০৮. প্রতীচ্য সভ্যতা

অধ্যায় ৮ প্রতীচ্য সভ্যতা

 সত্যিকার পরিপ্রেক্ষিতে একজনের পক্ষে নিজের সভ্যতাকে দেখা কোনো মতেই সহজ কাজ নয়। এই লক্ষ্যে পৌঁছার কেবল তিনটি উপায় রয়েছে; ভ্রমণ, ইতিহাস এবং নৃবিজ্ঞান; আমি এ বিষয়ে যা প্রস্তাব করবো তাতে এই তিনটি উপাদানের সংমিশ্রণ থাকবে; তবে এই তিনটির কোনো একটি বস্তুগত তদন্তের ক্ষেত্রে বিরাট কোনো সাহায্য হবে না। কারণ পর্যটকরা তাদের কৌতূহলের বস্তুকেই কেবল দেখতে পান; উদাহরণত, মার্কো পলো একবারও দেখতে পাননি যে চীনা মহিলাদের পদযুগল ক্ষুদ্রাকৃতি। ইতিহাসকারগণ ঘটনাবলি সজ্জিত করেন নিজেদের অর্জিত অভ্যাস অনুসরণে; রোমকে সাম্রাজ্যের অবক্ষয়ের জন্য নানা কারণ দেখানো হয়েছে, যেমন সাম্রাজ্যবাদ, খ্রিষ্টধর্ম, ম্যালেরিয়া, বিবাহবিচ্ছেদ এবং দেশান্তরগমন। শেষ দুটি কারণ যথাক্রমে আমেরিকার পাদরি ও রাজনীতিবিদের কাছে খুবই জনপ্রিয়। নৃবিজ্ঞানী ঘটনা নির্বাচন এবং ব্যাখ্যা করেন তার সময়ে প্রচলিত সংস্কার অনুসরণে। আমরা যারা ঘরকুনো তারা বন্য লোকদের সম্পর্কে কী জানি? রুশোপন্থীরা বলেন তারা মহৎ, আবার সাম্রাজ্যবাদীদের কাছে তারা নির্দয়, ধর্মপুষ্ট মনের নৃবিজ্ঞানীরা বলেন, তারা পুণ্যবান পারিবারিক মানুষ, আবার বিবাহবিচ্ছেদ সংক্রান্ত আইন সংস্কারের প্রবক্তরা বলেন, তাদের জীবনাচরণে মুক্ত যৌনতার প্রাধান্য রয়েছে; স্যার জেমস ফ্রেজার বলেন, তারা সবসময় তাদের ঈশ্বরকে হত্যা করে। এদিকে অন্যেরা বলেন, তারা সর্বদাই দীক্ষা-কর্মানুষ্ঠানে নিয়োজিত। সংক্ষেপে, আদিম বা বন্য লোক নৃবিজ্ঞানীদের বাধিত করেন, অর্থাৎ নৃবিজ্ঞানীদের তত্ত্বের জন্য যা যা দরকার তারা তাই করেন। এই সব ক্রটি সত্ত্বেও ভ্রমণ, ইতিহাস এবং নৃবিজ্ঞান সর্বোৎকৃষ্ট পন্থা, এবং আমাদের এসবই সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করতে হবে।

তবে প্রথমেই একটা প্রশ্ন: সভ্যতা কী? আমি বলবো এর প্রথম আবশ্যিক বৈশিষ্ট্য হলো পূর্বচিন্তন। বাস্তবিকপক্ষে পূর্বচিন্তনই মানুষকে বন্যপশু থেকে আলাদা চিহ্নিত করে, বয়স্কদের পৃথক করে শিশুদের থেকে। তবে পূর্বচিন্তন যেহেতু মাত্রার ব্যাপার, অতএব আমরা বেশি কিংবা কম সভ্য জাতি এবং সময়কালকে পূর্বচিন্তনের প্রাপ্ত পরিমাণ অনুসারে পৃথক করে চিনতে পারি। এবং পূর্বচিন্তন সূক্ষ্ম পরিমাপে প্রায় সমর্থ। আমি বলবো না যে একটা গোষ্ঠীর গড় পূর্বচিন্তন কৌতূহলের পরিমাণের ব্যস্তানুপাতিক, অবশ্য এই মতটিও গ্রহণ করা যায়। কিন্তু আমরা বলতে পারি যে, যে কোনো কাজে পূর্বচিন্তনের মাত্রা তিনটি উপাদান দ্বারা পরিমাপ করা যায়; বর্তমানে যন্ত্রণা, ভবিষ্যৎ সুখ এবং এই দুটির মধ্যে বিরতির সময় পরিধি। অর্থাৎ পূর্বচিন্তন পাওয়া যায় ভবিষ্যৎ সুখ দিয়ে বর্তমান যন্ত্রণা প্রথমে ভাগ করে, অতঃপর মধ্যেকার বিরতিকাল দিয়ে গুণ করতে হবে। আবার ব্যষ্টিক ও সামষ্টিক পূর্বচিন্তনের মধ্যে তফাত রয়েছে। একটি অভিজাত কিংবা ধনিক সম্প্রদায়ে এক ব্যক্তি বর্তমান যন্ত্রণা সহ্য করতে পারে, অপরজন ভোগ করে ভবিষ্যৎ সুখ। এতে সামষ্টিক পূর্বচিন্তন সহজতর হয়ে পড়ে। এই অর্থে শিল্পায়নের সকল বৈশিষ্ট্যপূর্ণ কর্মকাণ্ড প্রদর্শন করে সামষ্টিক পূর্বচিন্তনের উচ্চমাত্রা; যারা তৈরি করেন রেলপথ, পোতাশ্রয় কিংবা জাহাজ তাদের কাজের সুবিধা কয়েক বছর পর লাভ করা যায়।

এটা সত্য যে আধুনিক জগতের কোনো ব্যক্তি এতটা পূর্বচিন্তন দেখান নি যতটা দেখিয়েছেন প্রাচীন মিসরবাসীরা মৃতদেহ মমি করে, কারণ এই কাজটি তারা করেন যে দৃষ্টিভঙ্গি থেকে তা হলো ঐ মমি দশ হাজার বছর পর পুনরুজ্জীবিত হবে। এখণ আমি আর একটি উপাদানের সন্ধান পেলাম যা সভ্যতার জন্য আবশ্যিক : জ্ঞান। কুসংস্কারভিত্তিক পূর্বচিন্তনকে পুরোপুরি সভা বলে গণ্য করা যায় না; অবশ্য এটা মনের এমন অভ্যাস জন্ম দিতে পারে যা সত্যকার সভ্যতা বিকাশের জন্য আবশ্যিক। উদাহরণ, এই যে শুদ্ধাচারীদের (পিউরিটান) অভ্যাস ছিল পরবর্তী জীবনের জন্য সুখ বিসর্জন, তা নিঃসন্দেহে পুঁজি সঞ্চয়ে সাহায্য করেছে। যে পুঁজি শিল্পায়নের জন্য ছিল খুবই দরকারি। তাহলে আমরা সভ্যতার সংজ্ঞা এইভাবে নিরূপণ করতে পারি: জীবনের একটা রীতি, যা জ্ঞান ও পূর্বচিন্তনের সমন্বয়ে গঠিত।

এই অর্থে সভ্যতা শুরু হয়েছে কৃষিকার্য এবং রোমন্থক জন্তু পোষ মানানোর সঙ্গে। এই কিছুকাল আগেও কৃষিজীবী এবং পশুপালক জনগোষ্ঠীর লোকেরা পরিষ্কারভাবে পৃথক ছিল। আমরা বাইবেলের আদিপুস্তকে পড়ি কীভাবে ইস্রায়িলীদের গোশেন প্রদেশে উপনিবেশ স্থাপন করতে হয়, মূল মিশরে তাদের জায়গা হয়নি, কারণ মিশরবাসীরা পেশা হিসেবে পশুপালনকে একেবারে পছন্দ করেনি, এ বিষয়ে তাদের ছিল ঘোর আপত্তি: পরে যোসেফ আপন ভ্রাতাদের ও পিতার স্বজনকে বললেন, আমি গিয়ে ফেরাউনকে জানাবো, তাকে বলবো, আমার ভাইয়েরা এবং পিতার স্বজনেরা কেনান দেশ থেকে আমার কাছে এসেছে; তারা মেষপালক, পশু রক্ষণাবেক্ষণ তাদের কাজ; এবং তাদের গোমেমাদি ও সর্বস্ব সঙ্গে এনেছে। এতে ফেরাউন যখন তোমাদের ডেকে জিজ্ঞেস করবেন, তোমাদের পেশা কী? তখন তোমরা বলবে, আপনার এই দাসগণ পুরুষানুক্রমে এবং অদ্যাবধি পশুপালন করে আসছে; ফলে তোমরা গোশেন প্রদেশে বাস করতে পারবে; কারণ মিশরবাসীরা পশুপালকদের একদম ঘৃণা করে। মি. হুকের ভ্রমণবৃত্তান্ত থেকে জানা যায়, পশুপালক মঙ্গলদের প্রতি চিনাদেরও অনুরূপ মনোভাব কাজ করেছে। মোটের উপর, কৃষিকাজ সব যুগের উচ্চতর সভ্যতার প্রতিনিধিত্ব করেছে। ধর্মের সঙ্গেও ছিল এর অন্তরঙ্গ সম্পর্ক। কিন্তু গোষ্ঠীপতিদের গো-মহিষাদির প্রভাবও ব্যাপক ছিল ইহুদি ধর্মের উপর, অতঃপর উক্ত প্রভাব খ্রিষ্টধর্মের উপর বর্তায়। কেইন ও আবেলের গল্প এক খণ্ড প্রচারণা মাত্র, এতে দেখানো হলো যে মেষপালকরা কৃষিজীবীদের চেয়ে পুণ্যবান। তথাপি এই সম্প্রতিকাল পর্যন্তও সভ্যতা প্রধানত কৃষিকার্যের উপর নির্ভরশীল ছিল।

আমরা এতক্ষণ এমন বিষয় বিবেচনার মধ্যে আনিনি যা প্রতীচ্যের সভ্যতাকে অন্যান্য অঞ্চলের সভ্যতা থেকে বিশিষ্ট করে তুলেছে। যেমন ভারত, চীন, জাপান এবং মেক্সিকোর সভ্যতা থেকে। বস্তুত বিজ্ঞানের উদ্ভবের আগে এই পার্থক্য খুবই কম ছিল। বিজ্ঞান ও শিল্পায়ন আজকের প্রতীচ্য সভ্যতার বিশিষ্টতার চিহ্ন; কিন্তু আমি প্রথমে বিবেচনা করব শিল্প বিপ্লবের আগে আমাদের সভ্যতা কেমন ছিল।

আমরা যদি পশ্চিমী সভ্যতার উৎপত্তির কারণগুলোতে ফিরে যাই তাহলে দেখতে পাবো মিশর ও ব্যাবিলন থেকে এটা যা গ্রহণ করেছে তা প্রধানত সকল সভ্যতারই বৈশিষ্ট্য এবং তা কেবল পশ্চিমের বিশেষ বৈশিষ্ট্য নয়। পশ্চিমী সভ্যতার বিশিষ্টতা শুরু হয় গ্রিকদের সঙ্গে, এই গ্রিকরা অবরোহী চিন্তার অভ্যাস এবং জ্যামিতি উদ্ভাবন করে। তাদের অন্যান্য গুণ হয় ছিল না কিংবা থাকলে তা অন্ধকার যুগে হারিয়ে যায়। সাহিত্য এবং শিল্পকলায় হয়তো তাদের শ্রেষ্ঠতা ছিল, কিন্তু বিভিন্ন প্রাচীন জাতিসমূহ থেকে তাদের বিভিন্নতা খুব গভীর ছিল না। পরীক্ষামূলক বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে তারা গুটিকয় ব্যক্তির জন্ম দেয়, এখানে আমরা আর্কিমিডিস-এর নামোল্লেখ করতে পারি, যিনি আধুনিক পদ্ধতি সম্পর্কে অনুমান করতে পেরেছিলেন, কিন্তু তারা কোনো মতবাদী গোষ্ঠী কিংবা ঐতিহ্য নির্মাণ করে যেতে পারেন নি। গ্রিকদের সভ্যতার একটা অতি সুস্পষ্ট অবদান হলো অবরোহী যুক্তি এবং বিশুদ্ধ গণিত।

যাহোক, গ্রিকরা কিন্তু রাজনীতির ক্ষেত্রে ছিলেন অযোগ্য এবং সভ্যতায় তাদের অবদান হয়তো সত্যিই হারিয়ে যেত শুধু রোমানদের প্রশাসনিক দক্ষতার জন্য টিকে থাকে। রোমানরা আবিষ্কার করেন সিভিল সার্ভিস এবং আইন দ্বারা একটা বিরাট সাম্রাজ্যের প্রশাসন কীভাবে চালাতে হয় তার কৌশল। পূর্ববর্তী সাম্রাজ্যগুলোতে সবকিছু নির্ভর করেছে সম্রাটের শক্তিমত্তার উপর, কিন্তু রোমক সাম্রাজ্যে সম্রাট খুন হতে পারতেন প্রেটরীয়ান রক্ষীদের হাতে এবং সেনাবাহিনী প্রশাসন যন্ত্রের বিন্দব্রিাত্র ক্ষতি না করে সাম্রাজ্যের জন্য নিলাম ডাকতে পারতেন। আর প্রশাসন-যন্ত্রকে যতটা ঝুট ঝামলো পোহাতে হতো তার সঙ্গে তুলনা চলতে পারে আজকের দিনে নির্বাচন পরিচালনায় যতটা ঝুটঝামেলা পোহাতে হয় তার সঙ্গে। মনে হয় রোমানরা ব্যক্তি প্রশাসকের প্রতি আনুগত্যের স্থানে নৈর্ব্যক্তিক রাষ্ট্রের প্রতি নিবেদিত চিত্ততার গুণ উদ্ভাবন করেন। সত্য যে, গ্রিকরা দেশপ্রেমের কথা বলতেন, কিন্তু তাদের রাজনীতিবিদরা ছিলেন দুর্নীতিপরায়ণ এবং এদের প্রায় সবাই কোনো না কোনো সময়ে পারস্য সম্রাটের কাছ থেকে ঘুষ গ্রহণ করেছে। রাষ্ট্রের প্রতি ভক্তির রোমক ধারণা পশ্চিমে স্থায়ী সরকার প্রতিষ্ঠা আবশ্যিক উপাদান হিসেবে কাজ করেছে।

প্রাক-আধুনিককালে প্রতীচ্য সভ্যতার জন্য আরো একটা উপাদানের আবশ্যকতা ছিল, আর তা হলো রাষ্ট্র এবং ধর্মের মধ্যে অদ্ভুত সম্পর্ক যা খ্রিষ্টধর্মের মাধ্যমে আসে। খ্রিষ্টধর্ম মূলত ছিল সম্পূর্ণ অ-রাজনৈতিক। কারণ রোমক সাম্রাজ্যে এই ধর্মের বিকাশ ঘটে তাদের প্রতি সান্ত্বনা স্বরূপ যারা জাতীয় এবং ব্যক্তিগত স্বাধীনতা হারিয়েছিল; এবং এটা ইহুদি ধর্ম থেকে জগতের শাসককুলের প্রতি নৈতিক দোষারোপের মনোভাবটা গ্রহণ করে। কনস্ট্যাটাইনের আগে খ্রিস্টধর্ম এমন সংঘ গড়ে তোলে যার প্রতি খ্রিস্টানদের আনুগত্য রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্যের চেয়ে ছিল বেশি। রোমের পতনের পর ইহুদি, গ্রিক ও রোমক সভ্যতার সারাৎসার গির্জা অসাধারণ সংশ্লেষণের মাধ্যমে সংরক্ষণ করে। ইহুদি নীতিপরায়ণতা থেকে আসে খ্রিস্টধর্মের নীতিসূত্র; অবরোহী যুক্তির প্রতি গ্রিক অনুরাগ থেকে আসে ধর্মতত্ত্ব; রোমক সাম্রাজ্যবাদ এবং আইনবিজ্ঞানের উদাহরণ থেকে আসে গির্জার কেন্দ্রীভূত প্রশাসন এবং ক্যানন ল।

যদিও উচ্চ সভ্যতার এই উপাদানগুলো, এক অর্থে, গোটা মধ্যযুগে সংরক্ষণ করা হয়, তবু এসব দীর্ঘকাল কম-বেশি সুপ্তাবস্থায় থাকে। বস্তুত ঐ সময় পশ্চিমী সভ্যতা সর্বোকৃষ্ট ছিল না; মুসলমান এবং চৈনিক সভ্যতা ছিল উচ্চতর। কেন পশ্চিম দ্রুত উপরের দিকে উঠতে শুরু করল তা, আমি মনে করি, অনেকাংশে বিরাট রহস্য হিসেবে রয়ে গেছে। আজকের দিনের ঝোঁক হলো সবকিছুর অর্থনৈতিক কারণ অনুসন্ধান, কিন্তু এই অভ্যাসভিত্তিক ব্যাখ্যা ঘটনার অতিসরলীকরণ মাত্র। কেবল অর্থনৈতিক কারণ দিয়ে, উদাহরণত, স্পেনের অবক্ষয় ব্যাখ্যা করা যায় না, বরং এর ব্যাখ্যা খুঁজে পাওয়া যাবে অসহিষ্ণুতা এবং নির্বুদ্ধিতার ভেতর। বিজ্ঞানের অভ্যুদয়ও অর্থনৈতিক কারণ দিয়ে ব্যাখ্যা করা ভুল হবে। সাধারণ নিয়মে সভ্যতার অবক্ষয় ঘটে কেবল বৈদেশিক উন্নততর সভ্যতার সম্পর্কে এলে। মানব ইতিহাসের গুটিকয় বিরল যুগেই, এবং বিক্ষিপ্ত অঞ্চলে, স্বতঃস্ফূর্ত প্রগতি ঘটে; এবং পশ্চিম ইউরোপে রেনেসাঁর সময় থেকে স্বতঃস্ফূর্ত প্রগতি লক্ষ্য করি। আমি মনে করি না যে কথিত যুগের এবং স্থানের সাধারণ সামাজিক অবস্থায় এমন কিছু ছিল যা, যে যুগে এবং স্থানে প্রগতি সংঘটিত হয়নি, তার থেকে বিশিষ্ট ছিল। তাহলে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হতেই হয় যে বিরাট প্রগতির যুগগুলো নির্ভর করেছে অসাধারণ দক্ষতা সম্পন্ন গুটিকয় ব্যক্তির উপর। অবশ্য এসবের কার্যকারিতার জন্য বিচিত্র সামাজিক এবং রাজনৈতিক অবস্থার দরকার ছিল, কিন্তু তা যথেষ্ট নয়। কারণ দেখা গেছে অবস্থা অনুকূলে কিন্তু অসাধারণ ব্যক্তি নেই, অনুরূপ ক্ষেত্রে কোনো প্রগতির দেখা মেলেনি। যদি কেপলার, গ্যালিলিও এবং নিউটন শৈশবেই দেহরক্ষা করতেন তাহলে আমরা এখন যে জগতে বাস করছি তার সঙ্গে ঘোড়শ শতাব্দীর যে বিরাট প্রভেদ, তা অনেক কম হতো। তাহলে এটা আমরা নীতি হিসেবে গ্রহণ করতে পারি যে প্রগতি কোনো নিশ্চিত ব্যাপার নয়; যদি বিখ্যাত ব্যক্তি সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায় তাহলে নিঃসন্দেহে আমরা বাইজান্টাইন ধরনের স্থবিরতার মধ্যে নিক্ষিপ্ত হবো।

মধ্যযুগের কাছে আমরা একটা বিরাট গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে ঋণী, আর তা হলো প্রতিনিধিত্বশীল সরকার। এটা গুরুত্বপূর্ণ এজন্য যে এই পদ্ধতি প্রথম বারের মতো সম্ভব করে তুলেছে যে বৃহৎ সাম্রাজ্যের সরকারকে শাসিতের কাছে মনে হতে হবে ঐ সরকার তারাই নির্বাচন করেছে। এই পদ্ধতি যেখানে সফল হয় সেখানে রাজনৈতিক স্থায়িত্ব হয় উচ্চমাত্রায়। তবে সম্প্রতিকালে এটা সুস্পষ্ট হয়েছে যে প্রতিনিধিত্বশীল সরকার ধুলার ধরণীর সব অঞ্চলের জন্য প্রযোজ্য ঔষধি নয়। বাস্তবিকপক্ষে, মনে হয়, এর সাফল্য ইংরেজিভাষী দেশসমূহ এবং ফরাসিদের মধ্যে সীমাবদ্ধ।

যে কোনো উপায়ে রাজনৈতিক সংহতি সৃষ্টি পশ্চিমী সভ্যতার বিশিষ্টতাসূচক চিহ্নে পরিণত হয়েছে। অন্যান্য অঞ্চলের সভ্যতায় যা দেখা যায় না। এর প্রধান কারণ দেশপ্রেম, যা, যদিও এর মূল নিহিত ইহুদি সবিশেষত্ব এবং রোমানদের রাষ্ট্রের প্রতি ভক্তিতে, জন্ম নিয়েছে আধুনিককালে, প্রথম সূচিত হয় ইংরেজদের আর্মাডা৫ প্রতিরোধের ভেতর এবং এর প্রথম সাহিত্যিক প্রকাশ ঘটে শেক্সপিয়ারে। ধর্মযুদ্ধ শেষ হবার পর থেকে প্রধানত দেশপ্রেমভিত্তিক রাজনৈতিক সংহতি পশ্চিমে দ্রুত বাড়ছে। এ ব্যাপারে জাপান অসাধারণ যোগ্য ছাত্র হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে। প্রাচীন জাপানে ছিল দাঙ্গাবাজ সামন্ত ব্যারনের দল, যাদের তুলনা গোলাপের যুদ্ধাকালীন ইংল্যান্ডের অসংখ্য ব্যারন। কিন্তু আগ্নেয়াস্ত্র এবং বারুদের সাহায্যে শোগুন অভ্যন্তরীণ শান্তি প্রতিষ্ঠিত করে; (জাহাজে আগ্নেয়াস্ত্র এবং গোলাবারুদের সঙ্গে জাপানে ধর্ম প্রচারকরাও এসেছিল); এবং ১৮৬৮ সাল থেকে শিক্ষা ও শিন্টো ধর্মের সাহায্যে সরকার পশ্চিমের মতোই একটা সমসত্ত্ব, দৃঢ়সংকল্প এবং একতাবদ্ধ জাতি গঠনে সফল হয়।

আধুনিক জগতে সামাজিক সংহতির উচ্চ মাত্রার জন্য প্রধানত দায়ী যুদ্ধকৌশলের পরিবর্তন; এবং গোলাবারুদ থেকে শুরু করে সবকিছুর উদ্ভাবন সরকারের ক্ষমতা বৃদ্ধি করেছে। সম্ভবত এই প্রক্রিয়া কোনো মতেই শেষ হয়ে যায়নি, কিন্তু এটা একটা নতুন উপাদানকে জটিল করে তুলেছে: যেহেতু সেনাবাহিনী অস্ত্রাদির জন্য শিল্প শ্রমিকদের উপর ক্রমান্বয়ে নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে তাই সরকারের খুব বেশি দরকার হয়ে পড়েছে জনসংখ্যার বৃহৎ অংশের সমর্থনের। এই ব্যাপারটা প্রচারণা কৌশলের কাজ এবং এক্ষেত্রে অদূর ভবিষ্যতে সরকারগুলো দ্রুত উন্নতি সাধন করবে বলেই মনে হয়। গত চার শ বছরের ইউরোপের ইতিহাস ছিল একই সঙ্গে উন্নতি ও অবক্ষয়ের, পুরাতন সংশ্লেষণের অবক্ষয়ের প্রতিনিধিত্ব করেছে ক্যাথলিক গির্জা, এবং এখনও সম্পূর্ণ না হলেও, নতুন সংশ্লেষণের উন্নতি অদ্যাবধি দেশপ্রেম এবং বিজ্ঞানের উপর নির্ভরশীল থেকেছে। এটা মনে করা যায় না যে আমাদের বৈজ্ঞানিক সভ্যতা অন্যত্র প্রতিস্থাপন করলে একই ফল পাওয়া যাবে বা উক্ত স্থানের বৈজ্ঞানিক সভ্যতা আমাদের অনুরূপ হবে। খ্রিষ্টধর্ম এবং গণতন্ত্রে আরোপিত বিজ্ঞান এমন ফলাফল জন্ম দিতে পারে যা কুলপূজা এবং একচ্ছত্র রাজতন্ত্রে আরোপিত বিজ্ঞানের ফলাফল থেকে একেবারে আলাদা। ব্যক্তির প্রতি সুনির্ধারিত শ্রদ্ধার জন্য আমরা খ্রিষ্টধর্মের কাছে ঋণী, কিন্তু এই অনুভূতির প্রতি বিজ্ঞান সম্পূর্ণত নিরপেক্ষ। বিজ্ঞান নিজের থেকে কোনো নৈতিক আদর্শের প্রস্তাব করে না, এবং এ ব্যাপারে সন্দেহ রয়েছে, কোন নৈতিক আদর্শ আমাদের ঐতিহ্য থেকে পাওয়া নৈতিক আদর্শের স্থান দখল করবে। ঐতিহ্য খুব ধীর গতিতে পরিবর্তিত হয়। আর আমাদের নৈতিক আদর্শ যে পর্যায়ে এখনও রয়ে গেছে তা কেবল প্রাক-শিল্পযুগের উপযোগী; তাই বলে এই ধারা অব্যাহত গতিতে চলতে থাকবে বলে আশা করা যায় না। মানুষ ক্রমান্বয়ে এমন ভাবনা অধিকার করবে যা তার বাস্তব অভ্যাসের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং এমন আদর্শ গ্রহণ করবে যা তার শিল্পপ্রযুক্তির সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ হবে না। জীবনোপায়ের পরিবর্তনের হার আগের যে কোন সময়ের চেয়ে এখন দ্রুততর; গত দেড় শ বছরে জগৎ যতটা পরিবর্তিত হয়েছে পূর্ববর্তী চার হাজার বছরে ততটা হয়নি। পিটার দ্য গ্রেট হামুরাবির সঙ্গে বাক্য বিনিময় করতে না-পারলেও একে অপরের কথা খুব ভালোভাবে বুঝতেন; কিন্তু এদের কেউ আধুনিক মহাজন কিংবা শিল্পপতির কথা বুঝতে পারতেন না। একটা কৌতূহলোদ্দীপক ব্যাপার এই যে, আধুনিক সময়ের সকল নতুন ধারণা কারিগরি কিংবা বৈজ্ঞানিক। বিজ্ঞান অতি সম্প্রতি নতুন নৈতিক আদর্শ লালন শুরু করেছে, আর এটা শুরু করেছে। কুসংস্কারাচ্ছন্ন নৈতিক বিশ্বাসের আগল থেকে হিতৈষণা মুক্তির মাধ্যমে। যেখানে প্রথাগত নীতি দুর্ভোগের দণ্ডের বিধান দেয় (উদাহরণত জন্মনিয়ন্ত্রণ নিষিদ্ধকরণে), সেখানে একটু সদয় নীতিকে নৈতিকতাবিবর্জিত মনে করা হয়; ফলে যারা তাদের নীতিকে জ্ঞান দ্বারা প্রভাবিত হতে দেয়, তাদের অজ্ঞানতার অবতাররা দুষ্ট চরিত্রের গণ্য করে। যাহোক, অবশ্য এটা নিতান্তই সন্দেহজনক যে, আমাদের সভ্যতার মতো একটি সভ্যতা যখন এতটা বিজ্ঞাননির্ভর, তা দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে, সফলতার সঙ্গে এমন জ্ঞান নিষিদ্ধ করতে পারবে যা মানুষের সুখ বিরাটাকারে বৃদ্ধি করতে সমর্থ।

প্রকৃত ব্যাপার এই যে আমাদের প্রথাগত নৈতিক আদর্শ হয় ব্যক্তিগত পবিত্রতার ধারণার মতো একেবারে ব্যক্তি-কেন্দ্রিক কিংবা আধুনিক জগতের গুরুত্বপূর্ণ গোষ্ঠীর চেয়ে অনেক ক্ষুদ্র গোষ্ঠীর উপযোগী। সামাজিক জীবনের উপর আধুনিক প্রযুক্তির অন্যতম প্রতিক্রিয়া হলো মানুষের কর্মকাণ্ড বিরাট মাত্রায় সংগঠিত হয়েছে বৃহত্তর গোষ্ঠী গঠনে, ফলে একজন মানুষের কার্যকলাপের প্রতিক্রিয়া অনেক সময় এমন জনগোষ্ঠীর উপর পড়ে যে গোষ্ঠীর সঙ্গে তার নিজ গোষ্ঠীর সম্পর্ক সহযোগিতার কিংবা দ্বন্দ্বের। পরিবারের মতো ক্ষুদ্র গোষ্ঠীগুলোর গুরুত্ব ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছে। এবং এখন কেবলমাত্র একটাই বৃহৎ গোষ্ঠী টিকে আছে, জাতি কিংবা রাষ্ট্র, যে সম্পর্কে প্রথাগত নৈতিকতা কিছুটা পাত্তা দেয়। ফলে এই যে আমাদের কালের কার্যকরী ধর্ম, যদি শুধু প্রথাগত না হয়, দেশপ্রেম নিয়ে গঠিত। গড় মানুষ দেশপ্রেমের জন্য জীবন উৎসর্গ করতে ইচ্ছুক, এবং সে এই নৈতিক দায়িত্বকে এতটা বাধ্যতামূলক মনে করে যে তার কাছে কোনো বিদ্রোহ সম্ভবপর মনে হয় না।

এটা অসম্ভব মনে হয় না যে ব্যক্তি স্বাধীনতা আদায়ের আন্দোলন যা ছিল রেনেসাঁসের যুগ থেকে উনিশ শতকী উদারতন্ত্রের যুগ পর্যন্ত সময়ের বৈশিষ্ট্য, তা শিল্পায়নের জন্য যে সংগঠনপ্রিয়তা বাড়ে তাতে বন্ধ হয়ে যাবে। ব্যক্তির উপর সমাজের চাপ, নতুন আকারে এতটা বড় হতে পারে যার তুলনা মিলবে কেবল বর্বর গোষ্ঠীগুলোতে, জাতিসমূহও হয়তো ক্রমান্বয়ে ব্যক্তির কৃতিত্বের চেয়ে সমষ্টির কৃতিত্ব নিয়ে নিজেরা বেশি গর্ব করবে। এই ব্যাপারটা ইতোমধ্যেই শুরু হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে লোকেরা গর্ববোধ করে গগণচুম্বী অট্টালিকা, রেলস্টেশন, সেতু ইত্যাদি নিয়ে; কবি, শিল্পী এবং বিজ্ঞানী নিয়ে তাদের কোনো গর্ব নেই। এই একই মনোভাব সোভিয়েত সরকারের দর্শনে অনুপ্রবেশ করেছে। সত্য যে, উভয় দেশে ব্যক্তিবীরের জন্য আকাক্ষা কাজ করে; রুশ দেশে ব্যক্তিগত বিশিষ্টতা কেবল লেনিনের; আমেরিকায় ক্রীড়াবিদ, মুষ্টিযোদ্ধা এবং চলচ্চিত্র তারকাদের। তবে উভয় ক্ষেত্রে কথিত বীরেরা হয় মৃত কিংবা তুচ্ছ এবং বর্তমানের গুরুত্বপূর্ণ কোনো কাজ সেই কারণে প্রসিদ্ধ কোনো ব্যক্তির নামের সঙ্গে যুক্ত করা হয় না।

একটা কৌতূহলজাগর ব্যাপারে কল্পনা খাটানো যায়; তাহলো, ব্যক্তি নয়, সমষ্টির প্রচেষ্টায় উন্নতমানের কিছু সৃষ্টি করা যায় কি-না এবং তেমন ধরনের সভ্যতা সর্বোৎকৃষ্ট মানের হতে পারে কি-না। আমি তো মনে করি এই প্রশ্নের উত্তর হঠাৎ করে দেয়া সম্ভব নয়। এটা সম্ভব যে শিল্পকলা এবং বুদ্ধিবৃত্তি উভয় ব্যাপারে অতীতে ব্যক্তির প্রচেষ্টায় যা অর্জন করা যেত এখন সহযোগিতার মাধ্যমে তার চেয়ে উন্নততর কিছু অর্জন করা যায়। বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে ইতোমধ্যেই একটা ঝোঁক তৈরি হয়েছে, কোনো কাজের ব্যাপারে ব্যক্তি নয়, গবেষণাগার-সংশ্লিষ্টতা অধিক গুরুত্ব পাচ্ছে, এটা আরো সুস্পষ্টভাবে হলে তা বিজ্ঞানের জন্য হয়তো ভালোই হবে, কারণ এতে সহযোগিতা বাড়বে। কিন্তু যে কোনো ধরনের গুরুত্বপূর্ণ কাজ যদি সামষ্টিকভাবে করতে হয় তাহলে প্রয়োজনেই ব্যক্তিকে খাটো করতে হবে: সে-ক্ষেত্রে তারা এতকাল যে প্রতিভাবান ব্যক্তি হিসেবে বড়াই করে এসেছেন সেটা আর সম্ভব হবে না। এই সমস্যায় প্রবেশ করে খ্রিস্টীয় নৈতিকতা, তবে স্বাভাবিকভাবে যা মনে করা হয় তার বিপরীত অর্থে। সাধারণভাবে ভাবা হয় যে, যেহেতু খ্রিস্টধর্ম পরার্থবাদী এবং প্রতিবেশীর প্রতি ভালোবাসা পোষণ করতে বলে, অতএব এই ধর্ম ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদ বিরোধী। যাহোক এটি একটি মনস্তাত্ত্বিক প্রমাদ। খ্রিস্টধর্মের আবেদন ব্যক্তির আত্মার প্রতি এবং এই ধর্ম ব্যক্তির মোক্ষের উপর জোর দেয়। একজন মানুষ তার প্রতিবেশীর জন্য যা করে, সে তা করে কাজটি তার জন্য সঠিক বলে, কারণ এই নয় যে সে, স্বাভাবিকভাবে কোনো বৃহত্তর গোষ্ঠীর অংশ বলে তা করে। সূচনা থেকেই খ্রিস্টধর্ম, এবং এখনও আবশ্যিকভাবে, রাজনৈতিক নয়, এমনকি পারিবারিকও নয়। ফলে এর ঝোঁক হলো প্রকৃতি ব্যক্তিকে যতটা বানিয়েছে তার চেয়ে বেশি স্বয়ম্ভর করে তোলা। অতীতে পরিবার ব্যক্তি-সংশোধনের শক্তি হিসেবে কাজ করেছে। কিন্তু এখন পরিবারের অবক্ষয় ঘটছে এবং মানুষের প্রবণতার উপর যে অধিকার ছিল তা হারিয়ে ফেলেছে। পরিবার যা হারিয়েছে, জাতির তাই লাভ হয়েছে। কারণ জাতি আবেদন রাখে মানুষের নৈতিক প্রবৃত্তির উপর, যে প্রবৃত্তিগুলো শিল্পায়িত জগতে কোনো সুযোগ পায় না। একজনের ইচ্ছে হয় মানুষ যদি তার জৈবিক সহজাত আবেগসমূহকে মানববংশের কল্যাণে প্রয়োগ করত; কিন্তু এটা মনস্তাত্ত্বিক দিক দিয়ে অসম্ভব বলেই মনে হয়। বাহ্যিক কোনো বিপদ, যেমন নতুন কোন রোগ কিংবা সার্বিক দুর্ভিক্ষ, হুমকি হয়ে দাঁড়ালে অবশ্য ভিন্ন কথা। এগুলো যেহেতু সম্ভব নয় তাই আমি দেখতে পাই না এমন কোনো মনস্তাত্ত্বিক উপায়ের সম্ভাবনা যা দিয়ে বিশ্ব-সরকার প্রতিষ্ঠা করা যায়। একটা উপায় তবু থেকে যায় কোনো জাতি বা কয়েকটা জাতি মিলে যদি গোটা বিশ্ব জয় করে। মনে হয় বিকাশের এটাই স্বাভাবিক ধারা, হয়তো আগামী এক শো কি দুশো বছরের মধ্যে এটা সম্ভবও হবে। পশ্চিমের সভ্যতার বর্তমান অবস্থায় প্রথাগত সকল উপাদানের চেয়ে বিজ্ঞান ও শিল্পপ্রযুক্তির গুরুত্ব অনেক বেশি। এ থেকে মনে করা ঠিক হবে না যে মানবজীবনের উপর এইসব নতুনত্বের ফলাফল সম্পূর্ণ বিকশিত হয়েছে: অতীত যুগের চেয়ে এখন সব কিছু দ্রুততর গতিতে চলে, তাই বলে খুব বেশি দ্রুত গতিতে চলে না। মানবিকতা বিকাশে গুরুত্বের দিক থেকে শিল্পযুগের সঙ্গে তুলনা চলতে পারে এমন সর্বশেষ ঘটনা হলো কৃষিবিজ্ঞান উদ্ভাবন এবং পৃথিবীর সর্বত্র ছড়িয়ে যেতে এর সময় লেগেছে হাজার হাজার বছর। সঙ্গে-সঙ্গে প্রসারিত হয়েছে ভাবনা-ধারণার একটি রীতি ও জীবন যাপনের পদ্ধতি। এমনকি কৃষিজীবন পদ্ধতি এখনও পৃথিবীর সকল অভিজাততন্ত্রকে জয় করতে পারেনি এবং অদ্ভুত রক্ষণশীলতার সঙ্গে এখনও শিকার যুগের স্তরে রয়ে গেছে, শিকারের জন্তু-জানোয়ার সংরক্ষণের নিয়মাবলি থেকে আমরা তা বুঝতে পারি। অনুরূপভাবে আমরা আশা করতে পারি যে কৃষিকার্যের দৃষ্টিভঙ্গি অনুন্নত দেশসমূহ এবং জনগোষ্ঠীর অনুন্নত অংশে বহুকাল টিকে থাকবে।

তবে এই দৃষ্টিভঙ্গি পশ্চিমা সভ্যতার বিশিষ্টতা নয়, কিংবা এর থেকে প্রাচ্যে যা জন্ম নিচ্ছে তাও নয়। আমেরিকায় দেখতে পাওয়া যায়, এখানকার কৃষিকার্যও আধা-শৈল্পিক মানসিকতার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। কারণ আমেরিকায় কোনো দেশীয় কৃষককুল নেই। রাশিয়া এবং চিনে সরকারের শিল্পায়নের দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে, কিন্তু বিরাট অজ্ঞ কৃষি জনসংখ্যার সঙ্গে বোঝাঁপড়া করতে হয়। যাহোক, এই সঙ্গে এটা স্মরণ করা গুরুত্বপূর্ণ যে, যে জনগোষ্ঠী লিখতে পড়তে জানে না তাদের সরকারি প্রচেষ্টায় দ্রুত পরিবর্তন করা যায়; পশ্চিম ইউরোপ এবং আমেরিকায় ব্যাপারটা ভিন্ন বলে কাজটা কঠিন। অক্ষরজ্ঞান বাড়িয়ে এবং সঠিক প্রচার প্রয়োগ করে রাষ্ট্র উদীয়মান প্রজন্মকে প্রবীণদের এতটা ঘৃণা করতে শেখাতে পারে যে, এতে সর্বোন্নত বিষয়াসক্ত আমেরিকাবাসীও অবাক মানবে, এবং এভাবে এক প্রজন্মের মধ্যে মানসিকতার সম্পূর্ণ পরিবর্তন সাধন সম্ভব। রুশদেশে এই প্রক্রিয়া পুরোদমে চলছে; চিনে শুরু হয়েছে। সুতরাং আশা করা যায় যে এই দুটি দেশ শিল্পের অনুকূলে নির্ভেজাল মানসিকতা গড়ে তুলবে। এই মানসিকতা হবে সেই সব প্রথাগত উপাদান থেকে মুক্ত, যা অতি ধীরে বিকাশমান পশ্চিমে এখনও টিকে আছে।

প্রতীচ্য সভ্যতার পরিবর্তন হয়েছে এবং এতটা দ্রুতগতিতে বদলে যাচ্ছে যে যারা এই সভ্যতার অতীতের প্রতি অনুরাগ বোধ করেন তারা দেখতে পান নিজেরা যেন ভিন্ন জগতে বাস করছেন। তবে চলতি কালটা এমন উপাদান আরো সুস্পষ্টভাবে বের করে আনছে যা রোমকদের সময় থেকে কিছু পরিমাণে সব সময় বিরাজিত ছিল, এবং এটাই সব সময়ই ভারত ও চীন থেকে ইউরোপকে বিশিষ্টতা দিয়েছে। বীর্য, সহিষ্ণুতা এবং বিমূর্ত বুদ্ধিবৃত্তি ইউরোপের স্বর্ণযুগকে প্রাচ্যের স্বর্ণ যুগ থেকে বিশিষ্টতা দেয়। সাহিত্য ও শিল্পে গ্রিকদের হয়তো শ্ৰেষ্ঠতা ছিল, তবে চিনের তুলনায় তাদের শ্রেষ্ঠতা মাত্রার ব্যাপারে শুধু। শক্তি ও বুদ্ধিমত্তা সম্পর্কে ইতোমধ্যেই আমি অনেক কিছু বলছি; কিন্তু অসহিষ্ণুতা সম্পর্কে কিছু বলা দরকার, কারণ ইউরোপের এই বৈশিষ্ট্য জনগণ যতটা উপলব্ধি করেন তার চেয়েও প্রকট।

গ্রিকদের এই অসদগুণের প্রতি আসক্তি তার উত্তরসূরিদের চেয়ে অনেক কম ছিল। তবু তারা সক্রেটিসকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করে; এবং প্লেতো, সক্রেটিসের প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা সত্ত্বেও, মনে করতেন রাষ্ট্র একটা ধর্ম সম্পর্কে শিক্ষা দেবে, এবং ঐ ধর্ম সম্পর্কে যদি কেউ সন্দেহ পোষণ করে তবে তাকে নির্যাতন করতে হবে। অবশ্য তিনি নিজে ঐ ধর্মকে মিথ্যা জ্ঞান করতেন। কনফুশিয়াস, তাও এবং বুদ্ধপন্থীরা এধরনের হিটলারসুলভ মতবাদ মেনে নিতেন না। প্লেতোর ভদ্রলোকোচিত শালীনতা ঠিক ইউরোপীয় ছিল না; ইউরোপ শাহুরিক ও মার্জিত নয়, বরং সমরপ্রিয় ও চতুর ছিল। প্রতীচ্য সভ্যতার বিশিষ্টতা বরং খুঁজে পাওয়া যাবে পুটার্কের সিরাকুস প্রতিরক্ষার বিবরণে। উক্ত যুদ্ধে সিরাকুস আর্কিমিডিস উদ্ভাবিত যান্ত্রিক কৌশলাদি কাজে লাগায়।

নির্যাতনের একটি উৎস, যেমন গণতান্ত্রিক ঈর্ষা, গ্রিকদের মধ্যে খুবই বিকাশ লাভ করে। আরিস্টিডেসকে নির্বাসিত করা হয় কারণ তাঁর ন্যায়পরায়ণতার প্রসিদ্ধি উদ্বেগজনক হয়ে দাঁড়িয়েছিল; ইফিসাসের হিরাক্লিটাস উল্লসিত হয়ে বলেছেন: ইফিসাসবাসীদের উচিত নিজেদের ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলানো, অন্তত এর প্রতিটি বয়স্ক ব্যক্তির তাই করা উচিত এবং নগরটা দাড়িহীন বালকদের হাতে ছেড়ে দেয়া হোক; কারণ তারা তাদের মধ্যেকার শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি হারমোডোরাসকে বহিষ্কার করেছে এই বলে আমাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ কাউকে থাকতে দেয়া হবে না; যদি কেউ থাকে সে অন্যত্র চলে যাবে, অন্যদের মাঝে বাস করবে। আমাদের কালের অপ্রিয় অনেক বৈশিষ্ট্যই গ্রিকদের ছিল। তাদের মধ্যে ছিল ফ্যাসিবাদ, জাতীয়তাবাদ, সমরবাদ, ক্যুনিজম, অফিসের প্রভু এবং দুর্নীতিপরায়ণ রাজনীতিবিদ; তাদের মধ্যে কলহপ্রিয় কদর্যতা এবং ধর্মীয় নির্যাতনও দেখা গেছে। তাদের মধ্যে মহৎ ব্যক্তি ছিল, তা আমাদের মধ্যেও তো রয়েছে; এখনকার মতো তখনও উৎকৃষ্ট ব্যক্তিদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ নির্বাসন, কারাবাস এবং মৃত্যুবরণ করেছে। গ্রিক সভ্যতার অবশ্য একটা ব্যাপারে আমাদের থেকে শ্রেষ্ঠতা ছিল, সেটা হলো পুলিশের অদক্ষতার ক্ষেত্রে। ফলে তখন মার্জিত লোকদের বিরাট একটা অংশ পালিয়ে রক্ষা পেয়েছে।

কন্সটানটাইন কর্তৃক খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করার পরই শুধু নিপীড়নকারী আবেগ সম্পূর্ণ প্রকাশের প্রথম সুযোগ পায়, এই নিপীড়নকারী আবেগের জন্যই ইউরোপ এশিয়া থেকে বিশিষ্ট। সত্য যে, গত দেড়শো বছরের বিরতিকালে উদারতন্ত্র ছিল, কিন্তু এখন আবার শ্বেত জাতিসমূহ ধর্মতাত্ত্বিক গোঁড়ামিতে ফিরে যাচ্ছে। এই গোঁড়ামি খ্রিষ্টানরা পেয়েছিল ইহুদিদের কাছ থেকে। ইহুদিরাই প্রথম এই ধারণা উদ্ভাবন করে যে কেবল একটা ধর্মই সত্য হতে পারে। কিন্তু তারা চায়নি যে সারা জগৎ এই ধর্ম গ্রহণ করুক। সুতরাং তারা কেবল অন্যান্য ইহুদিদের অত্যাচার করেছে। খ্রিষ্টানরা ইহুদিদের ঈশ্বরের বিশেষ প্রত্যাদেশে বিশ্বাস সংরক্ষণ করেও এতে যোগ করেছেন রোমকদের জগব্যাপী আধিপত্যের বাসনা এবং গ্রিকদের আধিবিদ্যক সূক্ষ্মতা। এই সমন্বয় সৃষ্টি করেছে অত্যন্ত হিংস্রভাবে নির্যাতনকারী একটি ধর্ম এবং ধর্মের ক্ষেত্রে এতটা হিংস্রতা ইতোপূর্বে ছিল না। জাপান ও চিনে বৌদ্ধধর্ম শান্তিপূর্ণভাবে গ্রহণ করা হয় এবং শিন্টো ও কনফুশীয় ধর্মের পাশাপাশি অবস্থানের অনুমোদন দেয়: মোহামেডান জগতে খ্রিষ্টান ও ইহুদিদের অত্যাচার করা হয়নি যতদিন তারা নজরানা প্রদান করেছে; কিন্তু খ্রিষ্টীয় জগতে ধর্মীয় অনুশাসন থেকে ক্ষীণ বিচ্যুতিরও স্বাভাবিক শান্তি ছিল মৃত্যুদণ্ড।

যারা ফ্যাসিবাদ ও ক্যুনিজমের অসহিষ্ণুতা পছন্দ করেন না তাদের সঙ্গে আমার দ্বিমত নেই, অবশ্য যদি না তারা মনে করেন এটা ইউরোপীয় ঐতিহ্য থেকে বিচ্যুতি। নিপীড়নমূলক সরকারি গোঁড়ামির আবহে আমাদের মধ্যে যারা মনে করেন তাদের শ্বাস রুদ্ধ হয়ে আসছে তারা আধুনিক রাশিয়া কিংবা জার্মানির চেয়ে ইউরোপের অতীতের যুগগুলোতে খুব ভালো বোধ করতেন না। জাদুর সাহায্যে আমরা যদি অতীতে ফিরে যেতে পারি, আমরা কি দেখবো আধুনিক রাষ্ট্রসমূহের চেয়ে স্পার্টা উন্নততর? আমরা কি সেই সমাজগুলোতে বাস করতে পছন্দ করতাম যোড়শ শতাব্দীর ইউরোপের মতো সে সমাজ ডাইনিতে অবিশ্বাস করলে মৃত্যদণ্ড প্রদান করেছে? আমাদের কি সহ্য হতো গোড়ার দিকের নিউ ইংল্যাণ্ড, কিংবা ইনকাদের প্রতি পিযারোর (Pizarro) আচরণ? রেনেসাঁস জার্মানি কি উপভোগ্য লাগত, যেখানে ১,০০,০০০ ডাইনিকে পুড়িয়ে মারা হয়? আমাদের কি ভালো লাগত অষ্টাদশ শতকের আমেরিকা, যেখানে বোস্টনের প্রধান। যাজকগণ ম্যাসাচুসেটসের অগ্নিগিরির জন্য দায়ী করেন বিদ্যুত্বহী তারের অধার্মিকতাকে? উনিশ শতকে আমরা কি নবম পোপ পাইয়াসকে সমর্থন করতাম যিনি জন্তু-জানোয়ারের প্রতি নিষ্ঠুরতা প্রতিরোধ সমাজকে নাকচ করে দেন এই যুক্তিতে যে নিম্ন শ্রেণির জীবের প্রতি মানুষের কোনো কর্তব্য আছে এই বিশ্বাস ধর্মবিরোধী? আমি আশংকিত যে ইউরোপ যতই বুদ্ধিমান হোক না কেন, এই মহাদেশ সর্বকালেই বীভৎস। ছিল, কেবল ১৮৪৮ থেকে ১৯১৪, এই সংক্ষিপ্ত সময়টা বাদ দিয়ে। দুর্ভাগ্যবশত এখন। আবার আদিরূপে প্রত্যাবর্তন করছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *