১.১ আদিপর্ব – গয়ানাথের জোতজমি

আদিপর্ব – গয়ানাথের জোতজমি

০০১.

হাটের পথে

একই হাটে একসঙ্গে দুটো সাইনবোর্ড যাচ্ছে–এ বড় একটা দেখা যায় না।

একটা বেশ লম্বা-চওড়া, বড়, নতুন। হলুদের ওপর কাল, সরকারি সাইনবোর্ড যেমন হয়, শিলমোহর আঁকা, কৃত্রিম গো-প্রজনন কেন্দ্র। আরো কী সব। টানতে লোকটির বেশ কষ্ট, একবার ঝুলিয়ে নেয়–কিন্তু তাতে রাস্তায় ঠুকে যায়। বগলেও নেয় দু-একবার–তাতে কাত হয়ে বেড় পাওয়া যায় না। অবশেষে মাথায়। সেটাই সবচেয়ে সুবিধের। এক হাতে মাথার ওপর সাইনবোর্ডটা ধরা, আর-এক হাতে নাইলনের জুতোজাড়াটা ঝোলানো«পেছনের ঝোরা পেরতে খুলতে হয়েছিল, সামনে আছে পায়ে ও ফেরিতে পার-হওয়ার আরো নদী, বার তিন-চার। নাইলনের, পান্টটাও হাটুর তলা পর্যন্ত গোটানো, বেশ ভাজ করে করে, যেন নদীগুলোর জলের মাপের একটা আন্দাজ আছে।

আর একটা সাইনবোর্ড, ছোট। কালর ওপর শাদা–কিন্তু মনে হয় বহুকালের। শিলমোহর আঁকা। বেশ বড় বড় হরফে, হলকা ক্যাম্প। থলির সঙ্গে বেঁধে পিঠে ঝুলিয়ে বিড়ি খেতে-খেতেই যাওয়া যাচ্ছে। বিড়ি না খেলে আর-এক হাতে করবেটা কী? ধুতিটা হাঁটুরও ওপরে-নদী-নালা-কাদাবালি পেরিয়ে যাওয়ার মত। পায়ের নতুন নীল ব্যান্ডের হাওয়াই স্যান্ডেলটার সোল আছে শুধু আঙুলের সঙ্গে খানিকটা। এতটা ক্ষইয়ে দিতে বেশ কয়েক বার নতুন ব্যান্ড পরাতে হয়েছে। পায়ের সঙ্গে এমন ভাবে মিশে গেছে যে, খুলে হাতে ঝুলিয়ে নিতে গেলে খসে টুকরো-টুকরো হয়ে যাবে। পা থেকে খসাতে গেলে, পায়ের পাতাও যেন কিছুটা খসে আসবে। এটা খুললে চলার এই শব্দটা থেমে যাবে। তা হলে আর চলাই যাবে না।

‘কৃত্রিম গো-প্রজনন কেন্দ্র’ এখন তার জুতোজোড়াটাও সাইনবোর্ডটার ওপর ফেলে, দুই হাতে সাইনবোর্ডের দুটো দিক ধরে, বেশ দুলে-দুলে তাড়াতাড়িই ছুটছে–এতক্ষণে যেন সে তার চলার একটা গতি বের করতে পেরেছে। অত বড় সাইনবোর্ডের টিনে ডডং-উং ডডং-ডং আওয়াজ উঠছে। ওপরে জুতো জোড়াটাও লাফাচ্ছে। তার চলার ছন্দটা বেশ, টিন পেটাইয়ের আওয়াজে সব দিকে ছড়িয়ে যাচ্ছে। চার পাশ এত নির্জন, আওয়াজ বড় হলে কেমন ছড়িয়ে মিশে যায় বেশ।

চারপাশ নির্জন, শুধু এই রাস্তাটুকু দিয়ে লাইন বেঁধে লোক চলছে। আজ ক্রান্তির হাট। হাইওয়েতে বাস থেকে নেমে কেউ-কেউ রিক্সাও নেয়। তারপর রিক্সাঅলার সঙ্গেই ছোট-ছোট নালা ঠেলেঠুলে রিক্সা পার করে। ফেরিতে রিক্সাঅলাই নৌকোতে মাল তুলে দেয়। ওপারেও রিক্সা আছে আজকাল। বড়বড় মালপত্র যাদের, তাদের ত রিক্সা লাগেই। কাটাকাপড়, গেঞ্জি, লুঙি, শার্টপ্যান্টের দোকানিরা সাইকেলের সামনে ঝুলিয়ে, পেছনে বেঁধে, কাজ সেরে নেয়। কিন্তু আলুর বা এলুমিনিয়ামের বড় দোকানির ত রিক্সা না হলে খরচা বেশি পড়ে যায়–এক রিক্সার মাল কয়েক জনের মাথায়-মাথায় নিয়ে যেতে।

কিন্তু বেশির ভাগই হেঁটে চলে–মাথায় বা বাকে বোঝা ঝুলিয়ে। বাসে হাইওয়েতে নেমে, বাসের মাথা থেকে বোঝা নামিয়ে, রিক্সায়-রিক্সায় কয়েক মাইল দূরের হাটে যাওয়ার সুবিধে। কিন্তু যারা দক্ষিণে, চকমৌলানি থেকে বা উত্তরে সেই হায়হায়পাথার থেকে টাড়ি বাড়ি-জঙ্গলের ভিতর দিয়ে, নদী-নালা, পেরিয়ে-পেরিয়ে, বাকে বা মাথায় বোঝা নিয়ে, বা গরু-ছাগল তাড়িয়ে-তাড়িয়ে রাস্তা ছোট করতে করতে আসে, তাদের আর এই পাকা রাস্তাটুকুতে রিক্সার দরকারটা কী। চিলতে রাস্তাটুকুতে যেন নদীর বেগ এসে যায়, একটু তলার দিকের পাহাড়ী নদীর বেগ, হঠাৎ ঘণ্টাখানেকের জন্য একটা বান বয়ে যাচ্ছে যেন। রিক্সাও বেশ ছুটে চলে, হটনও দেয়। পায়ের তলায় পাকা রাস্তা পেয়ে বোঝা-মাথায় বা বাককাঁধে মানুষের পায়েও বেগ এসে যায়। কেউ কারো দিকে তাকায়ও না, কথাও বলে না। তাড়াতাড়ি হাটার বা মাল বইবার ফলে মানুষজনের দ্রুত নিশ্বাসের আওয়াজ শোনা যায়। চার পাশ এত নির্জন যে মানুষের শ্বাস নেয়া-ছাড়ার মত প্রায় নিঃশব্দ আওয়াজও মিশে যেতে পারে না, আলাদা হয়ে থাকে।

কিন্তু হাটে যাবার এখন শেষবেলা বলেই হোক বা এই রাস্তাটুকু পাকা বলেই হোক ভিড়টা ছুটতে থাকলেও কেমন জমাট থাকে। এতগুলো মানুষ একসঙ্গে একই দিকে যাচ্ছে–এতেই ত তাদের ভেতর বেশ একটা মিল পাওয়া যায়। তদুপরি, একজনের মাথায় বড় বড় অক্ষরে লেখা সাইনবোর্ড আর আর-একজনের পিঠে বহু পুরনো এক ছোট সাইনবোর্ড যেন এই ভিড়টাকে আরো বেশি এক করে দিতে চায়–নিশান আর ফেস্টুনই যেমন মিছিল বানায়।

এখন, এই রাস্তার যে-ভিড়টুকু এদের দুই সাইনবোর্ডে বাধা পড়েছে, তার ভেতর দিয়ে হর্ন আর বেল বাজাতে বাজাতে রিক্সা আর সাইকেল একে বেঁকে বেরিয়ে যায় বটে কিন্তু তার পরেই ভিড়টুকু আবার জমাট। একজন একটিমাত্র ছোট খাশি নতুন দড়ি দিয়ে বেঁধে টানতে-টানতে নিয়ে যাচ্ছে। খাশিটার বোধ হয় আগেই কিছু অভিজ্ঞতা আছে বা ভয় পেয়েছে–এক পা-ও ফেলে না। লোকটিও বেশ নিশ্চিন্ত মনেই তাকে টানে। যেন জানে এভাবেই যথাসময়ে সে হাটে পৌঁছে যাবে। খাশিটা মাঝেমধ্যে রাস্তার ভেতর বসে যাচ্ছে। লোকটা দাঁড়িয়ে পড়ছে। খাশিটাকে টানছেও না, সাধছেও না। খাশির, পেছনেই, এদিককার ছোট বড় সব হাটেরই সেই চা-ওয়ালা ছেলেটি, তার কাঠের বাক্স মাথায়, ওরই ভেতর উনুনকয়লা চাবানানোর অন্য সব সরঞ্জাম। খাশিটা বসে গেলেই সে খাশির ঠিক পেছনে ছোট করে লাথি মারছিল আর খাশিটা কয়েক পা দৌড়য়। ছেলেটি কখন হাত বাড়িয়ে একটা কঞ্চি টেনে নিয়েছে। এখন আর লাথি মারতে হয় না, লম্বা কঞ্চিটা দিয়ে যথাস্থানে খোঁচা দিলেই খাশিটা একটু ছোটে। তিনটে ছোট-ছোট মুরগি উল্টো করে ঝুলিয়ে নিয়ে যাচ্ছে লুঙিপরা একজন। মাঝখানে একটি বাচ্চা ছেলের মাথায় বেশ বড় সাইজের কুমড়ো। খুব ছোট টাইট হাফপ্যান্ট, পাতলা নেটের গেঞ্জি, মোজা-কেডস পরে একজন খালি হাতেই চলেছে। যতবার নদী-নালা পার হচ্ছে–ততবার জুতো-মোজা খুলছে আর পার হয়ে, পরছে। এদিকের ন্যাওড়া নদীর পুবের, বাগানের মজুররা ক্রান্তিহাটে খুব একটা যায় না। ক্রান্তিহাটের পশ্চিমে ত প্রায় শুধুই চা বাগান–হাটে তাদের একটা ভিড় হয়। এ হয়ত কোথাও গিয়েছিল, ফিরছে। বা হাটে কারো সঙ্গে দেখা হওয়ার কথা আছে। তেল কুচকুচে কোকড়ানো চুল। পাতলা নাইলনের গেঞ্জির ভেতর থেকে শরীরের রং চিকচিকচ্ছে। তার বেশ ক্যাপ্টেনি মেজাজ—চলনে। এক ঝাক হাঁস খাঁচায়। একটা বাকের এক দিকে একটা লাউ আর-একদিকে একটা বড় বস্তা ছোট করে বাধা। এক জনের মাথায় সের দশেক পাট। ছিটের হাফশার্ট, চেক লুঙি, রবারের পাম্পসু, কাঁধে গামছা, ঘাড়ে-গর্দানে পিঠে-কোমরে বেশ পেটানো মাংস। জোতদার ত বটেই, বেচাকেনার ব্যাপারিও বোধহয়। হয়ত,লোক দিয়ে গরুর গাড়ি ভর্তি করে বেচার মাল পাঠিয়ে দিয়েছে আগেই। নয়ত, কিছু বেচার নেই, কিনতে যাচ্ছে। বা, হয়ত হাট বলেই যাচ্ছে, দর-ভাও জানতে, তেমন কোনো কাজ নেই। ফোতা-পরনে একখানা বেটি-ঘোওয়ার মাথায় কলার ডোঙা ভাজ করে বানানো পাত্রে মাছ, সারাদিন ডোবায় ধরে এখন বেচতে যাচ্ছে। মাঝারি সাইজের এড়ে বাছুর অনেকক্ষণ ধরে আসছে–গলায় নতুন দড়ি। তার মানেই হাট। কিন্তু গোহাটা ত বসে সকাল থেকেই। যারা বেচে আর যারা কেনে তারা সারাদিন ধরেই প্রায় ঘুরে-ফিরে দেখে আর দাম করে আর নজর রাখে, কেউ যেন তার পছন্দটা কিনে না ফেলে। শেষ হাটে আসে চোরাই গরু। দামও পড়ে শস্তা। হাট পর্যন্ত যেতে হয় না অনেক সময়ই। রাস্তা থেকেই বেচা-বিক্রি হয়ে যায়। ক্রান্তির হাটটা অবিশ্যি, সেদিক থেকে চোরাই গরু বিক্রির খুব ভাল জায়গা হতে পারত। পুবে হাইওয়ে থেকে দশ মাইল ভেতরে, মাঝখানে। এক খেয়া, চার খাল। পশ্চিমে বিশাল আপলাদ ফরেস্ট আর চা বাগান আর পাহাড়ি চড়াই সেই বাগরাকোট কয়লাখনি আর শেভক ব্রিজ পর্যন্ত–কোনো বর্ডার পার করে ময়নাগুড়ি দিয়ে এনে এই রাস্তায় ঢুকিয়ে দিলেই হত। কিন্তু তার পর? এই চার খাল–এক খেয়া পার হবে কী করে? গরু বেচিতে রাখোয়াল ফক্কা। তাই বর্ডারের চোরাই মাল আর আসে না। এদিক-ওদিক থেকে দুটো-একটা চোরাই গরু ফরেস্টের ভেতর বেঁধেটেধে রেখে সময়-সুযোগ মত হাটের রাস্তায় এনে বেচে দেয়।

এখন এই রাস্তা জুড়ে সেই শেষ হাটার যাত্রীরা চলেছে–

পয়লা হাটাত দোকানিয়া বেচে
মাঝা হাটাত দেউনিয়া বেচে
শেষো হাটাত ঘরুয়া বেচে।

হাটের প্রথমে ব্যবসায়ীদের বড় বড় কেনাবেচা শেষ হয়ে যায়। তখনই হাটের সারা দিনের দরদাম ঠিক হয়, পাট-তামাক এই সব কত করে যাবে। আজকাল ধান-চালের ত আর বড় কেনাবেচা হয় না–তার দামও আর এই সব হাটের ওপর ওঠানামা করে না। বড় বড় কেনাবেচা হয়ে গেলে গরুর গাড়িতে, আজকাল ত তেমন-তেমন সময় ট্রাকও আসে, মাল সারাদিন ধরে যেতে থাকে।

হাটের মাঝবেলায় আসে জোতদার-দেউনিয়া। সংসারের জিনিশও কেনে, চাষ-আবাদের জিনিশও কেনে। আবার বেচেও দেয় সংসার আর চাষ-আবাদের নানা জিনিশ। আর একেবারে শেষ হাটে আসে ঘর-গেরস্থালির মানুষ জিনিশ বেচতে–একটা কুমড়ো, একটা হাঁস, চারটি ডিম, একটা খাশি–এই সব।

এখন এই রাস্তাটুকু দিয়ে সেই শেষ হাট চলছে। চলতে গেলেই লাইন বাধা হয়ে যায়। আর লাইন বাধা হয়ে যায় বলেই আকাশের দিকে ফেরানো কৃত্রিম গো-প্রজনন কেন্দ্র’, আর পিঠে-ঝোলানো হলকা ক্যাম্প যেন এই পুরো লাইনটিরই পরিচয় হয়ে উঠতে চায়। যেন, এই পুরো লাইনটাই গিয়ে ঢুকবে গো-প্রজননের কৃত্রিম ব্যবস্থায় বা, সেটলমেন্টের হলকা ক্যাম্পে।

.

০০২.

 ন্যাওড়া নদীর খেয়া

গাছগাছালি, বনবাদাড়ের ভেতর দিয়ে দিয়ে এই পাকা রাস্তাটা শেষ হয়ে যায় নদীর পাড়ে। ন্যাড়া নদী। খেয়াটা ছাড়ছে। খেয়ায় উঠতে মাঝখানে আর-একটা হাঁটুজল পেরতে হবে। সবাই সাইনবোর্ড টাঙানো লাইন ভেঙে, গড় গড় করে গড়ান বেয়ে নেমে, হে-ই’ হে-ই করতে করতে শেয়ার দিকে ছু চলে। খাশিটাকে মুহূর্তে লোকটা কাঁধে তুলে নেয় আর কাঁধে উঠেই খাশিটা লেজ তুলে নাদি-কোতে থাকে, যেন অপেক্ষাতেই ছিল। লোকটাও যেন জানতই। কাঁধের ওপর এমন ভাবে খাশির চার পা গুটনো যে নাদিগুলো সবই বাইরে পড়ে, লোকটির গায়ে লাগে না। লোকটির গায়ে নাদি ফেলতে না পেরেই খাশিটা তারস্বরে চিৎকার তুলে শরীর ঝাঁকানোর ষ্টো করে যাতে কাধ থেকে ছিটকে যেতে পারে। কিন্তু লোকটি কাঁধের ওপর দুই হাতে খাশিটির চার পা আঁকড়ে লাফিয়ে গিয়ে খেয়ায় ওঠে। সাইনবোর্ড দুটো নিয়ে লোকদুটিও এমন ছোটে যে মুহূর্তে মনে হয়, তারা বুঝি এই সাইনবোর্ড-দুটিই বেচতে যাচ্ছে হাটে, যেন এখন এই সাইনবোর্ড-বেচার সিজন।

 কিন্তু বড় সাইনবোর্ডটা নৌকার ওপর খাড়া দাঁড় করানো হলে, আর ছোট সাইনবোর্ডটা পিঠেই ঝুলিয়ে লোকটি দাঁড়ালে মনে হয় সত্যিই পুরো নৌকোটা কৃত্রিম প্রজনন কেন্দ্র’ ও হলকা ক্যাম্প।

লোকটা ত ঘাট থেকে নৌকো আগেই ছেড়ে দিয়েছিল। এদের চিৎকারে লগিটা আর ঠেলে নি। এরা পাড়ের জলকাদা ডিঙিয়ে এসে কোনোরকমে নৌকোয় উঠেছে। নৌকোর পাটাতন ভেজাই ছিল। এরা আরো একটু ভেজায়। সবাই উঠতেও পারে নি। কিন্তু তোক বেশি হয়ে যাচ্ছে দেখে মাঝি লগি ঠেলে নৌকোটা সরিয়ে নিয়েছে। লগির আর দু-এক ঠেলাতেই ত ওপারে পৌঁছে যাওয়া যাবে–এতই ছোট নদী। হয়ত হেঁটেও পার হওয়া যায় কোথাও-কোথাও। কিন্তু সব জায়গায় ত সব সময় এক জল থাকে না। আবার ওপর থেকে ছোটখাট বানও এসে থাকতে পারে। সেই কারণেই নৌকোয় পার হওয়া।

নৌকোয় সবাইই দাঁড়িয়ে। তার মধ্যেই এদিককার সবচেয়ে বড় জোতদার নাউছার আলম। ওয়াকফ এস্টেটের মালিক। হাজার-হাজার বিঘার চুকানদার। ডুয়ার্স যখন প্রথম বন্দোবস্ত দেয়া হয় তখন থেকে নাউছার আলমরা এখানকার সব জমির মালিক। খাশ জমির আইন পাশ হওয়ার পর গত পঁচিশ-ত্রিশ বৎসর ধরে নাউছার আলমের সঙ্গে সরকারের মামলা লেগেই আছে। সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত অনেকগুলি কেস গিয়েছে, তার অনেকগুলোতে আলম জিতেছে, সরকার হেরেছে। তা ছাড়া অসংখ্য জমিতে ইনজাংশন হয়ে আছে দশবার-পনের-বিশ বছর। ইনজাংশনের নিষ্পত্তি না-হওয়া পর্যন্ত সেই সমস্ত জমির ফসল আলমের গোলাতেই উঠছে। সরকার আলমের জমির ঘাসও ছুঁতে পারে নি–এরকমই সবার ধারণা। আলমের জমির কোনো-কোনো অংশে আধিয়াররা মাঝে-মধ্যে ভাগ দেয় নি বা সরকারের কাছে জমির পাট্টা চেয়েছে। কখনো পেয়েছে। কিন্তু সাধারণভাবে তেমন ঘটনা খুব বেশি নয়। নাউছার আলম লোকটি বেঁটেখাট। শাদা হাফশার্ট আর ছোট মাপের একটা পায়জামা পরনে। হাতে ছাতা। সবাইই সেলাম দিচ্ছে। নাউছারও তাদের সেলাম জানাচ্ছে। নাম ধরে ধরে সবার খোঁজখবর করছে। এদিককার বড় বড় সব হাটে নাউছার কিছুক্ষণের জন্য গিয়ে বসে। সবার সঙ্গে দেখাশোনা খোঁজখবর হয়।

নাউছারের কাছেই, কিন্তু একটু যেন দূরত্ব রেখে, দাঁড়িয়ে যোগানন্দ মন্ত্রী। প্রফুল্ল ঘোষ যখন মাস তিনেকের জন্য মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিল–প্রথম যুক্তফ্রন্টের পর, তখন যোগানও মন্ত্রী ছিল; বোধ হয় মাস-দুই। তার পর থেকে তার নামই হয়ে আছে যোগানন্দ মন্ত্রী। ধুতি আর খদ্দরের পাঞ্জাবি পরে যোগানন্দও ছাতা হাতে দাঁড়িয়ে। নাউছার আলম যোগানন্দকে ডেকে জিজ্ঞাসা করে, মন্ত্রীমশাই, ঐ বড় সাইনবোর্ডে কী লিখা আছে? যোগানন্দ আগেই দেখেছিল। বলল, ঐ হরিয়ানার বলদের–

ও, নাউছার বুঝে যায়। এ অঞ্চলে সেইই প্রথম কৃত্রিম গো-প্রজনন শুরু করেছিল–তাও বছর কয় আগে। এখন তার বাথানে ত হরিয়ানা ছাড়া অন্য কোনো গরু নেই বললেই চলে। বাসে যেতে-যেতেও ফরেস্টের পাশের জমিতে মোষের সাইজের গরু চরতে দেখলে অনেকেই বলে দিতে পারে, নাউছারের গরু। নাউছার আবার জিজ্ঞাসা করে, আর ঐঠে কী লিখা মন্ত্রীমশাই, ঐ যে মানষিটার পিঠত?

যোগানন্দ বলে, কালি থিকা ত এইঠে হলকা ক্যাম্প বসিবে–

 ও–নাউছার বুঝে যায়। একটু চুপ করে থাকে। তারপর যেন আপন মনেই বলে, হলকা ক্যাম্পত জমি দিবে আর পশু হাসপাতাল বলদ দিবে, তবে ত মোর এইঠে সোনার সংসার হবা ধরিবে। কথাটা কেউ-কেউ শুনতে পায়, কেউ-কেউ একটু হাসেও। নাউছারের মাথায় এই দুটো সাইনবোর্ডের ব্যাপারটা খেলে গেছে বলেই সে কথাটা বলে। কথাটার মধ্যে কোনো ঝাঁঝ ছিল না। দূর থেকে একজন একটু চেষ্টা করেই নাউছারের নজরে পড়ে, তার পর দূর থেকেই সেলাম জানায়। নাউছার আলম জিজ্ঞাসা করে, কী, বিবি হাসপাতালঠে ফিরি আইসছে? লোকটি হেসে ঘাড় কাত করে। বেশ বেশ বলে নাউছার তার পাশের লোকটিকে কিছু বলতে মুখ ঘোরায়।

নৌকো পাড়ে ভিড়ে গেছে। নাউছারের পাশে পাড়ের দিকে যারা দাঁড়িয়ে ছিল তারা আস্তে নেমে যায়, নৌকো দুলিয়ে লাফায় না। পেছনে যারা ছিল, তারাও কেউ হুটোপাটি করে নামে না। নাউছার আলম আস্তে-আস্তে নৌকো থেকে মাটিতে নামে। নেমে নৌকোর দিকে তাকিয়ে হেসে যেন ধন্যবাদ দেয়, বুড়া মানষি, আর লাফাঝাপা করিবার না পারি, আসেন, নামেন এ্যালায় সব। ততক্ষণে যে যার মোট তুলে নিয়েছে। সবাই একে-একে নামতে শুরু করে।

যোগানন্দ পেছনের দিকে ছিল। সে ধীরেধীরে নামে। হাটে তার কোনো কেনা-বেচারকাজ নেই। মাঝে-মাঝে হাটে এলে সবার সঙ্গে দেখাশোনা হয়, কথাবার্তা হয়, দেশগায়ের ভাব বোঝা যায়। তা সে কথাবার্তা ত খেয়ানৌকোর ওপরও হতে পারে, নেমে পড়েও হতে পারে।

এছাড়াও অবশ্য যোগানন্দের অন্য একটা ভয় ছিল। যদি নাউছার আলম তার সঙ্গে চলতে শুরু  করে তা হলে ত সে আর-কিছু করতে পারবে না। কিন্তু হাটসুষ্ঠু লোক দেখবে যোগানন্দ এখন নাউছার আলমের সঙ্গে হাটে আসে। সেটা সে চায় না। সে নাউছার আলমকে এগিয়ে যাওয়ার সময় দেয়।

কিন্তু পাড়ে উঠে দেখে পাকা রাস্তায় রিক্সার ওপর নাউছার আলম বসে এদিকে তাকিয়ে। চোখ ফেরানোরও কোনো উপায় নেই। কাছে যেতেই নাউছার বলে, কী মন্ত্রীমশাই, আর ত রিক্সা নাই এইঠে, আপনি কি মোর পাকে আসিবেন, নাকি এদিকে কামকাজ আছে?

নাউছার আলমও কি তার সঙ্গে যেতে চায় না, নাকি? না, আপনি যান, আমার একটু দেরি হবে। খালপাড়াঠে একোজনের আসিবার কথা।

আচ্ছা, আচ্ছা। নাউছার জবাব দিতেই রিক্সাওয়ালা চালাতে শুরু করে দেয়। নাউছার আলম যেন সব সময়ই আইন মেনে চলে। আর-একটা রিক্সা থাকলে সে যোগানন্দের জন্যে পাড়াত না। কিন্তু তাই বলে যোগানন্দকে সে জোর করে ধরে তার রিক্সাতে তুলবে না। তার সঙ্গে রিয়ায় যাওয়ায় মন্ত্রীর যে-অসুবিধা তাও যেন নাউছার বোঝে। কিন্তু সে ডাকলে ত যোগানন্দ না করতে পারবে না। তাই কথার মধ্যেই ফাঁক রেখে দেয়ইচ্ছে করলে যোগানন্দ না-ও আসতে পারে। কিন্তু মাত্র একটা রিক্সা আছে দেখেও নাউছার আলম চলে যেতে পারে না, তাকে দাঁড়িয়ে থাকতেই হয় কতকাল আগের মাস-তিনেকের এক সরকারের মাস-দু-একের মন্ত্রীর জন্য। এই ঘাট থেকে হাটটা খানিকটা হাঁটা পথ। কিন্তু এপারে লোকজনের চলমান ভিড়টা জমাট বাধে না। এদিককার নানা টাড়ির, গায়ের, লোকজন হাটের দিকে চলেছে। মাঠঘাট দিয়ে অনেককেই চলতে দেখা যায়। নানা রাস্তা, নানা মাঠঘাট দিয়ে, সব দিক থেকে সবারই যেন এখন তাড়াতাড়ি গিয়ে পৌঁছনোর তাড়া, যে যার মত। গো-প্রজনন আর হলকা ক্যাম্প-ও কখন একসময় সেই রাস্তার ভিড়ের ভেতর দিয়ে হাটের দিকেই ছুটেছে।

.

০০৩.

‘সত্যমেব জয়তে’

পিঠে হলকা ক্যাম্পের সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে প্রিয়নাথ একটু এগিয়ে দেখল তাদের জিপ গাড়িটা এসেছে কি না! আসে নি। আসার কথাও নয় সন্ধ্যার আগে। সুতরাং সাইনবোর্ডসহ তার থলিটা পাশে নামিয়ে সে চা-মিষ্টির দোকানটার রাস্তার পাশের বেঞ্চিটাতে বসল। তার পেছনে চিতা-সাইজের দুই উনুনে, মানুষ ভাজা যায় এমন দুটো কড়াইয়ে নিমকি ভেজে পাশের ঝুড়িতে ফেলা হচ্ছে। সেঝুড়িটা উল্টে নিলে হাত-পা গুটিয়ে ভিতরে ঢুকে থাকা যায়। ঝুড়িটা একটা সাইজমাফিক গামলার ওপর বসানো–তেল যাতে চুঁইয়ে যায়। ভাজা নিমকির গন্ধ নাকে এসে লাগে। তার পেছনে ঐ উনুনের সামনে লম্বা টেবিলে একটা বছর চোদ্দর ছেলে খালি গায়ে চা বানিয়ে যাচ্ছে। প্রিয়নাথ তাকে উদ্দেশ্য করে বলল, দাদা, দুটা নিমকি, একটা চা।

আগামীকাল থেকে চা-নিমকি প্রিয়নাথ নিজের পয়সায় খাবে না। আগামীকাল কেন, আজ একটু পরে হাটে ঢোলাই দেয়ার পরই, আর তাকে নিজের পয়সায় চা-মিষ্টি-সিগারেট খেতে হবে না। হয়ত এই দোকানিই তাকে ডেকে-ডেকে খাওয়াবে। আজকাল ত ঘোষরাই জমি কেন বেশি। এখন গিয়ে এই সাইনবোর্ডটা দেখালে এই নিমকি-চাটাও বিনে পয়সায় হতে পারে। কিন্তু তা সে করতে যাবে কেন? সে ত সরকারি লোক। সেটেলমেন্টের পিয়ন। তাকে দুটো-তিনটে দোকান সাধবে, দু-তিনজন লোক পেছনে-পেছনে ঘুরবে, তবে, সে একজনের কাছ থেকে চা খেলেও খেতে পারে।

কাল থেকে এখানে হলকা ক্যাম্প বসবে। সে-খবর এখানকার সবাইই জানে। ফর্ম এর ইস্তাহার আগেই বিলি করা হয়ে গেছে, ৫৬ ধারার নোটিশও জারি করা হয়ে গেছে–আপন আপন পর্চা জমাবন্দি থাকিলে তাহা সহ উল্লিখিত মৌজায় হাজির হইয়া…। খানাপুরি বুঝারতের নোটিশও পড়েছে। আজকের হাটে একটা ঢোলাই দিতে হবে। সেই জন্য প্রিয়নাথ আগে চলে এসেছে। সাহেব তাকে বলেছিলেন, আমাদের সঙ্গে জিপেই চলুন, আমরা না হয় একটু আগে-আগে বেরব। কিন্তু সাহেবদের জিপে এলে প্রিয়নাথ বাসে আসার টি. এটা পেত না। সাইনবোর্ডটা এনেছে বলে রিক্সাভাড়া বাবদ এক টাকা তার প্রাপ্য। সেটাও পেত না। আর হাটে ঢোলাই বাবদ তিন টাকা–সবসুদ্ধ টাকা পাঁচেক তার ক্ষতি হত। সুতরাং সে যে রাস্তায় বাসে নেমে হেঁটে এল, সাহেবরা সেই রাস্তায় সোজ গিয়ে বয়ে ঘুরে মাল-ওদলাবাড়ি হয়ে আবার বায়ে ঘুরে মোট মাইল বিশেকের পাক দিয়ে এখানে আসবে।

নিমকির তেলে তার হাতের আঙুল ভেজা। প্রিয়নাথ মাথায় মেখে নিল। তারপর দুই হাত ঘষল। সে বসেছে একেবারে রাস্তার পাশে–যারা চা খেয়েই সরে পড়ে, বড় জোর নিমকি খায় তারাই এখানে বসে কিংবা দাঁড়ায়। এর পরে মাঝখানের সারিতে যারা বসে তারা চা খায়, নিমকি খায়, জিলিপিও খায়। তাদের সামনেই খোলা চৌকিতে জিলিপির পাহাড়। আর পাশে বড় বড় টিনে চানাচুর। আর, যারা বড় বড় মিষ্টিটিষ্টি খাচ্ছে, খাওয়াচ্ছে তারা সব বসেছে দোকানের একেবারে ভেতরে, সারি সারি টেবিল-চেয়ারে যে যত পারে ভেতরে সেঁদিয়ে। ভেতরের ঐ সব জায়গাতেই ত বড় বড় হাটে আসল বেচাকেনা সাব্যস্ত হয়। শুধু হাটের জিনিশ বেচাকেনাই নয়, আগামী বছর কোন জমি কে বেচবে, কে কিনবে, সে-সবের কথাবার্তাও এখান থেকেই শুরু হয়। কাল থেকে ক্যাম্প। কাল থেকেই লোকজন ত প্রিয়নাথকে নিয়ে যত পারে দোকানের ভেতরে ঢুকতে চাইবে। পারলে ওদিকের দেয়াল ভেঙে আরো ভেতরে নিয়ে যেতে চাইবে। কাল থেকে? তার ব্যাগটা আর সাইনবোর্ডটা হাতে তুলে নিয়ে আর-একবার দোকানটা দেখে ভাবে–এই ঢোলাইটা হয়ে গেলেই ত শুরু হবে, দাদা, দাদা। না, আজকে নয়। আজ ঢোলাইয়ের পর এখানে এসে, এখানে বসে, সবার সামনে সে আবার দুটো নিমকি ও এককাপ চা খেয়ে উঠে যাবে। হাটের লোকে দেখুক সেটেলমেন্টের পিয়ন নিজের পয়সাতেই চা-নিমকি খায়, খেতে পারে।

এবার প্রিয়নাথ ঝোলাটা কাঁধে আর সাইনবোর্ডটা হাতে ঝোলায়। তারপর রাস্তাটা কোনাকুনি পেরিয়ে হাটে ঢুকবার সময় রাস্তা থেকে একটা কাঠি কুড়িয়ে নেয়।

এদিকটায় ছাউনিঅলা দোকান। কোনো-কোনো ছাউনি ভামনির, একটা ছাউনি পেটানো টিনের, আর বেশির ভাগই প্লাস্টিকের চাদরের। ঐ দিয়ে মালপত্র বেঁধে নিয়ে এসেছে। ঐটাই মাথায় টাঙিয়েছে। এদের বেশিরভাগ দোকানেই জামাকাপড় আর গেঞ্জি-প্লাস্টিকের ঠোঙায় ভরা, আবার, কাগজের বাক্সও আছে। ঠিক পেছনেই খোলা বাজার। সেই ভোলা বাজারের মুখে দাঁড়িয়ে প্রিয়নাথ কাঠিটা দিয়ে টিনের সাইনবোর্ডটাকে সামনে এনে পেটায়। কেমন একটা ঢ্যাপ ঢ্যাপ আওয়াজ হয়। তাই প্রিয়নাথ আবার পেটায়। এবার সামনের ও পাশের দোকানদাররা চোখ তুলে তাকায়। আগামীকল্য হইতে ক্রান্তিহাটের হাটখোলাতে সেটেলমেন্টের হলকা ক্যাম্প বসিবে। দলিলপত্রসহ সবাই যথা মৌজায় যথাসময়ে হাজির হইবেন। হইবেনটা বেশ টান দিয়ে শেষ করে প্রিয়নাথ। আবার হাটে। দু পা এগিয়ে তার মনে পড়ে অপারেশন বর্গার কথাটা বলা হল না। পরের জায়গায় বলবে। কিন্তু কিছুতেই তার মনে থাকতে চায় না। হলকা মানে জোতদারের ব্যাপার। কে তার জমিতে বর্গা করে তার লিস্টি সেটেলমেন্টের হবে কেন। প্রিয়নাথ জলপাইগুড়ি শহরের মাইল-সাত দক্ষিণে বিঘা পাঁচেক জমি কিনে আধিতে দিয়েছে বছর বার। বাড়ির ছ-মাসের ধানটা আসে ওখান থেকে। তার আধিয়ারও কি রেকর্ড করাবে নাকি।

কাটা কাপড়ের দোকানের সারির মাঝখান দিয়ে প্রিয়নাথ সোজা পশ্চিমে যাচ্ছিল। মাঝখানে এক চৌপত্তির পর ডাইনোয়ে মশলার দোকান। ওদিক থেকে একজন, বেঁটে-এক ঘোড়ায় চড়ে আসছিল। ঘোড়র ওপর বসেও নোকটার মাথা হাটের চালাগুলো পর্যন্ত পৌঁছয় না। হয়ত ফরেস্টের ভেতরে বা চরের খুব ভেতরে কোথাও থাকে। ঘোড়া ছাড়া যাতায়াতের উপায় নেই। প্রিয়নাথ সরে গিয়ে ঘোড়ার যাওয়ার পথ ছেড়ে দেয়। কিন্তু সরে দাঁড়ানোর পরই পাশ থেকে ঘোড়ার চেহারা দেখে প্রিয়নাথের আত্মসম্মানে লাগে। মনে হল এই ঘোড়াটারই উচিত ছিল তার জন্য পথ ছেড়ে দেয়া,নইলে প্রিয়নাথকে ত এর পর গরুর জন্যও পথ থেকে সরে দাঁড়াতে হবে। সুতরাং ঘোড়া তাকে সম্পূর্ণ ছাড়িয়ে যাওয়ার আগেই প্রিয়নাথ তার হলকা ক্যাম্প দিয়ে ঘোড়ার পেছনে এক ধাক্কা মেরে পথে নামে। সেই ধাক্কাতেই ঘোড়ার কোমর থেকে পেছনটা একবার টাল খায় আর পেছনের ডান পা, যেটা প্রিয়নাথের দিকে, হাঁটুতে ভাজ হয়ে দুমড়ে পড়ে প্রায়, যেন বৈশাখ মাসের ঝড়ের মুখে হাটের চালাঘর। প্রিয়নাথ : এক লাফে আবার রাস্তার পাশে সরে যায়, পাছে ঘোড়াটা দুমড়ে-মুচড়ে তারই ওপর ভেঙে পড়ে। আর ঘোড়াটা তখন তাকে ছাড়িয়ে বা পাশের দোকানের সামনে দাঁড়ায়। ধুত, বলে প্রিয়নাথ পথে নামতেনামতে দেখে ঘোড়ায় চড়া লোকটি একটা লাঠির মাথায় বাধা ঝোলা এগিয়ে দিচ্ছে। ঘোড়া থেকে না নেমেই হাট করা।

মশলার দোকানগুলোর শেষে হাটটা ডাইনে বায়ে ছড়িয়েছে। সেখানে দাঁড়িয়ে প্রিয়নাথ আবার কাঠি দিয়ে তার সাইনবোর্ড পেটায়। আওয়াজ এত ঢ্যাপ ঢ্যাপ যে প্রিয়নাথকেও একবার সাইনবোর্ডটা তুলে টিনটা পরখ করতে হয়। যেন নিজের কীর্তির দিকে তাকিয়ে দেবে। হাটে ঢোলাই দেওয়ার কাজ হলকার সাইনবোর্ড পিটিয়ে সেরে-সেরে সে ঢিনাটকে প্রায় ফাটিয়ে এনেছে। পাছে টিনটি আরো ফেটে যায় এই ভয়ে প্রিয়নাথ কাঠিটা জোরে মারতে পারে না। একবার ডাইনোয়ে তাকিয়ে, টিনটাতে ছোট করে একটা কাঠি মেরে, মুখের কাছে হাত তুলে চেঁচাল, আগামীকল্য হইতে ক্রান্তিহাটে সেটেলমেন্টের হলকা ক্যাম্প বসিবে। আপনার দলে দলে যোগদান দিন।

হঠাৎ প্রিয়নাথের চেঁচানো শুনে পান আর শুকনো তামাকের দোকানদাররা মুখ তুলে তাকায়। হাটে ত নানারকম লোকই আসে। পুরনো হাটে ভিখিরি-পাগল এরাও চেনা হয়ে যায়। দোকানদাররা পাছে তাকে নতুন ভিখিরি বা পাগল ভাবে এই ভয়ে প্রিয়নাথ তার সাইনবোর্ডের লেখা-দিকটা ঘুরিয়ে দিল। কাঁধে ঝোলা আর সামনে সাইনবোর্ডলোকজনের এতে আরো সন্দেহ হওয়ার কথা। তাই প্রিয়নাথকে নিশ্চিন্ত হওয়ার জন্য সাইনবোর্ডটা আবারও দেখতে হয়। না, সরকারি চিহ্ন আকা আছে, সত্যমেব জয়তে, মুছে গেলেও বোঝা যায়। সত্যমেব জয়তে নিয়ে ত আর কেউ পাগলামি করে না।

.

০০৪.

ঢোলের বদলে মাইক

 প্রিয়নাথ ত এখন এই ঢোলাই দেওয়া বন্ধ রেখে, ফিরে গিয়ে, ঘরদোর গোছানো ঠিক আছে কি না দেখে সাইনবোর্ডটা টাঙিয়েও দিতে পারে। তার এই নতুন অফিসারটাকে সে যে এখনো পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারে নি। একেবারেই নতুন এসেছে, বিশেষ করে নাকি অপারেশন বর্গার জন্যই সরকার পাঠিয়েছে। কিন্তু সি-পি-এম নয়, নকশাল। আগেই নাকি নকশাল ছিল। তার পর অফিসার হয়েছে। জোতদার দেখলেই খেপে যায়। জোতদার নিজচাষ রেকর্ড করাতে চাইলেই বলে, হাত দেখি। হাতের কড়া গোনে। এখানকার ক্যাম্পে নিজেই থাকবে। কতজন গিয়ে বলেছে তাদের বাড়িতে থাকতে, চা বাগানের মালিকরা বলেছে বাগানের বাংলোতে থাকতে। এদিককার এইই রীতি। কিন্তু সাহেব কারো কথা শোনে নি। এখানে এসেই যদি শোনে ঢোলাই দেয়া হয় নি, তখন ত ধরা পড়ে যাবে–কোনো হাটেই কোনোদিন প্রিয়নাথ কাউকে ঢোলাই দিতে ডাকে নি। একটা কিছু ব্যবস্থা করা দরকার।

আর দেরি করা কোনো কাজের কথা নয়। প্রিয়নাথ একবার আন্দাজের চেষ্টা করে মুদি বা গালামালের দোকানগুলো কোনদিকে হতে পারে। মিষ্টির দোকানের পাশের বড় দোকানটার বাইরে যেন টিনের বাণ্ডিল দেখে ছিল। সেখান থেকে একটা টিন চেয়ে নিয়ে এলে তাড়াতাড়ি সারা হাটে একবার পিটিয়ে ঘুরে আসতে পারে। প্রিয়নাথ বাইরের সেই দোকানটায় যেতে পিছন ফিরল।

কিন্তু হাট থেকে বেরবার মুখটাতে দেখে বা দিকের বড় উঁচু ডাঙাটায় মদেশিয়াদের একটা দল–একজন ঢোল বাজাচ্ছে, আর একদল মেয়ে হাত দিয়ে এ ওর কোমর ঘিরে নাচতে লেগেছে। ওখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে প্রিয়নাথ একটু ভাবে যে এই সাইনবোর্ডটা দেখিয়ে ওর কাছ থেকে ঢোলটা চাওয়া যায় কি না। তা হলে ত ছেলেটাকেই বলতে হবে ঢোলাই দিতে। তার মানেই পয়সাটা হাতছাড়া। কিন্তু যদি বলে সেটেলমেন্টের পিয়ন–তোমার ঢোলটা দাও, ঢোলাই দিয়ে ফেরত দেব। ওরা নিশ্চয়ই চা বাগানে কাজ করে। সুতরাং সেটেলমেন্টের পিয়নকে খুব একটা কেয়ার না-ও করতে পারে। কিন্তু তার চাইতেও বড় কথা, ওকে ত বোঝাতে হবে-তোমকো ঢোলঠো দোও, হাম ঢোলাই দেগা! ঢোলওয়ালা চাই না, কিন্তু তার ঢোলটা চাই–এ রকম একটা কঠিন কথা বোঝাতে অনেক হিন্দি বলতে হবে। আর অতগুলো মদেশিয়া মেয়ে অনেকসময় একসঙ্গে হেসে ওঠে। প্রিয়নাথ মুদির দোকানের খোঁজেই বেরল।

এখন যেন হাটটা এই রাস্তাতেও ছড়িয়ে-ছাপিয়ে পড়ছে। একবার উঁকি মেরে দেখে নিল তাদের জিপটা এসে গেছে কি না। তার পরই সেই মাড়োয়ারির দোকানের দিকে চলল। গিয়ে দেখল, তার আন্দাজ ঠিক নয়, বাইরের ওগুলো কেরোসিন তেলের ব্যারেল। দোকানটা মালের কেরোসিন ডিলার, শর্মার।

আচ্ছা এখানে মুদির দোকান কোন দিকে?

এই রাস্তা ধরে বেঁকে যান, ডান হাতিতে।

প্রিয়নাথ রাস্তা ধরে ডানহাতিতে বেঁকল। মুদির দোকান। অনেক টিন আছে। হাঁফ ছেড়ে প্রিয়নাথ।

দাদা, একটা টিন দিবেন!

কিসের? ডালডার না বিস্কুটের?

একটা হলেই হল।

 ফুল সাইজ সাত টাকা, হাফ সাইজ চার টাকা।

অ্যাঁ? না, মানে আমি আবার ফেরত দিয়ে যাব।

 ফেরত দিয়ে যাবেন? করবেন কী?

কাল থেকে ত এখানে হলকা ক্যাম্প বসিবে—

কিসের ক্যাম্প?

 সেটেলমেন্টের

কথাটা শেষ হওয়ার আগেই লোকটা বলে দিল, ওসব আমাদের দরকার নেই। হবে না। প্রিয়নাথ একটু হকচকিয়ে যায়। সরে এসে দাঁড়িয়ে থাকে। এরকম একটা দোকান চালাচ্ছে লোকটা হাটের মধ্যে আর এখানে জমিজমা করে নি? নাকি লোকটা মালিক নয়, কর্মচারী? প্রিয়নাথের একবার মনে হয় জিজ্ঞাসা করে, আপনাদের মালিক কে? সে পেছন ফিরে তাকায়। কিন্তু সাহস করে উঠতে পারে না। আরো কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে অগত্যা তাকে সিদ্ধান্ত করতেই হয় যে সাহেবকে বলবে ঢোলাই দেওয়া হয়েছে। তার পর যদি সাহেবের সন্দেহ হয়–তখন দেখা যাবে। এখন বরং সাইনবোর্ডটা টাঙিয়ে ঘরটা ঠিকঠাক করে নেয়া দরকার।

এই হাট কমিটির হাতে নাকি কোন কো-অপারেটিভের তিনটে ঘর ছিল–তার ভেতর দুটো ঘর ক্যাম্পের জন্য পাওয়া গেছে। প্রিয়নাথ এখন সেই ঘর খুঁজতে চলল। যেতে-যেতেই তার মনে হয় সে মিছিমিছি এতক্ষণ ভয় পাচ্ছিল। সাহেবের কি আর-কোনো কাজ নেই যে এসেই জনে-জনে জিজ্ঞাসা করতে শুরু করবে হাটে ঢোলাই হয়েছে কি না। সে ত তাও দু-জায়গায় সাইনবোর্ড পিটিয়ে চেঁচিয়েছে। মিষ্টির দোকানটাতেই জিজ্ঞাসা করা ভাল, হাট কমিটির ঘরটা কোথায়, ভেবে, দোকানটাতে ঢোকে। আর তখনই মাইকে ধীর, শান্ত, গম্ভীর গলায় শুনতে পায়, ভাগ্যের চাকা ত সব সময়ই ঘুরছে। আজ যে রাজা, কাল সে ফকির। আমরা ভাগ্যের হাতে পুতুল। কিন্তু ভাগ্য ত সবসময় খারাপই হয় না। ভালও হয়। পুরুষের ভাগ্য দেবতারাও জানেন না। মেয়েদের ভাগ্যও দেবতারা জানেন না। কিন্তু কর্ম না করলে ত আপনি ভাগ্যের ফল পাবেন না। কর্ম আপনাকে করতেই হবে। পাঁচ টাকা নয়, দশ টাকা নয়, মাত্র এক টাকা দিয়ে লটারির একটা টিকিট কিনুন। প্রতি সপ্তাহে একবার খেলা। কে জানে, এবার হয়। ত আপনার টিকিটেই ফার্স্ট প্রাইজ উঠবে এক লক্ষ টাকা। এক টাকা দিয়ে এক লক্ষ টাকা। কিন্তু একটা টাকা দিয়ে টিকিটটা ত আপনাকে কাটতে হবে, আপনি ত আর অন্যের কাটা টিকিটে প্রাইজ পাবেন না। আসুন। এক টাকা দিয়ে একটা টিকিট কাটুন।

দোকানদার বলে দিল, হাটের একেবারে পেছন দিকে হাট কমিটির শেড। সেদিকে যাওয়ার আগে প্রিয়নাথ লটারির টিকিটের রিক্সাটার দিকে যায়। তাকে দেখে ছেলেটি মাইকেই বলে ওঠে, আসুন দাদা, কখানা?

না, শোনেন দাদা, টিকিট না, অন্য একটা কথা আছে।

কী কথা দাদা, বলুন। কথাও বলুন, টিকিটও নিন। মাত্র এক টাকায়—

ছেলেটি তার কথা মাইকেই বলে যাচ্ছিল। কিন্তু প্রিয়নাথের গলা মাইকে শোনা যাচ্ছিল না। ফলে প্রিয়নাথের কেমন অপ্রস্তুত লাগছিল। সে তাড়াতাড়ি বলল, মানে, কাল ত এখানে হলকা ক্যাম্প বসবে।

কী ক্যাম্প?

হলকা ক্যাম্প। সেটেলমেন্টের। এই জমিজমা মাপামাপি হবে। কোন জমি কার এইসব। তার ওপর কোন জমিতে কে চাষ করছে সেসব রেকর্ড হবে। এই কথাটা যদি মাইকে একটু বলে দেন সবাই জানতে পারবে।

মানে, কোনো কালচারাল ফাংশন হবে?

কী? ফাংশন?

হ্যাঁ, মানে কোনো আর্টিস্ট আসবে?

আরে না না, এ ত সরকারের ব্যাপার, আইনের ব্যাপার, ফাংশন না।

তা হলে সবাইকে বলতে বলছেন যে?

বললাম ত, জমিজমা মাপামাপি হবে, রেকর্ড হবে, অপারেশন বর্গা।

সে ত পার্টির ব্যাপার স্যার, আমরা কোনো পার্টিফার্টিতে নেই দাদা। একটা টিকিটের দাম মাত্র এক টাকা। কিন্তু এর বদলে আপনি এক লক্ষ টাকা পেতে পারেন–ছেলেটি একই গলায় ঘোষণা করে যায়। তার পর থেমে হঠাৎ প্রিয়নাথের দিকে তাকিয়ে বলল, ফাংশন না হোক, লোকজন আসবে ত?

সে ত আসবেই। সবাই যাতে জানতে পারে সে জন্যই আপনাকে একটু অ্যালাউন্স দিতে বললাম।

 সে করে দিচ্ছি। কিন্তু কাল আমাদের একটু চান্স দিতে হবে। টিকিট বিক্রি করব।

 নিশ্চয়, নিশ্চয়, সে আপনারা কাল সকাল থেকেই আসবেন।

 তা হলে বলুন, কী ক্যাম্প?

 হলকা।

 হলকা? এ কি দাদা একটা নাম হল! একটা ইংলিশ নাম দিলে পারতেন।

কিসের?

 এই ফাংশনের।

সে আমরা দেব কী করে? এ তো গবর্মেন্টের নাম। বরাবর তো হলকা ক্যাম্পই বলে।

ও আচ্ছা, আমি ভাবছিলাম নতুন জিনিশ। গবর্মেন্টেরও ত কত নতুন জিনিশ হয়, তা বলুন কী বলতে হবে। ভাইয়ো অউর বহির্নো, তগদির এক চিজ অউর তগদির কা খেল অউর এক চিজ, ছেলেটি হিন্দিতে লটারির টিকিট বিক্রি শুরু করে। প্রিয়নাথ একটু অপেক্ষায় থাকে। থামলে বলে, বলতে হবে আগামীকল্য হইতে এইখানে ক্রান্তির হাটে সেটেলমেন্টের হলকা ক্যাম্প বসিবে। আধিয়ারি রেকর্ডও করা হইবে। আপনারা সকলে দলিলপত্র লইয়া উপস্থিত থাকিবেন।

ধুত দাদা, এসব ত কীরকম পুলিশ পুলিশ শোনাবে। সবাই ভাববে আমরা সরকারি লোক। কেউ আর টিকিট কিনতে আসবে না।

না। ওটাই বলতে হবে তা নয়। ওটাকে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দিলেই হবে। এই যে এইটা দেখে নিন। হাতে কোন একটা নোটিশ না ইস্তাহার ছিল–সেটা এগিয়ে দেয়। ছেলেটা দু-চার লাইন পড়েই উল্টে শাদা পিঠটা দেখে। তার পর আবার ছাপাটা দেখে। আবার উল্টোয়। এ কি দিাদা, এ ত আমি কেন, আমার মামাও বুঝতে পারবে না। প্রিয়নাথ তাড়াতাড়ি বলে, ঐ সব মিলিয়ে-মিশিয়ে বলে দেন দাদা, একটু উপকার হয়। ছেলেটি একটু থেমে কিছু ভাবে। তারপর বলে, আচ্ছা শুনুন বলছি, এতে হবে কি না দেখুন। তারপর সেই গলাতেই বলে যায়, জীবনে কত কী ঘটে যাচ্ছে সব সময়। সবই ত নতুন। এইমাত্র আমাদের এক দাদা আমাদের এক নতুন জিনিশ শেখালেন, হলকা, হলকা ক্যাম্প। কাল সকাল থেকে নাকি এই ক্রান্তির হাটে এই হলকা ক্যাম্প বসবে। আপনারা নিশ্চয় সবাই সেই ক্যাম্পে আসবেন। ঘুরবেন। দেখবেন। এর আগে আমরা কখনো হলকা শুনি নাই। তেমনি আগামী কালের খেলার শেষে যখন আপনার দরজায় টেলিগ্রাফ পিয়ন এসে বলবে আপনি পশ্চিমবঙ্গ লটারির ফার্স্ট প্রাইজ পেয়েছেন–তখন আপনিও বলবেন লটারি যে কেউ পায় তা প্রথম জানলাম। তাই বলছিলাম জীবনে সব সময়ই ত নতুন কিছু ঘটছে। কালকের হলকা ক্যাম্প নতুন। তেমনি আপনার ফাস্ট প্রাইজ নতুন। কিন্তু একটা, একটা টিকিট ত আপনাকে কাটতে হবে। কী দাদা, চলবে?

হ্যাঁ, হ্যাঁ, এ ত খুব ভাল বলছেন। কিন্তু হলকা ত নতুন ব্যাপার নয়। এটা

 আচ্ছা, আচ্ছা, ওটা ম্যানেজ করে দেব।

আর, ঐ নাকিটা বলবেন না?

নাকি? মানে? নাকি বলব না! এখন মনে হতে লাগল মাইকে কোনো নাটক হচ্ছে। বা ঝগড়াও হতে পারে। দু-একজন লোক ঘাড় ফিরিয়ে তাকায়, একজন এগিয়ে আসে। আসুন দাদা, মাত্র এক টাকার বিনিময়ে লক্ষ টাকা। কিন্তু লোকটা টিকিট না কিনে করে দাঁড়িয়ে থাকে। প্রিয়নাথ দেখে ছেলেটি তার দিকে আর তাকাচ্ছে না। আসুন, পশ্চিমবঙ্গ লটারি-মাঝখানে প্রিয়নাথ বলে বসে, ঐ যে বললেন না হলকা ক্যাম্প নাকি বসবে, ওখানে বলতে হবে হলকা ক্যাম্প বসিবেই! ছেলেটি কোনো জবাবও দিল না। প্রিয়নাথের ভয় হল ছেলেটি বলে বসবে, মাইকে কিছুই বলতে পারবে না। তাই, তাড়াতাড়ি ঠিক আছে বলে সরে যেতে নেয়। পেছন থেকে ছেলেটি বলে, আমরা বলে দিচ্ছি। কিন্তু আমাদের রিক্সা কাল আপনাদের ক্যাম্পে এলে তখন যেন পুলিশ ঝামেলা না করে।

আরে না না, আপনারা আমার কাছে যাবেন। আমি ত থাকব। প্রিয়নাথ হাট কমিটির অফিসের দিকে যেতে শুরু করে। পেছনের মাইকে শুনতে পায়, জীবন মানে ত পদ্মপাতার জল, কিন্তু যা হওয়ার তা ত…

ক্যাম্প মানে ত কাল এখানে কিছুই না। কে-বির [খানাপুরী বুঝারত, মাঠখশড়া ফিল্ড-সার্ভে] কাজ ত মৌজায়। যাক, আসুক ত।

খানিকটা গিয়ে প্রিয়নাথ দাঁড়িয়ে পড়ে, ছেলেটি সত্যিই বলে কি না শুনতে। না বললে তার কিছু। করার নেই। বললেও তার কিছু করার নেই। ক্যাম্পে লোকজন জমলে লটারির রিক্সা আর আসবে না কেন, নিজের থেকেই আসবে। তাতে প্রিয়নাথেরও কিছু করার নেই। ছেলেটি একবারও বলে কিনা এইটি সে জেনে তবে সেই ঘর খুঁজতে যাবে।

কটি দাদা?

তু বল না কঠো?

 তু বল মাইকে মদেশিয়া মেয়ের রিনরিন গলা।

লে লে শুন। তু আঁখ বুজা কর। উসকো বাদ ই টিকিটপর হাত লাগা দে। যো উঠবেক, উ আমি কিন লিব। লে আখ বুজা কর। খিলখিল হাসিটাও মাইকে এসে ব্রজে। চা বাগানের কোনো মাতাল মজুর-মজুরনির কাণ্ড। এই দেখুন, লটারির টিকিট কিনতেও লটারি হচ্ছে। চোখ বুজে যতগুলো টিকিট উঠবে, ততগুলোই কিনবে এই, বলে ছেলেটি থেমে যায়, এরা, আসুন, যা, চোখ বন্ধ করুন। আবার মাইকে খিলখিল হাসি।

.

০০৫.

 প্রিয়নাথের সাহেব ও হাট কমিটি

হাট কমিটির ঘরের সামনে জিপ গাড়ি দাঁড়িয়ে, দূর থেকে প্রিয়নাথ দেখল। সাহেবরা এসে গেছেন। সে হটার গতি বাড়িয়ে দেয়। কিন্তু তাড়াতাড়ি হাঁটার প্রধান অসুবিধে তার স্যান্ডেল। ঐ হাওয়াই-এর খাপে খাপে তার পা এমনই মিশে আছে যে, যেরকম হাঁটলে গোড়ালির বাইরে সোলের মাথা-অংশটা তার পায়ের পাতার সঙ্গে ফর ফর করে লাগতে পারে, তার চাইতে বেশি জোরে হাঁটলেই স্যান্ডেলটা আটকে যায়। তখন আঙুলের তলায় সোলের যে অংশটুকু, তাও বেরিয়ে আসতে চায়, যেন স্যান্ডেলটা উল্টে আঙুলের সামনে চলে যাবে বা ফিতেটা তলা থেকে খুলে আসবে। ফিতেটা যাতে তলা থেকে খুলে না আসে সেজন্যে আবার সেফটিপিন দিয়ে আটকানো বটে কিন্তু সোলের সেই অংশটা ছিঁড়েও ত সেফটিপিনটা খুলে যেতে পারে। সুতরাং তেমন তাড়া থাকলে স্যান্ডেল খুলে হাতে নেয়াই ভাল। কিন্তু এ-দূরত্বটা এত বেশি নয় যে অতটা করার দরকার হবে। সে ত সব নিয়মমাফিকই করেছে তা হলে আর দৌড়াদৌড়ির দরকার কী? কিন্তু তার স্যান্ডেলের জন্য প্রিয়নাথ জোরে হাঁটতে পারে না অথচ তার পদক্ষেপে সেই দ্রুত হাঁটার বেগ এসে যায়–এই দোটানায় প্রিয়নাথের এইরকম হাটার সময় তার কোমরটা সমনে এগিয়ে যায় আর পা-টা থাকে পেছিয়ে। স্যান্ডেলের সঙ্গে পায়ের দোটানায় হাঁটুতে সব সময়ই একটা মোচড় আসে, যেন প্রত্যেকবার পা ফেলার সময় হাঁটু দুটো একটা করে পাক খায়।

প্রিয়নাথের সাহেব মাঠের ভেতর একটা চেয়ারে বসে ছিল। তার সামনে, কিন্তু কিছু দূরে, জিপ গাড়িটা দাঁড়িয়ে। প্রিয়নাথ পেছন থেকেই বলে, স্যার, এসে গেছেন!

সাহেব ঘাড় ঘুরিয়ে প্রিয়নাথকে দেখে বললেন, আরে, প্রিয়নাথবাবু। আপনি একেবারে মাইক-টাইক জোগাড় করে ফেললেন কোত্থেকে?

প্রিয়নাথ একগাল হেসে ফেলল–তা হলে স্যার আপনারা বেশিক্ষণ আসেন নি। তা স্যার ঘরদোর সব বলে বারান্দার দিকে তাকায়। বারান্দায় তাদের অফিসের লোকজন আর আরো দু-একজন। বারান্দায় উঠতে-উঠতে প্রিয়নাথ দেখে ঘরদোর সবই গোছানো, পরিষ্কার, ধোয়া। মালপত্র একটা ঘরের মেঝেতে ছড়ানো।

এই যে প্রিয়নাথদা, তোমাকে পাঠানো হল আগে যে সব বন্দোবস্ত করে রাখবে আর আমরা এসে দেখি প্রিয়নাথদা নোপাত্তা। শেষে নিজেদেরই সব করে নিতে হল। অনাথ বলল।

পাঁচ মিনিট আগেও দেখে গেছি স্যার, আপনারা আসেন নি, এর মধ্যে হুস করে এসে পড়লেন। অনাথের কথার জবাব না দিয়ে প্রিয়নাথ সাহেবকে বলে। ঘর তিনটি পর পর দেখে প্রিয়নাথ ফিরে আসে, এ ত সব পাকা বন্দোবস্ত করা হয়ে গেছে।

সে কী? এ-সব তুমি করো নি? আমরা ভেবেছি তুমিই সব ঠিকঠাক করে রেখেছ– বিনোদবাবু বললেন।

তা হলে ত আমাকে কাল ছাড়তে হত বাবু। আজ রওনা দিলাম এই আপনাদের আগে বাসে, আর পৌঁছলাম ত মাত্র ধরেন ঘণ্টাখানেক আগে।

তাও আবার আপনার ঐ স্যান্ডেল, এবার পেছন থেকে জ্যোৎস্না এসে বলে, আমরা ত ভাবলাম আপনি না এলেও আপনার স্যান্ডেল ঠিক আসবে।

দাঁড়ান, এই সাইনবোর্ডটা আগে লাগিয়ে নেই, বলে প্রিয়নাথ আবার বারান্দা থেকে মাঠে নামে।

আচ্ছা রাখো, তোমার সাইনবোর্ডটা পরে লাগালেও চলবে। এখন দেখো, রাত্রির রান্না ত চাপাতে হবে। কালকের বাজারটাও করে রাখো। ফিরে এসে সব গোছগাছ করা যাবে। বিনোদবাবু বললেন।

হ্যাঁ চলুন, আমি আর প্রিয়নাথবাবু হাটটা ঘুরে আসি, বলে সাহেব চেয়ার ছেড়ে উঠলেন। যে-ভদ্রলোক তিনজন এতক্ষণ পেছনে দাঁড়িয়ে ছিলেন তারা এগিয়ে এসে বললেন, আমাদের অনুরোধটা একটু রাখবেন না? এ ত স্যার আমাদের এখানকার ব্যাপার। এ ত বরাবরই আমরা করে থাকি।

না, না, আপনারা যেটুকু করেছেন সেটুকুই আমাদের পক্ষে যথেষ্ট। আমরা এতজন আছি, ঠিক করে নিতে পারব। কোনো অসুবিধে হল বরং আপনাদের জানাব। আজ হাটের দিন, আপনাদের ত আবার কাজকর্ম আছে।

না। সে সব ত হয়া গেছে। কিন্তু কথাটা হইল, মোদের এই ক্রান্তি হাট কুনো বাইরের পার্টি, সে সরকারের হবা পারে, আবার, ধরেন কেনে প্রাইভেট পাটিও হবা পারে, সে কুনোদিন এ্যামন হয় নাই যে তারা নিজেরা রান্না করিবার ধরিসে। এ ত মোদের একখানা সুনাম-দুর্নামের বিষয়।

ভদ্রলোক প্রৌঢ়, রাজবংশী। তিনি যখন কথা বলছিলেন সুহাস খুব মন দিয়ে শুনছিল। অথবা যেন সুহাস তাকে দেখছিলও। এই একটা অনুজ্জ্বল, ডাল, বিস্কুট রঙের জামা, সুহাস এদের ভেতর আরো অনেককে পরতে দেখেছে। এগুলো কি এদিকে তৈরি হয়, নাকি, শস্তা? সুহাস ভদ্রলোককে যে তাকে কথাটা শেষ পর্যন্ত বলতে দেয় সে কি তার কথা বলাটাই দেখছিল বলে। তার এখানকার, এই আঞ্চলিক ভাষা তিনি কী ভাবে মেশাচ্ছেন ভদ্রলোকদের ভাষার সঙ্গে। একবারের জন্য সুহাসের মনে হয়, আজকে রাত্রির জন্য এঁদের আতিথেয়তা মেনে নিয়ে কাল থেকে নিজেদের বন্দবস্ত করে নেয়াই ভাল কি না। তাতে অকারণ টেনশন হত না। এরাও খুশি হতেন, তার অফিসের লোকজনও খুশিই হত–পয়সাটা বাচত। আর এটা বোধ হয় তার পক্ষে একটু বাড়াবাড়িও হচ্ছে। সুহাস কোনো নীতিবাগীশ কারণে ত আর এদের আমন্ত্রণ-নিমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করছে না। তাকে ত সরকার টাকা দেয় খাওয়াদাওয়ার জন্য। সে-টাকাটা না নিয়ে ওদের কাছে খাওয়া যায়। কিন্তু অত হাঙ্গামা সে করবে কেন?

আসলে ভয় পায়–এদের আতিথেয়তা মেনে নিলে তার পর আবার কোনো চাপ তৈরি না হয়। সে এক নিজের জন্য রান্নার ব্যবস্থাটা রেখে বাকিদের ইচ্ছে মত ব্যবস্থা করতে বলতে পারে। কিন্তু তা হলেও ত এরা যার যার, বাড়িতে বা সাহায্যে, খাওয়া-দাওয়া করবে তাদের জন্য সুবিধে সুহাসের কাছ। থেকে আদায় করে দিতে পারে।

অগত্যা তাকে বলতে হয়, দেখুন, আমাদেরও ত একটা সুনাম-দুর্নামের ব্যাপার আছে। আমাদের কাজকর্ম চলুক। আমরা ত বেশ কিছুদিন এখানে আছি। সব চুকেবুকে যাওয়ার পর আমাদের না-হয় আপনারা একদিন ভাল করে খাইয়ে দেবেন। তবে এটা আমার কথা। আমি ক্যাম্পেই খাব। আপনারা এদের সঙ্গে কথা বলুন। এঁরা যা বলেন, এদের ব্যবস্থা সেই মত হবে। চলুন প্রিয়নাথবাবু, হাটটা ঘুরে আসি। সুহাস পেছন ফিরে হাটের দিকে রওনা দেয়।

পেছন থেকে বিনোদবাবু বলেন, স্যার, অনাথও আপনাদের সঙ্গে যাক না, একা প্রিয়নাথ। কথার উত্তর না দিয়ে সুহাস এগিয়ে যায়।

.

০০৬.

 প্রিয়নাথের সাহেব ও হাটের নাচ

এ হাটটা বেশ বড় হাট, না? সুহাস জিজ্ঞেস করে।

হ্যাঁ, স্যার, এদিককার সবচেয়ে বড় হাট।

 কী কী বিক্রি হয়, মানে পাইকারি বিক্রি?

ঠিক তা ত বলতে পারব না স্যার, তবে যেরকম পাহাড়ের মত শুকনো লঙ্কা আর পাট তাতে পাইকার ছাড়া আর অত মাল কে কিনবে?

শুকনো লঙ্কা? শুকনো লঙ্কা এদিকে কোথায় তৈরি হয়, মানে এখানে কি শুকনো লঙ্কা এত-শুনি নি ত?

প্রিয়নাথ হাটটার একটা আন্দাজ পেয়ে গিয়েছিল। সেই দোকানপাতির সদর রাস্তা আর এই হাট কমিটির ঘরের লাইন এই দুটো বোধ হয় পুব-পশ্চিমে। এখন তারা উত্তরের মাঠটা দিয়ে গিয়ে রাস্তায় পড়বে, সেখান থেকে হাটে ঢুকবে। মাঠ দিয়ে তারা খানিকটা এগবার পর বোঝে, ঘাস দেখা যাচ্ছে না, অন্ধকার হয়ে আসছে আর একটু এগতেই মাঠের মধ্যে দুটি-তিনটি কুপি জ্বলছে, দেখা যায়। ওখানে হাড়িয়া বিক্রি হচ্ছে। সুতরাং সাহেবকে নিয়ে প্রিয়নাথ আর-একটু উত্তরে যায়। ঘুরতেই ঢোলকের আওয়াজ। নাচটা এখনো চলছে? ওরা কতক্ষণ নাচবে?

নাচছে স্যার।

কারা?

 এই চা বাগানের কুলি-মজুর, হাটের দিন পেট ভরে হাড়িয়া খেয়েছে আর ঢোল বাজিয়ে নাচছে।

হ্যাঁ, এখানে চা-বাগান ত প্রচুর, ট্রাইব্যাল পপুলেশনওকথাটা শেষ করে না সুহাস, থেমে যায়। সাহেব আরো কিছু বলেন কি না অপেক্ষা করে প্রিয়নাথ বলে, হ্যাঁ স্যার।

দাঁড়ান, দেখি। তাদের সামনে তখন নাচটা। তারা নাচের পেছনে। মুখটা হাটির দিকে। নাচের মুখটাও হাটের দিকে। যেমন দেখা যায় ছবিতে, ফোটোতে, সিনেমায়, অবিকল তেমনই–এ-ওর কোমরে হাত দিয়ে জড়িয়ে একটা বন্ধনীর মত করে একই তালে দু-পা এগচ্ছে আর এক-পা পিছচ্ছে আর সেই আগু-পিছুর মধ্যেই দলটা একটু ঘুরে যাচ্ছে। এ রকম করে করে পুরোটাই তারা ঘুরবে আর ঘুরতে থাকবে। আর যে ঢোলক বাজাচ্ছে সে ঐ বন্ধনীর দুই মাথার মাঝখানের ফাঁকা জায়গাটাতে–ছবিতে, ফোটোতে, সিনেমায়, যেমন হয়। সুহাসদের সামনে কিছুদূরে হাটের দোকানপাট, চালাঘর। তাতে আলো জ্বলছে। চালাঘরের ছায়া যেন বাতাসে পড়েছে, বা ওখানে কিছু কিছু গাছও ত আছে। এখানে মাথার ওপরে আকাশ। সেই অসম্পূর্ণ বৃত্তের এগনো-পিছনোর সময় কখনো আকাশের শেষ আলো এসে পড়ছে, কখনো সামনের হাটের ছায়াতে সেই প্রায়বৃত্ত হারিয়ে যাচ্ছে। নাচটীর আবর্তনকে দেখাচ্ছে, যেন কোনো প্রাকৃতিক ঘটনার মত। এত কাছ থেকেই দেখছে, তবু ঢোলের আওয়াজটাকে মনে হয় যেন পাহাড়-টিলাবনের ভেতর থেকে আসছে।

স্যার, চলুন না সামনে, নাচ দেখবেন। চেয়ার নিয়ে আসি।

সুহাস প্রায় শিউরে উঠে বলে, না না, চলুন হাটে যাই

সুহাস আবার চলতে শুরু করে। প্রিয়নাথ পেছনে।

.

০০৭.

 প্রিয়নাথের সাহেব ও হাটের মাইক

সেই মিষ্টির দোকানটাতে তিন-চারটে হ্যাজাক। প্রিয়নাথ দেখে লটারির রিক্সাটাতেও মোমবাতি, আসুন, এক টাকার বদলে লক্ষ টাকা। সুহাস একটু এগিয়ে গেছে দেখে প্রিয়নাথ দৌড়ে লটারিঅলার সামনে গিয়ে বলে, এখন একটু বলুন না দাদা, আমাদের সাহেব এসেছেন। বলে আর দাঁড়ায় না, দৌড়ে আবার সুহাসের পেছনে পৌঁছে যায়। আপনাদের এই হাটে ত কত কী-ই ঘটছে রোজ। হ্যাঁ কটা? দুটো, এই যে নিন দাদা। এই ত কাল এখানে হলকা ক্যাম্প বসবে

প্রিয়নাথ সুহাসকে ডাকে, স্যার।

বলুন।

আমাদের ক্যাম্পের অ্যালাউন্স দিচ্ছে।

সেই ক্যাম্পে ত আপনারা সবাই আসবেন। আপনাদের জমিজমার বিচার হবে। কিন্তু এই হাকিমের চাইতেও এক বড় হাকিম আছে। সেখানে বিচার হয় আমাদের তগদিরের, ভাগ্যের। কে জানে, আপনার জন্য কী বিচার হয়ে আছে?

মাত্র এক টাকার বিনিময়ে সেই বিচার আপনারা জানতে পারবেন। কে জানে, আপনিই হয়ত এক লক্ষ টাকার প্রাইজটা পাবেন। কিন্তু টিকিট না কাটলে ত আর পাবেন না।

সুহাস দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুনছিল। তারপর হেসে ফেলল, এ আপনি কোত্থেকে জোগাড় করলেন?

স্যার, দেখলাম এখানে কোনো ঢোলঅলা নেই। এমনকি টিনঅলাও পেলাম না। তাই বাধ্য হয়ে স্যার…ওরা রাজি হল, কিন্তু রেটটা একটু হাই নিল।

তা ত নেবেই। মাইক বলে কথা।

 ওরা দশ টাকাই চেয়েছিল, আমি বলেকয়ে সাত টাকায় নামিয়েছি।

তা হলে আর এমন-কি বেশি?

স্যার, আমার কাছে ত অত টাকা ছিল না। বললাম, আপনারা এলে দিয়ে দেব।

বিনোদবাবুর কাছ থেকে এনেছেন? তা হলে দিয়ে আসুন সে ত ভুলে গেলাম স্যার।

সুহাস তার ব্যাগ থেকে দশ টাকার একটি নোট বের করে বলল, এখন দিয়ে আসুন। পরে, বিনোদবাবুর কাছ থেকে নিয়ে আমাকে দিয়ে দেবেন।

তা হলে আপনি একটু দাঁড়ান স্যার, আমি দিয়ে আসি।

সুহাস দাঁড়িয়ে থাকল। তার সামনেই প্রিয়নাথ লটারির রিক্সাটার ওপাশে গিয়ে দাঁড়াল। দাদা, আমাদের সাহেব খুব খুশি হয়েছেন। এই দুটো টাকা রাখুন, চা-সিঙাড়া খাবেন।

ছেলেটি মাইক সামনে নিয়েই রেগে উঠল, ধুত মশাই, চা-সিঙাড়া খাওয়াতে হয় আপনি এনে খাওয়ান, আমাদের হাতে টাকা ধরাচ্ছেন কেন? মাইকে এত জোরে কথাটা হওয়ায় প্রিয়নাথ চমকে যায়। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে সুহাস এদিকেই তাকিয়ে।

আচ্ছা দাদা, আচ্ছা, কিছু মনে করবেন না, টাকাটা ভাঙিয়ে দিন।

সামনের চায়ের দোকানটাতে গিয়ে দুটো টাকা দিয়ে বলল, ঐ লটারির রিক্সাতে তিনটে চা আর সিঙাড়া পাঠিয়ে দেন। টাকা দেয়া, বিশ পয়সা ফেরত নেয়া এই সবের ভেতরে প্রিয়নাথ সাতটি টাকা পকেটে রেখে দিল। দাদা তাড়াতাড়ি পাঠিয়ে দেন বলে দৌড়ে সুহাসের কাছে যেতে গিয়ে তার স্যান্ডেলের মাথাটা ভাজ হয়ে যাওয়ায় একটা হোঁচট খেল। সামলে, হাঁটতে-হাঁটতে পৌঁছে বলল, স্যার, চা-সিঙাড়া খাওয়াতে হল, বলে এক টাকা কুড়ি পয়সা সুহাসকে ফেরত দিল। সুহাস বলল, এটা আর বিল করবেন না। ঐ সাত টাকা নিয়ে আমাকে দিয়ে দেবেন।

আপনি একটু বলে দেবেন স্যার, উনি আমার কথা বিশ্বাস করবেন না।

না না, করবেন। আমরা সবাই ত ঢুকতে-ঢুকতেই মাইকে শুনলাম।

স্যার, এই দিকে–প্রিয়নাথ সুহাসকে হাটে ঢোকার পথ দেখায়।

.

০০৮.

হাট কত রকমের

হাট বসা, জমে ওঠা ও ভাঙার একটা যেন বাধা গৎ আছে।

কিন্তু সব হাটের এক রকম নয়। এদিকে চ্যাংমারির হাট বা বড়দিঘির হাট সপ্তাহে একদিন বসে–মোটামুটি সংসারের কেনাবেচার জন্য। গায়ের লোকজনই কেউ কেউ দোকান দিয়ে আসছে। বড়দিঘির হাটে চাবাগানের মজুররাও একটা বড় খদ্দের। তাদের কেনার মত জিনিশপত্রও আসে। কিন্তু সেসব হাট বসে বিকেলের দিকে। তার পর সন্ধ্যার একটু পরেই ভাঙতে থাকে।

ওদলাবাড়ি-লাটাগুড়ি হাট এখন বেশ বড়। বাস রাস্তার ধারে বলে তাড়াতাড়ি বসে আর দেরিতে ভাঙে। নদীর বাঁধের কাজকর্মের জন্য দুদিকেই প্রায় সারা বছর মাটিকাটা-পাথরভাঙা লোকজন থাকে। তাছাড়া ফরেস্টের লোকজনের সংখ্যাও নেহাত কম হবে না। ৬৮সালের বন্যায় যেসব ফরেস্টের গাছ-গাছড়া ভেঙে বা ভেসে গেছে-সেইসব ফরেস্ট এখন সরকার পুরো ফাঁকা করে দিচ্ছে। হয়ত ওখানে নতুন করে বন তৈরি হবে। বা, এখন ফেলে রাখবে। ফলে, সারা বছরই প্রায় ফরেস্টের গাহ চলছে। গ্রামে বিদ্যুতের জন্য শালের খুঁটিও বিক্রি হচ্ছে গত কয়েক বছর। তার জন্যেও ত প্রায় সারা বছরই ফরেস্টে কাজ। তাই ওদলাবাড়ি আর লাটাগুড়ির হাট বেশ বড়। কিন্তু সেও ত কেনাবেচার হাটই আসলে ব্যবসার হাট নয়। বসে দুপুরের দিকে, তার পর চলতে থাকে। গেল বছর লাটাগুড়ির হাটে টিনের শেড তুলে সাইকেলের দোকান দিয়েছে ছচ্ছড়িয়া। হাটবারের দিন, বুধ আর শনিত, খোলে। ওদলাবাড়িতে ত সাইকেল-রেডিওর দোকান আগে থাকতেই আছে। কিন্তু যত বড়ই হোক, এসব হাট তখদ্দের বুঝে চলে। খদ্দেরের হাতে টাকা ত হাট জমল। খদ্দেরের হাতে টাকা নেই ত হাট ফাঁকা। ঐ-সব হাট-বাজারের মত, দোকানের মত। কিন্তু হাট বললে ত এই ক্রান্তির হাট, ধূপগুড়ির হাট, চালসার হাট। এ-সব হাটে যেন খদ্দের নেই, দোকানদারও নেই, শুধু হাটটাই আছে। হাট জমবেই হাটের মত, আর খদ্দের-দোকানদাররা হাটের সঙ্গে নিজেদের শুধু মানিয়ে নেবে। হাটের ভূগোল যে জানে সে হয়ত গলিখুঁজি দিয়ে ঢুকতে পারে বেরতে পারে, কিন্তু যে চেনে না সে কোনো এক দিক দিয়ে ঢুকতে পারলেও–বেরবার সময় রাস্তা আর খুঁজে বের করতে পারবে না। যেন হাটটা তাকে গিলে খেয়ে শেষে উগরে দেবে।

এ হাটগুলো যে কখন বসে কেউ টের পায় না। হাটের ওখানে পাকাবাজার ত একটা আছেই। তাতে রোজকার বাজার চলে। তা ছাড়াও পাকাঘর, পাকাদোকান, পাকাগুদামে রেশন, মিষ্টির দোকান, ওষুধের দোকান, কাপড়ের দোকান, শুকনো মশলার দোকান-গুদাম, এফ-সি-আই-এর গুদাম, সারের এফ-সি-আই-এর গুদাম ও দোকান, কোঅপারেটিভ খানতিন-চার, গোটা দুয়েক কিশোর বা যুব সজল-এ সবও ত রোজকারই।

ধূপগুড়ি হাটের একটু দক্ষিণে পাঞ্জাবি ড্রাইভারদের একটা ধাবাও হয়েছে। ওভারসিং রায়ের বাড়ির পশ্চিমে আগেকার দারিঘরটার জায়গায়, এখন লম্বা-খোলা ঘর। সামনে সারি-সারি খাঁটিয়া পাতা। রাবণের সাইজের একটা উনুন। ঐ শেডেরই এক কোণে পাঠা আর মুরগি বাধা। ধূপগুড়ি দিয়ে ডাইনে থেকে আসামে চলে যায় দূরপানার ট্রাক। ওভারসিং রায় জায়গাটা ভাড়া দিয়ে, টান বাঁশের বেড়ায় তার বাড়িটা আলাদা করে নিয়েছে। তার পর বাড়ির উত্তরে দারিঘর বানিয়ে বাড়ির ঘাড় ঘুরিয়ে দিয়েছে। ক্রান্তি, চালসা, মেটেলিতে ধাবা নেই বটে, তবে ধাবা সাইজের মিষ্টির দোকান আছে, আর ট্রাক আছে। এই সবে ত এসব হাট, হাটবারের দিন ছাড়াও, জমজমাটই থাকে।

তাই হাটবারে বোঝাই যায় না, কখন হাটটা বসে। আগের দিন দুপুর থেকেই বাশের গাড়ি আসতে শুরু করে। ট্রাক অবিশ্যি সব সময় হাটবার মিলিয়ে আসে না। কিন্তু হাটবারের আগে গুদাম ত ভরতেই হয়। ফলে হাটবারের আগের দিনই কোনো-এক সময় থেকে শুধু গুরুর গাড়ির ক্যাচক্যাচ আওয়াজ উঠতে থাকে। প্রায় চব্বিশ ঘণ্টা জুড়ে এই আওয়াজেই যেন পরের দিনের হাটবারটা কাছে আসে। আর তখন থেকেই একটু-একটু করে বাতাস ভারী হয় মানুষের গলার আওয়াজে। বনে বৃষ্টি হলে বাতাস। যেমন ভারী হয়ে গায়ে লাগে, এই হাটগুলো লাগার আগে তেমনি মানুষের স্বরে ভারী বাতাস কানে লাগতে থাকে। এই আওয়াজটাই বাড়তে থাকে প্লেনের মত। প্রথমে গুঞ্জন, তারপর ধীরে-ধীরে আওয়াজটা বাড়তে বাড়তে মিলিয়ে যায়, শেষে আবার গুঞ্জন। কিন্তু প্লেনের মত ত মাত্র কয়েকটি মিনিটে এটা ঘটে না–ঘটে প্রায় চব্বিশ ঘণ্টা ধরে। ফলে গুঞ্জনটা শুরু হলে হয়ত বোঝা যায়, কিংবা গুঞ্জনটা শুনবার মত হয়ে উঠলে। তার পর, সেই গুঞ্জনটা ত বিরতিহীন চলতে থাকে, বাড়তে থাকে। কখন যে সেটা উঠছে তার কোনো চিহ্ন দেয়া যায় না, কিন্তু কোনো এক সময় যেন মনে হয় সারা দুনিয়া, জুড়ে হাটের ঐ আওয়াজটাই উঠছে, মাথার ওপর প্লেনের মত বা ফরেস্টের ভেতর ঝিঁঝির ডাকের মত। তার ওপর কোনো এক সময় নিশ্চয়ই গুঞ্জনটা আবার নামতে শুরু করে। কিন্তু নামার সেই সময়টা ত ধরা যায় না। ধীরে ধীরে অনেকক্ষণ ধরেই নামতে থাকে। হঠাৎ যখন খেয়াল হয়, তখন, দেখা যায় তার আগেই অনেকটা খালি হয়ে গেছে, যেন রোজকার চেহারায় ফিরে আসছে। বোঝাই যায় না এত বড় হাটটা কখন এত ফাঁকা হয়ে গেল।

এই প্রায় সব হাটের প্ল্যান যেন একরকম। সদর রাস্তার দুপাশ দিয়ে সারি বাধা ঘর, দোকান। হাটটা সব সময় সেই সব ঘরের পেছনে পড়ে যায়। দুই দোকানের মাঝখানের ফাঁকগুলো দিয়ে হাটের ভেতরে ঢুকতে হয়। যেন, একসঙ্গে পাশাপাশি দুই মানুষ ঢোকা যায় না এমন সব ফাঁক দিয়ে হাজারে হাজারে মানুষ ভেতরে ঢুকে বসে আছে। গরুর গাড়িগুলোর ভেতরে যাওয়ার একটা রাস্তা থাকে, সেটা হয়ে দাঁড়ায় হাটের পেছন। হাটের জন্যেই হয়ে যে-দোকানগুলো হাটটাকে আগলিয়ে সদর রাস্তার মুখোমুখি থাকে, সেই দোকানগুলোই যেন হাটটাকে দাবিয়ে প্রধান থাকতে চায়। মিষ্টির দোকানগুলোতে বাইরে তক্তপোশের ওপর শাদা চাদর পেতে জিলিপির পাহাড় ওঠে। কাপড়-গামছার দোকানে ও বারান্দায় কাপড়-গামছা ঝোলে। এমন কি, সাইকেলের দোকানে রাখা সাইকেলও দোকান উপছে রাস্তায় এসে পড়ে। আর, এই সবের ঘনিষ্ঠ আড়াল থেকে মানুষের সমবেত কণ্ঠ প্রবল হয়ে ওঠে। সেই কণ্ঠের কোনো আওয়াজের কোনো অর্থ করা যায় না, কোনো একটি ধ্বনিকে আলাদা করা যায় না, সমস্তটাই হয়ে ওঠে ধ্বনির প্রবাহ, প্রায় নদীস্রোতের মত। নদীস্রোতের মতই নেপথ্যের সেই প্রবল বর্ততান তার উচ্চতম কোলাহলের জোরেই একটা অস্তিত্ব হয়ে ওঠে ও আঘাতে-আঘাতে হাটের বাইরের এই দোকানের সারিকেও হাটের অন্তর্গত করে ফেলে। দোকানগুলোও হাটের ভেতরে ঢুকে যায়।

.

০০৯.

এই হাটটা কেমন

সন্ধ্যার পর হাটের একটা চেহারা এসে যায়। সারাদিন ধরে হাটটা যত পারে খুলেছে, সধ্যা হওয়ার পর সেটা যত পারে ছোট-ছোট টুকরোয় ভাগ হয়ে যেতে থাকে। আর এই টুকরোগুলো তৈরি হয় উজ্জ্বল আলোককেন্দ্রগুলোকে ঘিরে।

এখন, এই হাটের পাইকারি বাজারের দিকটা যেন খালি। গো-হাটার দিক ত প্রায় অন্ধকার। মাটির হাঁড়িকলসী বিক্রির বিরাট এলাকা হাটের পশ্চিম সীমা জুড়ে, তাতে যে শুধু খদ্দের নেই, তা-ই নয়, দোকানদাররাও কেউ-কেউ উঠে পড়েছে। তরি-তরকারির বাজারে ভিড়টা আছে–শেষ দিকের ঘরুয়া হাটের মানুষের ভিড়, শস্তায় নানারকম জিনিশ এখন পাওয়া যায়। জামাকাপড়ের দোকানগুলোতেও ভিড় লেগে আছে, বিশেষ করে নাইলনের গেঞ্জির দোকানে।

আলো কোথায় বেশি আর কোথায় কম এই নিয়ে যেন হাটটাকে কয়েকটা ভাগে ভাগ করা যায়। একেবারে উত্তরে, এক কোণে, একটা চালাঘরে চায়ের দোকানের মুখ হাটের দিকে। সেখানে হ্যাজাক জ্বলছে। চালাঘরটা এই হাটের যেন শুরু। কিন্তু তার বাইরেটা যত পরিষ্কার দেখা যায়, ভেতরটা তত দেখা যায় না। সামনে দাঁড়ালেও মানুষকে মনে হচ্ছে ভেতরের অন্ধকার থেকে বাইরের আলোর দিকে তাকিয়ে আছে। মুখের আর জামার এক-একটা অংশ একটু উজ্জ্বল বাকিটা অন্ধকারে মিশে আছে। সামনে কতকগুলো বেঞ্চ। তাতেও অনেকে বসে। তাদের ছায়াও সেই চালাঘরের ভেতরের দিকে পড়ায়, ভেতরটা আরো অন্ধকার।

তার সামনে এমনি কিছুটা অন্ধকারের বিস্তার, যেন মনে হয় কিছুটা জলের ওপারে ঐ চালাঘর। সেই কিছুটা অন্ধকার পেরিয়ে দুটো লম্বা সারির আলোর গলি। দুটো গলি না তিনটে গলি বোঝা যায় না। কিন্তু প্রায় প্রত্যেক দোকানেই হ্যাজাক থাকায় মনে হয় ওখানে একটা বেশ বড় বেচকেনা চলছে। জামাকাপড়ের দোকান। সবগুলো আলোই হ্যাজাকের নয়, মাঝে-মাঝে কার্বাইডের আলোও আছে। হ্যাজাকের লালচে আলোর পুঞ্জগুলির মধ্যে কার্বাইডের আলোর নীল শিখাগুলি ও সেই শিখাগুলির বিচ্ছুরিত আলোর ঠাণ্ডা বৃত্ত রঙের কেমন একটা নকশা তৈরি করে কমলায়-নীলে-ফিরোজার।

সেই আলোর নানা রঙের মিশেলের ওপর, আবার কুপি জ্বালানো অন্ধকারের চাকের পর, ঐ কাপড়হাটির সমকোণে লম্বা হাঁড়িহাটি। সারি-সারি উল্টনো হাঁড়ির ওপর কুপি বসানেলাইন করে, যেমন জলের ভেতর চরের নিশানা থাকে, একটু পরপর। কুপির আলোর বৃত্তের মধ্যে পোড়ামাটির লালচে। তেমনি পোড়ামাটির লালচে বৃত্ত, পর পর, পর পর, অনেক দূর। লম্বা সারির নির্জনতায় কুপির শিখা কাপে, মাটির হাঁড়িতে লালচে বৃত্ত দোলে, গোল-গোল মাপ-মত ছায়ারা হাঁড়ির বর্তুলে ছলকে-ছলকে যায়–যেন অন্ধকার, জলের মত তরল। ফলে, মনে হয়–এই দৃশ্যটা সাজানো। বা, এ যেন ঠিক হাটের ভেতরের দৃশ্য নয়।

হাঁড়িহাটির পরেই গো-হাটা, অন্ধকার, এক-একটা টর্চের আলো আচমকা ঝলসে যায়। এক-একটা হা-ম্বা ডাক অন্ধকার থেকে উঠে অন্ধকারেই আবার মেশে। ডাকের শেষটুকু একটা রেশ হয়ে যায় বলেই মিশে যেতে পারে। গো-হাটার কিছুই দেখা যায় না। কিন্তু হঠাৎ এই হাম্বা-ডাকে কেমন যেন, মনে হয় ওখানে অন্ধকারে কাদায় পা ডুবিয়ে নীরবে যেন অন্ধ হয়ে আছে আরো পশুপাখি, মোষ, মুরগি, হাঁস, পায়রা, পাঠা। তারা এখন অন্ধকারে ক্রমেই অন্ধ ও নীরব হতে থাকবে।

গো-হাটিকে ডাইনে রেখে বয়ে বেঁকলে, আবার একটা সমকোণে, একটু ডাঙামত জায়গায় ক্রমেই দক্ষিণ থেকে দক্ষিণে ছড়িয়ে গেছে এই হাটের সব চেয়ে বড় বাজার–পাইকার-হাটি। এখন সেই বিস্তারটা বোঝা যায়, বোধ হয় জায়গাটা ডাঙা বলেই, ক্রমেই উত্তর থেকে দক্ষিণে ডাঙা বলেই। এখন সেই ডাঙাটা বোঝা যায়, বোধ হয় জায়গাটা প্রায় একেবারে ফাঁকা বলেই, ক্রমেই বেশি কাঁকা আর যত দক্ষিণে তাকানো যায়, তত বেশি ফাঁকা। এই ডাঙাটার মধ্যে বা শেষে কোথাও আর বেশি আলোর কোনো দোকানপাট বা বাজার নেই। তাই এই ডাঙাটায় ছড়ানো কুপি, মোমবাতি আর লণ্ঠনের আলোয় যেন মনে হয় নদীর ভেতরে ছড়ানো-ছিটনো আলোজ্বালানো নৌকোর নদী। সেই একই রকম উজ্জ্বলতার আলো অতটা জায়গা জুড়ে ডাঙা হয়ে ছড়িয়ে আছে। তকতক করে বারবার ঝাড় দেয়া মাটি। তবু বর্ষা বলে কালচে। আর তাতে ছোট-ছোট ঢিবি, বেশির ভাগই শুকনো লঙ্কার, অনেকগুলো আলুর, মনে হতে পারে শুকনো লঙ্কা আর আলুই এদিককার প্রধান জিনিশ। পাইকারি হাটটায় আলু আর শুকনো লঙ্কা, আলু আর শুকনো লঙ্কা আর মাঝে-মাঝে পেঁয়াজের পাজাই ফাঁকায় ফাঁকায় ছড়িয়ে। এক-একটা পঁজার জন্য অনেকখানি জায়গা ছেড়ে দেয়া। বেচাকেনায় অনেকখানি জায়গা দরকার। মাঝে-মাঝে মোটা বাশের চারটে খুটিতে কাঠের বিরাট-বিরাট পঁড়িপাল্লা ঝুলছে। সেই বিরাট সাইজের পাল্লাগুলোর একটা দিকে ভার বসানো। আর-একটা দিক বাতাসে দোলে। মোমবাতি আর কুপির শিখার আলোতে ঐ বিরাট কাঠের পাল্লা আর লম্বা নাইলনের দড়ি অতিকায় ছায়ায়-হায়ায় পাক খায়।

পাইকার-হাটির পুব সীমা ধরে, হাটের দিকে মুখ করে বসা পাটহাটি! একটা সারিই এদিকে মুখ করে। তার পেছনের অংশটা মাঠেই ছড়িয়ে। সেখানে গরুর গাড়ির সারি, ওপরে পাটের বোঝা। গাড়ি ধরেই বিক্রি। এখনো গাড়িই আছে। আর গরুর গাড়ির আনাচকানাচে সামনে-পিছনে মানুষজনের আসাযাওয়া। গরুর গাড়ির চাকার ফাঁক দিয়েও দেখা যায়-ওদিককার কিছু মানুষজনের বসে থাকা বা চলাফেরা। পাটহাটির গরুর গাড়িগুলোতে লণ্ঠনই বেশি। আবার রাস্তা ধরে যেতে হবে। মাঝে-মাঝে শুধু টর্চ ঝলসায়।

পাইকার-হাটির দিকে মুখ করে বসা, পাটহাটির প্রথম লাইনটার শেষে দক্ষিণ সীমায়, মাটির ওপরই ছড়িয়ে রাখা হাল আর হালের আল। হালই বেশিফরেস্টের বিনি পয়সার কাঠে বানানো–বেশ বড়, শক্ত, হাল। ছোট রাস্তার ওপর ছড়ানো চা বাগানের চোরাই কলমকাটা ছুরি, দা কোদালি, ফাড়য়া। তার পাশে কামারের তৈরি দাকুড়োল, হাতুড়ি বড় সাইজের। কিন্তু সংখ্যায় বেশি নয়। আজকাল টাটা কোম্পানির কোদাল আর কুড়ল পাওয়া যায় লোহার দোকানে, তার ভারও বেশি, ধারও বেশি, দামও বেশি। তারও পাশে প্রায় অন্ধকারে কিছু চেয়ার, টেবিল, ছোট আলমারি–জাল দেয়া, এমন-কি একটা আয়না-লাগানো ড্রেসিং টেবিলও–বেশ চকচকে পালিশে মোমের আলো পিছলে যায়। আপাতত মনে হয়, হাটটা বুঝি এইখানেই শেষ হয়ে গেল। কিন্তু তারও পর, অন্ধকার মাঠ থেকে দুর্গন্ধ আসে। একটু নজরে লোকজনের আসা যাওয়াও বোঝা যায়। সারের এফ-সি-আই-এর ইউরিয়া আর মিশ্রসারের চোরাই বাজার। বসেই সন্ধ্যার পর। একটুখানি সময়ের মধ্যেই বিক্রি হয়ে যায়।

সারের হাটটার কাছে ত পৌঁছনো যায় না। গন্ধে তার আভাস পাওয়া যায়। মনে হয় হাটটা যেন অন্ধকারে মিলিয়ে গেছে। কিন্তু সেই অন্ধকারের দিকে, সেই গন্ধ শুঁকতে-শুঁকতে তাকিয়ে থাকলে যেন মনে হতে থাকে দূরে-দূরে অন্ধকারে, মাঠে-মাঠে, আরো দূরে-দূরে হাটটা ছড়িয়ে-ছড়িয়ে যাচ্ছে। অন্ধকার সেই মাঠের ভেতর থেকে আওয়াজ উঠে আসে চাপা প্রতিধ্বনির মত, কিন্তু ধারাবাহিক। যেন বাশের পঁজার ওপর গাড়ি-গাড়ি বাশ ফেলার আওয়াজ। সেই চাপা আওয়াজ একবার শোনা গেলে কানে আসতেই থাকে। থামে না। হতে পারে, ট্রাকের পর ট্রাক বাঁশ লোড হচ্ছে–টিটাগড়ের কাগজ কারখানার জন্যে। হয়ত ফরেস্টের সাপ্লাই। কিন্তু বেশির ভাগই কনট্রাকটারের। সে ফরেস্ট থেকেও কেনে, চাষির কাছ থেকেও কেনে। নইলে গ্রামের বন্দরের হাটে কখনো বাশহাটি বসত না। আবার হতেও পারে এটা বাশের আওয়াজই নয়। এমন ধারাবাহিক আওয়াজ ত অন্ধকারের ভেতর থেকে নানা কারণেই উঠতে পারে। দিনেও হয়ত ওঠে। কিন্তু অন্ধকারেই হয়ত বেশি শোনা যায়। তিস্তা কোন দিকে? কতদূর? তিস্তার বন্যায় ফরেস্টের কোনো শাল-সেগুন ভেঙে পড়েছে। এখন অন্ধকারে রাতারাতি তা টুকরো-টুকরো হয়ে বেরিয়ে আসছে। হতে পারে সেই কুড়োল কাটার শব্দ। বা, এখন সন্ধ্যায়, সেই দূরের ন্যাশন্যাল হাইওয়ে দিয়ে ট্রাকবাস যাওয়ার আওয়াজ মাটি কাঁপিয়ে আসে। বা পাহাড়ের ওপরের কোনো বন্যা ন্যাওড়া নদী দিয়ে এখুনি বয়ে যাচ্ছে–দুই পাড়ে ধাক্কা দিয়ে আরে বেগে ও আরো বেগে। কোথাও হুড়মুড় করে পাথর পড়ছে? নাকি চা বাগানের জেনারেটারের আওয়াজ ফরেস্টে নদীতে প্রতিধ্বনিত হয়ে-হয়ে ঘুরপাক খাচ্ছে? কুপি আর মোমবাতি, কারবাইড আর হ্যাজাকের আলোতে হাটভরা মানুষের আকার অনেক বড় হয়ে গেছে। অন্ধকারটাই প্রধান মাঝে-মাঝে আলোর ছোঁয়া, আবার কোনো-কোনো ফাঁকফোকর দিয়ে দু-একবার দিগন্ত বা কোনে অন্যমনস্কতায় আকাশ চোখে পড়লে ব্যাপ্ত অন্ধকারটাই দেখা যায়। আলোর নানা বৃত্তেও শুধু উজ্জ্বলতা নয়। কোনো মদেশিয়া রমণীর পিঠে কাপড় দিয়ে বাধা বাচ্চার মাথা দোল খায়, ওপরেই জেগে থাকে লাল ও কিছু অস্পষ্ট রঙের বুনো ফুলের ঝাড়, কালো চুলে। কালো মুখ অন্ধকারের সঙ্গে কোন অনির্দিষ্ট পরিপ্রেক্ষিতে গিয়ে মেশে। নাইলনের উজ্জ্বলতা পিছলে যায় কোনো তাগড়া আদিবাসী বুক থেকে ধনুকের একটা মাথা দেখা যায়। রাজবংশী রমণীর ফোতার ওপরে উঠে আসে নগ্ন হাত, গলাকাঁধ অন্ধকারে ঝিলিক দেয় কুচকুচে আদিবাসী রমণীর ঝকঝকে দাঁতের সারি। কোথাও নিষ্ঠুরতা ঘটে যেতে পারে। বটগাছের গুঁড়ির মত ভূয়োদর্শী মোঙ্গলয়েড মুখ চামড়ার অসংখ্য কুঞ্চনে নদীর চরের মত জেগে থাকে। কোথাও জমি চষা হয়ে গেছে। মেদহীন তীব্র পাহাড়ি চিবুকে পার্শমুখের শান। টিলার মাথা থেকে সমতল দেখা যায়। এ হাটের বেচাকেনা শেষে এখন যেন ভিড়েরই মুখ–বহু শত বর্ষের আদিবাসী ঘরানার মুখোশে অলঙ্কৃত সে-মুখময় শুধু বিস্ময় বা বিস্ময়ের অবসান। রেখা, রং আর অঙ্গসংস্থানে কোনো নতুনত্ব নেই, একটি মুখোশ থেকে আর-একটি মুখোশ আলাদা করা যায় না, অথচ প্রতিটি মুখোশই আলাদা হয়ে যায় অনিবার্য। এই দীর্ঘ-দীর্ঘ ছায়াসন্নিপাতে সেই মুখোশের ক্ষণিকতা অথচ তার বড় বেশি নির্দিষ্টতায় বিদ্যুচ্চমকিত অরণ্যের আভাস যেন খেলে-খেলে যায়। বা, কখনো, বিদ্যুচ্চমকের জন্য অরণ্যের অন্ধকার প্রতীক্ষা। সেই প্রতীক্ষাতেই নাচের গানে পাহাড়ের প্রতিধ্বনির ক্ষীণতা আসে। একাকী ঢোলে বোল ওঠে। কোন বিস্মৃত নিঝর বয়ে যায়। আর এই ভিড়, আর সওদা, আর বেচাকেনা, আর ভিড়, আর সওদার ভেতরে মিশে গিয়েও মিশতে পারে না, ভিড়ের হয়েও ভিড় থেকে যেতে পারে না, আরো একবার মেলায় এসেও যেন হারিয়ে যাওয়া আর ফিরে যাওয়ার মত বিষণ্ণ, আত্মবিস্মৃত, বিচ্ছিন্ন মুখ, মুখ, মুখের সারি।

.

০১০.

 হাটের আড়ালে হাট

হাটের পুব দিক থেকে উত্তর ঘিরে যে রাস্তাটা বেঁকে গেছে, সেই সমকোণেই ত এই হাটটা বসেছে। হাটের পাশে সারি সারি দোকান হাটটাকে রাস্তা থেকে আড়াল করেছে। বেশির ভাগ দোকানের মুখ রাস্তার দিকে। দু-একটা দোকানের পরই একটা করে ফাঁক-হাট থেকে বাইরে বেরবার। এ রকম ফাঁক-ফোকর অনেক।

তেমনি একটা ফাঁকের পাশে দু সারি দোকানের মাঝখানে পাটহাটিরও উত্তরে এক লম্বা-জমিতে হাটের আড়ালে হাট। খুব কাছাকাছি লাইন দিয়ে কুপি জ্বলছে। একদিকে সেই কুপির আলো বাইরে বেরতে পারছে না, নোয়ানো মানুষগুলোর মুখ চোখকেই শুধু আলোকিত রাখে। আর-একদিকের শিখাগুলোতে কোনো আড়াল নেই, যেন দমকা বাতাসে নিবে যেতে পারে। সাট্টা, জুয়া, ডুগডুগি খেলা চলছে। জায়গাটা লম্বাটে। জুয়ার টেবিল মাটির ওপর বা টুলের ওপর বসেছে লাইন দিয়ে–যেন বসার ভেতর একটা পরিকল্পনা আছে। কোনো কথা বা আওয়াজ শোনা যায় না। কেউ-কেউ দাঁড়িয়ে এ টেবিল থেকে অন্য টেবিলে উঁকিঝুঁকি মারছে। বেশির ভাগই নিচু হয়ে খেলছে। জায়গাটা যেন অন্ধের হাত। কেউ কিছু দেখছে না। সন্ধ্যা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বেআইনি হাট বসে গেছে। আসল হাট উঠে যাবে, এই হাট যতক্ষণ ইচ্ছে চলবে। কিন্তু বেআইনি বলেই এক ধরনের দ্রুততা আসে। সবাই যেন একই দ্রুততায় নিজের খেলাটুকু সারতে চাইছে।

আর-এক পাশে সারি সারি অ্যালুমিনিয়ামের ডেকচি আর গ্লাশ নিয়ে মেয়েরা। ডেকচিগুলোর ওপরে গামছার ঢাকনা। প্রত্যেক ডেকচি ঘিরেই ভিড়। হাড়িয়া বা পচাই। কোনো মাতালের স্বলিত চিৎকার নই। খুব চাপা স্বরে, প্রায় ফিসফিসের মত, স্বরের জড়তা, কথাটা ঠিক বোঝা যায় না। কিন্তু অতৃপ্ত আকাঙ্ক্ষার মত শোনায়।

মাটি থেকে উঠছে কেউ। এতক্ষণ মাটিতে গড়াচ্ছিল। হামাগুড়ি দিয়ে, উবু হয়ে বসে, দুই হাঁটুতে দুই হাতের ভর দিয়ে উঠতে গিয়ে বসে পড়ে। কিন্তু আবার সোজা উঠতে থাকে, মাথাটা একটু দোলে, তারপর খাড়া দাঁড়িয়ে অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে বলে, দেখলে, দেখ। দেখ দেখ, ভাইমন অউর হিনমন, দেখো, হাম খাড়া উঠলেক হো—আ-আ-ডা। এই খাড়া হয়ে উঠতে ও খাড়া ভাবটা রাখতে, তাকে কিছুটা মেহনত করতে হয়। তার পা যাতে না টলে তার মাথা যাতে না টলে, সেটা সামলাতে তাকে শুধু কোমরটা টলাতে হয়, কোমর থেকে গলা পর্যন্ত অংশটাও পাক খায়। ফলে সেই অন্ধকারে তার এই একান্ত একাকী প্রয়াস চলতে থাকে–সে শক্ত ও সোজা পা ফাঁক করে দাঁড়িয়ে, মাথাটা শক্ত ও সোজা, মাফখানের পেট, বুক মাঝে মাঝেই যেন ভেঙে পড়তে চায় কিন্তু কোমরটা দুলিয়ে সেটা সামলাতে হয়। সেই সামলানোর সময় কোনো পা হয়ত হাঁটু দুমড়ে পড়তে চায় কিন্তু তখন পটের দুলুনি উরুতে এনে উরুতেও একটা দোলানি দিয়ে সে ভাঙনটা রোখে। আর এর সঙ্গেই সেই স্থির মাথার স্খলিত উচ্চারণে সে চ্যালেঞ্জ জানায়, কুন কহথে মায় মাতৃগেলাক? কভি নেহি। হাম কভি মাতোয়ালা হনে নাহি শেকথে। এই দেখ। পাক্কা দে। হাম এই দোনো পায় পর খাড়া হয়। এই দেখ। পাক্কা দে। হামারা ই মাথাঠে ভি খাড়া হায়! তব? তব ভি হাম মাতোয়াল? কভি নেহি? এই দেখ, হাম পারিড করেগা। রে-ডি, ওয়ান টু থ্রি, লেফট রাইট, লোকটি তার পা দুটো একবারের বেশি তুলতে পারে না। তাতেই তার সমস্ত শরীরটা হুমড়ি খেয়ে যায়। লোকটা মাটির ওপর শুয়ে পড়ে।

আবার কিছুক্ষণ পর লোকটি হামাগুড়ি দিয়ে ওঠে কিন্তু বসে না। হামাগুড়ি দিয়েই ঐ হাড়িয়ার সারির দিকে এগয়। তারপর এক জায়গায় গিয়ে থামে। হামাগুড়ি থেকে উবু হয়ে বসে। আবার দাঁড়াবার জন্য দুই হাঁটুর ওপর দুই হাতের ভর দেয় কিন্তু উঠতে পারে না বা ওঠার চেষ্টাও করে না। সেখান থেকে অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে-তাকিয়ে বলে, দেখ, হাম পারেড ভি করলেক, আভি হামকো অউর এক গ্লাশ দে। হাম তো মাতোয়াল নাহি হোলাক, হে ডায়ানা, হাম জরুর অউর এক গ্লাশ পিগা, হে ডায়ানা, হামকো জরুর–

যে-মেয়েটি গ্লাশে-গ্লাশে হাঁড়িয়া দিচ্ছিল তার কাছে গিয়ে লোকটি দাঁড়ায়। যারা খাচ্ছিল তারা কেউ তার দিকে ফিরেও তাকায় না। মেয়েটির পাশে গিয়ে বসতে চেষ্টা করে। কিন্তু পা দুটো ভাজ করতেই টলে যায়। তারপর একবার টাল সামলাতে না পেরে ধপ করে পড়ে যায়। মাটির ওপর সোজা হয়ে বসে সে আবার সেই মেয়েটির দিকে হাত বাড়িয়ে বলে, হে ডায়ানা, হাম জরুর পিয়েগা, পয়সা লে, দারু দে। সেই মেয়েটি তার দিকে মুখ না ফিরিয়ে ডান হাত দিয়ে একটা ধাক্কা দিতেই লোকটি একেবারে গড়িয়ে যায়। আর ওঠে না।

বাতাসের মত ফিসফিস ফিসফিস স্বরে সহসা রটে যেতে থাকে জাপানি টেরিলিন, ষাট টাকা প্যান্ট পিস, সিকো ঘড়ি, বাঁ-হাতের পাতার ওপর মেলে ধরা কোনো ঘড়ির রেডিয়ামের বিদেশী দ্যুতিতে অন্ধকারে আদিবাসী চিবুকের ডৌল। লোকটা মুঠো বন্ধ করে ফেলে। আলো নিভে যায়। চিবুকের ডৌল অন্ধকারে মিশে যায়। বাতাস পাক খায় জাপানি হংকং, মেড ইন ইউ. এস. এ। সাট্টা আর জুয়োর ভিড়টা হুমড়ি খেয়ে খেলছে। আর চাকা থামলে, বা ডুগডুগি ওঠালে, বা, লুডোর গুটির মতো গুটি ফেললে একবার সমবেত হি-ধ্বনি উঠেই আবার চাপা হিংস্র নীরবতা।

জুয়োর বোর্ডের কিছু দেখা যায় না। কুপির শিখা মানুষজনের মুখের ওপর লকলক করছিল, দপদপ করছিল, পিছলে যাচ্ছিল। হাটের দূরদৃশ্যের মত নয়–অতি নিকট দৃশ্য। এত নিকট যে হাত-পাও দেখা যায় না, শুধু মুখ, বা সূর রেখা বা কপালের চ্যাপ্টা বা কালো কুচকুচে নাকের একটি পাশ। সাট্টা বোর্ডের কুপির আলোতে চেনা যায় না বোর্ডের মালিকের মুখটা-নেপালি, রাজবংশী, মেচ; কোচ, রাভা যে কোনো কিছু হতে পারে, পেছন থেকে দেখলে মাথার খুলিতে সঁওতালের লম্বাটে ধাচও যেন দেখা যায়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *