১.২ হাটের সামাজিকতা

০১১.

হাটের সামাজিকতা

সদর রাস্তার দু পাশের দোকানে হ্যাজাক বাতি, ডান হাতিতে একটু দূরে একটা ইন্টার-প্রভিন্সিয়াল ট্রাক দাঁড়ানো। বয়ে চায়ের দোকানগুলিতে লোকজনের ঠাসা ভিড়। ডাইনে-বায়ে তাকিয়ে সুহাস যেন হাটের ম্যাপটা আর-একবার ছকে নেয়।

সুহাস মিষ্টি ও চায়ের দোকানগুলোর দিকে যায়।

 বাইরের বেঞ্চিগুলোতেই বসার ইচ্ছে ছিল সুহাসের। কিন্তু সেখানে এখন গাদাগাদি ভিড়। খবরের কাগজের টুকরোর ওপর জিলিপি আর নিমকি। বেশির ভাগই চা বাগানের মজুর-মজুরনি। এদিককার ভাষায় মদেশিয়া। অনেকে, নিজেও খাচ্ছে, কোলের বাচ্চাটিকেও খাওয়াচ্ছে-ভেঙে-ভেঙে।

সুহাসকে ভেতরে গিয়েই বসতে হয়। আর, ভেতরেই যখন বসেছে তখন একেবারে শেষে গিয়ে বসাই ভাল। মাইকাটপ হাইবেঞ্চ। সামনে বেঞ্চিও আছে, কোথাও-কোথাও ভাজ করা চেয়ারও। সুহাস একটা ভাজ করা চেয়ারে আলগা হয়ে বসে। তার সামনের, পাশের সব টেবিলেই লোক। সুহাসের শুধু এক কাপ চা-ই খাওয়ার ইচ্ছে। অথচ বুঝতেই পারে চা-টা যথেষ্ট অখাদ্য হবে। কিন্তু এতটা ভেতরে বসে শুধু চা খাওয়া ঠিক কিনা বুঝতে পারে না। ছেলেটি এলে বলে, এক কাপ চা-ই দিন, পরে কিছু নিলে বলব।

কিন্তু ছেলেটি প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ফিরে আসে একটা চায়ের ডিশে গাদাগাদি মিষ্টি নিয়ে। সুহাস বুঝতেই পারত না মিষ্টিটা তারই জন্যে, যদি-না তার একেবারে মুখের সামনে এনে এই ছেলেটি দাঁড়িয়ে থাকত। আর সুহাস কিছু বলতে পারার আগেই ধুতি-গেঞ্জিপরা লোকটি সামনে এসে দাঁড়ায়। সুহাস বুঝে ফেলে, দোকানের মালিক। এতক্ষণ রসে থাকার জন্য ধুতির গিট তলপেটের অনেক নীচে নেমে গেছে, গেঞ্জিটা পেটের ওপর দিয়ে অতটা ঢাকতে পারছে না। খুব ফাইন ধুতি আর ফাইন গেঞ্জির মাঝখানে রোমশ একটা মোটা লাইন।

ছেলেটির হাত থেকে ডিশটা নিয়ে বলে, জল নিয়ে আয়, তারপর দু হাতে সুহাসের সামনে ধরে বলে, স্যার, নিন স্যার, আমার দোকানের মিষ্টি স্যার কলকাতায় যায়, চাবাগানের সাহেবরা বাগডোগরায় প্লেন ধরতে যাওয়ার সময় এখান থেকে মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে যান স্যার। বিকানীর সুইটস স্যার।

সুহাস তখন পারলে উঠে পালায়। কিন্তু লোকটার কথাতে, তার দোকানের আর মিষ্টির তারিফে, সে একটু স্বস্তি পায়–অন্তত এইটুকু বাচোয়া। কিন্তু তার সামনে লোকটি দুই হাতে এইটুকু ডিশে এমন পাজা করা মিষ্টি ধরে আছে–দেখলেই গা গুলিয়ে ওঠে। সে তাড়াতাড়ি এপাশে-ওপাশে তাকায়। বুঝতে পারে, সামনের বেঞ্চিতে যারা খাচ্ছে তারা ব্যাপারটা দেখছে। কিন্তু দোকান-ভর্তি মদেশিয়া আর রাজবংশী মজুর কৃষকরা এদিকে তাকাচ্ছেও না।

সুহাস তাড়াতাড়ি ব্যাপারটা চুকিয়ে দিতে চেয়ে বলল, আমি মিষ্টি খেতে পারি না। আপনি নিজে এনেছেন। একটা মিষ্টি দিন।

আচ্ছা স্যার, আমি জিদ করব না। কিন্তু আপনাকে টেস্ট ত করতেই হবে। রোজ একটা করে টেস্ট করলেই আমার সব মিষ্টি টেস্ট করা হয়ে যাবে। এই ডিশ লাও, লোকটির গলা খাদে আর চড়ায় খেলে গেল।

ডিশ মানেই অন্তত গোটা দুয়েক। সুহাস তাড়াতাড়ি হাত পেতে লোকটিকে বিপন্ন করে–হাতে দিন, একটা।

এ স্যার কি হয়, আপনাকে হাতে দিব?

 আমার ত হাতে খেতেই ভাল লাগবে–সুহাস মনে-মনে চটে। হঠাৎ মনে হয় দোকান ছেড়ে বেরিয়ে যায়।

বোধহয় তার মুখ দেখে দোকানদার কিছু আঁচ করে। সে সবচেয়ে তলা থেকে লম্বা, গোল সাইজের সবচেয়ে বড় মিষ্টিটা বের করে। সুহাস বলে, এইটি দিন, ওপরের সন্দেশটি দেখায়।

এ কী স্যার, এটুকু কী হবে স্যার, এ ত গালে দিতেই গলে যাবে।

 ঠিক আছে, ঐটিই দিন।

ইতিমধ্যে বাচ্চা ছেলেটি ডিশ নিয়ে এসে বেঞ্চির ওপর রাখে। তাতে সন্দেশটি তুলে দিয়ে আর-একটি মিষ্টিতে চামচ লাগাতেই সুহাস ডিশটি সরিয়ে নিয়ে বলে, উ–।

দোকানদার হে হে করে হেসে উঠল, স্যার, চা পাঠিয়ে দিচ্ছি, বলে চলে যায়।

সামনের বেঞ্চিতে যারা বসে খাচ্ছিল তাদের ভেতর একজন উঠে সুহাসকে নমস্কার করে বেরিয়ে যায়। সুহাস প্রতিনমস্কারের সময় পায় না। আর, তারপরই হাট কমিটির সেই বয়স্ক ভদ্রলোক এসে তার সামনের বেঞ্চিটাতে বসেন, হাটটা দেখলেন?

এখন ত সন্ধ্যা। বোধ হয় বিকেলে জমে বেশি।

 না, সে ত এখনো জমাই আছে। এ ত ডুয়ার্সের প্রায় ধরেন কেন বড় হাট। ধূপগুড়ির হাটঠে অনেক ঘট! ধূপগুড়ির হাট ত পাইকারি হাট।

সুহাসের মনে পড়ে যায়, সে জিজ্ঞাসা করে, আচ্ছা, এখানে কি শুকনো লঙ্কা তৈরি হয় নাকি? হাটে শুকনো লঙ্কার পাহাড় দেখলাম।

ছেলেটি এসে চা-টা রাখে।

না, না, এখানে শুকনা লঙ্কা হয় কোটে? এইঠে ত শুকনা লঙ্কা না হয়। ধরেন, এই ক্রান্তির হাটতও বছর খানিক আগতও শুকনা লঙ্কা না আছিল। তখন নারায়ণপ্রসাদের গোডাউন ছিল শিলিগুড়ি।

নারায়ণপ্রসাদ কে?

এই ধরেন কেনে এই তামান এলাকার, আসামের, শুকনা লঙ্কার ডিলার। উমরার শুকনা লঙ্কার মালগাড়ি ত এখন মাল স্টেশনে আসে।

ত সে এখানে কী করে?

নারায়ণপ্রসাদ বছর তিন আগে এইখানে একখান চাবাগান কিনি নিসে। ত বাগান মাস ছয় পর হয়্যা গেইল বন্ধ। নারায়ণপ্রসাদ ওর এই বাগানের গোডাউনটাক বানাইল শুকনা লঙ্কার গোডাউন। ব্যস, সেই থাকি আসাম আর তামান-তামান জায়গায় সব পাইকারি বেচাকেনা হবার ধরিছে এই ক্রান্তি হাটত। স্যালায় ত ক্রান্তি হাটার এ্যানং নামডাক।

আর সেই চা বাগান?

সে ত বছর খানেক আগে খুলি গেইছে। ত ফ্যাকটরি ত আর চলে না। গ্রিনটি বেচা হয়া যায়। গোডাউনটা শুকনা লঙ্কারই আছে।

সুহাসের চা খাওয়া হয়ে গিয়েছিল। সে বলল, আর আলু?

সে ত এই বছরই একখান ঠাণ্ডা ঘর চালু হবা ধরিছে ওদলাবাড়িত।

ওদলাবাড়িতে ত এখানে কী?

 সে ত ঠিক বলিবার পারিম না। এইঠেও বুঝি একটা গুদাম থাকিবার পারে।

সুহাস আগেই উঠে দাঁড়িয়েছিল। এখন আস্তে-আস্তে বেরতে শুরু করল। তখন ভদ্রলোক পেছন-পেছন এসে বললেন, আমাদের কথাটা একটু বিবেচনা করি দেখিবেন। এর মধ্যে ত কুনো দোষ নাই। আমাদের বাড়িঘরেরও ত সাগাইকুটুম আছে।

ভদ্রলোকের কণ্ঠস্বরে এমন কিছু আন্তরিকতা ছিল যার জন্যে সুহাসকে একটু ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতে হয়। কিন্তু দোকানের মাঝখানটাতে বড় ভিড়। এদিকের বেঞ্চের একটা বড় দল খাওয়ার পর উঠে পয়সা দিতে যাচ্ছিল–প্রায় লাইন দিয়ে। বোঝাই যাচ্ছিল দলটা আসলে একটাই-ওদিক দিয়ে বেরিয়ে যাবে। ফলে সুহাসকে তাড়াতাড়ি দোকান থেকে বেরিয়ে দোকানের সামনে দাঁড়াতে হয়।

ভদ্রলোকও পিছু-পিছু এসে পঁড়ান। সুহাস তখন তাকে বলতে পারে, আপনারা এরকম করে বললে আমারই লজ্জা হয়। হবে-খন, আমরা ত এখন থাকবই।

ভদ্রলোক দুই হাত সামনে নিয়ে বিনীত ভঙ্গিতে মাথা হেলান।

প্রিয়নাথ একটু দূরে দাঁড়িয়ে ছিল। যখন সুহাসের সঙ্গে আরো দু-চারজন কথা বলছে তখন প্রিয়নাথ এগিয়ে এসে এদের পেছন থেকে বলে, স্যার, আমি ক্যাম্পে এগুলো রেখে আসি?

সকলেই ঘাড় ঘুরিয়ে প্রিয়নাথকে একবার দেখে নেয়। আর তাদের দেখার সুবিধে করে দেয়ার জন্যেই যেন প্রিয়নাথ তার মুখটা আলোতে মেলে রাখে। এরপর ত তার সঙ্গেই সবাইকে কথা বলতে হবে।

আপনি যান, আমি যাচ্ছি সুহাস প্রিয়নাথকে বলল। তারপর হঠাৎ ভিড়টা সরে গেল। সুহাস ভেবেছে সে এখন চলে যেতে পারে। কিন্তু ফাঁক দিয়ে বেরবার জন্যে পা ফেলতেই খুব ছোটখাট একটা লোক সামনে এসে নমস্কার করে দাঁড়াল, খুবই মৃদু গলায় বলল, আমার নাম নাউছার আলম।

অ্যাঁ! বলে হকচকিয়ে সুহাস প্রতিনমস্কার করতে ভুলে গেল। নাউছার আলম–এই নামটা ত প্রায় গেজেটিয়ারে উঠে গেছে। সরকার বেশির ভাগ কেসেই হেরেছে সুপ্রিমকোর্ট পর্যন্ত। বাকি জমিতে ইনজাংশন। নাউছার আলম–এই নাম শুনে যাকে ভেবেছিল ডাকাতের মত পরাক্রান্ত, সে কি না এরকম ছোটখাট ভদ্রলোক। কিন্তু ততক্ষণে অন্য সবার দিকেও ঘুরে-ঘুরে নমস্কার করে, খুব স্বাভাবিক ভাবেই আচ্ছা চলি বলে ভদ্রলোক ভিড় থেকে বাইরে চলে গেছেন।

.

০১২.

শেষহাটি থেকে হাট শেষ

একটা চরম বিন্দু আছে যখন কোনো কিছুই আর হাটের বাইরে নয়। তখন যে হাটের রাস্তায় আছে, হাটে। এসে পৌঁছয় নি-সে-ও হাটের ভেতরে ঢুকে যায় দূর থেকে। এই একটা সময়, যখন হাটটা যেন তার অব্যবহিত চারপাশের অনির্দিষ্ট সীমাটুকুও উপছে যায়। বেড়ে যাওয়ার ও জমে ওঠার সেই অস্পষ্টতায় হাটটা যেন আর হাটে ধরছে না। এই সময়ই নেমে আসে গোধূলি। মানুষের পায়ের ধুলোয় আবছায়া ঠেকে সব। কোথাও-কোথাও লম্বা কুপি জ্বলে উঠে দীর্ঘ-দীর্ঘতর ছায়ায় ছায়ায় হাটটার ভিড় যেন সহসা কয়েকগুণ বাড়িয়ে দেয়। আর এই অবস্থাটা কিছুক্ষণ চলতে-চলতেই দেখা যায় সীমান্ত থেকে সীমান্তের দিকে চলে যাওয়া মুখগুলো আর এদিকে ফেরানো নয়, মুখগুলো ঘুরে গেছে, আদিগন্ত পথে-মাঠে মানুষের সারির মুখ এখন কেন্দ্রের বিপরীতে, দিগন্তের দিকে হাট শেষ-ভাঙা ভাঙতে শুরু করে। কখন যেন হাটটা চরমে উঠে মিইয়ে গেল। মানুষজনের পায়ের দাগ বদলে গেল।

হাটে যাওয়ার পথে মানুষজন যত কথা বলে, যেন হাট থেকে ফেরার পথে তার চাইতে অনেক বেশি। নাকি, হাট থেকে ফেরা ত সব সময়ই অন্ধকারে, তখন ত আর মানুষজন পরস্পরকে দেখতে পায় না, তাই কথা বলে বলে আন্দাজ নেয়। কথা বলে বলে পথ বানায়। নাকি, হাট-ভাঙা মানে সমবেত ধ্বনির সেই কেন্দ্রটিই ভাঙা, তার টুকরোগুলো তখন চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ছে। রাত্ৰিময় ধ্বনিমগ্ন পথে-পথে গড়াতে-গড়াতে গুড়ো-গুড়ো হয়ে হাটটা শেষে ধুলোবালি ও আকাশে ছড়িয়ে-ছড়িয়ে যায়।

হাটের শুরুও শুরু হয় দূরের মানুষ নিয়ে। হাটের শেষও শুরু হয় দূরের মানুষ দিয়েই। যারা বাস ধরবে, তারা সবচেয়ে আগে হাট ছাড়ে। যাদের বাস হাট থেকেই ছাড়ে, তারা তারও পর। রিক্সা যাদের দাঁড়িয়ে থাকে, এর পরই তারা ওঠে। তাদের শেষে, সাইকেলের যাত্রীরা। এই পুরো সময় জুড়েই চলে পায়ের যাত্রীরা-যদিও তাদের সংখ্যা বাড়তে থাকে, ক্রমেই বাড়তে থাকে। আর দূর-দূর রাস্তার দূরত্ব থেকে মানুষের কণ্ঠস্বর সময়ের সঙ্গে সঙ্গে গুটিয়ে আসতে-আসতে শেষ পর্যন্ত হাটের আশেপাশের গগঞ্জের মধ্যে মিশে যায়। সবচেয়ে শেষে আসে, শেষে যায়।

মানুষজন যে-ভাবে হাটে আসে সেভাবেই ত ফেরে, জিনিশপত্রের বোঝা নিয়ে, পশুপাখি ঝুলিয়ে, বা টেনে। মাঝখানে হাটে হাত বদল হয়ে যায়। ধীরে-ধীরে সন্ধ্যার অন্ধকারে পশুপাখির চোখের সামনের অভ্যস্ত আলো বা অন্ধকার বদলে যায়। সব অনভ্যস্ততেই ত পশুপাখির ভয়। কিন্তু সেই নিরুপায় অন্ধকারে অভ্যাসের একমাত্র ধারাবাহিকতা থাকে মানুষের কণ্ঠস্বরে বা মানুষের স্পর্শে। হাটে আসা-যাওয়ার পথ এই পশুপাখির অনিশ্চয়তার ডাকাডাকিতে মুখর হয়ে যায়। বা পায়রা-হাঁস-মুরগির অনিশ্চিত নীরবতায়। হাম্বা ডাক শুনে কি বলা যায় কোন বাছুর বিক্রি না হয়ে অভ্যস্ত হাতের টানে ফিরে চলে, আর কোন বাছুরের দড়িতে নতুন হাতের নতুন টান?

সেই অশ্বারোহী ও তার ঘোড়া এখন শূন্য হাটে পাক খায়। ঘোড়াটার পেছনটা এখন ঝোড়ো বাতাসে দোল খাওয়া চালাঘরের মত, আরো ঘন-ঘন দোল খাচ্ছে। এর পরই যে-কোনে সময় সম্পূর্ণ ভেঙে পড়বে। ঘোড়র পেছনটাই শুধু দেখা যায়–তার দুটো পায়ের কেমন অনেকগুলো ভাজ বা পেছনের হাড় দুটো উঁচু। লেজটা দুই পায়ের মাঝখানে নেতিয়ে ঝুলে, মাছি তাড়াবার জন্যও আর উঠবে না, এমন। ঘোড়ার সামনেটা আর ঘোড়ার নয়। অশ্বারোহী দুই হাতে ঘোড়ার কাঁধের ওপর ভর দিয়ে মাথাটা ঝুলিয়ে বসে। সেই চাপে ঘোড়ার গলাটা লম্বা হয়ে ঝুলে গেছে। ক্রমেই গলাটা আরো লম্বা হয়ে যাচ্ছে। ঘোড়াটি গলা লম্বা করে ঝুলিয়ে দিয়েও ঘাসে মুখ দেয় না। তার পিঠের ওপর নিজেরই ঘাড়ের ভেতর মাথা গুঁজে দেয় অশ্বারোহী আর লম্বা করে দেয়া গলার তুলনায় ঘোড়াটার নড়বড়ে পেছনটাকে কেমন হালকা লাগে, যেন মাথাঘাড়সমেত ঘোড়াটা কোনো ফাঁদ গলায় নিয়েছে, আর এখন শুধু পেছনের অংশটুকুই তার নিজের।

সেই ঘোড়া আর তার আরোহী এখন এই শূন্য হাটের অলিতে-গলিতে ঘুরে বেড়ায়, যেন এখনো সেখানে হাট, যেন এখনো তাদের মানুষজন ঠেলে-ঠেলেই এগতে হচ্ছে। কিন্তু এখন আর অশ্বারোহী তার ভিক্ষার ঝুলি কাঠির ডগায় ঝুলিয়ে এগিয়ে দিচ্ছে না। এখন আর ঘোড়াটিকে পেছনে ধাক্কা খাওয়ায় চমকে উঠতে হয় না। আর অস্পষ্ট চাঁদনিতে সেই ঘোড়া আর অশ্বারোহী ঘুমুতে-ঘুমুতে প্রায় নির্জন হাটের অলিগলি দিয়ে পাক খেতে-খেতে যেন মাঠের পর মাঠ পেরিয়ে বস্তির দিকেই চলেছে। এতে পারে, এই অশ্বারোহী অন্ধ। হতে পারে, এই ঘোড়াটি অন্ধ। হতে পারে, এই ঘোড়া আর অশ্বারোহী দুজনই ঘুমিয়ে পড়েছে। কোনো এক সময় পথ পেয়ে যাবে–তারপর আকাশের পটভূমিতে, নদীর চর ও অরণ্যের দূরত্বকে এই ঘোড়া আর তার আরোহী আদিগন্ত প্রান্তরের আলে-আলে কমিয়ে আনবে। ভাদ্রের আকাশের ধূসরতায়, নীল আর প্রান্তরের সবুজে, অরণ্যের কৃষ্ণাভ হরিতে এই ঘোড়া ও তার আরোহী কখনো মিশে যাবে, কখনো ঘোড়াটির লম্বিত গলাটিই ঝুলে থাকবে, কখনো ঘাড়ের ভেতর গুঁজে যাওয়া মাথা নিয়ে আরোহীর ছায়াটুকু ভেসে থাকবে, কখনো ঘোড়ার পেছনটা একটা ভাঙা মেশিনের মত লাফাতে লাফাতে যাবে–যেন কেউ টেনে নিয়ে যাচ্ছে, কখনো নদীর দুই পাড়ে ছায়া–মাঝখানের জলটুকুতে ওদের ছায়া, কখনো জলহীন নদীখাতটুকু যেন ঘোড়ার চারটি পায়ের ভঙ্গুরতা থেকে উজিয়ে গেছে, কখনো নদীর বাঁধের ওপর ছায়ায়-আলোয়, নদীর ভিতর-চরে বালিয়াড়ি ভেঙে, বা অরণ্যের কোনো গাছতলায়। এখন মধ্যরাত্রিতে এই শূন্য হাটে বোঝা যায় না, এই ঘোড়া ও তার আরোহীর কোথাও একটা অবতরণ আছে।

বিকেল আর সন্ধ্যার সব দৃশ্য এখন রাত্তির গভীরতায় ছায়ামূর্তি হয়ে যাচ্ছে। যেন, নদী বা পাহাড়পর্বত বা বনজঙ্গলের মত এই হাটখোলাও একটা প্রাকৃতিক ব্যাপার। যতক্ষণ এই হাটখোলায় মানুষজন ছিল, আলো ছিল, চঞ্চল ছায়া ছিল, পশু ও মানুষের আহ্বান ছিল–ততক্ষণ তার বিস্তার ছিল না, যেন সমস্ত দৃশ্যটাই ছিল সংহত, একান্ত। এখন, মধ্যরাত্রিরও পরে, এই জনহীনতায়, এই নৈঃশব্দ্যে, এই হাটখোলার প্রান্তর যেন তার প্রাকৃতিক বিস্তারে ফিরে যাচ্ছে–ধীরে-ধীরে, প্রায় কোনো সজীব অস্তিত্বের অনিবার্যতায়। এখন, এই রাত্রি আর অন্ধকারের ভেতর থেকে সারাদিনের সেই ব্যস্ততাকেই কেমন অলীক ঠেকতে পারে।

কিন্তু হাটটা এখন সম্পূর্ণ জনশূন্যও নয়। অত পাহাড়-পাহাড় মাল সবই কি ফেরত গেছে। কিছু হয়ত আছে, কাল সকালে যাবে। সেই যে প্রায় শেষহীন মাটির হাঁড়ি। আর অন্ধকার থেকে গো-হাটার গরুর হাম্বা। সারা হাটে, সেই হাটের পেছনের আপাত গোপন হাটেও, এখানে-ওখানে ঝরে পড়ে আছে দু-একজন মাতোয়ালা মানুষ এখন অন্ধকারে তাদের গায়ের চামড়ার তামা বা কাল মিশে গেছে, নাকের মোঙ্গলীয় খর্বতা আর অস্ট্রিক শান হারিয়ে গেছে, তাদের কুঞ্চিত বা স্বল্প সরল চুলে ঢাকা মাথার খুলির আকার অন্ধকার থেকে আর আলাদা করা যায় না। আজ সারারাত তাদের ওপর শিশিরপাত ঘটবে অবিরত। ভেতরে-ভেতরে তপ্ত সেই শরীর শিশিরে-শিশিরে ঠাণ্ডা হবে। কাল সকালে, বা রাতেই কখনো, এই মানুষজন তাদের নেশামুক্ত পায়ে আবার ফিরে যাবে পাহাড়ে, নদীর চরে, বনের ভেতরে।

আর এখন এই পুরো প্রকৃতি ছায়াময়–যেমন হয়, যখন উঠে আসার আগে চাঁদ দিগন্তের নীচে, বা, চাঁদকে আড়াল দিতে-দিতে সহসা কোনো পাহাড় বা টিলা উঁচু হয়ে উঠতেই থাকে, বা, মাঝখানে মাইল-মাইল ফরেস্টের ওপারের অববাহিকায় চাঁদ।

.

০১৩.

সাহেবের আত্মবিলাপ

 সুহাস বলে ফেলেছিল, যা হক, ক্যাম্পেই রান্না করবে–সেই জন্যই ত শেষ পর্যন্ত জ্যোৎস্নাবাবু-বিনোদবাবুও সেটা মেনে নিলেন। এ যেন, মন্ত্রীদের মত দু-কোপ মাটি কেটে হাড়কালি মেহনতের মানুষজনকে অনুপ্রাণিত করার নামে অপমান। জ্যোৎস্নাবাবু ত তার স্টাফ নন। প্রাইভেট আমিন। বিনোদবাবুদের চেনা লোক। সঙ্গে থাকলে কাজ খুব তাড়াতাড়ি এগয়। পাটিরা ওঁকে দিয়ে কাগজপত্র তৈরি করে নেয়। কিন্তু কর্মচারীদের সামনে তাকে যে এরকম একটা উদাহরণ হয়ে উঠতে হল এতেই সুহাসের নিজের ওপর এত বিরক্তি। আর, ব্যাপারটা এত আলোচিত-প্রচারিত হওয়ায় যেন একটা নৈতিক কর্মসূচির, না কী যেন, অ্যান্টিকরাপসন ড্রাইভ-এর চেহারা নিল। যেন সুহাস কোন নৈতিকতা বা সংস্কারের প্রয়োজনে এমন একটা ব্যবস্থার কথা বলেছিল!

কিন্তু সুহাসের বিরক্তিটা বাড়ে এই কারণে যে বিকল্পটাও সে বুঝতে পারে না। সে কি এখন হাট কমিটির জোতদার আর চা বাগানের ম্যানেজারদের বাড়িতে বা বাংলোয় গেস্ট হয়ে, এখানকার জমিজমার বেআইনি দখল বা আইনি দখল বা জমির আইনসঙ্গত পরিমাণ এই সব নির্ণয় করবে? আবার, এখানেও সুহাস আর-এক প্যাঁচে পড়ে যায়–সে কি সেটলমেন্টের অফিসার হয়ে এসে এই এলাকায় ভূমি-বিপ্লব ঘটাচ্ছে না-কি? তার কাজ ত রেকর্ড করা। রেকর্ড করার সময় দু-এক জায়গায় হয়ত সত্যনির্ধারণে তার বুদ্ধি বা বিবেচনাশক্তি, বা তার চাইতেও বেশি, ইচ্ছাশক্তি দরকার হতে পারে। এবার আছে বর্গাদার রেকর্ডিং। কিন্তু কেউ রেকর্ড করাতে চাইলে সে রেকর্ড করবে। সুহাস খুব ভালই জানে জমিব ওপর আধিয়ারের দখলটা যেখানে নির্ভর করে জোতদারেরই ওপর–নিজের বা নিজের মতই আরো অনেকের দখলবোধের ওপর নয়–সেখানে বর্গাদার রেকর্ডিং করাতে জোতদারও আসে না, বর্গাদারও আসে না। অপারেশন বর্গা ত সরকারের একটা আইন-যা আরো নানা আইনের মত ফাঁকি দিতে হয়।

এত জেনেশুনেবুঝেও সুহাস এই মাল এলাকা নিয়ে এত ম্যাপট্যাপ দেখে, একে, সেনসাস রিপোর্ট-টিপোর্ট ঘেটে, এত-এত তৈরি হল কেন।

এই মধ্যরাত্রিতে সুহাসের নিজের কাছেই নিজের এই দ্বিচারণ যে ধরা পড়ে যায়, সে কারণেই সে বিরক্ত হয়ে ওঠে। তার কোনো ক্ষমতা নেই জেনেও, আর এই সব রেকর্ডিং করে কিছু সমাধান সম্ভব ..নয় জেনেও, সে ত নিজেকে তৈরি করেছে যদি কিছু করা যায় তার জন্যেই।

সুহাস কি তা হলে বেঁচে যেত যদি সে নিজের খাওয়ার ব্যবস্থা নিজে করে নিত আর অফিসের কর্মচারীরা চিরকাল যা হয়ে আসছে তেমন ব্যবস্থাই মেনে নিতেন? কিন্তু জোতদার বা চা বাগান ত আর বিনা স্বার্থে লোকগুলোকে খাওয়াত না। তা হলে ত এই কর্মচারীরাই তার হাত দিয়ে চাবাগান আর জোতদারের কাজগুলো করিয়ে নিত। সব কিছুতে, সরকারেসংগঠনে-আইনে ও তার ব্যক্তিগত ভূমিকাতে, যতই অবিশ্বাস করুক সুহাস-তার হাত দিয়ে জোতদার আর চা বাগান কলকে খাবে এটা সে মেনে নেয় কী করে?

কিন্তু তার সততাপনায় বাধ্য হয়ে এই কম মাইনের কর্মচারীরা তাদের ডেইলি অ্যালাউন্সের টাকা কটা বাঁচাতে পারবেন না; অথচ একসঙ্গে এতগুলো টাকা পাওয়া যাবে বলে হয়ত খরচ-খরচার একটা প্ল্যানও তারা পরিবারে ছকে রেখেছেন। এই আত্মত্যাগ করে যাওয়ার জন্যে আদর্শের যে-ডোজ অবিরত দিয়ে যাওয়া দরকার তা সুহাস পাবে কোথায়? আর দেবেই বা কেন? তাহলে কি উচিত হয়েছে ওদের এতটা ক্ষতি করা? সুহাস ত ওঁদের চাইতে অনেক বেশি মাইনে পায়। তার ডেইলি অ্যালাউন্সও অনেক বেশি। তার বেশি টাকা মাইনের বেশি সুযোগ-সুবিধেয়, কম পারিবারিক খরচার ফাঁকে, একটু বাড়তি টাকা থাকে বলেই কি সুহাস নৈতিকতায় আদর্শস্থল হয়ে ওঠার দম্ভ দেখায় তার অধস্তন কর্মচারীদের সামনে?

এর সঙ্গে-সঙ্গে সুহাসকে আর-একটা সন্দেহে জড়িয়ে পড়তে হয়। অফিসের কর্মচারীরা অ্যান্টি করাপসন ড্রাইভ-এ যেমন তাকে সমর্থন দিতে বাধ্য, তেমনি সেই কারণে যে-আর্থিক ক্ষতি হবে তা পুষিয়ে তুলতে অন্য কোনো ব্যবস্থা কি নেবে না? শুধু খেলে ত না হয় গৃহকর্তার কাজটুকু করে দেয়ার থাকত। এখন কি ঘুষ আগে ব্যাপক হয়ে উঠবে না? অর্থাৎ সুহাসের হাত দিয়ে অনেক বেশি কলকে খাওয়ার চেষ্টা হবে না? তা হলে, সুহাসকে কতদিকে চোখ রাখতে হবে? কোন দিকে? একটা দিকের দায় মেটাতে সুহাস নিজেকে আরো কত প্যাঁচে জড়িয়ে ফেলল? আর, সুহাসের যাতে গা ঘুলিয়ে ওঠে, সেই ব্যক্তিগত নীতিবায়ুতেই কি সে জড়িয়ে পড়ল তার অফিস-টফিস সমেত? কিন্তু এত আবার অফিসার হিশেবেও তার করণীয় বা কর্তব্য–বেঙ্গল সার্ভিস রুল বা ফাইন্যান্স ডিপার্টমেন্ট হ্যান্ডবুকে নির্ধারিত। শেষে, সুহাস কি তার ব্যক্তিগত নীতিবায়ুজনিত আত্মদ্বন্দ্ব মেটাতে ব্যুরোক্রেসির নীতিতন্ত্রের নৈর্ব্যক্তিকে পরিত্রাণ খোঁজে, এই মধ্যরাতে, তেতো মনে? যেন, অফিসার বলেই তার আচার-আচরণের দ্বারাই সৎ-অসৎ, ভাল-মন্দ নির্ধারিত হবে? সে রান্না করে খাবে বলেই এরাও রান্না করে খাবেন? আমলাগিরির এমন নিচ্ছিদ্র ব্যবস্থার মধ্যে সুহাস এমন ফিট হয়ে যাচ্ছে কেমন করে? নাকি, সাহেবদের তৈরি ব্যবস্থায় এমনি ভাবেই ফিট হয়ে যেতে হয়? সুহাসের চাকরি জীবনের এই প্রথম ক্যাম্পেই।

.

০১৪.

ফরেস্টারচন্দ্রের আত্মঘোষণা

এখন এই মাঠটা একটু স্পষ্ট। হাটখোলার চালা আর ঘরগুলো মিলে ছায়ার একটা নকশাও তৈরি হচ্ছে। সেই নকশাটা ধীরে-ধীরে বোনা হচ্ছে–আকাশের পটভূমিতে। ধীরে-ধীরে সেই নকশার কারিকুরি বাড়ছে, বিস্তার বাড়ছে। ঝোঁপঝাড়, ফাঁক-ফুকর–সেই নকশার ভেতর এসে যাচ্ছে। ধীরে-ধীরে এসে যাচ্ছে দূরের, প্রায় দিগন্তরেখার গাছ-গাছালি। আর তারও পরে, বড়বড় গাছের মাথা। এখন, এই সমস্ত পরিবেশটাকেই নানা ধরনের ও দূরত্বের ছায়া দিয়ে-দিয়েই আন্দাজ করা যায়। ছায়াগুলো এত ধীরে-ধীরে বাড়ে আর ছড়ায়, ধীরে এত বেশি দূরত্ব ছায়ায়-ছায়ায় আভাসিত হয়, যেন, যে-কোনো মুহূর্তে এই স্থির ছায়া চঞ্চল হয়ে উঠতে পারে বা, এই স্থির ছায়াগুলির ভেতর দিয়ে কোনো চলচ্ছায়া চলে গিয়ে ছায়াময় পরিস্থিতিকে জ্যান্ত করে তুলতে পারে।

নানা উচ্চতার আর বেধের ছায়া যত স্পষ্ট হচ্ছিল-নীচটা যেন ততই হয়ে উঠছিল অস্পষ্ট, অন্ধকার। সেই নাচের মাঠ, সদর রাস্তা আর হাটে ঢুকবার নানা গলিখুঁজিতে অন্ধকারটা একটু বেশি জমাট বাধা। উঁচুতে, দিগন্তে এত বেশি নতুন নতুন ছায়ার মাথা যে সেই গোড়ার অন্ধকারটা যেন আরো তলানিতে পড়ে যায়।

মাঠটার ভেতরে সেই তলানিটুকু আলোড়িত হয়ে উঠছিল। অবশ্য আকাশের দিগন্তের, নীরব অথচ দ্রুত ছায়াময় বদলের অনুষঙ্গেই মনে হতে পারে তলার এই অন্ধকারও বদলাচ্ছে। রাত্রি ও অন্ধকার ত সবটুকু ব্যেপেই রয়েছে। তাই তার এক সীমান্তের আলোড়ন হয়ত আরেক সীমায় ঢেউ তোলে, ক্ষীণ।

জলের ভেতরের কোনো আলোড়ন যেমন সেই জায়গার ভেতর থেকে জলটুকুকে আলোড়িত করে–অন্ধকারটাও তেমন হচ্ছিল। একটা গোঙানিও যেন শোনা যায়–তবে রাত্রিতে ত কত রকমই আওয়াজ ওঠে।

আলোড়নটা যে অন্ধকারের নয় ও আওয়াজটাও যে শুধু রাত্রিরই নয়–সেটা বোঝাতেই ঐ অন্ধকারটা ধীরে ধীরে একটা কঠিন আলোড়নের আকার নেয়, গভীর নিভৃতিতে বাঘিনীর একা-একা খেলায় যেমন আলোড়ন ওঠে ঝোঁপঝাড়ে। তারপর সেই অন্ধকারটা ফুড়ে একটা মানুষের দাঁড়ানোর নানা চেষ্টা আর বারবারই পড়ে যাওয়া ঘটতে থাকে-নদীর স্রোতে ভেসে যাওয়া ডুবো মানুষের যেমন হাবুডুবু দেখা যায়। তার দাঁড়িয়ে ওঠাটাই যেন একটা কঠিন কাজ হয়ে ওঠে তার পক্ষে, যেমন সার্কাস-দেখানো যে-কোনো চারপেয়ে পশুরই হয়। কী অসম্ভব কষ্টে তাকে দু-পায়ের ওপর দাঁড়াবার চেষ্টা করে, আবার ভেঙে যেতে হয় নিজের শয়ান অস্তিত্বে।

এমনি করে এক সময় লোকটি দাঁড়িয়েই ওঠে। দাঁড়িয়েই থাকে তার গায়ে অন্ধকারের এক পুরু পলেস্তারা লাগিয়ে। দাঁড়িয়ে থাকে আর টলে। তাতে অন্ধকারটা টলে না অবশ্য, কিন্তু অন্ধকারের গাঢ়তার একটা তারতম্য ঘটে। তারতম্যের সেই সামান্য তফাতেই লোকটির ভঙ্গির আভাস মেলে–তা ছাড়া সবটাই ত ছায়া। পটভূমির ছায়ার লাইনটার ফাঁক দিয়ে মাঝেমধ্যে একটু আকাশ, তার মাথার ওপর তোলা দুই হাতের দশটি আঙুল আর মাথার চুলের ছায়াময় রেখাগুলিকে প্রখর করছিল। সেখানেও, ডুবো মানুষের মতই, লোকটি হাতটাই নাড়ায়।

লোকটি দাঁড়িয়ে ওঠার পর আর-কোনো গোঙানি শোনা যায় না। যেন, গোঙানিটা এতক্ষণ ছিল তার দাঁড়িয়ে ওঠার চেষ্টারই আনুষঙ্গিক আর, দাঁড়িয়ে ওঠার পর, দাঁড়িয়ে থাকার চেষ্টায় সে কোনো আওয়াজই করছিল না।

অনেকক্ষণ পর, মাটির দিকে তাকিয়ে কথা বললে যেমন আত্মগত আওয়াজ বেরয় গলা দিয়ে, তেমনি স্বরে লোকটি ডাকে, হু-জ-উর। সে এই ডাকটি ডাকার আগেই তার গলায় একটা ঘড়ঘড় আওয়াজ উঠেছিল। ডাকটি শেষ হয়ে গেলেও আওয়াজটি থাকে। জোরে ঢোক গিলে সেই আওয়াজটাকে বন্ধ করে। জোরে ঢোক গিলতে গিয়ে তাকে গলার ভেতরে যে-অতিরিক্ত জোর চালান করতে হয়, তাতেই তার ঘাড়টা তার বুকের ওপর ঝুলে পড়ে। ওরকম ঝুলেই থাকে, যেন মাথাটা তার মাথা নয়, গলার লকেট।

দুমড়ে-মুচড়ে গলাটাকে শক্ত করে সে তোলে। বেশি নাড়ায় না, পাছে আবার স্কুলে যায়। শক্ত অবস্থাতেই সামনে জোরে হাঁক দেয় হাকিম। দ্বিতীয় হাঁক দিতে পারে না। তা হলেই মাথাটা মুচড়ে ভেঙে যাবে, মাথাটা শক্ত রাখা দরকার। কিন্তু মাথা আর শক্ত রাখা যায় কতক্ষণ। সেটা যখন নিজের ভারেই নুয়ে ঝুলে পড়তে চায় বুকের ওপর, তখন লোকটি মাথাটা জোর করে পেছনে ভেঙে দেয় আর আকাশের দিকে তাকিয়ে ডাকে, সাহেব।

লোকটি যেন তার হুজুর-হাকিম সাহেবের আকাশ থেকে নেমে আসাটা দেখে। বেশ কিছুটা সময় লাগে ত আকাশ থেকে নামতে। কিন্তু তার হকিম মাটিতে পা ফেলার সঙ্গে সঙ্গে ত আর সে ঘাড় সোজা করে হাকিমকে দেখতে পারে না। তাকে ঘাড় তুলতে সময় নিতে হয়। তুলে,সে অন্ধকারের মধ্যে হুজুরকে ঘেঁজে–এদিকে-ওদিকে, এ-কোনায় ও-কোনায়, তারপর একদিকে সোজা কয়েক পা গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে বলে, হুজুর, মুই আসি গেছু, মুই ফরেস্টারচন্দ্র বাঘারুবর্মন।

ফরেস্টার তার দুটি হাত জোড়া করতে চায়। কিন্তু সেটা কিছুতেই হয়ে উঠতে পারে না। দুটো হাতের যেন দুধরনের গতি ও ভার। বাঁ হাতটা ওঠে ত ডান হাতটা ওঠেই না। বা হাতটাকে নমস্কারের ভঙ্গিতে অনেকখানি তুলে ফরেস্টার চোখ কুঁচকে দেখে তার ডান হাতটি নেই, চোখটা আরো পাকিয়ে সে যেন বুঝে উঠতে চায়, ডান হাতটা গেল কোথায়। তারপর এদিক-ওদিক তাকিয়ে নেহাতই অকস্মাৎ তার ডান পাশে সেই হাতটাকে খুঁজে পায়। তখন সেই হাতটাকে বা হাতের কাছে আনার জন্যে তুলতে থাকে। তাকিয়ে-তাকিয়ে একটু-একটু করে। এদিকে বা হাত আবার স্কুলে যেতে থাকে। কিছুটা ঝুলে যাওয়ার পর সেটাও ফরেস্টারের নজরে পড়ে। সে তখন দুটো হাতকেই স্থির করে একবার বা, আর একবার ডান হাতের দিকে তাকায়। এরকম বারদুয়েক তাকানোর পর আর দেরি না করে সে হঠাৎ দুটো হাতকেই নমস্কারের জায়গায় টেনে নিয়ে আসে। একটু বাকাচোরা ভাবে দুটো হাতই জোড়া লেগে গেলে ফরেস্টার সেই জোড়াহাতের দিকে তাকিয়ে খুব হাসে, যেন সে দুই হাতের গোলমাল ঠেকিয়ে দুই হাতকে খুব জব্দ করতে পেরেছে। আপন মনে হাসতে-হাসতে জোড়াহাতের দিকে তাকিয়ে ফরেস্টার বল, লায়? বলে, আবার হাসে।

এবার আর জোড়াহাতটাকে মাথায় না তুলে, সে মাথাটাকেই জোড়াহাতের ওপর নামিয়ে আনে। নামাতে তার সময় লাগে। মাথা ঠিক সমান ভাবে নামতে চায় না–ভেঙে দুমড়ে ঝুলে যেতে চায়। কিন্তু ফরেস্টার এখন ঝুলে যেতে দেয় না। সে ধীরে ধীরে মাথাটাকে জোড়াহাতের কাছাকাছি নোয়াতে চায়। হাত দুটো একটু এলোমেলো ভাবে জোড়া লেগেছিল, আঙুলগুলো ঝুলছে, কব্জিটা ওপরের দিকে। কব্জির ওপরে কপাল ঠেকায় ফরেস্টার। তারপর হাতদুটো জোড়া রেখেই সে মাথাটা সোজা করে। ধীরে ধীরে সোজা করতে করতে হঠাৎ সোজা হয়–যেন খট করে শব্দও হল ঘাড়টা ফিট হয়ে যাওয়ার। তারপর ফরেস্টার কথা শুরু করে, হুজু-উর, মুই ফরেস্টারচন্দ্র আসি গেইছু। এটুকু বলতেই জোড়াহাতের দিকে নজর পড়ে। তখন, যেন ছিঁড়ে আলাদা করতে হচ্ছে এমন ভাবে, ফরেস্টার হাতদুটোকে পরস্পর থেকে আলাদা করে, সোজা দাঁড়ায়। এবার হেসে বলে, হুজুর, আসি গেইছি। মুই ফরেস্টারচন্দ্র। ফরেস্টারচন্দ্র বাঘারুবন। দেখি নেন। মোর মুখোন, দেহখান, দেখি নেন। টর্চ ফিকেন, কি ম্যাচিসের কাঠি জ্বালান। দেখি নেন। ওয়ান-টু-থিরি

যেন একটা টর্চ সত্যি জ্বলল, ফরেস্টার এমন ভাবে দাঁড়ায়। তার দুই চোখ হাসিতে বুজে গেছে। তার মোটা-মোটা সঁহ্যাঁতগুলি বেরিয়ে আছে। সে সেই হাসিমুখ আবার ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখায়। যেন, তার ফোটো তোলা হচ্ছে। বায়ে একবার, ডাইনে একবার ঘাড় ঘুরিয়ে সোজা হয়ে ফরেস্টার জিজ্ঞাসা করে, হুজুর। দেখি নিছেন তো মোক? ভাল করি দেখি নিছেন ত? মোর নামখান ফোমে রাখিবেন হুজুর, ফরেস্টারচন্দ্র বাঘারুবর্মন। বাপাখানের নাম হইল। কিন্তু বাপাখানের কথা ছাড়ি দাও। বাপার বাদে অনেক কাথা। মোর নিজের কাথাটা আগত শুনাবু তোমাক।

সেই কথাটা শুরু করতে গিয়েও ফরেস্টার থেমে যায়। হঠাৎ দুই হাতের পাতা দিয়ে চোখ ঢাকে, তোমার টর্চের আলোখান মোর চোখদুইটা ঝলঝলাই দিছে হে হুজুর। চক্ষুর পাতাখানের উপর আলোর তারা চকমকাছে, চকমকাছেয্যানং তিস্তার চরত বালি চমকায়। খাড়াও হে হুজুর, এই চকমকিখান একটু কমিবার ধরুক।

দুই হাতের পাতায় চোখ ঢেকে, ফরেস্টার অন্ধকারকে আরো অন্ধকার করছিল। নীরবতা তৈরি হচ্ছিল। সে নীরবতায় এতক্ষণের কথাবার্তাগুলোও মিলিয়ে যাচ্ছিল। অবশেষে সেই নীরবতার ভেতর থেকে ফরেস্টার শুরু করে, শুন হে হুজুর, কাথা মোর একখান। না হে, একখান না হয়, দুইখান। কাথা মোর দুইখান। কী দুইখান কাথা? একখান কাথা হই যে তোমরা ত জমির হাকিম। ত মোর নামখান তুমি কাটি দাও। মোর জমিঠে মোর নামখান তুমি কাটি দাও। মোর একখান ত জমি আছিল। আপলাদ ফরেস্টের গা-লোগো। মোক ঐঠে পাঠায় গয়ানাথ জোতদার। হালবদল-বিছন গায় ওর। মুই হালুয়া আছি কয়েক বছর। অ্যালায় আর নাই। মোর নামখান কাটি দাও। ঐ জমিখান লিখি দাও গয়ানাথ জোতদারের নামত। বলদ যার, বিছন যার, হালুয়া যার, ধান যার-জমি ত তারই হবা নাগে হুজুর। ত ঐ জমিখান মুই, ফরেস্টারচন্দ্র বাঘারুবর্মন, ছাড়ি দিছু। লিখি দাও, শ্রীফরেস্টারচন্দ্র বাঘারুবর্মনক এই জমিঠে উচ্ছেদ দেয়া গে-এ-এ-ই-ল।

হাঁকটা শেষ করে ফরেস্টার হেসে ওঠে। হাসির ঝোঁকে শরীরের সামাল ঢিলে হয়ে যায় বলে একটু টাল সামলায় হাসতে-হাসতেই। হাসিটা শেষ হলে ফরেস্টার একটা তৃপ্তির আওয়াজ তুলে বলে, ব্যাস, হুজুর। মনত রাখিবেন। আপলচাঁদের ফরেস্টারচন্দ্র বাঘারুবর্মন উমরার দেউনিয়া-জোতদার গয়ানাথ রায়বর্মনক উচ্ছেদ দিয়া দিল। গয়ানাথ সব শিখিবার চাছে। কহে, হে ফরেস্টার, মোক হালুয়াগিরিখান শিখি দে। বাপপিতামহর কামটা মুই ভলি গেছু, মোক শিখি দে। ত মুই নিচয় শিখি দিম। হুজুর, কালি আমি গয়ানাথক সৰ শিখাই দিম, ক্যানং করি হাল দিবার নাগে, মই দিবার নাগে, পাতা গুছিবার নাগে, ছাই ছড়ি দিবার নাগে, কোদা করিবার নাগে, রোয়া গাড়িবার নাগে–সব শিখাই দিমকালি সকালে। ব্যাস, কালি সকালঠে গয়ানাথই জোতদার, গয়ানাথই হালুয়া। মুই এ্যালায় যাছ, গয়ানাথের বাড়িত, উমরাক হালুয়াগিরি শিখাবার তানে।

ফরেস্টার যাওয়ার জন্য পা বাড়ায়। তারপর ঘুরে দাঁড়িয়ে বলে, কিন্তু মোর ত দুইখান কাথা আছে। একখান কাথা মুই ফরেস্টারচন্দ্র এ্যালায় গয়ানাথ জোতদারক খালাশ দিছু। মনত রাখিবেন হুজুর, ফরেস্টারচন্দ্র বাঘারুবর্মন। এইঠে ত অনেক ফরেস্টার। অনেক বর্মন। কায় সাচা আর কায় মিছা? হুজুর! দেখি নেন। যেইলা ফরেস্টারচন্দ্রের বা পাছা, আর ডাহিন পিঠত বাঘের দুইখান থাবার দাগ আছে ঐলা ফরেস্টারচন্দ্র আসল। ত দেখাও। সগায় পাছার কাপড় তুলি দেখাও। তুলো হে তুলল। পাছার কাপড় তুলে আর পাছাখান ঘুরাও। ফরেস্টার নাচের ভঙ্গিতে ঘুরপাক খায় আর খিলখিল হাসিতে যেন তার চারপাশের অনুপস্থিত ভিড়ের এক-একজনকে আঙুল দেখিয়ে বলে, তুলল, তুলো, পাছার কাপড় তুলল, ফরেস্টার পাক খায় আর আঙুল দেখায়, তুলল, তুলল। এক পাক ঘোরা হয়ে গেলে ফরেস্টার মাথা ঝাঁকিয়ে বলে, কায়ও দেখাবার পারিবে না, হুজুর। সগার পাছা ঢাকা থাকিবে। সগার পাছত, হাগা আছে, বাঘা নাই। কিন্তু মুই সাচা ফরেস্টারচন্দ্র বাঘারুবর্মন–আদি। মুই মোর পাছাখান নং উদলা করি দিম। খাড়াও হে হুজুর। তোমার টর্চখান আর চোখত না ফেলল। হ্যাঁ, রেডি। ওয়ান-টু-থিরি।

ফরেস্টার তার পরনের কানিটুকু সরিয়ে পেছনটা উদোম করে দেয় আর যেন টর্চের আলো সত্যিই পড়েছে এমন ভাবে ঘুরিয়ে-ঘুরিয়ে দেখায়, এক পাক, তার চার পাশে যেন সত্যিই দেখবার লোকের জটলা।

পাক শেষ করে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে ফরেস্টার বলে, ব্যাস, হুজুর। এ্যালায় ত জানি গিছেন, যায় বাঘা সে-ই সাচা ফরেস্টারচন্দ্ৰ। এইঠে ফরেষ্টার ত অনেক হুজুর বর্মনও হুজুর অনেক। রায়বর্মনও কনেক-আধেক আছে। কিন্তুক বাঘাবর্মন এই একোটাই। ত মুই যাছ হুজুর। গয়ানাথক হালুয়াকাম শিখাবার যাছি। তোমরালা কাল রায় দিয়া দিবেন–বাঘারু তার জমি গয়ানাথ জোতদারক দিয়া দিছে, এ্যালায় গয়ানাথ হালুয়া হবা ধরিবে-এ।

ত মুই যাছ হুজুর, বাঘারু কয়েক পা গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে, হুজুর, একখান সিগারেট খায়্যা যাছু। বা কান থেকে একটা সিগারেট বের করে বাঘারু ঠোঁটে লাগায়। পোড়া সিগারেটের শেষাংশ। ডান কানের পেছন থেকে দেশলাইয়ের কাঠি আর কানের ভেতর থেকে দেশলাইয়ের বারুদ-লাগানো একটা টুকরো বের করে আনে। তারপর সিগারেট ঠোঁটে চাপাস্বরে বলে, সাহেব ভাবিছেন মুই মাতাল খাছি। দেখো কেমে, কেনং ফস করি জ্বালাম কাঠিখান। ওয়ান-টু-থিরি। প্রথমবার জ্বলল না। দ্বিতীয়বার জ্বলল। শিখাঁটিকে বাঁচাতে তার দুই পাঞ্জার ঘের দেয়। ওটুকু বেঁকাতেই তার শক্ত পাঞ্জায় টান ধরে, যেন ভেঙে যাবে। পাঞ্জার ওপর আনত মুখে ঐ অন্ধকারে খোদাই হয়ে যায় অনড় দৃঢ় মোঙ্গোলীয় স্থাপত্য। সিগারেটটা ধরিয়ে, কাঠিটা ফেলে দিয়ে, নাক-মুখ দিয়ে বাঘারু যত ধোয়া ছাড়ে তাতে মনে হয় সিগারেটটা একটানেই শেষ হয়ে গেছে। সিগারেটটা নামিয়ে বাঘারু তাকিয়ে-তাকিয়ে আগুন দেখে।

.

০১৫.

সার্ভে পার্টির যাত্রা

সুহাস টের পেয়েছিল যে ওঁরা জেগেছেন ও তৈরি হচ্ছেন। কিন্তু সারা রাতের ঘুম তখনই যেন চোখ ঝাঁপিয়ে আসে। সে পাশ ফিরে শোয়। কিন্তু পাশের ঘরের আওয়াজ আরো বাড়ছে। সকাল ছটা থেকে কাজ শুরু হবে সেই তিস্তা পারে– তারপর আপলাদের দক্ষিণ কিনারা দিয়ে উত্তর-পূর্ব দিকে এগবে। এখান থেকে হাঁটতে হবে দু-তিন মাইল। এখনই না-উঠলে দেরি হয়ে যাবে।

একথা ভাবতে-ভাবতেই দরজায় টোকা পড়ে স্যার। বিনোদবাবুর গলা।

হু, সাড়া দিয়ে সুহাসকে উঠতে হয়। চোখ খুলতে পারে না, এত জ্বালা করে। ফলে, পা-টা কিছুতেই স্যাণ্ডেলে গলাতে পারে না! দরজা খুলে সুহাস বেরিয়ে দেখে তার ঘরের সামনে বারান্দায় একটা বড় বালতিতে জল, পাশে মগ।

মুখ ধোয়া শেষ হতে-হতেই প্রিয়নাথ একটা কাপে চা নিয়ে সুহাসের টেবিলে রেখে আসে। এইবার সুহাস বুঝতে পারে, তার পার্টির আর-সবাইই একেবারে তৈরি হয়ে আছে, শুধু তার জন্যই দেরি। সে অবিশ্যি এখুনি তৈরি হয়ে যাবে, কিন্তু প্রথম দিন সে সবার শেষে তৈরি হচ্ছে এতে সুহাস একটু লজ্জা পেল। তবে তাকে কেউ যেমন তাগাদা দিল না, তেমনি বিনোদবাবু বা অনাথ-প্রিয়নাথ কেউই খুব তাড়াহুড়োও করছে না। ওরা যেন জানেই সুহাসের দেরি হবে। বা, সুহাস যখন বেরবে তখনই কাজ হবে–তাই ওদের কোনো উত্তেজনা নেই।

চা খেতে-খেতেই সুহাস দ্রুত জল নিয়ে এল ও দাড়িতে সাবান ঘষতে শুরু করল। সুহাস ভেবেছিল। দু-চুমুক চা খেতে-খেতেই দুই টানে দাড়ি নামিয়ে দেবে। নামালও তাই, কিন্তু ঠেকে গেল গোফে। গোফে তাড়াহুড়ো করলে সময় আরো বেশি লাগবে। তাই সুহাস ব্লেডটা আস্তেই চালাতে চায়। কিন্তু আঙুলটা যেন ঠিক থাকে না। সুহাস তাড়াতাড়ি ব্লেডটা তুলে নিল। আর আয়নায় নিজের গোফটার দিকে তাকিয়ে ভাবলু, প্রতিটি দিন ত এই গোফ তাকে জ্বালায় ও জ্বালাবে। এখুনি সে ত এটাকে নামিয়ে দিতে পারে। বড়জোর বিনোদবাবু, প্রিয়নাথবাবু আর অনাথবাবু সেটা টের পাবে। আর ত কেউ তাকে আগে দেখেও নি। অফিসে ফিরে গেলে, তখন…। এই সুযোগ ত তার দ্বিতীয়বার না-ও আসতে পারে। আজই ত সবাই গোফঅলা হাকিমকে দেখে ফেলবে। তখন ত আর সে গোফ উড়িয়ে দিতে পারবে না। শেষ পর্যন্ত সুহাস ব্লেডটা নিয়ে নীচের লাইনটা একটু সোজা করে দেয়, আর ওপরে ব্লেডটা-একটু বোলায় মাত্র। তবু যেন অভ্যাসবশেই আয়নায় দেখে নিতে হয়। আর দেখলে তখন সেই ছোট কাচিটাও তুলতে হয়। একটু লাইটা ঠিক করে আয়না থেকে তাড়াতাড়ি চোখ সরিয়ে নেয়।

বিনোদবাবু জানলায় এসে বলেন আপনি তৈরি হোন, আমি বরং ওদের নিয়ে এগিয়ে যাই। জ্যোৎস্নাবাবু আপনাকে নিয়ে যাবেন।

আমার ত হয়েই গেছে, বলে চায়ের কাপটাতে শেষ চুমুক দিয়ে সুহাস, বাথরুমটা যেন কোনদিকে? বলেই বোঝে বিপদে পড়ল। কাল সন্ধ্যাতেও দু-একবার মনে হয়েছে, কিন্তু জিজ্ঞাসা করে উঠতে পারে নি। বিনোদবাবু জানলা থেকে সরে গিয়েছিলেন, সেখান থেকেই বললেন, পায়খানা কি আছে? দেখি।

তার মানে, এরা সেই অন্ধকার থাকতে উঠে মাঠে বা ঝোঁপঝাড়ে কোথাও গিয়ে কাজ সেরে এসেছেন। এখন বেলা হয়ে গেছে। মাঠে যাওয়া সম্ভব নয়। তা ছাড়াও, সুহাস মাঠে যেতে পারবে কি? এই ব্যাপারটাতে সুহাস প্রথম থেকেই একটু অনিশ্চিত। এখনো সে অনিশ্চয়তা কাটে নি, ভাবছে, এদের মত শেষ রাতে উঠলে হয়ত তার পক্ষেও মাঠে যাওয়া সম্ভব হত। কিন্তু এখন বেরিয়ে দুপুর বারটা-একটা পর্যন্ত কাজ। তৈরি না-হয়ে বেরয়ই বা কী করে? দুপুরে ফিরে এলেও ত আর এখানে বাথরুম গজাবে না। একটু অপ্রস্তুত ভাবেই সুহাস ঘর থেকে বেরয়। তার বাথরুমের জন্যে সমস্ত পার্টির কাজে রওনা হতে দেরি হয়ে যাবে- এটাও তার ভাল লাগে না। তার চাইতে বরং বিনোদবাবু যা বললেন, সেটাই ভাল, প্রিয়নাথবাবু আর অনাথবাবুকে নিয়ে বিনোদবাবু গিয়ে পৌঁছন, জ্যোৎস্নাবাবুর সঙ্গে সে না-হয় একটু দেরিতেই পৌঁছবে। বারান্দায় কাউকে না-পেয়ে সুহাস সিঁড়ির মাথায় এসে দেখে, কুয়োপাড়ের কাছে বিনোদবাবু আর প্রিয়নাথবাবু দাঁড়িয়ে, আর জ্যোৎস্নাবাবু একটা লোককে কিছু বলছেন। সুহাস কিছু বলার আগেই বিনোদবাবু বললেন, স্যার, পায়খানাটা ত নোংরা হয়ে আছে, ভেতরে জঙ্গলও হয়েছে, এখন বলা হল, পরিষ্কার করে রাখবে। আপনি — বিনোদবাবু কথাটা শেষ করতে পারলেন না। ততক্ষণে জ্যোৎস্নাবাবু লোকটির সঙ্গে কথা সেরে ফিরে বিনোদবাবুর কথার পিঠেই সুহাসের দিকে তাকিয়ে বললেন, গিরিজাবাবুর কাছে খবর পাঠালাম, আমরা ফেরার আগেই সব ঠিকঠাক করে রাখবে।

হ্যাঁ হ্যাঁ চলুন, আমরা রওনা হয়ে যাই, পরে দেখা যাবে, বলেই সুহাস জামা-প্যান্ট পরতে ঘরে যায়। আর যেতে-যেতে ভাবে, নেহাত মাঠে যাওয়ার দরকার হলে বরং যেখানে যাচ্ছে সেখানেই সুবিধে। অবশ্য গা-সুদ্ধ লোক দাঁড়িয়ে থাকবে আর সাহেব মাঠে যাবে–সেটা দেখাবে কেমন। সার্ভে ত বেলা বারটা-একটা পর্যন্ত। দেখাই যাক। সুহাস বাইরে বেরিয়ে এসে বলে, চলুন, দেরি হল না ত? গিরিজাবাবু কে?

এখানকার হাট কমিটির, ঐ যে কাল আপনার সঙ্গে দেখা করলেন। না, দেরি আর কী, দেখতে-দেখতে পৌঁছে যাব।

কাল সন্ধ্যায়ই যার নিমন্ত্রণ অত করে প্রত্যাখ্যান করল সুহাস, আজ সকালেই তাঁর সাহায্য দরকার–এতে যেন লজ্জাই পায়। এখন আবার ভদ্রলোক বিকেলে এসে অন্য কোথাও নিয়ে যেতে না চান, যেখানে অ্যাটাচড…। সামনেই ত চা বাগান আর তাদের ইস্পেকশন বাংলো৷ সুহাস যে মাঠে যেতে পারে নি এতেই যেন তার দুর্বলতা ধরা পড়ে গেল।

ওঁরা পাকা রাস্তায় এসে দাঁড়ালেন। প্রিয়নাথ পেছন থেকে এসে বিনোদবাবুর হাতে চাবি দুটো দিল-তালা আটকাচ্ছিল। তারপর ওরা দক্ষিণ দিকে চলে। সুহাস কেবির (খানাপুরী কাম বুঝারত) কাজ শুরু করছে একেবারে তিস্তার পাড় থেকে–ঠিক যেখানে আপলাদ ফরেস্টের দক্ষিণ-পশ্চিম সীমা, গাজোলডোবা চা বাগান। পশ্চিমে তিস্তা। গাজোলডোবার একটু দক্ষিণ থেকে একটা ছোট নদী, খানা, বেরিয়ে আরো দক্ষিণে গিয়ে তিস্তাতে মিশেছে। এখান দিয়েই ৬৮ সালের বন্যায় তিস্তার বান ঢাকে। গাজোলডোবা চা বাগানের আর ঐখানে আপলাদ ফরেস্টের বেশ বড় অংশ একেবারে ভেসে যায়। ফলে; ওখানে ম্যাপিং-এর একটা বেশ ঝামেলা আছে। অর্থাৎ এখন তিস্তা কোথা দিয়ে বইছে, চর উঠছে কি না, গাজোলডোবার কতটা নদীতে আর কতটা এখনো কায়েমে, ৬৮র বন্যার পর গত দশ-পনের বছরে আবার আগের ম্যাপের অবস্থায় ফিরে এসেছে কি না, আপলাদের সাদার্ন আর সাউথ ইস্টার্ন বর্ডার কোথায় ধরা হবে–এই সবের একটা মীমাংসা করতে হবে। তারপর আপলাদ ফরেস্টকে বয়ে, উত্তরে রেখে ওরা ধীরে ধীরে সোজা উত্তর-পশ্চিমমুখো আনন্দপুর চা বাগানের জোল্যাস্ত পর্যন্ত পৌঁছবে। এখানে ম্যাপিং-এর ঝামেলা কম, আর ফরেস্ট ল্যাণ্ডের ত মৌজা ম্যাপ ইত্যাদি ডিপার্টমেন্ট থেকেই তৈরি করে দেয়, চা-বাগানেরও তাই। সুতরাং ফরেস্টকে বঁ হাতিতে রেখে ঐ ফালিটার সার্ভে শেষ করে, পরের দফায় আবার রাজাডাঙ্গা দিয়ে ঘুরে, এর নীচের ফালিটা দিয়ে দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে সেই একেবারে খালপাড় পর্যন্ত যাবে। এই প্ল্যান অনুযায়ীই নোটিশ ও মৌজা-ইস্তাহার দেয়া হয়েছে।

পাকা রাস্তা ছেড়ে ওরা মাঠে নামে, আল ধরে যেতে হচ্ছে বলে একটা লাইনও হয়ে গেল। সবচেয়ে আগে অনাথ-কাঁধে ফোভিংসার্ভে-টেবিল। তার বেশ পিছনে প্রিয়নাথ শিকলভরা থলিটা তার ডান কাঁধে, কিন্তু বা আর ডান দুই হাত দিয়েই সেটা চেপে ধরা। ভারের চোটে প্রিয়নাথের মাথা ব্যায়ে হেলে গেছে। তার পেছনে জ্যোৎস্নাবাবু–তার কাঁধে ঝোলানো ব্যাগ, হাতেও একটা বোঁচকা। তার নিজের জিনিশপত্র ব্যাগে, আর হাতে লাল সালুতে মোড়া মৌজার একটা অংশ। তার পেছনে সুহাস। দুই হাতই খালি। পেছনে বিনোদবাবু-তার হাতেও ত মৌজাই। সুহাসকে এরা কেউই কিছু নিতে বলে নি, সুহাসও কিছু চায় নি। কারণ সুহাস বুঝে উঠতে পারে না এর মধ্যে কোনটা সে চাইতে পারে। একমাত্র মৌজার দু-একটা খাতা সে নিতে পারত। কিন্তু এরা বস্তাগুলো বেঁধেইছেন এমন করে যে তার কিছু চাওয়ার উপায় থাকে না। কিন্তু সুহাসের নিজের পক্ষে এটা বড় খারাপ লাগে যে বাকি চারজন, বা বলা যায় তিনজন, কারণ জ্যোৎস্নাবাবু ত আর তার পার্টির লোক নন, যখন বেশ ভারী-ভারী মাল বইছে তখন সে একা একেবারে শূন্য হাতে। জ্যোৎস্নাবাবুরও ত কোনো কিছু বইবার কথা নয়। কিন্তু তিনি এই পার্টিতে থাকেন আর প্রাইভেট প্র্যাকটিস করেন বলে তাকে ওটুকু বইতেই হয়। এতে হয়ত তার প্র্যাকটিসেরও সুবিধে।

জ্যোৎস্নাবাবু, আমাকে আপনার কাঁধের ব্যাগটা দিন না-পেছন থেকে সুহাস বলে।

তার কথা শেষ হওয়ার আগেই যেন জ্যোৎস্নাবাবু বলে ফেলেন, না স্যার, না স্যার, ও ত আমার ব্যাগ।

অগত্যা সুহাসকে চুপ করতে হয়–একবার শুধু পেছনে বিনোদবাবুর দিকে তাকায় দুই হাতে মোটা-মোটা মৌজা নিয়ে হাঁটছেন। সুহাস সেই মৌজার সাইজ দেখেই বোঝে, তার পক্ষে এ ভাবে ঝুলিয়ে নেয়া সম্ভব হত না, কাঁধে দিতে হত। এবং নিজের মৌজা নিজে কাঁধে নিয়ে সার্ভে অফিসার উপস্থিত হলে তাকে আর সার্ভে করতে হবে না!

.

০১৬.

গয়ানাথের হালুয়াগিরি প্র্যাকটিস

হালে বলদ জুতে, মাঠে নামিয়ে বাঘারুর বাইরে থেকে গয়ানাথকে ডেকেছে–হে দেউনিয়া, উঠ কেনে, শাদা হবা ধরিছে হে।

গয়ানাথ উঠে বিছানায় বসে কাশি শুরু করেছে। এই কাশি তুলবে, তারপর খানিকটা হাফাবে, তারপর গয়ানাথ নামবে।

বাঘারু দারিঘরে ঢুকে মাচার পোয়ালের ফাঁকে বিড়ি খোঁজে। পায় না। বেরিয়ে এসে দেখে ভটভটিয়াখান বাইরে এনে রেখে এখন আসিন্দির-জোয়াই (জামাই) দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছে। হে জোয়াই, সিগারেট খিলাও একখান। নিজের সিগারেটটায় একটা লম্বা টান দিয়ে আসিন্দির হাত বাড়িয়ে রাঘারুকে দেয়। বাঘারুর সিগারেটটা হাতে ধরে রেখে টেনে-টেনে নিশ্বাস নেয়। সিগারেটের না, আসিন্দিরের গন্ধ। জোয়াইটার গা দিয়া ক্যানং প্যাটরোলের নাখান গন্ধ, আর ঐ বুড়াটার গাঅত কাদাখোচার গন্ধ।

অ্যাই, কহিছিস কী?

কুছু না, কুছু না, গন্ধে কাথা, বাঘারু মাঠের দিকে তাকিয়ে আধখানা সিগারেট টানে তর্জনী আর বুড়ো আঙুলে ধরে। কিন্তু তার আঙুলগুলি এতই থ্যাবড়া যে প্রায় অর্ধেক সিগারেট ঢাকা পড়ে যায়। ঠোঁট ছুঁচলো করে বাঘারু-ঠোঁট তার মোটা নয়। মাঠের মাঝখানে শাদা আর ছাই-ডাই বলদজোড়া নানা দিকে তাকিয়ে দেখছে, এক-একদিকে বেশ অনেকক্ষণ ধরে।

গয়ানাথ হাল দেবে বলেই দু-দুটো বলদ জোড়া হয়েছে। বলদেই টানুক। বুড়া শুধু ধরে থাকবে। এই সার্ভের সাহেব নাকি নাকশালিয়ার ঘর। যে-জোতদার নিজ চাষ দেখাবে, উমরাক নাকি কহিবে, চালাও, হাল চালাও, তারপর নাকি দুই হাত দেখিবার চাহিবে-নরম কি শক্ত, বেঁকে কি না-বেঁকে, গাও হাত দিলে বাবলা গাছের নাখান খড়খড় করে কি না করে, আর যায় হাল দিবার না পারিবে উমরাক ক্যানসেল করি দিবে, আধিয়ারের নামে জমি রেকর্ড করি দিবে।

গয়ানাথ তাই এখন হালুয়াগিরি শিখছে। আপলাদ ফরেস্টের পাশে, ফরেস্টের জমির সঙ্গে তার টানা জমি। নিজ চাষেই। সেখানে বাঘারু মাঝে-মাঝে চাষ করে, আরো কায়কায় করে। সেই জমিটা নিজচাষ রেকর্ড করার সময় সাহেব যদি গয়ানাথকে হাল চালিয়ে দৈখাতে বলে সে সত্যি হালয়া কি না! হাত গয়ানাথের এমন কিছু নরমও না, ফর্শাও না। কিন্তু হাল ত টানবে বলদ। বলদ ত চেনে বাঘারুকে। বলদ ত আর জানে না কে গিরি আর কে হালুয়া, আর কে সাহেব। শেষে, সাহেব যদি তাকে জমিতে নামায়, আর তখন যদি বলদ তার কথা না শোনে? তাই গয়ানাথ বাঘারুকে বলেছে, বলদটাকে একটু মোক চিনি দে কেনে বাঘারু, মোর আওয়াজ-টাওয়াজখান একটু চিনি দে।

আসিন্দির বলে, হে বাঘারু, তোর বুড়ার কি মাথাটা খারাপ হয়া গেইল রে? এ্যালায় হাল ড্রাইভ করিবার চাহে? বাঘারু এ কথার উত্তরে ঘুরে তাকায় না। মাঠের দিকে, বলদের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে, যেমন ঐ বলদ দুটিও আছে, সামনে, একটু নীচে, জমিতে হাল কাঁধে। তারপর বলে, কায় জানে? কালি হাটত শুনিবার পাছ সাহেব নাকি হাত টিপিবে, গাও টিপিবে, মাথা টিপিবে—

কথা শেষ হওয়ার আগে আসিন্দির জোরে হেসে ওঠে, এই প্রায়ান্ধকার উষার পক্ষে একটু বেশি জোরে, তোর আর বলদের ত একই বুদ্ধি। তোর সেটেলমেন্টের সাহেবের তানে কি বিয়া বসিবার ধইচছে হে কন্যার গাও টিপিবে, গাল টিপিবে? তারপর, আসিন্দিরের আরো কিছু মনে পড়ে, সে হো

হো হেসে গয়ানাথকে ইঙ্গিত করে বলে এই বুড়াখানের গাও টিপিলে ত জিভাখান বাহির হয়্যা যাবে, আর গাল টিপিলে ত সিনজাকাঠির [পাটকাঠি] নাখান হাড়গিলা মড় মড় করি ভাঙি যাবার ধরিবে।

গয়ানাথ দরজা খুলে বেরিয়ে খড়ম খটখটিয়ে কুয়োপাড়ের দিকে যায়, তার গায়ে ধুতির খুঁট। মুখে-চোখে জল দিয়ে আবার দ্রুত খটখটিয়ে ফিরে আসে। ঘরের ভেতর থেকে,-গেঞ্জি গায়ে দিয়ে, ধুতিটা হাঁটুর ওপর তুলে খড়মটা পায়েই, যেন তৈরি হয়ে, বেরিয়ে আসে। আসিন্দির তাকিয়ে-তাকিয়ে দেখে। বুড়ো যখন দরজার পাশে খড়মটা খুলে উঠোনে নামে, আসিন্দির বলে-তোমরালার কাম কি ঐ মাঠে যাওয়ার? ছাড়ি দেন। উকিলবাবুকে পাঠি দেন। ঐঠে আমিন আছে, যা করিবার উমরায় করিবেন, তোমরালা এ্যালায় হাল ঠেলিবার ধরিছেন?

গয়ানাথ হেসে জবাব দেয়, কেনে রে বাউ, হালুয়ার জোয়াই হবার তানে লাজ লাগিছে? তারপর মাঠের দিকে তাড়াতাড়ি নামতে নামতে বলে, হে বাঘারু, চল কেনে।

আসিন্দিরও পেছন পেছন আসে  মাঠের আলে নামে না। ওপর থেকে বলে,তোমাক এইখান বুদ্ধি কায় দিল, হাকিম কি ড্রাইভিং লাইসেন্স দিবেন নাকি?

আরে, কাল হাটত শুনিছু এ শালোর ঘর হাকিম নাকশালিয়া। হাত টিপিবে, গাও টিপিবে।

 আরে, তোমার কি মাথা খারাপ করিবার ধরিছেন। সেটেলমেন্টের হাকিম আসি তোমার হাত দেখিয়া জমি রেকর্ড করিবেন? তোমরালার এই সব কাম কী? ছাড়ি দাও, মুই যায় ক্যাম্পত, দেখিম।

আরে বাপা, তুই ত তোর জীবনখানে একখানসেটেলমেনটোও দেখিস নাইরে বাপা। যেইঠে যা নিয়ম, করিবার নাগে। খতিয়ানও থাকিলে, আবার ধর কেনে এই পেরাকটিসও থাকিলো।

কিসের পেরাকটিস?

 এই হালুয়াগিরির। যদি মোক আজি চাষ দিবার কহে?

তোমাক কোট হাল দিবার কহিবে?

 ঐ ফরেস্টের জমিঠে

ত তুমি চলি আইস কেনে, মুই পেরাকটিস দিছু। হাকিম কহিলে কহিবেন, মুই বুড়া হছি, এ্যালায় মোর জোয়াইখান হাল দিছে, আসিন্দির পাড়ায়।

আরে, খাড়ো না কেনে বাউ, বলে গয়ানাথ তাড়াতাড়ি গিয়ে বলদের পেছনে হাল ধরে।

আসিন্দির চিৎকার করে ওঠে, হে বাপ, মোক ছাড়ি দাও, মুই চাষ দিছু। গয়ানাথ একবার হেট আওয়াজ করে। বদলদুটো লেজ নাড়ায়, মুখটাও একটু ঘোরায়, কিন্তু নড়ে না। হেট বলে আর-একবার আওয়াজ তোলে গয়ানাথ কিন্তু বলদ নড়ে না। বাঘারু পাশ থেকে জিভ দিয়ে ঈকরায় দুটো আওয়াজ তুলতেই বলদ দুটো পা ফেলে এগিয়ে যায়।

আসিন্দির চিৎকার করে ওঠে, হেই বাপ, তোমাকতয় মুই ফেলি দিম, ছাড়ি দাও। মুই যাছু, মোক দেও।

গয়ানাথ এবার ধমকে ওঠে, হে-ই, চুপ যা কেনে ছাগির বেটা, তোর কথা শুনি মোর জমিখান আজি খরচা করিবার ধরিম নাকি হে?

.

০১৭.

 হাল, বলদ ও মোটরসাইকেল

আপলাদ ফরেস্টের সঙ্গে লাগোয়া জমিটার জন্যই এত ঝামেলা। ফরেস্টের সঙ্গে জমিটা এতই লাগানো যে, দেখলেই মনে হয় জমিটা ফরেস্টেরই, কেউ হয়ত চাষ আবাদ করছে। ঐ ফরেস্টের একটা অংশ ছিল এদেরই–গয়ানাথের বাবা পদ্মনাথ, পদ্মনাথের বাবা ভদ্রনাথের আমলে। ভদ্রনাথের আসল নাম ভাদই রায় তার আমল থেকেই এরা ভদ্র ও নাথ হয়েছে। পরে,বছর পঞ্চাশ আগে সেটেলমেন্টের সময় একটা দাগ নম্বরেই ফরেস্টের খাস জমিও ঢুকে যায়। এমন অবশ্য হওয়ার কথা নয়। হয়ও না। কিন্তু হয়ে যাওয়ার পর তার নিজ জমিটা যাতে ফরেস্টের জমির ভেতর ঢুকেই থাকে ও এক খতিয়ানেই থাকে সেটা ভদ্রনাথ রায়, পদ্মনাথ রায় ও গয়ানাথ রাগ তিনপুরুষ ধরে দেখে আসছে। তখনকার দিনে ত আর জমিজমার খবর হালুয়া-আধিয়াররা রাখত না। ফলে সবাই জানত ভাদই রায়ের জমিটাই ফরেস্ট ডিপার্টমেন্ট কেড়ে নিয়েছে। কিন্তু সেখানে ভাদই রায়ের জমির টানা অংশটা ভাদই রায়েরই আছে। আর ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের লোকও কোনো সময় একটা চাষের জমিতে শালগাছ পুঁততে যায় নি। বা যাতে না পেতে সেটা ভদ্রনাথ, পদ্মনাথ, গয়ানাথ তিনপুরুষ ধরে দেখে আসছে। ফলে, ফরেস্টের অনেক-অনেকখানি জমিও গয়ানাথ নিজের জমি বলেই চাষ করে।

কিন্তু এবার বিপদ হতে পারে। এখন সব হালুয়া-আধিয়াররা জমি বোঝে, মাপামাপিও বোঝে। তদুপরি এই জমির লাগাও আনন্দপুরের ভেস্ট জমিতে রাধাবল্লভের দলের জবরদখল। তারা উকিল-মোক্তার ডাকে, শিট ম্যাপ দেখতে পারে, কোন দাগ কোথা দিয়ে গেছে তাও বলে দিতে পারে। তারা যদি এখন জরিপের সুযোগে হঠাৎ ইনকিলাব বলে ঝাণ্ডা গাড়ে? সুতরাং গয়ানাথ কোনো ঝামেলাই নেই। তাকে যদি নিজে হাল চালিয়ে দেখাতে হয় জমি তার, তা হলে তাই দেখাবে।

গয়ানাথ জমিটার দক্ষিণ থেকে সোজা তার বাড়ির দিকে আসছিল–মাটিতে হাল লাগিয়ে কাঠি দিয়ে। যাচানোর মত একটা-সরু লাইন বানাতে রানাতে। আসিন্দির তার মোটরসাইকেলের স্টার্টারে কিক মারতেই বদল দুটো কান খাড়া করে যেন দাঁড়িয়ে পড়ে। গয়ানাথ চিৎকার করে ধমকে ওঠে, হে-ই শালা জোয়াই, ভটভটি বন্ধ কর। চেঁচালে গয়ানাথের গলা দিয়ে বনমোরগের মত আওয়াজ বেরয়। আসিন্দির পা নামিয়ে হে-হে করে হাসে, উঠি আইস কেনে, উঠি আইস, না-হয় ত তোমরাক ফেলি দিব হে বাপা। গয়ানাথ তার বাড়িটাকে পেছনে রেখে বয়ে ঘোরে। পেছন থেকে তার মেয়ে চিৎকার করে, বাবা, চা দিছি।

গয়ানাথ যখন জমিটার এই সীমায় চলে এসেছে, তখন আসিন্দির হঠাৎ মোটরসাইকেলটাতে স্টার্ট দিয়ে অ্যাকসেলিরেটারটাকে একবার পুরো ঘুরিয়ে দেয়। সেই গা আ-আ-আশব্দে মুহূর্তের মধ্যে কান ও লেজ খাড়া করে দুই বদল দুই দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েই দু-দিকে দৌড় দিল। গয়ানাথ হালের মাথা ছেড়ে দেয়ার সময়টুকুও পেল না, জমির ওপর উপুড় হয়ে পড়ল।

কাঁধে জোয়াল আর পেছনে হাল নিয়ে বলদ দুটো দুদিকে দৌড়তে গেলেই ঠেকে যায়। বা দিকের ছাইরঙা বলদটার পা বেকায়দায় ছিল। ডান দিকের শাদা বলদটা একটা হেঁচকা টানে পাশের ডাঙা জমির দিকে দৌড়লে হালটা এক ঝটকায় গিয়ে তার গায়ে পড়ে। আর ছাইরঙা বলদটা ঘুরে দৌড়তে গেলে প্রথমে দড়িতে পেঁচিয়ে যায়, আর তারপরে শাদা বলদটার বিপরীত টানে, জোয়াল দড়ি-টড়ি সব নিয়ে ধপাস করে মাটিতে পড়ে। জোয়ালের সঙ্গে ধাঁধা তার গলাটা মুচড়ে যায়। ছাই বলদটা পড়ে যাওয়ার হ্যাঁচকা টানে শাদা বলদের পেছনের পা দুটো সামনের উঁচু আল থেকে হড়কে যায়। বলদটা তখন সামনের পা দুটো দিয়ে মাটি খুবলে-খুবলে দাঁড়াতে চায়।

গয়ানাথকে পড়ে যেতে দেখে বাঘারু গয়ানাথের দিকে এক পা ফেলেই ঘুরে, হে-ই হে-ই বলে বলদ দুটোকে ধরতে দৌড়য়। বলদ দুটো পড়ে না গেলে ধরতে পারত কি না সন্দেহ! বাঘারু গিয়ে আগে জোয়ালটার দড়ি টেনে বের করে এনে ছাই-বলদটাকে ঢিলে করে। আর বলদটা দাঁড়িয়ে উঠে কান ঝটপট করে এদিক-ওদিক তাকিয়ে যেন খুঁজতে থাকে সেই আওয়াজটা কোথায়।

ছাই বলদটা খালাশ হতেই শাদা বলদটা জোয়ালটাকে টানতে-টানতে ওপরের আলটাতে সামনের দু পা তুলে দাঁড়ায়। পেছনে জোয়ালের আর লাঙলের ভার নিয়ে সে চট করে উঠতে পারে না। বাঘারু দৌড়ে গিয়ে তার দড়ি ধরে ফেলে। তারপর দুই লম্বা দড়ি জোয়াল থেকে ছাড়ানো শুরু করে।

ততক্ষণে গয়ানাথ মাটি থেকে হামাগুড়ি দিয়ে উঠে দাঁড়ায়। তার কপালে-নাকে-মুখে, গেঞ্জিতে হাঁটুতে কাপড়ে, কাদা। গয়ানাথ দাঁড়িয়ে উঠে নিজেকেও দেখে না, বলদগুলোকেও দেখে না। সে যে-টুকু হাল দিয়েছিল, তারই এক-খাবলা মাটি তুলে ঢিলের মত করে তার বাড়ির দিকে ছোড়ে। সেটা তার সামনেই ঝুরঝুর করে ঝরে যায়। তখন গয়ানাথ, শালো জোয়াই, তোর পাছত বাংকুয়া (ধাক)। সিন্ধাম-বলে তার বাড়ির দিকে দৌড়তে শুরু করে। আসিন্দির একসেলিরেটারটা একবার ঘুরিয়েই বন্ধ করে দিয়েছিল। আর তার হাসির শব্দে গয়ানাথের বৌ আর মেয়ে দৌড়ে এসে দাঁড়ায়। তখনো, গয়ানাথ মাটিতেই পড়ে। তিনজন মিলে যে-হাসি হাসে সেটা গয়ানাথ উঠে দাঁড়ানোর পরও থামে না। গয়ানাথ ঢিল মারার পর বেড়ে যায়। আর, গয়ানাথ তাদের দিকে ছুটতে শুরু করলে তিনজনই ঢিল-খাওয়া মুরগির মত নানা দিকে ছুটে যায়। এতটা দৌড়ে আর বাড়িতে ওঠার ঢাল বেয়ে উঠে গয়ানাথ হাঁপিয়ে গিয়েছিল। সে উঠেই মোটর-সাইকেলটাতে একটা লাথি মারে। মোটর-সাইকেলটা সামান্য নড়েও না। তার পায়ের কাছে একটা কাঠের টুকরো পড়ে ছিল, সেটা তুলে মোটরসাইকেলটার ওপর মারে। হেই, কী করিবার ধরিছেন? গয়ানাথের বৌ এসে দাঁড়ায়, চা ঠাণ্ডি হবা ধরিছে,. খায়্যা নেন। শুনে গয়ানাথের মেয়েও ঘর থেকে বাইরে আসে, বাবা, তোমাক কায় কহিসে হাল চালাবার!

তোর বাপ কইসে। কোটত স্যায় শেয়ালখাগের বেটা, শালো, ছাগির ছোয়া।

শুনে গয়ানাথের বৌ মুখে আঁচলচাপা দেয়। আর ঠিক পেছনে বাড়ির নীচে, মাঠের পাশ থেকে আসিন্দির জোড়হাতে চিৎকার করে, হে বাপা, মোক ক্ষেমা দাও কেনে, মোক ক্ষেমা দাও কেনে, বাপা, কিন্তু বলেই হেসে ফেলে। আসিন্দিরের গলা শুনে গয়ানাথ পেছন ফিরে বনমোরগের চিৎকার করে ওঠে, শালোলা, মুই হাল দিছু, আর তুই বেটার-ঘর ভটভটাছিস, শালো।

ক্ষেমা দাও কেনে বাপ, মোর কাথাটা কেনে শুনিলু না! মুই ত ওর্নিং দিছু তোমাক, নিরাপদ দূরত্ব থেকে আসিন্দির হাত জোড় করে।

শালো তোর ওর্নিং-এর পাছত মাররা। চায়ের কাপটা নিয়ে মেয়ে এসে গয়ানাথের সামনে দাঁড়ায়–ঠোঁটে আঁচলচাপা দিয়ে ও আসিন্দিরের উল্টোদিকে চেয়ে। চায়ের কাপটা গয়ানাথ হাতে নিতেই মেয়ে বারান্দায় পিড়ি পেতে বলে, বসিসি খাও বাপা। গয়ানাথ ততক্ষণে এক চুমুক দিয়ে ফেলেছে।

পিড়িতে বসে সে রাগের শেষটুকু দিয়ে চিৎকার করে, শালো, ছাগির বেটা, যা কেনে, তুই হাল ধর, মুই না যাও জরিপের পাখে, তোকই হাল দিবার নাগিবে।

.

০১৮.

আসিন্দিরের হাল দেয়া

এতে আসিন্দির যেন বেঁচে যায়। সে যাছি হে বাপ, যাছি, মুই ত যাবারই চাছি। বলে মাঠ বরাবর দৌড়য়, বাঘারু যেখানে দাঁড়িয়ে হালবদল নিয়ে। তার সেই দৌড়ে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে-তাকিয়ে গয়ানাথ ধুতির খুঁট খুলে মুখের কাদা মোছে। তারপর চায়ে চুমুক দেয়। গয়ানাথের বৌ ও মেয়ে এসে তার পেছনে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে-তাকিয়ে দেখে, আসিন্দির বাঘারুর হাত থেকে দড়িদড়া নিয়ে নিলে, বাঘারু জোয়ালটা দুই বলদের কাঁধে জোতে। ছাই বলদটা সরতে চাইছিল না। বাঘারু তার গলায় ঘাড়ে হাত দিয়ে নির্ভয় দিলে সেই শাদা বলদটার পাশে এসে দাঁড়ায়। যেন এখনো কোথাও মোটর সাইকেলের আওয়াজ উঠতে পারে–এমন ভাবে ডাইনের বলদটা ব্যায়ে অনেকখানি মাথা ঘুরিয়ে গয়ানাথের বাড়ির দিকেই তাকিয়ে থাকে। জোয়াল জোতা হয়ে গেলে আসিন্দির বাঘারুর হাত থেকে দড়িদড়া টেনে নিয়ে হালের গোছাটা চেপে ধরে। তারপর বলে, অ্যালায় স্টার্ট দিছু রে বাঘারু।

হে জোয়াই, আলাং-পালাং না করেন, গরু ডর খাছে,বলে বাঘারু আর অপেক্ষা না করে জিভ দিয়ে টাকায় একটা খুব নরম শব্দ তোলে।

বলদ দুটো নড়ে না। কিন্তু শব্দটা শুনতে ডাইনের বলদটা যেন মুখটা আর-একটু ঘোরায়। বাঘারু তখন নরম করে পর পর দুবার টট্টর টট্টর শব্দ তুলে সামনে গিয়ে দুই বলদেরই শিঙের মাঝখানে হাত রেখে একটু চুলকে দেয়। বলদ দুটো ঘাড় তোলে। গলকম্বলে একটু সুড়সুড়ি দিয়ে, বাঘারু বলে, দেন কেনে জোয়াই, স্টার্ট দেন।

আসিন্দির নির্ভুল নির্দেশ দেয়। আর বলদদুটো চলতে শুরু করে। হালের গোছা তার হাতে শক্ত করে ধরা আর ফাল পুঁতে যাচ্ছে মাটিতে। বেশ বড় বড় মাটির চাঙড় উঠে দু-পাশে পড়ে যাচ্ছে। সামান্য একটু পরেই বলদদুটি বোঝে অরা বেশ শক্ত সমর্থ দুই হাতে। জোয়ালের ওপর সমান টান পড়ছে। বলদ দুটোর ঘাড় ধীরে-ধীরে সোজা হয় আর আসিন্দির তার টাকরার আওয়াজে বলদ দুটোর গতি বাড়ায়। কোনোদিনই যাকে হাল ধরতে হয় না পেশিবহুল শক্তসমর্থ শরীরে এই আচমকা হালচালানোয় তার যেন একটা শারীরিক আরামই জোটে, স্বেদমোচনের আরাম। অভ্যেস নেই বলে আসিন্দিরের হাতের চাপটা সমান থাকে না, একটু কম-বেশি হয়ে যায়। তখন হালও লাফায়, জোয়ালও লাফায়, বলদও একটু হোঁচট খায়। কিন্তু সে ত মাত্র দু-একবার। তার ধুতি আর গেঞ্জিতে আসিন্দিরকেও জমির ভেতর প্রোথিত মনে হয় না, তাকেও মনে হয় শখের হাল চালাচ্ছে। কিন্তু দেখতে-দেখতে যে-গভীর নালী তৈরি হয়ে যায় তার হলচালনার ফলে, যেকালোকালো নরম মাটি ঝুরঝুর উপড়ে যাচ্ছিল ফালের দু পাশে–তাতে তার গায়ের জোর ও তার মোগ্যতার প্রমাণে হল।চালনার বিষয়টিই বদলে যাচ্ছিল।

দূরের দিকে তাকালে কুয়াশা এখনো গভীর। চোখের সামনের কুয়াশা কাটছে। সামনের বাশগাছের মাথায় মাকড়সার জালের মত কুয়াশার জাল। চার-পাঁচজন লোক ফরেস্টের পাশ দিয়ে বন পেরছে। দু-একজনের মাথায় এক-একটা পঁজা। দিগন্ত পর্যন্ত ত চেনাই এখানে–এমন-কি আকাশের রেখাঁটিও! বাঘারুকে একটু নজর করে এই দৃশ্যটা ঠাওরাতে হয়। হে জোয়াই, দেখ কেনে–আসিন্দিরকে বাঘারু ডাকে। আসিন্দির হাল ছেড়ে এলে দেখায় দেখ কেনে। একটু নজর করে দেখে আসিন্দির ছুটে গিয়ে মাঠ থেকেই গয়ানাথকে বলে, হে বাপা, তোমার সার্ভে পার্টি ত যাছে হে সার্ভের জায়গা। বাঘারু গিয়ে হালের দড়ি ধরে। অ্যাঁ? বলে গয়ানাথ লাফিয়ে ওঠে, বাঘারু-উ। বাঘারু মাঠের ভেতর থেকেই তাকায়। ঐ চিয়ারখান নিয়া ছুটি যা সার্ভের জায়গাত, ছুটি যা। বলে গয়ানাথ দৌড়ে কুয়োপাড়ে যায়। আসিন্দির তাড়াতাড়ি গিয়ে বাঘারুর হাত থেকে দড়িদড়া ধরে বলে, কাউক পাঠাই দে জলদি, আর চলি যা চেয়ারখান নিয়া।

বাঘারু দৌড়তে-দৌড়তে সদরবাড়ির ভেতর দিয়ে পেছনে গোয়ালবাড়িতে গিয়ে চিৎকার করে, হে-ই ভোচকু, যা কেনে বলদদুইটাক নিগি আন। তারপর আবার দৌড়ে ফিরে এসে দেখে গয়ানাথের মেয়ে চেয়ারটায় বসে। উঠো কেনে, উঠো। গয়ানাথের মেয়ে লাফিয়ে ওঠে। চেয়ারটা উল্টিয়ে মাথায় নিয়ে বাঘারু সোজা পশ্চিম দিক দিয়ে নেমে যায়। এই দিক দিয়ে একটা ছোট রাস্তা আছে। এখন তার পরনে নেংটি, সারা গায়ে আর-এক চিলতে কাপড় নেই, মাথার ওপর উল্টনো চেয়ার, পা ওপর দিকে তোলা। বাঘারু খুব তাড়াতাড়ি হাঁটতে শুরু করে, এ-আল, ও-আল দিয়ে। তাকে সার্ভে পাটির আগে পৌঁছতেই হবে। চেয়ারটা কোনো গাছের তলায় ঠিকঠাক করে রাখলে হাকিম বসবে। আর হাকিম যদি আগে যায় তবে বসবে কোথায়। হাকিম আছে, চেয়ার নেই–এই অসম্ভব অবস্থা দূর করার ভার নিয়ে বাঘারু তার বড় বেশি চেনাজানা এই মাঠ-ঘাট বনবাদাড় দিয়ে, ছোট থেকে আরো হোট পথে, ছুটছে।

গয়ানাথ জামাকাপড় পরে এসে উঠোন থেকে চেষ্টায়, হে জোয়াই, ভটভটিখান বাহির কর, লেট হয়্যা যাছে, মোক ছাড়ি দিয়া আয়। আসিন্দির ভোচকুকে দৌড়ে আসতে দেখে বলদদুটোকে ছেড়ে দৌড়ে এসে লুঙি-গেঞ্জিতেই মোটর-সাইকেলটাকে ঠেলে-ঠেলে উঠোন দিয়ে বাইরে নিয়ে যায়, বড় আলের মুখে। গয়ানাথ ঘরের ভেতর থেকে মার্কিন কাপড় দিয়ে বাঁধা একটা পুটুলি চটের ব্যাগে ভরতে-ভরতে বেরিয়ে আসে। সেটা হাত বাড়িয়ে সামনে নিয়ে, আসিন্দির ট্যাঙ্কের ওপর রাখে। গয়ানাথ পেছনে বসে। গয়ানাথের বৌ আর মেয়ে তাড়াতাড়ি বাইরে আসে কিন্তু তার আগেই মোটরসাইকেলে স্টার্ট দেয়ার আওয়াজ ওঠে। ওরা বড় আল দিয়ে হুস করে বেরিয়ে যায়।

.

০১৯.

 বনপথে আকাশ-বাতাস

সুহাসকে সামনে জ্যোৎস্নাবাবুর প্রাইভেট আর পাবলিক বোঝার ভার দেখতে হয় আর পেছনে বিনোদবাবুর ক্রমঘন নিশ্বাস শুনতে হয়। প্রিয়নাথ আর অনাথ তাদের কাঁধের আরো ভারি বোঝা নিয়ে অনেকটা আগে চলে গেছে তাদের টেবিল আর শিকলের ব্যাগটা দুলতে-দুলতে এগিয়ে যাচ্ছে, যেন ঐ ভারের বোঝাতেই তাদের পায়ের গতিও বেড়েছে।

মাসটা ভাদ্রের শেষ। বর্ষার একেবারে মধ্যপর্ব। এই সকালে অবশ্য বৃষ্টি নেই, মেঘও নেই। ফলে রোদের তাপ বাড়ছে। এই সকালেও। সেটা এত জোরে-জোরে হাঁটার জন্য, নাকি, এত সকালের এই চাপা রোদের তীব্রতার জন্যও, তা বোঝার উপায় নেই।

এখন এই বৃষ্টিহীন, মেঘহীন সাতসকালে যেন কারো মনে হয়ে যেতে পরে বৃষ্টি এবারের মত শেষ। মাঠের ঘাস, খেতখামার, ফরেষ্ট আর চা বাগানের সব গাছগাছড়ার, ঝোঁপঝাড়ের, গাছপালার রং একেবারে মোটা কাঁঠাল পাতার মত কালচে সবুজ। ঝোঁপঝাড় আর খাটো-খাটো সব বুনো গাছগাছড়া বর্ষার জলে ফুলেফেঁপে এতটাই, যে আর খাড়া থাকতে পারে না, নিজের ভারে নিজেই নুয়ে পড়ে মাটির ওপর পাকার–যেন এগুলো সবই মাটির ভেতরের জল থেকে ফেনিয়ে ওঠা। কিন্তু এখন, এই সকালের রোদে সেই সব ঝোঁপঝাড়ের ওপর থেকেও যেন বাড়তি জল উপচে যাচ্ছে। সামনে একটা ফরেস্ট শুরু হয়েছে। একটু উঁচুতে। এই তলা থেকে ফরেস্টের, ওপরে জলকণার এই বাষ্পীভবনের ধোয়া দেখা যাচ্ছে ফরেস্টের ভেতর থেকে, মাথা থেকে ধিকিধিকি আগুনের ধোয়ার মত, যেন পাতলা মেঘ ভেসে যাচ্ছে কোনাকুনি ওদলাবাড়ির দিকে তার মানে বাতাস এখনো পূর্ব থেকেই বইছে। কী ফরেস্ট যেন…। একই নামে একটা চাবাগানও আছে। সার্কল ম্যাপটা অত সুহাস সঙ্গে রাখতে পারত। কী যেন ফরেস্টটা, এটা?

মালহাটি, জ্যোৎস্নাবাবু না তাকিয়ে উত্তর দেন।

মালহাটি, মালহাটি। মালহাটি ফরেস্ট আর মালহাটি টি এস্টেট।

ওরা একটা টিলার মত উঁচু ডাঙা, বরমতল, থেকে নীচে নামছিল। সামনে আবার চড়াই-এ উঠে বোধহয় কিছুটা সমতল জমি–তারপর ফরেস্ট। সেই নিচু জমিটাতে একজন একটা বলদের ঘাড়ে লাঙল লাগিয়ে হাল দিচ্ছে। লোকটাকে অনেকক্ষণ ধরে দেখতে হয়, সেই ডাঙার মাথা থেকে। উল্টোদিকের চড়াইয়ের মাঝামাঝি পর্যন্ত। সামনের চড়াই মাঝামাঝি পর্যন্ত উঠলেই ফরেস্টে নজর আটকে যায়। তখন প্রিয়নাথ আর অনাথ প্রায় ফরেস্ট ছোয়-ঘেঁয়। এখন এই একটু তলা থেকে দেখা যাচ্ছে ফরেস্টের গাছগুলোর মাথাতে রোদ ঝলমল করছে। গাছের পাতায় বা বাতাসে কোথাও ধূলিকণা নেই, এমনু-কি আকাশেও মেঘ নেই, ফলে রোদ যেন শান দিয়ে উঠছে। আর ফরেস্টের মাথাটা তাতে ঝিকিয়ে উঠছে। অনাথ আর প্রিয়নাথ ফরেস্টের ভেতর কিন্তু ঢুকল না, ফরেস্টটাকে বাঁ হাতে রেখে ডাইনে ঘোরে। ফরেস্টের যত কাছে যাওয়া যায়–গাছের মাথাগুলো তত অদৃশ্য হয়ে যায়। দৃষ্টি যেন ধীরে-ধীরে ফরেস্টের মাথা থেকে কাণ্ড বেয়ে নেমে আসতে থাকে। তারপরই ফরেস্টের লম্বা ছায়াটায় ঢুকে যেতে হয়।

সেই ছায়া দিয়ে এগিয়ে, ফরেস্টটাকে বা হাতিতে রেখে ডাইনে ঘুরে, ফরেস্টটার গা ঘেঁষে যেতে হয়। তখন ত আর রোদ নেই। কিন্তু বর্ষার জলে ফরেস্টের রোদহীন এই অংশে মোটা ঘাস প্রায় হাঁটু পর্যন্ত। পায়ে জল লাগে আর এরকম একটু চলতে-চলতেই ধীরে-ধীরে ঘামটা শুকিয়ে যায়। আরাম লাগে। নিশ্বাসটা স্বাভাবিক হয়ে আসে। কিন্তু তারপরই একটু আগের রোদ ঝলমল যেন-শরতের আকাশকে মনেও পড়ে না। মনে হয় যেন চার পাশেই বৃষ্টি পড়ছে–তারা ফরেস্টের গাছের পাশ দিয়ে-দিয়ে যাচ্ছে বলে গায়ে জলকণা লাগছে না। ডাইনে তাকালে, কালচে সবুজ ঘন ঘাসের প্রান্তর, আর বায়ে তাকালে, নিচ্ছিদ্র প্রায়ান্ধকার জঙ্গল–গাছের কাণ্ডগুলোও জঙ্গলের সবুজে ঢাকা, শ্যাওলায় বা লতায়।

ততক্ষণে শীত লাগতে শুরু করেছে, আর সেই শীতের মধ্যেও চামড়াটা কেমন তৈলাক্ত হয়ে ওঠে। ফরেস্টের ভেতর থেকে গরম বাষ্পের ভাপ বইছে। একদিকে শীত, আর-একদিকে সেই ভাপের গরমের ঘাম। বুকটা পিঠটা ভারী হয়ে ওঠে। নিশ্বাসও ভারী হতে থাকে।

মাটির ওপর ফুলে ফেঁপে ওঠা এই জলীয় জঙ্গল যেন মাটিরই গেজিয়ে ওঠা। জলে-জলে লতাপাতার মাটির তলার শেকড় এত বেশি ফাপা, সেগুলো যেন আর মাটি আঁকড়াতে পারে না। শাল-সেগুন-খয়ের-লাম্পাতি নিজেদের শরীরের ভারেই সেঁদিয়ে যাচ্ছে মাটির ভেতরে। এত বর্ষার এত জলে এই গাছগুলোর পাতাও মোটা ও ঘন হয়ে ছড়িয়ে গেছে–ডালপালার সেই ভারে শালগাছের দৈর্ঘ্যকেও আর দীর্ঘ মনে হয় না।

কয়েক মাসের বর্ষার অবিরল জলে সব কেমন ছোট হয়ে গুটিয়ে গেছে। দুই ধারের মোটা মুথা ঘাসের নীচে পায়ে চলার পথ চাপা পড়ে গেছে। ডাইনের পড়ো নিচু জমির ভেতর থেকে ঘাস আর জঙ্গল বেড়ে বেড়ে যেন ডাঙা হয়ে উঠেছে। ছোট টিলার ওপর ছোটখাট বুনো গাছের মাথা আকাশে ঋকিয়ে উঠেছে। সেই সব গাছের মাথায় এখন আকাশের পটভূমি। ফলে, আকাশও যেন নেমে এসেছে কেশ নীচে। অথচ এই একটু আগে আকাশকে কেমন নীল ও গোল দেখাচ্ছিল। একদিকে ঘাস-লতাপাতা-ঝোঁপঝাড়-গাছপালা আর বিরাট-বিরাট গাছের ঝাকড়া ঝাকড়া মাথা নিয়ে মাটির সংকীর্ণ হয়ে ফুলেফেঁপে ওঠা, আর, তার সঙ্গে ওপর থেকে আকাশের এমন নিচু হয়ে এই সবের পরিপ্রেক্ষিত, হওয়া–পৃথিবীটাকে যেন গুটিয়ে দেয়, যেন সব কিছুই পাকিয়ে ওঠা, আড়াল হয়ে যাওয়া। টিলার। ওপরে, দৃষ্টি আড়াল করা কোনো ঝাকড়া গাছের মাথায় আকাশের নীল। গাছটা এখন মাটির তলায় জল শুষে চছে, বাড়ছে। কিন্তু এর ভেতরেই কি বর্ষার পরের এই প্রক্রিয়াটা শুরু হয়ে গেছে? এর পর শরতের রোদে মাটি শুকিয়ে গেলে, মাটির তলার জল আরো-আরো নেমে গেলে, জলকণা সরিয়ে বাতাস খড়খড়ে হয়ে উঠলে, এই সব ঝোঁপঝাড় ধীরে ধীরে শুকিয়ে যেতে শুরু করবে। পায়ের তলার মাটি এখন আচমকা দেবে যায়। দিনে দিনে এই জল মাটির আরো নীচে চলে যাবে–তখন ধীরে ধীরে মাটি শক্ত হবে, শক্ত হতে-হতে কোথাও-কোথাও পাথরের মত হয়ে উঠবে। কোথাও-কোথাও। কারণ, ফরেস্টের ভেতরের মাটি পচা পাতায় সারা বছরই ত নরম। এখনো ফরেস্টের, যাকে বলে ঝোঁপঝাড়, প্রায় যেন স্থির, কিন্তু উচ্ছ্বসিত জলাশয়ের মত ঢেউয়ের পর ঢেউ তুলে, দূরে-দূরে মিশে গেছে বড় বড় গাছের ফাঁক দিয়ে দিয়ে। ওগুলোতে মানুষ ডুবে যাবে। ডুবে গেলে আর মুখ তুলতে পারবে না–আরো নীচে লতাপাতা এত জটিল আর মাথার আচ্ছাদন এত কঠিন।

এই সব মিলিয়ে এখন যেন চারপাশ থেকে একটা ঢাকনা তোলার মত ভাব। আকাশটা নীল আর রোদটা এত প্রচণ্ড হওয়াতেই এই খোলামেলা ভাবটা ছড়ায় বটে কিন্তু সেই ঢাকনাটা এখনো সরে নি। আকাশ-ভাঙা জল আর মাটির তলার জল–এই দুদিকেই এখন ত জমা জলের পচন। আকাশের জল শেষ হলে মাটির তলার জল টেনে নেবে গাছপালা। এই ভরা বর্ষাতে কি সেই প্রক্রিয়াও শুরু হয়ে গেছে? বাতাসও কেমন অনিশ্চিত–পূর্ব থেকে কখনো, কখনো বা উত্তর ঘেঁষাও মনে হয়। রোদও তেমনি অনিশ্চিতকখনো মনে হয় আরামের আর কখনো মনে হয় শরীরের সব রস শুকিয়ে যাবে। ছায়াও তেমনি, কখনো মনে হয় ঠাণ্ডা, কখনো মনে হয় হিম।

আকাশ বাতাসের এই দুরকমের ভাবটা সবচেয়ে বোঝা যায় ধানখেতে। নতুন চারার কাঁচা সবুজ যেন উঠে যাচ্ছে–সমস্ত ধানখেতের চেহারাই এখন রঙচটা ফ্যাকাশে সবজে। বাতাসে ত ধানখেত দোলেই–এত পাতলা পাতায় ও গোছায় ধানখেত ত প্রায় জলের মতই। কিন্তু সেই দোলায় একটা রঙেরই রৌদ্র ছায়াপাতের প্রবাহ খেলে না, যেন মনে হয় বিবর্ণ মড়া একটা খেত ছড়িয়ে পড়ে আছে। এখন ধীরে-ধীরে খেতের জল শুকোবে। তারপর মাটি শুকোবে। তারপর মাটি খটখটে হবে। আর, সামনের তিনমাসের এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে-সঙ্গে ধানগাছের গা থেকে এই সবুজের শেষ আভাটাও চলে যাবে। বাতাসে ধানগাছের হিল্লোলিত রং দেখেই বোঝা যায় মাটিতে ও বাতাসে তখনো কতটা রস লেগে আছে। এই রস যত শুকোবে ধানগাছের সবুজ তত ঝরবে। ঝরতেঝরতে শেষে আর-এক রঙের দিকে বদলে যাবে। তখন ধানগাছের শরীরের সব রস শুকিয়ে ধানের দুধ ঘন হবে। যত শুকোবে-ধানের দুধ তত জমবে। যত জমবে–ধানগাছ তত হলুদ হবে। যত হলুদ হবে-ধানের ভেতর চাল তত তৈরি হবে। তারপর বাতাস, মাটি ও শরীরের সব জল ঝরিয়ে সমস্ত ধানখেতটা, সোনারং হয়ে যাবে। সোনালি হলুদ। ধানখেতের মরণের রোগ। যত শুকোবে তত সোনালি। আর, ধান তত পাকবে। তারপর একসময় সেই রসহীন শুকনো পাতার তুলনায় চালভরা শিষ অনেক ভারী হয়ে উঠবে, ধানখেত নুয়ে যাবে, নেতিয়ে পড়বে, ধানগাছের মাথায় ধানের শিষ মাটিতে ফিরে যেতে চাইবে আর মাটিতে নোয়াতে পাতাগুলো খড়খড়িয়ে সোজা হয়ে উঠে বাতাসে দুলবে। তখন ধানখেত বাতাসে জলাশয়ের মত, হিল্লোলিত হয় না, মাঠময় ছড়িয়ে থাকে–দেখলে মনে হয় ধানখেত, নয়-পোয়ালের খেত।

সামনে ফরেস্টটা শেষ হয়ে যায়। ফরেস্টের ছায়ার ভেতর থেকে ওরা সামনে দেখে, ঘাস আর গাছ-গাছালির ওপর সেই পুরনো পরিষ্কার রোদ। যেন সেই রোদের আভাসেই এখানে ফরেস্টের ছায়াচ্ছন্নতাও কেটে যাচ্ছে। ফরেস্টটা পেরিয়ে ওরা বা দিকে ঘোরে-ধানখেত।

ধানখেতের ভেতর দিয়ে সেই রোদে যেতে-যেতে আবার বর্ষাটাকে অতীত মনে হয়, যেন শরৎ শুরু হয়ে গেছে। ডাইনে একটা গা। বাঁশের বেড়ারলাইন আর গায়ে গা লাগানো বাড়িগুলোর পেছন দিক দিয়ে বানানো প্রাকারেই বোঝা যায় মুসলমান পাড়া। গোচিমারি। পাশ দিয়ে ওরা আরো কোনাকুনি এগয়। একটু পরেই তিস্তার ঠাণ্ডা বাতাস। বাতাসটা তিস্তার ওপর দিয়ে আসছে বাতাসের ঠাণ্ডাটা এমনই তাজা আর টাটকা, যদিও ভেজা। ফরেস্টের ভেতরের বাতাস যে বাইরে আসছিল, সেটাও ভেজা ছিল কিন্তু ফরেস্টের পাশ দিয়ে আসার সময় তার জলীয় তৈলাক্ত ভেজা ছায়াতেও ঘামিয়ে দিয়েছিল, ধানখেতের রোদেও সেটা যেন পুরো শুকোয় নি, অদৃশ্য তিস্তার এক ঝলকেই সেটা মুছে যায়। ওরা আর-একটা সরু পাকা রাস্তায় ওঠে। দলটা ডান দিকে ঘোরে। বিনোদবাবু পেছন থেকে বলেন, এইটা চ্যাংমারি হাটের রাস্তা, পেছনে।

চ্যাংমারিটাও সুহাসের হলকায় পড়বে। সুহাস যা কাজের পরিকল্পনা করেছে তাতে একেবারে শেষে ঐ অঞ্চল ধরতে হবে। এখন যে-লাইনটা শুরু করবে, এর পরে তার তলায় পুব-পশ্চিমে আর-একটা লাইন হবে চ্যাংমারিতে। তখন চ্যাংমারি থেকে আদাবাড়ি, চক মৌলানি, দক্ষিণ চক মৌলানি, দক্ষিণ মাটিয়ালি, ঝাড় মাটিয়ালি, লাটাগুড়ি আর উত্তর মাটিয়ালী–এই মৌজা দিয়ে কাজ শেষ হবে। এগুলো গত সেটেলমেন্টের পর মাল সার্কেলে এসেছে, তার আগে ছিল মাটিয়ালি সার্কেলে। সুহাস একটু দাঁড়ায়। বিনোদবাবু তার পাশ দিয়ে এগিয়ে যান। দলের দিকে পেছন ফিরে সুহাস এই রাস্তাটি দিয়ে চ্যাংমারি হাটের দিকে তাকায়। তারপর আবার ঘুরে দলের পেছন-পেছন চলে। একটু যেতেই সামনে দেখা যায় ফরেস্ট আর তিস্তা–ফরেস্টটা হঠাৎ এক জায়গায় শেষ হয়ে গেছে, সেখান থেকে একটা ঘসহীন কাদাহীন ভেজা বালির প্রান্তরের মত নদী। বাতাসে জলের গর্জন। আর একটু এগলে তিস্তার, স্রোত আর ফেনা দেখা যায়। তখন মনে হয়, তিস্তা ফরেস্টটাকে খাচ্ছে-ফরেস্টের পাড়ে এত ভাঙা জমি আর উপড়নো গাছ।

.

০২০.

 তিস্তার পাড়ে জমি জরিপের আয়োজন

সুহাসদের আসতে দেখেই পুরো ভিড়টা দাঁড়িয়ে ওঠে।

এর ভেতর প্রিয়নাথ আর অনাথ পৌঁছে গিয়েছিল। তারা সার্ভে টেবিলটা একটা শালগাছের তলায় পেতে ফেলেছে। তার থেকে একটু তফাতে একটা চেয়ার দেখা যাচ্ছে, খালি, সে-ও গাছতলায়। সেই চেয়ার আর টেবিলের চার পাশেই নানা রকম মানুষের জটলা। একটু দূরে আর-একটা গাছতলায় গাছে-গাছে এক পলিথিনের চাদর বেঁধে চায়ের দোকান, এদিককার সব হাটেই যে-ছেলেটি চায়ের দোকান দেয়, তার।

জায়গাটিতে এই পার্টি একটা ধাপ ভেঙে উঠল। তার আগে বিনোদবাবু আর জ্যোৎস্নাবাবু ওদের বোঝাটা মাটির ওপর নামিয়ে দিয়েছেন, সার্ভে টেবিলটার কাছে। ওপরে উঠে, জ্যোৎস্নাবাবু আর বোঝায় হাত দিলেন না, নিজের ঝোলানো ব্যাগটা নিয়ে ভিড়ের ঐ দিকেই চলে গেলেন, চায়ের দোকানটা যে-দিকে। হাফশার্ট গায়ে, ধুতি পরা, ক্যাষিশের পাম্পসু পায়ে গয়ানাথ এগিয়ে এসে নমস্কার করল, আসেন স্যার, আসেন। তারপর সেই চেয়ারটা দেখিয়ে বলল, বসেন স্যার। বসতে একটু ইচ্ছে করছিল সুহাসের। উনি বলা মাত্র ঐ খালি চেয়ারটায় গিয়ে বসলে মনে হবে, সুহাস এখানে অতিথি, বেশিক্ষণ থাকবে না, এই ভদ্রলোকই গৃহকর্তা। কিন্তু সার্ভে পার্টিটা ত সুহাসেরই। তার ওপর দ্বিতীয় আর-একটি চেয়ার নেই। বসার প্রয়োজন হলেও, একটু সময় নেয়া ভাল।

বিনোদবাবুর হাত প্রায় যন্ত্রের মত নিশ্চিত ও ব্যস্ততাহীন। তিনি সুহাসের কাছে কিছু জিজ্ঞাসাও করলেন না। লাল সালুর বস্তা খুলে মৌজা ম্যাপটা সুহাসকে দিলেন। তারপর এখানকার খানাপুরী টেকনিক্যাল ম্যানুয়াল খুলে, তার ভেতর এই সেটেলমেন্টের খশড়া ফর্মটা ঢুকিয়ে নিলেন। মৌজার এক নম্বর দাগ থেকে টুকে যাবেন। আর এই জায়গাটাতে ম্যাপিং-এর একটা ঝামেলা আছে। সেই জন্যই কেজি ওয়ান এখান থেকেই কাজ শুরু করছেন। খাতা আর কম্পাস হাতে বিনোদবাবু দাঁড়িয়ে অনাথ আর প্রিয়নাথকে খুঁজলেন। অনাথকে দেখেই বললেন, প্রিয়নাথকে ডাকো, তাড়াতাড়ি শিকল ধরো, এখন রোদ আছে, যতটা পার সেরে রাখো, ঐ, নদীর পাড় বরাবর চেন ফেলল। বিনোদবাবু সুহাসের কাছে এসে বললেন, আপনি ত ম্যাপটা দেখেছেন। এখানেই ফ্লাডের জন্য একটা নতুন ম্যাপিং করতে হবে। আমি চেইন ফেলছি।

বিনোদবাবু নদীর দিকে পা ফেললে অনাথ এসে বলল, প্রিয়নাথকে ত দেখছি না। বিনোদবাবু তার কথার কোনো উত্তর না দিয়ে বললেন, তাকে কি এর মধ্যেই বাঘে খেল? তাড়াতাড়ি চেইন ধরতে বলল। বৃষ্টি হলে ত তোমাকে-আমাকে আবার একদিন এখানকার কাজের জন্যেই আসতে হবে। দিন বেশি লাগালে তোমার-আমার কোনো লাভ নেই, অফিসার না হয় অ্যালাউন্স পাবে।

বিনোদবাবু জানেন প্রিয়নাথ ঐ ভিড়ের মধ্যে মলে ধরতে গেছে। বস্তি বা বড় জোতের কাজে বেশ সময় লাগে, অংশের মামলা থাকে, মক্কেলই প্রিয়নাথকে খুঁজে বের করবে। এখানে তিস্তা নদীর ভাঙন আর শাল গাছের ফরেস্টের মাপামাপি দেখতে ত এসেছে দুনিয়ার বনুয়ার দল–সে রাজবংশীই হোক, আর মদেশিয়াই হোক, আর নেপালিই হোক। সারা তল্লাটে যাদের এক চিলতে জমির কাজ জোটে নি, আর, এমন-কি ফরেস্টের জমি বেআইনি চাষ করতেও যাদের আসতে হয়েছে এই গাজোলডোবা-সিদাবাড়ির তিস্তার গড় পর্যন্ত, তাদের ভেতর আর মক্কেল পাবে কোথায়? এক গয়ানাথ জোতদার। কিন্তু সে তআর ভিড়ের মধ্যে মিশে থাকা খুচরো মক্কেল নয়। মৌজ-মৌজা জমিতে তার কারবার। কাজকর্ম ঠিকমত শেষ হলে সবাইকে থোক কিছু দেবে হয়ত। এখানকার কাজ তাড়াতাড়ি শেষ করে দিতে পারলেই লাভ। প্রিয়নাথ এর ভেতর কোনো দেউনিয়ার কোনো মামলা আছে কি না, সেটাই ঠাহর করতে গেছে। নদীর কাছাকাছি থেকে পেছন ফিরে বিনোদবাবু কেন, প্রিয়-না-থ। তার আওয়াজটা তিস্তার হওয়ার আওয়াজে ঢাকা পড়ে যায় বটে, কিন্তু তাতেও সুহাস পর্যন্ত একটু চমকে যায়, বিনোদবাবুর গলার এতটা জোর দেখে। মৌজা ম্যাপটা খুলে সুহাস চেয়ারটার দিকে এগয়।

স্যার, একটা কথা ছিল স্যার, কথা না হয়, অনুরোধ, অনুরোধ ছিল স্যার–সেই ভদ্রলোক

 এই স্যার, জরিপ মানে সার্ভে ত আপনার স্যার রোজই হওয়া লাগিবে। অনেক টাইম ত লাগিবেই স্যার কিন্তু এই রোজ-বোজ কি এই টেবিল আর খাতাপত্র স্যার আপনাদের পক্ষে, আপনার না স্যার, কিন্তু উনাদের পক্ষেও টানাটুনি করা উচিত স্যার?

সে আর কী করা যাবে, সার্ভে করতে হলে ত এ-সব লাগেই, ম্যাপটার দিকে তাকিয়ে-তাকিয়ে সুহাস চেয়ারটার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়।

সেটা বিষয়েই আমার স্যার একটা অনুরোধ রাখার ছিল। সেটা আমাদের ত এইটা কাজ এটা ত আপনাকে মানিতেই লাগে স্যার, সুহাস যখন চেয়ারটায় বসতে যাচ্ছে গয়ানাথ বাধা দিয়ে বলল, বসিবেন না স্যার, কনে থামেন।

সুহাস ম্যাপটা বেশ মন দিয়ে যাচাই করছিল। এর পর এই ম্যাপের ওপরই নতুন ম্যাপের লাইন কোথা দিয়ে টানা হবে সেটা বের করার আগে আউটলাইনটা দেখে নিচ্ছিল। খুব সুবিধে হত, যদি ঠিক এই সেকশনটার একটা এনলার্জড আউটলাইন আঁকা থাকত। লোকটার কথায় সে একটু চমকে চোখ তুলতেই চিৎকার উঠল, হে-ই বাঘারু। যে-ভিড়টা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল, তার ভতর থেকে একজন এসে দাঁড়ায়। সুহাসের দুই হাতে ম্যাপ মেলাহীল কাগজের ওপর শাদা রেখার। আর এই লোকটিই যেন আর-একটা ম্যাপ রিলিফে আঁকা, এমন নিষ্প্রাণ বস্তুর মত সামনে এসে দাঁড়ায়। তার মাথা থেকে পা শাল-সেগুনের দীর্ঘ কাণ্ডের মত অনিয়মিত, বর্ণশূন্য ও রুক্ষ। চোখদুটো কোন গভীরে-মণি দেখা যায় না। নাকটা থ্যাবড়া। পরনে একটি নেংটি–তার রংও গায়ের রংয়ের সঙ্গে মিশে আছে। গয়ানাথ এত জোরে চিৎকার করে উঠেছিল, যেন ফরেস্টের ভেতর থেকে বনমোরগের ডাক। আর এই লোকটি এল দাঁড়িয়ে পড়ার পর, দাঁড়িয়ে থাকার পর, বোঝা যায় তাকেই ডাকা হয়েছে।

চেয়ারখান মুছি দে।

সুহাসকে আবার সেই হাফশার্ট-পরা লোকটার দিকে তাকাতে হয়।

 ঠিক আছে, বলে সুহাস চেয়ারটায় বসে পড়ে-চেয়ারটা তা হলে এই লোকটিই আনিয়ে রেখেছে–আর দুই হাঁটুর ওপর ম্যাপটা মেলে ধরে। তখন সুহাস টের পায়, সে বসে পড়া সত্ত্বেও ঐ রিলিফ মত লোকটি চেয়ারের মাথা, পেছন দিকটা, পায়াগুলো হাত দিয়ে দিয়ে মুছে যাচ্ছে। শুকনো কাঠের সঙ্গে তার শুকনো হাতের ঘর্ষণে খসখস আওয়াজ উঠছে।

তাই স্যার এই টেবিল শিকল এসকল স্যার আমার লোকজন নিয়ে ঠিক জায়গায় গোছ করি রাখি। দিবে। আর রোজ-রোজ আনি দিবে। আর এই খাতাগুলা আনার জন্য একটা মানষিক সকালে আপনার ক্যাম্পত পাঠাম।

সুহাস আর মুখ তুলে তাকায় না। সে একটা পেন্সিল দিয়ে তিস্তার পাড়টার যে-অংশটুকু আজকের ব্যাপার, তাকে চিহ্নিত করে।

স্যার, এই স্থানে আমাদের একোটা সুনাম-খ্যাতি আছে, কিম-অফিসার-নেতাগণকে আমরা সেবা করিয়া থাকি। স্যালায় আপোনাকে এই নিবেদন।

 গয়ানাথ থামার পরে সুহাস বোঝে সে থেমেছে, সুহাস চোখ তোলে না।কিন্তু চোখ না তুলে বুঝতে পারে না লোকটি আছে না চলে গেছে।

একটু পরেই সুহাস বুঝতে পারে যে লোকটি যায় নি। সে একবার সোজা: তাকিয়ে দেখে নেয়–দূরের লোজন আর তার মধ্যে এই লোকটিই একমাত্র দাঁড়িয়ে। সুহাসের একবার ইচ্ছে হয়, লোকটিকে চলে যেতে বলে। কিন্তু বলতে গিয়েও থেমে যায়। সুহাস যেন একটু রেগে থাকতে চাইছে–এটা বুঝে সুহাসের নিজেরই ভাল লাগে না। লোকটি ত এখন পর্যন্ত আপত্তিকর কিছু বলে নি, সে মিছিমিছি বিরক্ত হচ্ছে কেন? সুহাস আবার ম্যাপের ওপর ঝোঁকে।

স্যার–লোকটির গলা। কিছুক্ষণ কেটে যায়। লোকটি আবার ডাকে, স্যার।

সুহাস ঘাড় না তুলে বলে, বলুন না, বলে যান, শুনতে পাচ্ছি।

হ্যাঁ স্যার, আমাদের উচিত নয় আপনাকে বাধা দেয়া।

সুহাস ঝোলানো ঘাড়টাই দোলায়। কিন্তু থামে না, দুলিয়েই যায়। লোকটি আর-কোনো কথা বলছে না দেখে সুহাস মাথাটা দুলিয়েই যায়। আর ম্যাপটার দিকে তাকিয়ে-তাকিয়ে সে ম্যাপটাকে এতটাই আত্মসাৎ করতে চায় যেন এর পর সে ম্যাপ না দেখে জমি চিনে নিতে পারে।

আপনার সুবিধার জন্যে স্যার, এইটুকু সুযোগ আমাদের দিবা নাগিবেই

একটু নীরবতার পর লোকটির গলা যেন অভিমানী হয়ে ওঠে, ই ত স্যার, আমাদের অঞ্চলের অপমান।

সুহাস মনে-মনে কৌতুক বোধ করে–হাকিম এমনই জিনিশ যার সঙ্গে মাতৃভাষায় কথা পর্যন্ত বলা চলে না। সুহাস চোখ তুলে তাকিয়ে দেখে, নদীর পাড়ে অনাথবাবু শেকলের একদিক ধরে দাঁড়িয়ে আছে, আর-একদিক নিশ্চয়ই তিস্তার পাড় ধরে বনের মধ্যে গেছে। বিনোদবাবু বোধহয় ঐ দিকেই।

সে চেয়ার থেকে ওঠে। ঐ লোকটি এখনো বসে বসে চেয়ারের পায়া মুছে যাচ্ছে। সুহাস নদীর পাড়ের দিকে যায়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *