২.১ বনপর্ব – বাঘারুর নির্বাসন

বনপর্ব – বাঘারুর নির্বাসন

০৪২.

এম-এল-এ ফিরে এল

ক্রান্তি হাটের হাটখোলায় সন্ধ্যা নেমে গেল। রাস্তার ওপরের মিষ্টির দোকানের হ্যাজাকের আলোতে মাঠের ঐ কিনারাটা উজ্জ্বল দেখায়। অন্য দোকানগুলোতেও আলো জ্বালানো হয়েছে। ফলে সুহাসের, এই বারান্দা থেকে রাস্তার ওপরটাকে, দোকানগুলোর চালাঘরের ওপর দিয়ে উজ্জ্বলতর দেখায়। ধীরে-ধীরে রাস্তার ধারের গাছগুলির নীচের পাতাগুলোতেও আলোর ছিটে লাগে।

সুহাসের বারান্দা থেকে রাস্তার এক অংশ দেখা যায় না, কিন্তু ওপরের আলোর আভা বোঝা যায়। সেটুকু বাদ দিয়ে হাটখোলার বাকি অংশটা সন্ধ্যায় অন্ধকারে দুমড়েমুচড়ে আছে। নড়বড়ে সব বাশের ওপর ভামনির ছাউনিগুলো মাটিতে আরো থুবড়ে পড়ে। সন্ধ্যা যত বাড়ে, মাটি আর আকাশের মাঝখানের ফাঁকটাও ততই বাড়ে।

একদল লোক মাঠটা পার হয়ে হলকা ক্যাম্পের এই ঘরের দিকে আসছে। সুহাস বারান্দায়, বসেছিল। অতজন লোককে একসঙ্গে আসতে দেখে সুহাস অনুমান করে, সার্ভের ব্যাপারে কিছু বলার জন্য দল পাকিয়ে আসছে। সে ঠিক করে ফেলে, কথা বলতে হলে সার্ভের সময় বলতে হবে আর আপত্তি থাকলে লিখিত দিতে হবে-সে সরকারি দলই তোক আর বিরোধী দলই হোক। প্রথম থেকেই সুহাস এ ব্যাপারটায় আইন-অনুযায়ী চলতে চায়, যাতে কারোই কিছু বলার না থাকে।

দলবলটা যখন মাঠের মাঝখানে, সুহাস শুনতে পায়, আপনার এখানে একটু বসব।

শুনেও প্রথমে সুহাস বুঝতে পারে না। চেয়ার থেকে উঠে সিঁড়ির দিকে একটু এগিয়ে যায়। অন্ধকারে তখনো চিনে নিতে পারে না, কে। তারপর হঠাৎ হাঁটার ভঙ্গিটা দেখে বুঝে ফেলে, এম-এল-এ।

ঘরের ভিতর থেকে প্রিয়নাথ এসে আগেই দাঁড়িয়েছিল। সে এবার লণ্ঠনটা, এনে দরজার বাইরে রাখে। আর, এম-এল-এ সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠতে-উঠতে বলে, আপনার এখানে একটু বসব।

আরে হ্যাঁ হ্যাঁ, আসুন আসুন, বলে সুহাস প্রিয়নাথের দিকে তাকাতেই প্রিয়নাথ ঘরের ভেতর থেকে একটা চেয়ার নিয়ে বাইরে দেয়। চেয়ারটা বাইরে আনতে-আনতেই এম-এল-এ উঠে এসেছে। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলছে। তা হলে চেয়ারটা দেবে কোথায়? এম-এল-এই সরে জায়গা করে দেয়। প্রিয়নাথ প্রথমে সিঁড়ির মাথাতেই চেয়ারটা রাখে। কিন্তু বোঝে, তাতে ওঠা-নামার অসুবিধে হবে। তাই একটু সরিয়ে দেয়।

এম-এল-এ চেয়ারটা দেখে। তারপর সেটাকে আর-একটু কোনাকুনি করে নিয়ে বসে, পাশে মাটিতে তার ব্রিফকেসটা রেখে। বসে পড়তেই এম-এল-এর ডান পাশে সিঁড়ি, বাপাশে ঘরের দরজা, সামনে বারান্দা, আর কোনাকুনি মাঠটা পড়ে। ঠিক কোথায় বসলে সবটাই তার সামনে পড়বে এ যেন এম-এল-এ অভ্যেসেই ঠিক করে নিতে পারে।

সুহাস প্রিয়নাথকে বলে, একটু চা এনে দেয়া যাবে, প্রিয়নাথবাবু? সে তার ঘরের দিকে যায় পয়সা আনতে। প্রিয়নাথ তার পেছন-পেছন দরজার কাছে সুহাসকে ধরে বলে, স্যার, স্টোভটা জ্বালিয়ে বানিয়ে দেই স্যার? আমাদের ত রান্নাও চাপাত হবে।

জ্যোৎস্নাবাবু–বিনোদবাবুরা কোথায়, জানেন?

 কাছাকাছিই আছেন কোথাও স্যার, চলে আসবেন। অনাথ একটু গেছে কাঁঠালগুড়ির মোড়ের দিকে, ওদের দেশের একটা দল নাকি ওখানে থাকে।

আচ্ছা, চা করুন তা হলে।

 আপনি খাবেন ত স্যার?

দেবেন এক কাপ, সুহাস কিছু ভাবে, প্রিয়নাথ ফেরার জন্যে ঘুরলে বলে, এখনই রান্না চাপাবেন না, ওঁরা এসেছেন—

প্রিয়নাথ একটু অবাক হয়ে বলে, কেন স্যার?

ওরা কেন এসেছেন বুঝতে পারছি না ত, যদি আমাদের কাছেই কাজকর্ম থাকে।

 প্রিয়নাথ একটু হেসে বলে, স্যার, তা হলে ত আপনার কোনোদিনই খাওয়া-ঘুম হবে না, এ ত লেগেই থাকবে।

প্রিয়নাথের হাসিতে অভিজ্ঞতার এমন ছাপ ছিল যে সুহাসকে মেনে নিতে হয়।

 প্রিয়নাথ ফিরে যায়।

সুহাস ঠিক বুঝে উঠতে পারে না কী ভাবে তৈরি হবে। হতে পারে, এম-এল-এ তাকে কিছু কাগজপত্র দিয়ে যাবে। সুহাস রেখে দেবে। তারপর সুহাস ভাবে, রশিদও দেবে। এই কাগজগুলোর একটা আলাদা ফাইল করবে। কিন্তু এখানে ত আর অফিসের আর-কেউ নেই। সে নিজেই ফাইলটা রাখবে। যদি জবাব দেয়ার থাকে, জবাবও দেবে। সুহাস যেন বুঝতে পারে, ঐরকম একটা নিয়মকানুনের বেড়া ছাড়া সে নিজেকে বাঁচাতে পারবে না। সুহাস ফেরে। প্রিয়নাথের রাখা লণ্ঠনের লাল আলোতে মেঝেটা চকচক করছে, এম-এল-এর চেয়ারের পায়া আর এম-এল-এর বাঁ পায়ের ওপর ওপর তোলা ডান পায়ের আঙুলগুলোতে আলো পড়েছে। এম-এল-এ পা-টা নাচাচ্ছে বলে বারান্দার সিলিঙে লণ্ঠনের আলোটায় ছায়া পড়ছে আর আলো হচ্ছে। এম-এল-এর মুখটার ছায়া দেয়ালের কোনায় একটু লেগে বাইরে চলে গেছে।

.

০৪৩.

 জমির আল ও এসেম্বলির মাথাধরা

এম-এল-এ সুহাসকে জিজ্ঞাসা করে, আপনার এখানে আর গোলমাল হয় নাই ত?

সুহাস একটু আলগা দাঁড়িয়েছিল। চেয়ারটা নিয়ে সে এম-এল-এর কাছে বসে না। আবার, চেয়ারটা এখন যেখানে আছে, সেখানেও যায় না। চেয়ার আর এম-এল-এর চেয়ারের মাঝখানে দাঁড়ায়, ভঙ্গিতে আত্মবিশ্বাস নিয়ে। যদি এম-এল-এ তার কছেই এসে থাকে তা হলে সেটা আগে বলুক। এম-এল-এর কথার জবাবে সুহাস বলে, না-আ, তারপর বোঝে আরো কিছু বলা দরকার, যোগ করে, আমাদের সঙ্গে আর কার কী গোলমাল হবে?

এম-এল-এ একটু জোরে হেসে ওঠে, এই আপনি ভাবছেন নাকি? আপনার সঙ্গেই তো গোলমাল।

কেন? আমাদের সঙ্গে আর গোলমাল লাগবে কি সে, এম-এল-এ কথাটা যে-হালকা চালে বলে সেটা সুহাসকেও ঘেঁয়; যেমন দেখব, তেমন লাইন টানব– এখানে আল, এখানে রাস্তা, এখানে গাছ।

ঐ সব আল, গাছ এইসব দাগ দিবেন কেন? বেশ হাসি-হাসি মুখেই এম-এল-এ জিজ্ঞাসা করে, যেন ধাঁধা।

আছে, তাই দেব।

হ্যাঁ, ঐ ত মজা। ঐটা যদি না থাকে তয় ত একজন বলিবার পারে ঐ জায়গাটায় গাছ নেই।

না থাকলে বলবে, নেই।

 না হয়, না হয়। যার সম্পত্তির সীমা ধরেন ঐ গাছ পর্যন্ত, সেইলা ত চাহিবে গাছটা না-থাকুক।

কেন?

কহিবার পারিবে, গাছ নাই ত মোর জমিখানারও সীমা নাই।

সুহাস হেসে ফেলে, তা অবিশ্যি পারে।

আর নিভৃত আলাপের সুরে এম-এল-এ বলে, তা উ ত আপনাকে আসিয়া বলিবে যে ম্যাপে গাছটা দিবেন না।

সুহাস আরো হেসে বলে, হ্যাঁ, তা পারে–

এম-এল-এ তখন হেসে বলে, দেখেন না, এক বিঘত জমি নিয়া খুনাখুনি পর্যন্ত হওয়া ধরে? আর, আপনি ত এই তামান জমির সীমা টানাটানি করিছেন।

সুহাস হাসি-হাসি মুখে তাকিয়ে থাকে। এম-এল-এ একটু চুপ করে থেকে বলে, গোলমাল তো আপনার সঙ্গেই হইবে, কত গোলমাল।

এম-এল-এর কথার ভেতর নিভৃত আলাপের ভঙ্গি ছিল। তার একটা কারণ, আলাপটা সত্যিই নিভৃত ছিল। আর-একটা কারণ, সুহাস অনুমান করতে চায় কি এই নিভৃত আলাপে এম-এল-এ তাকে কিছুটা সমর্থনই দিয়ে যেতে চায়! ভেবে ফেলেই সুহাস সাবধান হয়, এই সমর্থনটুকুর বদলেই হয়ত যাওয়ার আগে তাকে কোনো ব্যক্তিগত ও দলগত কাজের কথা বলবে। সুহাস আসলে বুঝতে পারছে না–এম-এল-এ তারই বারান্দায় এসে বসল কেন। সেটা না-বোঝা পর্যন্ত সুহাসের অস্বস্তি কাটবে না।

প্রিয়নাথ কাঁচের গ্লাসে চা এনে দেয়। তার পর জিজ্ঞাসা করে, একবার এম-এল-এর দিকে, আর একবার, সুহাসের দিকে তাকিয়ে, একটা বিস্কুট দেব?

দাও, একখান বিস্কুট দাও, এম-এল-এ বা হাতে চায়ের গ্লাশটা নিয়ে ডান হাতটা বাড়িয়ে রাখে। প্রিয়নাথ বিস্কুট আনতে যায়। সুহাস তাড়াতাড়ি জিজ্ঞাসা করে, আপনাকে কিছু খাবার এনে দেবে?

আরে নানা, প্রিয়নাথ বিস্কুটটা এনে দিলে এম-এল-এ গ্লাশের চায়ে নরম করে করে খায়। সুহাস বিস্কুট নেয় না। চায়ে চুমুক দিয়ে এম-এল-এজিজ্ঞাসা করে, আপনি ত এই প্রথম এই কাজে আসছেন, না?

জবাব দিয়েও সুহাস ঠিক বুঝে উঠতে পারে না, সে লোকটিকে পছন্দ করছে, না অপছন্দ করছে। লোকটার কথা বলার ভাষাটা এমন–রাজবংশী ভাষার সঙ্গে চলতি বাংলার মিশেলটা নিয়ে কোনো অস্বস্তি নেই। বলতে বলতে বলতে বলতে তার নিজের এই ভাষা তৈরি হয়ে গেছে। সেটা দিয়ে সে। সবার সঙ্গে সব জায়গাতেই কথা বলতে পারে–কলকাতাতে, নিশ্চয় তার পাটিটাটিতে, আবার তার এই সব গ্রামেও নিশ্চয়। লোকটাকে বেশ কাজের লোক বলে মনে হয় তার মুখের কথা শুনেই। আবার চেয়ারটা ভরে বসেছে একেবারে পাইকার-দেউনিয়ার মত, পায়ের ওপর পা তুলে, জামাটা ঘাড়ের পেছনে ঠেলে দিয়ে। চায়ে চুমুক দিয়ে এম-এল-এ আবার বলে, গ্রামের জমিজমার ত ধরেন কেনে দখলই হচ্ছে আইন। দখল যার জমি তার। আপনি যদি একখান লাইন টানি দিয়া আমার জমিখানের ভাগ, ধরেন, আর-একজনের জমির ভিতর ঢুকাইয়া দেন, তা হলি ত আমি পরের দিন লোকজন লাঠিসোটা নিয়া ঐ জমিটার দখল নিয়া নিম। ব্যাস, কথাটা শেষ করে এম-এল-এ বলে, ত আপনার সঙ্গে গোলমাল হবে না? প্রত্যেকদিন গোলমাল হবে আপনার মাপামাপি নিয়া। তবে আপনি ত শক্ত অফিসার। জোতদারদের বাড়ি খাবেন না, বলে দিছেন। জোতদাররা ভয় খাইছে, এম-এল-এ এবার বেশ জোরে-জোরে হেসে ওঠে।

সুহাস যেন নিজের অবস্থাটা বোঝানোর জন্য বলে, আমরা তো আর প্রপাটিরাইট মামে সম্পত্তি কার সে-সব ঠিক করছি না, সে-সব ত সিভিল কোর্টের ব্যাপার।

প্রপাটি রাইট-টাইট ত আপনার গয়ানাথ জোতদার, ফরেস্ট ডিপার্টমেন্ট আর আনন্দপুর চা বাগানের ব্যাপার। আর-সব মানুষের রাইট মানে ত এক বর্ষার চাষ। ব্যাস। কোর্টে যাইতে আমাদের সব মানষি ভয় পায়। সেইখানে ধরেন গ্রামের মাতব্বর, কি ধরেন পার্টির নেতা, কি ধরেন আপনাদের মতন, অফিসার যা হুকুম দেন সেটাই সবাই মানি নেয়। মানি নিবার চায় অন্তত। সাধারণ মানুষের কাছে ত সরকার মানেই সরকারি অফিসার–এই ধরেন ডি. সি, এস.ডি.ও, জে এল আর ও, থানার দারোগা আর আপনাদের মতন আরো সব অফিসার। অফিসার ভাল না-হলে ত সরকার বদলি যায়। এই দেখেন না, সাতালডির ব্যাপার। সব ইঞ্জিনিয়ারগুলা মিলি শয়তানি করে।

সুহাস একটু চমকে বোঝে, এই লোকটি এখানকারই এম-এল-এ বটে, কিন্তু সত্যি করেই তার পেছনে অভিজ্ঞতার এমন একটা ভূমি আছে, যেখান থেকে কোনো সময়েই লোকটা সরে না। আর সেই কারণেই এতক্ষণ তার কথায় এমন ঘনিষ্ঠতা বোধ করে ফেলছিল সুহাস। এই লোকটিও কি সেই কারণেই সুহাসের কাছে এসে বসল? সুহাসও এখানকার লোক নয়, তাই তাদের ভিতর, এখানকার অভিজ্ঞতা নিয়ে, এই সব কথা বিনিময় হতে পারে।

সুহাস জিজ্ঞাসা করে, আপনাকে তো নিশ্চয়ই এসেম্বলিতে প্রায়ই বলতে হয়।

মাঝে-মাঝে বলতে হয়, লোকাল ব্যাপার-ট্যাপার থাকলে, আর দু-এক সময় কোশ্চেন জিজ্ঞাসা করতে হয়। আমাদের অন্য কমরেডরা আছেন সব, তারাই বলে দেন।

লোকটি থেমে গেলে.সুহাস জিজ্ঞাসা করে বসে, আপনার ভাল লাগে এসেম্বলি? এম-এল-এচুপ করে যায়। সুহাস বোঝে, সে ভেবে নিচ্ছে কথাটার জবাব দেবে কি দেবে না। নাকি আসলে জবাবটাই ভাবছে, এমন করে কোনো কথা হয়ত তার এর আগে মনে হয় নি? অথবা, কতটা বলবে আর কতটা বলবে না, তার সূক্ষ্ম হিশেব?

এম-এল-এ নীরবে একটু হাসে, আপনি খুব জবর প্রশ্ন করলেন, আবার একটু চুপ করে থেকে বলে, হয় সত্যি জবাব দিব, না-হয় ত চুপ করি থাকব, আবার একটু চুপ করে থেকে বলে, আমিও আপনাকে জিজ্ঞাসা করতে পারি কেন এই কথা জিজ্ঞাসা করলেন। সুহাস বোঝে না এই ভাষায় প্রশ্নটা আসলে করাই হল কি না। এম-এল-এ বলে, কিন্তু সেটা ত আমি জানি, আপনারা কেন এই কথা জিজ্ঞাসা করেন জানি, আমি ঠিক উত্তরটাই দিব।

 একটু সময় নিয়ে এম-এল-এ বলে, প্রথম থিকেই বলি। বড় ঘুম পায়।

সুহাস হাসে, আমরা ত তাই শুনি, এসেম্বলিতে ভাল ঘুম হয়।

হ্যাঁ। এয়ার কনডিশন ত। আর কলকাতায় সে গরম। ঘামিটামি ঢুকিলেন আর অনং ঠাণ্ডা। শরীরটা চট করি ছাড়ি দিবার চায়। প্রথম প্রথম ত চোখ দুইখান খুলা রাখাই এক হাঙ্গামা হয়া গেইল। যখনই যাই তখনই ঘুমাই। তার পর ভাত না খাইয়া রুটি খাওয়া ধরিলাম।

এসেম্বলির জন্যে খাওয়া বদলালেন?

না বদলাই করি কী। আমরা ত ভাত খাই, জানেনই, হাইজাম্পের নাখান। অত ভাত খায়া ঐ হলে ঢুকিবার বাদে মরার মতন ঘুম আসে। এখন ঘুমটা কমি গেইসে। ইচ্ছা করিলে ঘুমাবার পারি। ইচ্ছা করিলে জাগি থাকবার পারি। কিন্তু মাথাধরাশান মোর এ্যালায়ও সারে নাই।

মাথা ধরে?

হ্যাঁ।

বক্তৃতায়?

 না। ঐ এয়ার কনডিশনে। যখন বাহিরে আসি কেমন গা গোলায় আর মাথা ধরে আর বুকটা ঠাণ্ডা লাগে।

তা হলে যান কেন? আপনাকে ত আর অত ঘন-ঘন বলতে হয় না!

আমাকে বলতে হয় না কিন্তু আমাদের সব প্রফেসর কমরেডরা আছে, উকিল কমরেডরা আছে। ভাল বলে। ইউনিয়নের নেতারাও ভাল বলে। তাদের সব পয়েন্ট দেই, কী কেস বুঝাই, কোর্টের মতন আর কী!

কোর্টের মতন?

ঐ আর-কি। আপনি আমি কি আর কোর্টে গিয়া সওয়াল করতে পারি? তার জন্য উকিল-মোক্তার। লাগে। কালা কোর্ট লাগে। ওরা সব কোর্টের আইন জানে। তেমনি এসেম্বলিরও নিয়ম আছে সব। কখন কোনটা বলা যায়। বললে ঠিকমত লাগবে। কখন কোন কথাটা তুলতে হয়। সেই সব যারা জানে তারাই বলা-কওয়া করে।

আপনিও তো উকিল। মেম্বার

জুনিয়র জুনিয়র বলে এম-এল-এ হো হো করে হেসে উঠে যোগ করে, আপনি আমার ভোটার না ত তাই বলি দিলাম। ভোটারকে বলি আমি না গেলে ত এসেম্বলি অচল বলে এম-এল-এ আরো হাসে। সুহাসও তার সঙ্গে যোগ দেয়। তারপর জিজ্ঞাসা করে, তাহলে যান কেন ওখানে?

এইটা আপনারা কী বলেন? এম-এল-এ হাসি কমাতে কমাতে বলে, পার্টি করি মানে তো ক্ষমতা চাই। এসেম্বলিতে যে-পার্টির মেম্বার বেশি সেই পার্টি ক্ষমতায় আসে। আমরাও ক্ষমতায় আছি। পাটি করিবেন কিন্তু ক্ষমতা নিবেন না এ ক্যানং করি হবে? বিয়া বসিবেন কিন্তু বউয়ের সঙ্গে শুবেন না–এ কি হয়? সে ত হিজড়ারাও কবার পারে–গর্ভ ধরে শুয়াররা আর এক মানষিই পারে হিজড়া হবার। এম-এল-এর হাসি উত্তাল হয়ে ওঠে। সুহাসকে, যেন পরাজিতের মত স্মিত থাকতে হয়।

.

০৪৪.

 এম-এল-এর চা খাওয়া

এম-এল-এ-র সঙ্গে যে-দলটা এসেছিল তার কেউ-কেউ চায়ের দোকানে গেছে আর কেউ-কেউ সিঁড়ির ওপর হেলান দিয়ে বসে। প্রিয়নাথের লণ্ঠনে এত কালি পড়েছে সেটার আলোতে আর-কিছু দেখা যায় না, শুধু সেটাকেই দেখা যায়। কিন্তু ক্রান্তি হাটের মত জায়গার একটা আস্ত এম-এল-এ এরকম অন্ধকারে একটা বারান্দায় বসে থাকবে-এটা ত খুব স্বাভাবিক ব্যাপার নয়। পরন্তু এম-এল-এ আজ দুপুরেই সার্ভে ক্যাম্প দেখে, সেখানে সকলের সামনে একটা বক্তৃতা দিয়ে, ক্রান্তি হাট দিয়ে, আপলাদ ফরেস্ট দিয়ে, সেই ফুলবাড়ি বস্তি চলে গিয়েছিল। আবার, সন্ধ্যাবেলায় ফিরে এসেছে। সঙ্গে ফুলবাড়ির লোকজন। লোকজন অবিশ্যি এম-এল-এর সঙ্গে সব সময়ই থাকে। কিন্তু দুপুরে ক্রান্তি হাট থেকে গিয়ে, আবার সন্ধ্যাতেই ক্রান্তি হাটে ফিরে আসা, এটা খুব সাধারণ ব্যাপার নয়। এম-এল-এরা সব সময় ফোঁড়াখুঁড়ি করে চলে। এদিক দিয়ে ঢুকে ওদিক দিয়ে বেরয়। এই বীরেনবাবু এম-এল-এ ফুলবাড়ি থেকে মানাবাড়ি-ওদলাবাড়ি দিয়ে বেরলে টুরে তার ঐ—-জায়গাটাও দেখা হয়ে যেত, লোকজনের সঙ্গে কথাবার্তা হতে পারত। তা না করে যখন সে ফিরে এসেছে তখন ঘটনা খুব পাকিয়ে উঠেছে, নিশ্চয়। এসে, আবার বারান্দায় বসে আছে? এম-এল-এ কখনো এক জায়গায় বসে থাকে না, মিটিং ছাড়া। এম-এল-এ মানেই চলছে–হয় হেঁটে, নয় গাড়িতে, না-হয় প্লেনে, না-হয় ট্রেনে। মিটিং ছাড়া এম-এল-এ একা-একা বসে আছে, মানে, ঘটনাটাও বসে পড়ার মত।

এই রকম একটা ঘটনা ক্রান্তি হাটেই ঘটে যাবে, আজ সন্ধ্যাবেলায়, এর জন্য কেউ তৈরি ছিল না। এম-এল-এ কাউকে খবর দেয় নি। যাবার সময় বলেও যায় নি, ফিরে আসবে। সোজা হলকা ক্যাম্পে গিয়ে বারান্দায় বসেছে, অন্ধকারে! আর, এখানকার লোকজনকে সে-খবরটা শুনতে হয়, ফুলবাড়ি বস্তির যারা এম-এল-এর সঙ্গে এসেছে, চায়ের দোকানে তাদের কারো কারো কথা থেকে। হাটবার ছাড়া ক্রান্তি হাটের এই চায়ের দোকানে এতগুলো অচেনা মুখের লোক যদি একসঙ্গে বসে চা খায়, তা হলে তাদের কথাবার্তায় কান পাততেই হয়, আর তাতেই খবরটা জানা যায়। তখন তাদের সরাসরি জিজ্ঞাসাও করা যায়–কেন এসেছে, কোথায় আছে, কী ব্যাপার। ফুলবাড়ির ফুলঝোরার ওপরে যে ক্যালভার্টটা তৈরি হচ্ছিল, তাই নিয়ে গোলমাল। এম-এল-এ নাকি রেলিংটাতে এক লাথি মেরেছে আর রেলিংটা ভেঙে গেছে। ইনজিনিয়ারকে ডাকতে মালবাজারে তোক গেছে। ইঞ্জিনিয়ারকে এখানে ধরে নিয়ে আসবে।

দোকানপাতিতে যারা বসে ছিল, তারা ত হাট-কমিটির ঘরের দিকে, এখন হলকা ক্যাম্পের দিকে, হাঁটা দেয়ই, এম-এল-এর পার্টির লোকদের খবর দেয়ার জন্যেও কেউ-কেউ, ছোটে, আর কেউ-কেউ যায় তাদের দেউনিয়াদের জানাতে। গেরিমাটি রঙের জামাপরা ভদ্রলোক সিঁড়ি বেয়ে উঠে মাঝখানে দাঁড়িয়ে পড়ে বলেন, এইঠে কখন আসি বসিছ?

এই তো অ্যালায় আইচচু।

 ফুলবাড়িঠে?

হয়।

ঐঠে কি লাথি দিয়া ব্রিজ ভাঙি দিছ!

না-হয়, না-হয়, বলে এম-এল-এ হাসে।

 ত চলো কেনে, ঘরতে চলল, হাত মুখ ধোও, তার বাদে আসি বসিও, এইঠে কি মিটিং দিবেন আজি?

না-হয়, না-হয় মিটিং দিম কেনে?

কায় যে কহিল মালবাজারঠে ইনজিনিয়ার আসিবে।

আসিবে। মোরঠে কাথা আছে।

রাস্তা থেকে একটা দল মাঠে নামে। তাদের পেছনে একটা খুব চড়া আলো ঝুলিয়ে কেউ আসে। আচমকা ভাবটা কেটে গেলেই বোঝা যায়, হ্যাজাক। মাঠের লোকজনের লম্বা-লম্বা ছায়া বারান্দার আর ঘরের দেয়ালের আলোকে অন্ধকার দিয়ে ফালাফালা করতে করতে ক্রমেই ওপরে উঠে যায়। সেই লোজন, আর তাদের পেছনে একজন একটা টিনের থালার মধ্যে কয়েক কাপ চা আর একটা ডিশে মিষ্টি আর সিঙাড়া নিয়ে, এসে দাঁড়ায়। যার হাতে হ্যাজাকটা ছিল সে পেছন থেকে সামনে এসে বারান্দার ওপর আলোটা রাখায় লোকজনের খাড়া ছায়া বারান্দার দেয়াল থেকে বারান্দা গড়িয়ে মাঠে লম্বা হয়ে যায়। হ্যাজাকের পাশেই চা-মিষ্টির থালাটা নামিয়ে রেখে খালি গায়ের ছেলেটি বুড়ো আঙুলে ভর দিয়ে গলা বাড়িয়ে বলে, ঐ দোকানঠে পাঠাই দিছে, এততি 

সেই গেরিমাটি-জামা ভদ্রলোক এতক্ষণে বারান্দায় উঠে এসে মিষ্টির ডিশটা তুলে এম-এল-এর সামনে ধরে বলে, ন্যাও; খ্যাও কেনে। একটা সিঙাড়া তুলতে-তুলতে এম-এল-এ সুহাসের দিকে আঙুল দেখিয়ে বলে, সাহেবকে দেন।

ভদ্রলোক সুহাসের সামনে নিয়ে যায়। সুহাস একটা ছোট মিষ্টি তুলে নেয়। ভদ্রলোক আবার এম-এল-এর সামনে ধরে বলেন, তুমি খাও ত বীরেন, আত্তিরে রাত্রিতে) এইঠে থাকিবেন ত?

আরে না-হয়, মোক কালি জলপাইগুড়ি যাবা লাগিবে, মিটিং আছে, বলে, এম-এল-এ একটা মিষ্টি তুলে মুখে ফেলে আঙুলটা পায়ে মুছে বলে, মুই আর খাম না, তারপর মিষ্টির ঢোকটা গিলে ফেলে বলে ওঠে, আরে আবার চা-টা কোথায়?

গেরিমাটির জামাপরা ভদ্রলোক মিষ্টির ডিশটা থেকে একটা করে মিষ্টি ভাগ করে করে বিলি করতে করতে বলে, দিছু খাড়াও, তারপর তাড়াতাড়ি এসে ঐ থালাটার ওপর ডিশটা নামিয়ে রেখে, থালায় উপচনো চায়ের জলে আঙুলটা ধুয়ে, একটা কাপ তুলে এনে এম-এল-একে দেয়। এম-এল-এ চায়ের কাপে চুমুকটা দিয়েই বলে, এ-হে, এ তো ঠাণ্ডা হয়া গেইসে–, বলে এক চুমুকে কাপটা শেষ, করে দেয়।

সুহাস একটু আড়ালে চলে গিয়েছিল তার নিজের ঘরের দিকে। এম-এল-এ যে চা-টা মুখে দিয়ে কথাটা বলে ওঠে এতে যেন তাদের দুজনের মধ্যে অভিজ্ঞতার একটা বিনিময় ঘটে যায়, নাগরিক অভিজ্ঞতার। সে জিজ্ঞাসা করে, কী, চা খাবেন নাকি আর-এক কাপ?

সুহাসের কথার ভেতরই ইঙ্গিত ছিল–সে বানানোর কথাই বলছে, দোকান থেকে আনার কথা নয়।

 আপনি খাবেন? তা হলে আমিও খাই, বলে এম-এল-এ হাসে।

সুহাস তার ঘরের কাছ থেকে এগিয়ে এসে প্রিয়নাথের ঘরে ঢোকে। প্রিয়নাথ তখন রান্না চাপিয়ে দিয়েছে, প্রিয়নাথবাবু, আপনার হাতের চা ত আমাদের ভাল লেগে গেছে।

বসেন স্যার, আমি দিচ্ছি করে, প্রিয়নাথ তরকারি কুটতে কুটতে বলে।

 আপনি একা বঁধছেন?

ওঁরা এসে যাবেন স্যার। ও তো আমাদের ঠিক হয়ে গেছে স্যার।

 সুহাস বেরিয়ে আবার তার ঘরের সামনে এসে চেয়ারটিতে বসে পড়ে।

তার মানে, এই এম-এল-এর রুচি-স্বভাবে কলকাতার ছোঁয়া লেগে গেছে? এই অঞ্চলের ভেতর প্রোথিত এই মানুষটির স্বাদে ও অভ্যাসে নাগরিকতা এসে যাচ্ছে? কলকাতা ও নাগরিকতার সেই টানেই কি লোকটি ফুলবাড়ি বস্তি থেকে এসে তার এখানে বসেছে, একই অভিজ্ঞতা বিনিময়ের লোভে?

এই একটু আড়াল থেকে সুহাস মনের এই প্রশ্নগুলি নিয়ে এম-এল-এর দিকে তাকায়। এম-এল-এ তখন তার পা নাচিয়ে-নাচিয়ে হাসতে-হাসতে সামনে মাঠের ভেতর ও পেছনে সিঁড়িতে দাঁড়ানো লোকগুলোর সঙ্গে মিশে যাচ্ছে।

.

০৪৫.

 এম-এল-এ ও গয়ানাথ

আলো ফেলে রাস্তায় একটা গাড়ি এসে দাঁড়ায়। কিন্তু আওয়াজ করতেই বোঝা যায় মোটর সাইকেল। মোটর সাইকেল চলার সময় যত আওয়াজ করে, দাঁড়ালে আওয়াজ হয় তার চাইতে বেশি। কয়েকবার হেঁচকি তুলে মোটরসাইকেলটা আবার চলতে শুরু করে। আস্তে-আস্তে চলছে বলে হ্যান্ডেলটা নড়ে আর আলোটা ব্যায়ের জঙ্গল আর ডাইনের বাড়িঘরের গায়ে আছড়ায়–যেন কিছু খোঁজাখুজি চলছে। আলোটা মাঠের ভেতর কিছু চলে আসে, আবার ঘুরে যায়। মোটর সাইকেলের আওয়াজটাও # বাড়ে-কমে। তারপরই মোটর সাইকেলের আলোটা এই বারান্দার দিকে পড়ে আর আরো আওয়াজ তুলে এদিকে ছুটে আসে। হেডলাইটের আলো বারান্দা টপকে ঘরের ভেতর চলে যায়, হ্যাজাকের আলোটা মুছে দিয়ে। কিন্তু মোটর সাইকেলটা হঠাৎ থেমে যায়। আওয়াজ বাড়ে, আলো বাড়ে কিন্তু মোটর সাইকেলটা আর এগয় না। সিঁড়ির ওপর থেকে কেউ বলে, ফাঁসি গেইছে। এম-এল-এ বলে ওঠে, দেখেন ত কায়, ঠেলি দিয়া আসেন কনেক। দুজন লাফিয়ে নেমে মোটর সাইকেলের আলোটার দিকেই ছুটে যায়–বলদের গাড়ি কাদোত গাড়ি গেইছে, ঠেলো এ্যালায়। আলোটা একটা আওয়াজ তুলে নিবে যায়।

তখন বারান্দায় হ্যাজাকের আলোতে দেখা যায় মোটর সাইকেলের ওপর একজন বসে আছে, আর-একজন, বেঁটেমত, সামনে দাঁড়িয়ে চিৎকার শুরু করেছে। গয়ানাথ জোতদারকে চিনতে এইটুকু আলোরও দরকার ছিল না, শুধু গলার আওয়াজ শুনলেই হত। সিঁড়ির ওপর থেকে কেউ বলে, ব্যাস, ভটভটি জোতদার আসি গেইল।

তার মানে, এখন এই ভিড়ে শুধু ফুলবাড়ি বস্তির লোকজনই নেই, এখানকার লোকজনও কেউ-কেউ আছে–যারা গয়ানাথকে সকালে ভটভটিয়াতে চড়ে সার্ভের জায়গায় যেতে দেখেছে। গয়ানাথের এই নামকরণ এর আগে কখনো হয় নি। জামাইয়ের ভটভটিয়াতে সে সাধারণত ওঠে না, এমন কি জলপাইগুড়ি যাওয়ার জন্যে বাস ধরতেও না। কিন্তু সকালে সার্ভে পার্টি পৌঁছে গেছে দেখে চড়তে হয়েছিল। আর, এখন এই সন্ধ্যায় আসিন্দিরই গিয়ে খবর দিল এম-এল-এ আবার এসে বসে আছে। একই দিনে দুই-দুইবার ভটভটিয়া চড়ে একই জনসমাবেশে নামলে ত একটা নামকরণ হয়েই যায়। কিন্তু নামটা টিকবে কি না তা নির্ভর করবে ভটভটিয়া সম্পর্কে গয়ানাথের পরবর্তী ব্যবহারে।

গয়ানাথ তখন তার কাপড় এক হাতে তুলে, আর-এক হাত নেড়ে আসিন্দিরকে শাসাচ্ছে, শালো, ভটভটিয়াখান তোর পাছত ঢুকাই দিম। মাঠে চষিবার ধইচছে এই এক দো-চকিয়া। কহিছু মোক আস্তার [রাস্তার ওপর নামি দে, নামি দে। না, চলো কেনে, চলো কেনে, এ্যালায় তো যাছি তর শ্বশুরবাড়ি। শালো, তর কোন জারুয়া [জারজ] বাপ মাঠের ভিতর দিয়া হাইওয়ে বানাই থছে? শালো ডাঙ্গুয়া [প্রৌঢ়া বিধবার যুবক সঙ্গী] ঢেমনা। সিঁড়ির ওপর ও মাঠে যারা দাঁড়িয়ে ও বসে ছিল তারা। হাততালি দিয়ে ওঠে।

এম-এল-এ চিৎকার করে ডাকে, হে গয়ানাথ কাকা, চলি আসেন এইঠে, ও ঠেলি দিবে উমরায়, চলি আসেন।

সেই ডাকে গয়ানাথ এদিকে আসতে শুরু করে বটে কিন্তু দুপা এসেই ঘুরে দাঁড়িয়ে আবার চিৎকার করে ওঠে, শালো ঢেমনা, তারপর হন হন করে এগিয়ে আসে, যেন এইটুকু গালগালই বাকি ছিল। গয়ানাথ কাছাকাছি আসতেই কেউ বলে, আসিন্দিরের পাছাখান কত ফাঁক হে, একখান আস্ত ভটভটি ঢুকি যাবে?

গয়ানাথ সেদিকে তাকিয়ে আবার চিৎকার করে, তর বাপের পাছত ঢুকিবে–

এম-এল-এ চিৎকার করে বলে, হে কাকা, ক্যানং বুদ্ধি তোমার, জোয়াইঅক [জামাই] কছেন অ্যালাং-প্যালাং?

গয়ানাথ তখন সিঁড়িতে পা দিয়েছে। চিৎকার করে ওঠে, কায় কহিছে ঐ ডেঙ্গুয়া মোর জোয়াই? মুই অক তালাক দিম।

পেছনে এবার হাততালির সঙ্গে চিৎকারও। এম-এল-এ হো হো হাসে। গয়ানাথ গিয়ে বারান্দায় ওঠে। আর তখনই মোটর সাইকেলের আলোটা সগর্জন জ্বলে হু–স করে বারান্দার সামনে চলে এসে আওয়াজটা দুই-চার বার বাড়িয়ে কমিয়ে হো-হো করে হেসে, বাইকটা ঘুরিয়ে, আসিন্দির রাস্তার দিকে চলে যায়। আসিন্দিরের ওপর রাগের ঝোঁকে গয়ানাথ হন হন করে বারান্দার ওপর উঠে এসেছিল। এখন বুঝতে পারছে বারান্দায় তার বসার বা দাঁড়ানোর জায়গা নেই। গয়ানাথ সামনের অফিস বরেও ঢুকতে পারে না, মেঝের ওপর ধপাস করে বসে পড়তেও পারে না। পারে, কিন্তু আর-কেউ ত তেমন বসে নেই। তার চাইতে মাঠে বা রাস্তায় ঘোরাঘুরি করাটাই ভাল ছিল–এম-এল-একে একবার মুখ দেখিয়ে। কিন্তু এম-এল-এ ফিরে এসে এই হা ক্যাম্পেই বসে আছে কেন, সেটা তার জানা দরকার। তখন গয়ানাথের বাঘারুর কথা মনে পড়ে। একবার তাকায়, তাকে কোথাও দেখা যায় কি না। তা হলে ওর সঙ্গে কথা বলে বুঝতে পারত ফুলবাড়ি বস্তিতে কী হয়েছে। কিন্তু বাঘারুকে কোথাও দেখা যায় না। বাঘারুর কথা মনে হতেই গয়ানাথ ভাবে যে তার ত হকই আছে এম-এল-এর, ভালমন্দের খবর নেয়ার, কারণ তার লোকই ত সঙ্গে ছিল নদী পার করে দিতে। গয়ানাথ দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়েই জিজ্ঞাসা করে, কুননা অসুবিধা হয় নাই ত তোমার?

কেনে? কী অসুবিধা? এম-এল-এ জিজ্ঞাসা করে।

এই, ফুলবাড়ি গেলেন, আবার চলি আসিলেন?

ই আর অসুবিধা কী। ঐ ইনজিনিয়ার খবর দিবার গিসে। এইঠে বসিবার সুবিধা, তাই বসি আছি।

উমরায় ঠিক মতন পার করি দিছে ত নদীখান?

কায়?

আরে, ঐ বলদটা, তোমার নগত যায় গিছে ফুলবাড়ি যাওয়ার বাদে।

হয়, হয়, এম-এল-এর মনে পড়ে যায়, বাঘারু। কী বাঘারু? এম-এল-এ মনে আনতে চেষ্টা করে।

গয়ানাথ জিজ্ঞাসা করে, হয় হয়। বাঘারু। ঐটা ফিরে নাই তোমার নগত?

তা ত কহিবার পার না। ফিরিবার পারে। ফিরিবার টাইমে ত নৌকা আছিল। আহা কহেন না কাকা–

কী?

তোমার ঐ মানষিটার নাম, কী, বামারু বর্মন ত?

 বর্মন? অর বাপা বর্মন!

আরে, উমরার একখান পুরা নাম, নাম্বা নাম আছে না?

বাঘারুর একখান নাম আছে? তোমাক কহিছে?

 কহিছে ত কত কথা। উমরাক তো বাঘ ধরিছিল?

 হয়। তোমার তানে কথা কহিছে ঐটা, এত্ত?

সে কি একখান কাথা? কত কাথা? অর জন্মকথা। অর মাই-এর কথা। মানষিটা বড় ভাল হে তোমার কাকা

বলদ।

উমরাক একখান আধিয়ারি দিছেন?

 কাক?

 উমরাক?

 বাঘারুক?

হয়।

 বাঘারুক আধিয়ারি?

হয়। এ্যানং কামের মানষিটা–

উ কহিছে তোমাক? আধিয়ারি দিবার কাথা?

না-হয়, না-হয়। মুই কহিছু।

 উ তো হালের আগত থাকে। হালের পাছত বান্ধিলে উল্টা চাষ হবা ধরিবে।

 কী কহিছেন? চারি পুহে এ্যাত জমি তুমার আর ঐ মানষিটাক একখান আধিয়ারি দিবার না পারেন?

আরে তোমরালা তো মোকই একখান আধিয়ার বানাবার ধইচছেন। মুই আর কাক আধিয়ারি দিম? খাড়াও কেনে। ঘরতে চলল। হাতমুখ ধোও। তার বাদে এইঠে আসি মিটিং দাও। আসিন্দিরক ডাকি, ভটভটিখান নি আসুক। গয়নাথ, হয় কথাটা এড়াতে, নয়, সামাজিকতার তাড়ায় বারান্দা থেকে নেমে রাস্তার দিকে হনহন করে হাঁটে। এম-এল-এ পেছন থেকে চেঁচায়, হে কাকা শুনেন, হে–

.

০৪৬.

এম-এল-এর লাথি

গাড়ির আওয়াজটা পাওয়া গিয়েছিল আগেই। সেটা ক্রমেই বাড়তে থাকে। তার পর, উত্তরে, কাঁঠালগুড়ির মোড়ে যে এদিকে ঘুরল সেটাও বোঝা যায় আওয়াজ থেকেই। তার পর, আলোটা রাস্তায় পড়ে। আর, সেই আলোটা আর আওয়াজটা বাড়তে থাকে। এই বারান্দায় বসে, এই মাঠটা পার হয়ে রাস্তায় গাড়িটাকে আসতে দেখা, যেন নদীর বান-আসা দেখার মত। কেউ একজন বলেও বসে, আসি গেইছে।

গাড়িটা একটু এগিয়ে আড়াল হয়, যা হওয়ার কথা। ঐ মিষ্টির দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে নিশ্চয়ই জিজ্ঞাসা করে নিচ্ছে, যা করার কথা। এম-এল-এ শুধু বলে দিয়েছিল, ক্রান্তি হাটের হলকা ক্যাম্প।

গাড়িটাতে আওয়াজ ওঠাপড়া শুরু হয়। তারপরই আলোটাকে দেখা যায় ফাঁক-ফোকর দিয়ে হাটখোলায় পড়ছে আর সরে যাচ্ছে। শেষে এই বারান্দাটাকেও একটু ছুঁয়ে ঘুরে যায়। এইবার গাড়িটা একটা জোর আওয়াজ তুলে মাঠের দিকে ঘোরে। হেডলাইটের আলো এসে বারান্দায় ঝাঁপিয়ে পড়ে।

যে-ভাবে গাড়িটা মাঠ বরাবর মোড় নিয়েছিল তাতে হু-স করে মাঠ পেরিয়ে বারান্দার সামনে এসে দাঁড়াবার কথা। তার বদলে ব্রেক কষে গো-গো করতে থাকে আর মাঠ বরাবর আলোটা শুধু পড়ে থাকে।

গাড়ি থেকে একজন, দুজন, তিনজন, চারজন, পাঁচজন নামে। তারা মাঠটা পার হয়ে সোজা হাঁটতে শুরু করে। গাড়িটা রাস্তার ওপর উঠে দাঁড়ানোর জন্যে পেছুতে গেলে, এদের ভেতর দুজন হাত তুলে না করে। বারান্দা থেকে সেই হাত-তোলা নিষেধটা ছায়ার মত দেখায়। আলোতে মাঠের কাদা-জল। দেখে-দেখে এরা সাবধানে এই ঘরবারান্দার দিকে এগয়।

এরকম দেখে-দেখে আসে বলেই, সময় নেয়। বা, এদের আসাটা এরকম দেখতে হচ্ছে বলেই মনে হয় সময় লাগছে। তাছাড়া পঁচজন কারা কারা সেটাও এই বারান্দা থেকে সবাই বুঝে নিতে চায়। বারান্দার ওপরে ত এক কোনায় এম-এল-এ চেয়ারে, আর-এক কোনায় সুহাস চেয়ারে। প্রিয়নাথও দরজায় আসে। সিঁড়িতে যারা ছিল তারা উঠে দাঁড়িয়েছে। আর, ঐ পাঁচজনের পেছনে-পেছনে আরো অনেকে ওদিককার দোকানগুলো থেকে বেরিয়ে চলে আসছে। এতক্ষণ সবাই নানা জায়গায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে অপেক্ষা করছিল, এখন জড়ো হয়ে যাচ্ছে।

ঐ পাঁচজনের দলটার ভেতর থেকে কেউ একজন চিৎকার করে ওঠে, হে-ই বীরেনদা, তুমি কি আর মিটিং ডাকার জায়গা পাও নাই নাকি, এই কাদা মাঠ? আরে, মণিদা আসছেন নাকি? এম-এল-এ তাড়াতাড়ি পা নামিয়ে সোজা হয়, তার পর উঠে বারান্দার কোনায় গিয়ে দাঁড়ায়। এবার এম-এল-এই চিৎকার করে ওঠে, আরে মণিদা, আপনি আবার কোথা থিকে আসছেন?

বাঃ বাঃ, এবার পাঁচজনের দলটা একেবারে কাছে চলে এসেছে, সিঁড়ির কাছের লোকজন সরে গিয়ে পথ করে দিচ্ছে, যাতে দলটা বারান্দার উঠে যেতে পারে, তুমি গিয়ে লাথি মেরে সব ক্যালভার্ট ভাঙতে পারো আর আমি এইটুকু আসতে পারি না?

এম-এল-এ হে-হে করে হেসে ওঠে, কিন্তু সে-হাসির আওয়াজটা একটু অন্যরকম শোনায়। তাকে ঘুরে দাঁড়িয়ে প্রিয়নাথকে বলতে হয়, একটা বিছানা-মাদুর-টাদুর কিছু পাওয়া যাবে, এখানে বসার জন্যে? প্রিয়নাথ ঘরের ভেতর ঢুকে যায়। সুহাসকে তার ঘরের সামনে চেয়ারটা ছেড়ে দাঁড়াতেই হয়। সে একবার ভাবে, চেয়ারটা এগিয়ে দিয়ে ঘরে ঢুকে যাবে। এই মিটিঙের সঙ্গে তার কোনো সম্পর্কই নেই। তার থাকাও বোধহয় উচিত নয়।

প্রিয়নাথ ঘরের ভেতর থেকে কয়েকটা চট বের করে আনে। সেগুলো একা-একা বিছিয়ে দিতে চেষ্টা করলে এম-এল-এ সিঁড়ির লোকজনের দিকে তাকিয়ে বলে, এই ধরেন কেনে আপনারা। দুজন তাড়াতাড়ি উঠে এসে চটটা ধরে। গাড়িটা এতক্ষণে রাস্তার ওপর ওঠার জন্যে পেছুতে শুরু করলে মাঠটা ও বারান্দাটা একটু অন্ধকার ঠেকে। হ্যাজাকটাতে একজন এসে পাম্প দিতে শুরু করে।

এম-এল-এ কি ভেবেছিল, সে চেয়ারে বসে থাকবে আর ইনজিনিয়ার-অফিসাররা বসার জায়গা না পেয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে? তা না-হলে বারান্দার ওপরে একটা বসার ব্যবস্থার জন্যে সে ত অনেক আগেই বলতে পারত।

মণিই প্রথমে বারান্দায় ওঠে–আমি তোমার জন্যে মালবাজারে বসে আছি, আর তুমি এখানে খুব মিটিং করছ, মণি পকেট থেকে সিগারেট-দেশলাই বের করে।

আরে আমি ভাবলাম ত ওদলাবাড়িতে সন্ধ্যাবেলায় একটু দেখাশোনা করি রাত্রিতে মালবাজারে চলি যাব। আপনার ত আজকে মালবাজারেই আসার কথা–কাল জলপাইগুড়ি যেতে হবে না?

সেই জন্যেই ত এলাম। এসে শুনি তুমি নাই।

 আরে ফুলবাড়ির ঐ জায়গাটা নিয়ে গোলমাল চলিছেই। আমার ত মাস-দুই-তিন আসাই হবে না, ভাবলাম গোলমালটা আজিকৈ চুকাই দেই।

তা চুকাও। কিন্তু এর পর ত তোমাকে সার্কাসের দলে নিয়ে নেবে–তুমি লাথি দিয়ে ক্যালভার্টের রেলিং ভেঙে দিলে?

সিঁড়ির কাছের ভিড় থেকে কেউ একজন চিৎকার করে বলে, সিমেন্টের বদলে বালি দিলে ত পোলাপানও লাথথি দিয়্যা ভাঙবার পারে। তা হালেই বোঝেন কী দিয়া ব্রিজ বানাইছে?

মণি সিগারেটে টান দিতে দিতে সিঁড়ির ভিড়ের কথাটা শোনে। তার পর আস্তে করে এম-এল-একে জিজ্ঞাসা করে, একটু সময় দিয়ে, কিন্তু সবাইকে শুনিয়ে, আমি ত ভাবলাম, তোমার পা ভেঙেছে তাই এখানে পড়ে আছ, নিয়ে যেতে হবে। তা এঁরা বলছেন, না, উনি ঠিক আছেন–ক্যালভার্ট ভেঙেছে।

এম-এল-একে এবার হেসে উঠতেই হয়। বলতে হয়, আমার কথা ছাড়ি দেন। ফুলবাড়ির মানষিদের সঙ্গে ত ইনজিনিয়ারদের দেখা হওয়ার দরকার।

ইনজিনিয়ারদের ত অফিস আছে।

সে অফিস-টফিস হইয়া গিছে মণিদা, উনি ফুলবাড়ির লোক শুইনলেই কয়্যা দ্যান দ্যাখা হব না, সিঁড়ির ওপর থেকে একজন চেঁচায়।

সে বলবেন, ওঁরা ত এসেছেন, এত চেঁচাচ্ছেন কেন? মণি সিঁড়ির দিকে দু-পা গিয়ে একটু কড়া গলায় বলে।

এই চুপ যা চুপ যা মিটিং শুরু হোক।

 না, আমিও ত কথার কথাই কইছি।

দেখি, দেখি, বলে সেই গেরিমাটি রঙের জামাপরা ভদ্রলোক ঢোকেন, পেছনে একজন মাথায় শতরঞ্চি। উনি বারান্দায় উঠে দাঁড়িয়ে লোকটিকে বলেন, টান-টান করি পাতি দেন। এতজন উঠতে থাকার ফলে সিঁড়ির মুখটাতে একটা ভিড় হয়। হাট কমিটির মেম্বার ওপরে ওঠেন। মণি নেমে আসে এম-এল-এ নেমে আসে। আর-একজন সিঁড়ির দুই ধাপ উঠে বলে, নমস্কার, মণিবাবু।

আরে গয়ানাথবাবু, আপনিও এসে গেছেন?

 আসিবার নাগে ত, কহেন? আমাদের ক্রান্তি হাটের আজি কত সৌভাগ্য।

কী হল, এত সৌভাগ্য?

এই যে আপনারা সব মিটিং করিবার সেন্টার বানিলেন, সৌভাগ্য না? বলে গয়ানাথ ইনজিনিয়ারদেরও দেখায়। তারা একটু দূরে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে। তাদের নিয়ে কিছু বলা হল দেখে একজন একটু হেসে জিজ্ঞাসা করে, কিছু বললেন?

মণি সিগারেট তুলেই না জানায়।

গয়ানাথ মণিকে বলে, হেই মণিবাবু, শুনেন একটু। সিঁড়ি থেকে নেমে একটু সরে দাঁড়ালে গয়ানাথ জিজ্ঞাসা করে, আতিত [রাত্রিতে] কতজন থাকিবেন? পাকাবার শুরু করি?

আরে না, না, আমরা এখনই যাব, এখনই, ও সব করবেন না।

.

০৪৭.

ভাষণ ও ভাবন

হাট কমিটির এই শতরঞ্চিটা এত বড়, সুহাসের দরজা পর্যন্ত প্রায় গেছে। চওড়ার দিকটা মুড়ে দিতে হয়েছে। সুহাসের দরজার কাছে, শতরঞ্চির মাথায় দুটো চেয়ার পাশাপাশি সাজানো। হ্যাজাকটা চেয়ার দুটোর কাছাকাছি রাখা। হাট কমিটির মেম্বার ভদ্রলোক সিঁড়ির মাথায় দাঁড়িয়ে বলে, মণিবাবু, বসেন এইঠে। আগত কহি রাখিলে ত টেবিল-চেয়ার আনা যাইত কিন্তু এ্যালায় ত ইশকুল বন্ধ আর মাস্টার ত থাকে সেই মানাবাড়ি

আরে না না, টেবিল চেয়ার লাগবে কিসে, এ ত আপনারা জনসভার ব্যবস্থা করছেন।

আমাদের আর কতক্ষণের মিটিং হবে? কী? বীরেনদা?

 হ্যাঁ। এ ত মিটিং না হয়, কথাবার্তা কহিবার জন্যে, বলতে-বলতে এম-এল-এ বারান্দায় ওঠে। জুতো খুলে হাতে নিয়ে একেবারে হ্যাজাকের সামনে গিয়ে বসে। আর এম-এল-এর পেছনে-পেছনে সব্বাই বারান্দায় উঠতে শুরু করে। যে যার, জুতো খুলে হাতে নিচ্ছে। একটা দল গিয়ে হ্যাজাকের সামনে এম-এল-এর মুখোমুখি, কিন্তু বারান্দার কোনার দিকে বসে। সবাই বসে পড়ার পর দেখা যায় জায়গার তুলনায় তোক অত বেশি নেই। এম-এল-এ ডাকে, মণিদা আসেন, আর দেরি করা যায় না।

মণি স্যান্ডেলটা বারান্দার ওপরে খুলে রেখে আসে। পেছন থেকে ইনজিনিয়ারদের একজন বলে, আপনারা দরকার হলে ডাকবেন, আমরা এখানে আছি।

কেন। কথা হবে আপনাদের সঙ্গে আর আপনারা ওখানে থাকবেন কেন, এম-এল-এ ইনজিনিয়ারদের দিকে তাকিয়ে বলে, যোগ করে, মুখোন পাছত করি করি কথা কহিবার নাগিবে?

ইনজিনিয়াররা এবার একে-একে উঠতে শুরু করে। তাদের প্রথম জনের পায়ে ফিতেওয়ালা জুতো বলে নিচু হয়ে খুলতে হয়। একটু সময় নেয়। পেছনের দু-জন দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়েই পা তুলে জুতোর বেল্ট, খুলে নেয়। আর-একজনের পায়ে স্যান্ডেল। মণিবাবুর জুতোর পাশে জুতোগুলো খুলে রেখে ওরা একটু এগিয়ে, সকলের পেছনে দেওয়াল ঘেঁষে বসে।

হঠাৎ গয়ানাথ সিঁড়ি ভেঙে বারান্দায় উঠে আসে, তার পর সরু গলাটা তুলে জিজ্ঞাসা করে, মণিবাবু ও আমাদের এম-এল-এ মেম্বার, আমার একটা প্রশ্ন ছিল। সবাই তাকালে গয়ানাথ বলতে থাকে, প্রশ্নটা হছে কি, এই মিটিংটা কি প্রাইভেট দিছেন না জনসভা দিছেন? য্যালায় প্রাইভেট মিটিং হবা ধরে, মোরা থাকিম না। কেনে। না, মোরা আপনার পার্টির মানষি না। আর যদি জনসভা দিছেন ত আমরা থাকিবার চাহি। কেনে। না মোরা জনসভার মেম্বার এবং মণিবাবু ও হামরালার এম-এল-এ মেম্বারের ভাষণ শুনিবার চাহি। কেনে–

গয়ানাথকে থামিয়ে দিয়ে মণি বলে ওঠে, কী, বীরেনদা?

এম-এল-এ গয়ানাথকে বলে, আরে বসেন না বসেন, এ ত সবার কথাই হচ্ছে, আপনি থাকিলে ত ভালই হয়। মোরা কহিবার পারিম গয়ানাথবাবুও এই মিটিঙে ছিলেন। আরে, যার ঘরত আসি বসিলাম, তিনিই নাই, এম-এল-এ দরজার দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে ডাকে, কই, আপনিও আসেন না।

সুহাস ঘরের ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে বলে, আমি আর এখানে কী—

আরে, বসুন না, বসুন, মণি ডান হাতটা ডাইনে ছড়িয়ে যেন জায়গা দেখায় ইনজিনিয়ারদেরই দিকে। সুহাস এম-এল-এর সামনে দিয়ে আবার প্রথম দলটার পাশ দিয়ে গিয়ে ইনজিনিয়ারদের কাছাকাছি দেওয়াল ঘেঁষে বসে।

গয়ানাথ আবার বলে, ঠিক আছে। আপনারা আলাপন শুরু করেন। মোর অনুমতিখান ত থাকিল। আপনাদের চায়ের ব্যবস্থা দেখি আসি, বসিম।

এম-এল-এ এমন ভাবে মুখটা তোলে যে সকলেই বোঝে এইবার সে কিছু বলবে। কিন্তু এম-এল-এ হঠাৎ পাশে তাকিয়ে ঘাড় উঁচু করে সিঁড়ির দিকটা দেখে, ঘাড় ফিরিয়ে, চেয়ারের ওপরটা দেখে, বলে ওঠে, আমার ব্রিফকেসটা? সকলেই একবার খোঁজে যেন। প্রিয়নাথ ঘরের ভেতর থেকে হাত বাড়িয়ে ব্রিফকেসটা দেয়।

ব্রিফকেসটা পাশে রেখে এম-এল-এ বলে, শুনেন, এখন কথাটা আরম্ভ হওয়া দরকার। এই কথাটা হওয়া উচিত ছিল ফুলবাড়িতে। কিন্তু সেখানে আমাদের এসিস্ট্যান্ট ইনজিনিয়ার সাহেব ছিলেন না। আর মালবাজারে তার অফিসেও আমি কথাগুলি বলতে পারতাম। কিন্তু একটা মুখোমুখি কথার দরকার ছিল। তাই আমি এইখানে আসার জন্য বলি। উনি দয়া করে আসিছেন। আমাদের জিলা কৃষক সমিতির সম্পাদক কমরেড মণি বাগচিও আসছেন। সুতরাং এখন কথাবার্তা হইতে পারে। তা হলে আমার অনুরোধ ফুলবাড়ির মানষি যারা, এইখানে আছে যারা, তাদেরই উচিত প্রথমে সব বলা। তাদের কী বলার আছে। তার বাদে আমরা ইনজিনিয়ার সাহেবের কথা শুনিব। ত কন, ফুলবাড়ির কমরেডরা, কেউ কহেন।

যে দলটা এম-এল-এর মুখোমুখি বারান্দার কোনার দিকে একসঙ্গে ছিল, তারা নড়েচড়ে বসে। সামনের একজনকে ধাক্কা দিয়ে বলে, হে-ই নকুইল্যা, তুই ক কেনে।

সে ঘাড় ঘুরিয়ে বলে, কাকা কহেন।

যাকে কাকা বলা হয় সে মাঝামাঝি বসে ছিল। সে বসে থেকে এম-এল-এর দিকে তাকিয়ে উঁচু গলায় শুরু করে, এর মধ্যি এত কওনের-শোননের কী আছে, জানি না। য্যাখন থিক্যা ঐ ফুলবাড়ির ফুলঝোরার উপর একখান ব্রিজ হইব বইল্যা ঠিক হইয়াছে, তখন থিক্যাই নানা গোলমাল লাইগ্যাই আছে। আমরা গিয়্যা খোঁজ নেই, তা কয়, কেডা কইছে ব্রিজ হব, আঁ, লোকটি একবার এম-এল-এর দিকে, একবার মণির দিকে, আর একবার মাথা ঘুরিয়ে ইনজিনিয়ারদের দিকে তাকায়। তারপর মাথা ঝাঁকিয়ে আবার জিজ্ঞাসা করে, কেডায় কইছে ব্রিজ হব, আঁ, কেডায় কইছে? নে বাবা, আমরা ত পইডল্যাম গিয়া সাত হাত জলের তলায় ত ধরেন গিয়্যা, ঐ ফুলঝোরার ব্রিজ নিয়্যাত গত ত্রিশ বচ্ছর ধইর্যাই কত কাণ্ড! আমি যখন ধরেন বিশ বছরের জুয়ান তখন খগেন দাশগুপ্ত মন্ত্রী। আর সেই কী কয়, আরে তখুন মালবাজার জেনারেল সিট, কী নাম, সেই এম-এল-এ, তারে তখুন ত কইলেই কয়, হয়্যা গ্যাল গা, এই ধর সামনের বর্ষার আগেই হয়্যা যাবে নে, একবার ত কাণ্ড।

লোকটি গল্প বলতে-বলতে একবার এম-এল-এর দিকে, একবার মণির দিকে, আর একবার ইনজিনিয়ারদের দিকে ঘাড় বারবার ঘোরাতে-ঘোরাতে নিজেই ধীরে-ধীরে ঘুরে যায়। এখন তার মুখ মণির দিকেই। মণি আর-একটা সিগারেট ধরিয়ে একটু এলিয়ে বসে আছে। মণি হেড়ে লম্বা। ফলে মনে হয় নিজেকে ভেঙেচুরে বসেছে যেন। তার মুখেচোখে বিরক্তির ভাবটা সে গোপনের চেষ্টা করে সিগারেটের ধোয়ার ছলে। লোকটি তখন বলতে শুরু করেছে, হইল কী, আমরা ত সেইবার পূর্তমন্ত্রীরে সবাই মিল্যা বলছি যে ব্রিজ নাই ত ভোট নাই। তাই শুইন্যা মন্ত্রী কয় কী, সে কী? ব্রিজ হয় নাই? আমাদের ত জানা হইয়া গেল ব্রিজ হইছে, তার টাকাপয়সা সুদ্ধ্যা দেয়ানেয়া শ্যাষ। আমরা ভাবলাম, খাইছে। মিথ্যা কইর‍্যা যদি একবার ব্রিজের টাকা বাইর হয়া থাকে, আবার কি আর হইব ব্রিজ? ব্যাস, খোঁজ-খোঁজ, কোথায় গেল ব্রিজ। অফিসাররা খুঁইজব্যার ধরল জলপাইগুড়ির অফিসের কাগজে-কই গেল ব্রিজ। মন্ত্রী খুঁইজব্যার ধইরল কইলকাত্তার কাগজে–কই গেল ব্রিজ। আর আমরা হককলে যুইজবার লাইগল্যাম এইখ্যানে, কই গেল ব্রিজ। লোকটি থামে। সে জানে এখানে হাসির জন্যে সবাই একটু সময় নেয়। সে নিজে খানিকটা হেসে সেই সময়টুকু দেয়। মণি এম-এল-এর দিকে তাকিয়ে হাতের পাতা একবার উল্টোয়। এম-এল-এর চোখ দেখে বোঝা যায় না, সে সেটা দেখল কিনা। কিন্তু গল্প যে বলছিল সে দেখে ফেলে তাড়াতাড়ি বলে ওঠে, মণিবাবু, আমি তাড়াতাড়ি কয়্যা দিচ্ছি। আচ্ছা, ছাড়ান দ্যান সেই গল্প। এখন কথাটা হইল কি–

পেছন থেকে একটি ছেলে গলাটা তুলে বলে, কাকা, মুই কম? এইবারকার কথাখান মুই কম?

 কাকা আবার সকলের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে, ক না ক্যা, আমি ত তগ কইতেই কই। আমি কথা শুরু কইরলেই সাত কইল্যানা কথা মনে আছে। আর তগ কাম হচ্ছে এই কল্যানা। ধরেন কেনে, আমাগো সময় নেতা ছিল নরেশ চক্কত্তি-পটল ঘোষ, আর এখন আমাগো মণিবাবু লিডার, তারপর কী কয়, বীরেনবাবু এম-এল-এ। এ্যাহন ত তরাই কবিক, ক।

কাকার গলার স্বরটা একটু উঁচুতে। সে টেনে-টেনে, নানা ভঙ্গিতে, স্বর তুলে নামিয়ে গল্পটা যখন বলছিল তখন কিন্তু ধীরে-ধীরে সেই গল্পের একটা আবহাওয়া তৈরি হচ্ছিল। এমন-কি, এইখানে যারা ভদ্রলোক, সুহাস আর ইনজিনিয়াররা আর প্রিয়নাথ, যদি মণিকে নাই ধরা হয়, তারাও যেন গল্পটার একটা টান বোধ করে ফেলছিল। এম-এল-এ এমন বসে ছিল যাতে মনে হয় গল্পটা সারারাত চললেও তার আপত্তি নেই, বা এখন থেমে গেলেও তার আপত্তি নেই, বা একমাত্র সে জানে কখন গল্পটা আপনি থেমে যাবে। একমাত্র মণি বাগচিই অধৈর্যে বারবার সিগারেট ধরাচ্ছিল। কিন্তু এই এলাকাটা বীরেনের। বীরেন এখানে বসে থেকে অ্যাসিস্ট্যান্ট ইনজিনিয়ারকে ডাকিয়ে এনেছে। সুতরাং কী-হবে না-হবে সেটা বীরেনই ঠিক করবে। পরে নিশ্চয়ই বীরেনকে সে বলবে, এইভাবে যদি অফিসারদের হ্যারাস করা হয় তা হলে কোনো অফিসার আর-কোনো কাজ করার উৎসাহ পাবে না। কিন্তু মণি জানে, বীরেনও তাকে জিজ্ঞাসা করে বসতে পারে যে এ্যসিস্ট্যান্ট ইনজিনিয়ার গিয়ে বলল আর মণি অমনি গাড়িতে কেন চড়ে বসল–এটা জেনেশুনে যে বীরেন ক্রান্তি হাটে নিজে বসে আছে। তাতে ত সবার ধারণা হল যে পার্টির ভেতর অফিসারদের খুঁটি হচ্ছে মণিবাবু। কিন্তু এমন আশঙ্কা আছে বলেই মণি ভেবে রেখেছে তার কৈফিয়ৎ। বীরেনবাবু লোকজন নিয়ে ক্রান্তি হাটে বসে থেকে যদি ইনজিনিয়ারদের ডেকে পাঠায় আর তারা যদি প্যানিকি হয়ে মণির সাহায্য চায়, তা হলে ত অফিসারদের মর্যাল রাখার জন্যেই মণিকে অফিসারদের সঙ্গে আসতে হয়। মণি জানে, তাদের পার্টির ভেতর এখন সবচেয়ে বড় দুশ্চিন্তা, অফিসাররা যেন ডিমর্যালাইজড না হয়, তাতে দু-এক জায়গায় লোকজন একটু ভুল বুঝলে, বুঝবে। মণিব ধারণা, পাটির ভেতরের এই ঝোঁকগুলো বীরেন বুঝে উঠতে পারে না। কিন্তু তাই বলে মণি ত আর বীরেনের এলাকায় নাক গলাতেও পারে না।

.

০৪৮.

 এম-এল-এ ও অফিসার : সংলাপের আরেক ধরন

তখন সেই ছেলেটি দাঁড়িয়ে উঠে বলতে শুরু করে, কমরেডমন।

এম-এল-এ হাতটা তুলে বলে, বসি-বসি বলো হেমেন, বসি-বসি বলো।

কাকা তখন একগাল হেসে একটা হাত তুলে নাড়ায়। কিন্তু হাসির বেগে কথা বলতে পারে না। কাকার ভঙ্গিতে অথবা এম-এল-এর কথায় ঐ দলটা হেসে ওঠে। দলটার ভেতর যে একটা বেশ উত্তেজনা পাকিয়ে উঠছিল, সেটা সত্ত্বেও সবাই হেসে ওঠে। হাসির ফলে উত্তেজনাটা যে একটু শিথিল হয়ে যায়, তা সত্ত্বেও হেসে ফেলে। আর হেমেন দুহাতে মুখ ঢেকে বসে পড়ে।

আরে, আরে, হল কী, হল কী, বলো, হেমেন, মণি সোজা হয়ে বসে বলে। মণির দাঁতগুলো বড়বড়। ফলে তার সব কথাই একটু রাগী রাগী শোনায়। আর এর মধ্যে কাজের কথার শুরুটাও যে ঘটে না এতে ত মণি একটু বিরক্তই ছিল। ইনজিনিয়ারদের কাছে সে ঘটনাটা শুনেছে। কিন্তু এদের তরফের কথাটা ত শোনে নি। যদিও না-শুনেও সে বুঝে ফেলতে পারে, ঘটনাটা কী হয়েছে। অফিসারদের কথা থেকেই সত্য ঘটনাটা জানা যায়। মণি বুঝতে পারছে না, বীরেন ব্যাপারটাতে কতটা জড়িত! স্বাভাবিক ছিল, মালবাজারে গিয়ে ইনজিনিয়ারের সঙ্গে কথা বলা। বীরেন যখন তা করে নি, তখন মণিকে আগে বীরেনের মনটা বুঝতে হবে। মণির কথাতে একটু বিরক্তি থাকায় এই দলের হাসিটা থেমে যায়। কাকাও হাসি বন্ধ করে বলে, আরে, ঐটা ত তোতলা। কথা কইব্যার পারে না। তাই খাড়া হইয়া ভাষণ দিব্যার ধইরছে। ভাষণ দিলে হেমেন আমাগ তোতলায় না- কাকার কথাতে আবার একটা হাসির দমক ওঠে। কিন্তু হেমেন হাতের ভেতর থেকে মুখ তোলে না।

ছাড়ি দ্যান, মুই কহিছু, জব্বর দাঁড়ায়। ফুলবাড়ির সবচেয়ে বড় জোতদারের ছোট ছেলে। কংগ্রেসের বাড়ি, বড় ভাইরাও সব কংগ্রেস। জব্বর সাতষট্টি সালে প্রথম সি-পি-আই হল। তার পর বছর দুই পর-পর পার্টি বদলিয়ে এখন আবার বামফ্রন্টে ঘুরে এসেছে। টেরিলিনের প্যান্ট আর টেরিলিনের গেঞ্জি পরনে জব্বর দাঁড়িয়ে বলতে শুরু করে, শুনেন, কথাটা ত সবারই জানা। আমাদের ফুলঝোরার ক্যালভার্টটা তৈরি হয়ে গেছে। কিন্তু আমরা প্রথম থিকেই এই ঠিকাদারের কাজে সন্তুষ্ট হতে পারি নাই। আমরা কেউই পারি নাই–আমার বাবাও পারে নাই, আবার জগদীশ কাকাও পারে তাই। এইটা পার্টির কথা না। আমাদের সবাইয়ের কথা। আমাদের ভয় ছিল ব্রিজটা ভাঙি পড়িবে। ত মাজ আমাদের এম-এল-এ সাহেবের পায়ের আঘাতেই সেইটা হল। এটা আমাদের পরম সৌভাগ্য। কারণ—

জব্বরের কথায় বাধা দিয়ে ইনজিনিয়ারদের ভেতর থেকে কেউ বলে, একটু জোরে বলুন, শুনতে পাচ্ছি না।

জব্বর আঙুল নাড়ায় যত বেশি, তত জোরে কথা বলে উঠতে পারে না। গলাটা একটু তুলে সে বলে, আজ আমাদের সৌভাগ্য এম-এল-এ সাহেব ফুলবাড়িতে গিয়াছিলেন এবং আমাদের অভিযোগ সত্য কি না, ব্রিজ ভাঙি যেতে পারে কি না, সেটা পরীক্ষার জন্য ব্রিজের রেলিঙে নিজেই লাথি মারিলেন এবং ব্রিজের রেলিঙ ভাঙি গেল। অর্থাৎ কিনা, আমরা যদি পরে বলতাম তা হলে ফুলঝোরার মানুষের সবই দোষ হইত যে তোমরা নিজেরাই ব্রিজ ভাঙিছ, বুঝেন, অমাদের ব্রিজ আমরাই ভাঙিব? যে-ব্রিজের জন্য আমাদের কত মানুষের কত কষ্ট গিয়াছে জব্বরের গলা উঠতেই এম-এল-এ হাত তুলে তাকে থামায়।

ঠিক আছে, জব্বর বসে পড়ে। এম-এল-এ পরিষ্কার করার জন্যে দু-তিনবার গলা ঝাড়ে। মুখের, ওপর দুই-একবার হাত বোলায়। বোঝা যায়, নিজেই এবার বলবে। ইনজিনিয়ারদের দলটা দেয়াল থেকে পিঠ সরিয়ে সোজা হয়। মণি আর-একটা সিগারেট ধরিয়ে পা গুটিয়ে সোজা হয়ে বসে। মণি বুঝতে চাইছে, বীরেন কী চায়। আর ব্যাপারটার সঙ্গে এমন আচমকা জড়িয়ে পড়ে মণি একটা সমাধান তাড়াতাড়ি বের করে নিতে চাইছে। বীরেন সমাধান চায়, না, আরো পাকাতে চায়–তা অবিশ্যি মণি জানে না। আর, এখন, এই জব্বর ছোকরার কথা শুনতে-শুনতে মণির মনে হতে থাকে যে সাব-এ্যাসিস্ট্যান্ট ইনজিনিয়ারের কাছে খবর পেয়ে আচমকা এখানে আসতে হচ্ছিল বলেই এ্যাসিস্ট্যান্ট ইনজিনিয়ার তাকে বুঝিয়েছে সে ব্যাপারটি মেটাতে চায়, মণিদেরই কথা মত, যদিও মণিদের পার্টির লোকজনের কথা ঠিক নয়। আজকের এই মিটিংটা একবার পার হয়ে গেলে ঐ অফিসারই নানা প্যাঁচ কষতে পারে। যদি প্যাঁচ কষাকষিই চলে, তা হলে বীরেনের প্যাঁচটাই পড়ক আগে। মণি, তার স্বভাব-অনুযায়ী, এতক্ষণ যা ভেবে আসছিল, তার বিপরীত সিদ্ধান্ত নিতে ঝুঁকছে। ততক্ষণে এম-এল-এ কথা শুরু করে দিয়েছে। গয়ানাথ, হাট কমিটির মেম্বারসহ আরো অনেকে সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে এসে শতরঞ্চির মাঝখানটাতে বসে–সুহাসের পাশে, ফুলবাড়ি বস্তির দলের পেছনে। শুদ্ধ্যা– এটা ফুলবাড়ি বস্তির সবাই বলতে পারে যে তারা এই কনট্রাকটারের ব্যাপারে আমাকে, সরকারকে ও ডিপার্টমেন্টকে অনেক চিঠি দিছে। আমার পক্ষ থিকে বলতে পারি যে আমি সেই সব চিঠির জবাব দিতে পারি নাই। কিন্তু আমি স্থানীয় পি-ডবলু-ডির এ্যাসিস্ট্যান্ট ইনজিনিয়ারের অফিসে সেই সব চিঠি পাঠাইছি। আমাদের কি এ্যাসিস্ট্যান্ট ইনজিনিয়ার সাহেব একটু আলোচনা করিবেন সেই চিঠিগুলি বিষয়ে যে তিনি পাইছেন কি না, কী করিলেন, এই সব বিষয়?

এ্যাসিস্ট্যান্ট ইনজিনিয়ার এই ধরনের মিটিঙে অনভ্যস্ত ত বটেই, একটু ভয়ও পেয়েছে। উঠে দাঁড়ায়। এম-এল-এ বলে, আপনি বসেন, আমরা শুনতে পাব, বসে বসে বলেন।

ইনজিনিয়ারকে একটু সময় নিতে হয় কী ভাবে শুরু করবে স্থির করতে, সভাপতি মহাশয়, না, বন্ধুগণ, না, কমরেডস। কমরেডস বলা চলে না, কারণ বোঝাই যাচ্ছে এখানে সব পার্টির লোকই আছে। আর, জীবনে কোনোদিনই ইনজিনিয়ারকে বন্ধুগণ বলতে হয় নি, বসে বসে বন্ধুগণ বলা যায় কি না বুঝতে পারে না। সভাপতি মহাশয় অবিশ্যি বলা যায় কিন্তু এটা সভাপতির সভা, না, এম-এল-এর সভা? খুব কম সময়ের ভেতর এতগুলো কথা তাকে ভেবে নিতে হয়। আর তখনই শোনে এম-এল-এ তাকে প্রশ্ন করে, আপনি এদের ডেপুটিশন আর আমার পাঠানো চিঠি ত পেয়েছেন?

হ্যাঁ। এই ব্যাপারটা ত আমাদের এস-এ-ই মিস্টার মণ্ডল ডিল করেন। উনি বলতে পারবেন।

ওনার সঙ্গে ত আমাদের কথাবার্তা হইছে। উনিই ত আপনাকে খবর দিছেন। আমি জানতে চাই যে আপনি কখনোই চিঠিপত্রগুলা দেখিছেন, কি দেখেন নাই? এম-এল-এ খুব ঠাণ্ডা ভাবে প্রশ্ন করে। কিন্তু ফুলবাড়ির ভিড়টা এই কথাতে যেভাবে একসঙ্গে মাথা নাড়ে তাতে মনে হয় প্রশ্নটা খুব দরকারি।

ইনজিনিয়ার তখন বলতে শুরু করে, আসলে সরকারি অফিসেও এক-একজন অফিসার এক-একটা কাজের চার্জে থাকেন, সেই সব কাজের করসপনডেন্স ফাইলগুলোও তারাই দেখেন। আমাকে যখন জানান তখন আমি জানতে পারি।

এই কথায় এম-এল-এ হেসে ওঠে, সামান্য, তারপর বলে, আপনার অফিসের জন্যে এই নিয়মটা ত আপনার ভাল নিয়ম। সেটা আমি জানতাম না বলেই সব গোলমাল পাকি গেইছে। কিন্তু এক-এক সরকারি অফিসে এক-এক নিয়ম হইলে আমাদের মত মানষির বিপদ হয়।

সব সরকারি অফিসেই ত মোটামুটি এই নিয়মই হয়, এক-এক ফাইল এক-এক অফিসারের চার্জে। আমি ত ফুলঝোরা ক্যালভার্টের ফাইল সঙ্গে নিয়ে এসেছি।

সে ত আজ এখন আনবেন, আমরা সব এইখানে বসি আছি, ত আনবেন। কিন্তু আপনি য্যানং সরকারি অফিসের আইন জানেন, আমরাও ত দুটা-একটা জানি। আমি এমন সরকারি অফিসের কথা জানি অফিসের কোনো নতুন বিয়া বসা মেয়ের চিঠি আসিলেও অফিসার নিজে পড়ি দেন–

একটা চাপা হাসির দমক ওঠে। গয়ানাথ ঘন-ঘন মাথা ঝাঁকায়, যেন এ-রকম তারও অনেক জানা। হাট কমিটির মেম্বার চুপচাপ হাসে। আর মণি একটু অবাক হয়ে বীরেনের দিকে তাকায়। বীরেন এত থেমে-থেমে, এত গুছিয়ে-গুছিয়ে, ইনজিনিয়ারকে অপদস্থ করে দিচ্ছে? এসেম্বলিতে বীরেন অবিশ্যি দুটো-না-তিনটে বক্তৃতা করেছে, কাগজে উঠেছিল। বক্তৃতা ও ভাল করে। আর এম-এল-এ হয়েও খাটে সবচেয়ে বেশি। কিন্তু তাই বলে এতটাই বদলে গেছে?

মণির যেন আর মনে থাকে না সে ইনজিনিয়ারদের কাছে শুনে তবে এখানে এসেছে। তার মনে হয়–বীরেনের এই পরিবর্তন দেখাটাই তার লক্ষ ছিল।

এম-এল-এ বলে, তা হলে এই কথাটা এই মিটিঙে আর তোলার দরকার নাই যে আমরা আপনার চিঠির জবাব কেন পাই না।

না, সেটা আপনারা নিশ্চয়ই বলবেন। কিন্তু আমাদের অফিসে ক্ল্যারিক্যাল স্টাফ মাত্র দুজন। আর, টাইপিস্ট একজন। তিনি মেটার্নিটি লিভ নেয়ায় নতুন রিলিভিং হ্যান্ড আসে নি। আমাদের একজন এ্যাসিস্ট্যান্ট, টাইপের কাজ চালিয়ে যাচ্ছিলেন। সেও তিনি কোঅর্ডিনেশন কমিটির মেম্বার বলে–

সে ঠিক আছে। কিন্তু আমি ত আপনাদের এইখানকার এম-এল-এ।

এবারের হাসিতে ইনজিনিয়ারও যোগ দেয়, মণিও হেসে ফেলে। এম-এল-এ তখন বলে, আমি কি আমাদের এই এলাকায় যে-সব কাজ হচ্ছে তা নিয়ে কোনো কথা জানাবার থাকলে আগে জানি নিব কোন অফিসার কোন কাজের চার্জে আছেন, তার পর তার কাছে লিখব?

না সেটা কেন হবে, আপনি আমাকেই লিখবেন।

কিন্তু আপনি ত আমার চিঠিরও কুনো জবাব দেন নাই। আমি আগে আপনাকে চিঠিতে জানালাম যে আজ আমি ফুলবাড়ির ঐ ব্রিজটা দেখতে যাব। কিন্তু ঐখানে দেখি আপনাদের মিস্টার মণ্ডল আছেন। কিন্তু কথা ছিল ত আপনার সঙ্গে।

আমি ওটা বুঝি নি। আমি ভেবেছি মিস্টার মণ্ডল কাজটার চার্জে আছেন, উনি থাকলেই হবে।

আমার যদি আপনার সঙ্গে কোনো কথা থাকত আমি আপনার অফিসে যেতাম। কিন্তু আসলে এই কথাটা ঐ ব্রিজের সামনে হওয়া দরকার। কারণ এই অভিযোগটা হচ্ছে যে কনট্রাক্টার এই কাজটা ঠিকমত করে নাই–

.

০৪৯.

ঠিকাদার আর ইনজিনিয়ার

এই সব কমপ্লেন যদি একটু স্পেসিফিক না হয়, কী পার্টিকুলার কমপ্লেন, তা হলে ত ডিপার্টমেন্টের পক্ষে এনকোয়ারি করা মুশকিল। এতে আবার সব কাজেরই প্রগ্রেস হ্যামপার করবে। কনট্রাকটাররা ডিমর্যালাইজড হবে।

সে যদি ফুলবাড়ি বস্তির লোকেরা আপনাকে বলতেই পারত যে কী কী দোষ হচ্ছে তা হলে ত ওরাই ইনজিনিয়ার হত। কিন্তু যে কথাটা বারবার হচ্ছিল যে কনট্রাকটার বালি আর সিমেন্টের মিশাল ঠিকমত বানাচ্ছে না। ফুলঝোরা দিয়া বর্ষায় ত বড় স্রোত যায়। ঐ রকম পাতলা মিশাল ভাসি যাবে। এইটা কি আপনাদের কানে যায় নাই?

হ্যাঁ। আমরা শুনেছি, কিন্তু স্পেসিফিক কমপ্লেন ত ছিল না, তাই

 মিশালের

 ফুলবাড়ি বস্তির ভিড় থেকে কেউ একজন বলে, মশলার।

 হ্যাঁ, হ্যাঁ, মশলার মিশাল কি আপনারা কেউ পরীক্ষা করে দেখছেন?

না। তা করা হয় নাই ঠিক। কিন্তু এইরকম ত কখনো করা হয় না। একজন কনট্রাকটার কেন ওরকম করতে যাবে সমবেত হাসিতে ইনজিনিয়ারের কথাট চাপা পড়ে যায়। ইনজিনিয়ার একটু অপ্রস্তুত হয়ে থেমে যায়।

এইটি আপনি কী বললেন? কনট্রাকটাররা কাজে কেন ফাঁকি দেবে বা চুরি করবে তা আপনি জানেন না? মণি খুব হেসে সিগারেটে টান দেয়।

ঠিকাদার আর ইনজিনিয়ার
দ্যাশখান কইরল ছারখার।

এই বর্ষাকাল আইল, কুথায় কুন ফরেস্টের মধ্যে কুন নদী ভাঙল, ব্যাস, ফেল পাথর। কার পাথর, কেডায় ফ্যালে আর কেডায় হিশাব রাখে, কন! এক-একডা পাথর জলে পইড়লে ঠিকাদারের বার আনি আর সাহেবের চার আনি। আর যে-পাথরডা তুলাও হয় না, ফেলাও হয় না–সেই পাথরের চোদ্দ আনি সাহেবের, দুই আনি ঠিকাদারের।

এই রকম কথা হলে ত মুশকিল।

 কাকা, চুপ করেন, এই সব কথা বলবেন না, যদি ধরতে পারেন স্যালায় কহিবেন, এম-এল-এর কথায় ফুলবাড়ির কাকা হো-হো করে হেসে ওঠে, এইডা ভাল কইছেন, তা হালি ত তিস্তাবুড়ির তানে হিশাব লইতে হয়, কী, না, বুড়ি কয়ডা পাথর পাইছ?

আজকা সকালে ঢালাই হল। আমি, ধরেন, সন্ধ্যার মুখে বা তার আগেই পৌঁছাই। আমি পরীক্ষা করার জন্য পা দিয়া একটা ঝাঁকি দিছি। আপনাদের মিস্টার মণ্ডলও ছিলেন। কিন্তু পুরা রেলিং ঝর ঝর করি পড়ি গেল। এইটাও কি প্রমাণ না? আপনার মিস্টার মণ্ডল তখন আমাকে বুঝান যে সব জায়গাতেই নাকি এরকম হয়– এম-এল-এ বলে।

মিস্টার মণ্ডল কিছু বলতে ওঠে কিন্তু ইনজিনিয়ার হাত তুলে তাকে থামিয়ে দেয়, কোনো ঢালাইই ত চব্বিশ ঘণ্টা না গেলে জমে না, সে যত সিমেন্টই দেয়া হোক। বার ঘণ্টার মধ্যে পা দিয়ে ধাক্কা দিলে হিন্দুস্থান কনস্ট্রাকশনের বানানো রেলিঙও ভেঙে যাবে–, ইনজিনিয়ার এতক্ষণে হাসার সুযোগ পায়। ইনজিনিয়ারদের অন্য কারো হাসি তার সঙ্গে মেশে না বটে, কিন্তু বোঝা যায়, ঐ দলটাতে একটা সমর্থনের নড়াচড়া ঘটে। এতক্ষণ এম-এল-এ যেরকম ঠাণ্ডা গলায় কথা বলছিল, ইনজিনিয়ারের গলায়। এতক্ষণে সেই ঠাণ্ডা ভাবটা আসে। তার কথা বলার ভঙ্গিতে বোঝা যায়, এই বিষয়টা তার জানার সীমার মধ্যে আর এ-বিষয়ে তার কোনো ইতস্তত নেই।

এম-এল-এ জানত তার জন্যে এই বিপদটা অপেক্ষা করে আছে আর কথাটা এখানে আসবেই। তার অভিজ্ঞতায় সে জানে, এই নিয়ে আলোচনা যত এগবে, ইনজিনিয়াররা তত বেশি সুবিধে পাবে। আর, এই এম-এল-এ তার কাজকর্মে বারবারই এখানে এসে ঠেকে যায়। তার ঠেকে যাওয়ার আরো অনেকগুলো জায়গা আছে, কিন্তু সে সব কিছুর ভেতর এই জায়গাটা এলে যেন পুরো আটকে যায়। এম-এল-এ মাথা ঠণ্ডা রেখে বলে, শুনেন, এইটা ত তর্ক করি মীমাংসা হবে না। আমাদের সন্দেহ ঠিক কি বেঠিক তার ত একটা পরীক্ষা হওয়ার নিয়ম আছে। সেই নিয়মটা আপনি বলেন আমরা শুনি।

ইনজিনিয়ার ঠাণ্ডা গলাতে জবাব দেয়, ঐ মিকশ্চারের স্যাম্পল নিয়ে স্টেট টেস্টিং ল্যাবরেটরিতে পাঠাতে হবে। তারা রিপোর্ট দেবে।

এই কেসটাতে আপনারা সেটা করতে রাজি আছেন?

 আমাদের রাজি-অরাজির ত কোনো কথা নেই। আপনারা যদি করতে বলেন আমরা পাঠাব। কিন্তু তা হলে ত যতদিন রিপোর্ট না আসে ততদিন কাজ বন্ধ রাখতে হবে?

কাজ আর বন্ধ থাকবে কী? রেলিংটা আর বানাবেন না, এই ত? কী? আপনাদের কি রেলিং ছাড়া খুব অসুবিধা হবে?

ঐ ব্রিজ তুমি নি গেলেও হামরালার কুনো অসুবিধা নাই, আজি বাদে কালি ত ভাঙি পড়িবেই, অ যতই ইনজারি বলেন না কেন, ফুলবাড়ির দলের ভেতর থেকে কেউ বলে।

এম-এল-এ ধমকে ওঠে, আজেবাজে কথা ছাড়েন, শুধাছি সেইটার জবাব দেন।

এর ভেতর ইনজিনিয়ারদের ভেতর কিছু কথা হয়। ইনজিনিয়ার বলে, আপনি শুধু রেলিং বলছেন কেন, প্ল্যাটফর্ম আর রোডের মধ্যে আর্থ ওয়ার্কও বাকি আছে, সেটাও হবে না। মানে ব্রিজটা ইউজ করা যাবে না। তা ছাড়া স্যাম্পল ত শুধু রেলিং থেকে নিলে হবে না, সব পার্ট থেকেই নিতে হবে।

খাড়ান, একে একে কন। মানে রাস্তা আর ব্রিজের মাঝখানের ফঁকখান বুজান হবে না, এই ত?

 হ্যাঁ।

আপনারা একবেলা কাম করি বুজি নিবার পারিবেন না? ফুলবাড়ির দলটাকে এম-এল-এ জিজ্ঞাসা করে।

হয়। কনট্রাকটার বুজালেও ত আমাগো দিয়্যাই কইরত। এইডাও আমরাই কইরব। বিনা পয়সায়।

মণি বুঝে উঠতে পারে না, বীরেন কোন দিকে যাচ্ছে ও কেন যাচ্ছে। ফুলঝোরার এক দুই-হাতি ক্যালভার্ট নিয়ে কোথায় স্যাম্পল পাঠাবে, আর, এই সুযোগে অফিসার আর ঠিকেদার মিলে এদিককার সব কাজ বন্ধ কর দেবে। তা ছাড়া এই ব্যাপারটা নিয়ে এতদূর কেন যাওয়া হবে, মণি তাও বুঝে উঠতে পারে না। ফুলবাড়িতে তাদের পার্টির লোকজন কোনো কালেই নেই, এই সরকার হাওয়ার পর হয়েছে। সরকার চলে গেলেই চলে যাবে। আর বীরেন এতদূর যাচ্ছেই বা কেন। এর সঙ্গে ত নীতির প্রশ্ন জড়িত। পার্টির ভেতরে বারবার আলোচনা হয়েছে, এমন কিছু কখনোই কেউ করবে না যাতে লোক্যা থানা বা অ্যাডমিনিস্ট্রেশন, বা গবর্মেন্ট অফিসাররা ছুতো ধরতে পারে। মণি বোঝে, তার এবার কথা বল উচিত। কিন্তু সে ঠিক করতে পারে না, এখানে যা হয় তা হতে দিয়ে, পরে, মানে, এখান থেকে ফিরে মালবাজারেই, ইনজিনিয়ার আর বীরেনকে নিয়ে বসে একটা মিটমাট করে দেবে, নাকি, এখানেই সে কথা বলবে। কিন্তু বীরেনের সঙ্গে আগে ত কথা বলে নি। সে জানে না, বীরেন এতটা রেগে আছে কেন।

তা হলে আজ রাত্রিতে বীরেনের সঙ্গে কথা বলে, কাল সকালে ইনজিনিয়ারকে আসতে বলতে পারে।

আর-একটা কথা কী বলছিলেন?

 স্যাম্পল ত সব জায়গা থেকেই নিতে হবে, সেই কথা।

তার জন্যে কি পুরা ব্রিজ ভাঙতে হবে, নাকি?

না, তা কেন, একটু নিলেই হবে ভেঙে।

 তা হলে কি তাই ঠিক হবে? এম-এল-এ সবার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করে।

.

০৫০.

এমএল-এর রাগ ও মিটিঙের শেষ

কনট্রাকটারের পক্ষ থেকে এই লোকটি কিছু বলতে চায়–ইনজিনিয়ার তাদের দলের মধ্যে বসে থাকা একজনকে দেখিয়ে বলে।

হ্যাঁ, বলেন, আপনি ঠিকাদারের লোক? এম-এল-এ জিজ্ঞাসা করে।

লোকটি উঠে দাঁড়িয়েছিল, বলল, হ্যাঁ, স্যার। আপনারা এই মিটিঙে যা ঠিক করবেন সে আমার মালিক বুঝবে, আমি কাল জলপাইগুড়ি গিয়ে মালিককে জানাব। কিন্তু আমাদের নিয়ে ত অনেক কথা এইখানে হল। আমরাও তা হলে কিছু কথা বলতে চাই, সেইটা আপনি বলেন।

বলেন, আপনি কী বলতে চান, বলেন, এম-এল-এ বলে। আপনারা ত কনট্রাকটার এই সব নিয়ে এত কথা বললেন। কনট্রাকটার ত আর এক রক না। আমার মালিক বড় কনট্রাকটার। এই সব ছোট কাজ করেন না। সে এই সাহেবরা জানেন। মণিবাবু জানেন। এম-এল-এ বাবুও জানেন। কিন্তু হল কি, আমি ওর সঙ্গে নানা সাইটে কাজ করছি পাঁচ-সাত বছর। এই রকম ছোট কাজ আমি মালিককে বলে ওনার নামে টেন্ডার দেই। আমার ত আর লিস্টে নাম নাই। আমার মালিকের টেন্ডার থাকলে সেটা ত সবাই জানবেই। আর রেট অনেক লো ছিল। কেন, না আমি নিজেই রাজের কাজ জানি। আমার দুই ভাই আছে, ওরাও জানে। আর কিছু লোক লাগাই। তাতে আমরা লো-তে কাজ তুলে দিয়ে মোটামুটি লাভ করতে পারি। এখন হল কি, মালিক যদি দেখে তার কোম্পানির নাম নিয়ে এইসব গোলমাল হচ্ছে, তাতে মালিকের বদনাম হয়ে যাবে, মালিক আমাকে বরখাস্ত করে দেবে। মানে চাকরি যাবে না ঠিকই, কারণ আমি মালিকের বিশ্বাসের লোক। কিন্তু এই যে আমি ছোট-ছোট কাজ করে নিজের একটা কাজ বানাচ্ছি এইটা আমার একেবারে বন্ধ হয়ে যাবে, লোকটি কথা শেষ করে দাঁড়িয়ে থাকে। এম-এল-এও তার দিকে তাকিয়ে থাকে। বোঝা যায়, এই লোকটির কথাতে অবস্থাটা আবার বদলাতে শুরু করেছে। মণি ভাবে, এই সুযোগটা সে নেবে। সে সিগারেটটায় টান দিয়ে কথা শুরু করার আগেই এম-এল-এ বলে ওঠে, সেটা তুমি অফিসারদের বলো। আমরা ত তাদের কবে থিকে বলছি যে এই ব্রিজ নিয়া একখান গোলমাল পাকি যাবার ধরিছে। ত অফিসার আমাদের কথার কোনো ত দামই দেন নাই। ত যাউক, টেস্ট-মেস্ট হইয়া আসুক

লোকটি বলে, এইটা নিয়ে আমার কথা আছে। আমি এতদিন বলি নাই। কিন্তু এখন ত আমার বিপদ হয়ে যাচ্ছে। তাই বলতেই হচ্ছে। আমি কারো নাম বলব না। আপনারাও জিগেস করবেন না। আমরা যখন প্রথম এইখানকার কাজ ধরি, মানে সাইটে আসি, তখনই এখানকার কয়েকজন এসে বলেন আমরা সরকারের পার্টির লোক, আমাদের পাঁচ বস্তা সিমেন্ট দিতে হবে। আমি কীভাবে কাজ করি তা ত আপনারা শুনলেন। পঁচ বস্তা সিমেন্ট দিলে আমার আর কী থাকবে। আমি বললাম, ভাই, একটু-আধটু নিতে হয় না, কিন্তু এত সিমেন্ট আমি কোথা থেকে দেব। কিন্তু তারা রাজি হয় না। উনি ওর একটা ঘরের বাইরের জায়গাটা ইট-সিমেন্ট দিয়ে বাধাতে চান। সেইটা আমি রাজি হই নাই বলেই আমার এই অবস্থা। আগে জানলে আমি দিয়ে দিতাম। কিন্তু তখন বুঝি নাই যে এত কাণ্ড হবে। আমি এতদিন এ-কথা বলি নাই। কিন্তু আজ না বললে আমার বিপদ বলেই বললাম, লোকটি বসে পড়ে। ফুলবাড়ির দলটার মধ্যে কথাবার্তা শুরু হয়ে যায়। কিন্তু মণি তার আগেই এম-এল-একে আস্তে করে বলে, আমি একটু বলছি। তারপর দাঁড়িয়ে ওঠে।

কিন্তু, সঙ্গে-সঙ্গেই গয়ানাথ উঠে দাঁড়িয়ে বলে, মণিবাবু, আমাদের ত এইটা একখান সৌভাগ্য কিনা তোমরালা সকলে, এম-এল-এ আর এ্যানং সব ইনজিনিয়ার মোর এই ক্রান্তিহাটত আসিছেন। ত হামরা তোমাক চা খিলাবার চাই। যদি বলেন ত এ্যালায় আনিবার কহি।

আনেন, চা খাওয়াবেন সে ত ভাল, বলে মণি অপেক্ষা করে, গয়ানাথ আর হাট কমিটির মেম্বার উঠে নীচে নামা পর্যন্ত, তারপর বলে, আমার এর মধ্যে কোনো কথা বলা উচিত না, আমি হঠাৎ এসে পড়েছি। কিন্তু আমার মনে হল কোথাও একটা ভুল বোঝাবুঝি হচ্ছে, না হলে এরকম ঘটনা কেন ঘটবে, এত ত ব্রিজ তৈরি হচ্ছে, রাস্তা তৈরি হচ্ছে। একটু আগে সাবধান হলে বোধ হয় এত গোলমাল। হত না। আমাদের ইনজিনিয়ার যদি আমাদের এম-এল-এর চিঠির জবাব দিতেন বা তাদের ভেতর যদি যোগাযোগ হত, তা হলে অনেক আগেই এ সব মিটে যেত। কী বলেন, ইনজিনিয়ার সাহেব?

ইনজিনিয়ার সে-ইঙ্গিত বুঝে ফেলে, বলে, আমার এটা নিশ্চয়ই দোষ হয়েছে। কিন্তু আমি ভেবেছিলাম মিস্টার মণ্ডল

ইনজিনিয়ারকে থামিয়ে দিয়ে এম-এল-এ হঠাৎ চিৎকার করে ওঠে, আপনার মানষিলার খুব প্রেস্টিজ লাগে, না, সিডিউল সিটের এম-এল-একে পাত্তা দিতে?

মণি হঠাৎ চমকে গিয়ে বলে ওঠে, এই বীরেনদা, কী বলছ? এম-এল-এ মণিকে বলে ওঠে, আপনি চুপ করেন, আপনারা এইসব বুঝবেন না, আপনাদের সঙ্গে ত এরা এরকম করে না। আপনারা ইংরাজি কহিলে ইংরাজি কহিবার পারেন। আমিও এই সব বুঝিতাম না, এম-এল-এ না হইলে। না-হইলে উনি মালবাজারের এক এ্যাসিস্ট্যান্ট ইনজিনিয়ার, উমরার সাহস হয় কী করি, মোর চিঠি আগত পাইছেন তবু ঐঠে হাজির না থাকিবার? আর এ্যালায় যদি জলপাইগুড়ি কি ধূপগুড়ির এম-এল-এ চিঠি দিত তার বাদে দশবার গিয়া স্যার স্যার করিতেন। ত হউক কেনে, বিচার হউক। যাউক মশলা টেস্ট করিবার। কিন্তু যদি দোষ বাহির হয়, তবে ঐ একখান গরিব ঠিকাদার আর ঐ আর-একখান সিডিউল কাস্ট মণ্ডলের উপর দোষ চাপানো চলিবে না; ইনজিনিয়ারক দায়ী হওয়া লাগিবে।

এই কথার জবাবে ইনজিনিয়ার বুঝি কিছু বলতে চায়, কিন্তু মণি হাত তুলে থামায়। মণি দাঁড়িয়েই থাকে। সে দাঁড়িয়ে আছে একমাত্র এই কারণে যদি বীরেনদা চুপ করে। মণি যে ইনজিনিয়ারকে থামিয়ে দেয় সেটা দেখে এম-এল-এ আবার বলে ওঠে, উমরাক থামাছেন কেনে, কহিবার দ্যান, আর নতুন কী কহিবেন? য্যালায় দেখিলেন ঐ সব টেস্টমেস্ট বলিয়াও হামরাক ঘাবড়ান গেইল না, স্যালায় ঠিকাদারের মানষিক দিয়া বলিবার ধইরছে যে এই ফুলবাড়ির মানষিগিলাই চোর।

ফুলবাড়ির দলটা একসঙ্গে ফুঁসে ওঠে, নাম কহেন, নাম কহেন, আমরা তাক ডাকি আনিব, দলের ভেতর থেকে দু-চারজন দাঁড়িয়ে উঠে ইনজিনিয়ারদের দলটার দিকে চেঁচায়। মণি তাদের দিকে হাত বাড়িয়ে বলে, বসি পড়েন, এই বসো।

এম-এল-এর রাগ ঠিক সেই সময় চরমে ওঠে, করিবেনটা কী? ঠিকাদারের চুরি ধরিলে আপনাকে চোর বানাবে, ইনজিনিয়ারক ফাঁকি ধরিলে আপনাক ঠক বানাবে, আইন ধরি চলিবার রাজি হইলে আপনাক বেতাইন বানাবে, কালি..গিয়া খবরের কাগজ-এডিওতে প্রচার করি দিবে–আবার ডুয়ার্সে গণআদালত, ইনজিনিয়ারদের বিচার।

মণি নিচু হয়ে এম-এল-একে অত্যন্ত দ্রুত কিছু বলে, তারপর সোজা দাঁড়িয়ে চিৎকার করে, শোনেন, আপনারা যদি না বসেন আমি এ মিটিং এখনই ভেঙে দেব, বসেন বসেন।

ধমকে ফুলবাড়ির দলটা বসে পড়তেই মণি চিৎকার করে বলতে শুরু করে, শোনেন, এমন কিছু হয় নাই যে এখানে একটা দাঙ্গা-হাঙ্গামা বেধে যাবে। এখানকার ইনজিনিয়ারদের ব্যবহারে আমাদের এম-এল-এ খুব দুঃখিত হয়েছেন। এম-এল-এ আমাদের সকলের ভোটের দ্বারা নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি। সুতরাং এমএল-এর দুঃখ আমাদের সকলের দুঃখ। তার দুঃখ আমাদের দূর করতে হবে। কিন্তু তিনি ত কোনো ব্যক্তিগত কারণে দুঃখ পান নাই। দেশের একটা কাজে এরকম একটা গোলমাল হয়ে গেছে বলেই তার দুঃখ। সরকারি কাজকর্মের নিয়মই আলাদা। সেই নিয়মে হয়ত ইনজিনিয়ারসাহেব ভেবেছেন যে ছোট ইনজিনিয়ারই সব বুঝিয়ে দিতে পারবে। কিন্তু ইনজিনিয়ারসাহেবের উচিত ছিল এম-এল-এ সাহেবের সঙ্গে দেখা করা। কিন্তু এই সব রাগারাগি দিয়ে ত আর আমাদের এই অঞ্চলের কাজকর্ম চলবে না। তার ওপর আমরা ঠিকাদারদের কথাও শুনলাম। সেও একজন অতি ছোট্ট ঠিকাদার। সে যদি আজ আইনের প্যাঁচে পড়ে যায় তা হলে বড় ঠিকাদার তাকে বাঁচাতে আসবে না, সেটাও আমাদের দেখতে হবে। তাই আমি প্রস্তাব দিচ্ছি যে, এই সভায় ত সব খোলাখুলি আলোচনা হল। এখন এইটুকু একটা ব্রিজ নিয়ে হিল্লিদিল্লি করার দরকার নেই। মালবাজারে একদিন এম-এল-এ, ইনজিনিয়ার, ঠিকাদার ও আপনাদের ফুলবাড়ির দুইজন লোক মিলে বসে সব মীমাংসা করে নেন। তাতে ব্রিজের কোনো অংশ ভেঙে যদি আবার তৈরি করতে হয়, তৈরি করে দিতে হবে। আর দুটো-একটা বর্ষায় ব্রিজের কোনো ক্ষতি হয় কিনা সেটা পরীক্ষা করার জন্যেও সময় দিতে হবে।

ঠিক এই সময়, গয়ানাথ আর হাট কমিটির মেম্বার আগে-আগে ও তাদের পেছনে-পেছনে একটি ছেলে একটা বড় কেটলি, আর-একটি ছেলে একটা ঝুড়ি, আর-একটি ছেলে আর-একটা ঝুড়ি নিয়ে সিঁড়ি ভেঙে বারন্দায় উঠে একেবারে শতরঞ্চির মাঝখানে চলে এলে, মিটিংটা যেন ভেঙে যাবার মত হয়। সেই ভাঙা মিটিঙের ওপর দুটো হাত তুলে মণি জিজ্ঞাসা করে, তা হলে এইটাই ঠিক ত? তা হলে এইটাই ঠিক থাকল?

গয়ানাথ আর মেম্বার মিলে চা দেয় হাতে-হাতে, চা নয়, চায়ের গ্লাশ। আর কেটলি হাতে ছেলেটি গ্লাশগুলোতে চা ঢালে, হেই দেখিস কেনে, ফেলিস না গাওত। ঐটুকু ছেলের অত বড় কেটলি নাড়ানোর অভিজ্ঞতা এমনই যে সে কোনো গ্লাশেই এতটা চা ঢালে না,যাতে উপচে যায়। গ্লাশ দেয়া হয়ে গেলে গয়ানাথ আর মেম্বার মিলে আর-এক ঝুড়ি থেকে প্রত্যেককে একটা করে সিঙাড়া আর একটা করে মিঠা নিমকি হাতে-হাতে দিতে শুরু করে।

এইসব মিটিং যেমন ভাঙে, এই মিটিংটাও তেমনি ভাঙতে শুরু করে। কথাবার্তা, ঝগড়াঝাটি, রাগারাগি, মিলমিশ এই সবের ভেতর দিয়ে বেশ একটা তৃপ্তির ভাব আসে। খুব বিশেষ বিশেষ উপলক্ষ ছাড়া এত রাতে এতগুলো মানুষ একই সঙ্গে এক জায়গা থেকে বেরচ্ছে এমন ঘটনা ক্রান্তিহাটে খুব হয় না। ফলে, মিটিং ভাঙার মধ্যে একটা নতুন অভিজ্ঞতার আরামও জোটে।

গাড়ি করে যারা মালবাজারে ফিরে গেল, মণি, এম-এল এ ও ইনজিনিয়ার, ঠিকাদার, আর, এখানে সুহাস, এই আরামের ভাগিদার নয়। আর নয় গয়ানাথ, কিছু পরিমাণে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *