যে-মানুষ হ্যাডলিবুর্গ-এর চরিত্র হনন করেছিল

যে-মানুষ হ্যাডলিবুর্গ-এর চরিত্র হনন করেছিল
The Man That Corrupted Hadelyburg

০১.

অনেক বছর আগেকার কথা। আশেপাশের সমগ্র অঞ্চলের মধ্যে হ্যাডলিবুর্গই ছিল সৎ ও ন্যায়পরায়ণ শহর। তিন যুগ ধরে শহরটার এই খ্যাতি অক্ষুণ্ণই আছে; অন্য যে কোন সম্পদ অপেক্ষা এই খ্যাতির জন্যই শহরটা অধিক গর্ববোধ করে থাকে। সে গর্ব এতই বেশী এবং তাকে অক্ষুণ্ণ রাখতে শহরটা এতই ব্যগ্র যে শিশু কাল থেকেই ছেলেমেয়েদের সদ্ব্যবহারের নীতি শিক্ষা দেওয়া শুরু হয়, এবং সমগ্র শিক্ষাক্রমের মধ্যে এই নীতি শিক্ষাকেই সংস্কৃতির প্রধান বস্তু বলে ধরে নেওয়া হয়। তাছাড়া, চরিত্র গড়ে ওঠার কালেও যুবকদের সামনে থেকে সব রকম প্রলোভনকে দূরে সরিয়ে রাখা হয় যাতে তাদের সততা দৃঢ় ও কঠিন হয়ে উঠবার সুযোগ পায় এবং তাদের অস্থির সঙ্গে মিশে যায়। আশপাশের শহরগুলো তার এই সসম্মান প্রাধান্যের জন্য তাকে ঈর্ষা করত; ঠোঁট বেঁকিয়ে হাড় লিবুর্গের এই গর্বকে বলত দেমাক; কিন্তু তা সত্ত্বেও হ্যাডলিবুর্গ শহর যে সত্যি রকম দোষের অতীত এ কথা স্বীকার করতে তারাও বাধ্য হত; একটু চাপ দিলেই তারা এ কথাও স্বীকার করত যে হ্যাঁড় লিবুর্গের কোন যুবক যখন নিজের শহর ছেড়ে বাইরে কোথাও দায়িত্বপূর্ণ চাকরির সন্ধনে যায় তখন সে যে হ্যাঁলিবুর্গ থেকে এসেছে সেটাই যথেষ্ট সুপারিশ বলে গণ্য হয়ে থাকে।

কিন্তু শেষ পর্যন্ত কাল-প্রবাহে একদা একটি অপরিচিত যাত্রীর মনে আঘাত দেবার দুর্ভাগ্য হ্যাঁড় লিবুর্গের কপালে দেখা দিল; এবশ্য কাজটা সে না জেনেই করেছিল; তাছাড়া সেটা নিয়ে সে মাথাও ঘামায় নি। কারণ হ্যাডলিবুর্গ এতই স্বয়ংসম্পূর্ণ যে অপরিচিত লোকজন বা তাদের মতামতে তার কিছুই যায়-আসে না। তথাপি এই লোকটির বেলায় ব্যতিক্রম হিসাবে একটু সতর্ক থাকলেই ভাল হত, কারণ লোকটি ছিল তিক্ত প্রকৃতির ও প্রতিহিংসাপরায়ণ। সারা বছর ধরে অনেক জায়গায় সে ঘুরল, কিন্তু সেই আঘাতের কথাটা তার মন থেকে গেল না; অবসর পেলেই সে ভাবে, কি উপায়ে সেই আঘাতের একটা যোগ্য জবাব দেওয়া যায়। অনেক মতলবই তার মাথায় এল, মতলবগুলো বেশ ভালও বটে, কিন্তু কোনটাই খুব লাগসই মনে হল না। যে মতলবটা সব চাইতে দুর্বল তার ফলেই হয় তো অনেক লোক আঘাত পেত, কিন্তু সে চায় এমন একটা মতলব যা গোটা শহরকেই আঘাত করবে, একটি লোককেও অক্ষত থাকতে দেবে না। শেয় পর্যন্ত একটা মনের মত মতলব তার মাথায় এল, আর সঙ্গে সঙ্গে একটা পৈশাচিক আনন্দে তার মস্তিস্কটা উদ্ভাসিত হয়ে উঠল। অবিলম্বে সে পুরো মতলবটা ভাঁজতে বসে গেল; মনে মনে বলল, এই কাজই করতে হবে-গোটা শহরকে আমি নষ্ট করে দেব।

ছ মাস পরে সে হাড় লিবুর্গে এসে হাজির হল। রাত দশটা নাগাদ একটা বগি গাড়িতে চেপে সে ব্যাংকের বুড়ো ক্যাশিয়ারের বাড়ি গিয়ে উঠল। একটা বস্তা নিয়ে বগি থেকে নামল, বস্তাটা ঘাড়ে নিয়ে টলতে টলতে উঠোনটা পেরিয়ে দরজার কড়া নাড়ল। একটি মহিলার গলা শোনা গেল, ভিতরে আসুন, সে ভিতরে ঢুকে বস্তাটাকে স্টোভের পাশে নামিয়ে রাখল। বৃদ্ধ মহিলাটি বাতির নীচে বসে মিশনারী হেরাল্ড  পড়ছিল। লোকটি বিনীতভাবে বলল:

আপনি যেমন আছেন তেমনই বসে থাকুন ম্যাডাম, আমি আপনাকে বিরক্ত করব না। এই তো-এটা বেশ ভালভাবেই লুকিয়ে রাখা হয়েছে; এটা যে এখানে আছে সেটা কেই বুঝতে পারবে না। এক মিনিটের জন্য আপনার স্বামীর সঙ্গে একবার দেখা করতে পারি কি ম্যাডাম?

না, সে ব্রিকস্টন গেছে; হয়তো কোন অসুবিধা হবে না। আমি শুধু চেয়েছিলাম এই বস্তাটা তার হেপাজতে রেখে যেতে, যাতে প্রকৃত মালিককে খুঁজে পাওয়া গেলেই ওটা তার হাতে তুলে দেওয়া যায়। আমি এখানে নবাগত; তিনি আমাকে চেনেন না; আমার মনের অনেক দিনের একটা সাধ মিটানোর জন্যই আজ রাতে এই শহর হতে আমি চলে যাচ্ছি। আমার সে সাধ মিটে ছে; খুসি মনে কিছুটা গর্বের সঙ্গেই আমি চলে যাচ্ছি; আপনি আমাকে আর কোনদিন দেখতে পাবেন না। বস্তুটার গায়ে একটা কাগজ লাগানো আছে: তাতেই সব কথা লেখা আছে। শুভ রাত্রি ম্যাডাম।

রহস্যময় আগন্তুককে দেখে বৃদ্ধা ভয় পেয়েছিল; সে চলে যাওয়াতে খুসি হল। কিন্তু কৌতূহলী হয়ে সে বস্তাটার কাছে গিয়ে কাগজটা তুলে নিল। তাতে লেখা আছে:

সংবাদপত্রে প্রকাশ করতে হবে; অথবা গোপনে অনুসন্ধান করে আসল লোককে খুঁজে বের করতে হবে-যে কোন একটা ব্যবস্থা করলেই চলবে। এই বস্তায় একশ ষাট পাউন্ড চার আউন্স ওজনের স্বর্ণমুদ্রা আছে-

কী সাংঘাতিক, আর আমাদের দরজায় তালা লাগানো হয় নি!

মিসেস রিচার্ডস্ কাঁপতে কাঁপতে ছুটে গিয়ে দরজায় তালা লাগিয়ে দিল, জানালার পর্দাগুলো নামিয়ে দিল এবং ভীত, বিচলিত ও বিস্মিত হয়ে দাঁড়িয়ে ভাবতে লাগল, নিজেকে ও এই সম্পদকে আরও নিরাপদ রাখতে আর কি কার উচিত। চোর-টোর আছে কিনা। বুঝবার জন্য কান পাতল, তারপর কৌতূহলের বশবর্তী হয়ে আবার বাতির কাছে গিয়ে কাগজটা পড়ে শেষ করল:

আমি বিদেশী; নিজের দেশেই ফিরে যাচ্ছি। সেখানেই স্থায়ীভাবে বসবাস করব। আমেরিকার পতাকাতলে দীর্ঘদিন বাস করবার সময় তার কাছ থেকে যা পেয়েছি সেজন্য আমি কৃতজ্ঞ; দু-এক বছর আগে তার জনৈক নাগরিক-হাড় লিবুর্গের জনৈক অধিবাসী আমার প্রতি যে পরম সদয় ব্যবহার করেছেন সেজন্য তার প্রতি আমি বিশেষভাবে কৃতজ্ঞ। তার দয়ায় দুটো ঘটনা আমি উল্লেখ করব। আমি ছিলাম একজন জুয়াড়ী। আবার বলছি-ছিলাম। জুয়া খেলে তখন আমি সর্বস্ত। এই গ্রামে এসেছিলাম রাতের বেলা-ক্ষুধার্ত, কপর্দকহীন। সাহায্যের জন্য হাত পাতলাম-রাতের অন্ধকারে; দিনের আলোয় ভিক্ষা চাইতে লজ্জা করেছিল। ঠিক লোকের কাছেই হাত পেতেছিলাম। তিনি আমাকে দিয়েছিলেন কুড়ি ডলার-আমার জীবন বাঁচিয়েছিলেন বলতে পারি। তিনি আমাকে সম্পদও দিয়েছেন, কারণ সেই টাকায় জুয়া খেলে আমি নিজেকে ধনী করে তুলতে পারছি। আর শেষ পর্যন্ত এমন একটা মন্তব্য তিনি করেছিলেন যেটা আজ পর্যন্তও আমার মনে আছে এবং শেষ পর্যন্ত আমাকে জয় করেছে; আমার মধ্যে যেটুকু নীতিবোধ অবশিষ্ট ছিল তাকে রক্ষা করেছে; আর কোন দিন আমি জুয়া খেলব না। কিন্তু সেই মানুষটি যে কে তা আমি জানি না, কিন্তু আমি তাকে খুঁজছি, খুঁজছি এই টাকাটা তাকে দিতে। তারপর তিনি এই টাকা দান করুন, ফেলে দিন, রাখুন, যা খুসি করুন। আমি শুধু এইভাবেই আমার কৃতজ্ঞতাটু কু জানতে চাই। এখানে থেকে যেতে পারলে আমি নিজেই তাকে খুঁজে বের করতে পারতাম; কিন্তু সে যাই হোক, তাকে অবশ্য খুঁজে পাওয়া যাবে। এটি একটি সৎ শহর, সব রকম পতনে উর্ধ্বে; আমি জানি নির্ভয়ে এ শহরকে আমি বিশ্বাস করতে পারি। আমার প্রতি যে মন্তব্য তিনি কেরছিলেন তাই দিয়েই তাকে চিনতে রারা যাবে; আমার দৃঢ় ধারণা সে মন্তব্য তার স্মরণে আছে।

এবার আমার পরিকল্পনার কথা বলি: যদি গোপনে অনুসন্ধান চালাতে চান তো তাই করুন। যাকেই আসল লোক বলে মনে হবে তাকেই এই চিঠির বক্তব্য শোনাবেন। সে যদি বলে আমি সেই লোক, আর আমি অমুক-অমুক মন্তব্য করেছি তাহলেই মিলিয়ে দেখবেন-অর্থাৎ বস্তাটা খুললেই তার মধ্যে একটা সিল-করা খাম পাবেন আর তার মধ্যেই পাবেন মূল মন্তব্যটা। লোকটি যে মন্তব্যের কথা বলবে সেটা যদি খামের ভিতরকার মন্তব্যের সঙ্গে মিলে যায়, তাহলে তাকেই টাকাটা দিয়ে দেবেন, আর কোন কথা জিজ্ঞাসা করবেন না, কারণ সেই আসল লোক?

আর যদি প্রকাশ্যে সন্ধান করাতে চান তো এই লোকটা কোন স্থানীয় সংবাদপত্রে প্রকাশের ব্যবস্থা করুন-আর তার সঙ্গে এই নির্দেশটি যোগ করে দিন: আজ থেকে ত্রিশ দিনের মাথায় প্রার্থী যেন স্বয়ং সন্ধা (শুক্রবার) আট টার সময় টাউন-হলে উপস্থিত হয়ে একটি সিল-করা খামে তার মন্তব্যটি রেভাঃ মিঃ বার্জেস-এর হাতে দেন (যদি তিনি দয়া করে এ কাজটা করে দিতে রাজী হন); এবং মিঃ বার্জেসও যেন তখনই বস্তার সিল ভেঙে খুলে মিলিয়ে দেবেন যে মন্তব্যটা সঠিক কিনা; সঠিক হলে এইভাবে আবিস্কৃত আমার উপকারীকে যেন আমার একান্ত কৃতজ্ঞতাসহ টাকাটা দিয়ে দেন।  

মিসেস রিচার্ডস্ উত্তেজনায় ঈষৎ কাঁপতে কাঁপতে বসে পড়ল এবং শীঘ্রই এই ধরনের চিন্তার মধ্যে ডুবে গেল: কী আশ্চার্য। ব্যাপার!…আর যে দয়ালু লোকটি তার রুটি খানা জলে ভাসিয়ে দিয়েছিল তারই বা কী ভাগ্য!… আমার স্বামী যদি এ কাজটা করত!-আমরা এত গরিব এত বুড়ো আর গরিব! (একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে) কিন্তু সে-লোক তো আমার এডোয়ার্ড নয়; সে তো কোন অপরিচিত লোককে কুড়ি ডলার দেয় নি। এখন বুঝতে পারছি সেটা কত দুঃখের কথা।… হঠাৎ শিউরে উঠে। কিন্তু এ তো জুয়াড়ীর টাকা। পাপের বেতন! এ টাকা আমরা নিতে পারি না; ছুঁতেও পারি না। এর কাছেও ঘেঁসতে আমি চাই না; এ তো অপবিত্র বস্তু। সে ওদিককার একটা চেয়ারে সরে গেল। এখন এডোয়ার্ড এসে এটাকে ব্যাংকে দিয়ে এলে বাঁচি; যে কোন মুহূর্তে একটা চোর এসে হাজির হতে পারে; এটা কাছে নিয়ে একলা থাকা যে কী ভয়ংকর।

এগারোটায় মিঃ রিচার্ডস্ এল। তার স্ত্রী বলল, তুমি আসায় কত যে খুসি হয়েছি, আর সে বলল, আমি বড় ক্লান্ত-ক্লান্তিতে অবশ: গরিব হওয়া যে কী কষ্ট; এই বয়সে এতোটা পথ পাড়ি দেওয়া। মাইনের জন্য সব সময় কেবল ঘুরঘুর ঘুরঘুর-অন্যের ক্রীতদাস; আর তিনি বেশ আরামে আয়েসে চটি পরে বাড়িতে বসে আছেন।

তুমি তো জান এডোয়ার্ড, তোমার জন্য আমিও কত দুঃখ পাই; তবু এই কথা ভেবে সান্ত্বনা লাভ কর: আমাদের একটা উপার্জন আছে; আমাদের সুনাম আছে-

ঠিক মেরি, সেটাই তো সব। আমার কথায় তুমি কিছু মনে করো না-ওটা একটা সাময়িক বিরক্তির ফ ল; ওর কোন মানে নেই। আমাকে চুমো খাও-বাস, সব কষ্ট দূর হয়ে গেল, আমার আর কোন নালিশ নেই। তুমি কি করছিলে? এই বস্তায় কি আছে?

স্ত্রী তখন গোপন কথাটা তাকে জানাল। মুহূর্তের জন্য সে বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে পড়ল; তার পরেই বলল:

এটার ওজন একশ ষাট পাউণ্ড? আরে মেরি, এযে চল্লিশ হাজার ডার-ভাব তো-একটা সম্পত্তি! এ গ্রামের দশটা লোকেরও তো এত সপত্তি নেই। কাগজটা দাও তো।

তাড়াতাড়ি সেটা পড়ে নিয়ে সে বলল:

বেশ একটা অ্যাডভেঞ্চার! আরে, এত একটা রোমান্স; যে সব অবাস্তব জিনিস বইতে পড়া যায়, কখনও চোখে দেখা যায় না, এ যে তাই। খুসিতে সে ডগমগ হয়ে উঠল। বুড়ি স্ত্রীর গালে টোকা মেরে ঠাট্টা করে বলল, আরে, আমরা তো এখন ধনী মেরি, মহাধনী। এখন শুধু সোনাটাকে মাটিতে পুঁতে দিয়ে কাগজটা সরিয়ে ফেললেই হল। জুয়াড়ীটা যদি কখনও খোঁজ করতে আসে তাহলে অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে আমরা শুধু বলব: কী সব আবোল-তাবোল বকছেন আপনি! আপনার কথা ও আপনার সোনার বস্তার কথা তো আমরা আগে কখনও শুনি নি; তখন তাকে যা বোকা-বোকা দেখাবে, আর-

আর এদিকে তুমি যখন এই সব মস্করা করছ ততক্ষণ সোনাটা কিন্তু এখানেই রয়েছে, আর চোরদের আসার সময়ও ক্রমেই এগিয়ে আসছে!

সত্যি কথা। আচ্ছা, তাহলে আমরা কি করব-গোপনে অনুসন্ধান করব? না, তা নয়; তাতে রোমান্সটাই নষ্ট হয়ে যাবে। প্রকাশ্য অনুসন্ধানই ভাল। কি রকম একটা হৈ-চৈ পড়ে যাবে ভাব। অন্য শহরগুলো আমাদের কি রকম ঈর্ষা করবে; কারণ তারাও জানে, কোন অপরিচিত লোক এ রকম লোক একটা জিনিস নিয়ে হ্যাডলিবুর্গ ছাড়া আর কোন শহরকেই বিশ্বাস করত না। এটাই আমাদের মোক্ষম তাস। এখনই সংবাদপত্রের আপিসে চললাম, নইলে দেরী হয়ে যাবে।

আরে দাঁড়াও-দাঁড়াও-এ জিনিস দিয়ে আমাকে একা ফেলে যেয়ো না এডোয়ার্ড!

কিন্তু সে তখন চলে গেছে। অবশ্য খুবই অল্প সময়ের জন্য। বাড়ি থেকে একটু দূরেই সংবাদপত্রের সম্পাদক-মালিকের সঙ্গে তার দেখা হয়ে গেল। তাকে দলিলটা দিয়ে বলল, তোমার জন্য একটা ভাল জিনিস এনেছি কক্স, এটা ছেপে দিও।

অনেক দেরী হয়ে গেছে মিঃ রিচার্ডস্: তবে আমি দেখছি কি করা যায়।

বাড়িতে ফিরে স্ত্রীর সঙ্গে বসে তারা এই আকর্ষণীয় রহস্য নিয়েই আলোচনা করতে লাগল; তাদের চোখে ঘুম নেই। প্রথমে প্রশ্নই হল,

অপরিচিত লোককে কুড়ি ডলার দিয়েছিল কে? উত্তরটা সহজ; দুজনই এক নিঃশ্বাসে বলে উঠল।

বার্কলে গুডসন।

রিচার্ডস্ বলল, হ্যাঁ, সেই হতে পারে, এ কাজ তারই উপযুক্ত; এ রকম লোক শহরে আর কেউ নেই।

সে কথা সকলেই স্বীকার করবে এডোয়ার্ড–অবশ্য গোপনে। ছ মাস হল গ্রামটি যেন আবার তার নিজস্ব বৈশিষ্ট্যে ফিরে গিয়েছিল-সৎ, সংকীর্ণ, স্বধর্মনিষ্ঠ, ও কঞ্জুষ।

মৃত্যুর দিন পর্যন্ত সে তো এই কথাই বলে গেছে-আর ঠিক কথাই বলেছে, প্রকাশ্যেই বলেছে।

হ্যাঁ, আর সে জন্য সকলে তাকে ঘৃণাও করেছে।

তা তো বটেই; তবে সে তা নিয়ে মাথা ঘামায় নি। আমি তো মনে করি, রেভারেণ্ড বার্জেস ছাড়া আমাদের মধ্যে সেই সব চাইতে বেশী ঘৃণা পেয়েছে।

দেখ, বার্জেস-এর এটা প্রাপ্য। শহরটাই ছোট লোকে ভরা, তাই তারা তো তাকে এই চোখেই দেখবে। এডোয়ার্ড, অপরিচিত লোকটি যে বার্জেস এর হাত দিয়েই টাকাটা দিতে বলেছে এটা কি অদ্ভুত কথা নয়?

দেখ, হ্যাঁ, তা বটে। তবে কি না-তবে কি না-

রাখ তো তোমার তবে কি না। তুমি কি তাকে এ কাজের ভার দিতে?।

দেখ মেরি, এও তো হতে পারে যে এ গ্রামের লোকের চাইতে অপরিচিত লোকটি ই তাকে ভাল করে জানে।

তাতে কি বার্জেস-এর খুব সুবিধা হত!

স্বামীটির মুখে কোন জবাব জুট ল না; স্ত্রীটি তার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে অপেক্ষা করতে লাগল। শেষ পর্যন্ত রিচার্ডস্ কিছুটা ইতস্তত করেই বলল: মেরি, বার্জেস তো খারাপ লোক নয়।

স্ত্রীটি তো অবাক।

বাজে কথা! সে চেঁচিয়ে বলল।

আমি জানি, সে খারাপ লোক নয়। তার প্রতি সাধারণের বিরাগের ভিত্তি তো সেই একটা জিনিস-যে জিনিস নিয়ে এত হৈ-চৈ হয়েছিল।

একটা জিনিসই বটে! কেন, সেই একটা জিনিসই কি যথেষ্ট নয়?

যথেষ্ট যথেষ্ট। তবে সে জন্য সে দোষী নয়।

কী বলছ তুমি! দোষী নয়! সকলেই জানে সে দোষী ছিল।

মেরি, আমি বলছি, সে নির্দোষ ছিল।

আমি এ কথা বিশ্বাস করতে পারি না, বিশ্বাস করিও না। তুমি কি করে জানলে?

এটা স্বীকারোক্তি। এ জন্য আমি লজ্জিত, কিন্তু এ স্বীকারোক্তি আমি করবই। একমাত্র আমিই জানি যে সে ছিল নির্দোষ। আমি তাকে বাঁচাতে পারতাম,আর-আর-দেখ, তুমি তো জান সারা শহর কি রকম তেতে উঠে ছিল-তাই আমার সাহসে কুলোয় নি। তার ফলে সকলেই আমার বিরুদ্ধে চলে যেত। নিজেকে সেদিন ছোট মনে হয়েছিল অনেক ছোট, কিন্তু আমি সাহস পাই নি; সে অবস্থার মুখোমুখি দাঁড়াবার মত পৌরুষ আমার ছিল না।

মেরিকে কেমন যেন বিচলিত বোধ হল; কিছুক্ষণ সে চুপ করে রইল। তারপর তোতলামির মত করে বলল:

আমি-আমি মনে করি না যে এতে তোমার কোন-এমন কাজ করা উচিত নয়-আঁ-জনসাধারণের মতামত-সকলকেই সতর্ক হতে হয়-কাজেই- কঠিন পথ; যেন কাদায় তার পা আটকে গেল; কিন্তু একটু পরেই সে আবার শুরু করল। খুবই দুঃখের কথা, কিন্তু সে কাজ করা আমাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না।সত্যি এডোয়ার্ড, সে কাজ আমরা করতে পারি নি। কোন কিছুর জন্যই তোমাকে আমি সে কা। করতে দিতাম না।

তার ফলে অনেক মানুষের শুভেচ্ছা আমরা হারাতাম মেরি; আর তখন-আর তখন-

দেখ এডোয়ার্ড, এখন আমার শুধু ভয়, না জানি আমাদের সম্পর্কে সে কি ভাবে।

সে? আমি যে তাকে বাঁচাতে পারতাম সে সন্দেহ তার মনে জাগে না।

স্বস্তির সুরে স্ত্রী বলে উঠল, আঃ! শুনে সুখী হলাম! তুমি যে তাকে বাঁচাতে পারতে এ কথা সে যতদিন না জানবে, ততদিন সে-সে-যাকগে, এটাই অনেক ভাল। আরে, সে যে এ কথা জানে না সেটা আমার বোঝা উচিত ছিল, কারণ সে তো সব সময়ই আমাদের বন্ধু হতে চেষ্টা করে, আমরাই খুব একটা উৎসাহ দেখাই না। এ নিয়ে অন্যরা আমাকে কত ঠাট্টা করেছে। ঐ তো উইলসনরা, উইলকক্সরা,হার্কনেদ্রা তামার বন্ধুবার্জেস, বলে আমাকে ক্ষেপিয়ে মজা পাবার চেষ্টা করে, কারণ তারা জানে যে এতে আমি বিরক্ত হই। সে এ ভাবে আমার পিছনে লেগে থাকুক সেটা আমি চাই না; সে যে কেন এমন করে বুঝি না।

আমি বলতে পারি। এও আর একটি স্বীকারোক্তি। ব্যাপার যখন বেশ গরম হয়ে উঠেছিল এবং সারা শহর তাকে তাড়াবার মতলব করছিল, তখন আমার বিবেকে বড় বাঁধল, ততটা আমি সহ্য করতে পারলাম না, গোপনে তার কাছে গিয়ে সব কথা জানিয়ে দিলাম, আর সেও শহর ছেড়ে চলে গেল এবং যতদিন এ শহরটা তার পক্ষে নিরাপদ না হল ততদিন বাইরেই কাটিয়ে দিল।

এভোয়ার্ড, শহরের লোকরা যদি জানতে পারত

ও কথা বলো না। সে কথা ভাবলে এখনও আমার ভয় হয়, কাজটা করে ফলেই আমার অনুশোচনাও হয়েছিল। পাছে তোমার মুখ দেখে কেই ব্যাপারটা বুঝে ফেলে সেই ভয়ে আমি তোমাকেও কিছু বলি নি। দুশ্চিন্তায় সে রাতে আমার ঘুম হয় নি। কিন্তু কয়েকদিন পরেই বুঝলাম যে কেউ আমাকে সন্দেহ করছে না। তারপর থেকেই কাজটা করতে পারার জন্য আমি খুসি বোধ করতাম। আজও তাই করি মেরি-পুরোপুরি খুসি বোধ করি।

আজ আমি ও খুসি, কারণ তা না করলে তার প্রতি ভয়ংকর ব্যবহার করা হত। হ্যাঁ, আমি খুসি, কারণ তুমি তো জান সেটা করাই সেদিন ছিল তোমার কর্তব্য। কিন্তু এডোয়ার্ড, ধর এখনও যদি কোনদিন কথাটা ফাঁসি হয়ে যায়!

হবে না।

কেন?

কারণ সকলেই গুডসনকেই দায়ী মনে করে।

তাই তো করা উচিৎ।

নিশচয়। অবশ্য সে পরোয়া করে না। সকলে বেচারি বুড়ো সবেরিকে বোঝাল, সে যেন গিয়ে তার ঘাড়েই দোষটা চাপায় আর সেও সেখানে গিয়ে তর্জন-গর্জন শুরু করে দিল, তাকে দোষী সাব্যস্ত করল। গুড সন তার দিকে তাকিয়ে বলল, আমার জবাব যদি চাও তো তোমাকে একটা পরামর্শ দেই সস্সবেরি; আমার জবাব শুনবার জন্য আবার যখন আসবে তখন একটা ঝুড়ি নিয়ে এসো যাতে তোমার হাড়গোড়গুলো বেয়ে নিয়ে যেতে পার। ব্যাপারটা সেখানেই মিটে গেল, আর আমরাও বেঁচে গেলাম। ও ব্যাপারটাই চাপা পড়ে গেল।

দুজনে আবার সোনার বস্তার রহস্য নিয়েই মেতে উঠল। কিন্তু শীঘ্রই তাদের আলোচনায় কেমন যেন বাধা পড়তে লাগল-মাঝে মাঝেই তারা গভীর চিন্তায় ডুবে যেতে লাগল। শেষ পর্যন্ত রিচার্ডস্ উঠে দাঁড়িয়ে উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘরময় পায়চারি করতে লাগল। এবং দুঃস্বপ্ন দেখে ঘুম থেকে জেগে ওঠা নিশাচর মানুষের মত দুই হাতে নিজের চুল টানতে লাগল। তারপর কি যেন একটা সংকল্প স্থির করে টুপিটা নিয়ে দ্রুত বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল; একটা কথা পর্যন্ত বলল না। তার স্ত্রী মুখ নীচু করে চুপচাপ বসে কি যেন ভাবতে লাগল; সে যে তখন একলা রয়েছে সে খেয়ালও তার নেই। মাঝে মাঝেই নিজের মনে বলতে লাগল, আমাদের নিয়ো ….কিন্তু-কিন্তু আমরা যে গরিব-বড়ই গবির।…আমাদের নিয়ো না….আঃ, এতে কারই বা ক্ষতি হবে?–আর কেউ কোনদিন। জানতেও পারবে না।…আমাদের নিয়ো… তার কথা থেমে গেল। একটু পরে চোখ তুলে তাকিয়ে আধা ভয়ে আধা খুসিতে সে বলে উঠল;

সে চলে গেছে! কিন্তু, তার হয় তো দেরী হতে পারে…বড় বেশী দেরী হতে পারে….নাও হতে পারে, হয় তো এখনও সময় আছে। উঠে দাঁড়িয়ে কি যেন ভাবতে লাগল। শরীরটা ঈষৎ কঁপছে। শুকনো গলায় বলল, উ শ্বর আমাকে ক্ষমা করুন-এ সব কথা ভাবাও খারাপ-কিন্তু..প্রভু, কি দিয়ে তুমি আমাদের গড়েছ-কি বিচিত্র ভাবে তুমি আমাদের গড়েছ!

আলোটা কমিয়ে দিয়ে সে চুপি চুপি বস্তাটার কাছে গেল। হাঁটু ভেঙে বসে বস্তাটার উঁচ-নীচু গায়ে আদর করে হাত বুলোতে লাগল; তার দুই চোখ ফুটে উঠল লোভের আলো নিজের মনেই বলল, সে যদি একটু অপেক্ষা করত!-আহা, এত তাড়াহুড়ো না করে শুধু যদি একটু অপেক্ষা করত।

ইতিমধ্যে কক্স আপিস থেকে বাড়ি ফিরে গেল; এই আশ্চর্য ঘটনার কথা স্ত্রীকে সবই বলল: সাগ্রহে এই নিয়ে আলোচনা করতে। লাগল। তারা বলল, স্বর্গত গুড় সনই এ শহরের একমাত্র লোক যে একটি অপরিচিত দুঃখী লোককে কুড়ি ডু লারের মত এত মোটা টাকা দিয়ে সাহায্য করতে পারে। একটু দুজনই চুপ করে গেল। কেমন যেন বিচলিত ও অস্থির হয়ে উঠল। অবশেষে স্ত্রী যেন নিজেকেই বলল:

রিচার্ডসরা ছাড়া এ গোপন খবর আর কেউ জানে না…আর জানি আমরা…আর কেউ না।

একটু চমকে উঠে স্বামীটি চিন্তা ছেড়ে সাগ্রহে স্ত্রীর মুখের দিকে তাকাল। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে ভয়ে ভয়ে একবার টু পিটার দিকে আর একবার স্ত্রীর দিকে তাকাল-যেন নীরবে কিছু জিজ্ঞাসা করল। মিসেস কক্স গলায় হাত রেখে দু-একটা সেঁক গিলল; তারপর কোন কথা না বলে মাথাটা নাড়ল। মুহূর্তকাল পরেই দেখল, বাড়িতে সে একা।

ওদিকে রিচার্ডস্ ও কক্স তখন নির্জন পথ ধরে বিপরীত দিকে থেকে দ্রুত ছুটে চলেছে। ছাপাখানার সিঁড়ির নীচে হাঁপাতে হাঁপাতে দুজনের দেখা হয়ে গেল। রাতের আলোতেই দুজন দুজনের মুখের ভাষা পড়ে নিল। কক্স চুপি চুপি বলল:

আমরা ছাড়া কেউ এ কথা জানে না তো?

চুপি চুপি জবাব এল।

কেউ না, সত্যি বলছি, একটি প্রাণীও না।

যদি এখনও বেশী দেরী না হয়ে থাকে-

দুজন সিঁড়ি বেয়ে উঠতে লাগল; এমন সময় একটা ছেলে এসে তাদের ধরে ফেলল। কক্সক্স জিজ্ঞাসা করল:

কে? জনি না কি?

হ্যাঁ স্যার।

সকালের ডাক তোমাকে ছাড়তে হবে না-কোন ডকই না; আমি না বলা পর্যন্ত অপেক্ষা কর।

ডাক তো চলে গেছে স্যার।

চলে গেছে! আর কষ্ট স্বরে অবর্ণনীয় হতাশা।

হ্যাঁ স্যার ব্রিক্সটন ও তার পরবর্তী সব শহরের টাইম-টে বল আজ থেকে বদলে গেছে স্যার-তাই অন্যদিন অপেক্ষা বিশ মিনিট আগেই কাগজ পাঠাতে হয়েছে। আমাকে তাড়াতাড়ি আসতে হয়েছিল; আর দু মিনিট পরে এলেই-

বাকিটা শুনবার জন্য অপেক্ষা না করেই তারা দুজন মুখ ফিরিয়ে ধীরে ধীরে হাঁটতে লাগল। দশ মিনিট কেউ কোন কথা বলল না। তারপর বিরক্ত গলায় কক্স বলল:

তোমার যে হঠাৎ এত তাড়াহুড়া পড়ে গেল কেন তা তো বুঝি না।

বিনীত জবাব এল;

এখন এবশ্য বুঝতে পারছি, কিন্তু আপনি তো জানেন, সব কিছু বুঝতেই আমার একটু দেরী হয়। কিন্তু এর পরে-

এর পরের কথা চুলোয় যাক। হাজার বছরে আর এ সুযোগ আসবে না।

তারপর শুভরাত্রি না জানিয়েই বন্ধুরা বিদায় নিল এবং মারাত্মকভাবে আহত লোকের মত কোন করমে বাড়ি ফিরে গেল। বাড়িতে পোঁছবামাত্রই স্ত্রীরা সাগ্রহে তারপর? বলেই তাদের মুখ দেখে জবাবটা আঁচ করতে পেরে মুখে কিছু না বলেই দুঃখে কষ্টে একেবারে ভেঙে পড়ল। দুই বাড়িতেই গরম-গরম কথাবার্তা চলল-ব্যাপারটা নতুন; আলোচনা আগেও হয়েছে, কিন্তু গরম-গরমও নয়, উদ্ধতত্ত্ব নয়। আজকে রাতের আলোচনায় চ লাল পরস্পরের বিষোদগার। মিসেস নিসার্ডস্ বলল:

তুমি যদি একটু অপেক্ষা করতে এড়োয়ার্ড–চিন্তা করে দেখবার জন্য যদি একটু সময় নিতে; তা নয়, খবরটা দুনিয়াময় ছড়িয়ে দেবার জন্য সঙ্গে সঙ্গে ছুট লে ছাপাখানায়।

ওতে লেখা ছিল, প্রকাশ করতে হবে।

সেটা কিছুই না; ইচ্ছা করলে গোপনেও করতে পার, সে কথাও তো লেখা ছিল। কি, ঠিক কি না?

তা অবশ্য ছিল; সে কথা ঠিক; কিন্তু যখন ভাবলাম এর ফলে কী হৈ-চৈ টাই না পড়ে যাবে, কেন অপরিচিত লোক হ্যাডলিবুর্গকে এতখানি বিশ্বাস করেছে এটা যে কত বড় সম্মান-

সে তো বটেই; সে তো আমিও বুঝি; কিন্তু একটু ভেবেচিন্তে দেখার জন্য তুমি যদি অপেক্ষা করতে তাহলেই বুঝতে পারতে যে আসল লোককে খুঁজে পাওয়া যাবে না, কারণ সে এখন করবে, আর তার ছেলেমেয়ে, আত্মীয়-স্বজন কেই নেই; কাজেই যার একান্ত দরকার সে রকম কেউ টাকাটা পেলে কারও প্রাণেই আঘাত লাগত না, আর–আর-

স্ত্রীটি কাঁদতে কাঁদতে বসে পড়ল। তাকে সান্ত্বনা দেবার জন্য স্বামী বলল:

কিন্তু যাই বল মেরি, যা ঘটে তা ভালর জন্যই ঘটে–নিশ্চয়ই তাই; তুমিও তা জান। আমাদের মনে রাখতে হবে যে এটাই ভবিতব্য

ভবিতব্য! বোকার মত কোন কাজ করলেই লোকে ভবিতব্যের দোহাই দেয়। আবার এও তো হতে পারে যে এইভাবে আমরা টাকাটা পাব সেটাই ছিল ভবতব্য, এথচ তুমিই আগ বাড়িয়ে বিধাতার বিধানকে ভেস্তে দিলে- সে অধিকার তোমাকে কে দিয়েছিল? এটা খুবই অন্যায় হয়েছে-পাপ হয়েছে, তোমার মত একজন ধর্মভীরু, বিনীত লোকের উপযুক্ত কাজ মোটেই নয়-

কিন্তু মেরি, তুমি তো জান অন্য সব গ্রামবাসীর মতই আমরাও সারাটা জীবন সতোর শিক্ষা পেয়ে পেয়ে এটাই আমাদের স্বভাবে পরিণত হয়েছে যে কোন সৎকর্মের সুযোগ এলে এক মূহুর্তের জন্যও আমরা চিন্তা করতে পারি না।

আঃ, আমি জানি, আমি জানি-সারা জীবন ধরে সতোর শিক্ষার এই ফল-জন্মাবধি সব রকম প্রলোভনের হাত থেকে সতোকে বাঁচিয়ে চলার এই ফল; তাই তো এ সততা এত কৃত্রিম ও দুর্বল যে প্রলোভনের এক ধাক্কায় ভেসে গেল; সেটা তো আজ রাতেই আমরা দেখলাম। ঈশ্বর জানেন, আজ পর্যন্ত আমার এই পচা অবিনশ্বর সততা সম্পর্কে সন্দেহের ছায়ামাত্র আমার মনে ছিল না,-আর আজ জীবনে প্রথম সত্যিকারের বড় প্রলোভনের সামনে পড়েই আমি-এডোয়ার্ড, এই বিশ্বাসই আমার মনে বদ্ধমূল হয়ে গেছে আমার মতই গোটা শহরের সততাই পচে গেছে; তোমার সতোর মতই পছে গেছে। এটা একটা বাজে শহর, কুঞ্জু ষ শহর, একমাত্র সততা ছাড়া আর কোন গুণ তার নেই; এথচ আজ আমি বিশ্বাস করি যে এমন দিন যদি কখনও আসে সেদিন গোটা শহরের মহা সুনাম তাসের ঘরের মতই ভেঙে পড়বে। এ কথা মুখ খুলে বলতে পেরে যেন কিছুটা স্বস্তি পাচ্ছি। আমি একটি ফাঁকিবাজ, সারা জীবন তাই ছিলাম, অথচ তা জানতাম না। কেউ যেন আর আমাকে সৎ লোক না বলে–আমি সৎ নই।

আমি-দেখ মেরি, আমারও ঐ এক কথা; সত্যি তাই। সত্যি অবাক কাণ্ড। এ কথা আগে কখনও বিশ্বাস করতাম না-কদাপি না।

অনেকক্ষণ চুপচাপ। দুজনই চিন্তামগ্ন। অবশেষে স্ত্রী চোখ তুলে বলল:

আমি জানি তুমি কি ভাবছ এডোয়ার্ড।

ধরাপরা লোকের মত বিমূঢ় ভাব রিচার্ডসের মুখে।

এ কথা স্বীকার করতে লজ্জা হচ্ছে মেরি, কিন্তু 

তাতে কি এডোয়ার্ড, আমি নিজেও তো ঐ কথাই ভাবছিলাম।

আমিও তাই আশা করি। বলে ফেল।

 তুমি ভাবছিলে, অপরিচিত লোকটির কাছে গুডসন কি মন্তব্য করেছিল সেটা যদি কেউ অনুমান করতে পারত।

ঠিক বলেছ। নিজেকে অপরাধী ও লজ্জিত মনে হচ্ছে। আর তুমি?

আমি ও সবের বাইরে! এখানেই একটা বিছানা করা যাক; সকালে ব্যাংকের ভূগর্ভ-কক্ষ খোলার পরে বস্তাটা সেখানে জমা দেওয়া পর্যন্ত তো এটাকে পাহারা দিতে হবে।…আহারে, ঐ ভুলটা যদি আমরা না করতাম!

বিছানা করা হলে মেরি বলল:

সেটা একই চিচিং ফাঁক-কথাটা কি হতে পারে? কি মন্তব্য সে করেছিল? কিন্তু এস, শুয়ে পড়া যাক।

ঘুমোব?

নাঃ চিন্তা করব।

ইতিমধ্যে কক্স-দম্পতিও তাদের ঝগড়া ও মিটমাটের পালা শেষ করেছে; তারাও ভাবছে আর ভাবছে, উল্টে পাল্টে দেখছে-আশ্রয়হীন সর্বহারা লোকটির প্রতি গু ডসন কিমন্তব্য করেছিল-কি সেই সোনালি মন্তব্য যে মন্তব্যের দাম নগদ চল্লিশ হাজার ডলার।

সেদিন রাতে গ্রামের টেলিগ্রাফ আপিসটা যে অন্যান্য দিন অপেক্ষা বেশী রাত পর্যন্ত খোলা ছিল তার কারণ: কক্স-এর সংবাদপত্রের ফোরম্যান ছিল এসোসিয়েটেড প্রেস-এর স্থানীয় প্রতিনিধি। তাকে বলা যায় অনাহারী প্রতিনিধি, কারণ বছরে চারবারও তার পাঠানো ত্রিশটি শব্দ প্রকাশের জন্য গ্রহণ করা হয় না। কিন্তু এবারে ব্যাপারটা অন্য রকম হল। সংবাদ পাঠাবার সঙ্গে সঙ্গে জবাব এল:

সমস্তটা পাঠাও-সম্পূর্ণ বিবরণ-বারো শ শব্দ।

মস্ত বড় অর্ডার! ফোরম্যান বিলটা পূরণ করল; আজ সে যুক্তরাষ্ট্রের সব চাইতে গর্বিত লোক। পরদিন প্রাতরাশের সময় নাগাদ সারা আমেরিকায়-মন্ট্রিল থেকে উপসাগর পর্যন্ত, আলাস্কার তুষার-প্রবাহ থেকে ফ্লোরিডায় কমলা-বন পর্যন্ত-সকলের মুখেই অদূষণীয়-চরিত্র হ্যাঁলিবুর্গের নাম ছড়িয়ে পড়ল; লক্ষ লক্ষ লোক আগন্তুক ও তার টাকার থলের কথা নিয়ে আলোচনা করতে করতে অবাক হয়ে ভাবল, সঠিক লোকটি কে কি খুঁজে পাওয়া যাবে; আর অপেক্ষা করতে লাগল, এ বিষয়ে আরও, সংবাদ কতক্ষণে আসবে।

.

০২.

হ্যাডলিবুর্গ গ্রামের ঘুম ভাঙল বিশ্বজোড়া খ্যাতির মধ্যে-বিস্মিত, সুখী, গর্বিত। কল্পনাতীত গর্ব! তার উনিশজন প্রধান নাগরিক ও তাদের স্ত্রীরা হাসতে হাসতে পরস্পরের সঙ্গে করমর্দন করতে লাগল, অভিনন্দন জানাতে লাগল, আর বলতে লাগল, এ ঘটনার ফলে অভিধানে একটা নতুন শব্দ যুক্ত হল-হ্যাডলিবুর্গ, অদূষণীয় চরিত্রের সমার্থবাচক শব্দ-এ শব্দ অভিধানের পাতায় চিরদিন বেঁচে থাকবে। ক্ষুদে নাগরিক ও তাদের স্ত্রীরাও ঐ একই কাজ করে ফিরতে লাগল। সোনার বস্তাটা দেখবার জন্য সকলেই ব্যাংকে ছুট ল; দুপুর হবার আগেই ব্রিক্সটন ও আশপাশের অন্য সব শহরের ক্ষুব্ধ ও ঈর্ষান্বিত লোকজন দলে দলে আসতে শুরু করল; সেদিন বিকেলে ও পর দিন নানা জায়গা থেকে প্রতিবেদকরা আসতে লাগল; বস্তা ও তার ইতিহাস খতিয়ে দেখল ও শুনল, নতুন করে তার বিবরণ লিখল, খট খট করে ফটো তুলল-বস্তাটার, রিচার্ডস্-এর বাড়ির, ব্যাংকের, প্রেবিটে রিয়ান গির্জার ব্যাপ্টিস্ট গির্জার, সরকারী বাগানের, যেখানে পরীক্ষা করে টাকাটা দেওয়া হবে সেই টাউন-হলের; এমন কি রিচার্ডস্-দম্পতি, ব্যাংকার পিংকার্টন, কক্স, ফোরম্যান, রেভারেণ্ড বার্জেস, পোষ্ট-মাস্টার, জেলে, শিকারী প্রভৃতি সকলের ছবিই তোলা হল। পিংকার্টন তো যে আসে তাকেই বস্তাটা দেখায় আর গর্ব করে বলে যে এবার এই দৃষ্টান্তের কথা গোটা মার্কিন মুলুকেই ছড়িয়ে পড়বে এবং নৈতিক নবজাগরণের একটি যুগান্তকারী ঘটনা হিসাবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। ইত্যাদি, ইত্যাদি।

সপ্তাহের শেষের দিকে অবস্থা আবার শান্ত হয়ে এল। গর্ব ও আনন্দের উত্তেজনা হ্রাস পেয়ে একটা মিষ্টি-মধুর নীরব আনন্দে সরলে খুসির নিঃশ্বাস ফেলল। সকলের মুখেই দেখা দিল শান্ত পরিত্র মুখের আভাষ।

তারপর আবার পরিবর্তন দেখা দিল। ধীরগতি পরিবর্তন; এতই ধীরগতি যে প্রথমে কারও নজরেই পড়ল না। কিন্তু ক্রমেই মনে হতে লাগল যে লোকজনের মুখে আগেরকার সেই হাসিখুসি ভাবটা নেই; কেমন যেন একটা বিষণ্ণতার ছোঁয়া লেগেছে; সকলের চোখেমুখে একটা রুগ্ন ভাব।

আর ঠিক সেই অবস্থায় উনিশটি প্রধান পরিবারের কর্তাদের মুখে শুতে যাবার সময় প্রায় দীর্ঘশ্বাসের সঙ্গে একটা কথা উচ্চারিত হতে লাগল: আহা, গুড সন যে মন্তব্যটি করেছিল সেটা কি হতে পারে?

আর সঙ্গে সঙ্গে তাদের স্ত্রীরাও শিউরে উঠে বলতে লাগল:

উঁহু, ও কথা ভেব না। মনের মধ্যে কী ভয়ানক কথার জট পাকাচ্ছে? ঈশ্বরের দোহাই, ও চিন্তা মন থেকে দূর কর।

কিন্তু পরদিন রাতে তাদের কঠে ঐ একই প্রশ্ন উচ্চারিত হল, আর ঐ একই পাল্টা জবাবই তারা পেল। তবে এবার প্রতিবাদের কণ্ঠ ক্ষীণতর।

তৃতীয় রাতেও পুরুষরা আবার ঐ একই প্রশ্ন উচ্চারিত করল–স্ত্রীরা দুর্বল কণ্ঠে আপত্তিও জানাল, কিছু একটা যেন বলতেও চাইল, কিন্তু বলল না। তার পরের রাতে তাদের জিভও সোচ্চার হয়ে উঠল:

আহা! সেটা যদি অনুমান করতে পারতাম!

এই ভাবে তিনি সপ্তাহ পার হয়ে গেল- আর এক সপ্তাহ বাকি। শনিবার সন্ধায়-আহারাদির পরে। অন্যান্য শনিবারের হৈ-চৈ, ব্যস্ততা, বাজার করা প্রভৃতির বদলে সেদিন রাজপথ ফাঁকা-নিৰ্জন। রিচার্ডস্ ও তার স্ত্রী ছোট বসবার ঘরটি তে দুঃখিত ও চিন্তিত মনে দূরে দূরে বসে আছে। এখন এটাই তাদের সান্ধকালীন অভ্যাসে পরিণত হয়েছে: সারাটা জীবন তাদের অভ্যাস ছিল পড়াশু না, সেলাই, খুসিমনে। আলোচনা, প্রতিবেশীকে বাড়িতে অভ্যর্থনা করা বা তাদের বাড়িতে যাওয়া-সে সব কিছু অনেক কাল আগেই মরে হেজে গেছে-অর্থাৎ দু-তিন সপ্তাহ আগেই সে সব তারা একদম ভুলে গেছে, কেউ এখন কথা বলে না, পড়ে না, দেখাসাক্ষাৎ করে না-গোটা গ্রামটাই যার যার বাড়িতে বসে থাকে, দীর্ঘশ্বাস ফেলে, দুশ্চিন্তা করে, চুপচাপ থাকে। শুধু সেই মন্তব্যটা কি হতে পারে তাই নিয়ে মাথা ঘামায়।

পিওন একটা চিঠি দিয়ে গেল। রিচার্ডস্ উদাসীনভাবে ঠিকানা ও ডাকঘরের ছাপটা দেখল-দুটোই অচেনা-চিঠিটাকে টেবিলের উপর ফেলে দিয়ে আবার নিজের চিন্তায়ই ডুব দিল। দু তিন ঘণ্টা পরে তার স্ত্রী ক্লান্তভাবে উঠে শুভরাত্রি না জানিয়েই-সেটাই এখন রেওয়াজ হয়ে দাঁড়িয়েছে-শুতে যাচ্ছিল; কিন্তু কি মনে করে চিঠি টার কাছে গিয়ে থামল, একান্ত অনাগ্রহে একবার তাকিয়ে দেখল, তার পর খামটা ছিঁড়ে চোখ বুলোতে লাগল। চেয়ারটাকে দেয়ালের গায়ে ঠেসান দিয়ে দুই হাঁটুর উপর থুতনি রেখে রিচার্ডস বসেই ছিল। হঠাৎ একটা কিছু পড়ে যাওয়ার শব্দ কানে গেল। তার স্ত্রী পড়ে গেছে। লাফ দিয়ে তার কাছে যেতেই স্ত্রী চেঁচিয়ে বলল:

আমাকে একা থাকতে দাও, আমি ভাল আছি। চিঠিটা পড়-পড়ে দেখ!

পড়ল। গোগ্রাসে গিলল। তার মাথা ঘুরে গেল। অনেক দূর থেকে চিঠি টা এসেছে। তাতে লেখা:

আমি আপনার অপরিচিত, কিন্তু তাতে কি, আমার কিছু বলবার আছে। এইমাত্র মেক্সিকো থেকে বাড়ি ফিরে ঘটনার কথা সবাই জেনেছি। মন্তব্যটা কে করেছিল তা আপনি জানেন না, কিন্তু আমি জানি আর জীবিত লোকদের মধ্যে একমাত্র আমিই জানি। গুড় সন। অনেক বছর আগে আমি তাকে ভাল করেই জানতাম। সেই রাতে আমিই আপনাদের গ্রামের ভিতর দিয়ে যাচ্ছিলাম এবং মাঝ রাতের ট্রেনটা না আসা পর্যন্ত তার বাড়িতেই অতিথি হয়ে ছিলাম। অন্ধকারে একটি অচেনা লোককে কথাটা বলতে আমি শুনেছিলাম-ঘটনাটা ঘটে ছিল হে গলিতে। বাড়ি ফিরবার পথে বাকিটা সময় তিনি ও আমি ঐ কথাটা নিয়েই আলোচনা করছিলাম। তার বাড়িতে বসে ধূমপান করতে করতেও তা নিয়েই কথা হয়েছিল। কথাপ্রসঙ্গে আপনাদের গ্রামের অনেকের কথাই তিনি বলেছিলেন-অধিকাংশ সম্পর্কেই মন্তব্যগুলি বিরূপ ছিল, কিন্তু তিনি দু তিনজন সম্পর্কে অনুকূল মন্তব্য করেছিলেন; তাদের মধ্যে একজন আপনি স্বয়ং। আমি অনুকুল কথাটাই ব্যবহার করলাম, আরও জোরালো কিছু না লিখে। মনে পড়ে, তিনি বলেছিলেন শহরের কোন লোককেই তিনি পছন্দ করেন না-একজনকেও না; কিন্তু আপনি-মনে হচ্ছে তিনি আপনার কথাই বলেছিলেন-সে বিষয়ে আমি প্রায় নিশ্চিত-এক সময়ে ভাল করে না জেনেই তার খুব উপকার করেছিলেন; তাই তার ইচ্ছা ছিল তার যদি একটি সম্পত্তি থাকত তাহলে মৃত্যুর সময় সে সম্পত্তি তিনি আপনাকে দান করে যেতেন, আর শহরের বাকি লোকদের প্রত্যেকের জন্য রেখে যেতেন একটা করে অভিশাপ। এখন আপনিই যদি তার সেই উপকার করে থাকেন, তাহলে তো ন্যায়ত আপনিই তার উত্তরাধিকারী এবং এই সোনাভর্তি বস্তার মালিক। আমি জানি, আপনার মর্যাদাবোধ ও সতোর উপর আমি ভরসা করতে পারি। কারণ হ্যাঁলিবুর্গের একজন। নাগরিকের পক্ষে এ গুণগু লি তো অপরিহার্য উত্তরাধিকার, আর তাই সেই মন্তব্যটি আমি আপনাকে জানিয়ে দিতে চাই, কারণ এ বিষয়ে আমি সম্পূর্ণ নিশ্চিন্ত যে আপনি যদি আসল লোক না হন তাহলে আপনিই সেই আসল লোককে খুঁজে বের করবেন এবং বেচারি গুড সন-এর কৃতজ্ঞতার ঋণ যাতে যথাযথভাবে শোধ হয় তার উপযুক্ত ব্যবস্থা করবেন। মন্তব্যটা এই:

আপনি খারাপ লোক হতে পারেন নাঃ যান, সকলকে সংশোধন করুন।

হাওয়ার্ড এল, স্টিফেন্সন।

ও এডোয়ার্ড, টাকাগুলো তো আমাদের; আমি এত কৃতজ্ঞ বোধ করছি-তুমি আমাকে চুমো খাও-কতদিন আমরা চুমো খাই নি-আর এটা আমাদের বড়ই দরকার ছিল-মানে এই টাকাটা-এখন তো পিংকার্টন ও তার ব্যাংকের হাত থেকে তুমি রেহাই পেয়ে গেলে; তুমি আর কারও ক্রীতদাস হয়ে থাকবে না; মনে হচ্ছে আমি যেন খুসিতে এখন উড়ে যেতেও পারি।

সেটি টাতে বসে আধ ঘন ধরে দুজন দুজনকে আদর করতে লাগল; পুরনো দিনগুলি যেন আবার ফিরে এসেছে-যেন দিন শুরু হয়েছিল তাদের পূর্বরাগ থেকে আর একটানা চলেছিল সেই দিনটি পর্যন্ত যেদিন অজানা লোকটি এসেছিল তার মারাত্মক অর্থ-ভাণ্ডার নিয়ে। কথাপ্রসঙ্গে স্ত্রী বলল:

ও হো এডোয়ার্ড, কী সৌভাগ্য যে বেচারি গুড সন-এর এত বড় একটা উপকার তুমি করেছিলে! তাকে আমি আগে কখনও পছন্দ করতাম না, কিন্তু এখন তাকে ভালবেসেছি। আর এত দিন এ কথা কাউকে যে বল নি, বা এ নিয়ে বাহাদুরী দেখাও নি, সেটা খুবই ভাল করেছ। তারপর একটু অনুযোগের সুরে বলল, কিন্তু আমাকে বলা তোমার উচিত ছিল এডোয়ার্ড; তুমি তো জান, তোমার স্ত্রীকে কথাটা জানানো উচিত ছিল।

দেখ, আমি-মানে-দেখ মেরি, অর্থাৎ-

ও সব মানে আর অর্থাৎ রেখে দাও। সব কথা আমাকে বল। তোমাকে তো সর্বদাই ভালবেসে এসেছি, কিন্তু এখন আমি তোমার জন্য গর্ববোধ করছি। প্রত্যেকেই মনে করে এ গ্রামে মাত্র একটি সৎ উদার লোক ছিল, কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে তুমিও-এডোয়ার্ড, কেন তুমি আমাকে সে কথা বল নি?

দেখ-মানে-আরে মেরি, আমি পারি না

তুমি পার না? কেন পার না?

দেখ, সে-মানে-তার কাছে আমি কথা দিয়েছিলাম, কাউকে বলব না।

স্ত্রী তাকে আপাদমস্তক ভাল করে দেখে নিয়ে ধীরে ধীরে বলল:

তুমি-কথা-দিয়েছিলে? এডোয়ার্ড, কেন আমাকে এ কথা বলছ?

মেরি, তুমি কি চাও যে আমি মিথ্যাবাদী হই?

স্ত্রী বিচলিত বোধ করল। মুহূর্তকাল চুপ করে রইল। তারপর স্বামীর হাতে হাত রেখে বলল:

না…না। পরস্পরের কাছ থেকে আমরা অনেক সরে এসেছি, কিন্তু আর না-ঈশ্বর সে জন্য আমাদের ক্ষমা করুন! সারা জীবন তুমি কখনও মিথ্যা বল নি। কিন্তু এখন-জীবনের ভিত্তিভূমিই যখন পায়ের নীচে ধসে যাচ্ছে তখন আমরা-আমরা- এক মুহূর্তের জন্য তার কথা বন্ধ হয়ে গেল; তারপর ভাঙা গলায় বলল, আমাদের নিয়ে না লোভের পথে..আমি মনে করি, তুমি কথা দিয়েছ এডোয়ার্ড। এ বিষয়টা এখানেই শেষ হোক। এখন-সে সব দিন তো পার হয়ে গেছে; এস, আমরা আবার সুখী হই; সন্দেহের মেঘ আর নয়।

এডোয়ার্ড অনেক চেষ্টা করে ঘাড় নাড়ল, কারণ সেও অবাক হয়ে ভাবতে লাগল কবে কোথায় গুডসন-এর কি উপকার সে করেছিল।

প্রায় সারাটা রাত দুজন জেগে কাটাল। মেরি সুখী ও ব্যস্ত, এডোয়ার্ড ব্যস্ত, কিন্তু সুখী নয়। মেরি মনে মনে হিসাব কষছে, কেমন করে টাকাটা খরচ করবে, আর এডোয়ার্ড মনে করবার চেষ্টা করছে, কি উপকারটা সে করেছিল। প্রথমেই বিবেক তাকে দংশন করছিল। কারণ মেরিকে সে মিথ্যা বলেছিল-যদি সেটা মিথ্যা হয়ে থাকে। অনেক ভাবনা-চিন্তার পরে-যদি সেটা মিথ্যা বলেছিল-যদি সেটা মিথ্যা হয়ে থাকে। অনেক ভাবনা-চিন্তার পরে-যদি সেটা মিথ্যা হয়েই থাকে? তাহলে কি হবে? এটা কি এতই বড় কথা? আমরা কি অনেক সময়ই মিথ্যা কাজ করি না? তাহলে মিথ্যা বললে কি হয়? মেরিকেই দেখ-সে কি করেছে দেখ। মুখে সত্যের কথা বলছে, কিন্তু কাজে কি করছে? কাগজটা নষ্ট করে ফেলে টাকাটা হাতিয়ে নেওয়া হয় নি বলে কাঁদছে! চুরি করা কি মিথ্যা বলার চাইতে ভাল?

আবার সেই পুরনো কথাটাই সামনে এসে দাঁড়াল। সত্যি কোন উপকার কি সে করেছিল? স্টিফেন্সন-এর চিঠি অনুসারে গুড সেন-এর নিজের সাক্ষ্যই তো তাই বলছে; তার চাইতে ভাল সাক্ষ্য আর কিছু তো হতেই পারে না-সেটাকে তো প্রমাণই বলা চলে। নিশ্চয়ই। কাজেই ও ব্যাপারটা মিটে গেল। সংকোচের সঙ্গে তার মনে পড়ল, উপকারটা রিচার্ডস্ করেছিল কি অন্য কেউ করেছিল সে বিষয়ে অপরিচিত মিঃ স্টিফেন্সনকেও কিছুটা সন্দেহগ্রস্ত বলে মনে হয়। তাছাড়া, সে তো ব্যাপারটা ছেড়ে দিয়েছে। রিচার্ডস্-এর সম্মানবোধের উপর। টাকাটা কার হাতে যাবে সেটা তাকেই স্থির করতে হবে-আর সে যদি ভুল লোক হয় তাহলে রিচার্ডস্ যে আসল লোককে খুঁজে বের করবে সে বিষয়েও মিঃ স্টিফেন্সন-এর মনে কোন সন্দেহ নেই। আহা, কোন মানুষকে এ রকম অবস্থায় ফেলা খুবই অন্যায়-স্টিফেন্সন ঐ সন্দেহটাকে কেন বাদ দিল না। ওটাকে আবার ঢোকাতে গেল কেন?

ভাবতে ভাবতে হঠাৎ রিচার্ডস্-এর এমন একটা ঘটনার কথা মনে পড়ে গেল যাতে সমস্ত ব্যাপারটাই বেশ পরিষ্কর হয়ে গেল। অনেক অনেক বছর আগে ন্যান্সি হিউ ইট নামে একটি সুন্দর মেয়ের সঙ্গে গুড সন-এর বিয়ের কথা হয়েছিল, কিন্তু যে ভাবেই হোক বিয়েটা ভেঙে যায়, আর মেয়েটি ও মারা যায়। তারপর গুডসন আর বিয়ে তো করেই নি, বরং নারী জাতির উপরেই তার একটা ঘৃণা জন্মে যায়। এতক্ষণে রিচার্ডস্-এর আবছা মনে পড়ে গেল, ঐ মেয়েটির দেহে যে যৎ সামান্য নিগ্রো রক্ত ছিল সে কথা সেই প্রথম জানতে পেরে গ্রামবাসীদের জানায় এবং গ্রামবাসীরা কথাটা গুড সনকে বলে। এইভাবেই একটি দো-আঁলা মেয়েকে বিয়ে করার হাত থেকে প্রকারান্তরে সেই গুড সনকে রক্ষা করেছিল। আর সেই কারণেই উপকারীর প্রতি কৃতজ্ঞতাস্বরূপ সে চেয়েছিল তার কোন সম্পত্তি থাকলে সেটা সে রিচার্ডসকেই দিয়ে যেত। উপকারের ব্যাপারটা এতক্ষণে একেবারে পরিষ্কার হয়ে গেল, আর সেও খুসিমত ঘুমুতে গেল। ইতিমধ্যে মেরি নিজের জন্য একটা বাড়ি ও স্বামীর জন্য একজোড়া চপ্পল কিনতে ছ হাজার ডলার খরচ করে মনের সুখে ঘুমুতে গেল।

সেই একই শনিবার সন্ধায় পিওন শহরের উনিশ জন প্রধান নাগরিকের প্রত্যেককে একটা করে চিঠি পৌঁছে দিল। চিঠি গুলোর কোন দুটো খাম এক রকম নয়, কোন দুটো খামের উপরকার লেখা এক হাতের নয়, কিন্তু ভিতরের চিঠি গুলো সব হুবহু এক-শুধু একটি বিষয় ছাড়া। সবগুলি চিঠিই রিচার্ডস্-এর চিঠির প্রতিলিপি-বক্তব্য ও হাতের লেখা সহ-সবগুলোতেই স্টিফেন্সন-এর স্বাক্ষর, কিন্তু প্রতিটি চিঠিতে রিচার্ডস্-এর নামের জায়গায় প্রাপকের নামটা লেখা।

সারাটা রাত ধরে আঠারো জন প্রধান নাগরিক সেই একই কাজ করে চলল যে কাজ করেছে তাদের সগোত্র-ভাই রিচার্ডস্-অর্থাৎ সর্বশক্তি নিয়োগ করে তারা চিন্তা করে বের করতে চেষ্টা করেছে বার্কলে গুড সন-এর কি উপকার তারা করেছে যার জন্য সে তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছে। কাজটা সহজ নয়, তবু তারা সফলতা লাভ করেছে।

তারা যখন এই কঠিন কাজে ব্যস্ত তখন তাদের স্ত্রীরা সারা রাত ধরে অতি সহজে প্রাণ খুলে টাকা খরচ করেছে। সেই এক রাতে উনিশটি স্ত্রী বস্তার ভিতরকার সেই চল্লিশ হাজার থেকে গড়ে সাত হাজার ডলার খরচ করে ফেলল-অর্থাৎ মোট খরচের পরিমাণ একশ তেত্রিশ হাজার।..

পার্শ্ববর্তী রাজ্যের জনৈক স্থপতি ও গৃহনির্মাতা সম্প্রতি এই গ্রামে একটি ছোট ব্যবসা খুলেছে; সপ্তাহখানেক হল তার সাইনবোর্ড টাও ঝোলানো হয়েছে। কিন্তু একটি খদ্দেরও জোটে নি; লোকটি নিরুৎসাহ হয়ে পড়েছে; এখানে আসার জন্য দুঃখিতও হয়েছে। কিন্তু হঠাৎ তার পক্ষে হাওয়া বদলে গেল। প্রথমে একজন, তারপর আর একজন প্রধান নাগরিকের স্ত্রী তার কাছে এসে গোপনে বলল:

সোমবার আমার বাড়িতে আসন-কিন্তু আপাতত এ বিষয়ে কাউকে কিছু বলবেন না। আমরা বাড়ি তৈরি করার কথা ভাবছি।

একদিনেই সে পেল এগারোটা প্রস্তাব। সেই রাতেই মেয়েকে চিঠি লিখে তার ছাত্রের সঙ্গে বিয়েটা ভেঙে দিতে বলল। আরও জানিয়ে দিল, এবার সে অন্তত মাইল খানের উঁচু কোন ঘরে বিয়ে করতে পারবে।

ব্যাংকার পিংকার্টন ও অপর দু-তিনজন ধনী লোক গ্রামাঞ্চল থেকে নির্বাচনে দাঁড়াবার কথা ভালেও আপাতত অপেক্ষা করতে লাগল। তাদের মত লোকরা ডিম ফুট বার আগেই তার হিসাব করে না।

উইলসনরা একটা চমৎকার নতুন জিনিসের কথা ভাবল-একটা ফ্যান্সি-ড্রেস বল-নাচ। কাউকে পাকা কথা দিল না বটে, কিন্তু পরিচি ত সকলকেই গোপনে জানিয়ে দিল যে ও রকম একটা নাচের কথা তারা ভাবছে-এবং সেটা ঠিক হলে আপনাকে অবশ্যই আমন্ত্রণ জানানো হবে! সকলেই অবাক হল; পরস্পরকে বলল, আরে, ওদের কি মাথা খারাপ হয়েছে না কি; গরিব মানুষ উইলসনরা এটা করতেই পারে না। উনিশ জনের মধ্যে কেউ কেউ আবার তাদের স্বামীদের বলল, মতলবটা ভালই; আপাতত আমরা চুপচাপ থাকি; তারপর তাদের এই সস্তার ব্যাপারটা হয়ে গেলেই এমন একটা বল-এর ব্যবস্থা করব যে ওদের চোখ ট্যারা হয়ে যাবে।

যত দিন যেতে লাগল, টাকা উড়াবার অংক ততই চড়তে লাগল, ততই উদ্দাম, ততই বেপরোয়া ও অর্থহীন হয়ে উঠতে লাগল। ভাবগতিক দেখে মনে হল, প্রতিশ্রুত ডলার পাবার আগেই উনিশ জনের প্রত্যেকেই পুরো চল্লিশ হাজার ডলার তো খচ করবেই, উপরন্তু বেশ কিছু ধার-কর্জও করবে। কোন কোন ক্ষেত্রে কিছু স্বল্পবুদ্ধির মানুষ শুধু খরচের পরিকল্পনা করেই ক্ষান্ত হল না, ধারে সত্যি খরচ ও করে বসল। জমি মর্টগেজ, খামার, শেয়ার, ভাল পোশাক, ঘোড়া ও আরও নানা জিনিস কিনল, কিছুটা আগাম দিল, বাকি টাকা দশ দিনের মধ্যে শোধ করে দেবার ওয়াদা করল।

আরও একটি লোক বড়ই বিপাকে পড়ল-রেভঃ মিঃ বার্জেস। দিনের পর দিন যেখানেই সে যায়, লোকে তার পিছু নেয়, অথবা তাকে খুঁজে বের করে; একটু নিরিবিলিতে পেলেই উনিশ জনের যে কোন একজন তার কাছে হাজির হয়ে গোপনে তার হাতে একটা খাম ওঁজে দিয়ে ফিস্ ফিস্ করে বলে, শুক্রবার সন্ধায় টাউন হলে খুলবেন, আর তারপরেই দোষী মানুষের মত হাওয়া হয়ে যায়। সে ভেবেছিল ঐ বস্তার একজন দাবীদার হয় তো পাওয়া যাবে-যদিও গুড সন-এর মৃত্যুর ফলে সে বিষয়েও তার সন্দেহ ছিল-কিন্তু এতগুলো দাবীদার যে থাকতে পারে এটা সে ভাবতেই পারে নি। অবশেষে মহান শুক্রবার এসে পড়লে সে দেখল, উনিশটা খাম তার হাতে এসে জমেছে।

.

০৩.

আগে কখনও টাউন-হলকে এত ভাল করে সাজানো হয় নি। হলের শেষ প্রান্তে অবস্থিত মঞ্চের পিছন দিকটা পতাকা নিয়ে। আগাগোড়া চমৎকারভাবে সাজিয়ে দেওয়া হয়েছে; দেওয়াল জুড়ে ফাঁকে ফাঁকেই ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে পতাকার মালা; গ্যালারির সামনেটা পতাকা দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়েছে; প্রতিটি খাম পতাকা দিয়ে মুড়ে দেওয়া হয়েছে। টাউনহল লোক সমাগমে পরিপূর্ণ। ৪১২টি স্থায়ী আসন ছাড়াও ৬৮টি বাড়তি আসন দেওয়া হয়েছে। সব পূর্ণ। মঞ্চের সিঁড়িতেও লোক বসেছে; কিছু বিশিষ্ট অভ্যাগতকে মাঞ্চের উপরেই স্থান দেওয়া হয়েছে; মঞ্চের সম্মুখভাগে অবস্থিত অশ্বক্ষুরাকৃতি টেবিলকে ঘিরে বসেছে দেশ-বিদেশ থেকে সমাগত বিশেষ সংবাদদাতার দল।

সোনার বস্তাটাকে মঞ্চের সামনে একটা ছোট টেবিলের উপর এমনভাবে রাখা হয়েছে যাতে সমবেত সকলেই সেটা দেখতে পায়। হলের অধিকাংশ লোকই সেটার দিকে তাকিয়ে আছে জ্বলন্ত আগ্রহে, মুখে জল আসা আগ্রহে, সকরুণ তৃষ্ণার্ত আগ্রহে; উনিশটি দম্পতি সেটাকে দেখছে ভালবাসায় ভরা মালিকানার দৃষ্টিতে, আর তাদের পুরুষ সঙ্গীরা মনে মনে সেই বক্তৃতাটির মহলা দিয়ে চলেছে যেটা তাদের একটু পরেই দিতে হবে উপস্থিত শ্রোতাবৃন্দের সমর্থন ও অভিনন্দনের উত্তরে কৃতজ্ঞতা জানাবার জন্য। মাঝে মাঝেই তাদের মধ্যে কেউ না কেউ পকেট থেকে একটু করো কাগজ বের করে লুকিয়ে সেটা দেখে নিয়ে স্মৃতিকে একটু ঝালিয়ে নিচ্ছে।

সারা হলে মৃদু গুঞ্জনের ঢেউ-এ রকমটাই হয়ে থাকে। কিন্তু অবশেষে রেভাঃ মিঃ বার্জেস যখন উঠে এসে বস্তাটার উপর হাত রাখল, অমনিই সব চুপ হয়ে গেল। বস্তাটি র আশ্চর্য ইতিহাস বিকৃত করে সে উল্লেখ করে চলল অকলংক সতোর জন্য হ্যাঁলিবুর্গ-এর। প্রাচীন ও সু-অর্জিত সুখ্যাতির কথা, আর সেই সুখ্যাতির জন্য শহরের সঙ্গত গর্বের কথা। সে বলতে লাগল, এই খ্যাতি একটি অমূল্য সম্পদ; ঈশ্বরের ইচ্ছায় তার মূল্য আজ অপরিমেয় ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে, কারণ সাম্প্রতিক এই ঘটনার ফলে এই খ্যাতি বহু দূর দূর দেশে ছড়িয়ে পড়েছে, গোটা মার্কিন মুলুকের দৃষ্টি পড়েছে এই গ্রামের উপর, আর তারা আশা ও বিশ্বাস মতে হাড় লিবুর্গের নাম চিরদিনের মত ব্যবসায়িক মদূষণীয় চরিত্রের সমার্থবাচক হয়ে বেঁচে থাকবে। [সোল্লাস সমর্থন] আর এই মহান সম্পদের অভিভাবক হবে কে-গোটা সমাজ কি? না! সে দায়িত্ব ব্যক্তিগত, সামাজিক নয়। আজ থেকে আপনারা প্রত্যেকেই ব্যক্তিগতভাবে এর একজন বিশেষ অভিভাবক; এর যাতে কোন ক্ষতি না হয় সেজন্য আপনারা প্রত্যেকেই ব্যক্তিগতভাবে দায়ী থাকবেন। এই গুরু দায়িত্ব আপনারা-প্রত্যেকেই গ্রহণ করছেন তো? [সরব সম্মতি] তাহলে তো সবই ঠিক আছে। এই দায়িত্বের ভার আপনাদের সন্তান ও তাদের সন্তানদের দিয়ে যাবেন। আজ আপনাদের সমাজে এমন একটি প্রাণীও নেই যে নিজের নয় এমন একটি কপর্দককেও লোভের বশে পর্শ করবে-দেখবেন এই গুণ যেন চিরদিন অক্ষুণ্ণ রাখতে পারেন। [রাখব! আমরা রাখব!] অন্য সমাজের সঙ্গে আমাদের তুলনা। করবার স্থান এটা নয়-তাদের কেউ কেউ আমাদের প্রতি বিরূপ; তারা তাদের পথে চলুক, আমরা চলি আমাদের পথে; তাতেই আমরা তুষ্ট। [সমর্থন] আমার কথা শেষ হল। বন্ধুগণ, আমার হাতের নীচে রয়েছে এমন একটা বস্তু যেটা আমাদের সততা সম্পর্কে একটি অপরিচিত মানুষের সরব স্বীকৃতি; তার হাত দিয়েই জগৎ আজ আমাদের স্বরূপ জানতে পারবে। তার পরিচয় আমরা জানি না, কিন্তু আপনাদের নামে আমি তার প্রতি আপনাদেরই কৃতজ্ঞতার বাণী উচ্চারণ করছি, আর অনুরোধ করছি, আপনারাও এক কণ্ঠে তাকে সমর্থ করুন।

সকলেই উঠে দাঁড়াল। দীর্ঘ এক মিনিট ধরে তাদের কৃতজ্ঞতার বজ্রগর্জনে ঘরের দেয়াল অবধি কেঁপে উঠল। তারপর সকলে আসন গ্রহণ করলে মিঃ বার্জেস পকেট থেকে একটা খাম বের করল। ধীরে ধীরে জোর গলায় সে চিঠির বক্তব্যটা পড়তে লাগল-শ্রোতারা মন্ত্রমুগ্ধের মত সেই যাদু-দলিলের কথাগুলি শুনতে লাগল-তার প্রতিটি শব্দ যেন এক একটি সোনার পিণ্ড:

বিপন্ন আগন্তুকের প্রতি যে মন্তব্য আমি করেছিলাম সেটা এই:

আপনি খুব খারাপ লোক হতে পারেনন নাঃ যান, সকলকে সংশোধন করুন।

তারপর সে আবার পড়তে শুরু করল।

এই মুহূর্তেই আমরা জানতে পারব এই মন্তব্যটি বস্তার ভিতরে লুকিয়ে রাখা মন্তব্যের সঙ্গে মেলে কি না,-আর তা যদি মেলে-নিঃসন্দেহে মিলবে-তাহলেই এমন একজন সৎ-নাগরিক এই সোনার বস্তার মালিক হবেন যিনি আজ হতে জাতির সম্মুখে সততার মূর্ত প্রতীক হিসাবে দেখা দেবেন-মিঃ বিলসন!

সমবেত শ্রোতারা একটা সোচ্চার সমর্থন জানাবার জন্য অনেকক্ষণ থেকেই প্রস্তুত হয়ে ছিল; কিন্তু তার বদলে তারা যেন পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়ল; দু-এক মিনিট গভীর নিস্তব্ধ তার পরে শুধু শোনা গেল অস্পষ্ট গুঞ্জন-ধ্বনি।

এমন সময় আর এক অবাক কাণ্ড! হলের এক কোণে মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে আছে ডি য়েকন বিন, আর অপর কোণে সেই একই ভাবে দাঁড়িয়ে আছে উকিল উইলসন।

সকলেই বিভ্রান্ত; উনিশটি দম্পতি বিস্মিত ও ক্ষুব্ধ।

বিলসন ও উইলসন পরস্পরের দিকে তাকাল। বিলসন তীক্ষ্ণ গলায় প্রশ্ন করল, আপনি দাঁড়ালেন কেন মিঃ উইল্সন?

যেহেতু দাঁড়াবার অধিকার আমার আছে। কিন্তু আপনি কেন দাঁড়ালেন, আশা করি ভাল মানুষের মত সে কথাটা সকলকে বুঝিয়ে বলবেন?

অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে। যেহেতু ওই কাগজটা আমিই লিখেছিলাম।

নির্লজ্জ মিথ্যা কথা! ওটা আমি নিজে লিখেছি।

এবার বার্জেস-এর বিভ্রান্ত হবার পালা। অর্থহীন দৃষ্টিতে সে একবার এর দিকে, একবার ওর দিকে তাকাতে লাগল; কি যে করবে বুঝেই উঠতে পারছে না। গোটা হল হতবাক। উকিল উইন বলল:

ঐ কাগজে যে নাম স্বাক্ষর করা হয়েছে সেটা পড়তে আমি সভাপতিকে অনুরোধ করছি।

এতক্ষণে সভাপতি আত্মস্থ হল, নামটা পড়ে দিল:

জন হোয়ার্টন বিলসন।

হল তো! বিলসন চেঁচিয়ে বলল। এবার নিজের পক্ষে কি বলবেন? আর এখানে যে জোচ্চুরির অভিনয় করার চেষ্টা করেছেন তার জন্য আমার কাছে এবং অপমানিত সমবেত সকলের কাছে কী ধরনের ক্ষমা চাইবেন বলুন?

ক্ষমা চাইবার কোন প্রশ্নই ওঠে না; উপরন্তু আমি প্রকাশ্যে আপনার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনছি, মিঃ বার্জেস-এ কাছ থেকে আমার চিঠি চুরি করে এনে তারই একটি অনুলিপিতে নিজের নাম সই করে আপনি তাকে পাঠিয়েছেন। অন্য কোন ভাবে ঐ মন্তব্য আপনার হাতে আসতে পারে না। জীবিত লোকদের মধ্যে একমাত্র আমিই এই চিঠির বয়ান জানতাম।

এ ভাবে চলতে থাকলে নিশ্চয়ই একটা কেলেংকারির সৃষ্টি হত; সকলেই সখেদে লক্ষ্য করল, সংক্ষেপ-লিপিকাররা পাগলের মত লিখে যাচ্ছে। অনেকে চীৎকার করে বলে উঠল: সভাপতি! শান্তি! শান্তি!

মিঃ বার্জেস হাতুড়ি পিটিয়ে বলল:

যথাযথ সৌজন্য যেন আমরা ভুলে না যাই। বোঝাই যাচ্ছে, কোন জায়গায় একটা ভুল হয়েছে; নিশ্চয়ই তার বেশী কিছু নয়। মিঃ উইলসন যদি আমাকে একটা খাম দিয়ে থাকেন-এখন মনে পড়ছে তিনি দিয়েছিলেন-তো সেটা আমার কাছেই আছে।

পকেট থেকে একটা খাম বের করে সেটা খুলে চোখ বুলিয়ে সে বিস্মিত ও বিব্রতভাবে কয়েক মুহূর্ত চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল।

সকলে বলে উঠল: পড়ুন! পড়ুন! ওতে কি লেখা আছে?

যেন ঘুমের ঘোরে বিমূঢ়ভাবে সে পড়তে লাগল:

দুঃখী আগন্তুকের প্রতি আমি যে মন্তব্য করেছিলাম সেটা এই: আপনি খারাপ লোক হতে পারেন না। [গোটা হল অবাক হয়ে হাঁ করে তাকিয়ে রইল] যান, সকলকে সংশোধন করুন।

[গুঞ্জন: অবাক কাণ্ড! এর অর্থ কি?] সভাপতি বলল, এটাতে সই রয়েছে থালো জিউ ইন।

উইল বলল, ব্যাস! আমি তো মনে করি সব মিটে গেল! আমি জানতাম, আমার চিঠিটা চুরি হয়েছিল।

বিলসন পাল্টা আক্রমণ করল, চুরি! আপনাকে সপষ্ট বলে দিচ্ছি, আপনার বা আপনার জ্ঞাতি-গুষ্টির কারও এত সাহস নেই।

সভাপতি: শান্তি! শান্তি! দয়া করে আপনারা দুজনেই বসে পড়ুন।

মাথা নেড়ে সক্রোধে আপত্তি জানিয়ে তারা বসে পড়ল। সভাস্থ সকলেই অত্যন্ত বিভ্রান্ত হয়ে পড়ল; কেউ বুঝতে পারছে না, এই অদ্ভুত পরিস্থিতিতে কি করা হবে। ইতিমধ্যে টম্পসন উঠে দাঁড়াল। টুম্পসন জুতো তৈরি করে। উনিশ জনের একজন হবার বাসনা তার ছিল; কিন্তু হতে পারে নি; ওই পদের অধিকারী হবার মত যথেষ্ট টুপির মালিক সে ছিল না। সে বলল:

সভাপতি মশাই, আমাকে যদি একটা পরামর্শ দেবার অনুমতি দেন তো বলি, এটা কি হতে পারে যে এরা দুজনেই ঠিক বলছেন? আপনিই বিচার করে দেখুন স্যার, ঘটনাক্রমে দুজনেই ঠিক বলছেন? আপনিই বিচার করে দেখুন স্যার, ঘটনাক্রমে দুজনেই কি আগন্তুককে একই কথা বলতে পারে না? আমার তো মনে হয়-

মুচি উঠে দাঁড়িয়ে বাধা দিল। সেও মনে মনে ক্ষুব্ধ; সেও নিজেকে উনিশ জনের একজন হবার উপযুক্ত বলে ভাবে; কিন্তু তাকে স্বীকৃতি দেওয়া হয় নি। সে বলল: সেটা তো কথা নয়! একশ বছরে দুবার হয়তো সে রকমটা ঘটতে পারে কিন্তু অন্য দিকটা তো তা। নয়। তারা কেউ ই তো কুড়ি ডলার দেন নি!।

[সমর্থনের ঢেউ বয়ে গেল।]

বিলসন: আমি দিয়েছি।

উইল্সন: আমি দিয়েছি।

তখন একজন আরেক জনের বিরুদ্ধে চুরির অভিযোগ তুলল।

সভাপতি: শান্তি দয়া করে দুজনেই বসে পড়ুন। কোন চিরকুট ই কোন সময় আমার হাতছাড়া হয় নি।

কে যেন বলল: ভাল-তবে তো মিটেই গেল।

মুচি: সভাপতি মশাই, একটা কথা বেশ পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে: এই দুজনের একজন নির্ঘাৎ অপর জনের বিছানার নীচে ঘাপটি মেরে থেকে পারিবারিক গোপন কথা শুনে নিয়েছে। কথাটা যদি পার্লামেন্টারী রীতি বিরোধী না হয় তো বলি দুজনেই এ কাজ করে থাকতে পারেন। [সভাপতি: শান্তি! শান্তি!] আমার মন্তব্য প্রত্যাহার করে নিয়ে শুধু এইটুকু বলতে চাই যে, মন্তব্যের ব্যাপারটাকে একজন যখন তার স্ত্রীকে বলছিলেন তখন যদি অপর জন লুকিয়ে সেটা শুনে থাকেন তো তাকে বের করতে হবে।

একটি কণ্ঠ স্বর: কেমন করে?

মুচি: সহজেই। মন্তব্যটাকে দুজন হুবহু একই ভাষায় উদ্ধত করেন নি।

একটি কণ্ঠ স্বর: তফাৎটা কোথায় আছে বলুন।

মুচি : 

বিলসনের চিঠিতে খুব কথাটা আছে, অন্য চিঠিটাতে নেই।

অনেক কণ্ঠ : ঠিক কথা-উনি ঠিক বলেছেন!

মুচি: কাজেই সভাপতি মশাই যদি বস্তার ভিতরকার মূল মন্তব্যটা পরীক্ষা করে দেখেন তাহলেই আমরা বুঝতে পারব এই দুই জোচ্চোরেরে-[সভাপতি: শান্তি!] এই দুই অতিলোভী দুঃসাহসিকের-[সভাপতি: শান্তি! শান্তি!] এই দুই ভদ্রলোকের-[হাসি ও সমর্থন] মধ্যে কোনটি এই শহরের প্রথম অসৎ পাষণ্ড যে এই শহরেই জন্মগ্রহণ করে একেই কলংকিত করেছে এবং এখন থেকে যার পক্ষে এখানে বাস করা শক্ত হয়ে উঠবে! [প্রচণ্ড উল্লাস।]

অনেক কণ্ঠ : খুলে ফেলুন!-বস্তাটা খুলে ফেলুন!

মিঃ বার্জেস বস্তার গায়ে একটা ফাঁস সৃষ্টি করে ভিতরে হাত ঢুকিয়ে একটা খাম বের করে আনল। তার মধ্যে ছিল কয়েকটি ভাঁজ-করা চিরকুট। সে বলল:

এর মধ্যে একটায় লেখা, সভাপতির (যদি কেউ থাকেন) কাছে লেখা সব চিঠি পত্র পড়া সেষ হবার আগে এটা পরীক্ষা করা চলবে না। অপরটিতে লেখা, পরীক্ষা। আপনারা অনুমতি করুন। এতে লেখা আছে:

আমার উপকারীরা যে মন্তব্য করেছিলেন তার প্রথম অর্ধংশের যথাযথ উদ্ধৃতির কোন প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না, কারণ। সেটুকু উল্লেখযোগ্য নয় এবং ভুলে গেলেও চলে; কিন্তু তার শেষের পনেরোটি শব্দ খুবই উল্লেখযোগ্য এবং সহজেই মনে রাখবার মত; সেই শব্দগুলি যদি সঠিকভাবে উল্লেখভাবে উল্লেখিত না হয় তাহলে প্রার্থীকে জোচ্চোর মনে করা যেতে পারে। আমার উপকারী। গোড়াতেই বলেছিলেন যে তিনি সাধারণত কাউকে পরামর্শ দেন, কিন্তু যদি কখনও দেন তাহলে সেটা খুবই উঁচু দরের হয়ে থাকে। তারপরেই তিনি এই কথাগুলি বললেন–কথাগুলি কখনই আমার স্মৃতি থেকে মুছে যায় নিঃ আপনি খারাপ লোক হতে পারেন না-

পঞ্চাশটি কণ্ঠস্বর: তাহলে তো মিটে ই গেল-উইন! উইন! উ ইন! বক্তৃতা! বক্তৃতা!

সকলে লাফিয়ে উঠে উইল্সনকে ঘিরে ধরল, তার হাত চেপে ধরে অতি-উৎসাহের সঙ্গে অভিনন্দন জানাল-আর এদিকে সভাপতি হাতুড়ি ঠুকে চীৎকার করতে লাগল:

শান্তি, ভদ্রজনেরা, শান্তি! শান্তি! চিঠি টা শেষ করতে দিন।

সকলে শান্ত হলে আবার চিঠি পড়া শুরু হল:

যান, সকলকে সংশোধন করুন-অন্যথায়, আমায় কথাগুলি লক্ষ্য করুন-আপনার পাপের জন্য যে কেন দিন আপনার মৃত্যু ঘটবে এবং নরকে অথবা হ্যাডলিবুর্গ-এ যাবেন-প্রথমটায় যেতেই চেষ্টা করুন।

একটা ভৌতিক নিস্তব্ধতা নেমে এল। প্রথমে নাগরিকদের মুখের উপর নেমে এল। প্রথমে নাগরিকদের মুখের উপর নেমে এল। ক্রোধের একটা ঘন কালো মেঘ; একটু পরে মেঘটা সরে যেতে লাগল; দেখা দিল একটা হাল্কা হাসির আভাষ; অনেক কষ্টে সকলে সেটাকে চেপে রাখল; প্রতিবেদকরা, ব্রিক্সট নবাসীরা, ও অন্য আগুন্তকরা মাথা নীচু করে দুই হাতে মুখ ঢেকে আপ্রাণ চেষ্টায় ও প্রচণ্ড সৌজন্যবোধে সে হাসিকে চেপে রাখল। তারপর সকলেই উঠে দাঁড়াল-স্বদেশী ও বিদেশী সকলেই। এমন কি মিঃ বার্জেসের গাম্ভীর্যও খসে পড়ল, আর তখনই সমবেত সকলে বুঝল যে সংযমের সরকারী দায় শেষ হয়েছে। আর যায় কোথায়! সে এক দীর্ঘ সময়ব্যাপী হাসি, ঝড়ের গতিতে বয়ে যাওয়া প্রাণ-খোলা হাসি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সে হাসিও থামল; সকলে চোখ-মুখ মুছে সোজা হয়ে বসল; মিঃ বার্জেসও মুখ খুলতে চেষ্টা করল; তখনই আবার হাসির বাঁধ ভাঙল; তারপর আবার; শেষ পর্যন্ত বাসে কোন রকমে এই কথাগুলি বলতে পারলঃ

ঘটনাকে চাপা দেওয়ার চেষ্টা করে কোন লাভ নেই-আমরা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়ের সম্মুখীন হয়েছি। আপনাদের শহরের সম্মান এর সঙ্গে জড়িত, এতে শহরের সুনামের মূলে আঘাত করা হয়েছে। মিঃউ ইন ও মিঃ বিন যে দুটি মন্তব্য পেশ করেছেন তাদের মধ্যে যে একটি শব্দের ফারাক ঘটেছে সেটাই তো যথেষ্ট গুরুতর, কারণ তা থেকে বোঝা যাচ্ছে এই দুটি ভদ্রলোকের যে কোন একজন চুরি করেছেন-

বিধ্বস্ত, বিকলাঙ্গপ্ৰায়ভাবে দুজন বসে ছিল; কিন্তু এই কথা শুনেই তারা বিদ্যুৎগতিতে উঠে দাঁড়াতে চেষ্টা করল

বসুন! সভাপতি কঠোর কঠে বলল। আর তারাও সে আদেশ মানল।

আগেই বলেছি, সেটাই যথেষ্ট গুরুতর। তবে তাদের যে কোন একজনের পক্ষে। কিন্তু এখন ব্যাপারটা আরও গুরুতর হয়ে উঠেছে, কারণ এখন দুজনের সম্মানই ভীষণভাবে বিপন্ন। আরও একটু এগিয়ে আমি কি বলব-সে বিপদ থেকে তাদের আর উদ্ধার নেই।? দুজনেই সেই মোক্ষম পনেরোটি কথাকে বাদ দিয়েছেন। মিঃ বার্জেস থামল। সেই ফাঁকে সর্বত্র পরিব্যাপ্ত স্তব্ধতা আরও ঘন হলে, আরও গম্ভীর হলে সে আবার মুখ খুলল: মাত্র একটি পথেই এটা ঘটতে পারে। তাই এই ভদ্রলোকদের আমি জিজ্ঞাসা করি-দুজনের মধ্যে কি কোন যোগসাজস ছিল??-ছিল কোন চুক্তি??

একটা মৃদু গুঞ্জন সমস্ত ঘরটায় ছড়িয়ে পড়ল; আর অর্থ: এবার দুজনকেই বাগে পেয়েছেন।

বিলসন কোন আকস্মিক পরিস্থিতিতে অভ্যস্ত নয়; সে নিরাশায় ভেঙে পড়ল। কিন্তু উইন উকিল মানুষ। চিন্তিত বিবর্ণ মুখে সে কোন রকমে উঠে দাঁড়াল। বলল:

এই বেদনাদায়ক ব্যাপারটি বুঝিয়ে বলবার আগে আমি আপনাদের সকলের কাছেই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। যে কথা বলতে যাচ্ছি সেজন্য আমি দুঃখিত, কারণ তার ফলে মিঃ বিলসনের অপূরণীয় ক্ষতি হবে। আজ পর্যন্ত তাকে আমি যথেষ্ট সম্মান ও শ্রদ্ধা করে এসেছি, আর আপনাদের সকলের মতই আমিও বিশ্বাস করতাম যে সব রকম প্রলোভনের তিনি উর্ধে। কিন্তু নিজের সম্মান রক্ষার জন্য অত্যন্ত লজ্জার সঙ্গে এ কথা বলতে আমি বাধ্য-সেজন্য আপনাদের কাছে আমি ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি-যে মূল মন্তব্যের শেষ পনেরোটি মানহারিকর শব্দ সহ সবগুলি কথাই আমি সেই সর্বস্বান্ত আগন্তুককে বলেছিলাম। [চাঞ্চল্য] সাম্প্রতিক ঘোষণাটি প্রকাশিত হতেই কথাগুলি আমার মনে পড়ে যায় আর আমিও স্বর্ণমুদ্রাভর্তি বস্তাটা দাবী করব বলে স্থির করি, কারণ সব দিক থেকেই সেটা পাবার অধিকার আমার ছিল। এবার আপনাদের আমি একটি কথা ভাল করে বিচার বিবেচনা করে দেখতে বলব: সে রাতে সেই আগন্তুকের আমার প্রতি কৃতজ্ঞতার সীমা ছিল না; সে নিজেই বলেছিল যে কৃতজ্ঞতা প্রকাশের উপযুক্ত ভাষা যে খুঁজে পাচ্ছে না এবং কখনও ক্ষমতায় কুলোলে সে-ঋণ সে হাজার গুণ করে ফি রিয়ে দেবে। এবার আমি আপনাদের জিজ্ঞাসা করি: আমি আশা করিতে পারি-বিশ্বাস করতে পারি-এমন কি দূরতম কল্পনায়ও আনতে পারি-যে এই মনোভাবের পরেও তার পরীক্ষার সঙ্গে সম্পূর্ণ অপ্রয়োজনীয় এই পনেরোটি শব্দ জুড়ে দেবার মত অকৃতজ্ঞ সে হতে পারে?-আমার জন্য এমন একটা ফাঁদ সে পাততে পারে?-একটি প্রকাশ্য সভায় আমারই আপনার জনদের সম্মুখে আমাকে আমার শহরের কুৎসাপ্রচারকারীরূপে প্রচার করতে পারে? এটা তো অস্বাভাবিক, অসম্ভব। তার পরীক্ষায় থাকা উচিত ছিল শুধু আমার মন্তব্যের গোড়ার দিকটা। সে বিষয়ে আমার মনে সন্দেহের ছায়ামাত্র ছিল না। আপনারাও এ অবস্থায় আমার মতই ভাবতেন। যাকে আপনারা বন্দু হিসাবে গ্রহণ করেছিলেন, যার প্রতি কোন অন্যায় আপনারা করেন নি তার কাছ থেকে এই হীন বিশ্বাসঘাতকতা নিশচয়ই আপনারা আশা করতেন না। আর সরল বিশ্বাসে, পরিপূর্ণ আস্থায় একটু করো কাগজ শুধু গোড়ার দিককার কথা লি লিখেই যাও, সকলকে সংশোধন কর দিয়ে শেষ করে দিয়েছিলাম। চিঠিটা খামে ভরতে যাব এমন সময় পিছনের আপিস থেকে ডাক আসায় কোন কিছু না ভেবেই কাগজটাকে ডেস্কের উপর রেখে চলে গিয়েছিলাম। সে থামল, ধীরে ধীরে বিলনের দিকে মাথাটা ঘোরাল, একটু অপেক্ষা করল, তারপর বলতে লাগল: এই কথাটা। টুকে নিন: একটু পরে যখন ফিরে এলাম তখন মিঃ বিন আমার ঘরের রাস্তায় দিককার দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেলেন।

[চাঞ্চল্য]

মুহূর্তের মধ্যে বিলসন উঠে দাঁড়িয়ে চীৎকার করে বলল:

মিথ্যে কথা! জঘন্য মিথ্যে!

সভাপতি: আপনি বসুন স্যার! এখন মিঃ উইলসনের বলার পালা।

বিলসনের বন্ধুরা তাকে টেনে বসিয়ে শান্ত থাকতে বলল। উ ইসন বলতে লাগল:

ঘটনাগুলি খুবই সরল। আমি যেখানে চিঠিটা রেখে গিয়েছিলাম তখন আর সেটা সেখানে ছিল না, টেবিলের উপরেই অন্য জায়গায় ছিল। সেটা আমার নজরে এলেও তখন কোন গুরুত্ব দেই নি; ভেবেছিলাম হাওয়ায় উড়ে গেছে। মিঃ বিন যে একটা গোপন চিঠি পড়তে পারেন সেটা আমার মাথায়ই আসে নি; তিনি একজন সম্মানিত ব্যক্তি, তাঁর তো এ সবের উর্ধ্বে থাকবারই কথা। যদি অনুমতি করেন তো বলি, তাঁর ঐ বাড়তি খুব কথাটারও একটা ব্যাখ্যা আছে; ওটা স্মৃতিশক্তির ত্রুটি র ফ ল। আমার কথা এখানেই শেষ।

উচ্ছ্বাসপূর্ণ বক্তৃতার মত জিনিস পৃথিবীতে দ্বিতীয়টি নেই। উইন বিজয়গৌরবে আসন গ্রহণ করল। সোচ্চার সমর্থনের বন্যায় শ্রোতৃবর্গ তাকে ভাসিয়ে দিল; বন্ধুরা এসে ভিড় করে হাত চেপে ধরে তাকে অভিনন্দন জানাল; আর তাদের চীৎকার চেঁচামেচিতে বিন একটা কথাও বলতে পারল না। সভাপতি হাতুড়ির পর হাতুড়ি পিট তে লাগল; বারবার চীৎকার করে বলল:

ভদ্রজনেরা, আমাদের কাজ চালাতে দিন, আমাদের কাজ চালাতে দিন।

অবশেষে পরিবেশ কিছুটা শান্ত হলে টুপিওলা বলল:

টাকাটা দিয়ে দেওয়া ছাড়া আর কি কাজ বাকি আছে স্যার?

অনেক কঠ :ঠিক! ঠিক! এগিয়ে এস উইলসন!

টুপিওলা: মিঃ উইন্সনের জন্য আমি তিনবার জয়ধ্বনি করছি; তিনি সেই বিশেষ গুণের প্রতীক যা-

তার কথা শেষ হবার আগেই সকলে জয়ধ্বনি করে উঠল; সেই সঙ্গে বারবার শোনা যেতে লাগল হাতুড়ির কর্কশ শব্দ; আর তারই মধ্যে কিছু উৎসাহী ভক্ত উইল্সনকে জনৈক বৃষষ্কন্ধবন্ধুর ঘাড়ে চড়িয়ে সগৌরবে মঞ্চের দিকে নিয়ে চলল। এদিকে সেই সব। হট্টগোলকে ছাপিয়ে শোনা গেল সভাপতির কঠ স্বর:

শান্তি! যার যার জায়গায় চলে যান! আপনারা ভুলে যাচ্ছেন যে এই দলিলটি পড়া এখনও শেষ হয় নি। সকলে শান্ত হলে সে দলিলটা হাতে তুলে নিল; পড়তে গিয়েও সেটাকে নামিয়ে রেখে বলল, আমি ভুলে গিয়েছিলাম; যে সব চিঠিপত্র আমি পেয়েছি সেগুলো সব পড়া শেষ না করে তো এটা পড়া চলবে না। পকেট থেকে একটা খাম বের করে তার ভিতর থেকে চিঠিটা হাতে নিয়ে সেটার উপর চোখ বুলিয়ে নিল-তাকে বিস্মিত বোধ হল-সামনে তুলে ধরে চিঠি টার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে রইল।

বিশ-ত্রিশটি কণ্ঠ সুর চীৎকার করে বলল:

ওটা কি? পড়ুন! পড়ুন!

ধীরে ধীরে বিস্মিত গলায় সে পড়তে লাগল:

আগন্তুকের প্রতি যে মন্তব্য আমি করেছিলাম-[অনেক কণ্ঠ : ওহে! এটা আবার কি?]-সেটা এই: আপনি খারাপ মানুষ হতে পারেন না, [অনেক কাঠ? মহান স্কট!] যান, সকলকে সংশোধন করুন। স্বাক্ষর করেছেন ব্যাংকার পিংকার্টন।

এবার ফুর্তি চরমে উঠে এমন হৈ-হট্টগোল শুরু হল যে বিবেচনাশীল লোকদের কান্না পেয়ে গেল। গোঁফে তা দেবার বয়স যাদের হয় নি তারা হাসতে হাসতে কেঁদে ফেলল; হাসির দমকে প্রতিবেদকরা এমন সব হিজিবিজি লিখতে লাগল কোন দিন যার পাঠোদ্ধার করা যাবে না; একটা ঘুমন্ত কুকুর হঠাৎ লাফিয়ে উঠে ভাবাচেকা খেয়ে ঘেউ ঘেউ শুরু করে দিল। গোলমালের মধ্যে নানা রকম কথা শোনা যেতে লাগল: আমরা তো ধনী হতে চলেছি-অদূষণীয় চরিত্রের দুটি প্রতীক!- বিলসনকে না ধরেই! তিন!-শ্যাড়বেলিকের ব্রা হোক!-কত বেশী আর ধরা যায়! ঠিক আছে- বিলসন নির্বাচিত! হায় বেচারি উইলসন-দুই চোরের শিকার!

একটি জোরালো কঠ: চুপ করুন! সভাপতি পকেট থেকে আরও মাল বের করছেন।

অনেক কণ্ঠ: হুররে! নতুন কিছু কি? পড়ুন! পড়ুন! পড়ুন!

সভাপতি [পড়তে লাগল ]: যে মন্তব্য আমি ইত্যাদি; আপনি খারাপ লোক হতে পারেন না; যান ইত্যাদি। স্বাক্ষর, গ্রেগরি ইয়েট স্।

কঠ সুরের ঝড় বেয়ে গেল; চারটি প্রতীক! হুররে ইয়েট স! আরও কি মাল আছে বের করুন!

সারা হল হাসি-ঠাট্টায় ফেটে পড়তে লাগল। শুধু মজা আর মজা। উনিশ জনের কয়েকজন গুটি গুটি দরজার দিকে পা বাড়াতে বহু কন্তর ধ্বনি উঠল:

দরজা, দরজা-সব দরজা বন্ধ করে দাও; অদূষণীয় চরিত্রবানদের কেউ এ স্থান ত্যাগ করতে পারবে না! সকলে বসে পড়ুন!

সে আদেশ সকলে মাথা পেতে নিল।

আরও মাল বের করুন! পড়ুন! পড়ুন!

সভাপতি আবার চিঠি বের করল; তার ঠোঁট থেকে সেই পরিচিত কথাগুলিই ঝরে পড়ল-আপনি খারাপ লোক হতে পারেন না।

নাম! নাম! নামটা কি?

এল, ইনগোল্ড সবি সার্জেন্ট।

পাঁচ জন নির্বাচিত! প্রতীক বাড়ছে! বলে যান, বলে যান!

আপনি খারাপ লোক হতে পারেন না

নাম! নাম!

নিকোলাস হুইট ওয়ার্থ।

হুররে! হুররে! আজ তো প্রতীক-দিবস!

একদল লোক হা-হা করে মিকাডোর সুরে গান জুড়ে দিল-পুরুষ যখন ভয়ে ভীত, সুন্দরী তখন-

এবার ডজনখানেক লোক উঠে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ জানাল। তারা বলল, এই প্রহসন নিশ্চয় কোন দল-ছুট জোকারের কাণ্ড; এটা সমগ্র সমাজের প্রতি অপমানস্বরুপ। কোন সন্দেহ নেই যে এই স্বাক্ষরগুলি সবই জাল

বসে পড়ুন! বসে পড়ুন! মুখ বন্ধ করুন! এ তো আপনাদেরই স্বীকারোক্তি। আপনাদের নামও এর মধ্যেই পাওয়া যাবে।

সভাপতি মশাই, এ রকম কতগুলি খাম আপনার কাছে আছে?

সব নিয়ে উনিশখানা।

ঠাট্টা-বিক্রপের ঝড় উঠল।

সবগুলিতেই গোপন কথাগুলি নিশ্চয় আছে। আমি প্রস্তাব করছি, আপনি সবগুলি খুলে ফেলুন আর স্বাক্ষরগুলো পড়ে দিন-চিরকুটের প্রথম আট টি শব্দও পড়বেন।

আমি এই প্রস্তাব সমর্থন করছি।

প্রচণ্ড হৈ-হল্লার মধ্যে প্রস্তাব পেশ ও গৃহীত হল। বেচারি বৃদ্ধ রিচার্ডস্ উঠে দাঁড়াল তার পাশে। পাছে কেউ দেখে ফেলে যে সে কাঁদছে তাই সে মাথাটা নীচু করে রেখেছে। স্বামী হাতটা বাড়িয়ে তাকে ধরে কাঁপা গলায় বলতে লাগল।

বন্ধুগণ, আমাদের দুজনকে-মেরি ও আমাকে-আপনারা আজীবন দেখে আসছেন। আমার ধারণা আপনারা আমাদের পছন্দ করেন, শ্রদ্ধা করেন-

সভাপতি বাধা দিল:

আমাকে বলতে দিন। আপনি যে বলছেন সেটা খুবই সত্যি মিঃ রিচার্ড : এই শহর আপনাদের দুজনকে চেনে; আপনাদের পছন্দ করে; আপনাদের শ্রদ্ধা করে; আরও-আপনাদের সম্মান করে, ভালবাসে-

হ্যালিডে–র গলা শোনা গেল।

এটা তো স্বীকৃত সত্য! সভাপতি যদি সত্য কথা বলে থাকেন আপনারা সকলে সে কথা বলুন। উঠে দাঁড়ান; বলুন-হিপ! হিপ! হিপ!–সকলে একসঙ্গে!

সকলে একসঙ্গে উঠে দাঁড়াল। সাগ্রহে বৃদ্ধ দম্পতির দিকে তাকাল। তুষারপাতের মত রুমাল নেড়ে ঘরের বাতাস ভরে তুলল, আর সহৃদয় কঠে তাদের জয়ধ্বনি করে উঠল।

সভাপতি বলতে শুরু করল:

আমি যা বলছিলাম: আপনাদের সৎ অন্তরের কথা আমরা জানি মিঃ রিচার্ডস, কিন্তু অপরাধীদের প্রতি দয়া-দাক্ষিণ্য দেখাবার সময় তো এটা নয়। [সকলের চীৎকার-ঠিক! ঠিক!] আপনাদের মুখেই আপনার মহৎ উদ্দেশ্য আমি দেখতে পাচ্ছি, কিন্তু আমি তো আপনাকে এই লোকগুলির পক্ষ সমর্থনের অনুমতি দিতে পারি না-

কিন্তু আমি বলছিলাম-

দয়া করে বলুন মিঃ রিচার্ডস্। বাকি চিঠি গুলোও খুলে দেখতেই হবে-যাদের চিঠি ইতিমধ্যেই খোলা হয়েছে তাদের প্রতি ন্যায়-বিচারের খাতিরেই এটা করা দরকার। আপনাকে আমি কথা দিচ্ছি, এ কাজটা শেষ হলেই আপনার কথা আমরা শুনব।

অনেক কণ্ঠ: ঠিক! সভাপতি ঠিকই বলেছেন-এ অবস্থায় কোন রকম বাধা দেওয়া চলবে না! শুরু করুন-নাম! নাম! প্রস্তাবে তাই ছিল!

বৃদ্ধ দম্পতি অনিচ্ছা সত্ত্বেও বসল। স্বামী স্ত্রীর কানে কানে বলল, এখানে বসে থাকা বড়ই বেদনাদায়ক; ওরা যখন জানবে যে আমরা নিজেদের জন্যই কিছু বলতে চেয়েছিলাম সেটা যে আরও লজ্জাকর ব্যাপার হবে।

নামগুলো যেমন পড়া হতে লাগল, ফুর্তির উচ্ছ্বাসও ততই বাঁধনহারা হয়ে উঠল।

আপনি খারাপ লোক হতে পারেন না-স্বাক্ষর, রবার্ট জে. টি টু মার্শ।

আপনি খারাপ লোক হতে পারেন না-স্বাক্ষর, এলিফ্যালেট উইস্।

আপনি খারাপ লোক হতে পারেন না-স্বাক্ষর, অস্কার বি. ওয়াইল্ডার।

ঠিক এই সময় একটা নতুন মতলব সকলের মাথায় খেলে গেল। সেই আট টি শব্দকে তারা সভাপতির হাত থেকে নিয়ে নিল। সভাপতিও তাতে অখুশি হল না। তারপর থেকে সভাপতি প্রতিটি চিঠি তুলে ধরে অপেক্ষা করতে লাগল, আর সবাই মিলে একসঙ্গে সেই আট টি শব্দকে একটানা সুরের অনেকটা গির্জার মন্ত্র উচ্চারণের মত করে আওড়াতে লাগল-আপনি খারাপ লোক হতে পারেন না; তারপরেই সভাপতি বলে উঠল, স্বাক্ষর, আচিল্ড উ ইক্স। এই ভাবে নামের পর নাম উচ্চারিত হতে লাগল। হতভাগ্য উনিশজন ছাড়া বাকি সকলেই খুসিতে ডগমগ।

তালিকাটি ক্রমেই ছোট হতে লাগল। বেচারি বুড়ো রিচার্ডস্ নামগুলো গুণতে লাগলো; অপেক্ষা করতে লাগলো কখন সেই ক্ষণটি আসবে যখন তাকে ও মেরিকেও উঠে দাঁড়াতে হবে এবং নিজের পক্ষ সমর্থনের এই কথাগুলি বলতে হবে: ..কারণ আজ পর্যন্ত আমরা কখনও কোন অন্যায় করি নি, কখনও কারও নিন্দাভাজন হই নি। আমরা খুবই গরিব, আমরা বৃদ্ধ, কোন ছেলেপিলে নেই যে আমাদের সাহায্য করবে; তাই আমরা লোভে পড়লাম, আমাদের পতন হল। এই স্বীকারোক্তি করবার জন্যই আমি উঠে দাঁড়িয়েছিলাম, বলতে চেয়েছিলাম যে আমার নামটা যেন প্রকাশ্যে ঘোষণা করা না হয়, কারণ সে অসম্মান আমরা সইতে পারতাম না; কিন্তু আমাকে বলতে দেওয়া হয় নি। ঠিক হয়েছে; সকলের সঙ্গে কষ্ট পাওয়াই আমাদের উচিত। আমরা খুবই কষ্ট পেয়েছি। এই প্রথম অন্যের মুখ থেকে আমাদের কলঙ্কিত নাম শুনতে হল। দয়া করুন; আমাদের লজ্জাকে যতটা সম্ভব হাল্কা করুন। এই সময় মেরির ধাক্কায় তার দিবাস্বপ্ন ভেঙে গেল। হলঘরে তখন মন্ত্রের মত উচ্চারিত হচ্ছে, আপনি খারাপ হতে ইত্যাদি।

মেরি ফিস ফিস করে বলল, তৈরি হও। এবার তোমার নাম উঠবে। উনি আঠারোটা পড়েছেন।

মন্ত্র থামল।

চারদিক থেকে প্রশ্নের গোলা ছুটতে লাগল-তারপর! তারপর! তারপর!

বার্জেস পকেটে হাত ঢোকাল। বৃদ্ধ দম্পতি কাঁপতে কাঁপতে উঠে দাঁড়াতে গেল। বার্জেস এক মুহূর্ত ইতস্তত করে বলল:

দেখছি সবগুলোই পড়া হয়ে গেছে।

আনন্দে ও বিস্ময়ে মূৰ্ছাহতের মত বৃদ্ধ দম্পতি আসনে বসে পড়ল; মেরি ফি সৃফিস্ করে বলল:

ঈশ্বরের করুণায় আমরা বেঁচে গেলাম!-উনি আমাদেরটা হারিয়ে ফেলেছেন-ও রকম একশটা বস্তার বদলেও একথা আমি প্রকাশ করব না।

সমস্ত হল-ঘরটা মিকাডো সুরের হাস্যকর অনুকরণে ফেটে পড়ল; মহা উৎসাহে তিনবার ফিরে ফিরে গেয়ে উঠে দাঁড়িয়ে তৃতীয় বারের শেষ লাইনটি উচ্চারণ করল–

বাজি রেখে বলছি, সতোর একটি প্রতীক তবু রইল!

সকলে সমস্বরে জয়ধ্বনি করে উঠল।

তখন সহিস উইংগেট উঠে দাঁড়িয়ে প্রস্তাব করল, শহরের পরিচ্ছন্নতম মানুষ, একমাত্র পদস্থ নাগরিক যিনি টাকাটা চুরি করবার চেষ্টা করেন নি-সেই এডোয়ার্ড রিচার্ডস্-এর জয়ধ্বনি করা হোক।

উচ্ছ্বসিত আন্তরিকতার সঙ্গে জয়ধ্বনি উচ্চারণের পরে একজন প্রস্তাব করল, রিচার্ডসকেই পবিত্র হ্যাডলিবুর্গ ঐতিহ্যের একমাত্র অভিভাবক ও প্রতীকরূপে নির্বাচিত করা হোক, এবং ব্যঙ্গমুখর জগতের সঙ্গে মোকাবিলা করবার ক্ষমতা ও অধিকারও তাকে দেওয়া হোক।

প্রস্তাবটি ধ্বনি-ভোটে গৃহীত হল; সকলে আর একবার মিকাডো গেয়ে বলল:

বাজি রেখে বলছি, সতোর একটি প্রতীক তবু রইল!

কিছুক্ষণ চুপচাপ; তারপর

একটি কণ্ঠ : এখন তাহলে বস্তাটা কে পাবে?

মুচি: [তীব্র বিদ্রুপের সঙ্গে] খুব সহজ ব্যাপার। আঠারোজন অদূষণীয় চরিত্রের লোকের মধ্যে টাকাটা ভাগ করে দেওয়া হোক। দুর্দশাগ্রস্ত আগন্তুককে তারা প্রত্যেক কুড়ি ডলার করে দিয়েছিলেন-মোটা দাম ৩৬০ ডলার। তারা তো শুধু সেই ধারটাই ফেরৎ চাইছেন-আসল আর সুদ-মোট চল্লিশ হাজার ডলার।

অনেক কণ্ঠ : [বিদ্রূপ করে] ঠিক! গরিবকে দয়া করুন-ওদের বসিয়ে রাখবেন না!

সভাপতি: শান্তি! এবার আগন্তুকের দলিলের বাকি অংশটা পড়ছিঃ

কোন প্রার্থী যদি হাজির না হয় [সমবেত আর্তনাদ] তাহলে আমার ইচ্ছা, আপনি বস্তাটা খুলবেন, টাকাগুলি গুণে আপনার শহরের প্রধান নাগরিকদের হাতে দেবেন, তারা একটা ট্রাস্ট হিসাবে সে টাকা গ্রহণ করবেন [ওঃ! ওঃ! ওঃ! চীৎকার] এবং আপনার সমাজের অদূষণীয় সতোর যে মহৎ খ্যাতি আছে তার প্রচার ও সুরক্ষার জন্য তারা যে ভাবে ভাল মনে করবেন সেই ভাবেই টাকাটা ব্যয় করবেন, যাতে তাদের নাম ও প্রচেষ্টা সেই খ্যাতিতে নতুন ও সুদূরপ্রসারী প্রভা যোগ করতে পারে। [বিদ্রুপাত্মক সমর্থনের সোচ্চার ঘোষণা।] এখানেই শেষ বলে মনে হচ্ছে। না-একটু পুনশ্চ আছে:

পুনশ্চ–হ্যাডলিবুর্গের নাগরিকগণ: পরীক্ষা-ভিত্তিক কোন মন্তব্যই নেই-কেউ তা করে নি। [বিস্ময় ও আনন্দের গুঞ্জন] অনুমতি করেন তো আমার গল্পটা বলি-দুএকটা কথায়ই হয়ে যাবে। কোন এক সময়ে আমি আপনাদের শহরের ভিতর দিয়ে যাচ্ছিলাম এব অকারণেই একটা গভীর আঘাত পেয়েছিলাম, অথচ সেটা আমার প্রাপ্য ছিল না। অন্য কেউ হলে আপনাদের দু-একজনকে খুন। করেই খুসি হয়ে যেত এবং ভাবত সে যব চু বেবুকে গেল, কিন্তু আমার কাছে সে প্রতিশোধ অতি তুচ্ছ ও নগণ্য; কারণ মৃত ব্যক্তিকে কোন দুঃখ সইতে হয় না। তাছাড়া, আপনাদের সব্বাইকে তো আমি খুন করতে পারতাম না-এবং আমার যা স্বভাব, তাতেও আমি সন্তুষ্ট হতাম না। আমি চেয়েছিলাম প্রতিটি পুরুষের প্রতিটি নারীর ক্ষতি করতে-তাদের দেহের বা সম্পত্তির ক্ষতি নয়, চেয়েছিলাম তাদের অহংকারে আঘাত করতে-দুর্বল ও নির্বোধ লোকদের ঐ স্থানটি তেই সহজে আঘাত করা যায়। তাই ছদ্মবেশে ফিরে এসে আপনাদের কজা করে ফেললাম। আপনাদের সতোর খ্যাতি যেমন প্রাচীন, তেমনই উতুঙ্গ, আর স্বভাবতই সে জন্য আপনারা গর্ববোধ করতেন-সেটাই আপনাদের সব সম্পদের সেরা সম্পদ-আপনাদের চোখের মণি। যেই বুঝতে পারলাম যে আপনারা অতি যত্ন ও সতর্কতার সঙ্গে নিজেদের ও সন্তান-সন্ততিদের প্রলোভন থেকে দূরে রেখে চলেন, তখনই বুঝতে পারলাম আমাকে কি ভাবে অগ্রসর হতে হবে। আরে, আপনারা তো সরল জীব, সব চাইতে দুর্বল হচ্ছে সেই গুণ যা কখনও পরীক্ষার আগুনে পরিশুদ্ধ হয় নি। একটা মতলব ঠাউরে নিয়ে একটা নামে তালিকা জোগাড় করলাম। আমার লক্ষ্যই ছিল অদূষণীয় চরিত্রের হ্যাডলিবুর্গ-এর চরিত্র হনন করা। আমি চেয়েছিলাম, প্রায় অর্ধশত অকলংক চরিত্রের নারী-পুরুষ যারা জীবনে কখনও মিথ্যা বলে নি অথবা একটা পেনিও চুরি করে নি তাদের মিথ্যাবাদী ও চোর বানিয়ে তুলব। আমার ভয় ছিল গুড সনকে। সে হ্যাঁড় লিবুর্গে জন্মে নি, সেখানে লালিত-পালিতও হয় নি। আমার ভয় ছিল, আপনাদের হাতে আমার চিঠি ধরিয়ে যদি কাজ শুরু করি তাহলে আপনারা হয়তো ভাববেন, আমাদের মধ্যে ৫ ড সন একমাত্র লোক যে একটা গরিব শয়তানকে কুড়ি ডলার বিলিয়ে দিতে পারে-আর সে ক্ষেত্রে আপনারা আমার টেপি নাও গিলতে পারেন। কিন্তু ঈশ্বরই গুড সনকে নিলেন; তখনই বুঝলাম, এবার আমি নিরাপদ এবং ফাঁদ পেতে টোপ ফেললাম। যাদের কাছে তথাকথিত পরীক্ষায় গোপন কথাটা ডাকে পাঠালাম তাদের সকলকে হয় তো আট কাতে পারব না, কিন্তু হ্যাডলিবুর্গ-এর চরিত্র যদি ঠিক মত ধরে থাকি তাহলে তাদের অধিকাংশকেই যে ফাঁদে আটকাতে পারব সেটা আমি জানতাম।…আশা করছি, আপনাদের অহংকারকে চিরদিনের মত ধ্বংস করতে পারব এবং হ্যাডলিবুর্গকে দিতে পারব এমন একটা নতুন খ্যাতি যা তার গায়ে লেগে থাকবে এবং দূরদূরান্তে ছড়িয়ে পড়বে। আমি যদি সফল হয়ে থাকি তো বস্তাটা খুলবেন এবং হ্যাডলিবুর্গ সুখ্যাতি প্রচার ও সুরক্ষা সমিতিকে। ডেকে পাঠাবেন।

বহু কণ্ঠের সাইক্লোন: খুলুন! ওটা খুলুন! আঠারোজনকে সামনে নিয়ে আসুন! ঐতিহ্য প্রচার সমিতি! অদূষণীয় চরিত্রেরা আগে বড়ো!

সভাপতি বস্তাটা ছিঁড়ে এক মুঠো চকচকে, চওড়া, হলদে মুদ্রা তুলে নিল; সেগুলোকে নেড়েচেড়ে পরীক্ষা করল

বন্ধুগণ, এগুলো গিলটি-করা সিসের চাকতি মাত্র!

এ খবর শুনে সকলে মজার হাসিতে ফেটে পড়ল। সে হাসি থামলে মুচি বলে উঠল:

এ ব্যাপারের আপাত প্রবীণতার অধিকারে মিঃ উইনই ঐতিহ্য প্রচার সমিতির সভাপতি। আমি বলি, সহযোগীদের পক্ষ হয়ে তিনি এগিয়ে আসুন এবং ট্রাস্টি হিসাবে এই অর্থ গ্রহণ করুন।

একশ কণ্ঠ : উইলসন! বক্তৃতা! বক্তৃতা!

উইলসন: [ক্রোধে কম্পিত কণ্ঠে ] আপনাদের অনুমতি নিয়ে, এবং আমার ভাষার জন্য কোন রকম ক্ষমা প্রার্থনা না করেই বলেছি-এ অর্থ চুলোয় যাক!

একটি কণ্ঠ : আঃ, কী পাদরি এলো রে!

একটি কণ্ঠ : সতেরোটি প্রতীক এখনও বাকি! এগিয়ে আসুন ভদ্রজনরা, আপনাদের দায় গ্রহণ করুন!

চুপচাপ-কোন সাড়া নেই।

সহিস: সভাপতিমশাই, অতীত অভিজাতদের মধ্যে একজন পবিত্র মানুষ এখনও আমাদের মধ্যে আছেন; তার টাকার দরকার; তিনি টাকা পাবার যোগ্য। আমি প্রস্তাব করছি, আপনি জ্যাক হ্যালিডেকে নীলামদার নিযুক্ত করুন; সে ওখানে দাঁড়িয়ে গিটি–করা কুড়ি ডলার মুদ্রাভর্তি বস্তাটা নীলামে তুলুক, এবং তার থেকে যা আদায় হবে সেটা আসল লোককে দেওয়া হোক-দেওয়া হোক সেই লোককে যাকে হ্যাডলিবুর্গ আজও সানন্দে সম্মান করে-সে লোক এডোয়ার্ড রিচার্ডস্।

মহাউৎসাহের সঙ্গে প্রস্তাব গৃহীত হল। কুকুরটি ঘেউ ঘেউ করে উঠল; সহিস প্রথম ডাক শুরু করল–এক ডলার। ক্রমে উত্তেজনা বাড়তে লাগল; ডাকও চড়তে লাগল-এক থেকে পাঁচ, তারপর দশ, বিশ, পঞ্চাশ, একশ, তারপর

নীলামের শুরুতেই বিব্রত রিচার্ডস্ স্ত্রীর কানে কানে বলল: মেরি, আমরা কি এটা মেনে নিতে পারি? বুঝতেই তো পারছ, এটা সম্মান-পুরঙ্কুর, চারিত্রিক সতোর স্বীকৃতি, আর-আর-আমরা কি এটা মেনে নিতে পারি? আমি কি উঠে দাঁড়িয়ে-ওঃ মেরি, আমাদের কি করা উচিত? তুমি কি মনে কর-[হ্যালিডের গলা: পনেরো-বস্তার দাম পনেরো!-কুড়ি!-আঃ, কুড়ি-ধন্যবাদ!-ত্রিশ-আবার ধন্যবাদ! ত্রিশ! ত্রিশ! ত্রিশ!-কেউ কি চল্লিশ বললেন?-হ্যাঁ, চল্লিশ! চালিয়ে যান ভদ্রজনরা, চালিয়ে যান!-পঞ্চাশ! ধন্যবাদ মহৎ রোমক! পঞ্চাশ, পঞ্চাশ, পঞ্চাশ-সত্তর!-নকই!-চমৎকার!-একশ!-ঠিক সময় মত!-একশ পঞ্চাশ! দুশো!-সাবাস! কি বললেন! দু-ধন্যবাদ-দুশ পঞ্চাশ!-]

এ যে আর এক প্রলোভন এডোয়ার্ড–আমার শরীর কাঁপছে-কিন্তু একটা প্রলোভনের হাত থেকে আমরা বেঁচেছি, আর তাতেই আমাদের সতর্ক হওয়া উচিত [ছয় কি শুনলাম? ধন্যবাদ! ছশ পঞ্চাশ, ছশ ও সাত শ!] তথাপি এডোয়ার্ড, ভেবে দেখ, কেউ যখন সঙ্গে [আট শ ডলার! হুররে! নতে তুলুন! মিঃ পার্স, আপনি কি বললেন–ধন্যবাদ নশ! আনকোরা নতুন সিসে ভর্তি এই বস্তা যাচ্ছে। মাত্র নশ ডলারে-গিটি সমেত আসুন! কি শুনলাম-এক হাজার!-ধন্যবাদ! কেউ কি বললেন এগারো? যে বস্তা সারা জগতের মধ্যে। একদিন সব চাইতে বিখ্যাত হয়ে উঠবে-] ওঃ এডোয়ার্ড কেঁদতে শুরু করে] আমরা এত গরিব!-কিন্তু-কিন্তু-তুমি যা ভাল বোঝ তাই কর-তুমি যা ভাল বোঝ তাই কর।

এডোয়ার্ড কাবু হল-অর্থাৎ নিশ্চল বসে রইল; তার বিবেক সন্তুষ্ট নয়, কিন্তু অবস্থার দাস।

ইতমধ্যে একটি অপরিচিত লোক সারা সন্ধার এই সব কার্যকলাপ গভীর আগ্রহের সঙ্গে লক্ষ্য করছিল আর তার চোখে মুখে একটা খুসির ভাব ফুটে উঠছিল। তাকে দেখে মনে হচ্ছে ইংরেজ জমিদারের সাজে সজ্জিত একজন সৌখীন গোয়েন্দা। এবার সে নিজের মনেই বলতে লাগল: আঠারো জনের কেউ নিলাম ডাকছে না; এটা আমার মনঃপূত নয়; এটাকে বদলাতে হবে-নাটকীয় ঐক্যের জন্য এটা দরকার; যে বস্তাটা তারা চুরি করতে চেয়েছিল সেটা তাদের কিনতে হবে; তার জন্য চড়া দাম ও তাদের দিতে হবে-তাদের মধ্যে কয়েকজন বেশ ধনী। আরও একটা কথা, হ্যাডলিবুর্গ-এর প্রকৃতি সম্পর্কে যখন আমি ভুল করি তখন যে লোক সেই ভুলটা। আমার উপর চাপিয়ে দিতে পেরেছিল তার নিশ্চয়ই একটা মোটা দক্ষিণ প্রাপ্য, এবং কোন একজনকে সেটা দিতেই হবে। এই গরিব বৃদ্ধ রিচার্ডস্ আমার বিচার-বুদ্ধিকে লজ্জা দিয়েছে; সে একটি সৎ লোক; এ সতোর অর্থ আমি বুঝি না, কিন্তু তাকে আমি স্বীকার করি।

সে নীলামের ডাক লক্ষ্য করছিল। এক হাজারে ডাক শেষ হল। সে তখন ১২৮২ পাউণ্ডের বস্তাটা ডে কে নিল। প্রবল জয়োল্লাসের মধ্যে সভা ভেঙে যাচ্ছিল, তখন সকলে দাঁড়িয়ে পড়ল; কারণ লোকটি উঠে দাঁড়িয়ে হাত তুলল। কতা বলতে শুরু করল।

আমি একটা কথা বলতে চাই, আর একটি অনুগ্রহ ভিক্ষা করতে চাই। আমি দুষ্প্রাপ্য জিনিস-পত্রের বেচা-কেনা করে থাকি; সারা পৃথিবীর মুদ্ৰাতত্ত্ববিশারদদের সঙ্গে আমার লেন-দেন চলে। এখানে যে কিনলাম এমনিতেই তাতে আমার লাভ হবে; কিন্তু আপনাদের সমর্থন পেলে এমন একটা পথ আছে যাতে এখানকার প্রতিটি সিসের বিশ-ডু লার মুদ্রার জন্য আমি সমান ওজনের স্বর্ণমুদ্রার দাম বা তারও বেশী পেতে পারি। আপনারা সম্মতি দিন, তাহলেই আমার লাভের একটা অংশ আমি আপনাদের মিঃ রিচার্ড সূকে দিতে পারি; তার অংশে প্রাপ্য হবে দশ হাজার ডলার; কাল সকালেই আমি টাকাটা তার হাতে তুলে দেব। [সকলের সমর্থনসূচক উল্লাস-ধ্বনি]। একটা ভাল সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে–দুই-তৃতীয়াংশ ভোট হলেই চলবে-যদি আপনারা প্রস্তাবটি পাশ করেন তো তাকেই আমি গোটা শহরের সম্মতি বলে মনে করব, আর সেটুকুই আমার প্রার্থনা। কোন উপায়ে কৌতূহল জাগাতে পারলে এবং লোককে মন্তব্য প্রকাশে বাধ্য করতে পারলেই দুষ্প্রাপ্য জিনিসের কদর বাড়ে। এই সব নকল মুদ্রা প্রতিটি র উপর এই আঠারোজন ভদ্রলোকের নামের ছাপ দেবার অনুমতি যদি আপনারা আমাকে দেন তাহলে…

দশ ভাগের নয় ভাগ শ্রোতা-কুকুরসহ মুহূর্তের মধ্যে উঠে দাঁড়াল এবং প্রচণ্ড সমর্থন ও হাস্যরোলের মধ্যে প্রস্তাবটি পাশ হয়ে গেল।

সকলে বসে পড়ল, কিন্তু ডাঃ ক্লে হার্কনেস ছাড়া অন্য সব প্রতীক-রা উঠে দাঁড়িয়ে প্রবল প্রতিবাদ জানাল, ভীতি প্রদর্শন করে

আগন্তুক শান্তভাবে বলল, আপনাদের মিনতি করছি, আমাকে ভয় দেখাবেন না। আমার আইনগত অধিকার কতখানি তা আমি জানি, আর ভয়ে কাবু হতে আমি অভ্যস্ত নই। [উল্লাসধ্বনি] সে বসে পড়ল। ডাঃ হার্কনেস এর মধ্যেই একটা সুযোগ পেয়ে গেল। এখানকার দুজন ধনীর সে অন্যতম, অপর জন পিংকার্টন। হার্কনেস একটি টাকশালের মালিক; অর্থাৎ তার একটি জনপ্রিয় ওষুধের কারখানা আছে। বিধানসভার নির্বাচনে সে দাঁড়িয়েছে এক টিকিটে, আর পিংকার্টন দাঁড়িয়েছে অন্য টিকিটে। দুজনের মধ্যে খুব রেষারেষি চলছে; বাজার গরম; প্রতিদিনই আরো গরম হচ্ছে। দুজনেরই প্রচণ্ড টাকার ক্ষিধে; একই উদ্দেশ্য দুজনই প্রচুর জমি কিনেছে; একটা নতুন রেলপথ হবার কথা আছে; প্রত্যেকেরই ইচ্ছা বিধানসভার সদস্য হয়ে রেলপথটাকে নিজের সুবিধামত পথে বসাবার ব্যবস্থা করবে; একটি মাত্র ভোটে ই সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হবে, আর সেই সঙ্গে আসবে দু-তিনটি সম্পত্তি। ঝুঁকিটা বেশ বড়, কিন্তু হার্কনেস দুঃসাহসী দাওবাজ। আগন্তুকের পাশেই সে বসেছিল। অন্য সব প্রতীকরা যখন সভার সামনে প্রতিবাদ ও আবেদন রাখছিল, সে তখন ঘাড় কাৎ করে ফিস ফিস করে জিজ্ঞাসা করল:

বস্তাটার জন্য কি দাম চান?

চল্লিশ হাজার ডলার।

কুড়ি দিতে পারি।

না।

পঁচিশ।

না।

তাহলে ত্রিশ।

দর রইল চল্লিশ হাজার ডলার; এক পেনি কম নয়।

ঠিক আছে, তাই দেব। সকাল দশটায় আপনার হোটেলে যাব। আমি চাই, কেউ যেন জানতে না পারে; গোপনে দেখা করব।

খুব ভাল। তখন আগন্তুক দাঁড়িয়ে বলল:

আমার দেরী হয়ে যাচ্ছে। এই ভদ্রলোকের বক্তৃতার মধ্যে গুণের অভাব নেই, আগ্রহের অভাব নেই, সাবলীলতারও অভাব নেই; তবু আমাকে বিদায় নিতে হচ্ছে বলে ক্ষমা করবেন। আমার আবেদন মঞ্জু র করে আমার প্রতি যে অনুগ্রহ দেখিয়েছেন সেজন্য আপনাদের ধন্যবাদ জানাই। সভাপতিকে অনুরোধ করছি, তিনি যেন আগামী কাল সকাল পর্যন্ত বস্তাটা আমার জন্য রেখে দেন, আর এই পাঁচ–শ ডলারের নোট গুলি মিঃ রিচার্ড সের হাতে তুলে দেন। নোট গুলো সভাপতির হাতে দেওয়া হল।

নটার সময় আমি বস্তাটা নিতে আসব, এবং এগারোটার সময় বাকি দশ হাজার মিঃ রিচার্ডসের বাড়িতে গিয়ে তার হাতে দিয়ে

আসব। শুভরাত্রি।

সে চলে গেল। শ্রোতাদের ভিতর থেকে যে প্রচণ্ড ধ্বনি উঠল তার সঙ্গে মিশে গেল উল্লাস, মিকাডো সঙ্গীত, কুকুর-নিনাদ ও মন্ত্রোচ্চারণ-আপনি খারাপ লোক হতে পারেন না-আ-আ-আ-আমেন!

.

০৪.

বাড়িতে মাঝ রাত পর্যন্ত রিচার্ডস্-দম্পতিকে অভিনন্দন ও প্রশংসার ধাক্কা সামলাতে হল। তারপর সকলে চলে গেল। মন খারাপ করে তারা ভাবতে বসল। শেষ পর্যন্ত একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে মেরি বলল:

তুমি কি মনে কর এডোয়ার্ড যে আমরা দোষী-খুব বেশী দোষী? টেবিলের উপর রাখা বড় ব্যাংক-নোট গুলোর দিকে সে অবাক চোখে তাকাল। এডোয়ার্ড সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিল না; পরে একটা নিঃশ্বাস ফেলে একটু ইতস্তত করে সেও বলল:

আমাদের-আমাদের কোন গত্যন্তর ছিল না মেরি। এটা-মানে-এটা যেন পূর্ব নির্দিষ্ট। সব কিছুই তো তাই।

মেরি চোখ তুলে তার দিকে তাকাল, কিন্তু বৃদ্ধ ফিরে তাকাল না। মেরি বলল:

আমার ধারণা ছিল অভিনন্দন ও প্রশংসা সব সময়ই ভাল লাগে। কিন্তু এখন বুঝতে পারছি-এডোয়ার্ড?

বল?

তুমি কি এখনও ব্যাংকে থাকবে?

ন-না।

পদত্যাগ করবে?

সকালে-চিঠি লিখে।

সেই ভাল।

দুই হাতের মধ্যে মাথা রেখে রিচার্ডস্ বলতে লাগল।

এতকাল হাজার হাজার মানুষের টাকা দুই হাতে নাড়াচাড়া করেছি, কিন্তু মেরি, আজ আমি ক্লান্ত-বড় ক্লান্ত-

শুতে চল।

সকাল নটায় আগন্তুক এসে একটা গাড়ি ডেকে বস্তাটাকে হোটেলে নিয়ে গেল। দশটায় হার্কনেস গোপনে তার সঙ্গে কথাবার্তা বলল। নিজের দাবী অনুসারেই আগন্তুক শহরের একটা ব্যাংকের উপর পাঁচ খানা বেয়ারার চেক পেল-চারখানা ১,৫০০ ডলারের আর একখানা ৩৪,০০০ ডলারের। প্রথমোক্ত চেকের একখানা সে নোট–বইতে রাখল, বাকি নোট ৩৮,৫০০ ডলারের চেকগুলি একটা খামে ভরে রাখল, এবং হার্কনেস চলে যাবার পরে একটা চিঠি লিখে তার ভিতরে রেখে দিল। এগারোটার সময় রিচার্ড–এর বাড়িতে গিয়ে কড়া নাড়ল। মিসেস রিচার্ডস্ খড়খড়ির ফাঁক দিয়ে দেখে নিয়ে বাইরে গিয়ে খামটা নিল। আগন্তুক একটাও কথা না বলে চলে গেল। কল্পিত পায়ে ফিরে এসে মিসেস রিচার্ডস্ কোন রকমে বলল:

লোকটিকে যেন চেনা-চেনা লাগল! কাল রাতেই আমার মনে হয়েছিল, এর আগেও কোথায় যেন তাকে দেখেছি।

এই লোকটিই বস্তাটা নিয়ে এসেছিল?

সে বিষয়ে আমি নিশ্চিত।

তাহলে এই লোকটাই ছদ্মবেশী স্টিফেন্সন; একটা বাজে ভেল্কি দেখিয়ে শহরের সব গণ্যমান্য লোকগুলোকে ফাঁসিয়াছে। আর এখানেও যদি নগদ টাকার বদলে চেক পাঠিয়ে থাকে, তাহলে আমাদেরও ফাসাবে। রাতের বিশ্রামের পরে যাও বা একটু আরাম লাগছিল, এখন ঐ খামটা দেখেই আবার যেন অসুস্থ বোধ করছি। খামটা মোটেই মোটা নয়; যত বড় ব্যাংক-নোটে ই হোক, ৮,৫০০ ডলার থাকলে খামটা আরও মোটা হত।

তুমি চেকে আপত্তি করছ কেন এডোয়ার্ড?

সে চেকে যে স্টিফেন্সন সই করেছে! ব্যাংক-নোটে পেলে ৮,৫০০ ডলার নেওয়াই আমি স্থির করেছিলাম, কারণ সেটাকেই আমি উপরের নির্দেশ বলে মনে নিয়েছিলাম, কিন্তু মেরি-কোন কালেই আমি খুব সাহসী লোক নই; ওই ভয়ংকর লোকটার সই-করা চেক ভাঙাবার সাহস আমার নেই। এটা একটা ফাঁদও হতে পারে। লোকটা আমাকেও গাঁথতে চেয়েছিল; কোন রকমে বেঁচে গিয়েছি; তাই এবার সে নতুন পথ ধরেছে। এই চেকগুলো যদি-

ওঃ এডোয়ার্ড, এগুলো তো খুবই খারাপ জিনিস তাহলে, চেকগুলোকে হাতে নিয়ে সে কেঁদে ফেলল।

ওগুলোকে আগুনে ফেলে দাও! জলদি! আমরা লোভের কাছে ধরা দেব না। অন্যদের মত আমাদের দেখেও যাতে পৃথিবীর মানুষ। হাসতে পারে এটা তারই কৌশল। তুমি না পার, ওগুলো আমাকে দাও! চেকগুলো ছিনিয়ে নিয়ে হাতের মুঠোয় চেপে ধরে রিচার্ডস্ স্টোভের দিকে এগিয়ে গেল; কিন্তু সে তো মানুষ, একজন ক্যাশিয়ার; সইটা সম্বন্ধেনিশ্চিত হবার জন্য এক মুহূর্ত থামল। তখন তার মূৰ্ছিত হবার মত অবস্থা।

বাতাস কর মেরি, বাতাস কর! এগুলো সোনার মতই খাঁটি!

খুব ভাল কথা এডোয়ার্ড! কিন্তু ব্যাপার কি?

এডোয়ার্ড, তুমি কি মনে কর।

তাকিয়ে দেখ-এদিকে দেখ! পনেরো-পনেরো-পনেরো-চৌত্রিশ। আটত্রিশ হাজার পাঁচ শ মেরি, বস্তাটার দাম তো বারো ডলারও নয়, আর হার্কনেসই-যতদূর মনে হচ্ছে-টাকাটা দিয়েছে।

আর তুমি কি মনে কর, দশ হাজারের বদলে সবটাই আমাদের হাতে এসেছে?

আরে, তাই তো মনে হচ্ছে। আর চেকগুলো বেয়ারারও বটে।

সেটা ভালতো এডোয়ার্ড? তার উদ্দেশ্য কি?

মনে হচ্ছে, দূরবর্তী কোন ব্যাংক থেকে টাকাটা তুলবার একটা ইঙ্গিত। হয় তো হার্কনেস চায় না ব্যাপারটা জানাজানি হোক। ওটা কি-একটা চিঠি?

হ্যাঁ। চেকের সঙ্গে ছিল।

হাতে লেখা স্টিফেন্সনের, কিন্তু কোন স্বাক্ষর নেই। চিঠিতে লেখা:

আমি হতাশ হয়েছি। আপনার সততা প্রলোভনের উর্ধ্বে। আমার ধারণাটা অন্যরকম ছিল, কিন্তু তাতে আপনার প্রতি অবিচারই করেছি, আর সে জন্য ক্ষমা চাইছি-আন্তরিকভাবেই চাইছি। আমি আপনার সম্মান করি-সেটাও আন্তরিকভাবেই করি। আপনার পোশাকের এক প্রান্তকে চুমো খাবার যোগ্যতাও এ শহরের নেই। প্রিয়া মহাশয়, নিজের মনেই আমি একটা বাজি ধরেছিলাম যে, আপনাদের আত্মতুষ্ট সমাজে উনিশটি ভ্রষ্টচরিত্র মানুষ আছে। আমি হেরে গেছি। বাজির পুরো টাকাটাই গ্রহণ করুন, ওটা আপনারই প্রাপ্য।

একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে রিচার্ডস বলল:

কথাগুলি যেন আগুনের অক্ষরে লেখা-তেমনই এর উত্তাপ। মেরি-আবার আমার অবস্থা শোচনীয় হয়ে উঠেছে।

আমারও প্রিয়। ইচ্ছা করে।

ভাব তো মেরি, আমার উপর তার কত বিশ্বাস।

বলো না এডোয়ার্ড, আমি সইতে পারছি না।

এই সুন্দর কতাগুলির উপযুক্ত যদি হতে পারতাম মেরি-ঈশ্বর জানেন, একদিন আমি তার উপযুক্তই ছিলাম-তাহলে তার জন্য চল্লিশ হাজার ডলার দিতেও আমি রাজী। তাহলে সোনা-রূপো, মণি-মানিক্যের মতই দামী এই কাগজখানাকেই চিরদিন কাছে রাখতাম। কিন্তু আজ-এর ভ্রুকুটি কুটিল উপস্থিতির ছায়ার তো বেঁচে থাকতে পারব না।

সেটাকে আগুনে ফেলে দিল।

একজন পত্রবাহক এসে একখানা খাম দিল।

তার ভিতর থেকে চিঠি টা বের করে রিচার্ডস্ পড়তে লাগল; বার্জেসের চিঠি।

একটা সংকটের সময় আপনি আমাকে উদ্ধার করেছিলেন। কাল রাতে আমি আপনাকে উদ্ধার করেছি।সেটা করেছি মিথ্যার মূল্যে, কিন্তু সেচ্ছায় সকৃতজ্ঞ চিত্তেই সে ত্যাগটুকু স্বীকার করেছি। এ গ্রামের আর কেউ না জানলেও আমি তো জানি আপনি কত সাহসী, সৎ ও মহৎ। মনে মনে আপনি আমাকে শ্রদ্ধা করতে পারেন না, যেহেতু যে-কারণে আমি একদা অভিযুক্ত হয়েছিলাম এবং সর্বসম্মতিক্রমে দণ্ডিত হয়েছিলাম সেটা তো আপনার অজানা নয়; কিন্তু আপনাকে মিনতি করছি, আপনি অন্তত এটুকু বিশ্বাস করুন যে আমি আপনার কাছে কৃতজ্ঞ; তাহলেই আমার বোঝা আমি বইতে পারব।

[স্বাক্ষর] বার্জেস

আরও একবার রক্ষা পেলাম। আর তাও এই শর্তে চিঠিটাকে সে আগুনে ফেলে দিল। আমার-আমার মরতে ইচ্ছা করছে মেরি। আহা, যদি এ সব কিছুর বাইরে চলে যেতে পারতাম।

ওঃ, দিনগুলি বড় তিক্ত এডোয়ার্ড। উদারতার জন্যই ছুরির আঘাতগুলি এত গভীর-আর এত দ্রুত সেগুলি আসছে!

নির্বাচনের তিনদিন আগে দুহাজার ভোট দাতার প্রত্যেকেই হঠাৎ একটা করে মনোরম স্মৃতিফলক পেল-বিখ্যাত নকল জোড়া ঈগলের ছবি। তার একদিককার মুখের চারদিকে ছাপ-মারা: গরিব আগন্তুকের প্রতি যে মন্তব্য আমি করেছিলাম সেটা হল- অপর দিককার মুখের চারদিকে ছাপমারা যাও অন্যদের সংশোধন কর। [স্বাক্ষর] পিংকার্টন। এই বিখ্যাত তামাসার সম্পূর্ণ আবর্জনার বোঝা একটি মাত্র মাথার উপরেই উপুর করে ঢালা হল, আর তার ফলও ফ লল বিপজ্জনক হয়েই। পিংকার্টনের মাথাকে ঘিরে ধ্বনিত প্রতিধ্বনিতে হল প্রচণ্ড হাস্যরোল; আর হার্কনেস অতি সহজেই নির্বাচন-বৈতরণী পার হয়ে গেল।

চেকগুলো পাবার চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যেই রিচার্ডস্ দম্পতির বিবেক ক্রমে শান্ত হয়ে এল। নিজেদের পাপের সঙ্গে আপোষ করবার। শিক্ষা বুড়ো-বুড়ির হয়েছে। কিন্তু অচিরেই তারা বুঝতে পারল, পাপ যদি কখনও প্রকাশের পথ খুঁজে পায় তো সে নতুন করে ভয়ংকর হয়ে ওঠে। গির্জার প্রাতঃকালীন অনুষ্ঠানে যথারীতি যোগদানের পরে উৎসাহী অভিনন্দনকারীদের হাত এড়িয়ে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব রিচার্ডস্ দম্পতি বাড়ির পথে পা বাড়াল। কেন কে জানে, একটা আবছা, ছায়া-ছায়া, অনির্দিষ্ট আতংকে তাদের হাড় পর্যন্ত ঠাণ্ডা হয়ে আসছিল। আর ঘটনাক্রমে মিঃ বার্জেস যেই একটা মোড় ঘুরেছে অমনি তার সঙ্গে তাদের দেখা হয়ে গেল। তারা মাথা নোয়াল, কিন্তু সে খেয়ালই করল না! সে তাদের দেখতে পায় নি; কিন্তু তারা সেটা বুঝল না। তার এই ব্যবহারের অর্থ কি? এর অর্থ-এর অর্থ-ওঃ, এর তো এক ড জন ভয়ংকর অর্থ হতে পারে। অতীতে একদিন রিচার্ডস্ তাকে দোষের হাত থেকে মুক্ত করতে পারত, অথচ তা না করে ভবিষ্যতে হিসাব মেলাবার আশায় নীরবে অপেক্ষা করেছিল-এ কথাই কি সে ভেবে নিয়েছে?

বাড়ি ফিরেও এ একই দুশ্চিন্তা-সম্ভব-অসম্ভব নানা জল্পনা-কল্পনা। এইভাবে অবস্থা যখন বেশ চরমে উঠেছে তখন একসময় রিচার্ডস্ হঠাৎ আঁতকে উঠল। তার স্ত্রী জিজ্ঞাসা করল:

কি হল?-কি হল?

ঐ চিঠি-বার্জেসের চিঠি! এখন বুঝতে পারছি, তার ভাষাটাই ঠাট্টায় ভরা। সে মুখস্ত বলে গেল: মনে মনে আপনি আমাকে শ্রদ্ধা করতে পারেন না, যেহেতু যে-কারণে আমি অভিযুক্ত হয়েছিলাম এবং- ওঃ, এখন তো পরিষ্কার বুঝতে পারছি। ঈশ্বর আমাকে রক্ষা করুন! আমি যে সব জানি তাও সে জানে! ভাষার কারিকুরিটা লক্ষ্য করেছ তো! এটা একটা ফাঁদ-আর এমনই বোকা আমি যে সেই ফাঁদে পা দিয়েছি। আর মেরি-?

ওঃ কী সাংঘাতিক-আমি জানি তুমি কি বলতে চাইছ-নকল পরীক্ষার ব্যাপারে তুমি নিজের হাতে যে চিরকুট টা পাঠিয়েছিলে সেটা সে ফেরৎ দেয় নি।

না-আমাদের সর্বনাশ করবার মতলবে সেটা রেখে দিয়েছে। মেরি, ইতিমধ্যেই কারও কারও কাছে আমাদের কথা সে ফাস করে। দিয়েছে। আমি জানি-ভাল করেই জানি। গির্জা থেকে বেরিয়ে আসবার সময় ডজনখানেক মুখে আমি সেটা লক্ষ্য করেছি। উঃ, তাই তো আমরা তাকে দেখে মাথা নাড়লেও সে জবাব পর্যন্ত দিল না-নিজের মতলবের কথা তখনই তার মনের মধ্যে ছিল।

সেই রাতেই ডাক্তারকে ডাকা হল। সকালেই চারদিকে খবর রটে গেল যে বৃদ্ধ দম্পতি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েছে-ডাক্তার বলেছে, হঠাৎ এতগুলো টাকা পাবার দরুণ উত্তেজনার চাপ, অভিনন্দন, রাত জাগা-এই সব কারণেই শরীর ভেঙে পড়েছে। গোটা শহর সত্যি সত্যি বিচলিত হয়ে পড়ল, কারণ এখন তো তাদের গর্ব করার মত মানুষ এরাই দুজন অবিশিষ্ট আছে।

দুদিনপরে আরও খারাপ খবর। বুড়ো-বুড়ি প্রলাপ বকছে, আর অদ্ভুত সব কাজ করছে। নার্সরা বলেছে, রিচার্ডস্ চেক দেখিয়েছে-৮,৫০০ ডলারের? না-টাকার অংক বিস্ময়কর-৩৮,৫০০ ডলার। তাদের এই প্রচ ও সৌভাগ্য ঘটল কেমন করে?

বড়দিনে নার্সরা আরও খবর দিল-আশ্চর্য খবর। পাছে চেকগুলোর ক্ষতি হয় তাই তারা সুগুলো লুকিয়ে রেখেছিল; কিন্তু পরে খুঁজতে গিয়ে দেখে রোগীর বালিশের তলা থেকে সেগুলো উধাও হয়ে গেছে। রোগী বলছে:

বালিশ রেখে দাও; কি চাও তোমরা?

আমরা ভেবেছিলাম যে চেকগুলো ভাল ভাবে-

সেগুলো আর কখনও দেখতে পাবে না-সেগুলো নষ্ট করে ফেলা হয়েছে। শয়তান সেগুলো দিয়েছিল। সেগুলোর উপর আমি নরকের চাপ দেখেছি; আমি জানি, আমাকে ভুলিয়ে পাপের পথে টেনে নেবার জন্যই সেগুলো পাঠানো হয়েছিল। তারপরই সে বক্ক্ করে এমন সব অদ্ভুত ও ভয়ংকর কথা বলতে লাগল যার কোন অর্থ বোঝাই দায়।

রিচার্ডস্ ঠিকই বলেছিল; চেকগুলো আর পাওয়া যায় নি।

কোন নার্স হয় তা ঘুমের মধ্যেই কথা বলেছিল, কারণ প্রলাপের ঝোঁকে যে সব নিষিদ্ধ কথা উচ্চারিত হয়েছিল দুদিনের মধ্যে সেগুলি সারা শহরের লোকই জেনে গেল। তারা সবিস্ময়ে জানল যে, রিচার্ডস্ নিজেই বস্তার একজন দাবীদার ছিল এবং বার্জেস তখনকার মত খবরটা চেপে রেখে পরে ঈর্ষাবশত ফাঁস করে দিয়েছে।

বার্জেসকে চেপে ধরলে সে প্রবলভাবে কথাটা অস্বীকার করল। সে আরও বলল, একটি রুগ্ন বুড়ো মানুষ প্রলাপের ঘোরে কি বলেছে না বলেছে তার উপর গুরুত্ব আরোপ করা ঠিক নয়। তবু সন্দেহের নিরসন হল না, নানা রকম কথা চলতেই থাকল।

দু-একদন পরে সংবাদ পাওয়া গেল, মিসেস রিচার্ডসের প্রলাপ-বকুনিতেও তার স্বামীর কথারই প্রতিধ্বনি শোনা গেছে। সন্দেহক্রমে বিশ্বাসে পরিণত হল; একটি মাত্র নাগরিকের চারিত্রিক সততা নিয়ে শহরের যে গর্ব ছিল তাও কমতে কমতে এক সময় নিঃশেষ হতে চলল।

ছ দিন পার হয়ে গেল। আরও খবর এল। বুড়ো-বুড়ি মৃত্যুশয্যায়। একেবারে শেষ মুহূর্তে রিচার্ডসের মনের ঘোর কেটে গেল। সে বার্জেসকে ডেকে পাঠাল। বার্জেস বলল:

সকলে ঘরটা খালি করে দিন। মনে হচ্ছে, উনি গোপন কিছু বলতে চাইছেন।

রিচার্ডস্ বলল: না! আমি সাক্ষী রাখতে চাই। আমি যাতে মানুষের মত মরতে পারি, কুকুরের মত নয়, সে জন্য আপনারা সকলেই আমার স্বীকারোক্তি শুনুন। অন্য সকলের মতই আমিও সৎ-কৃত্রিমভাবে-ছিলাম; তাই প্রলোভন যখন এল তখনই অন্য সকলের মতই আমারও পতন হল। একটা মিথ্যায় সই করে আমিও সেই হতভাগা বস্তাটা দাবী করে বসলাম মিঃ বার্জেসের মনে পড়ে গেল যে এক সময় আমি তার একটা উপকার করেছিলাম, তাই কৃতজ্ঞতাবশত (অজ্ঞানতাবশতও বটে) আমার দাবীটাকে চেপে দিয়ে তিনি আমাকে উদ্ধার করলেন। অনেক বছর আগে বার্জেসের বিরুদ্ধে কি অভিযোগ আনা হয়েছিল তা আপনারা জানেন। একমাত্র আমার সাক্ষ্যই তাকে অভিযোগমুক্ত করতে পারত; কিন্তু আমি ভীরু, তাই তাকে সেই অসম্মানের মধ্যেই ঠেলে দিয়েছিলাম-

না-না-মিঃ রিচার্ডস্ আপনি-

আর চাকরই সে গোপন কথা তাকে জানিয়ে দিয়েছিল-

কেউ আমাকে কিছুই জানায় নি।

আর তখনই যা স্বাভাবিক, যা ন্যায়সঙ্গত তাই তিনি করলেন, আমার প্রতি দয়া প্রদর্শনের জন্য আর অনুতাপ হল এবং আমার সব কথা তিনি ফাঁস করে দিলেন-সেটাই আমার প্রাপ্য ছিল-

কখনও না!-আমি শপথ করে বলছি-

সমস্ত অন্তর দিয়ে আমি তাকে ক্ষমা করছি।

বার্জেসের কোন প্রতিবাদই তার কানে পৌঁছল না; মৃত্যুপথযাত্রীর যাত্রা শেষ হল-সে জানতেও পারল না যে বেচারি বার্জেসের প্রতি সে। আরও একটি অন্যায় করে গেল। সেই রাতেই তার স্ত্রী ও মারা গেল।

পবিত্র উনিশ জনের শেষ মানুটি ও সেই শয়তানী বস্তার শিকার হল; শহরটি তার প্রাচীন গৌরবের শেষ চিহ্ন হতেও বঞ্চিত হল। শোকযাত্রায় জাঁকজমক ছিল না, কিন্তু গভীরতা ছিল।

অনেত আবেদন-নিবেদনের ফলে আইন করে হ্যাডলিবুর্গ-এর নাম বদলে রাখা হল (সে কথা থাক-সেটা আমি বলব না); এবং এই শহরের সরকারী সিল-এ যুগ যুগ ধরে এ নীতি-বাক্যটি ব্যবহৃত হয়ে আসছিল তা থেকে একটি শব্দও বাদ দেওয়া হল।

শহরটি এখন আবার সততায় বিশ্বাসী হয়ে উঠেছে; তাকে পুনরায় ঘুমন্ত অবস্থায় দেখতে হলে অনেক ভোরে ঘুম থেকে উঠতে হয়।

প্রাক্তন নীতি-বাক্যপরিবর্তন নীতি-বাক্য

নিয়ো না আমাদের প্রলোভনের পথে
নিয়ো না আমাদের প্রলোভনের পথে

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *