৩. বনলতা সেন বইটি

আকাশের ওপারে সহসা নতুন আকাশ

০১.

মানুষ, সমাজ ছাড়িয়ে যখন তিনি প্রকৃতির ভেতর আশ্রয় খুঁজছেন, যখন বিক্ষুব্ধ মনকে শান্ত করবার একটা পথ পেয়েছেন, তখনই পাশাপাশি পেলেন এক সুসংবাদ। যে বছর বিয়ে করলেন, সেই ১৯৩০-এ হারিয়েছিলেন তার দিল্লির চাকরি। তারপর দীর্ঘ পাঁচটা মর্মান্তিক বছর কাটিয়ে অবশেষে একটা নিয়মিত চাকরি পেলেন তিনি ১৯৩৫-এ। দীর্ঘ উতরাইয়ের পর যেন পেলেন একটা চড়াইয়ের পথ। চাকরিটা পেলেন অনেকটা কাকতালীয়ভাবেই। বরিশালের ব্রজমোহন কলেজে ইংরাজির লেকচারার ছিলেন তাঁরই বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠী মন্মথ ঘোষ। তিনি দিল্লির একটা কলেজে চাকরি পেয়ে চলে গেলে তার পদটা শূন্য হয়, মন্মথ নিজে এই চাকরিটা যাতে জীবনানন্দের হয়, তার জন্য জোর তদবির করলেন কলেজ কর্তৃপক্ষের কাছে। জীবনানন্দের বাবা, দাদাও বরিশালের মান্য ব্যক্তি, পরিচিতি আছে তাদের। সব মিলিয়ে পরিস্থিতি জীবনানন্দের অনুকূলে গেল এবং ব্রজমোহন কলেজে লেকচারার পদে নিয়োগ পেলেন তিনি। জীবনানন্দ ফিরে এলেন তাঁর প্রিয় শহর বরিশালে, যেখানে তাঁর প্রিয় নদী ধানসিঁড়ি, সেই সবচেয়ে সুন্দর করুণডাঙায়।

গুমোট এতগুলো বছর কাটাবার পর একটা সুবাতাস বইল তার জীবনে। নিজ শহরে একটা সম্মানীয় চাকরি অবশেষে মিলেছে, এতে তার বাবা-মা, আত্মীয়স্বজন সবার মনে স্বস্তি। লাবণ্যও চাঙা হয়ে উঠলেন। নতুন রূপে দেখা গেল তাঁকে। লাবণ্য আবার পড়াশোনা করতে চাইলেন। উৎসাহ দিলেন জীবনানন্দ। লাবণ্য ভর্তি হলেন ব্রজমোহন কলেজেই বিএতে। জীবনানন্দও অনেক দিন পর আবার ফিরে এলেন তাঁর পুরোনো রুটিনে। নিপাট পাঞ্জাবি, ধুতি, পাম্প শু আর কাঁধে একটা চাদর ঝুলিয়ে কলেজে যান, ক্লাস নেন। এখানে দিল্লির রামযশ কলেজের মতো উদ্ধত, বেপরোয়া ছাত্ররা নেই, তারা ইংরাজি বা হিন্দিতে নয় কথা বলে তাঁর প্রিয় বাংলায়। পেয়ে গেলেন তাঁর কবিতার অনুরাগী কিছু ছাত্র। ক্লাসে তার ছাত্র শামসুদ্দীন আবুল কালাম, যিনি নিজেও পরবর্তী সময়ে হয়ে উঠবেন সফল সাহিত্যিক, কথা বলেন জীবনানন্দের কবিতা নিয়ে। জানতে চান, স্যার, এই যে আপনার লাইন, আগুন বাতাস জল ব্যবহৃত ব্যবহৃত ব্যবহৃত ব্যবহৃত হয়ে হয়ে… এতবার ব্যবহৃত কেন? নিজের কবিতা নিয়ে ছাত্রের সঙ্গে আলাপে আনন্দ হয় জীবনানন্দের, বেশ উৎসাহের সাথে বলেন, এ তো ধরো বহু ব্যবহারের একঘেয়েমি, মনোটনি এসব বোঝাতেই…

.

০২.

 অনেক দিন পর জীবনে খানিকটা স্বস্তি আসাতে তাঁকে দেখা গেল বেশ আমোদে মেজাজেও। এ সময়ে একদিন বরিশালে বেড়াতে এলেন অচিন্ত্যকুমার। অচিন্ত্য তখন পিরোজপুরের মুনসেফ। অচিন্ত্যকে পেয়ে অনেক দিন পর তুমুল আড্ডা দিলেন জীবনানন্দ। খোশমেজাজে আড্ডা দিতে দিতে অনেক দিন পর সিগারেট টানলেন অচিন্ত্যর সঙ্গে। মন ভালো থাকলে একসময় এমন সিগারেটে টান দিতেন তিনি। ঠাট্টা-তামাশার মুডেও দেখা গেল তাঁকে। আনন্দের মুডে থাকলে তিনি কথা বলতেন বরিশালের কথ্য ভাষায়।

একদিন কুসুমকুমারীর বাবা জীবনানন্দের দাদু চন্দ্রনাথ দাশ হঠাৎ এসে পড়েছেন বরিশালের বাড়িতে। এসে পুকুরঘাটে গিয়ে গোসল করলেন চন্দ্রনাথ। কিন্তু লুঙ্গি আনতে ভুলে গেছেন। কী আর করা। পুকুরঘাট থেকে লাবণ্যকে। ডাকতে লাগলেন, বউমা, তোমার একটা শাড়ি দাও তো। লাবণ্য তার একটা শাড়ি এনে দিলেন চন্দ্রনাথকে। চন্দ্রনাথ সেটাকেই লুঙ্গির মতো পরলেন। চন্দ্রনাথকে ওই বিচিত্র পোশাকে দেখে মুচকি হাসতে হাসতে জীবনানন্দ বরিশালি টানে তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন, শাড়ির পাড় পছন্দ হইছে চন্দরনাথর? চুল আঁচড়নের কাঁকই পাইছ? তোমারে আর কি দেওন যায় কও?

চন্দ্রনাথ নিজে কবি, হাসির গান লিখে কুন্তলীন পুরস্কার পেয়েছেন। তিনি একদিকে জীবনানন্দকে আর অন্যদিকে লাবণ্যকে জড়িয়ে ধরে বলতে লাগলেন :

বাজার হুদা কিনা আইন্যা ঢাইলা দিছি পায়
তোমার লগে কেমতে পারুম হইয়া উঠছে দায়।
আরশি দিছি, কাঁকই দিছি, চুল বাঁধনের ফিতা দিছি,
বালিয়াড়ি চুড়ি দিছি, আর কি দেওন যায়?

বুড়া বুড়া কইয়া কেবল, খ্যাপাইয়া ক্যান কর পাগল?

বিয়া যহন করছ অহন ফ্যালবা কেমতে কইয়া দাও আমায়।

তাঁদের বরিশালের বাড়িতে কাজ করতেন দরিদ্র খ্রিষ্টান বৃদ্ধা ঝি সুন্দরমালা। সুন্দরমালার জন্য জীবনানন্দের বাবা বাড়ির পাশে একটা ছোট ঘর তুলে দিয়েছিলেন। সুন্দরমালার দাঁত সব পড়ে গিয়েছিল, হাঁটতেনও কুঁজো হয়ে। প্রতি রোববার সুন্দরমালা পাশের অক্সফোর্ড মিশন গির্জায় যেতেন প্রার্থনা করতে। সেখানে এক তরুণ পাদরি ফাদার হ্যাঁভোক নতুন বাংলা শিখে তাঁকে প্রায়ই বলতেন, প্রভু যিশু বলসেন সকোলকে প্রেম করটে। টাই হামিও টোমাকে প্রেম করি। সুন্ডমালা সটিই হামি টোমাকে প্রেম করি।

সুন্দরমালা এ কথা সবাইকে গল্প করলে, পাড়ার কিছু ছেলে তাকে বোঝায় যে ফাদার হ্যাঁভোক আসলে তাঁকে ভালোবাসে, সে যদি রাজি হয় তাহলে তাঁকে বিয়েও করবে।

জীবনানন্দ একদিন পেয়ে বসলেন তাঁকে, সুন্দরমালা হুনলাম ফাদার হ্যাঁভোক তোমার লাইগ্যা দাঁত বাঁধাইতে দেছে। ফোকলা দাঁতে তো আর বিয়ে বয়ন যায় না? তা তোমার হেই নকল দাঁতের খবর কি?

সুন্দরমালা হেসে বলেন, হ্যাবোইগ্যারে মরন দহায় পাইছে। দেহা করনের লেইগ্যা যত চ্যাষ্টাই করি না ক্যান, হেডায় কি দেহা দেয়? না হামনে আহে, ক্যাবল আড়ালে আবডালে রয়। রও হেডারে একবার পাইয়া লই। হার মতিগতি ভাল কইরাই বুইঝ্যা লইমু। বিয়া করনের ফিকির দেহায়–কাজের কালে ঢন ঢন। বড় ফাদাররে কইয়া দেহাইমু নে মজা?

নিজ শহরে, নিজ ভাষার, নিজ পরিমণ্ডলে যেন নতুন একটা জীবন পেয়েছেন। তখন জীবনানন্দ। কলকাতার দুর্বিষহ দিনগুলো ভুলে থাকতে চাইছেন তিনি।

.

০৩.

 ঠিক এ সময়টাতে কলকাতা থেকে একটা চিঠি পেলেন জীবনানন্দ। লিখেছেন তারই একান্ত অনুরাগী বুদ্ধদেব বসু। বুদ্ধদেব ইতিমধ্যে ঢাকা থেকে চলে এসেছেন। কলকাতায়। চিঠিতে আরও একটা সুসংবাদ। তিনি জানিয়েছেন, প্রগতি পত্রিকা বন্ধ হয়ে যাবার পর কবি প্রেমেন্দ্র মিত্রের সঙ্গে মিলে তাঁরা এবার নতুন একটা পত্রিকা বের করছেন কবিতানামে। এ পত্রিকায় শুধুই কবিতা ছাপা হবে। বুদ্ধদেব লিখলেন প্রগতি পত্রিকার মতোই কবিতা পত্রিকার দ্বার উন্মুক্ত থাকবে তার জন্য।

জীবনানন্দ যেসব পত্রিকায় কবিতা লিখছিলেন, আগে সেগুলো সব ইতিমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে। মাঝে বেশ কিছু গল্প-উপন্যাস লিখলেও গত পাঁচ বছরে লিখেছেন একটামাত্র কবিতা ক্যাম্পে, যা নিয়ে ঘটে গেছে বিতর্ক। বুদ্ধদেবের এই আহ্বানে আবার তিনি মনের ভেতর খুঁজে পেলেন কবিতার উত্তাপ। অনেক দিন পর জীবনে একটু সুস্থিরতা এসেছে তার, তছনছ হয়ে যাওয়া জীবনটাকে আবার একটু গুছিয়ে নেবার সুযোগ পেয়েছেন। আবার পুরোদমে ফিরে আসতে চাইলেন সাহিত্যের পৃথিবীতে। নতুন উদ্যোগে হাত খুলে আবার কবিতা লিখতে শুরু করলেন জীবনানন্দ। এবার তার মনে ক্লান্তি নয়, অন্ধকার নয়, গ্লানি নয় জেগে উঠল প্রেম। এ সময়ে যে কবিতাগুলো লিখতে শুরু করলেন, তার প্রধান থিম হলো প্রেম। তাঁর হারিয়ে যাওয়া প্রেম, হারিয়ে যাওয়া প্রেমিক। এসব কবিতায় দেখা যায় একটা আহত প্রেমের বোধ বরাবর যেন তাড়া করে ফিরছে তাঁকে। শোভনা যে তার মন থেকে কখনোই মুছে যাননি, তার প্রমাণ পাওয়া গেছে আগেই। তাঁর এই আহত প্রেমের নতুন কবিতাগুলোর নেপথ্যে যে শোভনা আছে, তা ভেবে নেওয়া যায় সংগত কারণেই। বাস্তব জীবনে সেই শোভনা, বেবী, বিওয়াই, অথবা ওয়াই ইতিমধ্যে স্বামী সংসার নিয়ে আছেন দূরের এক শহরে। জীবনানন্দের এই সময়ের কবিতায় প্রেমাস্পদকে না পাওয়ার গাঢ় বেদনা :

আবার বছর কুড়ি পরে তার সাথে দেখা হয় যদি!
আবার বছর কুড়ি পরে
হয়তো ধানের ছড়ার পাশে
কার্তিকের মাসে–
তখন সন্ধ্যার কাক ঘরে ফেরে–তখন হলুদ নদী
 নরম নরম হয় শর কাশ হোগলায়–মাঠের ভিতরে।

অথবা নাইকো ধান ক্ষেতে আর;
ব্যস্ততা নাইকো আর,
হাঁসের নীড়ের থেকে খড়
পাখির নীড়ের থেকে খড়
 ছড়াতেছে; মনিয়ার ঘরে রাত, শীত আর শিশিরের জল!

জীবন গিয়েছে চলে আমাদের কুড়ি কুড়ি বছরের পার–
তখন হঠাৎ যদি মেঠো পথে পাই আমি তোমারে আবার!

লিখলেন :

বেতের ফলের মতো নীলাভ ব্যথিত তোমার দুই চোখ
 খুঁজেছি নক্ষত্রে আমি–কুয়াশার পাখনায়–
 সন্ধ্যার নদীর জলে নামে যে আলোক
জোনাকির দেহ হতে–খুঁজেছি তোমারে সেইখানে
ধূসর পেঁচার মতো ডানা মেলে অঘ্রানের অন্ধকারে

ধানসিঁড়ি বেয়ে বেয়ে
 সোনার সিঁড়ির মতো ধানে আর ধানে
তোমারে খুঁজেছি আমি নির্জন পেঁচার মত প্রাণে।
… … …
চোখে তার
 যেন শত শতাব্দীর নীল অন্ধকার।
 স্তন তার করুণ শঙ্খের মত–দুধে আর্দ্র-কবেকার শঙ্খিনীমালার!
এ পৃথিবী একবার পায় তারে, পায় নাকো আর।

প্রেমিকাকে হারিয়ে ফেলার এই বেদনা আশ্চর্য মেদুরতায় ফিরে ফিরে আসে তার সে সময়ের কবিতায় :

হায় চিল, সোনালি ডানার চিল, এই ভিজে মেঘের দুপুরে
 তুমি আর কেঁদো নাকো উড়ে উড়ে ধানসিঁড়ি নদীটির পাশে!
তোমার কান্নার সুরে বেতের ফলের মত তার স্লান চোখ মনে আসে!
পৃথিবীর রাঙা রাজকন্যাদের মতো সে যে চলে গেছে রূপ নিয়ে দূরে;
 আবার তাহারে কেন ডেকে আনো? কে হায় হৃদয় খুঁড়ে
বেদনা জাগাতে ভালোবাসে!
হায় চিল, সোনালি ডানার চিল, এই ভিজে মেঘের দুপুরে
তুমি আর উড়ে উড়ে কেঁদো নাকো ধানসিঁড়ি নদীটির পাশে।

কে সেই রাঙা রাজকন্যা, আমরা তা আঁচ করতে পারি। প্রেমিকার সঙ্গে তাঁর অন্য পুরুষের সঙ্গ দেখে ঈর্ষান্বিত তিনি। কোনো এক সুরঞ্জনাকে উদ্দেশ করে তিনি বলছেন :

সুরঞ্জনা, ওইখানে যেয়োনাকো তুমি,
বোলোনাকো কথা ওই যুবকের সাথে;
ফিরে এসো সুরঞ্জনা :
নক্ষত্রের রূপালী আগুন ভরা রাতে;

ফিরে এসো এই মাঠে, ঢেউয়ে;
ফিরে এসো হৃদয়ে আমার;
দূর থেকে দূরে–আরো দূরে
যুবকের সাথে তুমি যেয়োনাকো আর।

কী কথা তাহার সাথে? তার সাথে!

শেষ এই লাইনটার নাটকীয়তা অদ্বিতীয়। একবার জিজ্ঞাসা করছেন ওই যুবকের সঙ্গে তোমার কী কথা? যুবককে আপনি করে বলছেন। তারপর একটা ড্যাশ। যেন একটু থেমে নিচ্ছেন। এরপর ভদ্রতার লেবাস ছেড়ে ক্ষুব্ধ হয়ে তিনি আপনি থেকে নেমে এসেছেন তুমিতে। জিজ্ঞাসা করছেন, তার সাথে কি কথা তোমার? তাহার থেকে হয়ে গেছে তার। সুরঞ্জনাকে নিয়ে সেই কবিতাটা এরপর শেষ হয় এক হাহাকারের ভেতর :

আকাশের আড়ালে আকাশে
 মৃত্তিকার মতো তুমি আজ :
তার প্রেম ঘাস হয়ে আসে।

সুরঞ্জনা,
 তোমার হৃদয় আজ ঘাস :
বাতাসের ওপারে বাতাস
আকাশের ওপারে আকাশ।

 বলা বাহুল্য, তার এসব আশ্চর্য প্রেমের কবিতা উপভোগের জন্য তাঁর ব্যক্তিজীবনের এসব সূত্র অবশ্যই অনিবার্য নয়। বরাবরের মতোই ব্যক্তিগত অনুভব, অভিজ্ঞতাকে তিনি স্থাপন করেন বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে। যেমন এই কবিতায় প্রেমকে তিনি স্থাপন করেছেন আরও বৃহত্তর দার্শনিক বৃত্তে, প্রেমের সঙ্গে মিলিয়ে দিয়েছেন মৃত্যুকে। লিখেছেন :

আমি যদি হতাম বনহংস,
 বনহংসী হতে যদি তুমি;
 কোনো এক দিগন্তের জলসিঁড়ি নদীর ধারে
ধানক্ষেতের কাছে
ছিপছিপে শরের ভিতর
এক নিরালা নীড়ে;

তাহলে আজ এই ফারুনের রাতে
 ঝাউয়ের শাখার পেছনে চাঁদ উঠতে দেখে
আমরা নিম্নভূমির জলের গন্ধ ছেড়ে
আকাশে রূপালী শস্যের ভিতর গা ভাসিয়ে দিতাম–
 তোমার পাখনায় আমার পালক, আমার পাখনায় তোমার রক্তের স্পন্দন
 নীল আকাশে খইক্ষেতের সোনালি ফুলের মতো অজস্র তারা,
 শিরীষ বনের সবুজ রোমশ নীড়ে
সোনার ডিমের মতো
 ফাল্গুনের চাঁদ।
হয়তো গুলির শব্দ;
আমাদের তির্যক গতিস্রোত,
 আমাদের পাখায় পিসটনের উল্লাস,
আমাদের কণ্ঠে উত্তর হাওয়ার গান!

হয়তো গুলির শব্দ আবার :
আমাদের স্তব্ধতা
 আমাদের শান্তি।
আজকের জীবনের এই টুকরো টুকরো মৃত্যু আর থাকত না;
 থাকত না আজকের জীবনের টুকরো টুকরো সাধের ব্যর্থতা ও অন্ধকার;
আমি যদি বনহংস হতাম,
বনহংসী হতে যদি তুমি;
কোন এক দিগন্তের জলসিঁড়ি নদীর ধারে
ধানক্ষেতের কাছে।

স্মরণযোগ্য যে গত পাঁচ বছরে জীবনানন্দ টুকরো টুকরোভাবে অগণিতবার মৃত্যুবরণ করেছেন, অগণিতবার মুখোমুখি হয়েছেন টুকরো টুকরো সাধের ব্যর্থতা আর অন্ধকারের।

.

অম্লান স্বাস্থ্যে হজম করা

০১.

কথা উঠল জীবনানন্দের বনহংসের এই কবিতার সাথে মিল আছে ইয়েটসের কবিতার, The White birds/ I would that we werel my beloved, white birds on the foam of the sea…. তাঁর ‘হায় চিল’ কবিতার সঙ্গেও মিল পাওয়া গেছে ইয়েটসের O Curlew, cry no no more in the air. Because your crying brings to my mind/ Passion dimmed eyes….

এ ছাড়া তাঁর আরও কিছু কবিতার সঙ্গে মিল পাওয়া গেছে ইয়েটসের, অ্যালেন পোর কবিতার। জীবনানন্দ এসব মিলের ব্যাপারে খুবই সচেতন ছিলেন। তবে কবিতার মৌলিকত্ব নিয়ে তাঁর ছিল নিজস্ব ভাবনা। এক প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন,

লরেন্স বা এজরা পাইন্ডের উদ্ধৃত করে কবিতা ছাপিয়ে (বা ইয়েটসকে স্মরণ করে কবিতা লিখে, যেমন আমি দু-একটা কবিতা করেছি) আধুনিক বাংলা কবিতার বৈভব দেখাতে যাওয়াটাকে আমি বাঁকা জিনিস মনে করি। কিন্তু সে মৌলিকতা তেমন নেই বলে লজ্জিত হবারও বিশেষ কারণ নেই। কারণ এমন কোন বড় ইংরেজ কবির নামই আমি মনে করতে পারি না যারা ইটালীর নিকট, এলিজাবেথানদের নিকট, পূর্বজ ইংরেজ কবিদের কাছে ষ্টাইল ও ভাববৈচিত্র্যের জন্য ঋণী নন। কিন্তু সেসব অম্লান স্বাস্থ্যে হজম করে নিতে পারছেন, আমাদের ভেতর কেউ কেউ পেরেছেন হয়তো। কারু কারু জিনিস উত্তীর্ণ হচ্ছে।

অম্লান স্বাস্থ্যে অন্যকে হজম করতে পারা, এই হচ্ছে আসল কথা তার কাছে।

ভূমেন্দ্র গুহ একবার বাসে যেতে যেতে এ নিয়ে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেছিলেন, আমি এ বিষয়ে ভাবি না। এ বিষয়ে পড়াশোনার কথাটা এসে পড়ে। তুমি পড় কেন, তোমার কোনও কিছু পড়াটা তোমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাপুঞ্জের যে একটি বস্তুপিণ্ড আছে, অথবা তোমার বেঁচে থাকার বৃত্তির সঙ্গে সঙ্গে যে বস্তুপিণ্ড তৈরি হয়ে ওঠে, তাকে এক রকম ভাবে আহত করে, সঙ্গে সঙ্গে তোমার অভিজ্ঞতাগুলো বিশ্লিষ্ট হয়, চরিত্র পায়, লিখতে জানলে তুমি লেখ, আঁকতে জানলে আঁক, সে নবনির্মিত অভিজ্ঞতার কথা লেখ বা আঁক। এটা একটা ঘাত-প্রতিঘাতের ব্যাপার। তা ছাড়া যেসব সাহচর্য তোমাকে ঘিরে থাকে, তারা তোমার চারিত্রও কোন কোনভাবে কাঁচে ছাঁটে, তুমি যে সমাজটায় থাক তার কথ্য ভাষার টানটাও তোমার জিভে এসে পড়ে।

এমনকি অনুবাদের ক্ষেত্রেও তিনি ছিলেন সেই হজম করা সূত্রের পক্ষে। তাঁর নিজের কবিতা যখন অন্যরা অনুবাদ করেছে, তখন বিরক্ত হয়েছেন এর আক্ষরিক অনুবাদের চেষ্টায়। একবার দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের উদ্যোগে তাঁর কিছু কবিতার অনুবাদ হয়েছিল, জীবনানন্দ অসন্তুষ্ট ছিলেন সেই অনুবাদে। দেবীপ্রসাদকে লিখেছিলেন, বনলতা সেন কবিতার এক জায়গায় raising her birds nest eyes আছে, পাখির নীড়ের মত চোখ তুলে ও এত বেশি literal translation না করে কিছুটা ভাবানুবাদ করতে পারা যায় না কি? বাংলায় আমি তো নীড় নয় নীড়ত্বের সঙ্গে তুলনা করেছিলাম।

.

০২.

পৃথিবীর নানা সাহিত্য, তত্ত্ব নিজের মতো হজম করে জীবনানন্দ অব্যাহত রাখছেন। কবিতা লেখা। ব্যক্তিজীবনে একটা আপাতস্থিরতা এসেছে তখন তার। কিন্তু গত পাঁচটা বছর জীবনানন্দের জীবনের গাঢ় বেদনার অভিজ্ঞতা হয়েছে। নীলিমা এবং পাতাল উভয়কেই গভীরভাবে দেখেছেন তিনি। এই অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে তার রক্তাক্ত বোধন হয়েছে। মানুষকে, জীবনকে, সাহিত্যকে নতুন আলোতে দেখতে শুরু করেছেন তিনি। আনন্দ আর বেদনাকে, জীবন আর মৃত্যুকে আকাশে ছড়িয়ে থাকা দুটো আড়াআড়ি তলোয়ারের মতো দেখতে শুরু করেছেন তিনি। ব্যক্তিজীবনের ভেতর দেখতে শুরু করেছেন মহাকালকে। সহজ বাক্যে অথচ গভীর ব্যঞ্জনায়, মুক্ত ছন্দে, অভিনব উপমায় নতুন ধরনের কবিতা নিয়ে তখন হাজির হতে শুরু করেছেন তিনি। এ সময় লেখা তাঁর হাওয়ার রাত কবিতাটা লক্ষ করা যাক :

গভীর হাওয়ার রাত ছিল কাল–অসংখ্য নক্ষত্রের রাত;
সারা রাত বিস্তীর্ণ হাওয়া আমার মশারিতে খেলেছে;
মশারিটা ফুলে উঠেছে কখনো মৌসুমী সমুদ্রের পেটের মতো,
কখনও বিছানা ছিঁড়ে
 নক্ষত্রের দিকে উড়ে যেতে চেয়েছে;
এক-একবার মনে হচ্ছিল আমার–আধো ঘুমের ভিতর হয়তো
মাথার উপরে মশারি নেই আমার,
 স্বাতী তারার কোল ঘেঁষে নীল হাওয়ার সমুদ্রে শাদা বকের মতো
উড়ছে সে! কাল এমন চমৎকার রাত ছিল।

(মশারির মতো এমন একটা আটপৌরে বস্তুকে কবিতায় এর আগে কেউ এমন অভিনবভাবে উপস্থাপন করেননি। তাকে স্থাপন করেননি এমন মহাকাশের প্রেক্ষিতে। বালুকণা থেকে তিনি যেন যাত্রা করছেন মহাশূন্যের দিকে)

সমস্ত মৃত নক্ষত্রেরা কাল জেগে উঠেছিল–আকাশে এক তিল
ফাঁক ছিল না;
পৃথিবীর সমস্ত ধূসর প্রিয় মৃতদের মুখও সেই নক্ষত্রের ভিতর দেখেছি আমি;
অন্ধকার রাতে অশ্বত্থের চূড়ায় প্রেমিক চিলপুরুষের শিশির-ভেজা
চোখের মতো ঝলমল করছিল সমস্ত নক্ষত্রেরা।
 জ্যোৎস্নারাতে বেবিলনের রাণীর ঘাড়ের ওপর চিতার উজ্জ্বল চামড়ার
শালের মতো জ্বলজ্বল করছিল বিশাল আকাশ।
কাল এমন আশ্চর্য রাত ছিলো।

(অভিনব সব উপমায় রাতের আকাশের এ এক অভূতপূর্ব বিবরণ)

যে নক্ষত্রেরা আকাশের বুকে হাজার হাজার বছর আগে মরে গিয়েছে
 তারাও কাল জানালার ভিতর দিয়ে অসংখ্য মৃত আকাশ সঙ্গে করে এনেছে;
যে রূপসীদের আমি এশিরিয়ায়, মিশরে, বিদিশায় মরে যেতে দেখেছি
কাল তারা অতিদূর আকাশের সীমানার কুয়াশায়-কুয়াশায় দীর্ঘ বর্শা হাতে
করে কাতারে কাতারে দাঁড়িয়ে গেছে যেন
 মৃত্যুকে দলিত করবার জন্য?
 জীবনের গভীর জয় প্রকাশ করবার জন্য?
প্রেমের ভয়াবহ গম্ভীর স্তম্ভ তুলবার জন্য?

(জীবন আর মৃত্যুকে পাশাপাশি দাঁড় করাচ্ছেন তিনি। সিস্টন চ্যাপেলের ছাদে যেমন মাইকেলেঞ্জেলো জীবন্ত করে তুলেছিলেন হাজার বছর আগের বাইবেলীয় গল্প, আকাশকে ক্যানভাস বানিয়ে জীবনানন্দ যেন তেমন এক ছবি আঁকছেন। আমাদের সামনে)।

আড়ষ্ট–অভিভূত হয়ে গেছি আছি,
কাল রাতের প্রবল নীল অত্যাচার আমাকে ছিঁড়ে ফেলেছে যেন;
আকাশের বিরামহীন বিস্তীর্ণ ডানার ভিতর
পৃথিবী কীটের মতো মুছে গিয়েছে কাল!
আর উত্তুঙ্গ বাতাস এসেছে আকাশের বুক থেকে নেমে
আমার জানালার ভিতর দিয়ে, শাঁই শাঁই করে,
 সিংহের হুঙ্কারে উৎক্ষিপ্ত হরিৎ প্রান্তরের অজস্র জেব্রার মতো!

(এ বর্ণনায় ঘোর লাগে। অবাক হয়ে লক্ষ করতে হয় কী করে জানালার বাতাস তাঁর কলমের জাদুর ছোঁয়ায় হয়ে পড়ে ভীতসন্ত্রস্ত হরিণ)

হৃদয় ভরে গিয়েছে আমার বিস্তীর্ণ ফেল্টের সবুজ ঘাসের গন্ধে,
দিগন্ত-প্লাবিত বলীয়ান রৌদ্রের আঘ্রাণে,
মিলনোন্মত্ত বাঘিনীর গর্জনের মতো অন্ধকারের চঞ্চল বিরাট সজীব
রোমশ উচ্ছ্বাসে,
জীবনের দুর্দান্ত নীল মত্ততায়!

আমার হৃদয় পৃথিবী ছিঁড়ে উড়ে গেল,
নীল হাওয়া সমুদ্রে স্ফীত মাতাল বেলুনের মতো গেল উড়ে,
একটা দূর নক্ষত্রের মাস্তুলকে তারায় তারায় উড়িয়ে নিয়ে চলল
একটা দুরন্ত শকুনের মতো!

(জীবনের নীল মত্ততায় তার হৃদয় হয়ে যাচ্ছে উড়ন্ত শকুন। শকুন কেন? শকুন তো মৃতভোজী। জীবন-মৃত্যু, আলো-অন্ধকার, পুলক আর বীভৎসতার দ্বৈত জীবনের ভেতর ঢুকেছেন তখন তিনি)

.

যা ভোলা যায় না, যা ভুল হয় না, যা হানা দেয়

০১.

নতুন হাওয়া লাগা জীবনানন্দের এসব কবিতা পরম উৎসাহে তখন ছাপিয়ে যাচ্ছেন বুদ্ধদেব বসু তাঁর নতুন পত্রিকা কবিতায়। বুদ্ধদেব বসুর সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ বিশেষ না হলেও নিয়মিত চিঠিতে যোগাযোগ আছে তাঁদের। একপর্যায়ে বুদ্ধদেব বসু লিখলেন, আপনার প্রথম বই বেরিয়েছে তো বহু বছর হয়ে গেল, এবার আরেকটি নতুন বই করুন। নয় বছর আগে জীবনানন্দ প্রকাশ করেছিলেন তার ঝরা পালক। এর মধ্যে তার জীবনের ওপর অনেক ঝড়ঝাপটা গেছে। মনে স্বস্তি ছিল না। অনেক দিন পর কিছুটা সুস্থির হয়ে আবার কবিতা লিখতে শুরু করেছেন তিনি। বুদ্ধদেবের উৎসাহ তাঁকে প্রেরণা দিল। জীবনানন্দ তাঁর দ্বিতীয় কবিতার বইটা প্রকাশের উদ্যোগ নিলেন। লেখাগুলো প্রুফ দেখা থেকে শুরু করে প্রকাশনার যাবতীয় কাজকর্ম কলকাতায় বসে করলেন বুদ্ধদেব। আবারও নিজেরই খরচে প্রকাশিত হলো তাঁর দ্বিতীয় কবিতার বই ধূসর পাণ্ডুলিপি। জীবনানন্দ বইটা উৎসর্গ করলেন বুদ্ধদেব বসুকে। ভূমিকায় লিখলেন, আমার প্রথম বই প্রকাশিত হয়েছিলো ১৩৩৪ সালে (১৯২৭)। কিন্তু সে বইখানা অনেকদিন আমার নিজের চোখের আড়ালেও হারিয়ে গেছে। আমার মনে হয় সে তার প্রাপ্য মূল্যই পেয়েছে। ১৩৩৬-এ আর একখানা কবিতার বই বার করবার আকাক্ষা হয়েছিলো। কিন্তু নিজ মনে কবিতা লিখে এবং কয়েকটি মাসিক পত্রিকায় প্রকাশিত করে সে ইচ্ছাকে আমি শিশুর মত ঘুম পাড়িয়ে রেখেছিলাম। শিশুকে অসময়ে এবং বার বার ঘুম পাড়িয়ে রাখতে জননীর যে রকম কষ্ট হয়, সেই রকম কেমন একটা উদ্বেগ–খুব স্পষ্ট নয়, খুব নিরুত্তেজও নয়–এ কবছর ধরে বোধ করে এসেছি আমি। আজ নবছর পর আমার দ্বিতীয় কবিতার বই বার হলো। এর নাম ধূসর পাণ্ডুলিপি এর পরিচয় দিচ্ছে।…

জীবনানন্দের প্রথম বই ঝরা পালক অনেকের তো বটেই, তাঁর নিজের চোখের আড়ালেও যে চলে গেছে, সেটা তিনি মানছেন এবং এ-ও মানছেন যে সেটাই ওই কবিতার বইয়ের প্রাপ্য মূল্য। তারপরও তিনি নতুন বই প্রকাশ নিয়ে তাড়াহুড়ো করেননি। নতুন কবিতা লিখেছেন কিন্তু সেগুলোকে সন্তানের মতোই ঘুম পাড়িয়ে রেখেছেন। তা সত্ত্বেও কবিতাগুলো একটা বই আকারে প্রকাশ হোক, এমন একটা চাপা উদ্বেগ মেশানো ইচ্ছা তাঁর ছিল। জীবনের নতুন প্রেক্ষাপটে তাঁর মনে হলো এবার সেসব কবিতার ঘুম ভাঙানো যায়। ফলে বেরোল তার দ্বিতীয় বই। মাঝখানে কেটে গেছে বিক্ষুব্ধ নয়টা বছর। তার এই নতুন বইয়ের কবিতাগুলো ঝরা পালক-এর কবিতাগুলোর চেয়ে ভিন্ন এক পৃথিবীর। ধূসর পাণ্ডুলিপিতে নতুন জন্ম ঘটল জীবনানন্দের। সত্যি বলতে নতুন জন্ম ঘটল বাংলা কবিতারও। যদিও সে ঐতিহাসিক জন্ম খুব নিভৃতে, নীরবে। বুদ্ধদেব বসু তাঁর কবিতা পত্রিকায় ঘোষণা করলেন ধূসর পাণ্ডুলিপির জয়যাত্রা, আমাদের বাঙলাদেশের পাঠক সাধারণের মধ্যে জীবনানন্দ যদি অজ্ঞাতেই থাকেন সেটা আশ্চর্যের বিষয় নয়। তবে গুণী যারা কাব্য সম্ভোগের প্রকৃত অধিকারী যারা তাদের মধ্যে ধূসর পাণ্ডুলিপি প্রকাশের পর তিনি স্বীকৃত ও সম্মানিত হবেন এ আশা জোর করেই করা যায়।…কবিতা যদি আমাদের কাছে ইয়ারকির বিষয় না হয়ে গভীর অনুশীলনের বিষয় হয়, তবে এ কথা আমাদের মানতেই হবে যে এই কবি এমন একটি সুরের সম্মোহন সৃষ্টি করেছেন, যা ভোলা যায় না, যা ভুল হয় না, যা হানা দেয়…

ঠিক সেই মুহূর্তে কেউ টের পাননি যে দস্তয়ভস্কি যেমন একবার বলেছিলেন আমরা সব গোগলের ওভারকোটের পকেট থেকে বেরিয়েছি, ঠিক তেমনি বাংলা কবিতার অনেকগুলো প্রজন্ম বের হবে এই ধূসর পাণ্ডুলিপির গর্ভ থেকেই।

.

০২.

জীবনানন্দ তাঁর প্রথম বই ঝরা পালক পাঠিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথকে। সেই বই নিয়ে রবীন্দ্রনাথ নেতিবাচক মন্তব্য করেছিলেন। জীবনানন্দ রবীন্দ্রনাথের সেই মতকে নাকচ করে দিয়েছিলেন যদিও। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন কবিতায় নান্দনিক প্রশান্তি থাকতে হবে, জীবনানন্দ তা মানেননি। প্রশান্তি আর অশান্তির যুগলবন্দীতে কী করে কবিতা হয়ে ওঠে, তারই চেষ্টা চালিয়ে গেছেন জীবনানন্দ। সে চেষ্টার ফল তার ধূসর পাণ্ডুলিপি। এ বইটাও জীবনানন্দ পাঠিয়ে দিলেন রবীন্দ্রনাথকে। এবারের চিঠিতে আরও খানিকটা বিনয় আর অনেকটা স্তুতি মিলিয়ে বইটা সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের মন্তব্য জানতে চাইলেন। লিখলেন :

‘সর্বানন্দ ভবন
বরিশাল।
৫-৩-৩৬
শ্রীচরণেষু,

আপনি আধুনিক পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ কবি ও মনীষী। আপনি মহামানব। আপনার সাহিত্যসৃষ্টি ও জীবন পৃথিবীর ইতিহাসে এক গভীর বিস্ময় ও গরিমার জিনিষ। জার্মান সাহিত্যে গ্যাটে, ইংরাজি সাহিত্যে শেকসপীয়র যে স্থান আমাদের দেশের সাহিত্যের ইতিহাসে আপনার সেই সর্বশ্রেষ্ঠ প্রতিষ্ঠা। এ যুগের বাঙালীর ও বিশেষ করে বাঙালী যুবকের সবচেয়ে বেশী গৌরব ও আনন্দ এই যে আপনার অনন্যসাধারণ প্রতিভা ও জীবনের নিত্যনতুন দীপ্তি তার সম্মুখে রয়ে গেছে।

আমি একজন বাঙালী যুবক, মাঝে মাঝে কবিতা লিখি। অনেকবার দেখেছি আপনাকে, তারপর ভিড়ের ভিতর হারিয়ে গেছি। আমার নিজের জীবনের তুচ্ছতা ও আপনার বিরাট প্রদীপ্তি সব সময়ই মাঝখানে কেমন একটি ব্যবধান রেখে গেছে–আমি তা লংঘন করতে পারিনি। আজ যদি সেন্ট পল কিম্বা খৃষ্ট অথবা গৌতম বুদ্ধ পৃথিবীতে ফিরে আসেন আবার, তাহলে ভিড়ে চাপা পড়ে তাদের সঙ্গে দেখা করে আসবো হয়তো কিন্তু তারপর তারা আমাকে ভীড়ের মানুষ বলে বুঝে নেবেন হয়তো।

প্রায় নয় বছর আগে আমি আমার প্রথম কবিতার বই একখানা আপনাকে পাঠিয়েছিলুম। সেই বই পেয়ে আপনি আমাকে চিঠি লিখেছিলেন, চিঠিগুলো। আমার মূল্যবান সম্পদের মধ্যে একটি। তখন আমি কোলকাতার কোন কলেজের ইংরাজির অধ্যাপক ছিলুম। তারপর বাংলাদেশ এবং এদেশের নানা কলেজ ঘুরে। বরিশালের ব্রজমোহন কলেজে অধ্যাপনা করছি।

প্রায় আট দশ বছর আগের রচিত কবিতা কুড়িয়ে এবার আর একখানা বই বার করলুম। এই বইখানা আপনাকে উৎসর্গ করতে পারিনি। এই একটি দুঃখ এবং লজ্জা। আমার রয়ে গেলো। যতদূর শীঘ্র সম্ভব এই অপরাধ থেকে আমি নিজেকে মুক্ত করে নেব। আমার এই বই– এই ধূসর পাণ্ডুলিপি আপনাকে পাঠালাম একখানা। মাঝে মাঝে ছাপার ভুল আছে–আরো ত্রুটি বিচ্যুতি রয়েছে। কিন্তু তবু আমার মনে হয় বইয়ের কবিতাগুলোর একটা নিজস্ব soul রয়েছে। সাহিত্যের বিষয়বস্তু চিরন্তন, কিন্তু প্রকাশের বৈশিষ্ট্য বিশেষ বিশেষ রূপের জন্ম দেয়। কোন কোন রূপ যেমন রবীন্দ্র কাব্য, ওয়ার্ডসওয়ার্থ বা শেলীর কবিতা অথবা শেকসপীয়র-এর রচনা অনবদ্য হয়ে থাকে। সে যা হোক, নিজের কবিতা বা অন্য কোন কবিতা সমালোচনা নিয়ে আজ আমি উপস্থিত হতে চাই না। কালিদাস তার মেঘদূতে বলেছিলেন শ্রেষ্ঠ জনের কাছে দাবী জানাতে হয়, তারা মানুষের আন্তরিক সম্মান রক্ষা করেন। আমিও আজ একট মস্ত বড় দাবী নিয়ে আপনার কাছে হাজির হয়েছি; আপনি যদি একটু সময় করে এই বইটা পড়ে দেখেন– ও তারপর বিশদভাবে আমাকে একখানা চিঠি লেখেন তাহলে আমি খুব উপকৃত বোধ করবো। বিস্তৃতভাবে আলোচনা করবার জন্য অনুরোধ করছি বলে ক্ষমা করবেন। কিন্তু আগেই বলেছি আমার আজকের দাবীটা খুব মস্তবড় এবং সবচেয়ে মহৎ জনের কাছে।

আপনার সর্বাঙ্গীন কুশল প্রার্থনা করি। আপনি আমার ভক্তিপূর্ণ প্রণাম গ্রহণ করুন।

ইতি
স্নেহাকাঙ্ক্ষী
 জীবনানন্দ’

বোঝা যায়, জীবনানন্দ সত্যিই খুব আন্তরিকভাবে চাচ্ছিলেন রবীন্দ্রনাথ একটু বিশদভাবে বইটা নিয়ে লিখুন। রবীন্দ্রনাথের কাছে তিনি যে নেহাত ভিড়ের মানুষ, তা কবুল করে নিয়েছেন শুরুতেই, রবীন্দ্রনাথের মহত্ত্বকে বড় গলাতেই বলেছেন। তারপরও তাঁর মনে হয়েছে এই ধূসর পাণ্ডুলিপিবইটার একটা নিজস্ব আত্মা আছে। অনেক আশা করে বসে ছিলেন বিশ্ববরেণ্য এই মানুষের একটা বিশদ মূল্যায়নের। কিন্তু বৃথা আশা তার। এবারও রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকে

জীবনানন্দ পেলেন এক সাদামাটা চিঠি। রবীন্দ্রনাথ লিখলেন :

‘কল্যাণীয়েষু,

তোমার কবিতা পড়ে খুশি হয়েছি। তোমার লেখায় রস আছে, স্বকীয়তা আছে এবং তাকিয়ে দেখার আনন্দ আছে।

ইতি

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ১৩৪৩’

বিস্তৃত আলোচনা তো দূরের কথা, নেহাত এক লাইনের একটা চিঠি লিখলেন রবীন্দ্রনাথ। এই চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ আর কোনো বিতর্কে যাননি। প্রশংসা হিসেবে এইটুকু বলছেন যে তার লেখায় তাকিয়ে দেখার আনন্দ আছে। জীবনানন্দের কবিতা নিয়ে তাঁর এই মন্তব্য নিঃসন্দেহে খুব মৌলিক এবং মোক্ষম। কিন্তু জীবনানন্দ তো আরও বড় দাবি নিয়ে হাজির হয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথের কাছে, সে দাবির এই উত্তর খুবই অকিঞ্চিৎকর। রবীন্দ্রনাথের তৈরি করা কবিতার পথ থেকে বাংলা কবিতাই যে একটা বড় বাক নেবে, এই ধূসর পাণ্ডুলিপিবইটার ভেতর দিয়ে সেটা রবীন্দ্রনাথ ঠিক টের পাননি বোঝা যায়। তিনি আঁচ করেননি কী করে এই বইটার মাধ্যমে ঘটে যাবে বাংলা কবিতার পালাবদল। শুধু তাকিয়ে দেখার আনন্দ আছে–এ কথা বলে ধূসর পাণ্ডুলিপিকে বইয়ের আলমারিতে তুলে রাখলে চলে না। ঝরা পালক-এর মতো ধূসর পাণ্ডুলিপিবইটাও রবীন্দ্রনাথের বিশেষ মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারেনি।

অবশ্য চিঠিতে জীবনানন্দের চাপা অহংও লক্ষ করা যায়। লোকে যখন নিজের বই রবীন্দ্রনাথকে উৎসর্গ করতে পারলে বর্তে যায়, সেখানে তিনি বেশ ঘোষণা দিয়েই জানিয়ে দিচ্ছেন যে এই বইটা তিনি তাকে উৎসর্গ করেননি। সে জন্য ক্ষমা চাইছেন এবং বলেছেন তাঁকে তিনি ভবিষ্যতে একটা বই উৎসর্গ করবেন। ভবিষ্যতে অনেকগুলো বই জীবনানন্দ লিখেছেন, তবে রবীন্দ্রনাথকে উৎসর্গ করেননি একটাও।

.

০৩.

সমকালীন প্রজন্মের মতামত পাবার জন্য জীবনানন্দ তাঁর প্রথম বই ঝরা পালক পাঠিয়েছিলেন প্রতিভাবান সমালোচক ধূর্জটিপ্রসাদকে আর এবার ধূসর পাণ্ডুলিপি পাঠালেন পরের প্রজন্মের নামজাদা লেখক প্রমথ চৌধুরীকে। বরিশাল থেকে প্রমথ চৌধুরীকে চিঠি লিখলেন জীবনানন্দ :

‘শ্রীচরণেষু,

আমি কয়েকদিন হল বরিশালে ফিরে এসেছি। বুদ্ধদেব বসুর সঙ্গে কয়েকদিন আগে আপনার Bright Street এর বাসায় গিয়েছিলাম ও আমার নতুন প্রকাশিত বই ধূসর পাণ্ডুলিপি একখানা আপনাকে দিয়ে এসেছিলাম- আপনার মনে আছে হয়তো।…

তৃপ্তি দিক অতৃপ্তি দিক–আমার কাব্যে কোন গুণ থাকুক বা অনেক দোষ থাকুক, ধূসর পাণ্ডুলিপি পড়ে আমার সম্পর্কে আপনার যা মনে হয়েছে সে সম্বন্ধে বিচিত্রায় একটি বড় প্রবন্ধ লিখলে আমি নিজেকে অত্যন্ত সম্মানিত বোধ করবো। আমার ধূসর পাণ্ডুলিপি সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে অনেক অনেক হৃদয়গ্রাহী মতামত প্রকাশ করেছেন। কিন্তু তবু সে সব সমালোচনা নয়। সেই সবুজপত্রের দিন থেকে জানি বাংলা সাহিত্যের অদ্বিতীয় সমালোচক হচ্ছেন আপনি। ধূসর পাণ্ডুলিপি সম্বন্ধে আপনার সমালোচনা সবচেয়ে মূল্যবান জিনিস হবে। যত শীঘ্র সম্ভব বিচিত্রায় আপনার প্রবন্ধ দেখতে পাব ও তৎপূর্বে আপনার চিঠি পাব এই আশা নিয়ে অত্যন্ত আগ্রহের সঙ্গে অপেক্ষা করছি।

আপনার সর্বাঙ্গীন কুশল প্রার্থনীয়। আমার ভক্তিপূর্ণ প্রণাম জানবেন।

 ইতি
 প্রণত, জীবনানন্দ’

প্রমথ চৌধুরী তাঁর বালিগঞ্জের ব্রাইট স্ট্রিটের বাসা থেকে উত্তর দিলেন :

‘কল্যাণীয়েসু,

..আমি আপনার কবিতার বই সম্বন্ধে আজও কিছু লিখে উঠতে পারিনি তার কারণ প্রথমত আমার শরীর এখন ভালো নেই। উপরন্তু এখানে এখন ভয়ঙ্কর গরম। গ্রীষ্ম আমাকে চিরদিনই কাতর করে, এখন আরো বেশী করছে। একটু বৃষ্টি পড়লেই লেখায় হাত দেব।…

ইতি
শ্রী প্রমথ চৌধুরী’

অত্যন্ত আগ্রহের সঙ্গে প্রমথ চৌধুরীর কাছ থেকে বড় একটি আলোচনার আশায় বসে ছিলেন জীবনানন্দ। কিন্তু না, প্রমথ চৌধুরী ধূসর পাণ্ডুলিপি নিয়ে আর লেখেননি। রবীন্দ্রনাথ এক লাইনের একটা মন্তব্য করলেন আর প্রমথ চৌধুরী গরমে কাতর হয়ে রইলেন। বৃষ্টিও আর পড়ল না, তিনি তাঁর লেখাও আর লিখতে পারলেন না।

কবিতার পৃথিবীতে তিনি নিঃসঙ্গ থেকে নিঃসঙ্গতর হতে লাগলেন। তাঁর কবিতার প্রথম অনুরাগী মাকে পাঠক হিসেবে হারিয়েছেন অনেক আগেই। তারপর পেয়েছিলেন অচিন্ত্যকে। তাঁর নতুন ধারার কবিতার ব্যাপারে অচিন্ত্যও হারিয়ে ফেলেছেন উৎসাহ। সেই সময়ের সাহিত্যের প্রধান মানুষ রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারেননি তিনি, পরবর্তীকালের সাহিত্য-দুনিয়ার মহারথী প্রমথ চৌধুরী, ধূর্জটিপ্রসাদ বা সুধীন্দ্রনাথ দত্ত তাকে বিশেষ গুরুত্ব দেননি। সজনীকান্ত তো শুধু অপছন্দ নয়, আক্রমণ করেই বেড়াচ্ছেন।

.

পাণ্ডুলিপি করে আয়োজন

০১.

 জীবনানন্দ বহু আগেই টের পেয়ে গেছেন যে আর্টিস্ট এক অবৈধ, অস্বাভাবিক মানুষ। শিল্পীর নিঃসঙ্গ যাত্রার জীবন তিনি মনে মনে গ্রহণ করে নিয়েছেন। সাহিত্যের কীর্তিমানেরা তাকে যতই উপেক্ষা করুন, জীবনানন্দের চিন্তা-দুশ্চিন্তা ওই লেখাকে ঘিরেই। হাল তিনি ছাড়বেন না। গৌতম বুদ্ধ বলেছিলেন, তুমি নিজেই নিজের প্রদীপ হও, সেই মন্ত্র নিয়ে জীবনানন্দ নিজের তাগিদেই কবিতা লিখে যাবেন, সেটা মনে মনে ঠিক করে নিয়েছেন। তাঁর পক্ষের মিছিলে যাত্রী একজনই–বুদ্ধদেব বসু। গল্প-উপন্যাস যা গোপনে লিখেছিলেন, সেগুলো ট্রাঙ্কবন্দী করে রেখেছেন। আবার তিনি মনোযোগী হলেন কবিতায়। আরও গভীর পরিশ্রমী কবিতা লিখতে শুরু করলেন। এক-একটা কবিতা লিখে অগণিতবার কাটাকুটি করতে লাগলেন। ভাস্করেরা যেমন এক খণ্ড পাথর নিয়ে তার থেকে অপ্রয়োজনীয় অংশটুকু হেঁটে ফেলে পাথরের ভেতর থেকে তুলে আনে লুকিয়ে থাকা ভাস্কর্যকে, তাঁর সেই সময়ের কবিতার খসড়ার দিকে তাকালে মনে হয় তিনি যেন শব্দ খুঁড়ে খুঁড়ে ভেতর থেকে বের করে আনছেন কবিতা। এই সময়ই বহুবার কেটে, ঘষে, মেজে তৈরি করলেন তাঁর বহুল আলোচিত কবিতা ‘বনলতা সেন’ :

হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে,
সিংহল সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে মালয় সাগরে
অনেক ঘুরেছি আমি; বিম্বিসার অশোকের ধূসর জগতে
 সেখানে ছিলাম আমি; আরো দূর অন্ধকারে বিদর্ভ নগরে;
আমি ক্লান্ত প্রাণ এক, চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন,
আমারে দুদণ্ড শান্তি দিয়েছিল নাটোরের বনলতা সেন।

চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা,
মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য; অতি দূর সমুদ্রের পর
হাল ভেঙে যে নাবিক হারায়েছে দিশা
সবুজ ঘাসের দেশ যখন সে চোখে দেখে দারুচিনি দ্বীপের ভিতর;
তেমনি দেখেছি তারে অন্ধকারে; বলেছে সে, এতদিন কোথায় ছিলেন?
 পাখির নীড়ের মতো চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন।

সমস্ত দিনের শেষে শিশিরের শব্দের মতন
 সন্ধ্যা আসে, ডানার রৌদ্রের গন্ধ মুছে ফেলে চিল;
পৃথিবীর সব রঙ নিভে গেলে পাণ্ডুলিপি করে আয়োজন
তখন গল্পের তরে জোনাকির রঙে ঝিলমিল;
সব পাখি ঘরে আসে-সব নদী–ফুরায় এ-জীবনের সব লেনদেন;
থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন।

পৃথিবী নানা দিগন্ত হাজার বছর ধরে চষে বেড়ানো এক পথিক, নাটোরের এক নারী, পাখির নীড় যেমন তার আশ্রয়, সে নারীর চোখ হয়ে দাঁড়ায় সে পথিকের আশ্রয়, জোনাকিরা যেমন শুধু তাদের প্রেমের কালেই জ্বলে-নেভে, তেমনি এক শব্দহীন রাতে পৃথিবীকে এক পাশে সরিয়ে রেখে সে পথিক বসে সেই নারীর সামনে। সেই নারী তাকে দুদণ্ড শান্তি দেয়। ঠিক এমন প্রেমের কবিতা বাংলার পাঠক পড়েনি এর আগে।

.

০২.

এই কবিতা ছাপা হবার পর আবার সরব হয়ে ওঠেন সজনীকান্ত। তাঁর শনিবারের চিঠিতে লিখলেন, ‘এই প্রতিভাবান কবিদের আর একটি কৌশল কবিতা লিখিতে লিখিতে অকস্মাৎ অকারণ এক একজন ভদ্রলোকের মেয়ের নাম করিয়া আমাদিগকে উৎসুক ও উৎসাহিত করিয়া তোলা। ইকনমিক্স লিখিতে লিখিতে শ্ৰীযুক্ত বুদ্ধদেব বসু অকারণে রানীকে টানিয়া আনিয়াছেন। জাতক এ শ্রী জ্যোতিরীন্দ্র মৈত্র সুরমা নামীয়া একটি ভদ্রমহিলাকে অত্যন্ত লজ্জা দিয়াছেন এবং বসন্তের গান-এ শ্রী সমর সেন মালতী রায় নামক কোন কামিনীর নরম শরীর লইয়া যাহা করিবার নয় তাহাই করিয়াছেন। ইহার সূত্রপাত হইয়াছে নাটোরের বনলতা সেনকে লইয়া।…’

জীবনানন্দ নিয়মিত শনিবারের চিঠি পত্রিকাটি পড়তেন। সজনীকান্তের কটাক্ষগুলোকে তিনি একরকম উপভোগই করতেন। লেখক বাণী রায় একবার বলেছিলেন, সজনীকান্ত যে অবিরাম তাঁকে নিয়ে এমন লিখে যাচ্ছেন তাতে তার বরং একরকম পাবলিসিটিই হচ্ছে।

.

০৩.

 বাস্তব কোনো চরিত্রের আদলে বনলতা সেন কবিতাটি সৃষ্ট কি না, এ নিয়ে কৌতূহল আছে পাঠক-পাঠিকার। সে প্রশ্ন অবশ্য অমীমাংসিতই রয়ে গেছে। শুধু জানা যাচ্ছে, জীবনানন্দ অশোকমিত্রকে বলেছিলেন, বনলতা সেন নামে রাজশাহীর জেলে আটক এক রাজবন্দীর খবর পত্রিকায় পড়ে নামটির ব্যাপারে আগ্রহী হয়েছিলেন তিনি। ওই পর্যন্তই। তবে সম্প্রতি বনলতা সেন কবিতার এক কৌতূহলোদ্দীপক ব্যাখ্যা নিয়ে হাজির হয়েছেন আকবর আলি খান। তিনি লিখেছেন বাংলাদেশের সরকারি আমলা হিসেবে রাজশাহীর নাটোরে চাকরি করতে গিয়ে ব্রিটিশ আমলের নথিপত্র ঘটতে ঘটতে তিনি আবিষ্কার করেছেন যে নাটোর একসময় বারবনিতাদের বড় কেন্দ্র ছিল। আকবর আলি খানের ধারণা, বনলতা সেন বস্তুত এক গণিকা চরিত্র। তিনি প্রস্তাব করছেন, বুদ্ধের অনন্ত যাত্রার সঙ্গে হাজার বছর ধরে পথ হাঁটিতেছির একটা সম্পর্ক আছে এবং সেই যাত্রায় স্থলন এবং পাপের সূত্র আছে। কবিতায় উল্লেখিত মগধের অধিপতি বিম্বিসার আর মৌর্য সম্রাট অশোক দুজনেই বৌদ্ধধর্মের অনুসারী ছিলেন। কিন্তু দুজনের জীবন ঘিরে পাপের প্রসঙ্গ আছে। অশোক ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ ঘটিয়েছেন। বিম্বিসারকে তার ছেলে হত্যা করে। কবিতায় যে বিদর্ভ নগরীর কথা বলা হচ্ছে মহাভারত অনুযায়ী বিদর্ভ অসামান্য রূপসী দায়মন্তের বাবার বাড়ি। কামার্ত দেবতা কলি কী করে দায়মন্তের সংসার ধ্বংস করে তার কাহিনি আছে মহাভারতে। বিদর্ভ তাই পাপের স্মৃতিবিজড়িত। কবিতায় বিদিশা নগরীর কথাও আছে। কালিদাসের মেঘদূতে বিদিশা নগরের কাহিনি আছে, যেখানে একে দেখানো হয়েছে পাপাচারের কেন্দ্র হিসেবে। সেই সঙ্গে যে শ্রাবস্তী নগরীর কথা বলা হচ্ছে, সেখানে বুদ্ধ তার জীবনের শেষ ২৫ বছর কাটিয়েছেন। কথিত আছে, সেখানে কামাতুর নারীরা বুদ্ধের ধ্যানভঙ্গের চেষ্টা করে। কিঙ্ক এবং সুন্দরী নামের দুই ভ্রষ্টা নারী এমনকি বুদ্ধের বিরুদ্ধে যৌন নির্যাতনের অভিযোগও তোলে। আকবর আলি বলছেন, কবিতার শুরুর যে আবহ তা পাপ, কাম ইত্যাদি দিয়ে নিয়ন্ত্রিত এক জগৎ। তিনি প্রশ্ন তুলছেন নাটোর কি সে সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে তেমনি এক জগৎ, যেখানে বনলতা সেন অপরূপ রূপসী এক বিদগ্ধ গণিকা? আর কে না জানে গণিকারাই পুরুষকে দুদণ্ড শান্তি দিয়ে থাকে। কবিতায় দেখা যায়, বনলতার সাথে কবির দেখা হয় শুধু অন্ধকারে। এতে সন্দেহ আরও দানা বাঁধে। কবি যে জিজ্ঞেস করছেন ‘এতদিন কোথায় ছিলেন?’, তার নানা রকম অর্থ হতে পারে। হতে পারে এই নারীর সঙ্গে তার দেখা হয়েছিল আগে তারপর বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিলেন তাঁরা কিংবা হতে পারে এই বিদুষী গণিকার মনে হয়েছে এই কবির মতো একজন মানুষের সঙ্গে পরিচয় হলে তাকে আর এ পথে আসতে হতো না ইত্যাদি। বনলতা সেনকে নিয়ে এযাবষ্কালের আলোচনায় এ নিঃসন্দেহে এক নতুন মাত্রা।

.

০৪.

বনলতাকে গণিকা হিসেবে দেখার এই প্রস্তাব বেশ অদ্ভুত, তবে ভাবনা উদ্রেককারী। দেখেছি জীবনানন্দের গল্পে, উপন্যাসে, কবিতায়, ডায়েরিতে গণিকাদের প্রসঙ্গ ঘুরেফিরে এসেছে। গণিকাদের জীবন বিষয়ে তাঁর পর্যবেক্ষণ পুরোনো, তিনি পতিতা নামে কবিতা লিখেছেন, তাঁর ডায়েরিতে দিল্লির গণিকালয়ে যাবার অভিজ্ঞতার কথা আছে, কলকাতায় বেকার জীবন কাটানোর সময় লেখা ডায়েরিতেও আছে গণিকাদের প্রসঙ্গ। কারুবাসনা উপন্যাসের চরিত্রকে তার মা বলছেন, ‘খুকির আবার পাঁচড়া হচ্ছে দেখলাম’।

‘হ্যাঁ।‘

‘সমস্ত হাত-পা, বুক-পিঠ, খুজলিতে ভরে গিয়েছে।‘

‘দেখেছি।‘

‘এ তো বড় ভাল কথা নয়’।

‘নাঃ ঘুরে-ঘুরে হচ্ছে।‘

‘কিন্তু বারবার এ রকম পাঁচড়া হয় কেন? এই আড়াই বছরের মধ্যে তিন বার হল?’

মাথা তুলে আমার দিকে তাকালেন।

‘কলকাতায় তুমি চোদ্দ বছর ধরে আনাগোনা করছ, কখনো কোনো প্রলোভনে পড়েনি তো?’

‘শরীরে কোনো রোগ আছে তোমার?’

‘ আছে বলে তো জানি না।‘

তাঁর ‘আস্বাদের জন্ম’ গল্পে স্বামী-স্ত্রীর আলাপ হচ্ছে, ‘স্ত্রী বলে, কেন সন্তান মরে, আমার অপরাধে না তোমার অপরাধে একদিন তার প্রমাণ হয়ে যাবে। বিধাতা আমাকে অপরাধিনী করবেন না নিশ্চয়ই’।

সোমনাথ একটু হেসে, ‘মনে করুন তা আমার অপরাধেই’।

বিভা—’আমি জানি। কলকাতায় তুমি অনেক সন্দেহজনক জীবন কাটিয়েছ?’

‘ভালোবাসার সাধ’ গল্পেও আছে স্বীকারোক্তি : ‘…ছেলেমেয়েদের বিয়ে করাবারও উপায় নাই আমার। আমার চল্লিশ বছরের জীবনের আর একটা পাপের কথা আপনার কাছে বলব দাদা। স্ত্রীর মৃত্যুর তিন চার মাস পরে আমি একবার কলকাতায় গিয়েছিলুম। মনের অবস্থা ভালো ছিলো না তখন। কলকাতা থেকে একটা গোপন রোগ নিয়ে আমি ফিরেছি। তারপর বিয়ে করার কোন পথ নেই আমার’।

সফলতা নিষ্ফলতাউপন্যাসে গণিকা প্রসঙ্গ আছে সরাসরি। উপন্যাসের চরিত্র বানেশ্বর বেশ্যাপাড়া ‘টেরিটিবাজারে’ যায়। তার বন্ধু নিখিল জিজ্ঞাসা করছে, অ্যাংলো ইন্ডিয়ান ছুঁড়িদের কাছে?

‘ছুঁড়ি অ্যাংলো ইন্ডিয়ানই ভালো।

ডবকা?

স্লিম।

থাইসিস হয়নি তো?

গিয়ে দেখলেই পারেন।

কত করে নেয়?

ট্রেড-ডিপ্রেশনের জন্য দাম কমে গেছে–আপনি একদিন যাবেন?

ভাবছি।

 অনেক প্রফেসররাও যায়।

ডি ইকন যেত?

যার টাকা আছে–যে কোলকাতায় আছে–ছেলে মানুষী করবার সময় আর যার নাই–সেই যায়।

তা হলে তো অনেক খদ্দের।‘

মোট কথা, বেশ্যাগমন, গোপন রোগ ইত্যাদি প্রসঙ্গ জীবনানন্দের লেখায় এসেছে। এর সঙ্গে বনলতা সেনের কী যোগ, তা নিয়ে তর্ক হতেই পারে। বিশেষ করে ব্যক্তি জীবনানন্দের যে প্রচলিত ইমেজ, বনলতা সেন নামটিকে কেন্দ্র করে তৈরি হওয়া যে রোমান্টিকতা, তার সঙ্গে এই গণিকা ব্যাপারকে মেলানো অনেকের কাছেই একটু বেমানান, অস্বস্তিকর। বনলতা সেন গণিকা কি না, সেটা একটা কৌতূহলোদ্দীপক প্রশ্ন হতে পারে। কিন্তু এ প্রশ্নের উত্তরের সঙ্গে এই কবিতাটির আবেদনের কোনো হেরফের হবার কারণ নেই। বনলতা সেনের পরিচয় যা-ই হোক, এ কবিতা বাংলা প্রেমের কবিতার ইতিহাসে এক অনন্যসাধারণ উদাহরণ হিসেবেই দাঁড়িয়ে গেছে। ক্লান্ত প্রাণ নিয়ে এক নারীর মুখোমুখি অন্ধকারে বসার যে আবহ, যে নারীর চুল অন্ধকার বিদিশার রাতের মতো, চোখ পাখির নীড়ের মতো, তা জনমানসকে প্রভাবিত করেছে ব্যাপকভাবে। বনলতা জীবনানন্দের চেয়েও জনপ্রিয়। জীবনানন্দের নামের চেয়ে লোকে বেশি জানে বনলতা সেনের নাম। বনলতা সেন হয়ে উঠেছে রীতিমতো জনসংস্কৃতির অংশ। হাজির হয়েছে বাংলা গানে, চলচ্চিত্রে, নাটকে।

.

রক্তাক্ত জ্যৈষ্ঠের রাতে এক ঢোঁড়া সাপ

০১.

ব্রজমোহন কলেজের নিয়মিত চাকরির সুবাদে জীবনানন্দের সংসারে অর্থের টানাটানি কিছুটা ঘুচেছে তখন। ইতিমধ্যে জন্ম নিয়েছে জীবনানন্দের দ্বিতীয় সন্তান ছেলে সমরানন্দ। লাবণ্যও সংসারের ফাঁকে ফাঁকে পড়াশোনা করে ব্রজমোহন কলেজ থেকে বিএ পাস করেছেন। সংসারে যে ঘোর অনিশ্চয়তা ছিল, সেটা অনেকটা কেটেছে।

কিন্তু জীবনানন্দ টের পান তাতে তার করোটির ভেতরের সেই যে ভূতের মতন এক বোধ, তার বিশেষ পরিবর্তন হয়নি। সেই বোধ তখনো তার সঙ্গে ঘুরছে। তিনি চলছেন সেই বোধও চলছে, তিনি থেমে যাচ্ছেন, থেমে যাচ্ছে সেই বোধও। এই যে একটা চাকরি পেয়েছেন, নিয়মিত বেতন পান, শুধু কুঁচো চিংড়ি খেয়ে থাকতে হয় না, তাতে কি তার মনের সেই মুদ্রাদোষের কোনো বদল হয়েছে? না, তা হয়নি। এখনো হৃদয় তার জলের মতো ঘুরে ঘুরে কথা বলে, এখনো সহজ লোকের মতো তিনি চলতে পারেন না, এখনো জীবনের নীল মত্ততার ভেতরও তার মনে নামে অন্ধকার। তাঁর মন থেকে অস্থিরতা, ক্লান্তি যায় না। জীবনানন্দ বুঝলেন এ তার এক অনিরাময়যোগ্য বোধ। এ বোধ তার পিছু ছাড়বে না। তিনি আগেই বলেছেন এ বোধ স্বপ্ন নয়, শান্তি নয়, ভালোবাসা নয় অন্য কিছু। এত দিন পর আবার সেই বোধের দিকে ভালোভাবে তাকালেন তিনি, বুঝবার চেষ্টা করলেন, এবার যেন তিনি চিনতে পারলেন সেই বোধকে। আগে সেই বোধ ছিল অনামি, নেহাতই একটা ‘বোধ’ এবার নতুন এক কবিতা লিখে সেই বোধটার একটা নাম দিলেন জীবনানন্দ। একে বললেন ‘‘বিপন্ন বিস্ময়’’।

সেই বোধের পরিচয় দিতে গিয়ে এক অদ্ভুত লোকের গল্প শোনালেন জীবনানন্দ, ‘‘আট বছর আগের একদিন’’ নামের সেই কবিতায়। এই কবিতায় যে লোকটার কথা বলছেন জীবনানন্দ, সে শুয়ে আছে এক লাশকাটা ঘরে। বরিশালে তাদের বগুড়া রোডের বাড়ির কাছে একটা মর্গ ছিল। সেই লাশকাটা ঘরের পাশ দিয়ে বহুবার হেঁটেছেন জীবনানন্দ। সেই লাশকাটা ঘরে টেবিলের ওপর শুয়ে থাকতে দেখেছেন মৃত মানুষকে। তেমনি এক মৃতের গল্প তিনি শোনালেন এই কবিতায়। লাশকাটা ঘর, এক অন্ধ পেঁচা, অশ্বত্থগাছ এমনি এক থমথমে পরিবেশে শুরু হলো সেই গল্প, যেন একটা খবর দিচ্ছেন সবাইকে সেভাবেই লিখলেন :

শোনা গেল লাশ কাটা ঘরে
নিয়ে গেছে তারে;
কাল রাতে–ফাল্গুনের রাতের আঁধারে
যখন গিয়েছে ডুবে পঞ্চমীর চাঁদ
মরিবার হল তার সাধ।

বধু শুয়ে ছিলো পাশে–শিশুটিও ছিলো;
প্রেম ছিলো, আশা ছিলো–জ্যোৎস্নায়,–তবু সে দেখিল
 কোন ভূত? ঘুম কেন ভেঙে গেল তার?
অথবা হয়নি ঘুম বহুকাল–লাশকাটা ঘরে শুয়ে ঘুমায় এবার।

এই ঘুম চেয়েছিল বুঝি!
রক্তফেনা-মাখা মুখে মড়কের ইঁদুরের মত ঘাড় গুঁজি
আঁধার ঘুজির বুকে ঘুমায় এবার;
কোনদিন জাগিবে না আর।

কোনদিন জাগিবে না আর
জাগিবার গাঢ় বেদনার
অবিরাম–অবিরাম ভার
সহিবে না আর
এই কথা বলেছিলো তারে
 চাঁদ ডুবে চলে গেলে–অদ্ভুত আঁধারে
যেন তার জানালার ধারে
 উটের গ্রীবার মতো কোন এক নিস্তব্ধতা এসে।

তবুও তো প্যাঁচা জাগে;
গলিত স্থবির ব্যাং আরো দুই মুহূর্তের ভিক্ষা মাগে
 আরেকটি প্রভাতের ইশারায়–অনুমেয় উষ্ণ অনুরাগে।

টের পাই যূথচারী আঁধারের গাঢ় নিরুদ্দেশে
চারিদিকে মশারির ক্ষমাহীন বিরুদ্ধতা;
 মশা তার অন্ধকার সঙঘারামে জেগে থেকে জীবনের স্রোত ভালোবাসে।

রক্ত ক্লেদ বসা থেকে রৌদ্রে ফের উড়ে যায় মাছি;
সোনালি রোদের ঢেউয়ে উড়ন্ত কীটের খেলা কত দেখিয়াছি।
ঘনিষ্ঠ আকাশ যেন–যেন কোন বিকীর্ণ জীবন
অধিকার করে আছে ইহাদের মন,
 দুরন্ত শিশুর হাতে ফড়িঙের ঘন শিহরণ
 মরণের সাথে লড়িয়াছে;
চাঁদ ডুবে গেলে পর প্রধান আঁধারে তুমি অশ্বত্থের কাছে
 এক গাছা দড়ি হাতে গিয়েছিলে তবু একা একা;
যে জীবন ফড়িঙের, দোয়েলের-মানুষের সাথে তার হয় নাকো দেখা
এই জেনে।

অশ্বত্থের
শাখা করেনি কি প্রতিবাদ? জোনাকির ভিড় এসে সোনালি স্নিগ্ধ ঝাঁকে
 করেনি কি মাখামাখি?
 থুরথুরে অন্ধ পেঁচা এসে
 বলেনি কি : বুড়ি চাঁদ গেছে বুঝি বোনোজলে ভেসে?
 চমৎকার!
 ধরা যাক দু একটা ইঁদুর এবার!
 জানায়নি প্যাঁচা এসে এ তুমুল গাঢ় সমাচার?

জীবনের এই স্বাদ-সুপক্ক যবের ঘ্রাণ হেমন্তের বিকেলের
তোমার অসহ্য বোধ হল
 মর্গে কি হৃদয় জুড়ালো
মর্গে–গুমোটে
থ্যাঁতা ইঁদুরের মতো রক্তমাখা ঠোঁটে!
 শোন
 তবু এ মৃতের গল্প;-কোনো
 নারীর প্রণয়ে ব্যর্থ হয় নাই;
 বিবাহিত জীবনের সাধ
কোথাও রাখেনি কোন খাদ,
সময়ের উদ্বর্তনে উঠে এসে বধূ
মধু–আর মননের মধু
দিয়েছে জানিতে;
হাড়হাভাতের গ্লানি বেদনার শীতে
এ জীবনে কোনদিন কেঁপে ওঠে নাই;
তাই
লাশ কাটা ঘরে
 চিৎ হয়ে শুয়ে আছে টেবিলের পরে।

জানি–তবু জানি
নারীর হৃদয়–প্রেম–শিশু-গৃহ-নয় সবখানি
অর্থ নয়, কীর্তি নয়, সচ্ছলতা নয়–
আরো এক ‘বিপন্ন বিস্ময়’
আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভিতরে
 খেলা করে;
 আমাদের ক্লান্ত করে
ক্লান্ত ক্লান্ত করে;
 লাশকাটা ঘরে
সেই ক্লান্তি নাই;
 তাই
লাশকাটা ঘরে
চিৎ হয়ে শুয়ে আছে টেবিলের ‘পরে।

তবু রোজ রাতে আমি চেয়ে দেখি আহা,
 থুরথুরে অন্ধ প্যাঁচা অশ্বত্থের ডালে বসে এসে,
 চোখ পালটায়ে কয় : বুড়ি চাঁদ গেছে বুঝি বেনোজলে ভেসে?
 চমৎকার!
ধরা যাক দু-একটা ইঁদুর এবার–

হে প্রগাঢ় পিতামহী, আজো চমৎকার?
আমিও তোমার মতো বুড়ো হবো-বুড়ি চাঁদটারে আমি
করে দেবো কালীদহে বেনোজলে পার;
আমরা দুজনে মিলে শূন্য করে চলে যাব জীবনের প্রচুর ভাঁড়ার।

এই কবিতা ছাপা হলো বুদ্ধদেব বসুর কবিতা পত্রিকায় ১৯৩৭ সালে। বুদ্ধদেব জীবনানন্দের অক্ষরবৃত্তে লেখা ৮৬ লাইনের এই কবিতাকে বললেন তার সবচেয়ে প্রাণতপ্ত এবং স্তরবহুল কবিতা। প্রজন্মের পর প্রজন্ম এই কবিতা নিয়ে অব্যাহত আছে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ। ফয়জুল লতিফ চৌধুরী জীবনানন্দের এই একটা কবিতা নিয়ে যত আলোচনা হয়েছে, তা সংকলন করে প্রকাশ করেছেন আস্ত এক বই।

.

০২.

‘‘আট বছর আগের একদিন’’ কবিতায় যে মৃত মানুষ, সে বেশ অদ্ভুত। মানুষের তো নানা রকম সাধ হয়। এই মানুষের মরার সাধ হয়েছে। মরার সাধ হলো, কারণ সে এমন একটা ঘুম চায় যে ঘুম থেকে আর উঠতে হবে না। কারণ জেগে থাকা অনেক কষ্টের ব্যাপার, অনেক ভার বহন করতে হয় তাতে। স্মরণ করা যেতে পারে যে এই কবিতাটা যখন তিনি লিখছেন সেই ১৯৩৭ সালের ঠিক আট বছর আগে জীবনানন্দ সদ্য বিবাহিত, তার বিছানাতেও তখন এক সদ্য জন্ম নেওয়া শিশু। তিনি তখন বেকার। তার সেই বিপর্যন্ত সময়ের ডায়েরিতে মরণ ঘুমে চলে যাবার কথা লিখেছেন তিনি অনেকবার। কিন্তু আট বছর পরের সেই মানুষ কি একই মানুষ? জীবনানন্দের সেই আট বছর আগের সত্তার সঙ্গে আজকের সত্তার যেন মোকাবিলা হচ্ছে এই কবিতায়।

তাঁর এই কবিতার লোকটার মরবার সাধ হলো যখন চাঁদ ডুবে গেছে, রাত অন্ধকার হয়ে গেছে, চারদিক নিস্তব্ধ। সেই নিস্তব্ধতা উটের গলার মতো। একটা প্রলম্বিত, দীর্ঘ সময় ধরে চলা নিস্তব্ধতাকে উটের গ্রীবার সাথে তুলনা করা যায় কে আর ভেবেছে জীবনানন্দের আগে? কিন্তু লোকটার যখন মরার সাধ হলো তখন তার স্ত্রী, সন্তান তার পাশেই শুয়ে ছিল। তবু সে লোক এক গাছা দড়ি হাতে গেল অশ্বখগাছের কাছে এবং সেখানে গিয়ে ঝুলে পড়ল। আত্মহত্যা করল সে। জীবনানন্দের আগে আত্মহত্যা নিয়ে বাংলা সাহিত্যে আর কেউ কবিতা লিখেছেন বলে জানা যায় না। রবীন্দ্রনাথ যে নান্দনিক প্রশান্তির কথা বলেছেন, এ কাণ্ড তা থেকে বহু দূরের। তবে জীবনানন্দ যে আত্মহত্যার ঘটনা উপস্থিত করলেন, সেটা একটা ধাঁধার মতো। লোকটা যে কেন আত্মহত্যা করেছে, সে এক জটিল জট। জীবনানন্দ অবশ্য এক প্রশ্ন-উত্তর পর্বের খেলার মতো সেই ধাঁধার জট খুলেছেন একটু একটু করে।

কবিতার এই লোকটার সঙ্গে গৌতম বুদ্ধের মিল আছে। রাজার ছেলে গৌতম একদিন রাজশকটে চড়ে প্রথমবারের মতো রাজপ্রাসাদের বাইরে বেরিয়েছেন। পথে দেখলেন এক লোক পথের ধারে শুয়ে ধুকছে। গৌতম জানতে চাইলেন কী হয়েছে লোকটির? রাজশকটের চালক তাকে বলল, এ লোক রোগগ্রস্ত, কোনো রোগ মানুষকে আক্রমণ করলে সে এমন শয্যাশায়ী হয়ে যায়। গৌতম অবাক হলেন। রোগ কাকে বলে তিনি জানতেন না। কিছুদূর গিয়ে দেখতে পেলেন এক বৃদ্ধ লোককে। গৌতম জানতে চাইলেন, এ লোক দেখতে এমন কেন? শকটের চালক তাকে বলল, এ হচ্ছে বার্ধক্য, বয়স হলে সবাই এমন নুজ হয়ে যায়। আশ্চর্য হলেন গৌতম। এর আগে তিনি বার্ধক্য দেখেননি কখনো। আরও কিছুদূর গেলে তিনি দেখলেন কয়েকজন লোক একজন মানুষের লাশ নিয়ে যাচ্ছে। গৌতম জানতে চাইলেন, কী হয়েছে এ লোকের? শকট চালক বলল, এ লোকের মৃত্যু হয়েছে, পৃথিবীর সব লোকেরই মৃত্যু হবে। গৌতম এই সত্য জেনে স্তব্ধ হয়ে গেলেন। মৃত্যু কাকে বলে জানতেন না তিনি। খুব বিপন্ন বোধ করলেন বুদ্ধ। রোগ, জরা, মৃত্যু এই তাহলে জীবনের পরিণাম? এই জীবনের জন্যই এত আয়োজন? সেদিন মাঝরাতেই তিনি তাঁর স্ত্রী-সন্তানকে ঘুমন্ত রেখে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। সংসার ত্যাগ করে গিয়ে বসলেন অশ্বথগাছের নিচে ধ্যান করতে, জানতে হবে কী মানে এই জীবনের। অভিধানে বলা আছে, অশ্বত্থ হচ্ছে সেই বৃক্ষ, যা বহুকাল অবিরোধে বাঁচিয়া থাকে। অশ্বখগাছকে সংসার-বৃক্ষও বলা হয়, যা ইহলোকের প্রতীক। ভগবত গীতায় আছে, তারা অক্ষয় অশ্বথ তরুর কথা বলে। এমন এক অক্ষয় গাছের নিচে দীর্ঘ ধ্যানের পর গৌতম পেলেন নতুন জীবন। ইহলৌকিক বৃক্ষের নিচে পেলেন পারলৌকিক বোধি। পেলেন নির্বাণের ধারণা, যার ভেতর দিয়ে জয় করা সম্ভব রোগ, জরা, মৃত্যুকে।

পরবর্তীকালে লেখা আরেক কবিতায় জীবনানন্দ সরাসরিই জানিয়েছিলেন বুদ্ধের প্রতি তাঁর আকুতির কথা :

কোথাও নতুন বুদ্ধের যেন জন্ম হয়
–এই ভেবে চলিতেছি
 বহুদিন ধরে স্ফুরিতেছি মোরা
 যেমন বনের পথে রক্তাক্ত জ্যৈষ্ঠের রাতে ফিরেতেছে ঢোঁড়া
–কোথাও ব্যাঙের যেন স্বাদ পাবে বলে।

জীবনানন্দের ‘‘আট বছর আগের একদিন’’ কবিতার এই লোক বুদ্ধের মতোই সাংসারিকতার ভেতর থেকেই নতুন জীবন লাভের জন্য গেছে অশ্বথগাছের কাছে। তার মরার সাধ জেগেছিল শুক্লা পঞ্চমীর রাতে। নিয়মমতো পরের দিন হচ্ছে ষষ্ঠী, যা দেবতা ষষ্ঠীর দিন। সনাতন ধর্মমতে ষষ্ঠী শিশুদের দেবতা। তিনি নবজাতককে সৃষ্টিও করেন, পালনও করেন। ব্যাপারটা তাৎপর্যময়, কারণ জীবনানন্দের কবিতার মানুষটার মরবার সাধ জাগে ওই ষষ্ঠীর দিনেই। মানুষটা এক নতুন জীবন সৃষ্টির জন্যই এক গাছা দড়ি হাতে গেছে অশ্বত্থের কাছে গৌতমের মতো।

কিন্তু এখানে জীবনানন্দ আবার এক নাটকের সৃষ্টি করছেন। যে লোকটাকে নিয়ে লিখছেন তাকেই আবার প্রশ্নবিদ্ধ করছেন। তাকে নানা রকম উদাহরণ দেখাচ্ছেন তিনি। বলছেন একটা থেঁতলে যাওয়া ব্যাঙও আরও দুই মুহূর্ত বাঁচবার জন্য আকুতি করে, দুষ্ট ছেলেরা যখন ফড়িং ধরে, তখন সেই ফড়িংরাও ছেলেদের হাত থেকে বাঁচবার জন্য ঘন ঘন পাখা নাড়ায়, মশারা কেমন দল বেঁধে গুনগুন করতে করতে উড়ে বেড়ায়, একটা প্যাচা যে আবার অন্ধ তারও ইঁদুর ধরবার কত শখ। জীবনানন্দ ওই আত্মহত্যা করা লোকটাকে প্রশ্ন করছেন এই সব পোকামাকড়, ব্যাঙেরও বেঁচে থাকার কত স্পৃহা অথচ মানুষ হয়ে সে কিনা নিজেকে ঝুলিয়ে দিল গাছে? কীটপতঙ্গের ভেতর যে জীবনের স্পৃহা আছে, সেটা জীবনানন্দ অনেক দিন থেকেই লক্ষ করে আসছেন কিন্তু মানুষের ভেতর কেন সেই সীমাহীন স্পৃহা নেই, সেটা ভেবেছেন। এত দিনে জীবনানন্দের এই কবিতার লোকটা তার উত্তর পেয়েছে। সে বোধিপ্রাপ্ত হয়েছে। সে জেনে গেছে যে কারণ যে জীবন ফড়িঙের, দোয়েলের মানুষের সাথে তার হয় নাকো দেখা।

জীবনানন্দ মানছেন তার কথা। কিন্তু আবারও তাকে প্রশ্ন করছেন। তুমি এক গাছা দড়ি হাতে গেলে ভালো কথা কিন্তু তখন ওই গাছ, জোনাকির ঝাঁক, চারপাশের যবের খেত এগুলো তোমাকে টানল না? তুমি বরং ওই মর্গে যাওয়াটাকেই ভালো মনে করলে? প্রশ্ন তিনি করছেন আবার লোকটার হয়ে উত্তরও তিনি দিয়ে দিচ্ছেন। তিনি জানাচ্ছেন যে এই লোক স্ত্রীর সাথে বনিবনা না হওয়ার জন্য আত্মহত্যা করেনি, তার স্ত্রী তাকে মধু, মনন সবই দিয়েছে, টাকাপয়সার কোনো টানাটানির জন্যও সে আত্মহত্যা করেনি, এ হাড় হাভাতে লোক নয়। অর্থ, কীর্তি, সচ্ছলতা, নারীর হৃদয় সবই তার আছে। এরপর জীবনানন্দ কবিতায় তাই কথাটা লাগিয়ে একটা ধাঁধা তৈরি করেছেন। সবকিছু আছে তাই লোকটা আত্মহত্যা করেছে। ‘আট বছর আগের একদিন’ কবিতার লোকটা মরেছে ব্যর্থতায় নয়, জীবনকে স্পষ্টভাবে জেনেছে বলে।

তবে জীবনানন্দ এমন সীদ্ধান্তহীনতায় এ লোকের গল্প শেষ করছেন না। তার বরং একটা নতুন আবিষ্কার আছে। তিনি বলছেন জাগতিক কিছু পাওয়া না পাওয়ার বাইরেও আমাদের কারও কারও রক্তের ভেতর এমন একটা বোধ আছে, যা আমাদের ভেতরে থেকে ক্ষয় করতে শুরু করে, ক্লান্ত করতে শুরু করে। কী সেই বোধ? তিনি তার নাম দিলেন ‘বিপন্ন বিস্ময়’। অনেক আগে থেকে যে বোধ তাকে তাড়া করে ফিরত, তার একটা চেহারা যেন তিনি পেলেন এই লোকের ভেতর। পৃথিবীর দিকে বিস্ময় ভরে তাকায় সেসব লোক কিন্তু এই বিস্ময় তাদের জীবনকে খুব কাবু করে। ফলে এ বিস্ময় বিপন্ন। অশ্বথগাছের নিচে বসে বুদ্ধ যেমন নির্বাণ আবিষ্কার করলেন, জীবনানন্দের কবিতার সেই লোকও আবিষ্কার করেছে ‘বিপন্ন বিস্ময়’। বস্তুত জীবনানন্দই তার হয়ে আবিষ্কার করলেন। তাঁর মায়ের প্রভাতসংগীত, বাবার উপনিষদ, সেই আলী মামুদ, মোতির মা, ফকির, মনুরুদ্দীন মিলে যে মায়াবী পৃথিবীর পরিচয় তাঁকে দিয়েছিলেন, জীবনের পথে চলতে চলতে তিনি কি বুদ্ধের মতো টের পাননি জীবনের মনের কথা আসলে বেদনা? তবু জীবন তো বিস্ময়করই। ‘বিপন্ন বিস্ময়’ এই বোধোদয়েরই নাম। এই সেই বোধ, যা কিছু কিছু মানুষের মাথার চারপাশে ঘোরে।

এই কবিতা যখন তিনি লিখছেন, তার আট বছর আগে একদিন তাঁরও এমন আত্মঘাতী হবার ইচ্ছা হয়েছে, তখন হয়তো তিনি নিজেকে ওই লোকের দলেরই মনে করতেন কিন্তু এখন করছেন না। জীবনানন্দ লোকটার আত্মহত্যার সিদ্ধান্তের যৌক্তিক কারণগুলো এক এক করে তুলে আনছেন ঠিকই কিন্তু শেষে গিয়ে তিনি তার পক্ষ নিচ্ছেন না। সেই ‘বিপন্ন বিস্ময়’ নামেই এই বোধ তাড়িত হলে তাকে আত্মহননের পথ বেছে নিতে হবে, তা তিনি মানছেন না। ফলে আত্মহত্যা করা এই মানুষটাকে তিনি শেষে বরং ব্যঙ্গ করছেন। জীবনানন্দ তাকে বলছেন, তুমি ওই মর্গে গিয়ে পচে মরো, আমি বরং ওই অন্ধ পেঁচার কাছে যাই, যে কিনা অশ্বথ নামের ওই সংসার-বৃক্ষে বসে এখনো ইঁদুর খোঁজে। জীবনানন্দ ওই লোকটার মর্গে যাওয়ার সিদ্ধান্তকে বুঝতে পারছেন কিন্তু মর্গে যাওয়াকে কোনো কাজের কাজ মনে করছেন না। জীবনানন্দ বরং ওই বুড়ো পেঁচাটার সঙ্গে মিলে জীবনের ভাঁড়ারে যা কিছু আছে সেগুলো সব উপভোগ করাকেই মোক্ষম কাজ বলে মনে করছেন। মৃত্যু দিয়ে কবিতা শুরু করলেও তার শেষ জীবনের জয়গানেই। আট বছর আগে তাঁর নিজের যে সত্তা মৃত্যুতাড়িত ছিল, সেই সত্তাকে যেন এক নতুন বোধাদয়ের প্রান্তে আনলেন তিনি।

.

০৩.

জন্ম-মৃত্যু, আনন্দ-বেদনার নাগরদোলা তৈরি করলেন তিনি এই কবিতায়। এই কবিতা তাঁর নিজের কবিজীবনেরও একটা মোড়। এরপর তাঁর কবিতার প্রধান সুর হয়ে উঠবে এই দ্বৈধতা। জীবনানন্দ যেন এই বোধিপ্রাপ্ত হয়েছেন যে দ্বৈধতাই মানুষের জীবনের এক অমোঘ সত্য। জরাথুস্ট যেমন বলেছেন মানুষের আত্মা নিয়ন্ত্রণের জন্য শুভর আর অশুভের লড়াই চলছে নিরন্তর, চীনা দার্শনিক লওৎসুও যেমন ইন আর ইয়াং নামে মানুষের ভেতর সব সময় প্রবহমান আলো আর অন্ধকারের দুটা শক্তির কথা বলেছেন, জীবনানন্দ যেন তেমন একটা বোধেই পৌঁছেছেন। তিনি এরপর লিখেছেন, আলোর রহস্যময়ী সহোদরার মত এই অন্ধকার…

লিখেছেন :

…জানি না নাকি আহা,
সব রাঙা কামনার শিয়রে যে দেয়ালের মতো এসে জাগে
ধূসর মৃত্যুর মুখ;

আরও লিখেছেন :

একবার মৃত্যু লয়ে–একবার জীবনেরে লয়ে
 ঘূর্ণির মতন বয়ে যে বাতাস ছেঁড়ে–তার মত গেছি বয়ে!

জীবনকে আলো-অন্ধকার, খারাপ-ভালো, আশা-নিরাশা আলাদা আলাদা থাকে না সাজিয়ে একই কাতারে দেখার বোধ জন্মেছে জীবনানন্দের। তিনি তাই লিখেছেন, অসম্ভব বেদনার সাথে মিশে রয়ে গেছে অমোঘ আমোদ।

.

০৪.

‘আট বছর আগের একদিন’ কবিতাটা প্রকাশিত হবার পর এবার সজনীকান্ত আর কোনো ব্যঙ্গ নয়, ব্যাপারটাকে অত্যন্ত সিরিয়াসলি নিলেন। কৃষ্ণনগরের এক সাহিত্য সম্মেলনে সজনীকান্ত জীবনানন্দসহ আরও কয়েকজন নতুন কবিকে উদ্ধৃত করে বললেন, ‘এই অস্বাভাবিক counterfeit বা জালিয়াতির অথবা চতুর ভান হইতে আধুনিক কবিরা মুক্তি লাভ না করিলে আধুনিক কাব্যের মুক্তি নাই…বাংলাদেশের তরুণ সম্প্রদায় কাব্যের নামে এই যে নিশ্চিত মৃত্যুর উপাসনা করিতেছেন এবং একটা প্রান্ত cult খাড়া করিয়া সেই তাণ্ডবে সকলকেই ঝাঁপ দিতে ডাকিতেছেন, তাহাতেই আশঙ্কাম্বিত হইয়া আমি আজিকার এই সাবধান বাণী উচ্চারণ করিলাম।‘

শুধু সজনীকান্ত নন, এক নবীন কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীও জীবনানন্দকে কড়া আক্রমণ করলেন। তিনি জীবনানন্দের কবিতার মূল প্রবণতা নিয়ে প্রশ্ন তুললেন। ‘আট বছর আগের একদিন’ কবিতার সূত্র ধরে তিনি লিখলেন জীবনানন্দের ভেতর একধরনের আত্মঘাতী ক্লান্তি আছে, তিনি হতাশাগ্রস্ত, তাঁর কবিতার ভেতর কোনো আশাবাদ নেই। এর আগে ক্যাম্পে কবিতা নিয়ে সজনীকান্তর সমালোচনার উত্তরে একটা লেখা লিখেছিলেন জীবনানন্দ কিন্তু সেটা ছাপাননি। কিন্তু নীরেন্দ্রনাথের অভিযোগকে তিনি গুরুত্বের সাথে নিলেন। পত্রিকায় একটা নিবন্ধ লিখে এই অভিযোগের উত্তর দিলেন। তিনি লিখলেন, … ‘আত্মঘাতী ক্লান্তি’ আমার কবিতার প্রধান আবহাওয়া নয়, কোনদিনও ছিল বলে মনে পড়ে না। আত্মঘাতী ক্লান্তির অভিযোগ প্রতিষ্ঠা করবার জন্য তিনি লাশ কাটা ঘরের কবিতাটি বেছে বের করেছেন। …কবিতাটি subjective নয় একটা dramatic representation মাত্র। কবিতাটি পড়লেই তা বোঝা যায় Hamlet বা Lear বা Machbeth এর ‘আত্মঘাতী ক্লান্তি’র সঙ্গে শেক্সপীয়রের যা সম্পর্ক, ও কবিতার ক্লান্তির সঙ্গে লেখকের সম্পর্কটুকুও সে রকম। কবিতাটিতে Subjective note শেষের দিকে ফুটেছে, কিন্তু সে তো লাশ কাটা ঘরের ক্লান্তির বাইরে–প্রকৃতির প্রাচুর্য ও ইতিহাসের প্রাণশক্তির সঙ্গে একাত্ম করে আনন্দিত করে রেখেছে কবিকে। তবু নিরেন বাবু লাশ কাটা ঘরের নায়ককে নায়কের স্রষ্টার সাথে ওতপ্রোত করে না জড়িয়ে কবিতাটি আস্বাদ করতে পারেন না মনে হয়। তিনি কী শেক্সপীয়রকে Mechbeth Bardolph Dogberry বা Golbs মনে করেন?

‘আত্মঘাতী ক্লান্তি বা আজকের যুগের যে কোন রকম ক্লান্তি থেকে মুক্তি পেতে হলে শুধু “আশাবাদী মনোভাব” কবচের মতন যে কোন জ্ঞান বিজ্ঞানালয় থেকে কিনে আনলে চলবে না। সে মনোভাব আশাবাদী হতে পারে, কিন্তু তা আরোপিত ও আড়ষ্ট–স্বাভাবিক ও সার্বজনীন নয়। “প্রচুর হয়েছে শস্য, কেটে গেছে মরণের ভয়” বালভাষিত কিন্তু কবিতা নয়, শস্য প্রচুর হলেই “মরণের ভয়” কেটে যায় না–আজকের এই জটিল শতাব্দীতে শিশুকে এ কথা কে বোঝাবে? নীরেন বাবু হয়তো মনে করেন এ রকম কতগুলো লাইন লিখতে পারলেই কবিতা হয়, আশাবাদী মনোভাবের পরিচয় পাওয়া যায় এবং আত্মঘাতী ক্লান্তির থেকে মুক্তি লাভ সম্ভব, বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির উদয় হয়। কিন্তু স্বর্গের সিঁড়ি এত সোজা নয়।

‘আধুনিক কবিতায় যে আমি’র ব্যবহার করা হয়–যেমন “ইতিহাসযানে” একটু আধটু করেছি–সে আমি যে কবির নিজের ব্যক্তিগত সত্তা মোটেও নয়, কবিমানসের কাছে সমাজ ও কালের রূপ যেভাবে ধরা পড়েছে তারই প্রতিভূ সত্তা–আধুনিক কাব্য পড়বার সময় অনেক সমালোচক তা মনে রাখেন না…’

একসময় জীবনানন্দের কবিতাকে অভিযুক্ত করা হয়েছে দুর্বোধ্য হিসেবে, এরপর অশ্লীল হিসেবে। এবার জীবনানন্দ বিষয়ে উঠল নতুন অভিযোগ, তিনি নিরাশাবাদী, প্রগতিবিরোধী।

.

অন্ধকার এবং স্তব্ধতায় একটা মোম

০১.

এ সময় আবু সয়ীদ আইয়ুব এবং হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় একটা বই সম্পাদনা করলেন আধুনিক বাংলা কবিতানামে। তাঁরা কবি নন কিন্তু বিদগ্ধ মানুষ হিসেবে পরিচিত। তাঁদের সে বইয়ে তারা আধুনিক বাংলা কবিতার অন্যতম প্রতিনিধি হিসেবে ঘোষণা করলেন সুধীন্দ্রনাথ দত্ত ও বিষ্ণু দে-কে। এই দুই কবিকে তারা উপস্থাপন করলেন সবচেয়ে সমাজ-সচেতন এবং প্রগতিপন্থী হিসেবে। সেই সংকলনে অতিরিক্ত হিসেবে জীবনানন্দের কয়েকটি কবিতা অবশ্য যুক্ত করলেন তারা। আবারও এর প্রতিবাদে এগিয়ে এলেন বুদ্ধদেব বসু। এক প্রবন্ধে লিখলেন, আমার পক্ষে সবচেয়ে বেদনার কারণ জীবনানন্দ, যার ধূসর পাণ্ডুলিপির পরও আরো কিছু উৎকৃষ্ট কবিতা বেরিয়ে গেছে ততদিনে, অথচ যিনি স্থান পেয়েছিলেন অতি সংকীর্ণ : আমি বহু তর্ক করে অন্যদের বোঝাতে পারিনি যে জীবনানন্দ শুধু বর্ণনাধর্মী লিপিকার নন, অতি গভীর ভাবনাঋদ্ধ এক কবি, আমাদের মধ্যে অন্যতম প্রধান।

.

০২.

 অকবিদের এসব কবিতা নিয়ে আলোচনায়, কবিতার বই সম্পাদনায় বিরক্ত হয়েই বুঝি এই সময় জীবনানন্দ লেখেন;

বরং নিজেই তুমি লেখো নাকো একটি কবিতা–
বলিলাম স্লান হেসে; ছায়াপিণ্ড দিল না উত্তর;
 বুঝিলাম সে তো কবি নয়–সে যে আরূঢ় ভণিতা;
পাণ্ডুলিপি, ভাষ্য, টীকা, কালি আর কলমের ‘পর
 বসে আছে সিংহাসনে–কবি নয়–অজর, অক্ষর
অধ্যাপক, দাঁত নেই–চোখে তার অক্ষম পিঁচুটি;
 বেতন হাজার টাকা মাসে–আর হাজার দেড়েক
 পাওয়া যায় মৃত সব কবিদের মাংস কৃমি খুঁটি;
 যদিও সে সব কবি ক্ষুধা প্রেম আগুনের সেঁক
চেয়েছিলো–হাঙরের ঢেউয়ে খেয়েছিলো লুটোপুটি।

কবিতার হাঙরভরা সাগরে তাঁর মা তো তাঁকে নামিয়ে দিয়েছেন বহু আগেই। জীবনানন্দ জানেন সেই সাগরে সাঁতার কাটবার বিপদ এবং রোমহর্ষ। এই কবিতাটা থেকে বোঝা যায়, জীবনানন্দের স্তিমিত মনে ক্রমশ রাগ জন্ম নিচ্ছে।

.

০৩.

এ সময় রবীন্দ্রনাথও বাংলা কাব্য পরিচয় নামে বাংলা কবিতার একটা সংকলন। প্রকাশ করলেন। সেখানে জীবনানন্দের একটা কবিতা অন্তর্ভুক্ত করলেন তিনি। বুদ্ধদেবের কবিতা পত্রিকায় এই কবিতাটা পড়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘জীবনানন্দ দাশের চিত্ররূপময় কবিতাটি আমাকে আনন্দ দিয়েছে’। ‘মৃত্যুর আগে’ নামের এই সেই কবিতা;

দেখেছি সবুজ পাতা অঘ্রানের অন্ধকারে হয়েছে হলুদ,
 হিজলের জানালায় আলো আর বুলবুলি করিয়াছে খেলা,
 ইঁদুর শীতের রাতে রেশমের মতো রোমে মাখিয়াছে খুদ,
 চালের ধূসর গন্ধে তরঙ্গেরা রূপ হয়ে ঝরেছে দু’বেলা
 নির্জন মাছের চোখে;-পুকুরের পারে হাঁস সন্ধ্যার আঁধারে
পেয়েছে ঘুমের ঘ্রাণ–মেয়েলি হাতের স্পর্শ লয়ে গেছে তারে;

এটা একটা দীর্ঘ কবিতা। রবীন্দ্রনাথ কবিতাটা অন্তর্ভুক্ত করলেন ঠিকই কিন্তু তাকে নিজের মতো কেটেহেঁটে ছোট করে নিলেন। এ ব্যাপারটা নিয়েও ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানালেন বুদ্ধদেব বসু। তার কবিতা পত্রিকায় একটা প্রবন্ধ লিখে এভাবে কবির অনুমতি ছাড়া কবিতাকে কাটাছেঁড়া করায় রবীন্দ্রনাথের কড়া সমালোচনা করলেন বুদ্ধদেব। তিনি লিখলেন একজন কবির কবিতা এভাবে নিজের মর্জিমতো কেটেছেটে ছাপানোর চাইতে সেটা বরং পুরোপুরি বাদ দেওয়াই উচিত ছিল। বুদ্ধদেব লিখলেন, ‘সাহিত্য ক্ষেত্রে কেউ কারো কৃপাপ্রার্থী নন। দয়া গ্রহণের চাইতে স্পষ্ট উপেক্ষার বর্জন অনেক সম্মানের’।

প্রতিষ্ঠিত সাহিত্যিকদের অবহেলার মুখে বুদ্ধদেব একাই লড়াই করে যেতে লাগলেন জীবনানন্দের পক্ষে। তিনি তাঁর কবিতা পত্রিকায় লিখলেন, ‘…সত্যি বলতে আমাদের আধুনিক কবিদের মধ্যে তিনি (জীবনানন্দ) বোধ হয় সবচেয়ে সক্রিয়। তার কল্পনা সর্বদাই নব নব রূপের সন্ধানী, তার রচনাভঙ্গী গভীরতর পরিণতির দিকে ঝুঁকছে। কিন্তু এতদিনেও আমাদের সাহিত্যের বাজারে তার খ্যাতির রোল ওঠেনি। আমাদের সুধীশ্রেণীও তার কাব্যের সঙ্গে যথেষ্ট পরিচিত, এমন মনে হয় না।…জীবনানন্দকে আমি আধুনিক যুগের একজন প্রধান কবি বলে বিবেচনা করি এবং ধূসর পাণ্ডুলিপি তার প্রথম পরিণত গ্রন্থ।…আমাদের দেশে কোন ক্ষেত্রেই কোনরকম ষ্টান্ডার্ড নেই, সাহিত্যে একেবারেই নেই। প্রতিভা হয় অবজ্ঞাত, তৃতীয় শ্রেণীর কবি অভিনন্দিত হয় অ-সাহিত্যিক কারণে। আমাদের মূল্যজ্ঞানহীন সমাজকে মাঝে মাঝে নাড়া দেয়াই দরকার, মাঝে মাঝে জোর করেই বলা দরকার। এদেশে মাতৃভাষার সাহিত্যকে যারা শ্রদ্ধা করে ভালোবাসেন (যদি আজকালকার দিনে এমন কেউ থাকেন) তার ধূসর পাণ্ডুলিপি নিজের গরজেই পড়বেন, কারণ এই বইয়ের পাতা খুললে তারা একজনের পরিচয় পাবেন যিনি প্রকৃতই কবি এবং প্রকৃতই নতুন…।‘

.

০৪.

ওই এক বুদ্ধদেব বসু তখন কেবল জীবনানন্দের পতাকা উড়িয়ে আসছেন। অন্য লেখক-কবিদের সবাই কোনো না কোনো তাঁবুর ভেতর আছেন কিন্তু জীবনানন্দের মাথার ওপর কোনো আচ্ছাদন নেই। তিনি খালি মাঠেই দাঁড়িয়ে আছেন একাকী। তাকে যে তাই থাকতে হবে তিনি তা বুঝে গেছেন। একসময় যেচে মানুষের কাছ থেকে তাঁর কবিতার মূল্যায়ন চেয়েছেন। এখন আর চান না। তাঁর কবিতা নিয়ে নানা সমালোচনার মুখে বেশ অনেকটা রাগ, ক্ষোভ, অভিমান নিয়েই সিদ্ধান্ত নিলেন কবিতা বলতে তিনি কী বোঝেন, সেটা লিখে জানাবেন। কবিতা পত্রিকায় এরপর তিনি একটা প্রবন্ধ লিখলেন, যার প্রারম্ভিক লাইন এরপর হয়ে উঠবে প্রবাদ। তিনি লিখলেন, ‘সকলেই কবি নয়। কেউ কেউ কবি; কবি কেননা তাদের হৃদয়ে কল্পনার এবং কল্পনার ভিতরে চিন্তা ও অভিজ্ঞতার স্বতন্ত্র সারবত্তা রয়েছে এবং তাদের পশ্চাতে অনেক বিগত শতাব্দী ধরে এবং তাদের সঙ্গে সঙ্গে আধুনিক জগতের নব নব কাব্য বিকীরণ তাদের সাহায্য করছে; কিন্তু সকলকে সাহায্য করতে পারে না, যাদের হৃদয়ে কল্পনা ও কল্পনার ভিতর অভিজ্ঞতা ও চিন্তার সারবত্তা রয়েছে তারাই সাহায্যপ্রাপ্ত হয়; নানারকম চরাচরের সম্পর্কে এসে তারা কবিতা সৃষ্টি করার অবসর পায়।…আমি বলি না যে কবিতা সমাজ বা জাতি বা মানুষের সমস্যাখচিত অভিব্যক্ত সৌন্দর্য হবে না। তা হতে বাধা নেই। অনেক শ্রেষ্ঠ কাব্যই তা হয়েছে। কিন্তু সে সমস্ত চিন্তা, ধারণা, মতবাদ, মীমাংসা কবির মনে প্রাককল্পিত হয়ে কবিতার কঙ্কালকে যদি দেহ দিতে যায় কিংবা সেই দেহতে দিতে চায় আভা তা হলে কবিতা সৃষ্ট হয় না–পদ্য লিখিত হয় মাত্র–ঠিক বলতে গেলে পদ্যের আকারে সিদ্ধান্ত, মতবাদ ও চিন্তার প্রক্রিয়া পাওয়া যায় শুধু। কিন্তু আমি আগেই বলেছি কবির প্রণালী অন্য রকম, কোনো প্রাকনির্দিষ্ট চিন্তা বা মতবাদের জমাট দানা বেঁধে থাকে না কবির মনে-কিম্বা থাকলেও সেগুলোকে সম্পূর্ণ নিরস্ত করে থাকে কল্পনার আলো ও আবেগ, কাজেই চিন্তা ও সিদ্ধান্ত, প্রশ্ন ও মতবাদ প্রকৃত কবিতার ভিতর সুন্দরীর কটাক্ষের পিছনে শিরা-উপশিরা ও রক্তের কণিকার মতো লুকিয়ে থাকে যেন, কিন্তু নিবিষ্ট পাঠক তাদের সে সংস্থান অনুভব করে, বুঝতে পারে যে তারা সঙ্গতির ভিতর রয়েছে, অসংস্থিত পীড়া দিচ্ছে না, কবিতার ভিতর আনন্দ পাওয়া যায়…’

এরপর তিনি তাঁর নিজের কবিতা লেখার মুহূর্তের বর্ণনা দেন, ‘…আমাকে অনুভব করতে হয়েছে যে, খণ্ড বিখণ্ডিত এই পৃথিবী, মানুষ ও চরাচরের আঘাতে উত্থিত মৃদুতম সচেতন অনুনয়ও এক এক সময় যেন থেমে যায়–একটি পৃথিবীর অন্ধকার ও স্তব্ধতায় একটি মোমের মতন যেন জ্বলে ওঠে হৃদয় এবং ধীরে ধীরে কবিতা জননের প্রতিভা ও আস্বাদ পাওয়া যায়। এই চমৎকার অভিজ্ঞতা যে সময়। আমাদের হৃদয়কে ছেড়ে যায়, সে সব মুহূর্তে কবিতার জন্ম হয় না, পদ্য রচিত হয়, যার ভিতর সমাজশিক্ষা, লোকশিক্ষা, নানারকম চিন্তার ব্যায়াম ও মতবাদের প্রাচুর্যই পাঠকের চিত্তকে খোঁচা দেয় সবচেয়ে আগে এবং সবচেয়ে বেশী করে; কিন্তু যাদের প্রতিভা ক্ষণস্থায়ী পাঠকের মন কোনো আনন্দ পায় না, কিংবা নিম্নস্তরের তৃপ্তি বোধ করে শুধু এবং বৃথাই কাব্যশরীরের আভা খুঁজে বেড়ায়…যে পর্যন্ত জনসাধারণের হৃদয় নতুন দিগবলয় অধিকার না করবে সে পর্যন্ত কয়েকটি তৃতীয় শ্রেণীর কবির স্কুল উদ্বোধন ছাড়া বাজারে-বন্দরে এবং মানবসমাজ ও সভ্যতার সমগ্রতার ভিতর কোনো প্রথম শ্রেণীর কাব্যের প্রবেশ থাকবে না…’

চারদিকের অনাত্মীয় অবহেলার মুখে কী আর করতে পারেন তিনি? অন্ধকার ও স্তব্ধতায় একটা মোমের মতন জ্বলে ওঠে প্রথম শ্রেণির কবিতা জন্ম দেওয়ার চেষ্টা করা ছাড়া? জীবনানন্দ তখন সেই চেষ্টাই করে যাচ্ছেন। লেখা তার কাছে জীবন ধারণেরই অপর নাম।

.

খোঁপার ভিতরে চুলে, নরকের কালো মেঘ

০১.

গত শতাব্দীর ত্রিশ দশকে বাস্তবিকই পৃথিবী খণ্ড-বিখণ্ড হবার উপক্রম হয়েছে। আঘাত নেমে আসছে মানুষ আর চরাচরে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের জের ধরে ইউরোপের ঔপনিবেশিক দেশগুলোর ভেতর শুরু হয়েছে ঘোর টানাপোড়েন। শুরু হয়েছে সম্পদের ভাগাভাগি নিয়ে দ্বন্দ্ব। তার প্রভাব পড়ছে পৃথিবীর নানা দেশে। পৃথিবী উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। হিটলার যে বছর জার্মানিতে ক্ষমতায় এল, সেই ১৯৩৩ সালে লেখা তার গল্প ‘সঙ্গ নিঃসঙ্গ’তে দেখা যাচ্ছে, সেই বরিশালে বসে জীবনানন্দ হিটলারের গতিবিধি খেয়াল করে যাচ্ছেন। সেই গল্পের এক চরিত্র বলছে, ‘সমস্ত সকাল চুরুট জ্বালাইয়া, জানালার কাছে চেয়ারটা টানিয়া লইয়া, একবার আমি আমের ডালপালার ভিতর হলুদ বউ কথা কও পাখিটির দিকে তাকাইয়া দেখিতাম–বহুক্ষণ অন্যমনস্কতার পর লাইনে নাজিদের কাণ্ডকারখারা, হিটলারের বিচিত্রতা, মস্কো ট্রায়াল, লুয়াংসির কাছে জাপানীদের অমানুষিক যুদ্ধ–এইসব দূরদূরান্ত, দিগন্তের এবং নিকটের ঘরের নানারকম চিত্তাকর্ষক সংবাদ ও অসংলগ্ন মন্তব্য লইয়া সমস্ত সকালবেলাটা জমিয়া উঠিত মন্দ না।‘

জীবনানন্দ নিয়মিত স্টেটসম্যান পত্রিকাটা পড়তেন। তিনি তখন দেখছেন জার্মানে হিটলারের উত্থান, ইতালিতে মুসোলিনির। রেডিও, পত্রিকা, জাহাজ, বিমান চলাচলের মাধ্যমে পৃথিবীর দেশগুলো পরস্পরের নিকটবর্তী হচ্ছে। দেখা দিচ্ছে বিশ্বায়নের উপাদান। এতে নানা দেশের ভেতর পারস্পরিক সম্পর্কগুলো চাপের ভেতর পড়ছে। পরস্পরের লাভ-ক্ষতির হিসাব হচ্ছে। সমঝোতার চেষ্টা হচ্ছে কিন্তু বিশেষ লাভ হচ্ছে না। বরং বাড়ছে পরস্পরের বৈরিতা। তাতে বিপদের আশঙ্কা বাড়ছে। পৃথিবী যেন আরও একটি যুদ্ধের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। সন্তানদের পেনসিল কাটতে কাটতে তখন তিনি নিজের দাম্পত্য নয়, সাহিত্য প্রতিষ্ঠা নয়, শঙ্কিত হয়ে উঠছেন পৃথিবীর ভবিষ্যৎ নিয়ে। প্রেম নয়, প্রকৃতি নয়, তাঁর মনজুড়ে তখন পৃথিবীব্যাপী এক আসন্ন সংঘর্ষের শঙ্কা। এই সময়টাতেই ১৯৩৮-এ ‘পৃথিবী ও সময়’ নামে একটা প্রবন্ধ লেখেন জীবনানন্দ।, আজকের বিশ্বায়নের ডামাডোলের বহু আগে উচ্চারণ করলেন অমোঘ ভবিষ্যদ্বাণী, ‘পৃথিবীর জাতিদের পরস্পরের ভিতর মৈত্রী স্থাপনের যে চেষ্টা কিছুদিন থেকে চলে আসছে–যার ফলে বিভিন্ন জাতীয়তা পৃথক সভ্যতা ও সংস্কৃতি মেনে নিয়েও এক অচ্ছিন্ন মানবসমাজের আশ্রয়ে মানুষ ও জাতি অন্তলীন অথচ স্বাধীন হয়ে থাকবার সুযোগ পেতে পারে–আনন্দে ও শান্তিতে–সে প্রয়াস যতটা কূটনৈতিক ততটা বৈজ্ঞানিক হয়ে উঠতে পারেনি এবং যেটুকু বা সংস্কারমুক্ত সত্যার্থী হতে সক্ষম হয়েছে বলে মনে হয় তার চেয়ে ঢের কম অনুপাতে আন্তরিক হতে পেরেছে। প্রথম মহাযুদ্ধের আগে পৃথিবী আজকের চেয়ে বড় ছিলো–মানে দীর্ঘতর ছিলো। যানশিল্পের যে অভাবনীয় দ্রুতগতির ফলে দেশে দেশে দূরত্ব বিচিত্রভাবে সংকুচিত হয়ে পড়েছে–এক জাতি আরেক সুদূর জাতিরও হয়ে দাঁড়াচ্ছে নিকট প্রতিবেশী, প্ৰাকসামরিক পৃথিবীতে এটা সম্ভব ছি না, এ জিনিস কষ্টকল্পনার ব্যাপার ছিল প্রায়।… তাছাড়া দেশে দ্বীপে এই নিকট যোগাযোগের ফলেই সুদূরগত জাতিকেও প্রায় মুখচেনা পড়শির মতো দেখবার বুঝবার সুযোগ পাওয়া যাচ্ছে–মানসিক দূরত্বের ব্যবধান ঘুচে যাচ্ছে, দৃষ্টিরীতির বৈষম্যের মানে ও মর্মার্থ গ্রহণ করতে পারা ক্রমেই সম্ভব হয়ে উঠছে। এই সবেরই সঙ্গত সুফল আশা করতে পারা যেত, সকলেই যখন কাছে, যে যার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট, কেউ দূরে নয় বিচ্ছিন্ন নয়, তখন সকল জাতিকে নিয়ে যার যার ব্যক্তিস্বাধীনতা ও জাতিস্বকীয়তা সত্ত্বেও শান্তির ও মৈত্রীর হেতুভূমিতে এক অবিচ্ছিন্ন মানবপরিমণ্ডল গঠন করবার ইচ্ছা ও আয়োজন অসঙ্গত মনে করা যেতে পারত কি? কিন্তু সৎ দার্শনিকের মনের নিভৃতে যে বিধানই চলতে থাকুক না কেন–মানবমৈত্রীর পরিবর্তে জাতিবিদ্বেষ, দেশে দেশে সংঘর্ষ নিরবচ্ছিন্ন রক্তান্ধকার আধুনিক ইতিহাসের পৃষ্ঠা অশুদ্ধ ভাবনা ও বিমিশ্র বাসনার শূন্যতা ও নিষ্ফলতায় আড়ষ্ট করে রাখছে। পরের জিনিসে লোভ, নিঃসহায়কে নিংড়ানো, শোকাবহ স্বৈরাচার, বারবার যুদ্ধ, মন্বন্তর ও কালোবাজারের অন্ধ বিমূঢ়তা সৃষ্টি করে চলেছে’।

.

০২.

প্রবন্ধে যে কথা বলেছেন, সে কথা আবার বলেন কবিতাতেও :

পরস্পরের থেকে দূরে থেকে, ছিন্ন হয়ে; বিরোধিতা করেছে
সকলের আগে নিজে–অথবা নিজের দেশ–নিজের নেশন
 সবের উপরে সত্য মনে করে জ্ঞানপাপে অস্পষ্ট আবেগ…

এই সময়টাতেই জাপান আক্রমণ করল চীনের সাংহাই। জীবনানন্দ ‘গোধূলিসন্ধির নৃত্য’ কবিতায় লিখলেন :

পিপুলের গাছে বসে পেঁচা শুধু একা
চেয়ে দেখে; সোনার বলের মতো সূর্য আর
রূপার ডিবের মতো চাঁদের বিখ্যাত মুখ দেখা।

হরীতকী শাখাদের নিচে যেন হীরার স্ফুলিঙ্গ
 আর স্ফটিকের মতো শাদা জলের উল্লাস;
 নৃমুণ্ডের আবছাড়া–নিস্তব্ধতা
বাদামী পাতার ঘ্রাণ–মধুকূপী ঘাস।

কয়েকটি নারী যেন ঈশ্বরের মতো :
পুরুষ তাদের : কৃতকর্ম নবীন;
 খোঁপার ভিতরে চুলে : নরকের নবজাত মেঘ
পায়ের ভঙ্গির নীচে হঙকঙের তৃণ।

সেখানে গোপন জল ম্লান হয়ে হীরে হয় ফের,
পাতাদের উৎসরণে কোনো শব্দ নাই;
তবু তারা টের পায় কামানের স্থবির গর্জনে
 বিনষ্ট হতেছে সাংহাই।

এই কবিতা নিয়ে নানা রকম ব্যাখ্যা হয়েছে তবে হংকং, সাংহাই, নরকের কালো মেঘ, পিপুল গাছে বসে থাকা একা পেঁচা ইত্যাদি যে একটি অশুভ সময়ের প্রেক্ষাপট এবং জাপানের বোমাবর্ষণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট, সেটা বোঝা যায়। এর কিছুকাল পরই তাঁর আশঙ্কা সত্য প্রমাণ করে হিটলার আক্রমণ করেন পোল্যান্ড। শুরু হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। যুদ্ধ ক্রমশ তীব্র হয়ে উঠলে জীবনানন্দ ভারাক্রান্ত মনে লেখেন :

ইতিহাস অর্ধসত্য কামাচ্ছন্ন এখনো কালের কিনারায়;
তবুও মানুষ এই জীবনকে ভালোবাসে, মানুষের মন
জানে জীবনের মানে, সকলের ভালো করে জীবনযাপন।
কিন্তু সেই শুভ রাষ্ট্র ঢের দূরে আজ।
 চারিদিকে বিকলাঙ্গ অন্ধ ভিড়–অলীক প্রয়াণ।
 মন্বন্তর শেষ হলে পুনরায় নব মন্বন্তর;
যুদ্ধ শেষ হয়ে গেলে নতুন যুদ্ধের নান্দীরোল,
মানুষের লালসার শেষ নেই;
উত্তেজনা ছাড়া কোন ঋতু ক্ষণ
 অবৈধ সঙ্গম ছাড়া সুখ
 অপরের মুখ ম্লান করে দেওয়া ছাড়া প্রিয় সাধ
 নেই।

.

০৩.

যুদ্ধ ধীরে ধীরে ইউরোপ ছাড়িয়ে পৃথিবীর অন্য প্রান্তে ছড়াতে শুরু করে। একপর্যায়ে তার ছোঁয়া লাগে বাংলায়। বাংলার আকাশে দেখা দেয় যুদ্ধবিমান, মাটিতে আর্মি কনভয়, পথে সৈন্য, চলে নিষ্প্রদীপ মহড়া। চারদিকের বাস্তবিক জীবনে এই সব নতুন অনুষঙ্গ দেখা দিতে থাকে তাঁর কবিতাতেও :

জীবনানন্দ লেখেন, আকাশকে নিরালম্ব করে বোমারু বিমান উড়ে যায়…

লেখেন :

এছাড়া দিনের কোন সুর
নেই,
বসন্তের অন্য সাড়া নেই
প্লেন আছে অগণন প্লেন
অগন্য এয়োরোড্রাম
রয়ে গেছে…

আরও লেখেন :

লরিতে বোঝাই করা হিংস্র মানবিকী
… … …
মাঝে মাঝে
এম্বুলেন্স গাড়ির ভিতরে
রণক্লান্ত নাবিকেরা ঘরে
ফিরে আসে…

যুদ্ধ বাড়ছে, হিটলার আর নরওয়েজিয়ান সেনানায়ক কুইসলিংয়ে আঁতাত হলে জীবনানন্দ লিখলেন :

কুইসলিং বানাল কি নিজ নাম–হিটলার সাত কানাকড়ি
 দিয়ে তাহা কিনে নিয়ে হয়ে গেল লাল…

যুদ্ধ তখন ছড়িয়ে পড়েছে পৃথিবীর নানা প্রান্তে :
পশ্চিমে প্রেতের মতন ইউরোপ;
পুবদিকে প্রেতায়িত এশিয়ার মাথা;
আফ্রিকার প্রেতাত্মা জন্তুর মতন ঘনঘটাচ্ছন্নতা;

.

একবার অশ্লীল, অতঃপর পাগল, অবশেষে মাতাল

০১.

এ সময় সাহিত্যিকদের ভেতর গঠিত হলো ‘ফ্যাসী বিরোধী লেখক ও শিল্পী সংঘ’। শুরু হলো প্রগতিশীল সাহিত্যিকদের নতুন আন্দোলন। তাঁরা ঘোষণা করলেন, ‘আশাবাদী সাহিত্য’ রচনা করতে হবে। তাদের ইশতেহারে বললেন, ‘আমরা চাই সাহিত্য প্রাত্যহিক জীবনের চিত্র ফুটিয়ে তুলুক আর যে ভবিষ্যতের পরিকল্পনা আমরা করেছি তাকে এগিয়ে আনুন…’। ভবিষ্যৎ জীবনের পরিকল্পনা বলতে তারা বুঝিয়েছেন সমাজতন্ত্রকে। অর্থাৎ প্রগতিশীল লেখককে হতে হবে সমাজতান্ত্রিক সমাজের পক্ষের মানুষ। রুশ বিপ্লবের মাধ্যমে পৃথিবীর রাজনীতি তখন দুই শিবিরে বিভক্ত হয়ে গেছে। একদিকে পুঁজিবাদ আর অন্যদিকে সমাজতন্ত্র। তৃতীয় বিশ্বের নানা প্রান্তের তরুণ লেখকদের মনে তখন বৈষম্যহীন সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন। মার্ক্সবাদী নন্দনতত্ত্বের আলোকে সাহিত্যে তখন সমাজতান্ত্রিক বাস্তববাদের জোয়ার। সাহিত্যিকদের ভেতর বিভাজন। যারা সমাজতন্ত্রের পক্ষে তারা প্রগতিশীল, যারা পক্ষে নন তারা প্রতিক্রিয়াশীল। জীবনানন্দ যতই তাঁর চোখ পৃথিবীর উত্থান পতনের দিকে রাখুন না কেন, যতই তিনি রাজনীতি, সমাজকে তাঁর কবিতা মূল উপজীব্য করুন না কেন, নতুন প্রগতিশীল লেখকেরা তাঁকে তাদের দলে ভেড়াতে রাজি নন। তাঁরা মনে করেন তাঁর কবিতায় ভবিষ্যৎ সমাজের আশার কথা নেই, নেই সাম্যবাদী স্বপ্নের কথা। প্রগতিশীল সাহিত্যের অগ্রগামী লেখক সুভাষ মুখোপাধ্যায় এক লেখায় লিখলেন :

‘দুই বিশ্বযুদ্ধের মাঝখানে দুটি দশক জুড়ে দেশের মানুষ কী দেখেছে? পৃথিবীর দুই গোলার্ধে দু পা রেখে বিরাট এক ভূখণ্ডের শৃঙ্খলমুক্ত মানুষ উঠে দাঁড়ায়। তার ট্রাক্টরের চাকায় মাঠের বুকে নেচে নেচে ফসলের সোনালী স্বপ্ন। তার এক হাতে সুখ, অন্য হাতে শান্তি। ঘরে ঘরে দেয় প্রাচুর্য। মূল্যবান বহুবর্ণ সজ্জায় জীবনকে সাজায়। দুনিয়া জোড়া দুঃশাসনের হাতে তুলে দেয় সে মৃত্যুর শমন। আর আকাশে মাথা তুলে বন্ধন জর্জরিত সমস্ত মানুষকে ডেকে বলে, ওঠো, জাগো। জয়ের আশ্বাস নিয়ে দেশে দেশে শৃঙ্খলিত মানুষ জেগে ওঠে। আসমুদ্রহিমাচলে জেগে ওঠে সংগ্রামের আগুন। জাতীয় মুক্তি এক বিশাল অর্থ পায়-জনতা দাবী করে সমৃদ্ধ জীবন…ইতিহাসের এই একই যুগপর্বে কী দেখান “বনলতা সেনের” কবি জীবনানন্দ দাশ?.. “হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি”…জীবনানন্দ তার কবিতায় তারস্বরে জানিয়ে দেন সময়ের গণ্ডি দিয়ে বাঁধা নন তিনি। তার কাছে “হাজার বছর শুধু খেলা করে”। সময়কে হাজার বছরের একেকটা গ্রন্থি দিয়ে যিনি মাপেন, দুই যুদ্ধের মধ্যবর্তী দুটি শীর্ণ দশক মহাসমুদ্রে বুদ্বুদের মতো তার কাছে মিলিয়ে যাবে তাতে আর আশ্চর্য কী?…প্রাচীনকালের গৌড়ীয় খুঁড়িখানায় থাকত এক রকমের চিহ্ন, সেই চিহ্ন দেখে ভেতরে ঢুকতেন পান রসিকেরা। জীবনানন্দের কবিতার দুর্বোধ্য সংকেত অনেকটা সেই চিহ্নের মত। ভেতরে ঢুকলে নেশাগ্রস্ত হওয়া যায়। তখন বেলের খোলায় পৃথিবীকে মনে হয় তালগোল পাকানো এক অসম্বদ্ধ প্রলাপ, প্রেম যেন হারানো অতীতের ছায়াচ্ছন্ন স্মৃতি, আক্রান্ত মানুষের শেষ আশ্রয় প্রকৃতির নির্জন গুহা।…’

বিপ্লবী সাহিত্য রচনার উত্তুঙ্গ উত্তেজনায় সুভাষের কাছে জীবনানন্দের কবিতাকে মনে হলো শুড়িখানার মাতলামি। এর আগে জীবনানন্দ তকমা পেয়েছেন পাগলের, এবার পেলেন মাতালের। এর আগে জীবনানন্দ তিরস্কৃত হয়েছেন রক্ষণশীল সাহিত্যের ধারক সজনীকান্ত প্রমুখের কাছ থেকে, তিরস্কৃত হয়েছেন আধুনিকতাবাদী সুধীন্দ্রনাথ প্রমুখদের কাছ থেকে, এবার তিরস্কৃত হতে শুরু করলেন প্রগতিবাদীদের কাছ থেকে। সে সময় বাংলা সাহিত্যের প্রচলিত প্রধান তিনটা ধারারই শত্রু হয়ে উঠলেন তিনি।

.

০২.

ঢাল দিয়ে চারদিক থেকে ছুটে আসার তির আর কত ঠেকাবেন জীবনানন্দ? তিনি ক্লান্তিবোধ করতে লাগলেন। যত অভিযোগই আসুক তিনি তো গভীরভাবে বিশ্বাস করেন যে কবিতা শুধু আশাবাদের উদযাপন নয়, ফরমায়েশ করে কবিতা লেখা হয় না, আশা-নিরাশার দোলাচলে চলা সত্তার গভীরতম দ্বন্দ্বকে ধারণ করতে চাওয়াই কবিতার আরাধ্য। তিনি আবার তাঁর কবিতার পক্ষে কলম ধরলেন। ফ্যাসিবিরোধী লেখক ও শিল্পী সংঘের এক প্রকাশনায়, কেন লিখি এই শিরোনামে একটা লেখা লিখলেন জীবনানন্দ, আবারও বললেন, কবিতা কি, কি তার কাজ–কি করে কবিতা গ্রহণ করতে হবে–এসব জিজ্ঞাসা সম্পর্কে কবি ও পাঠকের ধারণা ক্রমশ আরো পরিচ্ছন্ন না হলে উভয় পক্ষই অস্বস্তি বোধ করবেন। আমার এবং যাদের আমি জীবনের পরিজন মনে করি তাদের অস্বস্তি বিলোপ করে দিতে না পেরে, জ্ঞানময় করবার প্রয়াস পাই এই কথাটি প্রচার করে যে জীবন নিয়েই কবিতা : যদি ভাবা যায় যে কবিতা মানুষের আধুনিক জীবনকে নিরন্তর ভবিষ্যতের শ্রেয়তর সামাজিক জীবনে পরিণত করে চলেছে তা হলে সে ধারণা ঠিক হবে না। কবিতার ঐতিহ্যের সংস্পর্শে এসে বুঝে নিতে পারা যায় যে কবিতা মানুষের কল্যাণ মানসকে অপরোক্ষভাবে চরিতার্থ করবার সুযোগ না দিয়ে বরং স্বর্গ এবং আঘাটা সবেরই ভয়াবহ স্বাভাবিকতা ও স্বাভাবিক ভীষণতা আমাদের নিকটে পরিস্ফুট করে…কবিতার ওপর বাস্তবিক কোনো ভার নেই। কারু নির্দেশ পালন করবার রীতি নেই কবিমানসের ভিতর কিম্বা তার সৃষ্ট কবিতায়। অথচ সৎ কবিতা খোলাখুলিভাবে নয় কিন্তু নিজের স্বচ্ছন্দ সমগ্রতার উৎকর্ষে শোষিত মানবজীবনের কবিতা, সেই জীবনের বিপ্লবের ও তৎপরবর্তী শ্রেষ্ঠতর সময়ের কবিতা।

কবিতা যদি যথার্থ সৎ হয়, তবে তা এমনিতেই একাধারে বিপ্লব এবং বিপ্লব পরবর্তীকালেরও কবিতা, এমনই মনে করেন জীবনানন্দ। সেই সময়ের পৃথিবীজুড়ে বিপ্লবী সাহিত্যের যে উত্তেজনা তাকে তিনি অস্বীকার করতে চান না কিন্তু জীবনানন্দ চোখ রাখতে চান কালের বিস্তৃত প্রান্তে। তাই যেকোনো সমসাময়িক উত্তেজনার ব্যাপারে তিনি থাকতে চান সতর্ক।

.

০৩.

যে রুশ বিপ্লব প্রগতিশীল লেখকদের মূল অনুপ্রেরণা, জীবনানন্দ সে ব্যাপারেও তার নিবিড় পর্যবেক্ষণের কথা জানান তার যুক্তি, জিজ্ঞাসা ও বাঙালী নামে লেখা এক প্রবন্ধে, …ক্রমে ক্রমে রুশ বিপ্লবের সাড়া (ফরাসি বিপ্লবকে ওয়ার্ডসওয়ার্থ, কোলরিজ থেকে শুরু করে ইউরোপের সাদামাটা গদ্যপ্রাণ লোকও যে আশা বিশ্বাসের চোখে দেখেছিল ঠিক সে রকম নয়, অবশ্য, ঘটনাটা হয়ে যাবার খানিকটা পরে কিছুটা অস্পষ্টভাবে ভারতীয় সমাজের কোনো কোনো স্তরে রুশ বিপ্লবের মর্ম এসে পৌঁছাতে পেরেছিল), সমাজতন্ত্রবাদ (লেনিন ও ট্রটস্কির রাশিয়ার) ও মার্ক্সবাদে তখনকার বাঙালী মনের অনেকখানি অসংগতি কেটে গেল, মনে হয়েছিল রামমোহন ও তার জিজ্ঞাসা যুক্তি কাজ, বিদ্যাসাগর মশায়ের কাজ ও যুক্তি যা দিয়ে গেছে তার পরের বিশেষ ধাপ হিসেবে এই সব বিপ্লবের পূর্ব ও উত্তর সিদ্ধান্ত, নতুন চৈতন্য ও বিশ্লেষণের খুব দরকার ছিল। কিন্তু রুশ বিপ্লবের ফলে বাংলায় (ও ভারতবর্ষে) বলশেভিক, সোভিয়েত প্রভাব সাময়িক ও অনেক স্থলে প্রশস্থ ভাবে দেখা দিলেও সে পথে চলার মতো তেমন কোন যোগ্য চিন্তা বা কাজকর্ম দেখা গেল না…মার্ক্সবাদের সত্য মিথ্যা ভেদ করে জিজ্ঞাসার একান্ত মূল্যের ওপর সে দর্শনে যে জোর দেওয়া হয়েছে তার প্রভাবও শিথিল হয়ে পড়েছে বাঙ্গালীর চিন্তা জীবনে–খুব সম্ভব কয়েকজন পণ্ডিত অপণ্ডিতের তর্কবিতর্কের ভিতরই মার্ক্সবাদ বাংলায় (ও ভারতবর্ষে) আজ খানিকটা সূক্ষ্মভাবে স্থিত, আমাদের দেশে এর সামাজিক ব্যবহারের চেষ্টাচিহ্ন রয়েছে কিন্তু বেশি নয়। জীবন ও সমাজের (বা কোন কিছুরই) কোন শাশ্বতী সুধী বা শাশ্বত মীমাংসা আছে বলে মনে হয় না।

বাংলায় মার্ক্সবাদী আন্দোলনের পরিণতির যে চালচিত্র তিনি দেখেছেন, তা আশ্চর্যজনকভাবে সাম্প্রতিকও। তার কালে যারা সমাজতন্ত্রের আদর্শকেই জীবনের শাশ্বত মীমাংসা ভেবে নিয়ে তপ্ত ছিলেন, তাঁরা আজকের পৃথিবীতে ফিরে এলে জীবনানন্দকে হয়তো ধন্যবাদই দিতেন তাদের আগাম সতর্ক করার জন্য। শাশ্বত মীমাংসার সরল বিশ্বাস তিনি কাটিয়ে উঠেছিলেন অনেক আগেই। প্রগতিশীল সাহিত্যের নামে যে এক ডামাডোল শুরু হয়েছিল তখন, তার একটা মজার গল্প শুনিয়েছেন জীবনানন্দের ছাত্র শামসুদ্দীন আবুল কালাম, আমরা তখন লেখায় হাত মকশো করছি। কবিতা গল্প প্রবন্ধ কত কী। আর মুখে প্রগতি সাহিত্যের বাণীর খই ফুটছে। এই সময় কলেজে একদিন তার সঙ্গে কথা বলছি, এমন সময় এক প্রগতিশীল ছাত্র কবি হঠাৎ কথার মাঝখানেই তাকে প্রশ্ন করলেন, আপনি জনগণের কবিতা লেখেন না কেন? তার সাহস দেখে আমরা স্তম্ভিত হয়ে গেলুম।

জীবনানন্দ বাবু এমন প্রশ্নের জন্য প্রস্তুত ছিলেন না। কয়েকবার তার এবং আমার মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন, তুমি এ প্রগতিশীল সাহিত্য আন্দোলনের ভেতর আছো বুঝি?

সে বলল, হ্যাঁ অবশ্যই। আমরা এই সমাজব্যবস্থাকে বদলাতে চাই, কায়েম করতে চাই শোষণহীন সমাজব্যবস্থা। সেখানে কবি এবং সাহিত্যিকেরাও আমাদের সঙ্গে আসবেন তাদের বুর্জুয়া, পেটি বুর্জুয়া শ্রেণী পরিত্যাগ করে–মার্ক্সবাদ যে নতুন পথ দেখিয়েছে… কথার মাঝখানেই জীবনানন্দ বাবু হঠাৎ প্রশ্ন করলেন, তুমি কার্ল মার্ক্স পড়েছো? ডস ক্যাপিটাল?

ছাত্র কবিটি থতমত খেয়ে বলল, না।

জীবনানন্দ বাবু একটুকাল তার দিয়ে তাকিয়ে থেকে হাসি গোপনের চেষ্টা করেও অকস্মাৎ উচ্চহাস্যে ফেটে পড়লেন। হঠাৎ সে হাসি। এমন আচম্বিতে বেরিয়ে আসা–যে অবাক হয়ে দেখতে হয় তাকে। সঙ্গে হাসা যায় না।

ছাত্রটি ভ্যাবাচেকা খেয়ে পালিয়ে বাঁচল।..

.

যেকোনো ব্যাপারেই অতি বিশ্বাস আর অতি অবিশ্বাস দুটাই পরিহার করতে চেয়েছেন জীবনানন্দ। ফলে বিশ্বাসী এবং অবিশ্বাসী উভয় পক্ষেরই আক্রমণের শিকার হয়েছেন তিনি।

.

মহীনের ঘোড়াগুলি ঘাস খায়

০১.

ব্যক্তিজীবনে যুদ্ধ করতে করতে, প্রতিকূল সময়ের সমুদ্র পাড়ি দিতে দিতে জীবনানন্দ যখন খানিকটা কূলে উঠেছেন, তখন দেখলেন বাইরের পৃথিবী ক্রমশ তছনছ হয়ে যাচ্ছে। তার এক জীবনে দুই-দুইটা বিশ্বযুদ্ধের পরিস্থিতির ভেতর পড়েছেন তিনি। সমকাল, মহাকাল তাকে সব সময় ভাবিয়েছে। একদিকে নিজের জীবনের চড়াই-উতরাই, অন্যদিকে পৃথিবী, দেশের চড়াই-উতরাইয়ের ভেতর দিয়ে যেতে যেতে জীবনানন্দ আরও মনোযোগ দিলেন সময় ধারণাটার ওপর। তিনি সময় নিয়ে দার্শনিক প্রশ্নগুলো দিয়ে তাড়িত হলেন। জীবনানন্দ হাজার বছর ধরে পথ হাঁটার কথা আগেই বলেছেন। সেই পথ হাঁটাকে, সেই সমকাল মহাকালকে এক বিন্দুতে দেখতে পারার ব্যাপারটাকে এক অদ্ভুত কবিতায় তখন তুলে আনলেন জীবনানন্দ। কবিতার নাম ঘোড়া। ছাপা হলো চতুরঙ্গ পত্রিকায় ১৯৪০-এ :

আমরা যাইনি মরে আজো-তবু কেবলি দৃশ্যের জন্ম হয়
 মহীনের ঘোড়াগুলি ঘাস খায় কার্তিকের জ্যোৎস্নার প্রান্তরে;
 প্রস্তরযুগের সব ঘোড়া যেন–এখনো ঘাসের লোভে চরে
পৃথিবীর কিমাকার ডায়নামোর পরে।

আস্তাবলের ঘ্রাণ ভেসে আসে এক ভিড় রাত্রির হাওয়ায়;
বিষণ্ণ খড়ের শব্দ ঝরে পড়ে ইস্পাতের কলে;
চায়ের পেয়ালা কটা বেড়ালছানার মতো–ঘুমে—ঘেয়ো
কুকুরের অস্পষ্ট কবলে

হিম হয়ে নড়ে গেল ও-পাশে পাইস-রেস্তরাতে
প্যারাফিন-লণ্ঠন নিভে গেল গোল আস্তাবলে
সময়ের প্রশান্তির ফুঁয়ে;
এইসব ঘোড়াদের নিওলিথ-স্তব্ধতার জ্যোৎস্নাকে ছুঁয়ে।

সজনীকান্তের কলম আবার সরব হয়ে উঠল। সজনীকান্ত লিখলেন, পার্টকে হোল-এর মর্যাদা দেওয়া অথবা অস্ফুট প্রাণকে গোটা প্রাণীর সম্মান দেওয়ার রেওয়াজ আজকাল বড় বেশি দেখা যাইতেছে… চতুরঙ্গে কবি জীবনানন্দ দাশ (জীবানন্দ নহে) ঘোড়া কবিতায় এই কৌশল অবলম্বন করিয়াছেন। ঘোড়ার ডিমে তা দিলে ঘোড়া হইতে পারে, ইহা মানিয়া লইয়াই আমরা বলিব, ঘোড়ার ডিমকে ঘোড়া বলা তাহার অন্যায় হইয়াছে। …

জীবনানন্দের বিরূপ সমালোচনাকারীদের প্রতিনিধি হয়ে সজনীকান্ত তো লাগাতার তার কলম সক্রিয়ই রেখেছেন। তাঁর পক্ষে এযাবৎ কলম ধরেছেন শুধু বুদ্ধদেব বসু। কিন্তু দেখা গেল এবার মাঠে তার পক্ষে নেমেছেন আরেক লেখক সঞ্জয় ভট্টাচার্য। নিরুক্ত নামে একটা পত্রিকা সম্পাদনা করেন তিনি তখন। সঞ্জয় জীবনানন্দের এই কবিতাটার ভূয়সী প্রশংসা করলেন, লিখলেন, জীবনানন্দের ঘোড়া কবিতাটা বাংলায় সুররিয়ালিস্ট কবিতার প্রথম সফল উদাহরণ।

.

০২.

এই কবিতা যখন লিখছেন জীবনানন্দ, তার বেশ আগেই ইউরোপে শুরু হয়েছে সুররিয়ালিস্ট আন্দোলন। ফরাসি লেখক আঁদ্রে ব্রেতো ঘোষণা করেছেন সুররিয়ালিজমের মেনিফেস্টো। তারা দাবি করছেন, জীবনে বাস্তব যেমন সত্য, স্বপ্নও তেমন সত্য। শিল্প-সাহিত্যে তাই বাস্তব আর স্বপ্নকে একাকার করে দিতে হবে। অতিমাত্রায় বাস্তববাদিতা, যুক্তিবাদিতার বিরোধিতা করেন তাঁরা। তাঁদের কবিতায়, চিত্রকলায় দেখা দেয় অদ্ভুত ইমেজ, অযৌক্তিক উপমা। স্থিতিস্থাপক সময়কে ধরতে সুররিয়ালিস্ট চিত্রকর সালভাদর ডালি আঁকলেন গাছ থেকে গলে গলে পড়া ঘড়ি। জীবনানন্দ সরাসরি কোনো দেশীয় বা ইউরোপীয় আন্দোলনে শরিক হননি। তবে বিশ্বসাহিত্যের নানা ধারা তাঁকে প্রভাবিত করেছে বরাবরই। এই কবিতাতেও আছে সুররিয়ালিজমের উপাদান। আছে বাস্তব আর স্বপ্নকে মিলিয়ে দেখা আর সময়কে এক মহাকালের ব্যাপ্তিতে স্থাপন করার চেষ্টা।

অন্যান্য অনেক কবিতার মতোই জীবনানন্দের এই কবিতাটা আপাতভাবে সহজ চেনা শব্দ, বাক্য দিয়ে লেখা অথচ তারপরও কেমন যেন অধরা রয়ে যায়। কবিতা থেকে একটা সাধারণ ব্যাপার বোঝা যায় যে জ্যোৎস্না রাতে জনৈক মহীনের কতগুলো ঘোড়া ঘাস খাচ্ছে প্রান্তরে। এই দৃশ্যটির ভেতর কেমন একটি মাদকতা আছে। এই দৃশ্যের নেশায় পড়েই বুঝি কলকাতার কিছু ছেলে জীবনানন্দ মারা যাবারও বহু বছর পর সত্তর দশকে এসে মহীনের ঘোড়াগুলো নামে তৈরি করে ফেলে এক গানের ব্যান্ড। বাংলা গানে নিয়ে আসে এক নতুন মাত্রা।

.

জীবনানন্দ তাঁর এক পাঠককে লেখা চিঠিতে একবার লিখেছিলেন, …মহাবিশ্বের ইশারা থেকে উৎসারিত সময় চেতনা, কনসাসনেস অব টাইম অ্যাজ এ ইউনিভার্সাল তা আমার কাছে একটি সঙ্গতি সাধক অপরিহার্য সত্যের মত। কবিতা লিখবার পথে কিছুদূর অগ্রসর হয়েই এ জিনিসটা আমি গ্রহণ না করে পারিনি। এর থেকে বিচ্যুতির কোনো মানে নেই আমার কাছে।…

.

আইনস্টাইনের সময়ের আপেক্ষিকতার তত্ত্ব বিষয়েও জীবনানন্দ ভালোভাবে ওয়াকিবহাল ছিলেন। আমাদের প্রত্যেকের ব্যক্তিগত জীবন একটা সীমিত কালে, সেটা ব্যক্তিকাল, কিন্তু আমরা সবাই আবার মানবজাতির অংশ। ব্যক্তিমানুষের মৃত্যু হলেও মানবপ্রজাতির মৃত্যু হয় না, প্রত্যেক মানুষ তাই একটা মানবকালেরও অংশ। আবার মানবজাতিও অনন্তকাল এই পৃথিবীতে নেই। মানবের জন্ম হবার আগেও ছিল মহাবিশ্ব, ফলে সব মানুষ আবার সেই মহাকালেরও অংশ। মানুষ মাত্রই তাই বিচরণ করে ব্যক্তিকাল, মানবকাল আর মহাকালের ভেতর। সময়ের এসব পর্বকে বোঝাতে জীবনানন্দ জন্ম দিয়েছেন সময়গ্রন্থি বলে একটা শব্দের। ঘোড়া কবিতার মূল ভাবনা এই সময় নিয়েই।

.

০৩.

এ কবিতায় আমরা দেখছি কতগুলো ঘোড়া কার্তিক মাসের জ্যোৎস্নায় ঘাস খাচ্ছে, পাশ থেকে আস্তাবলের গন্ধ আসছে, সেখানে কলে ঘোড়ার জন্য খড় কাটা হচ্ছে, কবি একটি পাইস রেস্তোরাঁতে বসে এসব দেখছেন। রেস্তোরাঁর টেবিলে কতগুলো চায়ের কাপ দেখা যাচ্ছে, কাপগুলো সাদাই হবে। তখন চিনামাটির সাদা কাপই পাওয়া যেত। কাপগুলো সম্ভবত উল্টানো। ওই উল্টানো সাদা কাপগুলোকে গুটিসুটি মেরে ঘুমিয়ে থাকা সাদা বিড়ালের বাচ্চা বলে মনে হচ্ছে কবির। রেস্তোরাঁয় পাশে একটি ঘেয়ো কুকুর বসে আছে। বাইরে বেশ হাওয়া বইছে, এক ভীড় রাত্রির হাওয়া। সেই হাওয়ায় সেই সব ঘোড়াগুলোকে ছুঁয়ে একসময় নিভিয়ে দিল আস্তাবলের প্যারাফিন লণ্ঠন।

এই হচ্ছে ঘটনা। কিন্তু এখানে কিছু শব্দ যোগ করে এবং কিছু অভূতপূর্ব বাক্য তৈরি করে জীবনানন্দ জন্ম দিয়েছেন রহস্যের, কবিতাকে নিয়ে গেছেন অন্য এক স্তরে। যে ঘোড়াগুলো জ্যোৎস্নায় ঘাস খাচ্ছে তারা মহীন বলে জনৈক লোকের হলেও জীবনানন্দের মনে হচ্ছে ঘোড়াগুলো যেন প্রস্তরযুগের। সেই প্রস্তরযুগের ঘোড়াগুলো যেমন ঘাসের লোভে পৃথিবীতে চড়ে বেড়াত, সেই ঘোড়াগুলোই যেন এখন চড়ছে। সেই ব্যক্তি ঘোড়াগুলো নয় হয়তো কিন্তু এই ঘোড়াগুলোর ভেতর সেই একই ঘোড়াত্ব। যদিও এখনকার পৃথিবী প্রস্তরযুগের মতো নয়, অন্য রকম, এখানে ডাইনামো আছে, প্যারাফিন লাইট আছে, ইস্পাতের কল আছে। কিন্তু কবি যেন সেই প্রস্তরযুগের বা নিওলিথ যুগের ঘোড়াগুলোকেই দেখছেন আজকের পাইস হোটেলে বসে, যেখানে আস্তাবলের গন্ধ আছে, একটি ঘেয়ো কুকুর আছে, আছে কিছু চায়ের কাপ। তারপর যে বাতাস ঘোড়াদের ছুঁয়ে শেষে নিভিয়ে দিল প্যারাফিন লণ্ঠন। সে একই বাতাস তো বইত প্রস্তরযুগেও, এ তো সেই প্রাচীন সময়েরই প্রশান্তির ফু। কবি তো সেই প্রস্তরযুগের মানুষ নন, প্রস্তরযুগের ঘোড়া যারা দেখেছেন, সেই বাতাস যার গায়ে মেখেছেন তারা তো মারা গেছেন। অথচ কবি আধুনিক যুগে বসে দেখছেন। নিওলিথ যুগের দৃশ্য। এই হচ্ছে ধাঁধা। এই ধাঁধা দিয়েই জীবনানন্দ কবিতাটি শুরু করেছেন আমরা যাইনি মরে আজো–তবু কেবলই দৃশ্যের জন্ম হয়।

এ যেন সেই কনসাসনেস অব টাইম অ্যাজ এ ইউনিভার্সাল। বর্তমানের ভেতর অতীতকে দেখা। অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ একাকার হয়ে যাওয়া। প্রস্তরযুগ আর ডায়নামোর যুগকে একাকার করে ফেলা। নিজেকে একটি অনন্তকালের ভেতর দেখা। এই হচ্ছে সময়গ্রন্থি। এ দৃশ্য কবি একা দেখলেও জীবনানন্দ লিখলেন, আমরা। তিনি সবাইকেই এই সময়গ্রন্থির দর্শকের দলে যুক্ত করছেন। স্মরণ করিয়ে দিতে চাইছেন যে আমরা সবাই আসলে যে দৃশ্য দেখছি, তা বস্তুত দীর্ঘ সময়ের ধারাবাহিকতারই অংশ। আমরা মরিনি, তবু যে দৃশ্য আমরা দেখি, তা ওই ইউনিভার্সাল টাইমেরই অংশ।

.

০৪.

এ সময় আরও যে কবিতাগুলো জীবনানন্দ লিখতে শুরু করলেন তা সহজ শব্দ, বাক্যে রচিত হলেও হাজির করে সব জটিল দার্শনিক ধাঁধা। এ সময়ের একটা কবিতা :

বিকেলের থেকে আলো ক্রমেই নিস্তেজ হয়ে নিভে যায়—তবু
ঢের স্মরণীয় কাজ শেষ হয়ে গেছে :
 হরিণ খেয়েছে তার আমিষাশী শিকারীর হৃদয়কে ছিঁড়ে;
সম্রাটের ইশারায় কঙ্কালের পাশাগুলো একবার সৈনিক হয়েছে;
সচ্ছল কঙ্কাল হয়ে গেছে তারপর;
 বিলোচন গিয়েছিলো বিবাহ-ব্যাপারে;
প্রেমিকেরা সারাদিন কাটায়েছে গণিকার বারে;
সভাকবি দিয়ে গেছে বাকবিভূতিকে গালাগাল।
সমস্ত আচ্ছন্ন সুর একটি ওঙ্কার তুলে বিস্মৃতির দিকে উড়ে যায়।
এ বিকেল মানুষ না মাছিদের গুঞ্জরনময়!
 যুগে যুগে মানুষের অধ্যবসায়
 অপরের সুযোগের মতো মনে হয় 1…

এই নতুন ধারার কবিতাগুলো লিখে জীবনানন্দ এবার পড়লেন নতুন বিপদে। সজনীকান্তের মতো প্রবীণ সমালোচকদের সঙ্গে এবার তার সমালোচনায় যুক্ত হলেন নতুন অনেক আলোচকও। এ সময় আধুনিক বাংলা কবিতা আলোচনা করতে গিয়ে দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় লিখলেন, জীবনানন্দ দাশের সাম্প্রতিক কবিতায় শব্দবিহ্বলতা ও ভাষা বিহ্বলতা উভয়ই চরমে গিয়া পৌঁছেছে। তার ভাবাবেগ কিন্তু একান্তই গূঢ় ও ব্যক্তিগত, এদিকে শব্দচেতনা অনেক সময় প্রায় অস্বস্তিকর…

সত্যেন্দ্রনাথ রায় নামের আরেক আলোচক লিখলেন, জীবনানন্দ দাশ এমন এক একটা জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছেন যাকে বলা যেতে পারে অতিব্যক্তিবাদের অপঘাত মৃত্যুর জাজ্বল্যমান দৃষ্টান্ত…

কিন্তু মাঠে এখন শুধু বুদ্ধদেব নন, তাঁর পক্ষে আছেন সঞ্জয় ভট্টাচার্য। তিনি তার নিরুক্ত পত্রিকায় লিখলেন, যে ভাব প্রকাশ প্রচলিত ভাষায় কুলিয়ে উঠে না তার জন্য ভাষা হাতড়ে দুর্বোধ্য হবার মানে আছে–জীবনানন্দ দাশের পরীক্ষার স্থান তাই বাংলা কবিতাকে করে দিতে বাধ্য…

.

পৃথিবীর ভাঙাগড়া শেষ করে

০১.

যে রবীন্দ্র ঐতিহ্য থেকে মুক্তির প্রচেষ্টা সব নবীন কবির, সেই রবীন্দ্রনাথ মারা গেলেন এই সময়, ১৯৪১ সালে। বাংলা সাহিত্যকে পুষ্টি দিয়ে বিশ্বদরবারে পৌঁছে দিয়েছেন তিনি। ছিলেন আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্ব। সমান্তরালে জীবনানন্দের জীবন নেহাতই নিষ্প্রভ। তাঁর আন্তর্জাতিক পরিচিতি শূন্যের কোঠায়। অথচ নিভৃতে কবিতার যে সুড়ঙ্গ জীবনানন্দ কেটেছেন, সেটাই হয়েছে বাংলা কবিতার পরবর্তী গন্তব্য। পরবর্তী প্রজন্মের কবির কাছে রবীন্দ্রনাথ নন, জীবনানন্দ হয়েছেন নতুন দিশারি। রবীন্দ্রনাথ ও জীবনানন্দের পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়াটা অবশ্য খানিকটা জটিল। রবীন্দ্রনাথ জীবনানন্দের কবিতা সম্পর্কে কখনো বিরূপ মন্তব্য করেছেন, কখনো করেছেন এক লাইনের কিছু প্রশস্তি, কিন্তু জীবনানন্দের কবিতায় যে বাংলা কবিতার বাঁকবদলের ইঙ্গিত আছে, সে আভাস তিনি পাননি। টের পাননি তাঁর মৃত্যুর পর বাংলা কবিতার শূন্যস্থান পূরণ করবেন এই জীবনানন্দই। রবীন্দ্রনাথ তাকে যেভাবেই দেখুন, জীবনানন্দ রবীন্দ্রনাথকে অবশ্য বরাবর মর্যাদার সঙ্গেই দেখেছেন। নিজের বাসর রাতে রবীন্দ্রনাথের গানই শুনতে চেয়েছেন তিনি। তাকে নিয়ে কবিতা লিখেছেন গোটা পাঁচেক, নিবন্ধ লিখেছেন। তাঁর মৃত্যুর পর লিখেছেন রবীন্দ্রনাথ শিরোনামে কবিতা :

..যখন তুমি আমাদের দেশে সৃষ্টি শেষ করে ফেলে
 প্রকৃতির আগুনের উৎস থেকে উঠে একদিন
 নিঃস্বার্থ আগুনে ফিরে গেলে,
পতঞ্জলি, প্লেটো, মনু, ওরিজেন, হোমরের মতো
দাঁড়ায়ে রয়েছো তুমি একটি পৃথিবীর ভাঙা-গড়া শেষ করে দিয়ে, কবি,

.

০২.

পরের বছরে জীবনানন্দের সংসারে এক বিপর্যয় নেমে এল। হঠাৎ মারা গেলেন জীবনানন্দের বাবা সত্যানন্দ দাশ। ১৯৪২-এর নভেম্বর মাসে। জীবনানন্দ ছাড়া তার মা কুসুমকুমারীর দিনলিপিও উদ্ধার করে পাঠকের সামনে তুলে ধরেছেন ভূমেন্দ্র গুহ। জীবনানন্দের বাবার মৃত্যুক্ষণটাকে পাওয়া যায় তার মা কুসুমকুমারীর দিনলিপিতে। কুসুমকুমারী ডায়েরিতে কবিতা লিখেছেন সেই মৃত্যু নিয়ে। নিজের মনের সঙ্গে তিনি কবিতার ভাষাতেই কথা বলেন। কুসুমকুমারী লিখছেন, ৯:৩০টায় প্রদীপ নিভিল। ভগবান ভগবান ভগবান–এ কি করিলে? সজ্ঞানে কথা বলিতে বলিতে চলিয়া গেলেন। ভাল মন্দের মধ্যে মন্দটুকু বুঝিলাম না। এই কি চির বিদায়?

আমার চিত্তটুকু ভরেছিল যে অমৃত রসে
 তারে তুমি রিক্ত করে দিয়ে গেলে চক্ষের নিমিষে।
 চলে গেলে, কোন কথা নাহি গেলে বলে
 এত প্রীতি, এত স্মৃতি, সবই কি ভুলিলে?
ভাবি মনে, কি কারণে কি যে ঘটে যায়
 চোখের পলক ফেলি করি হায় হায়!!
… … …
নভেম্বর নভেম্বর!
 রেখেছ আমার লাগি একি ঘন ঘোর–?

বাবার মৃত্যু জীবনানন্দকে এক নতুন বাস্তবতায় দাঁড় করিয়ে দিল। জীবনানন্দের বাবা ছিলেন করিতকর্মা মানুষ। স্বল্প আয়ের সংসারকে মূলত তিনিই সামলেছেন। বাস্তব জীবনের নানা বিষয়ে জীবনানন্দ নির্ভর করেছেন তারই ওপর। জীবনানন্দের চাকরি, কাজের নানা ব্যবস্থায় তিনি সহায়তা দিয়েছেন। সংসারের বড় ছেলে জীবনানন্দ। বাবার মৃত্যুতে সংসারের নানা দায়িত্ব এসে পড়ে তাঁর ওপর। কিন্তু সংসারে তো নেহাতই আনাড়ি জীবনানন্দ। নিজের ভারই বইতে পারেন না, এত বড় সংসারের ভার বইবেন কী করে?

.

০৩.

তাঁর বাবার মৃত্যুর ঠিক পরের বছরই বরিশালসহ সারা বাংলায় ঘটল স্মরণাতীতকালের ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ। পৃথিবীজুড়ে তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের তীব্রতা বেড়ে চলেছে। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট আর ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী চার্চিল বৈঠক শুরু করেছেন হিটলারের বিরুদ্ধে মিত্রবাহিনী কী ধরনের যুদ্ধকৌশল নেবে তাই নিয়ে। ব্রিটেন বাড়িয়ে দিয়েছে তাদের যুদ্ধবাজেট। এ সময় ভারতের উৎপন্ন খাবার, শস্য ইংরেজরা মজুত করতে থাকে সৈন্যদের জন্য। তার মারাত্মক প্রভাব পড়ে ভারতে, বিশেষ করে বাংলায়। সেই সূত্র ধরেই ঘটে এই দুর্ভিক্ষ, সেই পঞ্চাশের মন্বন্তর। দুর্ভিক্ষের কবলে পড়ে পথে ঘাটে মারা যায় লাখ লাখ মানুষ। সরাসরি না হলেও দুর্ভিক্ষ ছুঁয়ে যায় তাঁদের পরিবারকেও। কুসুমকুমারীর দিনলিপির ১৯৪৩-এর জুন মাসে একটা পাতায় লেখা, যে দিন কাল ঘনাইয়া আসিতেছে–দারিদ্রর ক্রন্দন ও মরণ, মধ্যবিত্তের হাহাকার। কি হবে পরিণাম। খাওয়া আরো কমাইতে হইবে। যেটুকুতে জীবনধারণ হয় তাহাই যথেষ্ট। কাহারও সাহায্য করিতে পারি না, বিধাতা, সহায় হও।

চিত্রকর জয়নুল আবেদিন সেই দুর্ভিক্ষ নিয়ে তখন আঁকছেন কিংবদন্তিতুল্য ছবি। এই দুর্ভিক্ষ যে প্রাকৃতিক নয়, মানুষের তৈরি, সে কারসাজি নিয়ে বহুকাল পর গবেষণায় দেখালেন অমর্ত্য সেন, নোবেল পেলেন তিনি।

জীবনানন্দের কবিতাতে ধরা পড়ল সেই সমকাল, লিখলেন :

…নগরীর রাজপথে মোড়ে মোড়ে চিহ্ন পড়ে আছে;
একটি মৃতের দেহ অপরের শবকে জড়ায়ে
তবু আতঙ্কে হিম–হয়তো দ্বিতীয় কোন মরণের কাছে…

লিখলেন;

…স্বতই বিমর্ষ হয়ে ভদ্ৰসাধারণ
চেয়ে দ্যাখে তবু সেই বিষাদের চেয়ে
আরো বেশি কালো কালো ছায়া
লঙ্গরখানার অন্ন খেয়ে
মধ্যবিত্ত মানুষের বেদনার নিরাশার হিসেব ডিঙিয়ে
নর্দমার থেকে শূন্য ওভারব্রিজে উঠে
 নর্দমায় নেমে
ফুটপাত থেকে দূর নিরুত্তর ফুটপাতে গিয়ে
 নক্ষত্রের জ্যোৎস্নায় ঘুমাতে বা মরে যেতে জানে।

তাঁর মনের অভ্যন্তরীণ দোলাচল ক্রমশ ভীষণভাবে যুক্ত হচ্ছে বাইরের পৃথিবীর ঘাত-প্রতিঘাতের সঙ্গে। তাঁর জীবনজিজ্ঞাসাকে তা বদলে দেবে অচিরেই।

.

০৪.

এই মন্বন্তর, মৃত্যু, বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপটেই প্রকাশিত হয় জীবনানন্দের তৃতীয় কবিতার বই বনলতা সেন। কবিতা দিয়েই জীবনের, সময়ের শ্বাপদসংকুল পথ কেটে কেটে তাকে এগিয়ে যেতে হবে সে কথা জীবনানন্দ মনের নিভৃতে জেনে নিয়েছেন অনেক আগেই। এই প্রকাশেও মূল উদ্যোগ বুদ্ধদেব বসুর। বুদ্ধদেব তখন কলকাতায়, জীবনানন্দ বরিশালে। তাদের দেখাসাক্ষাৎ বিশেষ হয় না, চিঠিপত্রেই চলে তাদের যোগাযোগ। অব্যাহত থাকে অদেখা এক বন্ধুত্ব। বুদ্ধদেব তাঁর কবিতাভবন থেকে এক পয়সায় একটি নামে ১৬ পাতার কবিতার একটা সিরিজ বের করতেন। সেই সিরিজের বই হিসেবেই প্রকাশিত হলো জীবনানন্দের এই বই, তাঁর বহুল আলোচিত সেই কবিতাকে শিরোনাম করে। বরাবরের মতো জীবনানন্দের মাথায় আবার ছাতা ধরলেন বুদ্ধদেব, লিখলেন, আমাদের আধুনিক কবিদের মধ্যে জীবনানন্দ দাশ সবচেয়ে নির্জন, সবচেয়ে স্বতন্ত্র। বাংলা কাব্যের প্রধান ঐতিহ্য থেকে তিনি বিচ্ছিন্ন এবং গেল দশ বছরে যে সব আন্দোলনের ভাঙ্গাগড়া আমাদের কাব্যজগতে চলেছে তাতেও কোন অংশগ্রহণ করেননি…আমাদের সকলের মধ্যেই সেই যে একজন চিরকালের কবিকে মাঝে মাঝে দেখতে পাই যার দেশ নেই, কাল নেই, জাতি নেই, গোত্র নেই, মানুষের সমস্ত সুখ দুঃখ সভ্যতার সমস্ত উত্থান পতন পার হয়ে যার সুর আজকের মতো কোনো এক বসন্ত প্রভাতে হঠাৎ আমাদের মনে এসে ঘা দেয়, আর মুহূর্তে উচ্চনিনাদি প্রকাণ্ড বর্তমান সমগ্র অতীত ভবিষ্যতের মধ্যে বিলীন হয়ে যায়–সেই নামহারা ক্ষণস্থায়ীকে কিছু সময়ের জন্য যেন কাছে পেলুম বনলতা সেন বইটিতে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *