২.৪ পাখি জাগে, বাঘারু জাগে

০৭১.

পাখি জাগে, বাঘারু জাগে

এই ইতিহাস ও ভূগোলের মধ্যে নির্বাসিত বাঘারু, এখন, কোনো এক রাত শেষে, ঘুমিয়ে আছে পাহাড় আর ব্রিজের মাঝখানের ফাঁকাটাতে, নদীর বুকে, একটা ছোট টিলার মত একলা-পাথরের ওপরে।

তিন দিক থেকে তিনটি বনমোরগ একসঙ্গে ডেকে উঠে রাত্রির শেষ ঘোষণা করে দেয়। মোরগ তিনটির একটি বাঘারুর ডাইনে, আর-একটি বায়ে, জঙ্গলের ভেতর। তাদের ডাক দুটো মিশে যায়, কিন্তু প্রতিধ্বনি দুটো মেশে না। আর-একটা মোরগ ডাকে ব্রিজের দক্ষিণে চরের মাঝখান থেকে। তার ডাকটাই হালকা আসে, প্রতিধ্বনি ওঠে না। ফলে, তিনটি মাত্র বনমোরগের ডাকের সাত-আট রকম আওয়াজে জায়গাটা হঠাৎ ভরে ওঠে। আওয়াজগুলো ধীরে ধীরে মিলিয়ে যেতে অনেকটা সময় নেয়। নিঃশেষিত মিলিয়ে যাওয়ার আগেই চরের আর ফরেস্টের ভেতরের নানা আওয়াজ তার সঙ্গে মিশে যায়।

কোনো-কোনো পাখি পাখা নেড়ে ঘুম কাড়ে, গাছের পাতায়-পাতায় মর্মরধ্বনি ওঠে, সে-ধ্বনি গাছ থেকে গাছে চলে যায়। কোনো-কোনো পাখি ডেকে ওঠার অপেক্ষায় গলায় একটা স্বগত ধ্বনি তুলতে থাকে–গলায় উঠে সে ধ্বনি গলার ভেতরে চলে যায়। মহিষের বাথানের এক দিক থেকে আর-এক দিকে কান আর লেজ ঝাঁপটানোর আওয়াজ ওঠে। ঘাসবনে শির শির আওয়াজ টানা চলে যায় দূরে, মাটি ঘেসে-বাতাসের বা শ্বাপদের। ঝিঁঝির আওয়াজ থেকে-থেকে থেমে গিয়ে সেই নৈঃশব্দ্যকে আরো নিঃশব্দ করে তোলে।

সেই পাখিটা জেগে ওঠে-ডায়নার ওপরে, জঙ্গলের ভেতরে, কোনো উঁচু ডালে। তার পাখাঝাড়ার বেশ জোর আওয়াজ নদীপথ ধরে নেমে আসে। পাখিটা ডাল বদল করে। গাছের কয়েকটা পাতা অনেক শব্দ তুলে খসে যেতে থাকে। পাখিটার গায়ের সঙ্গে পাতার ঘর্ষণের আওয়াজও নদীপথ ধরে নামে। সে বসে বসেই আরো একবার পাখা ঝাঁপটায়। তার পর, সেই আধো অন্ধকারে, একটা কাতর ক-অ-অ-ক-ধ্বনি তোলার সময় জুড়ে, নদীপথের আকাশ জুড়ে তার পাখনাটার প্রবল আলোড়নে, উড়ে আসে, এই ফাঁকার ওপরে। এই ফাঁকাটায় সে দুবার পাক খায়, বাঘারুর পাথরটাকেও ঘোরে। তার পর ঝুপ করে নদীর ওপরেই যেন নেমে যায়। কিন্তু উল্টো টানে উঠে এসে বসে বাঘারুরই পাথরের কিনারায়। এই পাথরটায় উড়ে আসার জন্যেই যেন তার নদীতে ঝাঁপ দেয়ার দরকার ছিল।

কিন্তু এসে বসেই বাঘারুকে দেখে, পাখা আর গোটায় না, যেন আবার উড়ে যাওয়ার জন্যেই কাঁপায়, কিন্তু ওড়ে না। ঐ উঁচু পাথরের কিনারায় পাখাটা মেলে রেখে দুটো সরু ঠ্যাঙের ওপর বসে। পাখা-মেলা সেই শরীরের ভারে পা-দুটো কাপে, পাখিটা দোলে। কাপুনি আর দুলুনি থামাতে পাখি ঘোরে। পায়ে-পায়ে এক পাক দু পাক। তার পর পাখা মেলে রেখেই দুটো ছোট-ছোট লাফে সে বাঘারুর দিকে ঘোরে। ঘুরেও পাখাটাকে বন্ধ করে না। ভোলা পাখা নিয়ে স্থির হয়ে বাঘারুকে দেখতে চায়। ঐ স্থিরতার প্রয়োজনেই পাখাটা আস্তে বন্ধ করে মিশিয়ে নেয় নিজের শরীরের সঙ্গে তার পরে লম্বা শরীরটাকে দুলিয়ে বাঘারুর দিকে দুপা এগয়। আগে পাখাটা শরীরের সঙ্গে সম্পূর্ণ মেলে নি, তখন মেলে। ডালের ওপর বসলে যে লেজটা ঝুলে থাকতে পারে, এখানে পাথরের ওপর সেটাকে খাড়া রাখতে হয়।

পাখাটা সম্পূর্ণ গুটিয়ে নিয়ে পাখিটা নিজের শরীরের দৈর্ঘ্যকে স্পষ্ট করে বাঘারুর শিয়রে দাঁড়িয়ে থাকে। পাথরেরই ওপর আর-একটা পাথরের মত শুয়ে আছে বাঘারু। বাঘারুর মাথার ওপর দিয়ে পাখিটার গলা উঁচু করা; ফলে বাঘারুর মাথার রেখা, পাখির শরীরের রেখার সঙ্গে মিশে যায়। যেন বাঘারুর মাথাটাই উঁচু রেখায় পাখিটার গলার নরম ঢাল হয়ে ঠোঁট পর্যন্ত গিয়ে ফিরে এসেছে। সেই রেখাটা ভেঙে দিয়ে পাখি ডাইনে ঘাড় ঘোরায়। দু পা ঘোরে। তারপর কিনারায় সরে এসে বাঘারুর বিপরীতে পাহাড়ের দিকে মুখ করে। লেজটা বাঘারুর মাথায় ঠেকে গেলে উঁচু করে। বুকটা এমনই নিচু হয় যেন তখনই উড়ে যাবে। কিন্তু ওড়ে না। লেজটা বাঘারুর কপালের ওপর ফেলে রেখে ওড়ার ভঙ্গিতে স্থির হয়ে যায়।

বাঘারু জেগে যায়, চোখ খোলে, কিন্তু নড়ে না। পাখিটার লেজ তার কপাল ছাড়িয়ে চোখের ওপর পড়েছে। তবু এত অস্পষ্টতায় বাঘারু বুঝতে পারে না লেজটা কত বড়, কী রকম, শেষে চেরা, না গুটনো, লেজের শেষ দিকে কি অন্য কোনো রঙের ঘের আছে? পাখিটা তাকে যেরকম নিষ্প্রাণ ভেবে কপালের ওপর লেজটার ভর রেখে দিয়েছে, বাঘারু সেরকম নিষ্প্রাণ হয়ে থাকে। নইলে পাখিটা মুহূর্তে উড়ে যাবে। আর যদি বাঘারু পাথরের ওপর পাথরের মতই পড়ে থাকে, তা হলে পাখিটা ঘুরে এমন কোথাও দাঁড়াতে পারে যে বাঘারু তাকে সম্পূর্ণ দেখতে পাবে। তিন দিন ধরে বাঘারু পাখিটাকে একবার দেখতে চাইছে, পারছে না।

বাঘারুর কপালের ওপর লেজটা একটু নড়ল, সুড়সুড়ি লাগল। তা হলে পাখিটা একটু ঘুরল। সুড়সুড়ি লাগছে। লেজটা এখন বাঘারুর ডান চোখটা ঢেকে দিয়েছে। বাঁ হাত দিয়ে এক ঝটকায় বাঘারু পাখিটাকে ধরে ফেলতে পারে। লেজটা বাঘারুর কপাল থেকে উঠে যায়।

বাঘারু পাখার কোনো আওয়াজ পায় না। তা হলে উড়ে যায় নি। বাঘারু তার এই পাথরে পাখির পাতলা নখের কোনো স্পর্শ শোনে না। তা হলে কি নড়ছে না?

 তারপরই, বাঘারুর মুখের ওপর পাখার একটা ঝাঁপটা মেরে পাখিটা উড়ে চলে যায় বাঘারুর পায়ের দিকের আকাশে, ব্রিজের কাছটাতে। বাঘারু আবছায়া শুধু উড়ে যাওয়াটুকু বুঝতে পারে। দুই চোখ মেলে রেখে বাঘারু দেখে আকাশে কোনো তারা নেই! সে অপেক্ষায় থাকে পাখিটা আবার কখন উড়ে যাবে। ততক্ষণে পাখিটা ব্যায়ে মোড় নিয়ে আবার নদীর ওপরের ফাঁকাটায় চলে গেছে। বাঘারু উপুড় হয়ে যায়। দেখে, তার উল্টো দিকে, জলের ওপারে, উঁচলো বড় পাথরটার মাথায় গিয়ে বসল।

পাথরটা ছুঁচলো বলেই, পাখির ছায়াখন দেখা যাছে-য্যান একখান পাথরের পাখি। ঘাড় ঘোরাছে। স্যালায় বুঝা যায়, পাথর না হয়, পাখি। ছায়াখান মোরগের নাখান টানটান। বুকখান চিতানা। মাথাত ঝুটি আছে কি নাই, বুঝা না যায়। উপুড় হয়ে দুই হাতের ওপরে থুতনি রেখে বাঘারু তাকিয়ে। বাঘারু একবার পাখিটাকে দেখতে চায়, পুরোটা দেখতে।

পাখিটা ঐ পাথর থেকে উড়ে আবার এই পাথরে আসতে পারে। বা, আবার, নদীখান ধরি ফিরি যাবার পারে জঙ্গলে। পেছনের ঘাসবনেও নেমে যেতে পারে। না-হয়, না-হয়। ঐ পাখিটার এ্যালায় খোয়ায় মন নাই। দোসর চাহে, দোসর চাহে।

তা হলে ত ডেকে উঠতেও পারে, এখন বাঘারুর সামনে ঐ ছায়ামূর্তিতেই। তা হলে বাঘারু অন্তত একবার বুঝতে পারবে, গত তিন দিন যে-ডাকটা এই রাতশেষে আর সেই দিনশেষে পাগল করি দিবার ধইচেছে, সেউ ডাকটা এই পাখি কেনং করি ডাকে। তিন দিন ধরে পাখিটার ডাকের সাড়ায় বাঘারু ডেকে ওঠে। বাঘারু ডেকে উঠলেই পাখিটা চুপ করে যায়। তার পর চুপ করে থাকে অনেকক্ষণ। সেই অনেকক্ষণ কেটে যাওয়ার পর, রাগে জ্বলতে-জ্বলতে তীক্ষ্ণতর স্বরে, ঘন-ঘন ডেকে ওঠে। পাখোয়াল (পাখি) বুঝিবার ধইচছে, অর দোসর এইঠে আছে, ডাকিবার ধইচছে, কিন্তু আসিছে না কেনে? পাখিটার সারা শরীরে সঙ্গীর জন্যে ডাক উঠেছে। যখন ও ডাকে তখন ওর ডাকের কাপনে ওর শরীরে কাপন বোঝা যায়। শরীরের সেই কাঁপনে এমনই বিহ্বল যে বাঘারুর ডাককেই ভাবে সঙ্গীর ডাক?

কিন্তু সত্যি কি তাই ভাবে? বাঘারুকে যদি সত্যিই সঙ্গী ভাবত তা হলে আরো আউরায়বাউরায় চলি আসিত বনের ভিতরঠে। বাঘারু যে ওর সঙ্গী নয়, সেটা বুঝতে পেরেই কি বাঘারুর ডাকের শেষে অত চুপ করে থেকে অত তীক্ষ্ণতর ঘন-ঘন ডেকে ওঠে?, রাত ভাঙতে না-ভাঙতেই পাখি এসে এই ফাঁকটায় উড়ে-উড়ে বেড়ায়। ফরসা হওয়ার আগেই পাখা ঝটপটিয়ে চলে যাবে, জঙ্গলের ভেতর থেকে আরো ভেতরে যেখানে সব সময়েই অন্ধকার। বিকেলের রোদ সরে গেলে আবার পাখি ঝটপটিয়ে উড়ে আসবে এইখানকার আঁধারে। জঙ্গল থেকে নদীতে, পাথরে, আঁধারে-আঁধারে, পাখি তার সঙ্গীতে খুঁজছে। বাঘারুর জকে সেই সঙ্গীর ইশারা পেয়ে, খোঁজে?

বাঘারুর গলার ভেতরটায় একটা ডাক গুরগুর উঠে আবার ভেতরে চলে যায়। ডাকি উঠিবে? বাঘারু ভাবে, পাখি কি তাকেই সঙ্গী ভেবেছে, পাখি ভাবে নাকি তার সঙ্গীটা ডাকে অথচ আসে না কেন? ঐ বাশের নাখান চোখা পাথরের মাথায় বসি নদীর পাথর বুকখান দেখিবার ধইচছে কতক্ষণ ধরি ধরি.ঐ বড় পাথরটার পুরো শরীর একটা পাখির। উড়ে গেলে ঐ জায়গাটা ফাঁকা পড়ে থাকবে।

পাখিটা এখন সোজাসুজি বাঘারুর এই পাথরটার দিকে তাকিয়ে। তাই ওর ঠোঁট-মাথা ঝুঁটির আভাস আর আলাদা-আলাদা চেনা যায় না। পাখিটার পাথরটা থেকে বাঘারুর পাথরের মাথাটা সম্পূর্ণ দেখা যাবে না। তা হলে পাখিটা বাঘারুকে দেখতে পাচ্ছে না, কিন্তু পাথরটাকে দেখছে। এখন হঠাৎ উড়াল দিয়ে এই পাথরটাতে এসে যেতে পারে। বাঘারু স্থির হয়ে থাকে, নড়ে না। থুতনির নীচে তার হাত দুটো। কনুই পর্যন্ত দুই দিকে সমানভাবে ছড়ানো। বাঘারু ধীরে-ধীরে তার শ্বাসপ্রশ্বসটাও কমিয়ে আনে। আর সেই স্থিরতার অপেক্ষা করে, শরীরটাকে কেমন এগিয়ে, গলাটাকে বাড়িয়ে, পাখা দুটো ছড়িয়ে, মাঝখানের এই ফাঁকটুকু ভরে, পাখিটা ঐ পাথর থেকে এই পাথরের মাথায় কোনাকুনি উড়ে এসে বসবে। বাঘারু তার সেই পুরো ওড়াটুকু দেখতে পাবে–এই প্রথম। পাখার ছড়ান দেখে বুঝতে পারবে কত লম্বা, ঠোঁটের চোখ দেখে বুঝতে পারবে পাতলা না মোটা। আর যদি এই পাথরের ওপর বাঘারুর চোখের সামনে এসে বসে–ঘুরে-ঘুরে দাঁড়ায়! বাঘারু পাথরের মত স্থির থেকে যেন, পাথরের চোখ দিয়ে পাখিটাকে সম্পূর্ণ দেখে নিতে পারবে। সেই দেখে নেয়া শেষ হওয়ার পরও যদি পাখিটা বাঘারুর চোখের সামনেই বসে থাকে, তা হলে, বাঘারু খুব নিচু গলায় সেই ডাকটা ধীরে-ধীরে ডাকি উঠিবে। দেখিবার পাবে, তার ডাক শুনি পাখিটা কী করি, ক্যানং করি চুপ করি থাকে, কোন দিকে তাকায়, ঘাড়টা ক্যানং হেলায়। বাঘারু বুঝতে পারে, গুরগুর একটা ডাক তার গলার ভেতরে উঠে শরীরের আরো ভেতরে চলে যাচ্ছে। প্রায় দম আটকে বাঘারু ভাবে–ভোখাটা এখন ভুখে না ওঠে। কোথায় আছে, কে জানে। যদি বাঘারুর পায়ের দিকে নীচের পাথরে থাকে, ডাকবে না। কিন্তু যদি এমন জায়গায় থাকে, যে, পাখিটাকে দেখা যায়?

পাখিটা হঠাৎ উড়ল, কিন্তু সোজা একেবারে আকাশে, যেন কেউ ওটাকে দড়ি বেঁধে টেনে তুলল, প্রায় বাঘারুর সমান উঁচুতে এখন। বাঘারু উপুড় বলে দেখতে পায় না এদিকে আসছে কি না। তার পরই বাতাসে ঝাঁপট তুলে নদীর ওপারটা ধরে বনের সেই ভেতর দিকে চলে যায়–বাঘারুর চোখের সামনে ওর উড়াল শরীরটা পেছনের বনের সঙ্গে মিশে যায়। বাঘারু নড়ে না। আবার ফিরে আসবে। ভাবতে-ভাবতেই আবার নদী ধরেই ফিরে এল। এবার যেন জলে ঝাঁপ দিয়ে, আবার উঠে, বাঘারুর বায়ের ফরেস্টের দিকে উড়ে, মিশে, আবার অন্ধকার থেকে বেরিয়ে, বাঘারুর পাথরটার ওপর দিয়ে, ঘুরে, নেমে গেল। শালো। পাথরের বনত দোসর খুঁজিবার ধইচছিস? মানষিক দেখিবার পারিস না?

.

০৭২.

নদী জাগে

বাঘারু এতক্ষণ যেন জেগেও জাগে নি, এখন জাগছে। পাখিটার জন্যে শরীরটাকে এতক্ষণ স্থির করে রাখায় টান ধরেছিল, চিত হয়েপড়ে দুই হাত দুই পা পাথরময় ছড়িয়ে, তার পর দুটো হাত মুঠো পাকিয়ে মাথার পেছনে ছুঁড়ে, ঘাড়টা একটু মুচড়ে, বুকটা পাথর থেকে তুলে, বাঘারু অনেকক্ষণ ধরে আড়মুড়ি ভাঙে। সেই আড়মুড়ি ভাঙার গড়াগড়িতে শরীরটা শিথিল হয়ে যায়। বাঘারু ডান পা-টা টেনে তুলে আনে। বা-হাতটা ছড়িয়ে দেয়। বা ঘাড়টা কাত হয়ে থাকে। পাখিটা যেন বাঘারুর শেষতম ঘুমের ভেতর এসেছিল ও চলে গেছে। বাঘারু নতুন করে দেখে, আকাশে একটাও তারা নেই। বাঘারু নতুন করে ডেকে ওঠে, ভোখা।

বাঘারু না দেখেও বোঝে, ভোখা উঠে এসেছে, এখন তার পায়ের কাছে। ভাবতে-ভাবতেই ডান পায়ের আঙুলে লোখার ঠোঁটের ছোঁয়া পায়। পা-টা ছুঁড়ে বাতাসে লোখাকে খোঁজে। সেটা বুঝেই লোখা একটু এগিয়ে আসে। আর লোখার পিঠে বাঘারু তার বা পা-টা রাখে। সেটা নিয়ে একটু দাঁড়িয়ে লোখা বসে পড়ে। বাঘারুর পায়ের কাছে আবার কুণ্ডলী পাকিয়ে যায়। বাঘারু বহু ওপরের আকাশের দিকে তাকিয়ে খুক করে হাসে, শালো আলসিয়া।

রাত্রির শেষ আর ভোরের শুরুর মাঝখানের এই সময়টাতে সব চেয়ে বেশি অন্ধকার। চাঁদ আর তারার আলো আকাশে থাকে না। ভোরের আলো ফোটে না। ফরেস্টের বড় বড় গাছের মাথা আকাশে, ঝোপঝাড় মাটিতে লেপে যায়। ছায়ামূর্তিগুলোও স্পষ্ট হয়ে উঠতে পারে না। অ্যালায়ও ছায়া জাগো নাই। ভোখার পিঠের ওপরে বাঁ পা-টা বাঘারু নাড়ায়–শালো, আলসিয়া। ভুখিবারও চাহে না–নিদ যাবার চাহে। এ ঘুমা। ঘুমা কেনে। শালো নিদুয়া কুত্তা, ঘুমা।

বাঘারু পা-টা টেনে নিয়ে উঠে বসে। দুই হাতে হাঁটু জড়িয়ে বসলে সে দেখে পাখিটা দুটো পালক খসিয়ে গেছে। হাত বাড়িয়ে পালক দুটো ধরতে বা পা-টা তার পড়ে যায়। এখন সে তার ডান হাঁটুর ওপর ডান হাতটা রেখে, বা হাতে পালক দুটো ধরে বা পায়ের ওপর রাখে। মনে রাখা, ভুলে যাওয়া, মনে করা, ভুলে থাকা–এইসব মানসিক ক্রিয়া-প্রক্রিয়ায় ত বাঘারু খুব অভ্যস্ত নয়। পাখির সেই অনতিক্রম্য প্রমাণের দিকে তাকিয়ে শুধু সে মনে করতে পারে কালিও ফেলি গেইছে দুখান, তার আগের দিন সনঝাত আরো একখান ফেলি গেইছে। বাঘারু সেই পালক হাতে, এবার নদীর দিকে তাকায়। ঠিক নদীর দিকে নয়, তার বাথানের দিকে, বা বাথানসহ নদীর দিকে। আর, এই তাকানোর সঙ্গে-সঙ্গে তার কানে আসে জলের ছুটে যাওয়ার আওয়াজ আর জলের ভেতরে নুড়ি-পাথরের টুঙটাঙ। ঠিক এই সময়টাতে এই আওয়াজ ওঠে। রাত্রিতে বনের নানা আওয়াজ কানে আসে না। দিনের বেলাও তাই। রাত আর দিনের মাঝখানে এই সময়টাতে জলস্রোতের তলায় নুড়ি-পাথরের ধ্বনি কিছুক্ষণ ধরে বাজতে থাকে। এই ধ্বনি অনেক সময় ঘুম ভেঙেই কানে আসে। আর কানে এলেই বাঘারু বোঝে সকাল হতে শুরু করেছে।

আওয়াজগুলো একে-একে শুনে নিয়ে বাঘারু এবার নদী থেকে চোখ সরিয়ে তাকায় তার মোষগুলোর দিকে। এই পাথরটাকে এই জন্যেই বেছেছে বাঘারু। সব চেয়ে উঁচু পাথরটার তিন পাশে মোষগুলো ছড়িয়ে থাকে বালি আর পাথরের ওপর। তাকালেই প্রায় সবটা দেখা যায়। বৃষ্টিবাদলা মা থাকলে বাঘারু এই পাথরটাতেই শোয়। বৃষ্টিবাদলার জন্যে সামনের জঙ্গলের ভেতরে একটা গাম্ভারি গাছের সব চেয়ে তলার ডালটার ফেঁকড়িতে বাঁশ কঞ্চি-কাঠের টুকরো-টাকরা দিয়ে মাচান বানিয়েছে আর তার ওপরে সেই তরিকা পাতাগুলো বেঁধে-বেঁধে, ঝুলিয়ে ঝুলিয়ে, জোড়া লাগিয়ে একটা ছাউনি বানিয়েছে। গাছটার ঠাসা পাতার ভেতরে তরিকা পাতার ঐ ছাউনির নীচে হাত-পা গুটিয়ে বাঘারু ঘুমোতেও পারে।

মোঘগুলোর দিকে তাকাতেই কানে আসে রোমন্থনের সমবেত আওয়াজ। এই আওয়াজটাও সারারাত ধরে বাড়তে থাকে বটে কিন্তু ফরেস্টের অন্য সব আওয়াজ থেমে না গেলে শোনা যায় না আর যদি শোনা যায় তাহলে মনে হয় জঙ্গলের ভেতরে কোনো একটি জায়গাতে যেন কোনো মাটির গর্ত তৈরি হচ্ছে। এতগুলো মোষের এই নিজের গলার ঘাস, মুখ না খুলে, নিজেই চিবুনোর আওয়াজের এমনই একটা শরীর আছে যা ফরেস্টের ভেতর মিশে থাকে, ঝিঁঝির আওয়াজের মত। যতক্ষণ বাথান বেঁধে বনের মধ্যে ঘুরে বেড়ায় ততক্ষণ এই বাথান ফরেস্ট থেকে আলাদা; যখনই বনের সীমার বাইরে এই চরে রাত ভোর করে তখনই ফরেস্টের সঙ্গে মিশে যায়।

বাথানটাকেই আর-একটু ভাল করে দেখতে বাঘারু উঠে দাঁড়ায়। মনে হয়, পাথরটা আরো খানিকটা লম্বা হয়ে গেল। বাঘারু যে ছায়ামূর্তি হয়ে উঠতে পারে, তার কারণ বাঘারুকে ঘিরে আকাশ ও অবকাশ ছাড়া আর-কিছু ছিল না।

এই বনে সারাদিন সারারাত ধরে আলোকপাত বদলায়, ছায়াপাত বদলায়। পাথরের, গাছের, কখনো বা মানুষের মাথা–যা কিছু আকাশ ছুঁড়ে ওঠে তারই আকার বদলায়। আকাশরেখার এমন বিরতিহীন বদলেই শুধু সময়ের প্রবাহ বোঝা যায়।, বাঘারু দেখে, বাথান ঠিকই আছে। ভোখা ডাকে নি মানেই, ঠিক আছে। তোখা ঘুমোচ্ছে মানেই, সব ঠিক আছে। বাঘারু ভোখর সামনে গিয়ে ভোখার নরম পেটে তার পায়ের আঙুলগুলো ঢুকিয়ে রোমগুলো একটু নাড়িয়ে দেয়, আদরে, শালো, আলসিয়া, নিদুয়া। লোখা একটুও আওয়াজ না-করে সেই পা-টা জড়িয়ে ধরে আরো কুণ্ডলী পাকিয়ে যায়। কাদায় পা গাড়লে যেমন করে পা তুলতে হয়, সেরকম টানতে গিয়ে বাঘারু হেসে ফেলে, তোখা ছাড়ছে না।ছাড়ি দে, নামিম। বাঘারু টের পায়, লোখার পেটের নরম রোমগুলো তার পায়ের পাতায় নরম লাগে আর গোড়ালির কাছে ভোখার নখ।

পা-টা টেনে বের করে, পাখির পালক ধরা হাতটা মাথার ওপর তুলে, বাঘারু, পাথরের মাথা থেকে লাফিয়ে তার নীচের পাথরে নামে। সেখানে ঘুরে দাঁড়িয়ে আরো নীচের পাথরে। আকাশে বাঘারুর ছায়ামূর্তিটা ধীরে-ধীরে ফরেস্টের অন্ধকারের ভেতরে ডুবে-ডুবে যায়। সব চেয়ে শেষে ডোবে তার হাতের পাখির পালক। বাঘারুর রাত শেষ হল। বাথান এখনো জাগে নি। ফরেস্টের ভেতরে অন্ধকার এখনই সব চেয়ে ঘন।

সবচেয়ে নীচের পাথরটাতে পা দিয়ে একটা ছোট্ট লাফে বাঘারু নদীর বুকে নামে। এতক্ষণ পাথরের মাথায় যে-প্রকৃতির ভেতর বাঘারু ছিল, তা সম্পূর্ণ বদলে যায়। এখন সামনে ফেনার রাশি, নদীব কল্লোল চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে।

যে-পাথরটার ওপর থেকে বাঘারু নেমে আসে তার তলায় প্রায় পর-পর একটার পর একটা বড় পাথর। টিলার মত পাথটার সঙ্গে খাজে একটা কেমন আশ্রয়ের মত হয়েছে। বাঘারু সেই খাজটার ভেতর ঢুকে, নিচু হয়ে, আর-এক পাথরের সংযোগের মাঝখানের অবকাশটাতে পাখির পালক দুটো রাখে। ওখানে আরো তিনটি পালক আছে। আর, আছে, বাঘারুর সেই পরনামিয়া পাথর।

এই বার বাঘারু নেমে পড়ে নদীর বুকে, পাথর আর বালির ওপরে, তার বাথানের মাঝখানে। মোঘগুলোর পেছন, পেট, মুখ, শিঙ ছুঁয়ে ছুঁয়ে, এঁকেবেঁকে পথ করে নিতে-নিতে, বাঘারু জলের দিকে যায়। মোষগুলো ফোঁস-ফোঁস শ্বাস ছেড়ে বাঘারুকে জানান দেয়, চিনেছে। ঘাড়গুলো দিক বদলায়, কান আর লেজের ঝাঁপট পড়ে গায়ে পট-পট। পাথরের তলা থেকে জলের কিনারা পর্যন্ত আওয়াজে-আওয়াজে মোষগুলোর জানা হয়ে যায়-বাঘারু উঠেছে। রাতে ফেলা গোবরে বাঘারুর দুই পা ভর্তি। নাড়া-খাওয়া গোবরের গন্ধ শেষ রাতের ভারী বাতাসে লেগে যায় কিন্তু ছড়ায় না, বাঘারুর পায়ে তার সঙ্গে ভেজা বালি। মোষের গা থেকে কিছু হাতে লেপটে যায়। ডায়নার জলের কিনারায় চলে এসে বাঘারু একটু দাঁড়ায়।

জল থাকলেই সে-জায়গাটা একটু পরিষ্কার লাগে। জলে আলো খেলবেই। আর, ডায়নার ফেনা-ওঠা জল ত নিজেই আলো ছড়ায় একরকম। বাঘারু তাকিয়ে-তাকিয়ে দেখে। আরো নীচের তিস্তাপারের মানুষ সে। ওপরের এমন নদী রোজ দেখা ত তার অভ্যেস নেই। তাই ভুলে-ভুলে যায়। তিস্তা ত ফরেস্টের মত, বা একটা বড় ডাঙার মত, বা একটা আকাশের মত।–সেটা ত ঐঠে থাকি যায়, দেখো কি না দেখো। সেখানে ত অভ্যেস হওয়ার কিছু নেই-তুমিই ত সেই নদীর ভেতর আছো; জানো কি না-জানো। কিন্তু জলে ফেনা তুলে এরকম আওয়াজে ডায়নার ছুটে চলাটা এমনই, মনে হয়, যখন আমি দেখব না, তখন এই দৃশ্যটাও থাকবে না। সকাল হওয়ার আগে, রোজই, বাঘারুকে এমন একটু সময় দিতে হয় ডায়নাকে অভ্যেস করে নিতে, ডায়নার সেই চুটন্ত ফেনরাশির দিকে তাকিয়ে বুঝে নিতে যে ডায়না সারা রাত ধরে এমনই রয়েছে।

বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর ঐ কল্লোল ও স্রোত বাঘারুর ধাতস্থ হয়। বাঘারু একটু হাসে–ক্যানং নদীখান, ডাইনাং? ডুবিবার চাহিলে ডুবিবার পারো না, কিন্তু জল চলিবার ধইচছে দিন-আতি, আতি-দিন।

বাঘারু নদীতে নামে। পায়ের গোড়ালি ছাপিয়ে জল ওঠে। স্রোত পা বেয়েও খানিকটা উঠতে চায়! বাঘারু পা-টা জলে ফেলেই স্রোতের টান বুঝতে পারে। বাঘারুর পা-টা পেয়েই স্রোতটা একটু সঙ্কুল হয়ে ওঠে, আওয়াজ একটু বলদায়। জলের সারা রাতের উষ্ণতা বাঘারুর পা বেয়ে সারা শরীরে ছড়িয়ে যায়। বাঘারু পা ফেলে। পায়ে লেগে নুড়িগুলো ছিটকে যায়। নদীর মাঝামাঝি একটা চওড়া পাথরের ওপর বাঘারু দাঁড়ায়।

রোজ এই পাথরটাতেই দাঁড়ায় বাঘারু। তার পথ পাথরটাতেই ঘুরে-ঘুরে মুখটা ডায়নার মুখের দিকে ঘোরায়। পাহাড় আর জঙ্গলের ভেতর থেকে বেরিয়ে ঠিক যে-জায়য়াটায় ডায়না প্রায় সমকোণে বায়ে ঘুরেছে, পাথরটা ঠিক সেই জায়গায়। স্রোতের উল্টোমুখে দাঁড়ানো বাঘারুর বায়ে এখন সেই ছুঁচলো পাথর, যার ওপর পাখিটা বসেছিল আর ডাইনে, খানিকটা দূরে বাঘারুর পাথর।

জলের ভেতরের এই পাথরটা খুব স্থির নয়। নুড়িপাথরের ওপর আছে–স্রোতের ধাক্কায় সব সময়ই নড়ছে। বাঘারুর মত ওজন নিয়েই নড়ছে। অথচ এতগুলো দিন গেল, রোজ বাঘারু এই পাথরটার ওপর এসে দাঁড়িয়েছে। এর ভেতর একদিন একটা বড় বান গেল ঠিক প্রথম রাত্রিতে। বাঘারু পাথরটিলায় ছিল। মোষগুলোর প্রায় হাঁটু পর্যন্ত জল উঠেছিল। জলস্রোত এসে ঘা মারছিল পাথরটিলার তলাতেও। কিন্তু তবু সকালে এই পাথরটা এখানেই ছিল। স্রোতের অমন ধাক্কাতেও নড়ে নি।

তার দুটো বিশাল পায়েই ভরে যাওয়া পাথরটুকুর ওপর বাঘারুর দাঁড়ানোটা ত খাড়া, সোজা, কোনো নড়নচড়ন নেই। এইখান থেকেই বাঘারু ডায়নার বেশ খানিকটা একসঙ্গে দেখতে পায়। বাঘারু দেখে, যা রোজ দেখে, কিন্তু প্রতিদিনই যেন সে প্রথম দেখছে এতটাই নতুন সে দৃশ্য তার অভিজ্ঞতায়।

–আন্ধিয়ার দ্যাওয়াত চরক খেলিবার নখান ছুটি আসিছে ডাইনাং ঝোরাখান, শাদা, ফটফটা– অন্ধকার আকাশে বিদ্যুচ্চমকের মত-উদ্ভাসিত শাদা ফেনার একটি চলরেখায় ডায়না ছুটে নামছে। মাটির সঙ্গে জলের যে-ঘর্ষণে জলকল্লোল উঠছিল মনে হয়, তার পেছনে স্রোতের এমনই প্রবল ধাক্কা আছে বোঝা যায় ডায়নার এই প্রপাতের মত নিষ্প্রমণ দেখলে। পাখিখান এই স্রোতের ওপর দিয়া ওর ঘরত যায় আর ডাকো দেয়। ডাকিবু? এ্যালায়? বাঘারু ডায়নাকেই দেখে। ডায়না ত বাঘারুর নদী নয়। কিন্তু প্রতিদিন এই একটি সময় ডায়নার মাঝখানে দাঁড়িয়ে আরো খানিকটা দেখে নিতে নিতে বাঘারু যেন কোথায় একটা টান বোধ করতেও পারে; সামনের ঐ জঙ্গল-পাহাড় আর খাড়াপথ বাঘারুকে যেন আশ্রয় দিতেও পারে।

তার পাথরের ওপর দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে বাঘারু জলের ওপর ঝুঁকে পড়ে। সেই ফেনরাশিতে দুই হাত ডুবিয়ে দেয়। হাতে ছিটকে জল বাঘারুর চোখে-মুখে বুকে লাগে।

.

০৭৩.

বাথান জাগে

নদী ধরেই বাঘারু একটু ওপর দিকে ওঠে। তার পর নদী ছেড়ে উঠে যায়। সে এখন এক সীমা থেকে মোষগুলোকে একবার দেখে নেবে। শুধু দেখেই না। একটু সাজিয়ে নিতে হবে পুরো বাথানটাকে দুধিয়ালগুলোকে নিয়ে যেতে হবে বাঘারুর পাথরটার পশ্চিমে, রাস্তার দিকে অনেকখানি তুলে। দুধে গাড়ি এসে যাওয়ার পর, না হলে, না লাগে। মোষগুলোরও এটা অনেকখানি জানাই। তার এখানে বাঘারুর চেয়ে পুরনো। বাঘারুকেই নতুন করে জানতে হয়েছে। এখন একটু-আধটু ধাক্কা খেলেই মোষগুলো বোঝে কোথায় গিয়ে দাঁড়াতে হবে। সারাদিন বনেজঙ্গলে চরার পর বিকেলের দিকে বাথান যখন ফেরে তখন যে যেখানে ইচ্ছে দাঁড়ায়, কিংবা বসে। এখন এই সকালে তাদের লাইনবাঁধা শুরু করতে হয়। একবার পাম্প লাগানো শুরু হয়ে গেলে আর খেজাপাতি করা যায় না। এই জায়গাটা খুব ছড়ানো নয় বলে গায়ে গা লাগিয়ে মোষগুলো এক জায়গাতেই থাকে, বাঘারুর পাথরটাকে তিন দিক থেকে ঘিরে। জায়গাটুকুতে জঙ্গল নেই, শুধুই বালি ও পাথর, আর রাস্তার দিকের খানিকটা ঘাস। মোষগুলো বেশি ছড়াতে পারে না।

কিন্তু, তারই ফলে গায়ে গা লাগিয়ে এমন ভাবে থাকে যে ভেতর দিয়ে ঢোকার রাস্তা পাওয়া যায় না। আর বসার এই এক অদ্ভুত অভ্যেস মোষদের যে দুটো মোষ দুদিকে মুখ করে এমন ভাবে এ ওর গায়ে ঢলে থাকে যেন মনে হয় ওদের একটাই শরীর। শুধু বিপরীত মুখেই যে তা হবে, তা নয়, এক দিকেই মুখ করে এমন কোনাকুনি শরীর আর গলা রাখে যে হয় ডিঙিয়ে পেরতে হয়, না হয় ঘুরে যেতে হয়।

সারা রাত ধরে মোষগুলো যে যার ভঙ্গিতে প্রায় স্থির হয়ে থাকে বলেই কি বাঘারু এই বাথানজোড়া মোষের মূর্তিগুলোই দেখতে পায়, যেন, এগুলো মোষ নয়-পাথর। নাকি, সকালের আলো এখনো ফোটে নি বলে মোষগুলোর শুধু ছায়া আছে এখন। পুরো শরীর নেই, শরীরের আভাসটা একেবারে খোদাই হয়ে আছে। তাই তাদের পুরো শরীরের বাইরের রেখা এমন প্রখর হয়ে থাকে।

বাথানের পেছন দিকটাতে পৌঁছতে বাঘারুকে জলের কিনারা দিয়ে, তার পর কিনারা ছেড়ে, ক্রমেই ওপরে উঠতে হয়। মোষগুলোকে একসঙ্গে দেখায় যেন একটা অসমতল পাথুরে ডাঙা। তাতে কোনো-কোনো জায়গায় দুটো-একটার শিং জেগে আছে মাত্র। মাঝখানে, একটা মোষ দাঁড়িয়ে, তার গলাটা আকাশে অনেকখানি বাড়িয়ে কোনো উঁচু গাছের ডালে মুখ দিতে চায় এমন ভঙ্গিতে। শিং দুটো পেছনে হেলে শরীরের সঙ্গে মিশে গেছে, শুধু জেগে আছে তার হাঁ মুখটা মনে হয়, পিঠটাই এগিয়ে হা হয়ে আসে। বাঘারু চেনে–বুড়িয়ালি। শালো বুড়ি হচ্ছে, ঘুম কমি গেইছে। বাঘারু চলতে-চলতে জিভ দিয়ে টাকরায় একটা আওয়াজ তোলে–টট টর রর, টট টর রর।

চলতে-চলতেই আওয়াজ তুলে চলতে-চলতেই তাকায় বলে বাঘারু বুঝতে পারে না, তার ডাকে বুড়িয়াল সাড়া দিল কি না। এখন আরো সরে এসে সে ত বুড়িয়ালের ঐ লম্বা গলার ও মুখের আর-একটা চেহারা পায়। বাঘারু বুড়িয়ালকে একটু ব্যস্ত করতেই যেন, আবার আওয়াজ তোলে, টট টর রর, টট ট র র টরর। তার পর লাফিয়ে একটা মোষের পিঠ টপকে, আর-একটা মোষের পিঠে হাতের ভর দিয়ে একটু পাক খেয়ে সে বাথানের শেষ মোষটার কাছে গিয়ে পৌঁছয়। এইবার বাঘারু পুরো বাথানটাকে জাগাবে। কিন্তু তার আগেই মাঝখান থেকে বুড়িয়াল তার গলাটা আরো বাড়াতে থাকে, যেন ডালটা তার মুখের নাগালে আসছে না। আর তার পরই আঁ-আঁ আঁ করে ওর পুরনো ঘষা গলায় এক হকার তোলে। বাঘারুকে, আওয়াজ শুনে, খুঁজছে। না পেয়ে ডাকছে।

বুড়িয়ালের হাঁক শুনেই ঐ পাথরের মত মোষের মাথাগুলো একটু-একটু ঘোরে, খাড়া হয়। আর তখনই বাঘারু হাঁক দেয়, হে-ই, উঠ, উঠ, উঠ, হেট, উঠ। বাঘারু শেষ মোষটার পেছনে হাঁটু দিয়ে একটা গুতো মারে, হেই, উঠ, উঠ, হেট, উঠ, তার পর মোষটার ঘাড়ে আর পিঠে জোরে-জোরে চড় মারে, হেট, উঠ। বুড়িয়াল সেই মাঝখান থেকে ততক্ষণে মুখ ঘুরিয়েছে বাঘারুর দিকে। গলাটা তার বাড়ানোই থাকে। বাঘারুর হাঁক শুনে নিয়ে আবার একটা ডাক দেয়, আ আঁ–আ-গ। এবারের ডাকটা আর তত লম্বা নয়। বুড়িয়ালি জেনে গেছে, বাঘারু কোথায়। বাঘারু চেঁচায়, খাড়া গে খাড়া, যাছি, খাড়া। তার পর আবার বসা মোষটাকে পেছনে একটা খোঁচা দেয়–হেঁট হেঁট, উঠ, উঠ, টররর-অ, টররর-অ! এতক্ষণে মোষটা তার পেছনের পা দুটো নাড়াতে শুরু করে। বাঘারু তার কানের পিছে জোরে-জোরে দুটো চড় মারে। মোষটা পেছনের পা দুটো সোজা করতেই কানের ঝাঁপটা মারে বাঘারুর হাতে, বুঝে নিতে যে বাঘারুই, বা সাড়া দিতে। তার পর লেজের ঝাঁপটা মারে পিঠে। মোষটার পেছনটা উঁচু হতে থাকে। পেছনের পা দুটো মাঝামাঝি উঠতেই সামনের পা দুটো ঝট করে তুলে মোষটা খাড়া হয়ে যায়। মোটা মাটি থেকে একটু উঠতেই তলা থেকে পেচ্ছাব আর গোবরের গন্ধ উঠে আসতে থাকে। কিছু যেন ধোয়াও। আর গা থেকে বালি আর নুড়ি-পাথর খসে পড়ে।

মোযটার মুখটা এখন বাঘারুর দিকে ফেরানো। বাঘারু তার গলাটা ধরে ঘোরাতে থাকে। একটু ঘোরাতেই মোযটা নিজেই ঘুরতে শুরু করে। এই মোষটার গায়ে গা লাগিয়ে যেটা ছিল, সেটাও, এর মধ্যে বসে থেকেই গলাটা সোজা করেছে। বাঘারু আগের মোষটার গলার তলা দিয়ে ঐ মোষটার কাছে এসে হাঁটু দিয়ে একটা অঁতো মারে, উঠ, উঠ, আর তার পরের মোষটার পিঠে একটা চড় মারে। সঙ্গে সঙ্গে ঐ মোষ দুটো উঠতে শুরু করে। এবার এই মোষটাই চলতে-চলতে অন্য মোষদের উঠিয়ে দেবে।

ইতিমধ্যে পরের দুটো মোষই উঠে দাঁড়িয়েছে। প্রথম মোষটার পেছন-পেছন সে দুটোও চলতে শুরু করে। বাঘারু তার ডাইনেয়ে এই মোষের লেজ মুড়িয়ে, ঐ মোষকে হাঁটু দিয়ে গুতিয়ে, আর-একটাকে পিঠে চড় মেরে, হেই, উঠ, উঠ, টরর-অ, টর-র-র-অ আওয়াজ দিতে-দিতে এগিয়ে যায়। একটা মোষ যখন উঠছে, তখন পুরো বাথানটাই এখন দাঁড়িয়ে পড়বে। আর পেছনের মোষটা যখন চলতে শুরু করেছে, সেই চলার ধাক্কাতেই সামনের মোষগুলোও চলবে। কিন্তু তার আগে বাঘারু আগে গিয়ে দাঁড়াবে। তার পর দুধিয়ালগুলোকে আগে ছাড়বে, প্রায় লাইন বেঁধে।

এগতে-এগতে বাঘারু বুড়িয়ালের কাছে এসে পড়ে। সামনে দাঁড়িয়ে তার দুই শিঙের মাঝখানে একটু চুলকে দেয়। এমনকি বাঘারুর অতবড় থাবাও মোষটার কপালে কেমন ছোট দেখায়। বাঘারুর স্পর্শ পেয়ে মোটা তার গলাটা বাড়িয়ে দেয়, বাঘারুর কাঁধের ওপর তার গলাটা রাখে। নিজের মাথার পাশে মোষের মাথাটা নিয়ে বাঘারু দুই হাতে তার গলা জড়িয়ে ধরে আর আস্তে-আস্তে কানের পাশে গলকম্বলের নীচে দুই হাত দিয়ে মোষটাকে আরাম দিতে থাকে। বাঘারু শুনতে পায় বুড়িয়ালের গলার ভেতর থেকে একটা গুর, গুরু গুর আওয়াজ উঠে আসছে, খাড়া কেনে, খাড়া, এ্যালায় ত সাকালখান হই। বাঘারু আবার তার কানের পিছে হাত লাগিয়ে সুড়সুড়ি দেয়।

পেছনের মোষরা বাঘারু আর বুড়িয়ালকে মাঝখানে রেখে দু-পাশ দিয়ে এগতে শুরু করেছে। বুড়িয়ালের গলায় সুড়সুড়ি দিতে-দিতেই বাঘারু দেখে, সেই ভর পোয়াতি মোষটাও দুলতে-দুলতে চলেছে–আজি হবে কি কালি হবে। বাথান প্রায় পুরোটাই জেগে উঠেছে। এবার চলতে শুরু করবে। বুড়িয়াল যাবে না। এখানেই দাঁড়িয়ে থাকবে। বাঘারুকে এবার সামনে গিয়ে পঁড়াতে হয়। বাঘারু বুড়িয়ালের ঘাড়ে দুটো চড় মেরে, র কেনে র, আসিছু বলে খুব ধীরে চলমান মোষের দলের পেছন থেকে তাড়াতাড়ি সামনে এগিয়ে চলে।

কিন্তু এগিয়ে চলতে-চলতেই বাঘারু এক-একটা মোষকে গলা ধাক্কিয়ে সরিয়ে পেছনের কোনো মোষকে জায়গা করে দেয়। সেটা ফাঁকের ভেতর ঢুকে গেলে আগের মোষটাকে ছেড়ে দেয়। দুধিয়ালগুলোকে দরকার এখন। বাকিগুলো এখানেই থাক। মাঝখানে একটা বাছুর বড়বড় মোষের ভেতরে যেন পথ হারিয়ে ফেলেছে। বাঘারু সেটার লেজ তুলে এমন মলে দেয় যে, পেছনের দুই পা তুলে এক লাফ মেরে দৌড়তে শুরু করে। আর আগের দলটা যেন ছড়িয়ে-ছিটিয়ে যায়। বাঘারু হেসে উঠে তালি দিয়ে বলে, চল কেনে, টররর।

.

০৭৪.

দুধের ট্রাকের অপেক্ষায় গান

বাঘারু এখন ডায়না ব্রিজের ওপরে–রেলিঙে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে। দুটো মোষও ব্রিজটার ওপরে উঠে এসেছে। ঠিক মাঝখানে, শিং উঁচু করে বাঘারুর মতই পুব দিকে সোজা তাকিয়ে। ওদিকে বিন্নাগুড়ি। ঐদিক থেকেই দুধের গাড়ি আসবে। আসার সময় প্রায় হয়ে এসেছে। সময়ের খুব একটা হেরফের হয় না।

এখন বাঘারুর কোনো কাজ নেই, গাড়ির জন্যে অপেক্ষা করা ছাড়া। সুতরাং তার গান আসতে পারে। বাঘারুর গানও পূর্বনির্ধারিত। সূর্যোদয় আর সূর্যাস্তের মত ব্যস্ততাহীন নিয়মে বাধা তার কাজের ভেতরে এই গান যোগসূত্র হিশেবে তৈরিই থাকে। এক কাজ থেকে আর-এক কাজের ভেতর বাঘারুর এত বিচ্ছিন্নতা কখনোই ঘটে না যা গান দিয়ে জুড়ে দেয়া যায় না। যেমন বাঘারুর শরীর কাজ থেকে কাজে, নদী বা গাছের মতই চলে যায়, তেমনি সেই যাওয়ার ভেতরই গানটাও অবধারিত এসে যায়। কাজে কাজে অবিচ্ছিন্নতার সেই গানে এত বিরহ আসে কোথা থেকে?

বাথান বাথান করিসেন মইষাল রে-এ-এ
(অ তোর) বাথান করিলেন ঘর।
বাথান হইলেন আউলা ঝাউলা রে-এ-এ
 (অ তোর) বাথান ভরা গোবর।
অ মোর মইষাল বন্ধু রে-এ-এ

বাঘারুর সুর টান করে রাখে। বাঘারু নিজেই মইষাল, নিজেই তার বিরহিণী নায়িকার গান গায়–এখন দুধের গাড়ির জন্যে ডায়না ব্রিজের ওপর অপেক্ষার সামান্য. সময়টুকুর সকালে। হাঁটা বা কথা শেখার মত করে এইসব, গান,জানা হয়ে গেছে–এমন সময়ে গাওয়ার জন্যে। মইষালনির এই বিরহ বাঘারুর, বাঘারুই মইষালনি। বিরহ তার, মইষাল বাঘারুর জন্যেই। বাথান বাঘারুর জানা, মোষও বাঘারুর জানা; মইষাল ত বাঘারু নিজেই। এতগুলো জানা দিয়ে আর মইষালনি-হওয়ার–জানাটুকু পেরতে কী লাগে। বাঘারু তখন নাবাজানো দোতারার ঝোঁকে-ঝোঁকে গাইছে

বাথানে বাবোশ মইষ
ও মোর মইষাল এ্যাকেলা ঘুরেন,
ঘর মোর এই যৈবনখান্
কাপড়ে বান্ধি রাখেন।
অ-মোর মইষাল বন্ধু রে-এ-এ

বাঘারু নিজেই নিজের বিরহিণী।

বাঘারুর গানের উত্তরে, নীচে, চর থেকে লোখা জোরে-জোরে ডেকে ওঠে। বাঘারু গান থামিয়ে হেসে ফেলে বলে ওঠে, শালো। বাঘারু চুপ করে গেলে তোখা আরো জোরে ডেকে নীচে থেকে ছুটে ওপরে উঠে এসে ব্রিজটার মাঝখানে দাঁড়িয়ে পড়ে সেই ট্রাকের রাস্তার দিকে তাকায়।

ভোখার দাঁড়ানোর ভঙ্গিতেই সন্দেহ হয়েছিল। বাঘারু থেমে কান খাড়া করে-বহুদূর থেকে ট্রাকের শব্দটা পাওয়া যাচ্ছে। প্রথম দিকে বাঘারু টের পেত না। কিন্তু এখন ত এই ফরেস্টের আওয়াজগুলো চেনা হয়ে গেছে। কোনটা ফরেস্টের ভেতরের আওয়াজ আর কোনটা বাইরের সেসব এখন একবারেই ধরতে পারে। তার বা-পাশে হৃদয়পুর বস্তি। তার ওপরের, ফরেস্টের ওপার থেকে ট্রাক আসার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। আর-কিছুক্ষণের মধ্যেই এসে পড়বে।

আওয়াজটা বাঘারুর যত চেনা, ভোখার তার চাইতে কম ত নয়ই, একটু যেন বেশিই। তাই ভোখাই আগে শুনতে পেয়ে ব্রিজের ওপরে দাঁড়িয়ে পড়েছিল। কিন্তু মোষগুলোরও বোধহয় চেনা। সামনের মোষদুটো মাথাটা কেমন বাতাসে তুলেছে, যেন গন্ধ শুঁকছে, ওদের গলকম্বলটা টানটান হয়ে ওঠে।

বাঘারু তখনো দাঁড়ায় না। এখনো দেরি আছে। ট্রাকটা এখান থেকে মাইল কয়েক দূরে এই রাস্তার ওপর উঠে এই দিকে বেঁকবে। একটু আগে আওয়াজটা পাওয়া গিয়েছিল কারণ, ওদিকের রাস্তার একটা জায়গা এই কোনাকুনি–হৃদয়পুর বস্তি, একটা ছোট জলা ও ঐ দিকের পাতলা জঙ্গলটা পেরিয়ে–সোজা। আওয়াজ আসার পথে কোনো বাধা নেই। কিন্তু তার পরই আওয়াজটা বন্ধ হয়ে গেছে। এর পর আবার আওয়াজ শোনা যাবে, ট্রাকটা যখন এই রাস্তায় উঠবে। তখন অবিশ্যি আওয়াজটা ক্রমেই বাড়ে। প্রতিধ্বনিও হয় চার পাশ থেকে। যে-ভূগোল বাঘারুর দেখা নেই, আওয়াজ শুনেই সে সেটা ছকে নিতে পেরেছে।

সেই আওয়াজের পেছন-পেছন ট্রাকটা এসে প্রায় এই ব্রিজটার ওপর পৌঁছয়। ট্রাকটার থামা, দাঁড়ানো ইত্যাদি লোখা ও মোষগুলোর এত বেশি জানা যে ট্রাকটা অত জোরে আসছে দেখেও ওরা ব্রিজ থেকে নড়ে না। একটু সরে যায় মাত্র।

ভোখা বহু আগে থেকেই ট্রাকটার দিকে তাকিয়ে ডাকছিল। ট্রাকটা যত কাছে আসছিল, তত জোরে ডাকছিল। শেষে ট্রাকটা যখন থামল, তখন ভোখা ডাকতে-ডাকতে ট্রাকটার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে প্রায়। ড্রাইভার ও দুধের লোক, সামনে থেকে একজন আর পেছন থেকে একজন, নেমে এলে তোখা চিৎকার থামায়। তাও ব্রিজটার রেলিঙের কাছে গিয়ে আচমকা ডেকে ওঠে।

মোষদুটো সামনে দাঁড়িয়ে মাথা নাড়াচ্ছিল। ট্রাকটা থেমে যাওয়ার পর ওরা ব্রিজের ওপর নেমে যায়, দুটোই প্রায় একসঙ্গে। তার পর, ঢালের দিকে চলে যায়, যেখানে অন্য দুধিয়াল মইষানিগুলোকে ঠিক করে রেখে এসেছে বাঘারু।

ট্রাকটা এসে দাঁড়াতেই সেই পাইপটা নিয়ে একজন এগিয়ে আসে। এখন ত বাঘারুই শিখে গেছে। তাকে দুধের লোকটি পাইপটা ধরিয়ে দিলেও কিন্তু দাঁড়িয়ে থাকে।

লেও, পেট্রল চালাও লোকটি হেসে বলে।

বাঘারু নানড়েই হেসে জবাব দেয়, মোর প্যাটরখান দ্যান আগত।

ওঃ জরুর, জরুর। লোকটি তার প্যান্টের পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে একটা সিগারেট দিতে দিতে বলে, আচ্ছা, তোমাকে আমি একটা প্যাকেটই দিয়ে যাব, ব্যস, তা হলে তোমার রোজ পেট্রল লাগবে না।

পাকিট? কিসের পাকিট?

এই। তোমার পেট্রলের।

ড্রাইভার দরজা খুলে বেরিয়ে এসেছে, যা বাবা, তাড়াতাড়ি কর। এ পুরো ট্রিপ ঘুরে আসতেই ত বেলা দশটা বাজবে। ড্রাইভার রেলিঙের ওপর থেকে ঝুঁকে নীচের ডায়না দেখে।

মোক পাকিট দিবেন? পুরা একখান? সিগরিটের?

হাঁ পুরা পেটরোল। বাঘারু একটা সিগারেট বের করে নিয়ে প্যাকেটা আটকানোর চেষ্টা করে। কিন্তু হাতের মুঠোয় সিগারেটটা দুমড়ে না ফেলে বাঘারু ঐ কাগজের প্যাকেটটা আটকাবে কী করে? ফলে, তার যেন একটু বিহ্বলতাই আসে, বা হাতে সিগারেট আর ডান হাতে প্যাকেটটা নিয়ে। লোকটি এগিয়ে এসে দেশলাই দিলে বাঘারু একটা সমাধান পায় বটে প্যাকেটটা ভোলা অবস্থাতেই তাকে ফেরত দেয়ার, কিন্তু সেখানেও, দেশলাইটা আগে নেবে, না, প্যাকেটটা আগে দেবে এই নিয়ে আর-এক বিহ্বলতা দেখা দেয়। লোকটি ততক্ষণে দেশলাই থেকে কাঠি বের করে নিজেই জ্বালায়। সে যে এরকম জ্বালাবে, তার জন্যেও বাঘারু তৈরি ছিল না। ফলে, সে তার সিগারেটটা অত তাড়াতাড়ি মুখে দিতে পারে না। কাঠি নিবে গেলে লোকটি আর-একটি কাঠি জ্বালায়। ততক্ষণে বাঘারু সিগারেট ঠোঁটে দিতে পারে। আগুনের শিখার ওপর নত হতে-হতে বাঘারু বোঝে বাতাসে কাঠিটা আবার নিভবে। তখন একসঙ্গে সে একটা জটিল প্রক্রিয়ায় সমাধান ঘটায়–পিঠ দিয়ে বাতাস ঠেকানো, হাত বাড়িয়ে খোলা প্যাকেটটাই ফেরত দেয়া আর শিখার ওপর নত হয়ে সিগারেট ধরানো।

সিগারেটটা ধরানোর জন্যে বাঘারু যে-টান দেয় তাতে, ধরাতে গিয়েই সিগারেটটা একেবারে, শেষ হয়ে যেতে পারে যেন। সিগারেট ধরে যাওয়া ও দেশলাই কাঠি নিবে যাওয়ার পরও তার টান চলতে থাকে। আর, তার পর, শ্বাস বন্ধ করে ধোয়াটা ভেতরে নিয়ে সে যখন ছাড়ে, তখন মনে হয়, তার মুখের ভেতরে ছোটখাট উনুন আছে। ধোয়া বেরনো শেষ হওয়ার আগেই বাঘারু আর-এক টান দেয়। ড্রাইভার হেসে বলে, তোর এই টান দেখে ত আমাদের দম বন্ধ হয়ে যায় বাবা।

বাঘারুর চোখ তখন সিগারেটের নেশায় বন্ধ।

.

০৭৫.

শহুরে কিছু প্রক্ষিপ্ত

ট্রাকটার ওদিকে ক্লিনারটা তখন ভোখার সঙ্গে খেলা জুড়েছে। লোখার নাকের সামনে কী একটা দোলাচ্ছে। ভোখা সেটা ধরতে গেলেই, সরিয়ে নিচ্ছে ভোখার পিঠের ওপরে। ভোখা নিজের মুখ নিজের পিঠের দিকে নিয়ে যাওয়ার জন্যে গোল হয়ে লাফাচ্ছে আর লাফাতে লাফাতে, গোল হতে-হতে মাটিতে শুয়ে পড়ছে। ছেলেটি তখন হো হো হেসে উঠছে। তার হাসিতে, ও ঐ লাল জিনিশটার দোলা বন্ধ হওয়ায়, ভোখা তার খেলা ছেড়ে কুকুরের সব চেয়ে চেনা ভঙ্গিতে সোজা হয়ে মাটিতে বসে। ক্লিনারটি ড্রাইভারকে বলে, শালা, ভাল কোয়ালিটির জিনিশ দাদা। কোথা থেকে পায় এই সব? বলব, একটা ধরে রাখতে?

ফরেস্ট থেকে নিবি ত একটা বাঘটাঘ নে। ফরেস্ট থেকে কেউ কুত্তা নেয়? বোকা, ড্রাইভার নদীর দিকে তাকিয়েই বলে।

আমার দাদা খুব শখ একটা অ্যালসেসিয়ানের। মালবাজারের বকুলদা বলেছে একটা দেবে।

কোত্থেকে?

তা জানি না। তবে বকুলদা ভাই লিডার লোক। ও ঠিক কোনো বাগান থেকে জোগাড় করে দেবে।

ঐ আশাতেই থাক। ব্যাটা, অ্যালসেসিয়ানের একটা বাচ্চার দাম জানিস?

হ্যাঁ হ্যাঁ জানি।

তোর চাইতে বেশি।

 বেশি ত বেশি।

তেমন জিনিশ পেলে, বকুল মিত্তির তোকে দিতে যাবে কেন?

মাঝরাত্রিতে যখন গাড়ি নিয়ে বাগানে যেতে হয়, তখন তুমি যারে?

আমি যাব কেন? আমার অ্যালসেসিয়ানও দরকর নেই, যাওয়ারও দরকার নেই। তুই কি ঐ সব শুরু করেছিস নাকি?

কী?

 বকুল মিত্তিরের সঙ্গে গাড়ি নিয়ে যাস? রাত্তিরে? গাড়ি পাস কোথায়?

গাড়ি ত বকুলদার নিজেরই আছে। অত রাত্তিরে চালানোর লোক পায় না। আমি একবারই, গিয়েছিলাম।

তুই ত গাড়ি চালানোর লাইসেন্স পাস নি, এখনো, তার মধ্যে গাড়ি নিয়ে রাত্তিরে? যাস না।

 বকুলদা বলেছে আমাকে একটা অ্যালসেসিয়ানের বাচ্চা দেবে।

জেলে বসে অ্যালসেসিয়ান পুষিস?

কেন?

বকুল মিত্তির রাত্রিতে গাড়ি নিয়ে মার্ডার কেস পর্যন্ত করে তা জানিস?

কে বলল?

তোর তা দিয়ে দরকার কী? ওরকম রাতবেরাতে যাস না।

ছেলেটি একটু চুপ করে থাকে। একটা কুকুরের কথা থেকে যে এতটা এসে যাবে, সে ভাবে নি। তাই ভেবে নিতে তাকে একটু চুপ করেই যেতে হয়। বোঝা যায় না, অ্যালসেসিয়ান কুকুর না-পাওয়ার দুঃখ, আর বকুল মিত্তিরের সঙ্গে রাত্রিতে গাড়ি চালানোর বিপদ–এই দুটোর মধ্যে কোনটাতে সে বেশি চিন্তিত। ছেলেটা এই কথা থেকে সরে যেতেই যেন ব্রিজের মাথার দিকে হাঁটতে শুরু করে। কিন্তু কয়েক-পা গিয়েই ফিরে আসে। ছেলেটির সঙ্গে কথা বললে বলতে ড্রাইভার রেলিঙে পেছন ফিরে দাঁড়িয়ে ছিল। ছেলেটি তার কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করে-বকুলদা ত আমার থাকার জায়গাটা চিনে গেছে।

কী হয়েছে?

যদি পরে আবার আসে?

 বলে দিবি, যাবি না।

বাঃ, আগের দিন গেলাম যে

বলিস, আমার লাইসেন্স নেই, রোজ-রোজ যাব না।

 মারলে?

 খাবি

বকুলদা তাকে অ্যালসেসিয়ান দেবে এই থেকে, বকুলদা তাকে মাঝরাত্রিতে ধরে মারবে, আর সে মার খাবে–এই সত্যটা মেনে নেয়ার ভেতর নিজেকে ও নিজের চার পাশকে উল্টে দেখতে হয়, মাত্র এই সময়টুকুরই ভেতর। এই ছেলেটির পক্ষে সেটা এতই কষ্টকর যে সে সেটা সহজতম করে নেয়। বকুলদা তাকে মারবেই, নিদেন একখানা চড়, এটা সে জানে। আর তাই এই মুহূর্ত থেকেই সেই চড়টা খেতে শুরু করে। পেছন থেকে ড্রাইভার আবার ডাকে, এ-ই।

ছেলেটি দাঁড়িয়ে ঘুরে তাকায়।

শোন।

ছেলেটিকে আবার ফিরে যেতে হয়। ড্রাইভার রেলিঙের ভর ছেড়ে সোজা হয়ে বলে, শোন্। বকুলবাবু এর পরে কোনোদিন এলে বলবি তোকে থানার দারোগা খুব মেরেছে লাইসেন্স ছাড়া গাড়ি চালাস বলে, আর জিগগেস করেছে বকুলবাবুর গাড়ি চালাস কিনা। শুধু এইটুকু বলবি। তা হলে দেখবি তোকে আর নেবে না।

দারোগার কথা বলব?

হ্যাঁ, ঐ বলবি, দারোগা তোকে বকুলবাবুর কথা জিগগেস করেছে।

এবার ছেলেটি দুধদোয়ানোর জায়গাটার দিকে যায়। তার হাতে লাল রুমালটা ছিলই। সেটা একবার লোফে। দেখেই তোখা লাফিয়ে তার সামনে চলে আসে। কিন্তু সে আর ভোখার সঙ্গে খেলে না।

.

০৭৬.

দুধ-দোয়ানো

 প্রথম দিন পাইপ দিয়ে দুধ দোয়ানো শিখতে বাঘারুর তিন-চার মোষ লেগেছিল। পরে বোঝা গেল, শিখতে গিয়েই সে হাঙ্গামা বাধিয়েছে। আসলে শেখার কিছুই নেই, এমনই যন্ত্র যে লাগিয়ে দিলেই হয়ে যায়। হাতের মত একটা রবারের পাতা। তাতে হাতের পঁহ্যাঁচ আঙুলের বদলে একটু ফাঁকে-ফাঁকে চার আঙুল। আঙুলগুলোর মাথা খোলা। মোষগুলোর বাটের ভেতর একটু ফাঁক করে ঢুকিয়ে দিতে হয়, বেলুনের নাখান। তারপর, ঐ ট্রাক থেকে ত পাম্প হতেই থাকে। আর, দুধের মানষিটা ড্রাম ভরতে থাকে। পাইপটা, কাঁচের মত প্লাস্টিকের। ভেতরটাতে, দেখাই যায়, দুধ পাইপটা ভরে চলে যাচ্ছে। যেন দুধটা জলের মত জিনিশ না, গড়ায় না। যেন, দুধটা শক্ত জিনিশ। এই ব্যাট থেকে ঐ ড্রাম পর্যন্ত লেগে আছে। ঐ যে, ট্রাকের ওপর কী-একটা পাম্প করে, তাতে, বাটের ওপর লাগানো ঐ বেলুনের মত জিনিশটা একবার চিপে ধরে, আর-একবার ছেড়ে দেয়, ঠিক আঙুল দিয়ে দোয়ানোর মত।

প্রথম-প্রথম বাঘারু একটা মোষের বাটে পাইপ লাগিয়ে তার পরের মোষটার বাট একটু টানাটানি করত, দুধটা নিয়ে আসতে। এখন তাও করে না। বাছুরের চোষাতেই এসে যায়।

বাথানে বাছুর থাকে না। কারণ, টাড়িতে বাছুরের কাজ অনেক বেশি থাকে। কিন্তু বাছুর না-দেখলে, আর মাঝে-মাঝে বাছুর না-টানলে, আর মাঝে-মাঝে বাছুরের পিঠ না-চাটলে মোষের দুধ আসা বন্ধ হয়ে যায়। সে কাজ একটা বাছুরই করতে পারে। কিন্তু একটা বাছুর এতগুলো বঁট চুষলে তার চোয়াল আটকে যাবে। আর, এতগুলো মোষ মিলে একটা বাছুরকে চাটলে তার চামড়া উঠে যাবে। তাই চারটি বাছুর বাথানের সঙ্গে থাকে।

ব্রিজের মাথায় বাঘারু রাস্তার ওপরেই বসেছে। এতে কাজের একটু অসুবিধে হয়। ওদিক থেকে একটু চড়াই হয়ে মোষগুলোকে ওপরে উঠতে হয়। অনেক মোষ তা করতে চায় না। নীচেই দাঁড়িয়ে থাকে। কোনো-কোনো মোষ আবার ঘুরে পেছনে চলে যায়। ওদিকে যদি কেউ থাকত, তা হলে এখানে বসে কাজ করাই সুবিধে–তলা থেকে পাঠিয়ে দিত, এখানে দুইয়ে নিয়ে, বাঘারু আবার তলায় পাঠিয়ে দিত। ভোখাকে দিয়ে বাঘারু খানিকটা করায় অবিশ্যি, মোষগুলোও ভেখার কথা শোনে। কিন্তু যদি কেউ গড়বড় করে তা হলে মোষ-ভোখা এই সব নিয়ে একটা হুলস্থুল কাণ্ড। সেই জন্যে বাঘারু ভোখাকেও বড় একটা ডাকে না। এই বড় রাস্তার ওপর বসে বাঘারু যেকটাকে হাতের কাছে পায়, দুইয়ে নেয়। তার পর, একবার উঠে গিয়ে বাকিগুলোকে তুলে নিয়ে আসে। মুশকিল হয়, তখন যদি কোনো মইষানিকে খুঁজে পাওয়া না যায়। এই জায়গাটার এটাই সুবিধে যে এদিক-ওদিক আলগা হওয়ার সুযোগ কম।

সারা দিনের ভেতরে একমাত্র এই দুধ-দোয়ানোর সময়টাতেই ত পুরো বাথানকে একটা কাজ শুরু আর শেষ করতে হয়। তাই এই সময়টাতে বাথানের ভেতর এমন একটা ভাব আসে যা সারা দিনে অন্য কোনো সময় ঘটে না। এখন দুধিয়ালগুলো সব চেয়ে আগে, তারা জানে একটার পর একটা গিয়ে দুধ দিয়ে আসতে হবে। বাথানের বাছুরগুলোর খিদে কম। বা দুধের খিদে বিশেষ কিছু আর বাকি থাকে না। এতগুলো বাট। প্রত্যেক বাট একবার করে চুষলেই চারটি বাছুরের পেট ঢাক হয়ে যায়। ফলে মইষানিগুলোর বাট ফুলে বোধহয় ব্যথাও করে। পাম্প করে যে দুধটা টেনে নেয় তাতে নিশ্চয়ই শরীরে একটা আরাম ছড়িয়ে পড়ে। তাই মইষানিরা যখন বুঝে যায় যে এবার দোয়ানো হবে তখন তারা কাছাকাছিই থাকে, যেন চায়, দোয়ানোটা একটু আগে হোক।

আর বাছুরগুলো ত আর খিধেয় জ্বালায় চাটে না। বাট টানার নেশা ত দুই-চার বাট টানলেই মিটে যায়। তার পর ঐ চারটি বাছুর মিলে পুরো লাইনটাতে গোলমাল বাধায়। এই দুধিয়ালের পেছনে মাথা ঢোকায়, আর-এক মইষানির পেটের তলায় ধাক্কা দেয়। এমন ছুট লাগায় যেন সামনে কোনো বাধা নেই। তার পর কোনো কিছুতে লেগে পড়ে যায়। আবার গা ঝাড়া দিয়ে ওঠে, ছোটে।

বাছুর আর দুধিয়াল ছাড়া এই সময় অন্য মোষদের ত কোনো কাজে থাকে না। তাদের কেউ-কেউ, বিশেষত বুড়িয়াল, বলদখান আর দু-একটি বুড়ি মইষানি তলাতেই থাকে। কিন্তু ছোকরাছুকরি মোষগুলো কিছুটা এই রাস্তার ওপর উঠে আসে, আর, কিছুটা ছড়িয়ে যায় আশেপাশে। পিচের রাস্তার ওপর দিয়ে মোষগুলো চলতে গেলে পা ভেঙে যায়। সেই জন্যেই মোষগুলো দাঁড়িয়ে থাকে রাস্তার ওপর, কিন্তু হাটে রাস্তার পাশ দিয়ে।

বাঘারুর মাথা এখন মোষের পেটের তলে। আর এইখানে বসে বসে সে পেটের তলা দিয়ে-দিয়ে। অনেকখানি দেখতে পায়। পেচ্ছাব আর গোবরের গন্ধটা নাকে বেশি লাগার কথা, যদি বাঘারু ঐ গন্ধগুলোকে আলাদা করে চিনতে পারত। এখন, সেই গন্ধের মধ্যে এক বাটে পাইপ লাগিয়ে সে পরের বাটের দিকে হাত দেয়। হাত দিয়েই বোঝে বাছুরের চাট পড়েছে কি পড়ে নি, শক্ত না নরম, শুকনো না ভেজা। বাঘারু জিভের টাকরায় অন্যরকমের আওয়াজ তোলে। আর দু-একটা বাছুর চলে আসে। বাছুরের ঘাড়টা ধরে বাঘারু বাটের মধ্যে ঢুকিয়ে দেয়। বাছুর ব্যাট থেকে মুখটা সরিয়ে আনতে গেলে বাছুরের কানটা ধরে কাত করে। তারপর এক হাতে বাট আর-এক হাতে বাছুরের মাথা ধরে কাছাকাছি টেনে আনে। যার বাট নিয়ে টানাটানি সেই দুধিয়াল জিভটা বের করে একটু গা চাটতে চায়, পায় না। ডান থেকে বায়ে ঘাড় ঘোরায়। বাটে টান পায়। তৃপ্তি জানানোর আর-কোনো উপায় না পেয়ে দুধিয়াল একটা লম্বা আ-আ-আঁ ডাক ছাড়ে তার স্তন্যের সেই পায়ীর জন্যে যে-এখন তার স্তনলগ্ন। দুধিয়ালটার পেছনের পা দুটো একটু ফাঁক করা–যাতে ভাল ভাবে টানতে পারে। এর ভেতর আগের মোষটার দোয়ানো শেষ হয়ে গেলে বাঘারু বা হাতে সেই পাইপটা খুলে, ডান হাতে বাছুরটাকে ব্যাট থেকে সরিয়ে পাইপটা লাগিয়ে দিতে যায়। বাটে একবার অনিচ্ছুক মুখ লাগালেও বাছুর আর মুখ সরাতে চায় না। বাঘারু এক ধাক্কায় সেটাকে সরায় ও পাইপটা লাগায়। দুধিয়াল পেছনের পা দুটো ফাঁক করেই থাকে। আর পাইপের ভেতর দিয়ে আসা স্পন্দিত টান বাটে বোধ করতে করতে তার তৃপ্তি জানানোর জন্যে একটা লম্বা আ আ আ ডাক ছাড়ে তার স্তন্যের সেই পায়ীর জন্যে যখন সে আর তার স্তনলগ্ন হতে পারে না। দুধিয়ালের সব চেয়ে আরামের সময় এইটাই, যখন তার ব্যাটে টান পড়ে তার শরীরের ভার হালকা হয়ে যায়। বাঘারু তার দুই কর্কশ হাতে তার তল পেটটা হাতিয়ে দেয়, গলাটায় সুড়সুড়ি দেয়, পেটের ভেতরটা চুলকে দেয়। দুধিয়ালটার পেছনের পা বেয়ে শিহরণ খেলে যায়। তার পিঠের চামড়াও চমকে-চমকে ওঠে। একবার পেছনের বা পা মাটিতে ঠোকে। বাঘারু এতক্ষণে পরের দুধিয়ালের ব্যাটে হাত দিয়ে দেখে নেয় বাছুরের চাট পড়েছে কি না।

এরকম দুধ দুইতে আর কতক্ষণ লাগে। বাঘারু ট্রাকটার কাছে এসে দাঁড়ায়। সেই লোকটি একটা কাগজের পেছনে বাঘারুর টিপসই নেয়। টিপসই-এর স্ট্যাম্পপ্যাড তার পকেটেই আছে। সেই কাগজে কী হিশেব লেখা আছে আর বাঘারু তাতে কী টিপসই দিল–সে কোনো কিছুই ত বাঘারুর পক্ষে জানা সম্ভব নয়। সে এটা বোঝে কত দুধ দোয়ানো হল তারই একটা রশিদ ওটা কনট্রাক্টার জোতদারকে দেবে। মাসের শেষে ঐ কাগজ দিয়েই হিশেব হবে। এ ত আর দু-চার সের দুধের ব্যাপার না, যে, এক পোয়া আধ পোয়া হিশেবের গোলমাল হবে। প্রত্যেক দিনই একই সংখ্যক মোষের দুধ একটা পরিমাণেরই হওয়ার কথা। এর মধ্যে দিন তিনেক বাঘারুর একটা দুধিয়ালকে দোয়ায় নি। বাটে ঘা হয়েছিল। সেই কয়েক দিন বাঘারু ঐ রশিদের পেছনে একটা দাগ দিতে বলেছে। তার নীচে সে টিপসই দিয়েছে। সে মুখে বললে দেউনিয়া না-ও বিশ্বাস করতে পারে। কিন্তু অবিশ্বাসই বা করবে কেন? একটা মোষের দুধ না-দুইয়ে বাঘারু করবেটা কী?–খাবে? কত খাবে বাঘারু? বেচিবে? কাক বেচাবে? পাহাড়ক? তা ছাড়া কনট্রাক্টরের লোকটা ত রোজকার হিশেব বুঝে নেয়। সে দেখবে না যে কটা মোষ দোয়ানো হল, কটা বাদ গেল, কেন গেল। কিন্তু সেসব ত কাথার কথা। বাঘারু একখান দাগ দিয়া টিপসই দিছে যে একখান তারিখ দেয়া হয় নাই।

দুধ নিয়ে ট্রাকটা সোজা চলে যায়। ড্রাইভার আর সেই লোকটা হাত বাড়িয়ে বাঘারুকে বিদায় জানায়। ট্রাকের পেছনে ডালার ওপরে সেই ক্লিনার ছেলেটা বসে। তার দিকে তাকিয়ে ঘাড় উঁচু করে ঘেউ-ঘেউ করতে করতে ভোখা ভুকতে-ভুকতে যায়। ছেলেটির লাল রুমাল এখন তার দাতে চেপে ধরা। সে ভোখার ডাক শুনতেই পায় না যেন, কেমন উদাসীন মুখ ঘুরিয়ে নেয়। তোখা, ডায়না ব্রিজ, এই মোষের পাল, বাঘারু ফরেস্ট ও পাহাড় থেকে সোজা, যেদিকে ট্রাক চলেছে, সেই দিকে। এই সকালের আলোয় তার চোখে এখন মধ্যরাত্রির গোপন হত্যা লেগে গেল?

ট্রাকটার চলে যাওয়া বাঘারু আর মোষগুলো দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে দেখে। বেশ অনেকক্ষণ দেখা যায়, এরোপ্লেনের মত ছোট হয়ে মিলিয়ে যাওয়া পর্যন্ত। তার পরেও আওয়াজটা শোনা যায়। এদিকে পাহাড়, বন, নদী, চাবাগান। সুতরাং এই ছোট ট্রাকের এত আওয়াজ এই সব নানা জায়গার ওপর দিয়ে, ধাক্কা খেয়ে-খেয়ে গড়িয়ে, প্রতিধ্বনিত হয়, চার পাশের আরো নানা আওয়াজের সঙ্গে মিশে-মিশে যায়।

সারা দিনের মধ্যে এই কাজটা সব চেয়ে দরকারি। আর সারাদিনের ভেতর এই একবারই ত এতগুলো লোকের মুখ দেখতে পায় বাঘারু। বাঘারু ছাড়া অন্য লোকের মুখ দেখতে পায় এই এতগুলো মোষ। তাই, তারা চলে গেলে কিছুক্ষণের জন্যে এমন একটা ভাব আসে যে আবার আগামীকাল সকালে এই কাজটা করতে হবে। কিন্তু সে ভাবটা এতই কম সময়ের জন্যে আসে যে আওয়াজটা মিলিয়ে যাওয়ার আগেই মিলিয়ে যায়।

বাঘারু ব্রিজটার রেলিঙের পাশে বাধানো উঁচু জায়গাটায় বসে। সে ত এই কাল কুচকুচে বাঁধানো রাস্তা আর শাদা ফটফটে বাধানো ব্রিজে দিনে একবারই আসে। তাই তার মনে হয়, যেন অনেক দূরে এসেছে।

এই যে বা থেকে ডাইনে রাস্তাটা এত পরিষ্কার চলে গেছে বনটাকে দুই ভাগ করে, তাতেই কেমন গোলমাল লাগে। যেন কোনো একটা দিক আটকা পড়ে গিয়েছিল, এই রাস্তাটা সেই দিকটা খুলে দিয়েছে। যদিও এই রাস্তা দিয়ে তাকিয়েও দিগন্ত দেখা যায় না, তবু বাঘারু বোঝে এই রাস্তার দু পাশে দুটো দিগন্ত আছে।

বাঘারু যেখানে আছে ডায়নার সেই বনে দিক বা দিগন্ত নেই। এক আকাশ আছে, আর মাটি আছে। বাঘারু যে এসব খুব ভাল মত বোঝে তা নয়। কিন্তু এই ব্রিজেরই তলায়, বা সামনের ফরেস্টে, বা পেছনের চরে, চব্বিশ ঘণ্টা থাকা সত্ত্বেও সকালে এই কিছুক্ষণের জন্যে এই রাস্তায় আর ব্রিজে এসে বহু, দূরে কোথাও এসেছে বলে তার মনে হয়। যা কিছু আমাদের অভ্যাসের বাইরে তাই ত দূর!

.

০৭৭.

 বাথান : কায়ও কারো না, সগায় সগার

বাঘারু এখন বাথান নিয়ে ডায়না ফরেস্টের ভেতর।

সেই বুড়িয়ালের ওপর বাঘারু শুয়ে। বুড়িয়াল দুলে-দুলে চলে। আর বুড়িয়ালের পিঠে বাঘারুও দোলে। দুলতে-দুলতে বাঘারু ফরেস্টটাকে উল্টো দিক থেকে দেখে–যেমনটা এমনিতে দেখা যায় না। যেন, এই গাছের পাতার ফাঁকফোকর দিয়ে যে আকাশটা ছিটিয়াল দেখা যায়, সেই আকাশটাতে গাছগুলোর পাতা-ডাল পোতা আর শেকড়কাণ্ড এই সব ওপর দিকে তলা। বাঘারু ত মাটির ওপরের জঙ্গলটা দেখতে পায় না। মাথার ওপরের গাছের পাতার গোল ছাউনি অনেক ওপরে। মাঝখানে নানা মাপের নানা গাছের পাতা ছড়ানো আছে বটে কিন্তু কোনো সময়েই তা মাটির জঙ্গলের মত ঘন নয়। বাথান নিয়ে বাঘারুর বেলা এমনই অলস কাটে এই ফরেস্টের ভেতর, যে সে ফরেস্টটাকেও সোজা দেখে না।

বুড়িয়াল একটা ছোট হাতি-সাইজের মোষ বুড়ি কাছার পাড়ি (বিরাট, বুনোটে, স্ত্রী মোয)। ওর আর বাচ্চা হবে না। দুধ দেয় না। এমনি কোনো কাজে আসে না। কিন্তু বাথানে এমন একটা পাড়ি না থাকলে, সে বাথান ত বাথানই নয়। টানা খাড়া শিং। ফরেস্টের ভেতর যখন চলে নিচু লতা-পাতা, ডালপালা সেই শিঙে লেগে যায়। শিং দুটো তুলে সামনে দাঁড়ালে মনে হয়, ছোট সাইজের কোনো বাঘকে গুঁতিয়ে দুই শিঙে গেঁথে ঘুরিয়ে ফেলে দিতে পারে। গায়ের নোম লালচে। দুই চোখের মাঝখানে এতটাই জায়গা যেন ডায়না নদী বয়ে যেতে পারে। পুরোপুরি লম্বা হওয়ার আগেই মুখটা থেতলে গেছে। একবার হাঁ করে জিভ নাড়লে কাঠাখানেক জঙ্গল সাফ করে দেবে। কপালের দু পাশে চোখ দুটো নাক থেকে এত তফাতে যেন সব সময়ই একসঙ্গে দুটো জিনিশ দেখছে। একটা জিনিশই দুই চোখ দিয়ে দেখার জন্যে লাল চোখ দুটোর মণি ঘুরপাক খেয়ে নাকের পাশে চলে আসে। হাতির পাল, বা বাঘ, বা ওইকিয়া (একা) গুণ্ডা হাতি যদি এসে দাঁড়ায় তাহলে পুরো বাথানের মধ্যে এক এই বুড়িয়ালই খাড়া শিং আর পুরো বুক তুলে দাঁড়াতে পারে। বাঘারু দেখেছে, ঐ রকম করে যখন দাঁড়ায়, তখন তার গলার নীচে সামনের দুই পায়ের মাঝখানে এতটা জায়গা খুলে যায় যে পুরো বাথানটাই সেখানে ঢুকে গা বাঁচাতে পারে।

এই বাথান ত কিনি-কিনি বনাইছে দেউনিয়া। এই বাথানের কুনো মইষ কুনো মইষের কায়ও না। কিন্তুক দেখিলে মনত খায়, সগায় বুঝি বুড়িয়ালের বাচ্চা। কায়ও না। কিন্তু বুড়িয়াল যখন খাড়ি যায়, স্যালায় মনত খায় কি, তামান মইষ ঐ বুড়িয়ালের প্যাটতঠে বাহিরত আইচচে।

বাথানে যেমন বুড়িয়াল আছে–কায়ও ওর বাচ্চা না-হয়, ও সগারই মাও–তেমনি আবার দু-দুটো বুড়ো মোষ আছে, যেগুলো আগে বাপ-মহিষ ছিল, এখন বুড়ো ও বাতিল হয়ে আছে।

-কুনো মইষানির প্যাটত ও বাচ্চা দিবার পারে না, তবু বাথানে থাকে। এমন বাতিল ও বুড়ো মোষ দেখলে মনে হয় বাথানটা যেন এই ফরেস্টের গাছগুলোর মতই পুরনো। ফরেস্টের ভেতরে যেমন বুড়ো জন্তুও থাকে, চ্যাংড়া জন্তুও থাকে, বাথানেও তেমনি। এটাও ত কিনতেই হয়েছে দেউনিয়াকে। এই সব মোষের দাম কম। কিন্তু বা খানে রাখতে হয়। কোনো-কোনো সময় ত কাজেও লাগে। যদি ফরেস্টের মধ্যেই কোনো বড় শালগাছ পড়ে থাকে–দড়ি বেঁধে এই সব মোষের গলায় বেঁধে দিলে সেটা টেনে রাস্তার কাছে নিয়ে যায়। আর, একটা শালগাছ যদি বেচে দেয়া যায়, তা হলে বাথানের দুধবেচার আর দরকার নেই। এখানে, এই ডায়না ফরেস্টে তার সুবিধে নেই। পহাড়ি জায়গায় গাছ টেনে নেয়া মুশকিল। টেনে নিয়ে গেলেও রাস্তার ধারে কোন ট্রাকে তুলবে? এখানে আর সারা দিনে কটা ট্রাক যায়? সে-সব সুবিধে লাটাগুড়ি-ওদলাবাড়ির দিকে। কিন্তু গয়ানাথের এই বাথান যে আগামী বছরেও এখানেই থাকবে, তা কে বলতে পারে? বা, তেমন হলে ত এই বুড়ো মোষটাকেই গয়ানাথ লাটাগুড়ি ওদলাবাড়ির কাছে নিয়ে যেতে পারে। সেখানে একটা চোরাই শালগাছ রাস্তার পাশে ফেলে রাখলে বেচতে আর কতক্ষণ লাগে? তাই বাথানে এই দু-দুটো বুড়ো মোষকায়ও উমরার বাচ্চা না-হয়, উমরায় সগার বুড়া বাপ।

বাছুর চারটে ত আছেই–নইলে বাট চেটে দুধ আসবে কোত্থেকে। এ চারটে বাছুরের কোনোটাই হয়ত এ বাথানের নয়। হয়ত বাছুরও দেউনিয়া কিনে এনেছে। বা, হয়ত বাড়িতে তার যে-মোষগুলো আছে তাদেরই বাছুর এই কটি। এখন বাথানে পাঠিয়েছে। বাথানে মোষ তাড়াতাড়ি বাড়ে। বাথানে বাচ্চা হলে দেউনিয়া নিয়ে যায়। বেশি বাছুর রাখার চাইতে বেচে দেওয়ায় লাভ বেশি। শুধু নিজের বাথানটা যাতে ভরে ওঠে, ভরা থাকে, তার জন্যে যতগুলো বাছুর রাখার, রেখে, বাকিগুলো বেচে দেয়। –এই বাছুর গিলান কায়ও বাথানের বাছুর না-হয়, কিন্তু সবগুলা মইষানির এই চারিটাই বাছুর, এই চারিটাই।

দুধিয়াল মইষানিগিলাই ত বাথানের আসল জিনিশ। পুরা বাথানখানই ত উমরার তানে আছে। বাঘারুও ত উমরার তানে আছে। যত খিলায়, দুধ হয় তত ভাল। কিন্তু দুধ হওয়ার ভেতরেও ত একটা নিয়ম তৈরি করতে হয়। সবগুলো মইষানি যদি একসঙ্গে দুধ দেয়, তা হলে দুধ বন্ধও ত হবে একসঙ্গে। তাই সবার একসঙ্গে বাচ্চা হওয়া চলে না। কিন্তু যেগুলো দুধ দিচ্ছে, তাদের চালু রাখাটাই বাথানের প্রধান কাজ। তেমন-তেমনি বিপদ হলে ত সব মোষ ছেড়ে ঐ কটি মোষকেই প্রথম বাঁচাতে হবে বাঘারুকে। বাথানের সব মোষই দুধিয়াল না, কিন্তু দুধিয়ালরাই বাথানের সব।

আজি না-হয় দুধিয়ালক দিয়া চালাছ, কালি কী হবে? কী হবা পারে? কাল কী হবে? বাথান ত বছরের পর বছর থাকবে, বছরের পর বছর দুধ দেবে। তোমার ত শুধু এখনকার, এই মাসের, বা এই বছরের হিশেব করলে চলবে না। দুধটা ত কোনো দুধিয়ালের একার না। দুধটা ত পুরা বাথানের। তাই যতগুলো দুধিয়াল আছে, ততগুলো, বা তার বেশিই আছে, এমন মাদিমোষ, যাদের প্রথম বাছুর এখনো হয় নি। সেই ডবকানি মোষগুলো বাথানে আছেই বাথান চালু রাখার একমাত্র উপায় হিশেবে। এ সংখ্যা ত প্রায় সব সময়ই হিশেবে থাকে কটা মোষ গাভিন হল, কটা আরো হবে, তাদের বাছুর হবার দিন কবে, কবে থেকে দুধ দেবে, তার ভেতর কটার দুধ বন্ধ হবে, পরের বছর আবার কটা গাভিন হবে।

এই মোষগুলোকে গাভিন করবার জন্যে সঙ্গে আছে একটা ওয়ালি পাড়া। –সে শালোর ত আরকুনো কাম নাই, ঘাস খায় আর ঝিমায়, ঝিমায় আর ঘাস খায়। চলিবার বলিলে, ঘুমি-ঘুমি চলে। আর য্যালায় জাগিল অমনি উমরা গিয়া একখান মইষানির পাছত দুইখান পাও তুলি দিল। শালোর ঐ তিনখানই কাম-খাওয়া, ঘুম আর–। আর বাঘারুকে সাবধান থাকতে হয় ঐ একটি ব্যাপারেই। সে জানে, এই বাথান কী ভাবে বাড়তে পারে–সংখ্যায় আর দুধে। আর সেই অনুযায়ী ওয়ালি পাড়াকে চালাতে হয়, কখন কার পেটে বাচ্চা বানাবে।

কিন্তু সাবধানতার আর-একটি প্রধান কারণও আছে। বাথানে ওয়ালি পাড়া একটার বেশি রাখা যায় না। কিন্তু এই ফরেস্টের কাছাকাছি কোথাও অন্য কোনো বাথান থাকতে পারে। তাদের ওয়ালি পাড়া এই দলে এসে ভিড়তে পারে। তার পর একটা-দুটো মাদি-মোষকে ভাগিয়ে নিয়ে যেতে পারে। বা, কাছাকাছি কোথাও যদি কোনো একোই (একা) খুটা অরনা (বুনো) থাকে, সে ত এই বাথানের মইষানিদের ভাগিয়ে নিয়ে নিজের দল বানাতে পারে। বাথানে মোষ-মইষানি একসঙ্গে থাকে–একা থাকতে ভয় পায় বলে। কিন্তু সেই সাহসটা যদি অন্য কোনো মোষ তাকে জোগায় তা হলে তার সঙ্গেও চলে যেতে পারে। মহিষ যদি বাথান ছাড়ি পালবার চাহে, কুনো বাথানদারের কুনো খ্যামতা নাই উমরাক ঠেকাবার পারে। সেই জন্যেই সতর্ক নজর রাখতে হয় কোনো মইষানির শরীর যদি গরম খায়, সে গরম যেন নষ্ট না হয়।

আবার তার সঙ্গে-সঙ্গে একটা লোভও ত থাকে। তেমন গরমের সময় কোনো মইষানি যদি কোনো অরনার (বুনো মোষ) সঙ্গে ভাব করে, তা হলে তার পেটে দোমাচা বাচ্চা হয়–তার গায়ের জোর বেশি, দুধ বেশি। বাথানের মইষানি বাথানেই বাধা থাক, কিন্তু অরনার বাচ্চা পেটে ধরুক।

এই ত বাথান–কায়ও কারো না। সগায় সুগার। যার একোটাও বাচ্চা নাই, সেইলা সগার মাও। যে-বাছুর গিলার একোটার মা নাই, সেইলা সগার বাছুর। যে-মইষানির এ্যালায়ও বাছুর নাই, স্যায়। বুনাক ধরিবে কিন্তু বাথানও রাখিবে। আর এ-সব কিছুই গয়ানাথের।

এই ওয়ালি পাড়া এই কুমারী পাড়া এই অরনা, এই দোমাচা, সব গয়ানাথের। যে-মোষ এই, বাথানে, যে-মোষ ঐ হাটে, যে-মোষ গোয়ালে, সব গয়ানাথের।

যায়লার জন্ম হইছে, যায়লার জন্ম হয় নাই, যায়লা জম্মিবে, যায়লা মরিবে, সব গয়ানাথের।

.

০৭৮.

বাঘারুবাড়ি

 –সগায় গয়ানাথের। এই ডায়নার জঙ্গলখান গয়ানাথের। হু-ই আপলাদের জঙ্গলখান গয়ানাথের। এই ডায়না নদীখান গয়ানাথের। হু-ই তিস্তা নদীখান গয়ানাথের। ঐঠে জমিগিলান গয়ানাথের। এইঠে জঙ্গলখান গয়ানাথের। এই বুড়িয়াল গয়ানাথের, দুধিয়াল গয়ানাথের, পোয়াতিখান গয়ানাথের। এই বাঘারু মইষ্যালখান গয়ানাথের

বাঘারু আকাশময় ফরেস্টের দিকে তাকিয়ে ভাবে। বুড়িয়ালের পিঠের ওপরে চিৎপাত শুয়ে থাকে–দুটো পা বুড়িয়ালের পেট দিয়ে ড্যাং ড্যাং করে নীচে দোলে আর এই ফরেস্টের পাতাগুলোর, মাথাগুলোর নানা নকশা চোখের সামনে সামনে বদলে বদলে যায়, পাতাগুলোর ভেতর দিয়ে বহুবহু। ওপরে ছিটিয়াল আকাশ দেখা যায় বাঘারু গাছের পাতার দিকে তাকিয়ে বুঝে যায়, তারা সেই পোরালি বাড়ির (পোড়া বন) দক্ষিণ দিয়ে যাচ্ছে। এখন যদি বাঘারু ডাইনে তাকায়, সেই পোড়া গাছগুলোর লাইন দেখতে পাবে। তার ওদিকে ডাইনাং কি বাইনাং-এর ছড়া (শুকনো নদীখাত)।

কুনোবার বানায় জল উঠি আসি ঐঠে গাছগিলানক পুড়ি দিছে হয়ত। জলত ক্ষার আছিল। সেই জলত তামান বনখান মাটিখোলা হয়্যা গেইসে। তার বাদে ফরেস্টের মানষিলা অগুন লাগি পুড়ি দিছে। কেনে? না, ঐঠে আর নতুন মাটি না-পড়িলে নতুন জঙ্গল গজাবে না। তা পুড়ি দাও। যেইলা বন মাটির আগুন পুড়ি যায়, উমরাক আগুন লাগি পুড়ি দাও। তাই ঐঠে পোরালি বাড়ি

কিন্তু এই জায়গাটা ত ভরভরন্ত বন, এই জায়গাটা, যেখানে মোষের পিঠে চিৎপাত হয়ে বাঘারু আকাশের বন দেখে মাটির বনের হদিশ পায়।

গয়ানাথ মোক এইঠে পাঠাছে। বাথান করিবার। মুই আধি চাহ নাই। মোক বাথান দিছে। এইঠে মোক কায়ও খুঁজি পাবেন না। মুইও কাক পাম না। মুই এইঠে আগত আসি নাই রো। মুই এইঠেকার বন চিনি নাই রো। গয়ানাথ মোক এইঠে পাঠাছে। মোর অচিনা জায়গাটাত্ পাঠাছে। মোক উদাস করিবার তানে পাঠাছে–।

বুড়িয়াল বা দিকে একটা নালীর মধ্যে সামনের বা পা দিয়ে ফেলায় বেঁকে যায়। বাঘারু নড়ে ওঠে, কিন্তু উঠে বসে না। সে জানে, হেঁটে গেলেও এমন হেঁচট সে খেতে পারত। বুড়িয়াল জানে, বাঘারু তার পিঠে উঠে বাথানে ঘোরে, এটাই বুড়িয়ালের সব চেয়ে বড় কথা। তাই বুড়িয়াল ঠিক সামলে নেবে।

একটু দাঁড়িয়ে পড়ে বুড়িয়াল। পেছনে বোধহয় একটা ছোেট মোষ ছিল। সেটা যখন পাশ দিয়ে যায় বাঘারুর পায়ে ঘষা লাগে। বাঘারু বা হাতটা বাড়িয়ে মোষটাকে ছুঁতে চায়। কিন্তু পারে না।

ততক্ষণে বুড়িয়াল পেছনের পা দুটো সরিয়ে এনে, সামনের বা পাটাকে তুলে এনে আবার সমান হয়েছে। আকাশজোড়া বনের দিকে তাকিয়ে বাঘারুর নিজেকে নিয়ে এমন কিছু একটা কথা মনে আসে, যার ভাষা তার জানা নেই। তবু তাকে এরকম ভাবতে হয়, এই বুড়িয়ালটা গয়ানাথের। এই বাঘারুখান গয়ানাথের! এই জঙ্গলখান গয়ানাথের। বুড়িয়ালের পিঠত বাঘারু শুই থাকে। গাছ দেখে। আকাশ দেখে। আর দোলা খায়। দোলা। বুড়িয়ালের নাখান এ্যানং চওড়াকিয়া পিঠ আর কার আছে? কায়রো না। কায়রো না। বাঘারু আকাশের দিকে তাকিয়ে বনের গাছগুলো দেখে আর চেনে, এই ঠে কোশল-বাড়ি (হরিতকি গাছের জঙ্গল) শুরু হয়্যা গেইল। তামান বনত এইঠে শুধু, ধর কেনে পঁচিশ-তিরিশখান কোশল গাছ আছে। আর কোটত নাই। কোনামারা পাতাখান, আর গুলটিমারা উঁটখান। পাতা আর ভঁটা সেইঠে মিলে এইঠে একখান ছোট গোল নাখান গুলটি–

 বাঘারু ত নীচ থেকে পাতাগুলো দেখছে, পাতার তলাগুলো, ক্যানং লোম-লোম হয়্যা আছে।

বাঘারু জানে সে যদি নীচে নেমে খোঁজে এত কোশল পাবে যে রাখার জায়গা খুঁজে পাবে না। শহরে নিয়ে গেলে কবরেজের দোকানে বিক্রি হয়। হাটে নিয়ে বসলেও বিক্রি হয়-খয়েরি রঙ বানাতে। কিন্তু বাঘারুর ত তার দরকার নেই। বাঘারু এই জায়গাটার নাম দিয়েছে কোশলবাড়ি।

হেঃ গয়ানাথ, মোক এইঠে পাঠাছে অচিনা দেশত্। আর মুই এইঠে একখান বাড়ি বানি নিছু। বাঘারুবাড়ি। কোটত যাছেন? না, কোশলবাড়ি। কুন কোশলবাড়ি? না, ঐ পোরালিবাড়িখানের দক্ষিণে আর হুই যে বড় গর্জালি বাড়ি (বর্ষার ঘাসজঙ্গল), ঐটার পচ্চিম পাখত–নদীর নাম ডাইনাং. থানার নাম নাগরাকাটা, গ্রামের নাম, বাঘারুবাড়ি।

বাঘারু আপনমনে খিক খিক করে হাসে। আর হাসির ফুর্তিতে ডান গোড়ালি দিয়ে বুড়িয়ালের পেটে মারে খোঁচা। আর বুড়িয়াল তার জবাবে ওর লেজ দিয়ে সেই পায়েই মারে ঝাঁপট।

শালো গয়ানাথক গিয়া কহিবু, হে দেউনিয়া, তোমার বাথানখান আছে, ধরো কেনে–ডাইনাং নদীর ডাইনের যে-ঘাসবন, তার পচ্চিম পাশের পাহাড়ের গা দিয়া উঠি, ডাইনে ঘুরত যাবেন। তার বাদে দেখিবেন কনেক-আধেক পাতলা-পাতলা জঙ্গল, তার বাদে বাঘারুবাড়ির পাহাড়। তার মধ্যে কোশলবাড়ি, তার বাদে।

বাঘারু এবার হেসে উঠে বুড়িয়ালের ওপর পিঠ নাচিয়ে ফেলে প্রায়। গয়ানাথের মুখটা তার চোখের সামনে ভাসে। এই ফরেস্টটা গয়ানাথের, বাথানটা গয়ানাথের, বাঘারু গয়ানাথের। কিন্তু গয়ানাথ যদি এখন এই ফরেস্টে, এই বাথানে, এই বাঘারুকে খুঁজে নিতে চায়? খ্যাক খ্যাক করে কোমর নাচিয়ে এমন হাসতে হয় বাঘারুকে! শালো, কোটত খুঁজিবে মোর দেউনিয়া, মোক? আর এই বাথানক?

এটা একবার মনে হওয়ার পর হাসি আর যেন থামতে চায় না বাঘারুর। শেয়াল ডাকার মত খ্যাক-খ্যাক করে হেসেই যায়। বাঘারু ত এমন কিছু বলতে পারে না, যা দেখতে পাচ্ছে না। বাঘারু ত এমন কিছু ভাবতে পারে না, যা সে দেখতে পাচ্ছে না। বাঘারু ত এমন কিছু ভাবতে পারে না যা সে তার শরীর দিয়ে করতে পারে না। তাই বাঘারুর এমন হাসি, এমন থামতে না-চাওয়া হাসি। কারণ, তখন ত সে দেখতে পাচ্ছে গয়া-দেউনিয়াকে, হুই ডাইনাং ব্রিজের উপর, এদিক চাহে, জঙ্গল, ঐ পাখে চাহে, নদী, হু-ই পাখে চাহে পাথর, হেই পাখে চাহে বালুবাড়ি। গয়া-জোতদার জানে এইঠে তার বাথান থাকে। কিন্তু ব্রিজঠে নামিবার পথ পায় না। ত খুঁজ কেনে, খুঁজ। ব্রিজের উপর, আস্তার উপর তোর বাথানখান খুঁজ।

এই দৃশ্যে বাঘারুর হাসি আর থামতে চায় না যে বাথানের সঙ্গে বাঘারু কেমন ঘুরে বেড়াচ্ছে, আর গয়ানাথ তার নিজের জঙ্গলবাড়ি আর বাথানবাড়ি আর বাঘারু মাইষ্যালক খুঁজি পায় না, খুঁজি পায় না।

খুঁজু কেনে, খুঁজ, খুঁজি-খুঁজি দেখ, কোটত গেইল তোর মাইষ্যাল আর বাথান, বাঘারু দেখে তারা তখন চালতা বনের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে, আরে রে রে, রররররর আওয়াজ তুলতে-তুলতে বাঘারু উঠে বসে। বুড়িয়ালের পিঠে পা দু-দিকে ঝুলিয়ে বসা যায় না, পেটটা এত চওড়া। বাঘারু মোষের উল্টোদিকে মুখ করে, তাই তাকে বা পা তুলে নিতে হয়। ততক্ষণে বুড়িয়াল থেমে গেছে। বাঘারু বুড়িয়ালের ওপর উঠে দাঁড়ায়। আর পাকা চালতা খোঁজে। ওপরের ডাল ধরে, টর ররর আওয়াজ দিতেই বুড়িয়াল খুব ধীরে হাঁটে। বাঘারু তিন-চারটি চালতা পেড়ে, বুড়িয়ালের পিঠে এবার মুখ সোজা করে বসে, টর দিতেই বুড়িয়াল আবার চলতে শুরু করে। হাত বাড়িয়ে বুড়িয়ালের অন শিংটার আগায় মেরে বাঘারু চালতাটা ফুটো করে নেয়, তার পর হাত দিয়ে ছেলে। পাকা চালতার গন্ধে তার জিভ জলে ভিজে যায়। ডান পা মুড়ে রাখায় মোষের পিঠে যে ফাঁকাটা তৈরি হয় তার ভেতরে বাকি চালতাগুলো রেখে বাঘারু দুই হাতে পাকা চালতা তার মুখগহ্বরে ঠেসে ধরে আর সেই রসে মুখ ভরে যায়। সেই স্বাদে ও গন্ধে হঠাৎই বাঘারুর মনে পড়ে যায় পাকা চালতা বনে হাতির পাল আসে। সে। একবার চোখ তুলে তাকায় এদিক-ওদিক।

.

০৭৯.

 বাথানে গৃহযুদ্ধ

 বাঘারু তার গলাটা সোজা করে সেই পাখির ডাকটা ওঠে আচমকা-অ-অ-অ-অক, ক-অ-অক। ডাকটার সবই হয়, কিন্তু বাঘারুর নিজেরই মনে হয়, কেউ.একজন নকল করে ডাকছে। হয়ত বাঘারু নিজেই অমন ডাকছে বলে তার তাই মনে হচ্ছে। কিন্তু বাঘারু কি আর ঐ পাখিটার মত কাপিকাঁপ উঠিছে, শরীরের গরমত? তবে বাঘারুর ডাকে শরীরের সেই কাঁপন আসবে কোত্থেকে। বাঘারু আরো একবার সেই পাখিটার ডাক ডাকে–ক-অ-অ-অক, ক-অ-অক। শেষের কৃ-টা যেন শোনাই যায় না, এমনই গভীর খাদে নেমে যায়। ঐখানটাতেই মনে হয়, পাখিটার শরীর কাপি কাঁপ উঠিছে। কিন্তু বাঘারু একবার দেখতে পাবে না, পাখিটাকে, একবার দেখতে পাবে না?

হে-এ-ই, হে-ই, হে, হে, হে-ই, বলতে বলতে বাঘারু সোজা হয়ে বসে আর বুড়িয়ালের পেটে গোড়ালি দিয়ে খোঁচা মারে। বুড়িয়াল হনহন করে চলতে শুরু করে আর বাঘারু দুলে-দুলে ওঠে। হে-এই, হে-ই, হে-হে, বাঘারু বুড়িয়ালের পেটে গোড়ালি দিয়ে আরো এক খোঁচা মারে, তাড়াতাড়ি, তাড়াতাড়ি, সেই ওয়ালি পাড়া (ফাঁড়) সেই ভর-পোয়াতি মইষানিকে ঐ দিকের জঙ্গলটাতে এমন ছুঁসাচ্ছে যে মইষানিটা পড়ে যাবে, এখুনি, আর, পড়ি গেলে ত ঐটা আরো খতম করিবে। হে-ই ভোখা, ভোখা, বাঘারু ততক্ষণে বুড়িয়ালের দুই শিং ধরে উঠে দাঁড়িয়েছে। বুড়িয়ালের পিঠে খাড়া বাঘারুর মাথায় নিচু ডালপালা দুটো-একটা লাগছে। বাঘারু একবার ডান হাতে, একবার বা হাতে সেগুলো, সরিয়ে-সরিয়ে দিচ্ছে। কখনো শিংটা ধরছে। কখনো ধরছে না। ভোখা বহু সামনে কোথাও ছিল। বাঘারুর ডাক শুনে ছুটে এদিকে আসতে-আসতেই তার নজরে পড়ে যায় সেই পোয়াতি মইষানিকে ওয়ালি পাড়াটা জঙ্গলের ভেতর এমন উঁসিয়ে তাড়া করছে যে মইষানিটা মাটিতে পড়ে গেল আর-কি। বাঘারু দূর থেকেই ভোখাকে চিৎকার করে বলে, সিও, সিও। ভোখা ঐ দৌড়ের মধ্যে মুহূর্তে থেমে যায়। আর তার পরই তার বয়ে বেঁকে, ঘুরে, একটু পেছনে, সেই ওয়ালি পাড়াটার দিকে ধেয়ে যায়। জায়গাটায় পৌঁছে লোখা প্রথমে একই বেগে ওয়ালি আর মইষানির মাঝখানে ঢুকে যায় চিৎকার করতেকরতে। কিন্তু ওয়ালি তার শিং নাড়া দিতেই মইষানির পেটের ভেতর দিয়ে বেরিয়ে উল্টো দিকে গিয়ে প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ার মত ভঙ্গি করে ও চিৎকার করে পাড়াটাকে ঠেকাতে চায়। পাড়াটাকে যে, ভোখার দিকে দুবার শিং নামাতে হয় তাতেই মইনি নিজের পায়ে সোজা হয়ে একটু সরে যাওয়ার সময় পায়।

ততক্ষণে পিঠে বাঘারুকে নিয়ে বুড়িয়ালও অনেকখানি এগিয়ে এসে পড়েছে। বনের ভেতর কোনো-একটা পথ দিয়ে ত আর পুরো বাথানটা যাচ্ছিল না। একটা জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে এদিক-ওদিক ঘুরছিল, খাচ্ছিল। তাই বাঘারুর চোখে যখন পড়ে ঐ পাড়াখান ঐ মইষানিকে নিয়ে কী শুরু করেছে তখন সেদিকে ছুটে যেতে ও একটা জায়গায় পৌঁছতেও ত তার সময় লাগে।

বাঘারুর চিৎকার, ভোখার ছোটাছুটি ও চিৎকার, আর শেষে বাঘারুকে নিয়ে বুড়িয়ালের ঐ ছোটায়, কাছাকাছির সব মোষই ঘাড় তুলে তাকায়। যে-মোষগুলো দূরে বা আড়ালে চলে গেছে, দেখতে পাচ্ছে না, কিন্তু শুনতে পেয়েছে, সেগুলোও দূর থেকে আ-আ-আঁক আ-আ-আক ডাকতে শুরু করে দিয়েছে। ফলে বুড়িয়ালের পিঠে বাঘারু সেখানে পৌঁছুবার আগেই ঐ জায়গাটাতে একটা চেঁচামেচি হৈ-হল্লা শুরু হয়ে যায়। বুড়িয়াল তার কর্তব্য অনেক আগেই বুঝে যায়। আর সে কর্তব্য শুধু তার এতদিনের অভিজ্ঞতা আর শক্তির জোরেই ঠিক করে তা নয়। তার চওড়া পিঠে যেসওয়ার দুই শিঙের মাঝখানে শালগাছের মত খাড়া, তার সাহস, শরীর ও শক্তির জোরেও সাব্যস্ত হয়। বুড়িয়ালের এত চওড়া পিঠ, এমন খাড়া শিং আর এই চিতনো বুক এমন সওয়ার তার যৌবনে পায় নি। তার চারপাশের দুনিয়ায় এই সাহস, শরীর ও শক্তি মেপে মেপেই ত পশুকে তার জন্ম থেকে স্বেচ্ছামৃত্যুর বার্ধক্যে পৌঁছুতে হয়।

এত দূর থেকে ছুটে আসার ফলে তার অত বড় শরীরে যে-গতিবেগ তৈরি হয়ে যায়, তা একটুও শ্লথ হতে না দিয়ে বুড়িয়াল বাঘারুকে পিঠে নিয়ে সেই পাড়া আর মইষানির মাঝখানে ঢুকে যায়। বাঘারু চিৎকার করে চলে,তার পক্ষে যতটা জোরে সম্ভব, হে-ই, হে-এ-ই, হে-এ, হেট হেট, হৈ-ই। বাঘারু আর বুড়িয়াল পৌঁছে গেছে দেখে ভোখাও জোর পেয়ে প্রায় পাড়ার গলার তলা পর্যন্ত চলে যায়–ঘেউ-ঘেউ করতে করতে। একসঙ্গে এত দিক আক্রমণে পাড়াটা ওর শিং বাতাসে তুলে ঘাড়টা ঘুরিয়ে নেয়–মইষানিকে ছেড়ে দিয়ে।

বুড়িয়াল যে এই রকম দুই মোষের মাঝখানে ঢুকে যাবে, বাঘারু তা ভাকে নি। সে ভেবেছিল, গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে বুড়িয়াল তাকে নামিয়ে দেবে। কিন্তু কাছাকাছি এসেই বুড়িয়াল যখন তার গতিবেগ বাড়িয়ে দেয়, বাঘারু আর তার পিঠ থেকে নামে না। বাঘারুও বোঝে, বুড়িয়াল এই চেহারায়, আর শিঙে, তার গায়ের জোরে ছুটে দুটোর মাঝখানে যদি পড়ে, তা হলে ঐ পাড়াটাকে প্রথমে পেছুতেই হবে। একবার পেছুলে আর এগনো যায় না। এত কিছু ভাবা সত্ত্বেও বুড়িয়ালের পিঠের ওপরে বাঘারু কিন্তু ডান শিং ধরে ডান দিকেই ঝুঁকে থাকে, যাতে, যদি ঐ পাড়া বুড়িয়ালকে আক্রমণই করে, বাঘারু ডাইনে লাফিয়ে পড়তে পারে।

পাড়াটা শিং উঁচিয়ে ঘাড় ঘোরাতেই ও বুড়িয়াল ওদের দু জনের মাঝখান দিয়ে পেরিয়ে যেতেই বাঘারু লাফিয়ে নীচে নামে। মাটিতে হাত বাড়িয়ে যে-ডালটা পায়, সেটাই কুড়িয়ে দুই হাতে তুলে, শালো বলে, সরাসরি সেই পাড়ার বা চোয়াল মারে। ডাল ভেঙে যায়। নিজের হাতের টুকরোটা ফেলে দিয়ে বাঘারু ছুটে আর-একটা ডাল তোলে। বাঘারুর ঐ হাতের পুরো একটা মার ঐ পাড়ার পক্ষেও সহ্য করা সম্ভব নয়। সে তার মুখটা আরো বায়েই ঘোরায়। ততক্ষণে বাঘারুর হাতের ডাল পুরো জোরে আছড়ে পড়ে কিন্তু চোয়ালটা তোলা ছিল বলে এবার একেবারে মুখের ওপরে। পাড়া দু পা পেছিয়ে গিয়েছিল, সামনের পা দুটো একটু উঁচু করে, গলা তুলে, মুখ বাঁচাতে। দ্বিতীয় মারটা খাওয়ার পর মুখ না নামিয়েই যেটুকু ঘুরতে পারে ঘুরে সে ছুট লাগায়। বাঘারু তার পেছন-পেছন কয়েক পা ছোটে, তার পর, শালো, যা কেনে, অরনার (বুনো মোষ) গুতা খাওয়ার তানে যা, বলে দাঁড়িয়ে পড়ে। তোখা সেই পাড়ার পেছনে-পেছনে ছুটতেই থাকে।

বাঘারু এইবার সেই মইষানিটার কাছে আসে। মইষানিটা এক জায়গাতেই দাঁড়িয়ে ছিল। কোথাও জখম হয়েছে কিনা দেখতে বাঘারু শিং ধরে-ধরে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে মুখটা দেখে, চোখ দুটো দেখে। তার পা ডাইনে বায়ে ঘুরিয়ে চোয়াল আর গলার সংযোগস্থলের নরম মাংসের জায়গাটা দেখে নেয়। মোষের শরীরের অন্য কোথাও লাগলে কিছু যায়-আসে না।

বাঘারুর হাতের ছোঁয়া পেয়েই মইষানিটার যেন আত্মাদ হয়ে যায়। সে তার গলাটা ক্রমেই উঁচুতে তুলতে থাকে, আস্তে-আস্তে। ছোট মইষানি। গলা অতটা বাড়ালে বাঘারুর মাথা ঘেঁয়। বাঘারু তার গলকম্বলে হাত বুলিয়ে দিতে থাকে, হয়, হয়।

কাছেপিঠের মোষগুলো বুঝে নেয় ব্যাপার মিটে গেছে। ততক্ষণে তারা কেউ-কেউ বসে পড়েছে, যেন এখানে অনেকক্ষণ থাকা যাবে। কেউ-কেউ দাঁড়িয়ে থাকে, চুপচাপ। কেউ-কেউ মাটিতে গন্ধ শোকে আর ঘাসে মুখ দেয়।

বাথান আবার বাথানের মত হয়ে গেছে।

 বাঘারু একটু হেঁটে দেখার জন্য এগিয়ে যায়।

.

০৮০.

বাথান দিয়ে সমাজসেবা

 আওয়াজ শুনে বাঘারু বুঝতে পারে, কোথাও খুব কাটাকুটি চলছে। ফরেস্টে আওয়াজ শুনে দিক ঠিক করা অসম্ভব। কিন্তু বাঘারু জানে, কাঠ কাটতে হলে বা দিকের বনটাতেই হবে। ঐখানে একটা রাস্তা আছে, ফরেস্টের তেভরের রাস্তা যেমন হয়, পাথর বেছানো, কিন্তু তার ওপর পাতা পড়ে-পড়ে নরম হয়ে আছে। ঐ রাস্তা দিয়ে ট্রাকগাড়ি ভেতর পর্যন্ত আসতে পারে। বাঘারু সেদিকেই একটু এগয়, দেখতে।

ফরেস্টের যেসব জায়গায় অনেক গাছ অনেক দিন ধরে কাটা হয়, সেখানে তলার জঙ্গল কেটে সাফ করে নেয় আগে। এই সব জায়গা বেশ অনেক দূর থেকে দেখা যায়। বাঘারু তেমনি দেখতে পায়, তার সামনের অনেকখানি জঙ্গল পেরিয়ে, অনেকগুলো তোক মিলে গাছ কাটছে। গাছ কাটছে না, কাটা-গাছের ডালপালা ছাঁটছে। হই-হাই আওয়াজ, কুড়ল চালানোর, এখান থেকেই পাওয়া যাচ্ছে। বাঘারু ওখানে দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়েই দেখে।

দাঁড়িয়ে থাকে বলেই দেখে, শুধু ডালপালা ছাঁটা হচ্ছে না, হাঁটার পর ঐরকম আস্ত গাছের গায়ে দড়ি বেঁধে টেনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। বাঘারু একটা গাছ একটুখানি টানতে দেখে। কী ভাবে টেনে নিয়ে যায়, সে আর বাঘারু নতুন করে কী দেখবে। ওদিকে কোথাও হয়ত ট্রাকগাড়িটা আছে।

কিন্তু অত জন লোক মিলে বাঘারুকে দেখছে। প্রথমে যে-যার মত দেখে নিয়ে, এখন বারেবারে ঘুরেফিরে দেখছে। দেখারই ত কথা। এমন বনে বাঘারুর মত একা মানুষ! বাঘারুর কোনো মোষ ত তার আশেপাশে নেই। থাকলে, ওরাও অত দূর থেকেই বুঝত, বাঘারু কে।

শেষ পর্যন্ত ওরা এত বেশি দেখতে থাকে বাঘারুকে যে বাঘারু আর দাঁড়ায় না। কিন্তু ফিরে আসার জন্যে ঘুরতেই ঐ-জায়গা থেকে হাঁকাহাঁকি শুরু হয়ে যায়, হে-এ-ই, এই, শুনো, এই, শুনো। ডাকটার মধ্যে এমন একটা তাড়া ছিল যে বাঘারুর মনে হয় দাঁড়িয়ে পড়াটা ঠিক নয়। বাঘারু একটু তাড়াতাড়ি হাঁটতে শুরু করতেই শোনে তার পেছনে কেউ ছুটে আসছে। বাঘারুও দৌড়বার আগে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে ফেলে, খাকি পোশাকে, ফরেস্ট গার্ড। সে দাঁড়িয়ে পড়ে।

তাকে দাঁড়িয়ে পড়তে দেখে ফরেস্ট গার্ডটাও আর দৌড়য় না। হাটে। কিছুটা হেঁটে এসে, সম্ভবত যখন সে বাঘারুকে সম্পূর্ণটা দেখতে পায়, তখন, আর হাটেও না। ওখানেই দাঁড়িয়ে হাত তুলে বাঘারুকে ডাকে।

যেখানে কাঠকাটা চলছিল সেখানকার লোকজন তাকিয়ে-তাকিয়ে দেখছে। বাঘারু ফরেস্ট গার্ডের দিকে এগিয়ে যায়। ডায়নার এই জঙ্গলে আসার পর এমন একা-একা বাঘারুকে প্রায় কোনো সময়েই এত অচেনা মানুষের সামনে বিদেশীয়ার মত দাঁড়াতে হয় না। সঙ্গে ত তার বাথান থাকেই। সবাই ত তাকে দেখেই মইষ্যাল বলে চিনতে পারে। বাঘারুর নিজের অবাক লাগে যে এরা তাকে চিনতে পারছে না। মাত্র এই কটা দিনেই এই পরিচয় তার নিজের কাছে এত পরিচিত ঠেকে! বাঘারুর কাজের পরিচয়টাতেই সে নিজে এত অভ্যস্ত হয়ে গেছে যে সেই পরিচয় ছাড়া এই একজনের সম্মুখীন হতেও তার সঙ্কোচ হয়?

বাঘারু যতই তার কাছে আসে, ফরেস্ট গার্ড ততই বাঘারুকে সম্পূর্ণ করে দেখে। আর, বাঘারু তার সামনে গিয়ে দাঁড়ালে, দেখার আর-কিছু বাকি থাকে না। ফরেস্ট গার্ড তাকে দাঁড় করিয়ে রেখে, একটু পরে জিগগেস করে তুমি, এইঠে কোটত আসিলেন?

মোর বাথান আছে, ঐঠে।

বাথান! কার বাথান?

 গয়ানাথ জোতদারের।

 অ। কোটে এ্যালায় তোমার বাথান?

 হু পাকে, বাঘারু হাত তুলে একটা নির্দেশ দেয়।

 এইঠে কী করিছেন?

কিছু না।

 বাথান ওইঠে। আপনি এইঠে। কিছু না?

 না। ঐ পাকে শুনিলাম গাছ কাটিবার আওয়াজ তাই

তাই কী?

দেখিবার আইচছি, কায় কাটে, কী কাটে।

 রাতিত কোটত থাকেন? এইঠে?

 ডাইনাং নদীর চরত—

 অয়। ঠিক আছে। গার্ডটি যেন আশ্বস্ত হয়, আজ তাড়াতাড়ি চলে যাবেন এইঠে।

চলি যাম? এ্যালায়?

 ফরেস্ট গার্ডটি আকাশের দিকে তাকায়, তাড়াতাড়ি যাবেন, গিরহন (গ্রহণ) নাগিবে।

গিরহন? আজি? এ্যালায়?

 হ্যাঁ। ধরো কেনে দুই দুপরের বাদে।

দুপুর ত হয়্যা গেইল না?

 ফরেস্ট গার্ডটি আবার আকাশের দিকে তাকায়, না, এ্যালায়ও বাকি আছে।

না, মুই এ্যালায়ই যাছি। মোর নামিবার টাইম নাগিবে। গিরহন নাগিবে?

আজি?

 ফরেস্ট গার্ডটির সঙ্গে বাঘারুর কথাবার্তা যখন চলছে তখন কাঠকাটার লোকজনের ভেতরে একজন এগিয়ে আসে। তার পোশাকআশাকে বোঝা যায় কাঠকাটার লোক সে নয়, তার লোকরাই কাঠ কাটছে–কনট্রাক্টার। সে কথাবার্তা শুনে গার্ডকে বলে, এর কাছে ত মোষ আছে।

হ্যাঁ। মোষের বাথান।

আমাদের গাছগুলো টেনে দিক না। পয়সা যা লাগে দেব। তা হলে, কাজটা তাড়াতাড়ি হয়ে যায়। গার্ডটা এই কথা শুনে বাঘারুকে জিজ্ঞেস করে, কী? করিবু?

কী?

তোর মহিষ দুই-চারিখান নিগি আয়। এই গাছগিলান ঐঠে টানি দিবেন।

পাইসা পাবেন। পাইসা।

আপনি যে কহিলেন গিরহন নাগিবে। মোর ত বাথান নিগি নামি যাবার নাগিবে, ডাইনাং-এর চরত। নীচে।

আরে স্যালায় ত ইমরার এ্যানং তাড়াতাড়ি। ই মানষিলা গিরহনের আগত–বন ছাড়ি চলি যাবার চাহে। কাটা-গাছ গিলাকি ফেলি যাবে? এইঠে? কাঠচোরলা চুরি করি নি যাবে না? তুই কাঠচোর?

মুই কাঠচোর না হই। ত নিগি আসিম? মহিষ?

গার্ডটি এবার কনট্রাক্টারকে জিজ্ঞাসা করে, কী? আনিবে? কনট্রাক্টার বাঘারুকে জিজ্ঞাসা করে, কতদূরে তোমার মোষ?

ঐ ত হু পাকে, হু পাকে।

 আনিবার পারিবু? ঝট করি?

 এ্যালায়, যাম। নিগি আসিম। কটা নাগে বাবু আপনার?

আরে দু-চারটে আনলেই হবে। আমাদের আর বেশি গাছ ত বাকি নেই। টেনে ঐ দিকের নালীটাতে ফেলে দেবে, তার পর আমরা ঢাকাটাকা দিয়ে চলে যাব। কাল সকালেই ত আবার আসব। আজকের রাতটার জন্যেই একটু সাবধান হওয়া।

ও। এইঠে টানি ঐঠে ফেলিবার নাগিবে? ট্রাকত তুলিবার নাগিবে না? মুই আসিছু এইঠে, খাড়ান, বাঘারু যাবার উদ্যোগ করতেই ফরেস্ট গার্ডটি বলে, তুই থাকি যা না আজিকার রাতটা, এইঠে, বাথান নিয়ে, কাঠ পাহারা দিবু। পাইসা পাবু।

বাঘারুকে একটু চিন্তা করতে হয়। না, বাবু, মুই না পারো।

কেনে? পাইসা পাবু।

না বাবু। গিরহন নাগিবে। বনত মোর মোষগুলোর কী হয়, না-হয়।

কী আর হবে? থাকি যা, থাকি যা।

বাঘারুকে যেন প্রায় রাজিই হয়ে যেতে হয়। তখনই তার মনে পড়ে যায় সকালেই দুধের গাড়ি আসবে।

না বাবু। মুই থাকিবার না পারি। সকালত দুধের গাড়ি আসিবে। দুধ দুহি দিবার নাগিবে। মুই মোর মহিষ আনিছু। টানি দিম আপনার গাছ। খাড়ন। আনিছু। বাঘারু আর দাঁড়ায় না। ঘুরে তাড়াতাড়ি ছোটে তার বাথানের দিকে। এরা বাঘারুকে দেখতেই পায়, কেমন ছুটে সে প্রথমে যেখানে দাঁড়িয়েছিল সেটাও পেরিয়ে গিয়ে, আরো একটা জঙ্গলের পেছনে আড়াল হয়ে যায়। তার পরই ওরা বাঘারুর গলা শুনতে পায়–এই, ট র-এ টর-এ।

এই আওয়াজগুলো বারকয়েক নানা রকম হয়ে ওঠে, নামে, আবার ওঠে, আবার নামে। তার পর আর ওঠেই না। কিন্তু একটু পরেই দেখা যায় বাঘারু একটা মোষের ওপর বসে, আর তার পেছনে আরো তিনটি মোষ! বাঘারু একবার এসেছে ও একবার গেছে যে রাস্তা বানিয়ে, সেটা যেন তার কতই চেনা হয়ে গেছে। চার মোষ নিয়ে বাঘারু সেই চেনা রাস্তায় সব দলে চলে আসে। চলে আসে একেবারে কাঠকাটাইয়ের দলের মাঝখানে।

কাঠকাটাইয়ের দলের লোকসংখ্যা কম নয়। একদল কাটা গাছের ডালপালা সাফ করে। আর একদল সেই সাফ করা গাছ টেনে নিয়ে যায়। কিন্তু চার-চারটি মোসহ বাঘারু এখানে এসে গেলে মনে হয় বাঘারুই যেন জায়গাটিকে ভরে ফেলল–এতক্ষণের লোকজনকে তুচ্ছ করে। বাবু, দড়ি নেন, দড়িবাঘারু মোষের পিঠ থেকে নেমে বলে। আর সবাই কাজ থামিয়ে বাঘারুর কাজ দেখতে শুরু করে।

বাঘারু সেই ওয়ালি পাড়া-টাকে এনেছে, বুড়া বলদ মোষ দুটোকে এনেছে আর তাগড়া মইষানি এনেছে একটা। বাঘারু দড়িটার একটা দিক শোয়ানো গাছের মাথায় বেশ খাজ বুঝে বাধে। আর-একটা দিক বেঁধে দেয়, দুটো মোষের বুকের নীচে, পায়ের ওপরে। বেশি দূর ত আর টানতে হবে না। একটু দূরেই লম্বা নালীর মধ্যে ফেলতে হবে। ওর পাশে নিয়ে ফেললেই লোকজন ঠেলে গড়িয়ে দেবে। এখানে ত আর জোয়াল নেই। বুকের ওখানে বেধে দিলেই, যেন গলায় ঝুলিয়ে নিয়ে যাচ্ছে এমন ভাবে টেনে নিয়ে যেতে পারবে। দুটো মোষের মাঝখানে গাছটাকে একটু উঁচু করে দিতে হয়, মাটি থেকে।

বাঘারু সেই পাড়াটার সঙ্গে একটা বুড়ার, আর মইষানিটার সঙ্গে আর-একটা বুড়ার জোড় করে দেয়। দুটো জোড়ের গলায় গাছটা বেঁধে দিয়ে সে টররর দিয়ে পেছনে দাঁড়ায়। ফরেস্টের জমির ওপর দিয়ে কোনো কিছু টেনে নেয়া অসুবিধে। উঁচু-নিচু, কাটাগাছের গোড়া, গর্ত, এই সবে আটকে যায়। বাঘারু এদের পেছনে-পেছনে থেকে একবার একটার বাধা সরিয়ে দেয়, আরেকবার আরেকটা আটকে গেলে ছাড়িয়ে দেয়।

এমন ঠেকে-ঠেকে গেলেও, দড়ির ফাঁসে ঝুলিয়ে যে-গাছ নিতে জনা ছ-আট মানুষের আধ ঘণ্টা-পঁয়তাল্লিশ মিনিট লেগে যায়, বাঘারু তার জোড়ামোষে তা নিয়ে যায় অর্ধেক সময়ে, তাও আবার একসঙ্গে দুটো। ফলে, দুবারে চারটি গাছ সরানোর পরেই সমস্ত ঘটনাটা যেন বাঘারুর নেতৃত্বে ঘটছে এমনই দেখায়।

এতক্ষণ বাঘারু আর তার মোষ ছাড়া এই কাঠ-সরানো চলছিল কী করে?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *