২.৩ পাথর বা ধাতু বা…

০৬১.

পাথর বা ধাতু বা…

এই যে এতক্ষণ বাঘারু গাছের দিকে পেছন ফিরে, নিচু হয়ে পাথর খুঁজে ফিরছে তাতেই তার মনে হতে শুরু করে দেয়, সে মিছিমিছি পাথর খুঁজে যাচ্ছে। তরিকা গাছের ডাল আর কত মোটা হতে পারে–সেটা মুচড়ে ছেঁড়া যাবে না, বা টেনে তুলে ফেলা যাবে না?

সে এই তলা থেকেই চাবাগানের বেড়াটার দিকে তাকায়। এখান থেকে যেন আরো ভাল দেখা যাচ্ছে, বুনো ঝাড় নয়, যত্ন করে লাগানো লাইন বাধা ঝোপ। আর-কেউ কোনোদিন এই ঝোপগুলো থেকে পাতা কাটেনি বোধহয়। গাছের পাতাগুলো টিনের চালের মত ছাউনি তৈরি করেছে, বেড়াছাড়া ছাউনি, বারান্দার নাখান। এখান থেকে পাতাগুলোকেই, প্রধানত দেখা যায় বলে, মনে হচ্ছে, ঐ পাতাগুলোর নীচে ঘর-সংসার পাতা যায়। দুটো পাতা দু-দিকে দুই ছোট বশের মধ্যে বেঁধে দিলে ছোট বাচ্চাকাচ্চার ঘর হয়ে যাবে। ওদ নাগিবে না, বৃষ্টির ছাট নাগিবার পারে। দুটো লম্বা আর দুটো আড়াআড়ি দিলে একখান বেটিছোঁয়া ঢাকি যাবে। আর তার সঙ্গে আরো দুটোপাতা লম্বা করলে বাঘারুর কোমর পর্যন্ত পুরো ঢাকবে। তা হলে কি বাঘারুকে.এখন তরিকা গাছের ছ-ছটা পাতা কাটতে হবে? একটা নয়, দুটো নয়, ছ-ছটা?

পাতার সাইজ দেখে, হিশেব করে বাঘারুকে নিশ্চিত হতে হয়, এই পাতাগুলো কাটার জন্য তার দা বা ছোট কুড়োল দরকার, মুচড়ে নেয়া অসম্ভব। পাথর তেমন একটা পেলে হয়ত চেষ্টা করা যায় কিন্তু তাতে কতক্ষণে কটা কাটা যাবে তার আন্দাজ এখন চলে না। অর্থাৎমুচড়ে নেয়া ত সম্ভবই নয়। পাথর হল সর্বশেষ অস্ত্র। সুতরাং বাঘারুকে পেছন ফিরে ঐ মাঠের ভেতর একটু এগিয়ে পাথর খুঁজতে হয়।

বাঘারু একটু উদাসীনই এগিয়ে চলে। পাথরটা যে সে পেল না, এই ঘটনাটা যেন কোনো জায়গাতেই শেষ হয় না। সে খুঁজতে-খুজতে এরকম পা ফেলে চলবে। তার চলার সঙ্গে এই খোঁজট মিশে যাবে। তার পর সেই চলার নিয়মেই, কোনো এক সময়, খোঁজাটা শেষ হয়ে যাবে। তখন চলবে কিন্তু আর খুঁজবে না। তার আগেই সে খোঁজার নিয়মে পেয়ে যেতে পারে কিন্তু আর ফিরবে না। সেখান থেকে ফিরে আর কাটা চলে না।

বাঘারু লোহার পাতের একটা বান্ডিল, ছোট, দেখতে পায়। চায়ের বাক্স বাধা হয় এই পাতগুলো দিয়ে মুড়ে। সে দৌড়ে গিয়ে তোলে। তার হাতে উঠে আসতেই কিছুটা ঝরে পড়ে যায়। মরচেতে ঝুরঝুরে হয়ে গেছে। তবু বাঘারু দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে বান্ডিলটা খুলতে থাকে। খানিকটা অংশও যদি ব্যবহার্য থাকে।

ছোট পাতের বান্ডিলের একটা মাথা আগে খসে গেছে। কয়েকটা গিঠে গোল-পাকানো আর-একটা মাথা ভেতরে। বাঘারু প্রথমে গিঠগুলো খুলে সোজা করে, তা থেকে একটা টুকরো, সে যত ছোট টুকরোই হোকলোহা ত, বের করতে চায়। কিন্তু গিঠের দু-দিকের পাত ধরে টান দিতেই ঝুরঝুরিয়ে খসে যায়। তখন বাঘারু গিঠ না খুলে তাকিয়ে-তাকিয়ে দেখে যে ভেতর দিকের কোনো-একটা অংশ একটু আস্ত আছে কিনা। নেই। তখন তার এক হাতের মুঠোর ভেতর লোহার সেই পাতটা গুড়ো-গুড়ো ধুলো করে ফেলে দেয়।

কিন্তু মরচে ধরা লোহার পাতই যদি এমন জুটে যায়, এখানে, তা হলে ত মরচে না ধরা খানিকটা তারও অন্তত বাঘারু পেয়ে যেতে পারে। বা, আর-একটা ভাল পাতই, বা পাতের টুকোরই। বাগানের সীমার জমিতে বাগানের ময়লাটয়লা ফেলে হয়ত কখনো কখনো। তাতে একটা ছোেট, আস্ত, লোহার পাত কি আর মরচে না পড়ে, এখন পর্যন্ত, বাঘারুর জন্যে থেকে যেতে পারে না? বা অন্তত তার? দড়ির মত এক টুকরো তার?

তারের কথাটা মনে হতে, পাতের চাইতে তারটাই তার কাছে বেশি কাজের লাগে। শক্ত, নতুন তার যদি হয়, গাছের গোড়ায় গোল করে লাগিয়ে দু প্রান্ত ধরে বাঘারু যদি টানে, গাছের নরম কাণ্ডের ভেতর তারটা বসে যাবে আর গাছটা কেটে আসবে। যদি কাণ্ডটা বেশি মোটা হয়, তা হলে একটা-একটা করে, পাতা কেটে নিতে পারবে।

পাথর শেষ হয়ে এখন ঘাস ঝোপঝাড় চলছে। বাঘারু লোহার পাত, আর তারের সঙ্গে সঙ্গে কাঁচের টুকরোও খোঁজে! বাগানের মানুষরা কাঁচ ব্যবহার করে। তা হলে এখানে ভাঙা কাঁচের টুকরোও পাওয়া যেতে পারে। বোতলভাঙা কাঁচের কোনাটা সব সময়ই ধারালো হয়। বোতলের কাঁচ ত লম্বালম্বিই ভাঙে। একটা দিক ধরে, আর-একটা দিক দিয়ে কাটা যায়। যদি গোল করেও ভাঙে তা হলেও ঘষে-ঘষে কাটা চলে। সুতরাং বাঘারু কাঁচও খোঁজে।

লোহার পাত, বা তার, বা কাঁচকোনো কিছুতেই বাঘারুর কোনো অসুবিধে নেই যেন। টানতে, বা ঘষে ঘষে কাটতে, সেই তার বা কাঁচ তার হাতের তালুতেও কেটে বসে যেতে পারে না যেন!

পাথর শেষ হয়ে যায়।

বাঘারু ক্রমেই মাঠের মাঝ বরাবর চলে আসে। মাঝেমধ্যে ঝোপঝাড়। কিন্তু কোথাওই এমন-কিছু নেই যা মানুষ ব্যবহার করে ফেলে দিয়েছে, এবং এখন বাঘারু ব্যবহার করতে পারে। বা, একটা পাথর, যা বাঘারুই প্রথম ব্যবহার করবে।

.

০৬২.

বাঘারুর অস্ত্রলাভ

কিন্তু বাঘারু তার পাথরটা পেয়ে যায়, তারই জন্যে তৈরি পাথরটা। নাকি পাথরটাই বাঘারুকে পায়।

এই পাথরটা পাবে বলেই পাথর দিয়ে বানো ঢালে কোনো পাথর মিলল না! ঢালের শেষেও মাঠের ভেতর পাত, বা তার, বা কাঁচ মিলল না! বাঘারু তখন পায়ে-পায়ে চলে আসছে। চলে আসছে আর মনে-মনে ছকতে শুরু করেছে মাঠটা কোনাকুনি যাবে, যেখানে পাবে ডেমকাঝোরা সেখানেই পার হবে, তার পর, ওপারে উঠে নিজের রাস্তা ধরবে। এরকম ছকে নিতে তাকে দু-একবার ঘাড় তুলে মাঠের শেষটা দেখতে হয়েছে। বোধহয়, পাথরখোঁজা, আর পথখোঁজা, মাঠদেখা আর মাঠ শেষদেখা–এই সবের ভেতর সে ধীরে-ধীরে একটু ভাগ হয়ে যাচ্ছিল বলেই তার বাঁ-পায়ের বঁ-দিকটা হঠাৎ খাড়া ধারালো কিছুর ওপর পড়ে! মনে হল, তার পায়ের মাংসের ভেতর ধারটা একেবারে বসে গেল। তাও আবার বাঘারুর পা, যার চাপে পাথর গুড়ো হয়ে যায়। যদিও বাঘারুর মনে হয়, তার পায়ের মাংসের ভেতরশান-দেয়া কোনো লোহার ধার বসে গেল, তবু, ব্যথায় বসে পড়েও, সে প্রথমে পা দেখে না, কিসে কাটল, সেটা খোঁজে।

কুড়োলের আগার মত ছড়ানো একটা পাথরের ধারালো দিক মাটির ভেতর থেকে উঁচিয়ে আছে। ঠিক ওপরে তার পা পড়েছে। বাঘারু পা দেখে, কাটে নি। কিন্তু ব্যথা তখনো আছে। পা ছেড়ে দিয়ে বাঘারু দুই হাতে পাথরটাকে নাড়ায়, ঢিলে করে নিয়ে মাটির ভেতর থেকে টেনে তুলে ফেলবে বলে। পাথরটা বেশি গাড়া ছিল না। বাঘারু যে-জোরে নাড়া দেয়, তাতেই উপড়ে যায়, আর বাঘারু হুমড়ি খেয়ে পড়ে সামনে। সামলে, দুই হাতে পাথরটাকে নিয়ে দেখে বাঘারু। তারপর, উঠে দাঁড়ায়। দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে পাথরটাকে আরো ভাল করে দেখে সে, যে-দিকটা মাটির ভেতর ছিল, সেই মোটা :: অংশটা ভেজা ও মাটি লাগা। ওপরের দিকটা চকচকে ধারালো, পাথরের পক্ষে যতটা ধারালো হওয়া সম্ভব-মানুষের হাতের ঘষা ছাড়াই। মানুষের হাতের ঘষা পড়লে এ-পাথরে লোহার শান আসে।

বাঘারু পাথরের আকারটাকে বুঝতে চায়। হাত-দাওয়ের নাখান? গর্তখান নাই ত? কাটিবার গর্তখান? বরং সে দিকটা ভরা। কিন্তু আকারটা যেন তার চেনা-চেনাও ঠেকে। তলার দিকটা সরু। এক মুঠোতেই ধরা যায়। ডান হাতের মুঠোতে পাথরটা ঝুলিয়ে হাতটা দোলায়। পাথরটা দোলে। দোলাতে-দোলাতে হাতটাতে গতি আনে। তার পর, পাথরসহ হাতটাকে বেগে মাথার ওপর তোলে। যেন, কোনো কিছুর ওপর নামাচ্ছে এমন ভাবে পাথরটা যখন বাতাস কেটে খাড়া নামায়, তখন বাঘারুর মনে ঝিলিক দেয়, পাহাড়ি মানষিলার খুরকির নাখান?

বাঘারুর নামানোর বেগে হাতটা পাথরসহ আবার দোল খায়। দুলুনি থেমে এলে দুই হাতে পাথরটাকে ধরে। তার পর আবার পাথরটাকে দেখে, এই পাথরটা হলেই চলে যাবে বাঘারুর, পাতা না-হলেও। কত ভাবেই না পাথরটাকে ব্যবহার করবে সে, ভেবে, দুই হাতে পাথরটাকে মাথার ওপর ট্রন-টান তোলে। তুলে দেখবার জন্যে নিজেই ঘাড় ভেঙে তাকায়।

ঘাড়টা এতই হেলানো বাঘারুর, আকাশের টলটলে নীলটাই শুধু দেখতে পায়, ওপর থেকে তাকে ঢাকা দিয়ে ফেলেছে যেন। দুই হাতে ধরা পাথরটা সেই নীলে উৎক্ষিপ্ত। বাঘারু দেখে, ঐ পাথরের মাথা থেকে, বাঘারুর মুষ্টি, কব্জি, পুরোবাহু ও বাহু পর্যন্ত একটাই পাথর যেন। দেখাটা এমন ঘটে যায় বলেই ঐ নীলে ক্ষোদিত পাথরের আকারটাকে চিনে নিতে পারে বাঘারুতার বাহু, পুরোবাহু, কব্জি আর দুটো হাত নমস্কারের মত জোড়া করা একটা পাথর যেন! পরনামিয়া পাথর।

বাঘারু পাথরসহ হাত দুটি নামিয়ে আনে। তার পর, এক হাতের মুঠোতে যেন এক জোড়া হাত ধরে নাড়তে নাড়তে তরিকা গাছের ঝাড়ের দিকে ছোটে।

ঢাল বেয়ে ওপরে উঠতে বাঘারুর একটু অসুবিধা হয়। সে যেমন তার শরীরের ভারে নেমে আসতে পারে, সহজে, তেমনি, সেই ভারের জন্যেই, নুড়ি আর কুচি পাথরে ভরা ঢাল বেয়ে উঠতে পারে না, পাথরগুলো গড়িয়ে যায়। ঢালের মাথায় পৌঁছে একটা কিছু ধরার দরকার হয়। না হলে, তরিকা গাছের গোড়ায় একটা পা তুলতে আর-একটা পায়ে যে ভর দেবে, তাতেই হড়কে পড়ে যাবে। বাঘারু ঢালের মাথায় পাথরটা রাখে। তার পর মাটির একটা খুঁজ ধরে, হেঁচড়ে ওপরে উঠে পাথরটা নিয়ে দাঁড়ায়।

বাঘারু পাতা বাছতে শুরু করে। পাতা বড় হলেই হবে না, সোজা হওয়া চাই। তরিকা পাতার মজাই এই, টিনের মত খাজ কাটা। একটা পাতার জের ওপর আর-একটা পাতা বসে যেতে পারে। বৃষ্টির জল ঐ খুঁজ দিয়ে গড়িয়ে যায়। পাতা যদি বাকাচোরা হয়, খাজে-খাজে না মেলে, জল ভেতরে গড়িয়ে পড়ে। পাতা খুব বেশি বড় হলে, পাশের দিকটা ছড়িয়ে যায়–কলাপাতার মত। আর নিজের ভারে-ভারে বেঁকে চুরে যায়। বাঘারু তাই এমন একটা পাতা খোঁজে যেটা বড় কিন্তু বুড়ো নয়; কলাপাতার মত দু পাশে ছড়িয়েছে কিন্তু বেঁকে যায় নি। এমন একটা পাতা, যার মাঝখানের খাজটা গোড়া থেকে আগা পর্যন্ত, নিটোল।

তরিকা গাছের এমন সারিতে, এমন তরতরিয়ে বেড়ে ওঠা পাতার রাশির মধ্যে বাঘারু তার পাতাটি বা পাতাগুলো খুঁজে পায় না, খানিকটা যেন দিশেহারা হয়েই, আর খানিকটা যেন ইচ্ছে করেই, এমন বাছাইয়ের স্বাধীনতা তার আছে বলেই।

দিশেহারা ভাবেই হোক আর স্বাধীন ভাবেই হোক, বাঘারুর এমন বাছাবাছির ভেতর আবার একটা সভয় তাড়াও ছিল।

এই বেড়ার ওপাশেই চা-বাগান। মাঠের মত লম্বা-লম্বা রাস্তা, রাস্তায় রাস্তায় মোড়, মাঠের মত সমান শিরীষ গাছের মাথা। সেখানে পাতি তোলে, নালী কাটে, ডাল ফাড়ে। শেয়ালও যাতে ঢুকতে না পারে, সেইজন্যে এই তরিকা গাছের সারির তলার মাটিচাপা দেয়া আছে! হাতির পাল যাতে ভাঙতে না পারে, সেইজন্যেই তরিকা গাছের কাটা পাতার সারি। পাতা যাতে বড় হয়, বেড়ে ছড়িয়ে পড়ে, সেইজন্যে এই গাছগুলোর ত দেখাশোনাও হয় নিশ্চয়। যে-পাতা এতগুলো কাজের জন্যে রাখা, সেই পাতা বাঘারু কেটে নিচ্ছে! বাঘারুকে যদি ধরতে পারে!

ধরতে পারলে কী হবে, সে-বিষয়ে তার কোনো নিশ্চিত ধারণা নেই। ভয়ও নেই। কিন্তু ধরতে এলে মানুষ পালায়, সেই নিয়মে বাঘারু ঘাড় ফিরিয়ে দেখে নিতে চায় মাঠটার ভেতর চা বাগানের সীমাটা কদ্দূর। যেন তার ওপরই তাকে ধরা বা না-ধরা নির্ভর করে।

আর দেরি করে না। প্রথম পাতাটা খুঁজতেই সে এত দেরি করছে, অথচ তাকে ত, একটা নয়, ছয-ছয়টা পাতা বের করতে হবে।

একটা পাতা বাঘারু পেয়ে যায়। সেটা যেন কাটা পড়ার জন্যেই খাড়া দাঁড়িয়েছিল। কচি, কিন্তু বড়, মাঝখানের খাজটা নিটোল গভীর! কিন্তু পাতার গোড়াটা গাছের ওদিকে। এদিক থেকে কাটতে গেলে হাতটা বাড়িয়ে ওদিকে দিয়ে তবে কাটতে হবে। সেটা দা-মত কিছু দিয়ে করা যেতে পারে। কিন্তু পাথরটাকে ত ওপর থেকে নামাতে হবে। বাঘারু ছেড়ে দেয়।

বেড়ার এদিকে একটা পাতা পেয়ে যায়। গোড়ার দিকটা একটু হেঁতলানো। কিন্তু বাঘারু ঠিক করে এটাকেই কাটবে। তারপর খুঁজতে হলে, আরো পাঁচটা খুঁজবে। পাতাটা ডালের সবচেয়ে নীচে, এদিকে ছড়িয়ে পড়েছে বাঘারুর দিকে যেন গলা বাড়িয়ে দিয়ে আছে। ডালের যে-জায়গাটা থেকে পাতাটা বেরিয়েছে সেখানে কোপটাও দেয়া যায় বাধাহীন।

পাথরটাকে একবার যাচাই করে নেয়–লোহার অস্ত্রের ধার পরীক্ষার মত। তার পর সরু দিকটা দুই হাতের মুঠোতে চেপে মাথার ওপর তোলে। দমটা টেনে পুরো ধার আর ভারটা নামিয়ে আনে পাতাটার ওপর–নিজের শরীরের ভার যোগ করে। পাতাটা ভেঙে নেতিয়ে যায়। বাঘারু দেখে, গাছের কাটার ধারও কমে গেছে অনেকখানি। পাথরের গা থেকে রস, গাছের কাঁচা চামড়া মুছে নিয়ে বাঘারু আর এক কোপ তোলে।

.

০৬৩.

কুকুরের তাড়া

এখন বাঘারু মাথায় তরিকা পাতাগুলো, একটার পর একটা,লম্বালম্বি। খাজে-খাজে মিলে আছে। তার পরে, ঠিক বাঘারুর মাথার ওপরে পাথর। পাথরটা একটু এদিক-ওদিক হলে পাথরের ভারে যাতে পাতাগুলো ভেঙে না যায়। এতক্ষণ এক হাতেই পাতাগুলো ধরে হাটছিল। এখন, দুই হাতে ধরে ডেমকাঝোরায় নামছে।

ডেমকাঝোরা ছোট খালের মত নদী, কিন্তু পাড় বেশ উঁচু। মাথায় পাতা আর পাথর নিয়ে বাঘারুকে পা টিপেটিপে নামতে হয়। জলে নামার আগে মাটিতে বসে পড়ে। ডান পা দিয়ে জলে নামার জায়গা পরখ করে, ঘুরে দাঁড়িয়ে বা হাতে পাড় আর ডান হাতে পাতা ধরে বা পাটা ধীরে-ধীরে নামিয়ে, ঘুরে যায়। জলে একবার নেমে পড়ার পর দু হাতে পাতাগুলো ধরে বাঘারু ধীরে ধীরে এগয়।

যদি একটা গামছা বা ত্যানা থাকত, বা রাস্তায় যদি কিছু পোয়াল পেয়ে যেত, তা হলে একটা বিড়ে পাকিয়ে, মাথার ওপর পাতা আর তার ওপর পাথর দিয়ে, দু হাত ছেড়েই হাঁটতে পারত। এক হাতে পাতা, আর-এক হাতে পাথর ঝুলিয়ে হাঁটা যায় না–দুই হাতই আটকে যায়। পথে যদি কোনো ভামনি বন পায়, তা হলে একটা বিড়ে পাকিয়ে নেবে।

জলটা যদি আচমকা কোথাও বেশি হয়ে যায়, তা হলেই বিপদ। সে জন্যেই বাঘারু দুই হাতে পাতাগুলো শক্ত করে ধরে রাখে, যাতে তেমন হলে পাতাগুলো নামিয়ে সামনে ভাসিয়ে, পাথরটাকে এক হাতে নিয়ে সে একটু সাতরে যেতে পারে।

এইবার জলটা কোমর পর্যন্ত ওঠে। বাঘারু এক-পা, এক-পা করে এগয়। আচমকা পাথরটা যদি জলে পড়ে যায় তা হলে ডুবে-ডুবে তুলতে হবে। পাড় সামনে এসে গেছে। এর মধ্যে জলটা আর আচমকা বাড়বে না। তবে জলকে বিশ্বাস নেই। হয়ত পাড়ের কাছেই একটা গভীর গর্ত হয়ে আছে। সামনের পাড় এসে গেল।

বাঘারু আগে পাতা আর পাথর নামিয়ে রাখে, তার পর নিজে ওঠে। সে উঠে দাঁড়াতেই তার গায়ের জলে জায়গাটা কাদা হয়ে যায়। বাঘারু দু হাতে শরীরের জল কাঁচে। এদিক-ওদিক তাকায়। সে আরো একবার তার গায়ের জল কেচে ফেলে। তার পর পাতা আর পাথর মাথায় তুলে, দু হাতে একটু ঠিক করে নিয়ে, আবার হাঁটতে শুরু করে।

হাটের লোকজনের যাতায়াতে ডেমকাঝোরা থেকে হায়হায়পাথার যাওয়ার একটা ছোট কাঁচা রাস্তা। তৈরি হয়ে গেছে। সেই রাস্তায়, সামনে একটা বড় টাড়িও দেখা যায়। তা হলে কি বাঘায় সেখান থেকে একটু দড়ি চেয়ে নেবে, পাটের? না হয় ত, কিছু পোয়াল? পাতা আর পাথর বেঁধে নেবে, বিড়ে পাকাবে।

যে-কাঁচা রাস্তা দিয়ে বাঘারু ঐ টাড়িতে ঢুকছিল, তার ওপর একটা কুকুর শুয়ে ছিল। সামনেই একটা টিনের চালের বড় বাড়ি। ঐ বাড়িতেই ঢুকবে বাঘারু।

বাঘারুর পায়ের আওয়াজ শুনে কুকুরটা শুয়ে থেকেই, চোখ না খুলেই, একবার ডেকে দিল, ঘেউ। তার আওয়াজে বাঘারুর পায়ের আওয়াজ থামে না দেখে, সে আবার ডাকে, ঘেউ। বাঘারু তার পাশ দিয়ে হনহনিয়ে চলে যায়। বাঘারুর মাটিকাঁপানো চলনে কুকুরটা চমকে ঘাড় ঘোরায়। তার পরই ঘেউ-ঘেউ আওয়াজে আকাশ ফাটিয়ে বাঘারুকে তাড়া করে। কুকুরটা বাঘারুর পাশ দিয়ে ছুটে সামনে গিয়ে দাঁড়ায় আর তার পথ আটকে আকাশ-ফাটানো চিৎকার জুড়ে দেয়। বাঘারু তার গতি একটুও না কমিয়ে হনহন করে এগিয়ে যাওয়ায়, কুকুরটা দৌড়ে সরে যায়, আবার ফিরে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে। সামনে ডান হাতে সেই বড় বাড়ি, বাঘারু ঢুকবে। কিন্তু প্রথম কুকুরটার ডাকাডাকিতেই হোক, আর, বাঘারুর চলার গতিতেই হোক, ঐ বাড়িটা থেকেই দশবারটা কুকুর একসঙ্গে বেরিয়ে এসে বাঘারুকে ঘিরে ধরে এমন চেঁচানো শুরু করে, যেন অন্ধকার রাত্রিতে পাড়ায় ডাকাত পড়েছে। কুকুরগুলো বাঘারুকে এমনই ঘিরে ফেলে কিছুতেই এগতে দেবে না। এখন যদি বাঘারুকে ঐ বাড়ির বাহির এগিনায় ঢুকতে হয় তা হলে কুকুরগুলোকে ঠেলে এগতে হবে। বাঘারু আর ঐ হাঙ্গামায় না গিয়ে সোজা হাঁটতে থাকে, একই গতিতে। বাঘারু চলার গতি একটুও কমায় না দেখে কুকুরগুলো সামনের পথটা ছেড়ে দিয়ে তাকে তিনদিক থেকে ঘিরে চেঁচাতে থাকে। টাড়িটার শেষে বাশঝাড়। ডাইনে রেখে রাস্তাটা বায়ে বেঁকেছে। তার বায়ে টাড়ির বুড়িঘর পাটকাঠি দিয়ে তৈরি। কুকুরগুলো ঐখানে দাঁড়িয়ে পড়ে আর বাঘারু বাঁক নেয়। একটা কুকুর তবু ডেকে-ডেকে ওঠে। বাঘারু বাশঝাড়কে ডাইনে রেখে ডাইনে বাক নিয়ে আড়াল হয়ে গেলে, একটু পরে শুনতে পায় কুকুরগুলো আবার একসঙ্গে অলস ডেকে উঠে, ধীরে-ধীরে একে-একে থামতে শুরু করে। মাঝেমধ্যে একটা কুকুরের ঘেউ-ঘেউ ডাক ওঠে। তার পর সেটাও থেমে যায়।

বাঘারু দাঁড়িয়ে দু হাতে মাথার পাতাটা একটু সরিয়ে দেখে, বায়ে তার পেছনে হায়হায়পাথার চা বাগানের সীমা। একটু বুঝে নিতে, আরো একটু দেখতে হয় বাঘারুকে। ডেমকাঝোড়া নদী নিশ্চয়ই ঐখানে একটা বাঁক নিয়েছে। নদীটাকে বায়ে রাখতে এই রাস্তাটা ডাইনে ঘুরে, আবার বায়ে ফিরে, চা বাগানের দিকে গেছে। বাঘারু আর-কিছুতেই চা বাগানে ঢুকবে না। সে রাস্তা ছেড়ে মাঠে নেমে পড়ে। সোজা গিয়ে হায়হায়পাথারের ডাঙা পার হয়ে উত্তরে হাঁটলে শালবাড়িতে উঠবে। শালবাড়িতে–ও উঠতে পারে, দক্ষিণ দিয়ে ফরেস্টে ঢুকে ফরেস্টের ভেতর দিয়ে দিয়েই হাইওয়েতে উঠবে। তার পর হাইওয়ে ধরেই চালসা হয়ে নতুন রোড ধরত পারে। আবার, ফরেস্টের ভেতর দিয়েও যেতে পারে। সে, তখনকার কথা তখন। এখন, সামনে মাল নদী। পাতা আর পাথরটা তার আগে বেঁধে ফেলতে হবে।

বাঘারু উঁচুতে উঠছে। হায়হায়পাথারের সেই নিধুয়া ডাঙা যেন বিশাল একটা খেপা শুয়োর–লেজটা মাটিতে লাগিয়ে মাথাটা সিধে নিয়ে উত্তরের পাহাড়ের দিকে ছুটে যাচ্ছে। ঘাস নাই, গাছ নাই, চাষ নাই, বাড়ি নাই। শুয়োরের বা পেট বেয়ে বাঘারু উঠছিল, পেছনের বা পায়ের পাশ দিয়ে।

বাঘারুর চোখ এখন পায়ের দিকে লাল-লাল পাথরে ছাওয়া চড়াই। এই রকম পাথর এদিকে দেখা যায় না। এ-পাথর পাহাড় থেকে নদী বেয়ে গড়িয়ে গড়িয়ে গোল হয়ে নামে নি। মনে হয় যেন খুব একটা ভাঙাভাঙি হয়েছিল এখানে। সব পাথরই চোখা। বাঘারু ভাবে, এখানে ধারালো পাথর বোধ হয় খুঁজতে হয় না, হাত দিলেই মেলে। পাথর কথাটা মনে হতেই তাড়াতাড়ি তার নিজের পাথরটা মনে আসে। যেইলা একখান পরনামিয়া পাথথর মোর জুটি গেইছে, ঐলা পাথর কোটত মিলিবে?

শুয়োরের ভাঙার পিঠটা ডান দিকের ঢাল বেয়ে নদীর দিকে নামার সময় বাঘারু পা দিয়ে-দিয়ে দু-একটা পাথর গড়িয়ে দিতে চায়, দেখে মজা পেতে। কিন্তু প্রায় কোনো পাথরই নাড়াতে পারে না, দুটো একটা আলগা পাথর ছাড়া। এই সব কি পাথরের গাছ? সব মাটির ভিতরঠে মাথা তুলিছে…! উঁচু থেকে নামছে বলেই বাঘারু এখন অনেকটা দৃশ্য দেখতে পায়–এই পাথরের শেষ, সবুজের শুরু, জলের রেখা, চা-বাগানের সীমা, টাড়িবাড়ির গাছগাছড়া। আরমাল নদীর ওপারে ফরেস্টের ছাইরঙা দেয়াল, দূর থেকে সব ফরেস্টকেই যেমন লাগে, মনে হয় ঢোকা যাবে না। মাল নদীর ওপারে এই যে-ফরেস্ট শুরু হল, এর আর শেষ নেই। মাঝে হাইওয়ে আছে, চা বাগান আছে, রেল লাইন আছে, নদী আছে, নদীর চরও আছে–কিন্তু সে সবই ফরেস্টের মধ্যে। এই ফরেস্টের ভেতরেই একটি জায়গায় গিয়ে বাঘারুকে পৌঁছতে হবে। ডায়না ফরেস্টে।

নামতে নামতে আবার দৃশ্য কমতে শুরু করে। কিন্তু বাঘারুকে একটা কিছু খুঁজতে হবে, এই পাতা আর পাথর বাধতে। তাকে একটু দেখতে হবে, কোথাও দড়ির মত কিছু পাওয়া যায় কিনা।

বাঘারু দাঁড়িয়ে মাথা থেকে পাথরটা ডান হাতে নামায়। বা হাতে পাতা আর ডান হাতে পাথর ঝুলিয়ে সে নামতে শুরু করে।

.

০৬৪.

কুকুরের সাড়া

নদীর একটু ওপরে, ঢালের গায়েই বাঘারু মাটির ওপর পাতাগুলো রেখে পাথর চাপা দেয়। তার পর খালি হাতে নামে। ঘাড় ঘুরিয়ে একটু দেখে নেয় পাতা-পাথর ঠিক থাকবে কি না। দড়িদড়া বা পোয়ালা বা লতাগোছের কিছু পায় কি না দেখতে বাঘারু এদিক-ওদিক ঘুরবে। এগুলো বেঁধে না-নিলে মাল নদ পেরনো যাবে না।

নীচে নেমে ফিরে তাকিয়ে বাঘারু দেখে, শুয়োরের ডাঙার এই ঢালের ওপরের দিকে একটা কুকুর দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে লেজ নাড়ছে। ডাঙার মাথার দিকে কুকুরের লেজ, ডাঙার লেজের দিকে কুকুরের মাথা। মুখটা এখন এদিকে ঘোরাচ্ছে-ফেরাচ্ছে–ফরেস্টের দিকে ওপারে, বাঘারুর দিকে এপারে, এমন-কি, এই দুইয়ের মাঝখানে নদীর টুকরোটার দিকেও।

বাঘারু তাকে দেখল এটা সে বুঝেছে–জানাতে কুকুরটা ঘাড়ের সঙ্গে সামনের পা দুটোও এদিকে সামান্য একটু ঘোরায়, নদীর দিকে চোখ রেখেই। লেজটাও একটু নাড়ায়। ভাবটা, তারও ওপারেই যাওয়ার কথা।

কিন্তু এই ডাঙার ওপর কুকুর আসবে কোত্থেকে? পথ হারিয়ে ফেলেছে? কুত্তায় আস্তা (রাস্তা) হারায় না। বাগানের দিক থেকে এসেছে? আসিবা পারে, কিন্তু কেনে? তা হলে কি বাঘারুরই পেছন-পেছন কোথাও থেকে চলে আসছে? কোনঠে? বাঘারু ত টের পায় নি। মাথায় পাতা থাকায় বাঘারু অবশ্য পায়ের সামনেটুকু ছাড়া কিছু অনেকক্ষণ ধরে দেখতেই পাচ্ছিল না। কিন্তু কুকুরটা কি একবারও তার সামনে আসে নি। আওয়াজও ত পায় নি। ভোখিবার ধরে নাই, একবারও? না-ও ডাকতে পারে। পেছন-পেছন এসেছে, ডাকতে যাবে কেন। বাঘারু কি একবারও পেছন ফিরে তাকায় নি? পাছত চাও নাই? শেষ কখন পেছনে তাকিয়েছে বাঘারু?

এতটা দূর একা হেঁটে এসে, এমন ডাঙায় ফরেস্টে ঢোকার আগে শেষ নদীটায় ও ওপারে ফরেস্টের গভীর নির্জনতার সামনে বাঘারুর যেন বড় দরকার হয়ে পড়ে, কুকুরটা যে তারই পেছু-পেছু এসেছে, নিজের কাছে সেটা প্রমাণ করার। কুত্তা আর গাই, যা কওয়াবেন তাই।

ডেমকাঝোরা পার হয়ে, পাড়ে পাতা আর পাথর রেখে, বাঘারু চার পাশে তাকিয়েছে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। তার পর, আবার মাথায় নিয়ে রওনা দিয়েছে। ঘঁটি আসিছে। হাটি আসিছে। আর ত পেছন ফিরে তাকায় নি। আর ত পাছত না তাকাই। সেই টাড়িটায় একটা বিরাট কুকুরের দল বাঘারুকে ঘিরে ধরল।

এই পর্যন্ত ভাবতেই বাঘারু যেন থই পেয়ে যায়। তখনই এই কুকুরটা তার পেছনে ছিল? সেই জন্যেই টাড়ি বাড়ির কুকুরের পাল এত খেপে গিয়েছিল?- না-হয় তা বাঘারুক দেখি এ্যানং ভোকিবার ধরিবে কেনে? বাঘারু সাহেব না-হয়, বাঘারুর মাথাত্ টুপি নেই, বাঘারুর ভটভটিয়া নাই, বাঘারু ত নিজের এই দুইখান পায়ের উপর খাড়া একখান মানষি। কুত্তালা ত চিনিবার পারে। ত স্যানং ভোকিবার ধরিল কেনে?

নিশ্চয়ই এই কুত্তাটাও তখন পেছনে ছিল আর টাড়ির দল এই দলছুট কুত্তাকে তাড়া করেছিল।

–এইখান ত একবারও ভোকে নাই? তাড়িখোয়া কুত্তার ডোকাভুকি নাই। এইখান ত একবারও সমুখত আসে নাই? সমুখত কায় আসিবে? দুই ঠ্যাঙের ভিতর ন্যাজখান ঢুকাই মোর দুই ঠ্যাঙের ভিতর সিন্ধাইছে? ত মুই দেখ নাই? কোন কুত্তা তাড়িছে আর কোন কুত্তা তাড়ি খাছে? কায় জানে? দেখিছু কিন্তু বুঝিবার পার নাই।

নিজের সঙ্গে এই কথাবার্তার শেষে বাঘারু হায়হায়পাথারের এই শুয়োরের ডাঙার তলা থেকে কুকুরটার দিকে তার লম্বা হাত বাড়িয়ে ডাকে, সিও সিও।

মুহূর্তে কুকুরটা সোজা হয়ে যায়, যেন যাচাই করতে চায় ডাকটা সত্য কি না। সোজা হয়ে লেজ-কান-নাড়ানো বন্ধ করে ওপারের ফরেস্টের দিকে ঘাড় তুলে তাকায়। মোক ঢক দেখাছে? চেহারা দেখাচ্ছে, বাঘারুকে। বাঘারুর অবিশ্যি দেখতে ভালই লাগে কান খাড়া, ঘাড় সিধা, ঠ্যাং সরু-লম্বা, বুক বড়। শালো, ঝাপিবার পাড়িবে। ঝাপাতে পারবে। কিন্তু দৌড়? বাঘারু ত এখনো ওর পিঠ আর পেছন দেখে নি।

বাঘারু আবার তার ডান হাতটা তুলে দেয়, সিও, সিও। এই দ্বিতীয় ডাক শুনে কুকুরটা আর না-নড়ে পারে না। দু পা নেমে দাঁড়িয়ে পড়ে। অন্য দিকে তাকিয়ে লেজ নাড়ায়। যেন, এখন বাঘারুরই এগিয়ে আসার কথা। এই বাঘারু আর এই কুকুরের ত একবারও চোখাচোখি হয় নি, তাদের চামড়ায়-চামড়ায় একবারও ঘষাঘষি হয় নি। এখনো ত তারা দুজন দুজনের ভাষা জানে না। অন্তত একবার জেনে নেয়া দরকার। মাত্র একবারই। কুত্তা আর গাই, যা কওয়াছেন তাই।

বাঘারু কুকুরটার দিকে উঠতে শুরু করে।

কুকুরটা অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। একটা নতুন মানুষ তার দিকে উঠে আসছে আর সে দাঁড়িয়েই আছে এই অনিশ্চয়তা তার পক্ষে অসহ্য বলেই যেন ঘাড়টা ফেরানো। কিন্তু বাঘারু মাঝামাঝি পর্যন্ত উঠে এসেছে দেখে সে একবার বাঘারুকে না দেখে পারে না। ততক্ষণে লেজকান ঘাড় নাড়ানো শুরু হয়ে গেছে। খুব দুর্বল ভাবে একবার দেখে নেয় শুয়োরের ডাঙার পিঠটা-পালিয়ে যাওয়ার পথ। বাঘারু কুকুরটার কাছে চলে এসেছে। কুকুর তার গলাটা মাটির ও বাঘারুর দিকে লম্বা করে দু-পা পেছিয়ে যায়। বাঘারু আর দু-পদক্ষেপেই তার একেবারে কাছে এসে পড়ে।

এখন বাঘারু কুকুরটাকে ধরে ফেলতে পারে। কিন্তু ধরে না। এখন কুকুরটা লাফিয়ে পালিয়ে যেতেও পারবে না। লেজটা ঠ্যাঙের মধ্যে দিয়ে কুকুরটা কুঁই কুঁই শুরু করে। না-নড়ে, শুধু হাত বাড়িয়ে ওর গলটা বাঘারু ধরতে গেলে, কুঁই কুঁই করতে করতে একটু সরে যায়। বাঘারু আর এগয় না। সে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে, দুই হাত সামনে বাড়িয়ে ডাকে, সিও, সিও। ডাকে, ফিসফিস করে।

ঘাড় লেজ নিচু রেখেই কোনাকুনি তাকিয়ে কুকুরটা যেন বুঝে নিতে চায়, শেষ বারের মত স্বাধীনভাবে, বাঘারুকে। এখন ত সে সবটাই বাঘারুর হাতের সীমানায়। কিন্তু বাঘারু আর এগচ্ছে না। কুকুরটা একবার এগিয়ে ধরা দিয়ে ফেললে তার ফেরার আর-কোনো পথ থাকবে না। তার গৃহহীনতার টান কুকুরটা শেষবারের মত বোধ করছে। বাঘারুকে সে যে চেনে না, সেই ভয়ও তার এখন চরমে। দুটো একসঙ্গেই ছিঁড়বে। ভেঁড়ার সেই শেষতম মুহূর্তের টানে কুকুরটা মাটির সঙ্গে মিশে যাচ্ছিল।

কিন্তু কুকুরটা জানতই তাকেই একটি পা বাড়িয়ে দিতে হবে এবার–যত ভয়ে-ভয়েই হোক। গলাটাও বাড়িয়ে দিতে হবে এবার মাটির সঙ্গে লেপটে হলেও।

কুঁই কুঁই করতে করতে দুপা আসে। বাঘারু কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে কুকুরটা লেজ নাড়ে। বাঘারু তাকে ছোয় না। কুকুরটা বোঝে, হেঁয়ার সময় পার হয়ে যাচ্ছে। তখন সে অতি ধীরে-ধীরে তার মুখটা তুলতে থাকে। প্রথমে বাঘারুর দুই পায়ের ফাঁক দিয়ে সেই নদী-ফরেস্টের চেনা দৃশ্যের দিকে। তার পর, তার সম্মুখতম অচেনা দৃশ্যের গায়ে। কিন্তু তখনো বাঘারু তার হাত অথবা পা কুকুরটায় গায়ে হেঁয়ায় না। কোনো পশুর পক্ষে এতটা সময় নিজের ক্ষমতা প্রয়োগসীমার সম্পূর্ণ বাইরে থাকা সম্ভব নয়। লেজ নাড়ানো বন্ধ করে কুকুরটা বাঘারুর কোমরের দিকে মুখ তোলে। পেছনের পা দুটো দিয়ে মাটি আঁচড়ায়। কিছু নুড়ি-পাথর ঝুরঝুর ঝরে যায়। কুকুরটার মুখের দিকে হাসি-হাসি মুখে একটু তাকিয়ে বাঘারু ডান হাতে খুব নরম করে কুকুরের মুখটা চেপে ধরে। হাতের তালু কুকুরটার ঠোঁটের ওপরে।

সে এই ইঙ্গিতটুকু পাওয়ার অপেক্ষায় ছিল, তার ভেজা ঠোঁট আরো একটু ঢুকিয়ে দেয় বাঘারুর মুঠোর মধ্যে। বাঘারুর হাতের তালুতে কুকুরের ঠোঁটের জল লাগে। বাঘারু এই ইঙ্গিতটুকু পাওয়ার অপেক্ষায় ছিল। সে দু হাতেই কুকুরের দু গালে আদরের চড় মারে।

.

০৬৫.

বাঘারুর সঙ্গীলাভ

এতটা সময় যে তাকে ঘাড়-বেজ নামিয়ে মাটির সঙ্গে লেপটে থাকতে হয়েছে, সেটা ভুলে যেতে, মুহূর্তের মধ্যে কুকুরটা বাঘারুর মুঠোর ভেতর থেকে ছিটকে সরে যায় আর পেছনের দুই পায়ের ওপর। ভর দিয়ে সামনের পা দুটো বাঘারুর বুকের ওপর তুলে মুখটা বাড়িয়ে দেয় বাঘারুর মুখের দিকে। বাঘারু মাথাটা সরায়। নাকে কুকুরটার গায়ের গন্ধ লাগে। কুকুরটা বাঘারুর গলার কাছাকাছি নাকটা নিয়ে গিয়ে বাঘারুর গায়ের গন্ধ তার ছোট-ছোট শাসে টেনে নিতে থাকে।

কুকুরটা তার বুকে ভর দিয়ে দাঁড়ানোয় বাঘারুর পা হড়কে যেতে শুরু করে। সে কোমরটা আর ব-পাটা একটু এগিয়ে দিয়ে শরীরের ভর ঠিক রাখে।উদ্বেগ ও অনিশ্চয়তা থেকে এতক্ষণ পর ছাড়া পেয়ে কুকুরটা তার বশ্যতার সম্পূর্ণ শারীরিক তৃপ্তি ছাড়া শান্ত হবে না।

বাঘারু তাড়াতাড়ি কুকুরটার সামনের দুই পায়ের নীচে দুই হাত দিয়ে একটু সামাল দিতে চায়। তারপর বা হাতটা কুকুরটার ঘাড়ের লোমের ভেতর সম্পূর্ণ ঢুকিয়ে দিয়ে ঘাড়ের চামড়ার কাছে নখগুলো বেঁধায়। হয়, হয়, সিও, সিও–এই শান্ত করার ধ্বনিতেও বাঘারুর শ্বাসের উষ্ণতা লাগে।

বাঁ হাতটা কুকুরের ঘাড়ে ঢোকানোয় বাঘারুর বা বাহু ও ঘাড় ওর মুখের নাগালের ভেতর চলে। আসে। কুকুরটা বাঘারুর বাহুটা হাঁ করে কামড়ে ধরে। বাঘারু তার বাহুতে সঁতের ধার টের পায়। ডান হাতটা দিয়ে একটু ঠেলে রেখে তপ্ত শাসে বাঘারু বলে, খাড়ো, খাড়োকনেক, খাড়ো। ডান পাটা একটু সরাতে হয় বাঘারুকে। আর তখনই কুকুরটা এমন তীব্রতায় ডান থেকে বায়ে তার ঘাড় ঘোরায় যে বাঘারুকে পা হড়কে চিৎপাত পড়ে যেতে হয় মাটিতে। কুকুরটা পাশে পড়ে যায় কিন্তু চার পায়ের ওপর ঠিক দাঁড়িয়ে পড়ে। আর এইবার যেন ভাল বাগে পেয়েছে এমন ভাবে বাঘারুর ঘাড়ের খাজটার দিকে হা করে মুখ এগিয়ে দেয়। খাড়ো, খাড়ো, বলে বাঘারু ওকে ঠেকাতে চায়। কিন্তু তবু ও জোর খাটায় দেখে, হেসে ফেলে, বাঘারু দু হাতে ওর ঘাড় ধরে, শা-লো বলে ছুঁড়ে ফেলে দেয়।

কুকুরটা বাঘারুর পায়ের দিকে গড়িয়ে যায়। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়ায়। ততক্ষণে, বাঘারু উঠে পড়ার জন্য মাথা থেকে পা পর্যন্ত আকাশের দিকে ধনুকের মৃত তুলে দিয়েছে। সেই ভঙ্গিকে আহ্বান ভেবে তার দুই পায়ের ফাঁক দিয়ে কুকুরটা বাঘারুর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। কিন্তু ও নিচু থেকে ঝাঁপ দেয় বলেই ধপ করে বাঘারুর বুকের ওপর পড়ে যায় আর বাঘারু আবার চিৎ হয়ে পড়ে। এবার কুকুরটা তার ওপরে।

শালো, বার বার কছি খাড়ো, তা শুনিবার চাহে না, বাঘারু তার শক্ত দুই হাতে জড়িয়ে ধরে কুকুরটাকে পাশে কাত করতে নেয়। কুকুরটাও তার শরীরের ওজনে বাঘারুকে চেপে রাখতে পারে খানিকটা। বাঘারু তার দুই হাঁটুকে সঁড়াশির মত করে নিয়ে কুকুরটাকে কাত করে ফেলে। তার পর সেই ঝোঁকেই ওটাকে আরো শাস্তি দিতে চিৎ করে ফেলে। কুকুরটার পাশে উপুড় হয়ে বাঘারু হাত আর পায়ের জোরে কুকুরটাকে চিৎ করে ঠেসে রাখে। আকাশের দিকে চার ঠ্যাং তুলে আর মুখটা একবার ডাইনে আর একবার বায়ে ঘোরাতে-ঘোরাতে কুকুরটা কুঁই কুঁই শুরু করে, ছাড়া পেতে গায়ে আঁকি দেয়। শালো, বার বার কছি, খাড়ো, খাড়ো, শুনিবার চাহে না। বড় গরম দেখাছিস্? এ্যালায় থাক কেনে এ্যানং চিৎ হয়্যা।

যেন তার জবাবেই কুকুরটা কুঁই কুঁই করে ওঠে–অ্যালায় কুঁই কুঁই করিবার ধইচছিস! বাঘারু বা হাতের আর বা পায়ের চাপে ওকে চিৎ রেখে, নিজে যেন বিশ্রামের জন্য নিজের ডান কনুইয়ের ভাজে, কপাল ঠেকায়। কুকুরটা আরো করুণ কুঁই কুঁই শুরু করে আর গা ঝাড়া দিয়ে উঠে পড়তে চায়। শালো, বলে বাঘারু হাত আর পায়ের চাপটা শিথিল করতেই কুকুরটা এক ঝটকায় সরে যায়। বাঘারুর হাত আর পা ওখানেই পড়ে থাকে। সে আর চোখে খোলে না। মাথা গুঁজে উপুড় হয়ে পড়ে থাকে।

ছাড়া পেয়ে কুকুরটা প্রথমে কয়েকবার গা ঝাড়া দেয়। একবার ঘেউ ঘেউ করে ডেকে ওঠে। চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে, যেন বাঘারু ওখানে নেই। শেষে বাঘারুর দিকে তাকায়। বাঘারু অমন চুপচাপ উপুড় হয়ে শুয়ে থাকায়, নড়াচড়া না করায় আর তার বা-হাত বাঁ-পা ঐ রকম ছিটকে থাকায় কুকুরটার যেন কেমন সন্দেহ হয়। সে নরম গলায় ঘেউ ঘেউ ডেকে ওঠে, বাঘারুকে ডাকতে। তবু বাঘারু নড়ে না দেখে মাটি শুঁকতে-শুঁকতে বাঘারুর হাতের কাছে আসে। হাতটা শোকে। বাতাসটা সেঁকে। আর দু পা এগিয়ে এসে বাঘারুর পিঠটা শুঁকতেই থাকে। ওর ঠোঁটের ভেজা ঘেঁয়া বাঘারু সারা পিঠময় পেতে থাকে!

তার পর হঠাৎ কী-একটা দেখে কুকুরটা বাঘারুর পিঠ থেকে মুখটা তুলে ফেলে, যেন ভয় পেয়েছে এমন গলায় চাপা গরুর আওয়াজ করে। তার পর আবার বাঘারুর ডান পিঠের ওপরের জায়গাটা শুঁকতে থাকে। শুঁকতে-শুঁকতে গরুর আওয়াজ করে। তার পর ঠোঁটটা হেঁয়ায়, আওয়াজ বন্ধ হয়। পেছনের পায়ের নখে মাটি আঁচড়ায়। ঘন-ঘন শ্বাস পড়ে কুকুরটার। বাঘারু বোঝে, কুকুরটা তার পিঠে বাঘের থাবার দাগ চিনতে পেরেছে।

বাঘারু টের পায়, এইবার চাটতে শুরু করল। গরম কর্কশ সেই চাটায় বাঘারুর আরাম লাগে। জিভের টানে পুরনো জখমের জায়গাটা শিরশির করে ওঠে। আর..লালায় ভিজে যায়। চেটে-চেটে পরিষ্কার করে নিয়ে কুকুরটা আর-এক জন্তুর পুরো থাবাটার দাগ থাবাহীন মানুষটার শরীরে চিনে নিতে চায়।

.

০৬৬.

নির্বাসনের দিকে

কুকুরটাকে দেখার আগে বাঘারু যেদিকে যাচ্ছিল, এখন কুকুরটাকে নিয়ে সেই ঝোপঝাড় গাছপালার দিকে যায়। কুকুরটা বাঘারুর পায়ে-পায়ে চলছিল না; নিজের মত চলছিল। মাঝে-মাঝে নিজের লেজ ধরার জন্যে নিজের চারপাশে পাক দিয়েও নিচ্ছিল।

পাতা আর পাথরগুলো বাধার কিছু একটা পেলেই হয়নদীটুকু পেরতে। ওপারে উঠলেই ত ফরেস্ট। একটা ঝোপের ওপরে-লতানো একটা পাতা দেখে বাঘারু টান দিয়ে দেখতে গেলে, ছিঁড়ে যায়। এত কিছুর দরকারই ছিল না, একটু পোয়াল পেলেই হত। সেই একটু পোয়াল পাওয়া গেল না। বা, সারা রাস্তায় একটা ভামনি বন পড়ল না।

একটা পাকুড় গাছ থেকে সরু ঝুরি নেমে এসেছে। দেখে বাঘারু দাঁড়ায়। শুকনো। শক্ত হবে। প্যাঁচ লাগে নি। তা হলে হয়ত ছেঁড়াও যাবে।

ছেঁড়া যায় কি না পরীক্ষা করতে বাঘারু এক হাতে ঝুরিটা ধরে হেঁচকা টান দেয়। টানটা পুরো তার হাতেই লাগে। বাঘারু আবার তার হাতে প্যাচায়। টেনে ছিঁড়তে না-পারলে ঐ পাথরটা এনে তেলে কেটে নেবে। আর-একটা পাথর এনে, তার ওপর, ধরে।

বাঘারু এবারের টানটা আরো যাচকা মারে। তাতে তার মনে হয়, ছেঁড়া যেতেও পারে। এতক্ষণ পর অন্তত এতটা শক্ত একটা লতা যখন পাওয়া গেছে বাঘারু ছাড়ছে না।

বাঘারু এবার দুই হাতে ঝুরিটা ধরে পেঁচিয়ে, হাত দুটো মাথার ওপর তোলে। ফলে ঝুরিটা ঢিলে হয়ে যায়। এখন আচমকা একটা হ্যাঁচকা টান মেরে প্রায় ঝুলে পড়ে। ওপারে পটপট আওয়াজ ওঠে। বাঘারু বোঝে, একটু নেমেও এল। আর দু-একটা টানেই ছেঁড়া যাবে। বাঘারু ঢিলে দেয়।

আবার দু হাতে পেঁচিয়ে নিয়ে, হাতটা মাথার ওপর তুলে, আচমকা এ্যাচকা টান মেরে, বাঘারু ঝুরিটাতে ঝুলেই পড়ে। তার শরীরের ভার দিয়ে বুঝতে পারে ঝুরিটা নেমে আসছে। বড় জোর আর দু-এক টান লাগবে। কিন্তু বাঘারু ঝুরি থেকে নামে না। সে তার শরীরের ওজনটা দিয়ে ঝুলে থাকে। পটপট আওয়াজ তুলে ঝুরিটা ডাল থেকে খসতে শুরু করে। কিন্তু খসে পড়ার আগেই ছিঁড়ে যায়, আর বাঘারু সেই ঝুরিসহ মাটিতে ধপাস করে পড়ে। বাঘারু আগে মাটিতে পড়ে, ঝুরিটা তার ওপর পড়ে। তাকে জড়িয়ে ফেলে।

কুকুরটা এতক্ষণ একটু দূরে দাঁড়িয়ে হাঁ করে নীরবে লাফিয়ে লাফিয়ে বাতাস থেকে পোকা তাড়াচ্ছিল। বাঘারুকে পড়ে যেতে দেখে, ঘেউ করে ডেকে উঠে লাফিয়ে সামনে চলে আসে। শালো ভোখছে খালি, শালো ভোখা, খাড়া।

বাঘারু ততক্ষণে ঝুরিসহ উঠে দাঁড়িয়ে মাথা-ঘাড় থেকে ঝুরিটা খোলে। বেশ লম্বা ঝুরি। মাঝখান থেকে ছিঁড়ে গেছে। দেখতে-দেখতে লতাটাকে বা হাতের কব্জিতে ডান হাত দিয়ে পেঁচাতে থাকে। বেশ অনেকখানি হয়। বাঘারু এসে পাথর আর পাতার পাশে বসে।

বাঘারু ভাবতে শুরু করে কী ভাবে বাধবে। শুকনো লতা শক্ত বলেই ছিঁড়বে না, কিন্তু আবার, শক্ত বলেই জোরে গিঠ দেয়া যাবে না। একটু ভেবে পাথরটাকে আলাদা করে। তার পর পাতাগুলো দেখে আর হাতের লতাটা দেখে। লম্বালম্বি একটা বা দুটো প্যাঁচ দিলে জলের ধাক্কায় পাতাগুলো বাধনের পাশ। গলিয়ে বেরিয়ে যেতে পারে। আড়াআড়ি বঁধলে ত তুলা দিয়ে গলে যাবে। লতাটা হাতে নিয়ে আর পাতার গোছাটা সামনে নিয়ে বাঘারু একবার হাতের দিকে আর একবার পাতার গোছর দিকে ফিরে-ফিরে তাকায়। সেই প্রক্রিয়াতেই তার হাত যেন বাঁধনের ধরনটা তৈরি করে ফেলে। বাঘারু একবার ঘাড় ঘুরিয়ে নদীর স্রোতের দিকে তাকায়, কত জোরে ধাক্কা মাররে, সেটারও আন্দাজ পেতে।

বাঘারু পাতাগুলোয় আড়াআড়ি একটা বাধন দেয়–গোড়ার কাছে। এখানে পাতাগুলো সবচেয়ে কম চওড়া, তাই বাধনটা দেয়া যায় বটে, গিঠটা জোর হয় না। লতার জন্যেও বটে, পাতার জন্যেও বটে, পাতাগুলো তা হলে ভেঙে যাবে। এই বাঁধনটা দিয়ে বাঘারু কিছুক্ষণ তাকিয়ে-তাকিয়ে দেখে, লতাটা কাটে না, যেন নিশ্চিত হয়ে যেতে চায়, এটাই ঠিক। তার পর পাথরটা তুলে নেয়। লতাটার নীচে একটা টুকরো পাথর এনে রাখে। এক হাতে পরনামিয়া পাথরটা তুলে লতাটার ওপর মারে। বাঘারুর মুখে হাসি ফোটে। এমন ধার তার পাথরের, এক কোপেই প্রায় কেটে যয়। বাঘারু একটানে থেঁতলানো জায়গাটা ছিঁড়ে ফেলে। এবার, আর-একটা গিঠ দেবে আগার দিকে।

শেষ পর্যন্ত যা হয়, সেটা নিয়ে বাঘারু দাঁড়ায়! দাঁড়িয়ে, ঝোলায়। ঝুলিয়ে, দেখে নেয়। আগায় আর গোড়ায় দুটো আড়াআড়ি, আর সেই দুটো গিঠকে যোগ করে লম্বালম্বি একটা গিঠ। একটা খাঁচার মত হয়ে গেছে। পাতাগুলো স্রোতের ধাক্কায় বেরিয়ে যেতে পারবে না। কিন্তু ঢিলে হয়েছে। এক ভরসা ঐ মাঝখানের খুঁজে-খাজে পাতাগুলো আটকেই আছে। আর পাতাগুলো পিছল নয়।

কিন্তু পাতাগিলা ত ঝুলিবার নাগিবে, হাত বরাবর কাঁধত। কাধ থেকে ঝোলানোর ফাসটা বাঘারু এবার বানায়।

পাথরটা পেঁচানোর জন্যে বাঘারুকে এত কিছু ভাবতে হয় না। সে আন্দাজমত অংশ কেটে নিয়ে চ্যাপ্টা পাথরটাকে আড়াআড়ি লম্বালম্বি পেঁচিয়ে, একটা গিঠ মেরে, খানিকটা ফাঁক দিয়ে, একটা ফাস বানিয়ে নেয়। ব্যাস, মালার মত হয়ে গেল। বাঘারু দাঁড়িয়ে ফাস হাতে নিয়ে ঝোলায়। ব্যাস, ঝুলিও নিগার পারি। বাঘারু ফাসটা গলায় পরে নেয়। পাথরটা তার বুকের কাছে দোলে। সেটা দুলে-দুলে বুকে লাগবে কি না দেখতে কয়েক পা হাঁটে। কিন্তু নদীর ভিতর পাথরখানা দুলিবে কেনে। স্যালায় ত সঁরিবার নাগিবে। বাঘারু থেমে যায়। কিন্তু তার পরই তার মনে আসে, পাড়ে উঠেও ত পাতাগুলো কাঁধে ও পাথরটা গলায় ঝুলিয়ে সে হাঁটতে পারে। বাঘারু পাথরটা গলা থেকে খুলে ফ্লাসটা আর-একটু ছোট করে নেয়, যাতে পাথর দুলে বুকে লাগার বদলে সেঁটে থাকে।

তাও বেশ খানিকটা লতা বেঁচে যায়। বাঘারু কুকুরটার দিকে তাকায়। সেটা তখন নিজের লেজ ধরার জন্য পেছনের দুই পায়ের ভেতর দিয়ে মুখ গলাতে গিয়ে গড়িয়ে পড়ে যাচ্ছে। শালো, ভোখা না-হয়, বোকা, হে বোকা এইঠে আয়। কুকুর তার কথা শোনে না। বাঘারু চেঁচায়, এততি আয় বোকা। তার পর বা হাতে কুকুরের ঘাড় ধরে এনে তার গলায় বাকি লতাটা পেঁচিয়ে-পেঁচিয়ে দেয়। থাকুক, কুখন কুন কামে লাগি যায়, কায় জানে।

এইবার বাঘারু নদীর দিকে চলে। বুকে পাথর ঝুলছে। কাঁধে পাতা। পাশে তার কুকুর, গলায় লতা পেঁচানো। বাঘারু সরাসরি নদীর পাড়ে চলে আসে। তারপর পাড় দেখতে-দেখতে হাটে, কোথায় নামা যায়। পাড়টা উঁচু ও ভাঙা। কিন্তু পাথর আছে–ছোট-বড় নানা সাইজের পাথর। পা দিয়ে-দিয়ে নীচে নেমে যাওয়া যায়।

তেমনি একটা জায়গা পেয়ে বাঘারু দাঁড়ায়। তার পর পাড়ের পাথরটিতে পা দিয়ে এক লাফে জলের কিনারের পাথরের ওপর দাঁড়ায়। তার পর একটুও না দাঁড়িয়ে আরো নীচে জলের, আরো কিনারের পাথরটিতে পা দেয়। তার পরেই জলে পা হাঁটু পর্যন্ত ডুবে যায় আর পাতাগুলো হাতের পাশে ভেসে কাঁধে লাগে, সাঁতার কাটতে ডান হাত নাড়াতে পারবে না। বাঘারু মুহূর্তের মধ্যে ফাস থেকে হাত বের করে নিয়ে ফাঁসটা গলায় পরে নেয়–পাতাগুলো পিঠের ওপর ভেসে থাকে। চকিতে একবার ভাবে, পাথরটা কোমরে বেঁধে নিলে ভাল হত, কিন্তু তার আর সময় নেই। যে-জনপদ সে পেরিয়ে এল সে দিকে একবারও না তাকিয়ে বাঘারু জলের ভেতরে ঢুকে যায়, যেমন ঢুকে যাওয়া বাঘারুর স্বভাব, যেন সে জলের ওপর দিয়ে হেঁটে যেতে পারে, এই পাথর ভাসানো স্রোতের ওপর দিয়ে। ওপারে অরণ্যপদ। সে-অরণ্যের শেষ বাঘারু দেখে নি, জানে না। সেখানে তার নির্বাসন। মাল নদীতে স্রোত ছিল। স্রোত এসে বাঘারুর গায়ে ধাক্কা লাগায়। বাঘারু সে স্রোতে গা ভাসিয়ে দেয়। বাঘারু পেছন ফিরে দেখে নি, সেই তার কুকুর, জলে নামল, কি নামল না। ভাসতে-ভাসতে বুঝতে পারে, কুকুরটা–ভোখাবোকা–তার পাতলা শরীরে স্রোতের ধাক্কায় বাঘারুকে ছাড়িয়ে এগিয়ে গেল। তার পরই সামনে দেখতে পায়, ভোখাবোকা মাথাটা স্রোতের ওপর ভাসিয়ে রেখে ডাইনে বয়ে ঘোরাচ্ছে। বাঘারুর মাথার পেছনে পিঠের ওপরে পাতার গোছা ভাসে, গলায় পাথর ডোবে আর লোখাবোকার মতই স্রোতে ভেসে থেকে বাঘারু ওপারে, ফরেস্টে, তার নির্বাসনে চলে যায়।

.

০৬৭.

অর্থনীতির কিছু প্রক্ষিপ্ত

সরকারি ফরেস্টে গরুমোষ চরাবার একটা ব্যবস্থা আছে। তার জন্যে গরুমোষপিছু একটা পয়সা দিয়ে লাইসেন্স নিতে হয়।

শীতের শেষে আগুন লাগিয়ে জঙ্গল সাফ করা হয়, যাতে বর্ষার আগে নতুন গাছ পোতা হয়। কোনো-কোনো জায়গায় মরা গাছ কেটে বাদ দেয়া হয়। কোনো-কোনো গাছ এতই মরা যে কাটার খরচ পোষায় না। সেসব গাছও পুড়িয়ে দেয়া হয়।

এই সব আগুনটাগুন লাগিয়ে যখন ফরেস্ট সাফসুরত করা হয় তখনই গরুমেষ চরাবার লাইসেন্স করে রাখতে হয়। এসব লাইসেন্স দেয় বিট অফিস। তবে, সেখান থেকে রেঞ্জ অফিসে গিয়ে সিল লাগিয়ে আনতে হয়।

আগুন লাগানোর পর সারাটা ফরেস্ট কেমন খালি-খালি লাগে। তলায়-তলায় বহুদূর পর্যন্ত চোখ চলে যেতে পারে–এক নদীর পার থেকে আর-এক নদীর আর-এক পার। বর্ষার প্রথম কদিন যায় ফরেস্টের পোড়া দাগটা ধুয়ে যেতে। দেখতে দেখতে পরিষ্কার হয়ে যায়। বেশ তকতকে ঝকঝকে লাগে পুরো ফরেস্টের আঙিনা ঐ আকাশ-ছাওয়া গাছগুলোর তলায়।

কখন এক সময় নতুন ঘাস গজানো শুরু হয়ে যায়। ফরেস্টের মাটি দেখতে-দেখতে কচি-কচি ঘাসে ভরে যায়। দেখতে-দেখতে পোড়া জঙ্গল জুড়ে এই সবুজ নতুন ঘাস লক লক করে ওঠে। সেই সময় গরু আর মোষের বাথানে বিভিন্ন এলাকা ভরে উঠতে থাকে।

বাথানদার প্রায় সারা বছরই ফরেস্টে কাটায়। শীতের শেষে বসন্তের শুরুতে তাদের লাইসেন্সের মেয়াদ আইনত পার হয়ে যায়। তাদের বাথান নিয়ে ফরেস্টের বাইরে চলে আসতে হয়–এটাই আইন। কারণ, তখন জঙ্গল সাফ করার সময়। কিন্তু বাথান নিয়ে বেরিয়ে আসা প্রায় অসম্ভব। পঁচিশ-পঞ্চাশ-একশ গরুমোষ নিয়ে কি ফরেস্ট থেকে বেরিয়ে আবার গায়ে ফিরে যাওয়া সম্ভব? এসব গরু-মোষের সঙ্গে গায়ের কোনো সম্পর্কই নেই। বাথানদাররা তাই ঐ সময়েও ফরেস্টের ভেতরেই থাকে। বাথানদাররা জানতেই পারে, কখন কোন জঙ্গল সাফ হবে। সেই অনুযায়ী সরে-সরে যায়। তেমন সুযোগ থাকলে, ফরেস্টের ভেতরে ফরেস্টেরই ভোলা খালি জমিতে, বা নদীর চরে, বা কোনো চা বাগানের বড় মাঠে ঐ কটি দিন কাটিয়ে দেয়। ফরেস্টের মধ্যেই চা বাগানের তেমন-তেমন খোলা জমি থাকলে সেখানে এই কয়েক দিনের জন্যে বিরাট গো-হাটা মোষ-হাটা বসে যায়। কয়েকটা বাথান একসঙ্গে কয়েকদিন থাকে। তেমন সুযোগ থাকলে মালিকরাও এই সময় এসে তাদের বাথান দেখে যায়। কিছু-কিছু বেচাকেনাও চলে। বছরের পর বছর এই একই নিয়মে চলতে-চলতে এখন সবটাই সকলের জানা হয়ে গেছে, কখন কোন বাথান কোথায় থাকে।

সারাটা বছর জুড়েই কেন এই বাথানবাথান গরুমোষ ফরেস্টের ভেতরে-ভেতরে থাকে?

তার দুটো কারণ আছে দু-দিক থেকে। একটা কারণ ফরেস্টের। এত গরুমোষ খাওয়ার পরেও ফরেস্টে এত আগাছা জন্মায় যে নতুন চারার বাড় নষ্ট হয়, পুরনো গাছের শরীর খাক হয়ে যায়। বিশেষত, জলপাইগুড়ির এই ফরেস্টে, যেখানে বার মাসের সাত মাসই বৃষ্টি। এই কারণের ভেতর আরো অনেক ছোট ছোট কারণ জন্মে গেছে, অনেক দিন ধরে। সারা বছরের জন্য গেরুমোষ চরাবার লাইসন্স-ফি মাথা পিছু দশ-বিশ পয়সা। যার বিশটা সে দশটার জন্যে, যার পঞ্চাশটা সে পঁচিশটার জন্যে, যার একশটা সে পঞ্চাশটার জন্যে, লাইসেন্স ফি দেয়। এর অতিরিক্ত গরুমোষের জন্যে ফরেস্ট গার্ড, বিট অফিসার, তেমন বড় বড় বাথানের বেলায় এমন কি রেঞ্জ অফিসারও, একটা পয়সা পায়। সুতরাং ফরেস্টে গরুমেষ চরানোয় ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের স্বার্থ যেমন, কর্মচারীদেরও তেমনই স্বার্থ।

ফরেস্টে বাথান রাখার একটা কারণ আছে বাথানের মালিকদের। ফরেস্টের ভেতর বাথান রেখে দেয়াটা অনেক শস্তা পড়ে। গরুমোষের খাবার খরচই যে বাঁচে তা নয়, এতগুলো গরুমোষ রাখতে যে-পরিমাণ জমি নষ্ট হত, গোয়ালঘর রাখতে আর প্রতি বছর ছাইতে যে-খরচ পড়ত, সেটা বেঁচে যায়।

কিন্তু এই মালিকদের বেলাতেও এই প্রধান কারণটার সঙ্গে আরো অনেক ছোট-ছোট কারণ জড়িয়ে আছে, অনেক দিন ধরে। অনেক ক্ষেত্রে সেই ছোট কারণগুলোর যোগফল, প্রধান কারণের চাইতেও বেশি।

ফরেস্টের জমি ত সর্বত্রই ছড়ানো। গাছগাছড়ার জঙ্গলে বাইরে অনেক জায়গা পড়ে থাকে। কোথাও-কোথাও ত ফরেস্টের ব্লকটার চাইতে এই খালি জায়গাটাই বড়। বাথানের মালিক ঐ রকম মাঠওয়ালা ব্লকের লাইসেন্স জোগাড় করতে পারলে বাথানদার হাল-বিছনও নিয়ে আসে। বাথান বাথানের মত থাকে আর বাথানদার ফরেস্টের জমিতে জোতদারের জন্যে চাষ-আবাদ করে। ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের যারা এই দিকে থাকে তারাও চাষে সাহায্য করে। কারণ ফসলের একটা অংশ তারাও পায়।

ফরেস্টের জমিতে চাষ লাগানোর, অর্থাৎ জমি ফরেস্টের আর হাল বলদ-বিছন জোতদারের, আর-একটি পদ্ধতিও আছে। ফরেস্টের ভেতরে ফরেস্ট-ভিলেজার বলে এক-একটা দলকে থাকতে দেয়া হয়। তারা শুকনো পাতা, কাঠকুটো আর হাতের মুঠোর জমিটুকুতে কিছু চাষ করা আর থাকার অধিকারের বদলে ফরেস্ট পাহারা দেয়–প্রধানত পোচার ও চোরা কাঠকাটুনিদের খবর বিট অফিসে পৌঁছে দেয়। এরা সারাধারণ এত গরিব যে গরিব রাজবংশী গ্রামেও এদের জায়গা জোটে না। কিন্তু ফরেস্ট ভিলেজার হিশাবে এখন এদের কদর বাড়ছে বাইরের জোতদারদের কাছে। এই ফরেস্ট ভিলেজারদের সামান্য আইনি অধিকার আছে ফরেস্টের জমিতে। কিন্তু সেইটুকু অধিকারের সুযোগেই যদি তাদের হাল আর বিছন দেয়া যায়–বাথানদারদের হাত দিয়ে, আর তাদের ঘরের লাগাও জমি চাষে দেয়া যায় তা হলে ত সেটা আইনসঙ্গত চাষই হয়। জোতদার-দেউনিয়া তার ন্যায্য ভাগটুকু নিলে সেটাও আইনসঙ্গত ভাগই হয়।

এটাকে দুদিক থেকেই দেখা যায়-ফরেস্টের জমিতে জোতদারের আধিয়ারি, বা ডুয়ার্সের গভীর অরণ্যে কৃষিকর্মের বিস্তার।

নানা ভাবে এই প্রক্রিয়া ভারতের সব বনাঞ্চলেই শুরু হয়েছে। ফরেস্টের চাষযোগ্য জমিতে ফরেস্ট আর দখল রাখতে পারছে না। পুলিশ-টুলিশ দিয়ে এই সব জবরদখলকারীদের তুলে দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু দেখতে-দেখতে গত কয়েক বছর খবরের কাগজে ফরেস্ট স্কোয়াটার্স শব্দটা তৈরি হয়ে গেছে।

ফরেস্টে গেলেই রাশি রাশি জমি আর ফসল ব্যাপারটা যদি এই হত তা হলে ত ফরেস্টেই গ্রাম বসে যেত। হয়ত যেত। কিন্তু এখন ত আর তা সম্ভব নয়। এখন ফরেস্টের ব্যবসা জোতদারের চাষের ব্যবসার চাইতেও অনেক-অনেক গুণ লাভের। জোতদার, বা যে-কোনো ব্যবসায়ীর কাছেই, যে ব্যবসার টাকা তার ঘরে আসে না, সেই ব্যবসাটাই অর্থহীন। কী বা হছে, এ্যানং পাহাড়-পাহাড় আর জিলা-জিলা জঙ্গল রাখি? আরে মানষি থাকিবার পারে না, ত গাছ! তার আবার বাঘক বাঁচাবার নাগে, কুমিরক বাঁচাবার নাগে। তা বাঁচা কেনে, বাঁচা। মানুষজনক ধরি-ধরি বাঘ দে কেনে। বাচুক তর বনজঙ্গল আর বাঘ-হাতি।

নিজেদের ফরেস্ট বানাবার আর কাঠ বেচবার যদি আইন থাকত, তা হলে এরাই ধানগম চাষ তুলে দিয়ে শুধু বনচাষ করত।

কিন্তু উল্টোদিকে আবার ব্যাপারটা অর্থনীতির এমন সরল অঙ্ক নয় যে বাথানের ছুতো করে বন ঢুকে নানা কায়দায় বেআইনি জোতদারি করাটাই এত সব বাথানের উদ্দেশ্য। বাথান রাখার সরাসরি খুব কারণ আছে–দুধ বেচে বিনি খাটুনি বিনি খরচায় দৈনিক লাভের কারণ। কিন্তু তার সঙ্গে কখনো কখনো এই বেআইনি জোতদারিও মিলে যায়। আবার অনেক সময় যায়ও না, নেহাত বনের ভেতর বাথান রেখে দেয়ার সুবিধে বলেই রেখে দেয়া হয়। কথাটা শুধু এই যে বনের জমিতে গরুমোষের বাথান রাখা যেমন একটা ব্যবসা বা রীতি, বনের জমিতে বেআইনি জোতদারিটাও একটা রীতি। প্রথমটা অনেক প্রাচীন রীতি–এখন আবার নতুন ভাবে শুরু হয়েছে। দ্বিতীয়টা একেবারেই নতুন রীতি–এতটাই নতুন যে এখনো রীতি হিশেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে বলা যায় না। ফরেস্টের ভেতরে এত পশুর খাদ্য থাকে, যা বাইরে জোটে না, আর, বাথান নিয়ে থাকা লোকগুলোর পেটে এত সামান্য খিদে থাকে, যা বাইরে মেটে না। তাই বাথান, আর বাথানদার, গাছ-গাছড়া-পশুপাখি, এমন কি, বাঘ-হাতির মত পশুও, একটা সুসঙ্গতিতে থেকে যেতে পারে। সেই সঙ্গতিটাই জোরদারির ফলে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।

.

০৬৮.

কৃষিবিজ্ঞানের কিছু প্রক্ষিপ্ত

সঙ্গতি নষ্ট হচ্ছে কৃষিকাজের আধুনিকতার ফলে।

শুধু হালবলদে চাষ হতে পারে, বিছন হলেই ফসল হতে পারে। ফসল হলেই ত আর ফলন হয় না। পাকা ও কাটা পর্যন্ত ত সেই ফসল মাঠে রাখতে হয়।

ফরেস্টের ভেতরের জমিতে ফরেস্ট-ভিলেজাররা আগে লাঙল ছাড়া, বলদ ছাড়া, যেটুকু জমি দুই হাতে চষতে পারত, সেটুকুর ফসল দুই হাতে ফলন পর্যন্ত রাখতে পারত। কিন্তু ফরেস্টের ভেতর হালবলদের চাষের বিছন-ছড়ানো ফলন দুই হাতে রক্ষা করা যায় না। প্রধান বিপদ দু-দিক থেকে আসতে পারে।

এক : বনের পাখিরা এতটা খোলা জায়গায় এত ঘন ধানের এত ফলন দেখে নি। ফসল ফলল কি ফলল না, তারা ঝাঁকে ঝাকে নেমে এসে কয়েক দিনের মধ্যেই ধানগুলো খেয়ে ফেলে। ধানছাড়া গাছগুলো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কয়েক দিনের মধ্যে পোয়াল হয়ে গেলে ওড়াউড়ির তাতে কোনো অসুবিধে হয় না।

দুই : ধান গাছও আগুনের মত–নিজের পোকা নিজেই টেনে আনে। দু-হাতের মুঠোয় এটে যায় এমন ফলনে সে-পোকা দু-আঙুলে টিপে মেরে ফেলা যায়। কিন্তু হালবলদের চাষের বিছন-ছড়ানো ধানের পোকা মারতে ওষুধ লাগে। সেই পোকা মারার ওষুধের কোনো অসুবিধেও নেই আজকাল। দেউনিয়া জোতদারদের ঘরে কৌটোয়, জেলিক্যানে, প্লাস্টিকের বস্তায় ভোলা থাকে। পাট, ধান আর আলুর পোকা মারা ছাড়া সে-ওষুধ জোতদাররা অন্য কাজেও লাগায় কখনো কখনো। ঘরেও লাগায়, বাইরেও লাগায়। তাছাড়া আছে চা-বাগান। সেখানে ত এই সব ওষুধের গুদাম। চা-গাছের পাতার দাম ধানগমের চাইতে অনেক বেশি। সে পাতা বাঁচানোর ওষুধের দামও অনেক গুণ। তেমন দরকারে, ফরেস্টেরই ভেতর ছড়ানোছিটনো চা বাগানগুলো থেকে এসব সব ওষুধ আনা যায়। আনা হয়।

ফরেস্টের ভেতরে হালবলদে চষা বিছনছেটানো খেতে, এই সব ওষুধ ছিটিয়ে দেয়া হয়। কতটা ওষুধ কী ভাবে ছেটাতে হয়, সে-সবই আন্দাজ মাত্র। কোনোটাই জানা নয়।

হরিণ, হাতি, গণ্ডার, এরা ধান খেতে ভালবাসে। ধানের খোঁজে পাল বেঁধে ফরেস্টের বাইরেও চলে যায়। ফরেস্টের ভেতরে, হয়ত তাদের যাতায়াতের পথের পাশেই, এমন ধানখেত দেখলে তারাও আসে। হরিণেরা পাল বেঁধে, হাতিরা দল বেঁধে আর বেশির ভাগ গণ্ডার একা-একা।

ওষুধ ছিটনোর পরপরই যদি তারা আসে তা হলে ধানের সঙ্গে সঙ্গে এই সব ওষুধও গিলতে থাকে রাশি রাশি। ফলে, এই পশুর দল বনে ফিরে যাওয়ার পর এই ওষুধের বিষক্রিয়া শুরু হয়। এরা কতটা বিষ খেয়েছে সেই অনুপাতে মরে। সেই মৃত পশুদের মাংস যে-সব শেয়াল, বনকুকুর আর পাখিরা খায়–সেগুলোও মরতে শুরু করে। ফলে, নেহাতই আচমকা, এক-একটা ফরেস্টের এক-একটা জায়গায় মহামারী লেগে যায় যেন। আজকাল, এই সব মহামারী যাতে ছড়িয়ে না পড়ে, তার নানা রকম ব্যবস্থা হয়েছে–কিন্তু সেসব ব্যবস্থাই ত কীটনাশক, জীবাণুনাশক দিয়ে। কীট আর জীবাণুনাশক খেয়েই যে-মড়ক শুরু তা প্রতিরোধের কোনো উপায় নেই। এক ভরসা; কাছাকাছি স্রোতবতী নদী না-থাকলে মড়ক বেশি দূর ছড়াতে পারে না। থাকলে, স্রোতের সঙ্গে বিষ আরো নীচে নেমে যায়। আর-এক ভরসা, যদি বৃষ্টি হয় প্রচুর, তা হলে অত জলে বিষের সক্রিয়তা কমে যায়। কিন্তু ফসল ত পাকে, বর্ষা শেষের রোদেই। তখনই ত পোকা ধরে বেশি, পশুপাখিও ধান খেতে যায় বেশি আর ওষুধও ছেটানো হয় বেশি।

দাক্ষিণাত্যের কোনো-কোনো ফরেস্টে বাথানের গরুমোষ বাঘ মেরে নিয়ে গেলে বাথানদারেরা সেই মারা পশুটাকে খুঁজে বের করত জঙ্গলের মধ্যে। বাঘ ত আর একবারে সবটা খেতে পারে না, পরে খাবে বলে রেখে দিয়ে যায়। সেই মড়াটার ভেতরে এই বীজাণুনাশক ও কীটনাশক ওষুধ গ্রামবাসীরা ঢুকিয়ে দিয়ে আসত। তার পর সেই মাংস খেয়ে বাঘ ত মরতই, শকুন-শেয়াল-হায়নাও মরত। নিজেদের বাথানের গরুমোষ ফরেস্টে নিরাপদে চরাবার জন্য ফরেস্টের মাংসাশীদের সেই ওষুধের বিষে নিকেশ করা হয়। ১৯৭৬ সালেই কেনেথ অ্যাণ্ডারসন বলেছেন, এর ফলে আজ দাক্ষিণাত্যের এই সব বনে কোনো বাঘ নেই, শেয়াল নেই, হায়না নেই. শকুন নেই।

জলপাইগুড়ির ডুয়ার্সে অবস্থা এখনো ততটা খারাপ নয়। কিন্তু লক্ষণটা দেখা দিয়েছে। কয়েক বছর আগে ফরেস্টের এক ব্লকে একটি রাত্রিতে সম্বর হরিণের একটা পাল সারাটা সল্ট লিক জুড়ে শুকনো পাতার মত ছড়িয়েছিটিয়ে পড়ে ছিল। শরীরের ভেতরের অনভ্যস্ত বিষক্রিয়ায় শরীরেরই কোনো এক অজানা নিয়মে জিভ বের করে নুনমাটি চাটতে-চাটতেই মরে যায়। এই মৃত্যুর তদন্ত হয়েছিল। কলকাতা থেকে বিশেষজ্ঞরা এসেছিলেন। পোস্টমর্টেমও হয়েছিল। তার পরে আর-কিছু জানা যায় নি।

বেশ কয়েক বছর আগে ফালাকাটার কাছে যে-গণ্ডারটা মারা যায়, তারও কারণ নাকি বিষ। কেউ-কেউ সন্দেহ করে, সে বিষ মিশিয়েছিল পোচাররাই। দুটো গণ্ডার প্রায় নিয়মিত ধান খেতে আসত সংলগ্ন খেতে। ভোরের আগেই ফিরে যেত। জ্যোৎস্না রাতে অনেকে দেখেওছে, গণ্ডার দুটো সীমানায় দাঁড়িয়ে আছে–দেখে মনে হয়েছে কোনো কাটা গাছের মোটা গুঁড়ি পড়ে আছে। যারা ঐ খেত চব্বিশ ঘণ্টা দেখছে তারা ত জানে ওখানে কোনো গাছের গুঁড়ি নেই। প্রথম-প্রথম গণ্ডার দুটোকে তাড়িয়ে দেয়ারও চেষ্টা করেছে। ফল খুব একটা হয় নি। শেষে, ধীরে-ধীরে এটা অভ্যাসই হয়ে যায় রাস্তার বা পাড়ার ষাড় যে-নিয়মে চেনা হয়ে যায়। আর, একবার অভ্যাসে এসে গেলে ত এই গণ্ডার দুটো ঐ রাতগুলোর জন্যে ঐ গ্রামটারই বাসিন্দা হয়ে যায়।

কিন্তু অভ্যাসের অন্য একটা দিকও আছে। গণ্ডার দুটোর আসাটা যখন প্রায় নিয়ম হয়ে গেছে, সবার জানা হয়ে গেছে, তেমনি কোনো একদিন দেখা গেল, একটা গণ্ডার মরে পড়ে আছে। বলা উচিত, শোনা গেল। কারণ শেষ রাতে অপর গণ্ডারটির তীব্র চিৎকারেই সবার ঘুম ভাঙে। প্রথমে কেউ চিৎকারটি চিনে উঠতে পারে নি। কিন্তু নিয়মিত ব্যবধানে একই জায়গা থেকে চিৎকারটি বার বার উঠে আসায় বাধ্য হয়ে তোকজনকে বেরতে হয়। বেরনোর পর বোঝা যায় চিৎকারটি একটি গণ্ডারের নয়, দুটো গণ্ডারের। ততক্ষণে একটি গণ্ডার খেতের ভেতর এমন ছুটছে, যেন ভূমিকম্প হয়ে চলেছে। আর-একটি গণ্ডার ছোটে না, দাঁড়িয়ে থাকে। সমস্ত দৃশ্যটা দেখতে হয় বেশ দূর-দূর থেকে। একটা গণ্ডারের মৃতদেহ বেরল সকালে। কিন্তু মাদি গণ্ডারটা তখনো দাঁড়িয়ে। শুধু তখনই নয়, দিনের পর দিন। জায়গাটা থেকে নড়ছিলই না। প্রথম দিকে ঘন-ঘন চেঁচাচ্ছিল। পরের দিকে মাঝেমধ্যে। সে চিৎকারে মাটি ফেটে যাচ্ছে মনে হত। মাদি গণ্ডারটাকে বনে ফিরিয়ে দিতে আর মৃত গণ্ডারটার মৃত্যুর তদন্ত করতে কলকাতা থেকে বিশেষজ্ঞরা এসেছিলেন। গণ্ডারের পেট কাটতে ইলেকট্রিক করাত আনতে হয়েছিল। সে করাত চালাতে জেনারেটারঅলা গাড়ি আনতে হয়েছিল। তার ফলে কী জানা যায়, তা জানা যায় নি।

শোনা যায়, গণ্ডারটা মরেছিল ঐ পোকামারার ওষুধ খেয়ে। সে বিষ নাকি মিশিয়েছিল পোচাররাই। তারা নাকি ঐ জমিতে এত ওষুধ ঢালে যে ঐ জায়গাটা একেবারে পুড়ে যায়। কিন্তু দুটো গণ্ডারের বদলে একটা গণ্ডার ধান খেতে গেল কেন? সেটা ত অনেক সময় হতেও পারে। কেন হয়, তা এক পশুরাই জানে।

অনেকে বলে, যার জমি তার ভুলে এটা হয়েছে। অনেকে বলে, তারই বা পোচার হতে বাধা কোথায়? বা পোচারদের হয়ে এই কাজটুকু করে দিতে?

তবে, গণ্ডারের মৃত্যু এই কীটনাশক থেকে হতে পারে কি না এই নিয়ে অনেক তর্কবিতর্ক আছে। কিন্তু যদি কীটনাশকে মৃত্যু না হয়ে থাকে অথচ কোনো-কোনো লোক যদি সেটাকেই মৃত্যুর কারণ মনে করে, তা হলেই ত বুঝতে হয় এটা একটা সামাজিক বাস্তবতা হিশেবে স্বীকৃত হয়ে যাচ্ছে–পশুপাখি, গাছপালা, নদীনালা, মানুষজন নিয়ে ফরেস্টের সে-সঙ্গতি তা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, এমনই এক সামাজিক বাস্তবতা হিশেবে।

.

০৬৯.

রাজনীতির কিছু প্রক্ষিপ্ত

পুরনো জোতদারির নতুন কৃষির মত, নতুন করে বাথানদারিও শুরু হয়েছে।

জলপাইগুড়ি, ডুয়ার্স আর দার্জিলিং পাহাড়ের তলার দিকের অনেক জায়গায় নামই আছে বাথান দিয়ে। গরুবাথান, মহিষবাথান ত বেশ চেনা নাম। ছোট অনেক জায়গায় নামও এরকম আছে। কেন এই নামগুলো এমন হয়েছে তা নিয়ে কিছু-কিছু গল্প আছে। এসব জায়গার লোকবসতি ত খুব বেশি দিনের নয়। সুতরাং সেসব গল্পের ভেতর এখনো পর্যন্ত ইতিহাসই হয়ত আছে।

কিন্তু এখনকার এই বাথানবাথান গরুমোষ রাখা শুরু হয়েছে বড় জোর বছর পনের। ঠিক ভাবে বলতে গেলে, দশ বার বছরও হতে পারে।

১৯৬২-তে চীন-ভারত যুদ্ধ যখন শুরু হল, সকাল-সন্ধ্যা রেডিওতে নতুন-নতুন জায়গার নাম শোনা ছাড়া, ডুয়ার্সের লোকজন যুদ্ধ কিছু বোঝে নি। হাইওয়ের কাছে যারা থাকে তারা দেখেছে, মিলিটারি গাড়ি যাতায়াতের যেন শেষ নেই। কিন্তু সবাই ত সেটাও দেখতে পায় নি। তারাও দেশের অন্যান্য জায়গার লোকের মত রেডিওতে শুনেছে, যারা পড়তে পারে কাগজে পড়েছে। সে যুদ্ধ ত কয়েক মাস পর থেমেও গেল।

যুদ্ধ থেমে যাওয়ার পর সারাটা ডুয়ার্স জুড়ে নানা ঘটনা ঘটা শুরু হল বছরের পর বছর। সরু রাস্তাগুলো চওড়া হয়ে গেল। কাঠের ক্যালভার্টগুলো ঢালাই হয়ে গেল। ছোট-ছোট নদীর ওপর পাকা ব্রিজ হল। জলপাইগুড়ির ওপর তিস্তার ব্রিজ হল। এখন আর শিভক ব্রিজ হয়ে ঘুরে যেতে হবে না। আর, শিলিগুড়ির উত্তরে দার্জিলিং পাহাড়ের তলা থেকে আসাম পর্যন্ত, হাইওয়ের দুপাশে, বনের ভেতরের জঙ্গল পরিষ্কার করে, মিলিটারির ক্যাম্প বসল। সে ক্যাম্পের যেন আর শেষ নেই। বনের ভেতরটা পরিষ্কার করে পাকা বাড়ি, পাকা রাস্তা, অগুনতি গাড়ি আর অগুনতি মানুষজন। ফরেস্টের বড়বড় গাছ থেকেই গেল, তলাটা সাফ করে নেয়া হল।

শুধু জঙ্গলেই নয়, কোথাও-কোথাও শহরের বাইরে আর-এক শহর তৈরি করে ফেলল মিলিটারিরা। সেই সব শহর কোথা থেকে শুরু আর কোথায় শেষ কেউ জানে না। সমস্ত জায়গাটাই কোথাও দেয়াল, কোথাও কাটাতার দিয়ে ঘিরে রাখা। কখনোকখনো সেই সব ঘেরের ভেতর প্লেন নামে। তা ছাড়া, গাড়ির সারি ত লেগেই আছে। এরকম কত ঘেরা শহর তৈরি হয়ে আছে দার্জিলিং পাহাড়ের তলায়, শিলিগুড়ির উত্তর থেকে, হাইওয়ে ধরে, আসাম পর্যন্ত। কিন্তু এমন টানা ও প্রায় অবিচ্ছিন্ন নতুন সামরিক পত্তনের কোনো পরিচয় স্থানীয় লোকেরা না-জানলেও বহু দূর-দূর জায়গা এরই সূত্রে একত্রিত : হয়ে যায়। কোথায় কোন পাহাড়ের আড়ালে কামানের গোলার শক্তি পরীক্ষায় বা কামান চালনার অভ্যাসে কতদূর পর্যন্ত কেঁপে-কেঁপে ওঠে। এতদিন সেই কম্পনে লোজন অভ্যস্ত হয়ে গেছে। কামানের গোলার ধ্বনিতে প্রতিধ্বনিত হওয়া ছাড়া এই ব্যাপক অঞ্চলের ভেতর এই এত সামরিক ঘটনার কোনো প্রতিক্রিয়াই ঘটে না। তার একটা কারণ নিশ্চয়ই এই সারা এলাকায় জমির তুলনায় বসতি অনেক কম আর বসতির তুলনায় পাহাড়-নদীবন অনেক বেশি। তাই এই এত দূর বিস্তৃত অঞ্চল জুড়ে সেনানগর গড়ে উঠতে পারে স্বাধীনভাবে। স্থানীয় কোনো ব্যাপারের ওপর তার কোনো প্রতিক্রিয়া হল না। শুধু, মালবাজারে আর হাসিমারাতে পুরনো ও বাতিল ইউনিফর্মের দুটো দোকান হল। এই দুই জায়গাতে বেশ কটি ফটোর দোকান হল। আর এই দুই জায়গায় ত বুটেই, আরো কোনো-কোনো জায়গার ছোট-ছোট বই আর পত্রিকার দোকান বেশ বেড়ে গেল। মালবাজার আর হাসিমারার মত জায়গায় হিন্দি-ইংরেজি ত বটেই, তামিল, মালয়ালি, তেলেগু ভাষার কাগজ পর্যন্ত দোকানে টাঙিয়ে রাখা। এত ভাষার এত কাগজ সত্ত্বেও সব কাগজের ওপর একই মেয়ের ছবি! বীরপাড়াতে একটা বিরাট দোকান হল–তাতে ওষুধ থেকে শুরু করে জামাকাপড়, স্যুটকেস-সাইকেল-মদ সবই পাওয়া যায়।

কিন্তু সামান্য এই কটি দোকানপাট ছাড়া, এই যে এতগুলো ক্যাম্প যত্রতত্র বসে গেল–শোনা যায় বিন্নাগুড়িতে ত নাকি একটা পুরো ক্যান্টনমেন্টই হয়ে আছে, শুধু এখনো ক্যান্টনমেন্ট বলে ঘোষণা হয় নি এই মাত্র–তার কোনো প্রতিক্রিয়া স্থানীয় বাজারের ওপর হল না। অর্থাৎ বাজারে জিনিশপত্রের বিক্রিবাটরা বাড়বে, আমদানি বাড়বে, লোকের হাতে একটু পয়সা খেলবে, সে-সব হল না। লোকের ভাগ্যে থাকল ঐ ছেঁড়া পোশাক আর কাগজের দোকানে দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে মিলিটারির সুবাদে বিনি পয়সায় নানা ভাষায় ও নানা রঙে একটি মেয়েরই আধা ন্যাংটো ছবি মলাটে দেখা।

এত-এত ক্যাম্পের এত-এত খাবার, সেসব কনট্রাক্টাররা আনে ট্রাকে করে করে বাইরে থেকে। শিলিগুড়িতে একটা ডিপো আছে। কাঁচা তরকারিটরকারি সেখান থেকে কিছু আসে। কিন্তু খাশি আসে বিহার থেকে, একেবারে ট্রাক-ট্রাক লাদাই করে। এখন নাকি কিষনগঞ্জের পরে একটি জায়গায় আর ওদিকে বালুরঘাটে ডিপো হয়েছে। বালুরঘাটের ডিপোর কারণ বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে চোরাই-চালান। মিলিটারির কাজকারবার সারা দেশ জুড়ে। আর এই সব মিলিটারি কনট্রাক্টারদের কারবারও যেন তাই। যেন, এইখানে যে-কোম্পানি বদলি হয়ে আসে, তার সঙ্গে-সঙ্গে কোম্পানির কনট্রাক্টাররাও চলে আসে–সে ভারতের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত থেকেই হোক বা ভারতের পশ্চিম সমুদ্রের পার থেকেই হোক। এতদিনে হয়ত এই-সব কনট্রাক্টাররা এখানে, বিশেষত শিলিগুড়িতে, এখানকার লোকদেরও কিছু-কিছু সাবকনট্রাক্টারি দিচ্ছে কিন্তু আসল কনট্রাক্টের ব্যাপারে কেউ নাক গলাতে পারে না। অর্থাৎ পুরো এলাকা জুড়ে ৬২র যুদ্ধের পর মিলিটারির এত কিছু কাণ্ড হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও স্থানীয় লোকজনের আয়ব্যয়ের ওপর তার কোনো প্রতিক্রিয়া হয় নি। মিলিটারি জাতীয় ব্যাপার বলেই হয়ত তার প্রতিক্রিয়াও জাতীয়-স্তরেই হয়, এত তলায় আর নামতে পারে না।

কিন্তু একটি জিনিশ কনট্রাক্টারদের স্থানীয় ভাবেই সংগ্রহ করতে হত–দুধ। পাউডার মিল্ক বা ঐ-জাতীয় পানীয় সরবরাহে কোনো অসুবিধে হয়ত আছে। বা হয়ত, ঐ ধরনের পানীয়, যা দূরের কোনো জায়গা থেকে একবারে আসে, তার সঙ্গে স্থানীয় ভাবে সংগৃহীত দুধ দিয়েই দৈনিক রেশনের কোটা পূরণ করা যায়। কারণ যাই হোক, মিলিটারি ক্যাম্পের ফলে স্থানীয় ভাবে দুধের চাহিদা শুধু বেড়ে যায় বললেই হয় না, বাড়তে বাড়তে তা ছড়িয়ে পড়ে শিভক ব্রিজ পেরিয়ে সেই পাহাড়ের তলায়, বনে, এমন কি, পাহাড়েও, ব্যাঙডুবি-মিরিক থেকে সেই আসাম সীমা পর্যন্ত। দুধের জন্যেও ত কনট্রাক্টার আছে। তারা আবার ফড়ে লাগায়। ফড়েরা আবার লোক লাগায়। তারা সব দুধ জোগাড় করে আনে বস্তির আর টাড়ির ভেতর থেকে।

প্রথম দিকে এ নিয়ে নানা কাণ্ডও হয়েছে। মিলিটারি ক্যাম্পেক্যাম্পে এই দুধ জোগানোর ব্যাপারে নদী-নালাবন-পাহাড়ের আড়ালের সব বস্তি-টাড়ি পর্যন্ত, রাজবংশী-নেপালী-মদেশিয়া যাবতীয় লোকজন, জড়িয়ে গেছে। বস্তির লোক এক জায়গায় নিয়ে যেত। সেখান থেকে আর-একজন আরেক জায়গায়। সেখান থেকে আর-একজন বড় রাস্তায়। সেখান থেকে ট্রাকে, ইত্যাদি ইত্যাদি। সে-সমস্ত প্রাথমিক স্তর কেটে গিয়ে এখন একটা পাকাপাকি ব্যবস্থা তৈরি হয়েছে।

জোতদাররা বছর তিন-চারেকের মধ্যে কিষনগঞ্জ-পূর্ণিয়াতে তোক পাঠিয়ে, মোষ কিনে এনেছে। সামরিক কারণেই বোধহয়, ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টও উৎসাহ দেখায় গরুমোষ চরানোর লাইসেন্স দিতে। দেখতে-দেখতে মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে এই হাইওয়ের দু-পাশে সেই শিলিগুড়ির উত্তর থেকে আসামের সীমান্ত পর্যন্ত ফরেস্টগুলো গরুমোষ রাখার বাথানে ভরে গেল। দুধের কনট্রাক্টারের সঙ্গে প্রত্যেক বাথানের মালিকের ব্যবস্থা। কনট্রাক্টারকে যেবা যে-যে ক্যাম্পে দুধ সাপ্লাই করতে হয়, সেই ক্যাম্পের রাস্তার কাছাকাছি ফরেস্টে বাথান রাখতে হয় যাতে গাড়ি করে সাতসকালে দুধ সংগ্রহ করে আনা যায়। তাতে অবশ্য অসুবিধে হয় না, কারণ এক মালিকের যেমন একাধিক বাথান থাকে, তেমনি এক কনট্রাক্টারেরও একাধিক ক্যাম্প থাকে। ফরেস্টের ভেতর বড় রাস্তাগুলো জুড়ে সকালে ট্রাক-ট্রাক দুধ ভরে ছোটাছুটি চলতে থাকে। ফানেল আটকানো লম্বা-লম্বা নল গরুমোষের ব্যাটে লাগিয়ে যন্ত্র দিয়ে পাম্প করে দুধ দোয়া হয়ে যায়। ডায়না নদীর ব্রিজের নীচে, ল্যাটারাল রোডের পাশে, গয়ানাথের এমনই এক বাথান।

.

০৭০.

নির্বাসনভূমি

বাঘারুর এই নির্বাসনভূমি দিগন্তজোড়া ধনুকের মত বাকা ও নদীর এক পার থেকে অন্য পারের মত ধূসর।

কলকাতা থেকে আসাম ন্যাশনাল হাইওয়ে চালসার কাছে দক্ষিণে নেমে, আবার ময়নাগুড়ি দিয়ে উত্তরে উঠেছে। যে বিশাল ফরেস্টটা এই প্রায় মাইল পঞ্চাশ লম্বা U-এর বিচ্ছিন্ন দুই প্রান্ত ঘিরে রেখেছে, ফরেস্টের ম্যাপে তার নানা জায়গার নাম আছে–ওপর-চালসা আর নীচ-চালসা, ওপর আর নিচু তণ্ডু, ডায়না রেঞ্জ, ডায়না চর, গরুমারা, খুঁটিমারি। ফরেস্টের ম্যাপের এই নানা নামের ভেতরে একটা নিয়ম আছে–বড় থেকে ছোট হয়ে আসা নাম। ঐ চালসা থেকেই একটা ল্যাটারাল রোড বেরিয়ে এই পঞ্চাশ মাইল U-টার ওপরের দু-মাথা যোগ করে প্রায় সত্তর আশি মাইল বড় একটা গোল 0 বানিয়ে দিয়েছে।

বাঘারুর নির্বাসনভূমি যে-ধনুকের মত বাকা, এই ল্যাটারাল রোডটা সেই ধনুকের ছিলা। ডায়না নদীর ব্রিজটা সেই ছিলার মধ্যবিন্দু। ছিলা আর ধনুকের মাঝখানের শূন্যতা জুড়ে ডায়না নদী। ডয়না-চর ত জঙ্গল। তার পেছনে পাহাড়ের গা বেয়ে ফরেস্ট উঠে গেছে খাড়া ও ধনুকের মত বাকা। তার ওপারে ভূটান পাহাড়। এই ডায়না নদীর কোনো পাড় নেই, নীচে তিস্তার যেমন আছে। এই নদীর তিন দিক জুড়ে পাহাড়–আপলাদের তিস্তার তেমন নেই। এই নদীর চাইতে আপলাদের নদীর বুক বড়। এই ডায়নার খোলা বুকের মাত্র একটা অংশ দিয়ে পাথরে-পাথরে ধাক্কা খেয়ে-খেয়ে এই নদী এমনই বেগে ছুটছে–জল মাটি ছুঁতে পারে না। এত পাথরে ধাক্কা খেয়ে এত মুহুর্মুহু বাক নিয়ে এই ডায়না নদী নামে আর ছোটে যে মনে হয় নদীতে জল নেই, শুধু বুদ্বুদ আছে। বাঘারুর তিস্তায় ফেনা নেই বুদ্বুদ নেই–মাটির কোন অতল পর্যন্ত জল, তিস্তার বুকের ভেতর জল আঁটে না, ফেটে যায়। তিস্তার মত এপার-ওপার করে নয়, ডায়নাকে দেখতে হয় লম্বালম্বি, তলা থেকে ওপরে। কিন্তু লম্বালম্বিও ডায়নার অনেকটা একসঙ্গে দেখা যায় না, পাথর ও পাহাড়ে নদী এমনই হামেশা আড়াল হয়।

নদীর বুকের কিছু অংশে, জলের দু পাশে, বালি। তারপর অনেকটা জুড়ে শুধুই পাথর, যেন মনে হয় পাহাড়কে পাহাড় ভেঙে হঠাৎ ওখানে ছড়িয়ে আছে। ছোট-ছোট পাহাড়ের সমান এমন বড় বড় পাথর নদীর মাঝখানে আলগা পড়ে আছে, যার মাথায় উঠতে মানুষের বুকি,আর বাঘ বা কুকুরের নখ, দরকার। এমন বড় পাথরের খাড়া মাথা মাটির ওপর ঝুঁকে নিজেরই শরীরের ভেতরে এমন গর্ত তৈরি, করে, যেখানে ঝড়বৃষ্টির সময় মানুষ ও পশু আশ্রয় নিতে পারে। কোনো-কোনো পাথর আকাশে সূচ্যগ্র জেগে থাকে। চড়াইয়ে গড়াতে-গড়াতে ঝুলে থাকে কোনো পাথর, যেন এই মুহূর্তে গড়িয়ে নেমে আসবে। কিন্তু সেই পাথরের আড়াল থেকে নামা স্রোতের ধাক্কায়-ধাক্কায় তার তলায় শ্যাওলা পুরু হয়ে আছে। কোথাও-কোথাও কোনো এমন পাথর ঘিরে মানুষ-ডোবা ঘাসের জঙ্গল। সমান পাথরের বেদিতে কোনাকুনি খাড়া হয়ে আছে শাদা পাথরের স্থাপত্য-ধূসর সবুজের সামনে, স্রোতস্বান, ফেনপুঞ্জের পেছনে, বালি আর নুড়ির মাঝখানে।

পাহাড়ের মত এত-এত পাথর, নুড়ির মত ছড়িয়ে আছে বলেই চট করে বোঝা যায় না, নদীর সারাটা বুক বোল্ডারে ঠাসা কেন, যেন বাধানো। বালিভূমি আর নদীখাত জুড়ে এত বোল্ডার পড়ে, মনে হতে পারে, এই পাহাড়-পাহাড় পাথর দিয়ে নদীটাকে বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে।

এই বড় পাথর আর বোল্ডার ছাড়া প্রায় বালির মতই ছড়ানো নুড়ি পাথর। নানা আকারের, নানা রঙের। ডায়না দিয়ে বান বয়ে যাওয়ার সময় এই সব নুড়ি পাথরের ওপর দিয়ে জল নেমে যায় প্রায় ভাঙনেরই টানে। তার পর, জল কমতে শুরু করলে জলের ভেতরে রামধনুর রঙে চমকে-চমকে ওঠে নুড়ি পাথরের এই প্রান্তর। ডায়নার সহসাবিস্তৃত সেই জলরাশিতে মনে হয় আকাশের ছায়া, পড়েছে–এত গভীর আর এত রঙিন সেই নুড়ি-পাথরের জলপথ।

আপনাদের তিস্তায় পাথরের এই বিস্তার নেই। সেখানে মধ্যরাত্রিতে তিস্তার গভীর থেকে কামানের গর্জন উঠে আসে। লোকে বলে, তিস্তার কামান। তিস্তার তলার মাটিতে পাথরে-পাথরে ধাক্কা লাগে। জল এত গভীর, নদী এত ছড়ানো, পাথর মাথা তুলতে পারে না। আপলাদ ত নীচে, সমতলে, সেখানে মাটির ঢাল এত খাড়া নয়।

ডায়না নদীর ঠিক এই জায়গাটিতেই এমন ঘটছে, কারণ এখানেই পাহাড় থেকে নেমে এসে, ডায়না একটু বায়ে বেঁকে, সমতলে চলে গেছে! পশ্চিমে গাটিয়া, আরো কিছু পশ্চিমে জলঢাকাও, গিয়ে নীচে ডায়নায় মিশেছে। ডায়নার ব্রিজে দাঁড়িয়ে দক্ষিণে তাকালে সেই সমতলটা দেখা যায়। বেশ কিছুটা পর্যন্ত ডায়নার চর। তার পর থেকেই লোয়ার তণ্ডুর ফরেস্টের নদীসীমা গাছের দেয়াল দিয়ে গাথা। ডায়নার বুক ক্রমেই চওড়া থেকে চওড়া হয়ে নীচে নেমে গেছে–তিন-তিনটি বড় নদীর জল, আরো অনেক ঝোরা-নালীর জল ঐ বুকে এঁটে যায়। ওখান থেকেই জলঢাকা-গাটিয়া-ডায়না, তিস্তা থেকে পুবে, আরো পুবে সরে-সরে গেছে, শেষে, আরো পুবে কোচবিহারের পাশ দিয়ে। তার নীচে দক্ষিণ-পুবে মোড় নিয়ে রংপুরের কাছে তোর্সার সঙ্গে মিশে তিস্তায় গিয়ে পড়েছে। ডায়নার পুবে আর-কোনো নদী নীচে তিস্তায় পড়ে নি। পশ্চিমে তিস্তা আর পুবে ডায়না–এই ত সম্ভাব্য বিস্তৃততম তিস্তাপার।

ডায়নার এই চরে গয়ানাথের বাথান। এই চরের বাথানটুকু পেতে গয়ানাথকে, তার জোয়াই আসিন্দিরকে লাগিয়ে, ফরেস্টের অফিসে তদবির করতে হয়েছিল। বাথান তাকে রাখতেই হবে, এদিকে। তার কনট্রাক্টার দুধ সাপ্লাই দেয় এই ল্যাটারাল রোডের ওপর, বিন্নাগুড়ির দিকে। সে ত আর ট্রাকের তেল পুড়িয়ে আপলচাদে গিয়ে দুধ দোয়াত না। অবিশ্যি উল্টো দিকে, আপাদে বাথান থাকলে গয়ানাথ ওদলাবাড়ির দিকের কোনো কনট্রাক্টারের সঙ্গে বন্দোবস্ত করত। কিন্তু সেদিকেও যে গয়ানাথের বাথান নেই, তার নিশ্চয়তা কী? তিস্তাপারের পুব সীমা শিভক আর পশ্চিম সীমা এই ডায়নার মধ্যে কোথায় গয়ানাথ আছে আর কোথায় নেই, তা কি সব সময় গয়ানাথেরই জানা?

ডায়নার এই চরটাই বাথানের জন্যে বাছার কারণ একসঙ্গে এতগুলো যে তার ভেতর কোনটা আগে কোনটা পরে বিচার করা শক্ত।

এখানেই, ডায়না, পাহাড় থেকে নেমে, সমতলে চলে যায় বলে ব্রিজের পরে জলটা যেন ফেটে ছড়িয়ে পড়ছে। অথচ বালি আর পাথরের জন্যে এত বড় বুকটাও ত অসমান। ফলে, ডায়নার চরটাকে মাঝখানে রেখে অনেক দূর-দূর দিয়ে দুটো বড় ধারা গড়িয়ে গেছে। কিছু-কিছু ধারা আবার চরের মধ্যেও ঢুকে গেছে। এই মাঝখানের চরটাতে যদি বাথান থাকে, তা হলে দু ধারের জলই বাথানটাকে অনেকখানি বাঁচায়।

এই মাঝখানটাতে থাকার ত অন্য অসুবিধে নেই, কারণ, চরটা উঁচু ঘাসের জঙ্গলে ছাওয়া। যদি নানারকম ঘাস খাওয়াতেই ইচ্ছে হয়, চরটার ভেতর ঘুরতে দিলেই গরুমোষ নিজেই পছন্দমত ঘাস জোগাড় করে নেয়। তার ওপর, এই ঘাসবনের পরেই জঙ্গলবাড়ি। সেখানে ছোটখাটো নানা রকম ঝোপঝাড়, লতাপাতা, গাছগাছড়া। ঘাড় নুইয়ে ঘাস খেতে-খেতে গরুমাষের যদি একটু একঘেয়ে লাগে, তা হলে তাকে জঙ্গলে এক পাক ঘোরানোও যায়। তারও পরে পাথর আর বালি পার হয়ে পাহাড়ের গা বেয়ে ফরেস্ট শুরু। পুরো বাথান নিয়ে সেই ধনুকাকার ফরেস্টের বা দিক দিয়ে সকালে ঢুকে, ডান দিক দিয়ে বেরিয়ে বিকেলের ভেতর চরে ফিরে আসা যায়। ফরেস্টের কতকগুলো জায়গা যেমন কতকগুলি কাজের জন্যেই নির্দিষ্ট থাকে, এই জায়গাটি তেমনি যেন বাথান রাখার জন্যেই ঠিক করা। এই সব চরের জঙ্গলবাড়ি-ঘাসবাড়িতে একমাত্র ভয় গোবাঘারুর। কিন্তু তেমন কোনো বাঘ আছে কি না, এ খবর আগেই পাওয়া যায়। তা ছাড়া এতগুলো মোষ নিয়ে গো বাঘারুর মুখোমুখি হওয়ার সাহস না থাকলে তার আর বাথান রাখার দরকারটা কী? ল্যাটারাল রোডটা মাঝখান দিয়ে চলে গেছে বলে গাড়িঘোড়ার আওয়াজে বাঘ এদিকে আসে না। অথচ এই রাস্তা আছে বলেই সকালে কনট্রাক্টারের গাড়ি এসে দাঁড়াতে পারে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *