২.২ এক মিটিঙের তিন ফল

০৫১.

এক মিটিঙের তিন ফল

চা-সিঙাড়া খেতে-খেতে মিটিংটা ভাঙার পর সবাই নানা দলে ভাগ হয়ে যায়। ক্রান্তিহাটের দল মালবাজারের গাড়ি চলে গেলে যে যার বাড়ি চলে যাবে। গয়ানাথ আর হাট কমিটির মেম্বারকে এম-এল-এ বলে, শতরঞ্চিটা রেখে দিতে যাতে ফুলবাড়ির ওরা রাতটা ঘুমতে পারে, আর সুহাসকে বারবার দুঃখ জানায় তার ঘাড়ে এসে মিটিংটা করল বলে। মিষ্টির দোকানদার হ্যাজাক নিয়ে যেতে লোক পাঠায়। সেই লোকটি হ্যাজাক ধরে পথ দেখিয়ে এম-এল-এ, ইনজিনিয়ার ও মণিবাবুকে জিপ গাড়ির সামনে নিয়ে যায়। গাড়ি স্টার্ট দিয়ে তৈরিই ছিল বলে বিদায় নিতে দেরি হয় না।

গাড়িটা মিনিট দু-এক চলার পরই ইনজিনিয়ার এম-এল-একে বলে, বীরেনবাবু, আমি না বুঝে আপনার সেন্টিমেন্টকে আঘাত দিয়েছি। বিশ্বাস করুন, সত্যি আমি ওরকম কিছু ভেবে কিছু করি নি। আপনি কিছু মনে করবেন না। আর এই ব্রিজের ব্যাপারটা আপনি ভাববেন না, আমি দেখব।

আপনি আগে দেখলেই ত এত গোলমাল হত না। আমিও জানি লোক্যাল ঘটনা সব আছে। ধরেন, ঐ জব্বরের দাদারাই ত কনট্রাকটরি করে। ওরা সব যেই দেখছে এদিকে এই সব কাজ শুরু হইছে–অমনি বলাকওয়া শুরু করে দিছে যে লোক্যাল কনট্রাকটারদের দিয়া কাজ করিবার লাগবে। এই মিটিঙেই সেই কথা তুলত, নেহাত সুযোগ পায় নাই। আবার এই ভদ্রলোক ঐসব বললেন, এই নিয়ে সাত কথা হবে।

আমি স্যার বুঝি নাই, ঝোঁকের মাথায় বলে ফেললাম।

না ঐ কথাটা তুমি বলতে গেলে কেন, তুমি ত আর নামধাম বলবে না, সে কথা কি আর দশ জনের সামনে বলা যায়, সাব-এ্যাসিস্টান্ট ইনজিনিয়ার মণ্ডল বলে।

যাক, ছেড়ে দিন। আসলে এসব লোক্যাল ইস্যু বাড়তে দিলেই বাড়ে। তার ওপর নানা রকম ইন্টারেস্ট আছে। পলিটিক্যাল ইন্টারেস্টই কি কম। আপনারা একটু ট্যাক্টফুলি চলবেন। বীরেনদাও যদি আপনাদের ওপর রাগ করেন, তা হলে আর আপনারা কাজ করবেন কাকে নিয়ে? বীরেনদাইবা অত। রেগে গেলে কেন? আরো যাও লাথি মেরে রেলিং ভাঙতে, এখন পা ব্যথা করছে?

আরে না, না, আমি কি আর জোরে লাথি মারতে গেছি? তবে আপনারা যাই বলেন, ঐরকম পাটকাঠির মতন রেলিং কোনো ব্রিজের থাকে না। আপনি ও নিয়ে ভাববেন না স্যার, আমি কাল সকালে ঠিকাদার আর মণ্ডল দুজনকে নিয়ে গিয়ে দেখে কী ভাবে কী করা যায় ঠিক করে আসব। আমি আপনাকে জানিয়ে দেব।

.

সে শুধুই দর্শক আর শ্রোতা ছিল যে-মিটিংটাতে, তার অভিজ্ঞতা সুহাস নিজের কাছে ছকে নিতে চায় কিন্তু পারে না। শেষ পর্যন্ত ত ধরা পড়ে যায় গ্রামের ভেতরের কোন-একটা ছোট নদীর ওপর তৈরি ক্যালভার্টে নিয়ম অনুযায়ী সিমেন্ট-বালি-লোহা এই সব ব্যবহার করা হয়েছে কি না তা নিয়ে এম-এল-এর এত গভীর উদ্বেগের আসল কারণ তার চিঠি পেয়েও এ্যাসিস্ট্যান্ট ইনজিনিয়ার না এসে সাব এ্যাসিস্ট্যান্ট এসেছে কেন, আর তাকে স্যার বলা হয় না কেন। যদি ইনজিনিয়ারটি ফুলবাড়িতে যেত, তা হলে ত আর এরকম একটা মিটিং হত না। যদি কোথাও কোনো গোলমাল থাকত তা হলে সেটা ঐ ইনজিনিয়ারের অফিসেই মিটমাট হত–যেমন এখনো হবে। যে-নিয়ম ও আইনকানুনের কথা বারবার ইনজিনিয়ার ভদ্রলোক বলছিলেন, সুহাস তা মেনে ন নিয়ে পারে না, শুধু এই নেহাত ব্যক্তিগত কারণে যে তার কাজের ভেতর এ-রকম হস্তক্ষেপ হলে তারও ত একমাত্র রক্ষাব্যবস্থা সরকারি ঐ আইনকানুনই। আর এত মিটিং-টিটিং সত্ত্বেও সকলের চোখের সামনেই ত ইনজিনিয়ার ওদের কৃষক সমিতির সম্পাদককে গাড়ি করে নিয়ে এল। এটা আর কে না বুঝবে ঐ ভদ্রলোক ইনজিনিয়ারদের। নিরাপত্তার গ্যারান্টিই শুধু ছিলেন না, এমন-কি এম-এল-এর সঙ্গে ঝগড়ারও একমাত্র মীমাংসাকর্তা ছিলেন তিনিই।

এই সরকারি চাকরিতে ঢোকার আগে সুহাস গ্রাম ও কৃষক নিয়ে এক জাগরণের অনির্দিষ্ট অথচ যেন সম্ভাব্য চিন্তায় মগ্ন ছিল। অনির্দিষ্ট বলেই তাতে এমন সব নেহাত বাস্তব ঘটনার জায়গা করে দিতে পারে না সুহাস যে সরকারি পার্টির লোক হবার সুবাদে কনট্রাকটারের কাছ থেকে কিছু সিমেন্ট আদায় করার চেষ্টা আর ঠিকেদারদের কাজের ওপর এমন নজর রাখা একই সঙ্গে ঘটতে পারে। বাস্তবে, ঘটনার গায়ে ঘটনা, কার্যকারণের শৃঙ্খলা ছাড়াও যে লেগে থাকে, আর সেই একটি ঘটনার ভূমিকা যে অন্য ভূমিকার ওপর নির্ভরশীল থাকে না সব সময়, কোনো-কোনো সময় আলাদা ও স্বাধীন হয়ে যেতে পারে, এমন সম্ভাবনার কথা সুহাস ত জানে না। তাই তার ব্যক্তিনিরপেক্ষ মহত্তর-বৃহত্তর কামনাবাসনায় গ্রহণই লেগে থাকে সুহাসের। বীরেন্দ্রনাথ রায়বর্মনের মত এক স্থানীয় এম-এল-এ-র সঙ্গে সরকারি চাকরির ঐতিহ্যবান ইনজিনিয়ারদের এই মোকাবিলায় এম-এল-এ যে ইনজিনিয়ারকে তাদেরই খেলার নিয়মে প্রায় হারিয়ে দিচ্ছিল টেস্ট হাউসে পরীক্ষা করতে পাঠানোয় আরজি হয়ে গিয়ে, সেটা ত সুহাসের কাছে একটা কৌশলমাত্র। সেই কৌশলটা যে এম-এল-এ আয়ত্ত করতে পেরেছে এটা তার কাছে ধরা পড়ে না। এতটা পরিবেশনিরপেক্ষ হলে সুহাসকে নিজেরই চারপাশে পাক খেতে হবে। সুহাস নিজেকে ঘিরে আর-একটা পাক জড়ায়।

গয়ানাথ তার বাড়ির বাইরে উঠোনে ঢুকতে-ঢুকতেই চেঁচায়, হেই বাঘারু, বাঘারু, হেই বাঘারু। গয়ানাথের গলা শুনে ভেতর থেকে একজন একটা লণ্ঠন নিয়ে আসে। সেই লণ্ঠনের আলোতে গয়ানাথের এই বাড়িঘর সর লম্বা হয়ে মাটিতে দোল খায়।

গয়ানাথের বৌ ভেতরে চিৎকার করে ওঠে, নিজের বাড়িত কি ডাকাতি করিবার আইচছেন?

আসিন্দির মোটর সাইকেলটা ঠেলতে-ঠেলতে ভেতরে নিয়ে রাখে। চেঁচায়, এই, কায় আছিস, লণ্ঠনখান ধর এতৃতি। যে লণ্ঠন নিয়ে আসছিল সে দাঁড়িয়ে পড়ে, তারপর পথ দেখাতে উঁচু করে ধরে।

গয়ানাথ আবার চিৎকার করে ওঠে, হে-ই বাঘারু, বাঘারু। তার পর হঠাৎই তার একেবারে সামনে, প্রায় তার ওপরে, বাঘারুকে দেখে চমকে ওঠে, শালো বলদ, জবাব দিবার পারিস নাই? শালা, বোবা ত হাম্বা ডাক কেনে। যা, দূরত যা, দূরত যা।

বাঘারু একটু দূরে সরে যায়। কিন্তু তখনো গয়ানাথ তার চোখের দিকে তাকাতে পারে না। বস ঐঠে, শালো বলদ, বস কেনে, খাড়া হইছে য্যান ফরেস্টের শালগাছ।

গয়ানাথের কথা শুনে বাঘারু বসে পড়ে, মাটির ওপরে। হয়ত রাত্রি বলেই, বসার পর বাঘারুর সামনে গয়ানাথকে যেন আরো ছোট দেখায়। গয়ানাথ তার ফাটা বাঁশের মত চেরা অথচ সরু গলায় চিৎকার করে ওঠে, কী কহিছিস এম-এল-অক?

বাঘারু জবাব দেয়, কিছু কহ নাই।

কহ নাই? যেইলা উমরাক ফুলবাড়িতে নিয়া গিছিস, কী কহিছিস?

মোর নামখান কহিছু।

খুব নাম চিনবার ধইচছিস, না?

 মোর জন্মকথাখানা কহিছু। তুই শালো অবতার হবার ধইচছিস, না? নিজের জন্মকথাখান নিজেই শুনাবার ধইচছিস মানুষক? আধিয়ারির কথা কহিস নাই, এম-এল-অক?

কী কাথা?

আধিয়ারির কাথা। এম-এল-এ হামাক কহিল, তুই কহিছিস আধিয়ারির কাথা। এম-এল-এ হামাক কহিল, উমরাক একখান আধিয়ারি দ্যান কেনে। শালো, জমিন মোর, না তোর এম-এল-অর?

মুই কহ নাই।

কহিছিস কি কহিস নাই, বুঝিবু এ্যালায়। তুই কালি সূর্য উঠিবার আগত এই তিস্তাপার ছাড়ি চলি যাবি। হু-ই নাগরাকাটাত ডায়না নদীর চরত মহিষের বাথান আছে, ঐঠে থাকিবু। বুঝলু? আর কান্দুরা ঐঠে আছে। পাঠাই দিবি। বুঝলু?

.

০৫২.

 বাঘারু ও চাঁদ

পরদিন, রাত না পোহাতে বাড়ি থেকে নেমে বাঘারু দেখে, আলো সবে ফুটতে শুরু করেছে, আকাশ ঝকঝকে সবুজ, সেখানে একটা শাদা চাঁদ।

বাঘারু ডাঙা থেকে লাফ দিয়ে নীচে নামে। আর চাঁদটাও তড়াক করে লাফ দিয়ে আপলাদ ফরেস্টের মাথা থেকে তার মাথার ওপর এসে পড়ে। লাফ দিয়ে নেমে বাঘারুকে দাঁড়াতে হয়। চাঁদটাও আকাশে আটকে যায়। বাঘারু মাঠ দিয়ে চলা শুরু করে দক্ষিণ হাঁসখালির দিকে। চাঁদটাও গড়িয়ে-গড়িয়ে চলে। চাঁদটা টাকার জলছাপের মত। চার পাশে আলো ফুটলে আর দেখা যাবে না। আকাশটা এত ঝকঝকে সবুজ, আলো ফুটতে দেরি হবে না।

তিস্তা এখন তার পেছনে। তাকে তিস্তা পার থেকে চলে যেতে হচ্ছে। দেউনিয়া এখনো ঘুম থেকে ওঠে নি। আসিন্দিরজোয়াইও ওঠে নি। ওরা উঠে দেখবে বাঘারু নেই। জানে, বাঘারু থাকবে না। বাঘারুকে ডাকবে না।

বরসোজা উত্তরে-পুবে, এই আনন্দপুর বাগানে ঢুকে ও চাঁদটা আরো বায়ে

এখন নিজের চোখের সামনেটা পরিষ্কার। বিঘাখানেক দূরের জায়গা নজরে আসে না। দূরে, বাড়ি-টাড়ি জলছিটানো কুয়াশায় ঢাকা। এই ধোয়া ধোয়া ভাবটা কাটতে সময় নেয়। সারা দিনই কিছু-না-কিছু লেগে থাকে গাছের মাথায়, নদীর ওপরে। এগুলো আকাশের কুয়াশা নয়–বনের বা নদীর কুয়াশা। সোজা তাকিয়ে হাঁটলে মনে হয় চাঁদের আলোয় হাঁটছে, সামনে কী আছে জানে না। আকাশের দিকে তাকিয়ে হাঁটলে বেশি দূর দেখা যায়। বাঘারু ঘাড় কাত করে আকাশেই তাকায়।

গোচিমারি থেকে হাঁসখালি পর্যন্ত অনেকখানি ঢাল জমি–তিন পাশের সব জমিই উঁচু, কোনো-কোনোটা ত বেশ উঁচু। এই ঢালটার ওপরে, এই সবুজ আকাশ যেন ঢাকনা। গোচিমারির ঢালের মাঝখানটা কড়াইয়ের মত। সেখানে নামতেই চাঁদটা এক লাফে তার মাথার ওপর এসে পড়ে। চার পাশে উঁচু ডাঙার জন্যে আর-কিছুই দেখা যায় না। দূরে ফরেস্টের গাছগুলোকে মনে হয় পাহাড়ের গায়ে জঙ্গল। সেই খাদের ভেতর বাঘারু আকাশের চাঁদের মুখোমুখি।

বাঘারু চাঁদের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলে। হেসে বাঁ দিকে মুখ ঘোরায়-চঁদ ডাইনে সরে। ডাইনে মুখ ঘোরায়, চাঁদ বয়ে সরে। বাঘারু একটা ঢেলা কুড়োয়। সেটা চাঁদের দিকে ছোঁড়ার জন্যে কয়েক পা দৌড়তেই চাঁদটাও তাড়াতাড়ি গড়িয়ে সরে যায়। ঢেলাটা ছুঁড়ে বাঘারু দাঁড়িয়ে পড়ে। চাঁদটাও থেমে যায়। একটু দূরে ঢেলাটা পড়ে যাওয়ার ধুপ আওয়াজ হয়। চাঁদটার দিকে একটু ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে বাঘারু আবার হাঁটতে শুরু করে হাঁসখালির বাঁধের দিকে। চাঁদও গড়াতে থাকে আপলাদের দিকে। এখন বাঘারুকে আবার একটু-একটু করে উঁচুতে উঠতে হচ্ছে–কড়াইয়ের গা বেয়ে। চাঁদটাও একটু-একটু করে ওপরে উঠে যেতে থাকে–আরো উত্তরে। এখন আবার ডাঙার ওপরের গাছগাছড়া দেখা যাচ্ছে। ফরেস্টটা মাটিতে নেমে আসছে। সেই ফাঁকে চাঁদটা আড়ালে সরে যায়। বাঘারু বোঝে, দেখা না-গেলেও কোথাও আছে। সে হাঁসখালির বাধে উঠে পড়ে। আর দেখে, বাঁধ বরাবর সোজা উত্তরে-পুবে, একেবারে তার সামনাসামনি, চাঁদটা আকাশের গায়ে সেঁটে আছে। এই হাঁসখালির বাধ বা হাতির রাস্তাটা সোজা আনন্দপুর বাগানে ঢুকে গেছে। আপলাদের ভিতর দিয়ে যে রাস্তাটা ওদলাবাড়ির দিকে গেছে, সেটা বয়ে রেখে বাঘারু সিধে হাঁটে। চাঁদটা আরো বায়ে ফরেস্টের মাথায় চলে যায়। বাঘারু ফরেস্টের মাথার ফাঁক দিয়ে দিয়ে চাঁদটাকে দেখে। ফরেস্টের ভেতরটায় এখনো অন্ধকার–শেষ রাত্রি। সেই অন্ধকারের ভেতর দিয়ে আকাশটা আরো সবুজ ও চাঁদটা আরো স্পষ্ট দেখায়–সকালের শাদা চাঁদ নয়, রাত্রির জ্বলজ্বলে চাঁদ। এখন, এই হাতির রাস্তাটা ছেড়ে ফরেস্টের ভেতর ঢুকলে চাঁদের সেই আলো পাওয়া যাবে। ফরেস্টের ভেতরের এই রাত্রির আড়ালে-আড়ালে চাঁদটা অনেকখানি এগিয়ে যেতে পারে। মাঝখানে একটা আগুনলাইনের সড়ক–ফরেস্টটাকে দু-ভাগ করছে। বাঘারু বায়ে ঘুরে, দাঁড়িয়ে পড়ে। ফরেস্টের ভেতরের রাত্রির ওপরে চাঁদটা ডাইনে লেগে আছে। যে-আগুনলাইনের দিকে মুখ করে বাঘারু দাঁড়িয়ে সেটাতে গাছপালা নেই। তাই একটু আলো আছে। কিছুদূর গিয়েই সে আলো আবার আবছা। এখনো আকাশে দিনের আলো এত জমে নি যে এই আগুনলাইনটা পুরো দেখা যাবে। মাঝখানের সেই অন্ধকারের পরে ঐ আগুনলাইনের শেষের আভাস দেখা যায়–আকাশের সবুজ আর নদীর বালির শাদায়। মনে হয়, সেখানে আরো বেশি সকাল হয়ে আছে।

বাঘারু যে-ভাবে আগুনগলির সামনে দাঁড়িয়ে, সেভাবে সাধারণত বনের পশুরা দাঁড়ায়, যেন পথ ঠিক করতে পারছে না। লম্বা হাত দুটো নাড়িয়ে ফরেস্টের বাতাস কেটে বাঘারু গন্ধ শোকে–ফরেস্টের। একবার ডাইনে ঘাড় ঘুরিয়ে হাতির রাস্তা ধরে আনন্দপুরের দিকে তাকায়। আবার, ঘাড় কাত করে আকাশের চাঁদটাকে দেখে। তার পর, ফরেস্টের ভেতরটা একবার দেখে। শেষে, ডাইনে ঘুরে সোজা হাঁটতে শুরু করে বাগানের দিকে।

এখন, বাঘারু যতই বাগানের দিকে এগয়, চাঁদটা ততই গাছের ডালে-ডালে তিস্তার দিকে পেছয়। মাঝেমধ্যেই তাকিয়ে-তাকিয়ে বাঘারু দেখে নেয়। ঘাড়টা তাকে বারবারই বেশি ঘোরাতে হয়। আনন্দপুরে ঢুকে যাওয়ার পর ঘাড় ঘুরিয়েও চাঁদটাকে হয়ত আর দেখা যাবে না। আরো খানিকটা সকাল ত হল– বেশিক্ষণ আকাশ সবুজ থাকবে না। আলো পড়লেই প্রথমে নীল, তার পর শাদা হতে শুরু করবে। তখন ঐ জলছাপ চাঁদ আর দেখা যাবে না। বাঘারুর হাটার বিপরীতেই যখন ঐ চাঁদের গতি আজ, তা হলে চাঁদটা তিস্তার ওপর গিয়ে পড়বে। ওপরে নীলচে শাদা আকাশ, নীচে তিস্তার শাদা ঘোলাটে জল–ও চাঁদ তখন কোথায় মিশে যাবে?

এখন এই ফরেস্ট, খেতবাড়ি, নদী, হাট, বাড়ি-টাড়িবস্তি, এই বাতাস, ভেজা ঘাস, আপথ, বাঁশ ঝাড়, চা-বাগানের ফ্যাকটরির নল, এই-সব কিছু নিয়ে একটা নতুন দুনিয়া তৈরি হয়ে উঠেছে আবার একটা দিনের জন্যে।

সেই নতুন দুনিয়ার এখন পর্যন্ত এক বাঘারু আছে আর ঐ চাঁদ আছে।

.

০৫৩.

ভোরের আগে চা-বাগান

মাঠে-মাঠে খেতবাড়িতে, জঙ্গলবাড়িতে, ধানবাড়িতে যেমন হাটে বাঘারু, তেমনি হটছে, এখন। নদীর বা ফরেস্টের জঙ্গলের ভেতর আলাদা হাঁটা–ঠেলে-ঠেলে। আর-সব হাঁটাই এক রকম–আকাশের অনেক ওপরে পাখির ডানা-ভাসানো ওড়ার মত ভেসে-ভেসে হাটা, পায়ে-পায়ে খুব বেশি ধুলো ওড়ে না, খুব বেশি দাপাদাপি হয় না–মাটির ওপর নিজের ওজন ছাড়া। তিস্তার খুব টান-টান স্রোতে শালগাছ যেমন হালকা হয়ে যায়, এই বহুদূর পর্যন্ত ছড়ানো মাঠের টানে বাঘারুর লম্বা শরীর, চওড়া বুক-পিঠ, লম্বা-চওড়া, বাহুকজি, শক্ত কাঁধ আর লম্বা পা দুটোর তেমনি সব ভার চলে যায়।

কিন্তু মাঠেরও স্রোত আছে আর বাঘারুও শালগাছ বলে হাঁটাটা মাটির ভেতর গেঁথে যায়। এতটাই, যেন মাটিটা হাঁটে–ফরেস্ট, হাট, টাড়ি-বাড়িসহ এই মাটিটাই। তখন সামনে যাই আসুক, গতি প্রতিহত করা যায় না। হয় বাঘারুকে ধাক্কা খেয়ে পড়ে গিয়ে নামতে হবে, নয় সামনের বাধাটাই ভেঙে গুঁড়িয়ে যায়।

বাঘারুর ত আর রাস্তা দিয়ে যাওয়া নয়। রাস্তায় সামনে অনেকখানি দেখা যায়, রাস্তাটাও দু-পাশের সঙ্গে মিশে যায় না, আলাদা থাকে, দু-পাশটাই বদলায়।

কিন্তু তাই বলে ত মাঠজঙ্গল ভেঙে হাতির পাল, মোষের পালের মত যাওয়া বাঘারুর নয়। তার পায়ের একটা আন্দাজ আছে–নির্ভূল। তাকে যদি চালসার পুবে ডায়না নদীর চরে পৌঁছতে হয় তা হলে তাকে প্রায় সিধে উত্তর-পূবে হাঁটতে হবে। এখন থেকে সিধে কোনাকুনি চললে রাস্তা ছোট হয়ে আসবে। কিন্তু রাস্তা ছোট করার জন্যে বাঘারু ত আর তার চেনা লাইন, চেনা জায়গা ছাড়তে পারে না।

আনন্দপুর চা-বাগানে ঢোকার একটা গেট আছে। গেটের আগে জলনিকাশী বড় নালার ওপরে লোহার পাইপ একটু-একটু ফাঁক করে সাজিয়ে তৈরি করা ক্যালভার্ট। গরু-ছাগলে ঢুকতে পারে না, পাইপে পা পিছলে ফাঁকে আটকে যায়। চওড়া বেঁটে গেটের পাশে লোহার খুঁটি সানজির। (দুই আঙুলের মাঝখানের ফাঁক] মত–যাতে মানুষজন যাতায়াত করতে পারে, গেট বন্ধ থাকলে। ওখান থেকেই বাগান ঘেরা তারের বেড়া।

আনন্দপুরের গেটটা পার হতেই সকালটা যেন শুরু হয়ে যায় কেন, বাঘারু বোঝে না। এতক্ষণ যে বাঘারু হেঁটে এল আকাশ আলো-গাছপালা-হাওয়া সব এক হয়ে মিলেমিশে ছিল। আনন্দপুরে সবই সাজানোগোছানো, আলাদা-আলাদা। দু-পাশে চা-বাগানের কাটাছাটা সমান বেড। সেগুলোর মাথার ওপরে ছায়া-দেয়া গাছের সমান মাথা। মাঠের মত সমান চা-বাগানের বেডের ওপরে ছাতির মত সমান। গাছের মাথা। বেড়গুলো তারের বেড়া দিয়ে ঘেরা, ওপাশে গভীর নালা। জল যা যাওয়ার যায়, কিন্তু বেডের ভেতর হাতি ঢুকতে পারে না ঐ নালীর জন্যে। মানুষজনের যাতায়াতের জন্যে মাঝেমধ্যে ইটের সিঁড়ি, কোথাও-বা কাঠেরও সিঁড়ি, দুই-এক জায়গায় আবার আঙুলফাঁক লোহার খুঁটি।

মাঠঘাট বনবাদাড় পেরিয়ে এসে বাঘারুকে এই চা-বাগান আনন্দপূরে শুধু রঙ দেখতে হয়। বাবুদের বাড়ির টিনের চালের সবুজ বাংলোর দোতলা চালের সবুজ, জানলা-দরজার সবুজ–চার পাশের এত সবুজের মধ্যেও এই সবুজগুলো আলাদাভাবেই চোখে পড়ে। রাস্তার মোড়ে-মোড়ে লাল-শাদা রঙের খুঁটিগুলোর বাক অনেক দূর থেকে দেখা যায়। আর, মোড়ের যেন শেষ নেই। একটা মোড় পেরনোর সময় ডাইনোয়ে সামনে-পেছনে তাকালেই দেখা যায় চারদিকে লাইন বেঁধে মোড়ের পর মোড়, মোড়ের পর মোড়। আর মোড় মানেই ত রাস্তা, রাস্তার পর রাস্তা। একই রকম শিরীষ গাছের তলায়, একই রকম চাবাগিচায়, একই রকম রাস্তায়, তার পর একই রকম মোড় হয়ে হয়ে যাওয়ায় সোজাসুজি রাস্তারই একটা গোলক ধাঁধা তৈরি হয়। এত রাস্তা দিয়ে কত লাক হাঁটে। এত রকম বাড়িতেই বা কত লোক আঁটে। ছোট-ছোট বারান্দার বাড়ি, লম্বা-লম্বা বারান্দার বাড়ি, ছাদের বাড়ি, টিনের বাড়ি, ভামনির বাড়ি, কাঠের বাড়ি, দালানের বাড়ি, বেড়ার বাড়ি।

আনন্দপুরের লোকজন এখনো ঘুম থেকে ওঠে নি, অন্তত ফ্যাক্টরি আর অফিসের এই রাস্তায় আসে নি। কিন্তু গোচাবাড়ি থেকে বেরবার পর মাঠে, হাঁসখালির বাধে, হাতির রাস্তায়, আকাশের আর মাটির রঙে সকালটা যেরকম হচ্ছিল আনন্দপুরে তা বদলে যায়। শিরীষ গাছের ছাউনি আর চা-গাছের মাথার মাঝখানে ত আর-কিছু নেই–সমস্তটা ফাঁক। আকাশ নয়, মাটি নয়, আকাশ-মাটির মাঝখানের ঐ জায়গাটা ফাঁকা। আর চা বাগানে ত ঐ মাঝখানের জায়গাটাই আসল। ঐ ফাঁক দিয়ে আলো, আকাশের মতই, ছড়িয়ে পড়তে পারে।

বাঘারু সেই বানানো সকালের মধ্যে, ডাইনে বয়ে করতে করতে, বাগানের পুর সীমার দিকে চলে–বেরিয়ে যেতে। বাঘারু ভেবেছিল পুরগেট দিয়ে বেরিয়ে ডাইনে বেঁকে মাঠ-বরাবর বারঘরিয়ায় উঠবে। কিন্তু একটা মোড় থেকে ডাইনে তাকিয়ে সে বেঁকে যায় মনে হয়, এদিককার বেড়া গলে ওদিকের মাঠে নেমে যেতে পারবে।

কিন্তু এগিয়ে দেখে গলতে হবে না, বেরবার একটা রাস্তা আছে, দু-আঙুলের ফাঁকের মত লোহার খুঁটি।

বাইরে যাবার রাস্তা, এত বর্ষার পরও শক্ত। পায়ে চলা রাস্তাতেও ঘাস গজায় নি। রাস্তার পর রাস্তা, মোড়ের পর মোড়, মোড় থেকে মোড় দিয়ে ঘেরা ছক, ছকের ভেতর মাঠের মত সমান চা-গাছ আর ছাতার মত সমান শিরীষ গাছ–এমন চা-বাগান ছেড়ে বাঘারু এখন, আল বেয়ে, আরো-আরো আল দিয়ে দিয়ে ছক কাটা, অসমান, নানা আল দিয়ে নানা অসমান ছককাটা মাঠে নামে। এই সামান্য একটু উঁচু থেকে বাঘারুর মনে হয়, মাঠটার আলগুলো শীতকালের নদীর মতন; কোথায় শুরু, কোথা দিয়ে বয়, কখনো সরু, কখনো মোটা।

মাঠের ভেতর নেমে এলে আর তেমন লাগে না। তখন মাঠেরই দূরের কোনো অংশ তার থেকে উঁচুতে, আবার সামনের আলটাই ছোট্ট একটা গাছ বেয়ে ওপরে উঠেছে। বাগানের গা-লাগা জমিটা একটা ঢাল। তার পরই ডাঙা। ঢাল জমিটাতে ভাল ধান হয়েছে। কিন্তু তার পরই পাথুরে বরমতল। এখন ত চা বাগান আর ফরেস্ট শুরু হবে। ধানি জমি কমে আসবে। খেতবাড়ি তিস্তাপারেই ভাল।

সেই নিচু জমির আলটা দিয়ে চলতে-চলতেই বাঘারু দেখে,সামনের ডাঙারও ওপারে আকাশটা লাল হয়ে উঠছে, যেন ঐ ডাঙাটা আকাশটারই ঢাল। বাঘারু খুশি হয়ে ওঠে। গোচামারিতে বাড়ি থেকে বেরতে-বেরতেই যদি সূর্যটা উঠত, তা হলে তার পেছনে পড়ত, সে সূর্যোদয় দেখতে পেত না, অবিশ্যি আকাশটাও অনেকক্ষণ তার মাথার ওপর ছিল–সেখানে রঙের খেলা দেখতে পেত। কিন্তু এখন ত তার মুখোমুখি সূর্যোদয়, এই ঢাল পেরিয়ে ঐ ডাঙায় উঠলেই। যেন এই সূর্যোদয়ের কারণেই এই বারঘরিয়ার মাঠে বাঘারুর আসা–এমনই লাফিয়ে লাফিয়ে সে ডাঙাটার দিকে ছোটে।

ডাঙাটাতে উঠে দাঁড়িয়ে পড়ে। তার সামনে কোণাকুনি বারঘরিয়ার মাঠটা ছড়িয়ে গেছে সেই পুব-দক্ষিণে কান্তদিঘি কুমারপাড়া পর্যন্ত। কান্তদিঘি কুমারপাড়ার ঐ দিক থেকে সূর্য উঠছে। এখন, বাঘারুকে যেতে হবে এই সূর্যটাকে ডাইনে রেখে একটু উত্তর বরাবর। কিন্তু, এমন সূর্যোদয়ের মুখোমুখি পড়ে বাঘারু যেন আর নড়তে পারে না। ডাঙার ওপরে উঠেই সে দাঁড়িয়ে পড়ে। তারপর, যেন একটা ভাল জায়গা বেছে, শ্যাওড়া গাছটার নীচে গিয়ে দাঁড়ায়। তার সামনে, অর্ধবৃত্তাকার প্রান্তরের শেষে দিগন্তে সূর্যোদয়ের দৈনন্দিন ধারাবাহিকতা শুরু হয়ে গেছে।

.

০৫৪.

বাঘারু ও সূর্যোদয়

কান্তদিঘিকুমারপাড়ার দিকে মুখ করে বাঘারু দাঁড়িয়ে। তার পুবে কুমলাই, তার পুবে মাথাচুলকা, মাথা চুলকার পুবে ধূপঝোরা। এই সূর্যোদয়ের ভূগোল বাঘারুর এই পর্যন্তই জানা। সে যেখানে যাচ্ছে, সেই ডায়না নদীর জঙ্গলে ত পুব দিক আছে। সেই সব পুব দিকের নাম তার জানা নেই। সূর্য ত সেখান দিয়েও উঠছে। পুবের রাস্তা, সেখানে, আরো পুবে, আসামের দিকে গেছে। সেই সব পুবদিক দিয়েও এই একই সূর্যোদয়। এখন বাঘারু সেই না-জানা পুবদিকেই চলেছে বলে এই সূর্যোদয় আকাশময় ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে-সঙ্গে সেই জানা-অজা মেশানো সারাটা পুবদিকই বাঘারুর সামনে খুলে যাচ্ছে।

কান্তদিঘি-কুমারপাড়া আর কুমলাইয়ের আকাশটা আগুনরাঙা। সেই আগুন ফরেস্টের বড় বড় গাছগুলোর মাথা উঁল। এতদূর থেকে ফরেস্ট ত সবুজ না, ছাই-ছাই। যেখানে-যেখানে আগুন লাগছে, ছাই ফেটে অন্য রঙ বের হচ্ছে। দূর থেকে দেখায়, ফরেস্টের ভেতর এক-একটা আলগা-আলগা গাছে আগুন লেগেছে, এক-একটা গাছে যেমন বাজ পড়ে।

ফরেস্টের ছাই-ছাই রঙ আর নদীর ওপরে বা মাঠের শেষে দিগন্তের ছাই-ছাই এমনই মিলে গেছে, কোনটা ফরেস্ট বোঝা যাচ্ছিল না, এখন বহু দূরে-দূরে ঐ আগুন রঙ লেগে যাচ্ছে বলে বাঘারুর চোখের সামনে, গাছগাছড়া জলজঙ্গলের রঙগুলো আলাদা-আলাদা হয়ে যায়।

কিন্তু সূর্যের সেই আগুনরাঙা আলো সারা আকাশে ত একই রকম লেপে যাচ্ছে না। গয়ানাথের বাড়ি থেকে তার মাথায়-মাথায় চলে আসছে যে-আকাশ, সবুজ নাগান, সেই আকাশের বহুদূর পর্যন্ত আগুনরঙের ফালি চলে গেলে তার ভেতর থেকে সবজে ফালিগুলোও বেরিয়ে থাকে। আকাশের সবুজের নীচে, কোথাও-কোথাও কিছু-কিছু মেঘ ছিল। সেই সব জায়গায় আকাশের রঙ, মেঘের রঙ, আলোর রঙ মিলে আর নানা রকম রঙ তৈরি হচ্ছিল।

কুন অং [রং] কুখন ফুটে উঠে আর মিলি যায়, না-দেখা যায়, না-বোঝা যায়। চক্ষুর পলকখান একবারে ফেলিবার মধ্যে আকাশখান আর-এক ঝলক বদলি গিছে। আগুনের নাখান অংটা দূরত-দূরত চলি যাছে, হু-ই পচিম পাখত তিস্তানদীর পারত, তার পচিমে জলপাইগুড়ি সদরত, তার পচিমে কোটত কোটত আজগঞ্জ—-সবখানের আকাশ নাল [লাল টকটকা হবা ধরিছে হে। এ্যালায় কুমলাইয়ের পুবত অংখান পাতলা হবা ধরিছে। কায় য্যান ঐ লাল অংটা ধুইবার ধইচচে। আর-হুঁ-ই তিস্তাপারের পচিম পাখ তক পাতলা হয়্যা যাছে। কোটত আলো কোটত যায়।

বন্যার তিস্তায় ঝাঁপ দেওয়ার আগে যেমন সামনে পাশে ঘাড় ঘুরিয়ে-ঘুরিয়ে বাঘারু স্রোতের ছক বুঝে নেয়, জলের ঢক দেখে নেয় আর নিজের মনে-মনে একটা নকশা ভেবে নেয়, তেমনি করে ডাইনে আপলাদের দিকে তাকায়–উচা উচা গাছার মাথত আগুন লাগি গেইসে–পেছন ফিরে মাথার ওপরে শ্যাওড়া গাছটাকে দেখে পাতাগিলা ঝলঝল করিবার ধইচছে য্যান বিষ্টি হবা ধরিছে,–বাঘারু তার নিজের শরীরের দিকে তাকায়—-সারা শরীলখান কায় অং মাখাছে–বাঘারু পায়ের তলার ঘাসের দিকে তাকায়–ঘাস গিলা সব আয়না হয়্যা যাছে

আলোর সেই নিমজ্জনে বাঘারু দাঁড়িয়ে থাকে, খাড়া। এতটা এমন বেগে হাঁটার পর তার গা জুড়ে ঘাম ফুটে উঠতে শুরু করে। সেই বরমডাঙার [ব্রহ্মভাঙা] এক সীমায় দাঁড়িয়ে আর-এক সীমার তাদৃশ্য পেছন থেকে ঘটে যাওয়া সূর্যোদয় দেখতে-দেখতে বাঘারু ঘামে। এই বারঘরিয়ার মাঠটায় ঠিক এই সময় উঠতে না পারলেই ত বাঘারু আর এই সূর্যোদয় পেত না। গোচিমারি থেকে হাঁসখালির পথে ঘটে গেলে ত পেছনে থাকত। হাতির রাস্তা ঘটে গেলে ত কোনাকুনি থাকত। আনন্দপুর বাগানের ভেতর ঘটলেও ডান কোনায় পড়ত। এই বারঘরিয়র মাঠে সে কখন পৌঁছবে তার জন্যেই যদি সূর্যোদয় অতক্ষণ ঠেকে থাকে, তা হলে ত বাঘারুকে দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে দেখতেই হয়, দেখার জন্য দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে ঘামতেও হয়।

সেই দেখা আর ঘামার মধ্যেই বাঘারুকে এক সময় এইটা বুঝতে হয়, মুই খালি-খালি খাড়া আছি। আর সত্যি যে শুধু তার এই উদোম ঢ্যাঙা শরীরটা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সেটা তার শরীরের ভারহীনত দিয়ে তাকে বুঝে নিতে হয়। তার কাঁধে লাঙল নেই–গয়ানারে লাঙল। মোর কাঁধত গাছ নাই–গয়ানাথের গাছ। বাঘারুকে গয়ানাথ নির্বাসন দিয়েছে। ডায়না নদীর জঙ্গলে তার মহিষের বাথান আছে–বাঘারু সেখানেই যাচ্ছে। কিন্তু যাচ্ছে ত তার এই শরীরটা নিয়েই শুধু। বরমতলায় সেই সূর্যোদয়ের সামনে নির্বাসনের পথে বাঘারুর শরীরে-মনে কেমন মুক্তির বোধ এসে যায়। আর সেই বোধটাকে নিজে নিজে বুঝে নিতে, নিজেই নিজের শরীরের দিকে ফিরে-ফিরে তাকায়।

কোনো অদৃশ্য আড়াল থেকে উৎক্ষিপ্ত রঙের এই আকাশমাটিব্যাপী বিস্ফোরণে আর নিজের এই শরীরটার এমন মুক্তিতে বাঘারু হাসে। বাঘারু ত তার অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলোকে দিয়ে আলাদা-আলাদা কাজ করতে পারে না। সে যা করে তার সারাটা শরীর দিয়েই করে। শুধু ঠোঁট দিয়ে হাসতে পারে না ত বাঘারু, তাই সেই আলোর রঙের ধাক্কায় বাঘারুর সারাটা শরীরই হেসে উঠে কাঁপতে থাকে–বাতাস লাগা শিরীষ গাছের মত। বাঘারুর ত শরীর ছাড়া কিছু নেই–তাও আবার এত বড় একটা শরীর যে, শুধু শরীরটাই আছে বললেও তাকে যেন ততটা সর্বস্বহীন বোঝায় না। অত বড় শরীরটা রঙিন আলোর আঘাতে শিহরিত হতে থাকে।

শরীরের এই শিহরণ ত বাঘারুর চেনা নয়। বা, এমন কিছুই ত তার চেনা নয়, যা এই শিহরণের মত ব্যক্তিগত। তাই বাঘারু তার নিজের শরীরের কম্পনে নিজেই হে-হে হাসে। এমন একা-একা হাসা নিজের হাসির আওয়াজে বাঘারু আরো হেসে ওঠে। আর তাতেই তার আরো হাসি উঠে আসে। নিজের হাসির আওয়াজ বাঘারুর ত খুব চেনা নয়।

দুহাতে মুখ ঢেকে বাঘারু হাসিটা ঢাকতে চায়। তার হাত এত শক্ত যে এখন আর আঙুলগুলো বেকানো যায় না। তবু, হাত যখন, একটা তালু থাকে। আর তালু যখন, তখন আঁজলা হয়। বাঘারু মুখ ঢাকতে দুই হাত তুললে, হাতের তালু আলোতে, রঙে ভরে যায়, যেন বাঘারু নিচু হয়ে মাঠ থেকে আঁজলা ভরে আলো আর রঙ তুলে আনল। এখন তার চোখের সামনে দুই অঞ্জলি থেকে সেই রঙিন আলো ঝরঝর ঝরে পড়ে শরীরে।

নিজের হাতের আঁজলায়, নিজের শরীরে, এই প্রথম রঙ-আলো ঢালছে বাঘারু। শরীরটা এই প্রথম তার নিজের হয়ে উঠছে যেন।

হাত দুটো মাথার ওপরে, বা হাতে ডান হাতের মগরা (কজি চেপে ধরে বাঘারু পিঠটা ধনুকের মত বাকায়, পেছনে। কাঁচা বাশের মত তার শরীরটা ঐ রকম হেলে থাকে আর হেলানোর ভার বইতে তার পায়ের মচকা [বাটি], থলমা [উরু] আর পেটের বুকের পেশিগুলো টুকরো-টুকরো হয়ে ফুলে-ফুলে ওঠে। আড়মুড়ি ভাঙছে বাঘারু। আবার, পেছন ফিরে দুই হাত মাথার ওপর তুলে ধনুকের মত বাকায়, সামনে। তার পাথরের চাঙাড়ের মত পিঠটার ঢাল মাটির দিকে নেমে গেলে নড়ডারুর গিঠগুলো প্রখর জাগে, যেন ঐ শিরদাঁড়া বেয়ে এখনই কোনো ঝরনা ঝপাবে। কাঁধে, ঘাড়ে, পিঠে, বাহুতে, কোমরে, উরুতে, কটিতে আলোর স্বাদ পেতে ভালো লাগে বাঘারুর–আলোর উষ্ণ স্বাদ। সে একটু ঘুরে দাঁড়ায়, বায়ে, আলো তার বা পাজর দিয়ে, বা তলবুক থেকে বা তলপেটে চলে যায়। খানিকক্ষণ ও-রকম থেকে বাঘারু ডাইনে ঘোরে, আলো তার ডান পাজর থেকে ডান তলপেট পর্যন্ত লেপটে যায়।

খাড়া হয়ে ঘুরে দাঁড়িয়ে বাঘারু দেখে, সূর্যের প্রথম আলো তীক্ষ্ণ রেখায় প্রান্তরের অপর প্রান্ত থেকে বাঘারুর দিকে ছুটে আসছে সঁ সঁ। বাঘায়ু আলোর দিকে ছুটে যায় কিন্তু সে পৌঁছনোর আগেই আলোর তীক্ষ্ণ সূচিমুখটা ফেটে যায় আর আলো ছড়িয়ে পড়ে মাঠময়। বাঘারু মাটিতে গড়িয়ে পড়ে মাটি থেকে আলো সর্বাঙ্গে মাখতে থাকে।

.

০৫৫.

বাঘারুর সঙ্গীতলাভ

বারঘরিয়ার মাঠ ছেড়ে বাঘারু নিপুছাপুরের দিকে চলতে শুরু করে। ডান দিক জুড়ে সূর্যোদয়ের অব্যবহিত পরের মাঠের দিকে তাকিয়ে বাঘারু বিড়বিড় গুনগুন করে! আর, একবার করেই থাকেম না। বার বার ঘুরেফিরে করে। করে, আর হাঁটতে-হাঁটতেই দোলে।

উঠেন উঠেন বেলা ঠাকুর চিকচিক্যানি দিয়্যা
 উঠেন উঠেন বেলা ঠাকুর আগুন-টকটক হয়্যা
খুলি দিছু দেহবাড়ি ছ্যাকা দিয়্যা যান।
জল যাউক, হিম যাউক, খাড়াউক শরীলখান।

 কোলের বাচ্চাদের চপচপ করে তেল মাখিয়ে সূর্যের দিকে ধরে দোলাতে-দোলাতে এই গান মায়েরা গায়। বাঘারুর দুই হাতে কখনো কোনো শিশু দোল খায় নি। আর এখন সূর্যের দিকে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দোলানোর মত শিশু যখন বাঘারুর হাতের মধ্যে নেই, তখন বাঘারু নিজেকেই দোলাক। এই কম হাঁটতে-হাঁটতে যতটা দোলানো যায়, দোলাক। আর যতটা বিড়বিড় গুনগুন করা যায়, করুক। বাঘারু এখন তার নিজেরই শিশু।

কিন্তু একবার বলেই ত আর থামতে পারে না বাঘারু, এমন কি, বারকয়েক বলেও না। এই ছড়া একবার মাথার ভেতর সেঁদিয়ে গেলে আর বেরতে চায় না। তার ওপর আবার হাঁটার দোলনটাও ছড়ার সঙ্গে মিশে গেছে। হাটা না থামালে আর এই বিড়বিড়-গুনগুন থামবে না। এই দোলানি আর ছড়ানি কবে সেই জন্মকালে বাঘারুর মাথার ভেতর সেঁদিয়ে আছে–তার ব্যস্ততাহীন নির্জন মাথায়। তারপর পাখির ডাক, জীবজন্তুর মুখ আর আলো-হাওয়ার গতি যেমন.চেনা হয়ে যায় মুহূর্তের মধ্যে, যখনই তেমন সময় আসে, তখনই, এই ছড়ানিগিলা চলি আসিবার ধরে এ্যানং নাম্বা লম্বা হাঁটনে, কামছাড়া গাওছাড়া এ্যানং নাম্বা হাঁটেন, ছড়াগিলা গানগিলা পিপিড়ার মত চলি আসিবার ধরে এককারে লাইন বান্ধি, একোটার পর একোটা, কোটত আসে কোটত যায় কায় জানে।

বাঘারু চলতে-চলতে দোলে আর দুলতে-দুলতে বলে

 বেলা ঠাকুরের মাই গে
সিন্দুর ফেল্যান কেনে, সিন্দুর ফেল্যান কেনে?
না ফেলিছু, না ফেলিছু, কৌটা উলটি গেইছে।
দাওয়া লালাইছে তায়।

সূয্যি ঠাকুরের মা, সিঁদুর ফেলেন কেন? ফেলি নাই, সিঁদুর ফেলি নাই, সিদুরের কৌটো উল্টে গেছে। আকাশ তাই লাল।

বেলা ঠাকুরের মাই গে
 জল ঢালিছেন কেনে, জল ঢালিছেন কেনে?
না ঢালিছু, না ঢালিছু ছোঁয়াক নোহাইছু
মাটি ভিজেন তায়।

 সুয্যি ঠাকুরের মা, এত জল ঢালেন কেন? ঢালি নাই, জল ঢালি নাই, ছেলেকে নাইয়েছি, সেই জলে। মাটি ভেজা।

বেলা ঠাকুরের মাই গে
ঝাঁটা ঝাড়িছেন কেনে, ঝাটা ছাড়িছেন কেনে?
 না-ঝাড়িছু, না-ঝাড়িছু, ছোঁয়াক শুকাইছু
বাও উঠেন তায়।

সূয্যি ঠাকুরের মা, সকালে এত ঝাড়েন কেন, হিমেল বাতাস দেয় কেন? ঝাড়ি নাই, ঝাড়ি নাই, আঁচলের বাতাস দিয়ে, ছেলের গায়ের জল শুকাই, তাই বাতাস ওঠে।

বেলা ঠাকুরের মাই গে।
ঘর বোয়া কইচছিস কেনে, ঘর থোয়া কইচছিস কেনে?
না করিছু, না করিছু ছোঁয়াক ছাড়ি দিম
এগিনা ধুছি তাই।

 সূয্যি ঠাকুরের মা, ঘরদোর এত বোয়া-মোছা করছেন কেন আকাশ নীল ঝকঝকে? মুছি নাই, ঘর মুছি নাই, ছেলেকে ছেড়ে দেব বলে আঙিনা, আকাশ, ধুচ্ছি।

বেলা ঠাকুরের মাই গে
ছোঁয়াক ছাড়েন কেনে, ছোঁয়াক ছাড়েন কেনে?
মোর ছোঁয়াটার ছ্যাঁক নাগিলে তোর ছোঁয়াটা উঠে
ছোয়াক ছাড়িছু তাই।

 সূয্যি ঠাকুরের মা ছেলেকে ছেড়ে দিচ্ছেন কেন? আমার ছেলের ঘঁহ্যাঁকা খেয়ে তোর ছেলে উঠবে, তাই।

হেই গে মোর বেটাখান
হেই গে মোর ছোয়াখান।
হেই গে মোর ছাওয়া-ছোটর ঘরখান
 নিন্দ ভাঙ্গি উঠি গেইছে।
 হা করিছে, ভ্যা করিছে
আর তোর ছোয়াখানেক দেখি পুটপুটাইয়া হাসিবার ধইরেছে…

আমার ছেলে উঠে গেল, আমার বেটার ঘুম ছুটল, হাই তুলছে, কাঁদছে আর তোমার ছেলে সূর্যের দিকে তাকিয়ে হাসছে।

উঠেন উঠেন বেলা ঠাকুর চিকমিক্যানি দিয়া….

বাঘারুর কবিতার সঙ্গতিতেই আকাশের লাল রঙ ধুয়ে ঝকঝকে নীল রঙ বেরিয়ে পড়ে। আর কান্তদিঘি কুমারপাড়া, কুমলাই, মাথাচুলকার আড়ালে-আড়ালে যে সূর্য উঠছিল সেটা যে এখন সারা দুনিয়াতেই উঠে গেছে, অন্তত বাঘারুর সারা দুনিয়াতে, নিপুছাপুরের ফ্যাক্টরির টানা লম্বা বাঁশিতে তা রটতে থাকে।

সেই দুনিয়ার এক সীমান্ত থেকে আরেক সীমান্তের দিকে বাঘারুর এই চলার সামনে এখন এই বারঘরিয়ার প্রান্তরের ঢাল। ঢাল বেয়ে শিশুর মত গড়াতে গিয়ে বাঘারু তার শরীরের দোলা আর ছড়ার দোলা হারিয়ে ফেলে।

ছড়ায় শিশু ছাড়া সকাল নেই। শিশু ছাড়া কবিতা নেই। বাঘারু এখন তাই নিজেই নিজের শিশু।

.

০৫৬.

শ্রমিকদের দৈনিক উৎসব

বাঁশি শুনে নিপুছাপুর চা বাগানের লাইনগুলো থেকে সবাই বেরিয়ে পড়েছে। সবার কাঁধে একটা ছাতা। কাঁধে কাঁধে রুমালের মত থলি, লম্বা ডাণ্ডির মাথায় ছোট চ্যাপ্টা কোদাল, হাতের আঙুলের মত কাটা কোদাল, বাকা দাও, লম্বা কলম ছুরি। যার কাঁধে যেমন ঝোলানো বা আটকানো সে তেমন হাঁটছে। যার কাঁধে রুমাল দোলে সে নিজে যেমন খুশি দুলতে পারে। কোদালগুলো যাদের কাঁধে তারাও খানিক হেলতে পারে। কিন্তু দাও আর ছুরি যাদের কাঁধে লাগানো তারা সেই কাধটা নাড়ায় না।

মরদদের বেশির ভাগেরই পরনে উরু কামড়ে থাকা ছোট হাফ প্যান্ট–সামনে পেছনে অনেক সেলাই ও পকেট। আর গায়ে নানা রকমের গেঞ্জি-গোলগলা, কলার, ভিকলার, কলারের সামনে-পেছনে দাগ, বুকে-পিঠে নকশা। গেঞ্জির রঙ নানা রকম। কিন্তু সব রঙই মরে গেছে, মাঝে-মাঝে আচমকা এক-একটা টাটকা রঙ ছাড়া। বয়স্ক কারো কারো পরনে ধুতি-হাঁটুর ওপর টেনে তোলা, ও গেঞ্জি। কারো কারো খাকি প্যান্টের ভেতর হাফশার্ট গেঁজা। বেশির ভাগই খালি পা। আচমকা দু-একজনের পায়ে মোজাসহ বুটজুতো, চকচকে। তেমন দু-একজনের হাতে ছোট স্টিকও আছে। কেডস-পরাও আছে কয়েকজন। তারা এমন হাঁটে, যেন খেলতে যাচ্ছে। তেল চকচকে কাল চুল পাট-পাট আঁচড়ানোর নানা বাহার–পেছনে বাবরি, দু-পাশে বাবরি, সামনে সিঙাড়া, মাঝখান দিয়ে চিরে চিরে দু-পাশে সিঙাড়া, মাঝখান দিয়ে সমান চিরে আবার মিশিয়ে দেয়া, কপালের ওপর একটু এগনো-ফেল্ট ক্যাপের মত, আবার কপালের ওপর একেবারে ভুরু পর্যন্ত লেপটিয়ে নামিয়ে গোল করে তুলে দেয়। কিন্তু বাহার শুধু সামনের নয়, পেছনেরও। কোনো ঘাড় বাবড়ি, কোনো ঘাড় বব, কোনো ঘাড় মোটা ভাবে হেঁটে তোলা, কোনো ঘাড় ইংরেজি ইউ-এর মত, কোনোটা ইংরেজি ভি-এর মত, কারো দুকান সম্পূর্ণ ঢাকা, কারো অর্ধেক, কারো পেছনটাও সিথির মত চেরা। এরই ভেতর দু-একজন আছে, সম্পূর্ণ ন্যাড়া।

মেয়েদের শাড়ির চড়া রঙ। শাড়িগুলো একটু উঁচু করে পরা। আঁচল নেই। সামনের দিকটা একটু বেশি তুলে আঁচলটা বুক থেকে নেমে এসেছে। কারো কারো আঁচল নেই-ই, পুরো শাড়িটাই বুকের ওপর থেকে গোল হয়ে নেমে এসেছে। চুলের বাহার পরনের বাহারকে হার মানায়। কারো চুল মাঝখানে সিথির দু-পাশে পাট করা। কারো বা দুই বেণী মাথার ওপর তুলে গিঠ দেয়া। কারো আবার ছোট চুল, ঘাড়ের কাছে গিঠ। কারো একটু উঁচুতে ঘেঁপা বাধা। প্রায় সবার চুলেই ফুল। সকালে যে যা হাতের কাছে পেয়েছে, সেই ফুলই খুঁজে দিয়েছে। দু-একজনের মাথায় বড় বড় গাদা। কাল রাত্রিতে বাংলো থেকে তুলে এনে রেখেছে। বেগুনি রঙের ছোট-ছোট ঘাস ফুলও কেউ-কেউ ঝাটার কাঠিতে গেঁথে গুঁজে দিয়েছে। ফুলের কাঠি মাথার ওপর উঠে আছে, চলার সময় কাঁপছে।

মেয়েদের অনেকেরই পিঠের ঝোলায় বাচ্চা। ঝোলার বাইরে বাচ্চার ন্যাড়া মাথা বেরিয়ে আছে। চলার তালে দোলে। পা আর হাত দুটোও বেরিয়ে ঝোলে। বোধহয় চলার দুলুনিতেই, সব বাচ্চাই প্রায় ঘুমিয়ে।

মেয়েরা এত রঙিন বলেই হয়ত শাদা শাড়ি আর জামায় দুএকজন মাঝবয়সিনীকেও রঙিনই দেখায় মাঝে-মাঝে।

কিন্তু মেয়েমরদ, বুড়োবুড়ি, ছোকরাছুকরি–এইরকম ভাগ-ভাগ করে দেখলে কুলি লাইনের রাস্তাটা ধরে এই যে সবাই এক সঙ্গে সকালের বাঁশি শুনে কাজে চলেছে, সেই এক সঙ্গে যাওয়াটাকে ঠিক বুঝে ওঠা যায় না। এখন এই বাঁশি শুনে, এই সকালে, এক সঙ্গে যাওয়াটাই সব চেয়ে বড় হয়ে উঠেছে। তাতে কাউকে আলাদা করা যায় না, সব মিলেমিশে একটা ঘটনা ও একটা দৃশ্য হয়ে ওঠে। পোশাকেআশাকে চলনেবলনে কেউ যদি আলাদা হয়ে যায় সেটাও যেন এই সমগ্রতাকেই স্পষ্ট করে। কত রকমের হটাতেই না এই চলাটা তৈরি হয়ে উঠেছে। তাড়াতাড়ি পা চালাতে গিয়ে কেউ প্রায় দুলে-দুলে চলে, কেউ কোমরটা বেশি নাচিয়ে ফেলে, চুলের গোছার দোলায় কারো হাঁটার ছন্দও অন্য রকম দেখায়, কোনো আধবুড়ো হাঁটুর কাছে ঝোলা হাফ প্যান্টে মাটির দিকে তাকাতে-তাকাতে ছোট-ছোট পায়ে এগিয়ে চলে। এত বিচিত্র হাঁটা সত্ত্বেও কাজের জায়গাতে পৌঁছবার তাড়া যে-গতি আনে সেটাই প্রধান হয়ে ওঠে–সব বৈচিত্র্য সত্ত্বেও।

দুটো নতুন সাইকেল ঠেলে-ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে–অত ভিড়ের মধ্যে। মাঝে-মাঝে বেল বাজাচ্ছে। সাইকেলের হ্যাঁন্ডেলে প্লাস্টিকের দড়ির গুচ্ছ–চালালে ওড়ে। এইটুকু রাস্তা ত চড়লেই ফুরিয়ে যাবে। তার চাইতে সবাইয়ের সঙ্গে হাঁটতে-হাঁটতে সাইকেলটা টেনে নিয়ে যেতে ত অনেকটা সময় লাগবে। এতটা সময়ই তো সাইকেলটা নতুন থাকবে। এখন কিছুদিন চলবে–ঠেলে-ঠেলে কাজের জায়গায় নিয়ে গিয়ে আবার ঠেলে-ঠেলে ফিরিয়ে আনা। সাইকেল আছে বলে বাবু তাকে কোনো জরুরি কাজে পাঠাতে পারে। তেমন হলে, পুরো বাগানটাই টহল দিয়ে আসতে হতে পারে। তখন, একা-একা সাইকেলটা চালাতে খুব ভাল লাগে। দু-পাশের বেডে বা রাস্তায় কাজ করছে যারা, তারা তাকিয়ে দেখে, কে সাইকেল কিনল। চেনাজানা লোক আওয়াজও দেয়। মেয়েগুলো খিলখিল হাসে। আর এই সবে প্যাডেলের জোর বেড়ে যায়। দু-পাশের ঘন সবুজ চা গাছের ভেতর দিয়ে চকচকে সবুজ সাইকেলটা চলে। শুধু রঙের জন্যে পঁচাত্তর টাকা বেশি। হ্যাঁন্ডেলের লাল ঝালরগুলো বাতাসে ওড়ে দু-পাশে। হ্যাঁন্ডেলের সঙ্গে লাগানো দু-দুটো আয়নায় পেছনের চা-বেডগুলো সঁ সঁ সামনে ছড়িয়ে যাবে। দুটো আয়নার জন্যে পঞ্চাশ টাকা বেশি। পেছনের লাল আলো চার পাশের সবুজের ভেতর জ্বলজ্বল করে। যেন আলো দেখেই চিনে নেয়া যায় কার সাইকেল চালাতে হলে সাইকেল ঐরকম চালানোতেই সুখ–যেন, সার্কাসের খেলোয়াড় খেলা দেখাচ্ছে, চার পাশে গ্যালারি, আওয়াজ, হাততালি। আর, যদি এমন হয়, যেখানে চালাচ্ছে, তার দু-পাশে কেউ নেই, তা হলেও ত নিজের কানের দু-পাশে নিজেরই ছোটার হাওয়া লাগে, যত লাগে সাইকেলের গতি তত বাড়ে। চালাতে হলে ঐ রকম সাইকেল চালাতে হয়, না-হলে, ভো শুনে সবার সঙ্গে হেঁটে যাওয়াই ভাল, সাইকেলটাও যেন কাজে যাচ্ছে।

সারাটা মিছিল জুড়েই ট্রানজিস্টার বাজে। চামড়ার ব্যাগে কারো কাঁধে ঝোলানো, ব্যাগছাড় কারো হাতে ঝোলানো, কারো হাতের পাতায় আটা, কানে কানে সাটা। যে যার মত সেন্টার ধরে আছে–বিবিধ ভারতী, সিলোন, করাচি। রাশি রাশি গান বাজছে। এক-একটা গানের পাশে জোট বেঁধে সেই শ্রোতারা ছুটছে। কেউ-কেউ সঙ্গে-সঙ্গে গায়। কেউ হাততালি দেয় তালে-তালে। দু-হাত ওপরে তুলে কেউবা দুই হাতেই তুড়ি বাজায়।

এত গান এত জোরে একসঙ্গে বাজছে যে সেই সব মিলে একটা অর্থহীন কোলাহলের আওয়াজ ক্রমেই বেড়ে ওঠে। এতগুলো লোকেরএকসঙ্গে ছোটা, কথা বলা, গান গাওয়া, হাসাহাসি ইত্যাদির ফলেও সেই আওয়াজ ক্রমেই বেড়ে ওঠে। চোখ বুজে শুনলে মনে হতে পারে একটা অর্থহীন উদ্দেশ্যহীন কোলাহল বাগানের এই রাস্তাটা ধরে ছুটে চলেছে। সেই আওয়াজের কোনো উদ্দেশ্য নেই বলেই তাতে কোনো আকস্মিকতা থাকে না। আর থাকে না বলেই মাঝে-মাঝেই কৃত্রিম নাটকীয়তায় উচ্চগ্রামে উঠে আবার আচমকা নেমে যায়।

কিন্তু যারা এই কোলাহলের মাঝখানে আছে তারা যে-যার মত গান শুনছে, অথবা শুনছে না। যে-যার পছন্দমত গান বেছে নিতেও পারছে। এক গান শেষ হলে, অন্য রেডিয়োর অন্য গান ভাল লাগলে একটু সরেও যাচ্ছে। আর নিজেদের এই ভাল লাগাটা কোনো-না-কোনো ভাবে জানিয়েও দিচ্ছে–গেয়ে, বা হাত-তালিতে, বা তুড়িতে, বা উল্লাসে। যে-ভাললাগার বিষয় নিজেরা কোনো-না-কোনো ভাবে তৈরি করে নি, সে-ভাললাগার ওপর এদের যেন পুরো স্বত্ব প্রতিষ্ঠিত হয় না।

এত কিছুর পরেও এই এত মানুষের ভিড়ের এমনি ছোেটার ভেতর অভ্যাস আর দৈনন্দিনের এক ছন্দ থাকে। কখনোই মনে হয় না–এটা ছুটির দিন। এটাও কখনো মনে হয় না-কাজে যাবার আগের শেষতম মুহূর্তটি পর্যন্ত নিজেদের জীবনযাপনের স্বাভাবিকতাটা আস্বাদ করে নেয়ার স্বাসরুদ্ধকর এক তাড়াতেই এমন হৈ-হল্লা। চা বাগানের কাজকর্মের ভেতর অনিবার্যতই কৃষিকাজের অবকাশ ছড়ানো থাকে কিছু। তাই বাগিচার পাশেই এই সাইকেল দাঁড় করানো থাকবে, রেডিও চা-গাছের ওপর শোয়ানো থাকবে। এই রঙ, এই সাজগোছ, এই গান, এই তালের ভেতর দিয়ে এরা সবাই কাজে চলেছে–রোজকার কাজে, বাগানের বাঁশির সঙ্গে-সঙ্গে। যেন উৎসব। কাজে যাওয়াটা ত শ্রমিকদের রোজকারই উৎসব।

.

০৫৭.

 বাঘারু ও শ্রমিকশ্রেণী

বাঘারু এই উৎসবের কেউ নয়। বারঘরিয়ার মাঠ থেকে নেমে নিপুছাপুরে ঢুকে সে এই উৎসবের পথে, উৎসবের ভেতর আটকা পড়ে গেছে। বারঘরিয়ার মাঠ নিচু হয়ে ঢলে পড়েছে নিপুছাপুরেরই বাগিচার বাইরের জমির ওপর। কোম্পানি এগুলো অল্পস্বল্প আধিতেও দেয় কুলিদের। সেই ধানি জমিগুলো দিয়ে তারের বেড়া টপকে কুলি লাইনের ভেতরের রাস্তায় বাঘারু পড়ে। প্রথমে সে বোঝে নি আটকা পড়ে যাচ্ছে। ভো শুনে যে যার মত হাঁটছে, বাঘারুও হাঁটছে। কিন্তু অমন কয়েক পা হাঁটতে-হাঁটতেই রাস্তায় দু-দিকের বাড়িঘর, ফঁকফোকর, ওদিকের বাড়িঘর, ভেতরের ফাঁকফোকর এই সব কিছু থেকে কিলবিল করে মানুষজন বেরতে থাকে। জানলে, তখনো বাঘারু সরে দাঁড়াতে পারত। এরা চলে গেলে, নিজের পথে যেত। কিন্তু ততক্ষণে এই ভিড়টা তৈরি হয়ে গেছে আর ভিড়টা ছুটে চলেছে নিজের বেগে, নিজের নিয়মে। আর বাঘারু নিজে টের পায়, সামনের ও পাশের লোকটি যে-গতিতে ছুটছে, যেমন করে পা ফেলছে, তাকেও সেই গতিতে ছুটতে হচ্ছে ও সেই মত পা ফেলতে হচ্ছে। বাঘারু দু-একবার থেমে পড়তে চেয়েছে। কিন্তু পারে নি। এমন নিজে ভেবে থেমেঘর্তে সে শেখেনি পারে না। যদি পড়ে যেত আর তার ওপর দিয়ে এরা চলে যেত, বা যদি সবাই মিলে ধাক্কিয়ে তাকে বের করে দিত যে সে এই লাইনের লোক না, তা হলেই বাঘারু এই মিছিল থেকে আলাদা হতুে পা-কিন্তু বাঘারু ত কোনোদিনই ঘটনা ঘটিয়ে উঠতে পারে না, তাকে নিয়ে ঘটনা শুধু ঘটে যায়। যতক্ষণ তা না ঘটে, ততক্ষণ বাঘারুকে এই ভিড়ের আর এই মিছিলের চলার সঙ্গে ছুটতে হচ্ছে, এরা যেদিকে যায় সেদিকেই।

তাতেও কিছু হত না। বাঘারু ত মিশেই যেতে পারত এই বিচিত্র মিছিলে। বাঘা যদি একটু ছোটখাট হত কারো নজরই পড়ত না তার ওপর। বা, বাঘারুর অত বড় শরীরটা যদি একটু ঢাকা থাকত। বাঘারু ঐ ভিড়ের মধ্যে পড়ে গিয়ে যখন ভিড়েরই বেগে ছোটে, তখন, তাকে দেখায় যেন ঐ ভিড়ের মাস্তুল। বহু পেছনের মানুষও বাঘারুর মাথা দেখেই দিক ঠিক করবে। কিন্তু সত্যিকারের মাস্তুলের গায়েও অন্তত আলকাতরার বা রঙের যে আবরণটুকু থাকে, বাঘারুর তাও নেই। একটি ছোট, নেংটি তার কোমরের সামনে বাধা। গাছের পাতাতেও এর চাইতেও বেশি ঢাকে। ফলে, সেই একমুখো ভিড়ের সঙ্গে স্রোতের বেগে ছুটলেও বাঘারু স্রোত হয়ে যেতে পারে না। সে স্রোত নয়, স্রোতোবাহিত-তিস্তার স্রোতের টানে. যেমন পড়ানো শালগাছ ছোটে। মেয়েদের যে-দলটা বাঘারুর ঠিক পেছনে গিয়ে পড়ে, তারা বাঘারুকে হঠাৎ দেখে ফেলেই হাসতে শুরু করে দেয়। এমন উৎসবের পথে হাসি ত সংক্রামক, দেখতে-দেখতে হাসিটা ছাড়িয়ে পড়তে থাকে। যারা কাছাকাছি তারা ত হাসির কারণ চোখের সামনেই দেখতে পায়। আর-একটু ভাল করে দেখতে তারা কাছে আসতে চায়। মেয়েদের ভেতর একটা হুড়োহুড়ি পড়ে যায়। এ ওকে ঠেলে এগতে চায়, পারে না। বাঘারুর পেছনে যারা প্রথম সারিতে ছিল, তারা কিছুতেই জায়গা ছাড়ে না। পেছন থেকে ক্রমে কেউ-কেউ তার ভতরেই ঠেলেঠুলে ঢুকে পড়ে। দেখতে-দেখতে বাঘারুকে ঘিরে একটা ঘের-মত হয়ে যায়; প্রধানত মেয়েদের।

জলে একটা ঢিল পড়লে যেমন জলের কাঁপন চলতেই থাকে, এই ভিড়ে বাঘারুকে নিয়ে হাসির কাপন তেমনি ছড়িয়ে পড়তে থাকে। যারা বেশ দূরে তারা বাঘারুকে ভাল করে না দেখেও হাসতে থাকে। কেউ-কেউ আঙুল তুলে বাঘারুকে দেখায়। আর হাসিটা আরো দূরে-দূরে ছড়ায়। শেষ পর্যন্ত। বাঘারু এই সম্পূর্ণ অথচ ক্রমবর্ধমান মিছিলের অন্তর্গত চলমান দৃশ্য হয়ে পড়ে।

.

প্রতিদিন কাজে যাওয়া মানুষজনের এই মিছিলের ভিড়ের ভেতর পড়ে গেছে বলেই যেন বাঘারুকে কেমন আউলাভাউলা দেখায়। তার চুল জটপাকানো-ধুলো-মাটিতে। সারা গায়ে ধুলোমাটিরই রঙ। যেন ধুলোমাটি থেকে উঠেই সে এমন লাইনে ঢুকে গেছে। এত বড় একটা লাইনের এত মানুষজন বাঘারুতে যেন একটা খেপাবাউড়া পেয়ে যায়। মিছিলের একটা অংশ তাকে ঘিরে খেপাতে-খেপাতে চলছে।

একটা লোক বেশ লাফিয়ে-লাফিয়ে চলছিল। টাইট ছোট প্যান্ট আর টাইট গোল গলার গেঞ্জি, পায়ে মোজাসহ কেডস, হাতে একটা মাথা বাঁধানো স্টিক। সে মাঝে-মাঝেই স্টিকটা দিয়ে কেডসটাতে মারছিল আর নিজেই লাফিয়েলাফিয়ে উঠছিল। সেই লোকটি যেন তার স্টিকার আরো ভাল ব্যবহার খুঁজে পায়, বাঘারুর সামনে এসে পঁড়ায়। তার পর যেন পেছনে পা ফেলে মার্চ করে করে চলছে এই রকম করে পা তুলে-তুলে হাঁটে। বৃঘারুর সারা শরীরে তখন মিছিলের হাঁটা বা ছোটার গতি ধাক্কা দিয়েছে। এমন দলবদ্ধ ছোটায় ত সে অভ্যস্ত নয়। আর তার এত বড় শরীরে ছোটার একটা গতি এসে গেলে, শরীরটার ভারও সেই গতিটাকে ক্রমেই বাড়িয়ে দিতে থাকে, পাথরের পাহাড় গড়ানো যেমন। মাথায় লোকটি বাঘারুর কোমরের কাছ পর্যন্ত। সে যখন বাঘারুর সামনে ঐরকম কদমে কদমে পেছনে পা ফেলে, তখন মনে হয়, বাঘারু যেন কোনো উঁচু মূর্তি, লোকটি তাই দেখছে। আর সেই দেখার যুক্তিতেই সে তার বাধানো স্টিকটা তুলে বাঘারুর বা বাহুতে মারে। হাতে পেলে টিপে দেখত, পাচ্ছে না বলে স্টিক দিয়ে টিপছে। ডান বাহুতেও একই রকম মারে। বাঘারুর পেটে একটা বেঁচা-মত দিতেই যে মেয়েদের দল বাঘারুকে ঘিরে ফেলেছিল তারা হাতগুলি দিয়ে নেচে উঠে কৌতুকে দুই হাত একসঙ্গে ঠোঁটের কাছে তুলে ধরে, আচমকা, বাতাসে-হেলা গাছের মত, হাসির দমকে হেলে পড়ে।

মাথায় ফুল গোজা, রঙচঙে শাড়ি পরা, এমন একদল মেয়ে যদি সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে পড়ে আর এক দিকে হেলে যায়, তা হলে তাদের হাতে-হাতে ধরতেই হয়। আর তেমন ধরলেই, নাচের তাল এসে যায় পায়ে। নিজেরাই বুঝে ওঠার আগে বাঘারুকে ঘেরা এই মেয়েদের সারি পরস্পরের কোমরে হাত দিয়ে নাচের তালে-তালে পা ফেলে দেয় আর আপন মনেই খিলখিল হেসে সেই নাচের সঙ্গত দেয়।

আরে ও রাখোয়াল, তাড়াতাড়ি এসো,
পাহাড় থেকে এক বুনো, ভালুক নেমে এসে
আমাদের নাচের সারি ভেঙে দিল

এই গানের সঙ্গতিতে ঐ লোকটি চট করে বাঘারুর পেছনে চলে আসে, বাঘারু আর মেয়েদের সারির মাঝখানে। মেয়েদের গানের তালে-তালে পা.ফেলে সে বাঘারুর পেছনে-পেছনে চলে। বাঘারুর অত বড় শরীরটার পেছনে লোকটির অতটুকু শরীর আর টাইট ছোট প্যান্টে তার কোমরের অত ঘন-ঘন দুলুনি, কেমন নাচে-গানে অভিনয়ে নটঙ্গী তামাশা-মতই জমে ওঠে। লোকটি তার স্টিক তুলে বাঘারুর পেছনে-পেছন চলে, একবার বা পায়ের বায়ে ডান পা ফেলে, আবার ডান পায়ের ডাইনে বা পা ফেলে। লোকটি স্টিকটা দিয়ে বাঘারুর পায়ের বাটিতে মারে, ডাইনোয়ে, উরুতে মারে, ডাইনোয়ে, পেছনে মারে, ডাইনে বায়ে। আর শেষে পেছনের ফাঁকটাতে, কানিটার ওপরে, লাঠিটাকে সোজা করে ধরে, যেন সেটা বাঘারুর পাছার ভেতরে ঢোকাবে।

এতে হাসি সামলানোর জন্যে হাতগুলো মেয়েদের দরকার হয় বলে নাচের সারি ভেঙে যায়, গান থেমে যায়, আর এই লোকটির পেছনে সারাটা মিছিল হো হো হাসিতে, খিলখিল হাসিতে, ফেটে পড়ে। বাঘারু ত মিছিলটার মাঝখানে পড়ে গেছে, তার সামনেও ত লোকজন আছে। তারাও ফিরে তাকায়, আর বাঘারুকে দেখেই বুঝে নেয়, পেছনের অত হল্লার কারণ কী।

তাকে ঘিরে এই মিছিলটা মেতে উঠেছে–বাঘারু টের পায়। তাকে ঘিরে সারাটা মিছিলে হাসি উঠেছে–বাঘারু বোঝে। তাকে ঘিরে মেয়েদের দল নাচতে শুরু করে–বাঘারু দেখেও খানিকটা। ঐ বেঁটে লোকটা এসে তাকে খোঁচায়। সামনে থেকে আবার পেছনে চলে যায়। কিন্তু বাঘারু বুঝে উঠতেই পারে না, সে কী করবে। বাঘারু এই ভিড়টা থেকে ছুটে বেরিয়ে যেতে পারে, কিন্তু যাবে কোথায়। এই মিছিলের পাশেই ত ঘরবাড়ি, ঘরের দুয়োরে বাচ্চারা ও মুরগি-ছাগল। মিছিলটাকে তছনছ করে দিয়ে বেরিয়ে গিয়ে সে দাঁড়াবে কোথায়? মিছিলের বাইরে? মিছিলটা চলে যাওয়ার অপেক্ষায়? বন্যায় উৎপাটিত শালগাছের মত বাঘারু অগত্যা মিছিলের টানে চলে–তাকে ঘিরে হাততালি আর নাচগানার হুল্লোড়ের সঙ্গে সঙ্গে।

তাকে ত এক পলক দেখেই বোঝা যাচ্ছিল সে এ-ভিড়ের কেউ নয়। এই সাতসকালে কাজের মিছিলে বাঘারুর শরীরটা বড় বেশি নগ্ন হয়ে গেছে। এতটা নগ্নতা এই মিছিলেরও সয় না। হুল্লোড় বাধিয়ে মিছিলটা তাই বাঘারু থেকে নিজেকে আলাদা করে নিচ্ছে, বাঘারুর এই নগ্ন শরীরটা থেকে নিজেকে তফাত করছে।

অথচ বাঘারুর পায়ের পাতা দুটো এমনই লম্বা-চওড়া, যে মনে হয় এই মিছিলেই প্রোথিত, মাটির ভেতর থেকে উঠে মাটিসহ চলছে। তার শরীরময় শুধু ত সেই নেমে যাওয়া শিকড়ের টান। কয়েক দশক ধরে বেড়ে ওঠা মহীরুহের কাণ্ডের মত তার পিঠটা কোথাও পিছল, কোথাও শ্যাওলাধরা, কোথাও রুক্ষ। অথচ মেরুদণ্ডের দু পাশের পেশিপুঞ্জ এমন ঝরনার মত নেচে-নেচে ওঠেনামে যে বোঝা যায়, এ-শরীরে বৃক্ষের প্রাচীনতা আছে অথচ স্থাণুতা নেই। ঐ কোমর থেকে পায়ের সরল অবতরণ, মূর্তির আকার নেয়, কোথাও কোনো ঢাকা নেই বলেই। যেন, নির্মীয়মাণ কোনো ব্রিজের সদ্য তৈরি দুটো পিলার নদীখাত থেকে উঠে এসে এই মিছিলে ছুটছে। অথচ এই মিছিলে প্রোথিত এই শরীর এই। মিছিলের নয়। বাঘারুর শরীর এখন বাঘারুর বৈরী।

বাঘারুকে ঘিরে নাচতে নাচতে, গাইতে-গাইতে, বাঘারুকে বেঁচাতে-খোঁচাতে এই মিছিলটা একটা চড়াই ভেঙে ওঠে। বাঘারু চড়াইটা দেখতে পায় নিতার আগে এত লোক। কিন্তু পায়ে-পায়ে পায়ের বাটির পেশির টানে, আঙুলের ভরে, টের পেয়ে যায়। চড়াইটায় উঠতেই এই মিছিল থেকে একটা ভিড় আলাদা হয়ে ডাইনে বেঁকে। বাঘারু সরে দাঁড়াতে গেলে আবার সেই মিছিল তাকে সোজা টেনে নিয়ে যায়, সে আর বেরতে পারে না। ফ্যাক্টরি ডাইনে পড়ে থাকে। পাতা শুকোবার শেড পড়ে থাকে। বাঘারুকে নিয়ে মিছিলটা এগিয়ে যায় আর মিছিল থেকে গোছা-গোছা নোক খসে পড়ে, যে-যার কাজের জায়গায়। এখন বাঘারু দেখতে পায় তার সামনে আনন্দপুরের গেটের মতই একটা গেট আর তার ওপরে চা-বাগিচা। সাইকেল আর ট্রানজিস্টার নিয়ে ঐ বাকি মিছিলটা চা-বাগিচায় নামে।

এখন বাঘারুকে নিয়ে মিছিলটা আর ব্যস্ত নয়, কিন্তু বাঘারু মিছিলটাতে আটকা পড়ে গেছে। এই উঁচু থেকে বাঘারু দেখতে-দেখতে নীচে নেমে যায়–তারের বেড়ার ঘের দেয়া চা বাগান, রাস্তার পর রাস্তা, মোড়ের পর মোড়, মাঠের মত সমান চা-গাছের মাথার ওপরে ছাতার মত সমান শিরীষ গাছের মাথা। আর সেই বাগিচা জুড়ে নানা রঙের মানুষ কাজ করছে।

কিন্তু, দেখতে না-দেখতেই মিছিলটা বাগিচার ভেতর নেমে পড়ে বলে বাঘারু আর দেখতে পায় না। সে সমান বেগেই ছোটে–তার শরীর ঘেরা মিছিলটা খসাতে-খসাতে।

.

০৫৮.

বাঘারু ও বাবু

দুই পাশে চা বাগিচার সারি, মাঝখানে চওড়া সবুজ রাস্তা, বাঘারু দাঁড়িয়ে থাকে, একলা, বাকল খুবলে নেয়া অর্জুন গাছের মত, মিছিলটা যে সম্পূর্ণ ঝরে গেছে, বুঝতে।

বাঘারুর সামনে সব জায়গাতেই কাজ। চা-ঝোপে মেয়েদের বুক পর্যন্ত ঢাকা-যেন স্নানে নেমেছে। মেয়েরা টুকটুক করে পাতি ভেঙে হাতের ভেতরই রাখছে। হাত ভরে গেলে কাঁধে ঝোলানো থলিটাতে ফেলে। আঙুলগুলো আবার গাছের ওপর নেমে আসে। খোঁজাখুজি নেই। আঙুলগুলো জানে, কোথায় পাতা! মুহূর্তে-মুহূর্তে পুটপুট আওয়াজ। ধানখেতের গোড়া নিড়নোর সময় এরকম আওয়াজ খেতময় ছড়িয়ে পড়ে। ধানখেতের কথা মনে হতেই বাগিচার এই কাজ আর তার নিজের কাজের ভেতর কেমন মিল খুঁজে পেয়ে যায়, দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়েই, আর নিজের হাত দুটো নিজের চোখের সামনে মেলে ধরে। তাকে যদি পাতি তুলতে হয়, সে কি একটি পাতিও তুলতে পারবে? নাকি, তার আঙুলগুলো, ষাড়ের জিভের মত, এক গোছ পাতা মুচড়ে আনবে? ডান হাতটা চোখের সামনে মেলে, বুড়ো আঙুলটা বঁকিয়ে, ভেতর দিকে আনার চেষ্টা করে। আঙুল বেঁকে না। বুড়ো আঙুলের তলার মাংসতে দুটো-একটা দাগ পড়ে মাত্র। বাঘারু তখন তার বুড়ো আঙুলটা দিয়ে বাকি চারটি আঙুলের মাথা ছুঁয়ে যায়। বোঝার চেষ্টা করে, হেঁয়াটা সে বুঝতে পারে কি না।

বাঁ-পাশে একদল মরদ বাকানো দা নিয়ে চা-গাছগুলোর ডাল কাটছিল। দা-টা ছুরির মত পাতলা, হাতলটা ছোট্ট। বাঘারু কি তার হাতের মুঠোয় ঐটুকু হাতল ধরতে পারত? বাঘারু আবার তার ডান হাতটা তুলে চোখের সামনে পরীক্ষা করে। অভিজ্ঞ চোখে ধরা পড়ে, তার মুঠোর ফাঁকাটা এতই বড় যে কুড়োল, কোদাল বা লাঙল ধরা যায়, কিন্তু ছুরির মত দায়ের বাট আলগা হয়ে খসে যাবে। বাঘারু ডান হাতটা মুঠো পাকায়। অবলম্বনহীন তার আঙুলগুলো গেঁথে বসতে পারে না, আলগা থাকে। বাঁ দিকে একদল মরদ নালীর মধ্যে নেমে কোদাল দিয়ে নালীর গা থেকে ভেজা মাটি তুলে-তুলে ওপরে ফেলছিল। মাথার ওপর কোদাল তুলে ধরার ভঙ্গি বাঘারুর চেনা। উৎপাটিত সেই মাটির কাল বাঘারুর চেনা। বর্ষার জঙ্গলে বন্ধ নালীটার একটা ছোট অংশের ধীরে-ধারে পরিষ্কার হয়ে ওঠাটা বাঘারুর চেনা।

সামনে তাকিয়ে দেখে, মোড়ে কয়েকজন বাবু। মিছিলটা তাকে এখানে রেখে ঝরে যাওয়ার পর, আবার তার নিজেরই কাছে নিজের গ্রাহ্য হয়ে উঠতে বাঘারুর সময় লাগে। চা বাগিচার চারপাশের এই সব আধোচেনা কাজকর্ম আর সে-সবের সঙ্গে তার নিজের কাজ করার অভিজ্ঞতার বিনিময়–এই সবের ভেতর দিয়ে বাঘারু তার নিজের কাছে ফিরে আসে।

সামনে, বাবুদের দেখতে পেয়ে যেন যাওয়ার একটা জায়গা পায়। বাবুরা ছিল না বলেই বাঘারু এতক্ষণ মিছিলবন্দী হয়ে ছিল। বাবুরা আছে বলেই এখন ত বাঘারুর একটা কাজও জুটে যেতে পারে–এরকম নালী কাটা বা কোদাল কুড়োল চালানো কাজ। কাজ থাকলে মিছিলটা তাকে এরকম তাড়া করে ফিরত না, তার পর তাকে একা ফেলে খসে যেত না। বাঘারু কি মিছিলেই ঢুকতে চায়? বাবুদের সামনে বাঘারু পৌঁছে যায় বটে কিন্তু তার পরই মুশকিল বাধে। বাঘারু এমনি ত যেখানে-সেখানে একা-একা দাঁড়িয়ে থাকতে পারে কিন্তু এখন যে তাকে এত উঁচু থেকে চোখ নামিয়ে বাবুদের দিকে তাকিয়ে কথা বলতে হয়–সেটাই বড় কষ্টের। শরীরটাই এমন বাঘারুর যে শুধু দাঁড়িয়ে থাকলেও না-দেখে উপায় নেই। বাবুই জিজ্ঞাসা করেন তাকে, কী? কিছু বলছ?

না হয় বাবু, বলে ফেলে তার মনে পড়ে যায় সে ত এইটুকু বলতে চেয়েছিল যে কোদালকুড়োল চালানোর কাজটা সে পারে। সে তাড়াতাড়ি বলে, হয় বাবু

বাবুর বোধহয় একটু সময় ছিল, বাবুদের হাতে যেমন থাকে। জিজ্ঞাসা করেন কী হয়?

 বাঘারু আবার ফাঁপরে পড়ে। বাবুরা প্রায় কোনো সময়ই বাঘারুকে কিছু জিজ্ঞাসা করে না। কিন্তু অন্যদের করলে সেটাও ত বাঘারু শুনতে পায়। কখনো কখনো কোনো-কোনো বাবু তার সঙ্গে কথা বলে, যেমন এমেলিয়া বাবু। কিন্তু কখনো কোনো বাবুর কথার কোনো জবাব তার মাথায় এল না। বাবুরা কী জানার জন্যে কী জিজ্ঞাসা করে, বাঘারু, তার আন্দাজ পায় না। তাড়াতাড়ি বলে, না হয় বাবু।

জবাবটা শুনে বাবু খুশি হয়েছেন বোঝা যায়। হাসেন। যেন এই জবাবই তিনি চাইছিলেন। বাঘারু বলতে চায়, সে পাতি তোলার কাজ জানে না, ছুরি চালানোর কাজ জানে না। এর পর সে বলতে চায়, সে কোদাল চালানোর কাজ জানে, সে কুড়োল চালানোর কাজ জানে। এরও পর সে বলতে চায়, বাবু তাকে একটা কোদাল বা কুড়োল দিক।

কিন্তু এই তিনটি কথার কোনটা আগে আর কোনটা পরে বলবে তা নিয়ে বাঘারুর সংশয়ের শেষ নেই। মনেও থাকে না তার, কোনটা আগে আর কোনটা পরে–যদিও সেই ক্রমটা বাঘারুই ঠিক করেছে। বাঘারুর নিজের কাছে কথাটা যেমন পরপর আসে, বাবুর কাছে সেরকম পরপর হয়ত আসে না। এই একটা হয়ত-তে বাঘারু বিপর্যস্ত হয়ে যায়।

 বাবু, মুই পাতা তুলিবার না পারি।

শুনে বাবু মুখ তুলে তাকায়। বাঘা ঘাড় ঘোরায় সেই জায়গাটা খুঁজতে, যেখানে মেয়েরা পাতি তুলছিল, এমন ভাবে যেন বুকজলে নেমে আছে। সে জায়গাটা দেখতে পায় না। ফলে বাঘারুকে ঘুরে দাঁড়াতে হয়, বাবুকে সম্পূর্ণ ভুলে, অথচ, তার কথার প্রমাণের জন্যে বাবুর সামনে ঐ পাতিতোলা কাজটা দেখাতে। বাঘারু কথা দিয়ে কাজ বোঝাতে পারে না, কাজ দিয়ে কথা বোঝায়।

সেই মেয়েদের দেখতে পেয়ে আঙুলটা তুলে বলে, ঐ যে বাবু।

কী?

পাতা তুলিছে বেটিছছায়ার ঘর। মুই না পারি।

হু, বাবু চোখটা ঘুরিয়ে নেন। সেই চোখ ঘোরানোতে কোনো অবজ্ঞাও থাকে না, মাতাল কুলিকামিনের এমন দার্শনিক সংলাপে তার অভিজ্ঞতারই একটা প্রকাশ থাকে মাত্র।

বাবু

হু

মুই ডাল কাটিবার না পারি, বলে বাঘারু বাবুর সামনে তার হাতটা তোলে, বাবুকে ছাড়িয়ে হাতটা বিঘত খানেক এগিয়ে যায়–তার হাতটা এতই লম্বা, ঐ ঠে বাবু।

হু

ঐ ঠে ছুরিখান চালাছে। মুই না-পারি বাবু।

হু

ডাল কাটতে পারে, কিন্তু ঐ কলম ছুরি তার হাতে ধরবে না এত জটিল কথা কী ভাষায় বোঝায় বাঘারু?

বাঘারু চুপ করে যায়। তার আর-কিছু মনে পড়ে না। কিন্তু এটা বোঝে তার কথাটা বাকি আছে। বাঘারুর সাইজের একটা মানুষ এত কাছে দাঁড়িয়ে থাকলে তার ছায়া পড়ে। বাবু যেন অপেক্ষায় ছিলেন, সেই ছায়াটা সরে যাবে। যায় না দেখে মুখ ঘুরিয়ে বলেন, ত হয়েছে ত, এবার যাও।

কোটত বাবু?

যেখানে যাচ্ছিলে।

কোটত বাবু?

সেটা আমি বলব কী করে বাবা, এখানে পাতিটেপা ফাড়ুয়ামারা এই সব হচ্ছে, এ-সব ত তোমার কাজ না, এখন যাও।

বাবুর এই কথাটিতেই বাঘারুর আবার মনে পড়ে যায়, সে তাড়াতাড়ি বলে ফেলে, মনে পড়ার আনন্দে উদ্ভাসিত হয়ে, মুই কোদাল চালাবার পারি বাবু, কুড়িয়াল চালাবার পারি। যা পারে সেটা বলে ফেলতে পেরে এবার তার প্রমাণ দিতে দুই পা ফাঁক করে বাঘারু হাত দুটো ওপরে তুলে কুড়োল-কোদাল নামানোর ভঙ্গিতে বলে, এ্যানং, বাবু।

হু

এই, এ্যানং, যেন কোদাল কুড়োল চালানোটা কথা দিয়ে বাবুকে বাঘারু সম্পূর্ণ বুঝিয়ে উঠতে পারছে না, তাই তাকে দেখিয়ে বোঝাতে হচ্ছে।

পার ত চালাও।

 বাঘারু মুহূর্তে সোজা হয়ে দাঁড়ায়। তার পর তার চোখ স্থির করতে হয় সেই ফাড়য়া-চালানো দলটার কাছে নালীর মাটি যারা তুলছিল তাদের ওপর। বাঘারু তাদের দিকে ছুটে যায়।

বেড় ও রাস্তার মাঝখানে সরল নালীটা এতটাই গভীর যে সেখানে নেমে যারা কাজ করছিল তাদের ঘাড়টুটু শুধু ওপরে আছে, এতটাই চওড়া, যে অইন বেঁধে এই দলটির কোদাল চালাতে কোনো অসুবিধে হচ্ছে না, এমন কি, ঘুরে দাঁড়িয়ে দেয়াল চাছতেও পারছে। কিন্তু গভীরতা এত বেশি বলেই চওড়াটা চোখে পড়ে না। অভ্যস্ত কাজের ব্যস্ততাহীনতায় ভেতরের জংলা কাল মাটি চেঁছে ওপরে তুলে রাখা হচ্ছিল আর কোদালের ঝিলিক তুলে আবার মাথার ওপর থেকে নামানো হচ্ছিল গর্তের অন্ধকারে।

বাঘারু সরাসরি অনেকটা চলে যায়। যেন তার জন্যে একটা কোদাল বাইরে রাখাই আছে, নিয়ে গর্তে নেমে যাবে–এমন নিশ্চয়তায় সে কোদাল খুঁজে যায়। বেশ খানিকটা গিয়ে আবার ফিরতে-ফিরতে বলতে শুরু করে, মোর কোদালখান কোটত, বাবু কহিল মোক, মোর কোদালখান?

ততক্ষণে বাবু তাকে একটু জোরেই ডাকেন, এই, এই এখানে কী, এই, এদিকে এসো, আরে

মুখ ফিরিয়ে দেখে বাবু তাকেই ডাকছেন, এদিকে এসো, ওখানে কী?

আবার বাবুর কাছে ফিরে যেতে শুরু করে। কাছাকাছি আসতেই বাবু রেগে উঠে বলেন, ওখানে কী করছ? কাজ হচ্ছে, যাও, বাবু বা-হাতটা তুলে বা-দিকটা, বাঘারুর দাঁড়িয়ে থাকা রাস্তাটাই সোজা, দেখিয়ে দেন, সেটাই বাঘারুর বেরবার একমাত্র রাস্তা, আর, বাঘারু সেই রাস্তা ধরে সঙ্গে সঙ্গে চলতে শুরু করে–এমন নির্দেশ পালনের শারীরিক অভ্যাসে! বাবু পেছন থেকে বলে ওঠেন, এ ত বুলডোজার, বাবা।

 বাবুর কাছ থেকে বাঘারু একটু সরে যেতেই সে আবার ঐ ঝোপঝাড় আর গাছ-পালার অংশ হয়ে যায়। চা বাগানটায় ঝোপঝাড় আর গাছপালাই ত বেশি, ক-টা জায়গাতেইবা কাজ হয়। কিন্তু এত সাজানো-গোছানো ঝোপঝাড় আর টানা সোজা চওড়া রাস্তায় বাঘারুর এই এত লম্বা শরীরটা এত উদোম হয়ে থাকে।

.

০৫৯.

মাথা-ছাউনির পাতা

সামনে, কিছু দূরে চা বাগানের শেষে টানা ঝোপের লাইন শুরু, রাস্তার শেষে। ওদিকে নিশ্চয়ই ঝোরা। বা, গর্তের লাইন। বাগিচার সীমানা শেষ। ঐ ঝোপের ফাঁক দিয়ে বাঘারু বাইরে বেরিয়ে যেতে পারবে। বড় জোর একটু এদিক-ওদিক করতে হবে।

ভিড়ের মাঝখানে আচমকা পড়ে, ভিড়ের টানে-টানে এতটা চলে আসতে হয়েছে বাঘারুকে, এই, একেবারে চা বাগানের মাঝখানে। তার পর সেই ভিড় বাঘারুকে আবার একলা ফেলে খসে পড়েছে।

এত ঘন আর এত লম্বা একটা ভিড় তাকে ঘিরে টেনে এতদূর নিয়ে এসে ফেলেছে বলেই কি বাঘারুর,, এখন এই চাবাগানের এমন নির্জনতাতেও, নিজেকে নাংটিয়া লাগে। মাঠে, ফরেস্টে, নদীতে, নদীর পাড়ে ত বাঘারুর এমন লাগে না। সেখানে ত তার শরীরটা একটা গাছের মত, নাগিন (চাপা) গাছ, বাতাসটা ধরার জন্যে, খাড়া। ফুলের গন্ধ ছড়িয়ে বাতাসের ইশারা দেয়ার জন্যে, খাড়া। বা স্রোতের ইশারা দেয়ার জন্যে, শোয়া। বাঘারুর শরীর যেন সেই ইশারা হারিয়ে ফেলে–মানুষের হাতে পোতা এই হাজারে-হাজারে চা-গাছ আর সারে-সরে শিরীষ গাছ আর ঝোপঝাড়ের মাঝখানে! মাঠের মত সমান চা-গাছের মাথা আর ছাতার মতন সমান শিরীষ গাছের মাথার মাঝখানে মানুষের বানো আকাশ দিয়ে হাওয়া এসে বাঘারুর গায়ে লাগলে সে কুঁকড়ে যায় তার শরীরটা আর-একটু ছোট হলে পারত, বা তার নেংটিটা আর-একটু বড়, এই চা বাগানের ভেতর দিয়ে চলার মত ছোট, বা বড়।

ডাইনে বাঁয়ে না বেঁকে বাঘারু সোজা ঐ ঝোপঝাড়ের দিকেই চলে। ঐ মিছিলটা তাকে অনেকখানি উত্তরে সরিয়ে এনেছে। বেরিয়ে একটু দক্ষিণে গিয়ে তাকে ডেমকাঝোরার রাস্তাটায় উঠতে হবে। দিকের নিশানা ঠিক থাকলে ঐ রাস্তাটাতে গিয়েই ঠেকবে।

সামনে এসে দেখে তরিকা গাছের সারি দিয়ে বেড়া। আনারসের মত মোটা, শক্ত, অথচ অনেক বড়, চ্যাপ্টা পাতা ছড়ানো! বড় বড় গাছগুলোতে আবার একটা ডাল থেকে আর-একটা ডাল বেরিয়েছে। মাথা নিচু করে বাঘারু ফল খোঁজে, ছিঁড়ে নেবে। একটু এদিকে-ওদিকেও তাকায়। এখন ফলের সময় না। তবু গাছ দেখলেই ফল খুঁজতে হয়। গাছো দেখিবেন, ফলো খুঁজিবেন।

ফল না পেয়ে বাঘারু এবার পাতাগুলো দেখে। এখানে কেউ এ পাতা কাটে না। লাগেও না হয়ত কাররা। এখানকার কুলিদের ত ঘর আছে। তা হলে ঐ পাতা দিয়ে আর ছাওয়াবে কী? আর এত এমনিতে হয় নি, লাইন বেধে। চা বাগানের সীমানা দিয়ে পোতা হয়েছে কাটাবেড়া দেয়ার জন্যে।

বাঘারুর ত এই পাতাগিলান নাগে। যেইঠে যাছে বাঘারু, ঐঠে যদি এইলা বড়বড় তরিকা পাতা না মিলে? এ্যানং টিনের নাখান তরিকা পাতা দেখি ক্যানং করি ছাড়ি যাবে বাঘারু? ছাড়া যায়? এ্যানং সাইজের পাতাগিলা, এ, ধর কেনে একখান হবা ধরিবে সিকিখান দশ ফুটি টিন। তা, ধর কেনে, চারখান পাতা জোড়া লাগিলে একখান টিন হয়্যা যাবে। আর দুইখান টিন পাশত দিবেব্যাস, বাঘারুর এই ঠ্যাং দুটা বাদ দিয়া বাকি শরীলখানের উপরে চালা উঠি যাবে

নিজের শরীর আধাআধি ঢাকার মত এমন ছাউনি হাতের নাগালে পেয়ে ছাড়ে কী করে বাঘারু?

কিন্তু এত মোটা, লম্বা পাতা ত আর মুচড়ে ঘেঁড়া যাবে না, কাটতে হবে। দা বা কুড়োল পাবে কোথায়? নিচু হয়ে ঝোপঝাড়ের তলায়-তলায় সুবিধেমত পাথর খোঁজে। এই পাতার ডালগুলোতে রস থাকে। চ্যাপ্টা ধারালো পাথর পেলে সেটা দিয়ে মেরে-মেরে তেলে-তেলে কেটে নিতে পারে। কিন্তু তেমন একটা সুবিধেমত পাথর পায় কোথায়? আর, তাও আবার এদিকে? বাগানের ভেতরে? এখানে পাথর আসবে কোত্থেকে? এলেও ত কুড়িয়ে ফেলে দেবে–বাগান পরিষ্কার রাখতে। বেড়ার ওদিকটায় গেলে পাথর পাওয়া যেত, হয়ত, চ্যাপ্টা ধারালো পাথর।

বাঘারু ঝোপের ফাঁক খোঁজে–বাইরে গলে যাওয়ার ফাঁক। বর্ষায় জল আর মাটির রস খেয়ে গাছগুলোর গোড়া এত ফোলা যে ঘেঁষাঘেঁষি হয়ে গেছে। তলায় ফেঁকড়িও বেরিয়েছে অনেক। গাছের গোড়ায় মাটি আগের মত উঁচু করে সাজানো-যাতে কোনো ফাঁক না থাকে। অথচ বাঘারু তেমন একটা ফাঁকই খোঁজে-শেয়ালের তৈরি করা ফাঁক। শেয়াল সামনের দুই পায়ের নখে মাটি সরিয়ে-সরিয়ে, পরে চার পায়ের নখে বেড়ার তলায় গর্তবানায়। গর্তের পেছনে টান-টান হয়ে শুয়ে আর ঘষে-ঘষে গলা গর্তের মধ্যে নামায় মাটিরা নিন্দুরের (মেটে ইঁদুর) নাখান। তার পর গর্তের ঢাল বেয়েই বেড়ার অন্য দিকে গলা তুলতে থাকে, যেন শিয়াল কোনো চার পেয়ে খাড়া জন্তু নয়, লেপটানো জন্তু। পেছনটা একবার পেরিয়ে গেলেই লাফিয়ে চার পায়ের ওপর খাড়া হয়ে, গা ঝাড়া দিয়ে ধুলোমাটি ঝরিয়ে নেয়। শিয়ালের ঘোড়া তেমন গর্ত পেলে বাঘারু নিজের দুই হাতে তাকে আরো কিছুটা গভীর করে, গলে যাবে? এই একটু আগে যে বাঘারু নিজের শরীরের বিশালতা ও নগ্নতা নিয়ে হাঁটতে-হাঁটতে কুঁকড়ে যাচ্ছিল সে এখন একটা বেড়া টপকানোর জন্যে নিজের শরীরকে শেয়ালের মত নরম ও নমনীয় ভেবে নিতে পারছে?

কিন্তু বাঘারু করে বসে উল্টোটা। পাথর বা ফাঁক খুঁজতে কোমর ভেঙে ডানদিকের ঝোপটার তলায় তাকাতে-তাকাতে যাচ্ছিল–যেন তার পয়সা হারিয়েছে। একটা জায়গায় এসে দেখে, গাছগুলোর গোড়া তেমন বড় ও মোটা নয়। তা হলে মাথায়ও বাড়ে নি নিশ্চয়। উঠে দাঁড়ায়, দেখতে। কিন্তু, দাঁড়িয়েই, দুই হাতে পাতাগুলোকে দুদিকে একটু কাত করে, নিজে কাত হয়ে প্রথমে বা পা বাইরে দেয়, তার পর ডান পা টানে। হাতি এই রকম ফাঁক বুঝে কাটাগাছ পেরোয়, তলায় কাটাগাছের ঝোপ একটুও না ছুঁয়ে।

বাঁ পা-টা বারু গাছের নীচৈ উঁচু করে দেয়া আলগা মাটির ওপর রেখেছিল। কিন্তু তখনো শরীরের ওজন তার ডান পায়ের ওপর, বাগানের ভেতরে। যেই ডান পাটা তুলে বুকটাকে ঝোপের ফাঁকে গলিয়ে দিয়েছে, অমনি নিজেরই শরীরের ভারে পায়ের তলার মাটি খসে যায়; আর, নদীর পাড়ভাঙার মত, বাঘারুর একেবারে হুড়মুড় করে ধসে যায়।

 পাক খেয়ে-খেয়ে গড়াতে-গড়াতে বাঘারু এক জায়গায় আটকে যায়। ঘাড়টা তুলতে গিয়ে আবার একটু গড়ায়, কিন্তু ততক্ষণে লতার মত লম্বা আর পাথরের মত শক্ত পায়ের গিরগিটির মত আঙুলগুলো মাটি পেয়ে গেছে।

সেই পায়ের ভর দিয়ে বাঘারু প্রথমে উঠে বসে। চারপাশে দেখে। এমন কিছু নয়। চা-বাগানটা খাড়াইয়ে, মাটি ভেঙে ঢাল বেয়ে বাঘারু নীচে পড়ে গেছে। এই ঢালটার সামনে খোলা মাঠ।

আর-একবার তাকিয়ে বাঘারু আবিষ্কার করে ঢালটা পাথরে-পাথরে বোঝাই। এই এত পাথর দেখে তার মনে পড়ে, সে পাথর খুঁজছিল। আচমকা পড়ে যাওয়ায়, সে ভুলে গিয়েছিল। মনে পড়ার পর পতনটাই ভুলে গিয়ে বাঘারু খাড়া দাঁড়ায়। বাঘারুর চুল থেকে গোড়ালি পর্যন্ত অসংখ্য কুচো পাথর লেগে আছে, যেন সে আর বাঘারু নয়, বাঘারুর পাথুরে মূর্তি। শরীর তার পেশিতে পেশিতে এমনই খুঁজময় আর ঘাম-ঘামভাবে এমনই আঠালো যে পাথরকুচি তার সারা গায়ে লেগে, ফুটে, থেকে যেতে পারে।

দাঁড়িয়ে উঠে, মাটিতে চোখ ফেলে বাঘারু পাথরগুলোকে একবার দেখে নেয়। পাথর যা আছে, এই ঢালটারই গায়ে। বড় বড় পাথরগুলো ঢাল বেয়ে নিচুতে। তা ছাড়া বোল্ডার আর বড় সাইজের পাথরই বেশি। সেই ফাঁকগুলো পাথরকুচিতে ভরা। বড় পাথরগুলোতে তলার দিকে শ্যাওলা, অনেকদিন ধরে পড়ে আছে। ছোট পাথরগুলো হলদেটে বেশি। কিছু শাদা। চা বাগানের সীমানার ঢাল। জমিটা হয়ত চা বাগানেরই, কিন্তু চায়ের খেত হয়ত ঐখানেই শেষ। মাটি যাতে না ভাঙে সেইজন্যে কোম্পানি প্রতি বছরই পাথর ফেলে।

.

০৬০.

বাঘারুর পাথর খোঁজা

দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চোখ দিয়ে বাঘারু তার পাথরটা খোঁজে। যে-কোনো একটা পাথর, হাতে ধরা যায় এমন ছোট, আর কাটা যায় এমন ধারালো। লম্বাটে একটা পাথরের টুকরো তার চোখে পড়ে-কাঠের টুকরোর মত, ধরার সুবিধে। কিন্তু চকচক করছে। তার মানে বালি-পাথর। ভেঙে যায়।

সেটা থেকে চোখ সরিয়ে এপাশ-ওপাশ দেখতে-দেখতে আবার সেটাকেই ফিরে দেখে ফেলে। এখান থেকে দেখে, তার কাজের পক্ষে সবচেয়ে ভাল পাথর ওটাকেই মনে হয়। কিন্তু এত চকচক করছে যখন, রাঘারু জানে, ওটা বালি-পাথর। তবু, একবার যাচাই করে ফেলে না দিলে চোখটা বারবারই ওদিকে যাবে। বাঘারু পাথরটার দিকে পা ফেলে। তার পা ফেলার দোলায় শরীরে লেগে থাকা পাথরকুচি পাথরে ঝরে পড়তে থাকে।

পাথরটা তুলে দেখে–গোটা নয়, একটা দিকে কোনাকুনি ভেঙেছে আর সেই দিকের খানিকটা চটে গেছে। তার ফলে ঐ দিকটাতে একটা ধার আছে। মারলে কেটে যাবে। কিন্তু ধরার জায়গা নেই। সে না-হয় দুই হাতেই ধরল। দুই হাতে ধরে দেখে বাঘা। মনে হয় পাথরের ওপরটা কে যেন খুঁটে রেখেছে। বালি-পাথরগুলো তুললেই এরকম মনে হয়। বোন্ডার পাথরগুলো একেবারে চকচকে গোল। কোনো জায়গায় একটু ওঠা-নামা নেই।

দুই হাত তুলে গাছের গোড়ায় মারলে পাথরটা ভেঙে যাবে কিনা পরীক্ষা করতে, বাঘারু দুই হাতে ধরে দুই দিকে চাপ দেয়। বা হাতে পাথরটা লম্বালম্বি ভেঙে যায়। বাঘারুর দুই হাতই সরিয়ে নিলে পাথরটা তার পায়ের কাছেই পড়ে। তাতে আবার একটা ছোট লম্বা টুকরো হয়। বাঘারু দেখে, তার পায়ের কাছে পড়ে আছে একটা ভাঙা মৃর্তি, পিঠের বাকটার কাছে একটু খোবলানো, গলাটা লম্বা। বেটিছোঁয়াদেও। বাঘারু তার মূর্তি থেকে চোখ সরিয়ে নেয়। বাঘারু ত গাছতলায় বসাবার পাথর খুঁজছে না, সে ডাল কাটার অস্ত্র খুঁজছে।

আর-একটা পাথর দেখে এগয়। তার শরীর থেকে পাথরকুচি পাথরে পড়ে ঝুরঝুর। কাছে গিয়ে দেখে, বোধহয় গেড়ে আছে। পা দিয়ে পাথরটা নাড়ায়, নড়ে না, তার মানে মাটির অনেকখানি ভেতরে সেঁদিয়ে আছে। বাইরে যেটুকু দেখা যাচ্ছে, তাতে কিছুই বোঝা যায় না। গা ঐ পাথরের ওপরই রেখে আবার পাথর খোঁজে বাঘারু।

পায়ের কাছে একটা ছোট জাম্বুরা [বাতাবি) সাইজের পাথর পড়ে ছিল; কুড়িয়ে নেয়। দুই হাতের চেটোতে সেই গোল, নিটোল পাথরটাকে ঘুরিয়ে-ঘুরিয়ে দেখে। দেখতে কী সুন্দর! হেই এটুস ময়লা-ময়লা শাদা, ঠাণ্ডা নাখান, আর ডিমের নাখান একটা দিক গোল, আরেকখান চুখা। বাঘারু চোখা দিকটা এক হাতে ধরে সোজা করে। মানষির মাথার নাখান।

সেটা ঘুরিয়ে-ঘুরিয়ে বাঘারু দেখে এটা থেকে কত ভাল একটা টুকরো বের করা যেত। করাত দিয়ে কাটলে, মাঝখানের টুকরোটা একেবারে আস্ত একটা দা হয়ে যেত। বাঘারু পাথরটাকে তার হাতের সমস্ত জোর দিয়ে সামনের একটা বড় পাথরের ওপর মারে। আগুনের ফুলকি ছোটার সঙ্গে সঙ্গে কয়েকটা বন্দুকের আওয়াজ একসঙ্গে হয়। বারুদের গন্ধটা বাঘারুর নাকে এসে লাগে যখন, প্রতিধ্বনিটা তখন আসে বাগানের দিক থেকে। পাথরটা তখনো গড়িয়ে যাচ্ছে।

বাঘারু দেখে, বা দেখেছিল আগেই, এখন ভাবে, বরং এই এত পাথরের মধ্যে খুঁজে বের করার চাইতে, আর-একটু নীচে নেমে, যেখানে ঢাল শেষে হয়েছে, সেখানে ছড়ানো-ছিটনো পাথরগুলোর ভেতর খুঁজে বের করা বোধ হয় সহজ। বাঘারু তাই নীচে নামতে থাকে। একটা বড় পাথর থেকে আর-একটা বড় পাথরে লাফিয়ে, নুড়ি পাথরগুলোর ওপর একটা পা দিয়ে আর-একটা বড় পাথরে উঠে, বাঘারু লাফিয়ে, ঢালটার তলায় নেমে যায়। তার পায়ের ধাক্কায় আর তার এক-একটি লাফে নুড়িপাথর আর ঢিল পাথরগুলো ঝুরঝুর গড়গড় করে গড়িয়ে যেতে থাকে আর যে-দুই জায়গায় সে পা রাখে, সেখানকার পাথর মাটিতে গেড়ে যায়।

যেখানে লাফিয়ে নামে, সেখানে, তার সামনে, বাঘারু দেখে একটা বিরাট উঁচু মানুষের মাথা এলোমলো হয়ে পড়ে আছে। ঘাস, বালি আর বুনো ঝোপের মাঝখানে, যেন কেউ ফেলে রেখে গেছে। বাঘারু নিচু হয়ে মাথাটাকে সোজা করে দিতে চায়, পারে না, এত ভারী। তখন দুই হাতে পাথরটাকে টানে। মাটি আর পাথরের রেখায় বাঘারু বোঝে, এখানে বর্ষার জল নেমে, জমে, আবার বেরিয়ে যায়। আর সঙ্গে নিয়ে আসে ছোট-ছোট পাতলা নুড়ি। মাটির সঙ্গে মিশে শক্ত হয়ে-হয়ে এই মানুষের মাথাটা তৈরি হয়েছে। এখন বাঘারু ওটাকে উল্টে দেয়ায় মানুষের মাথা বলে মনে হচ্ছে না। বায়ারু দুই হাতে ওটাকে তুলে সামনের উঁচু পাথরটার ওপরে বসিয়ে দেয়। দেখে-দেখে হেসে ওঠে। ছিলুমাঠত, শুইয়া, এ্যালায় থাকেন পাথরের ওপর বসিয়া। বাঘারু যেন জানে, ঐ মূর্তিটা সে ওখানে চিরকালের জন্যই গড়ল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *