৬১-৭০. ফরিদপুর জেলে ফিরে এলাম

৬১.

ফরিদপুর জেলে ফিরে এলাম। দেখি চন্দ্র বাবু হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন, অবস্থা খুবই খারাপ। তাঁর হার্নিয়ার ব্যারাম ছিল। পেটে চাপ দিয়েছিল, হঠাৎ নাড়ি উল্টে গেছে। ফলে গলা দিয়ে মল পড়তে শুরু করেছে। যে কোন সময় মারা যেতে পারেন। সিভিল সার্জন সাহেব খুব ভাল ডাক্তার। তিনি অপারেশন করতে চাইলেন, কারণ মারা যখন যাবেনই তখন শেষ চেষ্টা করে দেখতে চান। আত্মীয়স্বজন কেউ নাই যে, তার পক্ষ থেকে অনুমতিপত্র লিখে দিবে। চন্দ্র ঘোষ নিজেই লিখে দিতে রাজি হলেন। বললেন, “কেউ যখন নাই তখন আর কি করা যাবে!” সিভিল সার্জন সাহেব বাইরের হাসপাতালে নিতে হুকুম দিলেন। চন্দ্র ঘোষ তাঁকে বললেন, “আমাকে বাইরের হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছেন। আমার তো কেউ নাই। আমি শেখ মুজিবুর রহমানকে একবার দেখতে চাই, সে আমার ভাইয়ের মত। জীবনে তো আর দেখা হবে না।” সিভিল সার্জন এবং জেলের সুপারিনটেনডেন্ট, তাদের নির্দেশে আমাকে জেলগেটে নিয়ে যাওয়া হল। চন্দ্র ঘোেষ স্ট্রেচারে শুয়ে আছেন। দেখে মনে হল, আর বাঁচবেন না, আমাকে দেখে কেঁদে ফেললেন এবং বললেন, “ভাই, এরা আমাকে সাম্প্রদায়িক’ বলে বদনাম দিল; শুধু এই আমার দুঃখ মরার সময়। কোনোদিন হিন্দু মুসলমানকে দুই চোখে দেখি নাই। সকলকে আমায় ক্ষমা করে দিতে বোলো। আর তোমার কাছে আমার অনুরোধ রইল, মানুষকে মানুষ হিসাবে দেখ। মানুষে মানুষে কোন পার্থক্য ভগবানও করেন নাই। আমার তো কেউ নাই, আপন ভেবে তোমাকেই শেষ দেখা দেখে নিলাম। ভগবান তোমার মঙ্গল করুক।” এমনভাবে কথাগুলো বললেন যে সুপারিনটেনডেন্ট, জেলার সাহেব, ডেপুটি জেলার, ডাক্তার ও গোয়েন্দা কর্মচারী সকলের চোখেই পানি এসে গিয়েছিল। আর আমার চোখেও পানি এসে গিয়েছিল। বললাম, “চিন্তা করবেন না, আমি মানুষকে মানুষ হিসাবেই দেখি। রাজনীতিতে আমার কাছে মুসলমান, হিন্দু ও খ্রিষ্টান বলে কিছু নাই। সকলেই মানুষ। আর কথা বলার শক্তি আমার ছিল না। শেষ বারের মত বললাম, “আল্লাহ করলে আপনি ভাল হয়ে যেতে পারেন। তাকে নিয়ে গেল। সিভিল সার্জন সাহেব বললেন, “আশা খুব কম, তবে শেষ চেষ্টা করছি, অপারেশন করে।”

আমরা সকলেই খুব চিন্তায় রইলাম, কি হয়! দুই ঘণ্টা পরে জেল কর্তৃপক্ষ খবর দিল, অপারেশন করা হয়ে গেছে, অবস্থা ভালই মনে হয়। সন্ধ্যায় আবার খবর পেলাম, বাঁচার সম্ভাবনা আছে, তবে এখনও বলা যায় না। রাতটা অনেক উদ্বেগে কাটালাম, সকালবেলা খবর পেলাম তার অবস্থা উন্নতির দিকে। গলা দিয়ে মল আসছে না। আশা করা যায়, এবারকার মত বেঁচে যাবেন। পরের দিন সরকার থেকে খবর এসেছে তাকে মুক্তি দিতে। মুক্তি তিনি পেলেন, তবে কিছুদিন হাসপাতালে থাকতে হবে, যদি বেঁচে যান। বোধহয় পনের দিন হাসপাতালে ছিলেন। আর ভয় নাই, শুধু ঘা এখনও সম্পূর্ণরূপে ভাল হয় নাই। তাঁকে হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেওয়ার সাথে সাথে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট অন্তরীণ আদেশ দিলেন। তার গ্রাম রামদিয়ায় তাকে থাকতে হবে। চন্দ্র ঘোষ জেলা ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের সাথে দেখা করতে গেলে তিনি বললেন, “যদি পাকিস্তানে থাকতে হয়, তবে গ্রামে অন্তরীণ থাকতে হবে। আর যদি চিকিৎসা করতে কলকাতা যেতে চান, আমাদের আপত্তি নাই। যখন আসবেন, পুলিশকে খবর দিতে হবে।”

চন্দ্র বাবু রাজি হলেন এবং জেলগেটে আসলেন, তার সামান্য জিনিস নিতে। আমাকে যাবার পূর্বে খবর দিয়েছিলেন। তার চলে যাওয়াতে সত্যই আমি দুঃখ পেয়েছিলাম। কয়েকদিন পরে ফণি বাবুও যেন কোথায় চলে গেলেন। এখন এই কামরায় আমি একলা পড়লাম; দিনেরবেলায় যদিও দেখা হত অন্যান্য রাজনৈতিক বন্দিদের সাথে। রাতে আমাকে একলাই থাকতে হত। তবে প্রত্যেক রবিবার আমরা এক জায়গায় বসতাম এবং হালকা গল্পগুজব করতাম, যে যা জানে। আমাদের মধ্যে রাজনীতির বেশি আলাপ হত না। কোনো সময় আলোচনা শুরু হলেই তর্ক-বিতর্ক শুরু হত। চারজন ছিলেন একমতাবলম্বী, আমি একা এবং বাবু নেপাল নাহা অন্য মতের। আমাদের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি আলাদা। ডা, মারুফ হোসেন আমাদের খাবার ইনচার্জ ছিলেন। আমরা তাঁকে ম্যানেজার বলতাম। আমাদের কষ্ট হত কারণ যা আমাদের দেওয়া হত, তাতে চলা কষ্টকর ছিল। ফরিদপুর জেলে যথেষ্ট শাক-সবজি হত। তার থেকে কিছু আমাদের মাঝে মাঝে দেওয়া হত।

যাহোক, আরও একবার গোপালগঞ্জ যাই। আমার স্বাস্থ্য খুব খারাপ হয়ে পড়েছিল। হার্ট দুর্বল হয়ে গেছে, চক্ষু যন্ত্রণা বেড়ে গেছে, লেখাপড়া করতে পারছি না। আমার বাম পায়ে একটা রিউম্যাটিকের ব্যথা হয়েছিল। সিভিল সার্জন ও ডাক্তার সাহেব আমাকে খুব ভালভাবে চিকিৎসা করছিলেন, ন্তুি কোনো উন্নতি হচ্ছে না দেখে আমাকে বললেন, “আপনাকে ঢাকা জেলে পাঠিয়ে দিতে চাই। কারণ চোখের ও হার্টের চিকিৎসা এখানে হওয়া সম্ভব নয়। মেডিকেল কলেজে আপনার ভর্তি হয়ে চিকিৎসা করা দরকার।” আমি বললাম, “যা ভাল হয়, তাই আপনারা করবেন। আমি কি বলতে পারি!” লেখালেখি করতে কয়েকদিন সময় লাগল। তারপর আরও কিছুদিন পরে সরকার থেকে হুকুম এল আমাকে ঢাকা জেলে পাঠাতে। ফরিদপুর থেকে ট্রেনে গোয়ালন্দ। গোয়ালন্দ থেকে জাহাজে নারায়ণগঞ্জ আসলাম এবং নারায়ণগঞ্জ থেকে ট্যাক্সিতে করে ঢাকা জেল। জেলগেট থেকে জেল হাসপাতাল।

গোয়ালন্দের জাহাজ তখনও ভাল এবং আরামদায়ক ছিল। সরকার আমাকে ইন্টার ক্লাসে নিয়ে যাওয়ার পাস দিয়েছিলেন। আমি বললাম, “আমি প্রথম ক্লাসে যাব। কারণ, জাহাজে অত্যন্ত ভিড়, আমার ঘুমাতে হবে। আমার টাকা আছে আপনাদের কাছে, সেই টাকা দিয়ে প্রথম শ্রেণীর টিকিট কিনে নেন।” কি করবে? আমার সাথে গোলমাল করে বোধহয় বেশি সুবিধা হবে না। তারা রাজি হলেন। এছাড়াও গরিব সরকারি কর্মচারীরা কখনও চায় নাই আমার কোনো অসুবিধা হোক।

 

৬২.

আমি যখন ঢাকা জেলে আসলাম তখন ১৯৫১ সালের শেষের দিক হবে। প্রায় এক মাস জেল হাসপাতালে রইলাম। আমার মালপত্র সেই পুরানা জায়গায় নিয়ে রাখা হয়েছিল। মওলানা ভাসানী সাহেব পূর্বেই মুক্তি পেয়ে গেছেন। কয়েকদিন পরে খবর পেলাম, বরিশালের মহিউদ্দিন সাহেবকে ঢাকা জেলে নিয়ে আসা হয়েছে, নিরাপত্তা আইনে বন্দি করে। সে কিছুদিন পূর্ব পর্যন্ত জেলা মুসলিম লীগের সম্পাদক ছিল। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় জড়িত থাকার জন্য তাকে নাকি সরকার গ্রেফতার করেছে। ১৯৫১ সালে বরিশালে এক ভয়াবহ দাঙ্গা হয়েছিল। মহিউদ্দিন পাকিস্তান আন্দোলনের ভাল কর্মী ছিল। ছাত্র আন্দোলনে সে আমার বিরুদ্ধ দলে ছিল। আমরা মুসলিম লীগ ত্যাগ করলেও সে ত্যাগ করে নাই। বরিশালে তারই এক সহকর্মী আমার বিশিষ্ট বন্ধু কাজী বাহাউদ্দিন জেলা ছাত্রলীগের নেতা ছিলেন এবং মহিউদ্দিন সাহেবের বিরুদ্ধ দলে ছিলেন। আমি ও আমার সহকর্মীরা মহিউদ্দিনকে ভাল চোখে দেখতাম না। কারণ, তখন পর্যন্ত সে সরকারের অন্ধ সমর্থক ছিল। মহিউদ্দিনের সাথে আলাপ করে দেখলাম, তার অনেক পরিবর্তন হয়েছে। বের হতে পারলে সে আর মুসলিম লীগ করবে না, সেটা আমি বুঝতে পারলাম। সাম্প্রদায়িক রাজনীতি যে পাকিস্তানের জন্য ক্ষতিকর একথাও সে স্বীকার করল।

ঢাকা জেল হাসপাতালে আমার চিকিৎসা হবে না, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠাতে হবে। আমি জানিয়ে দিলাম আমাকে কেবিন দিতে হবে, না হলে আমি যাব না। সরকার কেবিন দিতে রাজি হলেন। আমাকে মেডিকেল কলেজে নিয়ে যাওয়ার বন্দোবস্ত চলছে। আমার ও মহিউদ্দিনের মধ্যে অনেক ভুল বোঝাবুঝি ছিল পূর্বে, এখন দুইজনই বন্দি। আমাদের মধ্যে বন্ধুত্ব গড়ে উঠল। মহিউদ্দিন আমাকে বলল, “তোমার জন্য তো তোমার দল ও ছাত্রলীগ মুক্তি-আন্দোলন করবে। আমার জন্য কেউ করবে না, আমি তো মুসলিম লীগে ছিলাম, আর মুসলিম লীগ সরকারই আমাকে গ্রেফতার করেছে। তুমি তো বোঝ, আমি রাজনৈতিক কর্মী। আমার পক্ষে নিজ হাতে দাঙ্গা করা সম্ভব নয়; আমার নামে মিথ্যা কথা রটাচ্ছে। কারণ, লীগের মধ্যে দুইটা দল হয়ে গেছে। আমি নূরুল আমিন সাহেবের দলের বিরুদ্ধে, তাই তিনি আমাকে নিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার করেছেন।” আরও বলল, “তোমার জন্য শহীদ সাহেব ও ভাসানী সাহেবও আন্দোলন করবেন।” আমি বললাম, “যা হবার হয়ে গেছে, তারা আমার মুক্তি চাইলে তোমার মুক্তিও চাইবেন। সে বন্দোবস্তও আমি করব, তুমি দেখে নিও।”

কয়েকদিন পরেই আমাকে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে আসা হল। চক্ষু দুইটা বেশি যন্ত্রণা দিতেছিল। তাই প্রথমে চোখের চিকিৎসা শুরু করলেন ক্যাপ্টেন লস্কর, চোখের বিখ্যাত ডাক্তার। কিছুদিনের মধ্যে কিছুটা উপকার হল, আরও কিছুদিন লাগবে। ডা. শামসুদ্দিন সাহেব হার্টের চিকিৎসা শুরু করলেন। বিকালে অনেক লোক আসত আমাকে দেখতে। কারণ, বিকাল চারটা থেকে ছয়টা পর্যন্ত যে কেউ হাসপাতালে আসতে পারত। তখন সামান্য কয়েকটা কেবিন ছিল। আমার কেবিনটা ছিল দোতলায় ঠিক সিড়ির কাছে। মেডিকেল কলেজের ছাত্ররা দলে দলে আসত, কেউ কিছু বলতে পারত না। পুলিশরা কেবিনের বাইরে ডিউটি করত। সন্ধ্যার পরে যখন ভিড় কম হত, আমি বাইরে বারান্দায় ঘুরতাম। আমি খুব দুর্বল হয়ে পড়েছিলাম।

ভাসানী সাহেব জেল থেকে বের হয়ে বসে নাই। হক সাহেব কিছুদিন চুপ করে ছিলেন। শহীদ সাহেবও পূর্ব বাংলায় এসেছেন। ভাসানী সাহেবকে নিয়ে তিনি ময়মনসিংহ, কুমিল্লা আরও অনেক জায়গায় সভা করলেন। প্রত্যেক সভায় মুসলিম লীগ গোলমাল করতে চেষ্টা করেছে। ঢাকার সভায় ১৪৪ ধারা জারি করেছিল, তবুও শহীদ সাহেব আরমানিটোলায় গিয়েছিলেন, কারণ অনেক লোক জমেছিল। শহীদ সাহেব সকলকে অনুরোধ করেছিলেন চলে যেতে। কারণ তিনি ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করতে চান না। শহীদ সাহেব ও ভাসানী সাহেব আমার মুক্তির জন্য জোর দাবি তুলেছিলেন। আমি যে অসুস্থ, হাসপাতালে আছি সে কথাও বলতে ভোলেন নাই। শহীদ সাহেব ও আতাউর রহমান সাহেব বিশেষ অনুমতি নিয়ে আমাকে দেখতে আসেন হাসপাতালে। অনেক কথা হল, শহীদ সাহেব আমাকে খুব আদর করলেন। ডাক্তার সাহেবদের ডেকে বললেন, আমার দিকে বিশেষভাবে নজর দিতে। আমি মহিউদ্দিনের কথা তুললাম। শহীদ সাহেব আমার দিকে আশ্চর্য হয়ে চেয়ে রইলেন এবং বললেন, “তুমি বোধহয় জান না, এই মহিউদ্দিনই আমার বিরুদ্ধে লিয়াকত আলী খানের কাছে এক মিথ্যা চিঠি পাঠিয়েছিল যখন বরিশাল যাই, শান্তি মিশনের জন্য সভা করতে ১৯৪৮ সালে। আবার সে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাও করেছে ১৯৫১ সালে।” আমি বললাম, “স্যার মানুষের পরিবর্তন হতে পারে, কমী তো ভাল ছিল, আপনি তো জানেন, এখন জেলে আছে, আমার সাথেই আছে। আমি আপনাকে বলছি আপনি বিশ্বাস করুন, ওর অনেক পরিবর্তন হয়েছে। ভালপথে আনতে পারলে দেশের অনেক কাজ হবে। আমরা উদার হলে তো কোন ক্ষতি নাই। আমার জন্য যখন মুক্তি দাবি করবেন ওর নামটাও একটু নিবেন, সকলকে বলে দিবেন।” শহীদ সাহেব ছিলেন সাগরের মত উদার। যে কোন লোক তার কাছে একবার যেয়ে হাজির হয়েছে, সে যত বড় অন্যায়ই করুক না কেন, তাকে ক্ষমা করে দিয়েছেন।

শওকত সাহেব এবং ছাত্রলীগ কর্মীরা একটা আবেদনপত্র ছাপিয়েছে, ঢাকার বহু গণ্যমান্য ব্যক্তিদের দিয়ে দস্তখত করে আমার মুক্তি দাবি করে। আমি শওকত মিয়াকে বললাম, মেহেরবানি করে মহিউদ্দিনের নামটাও আমার নামের সাথে দিবে। ছাত্রলীগ তো ক্ষেপে অস্থির। ছাত্রলীগ নেতারা পালিয়ে অনেক রাতে আমার সাথে মেডিকেল কলেজে দেখা করতে আসত। অনেকে আবার মেডিকেল কলেজের ছাত্র সেজে আমার সাথে দেখা করতে আসত। আমি অনেককে বুঝিয়ে রাজি করলাম। কিন্তু বরিশালের ছাত্রলীগ নেতারা আমাকে ভুল বুঝল। যদিও আমি মুক্তি পাওয়ার পরে ভুল বোঝাবুঝি দূর করতে পেরেছিলাম।

 

৬৩.

১৯৫১ সালের অক্টোবর মাসে মওলানা ভাসানী ও আমি যখন জেলে, সেই সময় জনাব লিয়াকত আলী খানকে রাওয়ালপিন্ডিতে এক জনসভায় গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল। খাজা নাজিমুদ্দীন সাহেব গভর্নর জেনারেলের পদ ছেড়ে দিয়ে প্রধানমন্ত্রী হলেন এবং গোলাম মোহাম্মদ অর্থমন্ত্রী ছিলেন, তাঁকে গভর্নর জেনারেল করলেন। লিয়াকত আলী খান যে ষড়যন্ত্রের রাজনীতি শুরু করেছিলেন সেই ষড়যন্ত্রেই তাঁকে মরতে হল। কে বা কারা লিয়াকত আলী খানকে হত্যা করার পেছনে ছিল আজ পর্যন্ত তা উদঘাটন হয় নাই। আর হবেও না। এই ষড়যন্ত্রকারীরা যে খুব শক্তিশালী ছিল তা বোঝা যায়। কারণ তারা কোনো চিহ্ন পর্যন্ত রাখে নাই। প্রকাশ্য দিবালোকে জনসমাবেশে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল। কি করে হত্যাকারী অত নিকটে স্থান পেল? কি করে পিস্তল তুলে গুলি করল কেউই দেখতে পেল না কেন? গুলির সাথে সাথে আততায়ীকে গুলি করে হত্যা করার কারণ কি? অনেক প্রশ্নই আমাদের মনে জেগেছিল। যদিও তারই হুকুমে এবং নূরুল আমিন সাহেবের মেহেরবানিতে আমরা জেলে আছি, তবুও তাঁর মৃত্যুতে দুঃখ পেয়েছিলাম। কারণ ষড়যন্ত্রের রাজনীতিতে আমরা বিশ্বাস করি না।

পাকিস্তানে যে ষড়যন্ত্রের রাজনীতি শুরু হয়ে গেছে, তাতেই আমাদের ভয় হল। রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীকে গুলি করে হত্যা করা যে কত বড় জঘন্য কাজ তা ভাষায় প্রকাশ করা কষ্টকর। আমরা যারা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি, তারা এই সমস্ত জঘন্য কাজকে ঘৃণা করি। খাজা নাজিমুদ্দীন সাহেব তার মন্ত্রিত্বে একজন সরকারি আমলাকে গ্রহণ করলেন, তার নাম চৌধুরী মোহাম্মদ আলী। তিনি পাকিস্তান সরকারের সেক্রেটারি জেনারেল ছিলেন। তাঁকে অর্থমন্ত্রী করা হল। এরপর আমলাতন্ত্রের প্রকাশ্য খেলা শুরু হল পাকিস্তানের রাজনীতিতে। একজন সরকারি কর্মচারী হলেন গভর্নর জেনারেল, আরেকজন হলেন অর্থমন্ত্রী। খাজা সাহেব ছিলেন দুর্বল প্রকৃতির লোক। তিনি অনেক গুণের অধিকারী ছিলেন, তবে কর্মক্ষমতা এবং উদ্যোগের অভাব ছিল। ফলে আমলাতন্ত্র মাথা তুলে দাঁড়াল। বিশেষ করে যখন তাদেরই একজনকে অর্থমন্ত্রী করা হল, অনেকের মনে গোপনে গোপনে উচ্চাশারও সঞ্চার হল। আমলাতন্ত্রের জোটের কাছে রাজনীতিবিদরা পরাজিত হতে শুরু করল। রাজনীতিকদের মধ্যে তখন এমন কোনো ব্যক্তিত্বসম্পন্ন নেতা মুসলিম লীগে ছিল না, যারা এই ষড়যন্ত্রকারী আমলাতন্ত্রকে দাবিয়ে রাখতে পারে। নাজিমুদ্দীন সাহেব গণতন্ত্রের মূলে কুঠারাঘাত করলেন। কারণ জাতীয় পরিষদের সদস্য নন, একজন সরকারি কর্মচারী, তাকে চাকরি থেকে পদত্যাগ করিয়ে মন্ত্রিত্ব দেওয়ার কি অর্ধ থাকতে পারে? আমাদের মনে হল একটা বিশেষ প্রদেশের চাপে পড়েই তাকে একাজ করতে হয়েছিল। তিনি প্রধানমন্ত্রী হলেও দুইটা গ্রুপ তার ক্যাবিনেটে কাজ করছিল। একটা গ্রুপ পাঞ্জাবিদের আর একটা গ্রুপ বাঙালিদের। পাকিস্তানের অন্যান্য প্রদেশের নেতারা বাঙালি গ্রুপকে তলে তলে সাহায্য করছিল। খাজা সাহেব বিরাট ভুল করে বসলেন।

প্রধানমন্ত্রী হয়ে কিছুদিন পরে তিনি পূর্ব বাংলায় আসেন। প্রথমবারে তিনি কিছুই বলেন নাই। কিছুদিন পরে, বোধহয় ১৯৫১ সালের শেষের দিকে অথবা ১৯৫২ সালের জানুয়ারি মাসে পল্টন ময়দানে এক জনসভায় তিনি বক্তৃতা করলেন। সেখানে ঘোষণা করলেন, “উর্দুই পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে।“ তিনি ১৯৪৮ সালে পূর্ব বাংলার প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে যে ওয়াদা করেছিলেন, সে ওয়াদার খেলাপ করলেন। ১৯৪৮ সালের রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সাথে চুক্তি করেছিলেন এবং নিজেই পূর্ব বাংলা আইনসভায় প্রস্তাব পেশ করেছিলেন যে, পূর্ব বাংলার অফিসিয়াল ভাষা বাংলা হবে। তাছাড়া যাতে বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করা হয়, তার জন্য কেন্দ্রীয় আইনসভায় কেন্দ্রীয় সরকারকে অনুরোধ করা হবে। এ প্রস্তাব পূর্ব বাংলার আইনসভায় সর্বসম্মতিক্রমে পাস হয়। যে ঢাকায় বসে তিনি ওয়াদা করেছিলেন সেই ঢাকায় বসেই উল্টা বললেন। দেশের মধ্যে ভীষণ ক্ষোভের সৃষ্টি হল। তখন একমাত্র রাজনৈতিক দল পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ, ছাত্র প্রতিষ্ঠান ছাত্রলীগ এবং যুবাদের প্রতিষ্ঠান যুবলীগ সকলেই এর তীব্র প্রতিবাদ করে।

আমি হাসপাতালে আছি। সন্ধ্যায় মোহাম্মদ তোয়াহা ও অলি আহাদ দেখা করতে আসে। আমার কেবিনের একটা জানালা ছিল ওয়ার্ডের দিকে। আমি ওদের রাত একটার পরে আসতে বললাম। আরও বললাম, খালেক নেওয়াজ, কাজী গোলাম মাহাবুব আরও কয়েকজন ছাত্রলীগ নেতাকে খবর দিতে। দরজার বাইরে আইবিরা পাহারা দিত। রাতে অনেকে ঘুমিয়ে পড়েছে। তখন পিছনের বারান্দায় ওরা পাঁচ-সাতজন এসেছে। আমি অনেক রাতে একা হাঁটাচলা করতাম। রাতে কেউ আসে না বলে কেউ কিছু বলত না। পুলিশ চুপচাপ পড়ে থাকে, কারণ জানে আমি ভাগব না। গোয়েন্দা কর্মচারী একপাশে বসে ঝিমায়। বারান্দায় বসে আলাপ হল এবং আমি বললাম, সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠন করতে। আওয়ামী লীগ নেতাদেরও খবর দিয়েছি। ছাত্রলীগই তখন ছাত্রদের মধ্যে একমাত্র জনপ্রিয় প্রতিষ্ঠান। ছাত্রলীগ নেতারা রাজি হল। অলি আহাদ ও তোয়াহা বলল, যুবলীগও রাজি হবে। আবার ষড়যন্ত্র চলছে বাংলা ভাষার দাবিকে নস্যাৎ করার। এখন প্রতিবাদ না করলে কেন্দ্রীয় আইনসভায় মুসলিম লীগ উর্দুর পক্ষে প্রস্তাব পাস করে নেবে। নাজিমুদ্দীন সাহেব উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার কথাই বলেন নাই, অনেক নতুন নতুন যুক্তিতর্ক দেখিয়েছেন। অলি আহাদ যদিও আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের সদস্য হয় নাই, তবুও আমাকে ব্যক্তিগতভাবে খুবই শ্রদ্ধা করত ও ভালবাসত। আরও বললাম, “খবর পেয়েছি, আমাকে শীঘ্রই আবার জেলে পাঠিয়ে দিবে, কারণ আমি নাকি হাসপাতালে বসে রাজনীতি করছি। তোমরা আগামীকাল রাতেও আবার এস।” আরও দু’একজন ছাত্রলীগ নেতাকে আসতে বললাম। শওকত মিয়া ও কয়েকজন আওয়ামী লীগ কর্মীকেও দেখা করতে বললাম। পরের দিন রাতে এক এক করে অনেকেই আসল। সেখানেই ঠিক হল আগামী ২১শে ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা দিবস পালন করা হবে এবং সভা করে সংগ্রাম পরিষদ গঠন করতে হবে। ছাত্রলীগের পক্ষ থেকেই রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের কনভেনর করতে হবে। ফেব্রুয়ারি থেকেই জনমত সৃষ্টি করা শুরু হবে। আমি আরও বললাম, “আমিও আমার মুক্তির দাবি করে ১৬ই ফেব্রুয়ারি থেকে অনশন ধর্মঘট শুরু করব। আমার ছাব্বিশ মাস জেল হয়ে গেছে। আমি একথাও বলেছিলাম, “মহিউদ্দিন জেলে আছে, আমার কাছে থাকে। যদি সে অনশন করতে রাজি হয়, তবে খবর দেব। তার নামটাও আমার নামের সাথে দিয়ে দিবে। আমাদের অনশনের নোটিশ দেওয়ার পরই শওকত মিয়া প্যামপ্লেট ও পোস্টার ছাপিয়ে বিলি করার বন্দোবস্ত করবে।”

দুই দিন পরেই দেখলাম একটা মেডিকেল বোের্ড গঠন করে আমাকে এক্সজামিন করতে এসেছে। তারা মত দিলেন আমি অনেকটা সুস্থ, এখন কারাগারে বসেই আমার চিকিৎসা হতে পারে। সরকার আমাকে ঢাকা জেলে পাঠিয়ে দিলেন, ভালভাবে চিকিৎসা না করে। আমি জেলে এসেই মহিউদ্দিনকে সকল কথা বললাম। মহিউদ্দিনও রাজি হল অনশন ধর্মঘট করতে। আমরা দুইজনে সরকারের কাছে পহেলা ফেব্রুয়ারি দরখাস্ত পাঠালাম। যদি ১৫ই ফেব্রুয়ারির মধ্যে আমাদের মুক্তি দেওয়া না হয় তাহা হলে ১৬ই ফেব্রুয়ারি থেকে অনশন ধর্মঘট করতে শুরু করব। দুইখানা দরখাস্ত দিলাম। আমাকে যখন জেল কর্তৃপক্ষ অনুরোধ করল অনশন ধর্মঘট না করতে তখন আমি বলেছিলাম, ছাব্বিশ-সাতাশ মাস বিনাবিচারে বন্দি রেখেছেন। কোনো অন্যায়ও করি নাই। ঠিক করেছি জেলের বাইরে যাব, হয় আমি জ্যান্ত অবস্থায় না হয় মৃত অবস্থায় যাব। “Either I will go out of the jail or my deadbody will go out.” তারা সরকারকে জানিয়ে দিল। বাহিরে খবর দিয়েই এসেছিলাম এই তারিখে দরখাস্ত করব। বাইরে সমস্ত জেলায় ছাত্রলীগ কর্মীদের ও যেখানে যেখানে আওয়ামী লীগ ছিল সেখানে খবর পাঠিয়ে দিয়েছিল। সামান্য কয়েকটা জেলা ছাড়া আওয়ামী লীগ তখনও গড়ে ওঠে নাই। তবে সমস্ত জেলায়ই আমার ব্যক্তিগত বন্ধু ও সহকর্মী ছিল। এদিকে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদও গঠন করা হয়েছে। একুশে ফেব্রুয়ারি দিনও ধার্য করা হয়েছে। কারণ, ঐদিনই পূর্ব বাংলার আইনসভা বসবে। কাজী গোলাম মাহাবুবকে সংগ্রাম পরিষদের কনভেনর করা হয়েছিল। ১৯৪৮ সালে ছাত্ররাই এককভাবে বাংলা ভাষার দাবির জন্য সংগ্রাম করেছিল। এবার আমার বিশ্বাস ছিল, জনগণ এগিয়ে আসবে। কারণ জনগণ বুঝতে শুরু করেছে যে, বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা না করতে পারলে তাদের দাসত্বের শৃথল আবার পরতে হবে। মাতৃভাষার অপমান কোনো জাতি সহ্য করতে পারে না। পাকিস্তানের জনগণের শতকরা ছাপ্পান্নজন বাংলা ভাষাভাষী হয়েও শুধুমাত্র বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা বাঙালিরা করতে চায় নাই। তারা চেয়েছে বাংলার সাথে উর্দুকেও রাষ্ট্রভাষা করা হোক, তাতে আপত্তি নাই। কিন্তু বাঙালির এই উদারতাটাই অনেকে দুর্বলতা হিসাবে গ্রহণ করে নিয়েছে। এদিকে বাঙালিরা অনুভব করতে শুরু করেছে যে, তাদের উপর অর্থনৈতিক দিক দিয়ে, ব্যবসা-বাণিজ্য, সরকারি চাকরিতেও অবিচার চলছে। পশ্চিম পাকিস্তানের করাচিতে রাজধানী হওয়াতে বাঙালিরা সুযোগ-সুবিধা হতে বঞ্চিত হতে শুরু করেছে। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবি এবং শেষ পর্যন্ত সর্বদলীয় গ্রান্ড ন্যাশনাল কনভেনশনে স্বায়ত্তশাসনের দাবি করায় বাঙালিদের মনোভাব ফুটে উঠেছে। পূর্ব বাংলার মুসলিম লীগ নেতারা যতই জনগণের কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছিলেন ততই পশ্চিম পাকিস্তানের কোটারি ও আমলাতন্ত্রের উপর নির্ভর করতে শুরু করেছেন ক্ষমতায় থাকার জন্য। খাজা নাজিমুদ্দীন ও জনাব নূরুল আমিন জনগণকে ভয় করতে শুরু করেছেন। সেইজন্য টাঙ্গাইল উপনির্বাচনে পরাজিত হওয়ার পরে অনেকগুলি আইনসভার সদস্যের পদ খালি হওয়া সত্ত্বেও উপনির্বাচন দিতে সাহস পাচ্ছিলেন না।

জনগণের আস্থা হারাতে শুরু করেছিল বলে আমলাতন্ত্রের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিল মুসলিম লীগ নেতারা। তখন পূর্ব বাংলার চিফ সেক্রেটারি ছিলেন জনাব আজিজ আহমদ (পুরানা আইসিএস)। তিনি বুদ্ধিমান এবং বিচক্ষণ ছিলেন, কাজকর্ম খুব ভাল বুঝতেন। কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিনিধি হিসাবেই কাজ করতেন। হামিদুল হক চৌধুরী সাহেবের বিরুদ্ধে পোডডা মামলায় সাক্ষী হিসাবে তিনি স্বীকার করেছিলেন, তিনি মন্ত্রীদের কাজকর্ম সম্বন্ধে ফাইল রাখতেন এবং কেন্দ্রীয় সরকারকে সে ব্যাপারে খবর দিতেন। হামিদুল হক চৌধুরী সাহেব মন্ত্রিত্ব ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন, কিন্তু তাঁর সহকর্মীরা ক্ষমতায় ছিলেন। তাঁরা সাহস পেলেন না কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করতে। আজিজ আহমদের ব্যক্তিত্বের সামনে অনেকে কথা বলতেও সাহস পেতেন না। মুসলিম লীগ সরকার জনমত যাতে তাদের দিকে থাকে তার চেষ্টা না করে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল আওয়ামী লীগ এবং বিরুদ্ধ মতবাদের কর্মী ও নেতাদের উপর। যে কোন অজুহাতে নিরাপত্তা আইন ব্যবহার করতে শুরু করেছিল।

 

৬৪.

এদিকে জেলের ভেতর আমরা দুইজনে প্রস্তুত হচ্ছিলাম অনশন ধর্মঘট করার জন্য। আমরা আলোচনা করে ঠিক করেছি, যাই হোক না কেন, আমরা অনশন ভাঙব না। যদি এই পথেই মৃত্যু এসে থাকে তবে তাই হবে। জেল কর্তৃপক্ষ বিশেষ করে সুপারিনটেনডেন্ট আমীর হোসেন সাহেব ও তখনকার দিনে রাজবন্দিদের ডেপুটি জেলার মোখলেসুর রহমান সাহেব আমাদের বুঝতে অনেক চেষ্টা করলেন। আমরা তাদের বললাম, আপনাদের বিরুদ্ধে আমাদের বলবার কিছু নাই। আর আমরা সেজন্য অনশন করছি না। সরকার আমাদের বৎসরের পর বৎসর বিনা বিচারে আটক রাখছে, তারই প্রতিবাদ করার জন্য অনশন ধর্মঘট করছি। এতদিন জেল খাটলাম, আপনাদের সাথে আমাদের মনোমালিন্য হয় নাই। কারণ আমরা জানি যে, সরকারের হুকুমেই আপনাদের চলতে হয়। মোখলেসুর রহমান সাহেব খুবই অমায়িক, ভদ্র ও শিক্ষিত ছিলেন। তিনি খুব লেখাপড়া করতেন।

১৫ ফেব্রুয়ারি তারিখে সকালবেলা আমাকে জেলগেটে নিয়ে যাওয়া হল এই কথা বলে যে, আমার সাথে আলোচনা আছে অনশন ধর্মঘটের ব্যাপার নিয়ে। আমি যখন জেলগেটে পৌঁছালাম দেখি, একটু পরেই মহিউদ্দিনকেও নিয়ে আসা হয়েছে একই কথা বলে। কয়েক মিনিট পরে আমার মালপত্র, কাপড়চোপড় ও বিছানা নিয়ে জমাদার সাহেব হাজির। বললাম, ব্যাপার কি? কর্তৃপক্ষ বললেন, আপনাদের অন্য জেলে পাঠানোর হুকুম হয়েছে। জিজ্ঞাসা করলাম, কোন জেলে? কেউ কিছু বলেন না। এদিকে আর্মড পুলিশ, আইবি অফিসারও প্রস্তুত হয়ে এসেছে। খবর চাপা থাকে না। একজন আমাকে বলে দিল, ফরিদপুর জেলে। দুইজনকেই এক জেলে পাঠানো হচ্ছে। তখন নয়টা বেজে গেছে। এগারটায় নারায়ণগঞ্জ থেকে জাহাজ ছাড়ে, সেই জাহাজ আমাদেরকে ধরতে হবে। আমি দেরি করতে শুরু করলাম, কারণ তা না হলে কেউই জানবে না আমাদের কোথায় পাঠাচ্ছে! প্রথমে আমার বইগুলি এক এক করে মেলাতে শুরু করলাম, তারপর কাপড়গুলি। হিসাব-নিকাশ, কত টাকা খরচ হয়েছে, কত টাকা আছে। দেরি করতে করতে দশটা বাজিয়ে দিলাম। রওয়ানা করতে আরও আধা ঘণ্টা লাগিয়ে দিলাম। আর্মড পুলিশের সুবেদার ও গোয়েন্দা কর্মচারীরা তাড়াতাড়ি করছিল। সুবেদার পাকিস্তান হওয়ার সময় গোপালগতে ছিল এবং সে একজন বেলুচি ভদ্রলোক। আমাকে খুবই ভালবাসত এবং শ্রদ্ধা করত। আমাকে পাকিস্তানের পক্ষে কাজ করতে দেখেছে। আমাকে দেখেই বলে বসল, ইয়ে কেয়া বাত হ্যায়, আপ জেলখানা মে।” আমি বললাম, “কিসমত”। আর কিছুই বললাম না। আমাদের জন্য বন্ধ ঘোড়ার গাড়ি আনা হয়েছে। গাড়ির ভিতর জানালা উঠিয়ে ও দরজার কপাট বন্ধ করে দিল। দুইজন ভিতরেই আমাদের সাথে বসল। আর একটা গাড়িতে অন্যরা পিছনে পিছনে ভিক্টোরিয়া পার্কের পাশে রোডের দিকে চলল। সেখানে যেয়ে দেখি পূর্বেই একজন আর্মড পুলিশ ট্যাক্সি রিজার্ভ করে দাঁড়িয়ে আছে। তখন ট্যাক্সি পাওয়া খুবই কষ্টকর ছিল। আমরা আস্তে আস্তে নামলাম ও উঠলাম। কোন চেনা লোকের সাথে দেখা হল না। যদিও এদিক ওদিক অনেকবার তাকিয়ে ছিলাম। ট্যাক্সি তাড়াতাড়ি চালাতে বলল। আমি ট্যাক্সিওয়ালাকে বললাম, “বেশি জোরে চালাবেন না, কারণ বাবার কালের জীবনটা যেন রাস্তায় না যায়।”

আমরা পৌঁছে খবর পেলাম জাহাজ ছেড়ে চলে গেছে। এখন উপায়? কোথায় আমাদের নিয়ে যাবে? রাত একটায় আর একটা জাহাজ ছাড়বে। আমাদের নারায়ণগঞ্জ থানায় নিয়ে যাওয়া হল। ওপরওলাদের টেলিফোন করল এবং হুকুম নিল থানায়ই রাখতে। আমাদের পুলিশ ব্যারাকের একটা ঘরে নিয়ে যাওয়া হল। একজন চেনা লোককে থানায় দেখলাম, তাকে বললাম, শামসুজ্জোহাকে খবর দিতে। খান সাহেব ওসমান আলী সাহেবের বাড়ি সকলেই চিনে। এক ঘণ্টার মধ্যে জোহা সাহেব, বজলুর রহমান ও আরও অনেকে থানায় এসে হাজির। আমাদের জন্য খাবার নিয়ে এসেছে। পরে আলমাস আলীও আমাদের দেখতে এসেছিল। আমি ওদের বললাম, “রাতে হোটেলে খেতে যাব। কোন হোটেলে যাব বলে যান। আপনারা পূর্বেই সেই হোটেলে বসে থাকবেন! আলাপ আছে। আমাদের কেন বদলি করেছে, ঢাকা জেল থেকে ফরিদপুর জেলে, এর মধ্যেই বলে দিলাম। বেশি সময় তাদের থাকতে দিল না থানায়। হোটেলের নাম বলে বিদায় নিল। আমি বললাম, “রাত আটটা থেকে সাড়ে আটটায় আমরা পৌঁছাব।” নতুন একটা হোটেল হয়েছে ঢাকানারায়ণগঞ্জ রোডের উপরে, হোটেলটা দোতালা।

আমি সুবেদার সাহেবকে বললাম যে, “আমাদের খাওয়া-দাওয়া দরকার, চলুন, হোটেলে খাই। সেখান থেকে জাহাজঘাটে চলে যাব।” সে রাজি হল। আমার কথা ফেলবে না এ বিশ্বাস আমার ছিল। আর আমাদের তো খাওয়াতে হবে। একজন সিপাহি দিয়ে মালপত্র স্টেশনে পাঠিয়ে দিল আর আমরা যথাসময়ে হোটেলে পৌঁছালাম। দোতালায় একটা ঘরে বসার ব্যবস্থা ছিল। সেখানে আমাদের বাবার বন্দোবস্ত করে রেখেছে। আমরা বসে পড়লাম। আট-দশজন কর্মী নিয়ে জোহা সাহেব বসে আছেন। আমরা আস্তে আস্তে খাওয়া-দাওয়া করলাম, আলাপ-আলোচনা করলাম। ভাসানী সাহেব, হক সাহেব ও অন্যান্য নেতাদের খবর দিতে বললাম। খবরের কাগজে যদি দিতে পারে চেষ্টা করবে। বললাম, সাপ্তাহিক ইত্তেফাক তো আছেই। আমরা যে আগামীকাল থেকে আমরণ অনশন শুরু করব, সেকথাও তাদের বললাম, যদিও তারা পূর্বেই খবর পেয়েছিল। নারায়ণগঞ্জের কর্মীদের ত্যাগ ও তিতিক্ষার কথা কোনো রাজনৈতিক কর্মী ভুলতে পারে না। তারা আমাকে বলল, “২১শে ফেব্রুয়ারি তারিখে নারায়ণগঞ্জে পূর্ণ হরতাল হবে। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবি তো আছেই, আপনাদের মুক্তির দাবিও আমরা করব।” এখানেও আমাকে নেতারা প্রশ্ন করল, “মহিউদ্দিনকে বিশ্বাস করা যায় কি না। আবার বাইরে এসে মুসলিম লীগ করবে না তো?” আমি বললাম, “আমাদের কাজ আমরা করি, তার কর্তব্য সে করবে। তবে মুসলিম লীগ করবে না। সে সম্বন্ধে কোন সন্দেহ নাই। সে বন্দি, তার মুক্তি চাইতে আপত্তি কি! মানুষকে ব্যবহার, ভালবাসা ও প্রীতি দিয়েই জয় করা যায়, অত্যাচার, জুলুম ও ঘৃণা দিয়ে জয় করা যায় না।”

রাত এগারটায় আমরা স্টেশনে আসলাম। জাহাজ ঘাটেই ছিল, আমরা উঠে পড়লাম। জাহাজ না ছাড়া পর্যন্ত সহকর্মীরা অপেক্ষা করল। রাত একটার সময় সকলের কাছ থেকে বিদায় নিলাম। বললাম, “জীবনে আর দেখা না হতেও পারে। সকলে যেন আমাকে ক্ষমা করে দেয়। দুঃখ আমার নাই। একদিন মরতেই হবে, অন্যায় ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে যদি মরতে পারি, সে মরাতেও শান্তি আছে।”

জাহাজ ছেড়ে দিল, আমরা বিছানা করে শুয়ে পড়লাম। সকালে দুইজনে পরামর্শ করে ঠিক করলাম, জাহাজে অনশন করি কি করে? আমাদের জেলে নিতে হবে অনশন শুরু করার পূর্বে। সমস্ত দিন জাহাজ চলল, রাতে গোয়ালন্দ ঘাটে এলাম। সেখান থেকে ট্রেনে রাত চারটায় ফরিদপুর পৌঁছালাম। রাতে আমাদের জেল কর্তৃপক্ষ গ্রহণ করল না। আমরা দুইজনে জেল সিপাহিদের ব্যারাকের বারান্দায় কাটালাম। সকালবেলা সুবেদার সাহেবকে বললাম, “জেল অফিসাররা না আসলে তো আমাদের জেলে নিবে না, চলেন কিছু নাশতা করে আসি।” নাশতা খাবার ইচ্ছা আমাদের নাই। তবে যদি কারও সাথে দেখা হয়ে যায়, তাহলে ফরিদপুরের সহকর্মীরা জানতে পারবে, আমরা ফরিদপুর জেলে আছি এবং অনশন ধর্মঘট করছি। আধা ঘণ্টা দেরি করলাম, কাউকেও দেখি না—চায়ের দোকানের মালিক এসেছে, তাকে আমি আমার নাম বললাম এবং খবর দিতে বললাম আমার সহকর্মীদের। আমরা জেলের দিকে রওয়ানা করছি, এমন সময় আওয়ামী লীগের এক কর্মী, তার নামও মহিউদ্দিন—সকলে মহি বলে ডাকে, তার সঙ্গে দেখা। আমি যখন ফরিদপুরে ১৯৪৬ সালের ইলেকশনে ওয়ার্কার ইনচার্জ ছিলাম, তখন আমার সাথে সাথে কাজ করেছে। মহি সাইকেলে যাচ্ছিল, আমি তাকে দেখে ডাক দিলাম নাম ধরে, সে সাইকেল থেকে আমাকে দেখে এগিয়ে আসল। আইবি নিষেধ করছিল। আমি শুনলাম না, তাকে এক ধমক দিলাম এবং মহিকে বললাম, আমাদের ফরিদপুর জেলে এনেছে এবং আজ থেকে অনশন করছি সকলকে এখবর দিতে। আমরা জেলগেটে চলে আসলাম, মহিও সাথে সাথে আসল।

 

৬৫.

আমরা জেলগেটে এসে দেখি, জেলার সাহেব, ডেপুটি জেলার সাহেব এসে গেছেন। আমাদের তাড়াতাড়ি ভিতরে নিয়ে যেতে বললেন। তারা পূর্বেই খবর পেয়েছিলেন। জায়গাও ঠিক করে রেখেছেন, তবে রাজবন্দিদের সাথে নয়, অন্য জায়গায়। আমরা তাড়াতাড়ি ঔষধ খেলাম পেট পরিষ্কার করবার জন্য। তারপর অনশন ধর্মঘট শুরু করলাম। দুই দিন পর অবস্থা খারাপ হলে আমাদের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হল। আমাদের দুইজনেরই শরীর খারাপ। মহিউদ্দিন ভুগছে পরিসিস রোগে, আর আমি ভুগছি নানা রোগে। চার দিন পরে আমাদের নাক দিয়ে জোর করে খাওয়াতে শুরু করল। মহাবিপদ! নাকের ভিতর নল দিয়ে পেটের মধ্যে পর্যন্ত দেয়। তারপর নলের মুখে একটা কাপের মত লাগিয়ে দেয়। একটা ছিদ্রও থাকে। সে কাপের মধ্যে দুধের মত পাতলা করে খাবার তৈরি করে পেটের ভিতর ঢেলে দেয়। এদের কথা হল, মরতে দেব না।

আমার নাকে একটা ব্যারাম ছিল। দুই তিনবার দেবার পরেই ঘা হয়ে গেছে। রক্ত আসে আর যন্ত্রণা পাই। আমরা আপত্তি করতে লাগলাম। জেল কর্তৃপক্ষ শুনছে না। খুবই কষ্ট হচ্ছে। আমার দুইটা নাকের ভিতরই ঘা হয়ে গেছে। তারা হ্যান্ডকাপ পরানোর লোকজন নিয়ে আসে। বাধা দিলে হ্যান্ডকাপ পরিয়ে জোর করে ধরে খাওয়াবে। আমাদের শরীরও খুব দুর্বল হয়ে পড়েছে। পাঁচ-ছয় দিন পরে বিছানা থেকে ওঠার শক্তি হারিয়ে ফেলেছি। আমরা ইচ্ছা করে কাগজি লেবুর রস দিয়ে লবণ পানি খেতাম। কারণ এর মধ্যে কোনো ফুড ভ্যালু নাই। আমাদের ওজনও কমতে ছিল। নাকের মধ্য দিয়ে নল দিয়ে খাওয়ার সময় নলটা একটু এদিক ওদিক হলেই আর উপায় থাকবে না। সিভিল সার্জন সাহেব, ডাক্তার সাহেব ও জেল কর্তৃপক্ষ আমাদের কোনো অসুবিধা না হয়, তার চেষ্টা করছিলেন। বার বার সিভিল সার্জন সাহেব অনশন করতে নিষেধ করছিলেন। আমার ও মহিউদ্দিনের শরীর অতিশয় দুর্বল হয়ে পড়েছে। এখন আর বিছানা থেকে উঠবার শক্তি নাই। আমার হার্টের অবস্থা খারাপ হয়ে পড়েছে বুঝতে পারলাম। প্যালপিটিশন হয় ভীষণভাবে। নিঃশ্বাস ফেলতে কষ্ট হয়। ভাবলাম আর বেশি দিন নাই। একজন কয়েদিকে দিয়ে গোপনে কয়েক টুকরা কাগজ আনালাম। যদিও হাত কাঁপে তথাপি ছোট ছোট করে চারটা চিঠি লিখলাম। আব্বার কাছে একটা, রেণুর কাছে একটা, আর দুইটা শহীদ সাহেব ও ভাসানী সাহেবের কাছে। দু’একদিন পরে আর লেখার শক্তি থাকবে না।

২১শে ফেব্রুয়ারি আমরা উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা নিয়ে দিন কাটালাম, রাতে সিপাহিরা ডিউটিতে এসে খবর দিল, ঢাকায় ভীষণ গোলমাল হয়েছে। কয়েকজন লোক গুলি খেয়ে মারা গেছে। রেডিওর খবর। ফরিদপুরে হরতাল হয়েছে, ছাত্র-ছাত্রীরা শোভাযাত্রা করে জেলগেটে এসেছিল। তারা বিভিন্ন শ্লোগান দিচ্ছিল, ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’, ‘বাঙালিদের শোষণ করা চলবে না’, ‘শেখ মুজিবের মুক্তি চাই’, রাজবন্দিদের মুক্তি চাই’, আরও অনেক স্লোগান। আমার খুব খারাপ লাগল। কারণ, ফরিদপুর আমার জেলা, মহিউদ্দিনের নামে কোনো স্লোগান দিচ্ছে না কেন? শুধু ‘রাজবন্দিদের মুক্তি চাই’, বললেই তো হত। রাতে যখন ঢাকার খবর পেলাম তখন ভীষণ চিন্তাযুক্ত হয়ে পড়লাম। কত লোক মারা গেছে বলা কষ্টকর। তবে অনেক লোক গুলি খেয়ে মারা গেছে শুনেছি। দু’জনে পাশাপাশি বিছানায় শুয়ে আছি। ডাক্তার সাহেব আমাদের নড়াচড়া করতে নিষেধ করেছেন। কিন্তু উত্তেজনায় উঠে বসলাম। দুইজন কয়েদি ছিল আমাদের পাহারা দেবার এবং কাজকর্ম করে দেবার জন্য। তাড়াতাড়ি আমাদের ধরে শুইয়ে দিল। খুব খারাপ লাগছিল, মনে হচ্ছিল চিন্তাশক্তি হারিয়ে ফেলেছি। গুলি করার তো কোন দরকার ছিল না। হরতাল করবে, সভা ও শোভাযাত্রা করবে, কেউ তো বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে চায় না। কোনো গোলমাল সৃষ্টি করার কথা তো কেউ চিন্তা করে। নাই। ১৪৪ ধারা দিলেই গোলমাল হয়, না দিলে গোলমাল হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে। অনেক রাতে একজন সিপাহি এসে বলল, ছাত্র মারা গেছে অনেক। বহু লোক গ্রেফতার হয়েছে। রাতে আর কোন খবর নাই। ঘুম তো এমনিই হয় না, তারপর আবার এই খবর। পরের দিন নয়-দশটার সময় বিরাট শোভাযাত্রা বের হয়েছে, বড় রাস্তার কাছেই জেল। শোভাযাত্রীদের স্লোগান পরিষ্কার শুনতে পেতাম, হাসপাতালের দোতলা থেকে দেখাও যায়, কিন্তু আমরা নিচের তলায়। হর্ন দিয়ে একজন বক্তৃতা করছে। আমাদের জানাবার জন্যই হবে। কি হয়েছে ঢাকায় আমরা কিছু কিছু বুঝতে পারলাম। জেল কর্তৃপক্ষ আমাদের কোনো খবর দিতে চায় না। আমরা যেন কোন খবর না পাই, আর কোনো খবর না দিতে পারি বাইরে, এই তাদের চেষ্টা। খবরের কাগজ তো একদিন পরে আসবে, ঢাকা থেকে।

২২ তারিখে সারা দিন ফরিদপুরে শোভাযাত্রা চলল। কয়েকজন ছাত্র-ছাত্রী এক জায়গায় হলেই শ্লোগান দেয়। ছোট্ট ছোট্ট ছেলেমেয়েরা রাস্তায় বেড়ায় আর স্লোগান দেয়। ২২ তারিখে খবরের কাগজ এল, কিছু কিছু খবর পেলাম। মুসলিম লীগ সরকার কত বড় অপরিণামদর্শিতার কাজ করল। মাতৃভাষা আন্দোলনে পৃথিবীতে এই প্রথম বাঙালিরাই রক্ত দিল। দুনিয়ার কোথাও ভাষা আন্দোলন করার জন্য গুলি করে হত্যা করা হয় নাই। জনাব নূরুল আমিন বুঝতে পারলেন না, আমলাতন্ত্র তাকে কোথায় নিয়ে গেল। গুলি হল মেডিকেল কলেজ হোস্টেলের এরিয়ার ভেতরে, রাস্তায়ও নয়। ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করলেও গুলি না করে গ্রেফতার করলেই তো চলত। আমি ভাবলাম, দেখব কি না জানি না, তবে রক্ত যখন আমাদের ছেলেরা দিয়েছে তখন বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা না করে আর উপায় নাই। মানুষের যখন পতন আসে তখন পদে পদে ভুল হতে থাকে। বাংলাদেশের মুসলিম লীগ নেতারা বুঝলেন না, কে বা কারা খাজা সাহেবকে উর্দুর কথা বললেন, আর কেনই বা তিনি বললেন! তারা তো জানতেন, উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার কথা বলে মিস্টার জিন্নাহর মত নেতাও বাধা না পেয়ে ফিরে যেতে পারেন নাই। সেখানে খাজা সাহেব এবং তার দলবলের অবস্থা কি হবে? একটা বিশেষ গোষ্ঠী—যাঁরা ষড়যন্ত্রের রাজনীতি করতে শুরু করেছেন, তাঁরাই তাঁকে জনগণ থেকে যাতে দূরে সরে পড়েন তার বন্দোবস্ত করলেন। সাথে সাথে তার সমর্থক নূরুল আমিন সাহেবও যাতে জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যান সে ব্যবস্থাও করালেন। কারণ ভবিষ্যতে এই বিশেষ গোষ্ঠী কোনো একটা গভীর ষড়যন্ত্রের প্রস্তুতি গ্রহণ করছে। যদিও খাজা সাহেবের জনসমর্থন কোনোদিন বাংলাদেশে ছিল না।

খবরের কাগজে দেখলাম, মওলানা আবদুর রশিদ তর্কবাগীশ এমএলএ, খয়রাত হোসেন এমএলএ, খান সাহেব ওসমান আলী এমএলএ এবং মোহাম্মদ আবুল হোসেন ও খোন্দকার মোশতাক আহমদসহ শত শত ছাত্র ও কর্মীকে গ্রেফতার করেছে। দু’একদিন পরে দেখলাম কয়েকজন প্রফেসর, মওলানা ভাসানী, শামসুল হক সাহেব ও বহু আওয়ামী লীগ নেতা ও কর্মীকে গ্রেফতার করেছে। নারায়ণগঞ্জে খানসাহেব ওসমান আলীর বাড়ির ভিতরে ঢুকে ভীষণ মারপিট করেছে। বৃদ্ধ খান সাহেব ও তার ছেলেমেয়েদের উপর অকথ্য অত্যাচার হয়েছে। সমস্ত ঢাকায় ও নারায়ণগঞ্জে এক ত্রাসের রাজত্ব সৃষ্টি করেছে। আওয়ামী লীগের কোন কর্মীই বোধহয় আর বাইরে নাই।

আমাদের অবস্থা এখন এমন পর্যায়ে এসেছে যে, যে কোনো মুহূর্তে মৃত্যুর শান্তি ছায়ায় চিরদিনের জন্য স্থান পেতে পারি। সিভিল সার্জন সাহেব দিনের মধ্যে পাঁচ-সাতবার আমাদের দেখতে আসেন। ২৫ তারিখ সকালে যখন আমাকে তিনি পরীক্ষা করছিলেন হঠাৎ দেখলাম, তার মুখ গম্ভীর হয়ে গেছে। তিনি কোনো কথা না বলে, মুখ কালো করে বেরিয়ে গেলেন। আমি বুঝলাম, আমার দিন ফুরিয়ে গেছে। কিছু সময় পরে আবার ফিরে এসে বললেন, “এভাবে মৃত্যুবরণ করে কি কোনো লাভ হবে? বাংলাদেশ যে আপনার কাছ থেকে অনেক কিছু আশা করে।” আমার কথা বলতে কষ্ট হয়, আস্তে আস্তে বললাম, “অনেক লোক আছে। কাজ পড়ে থাকবে না। দেশকে ও দেশের মানুষকে ভালবাসি, তাদের জন্যই জীবন দিতে পারলাম, এই শান্তি।” ডেপুটি জেলার সাহেব বললেন, “কাউকেও খবর দিতে হবে কি না? আপনার ছেলেমেয়ে ও স্ত্রী কোথায়? আপনার আব্বার কাছে কোনো টেলিগ্রাম করবেন?” বললাম, “দরকার নাই। আর তাদের কষ্ট দিতে চাই না। আমি আশা ছেড়ে দিয়েছি, হাত-পা অবশ হয়ে আসছিল। হার্টের দুর্বলতা না থাকলে এত তাড়াতাড়ি দুর্বল হয়ে পড়তাম না। একজন কয়েদি ছিল, আমার হাত-পায়ে সরিষার তেল গরম করে মালিশ করতে শুরু করল। মাঝে মাঝে ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছিল।

মহিউদ্দিনের অবস্থাও ভাল না, কারণ পুৱিসিস আবার আক্রমণ করে বসেছে। আমার চিঠি চারখানা একজন কর্মচারীকে ডেকে তাঁর কাছে দিয়ে বললাম, আমার মৃত্যুর পরে চিঠি চারখানা ফরিদপুরে আমার এক আত্মীয়ের কাছে পৌঁছে দিতে। তিনি কথা দিলেন, আমি তার কাছ থেকে ওয়াদা নিলাম। বার বার আব্বা, মা, ভাইবোনদের চেহারা ভেসে আসছিল আমার চোখের সামনে। রেণুর দশা কি হবে? তার তো কেউ নাই দুনিয়ায়। ছোট ছেলেমেয়ে দুইটার অবস্থাই বা কি হবে? তবে আমার আব্বা ও ছোট ভাই ওদের ফেলবে না, এ বিশ্বাস আমার ছিল। চিন্তাশক্তিও হারিয়ে ফেলছিলাম। হাচিনা, কামালকে একবার দেখতেও পারলাম না। বাড়ির কেউ খবর পায় নাই, পেলে নিশ্চয়ই আসত।

মহিউদ্দিনের তো কেউ ফরিদপুর নাই। বরিশালের এক গ্রামে তার বাড়ি। ভাইরা বড় বড় চাকরি করেন। এক ভাই ছাড়া কেউ বেশি খবর নিতেন না। তিনি সুপারিনটেনডেন্ট ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন। তাঁকে আমি জানতাম। যাহোক, মহিউদ্দিন ও আমি পাশাপাশি দুইটা খাট পেতে নিয়েছিলাম। একজন আরেকজনের হাত ধরে শুয়ে থাকতাম। দুজনেই চুপচাপ পড়ে থাকি। আমার বুকে ব্যথা শুরু হয়েছে। সিভিল সার্জন সাহেবের কোন সময় অসময় ছিল না। আসছেন, দেখছেন, চলে যাচ্ছেন। ২৭ তারিখ দিনেরবেলা আমার অবস্থা আরও খারাপ হয়ে পড়ল। বোধহয় আর দু’একদিন বাঁচতে পারি।

২৭ তারিখ রাত আটটার সময় আমরা দুইজন চুপচাপ শুয়ে আছি। কারও সাথে কথা বলার ইচ্ছাও নাই, শক্তিও নাই। দুইজনেই শুয়ে শুয়ে কয়েদির সাহায্যে ওজু করে খোদার কাছে মাপ চেয়ে নিয়েছি। দরজা খুলে বাইরে থেকে ডেপুটি জেলার এসে আমার কাছে বসলেন এবং বললেন, “আপনাকে যদি মুক্তি দেওয়া হয়, তবে খাবেন তো?” বললাম, “মুক্তি দিলে খাব, না দিলে খাব না। তবে আমার লাশ মুক্তি পেয়ে যাবে।” ডাক্তার সাহেব এবং আরও কয়েকজন কর্মচারী এসে গেছে চেয়ে দেখলাম। ডেপুটি জেলার সাহেব বললেন, “আমি পড়ে শোনাই, আপনার মুক্তির অর্ডার এসে গেছে রেডিওগ্রামে এবং জেলা ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের অফিস থেকেও অর্ডার এসেছে। দুইটা অর্ডার পেয়েছি। তিনি পড়ে শোনালেন, আমি বিশ্বাস করতে চাইলাম না। মহিউদ্দিন শুয়ে শুয়ে অর্ডারটা দেখল এবং বলল যে, তোমার অর্ডার এসেছে। আমাকে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগল। ডেপুটি সাহেব বললেন, “আমাকে অবিশ্বাস করার কিছুই নাই। কারণ, আমার কোনো স্বার্থ নাই; আপনার মুক্তির আদেশ সত্যিই এসেছে।” ডাক্তার সাহেব ডাবের পানি আনিয়েছেন। মহিউদ্দিনকে দুইজন ধরে বসিয়ে দিলেন। সে আমাকে বলল, “তোমাকে ডাবের পানি আমি খাইয়ে দিব।” দুই চামচ ডাবের পানি দিয়ে মহিউদ্দিন আমার অনশন ভাঙিয়ে দিল। মহিউদ্দিনের কোনো অর্ডার আসে নাই এখনও। এটা আমায় আরও পীড়া দিতে লাগল। ওকে ছেড়ে যাব কেমন করে? মুক্তির আদেশ এলেও জেলের বাইরে যাবার শক্তি আমার নেই। সিভিল সার্জন সাহেবও ছাড়বেন না। মাঝে মাঝে ডাবের পানিই আমাকে খেতে দিচ্ছিল। রাত কেটে গেল। সকালে একটু খেলেও ডাব খেতে দিল। আমি অনেকটা সুস্থ বোধ করতে লাগলাম, কিন্তু মহিউদ্দিনকে ফেলে যাব কেমন করে? দু’জন একসাথে ছিলাম। আমি চলে গেলে ওর উপায় কি হবে, কে দেখবে? যদি ওকে না ছাড়ে! ওর অবস্থা তো আমারই মত, তবে কেন ছাড়বে না! আমি তো পাকিস্তান হওয়ার পর থেকে ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ দলের। নেতাদের দুশমন’ হয়ে পড়েছি, কিন্তু মহিউদ্দিন তো জেলে আসার পূর্ব দিন পর্যন্তও মুসলিম লীগের বিশিষ্ট সদস্য ছিল। রাজনীতিতে দেখা গেছে একই দলের লোকের মধ্যে মতবিরোধ হলে দুশমনি বেশি হয়।

সকাল দশটার দিকে খবর পেলাম, আব্বা এসেছেন। জেলগেটে আমাকে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। তাই কর্তৃপক্ষ তাকে ভিতরে নিয়ে আসলেন। আমাকে দেখেই আব্বার চোখে পানি এসে গেছে। আব্বার সহ্য শক্তি খুব বেশি। কোনোমতে চোখের পানি মুছে ফেললেন। কাছে বসে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন এবং বললেন, “তোমার মুক্তির আদেশ হয়েছে, তোমাকে আমি নিয়ে যাব বাড়িতে। আমি ঢাকায় গিয়েছিলাম তোমার মা, রেণু, হাচিনা ও কামালকে নিয়ে, দুই দিন বসে রইলাম, কেউ খবর দেয় না, তোমাকে কোথায় নিয়ে গেছে। তুমি ঢাকায় নাই একথা জেলগেট থেকে বলেছে। যদিও পরে খবর পেলাম, তুমি ফরিদপুর জেলে আছ। তখন যোগাযোগব্যবস্থা বন্ধ। নারায়ণগ এসে যে জাহাজ ধরব তারও উপায় নেই। তোমার মা ও রেণুকে ঢাকায় রেখে আমি চলে এসেছি। কারণ, আমার সন্দেহ হয়েছিল তোমাকে ফরিদপুর নেওয়া হয়েছে কি না! আজই টেলিগ্রাম করব, তারা যেন বাড়িতে রওয়ানা হয়ে যায়। আমি আগামীকাল বা পরশু তোমাকে নিয়ে রওয়ানা করব বাকি খোদা ভরসা। সিভিল সার্জন সাহেব বলেছেন, তোমাকে নিয়ে যেতে হলে লিখে দিতে হবে যে, আমার দায়িত্বে নিয়ে যাচ্ছি। আব্বা আমাকে সান্ত্বনা দিলেন এবং বললেন, তিনি খবর পেয়েছেন মহিউদ্দিনও মুক্তি পাবে, তবে একসাথে ছাড়বে না, একদিন পরে ছাড়বে।

 

৬৬.

পরের দিন আব্বা আমাকে নিতে আসলেন। অনেক লোক জেলগেটে হাজির। আমাকে স্ট্রেচারে করে জেলগেটে নিয়ে যাওয়া হল এবং গেটের বাইরে রেখে দিল, যদি কিছু হয় বাইরে গিয়ে হোক, এই তাদের ধারণা। আমাকে কয়েকজনে বয়ে নিয়ে গেল আলাউদ্দিন খান সাহেবের বাড়িতে। সেখানে কিছু সময় রাখল। বিকালে আমার বোনের বাড়িতে নিয়ে আসল। রাতটা সেখানে কাটালাম। আত্মীয়স্বজনসহ অনেক লোক আমাকে দেখতে আসল। আব্বা আমার কাছেই রইলেন। পরের দিন সকালে আমার এক বন্ধু ট্যাক্সি নিয়ে এল। সে নিজেই ড্রাইভ করে আমাকে ভাঙ্গায় নিয়ে আসল। আব্বা একটা বড় নৌকা ভাড়া করলেন। আমার ফুপুর বাড়ি রাস্তার পাশেই। তিনি রাস্তায় চলে এসেছেন আমাকে দেখতে। আব্বাকে বললেন, তাঁদের বাড়ি নূরপুর গ্রামে থাকতে। আব্বা বললেন, এখান থেকে নৌকায় ভেবোনের বাড়ি দত্তপাড়া যাবেন। সেখানে আরও একদিন থাকবেন। একটু সুস্থ হলে বড়বোনকে সাথে নিয়ে বাড়িতে যাবেন। আমি অনেকটা সুস্থ বোধ করছি, যদিও খুবই দুর্বল।

দত্তপাড়া মাদারীপুর মহকুমায়, সেখান থেকে একদিন একরাত লাগবে গোপালগঞ্জ পৌঁছাতে নৌকায়। সিন্ধিয়া ঘাটে কর্মীরা বসে আছে খবর পেয়ে। আমাকে দেখেই তারা স্টিমারে গোপালগঞ্জ রওয়ানা করল। আমি কয়েক ঘন্টা পরে গোপালগঞ্জ পৌঁছে দেখি, বিরাট জনতা, সমস্ত নদীর পাড় ভরে গেছে। আমাকে তারা নামাবেই। আব্বা আপত্তি করলেও তারা শুনল না। আমাকে কোলে করে রাস্তায় শোভাযাত্রা বের করল এবং আবার নৌকায় পৌঁছে দিল। আব্বা আর দেরি না করে আমাকে নিয়ে বাড়িতে রওয়ানা করলেন। কারণ, আমার মা, রেণু ও বাড়ির সকলে আমার জন্য ব্যস্ত হয়ে আছে। আমার ভাইও খবর পেয়ে খুলনা থেকে রওয়ানা হয়ে চলে এসেছে।

পাঁচ দিন পর বাড়ি পৌঁছালাম। মাকে তো বোঝানো কষ্টকর। হাচু আমার গলা ধরে প্রথমেই বলল, “আব্বা, রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই, রাজবন্দিদের মুক্তি চাই।” ২১শে ফেব্রুয়ারি ওরা ঢাকায় ছিল, যা শুনেছে তাই বলে চলেছে। কামাল আমার কাছে আসল না, তবে আমার দিকে চেয়ে রইল। আমি খুব দুর্বল, বিছানায় শুয়ে পড়লাম। গতকাল রেণু ও মা ঢাকা থেকে বাড়ি এসে আমার প্রতীক্ষায় দিন কাটাচ্ছিল। এক এক করে সকলে যখন আমার কামরা থেকে বিদায় নিল, তখন রেণু কেঁদে ফেলল এবং বলল, “তোমার চিঠি পেয়ে আমি বুঝেছিলাম, তুমি কিছু একটা করে ফেলবা। আমি তোমাকে দেখবার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম। কাকে বলব নিয়ে যেতে, আব্বাকে বলতে পারি না লজ্জায়। নাসের ভাই বাড়ি নাই। যখন খবর পেলাম খবরের কাগজে, তখন লজ্জা শরম ত্যাগ করে আব্বাকে বললাম। আব্বা ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। তাই রওয়ানা করলাম ঢাকায়, সোজা আমাদের বড় নৌকায় তিনজন মাল্লা নিয়ে। কেন তুমি অনশন করতে গিয়েছিলে? এদের কি দয়া মায়া আছে? আমাদের কারও কথাও তোমার মনে ছিল না? কিছু একটা হলে কি উপায় হত? আমি এই দুইটা দুধের বাচ্চা নিয়ে কি করে বাঁচতাম? হাচিনা, কামালের অবস্থা কি হত? তুমি বলবা, খাওয়া-দাওয়ার কষ্ট তো হত না? মানুষ কি শুধু খাওয়া পরা নিয়েই বেঁচে থাকতে চায়? আর মরে গেলে দেশের কাজই বা কিভাবে করতা?” আমি তাকে কিছুই বললাম না। তাকে বলতে দিলাম, কারণ মনের কথা প্রকাশ করতে পারলে ব্যথাটা কিছু কমে যায়। রেণু খুব চাপা, আজ যেন কথার বাঁধ ভেঙে গেছে। শুধু বললাম, “উপায় ছিল না।” বাচ্চা দুইটা ঘুমিয়ে পড়েছে। শুয়ে পড়লাম। সাতাশ-আঠাশ মাস পরে আমার সেই পুরানা জায়গায়, পুরানা কামরায়, পুরানা বিছানায় শুয়ে কারাগারের নির্জন প্রকোষ্ঠের দিনগুলির কথা মনে পড়ল। ঢাকার খবর সবই পেয়েছিলাম। মহিউদ্দিনও মুক্তি পেয়েছে। আমি বাইরে এলাম আর আমার সহকর্মীরা আবার জেলে গিয়েছে।

পরের দিন সকালে আব্বা ডাক্তার আনালেন। সিভিল সার্জন সাহেবের প্রেসক্রিপশনও ছিল। ডাক্তার সকলকে বললেন, আমাকে যেন বিছানা থেকে উঠতে না দেওয়া হয়। দিন দশেক পরে আমাকে হাঁটতে হুকুম দিল শুধু বিকেলবেলা। আমাকে দেখতে রোজই অনেক লোক বাড়িতে আসত। গোপালগঞ্জ, খুলনা ও বরিশাল থেকেও আমার কিছু সংখ্যক সহকর্মী এসেছিল।

একদিন সকালে আমি ও রেণু বিছানায় বসে গল্প করছিলাম। হাচু ও কামাল নিচে খেলছিল। হাচু মাঝে মাঝে খেলা ফেলে আমার কাছে আসে আর আব্বা আব্বা’ বলে ডাকে। কামাল চেয়ে থাকে। একসময় কামাল হাচিনাকে বলছে, “হাচু আপা, হাচু আপা, তোমার আব্বাকে আমি একটু আব্বা বলি। আমি আর রেণু দুজনই শুনলাম। আস্তে আন্তে বিছানা থেকে উঠে যেয়ে ওকে কোলে নিয়ে বললাম, “আমি তো তোমারও আব্বা।” কামাল আমার কাছে আসতে চাইত না। আজ গলা ধরে পড়ে রইল। বুঝতে পারলাম, এখন আর ও সহ্য করতে পারছে না। নিজের ছেলেও অনেক দিন না দেখলে ভুলে যায়। আমি যখন জেলে যাই তখন ওর বয়স মাত্র কয়েক মাস। রাজনৈতিক কারণে একজনকে বিনা বিচারে বন্দি করে রাখা আর তার আত্মীয়স্বজন ছেলেমেয়েদের কাছ থেকে দূরে রাখা যে কত বড় জঘন্য কাজ তা কে বুঝবে? মানুষ স্বার্থের জন্য অন্ধ হয়ে যায়। আজ দুইশত বৎসর পরে আমরা স্বাধীন হয়েছি। সামান্য হলেও কিছুটা আন্দোলনও করেছি স্বাধীনতার জন্য। ভাগ্যের নিষ্ঠুর পরিহাস আজ আমাকে ও আমার সহকর্মীদের বছরের পর বছর জেল খাটতে হচ্ছে। আরও কতকাল খাটতে হয়, কেইবা জানে? একেই কি বলে স্বাধীনতা? ভয় আমি পাই না, আর মনও শক্ত হয়েছে। যে পাকিস্তানের স্বপ্ন দেখেছিলাম, সেই পাকিস্তানই করতে হবে, মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম। গোপালগঞ্জ মহকুমার যে কেউ আসে, তাদের এক প্রশ্ন, “আপনাকে কেন জেলে নেয়? আপনিই তো আমাদের পাকিস্তানের কথা শুনিয়েছেন।” আবার বলে, “কত কথা বলেছিলেন, পাকিস্তান হলে কত উন্নতি হবে। জনগণ সুখে থাকবে, অত্যাচার জুলুম থাকবে না। কয়েক বছর হয়ে গেল দুঃখই তো আরও বাড়ছে, কমার লক্ষণ তো দেখছি না। চাউলের দাম কত বেড়ে গেছে।” কি উত্তর দেব! এরা সাধারণ মানুষ। কি করে এদের বোঝাব! গ্রামের অনেক মাতবর শ্রেণীর লোক আছেন, যারা বিচক্ষণ ও বুদ্ধিমান। কথা খুব সুন্দরভাবে বলতে পারেন। এক কথায় তো বোঝানোও যায় না। পাকিস্তান খারাপ না, পাকিস্তান তো আমাদেরই দেশ। যাদের হাতে ইংরেজ ক্ষমতা দিয়ে গেছে তারা জনগণের স্বার্থের চেয়ে নিজেদের স্বার্থই বেশি দেখছে। পাকিস্তানকে কি করে গড়তে হবে, জনগণের কি করে উন্নতি করা যাবে সেদিকে ক্ষমতাসীনদের খেয়াল নাই। ১৯৫২ সালে ঢাকায় গুলি হওয়ার পরে গ্রামে গ্রামে জনসাধারণ বুঝতে আরম্ভ করেছে যে, যারা শাসন করছে তারা জনগণের আপনজন নয়। খবর নিয়ে জানতে পারলাম, ২১শে ফেব্রুয়ারি গুলি হওয়ার খবর বাতাসের সাথে সাথে গ্রামে গ্রামে পৌঁছে গেছে এবং ছোট ছোট হাটবাজারে পর্যন্ত হরতাল হয়েছে। মানুষ বুঝতে আরম্ভ করেছে যে, বিশেষ একটা গোষ্ঠী (দল) বাঙালিদের মুখের ভাষা কেড়ে নিতে চায়।

ভরসা হল, আর দমাতে পারবে না। বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা না করে উপায় নাই। এই আন্দোলনে দেশের লোক সাড়া দিয়েছে ও এগিয়ে এসেছে। কোনো কোনো মওলানা সাহেবরা ফতোয়া দিয়েছিলেন বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে। তারাও ভয় পেয়ে গেছেন। এখন আর প্রকাশ্যে বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে কথা বলতে সাহস পাচ্ছেন না। জনমত সৃষ্টি হয়েছে, জনমতের বিরুদ্ধে যেতে শোষকরাও ভয় পায়। শাসকরা যখন শোষক হয় অথবা শোষকদের সাহায্য করতে আরম্ভ করে তখন দেশের ও জনগণের মঙ্গল হওয়ার চেয়ে অমঙ্গলই বেশি হয়।

 

৬৭.

মার্চ মাস পুরাটাই আমাকে বাড়িতে থাকতে হল। শরীরটা একটু ভাল হয়েছে, কিন্তু হার্টের দুর্বলতা আছে। আব্বা আমাকে ছাড়তে চান না। ডাক্তারও আপত্তি করে। রেণুর ভয় ঢাকায় গেলে আমি চুপ করে থাকব না, তাই আবার গ্রেফতার করতে পারে। আমার মন রয়েছে ঢাকায়, নেতারা ও কমারা সকলেই জেলে। সংগ্রাম পরিষদের নেতারা গোপনে সভা করতে যেয়ে সকলে একসাথে গ্রেফতার হয়ে গেছে। ছাত্রলীগের নেতা ও কর্মীরা অনেকেই জেলে বন্দি। আওয়ামী লীগের কাজ একেবারে বন্ধ। কেউ সাহস করে কথা বলছে না। লীগ সরকার অত্যাচারের স্টিমরোলার চালিয়ে দিয়েছে। যা কিছুই হোক না কেন বসে থাকা চলবে না।

এই সময় মানিক ভাইয়ের কাছ থেকে একটা চিঠি পেলাম। তিনি আমাকে অতিসত্বর ঢাকায় যেতে লিখেছেন। চিকিৎসা ঢাকায়ই করা যাবে এবং ঢাকায় বসে থাকলেও কাজ হবে। আমি আব্বাকে চিঠিটা দেখালাম। আব্বা চুপ করে থাকলেন কিছু সময়। তারপর বললেন, যেতে চাও যেতে পার। রেণুও কোনো আপত্তি করল না। টাকা পয়সারও দরকার। খবর পেয়েছি, আমার বিছানাপত্র কাপড়চোপড় কিছুই নেই। আবার নতুন করে সকল কিছু কিনতে হবে। আব্বাকে বললাম, খাট, টেবিল-চেয়ার, বিছানাপত্র সকল কিছুই নতুন করে কিনতে হবে। আমার কিছু টাকার দরকার। কয়েক মাসের খরচও তো লাগবে। ঢাকা থেকে আবদুল হামিদ চৌধুরী ও মোল্লা জালালউদ্দিন খবর দিয়েছে তাঁতীবাজারে একটা বাসা ভাড়া নিয়েছে। আমি তাদের কাছে উঠতে পারব। ১৫০ নম্বর মোগলটুলীতে আর উঠতে চাই না, কারণ সেখানে এত লোক আসে যায় যে, নিজের বলতে কিছুই থাকে না। তবে ওখানে থাকার আকর্ষণও আছে। শওকত মিয়ার মত মুরব্বি থাকলে চিন্তা করতে হয় না। আমার শরীর ভাল না, চিকিৎসা করাতে হবে। রেণুও কিছু টাকা আমাকে দিল গোপনে। আব্বার কাছ থেকে টাকা নিয়ে ঢাকায় রওয়ানা করলাম, এপ্রিল মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে। হাচিনা ও কামাল আমাকে ছাড়তে চায় না, ওদের উপর আমার খুব দুর্বলতা বেড়ে গেছে। রওয়ানা করার সময় দুই ভাইবোন খুব কাঁদল। আমি বরিশাল হয়ে ঢাকায় পৌঁছালাম। পূর্বেই খবর দিয়েছি, জালাল আমাকে নারায়ণগঞ্জ থেকে নিয়ে যেতে আসল ওদের বাসায়। আমার জন্য একটা কামরাও ঠিক করে রেখেছে।

শামসুল হক সাহেব আওয়ামী লীগের অফিস নবাবপুর নিয়ে এসেছেন। এই বাড়ির দুইটা কামরায় মানিক ভাই তার ছেলেমেয়েদের নিয়ে কিছুদিন ছিলেন। মানিক ভাই, আতাউর রহমান সাহেব ও আরও অনেকের সাথে দেখা করলাম। ডাক্তার নন্দীর কাছে যেয়ে নিজেকে দেখলাম। তিনি ঔষধ লিখে দিলেন, আওয়ামী লীগ অফিসে যেয়ে দেখি একখানা টেবিল, দুই তিনখানা চেয়ার, একটা লং টুল। প্রফেসার কামরুজ্জামান অফিসে বসেন। একটা ছেলে রাখা হয়েছে, যাকে অফিস পিয়ন বলা যেতে পারে। শামসুল হক সাহেব জেলে। আমি জয়েন্ট সেক্রেটারি। ওয়ার্কিং কমিটির সভা ডাকলাম। তাতে যে বার-তেরজন সদস্য উপস্থিত ছিলেন তারা আমাকে এ্যাকটিং জেনারেল সেক্রেটারি করে প্রতিষ্ঠানের ভার দিলেন। আতাউর রহমান সাহেব অন্যতম সহ-সভাপতি ছিলেন, তিনি সভাপতিত্ব করলেন।

ঢাকায় তখন একটা ত্রাসের রাজত্ব চলছে। ভয়ে মানুষ কোনো কথা বলে না। কথা বললেই গ্রেফতার করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজগুলিতে একই অবস্থা। আওয়ামী লীগ অফিসে কেউই আসে না ভয়ে। আমি ও কামরুজ্জামান সাহেব বিকালে বসে থাকি। অনেক চেনা লোক দেখলাম, নবাবপুর দিয়ে যাবার সময় আমাদের অফিসের দিকে আসলেই মুখ ঘুরিয়ে নিতেন। দু’একজন আমাদের দলের সদস্যও ছিল। আমার সাথে কেউ দেখা করতে আসলে আমি বলতাম, অফিসে আমার সাথে দেখা করবেন, সেখানেই আলাপ করব।

শহীদ সাহেব যখন এসেছিলেন, তাঁর এক ভক্তের কাছ থেকে একটা টাইপ রাইটিং মেশিন নিয়ে অফিসের জন্য দিয়ে গিয়েছিলেন। ঢাকার একজন ছাত্র সিরাজ, এক হাত দিয়ে আস্তে আস্তে টাইপ করতে পারত। তাকে বললাম, অফিসে কাজ করতে, সে রাজি হল। কাজ করতে করতে পরে ভাল টাইপ করা শিখেছিল। একজন পিয়ন রাখলাম, প্রফেসার কামরুজ্জামান সাহেবের বাসায় থাকত।

এই সময় একজন এডভোকেট আমাদের অফিসে আসলেন। তিনি বললেন, “আমি আপনাদের দলের সভ্য হতে চাই। আমার দ্বারা বেশি কাজ পাবেন না, তবে অফিসের কাজ আমি বিকালে এসে করে দিতে পারি।” আমি খুব খুশিই হলাম। ভদ্রলোক আস্তে আস্তে কথা বলেন, আমার বয়সীই হবেন। আমার খুব পছন্দ হল। আমি তাকে অনুরোধ করলাম, অফিসের ভার নিতে। তিনি বললেন, কোর্টের কাজ শেষ করে বাড়ি যাওয়ার পূর্বে রোজই আসব। সত্যই তিনি আসতে লাগলেন এবং কাজ করতে লাগলেন। পুরানা অফিস সেক্রেটারি ভদ্রলোক কেটে পড়েছেন। পরে ওয়ার্কিং কমিটির সভায় আমি প্রস্তাব করলাম, তাঁকে অফিস সেক্রেটারি করতে। সকলেই রাজি হলেন। আজ ষোল বৎসর তিনি অফিস সেক্রেটারি আছেন। কোনোদিন কোনো পদের জন্য কাউকেও তিনি বলেন নাই। আমার সাথে ব্যক্তিগত বন্ধুত্বও হয়ে গিয়েছে। তিনি কোনোদিন সভায় বক্তৃতা করেন না। তাকে অফিসের কাজ ছাড়া কোনো কাজেও কেউ বলেন নাই। তিনিও চান না অন্য কাজ করতে। অফিসের খরচও তাঁর হাতে আমি দিয়েছিলাম। হিসাব-নিকাশ তিনিই রাখতেন। আমাদের আয়ও কম, খরচও কম। কোনোদিন কোনো সরকার তাঁকে খারাপ চোখে দেখে নাই। আর গ্রেফতারও করে নাই। এবারেই তাকে কয়েকদিনের জন্য গ্রেফতার করে এনেছিল। তার শরীরও ভাল না। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ তার মত অফিস সেক্রেটারি পেয়েছিল বলে অনেক কাজ হয়েছে। তার নামটা বলি নাই, মিস্টার মোহাম্মদউল্লাহ। শহীদ সাহেব ও ভাসানী সাহেবও তাকে ভালবাসতেন এবং বিশ্বাস করতেন। অফিসের কাজ কখনও পড়ে থাকত না।

যাহোক, দুই তিনটা জেলা ছাড়া জেলা কমিটিও গঠন হয় নাই। প্রতিষ্ঠান গড়ার সুযোগ এসেছে। সাহস করে কাজ করে যেতে পারলে প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠবে। কারণ, জনগণ এখন মুসলিম লীগ বিরোধী হয়ে গেছে। আর আওয়ামী লীগ এখন একমাত্র বিরোধী দল, যার আদর্শ আছে এবং নীতি আছে। তবে সকলের চেয়ে বড় অসুবিধা হয়েছে টাকার অভাব।

এদিকে মুসলিম লীগের কাগজগুলি শহীদ সাহেবের বিবৃতি এমনভাবে বিকৃত করে ছাপিয়েছে যে মনে হয় তিনিও উর্দুই একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হোক এটাই চান। আমি সাধারণ সম্পাদক হয়েই একটা প্রেস কনফারেন্স করলাম। তাতে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করতে হবে, রাজবন্দিদের মুক্তি দিতে হবে এবং যাঁরা ২১শে ফেব্রুয়ারি শহীদ হয়েছেন তাঁদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দান এবং যারা অন্যায়ভাবে জুলুম করেছে তাদের শাস্তির দাবি করলাম। সরকার যে বলেছেন, বিদেশী কোন রাষ্ট্রের উসকানিতে এই আন্দোলন হয়েছে, তার প্রমাণ চাইলাম। হিন্দু ছাত্ররা’ কলকাতা থেকে এসে পায়জামা পরে আন্দোলন করেছে, একথা বলতেও কৃপণতা করে নাই মুসলিম লীগ নেতারা। তাদের কাছে আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ছাত্রসহ পাঁচ ছয়জন লোক মারা গেল গুলি খেয়ে, তারা সকলেই মুসলমান কি না? যাদের গ্রেফতার করা হয়েছে তাদের মধ্যে শতকরা নিরানব্বইজন মুসলমান কি না? এত ছাত্র কলকাতা থেকে এল, একজনকেও ধরতে পারল না যে সরকার, সে সরকারের গদিতে থাকার অধিকার নাই। পার্টির কাজে আতাউর রহমান খান সাহেবের কাছ থেকে সকল রকম সাহায্য ও সহানুভূতি আমি পেয়েছিলাম। ইয়ার মোহাম্মদ খানও আমাকে সাহায্য করেছিলেন কাজ করতে। আমরা এক আলোচনা সভা করলাম, তাতে ঠিক হল আমাকে করাচি যেতে হবে। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীনের সাথে সাক্ষাৎ করে রাজবন্দিদের মুক্তির দাবি করতে হবে। শহীদ সাহেবের সাথেও আলাপ-আলোচনা করা দরকার। তার সাহায্য আমাদের খুব প্রয়োজন।

 

৬৮.

পশ্চিম পাকিস্তানের পাঞ্জাব, সীমান্ত প্রদেশ, সিন্ধু ও করাচিতে আওয়ামী লীগ গঠন করা হয়েছে। তবে নবাব মামদোতের দল জিন্নাহ মুসলিম লীগে যোগদান করায়, জিন্নাহ আওয়ামী মুসলিম লীগ করা হয়েছে পাবে। আমরা পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটি সভায় সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে, আমাদের প্রতিষ্ঠানের নাম পরিবর্তন করব না। জিন্নাহ সাহেবের নাম কোন রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের সাথে রাখা উচিত না। কোনো লোকের নামেই রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হতে পারে না। আমাদের ম্যানিফেস্টোও আমরা পরিবর্তন করব না। তখন পর্যন্ত আমরা এফিলিয়েশন নেই নাই। সোহরাওয়ার্দী সাহেব তাতে অসন্তষ্ট হয়েছেন। এ সমস্ত বিষয় নিয়েও তার সাথে আলোচনা করা দরকার হয়ে পড়েছে। তিনি আমাকে চিঠিও লিখেছেন হায়দ্রাবাদ (সিন্ধু) থেকে। তখন তিনি ‘পিন্ডি কন্সপিরেসি’ মামলার আসামিদের পক্ষ সমর্থন করছিলেন। মে মাসে আমি করাচি পৌঁছালাম। আমাকে করাচি আওয়ামী লীগের সভাপতি মাহমুদুল হক ওসমানী ও জেনারেল সেক্রেটারি শেখ মরুল হক দলবল নিয়ে অভ্যর্থনা করল। আমি ওসমানী সাহেবের বাড়িতে উঠলাম। আওয়ামী লীগ কর্মীদের এক সভা ডাকা হয়েছিল। সেখানে আমাকে ইংরেজিতেই বক্তৃতা করতে হল। উর্দু বক্তৃতা আমি করতে পারতাম না, তাঁরাও বাংলা বুঝতেন না।

আমি পৌঁছেই খাজা সাহেবের কাছে একটা চিঠি পাঠালাম, তার সাথে দেখা করার অনুমতি চেয়ে। তিনি আমার চিঠির উত্তর দিলেন এবং সময় ঠিক করে দিলেন দেখা করার অনুমতি দিয়ে।

আমানুল্লাহ নামে এক বাঙালি ছাত্র করাচিতে লেখাপড়া করত, সে আমার সেক্রেটারি হিসাবে সকল কাজকর্ম করে দিত। সর্বক্ষণ আমার সাথেই থাকত। সে করাচি আওয়ামী লীগের সভ্যও ছিল। সমস্ত কাজ করতে পারত, কোনো বিশ্রামের প্রয়োজন তার ছিল না বলে মনে হত। করাচির কফি হাউসই ছিল করাচির রাজনৈতিক কর্মীদের প্রধান আড্ডাখানা। সেখানেও সে আসর গরম করে রাখত এবং একাই লড়ত বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার জন্য। জনাব ওসমানী ও মর ঠিক করল আমাকে এক প্রেস কনফারেন্স করে পূর্ব পাকিস্তানে কি ঘটেছিল এবং কি ঘটছে তা বিস্তারিতভাবে প্রকাশ করতে হবে এখানে। কারণ, পশ্চিম পাকিস্তানে একতরফা প্রপাগান্ডা হয়েছে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন সম্বন্ধে।

আমি যথাসময়ে প্রধানমন্ত্রী খাজা সাহেবের সাথে দেখা করতে তাঁর অফিসে হাজির হলাম। প্রধানমন্ত্রীর এ্যাসিসট্যান্ট সেক্রেটারি মিস্টার সাজেদ আলী আমাকে অভ্যর্থনা করলেন। তাকে আমি পূর্ব থেকে জানতাম, তিনি কলকাতার বাসিন্দা। পূর্বে তিনি পূর্ব পাকিস্তান প্রধানমন্ত্রীর পিএ ছিলেন। আমাকে নিয়ে বসালেন তার কামরায়। আমার জন্য বিশ মিনিট সময় ধার্য করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী। আমাকে খাজা সাহেব তার কামরায় নিজে এগিয়ে এসে নিয়ে বসালেন। যথেষ্ট ভদ্রতা করলেন, আমার শরীর কেমন? আমি কেমন আছি, কতদিন থাকব—এইসব জিজ্ঞাসা করলেন। তিনিও জানতেন, ব্যক্তিগতভাবে তাকে আমি শ্রদ্ধা করি। আমি যে একজন ভাল কর্মী সে কথা তিনি নিজেই স্বীকার করতেন এবং আমাকে স্নেহও করতেন। আমি তাকে অনুরোধ করলাম, “মওলানা ভাসানী, শামসুল হক, আবুল হাশিম, মওলানা তর্কবাগীশ, খয়রাত হোসেন, খান সাহেব ওসমান আলীসহ সমস্ত কর্মীকে মুক্তি দিতে। আরও বললাম, জুডিশিয়াল ইনকোয়ারি বসাতে, কেন গুলি করে ছাত্রদের হত্যা করা হয়েছিল?” তিনি বললেন, “এটা প্রাদেশিক সরকারের হাতে, আমি কি করতে পারি?” আমি বললাম, “আপনি মুসলিম লীগ সরকারের প্রধানমন্ত্রী, আর পূর্ব বাংলায়ও মুসলিম লীগ সরকার, আপনি তাদের নিশ্চয়ই বলতে পারেন। আপনি তো চান না যে দেশে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হোক, আর আমরাও তা চাই না। আমি করাচি পর্যন্ত এসেছি আপনার সাথে দেখা করতে, এজন্য যে প্রাদেশিক সরকারের কাছে দাবি করে কিছুই হবে না। তারা যে অন্যায় করেছে সেই অন্যায়কে ঢাকবার জন্য আরও অন্যায় করে চলেছে।” তিনি বিশ মিনিটের জায়গায় আমাকে এক ঘণ্টা সময় দিলেন। আমি তাকে বললাম যে, “আওয়ামী লীগ বিরোধী পার্টি। তাকে কাজ করতে সুযোগ দেওয়া উচিত। বিরোধী দল না থাকলে গণতন্ত্র চলতে পারে না। আপনি গণতন্ত্রে বিশ্বাস করেন, তা আমি জানি।” তিনি স্বীকার করলেন, আওয়ামী লীগ সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দল। আমি তাঁকে বললাম, “আওয়ামী লীগ বিরোধী দল আপনি স্বীকার করে নিয়েছেন, একথা আমি খবরের কাগজে দিতে পারি কি না?” তিনি বললেন, “নিশ্চয়ই দিতে পার।” তিনি আমাকে বললেন, প্রদেশের কোন কাজে তিনি হস্তক্ষেপ করেন না, তবে তিনি চেষ্টা করে দেখবেন কি করতে পারেন। আমি তাকে আদাব করে বিদায় নিলাম। তিনি যে আমার কথা ধৈর্য ধরে শুনেছেন এ জন্য তার কাছে আমি কৃতজ্ঞ। দুই দিন পরে প্রেস কনফারেন্স করলাম। আমার লেখা বিবৃতি পাঠ করার পরে প্রেস প্রতিনিধিরা আমাকে প্রশ্ন করতে শুরু করলেন, অনেক প্রশ্নই আমাকে করলেন। আমি তাদের প্রশ্নের সন্তোষজনক উত্তর দিতে পেরেছিলাম এবং পূর্ব বাংলার অবস্থা তাদের বুঝিয়ে বলতে পেরেছিলাম। এখানে এক প্রশ্নের উত্তরে তাদের বলেছিলাম, “প্রায় ত্রিশটা উপনির্বাচন বন্ধ করে রাখা হয়েছে। যে কোন একটায় ইলেকশন হোক, আমরা মুসলিম লীগ প্রার্থীকে শোচনীয়ভাবে পরাজিত করতে সক্ষম হব।”

 

৬৯.

তখনও পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণ ও শিক্ষিত সমাজের ধারণা, আওয়ামী লীগের কোনো জনপ্রিয়তা নাই। মুসলিম লীগ নির্বাচনে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে। পাঞ্জাবে নির্বাচনের ফলাফল দেখে তাদের এই ধারণা হয়েছে। তারা বাংলার জনসাধারণকে জানেন না, আর তাদের সম্বন্ধে ধারণাও নাই। সরকার সমর্থক কাগজগুলি এমনভাবে প্রচার করে চলেছে যে, সত্য চাপা পড়ে আছে। পূর্ব বাংলার সঠিক অবস্থা, পশ্চিম পাকিস্তানকে কোনোদিন বলা হয় নাই। স্বায়ত্তশাসনের দাবি সম্বন্ধেও প্রশ্ন করা হয়েছিল, আমি তাদের পাকিস্তানের ভৌগোলিক অবস্থা চিন্তা করতে অনুরোধ করেছিলাম। প্রায় দুই ঘণ্টা প্রেস কনফারেন্স চলেছিল। আমার মনে হল, তারা কিছুটা বুঝতে পেরেছিলেন। পাকিস্তান টাইমস ও ইমরোজ খুব ভালভাবে ছাপিয়েছিল আমার প্রেস কনফারেন্সের জবাবগুলি। মুসলিম লীগের অনেক পুরানা সহকর্মীদের সাথে সাক্ষাৎও হয়েছিল। শেখ মঞ্জুরুল হক দিল্লিতে মুসলিম লীগ ন্যাশনাল গার্ডের সালারে সুবা ছিল। এখন আওয়ামী লীগের সেক্রেটারি হয়েছে। দিল্লিতে তার সাথে আমার পরিচয় হয়েছিল। আমি এই প্রথম করাচি দেখলাম; ভাবলাম এই আমাদের রাজধানী! বাঙালিরা কয়জন তাদের রাজধানী দেখতে সুযোগ পাবে! আমরা জন্মগ্রহণ করেছি সবুজের দেশে, যেদিকে তাকানো যায় সবুজের মেলা। মরুভূমির এই পাষাণ বালু আমাদের পছন্দ হবে কেন? প্রকৃতির সাথে মানুষের মনেরও একটা সম্বন্ধ আছে। বালুর দেশের মানুষের মনও বালুর মত উড়ে বেড়ায়। আর পলিমাটির বাংলার মানুষের মন ঐ রকমই নরম, ঐ রকমই সবুজ। প্রকৃতির অকৃপণ সৌন্দর্যে আমাদের জন্ম, সৌন্দর্যই আমরা ভালবাসি।

মঞ্জুর তার জিপে করে আমাকে নিয়ে হায়দ্রাবাদ চলল। কিছুদূর যাওয়ার পরই মভূমি চোখে পড়ল। অনেক মাইল পর্যন্ত বাড়িঘর নাই, মাঝে মাঝে দু’একটা ছোট ছোট বাজারের মত। দেখলাম, সামান্য কয়েকজন লোক বসে আছে। মরকে বললাম, “তোমরা এই মরুভূমিতে থাক কি করে?” উত্তর দিল “বাধ্য হয়ে। মোহাজের হয়ে এসেছি, এই তো আমাদের বাড়িঘর, এখানেই মরতে হবে। দিল্লি তো তুমি দেখছ, এ রকম মরুভূমি তুমি দেখ নাই? প্রথম প্রথম খারাপ লেগেছিল, এখন সহ্য হয়ে গেছে। আমরা মোহাজেররা এসেছি, ভবিষ্যতে আসলে দেখ করাচিকেও আমরা ফুলে ফুলে ভরে ফেলব।”

আমরা বিকালে পৌঁছালাম। মজুর নিজেই ড্রাইভ করছিল। সে চমৎকার গাড়ি চালাতে পারে। মধুরের সাথে আমার বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল। অনেক উত্থান-পতন হয়েছে, বন্ধুত্ব যায় নাই। পরে যতবার করাচি গিয়েছি, ছায়ার মত আমার কাছেই রয়েছে। যাহোক, সোজা ডাকবাংলোতে পৌঁছালাম। শহীদ সাহেব বাইরে গেছেন, রাতে ফিরবেন। আমরা দুইজনে একটা হোটেলে চলে আসলাম, সেখানে হাতমুখ ধুয়ে খাওয়া-দাওয়া করে রাত নয়টার সময় ডাকবাংলোতে এসে দেখি তখনও তিনি ফেরেন নাই। আমরা অনেকক্ষণ অপেক্ষা করতে লাগলাম। রাত দশটায় তিনি ফিরলেন। আমাকে দেখে বললেন, “খুব প্রেস কনফারেন্স করছ পশ্চিম পাকিস্তানে এসে।” বললাম, “কি আর করি!’ আমি যে হায়দ্রাবাদ আসব তিনি জানতেন। অনেকক্ষণ পর্যন্ত আলোচনা হল।

তিনি পূর্ব বাংলার কথা জিজ্ঞাসা করলেন, নেতারা সকলেই জেলে আছেন, কি আর ভাল থাকবেন! নাজিমুদ্দীন সাহেবের সাথে আমার যে আলাপ হয়েছিল তাও বললাম। একুশে ফেব্রুয়ারি যা যা ঘটেছিল তাও জানালাম। বললাম, রাষ্ট্রভাষা সম্বন্ধে তার মতামত খবরের কাগজে বের হয়েছে। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, “কি বের হয়েছে?” আমি বললাম, “আপনি নাকি কোন রিপোর্টারকে বলেছেন যে, উর্দুই রাষ্ট্রভাষা হওয়া উচিত। তিনি ক্ষেপে গেলেন এবং বললেন, “এ কথা তো আমি বলি নাই। উর্দু ও বাংলা দুইটা হলে আপত্তি কি? একথাই বলেছিলাম। আরও জানালেন যে, গুলি ও অত্যাচারের প্রতিবাদও তিনি করেছেন। আমি তাকে জানালাম, “সে সব কথা কোনো কাগজে পরিষ্কার করে ছাপান হয় নাই। পূর্ব বাংলার জনসাধারণ আপনার মতামত না পেয়ে খুবই দুঃখিত হয়েছে।” তিনি আমাকে পরের দিন বিকালে আসতে বললেন, কারণ সকালে কোর্ট আছে। পিত্তি ষড়যন্ত্র মামলার বিচার হায়দ্রাবাদ জেলের ভিতরে হচ্ছে। তিনি সন্ধ্যার দিকে হায়দ্রাবাদ থেকে মোটরে করাচি যাবেন। আমিও সাথে যেতে পারব। মজুর বলল যে, সে সকালেই চলে যাবে। আমরা দুইজন হোটেলে চলে আসলাম। মঞ্জুর সকালবেলা মিস্টার মাসুদকে খোজ করে নিয়ে আসল। মাসুদ সাহেব নিখিল ভারত স্টেট মুসলিম লীগের সেক্রেটারি ছিলেন। এখন হায়দ্রাবাদে এসে বাড়ি করেছেন। শহীদ সাহেবের ভক্ত এবং আওয়ামী লীগে যোগদান করেছেন। মজুর তার কাছে আমাকে রেখে রওয়ানা করল। মাসুদ সাহেব আমাকে নিয়ে বেলা একটা পর্যন্ত ঘুরলেন। একসাথে খাওয়া-দাওয়া করলাম এবং অনেকের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন।

দুটার সময় আমি মালপত্র নিয়ে শহীদ সাহেবের কাছে চলে আসলাম। শহীদ সাহেব কয়েকখানা বিস্কুট ও হরলিক্স খেলেন। এই ভর দুপুরের খাওয়া। এক এডভোকেট পেশোয়ার থেকে এসেছিল, অন্য এক আসামির পক্ষে। রাতে শহীদ সাহেব তাকে এবং আমাকে নিয়ে বানা খান। আমি বললাম, “এভাবে চলে কেমন করে?” তিনি বললেন, “বিস্কুট, মাখন, রুটিও আছে, এই খেয়েই হয়ে যায় দুপুরবেলা।” কোনো লোজনও নাই। নিজেই সকল কিছু করেন। আমরা আবার আলাপ শুরু করলাম। তিনি বললেন, “পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ কোনো এফিলিয়েশন নেয় নাই। আমি তো তোমাদের কেউ নই।” আমি বললাম, “প্রতিষ্ঠান না গড়লে কার কাছ থেকে এফিলিয়েশন নেব। আপনি তো আমাদের নেতা আছেনই। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ আপনাকে তো নেতা মানে, এমনকি পূর্ব পাকিস্তানের জনগণও আপনাকে সমর্থন করে। তিনি বললেন, “একটা কনফারেন্স ডাকব, তার আগে পূর্ব-পাকিস্তান আওয়ামী লীগের এফিলিয়েশন নেওয়া দরকার। আমি তাঁকে জানালাম, “আপনি জিন্নাহ আওয়ামী লীগ করেছেন, আমরা নাম পরিবর্তন করতে পারব না। কোনো ব্যক্তির নাম রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের সাথে যোগ করতে চাই না। দ্বিতীয়ত আমাদের ম্যানিফেস্টো আছে, গঠনতন্ত্র আছে, তার পরিবর্তন করা সম্ভবপর নয়। মওলানা ভাসানী সাহেব আমাকে ১৯৪৯ সালে আপনার কাছে পাঠিয়েছিলেন। তখনও তিনি নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগ গঠনের জন্য অনুরোধ করেছিলেন। তারও কোনো আপত্তি থাকবে না, যদি আপনি পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের ম্যানিফেস্টো ও গঠনতন্ত্র মেনে নেন।

অনেক আলোচনার পরে তিনি মানতে রাজি হলেন এবং নিজ হাতে তার সম্মতির কথা লিখে দিলেন। কারণ, আমাকে ফিরে যেয়ে ওয়ার্কিং কমিটির সভায় তা পাস করিয়ে এফিলিয়েশনের জন্য দরখাস্ত করতে হবে। আমি বললাম, “আপনার হাতের লেখা থাকলে কেউই আর আপত্তি করবে না। মওলানা সাহেবের সাথে জেলে আমার কথা হয়েছিল। তাতে আমাদের ম্যানিফেস্টো, নাম ও গঠনতন্ত্র মেনে নিলে এফিলিয়েশন নিতে তার আপত্তি নাই।” আমি আর একটা অনুরোধ করলাম, তাকে লিখে দিতে হবে যে, উর্দু ও বাংলা দুইটাকেই রাষ্ট্রভাষা হিসাবে তিনি সমর্থন করেন। কারণ অনেক ভুল বোঝাবুঝি হয়ে গেছে। মুসলিম লীগ এবং তথাকথিত প্রগতিবাদীরা প্রপাগান্ডা করছেন তাঁর বিরুদ্ধে। তিনি বললেন, “নিশ্চয়ই লিখে দেব, এটা তো আমার নীতি ও বিশ্বস।” তিনি লিখে দিলেন।

মামলা শেষ হলেই তিনি পূর্ব পাকিস্তানে আসবেন, কথা দিলেন। বললেন, এক মাস থাকবেন এবং প্রত্যেকটা জেলায় একটা করে সভার ব্যবস্থা করতে হবে। সময় নষ্ট করা। যাবে না। তবে বিপদ হয়েছে, কতদিন এই মামলা চলে বলা যায় না। তাকে যখন জিজ্ঞাসা করলাম, “পিডি ষড়যন্ত্র মামলা সত্য কি না? আসামিদের রক্ষা করতে পারবেন কি না? আর ষড়যন্ত্র করে থাকলে তাদের শাস্তি হওয়া উচিত কি না?” তিনি বললেন, “ওসব প্রশ্ন কর না, আমি কিছুই বলব না, কারণ এডভোকেটদের শপথ নিতে হয়েছে, কোন কিছু কাউকেও না বলতে এ মামলা সম্বন্ধে। তিনি একটু রাগ করেই বললেন, আমি চুপ করে গেলাম।

বিকালে করাচি রওয়ানা করলাম, শহীদ সাহেব নিজে গাড়ি চালালেন, আমি তার পাশেই বসলাম। পিছনে আরও কয়েকজন এডভোকেট বসলেন। রাস্তায় এডভোকেট সাহেবরা আমাকে পূর্ব বাংলার অবস্থার কথা জিজ্ঞাসা করলেন। বাংলা ভাষাকে কেন আমরা রাষ্ট্রভাষা করতে চাই? হিন্দুরা এই আন্দোলন করছে কি না? আমি তাদের বুঝাতে চেষ্টা করলাম। শহীদ সাহেবও তাঁদের বুঝিয়ে বললেন এবং হিন্দুদের কথা যে সরকার বলছে, এটা সম্পূর্ণ মিথ্যা তা তিনিই তাঁদের ভাল করে বুঝিয়ে দিলেন। আমার কাছে তাঁরা নজরুল ইসলামের কবিতা শুনতে চাইলেন। আমি তাঁদের কে বলে তোমায় ডাকাত বন্ধু’, ‘নারী’, সাম্যআরও কয়েকটা কবিতার কিছু কিছু অংশ শুনালাম। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের কবিতাও দু’একটার কয়েক লাইন শুনালাম। শহীদ সাহেব তাদের ইংরেজি করে বুঝিয়ে দিলেন। কবিগুরুর কবিতার ইংরেজি তরজমা দু’একজন পড়েছেন বললেন। আমাদের সময় কেটে গেল। আমরা সন্ধ্যারাতেই করাচি পৌঁছালাম। শহীদ সাহেব আমাকে ওসমানী সাহেবের বাড়িতে নামিয়ে দিলেন এবং সকালে ১৩ নম্বর কাচারি রোডে যেতে বললেন।

তাঁর সাথে দেখা করতে গেলে তিনি বললেন, আমাকে লাহোর হয়ে ঢাকায় যেতে। তিনি লাহোরে খাজা আবদুর রহিম বার-এট-ল এবং রাজা হাসান আখতারকে টেলিগ্রাম করে দিবেন বললেন। লাহোরেও প্রেস কনফারেন্স করতে এবং কর্মীদের সাথে আলোচনা করতে বললেন। অনেক দিন হয়ে গেছে, দেরি না করে ট্রেনে আমি লাহোর রওয়ানা করলাম। খাজা আবদুর রহিম পূর্বে আইসিএস ছিলেন (তখন ওকালতি করেন), ধুবই ভদ্রলোক। আমাকে তার কাছে রাখলেন, জাভেদ মঞ্জিলে’। তিনি জাভেদ মঞ্জিলে থাকতেন। জাভেদ মঞ্জিল’ কবি আল্লামা ইকবালের বাড়ি। কবি এখানে বসেই পাকিস্তানের স্বপ্ন দেখেছিলেন। আল্লামা শুধু কবি ছিলেন না, একজন দার্শনিকও ছিলেন। আমি প্রথমে তার মাজার জিয়ারত করতে গেলাম এবং নিজকে ধন্য মনে করলাম। আল্লামা যেখানে বসে সাধনা করেছেন সেখানে থাকার সুযোেগ পেয়েছি!

খাজা সাহেব ও লাহোরের শহীদ সাহেবের ভক্তরা প্রেস কনফারেন্সের আয়োজন করলেন। আমি অনেকের সাথে দেখা করেছিলাম। হামিদ নিজামীর সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম। পূর্বে যখন লাহোর এসেছিলাম, তিনি আমাকে খুব আদর আপ্যায়ন করেছিলেন। তিনি নিজেই প্রেস কনফারেন্সে উপস্থিত থাকবেন বললেন এবং সকলকে ফোন করে দিলেন। প্রেস কনফারেন্সে সমস্ত দৈনিক কাগজের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। এমনকি এপিপি’র প্রতিনিধিও উপস্থিত ছিলেন। আমার বক্তব্য পেশ করার পরে আমাকে প্রশ্ন করতে শুরু করলেন, আমি তাদের প্রশ্নের সন্তোষজনক উত্তর দিতে পেরেছিলাম। আমরা যে উর্দু ও বাংলা দু’টাই রাষ্ট্রভাষা চাই, এ ধারণা তাঁদের ছিল না। তাদের বলা হয়েছে শুধু বাংলাকেই রাষ্ট্রভাষা করার দাবি করছি আমরা। পাকিস্তান আন্দোলনে যে সমস্ত নেতা ও কর্মী মুসলিম লীগ ও পাকিস্তানের জন্য কাজ করেছে তারাই আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠান গড়েছে তা আমি প্রমাণ করতে পেরেছিলাম। আমি যখন এক এক করে নেতাদের নাম বলতে শুরু করলাম তখন তারা বুঝতে পারলেন বলে মনে হল। লাহোরের আওয়ামী লীগ নেতারা আমাকে অনেক ধন্যবাদ দিলেন। আমি তাঁদের বললাম, আমি মুখে যা বলি, তাই বিশ্বাস করি। আমার পেটে আর মুখে এক কথা। আমি কথা চাবাই না, যা বিশ্বাস করি বলি। সেজন্য বিপদেও পড়তে হয়, এটা আমার স্বভাবের দোষও বলতে পারেন, গুণও বলতে পারেন। একটা কথা লাহোরে পরিষ্কার করে বলে এসেছিলাম, ইলেকশন হলে খবর পাবেন মুসলিম লীগের অবস্থা। তারা এমনভাবে পরাজিত হবে যা আপনারা ভাবতেও পারবেন না।

 

৭০.

এক বিপদ হল, সাত দিন পরে একদিন প্লেন লাহোর থেকে ঢাকায় আসে। তিন দিন পরে যে প্লেন ছাড়বে সে প্লেনে যাওয়ার উপায় নাই। কাজ শেষ হয় নাই, আর টিকিটও পাওয়া যাবে না। পরের সপ্তাহেও প্লেন যাবে না, শুনলাম প্রায় সতের-আঠার দিন আমাকে লাহোরে থাকতে হবে। খাজা আবদুর রহিম ও রাজা হাসান আখতার রাওয়ালপিন্ডি ও মারী বেড়াতে যাবেন। আমাকেও যেতে বললেন। আমি রাজি হলাম। একদিন রাওয়ালপিন্ডিতে দেরি করে দেখে নিলাম আমাদের মিলিটারি হেডকোয়ার্টার্স, আরও দেখলাম সেই পার্ক–যে পার্কে লিয়াকত আলী খানকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল। পরের দিন সকালে মারী পৌঁছালাম। মারীতে রীতিমত শীত। গরম কাপড় প্রয়োজন, রাতে কম্বলের দরকার হয়েছিল। রাওয়ালপিন্ডির গরমে আমার মুখ আগুনে পুড়লে যেমন গোটা গোটা হয়, তাই দু’একটা হয়েছিল। মারী পিন্ডি থেকে মাত্র ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ মাইল দূরে, কিন্তু কি সুন্দর আবহাওয়া! বড় আরাম লাগল। পাহাড়ের উপর ছোট্ট শহর। পাঞ্জাবের বড় বড় জমিদার ও ব্যবসায়ীদের অনেকের নিজেদের বাড়ি আছে। গরমের সময় ছেলেমেয়ে নিয়ে মারতে থাকেন। আমার খুব ভাল লাগল। সবুজে ঘেরা পাহাড়গুলি, তার উপর শহরটি। একদিন থাকলাম, ইচ্ছা হয়েছিল আরও কিছুদিন থাকি। পরের দিনই আমাদের চলে আসতে হল। লাহোরে পীর সালাহউদ্দিন আমার সাথী ছিলেন। তাঁকে নিয়ে ঘোরাফেরা করতাম। নওয়াই ওয়াক্ত, পাকিস্তান টাইমস, ইমরোজ ও অন্যান্য কাগজে আমার প্রেস কনফারেন্সের বক্তব্য খুব ভালভাবে ছাপিয়েছিল। সরকার সমর্থক কাগজগুলি আমার বক্তব্যের বিরুদ্ধে সমালোচনাও করেছিল। আমি রাষ্ট্রভাষা বাংলা, রাজবন্দিদের মুক্তি, গুলি করে হত্যার প্রতিবাদ, স্বায়ত্তশাসন ও অর্থনৈতিক সমস্যার উপর বেশি জোর দিয়েছিলাম।

লাহোর থেকে প্লেনে ঢাকা আসলাম। তখন সোজা করাচি বা লাহোর থেকে প্লেন আসত না। দিল্পি ও কলকাতা হয়ে প্লেন আসত। ঢাকা এসেই ওয়ার্কিং কমিটির সভা ডাকলাম। মওলানা সাহেবের সাথে যোগাযোগ করলাম। সোহরাওয়ার্দী সাহেবের মতামত সকলকে জানালাম। সকলেই এফিলেশন নিতে রাজি হলেন। সর্বসম্মতিক্রমে প্রস্তাব নেওয়া হল। সাপ্তাহিক ইত্তেফাক তখন খুবই জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। মানিক ভাই সব দিয়ে কাগজটি চালাচ্ছেন। আমি তাঁকে দরকার মত সাহায্য করছি। আতাউর রহমান সাহেবও সাহায্য করতে ক্রটি করেন নাই।

এই সময় মওলানা সাহেব অসুস্থ হয়ে পড়ায় তাঁকে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। সরকার তার কেবিন খরচ দিতে রাজি হল না। ওয়ার্ডে রাখতে রাজি আছে। কেবিনে থাকতে দিতে আপত্তি নাই, তবে খরচটা বাইরে থেকে দিতে হবে আমাদের। মওলানা ভাসানী বন্দি, টাকা পয়সা কোথায় পাবেন? সরকারের খরচ দেওয়া উচিত, তবুও দেবে না। কতটুকু নিচ হলে এ কাজ করতে পারে একটা সরকার। আমাকে মওলানা সাহেব খবর দিলেন, কি করবেন? মহাবিপদে পড়লাম, টাকা কোথায় পাব, আর কেইবা আমাদের সাহায্য করবে? দশ দিনে প্রতিদিন প্রায় একশত পঞ্চাশ টাকা করে লাগবে। কেবিনে থাকলে ঔষধ এবং অন্যান্য জিনিস নিজের কিনতে হবে। তবুও আমি মওলানা সাহেবকে কেবিনে যেতে বললাম এবং টাকার বন্দোবস্তে লাগলাম। আতাউর রহমান সাহেবও কিছু সাহায্য করবেন বললেন। আমার এক সরকারি কর্মচারী বন্ধু এবং আনোয়ারা খাতুনও মাঝে মাঝে সাহায্য করতেন। তবে একজনের কথা স্বীকার করা দরকার। হাজী গিয়াসউদ্দিন নামে একজন বন্ধু ছিলেন আমার। তিনি ব্যবসা করতেন। কোনোদিন আওয়ামী লীগের সভ্য হন নাই; তবে আমাকে ভালবাসতেন। তাঁর বাড়ি কুমিল্লায়। যখন আর কোথাও টাকা জোগাড় করতে পারি নাই, তখন তার কাছে গেলে কখনও আমাকে খালি হাতে ফিরে আসতে হয় নাই। দশ দিনের মধ্যেই টাকা জোগাড় করতে হত। দেরি হলেই মওলানা সাহেবের কাছে নোটিশ আসত আর মওলানা সাহেব আমাকে চিঠি দিতেন হাসপাতাল থেকে। দু’একবার মওলানা সাহেবের সাথে আমি হাসপাতালে সাক্ষাৎও করেছি। তবে কথা বেশি বলতে পারতাম না। গেলেই পুলিশ বা আইবি কর্মচারী বলতেন, তাদের চাকরি থাকবে না। ফলে আমি বাধ্য হয়ে চলে আসতাম। এই সময় ঢাকার বংশাল এলাকার অনেক কর্মী জনাব আবদুল মালেক ও হাবিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগে যোগদান করে। তারা নিজেরাও টাকা তুলে সাহায্য করত। তখন কর্মীরাই আওয়ামী লীগে টাকা দিয়ে কাজ চালাত।

মওলানা সাহেব যখন হাসপাতালে তখন আমি জেলায় জেলায় সভা করার জন্য প্রোগ্রাম করলাম। আতাউর রহমান খান ও আবদুস সালাম খানের মধ্যে তখন মনে মনে রেষারেষি চলছিল। সালাম সাহেবও সহ-সভাপতি, তাকে কোন গুরুত্ব দেওয়া হয় না, শুধু আতাউর রহমান খানকে দেওয়া হয়। তাই তিনি বলতে আরম্ভ করলেন, তিনি হাইকোর্টের এডভোকেট আর আতাউর রহমান জজ কোর্টের এডভোকেট, বয়সেও তিনি বড়, আর রাজনীতিতেও তিনি সিনিয়র, তবু তাকে গুরুতুও দেওয়া হয় না। আমি তাকে বুঝাতে শুরু করলাম। বললাম, “আতাউর রহমান খান সাহেব পূর্বের থেকেই ঢাকায় আছেন, ঢাকার জনগণ তাঁকে জানে। আপনি ঢাকায় নতুন এসেছেন। এতে কিছুই আসে যায় না।” ওয়ার্কিং কমিটির সভায় একদিন আতাউর রহমান সাহেব সভাপতিত্ব করতেন, আর অন্য দিন আবদুস সালাম খান করতেন। মওলানা সাহেব বন্দি। আমি পড়লাম বিপদে। সালাম সাহেব কর্মীদের সাথে মিশতে জানতেন না। দরকার মত তাকে পাওয়া কষ্টকর ছিল। কিন্তু আতাউর রহমান সাহেবকে যে কোন সময় ডাকলে পাওয়া যেত। কাজী গোলাম মাহাবুব আত্মগোপন করে থাকার সময় ও পরে জেলে গেলে আতাউর রহমান সাহেব রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের ভারপ্রাপ্ত আহ্বায়ক হন। ফলে তিনি কর্মী ও ছাত্রদের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে মেলামেশা করার সুযোগ পান। যে কোন সময় আতাউর রহমান সাহেবকে পেতাম। ফলে আমিও তাঁর দিকে বেশি ঝুঁকে পড়েছিলাম। তিনি কোনো সময় কোনো কাজে আপত্তি করতেন না। তাঁর নিজের উদ্যোগ খুব কম ছিল, তবুও ডাকলে পাওয়া যেত। আমি বাইরে প্রকাশ করতাম

যে, আতাউর রহমান সাহেবকে আমি বেশি পছন্দ করি। আমি সালাম সাহেবকে বললাম, আতাউর রহমান সাহেবকে নিয়ে আওয়ামী লীগ গড়তে উত্তরবঙ্গে যাচ্ছি। আপনি আমার সাথে ফরিদপুর, কুষ্টিয়া, যশোর ও খুলনা যাবেন। তিনি রাজি হলেন।

আতাউর রহমান সাহেব ও আমি পাবনা, বগুড়া, রংপুর ও দিনাজপুরে প্রোগ্রাম করলাম। নাটোর ও নওগাঁয় কমিটি করতে পেরেছিলাম, কিন্তু রাজশাহীতে তখনও কিছু করতে পারি নাই। দিনাজপুরে সভা করলাম, সেদিন বৃষ্টি ছিল। তাই লোক বেশি হয় নাই। রাতে এক কর্মিসভা করে রহিমুদ্দিন সাহেবের নেতৃত্বে একটা জেলা কমিটি করলাম। এইভাবে বিভিন্ন জেলায় কমিটি করতে পারলাম। কিন্তু রাজশাহীতে পারলাম না। পাবনায়ও কেউ এগিয়ে আসল না। থাকার জায়গা পাওয়া কষ্টকর ছিল। পরে ক্যাপ্টেন মনসুর আলী ও আবদুর রব ওরফে বগাকে দিয়ে একটা কমিটি করলাম। অন্য কোনো লোক পাওয়া গেল না বলে, কয়েকজন ছাত্রের নাম দিয়ে দিলাম। পাবনায় ছাত্রলীগের কর্মীরা দুই ঘণ্টার নোটিশে এক সভা ডাকল টাউন হল মাঠে। মাইক্রোফোন ছিল না। আমি ও আতাউর রহমান সাহেব মাইক্রোফোন ছাড়াই সভা করলাম। এইভাবে উত্তরবঙ্গ সেরে আবার দক্ষিণ বঙ্গে রওয়ানা করলাম। কুষ্টিয়া, যশোরে ভাল কমিটি হল। খুলনায় কোন বয়েসী লোক পাওয়া গেল না। আমার সহকর্মী যুবক শেখ আবদুল আজিজ সভাপতি এবং মমিনুদ্দিনকে সেক্রেটারি করে জেলা আওয়ামী লীগ গঠন করলাম। সালাম সাহেব আপত্তি করছিলেন। আমি বললাম, “বয়স্ক লোক না পাওয়া গেলে প্রতিষ্ঠান গড়ব না মনে করেছেন। দেখবেন এরাই একদিন এই জেলার নেতা হয়ে কাজ করতে পারবে। যেখানে এডভোকেট সাহেবরা যেতে পারে নাই, সে সমস্ত জেলায় আমি একলাই যেতাম এবং সভা করতাম, কমিটি গঠন করতাম। জুন, জুলাই, আগস্ট মাস পর্যন্ত আমি বিশ্রাম না করে প্রায় সমস্ত জেলা ও মহকুমা ঘুরে আওয়ামী লীগ শাখা গঠন করতে সক্ষম হয়েছিলাম।

শামসুল হক সাহেব পূর্বেই ময়মনসিংহে কমিটি গঠন করেছিলেন। জনাব আবুল মনসুর আহমদ সাহেব কলকাতা থেকে ফিরে এসেছেন। তিনি আওয়ামী লীগের সভাপতি হলেন এবং হাশিমউদ্দিন সাহেবকে সেক্রেটারি করলেন। হাশিমউদ্দিন আহমদ সাহেব, রফিকুদ্দিন ভূঁইয়া, হাতেম আলী তালুকদার রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সময় গ্রেফতার হয়ে রাজবন্দি হিসাবে জেলে ছিলেন। নোয়াখালীতে আবদুল জব্বার খদ্দর সাহেব জেলা কমিটি গঠন করেছেন। চট্টগ্রামে আবদুল আজিজ, মোজাফফর আহম্মদ, জহুর আহমদ চৌধুরী ও কুমিল্লায় আবদুর রহমান খান, লাল মিঞা ও মোশতাক আহমদ আওয়ামী লীগ গঠন করেছেন। আমি এই সমস্ত জেলায়ও ঘুরে প্রতিষ্ঠানকে জোরদার করতে চেষ্টা করলাম। আগস্ট মাসের শেষের দিকে বরিশাল হয়ে বাড়ি যেতে হল, টাকা পয়সার খুব অভাব হয়ে পড়েছে। কিছুদিন বাড়িতে থাকলাম, তারপর ঢাকায় ফিরে এলাম। লপড়া ছেড়ে দিয়েছি। আব্বা খুবই অসম্ভষ্ট, টাকা পয়সা দিতে চান না। আমার কিছু একটা করা দরকার। ছেলেমেয়ে হয়েছে, এভাবে কতদিন চলবে! রেণু কিছুই বলে না, নীরবে কষ্ট সহ্য করে চলেছে। আমি বাড়ি গেলেই কিছু টাকা লাগবে তাই জোগাড় করার চেষ্টায় থাকত। শেষ পর্যন্ত আব্বা আমাকে টাকা দিলেন, খুব বেশি টাকা দিতে পারেন নাই, তবে আমার চলবার মত টাকা দিতে কোনোদিন আপত্তি করেন নাই। আমার নিজের বেশি কোনো খরচ ছিল না, একমাত্র সিগারেটই বাজে খরচ বলা যেতে পারে। আমার ছোট ভাই নাসের ব্যবসা শুরু করেছে খুলনায়। সে আমার ছেলেমেয়েদের দেখাশোনা করে। বাড়ি থেকে তার কোনো টাকা পয়সা নিতে হয় না। লেখাপড়া ছেড়ে দিয়েছে। মাঝে মাঝে কিছু টাকা বাড়িতে দিতেও শুরু করেছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *