৩.১ চরপর্ব – নিতাইদের বাস্তুত্যাগ ও সীমান্তবাহিনীর সীমান্তত্যাগ

চরপর্ব – নিতাইদের বাস্তুত্যাগ ও সীমান্তবাহিনীর সীমান্তত্যাগ

০৮৬.

ব্রিজে আলো কেন?

 নরেশ ওর লাল টর্চটা জ্বেলে হাতের ঘড়ি দেখে। টর্চের আলো ভেজা এটেল মাটিতে গোল হয়ে ছড়িয়ে পড়ে। সেই আলোর বৃত্তে শুধু পা-মাথাছাড়া, ধড়ছাড়া পা; হাঁটু পর্যন্ত, কুচকি পর্যন্ত খালি পা; জলেকাদায় বেশির ভাগ পায়েরই হাঁটু পর্যন্ত লেপ্টানো।

নরেশ টর্চ নিবিয়ে দেয়। তাতে মাটির ওপরটা অন্ধকার হয়ে যায় কিন্তু সেখানে টর্চের আলো পড়ে নি। সেই আবছা কুয়াশার মত উজ্জ্বলতার ভেতর দিয়ে নরেশ তিস্তা ব্রিজের দিকে তার নেবানো টর্চটা তুলে দেখায়, নেবানো টর্চটা সহ হাতটা টানটান তুলে দেখায়, যেন ওটা টর্চ নয়-বন্দুক, বা অন্তত রিভলভার, হিন্দি ছবিতে ভিলেইনের হাতে একমাত্র দেখা রিভলভার। রিভলভারের কথা একবার মনে এলে তখন নরেশের টর্চটাকে সত্যি-সত্যি রিভলভারের মতই দেখতে লাগে যেন; সিনেমায় দেখা  রিভলভারের সঙ্গে মিলিয়ে দেখা মনে-মনে একবার শুরু হলে তখন আবার মনে হয় নরেশের টর্চটা বরং উল্টনো রিভলভারের মত দেখতে–নলটা নরেশেরই বুকে, টর্চের হ্যান্ডেল আর ঘোড়াটা হচ্ছে কাঁচে ঢাকা বান্ধ। কিন্তু সেই উল্টনো টর্চ থেকে এখন অন্ধকারই ছোঁড়া হয় তিস্তা ব্রিজের দিকে।

নরেশ বলে–রাত্তির বাজে দশটা, এখনো তিস্তা ব্রিজের আলো নিবায় না?

 সবাই তখন তিস্তা ব্রিজের দিকে ঘুরে দাঁড়ায়।

নরেশের টর্চের ইঙ্গিতে এরা সবাই তিস্তা ব্রিজের দিকে ঘুরে দাঁড়ায়। ঘুরে দাঁড়ানোর দরকার ছিল না, শুধু ঘাড়টা ফেরালেই দেখা যেত, আর দেখার জন্যে ঘাড় ফেরানোরও কোনো বাধ্যতা ছিল না, একেবারে উল্টো দিকে তাকিয়েও ত বোঝা যায় পেছনে তিস্তা ব্রিজে আলো জ্বলছে। কিন্তু, এখন, নরেশের কথায়, আবার খানিকটা যেন রিভলভারের মত উদ্যত নরেশের টর্চের নেবানো নির্দেশেই, ওরা ঘুরে দাঁড়ায় এবং দেখে, তিস্তা ব্রিজের আলো নেবে নি। ঘড়ি দেখার জন্যে নরেশের টর্চের আলো একটু আগে ভেজা মাটিতে গোটা-গোটা এত পা মাটি থেকেই খুঁড়ে তুলেছিল আর সেই পাগুলোর লম্বা, কোনাচে, খাটো ছায়াগুলো পরস্পরকে কাটাকুটি করে মাটিতে এমন জট পাকিয়ে-পাকিয়ে গিয়েছিল বা গা বেয়ে উঠে শরীরের ওপরের অন্ধকারে এমন মিশে গিয়েছিল, যেন, তখন, নরেশের টর্চের চৌহদ্দিতে, মানুষের বন যদি নাও হয়, অন্তত দিগন্ত-আকাশে, মানুষের ভিড়। কিন্তু এখন, এই নদী থেকে আকাশজোড়া কুয়াশার মত আচ্ছন্নতার নীচে, দেখা যায় এরা মাত্র গুটিকয়েক মানুষ, যেন আকাশ-মাটি বিস্তৃত এই কুয়াশায় পথ হারিয়ে ফেলেছে, যেন, যেখানে তারা দাঁড়িয়ে সেটা কোনো মাটি নয়, চর নয়, বরং একটি নৌকো, মোহানায় পথহারানো নৌকো। তেমন একটি নৌকোয় যাত্রীরা, মাঝিরা, যেমন ওরকম একটা ছোট কাঠের টুকরোর ওপরে কোনো রকমে দাঁড়িয়ে থেকে চোখ দিয়ে তীর খোঁজে, শুধু চোখ দুটো দিয়ে, আর সেই জলপ্রান্তরে তাদের ভেসে থাকাটাকেই সবচেয়ে অপ্রাসঙ্গিক ঠেকে, এরা, এই চরের এই গুটিকয়েক মানুষ তেমনি সামনে তিস্তাব্রিজের আলোর দিকে তাকিয়ে থাকে–চরটা ভাসতে-ভাসতে ঐ ব্রিজে গিয়ে ধাক্কা খেয়ে ভেঙে যাবে এমনই এক আতঙ্কে। তখনো, ওদের এই চরের উত্তর পাড়ে তিস্তার জল এসে ধাক্কা খেয়ে, ডাইনে ঘুরে, শহরের দিকের পাড়ে গিয়ে আছড়ে পড়ছে। কিন্তু এখন আর ওদের কানে সেই আওয়াজটা আসছে না–জলের সেই লোহা-গুড়ানো আওয়াজ, কারণ গত তিনদিনে এই আওয়াজটা ওদের অভ্যাসে ঢুকে গেছে। এখন তাদের গলা তুলে কথা বলতে হয়, নইলে শোনা যায় না। বাতাস ত উড়িয়ে নিয়ে যায়ই, জলের সেই আওয়াজেও চাপা পড়ে যায়। কথা বলার সময় নিজেদের স্বরগ্রাম তুলে ওরা নদীর বন্যার আওয়াজকে চাপা দিতে চাইছে, এই ক দিন।

কেউ একজন বলে–ভুলি গেইসে।

ভুলে ত রুজ সন্ধ্যায়, আইজ একিবারে মাঝরাত্তির পর্যন্ত ভুইল্যা থাইকল?

 সিনেমা দেখিবার গেইসে, ফিরে নাই–ভঙ্গিতে রাবণকে চেনা যায়।

শ্বশুর বাড়ি গিছে, শালা, তিন রাত্রির ধইর‍্যা বিচি কপালে উইঠছে, কয় সিনিমায় গিছে?–জগদীশ বারুই খেপে উঠে বলে। একটা সামান্য হাসির আঁচ পাওয়া যায়। রাবণ জগদীশকে খেপানোর জন্যেই বলেছিল। জগদীশও খেপে উঠেছে। চুখ ভাল কইর‍্যা মেইল্যা দ্যাখ, ব্রিজের উপর গাড়িটাড়ি আছে, নি নাই? নরেশ বলে আর ডান পায়ের আঙুলের ওপর ভর দিয়ে সোজা হলেই চোখের দৃষ্টি বেড়ে যাবে, এমন ভাবে সে ব্রিজের দিকে তাকায়।

আওয়াজ পাও নি? ট্রাকের? জগদীশ এবার মাটির ওপর উবু হয়ে বসে বিড়ি ধরায়। তার চোখে ছানি পড়েছে, দিনের বেলাতেই এখান থেকে অত বড় ব্রিজটাকে মনে হয় ওপারের গাছগাছালি। দেখতেই যখন পারছে না, মিছিমিছি খাড়া দাঁড়িয়ে থেকে লাভ কী? বরং, এই ভিড়ের মধ্যে বসে পড়লে, যেন তিস্তা ব্রিজের আলোজ্বলা বিপদ কিছুটা কাটবে।

সেই ভিড়ের তলা থেকে জগদীশের চিৎকার, কী? দেখা যায় কিছু? নড়াচড়া? একটু সময় কাটে, যেন জগদীশের নির্দেশমত ওরা ভাল করে দেখছে, সত্যিই কিছু দেখা যায় কি না। তারপর চীৎকার করেই বলে, অয়, অয়, দেখা যায়, দেখা যায়। আরো একটু সময় কাটে, তর্জনী আর মধ্যমার মাঝখানে বিড়ি আঙুলের গোড়ার দিকে। মুঠো পাকিয়ে রেখেও জগদীশ টানে না, উত্তেজনায়। তারপর রেগে ওঠে, হালা শুয়ারের বাচ্চা, দেখা যায় ত কওয়া যায় না?

সকলে আবারও হেসে ওঠে। কথাটা জগদীশকে খেপানোর জন্যে গজেন বলেছে, আর জগদীশও খেপেছে।

এ জগদীশ, তুই আয় কেনে এইঠে, দেখ ত, নজর করি দেখ, ব্রিজটা আছে কি নাই, মোর মনত খায় কি ব্রিজটা নাইরো, জগদীশের প্রায় সমবয়সী রাবণের গলা আবার শোনা যায়। কিন্তু জগদীশের ছানি নিয়ে এই ঠাট্টাতেও সে চটে না, মনে-মনে চটে উঠলেও মুখে কিছু বলে না। একটু সময় কেটে গেলে নরেশ তার টর্চটা মাথার ওপর তুলে, ব্রিজের দিকে ফেলে, জ্বালায়, যেন, সে এতক্ষণ ধরে এই হিশেবই কষছে যে টর্চটা জ্বালালে কত দূর যাবে।

নরেশের সন্দেহ হয়, টর্চটা বোধ হয় জ্বলে নি। সে সুইচটা অফ করে আবার জ্বালায়। কিন্তু আবারও তাকে অফ করতে হয়। এবার নীচে নাবিয়ে একটা ঝাঁকি দিয়ে টর্চটা নিজের মুখের দিকে ঘুরিয়ে অন করে আর সঙ্গে-সঙ্গে চোখ বোজে–আলোতে তার চোখ ঝলসে যায়।

আরে নরেশুয়াক দেখি উমরার টর্চখানও নাজ্জা পাইসে হে রাবণের এ কথায় সকলেই হেসে ওঠে। ভিড়ের মাঝখানে জগদীশ বারুই যে হঠাৎ মাটির কাছাকাছি থেকে কেশে ওঠে তার কারণ, এক হতে পারে, সে-ও হেসে ফেলেছিল, তারপর বিড়ির ধোয়ায় কেশে ফেলেছে, আর, নয় ত, এত হাসির মাঝখানে সে একটু কেশে জানান দেয়, সে-ও আছে, কিন্তু বসে।

নরেশ আবার মাথার ওপর তুলে ব্রিজ লক্ষ করে টর্চটা জ্বালে। এবার বোঝা যায়, তার টর্চের আলো জ্বলছে কি না টের পাওয়াই যায় না কুয়াশা আর হাওয়া এতই জমাট। যেন, বাতাস সেই টর্চের আলোটাকেও মুহূর্তে মুছে ফেলছে। তার টর্চের আলো যে এই ঝড়-জল ভেদ করে একটুও যেতে পারে না, এতে যেন নরেশের একটু অপমান ঘটে, নিজের কাজে নিজের অপমান। খানিকটা আশঙ্কাও বটে। কারণ, এই টর্চটাই ত গত কদিন ধরে তাকে একটা মর্যাদা দিচ্ছিল, অন্তত রাতটুকুতে তাকে ছাড়া চলছিল না। কিন্তু এখন চোখের সামনে তিস্তা ব্রিজের লাইন বাধা আলো সত্ত্বেও, এখানে সে যে তার টর্চ দিয়ে একটু বিধতেও পারল না চারপাশের জল মেশানো বাতাস, তাতে ত তার ওপর সকলের সেই আগেকার নির্ভরতা একটু কমে যেতে পারে। নিতাই চিৎকার করে ওঠে, এই কায় আছিস, যা ত চট করি দেউনিয়ার রেডিও ধরি নিয়া আয়।

জগদীশ রে-রে করে দাঁড়িয়ে পড়ে–এই এই, বৃষ্টির জলত ব্যাটারি ডাউনহয়্যা যাবে, ডাউন হয়্যা যাবে, একখান রেডিওই এখন ভরসা, কানকাটু মাস্টারেরটা ত আগেই গিছে, রেডিও আনবা না, রেডিও আনবা না।

জগদীশ তারপরে দুই হাত সামনে দুলিয়ে বলে, কই? কেউ যাও নাই ত? অ্য, কথা কয় না কে কেউ?

নিতাই চিৎকার করে ওঠে, কথা আবার কী কবে নে? তোমার সব তাতেই পুতুপুতু। ব্রিজের উপর এত রাত্তিরে আলো জ্বলে, তা হালি কি এক্কেরে লাল সিগন্যাল দিল নাকি, রেডিওতে শুইনতে হবে না? নাকি কাকির সঙ্গে সিনেমার গান শুইনব্যা নে?

চুপ যা হারামজাদা, জগদীশও চিৎকার করে ওঠে, শুইনব্যার হয় ত বাড়িত গিয়্যা শুইন্যা আয়, তা আবার এইখানে রেডিও আননের কী আছে, এহন কি পতিঘাতিনী সতী পালা হব নাকি? যত্ত সব

জগদীশ দাঁড়িয়ে পড়েছিল। সে প্রায় কিছুই দেখতে পায় না বলে দাঁড়িয়ে একটা দিকে মুখ রেখে চেঁচায়। তার ঘাড় ফেরানোর ভঙ্গিতে একটু অনিশ্চয়তা ছিল যে যার উদ্দেশে বলছে, সে তার সামনেই আছে, কি না। কথার শেষে জগদীশ হাত মুঠো করে একটা খুব জোরে টান দেয়, কিন্তু বুঝতে পারে আগুন নিভে গেছে। সে হাতটা ঝাঁকিয়ে বিড়িটা ফেলে দেয়। বিড়িটা পড়ে না, তার হাতেই লেগে থাকে। জগদীশ মাথায় হাত দিলে বিড়িটা তার মাথার চুলে গেঁথে যায়।তো যা না নকু, রেডিওটা শুনি আয়, বানার সিগন্যালটা শুনিই চলি আসবি জগদীশ বলে।

নকু বলে, এইঠে খাড়ি-খাড়ি গাব না পাকি চলো কেনে সগায় যাই, এ্যালায় ত সিগন্যাল দিবারই নাগিসে, মুই আসার বাদে যদি আবার দেয়?

ত্যামন হলি ত তর জেঠি নোক পাঠাইবে, কাথা আছে, যা বাবা, আমরা এইখানে খাড়াইয়্যা-খাড়াইয়্যা ব্রিজের আলোর বৃত্তান্তটা দেখি, জগদীশ বলে।

অয়, অয়, জগদীশের আঁখতৎ ত ফোকাচিং লাইট, রাবণ আস্তে করে বলে। নকু চলে যায়। জগদীশ তার ধুতির খুঁট থেকে দুটো বিড়ি আর দেশলাই বের করে। একটা বিড়ি বাড়িয়ে ধরে বলে, কায় খাবে? নে।

রাবণ বিড়িটা নিয়ে বলে, বাপের তালই বসি আছে, দেখিবার পাস না?

জগদীশ দেশলাইটা জ্বালাতে যায়, পারে না। তারপর, আবার সে সেই ভিড়ের মধ্যে বসে পড়ে। এবার আঁজলার মধ্যে আগুনটাকে বাঁচিয়ে বিড়িটাকে ধরাতে পারে। রাবণও উটকো হয়ে বসে তার হাতের স্পর্শ দিয়ে বোঝায় সে আগুন চাইছে। জগদীশ আগুনটা এগিয়ে দেয় না, কিন্তু আজলার ওপর থেকে তার মুখটা সরিয়ে রাবণকে জায়গা করে দেয়। দেশলাই কাঠির আগুন থেকে জগদীশের কোঁচকানো চোখ, নাকের দুপাশ আর গলাটাতেও আলো পড়ে। সেটা মুছে রাবণ তার মুখ এগিয়ে দেয়।

.

০৮৭.

জগদীশের রাগ

ওরা বিড়ি খাচ্ছিল বিড়িটাকে হাতের মুঠোর মধ্যে নিয়ে। এর মধ্যে আরো দু-একজন জগদীশ আর রাবণের আশোপাশে বসেও পড়ে। তাদের মধ্যে দু-একজন বিড়ি ধরায়। যতক্ষণ এরা সবাই দাঁড়িয়ে ছিল তিস্তা ব্রিজের আলোর-দিকে তাকিয়ে ততক্ষণ বাতাস ও জলের ছাটের কথা যেন ওদের খেয়াল হয় নি। কিন্তু মাটিতে উবু হয়ে বসার পর বাতাস ও জল থেকে শরীর বাঁচাতে মাথাটা বুকের ওপর ঝুলিয়ে দেয়। যেন, ঘাড় ও পিঠটা তাদের শরীরের অংশ নয়। যেন, ঘাড়ে ও পিঠে বোঝা বইতে বইতে, সেখানে একটা প্রতিরোধ ক্ষমতা স্বতই জন্মে আছে।

নরেশের টর্চের আলোতে পায়ের স্থাপত্য দেখা গিয়েছিল। তিস্তা ব্রিজের দিকে তাদের সমবেত তাকানোতে, পটভূমির সঙ্গে মিশে যাওয়া এই বর্ণভঙ্গতে, গায়ে-গালাগান তাদের দেখা গিয়েছিল। এখন তাদের দেখায় যেন মূর্তির ধ্বংসস্তূপের মত সেখানে বাতাসের জোর এতই যে মূর্তির ভঙ্গি বদলে যায়। নকু যখন জগদীশের বাড়িতে রেডিওর খবর শুনতে গেছে, তখন ওদের অপেক্ষা করতেই হবে। রাত দশটার পরও তিস্তা ব্রিজের বাতি জ্বলা দেখে একবার রেডিও না শুনে থাকে কী করে। রেডিও বন্ধ হওয়ার পরও সারাটা রাত থাকে বটে কিন্তু শিলিগুড়ি থেকে শেষ খবরেও নতুন কিছু না বললে, কেমন একটা আশ্বাস জোটে, বোধহয় নতুন কোনো বিপদ হবে না। কিন্তু নতুন বিপদের দরকারই বা কী? পুরনো বিপদই যদি আর-একটু এগিয়ে আসে তাহলেই সেটা এদের পক্ষে চরমতম ও নতুনতম বিপদ হয়ে উঠতে কতক্ষণ।

হে নিতাই, তোমরালার পার্টিত কী কহিল বানার কথা, আসিবেক, না, না আসিবেক? নিতাই তার পার্টি থেকে এই চরের গ্রামসভার সদস্য। এই চরকে যুক্ত করে দেয়া হয়েছে ওদিকে দোমোহনির গ্রামসভার সঙ্গে। একটা গ্রাম এই চর, আর-গুলো আছে ডাঙাতেই। পঞ্চায়েতের অফিসও সেখানেই।

কহিল যে কমোরেড, বানা আসিলে কিন্তু আসিবেন না, না আসিলে কিন্তু কুনোভাবেই আসিবেন না, গজেন আস্তে বলে। এখানে এত আস্তে বলা কথা শোনা যাচ্ছিল না। কিন্তু ওরা সবাই মাথা নিচু করে বসেছিল বলেই বোধহয় শোনা যায়। যেন, যদি ওরা মাথাটা বুকের ওপর হেলিয়ে ওরকম চুপচাপ কথা বলে যায়, তাহলে পরস্পর ভালই শুনতে পাবে। গজেনের কথার জবাব না দিয়ে নিতাই বলে, পার্টি আবার কবে কী, অ্য, পার্টি কবে কী? বৃষ্টি হবার ধরছে পন্দর দিন ধইর্যা, আর সঙ্গে বাতাস পাহাড়ঠে বানা নামিছে, তা পার্টির এইঠে কী কহার আছে, কহেন দেখি–

এইডা একটা কথা হইল রে নিতাই। এত বড় একখান পার্টি তর, তক না পুছি পাহাড়ঠে বানা আমি ঠেলা মারিবে বানার এ্যানং সাহস? বদলি করি দে বানাক, ট্যানেসফার করি দে।

নিতাই একটু চুপ করে থাকে, যেন কথাটার একটা জবাব খোঁজে। তারপর বলে, মুই কহি আছুি। আমিই কয়্যা দিছি পাটিক।

কী? কী কহিছিস?

কয়া দিছি, আমাগো চরখান যদি ভাইস্যা যাবার দ্যাখেন আমাগো জন্যে মিলিটারি পাঠাইবেন না ক্যাম্প বসাইবেন না, রিলিফ দিবারও নাগবে নাকয়্যা দিছি।

রাগিস ক্যান বোকা, চুপ যা, জগদীশ যেন গোপন পরামর্শ দেয়।

আরে আমি ত চুপই আছি, দ্যাহ না, মুখ চাইপ্যা ধইরলে সব পাছা দিয়া কথা কয়– নিতাই জবাবে বলে।

পাছার কথায় ত গন্ধ বাড়ায়, ঐ কথা শুননের কামডা কী? জগদীশ মাটির দিকে তাকিয়ে বেশ চেঁচিয়ে বলে, যাতে সবাই শুনতে পায়, তারপর কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে সবার হাসি শোনার জন্যে। কিন্তু কেউ হাসে না, এমন কি নিতাইও না। জগদীশের নিজেরও হাসার সময় পেরিয়ে যায়। তা হলে এখন আবার বলে, আবার হাসতে হয়। শালা নিতাই, সকলের লাথথি খায় তাই ভাল, উয়্যার পক্ষে কথ কইলাম–শালা চুপ মাইর‍্যা থাইকল।

 জগদীশ রেগে হঠাৎ ঘাড় ঘুরিয়ে থুতু ফেলে কারো গায়ে লাগলে সে খুশিই হয়। সে যে রাতে প্রায় কিছুই দেখে না তা সবাই জানে, আর তাই নিয়েই এতক্ষণ তাকে ঠাট্টা করছিল। এখন সেই সুযোগটা নিতে পারে–সে ত দেখতেই পায় না, কার গায়ে লাগল কী করে দেখবে?

কিন্তু তবু কেউ কোনো আওয়াজ করে না। জগদীশের ইচ্ছে হয় উঠে একটা লাথি মেরে দেখবে কেউ আছে কি না, বেশ টানা একটা লাথি।

জগদীশের মাথায় এই ইচ্ছেটা জাগার সঙ্গে সঙ্গেই হঠাৎ সকলে হো হো করে হেসে ওঠে। নিতাই হাসতে-হাসতে চিৎকার করে, এই নরেশ, খোঁচা মারিস কেন তর হাতুড়ি দিয়্যা।

নরেশও হাসতে-হাসতে চিৎকার করে, আমারে গজেন ধাক্কাইছে, কিন্তু হাসির ধাক্কায় আর বলতে পারে না। বলার যেন দরকারও ছিল না, তার সঙ্গে সঙ্গেই গজেন চেঁচায়, আমারে আষাঢ় ধাক্কাইছে। গজেনের কথা শেষ হওয়ার আগেই আর-কেউ যেন বলে ওঠে, আরে, বঁড়খান গরম হইছে,.ফোঁ ফোঁস করিবার ধইরছে, থুতু ছিটাবার ধইরছে।

অনেকে মিলে চেঁচায়, গাই আন, গাই আন।

আর, জগদীশ উঠে দাঁড়ায়, শালারা আসিস এর বাদে, কোন তালই তগ খাওয়ায় দেখি বলে সে ভিড় থেকে ছিটকে বেরিয়ে যায়। বেরিয়ে গিয়েও পঁড়ায় না, হনহন করে হাঁটতে থাকে। বাতাসের বেগে সে ধাক্কা খায়, একটু পেছিয়ে আসে, কিন্তু পা ফেলে এগিয়ে যায়। তার পা ফেলার নিশ্চয়তার চাইতেও প্রধান হয়ে ওঠে বাতাস, এই বাতাসের ঠেলা সামলে তার এগিয়ে যাওয়া। সবাই মাটির ওপর উবু হয়ে, মাথা বুকের ওপর ঝুলিয়ে-ঘাড় আর পিঠটা বাতাস আর জলের ঝাঁপটের জন্যে খুলে এম বসে ছিল যেন পাথরের চাই। তা থেকে জগদীশের ছিটকে যাওয়াটায় এখন দেখায় যেন এই পাথরে চাই পড়ে আছে আর সেটা বেয়ে একা একজন মানুষ মেনে যাচ্ছে তিস্তার স্রোতের চাইতেও প্রবলতায় তিস্তার স্রোতের ধাক্কা একই রকম, সেই ধাক্কা ঠেলতে-ঠেলতে এগতে হয়, যেন মাথার ওপর বিশমণি পাথর, মাথার ওপর নিলে নিয়ে যেতেই হবে অথবা ঐ পাথরের চাপে বসে পড়তে হবে। আর এই বাতাস যেন শিলাবৃষ্টি-কোথায় যে লাগবে তার আন্দাজ করাও যায় না।

রাবণ এই দঙ্গলের ভেতর থেকে উঠে দাঁড়ায়, তারপর জগদীশের দিকে হাঁটতে শুরু করে। সে একবার চেঁচায়ও, হে-এ জগদীশ কিন্তু তার ডাকটা উল্টো দিকে উড়ে যায়। রাবণ আর ডাকে না কিন্তু একটু তাড়াতাড়ি হেঁটে জগদীশকে ধরতে চায়। বাতাসের ধাক্কায় তারা পরস্পর থেকে একই দূরত্বে থেকে যায়। জগদীশকে ডাকার জন্যেই বোধহয় রাবণ একবার হাত তোলে। বাতাসের ধাক্কায় তার হাতটা যেন ভেঙে নেমে আসে। এখন যেরকম বাতাস আর বাতাসে জলের কণা, তাতে জগদীশ আর রাবণকে দেখতে পাওয়ার কথা নয়, তাদের এই জলকুয়াশার আড়ালে চলে যাওয়ার কথা। কিন্তু এখনো যে তাদের দেখা যাচ্ছে, যেন দুটো গাছের মত দাঁড়িয়ে আছে আর বাতাস তাদের উপড়ে ফেলতে চাইছে, তাতেই বোঝা যায় তারা বেশি দূর এগতে পারে নি আর দু-জনের মাঝখানের দূরত্ব বাতাসে অপরিবর্তিত থাকছে। রাবণ আবারও হাত তোলে, যেন বাতাসই এক ধাক্কায় তার হাতটাকে পেছন থেকে মুচড়ে ওপরে তুলে সঙ্গে-সঙ্গে আবার মুচড়ে নীচে নামিয়ে দেয়। রাবণ হাত তোলে, কিন্তু চিৎকার করে না। তার চিৎকার বাতাসে উল্টো দিকে চলে যাবে, কিন্তু হাত তোলে কেন? জগদীশ ত তাকে দেখতে পাচ্ছে না। বোধ হয় জলে ডুবে গেলে মানুষ যেমন হাত তুলে বাঁচতে চায়, তেমনি, এই বাতাস থেকে বাঁচতে হাত তুলে ফেলছে মাঝে-মাঝে রাবণ।

এখানে কেউ জিজ্ঞাসা করে, কী, খাড়ি আছে, না যাছে?

যাবার দে, যাবার দে, তখন কইল্যাম, তোমার আর এই রাত্তির বেলা পাক খাওয়ার কাম কী, বসি থাকো, রেডিওটা শুনো কুনো খবর বলে কি না, তা না, কয়, ক্যান, আমিও যাব, চল, এখন দেইখব্যারও পায় না কিছু, কিন্তু সব জাইনব্যার লাগবে। যাবার দে, যাবার দে।

রাবণ কাহা আবার পাছ ধইরছে ক্যান?

রাবণ কাহা চলি যাবে, না, জগদীশকাহাক বুঝসুঝ করি আইনবে?

আনিবার দ্যাও, আনিবার দ্যাও, বাতাস খারাপ, সগায় একসঙ্গে থাকাই মনত লাগে।

বৃষ্টি এখন জোরেই বইছে, বেশ জোরে, বাতাস না থাকলে সারা শরীর-মাথা ভিজে যেত। কিন্তু এখন বাতাসের বেগে বৃষ্টি সোজা নেই, বেঁকে গেছে। সেই জ্বলের তীর এই দঙ্গলটার পিঠেঘাড়ে।

.

০৮৮.

একটা নদীর ভেতর অনেক নদী

এই ঝোড়ো বাতাস, এই বৃষ্টি, এই বন্যার মধ্যেও আকাশ থেকে আলো ছিটকচ্ছে একটা–এমন আলো যা দেখা যায় না। কিন্তু অনেকক্ষণ এই আকাশের নীচে নদীর পাড়ে ঘোরাঘুরি করলে বোঝা যায়। সে আলো এমন নয় যে অনেক দূর পর্যন্ত দেখা যাবে, বরং উল্টো, সে আলো এমনই, যা চোখের সামনে একটা আড়াল তৈরি করে, এমন ঘের, যা কিছুতেই ভেদ করা যায় না। সে আলো এমনই, যাতে কিছুই স্পষ্ট হয় না, অথচ সব কিছুরই বাইরের রেখাটা দেখা যায়। সব কিছুরই মানে, একটি নির্দিষ্ট দৃষ্টিসীমার ভেতরে সব কিছুর। সে আলোতে মাটি দেখা যায় না, অথচ মাটির অস্তিত্ব বোঝা যায়, পায়ের তলার মাটির অস্তিত্বটুকু, বড় জোর সামনে পা ফেলার জায়গাটুকুরও। সে আলোতে চোখের সামনে টেনে আনলেও মানুষের মুখের রেখাগুলো স্পষ্ট হয় না, অথচ তীরের ফলার মত বৃষ্টির ছাটগুলো এসে ঘাড়ে আর পিঠে বিধে থাকলে সেই জলবিন্দুগুলি নিষ্প্রভ এক উজ্জ্বলতায় পিঠটাকে, ঘাড়টাকেও আবছা স্পষ্টতা দেয়। এখন, পিঠঘাড়জোড়া আবছা উজ্জ্বলতায় এই দঙ্গলটা অনেকটা যেন স্পষ্ট, জলে ধুয়েধুয়ে যেমন পাথর স্পষ্ট করা হয়। কিন্তু, তার মধ্যেও, যারা বৃষ্টির ছাটটার দিকে পেছন ফিরে বসেছিল পূবের আর দক্ষিণের সেই লোকগুলির পিঠ ভিজে গেছে বেশি, উল্টো দিকের মানুষজনের পিঠ প্রায় শুকনো।

আলোটা আসছে আকাশ থেকেই, গত তিন দিনের সম্পূর্ণ লোপাট আকাশ থেকে। প্রথম থেকেই বাতাস দিয়ে শুরু, পরে বৃষ্টি এসেছে। যেন, দিন তিনেক আগে বুধবারে, এখানকার আকাশে, বাতাসই কোথাও থেকে খেদিয়ে নিয়ে এল মেঘ। তারপর বাতাসই সেগুলোকে নাড়িয়ে-চাড়িয়ে, ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে আকাশ আর তিস্তার মাঝখানের ফাঁকটা সম্পূর্ণ ভরে দিল। দিনের বেলা সূর্য দেখা যাচ্ছে না–আলোও মাঝেমধ্যে এত কমে আসছে যেন প্রায়ই অকালে সন্ধ্যা ঘনিয়ে উঠছে। আর ওপরে মেঘ, নীচে নদীর জলের মাঝখানের আকাশ জুড়ে বাতাস একেবারে দাপটে বেড়াচ্ছে। এই বাতাসে জল বাড়ে। এ বাতাস এখানকার বন্যার বাতাস না। ওপরে, পাহাড়ের ভেতরে কোথাও বর্ষা শুরু হয়েছে–সেই বর্ষা, যা মাটির তলায় ঢুকে যায়, তারপর সেখান থেকে মাটি খুঁড়ে, গাছ উপড়ে, পাথর টলিয়ে নেমে আসে নদীকে একেবারে দ্বিগুণ, তিনগুণ চওড়া করতে করতে। এখন ত তিস্তার প্রায় মাথা থেকে শেষ পর্যন্ত বাঁধে মোড়ানো। কিন্তু, বাঁধ ত আর মাটিকে গভীর করে তুলতে পারে না। খাতনা-পাওয়া জল ফুঁসে উঠে বাঁধের গায়েই ধাক্কা মারতে চায়। তারপর আবার বিপরীত আক্রোশে ফিরে আসে কিছু মাটি খুবলে নিয়ে। সেই জন্যে বাধ থেকে লম্বা-লম্বা স্পার নদীর মধ্যে চলে এসেছে, জল যাতে সোজা পাড়ে গিয়ে ঘা না মারতে পারে।

বর্ষার তিস্তায় ত এরকম কোথাও না কোথাও হবেই। কোথায় হবে সেটা নির্ভর করে পাহাড়ে কোথায় বৃষ্টি হচ্ছে। এখানে না হয় এই একটা নদীকেই তিস্তা বলে, এখানে–এই সমতলে। কিন্তু ওপরে, পাহাড়ে, তিস্তা ত আর একটা নদী নয়। কোথা থেকে কত ঝোরা, কত ছোট নদী নেমে এসে তিস্তায় মেলে।

এত জায়গায় এত স্রোত তিস্তা দিয়ে যায় বলেই তিস্তাও যেন নিজেকে এমন ছড়িয়ে দেয়। এমনকি এই সমতলে, যেখানে তিস্তা তিস্তাই, সেখানেও পশ্চিম পারে বোদাগঞ্জ রংধামালি জলপাইগুড়ি-হলদিবাড়ি আর পুব পারে মাল-লাটাগুড়ি-দোসোহনি-ময়নাগুড়ি- বানেশঘাট-বাকালি মেখলিগঞ্জ এই দুই পারের মাঝখানে তিস্তা মাইল-মাইল ছড়ানো-ছিটনো। যাকে তিস্তা বলা হয়, যে-জায়গাটিকে তিস্তা বলে সব সময় দেখা হয়, দেখানো হয় তার সবটা জুড়ে ত আর কখনো জল থাকে না। তিস্তা কোনো নদী নয়, এটা একটা ভূখণ্ড। শীতকালে এই ভূখণ্ডের মধ্যে পাথরের টিলা জেগে ওঠে, তাকে ঘিরে সুতোর মত সরু কিন্তু স্থায়ী জলরেখা সোনা রঙের বালিকে সব সময় ভিজিয়ে রাখে, আর ভেজা বালিতে সেই টিলার জীবন্ত ছায়া সকাল থেকে সন্ধ্যা ঘুরে যায়। এই ভূখণ্ডের কোনো অংশ জুড়ে নরম সবুজ কচি ঘাসের মাইল-মাইল বিস্তারে গরুমোষের বাখান ঘুরে-ঘুরে বেড়ায় আর আকাশের নীচে দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়েই দিগন্তের দিকে তাকিয়ে রোমন্থন করে। এই ভূখণ্ডের কোনো অংশ জুড়ে নতুন কোনো অরণ্য জেগে ওঠে। কাশফুলের মাইল-মাইল বিস্তারকে দূর থেকে শরতের রোদে জল বলে বিভ্রম জাগে।

বর্ষায় এই সব আবার ধ্বংস হতে থাকে। তিস্তার কোন খাত দিয়ে কখন জল গড়াবে তা কেউই জানে না। কোনো বর্ষায় ডাইনে, পশ্চিম পাড় ভাঙে ত, তার পরের বর্ষায়, বায়ে পুব পাড় ভাঙে। এমন-কি একই বর্ষার মাঝখানেও খাত বদলে যায়। বর্ষা জুড়ে জলের তলায় সেই অদলবদলের পর আবার শরৎ থেকে ধীরে-ধীরে তিস্তার ভূখণ্ডের নতুন চেহারা দেখা যায়। যেখানে জল ছিল না, সেখানে স্থায়ী স্রোত ভেজা বালির মধ্যে দিয়ে বইছে। যেখানে অনেকদিনের নদী বইছিল, সেখানকার জল হঠাৎ সবুজ হয়ে যেতে শুরু করে, কোথায় মূল নদীর স্রোতের সংযোগ তার আটকে গেছে, সহসা আবার জেগে উঠেছে পাথুরে টিলা–মাথার ওপরে বনের একটা ছোট টুকরো নিয়ে, সেই টুকরোর ওপরে প্রায় পঞ্চবটী বনের মত যেন বাছাই গাছ, কোথায় মাটির চর জেগে উঠেছে–হালেবলদে কলা গাছে আর ছনের ঘরে সেখানে দেখতে-দেখতে একটি জনবসতি গড়ে ওঠে, তিস্তার বড় খাতটা থেকে অর্ধেক। জলই আরেক খাত দিয়ে বইতে শুরু করে দেয়, নৌকাগুলো চরে আটকে যায়, তারপর নদী বদল করে, নদীর ভেতরেই নদী বদল করে। তিস্তা ত একটা নদী নয়–একটা নদীর ভেতরেই অনেক নদী।

বছরে ছ-মাস প্রায় এই ভূখণ্ডজোড়া অনেক নদীর পারস্পরিক যোগবিয়োগ ঘটতে থাকে।

কোনো নদী, বা সোঁতা, তার বহুদিনের খাত থেকে উঠে আসে, যেন মাটির সঙ্গে লেপটে থাকা হাতি হঠাৎ তার গুঁড়টা প্রথমে আকাশে নাচিয়ে, তারপর দুই-তিন ধাক্কায় এক ঘূর্ণিঝড় তুলে, জেগে উঠল, আর নিজের এতক্ষণের ঘুমের ক্ষতি পোষাতে, যেদিকে চোখ যায় সেদিকেই, খানিকটা ছুটে, আবার ফিরে আসে, তার পায়ের চাপে ধুলোর ঝড় ওঠে, তার গা থেকে ধুলোর ঝড় ঝরে, তার শুড়ের ঝাঁপটে শুকনো ঝড় মাটি থেকে আকাশে লাফিয়ে ওঠে হঠাৎ। তারপর, এমন হতে পারে, সে আবার তার পুরনো খাতেই ফিরে যাবে, অভ্যস্ত পুরনো খাতে। আবার, এমনও হতে পারে, ছুটতে ছুটতে খেলতে-খেলতে ঘুরতে-ঘুরতে, নিজের তৈরি ধুলোর ঝড়ে তার নিজেরই চোখে আঁধি লাগে। সে আর তার পুরনো খাত চিনে নিতে পারে না।

কোনো নদী, বা সোঁতা, তার মূল ধারা থেকে ছিটকে চলে যায়, একটা বড় হাতির পাল বা চলমান মহিষ বাথান থেকে যেমন কোনো বাছুর একটু বেশি স্বাধীনতায় এদিক-ওদিক করতে করতে দলছুট হয়ে পড়ে। দলছুট হওয়ার প্রথম আনন্দে সে যেন তার স্বাধীনতার স্বাদ পেতে থাকে চারপাশের আকাশবাতাস থেকে। মাটি কত রকম, কোন মাটিতে কী ভাবে হাঁটতে হয় সেসবও দলের কাছ থেকে যার শিখে নেয়া হয় নি, সে তার নিজের গায়ে-গায়ে মাটি চিনে নেই, ছোট্ট শুড় বা লালচে নাক তুলে বাতাস থেকে অজানা সব ঘ্রাণ নিতে শেখে। যেন সে জানেই, এরকম ভাবে আবার পালে বা বাথানে ফিরে যাওয়া যায়। কিন্তু তারপর সেই তরুণ হাতি বা মহিষ হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ে অদৃঢ় ঘাড় একবার পেছনে ফেরায়। তখনো সে ঘাড়ে, অতিক্রান্ত পথ দেখার অভিজ্ঞতার দাগ পড়ে নি। তখনো সেই খাটো গুঁড়ে নিজের অতিবাহিত বাতাস শোকার টান পড়ে নি। একবার, একবার শুধু নিজের লুপ্ত পদচিহ্নের জন্যে তীব্র করুণ ডাক দেয়। তারপর প্রতিধ্বনিকে প্রত্যুত্তর ভেবে পালে বা বাথানে ফিরে যাওয়ার জন্যে ভয়ের তাড়নায় ছোটে। সেই তরুণ পশু তখনো ধ্বনি-প্রতিধ্বনির নিয়ম শেখে নি। সে-নদী, বা সোঁতা চিরকালের জন্যে তার মূল খাত থেকে ছিন্ন হয়ে যায়, প্রত্যাবর্তনের সব পথ মুছে দিয়ে।

বা, তখনো পর্যন্ত নদীর মূল ধারা অবিচ্ছিন্ন গতিতে তার বিরাট বিস্তার নিয়ে প্রাকৃতিক নিয়মে বয়ে চলে, কোথাও কিছু ফেলে যায়–যেমন তার স্বভাব, যেন, হাতির একটা বিরাট পাল, বা মহিষেরই কোনো বিপুল বাথান। এ ত সেই পালের বা বাথানের নিয়মিত ঘোরাফেরা, চেনাজানা জায়গায়, নিজেদেরই অভ্যস্ত পায়ের ছাপ ধরেধরে, নিজেদেরই অভ্যস্ত গাছ-লতা পাতার গন্ধ শুঁকতে-শুঁকতে, নিজেদের ওপড়ানো বা ঘোড়া, গাছ বা মাটি, আরো ভেঙে ও খুঁড়ে, একটু বেশি রকম অসতর্ক। অভ্যস্ততায়। কিন্তু হঠাৎ কোথায় যূথপতির কান দুটো খাড়া হয়ে ওঠে, আকাশে গাছের মত উঠে যায় বিশাল মাথা, কিংবা হাতদুটো যেন বাতাস খুঁড়বে এমন শাণিত প্রস্তুতি নেয়, গুঁড়টা তখনো এক অনিশ্চয়তায় মাটির ওপর দোলে আর সেই দোলনের রেখা ধরে মাটির ওপরে নিশ্বাস পড়ে, ঘাস দোলে, কুটো ওড়ে, বা নাকের গরম নিশ্বাসে সামনে থেকে পোকামাকড় উড়ে যায়, ধীরে-ধীরে সেই শুড়ের দোলা বাড়তে থাকে, ডান দিকের পা দুটো একটু-একটু এগিয়ে থাকে, ঐ বিশাল মহীরুহের মত শরীরের ঢালে এক তীব্রতা আসে, তারপর হঠাৎ সেই যূথপতি শুড় বাতাসে তুলে এক চণ্ড বৃংহতিতে বন কাঁপিয়ে, বা শিং বাতাসে তুলে আর্ত আহ্বানকে প্রতিধ্বনিময় করে নিজের কান দুট্টোকে দু পাশে মেলে ধরে ছুটে চলে, এই বৃদ্ধের শ্রুতিতে কানে এসে পৌঁছেছে কোন সন্ততির পথ-হারানো সঙ্কেত, মুহূর্তে পুরো বাথান বা দল তৈরি হয়ে যায়, আকাশে মাঝে-মাঝেই সমবেত আহ্বানের সঙ্কেত তুলে-তুলে সেই হারানো বাছুরের খোঁজে এই পুরো পাল বা বাথান ছুটে চলে–সংক্ষিপ্ততম পথে, পথের মাঝখানে যত লতাপাতা, গাছগাছড়া, সব কিছুকে মুহূর্তে ধুলিসাৎ করে, ফলে সারা বাতাসে পিষ্ট পাতার গন্ধ মেশাতে-মেশাতে। সেই পাল, বা বাথান তার সন্ততিকে হয়ত আর কখনোই ফিরে পায় না, কিন্তু তার খোঁজে সে তার চারণভূমিই বদলে ফেলেছে, সেই পাল বা বাথান আর পুরনো জায়গায় ফিরে যায় না।

কিন্তু শুধু নদীই খাত বদলায়, তা ত নয়, ভূখণ্ডই বদলে যায় বছরের ছ মাস জুড়ে। আর তাতে ত নদীও বদলায়, নদীরা বদলায়। অদৃশ্য জলতলে কোথায় বালুবাড়ির ওপর থকথকে পলি পড়ে যায়, একেবারে সাত-আট ইঞ্চি পুরু–এক শীতের রোদে শক্ত হয়ে পরের বর্ষাতেই সেটা ধানি জমি হয়ে উঠতে পারে। আবার সেরকমই, দু-তিন, বা এমন-কি দশ-পনের, বছরের পুরনো ধানিজমি ও বসতি কলাগাছ-কুলগাছ ডোবানো জল বালির পাহাড়ে ঢেকে দেয়, যেন নদীর তলে কোথাও এক ধারাবাহিক মরুঝড় চলছে। জল সরে গেলে শীতে দেখা যাবে দু-একটা গাছের পাতাহীন শুকনো ডাল-যাদের শুকিয়ে যাওয়া তখনো শেষ হয় নি, দু-একটা আলগা বাশ–যেন বালির নিশানার জন্যে সদ্য পোতা কিন্তু আসলে বালির তলার মাটিতে সেগুলো পোতাই আছে। আর সেই বালির ওপর হুমড়ি খেয়ে থাকা কোনো বাড়ির চালের একটা টুকরো। তখন, শীতে দেখে মনে হয়, জলে নয়, ঝড়ে উড়ে গেছে, চালটা শুধু মুখ থুবড়ে আছে।

এখন, এই বর্ষার ছ-মাস তিস্তার ভেতরে-নদীগুলোর যোগবিয়োগ ঘটে চলেছে তীব্র অথচ অনিশ্চিত এক বেগে। জলের তলে তিস্তা-ভূখণ্ডের ভেতরেও সেই গতি সঞ্চারিত হয়ে গেছেনাটকীয় ঘনঘটায়, কিন্তু এমনই দ্রুততায় যেখানে কোনো নাটকীয় পরিকল্পনা নেই।

.

০৮৯.

ভূগোলের ভেতরে ইতিহাস

ওপরে, সেই মালবাজার-ওদলাবাড়ির কাছে মউয়ামারির চর থেকে শুরু করে নীচে হলদিবাড়ির কাশিয়াবাড়ি পর্যন্ত তিস্তার, মানে, তিস্তা বলতে যে-ভূখণ্ড বোঝায়, তার, একেবারে মাঝখানে, লোকবসতি তৈরি হয়ে আসছে অনেক দিন হল। কিন্তু সে অনেক দিনেরও একটা ইতিহাস আছে।

রাজবংশীরা তিস্তার চরে সাধারণত বসতি গাড়ত না, গাড়ে নি। তারা বরং যেন বেশি অভ্যস্ত ছিল তিস্তার পারে–জঙ্গলের মধ্যে। সেই জঙ্গল তাদের খেতিজমি দিত, দরকারী সার দিত, ঘর তুলবার ডালপাতা দিত।

নদীর সঙ্গে তাদের সম্পর্ক ছিল নদীর স্বভাবের মতই যখন যেমন, তখন তেমন। যে-নদী এমন ঘন-ঘন বদলায়, যে-নদী, নদী হিশেবে চিনতে-চিনতেই, ডাঙা হয়ে যায় আর ডাঙা, নদীর ভেতর চলে যায়, সে নদীকে নদীর জায়গা ছেড়ে দিয়ে রাজবংশীরা বনান্তরাল থেকে নদীকে ব্যবহার করত। ব্যবহার বলতে যে শোষণও বোঝায়, তেমন ব্যবহার নয়। এ যেন এই নিসর্গের মতই ব্যবহার–জলপাইগুড়ির এই নিসর্গ, যেখানে গহনতম ফরেস্ট নদীর জলপ্রান্তরকে আড়াল দিয়ে রাখে, যেখানে পাহাড়ের ঘের সেই ফরেস্টকে ঘিরে রাখে। যেন মনে হয়, এ নিসর্গকে দেখাতে পারে, পাহাড়বননদী দিয়ে ঘেরা, পাহাড়বন-নদী দিয়েই তৈরি এক রক্ষিত নিসর্গের মত। দেখাতে পারে এমন যে ঘিরে রাখা পাহাড় থেকে ধাপে-ধাপে নেমে এসেছে এই নদী বন-পাহাড়, যেন, এখানে এই ঘেরের মধ্যেই থাকবে বলে। এ ত মানসসরোবর নয়। এখানে, এই সীমার দক্ষিণে কোনো পাহাড় নেই, তিস্তা সেই মুক্তিতেই মিশে গেছে। কিন্তু তিন দিকে ত আছে। সেই তিন দিক ঘেরা এই দেশে পাহাড়বন-নদীর যে-সহাবস্থান ভূগোলের কারণেই ইতিহাস হয়ে উঠেছে, রাজবংশীরাও এই নদীর সঙ্গে সেই সহাবস্থানের নীতিতেই চলে আসে। সেখানে কোনো আক্রমণ নেই, কোনো দ্বিতীয় পক্ষ নেই, কোনো সংঘাত নেই। সেই অর্থে, রাজবংশীদের সঙ্গে তিস্তার সম্পর্কই নেই কোনো। কারণ, সম্পর্ক বলতেই ত দুইটি আলাদা জিনিশের ভেতরকার এক সংযোগকে বোঝায়। রাজবংশী সমাজ আর তিস্তা ত দুটো আলাদা জিনিশই নয় যে সেখানে আবার একটা সংযোগের দরকার হবে।

সেই সংযোগের দরকার হল, যখন দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ভাটিয়ারা এখানে এত বেশি সংখ্যায় আসতে লাগল যে, জনসংখ্যার পুরনো অনুপাত আর টিকল না। এই ভাটিয়াদের মধ্যে যারা আরো ভাটিয়া, তারা এল যেন গায়ে পদ্মা-মেঘনা এইসব জায়গার জলের গন্ধ নিয়ে। তাদের সঙ্গে নদীর সম্পর্ক হচ্ছে আক্রমণের, সংঘাতের, জয়পরাজয়ের, দখলবেদখলের। এই নদীকে তারা চেনে না। তারা যে-নদীকে চেনে তার তল দেখা যায় না, আর এই নদী যেন তার তলদেশের রঙিন পাথরগুলোকে ঢেকে রাখার জন্যেই বয়ে চলেছে। তারা যে-নদীকে চেনে, তার জলের রং কাল, মাটির রং কাল। আর এ, নদীর জল রোদের মত ঝলকায়, বড় জোর কাদামাটিগোলা। তারা যে-নদীকে চেনে তার চৌহদ্দি অত্যন্ত চিহ্নিত ও সেই চৌহদ্দির মধ্যে মানুষের সঙ্গে নদীর মরণবাচন লড়াই। আর, এ নদীর কোনো চৌহদ্দিই নেইকখনো গাছের মাথায় চড়ে, কখনো গাছ নদীতে মাথা ডুবিয়ে স্নান করে। কিন্তু যত পার্থক্যই থাক-নদী ত নদীই। আর, তারাও, এত উত্তরে এসেও, ঐ নদীর ভেতরে, ঐ অচেনা নদীর ভেতরেই, নিজেদের অভ্যস্ত জীবনযাত্রার অনুষঙ্গ খুঁজে পায়। জলে, জলের চেনা গন্ধ পায়।

