৪.৩ কাদাখোয়ার নিদ্রাভঙ্গ

১৪১. কাদাখোয়ার নিদ্রাভঙ্গ

অফিসারের জিপগাড়ি নরেশ-অমূল্যকে নিয়ে চলে যাওয়ার পর অশ্বিনী রায় কাদাখোয়াকে গিয়ে ডাকে–হে বাউ। কাদাখোয়া অশ্বিনী রায়ের গরুগুলো যে-খুঁটিতে বাধা, তার নীচে বাঁধের পশ্চিম ঢালুতে শুয়েছিল। সেদিকে বোল্ডারের মধ্যে একটা সমতল জায়গা সে খুঁজে বের করেছিল। তারা সারা শরীরে শুধু একটা নেংটি পরনে, আর একটা গামছা, মাথার ওর ঢাকনির মত দেয়া। বাঁধের জন্যে হাওয়াটা এখানে অত জোরে বইছে না বলে কাদাখোয়র উপুড় করা মাথার ওপর থেকে ওটা উড়ে যায় নি। কাদাখোয়া অবিশ্যি গামছাটা দিয়ে গলা পর্যন্ত মাথাটা এমন করে জড়িয়ে রেখেছে যে গামছাটা উড়ে যাওয়া সম্ভবও ছিল না। তার সারাটা শরীর এমন উলঙ্গ যে মাঝখানের নেংটিটুকুও চামড়ার সঙ্গে মিশে থাকে। মানুষের যেখানে কাপড়ের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন, সেখানে কাদাখোয়ার কোনো কাপড়ের রকার নেই। আর, যেখানে মানুষের কাপড়ের কোনো দরকার নেই, সেই মাথাটাকেই কাদাখোয়া গামছা দিয়ে ঢেকে প্রায় বেঁধে রেখেছে এমন করে যে চট করে দেখলে তাকে মানুষ মনে নাও হতে পারে। বন্যার সময় বাঁধের ওপর ওরকম কাঠ, গাছ কত পড়ে থাকে। 

অশ্বিনী রায়ের গলার স্বর নিচুতে। বাঁধের ওপর থেকে তার ডাক কাদাখোয়া শুনতেই পায় না। অশ্বিনী রায় তখন বসে বসে বাঁধের একটা বোল্ডার থেকে আর-একটা বোল্ডারে পা দিয়ে দিয়ে নামে আর ডাকে, হে বাউ, বাউগে-এ। কাদাখোয়া তাও শোনে না। ততক্ষণে অশ্বিনী কাদাখোয়র কাছে পৌঁছে গেছে। গিয়ে বোঝে কাদাখোয়া ঘুমুচ্ছে। গামছায় মোড়া তার মুখের ভেতর থেকে আওয়াজ বেরচ্ছে। অশ্বিনী আরো একটু এগিয়ে কাদাখোয়ার মাথাটা ধরেই মৃদু ঝাঁকায়–হে বা, বাউ গে–ডাকতে-ডাকতে।

বাঁধের ওপর থেকে জগদীশ বারুই চেঁচায়–বোল্ডার দিয়্যা মারো মাথায়, ঐডা ত মরার নাখান ঘুমায়, ধাক্কা দ্যাও, ধাক্কা। 

অশ্বিনী রায়ের মুখোচোখে সব সময়ই একটু অসহায়তার ভাব। সে জগদীশের দিকে তাকায়–যেন জগদীশের কথা না শুনলে জগদীশ রাগ করবে। তারপর আর-একটু এগিয়ে দুই হাতে কাদাখোয়ার পাথরের মত চওড়া পিঠটা ধরে নাড়ায় হে বাউ, বাউ গে-এ। 

কাদাখোয়ার অত বড় পিঠ অশ্বিনী রায় তার ঐটুকুটুকু হাতে নাড়াতে পারে না। কিন্তু কাদাখোয়া যে জেগে উঠেছে তা বোঝা যায় তার হাতদুটো গুটিয়ে আনায়। এতে অশ্বিনী রায় গলা আর-একটু তুলে ডাকে–হে বাউ, বাউ গে-এ।

এবার কাদাখোয়া তার গোটা শরীরটাকে চিৎ করে। এক জায়গাতেই নয়–সে গড়িয়ে চিৎ হয়। ফলে বোল্ডারের ওপর যে-ছোট-ছোট গাছগাছালি ছিল সেগুলো তার বুকের ওপর লেগে থাকে, লেগে থাকে কুচিকুচি পাথরও। এখন, তার মাথাটা বোল্ডার থেকে সরে গিয়ে একটা ফাঁকের মধ্যে পড়ে পেছনে হেলে যায়-গলাটা টান-টান হয়ে থাকে। পা দুটো ফাঁকই থাকে। দেখে, কোনো জীবন্ত মানুষ মনে হয় না।

বাঁধের ওপর তখন একটা লাইনই হয়ে গেছে। রঘু ঘোষ চেঁচায়–আরে মাথায় জল ঢালেন, জল ঢালেন। 

রঘু ঘোষের ভাগ্নী গোপা জিজ্ঞাসা করে–কী? নেশা করেছে নাকি? 

রঘু ঘোষের বউ লিলি বলে–কোথায় টিভির নৌকা দেখব, তা না ঐ মিঠুন চক্রবর্তীকে দেখতে হচ্ছে। বলেই খিলখিল হেসে উঠতেই রঘু ঘোষও হেসে ফেলে বলে, মিঠুন চক্রবর্তী ও রকম নেংটি পরে নাকি? 

এমন টাইট প্যান্ট পরে যে নেংটির মতই, বলে লিলি আর-এক দফা হাসে।

তোমার কাদাখোয়র জাগরণ ত কুম্ভকর্ণের নিদ্রাভঙ্গ। খোয়া দ্যাও, খোয়া দ্যাও, নয় ত জাইগবে না, জগদীশ ওপর থেকে বলে। 

আরো একবার তাকে ডাকার জন্যে অশ্বিনী হাত বাড়াতেই কাদাখোয়া দু হাত মুখের কাছে টেনে আনে। অশ্বিনী হাত সরিয়ে ডাকে, এই কাদাখোয়া, ঝট করি উঠ কেনে, ঝট করি উঠ, নৌকা ভাসিবার নাগিবে। 

কাদাখোয়া উঠে বসে। সে যেভাবে গামছাটা মাথায় জড়িয়েছিল সেটা তার চিৎ হওয়ায় পাক খেয়ে গেছে। সে খুলতে পারে না। গামছায় জড়ানো মুখটা নিয়েই উঠে বসে। বসেও দু হাতে গামছার কোণটা পায় না। তখন গামছায় জড়ানো মুখটা নিয়েই উঠে দাঁড়ায় আর হাত দিয়ে গামছার কোনা খোঁজে। না পেয়ে, সে বাঁধের ওপরে উঠবার জন্যে গামছায় জড়ানো মুখ নিয়েই পা ফেলে। শেষে, গামছার কোনা না-পেয়ে গলার কাছ থেকে গামছাটা টেনে ওপরে তোলে। গামছার ভেতর থেকে তার ঠোঁটটা বেরয় কিন্তু গামছাটা নাকে আটকে যায়। অবশেষে বাঁধের ওপর উঠে একটা টান দিতেই গামছাটা খুলে যায়। গামছাটা হাতে নিয়ে সে মুখটা মোছে। তারপর অশ্বিনী রায়কে খোঁজে।

অশ্বিনী রায় তখনো বাঁধের ওপর উঠতে পারে নি। কিন্তু কাদাখোয়া গামছা খুলে ফেলতে পেরেছে দেখে চিৎকার করে বলে, হাটের বগলত চলি যা, নরেশুয়া আছে, নৌকা ভাসিবার লাগিবে।

কাদাখোয়া গামছাটা দিয়ে মুখটা আর-একবার ডলতে-ডলতে বাঁধের ঐ ভিড়ের মধ্যে দিয়ে বাঁধের পুব দিকের ঢালের বোল্ডারের ওপর লম্বা লম্বা পা ফেলে কোনাকুনি জলের দিকে নেমে যায়, তারপর জলনিকাশী নালীটা এক লাফে ডিঙিয়ে জালঘেরা বোল্ডারের ওপর পড়ে বাক নিয়ে অদৃশ্য হয়ে যায়। 

কাদাখোয়া এই এত ভিড় দেখে না, এই এত হাওয়াবৃষ্টি দেখে না, নদীর এই এত জল দেখে না। সে যেন ঘুমতে-ঘুমতেই হেঁটে চলে গেল এমনই তার ভঙ্গি। বাঁধের ওপর থেকে নীচে লাফিয়ে লাফিয়ে নামার ফলে তার গা থেকে পাথরের কুচি ঝরে যায় কিছু-কিছু, সব নয়। 

রংধামালি হাটের কোথায় নৌকাটা থাকে সেটা সবাইই জানে। নৌকোর একটা মালিকও আছে বটে কিন্তু সাধারণ সময়ে নৌকোটা চরের লোকজন তরি-তরকারির বোঝা হাটে নিয়ে আসার জন্যেই ব্যবহার করে। ঠিক খেয়া না হলেও হাটের দিন খেয়ার মতই নৌকোটা ব্যবহার করা হয়। চরের যারা নৌকোটা ব্যবহার করে তারা হাটের দিন মালিককে কিছু পয়সা ধরে দেয়। নৌকোর মালিকের একটা ছোট মনোহারী দোকান আছে। নৌকোর দেখাশোনা, ছোটখাট মেরামত চরের লোকেরাই করে নেয়। কাদাখোয়া ঘুমের মধ্যেই নৌকা শুনে জেগে উঠে কোথায় যেতে হবে তা বুঝে যায়। 

তেমনি বুঝে যায় বাঁধের লোকজনও। চরের মানুষরা ত বটেই, হাট ও বাগানের মানুষও। তারা জানে নৌকোটা কোথায় বাধা আছে–এখান থেকে উত্তরে বাধটা যেখানে বাঁয়ে ঘুরেছে সেই কোণটাতে। অফিসার গাড়ি নিয়ে নরেশ-অমূল্যকে ঐ বাকটায় নামিয়ে দেবে আর কাদাখোয়া এদিক দিয়ে ঐ বাকটাতে গিয়ে পৌঁছুবে।

কিন্তু নৌকোটা ছাড়তে একটু প্রস্তুতির সময় লাগবে–এটাও বধের লোকজন জানে। এমনিতেই ভাঙাচোরা নৌকো-ঐটুকু জল পার হতেই নড়বড় করে। তার ওপর বৈঠা হিশেবে একটা বাঁশের সঙ্গে পেরেক সাঁটা একটা চওড়া কাঠ, থাকতে পারে, নাও পারে। এই ফ্লাডের জলে নৌকো ভাসানোর আগে, হাতুড়ি পাওয়া না যাক, অন্তত পাথর দিয়ে দুটো-একটা জায়গা ঠুকে নিতে হবে। আর, যেকজন যাবে, তিনজন ত হল, তাদের প্রত্যেকের হাতেই লম্বা লগি চাই, লগি ছাড়া এই জলের স্রোতে নৌকো সামলানো যাবে না। ভাল নৌকোই সামলানো যায় না, আর এ নৌকোর কথা কে বলবে? 

বাঁধের লোজন নদীর দিকে এসে দাঁড়িয়ে ছিল। উল্টোদিকে অফিসারের জিপ থামার আওয়াজ পাওয়া যায়। তখন আবার কেউ-কেউ উল্টো দিকে যায়। ততক্ষণে অফিসারই উঠে এসেছে। 

.

১৪২. অপারেশন বাঘারু

বাঁধের ওপর উঠে এসে সোজা নদীর দিকে মুখ করে কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে অফিসার বলে, এখুনি ছেড়ে দেবে। তারপর বাঁ দিকে তাকায়–নৌকোটা যেদিক দিয়ে আসবে। তার দেখাদেখি অন্যরাও বা দিকে তাকায়। 

এখন নৌকোটার আসাই প্রধান ব্যাপার। তাই বাঁধের ভিড়টা কিছুটা উত্তর দিকেও ছড়িয়ে পড়ে–সেখানে যে-দুটো-চারটে গরু বাধা ছিল সেগুলোকেও ছাড়িয়ে। আর, জিনিশপত্র পাজা করে যেখানে চরের লোকজন সংসার পেতেছে–মেয়েরা সেখানেই দাঁড়িয়ে গেছে। 

অফিসার একটু ডাইনোয়ে তাকিয়ে বলে, নৌকোর যে কনডিশন দেখলাম, যেতে পারবে ত? 

অফিসার বোধ হয় কোনো একটা উত্তর প্রত্যাশা করেছিল। কিন্তু উত্তর না পেয়ে সে আবারও ডাইনে বায়ে তাকায়। আবার, বা দিকে নৌকোর প্রবেশপথের দিকে এক ঝলক তাকিয়ে নিয়ে অফিসার একটু ঘুরে কাউকে খোঁজে। তারপর নদীর দিকে পেছন ফিরেই ঘোরে, আরে, সেপাই দুটো গেল কোথায়? অফিসার যখন সেপাই দুটোর খোঁজে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে তখনই বাঁধের মানুষজনের মধ্যে চাপা আওয়াজটা বাতাসের বিপরীতে খেলে যায়–আইসছে, আইসছে। প্রথম দেখতে পেয়েছিল–যারা বাঁধের উত্তরদিকটাতে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল। তার পরে যারা ছিল তারা দেখবার জন্যে হুড়মুড় করে এগিয়ে যেতে-যেতে বাঁধের ঢাল বেয়ে নীচে নেমে যেতে থাকে ততক্ষণে নৌকোটা একটা টুকরো কাঠের মত স্রোতের মুখে এই বাঁধের লোকজনের মুখোমুখি এসে পড়েছে। বাঁধের বাকি অংশ থেকেও সবাই হুড়মুড় করে নীচে জলের একেবারে কিনারায় নেমে যায় বাঁধের ওপর থাকে অফিসার, রঘু ঘোষ, লিলি, গোপা, অফিসবাবুর বড় শালী, গুদামবাবু, হাটের কেউ-কেউ। বানভাসিদের দিকেও দু-একজন বয়স্কা আর নীচে নামেনি। গরুগুলি কী রকম বুঝতে পারে নদীতে কিছু ঘটছে, তারা নদীর দিকে মুখ করে গলা বাড়িয়ে দেয়। একটা গরুর গলায় দড়ি পেঁচিয়ে যায়। স্রোতের ধাক্কায় নৌকোটা স্রোতের মুখে বেঁকে গেছে। পাড় থেকে মনে হচ্ছে যে-কোন সময় ঐ দিক দিয়ে উল্টে যেতে পারে। কিন্তু নরেশ, অমূল্য আর কাদাখোয়া সেদিকে তাকাতেও পারছে না। নৌকোটা আর সোজা নেই, বেঁকে গেছে। এটাই নৌকোর পক্ষে বিপদ-সোজা না-থাকলেই নৌকো ডোবে। স্রোতের সঙ্গে ভেসে যেতে-যেতেই নরেশ, অমূল্য আর কাদাখোয়া তাদের সমবেত শক্তিতে নৌকোটাকে সোজা করার জন্যে জলের ওপর প্রায় হুমড়ি খেয়ে পড়েছে–নৌকোর ওপর দাঁড়িয়ে থেকে যতটা হুমড়ি খাওয়া সম্ভব। নৌকোর মাথার দিকে একটু আগুপিছু দাঁড়িয়ে নরেশ আর অমূল্য লগি মারছে আর তুলছে, মারছে আর তুলছে। তারা স্রোতের বিপরীতে লগি মারছে যাতে স্রোতের মুখে নৌকোর গতি বাধা পায়। কাদাখোয়া নৌকোর পেছন দিকে দাঁড়িয়ে স্রোতের দিকে মুখ করে সেই একই কাজ করছে। কিন্তু তাকে একা দুজনের কাজ করতে হচ্ছে–সে লগিটা তুলে একবার ডাইনে মারছে, একবার বায়ে মারছে। তিনজনেরই কাজ নৌকোটাকে স্রোতের বিপরীতে রাখা। আর সেই চেষ্টার ফলেই নৌকোটা স্রোতে ভেসে যায় না, কিছুটা এদের লগির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। কিন্তু সেই নিয়ন্ত্রণটা আসে এরকম স্রোতের মুখে বেশ কিছুটা গেলে। স্রোতের মুখে নৌকোটা ছেড়ে দেয়ার পর প্রথম কাজ নৌকোটা সোজা রাখা। সোজা রাখতে পারলে কিছুক্ষণের মধ্যেই এই লগিফেলা-লগিতোলার মধ্যে একটা ছন্দ তৈরি হয়। তখন এমন স্রোতের মুখেও নৌকোটা আর ডোবে না। কিন্তু এখানে সেই সময়টা নিতে গেলে ঐ চর ছাড়িয়ে নৌকো চলে যাবে। তখন নৌকো ফেরানো অসম্ভব। বাধ থেকে ঐ চরের দূরত্বটা এখন জলে-জলে এতই কম যে কোনো রকমে নৌকোটাকে ঠেলে একটু সরিয়ে নিতে পারলেই নৌকোটা চরের কোনো চালে বা গাছে ঠেকে যাবে। কিন্তু এই স্রোতের বেগ ঠেলে সেই সামান্য সরিয়ে নেয়াটুকুও সম্ভব নয় যেন। 

বাঁধের মুখোমুখি এসে নৌকোটা প্রায় বেঁকে যায়, অর্থাৎ স্রোতের অনুকূলে তার মাথা ও লেজ না থেকে, স্রোতের প্রায় আড়াআড়ি হয়ে যায়। এটা যদি ঠেকাতে না পারে, তা হলে নৌকোটা দুটো-একটা পাক খেয়ে স্রোতের ধাক্কায় কাত হয়ে যাবে। 

কাদাখোয়া একবার ডাইনে একবার বায়ে মেরেও মেরেও নৌকোটিকে আর এটুকু সোজাও রাখতে পারে না, এদিকে অশ্বিনী রায়ের গুয়াবাড়ি প্রায় পার হয়ে যায়-যায়। হঠাৎ কাদাখোয়া বায়ে লগিমারা বন্ধ করে ডাইনেই পরপর তিনবার লগি মারে। সে লগিমারা যেন জলের মধ্যে বর্শা বেনো আর তোলা। নৌকোটা মুহূর্তের মধ্যে পাক খেয়ে যায়। বাধ থেকে একটা সমবেত আওয়াজ ওঠে, গেইল, গেই। কিন্তু ততক্ষণে নরেশ আর অমূল্যর মুখ চরের দিক থেকে বাঁধের দিকে ঘুরে আসতে থাকে আর কাদাখোয়া নৌকোর মাথায় চলে যায়। কাদাখোয়া নৌকোর দু-দিকে পা দিয়ে, যেন মাটি খুঁড়ছে, বা কোদাল মারছে এমন ভঙ্গিতে সেই লগি দু হাতে তুলে জলে বিদ্ধ করতে থাকে। জলে পড়তে না-পড়তে লগি কাত হয়ে যায়। কাত হতে না-হতেই লগি তুলে এনে আবার জলে বিধিয়ে দেয় কাদাখোয়া। নৌকোটা কোনাকুনি চরের দিকে ধেয়ে যায়–ঐ একখান সোঁতা পাইছে, পাইছে। ওখানে কোনো স্রোত চরের দিকেই যাচ্ছে। সেই স্রোতের বেগ ত চরের ওপর দিয়ে গেলেও কিছু কম নয়। কিন্তু ওরা নদীটা পার হয়ে চরে পৌঁছে গেছে। এখন চরে নৌকোটাকে আটকাতে পারবে কি না সেটা অন্য ব্যাপার। নৌকোটা ততক্ষণে অশ্বিনী রায়ের গুয়াবাড়ি ছাড়িয়ে সোজা দক্ষিণের স্রোতের দিকে যাচ্ছে। মাঝে-মাঝে জেগে থাকা এক-একটা চালের আড়ালে পড়ে যাচ্ছে। 

এই, এই, এই, আটকিছে, আটকিছে, বাধে একটা সাড়া পড়ে যায়।

 কী হল, কী হল? বলে অফিসার দু-পাশে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করে। কেউই জবাব দেয় না। 

অফিসার, তাড়াতাড়ি বাধ বেয়ে নীচে নামতে শুরু করে। তার সঙ্গে সঙ্গে রঘু ঘোষ, তার বৌ, ভাগ্নী, অফিসবাবুর বড় শালী, গুদামবাবু, হাটের লোকজনও নামতে থাকে। নামতে নামতেই লিলি জিজ্ঞাসা করে, কী, নৌকোটা উল্টে গেছে? 

গোপা বলে, বাবা, গেল কী করে? এখন ফিরবে, না ওখানেই থাকবে?

 লিলি বলে, ওখানে কি ওদের জন্যে বাগানের ইনস্পেশকশন বাংলো বানিয়ে রেখেছে নাকি? 

জলের ধারে পৌঁছে ওরা পেছনে পড়ে যায়। ওদের দিকে কেউ তাকায় না। অফিসার পেছন থেকে এমন কাউকে খোঁজে যার সঙ্গে আগে কথা বলেছে। কিন্তু তেমন কাউকে না পেয়ে সে একজনের জামা ধরে টানে। সে ঘাড় ঝাঁকিয়ে জামাটা ছাড়িয়ে নেয়। কিন্তু অফিসার আবার তার জামাটা টেনে ডাকে, শুনুত ত অফিসারের গলা শুনে লোকটা ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতেই অফিসার জিজ্ঞাসা করে, কী? হলটা কী? নৌকোটি কি পৌঁছেছে? 

হয়, হয়, আটকি গেছে, আটকি গেছে, বলে লোকটি আবার নদীর দিকে মুখ করে।

পেছন থেকে জগদীশ বারুই এসে অফিসারকে বলে, কী? দেখসেন? পৌঁছায়্যা গিছে? 

অফিসার নদীর দিকে পেছন ফিরে জগদীশকে জিজ্ঞাসা করে, কী ব্যাপার? নৌকোটা উল্টেটুপ্টে যায় নি ত?

জগদীশ চিৎকার করে বলে ওঠ, উন্ট্যাবে ক্যান? কাদাখোগারে কন না, ঐ নৌকা নিয়া কাশিয়াবাড়ি চইল্যা যাবে। আর আমাগো নরেইশ্যা আর অমূল্যরও জোর আছে। জগদীশের ভঙ্গিতে একটা অধিকারের ভাব আসে যেন নরেশ, অমূল্য আর কাদাখোয়ার এই রকমের সাফল্যের পেছনে তারই প্রধান ভূমিকা। 

অফিসার একটু অসহায় ভাবে বলে, এখন ফিরবে কখন?

জগদীশ খুব নিশ্চিত স্বরে বলে, ক্যান? এহনই? দেরি করব ক্যান? 

.

১৪৩. নৃত্যভাষায় সংলাপ

অশ্বিনী রায়ের চালের বা সুপুরি গাছের কাছে নৌকোটা ভেড়ে না, সেগুলোকে বায়ে রেখে নৌকোটা কোনাকুনি চরের মধ্যে ঢুকে গিয়ে একটা গাছের সঙ্গে ধাক্কা খায় প্রায়। নরেশ গাছটাকে জড়িয়ে ধরলে নৌকো হঠাৎ টাল খেয়ে গাছটাকে ঘুরে স্রোতের মুখে চলে যায়। নরেশকে গাছ আর নৌকোর মাঝখানে ঝুলতে হয় কিন্তু ততক্ষণে কাদাখোয়া এক হাতে নৌকোটাকে আর-এক হাতে গাছটাকে ধরে জলে ঝাঁপ দিয়েছে। তাতেই নৌকোটা গাছের সঙ্গে সেঁটে যায়। 

সমস্ত ঘটনাটা ঘটে যেন একেবারে সময়ের ছন্দে। বন্যার তিস্তার স্রোতে ভেসে এই গাছে এসে নৌকো লাগানোটা যেন অমূল্য, নরেশ আর কাদাখোয়র, প্রতিদিনের ফেরি পারাপারের মত দৈনন্দিন কাজ, যেন তাদের জানাই আছে স্রোতটার কোন জায়গায় এক দিক থেকে লগি তুলে নিলে নৌকোটা পাক খেয়েও ডুববে না, না-ডুবে সোজা এই চরের দিকে চলে আসবে, এবং অশ্বিনী রায়ের চালটাকে বায়ে রেখে কোনাকুনি এই গাছটাতে পৌঁছুবে।

 আসলে ত এই নদীর, এই বন্যার এই স্রোতের সামান্য এক আঙুল জায়গাও তাদের চেনা বা জানা নয়। বন্যার জল কখন আসবে সেই হিশেবনিকেশ করে যাদের বাড়িঘর ও দাঁড়ানো ফসল ছেড়ে বাধে উঠে আসতে হয়েছে এবং সে-জল তাদের চোখের সামনে প্রতি মুহূর্তেই প্রায় সম্পূর্ণ অপরিচিত হয়ে উঠতে উঠতে বসবাসের চরে তাদের ফিরে যাওয়াটাই অনিশ্চিত করে তুলেছে–তারা কী করে আগে থাকতে জানতে পারবে এই দিনরাত রাতদিন ধরে বয়ে আসা জলস্রোত কোথায় কোন মোড় নিচ্ছে। তবু যে তারা একটা আধভাঙা নৌকো নিয়েও এই এমন স্রোতে এমন অনায়াসে ভেসে পড়তে পারে, তার কারণ এইটুকু স্থির বিশ্বাস যে খালি হাতপায়ে ভেসে গেলেও তারা শরীর নিয়ে কোথাও না কোথাও গিয়ে ঠেকে যেতে পারবে, জলে ডুবে মরবে না। নিজের ওপর এই বিশ্বাসটা স্থির–যতটা স্থির হওয়া সম্ভব। আবার, এই নদীর এখনকার অনিশ্চয়তাও সেরকমই স্থির। জলে ভেসে যাবার পর কিন্তু অমূল্য, নরেশ আর কাদাখোয়া তিনজনেরই একটা মাত্র ভয় মনের ভেতরে কাজ করে, যদি নৌকো উল্টে যায় তবে তারা এই জলের সঙ্গে ভেসে আর বেঁচে থাকতে পারবে না। কিন্তু তবু যে মৃত্যুভয়ে তারা অস্থির হয়ে ওঠে না–গায়ে আগুন লাগলে যেমন অস্থির হয়ে ছোটাছুটি করে ফেলে সবাই তার কারণ, তারা ত দেখেশুনে ভেবেচিন্তেই নৌকোটা ছেড়েছে, স্রোতটা কত খর বেগে বইছে তার একটা হিশেবও তাদের জানা আর স্রোতে কী ধরনের ধাক্কা লাগতে পারে সেটাও তাদের আন্দাজ ছিল। তাই ঐটুকু প্রস্তুতি তাদের সামাল দেয়। কখনো একটা পায়ের ঝোঁকে, কখনো একটা হাতের চাপে নৌকোর টালমাটাল সামলাতে-সামলাতে তারা চরটাতে এসে যায়। নরেশ যে গাছটা জড়িয়ে ধরবে তা সে পূর্ব মুহূর্তেও জানত না, আর নরেশ গাছটা জড়িয়ে ধরলেই যে কাদাখোয়া গাছটা ধরে জলে ঝাঁপ দেবে তাও ঠিক ছিল না। এসব ত আর সেরকম ভাবে ঠিক থাকতে পারে না। এমন হতেই পারত যে নরেশ গাছের ডাল ধরে ঝুলে থাকল আর নৌকো তার পায়ের তলা থেকেও সরে গেল। তা হলে, নৌকো আর নরেশের পায়ের তলায় ফিরিয়ে আনা কারো পক্ষেই সম্ভব হত না। নরেশকে তা হলে ঐ গাছের ওপর উঠে বসে থাকতে হত। 

কিন্তু নরেশ গাছটা জড়িয়ে ধরলেই যে কাদাখোয়া ঝাঁপ দিয়ে জলে পড়ে সেটা এক অদ্ভুত রহস্যনদীর স্রোত আর সেই স্রোতের বিরুদ্ধে দাঁড়াবার বহু কালব্যাপ্ত এক অভিজ্ঞতা আর অভ্যাসের ফল, সমবেত অভিজ্ঞতা ও সমবেত অভ্যাসের ফল। অথচ এর পরের কাজটার সমর্থন ছাড়া আগের কাজটা সম্পূর্ণ অর্থহীন হয়ে যায়। কাদাখোয়া ঝাঁপ দিলেই নরেশের ঝাপটার একটা অর্থ আসে। সে-অর্থ আসবে কি আসবে না, না-জেনেই নরেশকে ঝাপটা দিতে হয়, তারপর অর্থটা বুঝতে হয়। নরেশ ঝাঁপ দেবে কি দেবে না, সেটা না-জেনেই কাদাখোয়া ঝাপটা দেয়। এমন হতেও পারত যে কাদাখোয়াই আগে ঝাঁপ দিল, নরেশ পরে গাছটা ধরল। কিন্তু এই দুটো কাজ কোনো এক ভাবে গাথা হয়ে যায় এই বিকেলে, এই আসন্ন আকাশের নীচে, এই অঝোর বৃষ্টি আর বাতাসের অভ্যন্তরে। রংধামালির হাটের কাছে যে-পচা পাটের দড়িটা দিয়ে নৌকোটা বাধা থাকে, এই ভরা ফ্লাডে অমূল্য সেই দড়িটা দিয়েই গাছের ডালের সঙ্গে নৌকোটাকে বাধে। তারপর, তারা সকলে বাঘারুকে দেখতে পায়। 

বাঘারু তার গাছগুলোর মধ্যে মাচানের ওপর দাঁড়িয়ে ছিল। সে বসেই ছিল–হঠাৎ ঐ চালটার ওপাশে মানুষের এমন ভেসে আসা স্বরে সে দাঁড়িয়ে পড়েছিল। নরেশ আর অমূল্য তাকে আগেই দেখতে পারত, আর গাছগুলোর পাশ দিয়েই ত কোনা মেরে নৌকোটা ঢুকল। কিন্তু সেই সময় ত নরেশ বা অমূল্যর আর-কিছু দেখার দিকে চোখ ছিল না। বাঘারু যখন দেখে, ওরা তাকে দেখেছে, সে বসে পড়ল। এদের দিকে মুখ করে দুই হাঁটু জড়িয়ে ধরে বসে থাকল। 

এখন এই নৌকো আর বাঘারুর গাছের মধ্যে মাত্র কয়েক হাত জল, জল না থাকলে এখানে অশ্বিনী রায়ের বেড়ার পরের খালি জমি। সেই খালি জমি, বাঁশের বেড়া, লাউয়ের মাচা, মটর শাকের ওপর কয়েক মানুষ সমান জলের মাথায় এই নৌকো আর ঐ মাচান। মাটিতে গাছের যে-ডালটা ঘাড় হেলিয়ে দেখতে হত, সেই ডালটাতে হাত লাগিয়ে নরেশ এখন তাকিয়ে বোঝে অশ্বিনী রায়ের চালের কাছে সুপুরি গাছের মাথাটা ঐ লোকটার ঐ মাচানে নামার সিঁড়ির মত। সুপুরি গাছে উঠে ও নেমে এসেছে–আর নরেশরা বাধ থেকে দেখল, নোকটা সুপুরি গাছে উঠল অথচ নামল না।

বাঘারু তার মাচানে বসে বোঝে, এই জায়গাটায় তা হলে আরো অনেকেই এসে পড়বে। এসে পড়ারই কথা। জলভোবা তিস্তায় ত এতগুলো চাল আর গাছ এক জায়গায় পাওয়াই মুশকিল। এখন এই জায়গাটাকে নদীটার মাঝখানেই মনে হচ্ছে বাঘারু জানে না আসলে কতটা মাঝখানে। বাঘারু দেখে–এর তিনজন তোক একটা নৌকো নিয়ে এসেছে কিন্তু কোনো গাছ নিয়ে আসে নি। 

তাদের দাঁড়ানো জলের তলার ঘরবাড়ি খেতখামারের ওপর দিয়ে নরেশ চিৎকার করে–আরে, তুমি ঐ চালের উপুর বইস্যা ছিলা? সেই তখন? 

কথাটা কী রকম অবান্তর হয়ে যায়। বাঘারু তার গাছগুলোর মধ্যে মাচানে আর এরা তিনজন এই একটা নৌকোয় একটা গাছ জড়িয়ে-মাঝখানে কয়েক হাতের তফাত। কিন্তু এই কয়েক হাতের ওপর দিয়ে জলরাশি বাকি জলস্রোতের মতই তীব্র, ঘোলাটে, ঘূর্ণিময় ও প্রায় ঢেউহীন। মাত্র এই কয়েক হাত জলের দূরত্ব তারা ঘোচাতে পারে না। কিন্তু সেই জলে গাছ ধরে ঝুলে থাকার প্রাণান্তিক ভঙ্গিতে নরেশ এমন কাতর স্বরে এই সামাজিক জিজ্ঞাসা ছাড়া আর-কিছু উচ্চারণ করতে পারে না। ঐ পাড় থেকে নরেশ আর অমূল্য যখন নৌকো নিয়ে ভেসেছে তখন তাদের লক্ষ্য ছিল এখানে এসে কোনো লোক থাকলে তাকে নৌকোতে তুলে নিয়ে যাওয়া। কিন্তু ঐ নৌকোটা জলে ভাসা মাত্র তাদের সেই লক্ষ্য। তারা ভুলেই যায়। তখন তাদের প্রাণপণ চেষ্টা কোনো রকমে এই সুপুরি গাছ আর টিনের চালের কাছে পৌঁছনো। যখন পৌঁছয়, তাদের প্রাথমিক উদ্দেশ্য তারা ভুলেই যায়। বাঘারুকে প্রায় আবিষ্কারের মত দেখে, আবার তাদের সেই কথা মনে পড়ে যায়। তখন ত তারা তিস্তার সেই দিগন্তব্যাপ্ত স্রোতের মুখে একটা কুটোর মত ভাসছে। নরেশের গলা থেকে ঐ অবান্তর সামাজিক জিজ্ঞাসা ছাড়া কিছু বেরয় না। 

কিন্তু বাঘারু বোঝেই না কথাটা তাকে বলা হল। সে এদের দিকে তাকিয়ে থাকে। লোকগুলো যখন একটা গাছ ধরতে পেরেছে তখন কোনো একটা ব্যবস্থা করে নেবে। বাঘারু তার দড়ি আর কুড়োলের কথা ভাবে বটে কিন্তু সেটা ওদের কোনো কাজে লাগবে কিনা আন্দাজ করতে পারে না। 

নরেশ দেখে, তাদের আবার কোন জলস্রোত ভাঙতে হবে। সে চিৎকার করে বলে, অমূইল্যা, জিগ্যাইবার পারস না? 

অমূল্য নৌকোর ওপর থেকে বাঘারুকে ডাকে, শুইনছেন? এই দেউনিয়া, শুইনছেন? বাঘারু ওদের দিকেই তাকিয়ে, দেখেও যে ওরা কিছু বলছে, কিন্তু কোনো জবাব দেয় না। সে বুঝতেই পারে না, ওরা তাকে ডাকাডাকি করছে! অমূল্য এবার একহাতের আঁজলায় নদীর জল তুলে বাঘারুর দিকে ঘেঁড়ে। সে জল বৃষ্টির সঙ্গে মিশে তাদের গায়েই পড়ে।

আরে, বোবা নাকি? ফিইরতে হব না? নরেশ বাঘারুর দিক থেকে ঘাড় ঘুরিয়ে সেই ফেরার অনিশ্চয়তাটা একবার মাপে। লোকটাকে নৌকোতে তুলে সেই স্রোতের মুখে আবার নৌকোটা ছাড়তে হবে। 

অমূল্য লগিটা নিয়ে বাঘারু ও তাদের মাঝখানে যে-জল তাতে মারে। একটু জল ছিটকোয় বটে, লগিটা স্রোতের এক ধাক্কায় অমূল্যর পেছনে চলে যায়। অমূল্য লগিটা তুলে আনে। 

বাঘারু বুঝে উঠতে পারে না–এরা তিনজন কী করছে। তোকগুলি এসে গাছটা জড়িয়ে ধরার পর সেই অবস্থাতেই আছে। গাছের ওপরও উঠছে না, গাছটাতে তেমন করে দড়িও বাধছে না। হাঁপি গেইছে, জিরাবার ধরিসে! এরকমই ভেবে নিয়েছিল বাঘারু। তারপর, ওদের জল ছিটনো, জলে বাশ মারা এগুলোর কোনো অর্থ তৈরি করতে পারে না। কিন্তু তার জীবনে, বা দৈনন্দিনেই যে কাজের সঙ্গে তার শরীরের সম্পর্ক তৈরি হয় নি, সে কাজের কোনো অর্থ তার কাছে তৈরি হয় না। বোঝার চেষ্টা না করার মধ্যে তার কোনো সিদ্ধান্ত নেই। শরীর ছাড়া সে কী দিয়ে বুঝবে? এমন কি, যেখানে তার শরীর থাকেও সেখানেও অনেক কিছু তার বোঝার বাইরে চলে যায়।

কিন্তু নরেশ আর অমূল্য অস্থির হয়ে ওঠে। তাদের কাছে এখন বাধে ফিরে যাওয়াটা খুব অনিশ্চিত হয়ে উঠছে। সেই অনিশ্চয়তার সামনে এখানে এই লোকটির এমন বোবা ও অথর্ব হয়ে বসে থাকাটা অসহ্য ঠেকছে। লোকটাকে এই নৌকোয় তোলার একটা সমস্যা আছে। কিন্তু সে-সমস্যাটা ত পরের কথা। লোকটির সঙ্গে কথাই ত এখনো বলতে পারল না। 

হঠাৎ মরীয়া হয়ে অমূল্য আর নরেশ একসঙ্গে চিৎকার করে ওঠে, কী, শুইনব্যার পারেন না? বোবা কালা? 

কাদাখোয়া গাছের ডালটা জড়িয়ে নৌকোর ওপরই বসেছিল–যে-দড়ি দিয়ে নৌকোটা বাধা সেটা স্রোতের একটানে ছিঁড়ে যাবে। নরেশ আর অমূল্য যে-ভাবে নৌকোর মধ্যে টলমল করতে করতে বাঘারুর দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে, তাতে বাঘারু বুঝে ফেলে ওরা তার কাছে কিছু একটা চাইছে। সে লাফ দিয়ে দাঁড়ায়, তার কুড়োলটা নিয়ে। সেটা হাতে তুলে বাঘারু চিৎকার করে, নাগিবে? 

নৌকোটা দুলে ওঠে। নরেশ আর অমূল্য একটু টাল খায়। তাড়াতাড়ি ঘাড় ফিরিয়ে সেই স্রোতপথ দেখে নেয়, গাছ থেকে আলাদা হয়ে গেলে যেখান দিয়ে তাদের ভেসে যেতে হবে। 

নরেশ আর অমূল্য ঘাড় ঘোরাতেই বাঘারু নাইলনের দড়ির বাণ্ডিলটা তুলে ধরে চেঁচায়, নাগিবে? এইখান নাগিবে? 

অমূল্যর মাথায় বুদ্ধি এসে যায়। সে দু হাত দিয়ে বোঝায় দড়িটা তাদের চাই। অমূল্যর ইঙ্গিত বুঝতে পেরে বাঘারু তাড়াতড়ি বাণ্ডিলটা থেকে দড়ি খুলতে থাকে। সেই প্রক্রিয়াটা ওদের দেখতে হয়–ঐ জলের ওপর দাঁড়িয়ে বাঘারু তার গলা থেকে পায়ে সোনালি দড়ির স্রোত নামিয়ে দিচ্ছে। 

নরেশ বলে–এ কে রে? একেবারে কুড়াল নিয়া, দড়ি নিয়া, আমাগো রেসকু দিব্যার ধইরেছে। বলেই নরেশ আবার চিৎকার করে, হে-এ দাদা, হে-এ দাদা। দুহাতে দড়ি নিয়ে বাঘারু তাকায়। নরেশ হাত তুলে তাকে থামতে বলে। বাঘারু থামে। নরেশ অমূল্যকে বলে, হে-এ অমূইল্যা, বুঝ্যায়া দে, দড়িখান কাটার কাম নাই, ভাসায়্যা দিক, ঐ মাথা ধরা থাকুক। আমরা দড়ি ধরা টাইন্যা ওর বগলে যাই। নয়ত বুঝাবি ক্যামনে যে আমরা অকনিব্যার আইসছি? অমূল্য হাততালি দিয়ে বাঘারুকে ডাকে। তারপর এক হাত বাতাসে তুলে রেখে আর-এক হাত জলে লাগিয়ে তুলে আনে, যেন জল থেকে কিছু তুলে আনল এমন ভঙ্গিতে। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে অমূল্য নিজের বুকে দুই হাত দু-তিনবার ছুঁয়ে বাঘারুর দিকে মেলে দেয়। দু তিনবারের পর, আরো দু-তিনবার। অমূল্য বোঝে, সে যদি এই কথাটা বোঝাতে পারে যে ওরাই বাঘারুর কাছে যেতে চাইছে, তা হলে বাঘারু দড়ি ভাসিয়ে দেবে। তাই সে দড়ি ভাসানোর অনুরোধ জানানোর ভঙ্গির আর পুনরাবৃত্তি করে না। অমূল্য যেন নিজেও নিশ্চিত নয় যে এক হাত জলে আর একহাত বাতাসে রেখে সে তার কথা বোঝাতে পারবে কিনা। কিন্তু তার চাইতে এ ভঙ্গিটা অনেক বেশি নিশ্চিত–দুই হাতে নিজের বুক ছুঁয়ে, হাত দুটি বাঘারুর দিকে বাড়িয়ে দিচ্ছে। এই ভঙ্গির দ্বিতীয় কোনো অর্থ হতে পারে না।  বাঘারু দু হাতে নাইলনের দড়িটা ঝুলিয়ে অমূল্যর দিকে তাকিয়ে থাকে। সে অর্থটা বুঝতে চায়। বন্যার তিস্তায় কোন ভঙ্গির কী অর্থ তা যেন আগে থাকতেই ঠিক হয়ে থাকে। এমন জলের মধ্যে যদি এমন সাক্ষাৎকার ঘটে যায় তা হলে সেখানে অর্থবিনিময়ে দেরি হওয়ার কথা নয়। কিন্তু তবু যে ঘটছে তার কারণ বাঘারুর আজীবন অর্থবোধহীনতা, এমনকি অন্যের শরীরের ভাষা বোঝার অক্ষমতা, শরীরেরও অক্ষরজ্ঞানহীনতা। বাঘারু তার নিজের শরীর দিয়ে একটার পর একটা এমন কাজ করে যেতে পারে–যার অর্থ, একেবারে নিকট অর্থ, হয়ত তার কাছে ধরা পড়ে, বা, যারা দেখে তাদের কাছে হয়ত একটা দূরার্থও এসে যায়। এই যেমন, বাঘারুকে যখন গয়ানাথ গাছগুলোর সঙ্গে ভেসে যেতে বলেছিল, তখন, বাঘারুর কাছে তার অর্থ ছিল ফ্লাডের জল আর স্রোত আর ভাসমান ঐ চারটি গাছের সঙ্গে নিজের শরীরটাকে জুড়ে দেয়া আর গয়ানাথ আসিন্দিরের কাছে তার অর্থ ছিল জল নেমে গেলেও গাছগুলো নিরাপদ থাকবে। এখন তার এই চারটে গাছের মধ্যে বানানো মাচানটাতে দাঁড়িয়ে বাঘারুর বর্ণপরিচয় ঘটছে, অমূল্যর ইঙ্গিত বুঝতে বুঝতে বর্ণপরিচয় ঘটছে। তাই এ সাক্ষাৎকারে এমন অকারণ দেরি ঘটে যাচ্ছে। 

কিন্তু বিকেল আর-বেশিক্ষণ নেই। ঝুপ করে অন্ধকার শুরু হলে এখান থেকে তারা আর ওপারে যেতে পারবে না। বৃষ্টি বাতাস কিছুই কমে নি। তিস্তায় এখনো এত জল আসছে যে তা মাপার মত কোনো দিগন্তও চোখের সামনে নেই। আজ রাতে এখানে গাছের ডালে, বা টিনের চালে, বা এই নৌকায়, বা ঐ মাচানে থাকা যাবে না। সারা রাতের মধ্যে এসব ভেসে যেতে পারে। নরেশ আর অমূল্যর পক্ষে সেটা আরো কঠিনফ্লাড আসার আগে যারা নিরাপদে গাই-গরু-সংসার নিয়ে বাধে উঠেছে, তাদের এখন এই ভরা ফ্লাডের ভেতর নিজের চরের চালে বা নিজের চরের গাছের ডালে রাত কাটাতে হবে? বাঁধের ওপর থেকে এই জেগে থাকা গাছ আর টিনের চালগুলোকে কত আপন লাগছিল তাদের, আর সেই চর-ডুবনো- এই জলরাশির ভেতরে ঐ গাছটাকেই, তাদের নিজেদের, চরের গাছটাকেই, কত অপরিচিত লাগছে। তিস্তার বন্যা যে তাদের সত্যি বসবাসহীন করে দিল–এটা বোঝার জন্যে কি এই বিকেলে কয়েকশ টাকার জন্যে নৌকো ভাসানো তাদের ঠিক হল? নরেশ আর অমূল্য যখন এমনই গৃহকাতর ও অস্থির হয়ে ওঠে তখনই অমূল্যর ভঙ্গির অর্থ বাঘারু বুঝে ফেলতে পারে। সে দড়ি ফেলে দিয়ে দুই হাত আকাশে তুলে তাদের আশ্বস্ত করে–আনছে, আনছে, তাদের এখানে আনছে। বাঘারু একথার পর মাচানটা দেখে, তারপর চালের টিনটা দেখে। 

.

১৪৪. বাঘারু ও উদ্ধারকারীদল

বাঘারু চট করে একটা হিশেব করে নেয়। মাচান থেকে দড়ি জলে ফেললেই ওরা ধরে ফেলতে পারবে। তারপর সেই দড়িটায় টান দিয়ে দিয়ে এই গাছগুলোর তলায় পৌঁছে যেতে পারে। কিন্তু এই গাছগুলোর ডালপালা, এই মাচান কি চার-চারটি লোকের ভার বইতে পারবে? ওরা এক সঙ্গে এর কোনো ডালে পা দিলেই ত সে ডাল ডুবে যাবে। তার চাইতে টিনের চালটাতে ওদের ভোলা যায়। সুপুরি গাছ দিয়ে ওরা চালে উঠে যেতে পারবে। 

বাঘারু ডাল বেয়ে-বেয়ে সুপুরি গাছটার কাছে গিয়ে সুপুরি গাছটাকে জড়িয়ে ধরে দু ধাক্কাতেই মাথায় উঠে যায়, তারপর একটু ঝুলে অশ্বিনী রায়ের চালে পা দেয়। যে-দড়িটুকু সে খুলেছিল, সেটুকু তার শরীর থেকে সেই জলের ওপরের শূন্যতায় ঝোলে, দোলে ও তার শরীরের গতির সঙ্গে সঙ্গে ঘুরপাক খায়। 

বাঁধের লোকজন দেখে সুপুরি গাছের ওপর থেকে লোকটা আবার অশ্বিনী রায়ের চালের ওপর নেমে এসেছে। 

নাইমছে, নাইমছে, চিৎকার ওঠে।

ক্যানং করি নামিবে, এতগিলা টাইম কায় পারে সুপুরি গাছের উপর বসি থাকিবার? ভাল করি দেখ, নরেশুয়াখান ঐঠে উঠিছে নাকি? কেউ একটু সন্দেহ জানাতেই সবাই এই বাধ থেকে মাপার চেষ্টা করে টিনের চালের ওপর লোকটা নরেশ কি না। 

অফিসার দু পাশে ঘাড় ঘুরিয়ে জিজ্ঞেস করে, কী? এই লোকটাই ভেসে এসেছিল নাকি? কিন্তু তার কথার কোনো জবাব কেউ না-দেয়ায় সে আবার দু পাশে ঘাড় ঘুরিয়ে বলে, অ্যাঁ? 

লিলিও এই একই প্রশ্ন করে রঘু ঘোষকে। রঘু ঘোষ ঘাড় না-ফিরিয়ে জবাব দেয়, তা আমি জানব। কী করে? তারপর ঘাড় ঘুরিয়ে যোগ করে, সেই লোকটাই কী না, তা দিয়ে তোমার দরকারই বা কী? তোমার ত ঐ চালে একটা লোক দরকার–সে যোই হোক না। 

অফিসবাবু পেছনে বাঁধের ওপর থেকে ডাকেন, এই রঘুবাবু, কী বলছেন? কে ওখানে?

 রঘু ঘোষ হাত তুলে আঙুলগুলো ঘুরিয়ে দেয়। 

না, না, কেডা কইছে নরেইশ্যা? নরেইশ্যা ত ফুলপ্যান্ট পইর‍্যা গিছে? এই লোকটার ত নেংটি। কেউ একজন নিশ্চিত স্বরে জানায়। 

এতডা জল ঠেইল্যা গেলে ফুলপ্যান্টও নেংটি হয়্যা যায়, আর-একজন সেই নিশ্চয়তা মুহূর্তে ভেঙে দেয়। 

তয়; কাদাখোয়া, হবা পারে, আর-একটা নতুন প্রস্তাব আসে।

এইবার আবার একটু সবাই চুপ করে যায়। এত দূর থেকে চালের ওপর লোকটার চলাফেরা আর দৈর্ঘ্যটাই কিছু বোঝা যাচ্ছে। কিন্তু নরেশও ত লম্বাই–যদিও এতটা লম্বা ঠিক মনে হয় না। তা হলে কাদাখোয়া হতেই পারে। কিন্তু লোকটি যে-ভঙ্গিতে চালের ওপর চলাফেরা করছে, হাত নাড়ছে সেটা কাদাখোয়ারই কিনা তা চিনে নেবার মত গভীর ভাবে কে কবে এখানে কাদাভোয়াকে কাজ করতে দেখেছে? চালের ওপরের লোকটি কাদাখোয়াই কিনা এটা যাচাই করতে করতেই এই ভিড়ের কাছে চেনা কাদাখোয়া অচেনা হয়ে যায়। 

হবা পাবে, কাদাখোয়া হবা পারে। 

কাদাখোয়া হবা পারে নরেশুয়াও হবা পারে।

ঐ মানসিডাও হব্যার পারে। না হইলে রেসকু করবেন কারে?

অফিসার দু পাশে ঘাড় ঘুরিয়ে জিজ্ঞাসা করে, লোকটিকে পেয়েছে ত, নাকি? কিন্তু অফিসারের কথার কোনো জবাব কেউ দেয় না। অফিসার আবার ঘাড় ঘুরিয়ে-ঘুরিয়ে জিজ্ঞাসা করে, পেয়েছে নাকি?

বাঘারু টিনের চালের কিনারে এসে দাঁড়ায়, তারপর তার পেছনে নাইলনের যে-দড়িটা ঝুলছে সেটা টেনে-টেনে এনে জড়ো করে। এই দড়ির ত কোনো আগা নেই, সবগুলো গাছই দড়িতে-দড়িতে বাধা। বাঘারুর হাতে টান লাগে, আর-দড়ি আসে না। তখন সে ঐ সবটা দড়ি পা দিয়ে নীচে ফেলে দেয়, জলে। জলে পড়া মাত্রই দড়িটা অনেকগুলো দড়ির মত চারদিকে ছড়িয়ে পড়েই সোজা হয়ে যায়। দড়ির মাঝখানের বৃত্তটা বড় হয়ে যায়। কিন্তু নরেশদের নৌকোর কাছে দড়িটা পৌঁছয় না। অমূল্য একটা লগি দিয়ে দড়িটা টেনে নেয়। 

নরেশ আর অমূল্য যেন বাঘারুকে উদ্ধার করতে আসে নি, বাঘাই যেন তাদের উদ্ধার করছে—অমূল্য এমন ভাবে দড়িটা টেনে পরীক্ষা করে। দড়িটাতে টান দিতেই তাদের নৌকোতেও টান লাগে, নৌকোটা চালের দিকে ঘোরে। কাদাখোয়া জিজ্ঞাসা করে, খুলি দিম? অমূল্যর সঙ্গে নরেশও দড়িটায় হাত লাগিয়ে আস্তে বলে, দে কেনে। কিন্তু নরেশের কথায় কিছু একটা সংশয় ছিল। কাদাখোয়া দড়ি খোলে কিন্তু গাছ ছাড়ে না।

দড়িটা বিপরীত দিকে কিসের সঙ্গে বাঁধা তা ত আর ওরা জানে না, ফলে ওরা দড়িটাতে জোরে টান দিতে ভরসা পায় না। যেখানে দড়িটা বাঁখা আছে সেটা যদি তাদের টানে খুলে যায় তা হলে স্রোতের একটা টানে নৌকোটা এমন ছিটকোবে, তারাও সেরকম ছিটকে জলে গিয়ে পড়তে পারে। সেই ভয়ে তারা নৌকোর ওপর দাঁড়িয়ে জোরে-জোরে টেনে পরীক্ষা করারও সাহস পাচ্ছে না। চালের ওপর থেকে বাঘারু চিৎকার করে, টানেন, টানেন, না-ছিড়িবে, না-ছিড়িবে, কিন্তু সেটুকু বলেই বাঘারু বসে থাকে না, সে দড়ির আর-একটা দিক চালের ওপর থেকে হাতে তুলে নেয়, দড়িটাকে সমান করে নিয়ে জোরে টানে। সেই টানের জোরে অমূল্য আর নরেশ বোঝে দড়ি খুলে যাবার কোনো ভয় নেই। খুলি দে, খুলি দে, কাদাখোয়াকে নরেশ বলে। 

কাদাখোয়া দড়িটা খুলতেই নৌকোটা গাছ থেকে সরে যায়, দড়িটা টানটান হয়ে পড়ে আর জলস্রোত এসে নৌকোর সামনে উছলে ওঠে। মাত্র কয়েক হাতের সেই দূরত্ব স্রোতের বিপরীতে যেতে তার সমস্ত জোর হাতে এনে দড়িটা ধরে টানে। কাদাখোয়ও হাত লাগায়। কিন্তু তাদের তিনজনই বুঝে ফেলে স্রোতের বিপরীতে একটা হেঁচকা টানে এই দূরত্বটা পার হতে গেলে স্রোত ফুলে উঠে নৌকো উল্টে দিতে পারে। তা ছাড়া, দড়িটাতে হাত লাগিয়ে শরীরটা ঝুলিয়ে দিয়ে যে-টান দেয়া যায়, তার জন্যে ত গোড়ালি রাখার একটা জায়গাও দরকার। এ নৌকোতে তেমন কোনো জায়গা নেই। স্রোতের মুখে নড়বড় করতে করতেও যে-নৌকো এ পর্যন্ত এসে গেছে, স্রোতের বিপরীতে সে-নৌকোর তলার তক্তা ফাঁক হয়ে যেতে পারে। 

কিন্তু মাত্র ত কয়েক হাতের ব্যাপার। তাই আস্তে-আস্তে টানলেও তারা ঐ গাছগুলোর কাছে পৌঁছে যায়। বাঘারু চালের ওপর হুমড়ি খেয়ে তলার বটমে হাত দিয়ে দড়িটা গুঁজে দেয়। কাদাখোয়া বাঘারুর গাছগুলোর একটা মোটা ডালে দড়িটা বেঁধে দিয়েও ডালটা ধরে থাকে। 

সুপুরি গাছটা ধরার জন্যে এই গাছগুলোর একটা ডালে একটু পা দিতেই হয়। অমূল্য পা দিয়েই বোঝে, ঝোঁক দিলে ডালটা ডুবে যাবে। সে আলগোছে ডালে পা দিয়ে সুপুরি গাছটায় যেন ঝাঁপিয়ে পড়ে। সুপুরি গাছ বেয়ে অমূল্য চালে নামতেই নরেশ তার লম্বা হাতে নৌকোর ওপর থেকেই সুপুরি গাছটাকে জড়িয়ে ধরতে পারে। ওরা দুজন নেমে গেলে নৌকোটা জলের ওপর আরো হালকা হয়ে যায়। কাদাখোয়া নৌকোর ওপর বসে বসে এই ডাল ঐ ডাল ধরে নৌকোটাকে ডালপালার আরো ভেতরে নিয়ে যায়। সেজন্যে তাকে বাধনটা খুলতেও হয়। নতুন বাধনে নৌকোটা আরো একটু ভালভাবে আটকা পড়ে। কাদাখোরা সামনে হেলে সুপুরি গাছটাতে হাত দেয়। কিন্তু কী মনে করে ঝাঁপ দেয় না–ধাক্কা দিয়ে হাতটা সরিয়ে আনে। তার ত চালের ওপর কোনো কাজ নেই, বরং এখানেই থাকুক, মুই এইঠে থাকি, নৌকোর ভিতর, এইঠে। সে নৌকোর ভেতর বসে পড়ে। 

.

১৪৫. বাঁধের ওপর তর্কবিতর্ক

বাঁধের ওপর থেকে দেখা যায়—আরো দু-জন চালের ওপর নেমে এল। অমূল্যকে সবাই চিনে ফেলে–সবার চেয়ে খাটো বলে। কিন্তু যে আগে চালের ওপর দাঁড়িয়েছিল সে, নরেশ, না কাদাখোয়া, এ নিয়ে সন্দেহ ছিল। এখন, অমূল্যর সঙ্গে যে নামল, তাকে যদি নরেশ বলে ধরে নেয়া যায়, তা হলে আগের লোকটা ত কাদাখোয়াই হয়। তা হলে, যে-লোকটিকে উদ্ধার করার জন্যে এরা এখান থেকে নৌকো নিয়ে রওনা হল, সে লোকটা কোথায়? সুবুরি গাছে চড়ে সে লোকটা কি সত্যি-সত্যি উধাও হয়ে গেল নাকি? 

অ্যাঁ? আরে, যে-মানুষডারে রেসকু কইরব্যার গেল, সেই মানুষই ত নাই, এহন অগরে রেসকু করার জন্যে আর একখান নৌকা ছাড়ো। অ্যাঁ? 

কথাটা শুনে অফিসার ব্যস্ত হয়ে পড়ে, সে কী? লোকটি নেই? লোকটি নেই নাকি? কী? আপনারা লোকটিকে দেখতে পাচ্ছেন না? 

পেছন থেকে একটা গলা শোনা যায়, চালের উপর কয়খান মানষি দেখিছেন?

দেখছি ত তিনজন, তিনজন, বলে অফিসার আবাব চালের দিকে তাকিয়ে মিলিয়ে নেয়, হ্যাঁ, তিনজনই। 

এইঠে কয়ডা মানষিক নৌকা করি ছাড়ি দিলেন? আবার প্রশ্ন।

ওরা ত দুজন ছিল, আর-একজন ত এখান থেকে যাওয়ার কথা, সে গিয়েছে ত? অফিসার একটু ব্যস্ত হয়ে এপাশ-ওপাশ ঘাড় ঘুরিয়ে জিজ্ঞাসা করে। তার কথাতে সবাই একসঙ্গে হেসে ওঠে। হাসিটার কোনো অর্থ অফিসার বুঝতে পারে না, কিন্তু তার কথার সঙ্গে এই হাসির সম্পর্ক অনুমান করে আবার এদিক-ওদিক তাকায়। হাসিটা থামার পর জগদীশ বারুই বলে ওঠে, এইখান থিকা আপনার চোখের সামনে কয়জনরে দেইখলেন নৌকা কইর‍্যা যাতে? 

তিনজন, তিনজন, তিনজনই ত ছিল– অফিসার জগদীশ বারুইকে খুঁজতে-খুঁজতে জবাব দেয়।

 হয়? ঐ তিনজনই ছিল, তিনজনই, আছে, জগদীশ বারুই বিড়ি টানে সশব্দে। 

তালই কি দেখব্যার পারতিছেন অগ? তয় না শুনি আপনার ছানি পড়ছে, খুব নিচু স্বরে কেউ বলে।

জগদীশ বারুই হাসতে গিয়ে কেশে ফেলে। তারপর, কাশিটা বাড়তে থাকে। বুক থেকে কফ তুলে কাশিটা শেষ। তারপরও জগদীশ বারুইকে গলা পরিষ্কার করতে হয়। এর মধ্যে একজন বলে, ঐটা কাদাখোয়া। কাদাখোয়াই আগত্ চালে উঠিছে, নরেশুয়ার গাওত ত জামা আছে 

হয়, হয়, নরেশুয়া, অমূল্যা, কাদাখোয়া–এই তিনো মানষি। আর সেই মানষিডা নাই। কথাটা প্রায় সিদ্ধান্তের মত শোনায়।

অ্যাঁ? লোকটা নেই? যাকে রেসকিউ করতে গেল, সেই লোকটাই নেই? আর আপনারা এখানে এমন চেঁচামেচি শুরু করলেন যেন ওখানে কত লোক ভেসে এসে উঠেছে। তারপর আবার হাজার। টাকা-দেড় হাজার টাকা নিয়ে দর কষাকষি শুরু করলেন। এখন ত আমাকে এক্সপ্ল্যানেশন দিতে হবে-লোক না দেখে নৌকো পাঠালাম কেন? বলতে বলতে অফিসার সরে আসে আর রঘু ঘোষকে দেখে তার সামনে দাঁড়িয়ে পড়ে চিৎকার করে, কী মশাই? আপনারাই ত বাগান থেকে ফোনের পর ফোন করলেন যে লোক ভেসে আসছে। এখন লোক কোথায়? দিন। 

রঘু ঘোষ হে-হে করে হেসে ওঠে, আরে, আপনি আমার ওপর রাগারাগি করছেন কেন? আমি কী করলাম? 

আপনারাই ত বাগান থেকে ফোন করেছেন–সকালে একবার, বিকেলে একবার।

সে ম্যানেজারবাবুকে বলুন, রঘু ঘোষ দায়িত্ব অস্বীকার করে, এখানকার লোক গিয়ে বলেছে তাই। ফোন করা হয়েছে। 

তাই বলে না দেখে ফোন করবেন নাকি? 

অফিসারের সঙ্গে রঘু ঘোষের কথাবার্তা শুনে বাগানের লোকজন পায়ে-পায়ে একদিকে জড়ো হতে শুরু করে–গুদামবাবু, অফিসবাবুর বড় শালী, লিলি, গোপা, আরো দু-একজন। গুদামবাবু জিজ্ঞাসা করে, কী? কী হয়েছে? 

রঘু ঘোষ একটু সরে এসে বলে আরে, ওখানে লোক পাওয়া যায় নি সেটা কি আমাদের দোষ? ফ্লাডের সময় কেউ যদি এসে বলে নদী দিয়ে তোক ভেসে যাচ্ছে, ফোন করে দিন, তা হলে আমরা কী করব, ফোন করব না? 

লিলি আস্তে বলে, অত চৈঁচাচ্ছ কেন? 

গুদামবাবু বলে, ঠিক আছে, ঠিক আছে, ওঁদের কিছু বলার থাকলে হেড-অফিসে জানান, আমাদের বলে কী লাভ? 

অফিসবাবুর বড় শালী বলেন, চলুন, চলুন, এখন ফিরে চলুন। 

এদিকে বাগানের বাবুদের ও বাবুদের বাড়ির মেয়েদের এক জায়গায় জড়ো হয়ে এরকম কথাবার্তা বলতে দেখে বাগানের যেকুলিকামিনরা এদিক-ওদিক ছড়িয়ে ছিল, তারাও এসে এখানে দাঁড়ায়। তাদের মধ্যে একজন একটু এগিয়ে এসে রঘু ঘোষকে জিজ্ঞাসা করে, কী, হোগেলাক হে, অফিসবাবু! 

রঘু ঘোষ তার দিকে তাকিয়ে হাত নেড়ে হেসে বলে, তোরা আবার কোত্থেকে এসেছিস? যা

 তা তুইও চলেক একটা মেয়ে পেছন থেকে বলে ওঠে, হে বৌদি, অফিসবাবুকে লিগেলা? 

কে রে? বলে রঘু ঘোষ হাসতে-হাসতে মেয়েদের দলটার দিকে চোখ পাকায়। অফিসার ততক্ষণে ভিড়টার পেছনে চলে গেছে। সেখানে দেখে জগদীশ বারুই আর অশ্বিনী রায় বোল্ডারের ওপর উবু হয়ে বসে বিড়ি খাচ্ছে আর মাঝেমধ্যে ঘাড় উঁচু করে ভিড়ের পেছনটা দেখছে। অফিসার তাদের সামনে দাঁড়িয়ে বলে, এই যে আপনারা এখানে! তখন ত খুব বললেন, কত লোক ভেসে আসছে, এখনি নৌকো পাঠাতে হবে, মিলিটারি চাই। মিলিটারি এলে ত আপনাদেরই এখন জলে ভাসাত 

অফিসার দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে বলছিল, ফলে, জগদীশ বারুই আর অশ্বিনী রায় বোঝে না কথাটা তাদেরই বলা হচ্ছে। তারা বিড়ি খেয়েই যায়। জগদীশ বারুই একবার মুখ তুলে জিজ্ঞাসা করে, কীরে, কিছু হইল নাকি? 

অফিসার বলে ওঠে, হবেটা আবার কী? লোক থাকলে ত আনবে। লোক না থাকলে কোত্থেকে আনবে? আর আপনারা এদিকে ত বলছিলেন কত লোক ভেসে আসছে– 

অশ্বিনী রায় ঘাড় তুলে অফিসারকে দেখে উঠে পঁড়ায়। জগদীশ বারুই অশ্বিনীকে দাঁড়াতে দেখে ঘাড় তুলে দেখে–তারপর সেও দাঁড়ায়। অশ্বিনী রায় একটু সরে যাওয়ার চেষ্টা করে! জগদীশ বারুই তার হাত ধরে টেনে অফিসারকে জিজ্ঞাসা করে, কী কন?

বলছি, তখন ত খুব লোক ভাসাচ্ছিলেন, এখন ত ওখানে একটা লোকও পাওয়া যাচ্ছে না। মিলিটারি এলে কী হত? 

সে কী হইত, আপনারা জানেন। লোক না থাইকলে কি লোক পয়দা কইর‍্যা ভাসায়্যা চালের উপর থুইয়্যা আইসব নাকি? তাও ত দশমাস লাইগব। সকাল বেলায় জ্বলজ্যান্ত মানুষরে সাগলে দেইখল চালের উপর, আর, সুপুরি গাছে চইড়া গেল কুথায়? সেইডা জিগান না? 

গেল কোথায়, সেটা কি আমি খুঁজে বের করব নাকি? অফিসার রেগে সরে যায়। ওরকম রেগে-রেগে অফিসার ক্রমেই ভিড়টার পেছনে সরে এসেছিল। সে প্রায় বাঁধের নীচে গিয়ে দাঁড়ায়। তার দাঁড়ানোর ভঙ্গিতেই একটা ইতস্ততের ভাব ছিল, যেন সে বাধ বেয়ে উঠে, ওদিক দিয়ে নেমে গিয়ে জিপে চড়ার একটা উপলক্ষ খুঁজছে। কিন্তু সেটা ঠিক পেরে উঠছে না। 

অফিসার আবার ভিড়টার মধ্যে এসে, দু-একজনকে সরিয়ে সামনে এগিয়ে যায়। তখন দেখা যাচ্ছে, সেই টিনের চালের ওপর ওরা তিনজন মিলে কথাবার্তা বলছে। অমূল্য চালের একদিকে বসেই পড়েছে, আর নরেশ কাদাখোয়া কথা বলে যাচ্ছে। কথা বলাটা বোঝা যায়, দু জনের দাঁড়ানোর ও হাত-পা নাড়ার ভঙ্গি থেকে। 

অমূল্যা করে কী ঐখানে বইস্যা বইস্যা?

কাদাখোয়ার তানে এ্যাত কথা কী কছে নরেশুয়া? 

এই দুটি জিজ্ঞাসা নিয়ে এ-পাড়ের ভিড় খুব বিব্রত হয়ে ওঠে। 

.

১৪৬. শীর্ষ বৈঠক

চালের ওপর নেমে নরেশ বাঁধের দিকে তাকায়। বাঁধের ওপর থেকে এই চালটাকে যত কাছে মনে হচ্ছিল, চালের ওপর থেকে বাধটাকে তত কাছের ত লাগেই না, একটু যেন দূরের লাগে। বাতাস আর বৃষ্টির কুয়াশায় আর তিস্তার জলস্রোতের শীকরে এই দূরত্বটার মধ্যে একটা পর্দার মত তৈরি হয়েছে ত বটেই, যেমন হয় ভোর রাতে, কিন্তু তা ছাড়াও বাধটাকে যেন দূরেরই ঠেকে, নরেশের। একটু ঠাহর করতেই সে ভিড়টাকে প্রায় চিনে নিতেই পারে, এমন কি, আর-একটু নজর করলে লোকজনকেও চিনতে পারে–তবু অশ্বিনী রায়ের চালের ওপর উঠে নরেশ বাধটাকে আর কাছের দেখে না। অথচ, অশ্বিনী রায়ের যে-ঘরটা এখন জলের তলে, যেসুপুরি গাছগুলো জলের ওপর শুধু মাথাটা তুলে জেগে আছে, সেই ঘর, সেই সুপুরি গাছের পেছন দিয়ে, তলা দিয়েও, নরেশ ত তার এই এতগুলো বয়স ধরে সামনের এই বাধটাই দেখে এসেছে। তার জন্ম যদিও এখানে নয়, কিন্তু এই চরটাতেই ত জোয়ান হয়ে উঠেছে সে। বাঁধের ওপর থেকে এই চরটার দিকে সারা জীবন যতক্ষণ তাকিয়েছে নরেশ, তার চাইতে অনেক বেশিক্ষণ তাকিয়ে থেকেছে চর থেকে বাধটার দিকে। অথচ, এখন নরেশের মনে হয় স্বাধটাতেই তার বাড়িঘর, কত তাড়াতাড়ি সেখানে ফিরে যাবে! অশ্বিনী রায়ের বাড়ির সামনের রাস্তা থেকে নরেশের বাড়ি দেখা যায় না। অশ্বিনী রায়ের চাল থেকে কি দেখা যেত? নরেশ একবার বাঁধের দিকে পেছন ফিরে জলের তলার এই চরে তার বাড়ি যেদিকে থাকার কথা, সেদিকে ঘোলা জলের ওপর দিয়ে তাকিয়ে জলের তলায় যেসব গাছ, বাড়ি, বাগান, গোয়ালবাড়ি ডুবে আছে সেগুলোকে একবার দেখে নিতে চায়। অশ্বিনী রায়ের বাড়ি আর তাদের বাড়ি আলাদা পাড়ায়। মাঝখানে একটা ছোট খালও আছে। দেখা না-যাওয়ারই কথা। কিন্তু নরেশদের ঘরটা খুব উঁচু-তার টিনের চালটা হয়ত দেখা যেতে পারে। নরেশ দেখে-চারিদিকে ধু ধু করছে শুধু জল। এখন যদি নরেশকে জলের তলায় নিয়ে গিয়ে তার বাড়ি খুঁজে নিতে বলে কেউ, নরেশ পারবে না। বাঁধের ওপর থেকে এই জল দেখেও মনে ভরসা থাকে যে জল নেবে গেলে চরে ফিরবে। কিন্তু এখানে এই চরেরই ওপর দাঁড়িয়ে সেরকম কোনো ভরসা ত নরেশ পায়ই না, বরং বাধটার দিকে তাকিয়ে সে ফিরে যাওয়ার একটা তাড়া বোধ করে। একটু ভয়ও যেন পায়। নরেশ বাঘারুকে জিজ্ঞাসা করে-তুমিই সকালে এই চালে উঠছিল্যা না? 

হয়।

তারপর সুপুরি গাছে উইঠ্যা ভ্যানিস? আর নামার নাম নাই।

গাছত আছিল।

আর, আমরা ভাবতাছি তুমি মানুষ, না ফ্লাডের ভূত। এ্যাহন চলো, চলো।

 কোটত যাম? বাঘারু সোনালি দড়ি গুছোতে-গুছোতে বলে।

 ঐঠে, বাধে যাব্যার নাগবে। আমরা ত তোমাক এসকু কইরব্যার আসছি। 

মুই না যাও, বাঘারু তাদের দিকে পেছন ফিরে বলে। নরেশ রেগে যায়, নাযাও কি? তোমার বাবার আহ্লাদ। যাবার লাগব। তোমা এসকু করিবার তানে নৌকা নিয়্যা দুইবতে-ডুইবতে আসছি, আর এ্যাহন না যাও! চলো- নরেশের গলায় একটা বিরক্ত হুকুমের স্বর আসে বটে কিন্তু সেই স্বরে কোথায় যেন এই প্রস্তুতিও ধরা পড়ে যায় যে নরেশ যেন জানত, বাঘারু যেতে চাইবে না। 

অমূল্য অশ্বিনী রায়ের চালের ওপর বসে পড়েছিল, বাঁধের দিকে মুখ করে। অমূল্যদের বাড়ি অশ্বিনী রায়ের বাড়ির পশ্চিমে, বাঁধের আরো সামনে, একটু কোনাকুনি, কিন্তু আলাদা পাড়ায়। অমূল্য নিজের সেই বাড়ির দিকে মুখ করেই বসে ছিল। অশ্বিনী রায়ের এই চালটা ভেসে থাকবে, সেখানে তারা এসে উঠবে ও বসবে, অথচ অমূল্যর বাড়ির, অত বড় বাড়ির, একটা মাথাও দেখা যাবে না, সমস্তটা জুড়ে শুধু। ঘোলা জল আরো ঘোলা জল উথলে বয়ে যাবে–এর ভেতর একটা অবিচার আছে, অমূল্যর ওপর একটা ব্যক্তিগত অবিচারই যেন। অমূল্যর ঘরজমির যে কোনো ইশারা পর্যন্ত পাচ্ছে না অমূল্য তাতে অন্যদের বাড়িঘর জমিজিরেত যেন ডাঙা হয়ে ওঠে। যেন, আর কারোই কিছু ডোবে নি, যা ডোবার তা এক অমূল্যরই ডুবল! অশ্বিনী রায়ের চালে উঠে যেমন বাধ দেখছে অমূল্য, সেরকম ত নিজের চালের ওপর বসেও দেখতে পারত–তাতেও বোঝা যেত, তার বাড়িটা আছে। কিন্তু যে-চরটায় তাদের বাড়িঘর, সেই চরটাতেই দাঁড়িয়ে বা বসে তারা শুধু জলই দেখে চারদিকে, সেই এক ঘোলা জল, এমন-কি আকাশ থেকে যেন সেই ঘোলাটে বৃষ্টিই হচ্ছে। অমূল্য বিরক্ত হয়ে চিৎকার করে ওঠে, না-যায় ত যাক, চল, আমি আর থাকইব না– 

নরেশ অমূল্যর দিকে তাকিয়ে কী বুঝে নেয়, তারপর গলার স্বর নীচে নামিয়ে বলে, কস কী? এডারে নিয়্যা না গ্যালে তরে টাকা দিব কেডায়?

না দিক। কেডায় জানত এড়া এহানে আছে 

না-জানতি ত আলি ক্যা?

 তুই টাকার তাল তুললি, শালা। টাকা? দেহিস না চাইরপাশে? তিস্তার তলে তর খাড়া জমিতে বালুবাড়ি হবার ধইরছে। 

নরেশ বাঘারুকে বলে, এই দেউনিয়া শুনেন—

বাঘারু ততক্ষণে সোনালি দড়ি গুছিয়ে ফেলেছে। সে নরেশের দিকে তাকিয়ে বলে, মুই দেউনিয়া না হই। গয়ানাথা জোতদার মোর দেউনিয়া।

তোমরালার ঘর কোথায়? 

ঐ বাঘারু যে-তিস্তা পেরিয়ে এসেছে, সেই পুরো তিস্তাটাকেই দেখায়। নরেশ ভেবেছে সে কিছু দেখাচ্ছে। তাই, বাঘারুর অঙ্গুলিনির্দেশে ঘাড় ঘুরিয়ে সেই একই জল দেখে ঘাড় ফিরিয়ে বলে, আরে, তোমার গাও কুথায়? 

বাঘারু সেই একই তিস্তার ওপর দিয়ে হাত ঘুরিয়ে আনে–ঐঠে।

 নরেশ আবার চুপ করে কিছু ভাবে। তারপর বাঘারুকে বলে, জলে ভাইস্যা গিছে তোমাগ গ্রাম?

বাঘারু ঘাড় নাড়ায়, না, ভাসে নি।

 তা, তুমি ভাইস্যা আইল্যা কোথথিক্যা মণি?

গয়ানাথর ফরেস্ট তিস্তা চুকি গিছে।

 তয়?

গাছ ভাঙি গিছে।

 তয়?

গয়ানাথ গাছগিলাক আর মোক ভাসি দিছে।

 তয়?

হামরালা ভাসি আসিছু। 

আসিছু ত আসিছু। বাবা, এহন বাধে যাবার লাগব! অফিসার আইসছে। আমাগো পাঠাইছে। চলল, চলোনরেশ একটু এগিয়ে বাঘারুর হাত ধরে। বাঘারু বাধা দেয় না। নরেশ হাত ধরে টানে, বাঘারু নড়ে না। নরেশ হাত ছেড়ে দেয়, বাঘারুর হাতটা পড়ে যায়। 

গয়ানাথ কহিছে, বাঘারু, গাছগিলার নগত ভাসি যা, য্যালায় বানা কমিবে তক খুঁজি নিম।

 তা তোমার গাছগুল্যা নিয়্যাই চলো বাবাঐখান থিক্যাই তোমার দেউনিয়া তোমাক খুঁজি নিবে।

 বাঘারু চুপ করে বাঁধের দিকে তাকায়। এই যুক্তিটা তার ভাল লেগে থাকতে পারে যে বাঁধের ওখানেই গয়ানাথের পক্ষে তাকে খুঁজে বের করার সুবিধে। আবার, ঐ পশ্চিম দিকে তাকিয়েই সে হয়ত রাত্রির আসন্নতা বুঝতে পারে। বাঁধ, বাঁধের মানুষজন, কিছু চলাফেরা–এসব তাকে টেনে থাকতেও পারে। 

নরেশ বলে, চলো, চলো, গাছগিলা নিয়্যাই চলল, চল্ অমুইল্যা। 

অমূল্য উঠে দাঁড়ায়। তারপর নরেশ সুপুরি গাছের দিকে এক পা বাড়ায়। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে, বাঘারু নড়ে না। 

.

১৪৭. কাদাখোয়ায় নৌচালনা

 নরেশ ঘুরে সঁড়িয়ে বিরক্ত হয়ে বলে, কী হইল? 

বাঘারু বাঁধের দিকে তাকিয়ে থেকে বলে, না যাম। মুই এইঠে থাকিম। 

নরেশ গলা আরো তুলে বলে, আরে তোমা ত তোমার দেউনিয়া কইছে যেইখানে ঠেইক্যা যাবি সেইখানে গাছগুলো নিয়্যা থাকবি, তক আমরা খুঁইজা নিব। এই কইছে ত? 

হয়। কহিছে।

 তা, তোমার দেউনিয়া আসি যদি ঐ বাঁধের উপর খাড়ায় আর তুমি যদি তোমার ঐ গাছের মাচানের উপর বইস্যা থাক, তমার দেউনিয়া তোমাক দেইখবে ক্যামন কইর‍্যা?

বাঘারু বাধ থেকে চোখ সরিয়ে নরেশের ওপর আনে। নরেশ তার চোখ দেখে অনুমান করে–এই যুক্তিটা যেন তার মনে ধরছে। সে যুক্তিটাকে আর-একটু জোর দিতে চায়। 

তোমার দেউনিয়া তোমাক বাধ দিয়্যা খুঁইজব না জল দিয়্যা খুঁইজব?

 বাধত খুঁজিবে।

তা বোঝ ত সবই, কাজের বেলায় অষ্টরম্ভা। বাধ দিয়া খুঁইজব ত বাধে চলো। এহানে খাবাডা কী? দেউনিয়া চিড়ামুড়ি কিছু দিছে? 

নাই রো।

 সারাদিন কিছুই খাও নাই? 

খিদ্যা পায় নাই?

হয়। 

নরেশ অমূল্যর দিকে তাকায়। তারপর নরেশ আর অমূল্য দুজন এক সঙ্গে বাঘারুর দিকে তাকায়। তারা বুঝে ফেলে–ঐ দেউনিয়া গাছগুলোকে বাঁচানোর জন্যে এই লোকটাকে গাছের সঙ্গে ভাসিয়ে দিয়েছে। যদি এখানে না ঠেকত তা হলে লোকটা আরো দূরে-দূরে ভেসে যেত। এই ফ্লাডের তিস্তা থেকে সে এক আজলা জলও ত পেত না। বাঘারুর দিকে তাকিয়ে এতক্ষণে নরেশ আর অমূল্য তাকে উদ্ধার করার জন্য আবেগ বোধ করে–জলে ভাসা ক্ষুধার্ত একটা মানুষকে উদ্ধার করার আবেগ। অফিসারটা এসে গেল বলে না-হয় নরেশ টাকার কথা বলেছে। কিন্তু অফিসারটা যদি না আসত আর এই লোকটাকে যদি এই চালের ওপর তারা বসে থাকতে দেখত, তা হলেও, তারা ঐ নৌকো নিয়ে এরকমই বেরিয়ে পড়ত। অমূল্য চালের ওপর দিয়ে হেঁটে, নরেশকে পেরিয়ে, বাঘারুর কাছে যায়। তারপর বাঘারুর হাত ধরে বলে, চলেন ত। এইঠে জলের মইধ্যে বইস্যা বইস্যা শুখায়্যা মইরবেন নাকি? চলেন। রাইতটা থাকেন। খান। ঘুমান। তারপর না হয় আপনি আপনার গাছ নিয়্যা ভাইস্যা যাইবেন। 

ভোখ পাইছে, কিন্তু ঐঠে ত অফিসার আছে।

আরে, শুনেন, আমরা এই চরের মানষি। এই চরে আমাদের খেতি-ঘর সব অমূল্য বলে। 

চরুয়া? 

হয়, হয়, চরুয়া। এই যে-চালডার উপর খাড়ায়া আছেন–এইডার যে-মালিক স্যায় ঐ বাধে আছে। আমার বাড়িখান ঐ দিকে। এর বাড়িখান ঐ দিকে। ফ্লাডের জইন্যে আমরা সব গিয়্যা ঐখানে বাঁধে উঠছি। আমরা কব, আপনি আমাগ মানষি, চরে আটকা পড়ছিলেন, আমরা তুইল্যা আনল্যাম, ত অফিসার করব কী? 

গাছগিলা? গয়ানাথ দেউনিয়ায় নখত অফিসারের ঝগড়া কাজিয়া। 

নরেশ হেসে ওঠ, কিছুট অকৃত্রিম, কিছুটা বানানো, তিস্তার বানাভাসা গাছের আবার আফিসার আছে নি? আরে চলেন ত! নরেশ গিয়ে বাঘারুর সেই হাতটাই ধরে যেটা অমূল্য ধরেছিল। 

বাঘারুকে এমন হাত ধরে টানাটানি করে কেউ কোথাও কখনো সাধে নি। তার সন্দেহটাও সেখানেই। কিন্তু তার খিদেটা বড় বেশি সত্য হয়ে উঠছে। রাতটা কাটানোর পক্ষে এই জলের চাইতে ঐ বাঁধ নিশ্চয় ভাল। তা ছাড়া সে ত গাছগুলো নিয়ে যে-কোনো সময়ই ভেসে যেতে পারে। বাঘারু পা বাড়ায়। 

নরেশ বাঘারুর হাতটা ছেড়ে দিয়ে আগে সুপুরি গাছে যায়। অমূল্য বাঘারুর হাতটা ধরেই ঘোরে, যেন, পেছনে মাঠ আছে, ছেড়ে দিলে বাঘারু দৌড়ে পালাবে। সুপুরি গাছের সামনে এসে অমূল্য বলে, নামেন আগে। বাঘারু হাতের ইশারায় অমূল্যকে নামতে বলে। অমূল্য সুপুরি গাছে ঝাঁপ দেয়। নীচে নেমে চেঁচায়, নামেন এহন। বাঘারু সুপুরি গাছে ভর দেয়। বাতাসে সুপুরি গাছটা এত বেশ দোলে যে বাঘারুর শরীরের ওজনে সেটা আর নতুন করে দোলে না। 

নীচে নেমে এখন সমস্য হল–গাছ আর নৌকো নিয়ে চারজন কী করে যাবে। নৌকো করে চারজন চলে যেতে পারত–গাছগুলো এখানে রেখে। কিন্তু নরেশ বা অমূল্যর সেটা বলার সাহসই হয় না। বাঘারুর গলায় সেই নাইলনের দড়ির বান্ডিল–যে-দড়িতে এই গাছগুলোর সঙ্গে বাঘারু আষ্টেপৃষ্ঠে বাধা। কিন্তু হাতে আর-সময় নেই। তাদের এখনই ভাসতে হবে। এখান থেকে তারা ত আর সরাসরি উল্টো দিকে যেতে পারবে না–স্রোতের মুখে তাদের কোনোকুনি ভাসতে হবে–তারপর ওপারে যেখানে গিয়ে ঠেকে। সেখান থেকে আবার পাড় দিয়ে নৌকো টেনে বাঁধের কাছে নিয়ে যেতে হবে। 

হে কাদাখোয়া–এই গাছগিলা কি নৌকাত বান্ধা যাবে? নরেশ জিজ্ঞাসা করে।

না হয়। নৌকাত গাছের ধাক্কা নাগিলে ডুবি যাবে, কাদাখোয়া বলে।

তোমরালা নৌকাত যাও কেনে, মুই গাছত যাছি, বলে বাঘারু আলগোছে তার মাচানে উঠে যায়। সেই মুহূর্তে এটাকে একমাত্র উপায় মনে হয়। নরেশ আর দেরি না করে বলে, তা গাছ ছাড় আগে, কুথায় তোমার নোঙর বাইন্ধছ? নরেশ হেসে ফেলে। বাঘারু একটা গাছের ডাল থেকে দড়ির পাক খুলতে হাত দেয়। নরেশ ঘেঁজে আর-কোথায় বাধন আছে–দেখে, অশ্বিনী রায়ের চালের টঙে।হে কাদাখোয়া, খোল কেনে, ঐখান খোল। 

কাদাখোয়া তাকিয়ে একবার দেখে। তারপর গাছের ডালে-ডালে সে ওপরে উঠে যায়। কাদাখোয়া আর বাঘারু দুজনের ওজনে গাছগুলো দুলে ওঠে, দুলতে থাকে, কিন্তু ডোবে না। মনে হয় যেন ওরা দুজনই ভাসমান গাছগুলোর ডালে ওঠার সময় নিজেরা মাধ্যাকর্ষণের টান অতিক্রম করে গেছে। নীচের নৌকোয় দাঁড়িয়ে নরেশ আর অমূল্য বাঘারু আর কাদাখোয়ার শরীরের চেহারার মিলটাও আবিষ্কার করে। আপাদমস্তক নগ্ন শরীর থেকে তাদের হাতগুলো ডালের মত আকাশে উঠে যাচ্ছে আর নেমে আসছে। 

দুদিকের বাধন খোলা সত্ত্বেও গাছগুলো নড়ে না। বাঘারু নীচে নেমে এসে কাদাখোয়াকে বলে, ঐঠে একখান আছে, ঐ নৌকাখানের কাছত। কাদাখোয়া সেই তলার বাধনটা খোঁজে, পায় না। বাঘারু ততক্ষণে উল্টোদিকের নীচের বাধনটা খুলে দিতে শুরু করেছে। আর সেই বাধনটা ঢিলে হওয়া ও খোলার সঙ্গতিতে গাছের বহর স্রোতের টানে নড়ে ওঠে। 

কাদাখোয়া বলে ওঠে, নাই রো। বাঘারু, খাড়ান কেনে, বলে তার বাধনটা খুলে দেয়। গাছের বহর স্রোতের টানে অশ্বিনী রায়ের ঘরের সঙ্গে লেগে যায় আর সেই ধাক্কায় নৌকোটা যেন গাছগুলোর ভেতর ঢুকে যায়। বাঘারু আবার ডালে-ডালে এদিকে চলে আসে। নরেশ আর অমূল্য নৌকাতেই দাঁড়িয়ে ছিল লগি হাতে। কাদাখোয়াকে বাঘারু বলে, নৌকাত যান, এটা খুলিলেই ত সোতের মুখে ভাসি যাবে। কাদাখোয়া নৌকায় যায়। নৌকাটা গাছগুলোর এত ভেতরে সেঁদিয়ে গেছে যে এই গাছগুলো ভেসে গেলে নৌকাটা কী করে যাবে, ঠিক বোঝা যায় না। 

হঠাৎ কাদাখোয়া বলে ওঠে, খাড়ি যান, খাড়ি যান।

বাঘারু দাঁড়িয়ে পড়ে। কাদাখোয়া নৌকোর বাঁধনটা খুলে দেয় আর স্রোতের ধাক্কায় নৌকোটা গাছগুলোর ভেতর সেঁদিয়ে গিয়ে আটকে যায়, এমন, যেন ওটাও একটা গাছ। নরেশ একটু ভয় পেয়ে বলে ওঠে, হে কাদাখোয়া দেখিস কেনে, গাছ চাপা পইড়লে নৌকা ত ডুইব্যা যাবে নে। 

কাদাখোয়া কোনো জবাব দেয় না। সে নৌকোটাকে আরো একটু ঠিক করে নিয়ে অমূল্য আর নরেশকে বলে, লগি ধরেন, লগি ধরেন। নরেশ আর অমূল্য লগি ধরলে কাদাখোয়া বাঘারুকে বলে, খুলেন কেনে, খুলেন। 

এদিকের বাধনটা যেখানে দেয়া ছিল, জল বেড়ে যাওয়ায় সেটা জলের তলায় চলে গেছে। . বাঘারুকে একটা ডাল বা হাত ধরে, ঝুঁকে ডান হাতে জলের তলার ঐ বাধনটা খুলতে হয়। প্রথম গিঠটা খুলতেই স্রোতের তোড় গাছের বহরকে একটু টেনে নেয়। বাঘারু বা হাতের ডালটা শক্ত করে ধরে একটা হ্যাঁচকা টান মারতেই গাছগুলো স্রোতের মুখে ভেসে যেতে গিয়ে আটকে যায়, ঘরের কোনায় একটা গাছের বড় ডাল আটকে গেছে। বাঘারু সেটা খোলে না। বরং সেই সুযোগে সে নৌকোর ওপর চলে আসতে পারে। আর, সেই ঝাঁকিতেও বটে, স্রোতের টানেও বটে, অশ্বিনী রায়ের গুয়াবাড়ির নোঙর ছেড়ে সেই বহর ঘোলাটে আকাশের নীচে তিস্তার ঘোলাটে স্রোতে উচ্ছন্ন বেগে ভেসে যায়। বাতাসের বিপরীত ধাক্কায় গাছের পাতায়-পাতায় এক ভাসমান ঝড়ের অলৌকিকতা সঞ্চারিত হয়। 

লগি মারেন, লগি মারেন, আঁকতে-হাঁকতে কাদাখোয়া তার লগিটা নিয়ে বাঘারুর গত রাত্রির অন্ধকারে হাতড়ে-হাতড়ে পাওয়া অভিজ্ঞতা আত্মসাৎ করে বেড়ালের মত পায়ে বাঘারুর মাচানে গিয়ে ওঠে আর সেইখান থেকে শুধু তার বায়ে লগি মারতে থাকে, এবার আর আগের মত বর্শা দিয়ে জল বিধবার মত করে নয়, লগিটা মেরে ঠেলছিলও একটু। বারকয়েক লগি মেরেই কাদাখোয়া চেঁচায়, এই গাছুয়ামানষিখান, উঠি আসেন, এইঠে, উঠি আসেন। বাঘারু নৌকো থেকে ডালে-ডালে তার মাচানে চলে যায়। এইঠে লগি মারেন, লগি মারেন, বলে কাদাখোয়া তার লগিটা বাঘারুর হাতে ধরিয়ে দেয়। বাঘারু লগি মারতে থাকে, কাদাখোয়া দাঁড়িয়ে সামনে তাকায়। যেন–গয়ানাথের এক বাঘারু এখন দুটো মানুষ হয়ে গেছে, তিস্তার ওপরে ঐ গাছের মাচানে তাদের এতই মিল। 

আসলে, যে-হিশেব কষে কাদাখোয়া হঠাৎ নৌকোটাকে গাছগুলোর মধ্যে সেঁদিয়ে দিয়েছিল সেটা অদ্ভুত মিলে গেল। এতগুলো গাছ এমন জড়ো করে বাধা যে জলস্রোত গাছের ভেতরে পুরো জোরে লাগে না। সেই গাছগুলোর ঢাকনায় নৌকোতে নরেশ আর অমূল্য লগি মারার এমন সুযোগ পায় যাতে স্রোতের ভেতরেও এই বহর স্রোতটাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। ক্রমাগত বায়ে লগি মারায় ওরা খুব বেশিদূর ভেসে না গিয়েই কোনাকুনি বাঁধের দিকে যেতে থাকে। ইস্, আর-একখান লগি থাকিলে সিধা পার হওয়া ধরিতাম হে, কাদাখোয়া তিস্তার ঘোলা স্রোতের দিকে তাকিয়ে চেঁচিয়ে বলে। 

.

১৪৮. সন্দেহ ও সংশয়

বাঁধের ওপর থেকে দেখা যায়, অশ্বিনী রায়ের চাল থেকে অমূল্য, নরেশ আর কাদাখোয়া সুপুরি গাছে চড়ার একটু পরে সেই গুয়াবাড়ির দক্ষিণ দিয়ে নৌকোর বদলে একটা বিরাট গাছের বহর নদী দিয়ে ভেসে যাচ্ছে। নৌকোটা গাছগুলোর এত ভেতরে যে বাধ থেকে দেখা যায় না। এমন-কি, কাদাখোয়া আর বাঘারু যে মাচানের ওপর দাঁড়িয়ে, সেটাও গাছের ডালপালায় আড়াল হয়ে থাকে। বন্যার সময় তিস্তা দিয়ে এরকম গাছ ত ভেসে যেতে পারেই, কিন্তু ওরা চাল থেকে সুপুরি গাছে উঠল আর তারপরই ঐ ফাঁক থেকে নৌকোর বদলে বেরল গাছের এই প্রকাণ্ড বহর–তাতেই সবার নজরে পড়ে যায়। তাও নজরে পড়ত না যদি গাছগুলো অশ্বিনী রায়ের গুয়াবাড়ির ফাঁকটা দিয়ে সোজা চলে যেত। কিন্তু সোজা বেরিয়েও গাছগুলো ঐ স্রোতটা থেকে আড়াআড়ি কোনাকুনি বয়ে আসে। কয়েকদিন ধরে এই খাতটাকে জলে ভরে উঠতে দেখে-দেখে স্রোতের ধারাটা এদের প্রায় সবারই চেনা হয়ে গেছে। তারা বোঝে, ঐ গাছ শুধু গাছ হতে পারে না, যদি হত তা হলে নদীস্রোতে সেটা অন্য রকম ভাসত। গাছগুলো বেরবার পরও বাঁধের লোকজন অপেক্ষা করে-নৌকোটা কখন বেরয়। কিন্তু প্রতীক্ষিত, সময়ের মধ্যে নৌকোটাও বেরয় না, গাছগুলোও সোজা না গিয়ে একটু কোনাকুনি হয়ে যায় তখন তারা এই দুইয়ের ভেতর যেন একটা সম্পর্ক থাকতে পারে বলে সন্দেহ করে। প্রথম কথাটা অশ্বিনী রায়ই বলে ওঠে, খাইসেন, খাইসেন, হামার কাঁঠাল আর লিচু গাছখান কায় কাটি দিসে হে, কায় কাটি দিসে। 

কথাটা শোনার পরও সবাই একটু চুপ করে থাকে। এটা কি ঠিক হওয়া সম্ভব? 

নরেশ-অমূল্য নৌকোর ওপর আছে। এই সময় যদি কেউ ঐ গাছ কেটে নিয়ে যায়, তা হলে তারা কি বাধা দিত না? এরকম অবিশ্যি এমন কাছাকাছি চরে হতেও পারে। বন্যার সুযোগে কেউ-কেউ নৌকো করে এসে গাছটাছ কেটে নিয়ে যায়। কিন্তু এই চরে তা করতে হলে এই বাধ থেকেই যেতে হবে। নাকি, যে-লোকটাকে সকালে দেখা গিয়েছিল সেই লোকটাই এই সব গাছ কেটে ভাসিয়ে নিয়ে যাবার জন্যে অপেক্ষা করছিল+অমূল্য আর নরেশ গিয়ে তাকে ধরেছে? কিন্তু তাই যদি হয়, তা হলে গাছগুলোকে কি এমন ভাসিয়ে দেবে? তা যদি হয়, তাহলে ত নৌকোটা পেছনে-পেছনে বেরবে! 

কেউ একজন বলে ওঠে, অশ্বিনী কাহার কাঠল আর লিচু গাছ কি ফ্লাডের জল খাইয়্যা শালগাছের নাগান বাইড়া গিছে? দ্যাহেন না, গাছ না, য্যান একখান ফরেস্ট! 

এত দূর থেকেও চোখের আন্দাজে বোঝা যায় এ গাছগুলো অশ্বিনী রায়ের বাড়ির গাছ নয়। সেকথাটা একজন বলে দেয়ার পর সকলেরই মনে হতে থাকে। জগদীশ বারুই গাছের আভাস পায়, কিন্তু পরিস্থিতিটা বুঝতে পারে না। সে নদীর দিকে সোজাসুজি তাকিয়ে চিৎকার করে বলে, আরে, গেল তিনজন মানুষ একখান নৌকায় আর তরা কত্যাছিস গাছের কথা? গাছের কথাডা আইল কোথ থিক্যা, অ্যাঁ? গাছের কথাডা আইল, কোথ থিক্যা?

জগদীশ বারুই চীৎকার করে বললেও, তার কথার কোনো জবাব কেউ দেয় না। বরং চাপা গলায় কেউ বলে ওঠে, হ্যাঁ, পাড়ের দিকেই ত আসে, হ্যাঁ, পাড়ের দিকেই আসত্যাছে। 

সেই চাপা স্বরে বিস্ময়টা আরো পরিষ্কার হয়। তারপরই এই ভিড়টা থেকে অনেকে বাধ ধরে ওপরে উঠে যায়, প্রায় দৌড়ে বাঁধের ওপর উঠে তারা বাধ ধরে দৌড়তে থাকে দক্ষিণে। নৌকোটা চর থেকে যখন ফিরবে, তখন আরো ভাটিতে গিয়েই লাগবে, তারপর পাড় ধরে ধরে এখানে ফিরে আসবে–এটা সবারই জানা। কিন্তু নৌকোর বদলে এত বড়-বড় গাছ একসঙ্গে স্রোতে ভেসে বেরিয়ে এল, আর স্রোত কাটিয়ে একটু আড়াআড়িই পার হল–এটা তাদের হিশেবের বাইরে। তাই বাঁধের ভিড়টা ভেঙে যায়। অনেকেই বাঁধের ওপর দিয়ে ছুটতে শুরু করে, যেখানে গাছগুলো এসে ভিড়বে সেখানে গিয়ে দাঁড়ানোর জন্যে। বাঁধের ভিড়টা ভেঙে যায়, দৌড়োদৌড়ি শুরু হয়, এই সব মিলিয়ে যেন একটা রহস্যের আভাস আসে। সকালে লোকটা চালের ওপর থেকে উধাও, বিকেলে তিন-তিনটে মানুষ নৌকোসুদু উধাও, তার বদলে এতগুলো গাছের স্রোত বেয়ে আসা– সব মিলিয়ে পরিস্থিতি বেশ জটিল হয়ে পড়ে। 

কিছু লোক বাধ বেয়ে উঠেছে আর কিছু লোক বাঁধের ওপর গিয়ে দাঁড়িয়েছে বলে পাড়ের বোল্ডারের ওপরের ভিড়টা আলগা হয়ে যায়। অফিসার বাঁধের ওপর উঠতে-উঠতে বলে, মশাই, মনে হচ্ছে ফ্লাড এক আপনাদের এখানেই হয়েছে। এক জায়গায় এসে যদি এতক্ষণ আটকে থাকতে হয় তা হলে অন্য জায়গায় যাব কখন? 

রঘু ঘোষের পেছন-পেছন উঠতে-উঠতে লিলি বলে, চলোনা, ঐ দিকে যাই–দেখি কী হল?

 রঘু ঘোষ পেছন না-ফিরেই বলে, আর ওখানে যেতে হবে না। এতক্ষণ এই বৃষ্টি আর বাতাসে আছো, সারা রাত ত বসে বসে খাস টানবে। এখন বাগানে চলো। অনেক দেখা হয়েছে। 

গুদামবাবু বধের ওপর আগেই উঠে গিয়েছিলেন। উনি বলেন, হ্যাঁ, হ্যাঁ। চলুন। এ-সব হাঙ্গামায় আর জড়িয়ে লাভ নেই। 

রঘু ঘোষ বলে, হাঙ্গামা আবার কী? 

গুদামবাবু–বাঃ, একটু আগে ত আপনাকেই দোষ দিচ্ছিল। এরপর দেখুন, ঐ গাছ না কী তাই নিয়ে আবার কী গোলমাল হয়? 

অফিসার এদের কাছেই ছিল, বলে, আরে মশাই, এদের ত রেসকিউয়ের নামে একটার পর একটা গোলমাল বেড়েই চলেছে। নৌকোটা গেল কোথায়? 

এরকম সময় সেই গাছগুলো একটু ঘুরে যায়, আর তাতেই ডালপালার ফাঁক দিয়ে বাঁধের এই জায়গাটা থেকে দেখা যায়–গাছের ওপরে কাদাখোয়া দাঁড়িয়ে আছে। একবারমাত্র দেখা যায় কিন্তু যারা দেখে তারা চিনে ফেলতে পারে–কাদাখোয়া, কাদাখোয়া, গাছগিলার মাথা কাদাখোয়া। গাছগিলার মাথাত কাদাখোয়া। ঐ দিকে গাছগুলো পাড়ের কাছাকাছি চলে এসেছে। যারা ওদিকে দৌড়ে গেছে, তারা নিশ্চয়ই আরো স্পষ্ট ভাবে দেখতে পাচ্ছে। এখানকার লোজন বাঁধের ওপর দিয়ে সেদিকে তাকিয়ে থাকে। এর মধ্যে গাছগুলো আরো ঘোরে। দেখা যায়, সত্যি কাদাখোয় দাঁড়িয়ে আছে। গাছগুলো আরো ঘোরে। দেখা যায়, কাদাখোয়র পাশে আর-একজন, কাদাখোয়ার মতই, দাঁড়িয়ে। কিন্তু নরেশ-অমূল্য নেই। সবাই গাছগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকে–কোনো ফাঁক দিয়ে নরেশ-অমূল্যকে যদি দেখা যায়। নরেশ-অমূল্য চরে যদি আটকে গিয়ে থাকে? কোনো বিপদ ঘটেছে নাকি? একা কাদাখোয়া ফিরে আসছে? সঙ্গে একটা লোক আছে, সে নিশ্চয়ই সকালের সেই লোকটাই? নাকি, নরেশ-অমূল্য পরে নৌকো নিয়ে আসবে? এ স্রোতে দুজনে একটা নৌকো চালাবে কী করে? 

গাছগুলো পাড়ের আরো কাছাকাছি চলে এসেছেকাদাখোয়া আর ঐ লোকটাকে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। এইবার গাছগুলো এই বাঁধের তাড়ালে চলে যাবে। ওখানে বাঁধের একটা বাক আছে, ডাইনে। গাছগুলো সেই বাকটার আড়ালে চলে যাবে। এখান থেকে কী করে জানা যাবে–গাছগুলো ওখানেই থাকবে, নাকি টানতে-টানতে এখানে নিয়ে আসা হবে। 

বাঁধের ওপর যারা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল তারা আরো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে যায়। কেউ-কেউ বাধ ধরে দক্ষিণের সেই বাকটার দিকে হাঁটা শুরু করে। বানভাসি যে-মেয়েরা এতক্ষণ বাঁধের ঢালের নানা জায়গায় দাঁড়িয়ে নদীর দিকে তাকিয়ে ছিল, তারা এখন বাঁধের ওপর উঠে এসে গরুগুলোর পাশে, দাঁড়িয়ে বা একটু এগিয়ে কপালে হাত দিয়ে বাঁধ বরাবর তাকায়। এখন রোদ নেই। হাওয়া ও বৃষ্টি অব্যাহত। কিন্তু দূরে তাকাবার জন্যে মেয়েদের ভঙ্গি ঐ একটাই। গরুগুলোও এতক্ষণ নদীর দিকে তাকিয়েছিল। তারাও শরীর না ঘুরিয়ে শুধু ঘাড়টা ডান দিকে ফেরায়। ব্যবধান রেখে মাঝে-মাঝে এক-একটা গরু হা-স্বা ডেকে ওঠে, গম্ভীর, প্রলম্বিত  হাম্বা। তারই মধ্যে, বাতাসে ঐ বাকের আড়াল থেকে মানুষের সমবেত চিৎকার শোনা যায়। এখানকার সবাই কান পেতে বুঝতে চায়, চিৎকারের ভেতর বিপদের কোনো সঙ্কেত আছে কিনা। 

.

১৪৯. বাঘারু ও কাদাখোয়ার সংবর্ধনা

চিৎকারটা উঠে নেমে যায় বটে, কিন্তু থামে না। বাতাসটা ওদিক থেকে এদিকে আসছিল বলে ওখানকার চেঁচামেচি এখানে শোনা যাচ্ছিল। বোঝা যায়, খারাপ কিছু ঘটে নি। মাঝে-মাঝেই চিৎকারটা আবার বাড়ছিল।

তারপরই দু-একটি বাচ্চা ওদিক থেকে বাঁধ দিয়ে দৌড়তে-দৌড়তে এদিকে আসে। আর, তাদের সেই দৌড়ের সঙ্গে ছন্দ রেখেই ওদিককার চিৎকারটাও এগতে থাকে–বাধ ধরে নয়, বাঁধের একটু নীচ দিয়ে, নদীর পাশ দিয়ে, বোল্ডারগুলোর ওপর দিয়ে। বাঁধের এখানে যারা দাঁড়িয়েছিল, তারা ঠিক বুঝে উঠতে পারে না কোন দিকে তাকিয়ে থাকবে–এখান থেকে নদীর দিকে কোনাকুনি, নাকি বাঁধের ওপর দিয়ে সোজাসুজি। যে বাচ্চাগুলো দৌড়ে আসছিল তারা পেছনে ফিরে কিছু দেখে দাঁড়িয়ে পড়ে, তারপর আবার দৌড়তে শুরু করে। 

তখনই দেখা যায়–সেই গাছগুলো বাকটা পেরিয়ে এদিকে আসছে, মানে পাড় দিয়ে গাছগুলোকে টেনে আনা হচ্ছে। গাছগুলো আর-একটু এগতেই দেখা যায়–গাছগুলোর সামনে নৌকোটা আর তাতে নরেশ আর অমূল্য দাঁড়িয়ে। পাড়টা উঁচু বলে নৌকোটা এতক্ষণ দেখা যাচ্ছিল না। নরেশ আর অমূল্য যে দাঁত বের করে হাসছে, সেটাও এখান থেকে দেখা যাচ্ছে। 

নরেশ আর অমূল্যর মাথার ওপরে, গাছের ডালের মধ্যে কাদাখোয়া আর সেই লোকটি দাঁড়িয়ে। দুজনেরই কোমরে হাত। একটা সোনালি দড়ি সেই গাছের ডালের মাথায় কাদাখোয়া আর লোকটির ভেতর থেকে পাড় পর্যন্ত ঝুলছে আর সেই দড়ি ধরে নৌকো আর গাছগুলোকে সবাই টানতে-টানতে নিয়ে আসছে। নৌকোর ওপর অমূল্য আর তার মাথার ওপরে ডালের মধ্যে কাদাখোয়া লগি দিয়ে দিয়ে পাড়ে মারছে–যাতে গাছগুলো পাড়ে ঠেকে না যায়। তাতেও পুরোটা সামলানো যাচ্ছে না, কারণ, গাছের পেছনের ডালপালা পাড়ে লেগে যাচ্ছে। এতজন দড়িটা ধরে টানছে যে–গাছগুলো আবার পাড় থেকে সরে যাচ্ছে। যারা টানছিল তারা কেউ-কেউ বোল্ডারের ওপর, কেউ-কেউ বোল্ডার আর নদীর মাঝখানের সংকীর্ণ পথটা দিয়ে আগে-আগে আসছে। তারা দড়ি টানছে না, যেন, গাছগুলো আর নৌকোটাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে আসছে।

কতটুকু আর দূরত্ব? দেখতে-দেখতে এরা সবাই বাঁধের এই অস্থায়ী ক্যাম্পের জায়গাটায় পৌঁছে যায়। পৌঁছনোর আগেই সবাই দেখতে পায়–সেই নতুন লোকটির গলায় নাইলনের দড়ির বড় বান্ডিল–আর সেই দড়িটাই পাড়ের লোকজনের হাতে। তারা ঐ দড়ি ধরেই গাছ আর নৌকো টানতে টানতে নিয়ে আসছে। 

বহরটা এসে দাঁড়ায় সেখানে, যেখানে সবাই প্রথমে ভিড় করেছিল। নদীর ভেতরে নৌকোয়, পাড়ের একটু নীচে, নরেশ আর অমূল্য, আর পাড় থেকে অনেক ওপরে, নদীরও অনেক ওপরে কাদাখোয়া আর সেই নতুন লোকটি। 

পাইছে, পইছে, গুয়াবাড়ির মানষিটাকে পাইছে।

সেই ফরেস্টঠে সারা রাতি ভাসি আসিছে।

সারা রাতি গাছের উপর ভাসি-ভাসি আসিছে।

ভাইস্যা আসত্যাছিল, গাছগিলা পায়্যা ধইরছে।

এত বড় দড়ি পাইল কোথ থিক্যা? জলে ভাইসব্যার আগে কি গলায় দড়ি দিছিল নাকি?

এ-সব নানা প্রশ্নোত্তরের মধ্যে নরেশ আর অমূল্য পাড়ে উঠে আসে। কাদাখোয়া আর বাঘারু নামে না–তারা ঠিক বুঝে উঠতে পারে না, তারা এখন নামবে কি না। নরেশ পাড়ে নেমেই জিজ্ঞাসা করে, কই, স্যার কই? 

নরেশের কথার প্রতিধ্বনিতে আরো দু-চারজন জিজ্ঞাসা করে, কই, অফিসার কই? 

আর, এর মধ্যেই কেউ নরেশকে বলে দেয়, অফিসার বাঁধের ওপরেই আছে। নরেশ বাঁধের ওপর উঠতে থাকে। তার পেছনে-পেছনে আরো অনেকে উঠলেও, সামনে কেউ থাকে না। সেই ঢাল বেয়ে নরেশের উঠে আসার জন্যেই যেন ঢালটা ফাঁকা। সেই ফাঁকার শেষ বাঁধের ওপরে অফিসার এসে দাঁড়ায়। বাঁধের ওপরে পৌঁছনোর আগে হঠাৎ পেছন ফিরে নরেশ হাত নেড়ে চিৎকার করে ওঠে, এই, দড়িখান বাইন্ধ্যা রাখ কোথাও, ছাইড়া দিস না, ভাইস্যা যাবে নে তালি। চিৎকারটা শেষ করে বাধে পা দিয়েই নরেশ দেখে সামনে অফিসার। এক পা পেছনে গিয়ে, বা হাতটা তার কোকড়ানো চুলের পেছনে দিয়ে, নরেশ তার শাদা দাঁতগুলো বের করে হাসে, তারপর, আইনছি স্যার, ঐ যে, বা হাতটা নামায় বাঘারুকে দেখাতে, চলেন স্যার, বা হাতটা নামিয়ে অফিসারকে পথ দেখায়। সেই পথ দেখানোর জন্যেই, নরেশের পেছনে যারা ছিল তারা, দুদিকে সরে যায়। মাঝখানে একটা পথের মত হয়ে যায়। 

নরেশ ঐভাবে হাত দেখানোর জন্যেই হোক, অথবা নরেশের পেছনের লোকগুলো দুদিকে সরে গিয়ে পথ করে দেয়ার জন্যেই হোক, অফিসার নরেশের পিঠে সস্নেহ হাত রাখে। তারপর নরেশের দেখানো পথে বোল্ডারের ঢালে নামার জন্যে পা বাড়িয়ে একবার দুদিকে তাকায়, হাসিমুখে, যেন এই সময় ওখানে টিভি ক্যামেরা, অন্তত প্রেসের ফটোগ্রাফারদের থাকার কথা ছিল। না-থাকলেও, তারা আছে এমন এক বিশ্বাসে অফিসার ধীরে-ধীরে ঢালটা বেয়ে বোল্ডারের পাড়ে নামে। সামনে নদী। বোল্ডারের পাড় পেরিয়ে নদীর ধারে গাছগুলো আর নৌকোর সামনে গিয়ে অফিসারকে দাঁড়াতে হয়। যেন এই ঢাল আর বাঁধ ধরে এতক্ষণ সে বারবার ওঠানামা করছিল না, যেন এইমাত্রই সে গাড়ি থেকে নেমে পূর্বনির্ধারিত কর্মসূচি অনুযায়ী নদীর পাড়ে এসে দাঁড়াল। 

অফিসার আর নরেশ পাশাপাশি দাঁড়িয়ে, তাদের পেছনে ভিড়। সামনে, প্রায় মাথার ওপরে কাদাখোয়া আর বাঘারু। তারা বোঝে না তাদের কী করতে হবে। নরেশ চেঁচিয়ে ওঠে, আরে, নাইমা আসেন, দ্যাহেন না স্যারে আইছে।

শুনে, বাঘারু মাচানের ওপর থেকে তার কুড়ালিয়াটা নিয়ে পেছনে নেংটির ওপরে গেজে। কাদাখোয়া লগিটা নিয়ে নীচের ডালে পা দেয়, তারপর বাঘারু একটু নিচু হয়ে কাদাখোয়াকে ডাল থেকে পাড়ে উঠতে সাহায্য করে ও নিজে মাচান থেকে নীচের ডাল, ডাল থেকে পাড়ে উঠতে সাহায্য নেয়। বাঘারুকে টেনে নেয়ার জন্যে পাড়ে নেমে কাদাখোয়াকে অফিসারের দিকে পেছন ফিরতে হয়, তারপর বাঘারু নামলে দুজনে এক সঙ্গে অফিসারের সামনে দাঁড়ায়। বাঘারুর গলায় হলুদ দড়ি দোলে। অফিসার ঠিক বুঝে উঠতে পারে না তাকে কী করতে হবে। নরেশ ওদের দেখিয়ে বলে, স্যার, ভাইস্যা আইসছে সেই ফরেস্ট থিক্যা–গাছগাছালি নিয়্যা।

এরপর যেন অফিসারের একটা কাজ করাই বাকি থাকে। সে বাঘারুর হাতটা ধরে। 

অফিসার হ্যান্ডশেকের ভঙ্গিতেই হাতটা এগিয়েছিল। কিন্তু বাঘারু হাতটা না বাড়ানোয় সে বাঘারুর শরীরের পাশে ঝুলে থাকা হাতের কব্জিটা ধরে ঝাঁকায়। তারপর ছেড়ে দেয়। এবার কাদাখোয়র দিকে আর হাত বাড়ায় না–একবারেই কব্জিটা ধরে ঝাঁকায় ও ছেড়ে দেয়। অফিসার হয়ত ভেবেছে এই দুজনই ভেসে এসেছে–দুজন এমনই একরকম দেখতে। অথবা, দুজন এমনই পাশাপাশি দাঁড়িয়ে যে তাদের সঙ্গে একই ব্যবহার করা ছাড়া অফিসারের আর-কোনো গতি নেই। কিন্তু কাদাখোয়াকে ত বাঁধের বানভাসিরা সবাই চেনে। অফিসার তার হাত নেড়ে দেয়ায় সবাই মজা পেয়ে হাততালি দিয়ে ওঠে। অফিসার সেই হাততালির দিকে তাকিয়ে হেসে মাথা নাড়ায়। 

.

১৫০. সংবর্ধনার পরে বাঘারু ও কাদাখোয়া

 বাঘারু আর কাদাখোয়া বোঝে না তাদের এখন কী করতে হবে–নরেশ বা অফিসারও বোঝে না। সবাই হাততালি দিয়ে ওঠায় নরেশ সেদিকে তাকিয়ে হাসে। এর মধ্যে অমূল্য এসে নরেশের পাশে পঁড়ায়। অফিসার আবার হাসিহাসি মুখে কাদাখোয়া আর বাঘারুর দিকে, তাদের পেছনে নদীর দিকে, বায়ে নরেশ-অমূল্যর দিকে, ও এমন-কি, ঘাড় ঘুরিয়ে বাঁধের দিকে তাকিয়ে নেয়। বাঁধের ওপর যারা দাঁড়িয়ে ছিল তারা নীচে হাততালি শুনে ঢাল বেয়ে নীচে নামতে শুরু করে। অফিসার নরেশের দিকে তাকিয়ে এতক্ষণে বলে, তা হলে ত তোমাদের রেসকিউ হল। এবার তা হলে আমার ছুটি, কী বলো? 

নরেশ আবার মাথা চুলকে বলে, হ্যাঁ স্যার, আপনার কষ্ট হইল কত!!

বাঁধে উঠবার জন্যে ঘুরতে-ঘুরতে অফিসার বলে, আরে, আমার ত এইই কাজ, এতে আবার কষ্ট কী? এই কথাটা শেষ করার জন্যে অফিসারকে হাত দিয়ে নরেশের কাঁধ ছুঁতে হয়। কিন্তু নরেশ এতটাই লম্বা যে-তার কাধ ধরতে হলে অফিসারের হাতটা টানটান করতে হয়। তাই, অফিসার তার পিঠের ওপর হাতটা রেখে নামিয়ে নেয়। সেই সুযোগে নরেশ ঘাড়টা নামিয়ে অফিসারকে বলে, স্যার, আমাগো পেমেন্টটা? 

হ্যাঁ, চল, এখনই পিচশ দিয়ে দিচ্ছি। আর কাল আমার অফিসে এসো

স্যার, আপনার অফিস ত চিনি না, নরেশ সোজা হয়ে, অপরাধীর ভঙ্গি করে।

দীপ্তি টকিজ চেনো ত?

হ্যাঁ, স্যার।

আর-একটু সোজা গেলেই ফায়ার ব্রিগেড

 চিনি সার, পেছন থেকে অমূল্য বলে। 

তার পাশেই, এবার অফিসার হাঁটতে শুরু করে। কিন্তু নরেশ আবার বলে ওঠে, স্যার, আপনারে জিপ পর্যন্ত আগাইয়া দেই, ঐখানেই পেমেন্ট দিবেন। 

জিপ ত ঠিক বাঁধের ঐ পাড়ে এনে রেখেছি। ঠিক আছে চলো অফিসার বাধে উঠতে শুরু করেন, পেছনে-পেছনে অমূল্য আর নরেশ। তার পেছনে ভিড়ের লোকজন। বাঁধের ওপর থেকে যারা নেমেছিল তারাও এদের সঙ্গে মিশে যায়। কাদাখোয়া আর বাঘারু বোঝে না–তাদের কী করতে হবে। কিন্তু তাদের যখন গাছ থেকে নামতে বলা হয়েছে তখন তাদেরও নিশ্চয় বাঁধের ওপরই উঠতে হবে–এ-রকম একটা সহজ ধারণা থেকে তারাও এই ভিড়ের সঙ্গে বাঁধের ওপর উঠতে শুরু করে। বাচ্চারা ততক্ষণে কাদাখোয়া আর বাঘারুর ব্যাপারে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে, তারা ওদের দুজনকে ধাক্কা দিয়ে-দিয়েই এগিয়ে যায়। বাঘারু আর কাদাখোয়া পেছনে পড়ে যায়। তারা ভিড়ের পেছনেই বাঁধের ঢাল বেয়ে ওপরে উঠতে থাকে।

একটু ওঠার পরই বাঘারুর গলা থেকে সেই হলদে দড়ি, গাছ পর্যন্ত, দুলতে থাকে। যারা এতক্ষণ দড়ি ধরে টেনে এনেছিল, তারা ত দড়িটাকে বোল্ডারের ওপর ফেলে রেখে বাঁধের ওপর নীচে ভিড়ের। নানা অংশে মিশে যায়। এখন বাঘারু যত উঁচুতে উঠছে, দড়িটাও তার সঙ্গে মাটি ছেড়ে ততটা উঠছে। আর, শেষে বাঁধের মাথা থেকে নদী পর্যন্ত ঝুলে থেকে দোলে। 

বাঁধের ওপর উঠে কাদাখোয়া আর বাঘারু আবার দাঁড়িয়ে পড়ে। অফিসারকে নিয়ে ভিড়টা ঢাল বেয়ে বাঁধের বিপরীত দিকে নেমে যাচ্ছে। তারাও সেই ঢাল বেয়ে নামবে কিনা বুঝতে পারে না। কারণ, বেশির ভাগ লোকই আর নামছে না, তারা বাকি ভিড়টার নামা দেখছে। কাদাখোয়া আর বাঘারুকে সেই ভিড়টাতে আটকা পড়ে যেতে হয়। তারা একবার অফিসারের চালের দিকে, আর একবার নদীর ঢালের দিকে এলোমেলো তাকায়। এমন সময় অশ্বিনী রায় ভিড়ের মধ্যে এসে ডাকে, হে-এ কাদাখোয়া। কাদাখোয়া অশ্বিনী রায়ের ডাক শুনে সেদিকে এগিয়ে যায়।  

অশ্বিনী রায় তাকে জিজ্ঞাসা করে, কী দেখি আসিছু রে? ঘরবাড়িখান ঠিকো আছে, না নাই?

কাদাখোয়া প্রশ্নটার মানে না বুঝে বলে, ঐঠে ত জল। 

জল ত, ঐ মানষিখান গুয়াগাছের মাথাত কী কইরবার ধইচছিল?

অশ্বিনী রায়ের প্রশ্ন শুনে ভিড়ের অনেকের মনে পড়ে ঐ লোকটি সুপুরি গাছে চড়ে আর নামে নি কেন সেট দেখার জন্যেই এখান থেকে নৌকো ভাসানো হয়েছিল। হঠাৎ কাদাখোয়া আর অশ্বিনী রায়কে ঘিরে ভিড়টা জমে ওঠে। তাদের ভেতর থেকে একজন জিজ্ঞাসাও করে, কী দেখিলুরে কাদাখোয়া, ক কেনে। 

কিছু দেখি নাই রো—

 কী দেখলু নাই? ঐঠে যে এই মানষিডা আছিল, দেখলু নাই?

হয়। মানষিডা আছিল।

কোটত আছিল?

ঐঠে আছি, জলের ভিতর আছিল।

জলের ভিতরত ভাসি আছিল? না খাড়া আছিল?

 বসি আছিল। বসি আছিল।

ঐটাক ছাড়ি দাও কেনে। নরেশুয়াখান আসুক কেনে, তার বাদে সবখান শুনা যাবে। 

লোকজনের এই সব কথা থামতেই অশ্বিনী রায় একটু যেন ব্লেগেই জিজ্ঞাসা করে, এই মানষিডার গুয়াগাছে উঠিবার কামখান কী আছি? 

অশ্বিনী রায়ের এই প্রশ্নের জবাব খুঁজতে কাদাখোয়া একবার শূন্যে তাকায়–যেন সেই শূন্যে অশ্বিনী রায়ের চাল, আর একবার মাটির দিকে তাকায়, যেন ঐ মাটিতে ফ্লাডের জল আর তাতে গাছগুলোর সঙ্গে বাঘারু ভাসছে। কিন্তু এই কথাটা বলার ভাষা না পেয়ে সে তার ডান হাতটা আকাশে তুলে ধরে বলে, ঐঠে ত চাল, আর এইঠে ত জল! 

উঠিসেন ত উঠিসেন। স্যালায় আবার গুয়াগাছখানত উঠিবার কামটা কী? 

অশ্বিনী রায় তার রাগ বজায় রাখার চেষ্টা করে। নরেশ তার কথার জবাব দেবে না, বা তার সব প্রশ্ন সে সাহসে ভর দিয়ে নরেশ বা অমূল্যকে করতে পারবে না। তাই তারা আসার আগেই সে তার ব্যক্তিগত কথাগুলো তার ব্যক্তিগত মানষিডার কাছ থেকে জেনে নিতে চায়। কিন্তু কাদাখোয়া জানাতে পারে না। সে আবার আকাশের দিকে তাকায়, যেন এখানে অশ্বিনী রায়ের চাল। সে আবার মাটির দিকে তাকায়, যেন ওখানে ফ্লাডে বাঘারু ভাসছে। আর, তারপর ডান হাতটা আকাশে তুলে সে শুধু আবারও বলতে পারে-ঐ ঠে ত চাল আর এইঠে ত জল। 

গুয়াগিলা আছে কি নাই? অশ্বিনী রায় কাদাখোয়র কাছে তার সুপুরি গাছগুলোর ফলের হিশাব চায়। কাদাখোয়া অশ্বিনী রায়ের প্রশ্ন শুনে সকলের মাথার ওপর দিয়ে বাতাস আর বৃষ্টি ভেদ করে সেই চরের দিকে তাকিয়ে দেখে নিতে চায় সপুরি গাছের সুপুরিগুলো আছে কি নেই। 

অশ্বিনী রায় যতটা পারে গলা তুলে বলে, দেখিবার মনত খায় নাই? 

কাদাখোয়া সেই চরের ওপর থেকে অশ্বিনী রায়ের চোখের ওপর তার দৃষ্টি ফিরিয়ে আনে। অশ্বিনী রায় গলাটা আর-একটু তুলে বলে, যা কেনে; গরুগিলাক খোয়া দে, সে আঙুল তুলে দেখায়ও কাদাখোয়াকে কোন দিকে যেতে হবে। সেই অঙ্গুলিনির্দেশিত পথে কাদাখোয়া চলে যায়। 

বাঘারু যেখানে এসে উঠেছিল, সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকে। বাঁধের ওপরের ভিড়টা দুভাগ হয়ে গেছে–একটা ঢাল বেয়ে নীচে অফিসার, নরেশ আর অমূল্যর সঙ্গে, আর-একটা অশ্বিনী রায় কাদাখোয়র সঙ্গে। ফলে, বাঘারু একটু নির্জনেই পড়ে যায় বা দুটো ভিড়েরই পেছনে। ভিড়দুটোর বাইরেও কিছু লোক ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল। দু-একজন বাঘারুকে আপাদমস্তুক দেখেওছে। দু-একজন বাঘারুর গলার দড়িটাও দেখেছে। কিন্তু বাঘারুকে কেউ কিছু জিজ্ঞাসা করে না। বাঘারু যেমন দাঁড়িয়েছিল, তেমনি দাঁড়িয়ে থাকে। তার সামনে বাঁধের নীচে ও তার পাশে বধের ওপরে নানা কথাবার্তার মধ্যে বাঘারুর গলা থেকে নদীর ভেতরে ভাসমান গাছ পর্যন্ত হলুদ রঙের মোটা নাইলনের দড়ি বন্যার বাতাসে দোল খায়। 

.

১৫১. বাঘারুর দ্বিতীয় সংলাপ

বাঁধের নীচে অফিসার নরেশকে বলে, আরে, ঐ লোকটার নাম-ঠিকানা ত নেয়া হল না, আমাকে ত রিপোর্ট করতে হবে। 

নরেশ পেছনে ঘাড় ঘোরায়, তারপর নিজেই বাধ বেয়ে ওপরে উঠতে থাকে বাঘারু ডাকতে। মাঝামাঝি উঠতেই দেখে বাঘারুকে একা-একা দাঁড়িয়ে আছে। আর না-উঠে বাঘারুকে নরেশ ডাকতে থাকে, হেই শুনিছেন, হে-ই শুইনছেন, আরে হে-ই 

বাতাসের আওয়াজ, চারপাশে নানারকম কথবার্তা, এই সব কারণে বাঘারু নরেশের ডাক শুনতে পায় না। অথবা, তাকে যে ডাকা হতে পারে সেটা সে ভাবেই নি। অগত্যা, নরেশকেই আবার পা বাড়াতে হয়। পা বাড়িয়েও সে ডাকতে থাকে, হে-ই গাছুয়ামানষি, আরে এই গাছুয়ামানষি। 

বাঘারু তখন বাঁধের ঢাল বেয়ে অফিসারের গাড়ির দিকে তাকিয়ে ছিল, যেমন সে নানাদিকেই অলস তাকাচ্ছিল। অফিসারের গাড়ি থেকে চোখ সরিয়ে আবার বাঁ দিকে চোখ সরাতে গেলে নরেশ তার নজরে পড়ে যায়। বাঘারু যদি সোজা তাকিয়ে, সোজাই বা দিকে ঘাড় ঘোরাত তা হলে নরেশকে দেখতে পেত না। কিন্তু অফিসারের গাড়িটার দিকে সে তাকিয়ে ছিল বলে তাকে মাটি থেকে কোনাকুনি চোখটা বায়ে বাঁধের ওপর তুলতে হচ্ছিল। তাই নরেশ তার চোখে পড়ে যায়।

নরেশ তখন হাত দিয়ে তাকে ডাকতে-ডাকতে চেঁচায়, আরে কানে শুনেন না নাকি? আসেন এইখানে, স্যার ডাইকতেছে। 

নরেশের কথাটা বাঘারু শোনে কি না বোঝা যায় না, শুনে থাকলেও সেই কথার মানে বোঝার জন্যে তাকে আবার অফিসারের গাড়ির দিকে তাকাতে হয়। সেই গাড়ির কাছ থেকে সবাই তার দিকেই তাকিয়ে আছে। নরেশ আবার চেঁচায়, আরে, এই মানষি কালা নাকি। আরে, আসেন, স্যারে, ডাইকতেছে। 

এবার বাঘারু বোঝে। সে ঢাল বেয়ে নামতে শুরু করে। সে দু-এক পা নামার পর নরেশ পেছন ফেরে। নরেশ দু-এক পা নেমে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে নেয় বাঘারু নামছে কিনা। 

বাঘারু গিয়ে অফিসারের সামনে দাঁড়ায় না। বাঁধের ঢালটার পরে যেখানে জিপের সামনে ভিড় শেষ হয়েছে সে সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকে। ততক্ষণে নরেশ অফিসারের সামনে পৌঁছে গেছে। সে পেছন ফিরে দেখে, তার পেছনের লোকজনের ওপরে বাঘারুর মাথা।

আরে এইখানে আসেন না। স্যার, আইসছে, নরেশ হাত দিয়ে তার পেছনে দাঁড়ানো লোকজনকে দুদিকে সরিয়ে দেয়, বাঘারুর আসার জন্যে পথ করে দিতে। কিন্তু পথ হওয়া সত্ত্বেও বাঘারু এগয় না–যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল, সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকে।

অফিসার জিপের ভেতর বসেছিল। সেখান থেকে গলা বাড়িয়ে জিজ্ঞাসা করে, এখানে আসুন, আপনার নামটা কী? জিজ্ঞাসার জন্যে অফিসার হাত দিয়ে নরেশকে সরিয়ে দেয়। এখন জিপের ভেতর অফিসার আর মাটিতে বাঘারু সোজাসুজি, কিন্তু দুজনের মাঝখানে হাত পাঁচ-ছয় তফাত।

বাঘারু কোনো জবাব দেয় না। ইতিমধ্যে অফিসার বুকপকেট থেকে ডটপেন ও একটুকরো কাগজ বের করে ডান উরুর ওপর রেখেছে। শুনে, লিখবে বলে অফিসার মাথা নিচু করেছে, কিন্তু শোনার সময় পেরিয়ে যাওয়ার পর তাকে আবার চোখ তুলতে হয়! চোখ তুলে বাঘারুকে দেখে নিয়ে আবার জিজ্ঞাসা করে, আপনার নাম কী? তারপর নরেশকে বলে, দড়িটা কিসের? 

বাঘারুর গলা থেকে সেই হলুদ দড়িটা বাঁধের ঢাল বেয়ে উঠে আড়ালে চলে গেছে। এখানে বাঁধের ঢালের জন্যে বাতাসে আর সে-দড়ি দুলছে না। 

নরেশ বলে, ও স্যার, ওর গাছবান্ধা দড়ি।

গলার সঙ্গে বাঁধা?

 নরেশ হেসে ওঠে, গাছগুলো বাইন্ধ্যা গলায় ঝুল্যায়া রাইখছে। 

অফিসার নরেশকে বলে, নামঠিকানাটা জিজ্ঞাসা করুন ত।

নরেশ বাঘারুর কাছে গিয়ে বলে, আরে, আপনারে না স্যার ডাইকতেছে, এহানে খাড়ায়্যা আছেন ক্যান? আপনার নামঠিকানা কন, স্যারে জিগায়। স্যারের লিখবার লাগব। আপনার নামঠিকানা কী? 

মোর নামঠিকানা নাই রো। মোর দেউনিয়া। গয়ানাথ জোতদার বাঘারু এতক্ষণে বলতে পারে।

শুনে নরেশ হেসে উঠে মুখে হাত চাপা দেয়। অফিসার জিজ্ঞাসা করে, কী, হল কী?

 স্যার, কয় যে এই মানিষডার কুনো নাম নাই। গয়ানাথ জোতদারের নাম লিখবার কয়। 

অন্যান্য লোকজনের চাপা হাসিটা শেষ হওয়ার পর অফিসার বলে ওঠে, আচ্ছা, গয়ানাথ জোতদারের ঠিকানাটা জিজ্ঞাসা করুন না। তা হলেই ত ওর ঠিকানা জানা যাবে, কেয়ার অব গয়ানাথ জোতদার। অফিসার কাগজের ওপর মাথা নোয়ায়। 

নরেশ বাঘারুকে জিজ্ঞাসা করে, গয়ানাথ জোতদারের ঠিকানাটা কন তালি।

মুই জানো না। লিখি দেন গয়ানাথ জোতদার।

আরে তা ত, লিখ্যাই ফেইলছে। সে জোতদার থাকে কই? ঘরডা কুথায় সেডা কইবেন ত?

 সবঠে থাকে। এইঠে আসিবে।

 বাঘারুর কথা শুনে নরেশ আবার হেসে ওঠে, মুখে হাত চাপা দিয়ে। এবার অফিসার জিজ্ঞাসা করে না, কী হল। হাসি শেষ করে নরেশই বলে, স্যার, বলে, অর জোতদার গয়ানাথ সব জায়গাতেই থাকে, এইহানেও থাকে। 

অফিসার একটু ভাবে, গয়ানাথের নাম ত সবাইই জানে। ও কোথায় নদীতে পড়ল সেটা জিগগেস করো, তাহলেই হবে। 

নরেশ বাঘারুকে বলে, আপনে কোথ থিক্যা নদীত পইড়লেন, সেইডা কন।

বাঘারু একটু ভাবে। নরেশ তার নীরবতাকে মনে করে উত্তর দেওয়ায় আপত্তি। সে তাই আবার প্রশ্নটা করে, সেইডাও গয়ানাথ জানে নাকি? ভাইসলেন আপনে, আর জাইনবে গয়ানাথ? 

ততক্ষণে বাঘারু নরেশের প্রশ্নটির জবাব পেয়ে যায়, মুই নদীত, পড়ো নাই। 

এতক্ষণে বোধহয় বোঝা হয়ে গেছে যে বাঘারু আধপাগলার মতই জবাব দিয়ে যাবে, আর তাতে সবাইকে হেসে উঠতে হবে। নরেশের হাসিটাকে মাঝখানে থামিয়ে দিয়ে বাঘারু তার জবাবের বাকিটুকু বলে, মুই ফ্লাড ভাসিছু। 

হাসি থামিয়ে নরেশ বলে, স্যার, বলতেছে নদীতে পইড়্যা যায় নাই, ফ্লাডে ভাইসছে। 

অফিসার যেন একটা ইশারা পায়। তাড়াতাড়ি বলে ওঠে, হ্যাঁ, তাই ত, কোথায় ভেসেছে ফ্লাডে সেটা বলুক। আর নামটা? 

অফিসারের কথা অনুযায়ী নরেশ বলে, ফ্লাডে ভাইসলেন কোখন? বলে নরেশের মনে হয়, এ ভাষাটা বাঘারু নাও বুঝতে পারে। সে রাজবংশী ভাষা মিশিয়ে আবার জিজ্ঞাসা করে, কোটত ভাসিলেন ফ্লাড 

বাঘারুর সঙ্গে সঙ্গে জবাব দেয়, গাজোলডোবা। বাঘারুর উত্তর দেয়ার মধ্যে এমন একটা ভাব আসে যেন সে সব প্রশ্নেরই জবাব দিতে পারে, প্রশ্নটা যদি ঠিক ভাবে করা হয়। 

একটা জায়গার নাম পেয়ে নরেশ উৎফুল্ল হয়ে এক লাফে অফিসারের কাছে এসে বলে, স্যার, কইছে, কইছে। 

কী বলেছে?

 জায়গার নাম কইছে।

 বলেছে ত বলছ না কেন? কৈাথা থেকে ভেসে এসেছে?

 গাজোলডোবা।

অফিসার উচ্চারণ করে করে কাগজের টুকরোটাতে লেখে, জি, এ, জে, এ, এ, না, ও, এল, তারপর নরেশকে বলে, নামটা বের করো। ডি, ও, বি, এ। নরেশ আবার বাঘারুর কাছে ফিরে আসে–শুনেন। আপনার নামটা কয়্যা দ্যান, তাহালিই স্যার চইল্যা যাবার পারে। ঐডা ত লিখ্যা নিছে–গয়ানাথ জোতদার, গাজোলডোবা। এইবার আপনার নামডা কন। 

গয়ানাথ জোতদার গাজোলডোবা না থাকে–বাঘারু বলে।

 খাইছে। এই না কইলেন, আপনে গাজোলডোবা ভাইসছেন।

মুই ভাসিছু। গয়ানাথ না থাকে। 

গয়ানাথ যেইখানে খুশি থাকুক গিয়া–আপনে ত গাজোলডোবার থিক্যা ফ্লাডে ভাইসছেন? তা হলিই হবে। 

কী এক গাজোলডোবা-গাজোলডোবা করছ, ওটা ত হয়েই গেছে, অফিসার গলা তুলে নরেশকে বলে, এখন যদি বাঘারু আবার কিছু বলে গাজোলডোবা নামটা প্রত্যাহার করে নেয় তা হলে যেটুকু পাওয়া গেছে, সেটুকুও হারাতে হবে। অফিসারের দরকার ছিল একটা জায়গার নাম–সেটা সে পেয়ে গেছে। নামটা বের করতে পারো কিনা সেটা দেখোনইলে ছেড়ে দাও। যেন গাজোলডোবা থেকে একটা মানুষ ভেসে যাচ্ছিল, গাছগাছালির সঙ্গে ভেসে যাচ্ছিল, তাকে উদ্ধার করে আনা হয়েছে–অফিসারের রিপোর্টের পক্ষে এইটুকুই যথেষ্ট। এতক্ষণ ধরে এতটা দূরত্ব যে-ফ্লাডের ভেতর ভাসতে-ভাসতে এসেছে, সে ত এতটাই অসুস্থ হয়ে পড়তে পারে বা শক্ত হয়ে থাকতে পারে যে নিজের নামটা আর বলতে পারে না। 

আপনার নামডা কন, নামডা, স্যার লিখবেনে। বাঘারু চুপ করে থাকে।

 একটু সময় নিয়ে নরেশ বলে, কী, কইবেন না নামডা?

বাঘারু বলে, মোর নাম নাই রো। 

নরেশ এবার না হেসে রেগে যায়, ফ্লাডে ভাইস্যা আসার আগে একখানা নাম দিবার পারেন নাই নিজের? ত এইখানে কম্বল, কাপড়, তিরপল, চিড়াগুড়–এইগুল্যা কুন নামে দিব আপনারে? না, এইগুলান লাগব না? 

নরেশ আশা করেছিল, বাঘারু এত জিনিশের সম্ভাবনায় লোভী হয়ে উঠে নামটা বলে দিতে পারে। কিন্তু বাঘারু বলে, গয়ানাথর নাম দেন কেনে। 

আরে–গয়ানাথ আবার? রিলিফ দিব আপনাক, আর নাম লিখব গয়ানাথের?

 মোর না নাগে। 

অফিসার ততক্ষণে গয়ানাথ জোতদারের জমিতে কর্মরত একজন কৃষিশ্রমিক কথাকটি লিখে ফেলে, ড্রাইভারকে বলে, চলো, আর নরেশকে বলে, ছেড়ে দাও। কার তোমরা যখন অফিসে যাবে তখন শুনে যেও। 

.

১৫২. দেড় হাতি ত্যানার বন্ধন, নাইলনের দড়ির বন্ধন ও টিভি ক্যামেরা ইত্যাদি নিয়ে বৃক্ষপর্বের শেষ অধ্যায়

বৃক্ষপর্ব এখানেই শেষ হতে পারে। বৃক্ষপর্বে ত বাঘারু কী করে গয়ানাথের গাছগুলোর সঙ্গে ভেসে এসে নিতাইদের চরে উঠল ও সেখান থেকে রংধামালির বাধে উঠল তার কাহিনী। রংধামালিরাধে সেদিন বিকেলে নরেশকে অফিসার যা টাকা দেয়ার দিয়েছে। পরদিন অফিসে যেতে বলেছে। আর-একটা রশিদে আরো কিছু টাকা দিয়ে দেবে। বাঘারু যে তার নামটা বলে উঠতে পারেনি সেটা সেদিক থেকে ভালই হয়েছে–অফিসার নিজের মত কিছু একটা লিখে নিতে পেরেছে। একটা লোক, বাঘা, অথচ সে দুবার রেসকু হয়েছে–তা হলে ত তার একটা নাম নতুন হতেই হয়। বেশি লোক রেসকিউ করতে পারলে সেটা ত অফিসারের সার্ভিস ফাইলে লেখা থাকবে। 

বাঘারু তার গাছগুলোকে নিয়ে একটু সরে গিয়েছে। সেখানেই বেঁধেছে। সে এই বাঁধের চরুয়াদের একজন নয়, কিন্তু আবার তাদেরই একজন। সে তার মাচানেই থাকে। মাঝেমধ্যে বাঁধের ওপরও ওঠে। কাদাখোয়ার সঙ্গে বাঘারুর আর দেখা হয় না। দেখা হয় না, মানে কথা হয় না। ওদের দুজনের পরস্পরকে বলার মতো কোনো কথা নেই। কাদাখোয়ার ত কাজকম্ম আছে–যদিও এখন কাজকৰ্ম্ম কমই। বাকি সময় সে গামছা দিয়ে মাথা মুড়ে বোল্ডারের ওপর ঘুমবে। বাঁধের লোকজন কোনো সময় বাঘারুকে কাদাখোয়া বলে ও কাদাখোয়াকে গাছারু বলে ডেকে ফেলে। 

বাঁধে এসে বাঘারু এই নতুন একটি নাম পেয়েছে, গাছারু। সে তার নাম বলেনি কিংবা বললেও বাধসুদ্ধ লোক তা জানতে পারত না। তারা তাকে নিজেদের একটা ডাকনাম দিতই। বাঘারুর গলার নাইলনের দড়ির বান্ডিলটা নিয়ে সেনামটা তৈরি হতে পারত। কিন্তু হয়ে ওঠেনি। অতগুলো গাছ আর সেই গাছের সঙ্গেই বাঘারুর শরীর বাধা, আবার, সেই গাছের মাচানেই বাঘারুর শোয়াবসা–এই সব কারণে গাছারু নামটাই চালু হয়ে গেছে। এ-চরে পূর্ববঙ্গের লোকরা অনেকে আছে–সেদিক থেকে গাছুয়াই হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু ভাষাতত্ত্বের বহির্ভূত কারণে নামকরণ ইত্যাদির ব্যাপারে পূর্ববঙ্গের এই লোকরাও তিস্তাপারের আদি নিয়মকানুনই মেনে ফেলে।

বাঁধে বাঘারু, গয়ানাথ ও আসিন্দিরের জন্যে অপেক্ষা করে। এই অপেক্ষা করা ছাড়া তার আর-কোনো কাজ নেই। এই বন্যা, হাওয়া, বৃষ্টি থামতে-থামতে আসিন্দিরের ভটভটিয়াতে চড়ে গয়ানাথ ঠিক এসে যাবে। বেশি খুঁজতে হবে না গয়ানাথকে–ঠিক জেনে যাবে বাঘারু রাংধামালির বাঁধে এসে ঠেকেছে। 

কিন্তু সেসব কোনো কিছুতেই বাঘারুর কোনো ভূমিকা নেই। তাকে দূর থেকে নিয়ে এসে গাজোলডোবা থেকে ফ্লাডে ভাসিয়ে দেয়া হয়েছিল। সে বিশ্বস্তভাবে ভেসে এসেছে। সে যেখানে ঠেকে যাবে সেখানেই যেন থেকে যায়। সে ফ্লাডের ভেতর ঐ চরে আটকে গিয়েছিল–এখন এই বাধে এসে আটকে আছে। এখন আর তার শরীর এই ফ্লাডের সঙ্গে জড়িয়ে নেই। গয়ানাথের জন্যে অপেক্ষা দিয়ে এই বৃক্ষপর্ব শেষ হতে পারে। 

নিতাই যে-রিলিফের ব্যবস্থা করে ফেরে–তার ভাগ বাঘারুও পায়। এরকম বানভাসি রিলিফে ত প্রত্যেকের নামে আলাদা করে চিড়েগুড় লিখতে হয় না–তাই মোট হিশেবের মধ্যে বাঘারু ঢুকে যায়। কিন্তু ফ্লাড, হাওয়া ও বৃষ্টি না কমলে চালগমের ব্যবস্থা হবে, ফ্লাডের জন্য নেমে যাওয়ার পরও নিতাইদের চর না শুকলে কাপড়, জামা, কম্বল ও ক্যাশডোলেরও ব্যবস্থা হবে–তখনো যদি বাঘারুকে চরুয়াদের একজন হয়ে থাকতে হয় তা হলে তার পুরনো নামধাম দরকার হবে, নতুন ডাকনামে চলবে না। 

কিন্তু সে-সম্ভাবনা দুই কারণে কম। চরের লোকজন ঐ চরেরই লোক বলে যে বিশেষ সুযোগসুবিধে পাবে তাতে বাঘারুকে ঢোকাতে চাইবে না। এই সব সুযোগসুবিধে দেয়া হয় পরিবারের ভিত্তিতে। বাঘারু চরের কারো পরিবারের অন্তর্ভুক্ত নয়। তৎসত্ত্বেও ফ্লাড়ের তিস্তায় অনেকে যেমন ভেসে-আসা টিনের চাল পর্যন্ত পেয়ে যেতে পারে, বা, শালের খুঁটি, ভামনির চাল, বাঁশের খুঁটি ত পেতেই পারে–তেমনি বাঘারুর মত ভেসে-আসা জোয়ান কাজের মানষিও পেয়ে যেতে পারে। নরেশ বা অমূল্য তা হলে বাঘারুকে নিজেদের পরিবারভুক্ত দেখাতেও পারত ও বাঘারুর প্রাপ্য জামাকাপড়, কম্বল, চালগম এ-সব পেতেও পারত। কিন্তু বাঘারু বড় বেশিবার গয়ানাথ জোতদারের নাম বলে বলে এটা সবাইকে জানিয়ে দিয়েছে-তার একখান দেউনিয়া আছে, সেই দেউনিয়ার গাছগুলোই সে সঙ্গে নিয়ে এসেছে (এই শেষের কথাটি অবিশ্যি কোনো সময়ই খুব স্পষ্ট হয়নি)। তাছাড়া, অতগুলো গাছ ত একটা সম্পত্তির মত। বাঘারুকে দেখেই বোঝা যায়, এ-সম্পত্তি তার ত হতেই পারে না, বরং এই গাছগুলোর যেমন মালিক আছে, তারও তেমনি মালিক আছে। চরের লোকজন সম্পত্তির নিয়মকানুন জানে। তাই, নরেশ বা অমূল্যর মত সম্পত্তির মালিক, বাঘারু ও গাছের সম্পত্তির মালিকের সম্পত্তিতে ভাগ বসায় না। বাঘারু চরুয়াদের একজন হয়ে যেতে পারে না, এটা তার একটা কারণ। তাই চরুয়া বানভাসি হিশেবে তার নাম রেকর্ড হয় না। 

দ্বিতীয় ও আর-একটি কারণ হল-বাঘারুকে ও গাছগুলোকে গয়ানাথ এতদিন এখানে কখনোই ফেলে রাখবে না। সে এই বৃষ্টি-হাওয়া ও বন্যার মধ্যে এসেই বাঘারুকে ও গাছগুলোকে ধরে ফেলবে। বাঘারু গয়ানাথের যেমন তেমনি গয়ানাথেরই থাকবে। বরং গাছগুলো গয়ানাথ এখানেও বেচে দিতে পারে। কিন্তু বাঘারুকে আবার তার জায়গায় পাঠিয়ে দেবে।

এখন দেখে বোঝার উপায় থাকে না মাত্র দু-চারদিন আগেও তিস্তা এরকম ছিল না, সামনে নিতাইদের চরে ভরভরন্ত গ্রাম ছিল, এই বাধটা ফাঁকা ছিল। এখন দেখে মনে হয়, তিস্তায় যেন সারা বছরই এ-রকম ফ্লাড় থাকে আর এই লোকজন এই বাঁধেরই বাসিন্দে। এরা সব এক গ্রামেরই লোক, ফলে বাধে এসে ওঠার পর সেই গ্রামের নিয়মেই বসবাস চালিয়ে যেতে কোনো অসুবিধে হয়নি। শুধু প্রতিদিনের কাজটা নেই–সেই কাকডাকা ভোর থেকে কাকের বাসায় ফেরা সন্ধ্যা পর্যন্ত কাজ। তার বদলে অবিশ্যি কেউ-কেউ রিলিফ-টিলিফ নিয়ে কিছু ব্যস্ত হয়ে পড়ে, কেউ-কেউ আবার শহরের জীবনযাপনের আস্বাদ ভোগ করতে থাকে। সিনেমা দেখা ত আছেই, তা ছাড়াও শহরের মধ্যেই ঘোরাফেরা। কেউ-কেউ আবার দিনবাজারের কাছে মেয়েদের পাড়ায় যাতায়াত করছে। ফলে, কখনো কখনো যেন মনে হয়–এরা যেন এই বাঁধের স্থায়ী বাসিন্দে, তেমনি কখনোকখনো আবার মনে হয়–এরা গ্রামসুদ্ধ লোক যেন ছুটি কাটাতে এখানে এসে উঠেছে। এর মধ্যে অনেক দিন ধরে জমিয়ে রাখা সর্ষে, বা তক্তা, বা বাঁশের জিনিশপত্র দিনবাজারে নিয়ে বিক্রি করার সুযোগ কারো কারো এসে যায়। 

বাঘারু অতগুলো গাছ নিয়ে বাঁধেরই এক কোণে, এদের মধ্যেই অথচ এদেরই একজন না-হয়ে যে দিন কাটাচ্ছে তাও নজরে পড়ে যায় কারো। এমনি বাঘারু যদি থাকত, তা হলে তাকে কেউ দেখত না, কিন্তু সে যে অতগুলো গাছ আগলে বসে আছে তাতেই যাদের দেখার তারা তাকে ও তার গাছগুলোকে দেখে ফেলে। তাদের কেউ-কেউ এসে বাঘারুর সঙ্গে কথাবার্তাও বলে। 

রংধামালি হাটের এক কাঠের আড়তদার এসে বাঘারুর গাছগুলোর পাশে অনেকক্ষণ বসে ছিল এর আড়তটা ছোট, কোনো ইলেকট্রিক করাত নেই। কিন্তু একটা করাতে গাছ কেটে তক্তা বানায় জনা তিন বিহারি মজুর। তার আড়তে আস্ত-আস্ত কিছু গাছ আছে আর একটা শেডের তলায় থাকে বিভিন্ন সাইজের তক্তাগুলো। লোকটি কোন দেশী তা জানা যায় না, নাম চরণ রায়। কথায় একটা বিদেশী টান আছে, চেহারায় নেপালি ধাচ আছে, রাজবংশীও মনে হতে পারে। সে একদিন গাছগুলো দেখে যাওয়ার সময় বাঘারুকে বলে, মোর স-মিলত আসেন না কেনে বাউ? দিনরাতি এইঠে নদীর পাড়ে করিবেনটা কী? রাতিত ঐঠে ঘুমাবার পারেন। 

বাঘারু যেন কথাটার কোনো মানেই বোঝে না। কথাটা যেন আর কাউকে বলা, সে এমনই চুপ করে থাকে। কিন্তু লোকটা আবার এসে জিজ্ঞাসা করে–আরে ক্যানং মানষি হে আপনে? সাগাই (নেমন্তন্ন) দিছু, তাও না গেলেন। বাঘারু একথারও কোনো জবাব দেয় না। লোকটা তখন বিড়ি টানতে-টানতে জিজ্ঞাসা করে, তোমরালার জোতদারের স-মিল আছে কি নাই? 

বাঘারু অন্য দিকে তাকিয়ে জবাব দেয়, না, জানো। 

বাঘারুকে লোকটা একটা বিড়ি দেয়। সেটা নিতে বাঘারুকে গাছ থেকে নেমে আসতে হয়, তার জ্বালানো কাঠি থেকে বিড়িটা ধরাতে তার কাছাকাছি যেতে হয় ও বিড়িটা ধরিয়ে তার কাছাকাছিই বসতে হয়। 

লোকটা তখন বলে, এত ফরেস্টের গাছ হে! তুমি ভাসি নিয়া আইচছেন।

বাঘারু চুপ করে থাকে। লোকটি বলে, পুলিশ দেখিলে ধরিবে।

কাক ধরিবে?

 তোমরাক ধরিবে। তোমরার গাছ, তোমরা ধরিবে।

 হামাক?

হয়, তোমাক ধরিবে। 

লোকটার কথাটা নিয়ে ভাবনাচিন্তা করতেই বাঘারু যেন আরো গভীর ভাবে বিড়ি টানে। তার পর লোকটাকে বলে, মোক আর-একখান বিড়ি দাও কেনে। লোকটি দিলে সেই বিড়িটা কানের পেছনে গুঁজে রাখে বাঘারু।

লোকটি বলে, গাছগিলা মোক বেচি দেন, মুই আড়তবাড়িত্ রাখি দিম। কায়ও জানিবার পারিবে না। স্যালায় তোমার জোতদারের ঘর আসিলে মোর পাকে নিগাও। টাকা দিয়া দিম। 

বাঘারু বিড়ি টানে। লোকটি নিজে বিড়ি ধরাবার আগে বাঘারুকে দেয়। বাঘারু সেটা আর-এক কানের পেছনে গোজে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এ নিয়ে কোনো কিছু ঠিক হয় না। লোকটি উঠে যাওয়ার সময় যদিও বলে যায়, কালি আসিম মোর করাতিয়ার ঘর নিয়া–, কিন্তু সত্যি-সত্যি সে আসে না। 

তার বদলে এসেছে জগদীশ বারুই। এসেছে বলা ঠিক নয়, কারণ জগদীশ বারুই ত এই বাঁধের ওপরই থাকে, সে আর আসবে কোথা থেকে? কিন্তু বাঁধের ওপরে বা ঢালে যখনই বাঘারুর সঙ্গে জগদীশের দেখা হয়, তখনই সে বাঘারুকে একটা বিড়ি দিয়ে ফিসফিস করে বলে, আরে, তোর জোতদার কি গুইন্যা রাখছে কয়ডা গাছ তুই ধরছিস? একখান বেইচ্যা দে, ঐ চাপাগাছখানই দে, আর টাকা নিয়্যা লুকাইয়্যা থো। তারপর নিজের মনেই হেসে বলে, টাকা থুবিই বা কনে? আছে ত ঐ একখান নেংটি। তা থুস, ঐ হানেই থুস, নেংটির মইধ্যে? কী, রাজি ত? জগদীশ বলে। খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে, শালা বোগদা, বলে আবার সরে যায়। 

মানুষ যেখানেই থাক, সেখানকার পরিবেশ-পরিস্থিতি, তাকে বুঝে নিতেই হয়। বাঘারুও বুঝে নেয় যে ঐ স-মিলের মালিক আর জগদীশ তাকে গাছগুলো, অন্তত একটা গাছ, বেচে দিতে বলছে। গয়ানাথের নানারকমের ব্যবসা, দশ রকমের জোতদারি। তার জোতজমি আছে, ডায়না নদীর পাহাড়ে তার মোষের বাথান থেকে মিলিটারিদের দুধ যায়, তার ফরেস্ট আছে, তার হাট আছে, তার নদী আছে। আর এই সব জায়গাতে কোনো-না-কোনো কাজে ত বাঘারুকে যেতে হয়, ঘুরতে হয়। তাকে অফিসারের পেছনে-পেছনে চেয়ার নিয়ে ছুটতে হয়, তাকে এম-এল-একে ঘাড়ে করে নদী পেরুতে হয়, তাকে বনের মধ্যে মোষের বাথান চরাতে হয়। গয়ানাথের এত কিছু করে যে বাঘারু, সে কি আর বোঝে না যে এই চারটি গাছের মধ্যে একটি গাছ, ঐ চাপা গাছটাই, বেচে দিয়ে গয়ানাথকে বলে দেয়া যায়-অন্ধকারে কখন গাছটা খসে গেছে সে বুঝতেই পারে নি? গয়ানাথ এই কথা শুনে রাগতে পারে, গালাগাল করতে পারে, মারতেও পারে–কিন্তু তার বেশি আর কী করবে? টাকা যদি নেংটির মধ্যে নাও রাখে, এত বোল্ডার চারদিকে–কোনো একটা পাথরে ঢাকা দিয়েও ত রাখতে পারে। বাঘারু খুব ভাল করেই জানে–এ-সব হয়, এ-সব করা যায়। বাঘারুর মাও ছিল গয়ানাথের, বাঘারু গয়ানাথের। দুই-দুই পুরুষ ধরে গয়ানাথের সঙ্গে থেকে-থেকে বাঘারু এটুকু শেখেনি যে গয়ানাথের একটা গাছ বেচে দেয়াটা কত সহজ? ফরেস্টের ভেতর থেকে বন্যার তোড়ে আলগা হয়ে স্রোতে পড়ে যাওয়া গাছ কেটে বন্যার জলে ভাসিয়ে দেয়ার চাইতেও কত সোজা? বাঘারু একবার নিগাও কেনে বললেই ত ঐ আড়তদারের লোকেরা এসে গাছ কেটে নিয়ে চলে যাবে। কিন্তু বাঘারু আড়তদারের আর জগদীশের দেয়া বিড়ি কানের পেছনে গোঁজে আর বুকে নাইলনের দড়ির বান্ডিল ঝুলিয়ে ঘুরে বেড়ায়। কেন বাঘারু নিগাও কেনে বলে না, তা বাঘারুও জানে না। কিন্তু বাঘারু বলে না, বলার কথা ভাবেও না। বলা যায় এটা জেনেও, বলবে কি বলবে না এই নিয়ে, এমনকি কোনো মানসিক দ্বন্দ্বের মধ্যেও যেতে পারে না বাঘারু। এতে মনে হতে পারে যে তার মন নেই, তাই মানসিক দ্বন্দ্বও নেই। তা মেনে নিলে বলতে হয়, তার মন নেই কিন্তু শরীর আছে-তার প্রতিদিনের বাঁচা এই শরীরের সর্বস্বতা দিয়েই বাঁচা। যদি বাঘারু তার নাইলনের দড়ির সঙ্গে বাঁধা চারটে গাছের মধ্যে একটা গাছ বেচে দেয়, তা হলে ঐ চারটে গাছ একসঙ্গে বেঁধে এই ফ্লাডের তিস্তায় তার শরীরের যে বাঁচা, তা থেকে ত একটা গাছ কম গড়বে! দ্বন্দ্বে দীর্ণ হওয়ার মন পর্যন্ত নেই যে বাঘারুর, শুধু শরীরটুকুই আছে যে বাঘারুর, এমনকি হাজার হাজার বছর ধরে তৈরি মানুষের এত পোশাক-পরিচ্ছদের মধ্যে মাত্র দেড় হাতি এক ত্যানা লেগে আছে যে বাঘারুর সম্পূর্ণ মানবশরীরটিতে, সেই দেড় হাতি ত্যানাতেই মাত্র যে বাঘারু মানবসভ্যতার সঙ্গে বাধা–সেই বাঘারু, প্লাবিত নদীতে, বৃষ্টিতে, ঝড়ে ও অন্ধকারে এতটা বন্যা পেরিয়ে আসা এই শরীরটা থেকে একটা গাছের বাঁচা বেচে দেবে কী করে? বাঘারুর যেমন মন নেই, তেমনি হয়ত মাথাও নেই। তাই সে কোনো কিছু করার পক্ষে যেমন যুক্তি জোগাড় করতে পারে না, তেমনি কোনো কিছু না করার পক্ষেও যুক্তি বানাতে পারে না। সে হয় একটা কাজ করে ফেলতে পারে অথবা না করতে পারে। যুক্তির প্রয়োজনীয় জোগান দেয়ার মত একটা মাথা পর্যন্ত নেই যে-বাঘারুর সে কী করে জগদীশ বারুইকে বা সেই কাঠের আড়তদারকে না করবে? সে শুধু ঐ চারটি গাছের সঙ্গে নিজেকেও বেঁধে ঐ নাইলনের দড়ির বান্ডিলটা গলায় ঝুলিয়ে বাঁধের ওপর কখনো কখনো দাঁড়াতে পারে, পাথরের আঙিনার ওপর দিয়ে কখনোকখনো হাঁটতে পারে, নিজের গাছগুলোর মাঘনের ওপর শুতে পারে। কুড়ালিয়াটা এখন বাঘারু সব সময় পেছনে গুঁজে রাখে না–একটা গাছের একটা ভেতরের ডালে কোপ বসিয়ে রেখে দিয়েছে। 

এরকম ভাবেই বাঘারু এখানে, এই রংধামালির বাধে গয়ানাথের, ও ফ্লাড কমে যাওয়ার, অপেক্ষায় দিন কাটায়। 

বন্যা ত আর অনন্তকাল ধরে চলে না–একদিন না-একদিন শেষ হয়। কিন্তু কবে শেষ হয় তার ওপর নির্ভর করবে খবরের কাগজ, টেলিভিশন এ-সব এই বন্যার কথা কতটা বলবে,কতটা দেখাবে। বিদ্যুতের মত এসে বজ্রপাতের মত মৃত্যু ঘটাতে পারে যদি কোনো ফ্লাড, তবে দীর্ঘস্থায়ী না হলেও সেটা খবর হতে পারে। তিস্তার সেবারের বন্যাটাও খবর হয়ে উঠল–বেশ ক-দিন থেকে গিয়ে। ফলে কলকাতা থেকে কাগজের ফটোগ্রাফাররা আর টিভির ক্যামেরাম্যান এসে পড়তে পারে। কিন্তু তাদের সব সময়ই তাড়াতাড়ি ফেরার তাড়া থাকে। সেই জন্যে জেলার তথ্য ও জনসংযোগ দপ্তর থেকে। শহরের পাশের এই দুটো জায়গা দেখিয়ে দেয়া হত। জলপাইগুড়ি শহর থেকে আট মাইল ভাটিতে মণ্ডলঘাটের দুনম্বর চর আর মাইল চার-পাঁচ উজানে এই রংধামালির বাঁধ। দুই জায়গাতেই কিছু বানভাসি পরিবার উঠে এসেছে, গরুবাছুরও আছে, গবর্মেন্টের ত্রিপলও আছে। রংধামালি হাটের বিশেষ সুবিধে এই যে দেখেই সোজা তিস্তা ব্রিজ দিয়ে ডুয়ার্সে চলে যাওয়া যায়। 

এ-রকম সব সময়, বিশেষত টিভির লোকজন যখন এসেছিল, তখন ক্যামেরাম্যান ও কাগজের ফটোগ্রাফাররা বাঘারুকে আবিষ্কার করে ফেলে। জেলা তথ্য ও জনসংযোগ দপ্তর অবিশ্যি একটা তালিকা দিয়েছে। তাতে কোথায় কত লোককে উদ্ধার করা হয়েছে তার হিশেব ছিল। কিন্তু সে হিশেবের মধ্যে বাঘারুর কোনো আলাদা পরিচয় ছিল না। ততদিনে, সেদিন সন্ধ্যার বাঘারুউদ্ধার কাহিনী সরকারি সংখ্যাতত্ত্বের ভেতর একটা সংখ্যামাত্র হয়ে গেছে, বা তাও হয়েছে কিনা সন্দেহ। ফটোর লোকজনেরা বাঘারুকে আবিষ্কার করেছে নিজেদের গুণেই। 

এমনি ত তিস্তার জল পেছনে রেখে বুড়োবুড়ি, মোষ, গরুমাছরু, বাচ্চাকোলে মা, জলের বিস্তার–এ-সব ছবি তোলা হচ্ছিলই। বাঘারু যে জায়গায় তার গাছ বেঁধেছিল সেখানে ফটোর লোজনদের পৌঁছুনোরই কথা নয়। কিন্তু টিভির ক্যামেরাম্যান একটা দূরদৃশ্যে বাধ থেকে তিস্তাটাকে গোল করে বা থেকে ডাইনে ফিরে আসতে-আসতে ভিউফাইন্ডারে বাঘারুকে পেয়ে যায়–বাঘারু দাঁড়িয়ে আছে, দড়ির বান্ডিল গলায়, গাছের মাচানে, গাছপালার মধ্যেই, মনে হচ্ছিল যেন জল থেকে কুঁড়ে বেরচ্ছে। প্যানিং শেষ হলে ক্যামেরা নিয়ে ক্যামেরাম্যান বাঘারুর সামনে চলে যায়, বাঁধ থেকে ঢাল বেয়ে নেমে বোল্ডারের শেষ পাড়টুকুতে জলের কিনারে হাঁটু গেড়ে বসে সে জলের ভেতর থেকে শাল গাছ-চাপা গাছ-খয়ের গাছ-সিসু গাছ সহ এক প্রায়-ফরেস্ট নিয়ে উত্থিত বাঘারুকে মেঘাচ্ছন্ন আকাশের সামনে দাঁড় করাতে চায়। অতটা না পেলেও, অনেকটা পায়। সে যতটা চাইছিল ততটা পেতে গেলে তাকে জলের ওপর শুয়ে ক্যামেরা আকাশের দিকে তুলে ছবি তুলতে হত। সে অবিশ্যি বাঘারুকে একট মুভ করতে বলে, কিন্তু বাঘারু নড়ে না। ফলে ছবিটাকে স্থিরচিত্র মনে হতে পারে বলে তার ভয় হয়। 

টিভির ক্যামেরাম্যানের পেছনে-পেছনে কাগজের ফটোগ্রাফাররাও এসে দৌড়তে-দৌড়তে ছবি তুলতে থাকে। টেলি ও ওয়াইডে বাঘারুর নেংটিপরা শরীর, মুখরেখা ও বধসহ বন্যার পরিধি ধরা পড়ে যায়। তারাও বাঘারুকে ঘুরেফিরে দাঁড়াতে বলে কিন্তু বাঘারু স্থিরই দাঁড়িয়ে ছিল। ফটোগ্রাফারদের মধ্যে ভাল ভিসুয়ালের জন্যে প্রতিযোগিতার উত্তেজনার মধ্যেই এমন রসিকতাও চলছিল,লোয়ার পার্টে টেলি ফেলো না, দেখিস, আবার নেংটির ভেতরের লোমটোমসুষ্ঠু তুলে ফেলিস না, ইত্যাদি। এতটা নগ্ন অথচ এতটা গোটা একটা শরীরকে লেন্সে সামলানো শক্ত। টিভির ক্যামেরাম্যান অবিশ্যি একেবারে তলা থেকে আকাশ পর্যন্ত একটা দারুণ প্যানিং করেছে–বন্যার জল, ক্লোজ-আপে আবর্ত, গাছের ডালপালায় জলের স্রোতের আঘাত, আরো ডালপালা, বাঘারুর দুটো পা-ক্লোজ-আপে, ধীরে-ধীরে হাঁটু, উরু, কোমর, নেংটি। মিডিয়াম শটে পেট, বুক, তারপর মাথা। সেখান থেকে বাঘারু ধীরে-ধীরে, দিগন্ত থেকে দিগন্তে, আকাশে নদীতে, স্থাপিত হয়। 

.

গয়ানাথের আসা পর্যন্ত এ-সবের মধ্যেই বাঘারুর বৃক্ষপর্ব কাটে। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *