১.৩ গাছের ডগায় মৌজা ম্যাপ

০২১.

গাছের ডগায় মৌজা ম্যাপ

অনাথকে ছাড়িয়ে নদীর আরো কাছে সুহাস তিস্তার পাড় ধরে সোজা উত্তরে তাকায়। এখন এই পাড়টা রাইট এ্যাঙ্গেলে উত্তরে গেছে। সুহাস যেখানে দাঁড়িয়ে সেই ফরেস্টটা মৌজা ম্যাপে জে-এল নাম্বার ৮৭ আর ৮৮র সিদাবাড়ি-গোচাবাড়ি বর্ডার লাইন থেকে উত্তরে, একটু পুবে সরে আসা। এখানেই এখন নদী। এর সরাসরি পশ্চিমে ছিল–এই সিদাবাড়ি-গোচাবাড়িরই একটা অংশ আর আপলাদের একটা ছোট ছিট। আর তার উত্তরে এই সার্কেলের সবচেয়ে বড় জে-এল ৮৪ নম্বর আপলাদ ফরেস্ট।

তার পশ্চিমে ৮৫ নম্বর গাজোলডোবা, ও তারও উত্তরে মৌজা হাঁসখালিরই ২১ নম্বর জে-এল। এই ২১ নম্বর জে-এল থেকে ৮৪-নম্বরের পশ্চিম সীমা, ৮৫ নম্বর গাজোলডোবা ও সে যেখানে দাঁড়িয়ে তারও বায়ের, পশ্চিমের, সিদাবাড়ি গোচাবাড়ি–সবটাই এখন তিস্তার ভেতরে। এর তলায় ৮৬ নম্বরে আপলাদের একটা ছিট ছিল, সেটুকুও ম্যাপ থেকে বোঝা যাচ্ছে–যদিও সেটা অন্য মৌজার। কিন্তু তারও নীচে এই ৮৪রই আরো একটা একটুখানি ছিট ছিল। তা হলে এখন যেটা ৮২ নম্বর উত্তর আর ৮৩ নম্বর দক্ষিণ হাঁসখালি তারও উত্তরে, আপলাদেরও উত্তরে ছিল আসল হাঁসখালি। আবার এখনকার এই সব জোতের নীচ পর্যন্ত ছিল আপলাদ। নইলে একই জেএল নম্বরের মাঝখানে এত জোত এসে যায় কেমন করে? মৌজা ম্যাপটা মাটির ওপরই মেলে ধরে তার ওপর উবু হয়ে বসে সুহাস বড় হাঁসখালির ২১ নম্বরে, ৮৫ নম্বরে, ৮৬ নম্বরে ৮৭ ও ৮৮ নম্বরের পশ্চিম অংশে একটা করে ঢেরা, মারে। ৮৭ ও ৮৮ নম্বরের পুবে একটা লম্বা দাগ দেয়। এর পর একটা রাস্তা আছে–সোজা আপলাদের মাঝখান দিয়ে চলে গেছে। এই গ্রামগুলো যদি বাতিল হয় তা হলেই একটা নতুন আউটলাইন বেরিয়ে আসে। কিন্তু নদী ত আর জেএল নম্বর ধরেধরে ভাঙে নি। তাই ৮০ নম্বরের পশ্চিম সীমাটা তাকে সাব্যস্ত করতে হবে।

এক-একটা ঢেরায় এক-একটা গ্রামের হিশেব চুকিয়ে, সুহাস ম্যাপটা তুলে সোজা হয়ে দাঁড়াতেই তিস্তার ভেতর থেকে এক হাওয়াপ্রপাত ঘটে যায় যেন, আর তার হাত থেকে অত বড় ও ভারী মৌজা ম্যাপটা একটা ছেঁড়া কাগজের মত উড়ে যায়। হে-এ-এ বলে একটা চিৎকার করে উঠে ম্যাপটার পেছনে সুহাস ছোটে। মাপটা তখন লাট খেয়ে মাটিতে পড়েছে। অনাথ শিকল ফেলে দিয়ে ম্যাপটা ধরতে ছোটে। কিন্তু সে ম্যাপটার ওপর পড়ার আগেই আবার ম্যাপটা উড়াল দেয়, এবার আর সোজা নয়, কোনাকুনি ভাবে ওপরে গাছের মাথার দিকে, প্লেনের আকাশে ওড়ার মত। তখন সুহাস দাঁড়িয়ে গেছে। কিন্তু অনাথ হাত তুলে ধরতে চেষ্টা করছে। ম্যাপটা যেন কোনো ওস্তাদের লাটাইয়ের সুতোয় বাধা ঘুড়ি, এমন নিশ্চয়তায় আরো ওপরে উঠল ও একটা মাঝারি সাইজের ডালের খাজে সেঁদিয়ে ঝুলতে লাগল। এতক্ষণের অলস ভিড়টা যেন মুহূর্তে প্রাণ পেয়ে সবাই মিলে ঐ ম্যাপের পেছনে ছুটছে। সুহাসও ভেবেছিল, বাতাসের দমকাটা চলে গেলেই ম্যাপটা ঝুপ করে পড়বে। কিন্তু পড়ল না। সুতরাং আর-একটা দমকায় গাছ থেকে ওটাকে ফেলে দেবে এই আশাই অগত্যা করতে হয়।

এখন নদীর পাড়ে, নদীর দিকে পেছন ফিরে সুহাস। তার সামনে একটু দূরে সার্ভে টেবিল। তার থেকে একটু দূরে গাছতলায় সেই চেয়ার। তার থেকেও একটু দুরে, বায়ে এই সমস্ত ভিড়টা গিয়ে জমা হয়েছে এক গাছের নীচে। সুহাস আঙুলে ধরা পেন্সিলের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলে। তারপর নিজের বোকামিটাই আরেকবার দেখতে একটু আনমনায় দিগন্তের দিগন্ত পর্যন্ত বিস্তৃত ধূসর জলভূমির দিকে তাকায়। তার ওপর দিয়ে যেন শুধু বাতাসই বয়ে আসছে-ধারাবাহিক কিন্তু প্রবলতর। হে এ বাঘারু–চিৎকারে যেন আবার মোরগ ডেকে উঠল। সুহাস আবার ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে, গাছতলায় সেই ভিড়টার পেছনে সেই খাটো, রোগা, শুকনো লোকটা চিৎকার করছে। তার চিৎকারে ভিড়ের ভেতর কী আন্দোলন হয় সুহাস দেখতে পায় না। কিন্তু কিছু একটা হচ্ছে, অনুমান করে। একটু এগিয়ে যেতেই লোকটি তার পাশে এসে বলে, স্যার, বাতাসটা বেশি ত, পাড়ি দিছি। সুহাস দেখে, একটা লোক তরতর করে গাছটাতে উঠে যাচ্ছে। সে কি সেই লোকটিই, যে চেয়ার মুছছিল? এ-লোকটি যেন সেরকম ভাবেই ডাকল।

যে গাছে উঠছিল সে ত এমন ভাবে গাছে ওঠে যেন হাঁটার চাইতেও গাছে ওঠার অভ্যাসই তার বেশি। কিন্তু সে ডালের খাজ থেকে ম্যাপটা বের করেও বুঝে উঠতে পারে না, ম্যাপটা নিয়ে কী করবে। সে যদি ওপর থেকে ছেড়ে দেয় তা হলে ত বাতাসে আবার উড়ে যাবে। সে যদি হাতে ধরে নামতে যায় তা হলে গাছের ঘসায় ম্যাপ ছিঁড়ে যেতে পারে। কিন্তু সুহাস, তার পাশের সেই হাফশার্ট-পরা লোকটি, আর গাছতলার ঐ ভিড়টা সমস্যা বুঝতে পারলেও লোকটি তা মেটাবার জন্য কিছুই করে না। সে একহাতের ঘেরে নিজেকে গাছটার সঙ্গে সেঁটে রাখে, আর-একহাতে ম্যাপটা ধরে থাকে। বাতাসের ধাক্কায় সেখানেই ম্যাপটা ফরফর করে।

হে-এ বাঘারু মুখত ধরি নামা কেনে, মুখত ধরি নামা।

লোকটি যেন জানতই এরকম কোনো নির্দেশ আসবে। মুহূর্তের ভেতর সে অতবড় ম্যাপটা দাতে চেপে ঝুলিয়ে সড় সড় করে নেমে আসতে শুরু করে–যেন বাতাসের বেগে গাছটাই কাত হয়ে মাটিতে পড়ে যাচ্ছে–ডালেপাতায় পাখির বাসা, পিঁপড়ের ডিম, এমন-কি সাপখোপ সবই। মাটিতে পৌঁছনের আগেই ম্যাপের একটা কোনা মাটি হোয়। লোকজন সেটা ধরে নেয়। লোকটা দাঁতের কামড় ছেড়ে দেয়। আর অন্যরা ম্যাপটা ধরে সুহাসের দিকে যায়। কিন্তু সুহাসের কাছে পৌঁছনোর আগেই সেই শাটপরা লোকটা নিয়ে নেয়। তারপর সে সুহাসের দিকে হেঁটে এসে, ম্যাপটা দিয়ে বলে–চাপি ধরি রাখিবেন, বড় বাতাস, যেন ম্যাপটা তার প্রীতি-উপহার। নদীর কাছে সার্ভে টেবিলের পাশে সুহাস, আর, ঐ দিকে ভিড়, তারও পেছনে লোকটা কোথায় দেখা যায় না–যে গাছে উঠেছিল। ঐ ভিড় আর সুহাসের মধ্যে এই হাফশার্ট-পরা লোকটা সংযোগ স্থাপন করে যায় যেন। কিন্তু এই লোকটা কে? কোনো-এক জোতদার ত বোঝাই যাচ্ছে। তালটা কী?

.

০২২.

জঙ্গলের ভেতরে

ফরেস্টের ভেতর থেকে প্রিয়নাথ বেরিয়ে আসে, স্যার, একটু ওদিকে চলেন, বিনোদবাবু দাঁড়িয়ে আছেন।

হ্যাঁ, চলুন, প্রিয়নাথের সঙ্গে শালবনে ঢুকতে ঢুকতে সুহাস হেসে বলে, ম্যাপটা হাত থেকে উড়ে গিয়েছিল।

যে বাতাস! আমাকে দেন স্যার, প্রিয়নাথ হাত বাড়িয়ে ম্যাপটা নেয়। সুহাস দেখে সেই শার্টপরা লোকটিও তার সঙ্গে চলেছে। একবার ভাবে বলে দেয়, আপনি কেন আসছেন। কিন্তু বলে না। দরকার কী। ওর সঙ্গে যখন কোনো মাপামাপির ব্যাপারে লাগবে তখন দেখা যাবে। কিন্তু তখনই-বা দেখা যাবে কেন? সুহাস ভেবেই নিচ্ছে কেন, লোকটি কিছু একটা বদ মতলবে ঘুরছে। সন্দেহটা সুহাস মন থেকে সরাতে চায়। কিন্তু মনে লেগে থাকে। আর সে কারণেই যেন সে থেমে, ঘুরে লোকটির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করে বসে, আপনারা ত এখানকার অনেক দিনের?

প্রশ্নটি শুনে প্রিয়নাথও থেমে যায়, লোকটিও থেমে যায়। প্রিয়নাথ একটু অবাক হয়ে সুহাসের দিকে তাকিয়ে থাকে। মাত্র ত এই কয়েক পা এসেছে–কিন্তু এতেই সুহাসের মনে হয় যেন ফরেস্টের কত ভেতরে। তিস্তাও দেখা যাচ্ছে না। তাদের সেই মাপামাপির জায়গাও না।

আর চারপাশে বর্ষার ফরেস্টের ঘন সবুজ জঙ্গলের ঘের। শালগাছের কাণ্ডময় গভীর শ্যাওলা। এই সবের ভেতর ওরা, দুজন থেমে যাওয়ায় সুহাসকেও থামতে হয়।

প্রিয়নাথ জিজ্ঞাসা করে, কে স্যার?

 সুহাস বলে, না, আপনাকে নয়, ওঁকে জিজ্ঞাসা করছি, আপনারা ত এখানে অনেক দিনের?

প্রিয়নাথ না নড়ে বলে, উনি ত স্যার গয়ানাথ জোতদার। কথাটা শোনাল যেন স্যারটা গয়ানাথের উপাধি। শুনে গয়ানাথ তার দুই হাত বুকের কাছে তুলে নমস্কারের ভঙ্গিতে ঘাড় নুইয়ে থাকে, যেন এখানে সুহাস আর প্রিয়নাথই শুধু নয়, বেশ অনেক লোক আছে, যেন এই গাছগাছড়ার কাছেও তার এই পরিচয়ের একটা অর্থ আছে। ভঙ্গিটা প্রায় অপরিবর্তিত রেখে গয়ানাথ বলে, হয়। মুই গয়ানাথ। লোকটি বোধহয় এই প্রথম তার নিজের ভাষাতেই সম্পূর্ণ কথাটি বলল। সুহাসের চোখেমুখে এই কথার কোনো অর্থ ধরা না পড়লেও সে বলে, ও! আচ্ছা। তারপর পা ফেলে।

গয়ানাথ কিন্তু সুহাস আর প্রিয়নাথের পেছনেই থাকে, পাশে আসে না। সেখান থেকেই জিজ্ঞাসা করে, আপনি, স্যার কী বলিছিলেন?

আপনারা ত এখানে অনেক দিন আছেন?

 হ্যাঁ স্যার। আমরা ত এইখানেই থাকি।

না। তা ত বটেই। কিন্তু ছোটবেলাতেও কি এখানে ছিলেন? মানে তিস্তা কি বরাবরই এরকম কাছাকাছিই ছিল?

তিস্তা ত স্যার, আটষট্টি সনটাক যদি বাদ করি ধরেন, তা হলে ধরেন একখান বলা যায় গয়ানাথ সুহাসের প্রথম প্রশ্নটার কোনো জবাব দেয় না।

মানে, আটষট্টির, ফ্লাডেই সবটা বদলাল?

না, সে ত বদল হয়ই, নদী ত আর মানষির দালানবাড়ি না-হয়, যে, একেবারে পাকা থাকিবে, নড়চড় না হবে। বদল ত হয়ই হওয়া নাগে।

সুহাস ওঁর কাছে আসলে জানতে চাইছিল সে ম্যাপের সঙ্গে মিলিয়ে যেবদলটা দেখছে তার কতটা এদের চোখে দেখা। কিন্তু গয়ানাথ অত দার্শনিকতায় পৌঁছে গেছে দেখে সে আর কথা বাড়ায় না। গয়ানাথের যেন খানিকটা প্রতীক্ষা ছিল, সুহাস কিছু বলবে, সেটুকু জুড়ে তীক্ষ্ণতর ঝিঁঝির ডাক আর প্রতিধ্বনিত তিস্তার গর্জনে এই ফরেস্টটা আরো ঘন ও নীরবতা আরো প্রসারিত হয়।

গয়ানাথ যেন আত্মচিন্তার মতই আবার যোগ করে, কিন্তু আবার নদীর ত একটা পাকাপাকি ভাবও আছে। অ, যতই ভাঙুক আর সক স্যার শ্যাষম্যাস একটা ঠিকই হয়। ধরেন–

গয়ানাথ একটু থামে। কী উদাহরণ দেবে সেটি তাকে একটু ভাবতে হয় যেন। আর সুহাসও একটা অনুমানের চেষ্টা করে–গয়ানাথ তার নিজের কয়েক বছরের কোনো দেখাকে যেন একটা পাকা সিদ্ধান্তের মত করে বলছে। নদীর পাড় একেবারেই বদলে যায়, নদী পুরনো খাতে আর ফিরে যায় না, এমন ঘটনা গয়ানাথ দেখে নি, কিন্তু তাই বলে ত সেটা মিথ্যা নয়। সুহাস যেন বুঝে যায়, গয়ানাথের কাছে তার ম্যাপের সাক্ষ্যের যে-সমর্থন চাইছিল তা পাওয়া যাবে না।

এই নীরবতায় তারা ভেজাপচা পাতার ওপর দিয়ে চলে যায়। সুহাস প্রিয়নাথকে জিজ্ঞাসা করে, কোথায়? প্রিয়নাথ কোনাকুনি হাতটা তুলে একটা আন্দাজ দেয়। সেই সময় গয়ানাথ বলে, ধরেন, এই আটষট্টির বানাটাই ধরেন। তিস্তা ত, ধরেন, এইখান থিকা সোজা বায়ে ঢুকে, ধরেন, তিস্তা আর ধরলার মাঝখানে যে বিশাল তেকেনিয়া জায়গাখান, ঐটাকে ভাজি-ভাসি চলি গেল। আমরা ভাবিলাম, এই হইল, এখন থিকা ধরলার খাতখান তিস্তার খাত হয়্যা যাবে। কিন্তু তিস্তা ত আবার তার পুরানা খাতেই ফিরি গেল। এখনো যাছে।

 এই একটু আগে যে-জায়গাগুলিকে ম্যাপ থেকে বাদ দেবে বলে ঢ্যারা কেটে এসেছে সেগুলোর কথা মনে রেখে সুহাস বলে-কিন্তু আপনাদের ত কত গ্রাম ভেসে গেছে। নামগুলো তার মনে পড়ে না। যেটা মনে পড়ে, সেটাই বলে, এই ফরেস্টেরই ত অনেকখানি ভেসে গেছে। এর উত্তরে হাঁসখালি।

কিন্তু স্যার, নদী মানেই ত ভাঙাভাঙি। যার পার ভাঙে আর নতুন পাড় হয়, সেইটা হয় নদী। আর যার পাড় ভাঙেও না নতুনও হয় না, ঐটা হয় ডোবা।

নদীর এই সংজ্ঞায় সুহাস বেশ চমৎকৃত হয়। সে কিছু বলতে যাচ্ছিল কিন্তু তার আগেই গয়ানাথ আবার শুরু করে দিয়েছে কিন্তু আপলাদের যত ভাঙিছে, ততখানই আবার গড়িবার ধরিছে।

কোথায়?

যেইঠে ভাঙিছে সেইঠেই, নতুন চর, নতুন জঙ্গল।

স্যার এই দিকে, প্রিয়নাথ বায়ে ঘোরে। আর সঙ্গে সঙ্গে তিস্তার গর্জন যেন বেড়ে যায়। একটা ঝোঁপ পার হতেই সামনে কয়েকটা গাছের ফাঁকে দেখা যায় তিস্তা। বিনোদবাবু এক জায়গায় ভাঙা গাছের ওপর বসে খাতায় নোট করছেন। সুহাসরা এল দেখে উঠে দাঁড়ান।

.

০২৩.

নদীর ম্যাপ আঁকা

স্যার, আপনি কি ম্যাপ কমপেয়ার করলেন?

হ্যাঁ, এই দেখুন। যেগুলোতে ক্ৰশ, তা বাদ যাবেই, তা হলে একটা আউট লাইন পাওয়া যায় বটে, কিন্তু ফরেস্টের, মানে এই ভিলেজটার টোটাল একারেজটা দরকার। তা হলে আগের একারেজের সঙ্গে এটার একটা কমপ্যারিজন করা যেত। দেখুন, আমার ডিমার্কেশন। সুহাস প্রিয়নাথের দিকে হাত বাড়ায়। প্রিয়নাথ ম্যাপটা খুলতে শুরু করে। সুহাস বলে, সাবধানে খুলবেন তারপর বিনোদবাবুর দিকে তাকিয়ে হেসে বলে, আমার হাত থেকে ম্যাপটা উড়ে গিয়েছিল, ওখানে। বিনোদবাবু সামান্য হাসির ভঙ্গি আনেন। সুহাস তখন নিজে হেসে বলে, একেবারে গাছের মাথায়।

মাটিতে ম্যাপটা পাতা হয়েছিল। সেই পড়েযাওয়া গাছটার ওপর এখন সুহাস বসে। বিনোদবাবু মাটির ওপর উবু হয়ে ম্যাপটার ঢেরা দেয়া জায়গাগুলোর ওপর দিয়ে আঙুলটা টেনে-টেনে বুঝে নেন। প্রিয়নাথ ম্যাপটা একদিকে চেপে থাকে। আর গয়ানাথ একটু দূরে দাঁড়িয়ে মাথাটা নিচু করে ম্যাপটার দিকেই তাকিয়ে থাকে, কিন্তু বোঝাই যায় সেখানে কিছু দেখছে না।

ব্যাপারটা বুঝে নিয়ে বিনোদবাবু উঠে দাঁড়িয়ে প্রিয়নাথকে বলেন, প্রিয়নাথ, চেইনটা একটু বায়ে সরাতে বলোত অনাথকে। আর-একটু ডাইনে সরো। মানে কোনাকুনি হবে। ঐটাকেই তা হলে পয়েন্ট ধরি স্যার, আপনি যেখান থেকে দেখলেন?

ধরুন, ওটা ত ভাল পয়েন্টই হবে।

প্রিয়নাথ শেকলটা একটু নাড়া দিয়ে চিৎকার করে কিছু বলে। তিস্তার বাতাসে সে-চিৎকার ভেসে। যায়। কিন্তু ওরকম ভাবেই ভেসে আসে অনাথেরও চিৎকার। বিনোদবাবু মেপে বলেন, হ্যাঁ ঠিক। আছে। নাকি, আর-একটু ছেড়ে দেব স্যার?

কথাটার জবাব খুঁজতে সুহাস একেবারে পাড়ে গিয়ে তিস্তার গতিটা আন্দাজের চেষ্টা পায়। নদীর দিকে তাকানো, মানেই ত ওপারের দিকে তাকানো, নীলাভ দিগন্তসীমায়। কিন্তু সুহাস তাকিয়ে আছে এই পারের তটরেখার দিকে, তার পায়ের তলায়।

এখানে পাড়টা অনেক বেশি খাড়া। আর, একেবারে পাড় থেকে ঝাকড়া মাথার বিরাট গাছ, লাম্পাতি, হালকা গাছ বলেই দাঁড়িয়ে থাকতে পারে। শাল হলে নিজের ওজনেই ভেঙে পড়ত। ওরা যেখানে দাঁড়িয়ে তার কয়েক হাতের মধ্যে একটা বিশাল খয়ের গাছ ডালপালা সমেত উপুড় হয়ে জলের মধ্যে পড়ে। জলের মধ্যে পড়া সত্ত্বেও তার ডালপালা-পাতা সব জলের ওপরেই আছে–তলার দিকের খানিকটা জলে ডুবে গেছে। সুহাস একটু ঝুঁকে দেখে, তলার মাটিটাও খেয়ে নিচ্ছে। সে বলে, এদিকে ত পাড়টা আরো ভাঙবে বলে মনে হয়, আর-একটু ছাড়বেন নাকি? …–

স্যার, আমরা এখন ওটাকেই পয়েন্ট ধরে করে রাখি। তারপর একারেজ দেখে আর নর্থের হলকার ম্যাপ দেখে অ্যালাইনমেন্টটা ঠিক করা যাবে।

আচ্ছা, তাই করুন। মৌজা মাপের ওপর বিনোদবাবু পেন্সিলের নতুন লাইন টানতে থাকেন আর প্রিয়নাথের পাশ থেকে পুরো শিকলটার লাইনটা দেখে দেখে নেন।

গয়ানাথবাবু, এর বাদে ত ওদলাবাড়ি চাবাগান? গয়ানাথকে জিজ্ঞাসা করেন বিনোদবাবু।

হ্যাঁ। কিন্তু নদী আর বন, কতটা খাবে, কতটা থাকিবে, তার হিশাব ম্যাপে করিবেন কেমনে? গয়ানাথ তার প্রত্যক্ষতাকে এদের আনুমানিকতার বিরুদ্ধে দাঁড় করায়, যে-আনুমানিকতা আবার মাপজোখে অনড়, প্রায় আদালতের রায়ের মতই। বিনোদবাবু কোনো উত্তর দেন না।

সেই ফাঁকে সুহাস দৃশ্য হিশেবেই দেখে–তিস্তার দিগন্ত থেকে দিগন্ত, যেন জলস্রোত নয়, একটা কঠিন জলভূমির বিস্তার। একটুক্ষণ তাকিয়ে থাকলে মনে হয়, তিস্তা চলছে না, এই পারভূমিটাই চলছে। তখন আবার চোখ বুজে ভাসার বিভ্রমটা কাটাতে হয়। তিস্তার স্রোত এতই খর যে প্রায় কোনো আলোড়নও হয় না, স্টিলের পাতের মত একই তলে নদীটা বিস্তৃত হয়ে আছে। হঠাৎ মাঝে-মাঝে, এক-একটা কাঠের গুঁড়ির ভাসমান মাথাটুকু কুটোর মত ভেসে গেলে বোঝা যায় নদীস্রোতের বেগ কতটা। কিন্তু নদীর গর্জনকে তার চার পাশ থেকে বিচ্ছিন্ন না করে শোনা যায় না, বিশেষ করে ফরেস্টে দাঁড়িয়ে, চারদিকের সমস্ত শব্দের সঙ্গে নদীর শব্দ এতটাই মিশে থাকে। কিন্তু নদীর দিকে তাকিয়ে-তাকিয়ে, স্রোত দেখতে-দেখতে, নদীর আওয়াজটাকে চার পাশের আওয়াজ থেকে আলাদা করে নিলে, সিনেমায় যেমন স্মৃতিভ্রংশের নষ্টস্মৃতির পুনরাগমন বোঝাতে সাইরেনের আওয়াজ ক্রমবর্ধমান হয়ে ওঠে, অবিকল যেন তেমনি, তিস্তার গর্জনটাই বাড়তে বাড়তে প্রধান হয়ে ওঠে। তখন মনে হয়, এই প্রচণ্ড পরিব্যাপ্ত আওয়াজটাকে না-শুনে কী করে থাকা যায়। তবু আওয়াজটার মধ্যে বিরতিহীন মেঘগর্জনের মত একটা দূরত্বের ইঙ্গিত আছে–যেন ভেসে আসতে হচ্ছে। কিন্তু অবরুদ্ধ গুম-গুম ধ্বনি জলের তলা থেকে আরো তলায় নেমে যাচ্ছে। পাহাড় থেকে বিরাট-বিরাট বোন্ডার জলস্রোতে ভেসে-ভেসে জলের তলা দিয়ে গড়িয়ে-গড়িয়ে যাচ্ছে। টানা গড়গড় আওয়াজে যেন পাহাড়ে ধস নেমেই চলেছে। জলের তলায় বোরে-বোল্ডারে যখন ধাক্কা লাগে তখন জলের তলা থেকে যেন কামান গোলার আওয়াজ হয়। লোকমুখে এই আওয়াজটার নামও তাই তিস্তার কামান। সুহাস যখন জলস্রোতের দিকে তাকিয়ে-কিয়ে দৃশ্য-শব্দ শব্দের-ভেতরে-শব্দ শুনতে পাচ্ছিল তখন সে আর-কিছু শুনতে পায় না, দেখতেও পায় না। আর এই দৃশ্য ও শব্দ তার সমগ্রতা নিয়ে তাকে যেন সম্পূর্ণ অবশ করে দিচ্ছিল। সে দেখতে পাচ্ছিল, তিস্তা যে এখান থেকে উত্তরে, পশ্চিমে বেঁকে গেছে সেখানে ঐ ঘোলা জলের স্রোত প্রায় একটা তৈরি করা স্রোতের মত নিটোলতায় উজানে বাক নিচ্ছে। সেই বাক থেকে জলটা বয়ে আসছে সুহাসের দিকে। আর সুহাস চোখে-চোখে স্রোতটা উজিয়ে-উজিয়ে সেই বাক পর্যন্ত পৌঁছচ্ছে। তার দৃষ্টিতে ঘোর লাগে–এই স্রোতের প্রবলতা দৃষ্টি দিয়েও উজনো যায় না। সুহাস এই ঘোর সামলাতে প্রথমে চোখ বোজে। তারপর বসে পড়ে।

.

০২৪.

নদী আছে কি নাই : গয়ানাথী তর্ক

চোখ বন্ধ করতেই নদী আর নদীর আওয়াজ দুটোই মিশে যায় পরিবেশের সঙ্গে। এই ভাবে নদীর সামনে বসেই নদী থেকে নিজেকে আলাদা করে নিতে বা নদীকে আবার তার পরিবেশের সঙ্গে মিলিয়ে অস্পষ্ট করে নিতে স্বস্তি বোধ করে সুহাস। সে নদীর দিকে পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখে বিনোদবাবু নোট নিচ্ছেন, গয়ানাথ তার দিকে তাকিয়ে, প্রিয়নাথবাবু নেই।

প্রিয়নাথবাবু কোথায়?

চেইন গোটাচ্ছে।

এবার গয়ানাথ সুহাসের দিকে এগিয়ে আসে, স্যার, এইখানে আপনাদের মাপামাপিতে কী পাইলেন? নদীখান কি ভাঙিছে? মাপামাপিতে!

সুহাস বসে বসেই বলে, আপনি যা দেখছেন আমরাও তাই দেখছি। আমরা শুধু এইসব মেপেটেপে একে রাখছি।

সেইটাই ত কহিতে চাই স্যার। আটষট্টির ফ্লাডে নদীখান এইঠে আসি গেইছিল, ঢুকি গেইছিল, ঠিকই। কিন্তু তারপর আর ভাঙে নাই। এ্যালায় ফরেস্টখানই ঐদিকে, নদীর দিকে, এর বাদে বাড়ি যাবে।

সে যখন যাবে, তখন যাবে, এখন ত আর যাচ্ছে না, বিনোদবাবু তার খাতা থেকে চোখ নাসরিয়ে বলেন।

কিন্তুক, স্যার, এই ভরা বর্ষায় ত নদী সবঠেই ঢুকি যাবে। যেখানে যাবে সেইটাই কি বাতিল? স্যালায় ত তামান মৌজা বাতিল হবা ধরিবে–গয়ানাথ উত্তেজনা প্রকাশ করে ফেলে, আর সাধুভাষা বলতে পারে না। আর এতক্ষণে গয়ানাথের কথাতে সুহাসের মনে হয়, এইটুকু গ্রামে সারাজীবন ধরে থেকে এইখানকার নদীটা দেখে-দেখেই গয়ানাথ কোনো সর্বজনীন দার্শনিকতার বুলি আওড়াচ্ছে না, তার যেন আরো নির্দিষ্ট কিছু বলার আছে। সে তাই গয়ানাথকে জিজ্ঞাসা করে, তা হলে আপনার বক্তব্যটা কী, মানে, আপনি কিছু বলছেন?

না স্যার, আমি কহিছি আপনার মৌজার ম্যাপখান বদলিবার ত কিছু নাই। য্যানং ম্যাপ আছে, থাউক– কথাটা গয়ানাথ শেষ করতে পারে না। কিন্তু বোঝা যায় সে শেষ করতে চায়।

সুহাস জিজ্ঞাসা করে, মানে, আমরা দেখছি গাজোলডোবা নেই, হাঁসখালি নেই, চুরাশি নম্বর নেই, এতগুলো দাগ নেই আর আমরা মৌজা ম্যাপে লিখে দেব সব ঠিক আছে!

না, না, তা লিখিবার কাম কী আছে স্যার, কিছুই লিখিবেন না, য্যানং আছে, থাকুক কেনে।

তা হলে ত সেটা রেকর্ড করতে হবে। আমি দাগ নম্বরই বা দেব কোথায়, আর দাগ নম্বর শুরুই বা করব কোথায়?

সে ধরেন, ফরেস্টের জমি হাসিল হছে যেইঠে।

ফরেস্টের জমি হাসিল হয়েছে, মানে?

 মানে, আগে ফরেস্ট ছিল, এ্যালায় চাষ হওয়া ধরিছে, সেটা ত আপনারা চাষজমি ধরিবেন?

 কে চাষ করছে? ফরেস্টের জমি ত ফরেস্টের। কারা চাষ করতে দিয়েছে? বরং উল্টোটা হতে পারে, আগে আবাদ ছিল, এখন ফরেস্ট হয়েছে।

হ্যাঁ। তাও হবা পারে। কিন্তু এইঠে ত সব জমিই ফরেস্টের ছিল, তার থিকা চাষ হওয়া ধরিছে।

বিনোদবাবু এতক্ষণে মুখ তুলে বলেন, সাত পুরনো কথা তুলে কী লাভ? সে যখন ফরেস্ট হাসিল হত, তখন হত। এখন আমরা দেখছি নদীটা এতদূর এসেছে, সেটা লিখব না? বিনোদবাবু উঠে দাঁড়ান, তারপর সুহাসকে বলেন, আপনি বুঝলেন না স্যার, ফরেস্টের জমি যখন গয়ানাথবাবুরা চাষ করবেন তখন সেটা চাষে দেখাতে হবে আর গয়ানাথবাবুর জমি যখন নদীর ভেতরে যাবে তখনো গয়ানাথবাবুরই থাকবে। কী বলেন গয়ানাথবাবু?

কথাটা আপনি সিধা বলিলেন আমিনবাবু, কিন্তু ঠিকই। জমিনের ত আর পাখনা নাই যে উড়ি যাবে, যেখানকার জমি সেইঠেই থাকে, সে জমির উপর জঙ্গলই হোক আর জলই হোক।

সুহাস বুঝতে পারে পাশাপাশি থেকে, পিছু-পিছু এসে, প্রথমে আনমনা ভাবে, এখন বেশ জোর দিয়ে গয়ানাথবাবু একটা কোনো কথা প্রমাণ করতে চাইছেন। সে কথার সমর্থনে আইনের প্রকাশ্য কোনো বিধান নেই বলেই তার কথাটা হয়ত এতটা ঘোরানো-প্যাচানো মনে হচ্ছে। কিন্তু হয়ত আইনের সমর্থন নিহিত আছে বা থাকতে পারে। সুহাসের সামনে কথা বলছে বলেই এ-রকম ভাবে বলছে। কিন্তু তাতে লাভটা কী আপনার? মানে আপনাদের? আমরা যদি নদীটা এঁকে নাও নেই, তা হলেও ত নদীটা এখানেই থাকবে।

কিন্তু নদী ত এইঠে সরি যাবে স্যার, আর মাস দুই বাদেই নদী সরি যাবে।

 না, সে ত যাবেই, বর্ষায় নদী যতটা আসে, শীতে ত আর ততটা থাকে না, কিন্তু আপনি শুধু শীতের নদীটাকেই নদী বলবেন নাকি, বর্ষার নদীটাও ত নদী, বর্ষার জল যাবে কোথায়?

সে ত স্যার, যদি আপনি এইটাক নদী বলি ডিক্লার করি দেন, নুটিশ দেন, তার বাদেও ত নদী আরো ছড়ি পড়িবার পারে, বৃষ্টি বেশি হইলেও বাড়িটাড়িত ঢুকিবার পারে, তখন কি কহিবেন, যে-যে-টাড়িত নদীর জল সিন্ধাইছে স্যালায় সর্ব টাড়ি নদীবাড়ি হয়্যা গেইল? গয়ানাথের এই কথা শুনে সুহাস বুঝতে পারে–উত্তর দেয়া মুশকিল এমন কথা না-শোনা, আর নিজের পক্ষে জোরদার কথা বার বার বলা–তর্কের এই বেশ অভিজ্ঞ প্যাঁচ গয়ানাথের ভাল আয়ত্তে আছে। সুহাসের ঐ সন্দেহ কেটে যায় যে গয়ানাথ তার কথাটা হয়ত বলতে পারছে না। বিনোদবাবু বলে ওঠেন, আমরা এখন যা দেখছি তাই লিখছি। এর পর অ্যাটেশটেশনের সময় বলবেন, তখন ত আর বর্ষা থাকবে না, যাচের সময় বলবেন, ভুল হলে ভুলের লিস্ট বের হবে। চলেন স্যার, আমাদের দেরি হয়ে যাবে। এক জায়গাতেই ত সময় গেলে চলবে না।

সে ত করা যাইবেই আমিনবাবু। কিন্তু, এইঠেও ত স্যারের কাছে মোর কাথাটা কহা যায়। যায় কি না-যায়?

সুহাস তাড়াতাড়ি বলে, নিশ্চয়, নিশ্চয়, আপনি বলুন না, আমি ত শুনছি আপনার কথা।

সুহাস টের পায় গয়ানাথ তার মত করে আইনের বিধান শুনিয়ে দিল। বিনোদবাবুও চুপ করে যান। গয়ানাথ তখন বলে, মোর কাথাটা ত সিধা স্যার, আপনারা যেইঠে নদী আঁকিলেন, ঐঠে নদী নাই, ঐটা বর্ষার জল।

যেন গয়ানাথের কথাটা যাচাই করে দেখার জন্যই সুহাস নদীর দিকে ফেরে। নদীর আরো একটু কাছে যায়। তারপর নিচু হয়ে সে পাড়ের মাটি ভাঙার লাইনটা দেখে। সে এবার ঐ লাইন বরাবর উত্তরে হাঁটে, নিচু হয়েই পাড় ভাঙার লাইন দেখতে-দেখতে, পরীক্ষা করতে করতে। মাঝখানে সেই উপড়নো গাছটার বাধা। ফলে সেই গাছটাকে ঘুরে পার হতে হয়। গয়ানাথ আর বিনোদবাবু পেছনেই থাকেন। সুহাস বুঝে গেছে গয়ানাথ আইনের জোরেই কথা বলতে চায়, সুতরাং সুহাসও তার যুক্তিটা আর-একটু যাচাই করতে চায়। সে একটা বাক পর্যন্ত দেখতে চায়–যে বাকটা এর চাইতেও ডাইনে নিয়ে গেছে নদীকে। এই পাড়ের লাইন নিশ্চিতভাবেই নদীর পাড়ভাঙার লাইন। বর্ষার জলে নদী যদি এতটা উঠে এসে থাকে তা হলে কি এ ভাবে পাড় ভাঙত? সুহাস নদীর পাড়ভাঙা খুব একটা দেখে নি। সামান্য দেখে থাকলেও, মাত্র সেটুকুর ভিত্তিতে তার পক্ষে এমন বর্ষা তার ধারণারও বাইরে। সুহাস সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে তিস্তার দিকে একবার তাকায়। তার সামনে একটু-আধটু পাতলা ঝোঁপঝাড়। তার ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে তিস্তা। দূর ঘোলাটে বিস্তারের ওপর আকাশের আর আলোর বিচিত্র সমিপাতে ছায়া আর রোদেরও কত অজস্র বিন্যাস। সেই বিন্যাসের মধ্যে কোথাও স্রোত নেই, ভাঙন নেই, আক্রমণ নেই, আওয়াজ নেই। সুহাসের ইচ্ছে হল, সে তিস্তার আওয়াজ শোনে। চোখ বুজে সে তিস্তার দিকে মন দেয়। প্রথমে ফরেস্টের ঝিঁঝির ডাকের সঙ্গে মিশিয়ে শুনতে পায়। তারপর ধীরে ধীরে সে শব্দ আলাদা হয়ে যায়। আলাদা হতে-হতে যেন জলতলের নির্ঘোষটা স্রোতের ওপরে উঠে আসে। তিস্তা যেন আবার, জলস্রোত থেকে ধ্বনিস্রোত হয়ে যায়। অবিরত ধ্বনি। বোল্ডারের সঙ্গে বোল্ডারের ঘর্ষণের কামানগর্জন মাটি ভেদ করে উঠে আসছে। অদৃশ্য জলগর্ভ জীবন্ত হতে থাকে। সুহাস চোখ খোলে। আওয়াজটা অনেকখানি মিলিয়ে যায়।

সুহাস ফেরে। সে তার যুক্তি ঠিক করে ফেলেছে। যদি কোনো প্রমাণ হাজির করতে পারে, গয়ানাথ করুক। নইলে সে যা লিখল, তাই পাকা।

গয়ানাথ, বিনোদবাবু তার দিকেই তাকিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। সুহাস তাঁদের কাছে গিয়ে ড়ায়। দুজনের কেউই কথা বলেন না। সুহাস বলে, না গয়ানাথবাবু, নদী এই পর্যন্তই এসেছে।

গয়ানাথ যেমন দার্শনিক ভাবে শুনছিল, তেমনি শোনে। কথা বলে না। কিন্তু গয়ানাথ বা বিনোদ কেউ নড়েও না। সুহাস যখন বলতে যাবে, তা হলে চলুন বিনোদবাবু, তখনই বিনোদবাবু বললেন, স্যার, বলছিলাম গয়ানাথবাবু যখন এতই আপত্তি তুলছেন তখন আর-একবার দেখে নিতে ক্ষতি কী?

আমি ত সেজন্যেই দেখে এলাম। এটা নদীরই আউটলাইন। স্পিল এরিয়া নয়। গয়ানাথবাবুর যদি কোনো প্রমাণ দাখিলা থাকে তবে হাজির করুন, বিনোদবাবুর এই কথায় সুহাস একবার গয়ানাথের আর-একবার বিনোদবাবুর মুখের দিকে তাকায়। সুহাসও এই কথাটিই ভেবে রেখেছিল বলবে বলে, কিন্তু গয়ানাথ কোনো কথা বললে তার উত্তরে বলবে, নিজে থেকে বলবে না। বিনোদবাবু আগেই বলে দিলেন? প্রমাণের কথা একবার উঠলে আর পেছুনো যায় না। তবু বিনোদবাবু বললেন কেন? গয়ানাথবাবু সুহাসের কথা শুনতেই দাঁড়িয়ে থাকে। সুহাস বলে, আপনার কোনো প্রমাণ থাকলে, বলুন।

আমাকে একটু টাইম দেন স্যার। মোক ঐঠে যাবা নাগিবে। তারপর প্রমাণ দিম।

নিশ্চয় দিম। হ্যাঁ, আপনি যান। তাড়াতাড়ি আসবেন।

 হ্যাঁ স্যার। যাম আর আসিম। যাম আর আসিম।

 গয়ানাথ মুহূর্তে সরসর শব্দ তুলে পাতা কাদার ভেতর দিয়ে বেরিয়ে গেল।

.

০২৫.

দশ বছর আগে-পরে ‘গয়ানাথের জোত’

সুহাস গয়ানাথের প্রস্থানের দিকে তাকিয়ে আছে। গয়ানাথ অবিশ্যি নেহাতই ছোটখাট, পাতলা। তার যাতায়াতে কোনো শব্দ না-হওয়ারই কথা। কিন্তু গয়ানাথ যেন তার চাইতেও নিঃশব্দে ফরেস্টের মধ্যে মিলিয়ে গেল খুব দ্রুতগামী জন্তুর মত। এতক্ষণ সুহাস, গয়ানাথের এমন তৎপরতা আছে, ভাবতেও পারে নি। সে খুব আস্তে জিজ্ঞাসা করে, কে ভদ্রলোক?

গয়ানাথ জোতদার। রায়বর্মন। তিনপুরুষের। দেখেন নি? এই মৌজার সবটাই ত ওর। এর নীচের মৌজাও আগে ত ওদেরই পুরোটা ছিল।

গয়ানাথ রায়বর্মন। সুহাস যেন কোন স্মৃতি থেকে নামটা মনে আনার চেষ্টা করছে। দলিলদস্তাবেজে নয়, রেকর্ডে নয়, দাখিলাপচায় নয়, গয়ানাথ নামটা তার কারো মুখে শোনা হয়ে আছে, এর কি ফরেস্টেরও দখল আছে না কি?

কোথায় নেই স্যার,? এটা ত গয়ানাথের জোত বলেই সবাই জানে। আপনি মৌজার নাম বদলেও দিতে পারেন, মৌজা গয়ানাথের জোত-ও লিখতে পারেন। কেন? তা লিখব কেন? সুহাস একটু আনমনা ভঙ্গিতে বিনোদবাবুকে বলে বটে কিন্তু কথাটার মধ্যে একটা কোনো জোর ছিল। বিনোদবাবু তাড়াতাড়ি বলেন না, স্যার, এমনি বলছিলাম।

এখন সুহাসের কাছে যেন অনেক কিছুই পরিষ্কার হয়। একটু হেসে নদীর দিকে আঙুল দেখিয়ে বলে, ওঁর জমি সব? বিনোদবাবু একটু হেসে মাথা হেলান। তা হলে নদীরও দোষ, আমাদেরও দোষ।

গত বারের সেটলমেন্টের পঁচিশ বছর পর এই সেটলমেন্ট হচ্ছে। মাঝখানে আটষট্টির বন্যার মত ঘটনা ঘটে গেছে। তিস্তা ব্যারাজের কাজ শুরু হবে। এই সার্ভে তিস্তা ব্যারাজের জন্যেও হচ্ছে। তিস্তা ব্যারাজ বাধা হলে নদীর অনেক কিছু বদলে যাবে। এখন, এই সার্ভেতে এই মৌজার ম্যাপ থেকে ঐ পুরনো দাগনম্বরগুলো চিরতরে বাদ চলে যাচ্ছে। হালের দাগ নম্বর নতুন করে শুরু হবে। তার মানে নদী যা খেয়েছে তা নদীরই সম্পত্তি হয়ে গেল। এখন যদি দু-চার আট-দশ বার-চোদ্দ বছর পর এখানে চর জাগে, বা ব্যারাজের ফলে পাড়টা আরো এগিয়ে যায় তা হলে তাতে গয়ানাথের কোনো অধিকার থাকবে না, পুরোটা পোয়াস্তি হয়ে যাবে। যার ইচ্ছা সেই তখন দখল নিতে পারবে ও সরকারও সেই পোয়াস্তির বন্দবস্ত যার সঙ্গে ইচ্ছা তার সঙ্গে করতে পারবে। কিন্তু যদি নদীর সীমা এতদূর পর্যন্ত মানা না যায়, পুরনো মৌজা ম্যাপটাই যদি চালু থাকে, তা হলে পঁচ-সাত, আট-দশ, বার-চোদ্দ বছর পরও চর পড়লে গয়ানাথ আইনত বলবে এটা চর নয়, তার নিজ খতিয়ানের অন্তর্গত কায়েম। আর, এবারের সেটলমেন্টে একজনের নামে একটা খতিয়ানই দেয়া হবে। মানে, ঐ নদীর তলের মাটির জন্যেও হালখতিয়ান পেতে চাইছে গয়ানাথ। সুহাস কয়েক পা এগিয়ে ঝুঁকে, নদীর পাড়টা আরো মন দিয়ে দেখে। এইবার নদীর এই ভগ্ন লাইনের একটা অন্য ব্যক্তিগত তাৎপর্য ধরা পড়ছে। এখানে যে-জমি ভাঙছে সেটা ফরেস্টের। কিন্তু আরো দক্ষিণে-দক্ষিণে যে-জমি ভাঙছে বা ভেঙেছে সে সব গয়ানাথের জমি। তিস্তার জলের তলের মাটিটা আর প্রাকৃতিক থাকে না, জলের তলার রহস্য থাকে না, অন্তস্রোতে আর খরস্রোতে যেন অমানবিক কোনো শক্তি থাকে না। তিস্তার জল, বিশেষত এই তীরবর্তী জল, তিস্তার মাটি, বিশেষত এই তীরবর্তী মাটি একটা খুব প্রাকৃত মানবিক শক্তি হয়ে ওঠে। ঝুপ ঝুপ করে যে-মাটি পড়ে, বা স্রোতের আঘাতে-আঘাতে যে-তীরের তলা ফাঁক হয়ে যায়, সেই সব মাটি আর তীরভূমি গয়ানাথের।

সুহাস তিস্তার দিকে তাকিয়ে থাকে। কিন্তু দূরের বিস্তারের অতিঅনির্দিষ্টতা থেকে চোখ গুটিয়ে আনে প্রায় চোখের তলার নিকট নির্দিষ্টতায় তিস্তার জল যেখানে ঘনিষ্ঠ মিত্র। সুহাস খুব কাছে তাকায় কাদাগোলা জলে ফেনার একটা সূক্ষ্ম শাদা রেখা, দুলছে, কয়েক হাত দূরে তিস্তার পাহাড় ধসানো স্রোতের টান এখানে পৌঁছয় না। মাটি থেকে একটা কুটো তুলে নিয়ে সুহাস ঐ জলে ছুঁড়ে দেয়, যেন পরিচিত আত্মীয়তায়। তারপর বিনোদবাবু বলে, তা, ওর যা প্রমাণ তা ওখানেই দিতে পারেন, এখানে আসার দরকার কী?

বিনোদবাবুও খানিকটা চুপ করে থেকে বিহুলের মত বলেন, হ্যাঁ, তাই ত স্যার। আপনি বললেন, আমিও আর ভাবলাম না, থেমে যোগ করেন, এখনো আমরা চলে যেতে পারি, ওরা ওখানে যাবে।

আচ্ছা এখানেই আসুন, যখন গেছেন বলে সুহাস সেই গাছটার ওপর বসে, হেসে বিনোদবাবুকে বলে, কি, মৌজার নাম বদলে দেবেন নাকি কী বললেন, গয়ানাথের জোত?

না স্যার, এমনি বলছিলাম, বিনোদবাবু যেন কৈফিয়ৎ দেন। কিন্তু সুহাস আবার বলে, মন্দ হত না নামটা–গয়ানাথের-জোত, এদিকে ত এরকম নাম থাকে।

হ্যাঁ স্যার, থাকে–

তাই কি সুহাসের মনে হচ্ছিল নামটা যেন তার শোনা, অনেকদিন আগে কেউ শুনিয়েছিল, স্মৃতিতে কোথাও আছেনকশালবাড়ি, বুড়ার জোত, মঙ্গলবাড়ি জোত, কালীর জোত? সেদিন এমন কোথাও চলে যাওয়ার বদলে, দশ বার বছর পরে, এখন, সুহাস বসে আছে এমন একটা জায়গায় যার নাম হতে পারে–গয়ানাথের জোত। সে ইচ্ছে করলেই এই নাম দিয়ে দিতে পারবে। দিয়ে দিতে পারে। আর গয়ানাথ জোতদার গেছে তার সামনে হাজির করার প্রমাণ-দলিল আনতে। সুহাস এখন জোতদারের বিচারক। এ ত সুহাসের একটা জিতই, বেশ বড় জিত। কিন্তু জয় বোধ করতে পারে না সুহাস, গয়ানাথের জোত এই একটা নামের অনুষঙ্গেই জয়বোধ উধাও হয়ে যায় তার মন থেকে। সে অপেক্ষা করে থাকে, গয়ানাথের। গয়ানাথ তাকে বসিয়ে রেখে গেছে, আবার ফিরে আসছে, দশ বছর আগে তাকে দেখে গয়ানাথ পালাতে-পালাতে এখন তাকে হাকিম বলে মেনে নিয়েছে। এখন গয়ানাথ আসছে–তার হাত দিয়ে এই নদী আর নদীর জল আর নদীর ভেতরের মাটি আর এই জঙ্গল সব গয়ানাথের বলে মানিয়ে নিতে। মেনে না নিলে আপিল হবে। আপিলের আপিল হবে। আপিলের আপিলের আপিল হবে। সেখানে সুহাস ত একটা ধাপ মাত্র। আত্মকরুণা থেকে নিজেকে বাঁচাতে সুহাস আবারও নদীর দিকে তাকায়। তাও ভাগ্যি তিস্তা গয়ানাথের এতটা জমি পেয়েছে–তাই সুহাস অন্তত জোতদারের হাকিম হয়ে বসতে  পেরেছে। সুহাস আবার একটা কুটো ছেড়ে নদীর জলে। জোতদারবিরোধী মিত্রশক্তি, না, শ্রেণীসংগ্রামের মিত্রশক্তি, আবার বামফ্রন্ট সরকার কৃষকের মিত্র সরকার, আবার, সুহাস কৃষকের মিত্র হাকিম। চার পাশেই মিত্র। কিন্তু যার মিত্র, তাকেই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।

.

০২৬.

 ভিড় ও গয়ানাথ

অনেক মানুষের পায়ের চাপে পচা ভেজা পাতা দলে পিষে যাচ্ছিল। তার একটা হিস হিস শব্দ পাওয়া যায়। সুহাস তাকিয়ে দেখে বহু লোক আসছে। বিনোদবাবু বলেন, কী ব্যাপার, ওখানকার সবাইকেই নিয়ে এল নাকি?

তাই ত মনে হচ্ছে, বলে সুহাস ভাবে, আগে থাকতেই তৈরি ছিল নাকি। তা হলে সকাল থেকে সার্ভের ওখানে যে এত লোক জমা ছিল, সে সবই গয়ানাথের লোক? যেন গয়ানাথের কোনো বিপরীত পক্ষ আছে, এমন করে সুহাস ভাবে, কেউ নদীর লোক নয়?

সুহাস ভাঙা গাছের ওপর বসেই ছিল। সমস্ত দলটা এসে সামনে দাঁড়িয়ে যায়। সুহাস বসে  সই তাকিয়ে থাকে। গয়ানাথকে দেখতে পায় না। তাতে যেন একটা যুদ্ধ-যুদ্ধ ভাব আসে। এখানেই বনের মধ্যে ত ছড়িয়ে যাওয়ার জায়গা নেই। ছড়িয়ে যাওয়ার জন্যে সবাই এখানে আসেও নি। বসার জায়গা নেই–বর্ষার জঙ্গলে। সমস্ত দলটাই ভিড় করে সামনে, দাঁড়িয়ে। তাতে, বাধ্য হয়েই ভিড়টাকে কয়েকটা লাইনে দাঁড়াতে হয়েছে। আর ভিড়টার মুখোমুখি একা-একা সুহাস, নদীকে পেছনে নিয়ে, বসে। বিনোদবাবু দাঁড়িয়ে, সুহাসের থেকে একটু দূরে, কিন্তু ভিড়ের সামনেই। এখানে, এরকম করে দাঁড়াতে হয়েছে বলেই সবগুলো মুখই মিশে গেছে। সাজানো-গোছানো ঠেকে, প্রায় ক্যালেণ্ডারের জাতীয় সংহতির ছবির মত সাজানো-গোছানোতামাটে মোঙ্গলীয় মুখের পাশেই খাটো নেপালি মুখের তীক্ষ্ণতা, পেছনে লম্বা সঁওতালি মুখ। সুহাস এখানে নতুন বলেই, ও এ-অঞ্চলের সঙ্গে তথ্যে আর ম্যাপে আর রিপোর্টেই তার পরিচয় বলে, এই মুখগুলোর পার্থক্য তার কাছে এত সহজে ধরা পড়ে। নইলে পোশাকে-আশাকে এ-ভিড়ের ভেতর বৈচিত্র্য এত কম যে লোকগুলিকে একটা ভিড় বলেই মনে হয়, আলাদা-আলাদা আদিবাসী-উপজাতির বলে মনে হয় না।

কিন্তু এতগুলো মানুষ এতটা ঘনিষ্ঠ হয়ে এই জঙ্গলের মধ্যে সুহাসের সামনে দাঁড়িয়ে, যেন, গয়ানাথ তাকে লোক জুটিয়ে ভয় দেখাচ্ছে। সুহাস উঠে দাঁড়ায়, তারপর একটু কড়া গলায় জিজ্ঞাসা করে, গয়ানাথবাবু কোথায়? হঠাৎ যেন সুহাস সতর্ক হওয়ার দরকার বোধ করে–এই জঙ্গলের ভেতর তাকে আর বিনোদবাবুকে এতটা আলাদা করে এনে কি গয়ানাথ কোনো ফাঁদে ফেলছে। বিনোদবাবুর দিকে তাকায় না সুহাস, কিন্তু বুঝতে পারে, তার ভঙ্গিতেও অনিশ্চয়তা আছে। সুহাস ভুলতে পারে না, তার ঠিক পেছনেই তিস্তা, বর্ষার। আর সামনে এত, মানুষ, আদিবাসী।

কিন্তু এত অনিশ্চয়তা-অস্থিরতা নিয়েও সুহাস সামনের এই মুখগুলোর দিকে তাকায়, এই যেরকম মুখের সমাবেশের স্বপ্ন বছর দশ বার আগে তারা দেখত নানা ঘটনার, ইতিহাসের, এখন মনে হয় রূপকথার, অনুষঙ্গে। ব্যক্তিত্ব নয়, সমষ্টিই যে-মুখের আয়তনে আর রেখায়, নাক-মুখ-চোখ-কানের মত ব্যক্তিগুলোর সব শারীরিকেও, খোদাই করা, তেমনি এত মুখের সারি সুহাসকে কোনো এক লুপ্ত সমাবেশের সামনে হাজির করে। কে জানত, এমন প্রতিপক্ষতায় তার এই আবিষ্কার ঘটে যাবে?

এই সরি যা, সরি যা-বনমোরগের গলায় গয়ানাথবাবুর এই চিৎকারটা দঙ্গলের ভেতর থেকে আগে শোনা যায়। তারপর সামনের সারির লোকজন একটু ফাঁক হয়ে যায় আর সেই ফাঁক গলে পেছন থেকে গয়ানাথ এদিকে আসতে গিয়েও আটকা পড়ে যায়। তাকে দেখতে না পেয়ে সামনের একজন বায়ে সরে ফাঁকটা বন্ধ করে দেয়। গয়ানাথকে কাত হয়ে, আগে মাথাটা বের করে, তারপর পিছলে, বেরিয়ে আসতে হয়। তার কাপড়ের একটা দিক ভিড়ের ভেতর কোথাও আটকে যায় বলে তার উরু পর্যন্ত খুলে যায়। পাছে কাপড়টাও খুলে যায় তাই গয়ানাথ কাপড়টা ধরে থাকে। ভিড়ের ভেতর থেকে কেউ খুঁজে পায় না কাপড়টা কোথায় আটকেছে। আর ঐ অবস্থায় গয়ানাথ বনমোরগের গলায় চিৎকার করে ওঠে, শালো চুতিয়ার ছোঁয়াগিলান, শালো জঙ্গলত আসি জঙ্গলিয়া হবা ধইচছিস, পাছত না দেখিস কায় আছে আর কায় না-আছে? এইঠে কি সার্কাস আসিবার ধইচছে, না, নাটঙ্গি হবা ধইচছে?

ততক্ষণে ধুতি গয়ানাথের কাছেই ফিরে এসেছে। গয়ানাথ সুহাসের সামনে দাঁড়িয়ে দঙ্গলটাকে আবার গালাগাল করে। তার খর্বতার জন্যেই ভিড়টার মুখোমুখি তাকাতে তার ঘাড়টা অনেক হেলাতে হত। অতটা হেলিয়ে এতটা রাগা যায় না। বা, ঘাড় হেলিয়ে গলার এই স্বরটা বের করা তার পক্ষে সম্ভব নয়। তাই ভিড়টার সামনে দাঁড়িয়ে, ঘাড় নুইয়ে, মাটির দিকে তাকিয়ে, গলার সবচেয়ে বেশি যে-জোর দেওয়া সম্ভব সেই জোর জোগাড় করে, গয়ানাথ গালাগালি চালাতে থাকে–কায় আসিবার কইছে সগাক? সগায় আসি গেইছে শালো ভূতের দল। শালো পিপিড়ার নাখান নাইল বানাও, নাইল করি চলো, শালো গরুর দল।

গয়ানাথের প্রথম চিৎকারে সবাই একটু ঘাবড়ে গিয়েছিল। কিন্তু কাপড়টা আটকে যাওয়ায় সবারই একটা কাজ জুটে গেল। আর, কোথায় আটকেছে সেটা খুঁজে না পেয়ে কাজটা বেড়ে গেল। এর ভেতর কাপড়টা পুরোই খুলে যেতে পারে গয়ানাথের এই ভয় দেখে সবাই মজাও পেয়ে যায়। এখন, গয়ানাথের মাথানোয়ানো চিঙ্কারের ওপরে ভিড়ের লোকজন এ ওর পায়ে ধাক্কা দিয়ে হাসে। কিন্তু হেসে ফেলে এ ওর আড়ালে মুখ লুকোতে চেষ্টা করে। ভিড়ের ভেতরে কেউই যে গয়ানাথকে দেখতে পায় নি, আর গয়ানাথই যে ভিড়ের আড়াল থেকে সামনে বেরতে পারছিল না–এর চাইতে বড় মজা ভিড়ের পক্ষে আর কী হতে পারে?

গয়ানাথ ওয়াক থু করে সশব্দে থুতু ফেলে। কোঁচা দিয়ে মুখটা ও ঠোঁটটা মুছে নিয়ে খুব দ্রুত কোঁচার তলাটা আবার উল্টো করে তুলে শার্টের নীচে গুঁজে দেয়। তারপর, আবার মুখটা নামিয়ে কোঁচাটা একটু তুলে মোছে। এ সবটাই সে করে সুহাসের দিকে পেছন ফিরে, ভিড়টার সামনে দাঁড়িয়ে, যেন ভিড়টা তার অন্দর। শেষে ভিড়টার দিকে পেছন ফিরে সুহাসের মুখোমুখি দাঁড়াবার আগে সে সামনের সারির লোকগুলোর চোখে চোখ রেখে নিজের মূল কণ্ঠস্বরে হিসিয়ে ওঠে, মহিষের বাথান।

সুহাস বসে পড়েছিল। বসেই থাকে। সে গয়ানাথকে জিজ্ঞাসা করে না। তার জিজ্ঞাসা করার কিছু নেইও। তা ছাড়া, সুহাস বোঝে, গয়ানাথ একটু আগে একা-একা, ধীরে-ধীরে কথা বলে, সুহাসদের সামনে নিজেকে বেশ ভাল ভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছিল, ফলে কিছুটা জোরও পেয়েছিল। এখন, যে-ভিড়টা তার সাক্ষ্য-প্রমাণ তাতেই সে চাপা পড়ায় তার এত চেষ্টা নষ্ট হল। এখন, সুহাসও তাকে আর জোর ফিরে পাওয়ার সময় দেবে না। তাকে তার প্রমাণ সোজাসুজি হাজির করতে হবে। যে-প্রমাণই হোক, সুহাস কী বলবে ঠিক করেছে–আপনার কথা শুনলাম, আমাদের যা সিদ্ধান্ত তা ড্রাফটে, খশড়ায় থাকবে। তখনো দেখে যদি আপনার আপত্তি থাকে দরখাস্ত করবেন।

গয়ানাথ বলে, স্যার।

 হ্যাঁ, কই কী এনেছেন? সুহাস হাত বাড়ায়।

 প্রমাণ দেখাম, স্যার? গয়ানাথ জিজ্ঞাসা করে।

 প্রমাণ দেখাবেন বলেছেন আপনি, দেখাবেন কিনা সেটা ত আপনার ব্যাপার, সুহাস আইনি ভাষায় কথা বলে।

স্যার, মুই ডাকিছু দুই জনাক, ইমরা সগায় আসি গেইসে।

সে আসুক না। কী দেখাবেন দিন না।

আপনি কিছু মনে করিবেন না স্যার।

 কেন?

এই জংলিগিলান এই জঙ্গলের ভিতর চলি আসিছে।

তাতে আমার কাজের ত কোনো অসুবিধে হচ্ছে না–আপনি কী দেখাবেন, দেখান না।

দেখাছি স্যার, কিন্তুক মোর কুনো দোষ নিবেন না।

দোষগুণের ব্যাপারই নেই কিছু। এ ত আইনের ব্যাপার।

না, এই জংলিগিলান আসি গেইসে।

 ঠিক আছে, দিন না কী দেখাবেন।

হে-এ-এ বাঘারু, আবার বনমোরগের গলায় চিৎকার করে গয়ানাথ।

গয়ানাথের ডাক শুনে ভিড়টাকে ঠেলেঠুলে একজন সামনে এসে দাঁড়ায়। ভিড়টাকে পেছনে ফেলে সে বেশি দূর এগিয়ে আসে না বলে বোঝা যায় না, গয়ানাথের ডাক শুনে সেই সামনে এল কি না। গয়ানাথ বলে, যা কেনে, ঝট করি যা, মৌজার লাইনখান ধরি যাবি, বুঝিলু? নীরবেই সেই লোকটি উত্তর দিকে চলে যায়, নদীর পাড় ঘেঁষে, নদীভাঙার লাইন পরীক্ষা করতে একটু আগে যেদিকে সুহাস গিয়েছিল। সেই লোকটি এ রকম চলে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর সুহাসের মনে হয়–আগে কি এই লোকটিই চেয়ার মুছছিল আর গাছে উঠেছিল? কিন্তু সেই লোকটিই কি? ভিড়ের দিকে তাকিয়ে সুহাস বুঝতে পারে না। এতবার গয়ানাথবাবুর মুখে এই নামটা উচ্চারিত হতে শুনেও সে যেমন লোকটির নাম বুঝতে পারছে না, তেমনি এই এত লোক সামনা-সামনি দল পাকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলেও সে চিনতে পারছে না–একটি মুখও। বা, একটি মুখ থেকে অপর মুখকে আলাদা করতে পারবে না।

লোকটি চলে যাওয়ার পর ভিড়া একটু আলগা হয়। অনেকে ওর সঙ্গে-সঙ্গেই উত্তর দিকে চলে যায় ঝোঁপের আড়ালে-আড়ালে। আবার অনেকে ঐ জায়গাতেই বসে পড়ে, হাঁটু জড়িয়ে হেলে, আর কেউ-কেউ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বিনোদবাবু, সুহাস আর গয়ানাথকে লক্ষ্য করে।

স্যার, আপনি ত এই জিলার ম্যাপট্যাপ সব দেখি নিছেন?

 জেলার? হ্যাঁ। কেন?

 না, এমনিই, ধরেন, হামরালা ত তিস্তার খুব পাখে খাড়ি আছি, আমাদের পাছত, মানে ধরেন কি না আরো উত্তরে আর পুবে চালসা, হায়হায়পাথার।

হ্যাঁ, সে ত জানিই।

সে ত জানিবেনই স্যার। আপনারা না জানিলে কায় জানিবে? আর এই যে তিস্তাখান, এর সরাসরি ঐ পারে, পচ্চিমে, বৈকুণ্ঠপুর ফরেস্ট। এই তামানটাই ত ফরেস্ট আছিল–সেই চালসাঠে হেই বোদাগঞ্জ।

তখন নদী ছিল না?

 সেইটাই ত বলি স্যার, নদী থাকে, ফরেস্টও থাকে, মৌজাও থাকে, কিছুই যায় না–

.

০২৭.

 জমি জরিপ : গয়ানাথী পদ্ধতি

গয়ানাথ নদীর দিকে আঙুল দেখায়। আর সুহাস দেখে, দূরে নদীতে দুজন মানুষ ঘাসকুটোর মত ভেসে যাচ্ছে। সুহাস একটু অপ্রস্তুত চিৎকারই করে ওঠে, আরে আরে।

ছাড়ি দেন স্যার, অ ত বাঘারু।

 মানে? জিজ্ঞেস করেই সুহাস যেন বুঝে ফেলে, কী ব্যাপার, এরা কি নদীতে নামল নাকি?

হ্যাঁ স্যার। যেইঠে এ্যালায় ভাসি যাছে ঐঠে ত মোর এই মৌজাখান শুরু।

 তাই বলে আপনি এই বর্ষার তিস্তায় ওদের নদীতে নামালেন?

ও ত বাঘারু স্যার, এ্যালায় উঠি আসিবে। আর মুই ত এক বাঘারুক নামিবার কইছি; আর-একটা কায় নামিছে রে? গয়ানাথ গলা তুলে জিজ্ঞেস করে।

 মইনুদ্দিন। ডোয়া-ডাবরির।

অ? মইনুদ্দিন। অয় ত চ্যাম্পিয়ন সাঁতারু স্যার। এ্যালায় মোর কাথাটা শুনেন স্যার। ঐ যেইঠে বাঘারু আর মইনুদ্দিন এ্যালায় পাক খাছে–ঐঠে বৈকুণ্ঠপুরের বোদাগঞ্জ আর এই আপলাদ এক হয়্যা আছি, মোর বুড়া ব্যাপার, মানে মোর ঠাকুরবাবার, মানে ঠাকুরদাদার মৌজাখান ঐঠে আছিল। কিন্তুক মুই এ্যালায় কি কছি যে ঐ যে মৌজাখানঐঠে মোর নামে লিখি দেন? মোরঠে ওর দলিল আছে, ঠিকঅ। কিন্তু ঐঠে ত নদী। তিস্তা নদী। ঐ নদীখান ত আমি মানি নিছি। কিন্তু তাই বলি কি এইঠেও নদী মানিব্বর নাগিবে? বলে সে পাড়ের তলায় জল দেখায়–এইঠে নদী না হয়, বর্ষার জল। বাঘারু এইঠে আসি গেলে দেখিবেন এইঠে জল নাই, সোতা নাই। যার জল নাই, সোতাও নাই–সেইটা কি নদী হবা পারে? এইটা নদী না হয়। এইটে আপনার দাগ নম্বর দিবা নাগিবে।

এতক্ষণে সেই পুরো ভিড়টাই নদীর পাড়ে ঘেষাঘেষি করে ওদের সাঁতার দেখছে। সুহাসের কেমন অপ্রস্তুত লাগে।

গয়ানাথ তাকে সঁতারে ফাঁসাবে সে ভাবতেও পারে নি। বিনোদবাবুও কি পারেন নি? নাকি তাঁর সঙ্গে গয়ানাথের বোঝাপড়া হয়ে গেছে কোনো! এই দুজনকে তার সামনে নদীতে নামানোর পেছনে গয়ানাথের কোনো মতলবও থাকতে পারে। যদি ঐ দুইজনের কিছু হয়? গয়ানাথের মতলবটা কী? সরকারি অফিসার হিশাবে তাকে কি কোনো কিছুর সাক্ষী রাখতে চাইছে? কিন্তু এখন কি সুহাস এখান থেকে সরে যাবে? সেটা যাওয়া যায়? ঐ লোকদুটো ওঠার আগে?

সুহাসের বাঁ পাশে গয়ানাথ। সুহাস তাকে বলে, আপনি এভাবে সময় নষ্ট করছেন কেন? আমাদের আজ সার্ভের প্রথম দিন। আমাদের ড্রাফট বেরলে আপনি যা প্রমাণ-সাক্ষ্য দেয়ার তা দিতে পারতেন। ওদের উঠতে বলুন।

ও ত এলায় উঠি আসিবে। কিন্তু তার টাইম ত দিবা নাগিবে। ওরা কী আর স্রোত কাটাইয়া আসিবার পারিবে? স্রোত ধরি-ধরি আসিবার নাগিবে।

এই তিস্তাটাকে আজ সকাল থেকে কতবারই না দেখতে হচ্ছে সুহাসকে। মাঝে-মধ্যে ত সে এমনিও তাকিয়ে-তাকিয়ে দেখল। কিন্তু তিস্তার পেটে গয়ানাথের জমিতে গয়ানাথ তার দখলের প্রমাণের কথা তুলেছে যখন থেকে, যেন এই নদী আসলে নদী নয়–গয়ানাথের জোত, তখন থেকেই তিস্তা যেন আর দৃশ্য থাকছিল না, হয়ে উঠছিল তার এই সার্ভেরই ঘটনাস্থল। আর, এখন তিস্তা নদীর এই দিগন্ত-ছাপানো বিস্তারে, ঐ দুটো প্রায় অদৃশ্য মানুষ জলের ফেনার মত ভেসে যেতে-যেতে তিস্তাকে যেন ঢুকিয়ে দিচ্ছিল সার্ভে ম্যাপের লাইনের মধ্যে। সুহাস আবার বলে, ওদের পাড়ে উঠতে বলুন।

উঠিবার বলিলেই কি আর উঠিবার পারিবে স্যার? এ ত স্রোতে ভাসি-ভাসি ঘুরি-ঘুরি উঠিবার লাগিবে। উজানে গিয়া নদীতে নামিয়া শরীরখান ছাড়ি দিছে। এলায় ভাটিত গিয়া, ধরেন কেনে মাইলটাক ভাটিত গিয়া, বায়ত মোড় নিবার পারিবে, ঐঠে একটা চরা আছে। সেইঠে সাঁতার কাটি এইঠে আসিবে।

সুহাস দেখে তিস্তার ভেতরে লোক দুটিকে আর দেখা যাচ্ছে না। সে তাদের মাথায় চুলটকুও দেখতে পাচ্ছে না। কিন্তু তার পেছনের ও পাশের সেই ভিড়ের কেউ আঙুল তুলে দেখাচ্ছে–ঐঠে ঐঠে, ভাসি গেলাক, আগত বাঘারু, হে-ই ডুবি গৈলাক হে। ঐ আঙুল ধরে-ধরে তাকিয়ে সুহাস দু একবার দুটো কাল বিন্দু দেখতে পায় বটে কিন্তু দেখামাত্র ঐ কাল বিন্দু দুটি এত দূরে ভেসে যায়, সে আর চোখ ঠিক রাখতে পারে না। কিন্তু যখন দু-এক মুহূর্তের জন্যে দেখে, তখন তার মনে হয় না ওরা কখনো ফিরতে পারবে, বা ফেরা সম্ভব–তিস্তার এই ধূসর বিস্তারে ঐ দুটি কাল বিন্দু এতই অবান্তর। হে-ই আর দেখা না যায়, চরটা পাই গেইসে।

কে-একজন মদেশিয়া ভাষায় জিজ্ঞাসা করল, দুই মানুষ চর পাই গেলাক?

 হয়। দুজনাই পাই গিছে।

 এ্যালায় ফিরিবে।

 কনেক বিশ্রাম করিবার নাগিবে ত হে।

শরীল ছাড়ি দিবে, বসি পড়িলে শরীল ছাড়ি দিবে।

বিশ্রাম কেনে হে? যাওয়ায় তানে ত স্রোত ভাসি গেইছে।

 স্রোত ভাসিবার আর জোর লাগে না, নাকি হে? ভাসি থাকিবার তানে—

 হয়, হয়, রওনা দিছে হে।

কোটত কোটত? ভুরুর ওপর হাতের ঢাকা দিয়ে অনেকেই দেখতে চেষ্টা করে। কিছুক্ষণের স্তব্ধতার পর কেউ বলে, না হে, কাঠ ভাসি যাছে, কাঠখান ভাসি গেলাক আর ভঁয় কইথে ভাসি আইলাক? মদেশিয়া গলায় নিরুত্তেজ রসিকতা, নদীর পানি পিকে মাইত গেলে হে? নদীর ভেতরে ঐ দুইজনের ভেসে যাওয়াটায় নজর রাখতে দৃষ্টি আর মন যে-তীব্রতায় বাধা ছিল, তা এখন শিথিল হয়ে গেছে। ঐ দুইজন নদীর ভেতরের কোনো একটি চরে একটু গা-হাত-পা মেলে দিয়ে যেমন বিশ্রাম নিচ্ছে হয়ত, এই এতগুলো লোকও তেমনি, নদীর ভেতরে ঐ দুজনকে যতক্ষণ আবার দেখতে না-পায় ততক্ষণ, কথায় কথায় একটু এলিয়ে নিচ্ছে।

গয়ানাথই এক বিশ্রাম নিতে পারছে না। সে ভুরুর ওপর একবার ডান হাতের ঢাকা, আর-একবার–হাতের ঢাকা দিয়ে কোনো একটি বিন্দুতে ঐ লোক দুজনকে খুঁজবার চেষ্টা করছে। গয়ানাথ যদি ভুরুটা একটা হাত দিয়েই ঢাকা দিত তা হলে হয়ত তাকে এতটা অস্থির দেখাত না। কিন্তু একবার ডান, আর-একবার বা হাত তোলা ও নামানোর ফলে মনে হচ্ছিল সে বুঝি তিস্তার পুরো বিস্তারটার ওপরই চোখ বোলাচ্ছে। আর, ঐ অত তীব্র স্রোতের অত বিস্তারের দিকে অতক্ষণ এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলে মনে হয়, এই পাড়টাই ভেসে চলেছে, জাহাজের মত, আর গয়ানাথ ডেকে দাঁড়িয়ে সমুদ্রের দূর-দূর দ্বীপে কাকে বা কাদের খুঁজছে।

সবাই চুপ হয়ে গিয়েছিল, অচেতনেই হয়ত। আর ফরেস্টের এত গভীরে, নদীর এত কিনারে চুপ হয়ে গেলে ত এই জায়গাটা তার স্বাভাবিক স্তব্ধতাই ফিরে পায়। তাতে যুক্ত হয় শুধু এতগুলো মানুষের সমবেত শাসপতন শাসগ্রহণ। সেই অবকাশে তিস্তার ওপর থেকে বাতাস লাফিয়ে উঠে গাছগাছড়ার মধ্য দিয়ে গভীরতর বনাঞ্চলে চলে যাওয়ার পথে যেন মুচড়ে দিতে চায় শালগাছকেও।

ফিরি আসিবার ধরিছে, খুব চাপা গলায় কেউ বলে। সবাইকে কথাটা মেনে নিতে হয়, কথটা এমন ভাবে বলা। তারপর খোঁজাখুজি চলে নীরবেই। সুহাসও তার চোখ তীক্ষ্ণ করে দেখে। কিন্তু সে ত জানেই না কোনদিকে তাকাতে হবে। একমাত্র যখন এই ধূসর সমতলের ওপর কাল বিন্দুটা স্থির দেখা যাবে, তখন সুহাস বুঝতে পারবে-সাঁতার কেটে এগিয়ে আসছে।

ঐ যে, ঐ যে, আসিছে, আসিছে সুহাস দেখে সবাই তার বয়ে আঙুল দেখাচ্ছে। তাকিয়ে থেকেও সে কিছু দেখতে পায় না। কতটা দূরত্ব এই স্রোতের বিপরীতে লোক দুটোকে সঁতরাতে হবে?

সুহাসের পাশ থেকে গয়ানাথ বলে, হে-এ মউয়ামারির সীমানায় ঢুকিল। না! সুহাস বলে ফেলে, অ্যাঁ?

তখন গয়ানাথ সুহাসকে জিজ্ঞাসা করে, দেখিছেন ত, উমরায় আসিছে?

কোথায়?

এই যে বা হাতঠে, গয়ানাথ তার ডান হাতটা সুহাসের মুখের ডাইনে আড়াল দিয়ে বলে, এই বার এইঠে বা দিকে ঘাড় ঘুরান ধীরে-ধীরে, ঘুরান, ব্যস, দেখেন, গয়ানাথ সুহাসকে সময় দেয়, দেখিবার পাছেন?

সুহাস যেন খুব নিশ্চিত নয় এমন ভাবে বলে, হ্যাঁ—

গয়ানাথ সুহাসকে আরো কিছু সময় দেয়। তারপর জিজ্ঞাসা করে, দেখিবার পাছেন ত স্যার?

হ্যাঁ হ্যাঁ। হ্যাঁ। সুহাস তার নজর স্থির রাখে। এখন ত ওরা সাঁতরে এদিকে আসছে–তাই কালো বিন্দুটা চোখ থেকে সরে যাচ্ছে না, একবার দেখতে পেলে কিছুটা অপরিবর্তিতই থাকছে।

ঐ যেইঠে সাঁতার কাটিবার ধরিছে ওর বা হাতে, মোর বা হাতে, এই সাইডে, বলে বা-হাতটা তোলে, আঠার নম্বর দাগ মউয়ামারি মৌজা আর ডাইনে, এই সাইডে, পাঁচ নম্বর হাঁসখালি মৌজা। দুইখানই মোর দাগ। ষোল আনা নিজ খতিয়ান। ত মউয়ামারিটা বাদ দেন। ঐঠে তে মউয়ামারি শেষ হয়্যা গেইসে। কিন্তু হাঁসখালিটা ধরেন। হাঁসখালির ত ঐঠে শুরু, ঐঠে ঘুরিঘুরি চলি আসিছে। দু-জনকে এখন বেশ স্পষ্টই দেখা যাচ্ছে। তাদের হাতের আর পায়ের কোনো আন্দোলন বোঝা যাচ্ছে না যদিও, কিন্তু ধীরে-ধীরে স্পষ্ট হয়ে উঠছে তাদের মাথা আর ঘাড়ের আন্দোলন। গয়ানাথ তার বনমোরগের গলাটাকে সবচেয়ে ওপরে তুলে, হে-এ-এ বাঘারু, বা-হাত সরি যা সরি যা, বলে ডান হাতটা নাড়ায় সরে যাওয়ার ইঙ্গিত দিয়ে। গয়ানাথের এত চিৎকার তিস্তার বাতাসে হুমড়ি খায় গাছের মাথায়।

দেউনিয়া, ঐ পাড়ে রংধামালির বাধে গিয়া চিল্লান, শুইনবার পাবে, এই পার থিক্যা চিল্লালে ত আপনার হাতির পাল আবার ডাইনা শুরু করবি নে–, বেশ ভারী উঁচু গলায় পূর্ববঙ্গের উচ্চারণে কথা কটি কানে আসে।

গয়ানাথ কানে নেয় না। ততক্ষণে সাঁতারু দুজনের হাতে তিস্তার জল-ছিটকনো চোখে পড়ে। গয়ানাথ আবার চিৎকার করে–সরি যা, বায়ে সরি যায়, সতের নম্বর দাগ ধর, ধর-দুজনের মধ্যে যে এগিয়ে ছিল সে সত্যি বয়ে ঘুরে যায় একটু, প্রথমে বোঝা যায় না, কিন্তু তার মাথা নিশ্চিত ভাবে বায়ে ঘোরে–ঐঠে একখান পুকুর আছে, ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের সঙ্গে অংশ বন্দোবস্ত, ঐঠে হাতির পাল। জল-খোয়ায় তানে আসিলে হামরালা কিছু করিম না। হে-এ-এ বাঘারু, ডাইনে ঘুর, ডাইনে ঘুর, সিধা আয়।

গয়ানাথ সুহাসকে যেন সময় দেয় সাঁতরে-সাঁতরে লোকটার ঘোরাটা দেখতে ও তার একটা আন্দাজি মাপ নিতে। তারপর বলে, এইঠে শুরু হইল স্যার, সিদাড়োবা, হাতিডোরা, বাঘাড়োবা।

গয়াডোবা–গলা শুনে সুহাস বুঝতে পারে সেই পূর্ববঙ্গের দলটা হবে। কিন্তু এই দলটা এল কখন, দেখে নি ত সুহাস, নাকি প্রথম থেকেই ওখানে ছিল–আড়ালে-আড়ালে।

শালো, তো বাপাডোবা, সুহাসের পাশ থেকেই গয়ানাথ পেছনে ঘাড় ঘুরিয়ে চেঁচায়। ফলে যে-সমবেত হাসি ওঠে তাতে বোঝা যায় গয়ানাথের এমন আচমকা রাগে সবারই ফুর্তি।

.

০২৮.

গয়ানাথী প্রমাণ

এখন আর নদীর ভেতরে কারো খুব মন ছিল না। লোক দুটি কাছাকাছি এসে গেছে। গয়ানাথ বলে, এইবার দেখেন স্যার, আপনাকে ত দুইখান মৌজা দেখাছি, এ্যালায় দেখেন, এই মৌজার কতখানি আপনারা নদীক ছাড় দিবার ধরিছেন-হে-ই বাঘারু সিধা বায়ে চলি যা। বাঘারু সোজা বয়ে চলতে থাকে। চলতেই থাকে। সুহাস গয়ানাথের দিকে তাকিয়ে বলে, আপনি ওদের উঠতে বলুন, আমি আপনার পয়েন্ট বুঝেছি, কিন্তু বোঝে সে এই জায়গা ছেড়ে না গেলে গয়ানাথও তাকে ছাড়বে না, আমরা ফিরে যাব, আর ফিরে যাচ্ছেই এটা বোঝাতে নদীর দিকে পেছন ফিরে ডাকে, বিনোদবাবু।

সুহাসকে পেছন ফিরতে দেখেই ভিড়টা ফাঁক হয়ে গিয়েছিল। বিনোদবাবুর গলা শোনা গেল, হ্যাঁ স্যার।

চলুন, আমরা ফিরে যাচ্ছি।

হ্যাঁ স্যার।

কিন্তুক হুজুর, মোর ত প্রমাণখান দেখিলেন না, আসল প্রমাণ?

দেখালেন ত সব, আবার কী প্রমাণ? সুহাস দুই পা সরে যায়, ভিড়টাও সরে যায়, গয়ানাথও সরে আসে। তিস্তার ভেতরে দুটো লোক ভাসতে থাকে। সেটা পাছে গয়ানাথ আর সবাই ভুলে যায় সুহাস বলে, ওদের উঠতে বলুন।

কিন্তুক স্যার, আপনি ত নদীখান দেখিলেন, মোর দাগনম্বরখান দেখিলেন না।

পেছন থেকে পূর্ববঙ্গের সেই দলটি বলে, কুঁচকি পর্যন্ত দেখাইয়া ছাড়ছেন ত—

সুহাসের সামনে থেকে গয়ানাথ.ঠাণ্ডা গলায় জবাব দেয়, তোর ধোকর বাপের ঘরখান বাকি আছে রে।

নিশ্চিত ভঙ্গি বা ঠাণ্ডা স্বর বা কথাটির জন্যই এবার গয়ানাথ জিতে যায়। সমবেত হাসিতে সেই অনুমোদন থাকে। সুহাস একটু অপ্রস্তুত হয়েই বোঝে তার ঠোঁটেও হাসিই লেগে আছে। বলাটা ভাল হয়েছে।

এক মিনিট স্যার, এক মিনিট, হে বাঘারু এইঠে আসি খাড়া, এইঠে–সামনে থেকে সবাইকে সরিয়ে দিয়ে গয়ানাথ সুহাসের জন্যে দৃশ্য খুলে দেয়। সুহাস তার জায়গা থেকে নড়ে না। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়। জলের ভেতর গয়ানাথের বাঘারু দাঁড়িয়ে। লোকটার বুক পর্যন্ত জল। মাথার চুল লেপটে আছে। এই লোকটিই কি…,আর-একজন সাঁতারু বোধহয় উঠে গেছে।

বাঘারু, এইবার হাটা ধর, সিধা হাটা ধর, জলের ভেতর বাঘারু মাতালের মত হাটে, সেটা জলের তলার অসমতলতার জন্যই হোক আর বাঘারুর ক্লান্তির জন্যই হোক।

পেছন থেকে আওয়াজ ওঠে, লেট রাইট, লেফট রাইট যেন বাঘারুকে হাঁটার নির্দেশ দিচ্ছে, লেফট রাইট।

বাঘারু এক জায়গায় ডুব জলে পড়ে গিয়েই ভেসে ওঠে। গয়ানাথ তার পকেট থেকে একগাদা দলিল বের করে বলে, এই যে স্যার, মোর খতিয়ানখান, ষোল আনির খতিয়ান। ভাজ খুলে সুহাস দেখে, এই মৌজার যে-এলাকা এখন নদীর ভেতরে তার বিভিন্ন দাগনম্বরের নানা খতিয়ান। সে দ্রুত উল্টে বলে, ঠিক আছে, আমি ত দেখলাম।

কী দেখিলেন স্যার?

আমার যা দেখার দেখলাম।

দেখিলেন ত স্যার, এ্যানং বিশালিয়া নদী, আর এইঠে ক্যানং হাঁটুজল না বুকজল। এইঠে বৃষ্টির জল আসি বসিবার ধইচছে–এইটা নদী না।

ঠিক আছে। আপনি আপনার খতিয়ানগুলো বিনোদবাবুকে দেখাবেন। আমি ত দেখে নিয়েছি। ঐ লোকটাকে মিছিমিছি অত দূর ঘোরালেন কেন, এখান থেকে বাশ ফেললেই ত আপনার কথা বোঝ যেত, নদী নয়, জল।

কিন্তু স্যার, আপনাকে ত ম্যাপের তানে সব বুঝিবার নাগিবে, তাই মৌজার আসল মাথাঠে শুরু। করিলাম। কোটত মাথা আর কোটত ল্যাজ!

সুহাস হাঁটতে শুরু করে। তাকে ঘিরে ধরা ভিড়টাও তার সঙ্গে-সঙ্গে ঘোরে। দু-পা হাঁটতেই সুহাস বোঝে সে একটা ভিড়ের মাঝখানে, ভিড়টা নড়লে তবে সে নড়তে পারবে। ভিড়টা যাতে নড়ে সে কারণে সে এগিয়ে যাবার ভঙ্গি করে। এমন সময় তার বা পাশ থেকে গলা পরিষ্কার করে একজন বলে ওঠে, স্যার, আপনার নিকট আমাদের কিছু বক্তব্য আছে।

সুহাস সেদিকে মুখ তোলে। এই জায়গা দাও, জায়গা দাও বলে পেছন থেকে কেউ ভিড় সরায়। সেই ফাঁকের মধ্যে একজন এসে দাঁড়ায় রোগা, কোরা কাপড়ের পাঞ্জাবি, বাড়িতে জলকাঁচা ধুতি, বগলে ছাতা, চুল আঁচড়ানো নেই, মুখে বসন্তের দাগ, গলায় কষ্ঠির মালা, লোকটি তার জন্যে নির্ধারিত জায়গায় এসে চোখ বন্ধ ও ঘাড় কাত করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে, ঠোঁটে হাসির একটা ভাবও আসে। কাত ঘাড়টাই একটু নাড়িয়ে চোখ বুজেই লোকটি বলে, কথাটা হচ্ছে–আমাদের বক্তব্য এই যে মাল থানার ক্রান্তি অঞ্চলে বিভিন্ন কুখ্যাত জোতদার, যথা এই গয়ানাথ বর্মন

খবরদার রাধাবল্লভ, গয়ানাথ আবার মাটির দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে ওঠে, মোক জোতদার কহিবার চাও, কহ, কিন্তুক মোক কুখ্যাত কহিবা না।

রাধাবল্লভ চোখ না-খুলে তার দিকে ঘাড়টা শুধু ঘুরিয়ে আর-একটু হাসি দিয়ে বলে, কী কহিব না? তারপর পাশাপাশি লোকদের দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে জিজ্ঞাসার ভঙ্গিতে তার হাসিতে কোঁচকানো মুখে বোজা চোখের ভুরু নাচায়।

হ্যাঁ বলুন, সুহাস বলে, চলুন না ওখানে গিয়ে একে-একে শোনা যাবে। এভাবে শুধু শুনে গেলে কোনোলাভ ত নেই, দাগ নম্বর ধরে-ধরে কাজ শুরু করা যাক, আপনাদের বক্তব্য বলবেন, সুহাস এবার বাইরে যাওয়ার জন্য হটতে শুরু করে। ভিড়টাও তার সঙ্গে-সঙ্গে চলতে থাকে। পেছন থেকে রাধাবল্লভের গলা শোনা যায়, আমাদিগের তাহাতে আপত্তি নাই। কিন্তু এই সমস্ত কুখ্যাত জোতদার যথা গয়ানাথ বর্মন, নগেন মজুমদার, তারানাথ বসু ও নাউছার আলি ইহাদের কথা অনুযায়ী যদি সেটেলমেন্ট হয়, তবে আমরা আমাদের জমি মাপিতে দিব না।

এতজন লোক তাড়াতাড়ি হাঁটতে পারছিল না। রাধাবল্লভ প্রায় সুহাসের ঘাড়ের পেছন থেকে বলে যাচ্ছে। সে যে কথাটা শুরু করেছিল, সেটা শেষ করে থেমে যায়।

সগায় কুখ্যাত আর এক রাধাবল্লভ সাহা সাচা-স্যার, এই ডাকাতিয়া মানষিটার কাথা না-শুনিবেন। গয়ানাথ বলে।

সুহাস একটু সন্দিগ্ধ হয়। আসলে কি এদের জবরদখল জমি, তাই মাপতে দিতে চায় না বলে একটা ওজর দিয়ে রাখছে? কিন্তু কথাটা তুলতে চায় না বলেই কিছু জিজ্ঞাসা করল না। এবার অবশ্য সরকার জোর দং, অনুমতি দং, বর্গা দং সবই রেকর্ড করাচ্ছে। শুধু খাশজমির জোর দং রেকর্ড না করার অর্ডার দিয়েছে। সুহাসের ধারণা, এ-অর্ডারও বদলাবে। প্রাইভেট ল্যান্ডের জোরদখল যদি রেকর্ড হয়, খাশ ল্যান্ডে কেন হবে না। তাই সে ঠিক করেছে শাদা কাগজে খাশজমির জবরদখলদারদের লিস্ট রাখবে।

সুহাসকে ঘিরে চলা ভিড়টার ভেতর থেকে কমরেড, কমরেড শব্দটা দু-একবার শোনা যায়। কিন্তু সুহাস বুঝতে পারে না, কে কাকে বলছে। রাধাবল্লভ কোনো পাটির লোক নিশ্চয়ই। কিন্তু কোন্। এক হতে পারে কংগ্রেস-আই। আর এক হতে পারে কমিনিস্টরা কেউ। সরকারি পার্টি ছাড়া এত জোর পাবে কোত্থেকে যে বলবে–সেটলমেন্টের শেকল ফেলে দেবে? কিন্তু কমরেড বললে ত আর কংগ্রেস-আই হবে না, যদি অবশ্য রাধাবল্লভকেই ডেকে থাকে। তাহলে কি এখানে অনেক পার্টি আছে? নাকি কংগ্রেস-আই আজকাল কমরেড বলাও ধরেছে?

এই সমস্ত দলটার পথ আটকে, সুহাসের একেবারে সামনে এসে দাঁড়ায় লোকটি–পায়ের নখ থেকে মাথার চুল পর্যন্ত ভেজা, সারা গায়ে জল, পরনের কানিটা ঊরুর সঙ্গে লেপটে গেছে। লোকটা একটা ভেজা শালগাছের মত দাঁড়িয়ে থাকে–বানের জল নেমে যাওয়ার পর ডাঙা জমির একটা বিচ্ছিন্ন শালগাছের মত এই ভিড়ের সামনে দাঁড়িয়ে থাকে। তার পাশ কাটিয়ে ভিড়টাকে এগতে হয়।

.

০২৯.

 জনসমাবেশ

আদিবাসী-উপজাতি ভিড়টাকে নিয়ে সার্ভে পার্টি যখন বন থেকে বেরিয়ে আসে তখন এখানে, সার্ভে টেবিল আর গয়ানাথের চেয়ার যেখানে পাতা, একটা বেশ সাজানো-গোছানো জনসমাবেশই হয়ে আছে। সমাবেশটা লম্বালম্বিই ছড়িয়েছে। এই জায়গাটা ডাঙার ওপরে, পুবে ঢাল বেয়ে নিচু জমি, একটু দূর থেকেই কাদায় ভরা। এখান থেকে ডাঙাটা বনের পাশ দিয়ে বেঁকে-বেঁকেই সোজা উত্তর-পুবে গেছে। দেখলে মনে হয় এটা যেন ফরেস্টেরই বর্ডার, যেন এই হাত দশ-পনের জমি ছাড় দিয়ে ফরেস্ট ডিপার্টমেন্ট ফরেস্ট বানিয়েছে।

এই রাস্তার মত জমিটার ওপর মোটা মুথাঘাস অসমভাবে বেড়ে উঠেছে। ফলে কোথাও ঘাসের আস্তরণ খুব পাতলা, তলার মাটিই প্রায় বেরিয়ে পড়েছে। আর কোথাও আস্তরণ এত মোটা, যে বসলে ঘাসে লেগে থাকা জলে পেছনের কাপড় চুপসে যায়। এই রাস্তার মত ডাঙার ওপরটা পরিষ্কার, যেন যত্ন করে নিয়মিত পরিষ্কার রাখা হয়। দু-পাশে–ডাইনের নিচু জমিটাতে বা বায়ের ছোট নালীর ওপারে বনের গাছগাছড়ার মধ্যে লম্বা ঘাসের জঙ্গল ঘন ও বড় হয়ে উঠেছে। এ-সব ঘাসবনে বাঘ থাকে। ঝোঁপঝাড়-জঙ্গলও দুপাশে মাটি কামড়ে, গাছ কামড়ে ছড়িয়েছে, বেড়েছে। অথচ রাস্তাটার ওপর কোনো ঝোঁপঝাড় বা ঘাসবন নেই। হাতির পাল এখান দিয়ে জল খেতে আসে। ফরেস্টের নানা জায়গা। থেকে সল্ট লিক এসে এই রাস্তায় মিশেছে। এখন বর্ষাকাল। ফরেস্টের ভেতরেই জল পাওয়া যায়। কিন্তু হাতির পাল অভ্যাসে কখনো কখনো আসা যাওয়া করে। আর সেই আসা যাওয়ায় এই রাস্তার মত ডাঙা পরিষ্কার হয়, হাতির পাল লম্বা নালীঘাস খেয়ে আর ঝোঁপঝাড় মাড়িয়ে সাফসুরত করে দিয়েছে। কিন্তু হাতির শুড়ের নাগালের বাইরে একদিকে ফরেস্টের আর-একদিকে নিচু জমির ঢালে সেই লম্বা নালীঘাস বেড়ে উঠেছে। হাতির পাল ঐটুকু নালী পেরতেও পারে না, আবার ঢাল বেয়ে নীচে নামতেও পারে না।

এখন এই হাতি-লাইন জুড়ে সেই মানুষজন লম্বা হয়ে ছড়িয়েছে। একটু দূরে আপলাদের ভেতর দিয়ে যে রাস্তা ওদলাবাড়ি গিয়ে ন্যাশন্যাল হাইওয়ের সঙ্গে মিশেছে সেই পাকা রাস্তার ওপরই একটা জিপগাড়ি দাঁড়িয়ে–আনন্দপুর চা বাগানের। আর ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের অ্যামবাসাডার আর-একটু এগিয়ে। দুই গাড়ির বাবুরা ও সাহেবরা কেউ গাড়ির ভেতরে বসে; কেউ গাড়িতে হেলান দিয়ে, কেউবা গাড়ির ওপর পা তুলে দিয়ে বাইরে, দাঁড়িয়ে। দুই গাড়ির মাঝখানের জায়গাটাতে ঢালের ওপর পা ছড়িয়ে ড্রাইভাররা ও একজন গার্ড গল্প করছে। গার্ডের পিঠে বন্দুক ঝোলানো। দুটো গাড়ির দাঁড়াবার জায়গা থেকে ফরেস্টের দিকে একটা এরকমই পরিষ্কার সল্ট লিক ভেতরে ঢুকে গেছে–সেই ফাঁকাটাতে দুটো-একটা ভাঙা গাছ ছাড়া গাছগাছড়া নেই, সামান্য একটু ঝোঁপঝাড় কোথাও-কোথাও। অনেক দূর পর্যন্ত এই এত ঘন সবুজ শূন্যতা দেখতে কেমন লাগে। ঠিক সল্ট লিকটার মুখে একদল মদেশিয়া বসে, গোল হয়ে। তাদের কারো পরনে গামছার মত রঙিন কাপড়ের ফালি, কারো পরনে হাফপ্যান্ট। কারো উদোম গা, কারো স্যান্ডো গেঞ্জি–ধবধবে, দু-একজনের গোলগলা নাইলনের। অনেকের হাতে ছোটখাট লাঠি।দু-জনের কাঁধে ছোট কুড়ল ঝোলানোকুড়লটাই আংটার মত ঘাড়ে লাগানো।

এই মদেশিয়ার দল আসল ভিড়টা থেকে একটু দূরেই আছে–সামনে যেখানে ম্যাপ-চেয়ার-টেবিল, সেখান থেকে। তারপর খানিকটা ঝোঁপ পেরিয়েই সেই জায়গাটি যেখান দিয়ে সার্ভে পার্টি ঢুকেছিল। এই এত মানুষের পায়ের চাপে জলেভেজা ঘাসগুলোর ওপরও যেন পায়ে চলা পথ তৈরি হয়ে গেছে। নেপালিদের একটা দল গলিটার পাশেই দাঁড়িয়েছিল, এখন সেখান থেকে সরে উল্টোদিকে এল। সকালে শুরুতে লোক ছিল না। তখন যেন, চায়ের দোকানটা বেশ দূরেই ছিল। কিন্তু এখন চায়ের দোকানটার সামনে-পাশে দুদিকেই মানুষজন। জ্যোৎস্নাবাবুও ঠিক এর পাশেই তার সেরেস্তা খুলে বসেছেন। ফলে সবচেয়ে বেশি ভিড় এই জায়গাতেই। চওড়া জায়গাটার ঠিক মাঝখানে চরের কৃষকদের একটা বিরাট দল বসে আছে। চা খাচ্ছে, বিস্কুট খাচ্ছে। দেখে মনে হয় তারা যেন এখানে সারাদিন থাকতেই এসেছে।

.

০৩০.

কৃষক সমিতির ‘প্রোগ্রাম’

দলবল নিয়ে রাধাবল্লভ এসে এই ভিড়ের মধ্যে দাঁড়ায়।

তার বা বগলে ছাতা, ডান হাতটা মাথার ওপরে কনুইয়ে ভাজ ফেলে, ডান হাতের আঙুলগুলো ঘাড়ের কাছে, চোখদুটো প্রায় সব সময়ই বোজা, বোধহয় কোনো অসুখ আছে, চোখের কোণে ময়লা জমে।

সকালে দলবল নিয়ে সার্ভের জায়গায় পৌঁছতে দেরি হয়ে যাওয়ায় রাধাবল্লভ যেন ঠিক ভূমিকা পাচ্ছে না। এমনকি জুতমতো একটা দাঁড়ানোর জায়গাও পাচ্ছে না। ঠিক ছিল, সকালবেলা এখানে ঝাণ্ডা গেড়ে, ভোটর দিন বুথ অফিসের মত একটা অফিসই খোলা হবে, চাটাই-মাদুর পেতে। অন্তত একজন উকিল বা মোক্তারবাবু যাতে অবশ্যই আসেন, কাল কোট আর শাদা প্যান্ট পরে, সেই ব্যবস্থা করতে শহরের পার্টি অফিসে দুদিন আগে তোক গিয়েছিল। শহর থেকে বলেও ছিল, নিশ্চয়ই পাঠাবে। সকালে এখানে একটা ঝাণ্ডাটাণ্ডা নিয়ে অফিস করে বসলে, তাতে উকিল বা মোক্তার একজন থাকলে, লোকজন বুঝত তাদের জোরও আছে, আইনও আছে।

ঠিক ছিল, সার্ভে শুরু হওয়ার আগেই শ্লোগানটোগান দিয়ে রাধাবল্লভ একটা বক্তৃতা করবে। বক্তৃতায় এখানকার কুখ্যাত জোতদারদের নাম বলবে ও অফিসারদের সাবধান করে দেবে যে এদের সঙ্গে যেন কোনো আপস করা না হয়। তা হলে কৃষক সমিত এই জরিপের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ আন্দোলনে নামতে বাধ্য হবে। অর্থাৎ এই সেটেলমেন্টকে কৃষকদের ও আধিয়ারদের পক্ষে প্রথম থেকেই নিয়ে আসতে হবে। আরো সব বক্তৃতায় সারা দিন ধরে এখানকার চা বাগানের জোতদারি, ফরেস্টের জোতদারি, খাশজমির দখলদারি নিয়ে সব বলবে–কিন্তু ধীরে-ধীরে। প্রথমে শুধু সাবধান করে দেবে, তারপর আবার শ্লোগান হবে। হৃষীকেশ বলেছিল, শুধু শ্লোগান কেউ শোনে না, গানও হওয়া চাই। তা করো, তুমি গান বাঁধো আর গাও, ভালই ত, অফিসার বুঝিবে আমরা গানও জানি।

কিন্তু তাদের পৌঁছতে-পৌঁছতে অনেক দেরি হয়ে গেল। ভগতের এঁড়ে বাছুরটা কাল রাত্তিতে ফেরে নি–সন্ধ্যায় আনতে গেলে দড়ি ছিঁড়ে পালিয়েছে। সেটাকে খুঁজে বের না করে আর সার্ভের এখানে আসে কী করে। গরু অবশ্য পাওয়া গেল পাশের বাড়িরই একজনের গোয়ালে। ভগতের বাছুর চিনে সে রাত্রিতে রাস্তা থেকে বেঁধে এনে রেখেছে। কিন্তু দেরি যখন হয়েইছে তখন জলপাইগুড়ির প্রথম বাসটাতে, উকিল-মোক্তার যেই শহর থেকে আসুক, তাকে নিয়েই ক্যাম্পে যাওয়া ভাল। সেবাসে কেউই এল না। হৃষীকেশ ঠাট্টা করে বলল, ভগতের কোটটা মুই পড়ি যাছ, উকিলের নাথান লাগিবে। ভগতের একটা কাল, কোট আছে–সারাটা শীতকাল নেংটির ওপর সেই কোটটা পরে থাকে।

ওরা দলবল নিয়ে যখন ক্যাম্পে পৌঁছেছে তখন ক্যাম্প পার্টি বনের ভেতর সেঁধিয়ে গেছে। ওদের ঝাণ্ডা গাড়াও হল না, বক্তৃতাও হল না, শ্লোগানও হল না, গানও হল না। গয়ানাথ যখন বাঘারুকে। ডাকতে এল তখন যেন ওরা এতক্ষণের অপেক্ষার পর হাতে শিকার, পেলবনের মধ্যে গয়ানাথের সঙ্গে অফিসার একা-একা কী করে। ওরাও সকলের সঙ্গে বনের মধ্যে ঢুকল। তারপর ওখানেই রাধাবল্লভ বক্তৃতাটা শুরু করেছিল, প্রোগ্রামের বক্তৃতা অংশটা অন্তত হোক, কিন্তু তখন সবাই বেরচ্ছে। বক্তৃতাটা শেষ হল না। বন থেকে বেরনোর মুখটিতে আবার সেই বক্তৃতাই শুরু করেছিল একটু। কিন্তু তাদের পাশ কাটিয়ে আর-সবাই যে-যার মত বন থেকে বেরিয়ে যায়। তখনো বক্তৃতাটি শেষ হল না। এখন দলবল নিয়ে রাধাবল্লভ এই আসল জায়গাটিতে ঢুকল। ওপরে নীচে তাকিয়ে সে পুরো জায়গাটি, সেই তিস্তাপাড় থেকেঐ ওদলাবাড়ি রোড পর্যন্ত, একবার দেখে–ঐ সীমায় মোটরগাড়ি, জিপগাড়ি, আর, এই সীমায় সার্ভের টেবিলচেয়ার।

চায়ের দোকানের সামনে এসে ওদের দলটা দাঁড়ায়। একে চায়ের দোকানের ভিড় উপচে পড়েছে। তার ওপর চরের লোকজন এসেও ওর সামনেই বসেছে। তদুপরি জ্যোৎস্নাবাবু–আমিন। ফলে ওরা আর এগতেই পারে না প্রায়। রাধাবল্লভ চায়ের দোকানের দিকে পেছন ফিরে জমির ঢাল দিয়ে সোজা পুরে তাকিয়ে থাকে। তার বগলের ছাতাটা নামায় না। ডান হাত দিয়ে একবার চোখ মোছে। বুদ্ধিমান এদিক-ওদিক ঘুরে রাধাবল্লভের পেছনে এসে বলে–কমরেড় লেকচার এইখানেই দাও, এত লোক, ঠিক শুনিবার পাবে, চাও খাছে, কায়ও নড়িবে না, শুনিবার হবে। বলে বুদ্ধিমান আবার হে হে করে হেসে হাততালি দেয়, যেন এই এতগুলি লোককে সেই বুদ্ধি করে এখানে নিয়ে এসে আটকে রেখেছে, এখন কমরেড বক্তৃতা শুরু করলেই হয়। বুদ্ধিমানের ডাকে রাধাবল্লভ ফেরে না। রাবণ এক গ্লাশ চা এনে রাধাবল্লভকে ধরিয়ে দেয়। রাধাবল্লভ সন হাতে চাটা নিয়ে চুমুক দেয়। তারপর বগল থেকে ছাতা না-সরিয়েই বা হাতটা দিয়ে পকেট ঝাঁকিয়ে দেখে পয়সা আছে কি না, একটা পান খেলে হয়। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে আলবিশ ভগত আর হৃষীকেশ চা খাচ্ছে। হৃষীকেশ ত কোথাও চুপ করে থাকতে পারে না ওখানেই চেঁচামেচি শুরু করেছে।

চা খাওয়া শেষ হলে আলবিশ এসে রাধাবল্লভের কাছে দাঁড়ায়। আলবিশ ভগত পুরোহিত। তাই মাছমাংস খায় না, চুলগুলো কানের দুপাশ দিয়ে কাঁধের ওপর থোকায়-থোকায় পড়েছে। কপালটা বড়। চুলে নিয়মিত তেল ও চিরুনি দেয়। দাড়ি বোধহয় রাখার চেষ্টা করে। কিন্তু কম থাকায় দেখার মত হয়ে ওঠে না। জুলপির কাছ দিয়ে খানিকটা নেমে এসেছে আর গোফটা ঠোঁটের ওপর ছেড়-ঘেঁড়া হয়ে ঝুলে আছে। আলবিশের চোখদুটো আর সামনের দাঁতগুলো বড় বড়। সে যখন কথা বলে তখন তার ঘাড়টা সামনে দোলায় আর দাঁতগুলো বের করে চোখটা নাচায়। হে কমরেড, তা এইখানে একখান লেকচার ঝাড়খে চলো, আলবিশ আবার ঘাড় দুলিয়ে হাসে, লেকচার ঝাড়খে, ঘরকে চলো।

আলবিশের দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে রাধাবল্লভ বলে, তোমার এখন ঐ এক কথা। ঘর চললে এখন কী হবে। এমনিই ত আমরা দেরি করি ফেলিলাম। এখনো ত আমাদের বক্তব্য বলাই হল না।

তব বোল কোরো কেনে, বক্তব্য বোল্ কোরো, বলে ভগত একটু সরে যায়। ইতিমধ্যে বুদ্ধিমান ও হৃষীকেশ আসে। বুদ্ধিমান বলে, কমরেড, এইখানে মিটিংখান শুরু করি দাও। হৃষীকেশ কোনো কথাই গোপনে বলে না, চিৎকার করে চার পাশে তাকিয়ে, এক হাতের তালুর ওপরে আর-এক হাতের মুঠোতে ঘুসি মেরে বলে, কমরেড, মিটিংখান শুরু করি দাও।

হৃষীকেশের চেহারা শৌখিন। তার পরনে শার্ট, আর নাইলনের প্যান্ট। পায়ে স্যান্ডেল–চামড়ার। বাগানের এক বাবুর কাছ থেকে সেলাইমেশিন জোগাড় করে লাটাগুড়ি হাটে হৃষীকেশ একটা দর্জির দোকান দিয়েছে। সেটাই তার প্রধান পেশা, এখন। ব্যাঙ্কের লোন পেলে একটা মেশিন কিনবে আর শিলিগুড়ি থেকে কারিগর আনবে। বছর বিশপঁচিশ আগে লাটাগুড়িতে খাশজমির দখলে হৃষীকেশের বাবা ছিল। হৃষীকেশের বাবা মারা গেছে অনেকদিন, সে-জমি অবশ্য দখলে আছে হৃষীকেশ ও তার দাদার মধ্যে দুই ভাগে। হৃষীকেশের ভাগে এখন আধি। সে চাষ করে না বটে কিন্তু তাই বলে কৃষক সমিতি ত আর ছাড়ে নি। কমরেডের সঙ্গে সার্ভে ক্যাম্পে এসেছে-কৃষক সমিতির দাবিদাওয়া নিয়ে। একটা গানও তৈরি ছিল-শখের নাটক আর গানে হৃষীকেশের দারুণ নেশা। কিন্তু আজ আর গানটা গাওয়ার কোনো সুযোগ পাবে মনে হয় না। হৃষীকেশ রাধাবল্লভকে বলে, ঐখানে যেটুকু বলা হইছে–তার পর থিকা বলেন।

রাধাবল্লভ জিজ্ঞাসা করল, বলব?

বুদ্ধিমান বলে, বলেন, বলেন, তাড়াতাড়ি বলেন। সগায় বসিসি চা খাছে, এখন বসিসি শুনিবে। বলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *