হাওয়ায় কেমন যেন পালকের মতন একবার ঢেউ খেয়ে এদিক আর একবার ঢেউ খেয়ে ওদিক ভাসতে-ভাসতে ও নামছে, আঁচ করল দুর্বলস্বাস্হ্য আচ্ছন্ন শিলাদ তরফদার। কে একজন দাড়িঝোলা পাকাচুল গরদপরা সাধু ওকে সুপারম্যানের কায়দায় ধরে ফেলে যাত্রাদলের ভুঁড়িভোম্বল অভিনেতার ঢঙে শুধোল, হে সম্ভো্চূড়ামণি, তোমার যৌনলীলার কোটা তো এখনও শেষ হয়নি, কস্তুরিরস জমে রয়েছে অঢেল; যেহেতু তুমি আমার পি.এ. কিছু একটা করতে হয়; লর্ড মাত্রেই তাদের পি.এ., পি.এস., স্ত্রী ছেলে মেয়ের জন্যে অনেক কিছু করে, যাতে তারা কয়েক পুরুষ বিলাস বৈভব ক্ষমতায় থাকে।
তন্দ্রার ঘোরে শিলাদ দাড়িঅলার পরিচয় জানতে চাইলে সে বলল, আমি ধর্মঠাকুর, তেত্রিশ কোটি লর্ডসভার সদস্য, লাউসেনের ইষ্টদেবতা। তুমি কি গর্ভপাত করানোর জন্য নার্সিংহোমের জমি চাও? মাগিবাজির হোটেলের সুউচ্চ ইমারত চাও? নারীপাচারের ঠিকেদারির বরাত চাও? কী চাও তাড়াতাড়ি বল।
আচ্ছন্ন স্মৃতিতে শিলাদের আবছাভাবে মনে পড়ল, দাদু ধর্মঠাকুরের কথা বলেছিল একবার। এই লর্ড উঠে এসেছিল পূর্ণচৈতন্যের সমুদ্র থেকে, চাহারা ধৌত কৃষ্ণেন্দু ধবল, বুকে কৌস্তুভ।
শিলাদ বলল, স্যার, আমি ওই সব পাওয়া আর পাইয়ে দেবার প্যাঁচাগোষ্ঠীর নই; প্লিজ, আমার সমস্যা বুঝুন, আমার এই জীবন এমনই সুখী যে ভীষণ রিপিটিটিভ হয়ে গেছে, প্লিজ ডু সামথিং, একদম ভাল্লাগছে না। এরকম খাও-দাও-সঙ্গম করো জীবনের মানে হয় না, আমি তো অন্যরকম জীবন চেয়েছিলুম।
দাড়িঅলা বলল, হে পীনপয়োধর-পরিসরমর্দন-চঞ্চলকর যুগশালী, তুমি এমন মাইন্ডসেট থেকে মুক্ত হবার জন্য কী চাও?
তন্দ্রার ঘোরে শিলাদ জবাব দিল, আমি একটা পারপাস চাই, অতিরঞ্জন চাই, কর্মব্যস্ততা চাই।
ধর্মঠাকুর: তুমি রঙ্গিলা হতে চাও না জঙ্গিলা?
শিলাদ: না, না, রঙ্গিলা নয়। জঙ্গিলা, জঙ্গিলা।
থপ।
শিলাদ শুনতে পেল শব্দটা। টের পেল ও সম্পূর্ণ সুস্হ সতেজ সচেতন, পড়ে রয়েছ রাস্তায়। ঘাড় ঘুরিয়ে নিজের দিকে দেখল। আরে। ও তো ফিকে হলুদ ঘরেলু গিরগিটি হয়ে গেছে, চারটে পা, চার-চারটে পা, লম্বা ল্যাজ ডগার কাছে গিয়ে সরু হয়ে গেছে।
ওর ওপর ছায়া খেলতে, ওপর পানে তাকিয়ে শিলাদ দেখল, ছোঁ মেরে তুলে নেবার জন্যে ধেয়ে আসছে নিঋিতি কোনার। ওরেব্বাপ, পায়ের ছুঁচালো বেয়নেট তাক করে নেমে আসছে। ওর নিরলস প্রেমিককে আর ও চিনতে পারবে না। প্রেমিক এখন খাদ্যবস্তু। ভয়ে শিলাদের মাথা কমলারঙে রঞ্জিত হয়ে উঠল। পার্টিবাবাজিউদের ডাঁই করে রাখা ঠিকেদারি-বালির মধ্যে গোঁতা মেরে ঢুকে পড়ল। যাক, জঙ্গিলার আন্ডারগ্রাউন্ড মুহূর্ত শুরুতেই এসে গেল।
বালি ফুঁড়ে মুখ বের করে শিলাদ আকাশে তাকিয়ে নিঋিতি নেই আঁচ করে যখন নিশ্চিন্ত হতে চাইছিল, দেখল ওর দিকে দু-পায়ের ছুরি-চাকু তাক করে বাতাস চিরতে-চিরতে উল্লাসে সেই চিলটা নেমে আসছে, যার ও পায়ু ধর্ষণ করার চেষ্টা করেছিল। আতঙ্কে ওর মাথা আবার অতিরঞ্জিত হল, আর লুকোবার জন্যে লাফ মারল ইঁটের পাঁজার ফাঁকে, যেখানে, দম নেবার জন্যে জিরোতে গিয়ে চোখাচুখি হল ইঁটের পাঁজার মালিক, মিলিটারি টুপি-পরা চুনিচোখ বুড়োটে-মার্কা কেউটে সাপের। দেখামাত্র পেছন ফিরে দৌড় লাগাল শিলাদ।
দৌড় শেষে সামনে যে সুপার মার্কেট ছিল তার দেয়াল বেয়ে সরসরিয়ে তরতরিয়ে উঠে গেল শিলাদ, বেশ ওপরে, এদিক-সেদিক দেখল, একটা গুয়ে মাছি নজরে আসতে, ভয় কমাবার জন্যে সেটাই খেয়ে ফেলল গপ করে। তবু হাঁপাচ্ছিল। এত হাঁপাচ্ছিল যে উদ্বিগ্ন শিলাদ ভাবল শেষে আবার অন্ধ্রপ্রদেশে গিয়ে হাঁপানি সারাবার মাছ খাবার জন্যে না সাত ঘন্টা লাইনে দাঁড়াতে হয়।
অবাকও হল শিলাদ। ঘনঘন আন্ডারগ্রাউন্ড হবারজঙ্গিলা জীবনের আতিশয্যে, পালিয়ে বেড়ানো থেকে মানসিক ক্লান্তি হতে পারে। চারপাশে তাকিয়ে, বিপদ-মুক্ত হয়েছে অনুমান করে, রাস্তায় নেমে, পেছনের ঝরনাবাগানের ঘাসে পৌঁছেছিল শিলাদ, ওর কানের পাশ দিয়ে একটা পাথরের টুকরো বেরিয়ে গেল। আশেপাশে তো পুলিশ আর মিছিল নেই, তার মানে ওকে থেঁতো করার জন্যেই কেউ ঢিলটা ছুঁড়েছে। শিলাদ লাফ মারল। সেঁধোল গাছের গোড়ায় শেকড়ফোলা গর্তে।
হাঁফ ছেড়ে, পেটে বুকে সূক্ষ্ম আঁশের সারি দেখে, নিজেকে ঘেন্না হল শিলাদের । এর চেয়ে তো সুটেড-বুটেড প্যাঁচা হয়ে স্মার্ট সৌম্যদেহ ভাল ছিল। কেন যে খারাপ লেগেছিল নিঋিতির খাওয়া বেড়ানো যৌনকর্মের নিত্যরুটিনে। সত্যি, গিরগিটিপনা তো এইটুকুতেই ক্লান্তিকর মনে হচ্ছে। জঙ্গিলা জীবনের লুকোচুরির চেয়ে বোধহয় রঙ্গিলা জীবনের হেলাফেলা ভাল। কী আর করা যাবে। এভাবেই কাটাতে হবে বাকি জীবন, জঙ্গিলা গিরি করে, পালিয়ে বেড়িয়ে।
গর্তের মুখে আরমা করছিল শিলাদ। ভেতর থেকে চিৎকার চেঁচামেচি শুনতে পেয়ে সেদিকে এগিয়ে দেখল জঙ্গিলা গোষ্ঠীর প্রতিনিধিদের গুপ্ত গুলছররা চলছে। মঞ্চে উঠে এক-এক করে নেতারা আত্মপরিচয় দিতে, শিলাদ জানতে পারল, সেখানে উপস্হিত রয়েছে একেশ্বরবাদী আরবিভাষী লালকালো গিলা, নিরাকারবাদী পুশতুভাষী ফিকেসবুজ অ্যানোল, বহু ঈশ্বরবাদী তামিল কালো-হলুদ জমিনগেকো, লোকঠাকুরবাদী ককবরক খয়েরি কুমিরপিঠ অ্যাগামিড, ধর্মভয় বাদী বাংলাস্তানি ফিকে লাল স্কিংক, অনীশ্বরবাদী নেপালি কালচে-হলুদ মনিটর, ঈশ্বরের প্রতিনিধিবাদী আইরিশ কালচে-সবুজ ল্যাসারটিড, একলষেঁড়ে ভগবানবাদী চেচনীয় ইগুয়ানিড, অজ্ঞাবাদী স্পেনীয় লম্বাল্যাজ টেজিড, ঈশ্বরপুত্রবাদী নাগা ল্যাজপাকানো চ্যামেলিয়ন, দেবী-দেবতাবাদী অহমি হলুদ-ফুটকি বড়চোখ আসল-গেকো, নিজভগবানবাদী তেলুগু হেলমেটমাথা ব্যাসিলিস্ক, একেশ্বরবাদী কাশ্মীরি নীল-জিভ টিলিকা প্রমুখ ইয়া-ইয়া দিগগজ।
সবাই ইংরেজিতে কথা বলছিল, তর্কাতর্কি করছিল, চাপানউতর করছিল; মনে হল ওটাই জঙ্গিলাদের পিতৃভাষা। মঞ্চের ওপর একপাশে রাখা রয়েছে, যাকে জঙ্গিলারা বলাবলি করছিল যে উনি হলেন উড়োনছু নামের বিখ্যাত গিরগিটির কংকাল।
একের পর এক দিগগজ নেতার তরল সান্দ্র গভীর সংঘাতী তঞ্চিত খামিরি মাতানো ধূমিত রসাল ভারিক লঘু চোহেল আবিল সতেজ শুটকো আধসেদ্ধ বিদগ্ধ বক্তৃতা শুনতে-শুনতে জঙ্গিলা-জীবন আর জীবনদর্শন সম্পর্কে খটকা লাগল শিলাদের। বিস্ফোরক বানানো, সেটাকে যার মাথায় ইচ্ছা ফাটানো, আর যার মাথায় ফাটানো হচ্ছে তাকে জঙ্গিলা সত্রু ঘোষণা করা, এইই মনে হচ্ছে মোদ্দা কথা।
জঙ্গিলা জীবনের কত কি জানত না শিলাদ। নানা রঙ্গিলার দেশে গিয়ে তাদের পয়সায় ডেঁড়েমুশে খেয়ে মৌজকরা, আর সেখানে লুকিয়ে থাকা যে জঙ্গিলার উদ্দেশ্য তা জানত না । ভ্যাবাচাকা গিলে-গিলে খেতে লাগল শিলাদ। এবার আবার দেবীরভ দোলায় আগমন; জঙ্গিলাদের মড়ক লাগলে কার লাশ কে গতি করবে কে জানে!
জঙ্গিলা দিগগজরা পরস্পরকে সাথি বা সাথিন বলে সম্বোধন করছিল। উড়োনছু ড্র্যাগনের বিচক্ষণ কংকালকে বলছিল মহাসাথীর মহাকংকাল। কোনো কিছু খুব ছোট হলে জঙ্গিলারা তাকে মহা পদবি দ্যায়, বোঝা গেল। বক্তৃতা শেষে মহাসাথীকে একইভাবে সেলাম ঠুকছিল প্রত্যেকে: ল্যাজ ঘুরিয়ে মুখের কাছে এনে সপাং।
পাশে দাঁড়ানো সবুজ-শাড়ি পরা গিরগিটি যুবতীর ল্যাজে ল্যাজ পাকিয়ে, জঙ্গিলা জীবন সম্পর্কে বিস্তারিত জানার জন্যে শিলাদ জিগ্যেস করল, সাথিন, আপনার নাম কী? যার জবাবে সবুজ শাড়ি রুষ্ট হয়ে বলল, আমাদের নাম হয় না, ওরফে হয়।
আপনার ওরফেটা কী?
শাহিনা শেখ ওরফে কাকলি কলিতা ওরফে মৌ মাহাতো ওরফে বনু বর্মন ওরফে ললিং লেসি ওরফে সুজান সামার ওরফে সাবিনা সিকন্দর ওরফে…
থাক থাক। এর পর কী কার্যক্রম মিস ওরফে? বলতে বলতে নিজের অকুস্হলকে সবুজ-শাড়ির অকুস্হলের প্রায় কাছাকাছি এনে ফেলেছিল শিলাদ, ল্যাজের পাক দিতে-দিতে।
ব্যাস ব্যাস ওই পর্যন্তই, আর পর আর আ্যালাউড নয়।
বাঃ, এর পরই তো জীবনের জয়গান। অতিরঞ্জন।
সাথী, নিজেকে সংবরণ করুন। জঙ্গিলাদের পুংচিজ স্ত্রীংচিজ থাকা অনুচিত। তাকে নিজেকে অচিজ বা নাচিজ করে তুতে হবে। ওই অপবস্তুটি কেবল রঙ্গিলাদের জন্যে বরাদ্দ। বলার সময়ে নিজের ল্যাজকে শিলাদের ল্যাজের জাপট থেকে আলতো করে সরিয়ে নিল সবুজ-শাড়ি।
আমি জঙ্গিলাতত্ব জানতে চাইনি, জানতে চাইছি এর পর কী? বিরক্ত প্রত্যাখ্যাত শিলাদ জাঁঝিয়ে উঙল, কেননা ও বুঝতে পারছিল যে জঙ্গিলা জীবনে ও আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে, গিরগিটির আত্ধমতা সম্পর্কে হয়ে উঠছে সন্দিহান। ওহোহোহো। অনুৎসাহী, ক্লান্ত, উদ্বেগময়। জঙ্গিলা রকমসকম সম্পর্কে বীতশ্রদ্ধ, কাহিল, বেদনার্ত।
শিলাদের অভিভূতি সামাল দিতে, ল্যাজের পাক খুলে ওরফে নামের সাথিন ভিড়ে মিশে যাবার পর, আধঘোমটায় মুখ-ঢাকা স্কিংক সাথিন ওর গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ফিসফিসিয়ে বলল, অধৈর্য হবেন না সাথী; অ্যানোলসাথী এবার চরস গাঁজা আফিম কোকেন হেরোইন বিক্রির টাকা ডলার পাউন্ড ইয়েন রিয়াল রুবল লিরা দিরহাম ফ্রাঁ মার্ক আমাদের বিলি করবেন।
কী কী? আফিম-কোকেন বেচার লাভাংশ? আঁৎকে উঠল শিলাদ। আরেকটু হলেই চেঁচিয়ে ফেলত।
হ্যাঁ সাথী, তা না হলে আর্ডিএক্স মর্টার বাজুকা রকেট রাইফেল গ্রেনেড ডিটোনেটর কিনবেন কী করে? খালি হাতে কজনকেই বা মারবেন? আর চোখ কান বুজে মারতেই যদি না পারলেন তাহলে জীবনের উদ্দেশ্য কী করে পুরো হবে?
শুনে, দমে গেল, মুষড়ে পড়ল শিলাদ, হতাশ, মনোহত। জঙ্গিলা মানে কি মারা, মরা, মারা, মরা, মারা, মরা, মারা, মরা? ধুসশালা। ঘোমটা ঢাকাকে শিলাদ বলল, আপনার চোখ, ঠোঁট, ল্যাজের নকশা কিন্তু অসাধারণ; লাভ অ্যাট ফার্স্ট সাইট হয়ে যাবার নিশ্চিত সম্ভাবনা।
বলে, শিলাদের মনে হল, এই পরিবেশে কথাগুলো বেমানান, এমন কি বেফাঁস। কথা ঘোরাবার চেষ্টা করল। এক কোণে লাল সবুজ গেরুয়া মুফতি ইত্যাদি রঙে বলের মতন কিছু জড়ো করা ছিল। শিলাদ জিগ্যেস করল, ওগুলো কী।
আমরা রঙ্গিলা ডিম চুরি করে এনে জন্মের আগে থেকে জঙ্গিলা বানাই। জঙ্গিলা গোষ্ঠীর রঙ অনুযায়ী সেই মতাদর্শের আরকে চোবাই। ডিম ফুটে বেরোলেই ওদের ইনডকট্রিনেট করে জীবন্ত অস্ত্রশ্ত্রর প্রশিক্ষণ দিয়ে শত্রু নিধনে পাঠানো হয়। আপনার আত্মনে এখনও রঙ্গিলাভাব প্রচুর জমে আছে, ঝেড়ে ফেলুন। বলে, ঘোমটা-ঢাকা মিশে গেল জঙ্গিলা জমঘটে।
সবাইয়ের মতন, আফিম-কোকেন বেচার বখরা শিলাদকেও নিতে হল। গর্তের মুখের কাছে গিয়ে, এদিক-ওদিক দেখে নিয়ে সবাই একে-একে সট সট করে বেরিয়ে গেল শত্রু এলাকায় আন্ডারগ্রাউন্ড হবার জন্যে। মহাসাথীর মহাকংকাল পড়ে রইল মহান অন্ধকারের মহাশয্যার মহাকন্টকে, যেমনকার তেমন। একটু বাইরে দিকে উঁকি মেরে শিলাদ দেখতে পেল জমিনগেকোকে ঠোঁটে নিয়ে উড়ে যাচ্ছে শাহিন বাজপাখি, ল্যাসেরটিডের পেট চিরে আমগাছের ডালে বসে নাড়িভুঁড়ির চাউমিন খাচ্ছে শঙ্খচিল। ওদের শহিদাত্মা-ল্যাজ কখনও জিজ্ঞাসাচিহ্ণের মতন, আবার কখনও বা বিস্ময়সূচক চিহ্ণের শেষ আকার নিচ্ছিল। রাতটা কাটুক, কাল দেখা যাবে, ভেবে শিলাদ সেখানেই শুয়ে রইল।
তন্দ্রামতন এসেছিল। কিছুক্ষণ পর কেউ একজন আচমকা ওর ল্যাজ ধরে হিড়হিড় করে ভেতর দিকে টেনে নিয়ে চলল, তারপর যেখানে সভা চলছিল সেখানে থামল বটে, তবে নিজের ল্যাজের সঙ্গে ল্যাজ পাকিয়ে টুঁটি ধরে চাপিয়ে নিল নিজের ওপর। অন্ধকার চোখসহা হলে শিলাদ দেখল, আরে, এ তো সেই মিস ওরফে, যে তখন ঠ্যাকারে ল্যাজ ছাড়িয়ে নিয়েছিল।
ওরফে গরম-গরম উত্তেজিত স্বরে বলল, কী রে রঙ্গিলা স্পাই, টিপতে এসছিস মাই, নে, কত টিপবি; বি কুইক অ্যান্ড ফাস্ট।
আপনি তো আমার ল্যাজ প্রায় ছিঁড়ে ফেলেছিলেন; রঙ্গিলা কাজেও দেখছি জঙ্গিলাভাব। এই কাজটা একটা আর্ট ফর্ম। ফোর প্লে করতে দেবেন তো।
রঙ্গিলা জীবনে ল্যাজ নিয়ে করবিটা কী? কাইকে কায়দামাফিক সেলাম ঠুকতে হয় না। তোদের তো হেঁ হেঁ করলি, হাত কচলালি, ব্যাস, সেলাম হয়ে গেল।
আপনি ভুল করছেন। জঙ্গিলা আমি স্বেচ্ছায় হয়েছি। কেউ আমায় ভুল বুঝিয়ে, ফুসলিয়ে, লোভ দেখিয়ে, কেতাব পড়িয়ে বা বাড়ি থেকে চুরি করে এনে জঙ্গিলা বানায়নি।
নে, নে, অনেক কপচেছিস। এখন যে কাজটা করতে চলেছিস তা মন-প্রাণ-দেহ ঢেলে ভালভাবে কর। আমার হাতে-পায়ে বিশেষ সময় নেই।
ওদের দুজনের লুটোপুটি হুটোপাটি কামড়াকামড়ি ওলোটপালোট আর হুড়দঙ্গের ধামসাধামসিতে লাল সবুজ গেরুয়া মুফতিরঙা ডিমগুলো ফেটে গাময় লেগে যেতে পেছলা-পিছলি প্রণয় সেরে একে আরেকজনকে চেটে পরিষ্কার করে দিল; তাতে পেটও ভরল শিলাদের। যেন কিছুই হয়নি, এরকম ভাব দেখিয়ে মিস ওরফে দৌড়তে-দৌড়তে বেরিয়ে গেল গর্ত থেকে।
কাল সকালেই বেরোব, নিজেকে বলল শিলাদ, আর উড়োনছু কংকালের বিচক্ষণ কংকালের পাশে ল্যাজে মাথা রেখে শুয়ে পড়ল। সঙ্গমের ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়ল। ঘুমের মধ্যে দাদু যাতুধান বিশাল ডানা মেলে শিলাদের ওপর উড়তে-উড়তে বলল, কী রে, বড় যে আদিখ্যেতা করছিলি শকুন জীবন ভাল্লাগেনা; এবার বোঝো ঠ্যালা, র্যালা করেছ কি ঠেলা পোয়াও, কতবার বলেছিলুম তোকে।
নিঋিতি কোনার, সাদা শিফনের আঁচল উড়িয়ে, স্বপ্নে নেমে এসে শিলাদের পাশে বসে গাল ফুলিয়ে খিলখিলিয়ে হাসল, আর মন্তব্য ছুঁড়ল, কী নাগর, তুমি ভেবেছিলে মেয়াদি করারের বিয়ে ভেঙে পালিয়ে গিয়ে সুখে থাকবে, জীবনের আসল মানে খুঁজে পাবে। এখন বুঝছো তো কোন পুকুরে কত ব্যাঙ, বকের কেন নাচের ঠ্যাঙ!
ল্যাজে মাথা রেখে ঘুমোতে-ঘুমোতে ফোঁপাচ্ছিল শিলাদ। এক ফাঁকে ওর ঘুমন্ত হাঁ-মুখের ভেতর দিয়ে ওর মগজে পা টিপে-টিপে যে মহাসাথীর মহাকংকাল ঢুকে পড়েছে, আর একটু-একটু করে হয়ে উঠেছে পেটরল-কুয়োঁর ধোঁয়াক্কার আগুন বমি করতে-থাকা পেল্লাই দশ ঠ্যাঙের গর্ণাখ্যাঁদা চিনা ড্র্যাগন, তা টের পায়নি ও, শিলাদ। ভয়ে ঘুমের ভেতর ঘুম ভেঙে গেল শিলাদ তরফদারের।
ঘুমের ভেতর জেগে-ওঠা শিলাদ নামের ঘরেলু গিরগিটিকে ড্র্যাগন বলল, তুই তো একটা আস্ত গাধা; তুই যাকে জঙ্গিলাজীবন ভেবে হাহুতাশ করছিস সে-ঘরানা বহুকাল তামাদি হয়ে গেছে। দেশে-দেশে জঙ্গিলাদের এখন হুদোহুদো ঘরানা। তুই কি জানির পেরুতে তেগু নামের তিন ফিটের গিরগিটি হয়; স্যালামানডাররা আসলে মাফিয়া ডন, মোটেই গিরগিটি নয়; মার্কিন গিরগিটিরা মাঝরাতে বেরোয়; মিশরের কোমোডো গিরগিটিরা দশ ফিট অব্দি হয়; অনেক গিরগিটির পা হয় না; আফরিকায় গিরগিটিরা নিজেদের মধ্যে লড়লে কী হবে, সর্পরাষ্ট্রের গ্রাস থেকে বাঁচতে নিজের ল্যাজ মুখে পুরে পাক খায় আর গড়িয়ে-গড়িয়ে হাওয়ার সঙ্গে হাপিশ হয়ে যায়; আফগানিস্তানের গিরগিটিদের সহজে ধরা যায় না, কাৎ হয়ে বালিতে পিছলে সাই-সাঁই করে পিছলে অনেকদূর চলে যায়? জঙ্গিলাজীবন আর আগেকার কালের হিরো-জীবনের মতন রোমান্টিক নেই; এখন সবাই ধান্দাবাজ।
আমি সত্যিই কনফিউজড, ঘুমন্ত ঘুমে ঘুমিয়ে থাকা শিলাদ ঘুমের মধ্যে নিজেকে দিয়ে বলালো।
তোকে তো তোর দাদু বলেছিল যে ভাষ্যকার নিজের আর ক্লায়েন্টের স্বার্থ মাথায় রেখে বাক্য বুকনি বিপ্লব বড়বড়াঙ ব্যধি বাতেলা বায়ু ব্যাখ্যা করে। তুই যদি জঙ্গিলাজীবনকে ওদের মতন অ্যাডভেঞ্চারাস চাকরি হিসাবে নিতিস তাহলে এরকম কেলিয়ে পড়তিস না, বিপর্যস্ত হতিস না।
ভাবিনি এভাবে স্বপ্নভঙ্গ হবে, ঘুমের মধ্যে ঘুমিয়ে-থাকা ঘুমন্ত শরটবদন শিলাদ শ্লেষ্মামাখা ঘড়ঘড়ে গলায় বলল।
উড়োনছু ড্র্যাগন পেটরল-আগুনের ধোঁয়াক্কার স্বাস ভলকে-ভলকে ছাড়তে-ছাড়তে বলল, স্বপ্নভঙ্গ বলে কিছু হয় না, অবস্হা বুঝে নিজেকে অবিরাম বদলাতে হয়। তার ফলে জীবনের উদ্দেশ্য আপনা থেকে পাল্টি খায়। এই দ্যাখ না আমাকেই, ছিলুম মহাসাথী, হয়ে গেছি কুমিরঠেঙে ঘোড়ামুখো ড্র্যাগন। আর কেউ আমাকে শ্রদ্ধাভক্তি করে না, সবই লোকদেখানে-লোকঠকানো। আসলে ওরা আমার কংকালটাকে ভয় পায়, কেননা আমার কংকালটা আজ আমার কিংবদন্তি।
আমার তাহলে কী হবে? জীবন তো তার মানে ফেলিওর। ইন্সটলমেন্টে দীর্ঘশ্বাস ফেলে-ফেলে ঘুমের মধ্যে বলল শিলাদ।
ব্যর্থ হবে কেন? অভয় দিল দশপদ ড্র্যাগন। কয়েক ভলক কেরোসিনগন্ধী আগুনের বমি উগরে শুধোল, অন্য অনেক উপায় আছে, সেগুলো যাচাই কর। এভাবে ভেঙে পড়লে চলে নাকি!
আপনি আমায় সাহায্য করুন না; এভাবে হেরে যাওয়া গিরগিটি জীবনের চেয়ে কয়রা কেউটের ছোবলের সামনে শুয়ে আত্মহত্যা করা ঢের ভাল। কাল সকালে বেরিয়েই কোনো তেলক-কাটা চশমাপরা ময়ূরের নজরে পড়ে শহিদ হব। দেড় ঘনফিটের একটা শহিদস্তুপ তো অন্তত হবে, তা সে সুলভ শৌচাগার চত্বরে হলেও হোকগে।
ভেবে বল, তুই কী চাস। আমি তো হতে চেয়েছিলুম সমাজবদলকারী; হয়ে গেলুম সেলাম-গ্রহণকারী উড়োনছু কংকাল, ওই সব জঙ্গিলাগুলোর জন্যেই। কত ভাল-ভাল কথা শুনিয়ে জনগণকে বোকা বানিয়ে আমায় করে ফেললে উড়োনছু কংকাল আর নিজেরা দিব্বি আমোদ-প্রোমোদ নিয়ে মজা করে চালালে।
কেয়াররি লাইফ চাই আমি, কাঁধের ওপর উদ্দেশ্যপূর্তির নোংরা বস্তা যাতে না বইতে হয়। আই ওয়ান্ট টু জাস্ট ফ্রিক আউট, জাস্ট চিল, হ্যাভ ফান।
তথাস্তু।
নিঃশ্বাসের আগুন সশব্দে নিভে গেল।
ঘুম ভেঙে গেল শিলাদ তরফদারের। তটিনীতে তটস্হ অবস্হায় ও টের পেল যে নানা রকমের মাপের রঙের আকৃতির মাছের ছানুবানু ঝাঁকে ও ভাসছে। তাহলে? ও কি আর ফিকে হলুদ ঘরেলু গিরগিটি নয়! তাই হবে হয়ত। গিরগিটি হলে এত গভীর জলে খাবি খেয়ে পেট ফুলে ডুবে মারা পড়ে ভেসে উঠত। আধ কুইন্টাল ওজনের একটা এলাকলাড়ি মাছের চোখের আয়নায় নিজের টেকনিকালার ফোটো দেখে বুঝতে পারল শিলাদ যে ও হয়ে গেছে নীল-কমলা রঙের মাছ। বুদবুদ উড়িয়ে আনন্দে শিস দিয়ে উঠল।
ওর শিস শুনে পাশে ভাসন্ত সাঁতরালু মাছেরাও নানা সুরে শিস দিয়ে উঠল। কে জানে এটা ঝিল বিল গাঙ খাল নদী না সমুদ্র, কেননা স্রোতের সঙ্গে ভাসার অভিজ্ঞতা ওর নেই। তবে জলের মিষ্টি নোনতা স্বাদ আর প্রতিবেশী সাঁতারু বোয়াল আড় গুজি রিটা কাত্তন বাচা ঘাউরা শিলং পাঙাস কালবোস শরপুঁটি এলেং টাটকিনি ঢেলা চাপিলা ফলুই ভেদা গুতুম রায়েক আর বেলের কখনও অলস আর কখনও ঝটিতি নাচ দেখে মনে হচ্ছে সমুদ্র খুব একটা দূরে নয়।
শিলাদ নিজে কী মাছ তা বুঝতে পারল না। হয়ত ওর কোনো আটপৌরে হেঁসেলি নাম নেই, যা আছে তা খটমট লাতিন-লোতেন ভাষায়। জলের বাসায় আত্মপরিচয় নিয়ে কি আর ধুয়ে খাবে?
সত্যিই বেশ দুর্ভাবনাহীন কেয়ারফ্রি জীবন, মনে হল শিলাদের। ঘুরে-ঘুরে সাইট-সিইংকরা যায়। তটের কাছে নাগরদোলা পোকা-দম্পতি দোল খেতে-খেতে উৎপলা-সতীনাথের রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইছে; টু=পিস মল্লিকা-শেরাবতি বিকিনি পরে ভেসে যাচ্ছে পিঠসাঁতারু পোকা, স্কিপিং খেলতে-খেলতে সত্যেন দত্তের পদ্য আওড়াচ্ছে জলমাকড়সা-মাকড়সি, কাদায় গোঁতাগুঁতি করছে শাসকদলের মাস্তান জলবিছে, জেলেদের পোঁতা বাঁশের ডগায় জুন ময়লা গঙ্গা-ফড়িং স্বচ্ছ ওঢ়না ওড়াচ্ছে, মুখ দিয়ে বুদবুদ ওড়াবার প্রতিযোগিতা চলছে জয় বাংলা কাঁকড়া-ক্লাবে, ব্যাঙানির খোঁজে লাফসাঁতার দিতে-দিতে উধাও হল অফিস-পালানো কটকটি ব্যাঙ , মাগবাড়ি যাবার আগে শ্যাওলার দিশি মদ খাচ্ছে কড়িকাইটা কাছিম। বাঃ, বেশ মনোরম। শিলাদের জীবন চলিয়া যায় নদীর স্রোতের প্রায়। কোনো পিছুটান নেই, কোনো দায়দায়িত্ব নেই।
হঠাৎ একদিন, পাশ দিয়ে যেতে-যেতে ওরই মতন এক নীল-কমলা মাছ সতর্ক করে দিয়ে গেল, পাড়ে ভুঁড়োশেয়াল পড়েছে।
কাছাকাছি হলদে-সবুজ মাদি মাছকে শিলাদ জিগ্যেস করল, হ্যাঁ গো, শেয়াল পড়েছে মানে কী? শেয়ালটা কি জলে ডুবে মরে গেল? তাহলে তো আড় বোয়াল চিতল প্রতিবেশীদের বাড়ি ভুরিভোজ।
মাদি মাছ মুখ ঝামটা দিয়ে বলল, মিনসের কথা শোনো; হাঁদাগঙ্গামাছ না কি তুমি? শেয়ালরা কাঁকড়া খেয়ে সাবাড় করছে। পাড়ের কাছে যেওনি। তোমাকেও এক গেরাসে চিবিয়ে হজম করে ফেলবে।
ছাঁৎ করে উঠল শিলাদের রঙিন বুক। বিশুদ্ধ কেয়ারফ্রি জীবন নয় তার মানে। গোপন শর্ত আছে, ক্ষুদে অক্ষরে লেখা । এ-জীবনেও ঘাপটি মেরে রয়েছে সন্দেহ সন্ত্রাস উৎকন্ঠা বিপদ সাবধানতার পরিসর। পাড়ের কাছে গিয়ে সাইট সিইং বাদ দিতে হল শিলাদকে।
জাগ-দেয়া পাটের আঁটি, ভাসন্ত মুলিবাঁশ, নৌকোর গলুইয়ের তলায়-তলায় সাইট সিইঙে নিত্যভ্রমণ সুরু করল শিলাদ। কিন্তু তাতেও যেচে পরামর্শ দিয়ে গেল আরেকজন নীল-কমলা মাছ। চিল বাজ কোড়া কালিম সরালি বেলেহাঁস নিশিবক নলঘোঙা কাস্তেচরা শামুকখোল পানকৌড়ি থেকে সাবধান; কপাৎ জলধিতলে হয়ে যাবে। অতএব এই বেড়ানোও ছাড়তে হল শিলাদকে। ওর মনে হল শকুন থাকতে এই রকম নিষেধ তো ছিল না। জল-স্হল-অন্তরীক্ষে স্বাধীন রাজত্ব ছিল।
এতদিন নানা স্বাদের শ্যাওলার রান্না খেয়ে বেড়াচ্ছিল কেওয়া গেওয়া হারগোজা রাহা আমুরা উড়ি ধানসি পশুর হেঁতাল বাইনের ওয়াটার রেস্তরাঁ বার হোটেলে ঘুরে-ঘুরে। গপাগপ ফপাফপ শপাশপ সুইট অ্যান্ড সাওয়ার প্ল্যাংকটন সুপ খেয়ে বেড়িয়েছে। দুদুটো হুঁশিয়ারির ধাক্কায় তা বন্ধ করতে হল।
শকুন থাকতে আকাশ ছিল অভয়াশ্রম। সে-কথা মনে পড়তে, একজন রঙিন মাছকে শিলাদ একদিন দুপুর একটা সাতচল্লিশ মিনিটে জিগ্যেস করল, দোস্ত, আমাদের কোনো অভয়াশ্রম আছে কি? সে বলল, ঝাঁকের ঠিক মাঝখানটায় ঢুকে থাকবে; তবে যে মাছ মানুষে খায় তার ধারেকাছে যেও না। এ জীবন হল সারভাইভাল অব দি ফ্লার্টেস্ট।
এ তো দেখছি অদ্ভুত সমস্যা, ভাবল শিলাত তরফদার, কানকো ফাঁপিয়ে। কেয়ারফ্রি বলতে তার মানে নিজের জীবনের এলাকা নয়; নিছক জলে বিচরণের এলাকা। আবার ওর অখেয়ালি অবসন্নতায় আক্রান্ত হবার উপক্রম হল। রুপোলি বুদবুদ উগরে বলে ফেলল, কিচ্ছু ভাল্লাগছে না।
অবসাদে নিজেকে ভাসিয়ে রেখে, শিলাদের একদিন নজরে এল, জঙ্গিলার একটা বিশেষত্ব ওর থেকে গেছে। যে প্রবালের বা শৈবালের কাছে ও যায়, সেই সময়টায় ওর গায়ের রঙ সেই প্রবাল বা শৈবালের মতন হয়ে যায়। স্রোতের সঙ্গে ভাসবার এ এক নৈতিক সুবিধা। কিন্তু জঙ্গিলাদের জাতিপ্রথা মাছের সমাজেও লক্ষ করে ব্যাপারটাকে ভবিতব্য হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছে। ওইটুকু জঙ্গিলা জীবনে ও দেখেছিল তাদের মধ্যে খয়রাতি জঙ্গিলা আর ভিখিরি জঙ্গিলার মাঝে বর্ণভেদ রয়েছে, তেমনই আছে বড়লোক জঙ্গিলা আর ছোটলোক জঙ্গিলার মাঝে, ডলার জঙ্গিলার সঙ্গে টাকা জঙ্গিলার, শাস্ত্রজ্ঞের সঙ্গে আনপঢ়ের, আস্তিকের সঙ্গে না-আস্তিকের, গোরার সঙ্গে কালার, বলিতে পাঠাও আর বলিদান দাও জঙ্গিলার মাঝে, বস্তিছাপ আর এয়ারকান্ডিশান জঙ্গিলার মাঝে।
মাছেদের সমাজে, টের পেল শিলাদ, রয়েছে যবাক্ষারজান জলের নিচড়া বর্গ, রোদবৃষ্টিমাখা জলের উচড়া বর্গের সঙ্গে মাঝামাঝি জলের নিচড়া বর্গ। অতি নিচড়া বর্গের গায়ে আঁশ নেই চোয়াল নেই ডানা নেই, তলানি খায়। নিচড়া বর্গের গায়ে হাড় নেই, সবই কার্টিলেজ, কানকোর জায়গায় খড়খড়ি; জলের বেসমেন্টে নামলে চোখের তলায় গর্ত দিয়ে শ্বাস নেয়। আর উচড়া বর্গ তো রোদে পাউডার চাঁদের ক্রিম আর শিশিরের পারফিউম মেখে চোপরদিন গোমরে ঝিকিমিকি। রঙিন বলে ওই সব বর্গের মাছেরা কেউই শিলাদকে নিজেদের লোক বলে মনে করে না, অথচ খুব হিংসে করে। রঙিন কাউকে দেখলেই ওদের পোঁদে হিং জমে।
বেসমেন্টে একদিন নেমেছিল শিলাদ, ডানা টিপে-টিপে, গায়ের রঙ পালটে। গিয়ে তো থ। দ্যাখে কি, গির্গিটবোমা অ্যানোলের পচাগলা লাশের মোরব্বা চেখে-চেখে খাচ্ছে মার্কিন কানিমাগুর আর ব্রিটিশ পাঁকাল। দেখে অব্দি মাছজীবনে বিতৃষ্ণা ধরে গেছে শিলাদের। এই কি শত্রুমিত্রের আকাঙ্খাপূর্তি? আর বেসমেন্টমুখো হয়নি। না হলে কী হবে, ওর জন্যে আরও ভয়ানক অভিঘাত সেই রাতে ঘতল, যখন, শৈবালের সবুজ মশারি থেকে বেরিয়ে শ্বাস নেবার জন্যে বাতাসে মুখ বাড়িয়েছিল। দেখল ভাসন্ত মুলিবাঁশের ওপর মিস ওরফেকে ল্যাংটো করে গেলবার তোড়জোড় করছে নিঋিতি কোনার।
সেই থেকে, যেটুকু এলাকায় কেয়ারফ্রি থাকা অনুমোদিত, যে জায়গায় রঙিন মাছেরা আফালি মারে, কেবল সেই পাড়াগুলোয় ঘুরে বেড়ায় শিলাদ।
তাতেও শান্তি নেই। এই রকম সতর্কবার্তা শুনতে হচ্ছে যখনতখন:
মৃগেলপোনা: ফলুই পাড়ায় কেউ যাবেন না, আড়কাঠিরা বেড়াজাল ফেলেছে। অপহরণ করে মাছগাছিতে বেচে দেবে।
খালুয়া কাছিম: পালাও, পালাও, দাগি ট্রলারের জলকাঁপন ঢেউ তুলেছে। কেউ বাঁচাতে আসবে না। নাগরিকরা নিজেদের সুরক্ষা নিজেরা করুন; জলরাষ্ট্রপতি হুকুম করেছেন।
ভোলাভেটকি: যে যেখানে পারো লুকিয়ে পড়ো। বাড়ির দরজা-জানলা বন্ধ করে দাও। ইরাবতী-শুশুক, তিলা-শুশুক, আর তরমুজমাথা শুশুকের বিরাট ডাকাত দল ডিগবাজি ভুটভুটিতে এদিকে আসতেসে।
ভাওয়া ব্যাঙ: সবাই সাবধানে থাকুন, সতর্ক থাকুন। জলবোড়া আর সবুজ ফানস কাছাকাছি কোথাও ঘাপটি মেরে আছে বলে বিশেষ সূত্রে খবর পাওয়া গেছে। অন্ধকার ্লে অ্যাটাক করবে।
পোয়াতি ইলিশ: মানুষরা চর দখল করে তাঁবু ফেলেছে। সঙ্গে এনেছে জগতবেড় বৈতিক ভাসাজাল শ্যাংলাজাল খালুই নৌকা তারিন্দা ধোচনা টেঁটা বিন্তি পলো কত কি। আর কারোর নিস্তার নাই। এবার শুরু হবে অপহরণ খুনখারাপি গণহত্যা সংহার বিনাশ অন্তর্জলি মহাযাত্রা। আমার ডিম পাড়া হয়নি এখনও, সিজারিয়ান করার ট্যাকাও নাই। পাশপুট থাকলে বাংলাস্তানে গিয়া ডিম পাড়তেম; খোকারা খেয়ে সাঁতরে বড়ো হতো। হায় গো হায়।
এই পরিবেশে কী করে সুখী থাকা সম্ভব। ভেবে-ভেবে পটকা চুপসে যাবার যোগাড় শিলাদের। মনীশ মলহোত্রার তৈরি রঙচঙে পোশাকের একজন মাছমডেলকে ওর পছন্দ হয়েছিল। কিন্তু তার যৌনাঙ্গে চুমো দিতে-দিতে চারজন পুংমাছ অষ্টপ্রহর সাঁতরায়, এমনকি ঘুমিয়ে-ঘুমিয়ে। আরেকজন আছে রিতু বেরির নকশাকরা জারদৌসি আঁশে; তার তো বুকপাছার এতো ঠ্যাকার যে চুনোরঙিনদের পাত্তা দেয় না; মালদার কাউকে পাকড়াও করার তালে আছে। যারা পাত্তা পায় না তারা মাছকুমারীটাকে লক্ষ করে ফিচিক-ফিচিক বীর্য ছোঁড়ে।
পূর্ববর্তী:
« জিন্নতুলবিলাদের রূপকথা – ১ম অংশ
« জিন্নতুলবিলাদের রূপকথা – ১ম অংশ
পরবর্তী:
জিন্নতুলবিলাদের রূপকথা – ৩য় অংশ (শেষ) »
জিন্নতুলবিলাদের রূপকথা – ৩য় অংশ (শেষ) »
Leave a Reply