৩.২ দক্ষিণে, পশ্চিমে–জাগো, আইস

০৯৬.

দক্ষিণে, পশ্চিমে–জাগো, আইস

তাও কেউ নিতাইকে চিনতে পারছে না দেখে সে চিৎকার করে ওঠে, আরে, সব ভূত দেইখছে নাকি?

আরে নিতাই? জগদীশ কাহা? আরে, তোমরা কুথায় গিছিল্যা? কলাগাছ ফেলে দিয়ে সবাই এগিয়ে আসে। ঐ আলোতে এদের চেহারা দেখলে মনে হয় অনেকদূর থেকে এল–প্রত্যেকের হাঁটু পর্যন্ত বালি। নিতাইয়ের মাথার চুল থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত বালি। ভিজে সে বালি গায়ের সঙ্গে লেগে গেছে। তাকে দেখাচ্ছে যেন বালির তলা থেকে বালি ফুড়ে উঠে এল। রাবণের অত লম্বা শরীরটায় বৃষ্টি আর বাতাস যেন বেশি লেগেছে। সেই অনেক বেশি বৃষ্টি আর বাতাস বহন করে সে কুঁজো হয়ে গেছে। জগদীশ পেছন থেকে লাফিয়ে ওঠে, সেই ধরো উত্তর পাক থিক্যা দক্ষিণ পাক পর্যন্ত জল মাইপ্যা আসছি, তিস্তা ব্রিজে সারা রাত্তির লাইট জ্বালাইয়া থুইছে।

আরে বস আগে। কও কী, ক্যান?

 তোমরা ভেলা বানাও ক্যান? নিতাই হাসে।

রেডিওয় ত কইল, শুইনল্যাম, তা ভাবল্যাম, যা-হয় তা-হয়, কয়ডা বানাইয়্যা রাখি।

 নিজেগার খুব ভাইবছ, চরের কথা কেডা ভাইবব? জগদীশ বলে।

যারা ভাইব্যা ঘুইর‍্যা অ্যাল, তারাই ভাবব। ত আমাগো কাম কী আগাইয়্যা থুল, নাকি পিছাইয়্যা থুল সেইডা কও। আর কী দেইখলা কও।

ঘোড়ার মাথা আর গাধার ডিম। চুপ যা। ঐদিকের পাড়ায় খবর দিছিস না দ্যাশ নাই? নিতাই সামনের লোকটাকে ধমকে ওঠে। নিতাইয়ের এই ধমকটাই হচ্ছে ওর সামাজিক সম্ভাষণ। সবাই একবার হেসে উঠল।

যাকে বলল সে বলে, আরে সারা চর ঘুইর‍্যা আইল্যা, এ্যাখন কি তোমরাই আবার খবর দিব্যার ছুইটব্যা নাকি? পোলাপান আছে কোন কামে? তোমরা বসো। এই ভোলা, সাইকেল বাইর কর খানদুই, না, খানতিন–

নিতাই দোকানের বারান্দায় গিয়ে বসে। তারপর হেসেই বলে আরে অমূইল্যা, তর মাথাত কী আছে একবার একসূরে করি দেখি আসিস ত।

অমূল্যর হাতে তখন দা। সে সেটা হাতে নিয়ে ঘোরাতে-ঘোরাতে বলে, ক্যান, কী কইরল্যাম?

কী কইরলি মানে? আরে, বানা আইসব তরা ত শুনছিস শেষ নিউজে।

 হয়।

 তা তহন আর কত রাইত? একবার সবাইক খোঁজডাক কইর‍্যা নিস ন্যাই?

এইহানে ভেলা বানাইস আর ঐহানে রমণী কাহা এমন ঘুমাইছে ঠেলা মাইর‍্যা তুলা যায় না। বন্যাতে ভাসি গেইলেও ত টের পাইব না–

এই নীলমোহন, যা ত রমণী কাকাক ডাইক্যা নিয়্যা আয়, অমূল্য বলে।

আর ডাইক্যা আইনতে হবে না, সে এতক্ষণে দৌড় দিয়্যা আসত্যাছে, জগদীশ একটা ঘরের দাওয়ায় বসে ছিল, সেখান থেকে বলে।

সাইকেল আনতে যাকে বলা হয়েছিল সে ও আরো দুজন সাইকেল নিয়ে এসে দাঁড়ায়। অমূল্য বলে, দাদা, ভোলারা আইছে, কয়্যা দ্যাও কুথায় কী খবর দিবে।

নিতাই একটু থেমে বলে, এক কাম কর, সিধ্যা ঘুইর‍্যা আয়। যদি দেখিস আর সব পাড়ায় সবাই জাইগ্যা আছে কয়্যা দিস আমরা এইখানে আছি, আর যদি দেখিস কুনো পাড়া চুপচাপ আছে ডাইক্যা জাগায়্যা দিস।

জগদীশ ডাকে, এই ভুলা, শুন্।

কন।

তর জেঠিরে কয়্যা দিস, আমি এইখানে আছি।

 ত আপনার আর থাকনের কাম কী, ভুলার সাইকেলের পিছনে বইস্যা চইল্যা যান। ভুলারা ঘুইর‍্যা আইসলে আমরাও যাব নে, নিতাই বলে।

তাই যাব? জগদীশ কিছু ভাবে।

 যাবেন না ক্যান, আপনার কি কালরাত্তির নাকি? গেলে ত ঐ পাড়াটার একটা বিলিবন্দবস্ত দইখবার পাইরবেন–নিতাই বলে।

তালি যাই, কী কস? জগদীশ ভোলার দিকে এগিয়ে যায়। ভোলা সাইকেলটা সোজা করে ধরে। জগদীশ সাইকেলের পেছনের ক্যারিয়ারে দুপা দুদিকে ঝুলিয়ে বসে। তার ওঠার মধ্যে এমন স্বাচ্ছন্দ্য ছিল যাতে বোঝা যায় সে এরকম চড়তে অভ্যস্ত। ভোলা শক্ত হাতে সাইকেলটা ধরে বলে, তিনজনই কি একদিকে যাব নাকি?

একদিকেই যা, দরকার হইলে একজন আইস্যা খবর দিতে পারবি নে, নিতাই বলে।

এখানে একটা হ্যাজাক জ্বালানো হয়েছে বলে আলোর একটা কেন্দ্র দেখা যাচ্ছে মাত্র। হ্যাজাকের আলোটা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে নি–গোল হয়ে স্থির আছে, যেন হ্যাজাকটাকেই দেখানোর জন্যে হ্যাজাকটা জ্বালানো হয়েছে। সেই আলোর মধ্যে এসেই সবাই কাজকর্ম করছে–তার বাইরে কিছুই দেখা যাচ্ছে না, যেন, হ্যাজাকের আলোটাই আলোর পেছনটাকে আড়াল করে রেখেছে। সেই আড়ালের দিকে তাকিয়ে নিতাই জিজ্ঞাসা করে, অমূল্য, কয়ডা বানাইছিস?

তিনখান বানাইছি। কিন্তু গরুগুলার জন্যে একড়া বড় করি বানাইব্যার ধরছি।

 ধুর বোকা, ভেলার উপুরে খাড়াইব্যার পারব না, শুয়্যা পড়ব নে, এক-এক ভেলায় এক-এক গরু ভাইসব্যার ধরবে নে

অমূল্য ওর গাই-বদলগিলাফ ভাসান দিবার ধরিবে, স্যালায় উমরার পাছত-পাছত গিয়া ধরিবে, কোন রত ঠেকিছে– গজেন বলে।

তোমরা কী দেইখল্যা, বানা আইসবেই? নিতাই, কত বড় বানা? অমূল্য হঠাৎ কাতর হয়।

 রেডিও শুইনলি ত তুই, আমরা ত তখন ব্রিজের দিকে চাইয়্যা আছি বালুবাড়িতে, তুইই ক না। কইছে? কত বড় বানা?

ও শালা এত গলা কাঁপাইয়্যাকাঁপাইয়্যা কয়, মনে হয় পাহাড়গুলা সব হাঁটা দিছে এই দিকে। ক কত জল, কত কিউসেক, সেই সবের বালাই নাই।

সগাক সরিবার কহিছে-নদীপারঠে? রাবণ শ্লেষ্মাজড়িত স্বরে বলে।

হে রাবণকাকা, তুমি এ বাড়িতে যাও না, কত আর ঘুইরব্যা? বাড়ির জিনিশপত্র গুছাবেনে কেডা? নিতাই বলে।

সে মোর তানে ফেলি রাখিছে নাকি হে, যেন রাবণ আগে থাকতেই জানে,, গোছানোর কথা আগে থাকতেই ঠিক হয়ে ছিল।

আরে কাকি খবর পাইছে কি পায় নাই, তয়? নিতাই বলে।

সারা চর জাগি আছে, আর তর কাকির যদি বেউলার ঘুম হয় ত হক কেনে?

এই অমুল্যা, বলে নিতাই উঠে দাঁড়ায়, চল ত পশ্চিম ঘাটাখান দেইখ্যা আসি, এ্যাখন জল কতখান বাইড়ছে–কম থাইকলে গরুবলদগুলাক পার করি দে।

নিতাই তাড়াতাড়ি রওনা দেয়। গজেন আর রাবণ ছুটে তার সঙ্গ নেয়।

এখান থেকে সোজা রাস্তা ধরে কিছুটা গেলে বাঁ দিকে পশ্চিমের ঘাটে যাবার রাস্তা। নিতাই যেতে-যেতেই অমূল্যা বলে ডাক দিয়ে এগিয়ে যায়। এখানে বসে থাকতে-থাকতে হ্যাজাকের আলোটা কেমন আড়ালের মত লাগছিল, হ্যাজাকের আলোটাকে পেছনে ফেলে এগিয়ে গেলে বোঝা যায় ঐ আলো একটু ছড়িয়ে গেছে। সেই ছড়ানো আলো জুড়ে নিতাইয়ের ছায়াটা ক্রমেই লম্বা হয়, মাটিতে শোয়, কিছু একটা বেয়ে খাড়া হয়, ছায়ার ঘত্ব কমতে থাকে, তারপর আকাশের দিকে উঠে ছায়াটা মিলিয়ে যায়। রাবণের ছায়া নিতাইয়ের শরীরটা আড়াল করে দেয়, আর বেঁটে গজেনের ছায়া লম্বা বারণকে ছাড়িয়ে ওঠে। মাত্র কয়েকবার এই তিনটি ছায়ার কাটাকুটি চলতে থাকে। তারপর অন্ধকারের ভেতর থেকে নিতাইয়ের চিৎকার ভেসে আসে–অমূল্যা, এই অমূল্যা।

হ্যাজাকের কাছাকাছি থেকে অমূল্য চিৎকার করে বলে, যাই যাই, আগাও, ধইরত্যাছি।

নিতাই অন্ধকার থেকে হাঁক দিয়ে বলে, গাইবদল বাছুরগুলাক লাইন বাইন্ধ্যা ঘাটে নিয়্যা আইসবার কয়্যা দে হককলরে

অমূল্য জিজ্ঞাসা করে, এহনই?

নিতাই গলা এত তুলে কথা বলছিল যে তার ধমক বোঝা যায় না, কিন্তু তার কথা যারা জানে তারা বুঝে নেয় নিতাই ধমকই দিল, অহনই, অহনই।

এই রাস্তাটা চরের ভেতরের রাস্তা। শক্ত আল, বৃষ্টিতে ভেজা ও পিছল, কিন্তু কাদা নেই। ফলে, ওরা প্রায় দৌড়ে-দৌড়ে যেতে পারছিল। বাতাস এখন পেছনে। মাঝে-মাঝে ধাক্কা মারছিল। কিন্তু তখনো ওরা বাড়িঘর, গাছপালা, বনবাদাড়ের ভেতর দিয়েই ছুটছে–ফলে বাতাসটা বেঁকে যাচ্ছে, ওদের গায়ে লাগছে না। পশ্চিমঘাটে যেতে বেশি সময় লাগবে না, কাজেই। কিন্তু সেজন্যে ওরা এত তাড়াতাড়ি ছুটছে না। ঐ দক্ষিণের বালুবাড়ি থেকে যে বাতাস ও বালি ঠেলে ওরা গায়ে ঢুকেছে, তার তুলনায় নাউয়াপাড়া থেকে পশ্চিমঘাটে যাওয়াটাতে যেন আরামই লাগে।

পেছন থেকে গজেন বলে, খাড়া কেনে নিতাই, একখান বিড়ি খা।

গজেন আর রাবণ এসে দেখে নিতাই দাঁড়িয়েছে। ওরা তিনজন মিলে গোল হয়ে দাঁড়ায়, নিতাই কাপড়ের অনেক গভীর থেকে শালাই বের করে। তিনজন যখন আগুনের ওপর ঝুঁকে পড়েছে, পেছনে চিৎকার শোনা যায়, নিতাই, খাড়া, আইসত্যাছি।

.

০৯৭.

 নদী এখনো পুরনো

নিতাই, রাবণ, গজেন আর অমূল্য পাশাপাশি দাঁড়িয়ে এখন নদীর দিকে চেয়ে। ওপারে একেবারে সামনে রংধামালি-রায়পুরের বাধ। এখন দেখে মনে হচ্ছে বন্যা যদি আসে তা হলেও এইটুকু এক খালের মত তিস্তা পার হয়ে ওপারে উঠতে আর কতক্ষণ। এ ত এখন যা অবস্থা তাতে দুই ডুব দিলেই পার। কিন্তু ওরা জানে, বন্যার জল একবার এখানে ঢুকে গেলে আর এই খাল সহজে পার হওয়া যাবে না। পার ত হতেই হবে। এই দিক দিয়ে পার হওয়া ছাড়া ত গতি নেই। কিন্তু এখন ত এখানে নদী পার হওয়ার জন্যে কয়েক পা যেতে হবে, ওপারেও এরকমই কয়েক পা উঠতে হবে। তারপরই ত বাঁধের বোল্ডার। কিন্তু একবার যদি এই খালে বন্যার জল ঢুকে যায় তা হলে ঐ বাধ থেকে বেরনো লম্বালম্বা পারগুলো ধাক্কা দিয়ে-দিয়ে স্রোত ঠেলে দেবে এই চরেরই দিকে, যাতে স্রোতের ধাক্কা গিয়ে বাধে না লাগে। তখন, এখান থেকে ওপারে যাওয়ার মানে এত বেগে ছুটে আসা বন্যার স্রোতের বিপরীতে যাওয়া, স্রোত ঠেলে যাওয়া। স্রোতের গায়ে যদি গা ভাসিয়ে দেয়া যায়, তা হলে সোজা এক টানে সেই দক্ষিণের পাকে নিয়ে যাবে–ব্রিজের দিকে। অভিজ্ঞতায় এরা একটা বিষয় জেনে গেছে–স্পারগুলোর ধাক্কায় স্রোতে এ দিকেই সব ছুটে আসে বলে, স্রোতে ভেসে গেলেও এই চরের এদিকে কোথাও ঠেকে যাবে। কিন্তু সেটা কতক্ষণ? যতক্ষণ, এই খালটা চওড়ায় মাত্র ততটুকুই থাকবে, যাতে, স্পার-এর ধাক্কায় স্রোত উল্টে এই পারের কাছাকাছি পর্যন্ত আসতে পারে। কিন্তু এই খালটা ত বন্যার জল ঢোকামাত্র এমন চওড়া হয়ে যাবে যে, এই এখন যেখানে নিতাইরা দাঁড়িয়ে আছে, সেসব প্রথম ধাক্কাতেই ডুবে জল উঠে যাবে, ঐ খানখেতের কাছে। তাতেই ত স্রোতের উল্টো ধাক্কা জলের মধ্যে কোথায় মিলিয়ে যাবে। তখন সবটাই ত তিস্তা। তখন জলের একটাই স্রোত, একটাই টান। সেই স্রোতের মধ্যে কেউ পড়লে, সেই টান থেকে সে নিজেকে বাঁচাতে পারবে না।

নিতাই, রাবণ, গজেন আর অমূল্য পাশাপাশি দাঁড়িয়ে নদীটাকে মাপে, একটু কোনাকুনি। এখন গরুগুলোকে এখানে ছেড়ে দিলে কানচি মেরে ওপারে গিয়ে উঠতে পারে। কিন্তু, এখন এই আবছা আলোতে ওদের এই সব হিশেবনিকেশে কোনো ভুল হচ্ছে না ত?

কয়ডা বাজে রে অমূল্যা, নিতাই আপন মনে জিজ্ঞাসা করে।

 খাইছে, ঘড়ি দেখি নাই, অমূল্য বলে।

নিতাই আকাশের দিকে তাকায়। এখানে আকাশ যেন একটু উঁচু, সেই কুয়াশার ভার যেন একটু কম। বৃষ্টি কমে থাকতেও পারে, কিন্তু এখানে বাতাস ত আসছে অনেকটা বাধা পেয়ে-পেয়ে। যে-জোর বাতাসের বাকি থাকে, সে-জোর নিয়ে ওপারের বাঁধের ওপর হামলে পড়ছে। ফলে, মনে হয় বাতাসটা যেন এদের মাথার ওপর দিয়ে যাচ্ছে।

সামনের বাঁধের ওপর দিয়ে ওদিকে রায়পুর রংধামালির আকাশের দিকে তাকালে উজ্জ্বল লাগে একটু, ওখানে ইলেকট্রিক লাইট আছে।

নিতাই কয়েক পা এগিয়ে বলে, গজেন, নাববি নি? নিতাই জলে পা দেয়, তার পায়ে স্রোতের টান লাগে, একটু গরম জল, বানার জল ঢোকে নাই এ্যাহনও, জল গরম।

নিতাইয়ের পেছন-পেছন ওরা একটু এগিয়ে আসে, টান কী রকম? অমূল্যও জলে পা ছোঁয়াতে-ঘেঁয়াতে জিজ্ঞেসা করে।

নিতাই হাঁটু জলে নেমে গিয়ে বলে, সকালে ও ত এ্যামনিই ছিল, জলের ওপর নিচু হয়ে নিতাই পায়ের বালি পরিষ্কার করতে শুরু করে। জলের ভেতরে তাকে কনুই ছাড়িয়ে ডোবাতে হয়। মুখটা প্রায় জলের ওপর নেমে আসে। জলের গন্ধ পায়। নিতাই গন্ধ শোকার জন্যে নাক নামায় নি। কিন্তু নাকে জলের গন্ধটা ঠেকলে তার নিজেরই মনে আসে–এটা বন্যার জলের গন্ধ না, রোজকার জলের গন্ধ। এই জায়গার জলটা পার হতে নৌকো লাগে ঠিকই, কিন্তু একদিকে বধ, আর-এক দিকে চরের মাঝখানে এই জলটায় কেমন মানুষের গায়ের গন্ধ লেগে থাকে, জলের ভেতরে মানুষের কাজের গন্ধ। এখন এই রাত্রিতে সে গন্ধ অনেকটা পাতলা, কারণ নিতাইয়ের মাথার ওপর দিয়ে সেই ঝা বয়ে যাচ্ছে ওপারের দিকে;কারণ, গত কয়েকদিনের বৃষ্টিতে এই খালের মত তিস্তার সোঁতার জলও কিছুটা বেড়েছে। ফলে, গন্ধটা তরল হয়েছে। কিন্তু তবু নিতাই গন্ধ পায়, অনিবার্যভাবেই পায়। রাত এখন বন্যার দিকে অনেকটাই এগিয়ে গেছে। আর, ঘণ্টাখানেক থেকে ঘণ্টা দুইয়েকের মধ্যে পাহাড় থেকে নামা বন্যায় এই খালটা একেবারে রামকান্তর জোত পর্যন্ত উঠে যাবে। কিন্তু রামাকান্তর জোত পর্যন্ত কেন? এই চরটা পুরোই জলের তলায় চলে যেতে পারে। পুরোটা? এই পুরোটা চর?

নদীর ভেতর থেকে নিতাই এই চরের দিকে মুখ করে তাকায়। ডাইনে মুখ ঘোরায়-দক্ষিণের বাঁক পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে। বায়ে মুখ ঘোরায়-বেশি দূর দেখা যায় না, এই দিকটাতে মাটি জলের মধ্যে অনেকখানি এগিয়ে এসেছে। নিতাই ঐ খালের বাকটার দিকে তাকায়, বেশ বড় বাক নিয়ে ঘুরে গেছে। ঐখানটাতে আলো আর একটু পরিষ্কার মনে হয়। নিতাই এক আঁজলা জল তুলে ঠোঁটের কাছে ধরে। তারপর ভেজা হাত সারা মুখে বোলাতে গিয়ে বলে, হে-এ, বালি এককারে কিচকিচ করত্যাছে

নিতাই মাথাতেও হাত দেয়, হে, বালি কিচকিচায়।

জলের ভেতর থেকে নিতাই ডাকে, গজেন।

ক কেনে।

নামবি? জলে?

তুই ত নামিই আছিস।

আমি ত এইখানে খাড়য়্যা আছি, অমূল্যা, গরুগুলাকে আইনতে কইছিস?

 এতক্ষণ রওনা দিয়্যা সারছে।

 ত দ্যাখ, কোথা দিয়্যা পার করবি? দ্যাখ। একটু বিরতি দিয়ে নিতাই বলে, এ্যাহনও পুরানা নদীই আছে

হয়?

 গজেন জিজ্ঞাসা করে।

 হয়। এ্যাহনও পুরানা নদীই খানিকটা জল তুলে বুকেপেটে লাগায় নিতাই, যেন বালি পরিষ্কার করছে।

নতুন জল ঢুকে নাই? অমূল্য জিজ্ঞাসা করে।

 দেখি বুঝিবার পার না? শুধাবার ধরছেন? রাবণ এমন ভাবে পায়ের ওপর বসে পড়ে যেন বন্যার স্রোতের ধাক্কায় এখনি একটা গাছ উপড়ে আকাশটা খালি করে দিল। রাবণ নদীর দিকে তাকিয়ে দেখে আরো, আরো বুঝে যায়।

নিতাই হাঁটু জলে ছিল, একটু উঠে আসে। পেছনে বা হাত দিয়ে কাছাটা খুলে খুব সাবধানে দুই পায়ের ভেতর দিয়ে সামনে গলিয়ে ডান হাতে ধরে। তারপরে আবার বা হাতে তুলে কাঁধের ওপর রাখে। তার পর দুই হাত দিয়ে ধুতিটার পাজা খুলতে থাকে। খোলার পর প্রথমে দুই হাতে দুদিক থেকে গুটিয়ে নিয়ে, ডান কাঁধে রেখে, হাত নামিয়ে কোমরের গিট খুলে দেয়। দুই হাতে কাপড়টাকে মাথার ওপর দিয়ে তুলে পোটলা পাকায়। পোটলাটা দুই হাতে বুকের কাছে ধরে। একটু পরেই বোঝা গেল নিতাই হিশেব কষছিল–ওখান থেকে কাপড়টা ছুঁড়ে দিলে পাড়ে পৌঁছবে নাকি বাতাসের ধাক্কায় জলে পড়ে যাবে। নিতাই বুকের কাছে তার কাপড়টা ধরে ঐ কয়েক পা হেঁটে এসে ভেজা বালুচরে ধুতিটা ফেলে দেয়। মাটিতে পড়ার আগে ধুতিটা একটু খুলে যায়। পাড়ে এলিয়ে পড়ে থাকে।

ততক্ষণে নিতাই পেছন ফিরে জলের ভেতরে হেঁটে যাচ্ছে।

সামনেই ওপারে বাঁধের পটভূমি ছিল বলে, নাকি, এখানে জলকুয়াশা নেই বলে, নাকি, আলো একটু হালকা বলে–জলের ভেতরে হেঁটে-হেঁটে আরো ভেতরে নিতাই যখন চলে যায়, তখন, নদীর মধ্যে–ঠিক নদীর মধ্যে নয়, নদী আর আকাশের মধ্যবর্তী আকাশ জুড়ে–তার শরীরের পরিণাহরেখা ক্ষোদিত হয়ে ওঠে ছায়াময়–তার মাথার ওপরে বাবরির সামান্য ঢেউ আর কাঁধের দুপাশে সেই বাবরির ফুলে ওঠা; তার ঘাড় বাবরিতে ঢাকা; সেই ঢাকা ঘাড়ের দুপাশ দিয়ে কাঁধের তরঙ্গিত বয়ে যাওয়া, বাহুর গোল, বাহু থেকে কনুই পর্যন্ত ঢেউ, কনুইয়ের চওড়া ক্রমে সরু হয়ে আঙুরে বিচ্ছিন্নতায় জলের ওপর দোলে। নিতাই হেঁটে যায়। আর এই চলন্ত রেখা নীচ থেকে জলে ডুবে যায়।

নিতাই হেঁটে-হেঁটে জলের ভেতর থেকে ভেতরে চলে যায়।

এখন হেঁটে যাওয়ার একটি উপলক্ষ ত নিতাই-এর আছেই। গরুগুলো রওনা দিয়েছে। বন্যা আসার আগে সেগুলোকে ওপারে পৌঁছে দিতে পারলে অনেকটা নিশ্চিন্ত। এখনো এখানে পুরনো নদী, পুরনো জল। গরুগুলোকে চেনা পথে ওপারে নিয়ে যাওয়া যাবে। কিন্তু পথটা আগে ঠিক করা ভাল। গজেনকে তাই জলে নামতে বলছিল নিতাই। জলে নেমে নিতাইও যেন সেই পথটাই পাকাপাকি ঠিক করছে।

নিতাইয়ের এখন গলাটুকু জেগে আছে, গলা মানে বাবরিটুকু। পাড় থেকে মনে হচ্ছে, প্রায় মাঝখানে। কিন্তু অভিজ্ঞতায় জানা আছে, এটা ঠিক মাঝখান নয়, মাঝখান আরো একটু দূরে। কিন্তু, এতদূর পর্যন্তও যদি হেঁটে যেতে পারে, নিতাই, তা হলে গরুগুলোকে সহজেই পার করে দেয়া যাবে, এখনো।

অমূল্য জিজ্ঞাসা করে, হে রাবণ কাহা, শুইনবার পান? গরুগুলা বাহির হইছে?

 রাবণ মাটির ওপর তার প্রায়নগ্ন শরীর নিয়ে বসে ছিল নদীর দিকে মুখ করে। তার বা হাঁটু মাটিতে শোয়ানো, ডান হাঁটু খাড়া। দুই হাতে সেই হাটুটা জড়িয়ে থাকে বারণ, মুখটা পায়ের মাঝামাঝি। যেন ওটা তার নিজের হাঁটু নয়, কোনো গাছটাছ। সে নদীর দিকে মুখ করে বসে ছিল বটে কিন্তু তার ঘাড়ের ভেতর মাথাটা এমনই সেঁদানো আর তার বাহুর গোড়ার হাড় দুটো লম্বা হয়ে তার কান পর্যন্ত এমনই উঠেছে যে বোঝা যায় না সে নিতাইয়ের দিকে তাকিয়ে, নাকি নিতাইকে ছাড়িয়ে বধের দিকে, নাকি সামনে, একটু দূরের, মাটির দিকে।

হয়। বাহির হছে মনত খায়, রাবণ আস্তে বলে।

 বাতাস পুর্ব থেকে পশ্চিমে আসছে। রাবণ এখন এই রাত-পেরনো নদীর তীরে মাটিতে এমন স্থির বসে যে, সে হয়ত বাতাসের নিহিত আওয়াজ শুনতে পাচ্ছে। শুনতে পাচ্ছে–তিস্তার ভূখণ্ড বদলানো যেবন্যা পাহাড় থেকে নামছে এই চর, ও এই রকম আরো অনেক চর, বা, গ্রাম, বন, ভাসিয়ে নতুন রকমে ভূখণ্ডটাকে সাজাতে, সেটা পৌঁছবার আগেই চরের প্রথম উদ্বাস্তুর পাল অনভ্যস্ত সময়ে চার পায়ে পথে নেমে প্রায় অন্ধের মত এই নদীতীরে ছুটে আসছে। এ রাস্তায় তারা রাতে আসতে অভ্যস্ত নয়। তাদের অভ্যস্ত পথে তারা আর-কোনোদিন এই চরে ফিরে না-আসতেও পারে।

নিতাই তার ডুবজলে পৌঁছে ভেসে ওঠে। দেখা যায়, সে তার বাবরি চুল ঘাড়ের এক-এক দোলায় ঝাপটাচ্ছে। ভেজা বাবরি তার মাথার ওপরে ঝলসে উঠছে।

জল নতুন চুকিবার ধইরছে? ঐঠে পাস? রাবণ তার ভঙ্গি না বদলে বলে। নিতাইকে বলে। নিতাইয়ের যেন একটা ছুততা দেওয়ার দরকার হয়–কেন সে এতটা দূরে, এতটা জলে, এতটা তৃপ্তি পাচ্ছে। ওখান থেকেই সে বলে, সারা মাথা-গা বালি কিচকিচাছে–

গরুর পালকে কোথা দিয়ে ওপারে তুলবে সেই পথনির্ণয়, নিতাইয়ের এই জলমগ্নতার কারণ হিশেবে যথেষ্ট ছিল না।

এই লেগুন-এর মত খালটুকু তিস্তারই অন্য কোনো বন্যায় তৈরি হয়েছিল।

তিস্তার মূলস্রোতের মাঝখানে বিচ্ছিন্ন সামান্য বালুচর, তার পাশ দিয়ে জলের ছোট রেখা কখনোকখনো বহমান থাকে। এই খালের মত তিস্তাটুকু পেরিয়েই এই চরের জীবনযাত্রাকে শহরের, বাজারের, পঞ্চায়েতের, ভোটের, সরকারের জীবনযাত্রার সঙ্গে গ্রথিত থাকতে হয়। সেই সামান্য বালুচর আর-কিছুক্ষণের মধ্যে হাজার-হাজার কিউসেক জলের আঘাতে কোথায় উবে যাবে, হয়ত, এই খালটুকু, লেগুন-এর মত খালটুকু, খালের মত তিস্তাটুকু সেই প্রবল মুহূর্তে এই প্রতিদিনের ইতিহাস থেকে উপকথায় চলে যাবে, এই চুর, এই মানুষজন, এই গাইবলদ, এই আবাদ, বালুচরে বসে থাকা ঐ বৃদ্ধ–যে তার শরীর দিয়েই শুধু জানে আর বোঝে, শরীরের বাইরে যার আর-কোথাও মন নেই–এই সব সহ, সব সহ।

পুরানা, পুরানা, এইঠে সব পুরানা, মাঝনদী থেকে নিতাইয়ের গলা ভেসে আসে রাবণের কতক্ষণ আগে করা প্রশ্নের জবাবে। সে তখন স্রোতের টানে গা ভাসিয়ে দক্ষিণে যাচ্ছে। খানিকটা গিয়েই নিতাই একট সরে এসে দাঁড়িয়ে পড়ে–আরে, রে, রে, অতগুলা মশাল জ্বালাইয়া মিস্তিরি পাড়ার দক্ষিণ পাকে.. বলতে বলতে থেমে যায় নিতাই। সে চিনতে পেরে যায়, এই খালের তিস্তার ভেতর থেকে ঐ দক্ষিণ পাড়া দেখা যাচ্ছে, ঐ তিস্তা ব্রিজ দেখা যাচ্ছে লাইট জ্বলে আছে, ঐখানে নরেশ আর নকু বাতাসের মধ্যে, জলকুয়াশার মধ্যে পাহারা দিচ্ছে তিস্তা ব্রিজের দিকে তাকিয়ে। নিতাই চেঁচায়, অশ্বিনী রায়ের জমিতে পাকা ভাদই কাইটতে নামছে..

এই চর জুড়ে তিস্তার বন্যার ছোঁয়া লেগে গেছে, এখন বন্যাটা আসাটুকুই বাকি। খেতের দাঁড়ানো পাকা ধান যতটুকু পারা যায় কেটে নেয়া।

নিতাই সেই জলের ভেতর থেকে দেখে–এই চরটার ওপর দিয়ে তিস্তা বয়ে যাচ্ছে। নিতাই সেই জলের ভেতর থেকে দেখে-আর-কোনো একটা নতুন চর তাকে খুঁজতে হচ্ছে। নিতাই সেই জলের ভেতর থেকে একবার ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে একটু ভেসে গেলেই ওপারে রংধামালি রায়পুরের বাধে উঠে সে বসে বসে আর-কিছুক্ষণের মধ্যে এই চর ডোবানো, এই খালের মত তিস্তা ভাসানো, নতুন জলের ফ্লাড় দেখতে পাবে।

নিতাই সেই মশালের আলো থেকে চোখ শেষবারের মত সরিয়ে নিয়ে উত্তর দিকে সাঁতার কাটে, এই খালের স্রোতটুকুর বিপরীতে, পাহাড়ের ফ্লাড ঐ দিক দিয়েই ত আসবে। এখনো এই পুরনো জলে, এই প্রতিদিনের জলে, এই জীবনযাত্রার জলের ভেতর দিয়ে সঁতরাতে-সঁতরাতে নিতাই হাঁক দেয়, গজেন, অমূল্যা, আয়, ফ্লাড দেইখ্যা আসি, কতদূর আইসল, আয়…

এতক্ষণে নিতাই সম্পূর্ণ উপলক্ষহীন হয়ে আত্মসমর্পণ করতে পারে–এই চরের আসন্ন সম্ভাব্য ধ্বংসের মুখে সে চরের সঙ্গে এক আসঙ্গে লিপ্ত হয়ে যেতে চায়।

সে এই চর আর জল জন্মসূত্রে পায় নি। প্রবাসী বলেই বোধহয় এ জলের টান এত বেশি, এত গাঢ়। এই জল ধ্বংস হওয়ার আগে নিতাই বোঝে এই জল তার শরীরেরই অংশ। এই শরীরে ও এই জলে তখন শেষ স্মৃতি ছিল বন্যার আগের শেষ স্মৃতি।

গজেন আর অমূল্য দৌড়ে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ে তাদের নেংটি আর ধুতি পাড়ে খুলে রেখে–সাঁতার কেটে কোনাকুনি নিতাইয়ের দিকে চলে স্রোতের উজানে এগিয়ে, বন্যাঢোকার সম্ভাব্য মুখে। এখানে জলকুয়াশা ছিল না, আকাশের আলো একটু হালকা ছিল, ওরা জলের মধ্যে মাছের মত বয়ে চলে এই পুরনো জলে, প্রতিদিনের জলে, জীবনযাত্রার জলে। ..

পাড়ে অনড় রাবণ শুনতে পায়, বংশানুক্রমে পাওয়া তার এই নদী বেয়ে যেবান ধারাবাহিক এসেই যাচ্ছে, সেই এখনো অনুপস্থিত বন্যার সামনে, চরের মাটি ছেড়ে প্রথম উদ্বাস্তুর পাল, শেষ রাত্রিকে বা প্রথম সকালকে হাম্বা রবে চকিত করে ছুটে আসছে।

.

০৯৮.

অকাল গোষ্ঠ

 বাঁধের ওপর গরু ভোলা মানেই বন্যা স্বীকার করে নেওয়া। গোয়াল থেকে গরু বের করে সারাটা চর পেরিয়ে সোঁতাটা কিছু হেঁটে, কিছু সাঁতরিয়ে, বাঁধের ঢাল বেয়ে ওপরে উঠে পড়া মানেই ঘর ভাসল। মুখে যতই বলা যাক না কেন যে গরুগুলোকে আগে তুলে দিলে ত আর ক্ষতি নেই, বন্যা যদি নাই আসে বা নেহাৎ ছোটখাট বন্যা যদি আসে, তা হলে নামিয়ে আনলেই হবে–গরুকে একবার ঘর ছাড়া করলে সে ঘরে আর টেকা যায় না। এমনি গরু আশেপাশে চরছে, বা, পাল করে গরুগুলোকে মাঠে নিয়ে যাওয়া হয়েছে–সে এক কথা। সে ত জানাই আছে-কখন সে গরু ফিরবে। বাড়ির সবচেয়ে ছোট ছেলে যদি সারা সকাল এবাড়ি ওবাড়ি ঘুরে বেড়ায় তা হলেও যেমন বাড়ি ভরাই থাকে। কিন্তু গোয়াল শূন্য করে, গরুর পালকে পাড়া ছাড়িয়ে, চর ছাড়িয়ে, নদী ছাড়িয়ে একেবারে বাঁধের মাথায় তুলে দেয়া–আর তারপর সেই ঘরবাড়িতেই থাকা–এ অসম্ভব। গোয়ালঘরের দড়িটা, গোয়ালঘরে গরুর মুখ থেকে খসে পড়া পোয়াল,আর ঘাস গরুর চোনা আর গোবরের গন্ধে বাড়িতে আর তিষ্ঠনো যায় না, কেমন ফাঁকা-ফাঁকা লাগে। যেন সারা পাড়াতেই কোনো শোক নেমেছে, বা, একটা কোনো বাড়ির শোকই সারা পাড়ায় ছড়িয়ে পড়েছে।

হিশেব অনুযায়ী পাহাড়ের বন্যা এখানে আর দু-এক ঘণ্টার মধ্যেই এসে যাচ্ছে যখন, তখন গরুর পালের সঙ্গে গরুগুলোকে তাড়াতে-তাড়াতে বাড়ির ও পাড়ার বাচ্চাকাচ্চারাও ছুটতে থাকে। রাতশেষের বানাবাতাসে আর বৃষ্টির ছাটে বিদ্ধ এ চরে গরুর পালের সেই সমবেত হাম্বার যেন চরের ভেতর থেকে জেগে ওঠে। মানুষের স্বরের সঙ্গে মেশানো হাম্বা ডাকে কেমন এক স্বস্তি থাকে। কিন্তু মানুষের স্বরের সমর্থনহীন এই রাত শেষ করা হাম্বায় মানুষের বসত উৎখাত হয়ে যায়। নদীর পথে ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয় পাল বেঁধে গরুরা ছুটে আসছে। অথবা হয়ত স্পষ্টও হয় না–ঐ জলকুয়াশা সরে সরে যায় আর সেই অবকাশ জুড়ে জেগে ওঠে ধাবমান গোষ্ঠের চলমূর্তি। যখন গ্রাম থেকে আরো দূরে যায়, তখন দেখা যায় সেই পালের ভেতর গরুর গায়ে গা লাগিয়ে পেছনে-পেছনে, ভেতরে-ভেতরে গায়ের বাচ্চারাও ছুটে আসছে। তাদের এক-এক হাত তোলা। কোনো কোনো হাতে কঞ্চি বা লাঠি আছে। কিন্তু সে কঞ্চি বা লাঠি কোনো গরুর পিঠে পড়ে না, গরুর পাল এতটাই সারি বেঁধে ছুটছে, ছুটছে অথচ সারি থেকে সরছে না।

গাঁয়ের এই রাস্তা এই গরুগুলোর চেনা, এই বাচ্চাগুলোরও চেনা। এই রাস্তা দিয়ে এতটা বড় পালে না হলেও, ছোটখাট পালে এই গরুগুলোত প্রায় রোজই ঘরে ফেরে, যায়-আসে। কখনো কখনো কোনো-কোনো গরু ত বাধা বাছুরের হাম্বা শুনে ছোটেও বটে। এত বড় গায়ে, এক-একটি এত বড় পাড়ায় কোনো-না-কোনো গরুর ত দুধের বাছুর থাকেই–গরুদের ত আর পরিবার পরিকল্পনা হয়নি–দুধের বাছুরের ডাক শুনে কোনোনা-কোনো গরুকে ত ছুটতেও হয়। কিন্তু তাই বলে এমন ছোটা? তাও এই রাত শেষ হওয়ার আগেই? মানুষের গলার স্বরের গরমে কুয়াশা কেটে যাবারও আগে? তাও আবার এত তাড়াতাড়ির আঙুলে খোলা দড়ি ফেলে? গলায় পিঠে মানুষের হাতের ছোঁয়া না নিয়েই?

এই রাস্তা ত মানুষের ও গরুর পায়ে-পায়ে এরকম পাল বেঁধে পালানোর জন্যে তৈরি হয়নি। তাই এত গরুর সঙ্গে ঐ গরুটার পেটের ধাক্কা লেগে যায়। একটা গরু একটু সরে গেলে তার একটু পেছনের গরুটার কাঁধে ধাক্কা লাগে। সেটা একটু পেছিয়ে গেলে তার পেছনের গরুর গলা এসে আগের গরুটার কোমরের হাড়ের ওপর ওঠে। একটু জোয়ান হয়ে ওঠা বাছুর এই সুযোগে একে ধাক্কা দিয়ে, ওকে সরিয়ে, আরো সামনে এগিয়ে যেতে চায় আর তার মা তাকে ধরবার জন্যে আর-একটু জোরে ছুটতে গিয়ে ধাক্কা খায়। যে-বাছুর এখনো বাট ছাড়ে নি সে এই সুযোগে পেছন থেকে মায়ের সারা রাত ধরে ভরে ওঠা বাটে মুখ ঢুকিয়ে টান দেয়–সেই টানের আবেশে মায়ের গলা লম্বা আর পা চারটে শিথিল হতে না-হতেই পেছনের গরুটার ধাক্কায় বাছুরটা ছিটকে যায়। মার বাটে মুখ ঢোকানোর জন্যে ওর ঘাড়টা নোয়ানো ছিল আর নোয়ানো ঘাড়ের ভারে সামনের পা দুটোর কুঁচকিতে ভাজ পড়ে। সেই ভাজের ঝোঁক সামলাতে পেছনের পা দুটো ফাঁক হয়ে থাকে, হাঁটু দুটোতেও একটু ভাজ পড়ে। পেছনের গরুর ধাক্কা খেয়ে তাই সে বাছুরটা প্রথমে ডাইনে ছিটকে যায়। ছিটকোতে-ছিটকোতে তার সামনের পা দুটো ভেঙে যায়, সেটা হুমড়ি খেয়ে পড়ে, পড়ে কাত হয়ে যায়। পেছনের গরুগুলোর ধাক্কায় তার মা চলে যায়, তার মার বোটা থেকে প্রথমে সরু ধারায়, তারপর ফোঁটায়-ফোঁটায় দুধ মাটিতে পড়তে থাকে–অনেকক্ষণ। বাছুরের পেছনের গরুগুলো তার ওপর এসে পড়ে না। তাকে পাশ দিতে বায়ে সরে যায়। ফলে, সবচেয়ে বায়ের গরুটা রাস্তা থেকে গড়িয়ে পড়তে গিয়ে মাথাটা নীচে নামিয়ে পেটটাকে রাস্তার ওপর এনে ফেলে। এর মধ্যেই পেছনের গরুটা তার জায়গা নিয়ে নেয়। সে এবার মাথাটা তুলে গলাটাকে ভিড়ের মধ্যে ঢুকিয়ে দেয়, তারপর পেটটাকে। ততক্ষণে বাছুরটা সামনের দুই পায়ের ওপর ভর দিয়ে সোজা হয়ে পেছনের পায়ের ওপর ভর দিয়ে গড়ায়, দৌড়য়, হা-স্বা, গরুর পালের ভেতর থেকে অনেকগুলো গভীর হাম্বা ওঠে। কার বাছুরের সাড়া কে দেয় বোঝা যায় না। প্রফুল্ল পালের গাইটা বুড়ি হয়েছে, মোটা হয়েছে। সেটা জোরে ছুটতে পারে না। কিন্তু পালের মাঝখানে তাকে জোরে ছুটতেই হয়। তার অত বড় পেটটার দোলনে সে নিজেই হাঁফিয়ে ওঠে। তার নাক দিয়ে ফেনা গড়ায়। দেড়া গজেনের গাইটা দুদিন আগে বিইয়েছে। তার বাছুরটা ছুটতে পারে না। তাকে তুলে দেয়া হয়েছে জগদীশের মোষের পিঠে। বাছুরটাকে নিয়ে মোষটা বেশ তালে-তালে দুলে-দুলে ছোটে পালের মাঝখানে। তার গায়ের ধাক্কায় অন্য গরুগুলো দু পাশে সরে যায়। কিন্তু বাছুরটা বারবারই পিঠের ওপর উঠে দাঁড়ানোর জন্যে সামনের পা দুটো কোলের ভেতর থেকে বের করতে চায় আর মোষের চলার দোলায় ও বেগে সঙ্গে-সঙ্গে তার ঘাড়টা নুয়ে পড়ে। সে আবার পা দুটোকে গুটিয়ে নিয়ে ঘাড়টা সোজা করে। তার মা-গাই মোষটার পেছন-পেছন ছোটে। বাছুরটাকে বসিয়ে দেয়া হয়েছে পেছন দিকে মুখ করে। তার মা জিভ বের করে গলা তুলে বাছুরটাকে চাটতে চায়। কিন্তু মোষের অত উঁচু পিঠ পর্যন্ত তার জিভ যায় না। তার বাছুরচাটা এখনো শেষ হয়নি।

গাঁয়ের বসতসীমানা ছেড়ে পালটা এবার চাষের সীমানায় আসে। এও ঠিক রাস্তা নয়। একটি বড় আল, দুপাশে মোটা ঘাস, মাঝখানে কাল মাটি জলে পিছল। রাস্তা থেকে দুপাশের জমি কোথাও বেশ ঢালুতে, কোথাও তার থেকে সামান্য উঁচু। পিছলে গেলে ঐ মাঠেই পড়ে যেতে হবে। পালটার গতি একটু কমে আসে। ছুটছে কিন্তু পদক্ষেপগুলো একটু ছোট হয়ে এসেছে যাতে পিছলে গেলে সামলানো যায়। আর হুড়োহুড়িটাও যেন কম। সঙ্গের ছেলেগুলো লাঠি বা কঞ্চি উঁচিয়ে দু পাশের খেতে নেমে গেছে। সেই ঢাল থেকে তারা কঞ্চি বা লাঠির ঘা মারছে রাস্তায়–হেই হেই হেই আওয়াজে–গরুর পা যেন পিছলে না যায়। গরুর পাল ছুটছে আর মাঠ দিয়ে ছেলেগুলোও ছুটছে। এখন আর দুপাশে গাছ বা বাড়িঘরের সারি নেই, যেন এতক্ষণ সেই সারি এই প্রায় ভোরে, এই শানশান বাতাসে, এই জলে খানিকটা আশ্রয় দিচ্ছিল। কিন্তু এই খেতিজমিও ত চেনাই। এই মাটি আর ঘাসপাতার ভেজাগন্ধও ত চেনাই। এই দু পাশের অবকাশ দিয়ে নদী ও নদীর বাঁক দেখাও ত এই পালের অভ্যন্তই। কিন্তু তারও ত একটা সময় আছে। এখন রোদ নেই, এখন ঘাসে মুখ দেয়া নেই, এখন কালো মাটির ওপর পেট ঢেলে দিয়ে শোয়া নেই, এখন গলা তুলে ভেতরের ঘাস মুখে নিয়ে আসা নেই। এখন ছোটা, ছোটা।

.

০৯৯.

গরুর পালের পাড়ে ও জলে নামা

জলের একটা গন্ধ আছে–গরুরা সে গন্ধ, চেনে। কিন্তু এখন জলের কোনো গন্ধ পাচ্ছিল না। বাতাস এলোমেলো ঝাঁপটে বইছিল, আর বাতাসের সঙ্গে মিশে ছিল সুচের মত জল। ধীরে-ধীরে গরুগুলোর বা দিকের পিঠের লোম ভিজে ওঠে বাতাসের ঝাপটা ঐ দিক থেকেই আসছিল। তাদের গায়ের লোমগুলো বাতাসের ঝাপসায় সরে-সরে যায় আর সেই ফাঁক দিয়ে জল একটু-একটু গড়ায়। তাদের বা মুখের লম্বা পাশটার নোমও সেরকম ফাঁক হয়ে থাকে আর সেই ফাঁক দিয়ে জল গড়িয়ে গলার দিকে নামে। বা দিক থেকে আসা বাতাস আর জলের ঝাপটা থেকে মুখটা বাঁচাতে পুরো পালটাই একটু ডান দিকে মুখটা ফিরিয়ে রাখতে চাইছিল। তাদের পা সোজা যাচ্ছে, তাদের শরীর সোজা আছে কিন্তু তাদের মুখগুলো একটু ডাইনে ফিরতে চাইছে। তাতে তাদের গতি এই খেতবাড়িতে আরো একটু কমে আসে। আর তাদের নাক থেকে জলের গন্ধ ক্রমেই হারায়। যতই তারা নদীর কাছাকাছি হয়, যতই তাদের বা চোখ, মুখ ও নাকের বা পাশ জলে ভিজে ওঠে, ততই তারা জলের গন্ধ থেকে দূরে সরে–যেন তারা জলের বিপরীতে ছুটছে। ..

খেতবাড়ি শেষ হয়ে যায়–পালের ক্ষুর পড়ে নদীর পাড়ের বালিতে! এখন আর পড়ে যাওয়ার ভয় নেই, এখন আর পিছলে যাবার ভয় নেই বালুবাড়িতে পা দিতে না-দিতেই পালটা যেন ছড়িয়ে পড়তে চায়। পুরোটা পালের ভেতর যে-একটা উদ্বেগ কাজ করছিল, বালুবাড়িতে পেঁছে সে উদ্বেগটা যেন আচমকা ও অতর্কিত শেষ হয়ে যায়, যেন তাদের এই বালুবাড়িতেই পৌঁছনোর কথাছিল। বালির ওপর দিয়ে হাঁটা যায় না, পায়ের ফাঁকে বালি ঢুকে যায়। সেই কারণে যে পালের গতি কমে আসে তাই নয়, বালিতে হটার জন্যে পালটা ছড়িয়ে যেতে চায়, গরুগুলো যে যার মত হাঁটতে চায়। কিন্তু সেই বাচ্চাগুলি এখন তাদের কঞ্চি আর লাঠি উঁচিয়ে সামনে এসে গেছে। দুদিক থেকে লাঠি আর কঞ্চি গরুর পালের ওপর নেমে আসতেই গরুগুলো দাঁড়িয়ে পড়ে মুখ সরিয়ে নেয় আর পায়ে-পায়ে আরার পুরনো লাইনে ফিরে আসে। সেই ছেলেরা আর এগয় না, ঐ জায়গায় দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে গরুগুলোকে লাইনে রাখে। তারপর বালির ওপর ধীর পায়ে পালটা যখন নদীর দিকে একটু টলতে-টলতেই এগয় তখন সেই ছেলেরা আরো পেছিয়ে গিয়ে চেঁচায় হেট হেট। পালটা এখন এই বালুবাড়িতে যেন একটা লাইনের মত দাঁড়িয়ে গেছে। দুপাশে নদীর খাত দিয়ে সারা রাতের বাতাস দক্ষিণ থেকে পূর্ব থেকে উত্তরে আর। পশ্চিমে শান-শানকরে ওড়ে আর সেই নদীখাতের অবকাশেই এই গরুরা যেন একটার্সাকো বা বাধ। নিতাই, গজেন, আর অমূল্য পাড়ের কাছের জলে ছিল। রাবণ সেই পাড়েই বসে ছিল। গরুর পাল দেখে জল থেকে উঠে নিতাই, গজেন, অমূল্য ছুটতে শুরু করে। জল ছেড়ে উঠেই ওরা পাড়ে ফেলে রাখা ধুতি-নেংটি এক পাক দিয়ে পরে নেয়। একে বালি, তায় ভেজা, বাতাসের বিপরীতে ওরা এগতে পারে না। নিতাই কিছু একটা বলে চেঁচায়–সে চেঁচানি বাতাসে উল্টো দিকে উড়ে চলে যায়। নিতাই একটু এগিয়ে ছিল অমূল্য তখনো জল থেকে যেন পুরো উঠতে পারে না। হঠাৎ অমূল্য জল থেকে না উঠে, আবার জলের দিকে চলে যায়, তারপর ডুব জলে পৌঁছে সাঁতার দেয়। নিতাই এ গজেন বলে ডাক দিয়ে পেছন ফিরতেই দেখে অমূল্য আবার জলে সাঁতার কাটছে। নিতাই দাঁড়িয়ে পড়ে কোমরে হাত দিয়ে চেঁচিয়ে ওঠে, এহন তর সাঁতার দেওনের টাইম? জলে ত তখনো বান ঢোকেনি। অমূল্য চিত হয়ে হাত মাথার দিকে ছুঁড়ে দেখায় সে ওপারে যাচ্ছে।

নিতাই বুঝে নেয়। ভালই ত করছে অমূল্য। গরুর পালকে নদী পার করানোর সময় ওপারে ত থাকতেই হবে কাউকে। কিন্তু একা অমূল্য কি পারবে। সে গজেনকে বলে, যা, তুইও যা ওপার–দেইখা আয়, কুনখান দিয়া পার করাই?

নিতাইয়ের কথায় গজেন জলে ফেরে কিন্তু সে অমূল্যর দিকে যায় না। পাড়ের কিনারা ঘেঁষা জলে ছপছপ করতে করতে সে এলোমলো পায়ে হাঁটতে থাকে। বালি দিয়ে হাঁটার সুবিধে অনেক। কিন্তু জলতল ত সমতল নয়। গজেন খানিকটা ছপছপ করে হেঁটে যাওয়ার পরই তার এক পা গর্তে পড়ে যায়–সে কাত হয়ে জলের মধ্যে পড়ে, তারপর হাতের ভরে আবার সোজা হয়ে হাঁটে। এবার সে পাড় ছেড়ে দিয়ে আর-একটু গভীরে যায়–সেখানে তার হাঁটু জল। খানিকটা মাটি শক্ত পায় গজেন–সে একটু আন্দাজের চেষ্টা করে শক্ত মাটির ঢালটা কোন দিকে। অন্তত হাঁটার আরামটুকু পাক। কিন্তু সেই মাপ নিতে গিয়েই গজেন আবার পড়ে, পড়ে গিয়ে সে আর ওঠে না–মাথাটা জলের তলায় নিয়ে যায়, অন্তত জলের তলায় ত আর ঐ বাতাস আর বৃষ্টির সুচ নেই! ভস করে মাথা তুলে গজেন একবার এপার-ওপার দেখে বটে, চুল থেকে জল ঝেড়ে ফেলেও বটে। হাত দিয়ে মুখচোখের জল সরিয়ে গজেন দেখে অমূল্য ওপারে উঠে হেঁটে-হেঁটে এদিকে আসছে। গরুগুলো যেখানে এখন দাঁড়িয়ে তার সোজাসুজি পশ্চিমের পাড়ের দিকে একটা জায়গা ঠিক করে গজেন আবার জলে ডুব দেয়।

ততক্ষণে বালুবাড়িতে গরুর পালটা এসে পড়েছে। আলগা দু-একটা গরু পেছনে আসছে। নিতাই সামনে দাঁড়িয়ে চেঁচায়–হেই বালিশ-সালিশ–তোরা দুইডা দুই পাকে খাড়াবি আর ঐ বলরামের ছোঁয়াটাক কয়্যা দে পাছত যাইতে, পাছত। ভয় পাস না। বানার জল এখনো আসে নাই, কোনোটা এদিক-ওদিক হইলে হইব না, চিল্লাচিল্লি করিস না।

সেই গরুর পালের মাঝখানে, সবচেয়ে উঁচুতে মোষের কালো কুচকুচে পিঠের ওপর বাদামি বাছুরটা আবার পায়ের ওপর উঠতে যায় আর তার ঘাড় ভেঙে যায়। মোষটা তার গলা উঁচু করে। শিঙ দুটো বাতাসকে বেঁকিয়ে দেয়। সেই কানো শিঙ এতই বাঁকানো যে তলার দিকটা ভিজে কাল হয়ে গেছে কিন্তু উঁচলো বাকটার নীচে জল লাগতে পারছে না, সেটা ধূসরই আছে! মোষটা যেকারণেই হোক একটু অস্তির হয়ে ওঠে–হয়ত ও বুঝেছে তার একটা বিশেষ দায়িত্ব আছে, হয়ত তার মালিকের কোনো হদিশ পাচ্ছে না বলে একটু অনিশ্চিত ঠেকছে তার। সে তার লেজের ঝাঁপট মারে। যার বাছুর সেই গাইটা দাঁড়ানোর সুযোগে জিভটা বাড়িয়ে তুলে বাছুরটাকে চাটতে চাইছিল। দাঁড়িয়ে আছে বলে মনে হচ্ছিল, বুঝিবা পেরে যাবে। মোষের লেজটা তার মুখে ঝাপটা মারে। বোধহয়, চোখেও লাগে। গাইটা চোখ কুঁচকে মুখটা নামিয়ে বা দিকে ঘুরিয়ে নেয়। পালটা এইটুকু মাত্র দাঁড়িয়ে আছে, তার মধ্যেই মাঝখানে এক এঁড়ে সামনের গরুটার ওপর দুই পা তুলে দেয় আর গরুটা সামনে হুমড়ি খায় এক বাছুরের ওপর। এঁড়ে পড়ে যায়। কিন্তু বাছুরটা গিয়ে পড়ে আর-এক বাছুরের ওপর। সে বাছুরটা ভাবে, আগের বাছুরটা তাকে টিসচ্ছে। সেটা শিঙ নামিয়ে তেড়ে যায়। পালের ঐ জায়গাটাতে একটা ধাক্কাধাক্কি পড়ে যায়।

নিতাই হঠাৎ লাফিয়ে সালিশের হাত থেকে তার লাঠিটা কেড়ে নিয়ে এড়েটার দিকে ধেয়ে যায়। এড়েটা বুঝতে পেরেছিল। সেটা প্রথমে ডান দিকে মুখ ঘোরায়, তারপর মুখ গলিয়ে একটু ফাঁক তৈরি করে উল্টো দিকে দৌড় দেয়। নিতাই ছিল পালের বায়ে, আর এঁড়ে দৌড়য় ডাইনে। ফলে নিতাই তার পেছনে ছুটতে পারে না। সে লাঠিটা উঁচিয়ে চেঁচায়–বাদ দে, ওটাক নিবার লাগিবে না, শালা, গরম খাইলেই হই! বানা নাই, ভাসা নাই, শালো বলদা!

কিন্তু বালিতে এডেটা দৌড়তে পারে না। ওদিক থেকে বালিশ দৌড়ে সেটাকে ধরে ফেলে।

 নিতাই পালটার মুখোমুখি গিয়ে দাঁড়ায়, নদীর দিকে পেছন করে–যেন একবার দেখতে চায় কোনো নতুন ব্যবস্থা নিতে হবে কিনা। সে একবার ডাইনে তাকায় নদীর ওপরটা অনেক দূর পর্যন্ত পরিষ্কার কিন্তু পারে এখনো আবছা অন্ধকার। নিতাই আকাশের দিকে তাকায়–আকাশ একেবারে মাটির বুকের ওপর নেমে এসেছে। পারের ঐ অন্ধকার আর আজ যাবে না। কদিন পর যাবে–এখন তাও বলা মুশকিল। বন্যাটা যেন উত্তরে, নিতাইয়ের বায়ের পাহাড় থেকে নামছে না–সমস্তটা আকাশই বন্যা হয়ে যেন এই চরের পৃথিরীর ওপর এসে পড়েছে। একেবারে পিষে মেরে ফেলবে। নিতাই আবার ডাইনে তাকায়, পুবে। তার লম্বা বাবরি চুলগুলো তার মাথা থেকে সমকোণে উড়তে থাকে। সে বা হাত দিয়ে চুলগুলোকে মুঠো করে ধরে কিন্তু ঘাড় ঘোরায় না। তার চোখে-মুখে জল আর বালির সুচ এসে বেঁধেনিতাই ঘাড় ঘোরায় না। ওদিক থেকে বান আসবে না, কিন্তু ওদিক থেকেই ত বাতাস আসছে, বৃষ্টি আসছে আর চরের পৃথিবীটাকে ঢেকে ফেলে নীচে নামা এই যে-মেঘ তার ওপর দিয়ে, তার ভেতর দিয়ে দিয়ে, আরো বহু মেঘ হু হু করে এদিকে ছুটে আসছে, ছুটে যাচ্ছে আরো উত্তরে। আরো বৃষ্টি হবে, আরো বন্যা আসবে। নিতাই সেই আগামী বৃষ্টি আর আগামী বন্যার আন্দাজ করতে, সামনের গরুর পালটা ভুলে গিয়ে শুধু তার ঘাড়টা ডাইনে ঘোরায়, আকাশে তোলে, আবার নামায়। নিতাইয়ের ধুতিটা যেন তাকে পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে চরে ফেলে দেবে এরকম ভাবে তার গায়ে সঁটে আর খসে।

নিতাই গরুর পালটার ওপর দিয়ে একবার চোখটাকে মেলে দেয়–পালের পেছনে, সেই খেতবাড়ির রাস্তায়, আরো পেছনে গ্রামের সেই রাস্তায়। এত কাছে গ্রামের সেই গাছগাছড়া। অথচ এখান থেকে দেখাচ্ছে যেন ঐ আকাশটাই নেমে এসে গ্রামের বেড়া হয়ে গেছে।

নিতাইয়ের মনে হয় সে এই গ্রামটাকে কি শেষবারের মত দেখছে? ঐ যে-গ্রামটা এখন তার চোখের আড়ালে চলে গেছে, বৃষ্টি আর বাতাসের ধূসরতায় যে-গ্রামটাকে সে দেখতে পাচ্ছে না ভাল করে-সেই গ্রামটাব গাছগাছালি বাড়িঘর জোতজমি সব, সব নদীর ঘোলা জলের তলায় চলে যাবে? নাকি, সে চলে যাওয়া শুরু হয়েই গেল? এখনো চর ডাঙাই আছে, এখনো এই নদীতে বানা ঢোকে নি কিন্তু আকাশ আর বাতাসের যা চেহারা তাতে ঐটুকুই মাত্র বাকি, বাকিটুকু ঘেরা হয়ে গেছে। নিতাইয়ের জীবনে প্রথম স্বাদ যে-নদীর তার ধাত আলাদা, জল আলাদা। আর এ-নদী ত নিতাইয়ের পুরো বয়সের নদী। জলের ভাষা নিতাই তার জলের তৈরি শরীর দিয়ে বোঝে।

নিতাই গরুর পালের দিকে তাকায়। পুরো পালটা যেন তার জন্যে অপেক্ষা করে আছে–সারি দিয়ে দাঁড়িয়ে। বন্যার ভয়ে গরুগুলোকে বাধে তুললেও অনেক বার হয়ত বন্যা আসে নি কিন্তু গরু সনো মানেই ঘর ভাঙা। এই গরুর পাল ওপারে উঠিয়ে দিয়েই গ্রামের মানুষগুলোকে বাধে তুলতে হবে। কিন্তু নিতাই কেন তুলবে? সকলেই ত আকাশ দেখছে, বাতাস দেখছে। না। নিতাই কাউকে ডাকার আগেই হয়ত দেখা যাবে গ্রামের কিছু-কিছু লোক এখানে এসে জড়ো হয়েছে। হোক। এমনিতেই হবে। নজের গরুর গন্ধ ছাড়া আর কতক্ষণ এই চরের ঘরে বসে থাকতে পারবে?

নিতাই দেখে গরুগুলো পা বদলাচ্ছে। না, আর দেরি করা যায় না। সে সামনের গরুটির গলার দড়ি ধরে নদীর দিকে এগুতে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। গরুটাকে ছেড়ে দেয়। তারপর চিৎকার করে বলে, হে-এ সালিশ, মইষটাক নিয়া আয় এইঠে।

বালিশ-সালিশ দু জনেই পালের ভেতরে ঢুকে, হাতের লাঠি আর কঞ্চিটাকে ওপরে তুলে এ-গরুকে সরিয়ে, ও-গরুর পাশ দিয়ে মোষটার কাছে পৌঁছে যায়। তারপর বালিশ মোষের গলার দড়িগাছটা ধরে সেটাকে পাল থেকে বাইরে আনতে চায়। মোষটা মুখ নাড়িয়ে বালিশের হাতটা সরিয়ে দেয়। বালিশ দাঁড়িয়ে মোষের নাক ঘেঁয় মাত্র। সে হাতটা আবার মাথার ওপর তুলে আবার মোষের গলার দড়ি ধরে টেনে সরু গলায় চেঁচিয়ে ওঠে, চল, কেনে, চ-ল, আগত চল্।

মোষটা এবার মাথা ঝাঁকিয়ে বালিশকে সরায় না বটে কিন্তু মুখটা একটুও নড়ায় না। বালিশ চল কেনে, চল বলতে বলতে টানতে-টানতে দড়ি ধরে প্রায় ঝুলে পড়ে কিন্তু মোষের গলার মাংসপেশীতে দড়িটা আরো বসে যায় মাত্র। মোষটা ঘাড় আর-একটু তুলে দেয়–বালিশের নাগালের বাইরে। বালিশ দড়ি ছেড়ে দেয়। মোষটা তার লেজ ঝাপ্টায়।

সালিশ হঠাৎ একটা লাফ দিয়ে দড়িটা ধরে ঝুলে পড়ে চেঁচায়, হে–এ বালিশ, পাছত খোঁচা মার কেনে, হেট, হেট, আগত-আগত।

ঠিক সেই সময়ই নিতাই সামনে থেকে টাকরায় ভি ঠেকিয়ে টরররর আওয়াজ তোলে বার দুয়েক আর চেঁচায়–হে-এ-এ-এ, আয় কেনে–এ-এ-এ। বাতাসের ঝাপ্টায় সে-আওয়াজের অনেকটা ভেসে চলে যায় বটে কিন্তু সেটুকু অন্তত পৌঁছে যায়, যাতে মোষটা বুঝতে পারে তাকে ডাকা হচ্ছে। সে ধীর পায়ে সালিশের টান অনুসরণ করে সারি থেকে বাইরে বেরতে ঘাড় ঘোরায়।

মোষটা খুব ধীর পায়ে চলে, তার পিঠের ওপর বাছুরটা দাঁড়াতে গিয়ে আবার পা মুড়িয়ে ফেলে আর মোষটার পেছন-পেছন গাইটাও বাছুরের দিকে গলা তুলে সারি থেকে বেরিয়ে আসে। সেই সারির পাশ দিয়ে তারা নিতাইয়ের কাছে এসে দাঁড়ায়। নিতাই মোষের গলার দড়িটা ধরে তাদের বলে, যা, আস্তে-আস্তে পার হবি, হাল্লাগুল্লা করিস না। নিতাই আর দাঁড়ায় নামোষের দড়িটা ধরে নদীর দিকে হাঁটে। এখনো বানার জল ঢোকে নি কিন্তু গত কয়েক দিনের বৃষ্টির জলে ত এই চেনা নদীটাতেও অচেনা গন্ধ লেগে গেছে। জল ঠাণ্ডাও বটে। সারা রাত গোয়ালের গরমে কাটিয়ে জলে পা দেয়া মাত্র যদি গরু বা মোষ ভয় খেয়ে যায় তা হলে সারাটা পালই ছত্রখান হয়ে যাবে, এদিক-ওদিক দৌড়তে শুরু করবে, কোনো-কোনোটা জলে গিয়েও পড়তে পারে। পেটে জল লাগলেই ভয় পেয়ে যাবে–ভাবতে পারে তাকে কোথাও নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।

নিতাই জলে নেমে যায়, তার হাতটা মোষের দড়িতে, মোষটাও জলে নেমে কয়েক পা এগিয়েছে, হঠাৎ নিতাই গর্তে পড়ে যায়–পড়ে যাওয়ার আগে সে মোষের দড়ি ছেড়ে দেয়-না হলে মোষটাও পড়ে যেত। নিতাই, ধুস শালা বলে উঠে পেছিয়ে আবার পাড়ে উঠে আসে। পাড় থেকে একটা লাঠি মত তুলে সে আবার তাড়াতাড়ি মোষটার কাছে চলে যায়। মোষটার পা যদি আচমকা গর্তে পড়ে, তা হলে ওর পিঠ থেকে বাছুরটাও পড়ে যেতে পারে একেবারে নদীর মধ্যে। এখন লাঠিটা দিয়ে গর্ত বুঝে-বুঝে নিতাই হাঁটে আর মোষটাকে টানে–নিতাইয়ের বা হাতে লাঠি, ডান হাত মোষের গলার দড়িতে।

মোষটা যেন বুঝেই যায় তাকে খুব আস্তে-আস্তে বুঝেশুনে পা ফেলতে হবে। নিতাই লাঠি ফেলে দেখে পা ফেলে এগবার পর সে পা ফেলে এগয়। সাঁতার জল পর্যন্ত গেলেই মোষটা ভেসে যেতে পারবে। একটু কি বেশি ঠাণ্ডা লাগছে জল, এখন? বানার জল কি ভেতরে-ভেতরে ঢুকে গেছে। মোষটা হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ে–আ-আ-আ-আঁ আওয়াজ তোলে। মোষ জলে ভয় পায় না, বরং আরাম পায়। সে জন্যে মোষটাকে দিয়ে এই পাল পার করানোর সুবিধে অনেক। হে-এ টরররর তালু দিয়ে আওয়াজ তোলে নিতাই। কিন্তু মোষটা নড়ে না। নিতাই পেছিয়ে গিয়ে মোষের পিঠের বাছুরটাকে দেখে-বেটা একটা পা পিঠ ছাড়িয়ে বাইরে বের করে দিয়েছে, ফলে তার শরীরটাও গড়িয়ে এসেছে, তার ঠিক পেছনে সেই গাই। এটা পেছনে আছে বলেই গোলমাল হচ্ছে। নিতাই লাঠিটা দিয়ে গাইটার মুখে মারে–শালো, গা চাটিবার ধরিছেন?

গাইটা ঘাড় নামিয়ে মুখটা সরিয়ে নেয়। নিতাই জলের মধ্যেই উঁচু হয়ে দাঁড়িয়ে পা-টা সহ বাছুরটাকে ভেতরে ঠেলে দেয় আর সঙ্গে-সঙ্গে মোটা চলতে শুরু করে। শুরু করে কিন্তু থেমে যায়। নিতাই আবার সামনে গিয়ে বা হাতে মোষের দড়ি ধরে। টাকরায় আওয়াজ তোলে–টবর রর-অ। মোষটা আবার পা ফেলে।

কিন্তু লাঠিসহই নিতাই একেবারে হুড়মুড় করে পড়ে যায়। পড়ে গিয়ে বোঝে ডুবজল। লাঠি ফেলে দিয়ে জলে হাতটা মারতেই সে স্রোতের টানে সরে যায়–আইস্যা গেছে রে, বান ঢুইক্যা গিছে। কিন্তু একটা ডুব দিয়েই নিতাই তার শরীরটাকে কজা করে ফেলে। সে চেঁচায় না। ভয় পেয়ে যাবে সবাই। এখন পালের অর্ধেকটাই জলে। এইবার মোষটা ডুবজলে নামবে। স্রোত ঢুকেছে কিন্তু জল এমন কিছু বাড়ে নি। নিতাই পা দিয়ে আন্দাজের চেষ্টা করে, যেখান থেকে সে পড়ে গিয়েছে সেই জায়গাটা কোথায়। পায় না। মোষটা দাঁড়িয়ে আছে একেবারে ডুবজলের কিনারায় হাঁটুজলে। নিতাই কী করে বোঝাবে, আর-এক পা পরেই ডুবজল, স্রোতের জল। যদি বোঝানো যেত তা হলে মোষটা সে ভাবেই নিজেকে ভাসিয়ে দিত। কিন্তু বোঝাবে কী করে নিতাই? মহিষটা ত ভাবব্যার ধরছে আস্তে-আস্তে ভাসব্যার লাগবে। গজেনকে ডাকবে? কিছু ঠিক করতে না পেরে আর স্রোতের ধাক্কায় সে যাতে সরে না যায় সে জন্যে, নিতাই হঠাৎ মোষটার বা পাটা হাটুর নীচে চেপে ধরে, যেন ওটা একটা খুঁটি। মোষটা তাতে কিছু বোঝে। সে আ-আ-আ-আঁ করে একটা ডাক ছেড়ে নিতাইয়ের হাতসহ বা পাটা তোলে, ও, নিতাই বোঝে, ডুবজলের দিকে এগিয়ে দেয়। সেই পা ভোলার ভঙ্গিতেই নিতাই বুঝে ফেলে মোষটা জেনে গেছে আর-এক পা পরেই ডুবজল। সে মোষের গলার তলা থেকে টরররর-অ করে ডেকে ওঠে। ডাকতে-ডাকতে নিতাই দেখে মাথার ওপর নেমে আসা আকাশটাতে নিজের মেঘের মত গলাটা বাড়িয়ে দিয়ে মোষটা তার ডান পাটাও ওঠাল আর নিমেষে চওড়া কাধটাকে জলের ভেতরে আরো চওড়া করে গলাটা তুলে ফেলল। সামনের পাদুটোকে যে জলের মধ্যেই একটু উঁচু করে জলে ভেসে উঠল, তাতেই তার পেছনের পা দুটো লম্বা হয়ে গেল, পিঠের উচ্চতা কমে গেল আর জলের মধ্যে সেই পিঠের ওপর বাদামি বাছুরটা ভাসতে-ভাসতে চলল, তার একটুও ঝাঁকি লাগে না। নিতাই মোষটার গলা জড়িয়ে ভেসে ওঠে, তারপর তার পাশে-পাশে সাঁতার কাটে–জিভে আওয়াজ তোলে–টরররর-অ।

.

১০০.

গরুর পালের পাড়ে ও বাঁধে ওঠা

 মাঝখানের এই গভীর খাতটুকু বেশি চওড়া নয়। মোষটার পাশে-পাশে সাঁতার দিতে-দিতে নিতাই বোঝে, নিশ্চিতভাবেই তার আগের বোঝাটা বোঝে-বানার জল ঢুকে গেছে। সামনের মোষটা এরকম ভেলার মত ভেসে যাওয়ায় পেছনের গরুগুলোও গা এলিয়ে ভেসে থাকে। কিন্তু, নিতাই যেমন তার শরীর দিয়ে বোঝে, এই এতগুলো পশু তাদের এতগুলো শরীর দিয়ে নিশ্চয়ই তার মতই, বা তার চাইতেও বেশি করে বুঝছে এতক্ষণ তারা হাঁটু জল দিয়ে হেঁটে এসে এই যে-গভীর জলে পড়ল সেটার রকম-সকম আলাদা। কিন্তু সেটা বুঝে উঠতে-উঠতেই মাঝখানের সোঁতাটা শেষ হয়ে যায়। মোষটা পায়ে মাটি পায়, মাটি পেয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে, কিন্তু পাড়ে ওঠার জন্যে পা তোলে না। নিতাই একটু এগিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে, দাঁড়িয়ে পা দিয়ে দিয়ে অনুভব করে এখানেও জলের নীচে পাড় ভেঙেছে। সে দাঁড়িয়ে দেখে, এই গরুর পালের গায়ে লেগে সোঁতার জলটা একটু আবর্তিত হচ্ছে আর ফেনা উঠছে। গরুগুলোর ফাঁক দিয়ে বা থেকে ডাইনে জল বয়ে যাচ্ছে–একটু ফেনা তুলে।

নিতাই পায়ে-পায়ে পাড়ের আন্দাজ নিয়ে পালটা থেকে একটু উত্তরে সরে। সেখানে জায়গা পেয়ে যায়। নিতাই সেখানে দাঁড়িয়েই ডাকে আয়-আয়, আর জিভে টর-র-র-র আওয়াজ তোলে।

মোষটা প্রথমে তাকিয়ে দেখে-ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে দেখে, তারপর আস্তে ডাইনে ঘোরে। তার পেছন-পেছন গরুগুলোও পা ফেলে। একটু ফাঁক হতেই একটা শব্দ তুলে স্রোতের জল বেরিয়ে যায়–এতটা স্রোত এই সোঁতায় কখনোই থাকে না। নিতাই জলের বেরিয়ে যাওয়া দেখে অনুমান করে কতটা বেগে জল এখানে ঢুকছে। বানা এসে গেছে।

নিতাই একটু অন্যমনস্ক হয়ে যায়। মোষটা কাছে এসে পঁড়াতে সেই অন্যমনস্কতা নিয়েই সে তার গলার দড়িয়ে হাত দিয়ে আবার স্রোতের দিকে তাকায়–পালের গরুগুলোর গায়ে কত জোরে স্রোতটা আছড়ে পড়ে, যেন সেটা আন্দাজ করতেই। মোষটা তার মাথা ঝাঁকিয়ে নিতাইকে মনে পড়িয়ে দেয়–তাদের এখন পাড়ে ওঠার কথা। নিতাই তাড়াতাড়ি মোষটার আড়াআড়ি দাঁড়ায়, দুহাত দিয়ে ওপরের বাছুরটাকে ধরে, চেঁচিয়ে ওঠে, হে এ গজেন, অমূল্যা, ধর, এইখানে আয়।

নরেশ নিচু স্বরে জানায়, তুল না তুই, আছি।

নরেশ কখন সেই দক্ষিণ পাড় থেকে এই এতটা রাস্তা পার হয়ে এসে এপারে উঠে গেছে? তা হলে তিস্তা ব্রিজেও কি বানের ধাক্কা লাগতে দেখে এসেছে নরেশ? নিতাই ভাবে বটে কিন্তু জিজ্ঞাসা করতে পারে না।

মোষটা আস্তে করে তার সামনের বা পা তোলে। একটু সময় নিয়ে সে ডান পাটাও পাড়ে তুলে দেয়। তার পর একটু সময় নিয়ে, বা, বাছুরটাকে সামলাবার জন্যে নিতাইকে একটু সময় দিয়ে, অত বড় শরীরটাকে একটা ঝাঁকিতে পাড়ের ওপর তুলে, পেছনের পা দুটো দ্রুত টেনে বোল্ডার আর জলের মাঝখানের সঙ্কীর্ণ জায়গাটাতে দাঁড়িয়ে পড়ে।

জলের সোঁতাটা, বা নদীর শাখাটা পেরবার চাইতেও নদীর পাড় থেকে বাঁধের ওপর ওঠাটা গরুর পালের পক্ষে কঠিন। বাঁধের মাটি বৃষ্টিতে যাতে ক্ষয়ে না যায় আর স্বাধ আর নদীর মাঝখানের পাড়টুকু যাতে স্রোতে না ভাঙে সেজন্যে বোল্ডার দিয়ে পুরোটা বাধানো-সে বোন্ডার আবার তারের জালে ঢাকা। পাড়ের বোন্ডার আর জলের সীমানাটুকুতে একফালি জমি। অনেক জায়গায় সে জমি ভেঙে গেছে, অনেক জায়গায় জলসহ বোল্ডার একেবারে জলের মধ্যে ঝুলে পড়েছে। ঐ সঙ্কীর্ণ জায়গা দিয়ে গরুর পালটা চলতে পারবে না। আর বোল্ডারের ওপর পা দিয়ে গরুগুলো এমনিতেই উঠতে পারবে না–তাদের ক্ষুর বোল্ডারে পিছলে যাবে; তারের জালের জন্যে আরো পারবে না–তারে পা আটকে যাবে।

গজেন আর নরেশ আগেই একটা ডাঙার কাছে দুটো সমতল বোল্ডার পাশাপাশি দিয়ে সিঁড়ির মত করে রেখেছে। সেটা দিয়ে উঠে তারের জালে আটকানো বোল্ডারগুলোর দুটো সারি পেরতে পারলেই একটা বোল্ডারহীন নালী পাওয়া যাবে। নালীটার ওপরের দিকে আবার বোল্ডার ও তারের জাল।  একমাত্র এই পথটা দিয়েই গরুর পালটাকে তোলা যাবে। গজেন আর নরেশ মোষটাকে সেদিকেই নিয়ে যায়–গজেন মাটিতে মোষের গলার দড়িটা-ধরে, আর নরেশ বোল্ডারের ওপর দাঁড়িয়ে দেখে কোনো মোষটা আবার পাড় ভেঙে পড়ে যায় কি না।

জায়গাটা এতই সরু যে এমনি দেখলে মনেই হত না ওখান দিয়ে কোনো গরুর পক্ষে যাওয়া সম্ভব। কিন্তু গরুগুলো পা ফেলে ঘেঁষে-ঘেঁষে–তাতে তাদের পায়ে-পায়ে একটু লেগেও যায় বটে কিন্তু এতই আস্তে যাচ্ছে যে কোনো গরু হুমড়ি খায় না। তারা বোল্ডার ঘেঁষেই চলেপেটটা বোল্ডারে ঘষে যায়, এইমাত্র। নরেশ কোমর ভেঙে গরুগুলোর পিঠ ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেয়।

জলের ভেতর থেকে নিতাই চিৎকার করে বলে, হে-এ নরেশ, একখান্ বোল্ডার ফেল্যা এইখ্যানে, মাটি ভাইংগ্যা গিছে। নরেশ দেখে, প্রফুল্ল পালের বুড়ি ও ধুমসো গরুটাকে নিতাই পাড়ে তোলার চেষ্টা করছে–সে গরুটার সামনে, বালিশ আর সালিশ দুই পাশে আর বলরামের ছেলেটা পেছনে। বাকি গরুগুলো জলের মধ্যে দাঁড়িয়ে।

আরে আরে–খাইছে রে খাইছে–ঐ বুড়িটারে তুললি ত এই ফালি দিয়্যা এক পাও আগাইবার পারব না, হে-হে-হে, বলতে বলতে নরেশ বোল্ডার থেকে ফালিটুকুতে নামে আর নেমে চেঁচায়–এই ন্যাতাই, আরে বুড়িটা পাশে রাখ, শ্যাষে তুলিস, চেঁচাতে-চেঁচাতে নরেশ গরুগুলোর পিঠে হাত ছুঁইয়েই যায়, ঘাড় নদীর দিকে ঘুরিয়ে রেখে।

নিতাই নরেশের কথার কোনো জবাব দেয় না। বাচ্চা দুটোকে বলে–সরায়্যা নে; সরায়্যা নে। জলের মধ্যে দাঁড়িয়ে বালিশ-সালিশ দু জনেই দু দিকে টানে। বুড়ি গরু বোধহয় নির্দেশটা বুঝতে পারে–সে সালিশের দিকে দু পা এগিয়ে যায়। নিতাই বলরামের ছেলেটাকে বলে–আ, ওগুলারে আ-ন। বলরামের ছেলে পেছনের গরুটাকে এগিয়ে দেয়। ঐটুকু বিরতিতে নিতাই দেখে, গরুগুলোর পায়ের চাপে পাড়টা এত ভেঙে ও ভিজে গেছে যে-কোনো গরু পড়ে যেতে পারে। সে বালিশকে বলে, আউগা, আর এটটু আউগা। সালিশ দড়ি ধরে টেনে দুই পা যেতে না-যেতেই ধপ করে গভীর জলে পড়ে যায়। বালিশ তীব্র শিশুকণ্ঠে চিৎকার করে ওঠে, অ কাহা, সালিশ পইড়্যা গিছে, আগাই কুথায়?

 নিতাই খাড়া বলে কিন্তু তাকিয়েও দেখে না, প্রফুল্ল পালের বুড়িটাও দাঁড়িয়ে যায়। সালিশ উঠে আসে। নিতাই দু পা পরে এক জায়গায় নতুন করে গরুগুলোকে পাড়ে তুলতে গিয়ে দেখে পাড়ের গরুগুলো এগচ্ছে না, দাঁড়িয়ে আছে, এখন কোনো গরু তুললে সেটা দাঁড়ানোরও জায়গা পাবে না।

নিতাই তার বাবরি চুলের রাশি বা থেকে ডাইনে ফেলে চিৎকার করে ওঠে, তুরা কি ঐখানে সঁজা টাইনবার ধরছিস নাকি, এই নরেইশ্যা।

নরেশ আধখানা ঘাড় ঘুরিয়ে বা হাত তুলে নিতাইকে থামতে বলে। নরেশ ঘাড় উঁচু করে দেখে পিঠের বাছুরটাকে নিয়ে মোটা ঐ নালী বেয়ে উঠতে পারছে না। আরে, শালা গজেন, তুর মাথা না শালকাঠ? বলতে বলতে নরেশ এক লাফে বোল্ডারের ওপর উঠে ঐ দিকে ছুটে যায়, শালা, পেরেক ঢোকে না মাথায়? বাছুরটাকে নামায়্যা থো বোল্ডারের উপর।

নরেশের চিৎকার শুনে গজেন পেছন ফিরে তাকিয়ে দাঁড়িয়েছিল। নরেশ গিয়েই মাটিতে নেমে তার লম্বা হাতে বাছুরটাকে টেনে মোষের পিঠের কিনারায়, আনে, গজেনকে বলে, ধর মাথা।

আরে, হাত দিয়্যা ঘ্যার পাই না, যে– গজেন বলে।

আরে শালা বাইটকুল, নরেশ হেসে ফেলে, টান, বোল্ডারের কাছে টান, টাইন্যা আন।

গজেন মোষের গলার দড়ি ধরে টেনে বোস্তারের কাছে নিয়ে আসে। নরেশ আর গজেন বোল্ডারের। ওপর উঠে পড়ে মোষের পিঠ থেকে বাছুরটাকে এক টানে নামাতে গিয়ে বোঝে পিছলে যেতে পারে। পেছনে সেই মা-গাইটা হঠাৎ হা-স্বা ডেকে ওঠে। নরেশ মোষটার পিঠে তার ডান পাটা দিয়ে দু বার চাপ দিয়ে যখন বোঝে মোষটাও বিপরীত চাপে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়েছে তখন ওয়ান টু থ্রি বলে এক ঝুঁকিতে বাছুরটাকে বোল্ডারের ওপর এনে আস্তে করে নামায়। পেছন থেকে বাছুরটার মা-গাই হামলে পড়ে–এতক্ষণে সে বাছুরটাকে জিভের আওতায় পেয়েছে। গজেন মোষের দড়ি ধরে নালী বেয়ে বাঁধের ওপরে উঠে যায়। নরেশ ছুটে যায় নিতাইয়ের দিকে।

.

এই নালীটা তৈরি হয়ে গেছে একটু অদ্ভুত কারণে। সাধারণ ভাবে বাঁধের ওপর থেকে কোনো জল স্রোতের মত গড়িয়ে পড়া নিষেধ। যদি তেমন স্রোত কোথাও কোনো-কোনো কারণে তৈরি হয়ে যায়, তা হলে সেটা তখনই বন্ধ করে দেয়ার কথা। নইলে বাঁধের মাটি ক্ষয়ে যাবে, বাঁধের তলার মাটি আলগা হয়ে যাবে। কিন্তু এই নালীটা তেমন কোনো স্রোতের ধাক্কায় তৈরি হয় নি বরং বাঁধের গা এখানেও তারের জালে আঁটা বোল্ডার দিয়ে বাঁধানো।

নদীর স্রোত বন্যার সময় যাতে সরাসরি বাঁধের গায়ে ধাক্কা না মারে, সে জন্যে, বিশেষ বিশেষ জায়গায় শালখুটির লম্বা খাঁচা নদীর ভেতর পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া হয়েছে–যাকে বলে স্পার। সেই স্পারগুলোর ভেতরটাও বড়বড় বোল্ডার দিয়ে ভরা। জলস্রোত সেখানে ঘা খেয়ে ঘুরে যায়, ঘুরে যাওয়ার সময় কিছুটা বালি ও মাটি ফেলে রেখে যায়। তাতে পাড়টা আর-একটু চওড়া হয়, নদী একটু দূরে সরে যায়। যখন নদীতে বন্যা আসে তখন এসব ব্যবস্থার সুফল বোঝা যায়–অনেকক্ষণ পর্যন্ত স্পারের ধাক্কায় নদীস্রোত উল্টোদিকের চরে, নিতাইদের চরে গিয়ে ধাক্কা মারে।

কিন্তু ৫৮ সালে বাঁধ তৈরির পর ৬২-৬৩ সালে দেখা গেল–আর সব জায়গা থেকে জল সরে গেলেও এই জায়গাটিতে একটা ছোট্ট খাড়ির মত থেকে যাচ্ছে। তাতে কারো কোনো দুশ্চিন্তা ছিল না–কারণ জল সরে গেলে এরকম একটা তিরিশ-পঁয়তিরিশ হাত খাড়ি থাকলেই বা কী আর না থাকলেই বা কী। কিন্তু তার পরের বৎসর বন্যায় এই খাড়ির ভেতর দিয়েই স্রোত গিয়ে:বাঁধের গায়ে সরাসরি ঘা মারল। সেবার বৃষ্টি বেশি হয় নি। সেই শীতকালেই বোল্ডার দিয়ে নদীর পাড়টাকে বাধিয়ে দেয়া হল–যাতে খাড়ির ভেতর জল ঢুকতে না পারে। খাড়িটা একটা জলহীন নালীর মত থেকেই গেল! ধীরে-ধীরে বুনো গাছগাছড়ায় ভরে গেল। কিন্তু একেবারে বুজে গেল না।

এখন জগদীশের মোট তার পিঠের বোঝা নামিয়ে সেই খাড়ি বা নালীর পাশ দিয়ে পা ফেলে-ফেলে উঠতে লাগল। গজেন মোষটার গলার দড়ি ধরে আগে-আগে যাচ্ছিল। দড়িতে কোনো টান লাগছিল না। মোষটা তা হলে নিজের মত করেই ধীরেসুস্থে উঠছে। গজেন দড়িটা ছেড়েও দিতে পারে।

কিন্তু ছাড়ে না। তারের জালেঘেরা বোল্ডার আর খাড়ির সীমানার মধ্যে জায়গাটা, মানে যে-জায়গাটা দিয়ে পালটা উঠবে, সেটা তত চওড়া নয়, যদিও নদীর পাড়ে আর বোল্ডারের মাঝখানের যে-পথটুকু ওরা পার হয়ে আসছে, তার থেকে চওড়া। তার ওপর আবার চড়াই ত বটেই। কোনো গরু বা বাছুর যদি এখান থেকে ঐ গর্তটার মধ্যে পড়ে যায় তা হলে সেটাকে ঐ গর্ত থেকে ভোলা সাত হাঙ্গামা। একেবারে ঘাড় মটকে যদি না পড়ে তা হলে মরবে না হয়ত, কিন্তু ঠ্যাংট্যাং ভেঙে যেতে পারে। ঘাড়ও যদি না মটকায়, ঠ্যাঙও যদি না ভাঙে তা হলে কোনো গরুর অবিশ্যি ওখানে থাকতে আপত্তি হবে না-গাছগাছালিও আছে, জলও আসবে না। কিন্তু এখন, চর খালি করার এই শুরুতেই এসব গোলমাল শুরু হওয়া ভাল নয়।

গজেন মোষটার সঙ্গে-সঙ্গে আধাআধি পর্যন্ত উঠেছে, তখন ফিরে তাকিয়ে দেখে গরুর পালটা মন্থর গতিতে পেছন-পেছন আসছে বটে কিন্তু তাদের গা থেকে এত জল ঝরছে যে পুরো চড়াইটা ভিজে গেছে। ভেজার রং দেখে বোঝা যায়–পিছল হয়ে গেছে। এই খাইসে, এ্যালায় ত গর্তত পড়ি যাবা ধরিবে, গজেন মোষটাকে থামিয়ে দেয়, তারপর নদীর দিকে মুখ করে দাঁড়ায়। নিতাই আর নরেশ এখনো নদীর পাড়ে। গজেন আর মোষটা থেকে শুরু করে সেই পাড় পর্যন্ত একটা করে গরু বা বাছুরের লাইন। নদীর মধ্যে পালের আরো কিছু গরু-বাছুর। এই পুরো লাইনটা এগনোর সঙ্গে-সঙ্গে পাড়ে একটা-একটা করে উঠছে।

হে-এ-এ নিতাই, গজেন চিৎকার করে ওঠে। সে চিৎকারটা বাঁধের ওপর দিয়ে বিপরীত দিকে চলে যায়। তা হলে কি মোষটাকে দাঁড় করিয়ে রেখে বলে আসবে? শালা অমূল্যা কোটত গেইল? গজেন এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখে বালিশ-সালিশ, বলরামের ছোঁয়া, আরো গোটা তিনেক ছাওয়াহোটর ঘর বাঁধের ওপর গরুর খোটা পোতা শুরু করেছে। আর, বোল্ডারের ওপর দিয়ে মাথায় ঘাসপোয়ালের বস্তা নিয়ে দুইটা আখোয়াল বাধে উঠছে। গজেন চিনতে পারে–অশ্বিনী রায়ের মানষি আর অমূল্যাদের মানষি। গজেন সেখানে দাঁড়িয়ে চেঁচায়–হে-ই বাউ, এইঠে আসেন কেনে। লোকদুটি গজেনের কথা শুনতে পায় না কিন্তু মুদ্রা দেখতে পায়। তারা বোল্ডার ভেঙে বাধে উঠছিল, গজেনের ডাক শুনেসিধে ডাইনে ঘুরে গজেনের দিকে আসতে শুরু করে। বাঁধের ঢাল দিয়ে আড়াআড়ি হাঁটা কঠিন। ওদের ডান-পাটা নীচে, বাঁ-পাটা ওপরে।

কিন্তু মোষটা দাঁড়িয়ে পড়ায় গরুর লাইনটাই ত দাঁড়িয়ে পড়েছে। ফলে, পাড়ে আর নতুন গরু তোলার জায়গা না পেয়ে নরেশ ঘুরে তাকায়, নিতাইয়ের চুল নদীর ভেতর থেকে জেগে ওঠে। ওরা তাকিয়ে কিছু বুঝতে চায়। গজেন হাত তুলে অপেক্ষা করতে বলে। লোকদুটি এগিয়ে আসে। নরেশের চিৎকার বাতাসের সঙ্গে এসে ঝাপটা মেরে উঠে যায়–ঐখানে খাড়ায়্যা-খাড়ায়্যা কি মৃতব্যার ধরছিস নাকি?

গজেন সে কথার কোনো জবাব না দিয়ে লোকদুটিকে বলে–এইঠে পিছল হয়্যা যাছে, খাড়ি করি ছাড়িবার ক, যা কেনে। লোকদুটি ওখান থেকে ঢালটার দিকে একবার তাকিয়েই সমস্যাটা বুঝতে পারে। গজেনের কথা শেষ হওয়ার আগেই দুজনে বোল্ডার দিয়ে সরসর করে নেমে যায়। অশ্বিনী রায়ের মানষিটা, আষাঢ়, নেমেই যায় কিন্তু অমূল্যাদের মানষিটা আবার উঠে আসে। সে বাঁধের ওপর উঠে মাথার বস্তাটা ফেলে আবার বোল্ডার দিয়ে নদীর দিকে ছোটে।

আষাঢ়ু নরেশকে গিয়ে বলতেই নরেশ হাতের ইশারায় জানায়, ঠিক আছে, এখন গজেন মোষটাকে নিয়ে উঠুক। আষাঢ়, আব অমূল্যার মানষিটা আবার বোল্ডার দিয়ে গরুর লাইনের দিকে আসে। আষাল্ড অমূল্যার মানষিটাকে কিছু বলে, সে তড়াক করে মাটিতে নেমে পাড়ে দাঁড়ানো গরুগুলোর পা থেকে জল কাচিয়ে ফেলতে শুরু করে আর আষাঢ় বোল্ডারের ওপর, বাঁধের ঢালুতে যে-সব আগাছা জন্মেছে সেগুলো ছিঁড়ে-ছিড়ে ঢালটাতে একবার ছড়িয়ে দিয়ে দ্বিতীয়বার আনার জন্যে পেছন ফিরতেই গজেনের হা-হা, হাসির আওয়াজে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে গরুগুলো সেই সব ঘাসপাতা জিভে তুলে চিবুতে শুরু করে দিয়েছে। সে তখন আবার ঘুরে, হেঁটে, এই লাইনটার দিকেই এগয়–গজেনের দিকে জিজ্ঞাসু মুখ তুলে। গজেন হাতের ইঙ্গিতে তাকে বাঁধের ওপর যেত বলে। মোষের দড়িটা ধরে নিজে পা বাড়ায়।

বাঁধের ওপর থেকে খোটা পোঁতার আওয়াজ মৃদু আসছে–আওয়াজের বাকিটা ত বাতাসে রংধামালির দিকে চলে যাচ্ছে। এখন ত গরুবাছুরগুলো এসে বাধে উঠল। এখনই যে-হ্যাঁর গরু-বাছুর আলাদা করে নেবে, আলাদা খোটায় পুঁতবে। যাদের অনেকগুলো গরু, নানা রকমের নানা কাজের গরু–তারা সেই অনুযায়ী গরুগুলোকে ভাগ করে খোটায় পুঁতবে। অমূল্যা আর অশ্বিনী রায় ত মানষি পাঠিয়েই দিয়েছে, জগদীশ বারুই এরকম পাঠায় না–সে জানে তার গরুমোষ দেখার লোকের অভাব হবে না। কিন্তু ঐচরে প্রতিদিনের কাজে যাদের সঙ্গে দেখা হয় না, তারা বন্যার মুখে এই বাধে গরুবাছুর পরিবারসহ এসে উঠলেও ত আর একেবারে মিলেমিশে যেতে পারবে না। শেষে দেখা যাবে-পাড়া অনুযায়ী এখানেও ভাগ হয়ে আছে। কিন্তু গরুর বেলায় পাড়াভাগে চলবে না–যার-যার গরু সে আলাদা-আলাদা করে নেবে। প্রথমে এল গরু। তারপরই আসছে গরুর খাবার আর দেখাশোনার লোক–যার মানষি আছে তার মানষি, যার ছাওয়াছোট আছে তার ছাওয়াছোট। যার-যার গরু তারার মত আলাদা হয়ে যাবে।

ভেঙে পড়া দিগন্ত থেকে উচ্ছন্ন বাতাস আর লোপাট আকাশ থেকে বৃষ্টির তীরে বিদ্ধ হতে-হতে এতক্ষণ যে গরুমোষবাছুরের পাল সমবেত এক বাঁচার প্রয়াসে এই বাঁধ পর্যন্ত ছুটে এল, তাদের ওপর ব্যক্তিস্বত্বের ভাগাভাগি কায়েম রাখতে বাঁধের ওপর খোটা পোতা হচ্ছে। সেই খোটা পোতার আওয়াজ বন্যার বাতাসে বাহিত হয়ে উড়ে যাচ্ছে।

গজেনের হতে ধরা জগদীশের মোষের বাকা শিং আকাশের ধূসর মেঘে জেগে ওঠে।

.

১০১.

চর দুই নম্বর

নিতাইদের চর থেকে নদী হয়ে মাইল আট আর জলপাইগুড়ি শহর হয়ে মাইল বার ভাটিতে এই দুই নম্বরটাও ত চর–লোকের মুখে-মুখে। আসলে এটা তিস্তার এই খাত বছরে আট মাসই শুকনো থাকে। বাকি চার মাসও শুকনো থাকতে পারে যদি তিস্তা অন্যদিক দিয়ে বয়ে যায়। তেমন পরপর তিন বছর গেল বলেই না এইখানে লাঙল নামল, মানুষজন নামল; তারপর ঘরও উঠল, কলাগাছও ফাপল, আর একসারি সুপুরি গাছও সাইসাই করে বাড়ল। কিন্তু, তারপরই আবার একবার তিস্তা আর-সব খাত ছেড়ে দিয়ে এই একটা খাতের দিকেই ছুটল। এরকম করতে করতে গত বছর দশেকে এখন এই নিচু চরের কোনো-কোনো জায়গা উঁচু হয়ে গেছে, কোনো-কোনো জায়গা ভোবা হয়ে আছে। আর দশ বছরে জমির ভাগাভাগিটাও পরিষ্কার। শীতকালে পুরো জমিতেই রবিচাষ হয়। গমও আজকাল ভাল হচ্ছে। যদি এরকম ভালই হয়, তা হলে অন্য রবি চাষ না করে গমই করবে সবাই। উঁচু জায়গাগুলো থাকে আমনের জন্যে। উঁচু, মানে এই চরের নিচু জমির চাইতে উঁচু কিন্তু, নদীর পাড়ের অনেক নিচু।

জমির উঁচুনিচুর হিশেব যদি কষা যায়, তা হলে এই দুই নম্বর আসলে তিস্তারও নীচে। কিন্তু তিস্তার বড় খাত আর দুই নম্বরের মাঝখানে বিরাট চওড়া কচুয়া–সেখানে পাকা বাড়ি পর্যন্ত আছে। জমির ঐ আড়ালটা থাকায় এখানে নদীর তলায় বসে নদী চাষ করা যায়। পাহাড়ের বৃষ্টিতে যদি ধস নামে, বন্যা নামে, তা হলে ওপর থেকেই তিস্তার জল আরো নানা খাত দিয়ে ছড়ায়। এই খাত দিয়েও। ওপরের বন্যার জলেই এই খাতে বান ডাকে। এর সঙ্গে বড় তিস্তার কোনো যোগ নেই। সে যোগ হলে তিন-চার গুণ লাল নিশানাতেও কুলোবে না। তেমন যে হয় না, তা নয়, অন্তত পনের যাদের বয়স তারা এখনো তেমন দেখে নি।

নদীর জমি যখন চাষে আসে তখন ষোল আনার ওপর আঠার আনা লাভ। কারণ, এ জমির কোনো মালিক নেই। যখন জমি জলে ভেজা, পা রাখলে দেবে যায়, থাকার জন্যে একটা বাঁশের মাচান বানাতে বঁশ পোতা যায় না, বাঁশ মাটির ভেতরে সেঁদিয়ে যায়, জল শুকোয় নি, একটু আঁচড়ালেই নীচের জল বেরিয়ে পড়ে, তখন যে গিয়ে প্রথম জমিটাতে নামে তার চোখের হিশেব আর মনের হিশেব হতে হয় নির্ভুল। এক কোনো পাগল-ছাগল যেতে পারে–চার পুরুষ ধরে জমি হারাতে-হারাতে এখন বটগাছের তলা ছাড়া যার নিজস্ব কোনো ছায়া নেই সে এই জমিটাকে নিজের জমি বলে ভাবতে পারে। তার পাগলামির সঙ্গে জমির একটা কার্যকারণের যোগ ঐতিহাসিক বলেই এটা সম্ভব হতে পারে, হয়ও অনেক সময়।

আর, নয় ত ঠিক এর উল্টো। তিস্তা কবছর পর-পর খাত বদলায় তার একটা আন্দাজি হিশেব যার বাপ-ঠাকুর্দার কাছ থেকে জানা আছে বা পর-পর কবছর এই খাতে জল কত পরে এসেছে ও কত আগে বেরিয়ে গেছে–এ হিশেব যার মনে আছে–তেমন হিশেবনিকেশ টাকাপয়সার মানুষ, আধপাগলা কাউকে দু-চার টাকা দিয়ে, এখানে বসিয়ে দিতে পারে জায়গাটার সম্ভাব্য দখল রাখতে।

 চরের জমির ত কোনো মালিক নেই–তাই যেন, ভগবানের জমি। যে আগে দখল নিতে পারবে, জমি তার। যে যতটা দখল নিতে পারবে, ততটাই তার। মণ্ডলঘাট আর কচুয়ার মাঝখানে দুই নম্বর। এখন মণ্ডলঘাট পর্যন্ত তিস্তার বড় বাধ দেয়া হয়েছে–একেবারে পুরনো পাহাড়ে হাট-এর মাঝখান দিয়ে। মণ্ডলঘাট চৌপত্তি থেকে এই বাধ একটা গোল হয়ে গেছে যেন। এ বাধটা যেন চৌপত্তিরই একটা অংশ। বাধে ওঠা যা, চৌপত্তিতে ওঠাও তাই। মাঝখানে জলাজঙলা কিছু জায়গা আছে। বানবন্যা ছাড়া এ বাধে কেউ আসে না, আর বানবন্যাতেও আসে ত দুই নম্বরের মানুষজনই। বাধটা ফাঁকা বলে, জঙ্গলটঙ্গল পরিষ্কার করে এখানেই ক্যাম্প হয়। এ চরের দখল রাখলে পরে এটা মণ্ডলঘাটেরই অংশ হয়ে যেতে পারে। আর কচুয়ার পশ্চিম দিয়ে আর-একটা বাধ_গেছে সেই বোয়ালমারির দিকে। তার মানে দুই নম্বরটা পড়ল একেবারে দুই বাঁধের মাঝখানে।

দুই বাঁধের মাঝখানে ত এক নদীই থাকতে পারে। ইনজিনিয়াররা নাকি দুই দিকে বাঁধ দিয়ে ইচ্ছে করেই এই জায়গাটিকে শুকনো রেখে দিয়েছে যাতে সাংঘাতিক বন্যার সময়, যখন পাহাড় ভেঙে নীচে নামবে, পাহাড়ের মাথা দিয়ে জল ঢুকে তলা দিয়ে বেরিয়ে আসবে, ফরেস্টকে ফরেস্ট উপড়ে আসবে, যখন বোল্ডারগুলো গড়াতে-গড়াতে নামে যেন ভূমিকম্প আসছে, যখন গোটা সাতেক লাল নিশানা রেডিওতে বাজে, ও স্থানীয় সংবাদে হেলিকপ্টার ওঠে ও মিলিটারি নামে তখন নদী বেরবার একটা রাস্তা পায়।

এ রকম একবার ঘটেছিল বটে আটষট্টিতে কিন্তু আবার কবে ঘটবে কেউ জানে না। ততদিন নদীর জন্যে এই খোলা পথটা আটকে দিয়ে আবাদ হবে। যেখানে জমি, যেখানে চাষ-আবাদ সেখানেই মালিকানা, দখল, ভাগাভাগি। নদী নিয়েও সেই মালিকানা, সেই দখল, সেই ভাগাভাগি, আছে। শুকনো হলেও এ ত নদীই।

কিন্তু নদী হলেও এ ত মাটিও বটে। মাটি ত আর নদী নয় যে বয়ে যাবে। মাটি মানে ত গাছ। তাও ছোটখাট ফুললতাপাতা না, কাটাগাছ না, ঝোপঝাড়ও না। মাটি মানে মহীরুহ গাছ–যেখানে আছে, সেখানেই আছে, বাকলের ওপর বাকল জমে, সেখানেই ডালে ঝুরি নামে, সেখানেই ডালে-ডালে সব পরগাছা বাসা বাধে, সেখানেই মাটির ওপর মাটি পড়ে, সেখানেই মাটি উঁচু থেকে আরো উঁচু হয়, লোকে বলে মাটির বুক, সেখানেই উঁচু নিচুতে নানা রকম বাসা বাধা হয়, চাষ চষা হয়–মাটি নিয়ে মানুষের কাজেরও আর শেষ নেই। তার পর কোন এক সময় কারো মনেও থাকে না এই মাটি আসলে মাটি নয়, নদী, বা বড়জোর নদীর জন্যে খুলে রাখা পথ–সে পথে নদী আর কখনো ঘুরে আসে নি। তখন ধীরে-ধীরে সেই নদী জনপদের প্রাক্তন এক উপকথায় পরিণত হয়, জনপদবাসীর পুরুষানুক্রমিক মুখে-মুখে। ধীরে-ধীরে তেমন মানুষ কমে আসে, যারা নিজেদের অতীতকে গৌরবান্বিত করতে এক নদীর ক্রমবিস্তার ঘটায়–সে কী নদী। ধীরে-ধীরে তেমন মানুষ কমে আসে, যাদের স্মৃতিতে নদী বহমান থাকে। ধীরে-ধীরে তেমন মানুষ কমে আসে, যারা নদীকে ডাকনামে ডাকে। সেই কোনো এক সময় এই জায়গাটিকে আর দু দিক বাঁধ বাধা বলে চেনা যাবে না। তখন নদীর প্রবহমাণ জলের জন্যে অন্য কোথাও নতুন ধাধের দরকার হবে।

এই জায়গাটি, এই দুই নম্বরটি, এখনো সেই পথে পৌঁছয় নি-যেমন ইতিমধ্যে পৌঁছে গেছে সেই পাহাড়ের তলার মঞ্জুলি, তার নীচে প্রেমগঞ্জ বা বাসুসুবার চর, দোমোহনি বা পদমতীর চর, বা তারও নীচে কোচবিহারের পুবে মেখলিগঞ্জ পশ্চিমে হলদিবাড়ির মাঝখানে নুয়াপাড়া থেকে দহগ্রামের বহু পুরনো চর। বা, তার আগেই এই কাশিয়াবাড়ি, বোয়ালমারি, এমন-কি কচুয়াও। তাই এখনো এই খাতে নিয়ে নদীর সঙ্গে কিছু-কিছু দখলের লড়াই চলছে। মানুষজন এখনো চাষে-চাষে এই নদীপথকে নদীর পক্ষে দুরধিগম্য করে তুলতে পারে নি। নদী এখনো জলে-জলে এই মাটিকে চাষের পক্ষে অযোগ্য করে তুলতে পারে নি। তাই এখনো বছরে কয়েকবার, বা দু-এক বছরে একবার চলে মানুষ আর নদীর দখলের লড়াই।

এই লড়াইটাতে মজা আছে। হঠাৎ জলের ধাক্কায় মাটির ভাগাভাগি বন্ধ হয়ে যায়। তিস্তার জল ঢুকে আলগুলোকে ঢেকে দিলেই, আলে-আলে ভাগ করা মালিকানাও ঢেকে যায়। তখন জল হয়ে পড়ে সকলেরই শত্রু। যেন জল সরে গেলে, মাটি বেরলে, এই মানুষজনের পুরনো কয়েকটি দখলের লড়াই আবার শুরু হতে পারবে; তার আগে পর্যন্ত, যতক্ষণ জল উঁচুনিচু, শুখা-দোআঁশলা, ঢাল-চড়াই জমির ভেদ লোপ করে দিতে থাকে, ততক্ষণ, এই সব জমির দখলদাররা, চাষীরা, মালিকরা, ভুলে থাকতে পারে, জলের নীচের মাটির অসমতলতা বা এই টানা জমির মাটির পরতে-পরতে বালি, চুনপাথর, এই সবের মিশেলের বৈচিত্র্য।

ঐ অসমতলতা আর ঐ মিশেলের রকমফেরের জন্যে জমির দাম বাড়ে কমে, দখল কায়েম হয়, হাতবদল হয়-সম্পত্তির মামলা ত মানুষের সঙ্গে মানুষেরই হয়। কিন্তু, এখন, এমন সব ঋতুবিপর্যয়ে, যখন পাহাড় থেকে ঢল নেমে নদীকে ক্রমেই করে তুলছে যে-কোনো আয়তনের পক্ষেই অনেক বড়, যখন জলের চেনা রং বদলে গেছে, জলের ওপর হুমড়ি খেয়ে তার একেবারে ঘোলাটে মেঘের মত শাদা রং, ফেনা, আর ফেনা কেটে গেলে আচমকা কাদাগোলা জল চিনতে হয়, যখন জন্ম যেন নদী বয়ে, আসছে না-নদীময় পাতাল থেকে উথলে উঠছে, তখন বাঁধের ঠিক নীচেই নদীর গভীর ভেতর থেকে ভাদই চিৎকার করে ধমকে ওঠে বাঁধের ওপর মহেশ্বর জোতদারকে বাবা গে, বঁশ ফেলি দাও, বাঁশ ফেলি দাও—

ভাদইয়ের সারা জীবনে মহেশ্বরকে ডাকার কোনো উপলক্ষই থাকার কথা নয়। আর কচ্চিৎকদাচ যদি হয়ও, তা হলেও দেউনিয়া কথাটিই কত-না শ্লেষ্মায় জড়িয়ে বেরিয়ে আসে। কিন্তু তিস্তার বানার মধ্যে দাঁড়িয়ে দেউনিয়া বড় দীর্ঘ শব্দ। আর এই তল্লাটের সবচেয়ে বড় জোতদারের একজন, মহেশ্বর দেউনিয়া, ভাইয়ের হুকুম মত বাঁধের ওপর জমিয়ে রাখা বাশ একটা তুলে বাঁধের ঢাল বেয়ে ধীরে-ধীরে নেমে জলের ভেতরে ভাইয়ের দিকে ছুঁড়ে দেয়। ভাদই সেই বাশটা ধরে ফেলে চিৎকার করে, আরো দ্যাও কেনে, আরে দ্যাও, যেন, এইমাত্র তিস্তার বন্যায় মানবেতিহাসে শ্রেণীসংগ্রামের চরম নিষ্পত্তি ঘটে গেল।

.

১০২.

বন্যার মুখে শয্যা

জল এসেছে সেই বুধবার থেকে। কিন্তু এখানে অন্তত সেদিন বৃষ্টি ছিল না। ফলে মনে হচ্ছিল, যেমন এসেছে, তেমনি চলে যাবে। কিন্তু আজ শনিবার, কাল গেল শুক্রবার, তার আগের দিন বৃহস্পতিবার থেকে এখানে ঝড়ো বাতাস আর বৃষ্টি শুরু হল। বৃহস্পতিবার সকাল দশটা-এগারটা নাগাদ থামলও একটু। রাস্তাঘাট শুকিয়ে গেল। রোদ উঠল না। কিন্তু আকাশের রোদটাকা মেঘে জল বেশি ছিল না। তাই রোদের আভা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল। দুই নম্বরের নদীর জল একটু-আধটু বেড়েও ছিল, যেমন বাড়ে, এ রকম ঝড়ো বাতাসে।

কিন্তু বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা থেকে ঝড়জল দ্বিগুণ হয়ে উঠল। বৃহস্পতিবার রাত দশটায় প্রথম, তারপর শুক্রবার সকাল জুড়ে রেডিওতে বারবার কমলা সঙ্কেতের কথা বলা শুরু হল। যারা নদীর চরে বা বাঁধছাড়া পারে বসবাস করেন তাদের নিরাপদ স্থানে সরে যাওয়ার নির্দেশ ঘন-ঘন দেয়া হল। সিকিমে কোন একটা জায়গায় বিরাট ধসের খবর পাওয়া গেছে কিন্তু বিস্তৃত বিবরণ এখনো মেলে নি। হেলিকপ্টার ও সৈন্যবাহিনীর কথা রেডিওতে শুক্রবার রাত দশটার আগে বলে নি, তার মানে কোথাও তখনো বন্যা শুরু হয় নি।

কিন্তু শুক্রবার রাত দশটাতেই বলা হল–সিকিমের কিছু খবর পাওয়া গেছে, কয়েকটি জায়গায় প্রবল ধসের ফলে নদীর মুখ আটকে গিয়ে কৃত্রিম হ্রদ সৃষ্টি হয়েছে। এই হ্রদগুলি ফেটে গেলে নদীর নিম্ন এলাকায় আকস্মিক ও প্রবল বন্যার আশঙ্কা দেখা দেবে। জলপাইগুড়ি ও কোচবিহারের জেলা কর্তৃপক্ষ সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিয়ে সর্বত্র কমলা সঙ্কেত দিয়েছেন। নদীর চরে ও বাধছাড়া পারে যারা বসবাস করেন তাদের এই মুহূর্তে নিরাপদ স্থানে যাওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তা ছাড়াও সকলকে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে।

রেডিওর এই ঘোষণাতেই যেন হাওয়া তিস্তার ওপরের শূন্যতা থেকে পারে ঝাঁপিয়ে পড়ে। যেন, জলস্রোত পাড় ভেঙে ফেলে লাফিয়ে উঠে আসতে পারছে না বলেই, হাওয়া, জল বেয়ে ধেয়ে এল ওপরে, একসঙ্গে, এক পরাক্রান্ত আক্রমণে, যা কিছু দাঁড়িয়ে ছিল তাকে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিতে। নিশ্চয়ই মিশে গেল, উড়ে গেল অনেক কিছু। বৃষ্টি ছিল, কিন্তু বাতাসের বেগে সে বৃষ্টি মাটিতে পড়তে পারে না–মাটির সমান্তরালে তীক্ষ্ণ ছুটে যায়।

সুতরাং শুক্রবার রাতটা ত প্রায় অন্ধের মতই কাটানো। শনিবার ভোর হয় যেন নেহাৎ ভোর হতে হয় বলে। ছাইরঙা আকাশ নদীর ওপর নেমে এসেছে আর ঘোলাটে নদী ধাধ বেয়ে উঠে গেছে অনেকটা। নদীর ভেতরে এই উঁচু ডাঙাটায় জল এখনো ওঠে নি বটে, কিন্তু কাল সন্ধ্যার তুলনায় সারা রাতে বেড়েছে প্রায় দেড় গুণ। বাতাস যেরকম তাতে মনে হয় যেখানে পাহাড়ে ধস নামছে, সেখানে আরো ধস নামবে। কিন্তু সেই ধসের ফলে কোথায় কোন পাহাড়ে নতুন-নতুন হ্রদ গোপনে-গোপনে তৈরি হয়ে আছে, সেগুলো যদি একসঙ্গে ফেটে যায় তা হলে বাধ ত বাধ, বাঁধের ওপর থেকে সরে যেতে হবে মণ্ডলঘাট স্কুলে। যদি সেই সব হ্রদের জল একসঙ্গে না বেরিয়ে এক-এক বারে, বা চুঁইয়ে চুঁইয়ে, বেরয় তা হলে এখানে বন্যা হবে না।

দেখতে-দেখতে বাঁধের ওপর কিছু-কিছু লোকজন আসা শুরু করে।

সবচেয়ে আগে আসে আবদুল–এই দুই নম্বরের বাঁধে।

তার রকমসকম দেখে মনে হয় সে সাগাই খেতে এসেছে। আকাশের মেঘ, বাতাস বা বৃষ্টির চাপ ও বেগে বা তার চোখের সামনে তিস্তার ঘোলাটে জলের ক্রমবিস্তারে আবদুলের যেন কিছুই যায় আসে না সে এমনভাবে তার একটা খুব সযত্ন ভাজকরা বিছানা, একটা ভাঙা ছাতাও সেই বিছানার সঙ্গে বাধা, একটা এলুমিনিয়ামের মগ, আর একটা এলুমিনিয়ামের হাড়ি নিয়ে এসে ভেজা ঘাসের মধ্যেই বসে পড়ে। কোন জায়গায় যে বসবে সেটা আবদুলকে একটু ভাবতে হয় বই-কি। সে একবার দুই নম্বরের এই গোলর্বাধটা চক্কর দেয়। পুরোটা চক্কর দিতে পারে না, উত্তরের দিকে এতটাই জংলা যে আবদুলও ফিরে আসে। তা ছাড়া বাধে বসলেও নদীর দিকে মুখ করেই ত বসতে হবে। শেষ পর্যন্ত আবদুল একটা ঝাকড়া কুলগাছের নীচের ডালটা বেছে নেয়। ঝোলানোর জন্যে বিছানাটা সে প্রথমে খোলে। ততক্ষণে বাধে যারা ছিল তারা নদীর দিকে পেছন ফিরে আবদুলের দিকে মুখ করে। আবদুলের বিছানাটা আসলে একটা তুলোর কম্বল–এরকমই কোনো বন্যার সময় রিলিফে পেয়েছিল। সেটার তুলো অনেক জায়গায় উঠে গেছে, কোনো-কোনো জায়গা ফেঁসেও গেছে, কিন্তু এমন নিপুণ ভজ আবদুলের যে বাইরে থেকে বোঝাই যায় না। সেই কম্বল খুলে তার ভেতর থেকে আবদুল একটা পাটের দড়ি বের করে। বের করে দড়িটাকে পাশে রেখে, আবার কম্বলটাকে ভাজ করে। কম্বলটা খোলা হয় যতটা, ভাজ তার চাইতে বেশি। সেই ভাঁজের ওপর দাগ পড়ে গেছে–বেশ মোটা দাগ। ঐ দাগগুলো ছাড়া অন্যভাবে আর একম্বল এখন ভাজ করাই যাবে না। কিন্তু আবদুল একবার লম্বালম্বি ভাজ করে আবার খোলে। পুরো কম্বলই দোর্ভাজি করে সে উঠে দাঁড়ায়, তার মাথা ধরে সামনে ঝুলিয়ে ঝাঁকায়, তারপর খুব ধীরে সেটাকে মাটিতে ছোঁয়ায় আর আস্তে করে শোয়াতে শোয়াতে, নিজে কোমর ভেঙে. নিচু হতে-হতে এগিয়ে কম্বলটাকে একেবারে মাটির ওপর মেলে দেয়। তারপর আবার যেখান থেকে সে শুরু করেছিল, সেই জায়গাটিতে ফিরে আসে, যেন কম্বলের, লম্বা করে শোয়ানো কম্বলেরও মাথা আর পা আছে। জল দেখতে আসা যে-ভিড়টা তখন আবদুলকে দেখছিল, তার ভেতর কেউ বলে, আবদুল, এ্যাখন শুইয়া পড়, রাত্তিরে ত বানা আইসলে জায়গতে হবে।

আবদুল সেকথার কোনো জবাব দেয় না। এমন-কি ফিরেও তাকায় না। সে এবার কম্বলের দুটো দিক ধরে আবার ধীরে-ধীরে এগতে থাকে, নিচু হয়ে। কম্বলটাকে তলার ভঁজের ওপর শুইয়ে সে এবার মাটির ওপর উবু হয়ে বসে দুহাত দিয়ে কম্বলটাকে সমান করে। এবার ডান দিক থেকে তুলে বা দিকের তলার ওপর ফেলে। তারপর আবার তার দিক থেকে তুলে ওপর দিকে ভাজ ফেলে। আবার দু হাতে ঝাড়ে আর দু হাতে কম্বলটাকে একটু চাপে। এবার সে উঠে দাঁড়ায় কম্বলটাকে ওখানে রেখেই। তার পরনে একটি খাকি ফুলপ্যান্ট–একটু ছোট কিন্তু খুব ঢোলা, গায়ের শার্টটা তার ভেতর গোজা, শার্টের ওপর একটা সোয়েটার। যে-ভঙ্গিতে রাস্তার মোড়ে গোল করে দাঁড়ানো ভিড়ের মধ্যে মাদারিকা খেল দেখানোর সময় মা বা বাপ ভিড়টার এক পরিধির একপ্রান্ত থেকে আর-এক প্রান্তে পেশাদারি নিশ্চয়তায় হেঁটে আসে, আবদুলও সেরকমই হেঁটে এসে পাটের দড়িটা তুলে নেয়। সে ভাজ করা কম্বলটা ওখানে না এনে, ওখান থেকে ফিরে এসে দড়িটা নিয়ে যে আবার কম্বলের কাছে ফিরে যায় তাতেই বোঝা, যায়কম্বলটা খোলা, ভাজ করা ও বাধা এই কাজটার চাইতেও কাজের প্রক্রিয়াটা তার কাছে বড়। আর, তার মুখচোখে একটা স্মিত হাসি লেগেই ছিল–সকলে তাকে দেখছে এই ঘটনাতে সে বেশ। অভ্যস্ত।

আবদুল গিয়ে কম্বলটার সামনে এক হাঁটু গেড়ে, আর-এক হাঁটু তুলে বসে দড়িটা বাণ্ডিলটার নীচে লম্বালম্বি দেয়। দুদিকে ধরে দড়িটা টানটান করে। একবার বাণ্ডিলটা তুলে সেটাকে ফেলে এমন করে বসায় যেন দড়িটা ঠিক মাঝখান দিয়ে যায়। উঠে গিয়ে ডান হাতি দড়িটাকে টানটান করে, আবার, বা দিকে গিয়ে বাঁ হাতি দড়িটাকে টানটান করে। তারপর বাণ্ডিলটার সামনে আগের ভঙ্গিতে বসে দুদিকের দড়ি দু হাতে ধরে একই টানে মাঝখানে নিয়ে এসে একটা গিঠ দেয়। হাঁটুটা দিয়ে সেই গিঠটা চেপে ধরে এবার সে দড়িটাকে পাশাপাশি ঘুরিয়ে দেয় আর বাণ্ডিলটাকে উল্টে দেয়। দড়িটাকে বাণ্ডিলের অপর দিক দিয়ে ঘুরিয়ে এসে সে আবার বাণ্ডিলকে উল্টে দেয়। এবার দড়ির দুটো প্রান্তকে আগের গিঠটার ভেতর দিয়ে গলিয়ে একটা গিঠ দেয় ও তার ওপর আবার একটা এমন ফাস বানায় যাতে বাণ্ডিলটাকে সে হাতে বা লাঠিতে ঝুলিয়ে নিতে পারে। এবার সে উঠে দাঁড়ায় ও দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বাণ্ডিলটাকে দেখে। দেখারও যেন একটা সময় ছিল, সেটা পেরিয়ে গেলে সে নিচু হয়ে বাণ্ডিলটা তুলে গাছের তলাটায় আবার চলে আসে। একবার তাকিয়ে ভাঙা ডালের অংশটা দেখে, তারপর, রোজই সে যেন এই গাছটাতেই বাণ্ডিলটা ঝুলিয়ে রাখে এমন ক্ষিপ্রতায় বাণ্ডিলটার ঐ হাতলের মত ফাঁসটাকে ঐ ভাঙা ডালে ঝুলিয়ে দেয়। বাণ্ডিলটা একটু দোলে। সে দুলুনি থামার আগেই আবদুল ওর ডেকচির ভেতর মগটাকে ঢুকিয়ে কুলগাছটার যে-জায়গাটা থেকে ডালপালা বেরতে শুরু করেছে, সেখানে ঐ হাঁড়িটাকে ঢুকিয়ে দেয়। হাঁড়ির সামনে দুই ডালের ওপর ওর লাঠিটা সেঁদিয়ে আবদুল দুই হাত ঘষে, তার কাজ শেষ।

.

১০৩.

বন্যার মুখে জিপগাড়ি

আবদুল এ-এলাকার পরিচিত পাগল। বা, পাগলও নয়, হয়ত। তার এমনিতে কোনো পাগলামি নেই। কথা প্রায় বলেই না। পোশাক-আশাকও যে তার এরকম হোমগার্ডদের মত, তার কারণ সে তার নিয়মিত চক্করের মধ্যে নগর বেরুবাড়ির বর্ডার ক্যাম্পে একবার যায়, অন্তত মাসে একবার। ওখানে গেলে টানা দিন সাতেক বা দিন পনেরও থেকে যায়। গিয়ে তার জন্যে কাজ যেন ঠিক করাই আছে এরকম দ্বিধাহীনতায় তরকারির বাগানে কাজ করতে লেগে যায়। ক্যাম্পের কিচেনে খায় আর একটা বারান্দায় ঘুময়। বারান্দার বাটামে তার বিছানা ও হাঁড়ি বাধা থাকে। কেউ আপত্তি করে না। তারপর। আবার একদিন ক্যাম্প ছেড়ে হাঁটা দেয়। সেটাও আগের মুহূর্তে বোঝা যায় না। কুয়োপাড়ে যায়, হাতমুখ ঘোয়, তারপর বারান্দায় এসে লাঠিটার ডগায় বাণ্ডিলটা ঢুকিয়ে, আর-এক দড়ির ফাসে হাঁড়িটাকেও লাঠির মাথায় গলিয়ে সে হাঁটা দেয়, যেন তরকারির বাগানের কাজটুকু করে দেয়ার জন্যেই সে এসেছিল, বা, সে এখানে রোজ খাটে, এখন দিনের শেষে বাড়ি ফিরছে।

আবার এরকম চক্কর মারতে-মারতেই মণ্ডলঘাটের চৌপত্তিতে, ঘুঘুডাঙার হাটে, কাদোবাড়ির হাটে যায়। কিন্তু কখনো কারো বাড়িতে বা কোনো পাড়ার মধ্যে যায় না। এতই চেনা আবদুলের গন্ধ যে রাতবিরেতে সে কোথাও ঢুকলেও কুকুররা ডাকে না, একবার এসে শুঁকে যায় মাত্র। যেখানে যায় সেখানেই তার খাবার জুটে যায় বটে কিন্তু খাবার কখনো চায় না আবদুল। বরং যেখানেই যায় সেখানেই সে সারা দিন ধরে এত কাজ করে যে মজুরি ধরলে তার একটা ভাল আয়ই হতে পারে। কিন্তু রোয়াগাড়াই হোক আর ধানকাটাই হোক–আবদুল কারো খেতে কখনো কাজ করে না। মনে হয়, যেন মানুষের সঙ্গেই ও থাকতে চায়, অনেক মানুষের সঙ্গে, মানুষের ভিড় কিন্তু কোনো একজন বা দুজন মানুষের সঙ্গে নয়। তাই আবদুল হাটে, চৌপত্তিতে, ক্যাম্পে ঘোরে কোনো বাড়িটাড়ির কাছে ঘেঁষে না।

আবদুল এসে ধাধের ধারে দাঁড়িয়ে, কোমরে হাত দিয়ে নদীর দিকে তাকায়। তিস্তায় বন্যা হবে, চরের সব মানুষ এসে বাধে উঠবে, এখানে ক্যাম্প বসবে, ত্রিপল টাঙানো হবে, সাধুসন্ন্যাসীরা আর অফিসাররা আসবে-যারে–আগামী কয়েক দিন এখানে অনেক কাজ আবদুলের। কুলগাছের ডালে বিছানা, হাঁড়ি আর লাঠি ঢুকিয়ে সে এখন সেই অত কাজের জন্যে তৈরি।

চৌপত্তির দিক থেকে একটা আওয়াজ ওঠে আর এই বাঁধের ভিড়টা প্রায় দৌড়েই চৌপত্তির দিকে ছোটে। বাচ্চাদের গলায় চিৎকার ওঠে, আসি গেইল, আসি গেইল, জিপগাড়ি আসি গেইল। আবদুল প্রায় একাই দাঁড়িয়ে থাকে। আবদুল ছাড়া আর দাঁড়িয়ে থাকে এ এলাকার সবচেয়ে বড় জোতদার মহেশ্বর রায়। তার প্রায় বিশ-ত্রিশটা গরু দুই নম্বরে থাকে। সে গরুগুলোর খোঁজখবর করতে এসেছে।

যে-ভিড়টা চৌপত্তিতে ছুটে গিয়েছিল সেই ভিড়টাই এখন চুপচাপ ফিরে আসে, হাঁটতে-হাঁটতে-মইনুদ্দিন ডিলার, গামবুটপরা দারোগার মত দেখতে একজন, আর একজন অফিসারের পেছনে-পেছনে। ওরা তিনজন সামনে সামনে ছিল, পেছনের ভিড়ের মধ্যেও শহর থেকে আসা আরো দু-একজন ছিল। মইনুদ্দিন ডিলারের পরনে লুঙি আর পাঞ্জাবি। সে এদের মধ্যে সকলের চেয়ে লম্বা আর অফিসারটি সবচেয়ে খাটো। আবদুল যেখানে দাঁড়িয়েছিল সেখানেই যে এরা এসে দাঁড়ায় তার কারণ হতে পারে যে আবদুল একা দাঁড়িয়ে থাকায় অফিসারটির মনে হয়েছে–এটাই দাঁড়াবার জায়গা। আবদুলের খাকি প্যান্ট দেখে তার মনে হয়ে থাকতে পারে–সে সরকারি কাজই করছে। এত বড় ভিড় ও অফিসারদের দেখে আবদুলের সরে যাওয়ার কথা কিন্তু সে যে সরে না আর মাত্র একবার তাকিয়েই আবার নদীর দিকে মুখ ফেরায় সেটাই বোধহয় তার পাগলামো।

মইনুদ্দিন ডিলার সবার ওপর দিয়ে গলা তুলে হাত বাড়িয়ে মহেশ্বর জোতদারকে ডাকে, এই যে মহেশ্বরবাবু, এইখানে আসেন। বাতাসে মইনুদ্দিনের গলা শোনা যায় না কিন্তু মহেশ্বর তার আহ্বানটা বোঝে। সে এগিয়ে আসে, ভিড়টা তাকে জায়গা ছেড়ে দেয়। সে অফিসারদের পাশে এসে দাঁড়ায়।

এই যে ডি-সি সাহেব আসছেন, বলেন, এখানকার পরিস্থিতি কী?

মহেশ্বর নমস্কার করে দু হাত দু দিকে ছড়িয়ে বলে, পরিস্থিতি ত সগায় দেখিছেন– যেন মহেশ্বরের দু হাতেই বন্যা।

ঐ চরে যারা থাকেন তারা সব উঠে এসেছেন ত? ডেপুটি কমিশনার জিজ্ঞাসা করেন।

কায় আর উঠিবে? গাইগরুগিলাই এখন ঐঠে থাকি গেইল! মহেশ্বর সেই একই ভঙ্গিতে বলে।

 মানে? রেডিয়োতে এতবার করে অ্যানাউন্সমেন্ট করা সত্ত্বেও আপনারা লোকজনকে সরান নি? এরপর ক্যাজুয়ালটি হলে তার দায়িত্ব কে নেবে? এখানকার পঞ্চায়েতের লোকজন নেই? ডেপুটি কমিশনার ঘাড় ঘুরিয়ে ভিড়টাকে জিজ্ঞাসা করেন।

পঞ্চায়েত আর কী করিবে, কহেন? এই ত মাস্টার আছে, মেম্বার। মহেশ্বর বলে।

কই? কে মেম্বার? ডেপুটি কমিশনার বলেন।

মাস্টার, মাস্টার, একটা গুঞ্জন ওঠে। ডেপুটি কমিশনার ঘুরে দেখেন-লুঙি ও গেঞ্জিপরা এক যুবক নমস্কার করে এগিয়ে এল।

কী? আপনারা রেডিয়োতে এতগুলো এ্যানাউন্সমেন্ট শুনেও চরের লোকদের পাড়ে তোলার কোনো ব্যবস্থা করেন নি? ডেপুটি কমিশনার একটু চেঁচিয়েই বলেন কিন্তু বাতাসের বেগ এতে বেশি যে বোঝা যায় না, তিনি রাগ করে জোরে বলছেন, নাকি এই বাতাসের জন্যে তাকে বাধ্য হয়েই জোরে বলতে হচ্ছে।

মাস্টার মৃদুস্বরে বলে, স্যার, আমরা ভাবছিলাম জল নেমে যাবে, তাই আর-কিছু করা হয় নি।

ডেপুটি কমিশনার নিজের মত করে বুঝে নেন এই মেম্বার পঞ্চায়েতের সভ্য নিশ্চয়ই কিন্তু এখানকার নেতা নয়। নেতা হলে জিপগাড়ি থেকে তার সঙ্গে আসত। কিন্তু পঞ্চায়েতকে না-জড়িয়ে কিছু করাও ঠিক হবে না। এবার ডেপুটি কমিশনার নদীর দিকে তাকিয়ে নিচু স্বরে ডাকেন, সান্যাল।

মইনুদ্দিন ডিলার ভাবে ডেপুটি কমিশনার তাকে বুঝি কিছু বলবেন। সে তার লম্বা ঘাড় ডেপুটি কমিশনারের কাছাকাছি এনে জিজ্ঞাসা করে, আমাকে কিছু বললেন স্যার?

ডেপুটি কমিশনার তার বিপরীত মুখটা ঘুরিয়ে বললেন, না। আমাদের ডিস্ট্রিক্ট পঞ্চায়েত অফিসার মিস্টার সান্যাল

কথা শেষ হওয়ার আগেই মিস্টার সান্যাল পেছন থেকে এগিয়ে এসে বলেন, হাঁ স্যার।

এখানে এ্যাভেইলেবেল পঞ্চায়েত মেম্বারদের মিট করুন পঞ্চায়েত অফিসে, আমি আসছি। আর, তার আগে নৌকো পাঠান; এখুনি, শেষ কথাটা ডেপুটি কমিশনার বলেন মোবাইল সিবিল এমার্জেন্সির অফিসারকে।

মিস্টার সান্যাল আর সিবিল এমার্জেন্সির অফিসার বাঁধ ছেড়ে চৌপত্তির দিকে যান। তাঁদের সঙ্গে ভিড়ের অনেকেও সেদিকে যায়। বাকি ভিড়টাকে নিয়ে ডেপুটি কমিশনার দাঁড়িয়ে থাকেন। সেই ভিড়টার ভেতরে থেকেও সেই ভিড়টার বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল আব্দুল সে প্রথমে যেখানে দাঁড়িয়ে লি সেখান থেকে এক পাও সরে নি। তার আশেপাশে, প্রায় গায়ে গা লাগিয়ে এই ভিড়ে যারা ছিল তাদের সবারই মুখ ডেপুটি কমিশনারের দিকে ফেরানো। ডেপুটি কমিশনারের পেছনে যারা তাদের মুখ নদীর দিকে কিন্তু তারা তাকিয়ে আছে ডেপুটি কমিশনারের দিকেই। আবদুল যেখানে দাঁড়িয়ে, সেখান থেকেই তার উচিত ছিল ডেপুটি কমিশনারের দিকে তাকানো।

.

১০৪.

বন্যা ‘ঘোষণা’–হল কি হল না?

 এখন অবিশ্যি আবদুলের দাঁড়ানোটার একটা মানে আসে, কারণ, ডেপুটি কমিশনারও নদীর দিকেই তাকিয়ে ছিলেন। জলের রং ঘোলা থেকে ঘোলা, স্রোতের বেগে সেই বিরাট বিস্তারের কোথাও একটা কুঞ্চন পর্যন্ত নেই। মাইল-মাইল বিস্তৃত সেই জল ধাতুপাতের মত পড়ে আছে স্রোতের বিভ্রম জাগিয়ে। সেই পশুটে বিবর্ণতা আকাশ থেকে নদী আর ডাঙায় ফোঁসফোঁস করছে। বুঝি, কোথাও কিছু ঘটে গেছে, বা এখনই ঘটবে।

তা হলি আপনি স্যার চলেন, ঐখানে বসি সব কথাবার্তা হোক-মইনুদ্দিন ডিলার গলাটা ডেপুটি কমিশনারের কানের কাছে এনে বলে।

ওখান যখন যাবার যাব। আপনি এক কাজ করুন–এখানে কি চিড়ে, আর গুড় পাওয়া যাবে?

এখানে পাওয়া যাবে না স্যার, ঘুঘুডাঙ্গাতে তা হালে রিক্সা পাঠাই?

 হ্যাঁ, এখুনি পাঠান।

 হ স্যার, বলে মইনুদ্দিন ডিলার ভিড় থেকে বেরতে গেলেই, ডেপুটি কমিশনার বলেন, শুনুন, এখন আবার রিক্সা ভাড়া নিয়ে দরদস্তুর করতে যাবেন না, যা চায় তাই দিয়ে পাঠিয়ে দিন।

মইনুদ্দিন বেরতে-বেরতে আবার ঘুরে দাঁড়িয়ে বলে, স্যার, ক্যাম্প কি তা হলে আজ থেকেই স্টার্ট হবে?

না, না, ক্যাম্প না। তবে লোকজন চরটর থেকে আসবে, সবাই ত আর রান্না করতে পারবে না। তাদের জন্যে স্টক করুন। ওয়েদার ফোরকাস্ট খারাপ। পাহাড়ে ভীষণ বৃষ্টি হচ্ছে। জল আরো বাড়বে।

আরো বাড়িবে স্যার? মহেশ্বরের জিজ্ঞাসায় কোনো উদ্বেগ নেই যেন।

 বাড়বে না? পাহাড়ে ত ধস নামছে। আপনাদের ত আজকাল এত রেডিয়ো হয়েছে। গত তিন দিন। ধরে শুনছেন না?

শুনছি স্যার, মহেশ্বর স্বীকার করে।

শুনছেন ত লোকজন সরান নি কেন?

রেডিয়োতে কথা ত সব সময় বিশ্বাস না যায়, সেই তানে স্যার।

স্যার, সিবিল মোবাইল এমার্জেন্সির অফিসারটি এসে পেছন থেকে বলে, এখানে ত একটা নৌকো পেলাম স্যার।

একটা নৌকোয় কী হবে? ডেপুটি কমিশনার জিজ্ঞাসা করেন। তারপর বলেন, নৌকো কি আছে। এখানে? তা হলে সেগুলো নিয়ে নেয়াই ত ভাল। দরকারের সময় কোথায় পাবেন?

অফিসারটি মহেশ্বরকে দেখিয়ে বলেন, ওঁর একটা নৌকো আছে স্যার, কিন্তু উনি দেবেন না।

মহেশ্বর চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। ডেপুটি কমিশনার একবার মহেশ্বরের দিকে, একবার অফিসারের দিকে তাকিয়ে বলেন, উনি ত তখন থেকে এখানেই দাঁড়িয়ে আছেন, নৌকো দেবেন না বললেন কখন?

স্যার, নৌকো ত রাইস মিলের সামনে আছে। ওখান দিয়েই এদিকে বেরবে। ওর লোকজন আছে। তারা বলল, তিনি নৌকো কাউকে দিতে না করেছেন। ডেপুটি কমিশনার একটু বুঝে নেন, তারপর বলেন, কী? আপনার নৌকো দেবেন না নাকি?

না স্যার।

ডেপুটি কমিশনার একটু অবাক হন। কিন্তু অভিজ্ঞতার জোরে বোঝেন তিনি রাগারাগি করলে হিতে বিপরীত হবে। যদি এর নৌকো থাকে তা হলে পঞ্চায়েতের লোকজনরাই সে নৌকো নিয়ে নেবে।

সে কি, লোকজনকে রেসকিউ করতে হবে না?

আমার গরুমানষিকও এসকু নাগিবে স্যার। আপনারা সেনাবাহিনী আনেন স্যার।

ডেপুটি কমিশনার আসার সুযোগটা নিয়ে বলেন, আচ্ছা, এক কাজ করুন। যে-নৌকোটা পেয়েছেন এটা এখনই চরের দিকে ছেড়ে দিন। আর ওরটা ত থাকলই। এখানকার একজন কাউকে সঙ্গে নেবেন। অফিসার চলে যান।

আবদুল বাঁধ থেকে নেমে জলের কিনারায় চলে যায়–ও নৌকোয় যাবে। তার দিকে আঙুল দেখিয়ে ডেপুটি কমিশনার জিজ্ঞাসা করেন-ও যাবে নাকি? যে ভিড়টা তখনো ছিল তার ভেতর থেকে হাসি ওঠে। মহেশ্বরও হেসে বলে, পাগলা।

তা হলে ওকে যেতে দিচ্ছেন কেন?

 না, না, ও খুব ভাল পারিবে স্যার।

আবার ওঁদের অপেক্ষা করতে হয়। বেশ কিছুক্ষণ পর দেখা যায় একটা নৌকো ওঁদের বা দিক থেকে বেরিয়ে কুটোর মত দক্ষিণ দিকে ভেসে যাচ্ছে কিন্তু পঁচজন লোক লগি দিয়ে নৌকোটাকে উল্টো দিকে ঠেলছে। আবদুল তার জুতোজামা-সোয়েটারসহ জলে ঝাঁপ দিয়ে স্রোতের টানে মুহূর্তে নৌকোটার কাছে পৌঁছে যায়।

ডেপুটি কমিশনার পঞ্চায়েতের মিটিঙের জন্যে পেছন ফেরেন। তিনি অন্তত বলতে পারবেন–ফাস্ট রেসকিউবোটটা স্টার্ট করে দিয়েছেন।

ডেপুটি কমিশনারের পেছনে-পেছনে মোবাইল সিবিল এমার্জেন্সির অফিসারও হাঁটতে-হাঁটতে বাইরে আসে। এতক্ষণ তাদের সঙ্গে লোকজনের যে-ভিড়টা ছিল সেটা খসে গেছে। কাউকে কাউকে ডেপুটি কমিশনারই কাজে পাঠিয়েছেন আর বাকিরা এখন নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে নৌকোটাকে দেখবে।

দুটো দোকানঘরের ফাঁক দিয়ে ওঁরা চৌপত্তিতে এসে যান। ওঁদের জিপগাড়িগুলো উল্টো দিকে দাঁড় করানো। তাদের দেখে ড্রাইভাররা একটু এগিয়ে আসে। কিন্তু ড্রাইভাররা ডেপুটি কমিশনারের কাছে পৌঁছনোর আগেই দুদিকের দোকান থেকেই অনেকে বেরিয়ে আসে। আসামের সিল্কের চাদর গায়ে, লুঙিপরা একজন এসে নমস্কার করে বলে, আসেন স্যার, একটু বসে যাবেন।

ডেপুটি কমিশনার যদিও বলেন, না, এখন আর বসব কী? একটু পঞ্চায়েতে গিয়ে দেখি। কিন্তু দুইহাত মাথার পেছনে দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েন, যেন একটু কথা বলতেই চান।

আপনি নিজে এসে গেলেন স্যার-সেই সিল্ক-চাদর গায়ে ভদ্রলোকই আবার বলেন।

না এসে আর উপায় কি? ডেপুটি কমিশনার হেসে বলেন, আমি ত জানিই আপনাদের যত নোটিশই দেয়া হোক, রেডিয়োতে যতই বলা হোক, আপনারা কিছুতেই চর ছেড়ে ডাঙায় উঠবেন না। এতগুলো ফ্লাড কাটালাম আপনাদের সঙ্গে–আর এটুকু বুঝব না?

ডেপুটি কমিশনারের সঙ্গে অন্য সবাইও হেসে ওঠে। একটি বাচ্চা ছেলে একটি কাপডিশ নিয়ে এসে দাঁড়িয়ে থাকে। সে বোঝে না কাকে দিতে হবে। একজন তার হাত থেকে কাপডিশটা নিয়ে, ডিশের চাটা ফেলে ডেপুটি কমিশনারকে এগিয়ে দেয়। ডেপুটি কমিশনার কাপটা নিয়ে ছোট্ট একটা চুমুক দেন। ইতিমধ্যে একজন বলে, স্যার, নিজের ঘরবাড়ি ছাড়ি আসিবার মন চাহে না। মনত খায়, দেখি কেনে আজি সকালটা, আজি রাইতটা

সে ত দেখলেন, তারপর জলে ভাসলে ত সব হবে সরকারের দোষ। আপনাদের পঞ্চায়েতও ত কিছুই করে নি। পঞ্চায়েত অফিসটা কোন দিকে?

এই যে স্যার, এই যে, আসেন–একজন সরে গিয়ে ডেপুটি কমিশনারকে পথ করে দেয়।

ডেপুটি কমিশনার চায়ে শেষ চুমুক দিয়ে কাপডিশটা কোথাও রাখার ভঙ্গি করতেই একজন হাত বাড়িয়ে নিয়ে নিলে, দেখি, একটু পঞ্চায়েতে গিয়ে, বলে ডেপুটি কমিশনার এগিয়ে যান।

.

১০৫.

 বন্যার মুখে পঞ্চায়েত

ডেপুটি কমিশনার কয়েক পা হাঁটতেই তার ড্রাইভার পেছন থেকে দৌড়ে এসে বলে, স্যার, গাড়িটা নিয়ে আসি?

ডেপুটি কমিশনার দাঁড়িয়ে পড়ে ড্রাইভারের দিকে ঘুরে বলেন, না, না, তুমি এখানেই থাকো। চাটা খেয়েছ?

ড্রাইভার দাঁড়িয়ে পড়ে ঘাড় হেলায়। ডেপুটি কমিশনার হাঁটতে-হাঁটতে দোকান ঘরগুলো পার হয়ে যান। বায়ের বিস্তীর্ণ বালির চড়ার দিকে আঙুল দেখিয়ে বলেন, এই জায়গাগুলো খুব ভাল ধানি জমি ছিল। আটষট্টির ফ্লাডে সব নষ্ট হয়ে গেল। এদিককার ধান ত খুব ভাল ছিল।

যারা সঙ্গে আসছিল, তাদের ভেতর একজন বলে, আপনি স্যার তখন ছিলেন স্যার এখানে?

হাঁটতে-হাঁটতে একটু ঘাড় ঘুড়িয়ে ডেপুটি কমিশনার বলেন, আমি তখন প্রবেশনে ছিলাম, সে বছরই ফ্লাড। তাই জলপাইগুড়িতে এলেই মনে হয় ফ্লাড হবে। আপনারা তখন ছিলেন, এখানে?

এ প্রশ্নের কোনো একটি জবাব হয় না–কেউ-কেউ ছিল, কেউ-কেউ তখন অনেক ছোট ছিল। কিন্তু সকলেরই কিছু-কিছু জানা আছে। সকলে মিলেই জবাব দিতে যায়–ডেপুটি কমিশনারও একবার বায়ে, একবার ডাইনে ঘাড় ঘুরিয়ে যেন সকলের কথাই শুনতে চান। শেষ পর্যন্ত তার পাশে যে ছিল সেই কথাটা চালিয়ে যেতে পারে–আটষট্টির বন্যার পর ত স্যার মণ্ডলঘাটের চেহারাই বদলি গিসে। কোটত সে পাহাড়ের হাট? কোটত সে সরকার পাড়া?

পঞ্চায়েত অফিস এসে যায়। ডেপুটি কমিশনারকে স্যার, এইখানে স্যার বলেই পাশের লোকটি দৌড়ে পঞ্চায়েত অফিসের ভেতরে চলে যায়। কিন্তু সে ঢুকবার আগেই পঞ্চায়েত অফিসের ভেতর থেকে অনেকে বেরিয়ে আসে, বারান্দায়। যারা তার সঙ্গে এসেছিল, তাদের দিকে ঘাড়টা একটু হেলিয়ে ডেপুটি কমিশনার বলেন, ঠিক আছে। এখন একটু এদের সঙ্গে বসি। আর আপনারা নিজেরা সব সাবধানে থাকবেন। জলপাইগুড়ির বন্যা শুনলেই ভয় হয়! সবাই একটু হেসে উঠলে ডেপুটি কমিশনার পঞ্চায়েত অফিসের বারান্দায় ওঠেন।

কী? আপনারা কজন মেম্বার আছেন? জিজ্ঞাসা করে, ডেপুটি কমিশনার বারান্দা থেকে পঞ্চায়েত অফিসের ভেতরে ঢোকেন।

ঢুকে তিনি দাঁড়িয়ে পড়েন, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অফিসের বেড়াগুলো দেখেন। দরজার মুখোমুখি বাঁশের বেড়াটাতে লেনিনের একটা রঙিন ছবি বানো। ডান দিকে সেক্রেটারিয়েট টেবিল, পাশে স্টিলের আলমারি। সেই টেবিলের পেছনের বেড়ায় ওপরে বামফ্রন্ট সরকার জিন্দাবাদ লেখা একটি পোস্টার। ডেপুটি কমিশনার যেখানে দাঁড়িয়ে তার বয়ে বেড়ার ওপরে রবীন্দ্রনাথের একটা রঙিন ছবি সম্ভবত কোনো ক্যালেন্ডার থেকে কাটা। বাধানো সেই ছবিতে একটা শুকনো মালাও দুলছে।

স্যার, বসেন স্যার, সেক্রেটারিয়েট টেবিলের উল্টো দিকের চেয়ারটাকে একটু এগিয়ে দেন একজন।

চেয়ারটাতে বসতে বসতে ডেপুটি কমিশনার জিজ্ঞাসা করেন, কী, আপনাদের মেম্বার কে কে আছেন, এখানে?

দরজার কাছের ভিড়টা থেকে একজন এগিয়ে আসে, স্যার, আমরা কয়েকজন মাত্র আছি স্যার, আর দুই জন মেম্বারের বাড়িতে সাইকেল দিয়া লোক পাঠানো হইছে স্যার। কিন্তু তারা এইখানে আছে না টাউনে গেইছে– মেম্বার বাক্যটি শেষ করতে পারে না।

এর মধ্যে আরে দুজন এগিয়ে এসেছে। ডেপুটি কমিশনার বলেন, আপনারা বসুন।

সেক্রেটারিয়েট টেবিলের সামনের চেয়ারের বা দিকের বেড়া ঘেঁষে একটা বেঞ্চ পাতা ছিল। মেম্বাররা সেই বেঞ্চটাতেই বসে। পাশের একটা ঘর থেকে একজন একটা চেয়ার এনে রাখে দেখে ডেপুটি কমিশনার জিজ্ঞাসা করেন, ওদিকেও একটা ঘর আছে নাকি?

হ্যাঁ স্যার, ছোটঘর একখান আছে। একটা ঘর ত ভিড় হয়্যা যায়, অফিসের কাজকর্মে বাধা হয়, স্যালায় ঐঠে কাজ হয়।

ডেপুটি কমিশনার আবার ঘরটার বেড়াগুলোতে চোখ বুলিয়ে বলেন, পঞ্চায়েত অফিসগুলোতে এখনো নতুন ঘরের গন্ধ পাওয়া যায়। তাই না? সকলে একটু হাসে। ডেপুটি কমিশনার আবার বলেন, ঘরটর নোংরা হতে দেবেন না। আর কাগজপত্র জমতে দেবেন না। যা বাজে জিনিস, সঙ্গে সঙ্গে নষ্ট করে ফেলবেন। একবার যদি নোংরা জমতে শুরু করে, তা হলে আর কোনো দিন পরিষ্কার করতে পারবেন না। আমাদের কাছারি দেখেন না? এখন হোয়াইট ওয়াশও করা যায় না। হ্যাঁ বলুন। আপনাদের এখানে ত দেখছি আপনারা কোনো ওয়ার্নিঙেই কান দেন নি। এরপর বড় একটি এ্যাকসিডেন্ট হয়ে গেলে, তখন কৈফিয়েত দেবে কে?

স্যার, বোধ হয়, এব্যাপারে কথা বলার জন্যেই আপনার কাছে আজ যাওয়া হয়েছে, একজন মেম্বার বলে।

এখনো যদি আমার কাছে ছোটেন তা হলে আর পঞ্চায়েত করে লাভ কী হল।

আপনাদের এলাকায় বন্যা হলে আপনাদেরই ব্যবস্থা নিতে হবে—

না স্যার। হামারালার ত জানা নাই টাকাপয়সার খরচা কতখান চলিবে আর কতখান চলিবে না–

প্রথমেই ফান্ডের কথা আসে কোত্থেকে। সেসব ত পরে পঞ্চায়েত অফিসার এসে আপনাদের সঙ্গে কথা বলে ঠিক করবেন। তার আগে ত বাঁধের ওপারে, নদীর দিকে যারা আছেন, তাদের নিয়ে আসতে হবে। তারা ত দেখলাম ভাবছে ফ্লাড় আসবে না। শেষে মাঝরাতে যদি লোক সরাতে হয় তখন কী করবেন? ঐ বাঁধের ওপর একজন ভদ্রলোকের নৌকো চাইলেন আমাদের সিবিল এমার্জেন্সির অফিসার, তিনি আমাকে বলে দিলেন নৌকো এখন তার কাজে লাগবে, নৌকো দেবেন না

কে স্যার?

 সে আমি কী করে বলব। দেখুন ত আমাদের সিবিল এমার্জেন্সির অফিসার বাইরে আছেন কি না।

একজন মেম্বার উঠে দরজায় যায়। দরজা থেকেই ডাকে, এইঠে আসেন, আপোনাকে স্যার ডাকিছেন।

সিবিল এমার্জেন্সির অফিসার ঘরে এলে ডেপুটি কমিশনার বলেন, আপনি এখনো ওখানে দাঁড়িয়ে আছেন? ওখানে যান, দেখুন নৌকোটা ঠিক মত ফাংশন করছে কিনা।

হ্যাঁ স্যার বলে ভদ্রলোক বেরিয়ে যান।

মহেশ্বর জোতদারের নৌকোর কথা কহিছেন স্যার? উমরায় নৌকো দেয় নাই?

কে দেয় নি তার নাম আমি জানি না। আমি একটা রেসকিউ নৌকো স্টার্ট করিয়ে দিয়েছি, এবার আপনারা দেখুন আর কোন-কোন পয়েন্টে লোক থাকতে পারে। যদি দরকার হয়, ঐ আর-একটি নৌকোও নিয়ে নিন। অন্তত আজ সন্ধের মধ্যে নদীর দিকে যেন কেউ না থাকে। এই কথাটি বলার জন্যেই আপনাদের সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছিলাম। ডেপুটি কমিশনার চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়েন। দরজার দিকে পা বাড়াতে গিয়ে আবার দাঁড়িয়ে বলেন, আপনাদের লিডাররা কেউ নেই বলে দেরি করবেন না। তারা এলে বলবেন, আমি আপনাদের বলেছি। আর ঘুঘুডাঙা থেকে চিড়েগুড় আনতে গেছে, সেগুলো এসে গেলে যা করার করবেন। ডেপুটি কমিশনার বারান্দায় এসে দাঁড়ান। সেখানে তখনো অনেকে দাঁড়িয়ে, বসে। রাস্তার দিকে তাকিয়ে ডেপুটি কমিশনার বলেন, গাড়িটাকে একটু আসতে বলুন না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *