ইসলাম

ইসলাম (প্রবন্ধ) – গোলাম মোস্তফা

ভূমিকা

আমাদের এই সংশয়জড়িত কালে মরহুম গোলাম মোস্তফা এক উজ্জ্বল বিশ্বাসের প্রতীক। জীবন থেকে আহরিত সেই ব্যক্তিক বিশ্বাস তার কাব্য ও সাহিত্যকে পরম সত্যের পথে নিঃসংশয়চিত্তে বহন করেছে। জীবন-সাধনার মতোই সাহিত্যের ক্ষেত্রেও তিনি কখনো দ্বিধা-দ্বন্দ্বে কিংবা সংশয়বাদিতায় পথভ্রষ্ট হননি।

কাব্যে প্রেম ও ইসলাম মূলতঃ উপজীব্য হলেও, গদ্যে তার বিষয়-বৈচিত্র্য লক্ষণীয়। ইসলামী চিন্তাধারাকে গদ্যরচনার ক্ষেত্রে আহ্বান করেছেন তিনি; কিন্তু ধর্মসর্ব চিন্তায় তাকে নিঃশেষিত হতে দেখা যায় না। রাজনীতি; ভাষা-সাহিত্য-শিক্ষা-আরো বিভিন্নমুখী ধ্যানধারণা তার প্রেক্ষাপটে বিস্তৃত।

কাব্যরচনায় গোলাম মোস্তফা মৌল আবেগের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। আবেগের প্রাবল্যে সংক্রমিত তার কাব্য উদ্বেল ও উচ্ছল। অপর পক্ষে, গদ্য বা প্রবন্ধ রচনায় তিনি আশ্চর্যভাবে যুক্তিবাদ ও ইতিহাস-আশ্রিত। এ-জন্যে তার গদ্যরচনাবলী প্রগাঢ় বাক্যচেতনায় কেবল বিশেষ ভারে অবলম্বন নয়; বিবিধ চিন্তাময় বক্তব্যেও মুখর। অবশ্য কবির আন্তরিক আবেগ ভাষাকে প্রাঞ্জল, গতিশীল ও সাবলীল করে তুলেছে।

গোলাম মোস্তফার সাহিত্যিক-রীতি ঐতিহ্য-সূত্রে প্রাপ্ত বিশ্বাসের আলোকে উজ্জ্বল। এ-জন্যে ধর্মীয় গদ্যরচনায় তিনি চিত্তকে আবিষ্ট ও আকৃষ্ট করেন। তার বিশ্বনবী আমাদের সত্তার বিশ্বাসের চিন্ময় বিস্তার। অন্যান্য গদ্যে, বিশেষতঃ প্রবন্ধাবলীতেও তিনি ঐতিহ্য-আহৃত বিশ্বাস দ্বারা ধ্রুব-সত্যের আবিষ্কারে নিঃশঙ্ক অভিসার-উনখ। গোলাম মোস্তফার বাক্যবাণী এহন বিশ্বাসের আশ্বাসে এক সফলতার তোরণে উত্তরণ-প্রয়াসী।

বর্তমান সংকলনে তিনি চিরন্তন সমস্যাদি উপস্থাপিত করে নতুন মূল্যবোধে যাচাই করেছেন। আবার কখনো আপাতঃ সমাধানকে নতুন সমস্যায় উজ্জীবিত করে তুলেছেন। নতুন বিষয়বস্তুকে প্রশ্নের তীক্ষ্ণ তীরে বিদ্ধ করার প্রক্রিয়া তার অজ্ঞাত ছিল না; দুর্বার মানসিক শক্তিও ছিল। এদিক থেকে মরহুম গোলাম মোস্তফার প্রবন্ধ-সংকলন বিশেষ ভাবে মূল্যায়নের দাবী রাখতে পারে।

সৈয়দ আলী আহসান
চট্টগ্রাম ৬৬/৬৮

আরয

আর মরহুম কবি গোলাম মোস্তফা সাহেবের “প্রবন্ধ-সংকলন” পুস্তকাকারে প্রকাশ করলাম। “প্রবন্ধ-সংকলন” মরহুম কবির বহু পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত ও সভা-সমিতিতে পঠিত প্রবন্ধসমূহের একটি সংকলন। আমার মরহুম স্বামী কবি গোলাম মোস্তফা তার বিবিধ প্রবন্ধের ধারাবাহিকতার ক্রমিক অনুসারে “আমার চিন্তাধারা” প্রকাশ করে গেছেন। জীবনের প্রারম্ভ থেকে শুরু করে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত অবিরাম লেখনী চালিয়ে তিনি যতো প্রবন্ধ, গল্প ও কবিতা লিখে গেছেন তার থেকে হয়তো স্বভাব কবির মানসিকতার প্রতিফলন স্বরূপ “আমার চিন্তাধারা। কিন্তু সংকলন হিসাবে যা আজও রয়েছে অপ্রকাশিত অন্ধকারের গহ্বরে, তারও প্রয়োজন আছে বাইরে বেরিয়ে আসবার, তাই আমার মরহুম স্বামীর আরব্ধ কাজ শেষ করার অভিলাষে আমার এই প্রচেষ্টা। যে-সমস্ত প্রবন্ধ নিয়ে এই সংকলন বের করবার গুরুদায়িত্ব মাথায় নিয়েছি তার বিচারের ভার দেশবাসীর উপর রইলো।

প্রকাশিত ও অপ্রাশিত প্রবন্ধসমূহের একটি সংকলন বের করবার ইচ্ছা আমার অনেকদিন থেকে ছিল। আজ যদি কবি বেঁচে থাকতেন, তবে এই গুরুদায়িত্ব আমাকে বহন করতে হোত না।

কবির বহুমুখী প্রতিভা, তার সুদূর প্রসারী চিন্তাধারা, মানবতা বোধ, সাহিত্য ও সংস্কৃতির উপর অগাধ জ্ঞানের জন্য লেখক সমাজে তিনি চির অমর হয়ে থাকবেন। কবি একাধারে সাহিত্যিক, সঙ্গীতজ্ঞ ও সুরশিল্পী ছিলেন। শেষ বয়সে তিনি ইসলামিক ধ্যান ধারণা, প্যান-ইসলামিজমের চিন্তাধারা ও বিশ্ব-মুসলিম ভ্রাতৃত্ববোধের উপর আলোকপাত করে গেছেন এবং তা প্রচারের প্রচেষ্টায় আত্মনিয়োগ করেছিলেন, তারই ফলস্বরূপ আল কুরআন দ্বিতীয় খণ্ড” ও বিশ্বনবীর উরদু সংস্করণ অপ্রকাশিতভাবে শেষ করে গেছেন। তার মননশীলতা, সহজ জীবনবোধ ও ভাবগম্ভীর প্রাঞ্জল ভাষা পাঠক-পাঠিকার চিত্ত জয় করতে সহায়তা করেছে। আবাল-বৃদ্ধবণিতা তাঁর কাব্য, সাহিত্য, প্রবন্ধ ও গল্প হতে জীবনের অনেক সমস্যার সমাধান পেয়েছে। কল্পনার রঙে রাঙিয়ে জীবনকে তিনি দেখেননি, তিনি দেখেছেন সাদামাটা মানুষের জীবনের অতীত ঐতিহ্য, বর্তমানের সমস্যাবলী ও ভবিষ্যতের এক সুন্দর “মরদে-মুমিন”।

মানুষকে তিনি ভালোবেসেছিলেন এক মহাজীবনের অধিকারী হিসাবে। মানুষের মধ্যে তিনি দেখেছিলেন এক মহাজীবনের আহ্বান, তারই জয়গান তিনি গেয়েছেন। কলুষ কালিমালিপ্ত যে জীবনবেদ তাকে তিনি ঘৃণা করেছেন। জাতির ঐতিহ্য, তাহজীব-তমদুন, শিক্ষা-সংস্কৃতি রূপ পেয়েছে তাঁর কাব্যে, প্রবন্ধে ও কবিতার মাধ্যমে। মহাকবি ইকবাল, হাফিজ, রুমি, রবীন্দ্রনাথের আদর্শে তিনি প্রভাবান্বিত। তবুও তার স্বাতন্ত্র্যবোধ, অনাবিল চিন্তাধারা তার নিজস্ব স্বকীয়তায় পরিপূর্ণ। স্বজাত্যবোধ ও জাতীয় চিন্তাধারার উন্মেষ তার চলার পথের পাথেয়।

এই প্রবন্ধ-সংকলন’-এ প্রাক-পাকিস্তান যুগ থেকে আরম্ভ করে সংগ্রামী যুগ পেরিয়ে পাকিস্তানে এসেছে। যুগ-প্রবাহের সঙ্গে সংযোগ রেখে তাই এগুলো পড়তে হবে। প্রবন্ধগুলো চার ভাগে ভাগ করা হয়েছে- (ক) ইসলাম, (খ) রাজনীতি, (গ) ভাষা, সাহিত্য ও শিক্ষা এবং (ঘ) বিবিধ। বিভাগগুলো কবির চিন্তাধারার মূল্যায়নে সহায়তা করবে বলে আশা করি।

কবির ভাষায় : “পুস্তকখানি আর একটা কারণে পাঠক-পাঠিকার কাছে আকর্ষণীয় হবে বলে আশা করা যায়। এই পুস্তক লেখকের অন্তর্লোকের একটি প্রবেশ দুয়ার। এই দুয়ার দিয়ে পাঠক তার মনোলোকে প্রবেশ করবেন এবং সেই সুযোগে লেখকের অন্তর মানুষটাকে দেখে ফেলবেন।”

কবির চিন্তাধারার বিভিন্ন দিক নজরুল ইসলামের উপর লেখা প্রবন্ধগুলিতে প্রতিফলিত হয়েছে বলে আমি বিশ্বাস করি। বিভিন্ন অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে লেখা এই প্রবন্ধগুলোতে নজরুল জীবনের আলোচনা ও সমালোচনা দুই-ই আছে। আশা করি পাঠক-পাঠিকা নিরপেক্ষ ভাবে বিচার করে দেখবেন যে কবির মানসলোকের ভাবধারা থেকে উৎসারিত এই প্রবন্ধগুলো নজরুল-মানসের বিভিন্ন দিক বিচার করে লিখিত কিনা। মতের পরিবর্তন ও পরিবর্ধন হয়তো অনেক আছে, কবি নিজেই বলেছেনঃ “রাজনীতির ন্যায় কাব্য-সাহিত্য ও দর্শন-বিজ্ঞানেও এমন মত-পরিবর্তন স্বাভাবিক। এলিয়ট, রবীন্দ্রনাথ, ইকবাল, নজরুল প্রত্যেকের চিন্তাধারাতেই পূর্বাপর কিছু না কিছু স্ববিরোধিতা আছে।”

কবির মৃত্যুর পর জনাব সৈয়দ আলী আশরাফ সাহেবের সম্পাদনায় কবির কাব্য সংকলন বের হয়েছে এবং পাঠক সমাজে তা আদৃত হয়েছে। আশা করি আমার এই প্রচেষ্টা “প্রবন্ধ সংকলন” পাঠক সমাজে আদৃত হবে।

এই পুস্তক সংকলনে আমি অনেকের নিকট ঋণি, তার মধ্যে জনাব সৈয়দ আলী আহসান সাহেবের নাম সর্বাগ্রে উল্লেখযোগ্য। জনাব সৈয়দ আলী আহসান সাহেব পুস্তকটির সম্পাদনার ব্যাপারে আমাকে সাহায্য করেছেন। এজন্যে আমি তাঁর নিকট কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। জনাব আবদুল কাদির সাহেব এবং আমার ভগ্নিপতি নারায়ণগঞ্জের ডাঃ জেড রহমান নানাভাবে সাহায্য ও সহায়তা করেছেন, তাদের নিকটও আমি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।

এ প্রসঙ্গে আমার জ্যেষ্ঠা কন্যা ফিরোজা খাতুনের নামও সমানভাবে উল্লেখযোগ্য। কেননা তার সহযোগিতা ব্যাতিরেকে এ সংকলন প্রকাশ করা আমার পক্ষে সত্যিই দূরুহ ছিল। প্রকৃতপক্ষে তারই অনুপ্রেরণায় আমি এ কাজে ব্রতী হয়েছিলাম।

পরিশেষে আমি গ্রন্থ প্রকাশক আহমদ পাবলিশিং হাউসের স্বত্তাধিকরী জনাব মহিউদ্দীন আহমদকে ঐকান্তিক ধন্যবাদ জ্ঞাপন করছি। নানা প্রতিকূলতা সত্বেও তিনি যে নিষ্ঠা ও আন্তরিকতা নিয়ে গ্রন্থ প্রকাশে এগিয়ে এসেছিলেন, তাতে মরহুম কবির স্মৃতির প্রতি তার শ্রদ্ধা ও মমত্ববোধেরই প্রকাশ সূচিত হয়েছে।

প্রবন্ধ-সংকলনের ২য় খণ্ড পরে প্রকাশ করবার ইচ্ছা রইলো।

শেষ কথা, আমার এই প্রথম প্রচেষ্টা “প্রবন্ধ-সংকলন” আমি কবির দেশবাসীর তথা পাঠক পাঠিকার উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করলাম। কবির রুহের শান্তি ও মাগফেরাত কামনা করি।

মাহফুজা খাতুন
মোস্তফা মঞ্জিল
শান্তিনগর, ঢাকা
২৬/৬/৬৮

বদর-যুদ্ধে রাসূলুল্লাহর ভূমিকা

বদর-যুদ্ধ ইসলামের ইতিহাসের একটি যুগপ্রবর্তক ঘটনা। এ কোনো একটা সাধারণ সামরিক অভিযান নয়। রাসূলুল্লাহ্ খামাখাই ৩১৩ জন মুসলিম সৈন্যের একটি ক্ষুদ্র বাহিনী লইয়া বদর অভিমান করেন নাই। এর পশ্চাতে ছিল একটা গভীর রাজনীতি ও কুটনীতির খেলা। রাষ্ট্র সংগঠনে বা যুদ্ধ পরিচালনায় কুটনীতির (Stratagem) প্রয়োজন হয়। সব কিছু প্রকাশ্যে খোলাখুলিভাবে করিতে গেলে অনেক প্রচেষ্টাই পণ্ড হইয়া যায়। শুধু যুদ্ধ বিগ্রহ কেন, জীবনের অধিকাংশ কাজই কৌশল ও বুদ্ধি লইয়া করিতে হয়। কাজেই, যাহারা মনে করেন-যেহেতু হযরত মুহম্মদ (সাঃ) পয়গম্বর ছিলেন, অতএব তিনি সব কাজই খোলাখুলি ভাবে করিতেন, তাহারা ভুল করিবেন। সদুদ্দেশে অনেক কাজ কৌশলে করাতে বাধা নাই। ইসলাম তাহা সমর্থন করে। ইসলাম এমন নীতি-বাক্যের ধর্ম নহে যাহা জীবনে কার্যকরী হয় না। কোরআন শরীফের একটি আয়াত এখানে উদ্ধৃত করিতেছি যাহা হইতে পাঠক সুস্পষ্ট ধারণা করিতে পারিবেন ইসলামের যুদ্ধনীতি কিরূপ।

যাহারা বিশ্বাসঘাতক তাহাদের সম্বন্ধে আল্লাহ্ বলিতেছেন–

واما تخافن من قوم خيانة فانبذ اليهم على سواء.

ان الله لايحي الخائنين *

অর্থাৎ : যদি তোমরা আশঙ্কা করো যে, বিধর্মীরা বিশ্বাসঘাতকতা করিবে, তবে তোমরাও তাহাদের সহিত তদ্রপ ব্যবহার করো। নিশ্চয়ই আল্লাহ বিশ্বাসঘাতকদিগকে ভালোবাসেন না।-(৮ : ৫৮)।

পাঠক এখানে লক্ষ্য করিবেন যে, যাহারা বিশ্বাসঘাতকতা করিবে, তাহাদের প্রতিই পাস্টা বিশ্বাসঘাতকতা করিবার কথা এখানে বলা হইতেছেনা, শক্ররা বিশ্বাসঘাকতা করিতে পারে-এরূপ নিশ্চিত আশঙ্কা জন্মিলেও পূর্বাহ্নেই যে কোনো চুক্তিবদ্ধ ব্যাপারে চুক্তিভঙ্গ করা যায় এবং তাহাতে কোনো দোষ হয় না। সত্য ও কল্যাণের প্রশ্নই শেষ প্রশ্ন।

যুদ্ধে যে ধোকাবাজি (Diplomacy) অসংগত নয়, স্বয়ং রাসূলুল্লাহ্র একটি হাদিস হইতেও তাহা প্রমাণিত হয়। তিনি বলিয়াছেন।

عن جابر (رض) قال رسول الله الحرب خدعة *

অর্থাৎ : (জাবের বলিয়াছেন) রাসূলুল্লাহ বলিয়াছেন যুদ্ধ ধোকাবাজীপূর্ণ।

কাজেই বদর-যুদ্ধের পূর্বে এবং পরে রাসূলুল্লাহ যতোগুলি অভিযান করিয়াছেন, তাহার সবগুলিই যে প্রতিরোধ বা আত্মরক্ষামূলক (Defensive) এরূপ মনে করিবার কোনো সংগত কারণ নাই। বদর-যুদ্ধের পূর্ববর্তী ও পরবর্তী অনেক অভিযানে রাসূলুল্লাহকে সম্পূর্ণ নিরীহ দেখাইবার জন্য অনেকে শত্রুপক্ষের ক্রিয়াকলাপকেই সম্পূর্ণরূপে দায়ী করেন এবং সেগুলোকেই রাসূলুল্লাহর সমর্থনের যুক্তিরূপে ব্যবহর করেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রে ইহা সত্য বটে, কিন্তু সব ক্ষেত্রে নয়। সত্যকে জয়যুক্ত করিবার নীতি হিসাবে এবং মিথ্যাকে প্রতিরোধ করিবার প্রয়োজনেও অনেক ক্ষেত্রে রাসূলুল্লাহকে আক্রমণাত্মক ভূমিকায় অবতীর্ণ হইতে হইয়াছে। বদর অভিযানের মধ্যেও ছিল এমনি এক সত্য ও আদর্শের প্রশ্ন। রাসূলুল্লাহ্ যে কতো বড় কুটনীতিবিশারদ দূরদর্শী সংগঠনী নেতা ছিলেন, বদর-যুদ্ধে তাহার প্রমাণ পাওয়া যায়। আমরা এখানে তাই বদর যুদ্ধের আনুপূর্বিক ঘটনাবলীকে কিছুটা নতুন আলোকে উদ্ঘাটিত করিবার প্রয়াস পাইতেছি।

বদর-যুদ্ধ

মক্কার কোরেশদিগের সগ্রামী মনোভাব ও গোপন সমরায়োজন লক্ষ্য করিয়া আঁ-হযরত মদিনাবাসীদিগকে অস্ত্রধারণ করিতে আহ্বান করিলেন। ইতোপূর্বে যে সনদপত্র স্বাক্ষরিত হইয়াছিল তাহার একটি শর্ত এই ছিল যে, বহিঃশত্রুর দ্বারা যদি মদিনা আক্রান্ত হয়, তবে জাতিধর্মনির্বিশেষে সকলে মিলিয়া দেশ রক্ষা করিবে। কিন্তু হযরত পরিষ্কার বুঝিতে পারিলেন ইহুদী ও খৃষ্টানদিগের মধ্যে সে মনোভাব আদৌ নাই। বরং তাহারা এমন ব্যবহার দেখাইতে লাগিল যেন কোরেশগণ মদিনা নগরী আক্রমণ করিয়া নব-জাগ্রত মুসলিম শক্তিকে ধ্বংস করিয়া দিলেই তাহারা খুশী হয়। শুধু তাই নয়, তাহারা যে তলে তলে কোরেশদিগের সঙ্গে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত আছে, এ সংবাদও হযরতের অজানা নাই। আঁ হযরত ইহাতে দমিলেন না। বুঝিলেন মুসলমানদিগকে দুই সীমান্তেই যুদ্ধ করিতে হইবে। তবে উভয় শত্রুকে এক যোগে ক্ষেপাইয়া দেওয়া বুদ্ধিমত্তার কাজ হইবে না ভাবিয়া তিনি সর্বপ্রথম কোরেশদিগকে দমন করিতেই বদ্ধপরিকর হইলেন।

এই উদ্দেশ্যে নবীজি আপন ভক্তবৃন্দকে এক পরামর্শ সভায় আহ্বান করিলেন। সমর পরিস্থিতির আলোচনা করিতে গিয়া তিনি বুঝাইয়া দিলেন, আবু সুফিয়ানকে অস্ত্রশস্ত্রসহ সিরিয়া হইতে নির্বিঘ্নে মক্কায় ফিরিয়া যাইবার সুযোগ দিলে বিপদ আরও ঘনীভূত হইবে। তৎকালে মক্কা হইতে সিরিয়া যাইতে হইলে বদরের গিরিপথ দিয়া যাইতে হইত। বদর ছিল মক্কা, মদীনা ও সিরিয়ার রাজপথের সন্ধিস্থল এবং মদীনার এলাকাধীন। কাজেই মদীনার বিরুদ্ধে ব্যবহারের জন্য মদীনার মধ্য দিয়াই শক্ররা মারাত্মক অস্ত্রশস্ত্র ও রসদপত্র লইয়া দেশে ফিরিবে অথচ মদীনাবাসীরা তাহাতে বাধা দিবে না, ইহার নাম নিজেদের মৃত্যু-পরোয়ানায় দস্তখৎ ছাড়া আর কিছু নয়। দুই দেশ যখন যুদ্ধের অবস্থায় (State of belligerency) আসিয়া যায়, তখন এরূপ ব্যাপার সংঘটিত হইতে দেওয়া কিছুতেই আর সম্ভব হয় না। কোনো আন্তর্জাতিক নীতিই ইহা সমর্থন করে না। রাসূলুল্লাহ্ তাই মনস্থ করিলেন, সিরিয়া হইতে রণসম্ভারসহ ফিরিবার পথে বদর-প্রান্তে তিনি আবু সুফিয়ানকে বাধা দিয়া তাহার অস্ত্রশস্ত্র কাড়িয়া লইবেন।

এই ব্যাপারই পরামর্শ সভায় আলোচিত হইল। রাসূলুল্লাহ সকলের মতামত জিজ্ঞাসা করিলেন। আবু বকর ও আলি রাসূলুল্লাহর কথায় সায় দিয়া বলিলেন, কালবিলম্ব না করিয়া বদর-প্রান্তরে অভিযান করা উচিত। আল-সিকদাদ নামক এক সাহাবী উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিলেন : ইয়া রাসূলুল্লাহ, আল্লাহর নির্দেশে আপনি যেখানে খুশি চলুন, আমরা আপনার সঙ্গে যাইব। হযরত মূসার শিষ্যদিগের ন্যায় আমরা এ কথা বলিব না, হে মূসা, তুমি আর তোমার প্রভু গিয়া যুদ্ধ করো, আমরা ঘরে বসিয়া থাকি। আমাদের কথা হইতেছে। আল্লাহর নামে আপনি যুদ্ধে চলুন, আমরাও আপনার সহিত যুদ্ধে যাইব। এই কথায় রাসূলুল্লাহ্ উৎসাহিত হইয়া উঠিলেন।

অতঃপর আনসারদিগের প্রতি চাহিয়া তিনি তাহাদের মনোভাব জানিতে চাহিলেন। তখন আনসার নেতা সাদ-বিন-মাজ উঠিয়া বলিতে লাগিলেনঃ হে রাসূলুল্লাহ, আনসারদিগের সম্বন্ধে চিন্তা করিবেন না। জীবনে-মরণে সুখে-দুঃখে ছায়ার ন্যায় আমরা আপনাকে সর্বদা অনুসরণ করিব। আপনি যেখানে যাইতে বলিবেন সেখানেই যাইব, যেখানে থামিতে বলিবেন সেখানেই থামিব। সাগরে ঝাঁপ দিতে বলিলে ঝাঁপ দিব, ডুবিতে বলিলে ডুবিব, মরিতে বলিলে মরিব।

শিষ্যদিগের এই মনোবল দেখিয়া হযরত যারপরনাই আশান্বিত হইলেন। অবিলম্বে অভিযানের জন্য তিনি প্রস্তুত হইতে লাগিলেন।

কিন্তু তবুও শিষ্যদিগের মধ্যে কিছুটা মত-বিরোধ দেখা দিল। একদল বলিলেন, শকে পূর্বাহ্নেই দূর হইতে বাধা দেওয়া উচিত। অন্যদল বলিলেনঃ মদীনা নগরে যখন ইহুদী-নাসারা ও অন্যান্য গৃহশ বিদ্যমান তখন সমস্ত মুসলমানের একযোগে নগর ত্যাগ করিয়া দূরে যাওয়া কিছুতেই যুক্তিসঙ্গত হইবে না। হযরত দেখিলেন দুই দিকেই সত্য আছে। তখন তিনি মুসলমানদিগকে দুই দলে বিভক্ত করিলেন। যাহারা মদীনায় থাকিবার পক্ষপাতি ছিলেন তাহাদিগকে মদীনাতেই রাখিয়া দিলেন আর যাহারা অভিযানে যাইতে ইচ্ছুক তাহাদিগকে লইয়া তিনি একটি স্বেচ্ছাবাহিনী বাহিনী গঠন করিলেন। এরূপ যিন্দাদিল দুঃসাহসিক মুসলিম বীরের সংখ্যা মিলিল মাত্র ৩১৩। তাহাদের অস্ত্রশস্ত্র আবার নিতান্ত মামুলী ধরনের। অশ্বারোহী সৈন্য মাত্র দুইজন। আর যানবাহনের জন্য পাওয়া গেল মাত্র ৭০টি উট।

এই ক্ষুদ্র বাহিনী লইয়াই হযরত আজ বাহির হইলেন সেনাপতির বেশে। আজ তাহার বীরমূর্তি। হাতে নাঙ্গা তলোয়ার। শিরে বাঁধা আমামা। রাত্রির অন্ধকারে নিঃশব্দে তাহারা গৃহত্যাগ করিলেন। নিজেদের গতিবিধি গোপন করিবার জন্য উটের গলার ঘন্টাগুলি কাটিয়া দেওয়া হইল। মুষ্টিমেয় এই সত্যের সৈনিকদল নীরবে বদর অভিমুখে যাত্রা করিলেন।

ইসলাম আজ সর্ব প্রথম দৃপ্ততেজে মাথা তুলিয়া দাঁড়াইল। তাহার প্রচ্ছন্ন রণমূর্তি আজ জগতে আত্মপ্রকাশ করিল। তুমি অন্যায় করিয়া আমার গালে চড় মারিবে আর আমি তোমার দিকে অন্য গালটি ফিরাইয়া দিব, ইসলাম তাহা নহে। তুমি দিনের পর দিন অত্যাচার করিয়া চলিবে, আর আমি তাহা নীরবে সহ্য করিয়া যাইব, ইসলাম তাহা নহে। দুনিয়ার ঝনঝই ঝামেলা হইতে নিরাপদে থাকিবার জন্য সন্ন্যাসী সাজিয়া বনে যাইব, ইসলাম তাহাও নহে। ইসলাম জীবনের ধর্ম। আত্মবিলপ্তি বা পশ্চাদপসরণ তাহার বাণী নহে। নিষ্ক্রিয় প্রতিরোধ বা হিযরতও তাহার মূলনীতি নহে-কৌশল মাত্র। প্রয়োজন হইলে সাময়িক ভাবে অত্যাচার সহ্য করিতে হয়, অথবা হিযরত করিয়া অপেক্ষাকৃত নিরাপদ স্থানে গিয়া উদ্দেশ্য সাধনের নূতন পথ খুজিতে হয়। হিযরতের অর্থ তাই পলায়ন বা আত্মগোপন নহে-প্রতিশোধ গ্রহণেরই এ এক প্রক্রিয়া বিশেষ। সংগ্রাম করিয়া অগ্রসর হও-ইহাই তাহার বাণী। যালিমকে বাধা দাও, মযলুমকে রক্ষ করো, সত্য ও আদর্শের জন্য তরবারি ধরো-প্রয়োজন হইলে মরো-প্রয়োজন হইলে মারো- ইহাই ইসলাম। ইসলামের তরবারি তাই নিরপরাধকে আঘাত করিবার জন্য নয়-আত্মরক্ষার জন্য।.. ন্যায়নীতি ও সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য-অন্যায়ের যথাযযাগ্য প্রতিকারের জন্য। জীবন বিমুখতা, কাপুরুষতা ভীরু হৃদয়ের মিনতি ইসলামে নাই। ইসলাম বলিষ্ঠ ধর্ম-স্বভাবের তটভূমিতে তাহার প্রতিষ্ঠা। স্বভাবে যাহা আছে, ইসলামেও তাহা আছে।

এই মহাসত্যকেই রাসূলুল্লাহ্ আজ প্রথম রূপ দিলেন। এতদিন তাহার এক হাতে ছিল কুরআন অপর হাত ছিল শূন্য। সেই শূন্য হাতে এবার তিনি তুলিয়া লইলেন তরবারি। এক হাতে কুরআন অপর হাতে তলোয়ার-মানুষের এই মহিমময় মূর্তি দেখিয়া কোন্ অর্বাচীন ইহাকে নিন্দা করে? এর চেয়ে সুন্দরতর মূর্তি আর কী হইতে পারে? সত্যের সহিত শক্তির এই যে মিলন-একি ঘৃণার? একি নিন্দার? কিছুতেই নয়। শক্তি ছাড়া সত্য পড়াইতেই পারে না। পক্ষান্তরে শক্তি যদি সত্যাশ্রয়ী না হয়, তাহা হইলেও মানুষের অশেষ দুর্গতি ও অকল্যাণ ঘটে। সত্যহীন শক্তি যুলুমে রূপান্তরিত হয়। জগতে বৃহত্তর কল্যাণের জন্য সত্য ও শক্তির সমন্বয়ের তাই একান্ত প্রয়োজন। ইহাতে শক্তিও সুনিয়ন্ত্রিত, সত্যও উন্নত শিরে তাহার পথ কাটিয়া চলে। প্রত্যেক মানুষের জীবনে তাই চাই সত্য ও শক্তির যুগপথ সাধনা। সত্যের আলো যদি আমাকে পথ দেখায়, সকল মিথ্যা, সকল ভ্রান্তি, সকল অসুন্দর হইতে সে যদি আমাকে বাঁচাইয়া চলে, সঙ্গে সঙ্গে আমার তরবারি যদি আমাকে দেয় সকল বাধা-বিঘ্নকে জয় করিবার বিপুল প্রেরণা; সকল ভীরুতা দুর্বলতাকে দূর করিয়া সে যদি দেয় আমার অন্তরে অসীম সাহস ও মনোবল, তবে আমর ভয় কি? লক্ষ্যস্থলে আমি পৌঁছিবই। ইসলামের সহিত তরবারির এমনই সম্বন্ধ।

কুরআন ও তরবারি তাই আদৌ অসামঞ্জস্য নয়। দুই বিরুদ্ধশক্তির সময়ই তো ইসলাম।

বস্তুতঃ ইসলাম মুসলামানকে দুইটি বস্তুই দান করিয়াছে। একটি কুরআন অন্যটি তলোয়ার। সত্য ও শক্তির, দীন ও দুনিয়ার-দুই চমৎকার প্রতীক এই কুরআন ও তলোয়ার।

ইহাই মুসলমানের সাজা চেহারা-ইহাই তাহার সংক্ষিপ্ত পরিচয়।

এই একহাতে তলোয়ার-আর এক হাতে কুরআনধারী নও-মুসলিমকেই আজ আবার আমরা সারা প্রাণ দিয়া কামনা করি।

হযরত মুহম্মদকে আমরা দেখিলাম আজ এই আদর্শ মুসলিম বেশে। ‘ এই বেশেই বীর নবী চলিলেন যুদ্ধ-অভিযানে।

কাফেলা প্রথমতঃ মক্কার পথ ধরিয়া চলিল, কিন্তু কিছুদূর গিয়া বদরের দিকে মুখ ফিরাইল। দুইদিন পথ-প্রবাস করিবার পর তৃতীয় দিন সন্ধ্যাকালে হযরত সদলবলে বদর গিরি-প্রান্তরে আসিয়া উপণীত হইলেন।

বদর-গিরি উপর জিন দিকে ছিল ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পাহাড়। পূর্ব দিকের একটি পাহাড় হইতে একটি ঝরণা-ধারা ভূমির উপর দিয়া প্রবাহিত হইতেছিল। ওয়াকিফহাল সাহাবাদিগের পরামর্শে হ্যরত সেই ঝর্ণার উৎস-মুথ অধিকার করিয়া ঘঁটি গাড়িলেন। একটি টিলার উপর খর্জুর শাখা ও পত্রাদির দ্বারা হযরতেয় ঐন্য একটি ছাউনি প্রস্তুত করা হইল। সেই ছাউনির মধ্যে হযরত রাত্রি যাপন করিলেন। সাদ-বিন-মাজ সারা রাত্রি সেই ছাউনি পাহারা দিলেন।

সমস্ত বন্দোবস্ত ঠিক হইলে কাফেলা আত্মগোপন করিয়া আৰু সুফিয়ানের প্রতীক্ষায়। রহিল। মাঝে মাঝে দুই একজন সাহাবী নিম্নে নামিয়া ছদ্মবেশে এদিক ওদিক গিয়া খোঁজ খবর লইতে লাগিলেন।

কিন্তু আবু সুফিয়ানও কম ধুরন্দর ছিল না। সিরিয়া হইতে ফিরিবার পথে বদরের সন্নিকটে আসিলেই সে অত্যন্ত সতর্কতার সহিত অগ্রসর হইতে লাগিল। সে ছিল, একজন পাকা গোয়েন্দা। বদর সীমান্তে পদার্পণ করিবার পূর্বেই তাহার সন্দেহ হইল হয়তো-বা মদীনাবাসীরা বদরে আসিয়া এবার তাহাকে বাধা দিবে। সেই আশঙ্কায় সে গোয়েন্দাগিরি শুরু করিয়া দিল। একটি বাজারের সন্নিকটে দুইজন উটওয়ালার সন্ধান পাইয়া সে তাহাদের পদচিহ্ন অনুসরণ করিতে লাগিল। কিয়দ্র গিয়া উটের খানিকটা শুষ্ক বিষ্ঠা দেখিতে পাইল। সেই বিষ্ঠা লইয়া গিয়া ধৌত করিয়া সে দেখিল তাহার ভিতর যে খেজুরের আঁটি রহিয়াছে, তাহা আকারে ছোট। বলা বাহুল্য, মদীনায় যে খেজুর হয়, তাহার আঁটি মক্কার খেজুরের আঁটি অপেক্ষা অনেক ছোট। কাজেই আবু সুফিয়ানের দৃঢ় প্রত্যয় জন্মিল যে এ অঞ্চলে মদীনার লোকেরা ঘোরাফেরা করিতেছে। এই ইংগিত পাইয়া আবু সুফিয়ান বদরের পথ ছাড়িয়া তাহার কাফেলাকে অন্য পথে পরিচালিত করিল। সঙ্গে সঙ্গে জমজম নামক জনৈক কোরেশ দূতকে দ্রুতগামী এক উটে মক্কয় পাঠাইয়া দিল। দূত গিয়া আবু জহলকে এই জরুরী খবর দিল যে, আবু সুফিয়ানের কাফেলাকে হামলা করিবার জন্য মুহম্মদ সসৈন্যে বদরে উপস্থিত। মক্কা হইতে যথেষ্ট সৈন্য, অস্ত্রশস্ত্র ও রসদপত্র না পাঠাইলে আবু সুফিয়ানের আর রক্ষা নাই।

সংবাদ পাওয়া মাত্র আবু জহল এস্তব্যস্তভাবে সমুদয় মক্কাবাসীকে আহ্বান করিয়া এই বিপদ সংবাদ জানাইল এবং তৎক্ষণাৎ যুদ্ধসজ্জায় সজ্জিত হইয়া আসিবার জন্য সকলকে আহ্বান করিল। আবু সুফিয়ানের স্ত্রী রণরঙ্গিনী হিন্দ স্বামীর অমঙ্গল আশঙ্কায় সিংহীর ন্যায় গর্জিয়া উঠিয়া তৎক্ষণাৎ আপন পিতা ওবা, চাচা শায়রা, ভ্রাতা অলিদ ও অন্যান্য বীর পুরুষদিগকে যুদ্ধ যাত্রার জন্য অনুপ্রাণিত করিতে লাগিল। নাখলায় নিহত ও বন্দী কোরেশদিগের আত্মীয় স্বজনও উৎসাহের সঙ্গে সেনাদলে আসিয়া যোগ দিল। মদীনাবাসীদের সুঃসাহস ও স্পধাকে দমন করিতেই হইবে; ইহাই হইল তাহাদের দৃঢ় পণ। অনতিবিলম্বে প্রায় এক হাজার সৈন্যের এক পরাক্রান্ত বাহিনী গঠিত হইয়া গেল। তন্মধ্যে ১০০ অশ্বারোহী ৭০০ উষ্ট্রারোহী ও অবশিষ্ট পদাতিক। এই সেনাকাহিনীর পরিচালক হইল সত্তর বৎসর বয়স্ক কোরেশ নেতা আবু জহল।

মুসলিমদিগের মনের অবস্থা তখন যে কিরূপ তাহা একটু চিন্তা করিলেই অনুমান করা যায়। অকস্মাৎ এমন পটপবির্তন ঘটিবে, কে জানিত। রাসূলুল্লাহও চিন্তিত হইয়া পড়িলেন। তাহারা আসিয়াছিলেন আবু সুফিয়ানের নিরস্ত্র কাফেলাকে আক্রমণ করিতে। কিন্তু সে কাফেলা কোথায় মিলাইয়া গেল, তদস্থলে ভাসিয়া উঠিল সশস্ত্র এক কোরেশ বাহিনী। এর জন্য রাসূলুল্লাহ ঠিক প্রস্তুত হইয়া আসেন নাই। এখন বাধ্য হইয়াই হাঁকে এই কঠিন বাস্তবের সম্মুখীন হইতে হইল। কোরেশ বাহিনীর মুকাবেলা করা ছাড়া উপায়ই বা কী ছিল? শত্রু তো তখন ঘাড়ের উপর চাপিয়া বসিয়াছে। রাসূলুল্লাহ নেতৃস্থানীয় সাহাবীদিগের সহিত পুনরায় পরামর্শ করিলেন। তিনি দেখিলেন, ভক্তবৃন্দ পূর্বের প্রতিজ্ঞায় অটল রহিয়াছেন। আল্লাহ্ ও রসুলের জন্য, ইসলামের জন্য তাহারা প্রত্যেকে প্রাণ দিতে প্রস্তুত। রাসূলুল্লাহ্ তখন দ্বিগুণ উৎসাহে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হইলেন। …দ্বিগুণ বেগে কোরেশ বাহিনী বদর পানে অগ্রসর হইল। অর্ধপথ অতিক্রম করিবার পর আবু সুফিয়ানের নিকট হইতে দ্বিতীয় দূত আসিয়া খবর দিল, আবু সুফিয়ানের কাফেলা মুহম্মদের লোক-লস্করকে এড়াইয়া নিরাপদ স্থানে পৌঁছিয়াছে। এখন সে অন্য পথ দিয়া মক্কায় ফিরিয়া যাইতেছে। কাজেই মক্কা হইতে আর সাহায্য পাইবার কোনো প্রয়োজন নাই।

এই সংবাদে কোরেশ বীরদলের অনেকেই নিরুৎসাহিত হইয়া পড়িল। অনেকে ফিরিয়া যাইতে মনস্থ করিল। কিন্তু আবু জহল প্রমুখ নেতৃবৃন্দ অন্যরূপ যুক্তি দেখাইল। তাহারা বলিল, আমরা যখন এত কষ্ট করিয়া বদরের কাছাকাছিই আসিয়া গিয়াছি তখন মদীনাবাসীদিগকে শায়েস্তা না করিয়া যাইব না। মুহম্মদের সঙ্গে কতোই বা লোক-লস্কর আছে, যুদ্ধই বা কয়জন জানে? কাজেই এ সুযোগ ছাড়া হইবে না। এখান হইতে ফিরিয়া গেলে সকলেই আমাদিগকে কাপুরুষ বলিবে। আমরা তাই কিছুতেই ফিরিব না। আমাদের সঙ্গে নর্তকী আছে, গায়ক-গায়িকা আছে, আমরা বরং বদরে গিয়া আবু সুফিয়ানের নিরাপত্তা ও রণ-চাতুর্যের জন্য আনন্দোৎসব করিব আর মুহম্মদ ও তাহার লোক-লস্করকে আমরা যে পরাজিত করিব, ইহা তো সুনিশ্চিত!

ইহাই ভাবিয়া কোরেশগণ দ্বিগুণ উৎসাহে বদর পানে অগ্রসর হইল। গ্রীষ্মকাল। রমযান মাস। কোরেশগণ হাঁফাইতে বদরে আসিয়া উপনীত হইল। পানির সন্ধানে কতিপয় সৈন্যকে সামনে অগ্রসর হইবার জন্য আবু জহল নির্দেশ দিল।

কয়েকজন লোক ঘুরিয়া ফিরিয়া সেই ঝরণার ধারে আসিয়া যেই পানি খাইতে নামিয়াছে অমনি বীরবর হামজা গুপ্তস্থান হইতে তাহার দল লইয়া সেই লোকগুলিকে আক্রমণ করিলেন। হামজা নিজে কোরেশদের সর্দারকে হত্যা করিলেন। কয়েকজন বন্দী হইল এবং একজন পলাইয়া আবু জহলকে এই সংবাদ দিল। আবু জহল বিচলিত হইয়া উঠিল। তাহারা যে শত্রু সৈন্যের এত কাছাকাছি আসিয়া পৌঁছিয়াছে, তাহা ভাবিতেই পারে নাই। কোরেশ দলে তখন সাজ-সাজ রব পড়িয়া গেল।

শুক্রবার। প্রভাত হইতে না হইতেই বেলালের কণ্ঠে ফযরের আযান ধ্বনিত হইল। মুসলমানেরা কাতার-বন্দী হইয়া রসুলে-করিমের ইমামতিতে নামায পড়িলেন। নামাযান্তে হযরত যুদ্ধের জন্য সকলকে সজ্জিত হইতে আদেশ দিলেন। যেখানে যাহাকে মোতায়েন করা দরকার, করিলেন। যাহাকে যে উপদেশ দিবার ছিল, দিলেন। মুসলিম সৈন্য প্রান্তর-ভূমি সম্মুখে রাখিয়া একটি অনুচ্চ পর্বতগাত্রে স্থান নিলেন। পানির ঝর্ণাটি তাহাদের অধিকারে রহিল।

কোরেশ সৈন্য প্রান্তরে ব্যুহ রচনা করিল। বিচিত্র বর্ণের পোষাক ও বর্মে সুসজ্জিত হইয়া তাহারা কাতারে কাতারে দাঁড়াইয়া গেল। অস্ত্রের ঝনঝনায় ও যোদ্ধাদের রণ-হুঁঙ্কারে বদর-প্রান্তর মুখরিত হইতে লাগিল।

যুদ্ধ আসন্ন জানিয়া রাসূলুল্লাহ্ আপন শিবিরে প্রবেশ করিলেন। তথায় গিয়া আল্লাহর ধ্যানে মগ্ন হইলেন। এই সংকট মুহূর্তে জীবনের চরম ও পরম বন্ধুর শরণ লইলেন। প্রাণের সকল আবেগ মিশাইয়া মুনাজাত করিলেনঃ “হে আমার প্রভু, আমার সহিত তুমি যে ওয়াদা করিয়াছিলে, তাহা পূরণ করো।[১] হে প্রভু! এই মুষ্টিমেয় সত্যের সৈনিকদলটিকে তুমি কি বাঁচাইবে না? ইহারা যদি আজ নিশ্চিহ্ন হইয়া যায়, তবে দুনিয়ায়। তোমার নামের মহিমা প্রচার বন্ধ হইয়া যাইবে।” বলিতে বলিতে হযরত একেবারে ভাবাবেশে তন্ময় হইয়া পড়িলেন। গায়ের উত্তরীয় খসিয়া পড়িল। তাহা দেখিয়া আবু বকর আর স্থির থাকিতে পারিলেন না। বলিলেনঃ হযরত যথেষ্ট হইয়াছে। আল্লাহ্ নিশ্চয়ই আপনার প্রার্থনা কবুল করিবেন।

[১. আ-হযরত মক্কায় অবস্থানকালে আল্লাহ্তা’লা একটি আয়াতের মাধ্যমে তাঁহাকে এই আশ্বাস বা প্রতিশ্রুতি দিয়াছিলেন যে, অচিরেই কোরেশ ও মুসলমানদিগের মধ্যে একটি যুদ্ধ হইবে এবং সে যুদ্ধে আল্লাহ রসুলুল্লাহকে জয়যুক্ত করিবেন। সে আয়াতটি সুরা আল্-কমরের ৪৫ নং আয়াতঃ “শীঘ্রই শক্রদল ছত্রভঙ্গ হইয়া পলায়ন করিবে।” এই ওয়াদার কথাই এখানে কল হইয়াছে।]

এই প্রার্থনার উত্তরে আল্লাহ্ তাহার রসুলকে এই আশ্বাসবাণী শুনাইলেন :

“ন্যায়বানদিগকে সুসংবাদ দাও। নিশ্চয়ই তোমার প্রভু বিশ্বাসীদিগের নিকট হইতে শদিগকে দূরে রাখিবেন, কারণ আল্লাহ্ অবিশ্বাসীদিগকে ভালোবাসেন না।” (২২: ৩৮)

হযরত উফুল্ল হইয়া বাহিরে আসিলেন। আবু বকরকে ডাকিয়া বলিলেন : যুদ্ধ আরম্ভ করো। নিশ্চয়ই আমরা জয়যুক্ত হইব।

ওদিকে আবু জহল মুসলমানদিগের সংখ্যা নির্ণয় করিবার জন্য মায়ের নামক জনৈক অশ্বারোহীকে আদেশ দিল। ওময়ের দ্রুতবেগে ঘোড়া দুটাইয়া মুসলমানদিগকে প্রদক্ষিণ করিয়া আসিয়া বলিল : মুসলমানের সংখ্যায় তিন শতের বেশী হইবে না।

শুনিয়া আবু জহল নিশ্চিত বিজয়ের গর্বে একেবারে অধীর হইয়া উঠিল।

কালবিলম্ব না করিয়া সে যুদ্ধাররে আদেশ দিল।

যুদ্ধ আরম্ভ হইল। কোরেশ শিবির হইতে রণ-ভেরী বাজিয়া উঠিল। তখনকার রীতি অনুসারে প্রথমে যুগযুদ্ধ আরম্ভ হইল। কোরেশদিগের মধ্য হইতে ওত্বা, তাহার ভ্রাতা শায়বা এবং পুত্র অলিদ বাহির হইয়া আসিয়া আস্ফালন করিতে করিতে বলিতে লাগিলঃ ওরে কাপুরুষ মুসলমানগণ, কার এমন বুকের পাটা, আয়তো দেখি। যুদ্ধ কারে বলে একবার দেখে যা এখানে।

এই আহ্বান শুনিয়া আনসারদিগের মধ্য হইতে তিনজন বীর লাফাইয়া উঠিলেন। কিন্তু মহানুভব রাসূলুল্লাহ্ তাহাদিগকে নিরস্ত করিলেন। তিনি ভাবিলেন, প্রথমেই যদি আনসারগণ যুদ্ধে নামে এবং যদি তাহাদের কেহ নিহত হয়, তবে লোকে বলিবে মোহাজেরদিগকে নিরাপদে রাখিয়া হযরত আনসারদিগের দ্বারাই যুদ্ধ চালাইতেছেন। ইহাই ভাবিয়া তিনি আপন পরমাত্মীয় হাজা, ওবায়দা ও আলিকে আহ্বান করিলেন। আদেশক্রমে তৎক্ষণাৎ বীরত্রয় যুদ্ধক্ষেত্রে অবতীর্ণ হইলেন। ওবার সহিত হামজার, শায়বার সহিত ওবায়দার এবং অলিদের সহিত আলির যুদ্ধ আরম্ভ হইল। মূহুর্ত মধ্যে বীর কেশরী আলির এক আঘাতেই অলিদের শির ভূলুণ্ঠিত হইয়া পড়িল। তদৃষ্টে ওত্ত্বা অধিকতর ক্ষিপ্ত হইয়া ভীম-বিক্রমে হামজাকে আক্রমণ করিল, কিন্তু অল্পক্ষণের মধ্যেই হামজা তাহাকে জাহান্নামে পাঠাইয়া দিলেন। পয়ষটি বর্ষীয় বয়োবৃদ্ধ ওবায়দাও শায়বাকে নিহত করিলেন বটে কিন্তু শায়বার তরবারির আঘাতে তিনিও গুরুতররূপে আহত হইয়া ধরাশায়ী হইলেন এবং অল্পক্ষণ পরেই শাহাদত লাভ করিলেন।

ওৎবাকে এত শীঘ্র সবংশে নিহত হইতে দেখিয়া কোরেশগণ স্তম্ভিত হইয়া গেল। দ্বন্ধ যুদ্ধে কোনো ফল হইবে না ভাবিয়া এইবার তাহারা সমবেত আক্রমণ আরম্ভ করিল। এদিকে মুসলমানগণও বিজয়ের প্রথম সূচনায় অধিকতর অনুপ্রাণিত হইয়া দ্বিগুণ উৎসাহে শক্রনিপাতে অগ্রসর হইলেন।

তুমুল যুদ্ধ আরম্ভ হইল। অস্ত্রের ঝনঝনায় ও সৈন্যদিগের রণ-হুংকারে বদর-প্রান্তর মুখরিত হইয়া উঠিল।

মুসলিম বীরবৃন্দ তখন বিপুল বেগে যুদ্ধ করিতেছেন। দুর্বার গতিতে তাহারা ব্যুহ ভেদ করিয়া শকদিগকে নেস্তনাবুদ করিয়া চলিয়াছেন। এক এক জন বীর চার পাঁচ জন শক্রকে নিপাত করিয়া তবে শহীদ হইতেছেন।

এই সময়ে মোআজ ও আবদুল্লাহ নামক দুই জন মুসলিম তরুণ আপন ত্যাগ ও অসামান্য বীরত্ব দ্বারা এই যুদ্ধকে আও পরিসমাপ্তির দিকে আগাইয়া দিলেন। আবুজহলকে হত্যা করিবার জন্য তাঁহারা জীবন-পণ করিয়া অগ্রসর হইলেন। আবুজহল তখন ব্যহ বেষ্টিত হইয়া অবস্থান করিতেছিলেন। যুবকদ্বয় বিদ্যুৎ গতিতে সেই ব্যুহ ভেদ করিয়া অতর্কিতে আবু জহলকে আক্রমণ করিলেন। মো’আজের এক আঘাতে আবুজহলের একটি পদ ছিন্ন হইয়া গেল। বাধ্য হইয়া সে ভূতলশায়ী হইল। পিতার এই মারাত্মক বিপদ দেখিয়া ইকরামা ছুটিয়া আসিয়া মো’আজকে আঘাত করিল; সেই আঘাতে মো’আজের একটি বাহু ছিন্নপ্রায় হইয়া ঝুলিতে লাগিল। মো’আজ দেখিলেন তাঁহার আপন বাহুই তাহার শত্রু হইয়াছে; তৎক্ষণাৎ তিনি দোদুল্যমান বাহুটিকে পদতলে চাপিয়া ধরিয়া এমন জোরে ঝটকা টান দিলেন যে বাহুটি ছিন্ন হইয়া ভূতলে পড়িয়া গেল। তখন মো’আজ স্বচ্ছন্দ চিত্তে অপর হস্ত দ্বারা তরবারী চালনা করিতে লাগিলেন। মো’আজের এই শোচনীয় অবস্থা দেখিয়া আবদুল্লাহ্ তৎক্ষণাৎ তাহার পার্ধে আসিয়া দাঁড়াইলেন। আবু জহল তখনও জীবিত ছিল, আবদুল্লাহ্র এক আঘাতে তাহার ছিন্ন মস্তক ধূলায় লুটাইয়া পড়িল।

আবু জহলের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে কোরেশ সেনাদল ছত্রভঙ্গ হইয়া পালয়ন করিতে আরম্ভ করিল। মুসলিমগণ সাফল্যের সূচনায় দ্বিগুণ উৎসাহিত হইয়া কোরেশদিগের পশ্চাদনুসরণ করিলেন। অনেককে নিহত করিলেন, অনেককে বন্দী করিলেন। মুসলিম সৈন্যরা ইচ্ছা করিলে এই সুযোগে আরো বহু শত্রুকে নিহত করিতে পারিতেন। কিন্তু প্রেম-করুণার মূর্ত ছবি মুহম্মদ! বাহিরে কঠোর হইলেও অন্তর তাহার হতভাগ্য মানুষের বেদনায় কাঁদিয়া ফিরিতেছিল। তৎক্ষণাৎ তিনি আদেশ দিলেনঃ উহাদিগকে মারিও না। বেচারাদের অনেকেই অনিচ্ছা সত্বেও আমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করিতে আসিয়াছে।

আল্লাহর এ কী খেলা! রাসূলুল্লাহ্ কী করিতেই বা আসিলেন আর কীই-বা করিয়া গেলেন। আসিয়াছিলেন বদর-সীমান্তে টহল দিতে এবং বিশেষ করিয়া সিরিয়া হইতে প্রত্যাগমনরত আবু সুফিয়ানের কাফেলাকে আক্রমণ করিতে। সেই হিসাবে ৩১৩ জনের সেনাবাহিনীই যথেষ্ট ছিল। কিন্তু কোন্ অদৃশ্য শক্তির ইংগিতে আবু সুফিয়ান সমুদয় অন্ত্রপাতি ও সাজ-সরঞ্জাম লইয়া নির্বিঘ্নে মক্কায় পৌঁছিয়া নিষ্ক্রিয় ভাবে বসিয়া রহিল, আর অন্য পথ দিয়া ইসলামের মারাত্মক শক্রগুলি রাসূলুল্লাহর সামনে আসিয়া হাযির হইল। আবু সুফিয়ানের দল আবু জহলের দলের সহিত মিলিতেই পারিল না। আল্লাহ্ যেন সুকৌশলে দুই দলকে বিচ্ছিন্ন করিয়া রাখিলেন। পঞ্চাশ হাজার টাকার অন্ত্রপাতি ও রসদপত্র তাই বিফলেই গেল। দুই দল এক যোগে আসিলে বদর যুদ্ধের ইতিহাস হয়তো অন্যরূপে লিখিত হইত।[২]

[২. এই ‘দুই দলের’ প্রসঙ্গে কুরআন শরীফে আল্লাহ নিম্নলিখতভাবে বর্ণনা করিয়াছেনঃ “এবং যখন আল্লাহ্ দুইটি দলের একটিকে তোমার হাতে দিবেন বলিয়া তোমার সঙ্গে ওয়াদা করিলেন এবং তুমি চাহিয়াছিলেন যে নিরস্ত্র দলটিই তোমার হউক, আল্লাহর ইচ্ছা ছিল অন্যরূপ। তিনি চাহিয়াছিলেন তাহার অঙ্গীকারের মধ্য দিয়া তোমাকে জয়যুক্ত করিবেন এবং অবিশ্বাসীদিগের মূলোচ্ছেদ করিবেন।” (৮ : ৭)]

বদর যুদ্ধে কোরেশদের নিহত সংখ্যা ছিল ৭০। বন্দী সংখ্যাও ছিল ৭০। মুসলমানদিগের নিহত সংখ্যা ছিল মাত্র ১৪ জন। যে কয়জন কোরেশ নেতা আঁ-হযরতের প্রধান শত্রুরূপে এতকাল তাঁহার বিরুদ্ধে শত্রুতা সাধন করিয়া আসিতেছিল, তাহাদের অধিকাংশই এই যুদ্ধে প্রাণ হারাইল। বহু অস্ত্রশস্ত্র এবং রসদপত্রও মুসলমানদিগের হস্তগত হইল।

কোরেশদিগের পলায়নের সঙ্গে সঙ্গে বদর-প্রান্তর পুনরায় শান্ত হইল। সত্যের বিজয়ে এবং মিথ্যার পরাজয়ে সারা প্রকৃতি যেন উষ্ণু হইয়া উঠিল।

বদর-যুদ্ধ ইতিহাসে এক যুগপ্রবর্তক ঘটনা। যে সমস্ত মুসলিম বীর যুদ্ধ করিতে আসিয়াছিলেন পরততী কালে তাঁহারা আরও অনেক বড় বড় যুদ্ধে অংশগ্রহণ করিয়াছিলেন; অনেক দেশও তাহাদের দ্বারা বিজিত হইয়াছিল; কিন্তু সে সব জয়-গৌরবকে কোনো মূল্য না দিয়া বদর-যুদ্ধে জড়িত থাকাকেই তাহারা জীবনের পরম সৌভাগ্য ও গৌরব বলিয়া মনে করিতেন। ইরাকের শাসনকর্তা, কুফা নগরীর স্থাপয়িতা পারস্য বিজয়ী মহাবীর সাদ অশীতি বর্ষ বয়সে মরণ-শয্যায় শায়িত অবস্থায় বলিয়াছিলেন, “বদর-যুদ্ধের পরিহিত বর্ম আমাকে পরাইয়া দাও; এই বেশে মরিব বলিয়া আমি উহা এতদিন সযত্নে তুলিয়া রাখিয়াছি।” বাস্তবিকই, বদর-যুদ্ধের গুরুত্ব এবং গৌরব মিথ্যা নয়। মক্কা বিজয়ের ইহাই প্রথম পদক্ষেপ। ইসলামের ইতিহাসের এখান হইতেই মোড় ফিরিয়াছে। এতদিন সে ছিল নিরীহ, এখন সে হইল নির্ভীক। এতদিন সে ছিল শান্ত ও সংযত; এখন সে হইল দুর্বার, প্রাণ-মাতানো ও গতিশীল। আল্লাহতালা এই জন্য বদর বিজয়ের দিনকে ‘মুক্তির দিন’ বলিয়া অভিহিত করিয়াছেন। সত্যই ইহা মুক্তির দিন। বিধর্মীরা ইসলামকে কবলিত করিবার জন্য যে সমস্ত আয়োজন করিয়াছিল, কিন্তু ইসলাম সকল বন্ধন ছিন্ন করিয়া এই দিন বিজয়ীর বেশে বাহির হইয়া আসিয়াছে।

বস্তুতঃ বদর-যুদ্ধের উপর অনেক কিছু নির্ভর করিয়াছিল। হযরত যদি এই যুদ্ধে জয়লাভ করিতে না পারিতেন, তবে কোরেশগণ মদিনা আক্রমণভো করিতই, অধিকন্তু নগরের পৌত্তলিক ইহুদী ও মুনাফিকগণও তাহাদের সহিত যোগ দিত। এইরূপ বহু বিপদের সম্ভাবনা হইতেই ইসলাম সেদিন মুক্তি পাইয়াছে।

পক্ষান্তরে বদর বিজয়ে মুসলমানগণ এক নূতন জীবনের সন্ধান পাইলেন। তাহাদের মধ্যে যে অসীম শক্তি ও সম্ভাবনা লুকাইয়া আছে, অগণিত শক্রর সঙ্গে যুদ্ধ করিয়াও তাহারা যে জয়ী হইতে পারেন, শত্রু সেনার সংখ্যা দেখিয়া তাহারা যে মোটেই শংকা মানেন না, তাহারা যে দুর্বার-দুর্দমনীয়, এই বিশ্বাস তাহাদের মনে বদ্ধমূল হইয়া গেল। ইসলাম যে আল্লাহর মনোনীত ধর্ম, হযরত যে সত্য সত্যই আল্লাহর প্রেরিত রসুল, আল্লাহ যে বিশ্ববাসীদিগকে ভালোবাসেন ও সাহায্য করেন, এই কথা সকলের মনেই দাগ কাটিয়া বসিল। হযরত এতদিন যে দাবী করিয়া আসিতেছিলেন, এবং যে আশার বাণী শুনাইতেছিলেন, বদর-যুদ্ধে তাহার সত্যতা প্রমাণিত হইল। আরও একটি সত্য মুসলমানেরা উপলব্ধি করিতে পারিলেন : যুদ্ধ না করিলে কোনো জাতি বড় হইতে পারে না।

এখানে একটা প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিকঃ রাসূলুল্লাহর বদর অভিযান কি আক্রমণমূলক (Aggressive) না আত্মরক্ষামূলক (Defensive)? এক কথায় এর জবাব দেওয়া যায়ঃ যুদ্ধটি সংঘটিত হইল কোন এলাকায়- মক্কা না, মদিনায়? রাসূলুল্লাহ্ যদি মক্কায় অভিযান করিতে যাইতেন, তবেই না তাহা আক্রমণাত্মক হইত! আপন দেশে শত্রুকে রোধ করার নামও কি আক্রমণ? বদর যুদ্ধের কথা তো দূরে থাক, সিরিয়া হইতে প্রত্যাগমনরত আবু সুফিয়ানের কাফেলাকে হামলা করিয়া তাহার যাবতীয় অস্ত্রশস্ত্র কাড়িয়া লইলেও রাসূলুল্লাহর পক্ষে তাহা আত্মরক্ষামূলকই হইত। এই সূত্র ধরিয়া ইহাও বলা যায়, আক্রমণকারী দুষমনকে হটাইতে হটাইতে তাহার দেশে লইয়া আক্রমণ করিলে অথবা তাহার দেশ জয় করিয়া লইলেও তাহাতে আক্রমণ করিলে অথবা তাহার দেশ জয় করিয়া লইলেও তাহাতে আক্রমণের (Aggression) অপরাধ হয় না; আত্মরক্ষারই উহা শেষ পর্যায়। মারাত্মক শত্রুকে ঘায়েল করিয়া ছাড়িয়া দেওয়া নিরাপদ নয়। ন্যায়নীতি ও শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য তাহাকে সম্পূর্ণ জয় করাই যুক্তিযুক্ত। ইসলামের যুদ্ধনীতি তাই অন্যরূপ। আক্রমণ বা আত্মরক্ষার শব্দগত অর্থ সে গ্রহণ করে না। তার মূল লক্ষ্য হইল জগতে শান্তি, ইনসাফ, ভ্রাতৃপ্রেম, মানবতা ও অন্যান্য আদর্শের প্রতিষ্ঠা। সেই উদ্দেশ্য সাধনের পথে যখন বাধা আসিবে, তখন তাহা জয় করিতেই হইবে। সে জয় সম্ভব হয় কখনও বা আত্মরক্ষা দ্বারা, কখনও বা আক্রমণ দ্বারা। বৃহত্তর মানব-কল্যাণের জন্য ইসলামে তাই আক্রমণ নিষিদ্ধ নয়।

বদর-যুদ্ধ এই নীতির সূচনা এবং মক্কা বিজয়ে এর পরিসমাপ্তি।

মদীনা-সীরাতুন্নবী সংখ্যা, ১৯৬২

নবী-নন্দিনী জয়নব

ইসলামের উদারতা, সহনশীলতা ও মানব-প্রীতির বহু নিদর্শন হযরত মুহম্মদের (সা.) জীবনে আমরা বহুভাবে লক্ষ্য করিয়াছি। তাহার পারিবারিক জীবনেও এই সব মহান আদর্শ যে কতোখানি প্রভাব বিস্তার করিয়াছিল, একটি ঘটনায় তাহা সুস্পষ্ট হইয়া আছে। জীবন সংগ্রামের কঠোরতার অন্তরালে স্নেহ-প্রীতি, প্রেম ও মহানুভবতা ও অন্যান্য সুকুমার বৃত্তিগুলি ফল্গুধারার মতো প্রবাহিত হইয়াছিল বলিয়াই ইসলামের জয়যাত্রা এমন দুর্নিবার হইয়া উঠিয়াছিল।

ঘটনাটি ষষ্ঠ হিজরীর। মক্কা হইতে একদল বণিক সিরিয়ায় গিয়াছিল। ফিরিবার পথে মদীনার মুসলমানদের সহিত হঠাৎ তাহাদের সংঘর্ষ বাধিল। ফলে তাহারা পরাজিত ও বন্দী হইয়া মদীনায় আনীত হইল। এই বন্দীদিগের মধ্যে ছিলেন হযরতের জামাতা আবুল আ’স্। আ’ ছিলেন বিবি খাদিজার ভ্রাতুস্পুত্র। সম্ভ্রান্ত ও ধনী গৃহেই তাহার জন্ম হইয়াছিল।

খাদিজা আ’সকে পুত্রবৎ স্নেহ করিতেন। খাদিজার ইচ্ছা অনুসারেই হযরত আপন কন্যা জয়নবকে আ’সের সহিত বিবাহ দিয়াছিলেন। এই বিবাহ হযরতের নবুয়ত প্রাপ্তির পূর্বেই সংঘটিত হইয়াছিল। রাসূলুল্লাহর নবুয়ত লাভের সঙ্গে সঙ্গেই বিবি খাদিজা ও তাহার পুত্র-কন্যারাও ইসলাম গ্রহণ করিয়াছিলেন। কিন্তু আস্ ইসলাম গ্রহণ করেন নাই। কোরেশদিগের পূর্ব ধর্মেই তিনি অটল রহিলেন। কন্যা মুসলমান, জামাতা পৌত্তলিক। হযরত ও বিবি খাদিজার মন ইহাতে বিচলিত হইলেও তাহারা কোনো দিনই ইসলাম গ্রহণের জন্য জামাতার উপর পীড়াপীড়ি করেন নাই; অথবা জয়নবকে আ’সের নিকট হইতে মুক্ত করিয়া আনিতেও চান নাই। কোরেশগণ কিন্তু ইহার বিপরীত ব্যবহার করিয়াছে। হযরতকে অধিকতর বিপন্ন ও হেয় করিবার উদ্দেশ্যে তাহারা জয়নবকে তালাক দিয়া অন্য একটি কোরেশ কুমারীকে বিবাহ করিবার জন্য আসূকে যথেষ্ট প্ররোচনা ও উৎসাহ দিয়াছে। অনেক প্রকার প্রলোভন ও ভীতি প্রদর্শনও করিয়াছে। কিন্তু আস্ সে কথায় কর্ণপাত করেন নাই। পক্ষান্তরে জয়নবের চরিত্র মাধুর্য ও মনোবলও লক্ষ্যণীয়। হযরত যখন আপন পরিবারবর্গকে মদীনায় স্থানান্তরিত করিলেন, তখন জয়নব মদীনায় না গিয়া মক্কায় স্বামীর গৃহেই রহিয়া গেলেন। ঠিক এই অবস্থায় বদর যুদ্ধে কোরেশদিগের স্বপক্ষে যুদ্ধ করিতে আসিয়া আস মদীনায় মুসলমানদিগের হস্তে বন্দী হইলেন। বন্দীগণ মদীনায় আনীত হইলে অন্যান্য কোরেশ বন্দীর ন্যায় আ’সেরও মুক্তিপণ নির্ধারিত হইল। তখন সংবাদ পাইয়া বিবি জয়নব মক্কা হইতে স্বামীর মুক্তিপণ বাবদ কিছু অর্থ ও একটি মূল্যবান স্বর্ণহার পাঠাইয়া দিলেন। এই হার বিবি খাদিজা জয়নবের বিবাহের সময় তাহাকে উপহার দিয়াছিলেন। হযরত সেই হার দেখিয়া বিচলিত হইয়া পড়িলেন। সাহাবাদিগকে বলিলেনঃ তোমাদের যদি আপত্তি না থাকে, তবে আসকে বিনাপণে মুক্তি দাও এবং এই হারও তাহাকে ফিরাইয়া দাও। সকল সাহাবাই এ প্রস্তাবে সম্মত হইলেন। তবে একটি শর্ত এই দেওয়া হইল যে, আস্ মক্কায় ফিরিয়া গিয়া জয়নবকে যেন একবার মদীনায় পাঠাইয়া দেন। আস তাহাতে রাজী হইলেন।

মক্কায় ফিরিয়া গিয়া আস্ তাহার ভ্রাতা কেনানার তত্ত্বাবধানে জয়নবকে মদীনায় পাঠাইয়া দিবার ব্যবস্থা করিলেন। কিন্তু একটু অগ্রসর হইতে না হইতেই কতিপয় কোরেশ দুবৃত্ত তাহাদিগকে আক্রমণ করিল। আৰু জহলের পুত্র ইকরামা ছিল ইহাদের দলপতি। জয়নব যে উটের পৃষ্ঠে বসিয়াছিলেন, ইকরামা বর্শা দ্বারা সেই উটটিকে বিদ্ধ করিয়া ফেলিল। জয়নব পড়িয়া গিয়া দারুণ আঘাত পাইলেন। ঠিক এই সময় আবু সুফিয়ান তথায় উপস্থিত হইয়া কেনানাকে বলিতে লাগিল : দেখ কেননা, এরূপভাবে জয়নবকে মদীনায় পৌঁছাইয়া দেওয়া তোমাদের খুবই অন্যায়। প্রকাশ্যভাবে যদি মুহম্মদের কন্যাকে আমরা যাইতে দিই, তবে সকলে ভাবিবে আমরা দুর্বল হইয়া পড়িয়াছি। গোপনে পাঠাইবার ব্যবস্থা করো, তাহাতে কাহারও আপত্তি থাকিবে না। যাও, এখনকার মতো মক্কায় ফিরিয়া যাও; তারপর অন্য সময়ে আসিও।

কেনানা তাহাই করিল। আ’ও ইহা যুক্তিসঙ্গত বলিয়া মানিয়া লইলেন। জয়নবকে পাঠানো স্থগিত রাখা হইল। ইহার কিছুদিন পর জায়েদ আসিয়া তাহাকে মদিনায় লইয়া গেলেন।

তিন বৎসর পর সেই আ’সিরিয়া হইতে মক্কায় ফিরিবার পথে পুনরায় বন্দী অবস্থায়, নীত হইলেন। আগোপনে জয়নবের সহিত সাক্ষাৎ করিলেন। জয়নবের মধ্যবর্তিতায় হযরত মুহম্মদ (দঃ) আসৃকে এবারও মুক্তি দিলেন। তাঁহার সমুদয় লুষ্ঠিত দ্রব্যও ফিরাইয়া দেওয়া হইল। আসের সঙ্গে সঙ্গে তাহার সঙ্গীরাও মুক্তি পাইল। হযরতের এই সদয় ব্যবহার এবং ইহার অন্তরালে জয়নবের একনিষ্ঠ প্রেম বিফলে গেল না। আ’সের গোপন হৃদয় বিগলিত হইতে আরম্ভ করিল। মনে মনে তিনি তখনই ইসলাম গ্রহণ করিলেন; কিন্তু সে কথা প্রকাশ করিলেন না। একটা পরাজয়ের অনুভূতি তাহার দুর্ধর্ষ কোরেশ আভিজাত্যকে আচ্ছন্ন করিয়া রাখিল। কিছুতেই তিনি এই অভিমানকে অতিক্রম করিতে পরিলেন না। যদি রাসূলুল্লাহ্ বা তাহার কন্যা আসিয়া তাহাকে ইসলাম গ্রহণ করিতে একটু অনুরোধ করিতেন, তাহা হইলেও তাহার এই অভিমান কিছুটা শান্ত হইতে পারি, কিন্তু তেমন কোনো অনুরোধ কাহারও নিকট হইতে আসিল না। ধর্মের এই মুক্ত স্বাধীনতা আজ তাহাকে পীড়া দিতে লাগিল। হ্যরতের পক্ষ হইতে অথবা জয়নবের পক্ষ হইতে একটু কিছু চাপ বা পীড়াপীড়ির জন্য আজ তাহার অন্তর উন্মুখ হইয়া রহিল। কিন্তু তেমন কোনো ভাবভঙ্গীই বিপক্ষ দল হইতে আসিল না। আপন আপন মর্যাদায় উভয় পক্ষই যেন অটল। আস্ তাই কিছুতেই মদিনার বুকে দাঁড়াইয়া ইসলাম গ্রহণ করিতে পরিলেন না। সেরূপ করিলে মক্কার কোরেশগণও যে তাহাকে কাপুরুষ কলিয়া মনে করিবে। তাই দারুণ মানসিক বিক্ষোভের মধ্যে তিনি মদিনা ত্যাগ করিলেন।

মক্কায় ফিরিয়া গিয়া কোরেশদিগের সমক্ষেই তিনি ইসলামের মূল কলেমা উচ্চকণ্ঠে ঘোষণা করিলেন। অতঃপর অল্পদিনের মধ্যেই আ’স মদিনায় ফিরিয়া আসিয়া জয়নবের সহিত একত্রে বাস করিতে লাগিলেন। ‘

অকৃত্রিম ভালোবাসা দিয়া এইরূপে জয়নব স্বমীর হৃদয় জয় করিয়া লইলেন। তাহাকে আলোকের পথে ফিরাইয়া আনিলেন। কিন্তু বেশীদিন স্বামীর সঙ্গে বাস করিবার সৌভাগ্য তাহার হয় নাই। উট হইতে পড়িয়া যাওয়ায় তিনি যে গুরুতর আঘাত পাইয়াছিলেন, তাহাই তাহার কাল হইল। এক বৎসর পরেই তিনি ইন্তিকাল করিলেন।

মদিনা-জুলাই, ১৯৬২

ইসলামে সার্বভৌমিকতা

ইসলামে সার্বভৌমিকতা কার-এ প্রশ্নের আলোচনা করতে গেলেই আগে বুঝতে হবে সার্বভৌমিক (Sovereign) অথবা সার্বভৌমিকতা (Sovereignty) শব্দ দ্বারা আমরা কি বুঝি বা বর্তমান রাষ্ট্রবিজ্ঞানে কথাটার অর্থ ও তাৎপর্য কি। তারপর ইসলামী রাষ্ট্রে কে সেই সার্বভৌম ক্ষমতা চালনা করে তা বুঝা বা বুঝানো আমাদের পক্ষে সহজ হবে। অপরিচ্ছন্ন কোনো প্রস্তাবনা (Premise) নিয়ে যুক্তি-তর্ক আরম্ভ করলে তার সদ্ধান্ত বা অনুমান (Inference) ও অস্বচ্ছ থেকে যাবে। অবশ্য সেই হিসাবে ইসলাম এবং ইসলামী রাষ্ট্র সম্বন্ধেও সঠিক সংজ্ঞার প্রয়োজন দেখা দেবে, কারণ ইসলাম কি এবং ইসলামী রাষ্ট্রই বা কি তারও কোনো সর্বজন গ্রাহ্য সংজ্ঞা পাওয়া যাবে না। মামুলী মত ও প্রগতিশীল মতে অনেক পার্থক্য আছে। আপাততঃ সে দিকটার প্রতি দৃষ্টি না দিয়ে ‘sovereignty’ থেকেই আমরা শুরু করি।

সভূরিন বা সভূরিনটি কথাটা অপেক্ষাকৃত আধুনিক। পঞ্চদশ শতাব্দীর পূর্বে কোনো, দেশের রাষ্ট্র-বিধানে কথাটির কোনো উল্লেখ পাওয়া যায় না। মোড়শ শতাব্দীতে ফরাসীদেশের রাষ্ট্রচিন্তাবিদ- Bodin সর্বপ্রথম তার পুস্তক Republics-এ কথাটির আলোচনা করেন। Sovereign শব্দটির ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে তিনি বলেনঃ “the supreme power over citizens and subjects unrestrained by law.’ আরেকজন চিন্তাশীল লেখক (Blackstone) বলেন : সভূরিনটি হচ্ছে “the supreme irresistible absolute uncontrolled authority.” E আরেকজন একে বলেছেন “the underived and independent power to command and compel obedience.” Grotius 16619, “The supreme political power vested in him whose acts are not subject to any other and whose will can not be overldden.”

সবগুলো সংজ্ঞাকে এক সঙ্গে মিলালে এই বুঝা যায় যে, একটা রাষ্ট্রের সার্বভৌম ক্ষমতা হচ্ছে সেই ক্ষমতা যাকে কেউ প্রশ্ন করতে পারেনা, বাধা দিতে পারেনা, সব আইন সব হুকুম সব নিয়ম-শৃঙ্খলা যেখান থেকে উৎসারী হয়।

এখন কথা উঠবেঃ এই সার্বভৌম প্রভুত্ব থাকবে কার হাতে-বিশ্ব নিয়ন্তা আল্লাহর হাতে, না মানুষের হাতে? আল্লাহই যদি আমাদের সময় প্রভু হন, তবে প্রজা-সাধারণের আচার-বিচারে, শাসনকার্যে, দৈনন্দিন ক্রিয়াকলাপে তার আইন-কানুন কি ভাবে কার দ্বারা কার্যকরী করা হবে, আবার মানুষই যদি বা সে ক্ষমতা পরিচালনা করে, তবে সে ক্ষমতা কি একজনের হাতে থাকবে, না গণমানুষের হাতে থাকবে, সে প্রশ্ন তখন জাগবে। অন্য কথায় রাজতন্ত্র, গণতন্ত্র, সাধারণতন্ত্র, ডিক্টেটরশিপ ইত্যাদি বিভিন্ন রাষ্ট্ররূপের কথা তখন আমাদের ভাবতে হবে।

মোটামুটি ভাবে বলা যায়, সার্বভৌম ক্ষমতা নিয়ে এখন দুই দলের মধ্যে dispute চলছে : (১) আল্লাহ্; (২) মানুষ। কেউ বলছেন, sovereignty একমাত্র আল্লাহর। আবার কেউ বলছেনঃ সে ক্ষমতা মানুষের। জনগণই হচ্ছে রাষ্ট্রের প্রকৃত সভূরিন। যে রাষ্ট্রবিধানে আল্লাহর সরিনটি স্বীকার করা হয়, সে হয় ধর্মরাষ্ট্র-Theocracy; আর মানুষকে (people) যারা সরিন বলে মানেন, তাদের রাষ্ট্রকে বলা হয় Democracy.

এখন দেখা যাক, ইসলামী রাষ্ট্রে এই সার্বিক ক্ষমতা বা প্রভুত্ব কার- আল্লাহর, না মানুষের।

ইসলামী রাষ্ট্রের সার্ভভৌমিকতা

উলেমা সমাজের অধিকাংশের মতঃ আল্লাহ যখন বিশ্ব-নিখিলের সময় প্রভু তখন ইসলামী রাষ্ট্রের বেলায়ও একমাত্র তিনিই হবেন তার পরম নিয়ন্তা। তারই রাজ্য, তারই আইন, তারই শাসন। মানুষের আইন প্রণয়নের বা আল্লাহর আইনের রদবদল করবার কোনো হাত নেই। আল্লাহ্ অবশ্য নিজে দেশ শাসন করেন না। যুগে যুগে দেশে দেশে তিনি বহু পয়গম্বর পাঠিয়ে তাদের মধ্যবর্তিতায় নিজের রাজ ও শাসন কায়েম করেছেন। নবী-রসুলেরা তাই আল্লাহর খলিফা বা viagent, অন্য কথায় রাজ-প্রতিনিধি হয়ে আসেন। খলিফাঁদেরও নিজের কোনো স্বাধীন ইচ্ছা থাকে না; আল্লাহর আদেশ-নিষেধকেই তারা যথারীতি পালন করে যান। তাদের শাসন তাই একটা পবিত্র আমানত (Sacred Trust) ছাড়া আর কিছু নয়। শেষ নবী হযরত মুহম্মদের (সা.) ইন্তিকালের সঙ্গে সঙ্গে নবী-রসুলের জামানা শেষ হয়েছে; আল্লাহর সাক্ষাৎ খলিফা আসার দরজাও বন্ধ হয়েছে। রাসূলুল্লাহর পরে ইসলামী রাষ্ট্রের যারা শাসক ছিলেন, তারাও খলিফা নামে অভিহিত হতেন বটে, কিন্তু তারা কেউ সাক্ষাৎ আল্লাহর খলিফা ছিলেন না; তাঁরা ছিলেন খলিফার খলিফা। রাসূলুল্লাহর জীবদ্দশায় ইসলামী শাসনের আইন-গ্রন্থ ছিল কুরআন এবং আল্লাহর নিকট থেকে প্রাপ্ত ‘অহি’ বা ঐশীবাণী-কিন্তু তাঁর মৃত্যুর পর থেকে ইসলামী শাসনের মূল ভিত্তি শুধু কুরআন নয়, হাদিসও।

তাহলে দেখা যাচ্ছে, ইসলামী রাষ্ট্রবিধানে সার্বভেীমিক ক্ষমতা একমাত্র আল্লাহর।

ইসলামে sovereignty সম্বন্ধে বিখ্যাত চিন্তাশীল আলিম জনাব মওদূদী বলেন :

“The belief in the unity and the sovereignty of Allah is the foundation of the social and moral systems propounded by the Prophets. It is the very starting point of the Islamic political philosophy……. None is entitled to make laws on his own authority and none is obliged to abide by them. This right vests in Allah alone.”

এই যুক্তি পরম্পরায় তিনি সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন?

“According to this theory, sovereignty belongs to Allah. He alone is the law-giver….. The Prophet himself is subject to God’s commands.”

এরূপ অবস্থায় ইসলামী রাষ্ট্র যে একটি ধর্মরাষ্ট্র (Theocracy) বা আল্লাহর রাজ্য (Kingdom of God), তাতে কোনোই সন্দেহ নেই। জনাব মওদূদী একথা নিজেও স্বীকার করেন?

“A more apt name for the Islamic polity would be the ‘Kingdom of God’ which is described in english as Theocracy.”

অবশ্য ধর্মরাষ্ট্র থেকে ইসলামকে তিনি কিছুটা রেহাই দিয়াছেন এই জন্যে যে, এর মধ্যে ইজমা, কিয়াস, ইসতিহাদ প্রভৃতির স্থান আছে। মওদূদী সাহেব বলেন : বিশেষ প্রয়োজনের ক্ষেত্রে ইজমা কিয়াস ইত্যাদি দ্বারা কিছু কিছু নূতন বিধানও সংযোজিত হতে পারে। কিন্তু থিওক্রাসির মূল কাঠামোর তাতে পরিবর্তন ঘটে না। সেই যে, “power of the invisible over the visible”-এ বিশেষত্ব ঠিকই থাকে।

বিচার

এইবার বিচারে আসা যাক।

গোড়াতেই বলে রাখা ভালো-আমাদের আজকার আলোচ্য বিষয়টির শিরোনামা একটু বিভ্রান্তিকর হয়েছে। ‘Concept of sovereignty in Islam’ এক কথা, আর ‘Concept of sovereignty in Islamic State আরেক কথা। ইসলামে সার্বভৌমিক প্রভু যে একমাত্র আল্লাহ এ-কথায় কোনো দ্বিমত নাই। ইসলাম যে মানবে, তাকে স্বীকার করতেই হবে যে- আল্লাহ্ হচ্ছেন বিশ্ব-নিখিলের একমাত্র প্রভু, পালয়িতা ও নিয়ন্তা। আমাদের সমস্যা সেখানে নয়। আমাদের সমস্যা ইসলামী রাষ্ট্রের সার্বভৌমিকতা নিয়ে। কাজেই ধরে নিতে হবে, আজকের আলোচনা শেষোক্ত প্রশ্নেই সীমাবদ্ধ থাকবে।

যুক্তি-তর্কে বিরুদ্ধ পক্ষ না থাকলে সত্য নিরূপিত হয় না। আমি তাই বিরোধী দলের ভূমিকা গ্রহণ করবো।

আমার প্রথম কথা এই: একই সত্যকে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা যায়। জীবন-দর্শন বা আধ্যাত্মিক তথ্যের দিক দিয়ে যদি কেউ প্রশ্ন করেনঃ বিশ্ব জগতের সার্বভৌমিকতা কার? আমি অকুণ্ঠ চিত্তে বলবো-একমাত্র আল্লাহর। কিন্তু রাষ্ট্রের সার্বভৌমিকতা কার? এ প্রশ্ন যদি কেউ করেন, তবে বলবো-রাষ্ট্র যার দ্বারা বা যাদের দ্বারা চালিত হয়, তার বা তাদেরই। রাষ্ট্র হলো একটি জাগতিক ব্যাপার। এর গঠন এবং পরিচালনায় মানুষের হাত আছে; কাজেই রাষ্ট্রক্ষমতা যেখান থেকে আসে, সেখানেই সাভৌমিকতা আরোপ করা উচিত। অন্যান্য দৈনন্দিন কাজে, সামাজিক কাজে আমরা সেরূপ করি, রাষ্ট্রকে তা করবো না? আল্লাহ্ আমাদের সৃষ্টিকর্তা এবং “ইন্নাল্লাহা আলা কুল্লি শাইন কাদির- (অর্থাৎ সব কিছুর উপরেই আল্লাহর অধিকার)-এ কথা মেনেই কি আমরা সব কাজ করি? বউটি কার? কোনো অতিরিক্ত আল্লাওয়ালা মুসলমান স্বামীও বলবে না যে বউটি আল্লাহর! এ বাড়ীটি কার?-আল্লাহর; এ টাকাকড়ি কার?–আল্লাহর; ছেলেটি কার?-আল্লাহ-আল্লাহ; এ যখন বলেন না, তবে খামাখা কেন বলবেন- ইসলামী রাষ্ট্র আল্লাহর। আল্লাহই রাজ্য, আল্লাহরই আইন, আল্লাহরই এ রাজ্য চালান-মানুষের কোনো হাত নেই-কোনো ক্ষমতা নেই; এমন কি আল্লাহর রসুল বা খলিফাঁদেরও কোনো ক্ষমতা নেই-শুধু তাঁরা ছবির মতো আল্লাহর হুকুম মেনে চলেন! একি কখনো কেথাও হয়েছে? গোটা ধারণাটাই মানব জাতির প্রতি এক চমক লাঞ্ছনা। আর এ লাঞ্ছনা কুরআন পাকের অর্থাৎ আল্লাহর বিধানের সম্পূর্ণ বরখেলাপ। আল্লাহ দিলেন মানুষকে তার খলিফার মর্যাদা, অথচ মানুষ বলে, তার কোনো কিছু করবার ক্ষমতা নেই- ‘Man is a born subject.’ আল্লাহকে মালিকুল্ মু’ স্বীকার করেও বলতে হবে-রাষ্ট্রের ব্যাপারে, মানবীয় ব্যাপারে মানুষের হাতেই আছে সার্বভৌমিক ক্ষমতা-চাই সে ক্ষমতা একজনের উপরেই থাকুক, দশজনের উপরেই থাকুক বা জনগণের উপরেই থাকুক। এই শাসনশক্তি, এই ক্ষমতা-আল্লাহ ইচ্ছা করেই মানুষকে দিয়েছেন-এটা হচ্ছে তারই প্রদত্ত ক্ষমতা delegated power)। আল্লাহর মূলনীতি ও নির্দেশ অনুসারে মানুষ স্বাধীন ভাবে দুনিয়া শাসন করবে এটা তাঁরই ইচ্ছা (it is His will). একে অস্বীকার করার অর্থ আল্লাহর নেয়ামতকে অস্বীকার করা।

বস্তুতঃ এ এক শোচনীয় অদৃষ্টবাদের (fatalism) মোহ ছাড়া কিছু নয়। কথায় ও কাজে এমন অসামঞ্জস্যও আর কোথাও দেখা যায় না। তেরো শ’ বছর ধরে এই মিথ্যা দর্শন আমাদিগকে বিভ্রান্ত করে রেখেছে।

কুরআন এবং হাদিস আমাদের অবশ্য অনুসরণীয়-কিন্তু আমি জিজ্ঞাসা করিঃ কুরআন-মজিদে বা হাদিস-শরীফে রাষ্ট্রের ব্যাপারে আল্লাহকে সার্বভৌম প্রভু বলে মেনে নিতে হবে, এরূপ কোনো সুস্পষ্ট নির্দেশ আছে কি? অনেক কথাই মনগড়া এবং অপপ্রয়োগ মাত্র। আল্লাহ নিজে রাজ্য চালাবেন, সবকিছু আইন-কানুন তিনি দেবেন, খলিফা পাঠিয়ে রাজ্য শাসন করবেন, শেষ খলিফার মৃত্যুর পরেও খলিফার সিলসিলা চলতেই থাকবে-এসব কথা কোথায় আছে আমি জানিনা।

আশ্চর্যের বিষয়, স্বয়ং রাসূলুল্লাহর জীবন, খোলাফায়ে রাশেদীনের শাসন এবং পরবর্তী খলিফা বা শাসন কর্তাগণের ইতিহাস এই প্রবাদের সম্পূর্ণ বিপরীত সাক্ষ্য দেয়। হযরত মুহম্মদ (সাঃ) নিজেই ছিলেন একজন পুরোদস্তুর sovereign, S. A. 9. Husaini দৃঢ় কণ্ঠে বলছেন?

“As long as the prophet lived, he was the sovereign of the muslim state. He was a diterminate human superior, not in

the habit of ‘obedience to a like superior’ receiving habitual obedience from the bulk of the muslim society. Hence he was the sovereign of that society. The prophet recognised Allah alone as his superior and according to the accepted definition of a sovereign, obedience to God did not detract from the full sovereignty of a human potentate.”

আল্লাহর বাণী তিনি যথাযথ ভাবে সকলকে পৌঁছে দিয়েছেন। কিন্তু তাই বলে জাগতিক ব্যাপারে তাঁর যে কোনেরূপ স্বাধীন ইচ্ছাই ছিল না, এ ধারণা ভুল। তিনি ছিলেন একাধারে

“Prophet, law-giver, religious leader, chief judge, commander of the army and civil head of the state.”

এরই নামই তো আল্লাহর খলিফা! আল্লাহর খলিফা কি একটা অকর্মণ্য ক্রীতদাস নাকি! আল্লাহ সভূরিন, তাঁর খলিফাও সভূরিন। বড় আর ছোট-এই যা প্রভেদ।

ব্যাপারটা আরও একটু পরিষ্কার করে বলি। আমি বলছি না যে, রাসূলুল্লাহ্ আল্লাহর কোনো তোয়াক্কা না রেখেই স্বাধীন ভাবে যা খুশী তাই করতেন। তা ঠিক নয়। আমার বক্তব্য এই যে, কতকগুলি fundamental principles আল্লাহ্ তাঁর রসুলকে দিয়েছিলেন, সেগুলি ঠিক রেখে যখন যেরূপ প্রয়োজন, তিনি তাই করতেন। এমন কি এরূপও ঘটেছে যে কুরআনে আল্লাহ্ বলেছেন একরূপ, কিন্তু অবস্থা বিবেচনায় রসুল করেছেন অন্যরূপ। শুধু রসুল কেন, হযরত ওমরও অবস্থা বিশেষে কুরআনের নির্দেশকে অতিক্রম করেছেন। হাতকাটা আইনের ব্যাপারে, যুদ্ধের অংশ দান করার ব্যাপারে, তালাকের ব্যাপারে তিনি স্বাধীন ভাবে কাজ করেছেন। একটা কথাই আছে যে, “The Sunnah can dispense with the Quran, but not the Quran with the Sunnah”.

এর দ্বারা এই কথাই প্রমাণিত হচ্ছে যে, রাষ্ট্রের ব্যাপারে আল্লাহ্ defacto sovereign নন, defacto sovereign হচ্ছে মানুষ। জাগতিক ব্যাপারে মানুষের সভরিনটি আল্লাহ স্বীকার করে নিয়েছেন। আল্লাহ যে বলেছেনঃ “আমাকে মানিলে রসুলকে মানো এবং রসুলকে মানিলে আমাকে মানা হয়”-এ কথার গূঢ় তাৎপর্য এইখানে। এখানেই তো দেখা যাচ্ছে ইসলামে দ্বৈত শাসন। দুই সভূরিনে এমন মিতালি আছে যে, একজনের ইচ্ছা আরেকজন মেনে নেয়।

মানুষের সরিনটিতে তাই আল্লাহর কোনো ভয় নাই। মানুষ ভালোই জানে যে, তার ক্ষমতা সীমিত। পূর্ণ ক্ষমতার অধিকারী সে নয়। মানুষের sovereignty সম্পূর্ণ স্বয়ংস্বাধীন হতে পারে না। শাশ্বত আল্লাহর বিচারের কাছে (‘Eternal judgments of God) তাকে নতি স্বীকার করতেই হবে। মানুষের সার্বভৌমিকতা তাই চিরন্তন নৈতিক নিয়মের (‘Eternal principle of the moral law’) দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। তাছাড়া প্রাকৃতিক নিয়মে (Laws of Nature) এবং আন্তর্জাতিক বাধ্যবাধকতা (International Laws), জাতীয় ঐতিহ্য ইত্যাদি দ্বারা খর্বিত।

Garner-এর ভাষায় তাই বলা যায়। প্রত্যেক রাষ্ট্রক্ষমতাই স্বয়ং-সীমিত, স্বয়ং নির্ধারিত এবং স্বয়ং-নিয়ন্ত্রিত (auto-determination, autolimitation and auto-obligation)

এই থিওরী অনুসারে আমি বলতে চাই যে, রাসূলুল্লাহ্ থেকে আরম্ভ করে অন্য যতো জনই রাষ্ট্রপতি হয়েছেন, তাঁরা চাই খলিফাই হউন, আর রাজাই হউন, আমীরই হউন বা বাদশাই হউন, ডিক্টেটরই হউন আর প্রেসিডেন্টই হউন সবাই ছিলেন sovereign. এ sovereignty মানুষ লাভ করেছে আল্লাহর কাছ থেকে delegated power স্বরূপ। এটার ফয়সালা আদমের জন্ম সময়েই হয়ে গেছে। আদমের শ্রেষ্ঠত্ব যখন প্রমাণিত হয়ে গেল, তখন আল্লাহ্ তামাম ফিরিশতাকে বললেনঃ তা হলে আদমকে সিজদা দাও। ইবলিসের মনে খটকা লাগলো। সিজদার অধিকারী তো একমাত্র আল্লাহ্। এতকাল তো তিনি এই শিক্ষাই আমাদের দিয়ে এসেছেন। আজ আবার কেন বলেন যে আদমকেও সিজদা দাও? কিছুতেই তা হতে পারে না। এই ভেবে ইবলিস আদমকে সিজদা দিল না, কিন্তু তামাম ফিরিশতা দিল। আল্লাহর অনুরূপ দ্বিতীয় একটা সিজদা যে আদমেরও প্রাপ্য একথা সেদিন প্রতিপন্ন হলো। এর গূঢ় তাৎপর্য এই যে, আল্লাহই স্বেচ্ছায় আদমকে তার শাসন ক্ষমতা delegate করলেন এবং সেটা মেনে নেবার জন্য তামাম ফিরিশতাকে আদেশ দিলেন। কিন্তু ইবলিস সে বিধান না মেনে আল্লাহর sovereignty মানতে গেল। ফলে আল্লাহ্ তাকে expel করলেন। সে শয়তান হয়ে গেল।

তারপর আস্থাহ যখন আদম এবং হাওয়াকে বেহেশতের বাগিচায় রাখলেন, তখন যা ঘটলো, তাতেও একই সত্য পরিস্ফুট হয়ে উঠলো। আল্লাহ্ আদমকে সবকিছু খেতে বললেন; কেবল একটা বৃক্ষের ফল খেতে নিষেধ করলেন। এতেই বুঝা যায় তিনি মানুষকে প্রায় পরিপূর্ণ স্বাধীনতাই দিলেন; একে বলা যায় controlled freedom. আল্লাহ্ গন্দম ফল ভক্ষণের হুকুমও ইচ্ছা করলে আগেই দিতে পারতেন, কিন্তু আদমকে পরীক্ষা করবার জন্যই তা দেননি। এইখানেই ছিল মানুষের নবসৃষ্টি ও উদ্ভাবনী শক্তির পরীক্ষা।মানুষ আল্লাহর আদেশ লংঘন করে অজানার পথে পা বাড়ায় কিনা, এইটে তিনি দেখতে চাইলেন। সে পরীক্ষায় আদম যখন উত্তীর্ণ হলেন তখন আল্লাহ মনে মনে খুশীই হলেন এবং তার পরই পরম ভরসায় তাকে দুনিয়ায় পাঠালেন। ভক্ত-প্রবর ইবলিসকে তার লক্ষ লক্ষ বৎসরের এবাদৎ-বন্দিগী সত্বেও তাকে দিলেন তিনি শয়তানের তকমা গলায় ঝুলিয়ে নির্বাসন। কেন? তাকে খলিফা করলেই তো পারতেন! আল্লাহ্ তা করেন নি, কারণ তিনি দেখলেন ইবলিসটা হয়েছে একটা “His Master’s Voice’. কেবল হুজুর হুজুর’ করে। সৃষ্টির উল্লাস নেই, ভুল করার কৌতূহল নেই, বিধি-নিষেধ উল্লঙঘন করার দুঃসাহস নেই। তাকে কেন তিনি খলিফা পদ দেবেন? শয়তান সে কথা ভোলেনি। কৌশলে সে মানুষকে ধ্বংস করবার চেষ্টায় আছে। আল্লাহতে সার্বভৌমিকতা আরোপের এই ব্যগ্রতার মধ্যে শয়তান তার কলকাঠি ঘুরাচ্ছে কিনা, কে জানে!

রাজ্যশাসনে আল্লাহর শক্তি ও ক্ষমতার কথা- অর্থাৎ, তার sovereignty-র কথা, মুসলমানেরাই যে প্রথম উত্থাপন করেছে, তা নয়। প্রাচীন কাল থেকেই এরূপ একটা সংস্কার চলে আসছে। গ্রীসের Aristotle ও Plato-র কাছেও কথাটা অবিদিত ছিল না। প্লেটোর ‘Ideal State’ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে যে এটা হবে ‘Kingdom of Heaven’-তবে পাপ-মলিন ধরার বুকে এ রাজ্য স্থাপন করা সম্ভব হবে না; ‘its pattern is laid up in heaven.” ইহুদীরাও এরূপ কল্পনা করেছিল। যিহোভাই প্রকৃত পক্ষে তাদের রাজা, তিনিই ইহুদী রাজ্যের সর্বময় কর্তা, এই ধারণা নিয়েই তারা চলতো। হিন্দুদের রামরাজ্য’ বা ‘ধর্মরাজ্যও সেইরূপ। মধ্যযুগে ‘divine right of kings’ নিয়ে ইউরোপে পোপদের মধ্যে এবং রাজাদের মধ্যে যে সব তুমুল কাণ্ড ঘটে গেছে, ইতিহাস-পাঠক তা জানেন। সে সব সংস্কারের যুগ মানুষ অতিক্রম করেছে। তার ফলে মানুষ এখন বড় বড় চিন্তা, আবিষ্কার ও সংগঠনে আত্মনিয়োগ করতে পারছে। কিন্তু আজ দৈবক্রমে পাকিস্তান হাতে পেয়ে আবার আমরা সেই পুরাতন কাসুন্দী ঘাটতে আরম্ভ করেছি। পাকিস্তানে আমরা ইসলামী রাষ্ট্র-খেলাফত চাই, আল্লাহর সার্বভৌমিকতা চাই-এই নিয়ে আমরা এখন ব্যস্ত।

ইসলামী রাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়া

জগত আজ অনেক দূর এগিয়ে গেছে। এমনদিন বেশি দূরে নয়- যেদিন আমরা World State’-এর অধিবাসী হবো। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক আমাদের ক্রমেই ঘনিষ্ট হচ্ছে। শরীরের একটা অঙ্গে কোনো কিছু আঘাত লাগলে যেমন অপর অঙ্গেও তার প্রতিক্রিয়া জাগে, আজকার পৃথিবীর দশাও তাই। নিরপেক্ষ ভাবে কোনো কাজ করবার উপায় এখন নেই। যে ভেবে-চিন্তে করতে হবে। ইসলামী রাষ্ট্র এবং খেলাফতী শাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব কিনা এবং তার ফল ওভ না অশুভ হবে, তা আমাদিগকে বিশেষ ভাবে ভেবে দেখতে হবে। State ও Sovereignty-র ধারণা এখন আর তীক্ষ্ণ নয়। State বা Sovereignty নিজেই তো একটা উদ্দেশ্য নয়, উদ্দেশ্যের উপায় স্বরূপ। উদ্দেশ্য সফল হলে এগুলো আপনা আপনি খসে পড়বে। বৃহত্তর মানব কল্যাণের দিক দিয়ে দেখতে গেলে, State ও State-এর সঙ্গে ভৌগলিক জাতীয়তাবোধের সম্বন্ধ আছে। বিশ্ব-শান্তির পক্ষে এই স্বদেশিকতা যে কতো মারাত্মক, গত দুই মহাযুদ্ধে তা আমরা দেখেছি। Harold Laski কি সুন্দরই না বলেছেনঃ

“Externally, surely the concept of an absolute and in dependent sovereign state which demands an unqualified allegiance to government from its members, and enforces that allegiancee by the power of its command, is incompatible with the interests of humanity …. In a creative civilisation what is important is not the historical accident of separate states, but the scientific fact of world-interdepedence. The real unit of allegiance is the world.”

অন্যত্র তিনি বলেছেনঃ

“In such an aspect the nation of an independent sovereign state is, on the international side, fatal to the well-being of humanity.”

এই সব উদার মহামানবতার বাণী আজ মুসলমানের কণ্ঠে উচ্চারিত হওয়াই উচিত ছিল না কি? কিন্তু আজ তার উল্টা হচ্ছে। অমুসলমানেরা আজ গণ্ডী ভেঙে বিশ্ব-মানুষের কথা চিন্তা করছে আর মুসলমানেরা বিশ্বমানবতার চিন্তা ছেড়ে আনুষ্ঠানিক ইসলামী স্টেট ও তার সভূরিন নিয়ে মশগুল আছে।

প্রতিক্রিয়া

বর্তমান পৃথিবীতে ইসলামী সভূরিন স্টেটের তাই কোনো প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি না। যে আদর্শের জন্য এর প্রয়োজন ছিল, অমুসলমান জাতিরা তার প্রায় সবগুলিই এখন গ্রহণ করে ফেলেছে। বহু জাতির constitution (constitution of the world) আমার সম্মুখে বিদ্যমান। তাতে দেখতে পাচ্ছি, যে সব বৈশিষ্ট্য ইসলামী বলে এতদিন আমরা দাবী করে এসেছি, তা প্রায় সব সভ্য দেশের শাসনতন্ত্রেই বিদ্যমান। সাম্য, মৈত্রী, বাক-স্বাধীনতা, আইনের চোখে সমদর্শিতা, ধর্মনিরপেক্ষতা, দুর্নীতি দমন, সমাজকল্যাণ ব্যবস্থা, আন্তর্জাতিক সমঝোতা-ইত্যাদি ব্যবস্থা সব শাসনতন্ত্রেই একরূপ সমান। কাজেই ইসলামী রাষ্ট্রের আবেদন বহির্জগতের কাছে আজ নাই বললেই চলে। বাকী যেটুকু (অর্থাৎ : ‘Soverneignty belongs to Allah,’ ‘No law shall be enacted which is repugnant to the Quran and Sunnah’ ইত্যাদি), আমাদের রাষ্ট্রের কপালে এটে দেওয়ায় বরং ক্ষতিই হচ্ছে বেশী। ঐ সমস্ত লেবেল দ্বারা মুসলিম রাষ্ট্রকে অহেতুক গণ্ডী-সংকীর্ণতার মধ্যে টেনে আনা হচ্ছে এবং উকট ধর্মান্ধতার ছাপ দিয়ে একে সাম্প্রদায়িক করে তোলা হচ্ছে। ফলে অন্যান্য রাষ্ট্র আমাদিগকে ভয়ের চোখে দেখা আরম্ভ করেছে। ইসলামী স্টেটের নাম শুনেই প্রতিবেশী ভারত আমাদের বিরুদ্ধে শক্রতা সাধন করছে। সঙ্গে সঙ্গে ভারতীয় মুসলিম প্রজাদের উপর কঠোর নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছে। শুধু যে অমুসলমানদেরই বিষ-দৃষ্টিতে আমরা পড়েছি তা নয়; মুসলিম দেশগুলিও একই কারণে পাকিস্তানকে ভালো চোখে দেখে না। Bugdad Pact বা United Arab Republic কাশ্মীর প্রশ্নেও পাকিস্তানকে সমর্থন করে নাই। কাজেই কুট-রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ইসলামী রাষ্ট্রের পরিকল্পনা সঙ্গত কি অসঙ্গত হচ্ছে, তা বিশেষ ভাবে আমাদের ভেবে দেখতে হবে।

ইসলামী রাষ্ট্র নিয়ে বেশি গোঁড়ামি দেখানো ভালো নয়। অনেকে মনে করেন খোলাফায়ে-রাশেদীনের বেশী কড়াকড়ির ফলেই তার প্রতিক্রিয়া স্বরূপ এলো রাজতন্ত্র। হযরত ওমরের হত্যা, হযরত ওসমানের হত্যা, হযরত আলির হত্যা-একে সহজ ভাবে নিলে চলবে না। কোন কোন বিক্ষোভের এগুলি বহিঃপ্রকাশ, অনুসন্ধান করলে অনেক কিছু ধরা পড়বে। অত্যধিক গোঁড়ামির ফলে খোলাফায়ে রাশেদীনের শেষ ভাগে যে গৃহযুদ্ধ আরম্ভ হয়, তা ইসলামের ইতিহাসে দুরপনের কলঙ্ক তো বটেই, বাইরেও তার প্রতিক্রিয়া হয়েছিল অত্যন্ত শোচনীয়। একজন ইংরাজ লেখক মদিনার এই গৃহযুদ্ধকেই “ইউরোপের মুক্তি” (Salvation of Europe) বলে অভিহিত করেছেন। এই গৃহযুদ্ধ ঘটলে ইউরোপ মুসলমানদের পদানত হতো। তেমনি ভাবে খামাখা ইসলামী রাষ্ট্রের খোলস ও সার্বভৌমিকতার লেবেল নিয়ে মারামারি করে আমরা কোথায় কোন বৃহত্তর সুযোগ হারাচ্ছি কে জানে। আল্লাহ যে বিশ্ব নিখিলের সময় প্রভু এ তো জানা কথা। আর ইসলামী রাষ্ট্র দিয়ে কী হবে?

প্রগতিশীল মন নিয়ে ও উদার দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আমাদের ইসলামী রাষ্ট্র-দর্শন গড়ে তুলতে হবে। আজ এক নতুন যুগ এসেছে। শুধু আমাদের কথা চিন্তা করলেই হবে না, বহির্বিশ্বের কথাও ভাবতে হবে। Harold Laski-র আর একটি উক্তি উদ্ধৃত করে এ আলোচনা শেষ করি:

“If men are to live in the great society tiey must learn the habits of co-operative intercourse. They must learn to think of their platoon as a part of the great regiment of mankind.

ইসলামেও তো এই কথাই বলে–

“সমগ্র মানবমণ্ডলী এক জাতি।”

২৯, সেপ্টম্বর, ১৯৬২

হযরত ওসমান কি ‘স্বজন-প্রিয়’ ছিলেন?

ইতিহাসের অধিকাংশ ছাত্রের বিশ্বাস : তৃতীয় খলিফা হযরত ওসমান অত্যন্ত ‘স্বজন-প্রিয় ছিলেন এবং তাহার রাজ্যশাসনেও ছিল দুর্বল হস্তের পরিচয়। von Kremer, Hitty এবং অন্যান্য ইউরোপীয় ঐতিহাসিকগণ হযরত ওসমানের বহু গুণের প্রশংসা করিলেও তাঁহার স্বজনপ্রীতি ও অক্ষমতার কথা উল্লেখ করিতে ছাড়েন নাই। এমন কি মিঃ আমীর আলীও তাঁহার “History of the Saracens”-এ হ্যরত :ওসমানের এই ত্রুটির কথা খুব জোরের সঙ্গেই উল্লেখ করিয়া গিয়াছেন। এই সব ইতিহাস পড়িয়া সকলের মনেই এমন একটা ধারণা বদ্ধমূল হইয়া গিয়াছে যে, হযরত ওসমান খলিফা পদের মর্যাদা রক্ষা করিতে পারেন নাই।

কিন্তু এ ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। আমরা দেখাইব আত্মত্যাগে, জনসেবায়, কর্মবহুলতায়, রাষ্ট্র গঠনে, রাষ্ট্র পরিচালনায় এবং উজ্জ্বল চরিত্র-মাধুর্যে চ্যরত ওসমানের মতো সার্থক, সুন্দর ও বলিষ্ঠ জীবন ইসলামের ইতিহাসে অত্যন্ত বিরল! তাঁহার স্বজনপ্রীতি এবং শাসন-দৌর্বল্যের অভিযোগও ভিত্তিহীন।

পরিচয়

হযরত ওসমান ছিলেন হযরত মুহম্মদের (সাঃ) ফুফাতো বোনের ছেলে অর্থাৎ ভাগিনেয়। বনি-উমাইয়া গোত্রে তাহার জন্ম। হাশেমীদিগের ন্যায় উমাইদীরাও আরবের মধ্যে প্রসিদ্ধ ছিল। বলা বাহুল্য এই প্রতিপত্তির কারণেই উভয় গোত্রের মধ্যে ভীষ রেষারেষি জাগিয়া ছিল। হযরত মুহম্মদের অন্যতম প্রধান শত্রু আবু সুফিয়ান এই উমাইয়া গোত্র হইতেই উদ্ভুত। কোরেশ জাতির জাতীয় পতাকা বহন করিবার গৌরব উমাইয়া বংশকেই দেওয়া হইয়াছিল। হযরত আলির ইন্তেকালের পর এই উমাইয়া বংশ পূর্ণ এক হাজার বৎসর ইসলাম জগতের উপরে আদিপত্য বিস্তার করিয়া ছিলেন।

হযরত ওসমান ছিলেন বড় ঘরের সন্তান। রাসূলুল্লাহ্ অপেক্ষা বয়সে তিনি মাত্র ছয় বৎসরের ছোট ছিলেন। তাহার চেহারা ছিল অতি সুন্দর। বাল্যকাল হইতেই তিনি ছিলেন সত্যবাদী ও বিনয়ী। তিনি লেখাপড়া জানিতেন। যৌবনে ব্যবসা করিয়া তিনি প্রভূত ধন সঞ্চয় করেন। স্বচ্ছ নির্মল চরিত্রের জন্য তিনি সকলেরই প্রিয় ছিলেন। হযরত আবুবকরের সঙ্গে ছিল তাহার প্রগাঢ় বন্ধুত্ব।

হযরত মুহম্মদ যখন ইসলাম প্রচার আরম্ভ করেন, তখন হযরত ওসমানের বয়স ৩৪ বৎসর। পুরুষদিগের মধ্যে হযরত আবুবকরই সর্বপ্রথম ইসলাম গ্রহণ করেন। ইহার কিছুদিন পরেই হযরত ওসমান দীক্ষিত হন। হযরত ওসমানের চাচা যখন এ কথা জানিতে পারেন, তখন তিনি তাঁহাকে হাত পা বাধিয়া ভীষণ ভাবে প্রহার করিতে থাকেন, কিন্তু কিছুতেই তিনি তাহার মত পরিবর্তন করাইতে পারেন নাই।

রাসূলুল্লাহ তাহার কন্যা রোকাইয়াকে হযরত ওসমানের সঙ্গে বিবাহ দেন। রোকাইয়ার মৃত্যুর পর তিনি তাহার দ্বিতীয়া কন্যা উম্মে কুলসুমকেও ওসমানের হস্তে সমর্পণ করেন। কোনো পয়গম্বরের দুইটি কন্যা বিবাহ করিবার সৌভাগ্য ও মর্যাদা ইতিহাসে আর কোনো ব্যক্তির ভাগ্যে ঘটে নাই।

আল্লাহ ও রাসুলের প্রতি তাঁহার অনুরাগ ছিল প্রগাঢ়। আল্লাহর নামে রসুলের নামে তিনি তাঁহার জান ও মাল সম্পূর্ণ কোরবান করিয়া দিয়াছিলেন। কোরেশদের অমানুষিক অত্যাচারে জর্জরিত হইয়া রাসূলুল্লাহ্ যখন একদল নও-মুসলিমকে আবিসিনিয়ায় হিজরত করিতে নির্দেশ দেন, তখন এই তরুণ যুবক ওসমান তাহার স্ত্রী রোকাইয়াকে সঙ্গে লইয়া অকাতরে সেই বিপদ-সঙ্কুল দেশে হিজরত করেন। রাসূলুল্লাহর হিজরতের সময়েও তিনি মক্কা হইতে মদিনায় হিজরত করিয়াছিলেন। এইরূপে ধর্মের জন্য দুই-দুইবার তিনি দেশ ত্যাগ করিয়াছিলেন। আল্লাহ্ ও রসুলের আহ্বানে যে কোনো মুহূর্তে তিনি যে সাড়া দিতে প্রস্তুত ছিলেন, এই দুইটি ঘটনা হইতে তাহার প্রমাণ মিলে। মদিনায় পৌঁছিয়াও হযরত ওসমান নানা ভাবে ইসলামের প্রচার কার্যে সাহায্য করিয়াছেন। মোহাজেরিনদিগের সংখ্যাধিক্য বশতঃ মদিনায় মুসলমানদিগের মধ্যে যখন ভীষণ পানির কষ্ট দেখা দিল, তখন রাসূলুল্লাহ্ অমুসলমানদিগের একটি কূপ কিনিয়া লইয়া সর্বসাধারণের ব্যবহারে লাগাইতে ইচ্ছা প্রকাশ করেন। হযরত ওসমান তৎক্ষণাত ৩৫,০০০ দিরহাম দিয়া সেই কূপটি কিনিয়ে লইয়া হযরতের ইচ্ছা পূর্ণ করিলেন। তাঁবুক অভিযানে যখন রাসূলুল্লাহ সাহাবাদিগকে সাহায্য করিবার জন্য আবেদন জানাইলেন, তখন ওসমান নগদ ১০,০০০ দিরহাম এবং এক হাজার উট দান করেন। মদিনা মসজিদের আয়তন বৃদ্ধির জন্য রাসূলুল্লাহ্ যখন মসজিদ-সংলগ্ন জমি কিনিতে চাহিলেন, তখন হযরত ওসমান নিজ ব্যয়ে সে জমি ক্রয় করিলেন। তাহার নিজের খেলাফত সময়ে এই জমির উপরেই তিনি নিজ ব্যয়ে মসজিদের কলেবর বৃদ্ধি করিয়া দেন। বস্তুত হযরত ওসমান তাহার সমস্ত ধন সম্পত্তি এবং সমগ্র জীবন ইসলামের সেবাতেই ব্যয় করিয়া গিয়াছেন।

শুধু যে অর্থ সাহায্য দ্বারাই তিনি ইসলামের খিদমত করিয়াছিলেন, তাহা নহে; ইসলামের প্রায় সমুদয় যুদ্ধেই তিনি সক্রিয় অংশ গ্রহণ করিয়াছিলেন। একমাত্র বদর যুদ্ধেই তিনি যোগদান করিতে পারেন নাই। বদর যুদ্ধে যখন সেনাদল রওয়ানা হইল, তখন ওসমানের স্ত্রী রোকাইয়া মরণ শয্যায় শায়িতা। প্রিয় কন্যার মৃত্যুশয্যার শিয়রে বসিয়া দুইটি সান্ত্বনা বাক্য শুনাইবার অবসরও মহাপুরুষদের নাই! কর্তব্যের আহ্বান রাসূলুল্লাহ্ তাই চলিলেন বদর-প্রান্তরে সেনাপতির বেশে। কিন্তু পশ্চাতের এই মানবতার আহ্বানও তো তুচ্ছ করিবার নয়। তিনি তখন ওসমানকে বলিলেন, তুমি যুদ্ধে যোগ দিও না, রোকাইয়ার সেবা-শুশ্রূষার জন্য মদিনায় থাকিয়া যাও। হযরত ওসমান তাই বাধ্য হইয়া বদর যুদ্ধে যোগ দিতে পারিলেন না। কয়েকদিন পর যখন বিজয়-সংবাদ লইয়া কাসেদ মদিনায় পৌঁছিল, তখন রোকাইয়া আর ইহজগতে নাই।

হযরত ওসমান বদর-যুদ্ধে যোগ দিতে না পারিয়া যারপরনাই মর্মাহত হন। রাসূলুল্লাহ ইহা বুঝিতে পারিয়া যুদ্ধ-লব্ধ গণিমতের মাল হইতে একটি হিসসা হযরত ওসমানকে দান করেন এবং ইহা দ্বারা তিনিও যে বদরে উপস্থিত ছিলেন, এই কথা প্রতিপন্ন করেন। সত্যই তো তাই। দৈহিক ভাবে না হইলেও আত্মিকভাবে হযরত ওসমান তো বাস্তবিকই বদর-প্রান্তরে উপস্থিত ছিলেন। এই আত্মিক সংযোগ উপেক্ষা করিবার নয়।

তারপর ওহুদ ও অন্যান্য প্রত্যেক যুদ্ধে হযরত ওসমান কার্যতঃ অংশ গ্রহণ করিয়াছিলেন। হুদাইবিয়ার সন্ধির প্রাক্কালে রাসূলুল্লাহ হযরত ওসমানকে দূতরূপে মক্কায় কোরেশদের নিকট প্রেরণ করেন, কিন্তু সেখানে কোরেশরা তাঁহাকে হত্যা করিবার অভিপ্রায়ে বন্দী করে। পরে তাহাকে ছাড়িয়া দেওয়া হয়। এইরূপে নানা অগ্নিপরীক্ষার মধ্য দিয়া হযরত ওসমানের কর্ম-জীবন অতিবাহিত হয়। ইসলাম প্রচারের ইতহাসে এই ত্যাগী-বীরের সেবা ও দান অক্ষয় হইয়া আছে।

খেলাফত

দ্বিতীয় খলিফা হযরত ওমর যখন ইন্তেকাল করেন, তখন তিনি কাহাকেও খলিফা মনোনীত করিয়া যান নাই; তবে তিনি ছয়জন বিশিষ্ট ব্যক্তিকে লইয়া একটি পরামর্শ-সভা (মজলিস-ই-সূরা) গঠন করিয়া দিয়া যান এবং বলিয়া যান যে, তাঁহারাই যেন পরামর্শ করিয়া একজনকে খলিফা মনোনীত করিয়া লন। জ্ঞানে গুণে সেবা ও মহত্বে এই ছয় জনই ছিলেন তখনকার দিনে আরবের সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যক্তি। এই ছয় জনের নাম-আবদুর রহমান, ওসমান, আলি, সা’দ, তালহা এবং জুবায়ের। আশ্চর্যের বিষয়, রাষ্ট্রের এই সর্বপ্রধান পদটি অধিকার করিবার জন্য এই ছয়জন মনীষীর মধ্যে এখনকার মতো কোনোই বিকৃত প্রতিযোগিতা দেখা যায় নাই। প্রথমেই আবদুর রহমান এ-পদ গ্রহণ করিবেন না বলিয়া ঘোষণা করেন। এ কারণে তাহাকেই এ কমিটির সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। তিনি তখন অবশিষ্ট সদস্যদিগের মতামত জিজ্ঞাসা করেন। এই সময় তালহা মদিনার বাহিরে ছিলেন, কাজেই তিনি সেই পরামর্শ সভায় উপস্থিত হইতে পারেন নাই। বাকী চার জনের মধ্যে সা’দ হযরত ওসমানকে ভোট দেন, জুবায়ের ওসমান ও আলি উভয়কেই ভোট দেন; হযরত ওসমান হযরত আলিকে ভোট দেন। পক্ষান্তরে হযরত আলি হযরত ওসমানকে ভোট দেন। এইরূপে চারজনের মধ্যে তিনজনেই হযরত ওসমানকেই মনোনীতি করেন। আবদুর রহমান মদিনার অন্যান্য বিশিষ্ট ব্যক্তিদিগের মতামতও গ্রহণ করেন এবং একবাক্যে সকলেই হযরত ওসমানকে ভোট দেন। তখন আবদুর রহমান হযরত ওসমানেই খলিফা বলিয়া ঘোষণা করেন এবং একে একে সকলেই তাহার আনুগত্যের শপথ গ্রহণ করেন। ইহার কিছু পরেই তালহা ফিরিয়া আসেন। ওসমান তখন তাঁহার খলিফা-পদ লাভ করিবার ইতিবৃত্ত তাহাকে শুনান এবং বলেন যে, তিনি (তাহা) যদি ভিন্ন মত পোষণ করেন, তবে তখনও তিনি (ওসমান) তাহার খলিফা পদ ছাড়িয়া দিতে রাজি আছেন। তাহাও সর্বান্তঃকরণে হযরত ওসমানকেই ভোট দেন। এইরূপে সর্বসম্মতিক্রমেই হযরত ওসমান খলিফা পদে অধিষ্ঠিত হন।

হযরত ওসমান ১২ বৎসর খেলাফতী করেন। প্রথম ছয় বৎসর তাহার খেলাফত বা কার্যাবলীর কোথাও কোনো সমালোচনা বা বিরুদ্ধতা দেখা যায় নাই। কিন্তু শেষের ছয় বৎসর তাহার বিরুদ্ধে নানা ষড়যন্ত্র ও বিদ্রোহ দেখা দেয় এবং ইহারই ফলে তিনি বিদ্রোহীদের হস্তে শহীদ হন।

হযরত ওসমানের খেলাফত সার্থক ও গৌরবমণ্ডিত হইয়াছিল। এমনকি আরববাসীরা হযরত ওমর অপেক্ষা হযরত ওসমানের শাসনকেই বেশী পছন্দ করিতেন। হযরত ওমরের শাসন ছিল কর্তব্য ও দায়িত্বে সুকঠোর; কিন্তু হযরত ওসমানের শাসনে ছিল কঠোরের সহিত কোমলের সমাবেশ। তাই অনেকের মতে হযরত ওমর অপেক্ষা হযরত ওসমানই ছিলেন অধিকতর জনপ্রিয়।

হযরত ওসমানের খেলাফতের সময়ে মুসলিম সাম্রাজ্যের কোনো ক্ষতি তো হয়ই নাই, বরং ইহার সীমানা আরও বিস্তৃত হয় এবং ভিত্তি আরও সুদৃঢ় হয়। পারস্য, মিসর, সিরিয়া প্রভৃতি স্থানে পারশিকরা ও রোমানরা বিদ্রোহ উপস্থিত করে বটে, কিন্তু তাহাতে ক্ষতি না হইয়া লাভই হয়। হযরত ওসমান সুদৃঢ় হস্তে সেই সব বিদ্রোহ দমন করিবার ব্যবস্থা করেন। তাছাড়া অনেক নূতন দেশও তাহার সময়ে বিজিত হয়। খোরাসান, মার্ত, তুস, বলখ, তুর্কীস্থান, হীরাট, কাবুল, কান্দাহার, আজার বাইজান প্রভৃতি দেশে ইসলামের হিলালী ঝাণ্ডা উড়িতে থাকে। অন্যদিকে তিফলিস ও কৃষ্ণসাগর পর্যন্ত মুসলিম সাম্রাজ্য বিস্তার লাভ করে। ইসলামের প্রথম নৌ-যুদ্ধের গৌরবও হযরত ওসমানের প্রাপ্য। সাইপ্রাস দ্বীপ তাহারই উদ্যোগে বিজিত হয়। এইরূপে হযরত ওসমানের খেলাফত সময়ে দিকে দিকে ইসলামের লাল মশাল জ্বলিয়া ওঠে।

হযরত ওসমানের ‘স্বজনপ্রীতি’ (?)

কিন্তু এত গুণ থাকা সত্বেও হযরত ওসমানের প্রতি ঐতিহাসিকগণ স্বজন-প্রীতির

দোষারোপ করিয়া গিয়াছেন। তাহাদের মতে এই কারণেই তাহার পতন ঘটে। অধিকাংশ ঐতিহাসিক বলেন : হযরত ওসমান বড় বড় রাজপদে অপর সকলের দাবী উপেক্ষা করিয়া নিজের আত্মীয়-স্বজনকে নিযুক্ত করেন। ইহাতেই জনসাধারণের মনে অসন্তোষ দেখা দেয় এবং কালে এই অসন্তোষই ধূমায়িত হইয়া দারুণ বিদ্রোহের আকারে আত্মপ্রকাশ করে এবং তাহার জীবনকে একটা শোচনীয় পরিণতিতে টানিয়া আনে।

এই অভিযোগ কতদূর সত্য, নিরপেক্ষ ইতিহাসের আলোকে এইবার আমরা তাহা বিচার করিয়া দেখিব।

অভিযোগকারীরা বলেন, হযরত ওসমান পারশে, মিসরে এবং কুফায় নিজের আত্মীয়-স্বজনকে গবর্নর নিযুক্ত করিয়াছিলেন। বসরার গভর্নর ছিলেন আবু মূসা আশারী। হযরত ওমর ইহাকে নিযুক্ত করেন, কিন্তু হযরত ওসমানের সময়ে বসরার লোকেরা আবু মূসার উপরে অসন্তুষ্ট হইয়া উঠে এবং হযরত ওসমানের নিকট অন্য আর একজন গবর্নর নিয়োগের প্রার্থনা জানায়। হযরত ওসমান তাহাদের ইচ্ছানুসারে তাহাদেরই মনোনীত এক ব্যক্তিকে তদস্থলে গবর্নর নিযুক্ত করেন। কিন্তু নূতন গবর্নরও সন্তোষজনক ভাবে কার্য করিতে না পারায় হযরত ওসমান তদস্থলে আবদুল্লাহ্ বিন আমেরকে গবর্নর নিয়োগ করিয়া পাঠান। এই আবদুল্লাহ্ ছিলেন হযরত ওসমানের দুধ-ভাই।

কিন্তু এই নিয়োগ আদৌ অযৌক্তিক হয় নাই, অথবা ‘স্বজনপ্রীতি’র দ্বারাও ইহা অনুপ্রাণিত হয় নাই। স্বজনপ্রীতি তখনই গর্হিত হয়- যখন যোগ্যতর ব্যক্তিকে রাখিয়া অযোগ্য ব্যক্তিকে দায়িত্বপূর্ণ পদ দেওয়া হয় এবং তাহার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগই কানে ভোলা হয় না। কিন্তু কোনো ব্যক্তি যদি গুণে-জ্ঞানে উপযুক্ত হয়, তবে স্বজন হইলেও তাহাকে কোনো যোগ্যপদ দান নিন্দাহ হইতে পারে না। বরং যোগ্য হইলে স্বজনকেই দায়িত্বপূর্ণ পদ দেওয়া বুদ্ধিমত্তার কার্য। যেখানে দলাদলি বা সাম্প্রদায়িক শত্রুতা বিদ্যমান, সেখানে বিশেষ পদগুলিতে (key posts) বিশ্বাসী নিজের লোক লওয়াই দরকার; যোগ্যতায় সে যদি অপরের অপেক্ষা কিছু খাটোও হয়, তাহাতেও কিছু আসে যায় না। এই হিসাবে দেখিলে দেখা যাইবে, আবদুল্লাহর নিয়োগ কোনোক্রমেই অন্যায় বা অসঙ্গত হয় নাই। এই আবদুল্লাহর দ্বারাই পারশ্যের সমস্ত বিদ্রোহ প্রশমিত হয় এবং মুসলিম বাহিনী একদিকে বলখ ও তুর্কীস্থান দখল করে, অন্যদিকে হীরাট, কাবুল এবং গজনীও তাদের পদানত হয়। এমন কি তুর্কীদের আজারবাইজান প্রদেশও আবদুল্লাহর সেনাদল দখল করিয়া লয়। এইরূপে আবদুল্লাহর হস্তে ইসলাম সাম্রাজ্যের উত্তর ও পূর্ব সীমান্ত কোনোরূপ ক্ষতিগ্রস্ত না হইয়া আরও শক্তিশালী হয়। দুধ-ভাই বলিয়া তাহাকে নিয়োগ না করিলেই কি ভালো হইত?

তারপর সিরিয়ার কথা। সিরিয়ার শাসনকর্তা ছিলেন মাবিয়া। ইনি হযরত ওসমানের আত্মীয় ছিলেন, সন্দেহ নাই; কিন্তু ইহাকে হযরত ওসমান নিয়োগ করেন নাই; হযরত ওমরের দ্বারাই তিনি উক্ত পদে নিযুক্ত হইয়াছিলেন। কাজেই, এই নিয়োগের জন্য হযরত ওসমানকে স্বজনপ্রীতির দোষ দেওয়া যায় না। অন্যান্য সকলের তুলনায় মাবিয়া ছিলেন যোগ্যতায় শ্রেষ্ঠ। কাজেই হযরত ওসমান তাহাকে নিজ পদেই বহাল রাখিয়াছিলেন। এই মাবিয়াই দুর্ধর্ষ এজিদের পিতা। কিন্তু হইলে কি হয়, তাহার যোগ্যতা ছিল প্রচুর। তাহার দ্বারাই ইসলামী সাম্রাজ্য সুদৃঢ় ও বিস্তৃত হয়। সিরিয়া হইতে তিনি রোমান-বিদ্রোহ সম্পূর্ণরূপে বিধ্বস্ত করেন। শুধু তাই নয়, নৌ-যুদ্ধে সাইপ্রাস দ্বীপ অধিকার করার মূলেও ছিলেন তিনি। মুসলমানদিগের ইহাই প্রথম নৌ-যুদ্ধ। হযরত ওমরের শাসন সময়েই মাবিয়া একবার এই সাইপ্রাস দ্বীপ অধিকার করিবার অনুমতি প্রার্থনা করেন; কিন্তু ওমর নৌ-যুদ্ধ করিতে সাহস পান নাই। মাবিয়ার সে সাধ হযরত ওসমান পূর্ণ করেন। তিনি মাবিয়াকে সাইপ্রাস দখল করিবার নির্দেশ দেন। মাবিয়া তদনুসারে মিশরের শাসনকর্তা আবদুল্লাহর সহিত একযোগে প্রয়োজনীয় রণতরীর ব্যবস্থা করেন। অচিরেই একটি নৌ যুদ্ধ হয় এবং আশ্চর্যের বিষয়, এই প্রথম নৌ-যুদ্ধে মুসলিম সৈন্যই জয়লাভ করে।

এইরূপে মাবিয়া খেলাফত-রাষ্ট্রের শক্তি বহুগুণে বৃদ্ধি করেন। এশিয়া মাইনরের মধ্য দিয়া তিফলিস্ এবং কৃষ্ণসাগর পর্যন্ত তিনি আধিপত্য বিস্তার করেন।

এখানেও দেখা যাইতেছে, মাবিয়ার নিয়োগের জন্য হযরত ওসমান দায়ী ছিলেন না এবং দায়ী হইলেও মোগ্যতা ও সফলতার দিক দিয়া এই নিয়োগকে কোনোক্রমেই অসঙ্গত বলিবার কোনো হেতু ছিল না। মাবিয়া তকালে সত্যই একজন প্রতিভাবান ব্যক্তি ছিলেন।

সিরিয়ার দেখাদেখি মিসরেও বিদ্রোহের আগুন জুলিয়া ওঠে। রোমানরা বিরাট শক্তি লইয়া আলেকজান্দ্রিয়া আক্রমণ করে। মিসরের শাসনকর্তা আমর বিন-আস্ অচিরেই রোমানদিগকে তাড়াইয়া দিয়া আলেকজান্দ্রিয়া দখল করেন। কিন্তু মিসরের পশ্চিম সীমান্তে তখনও রোমানরা দমিত হয় নাই। ঠিক এই সময়ে আমরের পদচ্যুতি ঘটে। ওসমানের এক পালিত ভ্রাতা আবদুল্লাহ্-বিন-সা’দ ছিলেন উচ্চ মিসরের (Upper Egypt) রাজস্ব বিভাগের কর্মচারী। হযরত ওমর ইহাকে নিযুক্ত করিয়া যান। শাসন সংক্রান্ত কোনো ব্যাপারে শাসনকর্তা আমরের সহিত তাহার বিরোধ বাধে। এই বিরোধের বিচার-মীমাংসার ভার পড়ে স্বযং খলিফার উপর। হ্যরত ওসমান তদন্ত করিয়া দেখেন আমরই এই ব্যাপারে দায়ী। হযরত ওমরও ইতোপূর্বেই আমরের উপর অসন্তুষ্ট হইয়াছিলেন। হযরত ওসমান তাহা জানিতেন। কাজেই তিনি আমরকে সরাইয়া আনেন এবং তদস্থলে আব্দুল্লাহ-বিন-সা’দকেই মিসরের, গবর্নর নিযুক্ত করেন। হযরত ওমরের শাসন সময়ে আফ্রিকার ত্রিপলি এবং বারকা পর্যন্ত মুসলিম শাসন বিস্তৃত হয়; কিন্তু অন্যান্য রোমক শক্তি অব্যাহত থাকে। হযরত ওসমান নব নিযুক্ত শাসনকর্তা আবদুল্লাহকে আদেশ দেন রোমানদের বিরুদ্ধে অভিযান করিয়া আরও অগ্রসর হইবার। এই উদ্দেশ্যে মদিনা হইতে তিনি নূতন একদল সৈন্য পাঠাইয়াও আবদুল্লাহকে সাহায্য করেন। আবদুল্লাহ্ নব উদ্যমে রোমান শক্তিকে আক্রমণ করেন। কয়েকটি যুদ্ধের পর রোমান সেনাপতি গ্রেগরী মুসলমানদের হস্তে নিহত হন এবং রোমান সৈন্য পরাজিত হয়। আবদুল্লাহ রোমানদের সহিত নৌ-যুদ্ধে করিবার জন্য একটা রণতরী বহরও সৃষ্টি করেন এবং নৌ-যুদ্ধে রোমানদিগকে পরাজিত করেন। এইরূপে আফ্রিকা মহাদেশের বহু স্থান মুসলিম অধিকারের অন্তর্ভুক্ত হয়।

কুফার শাসনকর্তা নিয়োগেও হযরত ওসমানকে দোষী করা যায় না। হ্যরত ওমরের সময় কুফার শাসনকর্তা ছিলেন পারশ্য-বিজয়ী সা’দ। কিন্তু কোনো ত্রুটির জন্য হযরত ওমর তাহাকে সরাইয়া আনেন, এবং তদস্থলে মুগীরাকে শাসনকর্তা নিয়োগ করেন। মৃত্যুশয্যায় হযরত ওমর এই ইচ্ছা প্রকাশ করিয়া যান যে, সা’দকে যেন পুনরায় কুফার শাসনকর্তার পদে নিয়োগ করা হয়। তদনুসারে হযরত ওসমান খেলাফতের প্রারম্ভেই মুগীরাকে ফিরাইয়া আনিয়া সা’দকে পুণর্নিয়োগ করেন। কিন্তু এবারও সা’দ বেশী দিন শাসনকর্তার পদে অধিষ্ঠিত থাকিতে পারেন নাই। কুফার খাজাঞ্চি ইবনে মাসুদের সঙ্গে সা’দের বিরোধ বাধে। সা’দ সরকারী তহবিল হইতে কিছু টাকা ধার নেন। সেই টাকা খাজাঞ্চি তলব করিলে সা’দ তাহা পরিশোধ করিতে অসমর্থ হন। ইহাই উভয়ের মধ্যে বিরোধের কারণ। এই বিরোধকে কেন্দ্র করিয়া বৈশ একটা দলাদলির সূত্রপাত হয়। একদল আসিয়া হযরত ওসমানের নিকট সা’দের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে। খলিফা তদন্ত করিয়া সা’দকেই অপরাধী সাব্যস্ত করেন এবং তাহাকে পুনরায় ফিরাইয়া আনেন এবং তদপরিবর্তে অলিদ-বিন-আক্কাসকে গবর্নর নিযুক্ত করেন। অলিদ খলিফার আত্মীয় ছিলেন সন্দেহ নাই। কিন্তু,এ ব্যাপারেও খলিফার পক্ষপাতিত্বের বা স্বজনপ্রীতির কোনো কথা আসে না, কারণ এ নিয়োগও তাঁহার খেলাফতের প্রারম্ভে দেওয়া হইয়াছিল। হযরত ওসমানের অতি বড় শত্রুরাও একথা স্বীকার করেন যে, হযরত ওসমান প্রথম ছয় বৎসর যে সব নিয়োগ বা বরখাস্ত করেন, তাহার মধ্যে কোনো অসঙ্গত স্বজনপ্রীতি বা পক্ষপাতিত্ব ছিল না। জনসাধারণ সকলেই খলিফার কার্যাবলীকে সমর্থন করিয়া গিয়াছেন। কাজেই অলিদের এই নিয়োগও অসঙ্গত হয় নাই। সরল মনে যোগ্যতার বিচার করিয়াই তিনি তাহাকে নিযুক্ত করিয়াছিলেন। তাহার মনে যদি কোনো স্বজনপ্রীতিই থাকিত, তবে এই অলিদের বিরুদ্ধেই লোকেরা যখন আবার মদ্যপানের অভিযোগ আনিল, তখন অমনি খলিফা তাহাকে বরখাস্ত করিয়া প্রকাশ্যে বেত্ৰদণ্ড দান করিলেন। ইহা নিশ্চয়ই কোনো স্বজন-প্রীতির লক্ষণ নয়। একজন প্রাদেশিক গভর্নরকে আত্মীয় হওয়া সত্বেও বরখাস্ত করিয়া বেত্রদও দিবার মতো মনোবল যাহার ছিল, তাহার উপর কি পক্ষপাতিত্বের দোষারোপ করা চলে? তারপর অলিদের শূন্যপদে হযরত ওসমান অলিদ-বিন-আস নামক এক ব্যক্তিকে নিযুক্ত করেন। খলিফার সহিত তাহারও আত্মীয়তা ছিল। কিন্তু এই অলিদও যখন অযোগ্য বলিয়া প্রমাণিত হইলেন, তখন তাহাকেও তিনি বরখাস্ত করিয়া আবু মুসা আশারীকে তদস্থলে নিযুক্ত করিয়া পাঠাইলেন। এই আশারীর সহিত খলিফার কোনোই সম্পর্ক ছিল না।

হযরত ওসমানের যে সমদর্শিতা ও ন্যায়বোধ ছিল তাহার আর একটি প্রমাণঃ মিশরের শাসনকর্তা আবদুল্লাহর বিরুদ্ধে যখন তুমুল আন্দোলন শুরু হইল, তখন খলিফা তাঁহাকে সরাইয়া তাহার স্থানে বিদ্রোহীদের মনোনীত প্রার্থী হযরত আবুবকরের পুত্র মুহাম্মদকে মিসরের শাসনকর্তা নিযুক্ত করিয়া পাঠান। এ কথা আমরা পরে বলিব।

এই সমস্ত ঘটনা হইতে পরিষ্কার বুঝা যাইবে যে, হযরত ওসমান যে কোনোরূপ স্বজন-পোষণ নীতি দ্বারা অনুপ্রাণিত হইয়াই তাঁহার আত্মীয়-স্বজনকে উচ্চ রাজপদে নিয়োগ করিয়াছিলেন, তাহা নহে। অনাত্মীয় যোগ্য লোকের অভাবেই তিনি উক্ত পদসমূহে যোগ্য আত্মীয়-স্বজনদিগকেই নিয়োগ করিতে বাধ্য হইয়াছিলেন। প্রকৃতপক্ষে আত্মীয়তার দাবী অপেক্ষা যোগ্যতার দাবীকেই তিনি উ েস্থান দিয়াছিলেন। হযরত ওসমানরে সাথে মদিনার সম্ভ্রান্ত ও উপযুক্ত ব্যক্তিদিগের আত্মীয়তা থাকা খুবই স্বাভাবিক ছিল। কাজেই উপযুক্ত কোনো ব্যক্তিকে নিয়োগ করিতে গেলেই আত্মীয়তার বন্ধন তিনি এড়াইতে পারেন নাই। গোত্রগত রাজনীতি (party politics) এর আওতার মধ্যে; এই নীতির যৌক্তিকতাও অস্বীকার করা যায় না। পক্ষান্তরে ইহাও প্রণিধানযোগ্য যে, বিদ্যা-বুদ্ধি ও যোগ্যতাতেও উমাইয়া বংশের লোকেরা হাশেমী বংশের লোকদের চেয়ে শ্রেষ্ঠতর ছিলেন। হযরত আলীর পরে উমাইয়া বংশই দীর্ঘ এক হাজার বত্সর ইসলামী সাম্রাজ্যের কর্ণধার ছিলেন। ইহা নিশ্চয়ই তাহাদের শক্তিমত্তার পরিচয়। কাজেই খলিফার স্বজন প্রীতির জন্যই যে লোকেরা বিদ্রোহী হইয়াছিল, তাহা ঠিক নহে। বিদ্রোহের আরও বহু কারণ ছিল। আমরা কতিপয় কারণ নিম্নে লিপিবদ্ধ করিতেছি।

বিদ্রোহের কারণ

খলিফার অতিমাত্রায় সরলতা ও গণতান্ত্রিক মনোভাবই ছিল সমুদয় বিদ্রোহের মূল কারণ। হ্যরত ওসমান অত্যন্ত সহজলভ্য ছিলেন। অতি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ব্যাপারেও লোকেরা তাঁহার নিকট বিচার প্রার্থনা করিতে পারিত। খলিফার দরজা সব সময়েই খোলা থাকিত। প্রাদেশিক গভর্নরদের উপরও এই আদেশ তিনি জারী করিয়াছিলেন। ইহাতে অসৎ লোকেরা গণ্ডগোল বাধাইবার সুযোগ পাইত। খলিফা নিজেকে জনসাধারণের একজন নগণ্য খাদেম বলিয়া মনে করিতেন। সুমার্জিত গণতান্ত্রিক দৃষ্টিতে এই মনোভাব আদর্শ

স্থানীয় সন্দেহ নাই। কিন্তু এই মুক্তা তিনি উলুবনে ছড়াইয়াছিলেন বলিয়া ইহার মূল্য কেহই দেয় নাই। দীর্ঘ দিন রাসূলুল্লাহর সংস্পর্শে থাকার ফলে মদিনার মুসলমানদের মনে ইসলামের সত্যিকার সাম্য ও ভ্রাতৃভাব স্থায়ী রেখাপাত করিয়াছিল; কাজেই মদিনায় এ আদর্শ অনেকটা কার্যকরী হইয়াছিল। কিন্তু বিজিত দেশের নব-দীক্ষিত মুসলমানদের মন তখনও বন্য প্রকৃতির ছিল। অনেক কুচক্রী লোকও নিজেদের স্বার্থ সিদ্ধির আশায় ইসলাম গ্রহণ করিয়াছিল। এই মুনাফেক দল তলে তলে মুসলিম সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করিতেছিল। অন্য একটি কারণও ছিল। পদচ্যুত কর্মচারীগণ স্থির হইয়া বসিয়া ছিলেন না। তাহারাও দল পাকাইতে ছিলেন। স্বজনপ্রীতির অভিযোগ তাহারাই করিয়াছিলেন, কারণ এই অজুহাত হযরত ওসমানের বিরুদ্ধে উত্তেজনা সৃষ্টির পক্ষে খুবই অনুকূল ছিল। এইরূপ নানা কারণেই হযরত ওসমানের বিরুদ্ধে ধীরে ধীরে একটা ষড়যন্ত্র মাথা তুলিয়া উঠিতেছিল।

খলিফার হত্যা

এই ষড়যন্ত্রের ফলেই খলিফা হযরত ওসমান শত্রুদের হস্তে অতি নিষ্ঠুর ভাবে নিহত হন। হযরত ওসমানের খেলাফতের ৮ম বর্ষে ইবনে সাবা নামক ইয়েমেন প্রদেশের একজন ইহুদী বসরা নগরীতে আসিয়া মুসলমান হয়। তাহার এই ধর্মগ্রহণ একটা ছলনা মাত্র। মুসলমান বেশে সে বসার, কুফা, সিরিয়া এবং মিসর,পরিভ্রমণ করে এবং জনসাধারণের মন খলিফার বিরুদ্ধে বিষাক্ত করিয়া তোলে। একমাত্র সিরিয়া প্রদেশেই মাবিয়ার বিচক্ষণতায় সে কোনো সুবিধা করিতে পারে নাই। মিসরে আসিয়া সে প্রকাশ্য ভাবে ঘোষণা করে যে, হযরত ওসমান খলিফার গদি অন্যায় ভাবে দখল করিয়া বসিয়া আছেন, হযরত আলীই প্রকৃত খলিফা। এই মত ধীরে ধীরে সর্বত্র ছড়াইয়া পড়ে। বসরা এবং কুফায় একদল লোক তার সহকর্মী হইয়া দাঁড়ায়। সীমান্তের দুর্ধর্ষ প্রকৃতির মুসলমানেরাও এই আন্দোলনে যোগ দেয়। হুজুগপ্রিয় লোকেরা যাহা শুনে তাহাই বিশ্বাস করে। বেদুঈনরাও তাই বিদ্রোহীদের সঙ্গে যোগ দেয়। ষড়যন্ত্রকারীরা তাহাদিগকে বলে যে, সমস্ত বড় বড় রাজপদ শুধু কোরেশরাই উপভোগ করিতেছে। বিভিন্ন গোত্রের নিকট বলা হয় যে, ওসমান শুধু বনি-উমাইয়াদিগকেই সমস্ত পদমর্যাদা ও সুখ-সুবিধা দান করিতেছেন। এইরূপে কুচক্রীদের প্রোপাগাণ্ডা অত্যন্ত জোরের সঙ্গে চলিতে থাকে।

হযরত ওসমানের আরও কতকগুলি কাজ চক্রান্তকারীদের সহায়তা করিল। আবু জার গিফারী নামক একজন সাহাবী ছিলেন একটু গোড়া প্রকৃতির। সারা জীবন তিনি ভোগ বিলাসশূন্য সাত্বিক জীবন অতিবাহিত করিয়াছেন। অর্থ-সম্পদকে চিরদিন তিনি নিন্দা করিয়া আসিয়াছেন। অর্থ-সঞ্চয়কে তিনি গায়ের-ইসলামী বলিয়া মনে করিতেন। দামেস্কে গিয়া তিনি খুব জোরে শোরে এই মত প্রচার করিতে থাকনে। কুরআন শরীফের এই

আয়াতের উপর তিনি খুব জোর দেনঃ “যাহারা স্বর্ণ-রৌপ্য মজুত করিয়া রাখে এবং আল্লাহর রাহে খরচ না করে, তাহাদিগকে (দোজখের) ভীষণ শাস্তির কথা ঘোষণা করো।”–(৯ : ৩৪) এই আয়াতের বরাত দিয়াই তিনি প্রচার করেন যে, কোনো মুসলমানই স্বর্ণ রৌপ্য বা টাকা-কড়ি সঞ্চয় করিতে পারিবে না, সমস্তই বিলাইয়া দিতে হইবে। অন্যান্য ওলামারা কিন্তু এ মত পোষণ করিলেন না। তাহারা বুঝাইতে চেষ্টা করিলেন যে, উক্ত আয়াতের অর্থ এ নয় যে, স্বর্ণ-রৌপ্য বা টাকা-কড়ি কিছুই সঞ্চয় করা যাইবে না। যাহারা ধন-সম্পদ উপার্জন করিবে, তাহারা যদি তাহা হইতে যথারীতি যাকাত না দেয় বা আল্লাহর রাহে ব্যয় না করে, তবে সেই মজুদকারীদিগেরই সাজা হইবে; কিন্তু তাহারা যদি সেই অর্থ হইতে নির্দিষ্ট পরিমাণ যাকত দেয় এবং সৎ কাজ করে তবে ধন-সম্পদে কোনো দোষ নাই। কিন্তু আবুজার তাহা না মানিয়া তাহার মতই প্রচার করিতে লাগিলেন। ইহাতে নানা স্থানে অশান্তি ও অসন্তোষ দেখা দিতে লাগিল। পাওয়ার দল তাহাকে সমর্থন করিতে লাগিল। একটা সামাজিক বিপর্যয়ের আশঙ্কা করিয়া মুয়াবিয়া তাহাকে মদিনায় পাঠাইয়া দিলেন। খলিফা বৃথাই বুঝাইতে চেষ্টা করিলেন যে, কুরআনের উপরক্ত আয়াত হইতে এরূপ সিদ্ধান্ত গ্রহণ ঠিক হইবে না। নির্দিষ্ট যাকাত ছাড়া স্টেট কাহারও সমস্ত সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করিতে পারে না। কিন্তু আবু জার সে কথাও শুনিলেন না। তখন খলিফা শাস্তি দিবার উদ্দেশ্যে তাহাকে অন্যত্র নির্বাসিত করিলেন। এই নির্বাসনদণ্ড ষড়যন্ত্রকারীদের কাজে লাগিল। তাহারা প্রকাশ্যে ঘোষণা করিতে লাগিল যে, আবুজারের মতো একজন মানব-প্রেমিক ত্যাগী পুরুষকে দেশ হইতে বাহির করিয়া দেওয়া খুব অন্যায় হইয়াছে।

অন্য একটি ঘটনাও চক্রান্তকারীরা নিজেদের কাজে লাগাইল। হযরত ওসমান দেখিলেনঃ বিভিন্ন গোত্রের বিভিন্ন বাক-ভঙ্গির দরুন কুরআনের পাঠে কিছু তারতম্য ঘটিয়াছে। পঠনের তারতম্য হইতে লেখনেও তারতম্য আসিয়াছে। তখন তিনি সমস্ত কুরআনের মধ্যে সামঞ্জস্য (uniformity) রক্ষার জন্য তৎপর হইলেন। সমগ্র মুসলিম জাহানে একই কুরআন প্রবর্তনের প্রয়োজনীয়তা তিনি অনুভব করিলেন এবং স্থির করিলেন, বিবি হাফসার ঘরে হযরত আবুবকর কর্তৃক অনুমোদিত যে কুরআন শরীফ রক্ষিত আছে, তাহার আরও কতিপয় সংখ্যা নকল করিয়া বিভিন্ন কেন্দ্রে তিনি পাঠাইবেন। এই সিদ্ধান্ত অনুসারে সরকারী তত্ত্বাবধানে কুরআন শরীফের অনেকগুলি অভ্রান্ত নকল প্রস্তুত করানো হইল। হযরত ওসমান তখন দেখিলেনঃ সর্বত্র একই কুরআন প্রচার করিতে হইলে ভুল নকলগুলি নষ্ট করিয়া ফেলা উচিত, নচেৎ কালে কালে আসল-নকল লইয়া মতবিরোধ দেখা দিবে। ইহাই ভাবিয়া তিনি যেখানে যে ভুল কুরআন ছিল, সমস্তই আনাইয়া পুড়াইয়া ফেলেন। ইসলামের পবিত্রতা রক্ষার জন্য এ যে কতো বড় একটা খিদমত, তাহা সহজেই অনুমেয়। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, এই মহত কার্যকেও কুচক্রীরা নিজেদের কাজে লাগাইল। তাহারা হযরত ওসমানের এইরূপ কুরআন জ্বালাইয়া দেওয়াকে একটা ভীষণ ধর্মদ্রোহিতার কাজ বলিয়া প্রচার করিতে লাগিল।

কুফায় প্রথম বিদ্রোহ দেখা দিল। কুফার শাসনকর্তা সা’দ আসিলেন মদিনায় খলীফার সঙ্গে পরামর্শ করিতে। কিন্তু তিনি যখন কুফায় ফিরিয়া গেলেন, তখন বিদ্রোহীরা তাহাকে বাধা দিল এবং তাহার সঙ্গের একজন ভৃত্যকে হত্যা করিয়া ফেলিল। সা’দ বাধ্য হইয়া মদিনায় ফিরিয়া গেলেন। সরলমতি খলিফা তখন বিদ্রোহীদের প্রতি কোনোরূপ শাস্তির ব্যবস্থা না করিয়া বরং তাহাদের ইচ্ছানুসারে সা’দকে বরখাস্ত করিয়া তদস্থলে আবু মুসা আশারীকে কুফার শাসনকর্তা নিযুক্ত করিলেন।

চারিদিকে বিদ্রোহের আভাস পাইয়া খলিফা প্রাদেশিক গভর্নরদের এক পরামর্শসভায় আহ্বান করিলেন। সকলেই বলিলেন কুচক্রীদের যাহারা নেতা, তাহাদিগকে শাস্তি দিলেই সব ঠাণ্ডা হইয়া যাইবে। কিন্তু খলিফা মুসলিম-নিধনে কুণ্ঠিত হইয়া পড়িলেন। মুয়াবিয়া বিপদের সংকেত দিয়া খলিফাঁকে দামেস্কে যাইতে অনুরোধ করিলেন। অথবা একদল দেহরক্ষী রাখিবার পরামর্শ দিলেন। কিন্তু কোনো প্রস্তাবেই খলিফা রাজী হইলেন না। যে মাটিতে তাঁহার প্রিয় রসূল ঘুমাইতেছেন, মদিনার সেই পাক-মাটি ছাড়িয়া নিজের জীবনের মমতায় তিনি যাইবেন অন্যত্র, এ ধারণা তাঁহার নিকট একেবারেই বিষদৃশ ঠেকিল। পক্ষান্তরে নিজের নিরাপত্তার জন্য সাধারণ রাজকোষ হইতে অর্থ লইয়া যে তিনি একদল সৈন্য মোতায়েন রাখিবেন, এ কার্যকেও তিনি নীতি-বিরুদ্ধ বলিয়া মনে করিলেন। তিনি আরও দেখিলেন, এ কাজ করিতে গেলেও সেই মুসলিম-নিধনকেই সমর্থন করিতে হয় যাহা তিনি আদৌ কামনা করেন না। কাজেই আদর্শবাদী মহানুভব খলিফা এসব পরামর্শের একটিও গ্রহণ করিলেন না। নগর-রক্ষকদিগকেও নিষেধ করিয়া দিলেন কোনো মুসলমানের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করিতে।

হজের সময় মদিনায় অবারিত দ্বার। মিসর, কুফা এবং বসরা হইতে বিদ্রোহীরা দলে দলে মদিনায় প্রবেশ করিল। তাহারা ভাবিয়াছিলঃ হযরত আলিকে খলিফা পদের প্রলোভন দিলে তিনি তাদের পক্ষ সমর্থন করিবেন। যখন তাহারা গোপনে হযরত আলির সহিত সাক্ষাৎ করিয়া এ প্রস্তাব পেশ করিল, তখন মহামতি আলি অত্যন্ত ঘৃণার সঙ্গে এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করিলেন এবং বলিলেন, খলিফাঁকে রক্ষার জন্য তিনিই সর্বপ্রথম তাঁহার তরবারি নিষ্কোষিত করিবেন। আলির নিকট হইতে বিমুখ হইয়া ষড়যন্ত্রীরা তালহা এবং জুবায়েরের নিকট গেল এবং তাহাদিগকে গভর্নরের পদ দিবার প্রলোভন দেখাইল। বলা বাহুল্য, এই দুই আদর্শ সাহাবাও বিদ্রোহীদের এই প্রস্তাব ঘৃণার সহিত প্রত্যাখ্যান করিলেন। এইরূপে নিরাশ হইয়া অবশেষে তাহারা একজনকে বশে আনিতে পারিল। ইনি হযরত আবুবকরের পুত্র মুহাম্মদ। কতিপয় কারণে মুহাম্মদ খলিফার উপরে অসন্তুষ্ট ছিলেন। এই সুযোগে তিনি তাঁহার প্রতিশোধ গ্রহণ করিবার প্রয়াস পাইলেন। মিসরের শাসনকর্তা হইবার জন্য গোপনে তিনি ষড়যন্ত্রকারীদিগকে স্বীকৃতি দিলেন।

বিদ্রোহীরা অন্য কোনো সমর্থনকারী না পাইয়া খলিফার নিকট নিজেদের কৃতকর্মের জন্য অনুতাপ ও দুঃখ প্রকাশ করিল এবং বলিল : মিসরের শাসনকর্তা আবদুল্লাহকে সরাইয়া তদস্থলে মুহাম্মদ-বিন-আবু বকরকে নিযুক্ত করিলেই তাহারা সন্তুষ্ট হইয়া ফিরিয়া যাইবে। খলিফা তাহাতেই রাজী হইলেন। মুহাম্মদকে তিনি মিসরের শাসনকর্তার পদে নিয়োগপত্র দিলেন। মুহাম্মদ সেই নিয়োগপত্র লইয়া বিদ্রোহীদের সঙ্গেই মিসর যাত্রা করিলেন। মিসর, কুফা এবং বসরার আন্দোলনকারীরা একই সঙ্গে মদিনা ছাড়িয়া চলিয়া গেল।

মদিনাবাসীরা শান্তির নিঃশ্বাস ফেলিল। কিন্তু কয়েকদিন পরেই দেখা গেল কুচক্রীরা পুনরায় মদিনায় আসিয়া হাজির হইয়াছে। এবার তাহারা একটা ক্রীতদাসকে ধরিয়া আনিয়াছে। ব্যাপার কি জিজ্ঞাসা করায় বলিলঃ এই ক্রীতদাস হযরত ওসমানের, উটও হযরত ওসমানের; মিসরের শাসনকর্তা আবদুল্লাহর নিকট একখানি গুপ্তপত্র লইয়া যাইতেছিল। আমরা তাহাকে ধরিয়া ফেলিয়াছি। এই সেই পত্র। এই বলিয়া তাহারা সেই পত্র সবাইকে দেখাইল। পত্রখানি হযরত ওসমানের তরফ হইতে মিসরের শাসনকর্তা আবদুল্লাহর বরাবর লেখা। পত্র লেখা আছে : “মুহাম্মদকে তোমার স্থলে গভর্নর নিযুক্ত করিয়া পাঠাইলাম বটে, কিন্তু এ আদেশ সত্য নহে। মুহাম্মদ ও তাহার দলবল তোমার নিকট পৌঁছিলেই তুমি তাহাদিগকে সাবাড় করিয়া দিবে।” তীক্ষ্ণবুদ্ধি হযরত আলি এই চক্রান্ত বুঝিতে পারিলেন। হযরত ওসমানের মতো সত্যবাদী মহান খলিফা এমন জঘন্য কৌশল অবলম্বন করিবেন, ইহা তিনি কিছুতেই বিশ্বাস করিলেন না। তিনি ভাবিয়া দেখিলেন : মদিনা হইতে তিনটি বিভিন্ন পথ-মিসর, কুফা এবং বসরায় গিয়াছে। শুরু হইতেই তিন দলকে এই তিন পথে যাইবার কথা। যে স্থানে পত্রখানি ধরা পড়িয়াছে বলিয়া বিদ্রোহীরা বলিতেছে, মদিনা হইতে তাহা অনকে দূরবর্তী। যদি একমাত্র মিসরের কাফেলাই সেই পত্র লইয়া ফিরিয়া আসিত, তাহা হইলেও বিশ্বাস করা যাইত; কিন্তু একই সঙ্গে কুফা এবং বসরার কাফেলা কি করিয়া একত্র হইয়া ফিরিয়া আসিল? মিসরের দল যদি কুফা-বসরার দলকে এই পত্রের কথা বলিয়া ফিরাইয়া আনিতেই চাহিত, তবে মদিনা হইয়া দুই পথে তাহাদিগকে দ্রুত অগ্রসর হইতে হইত। আর তাহা করিতে গেলেও ততক্ষণ বসরা ও কুফার লোকেরা স্ব-স্ব গন্তব্য স্থানে পৌঁছিয়া যাইত। হযরত আলি তাই বুঝিলেন, এই ষড়যন্ত্র পূর্বনির্ধারিত। তবুও তিনি বিদ্রোহীদলের নেতৃবৃন্দকে লইয়া হযরত ওসমানের নিকট আসিলেন এবং পত্রখানি দেখাইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন সেই পত্র তার লেখা কি-না। হযরত ওসমান পত্রখানি ভালো করিয়া দেখিয়া বলিলেন : “পত্রের সীল মোহর আমার বলিয়া মনে হইতেছে বটে, কিন্তু এ পত্র আমি লিখি নাই বা এ সম্বন্ধে আমি কিছু জানি না। এ জাল-পত্র।” বিদ্রোহীরা অনেক বাদানুবাদ করিল। অনেকে বলিল : “আপনি না লিখিলেও নিশ্চয়ই আপনার মন্ত্রী মারোয়ান এ পত্র লিখিয়াছেন। মারোয়ানকে আমাদের হস্তে সমর্পণ করুন।” কিন্তু এই সমর্পণের অর্থ কী খলিফা তাহা ভালোভাবেই বুঝিলেন। ইহার অর্থঃ মারোয়ানকে আযরাইলের হাতে তুলিয়া দেওয়া। দলিল নাই, প্রমাণ নাই, কেবলমাত্র অনুমানের উপর নির্ভর করিয়া কেমন করিয়া মহাপ্রাণ হযরত ওসমান একজন মুসলমানের হত্যার কারণ হইবেন? তাহার বিশ্বাস বিদ্রোহীরা নিজেরাই এই পত্র জাল করিয়া আনিয়াছে। প্রত্যেক মুসলমানের জান ও মাল রক্ষা করা খলিফার কর্তব্য। তাছাড়া যে সময় বিদ্রোহীরা এই দাবী করিতেছিল, তখন মারোয়ান খলিফার গৃহেই অবস্থান করিতেছিলেন। কাজেই, তিনি তখন খলিফার অতিথি। অতিথিকে শত্রুর হাতে সোপর্দ করা আরবীয় আতিথ্য ধর্মেরও সম্পূর্ণ বিপরীত। হযরত ওসমান তাই মারোয়ানকে বিদ্রোহীদের হস্তে সমর্পণ করিতে অস্বীকার করিলেন। বিদ্রোহীরা তখন ভীষণ উত্তেজিত হইয়া বেয়াদবিপূর্ণ ভাষায় বলিতে লাগিল “পত্র যেই লিখুক, খলিফা পদের যোগ্য আপনি নন। এখনই এই আসন পরিত্যাগ করুন।” খলীফা বলিলেন : “আল্লাহর নিয়োজিত এই দায়িত্বপূর্ণ পবিত্র পদ বিনা করণে কিছুতেই আমি ছাড়িব না-আমার ভুল দেখাও, আমি সংশোধন করিতে রাজী আছি।” বিদ্রোহীরা খলিফাঁকে শাসাইতে শাসাইতে চলিয়া গেল।

বিদ্রোহীরা মদিনার উপকণ্ঠে আড্ডা গাড়িয়া বসিল। খলিফা তবুও তাহাদের বিরুদ্ধে কোনো শাস্তির ব্যবস্থা করিলেন না।

শুক্রবার আসিল। জুমার নামাজের জন্য দলে দলে লোক সমাবেশ হইতে লাগিল। খলিফা খোতবা দিতে উঠিলেন। কিন্তু বিদ্রোহীরা বাধা দিল। জাল-পত্রের কথা প্রকাশ হইয়া পড়িলেই তাহাদের বিপদ। তাহারা মসজিদের মধ্যেই শোরগোল করিয়া খলিফাঁকে কিছু বলিতে দিল না। একজন খলিফার লাঠিটা লইয়া ভাঙিয়া ফেলিল, তারপরই প্রস্তর নিক্ষেপ শুরু হইয়া গেল। বৃদ্ধ খলিফা আহত হইয়া পড়িলেন। সকলে ধরাধরি করিয়া তাহাকে গৃহে পৌঁছাইয়া দিলেন।

বিদ্রোহীরা তখন খলিফার গৃহ পরিবেষ্টন করিয়া ফেলিল। বাহিরের সহিত তাহার কোনোই যোগসূত্র রহিল না। এমন ভাবেই তাহারা আট-ঘাট বন্ধ করিয়া দিল যে, বাহির হইতে পানিটুকু পর্যন্ত লইবারও উপায় রহিল না। হযরত আলি আসিয়া বিদ্রোহীদিগকে তিরস্কার করিয়া বলিলেনঃ মহামান্য খলিফার প্রতি তোমাদের এই আচরণ যারপরনাই ঘৃণ্য। কিন্তু তাহাতে কোনোই ফল হইল না। পানির অভাবে খলিফা ও তাঁহার পরিবারবর্গ দারুণ কষ্ট অনুভব করিতে লাগিলেন। ইহা জানিতে পারিয়া রাসূলুল্লাহর অন্যতম পত্নী উম্মে হাবিবা নিজে একটি খচ্চরের পিঠে পানি লইয়া আসিলেন; কিন্তু দুর্বত্তরা তাহাকেও লাঞ্ছিত করিয়া ফিরাইয়া দিল।

আশ্চর্যের বিষয়, এই সংকট মুহূর্তেও খলিফা কোনোরূপ বাধা দিবার চেষ্টা করিলেন na; মুসলিম-রক্তে পবিত্র মদিনা নগরী রঞ্জিত হইবে আর সে রক্তপাত তাহার নিজের নিরাপত্তা ও স্বার্থের জন্য সংঘটিত হইবে, ইহা কিছুতেই তিনি বরদাশত করিতে পারিলেন না। নগর-রক্ষী সেনাদলকে তাই তিনি অস্ত্র প্রয়োগ করিতে নিষেধ করিলেন না। মদিনবাসীরাও খলিফার বিনা অনুমতিতে হঠাৎ কিছুই করিতে পারিতেছিলেন না। হযরত আলি, তালহা, জুবায়ের প্রভৃতি সাহাবারাও একই মন্ত্রে দীক্ষিত। যে-আদর্শে অনুপ্রাণিত হইয়া স্বয়ং খলিফা অস্ত্র ধারণ করিতেছেন না, তাহারাও সেই একই আদর্শের অভিসারী। পাক-মদিনায় কোনোরূপ রক্তপাত যাহাতে না হয় তাহারাও তাহাই চাহিতেছিলেন। কাজেই সকলেই ঘটনা পর্যবেক্ষণ করিয়া যাইতেছিলেন মাত্র। তবে খলিফার নিরাপত্তার জন্য তাহারা যথারীতি ব্যবস্থা করিতে ভুলেন নাই। হযরত আলি তাহার দুই পুত্র হাসান হোসেনকে পাঠাইয়া দিলেন খলিফার গৃহ পাহারার জন্য। খলিফার রক্ষার্থে প্রয়োজন হইলে তাহারা জীবন দিবেন, ইহাই ছিল তাঁহাদের প্রতি নির্দেশ।

দেখিতে দেখিতে জিলহজ মাস আসিয়া পড়িল। মদিনাবাসীদের অধিকাংশই হজের জন্য মক্কা যাত্রা করিলেন। ইবনে আব্বাস খলিফার দ্বাররক্ষক স্বরূপ মোতায়েন ছিলেন। খলিফা তাহাকেও হজে যাইতে আদেশ দিলেন। মদিনার হাজীদিগের উপর তাহাকেই তিনি নেতা নিযুক্ত করিলেন। মক্কায় সমবেত হাজীদিগের নিকট বিদ্রোহীদের আচরণ ব্যাখ্যা করার কথাও তিনি বলিয়া দিলেন। বিদ্রোহীরাও হজের পূর্বেই মদিনা ছাড়িয়া চলিয়া যাইবে, অনর্থক কোনো রক্তপাত করিবে না, ইহাই তাহাদের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল।

বিবি আয়েশাও হজে চলিয়া গেলেন। যাইবার সময় তিনি আপন ভ্রাতা মুহাম্মদ বিন আবুবকরকেও সঙ্গে লইয়া যাইতে চাহিলেন; কিন্তু মুহাম্মদ তাহাতে স্বীকৃত হইলেন না। তাহার মন তখন বিকৃত। তিনিও যে বিদ্রোহীদের অন্যতম নেতা।

বিদ্রোহীরা বুঝিল ইহাই উপযুক্ত সময়। মদিনা নগরী প্রায় শূণ্য। আর কয়েকদিন পরেই হজ করিয়া সকলে ফিরিয়া আসিবে। কাজেই আর দেরী করা চলে না। বিদ্রোহীরা তাই একদিন খলিফার গৃহে জোর করিয়া ঢুকিবার চেষ্টা করিল। দ্বার রক্ষকেরা সংখ্যায় অতি অল্পই ছিল; বিদ্রোহীরা তাহাদিগকে আক্রমণ করিল। খানিকটা সংঘর্ষের পর দ্বার রক্ষীরা গৃহের অভ্যন্তরে আসিয়া ফটক বন্ধ করিয়া দিল। খুব হৈ-চৈ শুরু হইল। ইত্যবসরে মুহাম্মদ বিন্ আবুবকর তাহার দুইজন সঙ্গী লইয়া অলক্ষ্যে গৃহের পশ্চাৎদিক হইতে অন্য বাড়ির ছাদের সাহায্যে দেওয়াল টপকাইয়া ভিতরে ঢুকিয়া পড়িলেন। খলিফা তখন গৃহের অভ্যন্তরে স্ত্রী-পুত্র-পরিবেষ্টিত অবস্থায় কুরআন পাঠ করিতেছিলেন। একটা স্নিগ্ধ বেহেশতী জ্যোতিতে তাহার শুভ্ৰশশ্রুমণ্ডিত পবিত্র মুখমল ঝলমল করিতেছিল। বাহিরের এই উন্মত্ত কোলাহল-এই শয়তানি ষড়যন্ত্রের বিভীষিকা তাহাকে একটুও বিচলিত করিতে পারিল না; একটা নীরব প্রশান্তিতে মহান খলিফার অন্তর আজ ভরপুর। আল্লাহর উপর সে কী পরম নির্ভর! অন্যায় যে তিনি করেন নাই, তিনি যে তাহার বিবেক অনুযায়ী আপন কর্তব্য পালন করিয়াছেন, এই পরম সান্ত্বনায় আজ তিনি নির্বিকার।

আত্মরক্ষার জন্য আজ তাহার কোনো চেষ্টার প্রয়োজন নাই। তাহার জীবনমরণের ভার তিনি আল্লাহর উপর সোপর্দ করিয়া দিয়াছেন। ইচ্ছা হয় তিনি বাঁচাইবেন, ইচ্ছা হয় মারিবেন। বিদ্রোহীদের লক্ষ্যস্থল তিনি নিজে; ব্যক্তিগত কারণে লোকেরা যদি তাহাকে না ই পছন্দ করে, তবে সেইজন্য রাষ্ট্রের হেফাজতে নিয়োজিত সৈন্য বা রক্ষীদলকে অথবা মদিনাবাসীদিগকে তিনি কেন আহ্বান করিবেন? এরূপ কার্য করিতে তিনি লজ্জাবোধ করিলেন। অকৃত্রিম মুসলিম-প্রীতি, ইসলামের শিক্ষা ও আদর্শের প্রতি প্রগাঢ় অনুরাগ আজ তাঁহাকে স্তব্ধ করিয়া দিল। বলিষ্ঠ মনোবল লইয়া বীরের মতো তিনি আসন্ন ভয়ঙ্করের সম্মুখীন হইলেন।

ঘরে ঢুকিয়াই মুহাম্মদ-বিন-আবুবকর হ্যরত ওসমানের দাড়ি ধরিয়া সজোরে হেঁচকা টান দিলেন। এই অমার্জনীয় ধৃষ্টতা দেখিয়া মহান খলিফা ধীর শান্ত স্বরে কহিলেনঃ “বাবা মুহাম্মদ, যদি তোমার পিতা আজ জীবিত থাকিতেন আর তোমার এই আচরণ দেখিতে পাইতেন তবে তিনি নিশ্চয়ই লজ্জিত হইতেন। তুমি আজ আমার দাড়ির অমর্যাদা করিতেছ, কিন্তু তিনি এই দাড়িকে শ্রদ্ধা করিতেন।” মুহাম্মদ সে কথা শুনিয়া লজ্জায় সরিয়া আসিলেন। তখন অপর দুই পাষণ্ড খলিফাঁকে তরবারি দ্বারা আঘাত করিল। পার্শ্বেই খলিফার বিবি দাঁড়াইয়াছিলেন; তিনি সেই আঘাত আপন হাত দিয়া ঠেকাইতে গেলেন, তৎক্ষণাৎ তাহার হাতের কয়েকটি আঙ্গুল কাটিয়া মাটিতে পিড়য়া গেল। সঙ্গে সঙ্গে হযরত ওসমানও ধরাশায়ী হইলেন। তাহার হস্তস্থিত কুরআনখানি লণ্ডভণ্ড হইয়া ছিটকাইয়া পড়িল। খলিফার পবিত্র রক্তে কুরআনের পৃষ্ঠা রঞ্জিত হইয়া গেল। খলিফা তখনও দু-হাত বাড়াইয়া সেই রক্ত-রঞ্জিত ছিন্ন কুরআনের পৃষ্ঠাগুলি সযত্নে নিজের বুকে ধরিয়া তুলিয়া লইলেন। ইহার কিছুক্ষণ পরেই খলিফা শাহাদাত প্রাপ্ত হইলেন।

খলিফার স্ত্রী ও অন্যান্য পরিজনবর্গ তখন ভীতস্বরে চীৎকার করিয়া উঠিলেন। নিম্নে ফটকের পার্শ্বে সমবেত উন্মত্ত জনতাকে লক্ষ্য করিয়া তিনি বলিলেন : “আল্লাহর কসম, খলিফা নিহত হইয়াছেন।” সে কথা শুনিয়া তাড়াতাড়ি সকলে উপরে উঠিয়া আসিয়া দেখিল খলিফা নিহত অবস্থায় পড়িয়া আছেন। হযরত আলি, জুবায়ের ও অন্যান্য বিশিষ্ট ব্যক্তিরাও খবর পাইয়া ছুটিয়া আসিলেন। অপ্রত্যাশিতভাবে যে খলিফা নিহত হইবেন, তাহা তাহারা ভাবিতেই পারেন নাই।

ইত্যবসরে ঘাতকেরা কোন্ ফাঁকে পালাইয়া গিয়াছে, তাহা কেহ বুঝিতেও পারে নাই।

এমনই শোচনীয় বেশে হযরত ওসমান দুনিয়া হইতে শেষ বিদায় গ্রহণ করিলেন।

হযরত ওসমানের চরিত্র

উপরে আমরা হযরত ওসমানের শৈশব হইতে মৃত্যুর শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত জীবনের ঘটনাবলীর একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ দিলাম-উদ্দেশ্যঃ এই পটভূমিকায় তাহার চরিত্র-বিচার সহজ হইবে। পাঠক, একবার মনের চোখ দিয়া খলিফার জীবন-আলেখ্যের প্রতি দৃষ্টিপাত করুন। দেখিবেন, এই চিত্রের কোথাও কোনো মলিনতা নাই-এর আগাগোড়া আলোয় ঝলম। শৈশবে তিনি বিনয়ী, সত্যবাদী, যৌবনে তিনি মিতাচারী, সচ্চরিত্র, সর্বপ্রকার বিলাসিতা ও উজ্জ্বলতা হইতে মুক্ত। জীবনে তিনি কখনো মদ পান করেন নাই বা অপর কোনো নারীকে স্পর্শ করেন নাই; দাম্পত্য জীবন তাহার অতি পবিত্র-পরিবারে তিনি আদর্শ স্বামী, আদর্শ ভ্রাতা, আদর্শ পিতা। কর্মজীবনে তিনি অক্লান্ত কর্মী; ঈমানে অটল, বিপদে নির্ভীক, আল্লাহ্ ও রসুলের প্রতি তাঁহার প্রখর অনুরাগ। সমগ্র জীবন-সমগ্র সম্পদ তাহার ইসলামের সেবায় উৎসর্গীকৃত। ভোগে তৃষ্ণা নাই, বিষয়-আসয়ে বাসনা নাই। মানবকল্যাণে তিনি আত্মনিবেদিত। এমনই অবস্থায় জীবনের ৭০টি বৎসর অতিবাহিত করিয়া আসিয়া তিনি খলিফার দায়িত্বপূর্ণ গুরুভার গ্রহণ করিলেন। এই পদে তিনি ১২ বৎসর কাটাইয়াছিলেন। প্রথম ছয় বৎসর তাহার অযোগ্যতা বা স্বজনপ্রীতি সম্বন্ধে কোনো কথাই ওঠে নাই; এমন কি হযরত ওমর অপেক্ষাও তিনি জনপ্রিয় ছিলেন বলিয়া জানা যায়। জীবনের শেষ ছয়টি বৎসরই অভিযোগ শোনা গেল যে তিনি স্বজন-প্রিয়, অকমণ্য ও দুর্বল, খলিফা পদের অযোগ্য। এই স্বজনপ্রীতি এবং অকর্মণ্যতা সম্বন্ধেই আমরা এখন আলোচনা করিব।

হযরত ওসমানের বিরুদ্ধে প্রধান অভিযোগ এই যে, তিনি অতিমাত্রায় স্বজন-প্রিয় ছিলেন, অর্থাৎ কিনা বড় বড় রাজপদে তিনি অন্য সকলকে সরাইয়া আনিয়া নিজের আত্মীয়-স্বজনকে সেই সব পদে বসাইয়াছিলেন। সিরিয়ার শাসনকর্তা মুয়াবিয়া, আবদুল্লাহ বিন-আমের, মিসরের শাসনকর্তা, বসরার শাসনকর্তা এবং তার মন্ত্রী আবদুল্লাহ বিন সা’দ মারোয়ান-ইহারা সকলেই তাহার আত্মীয় ছিলেন।

কথাগুলি মিথ্যা নয়। এখন দেখা যাউক, এই নিয়োেগগুলি প্রকৃত পক্ষে স্বজনপ্রীতির দ্বারা অনুপ্রাণিত হইয়াছিল কিনা এবং হইলেও এগুলি সমর্থনযোগ্য কিনা।

সিরিয়ার শাসনকর্তা মুয়াবিয়াকে হযরত ওসমান নিয়োগ করেন নাই; ওমরের সময়েই তিনি এই পদে নিযুক্ত হইয়াছিলেন। ওসমান তাহাকে নিজ পদে বহাল রাখিয়া দিয়াছিলেন মাত্র। কাজেই এই নিয়োগ সম্বন্ধে হযরত ওসমানের উপর দোষ আরোপ করা মোটেই সমীচীন নয়।

বসরার শাসনকর্তা ছিলেন আবু মূসা আশারী। হযরত ওমর তাহাকে নিয়োগ করেন। হযরত ওসমানের খলিফা পদ-লাভের সঙ্গে সঙ্গেই বসরার লোকেরা আশারীর বিরুদ্ধে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ আনিল। তদন্ত করিবার পর ওসমান আশারীকে সরাইয়া আনিলেন এবং তদস্থলে বসরাসীদের মতানুসারেই অন্য এক ব্যক্তিকে তাহাদের গভর্নর নিযুক্ত করিলেন। কিন্তু ইনিও বেশীদিন ঐ পদে থাকিতে পারেন নাই। তাহার বিরুদ্ধেও নানা অভিযোগ আসিতে লাগিল। তখন ওসমান তাহাকে বরখাস্ত করিয়া আবদুল্লাহ্-বিন আমেরকে তদস্থলে নিযুক্ত করিলেন। এই আমের ওসমানের আত্মীয় ছিলেন বটে।

কুফার শাসনকর্তা ছিলেন পারস্য-বিজয়ী সা’দ। হযরত ওমর তাহাকে নিয়োগ করিয়া যান। কিন্তু সামান্য একটি অপরাধে হযরত ওমর তাহাকে বরখাস্ত করেন এবং মুগীরাকে তদৃস্থলে নিযুক্ত করেন। মৃত্যু-সময়ে হযরত ওমর এই কথা বলিয়া যান যে, সা’দকে যেন পুনরায় কুফার শাসনকর্তার পদে নিযুক্ত করা হয়। হযরত ওসমান খলিফা পদ লাভ করিয়াই হযরত ওমরের পরিত্যক্ত বাসনা পূর্ণ করেন। তিনি মুগীরাকে ফিরাইয়া আনেন এবং সা’দকে পুনরায় গভর্নররূপে কুফায় পাঠাইয়া দেন। কিন্তু সা’দ এবারেও বেশীদিন এই পদে থাকিতে পারিলেন না। ইবনে মাসুদ ছিলেন কুফার খাজাঞ্চি। তাহার নিকট হইতে সা’দ কিছু ঋণ গ্রহণ করেন। সরকারী তহবিল হইতেই মাসুদ এই টাকা সা’দকে দেন। কিন্তু যথাসময়ে সা’দ এই টাকা পরিশোধ না করায় মাসুদের সহিত তহার মনোমালিন্য ঘটে। সরকারী তহবিলের টাকা তিনিই বা কততদিন এরূপ ভাবে ফেলিয়া রাখিতে পারেন। বাধ্য হইয়া তখন তিনি এই ব্যাপার খলিফার গোচরীভূত করেন। হযরত ওসমান তদন্ত করিয়া দেখেন, সা’দ-ই দোষী। তখন বাধ্য হইয়া তিনি পুনরায় সা’দকে বরখাস্ত করেন এবং তদস্থলে অলিদকে নিয়োগ করিয়া পাঠান। অলিদ অবশ্য হযরত ওসমানের দূর-সম্পৰ্কীয় আত্মীয় ছিলেন।

মিসরের শাসনকর্তা ছিলেন আমর-বিন-আ’। হযরত ওমর তাহাকে বরখাস্ত করিয়া আবদুল্লাহ্-বিন-সা’দকে নিযুক্ত করিয়া যান। ইহাও তিনি বিনা কারণে করেন নাই। আমর বিন-আ’সের অধীনে আবদুল্লাহ-বিন-সা’দ ছিলেন রাজস্ব-সচিব। এ নিয়োগও হযরত ওমর করিয়া যান। উভয়ের মধ্যে শাসন-সংক্রান্ত বিষয় লইয়া মতভেদ ঘটে। ঘটনাটি পরে ওসমানের নিকট প্রেরণ করা হয়। খলিফা তদন্ত করিয়া আমর-বিন-আ’সকেই দোষী সাব্যস্ত করেন। একজনের হাতে রাজস্ব আর একজনের হাতে সেনাবিভাগ; কাজেই উভয়ের ভিতরে যদি মিল না থাকে, তবে শাসনকার্য চলিতেই পারে না। ওসমান তাই বাধ্য হইয়াই আস’কে সরাইয়া আনিয়া আবদুল্লাহ্-বিন-সা’দকেই মিসরের শাসনকর্তা নিয়োগ করিলেন। আমর-বিন-আ’সের বিরুদ্ধে হযরত ওমরও পূর্বেই বিরূপ হইয়াছিলেন। সুতরাং এ অপসারণের মূলেও হযরত ওমরের নীতিই অনুসৃত হইয়াছিল।

চারিটি প্রদেশের শাসনকর্তা এই ভাবেই নিযুক্ত হইয়াছিল। অন্যায় করিয়া বিনা কারণে হযরত ওসমান কাহাকেও পদচ্যুত বা নিযুক্ত করেন নাই। ঘটনার স্বাভাবিক গতিতেই এই নিয়োগ ও বৃদলীগুলি সংঘটিত হইয়াছিল।

এখানে একটি বিষয় লক্ষ্য করিবার আছে। যাহাকেই তিনি নিয়োগ করিয়াছেন, জনসাধারণের আস্থা হারাইলে তিনি আর তাহাকে সেই পদে রাখেন নাই। স্বজনদিগের প্রতিও তিনি একই ব্যবহার করিয়াছেন। মাবিয়ার বিরুদ্ধে কেহ কোনো অভিযোগ আনে নাই; কাজেই তিনি তাহাকে নিজ পদে বহাল রাখিয়াছিলেন। কিন্তু, অলিদের বিরুদ্ধে যেই অভিযোগ আসিয়াছে, অমনি ওসমান তাহাকে বরখাস্ত করিয়াছেন, এমন কি শরিয়তের বিধান অনুসারে তাহাকে প্রকাশ্যে বেত্ৰদণ্ডও দান করিয়াছেন। খলিফা যদি এইখানে কোনো তারতম্য করিতেন, তবে স্বজনপ্রীতির অভিযোগ টিকিত বটে। স্বজনপ্রীতির অভিযোগের ভয়ে উপযুক্ত আত্মীয়-স্বজনকে কোনো পদ না দিলেও তো আর এক অন্যায় হইত। কাজেই এখানে দৃঢ় মনোবল ও কর্তব্যবোধ থাকা দরকার। হযরত ওসমানের সেই দৃঢ়তা ছিল। উপযুক্ত হইলে স্বজনদিগকে নিয়োগ করিবার সৎসাহসও যেমন ছিল, অপরাধ করিলে সেই স্বজনদিগকে বরখাস্ত বা শাস্তি দিবার মনোবলও তাহার ঠিক সেইরূপই ছিল। পক্ষান্তরে ক্ষমা-গুণেরও তাঁহার অভাব ছিল না। কুফার শাসনকর্তা অলিদকে যখন তিনি বরখাস্ত করিলেন, তখন তিনি বসরার পদচ্যুত গভর্নর আবু মূসা আশারীকে পুনরায় কুফার শাসনকর্তা করিয়া পাঠাইলেন। আবার মিসেরর শাসনকর্তা আবদুল্লাহর বিরুদ্ধে যখন লোকেরা তুমুল আন্দোলন উপস্থিত করিল, তখন তাহাকেও তিনি ছাড়েন নাই, লোকমতের স্বপক্ষেই তিনি মুহাম্মদ-বিদ-আবুবকরকে তদস্থলে মিসরের শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন। এই মুহাম্মদ কিরূপ যোগ্য ব্যক্তি ছিলেন তাহা পাঠক পূর্বেই দেখিয়া আসিয়াছেন। হযরত ওসমানের ঘাতকদের মধ্যে ইনিই ছিলেন প্রধান। এরূপ লোক কি কখনও কোনো প্রদেশের শাসনকর্তা হইবার যোগ্য? অথচ এরূপ লোককেও জনসাধারণ সুপারিশ করে এবং ইহাদিগকে লইয়া খলিফার বিরুদ্ধে আন্দোলন চালায়। আন্দোলনকারীদের অভিযোগ যে কতো মিথ্যা, মুহাম্মদ বিন-আবুবকর তাহা প্রমাণ করিয়া গিয়াছেন।

এইবার দেখা যাউক, হযরত ওসমান যে সব আত্মীয়-স্বজনকে নিযুক্ত করিয়াছেন, তাহাদের যোগ্যতা ছিল কিনা। বলা বাহুল্য, এদিক দিয়াও হযরত ওসমানের দূরদর্শিতা ও বিচার-বুদ্ধির প্রশংসা না করিয়া পারা যায় না। সিরিয়া মিসর, বসরা এবং কুফা-এই চারিটি প্রদেশেই ছিল ফেলাফতের শক্তি-কেন্দ্র। এই চারিটি কেন্দ্রে বিচক্ষণ শাসনকর্তার নিতান্ত প্রয়োজন ছিল। হযরত ওসমান উপযুক্ত লোকই এই সব পদে নিযুক্ত করিয়াছিলেন। নিজেদের কার্যাবলীর দ্বারাই ইহাদের নিয়োগ সমর্থিত হইয়া যাইতেছে। রোমক ও পারশ্য শক্তি তখনও সম্পূর্ণ নির্বাপিত হয় নাই; দিকে দিকে শত্রুদের বিদ্রোহ ও অভিযান চলিতেছে; এই দুঃসময়ে মাবিয়া, আবদুল্লাহ্-বিন-সা’দ অথবা আবদুল্লাহ-বিন-আমেরের মতো বিচক্ষণ লোক না থাকিলে নবগঠিত ইসলামী সাম্রাজ্যের ভাগ্যে যে কী ঘটিত, তাহা সহজেই অনুমান করা যায়।

প্রথমেই ধরুন মুয়াবিয়ার কথা। রোমকগণ ৮০,০০০ সৈন্য লইয়া সিরিয়া আক্রমণের উদ্দেশ্যে এশিয়া মাইনরের পথে অগ্রসর হইল। মুয়াবিয়া সংবাদ পাইয়াই প্রস্তুত হইলেন। খলিফাও মদিনা হইতে একদল সৈন্য মুয়াবিয়ার সাহায্যে পাঠাইয়া দিলেন। মুয়াবিয়া রোমদিগকে সম্পূর্ণভাবে পরাজিত করিলেন। শুধু তাই নয়, তাহার সৈন্য বাহিনী আর্মেনিয়ার ভিতর দিয়া তিফলিস পর্যন্ত দখল করিয়া লইল। জল-পথেও যাহাতে শক্রদিগকে বাধা দেওয়া যায়, তাহার চিন্তাও মুয়াবিয়া করিয়াছিলেন। খলিফার অনুমতি লইয়া তিনি একটি নৌ-বহর প্রস্তুত করিলেন এবং সাইপ্রাস দ্বীপ দখল করিয়া লইলেন। ইহাই মুসলিমদিগের প্রথম নৌ-যুদ্ধ। মুসলিম নৌ-শক্তি গঠনের ইতিহাসে মুয়াবিয়ার নাম তাই স্বর্ণাক্ষরে লিখিত রহিয়াছে। হযরত ওমরের সময়ই জলপথে তিনি সাইপ্রাস দ্বীপ দখল করিবার প্রস্তাব করিয়াছিলেন, কিন্তু হযরত ওমর নৌ-যুদ্ধ করিতে সাহস পান নাই। হযরত ওসমান এই নূতন দুঃসাহসিক কার্যে উৎসাহ দিয়াছেন। ইহার পর রোমানেরা যখন আলেকজান্দ্রিয়া আক্রমণ করিতে চায়, তখনও মুয়াবিয়ার নৌ-বহর আবদুল্লাহর নৌ বহরের সহিত মিলিত হইয়া রোমকদিগকে বাধা দেয়। আশ্চর্যের বিষয় এই যুদ্ধেও মুসমানেরাই বিজয়ী হয়। এই নব-গঠিত নৌ-বহর ক্রীট, মাল্টা প্রভৃতি দেশ বিজয়ের পর কনস্টান্টিনোপোলর পাদদেশে আসিয়া উপস্থিত হয়।

মুয়াবিয়ার ন্যায় আবদুল্লাহর সামরিক তৎপরতাও ছিল প্রচুর। রোমক সেনাপতি গ্রেগরীর অধীনে রোমানেরা ১,২০,০০০ সৈন্য লইয়া মিসরের দিকে অগ্রসর হইল। কিন্তু আবদুল্লাহর সেনাদল তাহাদিগকে সম্পূর্ণভাবে পরাস্ত করিল। গ্রেগরী নিহত হইলেন। ইহার ৫ বৎসর পর রোমানেরা জলপথে আলেকজান্দ্রিয়া আক্রমণ করিবার জন্য ৫০০ রণ-তরীর এক বিরাট বহর লইয়া অগ্রসর হইল। আবদুল্লাহ্ পূর্ব হইতেই ছোটখাট একটি নৌ-বহর প্রস্তুত করিয়া রাখিয়াছিলেন। মুয়াবিয়ার নৌ-বহর আসিয়াও আবদুল্লাহর নৌ-বহরের সহিত যোগ দিল। উভয়ের মিলিত শক্তি রোমকদিগকে সম্পূর্ণ পরাস্ত করিল। এইরূপে মুয়াবিয়া এবং আবুল্লাহর সমবেত চেষ্টায় আফ্রিকা মহাদেশের দিকে দিকে ইসলামের লাল ঝাণ্ডা উড়িতে লাগিল। মুয়াবিয়ার শাসনক্ষমতা পূর্বে মাত্র দামেশকের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল, এখন তিনি সমগ্র সিরিয়ার শাসনকর্তা রূপে পরিগণিত হইলেন। এই রাজ্য বিস্তারের জন্য ঐতিহাসিকগণ তাহাকে ‘আরবের সীজার” বলিয়া অভিহিত করেন।

বসরার শাসনকর্তা আবদুল্লাহ বিন আমেরও বিচক্ষণ ব্যক্তি ছিলেন। আমেরের কর্মভার গ্রহণ করিবার সঙ্গে সঙ্গেই পারশ্যে বিদ্রোহ দেখা দেয়। পলাতক সম্রাট ইয়াজদূজর্দের সাঙ্গোপাঙ্গোরা সৈন্য সংগ্রহ করিয়া মুসলমানদিগের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ উপস্থিত করে। আবদুল্লাহ বিন আমের দক্ষতার সহিত সে বিদ্রোহ দমন করেন। খলিফা ওসমান মদিনা হইতে একদল সেনা পাঠাইয়া আমেরকে সাহায্য করেন। আমের শুধু পারশ্য পূনর্দখলই করেন না, বিদ্রোহীদিগের অনুসরণ করিতে করিতে একদিকে বল এবং তুর্কীস্তান, অপরদিকে হিরাত, কাবুল ও গজনী পর্যন্ত দখল করিয়া লন। খোরাসানের অধিকাংশ (নিশাপুর, তুস, মার্ভ প্রভৃতি) এই সময়েই মুসলিম শাসনাধীনে আসে। পরবৎসর মুসলিম শক্তি আজারবাইজান পর্যন্ত অগ্রসর হয়।

কুফার শাসনকর্তা অলিদ যদিও মদ্যপানের অভিযোগে বরখাস্ত হন, তবুও রাজ্যশাসনে তিনি অক্ষম ছিলেন না। মারওয়ানও তকালে একজন বুদ্ধিমান ও প্রতিভাশালী ব্যক্তি ছিলেন। কাজেই তাহাদের কাহারও নিয়োগই অযৌক্তিক হয় নাই। এই সব যোগ্য ব্যক্তিদের কল্যাণে হযরত ওসমানের সময় মুসলিম সাম্রাজ্য বহুগুণে বিস্তৃত হইয়া যায় এবং পূর্বাপেক্ষা অধিকতর শক্তিশালী হয়। বস্তৃত হযরত ওসমানের সময়েই প্রকৃতপক্ষে মুসলিম সাম্রাজ্য সুদৃঢ় ভিত্তির উপর পুনর্গঠিত হয়। চারিপাশে রোমক, পারশিক ও তুর্কীদিগের বিদ্রোহ ও আক্রমণ হইতে মুসলিম সামাজ্য শুধু সংরক্ষিতই হয় নাই, সংগঠিতও হইয়াছে। এই গৌরব সম্পূর্ণরূপে হযরত ওসমানের প্রাপ্য। তিনি যদি সিরিয়া, মিসর ও পারশ্যে উপযুক্ত গবর্নর নিযুক্ত করিতে না পারিতেন, তবে মুসলিম রাষ্ট্র ধ্বংস হইয়া যাইবার সম্ভাবনা ছিল। কাজেই মুয়াবিয়া, আবদুল্লাহ্ প্রভৃতি স্বজনদিগকে নিয়োগ করিবার জন্য হযরত ওসমানকে নিন্দা না করিয়া বরং উচ্ছ্বসিত প্রশংসাই করিতে হয়। ইহাদেরই কল্যাণে মুসলিম সাম্রাজ্য রক্ষা পাইয়াছে। এই সব যোগ্য ব্যক্তিদের নিয়োগ না করিলেই কি ভালো হইত? নিয়োজিত ব্যক্তিদিগের এইরূপ অসাধারণ যোগ্যতার প্রমাণ পাওয়ার পর হ্যরত ওসমানকে স্বজন-প্রিয় বলা কোনো চিন্তাশীল ঐতিহাসিকের পক্ষেই আর শোভা পায় না। অপদার্থ অ-স্বজন লোকদিগকে নিয়োগ করিলে হযরত ওসমান স্বজনপ্রীতির অভিযোগ হইতে মুক্ত থাকিতেন বটে, কিন্তু মুসলিম সাম্রাজ্য রসাতলে যাইত। যে স্বজনপ্রীতি স্বদেশ বা স্বজাতি-প্রীতির দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়, সে স্বজনপ্রীতি দোষের নয়।

তাহা হইলে একথা এখন পরিষ্কার ভাবেই বুঝা যাইতেছে যে, হযরত ওসমানের উপর যে সব অভিযোগ আনা হয়, তাহার মূলে কোনো সত্য নাই। তাহার সমস্ত কর্ম অকৃত্রিম দেশ ও স্বজাতি-প্রেম হইতে উৎসারিত হইয়াছে। যে প্রতিশ্রুতি দিয়া তিনি মুসলিম জাহানের খেলাফতের গুরু দায়িত্ব গ্রহণ করিয়াছিলেন, তাহা তিনি পরিপূর্ণ ভাবেই পালন করিয়া গিয়াছেন। তাহার হাতে মুসলিম সাম্রাজ্য দুর্বল তো হয়ই নাই; বরং পূর্বাপেক্ষা বহুগুণে সবল ও পরিপুষ্ট হইয়াছে। কাজেই স্বজনপ্রীতি বা অক্ষমতার অভিযোগ নিতান্তই হাস্যকর।

ষড়যন্ত্রকারীদের মিথ্যা অভিযোগের উপযুক্ত উত্তর খলিফা নিজেই দিয়া গিয়াছেন। যখন হযরত ওসমানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহীরা নানারূপ অভিযোগ আনিল, তখন তিনি একদিন মাদিনার মসজিদে সমবেত জনতার সম্মুখে দাঁড়াইয়া বলিতে লাগিলেন?

যখন আমার উপর খেলাফতের গুরুদায়িত্ব ন্যস্ত করা হয়, তখন আমি আরবের মধ্যে সর্বাপেক্ষা ধনী ব্যক্তি ছিলাম। আমার অগণিত উট ও কী ছিল। আর আজ আমার একটি উটও নাই, একটি বকরীও নাই-শুধু দুইটি ছাড়া, যাহা আমি কোরবানীর জন্য রাখিয়া দিয়াছি। বলুন, ইহা সত্য কিনা? (জনতা উত্তর দিল :, ইহা সত্য) আমার প্রতি এই অভিযোগ করা হইয়াছে যে, আমি আমার আত্মীয় ইবনে আবু সারাহকে যুদ্ধলব্ধ সমুদয় দ্রব্যাদি দান করিয়াছি। এই অভিযোগ অমূলক। যুদ্ধ দ্রব্যাদির একটা অংশ মাত্রই তাহাকে দান করা হইয়াছে। ইহার পরিমাণই এক লক্ষ টাকা।[৩] এইরূপ দান নূতনও নহে। হযরত আবুবকর এবং হযরত ওমরও এইরূপ ভাবে দান করিতেন। তাহা সত্বেও লোকেরা যখন আপত্তি তুলিল, তখন তাহাও আমি তাহার নিকট হইতে ফিরাইয়া লইয়াছি। আপনারা আরও অভিযোগ করিয়াছেন যে, আমি আমার আত্মীয়-স্বজনদিগের প্রতি অত্যাধিক অনুরাগী এবং তাহাদিগকে আমি অৰ্থ-সাহায্য করি। এ সম্বন্ধে আমার বক্তব্য এই যে, আমি তাহাদিগকে ভালোবাসিলেও অপরকে ঘৃণা করি না বা অপরের অধিকার তাহাতে ক্ষুণ্ণ হয় না। আত্মীয় হইলেও আমি তাহাদের উপর যথারীতি কর্তব্য চাপাইয়া দেই। তাহাদিগকে আমি যাহা দান করি, আমার নিজ সম্পত্তি হইতেই দান করি। বায়তুল মাল-তহবিল হইতে আমি এক কপর্দকও গ্রহণ করি না। এ মাল আমার বা আমার আত্মীয়-স্বজনের পক্ষে যায়েজ নয়। আপনারা জানেন, রাসূলুল্লাহ, হযরত আবুবকর এবং হযরত ওমরের সময়েও আমি নিজের আয় হইতে বহু অর্থ দান করিয়াছি। আমার যৌবনকালে যখন আমার অর্থের প্রয়োজন ছিল বেশী, প্রয়োজন ছিল বেশী, তখনই আমি এই সব দান করিয়াছি, এখন যখন আমি আমার বংশের নির্দিষ্ট আয়ু-সীমায় পৌঁছিয়াছি, আমার দিন শেষ হইয়া আসিয়াছে এবং আমি আমার ধন-সম্পত্তি যাহা আছে তাহা আমার আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যে দান করিয়া দিতেছি, তখনই অবিবেচক লোকেরা আমার বিরুদ্ধে স্বজনপ্রীতি ও অন্যান্য দোষ আরোপ করিতেছে। আল্লাহর কসম, আমি কোনো দেশের উপর অতিরিক্ত কর ধার্য করি নাই। দেশবাসীর নিকট হইতে যাহাই আদায় করিয়াছি, সম্মতই দেশবাসীর কল্যাণে ব্যয় করিয়াছি। সমুদয় রাজস্বের এক-পঞ্চমাংশই বায়তুল মাল তহবিলে আসে। ইহার মধ্য হইতে আমি নিজের জন্য এক কপর্দকও গ্রহণ করি না। এমন কি যাহা আমি খাই, তাহাও আমার নিজের উপার্জিত অর্থ হইতে খাই।[৪]

[৩. হডরত ওসমান ত্রিপলি অভিযানের সময় সেনাপতি ইবনে আবু সারাহকে বলেন যে, তুমি যদি ত্রিপলি জয় করিতে পারো, যুদ্ধ লব্ধ দ্রব্যাদির এক-পঞ্চমাংশ তোমাকে দান করিব। সেই প্রতিশ্রুতি অনুসারেই হিসাব করিয়া তাহাকে এই অর্থ দান করা হয়।

8. Omar the Great, by Shibli Nomani, P. 94 উদ্ধৃতাংশ তিনি তাবারী হইতে গ্রহণ করিয়াছেন।]

এই প্রকাশ্য ঘোষণা হইতেই হযরত ওসমানের চরিত্র-মাধুর্য প্রকাশ পাইতেছে। বায়তুলমালের অগাধ ধন-রাশির প্রতি তিনি ভুলিয়াও দিকপাত করেন নাই। এমন কি আইনানুসারে প্রাপ্য নিজের ভাতাও যিনি গ্রহণ করেন নাই, দীনহীন বেশে যিনি জীবন যাপন করিতেন, সেই নিঃস্বার্থ মানব-প্রেমিক খলিফাঁকেও বলা হয় কিনা তিনি ছিলেন, “অহঙ্কারী, অর্থলোলুপ এবং জাকজমকপ্রিয়!!” (‘Vain, fond of money and splendour,–Von Kremer.)

আর একটি ঘটনাতেও হযরত ওসমানের চরিত্র-মাধুর্যের সুন্দর পরিচয় পাওয়া যায়। হযরত আবুবকর মৃত্যুশয্যায় শায়িত। খলিফা পদে কাহাকে মনোনীত করিয়া যাইবেন, সে সম্বন্ধে সাহাবাদের সঙ্গে পরামর্শ করিয়া তিনি হযরত ওসমানকে নিজ কক্ষে ডাকিয়া পাঠাইলেন। হযরত ওসমান আসিলে হযরত আবুবকর বলিলেনঃ আমি খলিফা মনোনয়ন করিয়া যাইব, তুমি লিখিয়া লও। হযরত ওসমান লিখিতে বসিলেন। দুই-একটি কথা বলিবার পরই হযরত আবুবকর অচেতন হইয়া পড়িলেন। খলিফা ইন্তেকাল করিতেছেন ভাবিয়া হযরত ওসমান তাড়াতাড়ি লিখিয়া ফেলিলেনঃ “আমি হযরত ওমরকে খলিফা মনোনীত করিয়া গেলাম।” ইহার কিছুক্ষণ পরেই হযরত আবুবকরের আবার জ্ঞানসঞ্চার হইল। তিনি ওসমানকে জিজ্ঞাসা করিলেন? কি লিখিয়াছো? ওসমান পড়িলেন : “আমি খলিফা পদে হযরত ওমরকে মনোনীত করিয়া গেলাম।” শুনিয়া হযরত আবুবকর খুশি হইলেন এবং বলিলেনঃ “আল্লাহ তোমার মঙ্গল করুন।” অতঃপর এই ঘোষণাই বাহিরে অপেক্ষমান জনতাকে শুনাইয়া দেওয়া হইল। জনতা একবাক্যে তাহা সমর্থন করিল।[৫]

[৫.Early Caliphate, Mahammad Ali-P. 235]

এই নিভৃত নীরব মুহূর্তটিতে হযরত ওসমানের চরিত্রের যে উদার মহিমা প্রকাশ পাইয়াছে, তাহা সত্যই অনবদ্য।

অপদার্থ এবং দুর্বলই বা তিনি কেমন করিয়া ছিলেন? যাহার সময়ে রাজ্যের আয়তন বহুগুণে বাড়িয়া গেল, বহু নূতন দেশ বিজিত হইল, রাজস্ব বৃদ্ধি পাইল, বহু জনকল্যাণ ও দেশোন্নতি যাহার দ্বারা সাধিত হইল-পাক-কুরআনকে যিনি চিরদিনের মতো নির্ভুল থাকিবার ব্যবস্থা করিয়া গেলেন, মুসলিম নৌ-বহরের যিনি প্রতিষ্ঠাতা, তিনি হইলেন “অপদার্থ”। দুর্বল ও অক্ষম তো দূরের কথা, অশীতিবর্ষ বয়স্ক হ্যরত ওসমানের শাসনই ছিল সর্বাপেক্ষা বলিষ্ঠ, সার্থক ও সুন্দর। অত বড় গণতান্ত্রিক শাসনকর্তা আর দেখা যায় না। কমিউনিজম আজ পর্যন্ত যে পর্যায়ে পৌঁছিতে পারে নাই, হযরত ওসমান চৌদ্দ শত বৎসর পূর্বে সেই পর্যায়ে পৌঁছিয়া গিয়াছিলেন। বিকৃত কমিউনিজম নয়, খাঁটি ইসলামী কমিউনিজমের তিনি ছিলেন এক মূর্তিমান আদর্শ। পুঁজিবাদ ও সমূহবাদের কি করিয়া সময় হইতে পারে, তিনি তাহার চূড়ান্ত দৃষ্টান্ত দেখাইয়া গিয়াছেন। সঞ্চয় ও বিতরণ তিনি এক সঙ্গে করিয়াছেন। দুবৃত্তেরা হযরত ওসমানকে হত্যা করিয়া বায়তুল-মাল ধনাগার লুণ্ঠন করিতে গিয়া নিরাশ হইয়া দেখিল বায়তুল-মাল-ফাত্রে প্রায় সমুদয় অর্থ প্রজাদের কল্যাণে ব্যয় করা হইয়া গিয়াছে। নিজে খলিফা হইয়াও হযরত ওসমান নিজেকে স্টেটের একজন সাধারণ নাগরিক ছাড়া অন্য কিছু মনে করিতেন না। গভর্নরদের বিরুদ্ধে জনসাধারণ যে কোনো হোট-খাট ব্যাপারেও খলিফার নিকট নালিশ করিতে পারিত। জনপ্রিয়তা হারাইলে কাহারও রক্ষা ছিল না। খলিফা নিজের রুটি নিজেই উপার্জন করিতেন। “No work, no bread” সোভিয়েট রাশিয়ার এই গাল-ভরা বুলি শুধু কিতাবেই আছে, গোহালে নাই। হযরত ওসমান সেই নিজের রুটি নিজেই কামাই করিয়া বাইতেন। লেনিন কি তাহা করিতেন? স্ট্যালিন কি তাহা করিয়াছেন? হ্যরত ওসমান জনসাধারণকে যে নাগরিক অধিকার দিয়াছিলেন, সোভিয়েট রাশিয়ায় কি তাহা মিলে? “State must wither away” টে উড়িয়া যাইবে-এই নীতি সোভিয়েট রাশিয়ার চিরদিন আকাশ-কুসুমই হইয়া থাকিবে; কিন্তু হযরত ওসমান কার্যতঃ এই সব আদর্শের অনুসরণ করিয়া গিয়াছেন। এমন কি যে আমীর আলী বলিয়াছেন যে, হযরত ওসমানের খলিফা নির্বাচন ইসলামের ধ্বংস ডাকিয়া আনিয়াছিল, সেই আমীর আলীও বলিতে বাধ্য হইয়াছেন?

“The incursions of the Turks in Trasoxdana led to the conquest of Balkh. Similarly were Hirat, Kabul and Ghazni conquered. The risings in south Persia led to the subjugation of Kerman and Sistan. In the settlement of the new acquisitions, the policy of Omar was followed. No sooner were these countries conquered than effective measures were set on foot for the development of their material resoureces. Water-courses were dug, roads made, fruit trees planted and security given to trade by the establishment of regular, police organisation. In Africa, Tripoli and Barca, and in the mediterranean Cyprus, were conquered. A large fleet sent by the Romans to re-conquer Egypt was destroyed off Alexandria.” –History of the Saracens : p. 47

কি করিয়া তবে তিনি ‘দুর্বল’ বা ‘অক্ষম’ হইলেন?

হযরত ওসমানের রাজ্য-শাসন সম্বন্ধে মৌলানা মুহাম্মদ আলী বলিয়াছেন:

“যে কোনো গভর্নর বা উচ্চপদস্থ রাজ কর্মচারীর বিরুদ্ধে জনসাধারণ খলিফার নিকট নালিশ করিতে পারিত। সমস্ত বিভাগই হযরত ওমরের আদর্শে শাসিত হইত। রাজস্ব বিভাগের অভূতপূর্ব উন্নতি হইয়াছিল। একমাত্র মিসরের রাজস্বের পরিমাণই ২০ লক্ষ হইতে ৪০ লক্ষ মুদ্রায় পরিণত হইয়াছিল। আয় বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ভাতা দান এবং সাহায্যের পরিমাণও বর্ধিত হইয়াছিল। বহু নূতন ইমারত, নূতন রাস্তাঘাট, সেতু, মসজিদ, সরাইখানা ইত্যাদি নির্মিত হইয়াছিল। মদিনা নগরীকে বন্যা হইতে রক্ষা করিবার জন্য একটি বিরাট বাঁধ নির্মিত হইয়াছিল। মদিনার মসজিদ বৃহদাকারে নির্মিত হইয়াছিল।” –(Early Caliphate : P. 258)

হযরত ওসমানের ইহাই হইল সত্য পরিচয়। রাসূলুল্লাহ বলিয়া গিয়াছেনঃ হযরত ওসমানকে একমাত্র হযরত ইব্রাহিম বা স্বয়ং তাহার সহিতই তুলনা করা চলে। সত্যিই কি তাহা নহে! জীবনের প্রারম্ভ হইতে শেষ পর্যন্ত মহানবীর আদর্শকেই তিনি অনুসরণ করিয়া গিয়াছেন। এ জীবনের প্রারম্ভ যেমন সুন্দর, অবসানও তেমনি সুন্দর। এ যেন এক মহাকাব্যের বেদনা-সুন্দর অবসান। হালকা কোনো সুর নাই, গভীর সুরের খেলা। এক নিমেষে ইহাকে বুঝা যায় না, যুগ যুগ ধরিয়া ভাবিতে হয়। মনে হয় হযরত ওসমানের মৃত্যু তাহার জীবনের চেয়েও মধুর। হযরত ওমর, হযরত ওসমান এবং হযরত আলী তিনজনই আততায়ীর হস্তে নিহত হইয়াছিলেন, কিন্তু হযরত ওসমানের মৃত্যুবরণ ছিল অপর দুইজন অপেক্ষা অধিকতর গৌরবের। হযরত ওমর বা হযরত আলি অতর্কিতে নিহত হইয়াছেন, কিন্তু হযরত ওসমান জানিয়া শুনিয়া স্বজ্ঞানে আততায়ীদিগের হস্তে শহীদ হইয়াছেন। ইচ্ছা করিলে তিনি বিদ্রোহীদিগকে দমন করিতে পারিতেন, কিন্তু পবিত্র মদিনার মাটিতে তিনি রক্তপাত ঘটাইবেন না এবং কোনো মুসলমানকে তিনি বধ করিবেন না–ইহাই ছিল তাঁহার দৃঢ়পণ। দেশ-রক্ষা এবং দেশ-জয়ের জন্য যিনি অসংখ্য সৈন্য পাঠাইয়াছেন এবং যুবকের মতো মনোবল দেখাইয়াছেন, আত্মরক্ষার জন্য সেই খলিফাই একটি সৈন্যও মোতায়েন করিলেন না! মৃত্যু নিশ্চিত জানিয়াও তিনি জীবন রক্ষায় উদাসীন। মুয়াবিয়া বিপদ বুঝিতে পারিয়া নিজের কাছে খলিফাঁকে লইয়া যাইতে চাহিলেন, তাহাও তিনি অস্বীকার করিলেন। একদল সৈন্য পাঠাইতে চাহিলেন, তাহাতেও তিনি রাজী হইলেন না। সঙ্গে সঙ্গে বলিলেনঃ আল্লাহ আমার রক্ষক, আর কাহারও সাহায্য আমি চাই না। সমস্ত ধন-সম্পদ, সমস্ত সৈন্যবল, সমস্ত আত্মীয়-স্বজন, সমস্ত বন্ধু-বান্ধব দুয়ারের বাহিরে দাঁড়াইয়া রহিল, খলিফা আপন ঘরে আততায়ীর হস্তে নীরবে আত্মদান করিলেন। শুধু পাক-কুরআন রহিল সেই মৃত্যুর সাক্ষী। প্রাণান্তে জ্যোতি-দীপ্ত মুখে কুরআন বুকে লইয়া খলিফা চিরবিদায় গ্রহণ করিলেন।

বিদ্রোহের কারণ

একথা তাহা হইলে এখন নিশ্চয়ই বলা যায় যে, স্বজনপ্রীতি এবং অক্ষমতার কারণেই যে হযরত ওসমানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ উপস্থিত হইয়াছিল, তাহা নহে। খলিফার হত্যার জন্য খলিফা দায়ী নহেন-দায়ী স্বয়ং বিদ্রোহীরা, দায়ী সেই জামানার অসহ্যত মানব প্রকৃতি ও অশান্ত পরিবেশ। ষড়যন্ত্রকারীদের সম্মুখে কোনো ন্যায়-নীতি বা আদর্শ ছিল না! দুর্ধর্ষ আরবদিগের উৎকট দলীয় মনোবৃত্তিই এই বিদ্রোহের কারণ। অসভ্য বন্য প্রকৃতি হইতে মানুষের মন সবে মাত্র আলোকে উদ্ভাসিত হইয়া উঠিতেছিল, ঠিক এই সময়ে গণতান্ত্রিক খলিফাঁদের অভ্যুদয়। কাজেই লোকে তাঁহাদের উচ্চ আদর্শ এবং সাম্যবাদের মর্যাদা দিতে পারে নাই। যে দেশে শুধু কথায় কথায় মারামারি, রক্তারক্তি; কবিলাতে কবিলাতে যেখানে অনবরত যুদ্ধ ও দাঙ্গা-হাঙ্গামা, গোত্রগত বিবাদ-বিসম্বাদের যেখানে অন্ত ছিল না, নৈতিক চরিত্র যাহাদের তখনও গঠিত হয় নাই, তাহাদের মধ্যে হযরত ওমর বা হযরত ওসমানের সময়েও তাহাই হইয়াছিল। যাহাই তিনি করিতে গিয়াছেন, একদল লোক তাহাই অন্যায় ভাবিয়াছে। ভালো কাজ করিলেই যে সর্বসাধারণের চিত্ত জয় করা যায়, তাহাও তো নহে। ভালো কাজ করিতে গেলেও অনেকের শক্র হইতে হয়। হযরত ওসমান জুয়াখেলা তুলিয়া দিয়াছিলেন, তাহাতেও একদল লোক তাহাকে দেখিতে পারিত না। ভুল কুরআন জ্বালাইয়া দিয়াছিলেন; তাহাতেও একদল লোকের তিনি বিরাগভাজন হইয়াছিলেন। আবুজার গিফারীকে নির্বাসন দিয়াছিলেন, তাহাও অনেকের ভালো লাগে নাই। রাজকর্মচারীদের নিয়োগের বেলাও ঠিক এইরূপই হইয়াছিল। নিযুক্ত কর্মচারীরা উপযুক্ত হইলেও একদল লোক সব সময়েই খলিফাঁকে সমালোচনা করিয়াছে। সবাইকে কি কেহ কখনো সন্তুষ্ট করিতে পারে? কাজেই খলিফার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ দেখিয়া বা তাহার হত্যা দেখিয়া তাহার বিচার করিলে চলিবে না। ফল দেখিয়া কারণ অনুমান করা সঙ্গত হইবে না। সেরূপ করিলে হযরত ওমর ও হযরত আলিও মুক্তি পাইবেন না। হযরত ওমর তো আর জন প্রিয় ছিলেন না। অতবড় আদর্শ গণদরদী খলিফাও কেন নিহত হইলেন? তারপর যে আলির জন্য ষড়যন্ত্রকারীরা হযরত ওসমানকে হত্যা করিল, সেই আলিও কিছু দিনের মধ্যেই গুপ্তঘাতকের হস্তে কেন নিহত হইলেন? কোন নীতি বা আদর্শের প্রেরণায় পরপর তিনজন খলিফা নিহত হইলেন, তাহা কেহ বলিয়া দিতে পারে কি? উচ্ছল মনোবিকৃতির ফলেই এই সব হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হইয়াছিল।

স্বজনপ্রীতির অভিযোগ যদি হযরত ওসমানকেই দেওয়া হয়, তবে হযরত আলিও সেই দোষে দুষ্ট। হযরত আলিও তো নিজের আত্মীয়-স্বজনকে নিয়োগ করিয়াছিলেন। তাহা হইলে তো স্বয়ং রাসূলুল্লাহও এ দোষ হইতে মুক্তি পান না। মৃত্যুকালে তিনি আপন শ্বশুর হযরত আবুবকরকে কেন খলিফা নিয়োগের ইঙ্গিত দিয়া গেলেন? হযরত আবুবকর, হযরত ওসমান ও হযরত আলি প্রত্যেকেই তো রাসূলুল্লাহর আত্মীয়! ইহাদের মধ্যেই বা কেন ভোলাফায়ে রাশেদীন সীমাবদ্ধ রহিল? এও তো এক মস্ত বড় স্বজন প্রীতি!

বস্তুতঃ হযরত ওসমানের সত্যিকার ইতিহাস এখনো লিখিত হয় নাই। উমাইয়া ও আব্বসীয়দের দ্বেষ-হিংসার ফলে এই যুগের ইতিহাস বিকৃত হইয়া পড়িয়াছে। আব্বাসীয়দের হস্তে যখন শাসন-শক্তি আসিল, তখন তাহারা, উমাইয়া বংশের ইতিহাস কলঙ্কিত করিয়া দিল। ইহাই হ্যরত ওসমানের বিরুদ্ধে অভিযোগের মূল কথা।

William Muir Gigt? “Annals of the Early Caliphate at বলিয়াছেন :

“Most traditions attribute the writing and sealing of the order to Marwan, the Caliph’s unpopular cousin who, throughout the narration receives constant abuse as the author of Osman’s troubles; but all this is manifestly tinged by Abbaside and anti-Umayid prejudices.-”

অর্থাৎ : অধিকাংশ বিবরণেই প্রকাশ যে, জাল চিঠিখানির লেখা এবং সীল-মোহর করা-মারোয়ানের কাজ। সমস্ত বিবরণীতে তাই তাহাকে গালাগালি দেওয়া হইয়াছে এবং বলা হইয়াছে যে হযরত ওসমানের সমস্ত বিপদের মূলে ছিল এই মারোয়ান। কিন্তু এই সব কথা উমাইয়াদের প্রতি আব্বাসীয়দের বিদ্বেষের রঙেই অনুরঞ্জিত।

তিনি আরও এক স্থানে বলিয়াছেন :

“According to some authorities, Osman presented the royal share of they looty as a free gift to Marwan, his prime minister, and they add that this was one of the grounds of Osman’s impeachment. But it reads like a party calumny.” –Ibid: P. 300

অর্থাৎ : “কেহ কেহ বলেন, ওসমান যুদ্ধ-লব্ধ মালের রাজকীয় অংশ তাঁহার মন্ত্রী মারোয়ানকে উপহার স্বরূপ দান করেন এবং বলেন এই কারণেই হযরত ওসমানকে অভিযুক্ত করা হয়। কিন্তু ইহা দলীয় নিন্দা-গালাগালি বলিয়াই মনে হয়।”

হযরত ওসমানের প্রকৃত ইতিহাস তাই অসত্যের আবর্জনায় চাপা পড়িয়া আছে। এই মহান খলিফার ইতিহাস এখন পুনলিখিত হওয়া উচিত।

নওবাহার-১৯৫১

ইসলাম ও সঙ্গীত প্রিয় ভ্রাতৃত্ব

প্রিয় ভ্রাতৃবৃন্দ,–

ইসলামে সঙ্গীত যে বিলকুল্ হারাম-এতকাল এই কথাই শুনে আসছি। অনেক স্থলে হাতে-কলমেও এর পরিচয় পেয়েছি। আপনাদের এখানে গান গাইলে আমি সমাদার লাভ করি বটে, কিন্তু তাই বলে মনে করবেন না যে, সর্বত্রই একরকম। অনেক স্থলে গান গেয়ে আমাকে বেশ অপ্রস্তুতও হতে হয়েছে। তাই ঠেকে শিখে আত্মরক্ষার জন্য একটু প্রস্তুত হয়েছি। কোন্ অস্ত্র দিয়ে নিজেকে রক্ষা করবো, তাই আজ আপনাদেরকে খুলে বছি।

শাস্ত্রের দোহাই দিয়েই যখন সঙ্গীতকে নিষিদ্ধ বলা হয়, তখন সেই শাস্ত্র সম্বন্ধেই প্রথমে আলোচনা করা যাক।

কোরআন ও হাদিস (অবশ্য সহী হাদিস) আমাদের মাথার মনি। তাদের বিধি নিষেধকে উল্লংঘন করবার ঔদ্ধত্য আমার নাই। কোরআন ও হাদিসে বাস্তবিকই যদি থাকে যে, সঙ্গীত একেবারেই হারাম, তবে তা হারামই। এ সম্বন্ধে আর কোনো দ্বিরুক্তি নাই। কিন্তু আমরা পরিষ্কার করে জানৃতে চাই-কোরআন-হাদিসে সেরূপ নিষেধাজ্ঞা আছে কিনা। যারা সঙ্গীতকে হারাম বলে ফাতোয়া দেন, এ প্রমাণ-ভার তাদের উপর। পরিষ্কার করে জানতে হারাম বলে সিদ্ধান্ত করা হয়েছে। তাহলেই সব গণ্ডগোল চুকে গেল। হযরত মুহম্মদের আবির্ভাবকালে লাম্পট্য, মদ্যপান প্রভৃতি দুর্নীতির সঙ্গে সঙ্গীতও তো জড়িয়ে ছিল। সুতরাং সঙ্গীত সর্ব অবস্থায় নিষিদ্ধ হলে, সে সম্বন্ধে কোরআন শরীফে কোনও আয়াত থাকা খুবই স্বাভাবিক-যেমন নাকি অন্যান্য দুর্নীতি সম্বন্ধে আছে। আমরা চাই সেই আয়াত ও সেই হাদিস।

কোরআন-হাদিস সম্বন্ধে আমার যে সামান্য জ্ঞান আছে, তাতে তো মনে হয়-কোরআন-হাদিসে ওরূপ কোনো নিষেধাজ্ঞা নাই। কোরআন শরীফে তো নাই-ই, তবে কোনো আয়াত বিশেষকে আনুমানিক ও দূরাগত একটি অর্থ দিয়ে বিপক্ষ পক্ষ তাদের উদ্দেশ্য হাসিল করে থাকেন। হাদিস থেকেও তারা ২১ টি হাদিস উদ্ধৃত করেন বটে, কিন্তু তাও ততত সুস্পষ্ট নয়। সঙ্গীতের বিপক্ষে তারা যেরূপ ২/১টি হাদিস দেখিয়ে থাকেন, আমরাও স্বপক্ষে সেরূপ দু’একটি হাদিস দেখাতে পারি। পি দুটি হাদিসের উল্লেখ এখানে করছিঃ

এক হাবশী বালিকা একদিন বিবি আয়েশার গৃহে গান গাচ্ছিল হযরত রসুলে করিম বিবি আয়েশার সঙ্গে সেই গান শুনছিলেন। এমন সময় হযরত ওমর এসে গৃহ-প্রবেশের এজাজত চেয়ে দ্বারে দাঁড়িয়ে রইলেন। হযরত ওমর ছিলেন বাগরেশে’ পুরুষ। তাঁর নামে সকলের প্রাণে আতঙ্ক উপস্থিত হতো। হাবশী বালিকা ওমরের কথা শুনেই পালিয়ে গেল। ইত্যবসরে হযরত ওমর গৃহ-মধ্যে প্রবেশ করলেন। তিনি দেখলেন হ্যরত রসুল ও বিবি আয়েশা হযরত ওমরকে লক্ষ্য করে মৃদু মৃদু হাসছেন। তা দেখে হযরত ওমর তার কারণ জিজ্ঞাসা করলেন। তখন হযরত রসুল বললেন-একটা হাবশী বালিকা গান করছিল, আমরা শুনছিলাম। কিন্তু তোমার আসার কথা শুনেই সে পালিয়েছে। তা শুনে হযরত ওমর বললেন-”রাসূলুল্লাহ্, আপনি যা শুনতে পারছেন, আমি তা পারবো না? কই? মেয়েটি কোথায়? ডাকুন তাকে, সে গান করুক।” তখন মেয়েটিকে আবার ডাকা হলো এবং তিনজনে বসে তার গান শুনলেন।

আর একবার একটি আনসার জাতীয় মেয়ের বিয়ে হচ্ছিল। হযরত রসুল সেখানে উপস্থিত হয়ে সকলকে উদ্দেশ্য করে বললেন- “বিবাহে তোমরা কোনো আমোদ করছো না? বাজাও, দ বাজাও; আনসারগণ দ বাজানো খুব ভালোবাসে।

এ রকম আরও দু-একটা হাদিসের কথা উল্লেখ করা যায়।

এর থেকেই পরিষ্কার বুঝা যায়-সঙ্গীতে-অন্ততঃ বিশুদ্ধ সঙ্গীতে হযরত মুহম্মদের কোনোই আপত্তি ছিল না।

সঙ্গীত যে হযরত মুহম্মদের পূর্ববর্তী পয়গম্বরদিগের সময়েও প্রচলিত ছিল, তারও প্রমাণ পাওয়া যায়। হযরত দাউদ তার সুমধুর কণ্ঠ-সঙ্গীতের জন্য (লেহানে দাউদী) চির প্রসিদ্ধ হয়ে আছেন। হযরত মূসা যখন বনি-ইসরাইলদেরকে সঙ্গে নিয়ে নীল-নদ পার হয়ে যান, তখন বনি-ইসরাইল রমণীরা ওপারের তীরে উঠে আনন্দে অধীর হয়ে দ বাজিয়ে গান করতে থাকে। হযরতের সময়েও আরবে সঙ্গীতের যথেষ্ট প্রচলন ছিল। তার মৃত্যুর পরও সঙ্গীতের উৎস কখনো নিরুদ্ধ হয়ে যায়নি। খলিফা হযরত ওমর নিজে সঙ্গীত রচনা করতেন। তিনিই সুপ্রসিদ্ধ সঙ্গীতজ্ঞ ইবনে সুরঈদের উৎসাহদাতা ছিলেন। খলিফা হযরত আলি ও হযরত মুয়াবিয়া উভয়েই সঙ্গীতের আলোচনা করতেন। খলিফা অলিদ একজন প্রসিদ্ধ বীণা-বাদক ছিলেন। খলিফা আবু আব্বাস এবং মনসুর সঙ্গীত ও অন্যান্য ললিত-কলার পৃষ্ঠপোষকতার জন্য চির প্রসিদ্ধ হয়ে আছেন। খলিফা হারুন-অর-রশিদের নাম না বললেও চলতে পারে। বস্তুতঃ খলিফাঁদের সময়ে বাগদাদ, পারশ্য, কর্ডোভা ও গ্রানাডাতে সঙ্গীতের যথেষ্ট উৎকর্ষ সাধিত হয়েছে। ইতিহাস তার সাক্ষী।

অন্যদের কথা দূরে থাক, যারা খলিফাতুল মুমেনিন, তাঁদের সম্বন্ধেই এই কথা!

তারপর ভারতবর্ষ। সুদীর্ঘ মুসলিম শাসনে ভারতীয় সঙ্গীত মুসলমানদিগের হাতে নবজীবন লাভ করেছে। যদি বলি যে ভারতীয় সঙ্গীতের অর্থ মুসলিম-সঙ্গীত, তাতেও অত্যুক্তি হয় না। ভারতীয় সঙ্গীতের ৪টি বড় বিভাগ আছে :- (১) ধ্রুপদ, (২) খেয়াল, (৩) ইংরি, (৪) টপ্পা। আপনারা শুনে হয়তো স্তম্ভিত হবেন যে, একমাত্র ধ্রুপদ ছাড়া অন্য ৩টি বিভাগই মুসলামনদের সৃষ্টি। মুসলমানেরাই ভারতীয় সঙ্গীতের মুক্তিসাধন করেছে। আর্য-ঋষিরা সঙ্গীতকে ধ্রুপদের কারাকক্ষে বন্ধ করে তাকে দম আটকে মেরে ফেলবার কায়দা করেছিলেন, এমন সময় মুসলমান এসে সেই কারার দুয়ার ভেঙে সঙ্গীতকে বাইরে নিয়ে এসে আলকিমিয়ার যাদুস্পর্শ তার অসাড় অঙ্গে বুলিয়ে দিলো! অমনি খেয়াল-রূপিণী এক বিচিত্র মূর্তির আবির্ভাব হলো। সম্ভবতঃ এটা ত্রয়োদশ শতাব্দীর কথা। সম্রাট আলাউদ্দিন খিলজির সভাকবি ও সভাগায়ক আমির খসরুই খেয়াল গানের স্রষ্টা। খেয়াল গানের উৎকর্ষ যখন চরমে পৌঁছায়, তখন পাঞ্জাবের শোরি মিয়া টপ্পা গানের সৃষ্টি করেন।

মুসলমান আমলে আমির খসরু, তানসেন, ধোধি খাঁ, সূরষ খাঁ, চাঁদ ব্য, শোভন খাঁ, শোটি, হমূদ, মৌলাদাদ, ইলিয়াস, গোলাম নবী, সনদ,কদর, খুশাল খ, নবাব ওয়াজেদ আলি প্রভৃতি অসংখ্য ক্ষণজন্মা সঙ্গীত-স্রষ্টা জন্মগ্রহণ করেছিলেন। ভারতীয় মুসলমানের এই অধঃপতনের যুগেও আর কিছুতে না হোক-অন্ততঃ সঙ্গীতে মুসলমান সকলের শীর্ষস্থান অধিকার করে আছে। আল্লাবন্দে খাঁ, নাসিরুদ্দীন খাঁ, আব্দুল করিম খাঁ, হাফিজ আলি খাঁ, আলাউদ্দীন খাঁ (বাঙালী) প্রভৃতি অসংখ্য অপ্রতিদ্বন্দ্বী সুর-শিল্পী এখনো সগৌরবে ভারতে বিদ্যমান।

শুধু গায়ক হিসাবে নয়-রাগ-রাগিণী হিসাবেও সঙ্গীতে মুসলমানের দান অপরিসীম। বহু রাগ-রাগিণী মুসলমান সুর-শিল্পীরা সৃষ্টি করে গেছেন। আড়ানো, মিয়া সার, মিয়াঁ মল্লার, মিয়াকি জয়জয়ন্তী, হোসেনী কানাড়া, দরবারী কানাড়া, দরবারী তোড়ী, বাহাদুরী তোড়ী, জৌনপুরী তোড়ী, বাহার ইত্যাদি বহু নূতন রাগ-রাগিণী মুসলমানদের হাতে জন্ম লাভ করেছে।

সুতরাং স্পষ্টই দেখতে পাচ্ছেন-সঙ্গীতকে এক শ্রেণীর মৌলবী সাহেবরা নিষিদ্ধ বলে ফতোয়া দিলেও ইসলাম কিন্তু সঙ্গীতের সঙ্গে চিরবিজড়িত। মুসলমানের কোরআন-হাদিস এবং সুদীর্ঘ ত্রয়োদশ শতাব্দীর ইতিহাসই তার প্রমাণ। আশ্চর্যের বিষয়-খোদা যেখানে নীরব, রসুল যেখানে নীরব, খলিফাতুল মুমেনিনরা যেখানে প্রশ্রয়দাতা, সেখানে আজ তেরো শ’ বছর পরে এদেশীয় এক শ্রেণীর মৌলবীরা পঞ্চমুখ হয়ে ফতোয়া দিচ্ছেন যে- গান বিলকুল হারাম। যেন সঙ্গীতের এই সমস্যা স্বয়ং আল্লা, রসুল বা খলীফাদের জানা ছিল না। যেন মুসলমান আমলের শরিয়তপন্থী বড় বড় বাদশা, কাজী, মুফতী প্রভৃতি কারও মনেই এ সমস্যার উদয় হয়নি, অথবা তারা যেন কেউ-ই এ সমস্যা সমাধান করবার মোগ্যতা রাখতেন না।

উক্ত মৌলবী সাহেবরা সঙ্গীত সম্বন্ধে যে আপত্তি উত্থাপন করেন, তা এক হাস্যকর ব্যাপার। কেউ আমাকে বলেছিলেন-আপনার যে গলা কাঁপিয়ে রাগ-রাগিণী বার করেন, তার জন্যই সঙ্গীত হারাম হয়ে যায়। নতুবা কোরআন শরীফের মতো সুর করে কোনো কিছু পড়লে কিছুই দোষ হয় না। এ কথার কোনোই মূল্য নাই। রাগ-রাগিণী, আর যাকে বলে ‘খোশ এহান’-এরা উভয়ই একই মার পেটের সন্তান,-গলা জড়াজড়ি করে আছে। ওদের মধ্যে কোনো সীমারেখা নাই। তাছাড়া রাগ-রাগিণীই বলুন আর ‘এহানই’ বলুন- কোনো ধ্বনিই সা-রে-গা-মা-পা-ধা-নি-এই সুর সপ্তকের বাইরে নয়। শুধু Permutation ও Combination-এর যা তফাৎ! রাগ-রাগিণীও যেমন হারমোনিয়ামে বাজিয়ে দেওয়া যায়, কোরআন পাঠও তেমনি হারমোনিয়ামে বাজানো যায়। মানব কণ্ঠের যে-সুর বাধা আছে, তার বাইরে কোনো কথা নাই। আর এক মৌলবী সাহেব আমাকে বলেছিলেন

“আপনারা যে তাল দিয়ে গান করেন, সেই তালই হচ্ছে হারাম।” ঐ কথাও মূল্যহীন। তাল তো অন্য কিছু নয়, শুধু সময়ের সমতা রক্ষা করা মাত্র।

গান যদি যায়েজ হয়, তবে তাল হারাম হবে কেন? তাল তো মানুষের বহু কার্যের মধ্যেই বিদ্যমান। প্রতিদিন যে দরুদ শরীফ পাঠ করা হয়, তার মধ্যেও তো তাল রাখে। বিশ্ব-প্রকৃতিই তো ছন্দ-তালে পরিপূর্ণ। ঋতুচক্রের আবর্তনের নৃত্যে কোনো দিন তো তাল কাটে না। গ্রীষ্ম, বর্ষা, শীত, বসন্ত-সবাই তো তালে তালে নেচে যায়। গাছে গাছে ফুল ফোটে, ফল ধরে-সবই তালে তালে। আগে-পিছে হয়ে তারা কেউ আসে না। চন্দ্র সূর্য, গ্রহ-নক্ষত্র তালে তালেই আসে, তালে তালেই চলে যায়। আমাদের এই দেহের মধ্যেও তো তালের লীলা-খেলা চলেছে। ধমণীতে যে রক্ত-স্রোত প্রবাহিত হচ্ছে, তার মধ্যে চমৎকার তাল রয়েছে। কি সুন্দর তালে তালেই না নাড়ি আমাদের স্পন্দিত হচ্ছে। কি সুন্দর ছন্দ-তালেই না ফুসফুস নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস গ্রহণ করছে। বস্তুতঃ এই তাল রক্ষা করে চলাই হচ্ছে স্বভাবধর্ম। তাল যখন কেটে যায়, তখনই বিপদ ঘটে। নাড়ীর গতি অসম হয়। তখনই বুঝতে হবে-একটা কিছু বিমার হয়েছে। বস্তুতঃ তাল কেটে গেলে সৃষ্টির সব কিছু বেসুরো ঠেক্ততা, সৃষ্টি অচল হতো।

এইবার সাধারণভাবে একটু আলোচনা করা যাক। সঙ্গীত মানুষের এত প্রিয় কেন? হাজার হাজার মৌলবীর লক্ষ লক্ষ ফতোয়াও মানুষকে সঙ্গীত থেকে বিরত রাখতে পারে না কেন? তার কারণ-সঙ্গীতের সঙ্গে মানব-মনের অচ্ছেদ্য সম্বন্ধ আছে। এই নিখিল সৃষ্টির মূলে আমি শুধু দুটি উপাদানই লক্ষ্য করি- সে হচ্ছে সুর আর রূপ। সুর আর রূপের ভিতরেই সৃষ্টি ডুবে আছে। আকাশে তাকাও, পাতালে তাকাও-সর্বত্র রূপের লীলাখেলা। পথে-প্রান্তরে অন্তরে-বাহিরে যে দিকে যখনই কান দাও, সর্বত্র সুরের লীলা-তরঙ্গ। বিশ্ব বীণার তারে তারে নিশি-দিন সুর ধ্বনিত হচ্ছে। সেই Music of spheres যাদের কান আছে, তারাই শুনতে পায়।

এই যে সুর আর রূপের কথা বলছি, তার উপাদান সৃষ্টির মধ্যে যেমন লুকিয়ে আছে, মানুষের মনের মধ্যেও তেমনি লুকিয়ে আছে। খোদাতালা মানুষকে সুর আর রূপ দিয়েই সৃষ্টি করেছেন। সুর আর রূপে তাই মানব-হৃদয় এমন করে সাড়া দেয়। কাজেই ফতোয়া যদি দিতে হয়, তবে সে ফতোয়া মানুষের উপর নয়-খোদাতালার উপর দিতে হবে। খোদাতালাকে বলতে হবে-হে খোদা, তুমি মানুষকে মাটি দিয়ে সৃষ্টি করো, সে ভালো, কিন্তু দোহাই তোমার,-সেই মাটির ভিতর তোমার সুরের সুধা আর রূপের রং মিশিয়ে দিও না! এ না হলে এই দুনিয়ায় ফতোয়া দিয়ে মানুষকে আমরা কাবু করতে পারি না!

মানব-মনে সুর আর রূপের উপাদান যে আছে, তা একটা প্রবাদ বাক্যেও পরিষ্কার বুঝা যায়। আদমের দেহাভ্যন্তরে (কবের মধ্যে) যখন খোদাতালা রুহ (আত্মা) প্রবিষ্ট করান, তখন রুহ্ সেখানে থাকতে চাইলো না,-ছটফট করে বেরিয়ে এলো। তখন খোদাতালা ফেরেশতাদিগকে বললেন-সেই কবের কুঠরিতে আলো দিতে। অপূর্ব রূপচ্ছটায় কল আলোকিত হয়ে গেল। তখন রুহকে পুনঃপ্রবিষ্ট করানো হলো। এবারও রুহ থাকতে চাইলো না। তখন খোদাতালার হুকুম হলো-কলবের চারিদিকে সুমধুর বাদ্যধ্বনি করো। এইবার রুহু শান্ত হয়ে আদমের দেহে রয়ে গেল।

এই উপাখ্যানের মূলে গভীর সত্য নিহিত আছে। বাস্তবিকই সুর আর নূর ছাড়া সৃষ্টি অচল হতো। এই যে বিশ্ব-প্রকৃতি নিতি-নবভাবে এমন রূপ-সুষমায় প্রকাশ পাচ্ছে, এই যে ফুল ফুটছে, চাঁদ হাসছে-দিকে দিকে, লোকে-লোকে এই যে সুমধুর সঙ্গীত-ধ্বনি উত্থিত হচ্ছে, এ একবারে নিরর্থক নয়। বিরাট বিশ্বের সমবেত আত্মাকে (রুহ) মশগুল করে রাখবার জন্যই খোদাতালার এই বিপুল আয়োজন; বিশ্বের বিরহী আত্মা (রুহ) এই পরের ঘরে থাকতে চায় না, বিচ্ছেদ-বেদনায় বেরিয়ে যেতে চায়, তাই খোদাতালা তার রূপ ও তার সুর দিয়ে তাকে শান্ত করলেন। সুর আর রূপের মধ্যে আমাদের আত্মা তার পরমাত্মীয়ের পুলক-পরশ অনুভব করে বলেই যা কিছু সান্ত্বনা। বিরহী আত্মা তার প্রিয়তমের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে কতো দূরে এসে পড়েছে; এ যে অ-জানা অচেনা

দেশ; এখানে সে নিতান্ত নিঃসঙ্গ, তাই সে তার প্রিয়তমের খোঁজে ব্যাকুল। প্রিয়তমের দেখা সে পায় না, শুধু পায় একটু আভাস-একটু চরণধ্বনি শুধু দেখে তার রূপের ছটা, শুধু শোনে তার নুপুর-গুঞ্জন! এই রূপের ছটা আর গুঞ্জন-গীতিই তাকে যেন পথের সন্ধান বলে দেয়, যেন বলে-”এই পথ দিয়ে উঠে এসো, আমার সন্ধান পাবে।” যে মানুষের অন্তর এই দুটি পথের ইঙ্গিতকেই অস্বীকার করে, তার আবার কিসের বিরহ, কিসের কান্না, কিসের ব্যাকুলতা, প্রিয়তমের সন্ধান পাবার তার কোনো ভরসা নাই। Shakespeare এই রকম লোক সম্বন্ধেই বলেছেন-তারা ‘fit for treason and murder.’খোদাতালার এই সঙ্গীত-জলসা আর এই রূপের মেলা তাদের কাছেই শুধু ব্যর্থ।

মানুষের জীবনে ললিত-কলার প্রয়োজন আছে। যে জাতীয় উন্নতির দোহাই দিয়ে সঙ্গীত ও অন্যান্য কলা-বিদ্যাকে দূরে সরিয়ে রাখা হয়, সেই জাতীয় উন্নতির জন্যও এর অপরিহার্য দরকার। সৌন্দর্য-পিপাসা মানুষের মনকে সুন্দর করে, অসুন্দরকে ঘৃণা করতে শিখায়। যার মনে সৌন্দৰ্যবোধ জন্মেছে, সে ভিতরে বাহিরে কোনো দিক দিয়েই অসুন্দরের সঙ্গে মিতালি করতে পারে না; তাজমহলের সৌন্দৰ্য্য যদি আমায় পাগল করে তোলে, তবে কুঁড়ে ঘরে নোংরা জীবন যাপন করতে আমর সাধ যায় না। একটা অভাবের তীব্র অনুভূতি সারা চিত্তকে চঞ্চল করে তোলে। আজ ঝক্তিগত ও সামাজিক জীবনে প্রতি কার্যে আমরা অসুন্দরকে নিয়ে ঘর করছি। আমাদের যা আছে তাতেই আমরা সন্তুষ্ট হতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি। সৌন্দর্যবোধের অভাবই এর মূল কারণ। অসুন্দরকে জয় করি আমরা সুন্দর হবে-এই আগ্রহ আজ আমাদের নেই। আমাদের জীবনে সৌন্দর্য ও সুর নেই-উচ্ছল, এলোমেলো জীবন আমরা যাপন করছি। তার মধ্যে কোনো নিয়ম শৃঙ্খলা বা তাল নেই। কাজেই সুর আর রূপের আমাদের এত দরকার। আজ যদি আমরা ললিত-কলার অনুরাগী হই, তবে আমরা ধর্মে-কর্মে, ভিতরে-বাহিরে সব দিক দিয়েই সুন্দর হতে পারবো।

অবশ্য একটা কথা আছে। মৌলবী সাহেবরা সঙ্গীতকে যে দু’চোখ পেতে দেখতে পারেন না, তার যে একবারেই কোনো কারণ নেই, তাও মনে করবেন না। সঙ্গীত বলেই যে সঙ্গীত হারাম তাও যেমন নয়, আবার সঙ্গীত বলেই যে সঙ্গীত হালাল, তাও তেমনি নয়। প্রত্যেক জিনিসেরই ভালো-মন্দ আছে। দেশ, কাল ও পাত্র ভেদে সব জিনিসেরই বিচার করতে হয়। সঙ্গীত একটা তলোয়ার বিশেষ। যার হাতে যখন থাকে তার ইঙ্গিতেই চলে। ভালো লোকের হাতে থাকলে ভালো ফল হয়, মন্দ লোকের হাতে থাকলে মন্দ ফল হয়। সঙ্গীত এক দিকে যেমন মানবাত্মাকে শাস্ত্রের সকল সীমারেখা অতিক্রম করে অনন্ত ভাবরাজ্যে নিয়ে যেতে পারে, তেমনি আবার তাকে ধ্বংসের মুখেও ফেলে দিতে পারে। অবশ্য এ সঙ্গীতের দোষ নয়, এ সেই ব্যবহারকারীর দোষ। এমন যে হালাল জিনিস ভাত, তাও বিকৃত করে খেলে হারাম হয়ে যায়। কাজেই সর্বত্র আমাদের বিচার বুদ্ধির দরকার। যে সঙ্গীত আমাদেরকে সুন্দর করতে পারে, আত্মাকে উন্নীত করতে পারে, সেই সঙ্গীতই আমরা চাই। পবিত্র অন্তর দিয়ে সঙ্গীতের সাধনা করতে হবে, তা হলেই সঙ্গীত ইসলামের বাহন হবে। ইসলাম অশরীরী ভাবেই ধর্ম, জড়তুকে সে স্বীকার করে না। মানবাত্মার সূক্ষ্ম অনুভূতিকে সে সারা প্রাণ দিয়া উপলব্ধি করে। কাজেই এই অশরীরী ভাবকে মনের মধ্যে মূর্ত করে তুলতে সঙ্গীতই হবে বড় একটা সহায়, কেননা অনন্তকে সান্তের মধ্যে রূপ দেওয়াই হচ্ছে সঙ্গীতের চরম সার্থকতা। অবশ্য এ উদ্দেশ্য সফল করে তুলতে হলে, আমাদের আদর্শ অনুযায়ী নূতন নূতন সঙ্গীত রচনা করতে হবে-যা সহজ ভাবেই আমরা প্রাণ দিয়ে গ্রহণ করতে পারি। “এমন দিন কি হবে মা তারা”-এ রকম গান গাইলে আপনারা মৌলবীদের সঙ্গে ঝগড়া করে এটে উঠবেন না।

আমার মনে হয়, সঙ্গীতে যে মুসলমান চিরদিনই শ্রেষ্ঠ আসন অধিকার করে আসছে, তার প্রধান কারণই হচ্ছে, সে মুসলমান। ইসলামই সঙ্গীতের উপযুক্ত ক্ষেত্র। সঙ্গীতের যে সাধনা, ইসলাম তার থেকে দূরে নয়। মুসলমানের মনে কোনো স্থূলত্ব বা জড়ত্ববোধ নাই, নিরাকারের ধেয়ানী সে, অনন্তের রাজ্যে সে যাওয়া আসা করে, তাই একান্ত ও তন্ময় হয়ে সে গান করতে পারে, তাই তার সুরের মুকুরে অসীমের ছায়া পড়ে, তাই তার কণ্ঠ সঙ্গীত এত প্রাণবন্ত, এত জীবন্ত হয়ে ওঠে। কোনো পীর সাহেবের মুখে যদি কখনো গান শুনতে পেতাম, তবে তার চেয়ে সুন্দর জিনিস বোধ হয় আর কিছু হতো না।

পরিশেষে বলতে চাই-সঙ্গীত সম্বন্ধে মৌলবী সাহেবদের সঙ্গে আমাদের একটা আপোষ হওয়া নিতান্ত দরকার। সঙ্গীতের খারাপ দিক (Sark side) সম্বন্ধে আমাদিগকে যেমন হুঁশিয়ার হতে হবে, মৌলবী সাহেবদেরকে তেমনি সঙ্গীতকে জীবনের মধ্যে গ্রহণ করতে হবে। খোদাতালার এই যে সুন্দর আকাশ, পৃথিবী, এই যে রূপের আলো, এই যে বিচিত্র সুরের খেলা,—-তার অস্তিত্বের এই যে পুলক-পরশ এ যেন তাদের জীবনে ব্যর্থ হয়ে ফিরে না যায়। [৬]

[৬. কলিকাতা ইসলামিয়া কলেজের সাহিত্য সভায় লেখক কর্তৃক পঠিত।]

মাসিক মোহাম্মদী–১৯৩০

ইসলাম ও উচ্চাঙ্গের সঙ্গীত

আমার পূর্বলিখিত ‘ইসলাম ও সঙ্গীত’ নামক একটি প্রবন্ধে আমি দেখাতে চেয়েছিলাম যে ইসলামই সঙ্গীতের প্রকৃষ্ট প্রকাশ-ভূমি। সীমার মধ্যে অসীমকে মূর্ত করে তোলাই হচ্ছে সঙ্গীতের চরম সার্থকতা। যে সঙ্গীতে অনন্তের এক একটা ইঙ্গিতে ফুটে ওঠে, যে সঙ্গীতে অনির্বচনীয়কে উপলব্ধি করা যায়, তাই হচ্ছে শ্রেষ্ঠ সঙ্গীত। কিন্তু সবার কঠেই এই সঙ্গীত ধরা পড়ে না। এ অতি সূক্ষ্ম অশরীরী জিনিস, জোর করে একে ধরে আনা যায় না। অসীমের ধেয়ানী না হলে অসীমকে পাওয়া যায় না। মুসলমান নিরাকারের উপাসনা করে; স্থলকে অতিক্রম করে সূক্ষ্ম ভাব-রাজ্যে সে যাওয়া আসা করে; তার মনের দিকচক্রবাল অপরের চেয়ে অধিকতর ব্যাপক; তাই তার কণ্ঠে সঙ্গীতের যে আবেদন ধরা পড়ে, অপরের কাছে তা প্রায়ই পড়ে না। হারমোনিয়াম-কাঁধে-বাঁধা রাস্তার একজন সাধারণ পশ্চিমা মুসলমান গায়ক থেকে আরম্ভ করে ভারতের শ্রেষ্ঠ খেয়ালী ফৈয়াজ খাঁ, আবদুল করিম খাঁ, নাসির খাঁ, আল্লাদিয়া, রজব আলী খাঁ, বন্দে হোসেন খাঁ, ইংরি সম্রাট জমিরুদ্দীন খাঁ অথবা জগদ্বিখ্যাত সেতারী প্রফেসার এনায়েত খা-সকলেই একথা প্রমাণ করে। সঙ্গীতের ইতিহাস আলোচনা করলেও দেখা যায়-যুগে যুগে মুসলমানেরাই সঙ্গীতে শ্রেষ্ঠ আসন অধিকার করে আসছে। মুসলমানের বর্তমান রাজনৈতিক অধঃপতনের যুগেও এদিক দিয়ে তারা অপ্রতিদ্বন্ধী। আর কিছুতে না হোক-সঙ্গীতে এখনও মুসলমানেরাই ‘ওস্তাদ’।

সঙ্গীতের বিভিন্ন শাখায় মুসলমানদিগের দানও যে কতো বড়, তাও আমি পূর্ব প্রবন্ধে উল্লেখ করেছি।

কিন্তু তবুও এ কেমন কথা যে ইসলামে সঙ্গীত নিষিদ্ধ! একদিকে দেখি নিষেধের ফতোয়া, অপর দিকে দেখি-মুসলমানেরাই সঙ্গীতের শ্রেষ্ঠ সাধক এবং শ্রেষ্ঠ-সুরস্রষ্টা! এ অসামঞ্জস্যের ব্যাখ্যা কি? কোন্‌টি সত্য? ইসলামে সঙ্গীত নিষিদ্ধ, এইটেই সত্য, না ইসলামই সঙ্গীতের শ্রেষ্ঠ প্রকাশক্ষেত্ৰ এইটেই সত্য?

আমার মতে এই দুই মতই সত্য।

All great truths are self-contradictory. U QU og forca অসামঞ্জস্য বড় বেশী থাকেনা; কিন্তু মূলীভূত বড় বড় সত্যগুলি পরস্পর বিরোধী বলে মনে হয়। এখানেও তাই হয়েছে। ইসলামে সঙ্গীত নিষিদ্ধও বটে, আবার ইসলাম সঙ্গীতের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রকাশ-ভূমিও বটে। একই জিনিসকে দুটি বিভিন্ন দৃষ্টি-কেন্দ্র থেকে দেখা হয়েছে বলেই এই আপাত বিরোধ জেগে উঠেছে।

হোমিওপ্যাথিক ঔষধ কেমন করে তৈরী হয়, তার উপাদান কি, তা বোধ হয় সকলেই আপনারা জানেন। এলাপ্যাথিক ও হোমিওপ্যাথিক উভয় ঔষধের উপাদান একই; তবে এলাপ্যাথিক স্কুল আর হোমিওপ্যাথিক সূক্ষ্ম। স্থূল ঔষধকে পানি বা এলকোহলের সঙ্গে মিশিয়ে সূহ্মাংশে বিভাগ করতে করতে যখন আর মূল ঔষধের কোনো অস্তিত্বই অনুভব করা যায় না, তখনই তা হয় হোমিওপ্যাথিক ঔষধ। যে ঔষধ স্কুলকে এড়িয়ে যতো ঊর্ধ্বে উঠে যায়, ততোই তার শক্তি বেড়ে যায়। লক্ষতম শক্তির ঔষধ দশম শক্তির ঐষধের চেয়ে বহুগুণে শক্তিশালী। লক্ষতম শক্তির কোনো ঔষধের মধ্যে মূল ঔষধের নাম-গন্ধও খুঁজে পাওয়া যাবে না, অথচ তার মধ্যে মূল ঔষধের শক্তি ও ক্রিয়া শতগুণ বেড়ে গিয়েছে। বস্তু যেখানে স্কুল, সেখানে সে জড়, আর যেখানে সে সূক্ষ্ম, সেখানে সে বিদ্যুৎ সেখানে তার শক্তি অসীম। প্রত্যেক জিনিসেরই এইরূপ স্কুল ও সূক্ষ্ম রূপ আছে।

সঙ্গীতের ঠিক এমনি দুটো রূপ আছে। একটি স্কুল সঙ্গীত আর একটি সূক্ষ্ম সঙ্গীত। বিশ্বের যাবতীয় কণ্ঠ ও যন্ত্র-সঙ্গীতের অন্তরালে আর এক অপ্রকাশিত সঙ্গীত-জগৎ আছে, সে সঙ্গীতের ধ্বনি সহজে আমাদের কানে ধরা পড়ে না, তার জন্য স্বতন্ত্র কানের দরকার। এই অমর্ত সঙ্গীত সাধারণতঃ কানে যেমন শুনাও যায় না, কণ্ঠে তেমনি গাওয়াও যায় না। যাঁরা সঙ্গীতজ্ঞ, তাঁরা জানেন ‘উদারা’ মুদারা’ তারা’-এই তিন স্বরগ্রামে মানুষের কণ্ঠ বাঁধা। এর নিচেকার বা উপরকার স্বরগুলি মানুষের আয়ত্তের মধ্যে নেই। এই তিন সুর সপ্তকের অতীতে যে সুর আছে, মানুষের কণ্ঠ তার নাগাল ধরতে পারে না। কিন্তু মানুষের কণ্ঠে ধরা পড়ে না বলেই যে তারা নেই, তা তো নয়! কোথায় সেই সুর? কারা গায়, কারা শোনে সে সঙ্গীত? এ কথা, চিন্তা একেবারেই আমাদের লক্ষ্যের বাইরে পড়ে আছে।

সকলেই জানেন, গায়কদের কণ্ঠের উচ্চতা বা Pitch সকলের সমান নয়। যে গায়কের কণ্ঠ যে-সীমা পর্যন্ত স্বভাবতঃ ওঠে, তার অতীতের সুরগুলি সে কণ্ঠে গাইতে পারে না বটে, বাণী সেখানে রুদ্ধ হয়ে যায় বটে, কিন্তু তা হলেও মন তার সেই সুরগুলি নীরবেই গেয়ে যায় এবং নীরবেই শোনে! যার কণ্ঠ স্কুলকে যতো এড়িয়ে চলতে পারে, তার কণ্ঠ ততো মধুর। নারী-কণ্ঠের গান এই জন্যই আমাদের এত ভালো লাগে। পুরুষের কণ্ঠ অপেক্ষা নারী-কণ্ঠের উচ্চতা বা Pitch-ও খুব বেশী। তা ছাড়া তাদের কণ্ঠে সুর অপেক্ষা সুরের সূক্ষ্ম ইঙ্গিতই ফোটে বেশী করে। এই জন্যই তা আমাদের এত ভালো লাগে। নারী-কণ্ঠের গান যদি এত সুন্দর হতে পারে, তবে নারী-কণ্ঠেরও অতীতে যে সূক্ষ্মতর সুর আছে, সেই নাগাল-না-পাওয়া সুর আরও কতো মধুর!

সেই সুরের রূপ নাই। সেই অশরীরী সুরের লীলা-তরঙ্গে আমাদের আকাশ-বাতাস ভরপুর। বর্তমান সময়ে Wireless বা Radio আবিষ্কারের পর এ কথা আর অস্বীকার করার উপায় নাই। কোন্ সুদূর হতে ভেসে আসে না-শোনা গানের সুর, ধরা পড়ে তা বেতার-যন্ত্রে! যার যন্ত্র আছে সেই সে সঙ্গীত শুনতে পারে; যার নাই, সে তা শুনবে কেমন করে। সে হয়তো এ কথা বিশ্বাসই করবে না।

সঙ্গীতের এই যে সূক্ষ্ম রূপ, এটা উচ্চক্রম হোমিওপ্যাথিক ঔষধের মতোই। সুল বাদ-সঙ্গীত যেন এলোপ্যাথিক ঔষধ, তার মাত্রাও স্কুল, ক্রিয়াও শুল। আর এই উচ্চাঙ্গের সঙ্গীত যেন শক্তিকৃত হোমিওপ্যাথিক ঔষধ; তাকে চোখে দেখা যায় না, অথচ সে আছে এবং তার ক্রিয়াও আছে।

বলা বাহুল্য ইসলাম এই উচ্চাঙ্গের সঙ্গীতেরই পক্ষপাতী। কণ্ঠ যেখানে নীরব-বাণী যেখানে স্তব্ধ, সেখান থেকে তার যাত্রা। ইসলামে যে সঙ্গীত নাই, এ কথা একেবারেই মিথ্যা। হোমিওপ্যাথিকের যে ভক্ত, সে যেমন এলোপ্যাথিকের স্থল ঔষধ অথবা উগ্রগন্ধ কোনো দ্রব্যই গ্রহণ করে না; ইসলামের এই অরূপ-সঙ্গীতের ভক্তেরাও তেমনি স্কুল সঙ্গীতকে এড়িয়ে চলতে চায়।

এই উচ্চাঙ্গের সঙ্গীত শুনতে হলে হৃদয়ের বেতার-যন্ত্র দিয়ে শুনতে হয়। এ সঙ্গীত শুনতে হলে প্রশান্ত নীরবতার দরকার। ঢাক-ঢোলের বাদ্যের মধ্যে অথবা বাহিরের কলরোলের মধ্যে সে সঙ্গীতের সুর ধরা পড়ে না।

ঢাক-ঢোলের বাদ্যেও সঙ্গীত আছে, আবার মসজিদে নামাজের মধ্যেও সঙ্গীত আছে। কিন্তু তফাৎ এই যে, একটি এলোপ্যাথিক, আর একটি হোমিওপ্যাথিক। উভয় ঔষধই মূলতঃ এক হলেও লোকে হোমিওপ্যাথিক ঔষধের ধারে পর্যন্তও এলোপ্যাথিক ঔষধ রাখে না, খাওয়া তো দূরের কথা। এই কারণেই বোধ হয় মুসলমানেরা মসজিদের সামনে বাদ্যকে এত ভায়ের চোখে দেখে।

মুসলমানেরা যে কারণে পৌত্তলিকতার বিরোধী, সেই কারণে স্কুল সঙ্গীতেরও বিরোধী। সুল সঙ্গীত যেন সঙ্গীতের আকার-মূর্তি; মুসলমানেরা সে সঙ্গীতের পূজারী নয়; সে সঙ্গীত তাদের জীবনে খাপ খায় না। তাই যারা সাধক, ওলি-আল্লাহ বা দরবেশ, তারা এই শ্রেণীর সঙ্গীতকে বর্জন করে অনির্বচনীয় নীরব সঙ্গীতের মধ্যে ডুবে যান। এইখান থেকে দৃষ্টিপাত করলেই ইসলামের নিকট সঙ্গীত নিষিদ্ধ বলে মনে হয়। ইসলামে সঙ্গীত আছে, কিন্তু সঙ্গীতের পৌত্তলিকতা নাই।

বর্তমানে সঙ্গীত-চর্চার দিকে বাঙ্গালী মুসলামানদের ঝোঁক অত্যন্ত বেশী দেখা যাচ্ছে। স্কুল সঙ্গীতের দিকে তারা ঝুঁকে না পড়ে, সেই দিকে লক্ষ্য রাখা এখন দরকার। আকাশ-বাণীর তারে তারে নিশিদিন যে সঙ্গীত ধ্বনিত হচ্ছে-সমস্ত সুর যেখানে এক মহা ঐক্যতানে লয় হয়ে যাচ্ছে-হৃদয়ের নিভৃত কক্ষে বেতার-যন্ত্র বসিয়ে সেই উচ্চাঙ্গের সঙ্গীত-সেই Music of the spheres’ শুনতে হবে। নতুবা বাইরের এই স্কুল সঙ্গীত তাকে নীচের দিকেই টেনে নামাবে।

মোয়াজ্জিন

ভাদ্র, ১৩৪৩, ১৯৩৬

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *