১১. সক্রাতেস

দ্বিতীয় খণ্ড — সক্রাতেস, প্লাতন এবং আরিস্ততেলেস

১১. সক্রাতেস

 সক্রাতেস ঐতিহাসিকদের কাছে অতি কঠিন একটি বিষয়। বহু মানুষ আছেন যাদের সম্পর্কে আমরা খুব কম জানি- এটা নিশ্চিত, আবার বহু মানুষ আছেন যাদের সম্পর্কে অনেক কিছু জানা আছে- এটাও নিশ্চিত। কিন্তু সাতেসের ক্ষেত্রে আমরা তার সম্পর্কে কম জানি কি বেশি জানি সেটাই অনিশ্চিত। নিঃসন্দেহে তিনি ছিলেন আথিনার একজন মধ্যবিত্ত নাগরিক, তর্ক-বিতর্কে অধিকাংশ সময় ব্যয় করতেন এবং তরুণদের দর্শনশাস্ত্র শিক্ষা দিতেন কিন্তু সফিস্টদের মতো অর্থের বিনিময়ে নয়। এটা নিশ্চিত যে, তার বিচার হয়েছিল ও মৃত্যুদণ্ড হয়েছিল এবং প্রায় সত্তর বছর বয়সে, ৩৯৯ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে তাঁর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছিল। প্রশ্নাতীতভাবে তিনি আথিনার এক সুপরিচিত নাগরিক ছিলেন, কারণ, আরিস্তফানেস (Aristophanes) দি ক্লাউডস (The Clouds) নামে একটি পুস্তকে তাঁকে ব্যঙ্গ করেছেন। কিন্তু এর বেশি কিছু বলতে গেলে আমরা বিতর্কে জড়িয়ে পড়ব। তাঁর দুই ছাত্র ক্সেনোফন (Xenophon) এবং প্লাত (Plato) তাঁর সম্পর্কে প্রচুর লিখে গিয়েছেন কিন্তু তাঁদের দুজনের বক্তব্য একেবারেই ভিন্ন। যখন তারা একমত, এমনকি বার্ণেটের মতে তখন ক্সেনোফন প্লতনকে নকল করছেন। যেখানে তাঁদের মতভেদ রয়েছে সেখানে কেউ একজনকে বিশ্বাস করেন, কেউ বিশ্বাস করেন অন্যজনকে আবার অনেকে কাউকেই বিশ্বাস করেন না। এই বিপদজ্জনক দ্বন্দ্বে আমি কোনো পক্ষ অবলম্বন করার ঝুঁকি নেব না, আমি শুধু বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিগুলো লিপিবদ্ধ করব।

শুরু করা যাক ক্সেনোফন (Xenophon)-কে দিয়ে। সামরিক বাহিনীর লোক ছিলেন তিনি, বুদ্ধিমত্তায় খুব উজ্জ্বল ছিলেন না এবং মোটামুটিভাবে দৃষ্টিভঙ্গিতে ছিলেন গতানুগতিক। সাতেসের বিরুদ্ধে যে ধর্মহীনতার এবং তরুণদের কলুষিত করার অভিযোগ আনা হয়েছিল- এতে ক্সেনোফন খুব দুঃখ পেয়েছেন। তার যুক্তি ব্যাপারটা সম্পূর্ণ বিপরীত। সাতেস ছিলেন অত্যন্ত ধার্মিক এবং তাঁর সংস্পর্শে আসা মানুষদের উপর তার প্রভাব ছিল সম্পূর্ণ স্বাস্থ্যকর। তাঁর মতামতগুলো মনে হয়, ধ্বংসকারী তো ছিলই না বরং ছিল অতি সাধারণ এবং নীরস। সাতেসের প্রতি এই সমর্থন মাত্রাতিরিক্ত, কারণ এ থেকে আমরা সাতেসের প্রতি শত্রুতার কারণ খুঁজে পাই না। বার্গেট বলেন, (Thales to Plato, পৃষ্ঠা ১৪৯)ঃ সক্রাতেসের সপক্ষে ক্সেনোফনের প্রতিরোধ অত্যন্ত সফল। তিনি যদি ঐরকম হতেন তাহলে তাঁর মৃত্যুদণ্ড হতো না।

কোনো অসত্য চিন্তা করার বুদ্ধি ছিল না ক্সেনোফনের। তাই একটা প্রবণতা হলো ক্সেনোফনের সমস্ত বক্তব্যকেই সত্য মনে করা, কিন্তু এই ধরনের যুক্তি সত্যিই অসিদ্ধ। একজন বুদ্ধিমান ব্যক্তি সম্পর্কে একজন বুদ্ধিহীন ব্যক্তির প্রতিবেদন কখনোই নির্ভুল নয়, কারণ, সকল বস্তুকে আপন বোধগম্যতার সীমার ভিতরে তিনি অচেতনভাবে ভাষান্তরিত করে নেন। আমি বরং দার্শনিকদের মধ্যে আমার তিক্ততম শত্রুর দ্বারা বর্ণিত হব কিন্তু কোনো দর্শন অজ্ঞ বন্ধুর দ্বারা নয়। তাই ক্সেনোফনের বক্তব্য-দর্শনের কোনো কঠিন বিষয় সম্পর্কেই হোক বা সক্রাতেসকে অন্যায়ভাবে অভিযুক্ত করা হয়েছিল তা প্রমাণ করার যুক্তির অংশ সম্পর্কেই হোক- গ্রহণ করতে পারি না।

যাই হোক, ক্সেনোফনের স্মৃতিকথার কোনো কোনো অংশ খুবই বিশ্বাসযোগ্য। তিনি বলেন, (যেমন প্লাতনও বলেন), কী করে যোগ্য ব্যক্তিকে ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত করা যায় সেই সমস্যা নিয়েই সক্রাতেস নিয়ত ব্যস্ত থাকতেন। তিনি এইরকম প্রশ্ন করতেন, আমি যদি জুতো মেরামত করতে চাই তাহলে কাকে নিযুক্ত করব? অকপট কোনো তরুণ উত্তর করতেন, মুচির কাছে যাব হে, সাতেস! এভাবে তিনি জুতোর মিস্ত্রী, তাম্রকার ইত্যাদির সম্পর্কে বলে শেষে প্রশ্ন করতেন, রাষ্ট্ররূপ পোত কে মেরামত করবেন? ত্রিশজন স্বৈরতন্ত্রীদের সঙ্গে তাঁর যখন দ্বন্দ্ব শুরু হয় তখন তাদের নেতা ক্রিতিয়স (Critias), তিনি সাতেসের কাছে পড়াশোনা করেছেন, ফলে তাঁর শিক্ষণপদ্ধতি সম্পর্কে অবহিত ছিলেন। তিনি সক্রাতেসকে তরুণদের শিক্ষা দিতে নিষেধ করেছিলেন এবং আরও বলেছিলেন, আপনি ভালয় ভালয় মুচি, ছুতোর মিস্ত্রী আর তাম্রকারের ব্যাপারটা বন্ধ করুন। এতদিনে এগুলো পায়ে ঘুরেছে যথেষ্ট, ব্যাপারটা আপনি যেরকম চালু করেছেন (Exnophon, Memorabilia, Bk. I.. chapter ll)। পেলপনেশীয় যুদ্ধের পর স্পার্তানরা সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য যে স্বল্পতন্ত্রী স্বৈরাচারী সরকার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এ ঘটনা ঘটেছিল তাঁদের আমলে। কিন্তু অধিকাংশ সময়ে আথিনা ছিল গণতান্ত্রিক, এতটাই যে, সেনাপতিরাও হয় নির্বাচিত হতেন নয়তো তাঁদের লটারি করে বেছে নেওয়া হতো। সাতেসের সঙ্গে সেনাপতি পদাকাক্ষী এক তরুণের দেখা হয়েছিল এবং সক্রাতেস তাকে যুদ্ধের শিল্পকলা শেখার জন্য উদ্বুদ্ধ করলেন। তরুণটি সেই উপদেশ অনুসারে চলে গেলেন এবং রণকৌশল সম্পর্কে একটা সংক্ষিপ্ত শিক্ষণ নিলেন। প্রত্যাবর্তনের পর তরুণটিকে সক্রাতের শ্লেষমিশ্রিত প্রশংসা করে আরও শিক্ষা নেওয়ার জন্য প্রেরণ করলেন (তদেব, BK. III, cha. I)। আর একজন তরুণকে তিনি অর্থনীতির মূল তত্ত্ব শিখতে প্রেরণ করেছিলেন। একই ধরনের পরিকল্পনা তিনি বহু লোকের সম্পর্কেই প্রয়োগ করতে চেষ্টা করেছেন রণমন্ত্রীও তাদের অন্তর্গত। কিন্তু সিদ্ধান্ত হলো, যে সমস্ত দোষ সম্পর্কে সক্রাতেস অভিযোগ করতেন সেগুলো সংশোধন করার চাইতে তাঁকে হেমলক (hemlock) দিয়ে স্তব্ধ করা অপেক্ষাকৃত সহজ।

সক্রাতেস সম্পর্কে প্লাতনের দেওয়া বিবরণের অসুবিধাটা ক্সেনোফনের বিবরণের চেয়ে একেবারে আলাদা, অর্থাৎ প্লাতন ঐতিহাসিক সক্রাতেসকে কতটা চিত্রিত করতে চেয়েছেন এবং কতটা তার কথোপকথনে নিজ মতের প্রবক্তা হিসেবে সক্রাতেস নামক ব্যক্তিকে ব্যবহার করতে চেয়েছেন- সেটা বিচার করা অত্যন্ত শক্ত। প্লাতন শুধুমাত্র দার্শনিকই ছিলেন না, তিনি ছিলেন কল্পনা শক্তির অধিকারী মোহিনী লেখনীধারী এক বিরাট প্রতিভাধর ব্যক্তি। তাঁর লিখিত কথোপকথনগুলো যথাযথ- এরকম কেউ মনে করেন না, তিনি নিজেও সে দাবি করেন না। তবুও অন্তত প্রথমদিকের কথোপকথনগুলোতে বাক্যালাপগুলো সম্পূর্ণ স্বাভাবিক এবং চরিত্রগুলো যথেষ্ট বিশ্বাসযোগ্য। অতি প্রশংসনীয় লেখনী শক্তির অধিকারী লেখক প্লাতনই ঐতিহাসিক প্লাতনকে সন্দেহ করার কারণ। তাঁর চিত্রিত সক্রাতেস একটি সঙ্গতিপূর্ণ এবং অসাধারণ আকর্ষণীয় চরিত্র। এরকম চরিত্র সৃষ্টি করা অধিকাংশ লোকেরই ক্ষমতার অতীত কিন্তু আমার মনে হয় প্রাতন হয়তো এরকম চরিত্র সৃষ্টি করেও থাকতে পারেন। তিনি সত্যিই সেটা করেছিলেন কিনা সে প্রশ্ন স্বতন্ত্র।

যে কথোপকথনটি সাধারণভাবে ঐতিহাসিক বলে গৃহীত হয় তার নাম অ্যাপোলজি (Apology-ক্ষমাপ্রার্থনা)। বলা হয়, সক্রাতেস তার বিচারের সময় আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য এই বক্তৃতা করেছিলেন- এটা অবশ্য প্রত্যক্ষ অনুলিখন নয়। ঘটনার কয়েক বছর বাদে প্লাতনের স্মৃতিতে যা অবশিষ্ট ছিল তাই সংহত করে এটা লেখা- সাহিত্য সুষমায় মণ্ডিত করে। বিচারের সময় প্লাতন উপস্থিত ছিলেন এবং বেশ নিশ্চিত ও স্পষ্টভাবেই মনে হয়, যা লেখা হয়েছে, সেটা সাতেসের যে ধরনের বক্তব্য প্লাতনের স্মৃতিতে ছিল- তাই এবং উদ্দেশ্য ছিল মোটামুটি ঐতিহাসিক। এর নিজস্ব সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও সাতেসের চরিত্র সম্পর্কে মোটামুটি একটা নিশ্চিত চিত্র দেওয়ার পক্ষে এটা যথেষ্ট।

সতেসের বিচারের মূল তথ্যগুলো সম্পর্কে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। অভিশংসার ভিত্তি ছিল সক্রাতেস মন্দকৰ্মা এবং অদ্ভুত মানুষ, তিনি মাটির নিচে ও আকাশের উপরে সব বস্তুর অনুসন্ধান করেন এবং মন্দ উদ্দেশ্যকে ভালো প্রতিপন্ন করান ও অপরকে সেই সমস্ত শিক্ষা দেন। অবশ্য প্রায় নিশ্চিতভাবেই বলা যায় তাঁর বিরুদ্ধে শত্রুতার প্রধান কারণ তিনি অভিজাত দলের সঙ্গে সংযুক্ত-এই অনুমান। তাঁর ছাত্রদের অনেকেই ছিলেন এই অভিজাত দলের লোক এবং তাদের ভিতরে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত কিছু ছাত্র যে অত্যন্ত ক্ষতিকর লোক ছিলেন সে তথ্য প্রমাণিত। কিন্তু এই যুক্তি প্রকাশ করা সম্ভব ছিল না, কারণ রাজক্ষমা (amnesty)। সংখ্যাগুরু অংশ তাঁকে দোষী সাব্যস্ত করেন এবং আথিনীয় আইন অনুসারে মৃত্যুর চাইতে স্বল্পতর কোনো শাস্তি প্রার্থনা তার উপর নির্ভর করছিল। অভিযুক্তকে দোষীসাব্যস্ত করলে বিচারকরা অভিযোগকারীদের পরামর্শ এবং অভিযুক্তের দাবির ভিতর যে কোনো একটা বেছে নিতে পারতেন। সুতরাং সাতেসের নিজের স্বার্থেই বেশ বড় একটা শাস্তি প্রস্তাব করা উচিত ছিল। হয়তো বিচারকরা সেই শাস্তিকে যথেষ্ট মনে করে মেনে নিতেন। যাই হোক, তিনি প্রস্তাব করেছিলেন ত্রিশ মিনি (minae-তখনকার মুদ্রা) জরিমানা এবং এর জন্য তাঁর কোনো কোনো বন্ধু (তার ভিতরে প্লাতনও ছিলেন) জামিন হতে ইচ্ছুক ছিলেন। এই শাস্তি ছিল এতই অল্প যে, বিচারকরা রেগে তাঁকে মৃত্যুদণ্ড দিলেন। যতটা সংখ্যাগুরুত্বে তিনি দোষী সাব্যস্ত হয়েছিলেন তার থেকে বেশি সংখ্যাগুরুর দ্বারা তাঁর মৃত্যুদণ্ড হলো। নিঃসন্দেহে তিনি ফলাফল পূর্বানুমান করেছিলেন। স্পষ্টই বোঝা যায় তিনি এমন কোনো সুবিধার সাহায্যে মৃত্যুদণ্ড এড়াতে রাজি ছিলেন না যার ফলে মনে হতে পারে যে, তিনি দোষ স্বীকার করছেন।

অভিযোক্তাদের ভিতরে ছিলেন অনুতস (Anytus)- একজন গণতন্ত্রবাদী পলিটিসিয়ান (Politician-যিনি রাজনৈতিক ক্রিয়াকর্ম করেন) মেলেস (Meletus)-একজন বিয়োগান্তক কবি, তরুণ এবং অপরিচিত, দীর্ঘকেশী, স্বল্প শ্মশ্রু এবং বক্রনাসা (hooked nose), এবং লুকন (Lykon)-একজন স্বল্প পরিচিত বক্তা (Burnet-এর Thales to Plato, পৃষ্ঠা ১৮০ দেখুন) তাদের দাবি ছিল রাষ্ট্রপূজিত দেবতাদের সাতেস পুজো করেন না এবং অন্য নতুন দেবতাদের উপস্থিত করছেন। আরও তরুণদের তিনি এই ধরনের শিক্ষা দিয়ে দূষিত করছেন।

প্লাতনীয় সক্রাতেসের সঙ্গে আসল মানুষটির সম্পর্ক সম্বন্ধীয় সমাধানহীন প্রশ্ন নিয়ে সমস্যা সৃষ্টি না করে বরং দেখা যাক এই অভিযোগের উত্তরে প্রাতন তাঁকে দিয়ে কী বলাচ্ছেন।

সক্রাতেস শুরু করেছেন তার অভিযোগকারীদের বিরুদ্ধে বাগ্মিতার অভিযোগ করে এবং নিজের সম্পর্কে বাকপটুতার অভিযোগ খণ্ডন করে। তিনি বলেন, একমাত্র বাকপটুতা, যা তাঁর পক্ষে সম্ভব তা সত্যভাষণ। তিনি যদি বিভিন্ন শব্দ এবং বাক্যাংশ দিয়ে অলঙ্কৃত, আগাম প্রস্তুত বক্তৃতা না করে তাঁর নিজের অভ্যস্ত ভঙ্গিতে কথা বলেন তাহলে যেন ওরা ক্রোধান্বিত না হন। তিনি তখন সত্তরোর্ধ্ব এবং এ পর্যন্ত তিনি কোনো আদালতে হাজির হননি। তিনি যদি আদালতের রীতিবহির্ভূত কথা বলেন তাহলে তাকে অবশ্য ক্ষমা করতে হবে।

তিনি বলতে থাকেন যথাবিহিত অভিযোগকারীরা ছাড়াও তাঁর অনেক বিধিবহির্ভূত অভিযোগকারী আছেন। বিচারকদের শিশুকাল থেকে তারা বলে বেড়াচ্ছেন, সক্রাতেস বলে একজন আছেন, তিনি মানুষটা জ্ঞানী, তিনি উপরের আকাশ সম্পর্কে দূরকল্পন করেন এবং নিচে মাটির তলা পর্যন্ত অনুসন্ধান করেন ও মন্দকে উত্তম উদ্দেশ্য বলে দেখাতে চেষ্টা করেন। তিনি বলেন, এই সমস্ত মানুষ যে দেবতাদের অস্তিত্বে বিশ্বাস করেন না সেটা অনুমান করা যায়। বিধিবৎ অভিযোগের চাইতে জনমতের এই সমস্ত প্রাচীন অভিযোগ অধিকতর বিপজ্জনক আরও বেশি বিপজ্জনক এই জন্য যে, একমাত্র আরিস্তফানেস (Aristophanes) এর ঘটনা ছাড়া অন্য অভিযোগকারীদের পরিচয় তাঁর অজানা। এই প্রাচীন শত্রুতার কারণগুলোর উত্তরে তিনি দেখিয়েছেন, তিনি বৈজ্ঞানিক নন-ভৌত দূরকল্পনের সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই- তিনি শিক্ষক নন এবং শিক্ষাদানের পরিবর্তে কোনো অর্থ তিনি গ্রহণ করেন না। তারপর তিনি সফিস্টদের ব্যঙ্গ করেন এবং তাদের নিজেদের সম্পর্কে যে জ্ঞানের দাবি তা অস্বীকার করেন। তাহলে আমাকে জ্ঞানী বলারই বা কারণ কী আর কুখ্যাতিরই বা কারণ কী?

দেখা যায় ডেলফিতে দৈববাণীকারকে (Oracle) প্রশ্ন করা হয়েছিল সাতেসের চেয়ে জ্ঞানী কোনো ব্যক্তি আছেন কি না, তিনি উত্তর দিয়েছিলেন- সে রকম কেউ নেই। সাতেস স্বীকার করছেন, তিনি একেবারেই ঘাবড়ে গিয়েছিলেন, কারণ তিনি কিছুই জানেন না অথচ দেবতা মিথ্যা বলতে পারেন না। সুতরাং যাঁদের জ্ঞানী বলে খ্যাতি আছে তিনি তাঁদের ভিতর যাতায়াত করতে শুরু করেন, উদ্দেশ্য ছিল দেবতারা ভ্রমণকারী- এটা প্রমাণ করা যায় কিনা। প্রথমে তিনি গেলেন একজন পলিটিসিয়ানের কাছে, যাকে বহুলোকই জ্ঞানী ভাবতেন এবং তিনি নিজেকে ভাবতেন আরও বেশি জ্ঞানী। শীঘ্র তিনি দেখলেন লোকটি জ্ঞানী নন এবং তাঁকে একথা তিনি ভদ্র কিন্তু দৃঢ়ভাবে ব্যাখ্যাও করলেন, এবং এর ফল হলো তিনি আমায় ঘৃণা করতে লাগলেন। তারপর তিনি গেলেন কবিদের কাছে বললেন, নিজেদের লেখা ব্যাখ্যা করতে কিন্তু তারা তা করতে অক্ষম হলেন। তখন আমি বুঝতে পারলাম কবিরা কবিতা লেখেন প্রজ্ঞার সাহায্যে নয়, লেখেন এক ধরনের প্রতিভা এবং অনুপ্রেরণার সাহায্যে। তারপর তিনি গেলেন কারিগরদের কাছে, সেখানেও তিনি একইরকম হতাশ হলেন। তিনি বললেন, এই উপায়ে বহু বিপজ্জনক শত্রু তিনি সৃষ্টি করলেন। শেষ পর্যন্ত তিনি এটাই সিদ্ধান্ত করলেন, একমাত্র ঈশ্বরই জ্ঞানী এবং তাঁর দেওয়া উত্তরে তিনি দেখাতে চান মানুষের জ্ঞানের কোনো মূল্যই নেই কিংবা সামান্য মূল্যই আছে। তিনি সাতেসের কথা বলছেন না, তিনি শুধু আমার নামটি ব্যবহার করছেন উদাহরণস্বরূপ, যেন বলছেন-হে মানুষ, যিনি সাতেসের মতোই জানেন যে তাঁর জ্ঞানের আসলে কোনো মূল্যই নেই তিনিই শ্রেষ্ঠ জ্ঞানী। যারা জ্ঞানের ভান করেন তাদের স্বরূপ প্রকাশ করার জন্য তার সবটা সময় ব্যয় হয়, এজন্য তিনি এখন চরম দরিদ্র কিন্তু তিনি মনে করেন দৈববাণী সমর্থন করা তাঁর কর্তব্য।

তিনি বলেন, বেশি ধন শ্রেণির তরুণদের বিশেষ কিছু করার নেই, তাঁর লোকের স্বরূপ প্রকাশ করা শুনে তারা আনন্দ পান এবং নিজেরাও এই কর্ম করেন, এভাবেই তার শসংখ্যা বৃদ্ধি পায়। কারণ, তাদের জ্ঞানের ভান যে ধরা পড়েছে এটা তারা স্বীকার করতে চান না।

প্রথম শ্রেণির অভিযোগকারীদের সম্পর্কে এই পর্যন্তই।

এরপর সক্ৰাতেস তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগকারী মেলেতসকে পরীক্ষা করছেন, সেই ভালো লোকটি যিনি নিজেকে বলেন ভালো লোক এবং সত্যিকারের দেশ প্রেমিক। তিনি প্রশ্ন করেন তরুণদের কারা উন্নত করে। মেলেস প্রথম উল্লেখ করেন বিচারকদের, তারপর চাপে পড়ে মেলেতস ধাপে ধাপে বলতে বাধ্য হন যে, সক্রাতেস ছাড়া প্রতিটি আথিনীয়ই তরুণদের উন্নতিসাধন করেন। তখন সাতেস আথিনা নগরীকে তার সৌভাগ্যের জন্য অভিনন্দন জানান। তারপর তিনি দেখান খারাপ লোকের সঙ্গে থাকার চাইতে ভালো লোকের সঙ্গে থাকা অনেক ভালো। সুতরাং তিনি এমন নির্বোধ হতে পারে না যে, ইচ্ছে করে সহনাগরিকদের চরিত্রের অবনতি ঘটাবেন কিন্তু যদি অনিচ্ছাকৃতভাবে সেটা করা হয়ে থাকে তাহলে মেলেতসের উচিত তাঁকে আদালতে অভিযুক্ত না করে উপদেশ দেওয়া।

অভিযোগপত্রে বলা হয়েছিল সক্রাতেস শুধু রাষ্ট্রের দেবতাদের অস্বীকার করেন তাই নয়, তিনি তাঁর নিজস্ব অন্য দেবতাদের উপস্থাপন করেন। এদিকে মেলেতস বলেছেন, সাতেস একেবারেই নাস্তিক এবং যোগ করেছেন, সক্রাতেস বলেছেন সূর্য প্রস্তর এবং চন্দ্র মৃন্ময়। সক্রাতেস উত্তর দিলেন, মনে হচ্ছে মেলেতস অভিযুক্ত করেছেন আনাক্সাগরসকে, এক ড্রামা (drachma- তৎকালীন মুদ্রা) দিয়ে থিয়েটারে গেলেই তাঁর মতামত শোনা যায় (বোধহয় এউরিপিদেসের নাটকে)। সাতেস অবশ্য দেখিয়ে দিলেন সম্পূর্ণ নাস্তিক্য বিষয়ক নব অভিযোগ মূল অভিযোগপত্রের বিরোধী, তারপর তিনি আরও সাধারণ বিষয়গুলো বিচার করেন।

অ্যাপেলজি বইয়ের অবশিষ্ট অংশের সুর প্রধানত ধর্মীয়। তিনি সৈনিক ছিলেন এবং তাঁকে যেমন আদেশ করা হয়েছে তাঁর কর্তব্যস্থলে তিনি তেমনই রয়ে গিয়েছেন। এখন ঈশ্বর আমাকে আদেশ করছেন দার্শনিকদের বিশেষ কার্য- আপন ও অপরের অন্তরে অনুসন্ধান করা সম্পন্ন করতে। যুদ্ধক্ষেত্রে নিজস্ব অবস্থান পরিত্যাগ করার মতোই এই কাজ পরিত্যাগ করা লজ্জাজনক। মৃত্যুভয় প্রজ্ঞা নয়, কারণ, মৃত্যু বৃহত্তর মঙ্গল কি না কেউ জানে না। তার এতদিনের দূরকল্পন পরিত্যাগ করার শর্তে যদি তাকে জীবন দান করা হয় তাহলে তিনি বলবেন, হে আথিনাবাসীবৃন্দ, আমি আপনাদের সম্মান করি, ভালোবাসি, আমি বরং ঈশ্বরের আজ্ঞা পালন করব কিন্তু আপনাদের নয়, যতক্ষণ আমার জীবন এবং সামর্থ্য থাকবে ততক্ষণ আমি দর্শন চর্চা করা এবং দর্শন শিক্ষা দেওয়া বন্ধ করব না। আমার সংস্পর্শে যে আসবে তাকে প্রেরণা দেওয়া থামাব না…….। আপানারা জেনে রাখুন এটাই ঈশ্বরের আদেশ এবং আমি বিশ্বাস করি আমার ঈশ্বর সেবার চেয়ে কোনো বৃহত্তর মঙ্গল এই রাষ্ট্রে ঘটেনি। তিনি আরও বলেনঃ

আমার আরও কিছু বলবার আছে, সে কথা শুনে হয়তো আপনারা চিৎকার করে উঠবেন কিন্তু আমার বিশ্বাস আমার কথা শুনলে আপনাদের মঙ্গল হবে, সেজন্য আমার অনুরোধ- চিৎকার করে উঠবেন না। আমি আপনাদের জানাতে চাই আমার মতো একজনকে যদি আপনারা হত্যা করেন তাহলে আমার চেয়ে আপনাদের ক্ষতি হবে বেশি। কিছুই আমার ক্ষতি করতে পারবে না। মেলেতস নন, অনুতসও নন- তারা আমার ক্ষতি করতে পারেন না। কারণ, মন্দ লোক শ্রেয়তর একজনের ক্ষতি করতে অপারগ। আমি অস্বীকার করছি না, অনুতস হয় তাঁকে হত্যা করতে পারেন কিংবা নির্বাসনে পাঠাতে পারেন, অথবা তার নাগরিক অধিকার কেড়ে নিতে পারেন। তিনি এবং অন্য সবাই কল্পনা করতে পারেন তাঁরা তাঁকে গভীরভাবে আঘাত করছেন কিন্তু এখানেই তাঁদের সঙ্গে আমার মতভেদ। যে দুষ্কার্য তারা করছেন- অন্যায়ভাবে অপরের প্রাণহানি করা অনেক বেশি অমঙ্গলজনক।

তাঁর বক্তব্য- তার বিচারকদের স্বার্থেই তার ওকালতি, নিজের স্বার্থে নয়। তিনি এক গো-মাছ (gad-fly), ঈশ্বর কর্তৃক রাষ্ট্রকে প্রদত্ত- তাঁর মতো আর একজনকে পাওয়া সহজ হবে না। আমি সাহস করে বলছি, হয়তো আপনারা মেজাজ খারাপ করবেন (সহসা সুপ্তোখিতের মতো) এবং ভাববেন অনুতসের পরামর্শ মতো সহজেই আমাকে হত্যা করতে পারবেন। তারপর বাকী জীবনটা ঘুমিয়ে কাটাবেন যদি না আপনাদের দেখাশোনা করবার জন্য ঈশ্বর আর একটি গো-মাছি পাঠান।

তিনি কেন একান্তে উপদেশ দিয়েছেন, কেন জনস্বার্থে উপদেশ দেননি? আপনারা আমাকে নানা সময়ে এবং বহু বিচিত্র স্থানে দৈববাণী সম্বন্ধে কিংবা আমার কাছে উদ্ভাসিত ইঙ্গিত সম্বন্ধে বলতে শুনেছেন। এই সমস্ত দেবতাকে মেলেতস তার অভিযোগপত্রে বিদ্রূপ করছেন। এই ইঙ্গিত এক ধরনের কণ্ঠস্বর, আমার কাছে প্রথম পৌঁছাতে শুরু করে আমার শৈশবে; এই স্বর সবসময়ই আমাকে বাধা দেয় কিন্তু যে কাজ করতে যাচ্ছি সে সম্বন্ধে কোনো আদেশ জারি করে না। এই হলো আমার পলিটিসিয়ান হওয়ার বাধা। তিনি আরও বলেন, রাজনীতিতে কোনো সৎ লোক দীর্ঘজীবী হয় না। তিনি দুটো দৃষ্টান্ত দিয়েছেন- যখন তিনি সাধারণের ব্যাপারে জড়িয়ে পড়েছেন কিছুতেই এড়াতে পারেননিঃ প্রথমটি হলো, যখন তিনি গণতন্ত্রকে বাধা দিয়েছিলেন আর দ্বিতীয়টি হলো, ত্রিশজন স্বৈরতন্ত্রীর ব্যাপারে। প্রতিটি ক্ষেত্রেই কর্তৃপক্ষ বেআইনী কাজ করছেন।

তিনি বলেন, উপস্থিতদের মধ্যে অনেকেই তাঁর প্রাক্তন ছাত্র এবং তার ছাত্রদের পিতা ও ভ্রাতা। তরুণদের চিত্ত কলুষিত করার অভিযোগ প্রমাণ করার জন্য অভিযোগকারীরা এদের একজনকেও আদালতে উপস্থিত করেননি। (অ্যাপোলজি-তে উল্লিখিত যুক্তিগুলোর ভিতরে এই একটিমাত্র যুক্তি অভিযুক্তের সপক্ষের আইনজীবীদের অনুমোদন পেতে পারে)। তখনকার রীতি অনুসারে বিচারকদের মন ভেজানোর জন্য তার ক্রন্দনরত সন্তানদের আদালতে উপস্থিত করতে সক্রাতেস অস্বীকার করেন। তিনি বলেছেন, এইসব দৃশ্য অভিযুক্ত এবং নগর উভয়কেই হাস্যস্পদ করে। তাঁর কাজ বিচারকদের সন্দেহ ভঞ্জন করা, তাদের আনুকূল্য ভিক্ষা করা নয়।

রায় বেরোনো এবং বিকল্প শাস্তি ত্রিশ মিনি জরিমানার আবেদন আগ্রাহ্য হওয়ার পর (যে প্রসঙ্গে সাতেস আদালতে উপস্থিত প্লাতনকে জামিনদারদের একজন হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন) তিনি সর্বশেষ বক্তৃতাটি করেন।

এইবার, হে মানুষ, আপনারা যারা আমাকে দণ্ডদান করেছেন তাঁদের সম্পর্কে আমি একটা ভবিষ্যদ্বাণী করব, কারণ, আমি মৃত্যুপথযাত্রী এবং মৃত্যুর সময় মানুষের ভবিষ্যদ্বাণী করার মতো অতিমানবিক শক্তি জন্মায়। আমি ভবিষ্যদ্বাণী করছি আমার মৃত্যুর পর পরই আপনারা, যারা আমার হত্যাকারী, তাঁদের জন্য অপেক্ষা করছে আমাকে দেওয়া শাস্তির চেয়ে কঠিনতর শাস্তি….। যদি মনে করে থাকেন নরহত্যা করে আপনারা কাউকে আপনাদের দুর্নীতিগ্রস্ত জীবনের নিন্দা করা বন্ধ করবেন তাহলে ভুল করছেন। পলায়নের সে পথ সম্ভবও নয়, সম্মানজনকও নয়; সহজতম ও মহত্তম পথ হলো অপরকে অকর্মণ্য না করে আপনাদের নিজের উন্নতি করা।

তারপর তিনি যারা তাকে মুক্ত করার সপক্ষে ছিলেন সেই সমস্ত বিচারকদের উদ্দেশ্যে বলেন, সেদিনকার কোনো কর্মেই তাঁর দৈববাণী তাকে বাধা দেয়নি অথচ অন্যান্য অনেক সময় দৈববাণী তাঁকে বক্তৃতার মাঝখানে স্তব্ধ করে দিয়েছে। তিনি বলেন, এটা একটা ইঙ্গিত যে, আমার যা হয়েছে তা ভালোই হয়েছে এবং আমাদের মধ্যে যারা মৃত্যুকে অমঙ্গলজনক মনে করেন তারা ভুল করছেন। কারণ, হয় মৃত্যু এক নিঃস্বপ্ন ন্দ্রিা- যা স্পষ্টতই উত্তম অথবা মৃত্যুর পর আত্মা অন্য জগতে প্রবেশ করে, এবং যদি অর্ফেয়স, মুজায়েঅস, হেসিয়দ ও হোমেরের সঙ্গে কথা বলতে পারা যায় তাহরে একজনের অদেয় কী থাকতে পারে? বস্তুত, এই যদি সত্যি হয় তাহলে আমার পুনঃ পুনঃ মৃত্যু হোক। অন্যায্যভাবে যাদের মৃত্যু হয়েছে পরলোকে তাদের সঙ্গে তিনি বাক্যালাপ করবেন আর সর্বোপরি তিনি তার জ্ঞানানুসন্ধান করেই চলবেন। প্রশ্ন করার অপরাধে পরলোকে মানুষকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয় নাঃ এটা নিশ্চিত নয়, তার করণ, তাঁরা যে শুধু আমাদের চেয়ে সুখী তাই নয়, তারা হবেন অমর-অবশ্য যা বলা হয় তা যদি সত্য হয়……।

প্রস্থানের সময় হয়েছে এবং আমরা নিজের নিজের পথে চলব-আমি যাব মরতে আর আপনারা যাবেন বাঁচতে। কোনটা ভালো একমাত্র ঈশ্বরই জানেন।

অ্যাপোলজি-তে আমরা এক বিশেষ ধরনের চরিত্রের মানুষের স্পষ্ট ছবি পাইঃ মানুষটি গভীর আত্মবিশ্বাসী, উচ্চ মানসিকতাসম্পন্ন, পার্থিব সাফল্য সম্পর্কে নিস্পৃহ, ঐশ্বরিক বাণী তাঁর পথপ্রদর্শক এই বিশ্বাসে বিশ্বাসী এবং সঠিক জীবনযাপনের জন্য পরিচ্ছন্ন চিন্তাই সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ- এইরকম চিন্তায় প্ররোচিত। এই শেষের ব্যাপারটি ছাড়া তাঁর সঙ্গে খ্রিষ্টিয় শহীদ অথবা একজন পিউরিটানের সাদৃশ্য রয়েছে। শেষের অংশে যেখানে তিনি মৃত্যুর পরবর্তী ঘটনা সম্পর্কে বিচার করেছেন, অমরতা সম্পর্কে তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস ছিল এরকম বোধ না করা প্রায় অসম্ভব এবং তিনি যে অনিশ্চিতির কথা বলেছেন সেটা ভান মাত্র। খ্রিষ্টানদের মতো তিনি অন্তত যন্ত্রণার ভয়ে কাতর ননঃ পরলোকে তাঁর জীবন সুখের হবে সে বিষয়ে তিনি নিঃসন্দেহ। ফায়েদ (Phaedo) নামক পুস্তকে প্লাতনীয় সক্রাতেস তার অমরত্বের উপর বিশ্বাসের কারণগুলো বিবৃত করেছেন, এই কারণগুলো ইতিহাসের সাতেসকে প্রভাবিত করেছিল কিনা বলা সম্ভব নয়।

এক দৈববাণীকার কিংবা ডেমন (daimon-ইংরেজিতে demen শব্দের অন্যরূপ) দ্বারা ইতিহাসের সাতেস নির্দেশিত হচ্ছেন বলে দাবি করতেন- এ বিষয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। খ্রিষ্টানরা যাকে বিবেকের বাণী বলতেন তার সঙ্গে এর সাদৃশ্য। আছে কিনা কিংবা তার কাছে এটা সত্যই কণ্ঠধ্বনি বলে প্রতিভাত হতো কিনা- তা জানা অসম্ভব। জোয়ান অব আর্ক (Joan of Arc) কণ্ঠস্বরের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন, এগুলো উন্মাদ রোগের একটি সাধারণ লক্ষণ। সাতেসের অপম্মারাত্মক ন্দ্রিার আবেশ হতো, অন্তত সামরিক কর্মে নিযুক্ত থাকাকালীন একটি ঘটনার স্বাভাবিক ব্যাখ্যা এটাইঃ

এক প্রভাতে তিনি এমন একটা কিছু চিন্তা করছিলেন যার সমাধান তিনি করতে পারেননি কিন্তু চিন্তা তিনি ছাড়বেন না। খুব ভোরবেলা থেকে শুরু করে দুপুর অবধি তিনি ভেবেই চলেছেন- সেখানেই তিনি চিন্তামগ্ন হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। দুপুরবেলা তাঁর দিকে মনোযোগ আকর্ষিত হলো এবং বিস্মিত জনতার ভিতরে গুজব জড়িয়ে পড়ল। সকাল হওয়ার পর থেকে সাতেস দাঁড়িয়ে আছেন এবং কী একটা যেন চিন্তায় মগ্ন। শেষ পর্যন্ত সন্ধ্যাবেলা খাওয়া দাওয়ার পর কিছু ইওনীয় কৌতূহলী হয়ে (এখানে আমার ব্যাখ্যা করা উচিত ঘটনাটা ঘটেছিল গ্রীষ্মকালে, শীতকালে নয়) তাঁদের মাদুর বার করে সারারাত খোলা জায়গায় ঘুমিয়ে থাকলেন, তাঁদের উদ্দেশ্য ছিল সাতেস সারারাত দাঁড়িয়ে থাকেন কিনা লক্ষ্য করা। সাতেস পরের সকাল অবধি সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকেন এবং আলো ফুটবার পর সূর্যদেবের কাছে প্রার্থনা করে নিজের কাজে চলে যান (Symposium, পৃষ্ঠা ২২০ দ্রষ্টব্য)।

একটু স্বল্প পরিমাণে এই ধরনের ব্যাপার সাতেসের প্রায়ই হতো। সিম্পোসিয়াম-এর শুরুতে সক্ৰাতেস এবং আরিস্তদেমস (Aristodemus) একসঙ্গে ভোজসভায় চলেছেন কিন্তু বিমূর্ততার ক্ষণিক আক্রমণে সক্রাতেস পিছিয়ে পড়লেন। আরিস্তদেমস যখন পৌঁছালেন তখন নিমন্ত্রণ কর্তা আগাথন (Agathon) বললেন, সক্রাতেসকে নিয়ে তুমি কী করেছ? সক্রাতেসকে সঙ্গে দেখতে না পেয়ে আরিস্তদেমস বিস্মিত হন; সাতেসের খোঁজে একজন ক্রীতদাসকে পাঠানো হয়, সে প্রতিবেশীর বাড়ির দরদালানে তাঁকে দেখতে পায়। ক্রীতদাসটি ফিরে বলে, উনি ওখানেই স্থিরভাবে রয়েছেন, ডাকলেও কোনো সারা দেননি। যাঁরা তাঁকে ভালো করে চিনতেন তাঁরা ব্যাখ্যা করেন, অকারণে সে কোনো স্থানে থেমে পড়বার এবং নিজেকে হারিয়ে ফেলার তার একটা অভ্যাস আছে। তারা আর সক্রাতেসকে ঘটান না এবং ভোজ যখন প্রায় অর্ধসমাপ্ত তখন সাতেসের আগমন হয়।

সক্রাতেস অতি কুশ্রী ছিলেন- এ বিষয়ে সবাই একমত; তাঁর নাক ছিল খ্যাদা এবং বেশ বড় একটা ভূড়ি ছিল। ব্যাঙ্গাত্মক নাটকের সমস্ত সিলেসেস (Silanuses) থেকেও তিনি কুদর্শন ছিলেন (ক্সেনোফনের সিম্পোসিয়াম-এ)। তিনি সবসময় পুরোনো ছেঁড়া পোশাক পরতেন এবং সর্বত্র নগ্নপদে যেতেন। শীত-গ্রীষ্ম, ক্ষুধা-তৃষ্ণা ইত্যাদি সম্পর্কে তাঁর উদাসীনতা সবাইকে অবাক করত। সিম্পোসিয়াম এ আলকিবিয়াদেস (Alcibiades) সামরিক কর্মে নিযুক্ত সক্রাতেস সম্পর্কে বলেছেনঃ

তাঁর সহনশীলতা ছিল সত্যিই আশ্চর্যজনক, রসদ সরবরাহ বন্ধ হওয়াতে আমরা বাধ্য হয়েছিলাম না খেয়ে থাকতে- যুদ্ধের সময় এরকম ব্যাপার প্রায়ই ঘটে। এরকম ব্যাপারে তিনি শুধু আমার চাইতে নন, সবার চাইতেই শ্রেষ্ঠ ছিলেন। তাঁর সঙ্গে কারোরই তুলনা হতো না…। শৈত্য সম্পর্কে তাঁর সহিষ্ণুতাও আশ্চর্যজনক। প্রচণ্ড তুষারপাত হচ্ছিল কারণ ঐ অঞ্চলে সত্যিই প্রচণ্ড শীত পড়ে এবং আর সবাই ঘরের ভিতরেই থাকতেন, যদি বা তারা বাইরে যেতেন তাহলে অদ্ভুত পরিমাণ পোশাক আশাক পরতেন, তাঁদের পায়েও থাকত উত্তম জুতো, ফেল্ট এবং লোম দিয়ে ঢাকা থাকত পা। এরই ভিতরে সক্রাতেস নগ্নপদে এবং সাধাণ পোশাকে জুতো পরিহিত অন্যান্য সৈনিকদের চেয়ে ভালো মার্চ (march-কুচকাওয়াজে অগ্রসর হওয়া) করতেন বরফের উপরে। অন্য সৈনিকরা সাতেসের প্রতি শত্রুর দৃষ্টিতে তাকাতেন। কারণ, তাদের মনে হতো সক্রাতেস তাঁদের অবজ্ঞা করছেন।

সমস্ত দৈহিক আবেগের উপরে তাঁর প্রভুত্ব সম্পর্কে বারবার জোর দিয়ে বলা হয়েছে। প্রায় কখনোই তিনি মদ্যপান করতেন না কিন্তু পান করলে তিনি সবার চাইতে বেশিই করতে পারতেন; তাঁকে কেউ কখনো মাতাল অবস্থায় দেখেননি। প্রেমের ব্যাপারে প্রবলতম প্রলোভনের সামনেও তিনি প্লেটোনিক (Platonic-নিষ্কাম) থাকতেন, অবশ্য প্লাতন যদি সত্য কথা বলেন। তিনি ছিলেন খাঁটি অফীয় ঋষিঃ স্বর্গীয় আত্মা এবং মর্তের দেহের দ্বৈতোর ভিতরে দেহের উপরে আত্মার সম্পূর্ণ প্রভুত্ব তিনি অর্জন করেছিলেন। অন্তিমে মৃত্যু সম্পর্কে তাঁর উদাসীনতা তাঁর এই প্রভুত্বের শেষ প্রমাণ। অথচ তিনি গোঁড়া অফীয় ছিলেন না, তিনি শুধুমাত্র মূলগত মতবাদগুলো মানতেন, কুসংস্কার এবং শুদ্ধিকরণের অনুষ্ঠানগুলোকে মানতেন না।

প্লাতনীয় সক্রাতেস স্টোইক এবং অসুয়ক-দুইয়েরই পূর্বসূরি ছিলেন। স্টোইকদের মত ছিল নৈতিক উৎকর্ষ (virtue) শ্রেয়তম এবং বাইরের কোনো কারণ কোনো মানুষের নৈতিক উৎকর্ষচ্যুত করতে পারে না। বিচারকরা তাঁর কোনো ক্ষতি করতে পারেন না সাতেসের এই যুক্তিতে অন্তর্নিহিত ছিল স্টোইকদেরই মতবাদ। পার্থিব সম্পদকে সিনিকরা ঘৃণা করতেন এবং সভ্যতার আরামকে পরিহার করে তাঁদের এই ঘৃণা প্রদর্শন করতেন। এই একই দৃষ্টিভঙ্গি সক্রাতেসকে নগ্নপদে এবং খারাপ পোশাকে চলাফেরা করতে অনুপ্রাণিত করেছে।

প্রায় নিশ্চিতভাবেই মনে হয় সাতেসের প্রধান চিন্তা ছিল নৈতিক, বৈজ্ঞানিক নয়। আমরা দেখেছি, অ্যাপোলজি-তে তিনি বলেছেন, ভৌত দূরকল্পনের সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। প্লাতনের কথোপকথনের ভিতরে যেগুলো প্রাচীনতম, সাধারণত ধরা হয় সেগুলোই সর্বাধিক সক্রাতেস মতানুসারী, সেগুলো প্রধানত নৈতিক শব্দগুলোর সংজ্ঞা অনুসন্ধানে ব্যস্ত। খার্মিদেস (Charmides) ব্যস্ত মিতাচার এবং মধ্যপন্থার সংজ্ঞা নির্বাচনে, লুসিস (Lysis) ব্যস্ত বন্ধুত্ব নিয়ে, লাখেস (Laches) ব্যস্ত সাহস নিয়ে। এগুলোর কোন ক্ষেত্রেই কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছানো হয়নি কিন্তু এই সমস্ত প্রশ্নকে সক্রাতেস যে গুরুত্বপূর্ণ ভাবতেন সেটা উনি স্পষ্টই বলেছেন। স্নাতনীয় সক্রাতেস অটলভাবে বলেছেন, তিনি কিছু জানেন না, অন্যের চাইতে তিনি শুধুমাত্র এইকারণে প্রাজ্ঞতর- তিনি যে অজ্ঞ সেটা তিনি জানেন কিন্তু জ্ঞানকে অপ্রাপনীয় বলে তিনি মনে করেননি। বরং উল্টো, তিনি ভাবেন জ্ঞানের অনুসন্ধানই সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর মতে, কেউই স্বেচ্ছায় পাপ করে না সুতরাং সম্পূর্ণ নৈতিক শুদ্ধি হওয়ার জন্য শুধুমাত্র জ্ঞানই প্রয়োজন।

নৈতিক শুদ্ধি এবং জ্ঞানের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক সক্রাতেস এবং প্লাতনের বৈশিষ্ট্য। কমবেশি সমস্ত গ্রিক চিন্তনে এই ব্যাপার রয়েছে, খ্রিষ্টধর্ম এর বিপরীত। খ্রিষ্টিয় নীতিশাস্ত্রে পবিত্র হৃদয়ই হলো আসল এবং অন্ততপক্ষে সেটা মূর্খ এবং পণ্ডিত উভয়ের মধ্যে সমভাবে পাওয়ার সম্ভাবনা। গ্রিক এবং খ্রিষ্টিয় নীতিশাস্ত্রে এই পার্থক্য আধুনিক কাল অবধি চলে এসেছে।

দ্বান্দ্বিক পদ্ধতি অর্থাৎ প্রশ্ন এবং উত্তরের সাহায্যে জ্ঞানের অনুসন্ধান সক্রাতেস আবিষ্কার করেননি। মনে হয় এই পদ্ধতি প্রথম সুসংবদ্ধভাবে প্রয়োগ করেছিলেন পার্মেনেদেসের শিষ্য জেনো (Zeno), স্নাতনের কথোপকথন- Parmenides-এ। স্নাতনের অন্য বই অনুসারে সক্রাতেস অপরের সঙ্গে যেরকম আচরণ করেছেন, জেনো সক্রাতেসের সঙ্গে সেরকম আচরণ করেছেন। তবে সক্রাতেস যে এই পদ্ধতি ব্যবহার করেছেন এবং বিকশিত করেছেন- এরকম অনুমান করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। আমরা দেখেছি সক্রাতেসকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার সময় তিনি আনন্দের সঙ্গে চিন্তা করেছেন পরলোকে তিনি চিরকাল প্রশ্ন করে যেতে পারবেন এবং কেউ তাকে হত্যা করতে পারবে না। কারণ, তখন তিনি অমর হবেন। অ্যাপোলজি-তে বিবৃত দ্বান্দ্বিক পদ্ধতি ব্যবহারের অভ্যাস যদিও তাঁর থেকে থাকে তাহলে তাঁর প্রতি শত্রুতা সহজেই ব্যাখ্যা করা যায়ঃ আথিনার সমস্ত মূর্খ দাম্ভিকরা (humbug) তাঁর বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধই হতেন।

দ্বান্দ্বিক পদ্ধতি কোনো কোনো ক্ষেত্রে উপযুক্ত আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে নয়। হয়তো প্লাতনের অনুসন্ধানের বৈশিষ্ট্য নির্ধারণ করতে এই পদ্ধতি সাহায্য করেছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এই অনুসন্ধান ছিল এমন যার বিচার এই পদ্ধতিতে হতে পারে। এবং প্লাতনের প্রভাবে পরবর্তী অধিকাংশ দর্শনই এই পদ্ধতি থেকে উদ্ভূত গণ্ডির ভিতরে সীমাবদ্ধ থেকেছে।

স্পষ্টতই কিছু কিছু বিষয় এই পদ্ধতিতে বিচারের অনুপযুক্ত। যথা, পরীক্ষামূলক বিজ্ঞান। গ্যালিলিও (Galieo) তার তত্ত্বের সপক্ষে কথোপকথন পদ্ধতি ব্যবহার করেছিলেন সত্য কিন্তু সেটা করেছিলেন প্রাচীন সংস্কারকে অতিক্রম করার জন্য। তার আবিষ্কারের সত্যকারের যুক্তি অত্যন্ত কৃত্রিম উপায় ছাড়া কথোপকথনের অন্তর্গত করা যায় না। প্লাতনের লেখাতে দেখা যায় সক্রাতেস সবসময়ই ভান করছেন, তিনি যাদের প্রশ্ন করেন তাঁদের পূর্বজ্ঞাত জ্ঞানই তিনি প্রকাশ করছেন। এই যুক্তিতে তিনি নিজেকে একজন ধাত্রীর সঙ্গে তুলনা করেছেন। ফায়েদ (Phaedo) এবং মেনন (Meno)-তে তিনি যখন জ্যামিতি সমস্যায় এই পদ্ধতি প্রয়োগ করেছেন তখন তাঁকে এমন প্রশ্ন করতে হয়েছে যাতে উত্তরের আভাস রয়েছে, যা কোনো বিচারকই অনুমোদন করবেন না। এই পদ্ধতির সঙ্গে স্মরণিক মতবাদের (doctrine of reminiscence) ঐক্য রয়েছে, এই মতবাদ অনুসারে আমাদের শিক্ষা হয় পূর্বজন্মে জ্ঞাত জ্ঞান স্মরণ করে। এই দৃষ্টিভঙ্গির বিপরীতে অনুবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যে যে সমস্ত আবিষ্কার হয়েছে সেগুলো বিচার করুন, ধরুন জীবাণুর সাহায্যে রোগের বিস্তার; এইসব জ্ঞান, আগে থেকে জানে না এমন মানুষের কাছ থেকে প্রশ্নোত্তর পদ্ধতিতে আহরণ করা প্রায় অসম্ভব।

পূর্বেই যে সমস্ত ব্যাপার সম্পর্কে আমাদের যথেষ্ট জ্ঞান আছে সেই সমস্ত ব্যাপারে সঠিক সিদ্ধান্তের জন্য সক্রাতেসীয় পদ্ধতি প্রয়োগ সম্ভব, বিশেষত যদি ভ্রমাত্মক বোধের জন্য কিংবা বিশ্লেষণের অভাবের জন্য আমরা জ্ঞাত তথ্যের সর্বোত্তম যৌক্তিক ব্যবহারের অপারগ হই। ন্যায়বিচার কী?-এই ধরনের প্রশ্ন প্লাতনের কথোপকথন পদ্ধতিতে আলোচনার অতি উপযুক্ত। ন্যায় এবং অন্যায় কথাগুলো আমরা অবাধে ব্যবহার করি, এই শব্দগুলোকে আমরা কীভাবে ব্যবহার করি সেটা পরীক্ষা করে অবরোহী যুক্তির সাহায্যে এই শব্দগুলোর ব্যবহারযোগ্য সর্বাপেক্ষা উপযুক্ত সংজ্ঞায় আসতে পারি। দরকার শুধু জানা, আলোচ্য শব্দগুলো কী করে ব্যবহৃত হয়। কিন্তু অনুসন্ধান শেষে আমাদের আবিষ্কার হয়ে দাঁড়ায় শুধুমাত্র ভাষাতাত্ত্বিক, নীতিশাস্ত্র বিষয়ক আবিষ্কার নয়। কিন্তু বৃহত্তর ক্ষেত্রে এই পদ্ধতির লাভজনক ব্যবহার সম্ভব। যে ক্ষেত্রে তর্কের বিষয় যুক্তিভিত্তিক, তথ্যভিত্তিক নয়, সেক্ষেত্রে আলোচনা সত্য নির্ণয়ের একটি উত্তম পদ্ধতি। উদাহরণস্বরূপ, অনুমান করা যাক, কারও মত হলো গণতন্ত্র উত্তম কিন্তু কয়েকটি বিশেষ মতবাদে বিশ্বাসীদের ভোটাধিকার থাকা উচিত নয়, তাহলে তাকে অসঙ্গতির জন্য দোষী করতে পারি এবং প্রমাণ করতে পারি যে, তার দুটি সুদৃঢ় মতের ভিতরে অন্তত একটি কমবেশি ভুল। আমার মতে, যৌক্তিক ভুলের ব্যবহারিক গুরুত্ব অনেকে যা মনে করেন তার চাইতে বেশি। যারা এই ভুল করেন তারা পালা করে এই দুটি বিষয়েই একটা পছন্দসই মতবাদে বিশ্বাস করতে সক্ষম। যে কোনো যৌক্তিকভাবে সঙ্গতিপূর্ণ মতবাদই অংশত দুঃখদায়ক এবং সমসাময়িক সংস্কারের বিরোধী। দ্বন্দ্বমূলক পদ্ধতি- কিংবা আরও সাধারণভাবে বলা যায় বাধাহীন আলোচনা- যৌক্তিক সঙ্গতিকে সাহায্য করে এবং এদিক দিয়ে প্রয়োজনীয়ও বটে। কিন্তু নতুন তথ্য আবিষ্কার করাই যখন উদ্দেশ্য তখন এই পদ্ধতিতে কোনো লাভ হয় না। দর্শনশাস্ত্রর সংজ্ঞা হয়তো এভাবে দেওয়া যেতে পারে, প্লাতনের পদ্ধতিতে যা বিচার করা সম্ভব তার মোট যোগফল হলো দর্শনশাস্ত্র। কিন্তু এই সংজ্ঞা যদি সঠিক হয় তাহলে তার কারণ পরবর্তী দার্শনিকদের উপর প্লাতনের প্রভাব।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *