন। আমরা কোনটা আলোচনা করব সেটা আগে ঠিক করে না নিলে, এ মিটিঙে কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছনো যাবে না। বা, আমাদের মনে হতে পারে, যে, সরকার যেভাবেই হোক তাদের ইচ্ছা আমাদের ওপর চাপিয়ে দিচ্ছেন। বীরেনবাবু থেমে যান। কিন্তু তার ভঙ্গি একটুও বদলায় না। সবাইকেই অপেক্ষা করতে হয় যে তিনি আরো কিছু বলেন কিনা।

শিল্পমন্ত্রী চেয়ারটা একটু এগিয়ে আনেন। সুবিমলবাবু চেয়ারের ওপর কনুই রেখে হাতদুটো খাড়া রাখেন আর পাদুটো নাড়াতে থাকেন। ময়নাগুড়ির এম-এল-এ মুখটা বাড়িয়ে বলেন, কাকা, আপনিই বলেন না কেন, আইনের কথা বাদ দেন, কিন্তু এক দিনে শ্রীদেবীর নাচ আর আপনাদের সম্মিলন হলে ত সাংঘাতিক অবস্থা হবে, পুলিশ দিয়েও ত সামলানো যাবে না, শ্রীদেবীর নাচে ত শুনছি আসাম বিহার থেকেও লোক আসবে ট্রাক-ট্রাক।

সুবিমলবাবু পা নাড়াতে-নাড়াতেই মুচকি হেসে বলেন, সন্তোষই ত কুচবিহার থেকে দুই ট্রাক লোক নিয়ে আসবে।

সন্তোষবাবু সঙ্গে সঙ্গে বলে ওঠেন, দুই ট্রাক কেন? তুমি যে সেদিন ফোন করে বললে তোমার একটা আলাদা ট্রাক চাই কিন্তু মন্ত্রীর নামে ভাড়া করলে খারাপ দেখায়, আমি যেন ভাড়া করে রাখি, সেটা ধরলে তিন ট্রাক।

সকলে, এমনকি অফিসাররাও, হো হো করে হেসে উঠতেই হেমেনবাবু দাঁড়িয়ে একবার সুবিমলবাবুর দিকে, আর-একবার সন্তোষবাবুর দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে জোরে বলে ওঠেন, এই সুবিমলদা, সন্তোষদা, আপনাদের দুই বন্ধুর ফ্রেন্ডলি ম্যাচ থামান ত। মিটিঙটা ত শেষ করতে হবে। কাকা, বলেন।

বীরেনবাবু গলা পরিষ্কার করে নিয়ে হাতটা তোলেন। সন্তোষবাবু সেই হাতটার দিকে তাকিয়ে একটু হাসেন। বীরেনবাবু যখন এজলাশে তার সবচেয়ে শক্ত যুক্তিগুলো দেন তখন বা হাতটা এরকম একটু খাড়া রাখেন। টেবিলের দিকে তাকিয়েই বীরেনবাবু বলেন, ময়নাগুড়ির এম-এল-এ যে কথা বললেন সেটাই যদি এই মিটিঙের আলোচ্য হয় তা হলে তার জবাব খুব সোজা-শ্রীদেবী রোজ নাচছেন না, আর রোজ আমাদের সম্মেলন বেলা একটার আগেই শেষ হয়ে যাচ্ছে। তার পঁচঘণ্টা পর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান শুরু হচ্ছে। সুতরাং সম্মিলনের লোক আর অনুষ্ঠানের লোক কোনো সময়ই এক হচ্ছে না।

বীরেনবাবু থামামাত্র হেমেনবাবু বলে ওঠেন, বাঃ, সেইটা নিয়েই ত ক্রাইসিস, শ্রীদেবীর নাচ হবে রাত্রিতে আর আপনাদের জল্পেশ্বর অভিযান হবে সকালে। তা হলে?

বীরেনবাবুর দিকে সবাই তাকায়। তিনি তার ভঙ্গি একটুও বদলান না, গলার স্বর একটুও তোলেন না। অপরিবর্তিত স্বর ও ভঙ্গি দিয়ে তিনি সবচেয়ে বেশি মনোযোগ অনায়াসে টেনে নেন। কোনো-কোনো সময় এটাকে তার কৌশলই মনে হয়–যখন প্রতিপক্ষ তাদের আক্রমণ গুটিয়ে নিতে বাধ্য হয়। কিন্তু অনেক সময় এটা তার স্বভাবই মনে হয়–যখন প্রতিপক্ষকে তিনি সরাসরি আক্রমণ কখনোই করতে পারেন না। বীরেনবাবু বলছিলেন, আমাদের কর্মসূচি অনুযায়ী শ্রীদেবীর অনুষ্ঠান হবে রাত নটা থেকে সাড়ে এগারটা। অনুষ্ঠানের সময় বেড়ে যাবার কোনো আশঙ্কা নেই। কারণ, অনুষ্ঠান শেষ করে শ্রীদেবী তার থাকার জায়গা শিলিগুড়িতে ফিরে যাবেন। তা ছাড়াও, এমন-কি অনুষ্ঠান দেরি করে শুরু হলেও শ্রীদেবী সাড়ে এগারটাতেই তার অনুষ্ঠান শেষ করবেন। প্রতিটি বেশি মিনিটের জন্যে আমাদের অতিরিক্ত এত টাকা দিতে হবে যা আমাদের পক্ষে অসম্ভব। রাত সাড়ে এগারটায় আমাদের অনুষ্ঠান শেষ আর সকাল ছটায় জল্পেশ্বর শিবের মন্দিরের দিকে যাত্রা। মাঝখানে সাড়ে ছ-ঘণ্টা সময়। সুতরাং শ্রীদেবীর নাচের ভিড় আর জল্পেশ্বর শিবমন্দিরের যাত্রীদের ভিড় কোনো সময়ই মিলে যেতে পারে না। তা ছাড়াও, এখানকার লোক হিশেবে আপনারা নিশ্চয়ই জানেন, বছরের এই সময় জল্পেশ্বর শিবের দিকে নানা জায়গা থেকে নানা তীর্থযাত্রীর দল আসে। তার সঙ্গে কোনো অনুষ্ঠান বা সম্মিলনের সম্পর্ক নেই। আমরা আমাদের সম্মিলন ও অনুষ্ঠানের শেষ দিন সেই চিরাচরিত তীর্থযাত্রায় যোগ দেব বলে স্থির করেছি। তীর্থযাত্রার জন্যে সরকারের অনুমতি কোনো কালে দরকার হয় না। বরং তীর্থযাত্রীদের যাতে অসুবিধে না হয় সেজন্যেই সরকার যথাযোগ্য ব্যবস্থা করে থাকেন, এ বছরও করছেন ও নিশ্চয়ই আরো করবেন।

সবাই একেবারে চুপ করে বীরেনবাবুর নিচু গলায় এই কথাগুলি শোনে। একজন কেউ জোরে-জোরে শ্বাস ফেলছিল, পাশের লোকটি তাকে খুঁচিয়ে থামিয়ে দেয়। বীরেনবাবুর কথা শেষ হওয়ার পর যে-অতিরিক্ত সময়টুকু চুপ করে থাকতে হয়, তার কথা শেষ হয়েছে কি না বুঝতে, সেটুকু সময় কেটে গেলে, সন্তোষবাবু ঘাড় দোলান, ওস্তাদি গানে বাহবা দেবার ভঙ্গিতে, আরগুমেন্ট, আরগুমেন্ট, চাপা স্বরে বলে ওঠেন, সুবিমল, কতদিন ধরে বলছি হাইকোর্টের একটা বেঞ্চ এখানে বসাও, বীরেনদার মত এই সব লিগ্যাল টেলেন্টকে কাজে লাগাতে পারতে! তোমার উত্তরখণ্ডও হত না, কামতাপুরীও হত না। কী লিগ্যাল টেলেন্ট! আরগুমেন্ট, আরগুমেন্ট!

.

১৬৫. শ্রীদেবীর নাচ ও জল্পেশ অভিযান নিয়ে রাজনীতি

 শিল্পমন্ত্রীকে চেয়ারটা টেনে টেবিলের কাছে আনতে হয়। তারপর টেবিলের ওপর দুই হাত রেখে তিনি বলেন বীরেনদা, আপনার কথা অঙ্কের হিশেবে ত ঠিক কিন্তু বেঅঙ্কের হিশেবটা মেলাবে কে?

শিল্পমন্ত্রী বীরেনবাবুকে চেনেন না। রাজনীতির ব্যাপারেও ওঁর পরিচয় তিনি কখনো পান নি। কিন্তু তিনি বুঝে গেছেন–ইনিই পারেন অবস্থাটা সামাল দিতে। তা ছাড়া ডেপুটি কমিশনার একটা কাগজ আগেই দেখিয়েছিলেন–তাতে পার্টনারদের নাম ও পরিচয় ছিল। অনুষ্ঠানের ও সম্মিলনের সম্পাদক হিশেবে সেখানে এই বীরেন্দ্রনাথ বসুনিয়ার নামই আছে।

অতিরিক্ত একটা উদ্দেশ্যও শিল্পমন্ত্রীর ছিল। বীরেনবাবুর কথাগুলি যে প্রভাব ফেলেছিল, সেটা কিছু নষ্ট করা।

অথবা হয়ত অভিজ্ঞতার জোরেই তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, মিটিঙের সামনে সমাধানের একটা মুহূর্ত এসেছে, ওটাকে কাজে লাগানো উচিত। সুবিমলবাবু বা হাঁটুর ওপর ডান পা তুলে ডান হাঁটু নাচাচ্ছেন–শাদা চারদরটা ঠোঁট পর্যন্ত ভোলাই কিন্তু একটু বায়ে কেতরে বসেছেন। ওঁর চোখেমুখে বেশ একটা প্রশংসার হাসি। আর, এই সবের ফলে যে সুবিমলবাবু স্বনির্বাচিত সভাপতি হয়ে বসেছিলেন, মিটিঙের এই চরম মুহূর্তে তাকেই সভার বিষয় থেকে সবচেয়ে দূরবর্তী মনে হয়। এমন-কি, তাকে বিপক্ষের, প্রতি কিছু সহানুভূতিশীলও ঠেকে যায় যেন।

শিল্পমন্ত্রীর জিজ্ঞাসার জবাবে বীরেনবাবু চোখ তুলে তাকান। সন্তোষবাবু জিজ্ঞাসা করেন, বেঅঙ্কের হিশেবটা কী সেটা বলুন।

শিল্পমন্ত্রীর কথার ভঙ্গিতে উত্তরখণ্ডীরা ও অনুষ্ঠানের লোকজন হঠাৎ যেন বুঝে যায় যে সম্মিলন বা অনুষ্ঠান বাতিল হচ্ছে না, বীরেনবাবু মোক্ষম যুক্তি দিয়েছেন। বা বীরেনবাবুর যুক্তিকে মোক্ষম বলে মন্ত্রীরা মেনে নিয়েছেন।

শিল্পমন্ত্রী সেটা ইচ্ছে করেই বুঝতে দিলেন কি না–সেটা বোঝাও যাবে না, জানাও যাবে না। অতটা সূক্ষ্ম হিশেব করে কথা বলা হয়ত সম্ভবও নয়। কিন্তু শিল্পমন্ত্রীর একটা স্কুল হিশেব ছিল যে আজ বাদে কাল সম্মিলন ও অনুষ্ঠান, কোনো অবস্থাতেই কিছু বাতিল করা যাবে না। যদি কোনো রকমে জল্পেশ্বর অভিযানটা ঠেকানোযায় বা পেছুনো যায়, বা সম্মিলনটাই একটু পেছিয়ে দিতে এদের রাজি করানো যায় তবে তাই যথেষ্ট।

শিল্পমন্ত্রী বলেন, আমরা কেবল একেবারে আইন-শৃঙ্খলার দিক থেকেই শ্রীদেবীর নাচ ও আপনাদের ঐ মিছিলটা এক রাত্রিতে হবে এটাতে আশঙ্কা করছি। নানা জায়গার লোক আসবে, আপনাদের  মিছিলেরও লোক আসবে, সারা রাতে ত সব লোক চলে যেতে পারবে না, বেশির ভাগ লোকই থেকে যাবে, যে-কোনো মিসক্ৰিয়ান্ট একটা গোলামল পাকিয়ে দিতে পারে।

সে ত যে কোনো দিনই পারে, সন্তোষবাবু বলেন। তা পারে।

 কিন্তু শ্রীদেবীর সিনেমা এলে কলকাতায় হলের কাছে এজন্য পুলিশ পোস্টিং করতে হয় শুনি, আর এ একেবারে স্বশরীরে আবির্ভাব। আমি অবশ্য দেখি নি। কিন্তু যা রিপোর্ট পেলাম সে নাকি সেক্স সিম্বল। আপনারাই বা আপনাদের রাজনৈতিক সম্মিলনের অনুষ্ঠানের ব্যাপারে এরকম আর্টিস্ট আনলেন কেন বুঝলাম না। যা-হোক, আপনারা মিছিলটা এক দিন পেছিয়ে দিন।

মিছিল, মানে জল্পেশ্বর অভিযান? সন্তোষবাবু জিজ্ঞাসা করেন।

সম্মিলন ও অনুষ্ঠানের উদ্যোক্তাদের জায়গা থেকে সমবেত আপত্তির গুঞ্জন ওঠে। সন্তোষবাবু পেছন ফিরে একবার দেখেন। তারপর পাশে নকুলবাবুর সঙ্গে কথা বলে জেনে নিতে চান এটা কতটা সম্ভব বা কতটা অসম্ভব। সন্তোষবাবু তার ওকালতি বুদ্ধিতে মুহূর্তে অনুমান করে ফেলেন যে শ্রীদেবীর। নাচ ও জল্পেশ্বর অভিযানের দিনক্ষণ অপরিবর্তনীয়। এই বিষয়ে কোনো আপোশ হবে না। অন্য কোনো বিষয় নিয়ে হতে পারে।

সুস্থির দাঁড়িয়ে বলে, মাননীয় মন্ত্রী মহাশয়ের কাছে আমরা উত্তরখণ্ডীরা একটা অনুরোধ করছি যে শ্রী বীরেন বসুনিয়া যে-যুক্তিগুলি দিলেন তার প্রত্যেকটি ধরি-ধরি আলোচনা করেন আর না-হয় ত আমরা যে-ভাবে সম্মিলন ও ফাংশন করিবার চাহি করিতে দিন। আমরা আমাদের কর্মসূচির কোনো পরিবর্তন করিব না।

ময়নাগুড়ির এম-এল-এ হেমেনবাবু চট করে উঠে দাঁড়ান। তার গলার চাদরটা অর্ধেক তার গলায়, অর্ধেক চেয়ারে। তিনি ডান হাত দিয়ে চারদটাকে চেয়ারের ওপর ফেলে দিয়ে বলেন, শুনুন, আমি একটা কথা বলছি। বীরেনকাকাই কথাটি তুলেছেন। আমি দাঁড়িয়েই বলি, কারণ সবার মুখ দেখতে চাই। বীরেনকাকা বলেছেন বিষয়টির তিনটি দিক আছে–আইনগত দিক, আইনশৃঙ্খলার দিক ও রাজনীতির দিক। রাজনীতির দিকটা আমরা এখনো কেউ আলোচনা করি নাই কিন্তু করা উচিত। উত্তরখণ্ড আন্দোলন বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন কিনা, উত্তরবঙ্গ পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে বাঁচবে নাকি বাইরে আসি বাঁচবে–এগুলি রাজনীতির কথা, এবং এ সব কথারই আলোচনা করতে হবে। এই মিছিলে না হোক, বাইরের মিটিঙে। পাবলিক মিটিঙে। বৈঠক মিটিঙে। সব জায়গায় এসব আলোচনা করতে হবে। আমাদের পার্টির পক্ষ থেকে আমরা সেই রাজনৈতিক প্রচারে নামব। আপনারাও নামেন। কিন্তু শিল্পমন্ত্রী মশায়ের ভাল প্রস্তাব আপনারা প্রত্যাখ্যান করলেন। আপনাদের মিছিল একদিন পিছি দিলে আপনাদের কী ক্ষতি হত? কিন্তু আপনারা তাতে রাজি না হন। তা হলে আপনারাই বলেন–সরকারই বা কী করে ময়নাগুড়ি ও পাশাপাশি অঞ্চলের সাধারণ নাগরিকদের নিরাপত্তা সম্পর্কে নীরব থাকবে? আপনারা কাদের নিয়ে এই অনুষ্ঠানের টাকা তুলছেন? কারা এর পার্টনার? রামগোপাল আগরওয়ালা–সারা উত্তরবঙ্গে নেপালের সঙ্গেযে-চোরাবাজারের ব্যবসা চলে তাতে প্রধান টাকা খাটায় যে সে কমিটিতে আছে। এতে উত্তরখণ্ডীদের মধ্যে একটু গুঞ্জন উঠতেই হেমেনবাবু তার গলা আর-একটু চড়িয়ে দেন। তাতে তার বক্তৃতায় জনসভায় ভাষণের ভাব আসে। অফিসাররা মাথা নিচু করে শোনেন। আপনাদের আর-একজন পার্টনার সুখরাম বর্মন। সে তামাকের স্মাগলিঙে এখন বোধ হয় লক্ষপতি হয়ে নিজের নাম পর্যন্ত বদল করে ফেলেছে। এখন সে অমিতাভ বচ্চন। আপনাদের আর-একজন পার্টনার আসিন্দির রায়–গয়ানাথ জোতদারের জামাই। গয়ানাথ জোতদার সেটেলমেন্টের বিরুদ্ধে মামলা করে তিস্তা ব্যারেজের কাজ বন্ধ করার ষড়যন্ত্র করি যাচ্ছে আর ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের সঙ্গে মামলা করি ফরেস্টের গাছ কেটে বেচে নতুন বড়লোক হচ্ছে। আপনাদের পার্টনারদের অনেকেরই ত এই পরিচয়। আপনারা যদি উত্তরখণ্ড সম্মিলনই করবেন তা হলে আপনারা এই সব লোকদের ওপর নির্ভর করছেন কেন? কারণ, আপনাদের টাকার দরকার। এরা আপনাদের টাকা দিচ্ছে। এরা আপনাদের টাকা দিয়ে বম্বে থেকে শ্রীদেবী আনি দিচ্ছে আর আপনারা সেই টাকা সেই লোক নিয়ে জল্পেশ্বরের শিবের নামে সরকারবিরোধী মিছিল নি যাবেন। সরকারবিরোধী হলে আমাদের আপত্তি নাই। কিন্তু আমরা জানি আপনারা জল্পেশ্বরের পবিত্র নামকে সংকীর্ণ স্বার্থে ব্যবহার করিবেন। সেখানে তিস্তাবুড়ির পূজা অনুষ্ঠান হবে। সেই পূজার শেষে আপনারা শপথ নিবেন তিস্তা ব্যারেজের বিরুদ্ধে আন্দোলন করার জন্যে। কী? না গয়ানাথ জোতদার বংশানুক্রমে যে-সব জমি বেআইনি ভাবে ভোগদখল করি আসছে গোচিমারিতে, বাসুসুবায়, গাজোলডোবায় সেই সব জমি তিস্তা ব্যারেজে নেয়া চলিবে না। তিস্তা ব্যারেজে হলে লাখ-লাখ কৃষকের উপকার। আপনারা সেইটা চাহেন। আপনারা চাহেন গয়ানাথ জোতদারদের, রামগোপাল আগরওয়ালা আর অমিতাভ বচ্চনদের মত জোতদার, কালবাজারি আর চোরাকারবারিদের উপকার। বীরেন কাকা এই সব কথার বিচার করেন। যা সাফ কথা, তা সাফ-সাফ হওয়াই ভাল। আপনারা শ্রীদেবীর নাচ দেখবেন কি হেমামালিনীর নাচ দেখবেন–তা দেখেন। কিন্তু ঐ নাচের নাম করি হাজার-হাজার মানুষকে জল্পেশ্বরের মত ধর্মস্থানে নি যাবেন আর তিস্তা ব্যারেজের বিরুদ্ধে অভিযান করিবেন তা আমরা হতে দিব না। আমরাও তাহলে পাল্টা মিছিল করিব। আমরা জানি মাসখানেকের মাথায় তিস্তা ব্যারেজের উদ্বোধন করিবেন আমাদের মুখ্যমন্ত্রী। সেই উদ্বোধনে বিক্ষোভ দেখাবার জন্যে উত্তরখণ্ড কামতাপুরী গোখাল্যান্ড সবাই জোট বাঁধছে। আপনাদের এই সম্মিলনের উদ্দেশ্যও সেই কারণে তোক জোগাড় করা। আমরাও ধানের বিচি খাই। আমরা জানি, বম্বের শ্রীদেবী আর কলকাতার যাত্রা আনতে কত খরচা হয়। আর এ-টাকা কোখিকে আসে। বীরেন কাকা খুব ভাল যুক্তি দিয়ে কথা বলেছেন। কিন্তু আমরা সোজাসুজি বলতে চাই কথাটা আইনশৃঙ্খলারও না, আইনেরও না, কথাটা রাজনীতির। আপনারা রাজনীতি করিছেন, আমরাও তাই রাজনীতি করব।

.

১৬৬. উপেন্দ্রনাথ বর্মন ও উভয় পক্ষের ঐকমত্য

শেষ কথাটা হেমেনবাবু ধপ করে চেয়ারে বসে বলেন। বসেই তিনি চারদটা টানেন। কিন্তু নিজেই চাদরের ওপর বসে পড়ায় চাদরটা বেরয় না। ফলে হেমেনবাবু একটু উঠে চাদরটা টেনে বের করে নিয়ে ঘাড়ের ওপর ফেলেন।

হেমেনবাবুর বক্তৃতার শেষে সমস্ত মিটিঙের আবহাওয়া বদলে যায়। তার পুরো বক্তৃতার সময় ধরেই অবস্থাটা বদলাচ্ছিল বটে কিন্তু বোঝা যাচ্ছিল না কতটা বদলাবে। বীরেনবাবুর কথাগুলির পর মিটিঙের পরিস্থিতি যেমন বদলেছিল, এ বদল তেমন নয়। বীরেনবাবু মিটিঙের নিয়মকানুনের মধ্যে, মন্ত্রী ও অফিসারদের কথার ভেতরই একটা শক্ত পাল্টা যুক্তি খাড়া করেছিলেন। সেই পাল্টা যুক্তির জোরটা মেনেই শিল্পমন্ত্রী একটু নরম হয়ে মীমাংসার একটা প্রস্তাব দিয়েছিলেন। সে-প্রস্তাবটা মেনে নিলে হেমেনবাবু হয়ত কিছুই বলতেন না। কিন্তু মেনে না নেওয়ায় হেমেনবাবু মিটিঙের এতক্ষণের সব আলোচনা নস্যাৎ করে দিয়ে সেই সব কথাই তুললেন যে কথাগুলি এতদিন ও এতক্ষণ এড়িয়ে যাওয়া হচ্ছিল। সম্মিলন ও অনুষ্ঠানের লোকজন অনেকখানি উদ্বেগ নিয়েই মিটিঙে এসেছিল। কিন্তু মিটিঙের পরিবেশ-পরিস্থিতি দেখে তারা একটু জোর পেয়েছিল যে শেষ পর্যন্ত সম্মিলনও হবে, অনুষ্ঠানও হবে। কিন্তু শিল্পমন্ত্রীর প্রস্তাব প্রত্যাখ্যানের পর হেমেনবাবু অবস্থাটা যে এরকম বদলে দেবেন এটা কেউই ভাবতে পারে নি।

হেমেনবাবু বসে পড়ার সঙ্গে-সঙ্গেই সুস্থির উঠে দাঁড়ায়, হেমেনবাবু এম-এল-একে ধন্যবাদ যে তিনি আমাদের বিরুদ্ধে তার সমস্ত কথাই বলি দিছেন। কিন্তু শিল্পমন্ত্রী হঠাৎ তার চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে উঠে সুস্থিরকে বলেন, আপনি বসুন, বসুন, এখন কোনো কথা হবে না, বসুন।

আপনারা আমাদের মিটিঙে ডেকে এনে কথা বলতে দেবেন না? বলে সন্তোষবাবু দাঁড়িয়ে ওঠেন, হেমেনবাবু যা ইচ্ছে তাই অভিযোগ করে যাবেন? আমাদের রাজবংশীদের ঐতিহ্য, ধর্ম, কালচার সব কিছু নিয়ে প্রশ্ন তুলবেন? তখন শিল্পমন্ত্রী, সুস্থির ও সন্তোষবাবু তিনজন দাঁড়িয়ে কিন্তু সন্তোষবাবু লম্বা বলে ও তার গলার জোর বেশি বলে কথা বলে যাওয়ার সুযোগটা নিয়ে নেন, হেমেনবাবুর রাজবংশীদের ঐতিহ্য-সংস্কৃতি এখন পছন্দ না হতে পারে; তিনি কমিউনিস্ট হয়ে এখন জল্পেশ্বর মন্দিরের মাহাত্ম্য ভুলে যেতে পারেন, তিনি তিস্তাবুড়ির পুজোকে কুসংস্কার ভাবতে পারেন কিন্তু আমাদের কাছে জল্পেশ্বর সর্বশ্রেষ্ঠ দেবতা। তিস্তাবুড়ি আমাদের কাছে মা গঙ্গা। তিস্তা নদী নয়, তিস্তা দেবতা। হেমেনবাবুর যদি ইচ্ছে হয় তিনি তিস্তা ব্যারেজের পুজো করতে পারেন কিন্তু আমরা তিস্তা বুড়িরই পূজো করব। তাতে যদি আমাদের অপরাধ হয়, অপরাধ হবে। কিন্তু এই ভাবে আমাদের–

হঠাৎ খাবার জায়গায় পার্টিশনের কাছে কিছু যাওয়া-আসা শুরু হয় আর ডেপুটি কমিশনার চট করে চেয়ার ছেড়ে উঠে শিল্পমন্ত্রীর কানেকানে কিছু বলে বেরিয়ে যান। উপেন বাবু, উপেনবাবু কথাটা শোনা যায়। শিল্পমন্ত্রী বসার জায়গার দিকে একবার মুখটা বাড়িয়ে সন্তোষবাবুকে বলেন, উপেনদা এসেছেন, এখন আপাতত এই আলোচনা একটু বন্ধ থাক। উপেনদার সঙ্গে আমরা সবাই একটু কথা বলে নেই। তারপর, আবার আলোচনা শুরু হবে। ফলে, সন্তোষবাবুকে বসে পড়তে হয়।

সুবিমল বাবু পা নামিয়ে বসেন, বনবিভাগের রাষ্ট্রমন্ত্রী উঠে পড়েন, শিল্পমন্ত্রী বসার জায়গার দিকে চলে যান, ডি-সি ও এস-ডি-ওও তার সঙ্গে যান, ফলে মিটিঙটা ভেঙেই যায়। উত্তরখণ্ডের কেউ-কেউ বসার জায়গার দিকে যান উপেনবাবুর সঙ্গে দেখা করতে, কেউ দরজা দিয়ে বাইরে চলে যান। বীরেনবাবু তার জায়গাতেই বসে থাকেন।

কিছুক্ষণ পরই মিটিঙটা ভেঙে সব জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে, বসার জায়গায় উপেনবাবুকে ঘিরে মন্ত্রীরা, মিটিঙের টেবিলে বাকি অফিসাররা ও অন্যান্যরা কেউ-কেউ, বাইরে বারান্দায় ও মাঠে উত্তরখণ্ড ও অনুষ্ঠানের নোকজন এক-একটা দল পাকিয়ে উত্তেজনায় ফেটে পড়ছে।

এরকম একটা দলে সুস্থির চিৎকার করে নকুলকে বলে, আপনাদের যাকে ইচ্ছা তাকে নাচান, আমরা সম্মিলন করব, আমরা আর এই মিটিঙে থাকব না।

সন্তোষবাবু হঠাৎ সুস্থিরের ঘাড়টা বা হাত দিয়ে চেপে ধরে ডান হাতের আঙুল নাচিয়ে বলে ওঠেন, তোমাদের মত ফায়াররইটারদের জন্যেই আমাদের উত্তরখণ্ড মার খাবে। প্রথমত, তোমরা একটা বেআইনি কাজ করেছ–পারমিশনই নাও নি কনফারেন্সের। তার ওপর পারমিশন নিয়েছ কালচারাল ফাংশনের, করছ পলিটিক্যাল কনফারেন্স। গবর্মেন্ট যদি ইচ্ছে করে তোমাদের কনফারেন্স এক মিনিটে বন্ধ করে দিতে পারে। তার প্রতিক্রিয়া কী হবে সেটা আন্দাজ করতে পারছে না বলেই বন্ধ করার সাহস পাচ্ছে না। সরকারের সবগুলি দল যদি তোমাদের এগেইনস্টে নামে তোমরা কী করতে পারবে? তার চাইতে এখনি একটা কমপ্রোমাইজে রাজি হয়ে যাও। জল্পেশ্বর অভিযানটা করা দিয়ে কথা–সেটা যদি করতে না পার তাহলে ওকনফারেন্সের কোনো মানেই নেই। তার জন্যে যদি একটা দিন পেছতে হয় বা জায়গাটা বদলাতে হয়–একটা চেঞ্জে রাজি হও। তোমরা যদি কিছু না ছাড়ো, তা হলে ওরাইবা রাজি হবে কী করে? ডাকো, সবাইকে ডাকো, বীরেনদা কোথায়?

সন্তোষবাবু সুস্থিরের কাধ থেকে হাতটা তুলে নেন। সুস্থির সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকে–তার কাঁধে ঝোলা, বা হাতটা কনুইয়ের সমকোণে ভেঙে পেট আর বুকের মাঝখানে, ডান হাতটা খাড়া ঠোঁটে, মুখে সামান্য দাড়ি। সেই মুহূর্তে তাকে খুব একা লাগে, যেন, সুস্থির বুঝে গেল যে বীরেনবাবু, নকুলবাবু, সন্তোষবাবু এরা সব একমত হয়ে গেলে তার আর-কিছু করার নেই। তখন সুস্থির শারীরিক ভাবেও একাই-সন্তোষবাবু তার সামনে দাঁড়িয়ে মাত্র, অন্য সবাই দৌড়ে গেছে আরো কয়েকজনকে ডেকে আনতে যাতে মিটিংটা শুরু হওয়ার আগে তারা নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা করে নিতে পারে।

নকুল-জগদীশ মিটিঙের ঘর থেকে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে আসে। এসে বলে, বীরেন কাকাকে ডেকে নিয়ে উপেনবাবু গল্প করছেন। আমাদেরই ঠিক করতে হবে। এখানেই বসুন। ততক্ষণে সুরেন, শান্তি, ভূপেনবাবু এদিকে এসে এদের সঙ্গে মাঠের মধ্যেই বসে যান। এখানে এদের এতজনকে মাঠের মধ্যে গোল হয়ে বসতে দেখে যারা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল তারাও এসে গোল হয়ে বসে। এখানে চাপা স্বরে একটা পুরো দস্তুর মিটিঙ শুরু হয়ে যায়।

খানিকক্ষণ পর সার্কিট হাউসের বারান্দা থেকে ডাকাডাকি শুরু হয়,–সগায় আইসেন, মিটিঙ-মিটি।

শুনে ওরা একসঙ্গে উঠে পড়ে মিটিঙের ঘরের দিকে চলে। নতুন লোক কেউ আসে নি বরং দু-একজন চলে গিয়ে থাকতে পারে। কে কোথায় বসেছিল সে জায়গা নির্দিষ্ট হয়ে আছে। ফলে, মিটিঙটা আবার আগের অবস্থায় আসতে দেরি হয় না। শুধু এইটুকু তফাৎ-শিল্পমন্ত্রী বীরেনবাবুর বক্তব্য শোনার পর তার চেয়ারটাকে যেখানে টেনে এনেছিলেন সেখানে উপেনবাবু বসে আছেন। আর উপেনবাবুর পাশের চেয়ারে শিল্পমন্ত্রী। অফিসাররা সবাই একটা করে চেয়ার সরে গেছেন।

শিল্পমন্ত্রী দাঁড়িয়ে বললেন, আমরা উপেনবাবুকে অনুরোধ করেছিলাম আজকের সভায় থাকতে। কিন্তু তিনি খুব অসুস্থ। তাই সবার সঙ্গে একটু দেখা করে গেলেন। এখনই উনি চলে যাবেন। তাই আপনাদের সবাইকে উনি দেখতে চাইলেন।

উপেন্দ্রনাথ দাঁড়িয়ে নমস্কার করেন। সুস্থির ও আরো অনেকে দুই চোখ বড় বড় করে দেখে সেই কিংবদন্তির নায়ককে। সেকালের একজন রাজবংশী এম-এ বি-এল শুধু নন–দেশের যে-দায়িত্ব তিনি পেয়েছেন সেখানেই নিজের কৃতিত্ব প্রতিষ্ঠা করেছেন, দিল্লি, কলকাতা, লন্ডন, লস এঞ্জেলস; এই রাজ্যের বিধান পরিষদ একদিন পরিচালিত হয়েছে এই রাজবংশীর নির্দেশে, আর জীবনে তিনি কোনো সময় ভুলে যান নি তিনি রাজবংশী। এখনো উপেন্দ্রনাথের লেখা জল্পেশ্বর মন্দিরের ইতিহাস প্রচার করছে সুস্থিররা তাদের জল্পেশ্বর অভিযানের জন্যে। উপেন্দ্রনাথের মোটা তুষ চাদর বা কাধ আর ডান বগলের তলা দিয়ে ঘোরানো। মাথায় সামান্য চুল, গোটা দুদিকে সরু ও লম্বা–প্রায় সবটাই পাকা। মুখে স্মিত হাসিবিনয়ের ও আত্মবিশ্বাসের। চোখ তুলতে পারেন না–একটু যেন লাজুক। পাঞ্জাবির ঢোলা হাতা ঝুলিয়ে সকলকে নমস্কার করে আস্তে বলেন, আমি যাচ্ছি। আপনাদের নমস্কার।সকলে মিলেমিশে একমত হয়ে সব ঠিক করেন। আচ্ছা বলে একটু ঘুরে দাঁড়ান। শিল্পমন্ত্রী চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ান, সঙ্গে-সঙ্গে সবাই নমস্কার করে উঠে দাঁড়ান। শিল্পমন্ত্রী দুপা এগিয়ে যান, ডি-সি পেছন থেকে বলেন, স্যার, আমি ওঁকে তুলে দিয়ে আসছি, আপনি মিটিঙে বসুন। উপেন্দ্রনাথ একটু ঘুরে নমস্কার করে ধীর পায়ে বেরিয়ে যান। শিল্পমন্ত্রী এসে তার পুরনো চেয়ারেই বসেন।

শিল্পমন্ত্রী এসে বসতেই সন্তোষবাবু জিজ্ঞাসা করেন, উপেনদাকে আবার এটা বলেন নি ত যে শ্রীদেবী নাচবে?

সকলে হো হো করে হেসে ওঠায় সুবিমলবাবু বলেন, উপেনদাকে দিয়ে শ্রীদেবীর নাচটা ওপেন করালে কেমন হয় হেমেন?

এতে আর-এক চোট হাসি ওঠে, যেন, এখানে সবাই পারিবারিক বয়োজ্যেষ্ঠের কাছে গোপন করে কোনো নিষিদ্ধ আনন্দ ভোগ করছে–সেখানে তাদের মধ্যে কোনো মতবিরোধ নেই। ডি-সি এসে তার চেয়ারে বসেন। ফলে, শিল্পমন্ত্রী আর ডি-সির মাঝখানে একটা চেয়ার খালি পড়ে থাকে।

সন্তোষবাবু তার লম্বা হাতটা তুলে বলেন, সুবিমল, দেখো, আমার একটা প্রপোজাল আছে। এনাফ হিট হ্যাঁজ বিন জেনারেটেড বাই দি ফায়ারি ওরাটরি অব আওয়ার এসটিমড এম-এল-এ ফ্রম ময়নাগুড়ি।

তার পাল্টা আরো তাপ বিকিরণ করার জন্যে আমাদের জ্বালাময়ী বক্তা সুস্থির উঠে দাঁড়িয়েছিল বটে কিন্তু উপেনদার উপস্থিতি আমাদের এ যাত্ৰা বাঁচিয়েছে। সন্তোষবাবু কথা বলছিলেন সকলের দিকে মুখ ঘুরিয়ে-ঘুরিয়ে, বিশেষ করে উত্তরখণ্ডীদের দিকে, নিজে একটু হাসছিলেন। তাঁর পাশে নকুল হাসি-হাসি মুখ করে বসেছিল, যেন তার হাসি দিয়েই সে সন্তোষবাবুর প্রস্তাবটাকে যতটা পারে সাহায্য করতে চায়।

সন্তোষবাবু বলে যান, আইনশৃঙ্খলার ব্যাপার নিয়ে সরকারের উদ্বেগ দেখে আমরা প্রস্তাব দিচ্ছি যে উত্তরখণ্ড সম্মিলন যেখানে যেমন হচ্ছে সেরকমই হোক, কিন্তু শেষ দিন জল্পেশ্ব অভিযান সম্মিলনের জায়গা থেকে শুরু না হয়ে, চৌপত্তির এদিক থেকে শুরু হোক।

হেমেনবাবু সঙ্গে-সঙ্গে বলেন, অভিযানটা বাদ দেন না, আর সবই করেন। দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার জন্যে অভিযান পরিত্যক্ত। চৌপত্তিতে দাঁড়াবে কোথায় লোজন?

হেমেনবাবু ও সন্তোষবাবু হেসে ওঠেন বটে ও মুহূর্তে বোঝা যায় এই প্রস্তাবটা সকলে মেনে নেবে কিন্তু হেমেনবাবু অভিযান বাদ দেয়ার কথাটা নিয়ে আরো রগড়াবেন কি না এই নিয়ে একটি চাপা উদ্বেগও থাকে।

হেমেনবাবু বলেন, তার চাইতে জল্পেশ্বরের দিকে আর-একটু এগিয়ে আসুন, আপনারা বরং টাউনের বাইরে জমায়েতটা করুন।

বেশ, তাই হবে, বলে নকুল হাত তুলে দেয়। আর-কেউ কোনো আপত্তি না করায় নকুল দাঁড়িয়ে উঠে বলে, আমরা যারা এই কালচারাল ফাংশনের পার্টনার তাদের পক্ষ থেকে মাননীয় পর্যটন মন্ত্রী, শিল্পমন্ত্রী, বনমন্ত্রী ও এম-এল-এ সাহেবকে অনুরোধ করছি এই ফাংশনে, বিশেষত শেষ দিন, সপরিবার উপস্থিত থাকতে।

আরে থাকব বলেই ত তোমাদের এত করে বললাম উত্তরখণ্ডটা সরাও, শ্রীদেবীটা রাখো, তা তোমরা শুনলেই না, বলে সুবিমলবাবু অনেকক্ষণ ধরে চেয়ার ছেড়ে ওঠেন।

.

১৬৭. সম্মিলন ও অনুষ্ঠানপ্রাঙ্গণ

ময়নাগুড়ি ব্লক অফিসের পাশের মাঠে বিরাট প্যান্ডেল-হেশিয়ানের। ভেতরে খড়ের ওপর ত্রিপল ও হেশিয়ান বিছিয়ে বসার ব্যবস্থা। সামনের দিকে, একটু কোনাকুনি, স্টিলের ও কাঠের ভাজ করা চেয়ার–সেগুলো গিয়ে শেষ হয়েছে হেশিয়ানেরই বেড়ায়। ঐ চেয়ারগুলির জন্যে দর্শকদের কোনো অসুবিধা হবে না। খড়ের ওপর বেছানো হেশিয়ানের আসন আবার বাশ দিয়ে তিন ভাগ করা-ফাস্ট, সেকেন্ড, থার্ড ক্লাশ। পুবদিকে কোন গেট নেই। পশ্চিমদিকে তিনটি বড় গেট, কিন্তু তাতেও পর্দা ঝুলছে। এই পুরো প্যান্ডেলটিকে ঘিরে চারদিকেই টিনের বেড়া, বেশির ভাগই কাঁচা বাঁশের কাঠামোতে। স্টেজের পেছন দিকে ও পাশে কাঠের কাঠামো–তাতে টিনগুলো ভ্রু দিয়ে আঁটা। টিনের বেড়ায় ঢোকার রাস্তা বেশ চওড়া। সেই রাস্তাগুলি আবার বাঁশ দিয়ে দুভাগ করা–পুরুষদের ও মহিলাদের জন্যে। স্টেজের পেছনে স্টেজের চাইতে একটু কম উচ্চতায় কাঠের পাটাতন বিছিয়ে গ্রিনরুম। সেই গ্রিনরুম ও স্টেজ কাঠের কাঠামোতে টিন দিয়ে আলাদা করে ঘেরা। ঢোকার জন্যে দুদিকে দুটো কোল্যাপসিবল গেট-সেটা দিয়েই স্টেজে ঢোকা যায়। গ্রিনরুমের জন্যেই আবার একটা কাঠের দরজা–সেটা প্রয়োজনে ভেতর থেকে বন্ধ করা যায়।

এই প্যান্ডেলের বাইরের মাঠটাতে নানা রকম দোকান বসেছে। বেশির ভাগই খাবারের। একটা বেশ লম্বা দোকানের উনুনটা বাইরের দিকে। সেখানে জিলিপি আর সিঙাড়া ভাজা হয়। সেই দোকানটিতে ভেতরে বসার ব্যবস্থা আছে। অনেকে বসেও বটে, কিন্তু বেশির ভাগই বাইরে উনুনের সামনে দাঁড়িয়ে গরম-গরম জিলিপি আর সিঙাড়া খবরের কাগজের টুকরোর ওপর নেয়। তাই দোকানটাতে দুটো ক্যাশ বাক্স, একটা দোকানের ভেতরে আর একটা ঐ উনুনের পাড়ে। এই দোকানটি ছাড়া ছোট ও মাঝারি দোকানও আছে। শুধু একটা টেবিল ও একটা উনুনি নিয়ে চায়ের দোকান। মাঠের ওপর প্লাস্টিকের চাদর বিছিয়ে চিনির রসে পাকানো শুকনো মিষ্টি। এলুমিনিয়ামের সসপ্যানে রসগোল্লা আর লাড্ড নিয়ে বসে একজন একটা টুলের ওপর। মাথার ওপর ভামনির ছাউনি দিয়ে তার তলায় শোয়ানো কাঁচের শো-কেসে মেয়েদের নানা রকম নকল গয়না কাগজে সঁটা। পেছনে কাঠের তাকে প্লাস্টিকের নানা রকম খেলনা। একটা দোকানে প্লাস্টিকের বালতি-গামলাও বিক্রি হচ্ছে। খোলা মাঠের মধ্যে পেছনে টাঙানো একটা পর্দায় সারি-সারি বেলুন। একটু দূরে একটা টেবিলের ওপর রাখা একটা খেলনা বন্দুক। ঐ বেলুনগুলিতে নম্বর দেয়া আর নীচে সারি সারি প্রাইজেও নম্বর দেয়া। কুপির আলো জ্বালিয়ে চানাচুর বাদামওয়ালা আর তিলেরখাজাওয়ালা। রাস্তা দিয়ে ঢুকলে বায়ে-ডাইনে দু-দুটো পান-সিগারেটের দোকান–চৌকির ওপর। ঢোকার সময় ডান দিকের পান-সিগারেটের দোকানের পেছনে সাইকেল, মোপেড, স্কুটার ও মোটর সাইকেল রাখার জায়গা।

এই মাঠটা ব্লক অফিসের পাশে কিন্তু রাস্তা থেকে এই মাঠে আসার কোনো ব্যবস্থা নেই। রাস্তাটা মাঠ থেকে অনেক উঁচু। রাস্তা থেকে মাটি ভাঙতে-ভাঙতে গড়াতে-গড়াতে বিরাট নালায় এসে পড়েছে। নালাটার ভেতর এখন এই শীতে ভেজা কাল মাটি আর সেই মাটির ওপর সবুজ শ্যাওলার আস্তরণ। কিন্তু সব জায়গায় সমান নয়। কোথাও কাল ভেজা মাটির ঢিবি, কোথাও কাল ভেজা মাটির গর্ত। এই নালীটা সরকারি জমি। তাই এখান থেকে যে যার খুশিমত মাটি কেটে নিয়ে নিজের জমি উঁচু করে নিয়েছে। ফলে, রাস্তার পাশে টানা একটা শুকনো খালের মত নালীটা পড়ে থাকে।

রাস্তা থেকে সরাসরি খাল পেরিয়ে মাঠে উঠে আসা সম্ভব নয় আর এই খালটার ওপর বাশ বা কাঠের কোনো অস্থায়ী সঁকো তৈরি করা হয় নি। কিন্তু শ্রীদেবীর গাড়ি ঢোকানোর জন্যে সাধারণের পক্ষে নিষিদ্ধ একটা কাঠের কালভার্ট তৈরি করা হয়েছে। ব্লক অফিসে ঢোকার বড় ক্যালভার্টটাই প্রধান প্রবেশ পথ। সেই ক্যালভার্ট দিয়ে খালটা পেরিয়ে ব্লক অফিসের দেয়াল ডান হাতিতে রেখে বেঁকলেই মাঠটাতে ঢোকা যায়। সেখানে যে একটু-আধটু গর্ত ছিল খালের মাটি কেটে সেগুলো ভর্তি করা হয়েছে। দু-চার ট্রাক বালি ঢেলে লেবেল করে দেয়ায় ঐ জায়গাটাকে প্রায় সদর রাস্তার মতই লাগছে–এক ঐ ব্লক অফিসের দেয়ালের পাশের জায়গাটা একটু সংকীর্ণ, তবু সেখান দিয়েও মোটর সাইকেল চলে আসছে।

কিন্তু সদর রাস্তার ওপর এই সম্মিলনের জন্যেই পাবলিকের একটা সঁকো তৈরি না হওয়ায় বেশ জুতমত একটা গেট বানানো যায় নি। নিখিল বঙ্গ উত্তরখণ্ড সম্মিলন লেখা নীল রঙের ফেস্টুন–একটা টাঙাতে হয়েছে প্যান্ডেলের পেছনের হেশিয়ানের ওপর রাস্তার দিকে মুখ করে। আর, একটা টাঙানো হয়েছে পান-সিগারেটের দোকানটায় পাশে কোনাকুনি, সেটাও রাস্তার দিকে মুখ করে। কিন্তু গেট না থাকায় সেই ফেস্টুন দুটো কেমন আলগা হয়ে ঝোলে। রাস্তা থেকে ও-দুটো দেখা যায় ঠিকই, বাসের লোকজনও দেখতে পায়, কিন্তু এই সম্মিলনের লোকজনের চোখের আড়ালেই থেকে যায় ফেস্টুনদুটো। টিনের বেড়ার গায়ে দড়ি দিয়ে আর-একটা ফেস্টুন ঝোলানো আছে কিন্তু দড়িগুলো টানাটান হয় নি বলে সেটাতে এত নানা রকম ভাজ পড়েছে যে ঠিক পড়া যায় না। তা ছাড়া, টিনের ওপর কাগজে লেখা নানা পোস্টার আছে–কোন দিন কী অনুষ্ঠান হবে সে-সব জানিয়ে, সেগুলোই বেশি চোখে পড়ে।

গেট একটা বানানো হয়েছে ময়নাগুড়ির চৌপত্তিতে, পেট্রল পাম্পের কাছে, একেবারে ন্যাশন্যাল হাইওয়ের ওপরে! হাইওয়ের ওপর বলেই গেটটা উঁচু করতে হয়েছে, যাতে আসাম থেকে ও আসামের দিকে যে-সব ট্রাক পাহাড়প্রমাণ মাল নিয়ে যায় সেগুলোর মাথা না ঠেকে। অত উঁচু করার জন্যে ইলেকট্রিক ও ফোনের তারের ওপরে গেটটাকে তুলতে হয়েছে বটে কিন্তু তারও ওপরে হাই ভোল্টেজ লাইন থেকে অনেকটা নামিয়ে রাখতে হয়েছে। অত বড় রাস্তার এপার-ওপার জুড়ে গেটটা এত চওড়া আর উঁচু হয়েছে যে চোখে পড়লে তাক লেগে যায়। মাথার ওপর লেখা নিখিল বঙ্গ উত্তরখণ্ড সম্মিলন, ময়নাগুড়ি। কিন্তু চোখে পড়াটাই মুশকিল। গেটটার পুরো মাথাটা যত বড়, এক-একটি স্তম্ভ তত মোটা নয়। দুই স্তম্ভকে যুক্ত করেছে আড়াআড়ি মাথার ওপরের যে-অংশ সেটাও সরু। ফলে, গেটটা কেমন দু-পাশের ও মাথার ওপরের দোকানপাট, বাড়িঘর, গাছপালার সঙ্গে মিশে আছে। এতই মিশে আছে যে ট্রাক বা বাস থেকে নজরে ত পড়েই না, এমনকি রিক্সায় চড়ে যেতেও চোখে পড়ে না। কিন্তু একবার যদি নজরে পড়ে যায়, তা হলে বারবারই দেখতে হয়–হ্যাঁ, গেট একখান হইছেন বটে। সাত দিনের এই সম্মিলনে যারা আসে-যায় তাদের আর এই গেট না দেখে উপায় কী আছে? কিন্তু সম্মিলনের মূল জায়গায় রাস্তার ওপর কোনো গেট না থাকায়–চৌপত্তির এই গেটটা যে ঐ সম্মিলনেরই গেট তা বোঝা যায় না।

সম্মিলনের মাঠের ভেতর সাইকেল, মোপপড, মোটর সাইকেল, স্কুটার রাখার ব্যবস্থা হয়েছে বটে কিন্তু গরুর গাড়ি রাখার কোনো জায়গা নেই। যদি রাস্তা থেকে সঁকো একটা তৈরি করা যেত, তা হলে অত বড় মাঠের একটা দিক গরুর গাড়িতে ভরে যেত, যেমন সব হাটে হয়। সঁকো না-থাকায় গরুর গাড়িগুলোকে রাস্তার পাশেই লাইন দিয়ে দাঁড় করাতে হয়। তাতেও অসুবিধে। ন্যাশন্যাল হাইওয়ে হলেও রাস্তাটা তত চওড়া নয়। আপ-ডাউনের গাড়ির রাস্তা ছেড়ে দিলে আর কতটুকু জায়গা থাকে? সেখান থেকেই ত খালের ঢাল। সে-ঢালে গরুর গাড়ি নামিয়ে দিলে ভোলা মুশকিল। অথচ, গরুর গাড়ির সংখ্যাও ত নেহাৎ কম নয়। সন্ধ্যাবেলার ফ্যাংশন দেখার জন্যে সেই দুপুরের পর থেকেই। পাশাপাশি গায়ের মেয়েরা বাচ্চারা হেঁটে, রিক্সায় ও গরুর গাড়িতে আসতে শুরু করে। ফাংশন শুরু হওয়ার আগেই মাঠ রাস্তা মিলে একটা মেলার মত হয়। এক-একটা বড় গাছের নীচে রাস্তার ওপর, গরুর গাড়িগুলোকে রাখা হয় আর গরুগুলোকে, হয় গাড়ির চাকার সঙ্গে, আর না-হয় খুঁটি পুঁতে তাতে, দড়ি ছোট করে বেঁধে দেয়া হয়। মেয়েরা ও বাচ্চারা নানা রঙিন শাড়ি-জামায় সেই গাছতলাতেই অপেক্ষা করে–যতক্ষণ ভেতরে নিয়ে যাবার জন্যে দেউনিয়া না আসে।

.

১৬৮. উদ্বোধন অনুষ্ঠানের বিভিন্ন বক্তৃতার সংক্ষিপ্তসার

শনিবার সকালে সম্মিলনের উদ্বোধন হল। সময় ছিল সকাল আটটা। কিন্তু মোটামুটি লোকজন জমতে-জমতেই বেলা নটা হয়ে গেল। সকালে শুধু পতাকা উত্তোলন ও কয়েকজন বিশেষ বক্তার বক্তৃতা ছিল। পতাকা তুললেন রাজবংশী সমাজের প্রধান নেতা পঞ্চানন মল্লিক। আর বক্তৃতা করলেন আসাম ও দার্জিলিং থেকে আসা দুই প্রতিনিধি আর কয়েকজন স্থানীয় ব্যক্তি। স্থানীয় যারা বললেন তারা সরাসরি উত্তরখণ্ড আন্দোলনে যোগ দেন নি, কেউ-কেউ পার্টিতেও নেই, কিন্তু বিভিন্ন পেশায় ও রাজনীতিতে নিজেরা প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন।

শেষ পর্যন্ত অত বড় প্যান্ডেলে শ-দেড়েক মত উপস্থিত ছিল। তাদের মধ্যে অনেকেই বিকেলের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত কর্মী। সুস্থিরের সঙ্গে কাজ করেন এমন কয়েকজন প্রাথমিক শিক্ষক সংগঠিত ভাবে এসেছিলেন। আর, ময়নাগুড়ি বাজারের যে ব্যবসায়ীরা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত তাদেরও কেউ-কেউ। এ-ছাড়া বিভিন্ন অঞ্চল থেকে এসেছিলেন কয়েকজন–তাঁদের প্রতিনিধিই বলা যায়–যেকদিন সম্মিলন চলবে সেই ক-দিনই তাঁরা থাকবেন। এ ছাড়াও সম্মিলনে উপস্থিত ছিলেন কয়েকজন যারা রাজবংশী নন, কোনো ভাবেই উত্তরখণ্ড আন্দোলনের সঙ্গেও যুক্ত নন। তাদের একজন ৭০-৭১ সালে লাটাগুড়ি এলাকায় কৃষকদের মুক্ত এলাকা তৈরি করতে গিয়ে কৃষকদের হাতে মার খেয়ে হাসপাতালে যান, হাসপাতালের বেডেই তাকে গ্রেপ্তার করা হয়, তার বেডের পাশে কয়েকজন পুলিশ বসে, কিছুদিন পর তাকে কলকাতার এক হাসপাতালে বদলি করা হয়, সেখানে হাড়টাড়ের ওপর অনেক অপারেশন হয়, তারপর জেলেও থাকতে হয়। সব মিলিয়ে সাত-আট বছর পর ছাড়া পান। দাড়ি তখনো ছিল, এখনো আছে। কিন্তু সে-দাড়িতে এখন বেশির ভাগই শাদা ছোপ। এখন থাকেন জলপাইগুড়ি শহরেই, বাবার বাড়িতেই। কিছু করেন না। কিন্তু মাঝেমধ্যে এখানকার স্থানীয় নানা আন্দোলনে উপস্থিত থাকেন। তার কিছু করারও নেই কিন্তু এই ধরনের স্থানীয় সমস্যার ব্যাপারে তার যেন এক ধরনের আগ্রহ আছে। ইনি এসেছিলেন সঙ্গে একজন বন্ধুকে নিয়ে। কেউ তাকে নিমন্ত্রণ করেছে কি না বা আসতে বলেছে কি না–সেসব প্রশ্ন ওঠেই না। পাজামা-পাঞ্জাবি-দাড়ি আর একটা চাদরে এমন পরিচিত একজন ভদ্রলোককে দেখলে এসব সম্মিলনে একটু জোর আসে।

এরকমই এসেছিলেন ধূপগুড়ি ও বীরপাড়া অঞ্চলে কংগ্রেস নেতা বলে পরিচিত দুজন–অনিল রায় ও দেবকান্ত ক্ষত্রিয়। জেলাতে কংগ্রেস নেতা বলে এদের কেউ তেমন চেনে না কিন্তু স্থানীয়ভাবে কংগ্রেস নেতা বলে এদের যে-প্রতিপত্তি সেটা বিশেষত ভোটর সময় কাজে লাগে। কংগ্রেসের সরকার থাকলে স্থানীয় ব্যাপারস্যাপার নিয়ে এঁদের একটা ভূমিকা থাকে। এখন বয়স হয়ে গেছে। নিজেদের জমিটমি কিছু আছে কিন্তু এদের প্রধান একটা আয় হত নানা লোকের মামলা মোকদ্দমা বা সরকারের কাছে নানা কাজকারবারের ছোটখাট তদ্বির-তদারকি থেকে। এমন কিছু বড় কাজ নয়–এই সব কাজকেই খারাপ অর্থে এ-দেশী ভাষায় বলা হয় দেউনিয়াগিরি। এখন অনেক দিন সেই আয়টা নেই, সেই ভূমিকাটাও নেই। কংগ্রেসের সরকার থাকলে রাজনৈতিক মাতব্বরির যে-আত্মবিশ্বাস এদের চেহারার ফুটে ওঠে তাও নেই। ওরা স্থানীয় ভাবে নেতৃত্ব দিতে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলেন। পঞ্চায়েত-উঞ্চায়েত হয়ে গ্রামে নতুন সব নেতা তৈরি হয়ে গেছে। সেই নতুন নেতৃত্বের এরা কেউ নয়। অথচ পঞ্চায়েত যখন ছিল না তখন এরাই ছিল পঞ্চায়েত। উত্তরখণ্ডের আন্দোলন প্রধানত গ্রামাঞ্চলকে কেন্দ্র করেই হবে বলে আশা। সে কারণেই এদের চোখেমুখে যেন কিছু অসহায় ভরসা যে উত্তরখণ্ড : তাদের পুরনো নেতৃত্ব ফিরিয়ে দিতে পারে। কিন্তু উত্তরখণ্ড যেরকম মিছিল, মিটিঙ, সম্মিলন, দাবিদাওয়া–এসব করছে, তাতে তারা অভ্যস্ত নয়। বরং এ-সব থেকে তারা দূরেই থাকতে চায়।

উদ্বোধনের দিনের বক্তৃতাগুলো নানা রকম। উত্তরখণ্ডের নিজস্ব দলীয় পতাকা তোলা হল। লাল তেকোনা কাপড়ের মাঝখানে শ্বেত পূর্ণ সূর্য। পরে, এই নতুন পতাকা ব্যাখ্যা করে সভাপতি পঞ্চানন মল্লিক বলেছিলেন–ঠিক বলেন নি, তার ছাপানো সভাপতির ভাষণে ছাপা হয়েছিল, কামতাপুর রাজ্যের মুক্তির আন্দোলনের এই মুহূর্তে পতাকা রক্তবর্ণ ত্রিকোণ এবং মধ্যে মধ্যাহ্নকালীন খেত সূর্য ঘোষণা করা হয়েছে। উত্তরখণ্ড দল প্রাচ্যদর্শনে বিশ্বাসী। পৌরাণিক যুগ থেকে প্রাক ঐতিহাসিক যুগ পর্যন্ত ত্রিকোণ পতাকা প্রচলিত। ত্রিকোণ অর্থ ত্রিগুণ–সত্ত্ব, রজঃ, তমঃ। রক্তবর্ণ মাতৃরজঃ সুতরাং শক্তির প্রতীক। শ্বেতবর্ণ পিতৃওজঃ বীজ সুতরাং জ্ঞানের প্রতীক অর্থাৎ সূর্য জ্ঞানের প্রতীক। শক্তি ও জ্ঞানের সমন্বয়েই উন্নয়নের পথ। জৈবিক ত্রিগুণাত্মিক ত্রিকোণ শ্বেতসূর্যসমন্বিত পতাকা সম্পূর্ণ অহিংস গণতান্ত্রিক পথে জ্ঞানের আলোকে দলের বিপ্লবাত্মক চিন্তাধারাকে লক্ষ্যে পৌঁছানোর দৃঢ়তা ঘোষণা করে।

সভাপতি, উদ্বোধক ও প্রধান নেতা পঞ্চানন মল্লিকের বক্তৃতাতেও এই বিষয়টিই প্রাধান্য পেল–ভারতীয় হিন্দুদর্শনে বিশ্বাস, ভারতের সংবিধানের প্রতি বিশ্বাস, কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতি বিশ্বাস ও কলকাতার নেতৃত্বের প্রতি সম্পূর্ণ অনাস্থা। তার বক্তৃতাতেই স্বাধীন কামতাপুর রাজ্য প্রতিষ্ঠার দাবি তোলা হল। সেই দাবির সমর্থনে ইতিহাস থেকেও কিছু-কিছু যুক্তি এসেছে বটে কিন্তু বারবারই নিজেদের উপজাতীয় অস্তিত্বের স্বাতন্ত্র ঘোষণার সঙ্গে মিশে যাচ্ছিল বর্ণ হিন্দু সমাজের প্রতি আনুগত্যের সংস্কার।

তার বক্তৃতা শুরুই হল গীতার উদ্ধৃতি দিয়ে, তাও অনুবাদে নয়, সংস্কৃতে,

হতে বা প্রাপ্যসি স্বর্গং।
জিত্বা বা ডোক্ষ্যসে মহীং।
তস্মাদুত্তিষ্ঠ কৌন্তেয় যুদ্ধায় কৃতনিশ্চয়ঃ
 সুখদুঃখে সমে কৃত্বা লাভালাভৌ জয়াজয়ে
ততো যুদ্ধার যুজ্যস্ব নৈবং পাপমবাসি।

তিনি প্রথমেই বলে নেন, ভারতবর্ষ মাতৃভূমি। ভারতবর্ষের অখণ্ডতা ও জাতীয় সংহতি রক্ষা করায় প্রতিটি ভারতবাসীর মত আমরাও সর্বপ্রকার ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত আছি। তারপরই যোগ করেন, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের উত্তরাংশের মানুষের সর্বাঙ্গীন উন্নতির জন্যে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের আজ পর্যন্ত যা করার দরকার ছিল, তা করেন নি।….সবচেয়ে বেশি নির্যাতিত ও শোষিত হচ্ছেন এখানকার বসবাসকারী সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজবংশী, সংখ্যালঘু মুসলমান, বাস্তুহারা নমশূদ্র, বহু উপজাতি ও অন্যান্য সম্প্রদায়ের মানুষ। এই সকল অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে গড়ে উঠেছে উত্তরখণ্ড দল। উত্তরখণ্ড দলের উদ্দেশ্য হল উত্তরবঙ্গকে পশ্চিমবঙ্গ থেকে পৃথক করে ভারতীয় সংবিধানের ৩নং ধারা অনুযায়ী কামতাপুর নামে এক ভারতভুক্ত সমৃদ্ধিশালী অঙ্গরাজ্য গঠন করা এবং কলকাতা কেন্দ্রিক রাজনৈতিক কুচক্রী পুঁজিবাদী নেতাদের শোষণের থেকে উত্তরবঙ্গবাসীকে রক্ষা করে তাদের মুখে হাসি ফোঁটান।…আপনারা জানেন যে ভারতবর্ষের প্রাচীনকালে কামরূপ নামে এক রাজ্য ছিল। এই কামরূপ রাজ্যের পশ্চিম অংশে গঠিত হয় কামতাপুর রাজ্য। মহারাজা নরনারায়ণের রাজত্বকালে এই কামতা রাজ্যের সীমা আসাম ও উত্তরবঙ্গ পর্যন্ত বিস্তৃত হয় কিন্তু কালক্রমে কামতা রাজ্যের সীমা কিছু পরিবর্তিত হয়ে সমস্ত উত্তরবঙ্গ পর্যন্ত সীমাবদ্ধ থাকে।…. উত্তরবঙ্গের কোনো অংশ সিরাজদৌল্লার শাসনাধীন ছিল না। ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দের ২৩ জুন পলাশি প্রান্তরে সিরাজদৌল্লা ইংরাজের হাতে পরাজিত হলে বাংলাদেশ ইংরাজ শাসনাধীন হয় কিন্তু একথা ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণিত যে কামতা রাজ্য কোনোকালেই বঙ্গদেশের অন্তর্ভুক্ত ছিল না। স্বাধীনতা লাভের পর ভারত সরকার উত্তরবঙ্গকে পৃথক ভাবে শাসন করার জন্যে চেয়েছিলেন। ভাষা ভিত্তিক রাজ্য পুনর্গঠন কমিশন উত্তরবঙ্গে এলে সেই কমিশনের কাছে উত্তরবঙ্গকে কামতাপুর নামে এক রাজ্য হিশাবে ঘোষণা করার দাবি জানানো হয় ১৯৫৫ সালের ১৩ই মে তারিখে। এই কমিশনের মাননীয় সদস্য হৃদয়নাথ কুঞ্জরু, মিঃ পানিকর ও অন্যান্য সদস্যগণ কামতাপুর রাজ্য গঠনের যৌক্তিকতা স্বীকার করেন এবং প্রস্তাব গ্রহণ করেন। কিন্তু তৎকালীন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায় প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুকে নানা ভাবে বুঝিয়ে কামতা রাজ্যকে পশ্চিমবঙ্গের ভেতরে রাখেন। এরপর বোম্বাই ভেঙে মহারাষ্ট্র ও গুজরাট গঠন (১৯৬০), আসাম ভেঙে নাগাল্যাণ্ড (১৯৬২), পাঞ্জাব ভেঙে হরিয়ানা (১৯৬৬), আসাম ভেঙে মেঘালয় ও অরুণাচল (১৯৭১), মাদ্রাজ ভেঙে অন্ধ্র (১৯৫৩),এই সব উদাহরণ দেন।

কিন্তু পঞ্চাননবাবুর বক্তৃতার প্রধান অংশ খানিকটা আলগা ভাবে এই ইতিহাসের ওপরই নির্ভরশীল হয়ে থাকল। বর্তমান অবস্থার বিশেষত্বের প্রসঙ্গে তিনি বিশেষ কিছু প্রায় বললেনই না।

সেটা বরং একটু বেশি মাত্রায় স্পষ্ট করে দিলেন নকশালবাড়ি থেকে আসা সম্পৎ রায়। প্রথম যখন নকশালবাড়ি হয় তখন সেখানকার নকশাল-আন্দোলনের বিরুদ্ধে সম্পৎ রায় জোতদারদের একটা কৃষক সমিতি তৈরি করে নকশালপ্রভাবিত কৃষকদের বিরুদ্ধে সম্মুখযুদ্ধ নেমে পড়েন। তখন সম্পৎ রায়ের বয়স বছর চল্লিশ, এখন বছর ষাট। চারু মজুমদার, কানু সান্যালের নেতৃত্বে নকশালবাড়ির কৃষক আন্দোলন শুরুতে ত ছিল কৃষকদের ন্যায্য ভাগের আন্দোলন, কোথাও-কোথাও আধিয়ারির দখলের আন্দোলন। ও-সব এলাকায় কোনোদিনই গোলমাল-টোলমাল হত না, ফলে থানাপুলিশের ব্যাপার ছিল বললেই চলে। সম্পৎ রায়ই প্রথম স্থানীয় জোতদারদের দ্রুত সংগঠিত করে পূর্ণিয়া থেকে ভাড়া করে লোক নিয়ে এসে পাল্টা আক্রমণ শুরু করে। সম্পৎ রায় মাইক ফাটিয়ে বললেন, অনেকে বলেন এটা রাজবংশীদের দল–এই উত্তরখণ্ড দল। আমি এ কথা মানি না। উত্তরবঙ্গে রাজবংশী বেশী–যা কিছু করবেন তাতেই রাজবংশী বেশি হবে। কমিউনিস্টরা যখন মিছিল করে তখন সেখানেও রাজবংশী বেশি থাকে–তাকে ত কেউ রাজবংশী পার্টি বলে না। আবার চা বাগানের মজুরদের নিয়ে সিটু বা আই-এনটিইউসি যখন আন্দোলন করে, তখন তাকে ত কেউ মদেশিয়া আন্দোলন বলে না–কিন্তু তাতে ত মদেশিয়ারাই বেশি থাকে। আপনারা ভাবেন উত্তরবাংলায় রাজবংশীরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ অথচ দেখেন, কোনো জায়গায় রাজবংশীরা চাকরি পায় না, রাজবংশী কৃষক ব্যাঙ্কের লোন পায় না। গত চল্লিশ বছর দেশ স্বাধীন হল–তাতে রাজবংশীদের কোন উপকার হল? প্রত্যেক সরকার একজন করে রাজবংশী মন্ত্রী রাখে। আগে পুরা মন্ত্রী রাখত, এখন আধামন্ত্রী একজন রাখে। তাতেই রাজবংশীদের বাপঠাকুর্দা উদ্ধার হয়ে গেল। কিন্তু আমাদের এ-আন্দোলন–উত্তরবঙ্গের সকলের জন্যে আন্দোলন, শুধু রাজবংশীদের আন্দোলন এটা নয়। আমরা চাই উত্তরবঙ্গের সবাই আমাদের সঙ্গে আসেন।

আসাম থেকে যিনি এসেছিলেন তিনি আসামের কোন পার্টির প্রতিনিধি বা কেন এসেছেন সেটা বোঝা গেল না। কিন্তু তার বক্তব্যটা খুব নির্দিষ্ট ছিল। তিনি বললেন, ভারতবর্ষের রাজনীতিতে একটা গুরুতর পরিবর্তন ঘটছে। এতদিন পর্যন্ত দিল্লি থেকে সারা ভারতের শাসন চালানো হত, কিন্তু এখন একটা সময় এসেছে যখন আঞ্চলিক শক্তিগুলিই আলাদা-আলাদা অঞ্চল থেকে মিলিভাবে ভারতবর্ষ চালাবে। কেন্দ্রে একটা সরকার থাকতে পারে, থাকবেও, থাকা দরকার। কিন্তু সে-সরকারকে চলতে হবে এই আঞ্চলিক শক্তিগুলোর ওপর নির্ভর করে। এইভাবে এই আঞ্চলিক শক্তিগুলির সঙ্গে কেন্দ্রের একটা লেনদেনের সম্পর্ক তৈরি হবে। কেন, সে সম্পর্ক এখনই তৈরি আছে। তামিলনাড়ুর কথাই ধরুন। সেখানে কত দিন হল স্থানীয় ডি-এম-কে বা এ-আই-এ-ডি-এম-কে দলের সঙ্গে কেন্দ্রের কংগ্রেসের একটা বোঝাপড়া হয়ে আছে। রাজ্যে ডি-এম-কে বা এ-আই-এ-ডি-এম-কে ক্ষমতায় থাকবে–সেখানে কংগ্রেস কোনো ভাগ বসাবে না, কেন্দ্রে কংগ্রেসকে ক্ষমতায় থাকতে এরা সাহায্য করবে–সেখানে এরা কোনো ভাগ চাইবে না। একবার কংগ্রেস হিশেবে ভুল করেছিল, রাজ্যে ক্ষমতার কে আসবে! সেবার কংগ্রেসও সেই ভুলের খেশারত দিয়েছে। শুধু কংগ্রেস নয়, কেন্দ্রীয় ক্ষমতায় যারাই থাকবে তাদেরই রাজ্য বা আঞ্চলিক দলগুলির সঙ্গে এরকম বোঝাপড়া করে নিতে হবে। ধরুন, ১৯৭৭ সালের ভোটে তামিলনাড়ুতে এ-আই-এ-ডি-এম-কে ভোটে জিতল আর সারা ভারতে কংগ্রেস হারল। এই এ-আই-এ-ডি-এম-কের সঙ্গে কেন্দ্রের জনতা পার্টির আপোশ-সমঝাওতা হল। ১৯৮০-তে ইন্দিরা গান্ধী ফিরে এলেন, তামিলনাড়ুর এ-আই-এ-ডি-এম কে সরকারকে কংগ্রেসবিরোধী বলে বরখাস্ত করে ডিএমকের সঙ্গে সন্ধি করলেন। ছ মাস পরের ভোটের কংগ্রেস ডুবল, ডি-এম-কেও ডুবল। এ-আই-এ-ডি-এম-কে জিতে গেল। ইন্দিরা গান্ধী তার ভুল বুঝতে পেরে সাত তাড়াতাড়ি এ-আই-এ-ডি-এম-কের সঙ্গে রফা করে নিলেন রাজ্য তোমাদের, কেন্দ্র আমাদের। এই রাজনীতির ধরনটাই এখন ভারতে নতুন ভাবে এসেছে আপনাদের উত্তরখণ্ড আন্দোলনকে সেইভাবে পরিচালিত করতে হবে।

এই আসামের প্রতিনিধি রাজনীতির কায়দাকানুন নিয়ে আর-একটা কথা বলেন, এতদিন ভারতের রাজনীতি এই রকম ভাগে ভাগ হয়ে এসেছে কংগ্রেসবিরোধী ও কংগ্রেসসমর্থক। বা, এটাকে উল্টেও বলতে পারেন– কমিউনিস্টবিরোধী ও কমিউনিস্টসমর্থক। বা, এটাকে আর-এক ভাবে বলতে পারেন–কংগ্রেস কমিউনিস্টবিরোধী ও কংগ্রেস কমিউনিস্টসমর্থক। কংগ্রেস ভেঙে যে-সব দল তৈরি হয়েছে সেই সব দল ও বিজেপি, কংগ্রেস কমিউনিস্ট বিরোধী। এ রকম শাদায়কালয় রাজনীতিকে ভাগ হতে হবে কেন? কেন একদলকে কংগ্রেস ও কমিউনিস্টদের সমর্থক বা বিরোধী হতেই হবে? এই দুই দল কিন্তু সেরকম কোনো বাধানিষেধ মানে না। এরা যখন যার সঙ্গে ইচ্ছে রফা করে, যখন যার বিরোধিতার ইচ্ছে তার বিরোধিতা করে। আমরাও সেভাবেই চলব। আমরা কংগ্রেসও না, কমিউনিস্ট না। প্রত্যেকের সঙ্গেই আমাদের লেন-দেনের সম্পর্ক। এখন কমিউনিস্টরা এখানে ক্ষমতায় আছে। কমিউনিস্টরা যদি আপনাদের দাবি মেনে নেন–রাজবংশীপ্রধান অঞ্চলে যদি রাজবংশীদের প্রাধান্য স্বীকার করে নেন, যদি রাজবংশীদের চাকরির ব্যবস্থা করেন, বা, রাজবংশী ভাষার প্রাধান্য দেন, তা হলে আপনাদের আপত্তি কী? তেমনি আবার এই সব দাবি আদায়ের ব্যাপারে কেন্দ্রীয় কংগ্রেস সরকারের কংগ্রেস যদি আপনাদের সাহায্য করে তা হলে আপনারা কেন্দ্রীয় সরকারের বা কংগ্রেসের সাহায্য নেবেন। গোর্খাল্যাণ্ড হবে কি হবে না সেটা এখনই বলা যায় না বটে কিন্তু রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী যখন গোখাল্যাণ্ডের নেতা ঘিসিংকে জাতিদ্রোহী বলেছিলেন, কেন্দ্রের প্রধানমন্ত্রী তার বিরোধিতা করেছিলেন। আবার রাজীব গান্ধী যখন দার্জিলিং সফরে গেলেন, তখন ঘিসিং হরতাল ডেকে দিলেন। এটাই হওয়া উচিত। আপনাদের পক্ষে যা-কিছু যীক কাজে লাগানো, আপনাদের বিপক্ষে যা-কিছু তার বিরোধিতা করা। তার জন্যে কংগ্রেস বা কমিউনিস্টের স্থায়ী সমর্থক বা স্থায়ী বিরোধী হাওয়ার কোনো দরকার নেই। দেশের ভেতরে কি কংগ্রেস আর কমিউনিস্টই আছে–আর-কিছু নেই? দেশের বেশির ভাগ মানুষই কংগ্রেসও নয়, কমিউনিস্টও নয়। আপনাদের এই আন্দোলনকে সেই কংগ্রেস কমিউনিস্ট বিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত করতে হবে।

দার্জিলিং থেকে যিনি এসেছিলেন, তার বক্তৃতার পর জানা গেল তিনি অধ্যাপক। তিনি সম্পূর্ণ নতুন কথা বললেন, দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে ভাষার ভিত্তিতে প্রদেশ তৈরি করার প্রতিশ্রুতি কংগ্রেস দিয়েছিল, সব দল সেটা সমর্থন করেছিল। কেন? না, ব্রিটিশরা তাদের নিজেদের দরকার অনুযায়ী। দেশটাকে যখন যেমন ইচ্ছে ভাগ করে চালাত। মাদ্রাজ ছিল বিরাট একটা প্রদেশ। এখনকার কেরালা বা কর্ণাটক ছিলই না। ত্রিবাঙ্কুর-কোচিন, পেপসু এসব প্রদেশ বা রাজ্য হয়েছিল। বাংলা-বিহার-ওড়িশা একসঙ্গে ছিল, আবার আলাদা হয়ে যায়। উত্তরপ্রদেশ ছিল না, ছিল ইউনাইটেড প্রভিন্স। স্বাধীনতার পরে রাজ্যসীমা পুননির্ণায়ক কমিটি নতুন নতুন রাজ্য তৈরির সুপারিশ করেন, ভাষার ভিত্তিতে নতুননতুন রাজ্য তৈরি হয়। ভাষার ভিত্তি মানে ত জাতি-ভিত্তি। জাতি ও ভাষাগত এক-একটা রাজ্য–এটাই ভারতীয় সাধারণতন্ত্রের আদর্শ। যেমন, পাবলিক সেকটর ভারতীয় শিল্পনীতির আদর্শ। যেমন, পরিকল্পনা ভারতীয় উন্নয়নের আদর্শ। একটার পর একটা পাবলিক সেকটরের কারখানা তৈরি হয়। একবার কতকগুলি কারখানা তৈরি করে দিয়েই ত আর বলা হয় নি যে, ব্যাস এই হয়ে গেল আমাদের পাবলিক সেকটর। তেমনি, একটা পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা করেই ত আর বলা হয় নি, ব্যাস এই হয়ে গেল আমাদের পরিকল্পনা। তা হলে রাজ্যসীমা পুননির্ণায়ক কমিটিই বা চিরকালের জন্যে একবার। সব রাজ্যের সীমা ঠিক করে দিয়ে কেন বলবে, ব্যাস এইগুলিই আমাদের একমাত্র রাজ্য। ভারতবর্ষের নিজেরই সীমা গত চল্লিশ বছরে কত বদলে গেছে, বলুন। সিকিম আগে ভারতের মধ্যে ছিল না, সিকিমের বাইরে দিয়ে এখন ভারতের সীমা চলে গেছে। তেমনি আকসাই চীন কার্যত আমাদের হাতে নেই, কার্যত ভারতের মধ্যে নেই। এক আমাদের সার্ভে অব ইন্ডিয়ার মাপেই এসব জায়গাকে ভারতের জায়গা বলে দেখানো হয়, পৃথিবীর আর-সব দেশের ম্যাপে এ-সব জায়গাকে চীনের বলে দেখানো হয়, যেমন, আজাদ কাশ্মীরকে দেখানো হয় পাকিস্তানের জায়গা বলে। তা হলে, ভারতের সীমাই যদি এরকম বদলাতে পারে তা হলে রাজ্যের সীমাইবা বদলাবে না কেন? যখন ১৯৫৩ সালে রাজ্য সীমা স্থির হয়েছিল তখন বিহারের ও বাংলার আদিবাসীরা কিছুই জানত না, গোখারাও কিছু জানত না, আপনারাও কিছু জানতেন না। এখন আমরা যদি জেনেবুঝে বলি আমাদের ভাষা ও জাতির জন্যে আলাদা রাজ্য দাও, তার মধ্যে দোষটা কোথায়? বাঙালিরা তখন বলেছিল, বিহারের কিছু জায়গায় বাংলা ভাষা চালু আছে, যারা থাকে তারা বাঙালি, সেই জায়গাটা পশ্চিমবাংলায় দিয়ে দাও। দিয়ে দেয়া হল। এখন আমরা যখন বলছি যে যারা নেপালি ভাষা বলে তাদের একটা রাজ্য করে দাও–তখন আমাদের বলা হল, বিচ্ছিন্নতাবাদী। আপনারা যদি বলেন আমরা রাজবংশীরা একটা আলাদা রাজ্য চাই–তা হলে বলা হবে বিচ্ছিন্নতাবাদী। আমরা ত আসলে এখনই বিচ্ছিন্ন হয়ে আছি–নিজের ভাষা থেকে বিচ্ছিন্ন, নিজের হকের জায়গা থেকে বিচ্ছিন্ন, নিজের হক থেকেই বিচ্ছিন্ন। আর যাই হোক, এ কথা ত কেউ বলছে না যে নেপালিরা বাঙালি। তা যদি না বললো, তা হলে আমাদের আলাদা রাজ্য হবে না কেন। আপনাদের আলাদা রাজ্য হবে না কেন? রাজ্য পুননির্ণায়ক কমিটি আবার কাজে হাত দেবে না কেন? নাকি তা হলে পশ্চিমবাংলা ছোট হয়ে যাবে। তা হলে এ কথা ত ব্রিটিশরাও বলতে পারত বাংলাকে ভাগ করলে ছোট হয়ে যাবে, সবটাই পাকিস্তানে যাক। ১৯৫৩ সালে যখন রাজ্য ভাগ বাটোয়ারা হয় তখন আমরা ছিলাম না। ছিলাম না বলে আমাদের কাকা-জ্যাঠারা আমাদের সম্পত্তি দেখাশোনা করেছেন। এখন সাবালক হয়ে যখন আমরা সম্পত্তিতে আমাদের ভাগ চাইছি তখন সেই কাকা-জ্যাঠারা বলছেন-এ ছেলেটা বড় বেয়াদপ, আমাদের সুখের সংসারটাকে ভেঙে আলাদা হতে চাইছে। তা আমরা বলি, কাকা শোনো, জ্যাঠা শোনো, সংসারটাও তোমাদের, সুখটাও তোমাদের, আমার থাকল কী? ছেলে লায়েক হলে তার বিয়েশাদি দিয়ে তাকে সংসার তৈরি করে দিতে হয়। ত, আমার ত দাড়ি গজিয়ে এখন পাকতে শুরু করেছে, গোফ পাকার ভয়ে গোফ ছেটে দিয়েছি, কিন্তু তবু ত আমাকে বিয়েশাদি দিয়ে সংসার করানোর দিকে আপনাদের মন নেই। এ কেমন ব্যবহার। তা, এতদিন। যে আমাদের দেখভাল করলেন তার জন্যে আপনাদের প্রণাম করছি, কিন্তু এখন আমার দেখভাল আমাকেই করতে দিন। আপনারা রাজ্যের সীমা নতুন করে ঠিক করার কমিটি আবার চালু করুন, তার রায় মেনে নিন।

.

১৬৯. তিস্তা ব্যারেজ প্রসঙ্গে বক্তৃতা

 জলপাইগুড়ি শহর থেকে যে-দাড়িওয়ালা ভদ্রলোক কৃষকদের মুক্ত এলাকা তৈরির জন্যে অনেক বছর জেল খেটেছেন তাকে বক্তৃতা করতে ডাকা হয়। কিন্তু তার সঙ্গে এই সম্মিলনের সম্পর্কটা নিয়ে কেউই নিশ্চিত নয়–কে তাকে নেমন্তন্ন করেছে, এখন ইনি কী করেন। সাধারণ ভাবে এ-রকম ভদ্রলোকদের নাকশালিয়া বলেই ডাকা হয়। নাকশালিয়াই হোক আর যাই হোক একজন ভদ্রলোকের ছেলে, বা পড়াশোনাজানা একজন ভদ্রলোকই, যদি এরকম সম্মিলনে হাজির থাকেন তা হলে তাকে কিছু না বলতে দিলে হয়? কিন্তু ভদ্রলোক সবচেয়ে দরকারি কথা বললেন একেবারে উত্তরখণ্ড আন্দোলনের বর্তমান কর্মসূচির প্রধানত বিষয়টি নিয়ে। সরকার জানিয়ে দিয়েছেন আর-মাসখানেকের মধ্যেই তিস্তা ব্যারেজের প্রাথমিক উদ্বোধন হবে। মুখ্যমন্ত্রী উদ্বোধন করেন। তার জন্যে সেদিন সারা উত্তরবাংলা থেকে বামফ্রন্ট মিছিল নিয়ে আসবে। উত্তরখণ্ড দাবি করেছে যে তিস্তা ব্যারেজ এখন উদ্বোধন করা চলবে না। কৃষকদের জমি অধিগ্রহণ করা চলবে না, যে-জমি ব্যারেজের জন্যে অধিগ্রহণ করা হয়েছে তার ক্ষতিপূরণের বদলে সমপরিমাণ জমি কাছাকাছি এলাকায় সরকারি খাশজমি থেকে কৃষকদের দিতে হবে, যে কৃষকদের জমি ব্যারেজের জন্যে অধিগ্রহণ করা হয়েছে তাদের মধ্যে যদি এমন কেউ থাকে যার অন্য জমি ইতিপূর্বে ভেস্ট হয়ে গেছে, তাহলে অধিগৃহীত জমির সমপরিমাণ জমি তার সেই ভেস্ট জমি থেকে ফিরিয়ে দিতে হবে। এই সব দাবির ভিত্তিতে উত্তরবঙ্গের, বিশেষত জলপাইগুড়ি জেলার, নানা জায়গা থেকে বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে যাওয়া হবে তিস্তা ব্যারেজ উদ্বোধনের দিন। উত্তরখণ্ডের এই সম্মিলন থেকে বলা হচ্ছে আগামী একমাস ধরে সেই বিক্ষোভ মিছিল সংগঠনের জন্যে। এই নাকশালিয়া ভদ্রলোক এই বিষয়টি নিয়েই বললেন, শুধু এই বিষয়টি নিয়েই। ভারতে ভাকরা-নাঙ্গাল হয়েছে, হীরাকুঁদ বধ হয়েছে, নাগার্জুনসাগর হয়েছে, আরো কত-কত জায়গায় কত নতুন-নতুন ড্যাম হয়েছে, বাধ হয়েছে। এই পশ্চিমবঙ্গেই দামোদর হয়েছে, ময়ূরাক্ষী হয়েছে, মাইথন হয়েছে, পাঞ্চেৎ হয়েছে। কিন্তু যেখানেই হোক না কেন তাতে সর্বনাশ হয়েছে এই সব জায়গায় গরিব অধিবাসীদের, বিশেষত আদিবাসীদের। কেন? এই সব ব্যারেজ, ড্যাম ইত্যাদির জন্যে বাছা হয় পাহাড় ও জঙ্গলের এমন দুর্গম জায়গা যেখানে বন্য পশুর সঙ্গে লড়াই করে পশুর মতই জীবনযাপন করে আদিবাসী মানুষজন, গরিব মানুষজন। কেন? না, ঐ রকম দুর্গম জায়গায় তারা এই ভদ্রলোকদের শোষণের হাত থেকে বাঁচবেন। কিন্তু যখন ব্যারেজ বা ড্যামের জন্যে জমি বাছা হয় তখন সেই জমি থেকে এদের উচ্ছেদ করা হয় প্রথম। উচ্ছেদ করে ঐ ব্যারেজ বা ড্যামেই শ্রমিক হিশেবে নিয়োগ করা হয়। তারপর, ঐ ব্যারেজ বা ড্যামের জলে যখন জমিতে ফসল ফলাবার অবস্থা তৈরি তখন সেই জমির দাম ত সোনার দাম। তখন বড় বড় ব্যবসায়ীরা সেই জমিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে সবুজবিপ্লব তৈরি করে। ভারতে একটা উন্নয়ন পরিকল্পনার নাম বলুন, যেখানে একটা ব্যারেজ বা ড্যামের ফলে আদিবাসীদের বা গরিব মানুষদের এক ফোঁটা উপকার হয়েছে। আপনাদের এখানে এতদিন এই উপদ্রব ছিল না। তিস্তা ব্যারেজের চেহারায় সেই উপদ্রব শুরু হল। তিস্তা ব্যারেজের জলে নাকি লক্ষ-লক্ষ জমি উর্বর হবে, তাতে চাষ হবে, তাতে সোনা ফলবে, সেই সোনা বেচে কৃষকরা বড়লোক হবে, কিন্তু তার আগেই, ঐ ব্যারেজ থেকে এক ফোঁটা জলও কৃষির কাজে লাগার আগেই কৃষকরা জমি থেকে উচ্ছেদ হয়েছে, কৃষকের জমি নামমাত্র মূল্যে অধিগ্রহণ করা হয়েছে, যে কৃষককে জমির মালিক থেকে তিস্তা ব্যারেজের শ্রমিকে পরিণত করা হয়েছে সেই কৃষককে কি ব্যারেজের জল সোনার ফলন দেবে? ব্যারেজ হওয়ার আগে তাও কৃষক তিস্তার জল আজলা ভরে খেয়ে নিজের খিদে চাপা দিতে পারত, তিস্তার চরে বাঘভালুকের সঙ্গে লড়াই করে দু-এক মুঠো ধান ফলাতে পারত, ব্যারেজ হওয়ার পর কৃষক তাও পারবে না, কারণ আগে ত তিস্তার জল ছিল আকাশের বাতাসের মত–যার খুশি নিশ্বাস নাও। কিন্তু এখন ত তিস্তার জল সরকারি ব্যারেজের জল, এখন ত সে-জলের দাম আছে, যার ইচ্ছে সে ত এখন এই জল দুহাত ভরে তুলে নিতে পারবে না, খাওয়ার জন্যেও নিতে পারবে না। তিস্তার চর ত আর পতিত জমি নয় যে হাল যার ফলন তার। ব্যারেজের ফলে তিস্তার দামও ত হুহু করে বাড়ছে। এ কেমন উন্নয়ন যেখানে নদীর জলের ওপর তার স্বাভাবিক অধিকার কৃষক হারাবে? চরের জমির ওপর তার স্বাভাবিক দখল সে হারাবে? বনের জমির ওপর বাঘভালুকের স্বত্ব আছে কিন্তু সে-জমি কৃষক চাষ করলেই হয়ে যাবে স্কোয়াটার বা অনধিকারী দখলদার। এতদিন ভারতের মানুষকে বোকা বানিয়ে এই সব ব্যারেজ, ড্যাম তৈরি করা হয়েছে কিন্তু নিজেদের অভিজ্ঞতা থেকে লোকজন শিক্ষা নিয়েছে। ওড়িশাতেই দুটো ঘটনা ঘটেছে–একটা বালিয়াপোলে, আর-একটা কোথায় আমার মনে পড়ছে না। বালিয়াপোলে সরকার কামানের গোলা পরীক্ষার জন্যে সমুদ্রের ধারের জমি অধিগ্রহণ করেছে। কিন্তু সেখানকার লোকজন তাদের দখল ছাড়ছে না। সেখানে তুমুল আন্দোলন চলছে। সরকার এখনো তার দখল নিতে পারছে না। আর-একটি জায়গায় এক পাহাড়ে নতুন একটি উদ্যোগ নেয়া হলে সেখানকার আদিবাসীরা প্রবল প্রতিরোধ তৈরি করে বলেছেন তারা এই উদ্যোগ চান না। আপনাদের উত্তরখণ্ড আন্দোলনের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ আপনাদের হাতে। সে বিষয়ে আমি কিছু বলতে চাই না। কিন্তু মাসখানেক পরে তিস্তা ব্যারেজের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে বিক্ষোভ দেখাবার যেকর্মসূচি আপনারা নিয়েছেন–সেই কর্মসূচিকে সমস্ত শক্তি দিয়ে সফল করুন। আপনারা যদি চেষ্টা করেন, তা হলে তিস্তা ব্যারেজ বন্ধ করে দিতে পারবে, যা হয়েছে তাও অকেজো করে দিতে পারেন। সেটাই হবে আপনাদের প্রধান সাফল্য।

ভদ্রলোক যে এরকম বক্তৃতা দেবেন তা সভার উদ্যোক্তারা নিশ্চয়ই জানতেন না। তারা, ভেবেছিলেন, গয়ানাথ জোতদারকে দিয়েই তিস্তা ব্যারেজ সম্পর্কিত কথা বলবেন। গয়ানাথ জোতদার উত্তরখণ্ডে যোগ দিয়েছেন তার এই কথাটা উত্তরখণ্ডকে দিয়ে বলাবার জন্যেই, কিন্তু এই ভদ্রলোকই যখন সেকথা তুলে দিলেন, তখন তার পরেই সভার সভাপতি পঞ্চাননবাবু গয়ানাথ জোতদারের নাম ডেকে দিলেন এইটুকু যোগ করে যে গয়ানাথবাবুরা এই ডুয়ার্স অঞ্চলে পুরুষানুক্রমিকভাবে বসবাস করে আসিতেছেন এবং তিস্তা ব্যারেজের বিষয়ে তিনি অনেক কিছু জানেন।

গয়ানাথ কোনোদিন বক্তৃতা করে নি। নাম শোনার পর থেকেই তার বুক ধুকপুকুনি শুরু হয়। নাম ডাকার সঙ্গে ঐটুকু জুড়ে দেবার জন্যে যে সময় লাগে তাতে তার বুকটা একটু শান্ত হয় বটে কিন্তু গলা শুকিয়ে যায়। অথচ ইতিমধ্যেই তাকে পাশ থেকে দু-একজন বলে, গয়ানাথবাবু যান।

গয়ানাথ যেখানে বসে ছিল সেখানে বসে থেকেই যদি বলত, হয়ত তার খুব অসুবিধে হত না, কিংবা অসুবিধেটা সামলে নিত। শেষ পর্যন্ত ত তাকে উঠে মঞ্চে যেতে হয় ত মাইকের সামনে দাঁড়াতে হয়। গয়ানাথ তার কথা তাড়াতাড়ি শেষ করে দেবার বাস্তব বুদ্ধি থেকে প্রথমেই চিৎকার করে ওঠে, মোর কিছু কহিবার নাই। মোর একোটা কাথাই কহিবার আছে। গয়ানাথ এত জোরে চিৎকার করে যে মাইকে কুঁই কুঁই আওয়াজ শুরু হয়, মাইকওয়ালা তাড়াতাড়ি আওয়াজটা কমিয়ে দেয়। তখন গয়ানাথ বলে চলেছে, এই সব সরকারগিলান ভাবিবার ধরিছেন যে ধান, চাল, আলু, কুমড়া সব নদীর জলত ভাসি আসে। তার তানে জমির কুনো দরকার নাই। যেইলার ঘরত যতখান, জমি আছিল সব ত সরকারের ঘরত সিদ্ধাইছে। ত সরকারই চাষ করিবার ধরুক কেনে ঐ সব জমি। এ্যালায় একখান নতুন ঢক ধরিছে তিস্তা ব্যারেজের নামত। যার ঐঠে জমি আছিল, সব জমি নদীর ভিতর সিদ্ধাই নিছে। আগত মানষিলা নদীর ভিতর চরত গিয়া চাষ করিবার ধরিতেন। এ্যালায় তিস্তা ব্যারেজের তানে ডাঙ্গা জমি নদীর ভিতর টানি নিবার ধরিছে। তা, চাষ করো কেনে। তিস্তা নদীর জলত ধান চাষ করো। এইলা মানষিগিলা কোটত আসিছেন হে? হামার তিস্তাত্ যে কুনোকালে ব্যারেজবুরেজ না আছিল, তাহাতে ধান চাষ হইল কি না হইল। এ্যালায় জমিও টানিবার ধরিছে, নদীও টানিবার ধরিছে। মুই এইসব ব্যারেজবুরেজ না চাও। এইখানই মোর কাথা। গয়ানাথের বক্তৃতার শেষে হাততালি পড়ে। এতক্ষণ বক্তৃতাগুলো কেমন বানানো ও কঠিন মনে হচ্ছিল, গয়ানাথের বক্তৃতাটা সিধে ও সরল মনে হয় শ্রোতাদের কাছে।

.

১৭০. রাজবংশী সমাজের রূপান্তর সম্পর্কে আলোচনা

 এইভাবেই উত্তরখণ্ড সম্মিলন শুরু হয়। ছ-দিন ধরে চলতে থাকে। একদিকে পঞ্চানন মল্লিকের মত প্রবীন লোকজন যাদের কাছে উত্তরখণ্ড বলতে এক অস্পষ্ট অতীতের কিছু আনুমানিক গৌরবের দিন ফিরে যাওয়া বোঝায়–কিন্তু কী ভাবে সে-প্রত্যাবর্তন বা পুনরাগমন ঘটবে সে-বিষয়ে কোনো ধারণাই নেই। অন্যদিকে, সুস্থির রায় বর্মনের মত টগবগে তরুণ যারা উত্তরখণ্ড বলতে বোঝায় তাদের আদিবাসীসত্তার এক লড়াকু সংগঠন–যে-সংগঠন নিজেদের কৌম-সংহতির জোরে আদায় করে নেবে রাজশক্তির কাছ থেকে তাদের নিজস্ব ভূমিখণ্ড। পঞ্চানন মল্লিক আর সুস্থিরের মধ্যে সম্ভবত এই মিল ঘটে যায় যে তাদের উভয়েরই দরকার রাজবংশী অতীতের এক গৌরবময় লোককথা যা ইতিহাসে সমর্থিত। সেই হাজোর কাহিনী, শিশু-বিশুর কাহিনী, সেনাপতি চিলা রায়ের দিগ্বিজয়ের কাহিনী। তাদের চোখের সামনে এই প্রবল বর্তমানটা ত সব সময়ই হাজির থাকে যে কোচবিহারে এক রাজবংশী রাজবংশ সেই ১৫১০ থেকে ১৭৭৩ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত স্বাধীনভাবে, তারপর ১৯৪৯ পর্যন্ত করদ দেশীয় রাজ্য হিশেবে, ক্ষমতা ভোগ করেছে প্রায় মোট ৪৪০ বছর। পূর্ব আর পশ্চিমবঙ্গ মিলিয়ে আর-কোথাও এমন আর-কোনো দেশীয় রাজ্য ছিল না, নেই। এখনো সেরাজপ্রাসাদ দাঁড়িয়ে আছে। সেই রাজবংশেরই আর-একটি ভাগ বৈকুণ্ঠপুরের জমিদারি স্বাধীন রাজত্বের মতই ভোগ করেছে প্রায় এই পুরো সময়টাই। সেই সুবাদেই ত মালদহ থেকে দার্জিলিঙের তরাই পর্যন্ত এই বিরাট জনগোষ্ঠী নিজেকে রাজবংশী বলে পরিচয় দেয়। কিন্তু পঞ্চানন মল্লিক আর সুস্থিরের মধ্যে এই মিল সত্ত্বেও এই অমিলও যে-কোনো উপলক্ষে বেরিয়ে পড়ে যে পঞ্চাননের কাছে এই অতীত গৌরব বিষয়ে আত্মসচেতনতাই রাজবংশী সমাজের পক্ষে অনেকখানি বা প্রধান অবলম্বন–জনগোষ্ঠীর আত্মপ্রতিষ্ঠার জন্যে। আর সুস্থিরের কাছে এই অতীত গৌরব রাজবংশী সমাজের নিজস্ব ভূমি-অধিকারের একটা অবলম্বনমাত্র, একটা অবলম্বনই-তার বেশি কিছু নয়।

এই উত্তরখণ্ডের আওতার মধ্যে এসে যেতে চায় সম্পৎ রায়–যে নকশালবাড়ি আন্দোলনের মুখেই ভূমিহীন আদিবাসী কৃষকের ভূমিদখলের অভিযানের বিরুদ্ধে নিজস্ব এক সৈন্যবাহিনী তৈরি করে ছিল প্রায় বিশ বছর আগে, আর, জলপাইগুড়ির সেই ভদ্রলোকের নকশালিয়া ছেলে-যে নকশালবাড়ি কলকশন আন্দোলনের মধ্যেই এখনো খুঁজছে ভারতীয় কৃষকের অধিকার অর্জনের উপায়। সম্পৎ রায়ের কাছে উত্তরখণ্ড আন্দোলন শুধুমাত্র রাজবংশী সমাজের আন্দোলন নাও হতে পারে–সে চায় উত্তরবঙ্গের রাজবংশী জোতদারের হাতে যে-টাকা আছে তা এই উত্তরবঙ্গেই নানা ভাবে খেলাবার হক, সম্পৎ রায় পাঞ্জাব রাজস্থানের সবুজ বিপ্লবের এনট্রেনিয়ুর কৃষিবিনিয়োগকারীর উত্তরবঙ্গ সংস্করণ। সে আলাদা রাজ্য চায় না, আলাদা কিছু অধিকার চায়–যেসব তার কাছে তুচ্ছ, যেমন, পুরনো কামতাপুরী রাজত্বের গৌরবগাথা তার খুব দরকারে লাগে না। তার হাতে অনেক টাকা ও তার আরো অনেক টাকা আসছে–সে সেই সব টাকার বিনিয়োগক্ষেত্র:চায়, সেই বিনিয়োগক্ষেত্রের নাম যদি উত্তরখণ্ড হয় ত উত্তরখণ্ডই থোক। আর তার সঙ্গে অনায়াসে মতৈক্য ঘটে যায় সেই নাকশালিয়া ভদ্রলোকের কারণ, সম্পৎ-এর বিদ্রোহ সেই ভদ্রলোকের কাছে প্রতিষ্ঠিত ব্যবস্থার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ। কারণ, সম্পৎ এখানে কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থাকেই চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে। সেই কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থায় দিল্লিতে কংগ্রেস আর কলকাতায় বামফ্রন্ট, এ-পার্থক্য তার কাছে পার্থক্যই নয়। যে-কোনো রকম বিদ্রোহ ও নৈরাজ্যের প্রতি আবেগে ও বুদ্ধিসর্বস্ব সমর্থনে সে সম্পকে তার মিত্র মনে করে আর শত্রু ভাবে, একই রকম শত্রু ভাবে, দিল্লির সরকারকে ও রাজ্যের সরকারকে। সম্পৎ জানে যে তিস্তা ব্যারেজের জলের পুরো লাভ সে ঘরে তুলতে পারবে কিন্তু তিস্তা ব্যারেজের জন্যে যে-সব জোতদারের কিছু কিছু জমি সরকার নিয়ে নিয়েছে। তাদের যদি দলে রাখতে হয় তা হলে তিস্তা ব্যারেজের বিরুদ্ধেই প্রধান আওয়াজ তুলতে হবে। তিস্তা, ব্যারেজ সম্পৎ-এর কাছে হয়ে ওঠে রাজবংশীদের, জোতদার ও কৃষক রাজবংশীদের, কাছে একটা গ্রহণযোগ্য প্রতীক। কবে জল বেরোবে, সেই জলে এক বিঘেজমিতেই দশ বিঘের ফলন উঠবে, এ-হিশেবের চাইতেও অনেক বেশি প্রত্যক্ষ ঐ এক বিঘে জমির অধিগ্রহণ। আবার, সেই একই তিস্তা ব্যারেজ ঐ নকশালিয়া ভদ্রলোকের কাছে ভারতের মুস্ফুদ্দি পুঁজির আরো এক কারখানা যা দিয়ে গ্রামের গরিব মানুষকে আরো গরিব করে ফেলা যায়। অথচ মুছুদি খোঁজার অন্ধতায় সম্পদৎ রায়কে আর মুস্ফুদ্দি মনে হয় না বরং সম্পৎ রায়ের মত জোতদারও যদি রাজবংশী-আদিবাসীদের ভেতর একটা ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন তৈরি করে তুলতে পারে তা হলে সম্পৎ রায়ের সঙ্গে কিছুদূর চলতেই বা আপত্তি কিসের? যা কিছু কেন্দ্রীয় শাসনক্ষমতাকে আঘাত করে আর যা-কিছু আদিবাসীদের সংগঠিত করে তাই তার কাছে গ্রহণীয়।

এর সঙ্গে প্যান-বোরো সংস্কৃতির একটা ছোঁয়াও লাগছে যাতে উত্তরপূর্ব বা নর্থইস্টের বিরাটতর একটা অঞ্চল জুড়ে সংস্কৃতিক ঐক্য খোঁজ হচ্ছে।

এই সব কিছুর মধ্যে কোনো দৃঢ় মিল নেই, অনেক সময় এর ভেতর বৈপরীত্যও আছে। উত্তরখণ্ডের ভেতরে এমন কোনো লোক নেই যে বা যারা এই আন্দোলনকে সংগঠিত একটা তত্ত্বের ভিত্তি দিতে পারে। বীরেন বসুনিয়া বা কোচবিহারের সন্তোষবাবুর মত লোজন উত্তরখণ্ডকে কোনো-কোনো সময় বৃহত্তর সমাজে বা প্রশাসনে যোগ্যতার সঙ্গেই দাঁড় করাতে পারে কিন্তু সেটা ত আন্দোলনের একটা ছোট অংশ মাত্র, পুরো অংশও নয়। তাদের পক্ষে ত জননেতা হওয়া সম্ভব নয়।

আবার হয়ত উত্তরখণ্ড আন্দোলনের মত ঘটনা এ-রকম নানা পরস্পরবিরোধী স্বার্থ মিশিয়েই তৈরি হয়। কখনো এই স্বার্থ, কখনো ঐ স্বার্থ প্রাধান্য পায়। কিন্তু রাজবংশী জোতদারের নতুন টাকার যোগ্য বিনিয়োগক্ষেত্র খোঁজার জন্যে এ-ধরনের আন্দোলন এখন অনেক দিন পর্যন্ত তৈরি হয়ে উঠবে, তৈরি থাকবে। বৃহত্তর ভারতে ব্যবসা ও শিল্পের বাড়তি, হিশেববহির্ভূত, অসংখ্য টাকায় যে-সামাজিক শ্রেণী তৈরি হয়ে গেছে রাজবংশীরাও তা থেকে আলাদা নয়। ভারতের অর্থনৈতিক নিয়মেই তাদের সমাজের ভেতরে এখন তাদের বোরো ও কোচ রক্তের শুদ্ধতা জোর এই ঝোঁক সংগঠিত হচ্ছে, যেমন ভারতের অর্থনীতির নিয়মেই শিখরা আরো কত ভাল শিখ হতে পারে সেটা একটা রাজনৈতিক বিষয় হয়েছে; যেমন, সেই একই নিয়মে তেলুগুরা কত বেশি তেলগু সেটাই রাজনীতি হয়ে উঠেছে; যেমন সেই একই নিয়মে অহোমরা অহোম-ঐতিহ্যের প্রাগেতিহাস থেকে তাদের আত্মপরিচয় জোগাড় করে ভারতের ভবিষ্যৎ রাজনীতিতে ঢুকছে। ইতিহাসেরও অতীত, বর্তমানে এই কাজে লাগছে, রাজনীতির-অর্থনীতির ভারতীয় ভবিষ্যতের প্রয়োজনে।

কিন্তু নিজেদের উপজাতিত্বের অতীতকে বর্তমানের মধ্যে আবিষ্কার করার মধ্যে, অন্তত রাজবংশীদের ক্ষেত্রে, একটা এমন গোজামিল আছে, যা মীমাংসা করা অসম্ভব। রাজবংশীরা রাজবংশীও থাকবে, আবার কোচ-বোরো উপজাতিও হবে–এ ব্যবস্থা কোনো ভাবে সম্ভব নয়।

কেউ যদি বলেন, এখন আর রাজবংশীদের উপজাতিত্ব নির্ণয় করা যাবে না, তাই তাদের পক্ষে উপজাতিত্বে প্রত্যাবর্তন সম্ভব হবে না–তা হলে সে কথা ধোপে টিকবে না। কারণ ধোপটা দিচ্ছেন রাজবংশীরাই। তারা নিজেদের যে-উপজাতিত্ব স্বীকার করবে, সেই উপজাতিত্বই তাদের পরিচয়। তাতে হজসন, ডালটন, বেভারলি, হান্টার, রাউনি, বোয়লো, ম্যাগোঁয়ার, ওডোনেল, রিজলি, গ্রিয়ারসন, গেইট, ওমেলি, টমসন-এ-সব সাহেবদের লিস্ট করা জাতি-উপজাতিগোষ্ঠীর সঙ্গে মিল হল কি হল না। সেটা অবান্তর। কারণ, এই সব সাহেব যে-লিস্ট বানিয়ে দিয়েছে সেটা কোনো নতুন স্মৃতিশাস্ত্র নয় যে তাতে গাই-গোত্র মিলিয়ে তবে একটি উপজাতিকে উপজাতি হতে হবে।

কিন্তু এই উপজাতির-পরিচয় পুনরুদ্ধারের পথে বাধা রাজবংশীরা নিজেরাই। কারণ, তারা এতদিন ধরে নিজেদের এই উপজাতি-পরিচয় অস্বীকার করে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে হিন্দু হতে চেয়েছে, হিন্দু হয়ে উঠেছে।

কোচবিহারের রাজপরিবার আর জলপাইগুড়ির বৈকুণ্ঠপুরের রায়কত পরিবার ত রাজবংশীদের প্রধান ঐতিহাসিক প্রতিনিধি। কোচবিহারের আদি পুরুষ বিশু বা বিশাই। সেই বিশাইই হয়ে গেল বিশ্বসিংহ। এই বিশাই পুবে ব্রহ্মপুত্র থেকে পশ্চিমে ঘোরাঘাট পর্যন্ত নিজের রাজত্ব কায়েম করলে ব্রাহ্মণরা. তাকে হিন্দু বানিয়ে ফেলল। পাজি-পুথি ঘেঁটে তারা আবিষ্কার করল যে আসলে বিশাই ও তার জাতির লোজন ক্ষত্রিয়, পরশুরামের ভয়ে তাদের পৈতে ছিঁড়ে ফেলে তারা এই বনে পালিয়ে আসে। আর বিশাই হরিয়া চাড়ালের ছেলে নয়, আসলে শিবের ছেলে। তেমনি বিশাইয়ের ভাই শিশাইও শিবের ছেলে। বিশ্ব সিংহ সিলেট থেকে একদল ব্রাহ্মণ আমদানি করে কামরূপী ব্রাহ্মণ বলে একটি শ্রেণীই তৈরি করল। বিশ্ব সিংহের পর থেকে কোচবিহারের রাজপরিবার নারায়ণ পদবী ব্যবহার করে। তারা মদনমোহন ঠাকুরবাড়ি বানায়। আর জলপাইগুড়ির রায়কতরা হয়ে যায়, বৈকুণ্ঠপুরের অধিবাসী।

কিন্তু এটা কেবল রাজপরিবারের ব্যাপার নয়। রাজপরিবার সেই জনগোষ্ঠীর প্রধান পরিবার হিশেবেই এই ব্যবস্থা নিয়েছে এবং সেই জনগোষ্ঠীও নিজেদের রাজবংশী বলেই পরিচয় দেবে বলে ঠিক করে নেয়। সেটাই হয়ে দাঁড়ায় তাদের গৌরবের পরিচয়, তাদের উপজাতিত্ব অস্বীকারের পরিচয়, তাদের বৃহত্তর হিন্দু জাতির ভেতর ঢুকে পড়ার প্রধান ছাড়পত্র। তিনশ বছরের বেশি সময় ধরে এই হিন্দু পরিচয় রাজবংশী সমাজের এত ভেতরে সেঁদিয়ে যায় যে উনিশ শতকের শেষ থেকে এই হিন্দু ক্ষত্রিয় আত্মপরিচয় হয়ে দাঁড়ায় তাদের একটা আন্দোলনেরই বিষয়। সেটা ১৯২১ সাল নাগাদ, আদমশুমারির সমস্যা হয়ে দাঁড়ায় পর্যন্ত। ১৮৯১-এর আগেই বৈকুণ্ঠপুরের জমিদারি নিয়ে একটা মামলা প্রিভি কাউন্সিল পর্যন্ত গড়িয়েছিল। তাতে বলা হয়েছিল, বৈকুণ্ঠপুর পরিবারের প্রধানের নাম রায়কত, এরা বাংলার উত্তর-পূর্ব সীমান্তের কোচ উপজাতির অন্তর্গত এবং হিন্দু নয়। ১৮৯১-এর সেন্সাস রিপোর্টেও রাজবংশীদের কোচচরিত্র স্বীকার করে নেয়া হয়েছে। কিন্তু এই ১৮৯১-এর রিজলি মন্তব্য করেছেন, উত্তরবঙ্গের কোচ অধিবাসীরা নিজেদের রাজবংশী ও ভঙ্গক্ষত্রিয় বলে পরিচয় দেয়। তাদের ব্রাহ্মণ আছে, তারা ব্রাহ্মণ্য রীতিনীতি অনুসরণ করে ও ব্রাহ্মণদের গোত্র গ্রহণ করতে শুরু করেছে।

কিন্তু ১৯১১-তেই এই দ্বিধার ভাব চলে গেছে। ওমেলি তার সেন্সস রিপোর্টে লেখেন, নিজেদের ক্ষত্রিয় বলে পরিচয় দেওয়ার অধিকার চেয়ে উত্তরবঙ্গের রাজবংশীদের মধ্যে একটা স্থায়ী ও গভীর আন্দোলন চলছে। তারা কোচদের থেকে পৃথকভাবে বর্ণিত হতে চায়। শুধু তাই নয়, তারা নিজেদের ক্ষত্রিয় নামে নির্দিষ্ট করতে চায়। প্রথম অনুরোধটি কোনো ইতস্তত না করেই রক্ষা করা হয়েছে। কারণ তাদের উৎপত্তি কী ভাবে হয়েছে সে-প্রশ্ন নিরপেক্ষভাবেই, এ কথা এখন সন্দেহাতীত সত্য রাজবংশী ও কোচ আলাদা জাত (কাস্ট)। যাই হোক, তারে বংশোৎপত্তিগত উপাধি ও প্রাচীন পদবী ক্ষত্রিয় নামে তাদের চিহ্নিত করার কোনো প্রশ্নই আসে না। ১৯২৩-এর সেন্সস রিপোর্টে টমসন লেখেন, ১৯০১-এ অনেক কোচ নিজেদের রাজবংশী বলে চিহ্নিত করেছে, এবং এখন রাজবংশীরা। অনেকেই নিজেদের ক্ষত্রিয় পরিচয় লিপিবদ্ধ করানোর জন্যে শক্তি প্রয়োগ পর্যন্ত করে। এই ১৯২১-এই রাজবংশীদের ভেতর পৈতে পরা ও ক্ষত্রিয় সমিতি আন্দোলন এরকম ছড়িয়ে পড়ে যে, তাদের ক্ষত্রিয় বলে পরিচয় দিতে না দিলে রঙপুর থেকে কোচবিহার পর্যন্ত আদমশুমারি অচল হয়ে পড়ত। এই ক্ষত্রিয় পরিচয় অর্জনের আন্দোলন স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গেও অনেকখানি যুক্ত। যেন, নিজেদের হিন্দু পরিচয় প্রমাণ করাটা নিজেদের ভারতীয় পরিচয় প্রমাণ করারই সমার্থক। যেন, স্বাধীনতা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ভারতীয় জনসাধারণের যে-একটা পরিচয় প্রতিষ্ঠিত হচ্ছিল, নিজেদের হিন্দু বলে বর্ণনা দিলে সেই পরিচয়ের অন্তর্গত হওয়া যায়। তেমনি, আবার ততদিনে হিন্দু মধ্যবিত্তের প্রতিষ্ঠা হিন্দু মধ্যবিত্ত আদর্শকে রাজবংশীদের গ্রাহ্য করে তুলেছে। সেই পরিচয় যেন তাদের সামাজিক মর্যাদা পাওয়ার ছাড়পত্র। ক্ষত্রিয় সমিতি আন্দোলন–রাজবংশী সমাজের সবচেয়ে ব্যাপক ও গভীর আন্দোলন। তার ফলে রাজবংশী পরিবারের গঠন ও জীবনযাপন পর্যন্ত নিয়ন্ত্রিত হয়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *