০৮. জগৎ(২)

ক্ষুদ্র ব্রহ্মাণ্ড

[নিউ ইয়র্কে প্রদত্ত, ২৬শে জানুয়ারি, ১৮৯৬]

মনুষ্যমন স্বভাবতই বহির্মুখী। মন যেন শরীরের বাহিরে ইন্দ্রিয়গুলির মধ্য দিয়া উঁকি মারিতে চায়। চক্ষু অবশ্যই দেখিবে, কর্ণ অবশ্যই শুনিবে, ইন্দ্রিয়গণ অবশ্যই বহির্জগৎ প্রত্যক্ষ করিবে। তাই স্বভাবতই প্রকৃতির সৌন্দর্য ও মহত্ব প্রথমেই মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। মানবাত্মা প্রথমেই বহির্জগতের সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করিয়াছিল—আকাশ নক্ষত্রপুঞ্জ, অন্তরীক্ষে অন্যান্য পদার্থনিচয়, পৃথিবী নদী পর্বত সমুদ্র প্রভৃতি সম্বন্ধে প্রশ্ন জিজ্ঞাসিত হইয়া ছিল, আর আমরা সকল প্রাচীন ধর্মেই ইহার কিছু কিছু পরিচয় পাই। প্রথমে মানবমন অন্ধকারে অনুসন্ধান করিত করিতে বাহিরে, যাহা কিছু দেখিত ,তাহাই ধরিতে চেষ্টা করিত। এই রূপে সে নদীর একজন দেবতা, আকাশের অধিষ্ঠাত্রী আর একজন, মেঘের অধিষ্ঠাত্রী একজন, আবার বৃষ্টির অধিষ্ঠাত্রী আর এক দেবতায় বিশ্বাসী হইল। যেগুলিকে আমরা প্রকৃতির শক্তি বলিয়া জানি, তাহারাই সচেতন পদার্থে রূপান্তরিত হইল। কিন্তু যতই গভীর হইতে গভীরতর অনুসন্ধান হইতে লাগিল, ততই এই বাহ্য দেবতাগণে আর মানুষের তৃপ্তি হইল না। তখন মানুষের সমগ্র শক্তি তাহার নিজের ভিতরে চালিত হইল—তাহার নিজ আত্মা সম্বন্ধে প্রশ্ন জিজ্ঞাসিত হইতে লাগিল। বহির্জগৎ হইতে ঐ প্রশ্ন গিয়া অন্তর্জগতে পৌঁছিল। বহির্জগৎ বিশ্লেষণ করিয়া শেষ মানুষ অন্তজর্গৎ বিশ্লেষণ করিতে আরম্ভ করিল। উচ্চতর সভ্যতার স্তরে, প্রকৃতির সম্বন্ধে গভীরতর অন্তদৃষ্টি হইতে, উন্নতির উচ্চতর ভূমিতে এই ভিতরের মানুষ সম্বন্ধে গভীরতর অন্তদৃষ্টি হইতে, উন্নতির উচ্চতর ভূমিতে এই ভিতরের মানুষ সম্বন্ধে প্রশ্ন উত্থিত হয়।
এই ভিতরের মানুষই আজিকার অপরাহ্ণের আলোচ্য বিষয়। এই ভিতরের মানুষ সম্বন্ধে প্রশ্ন মানুষের যতখানি প্রিয় ও তাহার হৃদয়ের যত সন্নিহিত, আর কিছুই তত নহে। কত দেশে কত লক্ষবার এই প্রশ্ন জিজ্ঞাসিত হইয়াছে । কি অরণ্যবাসী সন্ন্যাসী, কি রাজা, কি দরিদ্র, কি ধনী, কি সাধু, কি পাপী, প্রত্যেক নরনরী সকলেই কোন না কোন সময়ে এই প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিয়াছেন—এই ক্ষণভঙ্গুর মানবজীবনে নিত্য কি কিছুই নাই? এই শরীর মরিলেও এমন কি কিছু নাই, যাহা মরে না? যখনই এই শরীর ধূলিমাত্রে পরিণত হয়, তখন কি কিছুই জীবিত থাকে না? অগ্নি শরীরকে ভস্মসাৎ করিলে তাহার পর আর কিছুই কি অবশিষ্ট থাকে না? যদি থাকে, তবে তাহার নিয়তি কি? উহা যায় কোথায়? কোথা হইতেই বা উহা আসিয়াছিল? এই প্রশ্নগুলি বার বার জিজ্ঞাসিত হইয়াছে, আর যতদিন এই সৃষ্টি থাকিবে, যতদিন মানব-মস্তিষ্ক চিন্তা করিবে, ততদিনই এই প্রশ্ন জিজ্ঞাসিত হইবে।ইহার উত্তর যে কখনও পাওয়া যায় নাই,তাহা নহে;যখনই প্রশ্ন জিজ্ঞাসিত হইয়াছে, তখনই উত্তর আসিয়াছে; আর যত সময় যাইতেছে, ততই উহা উত্তরোত্তর অধিক বল সংগ্রহ করিতেছে। বাস্তবিকপক্ষে সহস্র সহস্র বর্ষ পূর্বে ঐ প্রশ্নের উত্তর চিরদিনের জন্য প্রদত্ত হইয়াছিল, আর পরবর্তী সময়ে ঐ উত্তরই আবার কথিত, স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যাত হইয়া আমাদের বুদ্ধির নিকট উজ্জ্বলতররূপে প্রকাশিত হইয়াছে মাত্র। অতএব আমাদিগকে কেবল ঐ উত্তরের পুনরাবৃত্তি করিতে হইবে। সকলের চিত্তাকর্ষক এই সমস্যা-গুলির উপর নূতন আলোকপাত করিব, এমন ভান করি না। আমাদের আকাঙ্ক্ষা এই যে, সেই সনাতন মহান‍্ সত্য বর্তমান কালের ভাষায় প্রকাশ করিব, প্রাচীনদিগের চিন্তা আধুনিকদিগের ভাষায় ব্যক্ত করিব, দার্শনিকদিগের চিন্তা লৌকিক ভাষায় বলিব—দেবতাদের চিন্তা মানবের ভাষায় বলিব, ঈশ্বরের চিন্তা দুর্বল মানুষের ভাষায় প্রকাশ করিব, যাহাতে লোকে উহা বুঝিতে পারে। কারণ আমরা পরে দেখিব, যে ঐশী সত্তা হইতে ঐ-সকল ভাব প্রসূত, তাহা মানবেও বর্তমান—যে সত্তা ঐ চিন্তাগুলিকে সৃজন করিয়াছিলেন, তিনিই মানুষে প্রকাশিত হইয়া নিজেই ইহা বুঝিবেন।
আমি তোমাদিগকে দেখিতেছি। এই দর্শনক্রিয়ার জন্য কতগুলি জিনিসের আবশ্যক? প্রথমতঃ চক্ষু-চক্ষু অবশ্যই থাকা চাই। আমার অন্যান্য ইন্দ্রিয় অবিকল থাকিতে পারে, কিন্তু যদি আমার চক্ষু না থাকে, তবে আমি তোমাদিগকে দেখিতে পাইব না। অতএব প্রথমতঃ অবশ্যই আমার চক্ষু থাকা চাই। দ্বিতীয়তঃ চক্ষুর পশ্চাতে আর একটা কিছু থাকা আবশ্যক—সেটিই প্রকৃত দর্শনেন্দ্রিয়। তাহা না থাকিলে দর্শনক্রিয়া অসম্ভব। চক্ষু বাস্তবিক ইন্দ্রিয় নয়, উহা দর্শনের যন্ত্র মাত্র; যথার্থ ইন্দ্রিয়টি চক্ষুর পশ্চাতে অবস্থিত—উহা মস্তিষ্কস্থ স্নায়ুকেন্দ্র। যদি ঐ কেন্দ্রটি নষ্ট হইয়া যায় , তবে মানুষের অতি নির্মল দুটি চক্ষু থাকিতেও সে কিছুই দেখিতে পাইবে না। অতএব দর্শনক্রিয়ার জন্য ঐ প্রকৃত ইন্দ্রিয়টি থাকা বিশেষ আবশ্যক। আমাদের অন্যান্য ইন্দ্রিয়সম্বন্ধেও সেইরূপ। বাহিরের কর্ণ কেবল ভিতরে শব্দ লইয়া যাইবার যন্ত্রমাত্র। উহা মস্তিষ্কস্থ কেন্দ্রে পৌঁছানো চাই। তবু ইহাই শ্রবণক্রিয়ার পক্ষে যথেষ্ট হইল না। কখন কখন এরূপ হয়, তুমি তোমার গ্রন্থাগারে বসিয়া একাগ্রমনে কোন পুস্তক পড়িতেছ——এমন সময় ঘড়িতে বারোটা বাজিল, কিন্তু তুমি শুনিতে পাইলে না। কেন শুনিতে পাইলে না? এখানে কিসের অভাব ছিল? মন ঐ ইন্দ্রিয়ে সংযুক্ত ছিল না। অতএব আমরা দেখিতেছি, তৃতীয়তঃ মন অবশ্যই থাকা চাই। প্রথম বাহ্যযন্ত্র; তার পর এই বাহ্যযন্ত্রটি ইন্দ্রিয়ের নিকট যেন ঐ বিষয়কে বহন করিয়া লইয়া যায়; তারপর আবার মন ইন্দ্রিয়ে যুক্ত হওয়া চাই। যখন মন ঐ মস্তিষ্কস্থ কেন্দ্রে যুক্ত না থাকে, তখন কর্ণ-যন্ত্রে এবং মস্তিষ্কস্থ কেন্দ্রে বিষয়ের ছাপ পড়িতে পারে, কিন্তু আমরা উহা বুঝিতে পারিব না। মনও কেবল বাহক মাত্র, উহাকে এই বিষয়ের ছাপ আরও ভিতরে বহন করিয়া বুদ্ধিকে প্রদান করিতে হয়। বুদ্ধি নিশ্চয়াত্মিকা বৃত্তি। তবু যথেষ্ট হইল না। বুদ্ধিকে আবার আরও ভিতর লইয়া গিয়া এই শরীরের অধীশ্বর আত্মার নিকট উহাকে সমর্পণ করিতে হয়। তাঁহার নিকট পৌঁছিলে তবে তিনি আদেশ করেন——’কর’ অথবা ‘করিও না’। তখন যে যে ক্রমে উহা ভিতরে গিয়াছিল, সেই সেই ক্রমে আবার বাহিরে আসে—— প্রথমে বুদ্ধিতে, তারপর মনে, তারপর মস্তিষ্ককেন্দ্রে, তারপর বহির্যন্ত্রে; তখনই বিষয়জ্ঞান সম্পূর্ণ হইল, বলা যায়।
যন্ত্রগুলি মানুষের স্থূলদেহে——বাহিরেই অবস্থিত। মন কিন্তু তাহা নহে, বুদ্ধিও নহে। হিন্দু দর্শনে উহাদের নাম সূক্ষ্ম শরীর, খ্রীষ্টান ধর্মশাস্ত্রে আধ্যাত্মিক শরীর। উহা এই শরীর হইতে অনেক সূক্ষ্ম বটে, কিন্তু উহা আত্মা নহে। আত্মা এই সকলের অতীত। স্থূল শরীর অল্প দিনেই ধ্বংস হইয়া যায়—খুব সামান্য কারণে উহার ভিতরে গোলযোগ ঘটে এবং উহা ধ্বংস হইয়া যাইতে পারে। সূক্ষ্ম শরীর এত সহজে নষ্ট হয় না, কিন্তু উহাও কখন সবল, কখন বা দুর্বল হয়। আমরা দেখিতে পাই—বৃদ্ধ লোকের মনে তত বল থাকে না , আবার শরীর সবল থাকিলে মনও সবল থাকে, নানাবিধ ঔষধ মনের উপর কার্য করে, বাহিরের সকল বস্তুই মনের উপর কার্য করে, আবার মনও বাহ্য জগতের উপর কার্য করিয়া থাকে। শরীরের যেমন উন্নতি-অবনতি আছে, মনেরও তেমনি আছে; অতএব মন কখনও আত্মা হইতে পারে না। কারণ আত্মার ক্ষয় বা অধঃপতন নাই। আমরা কিভাবে উহা জানিতে পারি? কি করিয়া আমরা জানিতে পারি যে, মনের পশ্চাতে আরও কিছু আছে? কারণ স্বপ্রকাশ জ্ঞান কখন জড়ের ধর্ম হইতে পারে না। এমন কোন জড় বস্তু দেখা যায় না,চৈতন্য যাহার স্বরূপ।অচেতন জড় পদার্থ কখন নিজেকে নিজে প্রকাশ করিতে পারে না। জ্ঞানই সমুদয় জড়কে প্রকাশ করে। এই যে সম্মুখে হল (hall) দেখিতেছ, জ্ঞানই ইহার মূল বলিতে হইবে, কারণ কোন না কোন জ্ঞানের সহায়তা ছাড়া উহার অস্তিত্বই জানা যাইত না। এই শরীর স্বপ্রকাশ নহে। যদি তাহা হইত, তবে মৃত ব্যক্তির দেহও স্বপ্রকাশ হইত। মন বা আধ্যাত্মিক শরীরও স্বপ্রকাশ হইতে পারে না, উহা চৈতন্যস্বরূপ নহে। যাহা স্বপ্রকাশ, তাহার কখনও ক্ষয় হয় না। যাহা অপরের আলোকে আলোকিত, তাহার আলোক কখন থাকে, কখন থাকে না। কিন্তু যাহা স্বয়ং আলোকস্বরূপ, তাহার আলোকের আবির্ভাব-তিরোভাব, হ্রাস-বৃদ্ধি আবার কি? আমরা দেখিতে পাই, চন্দ্রের ক্ষয় হয়, আবার উহার কলাবৃদ্ধি হইতে থাকে—তাহার কারণ উহা সূর্যের আলোকে আলোকিত । যদি অগ্নিতে লৌহপিণ্ড ফেলিয়া দেওয়া যায়, আর যদি উহাকে লোহিত-তপ্ত করা যায়, তবে উহা আলোক বিকিরণ করিতে থাকিবে, কিন্তু ঐ আলোক অপরের বলিয়া উহা চলিয়া যাইবে। অতএব ক্ষয় কেবল সেই আলোকেই সম্ভব, যাহা অপরের নিকট হইতে গৃহীত, যাহা স্বপ্রকাশ তাহাতে নহে।
আমরা দেখিলাম এই স্থূলদেহ স্বপ্রকাশ নহে, উহা নিজেকে নিজে জানিতে পারে না। মনও নিজেকে নিজে জানিতে পারে না। কেন? কারণ মনের শক্তির হ্রাস-বৃদ্ধি আছে, কখন উহা সবল, আবার কখন দুর্বল হয়; বাহ্য সকল বস্তুই উহার উপর কার্য করিয়া উহাকে সবল বা দুর্বল করিতে পারে। অতএব মনের মধ্য দিয়া যে আলোক আসিতেছে, তাহা মনের নিজের নহে। তবে ঐ আলো কাহার? উহা অবশ্যই এমন কাহারও যাহার পক্ষে উহা নিজস্বরূপ, যাহা অপর আলোকের প্রতিফলন নহে, কিন্তু যাহা স্বয়ং আলোস্বরূপ; অতএব সেই আলোক বা জ্ঞান সেই পুরুষের স্বরূপ বলিয়া তাহার কখন নাশ বা ক্ষয় হয় না, উহা কখন প্রবল বা কখন মৃদু হইতে পারে না। উহা স্বপ্রকাশ—উহা আলোকস্বরূপ। আত্মা জানেন—তাহা নহে, আত্মা জ্ঞান স্বরূপ;আত্মার অস্তিত্ব আছে -তাহা নহে,আত্মা অস্তিত্বস্বরূপ; আত্মা সুখী–তাহা নহে, আত্মা সুখস্বরূপ। যে সুখী, তাহার সুখ অপর কাহারও নিকট প্রাপ্ত। যাহার জ্ঞান আছে, সে অপর কাহারও নিকট জ্ঞানলাভ করিয়াছে। যাহার অস্তিত্ব আছে, তাহার সেই অস্তিত্ব অপর কাহারও অস্তিত্বের উপর নির্ভর করিতেছে, উহা অপর কাহারও অস্তিত্বের প্রতিফলন। যেখানেই গুণ ও গুনীর ভেদ আছে, সেখানেই বুঝিতে হইবে সেই গুণগুলি গুনীর উপর প্রতিফলিত হইয়াছে। কিন্তু জ্ঞান, অস্তিত্ব, বা আনন্দ—এগুলি আত্মার ধর্ম নহে, আত্মার স্বরূপ।
পুনরায় প্রশ্ন হইতে পারে আমরা এ-কথা স্বীকার করিয়া লইব কেন? কেন আমরা স্বীকার করিব যে, আনন্দ-অস্তিত্ব-জ্ঞান আত্মার স্বরূপ, অপরের নিকট হইতে প্রাপ্ত নহে? ইহার উত্তর এই—আমরা পূর্বেই দেখিয়াছি, শরীরের প্রকাশ মনের প্রকাশে; যতক্ষন মন থাকে ততক্ষন উহার প্রকাশ, মন চলিয়া গেলে আর দেহের প্রকাশ থাকে না। চক্ষু হইতে মন চলিয়া গেলে আমি তোমার দিকে চাহিয়া থাকিতে পারি, কিন্তু তোমায় দেখিতে পাইব না, অথবা শ্রবণেন্দ্রিয় হইতে মন চলিয়া গেলে তোমাদের কথা মোটেই শুনিতে পাইব না। সকল ইন্দ্রিয় সম্বন্ধেই এইরূপ। সুতরাং আমরা দেখিতে পাইলাম শরীরের প্রকাশ—মনের প্রকাশে। আবার মন সম্বন্ধেও সেইরূপ। বর্হিজগতের সকল বস্তুই উহার উপর কার্য করিতেছে, সামান্য কারণেই উহার পরিবর্তন ঘটিতে পারে, মস্তিষ্কের মধ্যে একটু সামান্য গোলযোগ হইলেই উহার পরিবর্তন ঘটিতে পারে। অতএব মনও স্বপ্রকাশ হইতে পারে না, কারণ আমরা সমুদয় প্রকৃতিতেই দেখিতেছি, যাহা কোন বস্তুর স্বরূপ, তাহার পরিবর্তন হইতে পারে না। কেবল যাহা অপর বস্তুর ধর্ম, যাহা অপর বস্তু হইতে গৃহীত, তাহারই পরিবর্তন হয়। কিন্তু প্রশ্ন হইতে পারে-আত্মার প্রকাশ,আত্মার জ্ঞান, আত্মার আনন্দও ঐরূপ অপরের নিকট হইতে গৃহীত বলিয়া স্বীকার কর না কেন? এইরূপ স্বীকার করিলে দোষ এই হইবে যে, এরূপ স্বীকৃতির কোন অন্ত পাওয়া যাইবে না। আবার প্রশ্ন উঠিবে, সে কাহার নিকট হইতে আলোক পাইল? যদি বলো, অপর কোন আত্মা হইতে, তবে আবার প্রশ্ন উঠিবে, সেই বা কোথা হইতে আলোক পাইল? অতএব অবশেষে আমাদিগকে এমন এক জায়গায় আসিতে হইবে, যাহার আলো অপরের নয়, নিজের। অতএব ন্যায়সঙ্গত সিদ্ধান্ত এই—যেখানে প্রথমেই স্বপ্রকাশত্ব দেখিতে পাওয়া যাইবে, সেইখানেই থামা, এবং আর অগ্রসর না হওয়া।
অতএব আমরা দেখিলাম, মানুষের প্রথমতঃ এই স্থূল দেহ, তারপর সূক্ষ্ম শরীর, উহার পশ্চাতে মানুষের প্রকৃত স্বরূপ—আত্মা রহিয়াছেন; আমরা দেখিয়াছি, স্থূল দেহের সমুদয় গুণ ও শক্তি মন হইতে গৃহীত—মন আবার আত্মার আলোকে আলোকিত।
আত্মার স্বরূপ সম্বন্ধে আবার নানা প্রশ্ন উঠিতেছে। আত্মা স্বপ্রকাশ, সচ্চিদানন্দই আত্মার স্বরূপ—এই যুক্তি হইতে যদি আত্মার অস্তিত্ব স্বীকার করিতে হয়, তবে স্বভাবতই প্রমাণিত হইতেছে যে, উহা শূন্য হইতে সৃষ্ট হইতে পারে না। যাহা স্বপ্রকাশ-অপর বস্তু-নিরপেক্ষ,তাহা কখন শূন্য হইতে উৎপন্ন হইতে পারে না।আমরা দেখিয়াছি, এই জড়জগৎও শূন্য হইতে হয় নাই—আত্মা তো দূরের কথা। অতএব সর্বদাই উহার অস্তিত্ব ছিল। এমন সময় কখন ছিল না, যখন উহার অস্তিত্ব ছিল না; কারণ যদি বলো—এক সময়ে আত্মার অস্তিত্ব ছিল না, তবে ‘কাল’ কোথায় অবস্থিত ছিল? কাল তো আত্মার মধ্যেই অবস্থিত। যখন আত্মার শক্তি মনের উপর প্রতিফলিত হয়, আর মন চিন্তা করে, তখনই কালের উৎপত্তি। সুতরাং যখন আত্মা ছিল না, তখন চিন্তাও ছিল না, আর চিন্তা না থাকিলে কালও থাকিতে পারে না। অতএব যখন কাল আত্মাতে রহিয়াছে, তখন আত্মা যে কালে অবস্থিত, ইহা কি করিয়া বলা যাইতে পারে? আত্মার জন্মও নাই, মৃত্যুও নাই, উহা কেবল বিভিন্ন সোপানের মধ্য দিয়া অগ্রসর হইতেছে মাত্র। উহা ধীরে ধীরে নিজেকে নিম্ন অবস্থা হইতে উচ্চ ভাবে প্রকাশ করিতেছে। আত্মা মনের ভিতর দিয়া শরীরের উপর কার্য করিয়া নিজ মহিমা বিকাশ করিতেছে, এবং শরীরের দ্বারা বাহ্য জগৎ গ্রহণ করিয়া উহাকে বুঝিতেছে। উহা একটি শরীর গ্রহণ করিয়া উহাকে ব্যবহার করিতেছে, এবং যখন সেই শরীরের দ্বারা আর কোন কাজ হইবার সম্ভাবনা থাকে না, তখন আত্মা আর এক শরীর গ্রহণ করে।
এখন আবার আত্মার পুনর্জন্ম১ সম্বন্ধে প্রশ্ন দেখা দিল। অনেক সময় লোকে এই পুনর্জন্মের কথা শুনিলেই ভয় পায়, আর লোকের কুসংস্কার এত প্রবল যে, চিন্তাশীল লোকেও বিশ্বাস করিবে–আমরা শূন্য হইতে উৎপন্ন হইয়াছি, তারপর আবার চমৎকার যুক্তির সহিত সিদ্ধান্ত স্থাপন করিতে চেষ্টা করিবে, যদিও আমরা শূন্য হইতে উৎপন্ন,পরে আমরা অনন্তকাল ধরিয়া থাকিব।যাহারা শূন্য হইতে আসিয়াছে, তাহারা অবশ্যই শূন্যে যাইবে। তুমি আমি বা উপস্থিত কেহই শূন্য হইতে আসে নাই, সুতরাং শূন্যে যাইবে না। আমরা অনন্তকাল ধরিয়া রহিয়াছি এবং থাকিব, আর ব্রহ্মাণ্ডে এমন কোন শক্তি নাই, যাহা আমাদিগকে শূন্যে পরিণত করিতে পারে। এই পূনর্জন্মবাদে ভয় পাইবার কোন কারণ নাই, উহাই মানুষের নৈতিক উন্নতির প্রধান সহায়ক। চিন্তাশীল ব্যক্তিদের ইহাই যুক্তিসঙ্গত সিদ্ধান্ত। যদি পরে তোমার অনন্তকাল অস্তিত্ব সম্ভব হয়, তবে ইহাও সত্য যে, তুমি অনন্তকাল ধরিয়া ছিলে; অন্য কোনরূপ হইতে পারে না। এই মতের বিরুদ্ধে যে-সকল আপত্তি শুনিতে পাওয়া যায়, সেগুলি নিরাকরণ করিতে চেষ্টা করিতেছি। যদিও তোমরা অনেকে এই আপত্তি-গুলিকে অকিঞ্চিৎকর বোধ করিবে, তথাপি ঐগুলির উত্তর দিতে হইবে, কারণ কখন কখন আমরা দেখিতে পাই, মহাচিন্তাশীল ব্যক্তিও অতি মূর্খোচিত কথা বলিয়া থাকে। লোকে যে বলিয়া থাকে, ‘এমন অসঙ্গত মতই নাই, যাহা সমর্থন করিবার জন্য কোন-না-কোন দার্শনিক অগ্রসর না হন’—এ-কথা অতি সত্য। এ-বিষয়ে প্রথম আপত্তি এই—জন্মান্তরের কথা আমাদের স্মরণ থাকে না কেন? আমরা কি এই জন্মেরই অতীত ঘটনা সব স্মরণ করিতে পারি? তোমাদের মধ্যে কয়জনের শৈশবকালের কথা মনে পড়ে? শৈশবকালের কথা তোমাদের কাহারও মনে পড়ে না; আর যদি স্মৃতি-শক্তির উপর তোমার অস্তিত্ব নির্ভর করে, তবে তোমার মনে নাই বলিয়া ঐ শৈশবাবস্থায় তোমার অস্তিত্বও ছিল না—এ কথা বলিতে হইবে। আমরা যদি স্মরণ করিতে পারি, তবেই পূর্বজন্মের অস্তিত্ব স্বীকার করিব, ইহা বলা চরম নির্বুদ্ধিতা। আমাদের পূর্বজন্মের কথা যে স্মরণ থাকিবেই—ইহার কি কোন হেতু আছে? সেই মস্তিষ্ক নাই , তাহা একেবারে ধ্বংস হইয়া গিয়াছে, এবং নূতন একটি মস্তিষ্ক হইয়াছে। অতীতে অর্জিত সংস্কারগুলির সমষ্টি আমাদের মস্তিষ্কে আসিয়াছে—উহা লইয়া মন এই শরীরে বাস করিতেছে।
এইক্ষণে আমি ঠিক যেমনটি আছি, তাহা আমার অনন্ত অতীতের কর্ম-ফলস্বরূপ। আর সেই সমগ্র অতীত কে স্মরণ করারই বা আমার কি প্রয়োজন? কুসংষ্কারের এমনি প্রভাব যে, যাহারা পুনর্জন্মবাদ অস্বীকার করে, তাহারাই আবার বিশ্বাস করে, এক সময়ে আমরা বানর ছিলাম; কিন্তু তাহাদের বানরজন্ম কেন স্মরণ হয় না—এ বিষয়ে অনুসন্ধান করিতেও ভরসা করে না। যখন শুনি, কোন প্রাচীন ঋষি বা সাধু সত্য প্রত্যক্ষ করিয়াছেন, আমরা আধুনিকেরা তাঁহাকে নির্বোধ বলিয়া থাকি; কিন্তু যদি কেহ বলে, হাক্সলি ইহা বলিয়াছেন, টিণ্ডাল ইহা বলিয়াছেন, তখন আমরা বলি উহা অবশ্যই সত্য হইবে-অমনি আমরা তাহা মানিয়া লই। প্রাচীন কুসংস্কারের পরিবর্তে আমরা আধুনিক কুসংস্কার আনিয়াছি, ধর্মের প্রাচীন পোপের পরিবর্তে আমরা বিজ্ঞানের আধুনিক পোপ বসাইয়াছি। অতএব আমরা দেখিলাম, স্মৃতি সম্বন্ধে যে আপত্তি, তাহা সত্য নহে। আর এই পুনর্জন্ম সম্বন্ধে যে গুরুতর আপত্তি উঠিয়া থাকে, তাহার মধ্যে ইহাই একমাত্র আপত্তি, যাহা বিজ্ঞ লোকে আলোচনা করিতে পারেন। যদিও দেখিয়াছি, পুনর্জন্মবাদ প্রমাণ করিতে হইলে তাহার সঙ্গে সঙ্গে স্মৃতিও থাকিবে–ইহা প্রমাণ করার কোন প্রয়োজন নাই, তথাপি আমরা ইহা দৃঢ়ভাবে বলিতে পারি যে, অনেকের এরূপ স্মৃতি দেখা যায়, আর তোমরাও সকলে যে-জন্মে মুক্তিলাভ করিবে, সেই জন্মে এই স্মৃতি লাভ করিবে। কেবল তখনই জানিতে পারিবে–জগৎ স্বপ্নমাত্র, তখনই অন্তরের অন্তরে বুঝিবে যে, আমরা এই জগতে অভিনেতামাত্র, আর এই জগৎ রঙ্গভূমি, তখনই প্রবলবেগে অনাসক্তি ভাব তোমাদের ভিতর আসিবে, তখনই যত ভোগতৃষ্ণা-জীবনের উপর এই তীব্র আগ্রহ –এই সংসার চিরকালের জন্য চলিয়া যাইবে। তখন তুমি স্পষ্টই দেখিবে, তুমি জগতে কতবার আসিয়াছ, কত লক্ষ লক্ষ বার তুমি পিতামাতা পুত্রকন্যা স্বামী-স্ত্রী বন্ধু ঐশ্বর্য শক্তি লইয়া কাটাইয়াছ। কতবার এই-সকল আসিয়াছে, কতবার চলিয়া গিয়াছে। কতবার তুমি সংসার-তরঙ্গের উচ্চ চূড়ায় উঠিয়াছ, আবার কতবার তুমি নৈরাশ্যের গভীর গহ্বরে নিমজ্জিত হইয়াছ। যখন স্মৃতি তোমার নিকট এই-সকল আনিয়া দিবে, তখনই কেবল তুমি বীরের ন্যায় দাঁড়াইবে, এবং জগৎ তোমায় ভ্রূভঙ্গী করিলে তুমি শুধু হাসিবে। তখনই তুমি বীরের ন্যায় দাঁড়াইয়া বলিতে পারিবে—’মৃত্যু, তোমাকেও আমি গ্রাহ্য করি না, তুমি আমাকে কি ভয় দেখাও?’ যখন তুমি জানিতে পারিবে, তোমার উপর মৃত্যুর কোন শক্তি নাই, তখনই তুমি মৃত্যুকে জয় করিতে পারিবে। আর সকলেই কালে এই অবস্থা লাভ করিবে।
আত্মার যে পুনর্জন্ম হয়, তাহার কি কোন যুক্তিযুক্ত প্রমাণ আছে? এতক্ষণ আমরা কেবল শঙ্কানিরাস করিতেছিলাম, দেখাইতেছিলাম, পুনর্জন্মবাদ খণ্ডন করিবার যুক্তিগুলি অকিঞ্চিৎকর। এখন পুনর্জন্মের সপক্ষে যে-সব যুক্তি আছে, তাহা বিবৃত হইতেছে। পুনর্জন্মবাদ ব্যতীত জ্ঞান অসম্ভব। মনে কর, আমি রাস্তায় গিয়া একটা কুকুরকে দেখিলাম। উহাকে কুকুর বলিয়া জানিলাম কিরূপে? যখনই উহার ছাপ আমার মনের উপর পড়িল, উহার সহিত মনের ভিতরকার পূর্বসংস্কারগুলিকে মিলাইতে লাগিলাম। দেখিলাম—আমার যাবতীয় পূর্বসংস্কার স্তরে স্তরে সাজানো রহিয়াছে। নূতন কোন বিষয় আসিবামাত্রই আমি ঐটিকে সেই প্রাচীন সংস্কারগুলির সহিত মিলাইয়া দেখি। যখনই দেখি, সেই ভাবের আর কতকগুলি সংস্কার রহিয়াছে, অমনি আমি উহাদিগকে তাহাদের সহিত মিলাই, তখনই আমার তৃপ্তি আসে। আমি তখন উহাকে কুকুর বলিয়া জানিতে পারি, কারণ উহা পূর্বাবস্থিত কতকগুলি সংস্কারের সহিত মেলে। যখন উহার তুল্য সংস্কার আমার ভিতরে দেখিতে পাই না, তখনই আমার অতৃপ্তি আসে, এইরূপ হইলে উহাকে ‘অজ্ঞান’ বলে। আর তৃপ্তি হইলেই উহাকে ‘জ্ঞান’ বলে। যখন একটি আপেল পড়িল, তখনই মানুষের মধ্যে অতৃপ্তি আসিল। তারপর মানুষ ক্রমশঃ ঐরূপ কতকগুলি ঘটনার মধ্যে একটি শ্রেণীবিভাগ দেখিতে পাইল। কি সেই শ্রেণী? সকল আপেলই পড়িয়া থাকে। মানুষ উহার ‘মাধ্যাকর্ষণ’ সংজ্ঞা দিল। অতএব আমরা দেখিলাম—পূর্বে কতকগুলি অনুভূতি না থাকিলে নূতন অনুভূতি অসম্ভব, কারণ ঐ নূতন অনুভূতির সহিত মিলাইবার আর কিছু পাওয়া যাইবে না। অতএব কতিপয় ইওরোপীয় দার্শনিকের মতে ‘বালক ভুমিষ্ঠ হইবার সময় সংস্কারশূন্য মন লইয়া আসে’—এ-কথা যদি সত্য হয়, তবে এরূপ বালক কখনও কিছুমাত্র মানসিক শক্তি অর্জন করিতে পারিবে না, কারণ তাহার অনুভূতিগুলি মিলাইবার জন্য আর কোন সংস্কার নাই। অতএব দেখিলাম, এই পূর্বসঞ্চিত জ্ঞানভাণ্ডার ব্যতীত নূতন কোন জ্ঞান হওয়া অসম্ভব। বাস্তবিক আমাদের সকলকেই পূর্বসঞ্চিত জ্ঞানভাণ্ডার সঙ্গে করিয়া লইয়া আসিতে হইয়াছে। অভিজ্ঞতা হইতে জ্ঞানলাভ হয়, আর কোন পথ নাই। যদি আমরা এখানে ঐ জ্ঞান লাভ না করিয়া থাকি, অবশ্যই আমারা অপর কোথাও উহা লাভ করিয়া থাকিব। মৃত্যুভয় সর্বত্রই দেখিতে পাই কেন? একটি কুক্কুট এইমাত্র ডিম হইতে বাহির হইয়াছে—একটি বাজপাখি আসিল, অমনি সে ভয়ে মায়ের কাছে পালাইয়া গেল। কোথা হইতে ঐ কুক্কুটশাবকটি শিখিল যে, কুক্কুট বাজের ভক্ষ্য? ইহার একটি পুরাতন ব্যাখ্যা আছে, কিন্তু উহাকে ব্যাখ্যাই বলা যাইতে পারে না। উহাকে স্বাভাবিক সংস্কার(instinct) বলা হয়। যে ক্ষুদ্র কুক্কুটটি এইমাত্র ডিম্ব হইতে বাহির হইয়াছে, তাহার এরূপ মরণভীতি আসে কোথা হইতে? ডিম্ব হইতে সদ্য বহির্গত হংস জলের নিকট আসিলেই, জলে ঝাঁপ দিয়া পড়ে এবং সাঁতার দিতে থাকে কেন? উহা কখন সাঁতার দেয় নাই, অথবা কাহাকেও সাঁতার দিতে দেখে নাই। লোকে বলে উহা ‘স্বাভাবিক জ্ঞান’। ‘স্বাভাবিক জ্ঞান’ বলিলে একটা খুব লম্বা-চওড়া কথা বলা হইল বটে, কিন্তু উহা আমাদিগকে নূতন কিছুই শিখাইল না।
এই স্বাভাবিক জ্ঞান কি, তাহা আলোচনা করা যাক। আমাদের নিজেদের ভিতরই শত প্রকারের স্বাভাবিক জ্ঞান রহিয়াছে। মনে কর, একজন পিয়ানো বাজাইতে শিখিতে আরম্ভ করিল। প্রথমে তাহাকে প্রত্যেক পরদার দিকে নজর রাখিয়া তবে উহার উপর অঙ্গুলি প্রয়োগ করিতে হয়; কিন্তু অনেক মাস, অনেক বৎসর অভ্যাস করিতে করিতে উহা স্বাভাবিক হইয়া দাঁড়ায়, আপনা-আপনি হইতে থাকে। এক সময়ে ইহাতে জ্ঞানপূর্বক ইচ্ছার প্রয়োজন হইত, এখন আর উহার প্রয়োজন থাকে না, জ্ঞানপূর্বক ইচ্ছা ব্যতীতই উহা নিষ্পন্ন হইতে পারে, ইহাকেই বলে স্বাভাবিক জ্ঞান। প্রথমে ইহা ইচ্ছাসহ কৃত ছিল, পরিশেষে উহাতে আর ইচ্ছার প্রয়োজন রহিল না। কিন্তু স্বাভাবিক জ্ঞানের তত্ত্ব এখনও সম্পূর্ণ বলা হয় নাই, অর্ধেক কথা বলিতে এখনও বাকি আছে। যে-সকল কার্য এখন আমাদের স্বাভাবিক, তাহার প্রায় সবগুলিকেই আমাদের ইচ্ছার অধীনে আনা যাইতে পারে। শরীরের প্রত্যেক পেশীই আমাদের অধীনে আনা যাইতে পারে। এ বিষয়টি আজকাল সাধারণের ভালভাবেই জানা আছে। অতএব অন্বয়ী ও ব্যতিরেকী—দুই উপায়েই প্রমাণিত হইল যে, যাহাকে আমরা স্বাভাবিক জ্ঞান বলি, তাহা ইচ্ছাকৃত কার্যের অবনত ভাব মাত্র। অতএব যখন সমুদয় প্রকৃতিতেই এক নিয়ম রাজত্ব করিতেছে, তখন সমগ্র সৃষ্টিতে ‘উপমান’-প্রমাণের প্রয়োগ করিয়া অবশ্যই সিদ্ধান্ত করিতে পারা যায়, নিম্নতর প্রাণীতে এবং মানুষে যাহা স্বাভাবিক জ্ঞান বলিয়া প্রতীয়মান হয়, তাহা ইচ্ছার অবনত ভাবমাত্র।
আমরা বহির্জগতে যে নিয়ম পাইয়াছিলাম, অর্থাৎ প্রত্যেক ক্রমবিকাশ-প্রক্রিয়ার পূর্বেই একটি ক্রমসঙ্কোচ-প্রক্রিয়া বর্তমান, আর ক্রমসঙ্কোচ হইলেই উহার সঙ্গে ক্রমবিকাশও থাকিবে—এই নিয়ম খাটাইয়া আমরা স্বাভাবিক জ্ঞানের কি ব্যাখ্যা লাভ করি? স্বাভাবিক জ্ঞান তাহা হইলে বিচার-পূর্বক কার্যের ক্রমসঙ্কোচভাব হইয়া দাঁড়াইল। অতএব মানুষে বা পশুতে যাহাকে স্বাভাবিক জ্ঞান বলি, তাহা অবশ্যই পূর্ববর্তী ইচ্ছাকৃত কার্যের ক্রমসঙ্কোচভাব হইবে। আর ইচ্ছাকৃত কার্য বলিলেই পূর্বে আমরা অভিজ্ঞতা লাভ করিয়াছিলাম, স্বীকার করা হইল। পূর্বকৃত কার্য হইতে ঐ সংস্কার আসিয়াছিল, আর ঐ সংস্কার এখনও বর্তমান। এই মৃত্যুভীতি, এই জন্মিবামাত্র জলে সন্তরণ আর মনুষ্যের মধ্যে যাহা কিছু অনিচ্ছাকৃত স্বাভাবিক কার্য রহিয়াছে, সবই পূর্ব কার্য ও পূর্ব অনুভূতির ফল—এখন স্বাভাবিক জ্ঞানরূপে পরিণত হইয়াছে।
এতক্ষণে আমরা বিচারে বেশ অগ্রসর হইলাম, আর এতদূর পর্যন্ত আধুনিক বিজ্ঞানও আমাদের সহায়। আধুনিক বিজ্ঞানবিদেরা ক্রমে ক্রমে প্রাচীন ঋষিদের সহিত একমত হইতেছেন, এবং তাঁহাদের যতটুকু প্রাচীন ঋষিদের সঙ্গে মিলে ততটুকুতে কোন গোল নাই। বৈজ্ঞানিকেরা স্বীকার করেন যে, প্রত্যেক মানুষ এবং প্রত্যেক জীবজন্তুই কতকগুলি অনুভূতির সমষ্টি লইয়া জন্মগ্রহণ করে; তাঁহারা ইহাও মানেন যে, মনের এই-সকল কার্য পূর্ব অনুভূতির ফল। কিন্তু তাঁহারা এইখানে আর এক শঙ্কা তুলিয়া থাকেন।
তাঁহারা বলেন, ঐ অনুভূতিগুলি যে আত্মার, ইহা বলিবার আবশ্যকতা কি? উহা কেবল শরীরেরই ধর্ম বলিলেই তো হয়। উহা ‘বংশানুক্রমিক সঞ্চার‍‍‌’ (Hereditary transmission) এ-কথা বলিলেই তো হয়। ইহাই শেষ প্রশ্ন। আমি যে-সকল সংস্কার লইয়া জন্মিয়াছি, তাহা আমার পূর্বপুরুষদের সঞ্চিত সংস্কার, ইহাই বলো না কেন? ক্ষুদ্র জীবাণু হইতে সর্বশ্রেষ্ঠ মনুষ্য পর্যন্ত সকলেরই কর্মসংস্কার আমার ভিতরে রহিয়াছে, কিন্তু উহা বংশানুক্রমিক সঞ্চারবশেই আমাতে আসিয়াছে। এইরূপ হইলে আর কি গোল থাকে? এই প্রশ্নটি অতি সুন্দর। আমরা এই বংশানুক্রমিক সঞ্চারের কতক অংশ মানিয়াও থাকি। কতটুকু মানি? মানি কেবল এইটুকু যে উহা আমাদিগকে ভবিষ্যৎ শরীরের উপাদান প্রদান করে; আমরা আমাদের পূর্বকর্মের দ্বারা শরীর বিশেষ আশ্রয় করিয়া থাকি;আর যে-সকল পিতামাতা তাঁহাদের কার্যের দ্বারা ঐ আত্মাকে সন্তানরূপে পাইবার উপযুক্ত হইয়াছেন, তাঁহাদের নিকট হইতেই নূতন শরীরের উপাদান সংগৃহীত হয়।
বংশানুক্রমিক সঞ্চারবাদ বিনা প্রমাণেই একটি অদ্ভুত সিদ্ধান্ত স্বীকার করিয়া থাকে যে, মনের সংস্কাররাশির ছাপ জড়ে সঞ্চিত হইতে পারে। যখন আমি তোমার দিকে তাকাই, তখন আমার চিত্তহ্রদে একটি তরঙ্গ উঠে। ঐ তরঙ্গ চলিয়া যায়, কিন্তু সূক্ষ্ম তরঙ্গাকার থাকে। আমরা ইহা বুঝিতে পারি। শরীরের সংস্কার যে শরীরে থাকিতে পারে , তাহা আমরা বুঝি। কিন্তু শরীর যখন নষ্ট হয়, তখন মানসিক সংস্কার শরীরে বাস করে, ইহার প্রমাণ কি? কিসের দ্বারা ঐ সংস্কার সঞ্চারিত হয়? মনে কর, মনের প্রত্যেক সংস্কারের শরীরে বাস করা সম্ভব ; মনে কর , আদিম মানুষ হইতে আরম্ভ করিয়া বংশানুক্রমে সকল পূর্বপুরুষের সংস্কার আমার পিতার শরীরে রহিয়াছে এবং পিতার শরীর হইতে আমাতে আসিতেছে। কেমন করিয়া? তোমারা বলিবে—জীবাণু-কোষের (bio-plasmic cell) দ্বারা। কিন্তু কি করিয়া ইহা সম্ভব হইবে, কারণ পিতার শরীর তো সন্তানে সম্পূর্ণ আসে না? একই পিতামাতার অনেকগুলি সন্তানসন্ততি থাকিতে পারে। সুতরাং এই বংশানুক্রমিক সঞ্চার-বাদ স্বীকার করিলে, ইহাও স্বীকার করা অবশ্যম্ভাবী হইয়া পড়ে যে, পিতা-মাতা প্রত্যেক সন্তানের জন্মের সঙ্গে সঙ্গে তাঁহাদের নিজ মনোবৃত্তির কিঞ্চিদংশ হারাইবেন, কারণ তাঁহাদের মতে সঞ্চারক ও সঞ্চার্য এক অর্থাৎ ভৌতিক; আর যদি বলো, তাঁহাদের মনোবৃত্তিই সঞ্চারিত হয়, তবে বলিতে হয় প্রথম সন্তানের জন্মের পরই তাঁহাদের মন সম্পূর্ণরূপে শূন্য হইয়া যাইবে।
আবার যদি জীবাণুকোষে চিরকালের অনন্ত সংস্কারসমষ্টি থাকে, তবে জিজ্ঞাস্য এই, উহা কোথায় কিরূপেই বা থাকে? ইহা একটি অত্যন্ত অসম্ভব দৃষ্টিভঙ্গী। আর যতদিন না এই জড়বাদীরা প্রমাণ করিতে পারেন, কি করিয়া ঐ সংস্কার ঐ কোষে থাকিতে পারে, আর কোথায়ই বা থাকিতে পারে, এবং ‘মনোবৃত্তি শরীর-কোষে নিদ্রিত থাকে’, এই বাক্যেরই বা অর্থ কি, যতদিন না তাঁহারা বুঝাইতে পারেন, ততদিন তাঁহাদের সিদ্ধান্ত স্বীকার করিয়া লওয়া যাইতে পারে না। এ পর্যন্ত বেশ স্পষ্ট বুঝা গেল যে, এই সংস্কার মনেরই মধ্যে বাস করে, মনই জন্মজন্মান্তর গ্রহণ করিতে আসে; মনই আপন উপযোগী উপাদান গ্রহণ করে, আর যে মন বিশেষ প্রকার শরীর ধারণ করিবার উপযুক্ত কর্ম করিয়াছে, যতদিন পর্যন্ত না সে তাহা নির্মাণ করিবার উপযোগী উপাদান পাইতেছে, ততদিন তাহাকে অপেক্ষা করিতে হইবে। ইহা আমরা বুঝিতে পারি। অতএব আত্মার দেহ গঠনের উপযোগী উপাদান প্রস্তুত করা পর্যন্তই বংশানুক্রমিক সঞ্চারবাদ স্বীকার করা যাইতে পারে। আত্মা কিন্তু জন্মান্তর গ্রহণ করেন—শরীরের পর শরীর নির্মাণ করেন; আর আমরা যে-কোন চিন্তা করি, যে-কোন কার্য করি, তাহাই সূক্ষ্মভাবে থাকিয়া যায়, আবার সময় হইলেই উহারা স্থূল ব্যক্তভাব ধারণ করিতে উন্মুখ হয়।
আমার যাহা বক্তব্য, তাহা তোমাদিগকে আরও স্পষ্ট করিয়া বলিতেছি। যখনই আমি তোমাদের প্রতি দৃষ্টিপাত করি, তখনই আমার মনে একটি তরঙ্গ উঠে। উহা যেন চিত্তহ্রদের ভিতর ডুবিয়া যায়, ক্রমশঃ সূক্ষ্ম হইতে সূক্ষ্মতর হইতে থাকে, কিন্তু উহার একেবারে নাশ হয় না। যে-কোন মুহূর্তে স্মৃতিরূপ তরঙ্গাকারে উঠিতে প্রস্তুত হইয়া উহা মনের মধ্যেই বর্তমান থাকে। এইরূপেই এই সমুদয় সংস্কার সমষ্টি আমার মনেই রহিয়াছে, আর মৃত্যুকালে উহাদের সমষ্টি আমার সঙ্গেই বাহির হইয়া যায়। মনে কর, এই ঘরে একটি বল রহিয়াছে, আর আমরা প্রত্যেকেই হাতে একটি ছড়ি লইয়া সব দিক হইতে ইহাকে আঘাত করিতে আরম্ভ করিলাম; বলটি ঘরের এক ধার হইতে আর এক ধারে যাইতে লাগিল, দরজার কাছে পৌঁছিবামাত্র, উহা বাহিরে চলিয়া গেল। উহা কোন‍্ শক্তি লইয়া বাহিরে চলিয়া যায়?—যতগুলি ছড়ি মারা হইতেছিল, তাহাদের সমবেত শক্তি। উহার গতি কোন‍্ দিকে হইবে, তাহাও ঐ-সকলের সমবেত ফলে নির্ণীত হইবে। এইরূপ, শরীরের পতন হইলে আত্মার কোন‍্ দিকে গতি হইবে , তাহা কে নির্ণয় করে? ঐ আত্মা যে-সকল কার্য করিয়াছে, যে-সকল চিন্তা করিয়াছে, সেইগুলিই উহাকে কোন বিশেষ দিকে পরিচালিত করিবে। ঐ আত্মা নিজের মধ্যে ঐ-সকলের সংস্কার লইয়া গন্তব্যপথে অগ্রসর হইবে। যদি সমবেত কর্মফল এরূপ হয় যে, পুনর্বার ভোগের জন্য উহাকে একটি নূতন শরীর গড়িতে হইবে, তবে উহা এমন পিতা-মাতার নিকট যাইবে, যাহাদের নিকট হইতে সেই শরীরগঠনের উপযোগী উপাদান পাওয়া যাইতে পারে, আর সেই-সকল উপাদান লইয়া উহা একটি নূতন শরীর গ্রহণ করিবে। এইরূপে ঐ আত্মা দেহ হইতে দেহান্তরে যাইবে, কখন স্বর্গে যাইবে, আবার পৃথিবীতে আসিয়া মানব দেহ পরিগ্রহ করিবে; অথবা অন্য কোন উচ্চতর বা নিম্নতর জীবশরীর পরিগ্রহ করিবে। এইরূপে উহা অগ্রসর হইতে থাকিবে, যতদিন না উহার অভিজ্ঞতা অর্জন শেষ হয়, এবং পূর্বাস্থানে প্রত্যাবৃত্ত হয়। তখনই উহা নিজের স্বরূপ জানিতে পারে। তখন সমুদয় অজ্ঞান চলিয়া যায়, নিজের শক্তিসমূহ প্রকাশিত হয়। তিনি তখন সিদ্ধ হইয়া যান, পূর্ণতা লাভ করেন, তখন তাঁহার পক্ষে স্থূলশরীরের সাহায্যে কার্য করার কোন প্রয়োজন থাকে না—সূক্ষ্মশরীরের দ্বারা কার্য করিবারও প্রয়োজন থাকে না। তখন তিনি স্বয়ংজ্যোতিঃ ও মুক্ত হইয়া যান; তাঁহার আর জন্ম বা মৃত্যু কিছুই হয় না।
এ সম্বন্ধে আমরা এখন আর বিশেষ আলোচনা করিব না। পুনর্জন্মবাদ সম্বন্ধে আর একটি কথা বলিয়াই নিবৃত্ত হইব। এই মতই কেবল জীবাত্মার স্বাধীনতা ঘোষণা করে। এই মতই কেবল আমাদের সমুদয় দুর্বলতার দোষ অপর কাহারও ঘাড়ে চাপায় না। নিজের দোষ পরের ঘাড়ে চাপানোটা মানুষের সাধারণ দুর্বলতা।আমরা নিজেদের দোষ দেখিতে পাই না। চক্ষু কখনও নিজেকে দেখিতে পায় না। উহা অপর সকলের চক্ষু দেখিতে পায়। মানুষ আমরা, যতক্ষন অপরের ঘাড়ে দোষ চাপাইতে পারি, ততক্ষণ নিজেদের দুর্বলতা, নিজেদের ত্রুটি স্বীকার করিতে বড় নারাজ। মানুষ সাধারণতঃ নিজের দোষগুলি, নিজের ভ্রমত্রুটিগুলি তাহার প্রতিবেশীর ঘাড়ে চাপাইতে চায়, তাহা যদি না পরে, তবে ঈশ্বরের ঘাড়ে চাপায়; তাহা না হইলে অদৃষ্ট নামক একটি ভূতের কল্পনা করে এবং তাহারই উপর দোষারোপ করিয়া নিশ্চিন্ত হয়; কিন্তু কথা এই, ‘অদৃষ্ট’ নামে এই বস্তুটির স্বরূপ কি এবং উহা থাকেই বা কোথায়? আমরা তো যাহা বপন করি, তাহাই পাইয়া থাকি।
আমরাই আমাদের অদৃষ্টের নির্মাতা। আমাদের অদৃষ্ট মন্দ হইলে কাহাকেও দোষী করিতে পারা যায় না,আবার ভাল হইলে প্রশংসাও অপর কেহ পায় না। বাতাস সর্বদাই বহিতেছে। যে-সকল জাহাজের পাল খাটানো থাকে, সেইগুলিতেই বাতাস লাগে-তাহারাই পালভরে অগ্রসর হয়। যাহাদের পাল গুটানো থাকে, তাহাদিগের উপর বাতাস লাগে না। ইহা কি বায়ুর দোষ? আমরা যে কেহ সুখী, কেহ বা দুঃখী, ইহা কি সেই করুণাময় পিতার দোষ? তাঁহার কৃপা-বাতাস দিবারাত্র অবিরত বহিতেছে, তাঁহার দয়ার শেষ নাই। আমরাই আমাদের অদৃষ্টের রচয়িতা। তাঁহার সূর্য দুর্বল বলবান‍্—সকলের জন্য উদিত হয়। তাঁহার বায়ু সাধু পাপী—সকলের জন্যই সমানভাবে বহিতেছে। তিনি সকলের প্রভু, সকলের পিতা, দয়াময়, সমদর্শী। তোমরা কি মনে কর, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বস্তু আমরা যে দৃষ্টিতে দেখি, তিনিও সেই দৃষ্টিতে দেখিয়া থাকেন? ঈশ্বর সম্বন্ধে ইহা কি ক্ষুদ্র ধারণা! আমরা ছোট ছোট কুকুরছানার মতো এখানে জীবন-মরণ সংগ্রাম করিতেছি এবং নির্বোধের মতো মনে করিতেছি, ভগবানও ঐ বিষয়গুলি ঠিক তেমনি গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করিবেন। এই কুকুরছানার খেলার অর্থ কি, তাহা তিনি বিলক্ষণ জানেন। তাঁহার উপর সব দোষ চাপানো, তাঁহাকে দন্ড-পুরস্কারের কর্তা বলা নির্বুদ্ধিতামাত্র।তিনি কাহারও দণ্ডবিধান করেন না, কাহাকেও পুরস্কার দেন না। সর্ব দেশে, সর্ব কালে, সর্ব অবস্থায় সকলেই তাঁহার অনন্ত দয়া পাইবার অধিকারী। উহার ব্যবহার কিরূপে করিব, তাহা আমাদের উপর নির্ভর করিতেছে। মানুষ, ঈশ্বর বা অপর কাহারও উপর দোষারোপ করিও না। যখন নিজে কষ্ট পাও, তখন তাহার জন্য নিজেকেই দোষী বলিয়া স্থির কর এবং যাহাতে আপনার মঙ্গল হয়, তাহারই চেষ্টা কর।
পূর্বোক্ত সমস্যার ইহাই মীমাংসা। যাহারা নিজেদের দুঃখ-কষ্টের জন্য অপরের উপর দোষারোপ করে-দুঃখের বিষয়, এমন লোকের সংখ্যাই দিন দিন বাড়িতেছে—তাহারা সাধারণতঃ হতভাগ্য দুর্বলমস্তিষ্ক লোক; তাহারা নিজেদের কর্মদোষে এ অবস্থায় আসিয়া পড়িয়াছে, এখন তাহারা অন্যের উপর দোষারোপ করিতেছে, কিন্তু তাহাতে তাহাদের অবস্থার কিছুমাত্র পরিবর্তন হয় না, উহাতে তাহাদের কিছুমাত্র উপকার হয় না বরং অপরের ঘাড়ে দোষ চাপাইবার এই চেষ্টা তাহাদিগকে আরও দুর্বল করিয়া ফেলে। অতএব তোমার নিজের দোষের জন্য কাহাকেও নিন্দা করিও না, নিজের পায়ে নিজে দাঁড়াও, সমুদয় দায়িত্ব নিজ স্কন্ধে গ্রহণ কর। বলো, আমি যে কষ্ট ভোগ করিতেছি, তাহা আমারই কৃতকর্মের ফল। ইহা দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, আমার দ্বারাই এই দুঃখকষ্ট দূরীভূত হইবে। আমি যাহা সৃষ্টি করিয়াছি, আমিই তাহা ধ্বংস করিতে পারি; অপরে যাহা সৃষ্টি করিয়াছে, আমি কখনও তাহা ধ্বংস করিতে সমর্থ হইব না। অতএব উঠ, সাহসী হও, বীর্যবান‍্ হও। সব দায়িত্ব নিজের উপর গ্রহণ কর—জানিয়া রাখো, তুমিই তোমার অদৃষ্টের সৃষ্টিকর্তা। তুমি যে কিছু শক্তি বা সহায়তা চাও, তাহা তোমার ভিতরেই রহিয়াছে। অতএব তুমি এখন এই জ্ঞানবলে বলীয়ান‍্ হইয়া নিজের ভবিষ্যৎ গঠন করিতে থাকো। ‘গতস্য শোচনা নাস্তি’—অনন্ত ভবিষ্যৎ তোমার সম্মুখে। সর্বদা মনে রাখিও, তোমার প্রত্যেক চিন্তা, প্রত্যেক কার্যই সঞ্চিত থাকিবে; ইহাও স্মরণ রাখিবে, যেমন তোমার কৃত প্রত্যেক অসৎ চিন্তা ও অসৎ কার্য তোমার উপর ব্যাঘ্রের মতো লাফাইয়া পড়িতে উদ্যত, তেমনি তোমার সৎচিন্তা ও সৎকার্যগুলি সহস্র দেবতার শক্তি লইয়া তোমাকে রক্ষা করিতে প্রস্তুত।

——————-
১ গীতা, ৫/১৫
——————-