পুব বাংলায় নমশূদ্রেরাই প্রধানত তিস্তার চরগুলোতে প্রথম বসতি গাড়ে। দলবদ্ধ ভাবে বসতি হিশাবে। এর আগে, তিস্তার চরের ভামনি বনের ভেতর বাঁশ পুঁতে সেই বাঁশের মাথায় ঘর তুলে যে দু-চারজন কখনো কখনো থাকত, তারা কখনো বসতি গড়ে নি, বসতি গড়ার মত করে থাকেও নি। কিন্তু নমশূদ্ররা এই চরগুলোতেই আবিষ্কার করল সেই জমি, যার দখলের জন্যে তাদের কারো সঙ্গে দাঙ্গাহাঙ্গামা করতে হবে না। চরের জমি তারা চেনে–নিজেদের পছন্দমত জমি তারা বেছে নিতে পারল। তারপর ভামনি বন কেটে নিজেদের বসতের জমি আর আবাদের জমি দুইই তৈরি করতে লাগল। তারা রাজবংশীদের মত বাঁশের মাথায় ঘর বানাল না–ভিটে গাড়ল, দাওয়া বানাল, তারপর তিস্তার চরের ছন দিয়ে আর পারের ফরেস্ট থেকে বাশ এনে ভাটিয়া বাংলার মতই চারচালা ঝর তুলল। তিস্তার চরে এত ভামনি আর তিস্তার পারে এত বাশ, যেন এই রকমের ঘরবাড়ি একমাত্র এখানেই হওয়া সম্ভব। নমশূদ্রেরা এক সৈন্যবাহিনীর মত স্বয়ংসম্পূর্ণতায় এমন ভাবে এই চরগুলির দখল নিল–ওপরে মউয়ামারি থেকে তলায় কাশিয়াবাড়ি পর্যন্ত তিস্তার একেবারে মাঝ বরাবর এই চরগুলির দখল এমনভাবে নিল, যেন, তারা বরাবর এখানেই থেকেছে, সৈন্যবাহিনীর কাছে যেমন কোনো জায়গাই বিদেশ না, যুদ্ধ না করলেও ত একটা সৈন্যবাহিনী একটা অজানা-অচেনা জায়গায় তাদের প্রতিদিনের রুটিনে বাধা থাকে।

ভয় নিশ্চয়ই ছিল–তিস্তার ভয়। কিন্তু সেখানেও আশ্বাস ছিল আবার নতুন বসতি ও আবাদ গড়ে তোলার, কোথাও-না-কোথাও ত ডাঙা জাগবেই, সব ত আর ভেসে যেতে পারে না। আর, তখন, সেই মুহূর্তে যে-কোনো একটি জায়গায় খুঁটি গেড়ে বসাটাই ছিল প্রধান দুশ্চিন্তা। তিস্তার মত নদীর স্বভাবকে ভয় করে চরে না-যাওয়ার চাইতেও প্রবলতর ছিল, সেই ভয়ঙ্কর স্বভাবের মুখোমুখি হওয়ার আশঙ্কা সত্ত্বেও, একটা কোথাও ঘর তৈরি করা ও আবাদ বানানোর প্রয়োজন।

ঠিক যেন পুঁজিপুথি মেনেই, ১৯৫০ সালে তিস্তায় যেবন্যা এল, তার সঙ্গে জানা ইতিহাসের কোনো কথার তুলনাই চলে না। তিস্তার চরটর কোথায় উড়ে গেল। পারের ফরেস্টকে-ফরেস্ট, স্রোতের সঙ্গে উধাও হয়ে গেল। সেই প্রথম জলপাইগুড়ি শহরের ভেতরে তিস্তার জল ঢুকল।

এখন যদি তিস্তার চরের এই জনবসতির কথা ভেবে বিচার করা যায়, তা হলে, মনে হয়, ১৯৫০ সালের ঐ বন্যাটা হয়ে সব দিক থেকেই ভাল হয়েছে।

তখনো সব চরে ত বসতি হয়নি। সবে মউয়ামারির চরে কিছুটা জায়গা হাসিল করে বসবাস শুরু হয়েছে, চাষআবাদও একটু-আধটু হচ্ছে। ঠিক সেই সময়েই সেখানকার, ঐ মউয়ামারির নমশূদ্রেরা, বুঝে নিতে পারল তিস্তার অনিশ্চয়তাটা আসলে কী রকম অনিশ্চয়তা। জল যে এমন আচমকা এসে যায়, তাও আবার এরকম বেগে, তা এরা ভাবতেও পারে নি। নৌকো ছিল একটা মাত্র। ওস্তাদ মাঝির অভ্যস্ত হাল নৌকোর টাল সামলাতে পারে বটে কিন্তু জলের তলায় বিরাট-বিরাট পাথরের চাঙরের সঙ্গে ধাক্কা লেগে যে-নৌকোর তলা খসে যেতে পারে–সেটা জানা ছিল না। বন্যা নেমে গেলে ঐ চরেই আবার ঘর ভোলার ও আবাদের কাজ শুরু হল।

আর সেই প্রথম তিস্তাকে একটু সামলাবার ব্যবস্থা হল। সব দিক খোলা তিস্তা বর্ষাকালে শেবক পাহাড়ের তলা থেকে হলদিবাড়ি-মেখলিগঞ্জ পর্যন্ত ছিল সম্পূর্ণ স্বাধীন। যেখান দিয়ে খুশি বয়ে যেত। পঞ্চাশ সালের বন্যার পর শহর ঘিরে বাধ হল। তারপর তিস্তার দুই পারেই বাধ বেড়ে যেতে লাগল। লম্বা হতে-হতে সেই ওদলাবাড়ি থেকে কাশিয়াবাড়ি পর্যন্ত তিস্তার দুই পারই বাধে বাধা হয়ে গেল।

এরই ভেতর তিস্তার ওপর দিয়ে দুটো ব্রিজ তৈরি হল, একটা রোড ব্রিজ, আর একটা রেল ব্রিজ। ১৯৬৮ সালে তিস্তার বন্যা এই ব্রিজের পাশের বাধ ভেঙে শহরে ঢুকল। তার আগে ওদলাবাড়ির বন উপড়েছে, ন্যাওড়া আর ধরলার মাঝখানের ত্রিভুজটাকে মাটি থেকে খুবলে নিয়েছে, মউয়ামারির চর থেকে বোয়ালমারির চর পর্যন্ত সমস্ত জায়গায় তিস্তা তার পুরনো খাত বানে ভাসিয়ে দিয়েছে। ১৯৬৮ বন্যা কেন হয়েছে তার কারণ নিয়ে বহুবিধ মত আছে। মতের বৈচিত্র্য নির্ভর করে বন্যার সঙ্গে জড়িত সরকারি বিভাগের সংখ্যার ওপরে। তাতে অন্তত এটা প্রমাণিত হয়ে যায়, প্রত্যেক বিভাগেরই বন্যা বানাবার মত যথেষ্ট কারণ ছিল। এখানে ১৯৬৮র বন্যা আলোচ্য নয়। আলোচ্য তিস্তা ১৯৬৮ বন্যাতে এরকম প্রমাণ আবার পাওয়া গেল যে তিস্তা, বাধ বাধার ফলে, আরো অনিশ্চিত হয়ে উঠতে পারে। কিন্তু এটাও সত্যি যে বাহান্ন থেকে আটষট্টি ত ষোল বছর। এই সোল বছরে তিস্তার বন্যা ত অনেকটাই সামলানো গেছে। ৫০-এর পর ওরকম, বা ওর চাইতে বেশি বন্যার জন্যেও ৬৮ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছে। ৬৮র পর নিশ্চয়ই আরো বিশ বছর কাটার আগেই তিস্তা সম্পর্কে আরো বৈজ্ঞানিক ও সংগঠিত ব্যবস্থা নেয়া যাবে। ইতিমধ্যেই তিস্তা ব্যারেজের কাজ প্রথম দফা শেষ হয়ে গেছে। যদিও এখনো অতটা নিশ্চিত করে বলা যায় না, এবং এখনো বন্যার ভয় সব সময়ই আছে, তবু তিস্তার জল যাতে পাহাড় থেকে আচমকা নেমে সমতল ভাসিয়ে দিতে না পারে তার জন্যে তিস্তার মাঝামাঝি ত ব্যারেজ বাধা হয়েছে।

তিস্তার চরে যে স্থায়ীভাবে বসবাস করা যায়, চাষ-আবাদ করা যায়,সেটা পঞ্চাশ সালে প্রমাণিত ছিল না। উদ্বাস্তু নমশূদ্রেরা তখন তিস্তার চরে সবে আশ্রয় নিয়েছে। একটা বন্যা তাদের উৎখাত করার পক্ষে যথেষ্ট ছিল না। এমনকি বাহান্ন ও চুয়ান্ন সালের বন্যাতেও তারা মরে-ভেসে আবার চরে ফিরে এল। যদিও তখনো তারা চরে শিকড় গাড়ে নি।

কিন্তু ৬৮ সালের বন্যায় চরের মাটিসুষ্ঠু উপড়ে গেলেও, চরের মানুষদের চরে ফিরে আসা ছাড়া কোনো উপায় ছিল না। কারণ ততদিনে, প্রায় দুই দশকে তিস্তার চর, মউয়ামারি থেকে কাশিয়াবাড়ি পর্যন্ত বসতি হিশেবে প্রায় পাকাপাকি গড়ে উঠেছে। এর মধ্যে চরের কৃষকদের নিয়ে কো-অপারেটিভের চুরিজোচ্চুরি যেমন হয়েছে, তেমনি, চরের কৃষকের স্বাধীন উদ্যোগে, সরকারি সাহায্যহীন স্বাধীন উদ্যোগে, ধান ও তরকারির ফলনে জেলার কৃষি-অর্থনীতি ও বিপণনের চেহারা বদলে গেছে। ৬৮র বন্যার সময়, চরের কৃষক জলপাইগুড়ির জনবসতির একটা প্রধান অংশ, চরের ফসল ও ফলন আর্থিক জীবনের অপরিহার্য ভাগ।

তাই ৬৮র বন্যার পর চরের মানুষদের আবার চরে ফিরে আসা ছাড়া গত্যন্তর ছিল না। বন্যায় তিস্তার ভূখণ্ড পাল্টে গিয়েছিল। বন্যার পর সেই পরিবর্তিত ভূখণ্ডে এরাও নিজেদের মত করে আবার নিজেদের পুনর্বিন্যাস করে নিয়েছে। তাতে হয়ত দেখা যাবে, কোনো চর আর নেই, আবার নতুন চর দেখা দিয়েছে। তাতে হয়ত দেখা যাবে, তিস্তার সীমার মধ্যে তিস্তা নিজেকে যেমন বদলেছে, এই কৃষকরাও নিজেদের সেরকম বদলে নিয়েছে। কিন্তু ৬৮র বন্যাতেও তিস্তার ভেতর থেকে যাদের উচ্ছেদ করা যায় নি, তারা আর উচ্ছেদ হবার নয়। ৬৮-র বন্যাই যেন তিস্তার চরকে ও সেই চরের কৃষকদের প্রধান ভূভাগের অংশ করে দিল।

দেশ ভাগ হওয়ার পর পূর্ববঙ্গের উদ্বাস্তু নমশূদ্র চাষী, উত্তরবঙ্গের পাহাড়ি এ-নদীকে এক রকম করে জিতে নিল। ভূগোলের ওপর ইতিহাসের জয় ঘটল।

.

০৯০.

চরের ভেতরে চরুয়া

তিস্তার এই চর প্রধানত পূর্ববঙ্গের নমশূদ্র কৃষকরাই হাসিল করেছে, আবাদ করেছে। সরকারি আইন অনুযায়ী চরের জমির ওপর সাধারণ আইনকানুন খাটে না। কারণ নদীর চরকে, এরকম অনিশ্চিত চরকে, জনবসতির জায়গা হিশেবে সরকার মেতে নিতে পারে না। তাতে অবিশ্যি কোনো অধিকার থেকে এরা বঞ্চিত হয় নি। প্রতিটি নির্বাচনে ভোট দিয়েছে, এবার এমন-কি পঞ্চায়েতে সদস্যও পাঠিয়েছে। সরকারি আইন থেকে আইনই মুক্ত থাকার ফলে চরে প্রায় সবাই জোতদার, কেউই শুধু হালুয়া নয়। বা এই কথাটাই উল্টে বলা যায়, চরে সবাইই হালুয়া কেউই কেবল জোতদার না। জমির মালিকানা থেকে জমির ওপর, চাষের ওপর, ফসলের ওপর সমস্ত পুরুষানুক্রমিক ও আইনমাফিক স্বত্ব তৈরি হয়, চরে ত আর তেমন কোনো স্বত্বভোগের সুযোগ নেই। সুতরাং দেউনিয়া-জোতদারির কোনো ব্যাপার চরে যেন থাকতে পারে না।

থাকতে পারে না, কিন্তু আবার একরকমভাবে থাকেও বটে। সবার আর্থিক ক্ষমতা সমান না, সব বাড়িতে কাজের লোক সমান না। কখনো কখনো অনেককেই টাকার ধার করতে হয়। কাউকে কম সময়ের জন্যে, কাউকে বেশি সময়ে জন্যে। সে সময় টাকার ধার দেয়ার দেউনিয়া দরকার হয়। চরে এসমস্ত ধার অনেকটা নগদ টাকায়, শোধ হয়। যার নিজেরও টাকার ক্ষমতা আছে, সে টাকা দিয়ে সুদসহ ধার শোধ করে। কিন্তু এর মধ্যে কারো কারো আবার ফসলে শোধ করলে সুবিধে হয় বেশি। তার হয়ত টাকার জোর কম। তখন, যেমন জোতদারিতে, তেমনি চরেও, যখন শোধ করা হচ্ছে তখনকার শস্তা দরে না, যখন ধার দেয়া হয়েছিল তখনকার আক্ৰা দরে ঋণ শোধ করতে হয়। কিছু কিছু জমিতে কৃষক আর নিজে চাষ করে কুলোতে পারে না–সেখানে তারা কিছু-কিছু জমিতে কাজের জন্যে লোক রাখে। তেমন লোক সহজেই পাওয়া যায়-রাজবংশীরা এসে হালের সময়, বোয়া গাড়ার সময়, ধানকাটার সময় কাজ করে দেয়। সাধারণভাবে চরের অর্থনীতিতে আধিয়ারি চলে না। কিন্তু মজুরি জমা রেখে-রেখে ফলনের ভাগে মজুরি নিয়ে রোয়াও চালু আছে। এতে যেন রাজবংশী হালুয়ার অন্তত আধিয়ারির মর্যাদাটুকু জোটে।

এই চরগুলোতে একটা অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র চালু আছে–উৎপাদনের ভূমিকা থেকে তৈরি গণতন্ত্র। রাজবংশীরা কোনোদিন দলবদ্ধভাবে চরে বসতি গাড়ে নিতাই নমশূদ্রেরা চরকে বাসযোগ্য করে তোলার পর রাজবংশীরা সেখানে নিজেদের অধিকার দাবিও করে নি, সে নিয়ে কোনো ঝামেলাও হয় নি। বরং, যাকে বলা হয় কায়েম এলাকা, অর্থাৎ সরকার যে-জমি সেটেলমেন্ট মারফৎ জরিপ করতে পারে সেই আইনি জমিতে নমশূদ্ররা যেখানে বসতি গেড়েছে, সেখানে কোনো-কোনো সময় পুরনো রাজবংশী বসতির সঙ্গে দাঙ্গাহাঙ্গামা ঘটেছে। এরকম সবচেয়ে খারাপ ঘটনা ঘটেছিল বছর চোদ্দ-পনের আগে তিস্তাপারের ক্রান্তি থানার ঝাড়মাঝগ্রাম এলাকায়। সেখানে আগুন লাগানো, আগুনে পুড়িয়ে মারা, কুপিয়ে কাটা–এ সবই ঘটেছিল। কিন্তু চরে এখনো এরকম কোনো ঘটনা ঘটে নি, সাম্প্রদায়িক হুজ্জতহাঙ্গামার কোনো ঘটনাই নয়! আর প্রথম দিকে যদিবা বলা যেত যে নমশূদ্রেরা চরে নিজেদের লোক ছাড়া কাউকে বসতে দেয় না–তেমন কে-ই বা বসতে চেয়েছে–কিন্তু পরে, যখন চর বাসযোগ্য ও কর্ষণযোগ্য জায়গা হিশেবে সাধারণ ভাবে স্বীকৃত হয়ে গেল, তখন, প্রধানত মনশূদ্ররা হলেও, রাজবংশীদেরও বেশ কিছু অংশ একসঙ্গে চরে এসে বসতি গাড়ে, আবাদ করে।

ব্যাপারটা তখন এরকম দাঁড়িয়েছে যে, চরে নমশূদ্রেরাই যাবে তা নয়, চর যখন আছে, তখন সবাই মিলেই সেখানে যাওয়া যাক। এরকম একটা পরিবেশ তৈরি হয়ে গিয়েছিল। বিশেষত, তিস্তার দুই পারেই ত রাজবংশী জনবসতি আছে। তাদের সেই সব গ্রামবন্দরের ভেতর দিয়েই চরের মানুষজনকে যাতায়াত করতে হয়। এক ধরনের চেনাজানা, তার ফলে হয়েই যায়। স্বাধীনতার পরেই সেই প্রথম ধাক্কায় যা হওয়ার হয়েছে, কিন্তু তার পরে তিস্তার চরগুলিতে নমশূদ্র ও রাজবংশীদের মিশ্র জনবসতি তৈরি হয়েছে। তাতে হয়ত বেশির ভাগ জায়গাতেই নমশূদ্রদের প্রাধান্য, কিন্তু কোনো-কোনো জায়গায় রাজবংশীরাও সংখ্যাগুরু।

সামাজিক দিক থেকে, অন্তত সমাজের বাইরে দিক থেকে, বা, বলা ভাল, এই সমস্ত চরের জনসংগঠনের দিক থেকে নমশূদ্র ও রাজবংশীদের মিলিত জীবনযাপনই প্রধান, সংখ্যাগুরু ও সংখ্যালঘুর প্রশ্নটা সেখানে অবান্তর। জগদীশ বারুই-এর মত নমশূদ্র মহাজন এক-এক চরে নিশ্চয়ই আছে কিন্তু চরের কৃষকও আর পুরুষাক্রমিক খাতক নয়, সুতরাং সে বারুইয়ের ধার ধারতে পারে কিন্তু ভাত ধারে না। জনসংগঠনের এই গণতন্ত্র থেকেই বোধহয় চরের কৃষকদের ভাষাতেও পূর্ববঙ্গের আর রাজবংশী ভাষার একটা মিশ্রণ ঘটেছে। অন্ধকারে ভাষা শুনে বোঝা মুশকিল ভিড়টার প্রধান অংশ–ভাটিয়া না দেশিয়া। এই যেমন জগদীশ বারুই যে-ভাষায় খিস্তি করে উঠে যায়, রাবণ রায়বর্মন তাকে সেই ভাষাতেই প্রায় বুঝিয়েসুঝিয়ে ফিরিয়ে আনতে যায়।

.

০৯১.

ফ্লাড আসতে কতক্ষণ–চার ঘণ্টা না ছয় ঘণ্টা

 কিন্তু এবাতাস ঠেলে জগদীশও এগতে পারে না, রাবণও জগদীশের কাছে পৌঁছতে পারে না। এরা এখানে প্রায় গোল হয়ে বাতাসের ঝাপটায় শাণিত বৃষ্টির তীর পিঠে-ঘাড়ে-মাথায় নিতে নিতে দেখে, তাদের এখান থেকে উঠে গিয়েও জগদীশ বা রাবণ কোথাও যেতে পারছে না।

বৃষ্টিভরা বাতাসের কুয়াশার ভেতরে ওদিক থেকে বাতাসের অনুকূলতায় কু ক্রমেই ছুটে কাছে আসে। সে জগদীশকে এরকম দলছুট একাকী দেখবে, ভাবে নি। ভাবে নি বলেই যেন জগদীশকে দেখেও না দেখেই ছুটে আসে। জগদীশ নকুকে চিনতে পারে না। কিন্তু তার যেন মনে হয় বিপরীত দিক থেকে জমাট কুয়াশা নড়ে চড়ে এদিকে আসছে। এখন ওদিক থেকে এক নকুই আসবে। কিন্তু সেটা, তার কাছাকাছি হওয়া সত্ত্বেও কুয়াশার আরো ভেতরে চলে যায় দেখে জগদীশ চিৎকার করে ডেকে ওঠে,হে-এ নকু। সেই চিৎকারে আহ্বানের সঙ্গে ধমকও ছিল, বা হয়ত ওটাই জগদীশের স্বরের পাকা ভঙ্গি–সে কথা বললেই একটু জোরে বলে ফেলে। কিন্তু জোরটা এখানে তার স্বভাবের চাইতে অনেক বেশিই ছিল-নইলে এই বাতাসে সে-আওয়াজ রাবণের কাছে ও তারও পেছনে ঐ দলের কাছে অমন হুমড়ি খেয়ে পড়ত না-হে-এ নকু।

নকু দাঁড়িয়ে পড়ে। জগদীশ চিৎকার করে ওঠে, কী কইল রেডিওতে?

এখন, এই চরে কুয়াশায় তিনটি দাঁড়ানো মূর্তি রাবণ, নকু আর জগদীশ। একটু দূরে সেই দলটা গোল হয়ে বসে–মাথা নিচু করে। নকুকে জগদীশ ডাকতেই সেই দলের দু-একজন দাঁড়িয়ে পড়ে। নকু জগদীশের দিকে ফিরে গলার সমস্ত জোর দিয়ে চিৎকার করে-লাল সিগন্যাল দিই দিসে, লাল সিগন্যালনকুর চিৎকার ঐ বাতাসে ছিঁড়ে যায় আর আওয়াজগুলো পুর্ব থেকে পশ্চিমে চলে যায়। আওয়াজগুলো এমন টুকরো-টুকরো হয়ে উড়ে যায় যে এরা ছাড়া অন্য কারো পক্ষে সেগুলোর ভেতর কোনো সংযোগ তৈরি করা অসম্ভব হত–সেগুলোকে বাতাসেরই শব্দ মনে হত।

তিন-তিনজন দাঁড়িয়ে থাকায় বাতাস তাদের ঘিরে আরো উত্তাল হয়ে উঠতে পারে। জগদীশ পেছন ঘুরে এই দলটির দিকে ফিরে আসতে শুরু করে। এতক্ষণ জগদীশ বাতাস ঠেলে এগতে পারছিল না আর এখন হঠাৎ বাতাসটা তাকে পেছন থেকে ধাক্কায় ধাক্কায় সামনে ঠেলে দেয়। তাতে তার শরীরটা কেমন হালকা লাগে। স্রোতের বিপক্ষে সাঁতার কেটে হঠাৎ স্রোতের মুখে গা ছেড়ে দেয়ার মত।

নকুর কথা ঐ দলটাকে মুহূর্তে ভেঙে দেয়। সবাই যেমন একসঙ্গে গোল হয়ে ঘাড় নিচু করে বৃষ্টি আর বাতাস থেকে বাচছিলনকুর চিৎকারে বাঁচার সেই চেষ্টাটা তুচ্ছ হয়ে যায়। সবাই দাঁড়িয়ে পড়েছে আর কেমন আগোছালো ভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেছে। বাতাস এতক্ষণ এক রকম করে বইছিল, যেন জলের স্রোতের ঢালের মত, এরা যেন কোনোক্রমে সেই ঢালের নীচে মাথা বাঁচিয়ে বসে ছিল। আর, এখন ওরা দাঁড়াতেই বাতাস ওদের এতগুলো শরীরের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে লাগল। তাতে বাতাসের আওয়াজ যেন হঠাৎ বহুগুণ বেড়ে গেল। ঐ আওয়াজের মধ্যে ওরা খাবি খেতে লাগল।

এই দলের সবাই বাতাস ঠেলে নকু জগদীশ আর রাবণের দিকে এগতে চাইছিল। কিন্তু তার আগেই বাতাসের ঠেলায় ওরা এদের কাছে এসে পৌঁছে গেছে।

নকুই এই পুনর্গঠিত দলের ঠিক মাঝখানে পড়ে যায়, কহিল যে লাল সিগন্যাল দেয়্যা গেইল। সগায় রেডি থাকেন। ধাধছাড়, নদীর পারত যেইলা আছেন সায় ছাড়ি চলি যান, ছাড়ি চলি যান। যেইলা মানষিক এলায়ও যান নাই, স্যালার দায়ি সরকার না নিবেক। চরত যে মানষিলা আছেন স্যালায় এ্যানং এই রাতত ডাঙায় চলি যান, ডাঙায় চলি যান। পাহাড়ঠে বান নাবিবার শুরু করিছে, শিবক পাহাড়ের তলায় রেলের ব্রিজখান ভাঙি যাবার পারে-সেই তানে আসামের সব রেল ক্যানসেল, ক্যানসেল, ক্যানসেল নকুর দম ফুরিয়ে যায়। সে থামার পর তার কথার বাকি অংশ শেষ করে দিতেই যেন বাতাস হঠাৎ-গর্জনে মাটি থেকে আকাশে লাফ দিয়ে ওঠে। নকুর কথাটা যে এমন আচমকা শেষ হয়ে যাবে, সেটা কেউ বোঝে নি। তাই নকুর কথা শেষ হওয়ার পরও কেউ কোনো কথা বলতে পারে না। ঐ আকাশ জুড়ে বাতাস গর্জায়, গর্জে-গর্জে লাফায়।

নরেশ ব্রিজের দিকে মুখ করে বলে–সিগন্যাল আগেই আইসছে, ব্রিজের বাতি সারা রাত্রি জ্বালাইয়া রাইখচে

নিতাই বলে ওঠে, এই ব্রিজের তানে কিছু কইল?

নকু আবার পুরনো স্বরেই চিৎকার করে বলে, এই ব্রিজের তানে কিছু না কইসে, চরুয়া মানষি ডাঙায় যাও, ডাঙায় যাও, কায়ও নদীর কিনারাত থাকিবেন না, কায়ও থাকিবেন না

গজেন জিজ্ঞাসা করে, বান পাহাড়ত নামিবে কইসে, নাকি নামা ধরিসে, নকু? যেন নকু প্রাসঙ্গিক পাহাড় থেকে এইমাত্র নেমে এল, এরা তার কাছ থেকে প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ জেনে নিচ্ছে। কথাটার জবাব নকু চট করে দিতে পারে না। সে বাতাসের গর্জনের মধ্যে এক নিজস্ব নীরবতায় মনে আনবার চেষ্টা করে, এই একটু আগে রেডিওতে যা শুনেছে তার যথাযথ ভাষা।

মনত খায়নামা ধরিসেই বলিছে। নামা ধরিসে, শিবক পাহাড়ের রেল ব্রিজ বন্ধ করি দিয়া হইসে, হয়, হয়, নামা ধরিসে বলিছে, নামা ধরিসে, নামা ধরিসে। নকু পুনরাবৃত্তিতে নিজের কথার সত্য নিজেই পরীক্ষা করে যায়।

রাবণ উঁচু থেকে নীচে জিজ্ঞাসা করে, রাতত কি আবার নিউজ দিবা ধরিবে?

না দিবে। কহি দিছে–এইখানই শেষ নিউজ, এর বাদে আর কুনো নিউজ নাই, আর কহিসে সাইরেন বাজি দেয়া হইসে–

সাইরেন? বাজি দেয়া হইসে? শুনো নাই রো? কায় শুনিছেন? গজেন বলে ওঠে।

জগদীশ ধমকে ওঠে, চুপ যা বলদের দল, বাতাস কী সাইরেন বাজায়, শুনিস নাই? তর বিয়ার বাদে সানাই বাজাবার ধইরবে, শালো, নিজের আওয়াজ নিজে শোনন যায় না, সাইরেন শুনব? করবা কী তাড়াতাড়ি কও, তাড়াতাড়ি কও, জগদীশ চুপ করে গিয়ে আবার হঠাৎ কথা বলে ওঠে, হে-ই নকু, নকু, নকু কই রে? জগদীশ ছানিকা চোখ এলোমেলো বোলায়।

কহেন না, এইঠে আছি।

তর জেঠি রেডিওটা খুইল্যা রাইখল ত? বন্ধ কইর‍্যা থোয় নাই ত?

কহেন কী? এ্যালায় জেঠি গান শুনিবার বইসবে নাকি?

 চুপ যা শুয়ার। যদি আবার নিউজ দ্যায়।

 জয়হিন্দ কয়্যা দিছে, আবার নিউজ দেবে?

 জয়হিন্দ কয়্যা দিছে? তা হইলে, কী, হইব ডা কী, এই ন্যাতাই কেউ জবাব দেয় না।

জগদীশ আবার হাঁকড়ে ওঠে, এই ন্যাতাই, ন্যাতাই নাই এইখানে।

 নিতাই ধমকে ওঠে, আরে, চুপ যান তো দেখি, শুধু চিল্লাবার ধরেন। এই নরেশ, বাজে কয়ডা রে দেখ ত?

নরেশের টর্চের আলোয় এতগুলো লোকের শরীরের ওপর সময় ঝলকে ওঠে

এগারোটা বাইশ।

হে-এ, এককেরে বাইশ, শাপলা আকাশবাণী শিলিগুড়ির টাইম দিবার ধরসে, গজেন বলে।

 ত টাইম জিগাইলি, বেটাইম কব নাকি?

হে-ই, চুপ যা, চুপ যা–নিতাই এই ভিড়ের মাঝখানটাতে দাঁড়ায়। নিতাইয়ের চুলগুলো বাবরি। বাতাসে সব চুল তার মাথায় ওপরে উঠে আসে আর মাঝে-মধ্যেই ফণা তোলে। সেই চাপা আলোয় নিতাইয়ের মেদহীন শরীরের রেখাটা যেন খোদাই হয়ে যায়। এতক্ষণ এরা একসঙ্গে এখানে আছে–যেন দঙ্গলে ছিল সবাই। এতক্ষণ, এই বাতাস, এই বৃষ্টি, এই আলো তাদের ঢেকে রেখেছে। এখন কি স্পষ্ট হতে শুরু করল? নিতাই দুই হাত ওপরে তুলল, খাড়াও, এই তালই চিল্লাবেন না, শুনেন–

ভিড়টা একটু ঘন হয়।

নিতাই বলে; শুনেন, এখন বাজে রাত্তির সাড়ে এগার। ধরেন, তিস্তা বাজার থিক্যা এই খানত ফ্লাড আইসতে লাগে, কতক্ষণ, এই নরেইশ্যা, ছয় ঘণ্টা

হয়, ছয় ঘণ্টা

 তয় ত ধর কেনে, সাড়ে এগার সাড়ে

এগার ত এ্যাহেন বাজে, নিউজ হয়্যা গিছে সেই পনে এগারটায়।

 হয়, পনে এগারডায়।

 পনে এগারডায়? নিতাই জিজ্ঞাসা করে।

 হয়, পনে এগারডায়।

 তা হউক গ্যা, তর পনে এগারডাই হইল, তার সঙ্গে ছয় ঘণ্টা যোগ দেকয়ডা হয়? পনে এগারডা আর ছয় ঘণ্টা?

এ ধর কেনে এগারডা, হিশাবের সুবিধা তানে, গজেন বলে।

 শালো, তোর সুবিধার লাইগ্যা ফ্লাড লেট কইরা আইসবে–জগদীশ ধমকে ওঠে।

হেই তালই, আপনি কথা কহেন তয়, আমি চুপ যাই–, নিতাই ঠাণ্ডা গলায় জগদীশকে বলে।

ভুইল্যা গিছিলাম ন্যাতাই, তুই ক, তুই ক, এই শালো গজেনটা সব উল্টাপাল্টা কথা কয়-

– নিতাই আবার গলা তোলে, শুনেন, যে হিশাবই করেন, এইখানে ফ্লাড কাইল সকাল চাইড়ডার আগে আইসব না–

নিতাইয়ের এই হিশাবের একটা বড় তাৎপর্য আছে। সকাল চারটে মানে তারা আজ রাত্রির জন্যে নিরাপদ। এমন কি সকাল চারটোতও যদি চর ছেড়ে ডাঙায় চলে যাওয়ার দরকার হয়, তা হলে দিনের আলো ফুটে যাবে। নিতাই সকলের হয়ে মুখ ফুটে সময়টা বলেছে। এখন সবাই সময়টা খতিয়ে দেখছে। রাবণ কিছুক্ষণ পরে বলে ওঠে, কহিল যে আসামের রেলগাড়ি বন্ধ করি দিসে। স্যালায় ত ফ্লাড শিবক–তক আসি গেইসে

রাবণের কথার জবাবে নিতাই, বা অন্য কেউ, কিছু বলে না। তারা সবাই সঙ্গে সঙ্গে আর-একটা হিশাব করতে থাকে। ফ্লাডের ওয়ার্নিং দেয়ার উৎস–পাহাড়ের ভেতর, কালিম্পঙের পথে তিস্তারাজার বলে একটি জায়গা। সেখান থেকে জলের হিশেব পেলে, সেই অনুযায়ী আন্দাজ করা যায়–তিস্তাবাজার থেকে হলদিবাড়ির কাশিয়াবাড়ি পর্যন্ত তিস্তার বুকের ওপর দিয়ে প্রায় ষাট মাইল পথ আসতে জলের কতক্ষণ সময় লাগবে। শিবক ব্রিজ পর্যন্ত নদী নামে পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে। তিস্তাবাজার থেকে শিবক পর্যন্ত যত তাড়াতাড়ি নামবে, শিবক থেকে জলপাইগুড়ি তার চাইতে বেশি সময় লাগে–এই জায়গাটাতে তিস্তা শুধু সমতল তা-ই নয়, তিস্তার সেই ভূখণ্ড শুরু–তার নানা খাত, নানা পথ।

নরেশ বলে, এ্যাহন ত তাও সৰ্গলে জাইগ্যা আছে, রাত আড়াই তিনডায় যদি চর ছাইড়্যার লাগে ত অন্ধেকের বেশি ভাইস্যা যাবে নে

.

০৯২.

আটষট্টির বন্যার স্মৃতি

 নরেশ কথাটা যেন কাউকে শোনানোর জন্যে বলে না। কিন্তু এই বাতাসে তার স্বরে সেই নিভৃতি আর থাকে না, ভেঙে যায়। তার কথা শেষ হওয়ার পর তার কথার স্মৃতিতে সকলের মনে হতে থাকে, নরেশ যেন সবাইকে সাবধান করে দিচ্ছে। তারপরও, তাদের ওরকম চুপ করে থেকেই সেই সাবধান বাণীর অর্থ বুঝে নিতে হয়। সেই অন্ধকার শেষ রাতে জল চরে উঠতে শুরু করেছে। জলের সেই চেহারা দেখেই যে যার মত মুহূর্তে ঠিক করে ফেলবে-তখনই সব কিছু ফেলে পারের দিকে যেতে হবে। কেউ কারো সঙ্গে কথা পর্যন্ত বলতে পারবে না–সবাই মিলে জলপাইগুড়ি শহরের পারের দিকে ঝাঁপিয়ে পড়বে। কে পেছনে থাকল, কে পারল, কে পারল না, কে ভাসল, কে উঠল, সেসব হিশেব হবে পারে। ওঠার পর, খোঁজাখুঁজির পর, বাঁচার পর। একা-একা বাঁচার পর সবাই মিলে বাঁচা গেল কিনা সেই হিশাব হবে।

এখানে যারা আছে, তাদের প্রায় সবাই আটষট্টির বন্যায় তিস্তাকে দেখেছে। সবাই এখানেই ছিল, তা নয়। কিন্তু সকলেরই নিজের নিজের মত করে জানা আছে, কী করে বানভাসি মানুষের হিশেব বেরয়, কী ভাবে এক ধাক্কায় গোয়াল খালি হয়ে যায়, দিন পাঁচ-সাতের ভেতর ভরভরন্ত, ধানিজমি হাঁটুভর বালুয়ারি হয়ে যায় কী ভাবে। প্রত্যেকে একই পদ্ধতিতে হয়ত এই স্মৃতিচারণ করছিল না, কিন্তু সেই স্মৃতিই তাদের এই সব হিশেবনিকেশকে নিয়ন্ত্রণ করছিল। আগামী চার থেকে ছ ঘণ্টার হিশেবের সঙ্গে মিলে ছিল, প্রায় পনের-ষোল বছর আগের অভিজ্ঞতা।

কিন্তু পনের-ষোল বছর আগের অভিজ্ঞতা এখন এদের মধ্যে কতটা সক্রিয় থাকতে পারে। নিতাই-এর বয়স এখন কত হবে? ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ! তা হলে পনের বছর আগে তাকে থাকতে হয় পনের-বিশ বছরে। কিন্তু তখনই ত নিতাইকে দেখাত পঁচিশ-ছাব্বিশ বছরের। তা হলে, এখন কি নিতাইয়ের বয়স চল্লিশ হয়ে গেল? বা চল্লিশ পেরিয়ে গেল? জগদীশের বয়স কত? পনের-ষোল বছর আগেও জগদীশকে ত এখনকার মতই পঁয়তাল্লিশ-পঞ্চাশ লাগত। জগদীশের কি এখনই ষাট হল, না, তখনই তিরিশ ছিল।

ঠিক সেই মুহূর্তে তিস্তার ঐ চরে ঝঞ্জার ভেতরে বাতাসময় বৃষ্টিপাতে বিদ্ধ হতে হতে ঐ দঙ্গলবাধা মানুষগুলি এক অপরিবর্তিত ব্যক্তিগতে পৌঁছে গিয়েছিল। প্রত্যেকেই নিজের নিজের মত করে শেষ রাত্রির হিমেল জলের পাহাড়ভাঙা বন্যার ভেতর দিয়ে নিরাপত্তার খোঁজে সপরিবার ভাসছিল। সেই স্রোত হাতে কিছু রাখতে দেয় না। সেই স্রোতে শরীরের ভিতর থেকে শরীরটা বের করে আনে। সেই স্রোত শুধু অতলে টানে, শুধু অতলে। এখন সেই স্রোত রওনা হয়েছে ছ-ঘণ্টা দূরে, না চার-ঘণ্টা দূরে, কে জানে।

সেই মুহূর্তটিতে ওরা যেন এই নদীর ভেতরে চরের লোক আর থাকে না। নদীর ভিতরের এই চরে ওদের এমনই স্বাভাবিক বসবাস যে ওরা চরকে চর বলে মনে রাখে না, নদীকে নদী বলে চেনে না। ডাঙা দিয়ে হাঁটার মতই জল দিয়ে হেঁটে যায়। কিন্তু তখন ঐ বাতাসের মধ্যে ওরা ভয় পেয়ে যায়, নিজের নিজের মত করে গোপন, একান্ত ভয়, গভীর চাঁদনিতে কোনো অচেনা চরের বালুর ওপর দিয়ে মাইলের পর মাইল হেঁটে আসার সময় যেমন ভয় হয় পাশে কেউ হাঁটছে। এই চরটা জলপাইগুড়ি শহরের কাছে, রায়পুর চা বাগানের পাশে, তিস্তার রোড-ব্রিজ আর রেলব্রিজর উত্তরে। বাঁ দিকে দোমোহনি। এখান থেকে তিস্তা-ব্রিজের আলো, দেখা যাচ্ছে শুধু নয়, এতক্ষণ দেখে দেখে মনে হচ্ছে তারাও ঐ আলোর অন্তর্গত। নিরাপত্তা এত কাছে। ইলেকট্রিক আলল, বাঁধ, পাকা বাড়ি, লোহার ব্রিজ, কংক্রিটের ব্রিজ–এই সমস্ত মিলে এক নিরাপত্তা, তাদের ডাইনোয়ে, তাদের সামনে, এমনই প্রত্যক্ষ যে ছ-ঘণ্টা বা চার-ঘণ্টা পরে মরেও যেতে পারে এমন বাঁচতে এখন ভয় হচ্ছে।

জল বাড়ছে গত বুধবার থেকেই। বৃষ্টি শুরু হয়েছিল মঙ্গলবার রাত থেকে। কিন্তু মঙ্গলবার রাতের জলে ত আর এ নদীর জল বাড়বে না। বরং এ নদীর জল বাড়তে শুরু করেছিল এখানে বৃষ্টি থেমে যাবার পর। তখন বাতাস উঠেছে। এই টানা বাতাস। একেবারে যেন নদীর ভেতর থেকে জল নিয়ে এই বাতাস উঠে আসছে আর নদীর আকাশ জুড়ে সেই জলকণা ছিটিয়ে দিচ্ছে। বাতাসবাহিত জলকণায় আকাশমাটি জুড়ে এই জলকুয়াশা স্থির হয়ে আছে। বাতাস থাকলে ত হিমকুয়াশা মুহূর্তে কেটে যায়। কিন্তু এ জলকুয়াশা বাতাসের সঙ্গে-সঙ্গে বাড়ে, যত বাতাস তত ঘন হয়। বাইরে থেকে বা ওপর থেকে দেখলে এই চরটাকে আর আলাদা করে বোঝা যেত না, মনে হত, নদী-আকাশ জোড়া এই জলবাত্যায় চরটাকে নদীর মধ্যে টেনে নিয়েছে।

কিন্তু এত সত্ত্বেও এরা জল দেখে বুঝেছিল বিপদ নেই।

 বিপদের গন্ধ বাতাসে এল শুক্রবার, আজকের, সকাল থেকে, বা বেস্পতিবার, কাল শেষ রাত থেকে। সেও রেডিয়োর ফলে, আর, পারে গিয়ে নানা জন নানা খবর নিয়ে আসায়। পাহাড়ে তুমুল ধস নামছে, পাহাড় ভেঙে ঢল নামছে। বন্যা-ডিপার্টমেন্ট থেকে সিগন্যাল দেয়া শুরু হয়েছে।

এত সত্ত্বেও আজকের এই শুক্রবারের রাতটা, এখন, এই রাত প্রায় বারটায়, যে রকম বিপদসঙ্কুল হয়ে উঠল, তেমন না হতেও পারত। বাতাস কমে যেতে পারত। জল আর না বাড়তেও পারত। সেরকম একটা হিশেব ছিল বলেই আজ বিকেল পর্যন্ত সবাই দেখেছে। আর, দেখার পর আজ রাতে এরকম দল বেঁধে চর ঘুরতে বেরিয়েছে, নদীর জলের ধরন-ধারণ বুঝতে। তিস্তা ব্রিজের ওপর যদি রাত দশটাতেও আলো না দেখত, তা হলে হয়ত জলটল দেখে, সকাল নাগাদ আকাশ পরিষ্কার হয়ে যাবে এ রকম একটি আন্দাজ নিয়ে, যে যার মত ঘরে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ত। তার পর, সেই রাত আড়াইটে-তিনটের সময় ঘুমের ভেতর বন্যা ঢুকে যেত, সেই আটষট্টির মত। কিন্তু এখন, এখান থেকে সেই পনের-ষোল বছর আগের সময়টাকে যেন সহজ ঠেকে। যেন, তখন সেবন্যা তাও সামলানো, গেছে, এখন সেরকম বন্যা আর সামলানো যাবে না। তিস্তা ব্রিজের আলো থেকে রেডিওর সংবাদে জানা সিগন্যাল পর্যন্ত সেই বন্যা এত বেশি পূর্বজ্ঞাত হয়ে গেল যে চার বা ছ-ঘণ্টা পর গভীর ঘুম থেকে মুহূর্তে সম্পূর্ণ জাগরণে জেগে প্রায় অনিবারণীয় মৃত্যুর ভেতর থেকে বেঁচে ওঠার জন্যে প্রয়োজনীয় তড়িৎস্পর্শ শরীরের ভেতরে আর খেলে না। বরং তার বদলে ভয় ছড়িয়ে যায় সারা শরীরে। জানা গেল, অথচ, সেই জানা থেকে কোনো উপায় হাতে এল না–এমনি এক নিরুপায়ের ভেতরে সেই মধ্যরাত্রিতে ঝড় জলের মধ্যে ওরা দাঁড়িয়ে থাকে। যেন, এই খবর, এই খবর জানার আনুষঙ্গিক ছিল–অন্তত এমন কিছু নৌকো, যা সারারাত ধরে এই চরের মানুষের সংসারকে ডাঙায় নিয়ে গিয়ে তুলতে পারে। কিন্তু এত বড় চরে ত এখন নৌকো বলতে দু-তিনটে ভাঙা ডিঙি আর একটা খেয়া নৌকো। এই খেয়াতেই সারা দিন প্রধান স্রোতটা পেরনো হয়। তার পরে হেঁটে, সাঁতরে পারে ওঠা যায়।

তিস্তা ব্রিজে আলো জ্বলছে। তার মানে তিস্তা ব্রিজ রক্ষার কাজ শুরু হয়ে গেছে। আটষট্টির বন্যার সময় বন্যার খবরই পাওয়া যায় নি। আর এখন বন্যার খবর আসার পর সিগন্যাল দেওয়া ত হয়েইছে, সাইরেনও বোধহয় বেজে গেছে, এমন কি তিস্তা ব্রিজের আশেপাশে যাতে ভাঙন না ধরে তার জন্যে হয়ত গাড়ি গাড়ি বোন্ডার নিয়ে সারি সারি ট্রাকও দাঁড়িয়ে গেছে।

কিন্তু এখন এই দলের ভেতরে আটষট্টির বানভাসা এতগুলো লোক আটষট্টি থেকে পনের-ষোল বছর পরে বন্যার নিশ্চয়তা সম্পর্কে সম্পূর্ণ জ্ঞানটুকু নিয়ে একই উপায়হীনতায় অপেক্ষা করছে। আটষট্টিতে জ্ঞানই ছিল না, অপেক্ষাও ছিল না। তখন মনে হয়েছিল–আগে জানলে বাঁচা যেত। এখন, এত আগে জেনেও বাঁচার কোনো নিরাপত্তা, এরা, এই দলের এরা, নিজেদের ভেতর থেকে সংগ্রহ করতে পারে না।

.

০৯৩.

হিন্দি সিনেমার জোকার

বানার খবরের হিশাব ত ঐ তিস্তাবাজার থিক্যাই দেয়, ঐখান থিক্যাই ত সিগন্যাল দ্যায়, এর মইধ্যে আবার শিবক আইসল কবে থিক্যা? নরেশ বলে, এটা না বুঝেই সে-ই একটু আগে এর উল্টো কথাটা বলেছে।

শুইনলি কইছে আসামের গাড়ি বন্ধ কইরা দিছে, তা রেলগাড়ি কি তিস্তাবাজার দিয়া যায় নাকি? নিতাই ঠাণ্ডা গলাতেই বলে।

শুইনছে উপর থিক্যা বন্যা নামবার ধরছে, তাই বন্ধ কইরা দিছে, সে আবার কোন বছর দেয় না, জগদীশ বলে।

ঐ কথাখান ত এডিওত ভাল করি শনিবার নাগত, এলের ব্রিজত গাড়ি বন্ধ হইয়া গিছে নাকি আগতই বন্ধ করিছে রাবণ বলে।

এ্যাহন ত কথা ঝাড়ত্যাছ পুরুতের নাগান, তখন রেডিও শুইনতে গেলেই পারত্যা, রাবণের কথায় জগদীশ ঝাঁঝিয়ে উঠে রাবণের দিকে না তাকিয়েই জবাব দেয়। তাতে মনে হয় সে বোধহয় নরেশকেই বলে।

কহসেন কী আগরবাগর, বেলা আড়াইটার গাড়ি ত এই ব্রিজ দিয়া পার হইসে, গজেনের হঠাৎ মনে পড়ে যায় আর সে সবাইকে তাড়াতাড়ি মনে করিয়ে দেয়।

হ্যাঁ, কথাটা সকলের মনে পড়ে। মনে পড়ে, গোপনে, একান্তে। এটা এমন মনে পড়া নয় যা নিয়ে লাফালাফি ঝাপাঝাপি করতে হবে। গজেন ওটা খুব ভাল কাজ করেছে যে তার মনে পড়েছে, সে মনে পড়িয়ে দিয়েছে। এখন তারা এই ট্রেনের হিশেব থেকে পেছিয়ে-পেছিয়ে হিশেব কষতে থাকে, তাহলে নিশ্চয়ই এই শেষ সিগন্যালের পরে শিবকের রেলব্রিজ দিয়ে ট্রেন চলাচল বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। তার মানে কাল থেকে আর ট্রেন চলবে না। তার মানে, তাহলে সিগন্যালটা তিস্তাবাজার থেকেই এসেছে। এখানে সেই জল আসতে আসতে সেই সকাল হয়ে যাবে। তা হলে আজ রাত্রিতে আর চর ছেড়ে না গেলেও চলে।

নিতাই বলে, ট্রেন না হয় গিছে, কিন্তু সিগন্যাল দিল কুখন। স্থানীয় সংবাদ কেউ শুইনছে?

আমি ত শুনছি, বাজার দর শুনছি, না, তহন ত কিছু কয় নাই, না কয় নাই, জগদীশ তাড়াতাড়ি বলে। একটু চুপ করে থেকে নিতাই বলে, তালই, ভাল করি ভাইব্যা দ্যাখেন কয় নাই ত–

জগদীশ একটু চুপ করে থাকে। তার পক্ষে সেই সন্ধ্যার কথার স্মৃতি এই মধ্য রাতে খুঁচিয়ে তোলা খুব সহজ নয়। কিন্তু তবু সে একবার মনে করতে চেষ্টা করে যে কোন অবস্থায়, কী ভাবে সে খবরটা শুনছিল। বাজার দর শোনার সময় ত হাতের কাজ ফেলে কান খাড়া করল। কিন্তু দিন তিনেক ধরে এই বাতাসে আর জলের মধ্যে থেকেও কি জগদীশ বন্যার খবরটা শোনার জন্যে কান খাড়া করে থাকে নি? হঠাৎ মনে পড়ে যায় জগদীশের–না, কয় নাই, তোর কাকি জিগ্যাইল চিক্কর দিয়্যা, কী বানাটানার কাথা কিছু কইসে, আমি কইল্যাম, চিকুর দিয়্যা, না কয় নাই, কয় নাই, না, কয় মাই

তয় এতক্ষণ কী নিদ্রা গিছিলেন? নিতাই খেঁকিয়ে ওঠে, ধরো রাইত আটটার মইধ্যো সিগন্যাল দ্যায় নাই, সিগন্যাল দিছে তার বাদে, দশটাও যদি ধরো, রাত্তির চাইরড়ার আগে জল আইসবে না, আর ধরো, যদি একঘণ্টা আগেও ধরো, তা হলিও ত রাইত তিনড়ার আগে আইসবে না।

তা তিনটাত আসিলে করিবেনটা কী! স্যালায় যা আন্ধার হইবে, চান্দ ডুবি যাবে, রাবণ বলে।

আকাশের দিকে না তাকিয়ে তারা সেই ছায়াহীন মরা আলোতে চাঁদের হিবেশনিকেশ বুঝে নেয়। এখন শুক্লপক্ষ চলছে। চাঁদের আলো ঐ জলকুয়াশা ভেদ করে মাটিতে এসে পৌঁছচ্ছে না। তার ওপর আছে আকাশের মেঘ। আকাশের দিকে তাকিয়ে চাঁদটা কোথায়, তার হদিশও করা যায় না। শুধু চারদিকের এই আবছাভাবে বোঝা যায় কোথাও থেকে একটা আলো আসছে, নিশ্চিতই আসছে। রাত তিনটের সময় এই আলো থাকবে না। কিন্তু তখন যদি সকলে মিলে জিনিশপত্তর নিয়ে পারের দিকে যেতে হয়, তা হলে? চারটের সময়, চারটে কেন, পৌনে চারটের সময়ই এই সমস্যা আর থাকবে না। কিন্তু ফ্লাডের ঐ জল ত এক-ঘণ্টা পঁয়তাল্লিশ মিনিট দেরি করে আসবে না। তাহলে?

ঘুরে-ফিরে তারা আবার সেই একই সমস্যার সামনে এসে পড়ে। ট্রেন এই ব্রিজের ওপর দিয়ে শেষ কখন গেছে তা গজেনের মনে পড়া সত্ত্বেও বন্যা আসার সময় নির্ণয় করা যাচ্ছে না।

গজেন হঠাৎ বলে, হরে নিতাই, ফ্লাড চারিটায় আসিলে কি তোর হাতত পাখনা গজাবে, পাখির নাখান উড়ি যাবি, পারত?

কী হইছে ক না, শালা পালা গাবার ধরছে, নিতাই ধমকে ওঠে।

না, কহিবার ধইরছি কি, সকালেও ত যাবার নাগিবে, পারত, স্যাল্যায় ক্যানং যাবি?

সাঁতরি যাবে, দিনের আলোয় আবার কী, সব ত দেইখব্যার পাব।

হে-ই ধর সুখরঞ্জনের মাও, কানকাটুর মাও, আর তালইয়ের শাশুড়ি–সগায় সাঁতরি যাবার পারিবে? না, উমরাত বিসর্জন দিয়া যাম–, গজেন বেশ প্যাচানো যুক্তি পায়।

দে, দে, বিসর্জন দিয়া দে; ঐ বুড়িক নিব্যার জইন্যেই ফ্লাড আসিবার দে, এ্যাহন ঘাও দিয়্যা এ্যামন গন্ধ ছাড়ে যে ঘরে থাকন যায় না, জগদীশ বারুই হাত তুলে বলে। তার শাশুড়ি অসুখ নিয়ে এখানে মৃত্যু শয্যায়।

তা কইব্যার চাস কী, কয়্যা দে না, নিতাই ধমকে উঠেও যেন গজেনকে মিনতি করে। সমস্যার সমাধানটা এখনই দরকার।

এক কাম ধরো কেনে, সিগন্যাল য্যালায় দিবার ধইচছে, ফ্লাডের জল নামিবার ধইচছে, কী, কও, ধইচ্ছে কি ধরে নাই, গজেন প্রশ্নোত্তরে নিজের কথা গুছিয়ে নিতে চায়।

হয়, ধইচছে, ধইচছে, কেউ একজন সায় দেয়, নিম্ন স্বরেই, যেন জানাই আছে, এটুকু সায়েই গজেন কথাগুলো বলে যেতে পারবে। জগদীশ মাথা ঝাঁকায় সম্মতি জানিয়ে, এমনকি যেন গজেনের পরের কথাটাতেও সে আগাম সম্মতি জানাচ্ছে।

সেই তোমার রাইত তিন ঘড়িত আসুক আর ধরো কেনে কালি সকালত আসুক?

গজেন আবার প্রশ্ন করে।

হয়, আসুক, সেই প্রায় শোনা যায় না গলায় আবার ধুয়ো ওঠে। জগদীশ মাথা নাড়ে।

পাহাড়ঠে যে ফ্লাড নামিবার ধইচছে, স্যালায় ত আর হারি যাবার না পারে?

 না পারে

 এইঠেই নামিবার নাগিবে, এই ঠেই, এই তোমার চরত আসি ধাক্কা মারিবেই।

মারিবেই

স্যালায় হামাক এসকু (রেসকিউ) হবা নাগিবে?

 নাগিবে

ও এসকু হবার তানে কী নাগিবে? নৌকা নাগিবে।

নাগিবে

নৌকা ত নাই রো—

 নাই রো।

এক আছে রংধামালির হাটের ভাঙা নৌকাখান–সেইটা কুনো কাজে লাগিবার না হয়।

না হয়

হামরালা যেইলা এসকু হয়্যা যাম তার পাছত মিলিটারির নৌকা নামিবে।

নামিবে

 এ্যালায় এসখু আছে, নৌকা নাই।

 নাই

স্যালায় নৌকা আছে, এসকু নাই।

নাই

নিতাই দু হাতে তার পাশের লোকজনকে একটু সরিয়ে দিয়ে নিজে দুই পা পেছিয়ে যায়। তারপর গজেনের পেছনে এমন জোরে লাথি কষায় যে গজেন উল্টো দিকে রাবণের গায়ে হুমড়ি খেয়ে পড়তে যায়। রাবণ সরে যেতেই সে ভেজা বালির মধ্যে গিয়ে পড়ে। নিতাই তার দিকে আবার ধেয়ে যায়, শালা, হিন্দি সিনেমা দেইখ্যা দেইখ্যা জোকার করা শিখছে; তর কথা কওয়ার নাম নাই; এইডা হয়, না হয়, এইডা না হয়, হয়। কিন্তু নিতাই ধেয়েই যায়, আর মারে না। ততক্ষণে গজেন সোজা হয়ে গেছে, উঠে দাঁড়াতে পারে নি। এক হাতের কনুইয়ে মাটির ওপর ভর রেখে আর-এক হাত তুলে, গজেন বলে, ছাড়ি দে, ছাড়ি দে, কহিছু, কহিছু এ্যালায় ভেলা বানাবার ধরি চল দুই চারিখান।

গজেনের কথায় নিতাই সোজা হয়ে জিজ্ঞাসা করে, আর?

গজেন এবার উঠে বসার সুযোগ পায়, আর কহিছু দুই-চারখান পাট প্যাচি মশাল বানি রাখ কেনে, যদি কামত নাগে।

সমস্যার এমন সহজ সমাধানে নিতাই চিৎকার করে ওঠে, ত, উঠ কেনে।

.

০৯৪.

বালিয়াড়ির মাথায় কে?

এতক্ষণ এত আলাপ আলোচনা যেন হয়ই নি এমনভাবে নিতাই রওনা দেয়, যেন বহু আগে থেকেই ঠিক করা আছে যে আজ রাত্রিতে ভেলা বানানো হবে। নিতাই দু-এক পা হাঁটতেই বাকি সবাই তার পিছন পিছন-পিছন চলতে শুরু করে।

সবাই মিলে কথাবার্তা যতক্ষণ চলছিল, ততক্ষণ যেন বাতাসটা আড়ালে-আবডালে ছিল। বা, এরা গোল হয়ে দাঁড়িয়ে বাতাসটাকে এক রকম রুখে রেখেছিল, নিজেদের ভেতর কথাবার্তা সারার জন্যে। কথাবার্তার সময় তারা নিজেদের মাথা এত নাবিয়ে আনে, ঝুঁকিয়ে আনে, যে মাথার ওপর আকাশটাও যেন আকাশের মত ওপরে উঠে যেতে পারে। প্রলয়ের ভেতর আত্মরক্ষার চেষ্টায় যে এক ধরনের বিচ্ছিন্ন প্রকার নিজের চারপাশে তৈরি করে নেয়া যায়, সেই রকম অস্থায়ী প্রাকার নিজেরাই ভেঙে ফেলে এরা হাঁটতে শুরু করলে তিস্তা থেকে আকাশ জোড়া জলকুয়াশা আর বাতাস মুহূর্তের মধ্যে এদের ঘিরে ধরে, এদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। দু-চার পা যেতেই মনে হয় যেন এরা এতক্ষণ অন্য ভূমণ্ডলে ছিল, এখন এইমাত্র এখানে পা ফেলেছে। আকাশ একেবারে মাথার ওপর নেমে আসে। দুই হাতে সেই আকাশ সরিয়ে সরিয়ে ওদের পথ করে নিতে হয়। কিন্তু বাতাসের ধাক্কায় আবার পেছিয়ে আসতে হয়, বা দাঁড়িয়ে পড়তে হয়। বাতাস যেন এতক্ষণে এতগুলো মানবশরীর পেয়ে এই শরীরগুলোর ওপরই ঝাঁপিয়ে পড়েছে। এই শরীরগুলোর প্রত্যেকটিকে ঘিরে যেন আলাদা-আলাদা ঘূর্ণি, চলমান। এদের চলার সঙ্গে সঙ্গে ঘূর্ণিগুলিও চলছে। এই শরীরগুলোকে বাদ দিয়ে বাতাসের আর কোনো অবলম্বন নেই যেন এখানে।

সত্যি করে নেইও। মাইল চারেক লম্বা আর মাইল তিন চওড়া এই চরের এই দক্ষিণ সীমা ঢালু হয়ে নদীতে মিশেছে। এই জায়গাটা বালুবাড়ি মাঝখানের উঁচু ডাঙা থেকে গড়িয়ে-গড়িয়ে জলে নেমেছে। এমন হতে পারে যে এখান দিয়েই চরটা প্রথম নদীর ভেতর থেকে সিঁড়ি বেয়ে ধীরে ধীরে উঠে এসেছে। সঙ্গে নিয়ে এসেছিল নদীর ভেতরের বালি, পাথর। তারপর, এখানে বসতি হল, চাষ হল কিন্তু এর বালি আর ঘোচে নি।

ওরা এখানে এসেছিল পশ্চিম পারের রাস্তা দিয়ে হেঁটে হেঁটে। এখন ওদের ফিরতে হচ্ছে পুবদিক বরাবর হেঁটে। ফিরতে হচ্ছে, প্রথমত, বাতাসের বাধা সঙ্গে নিয়ে। দ্বিতীয়ত, পায়ের তলায় ভেজা বালিতে পা গেড়ে যাচ্ছে ও তোলার সময় পিছলেও যাচ্ছে। তৃতীয়ত, এই জায়গাটা একটু চড়াই–সেই চড়াইটাই ওদের ঠেলতে হচ্ছে।

নিতাই হঠাৎ ঘুরে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলে, নরেশুয়া আর নকু তোরা টর্চ হাতে এইঠে থাকি যা। কিছু দেইখলে দৌড় পাড়া খবর দিবি।

এইঠে দৌড়াবে ক্যানং করি গজেন চিৎকার করে হাসে, জল..দিয়া যাস কেনে, সাঁতরিয়া।

 নরেশ আর নকু পেছনে দাঁড়িয়ে যায়, তারপরে ফিরতে শুরু করে।

একটু দূর থেকে বা ওপর থেকে যদি এই কজনকে দেখা যেত তা হলে তেমন দৃশ্যঅভিজ্ঞ কারো মনে হতে পারত, বালিরই কতকগুলি স্তম্ভ বাতাসের টানে এগিয়ে চলেছে। জলকুয়াশার অস্পষ্টতা আর বালির অস্পষ্টতা মিলে একাকার হয়ে গিয়েছে এমন, সমস্ত দৃশ্যটাকেই একটা মাত্র দৃশ্য মনে হয়। কিন্তু পায়ে-পায়ে সেই দৃশ্যের বৈচিত্র্য টের পাওয়া যাচ্ছিল, বাতাসের ধাক্কায় অন্ধের মত পথ চলতে চলতেও।

কারণ, বৃষ্টিতে সমস্ত বালি ভিজে যাওয়ার আগেই বাতাসে বাতাসে এই বালির ভূগোল পরিবর্তমান থেকেছে। জলের তল থেকে শুশুকের মত উঠে আসা কোনো বাতাসে নীচের থেকে বালি আকাশে উঠে ঝুরঝুর করে জমা হয়ে গেছে একটু ওপরে বা আকাশের ভেতর থেকে চিলের মত নেমে আসা কোনো বাতাসে ওপরের কোনো স্কুপের মাথা ঝুরঝুর করে ভেঙে ছড়িয়ে গেছে। চারদিকে বালির ডাঙার মাঝখানে একটুখানি কালো জল টলটল করত-বাচ্চারা সাঁতার কাটতে পারে এ রকমই জল-এই ক-দিনের বাতাসে সে পুকুর ভরে গেছে, আর ফলে, জায়গাটিই হয়ে গেছে ফুটবল মাঠের মতন সমান। এই পরিবর্তনের পর বৃষ্টি নেমে তাকে পরবর্তী কয়েক দিনের রো পর্যন্ত একটা স্থায়িত্ব দেয়।

ফলে, এরা যেন এদের পায়ের পক্ষে অপরিচিত এক ভূখণ্ড দিয়ে হাঁটছিল। সাধারণভাবে, ত এদের প্রায় চোখ বুজে চলে যাওয়া উচিত, এই চরের প্রতিটি অংশ পায়ের তলায় তলায় এমনই চেনা। কিন্তু গত মাত্র দু-তিন দিনে একেবারে পারের এই বালুবাড়ি এমন অচেনা হয়ে গেছে যে যদি বাতাস না থাকত, যদি আলো এমন ছায়াহীন ধূসর না হত, তা হলেও ওদের পক্ষে সোজা হেঁটে যাওয়া সম্ভর হত না।

কে, বোঝা যায় না, কিন্তু, একজন ওদের চাইতে একটু বেশি লম্বা হয়ে যায়। পেছনের সবাই দেখতে পায় সে ধীরে ধীরে উঁচুতে উঠছে। আর, একটু উঁচুতে উঠেছে বলেই হয়ত বাতাস থেকে মুখটা একটু সরাতে পেরেছে। বালিয়াড়ির চড়াই ওভাবে ভাঙায় নীচ থেকে মনে হচ্ছে যেন পুরো বালিয়াড়িটাই যেন হাঁটছে। ধূসরতায় বালি আর মানুষ একে হয়ে গেছে। শুধু মানুষের মাথার চুল, তার পদক্ষেপের ভঙ্গি, তার শরীরের বিন্যাস বুঝিয়ে দেয় ওখানে একটা শারীরিক আলোড়ন আছে, বাধার সামনে মানুষের শরীরের আলোড়ন।

ঐ বালিয়াড়িতে যে উঠেছিল, সে টের না পেয়ে উঠেছে। সব জায়গাতেই ত বাতাস ধাক্কা দিচ্ছে, সব জায়গাতেই ত পা ডুবে যাচ্ছে। সামনের পায়ের ওপর ভর দিয়ে পেছনের পা তুলতে গেলে, সামনের পা ডুবে যাচ্ছে। পায়ের বাটিতে টান লাগছে। দুই পায়ের সমতা ঠিক রাখতে না পেরে টলে যেতে হচ্ছে। আর টলে যাওয়ার ফলে দিক বদলে যাচ্ছে। এরকমভাবে এই আচ্ছন্নতার ভিতর পথ চলতে গেলে  কারো কী আর পায়ে-পায়ে টের পাওয়ার কথা যে সে চড়াইয়ে উঠছে, তাও আবার বালিয়াড়ির চড়াইয়ের মত পিচ্ছিল চড়াইয়ে? সে টের পায় না। তাকে ঐ পুরো চড়াইটা ভাঙতেই হয়। কিন্তু, নীচে যারা ছিল তারা ত চলমান ঐ বালিয়াড়ি দেখে বুঝতে পারে কেউ একজন বালিয়াড়ি ভাঙছে, ওখানে বালিয়াড়ি আছে। সুতরাং তারা বায়ে ঘুরে যেতে চেষ্টা করে–যতটা বায়ে ঘোরা সম্ভব, যতটা চেষ্টা করা সম্ভব। বায়ে ঘুরতে গিয়ে আর-একটা চড়াই ওরা ডিঙবে কী না সে বিষয়েও নিশ্চয়তা। নেই। কিন্তু সামনে একজন বালিয়াড়ির মাঝখান থেকে যখন জানান দেয় যে ওখানে বালিয়াড়ির চড়াই, তখন আর-সবাইকে একটু ডাইনে বায়ে সরে যেতেই হয়–বালিয়াড়ি না ডিঙিয়ে শুধু বালিয়াড়িটাকে ঘের দিয়ে ঘুরলেই ওপারে যাওয়া যাবে। ডানদিকে যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না–বাতাস ওদিক থেকেই আসছে। বরং বাঁয়ে ঘুরে গেলে ঐ বালিয়াড়িতেই বাতাস থেকে একটু বাঁচা যাবে। একটু হলেও সে ত। সঁচাই।

যে চরটাকে নিজেরা হাসিল করে আবাদের জায়গা বানিয়েছে, বসবাসের জায়গা বানিয়েছে, সেই জায়গাটা দিয়ে এমন অন্ধের মত হাঁটায় একটা পরাজয় আছে। সেই পরাজয় মানতে-মানতে ওদের হাঁটতে হয়। বাতাসের ধাক্কায় নিজেদের চলার গতির আন্দাজ মেলে না–কতক্ষণে কতটা পৌঁছানো। যায়, বোঝা যায় না। বালির পেছুটানে নিজেদের হাঁটার গতির আন্দাজ মেলে না–কতটা হাঁটলে কতটা পৌঁছানো যায় টের পাওয়া যায় না। জলকুয়াশা-দৃষ্টির গতির আন্দাজ মেলে না–কতটা এল আর কতটা যেতে হবে হিশেব পাওয়া যায় না।

যারা নীচে ছিল তাদের ভিতর একজন চিৎকার করে, সগায় মিলি ফিরিবার ধইচছি, এ্যালায় ঐটা কুনটা আকাশত উঠিবার ধরিছেন হে?

স্বরে চেনা যায়, কথাটা রাবণের। কোনো জিজ্ঞাস নেই–কেবল মন্তব্য, একজন আকাশে উঠে যাচ্ছে।

আকাশখান এইঠে বালিত মিশি আছে, কায় জানে? কথাটা নিতাইয়ের, বালিয়াড়ির মাথা থেকে।

ঐঠেও কি বানা আছে হে? রাবণ রসিকতা করে।

বালিয়াড়ির মাথায় নিতাইয়েরও হাসি শোনা যায়–এইহানে ব্রিজের নাগাল লাইট জ্বলিছেন।

দেইখ্যা লাভটা কী হবে হে? এতক্ষণ ত গাড়ি-গাড়ি আলো দেইখলেন না? গজেন বলে। মনে হয়, নিতাই আরো এক ধাপ উঠেছে। এখন যদি বালিয়াড়ি ভেঙে ওখান থেকে পড়ে যায়, নিতাইকে তাহলে আর পুরোটা ঠেলতে হয় না।

রাবণ বালিয়াড়ির ভিত দিয়ে একটু ঘুরতে পারে।

সেখান থেকে মাথা উঁচু করে বলে, ঐ আলো দেখি ত জানলু বানা আসিবার ধইচছে, নয় ত নিন্দির মাঝত বানভাসি হবার ধইরত রাবণ বোধহয় বালিয়াড়ির একটু আড়াল পায়, তার কথাগুলো স্পষ্ট শোনা যায়।

তা ঠিক, ঠিক, ঠিক কথা, জগদীশ বারুইয়ের ছানিচোখের অবলম্বনহীনতা তার স্বরে শোনা যায়। কিন্তু বোঝা যায় না, আরো যে কজন বালিয়াড়ির ভিত ধরে এগচ্ছে তার ভেতর কোনটা জগদীশ।

সগায় ত জানে হামরালা এইঠে আছি, নৌকা আসতি পারে, গজেন বলে।

কেউ জবাব দেয় না বলে সে আরো যোগ করে, মিলিটারি নামিবার পারে, নৌকা আসিবার পারে, রিসকু করিবার তানে।

রিসকু আসিলে কি ফিরি যাবে না ডাকি-ডাকি তুলিবার ধইরেব? রাবণ বলে।

ক্যানং করি মিলিটারি মানষি বুঝিবার পারে এ্যানং বালুবাড়ি আর ধান্ধিনা পাথারের পাছত একখান চর আছে।

.

মিলিটারির নৌকা ত ভটভটি নৌকা, শুইন্যা ঘর থিক্যা আসা যায়, নিতাই বলে।

 ভটভটি নৌকা চলব্যার পারে না, কাদা টুইক্যা যায়, জগদীশ হে হে করে আনন্দ জানায় হঠাৎ, যেন, এই জলে মোটরবোট না-চলায় তার কোনো আনন্দের ব্যাপার আছে। নিতাই বালিয়াড়ির মাথার ভেতরে হঠাৎ ডুবে যায়। তাকে আর দেখা যায় না। তারপর সম্পূর্ণ নৈঃশব্দ্যে সেই বালিয়াড়ির মাথা থেকে বালির ভেতর ডুবে তল দিয়ে বেরিয়ে আসে। নিতাই যখন দাঁড়ায় তখন তার ভেজা শরীরের মাথা থেকে পা পর্যন্ত ভেজা বালি সেঁটে যায়।

শালা, নিতাই উঠে দাঁড়িয়ে দুই হাত ঘষে রালি ঝাড়ে, তারপর দু চোখের পাতা থেকে বালি ঝরিয়ে দেয়।

বালিয়াড়ি ঘিরে সামনে দুজন এসে গেছে। নিতাই বলে, শালা, সিধ্যা হাঁটতে হাঁটতে উঠছি বালুবাড়ির মাথায়।

নিতাই আবার হাঁটতে শুরু করে।

.

০৯৫.

বানা, জাগরণ ও ঘুম

হেই, দেখ কেনে, জগদীশ আবার তিস্তার ভিতরত সিন্ধি না যায়, রাবণ এগিয়ে যেতে-যেতে ঘাড় ঘুরিয়ে বলে।

তুই চল না, শালো, পাহাড়ের নাগাল কুয়াশা নাড়ি-নাড়ি চইলব্যার লাগছে, রাবণের ঠিক পেছনেই জগদীশ ছিল, এটা রাবণ বুঝতে পারে নি।

বালিয়াড়িটা পার হতেই এদের একটা লাইন হয়ে যায়। পায়ে আলের মাটি পাওয়া মাত্র পায়ের আঙুলগুলো মাটি আঁকড়ে ধরতে পারে, চেনা মাটি আঁকড়ে ধরতে পারে যেমন অভ্যস্ত আঙুল। এই সব আলে ওদের পায়ের চিহ্নগুলো থেকে গেছে। নিজেদের সেই প্রাচীন পদচিহ্নের ওপর ওরা পা ফেলে, আন্দাজে কুয়াশায়। এই কুয়াশায় পায়ের মাটি স্পষ্ট দেখা যায় না। কিন্তু পা দিয়ে মাটি অনুভব করা যায়। চরের উঁচু ডাঙা শুরু হয়ে গেছে। এখন সামনে ধানি জমি। তাতে অশ্বিনী রায় ভাদই পাকাচ্ছে বিঘা পাঁচ জমিতে। এবারের ফলন খুব ভাল ছিল। আজ শেষ রাত্রে পাকা ধান জলে ভাসবে।

অশ্বিনী রায়ের খেতের আগেই সরু-সরু ফালিতে সিঁড়ির মত উঠে গেছে নতুন চাষের ধান। এখন ধান গাছগুলো তলার জমি থেকে আল পর্যন্ত ওঠে নি। বাতাসে গত তিন দিন ধরে জলের মত উথালপাতাল খাচ্ছে। আর জলকুয়াশার ভারে নেতিয়ে প্রায় মাটির সঙ্গে মিশে আছে। এই বাতাস আর বৃষ্টি দুটোই এই ধানের পক্ষে ভাল। যদি এরকমই চলে আরও দু-একদিন তাও মন্দ না। তারপর এক বেলা রোদ পেলেই মাটিতে শোয়া ধানখেত চাঙা হয়ে আকাশে, নীল আকাশের তলায় মাথা তুলবে অন্তত বিঘৎখানেকের কাছাকাছি লম্বা হয়ে। ধানখেতের এই লম্বা হওয়াটা বোঝা যায়, এরকম টানা বাতাসজলের পর ত আরও বোঝা যায়। বাচ্চারা যেমন হাত-পা ছাড় দিলে কেমন লম্বা আর রোগা হয়ে যায়, ধানখেতটাকেও সেরকম লাগে। এরপর যখন টানে নুয়ে যাবে তখন মোটা লাগবে। কিন্তু এই ধানখেতগুলো আর লম্বাও হবে না, মোটাও হবে না। আজ শেষ রাতে কাঁচা খেত ভাসবে।

এদিক থেকে প্রথম পড়বে–দুই নম্বর মিস্ত্রিপাড়া। এখান থেকেই চরের বসতি শুরু। মাঝখান দিয়ে রাস্তা আর দুই পাশে খেত। সেই বসতের পেছনে আবাদ। মনে-মনে ভাবলে পাহাড়ের মত লাগে। নীচের ধাপে বালুবাড়ি, পরের ধাপে খেত, মাথার ধাপে বসত। কিন্তু তাই যদি হত, পাহাড়ের মত উঁচুই যদি হত তাহলে ত নিজেদের বাড়িতে বসে বসে পাকা ধান, কাঁচা খেত সব জায়গায় জলঢোকা, বানভাসা দেখতে পারত। কিন্তু তিস্তার বন্যার কাছে এ উঁচুনিচুটা কোনো ব্যাপার নয়।

মিস্ত্রিপাড়ায় ঢুকে কিছুটা এগলেই কুয়াশা হালকা। দুই দিকে বাড়িঘর থাকায় বাতাস আর কুয়াশা ভেতরে ঢুকতে পারে না। কিন্তু বাড়ি ঘরের ওপরে ত জলকুয়াশা লেগেই আছে। আকাশের আলোত আর সে-সব ভেদ করে নীচে নামতে পারে না। তবু, মিস্ত্রিপাড়ার ভেতরে খানিকটা এগিয়ে ঐ মধ্যরাত্রিতে ওরা যেন পরস্পরকে দেখতে পায়, প্রায় ভোরের আলোতেই। নিতাই দাঁড়ায়। নিতাইয়ের মালকোচামারা কাপড় তার ঊরুতে সেঁটে আছে, তার শরীরের জল আর বালি কেমন চমকায়। নিতাই তার বাবরি চুলের গোছা সামনে আনে, তারপর এক ঝটকায় পেছনে ঠেলে দেয়। চুলের বালি আর জল ঝেড়ে ফেলে। রাবণ দাঁড়ায়। রাবণ সবচেয়ে বয়স্ক, সবচেয়ে লম্বা। তার মাথায় চুল নেই, একেবারে গোড়া হাঁটা। তাকে ঐ আবছায়ায় গাছের মত লাগে। তার লম্বা শরীরের অতটা দৈর্ঘ্য, জুড়ে জলবিন্দু চমকে ওঠে–তার পরনে শুধু একটা নেংটি। পা থেকে মাথা পর্যন্ত রাবণকে মনে হয় ঐ জলে প্রতিবিম্বিত আলো দিয়েই আবছায়া তৈরি সে তার দুই চওড়া হাতে, মুখের, গায়ের ও হাতের প্রতিবিম্ব মুছে ফেলে।

জগদীশ সবচেয়ে খাটো যে সেটা বোঝা যায় রাবণের পরে সে আর গজেন পর পর দাঁড়িয়ে গেলে। তার ধুতি, কোমরে খুঁট দিয়ে পরা, আবার খানিকটা গোটানো। তার ওপর কোমর থেকে মাথা পর্যন্ত অংশটা থাকে-থাকে বসানো। বড় মাথা ছোট ঘাড়ের ওপর যেন আলগা করে রাখা আর সেই মাথার জায়গা করে দিতেই ঘাড় দুটো দু পাশে উঁচু হয়ে আছে, যেন হালবওয়ার মত উঁচু। জলবিন্দু সেই সব। উঁচুনিচু জায়গা, চওড়া বুক, বুকের খাজ, ছোট মেদহীন পেট ভরে রেখেছে। জগদীশের শরীরের সবটা এই অস্পষ্টতায় দেখা যায় না কিন্তু জলে আলোর আবছায়া প্রতিফলনেও বোঝা যায়, তার শরীরের দৈর্ঘ্যের অভাব, প্রস্থে সামলানো হয়েছে-পেশিবহুল প্রস্থে। জগদীশ খুট থেকে অনেকখানি কাপড় বের করে, ভেতরে গোঁজা ছিল। সেই শুকনো কাপড়ে সে মাথা, ঘাড়, মুখ মোছে, দুই হাতে। তার মুখ দিয়ে একটু তৃপ্তিরও আওয়াজ হয়, যেন, এইমাত্র স্নান সেরে উঠল।

গজেন দাঁড়িয়ে পড়ে এক পায়ের ওপর ভর দিয়ে, যেন ঐ ছোটখাট পাতলা শরীরের ওজন একটি পায়ের পক্ষেও যথেষ্ট নয়। সে এমন ভাবে দাঁড়ায় যেন এতটা রাস্তা বাতাস ঠেলে, বালি ঠেলে, আসে নি, যেন এই রাস্তাটুকু আসতে তার সারা শরীরের পেশিগুলো যদিও দলিত হয়েছে–সে আরো এমন অনেকখানি রাস্তা যেতে পারে। গজেনের মাথা থেকে পা খালি, শুধু মাঝখানে একটুখানি নেংটি। সে তার শরীরের কোনো জলকণা মোছে না, যেন ওগুলো জলকণা নয়, তার শরীরের ভেতর থেকে বেরিয়েছে। সেই জলকণার আবছায়া প্রতিফলনে গজেন নিজের শরীরকে নিজের শরীরে খোদাই করে দাঁড়িয়েছিল–তার কিশোরের মত শরীরকে খোদাই করে।

হগলরে আইসতে কবা, না, চিল্ল্যায়্যা কয়া দিবা? নিতাই জিজ্ঞাসা করে।

গজেন হেসে ওঠে, নিতাইচন্দ্র সরকার এ্যালায় ভাষণ দিবার ধইরবেন। আপনারা দলে দলে যোগদান দ্যান।

গজেন একটু জোরেই কথা বলে ওঠে। পাশের বাড়ির ভেতর থেকে নিদ্রা ও শ্লেম্মাজড়িত গলা শোনা যায়, কে রে? কে?

জগদীশ চিৎকার করে বলে, শালো, উইঠ্যা দ্যাখ তোর বাপ আইসছে, মানষির আওয়াজ পায়্যাও উঠার নাম নাই। বাড়িটা রমণী সরকারের।

রাস্তার ওপর থেকে আওয়াজে বোঝা যায়, ভেতরে রমণী সরকার উঠছে।

রাবণ বলে, হ্যালায় কি হামরালার মাইয়্যার বিয়া বইচছে–সাগাই কুটুমক নেমন্তন দিবার ধইচছি? রমণীর ত উঠিবার মাগিবে আধাঘণ্টা, তারপর বিড়ি ধরিবে তারপর লণ্ঠন জ্বালিবে, তারপর ঘর খুলিবে, চিল্লি কহি দেন না কেনে–

নিতাই চিৎকার করে, হে-এ কাহা, লাল সিগন্যাল দিয়া দিছে, শেষ রাতত বানা আসিবে; ভেলা বানি রাখো, হামরালা হরিসভাত আছি, এই চলো কেনে।

ওরা আবার রওনা হতেই ঘরের ভেতর থেকে রমণী চিৎকার করে ওঠে, এই খাড়া, খাড়া।

 গজেন পেছন থেকে ঘাড় ঘুরিয়ে বলে, আর খাড়াবেন কায়, তোমরালা আইস।

 রাবণ বলে, এই তোমার লাল সিগন্যাল, মানষিলা সগায় ঘুমাছে।

জগদীশ হ্যাঁ হ্যাঁ করে হেসে বলে, হালা সম্বন্ধীর বাপরা বুঝবেনে যখন ঘুমের মইধ্যে ফ্লাড ঢইকবে, বলেও জগদীশ হ্যা হ্যাঁ করে হাসে, যেন সে একটা মজা দেখার অপেক্ষায় আছে।

জগদীশকে বেশ ব্যস্ত দেখায়। নদীর পাড়ে তাকে অস্থির লাগছিল, যা হওয়া উচিত তা যেন হচ্ছে না। কিন্তু যখনই জানা গেছে লাল সিগন্যাল পড়ে গেছে, পাহাড় থেকে বন্যা নামছে, শেষ রাতে বন্যা এখানে পৌঁছে যাবে, তার জন্যে এখন থেকে ভেলা তৈরি করতে হবে–তখনই জগদীশ স্থির হয়ে গেছে। সেই স্থিরতায় সে তাদের মধ্যে বয়সে সবচেয়ে বড় হয়েও, প্রায় কিশোরের মত উৎসাহে টগবগ করছে। শেষ রাতে ঘুমের ভেতর তিস্তার মাঝখানে জেগে উঠে রমণীর কী হবে, তা ভেবে সে আপন মনেই খ্যাক খ্যাক করে হাসে। হাসে আর দৌড়ে-দৌড়ে ঘটে। তাকে দৌড়ে-দৌড়েই ঘটতে হয়, কারণ, নিতাই আর রাবণ লম্বা-লম্বা পায়ে এগিয়ে যাচ্ছে।

মিস্ত্রিপাড়াটা মূল বসতি এলাকার বাইরে। ধানি জমির মাঝখানে এই একটা পাড়া, তারপর আবার অনেকখানি ধানি খেত, তার শেষে আবার নাউয়াপাড়া। এখান থেকে বসতি জমাট। মিস্ত্রিপাড়া থেকে নাউয়াপাড়ার মাঝখানে দুপাশে ধানখেত, তারপরে এক বিরাট বাশবনের মধ্যে দিয়ে রাস্তাটা, এই রাস্তাটা, সমকাণে পশ্চিমে বেঁকে গেছে। এর পর থেকে নাউয়াপাড়া। নাউয়াপাড়ার পরে ছোট এক খাল, তিস্তার পুরনো বেনো জল আটকে গেছে, এখন জল সবুজ। সেই খালের ওপারে মাহিন্দরপাড়া, তার ডান পাশে আবার একটা বাশঝাড়। তার পরে সরকারপাড়া দুই নম্বর। এই ভাবে ধীরে-ধীরে চর যেন আর চর থাকে নি, হয়ে উঠেছে ভরভরন্ত গ্রাম, কাল শক্ত মাটির গ্রাম, বড়-বড় গাছের আড়ালে ছায়ার নীচে প্রবীণ সব গ্রাম। সে গ্রামের ভেতর ঢুকে কারো মনে হবে না আর-মাত্র ঘণ্টা দুই-তিন পরে এই সমস্ত কিছুর ওপর দিয়ে তিস্তার ঘোলা জল তীব্র আবর্তে বয়ে যাবে আর এই গ্রামের কিছু চিহ্ন সেই জলের ওপরে নিশানা দেবে। বাতাস এখানে কম ছিল, কিন্তু তাতে বাশবনের প্রায় মাটির কাছাকাছি নেমে এসে ছিলাছেঁড়া ধনুকের মত উঠে যাওয়া ঠেকে না। বাশপাতাগুলো এই বাতাসে এত আওয়াজ করে যেন মনে হয় আড়ালে কোথাও জলের স্রোত বইছে। বাশগুলো হেঁচকি তোলার মত মুচড়ে ওঠে–সে আওয়াজ চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে।

নাউয়াপাড়ার বাক নিয়েই ওরা দেখে এক হ্যাজাক জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে দীননাথের মুদিখানায় আর তার সামনের মাঠটুকুতে মরা মানুষের মত ফেলা কলাগাছের ধড়। একপাশে পাতার প। আলোতে অন্তত জনা ছয়-সাত কাজ করতে লেগে গেছে। দূর থেকে দেখে নিতাই বলে, আরে এগুলাও রেডিওর খবর পাইয়া গিছে, যাউক বাঁচাইল, হে-এ অমূল্যা।

ওদের হাঁক শুনে সবাই এদিকে তাকায়। কিন্তু কেউই কিছু দেখতে পায় না, আরো ওদের মুখের ওপরই পড়ে চোখ ধাধিয়ে দিয়েছে। হাতে কারো কারো দা, আর-এক হাতে কলাগাছ ধরে থাকা, কেউ শুধু হাতে, কারো হাতে উঁচলো লাঠি, সবাই এই বঁশবনের দিকে তাকিয়ে।

তারপর ভিড়ের ভেতর থেকে কেউ চেঁচায়, কে হয়।

ততক্ষণে ওরা আলোর সীমানার ভেতর ঢুকে গেছে। নিতাই আগে-আগে, হাসতে-হাসতে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *