১.৪ রাধাবল্লভের বক্তৃতা

০৩১.

রাধাবল্লভের বক্তৃতা

রাধাবল্লভ ছিল চায়ের দোকানের দিকে পেছন ফিরে। সে চায়ের দোকানের দিকে ঘুরল। তার বা বগলে ছাতা ত প্রায় সেঁটে আছে। ডান হাতটা তুলে মাথার ওপর কনুইয়ের ভাজ ফেলে আঙুলগুলো নিয়ে এল ঘাড়ে, মাথার পেছনে। রাধাবল্লভ চোখ বন্ধ করে, ঘড়িটা একদিকে হেলাতেই হৃষীকেশ পাশ থেকে বলে, রিপিট দিবেন না, যা বলা হই গিছে তার পর থিকা বলেন–

যেন এই কথার জবাবেই রাধাবল্লভ শুরু করে, কথাটা হচ্ছে আমাদের এই মাল-লাটাগুড়ি-ক্রান্তি অঞ্চলে বহু কুখ্যাত

এই পার্টটা ত হয়া গিছে কমরেড।

 রাধাবল্লভ চোখ খোলে, আমাকে বলতে দাও হৃষীকেশ।

বলেন, কিন্তু রিপিট দিবেন না।

রাধাবল্লভ আবার চোখ বন্ধ করে। সামান্য সময় নিয়ে ঘাড় হেলিয়ে শুরু করে, কথাটা হচ্ছে আমাদের এই মাল-লাটাগুড়ি-ক্রান্তি অঞ্চলে বহু কুখ্যাত জোতদার আছে। তাদের একমাত্র উদ্দেশ্য কৃষকদের শোষণ করা। কিন্তু কথাটা হচ্ছে কেন? ধরেন, আনন্দপুর চা বাগানের জোতের জমিও আছে, চায়ের জমিও আছে। কিন্তু এই মালিকলোক চায়ের জমিতে ধান চাষ করেন আর ধানের জমিতে চা চাষ করেন। এই মালিকলোক চা বাগানের মজুরদের দিয়ে ধান চাষ করান আর জমির আধিয়াদের দিয়ে চা বাগানের কাজ করান। কিন্তু এই কৃষকরা মজুরদের মতন মাহিনা পায় না। ঠিকা মজুরি পায়। আর মজুররাও কৃষকদের মতন আধি-ভাগ্য পায় না। মজুরির পয়সা পায়। কোম্পানির সব দিকেই লাভ-জোতদারিতেও লাভ, ডিরেক্টরিতেও লাভ। আর মজুর-কিষানের সব কিছুতেই ক্ষতি মজদুরিতেও ক্ষতি, হালুয়াগিরিতেও ক্ষতি রাধাবল্লভ, বোধহয় দম নেয়ার দরকারেই একটু থামে, সেই ফাঁকে হৃষীকেশ বলে, এ কোন লেকচার দিছেন কমরেড, ই ত মজুর কৃষককের মিটিং না হয়, সার্ভের, জমির সার্ভে হছে, জমির কথা কহেন, হৃষীকেশের কথা শুনেই হয়ত, বা হয়ত জমির কথাতে কিছুতেই আসতে পারছিল না বলেই রাধাবল্লভ জোর করে একটা বিরতি নিয়েছিল, আবার শুরু করেই সে সরাসরি জমির কথাতে চলে আসতে চায়, আগের কথার প্রসঙ্গসূত্র ছাড়াই।

আমরা কৃষক সমিতির পক্ষ থেকে সমস্ত জমির বন্দবস্ত চাই কৃষকের স্বার্থে। যে কৃষকরা খাশ জমি দখলে রেখে চাষ করিছেন, জোতদারের লাঠিগুলি, পুলিশের অত্যাচার, জেল-মামলা-মোকদ্দমা সহ্য করিছেন, তাদের সেই সব জমিতে বন্দোবস্ত দিতে হবে। যে কৃষকরা ফরেস্টের জমি দখলে রেখে চাষ করিছেন, যেখানে শুধু ছিল হায়-হায়-পাথার, সেখানে বানি দিছেন হলহলা ধানের খেত, সেই সব জমি দখলদার কৃষকের নামে বন্দোবস্ত দিতে হবে। কিন্তু ফরেস্টের জমিতে যে-সমস্ত জোতদার চাষ করে তাহাদের হাত হইতে এই সব জমি কাড়ি লইয়া হালুয়া-আধিয়ারের মধ্যে বিলি করিতে হইবে। রাধাবল্লভের কথাগুলিতে আবেগ সঞ্চারিত হয়ে যাচ্ছিল–তাদের কৃষক সমিতির প্রত্যক্ষ নানা অভিজ্ঞতার স্মৃতির আবেগ। আর সেই আবেগের টানে, স্মৃতির প্রবলতায় কেমন অবান্তর হয়ে যায় তার নানা বক্তব্যের বিরুদ্ধে সম্ভাব্য নানা যুক্তি। তার অব্যবহিতকে রাধাবল্লভ চরম গুরুত্বেই সামনে এনে দেয়–যুক্তির পরম্পরায় নয়, অভিজ্ঞতার সবল চাপে। সে একটু ধামে। আপাতত মনে হয় বটে, দম নেয়ার জন্যে, কথাটা শুনে বোঝা যায় সে আর-একটি সমস্যার মুখোমুখি দাঁড়াচ্ছে।

আর আমাদের একটি বিশেষ বক্তব্য আছে চরুয়াভাই কৃষকদের উদ্দেশ্যে। আমাদের এই তিস্তানদীর স্রোত সব সময়ই বদলায়। আজ যেটা কায়েম, কালি সেইটা চর। তাই জোতদারের দল তাদের জমি তিস্তার ভিতর গেলেও সেইখানে দখল রাখে। চরজমিতেও সাধারণ কৃষক দখল পায় না। আবার অন্যদিকে তিস্তার এমন-এমন চর আছে, যাহা শক্ত পাকা, নদীতে ভাসিবার কোনো আর ভয় নাই, কায়েমের থিকাও কায়েম। কিন্তু সরকারের নিয়ম যে পঞ্চাশ বছর ধরি চর যদি চর না থাকে তাহা হইলে কায়েম বলিয়া ডিক্লেয়ার হইবে না। সেই সুযোগে আমাদের পূর্ববঙ্গের হিন্দুভাইগণ আসিয়া এই তামান-তামান চর জমি চাষ করিবার ধরিছেন। যেইঠে আছিল ভামনি বন, বাঘের বাসা সেইঠে এখন ধান, পাট, তরকারি, তরমুজ হছে। কিন্তু এই পূর্ববঙ্গের ভাইরা আমাদের এইঠেকার রাজবংশী আর মদেশিয়াদের চরে ঢুকিতেই দেন না। যেন চরটা একটা

যে-বিরাট দলটা ছড়িয়ে বসে চা খাচ্ছিল তাদের ভেতর থেকে একজন লাফিয়ে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে ওঠে, এই শালা সাহা, চরের কথা এইখানে তোলার তুমি কে?

হৃষীকেশ এদিক থেকে হুঙ্কার দিয়ে ওঠে, খবরদার, লেকচার থামানো চলিবে না। হৃষীকেশের চিৎকার শেষ না-হতেই বুদ্ধিমান চিৎকার করে শ্লোগান তোলে ইন-কি-লাব, আর অত ভিড়ের ভেতরে নানা জায়গা থেকে অনেক হাত ওপরে ওঠে, কোনো-কোনো হাতে চায়ের গ্লাশও ধরা, জিনদাবাদ।

চরের দলের ভেতর থেকে একজন এক লাফে বুদ্ধিমানের সামনে এসে পড়ে–শালা। বুদ্ধিমান পাল্টা আক্রমণে প্রায় তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, শা-লো। কিন্তু কেউই কারো গায়ে হাত দেয় না। দুজন মুখোমুখি, গায়ে গা লাগিয়ে প্রায়, দুর্গা ঠাকুরের অসুরের ভঙ্গিতে পরস্পরের দিকে চোখ পাকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। যেন যে-কোনো মুহূর্তে মারামারি বাধবে।

এত গোলমালের ভেতর রাধাবল্লভ চোখ খোলে, মৃদু হাসিতে ডান হাতটা তুলে বাইকে বলে, আপনারা শান্ত হন। শান্ত হন। কথাটা হচ্ছে এই মারামারিতে কার লাভ হইবে? কথাটা হচ্ছে। আমাদের এই মাললাটাগুড়ি-ক্রান্তি অঞ্চলে অনেক কুখ্যাত জোতদার–

যে-লোকটি বুদ্ধিমানের সামনে লাফিয়ে পড়েছিল সে একটা পাল্টা লাফে রাধাবল্লভের দিকে ফিরে বলে, সে জোতদার-টোতদার নিয়্যা যা কওয়ার কও। চর নিয়্যা কিছু কওয়া চইলবে না। চরে জোতদারও নাই, আধিয়ারও নাই, সেটেলমেন্টও নাই, পাট্টাও নাই।

রাধাবল্লভ আবার তার ডান হাতটা তোলে, আপনারা শান্ত হন, কথাটা হচ্ছে চরের বা বাগানের কথা নয়। কথাটা হচ্ছে গত সেটেলমেন্টের পর আমাদের এই মাললাটাগুড়ি-ক্রান্তি এলাকায় অনেক ছু হইয়াছে, ফ্লাডও হইয়াছে, চরও জাগিছে, ফরেস্টও হইছে, জমিও হইছে, নদীও হইছে

হ্যাঁ, ঐ সব বলল সাহা, ফরেস্ট বলল, জোতদারও বলল, চরফর তুইলব্যা না, চরে শালা তোমার কৃষক সমিতি করা চইলবে না।

চরে জমি আছে আর চাষি আছে, চরের দলের ভেতর থেকে চিৎকার করে একজন বলে।

খবরদার। কৃষক সমিতির কথা তুলিলে জিভখান টানি লিব বলে হৃষীকেশ হঠাৎ লাফ দিয়ে ঐ দলটার সামনে পড়ে। সঙ্গে-সঙ্গে আলবিশ লম্বা হাত বাড়িয়ে তার পাট-পাট বাবরি ছুঁতেই সে বসে পড়ে।

শালো, কার কথা, কী কথা কুছু শুনবেক নাই, চিল্লাখে ত চিল্লাখে।

যে-লোকটি কৃষক সমিতির কথা তুলেছিল চরের দলের কেউ তার মাথায় চাটি মারে, ঠিক আছে, সাহা, বলো বলল।

কথাটা হচ্ছে, আপনারা জানেন এইবারের, সেটেলমেন্ট কৃষকের স্বার্থে করিতে হইবে।

ঠিক কথা, সাহা, শালা জোতদারগুলাক ঠ্যাঙাও আর জমিগিলা খালাশ করো।

রাধাবল্লভ হঠাৎ থেমে যায়, যেন সে বক্তৃতাটা থামিয়ে দিল মনে হয়। কিন্তু বক্তৃতাটা থামার মত জায়গায় আসে নি। সবাই রাধাবল্লভের মুখের দিকে তাকায়। রাধাবল্লভ হাসার চেষ্টা করছিল।

রাধাবল্লভ জোরে হাসতে পারে না। তার ব্রণের আর বসন্তের দাগভর্তি মুখে অসংখ্য কুঞ্চন দেখা যায়। তারপর, তার নীচের ঠোঁটটা বিস্ফারিত হয়। পান-খাওয়া জিভ আর দাঁত বেরিয়ে পড়ে। রাধাবল্লভ তার মুখের ওপর ডান হাতটা বুলিয়ে বলে, এইটা খুব মজার কথা হইছে, মজাটাতে তার এত. হাসি আসে যে তাকে আবার মুখেচোখে হাত বোলাতে হয়, জোতদাররা কয়, চরের কথা বলো, আর চরুয়ারা কয়, জোতদারের কথা বলো-।

হাসির ঝোঁকে রাধাবল্লভ চোখ ঢেকে মাথা নাড়ায়। আর চরের দলটাই হাততালি দিয়ে ওঠে।

বক্তৃতা থেমে যাওয়া, রাধাবল্লভের গলার স্বর নেমে আসা, হাসাহাসি, হাততালি–এতে আলবিশের মনে হয় বুঝি বক্তৃতা শেষই হল। সে তাড়াতাড়ি একটা পান এনে পেছন থেকে হাত বাড়িয়ে রাধাবল্লভকে দেয়। রাধাবল্লভ পানটা মুখে দিয়েও হাসতেই থাকে। তার ছোট শীর্ণ ঐটুকুমুখে অত বড় পান আর অতটা হাসি একসঙ্গে আঁটে না। থামানো লেকচার শুরু করা, পুরো হাসিটা হাসা আর পানটাকে চিবিয়ে দলা করে এক গালে ঠেলে নেয়া–এর ভেতরে যেটুকু সময় চলে যায় তাতেই যেন রাধাবল্লভের লেকচারটা শেষ হয়ে গেল বলে সবাই ধরে নেয়। আবার শুরু করতে হলে, রাধাবল্লভকে গোড়া থেকে ধরতে হবে।

রাধাবল্লভ হাসি মিশিয়ে পান চিবয়।

.

০৩২.

হৃষীকেশের গান

হৃষীকেশ সেই যে নীচে বসে পড়েছিল আর দাঁড়ায় নি, সেখানেই-উটকো হয়ে বসে আছে। ঐ বিরতির সুযোগে মুখ তুলে চিৎকার করে উঠল; চরের জমিতে জোতদারও নাই, আধিয়ারও নাই, শুধু গুড় আছে, চাটো আর চাটো, চাটো আর চাটো–

বলতে বলতেই সে উঠে দাঁড়িয়ে যাত্রার কুজা মন্থর মত দু-চার পা হাঁটে। তাতেই সবাই বোঝে হৃষীকেশ অভিনয় করবে, সবাই একটু নড়েচড়ে বসে। পিঠ নুইয়ে খুঁড়িয়ে-খুঁড়িয়ে হাঁটতে হাঁটতে হৃষীকেশ, সেই চরের দলটার সামনে গিয়ে দাঁড়ায় আর তাদের সামনে লম্বা জিভ বের করে হাতটাচাটার ভঙ্গিতে জিভের সামনে ওঠায়নামায়। যারা দাঁড়িয়েছিল বসে পড়ে। এই রিশিকেশ ঘুরে-ঘুরে। হৃষীকেশ হঠাৎ তার পেছনটা অনেক উঁচুতে তুলে দেয়, সেই উঁচু পেছন থেকে গড়িয়ে যেন পিঠটা নেমেছে, মাথাটা আরো নীচে, কিন্তু মুখটা ভোলা, তাতে জিভ বের করা। এটা হনুমানের লঙ্কাপোড়ানোর ভঙ্গি। তখন একটা বিরাট লেজ থাকে–পোয়াল দিয়ে মুড়ে-মুড়ে বানানো। হৃষীকেশ তার উঁচু পেছনটাকে আরো উঁচু করতে ও বেতালে নাচাতে পারে, একবার বায়ে, আর-একবার ডাইনে, দু-একবার দুটোই সমানে। এতে তার খুব নাম। হৃষীকেশ এবার তার পেছনটাকে চরের দলটার সামনে নিয়ে গিয়ে হঠাৎ প্রচণ্ড দুলিয়ে লাফিয়ে ঘুরে যায় আর হাতটা জিভের সামনে এদিক-ওদিক চাটা:ভঙ্গিতে ঘোরায়। চরের দলের একজন হৃষীকেশের পেছনে মারার জন্য একটা লম্বা লোমশ পায়ে লাথি ঘেঁড়ে কিন্তু হৃষীকেশ এমন পিছলে যায় যে লাথিটা লাগে না। লোকটার পা আছড়ে পড়ে। হৃষীকেশ আবার তারই সামনে পেছনটা ঘুরিয়ে নিয়ে যায়। সমবেত হাসিতে আর হাততালিতে লড়াইটা জমে ওঠে। আর, ঐ লোকটির পা-চালানো আর তারই মুখের ওপর হৃষীকেশের পেছন-ঘোরানোতে ব্যাপারটাতে যেন নাটকীয়তাই এসে যায়। হৃষীকেশ হঠাৎ মুখ তুলে সবাইকে জিজ্ঞাসা করে, কহেন আপনারা, এইটা কি চাটিবার ধইচছি আমি? এইঠে এক চাট, আবার ঐঠে এক চাট, কহেন, আপনারা।

হৃষীকেশ আবার হাতচাটার ভঙ্গিটা তার চারপাশে জমা ভিড়টাকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখায়। আর মাঝেমধ্যে বলে, কহেন আপনারা, এইটা কিসের চাটন? এক-একবার জিজ্ঞাসা করে আর তার পেছনটা উঁচু হয়ে দোলে। শেষে চরের দলটার সামনে একবার চাটন দেখিয়ে, আর-একবার পেছন নাচিয়ে হৃষীকেশ বলে, এইঠে চাটিলেও মিষ্টি, ঐঠে চাটিলেও মিষ্টি, য্যানং মোর আখি গুড়ের গজা, আর? আর? কহেন আর কী?

হৃষীকেশ গানের ঝোঁকে সোজা হয়ে এক পাক ঘোরে, আর জিজ্ঞাসা করে। ও এমনি ঘুরতে-ঘুরতে গানের পরের লাইনটার মিল খুঁজছে। দর্শক ও শ্রোতাদের মধ্যেও প্রত্যাশা তৈরি হয়ে উঠছে–একটা লাগসই পরের লাইনে গানটা পুরো জমে উঠবে। হৃষীকেশ ঘুরতে-ঘুরতে আবার চরের দলের সামনে এসে পড়ে।

হৃষীকেশ সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে, এক হাত কানের পাশে দিয়ে, আর-এক হাতে ঠোঁটটা ঢেকে চরের দলটার দিকে তাকিয়ে গলা ফাটিয়ে গান ধরে

ও-ও। আমার চরুয়া-হালুয়া ভাই।
তোর গুণের সীমা নাই।
তোর এতোখান জমিতে ভোখো না মেটে
 তোর প্যাটের সীমা নাই।
ও-ও আমার চরুয়া-হালয়া ভাই।
তোর প্যাটের সীমা নাই
তোর গলার তলায় প্যাটখান শুরু
হাঁটুর তলায় যায়।

চারদিকে হাততালির তুমুল সমর্থন। হৃষীকেশ থেমে সকলের দিকে তাকিয়ে মাথাটা একটু-একটু ঝাঁকিয়ে অভিনন্দন নেয়। পাট-পাট করা বাবরি চুল, ঝকঝকে সঁহ্যাঁত, সুপুষ্ট মুখে তাকে বেশ পেশাদার গায়কই মনে হয়। গানটা সে শুরু করে রাজবংশীদের প্রচলিত সুরেই প্রথমে একটা খুব বড় টান দিয়ে, এক-একটা নিশ্বাসের ঝোঁকে-ঝোঁকে। চরের দলের ভেতর থেকেই একজন একটা সিগারেট ছুঁড়ে দেয়। হৃষীকেশ লুফে নিয়ে বলে, থ্যাঙ্ক ইউ।

এরকম একটা গানের আসর বসে যাওয়ায় সবাই এসে ঘিরে দাঁড়িয়েছিল। দেখতে-দেখতে একটা যেন পালাগানের মত ভাবই ধরে। সেই ভিড়ের ভেতর রাধাবল্লভ আলবিশও দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে, শুনছিল। পেছন থেকে কেউ একজন একটা লাঠি দিয়ে আলবিশকে খোঁচা মারতেই আলবিশ পেছন। ফিরে তাকায়। লোকটি রাধাবল্লভকে দেখিয়ে আলবিশ আর রাধাবলভকে বাইরে আসতে বলে। ওরা দুজন যখন দেখি দেখি বলে বেরচ্ছে, হৃষীকেশ ওদের গলা শুনে দাঁড়িয়ে উঠে তাকাতেই চরের দলের একজন উঠে হৃষীকেশের হাত চেপে ধরে চিৎকার করে ওঠে, এই পুঙ্গির ভাই, থামবি না, গান যখন শুরু করছিস শেষ করতি হব। হৃষীকেশ দেখে আলবিশ আর রাধাবল্লভ ভিড় থেকে বেরিয়ে গেল, কিছু বলল না। সে আবার সকলের মুখের সামনে নিজের প্রসারিত হাতটা ঘুরিয়ে এক পাক ঘুরে আসে।

আ-আ মুই একি করলু রে
মোর চরুয়াহালুয়া ভাই
তোর সাথে মুই বিয়া বসিলু
 বাসর হইল নাই।

চারপাশের ভিড়টা জমাট বেঁধে যায়। অভিজ্ঞতায় তারা টের পেয়ে যায় হৃষীকেশ গানের নিয়ম অনুযায়ীই চরম বিন্দুর দিকে যাচ্ছে। হৃষীকেশ শেষ লাইন দুটো বার দুই গেয়ে ও গানের মুখে ফিরে গিয়ে কৌতূহলটাকে আরো বাড়ায়। এবার বেশ মোটা পেট নিয়ে হাঁটার ভঙ্গি করে ও প্রথম স্তবকটা ফিরে গায়। তারপর একটুও বিরতি না দিয়ে হঠাৎ ধরে বসে,

ও-ও-রে নিঠুর চরুয়া-হালুয়া রে-এ
তোর প্যান্টের তলায় প্যাট ডংডঙাছে
খাড়া কিছুই নাই

এতক্ষণে যেন পুরো গানটা তার প্রত্যাশিত চরম বিন্দুতে ওঠে। হৃষীকেশ ডান হাতটা সামনে নিয়ে কনুই থেকে আঙুল পর্যন্ত ঝুলিয়ে দোলায় আর ঘুরে ঘুরে গায়

তোর প্যাটের তলায় প্যাট ডংডঙাছে।
খাড়া কিছুই নাই

আর তার এক পাক ঘোরার মধ্যে হাসিটা যখন ছড়িয়ে পড়ছে আর উঁচুতে উঠছে তখন সেই চরের দলটার কাছে পৌঁছে হৃষীকেশ নিজের দুই পেটে দুই হাত দিয়ে চরম দুঃখের অভিনয়ে ডুকরে ওঠে

ও-ও রে মোর চরুয়া-হালুয়া রে-এ
মোর প্যাটের ভোখোত মিটাইলি রে
(কিন্তুক) মোর তলপেট ভরে নাই

 তলপেট চেপে ধরে ডুকরে কান্নার স্বরে হৃষীকেশ ঘুরে যায় মোর তলপেট ভরে নাই, আর কিছুটা এরকম ঘুরেই হঠাৎ সোজা হয়ে এক হাত মাথার ওপরে, আর এক হাত কোমরে দিয়ে কোমর দুলিয়ে দুলিয়ে গেয়ে যায়, মোর তলপেট ভরে নাই, মোর তলপেট ভরে নাই; তারপর ধপ করে মাটিতে বসে পড়ে এক পা, হাঁটুতে ভাজ ফেলে সামনে ছড়িয়ে, আর এক পা পুরো ভাজ করে, কাওয়ালির ঢঙে বাহাত কানের পাশে নিয়ে ডান হাত সামনে ছড়িয়ে দিয়ে কাধ থেকে কনুই পর্যন্ত ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে দ্রুত লয়ে গেয়ে ওঠে, তলপেট ভরে নাই তলপেট ভরে নাই। চারপাশের সবাই তার গান ও ভঙ্গির তালে হাততালি দিয়ে দিয়ে দ্রুত থেকে দ্রুত লয় বাড়াতে থকে। বাড়াতে বাড়াতে এক সময় সুরটা চরমে উঠে একটা চিৎকারে শেষ হয়ে যায়। হৃষীকেশ মাটি থেকে উঠে পকেট থেকে সেই সিগারেটটা বের করে ধরায়। তারপর এক মুখ হাসি নিয়ে চরের দলটার দিকে তাকিয়ে ধোয়া ছাড়ে।

.

০৩৩.

কৃষক-মজুর : আলোচনা

হৃষীকেশের গান যখন শুরু হয়েছে, অর্থাৎ রাধাবনভের বক্তৃতা থেমে গেছে–আনন্দপুরের বীরেনবাবু আর ফাগু ওরাও রাধাবল্লভকে ভিড়ের ভেতর থেকে বাইরে নিয়ে আসে। সঙ্গে আলবিশ। তারপর, সেই গাড়িদুটোর দিকে হাঁটতে থাকে। রাধাবভ বলে, এইখানেই কথাবার্তা বলেন, আপনাদের সঙ্গে অতদূরে গেলে এদিকে ত সবাই খোঁজাখুজি করবে।

আরে চলোই না। এখান থেকে কি কেউ দেখতে পাবে না নাকি, যে তুমি ওখানে কথা বলছ।

আলবিশ মাথা দুলিয়ে বলে, চলো, কমরেড, চলল, চলিবার কহথে ত চগে।

সবাই মিলে সল্ট লিক পার হয়ে গিয়ে বসে। একটু দূরে গাড়িতে, ফরেস্টের বাবুরা। সই দিকের মুখে মদেশিয়াদের যে-দলটা বসে ছিল তরা কেউ এদিকে আসেও না, তাকাও না।

বীরেনবাবুই প্রথম কথা শুরু করেন, শোনো রাধাবল্লভ, সার্ভে ত শুরু হল। এখনত মাঠখড়ার কাজ রোজই এগবে। তোমাদের জমি ত বোধহয় আজকালই পড়বে। দু-একদিনের মধ্যেই ত বাগানেও পৌঁছবে। তা তোমরা কী করবে বাগানের ব্যাপারে?

কথা হচ্ছে কিছু করার নাই। আপনাদের জোল্যান্ডের ভেস্ট জমিতে আমাদের কৃষকরা দখল নিয়ে এতদিন ধরে চাষ করে। আমরা সরকারের কাছে পাট্টা চাই।

পাট্টা ত আর তোমার সেটেলমেন্টে হবে না, সে যেখান থেকে চাওয়ার তুমি চাও। কিন্তু তোমরা এখন কোনো বোঝাপড়ায় না-এলে ত দাঙ্গা বাধবে।

দাঙ্গা বাধিলে তা আপনাদেরই সুবিধা। আপনাদেরই মুনাফা। আপনারা ত আপনাদের মজুরদের বুঝাইছেন যে আমরা জমি ছাড়ি দিলেই আপনারা ওদের বন্দোবস্ত দিবেন। তার উপর বলতে লাগছেন আপনাদের বাগান আর বাড়াতে পারেন না–এই জমি ছাড়া। তাই নাকি পার্মানেন লেবারও নিতে পারেন না। কাম যদি এত কমই আপনাদের, বাগানটা ছাড়ি দেন না।

ওটাও ভেস্ট করে দেব? তা বলে, আমাদের তুমি চাকরিবাকরি দেবে? বীরেনবাবু একটু হাসি দিয়ে কথাটা মোলায়েম করতে চেষ্টা করেন। রাধাবল্লভও চুপ করে যায়। একটু পরে বীরেনবাবু আবার শুরু করেন, এবারের সেটেলমেন্ট ত তোমাদের পক্ষেই যাবে। এখনই যা ব্যবস্থা করার করে নাও। এর পরের ভোটে যদি সি-পি-এম হেরে যায় তখন আবার তোমাদের ঝামেলা। এখন মেটানোই ত ভাল। কোম্পানিও বেকায়দায় আছে, রাজি হয়ে যাবে। আর সরকার ত এখন তোমাদেরই পক্ষে। এই অফিসারও ত শুনলাম নকশাল, মানে, ছিল। সে-ও ত তোমাদেরই পক্ষে। এখন একটা বন্দোবস্তকরে নিলে তোমাদেরই সুবিধে।

আলবিশ একটু পেছনে বসে ছিল। সে গলাটা বাড়িয়ে শুনছিল আর মাথা দোলাচ্ছিল, যেন মনে হয় সব কথাতেই তার সম্মতি আছে। মাঝে-মাঝে হ-হ-ও বলছিল। বীরেনবাবুর কথা শেষ হলে সে বলে বসে, হে-এ বাবুমন (বাবুরা], ভঁয় কহথে কি হামনিমন [আমরা] সব জমি ছোড় হুঁ? আউর বাগানিয়া-লোক এসব জমি দখল লে লিবে? ত হামনিমন কাহা যাবে?

বোধহয় অতটা ঝুঁকে আছে বলেই কথার শুরুতেই তার মুখ দিয়ে লালা পড়ার উপক্রম হয়। বার বার সেই লালা ট্রেনে ভেতরে নিতে-নিতে সৈ আবার বলে, তোঁহার মালকিকার (মালিকেরা এতনা ঠিকা মজদুরকো কাম মে লেতা রোজ, লেকিন কইকো পার্মানেন করনেসে ত বুঝ আতা হ্যায়, কিয়া, না-ই বাগানপর কাম হ্যায় বহুত, ইসকো অউর জমিকো জরুরত হ্যায়। কথা বলতে আলবিশ খুব একটা অভ্যস্তও নয়। কিন্তু তার লম্বা চেহারা, লম্বা চুল, বড় মাথায় মনে হয় তার যেন কথা আছে। তদুপরি মদেশিয়া হয়েও বাংলা আর রাজবংশী মিশিয়ে এক অদ্ভুত ভাষা তৈরি করে ফেলে, বীরেনবাবুদের সঙ্গে কথা বলছে বলেই।

আলবিশের কথার উত্তরে সেই ফাগু ওঁরাও ছেলেটি রেগে গিয়ে বলে, মালকিকারকে দোষ নাখে [নেই। বাগান বাঢ়নেকো জমিন না থে ত পার্মানেন কাম বানাই যাবে কেইসে?

আলবিশ বেশ জোরে-জোরে মাথা ঝাঁকায়, আর ঘ, ই,করে, যেন এতক্ষণে কথার আসল যুক্তিটা এই ছেলেটি ঠিক ভাবে বুঝতে পারল। ছেলেটি বেশ রেগেই কথাটা বলে। বীরেনবাবু হাত উঁচু করে বলে, ফাগু, এত রাগছ কেন, এতে ত কোনো ঝগড়ার কথা নেই। ফাগু তার লাঠিটা দিয়ে ঘাসের ওপর আস্তে-আস্তে মারে আর মুখটা একটু সরিয়ে রাখে। আলবিশ আবার কথা শুরু করতে চায়। তার ডানহাতটা সে এগিয়ে দেয় প্রথমে উপুড় করে–পঁচ আঙুল ছড়ান, তারপর চিত করে–পঁচ আঙুল, গুটোনো। একবার মুঠিও পাকায়, আলগা। সেটা যখন খুলে যায় তখন তার চওড়া কপালে লম্বালম্বা ভাজ, গভীর। কথাটা বলার চেষ্টাতেই এতটা পরিশ্রম করে, অবশেষে আলবিশ বলতে পারে, ঠিক বাত তু, ঠিক বাত। লেকিন বাগানের কাম বেশি, ফয়দা বেশি, মুনাফা বেশি ত পার্মানেন মজুর ভি বেশি হোগা, খা? তো হতে-হতে ত কোম্পানি কহতে শেকে যে, কি? না, বাগানকো এতনা কাম, আউর বাড়ানে হোগা, ত হামকো জমিন নাহি হ্যায়! হা? কোম্পানিকো হিশাব লাগানে বোলো, কুন সাল পর কেনা পার্মানেন লেবার হ-আ-আ এই শেষ হা-আ-আ-টায় এতটাই লম্বা করে ঘাড় হেলিয়ে ফেলে আলবিশ যে তার মুখ থেকে লালা গড়িয়ে তার নিজেরই হাতের ওপর পড়ে। পড়ার পর সে টের পায়। টের পেয়ে হ-আ-আ বলার জন্য মুখটা যে-ই করেছিল, সেটা বন্ধ করে। ঝোল টানার মত শব্দ করে লালা টেনে নেয়। হাতটা উল্টে ঘাসের ওপর মুছে নেয়। তারপর হাতের তালু দিয়ে ঠোঁটটা মোছে।

আলবিশের কথার পর সবাইই কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। এখানে যারা আছে তারা সবাই ব্যাপারটা এত বেশি জানে, যে কথাটা উঠতেই সবাই বুঝে যায় একথার উত্তর দেওয়া মুশকিল। কোম্পানির অজুহাত যে চা বাগানের এলাকা না বাড়ালে নতুন শ্রমিক নিয়োগ করা যাবে না, সুতরাং আনন্দপুরের জোতল্যান্ডের যে-অংশ ভেস্ট হয়েছে সেটা আনন্দপুর চা কোম্পানিই সরকারের কাছ থেকে লিজ নেবে চা বাগিচা বাড়ানোর জন্য। অর্থাৎ ভেস্ট জোল্যান্ড আবার তার জোতদারের কাছেই ফিরে যাবে ইনডাশট্রিয়াল ল্যান্ড হয়ে। সুতরাং সেই ভেস্ট জমি দখল করেছে যে কৃষকরা তাদের জমি ছাড়তে হবে। কিন্তু কোম্পানির পার্মানেন্ট শ্রমিক প্রতি বছরই কমছে। আগে কোম্পানি তার পার্মানেন্ট শ্রমিকের সংখ্যা বছর পঁচ-সাত আগে যা-ছিল তার সমান করুক, তবে ত বোঝা যাবে যে আরো নতুন শ্রমিকের দরকার। রিটায়ারমেন্ট, ছুটিছাটা, মৃত্যু এসব কোনো খালি জায়গাতেই কোম্পানি পার্মানেন্ট শ্রমিক নিয়োগ করে না। সব কাজ ঠিকা শ্রমিক দিয়ে সারছে। তাহলে এখন এই ছুতোয় ভেস্ট জমির কৃষকউচ্ছেদের এই চেষ্টা কেন?

আলবিশের কথার রেশটা কাটতে যতক্ষণ লাগে, তারপরে বীরেনবাবু বলে, কিন্তু একটা ত মীমাংসা তোমাদের করতে হবে। নইলে বাগানের শ্রমিকরাই বা তাদের হক ছাড়বে কেন?

রাধাবল্লভ তার ডান হাত দিয়ে মুখটা মুছে বলে, কিন্তু কথাটা হচ্ছে এই কথাটা আপনারা কেন সবাই। বুঝেন না চা বাগানের মজুরের হক কোম্পানির সঙ্গে, আর আমাদের এই ভেস্ট জমির হক, সরকারের সঙ্গে। আপনারা আমাদের ভিতর লড়াই লাগাচ্ছেন কেন?

রাধাবল্লভের কথার উত্তরে বীরেনবাবু একটু রাগ করেই বলেন, এই সব কথা বলে কোন লাভ নেই রাধাবল্লভ। সে কোম্পানির সঙ্গে যা তাদের করার মজুররা করবে, কিন্তু কোম্পানিকে বললেই ত বলছে আমাকে জমি দাও, আমি বাগান বাড়াব, বাগান বাড়লেই মজুরের লাভ হবে।

বীরেনবাবু রেগে ওঠায় রাধাবল্লভ আরো একটু বেশি রেগে জবাব দেয়–দেখেন বীরেনবাবু, আপনি ত কোম্পানি না?

তা ত না-ই, আমি ত কোম্পানির চাকরি করি।

 তা হলে আপনি কোম্পানির হয়ে এত কথা বলেন কেন?

তুমিও ত রাজবংশী না রাধাবল্লভ, তা হলে তুমিই বা রাজবংশীদের নিয়ে এত কথা বলো কেন?

রাধাবল্লভ উঠে দাঁড়ায়, এই আলবিশ চলেন, এদের সঙ্গে আর কী কথা হবে। ঠিক আছে, আপনারা যা করার করেন। এখন হাটে-হাটে ঢোলাই দেন রাধাবল্লভ সাহা ভাটিয়া, ও কেন রাজবংশীদের নিয়ে জমি দখল করে। তারপর চাদা দিয়া মানষি দিয়া একটা উত্তরখণ্ড পার্টি খাড়া করেন।

.

০৩৪.

কৃষক মজুর : লেনদেন

বীরেনবাবু বোঝেন একটা ভুল কথা বলে ফেলেছেন। কিন্তু এখন যদি একটা মীমাংসার সূত্র বের না করা যায় তা হলে সব মাঠে মারা যাবে। সেই কথাটাই বলতে পারলেন না। আসলে রাধাবল্লভ তার চাকরি নিয়ে কথা তুলেই মাথাটা গরম করে দিল। বীরেনবাবু ফাগুকে একটা তঁতো মেরে বলেন, এই ধরে আন, বুঝিয়ে-সুঝিয়ে, যা, তাড়াতাড়ি যা।

ফাগু দৌড়ে গিয়ে আলবিশ আর রাধাবল্লভের পথ আটকায়। সল্ট লিকের কাছের ভিড়টা থেকেও দু-চারজন গোলমালের আভাসে উঠে আসে। ফাগু তাদের দিকে ফিরে ধমক দিয়ে বলে, কিছু না খে, তফাত যাও। ফাগুর কথা শুনে তারা আর এগয় না, কিন্তু দাঁড়িয়ে থাকে।

ফাগু রাধাবল্লভকে ধরে বলে, হে কমরেড চলল, চলো, বাতচিতমে ঐসা ত হোতাই হ্যায়। তোমকো ভি কৃষক সমিতি লাল ঝাণ্ডা, হামকো ভি মজদুর ইউনিয়ন লাল ঝাণ্ড। তো বাতচিত ত হোনাই চাহে।

রাধাবল্লভের রাগ তত ছিল না কিন্তু যেন ক্লান্তি ছিল, সে বলে, আরে ভাই, এত কথা বলি কী কাজ হইবে? তোমরা কোথায় আমাদের পাকে কোম্পানিকে বলিবেন যে খাশজমির কৃষক উচ্ছেদ করা চলিবে না তা না, উল্টা কোম্পানিই তোমাদের দিয়া আমাদের উচ্ছেদ দিছে। এরপর একদিন তীরধনুক দিয়া মারামারি লাগাই দিবে আর তোমরাও লাগি যাবা।

আলবিশ রাধাবল্লভের কথার খেই ধরে বলে, আর ব্যস, লাগ যাবে দেশিয়া আর মদেশিয়ার ফাইট, পুলিশ আয়গা ব্যস–ফটাফট দুই দলের কমরেডমন এ্যারেস্ট। ফাগু বলে, আরে, ছোড় দোও উসব বাত। কায় না জানে তোমার খাশজমিঠে দেশিগা-ভাটিয়া-মদেশিয়া সব কোই হায়, চলো-চলো, বাত খতম করো

রাধাবল্লভ ফিরতে-ফিরতে বলে, ঐটাই ত তোমাদের কোম্পানির বিপদ, না-হইলে কত দাঙ্গা বান্ধাইত।

আলবিশ রাধাবল্লভকে সমর্থন দিয়ে বলে–ত–য়? তারপর দুজনেই বসে।

ফাগু তার উদ্যোগ ছাড়ে না। সে বীরেনবাবুকে বলে, আপনি ঐ সব আলগা বাত করবেন না। ই ত রাধা কমরেডনে বোলা, হামরা লেবাররাভি বলব, খাশজমিঠে কৃষকলোগকো হঠানা নাহি চোলেগা। আউর উলোক ভি হামকো বাত বোলেগা। কিয়া, ঠিক হ্যায় না রাধা কমরেড?

রাধাবল্লভ বলে, ঠিক ত হ্যায় কিন্তু বোলেগাটা কী?

 আলবিশ বলে, হ-আ, বোলো, কিয়া তোঁহার মতলব, বোলো

ফাগু বীরেনবাবুকে জিজ্ঞাসা করে, কিয়া বীরেনবাবু, ঠিক হ্যায় না?

বীরেনবাবু বলে, হা, এখন তোমরা ঠিক করো কী বলবে। তোমরা যদি দুই পক্ষ এক হয়ে কিছু বলো, সরকারও সেটা মানতে বাধ্য হবে, এই তোমার সেটেলমেন্টেই সেটা রেকর্ডও হয়ে যাবে।

ফাগু বলে, তো থোলো, কিয় বোলেগা?

ফাগু কথাটা কাকে বলে বোঝা যায় না, কারণ কথাটা সেই তুলেছে এবং জবাবটা তারই দেয়ার কথা। কিন্তু আবার বোঝা যায় যে সে এই কথাটারই জবাব বীরেনবাবুর কাছ থেকে জেনে নিতে চায়। বীরেনবাবুই তাদের আসল মুখিয়া কিন্তু তার কথার জবাবেই ত আর বীরেনবাবু শর্তটা দিতে পারে না, তাই তাকে চুপ করে থাকতে হয়। যেন ব্যাপারটা নিয়ে তারা সবাইই ভাবছে, বীরেনবাবুও। শেষে বীরেনবাবু শুরু করে, যারা জমি দখল করে আছে, মানে রাধাবাভের লোকেরা

বাধা দিয়ে রাধাবল্লভ বলে, আমার কোনো লোক নাই বীরেনবাবু, লোক থাকে ভদ্রলোকদের আর জোতদারদের। আমি ত ভদ্রলোকও না, জোতদারও না।

কেন? তোমাকে ত সবাই বাবু বলেই ডাকে, সে যাকগে, যারা জমি দখল করে আছে তাদের যাতে জমি থেকে সম্পূর্ণ উচ্ছেদ না হয় সেটা দেখতে হবে, এই ত?

শুনি না, আপনাদের কথাটা শুনি।

ফাগুরা কী বলবে বলুক। কী ফাগু?

 না, সে ত, বলনেই হোগা, জরুর।

 কিয়া? বীরেনবাবুই আবার প্রশ্ন করে।

ঐ যে, রাধাবল্লভমনকো উচ্ছেদ নাহি চলেগা।

 নাহি ত চলেগা কিন্তু জমিটা ত তোমাদেরও সই?

জরুর। চাবাগানকো খাশ, বাগানকো দেনা হোগা।

সবই ত হোগা। কিন্তু সেটা হবে কী করে সেটা বলল।

সে ত জরুর বলনে হোগা বলে ফাগু থেমে যায়। আবার কিছুটা চুপচাপ থেকে বীরেনবাবু বলে, তা হলে তোমাদের জমিটা মাপামাপি হোক আগে।

এইবার রাধাবল্লভ বলে ওঠে, মানে, আমাদের জমি আবার মাপামাপি কিসের? সরকারের ভেস্ট জমি। সরকার মাপামাপি করে দাগ নম্বর ধরি ধরি দখল নিছে। ব্যস-সরকারের ফর্ম দেখি সেটেলমেন্টে দাগ নম্বর মিলাবে। আমাদেরও পাট্টা দেয় নাই। আমরাও মাপতে দিব না। পাট্টা দিলে মাপ হবে, পাট্টা নাই ত, মাপ নাই।

বাঃ! তোমরা যদি পুরো জমিটা কার কত দখলে আছে তার একটা হিশাব বের করতে না দাও তা হলে মীমাংসাটা কী হবে?

কায় হিশাব কিয়েগা? হাম ত জানেথে কিসকো কেতনা জমিন।

আলবিশ কথা শুরু করলে রাধাবল্লভ তাকে থামিয়ে দিয়ে বলে, চু যান ভগত, চুপ যান। বীরেনবাবু আমাদের জমি মাপাইতে চায়। তো চাউক। যায় পারে স্যায় মাপুক।

রাধাবল্লভ, শোনো। যদি তোমার কথাটা মেনেও নেই, তা হলেও ত দেখতে হবে কে কতটা জমি দখল করে আছে? তাহলে কোম্পানিও সরকারকে বলতে পারে যে তোমাদের আইন-অনুযায়ী কৃষকদের পাট্টা দাও। তারপর দিয়েথুয়ে যা বাকি থাকবে সেটা কোম্পানি বাগানের জন্য লিজ নিবে। ফাগুরাও সেই কথা বলবে। কী ফাগু?

জরুর। হামনিমন বলেগা সব পাট্টা দোও, উসকে বাদ কোম্পানিকো দোও।

মানে, বীরেনবাবু, আপনারা আমাদের বলিছেন আমরা দুই বিঘা জমি নিজেদের দখলে রাখিয়া বাকি জমিটা আপনাদের দিয়া দিব?

সরকারের ত তাই নিয়ম। যা নিয়ম তাই ত করতে হবে। নইলে তোমাদের ওখানে এক-একজনের ত একহাল জমিও আছে। হৃষীকেশ ত দর্জিগিরি করে। ওর কী করে জমি থাকে?

ঐ সব কথা বাদ দেন। আমরা বিশ বছর ধরে জমি দখল রাখছি। আপনারা ত আমাকে গুলিও করছেন। মাথায় বুকে না লাগিয়া হাতে লাগিল, রাধাবল্লভ ডান হাত দিয়ে তার বা বাহুটা চেপে ধরে–বা বগলেই ছাতা, সে ত আর জমি ছাড়িবার জন্য না।

রাধাবল্লভ, তোমাকে গুলি কি আমরা করেছি? এই সব কথা বলো কেন?

ঠিক আছে। ঠিক আছে। সেটা কোনো কথা না। কথা হচ্ছে, এই যদি আপনাদের কথা হয় তবে কথাবার্তা এখানেই শেষ। আমরা জমি ছাড়িবও না, জরিপও করতে দিব না। ভেস্ট জমি ত খাশজমি। খাশজমির খতিয়ান আলাদা। তার আবার মাপামাপি কিসের?

বীরেনবাবু বুঝে যায় তার আসল প্রস্তাবটা রাধাবল্লভ প্রত্যাখ্যান করল। সেও তখন বলে, বাঃ বাঃ তোমরা খাশজমিতে আধিয়ারি চালাবে আর মজুররা বাগানের জমিতে নিজেদের হক পাবে না, না?

ঐটা বাগানের জমি না, সরকারের জমি। ঐখানে মজুরদের কোনো হক নাই। আপনারা মজুরদের সঙ্গে আমাদের দাঙ্গা বাধাচ্ছেন- রাধাবল্লভ উঠে দাঁড়িয়ে ছিল। সঙ্গে সঙ্গে আলবিশও। ফাগুও উঠে দাঁড়ায়। বীরেনবাবু বসে থেকেই বলেন, দাঙ্গা ত আমরা করতে যাব না–তোমাদের পার্টির ইউনিয়নই যাবে। তখন তাদরে সঙ্গে বুঝে। বাগানের ওয়ার্কাররাই দাবি করছে যে এই খাশজমি কতটা কার দখলে আছে, মাপা হোক।

ঠিক আছে বুঝব–আমরা জমিতেই আছি। আপনারা অফিসার ধরি আসেন। দেখি কে কার জমি মাপে রাধাবল্লভ উঠে পড়ে।

.

০৩৫.

 কৃষক-মজুর : শ্রেণীসংগ্রাম

বেরিয়ে এসেই রাধাবল্লভ বলে, ভগত, তাড়াতাড়ি জমিতে চলেন, গোলমাল হইতে পারে। তারপর সেই গানের আসরের দিকে তাকিয়ে বলে, বুদ্ধিমানকে ডাকি আনেন। রাধাবল্লভ দাঁড়িয়ে থাকে না, সে উল্টোদিকে সোজা হাঁটতে শুরু করে। আলবিশ ভিড়টার দিকে প্রায় ছোটে। তার বয়স হয়েছে। তাড়াতাড়ি হাঁটতে গেলে পিঠটা নুয়ে যায়, যেন পা যে যথেষ্ট তাড়াতাড়ি চলছে না, সেটার ক্ষতি পুষিয়ে নিতে সে কোমর থেকে মাথাটা এগিয়ে দিচ্ছে। আলবিশ ভিড়ের ভেতরে বুদ্ধিমানকে খুঁজে বেড়ায়। এক পাক ঘুরে দেখে চায়ের দোকানে বসে হৃষীকেশের গানের সঙ্গে তাল দিচ্ছে।

হেই বুদ্ধিমান উঠো, উঠো।

বুদ্ধিমান না তাকিয়ে বলে, আরে ভগত বসি যাও কেনে, দেখেন না শালো রিশিকেশ ক্যানং পালা বান্ধিছে, চরুয়ার পালা। ভিড়ের ভেতর থেকে হৃষীকেশের তারস্বর ভেসে আসে। ভগত আর দেরি করতে চায় না। রাধাবল্লভ আবার একা-একা গেছে। সে বুদ্ধিমানের পিঠে তার হাঁটু দিয়ে একটা গুতো মারে। এইবার বুদ্ধিমান আলবিশের মুখেরদিকে তাকায়, আলবিশ হাতের ইঙ্গিতে তাকে উঠতে বলে।

গত প্রায় পনের বছর ধরে বুদ্ধিমান কৃষক সমিতির সঙ্গে। আর এখানে কৃষক সমিতি মানেই এই খাশজমি দখলে রাখা, চাষ করা, লোন পাওয়া, মামলা করা এই সব। এক-একবার ভোটে এক-এক রকম সরকার এক-এক রকম আইন জারি করে। কিন্তু এই দখলি খাশজমির কোনো মীমাংসাই হয় না। দখলে রাখাই ত আইনের বার-আনি। সেই এত রকমের অভিজ্ঞতায় বুদ্ধিমান মুহূর্তে বুঝে ফেলে কিছু একটা গোলমাল হয়েছে। সে তড়াক করে লাফিয়ে উঠে আলবিশের কানে কানে বলে, কী হইল?

কমরেড তোঁহাক জুমিত যাবার কইসে।

কেন? কুনো গোলমাল বাধি গেইল?

 না জানি। বাহির চল।

আলবিশ আর বুদ্ধিমান তাড়াতাড়ি হাঁটতে শুরু করে। বুদ্ধিমান হঠাৎ দাঁড়িয়ে বলে, রিশিকেশকে ডাকি

আলবিশ দাঁড়িয়ে পড়ে। কিন্তু কিছু ভাবতে পারে না। হৃষীকেশকে ডাকা মানে ত এখন এই গানের আসরটা ভাঙতে হবে। তার মানে, এই এতগুলো লোকই ত জেনে যাবে। তার মানে, গোলমাল ত আরো পাকাতে পারে। কিন্তু গোলমাল ত এখনো শুরু হয় নি। হতে পারে। বীরেনবাবু শালোঠো ধমকসে বাত করলেক। কমরেড একেলা হো৷ না। ছোড় দে; আগারি চলো থ।

বুদ্ধিমান পা ফেলে বলে, চলো, চলো।

ওরা তাড়াতাড়িই হাঁটছিল। বুদ্ধিমান বেঁটে আর আলবিশ ঢ্যাঙা। ফলে বুদ্ধিমানের অস্থির পা ফেলার সঙ্গে আলবিশের লম্বা লম্বা পা ফেলা মিলে যাচ্ছিল।

আলবিশ বুদ্ধিমানকে বলল, শালো বীরেনবাবুঠো—

 কোন বীরেনবাবু?

আরে, শালো আনন্দপুরকো।

অ। অয় শালার ত চাকরি হবা ধরিছে হামরালার উচ্ছেদের তানে–উকিল।

 কায় উকিল হো?

ঐ শালার বীরেন। বীরেন-উকিল।

ধুত। উকিল ত কোর্টমে যাথে, কালা কোট পহিনকে। উকিল হোকে বাগানমে কিয়া করথে!

 তোমার মাথা করেগা। এ্যানং বড় উকিল যেইলার একখান মক্কেলও নাই। সেই তানে চা-কোম্পানি উমরাক চাকরি দিয়া নিয়া আসিছে–এ্যালায় এই খাশ-জমির হালুয়া-আধিয়ারের পাছত কাঠি দাও। ক একখান অফিসার হইছে, বাগানের। কী কহিছে শালা?

কহিছে কি তোমলোগ দু-বিঘা করকে লেকে বাকি জমিন ছোড় দো।

কেনে, শালোর বনুসের (বউ) পোকর মানষির তানে?

আলবিশ রেগে দাঁড়িয়ে পড়ে, আরে আগারি ত বাতঠো শুনেগা, না, এইসা বাত কর যায়গা?

কখন বলিবার ধরলেক হে, তোমাক ঐ শালো, এ্যানং কাথা?

এই, যব কমরেডকো লেকচারঠো—

কোন লেকচার? কমরেড ত তামান টাইমেই নেকচার ঝাড়িছে, ঘুমের ভিতরও কহে কুখ্যা জোতদার

এবার আলবিশ হেসে ফেলে, আরে এই গানবাজনা কো আগারি।

 কী? তোমরা ডাকি নিয়া গেইসে?

 হয়।

কায় ডাকি নিল?

 ফাগু আর বীরেনবাবু। তো হামনিমন্ ত গাই। উসকে বাত, বইঠকে বইঠকে উমনিমনকো সা বাতচিত হোথে লাগেল।

এককেবারে বইঠকে বইঠকে বাতচিত? খাড়কে খাড়কে না?

ওরা হাতির রাস্তার সেই বাকটার কাছাকাছি এসে গিয়েছিল, বায়ে ঘুরলেই সামনে, ডাইনে, সেই খাশজমির এলাকা শুরু, বয়ে ফরেস্টই চলে। চা বাগান আরো অনেক দূরে।

বাকটা ঘুরতেই ওরা দেখে সেই জমির ভেতরে আর হাতিরাস্তার ওপরে কিছু লোকজন। সেই সার্ভের লোকজনকেও দেখা যাচ্ছে। ওরা দু-জন দাঁড়িয়ে পড়ে। শালো, চেইন ফেলাচ্ছে–জমি মাপিবার ধইচছে?

বুদ্ধিমান ডাইনের ঢাল বেয়ে মাঠের ভেতর দিয়ে আলে-আলে দৌড়তে শুরু করে। আলবিশও তার হটার গতি বাড়ায়। কিন্তু সে ঢাল বেয়ে আলে নামে না। কাদায় থকথক করছে নতুন রোয়া মাঠ, আলে-আলে অত লাফাতে পারবে না আলবিশ।

কিন্তু ঘটনার জায়গাটিতে কোনো উত্তেজনা নেই, কোনো ঘটনাও নেই। সার্ভের লম্বা চেইনটা এই জমিগুলোর ওপর দিয়ে মরা সাপের মত পড়ে আছে। তার ওপর বসে আছে বেটিছোঁয়ারা, জেনিমন (মদেশিয়া চৌরা), ছাওয়া-ছোটর ঘর, লেড়কা-লেড়কি। রাধাবল্লভ সামনে কিছু লোক নিয়ে দাঁড়িয়ে। এই জমিটার একটা ঢাল ওপরে, কিছু দূরে চা বাগানের মজুরদের একটা ভিড়–কেউ-কেউ বসে, কেউ দাঁড়িয়ে। আর বাঁ পাশে হাতির রাস্তার মোড়টাতে সুহাস, বিনোদবাবু, প্রিয়নাথ, অনাথ দাঁড়িয়ে বীরেনবাবু ও আরো কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলছে।

বুদ্ধিমান এসে রাধাবল্লভের সামনে দাঁড়ায়। দীর্ঘ একটি শ্বাসে বুক ভরে জিজ্ঞাসা করে, কী হইছে কমরেড? তারপর নিশ্বাসটা ছাড়ে। মনে হয় বুদ্ধিমানের শ্বাস-প্রশ্বাসের চাপে তার গেঞ্জিটা ছিঁড়ে যাবে। এখন এতটা হেঁটে ও এইটুকু দৌড়ে আসায় তার চোখের নীচের উঁচু হাড়দুটোতে যেন ঘাম চকচকায়, ঐ দুটো আরো প্রখর হয়ে উঠতে পারে। নিশ্বাসে আন্দোলিত বুকের জন্যই কী না, বোঝা যায় না, বুদ্ধিমানের হাতদুটোও তার শরীরের পাশে ফুলে ফেঁপে দোলে।

ততক্ষণে আলবিশও পৌঁছে গেছে। রাধাবল্লভ চোখটা বন্ধ করে, ডান হাতটা মাথার ওপর কনুইয়ে ভেঙে আঙুলগুলোকে ঘাড়ের কাছে নিয়ে যায়, তারপর রোগা বুকটা চিতিয়ে, একটু কেতরে বক্তৃতার মত শুরু করে, কথাটা হচ্ছে, আমরা যখন আজ সার্ভের অফিসারের নিকট কৃষক সমিতির বক্তব্য বলিবার ছিলাম, তখন আমাকে আর আলবিশ ভগতকে আনন্দপুর চা বাগানের বাবু বীরেনবাবু আর ঐ ইউনিয়নের ফাগু উরাও ডাকি নিয়া আলোচনায় বসিবার চাহেন। আমরা আলোচনায় বসি। তাহারা অ্যালাং-প্যালাং বহুত কথা কহিছে। সেই সব কথা এখন আর বলিয়া কুনো কাম নাই। সে যাই হোক, বীরেনবাবু কহেন যে আমাদের জমি ছাড়িবার লাগিবে, মাথাপিছু দুই বিঘা করিয়া জমি থাকিবে আর এই তামান জমি মাপামাপি হওয়ার ধরিবে।

এই কথাতে, চারপাশে এমন গুঞ্জন ওঠে যাতে রাধাবল্লভকে থামতে হয়। সে হাত তুলে তাদের থামিয়ে বলে, কিন্তু সেইটাও কুনো কথা নহে। আমরা এই সব কথায় ঐ আলোচনাকক্ষ ত্যাগ করি। কিন্তু সেইটাও কুনো কথা নহে। আমরা যেই টাইমে ঐ সব আলোচনা করিবার ধইচছি, আলোচনা আর কথাবার্তা চলিছে, আর আমাদের কুননা মানষি যখন জমিতে নাই, সগায় গেইসে সার্ভের জায়গায়, রিশিকেশ গান গাহিবার ধরিছে, স্যালায় এই বীরেনবাবুর ঘর, এই কোম্পানির ঘর, আমাদের পাছত দিয়া, লুকাইয়া আমিনবাবুকে দিয়া, এইঠে আমাদের জমিতে চেইন ফেলিছে।

দম নেবার জন্য রাধাবল্লভকে থামতে হয়। তখন তার গলার সবগুলো রগ ফুলে উঠেছে। যে কণ্ঠস্বরে ও যে-ঘৃণায় সে এই কথাগুলো বলতে চায় তার সবটুকু যেন সে উগরে দিতে পারছে না। তাই তার মুখটা একটু ডাইনে বেঁকে গেছে–যদিও তার শ্রোতারা বেশির ভাগই বায়ে। আর তার নীচের ঠোঁটটা চেবড়ে যাচ্ছে। তাতে তার ক্ষয়ে-যাওয়া দাঁতের কালচে গোড়ায় জমে ওঠা থুতু দেখা যায়। রাধাবল্লভ ধিক্কারে বলে ওঠে, বীরেনবাবু আনন্দপুর চা-কোম্পানির চাকরি করেন। তিনি আলোচনার নামে আমাদের বনের আড়ালে নিয়া গিয়াছেন। আর সেই ফাঁকে এই আমিনকে চেইন দিয়্যা এইখানে জমি মাপিবার কাজে পাঠাইছেন। এইঠে আমাদের বেটিছছায়া, ছাওয়া-ছোটর ঘর সেই চেইনখান চাপি ধরি এইঠে বসি গিছে। আর সেই সময় চা বাগানের ইউনিয়নের এই শ্রমিকরা এইখানে আসিয়া লাই বান্ধি এই সব বোটিছোঁয়া আর ছাওয়া-ছোটর ঘরকে হুমকি দেখায়, ভয় দেখায়। আমি যখন এইখানে আসি পৌঁছাই তখন দেখি এই অবস্থা। আপনারা সবাই প্রস্তুত হোন। আমরা আমাদের দখলের জমি ছাড়িব না! এই জমি মাপিবার দিব না। চা-কোম্পানির আর আমলাতন্ত্রের ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করেন।

রাধাবল্লভ তার পাঞ্জাবির হাতায় মুখটা মোছে। রাধাবল্লভের পাশে দাঁড়িয়ে যারা তার কথা শুনছিল তারা আলগা হয়ে যায়। বুদ্ধিমান হঠাৎ লাফ দিয়ে সামনের আলটার ওপর উঠে মজুরদের দিকে তাকিয়ে থাকে। কয়েকবার পায়চারি করে। বুদ্ধিমানকে দেখিয়ে মজুরদের লাইনের মেয়েদের ভেতরে একটু হাসাহাসির ভাব আসে।

.

০৩৬.

কৃষক-মজুর : ভাষণসংগ্রাম

বুদ্ধিমান যে বড়, উঁচু আলটায় দাঁড়িয়েছিল, সেটা পশ্চিমে গিয়ে হাতির রাস্তার সঙ্গে মিশেছে। সেখান থেকে সুহাস ঐ আল ধরে এদিকে আসে, একা। আমিন আর চেইনম্যানেরা ওখানে দাঁড়িয়ে থাকে। বীরেনবাবুও।

সুহাস কাছাকাছি আসতেই বুদ্ধিমান শ্লোগান দিয়ে ওঠে, খাশজমির দখলদারি, আর সমবেত উঁচু আওয়াজ ওঠে, ছাড়ছি না, ছাড়িম না–

খাশজমি মাপামাপি
নাহি চলেগা, নাহি চলেগা
 খাশজমির পাট্টা চাই
লোন চাই, সার চাই

বুদ্ধিমানের গলা থেকে রাধাবল্লভ শ্লোগানটা নিয়ে নেয়। হাতটা তুলে টেনে বলে, কৃষকদের বিরুদ্ধে বাগানের মালিক ও আমলাদের ষড়যন্ত্র এই শ্লোগানটা এরা জানে না, চুপ করে থাকে। পেছন থেকে একটি মেয়ের ক্ষীণ গলায় একবার চলিবে না শোনা যায়। দম নিয়ে রাধাবল্লভই শ্লোগানের জবাবে আরো চিৎকার করে, ব্যর্থ করো। দ্বিতীয় ব্যর্থ করোতে অনেকেই গলা দিতে পারে।

এর মধ্যে সুহাস লাফিয়ে আল থেকে নেমে এদের সামনে চলে আসে।

শ্লোগান থামলেও সুহাস কথা শুরু করে না। তখন এরা আরো একটু চুপ করে, মজুরদের লাইনটাও একটু-একটু এগিয়ে আসে। সুহাস গলা না তুলে, বরং একটু হাসি মিশিয়ে বলে, আপনাদের জমি মাপা হবে না। আপনারা চেইনটা ছেড়ে দিন।

কথাটা সুহাস এত ঠাণ্ডা ভাবে বলে যে সবাই একটু অপ্রস্তুত হয়। কয়েক মুহূর্তের একটা ইতস্তত ভাব আসে, কী করা উচিত এই নিয়ে। সুহাস পাশের দিকে তাকায়। তারপর আবার মুখ ঘোরায়। অনাথবাবু আর প্রিয়নাথবাবুকে ডেকে চেইনটা গোটাতে বলবে কিনা ভাবে।

কিন্তু ওঁরা কেউ এদিকে আসছেনই না একেবারে।

ততক্ষণে রাধাবল্লভ চোখ বুজে ঘাড় কাত করে ফেলেছে। সে আর গলা চড়ায় না। কিন্তু তার শীর্ণ চোখেমুখে রাগ, ধিক্কার, কষ্ট এই সবের ছাপ বড় বেশি স্পষ্ট। রাধাবল্লভ বলে, আমরা সরকারের চেইন আটকাতে চাহি না। বিশেষত বামফ্রন্ট সরকারের চেইন, বামফ্রন্ট সরকার জনগণের বন্ধু-সরকার। কিন্তু যাহাদের চক্রান্তে এই চেইন খাশজমিতে ফেলা হইছে তাদের বিচর করিতে হইবে।

দেখুন, চক্রান্ত-টক্রান্ত কিছু নেই। আমরা এখন দাগনম্বরওয়ারি জমি মেপে যাচ্ছি। তাতেই আপনাদের জমিতে চেইন পড়েছে। আমাদের এখন এই জমি মাপার কথা নেই। আমরা চেইন তুলে নিচ্ছি, আপনারা ছেড়ে দিন। বিনোদবাবু, অনাথবাবু, প্রিয়নাথবাবু কেউই এগচ্ছেন না–সুহাস মনে-মনে একটু রেগেই আবার ডাইনে তাকায়। এখন চেইন যদি এরা ছেড়ে দেন, দিয়েছেন মনে হয়, তা হলে কি সুহাসকেই চেন গোটাতে হবে।

স্যার, এ-বিষয়ে আমাদের সমস্ত বক্তব্য শুনিলেই বুঝিবেন যে কত বড় ষড়যন্ত্রের মধ্যে এই চা-কোম্পানিরা বামফ্রন্ট সরকারকে ঠেলি দিচ্ছে।

সুহাসকে বাধ্য হয়েই দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। কিন্তু রাধাবল্লভ তার কথা শুরু করতে পারে না। মজুররা লাল ঝাণ্ডা তুলে জিন্দাবাদ জিন্দাবাদ শ্লোগান দিয়ে এগিয়ে আসে বড় আলটার ওপরে। তারপর সুহাসের উদ্দেশে আওয়াজ তোলে, খাশ জমিনকো সেটেলমেন্ট করনে হোগা, করনে হোগা, খাশ জমিনমে আধিয়ারি নাহি চলে গা, নাহি চলে গা, বামফ্রন্ট সরকারকো কানুন মাননে হোগা মাননে হোগা।

রাধাবল্লভকে বুদ্ধিমান জিজ্ঞাসা করে, কমরেড, রিশিকেশকে ডাকিব?

ডাকো ডাকো, সগাক ডাকো, খবর দাও, রাধাবল্লভ চোখ না খুলে বলে। বুদ্ধিমান ভিড়টার পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে মাঠ বরাবর ছুট দেয়–লড়াই বান্ধিবে। পেছনে শ্রমিক আর সামনে কৃষক নিয়ে সুহাস মাঝখানে। পেছনের শ্লোগান থামলে সে রাধাবল্লভকে বলে, দেখুন, আমি ত সার্ভে করতে এসেছি। আপনাদের জমি আমরা মাপব না, এ নিয়ে আর কী বক্তব্য আমি শুনব? শুধু সার্ভে নিয়ে কেউ কিছু যদি চলতে চান, বা, উত্তরাধিকার বা অংশ নিয়ে, দখল নিয়ে, সেইগুলো শুনতে পারি।

সুহাস আগেই আন্দাজ করেছিল যে এই দলের সবাই একটা এলাকায় এক লতে খাশজমি দখল করেছে। তাতে প্রায় প্রত্যেকেরই নিশ্চয় এক-দেড়-দুইহাল জমি আছে। এখন মাপামাপি করতে গেলে সেটা ধরা পড়বে। তখন ভেস্ট জমি আবার ভেস্ট হবে। তাই এরা প্রথম থেকেই আওয়াজ তুলেছে জমি মাপতে দেবে না। খাশজমি দখলে রেখেছে যে কৃষক সে ত বরং তাড়াতাড়ি রেকর্ড করাতে চায়। গবমেন্ট অর্ডার প্রথমে ছিল, খাশজমি মাপা হবে ও দখলদারদের নাম রেকর্ড হবে। পরে অর্ডার এসেছে, এখন ও-সবের দরকার নেই। দ্বিতীয় অর্ডারের কারণ নিশ্চয়ই এই রকমই আরো সব ঘটনা।

এতক্ষণ আনন্দপুরের এস্টেট অফিসারে নথিপত্র আর মৌজা ম্যাপ দেখে সুহাসের এই ধারণাটাই প্রমাণিত হয়েছে। চা-কোম্পানির মতলবও সুহাস বুঝতে পেরেছে। কিন্তু, সেই বিবাদ-মীমাংসায় তার কোনো ভূমিকা নেই। বরং সে একটু বিরক্তই হয়, বিনোদবাবু তাকে না বলে এই জমিতে চেইন ফেলে প্রথম দিনই এরকম একটা গোলমাল বাধালেন কেন?

যে-দলটা ঢালটার ওপর এসে দাঁড়িয়েছিল, তারা কিছুটা চুপচাপই সুহাস ও রাধাবল্লভের কথা শুনছিল। সুহাসের কথার পর চা বাগানের শ্রমিকদের দলের ভেতর থেকে বক্তৃতা শুরু হয়ে যায়, সাথিমন, চাবাগানকো লেবারলোক অউর কিষানলোক দুষমন নাখে। ভাই-ভাই হায়। সাথি-সাথি হায়। এককো দুখ অউরকো বুঝনা পড়লেক। নাহি বুঝলে ঔ মালিকমন মজুরকো অউর কিষানকো খতম করনে পড়ে। লেকিন সাথিমন, হামার এই ক্ষেতিপর এক খারাপি কাম হলেক, কী, না, চিয়া বাগানকো ভেস্ট ল্যাণ্ডপর কিষানলোর্কো জবরদখল কায়েম করতা-থে। এতনা জবর দখল যে ই গবমেন্টকো সেটেলমেন্ট ভি উ হোনা নাহি দেগা। লেকিন বামফ্রন্ট সরকার জনগনকো সাথি সরকার হ্যায়। ইসকো সব কাম ঠিক-ঠিক করনা পড়েক। ত হাম বলে কি, সরকারকে যো অফিসার হ্যায়, হিয়া, উ অফিসারকো সরকারকে কানুন ত সাফ-সাফ করনে তোগা। হামনিমনকো ই ডিম্যান্ড হ্যায় কি যযা ই-ভেস্ট জামিনকো পুরা মাপ করনে হোগা, অউর কোন কো পাশ কেতনা জমিন হ্যায় ইসকো লিস্ট বাহার করনে হোগা। সাথিমন, মজুরো অউর কিষানো দুষমন নাখে। মজুরকো ইউনিয়নকো লালঝাণ্ডা লাল, লাল পার্টি আর কিষান সমিতিকো ভি ওহি ঝাণ্ডা ওহি পার্টি। হামলোগ সাথি হ্যায়। উ হি দফে হামনিমন কি ডিম্যান্ড ই হায় যে সব খাশজমিকো তালাশ করনে হোগা, করনে হোগা। ই অফিসারলোগো অউর জোতদারলোগোকো যো কলকজা হোতা হ্যায়, যোক্যাপাসিটি হোতা হ্যায় উ খতম করনে হোগা। ইনকিলাব জিন্দাবাদ। ফাগু উরাওঁ বক্তৃতা শেষ করে আবার শ্লোগান দেয়, ইনকিলাব। কিন্তু এই শ্লোগানের জবাবে কোথায় যেন একটা মজাও মিশে থাকে। মদেশিয়া মেয়েদের অকারণ হাসিতে শ্লোগানের সুরটা রিনরিন বেজে ওঠে, বাজতে থাকে। তাতে শ্লোগানের একটা আদিবাসী ধরন ধরা পড়ে–কোনো কিছুই যেন গান ছাড়া বা নাচ ছাড়া হয় না, তেমনি আবার সন্দেহও উঁকি দেয় এই শ্লোগানের দল লড়াইয়ে আসে নি, এই শ্লোগানটার আদায়-অনাদায়ের সঙ্গে তাদের বাঁচামরার খুব ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক নেই।

সুহাস রাধাবল্লভের দিকে পেছন ফিরে, বাগানের দলকে বলে, আপনাদের এস্টেট অফিসারকে আসতে বলুন।

কৌন কে?

এস্টেট অফিসার, এস্টেট অফিসার, আমাদের সঙ্গে যিনি কথা বলছিলেন, ওখানে।

 ফাগু হুকুম দেয়, বীরেনকো বোলো, বীরেন এস্টেট অফিসার।

 হো বীরেনবাবু, বীরেনবাবু হো-অ, ডাকটা বাগানের দলটার সামনে থেকে পেছনে চলে যায়।

রাধাবল্লভের দিকে তাকিয়ে সুহাস বলে, দেখুন, এখন ত আমাদের রোজই সার্ভে করতে হবে। কাজটা তাড়াতাড়ি না হলে ত আপনাদেরও অসুবিধা। কিন্তু এসব হাঙ্গামা ত আমরা মেটাতে পারব না, মানে আমাদের ত এটা কাজ নয়।

কী আপনাদের কাজ নয়, স্যার, বামফ্রন্ট সরকার জনগণের বন্ধু সরকার সুতরাং

না। সে ত ঠিক আছে কিন্তু যার যা কাজ সে ত তাই করবে, আমি ত আর ধরেনফরেস্ট রেঞ্জারের কাজ করতে পারব না, এটা আমাদের, মানে সেটেলমেন্টের কাজ নয়।

কোনটা স্যার আপনাদের কাজ নয়?

এই যে, এই খাশজমি এক-একজন কতটা করে দখল করছেন, তারা পাবেন নাকি চা-কোম্পানি পাবে, এটা ত আমরা ঠিক করতে পারব না।

রাধাবল্লভ বলে, স্যার, আপনি যদি আমাদের মাপতে চান, চলুন স্যার মাপিবেন, আমরা চেইন ঘাড়ে করি আপনাকে মাপি দিব। মাপাই ত আপনার কাজ। আমরাও মাপাই চাই।

শুনুন, এই ভেস্ট জমিগুলো ত দাগে-দাগে মিলিয়ে সরকার মেপে তুবে দখল নিয়েছে, আমরাই নিয়েছি, সুতরাং এই জমির খানাপুরী বুঝারতের কাজ হয়ে আছে, আমাদের মৌজা ম্যাপেই আছে। আর, কার দখলে কে কতটা রেখেছেন সরকার তা রেকর্ড করতে নিষেধ করেছেন। অনেক জায়গায় তার একটা লিস্টি আমরা নিয়েছি। যদি সরকার চায়, আমরা জমা দেব। আপনারা যদি চান, সেরকম একটা লিস্টি বানিয়ে আমাকে দিতে পারেন।

ভগত বলে, সে আমরা লিশ্চয় দিব স্যার, আপুনি চাহিলে দিব স্যার, আমরা ত সরকারের সহিত বন্দোবস্তই চাহি স্যার, কিন্তুক খাশ জমি মাপিবার দফে বাগানের মজুরদের দাবি কেন স্যার, ই মাপামাপিতে ওদের ত কুনো ফায়দা নাই। না কি, ঐ বীরেনবাবুকো মারফৎ কোম্পানি দাঙ্গা বাধাবার ধরলেক, স্যার।

আপনি কি আমাকে ডেকেছেন? বীরেনবাবু ঢালের ওপর থেকে বলেন, নীচে নামেন না। সুহাস অপেক্ষা করে উনি নামবেন, কিন্তু বুঝে যায় নীচে কৃষক সমিতির লোকজনের ভেতর নামতে তার ভয় হচ্ছে। সুহাসের এই অপেক্ষা আর বোঝার মাঝখানের ফাঁকটুকুতে রাধাবল্লভ বলে, স্যার, এই বীরেনবাবু লোকটা আমাদের ফরেস্টের ভিতর নানান কথায় ভুলাইয়া রাখি এই সব আমিনবাবুর সহিত ষড়যন্ত্র করিয়া এইঠে চেইন ফেলিছে আর এ্যালায় বাগানিয়া মজুর আউর বস্তির কৃষকের ভিতর দাঙ্গা বাধিবার তাল করিছে।

বীরেনবাবু ওপর থেকে চিৎকার করে ওঠে, রাধাবল্লভ, বি কেয়ারফুল– সেটাও একটা শ্লোগানের মত শোনায়। বাগানের দল যেন তার জবাবেই বলে ওঠে, নাহি চলেগা, নাহি চলেগা।

সুহাস কৃষক সমিতির দিকে পেছন ফিরে বীরেনবাবুকে ধমকে বলে, শুনুন, আপনার ত এখানে কোনো ইন্টারেস্ট নেই, তবে আপনি কেন আমাদের কাজে এত ইনভলভড় হচ্ছেন আর একটা ল-অ্যান্ড-অর্ডার সিচুয়েশন তৈরি করছেন?

আমি আপনাদের কাজে কোনো ভাবেই বাধা দেইনি।

আপনি ত এদের সঙ্গে একটা কমপ্রোমাইজের চেষ্টা করছিলেন যখন এখানে চেইন পড়েছে–আর ঠিক তখনই কৃষক সমিতির দলটা পেছন থেকে আচমকা জিন্দাবাদ শ্লোগান তোলে আর হকার দিতে-দিতে হৃষীকেশ আর বুদ্ধিমান পেছন থেকে ছুটে আসে।

.

০৩৭.

কৃষকমজুর : সম্মুখসংগ্রাম

 হৃষীকেশ মৌজ করে সিগারেটের ধোয়া ছাড়ছিল। কিন্তু চরের দলটা প্রায় একসঙ্গে দাঁড়িয়ে ওঠে। তারপর হৃষীকেশকে বলে, হালায় আর সিগারেট ফুঁইকতে হবে না, তাড়াতাড়ি দৌড় লাগা। আনন্দপুরের জমিতে কাইজ্যা লাইগ্যা গিছে। চল চল।

হৃষীকেশ লাফিয়ে ওঠে। কেমন বিহুলের মত চারদিকে একবার তাকায় তাদের দলের কৈউই নেই। যারা এতক্ষণ গান শুনছিল তাদের কেউ-কেউ চায়ের দোকানটার কাছে, জ্যোৎস্না আমিনের সামনে কয়েকজন। অনেকে সোজা সেই হাতির রাস্তা ধরে উত্তরে আনন্দপুরের দিকে যাচ্ছে বেশ তাড়াতাড়ি, যেন এখানকার গানের পালার শেষে ওখানে আরো .. লম্বা পালা আছে। হৃষীকেশ কয়েক পা আস্তে-আস্তে হাঁটে। আবার আশেপাশে তাকায়। সে যেন বিশ্বাসই করতে পারে না তাদের দলের কেউ নেই। চরের দলের কেউ-কেউ তাকে ছাড়িয়ে এগিয়ে যায়। হৃষীকেশ পেছন ফিরে একবার তিস্তার দিকে তাকায়। সেই চেয়ারটা খালি পড়ে আছে, আর একটু দূরে সেই টেবিলটা। হৃষীকেশের এটা বুঝে নিতেই একটু সময় লাগে, যে-ভিড়টার মাঝখানে সে এতক্ষণ ছিল, সে-ভিড়টাতে সে এখন নেই। সিগারেটটা এতক্ষণ টানে নি। এইবার জোরে-জোরে দুটো টান দিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দেয়। চায়ের দোকানটার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করে, আরে, এই, কী হইছে? ভিড়টার ভেতর থেকে একজন চেঁচিয়েই জবাব দেয়, জানি না কী হবার ধরিছে–সগায় ত ঐঠে, হাকিম আমিন সগায়, শনিবার পাছ তোমরালার সমিতির তানে বাগানের মদেশিয়াগিলার মারামারি হবার ধরিছে।

অ্যাঁ?–এই একটি কথাতে হৃষীকেশ সম্বিৎ ফিরে পায়। এরকম একটা মারামারি লাগার আশঙ্কা ত সব সময়ই থাকে। আজ সার্ভের ব্যাপার নিয়েই সেটা লেগে যেতে পারে। কিন্তু হৃষীকেশ ছাড়া মারামারি হবে কী করে? হৃষীকেশ সঙ্গেসঙ্গেই দৌড়তে শুরু করে, যতটা জোরে পারে। কমরেড ত আর মারামারি করতে পারবে না। আলবিশও পারবে না। আর ত সব চ্যাংরাছোঁড়ার দল।তাদের কী করতে হবে, সেটা হৃষীকেশ ছাড়া আর-কেউ ঠিকই করতে পারবে না। এক বুদ্ধিমান আছে। কিন্তু বুদ্ধিমান ত একা পড়ে যাবে। হৃষীকেশ চরের লোকগুলোকে পেরিয়ে চলে যায়। এই খাড়া খাড়া, চ, আমরাও ত যাচ্ছি। হৃষীকেশ দাঁড়ায় না, দৌড়তে-দৌড়তেই ভাবে বাগানের মদেশিয়ারা যদি বস্তির মধ্যে এসে ঘরবাড়িতে আগুন লাগিয়ে দিয়ে থাকে? তাহলে ত…•! হৃষীকেশ আন্দাজের চেষ্টা করে চিয়াড়ি (তীর-ধনুক] চালানোর মত দল তাদের ভেতর পাকাতে কত সময় নেবে? কিন্তু সবই ত নির্ভর করে কে বেশি তৈরি, তার ওপর। আনন্দপুরে সমিতির সঙ্গে মারামারি বেঁধেছে আর সে এখানে গান করছে অথচ তাকে একবার না-ডেকেই সবাই চলে গেল! ডাকার টাইম পায় নাই? একটা হাঁক দিলেই ত হত, হৃষীকেশ চলি আইস–এখন দৌড়তে-দৌড়তে হৃষীকেশ সেই ডাক শোনার চেষ্টা করে। না কি ডেকেছিল, হৃষীকেশ শুনতে পায় নি, আর ওরা ভেবেছে হৃষীকেশ ত আসিছেই। তাহলে ত..। না কি, কেউ রোঝেই নাই। হঠাৎ শুরু হই গিছে? কিন্তু হৃষীকেশ ছাড়া একটা মারামারি এতক্ষণ চলছে কী করে। ততক্ষণে হৃষীকেশ আনন্দপুরের জমির কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। এই হাতির রাস্তাটা সামনে বায়ে বেঁকেছে–সেই বাকটা নিলেই আনন্দপুরের ভেস্ট জমির এলাকা। জমির কাছে এসে হৃষীকেশ বোঝে সে এত জোরে দৌড়চ্ছে যে জমিতে পৌঁছে আর দম পাবে না। সে তাড়াতাড়ি তার দৌড়ের বেগ কমিয়ে দেয়। কমিয়ে দিতেই তার বুক আর কানের পাশের শিরার দবদব শব্দে যেন কানে তালা লাগে।

হৃষীকেশ যখন বাকটার কাছাকাছি তখন দেখে উল্টোদিক থেকে বুদ্ধিমান ছুটে আসছে। হৃষীকেশকে দেখেবুদ্ধিমান দাঁড়িয়ে পড়ে চিৎকার করে, রি-শি-কেশ,ল-ডা-ই,ল-ডা-ই, বুদ্ধিমান এক লাফে নালীটা পার হয়ে জঙ্গলের মধ্যে গিয়ে পড়ে। সে ছোট কোঁতকার মত একটা ডাল নিয়ে আবার লাফিয়ে নালীটা পেরতেই হৃষীকেশ লাফ দিয়ে জঙ্গলের মধ্যে পড়ে। এদিক-ওদিক তাকিয়ে হৃষীকেশ ডালফাল কিছু পায় না। সে একটা গাছের নিচু ডালটাই টেনে নামিয়ে ভাঙে। ডালটা ভাঙে বটে কিন্তু সেটাকে গাছ থেকে ছেঁড়া যায় না। সমস্ত শরীর দিয়ে ডালটাকে টেনে নামানোর চেষ্টা করতে থাকে হৃষীকেশ। তখন বাইরে থেকে বুদ্ধিমান ডাক দেয়, হে-এ হৃষীকেশ চলি আয়, চলি আয়, এই লাঠিখান ধর।

বুদ্ধিমানের গলা শুনে হৃষীকেশ নালীটা লাফিয়ে পার হয়ে দেখে রাস্তার ওপর একটা সাইজমত ডাল। ফেলে রেখে বুদ্ধিমান সোজা দৌড়চ্ছে। হৃষীকেশ ডালটা তুলে নিয়ে একটা বিরাট হকার তুলে রে। এ-এ-এ করে সামনে হাতির রাস্তার ভিড়টার দিকে ছুটল। বুদ্ধিমানও হকার দিতে শুরু করেছে। আর হাতির রাস্তাটা দবদব করে ওঠে ওদের ছুটন্ত পায়ের দাপটে। সেই দৌড়ে, সেই হকারে আর লাঠিদুটোর ভঙ্গিতে সামনে বুদ্ধিমানের গেঞ্জিপরা আর পেছনে হৃষীকেশের জামাপরা শরীরে পেশির যেন নর্তনও দেখা যায়।

সামনে এই হাতির রাস্তাটার ওপরই ভিড়–সেখান থেকে ডাইনে জমি নেমে গেছে। সেখানেও ভিড়। দৌড়তে-দৌড়তে বোঝা যায় না কে কোন দিকে দাঁড়িয়ে। কিন্তু বুদ্ধিমান জায়গাটা দেখেই গিয়েছিল, তাছাড়া তারা জানেই কোন দল কোথায় দাঁড়াতে পারে। হাতির রাস্তার ওপরের ভিড়টা ঐ দুইজনের উদ্যত আক্রমণের সামনে ভাগ হয়ে গিয়েছিল–ওরা যাতে মাঝখান দিয়ে গলে যেতে পারে। কিন্তু তার আগেই প্রথমে বুদ্ধিমান, পেছনে হৃষীকেশ ঢাল বেয়ে নীচে নেমে যায়। সামনে একটা থকথকে কাদা জমি ছিল, লাফ দিয়ে তার আলে ওঠে। তারপর দুই-চারটা আল পেরিয়েই আবার একটু মাঠ। ভিড়টার কাছে ওরা ততক্ষণে প্রায় পৌঁছে গেছে। বুদ্ধিমান আর হৃষীকেশ লাঠিদুটোকে মাথার ওপর তুলে শা–লা, মাথা ফাটি দিম, শালা, বলে আরো জোরে হকার তুলতেই ভিড়ের ভেতর থেকে ইনকিলাব হকার উঠে ওদের গলার সঙ্গে মিশে যায়। সব সাজিয়েগুছিয়ে যেন হৃষীকেশ আর বুদ্ধিমানের জন্যই ওরা অপেক্ষা করছিল। তাদের আওয়াজ শুনেই ভিড়টা সরে তাদের ঢোকার জায়গা করে দিয়েছিল। ওরা পেছন থেকে ভিড়টার ভেতর ঢুকে পড়ে, এক লাফে বড় আলের ওপর উঠে সামনে বাগানের মদেশিয়াদের দিকে তেড়ে যায়। অত বেগে ঐ আওয়াজ তুলে মাত্র দুজনের ঐ তেড়ে আসায় বীরেনবাবু এক লাফে মদেশিয়াদের লাইনটার ভেতরে ঢুকে যান। তাতে আবার মদশিয়াদের ভেতর যারা সামনে ছিল তারা হঠাৎ দুপা পেছিয়ে যায়। তারা পেছিয়ে গেলে তাদের পাশাপাশি যারা তারাও দু-এক পা পেছিয়ে যায়। ফলে মদেশিয়া লাইনটাই একটু বেসামাল হয়ে পড়ে। এইটুকুর অপেক্ষাতেই যেন কৃষক সমিতি ছিল। রাধাবল্লভের চিৎকার শোনা যায়–ইন-কি-লাব; একটা দীর্ঘ প্রলম্বিত জিন্দাবাদ আওয়াজের সঙ্গে, যেন শ্লোগানটা শেষ করলেই দম ফুরিয়ে যাবে, কৃষক সমিতি প্রায় মিছিলের মত করেই বড় আলের ওপর উঠে মদেশিয়া লাইনটার ওপর আছড়ে পড়ে। মদেশিয়ারা সবাইই প্রথমে এক-পা দু-পা করে, তারপর প্রায় যেন দৌড়ের মত করেই, পেছুতে থাকে। এটা টের পেয়ে রাধাবল্লভ আবার রণধ্বনি তোলে–ইনকিলাব।

কিন্তু একেবারে আচমকা তাদের থেমে যেতে হয়। মদেশিয়ারা পেছুচ্ছে দেখে তাদের পেছনে এক ঢিবির ওপর থেকে তিনজন মজুর তিনটি চিয়াড়ি (ধনুক] বাগ করে ধরছে রাধাবল্লভদের দিকে। বুদ্ধিমান চিৎকার করে ওঠে, খবরদার। হৃষীকেশ ঘাড়টা ঘুরিয়ে তার দলের লোকদের চিৎকার করে বলে, চিয়াড়ি জোতো, চিয়াড়ি জোতো। কিন্তু কৃষক সমিতি বোধহয় চিয়াড়ি বের করার সময় পায় নি। রাধাবল্লভ আর হৃষীকেশ দুজনই পেছন ফিরে আঁতিপাতি খুঁজে নেয়, তাদের দলের চিয়াড়ি বেরিয়েছে কি না। কোথাও খুঁজে পায় না। ওদিকে মদেশিয়াদের চিয়াড়িতে তীর লাগানো হয়ে গেছে। একমাত্র উপায় সবাই মিলে আরো জোরে ছুটে চিয়াড়ি ছোঁড়ার আগেই ওদের ওপর হামলে পড়া। বুদ্ধিমান হকার তোলে–ইন-কি-লাব। কৃষক সমিতির দলটা নতুন উদ্যমে ছুটে যাওয়া শুরু করতেই–এবার আর বাধভাঙা বন্যার জলের মত নয়, এইবারের ছুটে যাওয়ার মধ্যে যেন মুহূর্তে একটা হিশেব হয়ে যায়, তিনটি চিয়াড়ি একবারও ছোঁড়া হলে তিনজন মারা যাবে, ওদের কাছ পর্যন্ত পৌঁছতে কবার ছুঁড়তে পারবে, কত জন মারা যাবে–আলবিশ ভগত পেছন থেকে দৌড়ে সামনে এসে মদেশিয়াদের দিকে মুখ করে দুই হাত ওপরে তুলে দাঁড়িয়ে পড়ে। কৃষক সমিতির দলটাও সঙ্গে সঙ্গে দাঁড়িয়ে পড়ে, বুক চিতিয়েই, আলবিশের ভঙ্গিতেই।

আলবিশের তখন চোখ দুটো আরো বড় হয়ে গেছে, কপালের লাইনগুলো যেন আরো গভীর, বাবরি চুল থোকা-থোকা ঘাড়ের ওপর আর হা করে থাকায় তার বড় বড় দাঁত, পান-খাওয়া লাল জিভ বেরিয়ে এসেছে।

সামনে ঢিবির ওপরে যারা চিয়াড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল তারা চিৎকার করে ওঠে, ভগত, তফাত হো। কিন্তু ভগত তফাতে যায় না, কোনো কথাও বলে না। আলবিশ ওঁরাও, ওদের একটা গোত্রের একটা অংশের পুরোহিত। কিন্তু পুরোহিত ত পুরোহিতই। ভগত ত ভগতই। কৃষক সমিতি হলেও ভগত। লালঝাণ্ডা হলেও ভগত। বুদ্ধিমানকে রাধাবল্লভ সঁতে দাঁত চিপে বলে, বুদ্ধিমান, শ্লোগান দিও না। চিয়াড়ির দলটা ভগতের ওপর তীর ছুঁড়তে ইতস্তত করছে, এত সামনাসামনি, যেন তাতে ভগতকেই মারা হয়। এখন শ্লোগান দিলে ওরা চিয়াড়ি ছাড়ার ছুতো পেয়ে যাবে। কিন্তু হৃষীকেশ আর রাধাবল্লভ এটাও বোঝে এখন যদি ওরা চিয়াড়ি ছাড়েই তাহলে তিনের বদলে ত্রিশ জন মারা যাবে। এখন আর ছুটে গিয়ে ওদের ওপর হামলে পড়া যাবে না। আর কৃষক সমিতির সবাই যেমন লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, তাতে চিয়াড়ি ছাড়লেই তিনজন পড়বে। সামনে দৌড়তে-দৌড়তে চিয়াড়ি বা গুলি খেলেও দল সামনেই ছোটে। কিন্তু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে একজন মারা গেলে, পুরো দল পেছন ফিরে দৌড়বে। তখন একের পর এক পড়তে থাকবে। রাধাবল্লভ আর হৃষীকেশ তাদের বুকের আর কপালের শিরার দবদব শব্দে যেন হিশেব কষে যায় জনা.দু-তিনের মৃত্যুতে তারা যেটা জিততে পারত, কতজনের মৃত্যু দিয়ে সেটা এখন হারতে হবে। বুকের এক-একটা আওয়াজে যেন এক-একজন করে মরছে।

কিন্তু আলবিশ কিছু একটা টের পায়। সে তার ওরাওঁ স্বভাবে বুঝে যায়–চিয়াড়ি-ছাড়ার চরম সময়টা পেরিয়ে গেল–এর পর আর চিয়াড়ি ছেঁড়া যায় না। কিন্তু দলটা, তৈরি চিয়াড়ি নামাতে পারছে না–তাতে তাদের হার মেনে নেয়া হয়। আলবিশ ঝট করে মদেশিয়াদের দিকে পেছন ফিরে দুই হাত তুলে কৃষক সমিতির দলকে চিৎকার করে বলে, বৈঠ করো, সবকোই বৈঠ করো, বৈঠ করো। রাধাবল্লভ আর হৃষীকেশ সবচেয়ে আগে বসে পড়ে। তারা পেছন থেকে টেনে বুদ্ধিমানকে বসায়। কৃষক সমিতির দল হুড়মুড় করে বসে পড়তে থাকে। আলবিশ ছাড়া।

.

০৩৮.

কৃষক মজুর : ঐক্যের সংগ্রাম

মাঠের ভেতর সুহাস একা দাঁড়িয়ে।

সদ্যরোয়া ধানখেত তখন পায়ে-পায়ে কাদা। চারাগুলো কাদার মধ্যে ঢুকে গেছে। এত মানুষের পা এই খেতটুকুকে দলেছে যে মাটির ভেতরের জল ওপরে উঠে এসেছে। সেই কাদাগলা জলে কিছু চারা ধান ভাসছে।

সার্ভের লোহার চেইনটা লম্বা হয়ে পড়ে আছে–ওদিকে সবুজ মাঠের ভেতর থেকে এখানে কাদামাটির ভেতর দিয়ে, ওদিকে হাতির রাস্তা পর্যন্ত।

বড় আলের নীচে সুহাস একা দাঁড়িয়ে জমিমাপার চেইনটা উদ্ধারে ব্যস্ত। তার কথার মাঝখানে চিৎকার করে দুজন ঢুকে পড়ার পর যেকাণ্ড শুরু হল–দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে দেখা ছাড়া সুহাসের কিছু করার ছিল না। কিন্তু সিনেমার মত দেখেও সুহাস ঠিক বুঝে উঠতে পারছিল না ওরা কি বুড়ো সাঁওতালকে দেখেই তীরধনুক নামিয়ে নিল, নাকি ভয় দেখানোর জন্যই তুলেছিল, ছোঁড়ার জন্য তোলে নি।

আজ থেকে মাত্র বছর দশ আগে ধনুক, সাওতাল, আদিবাসী, জমিন, লড়াই, টোটা, তীর..এই সব নিয়ে সুহাস যা-যা শুনত, ভাবত, দেখত, সেসব এখনই তার ওপর দিয়ে ঘটে গেল, ঘটে যাচ্ছে। অথচ এই ঘটনার একেবারে কেন্দ্রবিন্দু হয়েও সেই অতীতের, মাত্র বছরদশেকের অতীতের, কোনো ঝিলিক তার মনে কোথাওই খেলে গেল না। এতগুলো আদিবাসী মুখের ভিড় সত্ত্বেও না।

তাহলে, হয়ত বছর দশেক পরে স্মৃতিতে আজকের এই ঘটনাটায় সেই রূপকথা আবার ঝিলিক দিয়ে উঠবে, স্মৃতিতে এই ভিড়টাকে চেনা যাবে–আদিবাসীর, এই লড়াইটাকে চেনা যাবে–জমির। দশ বছর অতীতের স্বপ্ন আর দশ বছর পরের সম্ভাব্য স্মৃতির ভেতর বর্তমানে সুহাস বায়ে তাকিয়ে দেখে বিনোদবাবু, অনাথবাবু, প্রিয়নাথবাবু হাতির রাস্তা থেকে তার দিকে আসছেন। সুহাস এগিয়ে যায়, লাফিয়ে আলের ওপর ওঠে। তারপর ওদের দিকে হাঁটে। দূর থেকে বিনোদবাবু জিজ্ঞাসা করেন, স্যার, আপনার কিছু হয় নি ত?

না, তা হয় নি, কিন্তু আপনারা চেইন ফেললেন, অথচ এতক্ষণ ছিলেন কোথায়?

স্যার, যেরকম মারামারি দেখলাম, আমরা আর সাহস পেলাম না।

না। আমার জন্য বলছি না। কিন্তু চেইনটা গোটাতে হবে আপনাদের। আর আমি বুঝতে পারছি না বিনোদবাবু, চেইনটা এই জমিতে ফেলতে কে বলল।

কেন স্যার। আমরা ত পর-পর করে যাচ্ছি।

 না। তা ত করে যাচ্ছেন। এটা ত আর বর্ডার লাইন নয়, একেবারে ভেস্টেড ল্যান্ডের মাঝখানে। আমরা ত ভেস্টেড ল্যান্ড মাপছি না, মাপার কথাও নয়।

আমি ত দেখি নি স্যার, কী প্রিয়নাথ, তোমরা বিনোদবাবু বলেন। প্রিয়নাথ উত্তর দেয়, আমরা ত আর দাগ নম্বর চিনি না স্যার, আমরা যেমন লাইন বেঁধে চেইন টানছিলাম তেমনি টানছি।

অনাথ লাফিয়ে নেমে চেইন গুটোতে শুরু করে।

সুহাস ওঁদের তিনজনের দিকেই তাকিয়ে বলে, দেখুন, এরকম ভুল যেন আর না হয়, এত গোলমাল বেধে গেল এই এক কাণ্ড থেকে।

বিনোদবাবু একটু চুপ করে থেকে বলেন, আপনি কিছু বলছেন স্যার?

না। তেমন কিছু হলে ত বলতামই, তবে এরকম অদ্ভুত ভুল হওয়া ত নিরাপদ নয়।

সে ত স্যার আজকে একটা আপনার ডেনজারই হয়েছিল। তা হলে এখন ত ক্যাম্পে ফিরব স্যার?

 হাঁ চলুন।

আগে আগে সুহাস ও পেছনে-পেছনে বিনোদবাবু ফেরা শুরু করতেই স্যার, স্যার বলে পেছন থেকে হাঁকাহাঁকি শুরু হয়। সুহাস দাঁড়িয়ে পড়ে। রাধাবল্লভ, সেই বুড়ো সাঁওতাল, হাফপ্যান্ট-পরা একজন নিশ্চয়ই বাগানের, আর তাদেরও পেছনে বীরেনবাবু, ওপর থেকে এই আলে নেমে এদিকে আসছে। কাছাকাছি এসে রাধাবল্লভ, বলে, স্যার, আমরা ত আপনার জন্য বসি আছি স্যার।

আমার জন্য কেন?

না, আপনি তখন কী একটা কথা বলছিলেন, তার ভেতর একটা মিস্-আন্ডারস্ট্যানডিং মানে, ওরা দুজন, হৃষীকেশ আর বুদ্ধিমান, বীরেনবাবু বলেন। সুহাস বুঝতে পারে ওদের যুদ্ধের সমাপ্তিঘোষণার একটা উপলক্ষ চাই। তা হলে দুই পক্ষেরই একটা যুক্তি জোটে যে সরকারি অফিসারের কথা-অনুযায়ী তারা আপস করছে। নইলে তাদের নিজেদের ওপরই জয়-পরাজয় নির্ধারণের দায় চাপে।

সুহাস বলে, আমি ত আমার চেইন উদ্ধার করতে গিয়েছিলাম। এখন ক্যাম্পে ফিরে যাব। আপনাদের কি মিলমিশ হয়ে গেল?

ফাগু একটু হেসে বলে, মিলমিশ তো হোনা হোগা, কিষান অউর মজদুরকো এক পার্টি, এক ঝাণ্ডা। কিষান অউর মজদুরকে একাই

ফাগুকে থামিয়ে দিয়ে ভগত হাতিরাস্তার দিকে তাকিয়ে বলে, আরে, এম-এল-এ আসি গেলাক, এম-এল-এ।

সকলেই ঘুরে দেখে।

 বিনোদবাবু বলেন, আমরা তা হলে এই স্যার। আপনি

সুহাস দাঁড়িয়ে থাকে। এম-এল-এ এসে গেলে সে আর যায় কী করে?

.

০৩৯.

এ কি কৃষক না মজুর?

বড় আলপথটা দিয়ে বীরেন্দ্রনাথ রায়বর্মন এম-এল-এ আসছে–ধুতি-পাঞ্জাবিতে বেঁটেখাট মানুষটির চলনে কোনো জড়তা নেই। পেছনে গয়ানাথ। গয়ানাথের পেছনে সেই সার্ভে ক্যাম্পের চেয়ার উল্টো করে মাথায় নিয়ে বাঘারু।

এম-এল-এ-কে দেখা যাওয়ায় ওপরের লোকজন সব উঠে দাঁড়িয়েছে ও মারামারি হতে-হতে–হওয়ার ফলে যে-একটা সাজানোগোছানো ভাব এসেছিল সেটা ভেঙে গেছে। ওদের কাছাকাছি আসতেই গয়ানাথ পেছন ফিরে বাঘারুকে বলে, যা, ঐ দিক দিয়া উঠি আগত চেয়ারখান পাতি দে।

বাঘারু আল থেকে লাফিয়ে নীচে নামে, সেই বিধ্বস্ত ধানখেতে, তারপর ছোট আল দিয়ে এগিয়ে আবার বড় আলে উঠে, ঐ ভিড়টার কাছে পৌঁছয়। বাঘারু ভিড়ের পেছন দিয়ে ঢুকেছে। আর ভিড়টা সোজাসুজি এম-এল-এর দিকে মুখ করে আছে। ফলে, বাঘারুকে পেছন থেকে চেয়ারটা মাথায় নিয়ে ঠেলে-ঠেলে একেবারে ও-মাথায় ভিড়টার সামনে গিয়ে পৌঁছতে হবে, এম-এল-এ ওখানে পৌঁছনোর আগেই। এদিকে ভিড়ের পেছন থেকে বাঘারু যাকেই ঠেলা দেয় সেই হে-ই বলে চিৎকার করে ওঠে। ঢাকবার জায়গা আর বাঘারু পায় না। কিন্তু সে দেখতে পাচ্ছে এমেলিয়া ওদিক দিয়ে উঠতে শুরু করেছে। বাঘারু এতক্ষণ চেয়ার মাথায় ঢোকবার পথ খুঁজছিল, কারণ ফাঁক না পেলে লোকজনের মাথায়-ঘাড়ে চেয়ারের ধাক্কা লাগতে পারে। কিন্তু এখন, যখন দেউনিয়া এমেলিয়াকে নিয়ে প্রায় পৌঁছে গেছে তার আর-কিছু করার থাকে না। সে চেয়ারটা মাথা নিয়েই পেছন থেকে ঢুকে পড়ে। হে-ই, হে-ই, কায় রে হেই, হেই, বলতে বলতেই একটা গোলমাল পড়ে যায়। কিন্তু সঙ্গে-সঙ্গেই সবাই তাকিয়ে চেয়ারটা দেখে ফেলে সরে ফাঁক করে দেয়। লোকজন পেছনে চেয়ারের দিকে একবার আর সামনে এম-এল-এর দিকে একবার ঘাড় ঘোরায়। বাঘারু যখন প্রায় হাত দুয়েক দূরে, তখন এম-এল-এ দাঁড়িয়ে পড়েছে, আর, হাত দুয়েক দূর থেকেই বাঘারু চেয়ারটা মাথা থেকে নামিয়ে হুমড়ি খেয়ে এম-এল-এর সামনে চেয়ারটা মাটিতে রাখে। এম-এল-এই আচমকা দুপা পেছিয়ে যায়।

শালো, বলদ, চেয়ারের ওপর মানষি বসিবে, না মানষির উপর চেয়ার ফেলাছিস? চেয়ারটার মাথায় হাত দিয়ে এম-এল-এ দাঁড়ায় আর বাঘারু যেখানে দাঁড়িয়ে চেয়ারটা নামিয়েছিল সেখানটাতেই দাঁড়িয়ে থাকে–তার নেংটিপরা ঢ্যাঙা শরীরটা নিয়ে। যদি বাঘারু ছোটখাট হত, বা অন্তত একটু রোগা, ভিড়ের ভেতর দাঁড়ালেও যদি ওকে দেখা না যেত, যদি মিশে যেত ভিড়ের সঙ্গে, তা হলেও তাকে খেয়াল না করে থাকা যেত। কিন্তু এই বাঘারুটা ত একটা পুরনো শাল-গাছের মত–তার শ্যাওলা-ছাতাধরা শরীরে সবাইকে আড়াল করেই তাকে দাঁড়াতে হয়। এমনকি তার নেংটিটাও তার শরীরের সঙ্গে এমনই মিশে আছে যে বাঘারু যেন সত্যি একটা গাছই। কৃষক-মজুরের সমাবেশেও বাঘারু বেমানান। এখানে চা বাগানের মজুররা আছে। তাদের হাফপ্যান্ট, গেঞ্জি। কারো কারো নাইলনেরও। মাথায় তেল ও কাল চুল আঁচড়ানো। ধুতি পরাও যারা, একটু বয়স্ক, তাদের খাকি হাফশার্ট আর ধুতি ফর্শাও বটে। এখানে কৃষক সমিতির দলের সবাই হৃষীকেশ নয়, এমন-কি বুদ্ধিমানও নয়। আলবিশই আছে–তার পরনের কাপড় তু প্রায় নেংটিই, এত খাটো। কিন্তু তারও তৈলাক্ত বাবরি ঘাড়ের ওপর দোল খায়। অথচ এত বড় একটা বাঘারু, তার শরীরের চামড়া গাছের বাকলের মত, মুখ-চোখে কোনো ভাষা নেই, মাথার চুলের আলাদা রং নেই। সত্যি এখানে চলে না। এখানেও চলে না।

এ হে-ই বাঘারু, সরি যা কেনে।

 হে পাহাড়টো, তফাত হো ভাই।

হে-ই–

বাঘারু টের পায় না। আর তখন এম-এল-এ, তার একেবারে নাকের সামনে এরকম একটা প্রাচীরের মত লোক খাড়া থাকায় দুবার গলা খাকারি দেয় কিন্তু কিছু বলতে পারে না। গয়ানাথ পেছন থেকে এম-এল-এর পাশে এসে আঙুলটা তলার খেতের দিকে দেখিয়ে বলে, হে-ই বলদখান, ঐঠে গিয়া খাড়া, খাড়া থাকিব।

বাঘারু সঙ্গে-সঙ্গে সোজা হেঁটে এম-এল-এর পাশ দিয়ে, গয়ানাথের পেছন দিয়ে পরে আরো দু-একজনকে ঠেলা দিয়ে নীচে নেমে যায়। তার চেহারাটাই এমন যে অনেকখানি জায়গা না-হলে তার চলে না। ফলে, সে চলে যাওয়ার পর অত মানুষজন সত্ত্বেও জায়গাটা একটুক্ষণের জন্য একটুখানি খালি-খালি লাগে।

সেই সুযোগটা নিয়ে সুহাস এম-এল-এর সামনে এসে মনস্কার করে বলে, আমি এখানকার হলকার চার্জে

আচ্ছা, আচ্ছা, আপনারা ত হাটে ক্যাম্প করেছেন, দেখে আসছি, এইখানে কোনো প্রবলেম নাই ত? শুনলাম কি মারামারি নাকি—

সুহাস তাড়াতাড়ি না, আমার কোনো প্রবলেম নেই, বলে সবার দিকে মুখ ঘুরিয়ে যোগ করে, এদের যদি কিছু থাকে এরা বলবেন। আমি তা হলে যাই, আমাদের ক্যাম্পের লোকজন ওয়েট করছেন, ওঁদের তা আবার গিয়ে রান্নাবান্না- হ্যাঁ, হ্যাঁ, এম-এল-এ ঘড়ি দেখে, দুটা ত প্রায় বাজে। আমিও ত বসতে পারব না। আমি যাব সেই ফুলবাড়ি বস্তি, মাঝখানে ফরেস্ট, তাড়াতাড়ি যাওয়া লাগবে, ঐখানে একটা ক্যালভার্ট নিয়ে গোলমাল।

বাগানের জিপটাকে খবর দিচ্ছি, বীরেনবাবু বলেন।

ফুলবাড়ি বস্তিতে জিপও যায় না। নদী আছে, হাঁটতেই হবে। আর আপনাদের জিপগাড়ি বেশি চড়লে হাটা ভুলে যাব। তারপর আপনারা যখন জিপ দেবেন না? এম-এল-এ হাসে। সুহাসের সন্দেহ হয়, আসলে লোকটা বাগানের জিপের খোঁজেই এসেছিল, অন্তত নদী পর্যন্ত যেতে পারত, কিন্তু এখন আর জিপ নেয়া যায় না। এম-এল-এ যখন, জিপ নেবেই বা না কেন?

কিন্তু আপনি আমাদের এইখানে ক্যাম্পে হাত পুড়াবেন রান্না করে, সে ত আমাদের দুর্নাম।

 না, না, ঠিক আছে, আচ্ছা, আমি যাচ্ছি, নমস্কার।

হ্যাঁ, নমস্কার।

এইবার এম-এল-এ সোজা তাকিয়ে বলে, শুনেন, আমাদের সরকারের আমলে অন্তত আধিয়ার-রেকর্ডটা করে ফেলার জন্য এই সেটেলমেন্টের ব্যবস্থা। জলপাইগুড়িতে তিস্তা ব্যারেজের জন্যে এই এলাকার সেটেলমেন্ট অত্যন্ত দরকার। এখন আধিয়ার মানে যে আধিয়ারই, তা ত নাও হতে পারে। কিন্তু চাষটা কে করে সেইটা রেকর্ড হওয়া দরকার। সেটা অনুমতি দং-এও যদি হয়, তোক। কিন্তু হোক। কিন্তু এই সব নিয়ে নানারকম গোলমাল ধাবার চেষ্টা হচ্ছে। এখন আমাদের মধ্যে যদি গোলমাল থাকে, মারামারি থাকে সে-সব পরে মীমাংসা করা যাবে। এখন আপনারা গোলমাল করবেন না। কী রাধাবল্লভদা।

রাধাবল্লভ হেসে, চোখ বুজে, ঘাড় কাত করে থাকে। তারপর বলে, কথাটা হচ্ছে, আপনি আসছেন এ ত আমাদের সৌভাগ্যের কথা। কিন্তু আপনি ত থাকিতে পারিবেন না। একদিন আসেন আমাদের এইখানে, বসি আমাদের সব সমস্যা শুনেন, মীমাংসা করি দেন, তা হলি আর মারামারি হবে না।

হ্যাঁ। সে একদিন তাহলে, আপনাদের সুবিধেমত একদিন, যখন আমাদের সেসন বন্ধ, ঠিক করে বসলেই হবে।

আমাদের ত রোজই সুবিধা। আপনি সময়সুযোগ করি আসিবেন, আগে খবরদিবেন আর একদিন পুরা দিন পুরা রাত থাকিবেন। আসিলেন আর গেলেন এ্যানং নয়।

আচ্ছা, আচ্ছা, সে হবে, আমি জানাব চেয়ারের মাথা থেকে এম-এল-এ হাতটা তোলেন, কী ফাগু, তাহলে আমাকে ত আজ আবার ফুলবাড়ি যেতে হবে। গয়ানাথ পাশ থেকে সরে নেমে যায়।

উত ঠিকো বাত খে, সব করনে হোগা, ফাগু মাথা নাড়ে।

 কিন্তু কথাটা হচ্ছে আপনার বোধহয় আর-একটা বিষয় একটু জানা ভাল, রাধাবল্লভ বলে।

হ্যাঁ, হ্যাঁ, বলেন, বলেন, এম-এল-এ এক পা এগিয়ে আসে।

 কথাটা হচ্ছে বাগানের, চা বাগানের, কোম্পানি কোন অফিসার রাখবে, তার কী কাজ হবে, সেই সব ত আমাদের বিবেচনার বিষয় নয় কিন্তু একটা কথা আপনি কোম্পানির সঙ্গে করিবেন যে, কী যেন, এস্টেট অফিসারের কাম কী ইউনিয়ন করা?

বীরেনবাবু সামনেই ছিলেন, এম-এল-এর পাশে। তিনি হঠাৎ চাপা গলায় বলে ওঠেন, হাইলি অবজেকশনেবল। ফাগু

ফাগু ব্যাপারটা ধরতে পারে না। সে মাথাটা নাড়ায়। এম-এল-এ গলাটা একটু বাড়িয়ে অন্য গলার স্বরকে চাপা দিয়ে বলেন, সেটা ত রাধাবল্লভদা ইউনিয়নই বুঝবে, আপনি-আমি ত আর বলতে পারি না। কিন্তু এর ফলে যদি আমাদের ক্ষতি হয়, তা হলে ইউনিয়নের সঙ্গে বসতে হবে। আপনারা নিজেদের মধ্যে বসতে পারেন। আবার, আমি যেদিন আসব সেদিনও এই নিয়ে কথা বলা যাবে। কেমন? একটু থেমে তিনি যোগ করেন, কিন্তু আজ ত আর আমি থাকতে পারছি না, এখন রওনা হলেও ফুলবাড়ি পৌঁছতে বিকেল হয়ে যাবে। হ্যাঁ, হ্যাঁ, আর লেট করা ঠিক না রাধাবল্লভের কথাটা আসলে সমষ্টিমতেরই প্রকাশ, এখানকার অভিজ্ঞতায় যা নিয়ে কোনো মতপার্থক্য থাকতেই পারে না।

.

০৪০.

বাঘারুর জিপারোহণ

অনেকেই এম-এল-এ-কে এগিয়ে দিতে আসে। রাধাবল্লভ মোটা আলটায় নামে, সঙ্গে ভগত। হৃষীকেশ মোটা আলেই দাঁড়িয়ে পড়ে, রাধাবল্লভের সঙ্গে আর এগয় না। ফাগু এম-এল-এর পাশাপাশিই চলে। বীরেনবাবু একটু পেছনে। ফাগু বোঝাচ্ছিল, আপ কুচ শোচথে মাত। ই ত হামরা ঘরকা মামলা, ঘরমে ফয়শালা হোনা, কিয়া রাধা দাদা?

রাধাবল্লভ পেছন থেকে বলে, তুমি ত সবই বেশ বুঝমানের মত বলল সেই হল বিপদ, যে যাই বোঝায় তাইই বোঝো। শুনে এম-এল-এ ঘাড় ঘুরিয়ে রাধাবল্লভের দিকে তাকিয়ে হাসে।

ফাগু মাথা নেড়ে সায় দিয়ে বলে, ই ত ঠিক বাত।

এম-এল-এ তখন ফাগুর বাহুটা চেপে ধরে বলে, এই ফাগু কমরেড, শুনো। সব বাতই ত ঠিক বাত। লেকিন তোমাকে এইটা ভাবতে হবে, তোমার পার্টির পক্ষে কোন বাতটা ঠিক। সেইটা হচ্ছে সবার বড় ঠিক বাত।

হাঁ জরুর, ফাগু মাথা হেলায়। এম-এল-এ সহ সবাই একসঙ্গে হেসে ওঠে।

না। শুনো। এই যে আজ যদি আমাদের পার্টির মধ্যেই একটা দাঙ্গা হত, মারামারি-খুনাখুনি হত, পুলিশ আসত, কাগজে খবর ছাপা হত–সেটা ত আমার সরকারের বদনাম হত—

জরুর। লেকিন ঐ রিশিকো মাথা গরমাগরম্। উ কাহাসে লাঠি লেকে জিন্দাবাদ দেকে, আরে বাবা, বলে ফাগু হেসে নিতে কথা থামায়।

হ্যাঁ। নিশ্চয় রিশিকেশের দোষ। রিশিকেশ–এম-এল-এ পেছন ফিরে দেখে হৃষীকেশ নেই। রাধাবল্লভ হাসে, আর বলেন,কেন, একদিকে রিশিকেশ, সব কিছুতেই লাঠি, আর-একদিকে আমাদের ফাগু, সব কিছুতেই ঠিক বাত–এদের যে যায় বুঝায়, তাই বুঝে, রাধাবল্লভ বীরেনবাবুর দিকে তাকায়। এম-এল-এ চোখ সরিয়ে নেয়, যেন, এই ইঙ্গিতটা সে বুঝতে চায় না।

ওরা হাতির রাস্তায় উঠেছিল। রাধাবল্লভরা দাঁড়িয়ে পড়ে–আমরা আর আগাই না–তাহালি আপনি ত আসিবেন, তখনই সব কথা।

হ্যাঁ, হ্যাঁ ঠিক আছে, আপনারা যান। একটু মাথা ঠাণ্ডা করে চালাবেন। আমি আসার আগে চিঠি দিব।

আপনি কি একা-একা যাবেন নাকি ফরেস্ট দিয়া? পেছন থেকেই রাধাবল্লভ জিজ্ঞাসা করে। এম-এল-এ না ঘুরে হাত তুলে বলে, না না সে যাবে কেউ-ফাগুর বাহু এম-এল-এর হাতে ধরাই ছিল। ফলে, মনে হয় যেন এম-এল-এ চায়ই সে তার সঙ্গে আরো কিছুটা চলুক। হাত না-ছাড়লে আর গিয়ে থাকে কী করে? বীরেনবাবু একটু পেছন-পেছনই আসছিলেন। কিন্তু রাধাবল্লভরা চলে যাওয়ার পর, মনে হচ্ছে, তিনি এই দলের সঙ্গে যাচ্ছেন।

 ওরা ওদলাবাড়ি যাওয়ার রাস্তাটার মুখের দিকে এগচ্ছিল–ফরেস্টের ভেতর দিয়ে যে বড় রাস্তাটা ওদলাবাড়ি গেছে। দূর থেকে দেখাই যাচ্ছিল রাস্তাটার মুখে আনন্দপুরের জিপটা দাঁড়িয়ে। গয়ানাথ জোতদারও কাছেই দাঁড়িয়ে ছিল। সে এম-এল-একে আসতে দেখে দু-পা এগিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।

সেই মোড়, জিপগাড়ি ও গয়ানাথ কাছাকাছি আসতেই পেছন থেকে বীরেনবাবু বলেন, কী ফাগু, বাগানের জিপ ত দাঁড়িয়েই আছে।

ফাগু সঙ্গে-সঙ্গেই ঘুরে বীরেনবাবুকে বলে, হ। কমরেডকো পৌঁছ দোও, ফুলবাড়ি বস্তি। এই ঘোরার ফলেই ফাগুর বাহু থেকে এম-এল-এর হাত খসে যায়।

বীরেনবাবু একটু হেসে বলেন, তা হলে বাহাদুরকে ডাকো।

বাহাদুর জিপের পাশেই মাটিতে বসেছিল বলে তাকে দেখা যায় নি। সে উঠে দাঁড়াতেই বীরেনবাবু বলেন, বীরেনবাবুকে ফুলবাড়ি ছেড়ে দিয়ে এসো।

এম-এল-এ বলে ওঠে, আরে এইটুকু ত হাঁটিই চলে যাব, তার উপর বস্তি পর্যন্ত ত আর গাড়ি যাবে না, মাঝখানে ত নদী।

গয়ানাথ জিপের সামনের সিটের দিকে আঙুল তুলে বলে, উঠেন, উঠেন, ঐ নদী পর্যন্ত গাড়িতে যান, তার বাদে নদী পার করি দিবে–হে-এ বাঘারু।

যখন আঙুল তুলল তখন মনে হল গয়ানাথ জিপটার মালিক, যখন কথা বলল তখন মনে হল এম-এল-এর মালিক আর যখন বাঘারুকে ডাকল তখন মনে হল বাঘারুর মালিক।

গাড়িটা পেরিয়ে রাস্তার মুখে এলে বীরেনবাবু সামনের সিট দেখিয়ে বলেন, নিন, ওঠেন। কী, ফাগুও যাবে নাকি?

হাঁ, জরুর–এম-এল-এ উঠে ব্রিফ কেসটা কোলের ওপর তুলে একটু ডাইনে সরে জায়গা দেয়, ফাগু সামনের সিটে বসে। গয়ানাথ এগিয়ে এসে বলে, এই যাচ্ছে, মোর মানষি। আপনাকে নদীখান পার করি দিয়া, ফুলবাড়ি পৌঁছাই দিয়া, আসিবে।

এম-এল-এ বাঘারুকে ঠিক দেখে কিনা বোঝা যায় না। গয়ানাথ বলে, হে-এ বাঘারু, পাছত ওই কেনে।

জিপগাড়িটা তখন স্টার্ট দিয়ে তৈরি। এতই লম্বা বাঘারু যে সে মাটি থেকে পা তুলেই জিপের ভেতর ঢুকে যেতে পারত। কিন্তু পায়ের দৈর্ঘ্য আর জিপের উচ্চতার তুলনা ত কোনোদিনই তার অভিজ্ঞতায় আসে নি। তাই জিপ গাড়িটা যেন একটা পাহাড়, তাতে উঠতে বাঘারু পেছনের লোহার ডালাটার ওপর দুই হাতে শরীরের ভর দিয়ে ভেতরে গলে যেতে চায় কিন্তু তার মাথা ছাতে ঠেকে যায়। আর তখনই গাড়িটা চলতে শুরু করলে বাঘারু প্রায় হুমড়ি খেয়ে ঐ ঢাকনার ওপরই পড়ে। কিন্তু পড়তে-পড়তেই তাড়াতাড়ি হাতের ভরে উঠে, পা দুটো উঁচু করে, ডান হাঁটু ঐ রেলিঙের ওপরে তুলে দিতে পারে। ফলে রেলিংটার ওপরই বসে পড়ে। বাঁ পায়ের পাতা রাস্তায় ঘসে। তখন সে জিপের ভেতর গড়িয়ে যায়। তার লম্বা, পেশল, নগ্ন, রোমহীন, বা পাটা জিপের পেছনে শূন্যতার ফ্রেম জুড়ে অনেকক্ষণ থাকে। তার মাটিলেপা, থ্যাবড়া, হুকওয়ার্মের ফুটোয় দাগি পায়ের তলাটা খুব শাদাসিধে সোজা টাঙানোই যেন, ওখানে, পোস্টারের মত। আর ঐ পাটা অমনই যেন থাকার কথা ওখানে। নিজেকে টেনে হিঁচড়ে ভেতরে ঢোকাতে থাকে বাঘারু, যতক্ষণ তার মাথা সামনের সিটের পেছনে গিয়ে ঠেকে না যায়। আর নুড়িছড়ানো বর্ষার রাস্তার খানা-খন্দে লাফিয়ে-লাফিয়ে হেলেদুলে, কাতরে-বেঁকে জিপ গাড়িটা পাহাড়ের ঢাল বেয়ে গড়ানো বোল্ডারের মত বেতালে-বেচালে গড়িয়েই যাচ্ছিল। তাতে বাঘারুর এই ঝাপানো আর গড়ানো টেরই পাওয়া যায় না। শুধু বাহাদুর একবার টেরিয়ে দেখে নিয়েছিল। জিপের অতটুকু জায়গায় নিজের অতবড় শরীরটাকে সেঁদিয়ে, কাত হয়ে, উপুড় হয়ে, হাঁটু আর হাতের পাতার ওপর ভর দিয়ে উঠে, বসে, শেষে আবার ঘুরে বাইরের দিকে তাকানো–এমনিতেই মেহনত ও কৌশলের ব্যাপার, তদুপরি জিপের ঝাঁকুনিতে প্রায় অসম্ভবই হয়ে উঠতে চায়। শেষ পর্যন্ত জিপের মেঝেতে বসে, পেছন ফিরে, পেছন থেকে ফরেস্টের দিকে তাকাতে পারে বাঘারু।

এমনভাবে ফরেস্টেকে ত আর দেখে না, ফরেস্ট সব সময়ই প্রথমে বাঘারুর সামনে, তারপরে সে ফরেস্টের ভেতরে, তারপরে ফরেস্ট তার সব দিকে-ওপরে-নীচে, ডাইনে বায়ে, সামনে-পেছনে, শেষ পর্যন্ত ফরেস্ট তার গায়ের সঙ্গে মিশে যায়। এমনি হয়ে আসে বরাবর। কিন্তু পেছনে বসে ফরেস্টের উঁচু-নিচু, মাথা-গোড়া, কোনো কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। সেই আড়াল থেকে ফরেস্ট দুপাশে হু-হুঁ গলে গিয়ে রাস্তা বানিয়ে দিচ্ছে। ফরেস্ট স্থির থাকে, পাহাড়ের মত, আর বাঘারুই সেখানে ঢোকে। জিপের পেছনে সেই স্থির, ফরেস্ট তার দুপাশ দিয়ে সরে যায়। যেন ফরেস্টের ভেতর সে ঢুকছে না–ফরেস্টের ভেতর এই কাল রাস্তাটা সিদচ্ছে। পেছনে যতদূর চোখ যায় কাল রাস্তাটা লম্বা থেকে লম্বা হয়ে যাচ্ছে, আরো লম্বা। বাঘারু একটু বেশি লম্বা বলেই হয়ত তার চোখ একটু ঠেকে যায় সামনের ফাঁকটার ওপরে। তাই সে গাছের মাথা দেখতে পায় না। শুধু তাই নয়, তার মনে হচ্ছিল যেন এই বনের তলার জংলার ভেতর দিয়ে একটা পাতালের মত বনে সে ঢুকে যাচ্ছে। পাতালের মত বনে-যেখানে বনের মাথা দেখা যায় না, শুধু তলা দেখা যায়।

এই কি ফরেস্টারচন্দ্র বাঘারুবর্মনের ফরেস্ট? এর ত কোনো কিছুই সে চিনতে পারছে না, কোনোদিন যে এই ফরেস্টে সে ছিল তাও যেন মনে হচ্ছে না। অথচ চোখ বেঁধে ছেড়ে দিলে, বর্ষার এই জংলায় আর লতায় পা-জড়িয়ে যেতে পারে বটে, কিন্তু বড়, পুরনো কোনো গাছের সঙ্গে ঠোক্কর খাবে না, নিশ্চয়ই। এখন জিপের ভেতর থেকে, পেছনে সে বুঝতেই পারছে না, কোন দিক দিয়ে কোথায় যাচ্ছে।

জিপ গাড়ির পেছন থেকে, গাড়ির ভেতরে ঝাঁকুনি খেয়ে লাফাতে-লাফাতে, কাত হয়ে, হোঁচট খেয়ে বাঘারু তার এই চিরকালের ফরেস্টটাকেই অচেনা হয়ে যেতে দেখে, যেমন সে দেখে যখনই কখনো এরকম গাড়িতে দেউনিয়া তাকে তুলে দেয়। আসিন্দিরের ভটভটিয়ার পেছনে তাকে বসালে এরকম লাগে না। তখন ত সবই সামনে, তার বুকের সামনে। তাই, গাড়িটা থামার পর, প্রথমে ফাগু লাফিয়ে ও তার পরে এম-এল-এ ব্রিফকেসটা নিয়ে একটু ঘষটে, নেমে গেলেও বাঘারু নামতে পারে না। ফাগু আর এম-এল-এ নেমে যাওয়ার মানে যে তারও নামা–এই অভ্যস্ত প্রয়োজনীয় বোধটাও অর লোপ পেয়ে বসে থাকে মোটর গাড়িতে গতিতে অতিক্রান্ত দূরত্বটুকু বুঝতে। এত তাড়াতাড়িই কি ফুলবাড়ির নদীর পারে পৌঁছে যাওয়া যায়? এ যেন ফরেস্টটাকে টেনে ফুলবাড়ির নদীটার কাছে আনা। চারপাশের বনজঙ্গলের যে-পরিচয় অন্তত বাঘারুকে কিছু আশ্বস্ত করতে পারত–তাও এই জিপের আড়াল থেকে অদৃশ্য।

বাহাদুর হঠাৎ গিয়ার বদলে সঁ-আঁ করে জিপটা পেছিয়ে নেয়। তখন ফরেস্টটা বাঘারুর সামনে, সবটুকু দেখতে না পেলেও, সামনেই। ফরেস্টের ভেতরে সেই ঢুকছে, ফরেস্টটা স্থিরই আছে–এই বোধটুকু সে অন্তত ফিরে পায়।

কিন্তু পরক্ষণেই বাহাদুর আবার একটা ধাক্কায় সামনে এগিয়ে যায়। বাঘারু হুমড়ি খেয়ে পড়ে। গাড়িটা সবটুকু ঘুরিয়ে আনন্দপুর ফিরে যাওয়ার জন্য দাঁড় করিয়ে বাহাদুর ঘাড় না-ঘুরিয়ে বলে, উতরো।

তখন বাঘারুর সামনে, একটু দূরে, ব্রিফকেস হাতে এম-এল-এ আর ফাগু। গাড়িটা ঘুরে দাঁড়াতেই ফাগু ছুটে এসে সামনের সিটে বসার পরও বাঘারুর জিপ থেকে নামা শেষ হয় না। সে, বাহাদুরের কথা শোনামাত্র দাঁড়িয়ে পড়েছিল। মাথায় ঠোক্কর খেয়ে বসে পড়েছে। তারপর ঘষে-ঘষে ঐ পেছনের ডালাটার কাছে এসে এক পা বের করে। কিন্তু সে পা মাটিতে রাখার আগেই জিপ গাড়িটা হু-স করে বেরিয়ে যায়। ফাগু পেছন ঘুরে লাল সেলাম বলে এদিক-ওদিক ঘাড় ঘোরায়, কিন্তু এম-এল-এ-কে পায় না। তখন রাস্তা জুড়ে বাঘারু দাঁড়িয়ে। পেছন থেকে এম-এল-এ ডাকে, চলেন ভাই, ঝট করি নদীখান পার করি দেন।

জিপগাড়ি যখন আর দেখা যায় না, তখনো আওয়াজ আসছে। বাতাসে পেট্রলপোড়া গন্ধ। বাঘারু হাঁটতে শুরু করে। পেছনে এম-এল-এ। বাঘারু একটা ছোট ডালকে লাঠি বানায়। সেটা দিয়ে দু-পাশের জঙ্গল সরায়। একটুখানি বন পেরলেই মাঠ। মাঠ পেরলেই নদী। নদী পেরলেই ফুলবাড়ি।

.

০৪১.

মায়ের বাঘারুপ্রসব, বাঘারুর ব্যাঘ্ৰনিধন ও এম-এল-এ তরণ এবং বাঘারুর প্রথম সংলাপ নিয়ে আদিপর্বের শেষ অধ্যায়

কয়েক-পা যেতেই বনের গন্ধ সারা শরীরে ভর করে। ঝিঁঝির ডাক ক্রমে বাড়ে। দুজন দুজনের নিঃশ্বাসের শব্দ শুনতে পায়। যেন, এরকম অনেকক্ষণ হাঁটতে হবে, ওদের, যেমন হয়, বনে।

এম-এল-এ পেছন থেকে জিজ্ঞাসা করে, তোমরালার নামখান কী হে?

বাঘারু তার হাতের লাঠিটা দিয়ে সামনের জঙ্গল সরাতে-সরাতে বলে, ঐখান ত বড় লজ্জার কথা বাবু।..

কোনখান?

 ঐ। মোর নামখান।

ধুত, নামতে আর লজ্জা কী আছে? নাম ত নামই।

মোর নামখানি বাড়ি যাছে।

কায় বাড়ি যাছে?

 যত টাইম যাছে, মোর নামখান সলসল করি বড় হয়্যা যাছে। এ্যালায় এ্যাতখান বাড়ি গেইছে যে ঐ নামখানে মুই আর আটো না। ঢলঢলাছে।

ত নামখান ক কেনে, শুনি।

কছি, এমেলিয়া বাবু। কিন্তু তোমাক মোর নামটা ছোট করি দিবার নাগিবে। য্যানং সগার নাম ছোট হবার ধরে, মোর নামখানও ছোট হওয়া নাগিবে।

বাঘারু খুব নিচু গলায় কথা বলছিল। আর লাঠিটা দিয়ে সামনের জঙ্গলটা সরাতে-সরাতে এগচ্ছিল। এম-এল-এ দেখে, জঙ্গলটা যেন কোনো সময়ই বাঘারুর কোমর ছোয় না। সে যেন মাঠের ওপর দিয়ে হাঁটছে, এমনি তার হাঁটা, আস্তে-আস্তে। বাঘারুকে চালু রাখতে এম-এল-এ একটু অন্যমনস্ক গলায়ই বলে, নামখান আবার কার ছোট হইল রে?

সগারই ত ছোট হয় বাবু, মোরখানই এক বাড়ি যাছে। ধরো কেনে, মোর দেউনিয়া গয়ানাথ রায়বর্মনখান হয়্যা গিছে গয়া-জোতদার–

এম-এল-এ খুক করে হেসে ফেলে, আর?

ধরো কেনে, রাধাবল্লভখান হয়্যা গিছে রাধু-লিডার

 এম-এল-একে এবার আর-একটু বেশি হাসতে হয়, আর?

ধরো কেনে, তোমার নামখানও ত ছোট হবার ধরিছে। ছোট হয়্যা যাছে, আর বাড়িবে না।

কেনে?

আগত আছিল বীরেন্দ্রমোহন রায়বর্মন, এ্যালায় হছে এ্যামেলিয়া।

 ধুত, এইটা কি নাম নাকি, এইটা ত কাম।

ঐ ঐ বাবু, কামতই ত নামখান হয়। মোর ত সেইটাই গোলমাল। হাজারিয়া কাম। হাজারিয়া নাম। কামও বদলি যাছে, নামখানও বাড়ি যাছে। এক কামের পরে আরেক কাম, এক নামের পর আরেক নাম।

এম-এল-এ বলে ওঠে, তায় তোমাক মালষিলা ত বাঘারুই কয়?

মুখ না ফিরিয়ে চলতে-চলতে বাঘারু বলে, মানষিলা ত মোক বাঘারু নামখান দিয়াই খালাশ, কিন্তু মুই লাগাম কুনঠে? মানষিলা জানে না, মোর আর-একখান নাম আছিল। গয়ানাথ দিছে।

গয়ানাথ নাম দিছে?

 হয়। গয়ানাথ ত মোক নাম দিয়ে বাবু। গয়ানাথ মোর মাও-এর দেউর্নিয়া, মোর দেউনিয়া, জমির দেনিয়া, ফরেস্টের দেউনিয়া, তিস্তা নদীর দেউনিয়া, ভোটের দেউনিয়া। ত ধরো, এ্যানং একখান ভোটের আগত কহিল, হে বাউ, ভোটত তয় নামখান দিয়া দিছু। ত মুই পুছিলো, কী মোর নামখান। ত কহিল, ফরেস্টচন্দ্র বর্মন, মনত রাখিস ফরেস্টচন্দ্র বর্মন। ত মুই মনত রাখি দিছু ফরেস্টচন্দ্র বর্মন। মনত রাখি ভোট দিছু–গয়ানাথের ভোট। কিন্তু তার বাদে একেদিন সাহেব দেখিলো–পায়ে গামবুট, মাথায় টুপি, মিলিটারির নাখান ফরেস্টারসাহেব ফরেস্টের ভিতর হাঁটিছে, য্যান মাখনা হাতি। ত মুই মোর নামখান বদলি ফরেস্টার করি নিছু, মোর পাকা নাম। লিখা আছে ফরেস্টচন্দ্র বর্মন। কিন্তু মুই কহি ফরেস্টারচন্দ্র বর্মন। এম-এল-এ ততক্ষণে বাঘারুর পেছনে। তাকালে সে দেখতে পায়, বাঘারুর উদোম পিঠে ও পাছায় নানা দাগ–গাছের কাণ্ডে ফাটা-ফাটা যেমন কত দাগই থাকে।

তা তোর নামখান শেষ হইল কুনঠে?

ঐটাই ত কাথা। মুই ত সবখান নামই রাখি দিছু–ফরেস্টারচন্দ্র বাঘারুবর্মন। বর্মন এইঠে অনেক মিলিবে, ফরেস্টচন্দ্রও অনেক পাবেন, রায় বর্মনও আছে, কিন্তু বাঘারু-বর্মন এই একোখান। নামখান। এ্যানং বড় হয়্যা গেইল যে ঢলঢলাছে, খলখলাছে, খুলি-খুলি যাছে।

ত মানষি ত তোমার নামখান কাটছাট করি টাইট করি নিসে?।

ক্যানং?

 সগায় ত তোমাক বাঘারুই ডাকে, তুমিই ত এ্যালায় নামখান বড় করিবার ধরিছেন।

হে-এ এমেলিয়া বাবু। তোমরালার ক্যানং কাথা? আরে বাঘারুখান ত মোর নাম না-আছিল। মানষিলা দিসে–

তার আগত কী আছিল?

কহিছু না, ফরেস্টারচন্দ্র বর্মন। তার আগতও আছিল একখান।

 তার আগতও তোমার নাম আছিল?

আছিল ত। মোর জন্মিবার আগতও মোর একখান নাম আছিল।

জন্মিবার আগত?

হয়। হয়। মোর ত একখান মা আছিল। হয়।

তা ত থাকিবার নাগেই হে।

ত মুই এখান এ্যানং চায়ের বাগানের ফ্যাক্টরির চোঙের নাখান মানষি। মোর এখান মা না থাকিলে চলে? মা না থাকিলে মুই আসিম কুনঠে?

ত ঠিকই। কোটত আছিল তোমার মাও?,

মোর মাওখান ত গয়ানাথেরই আছিল। কাজকাম করিত। খোয়া খাইত। আর ফরেস্টের ভিতরত গিয়া শুখা কাঠ, ডালপালা কুড়ি আনিবার নাগিত। আস্ত-আস্ত ডাল। আস্ত-আস্ত গাছ। আনি গয়ানাথের খোলানে পাঞ্জা করি রাখিত। দিন নাই, রাতি নাই, কাঠ কুড়ি যাছে, কুড়ি যাছে। য্যালাই পাহাড়ের নাখান উচা হবার ধরিত, গয়ানাথ একখান ট্রাক ধরি আনি বেচি দিত। মুই য্যালায় মোর মাওয়ের প্যাটত আসিছু, প্যান্টের ভিতরত আসি গেইছু, মাওয়ের প্যাটখান বড় হওয়া ধরিছে, সগায় জানি গেইছে মুই আসিম, মুই আসিম, স্যালায় সগায় মোক ডাকিবার ধইচছে–কুড়ানিয়ার ছোঁয়া–

ত, এইখান তোমারালার প্রথম নাম।

তার আগত মোর নামখান আর আসিবে কোটত। কিন্তু মুই মাওয়ের প্যান্টের ভিতর ত বড় হওয়া ধইচছি আর মাওয়ের প্যাটখান এককেরে ঢাক হয়া যাছে, ফাটি যাবে কি যাবে না, সেই টাইমত একদিন বাঘারু ঘুরে এম-এল-এর মুখোমুখি দাঁড়ায়, মাওয়ের মোর প্রসববেদনা উঠিবার ধরিছে। মুই জন্মিবার ধইচছি। মাওয়ের প্যাটখান ফালা ফালা করি বাহির হওয়া ধইচছি। আর মাওখান মোর জমিত লুটাপুটি খাছে, লুটাপুটি খাছে–

বাঘারু তার কোমর বরাবর জঙ্গলের দিকে তাকিয়ে, যেন ওখানে ওর মা এখনো ছটফটায়। তার সেই দেখাটা চলতে থাকে নিজের জন্ম দেখা পর্যন্ত। তার থেকে কয়েক হাত দূরে এম-এল-এ সেই জায়গাটার দিকে তাকিয়ে থাকে।

মুইত বাহির হয়্যা গেছু। মাওয়ের প্যাট থিকা বাহির হয়্যা গেছু।

আবারও তাকে চুপ করতে হয়–মাটির ওপর শ্রান্ত মা ও নতুন বাচ্চাকে দেখতে। দেখা শেষ হলে, ফিস ফিস করে বলে, মুই ত এ্যানং কান্দিবার ধরিছু যে জঙ্গলের গাছঠে পাখি উড়ি গেইসে, সেই শালগাছ থেকে ওড়া পাখিদের দেখতে ও আকাশে চোখ তোলে। এম-এল-এও ঘাড় ভেঙে ওপরে তাকায়, যেখান থেকে আকাশ ভেঙে বনস্পতি মহীরুহ নেমে আসছে। বাঘারু দেখে, পাখিগুলো আকাশে পাক দিচ্ছে, শালগাছের মগডালে বসছে, আবার উড়ছে, পাক দিচ্ছে। সেই পাখিদের তীক্ষ্ণ ডাক ওপরে। আর সেই বাচ্চার তীক্ষ্ণ কান্না নীচে। ঐ নিস্তব্ধ ঝিঁঝি-ডাকা বনান্ত তোলপাড়। বাঘারু খুব গোপনে বলে, মূই কান্দি আর পাখি চিল্লায়। পাখি চিল্লায় আর মুই কান্দি। কিন্তু নাড়ী কাটিবে কায়? ক্যানং করি? বাঘারু চোখ তোলে না। বনতলে নাড়ীতে বাধা এক মা ও এক শিশু বিচ্ছিন্ন হয়ে আছে।

মোর মাও-এরঠে একখান ছোট কুড়ালিয়া আছিল। এই ধরো কেনে, ডাল কাটিবার তানে। সারাদিন ত কাটাকুটি চলিত। ধারও আছিল চকচকা। ঐ ছোট কুড়ালিয়াখান দিয়া মাও নিজের। নাড়ীখান কাটি দিল। ব্যস। কাটি দিল। বাঘারু তার বুক ও বাহুর দিকে তাকায়, ফিরে-ফিরে তাকায় আর এম-এল-একে দেখায় যেন তার এই সাবালকতা সদ্য, ঐ নাড়ীকাটার পরই। তারপর বলে, একটু হাসি মিশিয়ে, ওর তানে ত সগায় মোক কহিত,কুড়ালিয়া-কাটা। ত দেখো কেনে, জন্মিবার আগতঠে মোক নিয়া একখান পালাগান বান্ধা হওয়া ধরিছে–কুড়ানিয়ায় ছোঁয়া। কুড়ালিয়া কোটা।

বাঘারু আবার হাঁটতে-হাঁটতে, জঙ্গল সরাতে-সরাতে বলতে শুরু করে, রাবণের যেইলা গরু আর মহিষ, গয়ানাথের স্যানং বাথান। গয়ানাথের য্যানং গরুর বাথান, মহিষের বাথান, স্যানং গয়ানাথের মানষির বাথান, স্যানং গয়ানাতের জমির বাথান। য্যানং এই পৃথিবীর তামান মানষি গয়ানাথের আধিয়ার আর হালুয়া, এই পৃথিবীর তামান গরু আর মহিষ গয়ানাথের বাথানের গরু আর মহিষ, স্যানং এই পৃথিবীর তামান জমি গয়ানাথের জমি, তামান ফরেস্ট গয়ানাথের ফরেস্ট, ফরেস্টের ভিতর য্যালা হাতি আর বাঘ স্যালায় গয়ানাথের হাতি আর বাঘ–

ত এ্যানং একোদিন, আপলাদের ফরেস্টের ভিতরঠে দুপহরের টাইম মুই আসিবার ধরিছু। মনত না আসে কোটত আসিছু, কোটত যাছু। কিন্তুক কোটত-না-কোটত ত যাছুই। আপলাদের ফরেস্ট ত মোর ধরো কেনে গয়ানাথের খোলানবাড়ির নাখান। কত কাজ এইঠে থাকিবার পারে। ঐঠে গয়ানাথের চষিবার জমি আছে। চড়িবার গরু আছে। হালুয়া আর রাখোলিয়া মানষি আছে। মুইও আছি। ত মনত নাই এ্যালায়–কোটতঠে কোটত যাছি। কিন্তু হঠাৎ এক শালগুড়ির আড়ালঠে– না, কাথাটা ঠিক না হইল! মোর হাতত আছি একখানা গঠিয়া লাঠি। ধরো, এই দেড়হাতি একখান গাটিয়া লাঠি, এই লাঠিটার ঠে ছোট। মুই ত যাছি। আর, একবার এদিক, একবার ওদিক ঝোঁপ ঝাড়ত লাঠি চালাছি। এ্যানং এ্যানং করি।

বাঘারু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে একবার বায়ে একবার ডাইনে ঘুরে নাচের মত নিজেকে দোলায়। আর সেই নাচের সঙ্গতিতেই একবার বায়ে, আর একবার ডাইনে, এ্যানং এ্যানং করি, বলে বলে হাতের লাঠিটা দিয়ে জঙ্গলে মারে, বর্ষার জঙ্গলের মাথা ভেঙে-ভেঙে যায়। কিন্তু বাঘারু যে-ছন্দে ডাইনে বায়ে দুলছে। আর যে-ছন্দে তার হাতটা ওঠানামা করে সেটা কিন্তু দ্রুত হয় না। বাঘারু তার হাঁটা বোঝনোর জন্য তাড়াতাড়ি হাঁটে, একটু, ছুটে-ছুটে যাওয়ার ভাব এনে। এম-এল-এর সঙ্গে দূরত্ব বাড়িয়ে বেশ কয়েকটা গাছের আড়ালে চলে যায় সে। তারপর থেমে পড়ে। তারপর সেই গাছগুলোর ভেতর একটা গাছের মতই একেবারে সোজা হয়ে দাঁড়ায় দুই পা ফাঁক, কোমর থেকে বুক ঠেলে জেগেছে, আবার কাঁধদুটো উঁচু থেকে ঝুঁকে পড়েছে সেই বুকের চড়াইয়ে। মুহূর্তের জন্য বাঘারুর পুরো আকারটা যেন সেই জঙ্গলে, গাছগুলোর ভেতর খোদা হয়ে যায়। কিন্তু পরমুহূর্তে সেই ক্ষোদিত মূর্তিটা ভেঙে ফেলে সে কোমর; ভেঙে নিচু হয়ে বলে, এ্যানং করিতে করিতে যেই মুই এক শালগুড়ির তলার ঝোঁপটাত এ্যানং করি খোঁচা দিছু, দিয়া আবার চলিবার ধইচছি, বাঘারু একটি পা ফেলে বোঝায়–সে চলে যাচ্ছিল, অমনি পাছতঠে এ্যানং করি একখান বাঘ আসি মোর পাছত এক পা আর ঘাড়ত এক পা দিয়া মোর ঘাড়খানের বগলত অর হাঁ করা মুখোন নিয়া আসিছে, উঃ কি গন্ধ বাঘের মুখত। এম-এল-এ ঐ গল্পটার দিকে এগচ্ছিল। দাঁড়িয়ে পড়ল।

বাঘারু নাকে হাত দেয়, পরমুহূর্তে আবার সোজা হয়ে বলে, বাঘায় হামাক ঠেলিবার ধরিছে, ফেলি দিবার চাহে আর মুই পাও দুইখান গর্ত করি মাটির ভিতরত সিন্ধাবার চাহি, খসা ঝরা পাতায় য্যান মোর পাও দুইখান পিছল না খায়, পড়িলে ত সর্বনাশ আর এ্যানং করি ঘুরি গিয়া মোর ঐ দেড়হাতি লাঠিখান বাঘারুর মুখের ভিতর সিন্ধাই দিয়া দুই হাতত ঠেলিবার ধরিছু–কায় কাক ফেলিবার পারে–বাঘ মোক না মুই বাঘক, প্রায় দমবন্ধ করে বাঘারু বলে, চলিছে, ঠেলাঠেলি চলছে, আর, তারপর সে কেমন পেঁচিয়ে ঘুরে যায়, যেন তার পেছনে, তার পিঠের ওপর এখন সত্যিই বাঘ থাবা গেড়েছে, আর তার সেই মুচড়ে যাওয়া শরীরে সে দুই হাতে দুদিক থেকে বাঘের মুখের ভেতর আড়াআড়ি ঠেকানো লাঠিটা ঠেলছে, ঠেলছে। ফরেস্টের এই আবছায়ায় তার সেই স্থির অথচ প্রচণ্ড বেগের মূর্তিকে যেন দুর্গাপ্রতিমার অসুরের মূর্তি মনে হয়–কিন্তু অসুরের মত ত সে পিঠটা বাকাবার জোর পায় না, অসুরের মত ত সে বুকটা চিতিয়ে দাঁড়াতে পারে না। দুটো হাতের ওপর তার মোচড়ানো শরীরের সমস্ত ওজন, লাঠিখান একটু ঢিলা হবা ধরিলেই ত বাঘ মোর ঘাড়ত দাঁত বসাইবে, আর, দুই পা যেন একটুও না টলে, মোর ত জানা আছে আপলাদ ফরেস্টের জমিখান ঐঠে নরম, কুনতিঝরার জলকাদায় আর পাতাপচায়। বাঘা ত আর আপলাদের জমি চিনে না। মুই চিনো। কিন্তু পা দুইখান পিছলি যাবারও পরে ত–তাই গোড়ালিখন শক্ত করি দিছু। আবার, সেই শক্ত পায়ের চাপে মাটি কাপে, বাঘা মুখোন এদিক-ওদিক করিবার ধরিছে, বাঘারু নিজের মাথা ঝাঁকিয়ে বোঝায়, কিন্তু মুই ত আর না পারো, মোর হাঁটুখান ভাঙি যাছে যেন হাঁটু ভেঙে যাচ্ছে এমন একটা ভাজের মত আভাস আসে কোমরে, কাথাটা হইল,কায় আগত পড়ি যাবে, মুই না বাঘায়। যায় পড়িবে স্যায় হারিবে, ব্যস, মুই য্যালা ধরি নিছু মুই পড়ি যাম-যাম, এই মোর হাটুখান–ডান হাঁটুখান-ভাঙি গেইল-গেইল, আর পারিলো না হে, মুই বাঘারুর প্যাটত গেইল, গেইল হে, স্যালায়, ঠিক স্যালায়, বাঘান মোর ঘাড়ঠে আর পাছাঠে থাবাখান চট করি নামি নিল আর মোর দুই হাতত মোর দেড়হাতি লাঠিখান ধরা, মোর হাতটাও নামি যাছে, নামি যাছে, বাঘারু নিচু হতে-হতে দেখায় সেও কেমন বাঘের দিকে নেমে যাছে, স্যালায় মুই বুঝি গেইলু, আরে, আরে, বাঘাখান ত মোক ছাড়ি দিছে, ব্যাস, যেই বুঝিনু–সড়াত করি লাফ দিয়া সামনের গাছটাত চড়ি গেইল, চড়ি গেইল।

বাঘারু লাফ দিয়ে গাছের ডাল ধরে ঝুলে ডান পা-টা তুলে ডালের ওপর রেখে বা-পা-টা তোলার ভঙ্গি করে, তার বাদে আরো উপরত উঠিবার ধরি, নিচু হয়ে দেখায় তরতর করে ডাল বেয়ে ওপরে উঠল, একেবারে উপরত গিয়া চাহি দেখি, একটু ঝুঁকে, দেখার ভঙ্গি করে, যেন তলায় বাঘ, আর সেই গলের ওপর বসে হেসে কুটিপাটি হয়, সে হাসি আর থামো না, মোর ঐ দেড়হাতি লাঠিখান এ্যানং করি বাঘারুর মুখত চাপি গেইছে যে বাঘারুর সঁতের ফাঁকত লাঠিখান সিন্ধি গেইছে। আর বাঘা বাহির করিবা পারে না, শুধু মাথা ঝাঁকাছে ত ঝাঁকাছে, এ্যানং এ্যানং করি, বাঘারু দাতে লাঠিটা বাঘের মত মাথা ঝাঁকায়, স্যালায় মুই উপরের ডালঠে য্যালায় একখান বড় বাঘারুর মতন আওয়াজ ছাড়িছু-হালু-ম–স্যালায় ঐ বাঘা দাঁত কাঠিখান নিয়া চো চা দৌড়, দৌড়, দৌড়, দৌড়। বাঘারু আবার কিছু হেসে নেয়।

ব্যস। বাঘা গেইল অর বাড়ি। আর মুই জলপাইগুড়ির হাসপাতাল এ্যানং করি–কায় জানে ছয় মাস না দুই মাস। একখান চাষও চলি গেইল, মোর হালও চলি গেইল–সে দেখায় কী ভাবে শুয়ে ছিল।

সেইঠে মোর নাম হয়া গেইল বাঘারু। বাঘাখানক মুই হারি দেছু, স্যালায় মোর নাম হইল বাঘারু। যায় জেতে তার নামখান ত একড় [রেকর্ড] হয়। বাঘাখানা মোক মারিলে ঐ জায়গাখানের নাম ধরিত বাঘাথোয়া। তা, ধরো কেনে, পুরা একখান পালাটিয়া গান বান্ধ্যা হয়্যা গেইল-কুড়ানির ছোঁয়া, কুড়ালিয়া-কোটা, বাঘারুয়া, ফরেস্টুয়া, চন্দ্র বর্মন।

বাঘারু পেছন ফিরে পথ দেখিয়ে আবার চলতে শুরু করলে তার দেশিয়া ঘরের এম-এল-এও দেখে বাঘারুর পিঠে-পাছায় মাংস-খুলনো বাঘের থাবার দাগ–শাল-গাছের কাণ্ডে যেমন কত দাগই না থাকে। ঘাড় না ঘুরিয়ে বাঘারু বলে, এমেলিয়াবাবু।

কহেন।

মোক একখান ছোটনাম করি দেন।

 কহিলেন ত আপনার পালাটিয়া-গানের মতন নাম। মুই ত গান বান্ধিবার পারো না।

মুই না চাও পালাটিয়া-গান। নামের পালাটিয়াখান ঢলঢলাছে, খলখলাছে। মোক একখান মানষির নাম দেন।

এম-এল-এ কোনো জবাব দেয় না। চলতে-চলতে বাঘারু আবার বলে, তুমি একখান জ্যান্ত এমেলিয়ার ঘর। বাগানিয়া মানষিক ঝাণ্ডা দিছেন, বস্তির মানষিক জমি দিছেন আর মোক একখান নাম দিবার না পারেন? এ ক্যানং হাকিম হবা ধরিছু ই, এমেলিয়া?

জঙ্গলটা শেষ করে ওরা সেই পাথারে পড়ে। নিধুয়াপাথার। উঁচু ডাঙা, বরমতল, পাথার, পাথারের। পর নদী–ব্রিজহীন।

বাঘারু বলে, আসেন এমেলিয়াবাবু, পার হওয়া নাগে।

 এম-এল-এ জিজ্ঞাসা করে, ক্যানং করি?

বাঘারু বলে, মোর ঘাড়ত উঠেন।

এম এল-এ একবার চারপাশে তাকায়। জঙ্গল, পাথর, আকাশ আর এই নদী। বাঘারু নদীর পাড়ে বসে বলে, উঠেন।

ব্রিফকেস মাটিতে রেখে, জুতোটা খুলে বা হাতে নিয়ে বাঘারুর ডান কাঁধের ওপর দিয়ে এম-এল-এ পাটা নামিয়ে দেয়। বাঁ হাতে মাথাটা চেপে ধরে বা পা-টাও বাঘারুর বা কাধ দিয়ে নামাতে পারে। জুতোটা ডান হাতে বদলি করে নিচু হয়ে বা হাতে ব্রিফকেসটা তুলে নেয়। একহাতে ব্রিফকেস আর এক হাতে জুতোসহ বাঘারুর মাথাটা চেপে ধরে। বাঘারু জিজ্ঞাসা করে, টাইট করি বসিছেন?

বসিছু।

 খাড়াম?

খাড়া।

এম-এল-একে কাঁধে নিয়ে বাঘারু দাঁড়িয়ে দু-পা ফেলতেই জুতো-ব্রিফকেস নিয়ে বাঘারুর মাথাটা চেপে ধরে এম-এল-এ চিৎকার করে ওঠে, পড়ি যাছে, মোর ব্রিফকেস পড়ি যাছে। পেছিয়ে এসে বাঘারু বসে পড়ে। প্রথমে জুতোজাড়াটা মাটিতে ফেলে দিয়ে ব্রিফকেস সহ এম-এল-এ নেমে আসে, মুই না পার এ্যানং করি পার হবার

মোক গয়ানাথ কইছে. পার করি দিবার নাগিবে তোমাক।

ক্যানং করি পার হম? তরিবার পারি। সাতরিম? জামা কাপড় খুলি

না-হয়, না-হয়। ভিজা গাওত আবার জামা কাপড় পরিবেন কেমনে? গা শুখাবার টাইম নাগিবে। মোর পিঠত ঝুলো। নাও ঝুলো কেনে।

এই জুতা? ব্যাগ?

মোক দাও– বাঘারু এক হাতে জুতো আর-এক হাতে ব্যাগটা নেয়। কিন্তু এম-এল-এ বাঘারুর পিঠে ঝুলতে গেলে মাটিতে তার পাছা ঠেকে যায়। বাঘারু তখন পাড়ের নীচে পিঠ নুইয়ে দাঁড়ায়। আর এম-এল-এ তার গলা ধরে পেছনে ঝুলে পড়ে, দুটো পা দিয়ে বাঘারুর কোমর পেঁচিয়ে।

ঠিক আছে? হাটিম?

হয়। হাট।

বাঘারু জুতো আর ব্রিফকেস দুলিয়ে-দুলিয়ে, পেছনে এম-এল-এ ঝুলিয়ে জলে পা দিতেই এম-এল-এ বলে ওঠে, হে বাঘারু, না হয় রে– কেনে? বাঘারু দাঁড়িয়ে পড়ে।

হাত খুলি যাছে। মোক নামি দে। বাঘারু আবার পেছিয়ে পাড়ের কাছে নিচু হয়। এম-এল-এ তার পিঠ থেকে নামে। জুতো আর ব্রিফকেস ফিরিয়ে দিতে দিতে বাঘারু বলে, নিজের ওজনখান হাতত ধরিবার পার না? ত খাড়াও কেনে, খাড়াও।

এম-এল-এ সোজা হয়ে দাঁড়ায়।

জুতা আর বাক্স দুই হাতত টাইট করি ধর।

বাঘারু তার আপাদমস্তক ন্যাংটো শরীরের সঙ্গে দুহাতে জাপটে নেয় এম-এল-এ-কে। বাঘারুর শরীরের ওপর তার শরীরের পুরো ভারটা দিয়ে জুতো আর ব্রিফকেসসহ এম-এল-এ বাঘারুর গলাটাও জড়িয়ে ধরে। ধুতি, পাঞ্জাবি, জুতো, ব্রিফকেস সহ একটা আস্ত এম-এল-এ যেন বিসর্জনের ঠাকুর, বাঘারুর কাধ ছাড়িয়ে-জলের ঠিক ওপরেই, ঠিক ওপরেই। নদীর জলে ধীরে-ধীরে বাঘারুর হাঁটু ডোবে, কোমর ডোবে। তখন এম-এল-এর পেছন আর জুতো-ব্রিফকেস প্রায় জল হেঁয়-ছোয় যেন, আর দু-এক পা গেলেই সেই গভীর জল, সেখানে বাঘারু তলিয়ে যাবে-পরমুহূর্তে ভারমুক্ত ভেসে উঠতে।

কিন্তু বাঘারু জানে, আর দুই পা গেলেই জল আবার কমতে শুরু করবে। এই নদীটার সঙ্গে কোনো বরফগলা ঝোরার যোগ নেই–বাঘারু জানে।

না থাকলেও নদী ত! আকাশ ছাড়া কোনো ঢাকনা নেই।

নদী ত! স্রোত এসে বাঘারুকে ঘা মারলে ফুলে ওঠে–বানভাসি ফরেস্টে এক একটা শালগাছের গোড়ায় যেমন হয়।

চলন্ত শালগাছের মতন মাঝনদীতে বাঘারু দাঁড়িয়ে থাকে। তারপর আবার স্রোত সামলে এম-এল-এ কাঁধে পা বাড়ায়।

.

তিস্তাপারের এই বৃত্তান্তের আদিপর্ব এখানে–এই মাঝনদীতেই, আপাতত শেষ করা যায়। সামান্য কয়েক-পা গেলেই ওপারে ফুলবাড়ি বস্তি। নদীটা ব্রিজহীন হলেও, ফুলবাড়ি বস্তি ও তার আশেপাশে আরো, সব বসতি-এলাকায়, খেতিতে, চা বাগানে ছোট ছোট ঝোরায় বা স্রোতে অনেক জায়গায় ক্যালভার্ট আছে, যেমন থাকে। যা এখনো মাঝে-মাঝে দুটো-একটা তৈরি হচ্ছে, যেমন হয়। সেরকম একটা ক্যালভার্ট তৈরির ব্যাপারে ডিপার্টমেন্টের সঙ্গে স্থানীয় লোকজনের গোলমালের ব্যাপারেই এম-এল-এ যাচ্ছে। তার মানে, এঞ্জিনিয়ার, কনট্রাক্টার, ওভারসিয়ার, সিমেন্টের মিকশ্চার, লোহা, বালি, পার্সেন্টেজ, ইউনিয়ন, কৃষক মজুর, লিডার, অফিসার থেকে এম-এল-এ, আবার এম-এল-এ থেকে…,মিটিং, মিটিং ইত্যাদি। সেখানে ত ফরেস্টারচন্দ্র বাঘারুবর্মন আবার অবান্তর, এখনো যতক্ষণ-না একটা পথহীন ফরেস্ট বা ব্রিজহীন নদী পথে পড়ে।

কিন্তু সে ত বৃত্তান্ত আর-এক–

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *