৫.১ মিছিলপর্ব – উত্তরখণ্ডের স্বতন্ত্র রাজ্য দাবি

মিছিলপর্ব – উত্তরখণ্ডের স্বতন্ত্র রাজ্য দাবি 

১৫৩. গয়ানাথের স্বগত চিন্তা

গয়ানাথ জোতদার সাত-সকালে আসিন্দিরের মোটর সাইকেলের পেছনে বসে জলপাইগুড়ি শহরে তার উকিলবাবুর বাড়ি যাচ্ছিল। এখনো ঠিক আছে, ফেরার সময় বাসে ফিরবে, আসিন্দির তার কাজে চলে যাবে। সেই যে তিস্তা ব্যারেজের সেটলমেন্টের সময় শুরু হয়েছিল–এখন সে ব্যারেজ গত কয়েক বছরে নদীর মাঝামাঝি পর্যন্ত চলে গেছে–আসিন্দির তার শ্বশুর গয়ানাথের ড্রাইভারই হয়ে গেছে অনেকটা। গয়ানাথ জোতদারের মত বিখ্যাত লোকের নাম এখন লাটাগুড়ি রামসাই-ওদলা বাড়ি-ক্রান্তিহাট-মৌলানি, এমন-কি ময়নাগুড়িতেও, ভটভটি জোতদার বলেই চালু হচ্ছে। প্রথম-প্রথম লোকে আড়ালে বলত, এখন অনেকে তাকে এ ভটভটি দেউনিয়া বলে ডেকেও ফেলে। গয়ানাথ এই নিয়ে রাগারাগি ছেড়ে দিয়েছে।

মোটর সাইকেল ত আসিন্দিরের অনেক কালই আছে। কিন্তু আগে গয়ানাথ কখনো তার পেছনে উঠত না, ওঠার দরকারও পড়ত না। জলপাইগুড়ি শহরে তার বাবার আমলের বাধা উকিলবাবু আছেন। তার বাবা থেকে তার সময়ের মধ্যে বুড়া উকিলবাবুর ছোঁয়া উকিল হল, বুড়া উকিলবাবু মারাও গেলেন, এখন সেই ছোঁয়া উকিলবাবু হয়েছেন। তেমন দরকারে উকিলবাবুই লোক পাঠিয়ে ক্রান্তিহাটে খবর দিতেন, পরদিন সকালের বাসে জলপাইগুড়ি গিয়ে উকিলবাবুর সঙ্গে কথা বলে বিকেলের মধ্যে গয়ানাথ ফিরে আসতে পারত।

কিন্তু তিস্তা ব্যারেজের সেই-যে স্পেশ্যাল সেটলমেন্ট শুরু হল, তারপর থেকে গয়ানাথের যেন আর বিশ্রাম নেই। ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের সঙ্গে তার অংশের খতিয়ান নিয়ে মামলা, ব্যারেজের জন্যে জমি নিয়ে নেয়া হয়েছে তার বিরুদ্ধে মামলা, ক্ষতিপূরণের হারের বিরুদ্ধে মামলা-যেন মামলার কুরুক্ষেত্র। ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের বিরুদ্ধে মামলায় ত কিছু স্টে অর্ডার গয়ানাথ বের করেত পেরেছে। কিন্তু ক্ষতিপূরণের মামলা আর জমি অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে মামলা কলকাতার হাইকোর্ট পর্যন্ত গড়িয়েছে। জলপাইগুড়ির উকিলবাবুর লোকই কলকাতার উকিল ধরে দিয়েছে। গয়ানাথকে যেতে হয় নি, কিন্তু প্রথম বার, উকিলবাবুর লোকের সঙ্গে আসিন্দিরকে যেতে হয়েছিল। তার পর সে মামলা চলছে ত চলছেই। একবার একটা ক্ষতিপূরণের মামলা গয়ানাথ জিতেছে–সরকারও সেই আদেশের বিরুদ্ধে কোনো আপিল করে নি। বরং কোর্টের রায় অনুযায়ী নতুন হিশেবনিকেশ করে পাওনাগণ্ডা সাত-তাড়াতাড়ি মিটিয়ে দিয়েছে। গয়ানাথ যখন দেখল সরকার আপিল করল না, তখন সে আরো বেশি ক্ষতিপূরণের জন্যে আপিল করতে চাইলে তার উকিলবাবু বুঝিয়েছিলেন যে ওরকম আপিল করা যায় না। গয়ানাথ বুঝে ফেলে সরকার যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ব্যারেজটা শেষ করতে চায় বলেই কোর্টের হুকুম মাথা পেতে নিচ্ছে। তা হলে ব্যারেজটা হচ্ছেই–এটা গয়ানাথ বুঝে নিয়ে আরো অস্থির হয়ে ওঠে।

আগে আসিন্দির তার মোটর সাইকেল নিয়ে ঘুরে বেড়াত আর গয়ানাথ তার জোতজমিতে হেঁটে বেড়াত। কিন্তু ঐ স্পেশ্যাল সেটলমেন্টের পর থেকে গত কয়েক বছরে আসিন্দির, তার মোটর সাইকেল, আর গয়ানাথ এক হয়ে গেছে। ময়নাগুড়ির চৌপত্তি দিয়ে গয়ানাথ-আসিন্দিরের যাওয়ার কথা নয়। ভারতী সিনেমার কাছে ডান দিকের রাস্তা ধরে তারা বেরিয়ে যেতে পারত। কিন্তু ময়নাগুড়িতে মরণচাঁদের দোকানে মিষ্টি আর চা খাবে বলে তারা চৌপত্তিতে আসে। মোটর সাইকেলের পেছন থেকে নেমে গয়ানাথ চাদরটা ঝাড়ে। তারপর একবার তাকিয়ে দেখে, চেনাজানা কাউকে পায় কি না। সামনে, রাস্তার ওদিকে একটা মিনিবাসের ভেতরে লোজন, গাড়িটা আরো দু-চারজন প্যাসেঞ্জার নেওয়ার জন্যে দাঁড়িয়ে। যতক্ষণ আসিন্দির তার মোটর সাইকেল দাঁড় করিয়ে মরণচাঁদের দোকানে ঢুকে দুই জায়গায় দুইটা করি বোল্ডার, দুই কাপ চা, বলে বসে, তার মধ্যে গয়ানাথ রাস্তা পেরিয়ে ঐ মিনিবাসটায় একটা পাক দিয়ে আসে–চেনা কাউকে পায় না। কিন্তু ফেরার সময় চৌপত্তিজোড়া ফেস্টুনটা তার নজরে পড়ে। উত্তরখণ্ড সম্মিলন হচ্ছে ময়নাগুড়িতে। গয়ানাথের কাছে ওরা একবার গিয়েছিল। কিন্তু গয়ানাথ এ-সবের মধ্যে যায় নি। রাস্তা পেরবার জন্যে এদিক-ওদিকে তাকাতে গিয়ে গয়ানাথ দেখে উত্তরখণ্ডের অনেক পোস্টার।

মরণচাঁদের দোকানে ঢুকে, আসিন্দিরের পাশে বসতে বসতে গয়ানাথ বলে, হেপাখে এই উত্তরখণ্ড মানষিগিলান খুব মিটিং দিবার ধরিছেন। তারপর বিরাট সাইজের লালচে রসগোল্লা চামচ দিয়ে কাটে–রসগোল্লার ওপর থেকে মাছিগুলো উড়ে যায়।

আসিন্দিরের রসগোল্লা খাওয়া হয়ে গিয়েছিল। সে চায়ে চুমুক দিয়ে বলে, তোমাক কহিলাম জয়েন দেন। বোম্বাইঠে সিনেমার বেটিছোঁয়া আনিবার ধরিছে।

প্রথম বার চামচে যতটা মুখে দিতে পেরেছিল সেটা চিবিয়ে গয়ানাথ গেলে। রস তার দাঁতে লাগলে সিড়সিড় করে। তাই কৌশল করে রসগোল্লার টুকরোটা টাকরার পেছন দিকে নিয়ে জিভ দিয়ে চিপে খেতে হয়। একটু সময় লাগে।

দ্বিতীয় টুকরোটা মুখে ফেলার জন্যে চামচে তুলতে-তুলতে গয়ানাথ আসিন্দিরকে বলে, মোক কি বেটিছছায়ার নখত নাচিবার নাগিবে এলায়?

আসিন্দির চা শেষ করে জিভ দিয়ে দাঁত খোঁচাচ্ছিল শব্দ করে। সেটা থামিয়ে জবাব দেয়, আপনাক নাচিবার কায় কহে? ইমরায় ত রাজবংশীর তানে পার্টি খুলিছে। এলায় ত কংগ্রেস নাই, সগায় উত্তরখণ্ড হবা চাহে। তোমরালাইবা হবেন না কেনে? কত ত মামলা ঠুকিছেন সরকারের তানে কী হইল?

কথাটা বলতে বলতে পকেট থেকে সিগারেট-দেশলাই বের করে আসিন্দির দোকানের বাইরে চলে যায়। বাইরে গিয়ে সে সিগারেট ধরায় আর ভেতরে গয়ানাথ অনেকক্ষণ ধরে দ্বিতীয় রসগোল্লাটা শেষ করে। পুরো এক গ্লাশ জল খায়। ততক্ষণে তার চায়ে পুরু সর পড়েছে। কিন্তু সেই চাটাও গয়ানাথ তারিয়ে-তারিয়ে খায়। এই সমস্ত ত একা-একাই করতে হয়–উত্তরখণ্ডে যোগ দেয়ার ব্যাপারে আসিন্দিরের প্রস্তাবটায় অতক্ষণ নীরব থেকে।

পয়সা দিয়ে গয়ানাথ বাইরে আসতে-আসতেই আসিন্দির মোটর সাইকেলের ওপর বসে স্টার্ট দেয়। গয়ানাথ তার চাদরটা বুকের ওপর আড়াআড়ি দিতে-দিতে আবার সেই নীল ফেস্টুন ও পোস্টারগুলো দেখে। দুপা এগিয়ে যায় মোটর সাইকেলের পেছন দিকে। আবার বলে, খুব জোর শুরু করিবার ধরিছেন হে তোমার উত্তরখণ্ড। কিন্তু মোটর সাইকেলের আওয়াজে কথাটা শোনা যায় না। আসিন্দির পেছন দিকে হাত বাড়িয়ে পান, আর চুন-লাগানো বোটা, দেয়। গয়ানাথ সেটা নেয় না। আগে পাদানিটার ওপর ভর দিয়ে আসনে বসে, নড়েচড়ে ঠিক হয়, তারপর পানটা ধরে। গয়ানাথ পানটা নিতেই আসিন্দির মুখ বাড়িয়ে পিক ফেলে মোটর সাইকেলটা চালাতে শুরু করে। আসিন্দিরের পেছনে মোটর সাইকেলে বসতে এতই অভ্যস্ত হয়ে গেছে গয়ানাথ যে সে পানটা ঝেড়ে মুখে ঢোকাতে পারে। দাঁতটাত পড়ে যাওয়ায় গয়ানাথের মুখটা এতই চুপসানো যে পানটায় তার মুখটা একেবারে ভরে যায়।

মোটর সাইকেলে চলতে-চলতে ত আর দুজনের কোনো কথা হতে পারে না কিন্তু গয়ানাথের মনে নানা প্রশ্ন উঠছিল উত্তরখণ্ড নিয়ে। সে-সব কথা আসিন্দিরকে বলা যায়, কিছু খবর জানা যায়। কিন্তু এখনই কথাটা না বলে, পরে, ধীরেসুস্থে আলাপ-আলোচনার অভ্যেস ত গয়ানাথের নেই। তাই কথাগুলো তখন বলতে না পারায় সেটা তার নিজের সঙ্গেই সংলাপ হয়ে দাঁড়ায়। বরাবর কংগ্রেসের লোক গয়ানাথ, কংগ্রেসকেই ভোট দিয়ে আসে। কিন্তু গয়ানাথ জোতদারের মত বিখ্যাত লোক ত শুধু একজন ভোটার হতে পারে না–জোতজমিতে বসত দেয়া কয়েকশ লোক তার কথাতেই ত ভোট দেয়। নইলে তার সম্মান থাকে কোথায় যদি সে একা গিয়ে শুধু নিজের ভোটটাই দিয়ে আসে? ভোটের আগে তেমন কোনো আদেশনির্দেশ গয়ানাথকে কখনো দিতেই হয় নি–সবাই জানে কী করতে হবে। কিন্তু সবাই ত জানত ফরেস্টটা গয়ানাথের। সেই জানায় ত তার কোনো লাভ হল না। তা হলে, গয়ানাথ আর মানষির দল কংগ্রেসেরই পাকে থাকিবেন এই কথাটার ত কোনো লাভ নাই। তা হইলে এই সব মানষিক নিয়া গয়ানাথ নিজের জোরখান ত দেখাবার পারে।

উকিলবাবুর বাড়ির সামনের মাঠটুকুতে মোটর সাইকেল থেকে নামার আগে গয়ানাথ নিজেকে এই পর্যন্ত বোঝাতে পারে।

.

১৫৪. উকিলবাবু বনাম উত্তরখণ্ড

উকিলবাবুর বাড়ির সামনের মাঠটাতে আসিন্দিরের মোটর সাইকেলের পেছন থেকে নেমে গয়ানাথ হাতদুটো মাথার ওপর তুলে আড়মুড়ি ভাঙে। আসিন্দির মোটর সাইকেলটা ঘুরিয়ে নিতে নিতে বলে, আসিছু। কিন্তু রওনা হয়েও আচমকা থেমে গিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে জিজ্ঞাসা করে–এইঠে আসিম, না চলি যাম? আড়মুড়ি ভাঙার টানেই হাতদুটো পেছনে নিয়ে গয়ানাথ ঘাড়টা নিচু করে। শরীরের শক্ত টানটান ভাবটা শিথিল হওয়া পর্যন্ত রাস্তায় আসিন্দির ভটভট করতে করতে দাঁড়িয়ে থাকে। গয়ানাথ মুখ খুলে জবাব দেয় না ডান হাত তুলে আঙুল দিয়ে দেখায়। আসিন্দির তার অর্থ বোঝে–কোর্টে যেতে হবে। গয়ানাথ এবার উকিলবাবুর সেরেস্তার দরজায় সোজাসুজি গিয়ে দাঁড়ায়। উকিলবাবু বা তার মুহুরি তাকে একবার দেখে নিলেই গয়ানাথের কাজ শেষ। যখন দরকার, উকিলবাবুই তাকে ডাকবেন বা কোনো খবর দেয়ার থাকলে মুহুরিকে বলে পাঠাবেন। মুহুরিবাবু হয়ত গয়ানাথকে বলবে–কোর্টে দেখা করতে। ততক্ষণে গয়ানাথ এই মাঠটাতে দাঁড়িয়ে বা ঘুরেফিরে একটু-আধটু রোদ পোয়াতে পারে। বাইরের বারান্দার বেঞ্চির ওপরও বসে থাকতে পারে। এমন-কি, উকিলবাবুর সেরেস্তার কাজ শেষ হয়ে যাবার পর, সব লোকজন চলে যাবার পর, মুহুরি বাবুও সাইকেলে তার বাড়িতে চলে গেলে, গয়ানাথ হয়ত এখানে বসেই থাকবে। উকিলবাবু মানখাওয়াদাওয়া সেরে রিক্সায় কোর্টে রওনা হওয়ার সময় হয়ত বলবেন, কী গয়ানাথ বাবু! চলেন, কাছারিতে চলেন। উকিলবাবুর সঙ্গে রিক্সায় কোর্টে যাওয়ার অন্য লোক থাকলে হয়ত বলবেন, কী গয়ানাথ বাবু, আসেন, কোর্টে আসেন। গয়ানাথ তখন হাঁটতে-হাঁটতে কোর্টে রওনা দেবে।

গয়ানাথ তার বাবার সঙ্গে এই উকিলবাবুর বাড়িতে এসেছে। তখন এই উকিলবাবুর বাবা বুড়া উকিলবাবুর সেরেস্তা। তিস্তা ব্রিজ হয় নি। ডুয়ার্স থেকে সকালে এসে বিকেলে ফিরে যাওয়া খুব কঠিন। তখন উকিলবাবুদের এই নতুন দালানঘর ওঠে নি। এখানে চেগারের বেড়ায় টিনের দরজা ছিল বাড়ির ভেতরের সঙ্গে বাড়ির বাইরের কোনো সম্পর্ক ছিল না। এই মাঠটার পশ্চিম কোণে একটা কুয়ো ও পায়খানা ছিল। গয়ানাথ তার বাবার সঙ্গে আসত শীতের সময় গরুর গাড়ি নিয়ে মার নৌকোয় তিস্তা পার হয়েও এসেছে। এই মাঠে ইটের উনুনে রান্না হত। আর সন্ধ্যার পর সেরেস্তার বারান্দার চৌকিতে তারা শুয়ে থাকত। কোর্টকাছারির কাজ শেষ করে দু-একদিন পর আবার রওনা দিত। তখন, জলপাইগুড়ি শহরে একবার ঘুরে গেলেই মনে হত যেন দেশান্তরে বেরিয়ে এল। আর এখন, এই ত সকালে বাড়ি ছেড়ে এসেছে, দুপুরে গিয়ে আবার বাড়িতে ভাত খাবে। জলপাইগুড়ি শহরটাকে আর দেশান্তর মনে হয় না। আগে বছরে দু-একদিন কোর্টকাছারির কাজ ছিল কি ছিল না, এখন রোজ এলে রোজই কাজ থাকে।

গয়ানাথ উকিলবাবুর সেরেস্তায় ওঠে–দরজার কাছে গিয়ে মুহুরিবাবুকে বলবে যে উকিলবাবুকে যেন জানায় গয়ানাথ এসেছে। কিন্তু মুহুরিবাবু দেখার আগেই উকিলবাবু গয়ানাথকে দেখে ফেলেন, আরে গয়ানাথবাবু, আসেন, আসেন।

উকিলবাবু তার হাতের কলমটা কাগজের ওপর ফেলে হাতদুটো মাথার ওপর তুলে এমন আড়মুড়ি ভাঙেন যে মনে হয় তিনি গয়ানাথবাবুর জন্যেই অপেক্ষা করছিলেন। গয়ানাথ দু জন ভদ্রলোককে ছাড়িয়ে গিয়ে খালি চেয়ারটাতে বসেন। উকিলবাবু বলেন, কলকাতার উকিল চিঠি দিয়েছেন, এখান থেকে কয়েকটা কাগজ কপি করে পাঠাতে হবে। উকিলবাবু এবার মুহুরির দিকে তাকান, সন্তোষ, তোমার কাছে লিস্টটা আছে ত?

 মুহুরিবাবু জানান, হ্যাঁ, আছে।

উকিলবাবু এবার আবার গয়ানাথের দিকে তাকিয়ে বলেন, তা হলে আপনি কোর্টে গিয়ে সন্তোষের সঙ্গে দেখা করে যা করার করে দেবেন।

গয়ানাথ উকিলবাবুর দিকে তাকিয়ে বলে, আপুনির শরীরখান ভাল ত?

উকিলবাবু, হ্যাঁ, ভালই আছি, বলে হাতদুটো কাগজের ওপর নামান বটে কিন্তু কলমটা ধরেন না। কলমটা ধরে ফেললে গয়ানাথ আর কথা বলতে পারবে না অথচ যত দরকারই থাকুক, গয়ানাথের পক্ষে ত আর উকিলবাবুকে সরাসরি কিছু জিজ্ঞাসা করা সম্ভব নয়। গয়ানাথ এবার পাশের দুই ভদ্রলোকের দিকে তাকায়। ঠিক তার বাঁ পাশের ভদ্রলোককে সে দেখতে পায় না, কিন্তু প্রথম চেয়ারটির ভদ্রলোক উকিলবাবুর টেবিলের ওপর দুই হাতের কনুই রেখে হাত দুটো ঠোঁটের কাছে এনে রেখেছেন। চিনতে পারে না গয়ানাথ। এখানে আসতে-আসতে উকিলবাবুর অনেক ভদ্রলোক-মক্কেল গয়ানাথের মুখ চেনা হয়ে গেছে। গয়ানাথ একটু সঙ্কোচ বোধ করে, এদের সামনে উকিলবাবুকে আর কী জিজ্ঞাসা করবে। উকিলবাবুও চেয়ারে সোজা হচ্ছেন। এখন তিনি আবার কলমটা তুলে নেবেন। গয়ানাথবাবুর সঙ্গে তার এর বেশি কথা আর কবে হয়েছে। গয়ানাথ চেয়ার ছেড়ে ওঠে না। উকিলবাবু কলমটা তুলে নেয়ার আগেই বলে ফেলতে পারে, উকিলবাবু, কলিকাতার কুনো খবর কি পাওয়া গেল? কথাটা গয়ানাথ টেবিলের ওপর একটু এগিয়ে, একটু হেসে, খুব নিচু গলায় বলে যাতে পাশের ভদ্রলোক শুনতে না পান। কিন্তু উকিলবাবুও সম্পূর্ণটা শুনতে পান নি। তিনি চেয়ারে হেলান দিয়ে বলেন, হ্যাঁ? কী বললেন? কিসের খবর? গয়ানাথ এবার চেয়ারে আরো একটু এগিয়ে আসে, টেবিলের ওপর তার হাতদুটি আঙুলে-আঙুলে জড়িয়ে শুইয়ে রেখে। একটু হেসে বাধিত হওয়ার ভঙ্গিতে জিজ্ঞাসা করে, বলিছি, কলিকাতার হাইকোর্টের মামলাখান শ্যাষ হইবার কুনো আন্দাজ কি পাওয়া গেইসে? ওদিকে ত ব্যারেজের থাম্বাগিলান নদীখানক অর্ধেক করি দিবার ধরিছে।

সে ত হবেই। আপনার জমির মামলার জন্যে ত আর ব্যারেজের কাজ আটকে থাকবে না। তাও ত আপনার কাছে অন্তত একটা ভাল খবর পাওয়া গেল যে তিস্তা ব্যারেজের কাজ তাড়াতাড়ি হচ্ছে। আমাদের ত একটা রাস্তা রিপেয়ার করতেই আঠার মাস। উকিলবাবু কথাটা শেষ করেন ভদ্রলোক দুজনের দিকে তাকিয়ে। উকিলবাবু, সম্ভবত যিনি প্রথম চেয়ারটিতে বসে ছিলেন, তার কাজই করছিলেন, ফলে, তিনি একটু বিরক্তির সঙ্গেই হেসে গয়ানাথের দিকে তাকান। গয়ানাথও হাসে–ভদ্রলোকদের সঙ্গে কোথাও বসলে ভদ্রলোকরা যা করেন তারও তাই করার অভ্যেস। হেসেও সে বলে, কিন্তু ব্যারেজ শেষ হয়্যা গেইলে মোর জমির কী হবে উকিলবাবু।

উকিলবাবু বলেন, আপনার ত ক্ষতিপূরণের মামলা। জিতলেনও ত একটা। সেরকমই হবে। কিন্তু ব্যারেজ যে-জমি নিয়েছে সেটা কি-আর ফেরত দেবে নাকি?

হামরালা ত কহিছি–মোর ক্ষতিপূরণ না নাগে, মোর পুরানা ভেস্ট জমিঠে সমপরিমাণ জমি ফেরৎ দিক সরকার। মামলার আলোচনা শুরু হতেই গয়ানাথ আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলতে পারে।

হ্যাঁ। সে রিট ত করা হয়েছে। আপনার কথার মধ্যে ত সত্যি একটা যুক্তি আছে। হাকিম একথা মানতেও পারে। কিন্তু মামলার ব্যাপার। তার জন্যে ত আর ব্যারাজের কাজ আটকে থাকবে না। উকিলবাবু একটু জোরে-জোরে বলেন, যেন গয়ানাথ কানে একটু খাটো।

গয়ানাথ একটু চুপ করে থেকে বলে, কাছারিও ত সরকারেরই অফিস, হাকিম ত সরকারেরই মাহিনা পাছেন। একবার ব্যারেজঘান বান্ধা হই গেলে কি আর হামলার মামলার কথা হাকিম ভাববেন?

উকিলবাবু একটু চুপ করে থাকেন, তারপর তার সামনের কাগজের ওপর চোখ নামিয়ে বলেন–তার গলার স্বর এবার উঁচুতে ওঠে না, গয়ানাথবাবু আপনাদের ত কয়েক পুরুষের জোতদারি, জোতদারি কত পালটি গেছে, দেখেন না? আপনাকেও পুরানা জোতদারি ভুলতে হবে। কোর্ট-হাইকোর্টও বদলে গেছে। একটা ব্যারেজ তৈরি হবে+সেটা সরকারের কাজ। সেটা বন্ধ করে আপনার জমি উদ্ধার করে দেবে এটা আর ভাববেন না। কিন্তু ক্ষতিপূরণ যেন ন্যায্য হয়, বা, আপনি যা বললেন, ক্ষতিপূরণের বদলে কেউ যদি এই ব্যারেজের জন্যে নেয়া জমিটাকে ভেস্ট করে দিয়ে পুরনো ভেস্ট ফেরৎ পায় সেটা নিশ্চয়ই কোর্ট দেখবে, উকিলবাবু সোজা হয়ে বসে কলমটা তুলে নেন, এই পর্যন্ত আইনের কথা আর তা না হলে ত আপনাকে পার্টি বানাতে হয়, উত্তরখণ্ড পার্টি। তারা ত কামতাপুর রাজ্য চায়, পশ্চিমবঙ্গ থেকে আলাদা রাজ্য। সেই রাজ্যের হাইকোর্ট হলে হয়ত আপনার পক্ষে রায় দেরেব্যারেজ ভেঙে গয়ানাথবাবুর জমি গয়ানাথ বাবুকে দিয়ে দাও। ময়নাগুড়িতে ত বিরাট কনফারেন্স হচ্ছে। না?

গয়ানাথ মাথা হেলথ বাবুকে দিয়ে দাওলে হয়ত আপনার।

আপনি আছেন নাকি উত্তরখণ্ডে?উকিলবাবু লেখা শুরু করতে করতে জিজ্ঞাসা করেন। গয়ানাথ বোঝে না, কী জবাব দেবে। উকিলবাবুর কথা থেকে সে এটা বুঝে গেছে উত্তরখণ্ড উকিলবাবুর পছন্দ –কিন্তু গয়ানাথের জমির কথা যদি উকিলবাবুর বদলে উত্তরখণ্ড বেশি জোর দিয়ে বলে, তা হলে গয়ানাথ উত্তরখণ্ড হবেইনা কেন? গয়ানাথ একটা জবাব ভাবতে-ভাবতে দেখে উকিলবাবু লেখা শুরু করে দিয়েছেন। সে আস্তে করে চেয়ার ছেড়ে ওঠে, খুব নিচু স্বরে নমস্কার বলে চেয়ারের পাশ দিয়ে পেছনে চলে যায়। পেছনে তক্তপোশের ওপর মহুরিবাবু বসে আছেন। গয়ানাথ হাতের ভরে তার দিকে এগিয়ে নিচু স্বরে জিজ্ঞাসা করে, কী কী নকল করিবার নাগিবে, কহেন।

বসেন, বলে মুহুরিবাবু তার ডায়রির পাতা উল্টে অনেক ভাজ করা কাগজ খুলে-খুলে দেখে। শেষে না পেয়ে বলে, আপনি আসছেন ত কোর্টে, আমি বের করে রাখছি। গয়ানাথ এবার জিজ্ঞাসা করে, যে-দলিলগিলা নকল করিবার নাগিবে সেগিলা কি আপনার কাছে, না মোর কাছে?

মুহুরি বলে, দেখতে হবে। আপনি কোর্টে আসেন ত। আমি বের করে রাখব। গয়ানাথ আস্তে করে উকিলবাবুর ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ে!

.

১৫৫. গয়ানাথের পাবলিক সন্ধান

 গয়ানাথ বারান্দায় বসে। এ-রকম বসাটাই তার অভ্যেস, তারপর উকিলবাবুর সঙ্গে, বা পেছনে-পেছনে কাছারি যাওয়া। গয়ানাথ ত কখনো ঘড়ি দেখে কাজ করে না–সারাটা দিনের হিশেবে কাজ করে। সকালে উঠে যেখানে যাওয়ার কথা সেই জোতের উদ্দেশে রওনা দিল। রাস্তায় আরো দু-চার জায়গা ঘুরেও যেতে পারে। দুপুরে খাওয়ার জন্যে তাকে ফিরতেই হবে এমন কোনো নিয়ম নেই। আর ফিরবে না, এমন কোনো কথাও নেই। ফিরল ত ফিরল। ফিরল না, ত ফিরল না। এখন সন্ধ্যার পরে বড় একটা কোথাও যায় না সেই নাকশালিয়া হাঙ্গামার সময় থেকে রাতে বেরনো বন্ধ। একটা অভ্যেস নষ্ট হলে আর ফিরে আসে না।

জলপাইগুড়িতে এলে এটাই তার একটা অসুবিধে। ঘণ্টাখানেক পরে আসবেন, বা, সাড়ে বারটা নাগাদ দেখা করেন, এই সব কথা অনুযায়ী নিজের যাতায়াত ঠিক করাটা তার পক্ষে একটু অভ্যেসের বাইরে। তা ছাড়া, শহরে তার এত বেশি কাজ হাতে থাকে না যে এক কাজ সেরে ফেলার মাঝখানে আরো একটা কাজ সেরে ফেলবে। অথচ জোতজমিতে চলাফেরার সময় ঘড়ি ছাড়াই গয়ানাথ সময়ের মাপ রাখে বৈকি। শহরে সে-মাপটাও হারিয়ে যায়। সে বুঝতে পারে না যে এখন যদি ধীরে-ধীরে হেঁটে কাছারিতে গিয়ে বসে থাকে, তা হলে, সেটা কত আগে পৌঁছুনো হবে।

উকিলবাবুর বারান্দায় বসে গয়ানাথ একটু ভাবেও বটে। উকিলবাবু যা বলেছেন সে যে তা মনে-মনে ভাবে নি, তা নয়। যে-সাংঘাতিক ব্যারেজ তৈরি হচ্ছে তাতে গয়ানাথের জমি ত নস্যি। কিন্তু যত বড় ব্যারেজই হোক, গয়ানাথের জমি ত গয়ানাথের জমি। সরকার একটা দাম ধরে ক্ষতিপূরণ দিলেই ত আর সেই ক্ষতিপূরণের টাকা দিয়ে গয়ানাথ নতুন কোনো জমি কিনতে পারছে না। আর, কিনতে পারলেই ত আর পুরনো জমি হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার ক্ষতিটা পূরণ হয় না। জমি কি সরকারি অফিসের লোকদের মাইনে নাকি যে প্রত্যেক মাসের পয়লাতারিখে একই মাইনে পাবে? এমনিই ত জোতজমি রাখার আর-কোনো আইন নেই। সব আইনই জোতজমি ছাড়ার। আধিয়ারকেও জমি রেকর্ড করতে দিলে আর জোতদারের হাতে খতিয়ানটুকুর কাগজ ছাড়া থাকেটা কী? তাই হচ্ছে গত কয়েক বছর ধরে। গয়ানাথের জোতদারির-সময়টা ত এতেই গেল। জোতদারের থাকবে খতিয়ান আর জমি খাবে বারখান ভূত।

এই রাগের হিশেবনিকেশের মধ্যে গয়ানাথ ভোলে নি যে জমি তার হাত থেকে যতই চলে যাক না–জোতদারি তার বাবার আমল থেকে অনেক বেড়েছে। সেইখান ত হবা ধরিছে চাষের তানে। এ্যালায় চাষ কতখান বাড়ি গিছে। সার কতখান বাড়ি গিছে। পতিত জমি কত কমি গিছে।

কিন্তু সেটাও যে এই সরকারেরই সমর্থনে, নিজের সঙ্গে নিজের গোপন আলাপেও গয়ানাথ সেটা মানতে চায় না, এ্যালায় হামরালায় পুরা জমি থাকিলে ক্যানং ফলন হবার ধরিত। কিন্তু এখনকার এই চাষ কি অত জমিতে করা সম্ভব হত, এবং এই ত বেশ ভাল ব্যবস্থা হয়েছে–জমি একটু কমেছে বটে কিন্তু চাষ অনেক বেড়েছে। গয়ানাথ এটা জানে, না-জেনে উপায় নেই বলে। কিন্তু নিজের কাছেও তার না মানলে চলে, তাই মানে না।

মানে ত নাইই বরং গয়ানাথ মনে-মনে উকিলবাবুর কথাগুলোকে নিজের মত করে সাজিয়ে নেয়। জোতদারি আর আগের নাখান চলিবে না। হাকিম বদলি গেইছে। আইন বদলি গেইছে। ব্যারেজের জমি আর ফেরৎ পাওয়ার না-হয়। এই সরকারের আইনে ফেরৎ পাওয়ার না-হয়। কামতাপুরী রাজ্য করেন। স্যালায় নতুন রাজ্যের নতুন আইনত ফেরৎ পাইবেন। জমি ফেরৎ পাওয়ার নিশ্চয়তা থাকলে ত গয়ানাথই উত্তরখণ্ডের নেতা হয়ে বসত। কিন্তু তারা এখানকার কিছু লোক মিলে গোটা একটা রাজ্য বানাতে পারবে–এটা গয়ানাথ বিশ্বাসই করে না। অথচ, তার চলাফেরায় সে বুঝে ফেলেছে উত্তরখণ্ড পাছে হয়ে যায় সেজন্যেও সরকার অনেক কিছু দিতে রাজি আছে। উত্তরখণ্ড পাছে হয়ে যায়, এটা নিয়ে সরকার প্রায় সব সময়ই ভয়ে-ভয়ে থাকে। ভয়ে-ভয়েই যখন আছে তখন ভয় দেখাতে আর আপত্তি কী? আর, ভয় দেখালেই যদি সরকার ভয় পায় তা হলে গয়ানাথই বা একটু ভয় দেখাবে না কেন?

তবুও উত্তরখণ্ড দলে যোগ দিতে গয়ানাথের যেটুকু সঙ্কোচ তা রাজনীতি না করার সঙ্কোচ। তার বাবার আমল থেকে সে দেখে আসছে এই সব পার্টিপুর্টি মানেই জোতদারির ক্ষতি।সে কংগ্রেসরই ঘর হোক আর কমিনিস্টের ঘরই হোক। যায় জোতদারি করে স্যালায় জোতদারি করে, স্যালায় পার্টি ধরিবার টাইম না পায়। স্যালায় পার্টি করিবার ধরিলে, স্যালায় জোতদারি উঠি যায়। স্যালায় জাতদারি ছাড়ি দেউনিয়াগিরি করিবার ধরে। দেউনিয়াগিরির পয়সা বেশি, নগদ পয়সা, কিন্তু জোতদারি নাই।

অভিজ্ঞতা ও জীবনদর্শন মিশিয়ে গয়ানাথ এই ধারণাটা বানিয়ে ফেলেছে। কিন্তু সে যে বানিয়ে ফেলেছে, তা সে জানে না। তথ্য দিয়ে এ কথা সে প্রমাণ করতেও পারবে না, পার্টি করলে জোতদারি টেকানো যায় না। এটাও প্রমাণ করতে পারবে না, পাটি করা মানেই দেউনিয়াগিরি করা। বরং, হয়ত উল্টোটাই সত্য। তার ধারণার পক্ষেও খুঁজে পেতে কিছু সাক্ষ্যপ্রমাণ জোগাড় করা যায়। কিন্তু গয়ানাথের এই ধারণা তৈরি হওয়ার পেছনে এরকম সাক্ষ্য প্রমাণ বা অভিজ্ঞতা কাজ করে নি। গয়ানাথ এমনই আপাদমস্তক জোতদার যে সে জমি ও চাষের নিয়মের বাইরের যে-কোনো নিয়মই অপ্রয়োজনীয় ভাবে। সেই ভাবনাকে তার জীবনদর্শন বলা যায়। তার জোতদারি তাকে কখনো কংগ্রেস করতে দেয় নি–ভোটাভুটির সময় লোকজন নিয়ে গিয়ে একটা ভোট দিয়ে আসা সেটা ত বিয়েশাদির নেমতন্ন খাওয়ার মত ব্যাপার। সেই জীবনদর্শনেই তার বেধেছে উত্তরখণ্ডে যোগ দেয়ার সিদ্ধান্ত নিতে। কিন্তু গয়ানাথ যেন গন্ধ পাচ্ছে তাকে যোগ দিতেই হবে, সে যোগ দেবেও।

এ্যালায় টাইম পড়ি গেইসে পাবলিকের। যে কাম তোমরালা পাবলিক জোগাড় করি করিবেন না, সেকাম হবার না-হয়। আধিয়ারগিলা পাবলিক হয়্যা গিছে, সেইলার কাম হছে। জোতদারগিলারও পাবলিক হবা নাগিবে–স্যালায় কাম হবে।

কিন্তু নিজের সঙ্গে এই সংলাপে গয়ানাথ এসে ঠেকে এই প্রশ্নে, কিন্তু মোর কামটা কী?

এই প্রশ্নের কোনো সদুত্তর সে নিজের ভেতর থেকে টেনে বের করতে পারে না; তার কারণ, গয়ানাথ নিজে নিজের সেই উত্তরের সবটুকু জেনে নিতে চায় না। উত্তরখণ্ড করিলে কি ব্যারেজত মোর যেই জমিগিলা গিসে, স্যালায় ফিরি আসিবে? গয়ানাথ এর জবাব নিশ্চিত জানে, না। তাই সে প্রশ্নটাকে এভাবে তুলতে চায় না। তবু জমি, তোমার বাপ-ঠাকুর্দার জমি, যদি কেউ নিতে আসে তাকে বাধা দিতে হয়, আটকাতে হয়। লাঠিসোটা নিয়ে দখল করতে এলে লাঠিসোটা নিয়ে বাধা দিতে হয়। আল কেটে জমির ভেতর ঢুকতে চাইলে আল বেঁধে আটকাতে হয়। ফসল তুলে জমির ওপর চাষ  কায়েম করতে এলে, উপড়ে ফেলে বাধা দিতে হয়। সরকার নোটিশ জারি করে নিতে এলে কোর্টের নোটিশ দিয়ে বাধা দিতে হয়। গয়ানাথ তা দিচ্ছেও। পাট্টিপুট্টি যদি পাবলিক করি জমি নিবার আসে, স্যালায় পাবলিক করি বাধা দিতে হয়। উত্তরখণ্ড গয়ানাথের পাবলিক।

গয়ানাথ যে এরকম উদাহরণ পরম্পরায় নিজের যুক্তিকে শক্ত করে, তা নয়। কিন্তু সে যখন বোঝে তাকে উত্তরখণ্ডে যেতেই হচ্ছে তখন তাকে তার জীবনদর্শন থেকেই ত যুক্তি সংগ্রহ করতে হয়। এমন যদি হত সে উত্তরখণ্ড করাটাকে বরাবরই জরুরি ভাবছে–তা হলে ত সে প্রথম থেকেই সেখানে থাকত। বরং গয়ানাথ বোঝে যে চাষ-আবাদের কাজে সরকারের সঙ্গে সাগাইকুটুমের মত সম্পর্করাখা ভাল। এখন যা চাষ-আবাদ দাঁড়িয়েছে তাতে সরকারের সঙ্গে ভাল সম্পর্ক না থাকলে চাষ-আবাদ করাই সম্ভব নয়। বরং উত্তরখণ্ড-টণ্ড এই সব পাট্টিপুট্টি ধরলে সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ হয়ে যাবে। আর গয়ানাথের মত একজন জোতদারের সমর্থন পেলে উত্তরখণ্ডিলা চাহিবে মোক উশুল করিবার, আর, লাল পার্টি চাহিবে মোর মানষিগিলাক উশুল করিবার। তাতে ত গণ্ডগোল আরো বাড়বে। কিন্তু গয়ানাথের যে একটা পাবলিক দরকার, সেই পাবলিক সে পাবে কোথায়, এক উত্তরখণ্ড ছাড়া?

গয়ানাথ উকিলবাবুর বারান্দা থেকে নেমে কাছারির দিকে হাঁটা শুরু করে। রাস্তায় রিক্সা সাইকেল ভটভটিয়া নেমে গেছে–লোকজন অফিসে যাচ্ছে। ধীরে-ধীরে রওনা দিলে সে সময়মত কাছারিতে পৌঁছতে পারবে। মুহুরিবাবুর কাছ থেকে লিস্টটা নিলেই ত কাজ শেষ। তার মধ্যে আসিন্দির এলে হয়।

.

১৫৬. গয়ানাথের উত্তরখণ্ডে যোগদানের সিদ্ধান্ত ঘোষণা

গয়ানাথ যখন উকিলবাবুর বাড়ি থেকে বেরয় তখন তার মনে অন্য একটা হিশেবও ছিল। মুহুরিবাবু কোর্টে গিয়ে যদি অন্য কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে, তা হলে গয়ানাথকে সেই বিকেল পর্যন্ত বসিয়ে রাখবে।

সন্তোষ মুহুরি হয়ত রাখতও তাই। গয়ানাথকে দেখেই সে সামনের লোকজন দেখিয়ে বলে, গয়ানাথবাবু, এদের সবার কেস উঠেছে, আপনি একটু বসুন, এদের বিদায় করেই আপনার কাজে হাত দেব।

গয়ানাথ হাতজোড় করে, আজি মোক ছাড়ি দিবার নাগিবে। যাবার তানে ময়নাগুড়ি থামিম। আপুনি মোর কাগজখান দেন। আর যদি না-দেন পাঠি দিবেন।

গয়ানাথ জোতদারকে সাধারণত বসিয়ে রাখা যায় বটে কিন্তু সেরেস্তার এমন পয়সাঅলা মক্কেল যখন কাজটা করে দিতে বলে তখন সন্তোষ মুহুরি কেন, তার উকিলবাবুরও ক্ষমতা নেই কাজটা না করার। গয়ানাথ তার নিজের এই ক্ষমতা সবটুকু জানে না। কিন্তু সে অন্তত এটুকু বোঝে যে ময়নাগুড়িতে নামতে হলে এখানে বিকেল পর্যন্ত থাকলে চলবে না।

মুহুরিবাবু বলে, আপনি বসেন, বসেন, ঐ চেয়ারটাতে বসেন, একজন সেই হাতলভাঙা চেয়ারে বসে ছিল, সন্তোষ তাকে উঠিয়ে দিতে-দিতে নিজের বুকপকেট থেকে একগাদা কাগজ বের করে নানা, রকম ভাজ করা কাগজ, একটা ছোট নোটবইসহ। প্রায় প্রত্যেকটা কাগজই দেখে সন্তোষ, কিন্তু অত্যন্ত দ্রুত। তার দেখার সঙ্গে তাল রেখেই জিভ দিয়ে দই খাওয়ার মত আওয়াজ ওঠে।নেই বলে সন্তোষ সেই কাগজগুলি আবার বুকপকেটে ভরে, এই, গয়ানাথবাবুকে চা দাও, এই এক কাপ চা আনো ত, সন্তোষ তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা একজনকে বলে। তারপর নিজের সেই বড় ডায়রিটার পাতাগুলো উল্টে যায়। প্রায় প্রতিটি পাতাই উল্টোয় ও দই খাওয়ার শব্দ করে। উল্টোতে-উল্টোতে হঠাৎ থেমে যায় সন্তোষ, মুখের আওয়াজটাও বন্ধ হয়। যে-পর্যন্ত উল্টেছিল সেখানে একটা আঙুল রেখে সন্তোষ ডায়রির মলাটের খাপটার ভেতর দেখে। তার পর হাসি মুখে গয়ানাথের দিকে তাকিয়ে বলে, পেয়েছি, পেয়েছি।

গয়ানাথ বলে, কী, কী নাগিবে দেখেন।

ডায়রির ভেতর থেকে একটা ইনল্যান্ড বের করে খুলে পড়ে সন্তোষ বলে, আপনার ঐ ২৩১ নম্বর দাগের পর্চাটা।

সে ত আপনার প্রথমঠে আপনার কাছেই

অ্যাঁ? তা হলে বোধহয় আর-এক কপি লাগবে। নাকি এটা ২৩৩ নম্বর দাগ?

২৩৩ নিয়া ত কুনো মামলা নাই।

সে না থাকলেও লাগতে পারে।

সন্তোষ যে-লোকটিকে পাঠিয়েছিল সে এককাপ চা এনে গয়ানাথকে দেয়। গয়ানাথ চায়ে একটা চুমুক দিলে সন্তোষ বলে, গয়ানাথবাবু, আপনি বরং এই চিঠিটা নিয়ে যান, কাউকে দেখিয়ে নেবেন কী কী লাগবে, সেগুলো নিয়ে আসেন, আমি তখন দেখে নেব। এদের সবার কেসের ডাক পড়বে, এখনি।

আচ্ছা, আচ্ছা আমাকে দিয়া দ্যান, সন্তোষের হাত থেকে চিঠিটা নিয়ে সেটা ভাজ করে পকেটে ঢোকাতে গয়ানাথকে চায়ের কাপটা টেবিলে রাখতে হয়; কিন্তু যদি কুনো কুনো দলিল আপনারঠে থাকে?

সে ত আমি যখন পাঠাব, তখন দেখেই দেব, সন্তোষ না-তাকিয়ে বলে।

চাটা আর-এক চুমুকে শেষ হয়ে যায়। গয়ানাথ উঠে বলে, আচ্ছা মুহুরিবাবু, নমস্কার।

সন্তোষ মুখ তুলে হ্যাঁ, নমস্কার, বলে আবার টেবিলের ওপর ঘাড় নামিয়ে ফেলে।

গয়ানাথ রাস্তায় নেমে ভাবে, আসিন্দিরের জন্যে কোথায় পঁড়াবে? সেটা ভাবতে-ভাবতেই আসিন্দিরের আসার পথের বাকটা দিয়ে বড় রাস্তার দিকে হাঁটে। হাঁটতে হাঁটতে গয়ানাথ ঠিক করে ফেলে সোজা পি-ডবলু-ডির মোড়ে গিয়ে অপেক্ষা করবে।

পি-ডবলু-ডির মোড়ে স্কুলবোর্ডের অফিসের সামনে অনেকগুলো চায়ের দোকান। তার বাইরের দিকের একটা বেঞ্চের এক কোণে সে বসে। রোদের আচ গায়ে লাগে–কিন্তু সে ত আর চা খাবে না তাই আর ভেতরে বসছে না। শহরের ভেতর থেকে সব বাস-মিনিবাসই এখান থেকে তিস্তাব্রিজের দিকে বাক নিচ্ছে, এখানে দাঁড়াচ্ছেও কিছুক্ষণ। যে-কোনো গাড়িতে উঠলেই আধঘণ্টার মধ্যে ময়নাগুড়ি। গয়ানাথ এক-একবার ভাবে সে বরং মুহুরিবাবুকে বলে বাসে করে ময়নাগুড়িতে চলে যাক! মুহুরিবাবু আসিন্দিরকে ময়নাগুড়ি চৌপত্তিতে মরণ ঘোষের দোকানে পাঠিয়ে দেবে। গয়ানাথ ইতিমধ্যে উত্তরখণ্ডের সভাপতি পঞ্চানন মল্লিকের সঙ্গে দেখা সেরে ফেলবে।

তা করতে হলে তাকে আবার কাছারিতে গিয়ে মুহুরিবাবুকে বলে আসতে হয়। কিন্তু গয়ানাথ আন্দাজ করছে যে আসিন্দির এখন যে-কোনো সময় এসে যেতে পারে। ময়নাগুড়িতে পঞ্চানন মল্লিকের সঙ্গে দেখা করার কথাটা তার মাথায় আসার ফলেই গয়ানাথের মনে হচ্ছে যে আসিন্দির দেরি করছে। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে সে বোঝেও, আসিন্দির যে-কোনো সময় এসে যাবে এখন। গয়ানাথ চায়ের দোকানের বেঞ্চিটাতে বসেই থাকে। এদিক-ওদিক তাকায়, বাস-মিনিবাস দেখে, বড় ব্রিজ দিয়ে যে-সব রিক্সা কাছারির দিকে মোেড় নিচ্ছে সেটাও দেখে।

আসিন্দিরের যে কথাটা শুনে গয়ানাথ চমকে তাকিয়ে দেখে তার সামনে দাঁড়িয়ে আসিন্দির ভটভটিয়াতে আওয়াজ করছে তা হল–নিদ যাছেন নাকি বাপা হে? গয়ানাথ চমকে উঠে দেখে আসিন্দির তার ভটভটিয়ার ওপর বসেই হো-হো হাসছে। আসিন্দিরের হাসি দু-একজন দেখে আর গয়ানাথ বেঞ্চ থেকে উঠে চাদর ঠিক করতে-করতে নিজের অপ্রস্তুতি কাটায়।

হাসি থামিয়ে আসিন্দির বলে, এইঠে তোমার চক্ষুর ওপর দিয়া গেছু আর তোমরালা দেখিবার পাও না? ঐঠে কোর্ট তোমরা নাই রো। মুহুরিবাবু কহে উ ত চলি গেইছে। ত, ভাবিছু-কি, বাপোটা মোর ঠিক পি-ডবলু-ডির মোড়টা বসি আছে। এইঠে আসি তোমাক দেখি প্যাক প্যাক দিছু, শোন নাই। ডাকিছু। শোন নাই—

আসিন্দিরের এই কথা জুড়ে গয়ানাথ তার পেছনে ওঠে, বসে, চাদর ঠিক করে। আসিন্দির গাড়ি চালানো শুরু করলে তার কথা থামিয়ে দিয়ে বলে, ময়নাগুড়িত্ পঞ্চানন মল্লিকের ঘরত যাম। 

গাড়ি থামিয়ে আসিন্দির ঘাড় ঘুরিয়ে জিজ্ঞাসা করে, পঞ্চানন মল্লিক? বাপো, উত্তরখণ্ড ধরিবেন নাকি হে? তারপর রাস্তায় ওঠার মুখে মোটর সাইকেলটা থামিয়ে দেয়।

আচমকা থামানো মোটর সাইকেলটা কাঁপছে, তার ওপর গয়ানাথও কাঁপছে, আসিন্দির দু দিকে মাটিতে পা নামিয়ে দিয়েছে, তার ঘাড় ঘোরানো। এরকম অবস্থায় গয়ানাথ তার ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে, ধরিম ত, উত্তরখণ্ড ধরিম। মুই না ধরো, ত তোক দিয়া ধরাম। না ত তোর এই কোর্ট আর হাকিম করি আর-জোতজমি সামলিবার পারিবেন না হে।

আসিন্দির তার ডান হাতটা তুলে হ্যাঁণ্ডেলের ওপর ফেলে চেঁচিয়ে ওঠে, তাই কহ, বাপা আমারস এ্যালায় লিডার হওয়া ধরিবে, বাপা আমার লিডার হবে এ্যালায়, উত্তরখণ্ডের লিডার। সে গাড়ি ছাড়ে।

একটু পরে পেছন থেকে গয়ানাথ চিৎকার করে, শুন, এ্যালায় মুই না যাও, তুই যা কেনে–

আসিন্দির কথাটা স্পষ্ট শুনতে পায় না। গতি না কমিয়ে ঘাড়টা ঘুরিয়ে জিজ্ঞাসা করে, কোটত যাম? ময়নাগুড়িত যাছি ত।

আসিন্দিরের পিঠে স্পর্শ দিয়ে গয়ানাথ বোঝায়–ঠিকই যাচ্ছে। সামনে তিস্তা ব্রিজের মাথা আকাশে।

আসিন্দির ঘাড় ঘুরিয়ে চিৎকার করে, কী? কহিছেন কী?

আবার আসিন্দিরের পিঠে হাত দিয়ে গয়ানাথ চিৎকার করে, কহিম, কহিম। এ্যালায় চল কেনে ময়নাগুড়ি। গলাটা আরো উঠিয়ে বলে, আগত চৌপত্তিতে নামিবু।

.

১৫৭. শব্দের অর্থ নিয়ে পঞ্চানন-গয়ানাথের বিচার ও সিদ্ধান্ত

 ময়নাগুড়িতে পঞ্চানন মল্লিকের বাড়িতে যাওয়ার আগে চৌপত্তিতে মরণাদ ঘোষের দোকানে দুকাপ চা খেতে-খেতে গয়ানাথ ও আসিন্দিরের মধ্যে একটা আলোচনা হয়। গয়ানাথ বলে, প্রথমেই তার যোগ দেয়াটা ভাল হবে না। সে যোগ দিলে সরকার তার মামলা-মোকদ্দমা ডিসমিস করে দিতে পারে। তা ছাড়া, সেইবা একেবারে প্রথম থেকে পুরোপুরি যাবে কেন। সামনে ভোট আসছে। গয়ানাথের হাতে ভোট ও নেহাৎ কম, নেই। আসিন্দির গেলে–সব পার্টিই ভয় পাবে যে জামাই শ্বশুরকে টেনে নিতে পারে। কিন্তু গয়ানাথকে কেউ জিগগেস করলে সে বলতে পারবে–মোর জোয়াইখান ত জোতদারি না করে, কনট্রাক্টারি করে। মোর কথা ও না শুনে।

গয়ানাথের একথার আসিন্দির বলে, মোক হাউলি খাটাবার চাছেন? আসিন্দিরের ধারণা–এ-সবে এখন আর কেউ ভোলে না। সবাইই বুঝবে, গয়ানাথ নিজে না গিয়ে আসিন্দিরকে হাউলি খাটাচ্ছে। তাতে জাতও যাবে, পেটও ভরবে না। যেতে হলে গয়ানাথ-আসিন্দির দুজনেরই যাওয়া উচিত। তাতে সবাই একটু নাড়া খেতে পারে। লিডারি করিবার চাহেন ত লিডারি করিবার নাগিবে। লিডারি কি হাউলি দিয়া হয়? না হয়।

গয়ানাথ কিছুটা দুর্বলভাবেই বলে যে এদের লিডারটিডার সব ঠিক হয়েই আছে, সে গেলেই কি তাকে লিডার বানাবে নাকি।

আসিন্দির তাতেও তাকে বলে বসে, কহেন কী? গয়ানাথ জোতদার জয়েন দিলে সেইটা ত একখান জোর খবর হবা ধরিবে উত্তরখণ্ডের পাকে। তোমরালা কি চ্যাংড়ার ঘর যে ভলান্টিয়ার করিবেন? তোমরালা জয়েন দিলেই লিডার। ফলে, চা শেষ করে মোটর সাইকেলে চড়ে যখন পঞ্চানন মল্লিকের বাড়িতে যায়, তখন তারা কিছুটা দ্বিধার আছে। উত্তরখণ্ডে যোগ দেবে–এই পর্যন্তই ঠিক। আসিন্দির যেমন বলছে গয়ানাথ যোগ দিলে হৈ-হৈ বাধবেই, গয়ানাথ তেমনি চাইছে–অত হৈ-হৈ-এর দরকার কী?

পঞ্চানন মল্লিক দুপুর বেলা ঘুমুচ্ছিলেন। তার দারিঘরে গয়ানাথ ও আসিন্দিরকে বসানো হয়। একটি ছোট ছেলে একটা কাসার ঘটিতে জল আর স্টেইনলেস স্টিলের গেলাস দিয়ে যায়। পঞ্চানন মল্লিকের দারিঘরে একটা বড় তক্তপোশ আছে, আবার একটা টেবিল আর কিছু চেয়ারও আছে। দারিঘরে ঢুকে তাকিয়ে গয়ানাথ যেন স্থির করতে পারে না কোথায় বসবে। পেছন থেকে আসিন্দির বলে, চেয়ারঠে বসেন, মুই পাছত বসিছু। আসিন্দির গিয়ে তক্তপোশটায় বসে। গয়ানাথ চেয়ারে বসলে আসিন্দির পেছনে পড়ে যায়, গয়ানাথ চেয়ারটা একটু-একটু ঘুরিয়ে বসে। কিন্তু হেলান দেয় না। গয়ানাথ যেন এখনো উঠে যেতে পারে–তার মুখচোখে সেই রকম অনিশ্চয়তা। আসিন্দির-জিজ্ঞাসা করে, তোমরালা চেনেন ত পঞ্চানন মল্লিক?

একথার জবাব দেবার সময় গয়ানাথ পায় না। তার আগেই দারিঘরের দাওয়ার নীচে পঞ্চানন মল্লিক এসে যান। দারিঘরটা উঁচু মাটির। দুটো দরজা, নীচে কাঠের একটা গুঁড়ি। সেটা অনেকদিন ধরে সিঁড়ি হিশেবে ব্যবহৃত হতে-হতে এই মাটির ঘরের সঙ্গে মিশে গেছে। দুই দরজা মুখোমুখি বলে ঐ দরজা দুটো জুড়ে রোদ। ঘরের বাকিটুকু আবছায়া। তবে ভামনির বেড়ার ফাঁক দিয়ে বাইরের উজ্জ্বলতা দেখা যায়।

ঘরের ভেতর উঠবার জন্যে দরজা ধরতে হয় পঞ্চানন বাবুকে। তার পরনে গেঞ্জি ও ধুতি। গেঞ্জির ফাঁক দিয়ে পৈতে দেখা যাচ্ছে। ঘরের ভেতর উঠে তিনি নমস্কার করেন গয়ানাথকে। গয়ানাথকে পার হয়ে তাকে টেবিলে বিপরীত দিকের চেয়ারে বসতে হয়। সেখানে বসেও তিনি আসিন্দিরকে দেখতে পান না–দেখতে পান গয়ানাথের ওপর থেকে চোখ সরাতে গিয়ে।

গয়ানাথই কথা শুরু করে, গেছিল জলপাইগুড়ির কোর্টত। যাবার তানে দেখি উত্তরখণ্ড সম্মিলন হবা ধরিছে। ত ভাবিছু–আপনার নখত কনেক দেখা করি যাই। এত হামরালারই সম্মিলন, রাজবংশী মানষিলার।

পঞ্চাননবাবু গলাটা পরিষ্কার করে নিয়ে ধীরেসুস্থে বলেন, বলেন, প্রধানত রাজবংশীদের। কেন? না, রাজবংশীরাই উত্তরবঙ্গের প্রধান। কিন্তু উত্তরখণ্ড দল সব মানুষের। যারা কামতাপুর নামে স্বতন্ত্র রাজ্যের দাবি সমর্থন করে তাদেরই দল উত্তরখণ্ড।

নিশ্চয়, নিশ্চয়, সে ত হবাই নাগিবে। আপনারা কি তিস্তা ব্যারেজের তানে কিছু ভাবনাচিন্তা দিবার চাহেন? গয়ানাথ জিজ্ঞাসা করে।

হ্যাঁ, এ্যা। উত্তরবঙ্গের সব বিষয়েই ত আমাদের বলতে হবে। আপনার ত অনেক জমি চলি গিছে।

সেই কথাখানই কহিবার চাহি। আমার সঙ্গে সরকারের ত মামলা চলিবার ধরিছে কলিকাতার হাইকোর্টত আর জলপাইগুড়ির কোর্টত। ফরেস্ট ডিপার্টমেন্ট কোর্ট স্টে-অর্ডার দেন নাই। কিন্তু ক্ষতিপূরণের একখান মামলা জিতি গেইছি। এ্যালায় মোর এই কাথাখান কহিবার আছে যে যেইলা জোতদারের জমি আগত ভেস্ট হয়া গেইসে, সেইলার সেই ভেস্ট জমিঠে, এখন ব্যারেজের তানে যে নতুন জমি অধিগ্রহণ করা হই তার সমপরিমাণ জমি, জোতদারকে ফিরি দিবার নাগিবে।

পঞ্চানন একটু ভেবে বলে, এইটা ত খুব ভাল প্রস্তাব। কিত জোতদার কহা না যায়।

কেনে? জমি ত জোতদারের ভেস্ট হইছে। গয়ানাথ বলে।

 তা হইছে। কিন্তু আমাদের পার্টিকে ত সরকারের লোক, কমিনিস্টিরা, জোতদারের পার্টি বলে। সেই কারণে আমাদের প্রস্তাবে কি বক্তৃতায় জোতদার না বলিয়া কৃষক বলিবার কথা। আমরা কৃষকের স্বার্থের কথা বলিব।

গয়ানাথ চুপ করে যায়। চুপ করে থেকে তাকে শব্দার্থের এই গণ্ডগোলটা বুঝতে হয়। এতদিন সে শুনে এসেছে ও জেনে এসেছে, কৃষক মানে পাটির মানষি, লাল পাটির মানষি। কৃষক একপাখে। আর জোতদার একপাখে। কিন্তু পঞ্চানন মল্লিক বলিছেন জোতদারক কৃষক হবা নাগিবে।

কিন্তু কৃষক ত উমরালা কছে কমিনিস্টের ঘর, কৃষক সমিতি জিন্দাবাদ, কৃষকের দখল দিতে হবে দিতে হবে, কৃষক উচ্ছেদ না চলিবে না চলিবে না।

পঞ্চানন এই প্রশ্নটির জবাব দিতে অভ্যস্ত হয়ে গেছেন। বোধ হয়, ভালও বাসেন–কৃষক কথাটি ত সংস্কৃত। যে কৃষি কাজ করে সে কৃষক। জোতদাররা ত চব্বিশ ঘণ্টা কৃষি কাজ করে। জমি আপনি কেন চাহেন? কৃষি করিবার তানে। সেই কারণে আমরা নিজেদের কৃষক বলিব। কমিনিস্টের ঘর কৃষক কথাখান সম্পত্তি করিয়া নিছে। আর জোতদার কথাখান গালি বানাইছে। উত্তরখণ্ড দল কৃষক কথাখানের আসল অর্থ সবাইকে জানাইবে। আমরা ত কৃষক, সগায় কৃষক–সে আধিয়ার হউক, দেউনিয়া হউক আর খাঁটিবার মানষি হউক।

এটা বুঝে নেয়ার জন্যে একটু সময় গয়ানাথ চুপ করে থাকে। তার কাছে কৃষক কথাটিকে খুব সম্মানজনক ও জোতদার কথাটিকে গালাগাল মনে হয় না। সে যেন জোতদারই থাকতে চায়। উত্তরখণ্ড যে তাকে কৃষক হতে বলবে এর জন্যে সে যেন তৈরি ছিল না।

আসিন্দির তক্তপোশ থেকে উঠে এসে বলে, বাপা হে, যেইলা জোতদার ঐলাই কৃষক। উত্তরখণ্ডের কৃষক আর লাল পার্টির কৃষক এক নহে, আলাদা। আসিন্দিরের নেতিবাচক বাক্যে পঞ্চানন মাথা দোলান আর আসিন্দিরের ইতিবাচক বাক্যে ঘাড় হেলান। যেন, কথাগুলি আসিন্দিরের, ভঙ্গি পঞ্চাননের।

মানষিরা বুঝিবেন ক্যানং করি? লালপাটি কহিবেন, কৃষককে উচ্ছেদ দেয়া চলিবেন না, আপনারাও কহিবেন, কৃষক উচ্ছেদের অধিকার দিতে হবে মানষির নখত ত সব কথা গণ্ডগোল হবা ধরিবে। মুইও কৃষক, মোর এই জোয়াইও কৃষক, মোর মানষি সেই বাঘারুখানও কৃষক?

শুনেন গয়ানাথবাবু, আমরা ত একটা দল গড়িবার চাই–উত্তরখণ্ড দল। তার উদ্দেশ্য কী? পশ্চিমবঙ্গ হইতে আলাদা রাজ্য গঠন। কোন রাজ্য? কামতাপুর রাজ্য। সেই রাজ্যের দাবিতে ত সকল মানুষকে আসিতে বলিতে হবে। রাজ্যে ত অনেক মানুষ থাকিবে। কৃষক বলিলে সবাইকে বুঝায়। জোতদার বলিলে ত সবাইকে বুঝাইবে না। কিন্তু লোকে যখন শুনিবে যে উত্তরখণ্ড দল বলেভেস্ট জমি হইতে ব্যারেজের জমি ফেরৎ দাও–তখন সগায় বুঝিবে যার ভেস্ট জমি ছিল, আমরা শুধু সেই মানষিদের কথা বলিবার চাহি।

গয়ানাথ এবার মাথা হেলিয়ে বলে, হ্যাঁ, এই কাথাটা ঠিক কহিছেন। মানষি আনিবার নাগিবে। জোতদার বলিলে ত মানষি আসিবে না। আর, ভেস্ট জমি বলিলে লোকে বুঝি নিবে জোতদারির কথা হছে।

তা কেন বলেন? শুধু জোতদারির কথা নহে, ন্যায্য কথা, ধর্মের কথা। পঁচখান টাড়ি (গ্রাম) দিলে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ হইত না আর সরকার আপনার এতগিলা জমি প্রথমে ভেস্ট নিল, পরে আবার এতগিলা জমি ব্যারেজের জন্যে অধিগ্রহণ করিল। পঞ্চানন মহাভারতের উদাহরণ দিয়ে কী বোঝাতে চাইলেন, তিনি নিজেও বোঝেন না, গয়ানাথ ত বোঝেই না।

আপনাদের কামতাপুরী রাজ্যে এই তিস্তা ব্যারেজ কী থাকিবে? গয়ানাথের এই সরল জিজ্ঞাসায় পঞ্চানন গম্ভীর হয়ে যান। এই প্রশ্নের জবাব তিনি ভাবেন নি। আসলে, গয়ানাথের মত বড় জোতদার উত্তরখণ্ড যোগ দিলে তার স্বার্থে এই তিস্তা ব্যারেজ সংক্রান্ত প্রস্তাব নিতেই হবে। কিন্তু সে-প্রস্তাব নিলেও পঞ্চানন এখন কী করে বলবে কামতাপুর রাজ্যে তিস্তা ব্যারেজ থাকবে কি থাকবে না।

পঞ্চানন বলে, ব্যারেজ নিয়া ত আপনার কুনো অভিযোগ নাই। আপনার অভিযোগ জমি অধিগ্রহণ বিষয়ে। কামতাপুরে দরকার হইলে ব্যারেজ করিতে হইবে কিন্তু কখনোই কৃষকের জমি অধিগ্রহণ করা হইবে না। নদীর জমি দিয়া নদীর ব্যারেজ বান্ধো। পঞ্চানন এত সুন্দর ভাবে কথাটির জবাব দিতে পেরে খুশি হন।

গয়ানাথ পাল্টা প্রশ্ন করে, আর, ফরেস্ট ডিপাটমেন্ট? কামতাপুরেও কি ফরেস্ট ডিপাটেমন্টে থাকিবে?

পঞ্চানন জবাবের যেকায়দা বের করেছেন সেটা ছাড়তে চান না, গয়ানাথবাবু, আমাদের কামতাপুর রাজ্য ত ভারতের মধ্যে একটি রাজ্য হইবে। ভারতের সব রাজ্যের যে-নিয়মকানুন, কামতাপুরেও তা, থাকিবে কিন্তু তা কখনোই কৃষকের বিরুদ্ধে যাইবে না, কৃষকের স্বার্থে থাকিবে।

কৃষক মানে লালপার্টির কৃষক না হয়, উত্তরখণ্ড দলের কৃষক? নিশ্চয়ই। কৃষক বলিতে শুধু হালুয়ামানষি আধিয়ারমানষিক বুঝাবেন কেন? যার জমি সেও ত কৃষক। শুনেন গয়ানাথবাবু, আপনি উত্তরখণ্ডে যোগ দিলে সেটা আমাদের গৌরব। এই ডুয়ার্সের সগায়, কোচবিহারের সগায়, তরাইয়ের সগায় আমাদের পুছিবার ধরে–গয়ানাথবাবু কেন আসেন নাই? আপনারা কয়েক পুরুষের মধ্যস্বত্ব ভোগী। আপনি আসিয়া আপনার বক্তব্য বলেন, আমরা সেসব নিয়া আলোচনা করি, দশজনের সঙ্গে আপনি বসেন।

গয়ানাথ একটু চুপ করে থেকে বলে, সেই তানেই ত আপনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করিবার আসিছু। কিন্তু মোর ত এতগিলা মামলা চলিছে। স্যালায় মুই আগত যাম না। মোর পক্ষে মোর জোয়াই এই আসিন্দির উত্তরখণ্ড করিবে। মুইও আপনাদের তামান কাম করিম কিন্তু মুই নাম লিখিবার আগে দুই-চারি মাস দেখিবার চাহি।

কী দেখিতে চান? আমাদের কাজকর্ম?

না-হয়, না-হয়। মোর মামালা-মোকদ্দমাগিলা কোটত দাঁড়ায়?

মামলা চলিবে মামলার মত, তাতে আপনার উত্তরখণ্ড করিবার বাধা কোথায়? আপনি ত চাহেন তিস্তা ব্যারেজের বিষয়ে আমরা সম্মিলনে কথা তুলি? আপনি নিজে না-আসিলে কে তুলিবে? কী তুলিবে? ব্যারেজের ব্যাপারখানে ত আপনাকে নেতৃত্ব দিতে হবে আমাদের। আপনি আমাদের লিডার হবেন।

আসিন্দির গয়নাথের পাশে দাঁড়িয়ে বলে ওঠে, মুই ত কহিছু বাপাক। তোমার কি এ্যালায় লুকি থাকিবার বয়স, নাকি, ভলান্টিয়ার বানিবার বয়স? তোমাক এ্যালায় লিডার হবা নাগিবে। লিডার হও কেনে, বাপা, লিডার হও। গয়ানাথ একটু চুপ করে থেকে বলে, আচ্ছা, ব্যারেজের তানে সুই আসিম। কিন্তু অন্য কাজ সব আসিন্দির করিবে।

তারপর আবার কী ভেবে বলে, না, মুই আসিলে আসিন্দিরকে বাদ দ্যান। দুইজন মিলিযোগদান হইলে সগায় ভাবিবে হামরালা সরকারের বিরুদ্ধ যুদ্ধ ঘোষণা দিছু।

তাহলি জামাইঅক আমাদের সংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের পার্টনার করি দ্যান।

সেইখান কী?

পঞ্চানন দু হাত তুলে বলে, এক কাজ করেন। আপনি ঘরে ফিরিয়া যান। দু-এক দিনের মধ্যে আমি আর আমাদের সম্পাদক বীরেন্দ্রনাথ বসুনিয়া আপনার সঙ্গে দেখা করিম।

.

১৫৮. উত্তরখণ্ড সম্মিলন শ্রীদেবীর নাচ

ময়নাগুড়িতে নিখিল বঙ্গ উত্তরখণ্ড সমিতির প্রথম সম্মিলনের আয়োজন জমে উঠেছে। কিন্তু সেটা উত্তরখণ্ড সমিতির সম্মিলনের জন্যে, নাকি সম্মিলনের শেষে প্রত্যেক সন্ধ্যায় আয়োজিত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের জন্যে, তা বোঝা যাচ্ছে না, কারণ এখনো বোঝার সময় আসে নি। কিন্তু সম্মিলন আর অনুষ্ঠান যখন শুরু হবে তখন সম্মিলনের কথা যে কারো মনে থাকবে না– তা এখনই আন্দাজ করা যায়। অবিশ্যি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান যদি সত্যিই এতটা সফল হয় তা হলে সেটাও ত উত্তরখণ্ড সম্মিলনেরই সাফল্য হিশেবে ধরা হবে। ইতিমধ্যেই ত এই সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের নাম লোকের মুখে-মুখে উত্তরখণ্ড ফাংশন হয়ে গিয়েছে।

সম্মিলনে আসার জন্যে কোনো পয়সা দিতে হবে না–সকলে দলে-দলে যোগদান করুন। কিন্তু সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের জন্যে টিকিট আছে–ফার্স্টক্লাশ পনের টাকা, সেকেণ্ডক্লাশ দশ টাকা, থার্ডক্লাশ পাঁচটাকা। চেয়ারগুলো ডোনারদের জন্যে ও কমপ্লিমেন্টারি কার্ড যাদের দেয়া হবে তাদের জন্যে।

সম্মিলন হবে সকালে আর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হবে বিকেলে। দুদিন নবরঙ্গ অপেরার কুলটার কুল ও প্রমোদতরণী। এতে তিনজন ফিল্ম এ্যাকটর আছে–সানু ব্যানার্জি, এলবার্ট সেন আর মোনা গুপ্তা। মোনা গুপ্তা সিনেমাতেও নাচে, যাত্রাতেও নাচবে। আছে হিন্দি বাংলা গানের আসর। তাতে মান্না দে থেকে অনুপ জালোটা। চিত্রা সিং-এরও আসার কথা আছে, এখনো পাকা হয় নি। আছে–কলকাতার একটি গ্রুপ থিয়েটারের সামাজিক নাটক। একদিন সারা রাত ভিডিওতে চারটি ফিল্ম দেখানো হবে। আর শেষ দিনে, ও সেটাই চরম দিন,বম্বের ফিল্ম আর্টিস্ট শ্রীদেবীর প্রোগ্রাম। পরদিন সকালে সম্মিলন বা অনুষ্ঠান মণ্ডপ থেকে বিরাট শোভাযাত্রা যাবে জল্পেশ মন্দিরে। সেখানে জল্পেশ্বর শিবের সামনে শপথগ্রহণ।

উত্তরখণ্ড সম্মিলনের জন্যেই এরকম সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হচ্ছে তা নয়। বরং সম্মিলনটাই নতুন, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান প্রতি বছরই কোথাও-না-কোথাও হয় পুজোর পর, এ-রকম সময়ে। অনকে বছর ধরে হতে-হতে ওটার একটা সংযোগ ব্যবস্থাও তৈরি হয়ে গেছে। আসাম থেকে ফিরতি পথে ডুয়ার্সের নানা জায়গায় শিল্পীদের পক্ষ থেকে বা কোম্পানীর পক্ষ থেকে উদ্যোক্তাদের কাছে লোকজন আসা-যাওয়া শুরু করে। ডুয়ার্সের কোথাও বা শিলিগুড়ি শহরে এরকম অনুষ্ঠান হয়। যারা অনুষ্ঠান করায় তারা ব্যবসার ভিত্তিতেই করে। ফলে কাছাকাছি দুটো অনুষ্ঠান হয় না বা একই জায়গায় পর-পর, দুবছর হয় না। যেখানেই হোক, বড় আর্টিস্ট থাকলে আসাম-বিহার থেকেও লোকজন আসে। উত্তরখণ্ডের ফাংশনে শ্রীদেবীর প্রোগ্রামের দিন ত এসব জায়গা থেকে প্রচুর লোক আসবে আশা করা হচ্ছে।

উত্তরখণ্ড সম্মিলন এই বছরই প্রথম হচ্ছে অথচ এই সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের নামই হয়ে গেছে উত্তরখণ্ড ফাংশন। তেরজন মিলে শেয়ার কিনে ফাংশন করছে তাদের সঙ্গে সম্মিলনের সরাসরি যোগ নেই। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের পোস্টার লাগানো হয়েছে উত্তরবঙ্গের সর্বত্র দার্জিলিং থেকে ফারাক্কা পর্যন্ত, এমনকি কিছু-কিছু পোস্টার বহরমপুর পর্যন্তও। শিলিগুড়ি-কোচবিহার-ডুয়ার্স পোস্টারে-ফেস্টুনে ছেয়ে দেয়া হয়েছে। যে বাসগুলো তিস্তা ব্রিজ পার হয়ে আসাম যায়, তার পেছনে পোস্টার ত আছেই, তা ছাড়াও বঙ্গাইগাও, চুটিয়াপাড়া, পাণ্ডু ও গৌহাটিতে ফেস্টুনও ঝুলছে। আবার আসাম থেকে কিষনগঞ্জ হয়ে পূর্ণিয়ার দিকে যে-সব ট্রাক যাতায়াত করে সেগুলোতেও পোস্টার সঁটা। কিন্তু ট্রাকে পোস্টার থাকে না, ছিঁড়ে যায়। তাই কলকাতা থেকে কিছু প্লাস্টিক শিট ছাপিয়ে এনে ট্রাকের সামনের কাঁচে লাগানো হয়েছে। কিষনগঞ্জ-ডালখোলার রিক্সার পেছনেও পোস্টার। কথা আছে, ফাংশনের দু-একদিন আগে ময়নাগুড়ি আর জলপাইগুড়ির রিক্সাওয়ালাদের গেঞ্জি দেয়া হবে–শ্রীদেবীর ছবি ছাপিয়ে।

সেই আসাম, বিহার, পাহাড়, ডুয়ার্স জুড়ে এত প্রচার–আসামি, হিন্দি, নেপালি ভাষায়। পাণ্ডুতে একটা বাংলা ফেস্টুনও লাগানো হয়েছিল–পরীক্ষার জন্যে। কেউ ঘেঁড়ে নি দেখে আরো কয়েকটা ঝোলানো হয় রেলওয়ে কলোনির ভেতরে। কিষনগঞ্জে হিন্দি পোস্টার ও ফেস্টুন। ডালখোলার মোড়ে হিন্দি বাংলা দুই পোস্টারই আছে, ডুয়ার্সেও তাই।

ডালখোলার মোড়ে তিনটি দোকানে, কিষনগঞ্জের ছটি দোকানে, পাণ্ডুতে একটি দোকানে, বঙ্গাইগাঁওয়ের হুইলারে, চুটিয়াপাড়ার সিনেমা হলে, গৌহাটির তিনটি দোকানের, আলিপুর দুয়ারের, একটি মিষ্টির দোকানে ও আলিপুর দুয়ার জংশনে একটি অফিসে, দার্জিলিঙের একটি অফিসে ও দুটি দোকানে, কার্শিয়াঙের ট্যাক্সিস্ট্যাণ্ডে, শিলিগুড়িতে এয়ারভিউ হোটেলের মোড়ে ছাতার নীচে, জলপাইগুড়িতে নিরালা হোটেলে, পূর্ণিয়ায় এক ডাক্তারখানায়, কোচবিহারে একজন একাই কন্ট্রাক্ট নিয়েছে, ডুয়ার্সের নানাজায়গায় টিকিট বিক্রির ব্যবস্থা আছে। কিন্তু অনুষ্ঠানের পাঁচ দিন আগে বাইরের এই সব টিকিট বিক্রির জায়গা থেকে টিকিট ফেরৎ নিয়ে এসে শুধু কয়েকটা নির্দিষ্ট জায়গা থেকে বিক্রি করা হবে। লক্ষ-লক্ষ টাকা খাটানো হয়েছে এই অনুষ্ঠানে। সে-টাকা তুলে তার ওপর লাভ করতে হবে। এক ও একমাত্র উপায় টিকিট বিক্রি করা। উদ্যোক্তারা তাই প্রচারের ওপর যেমন জোর দিয়েছে, তেমনি জোর দিয়েছে টিকিট সব জায়গায় ছড়িয়ে দেয়ার ওপর। টিকিটের জন্যে কেউ অনুষ্ঠানে আসতে পারল না–এটা যেন না হয়। যদিও ছদিন ধরে অনুষ্ঠান ও ছদিনের টিকিটই যারা নিচ্ছে তাদের পাঁচ দিনের দাম দিতে হচ্ছে, কিন্তু সব ব্যবস্থাই শেষ দিনে শ্রীদেবীর অনুষ্ঠানের জন্যে। শ্রীদেবীর নাচ দেখতে কত লোক যে আসবে তার হিশেব করাও মুশকিল! এই শেষ দিনের অনুষ্ঠানের টানেই অন্য দিনের টিকিটগুলি এমন বিক্রি হয়ে যাচ্ছে! শ্রীদেবীর অনুষ্ঠান আসাম-বিহার-ডুয়ার্স থেকে লোক যদি আসে তা হলে লাভ বেশ ভাল হবে।

দূর থেকে যারা আসবে তারা নিজেরাই ট্রাকবাস ভাড়া করে আসবে। এমন-কি চা বাগান থেকেও যারা আসে, তারা চা বাগানের ট্রাকেই আসে। কিন্তু পাশাপাশি ১৫ থেকে ৩০ কিলোমিটার ব্যাসার্ধের এলাকা থেকে অনুষ্ঠানের নিয়মিত দর্শকরা আসবে–এটা আশা করা যায়। তাদেরও অনেকেই গরুর গাড়িতে আসে বটে কিন্তু অনুষ্ঠানের শেষে কতকগুলি রাস্তায় কিছুদূর পর্যন্ত অনন্ত দুটি-একটি বাস যাওয়ার আশ্বাস থাকলে অনেকেই ভরসা পায়। সেই জন্যে প্রাইভেট বাস বা হাট বাসের সঙ্গে কথাবার্তা চলছে।

এই অনুষ্ঠানে আসার জন্যে আসামে, বিহারে, দার্জিলিঙে, তরাইয়ে নানা রকম ব্যবস্থা শুরু হয়েছে। অনেকে শুধু শ্রীদেবীর অনুষ্ঠান দেখাবার জন্যে ডিলাক্স বাসে যত জনকে আনা সম্ভব তত জনের টিকিট কেটে নিয়ে গিয়ে তার সঙ্গে বাস ভাড়া ইত্যাদি মিলিয়ে একটা রেটে বিক্রি করছে। বাসওয়ালাদের মধ্যে ডিলাক্স বাস, অর্ডিনারি বাস যেমন আছে, তেমনি ডি-লাক্সের মধ্যে ভিডিও বাস আলাদা। তারা যাওয়ার সময় ও ফেরার সময় ভিডিওতে শ্রীদেবীর ফিল্ম দেখাবে। দুরত্বের ওপর নির্ভর করে, কোনো-কোনো বাসে একটা বড় খাওয়া, দুটো ছোট খাওয়ার ব্যবস্থা আছে। কোনো-কোনো বাসে খাওয়া-দাওয়ার কোনো ব্যবস্থাই নেই। আবার অনেকে নিজেরাই বাসট্রাক ভাড়া করে আসছে।

ফলে, এই শেষ দিনের অনুষ্ঠানে, ময়নাগুড়ি শহর পুরো জ্যাম হয়ে যেতে পারে। এইটুকু ত শহর, রাস্তাগুলোও সরু সরু। যদি একবার কোনো গাড়ি আটকে যায়, সেটা বের করা প্রায় অসম্ভব। সেইজন্যেই পুলিশের ওপর পুরো নির্ভর। অনুমতি ত নেয়া হয়েইছে–পুলিশই বিভিন্ন মাসে বাস ও ট্রাস পার্কিঙের ব্যবস্থা করে দেবে। কোম্পানীকে শুধু সেই মাঠে ঢোকার রাস্তা বানিয়ে দিতে হবে। আসাম থেকে আসা গাড়িগুলোকে চৌপত্তির আগেই পার্ক করাতে হবে আর বিহার বা তিস্তাব্রিজ পার হওয়া গাড়িগুলোকে পশ্চিম দিকে পার্ক করাতে হবে। মাঠগুলো বেশ বড় বড় আছে, এই যা বাঁচোয়া। শ্রীদেবীর নাচের জন্যে ময়নাগুড়ির মত এইটুকু থানা শহরে সর্বভারতীয় ব্যবস্থা গড়তে হচ্ছে, যেন আসামের গাড়ির সঙ্গে বিহারের গাড়ি মুখোমুখি না হয়, ডুয়ার্সের গাড়ির সঙ্গে তরাইয়ের গাড়ি মিশে না যায়–সব গাড়িরই মুখ যেন থেকে শ্রীদেবীর মঞ্চের দিকে, কিন্তু নানা দিক থেকে।

.

১৫৯. একটি প্রয়োজনীয় জীবনী–সংক্ষেপে

বীরেন্দ্রনাথ বসুনিয়া থানার বড়বাবুর কাছ থেকে চিঠিটা পেয়ে যান সেদিন বিকেলের মধ্যেই।, বীরেনবাবুকে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের সম্পাদক হিশেবে জানানো হয়েছে, যে-তেরজন আর্থিক দায়িত্ব নিয়ে ও একটি কমিটি তৈরি করে এই সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের অনুমতি প্রার্থনা করেছিলেন তাদের জলপাইগুড়ি সার্কিট হাউসের সভায় উপস্থিত থাকতে জানানো হচ্ছে। ঐ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের প্যাণ্ডেলে একই সঙ্গে নিখিলবঙ্গ উত্তরখণ্ড সম্মিলন নামে যে-সম্মিলন হচ্ছে ও যে-সম্মিলন সম্পর্কে সরকারকে এখনো পর্যন্ত কিছু জানানো হয় নি তাদের সংগঠকদেরও যেন সাংস্কৃতিক সম্মিলনের উদ্যোক্তারা নিয়ে আসেন–এই নির্দেশের সঙ্গে সঙ্গে জানিয়ে দেয়া হয়েছে যে মাননীয় পর্যটনমন্ত্রী, শিল্পমন্ত্রী ও বনবিভাগের রাষ্ট্রমন্ত্রী দয়া করে এই মিটিঙে উপস্থিত থাকবেন।

বীরেনবাবু চিঠিটা বার দুয়েক পড়ে ফতুয়ার পকেটে রেখে আবার তার কপি খেতে নেমে যান। শীতকালের শুরুতে বাড়ির পাশের ও পেছনের পড়ে থাকা বিরাট জমির মাত্র কিছু অংশেই পালং, ফুলকপি-বাঁধাকপি, মটর শাক করেন বীরেনবাবু। তার কয়েকটা গরু আছে–সেই রাখালটাই বাগানের দেখাশোনা করে থাকে। বীরেনবাবু সাত সকালে ঘুম থেকে উঠে চারাগুলোর ওপর কলাগাছের খোল কেটে বানানো ছোট-ছোট আড়ালগুলো দিয়ে দেন। আবার বিকেলের শেষ দিকে বীরেনবাবু সেই কলার খোলের আড়ালগুলো সরিয়ে চারাগুলোকে খুলে দেন। এদিকে এত শিশির আর হিম পড়ে যে এই একেবারে কচি চারাগুলো সারা রাত খোলা থাকলে সেই হিমে ভিজে ঝরঝরে হয়ে ওঠে। এই সকালে ও বিকেলে তার লোকটি গরুগুলোকে নিয়ে ব্যস্ত থাকে। তা ছাড়া মাত্র বছর তিনেক আগেও বীরেনবাবু নিজে হাতেই এই খেতটা করতেন। কিন্তু তিন বছর আগে বুকে শ্লেষ্ম জমায় আর ব্লাডপ্রেশার বাড়ায় তাকে জলপাইগুড়ি হাসপাতালে দিন দশেকের জন্যে ভর্তি হয়ে হয়েছিল। হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে বীরেনবাবু আর আগের মত কাজে ফিরে যেতে পারেন নি। বোধহয় চান না। তার কিছু খেতি জমি আছে, তাতে বাড়ির সারা বছরের খাবার হয়ে, সরকারের লেভি শোধ করেও কিছু বিক্রয়যোগ্য উদ্বৃত্ত ফসল থেকে যায়। চার মেয়েরই বিয়ে হয়ে গেছে। বড় ছেলে জলপাইগুড়ি কলেজ থেকে বিএ পাশ করে বাড়িতেই থাকে, জমিজমা দেখাশোনা করে, পুকুর কেটে মাছচাষের ব্যবসায় নেমেছে। সে ছেলের একটিই মেয়ে। ছোট ছেলে কলকাতায় ওকালতি পড়তে। এখন অবিশ্যি নর্থ বেঙ্গল ইউনিভার্সিটিতেও ল ফ্যাকাল্টি হয়েছে, জলপাইগুড়িতেও ল কলেজ আছে, সন্ধ্যায় ক্লাশ করে রাতে ময়নাগুড়িতে ফিরে আসে অনেকেই। কিন্তু বীরেনবাবু চেয়েছিলেন তার ছেলে ওকালতি যখন পড়ছেই তখন কলকাতাতেই পড়ক। সেই ছোট ছেলের জন্যেই এখনো সেরেস্তা আঁকড়ে আছেন বীরেনবাবু। নইলে হয়ত ওকালতি ছেড়ে দিয়ে বাড়িতে বসে থাকতেন। ওকালতি পেশার ওপর বীরেনবাবুর যা টান, তার চাইতে অনেক বেশি টান তার নিজের তৈরি এই সেরেস্তার ওপর। তিনি ময়নাগুড়িতে বসেই বরাবর প্র্যাকটিশ করে আসছেন জলপাইগুড়ি কোর্টে। আগে জলপাইগুড়িতে একটা ছোট বাড়ি ভাড়া করে থাকতেন। তিস্তা ব্রিজ হয়ে যাওয়ার পর সেই বাড়িটা ছেড়ে দেন। বীরেনবাবু ওকালতি পেশাটাকে ভালবাসেন। আইনের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম নানা বিচার-বিশ্লেষণে তার আগ্রহ আছে। বেশির ভাগ উকিলেরই তা থাকে না, থাকার দরকারও হয় না। এমন কি জজকোর্টেও মাত্র দু-চারজন উকিলই ঐ সব ল-পয়েন্ট-টয়েন্ট নিয়ে মাথায় ঘামায়। ওকালতির ভাষা জানলেই একজন উকিলের মোটামুটি চলে যায়। কিন্তু বীরেনবাবু শুধু জামিনের উকিল হতে চান নি, ফৌজদারি মামলা তিনি জীবিকার জন্যে করতেন–বেশিই করতেন, কিন্তু তিনি তার সেরেস্তা তৈরি করতে চেয়েছিলেন প্রধানত সিভিল কেসের ওপর। আর সেইখানেই তার সারাটা জীবন তিনি সবচেয়ে বেশি বাধা পেয়েছেন, যেন, রাজবংশী উকিল বলেই তার বুদ্ধিসুদ্ধি কিছু কম, মারদাঙ্গার মামলা যদিবা করতে পারেন, তাই বলে সম্পত্তির মামলায় তার ওপর ভরসা করার মক্কেল পাওয়া যেত না। রাজবংশী সমাজের লোকরাই তাকে মামলা দিতে চাইত না। তার কম বয়সে তিনি প্রথম একটা বড় মামলা পান বাকালির গোলাম মুস্তফার কাছ থেকে। গোলাম মুস্তফা মুসলমান রাজবংশী-বিরাট জোতদার, জলপাইগুড়ি শহরের নতুন পাড়ায় তার বাংলো বাড়ি বাকালি হাউস সকলে চেনে। জলপাইগুড়ি শহরের বড়বড় উকিলরা তার মামলা করেন। তিনিই একদিন তার বাকালির বাড়িতে বীরেনবাবুকে ডেকে পাঠিয়ে একটা মামলার দায়িত্ব নিতে বলেন, কারো জুনিয়ার হিশেবে নয়, পুরো দায়িত্ব, তবে বীরেনবাবু যদি মামলার দরকারে কোনো সিনিয়ারের সঙ্গে কথা বলতে চান বা সিনিয়ারকে দিয়ে ড্রাফট করাতে চান সেটা বীরেনবাবুর ব্যাপার। কিন্তু, মামলায় হারা চলিবে না, স্যালায় হাইকোর্ট করিবার নাগে করিবেন, কিন্তু জিতিবার নাগিবে। গোলাম মুস্তফা সাহেব হেসে বলছিলেন, চেককাটা লুঙি আর ধবধবে গেঞ্জিতে কাঠের হাতাওয়ালা ও হেলান দেয়া লম্বা বেঞ্চের কিনার থেকে পিক ফেলে বলেছিলেন, হো-হো করে হেসে পিক ফেলে বলেছিলেন, হারিবার চাহিলে ত হামার ভদ্দরমানষি ভাটিয়ার ঘর উকিল আছে–ননিলী ঘোষ, মকবুল হোসেন, খগেন। মহলানবিশ–কিন্তু এই মামলাটা মুই হামার রাজবংশী উকিল দিয়া জিতিবার চাহি–জিতন কেনে ভাই, জিতি আনেন।

মামলাটা এমন কিছু না–জেতারই মামলা। তখনকার আইনকানুনও ছিল অনেক সোজা। কিন্তু গোলাম মুস্তফা, কে, বীরেন বসুনিয়াকে উকিল রেখেছেন–এ থেকেই তার পশার বাড়তে শুরু করে। মুস্তফা সাহেবই বীরেনবাবুকে বলেছিলেন, হাময়ালার বাহের ঘর তোমাক মামলা দেয় না কেনে, কহেন ত? তারপর নিজেই উত্তর দিয়েছিলেন, এই আইনকানুন সম্পত্তি কোর্টকাছারি এইগুলা সব ভাটিয়ার ভদ্দরমানুষের তৈরি। তা সগায় ভাবে–এই সব মামলা মোকদ্দমা ভাটিয়ার ঘরই ভাল বুঝে, তোমার রাজবংশীয় ঘর কি আর অনং ইংরাজি কহিবার পারে হাকিম সাহেবের মুখত? মুস্তফা সাহেব পাকিস্তানে যান নি অনেক দিন, বোধহয় যাবেন নাই ঠিক করেছিলেন, কিন্তু সুতান্ন সালের একটা ছোট দাঙ্গার পর হঠাৎ সমস্ত সম্পত্তি বিনিময় করে চলে গেলেন। মুস্তফা সাহেবের দৌলতেই বীরেনবাবু তার সেরেস্তা তৈরি করতে পেরেছেন। তার ধারণা মুস্তফা সাহেব দাঙ্গার জন্যে ইন্ডিয়া ছেড়ে পাকিস্তানে যান নি। তিনি হঠাৎ বুঝতে পেরেছিলেন, ইন্ডিয়ার জোতদারি-জমিদারির দিন শেষ হয়ে যাচ্ছে। এ কথা কোনো-দিন কাউকে বলেন নি বীরেনবাবু। কিন্তু মনে-মনে এটাই তিনি এখনো বিশ্বাস করেন যে মুস্তফা সাহেব প্রথমত ছিলেন একজন জোতদার, দ্বিতীয়ত ছিলেন একজন রাজবংশী আর তৃতীয়ত ছিলেন একজন মুসলমান। নইলে সেই লিগ আমলে গোলাম মুস্তফার মত একজন মুসলমান ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের চেয়ারম্যান অন্তত হতে পারতেন কিন্তু লিগ না করেই মুস্তফা সাহেব চালিয়ে গেছেন। একবার বীরেনবাবুকে বলেছিলেন, তোমরালা বাহের ঘর ক্ষত্রিয় সমিতি বানাইছেন, ভাল, কিন্তু দেখেন ত কেনে তোমার মহাভারত মুসলমান ক্ষত্রিয় আছে কি নাই। না-থাকিলে হামরালা যাম কোটত-হামরালা বাহে মুসলমানের ঘর, যাম কোটত, কহেন!

বীরেনবাবুও কি গোপনে-গোপনে প্রথমত একজন রাজবংশীই? নইলে উত্তরখণ্ড দল যখন তাকে সম্পাদক করে এই সম্মিলনের ব্যবস্থা করল তিনি রাজি হয়ে গেলেন কেন? আবার, নাগরিক কমিটিরও তিনিই সম্পাদক- যারা এই সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করছে। নইলে তিনি এখনো তার সেরেস্তাটা ছোট ছেলের জন্যে রক্ষা করতে নিয়মিত কোর্টে যাতায়াত করছেন কেন, একথা জেনেও যে তার ছেলে ময়নাগুড়ি বা জলপাইগুড়িতে বসে প্র্যাকটিশ করবে না হয়ত, হয়ত কলকাতাতেই বসবে? বসুক, এটা যেন বীরেনবাবু চানও, না-জেনেই চান। আজকাল প্রায় কোনো মামলাই জজকোর্টে নিকেশ হয় না, সব মামলাই হাইকোর্ট পর্যন্ত চলে। তা যদি চলে, তা হলে, একজন রাজবংশী উকিল তার এই সেরেস্তার মামলা দিয়েই তার প্র্যাকটিশ শুরু করতে পারে–তার সেই ভাবী এ্যাডভোকেট ছেলের জন্যে বীরেনবাবু সেরেস্তা আগলাচ্ছেন।

বীরেনবাবু সবগুলো কপিচারার ওপর কলার খোলের ঢাকনি দেয়া শেষ করেন। কাজটা করতে তার একটু সময় লাগে। দাঁড়িয়ে কোমর বেঁকিয়ে সরাতে গেলে তাড়াতাড়ি হত, কিন্তু তাতে তার কোমরে ব্যথা হয়। সেজন্যে তিনি উটকো পায়ে-পায়ে এগিয়ে যান। এতেও ব্যথা হয়–হাঁটুতে। কিন্তু এক-একটা সারির শেষে উঠে দাঁড়িয়ে পাটা টানটান করে নিলে ব্যথাটা থাকে না। 

বীরেনবাবু তার জমির ছোট দুই টুকরোয় এখন তরকারি লাগান–বাকি প্রায় বিঘে দেড়েক জমি.ত পড়েই থাকে–গোয়াল, পোয়ালবাড়ি এ-সব সহ। আজকাল অবিশ্যি এদিকে একটা নতুন ব্যবসা চালু হচ্ছে। এরকম বড় জমির ওপর বাড়ি যাদের তাদের কাছে তরকারি চাষিরা এসে ঐ বছরের জন্যে জমিটা নিতে চায়। সমস্ত খরচ চাষির। তরকারি যা হবে তার একটা অংশ জমির মালিকের। কতটা জমির মালিকের আর কতটা চাষির তা এখনো স্থায়ী ভাবে স্থির হয় নি, কারণ এক-একজন এক-এক নিয়মে জমি, যদি দেয়, দিতে রাজি হয়। কেউ আধিভাগে দেয়–তা হলে অবিশ্যি ফলনের খরচাও বার আনি-চার আঁনি ভাগ হবে। বীরেনবাবুর কাছেও এই প্রস্তাব দিয়ে দু-তিন বছর হল লোক আসছে। কিন্তু তিনি রাজি হননি। তিনি রাজি হন নি ওকালতি বুদ্ধিতে–একই জমিতে পর-পর দু-তিন বছর একই লোক তরকারি ফলালে একটা সম্পর্কে গড়ে ওঠেই, তারপর তাকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করা যায় না। তাছাড়া তার অতটা দরকারও নেই। কিন্তু যাদের দরকার আছে–আগে সম্পন্ন পরিবার ছিল, এখন নানা কারণে পড়ে গেছে, অথচ বাড়িটা দু-বিঘে তিন-বিঘে জমির ওপর তাদের কাছে ত এটা উপার্জনের উপায়। বীরেনবাবু চোখের সামনেই জিনিশ দেখছেন। এক বছর দু-চারের মধ্যেই শহরের বাড়িঘরের এই সব জমির ওপর তরকারি চাষিদের একটা দখল অন্তত আশ্বিন থেকে মাঘের শেষ পর্যন্ত, কায়েম হয়ে যাচ্ছে। আর, দুই? এই তরকারি চাষিদের অনেককেই টাকার যোগান দিচ্ছে ডুয়ার্স ও জলপাইগুড়ি শিলিগুড়ির কাঁচা তরকারির বড়বড় আড়তদাররা। বীরেনবাবুর হিশেব, আর দু-এক বছরের মধ্যেই এখানে আলু চাষ হবে, আলু রাখা যায় বেশি দিন, কোল্ড স্ট্রোরেজও হবে। পুরনো বাড়ি ছাড়া কাদের আর দু-তিন বিঘে বাস্তু জমি থাকবে। সে-সব বাড়ির প্রায় চোদ্দ-পনের আনাই ত রাজবংশী বাড়ি। ময়নাগুড়ির মত শহরে যদি এই বাস্তুজমিতে তরকারি চাষের দাদন চলতে থাকে তা হলে দশ বছরের মধ্যে বাস্তুজমির ঐ অংশ বেচে দিতে হবে। আগে, জলপাইগুড়ি শহরে যত রাজবংশী পরিবার থাকত, এখন আর তা থাকে না। ময়নাগুড়িতেও বাস্তুজমির রাজবংশী মালিকানার অনুপাত কমে যাবে, দ্রুত। জলপাইগুড়ি শহরে রাজবংশী বাড়ি কমে যাওয়ার একটা বড় কারণ তিস্তা ব্রিজ, বাস-মিনি-ট্যাক্সির এরকম বাড়। আগে, জলপাইগুড়ি শহরে যেতে হলে তিস্তায় খেয়াপার হয়ে, হেঁটে, সঁতরে, ট্যাক্সিতে চেপে যেতে হত। অথচ স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল, অফিস, কাছারি সবই জলপাইগুড়িতে। তখন স্কুল বলতে ত যজ্ঞেশ্বর রায়ের রাঙ্গালিবাজনার স্কুল, দোমহানির রেল স্কুল আর ময়নাগুড়ির। আর, এখন কলেজইত একটা ফালাকাটায়, একটা ধূপগুড়িতে। স্কুলের ত কথাই নেই। কমার্স কলেজ আর ল কলেজের ছেলেরা রাত আটটায় শহরে ক্লাস শেষ করে ডুয়ার্সে ফিরে যেতে পারে। তারপর যারা ঐ মোটর সাইকেল কিনছে তাদের ত কথাই নেই। জলপাইগুড়িতে ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার জন্যে একটা বাড়ি রাখা ত খরচের ব্যাপার। সে-খরচ কেউ করবে কেন আর? বীরেনবাবুরই ত আগে শহরে একটা বাড়ি ছিল, এখন নেই। সুতরাং জলপাইগুড়ি শহরে রাজবংশী পরিবারের আনুপাতিক সংখ্যাহ্রাসের কারণটা বোঝা যায়।

কিন্তু সেসব কোনো কারণই ত ময়নাগুড়িতে নেই। এরকম একটা জংশন-গঞ্জের মত জায়গা ময়নাগুড়ি, যেখান থেকে শিলিগুড়ি হয়ে পাহাড়-বিহার, ধুবড়ি হয়ে আসাম পর্যন্ত ঘণ্টাকয়েকের মধ্যে মালপত্র পাঠানো যায়, সেখানে পুরনো রাজবংশী পরিবাররা দু-বিঘে চার-বিঘে জমির বেশির ভাগটাই ফেলে রেখে দুটো-একটা ছোট টিনের ঘরে মাত্র বসবাস করবে, তা তরিতরকারির আড়তদাররা চলতে দেবে কেন? শুধু নগদ টাকার স্বাদ দিয়েই ত এ জমিগুলো তারা হাতিয়ে নেবে। এখনো নেয় নি বটে, কিন্তু জলপাইগুড়ির জজ কোর্টে গত পঁয়ত্রিশ বছর প্র্যাকটিশের অভিজ্ঞতা থেকে বীরেনবাবু বুঝতে পারছেন ময়নাগুড়ি, ধূপগুড়ি, ফালাকাটার মত জায়গায় ভূসম্পত্তির মালিকানার এই বদল আসন্ন, সাত-আট মাসের পোয়াতির মত আসন্ন। ডুয়ার্সে রাজবংশীরা সংখ্যালঘু হয়ে যাবে–সম্পত্তির মালিকানাতেও। আইনের পথে একে ঠেকানোর আর-কোনো উপায় নেই– একমাত্র উপায় সমস্ত রাজবংশীকে এক করে আসামের মত কোনো আন্দোলন। তা হলে গোলমালের ভয়ে ভূসম্পত্তি এখনই কেউ কিনতে চাইবে না হয়ত। কিন্তু তাতেও ত স্থায়ী সমাধান হবে না। স্থায়ী সমাধানের জন্যে আসামের মত বিদেশী খেদাও আন্দোলন হয়ত করা যাবে না, কিন্তু, অন্তত এটাও আদায় করা যায় যে রাজবংশীদের কাছ থেকে কোনো সম্পত্তি অরাজবংশী কেউ কিনতে পারবে না। অর্থাৎ আদিবাসী-উপজাতি অঞ্চলের এই নিয়ম জলপাইগুড়ি ও ডুয়ার্সেও প্রয়োগ করতে হবে। তার মানেই রাজবংশী-অঞ্চলের জন্যে কিছু স্বতন্ত্রতা দাবি করা। তার নাম হয়ত আপাতত দেয়া হয়েছে উত্তরখণ্ড। সে নাম পরে বদলাতেও পারে। কিন্তু রাজবংশী বা উত্তরবঙ্গের আদিবাসীদের স্বার্থরক্ষার জন্যে আর-কোন্ বিকল্প রাস্তা আছে? না হলে এটা মেনে নিতে হয়–সারা দেশে যা হচ্ছে এখানেও তাই হোক; সেখানে রাজবংশীর কথা আলাদা ভাবে তোলা কেন? তরকারি খেতের কাজ বীরেনবাবুর হয়ে গিয়েছিল। তিনি সেখান থেকেই কুয়োপাড়ে গেলেন–জল তোলাই ছিল, একটা ঘটিতে তুলে খানিকটা মুখে দিলেন, খানিকটা পায়ে। বারটা সিঁড়ি ভেঙে তাকে বারান্দায় উঠতে হয়। আগেকার দিনের বাড়িগুলো এরকম দেড়তলার মত উঁচু হত। বীরেনবাবুও গল্প শুনেছেন–বাঘের ভয়েই নাকি উঁচু করা। কাঠের বাড়ি, রাতে মইটা তোলা থাকত। কিন্তু তার আমলেই ত কাঠের বাড়ি বদলে ইটের হল, কই তিনি ত উচ্চতা কমান নি। এক-এক ধরনের বাড়িতে থাকা অভ্যেস হয়ে যায়। বীরেনবাবুদের অভ্যাস এরকম উঁচু বাড়িতে থাকা।

বারান্দায় টাঙানো তারে গামছা ছিল, তাতে মুখ আর পা মুছে, বীরেনবাবু ঘরে ঢোকেন। বাগানের কাজ করার সময় ধুতিটা একটু তুলে নিয়েছিলেন, এখন ঘরে এসে নামালেন। তারপর ফতুয়ার ওপর গরম কাপড়ের পাঞ্জাবি ও তুষটা নিয়ে, পাম্প শুটা পরে বেরিয়ে এসে একটু উঁচু গলায় স্ত্রীকে বললেন, আমি উত্তরখণ্ডে যাচ্ছি। সম্মিলন আর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের জায়গাটা এখন এই নামেই চলছে।

হঠাৎ সরকারের চিঠিটা পেয়ে তার ওকালতি জীবনের স্মৃতি, তার ছোট ছেলের কলকাতা হাইকোর্টে প্র্যাকটিশের স্বপ্ন, আর জলপাইগুড়ির ডুয়ার্সে রাজবংশীদের সম্পত্তিহ্রাস যে বীরেনবাবুর ধারাবাহিক মনে পড়ে গেল, তা নয়। তিনি উত্তরখণ্ড ও শ্রীদেবীর অনুষ্ঠানের কর্মকর্তা হলেন কী করে–ঐ স্মৃতিসহ প্রত্যাশা তারই যেন কারণপঞ্জি। বীরেনবাবুর মনে ঐ সব কথা একসঙ্গে এখন এই বৃত্তান্তের প্রয়োজনের সুযোগমত এসে যায় নি। বীরেনবাবুর নিজের কাহিনী, রাজবংশী হয়েও উকিল হিশেবে প্রতিষ্ঠার কাহিনীই ত একটা আলাদা বৃত্তান্তের লোভনীয় বিষয় হতে পারে। তার মত লোক কেন উত্তরখণ্ডের মত আন্দোলনে ঢুকে পড়েন সে-সবের আভাস দেয়ার জন্যেও বীরেনবাবু সম্পর্কিত এই সব কথা ওঠে নি। কিন্তু বীরেনবাবুর মত একজন উকিল মানুষ, ও বয়স্ক লোক, যিনি সারাটা কর্মজীবন কাটিয়েছেন জেলা। শহরের কেন্দ্রে, জেলার রাজনীতি ও প্রশাসনের মাঝখানটিতে, তার কাছে, দারোগার এই চিঠিটা কী করে ও কেন লেখা হল সেটার জলের মত পরিষ্কার হয়ে যায় চিঠি পাওয়ার সঙ্গে-সঙ্গেই। ওরা চাইছে সম্মিলন ও অনুষ্ঠানের মধ্যে একটা ভাগাভাগি ঘটিয়ে সম্মিলনটাকে বন্ধ করাতে ও অনুষ্ঠানটা করাতে। বামফ্রন্টের সরকার ও সরকারের পার্টিগুলির কাছে বম্বের কোন সিনেমাওয়ালি শ্রীদেবীর নাচ অনেক নিরাপদ। কিন্তু রাজবংশীরা আলাদা ভাবে বসে কিছু কথাবার্তা বলাটা অনেক বেশি বিপজ্জনক–উগ্রপন্থী, বিচ্ছিন্নতাবাদী। তিনি অত্যন্ত কম কথা বলেন বলেই অমন চিঠি পেয়েও সেটা ফতুয়ার পকেটে ভরে ফুলকপির চারা থেকে কলার খোল খুলে দেয়ার কাজটা অব্যাহত রেখে, চিঠিটাকে উপেক্ষা ও অপমান করে, নিজের ও নিজেদের বহু বহু প্রাচীন উপেক্ষা ও অপমানের শোধ নেন। তার জীবনের এই খবরগুলি সেই সব উপেক্ষা অপমানেরই প্রাসঙ্গিক।

.

১৬০. উত্তরখণ্ডের ফাংশনের আলোচনা-এক

বীরেনবাবুর বাড়ি থেকে সম্মিলন ও অনুষ্ঠানের জায়গায় যেতে বেশ কিছুটা হাঁটতে হয়। তিনি হেঁটেই, যান, রিক্সা নেন না। কিন্তু হাঁটার পক্ষে এই রাস্তাটা আর ভাল নেই। সব সময় ট্রাক, বাস আর মিনি যাচ্ছে। রাস্তাটাও ছোট, দোকানপাট বসায় সেটা আরো ছোট হয়ে গেছে। একটু যে পাশ দিয়ে যাবেন, তেমন পাশও নেই। প্যান্ডেল তৈরি হচ্ছে ব্লক অফিসের পাশে। এখন পুরোদমে কাজ হচ্ছে-সকলকে সেখানেই পাওয়া যাবে। তবু যাওয়ার সময় চৌপত্তিতে মরণচাঁদের দোকানটাতে একবার উঁকি দিলেন–অনেক সময় ওরা সন্ধ্যায় এখানে বসে। কিন্তু এখন কেউ নেই।

প্যান্ডেলে নকুলকে পেয়ে গেলেন। পেয়ে যাবেন–সেটা আশাই করেছিলেন। নকুলকে খবর দিলে ঐ ছোটাছুটি করে সবাইকে জড়ো করবে।

পাঞ্জাবির নীচে ফতুয়া, ফতুয়ার ভেতরে-পকেট। সেই পকেটের ভেতর থেকে চিঠি বের করতে বীরেনবাবুকে কিছুটা সময় নিতে হয়। তবে বীরেনবাবুকে সব কাজেই কিছুটা সময় দেয়াটা সকলের অভ্যেস হয়ে গেছে।

বীরেনবাবুকে দেখে, আসেন, কাকা বলে নকুল সিগারেটটা ফেলে পায়ের তলায় দলে দেয় আর গিরিজা একটা ভাঁজ করা চেয়ার এগিয়ে দেয়। চিঠিটা বের করে নকুলের দিকে এগিয়ে দিতে-দিতে বীরেনবাবু বসেন। নকুল চিঠিটা না-নিয়ে জিজ্ঞাসা করে–কাকা কি আমাকে এই বয়সে আবার ক্লাশ পালানো শেখাবেন? সেই যে ক্লাশ এইটে জানলা দিয়ে পালিয়েছি আর দরজা দিয়ে কখনো মা সরস্বতীর সামনে দাঁড়াই নি। টেন্ডার নোটিশ পড়তে পারি না আর আপনি আমাকে চিঠি দেখাচ্ছেন? মা সরস্বতী লজ্জা পাবেন বলে সরস্বতী পুজোর দিন না খেয়ে থাকি কিন্তু অঞ্জলি দেই না।

বীরেনবাবু চিঠিটাসহ হাতটা কোলের ওপর রেখে নকুলের পেটের দিকে তাকিয়ে বলেন, জলপাইগুড়ির সার্কিট হাউসে মিটিং, নর্থ বেঙ্গলের মন্ত্রীরা থাকবে, তোমাদের তেরজনকে থাকতে হবে আর উত্তরখণ্ডের লোকদের সঙ্গে নিতে হবে।

মানে? কবে? নকুল যেন আকাশ থেকে পড়ে, সে হাঙ্গামা, সেদিন থানার মিটিঙে মেটে নি? তারপর ত ওরা আর-কিছু জানায় নি, কাকা? এখন ত চারদিনের মাথায় ফাংশন-এখন মিটিং? মন্ত্রীরা আসবে? নকুল থেমে যায়, দুপা হাটে, ফিরে আসে, তারপর জিজ্ঞাসা করে, কবে?

পরশুদিন। বীরেনবাবু জবাব দিয়েও আবার খাম থেকে কাগজটা খুলে মিলিয়ে নিয়ে কাগজটা ভাজ করে খামে ভরে রাখেন।

পরশু? মানে, বুধবার? আর শনিবার উদ্বোধন? এ সবের মানে কী? কী, চায় কী?

বীরেনবাবু হাত তোলেন-নকুলকে থামানোর ভঙ্গিতে। নকুল থেমে গেলে আবার তার পেটের দিকে তাকিয়ে বীরেনবাবু বলতে থাকেন, উত্তেজিত হয়ো না। সরকারের উদ্দেশ্যে পরিষ্কার-উত্তরখণ্ড সম্মিলনটা হতে দেবে না। তাও প্রথম দিকে ওসব হতে দিতে আপত্তি নেই। সরকার শেষ দিনের জল্পেশ্বর অভিযান ও তিস্তা বুড়ি পূজাটাকে ঠেকাতে চায়। সুতরাং উদ্বোধন-টুদ্বোধন নিয়ে ভেবো না। তোমরা, কাঠের মিস্ত্রির হাতুড়ি ঠোকার আওয়াজে বীরেনবাবু থেমে যান। নকুল সেদিকে তাকিয়ে চিৎকার করে ওঠে, এই থামাও ত তোমাদের হাতুড়ি। হাতুড়ির আওয়াজ থামলে বীরেনবাবু বলেন, আগে ফাংশনের ও কনফারেন্সের যারা রিয়্যাল লিডার তারা বসো, পারলে আজ রাতেই, আবার ওখানেও বসতে পারো। অন্তত, যে-কজন অ্যাভেইলেবল। তারপর তোমাদের তের জনের ও উত্তরখণ্ডের এক্সিকিউটিভ কমিটির একটা জয়েন্ট মিটিং করতে হবে-কাল বিকেলেই। সেখানে ফর্মাল প্রস্তাব নিতে হবেনা-হলে যারা ঐ মিটিঙে যাবে তারা বলবেটা কী?

নকুল হঠাৎ হাত জোড় করে উটকো হয়ে বসে পড়ে, কাকা, আমাকে ছেড়ে দেন। এই মিটিং-মুটিং প্রস্তাব-ট্রস্তাব শুনলে আমার মাথা ঘোরে। আমি চললাম। যা টাকা এর মধ্যে দিয়েছি তা ফেরৎ চাই না–ও আমি একটা টেন্ডার পেলে সরকারের কাছ থেকে দশগুণ উশুল করে নেব। কিন্তু এ আমি পারব না কাকা। এলাম, একটু ফুর্তি করতে, আর এ ত শালা ফেঁসে যাচ্ছি মিটিঙে।

বীরেনবাবু চুপ করে থাকলেন। প্যান্ডেলের অন্যান্য জায়গায় আরো দু-চারজন যারা ছিল, তারা, হাতুড়ির আওয়াজ থামার পরে নকুলের চেঁচামেচি শুনে এগিয়ে আসে। নবীন দূর থেকেই বলে, কী। হইল? নকুলদা নিজেই যাত্রা ধরিলেন নাকি?

এবার নকুল দাঁড়িয়ে তাদের দিকে ফিরে বলে, এই ত ভাই, তোমরা আছ–উত্তরখণ্ড-শ্রীদেবী যা-ইচ্ছে বুঝে নাও, আমাকে ছাড়ো ভাই, আমার সাধ মিটে গেছে।

ততক্ষণে ওরা এদের কাছে পৌঁছে গেছে। কী হল আর জিজ্ঞাসার দরকার হয় না। কিন্তু বীরেনবাবু কোনো কথা না বলায় নকুলকেই বলতে হয়–পরশুদিন জলপাইগুড়ির সার্কিট হাউসে মন্ত্রীরা মিটিং ডেকেছে, উত্তরখণ্ড আর এই ফাংশন নিয়ে কথা বলতে হবে। সবাইকে যেতে হবে।

নবীনের পাশে ছিল তিলক। সে জিজ্ঞাসা করে, কী কথা হবে?

কী আর কথা হবে। গবমেন্ট চায় না উত্তরখণ্ড হোক, কিন্তু চায় শ্রীদেবী হোক।

বীরেনবাবু মুখটা তোলেন কিছু বলতে কিন্তু তার আগেই তিলক বলে ওঠে, সে ত ভালই। কাইল কাগজে একখান বিজ্ঞাপন ছাড়েন যে সরকারের নির্দেশে শ্রীদেবীর অনুষ্ঠান বাতিল করা হইল। আমাদের কোনো কারণ জানানো হয় নাই। যাহারা কারণ জানিতে চান তাহারা মন্ত্রীদের কাছে যান–তা হলেই লোকে মন্ত্রীদের শ্রীদেবীর নাচ নাচাইয়ে ছাড়বে–একেবারে মিস্টার ইন্ডিয়া। তাতে সামান্য যে সমবেত হাসি ওঠে তাতেও তিলকের কথার নিহিত রাগ চাপা পড়ে না। কিন্তু তিলকের কথা শোনামাত্র বীরেনবাবু তিলকের মুখের দিকে তাকাল। যেন, তিনি যাচাই করতে বলে এরকম একটা বিকল্প দেয়ার বাস্ততটা কতটা?

তাতে বীরেনবাবু হাত তোলেন, সকলে একটু কাছে আসে। বীরেনবাবু সোজা তাকিয়ে তার নিম্নস্বরে বলতে থাকেন, শোনো, পরশুদিন সকালে মিটিং, মন্ত্রীরা থাকবেন, মিটিঙে তারা নিশ্চয়ই নির্দিষ্ট প্রস্তাব দেবেন, তোমাদের সেই প্রস্তাবের জবাবে নির্দিষ্ট কথা বলতে হবে, হ্যাঁ কি না, বা নির্দিষ্ট প্রস্তাব দিতে হবে। সেটা তোমাদের নিজেদের মিটিং করে লিখিত প্রস্তাব নিতে হবে যে এই প্যান্ডেলে উত্তরখণ্ড সম্মিলন করতে দিতে সরকার যদি আপত্তি করে তা হলে শ্রীদেবীর অনুষ্ঠান, মানে কালচারাল ফাংশন, হবে কি হবে না। এক-একজন এক-এক মত দিলে হবে না। ঐ মিটিঙেও এক-একজন এক-এক রকম কথা বললে হবে না। এখন একটা লিস্ট করে যাদের-যাদের পার, খবর দিয়ে দাও।

নকুল নবীনকে বলে, এই, লিস্ট বানাও, নবীন।

 নবীন বীরেনবারুকে বলে, কাকা, আমরা যদি মিটিঙত না যাই কী হয়?

বীরেনবাবু মুখ তুলে নবীনকে দেখেন–যেন, তিনি যাচাই করতে চান এরকম একটা বিকল্পের বাস্তবতা কতটা?

নবীন বলে যায়, কী করিবে? পুলিশ আসি উত্তরখণ্ডক বাধা দিবে আর শ্রীদেবীকে ছাড়ি দিবে–তা কেমন করি করিবে? আর যদি গ্রেপ্তার করে, ত করুক। আমরা গ্রেপ্তার হন।

বীরেনবাবু হঠাৎ উঠে দাঁড়ান, তোমরা তা হলে লিস্ট বানিয়ে খবর দাও। আর এদেরও মিটিঙে আসতে বলল, কথাটা নকুলকেই বললেন তিনি, তোমরা রাত্রিতে আমার বাড়িতে এসো, কী হল শুনব। নকুল পাশে-পাশে হাঁটে, অন্যরা পেছনে-পেছনে। বীরেনবাবু হঠাৎ দাঁড়িয়ে নকুলকে বলেন, তোমাদের তের জন পার্টনারের মধ্যে কারো এটা বলা ঠিক হবে না কিন্তু নকুল, যে, উত্তরখণ্ড শেষ দিনের জল্পেশ্বর অভিযান আলাদা জায়গায় নিয়ে যাক।

নকুল একটু চুপ করে থাকে, যেন সে বীরেনবাবুকে আভাসে জানাতে চায় সেরকম কেউ-কেউ ভাবতেও পারে। কিন্তু নীরবতাটা ভেঙে সে বলে, সে আগে হলে না হয় ভাবা যেত, থানার মিটিঙো হলে কথা ছিল। কিন্তু এখন হলে ত মনে হবে সরকার জোর করে উত্তরখণ্ডকে শাস্তি দিচ্ছে আর আমরা, তার সুযোগ করে দিলাম। সবাই সব জায়গায় একসঙ্গে কাজ করছে কে উত্তরখণ্ড আর কে শ্রীদেবী তা কে ঠিক করবে? আর তা হয় কী করে কাকা, এখন আর তা হয় না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *