দস্যু দুহিতা

দস্যু দুহিতা – রোমেনা আফাজ [দস্যু বনহুর সিরিজের দ্বাদশ উপন্যাস।]

০১.

ভোরের শীতল হাওয়া শরীরে লাগতেই ঘুম ভেঙ্গে গেল দস্যু বনহুরের। হাই তুলে শয্যায় উঠে বসল সে। গত রাতের ঘটনাগুলো একেরপর এক মনে পড়তে লাগলো–সর্বপ্রথম স্মরণ হলো নূরীর কথা, না জানি সে ঘুমোতে পেরেছে কিনা—

হঠাৎ বনহুরের চিন্তাজালে বাধা পড়ল ক্যাবিনের দরজায় এসে দাঁড়াল রহমান-সর্দার–

বনহুর তাকে ডাকল–ভেতরে এসো রহমান

রহমান ক্যাবিনে প্রবেশ করতেই বনহুর বলল–এবার বজরা ছাড়ার আয়োজন কর।

রহমান মুখ তুলল, বিমর্ষ মলিন তার মুখ, বেদনাভরা গলায় বলল সে–সর্দার নূরী নেই।

চমকে উঠলো বনহুর বিস্ময়ভরা আরষ্ঠ কণ্ঠে বললো–নূরী নেই।

কখন যে নূরী বজরা থেকে চলে গেছে আমরা জানি না।

বনহুর ব্যস্তভাবে শয্যা ত্যাগ করে নেমে দাঁড়াল, রহমানকে লক্ষ্য করে বলল–দুটো বজরাই খুঁজে দেখেছ?

হ্যাঁ সর্দার, দুটো বজরাই খুঁজে দেখা হয়েছে।

এমন সময় দ্বিতীয় বজরায় নূরীর দাসী কাঁদতে কাঁদতে এসে দাঁড়াল সেখানে—হুজুর, মনি নেই। ওকে খুঁজে পাচ্ছি না।

চিত্রার্পিত্রের ন্যায় দাঁড়িয়ে বনহুর প্রতিধ্বনি করে উঠল—মনিও নেই।

দাসী ক্রন্দনজড়িত কণ্ঠে বললনা।

বনহুরের চোখের সামনে সীমাহীন চিন্তাজাল জট পাকাতে শুরু করল। নুরী যখন গত রাতে তার নিকট থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেল তখন তাকে অতি বিষণ্ণ মলিন দেখাচ্ছিল। নূরী তারপর একটি কথাও বলতে পারেনি তাকে। বনহুর নূরীকে সান্ত্বনা দেবার অনেক চেষ্টা করেছিল, কিন্তু ব্যর্থ হয়েছে সে। নূরীর মুখে বনহুর কিছুতেই হাসি ফোটাতে পারেনি।

নূরীকে তার বজরায় বনহুর নিজে পৌঁছে দিয়ে এসেছিল। তারপর সবকিছু ঠিকঠাক করে রাতটুকুর মত কোন নির্জন স্থান দেখ বজরা বাঁধার নির্দেশ দিয়েছিল সে নিজে। তখন কি বনহুর ভেবেছিল যে, নূরী পালিয়ে যাবে। তাহলে কিছুতেই সে বজরা বাঁধার আদেশ দিত না।

আজ নূরীর অভাব বনহুরের হৃদয়ে প্রচন্ডভাবে আঘাত করল। বনহুর কিছুক্ষণ স্তব্ধভাবে চিন্তা করে বলল—তাজকে নিয়ে কায়েস বোধ হয় কান্দাই পৌঁছে গেছে।

হাঁ সর্দার, তাজ আর দুলকী এতদিনে কান্দাই পৌঁছে গেছে। সর্দার, বজরা ভাসান হবে না?

না। যতক্ষণ নূরীকে খুঁজে না পাই ততক্ষণ বজরা এখানেই থাকবে। রহমান, তুমি প্রস্তুত হয়ে নাও, এখনই যাব নূরীকে খুঁজতে।

রহমান আর বনহুরের মধ্যে যখন কথাবার্তা হচ্ছে, তখন মনিরা এসে দাঁড়াল সেই ক্যাবিনে। মনিরা বনহুরের মুখোভাব লক্ষ্য করে বেশ বুঝতে পারল তার মনোভাব স্বাভাবিক নেই। ইতোমধ্যে গত রাতের মেয়েটি-যে তাদের বন্দী করেছিল সে উধাও হয়েছে কথাটা তারও কানে গিয়েছিল। রাতের অন্ধকারে মেয়েটিকে সামান্য দেখে মনিরা তাকে চিনতে পারেনি, কারণ তার শরীরে ছিল পুরুষের পোশাক। আজ সকালে একজন অনুচরের মুখেই শুনতে পেয়েছে, সেই যুবক পুরুষ নয়-নারী। এবং এটাও মনিরা জানতে পেরেছিল—তার নাম নূরী। সেই থেকে তার মনের কোণে যন্ত্রণার কাঁটা বিঁধছিল। তাই মনিরা ছুটে এসেছে, কিন্তু এসে স্বামীকে গম্ভীর ভাবাপন্ন বিষণ্ণ দেখতে পেয়ে থমকে দাঁড়াল।

রহমান বেরিয়ে গেল ক্যাবিন থেকে।

মনিরা স্বামীর পাশে ঘনিষ্ঠ হয়ে দাঁড়াল—এই গহন বনে নামবে তুমি?

হাঁ মনিরা।

কিন্তু…

উপায় নেই।

আমিও যাব তোমার সঙ্গে।

তা হয় না।

কেন?

এসব বন অতি ভয়ঙ্কর স্থান। জানি না নূরী এতক্ষণ বেঁচে আছে কিনা, তাছাড়া তার কোলে শিশু মনি আছে।

বনহুরের কথায় মনিরার কুঞ্চিত হল, নূরীর পরিচয় সে জানত। কান্দাইয়ের পোডড়াবাড়িতে নূরীর সঙ্গে একবার তার দেখাও হয়েছিল, তা ছাড়া এ নামটা বনহুরের মুখেও দু’এক দিন শুনেছিল মনিরা। আর এটাও মনিরা জানত, নূরী বনহুরকে ভালবাসে শুধু ভালবাসে নয়, প্রাণ দিয়ে সে চায় ওকে। সেই নূরীর কোলে শিশুসন্তান–মনিরার মনে সন্দেহের দোলা লাগে।

বনহুর ততক্ষণে নিজের কাল দস্যু ড্রেস পরতে শুরু করেছে।

মনিরা নিৰ্ণিমেষ নয়নে তাকিয়ে দেখতে লাগল। কতদিন সে স্বামীকে এই ড্রেসে দেখেনি। বড় সুন্দর লাগছে বনহুরকে। স্বামীর বুকে মাথা রাখার জন্য মনিরার মন হাহাকার করে উঠল। কিন্তু এখন বনহুরের মনোভাব সম্পূর্ণ অন্য রকম। কোনদিকে যেন তার খেয়াল নেই। নূরী আর তার কোলের শিশুটাই যেন তার একমাত্র লক্ষ্য। অভিমানে ভরে উঠল মনিরার মন।

বনহুরের পোশাক পরা হয়ে গেছে। রাইফেলটা হাতে তুলে নিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াল—মনিরা, তোমরা সাবধানে থাকবে। যতক্ষণ না ফিরে আসি বজরার বাইরে কেউ বের হবে না। একবার মনিরার মুখের দিকে তাকিয়ে বনহুর দ্রুত কক্ষ থেকে বেরিয়ে গেল।

রহমান তার ড্রেস পরে রাইফেল হাতে কক্ষের বাইরে প্রতীক্ষা করছিল।

রহমান আর বনহুর বজরার সিঁড়ি বেয়ে নিচে নদীতীরে নেমে গেল। মনিরা ছুটে এসে বজরার মুক্ত জানালায় দৃষ্টি নিক্ষেপ করল।

বনহুর আর রহমান গহন বনের মধ্যে অদৃশ্য হতেই মনিরা ছুটে এসে লুটিয়ে পড়ল বনহুরের শূন্য বিছানায়। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল। আজ মনিরার মনে নানা কথা উদয় হচ্ছে। তার নারী জীবনে কি এতই বিড়ম্বনা ছিল। স্বামী-সন্তান নিয়ে সবাই সুখের ঘর বাঁধে, ছোট একটা পরিচ্ছন্ন সংসার গড়ে তোলে, আর তার জীবনটা এসব থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। স্বামীভাগ্য তার সত্যি অতি অদ্ভুত, যা কোন নারীর ভাগ্যে হয় না। দস্যু বনহুরকে স্বামীরূপে পাওয়া—এ চরম, সার্থক নারী জীবনের পরম উপলব্ধি। কোন মেয়ে যা কোনদিন কল্পনা করতে পারে না বা পারেনি, বজরার জীবনে সেই কল্পনা বাস্তবে পরিণত হয়েছে সেই দুর্লভ রত্ন সে লাভ করেছে এর চেয়ে আর কি সে কামনা করতে পারে। কিন্তু তবুতো মনিরার জীবন আজ অভিশপ্ত, এত পেয়েও না পাওয়ার হাহাকারে তার অন্তর জর্জরিত, নিষ্পেষিত। এর চেয়ে না পাওয়াটাই ছিল তার জীবনের সান্ত্বনাময় একটি দিক। এখন পেয়ে না পাওয়ার দীর্ঘশ্বাসের জ্বালা বড়ই অসহ্য তীক্ষ্ণ। মনিরা ফুলে ফুলে কাঁদতে থাকে।

গোটা রাতের ঝড়-ঝঞার ঝাপটায় সুফিয়ার শরীর ক্লান্তি আর অবসাদে ভরে উঠেছিল, অঘোরে ঘুমাচ্ছিল সে। ঘুম ভাঙতেই মনিরাকে না দেখে উঠে বসে বিছানায়।

বজরার জানালাপথে তখন ভোরের সূর্যের আলো মেঝেতে এসে পড়েছে। সুফিয়ার মনে গত রাতের ঘটনাগুলো ধীরে ধীরে ভেসে উঠল। মনে পড়ল মনিরার কথাগুলো, বিনয় সেন মনিরার স্বামী কাল রাতে মনিরা তার কাছে সব কথাই খুলে বলেছে। তবে কি আজ ভোর হতে না হতেই মনিরা তার স্বামীর কক্ষে গিয়েছে? হয়তো তাই, বহুদিন পর স্বামীর সন্ধান পেয়েছে বেচারী, তদুপরি যা তা স্বামী নয়! পুরুষের মত পুরুষ বটে বিনয় সেন। মনিরার স্বামীভাগ্য অতি গৌরবময়।

সুফিয়ার মনে একটা অতৃপ্ত কামনা উঁকি দিয়ে গেল। শিহরণ জাগল তার হৃদয়ে। নিশ্চয় এখন তার স্বামীর বুকে মাথা রেখে অনাবিল শান্তি অনুভব করছে। স্বামীর বাহুবন্ধনে নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে তার নারীজীবন সার্থক করে তুলেছে। এ দৃশ্য না জানি কত মধুর, স্বর্গীয়, সুফিয়া উঠে দাঁড়াল, চুপি চুপি পাশের মুক্ত জানালার পাশে গিয়ে উঁকি দিল। কক্ষে দৃষ্টি পড়তেই সুফিয়ার কল্পনাজাল ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হলো –একি, কোথায় সেই মহাপুরুষ–মনিরাই বা বিছানায় লুটিয়ে অমন করে কাঁদছে কেন?

সুফিয়া কিছুক্ষণ নির্বাক পুতুলের মত দাঁড়িয়ে রইল। তারপর অতি লঘু পদক্ষেপে কক্ষে প্রবেশ করে ডাকল—মনিরা।

সুফিয়ার কণ্ঠস্বরে মনিরার কান্নার বেগ যেন আরও বেড়ে গেল। বাঁধভাঙা স্রোতধারার মত বাধা বন্ধনহীনভাবে নেমে এলো মনিরার অশ্রু।

সুফিয়া মনিরার পাশে এসে বসল, সস্নেহে পিঠে হাত রেখে ডাকল–মনিরা, কি হয়েছে বোন?

মনিরা কি বলবে, বলার মত কিছুই যে নেই। অন্তরে যে না পাওয়ার বহ্নিজ্বালা অহরহ ধিকধিক করে জ্বলছে তা বলার নয়। নারীর স্বামীই যে একমাত্র সম্বল।

সুফিয়া পুনরায় জিজ্ঞেস করলমনিরা কি হয়েছে তোমার ভাইজানই বা কোথায়?

মনিরা এবার মুখ তুলে তাকাল। দু’চোখে তার অশ্রুধারা ঝরে পড়ছে। অন্তরের ব্যথা পরিস্ফুটিত হয়ে উঠেছে তার কোমল সুন্দর মুখমণ্ডলে।

কতদিন কত সাধনার, কত প্রতীক্ষার পর দেখা পেয়েছিল মনিরা তার অবাধ্য দেবতার। পেয়েছিল ক্ষণিকের জন্য সমস্ত অন্তরের অনুভূতি দিয়ে তাকে উপলব্ধি করার সময়ও পায়নি মনিরা! যতই পেয়েছে ততই ভয় হয়েছে এই বুঝি হারাই।

মনিরার দুশ্চিন্তা সত্যে পরিণত হলো—রাত্রি অবসানের সঙ্গে সঙ্গেই এক মহাবিচ্ছেদের দাবানল তার অন্তরকে জ্বালিয়ে দিল অগ্নিদগ্ধ লৌহ-শলাকার মত। সেই বিচ্ছেদের জ্বালায় অস্থির হয়ে উঠল বুকের ভেতরটা। এই অজানা-অচেনা গহন বনের কোণে অশরীরী আত্মার অদৃশ্য হাতছানি তার সমস্ত কামনাকে চূর্ণ করে দিল! নূরী-নূরীই তার সমস্ত পাওয়াকে মুছে নিয়ে চলে গেছে।

মনিরা বলল—সে চলে গেছে!

সুফিয়ার চোখে বিস্ময় ফুটে উঠল চলে গেছে! ভাই জান গেছে কোথায়, কেন?

মনিরা সোজা হয়ে বসে বলল—ঐ যুবকবেশী নারী অন্য কেউ নয়—সে নূরী। নূরী চলে গেছে, তারই সন্ধানে গেছে সে।

নূরী! কে এই নারী?

ওর পরিচয় আমি জানি না, সুফিয়া। এইটুকু জানি, সে আমার স্বামীকে ভালবাসে।

ভাইজানকে সে ভালবাসে।

হাঁ।

কিন্তু সে যে তোমার।

আমার স্বামী, কিন্তু তাকে ধরে রাখার সামর্থ আমার নেই। ধূমকেতুর মত ক্ষণিকের জন্য তাকে কাছে পাই, আবার কোথায় মিলিয়ে যায় কোন স্বপ্নরাজ্যের মায়াময় জগতে। সুফিয়া, আমি বড় হতভাগিনী।

সুফিয়া মনিরাকে নিবিড়ভাবে টেনে নেয় কাছে। সেও তো নারী নারীর হৃদয়ের ব্যথা তার অন্তরেও নাড়া দেয়। যদিও সে স্বামী কি জিনিস আজও তা উপলব্ধি করেনি, কিন্তু বুঝতে তো পারে। মনিরার অন্তরের ব্যথা তাই সুফিয়ার মনে এক অভিনব দোলা জাগায়। বলে সে মনিরা, একদিন, তোমার পাওয়া সার্থক হবে। আর সে চলে যাবে না তোমার পাশ থেকে,

সেদিন তুমি ওকে অক্টোপাশের মত সর্বক্ষণ ঘিরে থেক।

কিন্তু সেদিন বুঝি কোনদিন আমার জীবনে আসবে না, আমি বুঝি কোনদিন ওকে তেমন করে পাব না সুফিয়া।

ছিঃ এত অবুঝ হলে কেন মনিরা? সে গেছে হয়তো এক্ষুণি ফিরে আসবে। তছাড়া ঐ যে নূরী না কে বললে, এলোই বা সে তার সঙ্গে, কিন্তু তার কি অধিকার আছে তোমার স্বামীর উপর? সে হয়তো তাকে ভালবাসে, তাই বলে স্ত্রীর দাবী নিয়ে কোন সময় তার পাশে এসে দাঁড়াতে পারবে না।

সুফিয়ার কথায় মনিরা সান্ত্বনা খুঁজে পায় না, একটা অজ্ঞাত ব্যথা গুমরে ফেরে তার মনের কোণে। মনিরা জানে নূরী বনহুরের আস্তানায় থাকে। বনহুরকে নিজের করে পাবার জন্য নূরীর চেষ্টার ত্রুটি নেই। নানাভাবে নানা কৌশলে বনহুরকে সে বশীভূত করার চেষ্টা করছে। বনহুর মুখে না বললেও সে দিন কান্দাই বনের পোড়োবাড়ির ঘটনাতেই বেশ অনুমান করে নিয়েছে যে নূরী বনহুরের জন্য উন্মাদ। নিশ্চয়ই নূরী ওকে পাবার জন্য সদা ব্যাকুল থাকে। পুরুষ কতক্ষণ সংযত রাখতে সক্ষম হবে? তবে কি নূরীর কোলে শিশুসন্তান সে তারই…স্বামীর না না, এই চিন্তা তাকে পাগল করে ফেলবে। মনিরা সব বলতে পারে কিন্তু, স্বামীর সম্বন্ধে এ কথাটা কি করে সুফিয়ার কাছে বলবে? অসম্ভব।

সুফিয়া বলে উঠল-কোন চিন্তা করো না। তোমার স্বামী অদ্ভুত শক্তিশালী পুরুষ। তার কাছে বন্য জন্তুর শক্তিও হার মানে। নিশ্চয়ই এসে যাবে। চলো আমরা কক্ষে যাই।

উঠে দাঁড়ায় মনিরা, আঁচলে অশ্রু মুছে বলে চলো।

০২.

গহন বন।

চারদিকে হিংস্র জন্তুর গর্জন আর ভয়াবহ থমথমে ভাব। নূরী শিশুমনিকে বুকে আঁকড়ে ধরে এগুচ্ছে। কোন বাধাবিঘ্নই আজ তার পথ রোধ করতে সক্ষম হচ্ছে না।

সূর্য প্রায় মাথার ওপর।

বেলা অনেক হয়েছে।

নূরী ক্ষুধায় কাতর হলেও তেমন কিছু আসে যায় না। মনির জন্য যত ভাবনা। মনি ক্ষুধায় বার বার নড়েচড়ে উঠছে। লক্ষ্মী ছেলে বলে এখনও তেমনি নীরব রয়েছে। মনি দুষ্ট হলেও বেশ ধীর শান্ত ছেলে, হাজার ক্ষুধা পেলেও সে চিৎকার করে কাঁদত না। ক্ষুধার সময় একটা অদ্ভুত শব্দ করত মনি, আর মাঝে মাঝে দু’হাতের মুঠি দিয়ে চোখ ঘষতো।

নূরীর অজানা ছিল না এসব।

ছোট্ট নাদুস নুদুস কচি কচি হাত দু’খান দিয়ে মনি যখন নাকমুখ ঘষে একটা অস্ফুট ভাঙ্গা শব্দ করতে থাকে, তখন নূরীর মনটা অস্থির হয়ে ওঠে। নিজের জন্য তার চিন্তা হচ্ছে না, চিন্তা তার মনিকে নিয়ে।

ঘন বনের মাঝ দিয়ে এগিয়ে চলেছে নূরী। পাতার ফাঁকে ফাঁকে সূর্যের আলো পড়ায় ঘন বনের জমাট অন্ধকার কিছু কিছু হালকা হয়ে এসেছে।

একটা গাছের তলায় এসে বসল নূরী।

মনি তখন বেশ অস্থির হয়ে পড়েছে। হবে না কেন, মনি তো কচি শিশু। হঠাৎ নূরীর কানে আসে একটা জলধারার ক্ষীণ শব্দ। নূরী উঠে দাঁড়ায় মনিকে বুকে নিয়ে সেই শব্দ লক্ষ্য করে এগুতে থাকে। কিছুদূর এগুতেই নূরীর নজর পড়ে অদূরে ঘন বনের মাঝখান দিয়ে একটি পাহাড়িয়া ঝর্ণা কুল কুল করে বয়ে চলেছে।

মনিকে কোলে করে নূরী ঝর্ণার পাশে এসে দাঁড়াল। নির্মল স্বচ্ছ জলধারা। মনিকে হাঁটুর উপরে বসিয়ে নূরী ঝর্ণার পানি দক্ষিণ হাতে তুলে ওর মুখে ধরল। পিপাসায় কাতর হয়ে পড়েছিল মনি, প্রাণভরে পানি খেল। নূরী নিজেও ঝর্ণার শীতল স্বচ্ছ পানি খেয়ে ক্লান্তি আর তৃষ্ণা দূর করলো।

পানি পান শেষ করেই ফিরে দাঁড়াল নূরী, সঙ্গে সঙ্গে বিস্ময়ে চমকে উঠল। একদল ভীমকায় লোক তার চারপাশে ঘিরে দাঁড়িয়েছে। সকলের হাতেই শরকি, বল্লম আর তীর ধনুক।

নূরীর মুখমণ্ডল মুহূর্তে ফ্যাকাশে বিবর্ণ হলো। ওরা যে কোন দস্যুদল এটা সহজেই অনুমান করে নিল নূরী। কারণ এ পোশাক এবং এ ধরনের লোকজন তার অপরিচিত নয়। শিশু মনিকে বুকে আঁকড়ে ধরে ভীতকণ্ঠে বলল—তোমরা কে? কি চাও?

একজন ঐ দলের সর্দার বা দলপতি হবে সে এগিয়ে এলো নূরীর পাশে, নূরীর শরীরে পুরুষের ড্রেস অথচ তার নারী কণ্ঠ শুনে কিছুটা আশ্চর্য হলো, বলল, তুমি কে?

নূরী চট করে বলল—আমি দস্যু দুহিতা।

লোকটার চোখেমুখে বিস্ময় ফুটে উঠল। অচেনা-অজানা একটা গহন বনের বাসিন্দা হলেও দলপতি যে তার কথাটার মর্ম বুঝতে পারল, তাতে কোন সন্দেহ নেই। মনে মনে খুশিই হলো দলপতি, বলল এবারদস্যু দুহিতা মানে দস্যুকন্যা।

হাঁ, আমি দস্যুকন্যা।

এ বনে কোথা থেকে এলে তুমি?

পথ ভুলে।

ও তোমার কে?

আমার….আমার সন্তান।

এবার দলপতি কঠিন কণ্ঠে বলল-জান এ বনের একচ্ছত্র অধিপতি ডাকু ভীম সেন।

নূরী হেসে নিজেকে স্বচ্ছ করে নিতে চাইল, ভয় পেলে এখন তার চলবে। সেও যে সে মেয়ে নয়, দস্যুরক্ত তার ধমনিতেও প্রবাহিত। গম্ভীর কণ্ঠে বলল সে–তুমিই বুঝি ডাকু ভীম সেন?

না, আমরা ডাকু ভীম সেনের অনুচর। আমি এই দলের নেতা।

ও, তুমি ভীম সেন নও। হাসবার চেষ্টা করল নূরী, বলল তোমাদের দলপতির কাছে নিয়ে যাবে আমাকে?

যে এতক্ষণ নূরীর সঙ্গে আলাপ করছিল, সে ভীম সেনের প্রধান অনুচর রঘু ডাকু।

রঘু বলল—তোমার সাহস দেখে আমি মুগ্ধ হলাম দস্যু দুহিতা। যে ভীম সেনের নাম শুনে মানুষের হৃদকম্প শুরু হয়, সমগ্র আন্দামান রাজ্যের মানুষ যার ভয়ে তটস্থ, সেই ভীম সেনের সঙ্গে তুমি সেচ্ছায় দেখা করতে চাও? সত্যি তুমি সাহসী রমণী। তারপর নিজের দলের দিকে তাকিয়ে বলল রঘু ডাকু—একে সঙ্গে করে নিয়ে চলো আমাদের আখড়ায়।

নূরী ভেতরে ভেতরে যে, ভীত না হয়েছে তা নয়, কিন্তু মুখোভাবে সে ভয়ের চিহ্ন ফুটতে দিল না ডাকাত দলের সঙ্গে এগিয়ে চলল নূরী। পুরুষদের তালে তালে পা ফেলে এগুতে খুব কষ্ট হচ্ছিল তার, তবু মনিকে বুকে আঁকড়ে ধরে চলতে লাগল।

কত বন, জঙ্গল আর ছোট ছোট নদীর মত ঝর্ণা পেরিয়ে এগুলো তারা।

গহন বন ছাড়িয়ে তারা একটা পাহাড়িয়া জঙ্গলায় এসে পৌঁছল। সন্ধ্যার ঝাপসা আলো তখন পৃথিবীর বুকে নববধুর মত ঘোমটা টেনে দিয়েছে।

মস্তবড় একটা গুহার সামনে এসে দাঁড়াল রঘু ডাকু ও তার দলবল।

রঘু তিন বার হাতে তালি দিল।

সঙ্গে সঙ্গে মেঘ গর্জনের মত একটা শব্দ হলো। নূরী বিস্ময়ে তাকিয়ে দেখল সম্মুখস্থ গুহার মুখের প্রকাণ্ড পাথরখণ্ড ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছে। পাহাড়টা যেন কোন অদৃশ্য ইংগিতে কেঁপে কেঁপে উঠছে।

অল্পক্ষণেই গুহার মুখ একটা সুড়ঙ্গপথে পরিণত হলো। রঘু তার দলবল নিয়ে প্রবেশ করল সুরঙ্গপথে। নূরীও রয়েছে তার সঙ্গে।

দস্যু বনহুরের সঙ্গিনী নূরী, নিজেও সে দস্যু দুহিতা—কিন্তু এসব যেন তার কাছে নিজেদের আস্তানার চেয়ে আরও ভয়ঙ্কর বলে মনে হলো।

নূরী রঘু ডাকুর সঙ্গে এগুচ্ছে।

পেছনে ডাকাতদল সারিবদ্ধভাবে এগিয়ে আসছে।

নূরীর হৃদয়ে ভয়-ভীতি আর দুশ্চিন্তা জোট পাকাচ্ছিল। সে নারী-এতগুলো পুরুষের সঙ্গে একা। না এসে কোন উপায় ছিল না, জোর করেই ওকে ধরে আনত, কাজেই স্বেচ্ছায় এসেছে সে। এখন কৌশলে নিজেকে বাঁচিয়ে চলতে হবে। নারী হলেও সে অন্যান্য মেয়ের মত দুর্বল প্রাণ নয় এত সহজেই ভীত হলে তার চলবে কেন?–

নূরী মনিকে কোলে নিয়ে রঘু ডাকুর সঙ্গে এগুচ্ছে।

পাথর কেটে যেন সুড়ঙ্গপথটা তৈরি করা হয়েছে।

কিছুটা এগুনোর পর রঘুর অনুচরগণ দু’দলে বিভক্ত হয়ে সুড়ঙ্গের দু’পাশে কোথায় অদৃশ্য হয়ে গেল। নূরী অবাক হয়ে তাকাল পেছনে।

রঘু ডাকু বলল—এরপর আর যাওয়া চলবে না, শুধু তুমি চলো আমার সঙ্গে।

নূরীর মনে কেমন একটা ভয় দোলা দিয়ে গেল। যা হোক, এতগুলো লোক থাকায় তবু একটু সাহস ছিল তার মনে। কেমন যেন দুর্গম পথ। গাঢ় অন্ধকার কিছুটা দূরীভূত করেছে সুড়ঙ্গের মাঝে মাঝে জ্বলন্ত মশালের আলো।

রঘু ডাকু আর নূরী, কোলে তার শিশু মনি, দু’জনেই এগুচ্ছে।

বেশ কিছুটা চলার পর সামনে তাকিয়ে হঠাৎ চমকে, শিউরে উঠল নূরী। সুউচ্চ পাথরাসনে ভয়ঙ্কর জমকালো একটা লোক বসে রয়েছে। তার দু’পাশে দু’জন ঐ রকম চেহারা লোক সুতীক্ষ্ণধার বল্লাম হাতে দণ্ডায়মান।

দেয়ালের দু’পাশে দুটো মশাল দপ দপ করে জ্বলছে। মশালের আলোতে ডাকাত দলপতি ভীম সেনের জমকালো চেহরার জমাট পাথরের মূর্তি বলেই মনে হচ্ছে। মাথায় কঁকড়া চুল। মস্ত একজোড়া গোঁফ। চোখ দুটো যেন আগুনের ভাটার মত জ্বলছে।

নূরী দস্যু দুহিতা হলেও এই ভীষণ চেহারার লোকটার সামনে ভীত হয়ে পড়ল।

রঘু ডাকু কিছু বলার পূর্বেই গর্জন করে উঠল ভীম সেন–এ কে?

রঘু নতমস্তকে কুর্ণিশ জানিয়ে বলল–দস্যু দুহিতা।

দস্যু দুহিতা! কি রকম?

এ পুরুষ নয়-নারী।

তা এখানে কি করে এলো?

পথ ভুল করে আন্দামানের বনে এসে হাজির হয়েছিল।

আর তুমি তাকে ধরে এনেছ?

রঘু মস্তক অবনত করে রইল।

ভীম সেন পুনরায় হুংকার ছাড়ল—তা ওর কাছে কি পেলে?

রঘু এবারও নত মস্তকে রইল কোন জবাব দিল না।

ভীম সেন বজ্রকঠিন কণ্ঠে বলল—জান এখানে নারীর প্রবেশ নিষেধ?

চোখ তুলে তাকাল রঘু, নিজের ভুল বুঝতে পেরে হকচকিয়ে গেল, বললো—আমার কোন দোষ নেই সর্দার। এই মেয়েটি আপনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চেয়েছিল।

তাই তুমি নিয়ে এলে? এত সাহস তোমার! এ জন্য তোমাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হলো।

রঘু আর্তনাদ করে উঠল—সর্দার!

নূরী তখন কেমন যেন সংজ্ঞাহারার মত হয়ে পড়েছে। একি হলো! রঘু ডাকু তার জন্য মৃত্যুবরণ করবে। একটা প্রাণ যাবে তার জন্য?

নূরী নিশ্চুপ ছিল এতক্ষণ, হঠাৎ বলে উঠল-বাবা, আমি নারী হলেও তোমাদের কোন অন্যায় বা ক্ষতি করব না। আমাকে তুমি মেয়ে বলেই জেন।

হঠাৎ নূরীর কণ্ঠে বাবা সম্বোধন ভীম সেনের কঠিন হৃদয়ে আলোড়ন জাগাল। নিঃসন্তান ভীম সেন জীবনে কোনদিন বাবা ডাক শুনেনি। আজ এ ডাক তাকে অভিভূত করে ফেলল। কিছুক্ষণ ভীমসেন নির্বাক নয়নে তাকিয়ে রইল নূরীর দিকে–শিশু মনি তার কোলে, ক্ষুধায় কাতর মনি ঘুমিয়ে পড়েছে অনেকক্ষণ।

ভীম সেন এবার বলে উঠল—বাবা! কে তোমার বাবা?

তুমি।

না, আমার কোন সন্তান নেই।

নূরী করুণ কণ্ঠে বলল আমি তোমার সন্তান, দয়া কর বাবা, আমার জন্য রঘুকে হত্যা কর না। তার চেয়ে তুমি আমাকেই হত্যা কর।

ভীম সেন কি যেন ভাবতে লাগল। ডাকাত হলেও সে তো মানুষ! তার দেহেও তো রক্ত-মাংস রয়েছে। নূরীর কথাগুলো ভীম সেনের অন্তরে সাড়া জাগাল।

ভীম সেন চিন্তা করছে।

রঘু মৃত্যুভয়ে বিবর্ণ হয়ে উঠেছে।

নূরী ব্যাকুল আগ্রহে তাকিয়ে আছে ভীম সেনের মুখের দিকে। দু’চোখে তার করুণ অসহায় চাহনি। নূরীর কোলে ঘুমন্ত শিশু মনি।

ভীম সেন এবার বলে উঠল—মা, আমি তোমার কথায় রঘুকে ক্ষমা করে দিলাম। জীবনে ভীম সেন কাউকে ক্ষমা করেনি, এই তার প্রথম ক্ষমা।

রঘু মুখ তুলে তাকাল।

নূরীর মুখ খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল।

ঠিক সেই মুহূর্তে জেগে উঠলো মনি। ক্ষুধায় কেঁদে উঠল সে।

ভীম সেন কোনদিন শিশু দেখেনি, মনির অপরূপ চেহারা তাকে মেহকাতর করে তুলল। বলল ভীম সেন-রঘু, ওদের নিয়ে যাও। শিশুর ক্ষুধা পেয়েছে, খাবার ব্যবস্থা কর।

রঘুর দু’চোখে আনন্দের ছটা ফুটে উঠল। সর্দারকে রঘু জানে তার কঠিন আদেশের নড়চড় নেই। নিশ্চিত মৃত্যু থেকে মুক্তি পেল রঘু! নূরীকে লক্ষ্য করে বলল সে–চলো।

রঘুর পেছনে পা বাড়াল নূরী।

এই নির্জন বনে নিঃসঙ্গ অসহায় অবস্থায় যে কোন আশ্রয়ই তার কাছে খোদার দান বলে মনে হলো।

০৩.

গোটা বন তন্ন তন্ন করে খুঁজেও বনহুর ও রহমান নূরী আর শিশু মনিকে পেল না। শক্তিমান বনহুর আর বলিষ্ঠ হৃদয় রহমান এক সময়ে ক্লান্ত হয়ে পড়ল।

বনহুরের সুন্দর মুখমণ্ডল বিষণ্ণ, মলিন হলো। ললাটে ফুটে উঠল গভীর চিন্তারেখা—তবে সে গেল কোথায়? বাঘ-ভালুকে কি তাকে খেয়ে ফেলেছে? কিন্তু তাহলেও তার জামাকাপড়ের কোন চিহ্ন পাওয়া যেত। রক্তমাংসের দাগ দেখতে পেত। নূরী কি তবে বেঁচেই আছে। কিন্তু কোথায় সে অদৃশ্য হয়েছে? ক্লান্তকণ্ঠে বলল বনহুর রহমান, নূরীকে বুঝি আর আমরা ফিরে পাব না!

রহমান নতমস্তকে ব্যথাভরা কণ্ঠে বলল সর্দার, হতাশ হবার কিছু নেই। নূরী সাধারণ মেয়ে নয়—সে দস্যু কন্যা, তার ধমনিতে প্রবাহিত হচ্ছে দস্যুরক্ত। এত সহজে সে নিজেকে বিলীন হতে দেবে না।

কিন্তু এই গহন বনে, এক, নিরস্ত্র, একটি শিশু তার কোলে, কি করে সে নিজেকে রক্ষা করবে বা করতে পারে? এ বনে নানা হিংস্র জন্তুর আনাগোনা রয়েছে। বনহুরের কথা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গেই একটা ভীষণ গর্জন ভেসে এলো—বাঘের ভীম গর্জন।

বনহুর আর রহমান তটস্তভাবে উঠে দাঁড়াল। সামনে ঝোপটার দিকে নজর পড়তেই চমকে উঠল, রহমানকে লক্ষ্য করে বলল বনহুর——ঐ দেখ।

রহমান সেদিকে চেয়ে দেখল-একটা ভয়ঙ্কর বিরাট বাঘিনী ঝোপটার পাশে শুয়ে আছে। পাশে কয়েকটা বাচ্চা খেলা করছে।

রহমান মুহূর্তে রাইফেল উদ্যত করে ধরল।

বনহুর রহমানের রাইফেলের মাথাটা হাত দিয়ে নত করে দিয়ে বলল, মের না রহমান।

সেকি সর্দার। মনে মনে আশ্চর্য হলো রহমান। যে সর্দার মানুষের বুকে রাইফেল ছুড়তে দ্বিধাবোধ করে না, আজ সেই সর্দার একটা হিংস্র জন্তুর বুকে গুলি ছুড়তে বারণ করছে? অবাক না হয়ে পারল না রহমান।

বনহুর রহমানের মনোভাব বুঝতে পেরে বলল কি হবে ওকে মেরে। অযথা কতগুলো অসহায় বাচ্চার কষ্ট হবে।

রহমান কোন জবাব দিতে পারল না।

বনহুর বলল-চল রহমান, সাবধানে এখান থেকে সরে পড়ি। এখন বাঘিনী তার বাচ্চাদের নিয়ে আনন্দ উপভোগ করছে। হাঁ, একেই বলে মায়ের প্রাণ।

বনহুর আর রহমান অতি সন্তর্পণে এগিয়ে চলল। কিন্তু বেশিদূর এগুতে পারল না। একটা বন্য শুকর সুতীক্ষ্ণ ধারাল দাঁত বিস্তার করে তীর বেগে ছুটে এলো।

মুহূর্তে রহমানকে ঠেলে দিয়ে বনহুর রাইফেল উদ্যত করে গুলি করল—অব্যর্থ লক্ষ্য বনহুরের, শুকর ছুটে আসতে গিয়ে গুলির আঘাতে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল। পড়ে গিয়ে আবার উঠতে গেল কিন্তু ততক্ষণে বনহুরের রাইফেলের আর একটা গুলি শুকরের পৃষ্ঠদেশ ভেদ করে চলে গেল। আর সে উঠতে পারল না।

বনহুর আর রহমান বনে বনে আরও সন্ধান করল, কিন্তু নূরীর কোনো খোঁজ পাওয়া গেল না।

রহমান লক্ষ্য করল, তার সর্দারকে আজ বড় বিষণ্ণ, বড়ই উদাসীন মনে হচ্ছে। নূরীর ব্যথা তাকে অস্থির করে তুলেছে।

সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো এক সময়!

ঘন বনের মধ্যে চারদিক থেকে শোনা যাচ্ছে হিংস্র জন্তুর গর্জন। রহমান বলল—সর্দার!

জানি তুমি কি বলতে চাচ্ছ। কিন্তু নূরীকে এই গহন বনে একা রেখে আমি যাব কোন্ প্রাণে?

সর্দার, রাত হয়ে আসছে। এখানে বিলম্ব করা মোটেই উচিত হবে না। নূরীর সন্ধান করে তাকে পাওয়া এখন দুরাশা।

হাঁ, দুরাশাই বটে। গহন বন। অন্ধকার রাত। কোথায় আমি তাকে খুঁজব রহমান?

খুঁজে আর ফল হবে না সর্দার। ওর অদৃষ্টে যা ছিল তাই হয়ে গেছে।

নূরী তবে নেই বলতে চাও?

না, কারণ এই হিংস্র জন্তু ভরা গহন বনে তার বেঁচে থাকাটা অসম্ভব সর্দার।

রহমান!

হাঁ সর্দার, নূরী আর বেঁচে নেই।

বনহুরের মুখমণ্ডল সন্ধ্যার অন্ধকারে স্পষ্ট দেখা না গেলেও এটা বেশ বুঝতে পারল রহমান, তার সুন্দর দীপ্ত মুখমণ্ডল কাল হয়ে উঠেছে। সর্দার নূরীকে কতখানি ভালবাসে, রহমান হৃদয়ের সমস্ত অনুভূতি দিয়ে অনুভব করল।

বেশ কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থেকে নিজেকে সংযত করে নিল বনহুর। তারপর বলল। চল রহমান।

সর্দার।

হাঁ চল, আর বিলম্ব করে লাভ নেই।

বনহুরের প্রতীক্ষায় মনিরা ব্যাকুল হয়ে পড়েছিল। তাছাড়া বজরার সবাই দুশ্চিন্তাগ্রস্ত মন নিয়ে অপেক্ষা করছিল সর্দারের। সন্ধ্যা ঘনিয়ে যখন রাতের অন্ধকার নেমে এলো তখন সবাই হতাশ হয়ে পড়ল। এই অজানাঅচেনা গহন বনে শুধুমাত্র দুটি প্রাণী কি করে এতক্ষণ হিংস্র জন্তুর কবল থেকে বাঁচতে পারে।

মনিরা কায়মনে খোদাকে স্মরণ করতে লাগল। মনিরার ব্যথাকরুণ অবস্থা দেখে সুফিয়ার চোখেও পানি এলো। সান্ত্বনা দিতে গেল, কিন্তু তার কণ্ঠও রোধ হয়ে এলো? সত্যি যদি আর ওর স্বামী ফিরে না আসে।

কিন্তু যখন বনহুর বজরায় ফিরে এলো তখন দু’টি বজরার সব লোকই খুশিতে আত্মহারা হয়ে পড়ল। কিন্তু নূরী ফিরে না আসায় সবাই মর্মাহত হলো।

ছুটে এলো মনিরা আর সুফিয়া।

সুফিয়া থমকে দাঁড়াল, আজ প্রথম সে বনহুরকে কাল ড্রেসে সজ্জিত দেখল—অপরূপ সুন্দর লাগছে বনহুরকে। সুফিয়া কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে চেয়ে রইল বনহুরের সুন্দর মলিন-বিষণ্ণ মুখখানার দিকে।

মনিরা ছুটে গিয়ে বনহুরের জামার আস্তিন চেপে ধরল-কেন তুমি এত বিলম্ব করলে?

বনহুর মনিরার প্রশ্নের কোন জবাব দিতে পারল না। একটা দীর্ঘশ্বাস চেপে গেল সে অতি সাবধানে।

স্বামীর মুখোভাব লক্ষ্য করে মনিরার হৃদয় গুমড়ে কেঁদে উঠল। কি করে ঐ মুখে হাসি ফুটাবে ভাবতে লাগল সে।

সুফিয়া ধীরে ধীরে সরে পড়ল সেখান থেকে।

এ সময় এখানে থাকা তার উচিত হবে না।

বেশ কিছুক্ষণ মৌন থাকার পর বলল বনহুর—নূরীকে খুজে পাওয়া গেল।

মনিরা হঠাৎ প্রশ্ন করে বসল—সে চলে গিয়েছিল কেন?

জানি না।

আচ্ছা, একটা কথা তুমি আমায় বলবে?

বল।

ওর সঙ্গে তোমার সম্বন্ধ…

মনিরার কথা শেষ হয় না, রহমান এসে দাঁড়ায় দরজার বাইরে সর্দার!

বনহুর বলে এসো।

রহমান ক্যাবিনে প্রবেশ করে বললসর্দার, যা হবার হয়ে গেছে। এখানে বিলম্ব করা আর উচিত হবে না।

একথা আমিও চিন্তা করেছি রহমান, বজরা ছাড়ার আদেশ দেব কিনা ভাবছি।

সর্দার, একে অজানা-অচেনা দেশ, তারপর এসব বন রাত্রিকালে আরও ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করে। নানা হিংস্র জীবজন্তুর আবির্ভাব ঘটা অস্বাভাবিক নয়।

আচ্ছা, তুমি বজরা ছাড়তে বল।

রহমান কুর্ণিশ জানিয়ে বেরিয়ে যায়।

মনিরা তাকায় বনহুরের মুখের দিকে। সে মুখ যেন বিষাদে ভরা। মুক্ত জানালা দিয়ে দূরে অন্ধকারে নদীবক্ষে দৃষ্টি নিক্ষেপ করল বনহুর। বুকের মধ্যে তার একটা প্রচণ্ড ঝড় বয়ে যাচ্ছে, এটা বুঝতে কষ্ট হলো না মনিরার।

মনিরা কোন কথা বলতে পারল না বা বলার সাহস পেল না, এ সময় বনহুরকে বিরক্ত করতেও তার মন চাইনা।

মনিরা চলে যাবার জন্য দরজার দিকে পা বাড়াল, বনহুর ডাকলমনিরা!

মনিরা থমকে দাঁড়াল। কোন কথা বলল না। বনহুর মনিরাকে টেনে নিল কাছে, বলল—তুমি কি প্রশ্ন করেছিলে না?

না, কিছু না! আমি যাই এখন।

মনিরা, তুমি যেও না। আরও ঘনিষ্ঠভাবে মনিরাকে টেনে নিল বুকের মধ্যে বনহুর।

আগে এবং পেছনে দু’খানা বজরা এগিয়ে চলেছে।

মনসা নদী পেরিয়ে যোগিনী নদীর বুক চিরে এগুচ্ছে বনহুরের বজরা দু’খানা।

স্বামীর বুকে মাথা রেখে মনিরা কখন ঘুমিয়ে পড়েছে। দু’ফোঁটা অশ্রু তখনও চিকচিক করছে মনিরার চোখের কোণায়। মনিরা ঘুমিয়ে গেলেও দস্যু বনহুরের চোখে ঘুম নেই। ধীরে ধীরে মনিরার চুলে হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল সে? এখনও তার হাতখানা সম্পূর্ণ থেমে যায়নি। অতি মৃদু সঞ্চারণ হচ্ছিল মনিরার চুলে! বনহুর গভীর চিন্তায় মগ্ন। ফিরে গেছে সে অতীতে তলিয়ে যাওয়া একটা দিনে–বালক বনহুর অস্ত্রশিক্ষা করছিল দস্যু কালু খাঁর কাছে। অদ্ভুত দক্ষতার সঙ্গে অস্ত্রচালনা করেছিল বনহুর। বৃদ্ধ কালু খাঁর দু’চোখে ভবিষ্যতের উজ্জ্বল স্বপ্ন। হাস্য-উচ্ছলতায় মুখমণ্ডল উদ্ভাসিত, মাঝে মাঝে অস্কুটধ্বনি করছে সে-সাবাস! সাবাস বেটা! সাবাস!

বালক বনহুরের শিরায় শিরায় তখন উষ্ণ রক্তের প্রবাহ, হৃদয়ে অফুরন্ত উন্মাদনা। চোখমুখ প্রতিভাদীপ্ত, তীব্র উত্তেজিত। অস্ত্রশিক্ষার প্রচণ্ড পিপাসা তাকে উম্মাদ করে তুলেছে। বালক বনহুরের হাতের প্রচণ্ড আঘাতে এক সময় কালু খাঁর অস্ত্র ঝন ঝন করে খসে পড়ল।

উচ্ছ্বসিত আনন্দে কালু খাঁর মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। দু’হাত প্রসারিত করে জড়িয়ে ধরল বালক বনহুরকে বুকের মধ্যে।—সাবাস বেটা! সাবাস!

কালু খাঁ যখন বনহুরকে বুকে টেনে আদর করছিল তখন তার একজন অনুচর এসে দাঁড়াল—সর্দার দলবল এসে গেছে।

কালু খাঁ বনহুরকে ছেড়ে দিয়ে উঠে দাঁড়াল, বলল—চল।

যতক্ষণ কালু খাঁ আর বনহুরের লড়াই হচ্ছিল ততক্ষণ একটা পেয়ারা গাছের ডালে পা দুলিয়ে পেয়ারা খাচ্ছিল আর গুরুশিষ্যের খেলা দেখছিল। নূরী। গলায় দুলছিল তার একটা বনফুলের মালা।

কালু খাঁ তার অনুচরদের সঙ্গে চলে যেতেই নূরী লাফ দিকে গাছ থেকে নেমে ছুটে এলো বনহুরের পাশে, তৃপ্তির হাসিতে তার মুখ উজ্জ্বল। নিজের গলা থেকে মালাটা খুলে নিয়ে পরিয়ে দিল বনহুরের গলায়—হুর তোমার জয় হয়েছে—সে জন্য এটা আমি তোমাকে উপহার দিলাম।

বনহুর নূরীর দিকে তাকিয়ে হাসল, তারপর মালাটা নেড়ে দেখল।

এমনি আরও কত কথা, কত দৃশ্য ভেসে উঠতে লাগল বনহুরের চোখের সামনে।

ঝর্ণার পানিতে সাঁতার কাটছিল বনহুর ও নূরী।

কিশোর বনহুর আর কিশোরী নূরী। উচ্ছল হাসিতে মেতে উঠেছে দু’জন। সাঁতার কাটতে কাটতে এ-ওর দিকে পানি ছিটিয়ে দিচ্ছিল। তাদের পাশে নদীর বুকে সাঁতার কাটছিল শুভ্র রাজহংসীর দল। হঠাৎ একটা বাচ্চা হাঁস ভেসে চলে গিয়েছিল স্রোতের টানে। নূরী হাঁসটাকে ধরার জন্য এগিয়ে যায়, কিন্তু সে নিজেও স্রোতের মুখে পড়ে হাবুডুবু খায়। এই ডুবে যায়, আর কি!

বনহুর লক্ষ্য করে দ্রুত এগিয়ে গেল। প্রখর স্রোত ধারায় অতি কষ্টে নূরীকে সেদিন বাঁচিয়ে নিল বনহুর। নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পেয়ে নূরীর আনন্দ আর ধরে না। কি দিয়ে যে সে বনহুরকে কৃতজ্ঞতা জানাবে। দু’হাতে বনহুরের গলা জড়িয়ে ধরে নিস্পাপ নূরী দুটো চুম্বনরেখা এঁকে দিয়েছিল ওর গণ্ডে ৭ হেসে বলেছিল নূরী আমার জীবনের বিনিময়ে কি দেব তোমাকে তাই–

নূরীর স্বাভাবিক স্বচ্ছ হাসির সঙ্গে সেদিন তাল মিলিয়ে হেসেছিল বনহুর। আজ বারবার সেই দিনগুলোর স্মৃতি ভেসে উঠতে লাগল বনহুরের মানসপটে।

নূরীর জন্য আজ বনহুরের হৃদয় হাহাকার করে কেঁদে উঠল। মনিরার ঘুমন্ত মাথাটা ধীরে ধীরে নামিয়ে রাখল নিজের বালিশের ওপর। তারপর উঠে দাঁড়াল, অতি সন্তর্পণে ক্যাবিনের দরজা খুলে বেরিয়ে এলো বাইরে।

জমাট অন্ধকারে আচ্ছন্ন সমস্ত বজরাখানা।

কয়েকজন পাহারাদার নীরবে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পাহারা দিচ্ছিল। মাঝিদের দাড়ের ঝুপঝাপ শব্দ হচ্ছে।

বনহুর বজরার পেছনে গিয়ে দাঁড়াল, অদূরে দাঁড়িয়ে রহমান। গুলিভরা রাইফেল হাতে পাহারা দিচ্ছে।

বনহুর ডাকল—রহমান!

রহমান এগিয়ে এলো অন্ধকারে—সর্দার!

তাদের অলক্ষ্যে অদূরে অন্ধকারে এসে দাঁড়াল একটা ছায়ামূর্তি। নিঃশব্দে ওদের কথাবার্তা শুনতে লাগলো।

বনহুর বলছে-নূরী কি সত্যই বেঁচে নেই রহমান।

ঐ হিংস্র জীবজন্তু ভরা ভয়ংকর জংগলে বেঁচে না থাকাই স্বাভাবিক।

কিন্তু আমার মন বলছে সে বেঁচে আছে।

কিন্তু গোটা বন তো আমরা তন্নতন্ন করে খুঁজেছি সর্দার?

এমন কোন জায়গায় সে আছে যেখানে আমরা যেতে পারিনি বা যাইনি।

হাঁ তা হতে পারে সর্দার।

রহমান!

বলুন সর্দার।

আমরা সেই বন ছেড়ে কতদূর এসেছি বলতে পার?

পারি সর্দার। দশ মাইলের বেশি হবে।

দশ মাইল!

তারও বেশি হবে।

ভোর হলে আবার আমরা ফিরে যাব।

কিন্তু তা সম্ভব নয়।

কেন?

বহুদিন সবাই বাড়িছাড়া, মাঝিরা কেউ আর ফিরে যেতে চাইবে না।

আমার হুকুম, বজরা ফিরাতেই হবে।

সর্দার!

হাঁ রহমান।

নিজের ক্যাবিনে প্রবেশ করতেই চমকে উঠল বনহুর, মনিরা নিশ্চল পাথরের মূর্তির মত দরজার পাশে দাঁড়িয়ে।

বনহুর ফিরে তাকাতেই মনিরা দৃঢ়কণ্ঠে বললনা, এ বজরা আর ফিরবে না।

বনহুর অস্ফুট কণ্ঠে বলল—মনিরা!

সবাই তোমার দাপটে ভীত হতে পারে, কিন্তু আমি নই, তোমরা সবাই ফিরে যেতে পার কিন্তু আমাকে এই মাঝনদীতে নামিয়ে দিয়ে যেতে হবে।

মনিরা!

হাঁ। আমি শপথ করেছি, এই নদী থেকে আমি কিছুতেই পেছনে ফিরে যাব না। আমার জীবনের সব মুছে নিয়ে গিয়েছিল ঐ সিন্ধি নদী, ঐ মনসা-ঐ যোগিনী নদী। না, না, আমাকে আজ তোমরা পেছনে নিয়ে যেতে পারবে না। হয় মনিরাকে বিসর্জন দেবে, নয় নূরীকে।

মনিরা!

সব আমি সইতে পারি কিন্ত আকুলভাবে কেঁদে ওঠে মনিরা।

বনহুর এ দৃশ্য সহ্য করতে পারে না। দস্যুপ্রাণ হলেও মনিরার ব্যথা তাকে অস্থির করে তোলে, এগিয়ে গিয়ে মনিরাকে টেনে নেয় কাছে।

মনিরা স্বামীর প্রশস্ত বুকে মুখ লুকিয়ে উচ্ছ্বসিতভাবে কেঁদে ওঠে—জান, তোমার জন্য আজ আমি সর্বহারা। পিতা-মাতা, মামা-মামী, আত্মীয়স্বজন, আমার একমাত্র নয়নের মনি নূরকেও আমি হারিয়েছি শুধু তোমার জন্য–শুধু তোমার জন্য—আর আমি কোন ব্যথা সহ্য করতে পারব না। এই নদীতে নিজেকে সঁপে দিয়ে তোমাকে আমি মুক্তি দেবো। যাও, যেখানে খুশি চলে যেও, কেউ থাকবে না তোমাকে বাধা দেবার জন্য।

বনহুর গভীর আবেগে মনিরাকে টেনে নিল বুকের মধ্যে। কোন কথা বলতে পারল না সে।

কেঁদে কেঁদে মরিয়ম বেগম শয্যাশায়ী হয়ে পড়েছেন। আগে যা একটু সংসার দেখতেন এখন তাও দেখেন না। ঝি-চাকর নিজেরাই যতটুকু পারে গুছিয়ে নিয়ে করে। নকিব পুরোন চাকর–সেই মাতব্বর হয়ে সবাইকে চালনা করে, আদর করে।

বৃদ্ধ সরকার সাহেব বাইরের যত দেখাশুনা চালিয়ে যাচ্ছেন। তিনি না থাকলে আজ বুঝি চৌধুরী বাড়ির অবস্থা শোচনীয় হয়ে পড়ত।

মরিয়ম বেগম নিজে কিছুই দেখেন না, দেখার চেষ্টাও করেন না। কত টাকা আসছে, কত টাকা ব্যয় হচ্ছে সব, সরকার সাহেব হিসেব রাখেন। একদিন সরকারের অনুপস্থিতিতে মরিয়ম বেগম কোন কাজে সিন্দুক খুললেন। সিন্দুকের তালা খুলে বেগম সাহেবার চক্ষুস্থির! সিন্দুকে টাকা আর ধরছে না। ব্যাংকেও তাদের প্রচুর টাকা জমা রয়েছে, জানেন তিনি। আবার সিন্দুকেও টাকা রাখার জায়গা নেই

এত টাকা, আনন্দ হবার কথা কিন্তু মরিয়ম বেগমের খুশির বদলে দু’চোখে অশ্রু ভরে উঠেছিল। আছে অনেক কিন্তু খরচ করার লোক নেই।

একদিন মরিয়ম বেগম সরকার সাহেবকে ডেকে বলে দিলেন, আবর্জনাগুলো সিন্দুকে জমা করে রেখে কি হবে সরকার সাহেব, তার চেয়ে কিছু বিলিয়ে দিন দিন-দুঃখীদের মধ্যে যারা না খেয়ে আছে তারা বাঁচবে।

সরকার সাহেব নতমুখে বলেছিল সেদিন—চৌধুরীবাড়ি থেকে কোনদিন কোন দীন-দুঃখী রিক্তহস্তে ফিরে যায় না বেগম সাহেবা। যা দেবার, যা তাদের প্রয়োজন, আমি দিয়ে দেই।

তবে অতসব হলো কি করে?

বেগম সাহেব, এ সংসারে খানেওয়ালা তো মাত্র আপনি আর ঐ চাকর-বাকরের দল। খরচ তো তেমন কিছু হয় না। ড্রাইভারকে মাসে তার পাওনা মিটিয়ে দিচ্ছি। বাগানের ফুলগাছ আর নতুন করে লাগান হয় না, তবু মালীকে তার মাসিক টাকা ঠিকভাবেই বুঝিয়ে দেই।

বুঝেছি, আমার সংসারে ডুমুর ফুল এসেছে।

সত্যি তাই বেগম সাহেবা।

সেদিন রাত হয়ে গেছে। মরিয়ম বেগম নিজের ঘরের দাওয়ায় একটা আরাম কেদারায় গা এলিয়ে দিয়ে শুয়েছিলেন। পাশে অনতিদূরে একটা চেয়ারে বসে সরকার সাহেব। সংসার সম্বন্ধে আলাপ-আলোচনা চলছিল। একথা-সে কথার মাঝে রাত বেড়ে আসে।

নবিক এসে বলে-বেগম সাহেবা ঠাণ্ডা পড়ে গেছে, ঘরে চলুন। বাতের ব্যথাটা আবার বেশি হবে ক্ষন।

হবে না হবে না। তোরা আমার জন্য এত ব্যস্ত হচ্ছিস কেন, আমাকে আরও বাঁচিয়ে রাখতে চাস?

সরকার সাহেব বলে উঠলেন–না বেঁচে যে কোন উপায় নেই বেগম সাহেবা-যতদিন আপনার মনির ফিরে আসে ততদিন আপনাকে এ বোঝ বইবার জন্য বেঁচে থাকতেই হবে।

কিন্তু বেঁচে থাকা কি আমার নিজস্ব ইচ্ছা সরকার সাহেব?

যদিও নয়, তবু আপনাকে সাহসে বুক বাঁধতে হবে।

তারপর কি হবে?

মনির ফিরে আসুক।

সে কি কোনদিন মানুষ হয়ে ফিরে আসবে!

আসবে সরকার সাহেবের কথা শেষ হয় না। গম্ভীর মধুময় একটা কষ্ঠস্বর শোনা যায়-মা!

কে—কে–আমার মনি, আমার মনি!

ততক্ষণে বনহুর মায়ের পাশে এসে দাঁড়ায়। মনিরা তার পেছনে। মনিরা অস্ফুট আর্তনাদ করে মরিয়ম বেগমের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে-মামীমা!

আমার মা মনিরা! কোথায় ছিলি মা এতদিন?

মনিরা মামীর বুকে মুখ গুঁজে ছোট বালিকার মত ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে। এতদিনের জমানো ব্যথা আজ অশ্রু হয়ে ঝরে পড়ে তার দুচোখে।

নকিব এমনভাবে প্রকাশ্যে কোনদিন বনহুরকে দেখেনি। আজ বিস্ময় বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে রইল বনহুরের দিকে। খুশিতে নকিবের দু’চোখে আনন্দের বান বয়ে যায়। যেমন মা তেমনি তার সন্তান। তাই তো বেগম সাহেব সর্বদা এমন হা হুতাশ করেন।

মনিরাকে ফিরে পেয়ে বাড়িতে খুশীর ফোয়ারা বইল। ঝি-চাকর সবাই যেন তাদের হারানো ধন ফিরে পেয়েছে।

মরিয়ম বেগম কিছুতেই পুত্রকে ছেড়ে দিলেন না।

রাতে নিজের পাশে বসিয়ে বললেন—মনির, এবার তোর সংসার তুই বুঝে নে। আয় দেখবি আয়-পুত্রের হাত ধরে টেনে নিয়ে চললেন মরিয়ম বেগম সিন্দুকের পাশে। ডালা খুলে বললেন দস্যুতা আর তোকে করতে হবে না। নিয়ে যা, আমাকে রেহাই দে মনির।

মা!

না না, তোর কোন কথাই আমি শুনতে চাই না। বল, তুই আমাকে রেহাই দিবি কি না?

মা, তুমি কি মনে কর আমি অর্থের লালসায় দস্যুবৃত্তি করি?

তা না হলে তুই কি চাস? রক্ত! রক্ত চাস? নে, আমার বুকের রক্ত তুই চুষে নে। আমার বুকের রক্ত নিয়েও যদি তুই ক্ষান্ত হোস। দেয়ালে মাথা ঠুকে চলেন মরিয়ম বেগম।

বনহুর শক্ত হাতে ধরে ফেলল——মা, মা, মাগো।

না, আমি কোন কথাই শুনব না।

মনিরা এতক্ষণ নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে দেখছিল সব। নীরবে দেখা ছাড়া কিইবা করার আছে তার। মনিরা জানে, কোন বাধাই তার স্বামীকে ধরে রাখতে পারে না। বাধা বন্ধনহীন জলস্রোতের মত তার গুতি।

মরিয়ম বেগমের ললাট কেটে রক্ত গড়িয়ে পড়ল।

মায়ের এই দৃশ্য বনহুরকে বিচলিত করে তুলল। মায়ের পদ তলে বসে পড়ে বলল–মা, তুমি আমাকে ক্ষমা করো মা। শত শত অসহায় দীন হীন জনগণ। যারা এখনও তোমার সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে দিনের পর দিন প্রতীক্ষা করছে। বল কোনটা আমাকে করতে বল? সংসার না দেশ মাতার সেবা?

কেন, দেশ ও দশের সেবা করার কি অন্য কোনো উপায় নেই? কাঁদতে কাঁদতে বললেন মরিয়ম বেগম।

আছে কিন্তু তোমার অর্থে কদিন কুলাবে মা?

তাই বলে তুই অন্যায়ভাবে টাকা সংগ্রহ করে—

মা?

জানি তুই কি বলতে চাস?

মা, তোমার সন্তান কোনদিন অন্যায়ভাবে কারও টাকা কেড়ে নেয়নি, নেবেও না। যাদের অসৎ পথে উপার্জিত অর্থে সিন্দুক কেঁপে ওঠে, তাই আমি হালকা করে দেই। তাদের অপ্রয়োজনীয় অর্থগুলোর সৎগতি করি। এতে তাদেরও কোন ক্ষতি হয় না। আর যারা দিনের পর দিন না খেয়ে তিলে তিলে শুকিয়ে মরছে, যারা লজ্জা নিবারণের জন্য একখণ্ড বস্ত্র সংগ্রহ করতে অক্ষম, যাদের রুক্ষ চুলে মাসের মধ্যে একটি দিন তেল পড়ে না, আমি তাদের হাতে তুলে দেই সেই অর্থ–এতটুকু উপকার যদি হয় তাদের? মা বল, একি আমার অন্যায়?

মরিয়ম বেগম কিছুক্ষণ স্থির হয়ে ভাবেন, পুত্রের কথাগুলোই বুঝি তার মনের মধ্যে আলোড়ন সৃষ্টি করে চলেছে! শত শত দীন-দুঃখীর ব্যথাকরুণ মুখ ভেসে উঠেছে বুঝি তার মনের গহনে। দু’চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ে ফোঁটা ফোঁটা অশ্রু।

বনহুর উঠে দাঁড়িয়ে নিজের রুমালে মায়ের অশ্রু মুছিয়ে দিয়ে বলল তোমার চোখে অশ্রু আমাকে পাগল করে ফেলবে। মা, তুমি যা বলবে তাই আমি করব। বল, বল আমাকে তুমি কোনপথে যেতে বল?

মরিয়ম বেগম ধ্যানগ্রস্তের মত নিশ্চুপ হয়ে গেছেন। এদিকে তাঁর সোনার সংসার-পুত্র, পুত্রবধু, তাদের সন্তান-সন্ততি, আর এক দিকে দেশের শত শত দীন হীন অসহায় জনগণ কোন দিকটা তিনি চান, কোন দিকটাকে তিনি মনের মনিকোঠা থেকে গ্রহণ করবেন।

কোন জননী না চায় পুত্র, পুত্রবধু তাদের সন্তান সন্ততি নিয়ে সংসার বাঁধতে? কিন্তু বিবেকের কাছে পরাজিত হন মরিয়ম বেগম। নিজের দিকে দেখতে গিয়ে দেশের অসহায় জনগণের কথা ভুলে যাবেন কোন মুখে, কোন প্রাণে? একমাত্র পুত্রের বিনিময়ে তিনি যদি শত শত পুত্রের দুঃখব্যথা মুছে ফেলতে পারেন তাহলে তাঁর মত সুখী কে! কি হবে তার একার সুখ আর আনন্দ দিয়ে দেশের অগণিত নর-নারী যদি ক্ষুধায় মরে যায়, তাদের হাহাকারে দেশ যদি অশান্তিময় হয়ে ওঠে, তবে সে সুখ কাম্য নয় মরিয়ম বেগমের।

তিনি বলে উঠলেন—মনির, যা যা তুই, আমি তোকে ধরে রাখতে চাই না।

মা, তুমি রাগ করেছ?

না, রাগ আমি করিনি করতে পারি না। তোকে আমি পেটে ধরলেও তুই আমার একার সন্তান নস্। শত শত মায়ের ছেলে হয়ে জন্মছিস। তোকে কি আমি ধরে রাখতে পারি।

মা, মাগো। বনহুর মায়ের বুকে মুখ লুকিয়ে ছোট্ট শিশুর মত আনন্দধ্বনি করে উঠল।

০৪.

মনিরাকে মায়ের কাছে পৌঁছে দিয়ে ফিরে এলো বনহুর তার বজরায়। একটা দিকে নিশ্চিত হলো বনহুর। এবার সুফিয়া। পুলিশ সুপার আহমদ সাহেবের আধুনিক কন্যা সুফিয়া। তাকে তার পিতামাতার নিকটে পৌঁছে দিয়ে তবে নিশ্চিত হবে সে। কিন্তু মনিরাকে যত সহজে পৌঁছে দিতে পেরেছে তত সহজ নয় সুফিয়াকে পৌঁছান। অনেক চিন্তা করে তবেই এ কাজ সমাধা করতে হবে। এতদিন পর সুফিয়া যদি সহজভাবে বাড়ি ফিরে যায়, নিশ্চয়ই তাকে সমাজ সহজে গ্রহণ করবে না। পিতামাতার মনেও একটা সন্দেহের দোলা খোঁচা দেবে। হয়তো নিস্পাপ সুফিয়ার জীবনটা ব্যর্থ হয়ে যাবে। সুফিয়াকে শুধু তার পিতামাতার নিকটে পৌঁছানই বড় কাজ নয়—সুফিয়া যে সত্যিই একটা সতী মেয়ে, সে কথাও স্পষ্ট বুঝিয়ে দিতে হবে তাদেরকে।

এ-কথা সুফিয়াই বলেছিল মনিরার কাছে। বলেছিল, মনিরা তুমিতো যাচ্ছ, তোমার স্বামী তোমাকে যাচাই করে নিয়েছেন। সকল সন্দেহ থেকে তুমি মুক্ত। আর আমি, যদিও আমি মা-বাবার নিকটে যাচ্ছি বা যাব কিন্তু তারা কি আর আমাকে আগের মত স্বচ্ছ মন নিয়ে গ্রহণ করতে পারবেন? আমি কেমন করে সবাইকে বুঝাব আমি নিস্পাপ নিষ্কলঙ্ক।

মনিরা সব বলেছিল বনহুরের কাছে, এ কথাও বলেছিল–সুফিয়াকে শুধু পৌঁছে দেবার দায়িত্বই তোমার নয়, ওর জীবনে যেন কোন কলঙ্কের কালিমা লেপন না হয়, একাজও তোমাকে করতে হবে।

কাজেই সুফিয়াকে শুধু পৌঁছে দেওয়াই নয় ওর বিরাট একটা পরিণতি নির্ভর করছে দস্যু বনহুরের ওপর। লোকসমাজ জানে—দস্যু বনহুর শুধু দুর্দান্ত দস্যুই নয়, সে লম্পট নারীহরণকারী।

বনহুর আধুনিক যুবকের বেশে সুফিয়াসহ পুলিশ সুপারের বাড়ির গেটে হাজির হলো।

নতুন ছোট্ট কুইন গাড়িখানা গেটে পৌঁছতেই সেলুট করে সরে দাঁড়ালো পাহারাদারগণ।

গাড়ি-বারান্দায় গাড়ি পৌঁছতেই সুফিয়া নেমে ছুটে গেল অন্দরমহলে। একমাত্র কন্যার অন্তর্ধানে মিঃ আহমদ ও মিসেস আহমদ একেবারে ভেঙে পড়েছিলেন। মিসেস আহমদ একরকম প্রায় শষ্যাশায়ী হয়ে পড়েছেন। সুফিয়া ছুটে গিয়ে কক্ষে প্রবেশ করে ডাকল—আম্মা! আব্বা!

মুহূর্তে মিঃ আহমদ ও মিসেস আহমদের মুখমণ্ডল উজ্জ্বল দীপ্ত হয়ে উঠল। আকাশের চাঁদ যেন ফিরে পেলেন তাঁরা।

সুফিয়া পিতার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ল–আব্বা। আব্বা।

মিঃ আহমদ কন্যাকে সস্নেহে বুকে আঁকড়ে ধরে বললেন মা কোথায় কোথায় গিয়েছিলি?

আব্বা, সব বলব–সব শুনবে। সুফিয়া আবার মায়ের বুকে মুখ লুকায়, কতদিন পর আজ সে মাকে পেয়েছে। সুফিয়া তারপর বলেআব্বা, তুমি বাইরে যাও। আমার রক্ষাকারী যিনি তিনি গাড়ি-বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছেন।

বলছিস কি মা? তাকে গাড়ি-বারান্দায় দাঁড় করিয়ে রেখেছিস? চল দেখি–বেরিয়ে যান আহমদ সাহেব।

হঠাৎ সুফিয়ার নজর চলে যায় পিতার বিছানার একপাশে। ইংরেজি দৈনিক পত্রিকাখানা পড়ে রয়েছে সেখানে। একটা ছবিতে দৃষ্টি পড়তেই বিস্ময়ে আড়ষ্ট হয়ে গেল সুফিয়া। এ যে মনিরার স্বামীর ছবি! যিনি তাকে এইমাত্র পৌঁছে দিতে এসেছেন। সুফিয়া তাড়াতাড়ি পত্রিকাখানা হাতে তুলে নিয়ে চোখের সামনে মেলে ধরল একি! সুফিয়ার চোখ ছানাবড়া হলো।

মিসেস আহমদ বললেন সুফিয়া, তোকে হরণ করার অপরাধে দস্যু বনহুরের নামে

সুফিয়া অস্কুট ধ্বনি করে উঠল–মা!

কি হলো, কি হলো সুফিয়া?

সুফিয়া মায়ের কথার কোন জবাব না দিয়ে ছুটে গেল। কিন্তু কয়েক পা এগুতেই কানে ভেসে এলো পাশের কক্ষে পিতার চাপা কণ্ঠস্বর, ফোনে আলাপ করেছন তিনি। মিঃ হারুন এই মুহূর্তে পুলিশ ফোর্স নিয়ে চলে আসুন। আমার হলঘরে দস্যু বনহুর–এরপর আর শোনার অপেক্ষা করল। ছুটে গেল হলঘরে, কিন্তু একি, হলঘর শূন্য। ব্যস্তভাবে চারদিকে তাকাল সুফিয়া। কই কোথাও তো তিনি নেই। হঠাৎ তার দৃষ্টি পড়ল সোফার দিকে। ভাঁজ করা একটা কাগজ পড়ে রয়েছে সোফার ওপর।

সুফিয়া তাড়াতাড়ি কাণজখানা হাতে তুলে নিয়ে পড়তে শুরু করল।

“বোন সুফিয়া, তোমার মঙ্গলই আমার কামনা। তোমার নিস্পাপ পবিত্র জীবন চিরসুন্দর এবং সুখের হোক।”
তোমার ভাইয়া
–দস্যু বনহুর।

মিঃ আহমদ কক্ষে প্রবেশ করে বললেন—ও কই—

কে?

যে তোমাকে চুরি করে নিয়ে ফেরত দিয়ে গেল।

আব্বা! তুমি ভুল বুঝেছ।

সুফিয়া, দস্যু কোনদিন সাধু হয় না। তোমার নারীজীবন কলঙ্কময় করে এসেছে তোমাকে ফিরিয়ে দিয়ে সাধুগিরি দেখাতে!

এই দেখ সে মানুষ নয়—ফেরেস্তা।

সুফিয়া!

হাঁ, তুমি এই কাগজের টুকরাখানা পড়লেই সব বুঝতে পারবে। সে আমাকে নিজের বোনের মত মনে করত। তাছাড়া তার চেষ্টাতেই আমি নিজেকে ফিরে পেয়েছি। রক্ষা করেছেন তিনি আমাকে, রক্ষা করেছেন নারীর অমূল্য সম্পদ সতীত্ব। তিনি আমার বড় ভাইয়ের সমান।

মিঃ আহমদ কন্যার হাত থেকে কাগজের টুকরাখানা নিয়ে তুলে ধরলেন চোখের সামনে।

ঠিক সেই মুহূর্তে প্রবেশ করলেন মিঃ হারুন ও তার পেছনে পুলিশ ফোর্স। সকলের হাতে উদ্যত রাইফেল। মিঃ হারুনের হাতে রিভলবার।

ব্যস্তকণ্ঠে বললেন মিঃ হারুন—স্যার, কোথায় সেই নরপিচাশ?

মিঃ আহমদ বললেন—পালিয়েছে!

মিঃ হারুন সুফিয়াকে দেখে চোখমুখে বিস্ময় এনে বললেন–ইনি।

মিঃ আহমদ ছোট্ট কাগজের টুকরাখানা মিঃ হারুনের হাতে দিলেন–পড়ে দেখুন।

হিঃ হারুন চিরকুটখানা পড়ে পরপর কয়েকবার তাকালেন বনহুরের লেখা চিঠিখানা ও সুফিয়ার মুখের দিকে, তারপর বললেন আশ্চর্য!

সুফিয়া গম্ভীর কণ্ঠে বলল–আশ্চর্য নয়, সবই সত্য। আপনারা বসুন, আমি সব ঘটনা বলছি।

মিঃ আহমদ বললেন হাঁ, এখনও সুফিয়ার মুখে কোন কথাই আমাদের শোনা হয়নি।

মিঃ হারুন পুলিশ ফোর্সকে ইংগিতে বাইরে যেত বললেন।

পুলিশ ফোর্স তৎক্ষণাৎ কক্ষত্যাগ করল।

মিঃ আহমদ বললেন–বসুন। নিজেও আসন গ্রহণ করলেন আহমদ সাহেব।

সুফিয়া নিজে একটা আসনে বসে বলতে শুরু করল–আব্বা আমাকে যখন গুণ্ডাদল কৌশলে হাত-পা-মুখ বেঁধে তাদের গোপন আস্তানায় নিয়ে গেল, তখন আমি মনে করেছিলাম, নিশ্চয়ই আমি দস্যু বনহুরের কবলে পড়েছি এবং আমি ভয়ে মুষড়ে পড়লাম, কেঁদে কেটে অস্থির হলাম। এমন কি ওরা যত টাকা চায় তাই দেবার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলাম।

তারপর? বললেন মিঃ হারুন?

সুফিয়া তখনও বলে চলেছে–তবু আমাকে ওরা মুক্তি দিল না। আমাকে এমন এক কক্ষে বন্দী করে রাখা হয়েছে যে কক্ষে আরও কয়েকজন যুবতী ছিল। তাদের সঙ্গে আমিও সেই অন্ধকার কক্ষে বন্দী অবস্থায় রইলাম। তারপর গভীর রাতে আমাদের কয়েকজনকে হাত-পামুখ বেঁধে একটা নৌকায় উঠান হলো।

মিঃ আহমদ অস্ফুট ধ্বনি করলেন নৌকায়?

হাঁ, আব্বা, সেই নৌকা অবিরত কয়েকদিন চলার পর অজানা-অচেনা এক শহরে গিয়ে পৌঁছল। সেখানেও গভীর রাতে আমাদের পূর্বের মতই অবস্থা করে একটা ঘোড়ার গাড়িতে উঠান হলো। তারপর গাড়িখানা উঁচুনীচু পথ বেয়ে চলতে লাগল। আমাদের শরীরে সে ঝাঁকুনির ব্যথা অত্যন্ত বেদনাদায়ক হয়ে উঠল। তবু সহ্য করতে বাধ্য হলাম। তাছাড়া কোন উপায়ও ছিল না।

উঃ! শয়তান নরপিচাশের দল–আহমদ সাহেব দাঁতে দাঁত পিষে বললেন।

মিঃ হারুন বলে উঠলেন–দস্যু বনহুরের কাজ ছাড়া এ কারও কাজ নয়। আমরা জানি, সে যেমন হৃদয়হীন দস্যু তেমনি নারী

সুফিয়া কঠিন কণ্ঠে বলে উঠলআপনি ভুল করছেন। তাঁর মত হৃদয়বান দ্বিতীয় ব্যক্তি নেই—

মিঃ হারুন হাঃ হাঃ করে হেসে উঠলেন—মিস সুফিয়া, আপনি তার উপরের রূপ দেখে মুগ্ধ হয়েছেন। কিন্তু তার

না, আপনি চুপ করে শুনুন—তারপর বলবেন।

মিঃ আহমদ বলেন, হাঁ ইন্সপেক্টার, আগে ওর কথা শোনা যাক, তারপর সাব বুঝা যাবে। আচ্ছা তুমি বল মা।

আব্বা, আমি এক নারীহরণকারী গুণ্ডাদলের হাতে পড়েছিলাম যারা ঐ ব্যবসায়ে লাখ লাখ টাকা উপার্জন করছিল।

বল মা, তারপর কি হলো?

হাঁ আব্বা, আমাকে একটা পুরানো বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হলো। শুধু আমাকে নয়, আমার সঙ্গিনীগণকেও সেখানে নিয়ে যাওয়া হলো। সে বাড়ি নারী ব্যবসায়ী এক মহিলার। আপনাদের বুঝিয়ে বলতে পারব না সে কি রকম স্থান। সেই মহিলার চেহারা মনে হলে আজও হৃদয় ভয়ে শিউরে ওঠে। ভীমকায়, বিরাটদেহী এক মহিলা। যার প্রভাব গোটা দেশ থেকে দেশান্তরে ছড়িয়ে রয়েছে। ওই মহিলার অনুচরগণ বিভিন্ন দেশ থেকে নারী এবং শিশুদেরহরণ করে নিয়ে যেত সেখানে। সেখান থেকে চালান হত বিভিন্ন জায়গায়। আমাকে সেই মহিলা একটি বিরাট কক্ষে বন্দী করে রাখল। সেখানে আমার মত আরও কত যে যুবতী ধরে এনে আটকে রাখা হয়েছে, তার শেষ নেই। প্রতি রাতে ওই মহিলার কাছে লোক আসত। যাকে পছন্দ হত উচিত মূল্য দিয়ে ক্রয় করে নিয়ে যেত। আমিও একদিন বিক্রি হলাম। ঝিন্দের রাজকুমারের এক গুণ্ডা অনুচর আমাকে কিনে নিয়ে গেল।

অবশ্য এ কথা আমি পরে জানতে পেরেছিলাম। মাতাল ঝিন্দ রাজকুমারের জঘন্য মনোবৃত্তি থেকে সেদিন আমার উদ্ধার ছিল না, যদি এই মহান ব্যক্তি আমাকে বাঁচিয়ে না নিতেন, সুফিয়া আনমনা হয়ে পড়ল।

মিঃ আহমদের চোখ-মুখেও ভাবের উদয় হলো, তিনি কন্যার অন্তরের কথা হৃদয় দিয়ে উপলদ্ধি করলেন।

কিন্তু মিঃ হারুনের মুখে একটা মৃদু হাসি ফুটে উঠল, বললেন—দস্যু বনহুরের এটাও মস্ত অভিনয়। নইলে এতগুলো যুবতীকে নারীহরণকারীদের হাতে রেখে শুধু আপনাকে সে উদ্ধার করত না, আপনি যদি পুলিশ সুপারের কন্যা না হতেন। পুলিশ সুপারের মেয়েকে উদ্ধার করে তার পিতার নিকটে ফিরিয়ে দিয়ে দস্যু নিজেকে সাধু বানাতে চেয়েছিল।

আপনি এসব তার সম্বন্ধে অন্যায় উক্তি করছেন। সত্যি তিনি মহৎ মহান দস্যু হলেও তিনি একজন হৃদয়বান লোক। আপনি বলেছেন, তিনি শুধু আমাকেই উদ্ধার করেছেন, তা নয় পুলিশ যা পারেনি রাজ্য পরিচালকগণ যা করতে সক্ষম হয়নি, সেই অসাধ্য সাধন করেছেন দস্যু বনহুর। তিনি নারীহরণকারীদের শুধু সায়েস্তাই করেননি, সমূলে তাদের ধ্বংস করেছ।

মিঃ আহমদ অস্ফুট কন্ঠে ধ্বনি করে উঠলেন–কি বলিস মা।

হাঁ আব্বা, নারীহরণকারীদেরকে এক এক করে তিনি হত্যা করেছেন। তারপর যত যুবতী তাদের বন্দীখানায় ছিল, সবাইকে তিনি বোনের মত সম্মান দিয়ে যার যার আবাসে পৌঁছে দিয়েছেন। আর যাদের তিনি পৌঁছে দিতে পারেননি, তাদের থানা অফিসারদের হেফাযতে দিয়েছেন যেন ওরা স্বদেশে নিজ নিজ পিতামাতা, আত্মীয়-স্বজনের নিকট পৌঁছতে সক্ষম হয়। বলুন আপনারা, তিনি এসব করে অন্যায় করেছেন?

মিঃ হারুন কোন কথা বললেন না।

মিঃ আহমদ ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন কন্যার মুখের দিকে।

০৫.

ভীম সেন নূরীকে কন্যারূপে গ্রহণ করেছে। সকল অনুচরকে বলে দিয়েছে—এই তাদের রাণী। যা বলবে সে, তাই যেন ওরা করে বা শোনে। ভীম সেন নিজেও নূরীর কথা মানতো, যেখানেই দস্যুতা করতে যাক নূরীর পরামর্শ নিত, ভীম সেন নূরীর মধ্যে এমন একটা আলোর সন্ধান পেয়েছে। যা তাকে অভিভূত করে ফেলেছে। দস্যু দুহিতা নূরী নিজের প্রভাব সম্পূর্ণরূপে বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছে ভীম সেনের দলের মধ্যে, নূরীর বুদ্ধি এবং কৌশলে সবাই তাকে রাণী বলে মেনে নিতে অস্বীকার করল না।

ভীম সেন যখনই জাহাজে দূরদেশে দস্যুতা করতে যেত তখনই নূরী তাদের সঙ্গে যেত, মনিও যেত তাদের সঙ্গে।

মনি এখন হাঁটতে শিখেছে, ভাঙ্গা ভাঙ্গা কথা বলতে শিখেছে। নূরীকে মনি মা বলে ডাকে।

দিন যায়।

নূরী এখন ভীম সেনের দলের একচ্ছত্র রাণী। ডাকু ভীম সেন এবং রঘু নূরীর কথায় উঠে-বসে, এমনকি নুরী যেদিন দস্যুতা করতে যাবার জন্য আগ্রহ দেখায় তখনই ভীম সেন দলবল নিয়ে যাত্রা করে।

ভীম সেনের দলকে নূরী নিজের বশীভূত করার পেছনে ছিল একটা গোপন অভিসন্ধি। যেদিন নূরী বজরা ত্যাগ করে চলে আসে, সেদিন যে শপথ গ্রহণ করেছিল, বনহুর তার ভালবাসার প্রতিদানে চরম আঘাত দিয়েছে—এর প্রতিশোধ সে নেবে। তার হৃদয়ে যে বিষের আগুন সে জ্বেলে দিয়েছে, সে আগুন দিয়ে বনহুরকে নূরী দগ্ধীভূত করবে। বনহুরকে চরম আঘাত দিতে পারলে তবেই হবে তার শান্তি। চৌধুরীকন্যা মনিরার সকল সাধ সে ধূলায় মিশিয়ে দেবে। বনহুরকে নূরী শিশুকাল থেকে ভালবেসে এসেছে, প্রাণের চেয়েও অধিক সে ভালবাসা, মায়া মমতা। সেই গভীর প্রেমকে বনহুর পদদলিত করে অন্য একটি মেয়েকে স্ত্রীর আসনে প্রতিষ্ঠিত করেছে। সব আঘাত নূরী সইতে পারে। মাথায় যদি বজ্রাঘাত হত তাতেও নূরী বিচলিত হত না যাত আঘাত পেয়েছে সে, বনহুর যখন বলেছে, মনিরাকে সে বিয়ে করেছে। না না, এ কথা নূরী ভাবতেও পারে না। হুরসে যে তার একার! ওকে ছাড়া নূরী বাঁচতে পারে না। সে বিষের জ্বালা নূরীর মনে দাউ দাউ করে জ্বলছিল। যতক্ষণ এর প্রতিশোধ সে না নিতে পেরেছে ততক্ষণ তার মনের সে আগুন নিভবে না।

আজ সেই দিন সামনে উপস্থিত।

নূরী চেয়েছিল নিজে একটা দস্যুদল গঠন করবে। তারপর বনহুরকে কেমন করে শায়েস্তা করতে হয় দেখিয়ে দেবে। দেখিয়ে দেবে তার প্রেমকে উপেক্ষা করার কি পরিণতি। তার সে ইচ্ছা অতি সহজেই পূরণ হলো–ভাগ্যই তাকে টেনে নিয়ে এসেছে ডাকু ভীম সেনের গুহায়।

নুরী মনের অভিসন্ধি মনে চেপে দিনের পর দিন নিজের দলকে অতি নিপুণভাবে তৈরি করে নিল যাতে দস্যু বনহুরকে পাকড়াও করতে তার এতটুকু বেগ পেতে না হয়।

কিন্তু দিনরাত নুরী মনের সঙ্গে দ্বন্দ করে চলল, শেষ পর্যন্ত বনহুরের নিকট তার দলের যদি পরাজয় হয়। বনহুরকে যদি পাকড়াও করতে না পারে তাহলে? কিন্তু তবু যে কোন উপায়ে, হোক ওকে সমুচিত শাস্তি না দেয়া পর্যন্ত তার হৃদয়ের জ্বালা নিভবে না। প্রতিশোধ চাই, প্রতিশোধ–

একদিন ভীম সেনকে বলল নূরী বাপু, তোমার কাছে আমি কোনদিন কিছু চাইনি, একটা কথা তোমাকে রাখতে হবে।

ভীম সেন হেসে বলল–বল, কি কথা তোমার রাখতে হবে মা! আমার জীবন দিয়েও তা রাখতে চেষ্টা করব।

বাপু, আমি জানি, পৃথিবীতে সবচেয়ে বড় ডাকু তুমি।

হাঁ মা, একথা কেউ অস্বীকার করতে পারে না। ভীম সেনের মত বিখ্যাত ডাকাত আর ত্রিভুবনে নেই। কেন মা?

বাপু, শুনেছি দস্যু বনহুর নাকি মস্ত দস্যু। কেউ নাকি তাকে কোনদিন বন্দী করতে পারে না, আমি চাই তাকে বন্দী করতে।

হাঃ হাঃ হাঃ এই কথা। দস্যু বনহুর সে আবার একজন মস্ত দ কি যে বল মা। কিন্তু হঠাৎ এ সখ কেন হলো মা?

বাপু, আমার বড় রাগ হয় যখন শুনি দস্যু বনহুর নাকি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় দস্যু। তাই ওকে বন্দী করে কিছুটা সাজা দেয়া আমার ইচ্ছা।

বেশ বেশ, তোমার ইচ্ছা আমি কি পূরণ না করে পারি?

ভীম সেন সেই দিনই তার অনুচরগণকে ডেকে বলল–তোমরা প্রস্তুত হয়ে নাও। আমি আজ রাতেই দস্যু বনহুরকে গ্রেফতার করতে যাব।

নূরী চমকে উঠল, কথাটা সে নিজে বলেছে সত্য, কিন্তু অপরের মুখে এ কথাটা যেন তার কানে গরম সীসা ঢেলে দিল। অনেক চিন্তা করার পর নিজেকে কঠিন করে নিল নূরী। না, সে কিছুতেই নিজেকে বিচলিত করবে না। মনকে সে পাষাণ করবে। বনহুর তার সব আশা-আকাঙ্খা-বাসনা ধূলিস্মাৎ করে দিয়েছে। কিছুতেই সে ওকে ক্ষমা করবে না। কিন্তু ভীম সেনের দল কি পারবে তাকে বন্দী করে আনতে? কারও সাধ্য নেই বনহুরকে বন্দী করে। শুধু নূরী—নূরী পারে তাকে বন্দী করতে। তাকে নাকানি চুবানি খাওয়াতে।

নূরী গোপনে ভীম সেনের কানে কিছু গোপন কথা বলে নিল। যা বলল, তাতে দস্যু বনহুরকে বন্দী করা মোটেই কঠিন হবে না।

কয়েকখানা বড় নৌকা নিয়ে ভীম সেনের দল নদীপথে রওয়ানা দিল। নূরী এবং মনিও চলল তাদের সঙ্গে। পথে যাতে নূরী ও তার শিশুর কোন কষ্ট না হয় সেজন্য ভীম সেনের লক্ষ্য কম ছিল না। দিনের বেলায় নৌকাগুলো নদীর কোন জঙ্গলময় স্থানে লুকিয়ে রাখা হত, আর গোটা রাত ধরে চলত তাদের পথচলা। কয়েকদিন অবিরত চলার পর কান্দাই বনের অদূরে শম্ভ নদীর একটা গোপন স্থানে তারা নৌকা রাখল। জায়গাটা জঙ্গলে ঘেরা একটা বাঁক। সহসা কারও নজরে পড়বে না নৌকা। নূরী বহুদিন বনহুরের সঙ্গে শম্ভু নদীতীরে ঘোড়ার চড়ে বেড়াতে এসেছে। কাজেই এসব পথ তার অতি পরিচিত।

নূরী ভীম সেনের অনুচরদের নিয়ে নৌকা থেকে নেমে পড়ল। একে অন্ধকার রাত তদুপরি ভীম সেনের জংলী অনুচরগণের জমকালো চেহারা। কাল রাতের অন্ধকারে ওদের কাল দেহ মিশে যেন এক হয়ে গেল।

সবাই অস্ত্র নিয়ে নূরীকে অনুসরণ করল।

নূরী নৌকা থেকে নেমে পুনরায় একবার সবাইকে বলল–তোমাদের কাছে আমার বারবার অনুরোধ, দস্যু বনহুরকে তোমরা জীবন্ত পাকড়াও করবে, ভুল করেও যেন তার শরীরে আঘাত কর না।

রঘু বলল–যদি সে আক্রমণ করে?

নূরী কিছু বলার পূর্বেই বলল ভীম সেন–তোমরা শুধু নিজেদের রক্ষা করবে।

নূরী, ভীম সেন ও রঘু চলল আগে, আর তাদের দলবল চলল পেছনে।

অন্ধকার রাতে চলা ডাকাত বা দস্যুদের কষ্টকর কিছু নয়। এসব তারা অভিজ্ঞ ও অভ্যস্ত। কাজেই ভীম সেনের দল নূরী ও সর্দারের পদশব্দ লক্ষ্য করে এগিয়ে চললো।

যে পথে নূরী অগ্রসর হলো সে পথ অতি গোপনীয়। এ পথের সন্ধান আর কেউ জানে না—একমাত্র বনহুর আর নূরী ছাড়া। আর জানে রহমান।

নূরী বনহুরের আস্তানার নিকটবর্তী হয়েই ভীম সেন ও তার দলবলকে বলল–আমি গোপনে আস্তানার মধ্যে প্রবেশ করছি, যতক্ষণ ফিরে না আসব ততক্ষণ তোমরা এই বনের মধ্যে ঝোপঝাড়ের আড়ালে অতি সাবধানে লুকিয়ে থাকবে—দেখ কোনরকম যেন শব্দ না, হয় আমি এসে বাঁশীতে ফুঁ দেব। সেই বাঁশী টেনে আনবে বনহুরকে।

ভীম সেন বলল বাশী। বাঁশী তুমি কোথায় পাবে মা?

সে অনেক কথা–বলব পরে।

ইতোমধ্যে নূরী যখন ভীম সেনের দলকে পথ দেখিয়ে নিয়ে আসছিল তখনও একবার ভীম সেন প্রশ্ন করেছিল—এসব পথ তুমি কি করে চিনলে মা?

নূরী বলেছিল, বাপু, একদিন সব তোমাকে খুলে বলব আজ তুমি কিছুই জানতে চেওনা।

ভীম সেন বাশী সম্বন্ধে প্রশ্ন করে একটু লজ্জা পেল। নূরী চলে গেছে ততক্ষণে।

ভীম সেন দলবল নিয়ে অন্ধকারে অদৃশ্য হলো। এসব ব্যাপার তার কাছে এমন কোন নতুন নয়। ভীম সেন নূরীকে নিয়ে সতর্ক রইলো কখন নূরী ফিরে আসে।

নূরী আসার সময় মনিকে নৌকায় ঘুমপাড়িয়ে রেখে এসেছে। দু’জন অনুচরকে তার পাহারায় রেখে এসেছে সে। কাজেই নূরী মনির ব্যাপারে নিশ্চিন্ত। নূরী অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে আস্তানায় প্রবেশ করল। যে পথে নূরী আস্তানায় প্রবেশ করল এ পথ অত্যন্ত গোপন পথ। কাজেই এদিকে বনহুরের কোন অনুচর পাহারায় থাকত না। নূরী অতি সতর্কতার সঙ্গে কৌশলে এগিয়ে চলল। অনেক দিন আগে ছেড়ে যাওয়া তার নিজের কক্ষের দিকে।

নূরী নিজ কক্ষের পাশে এসে থমকে দাঁড়াল। ঐ স্থান থেকে বনহুরের কক্ষ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। কক্ষে আলো জ্বলছে তখন। নিশ্চয়ই আজ বনহুর আস্তানা ছেড়ে বাইরে যায়নি। এটাই নূরী চেয়েছিল, মনে মনে খুশি হলো সে।

অতি কৌশলে নিজের কক্ষে প্রবেশ করল নূরী। কক্ষ শূন্য। কক্ষে কোন আলো না থাকায় কিছুই সে দেখতে পাচ্ছে না। কিন্তু আজও নূরীর মানসপটে কক্ষের প্রতিটি স্থান ও তার নিজ হাতে রাখা জিনিসপত্রের অস্তিত্ব অনুভব করল। নূরী হাতড়িয়ে এগুলো। পূর্বধারে তার বিছানা পাতা ছিল। হাঁ, ঠিক সে ভাবেই রয়েছে। একপাশে আলনায় তার জামা কাপড়গুলো সাজান ছিল—হাঁ, সেগুলোও ঠিক তেমনি আছে। কোন জিনিস নড়চড় হয়নি। নূরী এবার দেয়াল হাতড়িয়ে তাক খুঁজে দেখতে লাগল। হাঁ পেয়েছে ছোট্ট একটা লম্বা বাক্স। নূরী অন্ধকারেই বাক্সটা চেপে ধরল বুকে। এ বাক্সে রয়েছে তার অতি প্রিয় বাঁশী, যে বাঁশীর সুর শুধু কান্দাই বনের গাছের শাখায় শাখায় দোলা জাগায়নি, বনের প্রতিটি পশুপক্ষী সে সুরে তন্ময় হয়ে গেছে। তন্ময় হয়েছে বনহুরের অনুচরগণ। স্তব্ধ হয়ে গেছে কান্দাই বনের আলো-বাতাস।

নূরী যখন ঝর্ণার পাশে বসে বাঁশী বাজাত তখন দস্যু বনহুর যেখানেই থাক বাঁশীর সুর কানে পৌঁছামাত্র আত্মহারা হয়ে ছুটে আসত তার পাশে। এমন কোন শক্তিই ছিল না যে শক্তি বনহুরকে বাধা দেয়।

আজ নূরী সেই যাদুকাঠি তুলে নিল হাতের মুঠায়। তার দু’চোখে আজ প্রতিহিংসার তীব্র জ্বালা। অতি সন্তপর্ণে নূরী নিজ কক্ষ থেকে বেরিয়ে এলো।

এত সহজে সে আস্তানা থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে ভাবতে পারেনি। নূরী, হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো কিন্তু একটা আশঙ্কা বারবার জাগতে লাগল তার হৃদয়ে। বুকটা টিপ টিপ করছে।

নূরী এসে দাঁড়াতেই ভীম সেন আর রঘু বেরিয়ে এলো। ভীম সেন বলল–কি হলো মা? খবর ভাল?

হাঁ। গলাটা কাঁপলো নূরীর। রঘু বলল, দস্যু বেটা আজ তাহলে বাইরে যায়নি?

নূরী কম্পিত ঠোঁটে বাঁশীখানা চেপে ধরল। বহুদিন পর আজ আবার সেই সুর। নূরীর ঠোঁটে বাঁশীর সুর কেঁপে কেঁপে উঠল। বনের শাখায় শাখায় পাখিগুলো পাখা ঝাপটা দিয়ে উঠল, স্তব্ধ বাতাসে জাগল স্পন্দন। দোলা লাগল পাতায় পাতায়।

নূরী চাপাকণ্ঠে বলল–দস্যু বনহুর নিশ্চয়ই আসবে, অতি সাবধানে তাকে ধরে ফেল তোমরা। দেখো যেন আঘাত করোনা। আবার নূরী বাঁশীতে ঠোঁট রাখল। অপূর্ব সুরের মুর্ঘনায় অন্ধকার বনভূতি মুখর হয়ে উঠল।

পাঁচ মিনিট, দশ মিনিট–কই সে তো আসছে না। নূরীর বাঁশীর সুরে আরও জোরে ঝঙ্কার উঠল।

ঐ তো শুকনো পাতায় মানুষের পদশব্দ শোনা যাচ্ছে। নূরীর বাঁশীর সুর লক্ষ্য করে কে যেন এগিয়ে আসছে।

ভীম সেন রঘুকে ইংগিত করল।

পদশব্দ আরও স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে। ওইতো সামনে এগিয়ে আসছে, কে। রঘু শিস্ দিল।

সঙ্গে সঙ্গে ভীম সেনের দল ঝাঁপিয়ে পড়ল।

মুহূর্তে থেমে গেল নূরীর বাঁশীর সুর।

প্রচণ্ড ধস্তাধস্তির শব্দ। পরমুহূর্তে ভীম সেনের কঠিন গম্ভীর কণ্ঠস্বর–খবরদার, নড়ো না।

নূরী একটু দূরে দাঁড়িয়ে দেখল—একজনকে প্রায় পঞ্চাশ জন লোক অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ঘিরে ধরেছে। নিশ্চয়ই বনহুর ছাড়া অন্য কেউ নয়। কেমন জব্দ করেছে নূরী তাকে।

ভীম সেন দস্যু বনহুরকে পাকড়াও করার জন্য শিকল সঙ্গে এনেছিল, ওকে মজবুত করে বেঁধে ফেলা হলো। তারপর সবাই মিলে নিয়ে চলল তাকে।

০৬.

হঠাৎ এ অবস্থার জন্য বনহুর একেবারেই প্রস্তুত ছিল না। গভীর রাতে যখন সে বিছানায় শুয়ে নানা কথা চিন্তা করছিল–মা, মনিরা নূরী–পর পর সকলের কথা ভেসে উঠছিল তার মনের পর্দায়। কিছুতেই ঘুম আসছিল না তার চোখে, এমন সময় তার কানে ভেসে আসে সেই সুর–যে সুর তার অতি পরিচিত। বহুদিন বনহুর এই সুরের আকর্ষণে ছুটে গেছে বন হতে বনান্তরে। নূরী কোন গোপন স্থানে লুকিয়ে বাঁশী বাজাত। বনহুর তাকে খুঁজে খুঁজে হয়রান হয়ে যেত। নূরী লুকিয়ে থেকে হাসত খিল খিল করে। আজ সেই বাঁশির সুর বনহুরকে তন্দ্রাচ্ছন্নের মত করে ফেলে। বনহুর জানে নূরী হারিয়ে গেছে। রাগ বা অভিমান করে চলে গেছে। কোথায় গেছে কেউ জানে না। তবে কি নূরী ফিরে এসেছে? সেই পরিচিত সুরে তাকে আহ্বান জানাচ্ছে? বনহুর কিছু চিন্তা না করে নিরস্ত্রভাবে ছুটে বেরিয়ে এসেছিল? ভুলে গিয়েছিল সেখানে কোন বিপদ লুকিয়ে থাকতে পারে।

বুদ্ধিমান দস্যু বনহুর নূরীর চিন্তায় গভীরভাবে মগ্ন হয়ে পড়েছিল, ঠিক সেই মুহূর্তে নূরীর বাঁশীর সুর–বনহুর ভুলে গিয়েছিল নিজের অস্তিত্ব প্রবল একটা আকর্ষণে ছুটে এসেছিল সে এখানে–নইলে তাকে বন্দী করা এত সহজ ছিল না। শুধু নূরীর বাঁশীর সুরই তাকে এই পরাজয়ের মালা পরিয়ে দিল।

দস্যু বনহুরকে বন্দী করে এ সাধ্য ছিল না ভীম সেন বা তার দলের। যতবড় ডাকাত বা দস্যু হোক, কিছুতেই ওকে বন্দী করতে সক্ষম হত না, যদি নূরী কৌশল অবলম্বন না করত। নূরীর বুদ্ধি ও চতুরতায় বন্দী হলো দস্যু বনহুর।

বনহুরকে শিকলে বেঁধে নৌকায় তুলে নেয়া হলো। বনহুর জানল, না কে তাকে এভাবে বন্দী করল। আর কোথায়ই বা তাকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।

কয়েক দিন অবিরত চলার পর ভীম সেনের আস্তানায় পৌঁছল তারা।

বনহুরকে পূর্বের ন্যায় শিকলাবদ্ধ অবস্থায় এখানে আনা হলো পাহাড়ের একটি গুহায় আবদ্ধ করে রাখা হলো। ক্রুদ্ধ সিংহ বন্দী হলে তার যেমন অবস্থা হয়, তেমনি হলো দস্যু বনহুরের।

ক’দিন সম্পূর্ণ অনাহারে রয়েছে সে।

কিছু মাংস আর রুটি তাকে নৌকায় খেতে দেয়া হয়েছিল, কিন্তু বনহুর তা খায়নি শুধু পানি খেয়েছিল মাঝে মাঝে।

অন্য নৌকায় থাকলেও নূরী এ খবর পেয়েছিল। যতই কঠিন হতে যাক সে, তবু পারছিল না। মনের মধ্যে ব্যথার কাঁটা খচখচ করে বিঁধছিল। যার এতটুকু কষ্ট তার কোন দিন সহ্য হয় না, যার মলিন ব্যথাভরা মুখ দেখলে নূরীর হৃদয় ডুকরে কেঁদে উঠে, যার জন্য নূরী প্রাণ দিতেও কুণ্ঠা বোধ করে না, সেই হুর আজ ক’দিন সম্পূর্ণ অনাহারে রয়েছে। নূরীর অন্তরটা গুমড়ে কেঁদে মরলেও কিছু বলতে বা করতে পারছিল না। কারণ বন্দীর প্রতি অনুরাগ দেখান শোভা পায় না তার। তাছাড়া ভীম সেন এতে সন্তুষ্ট হবে না। নূরী এখন তীব্র জ্বালায় মরছে। না পারছে বনহুরের কষ্ট সহ্য করতে, না পারছে তার প্রতি কোন দরদ দেখাতে। নূরী নিজে ভেতরে ভেতরে ছটফট করতে লাগল। কাউকে মনের কথাও বলবে না বা বলার সাহসও নেই নূরীর। বনহুরকে বন্দী করে আনতে ভীম সেনের দলকে যা দারুণ কষ্ট সহ্য করতে হয়েছে তা বলার নয়। এত করার পর বন্দী সম্বন্ধে সহানুভূতি দেখান তার পক্ষে সমীচীন হবে না। ভীম সেন ডাকাত–কঠিন প্রাণ মানুষ। হয়ত হিতে বিপরীত হতে পারে। হয়ত ভুল বুঝতে পারে। মনের কোণে দারুণ ব্যথা নীরবে সহ্য করে চলল নূরী।

একটা অন্ধকার গুহায় বনহুরকে শৃঙ্খলাবদ্ধ অবস্থায় রাখা হয়েছে। গুহার এককোণে একটা মশাল দপ দপ করে জ্বলছে। গুহার দরজায় দু’জন ভীষণ চেহারার দস্যু সুতীক্ষ্ণ বর্শা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে।

গুহার সামনে অগ্নিকুণ্ড দাউ দাউ করে জ্বলছে।

ভীম সেনের আস্তানা আজ ঝিমিয়ে পড়েছে। গত কদিনে অবিশ্রান্ত পরিশ্রম আর জাগরণের পর সবাই বিশ্রামের জন্য শয্যা গ্রহণ করেছে।

কিন্তু নূরীর চোখে ঘুম নেই।

বিছানায় শুয়ে ছটফট করছে সে। পাশে ঘুমন্ত মনি। নূরী শয্যা ত্যাগ করল, নিজের খাবার সে অতি যত্নে ঢেকে রেখেছে। তার হুর আজ ক’দিন উপবাস রয়েছে আর সে খাবে কোন মুখে। খাবারের থালা হাতে দরজার পাশে এসে উঁকি দিল, কোন রকমে যদি একবার ওর মুখে একটু খাবার তুলে দিতে পারত। কিন্তু উপায় নেই। নূরী ভেবেছিল, বনহুরকে কঠিন শাস্তি দিলে তার মনে শান্তি আসবে। কই, তা তো হলো না। বরং ওকে বন্দী করে নূরীর হৃদয়ের জ্বালা আরও দশগুণ বেড়ে গেছে। নূরী খাবারের থালা হাতে ফিরে এলো কুঠরির মধ্যে। পাথরের খণ্ডটার উপরে খাবারের থালা রেখে বসে পড়ল হতাশায় ভরে উঠল তার মন।

রাত ভোর হলো, গাছে গাছে পাখি পাখা ঝাপটে জেগে উঠল বিছানায় জেগে উঠল মনি। নূরী তখনও খাবার থালার সামনে বসে অশ্রু বিসর্জন করছে।

মনি বিছানার পাশে নূরীকে না দেখে আধো ভাঙ্গা কণ্ঠে ডাকল মাম্মা। মাম্মা। কই।

নূরী তাড়াতাড়ি চোখ মুছে উঠে আঁড়াল, ফিরে তাকিয়ে দেখল মনি বিছানায় বসে দু’হাত প্রসারিত করে তাকে আহ্বান জানাচ্ছে। সুন্দর ছোট্ট ফুটফুটে মুখে এ কিসের আকুলতা। ওর ঐ মুখখানা কেন নূরীকে বারবার স্মরণ করিয়ে দেয় তার হুরের কথা। সেই নাক, সেই মুখ, সেই গভীর নীল দুটি চোখ। নূরী এগুতে গিয়ে এগুতে পারে না। সুন্দর ছোট ললাটে কুঞ্চিত একগোছা চুল ঠিক তার হুরের মত। নূরী ছুটে এসে বুকে তুলে নেয়, আদর করে ডাকে মনি, আমার মনি, বাপ আমার—

মনি নূরীর গলা জড়িয়ে আনন্দে স্কুট ধ্বনি করে ওঠে–মাম্মা! মাম্মা! তুমি ঘুমোওনি?

সুন্দর ভাঙা ভাঙা অস্ফুট ধ্বনি নূরীর কানে মধু বর্ষণ করে।

নূরী বলে—না বাপ, আমি ঘুমাইনি।

কেন আম্মা?

নূরী তার কোন জবাব দিতে পারল না।

মনির ফুটফুটে নধর শরীরে তখন কোন জামা ছিল না। নূরী মনির দক্ষিণ হাতখানা নিয়ে বারবার দেখতে লাগল। মনির দক্ষিণ বাজুতে একটা জট রয়েছে। নূরী মাঝে মাঝে এই জট অবাক হয়ে দেখত, সুন্দর ফর্সা হাতে একটি কায়লা সঙ্কেতচিহ্ন।

নূরী মনিকে নিয়ে বনহুরের কষ্টের কথা ভুলতে চেষ্টা করল। কিন্তু যখন শুনল, বনহুরকে পাথরে বেঁধে চাবুকের আঘাত করা হবে, তখন নূরী কিছুতেই নিজেকে সংযত রাখতে পারল না। একে আজ কদিন অনাহারে কাতর সে, তারপর এই নির্মম শাস্তি না না, কিছুতেই এ হতে পারে না। ভীম সেনকে বলে সে এই আদেশ রদ করবে।

নূরী ছুটে গেল ভীম সেনের গুহায়, কিন্তু তার পূর্বেই বনহুরকে পাথরখণ্ডের সঙ্গে দু’হাত বেঁধে চাবুক দিয়ে মারা হচ্ছে। অন্ধকার গুহায় মশালের আলো দপ্ দপ্ করে জ্বলছে। গুহায় পাথরের ফাঁকে উঁকি দিয়ে দেখল নূরী। একজন জমকালো লোক চাবুক নিয়ে বনহুরের দেহে আঘাতের পর আঘাত করে চলেছে। ভীম সেন সামনে দণ্ডায়মান। সকল অনুচর অস্ত্র হাতে দু’পাশে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আছে। রঘু ডাকু ভীম সেনের পাশে একটা ছোরা হাতে দণ্ডায়মান।

আঘাতের পর আঘাত পড়ছে বনহুরের শরীরে। দেহের জামা ছিড়ে একপাশে ঝুলে নেমেছে। দেহের কতক অংশ বেরিয়ে পড়েছে। কয়েক জায়গা কেটে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে।

নূরী দু’হাতে চোখ ঢেকে ফেলল। একি নির্মম দৃশ্য। কেন সে এমনভাবে প্রতিশোধ নিতে গেল কেন সে এমন ভুল করল।

বনহুরের শরীরে আঘাত পড়ার সঙ্গে সঙ্গে নূরী নিজের শরীরে সেই আঘাত যেন অনুভব করতে লাগল। বিকৃত হলো তার মুখমণ্ডল।

দু’হাতে বুক চেপে ধরে ছুটে গেল। নিজের গুহায়। মনিকে বুকে তুলে নিয়ে ফুঁপিয়ে কেদে উঠল। চোখের সামনে ভাসতে লাগল বনহুরের প্রতি

সেই নির্মম যন্ত্রণার করুণ দৃশ্য। নূরী উচ্ছ্বসিতভাবে কেঁদে উঠল।

বহু চেষ্টা করেও নূরী বনহুরকে উদ্ধার করার উপায় খুঁজে পেল না।

নূরীকে কাঁদতে দেখে মনির মনের অবস্থা খারাপ হয়ে গেল। কিছুতে ভেবে পাচ্ছে না তার মা এমন করে কাঁদছে কেন?

মনি অস্ফুট কন্ঠে বলল–আম্মা, তুমি অমন করে কাঁদছ কেন?

নূরী কি বলবে, কি জবাব দেবে শিশু মনির প্রশ্নের? কি করে বলবে যাকে ধরে আনা হয়েছে সে অপর জন নয়, সে তার প্রাণের চেয়েও অধিক প্রিয়। কেমন করে এ কথাটা কচি মনিকে বুঝিয়ে বলবে।

নূরী নীরবে কাঁদে।

আজও গোটা দিন নূরী কিছু মুখে দিল না। সেই মর্মস্পর্শী হৃদয় বিদারক দৃশ্যটা বারবার মনের পর্দায় ভেসে উঠতে লাগল। দেয়ালের সাথে হাত দুটো শিকলে বাঁধা—বনহুরের শরীরে চাবুকের আঘাত করা হচ্ছে তার সুন্দর দেহ কেটে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। মুখোভাবে ফুটে উঠেছে দারুণ যন্ত্রণার চিহ্ন। অথচ নীরব সে। একটি শব্দও সে করছে না। যতই সে দৃশ্যের কথা ভাবে নূরী, ততই তার মনে বেদনার কাটা শেল হয়ে বিদ্ধ হয়। নূরী কি জানত বনহুরের কষ্ট ব্যথা তারই হৃদয়ে এসে আঘাত করবে।

আজও বনহুর জানে না, কেন এভাবে বন্দী করে আনা হয়েছে। কেন তার ওপর এই নির্মম কশাঘাত করা হচ্ছে। কার অদৃশ্য ইংগিত রয়েছে এর পেছনে, কিছুই জানে না সে।

বনহুর জানে নূরী বেঁচে নেই।

আর বেঁচে থাকলেও সে কোথায় আছে, কেমন আছে, কে জানে?

০৭.

গভীর রাত।

নূরী শয্যা ত্যাগ করে উঠে দাঁড়াল। ওপাশ থেকে একটা মাটির ছোট্ট পাতিল তুলে নিল হাতে, তারপর বেরিয়ে এলো গুহা থেকে। অদূরে আর একটা গুহার মুখে দু’জন ভীম চেহারার দস্যু সুতীক্ষ্ণ ধারাল বর্শা হাতে পাহাড়া দিচ্ছে। সামনে অগ্নিকুণ্ড দাউদাউ করে জ্বলছে।

নূরী মাটির ছোট্ট পাতিল হাতে চারদিক সতর্ক দৃষ্টি রেখে এগুলো। নিস্তব্ধ বনভূমির জমাট অন্ধকার অগ্নিকুণ্ডের আলোতে যদিও কিঞ্চিত আলোকময় হয়ে উঠলো, তবুও বেশ অন্ধকার বোধ হচ্ছিল। নূরী অতি সতর্কতার সঙ্গে ভীম চেহারার পাহারদার দু’জনের পাশে এসে দাঁড়াল।

নূরীকে দেখে বিস্ময় ফুটে উঠল পাহারাদারদের চোখেমুখে। বলল একজন—রাণীমা, তুমি!

নূরী ফিস্ ফিস করে বলল তোমাদের জন্য একটু তাল রস রেখেছিলাম, এনেছি খাবে?

পাহারাদার দু’জনের চোখ খুশিতে উজ্জ্বল হলো।

তালরস পেলে এরা সব ভুলে যায়। তাছাড়া রাণীমা যখন নিজ হাতে নিয়ে এসেছে—কম কথা নয়।

পাহারাদার দু’জন নূরীর হাত থেকে মাটির পাতিলটা নিয়ে ঢক ঢক করে এক নিঃশ্বাসে কিছুটা খেয়ে দ্বিতীয় জনের হাতে দেয়। সেও খুশিতে আত্মহারা, অল্পক্ষণেই ছোট পাতিলটা শূন্য হয়ে গেল।

ঢুলু ঢুলু করছে পাহারাদার দস্যু দু’জনের চোখ। এ ওর গায়ে ঢলে পড়তে লাগল। কিছুক্ষণের মধ্যেই দু’জন চিৎপাত হয়ে পড়ে গেল অগ্নিকুণ্ডের পাশে।

নূরী দ্রুত হাতে পাহারাদার দু’জনের কোমর হাতরে গুহার দরজা খোলার চাবি বের করে নিল। তারপর ফিরে গেল নিজের গুহায়, দ্রুত হাতে কিছুটা খাবার নিয়ে পুনরায় ফিরে এলো, তারপর দরজা খুলে প্রবেশ করল বনহুরের অন্ধকার গুহার মধ্যে।

গুহার এক পাশে মশাল জ্বলছে। সেই আলোতে নূরী তাকিয়ে দেখলো অদূরে একটা প্রশস্ত পাথরের উপরে উবু হয়ে শুয়ে আছে বনহুর।

নূরী কিছুক্ষণ স্থির হয়ে দাঁড়াল। বনহুর ঘুমাচ্ছে। গোটা দিন তার উপরে যে নির্মম যন্ত্রণা চলেছে সে অতি জঘন্য। নূরীর গণ্ড বেয়ে দরদর করে অশ্রু ঝরে পড়তে লাগল। ধীরে ধীরে এগুলো নূরী বনহুরের দিকে। পাশে গিয়ে খাবারের থালাটা রাখলতারপর বসে পড়ল ওর পাশে। মশালের আলোতে দেখল, বনহুরের পিঠের চামড়া কেটে রক্ত জমাট বেঁধে আছে। ব্যথিত দৃষ্টিতে নূরী দেখতে লাগল। বনহুরের জামাটা ছিড়ে খণ্ড খণ্ড হয়ে গেছে। পিঠ ও দক্ষিণ হাতখানা সম্পূর্ণ বেরিয়ে পড়েছে। নূরীর দৃষ্টি হঠাৎ চলে গেল বনহুরের দক্ষিণ বাজুতে। একটা কাল জট তার সুন্দর হাতের বাজুতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। নূরী চমকে উঠল এ চিহ্ন যে তার মনির বাজুতেও রয়েছে। কিন্তু ভেবে পায় না নূরী, বনহুরের সঙ্গে তার মনির এত মিল রয়েছে কেন? যাক ক্ষতগুলোর দিকে। ব্যথায় দিয়ে উঠল নূরীর হৃদয়। মোচড় নিজের ওসব ভাবনার সময় এখন তার নেই। নূরী আবার তাকাল বনহুরের পিঠে অজ্ঞাতে হাতখানা ওর পিঠে এসে পড়ল। খুব ধীরে ধীরে হাত বুলিয়ে দিতে লাগল নূরী।

সঙ্গে সঙ্গে বনহুরের ঘুম ভেঙে গেল, কার কোমল হাতের স্পর্শ তার পিঠে এসে পড়েছে। বনহুর চট করে উঠে বসল কিন্তু নূরী ততক্ষণে মাথায় ঘোমটা টেনে সরে বসে।

বনহুর উঠে বসে তাকাল, কঠিন স্বরে বলল-কে তুমি?

নূরী এভাবে ঘোমটা টেনে দিয়েছিল যে তাকে চিনার কোন উপায় ছিল। নূরীর চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়তে লাগল। কোন কথা বলল না।

বনহুরের অভ্যাস নয় কোন নারীর দেহ স্পর্শ করা। সে ইচ্ছা করলেই নূরীর ঘোমটা সরিয়ে ফেলতে পারে কিন্তু সে তা করল না।

নূরী নীরবে খাবার থালাটা এগিয়ে দিল বনহুরের সামনে।

বনহুর বিস্ময়ভরা দৃষ্টি মেলে তাকাল ঘোমটা ঢাকা মুখখানার দিকে–কে এই নারী? তার প্রতি এত দরদই বা কেন? আর এই গহন বনে অজানা দস্যু-গুহায় সাধারণ মেয়ে মানুষ এলোই বা কি করে?

ক্ষুধার্ত বনহুর অবহেলা করতে পারল না। থালাখানা টেনে নিয়ে গোগ্রাসে খেতে শুরু করল।

বনহুরের খাওয়া শেষ হলে নূরী থালাটা হাতে তুলে নিঃশব্দে বেরিয়ে গেল।

এরপর থেকে প্রতিদিন নূরী বনহুরের গুহায় আসত। নিজের খাবার থেকে কিছু বাঁচিয়ে বনহুরকে খাইয়ে রেখে যেত। কিন্তু সাবধান থাকত সে, কোন সময় ঘোমটা সরাত না বা কোন কথা বলত না।

অজানা নারী মনে করে বনহুরও কোন কথা বলত না—প্রশ্ন করত না কিছু।

বনহুর একা এই গুহায় প্রহর গুণত, কখন আসবে সেই নারী মূর্তি, যার নীরব মায়ায় তার হৃদয় আচ্ছন্ন হয়েছে। অজানা অচেনা এই নারী সম্বন্ধে বনহুরের অনেক চিন্তা। নারীটি কে? কি এর পরিচয়? এই বদ্ধগুহায় প্রবেশই বা করে সে কেমন করে? আর রোজ তাকে এমনি খাবার খাইয়ে যায়? বনহুর ভাবে, একদিন ওর ঘোমটা খুলে ফেলবে—দেখবে কে সে। কেনই বা আমার নিকট অমন করে নিজেকে লুকিয়ে রাখে।

পরদিন গভীর রাতে নূরী এলো অতি সন্তর্পণে ঘোমটা মুখ ঢেকে, হাতে খাবারের থালা।

বনহুর মিছামিছি ঘুমের ভান করে শুয়ে রইলো পাশ ফিরে। আজ সে কথা না বললে কিছুতেই জাগবে না বা খাবে না।

নূরী অতি লঘু পদক্ষেপে বনহুরের পাশে এসে দাঁড়াল। বনহুরকে ঘুমন্ত মনে করে খাবারের থালাটা মেঝেতে শব্দ করে রাখল।

কই, তবু তো ঘুম ভাঙল না ওর।

নূরী পুনঃ পুনঃ থালার শব্দ করল।

ঘুমন্ত মানুষকে জাগানো যায়, জাগ্রত মানুষকে জাগানো যায় না। নূরী বেশ চঞ্চল হয়ে পড়ল ভয় হঠাৎ যদি কেউ এদিকে এসে পড়ে তাহলে উপায় কি হবে?

নূরী বনহুরের পাশে বসে গায়ে হাত রাখল, একটু নাড়া দিল কই, তবুও ঘুম ভাঙছে না? বনহুরের দুষ্টামি বুঝতে পারল নূরী। নিশ্চয় তাকে কথা বলাতে চায়।

নূরী খাবার রেখে বেরিয়ে যাবার জন্য দরজার দিকে পা বাড়াল। অমনি বনহুর উঠে নূরীর পথ রোধ করে দাঁড়াল।

থমকে দাঁড়াল নূরী, ঘোমটার ফাঁকে তাকিয়ে দেখল বনহুর তার মুখের দিকে নিস্পলক চোখে তাকিয়ে আছে। এবার বলল বনহুর–আজ তোমার মুখের আবারণ খুলে ফেলতে হবে। কে তুমি?

নূরীর বুকটা ধক করে উঠলো। জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়ালো সে।

বনহুর এগিয়ে এলো–তুমি যদি তোমার মুখের ঘোমটা না সরাও তবে আমি জোর করে খুলে ফেলব।

নূরী তবু নীরব।

বনহুরের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেল। সে একটানে ঘোমটা খুলে ফেলল। সঙ্গে সঙ্গে অস্ফুট ধ্বনি করে উঠল বনহুর নূরী!

নূরী উচ্ছ্বসিতভাবে কেঁদে উঠে বনহুরের বুকে মুখ লুকাল।

বনহুর বিস্ময়ে স্তম্ভিত হয়ে যায়। যে নূরীর সন্ধানে সে বনে বনে ঘুরে ফিরছে, যে নূরীর চিন্তায় বনহুরের রাতের দ্রিার ব্যাঘাত ঘটেছে সেই নূরী তার সামনে জীবিত সে।

বনহুর গভীর আবেগে নূরীকে টেনে নিল বুকে। বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে বললনূরী, তুমি এখানে কি করে এলে?

নূরী সে কথার জবাব না দিয়ে বলল—হুর, তুমি আমাকে হত্যা কর! হত্যা কর হুর। আমিই তোমার এ অবস্থার জন্য দায়ী।

নূরী!

হাঁ হুর, আমিই সেদিন কান্দাই বনে বাঁশী বাজিয়ে তোমাকে ঘর থেকে বনে নিয়ে এসেছিলাম। ভীম সেন ডাকাতের দ্বারা তোমাকে বন্দী করিয়েছি।

নূরী!

হুর, তোমাকে নির্মম শাস্তি দিতে আমিই ডাকাতদলকে বাধ্য করেছি।

বেশ, এতেই যদি তোমার শান্তি হয়, আমি তোমার সে দান মাথা পেতে নেব।

হুর! নূরী আবার লুটিয়ে পড়ল বনহুরের বুকে, আমাকে তুমি মাফ কর হুর, আমাকে তুমি মাফ কর।

বনহুর পাথরের মূর্তির মত স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।

নূরী কেঁদে কেঁদে এক সময় শান্ত হল। বলল নূরী হুর, চলে যাও তুমি, এই মুহূর্তে চলে যাও হুর।

গম্ভীর কণ্ঠে বলল বনহুর–আর তুমি? আমি আর ফিরে যাব না।

নূরী, জানি না কেন তুমি আমার প্রতি এত অবিচার কর? কেন তুমি সেদিন বজরা থেকে অমন চুপ করে পালিয়ে গিয়েছিলে? আমাকে ব্যথা দিয়ে তুমি কি শান্তি পাও নূরী?

হাঁ, তুমি ঠিক বলেছে হুর। তোমাকে ব্যথা দিয়ে আমি আনন্দ পাই। নূরী! হুর, তুমি চলে যাও। চলে যাও!

না, তোমাকে না নিয়ে আমি কিছুতেই যাব না।

কিন্তু—

কিন্তু কি?

ভীম সেন ডাকু আমাকে নিজ কন্যার আসনে প্রতিষ্ঠিত করেছে, তাকে আমি ধোকা দিতে পারি না।

আর আমাকে তো তুমি ধোকা দিয়ে পালিয়ে আসতে পেরেছিলে নূরী? কেন আমি কি তোমায় একটুও ভালবাসি না।

হুর।

বল নূরী?

এই মুহূর্তে তুমি চলে যাও।

আর তুমি?

আমি মনিকে নিয়ে এখানেই কাটিয়ে দেব।

মনি! তোমার মনি বেঁচে আছে নূরী?

হাঁ, সে এখন অনেক বড় হয়েছে। কথা বলতে শিখেছে।

নূরী আমি তোমাকে একা ফেলে যাব না।

তুমি আমার জন্য ভেবো না হুর, আমি এখানেই ভাল থাকব।

আবার যদি আমাকে বন্দী করে নিয়ে আস?

তোমাকে বন্দী করে রেখেছি আমার মনের সিংহাসনে। তোমার বাহ্যিক দেহটার কোন প্রয়োজন নেই আমার।

নূরী! গভীর আবেগে নূরীকে টেনে নেয় বনহুর।

না, তুমি যাও, তুমি যাও।

আমি যাব না।

সেকি!

হাঁ, তোমাকে রেখে আমি যেতে পারব না। যেতে পারব না নূরী—

নূরী নিজেকে হারিয়ে ফেলে বনহুরের মধ্যে।

০৮.

বনহুর ভীম সেনের হাত ধরে শপথ করে আমি তোমার কোন ক্ষতি করব না।

খুশি হয় ভীম সেন।

দস্যু বনহুরকে বশীভূত করা কম কথা নয়। ভীম সেন বনহুরের শিকল নিজ হাতে খুলে দেয়।

বনহুর আর ভীম সেন বুকে বুক মিলিয়ে একতাবদ্ধ হয়।

রঘু কিন্তু এ মিলনে খুশি হতে পারল না কেমন একটা হিংসা তার মনে জট পাকাতে লাগল। ভীম সেনের প্রিয় এবং বলিষ্ঠ জন ছিল রঘু। বয়স রঘুর খুব বেশি নয়, বনহুরের চেয়ে দু’এক বছরের বেশি হবে।

বনহুর এমন বেশে স্বচ্ছভাবে ভীম সেনের দলের সঙ্গে মিশে গেছে। ভীম সেন তাকে নিজের দলের একটা শ্রেষ্ঠ আসন ছেড়ে দিয়েছে। রঘুর এটাও একটি ঈর্ষার কারণ হলো।

বনহুর দেখল শক্তি এদের কম নেই। কিন্তু বুদ্ধির অভাব যথেষ্ট।

একদিন বনহুর ভীম সেনের দলের সঙ্গে জলপথে যাত্রা করল।

উদ্দেশ্য—কোন বজরা বা নৌকা লুট করা।

বনহুর কিন্তু ভীম সেনকে বলল–তার চেয়ে চল কোন ধনীর বাড়ি হানা দিয়ে মোটা সোনাদানা নিয়ে আসি। নৌকা বা বজরার যাত্রীদের কাছে কতই বা পাওয়া যাবে!

বনহুরের কথামত এক গ্রামে ধনবান এক মহাজনের বাড়িতে হানা দিয়ে তারা বহু অর্থ আর অলঙ্কার নিয়ে ফিরে এলো। ভীম সেন জীবনে এত অর্থ ও অলংকার এক সঙ্গে কোনদিন লুট করে আনতে সক্ষম হয়নি। আজ ভীম সেনের আনন্দ আর ধরে না।

আস্তানায় একটা উৎসবের আয়োজন করল ভীম সেন।

অনেক ছোরা, তরবারি, লাঠি খেলা দেখাল। পুরুষরা নাচও দেখাল অনেকে।

এখানে যখন ভীম সেনের দল আনন্দে মাতোয়ারা। তখন বনহুর ধীরে ধীরে সরে পড়ল সেখান থেকে। নূরীর সন্ধানে চারদিকে তাকাল।

নূরী আজ উৎসবের স্থানে নেই। ঘন বনের মধ্যে একটা পাহাড়িয়া নদী, নাম তার মন্দিনা–নূরী মন্দিনার তীরে একটা পা ঝুলিয়ে বসেছিল। জ্যোস্নাভরা আকাশ, রাত কিন্তু বেশ হয়েছে। মনি ঘুমিয়ে পড়েছে অনেকক্ষণ।

সেদিনের পর থেকে নূরী আর বনহুরের সামনে যায়নি। রাগ না অভিমান, না অন্য কিছু—এ সে নিজেই জানে না। যতদূর সম্ভব নূরী বনহুরকে এড়িয়ে চলে। কোন সময় বনহুরকে সে দেখা দেয় না।

নূরীর এই পালিয়ে বেড়ান বনহুরের কাছে অসহ্য লাগে। এত লোকের মধ্যে থেকেও নিজেকে সে বড় একা বোধ করে। কিসের জন্য যদি না নূরীর ইংগিত থাকত এর পেছনে।

নূরীর পাশে এসে বনহুর দাঁড়াল।

নূরী তন্ময় হয়ে কিছু ভাবছিল। বনহুরের পদশব্দে ফিরে তাকাতেই চমকে উঠে বলে–তুমি!

বনহুর ওর পাশে ঘনিষ্ঠ হয়ে বসে পড়ল–আর এখানে তুমিও বা কেন?

হুর, আমি চাই না তুমি ভীম সেনের সঙ্গে যোগ দিয়ে দস্যুতা কর।

এতে তোমার অমত কেন নূরী? বনহুর নূরীর চিবুকটা তুলে ধরে দক্ষিণ হাতে–আজ ক’দিন তোমাকে দেখিনি।

আমি তোমার কাছ থেকে দূরে সরে থাকতে চাই।

সে কারণেই তুমি সরে এসেছিলে বুঝি?

হাঁ।

কিন্তু আমি যদি তোমাকে–

নূরী বনহুরের মুখে হাতচাপা দেয় –চুপ কর।

নূরী নিজেকে কিছুতেই বনহুরের বাহুবন্ধন থেকে মুক্ত করে নিতে পারল না।

আকাশে চাঁদ হাসছে।

বনহুরের বাহুবন্ধনে নূরী। মৃদুমন্দ বাতাস দোলা দিয়ে যাচ্ছে নূরীর কুঞ্চিত কেশগুচ্ছতে। বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে পড়ছে নূরীর চোখে মুখে। বনহুর নূরীর ললাট থেকে কেশগুচ্ছ সরিয়ে দিয়ে বলে উঠে–চল নূরী, আমরা ফিরে যাই।

কিন্তু—

কিন্তু কি নূরী?

তোমার মনিরাকে ছাড়তে পারবে?

অস্কুট ধ্বনি করে উঠল বনহুর মনিরা–ধীরে ধীরে আনমনা হয়ে গেল বনহুর। উদাসভাবে তাকাল দূরে–অনেক দূরে, মন্দিনা নদীর অপর পারে।

নূরীর মুখমণ্ডল বিষণ্ণ মলিন হয়ে ছিল। বুকের মধ্যে কে যেন. তপ্ত লৌহ শলাকা দিয়ে আঘাত করল।

কখন যে নূরী বনহুরের বাহুবন্ধন থেকে নিজেকে মুক্ত করে নিয়ে চলে এসেছে খেয়াল নেই। ঘুমন্ত মনিকে বুকে চেপে চোখের পানিতে বালিশ সিক্ত করে ফেলেছে। সব ব্যথা ছাপিয়ে মনে পড়ছে নূরীর একটা কথা–বনহুরকে সে কোনদিন ফিরে পাবে না।

মনিরা তার মন চুরি করে নিয়েছে।

০৯.

নকিব একখানা কাগজের টুকরা এনে মনিরার হাতে দিল–আপা মনি একজন বুড়ো মানুষ আপনার সঙ্গে দেখা করতে চায়।

বুড়ো মানুষ? মনিরা ভাজকরা কাগজখানা খুলতে খুলতে বলে।

তারপর কাগজখানায় দৃষ্টি ফেলতেই চমকে উঠে,লেখা রয়েছে শুধু মাত্র দু’লাইন—বৌ রাণী, কথা আছে।

মরিয়ম বেগম পাশে বসে একটা বই পড়ছিলেন। চশমার ফাঁকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললেন–কে মা? কি লিখেছে?

মনিরা উঠে কাপড় ঠিক করতে করতে বললআগে নয় এসে বলব। দ্রুত চলে গেল মনিরা নিচে।

হলঘরে উদ্বিগ্নভাবে দাঁড়িয়ে আছে এক বৃদ্ধ।

মনিরা প্রথমে চমকে উঠল–পরে নিজের মনে খেয়াল করে নিল রহমানের চেহারাটা।

মনিরাকে দেখে এগিয়ে এলো রহমান–বৌরাণী।

রহমান খবর কি? ও কেমন আছে?

নতমুখে জবাব দিল–সেই খবর নিয়েই এসেছি।

উৎকণ্ঠাভরা গলায় বলল মনিরা শিগগির বল কি খবর রহমান?

রহমানের চোখ অশ্রু ছলছল করছে–ধরা গলায় বলল—

সর্দার আজ কদিন হলো নিরুদ্দেশ হয়েছেন।

নিরুদ্দেশ হয়েছে। কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে থাকে মনিরা। তারপর পুনরায় বলে ওঠে–কোথায়? কবে? কি করে?

আমরা কিছুই জানি না বৌরাণী। একদিন ভোরে আমরা সর্দারের কক্ষে প্রবেশ করে দেখি তিনি নেই—বিছানা শূন্য।

তোমাদের না বলে কোথায় গেল?

তিনি যেখানেই যান আমাকে না বলে কোথাও যান না। তা ছাড়া সর্দার নিরস্ত্রভাবে কোথাও যাবেন না, এটা আমরা জানি।

তার মানে?

সর্দার তার কোন অস্ত্রই সঙ্গে নিয়ে যাননি। এমনকি তার রিভলবার খানাও টেবিলে যেমন রেখেছেন, তেমনি আছে।

এ তুমি কি বলছ রহমান!

হাঁ, বৌরাণী, আমরা সবাই বড়ই চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েছি। সর্দার কোনদিন আমাদের না জানিয়ে কোথাও যান না। আর গেলেও নিরস্ত্রভাবে যান না–

তবে কি হলো রহমান?

কেমন করে বলব বৌরাণী। আজ কদিন তার প্রতীক্ষায় অপেক্ষা করে তবে এসেছি আপনাকে কথাটা জানাতে।

এ তুমি কি সংবাদ আনলে রহমান! একটু থেমে বলল মনিরা আর তোমরা সবাই চুপ করে বসে আছো?

রহমান গম্ভীর কণ্ঠে বলল—না, আমরা চুপ করে বসে নেই বৌরাণী, আমাদের বিভিন্ন দল দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়েছে। আমি নিজেও বহু জায়গায় সন্ধান নিয়েছি, এমনকি পুলিশ অফিসেও খোঁজ নিয়ে জেনেছি সর্দার কোথাও বন্দী হয়েছেন কিনা। আজ তাহলে চলি। আবার ঝিন্দে যাব। যদি সেখানে কোন কারণে গিয়ে থাকেন।

আচ্ছা যাও। হতাশভরা কণ্ঠে রহমানকে বিদায় জানাল মনিরা। রহমান চলে গেল। মনিরা ফিরে এলো বিষণ্ণ মলিন মুখে।

মরিয়ম বেগম মনিরাকে বিষণ্ণ মুখে ফিরে আসতে দেখে চিন্তিত হলেন, বললেন—কে এসেছিল মা মনিরা?

মনিরা মামীমার পাশে এসে বসল, বলল–রহমান।

রহমান! সে আবার কে?

তোমার ছেলের সহকারী।

মনিরের সহকারী? কি সংবাদ ওর? আমার মনির তো ভাল আছে?

সেই সংবাদই তো নিয়ে এসেছে সে।

কি সংবাদ ব মা, দেরী করিসনে।

তোমার ছেলে নিরুদ্দেশ হয়েছে। তাকে ক’দিন থেকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।

আর্তনাদ করে উঠলেন মরিয়ম বেগম–আমার মনিরকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।

না।

এ তুই কি বলছিস মনিরা?

হাঁ মামীমা, আজ ক’দিন নাকি তার কোন সন্ধান নেই।

মরিয়ম বেগম ললাটে করাঘাত করলেন–হায়, একি হলো। আমি এই রকম একটা ভয়ই করছিলাম। কি হবে মা এবার?

মনিরার চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়তে লাগল অশ্রুধারা। সত্যিই তার যদি কিছু হয় বা হয়ে থাকে, তাহলে মনিরা, বাঁচবে কাকে নিয়ে। কার পথের দিকে তাকিয়ে প্রহর গুণবে।

মনিরা ছুটে গেল নিজের ঘরে। তার আর শিশু বনহুরের ফটোখানার পাশে গিয়ে দাঁড়াল। ফটোখানা খুলে নিয়ে চেপে ধরল বুকের মধ্যে, আপন মনেই বলে উঠল–তুমি কোথায়? ওগো তুমি কোথায়? আমার জীবনের একমাত্র প্রদীপ তুমি। আমার জীবনের একমাত্র সম্বল।

কেঁদে কেঁদে মনিরার দু’চোখ রাঙা হয়ে উঠল।

চৌধুরী বাড়িতে নেমে এলো এক দুর্যোগময় ঘটনা। বাড়ির সরকার আর নকিব ছাড়া কেউ জানল না এ বাড়িতে কি ঘটেছে, যার জন্য, মরিয়ম বেগম এবং মনিরার অশ্রু শুকাচ্ছে না।

কেঁদে কেটে আকুল হলেন মরিয়ম বেগম, কিন্তু কোন উপায় নেই যাতে তার সন্তানের খোঁজ পাবেন।

সরকার সাহেব অনেক সান্ত্বনা দিতে লাগলেন কিন্তু কিছুতেই প্রবোধ মানলেন না মরিয়ম বেগম।

মনিরার মনের অবস্থাও তাই।

চৌধুরী বাড়িতে যখন বনহুরকে নিয়ে চিন্তার অবধি নেই, তখন বনহুর ভীম সেনের দলে শ্রেষ্ঠ আসন দখল করে বসেছে।

ভীম সেন সব সময় বনহুরকে নিজের পাশে রেখে কাজ করে। তারই পরামর্শে চলে।

রঘুর হিংসা দিন দিন বেড়ে চলল। যাকে বন্দী করে নিয়ে আসা হলো সে এখন সর্দারের সহকারী। গোপনে সে নিজের দল গঠনে লেগে পড়ল এবং সুযোগ খুঁজতে লাগল কেমন করে বনহুরকে হত্যা করবে।

বনহুর সরল স্বাভাবিক মন নিয়ে মেতে রয়েছে নিজের কাজে। ভীম সেন যাতে খুশি থাকে সেই কাজ করে সে। আবার সুযোগ পেলেই ছুটে যায় নূরীর পাশে।

মন্দিনা নদীতীরে নূরী আর বনহুর হাসে, গান গায়—বনে বনে ঘুরে বেড়ায়। মনিও থাকে তাদের সঙ্গে।

এ দৃশ্য একদিন রঘুর চোখে পড়ে যায়।

বনহুর আর নূরী সেদিন একটা গাছের গুঁড়িতে ঠেস দিয়ে বসে গল্প করছিল। হাসছিল ওরা দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে।

রঘু দূর থেকে লক্ষ্য করল। চুপ করে গিয়ে জানাল ভীম সেনের কাছে।

ভীম সেন তখন অস্ত্র পরীক্ষা করে দেখছিল, রঘু গিয়ে দাঁড়াল তার পাশে—সর্দার।

ভীম সেন তাকাল তার মুখের দিকে।

রঘুর দু’চোখ দিয়ে যেন আগুন ঠিকরে বের হচ্ছে, কঠিন কণ্ঠে বললসর্দার, বনহুর রাণীর সঙ্গে প্রেম করছে।

গর্জে উঠল ভীম সেন–প্রেম!

ভীম সেনের আদেশ ছিল, তার আস্তানায় কোন নারী থাকবে না বা কোন অনুচর নারীর সংশ্রবে যাবে না। নূরীকে ভীম সেন কন্যার আসনে স্থান দিয়েছিল এবং তার প্রতি সেই রকম আচরণ সে নিজে করত আর অনুচরগণকেও করার জন্য আদেশ দিয়েছিল। বনহুরের সঙ্গে নূরীর যে কোন সম্বন্ধ বা পরিচয় থাকতে পারে, একথা ভীম সেন কোন সময় ভেবে দেখেনি বা ভাবার মত তার মনোভাব হয়নি।

হঠাৎ রঘুর মুখে ‘প্রেম’ শব্দটা শুনে তেলে বেগুনে জ্বলে উঠল ভীম সেন, বলল—বনহুর রাণীর সঙ্গে প্রেম করছে?

হাঁ, সর্দার। আমার সঙ্গে এসো, দেখবে চল।

ভীম সেন আর রঘু খোলা তরবারি হাতে দ্রুত এগিয়ে চলল। একটা গাছের আড়ালে এসে দাঁড়াল ওরা দু’জন। একটু পূর্বে যেখান থেকে রঘু দেখে গিয়েছিল বনহুর আর নুরীকে।

ভীম সেনের মুখ কঠিন হয়ে উঠল, দেখলো বনহুর শিশু মনিকে নিয়ে আদর করছে। নূরীর চিহ্ন নেই সেখানে। ভীম সেন রঘুকে অবিশ্বাসী বলে গাল দিল।

রঘু সর্দারের মুখে এই শব্দ প্রথম শুনল। রাগে ক্ষোভে অধর দংশন করল রঘু। তারপর চলে গেল সেখান থেকে। এমন অপদস্থ জীবনে সে কোনদিন হয়নি। এ তার চরম অপমান।

রঘুর মনে প্রতিহিংসার আগুন দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল। প্রকাশ্যে কিছু না বললেও ভেতরে ভেতরে নূরীর প্রতি রঘুর লালসা ছিল। শুধু ভীম সেনের ভয়ে সে কোনদিন নূরীর প্রতি হস্তক্ষেপ করার সাহস পায়নি।

নূরী নিজের গুহায় বসে জামা সেলাই করছিল। মনির এবং নিজের জামাকাপড় নূরী নিজেই সেলাই করত। আজ একটা জামা সেলাই করছিল আর গুন গুন করে গান গাইছিল। নূরীর মনে আজ কোন দুঃখ নেই। তার হুরকে সে জয় করে নিয়েছে, সমস্ত অন্তঃকরণ দিয়ে ওকে সে পেয়েছে।

নূরী বনহুরের চিন্তায় মগ্ন, ঠোঁটে গানের মৃদু দোলা। চোখের সামনে ভাসছে অতীতের কত দৃশ্য।

হঠাৎ পেছন থেকে রঘু নূরীর মুখ চেপে ধরল। সঙ্গে সঙ্গে মুখে গুঁজে দিল একটা রুমাল। অতি সহজে তুলে নিল কাঁধে। গুহার অদূরে অন্ধকারে কয়েকজন রঘুর অনুচর অপেক্ষা করছিল। নূরীকে নিয়ে রঘু পৌঁছতেই তারা ওকে ধরে মন্দিনা নদীবক্ষে ছোট্ট একটা ডিঙ্গি নৌকাতে তুলে নিল।

রঘু ফিরে এলো আস্তানায়।

নূরীকে যখন মুখে রুমাল গুঁজে মন্দিনা নদীবক্ষে ডিঙ্গি নৌকায় উঠিয়ে নেয়া হলো তখন বনহুর নিজের গুহায় পাথরের শয্যায় শুয়ে বিশ্রাম করছে।

পরদিন ভীম সেনের দলের মধ্যে একটা মহা আলোড়ন শুরু হলো–নূরী নিরুদ্দেশ হয়েছে।

বনহুরের কানেও কথাটা গেল। শুনে সে চিন্তিত হলো, এই গহন বনে সে যাবে কোথায়?

মনি মায়ের জন্য আকুলভাবে কাঁদছে।

বনহুর মনিকে তুলে নিল বুকে। কিন্তু নূরী গেল কোথায়? বনহুর ভীষণ চিন্তিত হয়ে পড়ল। এখানে সে কার জন্য রয়েছে? শুধু নূরী-সূরীর জন্য সে আজও এই ভীম. সেনের আড্ডায় পড়ে রয়েছে।

বনহুর শিশু মনিকে কিছুতেই প্রবোধ দিতে পারছে না।

ভীম সেন অত্যন্ত দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়ল। নিজের অনুচরগণকে নূরীর সন্ধানে ছড়িয়ে দিল সে বনের বিভিন্ন স্থানে।

ভীম সেন নিজেও বের হলো ঘোড়ায় চেপে।

রঘু হাসল মনে মনে।

বনহুর রঘুর মুখোভাব লক্ষ্য করে দাঁতে দাঁত পিষলো।

নূরীকে যখন ডিঙ্গিনৌকায় তুলে নেওয়া হলো তখন নূরী চিৎকার করতে না পারলেও সে নিজের হাতের আংটি এবং মাথার কাঁটা খুলে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিল নদীতীরে।

কয়েকজন বলিষ্ঠ লোক তাকে মজবুত করে হাত-পা বেঁধে ডিঙ্গির উপর ফেলে রাখল।

গোটা রাত ধরে ডিঙ্গি চলল। ভোর হবার পূর্বেই একটা দ্বীপের মত জায়গায় এসে তারা ডিঙ্গি নৌকাখানা বেঁধে ফেলল। নূরীকে এবার বন্ধনমুক্ত করে দিল।

নিঃশ্বাস ফেলে বাঁচল নূরী। এতক্ষণ মুখে রুমাল বাঁধা থাকায় নিঃশ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছিল।

নূরীকে জোরপূর্বক টেনে হিচড়ে নিয়ে চলল বলিষ্ঠ লোকগুলো।

নূরী শত চেষ্টা করেও ওদের হাত থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে নিতে পারলো না।

চারদিকে পানি আর মধ্যে এই অদ্ভুত ধরনের দ্বীপ। বড় বড় পাথর আর টিলার মত উঁচুনীচু অসমতল জায়গা। মাঝে মাঝে বড় বড় জংগল আর গাছপালা।

নূরীকে এই দ্বীপের এক স্থানে এনে নামিয়ে নেওয়া হলো। কতগুলো পাথর এক জায়গায় পাকার হয়ে পড়ে রয়েছে। লোকগুলো নূরীকে নিয়ে সেই পাথরের স্তুপের কাছে এসে থামল। কয়েকজনে ধরে একটা পাথর সরিয়ে ফেলল, সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে এলো একটা সুড়ঙ্গপথ।

লোকগুলো সেই সুড়ঙ্গপথে নূরীকে নিয়ে চলল।

নূরীকে যখন লোকগুলো সুড়ঙ্গপথে নিয়ে যাবার জন্য টানাটানি করছিল তখন নুরী নিজের আংগুল কমড়ে কিছুটা কেটে ফেলল। রক্ত বেরিয়ে এলো নুরীর আংগুল বেয়ে। নূরী সেই রক্ত পাথরের গায়ে একটা সংকেত চিহ্নের আকারে মুছে নিল।

নূরীকে নিয়ে লোকগুলো সুড়ঙ্গপথে অগ্রসর হল। কোথায় চলেছে, পথের যেন শেষ নেই। অন্ধকার পথ, একটা লোক মশাল হাতে আগে আগে চলেছে।

সমতল সুড়ঙ্গপথ।

মাঝে মাঝে বাঁক ঘুরে চলে গেছে অন্যদিকে। নূরী ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। যেখানে তাকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে সে পথের যেন শেষ নেই। নূরী নিজের জীবনের আশা ত্যাগ করল।

মৃত্যু ছাড়া এখান থেকে বের হবার আর কোন পথ নেই তার।

হুর–মনি তার মনি না জানি কত কাঁদছে। কচি মনির মুখখানা নূরীর চোখের সামনে ভেসে বেড়াতে লাগল।

এবার প্রশস্ত একটা জায়গায় এসে থমকে দাঁড়াল লোকগুলো।

নূরী মশালের আলোতে দেখলো, গভীর মাটির নিচে একটি প্রশস্ত কক্ষ। চারদিকে পাথরের দেয়াল, মাঝে মাঝে গাছের গুড়ির থাম দিয়ে ছাদটা আটকে রাখা হয়েছে। কেমন ভিজে স্যাতসেঁতে মেঝে। একপাশে গাছের গুড়ির তৈরি একটি খাটিয়া, কয়েকটা মোটা ধরনের লতাগুল্মের তৈরি বসার আসন। আরও দেখল নূরী, একপাশে মেঝেতে পড়ে রয়েছে দুটো মাটির কলসী। কয়েকটা বড় বড় বোতল।

শিউরে উঠল নূরী, এগুলো কিসের বোতল তা সে জানে। এত গভীর মাটির নিচে মদের বোতল এলো কি করে! নিশ্চয়ই এটা শয়তানদের গোপন আস্তানা।

নূরীর অনুমান মিথ্যা নয়।

শয়তান রঘু গোপনে এই আস্তানা তৈরি করে নিয়েছে। এখানেই তার গোপন বৈঠক চলে। আর চলে মদের আড্ডা। রঘু দুর্দান্ত এবং চালাক ডাকু। ভীম সেন সর্দার হলেও তাকে রঘু ভেতরে ভেতরে কমই পরোয়া করত। মাঝে মাঝে ছদ্মবেশে লোকালয়ে গিয়ে বিলেতী মদ নিয়ে আসত। স্বভাবও তার মোটেই সৎ ছিল না। নূরী এখানে আসার পর থেকে তার মনে কুচিন্তা দানা বেঁধেছে। কিন্তু ভীম সেনের আস্তানায় থেকে তার মনোবাসনা সিদ্ধ হবে না। কাজেই সেই থেকে রঘু নূরীকে সরাবার জন্য কৌশলে জাণ বিস্তার করছিল। অজানা-অচেনা এক দ্বীপে সে সুড়ঙ্গ কেটে একটা জায়গা তৈরি করে নিচ্ছিল, যেখানে সে নূরীকে নিয়ে চিরদিনের জন্য সরে যেতে পারে। ভীম সেন কেন, ভীম সেনের বাবা এলেও আর তার ও নূরীর সন্ধান পাবে না।

কিন্তু সময়ের প্রয়োজন।

তাই রঘু ধীরে ধীরে তার লক্ষ্য পথে অগ্রসর হচ্ছিল। এমন দিনে হঠাৎ অস্বাভাবিকভাবে বনহুর এসে পড়ল তাদের দলে। কেঁচো তুলতে সাপ বেরিয়ে পড়ল। নূরীকে সরাতে তার কোন বেগ পেতে হত না, কিংবা কয়েকদিন পরে সরালেও চলত, কিন্তু তা হবার উপায় নেই। তাই রঘু নূরীকে দ্রুত সরিয়ে ফেলল ভীম সেনের আস্তানা থেকে। একমাত্র বনহুরের জন্য তাকে এত তাড়াতাড়ি করতে হলো।

একদিন নয়, আরও কয়েকদিন রঘু বনহুর আর নূরীকে একসঙ্গে মিশতে দেখেছে। আড়ালে দাঁড়িয়ে দাঁতে দাঁত পিষেছে। কিন্তু নীরব রয়েছিল

সে, বললে সব কাজ হয়ত ফাঁস হয়ে যাবে।

তবু একদিন বলেছিল রঘু ভীম সেনের কাছে। তাতেও হিতে বিপরীত হয়েছে। ভীম সেন তাকে অবিশ্বাসী বদনাম দিয়েছে। নূরীকে সরিয়ে বনহুরকে শেষ করবে, এই তার মনের বাসনা।

নূরীকে তার অনুচর দ্বারা সরিয়ে ফেললেও রঘু ভীম সেনের পাশে পাশে রইল। তাকে যেন কোনরকম সন্দেহ না করে।

ভীম সেন বনে বনে নূরীর সন্ধান করতে লাগল। বনহুর আর রঘু তার সঙ্গে রয়েছে।

বনহুরের মুখমণ্ডল গম্ভীর ভাবাপন্ন।

আর রঘুর মুখোভাব দুষ্টামিতে ভরা, গোপনে বারবার সে বনহুরের মুখ লক্ষ্য করে নিচ্ছিল আর মনে মনে খুশি হচ্ছিল।

ভীম সেন ক্লান্ত হয়ে পড়ল। সে সত্যিই নূরীকে মেয়ের মত ভালবেসে ফেলেছিল। নূরীর অদর্শনে ভীম সেনের হৃদয়ে শান্তি ছিল না।

মন্দিনা নদীতীরে এসে দাঁড়াল ভীম সেন, রঘু আর দস্যু বনহুর। ভীম সেন নদীর দিকে তাকিয়ে দু’হাত জুড়ে বলল—মা গঙ্গে, তুই আমার মাইয়ারে এনে দে। মা গঙ্গে–

ভীম সেন চোখ মুদে নদীর নিকটে প্রার্থনা জানাতে লাগল, তার মুদিত চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়তে লাগল। এত দুঃখেও বনহুরের হাসি পেল। নদী কি করে তার মেয়েকে এনে দেবে, ভেবে পেল না বর্নহুর।

হঠাৎ বনহুরের দৃষ্টি চলে গেল নদীর ধারে একটা স্থানে। কি যেন পড়ে রয়েছে সেখানে। বনহুর এগিয়ে এলো, নত হয়ে যেমনি জিনিসটা হাতে উঠিয়ে নিতে যাবে, অমনি রঘু পায়ের চাপে মাটিতে দেবে দিল।

বনহুর সোজা হয়ে দাঁড়াল, কঠিন মুখোভাব নিয়ে তাকাল রঘুর দিকে।

রঘু কোন জবাব না দিয়ে মাটি থেকে জিনিসটা হাতে তুলে নিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিল নদীর পানিতে। তারপর বলল—বাপু চলো!

ভীম সেন হাতের পিঠে চোখ মুছে দাঁড়াল।

ভীম সেনের সঙ্গে রঘু পা বাড়াল। বনহুর ফিরে তাকাল পূর্বের সেই স্থানটিতে। যেখানে ইতোপূর্বে কোন একটা জিনিস সে দেখেছিল যা রঘু নদীগর্ভে নিক্ষেপ করেছিল। জিনিসটা কি ছিল, কেনই বা রঘু তাকে দেখতে দিয়ে নদীগর্ভে নিক্ষেপ করল? বনহুর তাকাতেই অদূরে ঠিক তার কাছ থেকে হাত দুই দূরে কি যেন চকচক করে উঠলো। বনহুর এবার ক্ষিপ্রগতিতে এগিয়ে গিয়ে চকচকে জিনিসটা হাতের তালুতে উঠিয়ে নিল। সঙ্গে সঙ্গে চমকে উঠল বনহুর, এ যে নূরীর আংটি! বনহুরই একদিন নূরীকে এটা উপহার দিয়েছিল। বনহুর তাকিয়ে দেখল ভীম সেন আর রঘু অনেক দূরে এগিয়ে গেছে।

বনহুর আংটিটা হাতে নিয়ে এবার ভাবতে লাগল, তারপর তাকাল অদূরে এগিয়ে চলা রঘুর দিকে। নিশ্চয়ই রঘুর চক্রান্তেন নূরী নিরুদ্দেশ হয়েছে এবং তাকে এই নদীপথেই সরানো হয়েছে। নূরী চিহ্নস্বরূপ তার আংটি রেখে গেছে নদীতীরে। বনহুর লক্ষ্য করল যেখানে আংটিটা পেয়েছে সেখানে এবং তার আশেপাশে ভিজে মাটিতে বেশ কিছু সংখ্যক পায়ের দাগ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।

বনহুর বুঝতে পারল, নূরীকে নৌকাপথে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।

বনহুরও এগুলো ভীম সেন ও রঘুর পেছনে পেছনে।

নূরী বন্দিনী অবস্থায় ভূগর্ভে নীরবে অশ্রু বিসর্জন করে চলল।

রঘুর অনুচরগণ তাকে সেখানে রেখে কিছু খাবার ও এক কলসী পানি ছাড়া আর কিছুই দিয়ে যায়নি।

নূরী এই নির্জন পাতাল গহ্বরে একা কি করবে। এখান থেকে আর তার উদ্ধার নেই। বাঁচার কোন আশাও নেই। মৃত্যুর জন্য নূরী ভীত নয়। ভয় এই নির্জন পাতালপুরীতে কেউ যদি তার ওপর হামলা করে বসে। ভয় তার ইজ্জতের, ভয় তার সতীত্বের।

যা ভেবেছিল তাই হলো।

একদিন অকস্মাৎ আবির্ভাব হলো রঘু ডাকুর। সে কি ভীষণ চেহারা, মদ পান করে মাতাল হয়ে এসেছে সে। হাতে তার মদের বোতল।

নুরী রঘুকে দেখেই ভয়ে বিবর্ণ হলো।

তাকে যে রঘুই হরণ করে এনে এখানে লুকিয়ে রেখেছে, এ কথা সে জানে। কারণ, তাকে যখন নৌকায় তুলে নেওয়া হচ্ছিল তখন রঘুই তাকে কাঁধে করে এনেছিল।

নূরী ভীত হলেও ঘাবড়াল না, বলল রঘু, তুমিই আমাকে একদিন বাঁচিয়েছ, আর আজ তুমিই….

অট্টহাসিতে ফেটে ছিল রঘু, তারপর হাসি থামিয়ে বললবাঁচিয়েছিলাম বলেই আজ আমি তোমাকে চাই।।

রঘু, তুমি না বাপুর কাছে শপথ করেছ, কোন নারীকে তুমি স্পর্শ করবে না?

হাঃ হাঃ হাঃ, শপথ–রেখে দাও তোমার শপথ। আমি ওসব মানি না। যেদিন তোমাকে প্রথম দেখেছি, ঐ দিন তোমাকে জীবন সঙ্গিনী করবো বলে শপথ করেছি। আমি তোমাকে চিরদিনের জন্য চাই–আর তারই জন্য আমার এত প্রচেষ্টা। জান এই পাতাল গহবরে আমি কত কষ্ট, কত পরিশ্রম করে এই গোপন স্থানটি তৈরি করে নিয়েছি। এখানে কেউ তোমার সন্ধান পাবে না। সর্দার ভীম সেনও না।

নূরী অসহায়ভাবে বলে উঠল কিন্তু পাপ তোমার চাপা থাকবে না।

পাপ হাঃ হাঃ হাঃ, পাপ! রঘু ডাকু পাপকে ভয় করে না সুন্দরী। ডাকু লোক পাপকে ডরায় না। পাপ ডরায় ডাকুকে দেখে, বুঝেছ? এসো সুন্দরী! রঘু এগোয় নূরীর দিকে।

নূরী ভীতভাবে পিছু হটতে থাকে।

বনহুর একটা ছোট ছিপ নৌকা বেয়ে দ্রুত এগিয়ে আসছে। মন্দিনা নদীর বুকে বনহুরের বৈঠার ঝুপঝাপ শব্দ দ্বিপ্রহরের নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করছিল।

বনহুরের শরীর ঘেমে নেয়ে উঠেছে। দ্রুত হাত চালাচ্ছে সে।

বনহুর রঘুকে অনুসরণ করেই নৌকা ভাসিয়েছিল। ও যাতে টের না পায় সেজন্য বেশ দূরত্ব রেখে ধীরে ধীরে এগুচ্ছিল। তার লক্ষ্য ছিল রঘুর নৌকায়।

রঘুর নৌকা যখন দ্বীপে এসে ভীড়লো তখন বনহুরের ছিপনৌকা রঘুর নৌকা থেকে প্রায় দু’শ হাতের বেশি দূরে। রঘু নৌকা রেখে দ্বীপে. অদৃশ্য হবার পর বনহুর এসে পৌঁছল রঘুর নৌকার পাশে।

প্রখর সূর্যের তাপে বনহুরের মুখমণ্ডল রাঙা হয়ে উঠেছে। সুন্দর ললাটে ফুটে উঠেছে ক্লান্তির ছাপ। তবু কোন হতাশ নেই, প্রবল উত্তেজনা নিয়ে ছুটে এসেছে সে নূরীর সন্ধানে।

নূরী নিরুদ্দেশ হবার পর বনহুর রঘুর প্রতি তীক্ষ্ণ নজর রেখেছিল। কারণ, প্রথমেই তার সন্দেহ হয়েছিল রঘুকে। যদিও নূরী অদৃশ্য হবার পর রঘু ভীম সেনের আস্তানা ছেড়ে একবারও বাইরে যায়নি, তবুও বনহুরের মনে এ সন্দেহ বদ্ধমূল হয়েছিল যে, রঘুই নূরীকে সরিয়েছে। সেদিনের পর থেকে তাই বনহুরের চোখে নিদ্রার অবসান হয়েছে। সর্বদা বনহুর রঘুকে পাহারা দিত। রাতে বিছানায় শুয়ে গোপনে তাকিয়ে থাকত রঘুর দিকে। দিনে রঘু যেখানেই যেতো বনহুরও থাকত ওর পাশে। সুচতুর রঘু অনেক করেও বনহুরের দৃষ্টির বাইরে যেতে পারেনি। বনহুর রঘুর চেয়ে কম চতুর নয়।

বনহুর সেদিনই বুঝতে পেরেছিল, যেদিন সে নদীতীরে নূরীর আংটি কুড়িয়ে পেয়েছিল-বুঝতে পেরেছিল কোন পথে নূরীকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সেদিন হতেই বনহুর প্রস্তুতি নিচ্ছিল–নদীপথে শয়তানকে অনুসরণ করতে তার যেন কোন ভুল না হয়। অসুবিধা না হয়। অতি গোপনে একটা ছিপনৌকা সংগ্রহ করে নিতে সক্ষম হয়েছিল সে।

আজ বনহুর সেই ছিপনৌকা নিয়েই রঘুকে গোপনে অনুসরণ করছিল।

বনহুর দ্রুতহস্তে ছিপনৌকাখানা টেনে খানিকটা উপরে তুলে নিল। তারপর ছুটতে শুরু করল বালির উপর রঘুর পদচিহ্ন লক্ষ্য করে। কিন্তু কিছুদূর এগুতেই বালুভূমি শেষ হয়ে উঁচুনীচু অসমতল জঙ্গলাকীর্ণ পথ শুরু হলো। বনহুর কোন দিকে এগুবে ভাবতে লাগল। কিন্তু বেশিক্ষণ ভাবার তার সময় নেই। আবার এগুতে শুরু করল।

বনহুর যখন বনভূমি ডিংগিয়ে অগ্রসর হচ্ছিল, ওদিকে তখন রঘুর কবলে নূরী হিংস্র বাঘের থাবায় যেমন মেষশাবকের অবস্থা হয় তেমনি নিজেকে রক্ষার জন্য কক্ষময় ছুটাছুটি করছিল।

প্রসারিত থাবা মেলে রঘু নূরীকে ধরার জন্য অগ্রসর হচ্ছে। আর নূরী নিজেকে রক্ষা করার জন্য প্রাণপণ চেষ্টায় পিছু হটছে।

নূরী কয়েকবার মদের খালি বোতল ছুড়ে মেরেছে।

রঘু অতি কৌশলে নিজের মাথা বাঁচিয়ে নিয়েছে।

ক্ষুদ্ধ শার্দুলের মত রঘু নূরীকে ধরার জন্য উম্মাদ হয়ে উঠেছে।

বনহুর তখন বনময় ছুটাছুটি করছে, কোথায় রঘু অদৃশ্য হলো। না জানি নূরীকে সে কোথায় বন্দী করে রেখেছে, তার উপর কি অত্যাচার করছে তাই বা কে জানে। বনহুর পাগলের ন্যায় অন্বেষণ করে চলেছে। হঠাৎ বনহুরের দৃষ্টি গিয়ে পড়ে অদূরে কয়েকটা পাথর পাশাপাশি পড়ে রয়েছে। একটা পাথরের উপর নজর পড়তেই বনহুর চমকে উঠল, পাথরটার গায়ে রক্তের একটা ক্রস চিহ্ন।

ইতোপূর্বে রঘু এখানেই, এই পথেই এসেছে এবং সুড়ঙ্গে প্রবেশ করেছে, কিন্তু ঐ রক্তের চিহ্ন তার নজরে পড়েনি। কারণ সে তখন স্বাভাবিক মনোভাব নিয়ে ছিল না। কিছুটা মদ সে এখানে দাঁড়িয়েই পান করে নিয়েছিল। একটা ছিপিও বনহুর কুড়িয়ে পেল।

এবার বনহুরের কাছে সব স্বচ্ছ হয়ে এলো। অতি সহজেই পাথরখন্ড সরিয়ে ফেলল বনহুর। বিস্মিয়ে স্তম্ভিত হলো সামনে একটা সুড়ঙ্গপথ দেখতে পেল সে।

মুহূর্ত বিলম্ব না করে সুড়ঙ্গপথে প্রবেশ করল।

ওদিকে রঘু নূরীকে ধরে ফেলেছে।

নূরী নিজেকে বাঁচাবার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করছে! কিল, চড়, লাথি দিয়ে ও রঘুর হাত থেকে উদ্ধার পাচ্ছে না সে। নূরী কামড়ে রঘুর হাত রক্তাক্ত করে দিয়েছে, তবু রঘু তাকে প্রবলভাবে এটে ধরেছে। চোখে মুখে রঘুর উন্মত্ত নেশা।

নূরী মরিয়া হয়ে ধস্তাধস্তি করছে। মনে প্রাণে খোদাকে সে স্মরণ করছে, হে দয়াময়! তুমি আমাকে বাঁচাও! আমার ইজ্জত রক্ষা কর।

আর বুঝি নিজেকে রক্ষা করতে পারে না নূরী।

এই বুঝি তার জীবনের চরম পরিণতি। নূরী হাত-পা ছোড়ে, দাঁত দিয়ে কামড় দেয়, তবু নিজেকে রঘুর কবল থেকে উদ্ধার করতে সক্ষম হচ্ছে না।

রঘু আর নূরীতে ভীষণ ধস্তাধস্তি হচ্ছে।

ঠিক সেই মুহূর্তে বনহুর এসে দাঁড়াল সুড়ঙ্গমুখে। কঠিন কণ্ঠে গর্জে উঠল নূরীকে ছেড়ে দাও রঘু।

রঘু সামনে যম দেখলেও বুঝি এত চমকে উঠত না।

সঙ্গে সঙ্গে রঘু নূরীকে ছেড়ে দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াল।

ক্ষুব্ধ শার্দুলের কবল থেকে হরিণ শিশু ছাড়া পেয়ে যেমন ছুটে যায় মায়ের পাশে, তেমনি নূরী রঘুর কবল থেকে ছাড়া পেয়ে ছুটে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল, বনহুরের বুকে।

বনহুর নূরীকে গভীরভাবে বুকে টেনে নিল, পরক্ষণেই নূরীকে সরিয়ে দিয়ে প্রচণ্ডভাবে আক্রমণ করল রঘুকে।

রঘু ভাবতেই পারেনি এই পাতালপুরীতে কেউ তার সন্ধান পাবে।

রঘু আর বনহুরে চলল লড়াই।

অসীম শক্তিশালী ওরা দু’জনই।

রঘু নিরস্ত্র বলে বনহুর নিজের ছোরা ব্যবহার করল না। নইলে এক নিমেষে ওকে শেষ করে ফেলত।

রঘু অল্পক্ষণেই টের পেল, তার চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী দস্যু বনহুর।

এবার রঘু পালাবার জন্য পথ খুঁজতে লাগল।

হঠাৎ বনহুরকে ধাক্কা দিয়ে সুড়ঙ্গপথের বিপরীত দিকে অগ্রসর হলো রঘু।

ওদিকে দেয়াল।

রঘু কোথায় যেন চাপ দিল, সঙ্গে সঙ্গে ওদিকে একটা পথ বেরিয়ে এলো। রঘু সেই পথে ছুটতে শুরু করল। বনহুরও তার পেছনে ছুটে চলল।

আবার ধরে ফেলল বনহুর রঘুকে।

রঘু পড়ে গেল মেঝেতে।

চলল আবার ধস্তাধস্তি।

নূরী কিছুতেই একস্থানে স্থির হয়ে দাঁড়াতে পারল না। সেও বনহুরের পিছু পিছু ছুটে এলো।

এদিকে যে এমন একটা পথ আছে একটুও বুঝার উপায় ছিল না।

বনহুর আর রঘুর লড়াই চলেছে।

রঘু নিজেকে বাঁচাবার জন্য বহু চেষ্টা করছে। হঠাৎ বনহুরকে ধরাশায়ী করে রঘু ছুটে পালাল। মাত্র এক মুহূর্তে, বনহুর উঠে রঘুর পেছনে ধাওয়া করল।

কিন্তু কি আশ্চর্য, আর অল্প দূরে গিয়েই রঘু লাফিয়ে পড়ল একটা গর্তের মধ্যে।

বনহুর আর নূরী ছুটে গিয়ে দেখল, গর্তটা খুব গভীর এবং নিচে পানির ভীষণ ছলছল কলকল শব্দ হচ্ছে।

বনহুরও লাফিয়ে পড়তে যাচ্ছিল, কিন্তু নূরী ওকে জাপটে ধরে ফেলল-না না, হুর, তুমি ও কাজ করনা। ক্ষান্ত হও।

বনহুর সোজা হয়ে দাঁড়াল।

শরীর বেয়ে ঘাম ঝরে পড়েছে। জামাটা ভিজে চুপসে গেছে। নূরী বনহুরের বুকে মুখ লুকিয়ে বলে উঠল—হুর!

বনহুর নূরীকে নিবিড়ভাবে টেনে নিল কাছে। অস্ফুট কণ্ঠে ডাকল–নূরী!

নিজের আঁচলে নূরী বনহুরের ললাটের এবং মুখের ঘাম মুছে দিতে লাগল।

১০.

ভীম সেনের সামনে দাঁড়িয়ে রঘু।

ভীম সেনের দু’চোখে যেন আগুন ঠিকরে বের হচ্ছে। কঠিন কণ্ঠে গর্জে উঠল ভীম সেন-তোমার কথা সত্য?

হাঁ সর্দার, সব সত্য। আপনার কন্যা সমতুল্য নূরীকে ঐ শয়তান বনহুর গোপনে লুকিয়ে রেখেছিল। আমি আজ তাকে হাতে নাতে ধরে ফেলেছি। আর নূরীকে উদ্ধার করতে গিয়ে এই দেখুন আমার অবস্থা….নিজের শরীরের ক্ষতগুলো দেখায় রঘু।

ভীম সেনের দেহের রক্ত উষ্ণ হয়ে উঠল।

সে তখনই তার অনুচরগণকে আদেশ দিল নিয়ে এসো ধরে যেখানে পাবে বনহুরকে। আমি তাকে আগুনে পুড়িয়ে মারব।

ভীম সেন যখন তার হুকুম পেশ করছিল তখন নূরীকে নিয়ে হাজির হলো বনহুর।

রঘুকে ভীম সেনের সামনে দণ্ডায়মান এবং ভীম সেনকে ক্রুদ্ধ দেখে বনহুর সমস্ত ব্যাপারখানা বুঝে নিল।

কিন্তু তার পূর্বেই রঘুর ইংগিতে বনহুরের বুকে তীর-ধনু বাগিয়ে ধরা হলো।

ভীম সেনের অন্যান্য অনুচর বনহুরকে বন্দী করে ফেলল।

অবশ্য বনহুর নিজে একা হলে তাকে বন্দী করার সাধ্য তাদের তখন ছিল না, সবাইকে পরাজিত করে পালাতে সক্ষম হতো সে, কিন্তু নূরী আর

মনিকে রেখে পালাবে কি করে?

নূরী আর মনির জন্যই বনহুর আজ ভীম সেনের দলের হাতে নিজেকে সমর্পন করল।

নূরী অনেক করে বুঝিয়ে বলল, বনহুর তাকে বাঁচিয়ে নিয়েছে। সব দোষ রঘুর। রঘুই তাকে চুরি করে নিয়ে গিয়েছিল-সব বলল। কিন্তু ভীম সেন সে কথা কিছুতেই বিশ্বাস করল না। . রঘুর চক্রান্তভরা কথাই ভীম সেন মেনে নিল।

ভীম সেন নারীহরণের অপরাধে বনহুরকে কঠিন শাস্তি-অগ্নিদগ্ধ করবে মনস্থ করে ফেলল।

বনহুরকে আবার সেই অন্ধকারময় গুহায় শিকলে আবদ্ধ করে রাখা হলো।

ভীম সেন আদেশ দিল শুকনো কাঠ আর ডালপালা সংগ্রহ করতে, বনহুরকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করা হবে।

ভীম সেনের আদেশ লংঘন হবার উপায় নেই।

বনের মধ্যে একটা জায়গায় শুকনো কাঠ আর শুকনো ডালপালার স্তুপাকার হয়ে উঠাল একটা উঁচু জায়গায় বনহুরকে হাত-পা বেঁধে দাঁড় করিয়ে আগুন ধরিয়ে দেবায় আয়োজন করা হলো।

নূরী মনিকে বুকে চেপে কাঁদতে লাগল। এবার আর ওকে বাঁচান সম্ভব হবে না। নিজের দোষে আজ নূরী বনহুরের হত্যার কারণ হয়ে দাঁড়াল। নানাভাবে চিন্তা করতে লাগল, কোন উপায় ওকে বাঁচাতে পারে কিনা, কিন্তু কোন কৌশলেও সম্ভব হবে না।

এক সময়ে ভীম সেনের নিকটে গিয়ে সে কেঁদে পড়ল—বাপু, তোমার মনে পড়ে, বলেছিলে এ পথ তুমি চিনলে কি করে? যেদিন আমি বনহুরকে ধরার জন্য কান্দাই বনে যাই? মনে পড়ে বাঁশীর সুরে আমি যখন বনহুরকে ঘর থেকে বের করে আনি তখন বলেছিলে-ওর সংগে তোমার বাঁশীর সুরে যোগাযোগ হলো কি করে? আমি বলেছিলাম বলব পরে।

হাঁ, তুমি বলেছিলে বেটি, বলেছিলে। কিন্তু কি কথা তা তো আজও বলনি?

বাপু, শোন আজ বলছি। আমি দস্যু দুহিতা, বনহুর আমার স্বামী!

স্বামী! অস্কুট ধ্বনি করে উঠল। তাকাল তীক্ষ্ণ দৃষ্টি মেলে নূরীর মুখের দিকে। তারপর বললো—এ কথা আগে বলিসনি কেন মা? আমি ওকে পরপুরুষ জেনে তোকে মিথ্যাবাদী ঠাউরিয়েছি। আর তাই তো ওকে আগুনে পুড়িয়ে মারার আয়োজন করেছি।

নূরীর মনের আকাশ মুহূর্তে মেঘমুক্ত হয়ে গেল। গভীর উত্তেজিত কণ্ঠে বলল-বাপু, রঘুই আমাকে গোপনে ওর অনুচর দ্বারা চুরি করে অজানা একটা দ্বীপে বন্দী করে রেখেছিল এবং আমার ইজ্জত নষ্ট করার জন্য উম্মাদ হয়ে উঠেছিল।

ঠিক সেই মুহূর্তে রঘু গুহায় প্রবেশ করল—সর্দার, বনহুরকে তার আসনে আনা হয়েছে।

ভীম সেন তাকাল রঘুর মুখে।

রঘু দেখল নূরী ভীম সেনের সম্মুখে দণ্ডায়মান।

ভীম সেন বলল—হয়েছে?

হাঁ সর্দার, হয়েছে। এখন আপনি গেলেই শুকনো কাঠে আগুন ধরিয়ে দেয়া হবে।

ভীম সেন হঠাৎ হেসে উঠল ভীষণভাবে—হাঃ হাঃ হাঃ, চমৎকার। চল তাহলে।

ভীম সেন এগুলো, পাশে চলল রঘু।

নূরী পেছনে।

ভীম সেনের হাসির শব্দে নূরীর হৃৎপিণ্ড থরথর করে কেঁপে উঠল। একটু পূর্বে তার হৃদয়ে যে ক্ষীণ আশার আলো জ্বলে উঠেছিল, দপ করে তা নিবে গেল নিমেষে।

শিথিল পা দুখানা টেনে নিয়ে নূরী এসে দাঁড়লে ভীম সেনের পাশে। তাকাল সামনে।

উঁচু একটা বেদীর মত জায়গায় বনহুরকে শিকল দিয়ে দু’হাত দুটো গাছের গুঁড়ির সঙ্গে মজবুত করে বেঁধে দেয়া হয়েছে। পা দুটোও বাঁধা হয়েছে শিকলে। তার চারপাশে স্তুপাকার শুকনো কাঠ আর ডালপালা।

একজন ভীষণ চেহারার লোক জ্বলন্ত মশাল হাতে দাঁড়িয়ে আছে। সামনে। আদেশের প্রতীক্ষা মাত্র।

নূরী দু’হাতে চোখ ঢেকে ফেলল।

বনহুর তাকিয়ে আছে নূরীর দিকে।

নূরী কাঁদছে।

বনহুরের মুখমণ্ডল কঠিন পাথরের মত। এতটুকু বিচলিত হয়নি বা ঘাবড়ে যায়নি সে। মৃত্যু যখন একদিন হবেই তখন এতে ঘাবড়াবার কি আছে! কিন্তু মরার সময় মা, মনিরা এদের সঙ্গে দেখা হলো না এই যা দুঃখ।

এখানে যখন বনহুর মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হয়ে নিয়েছে, তখন কান্দাই শহরে চৌধুরীবাড়ির একটা কক্ষে মরিয়ম বেগম নামাযান্তে দু’হাত তুলে পুত্রের মঙ্গল কামনা করে খোদার নিকটে দোয়া প্রার্থনা করছিল। দু’গণ্ড বেয়ে গড়িয়ে পড়ছিল তাঁর অশ্রুধারা।

মরিয়ম বেগমের দোয়া খোদার আরশে গিয়ে পৌঁছল। তিনি মায়ের দোয়া মঞ্জুর করলেন।

ভীম সেন কঠিন কষ্ঠে আদেশ দিল-বনহুরকে মুক্তি দাও। রঘুকে বন্দী কর।

সঙ্গে সঙ্গে একদল অনুচর রঘুকে ঘিরে ফেলল। অপর দল বনহুরের শিকল খুলে দিতে লাগল।

রঘু এ অবস্থার জন্য মোটেই প্রস্তুত ছিল না। সে আনন্দিত মনে প্রতীক্ষা করছিল, বনহুরের অগ্নিদগ্ধ দেহটা ছুড়ে ফেলে দিয়ে নূরীকে নিয়ে নিরুদ্দেশ হবে। কিন্তু সব আশা তার মুহূর্তে ধূলিস্যাৎ হয়ে গেল।

শিকলে আবদ্ধ হলো রঘু।

বনহুরের স্থানে রঘুকে মজবুত করে বাঁধা হলো। মাত্র কয়েক মুহূর্ত, দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল লেলিহান অগ্নিশিখা। রাতের অন্ধকার আলোয় গোটা বন আলোময় হয়ে উঠল।

গনগনে অগ্নিকুন্ডের মধ্যে থেকে ভেসে এলো রঘুর আর্তচিৎকার–মরে গেলাম! জ্বলে গেল। জ্বলে গেল। মরলাম….মরলাম…

ভীম সেন অট্টহাসি হেসে উঠলনারীহরণকারীর জ্বলে মরাই উচিত সাজা।

নূরী ছুটে গিয়ে বনহুরের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ল।

বনহুর ওকে নিবিড়ভাবে টেনে নিল।

ভীম সেন আনন্দের হাসি হাসল।

বনহুর এবার বিদায় চাইল ভীম সেনের কাছে।

ভীম সেন বনহুরকে বুকে জড়িয়ে ধরে বিদায় দিল।

১১.

মন্দিরা নদীর বুকে নৌকা ভাসল। বনহুর আর নুরী পাশাপাশি বসে হাত নাড়ছে, ওদের মাঝখানে মনি। সেও ছোট্ট হাত নেড়ে ভীম সেন এবং তার দলকে বিদায় সম্ভাষণ জানাচ্ছে।

ধীরে ধীরে ভীম সেনের দলসহ নদীতীর অদৃশ্য হলো।

নূরী মনিকে তুলে নিল বুকে।

বনহুর হাসল।

নূরী তাকিয়ে দেখল বনহুরের মুখের দিকে। অপূর্ব সে হাসি। বনহুরের দীপ্ত মুখমণ্ডলে এক অদ্ভূত উজ্জ্বলতার ছাপ।

নদীবুকে দুলে দুলে নৌকা এগিয়ে চলেছে।

বনহুরের বুকে মাথা রেখে নূরী শুয়ে আছে। পাশে ঘুমন্ত মনি!

বনহুর নূরীর চুলে ধীরে ধীরে হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল।

নিস্তব্ধ রাত।

জোস্নাভরা আকাশ।

নদীর জলে জোস্নার আলো অপূর্ব এক মোহময় পরিবেশ সৃষ্টি করে চলেছে। ঝুপঝাপ দাঁড়ের শব্দের সঙ্গে পানির ছলাৎ ছলাৎ শব্দ মিশে একটানা সংগীতের মত মনে হচ্ছে।

নৌকা বেয়ে চলছে ভীম সেনের দু’জন অনুচর।

আকাশের দক্ষিণ কোণে ভেসে ওঠে একখণ্ড কাল মেঘ।

বনহুর আর নূরী তা টের পায় না। ওরা তখন নৌকার মধ্যে আপ কথায় মগ্ন। বনহুর নূরীর মুখখানা তুলে ধরে হাতের তালুতে–নূরী, আজ আমার জয়যাত্রা।

নূরী সোজা হয়ে বসল, হেসে বলল-তোমার নয় আমার, এ জয়যাত্রা আমার।

উঁহু, আমার নূরী। কারণ আমি তোমাকে জয় করে নিয়ে চলেছি।

না, আমি তোমায় জয় করে নিয়েছি, হুর!

দু’জনই হেসে উঠল উচ্ছ্বসিতভাবে।

নূরীর গালে মৃদু টোকা দিয়ে বলল-নূরী, তুমি কোন দিন সিনেমা দেখেছ?

সে কি রকম জিনিস?

ছায়াছবি। ছবি কথা বলে, গান গায়, হাসে, কাঁদে….

সত্যি?

হ্যাঁ, জীবন-কাহিনী নিয়ে তৈরি হয় এই ছায়াছবি।

আশ্চর্য!

নূরী, জান ছবির প্রধান চরিত্র হলো ছবির নায়ক-নায়িকা। একজন নায়িকা, হয়তো তার বিপরীতে থাকে দু’জন নায়ক। দু’জনই ভালবাসে একজনকে। কিন্তু আসল নায়ক হলো একজন, দ্বিতীয় জন ভিলেন বা আসল নায়কের ভালবাসায় বাধা প্রদানকারী।

নূরী অত্যন্ত মনোযাগের সঙ্গে বনহুরের কথাগুলো শুনে যাচ্ছিল। বললহা বুঝলাম।

বনহুর বলে চলে—কিন্তু শেষ পর্যন্ত ভিলেনের পরাজয় হয়-হয় মৃত্যু, নয় মতের পরিবর্তন। এক নায়িকার দুই নায়ক থাকতে পারে না কোনদিন।

হ্যাঁ, এটা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন–অসম্ভব।

বনহুর মৃদু হেসে বলল——আর এক নায়কের যদি দুই নায়িকা হয়?

তাও অসম্ভব! একটি প্রাণ কোনদিন দু’জনের হয় না। কিন্তু এসব তুমি আমায় বলছ কেন হুর?

নূরী, তুমি জান আমি মনিরাকে বিয়ে করেছি।

মুহূর্তে নূরীর মুখ অন্ধকার হয়ে উঠল। যদিও নূরী এ কথা জানে তবু বনহুরের মুখে কথাটা শুনে হৃদয়টা খান খান হয়ে গেল ওর। ব্যথায় মুচড়ে উঠল ভেতরটা। মুখ ফিরিয়ে তাকাল অন্য দিকে।

আকাশে তখন মেঘ জমাট বেঁধে উঠেছে।

মাঝিদের মনে আশঙ্কা জাগল। তবু দাড় টেনে চলেছে তারা দ্রুত হস্তে। চাঁদ এখনও সম্পূর্ণ মেঘের নিচে ঢাকা পড়ে যায়নি। তাই জোছনার আলো নদীবক্ষে ঝিকমিক করছিল।

নৌকার মধ্যে নূরী আর বনহুর টের পায়নি কিছু।

বনহুর বুঝল এবং জানে, মনিরাকে নূরী সহ্য করতে পারে না –মনিরাও সহ্য করতে পারে না নূরীকে। কিন্তু উভয়ে গভীরভাবে ভালবাসে একজনকে—সে হলো বনহুর নিজে।

এমন অবস্থায় বনহুরের কি কর্তব্য? বনহুর নিজের মনে বিচার করে দেখেছে, সে উভয়কেই ভালবাসে। নূরী ছাড়া বনহুর ভাবতে পারে না। মনিরাকে, মনিরাকে বাদ দিয়েও নূরীকে ভাবতে পারে না। এই দুই নারীর প্রেম ভালবাসা-মমতা বনহুরকে সমানভাবে দখল করে বসেছে।

বনহুর জানে, পৃথিবীতে একজন-একজনকেই মনপ্রাণ সব দিতে পারে, দু’জনকে নয়। কিন্তু তার অবস্থা পৃথিবীর সকলের চেয়ে অন্য রকম। মনিরা আর নূরী বনহুরের কাছে সমান বলে মনে হয়।

মনিরা বনহুরের হৃদয়ে জাগায় শিহরণ, নূরী জাগায় স্পন্দন। মনিরার মধ্যে বনহুর রচনা করে খুশির উৎস। মনিরা তার হৃদয়ের রাণী আর নূরী তার প্রাণ প্রতিমা। কাউকে বনহুর তুচ্ছ বা নগণ্য মনে করতে পারে না। আজ তাই বনহুর নূরীকে হঠাৎ এই প্রশ্ন করে বসল।

বনহুর নূরীর চিবুকটা ফিরিয়ে নিল নিজের দিকে, শান্তকণ্ঠে বলল-কি হলো নুরী?

কিছু না।

কিন্তু পৃথিবীতে যা না হয়েছে আমি তাই চাই নূরী। আমি চাই তোমাদের দুজনকে।

নূরী বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে বলল–তা কি সম্ভব?

নূরী, যা সম্ভব নয় আমি তাই চাই–গভীর আবেগে নূরীকে কাছে টেনে নেয় বনহুর।

মনি এমন সময় নড়ে ওঠে। নূরী বলে—ছিঃ মনি জেগে যাবে যে?

ঠিক সেই মুহূর্তে মাঝির কণ্ঠে শোনা গেল ভয়ার্ত স্বর-হুজুর, ঝড় আইবো। আকাশে দারুণ মেঘ অইছে।

বনহুর আর নূরী ছৈয়ের ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো বাইরে। গাঢ় মেঘে আকাশ আচ্ছন্ন। বনহুরের আর একটা দিনের কথা বিদ্যুতের মত খেলে গেল মনের আকাশে। এমনি সেদিনও সে দাঁড়িয়ে ছিল পিতার পাশে, আকাশে ঘন মেঘ জমাট বেঁধে উঠেছিল। পরক্ষণেই ঝড়-বৃষ্টি তুফান–তারপর সব ওলোট পালট হয়ে গিয়েছিল, এমন কি তার জীবনটাও।

বনহুর আজ সেই ছোট্ট বালকটি নেই, আজ সে বলিষ্ঠ যুবক।

বনহুর দ্রুত নিজে গিয়ে দাঁড় তুলে নিল হাতে। নূরীকে লক্ষ্য করে বলল-শিগগির ভেতরে যাও নূরী, মনিকে কোলে নিয়ে বস।

আর তুমি?

আমি দেখি নৌকাটাকে বাঁচাতে পারি কিনা–বনহুরের কথা আর শোনা যায় না ঝড়ো হাওয়ায়। নূরী গিয়ে ঘুমন্ত মনিকে তুলে নেয় কোলে।

ঝড়ের দাপটে নৌকাখানা দোলনার মত দুলতে লাগল। দু’জন মাঝি আর বনহুর নিজে নৌকাখানা বাঁচানোর জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করতে লাগল।

বৃষ্টির পানি আর উচ্ছ্বসিত ঢেউয়ের পানিতে বনহুরের সমস্ত শরীর ভিজে চুপসে গেল। বলিষ্ঠ হাতে দাঁড় ঠিক রেখে নৌকাকে বাঁচাবার আপ্রাণ চেষ্টা করতে লাগল সে।

হঠাৎ প্রচণ্ড একটা ঝাপটায় বনহুর নৌকার গলুই থেকে ছিটকে পড়ল নদীতে। সঙ্গে সঙ্গে নৌকাখানা একটা ঘুরপাক খেয়ে তীরবেগে ছুটতে লাগল লক্ষ্যহীনভাবে!

১২.

একদল সখী পরিবেষ্ঠিত রাজকুমারী হীরাবাঈ গঙ্গাস্নান সেরে বাড়ি ফিরছিল। খুব ভোরে রোজ হীরাবাঈ সখীদের নিয়ে গঙ্গাস্নানে আসে। অপূর্ব সুন্দরী হীরা বেলা ওঠার পূর্বে রাজপথ বেয়ে গঙ্গাতীরে যায়। আবার লোক জাগার পূর্বেই রাজপুরীতে ফিরে আসে। যতক্ষণ হীরা রাজপথ দিয়ে গঙ্গাস্নান সেরে ফিরে না যায় ততক্ষণ নগরীর দোকানপাট বা যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকে।

সাত ঘোড়ার গাড়িতে হীরাবাঈ সাত সখী পরিবেষ্ঠিত হয়ে গঙ্গাতীরে স্নানে আসে। এমন কি ঘোড়াগাড়ি চালক পর্যন্ত নারী। হীরাবাঈ বাল্যবিধবা, ব্রাহ্মণ-কন্যা। রাজা নারায়ণ দেব অতি নিষ্ঠাবান রাজা। কন্যা বিধবা হলেও তার কোন স্বাদ-আহলাদ থেকে তিনি বঞ্চিত করেননি। যা হীরাবাঈ ভালবাসে চায়, তাই করেন রাজা নারায়ণ দেব।

প্রতিদিনের মত আজও হীরাবাঈ সাত সখী নিয়ে গঙ্গায় স্নান সেরে বাড়ি ফেরার জন্য গঙ্গাতীর বেয়ে গাড়ির দিকে অগ্রসর হচ্ছিল।

হঠাৎ হীরাবাঈয়ের দৃষ্টি চলে যায় অদূরে, সে দেখল বালুচরে পড়ে রয়েছে একটি লোক। সংগিনীদের দেখিয়ে বলল হীরা–দেখ দেখ ও কে পড়ে আছে!

হীরা সখীদের নিয়ে অগ্রসর হলো।

নিকটে পৌঁছে বিস্ময়ে স্তম্ভিত হলো হীরা। সখীরাও কম আশ্চর্য হলো। অপূর্ব সুন্দর এক যুবক অজ্ঞান অবস্থায় পড়ে রয়েছে বালুচরে।

হীরা পুরুষ মানুষ তেমন করে কোনদিন দেখেনি। যদিও দেখেছে দূরে, এত কাছে একমাত্র পিতাকে ছাড়া কাউকে দেখার সুযোগ তার কোনদিন হয়নি।

হীরা অবাক নয়নে তাকিয়ে রইল যুবকের মুখের দিকে।

সখীরা এ ওর মুখ চাওয়া-চাওয়ি করতে লাগল। হীরা বাল্যবিধবা, কোন পুরুষ দেখা তার পাপ। সখীরাও যুবকের অপরূপ সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে গেছে।

হীরা বসে পড়ল যুবকের পাশে। তাড়াতাড়ি বুকে কান রেখে বলল-পারুল এ জীবিত!

পারুল বলল—হয়ত কোন নৌকাডুবি লোক।

হীরা ব্যস্তকণ্ঠে বলল-একে নিয়ে চল পারুল।

সর্বনাশ, মহারাজ যদি জানতে পারেন?

আমি ওকে কিছুতেই এখানে রেখে যাব না পারুল, ওকে নিয়ে যাবার ব্যবস্থা কর। নিশ্চয়ই কোন রাজকুমার হবে।

একজন সখী বলল—কিন্তু পোশাক তো রাজকুমারের মত নয়। দেখছ না জামা ছেড়া।

অন্য একজন সখী বলল—সত্যি, এ অপূর্ব সুন্দর কিন্তু।

আর একজন বলল—দেবকুমারের মত দেখতে।

পারুল বলল-আমার হীরার সংগে সুন্দর মানত যদি সে বিধবা না হত–

হীরা গম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠল-ন্যাকামি রাখ দেখি। আহা বেচারী না জানি কে, কি এর পরিচয়!

পারুল হেসে বলল জ্ঞান ফিরলেই সব জানা যাবে।

হীরা বলল—তাড়াতাড়ি তুলে নে আমার গাড়িতে।

সবাই মিলে যুবকের সংজ্ঞাহীন দেহটা তুলে নিল গাড়িতে।

জ্ঞান ফিরতেই চোখ মেলে তাকাল বনহুর।

একি! বিস্ময়ে স্তম্ভিত হলো। দুগ্ধ-ফেনিল শুভ্র বিছানায় নরম তুলতুলে বালিশে মাথা রেখে শুয়ে আছে সে। বনহুর ধীরে ধীরে তাকাল কক্ষের চারদিকে। সুন্দর করে সাজান কক্ষটি। নানা রকমের বিচিত্রময় কারুকার্যখচিত দেয়াল। বড় বড় ঝাড়বাতি আর মূল্যবান লণ্ঠন ঝুলছে। যে খাটে শুয়ে রয়েছে সে খাটখানা অতি সুন্দরভাবে তৈরি। খাটের সংগে মখমলের ঝালর টাঙানো রয়েছে। খাটের পাশে গোল মার্বেল পাথরের টেবিল। টেবিলে মস্তবড় একটা ফুলদানি। ফুলদানিতে অনেকগুলো ফুল গোঁজা রয়েছে।

বনহুর এবার বিছানায় উঠে বসল, সঙ্গে সঙ্গে চমকে উঠল সে। পাশের একটা লম্বা সোফায় অপূর্ব সুন্দরী এক যুবতী নিদ্রামগ্ন। গোলাপের পাপড়ির মত মুদিত দুটি আঁখিযুগল। আপেলের মত গণ্ডদ্বয়। বনহুর তন্ময় হয়ে তাকিয়ে থাকে ঘুমন্ত যুবতীর মুখের দিকে।

একি সে স্বপ্ন দেখছে! বনহুর স্মরণ করতে চেষ্টা করল এখন সে কোথায়?-মনে পড়ল সব কথা। নৌকা থেকে নবীবক্ষে ছিটকে পড়ার দৃশ্য ভেসে উঠল তার মানসপটে। মনে পড়ল নূরী আর মনির কথা। না জানি তাদের অবস্থা কি হয়েছে। হয়ত সলিল সমাধি লাভ করেছে ওরা। ব্যাথায় টনটন করে উঠল বনহুরের মন।

কিন্তু এখানে এলো সে কি করে!

নদীর উচ্ছ্বসিত জলরাশির সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে কখন তার হাত দু’খানা অবশ হয়ে এসেছিল, তারপর কখন যে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিল, খেয়াল নেই কিছু।

বনহুর নিজেকে এই সুসজ্জিত রাজকক্ষে দেখে অনুমানে কিছুটা বুঝে নিল। কিন্তু এটা কোন দেশ, কে এই যুবতী, তাকে কি করেই বা এখানে আনল। ইচ্ছা করলে এখনই বনহুর কক্ষ থেকে বেরিয়ে যেতে পারে। কিন্তু কিছু না জেনে হঠাৎ এমনভাবে বাইরে বের হওয়া এখন তার পক্ষে উচিত হবে না।

বনহুর জানালার পাশে দাঁড়িয়ে দেখল, রাজবাড়িই বটে। ফিরে এলো সে ঘুমন্ত যুবতীর পাশে, ঝুঁকে পড়ে দেখতে লাগল সত্যি অদ্ভুত সুন্দরী মেয়েটি। নিশ্চয়ই রাজকন্যা হবে। কিন্তু সে রাজকন্যার শয়ন কক্ষে এবং বিছানায় শায়িত কেন? মোমবাতি নিয়ে বনহুর হীরার মুখটা ভাল করে দেখতে লাগল!

হঠাৎ এক ফোটা তপ্ত মিম ঝরে পড়ল হীরার গণ্ডে।

চমকে জেগে উঠল হীরাবাঈ। চোখ মেলতেই দেখল সেই যুবক তার পাশে দাঁড়িয়ে। দক্ষিণ হাতে তার মোমবাতি।

বনহুর তাড়াতাড়ি সরে যাচ্ছিল; হীরা পিছু ডাকল শোন।

থমকে দাঁড়িয়ে বনহুর ফিরে তাকাল।

হীরা মৃদু হেসে উঠে দাঁড়াল। এগিয়ে এলো তার পাশে। বললোযুবক, কে তুমি? কেমন করে নদীতীরে এসেছিলে?

বনহুর বুঝতে পারল—সে মন্দিরা নদী থেকে প্রবল ঝড়ের দাপটে ঢেউয়ের আঘাতে কোন অজানা দেশে এসে পড়েছে। নদীতীরে হয়ত পড়েছিল সে, এরা তাকে তুলে এনেছে। কিন্তু এ যুবতীর কক্ষে কেন?

হীরা পুনরায় প্রশ্ন করল কি ভাবছো যুবক? আমার প্রশ্নের জবাব দিচ্ছ না কেন?

বনহুর শান্তকণ্ঠে বলল—আমি বনহুর।

হীরা বনহুরের কথাটা পুনরাবৃত্তি করল—বনহুর! তারপর বলল—কোন দেশের রাজকুমার তুমি?

আমি রাজকুমার নই।

তবে কে তুমি?

আমি দস্যু।

দস্যু! ডাকু তুমি?

হাঁ, কিন্তু তুমি?

হীরাবাঈ। আমার বাবা নারায়ণ দেব সিন্ধু রাজ্যের মহারাজ।

হুঁ, রাজকুমারী হীরাবাঈ। কথাটা আপন মনেই বলল বনহুর। একটু থেমে বলল সে আমাকে নদীতীর থেকে কুড়িয়ে এনে ভাল করনি হীরাবাঈ।

কেন?

আমি তোমার সব অলঙ্কার লুটে নিতে পারি।

তুমি আমার সাথে অন্যায় করবে?

করব না, কারণ তুমি আমার জীবন রক্ষা করেছ। বনহুর সরে এলো হীরাবাঈয়ের পাশে আমাকে চলে যাবার পথ দেখিয়ে দাও এবার।

চলে যাবে?

হাসল বনহুর—না গিয়ে কি পারি?

তুমি চিরদিন এখানে থাকতে পার না?

বনহুর সুতীক্ষ্ণ দৃষ্টি মেলে তাকাল হীরাবাঈয়ের মুখের দিকে।

হীরা দৃষ্টি নত করে নিল।

বনহুর দেখল, হীরাবাঈয়ের মুখমণ্ডলে একটা অব্যক্ত ব্যথার্ত ভাব ফুটে উঠেছে। কি যেন বলতে চায়, কিন্তু পারছে না।

বনহুর এসে বসল বিছানার একপাশে, হীরাকে লক্ষ্য করে বলল–এখানে আমাকে কে নিয়ে এসেছে হীরাবাঈ?

হীরা মুখ তুলে তাকাল, এগিয়ে এলো বনহুরের পাশেবলল আমি আর আমার সখীগণ।

তোমার বাবা নারায়ণ দেব আমার কথা জানেন না?

না।

সেকি!

হ্যাঁ, আমার বাবা তোমার সম্বন্ধে কিছুই জানেন না।

কেন, তোমরা তাকে বলোনি আমার কথা?

না, আমার বাবা তোমার কথা জানতে পারলে আর কোনদিন তোমাকে আমার কাছে আসতে দেবেন না।

বনহুর হীরাবাঈয়ের কথা যতই শুনছিল ততই অবাক হয়ে যাচ্ছিল। তাই বনহুর প্রশ্ন করে কেন?

হীরা এবার বসল বনহুরের পাশে, বললপুরুষলোক আমার দেখা মানা।

মানা!

হ্যাঁ, কারণ আমি বিধবা।

বিস্ময়ে অস্ফুট ধ্বনি করে বনহুর—তুমি বিধবা! কিন্তু তোমার বয়স তো তেমন বেশি বলে মনে হচ্ছে না হীরাবাঈ?

আমি বাল্যবিধবা। খুব ছোট্টবেলায় আমার বিয়ে হয়েছিল। আমি স্বামীকে চিনার আগেই সে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছে।

সে কারণে পুরুষলোক দেখা তোমার মানা?

ব্রাহ্মণ বিধবা আমি, কাজেই আমার কোনদিন–চুপ হয়ে যায় হীরাবাঈ।

বনহুর এবার সব বুঝতে পারে। করুণাভরা নয়নে তাকাল ওর মুখের দিকে। হীরার কথাগুলো তার হৃদয়ে আঘাত করল। বনহুর জানত হিন্দুঘরের বিধবা মেয়েদের কাহিনী অত্যন্ত করুণ, বেদনাদায়ক। কিন্তু চাক্ষুষ দেখার বা অনুভব করার সুযোগ এই তার প্রথম।

বনহুর হীরাঈবায়ের অপরূপ সৌন্দর্যভরা যৌবন ঢলঢল চেহারার দিকে তাকিয়ে স্তব্দ হয়ে যায়। এর জীবনটা কি তাহলে এমনিভাবে নষ্ট হয়ে যাবে। ফুল ফুটে নীরবে যদি ঝরে যায়, কেউ যদি তার ঘ্রাণ গ্রহণ করতে না পারে, তবে সে ফুলের জীবনে সার্থকথা কি?

বনহুর আনমনা হয়ে গিয়েছিল। হঠাৎ হীরার দীর্ঘশ্বাসের শব্দে চোখ তুলে তাকায়।

হীরা বলে ওঠে–তোমাকে কোনদিন যেতে দেব না।

একটুকরা ম্লান হাসি ফুটে উঠল বনহুরের ঠোঁটের কোণে। কোন জবাব দিল না সে।

পূর্বাকাশ তখন ফর্সা হয়ে এসেছে।

সাত সখী প্রবেশ করল কক্ষে। বনহুর ও হীরাবাঈকে পাশাপাশি বসে কথা বলতে দেখে থমকে দাঁড়াল।

হীরাবাঈ হেসে বলল–ভয় নেই, ওরা আমার সখী।

বনহুর ভয় পাবে নারীদের দেখে। তবু চোখেমুখে ভীতিভাব এনে বলল বাচলাম।

একসঙ্গে সখীগণ হেসে উঠল।

হীরা বলল-ওদের সাহায্যেই আমি তোমাকে এখানে এনেছি।

ও, তাই বল। তুমি একা নও।

আমি কি পারি তোমার ওই বলিষ্ঠ দেহটা একা তুলতে। আচ্ছা তুমি আমার এই কক্ষে থাক, আমি গঙ্গাস্নান করে আসি।

সখীদের মধ্য থেকে পারুল বলল—এরই মধ্যে খুব যে ভাব জমিয়ে নিয়েছ হীরা, দেখ সাবধান। বাঁকা চোখে একবার বনহুরের দিকে তাকিয়ে দেখে নিল সে।

হীরা সখীদের সঙ্গে বেরিয়ে গেল।

নগরী জাগরিত হওয়ার পূর্বেই আবার ফিরে আসবে ওরা।

১৩.

ইচ্ছা থাকলেও বনহুর হীরাবাঈ আর তার সাত সখীর নিকট হতে পালাতে সক্ষম হলো না। বিশেষ করে হীরার চোখের পানি তাকে অভিভূত করে ফেলল। বড় মায়া হলো বনহুরের, চাইল হীরার জীবনটা যেন নষ্ট হয়ে না যায় তাই করতে।

সব সময় বনহুর ভাবতে লাগল—কি করে হীরার জীবন সুখের এবং আনন্দের করা যায়! কিন্তু এ সবের মধ্যেও বারবার বনহুরের মনে নূরী আর মনির কথা উদয় হতে লাগল। সেই মন্দিনা নদী থেকে এদেশ কত দূরে। কত দুরে সেই কান্দাই নগর, যেখানে তার মা আর মনিরা তার প্রতীক্ষায় প্রহর গুণছে। নূরী আর মনির জন্যই বনহুরের মন বেশি বেদনাবিধুর হয়ে পরেছে। ইচ্ছা করলে এখনই সে চলে যেতে পারে কিন্তু হীরা হীরাকে এমনভাবে ফেলে মন তার যেতে চাইল না।

বনহুর যখন হীরাবাঈয়ের জন্য গভীরভাবে চিন্তা করছে, হীরা তখন বনহুরকে কেন্দ্র করে রচনা করে চলেছে স্বপ্নসৌধ।

হীরা বাগানের ফোয়ারার পাশে বসে বীণা বাজাচ্ছিল। আর ভাবছিল বনহুরের কথা। ওকে আর কোনদিন ছেড়ে দেবে না হীরা। যোক সে বাল্যবিধবা, মানবে না ওসব কিছু। গোপনে বনহুরকে সে লুকিয়ে রাখবে নিজের অন্তঃপুরে, যেখানে কোন পুরুষের প্রবেশ নিষেধ, কেউ জানবে না ওর কথা।

হীরা মাঝে মাঝে পারুলের কাছে মনের কথা সব খুলে বলত। আজ পারুল এসে বসল হীরার পাশে। ওকে চমকে দেবার জন্য পেছন থেকে হীরার চোখ দুটি চেপে ধরল।

হীরার হাতে বীণার সুর থেমে গেল।

হীরা চমকে উঠলো, বনহুরের চিন্তায় হীরা তন্ময় ছিল, কাজেই সে চট করে বলল তুমি?

পারুল হীরার চোখ ছেড়ে দিয়ে খিলখিল করে হেসে উঠল। হীরা লজ্জিত কণ্ঠে বলল-ও তুই?

দু’সখী মিলে যখন কথা হচ্ছিল, অদূরে এসে একটা গাছের আড়ালে দাঁড়াল বনহুর। যেখান থেকে হীরা আর পারুলের কথা সব শুনতে পাবে।

পারুল বসে পড়ল হীরার পাশে, হীরার গালে টোকা দিয়ে বললসব সময় তার ধ্যানেই মগ্ন থাকবি?

পারুল্ল!

হীরা, আমি সব জানি।

আমি ওকে ছাড়া বাচব না পারুল।

কিন্তু তুমি যে হিন্দু ঘরের বিধবা–

পারুল! চিৎকার করে ওঠে হীরা।

পারুল বলে কিন্তু জান এর পরিণতি কি হবে?

বাবা আমাকে মৃত্যুদণ্ড দেবেন।

হ্যাঁ, তিনি যেমন নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ রাজা—তোমার জন্য তিনি নিষ্ঠা নষ্ট করবেন না। সমাজের তিনি অধিপতি–

পারুল, সমাজের জন্য, নিষ্ঠার জন্য আমার জীবন নষ্ট হয়ে যাবে? আমার কি কাউকে ভালবাসার অধিকারটুকু নেই?

হীরা। তুমি তো জান, তোমার মাসিমা দেবীকা বাঈ তাঁর মৃত স্বামীর সঙ্গে সহমরণেও গিয়েছিলেন।

আমাকে তাহলে তখন স্বামীর জ্বলন্ত চিতায় পুড়ে না মেরে জীবিত রেখেছিল কেন? না, না, আমি বাঁচতে চাই না পারুল, আমি বাঁচতে চাই না–পারুলের বুকে মুখ গুঁজে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে হীরাবাঈ।

বনহুর আড়ালে দাঁড়িয়ে অধর দংশন করে। অব্যক্ত একটা ব্যথা তার মনে চাড়া দিয়ে ওঠে। দাঁতে দাঁত পিষে ভাবে হিন্দু সমাজের টুটি ছিড়ে ফেলবে সে। হীরাকে বিয়ে দিয়ে নিষ্ঠাবান রাজার দর্প চূর্ণ করবে কিন্তু পাত্র কোথায়? কোথায়?

সেদিন হীরা সখীদেরকে নিয়ে বনহুরকে নাচ দেখাচ্ছিল। একটা আসনে বনহুর বসে ছিল, হীরা আর তার সখীগণ নেচে চলেছে।

বনহুর তস্ময় হয়ে দেখছে, হীরা অপূর্ব সুন্দর নাচছে।

হীরা এত সুন্দর নাচতে পারে, ভাবতেও পারেনি বনহুর।

সেদিন হীরার বীণার সুর তাকে বিমুগ্ধ করে ফেলেছিল।

বনহুর ভাবে, এত সুন্দর একটা জীবন নীরবে শুকিয়ে যাবে, তা হয় না।

নাচা শেষ হলে সখীরা চলে যায়।

হীরা তাকায় বনহুরের মুখের দিকে। হীরার মুখে ঘামের বিন্দুগুলো ঠিক যেন মুক্তার মত চক চক করছিল। অপূর্ব সুন্দর দেখাচ্ছিল ওকে।

বনহুর সরে আসে হীরার পাশে। মধুর কণ্ঠে ডাকে–হীরাবাঈ।

হীরা গম্ভীর হয়ে বলে—উঁহু, শুধু হীরা বলে ডেক।

বেশ, তাই ডাকব। হীরা, অপূর্ব নেচেছ!

উফুল্ল কণ্ঠে বলে হীরা—সত্যি!

হ্যাঁ হীরা!

হীরা আবেগমাখা কণ্ঠে বলল-বনহুর!

হীরা!

বল?

সেদিন পারুলকে তুমি যা বলেছ সব শুনেছি।

চমকে উঠল হীরা–শুনেছ?

হ্যাঁ, কিন্তু তুমি যা বলছ তা সম্ভব নয়। আমি মুসলমান।

হীরা একবার তাকাল বনহুরের দিকে, তারপর বলল কিন্তু আমি যে তোমাকে ভালবেসে ফেলেছি!

ভাল আমিও তোমাকে বেসেছি হীরা।

বনহুর!

হাঁ, তোমাকে আমি বোনের মত স্নেহ করি।

চমকে তাকাল হীরা, অস্ফুট কণ্ঠে বলল-তুমি–তুমি–

হীরা, আমি বিবাহিত, আমার স্ত্রী আছে,–এমনকি একটি সন্তানও কথা শেষ না করে থেমে যায় বনহুর।

হীরা পাথরের মূর্তির মত স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। গণ্ড বেয়ে গড়িয়ে পড়ে ফোটা ফোটা অশ্রু।

বনহুর হীরার চোখের পানি নিজের আংগুলে মুছে দিল।

হীরা আবেগভরা কণ্ঠে বলল—এ তুমি কি করলে? সঙ্গে সঙ্গে হীরা ঢলে পড়ল মেঝেতে।

বনহুর তাড়াতাড়ি হীরার মূৰ্ছিত দেহটা ধরে ফেললো দু’হাত দিয়ে। তারপর তুলে নিল হাতের উপর।

ঠিক সেই মুহূর্তে পারুল এসে দাঁড়াল—একি! ওকে আপনি স্পর্শ করলেন?

বনহুর একটু হকচকিয়ে গেল, বলল—হঠাৎ হীরা অজ্ঞান হয়ে পড়েছে।

কিন্তু জানেন তো, আমাদের জাতের মধ্যে যে পুরুষ একবার কোনো নারীকে স্পর্শ করে তাকেই বিয়ে করতে হয়।

বনহুর হাসল—চল আগে ওকে বিছানায় শুইয়ে দিই।

পারুল আর বনহুর হীরার সংজ্ঞাহীন দেহটা এনে বিছানায় শুইয়ে দিল।

পারুল হীরার চোখে-মুখে পানির ঝাপটা দিতে দিতে বলল—একি করলেন! একি করলেন আপনি?

আমি–আমি তো কিছু করিনি।

কথা দিন ওকে বিয়ে করবেন?

সে কথা তোমার সখীর সংগে হয়ে গেছে পারুল।

ও, তাই বুঝি হীরা আনন্দে….

হাঁ, আনন্দে অজ্ঞান হয়ে পড়েছে। আচ্ছা পারুল, তুমি সখীর পাশে এসে সেবা কর, আমি পাশের কক্ষে বিশ্রাম করছি।

তা হয় না, অপনি বরং বসুন, আপনার জন্যই বেচারীর এ অবস্থা।

কিন্তু আমার যে বড্ড ঘুম পাচ্ছে।–বনহুর চট করে উঠে চলে গেল পাশের ঘরে। তারপর খিল এঁটে দিল।

বনহুর সম্মুখ দরজায় খিল দিয়ে পেছনের জানালার কাঁচ খুলে ফেলার চেষ্টা করতে লাগল। অনেক চেষ্টা করে একটা চাকু সংগ্রহ করে নিল বনহুর। তারপর কিছুক্ষণ চেষ্টা করার পর জানালা দিয়ে বেরিয়ে পড়ল বাইরে।

ছাদের রেলিং বেয়ে অতি কষ্টে এগুতে লাগল মহারাজার কক্ষের দিকে।

বনহুর মহারাজের কক্ষের নিকটে এসে পৌঁছল। এবার অতি সহজে তার কক্ষের মুক্ত জানালাপথে ভেতরে প্রবেশ করল। কক্ষে প্রবেশ করেই দেয়ালে টাঙানো সুতীক্ষ্ণধার ছোরাখানা তুলে নিল দক্ষিণ হাতের মুঠোয়। পকেট থেকে রুমালখানা বের করে মুখে বাঁধল যেমন দস্যুরা বাঁধে।

বনহুর এবার সুতীক্ষ্ণ ছোরা হাতে মহারাজ নারায়ণ দেবের শয্যার পাশে এসে দাঁড়াল। একটানে তাঁর শরীরের চাদর সরিয়ে দিল সে।

ধড়ফড় করে উঠে বসলেন রাজা নারায়ণ দেব। সম্মুখে তাকিয়ে চোখ তার ছানাবড়া হলো। ঢোক গিলে বললেন–কে তুমি? কি চাও?

আমি দস্যু বনহুর।

দস্যু বনহুর! কি চাও আমার কাছে? যা চাইবে তাই দেব। শুনেছি কান্দাই জঙ্গলে দস্যু বনহুর বলে এক ভয়ঙ্কর দৃস্যু আছে, সেই দস্যু তুমি?

হাঁ, আমিই।

আরও শুনেছি, দস্যু বনহুর নাকি ভয়ঙ্কর হলেও দয়ার প্রতীক। দীন-হীন জনের বন্ধু। বহুদিনের আশা আমার সফল হলো। মনে মনে বহুদিন তোমাকে দেখার বাসনা আমার মনে উঁকি দিত। দস্যু হলেও তুমি দেবতার সমান–

অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল বনহুর—মায়াভরা কথাতে দস্যু বনহুরের হৃদয় কোমল হয় না মহারাজ।

তুমি যাই বল, তুমি আমারও বন্ধু–কারণ, আমি চাই আমার দ্বীনহীন প্রজাদের মঙ্গল, আমার অনাথ মা বোনদের শান্তি–

এবার বনহুর ছোরাখানা মহারাজ নারায়ণ দেবের বুকের কাছে চেপে ধরল –তোমার নিজের ঘরের দিকে দেখেছ রাজা?

দেখেছি, ও অর্থ আমার নয়। সব আমার প্রজাদে–

সে কথা বলছি না, বলছি–তুমি মা-বোনদের শান্তি চাও?

চাই–শতবার চাই।

তোমার কন্যার মনের দিকে তাকিয়ে একবার দেখেছ রাজা?

চমকে ওঠেন মহারাজ নারায়ণ দেব–আমার কন্যা?

হাঁ, তোমার কন্যা হীরাবাঈ।

চঞ্চলকণ্ঠে বলে উঠলেন মহারাজ-হীরা! আমার হীরার কি হয়েছে দস্যু?

তোমার যদি এতটুকু বিবেক থাকত রাজা, তাহলে নিজের কন্যাকে টুটি টিপে হত্যা করতে না।

হত্যা! আমার হীরাকে হত্যা করেছি টুটি টিপে?

তা নয় তো কি? শিশুকালে তাকে বিয়ে দিয়ে বৈধব্য যন্ত্রণা তার ঘাড়ে চাপিয়ে তিলে তিলে তাকে হত্যা করছ।

একি বলছ? তার অদৃষ্টে যা ছিল তা ঘটেছে।

অদৃষ্টে ছিল না—তুমিই তার জীবনটাকে বিনষ্ট করে দিয়েছ। তার চিরদিনের স্বাদ আহলাদ সব, তুমি নষ্ট করে দিয়ে নিষ্ঠুরতার পরিচয় দিচ্ছ।

হাঁ, আমরা যে ব্রাহ্মণ, আমাদের ধর্মে মেয়েদের একবারই বিয়ে হয়।

স্বামীকে যে কোনদিন দেখেনি, স্বামী কি জিনিস যে বুঝেনি তার আবার বিয়ে? হাঃ হাঃ হাঃ এই তোমাদের হিন্দুধর্ম! বল রাজা, তোমার কন্যা হীরার আবার বিয়ে দেবে না মৃত্যুবরণ করে নেবে-কোনটায় তুমি রাজী?

তা হয় না। আমাদের হিন্দুমতে ব্রাহ্মণকন্যার পুনঃবিবাহ হয় না।

হতে হবে–নইলে আমি তোমাকে হত্যা করব।

তুমি যত টাকা চাও নিয়ে যাও দস্যু। তবু আমার নিষ্ঠা ভঙ্গ কর না।

তোমার কন্যার জীবনের বিনিময়ে তুমি আমাকে অর্থ দিতে চাও, নিজের জীবনের বিনিময়ে নয়?

আমি নিরুপায়।

না, তোমাকে হীরার বিয়ে দিতেই হবে।

কিন্তু কে তাকে বিয়ে করবে? বিধবাকে কে বিয়ে করবে বল?

আমি তোমার কন্যার পাত্র খুঁজে দেব। বল রাজী?

রাজী।

তিন বার বল রাজী, তিন সত্য করে বল।

রাজী। রাজী। রাজী।

বনহুর যেমন আচম্বিতে এসেছিল তেমনি মুহূর্তে জানালাপথে অদৃশ্য হলো।

পরদিন মহারাজ নারায়ণ দেব রাজসভায় গেলেন না। কোন পরিষদের সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ করলেন না। রাজকার্য করলেন না। রাজকর্মচারিগণ বিস্মিত হলেন। আত্মীয়-স্বজন দুশ্চিন্তায় পড়ল, মহারাজের হঠাৎ এক রাত্রের মধ্যে কি হলো।

আহার-নিদ্রা ত্যাগ করলেন মহারাজ। সদা চিন্তা করতে লাগলেন, কি করে তার বিধবা কন্যাকে আবার বিবাহ দেবেন। সমাজে তার মাথা হেট হয়ে যাবে। নিষ্ঠাভঙ্গ হবে। সবাই ছিঃ ছিঃ করবে। এর চেয়ে মৃত্যু অনেক ভাল।

বনহুর সেই দিনের পর থেকে সিন্ধু রাজ্যে প্রতি ঘরে ঘরে পাত্র খোঁজ করে চলল। হীরার পাত্র সুন্দর, সুপুরুষ, জ্ঞানী, বুদ্ধিমান এবং কুলীন ব্রাহ্মণ হতে হবে।

পেয়েও গেল সে একদিন।

পাশের রাজ্যে ব্রাহ্মণ তরুণ রাজা জহর সেনকে আবিষ্কার করল বনহুর।

তারপর একদিন গোপনে হীরার ছবি নিয়ে রাজা জহর সেনের রাজসভায় বৃদ্ধ জ্যোতিষীর বেশে গিয়ে হাজির হলো।

রাজা জহর সেন যেমন সুন্দর তেমনি হৃদয়বান এবং মহৎ। সে জ্যোতিষীকে আদর করে নিজের পাশে বসাল।

বনহুর জ্যোতিষীর বেশে নিজকে আসনে প্রতিষ্ঠা করে গম্ভীর কণ্ঠে বলল –মহারাজা আপনার জয় হোক।

সসম্মানে বলল জহর সেন—জ্যোতিষী আপনার আগমনের কারণ জানতে পারি কি?

নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই পারেন মহারাজ। আমি এসেছি একটি শুভবার্তা নিয়ে।

বলুন জ্যোতিষী।

বনহুর থলের মধ্যে হতে হীরার ফটোখানা বের করে বলল –এই মেয়ে পছন্দ হয়?

কুমার জহর সেন বনহুরের হাত থেকে ফটোখানা নিয়ে দেখতে লাগল। চোখ মুখ মুহূর্তে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। অনেকক্ষণ তন্ময় হয়ে তাকিয়ে দেখল জহর সেন, তারপর বলল হাঁ, জ্যোতিষী এ মেয়েটি আমার অত্যন্ত পছন্দ হয়েছে।

সত্যি রাজা?

হাঁ এবং অতি শীঘ্র একে আমি বিয়ে করতে চাই।

বেশ, তাই হবে। উঠে দাঁড়ায় বনহুর।

জহর সেন নিজ কণ্ঠের মুক্তার মালা খুলে জ্যোতিষীর হাতে দিতে যায়–এই নিন আপনার পুরস্কার।

না। শুভ কাজের পর আমি পুরস্কার নেবআগে নয়। এখন চললাম।

জহর সেন প্রণাম জানায়। জ্যোতিষী বিদায় গ্রহণ করে।

১৪.

পৃথিবীর বুকে যেন একটা ধ্বংসের লীলা খেলা হয়ে গেছে। গত রাতের ঝড় সব তচনচ করে দিয়ে গেছে। নূরী শিশু মনিকে নিয়ে নৌকায় বসে আছে। নৌকা আপন মনে দুলে দুলে এগিয়ে চলেছে। কোথায় চলেছে, কোথায় এর শেষ-কেউ জানে না।

নৌকার মাঝিদ্বয় বনহুরকে উদ্ধারের জন্য নদীবক্ষে লাফিয়ে পড়েছিল, ফিরে আর আসেনি। কোথায় চলে গেছে ওরা কে জানে। ঝড় থেমে গেছে। প্রকৃতি শান্ত ধীর স্থির হয়েছে। নদীর উচ্ছ্বসিত জলরাশি নিটল নির্মল হয়েছে। কিন্তু এ কোথায় এসে গেছে নূরী আর মনির নৌকা। যেদিকে তাকায় নূরী শুধু জল আর জল। কোথাও তীরের চিহ্ন নেই।

নূরী ভয়ে বিবর্ণ হয়ে উঠল। ক্ষুধা পিপাসায় কণ্ঠনালী শুকিয়ে এসেছে। মনির তো কথাই নেই। বার বার মনি বলছে–আম্মা, আমরা কোথায় যাচ্ছি?

নূরী মনিকে বুকে চেপে বলে উঠে কেমন করে বলব বাবা।

আম্মা, আমার ক্ষিদে পেয়েছে।

হু হু করে কেঁদে উঠল নূরীর মন, বলল–কি খাবে বাপ। কিছুই যে নেই।

কিন্তু কতক্ষণ এমনি করে ওকে ভুলিয়ে রাখা যাবে।

গোটা দিন কেটে গেল। রাত এলো—

নূরী আর মনি নৌকার মধ্যে ভেসে চলেছে—দিকহারা, দিশেহারা যাত্রী তারা।

সে রাত গেল, আবার ভোর হলো।

গোটা পৃথিবী সূর্যের আলোতে ঝলমল করে উঠল।

নূরী আর মনির নৌকা ভেসে চলেছে।

মনির সুন্দর গোলাপকুড়ির মত মুখখানা শুকিয়ে এতটুকু হয়ে গেছে। কাঁদতে পারছে না মনি, কণ্ঠ নীরস শুষ্ক।

নূরী হতাশ হয়ে পড়ল। চোখে অন্ধকার দেখল আর বুঝি মনিকে সে বাঁচাতে পারল না।

এলিয়ে পড়েছে মনি নূরীর কোলে।

নূরীর চোখ বসে গেছে, কণ্ঠ দিয়ে কথা বের হচ্ছে না। নূরী নিজের এবং মনির জীবনের আশা ত্যাগ করল।

আর নূরীর মনে হলো, মনিকে সে রেখে ভুল করেছে।

কেন যে মনিকে তার বাপ-মার কাছে ফেরত দেয়নি।

তাহলে মনি আজ এমনভাবে শুকিয়ে মরত না। কে এর বাবা-কে এর মা, কার এ শিশু-নূরীর চোখ দিয়ে দু’ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। হয়ত তখন সন্ধান করলে এর বাবা মাকে খুঁজে পাওয়া যেত। নিশ্চয়ই ইচ্ছা থাকলে উপায় হত, কিন্তু নূরীই তা হতে দেয়নি। একটা গভীর স্নেহ তার নারী-হৃদয়ে দানা বেঁধে উঠেছিল।

নৌকা ভেসে চলেছে।

নূরীর কোলে মনি ঘুমন্ত না জাগ্রত বুঝার উপায় নেই। চোখ দুটো মুদে আছে। নূরী মাঝে মাঝে ভাবে মনির মৃতদেহ নদীবক্ষে বিসর্জন দিয়ে নিজেও নদীবক্ষে ঝাঁপিয়ে পড়বে, বাস্ সব শেষ হয়ে যাবে।

যেখানে তার হুর গেছে, তার মনি যাবে, সেখানেই হবে নূরীর চিরশান্তি।

নৌকা দুলে দুলে এগিয়ে চলেছে।

উপরে প্রখর সূর্যের তাপ অগ্নিবর্ষণ করছে।

নিচে সীমাহীন অথৈ জলরাশি—

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *