০১. মায়া

মায়া

(লণ্ডনে প্রদত্ত বক্তৃতা)

‘মায়া’ কথাটি আপনারা প্রায় সকলেই শুনিয়াছেন। সাধারণতঃ কল্পনা বা কুহক বা এইরূপ কোন অর্থে মায়া-শব্দ ব্যবহৃত হইয়া থাকে, কিন্তু তাহা উহার প্রকৃত অর্থ নহে। মায়াবাদ-রূপ অন্যতম স্তম্ভের উপর বেদান্ত স্থাপিত বলিয়া মায়ার যথার্থ তাৎপর্য বুঝা আবশ্যক। মায়াবাদ বুঝাইতে হইলে সহসা হৃদয়ঙ্গম না হইবার আশঙ্কা আছে, এজন্য আপনারা কিঞ্চিৎ ধৈর্যের সহিত শ্রবণ করিবেন, ইহাই আমার প্রার্থনা।

বৈদিক সাহিত্যে কুহক অর্থেই মায়া-শব্দের প্রয়োগ দেখা যায়। ইহাই মায়া-শব্দের প্রাচীনতম অর্থ। কিন্ত্তু তখন প্রকৃত মায়াবাদের অভ্যুদয় হয় নায়। বেদে আমরা এইরূপ বাক্য দেখিতে পাই, ‘ইন্দ্রো মায়াভিঃ পুরূরূপ ঈয়তে’-ইন্দ্র মায়া দ্বারা নানা রূপ ধারণ করিয়াছিলেন। এস্হলে মায়া-শব্দ ইন্দ্রজাল বা অনুরূপ কোন অর্থে ব্যবহৃত হইয়াছে। বেদের অনেক স্থলে মায়া-শব্দ ঐরূপ অর্থে প্রযুক্ত হইয়াছে দেখা যায়। অতঃপর কিছুদিনের জন্য মায়া-শব্দের ব্যবহার সম্পূর্ণ লুপ্ত হইয়া গেল। কিন্ত্তু এই অবকাশে ঐ শব্দ-প্রতিপাদ্য ভাব ক্রমশই পরিপুষ্ট হইতেছিল। পরবর্তী সময়ে দেখা যায়,প্রশ্ন করা হইতেছে, ‘আমরা জগতের গুপ্ত রহস্য জানিতে পারিনা কেন?’ ইহার এইরূপ গভীরভাবব্যজ্ঞক উত্তর পাওয়া যায়, ‘আমরা জল্পক, ইন্দ্রিয়সুখে পরিতৃপ্ত ও বাসনাপর বলিয়া এই সত্যকে নীহারাবৃত করিয়া রাখিয়াছি’-‘নীহারেণ প্রাবৃতা জল্প্যা চাসুতৃপ উকথশাসশ্চরংতি!’১ এস্থলে মায়া-শব্দ আদৌ ব্যবহৃত হয় নাই, কিন্তু উহাতে এই ভাবটি পরিস্ফুট হইতেছে-আমাদের অজ্ঞতার যে কারণ, তাহা সত্য এবং আমাদের মধ্যে কুজ্ঝটিকাবৎ বর্তমান।

অনেক পরবর্তী কালে অপেক্ষাকৃত আধুনিক উপনিষদে ‘মায়া’-শব্দের পুনরাবির্ভাব দেখা যায়। কিন্তু ইতোমধ্যে ইহার প্রভূত রূপান্তর ঘটিয়াছে, ইহার সহিত নূতন অর্থ সংযোজিত হইয়াছে. নানাবিধ মতবাদ প্রচারিত ও পুনরালোচিত হইয়াছে; অবশেষে মায়া-বিষয়ক ধারণা একটি নির্দিষ্ট ভাব পাইয়াছে। আমরা শ্বেতাশ্বতর উপনিষদে পাঠ করি, ‘মায়ান্তু প্রকৃতিং বিদ্যান্মায়িনন্তু মহেশ্বরম্ ।’-মায়া কেই প্রকৃতি বলিয়া জানিবে এবং মায়ীকে মহেশ্বর বলিয়া জানিবে।


১ ঋগ্বেদ-১০ম মন্ডল, ৮২ সূক্ত, ৭ম ঋক্

মহাত্মা শঙ্করাচার্যের পূর্ববর্তী দার্শনিকগণ এই মায়া-শব্দ বিভিন্ন অর্থে ব্যবহার করিয়াছিলেন । বোধ হয়, মায়া-শব্দ বা মায়াবাদ বৌদ্ধদিগের দ্বারাও কিছুটা পরিবর্তিত হইয়াছে। কিন্তু বৌদ্ধদিগের হস্তে ইহা অনেকটা বিজ্ঞানবাদে পরিণত হইয়াছিল এবং ‘মায়া’ কথাটি এইরূপ অর্থেই এখন সাধারণতঃ ব্যবহৃত হইতেছে। হিন্দু যখন বলেন, ‘জগৎ মায়াময়’, তখন সাধারন মানবের মনে এই ভাব উদিত হয় যে, জগৎ কল্পনামাত্র। বৌদ্ধ দার্শনিকদের এইরৃপ ব্যাখ্যার কিছু ভিত্তি আছে ; কারন এক শ্রেনীর দার্শনিক বাহ্যজগতের অস্তিত্বে আদৌ বিশ্বাস করিতেন না। কিন্তু বেদান্তোক্ত মায়ার শেষ পরিপূর্নরূপ বিজ্ঞানবাদ, বাস্তববাদ বা কোন মতবাদ নহে। আমরা কি এবং সর্বত্র কি প্রত্যক্ষ করিতেছি, এই সম্বন্ধে প্রকৃত ঘটনার ইহা সহজ বর্ণনামাত্র।

আপনাদিগকে পূর্বে বলিয়াছি, বেদ যাঁহাদের হৃদয়নিঃসৃত, তাঁহাদের চিন্তাশক্তি মূলতত্বের অনুধাবন ও আবিষ্কারেই অভিনিবিষ্ট ছিল। তাঁহারা যেন এই-সকল তত্বের বিস্তারিত অনুশীলন করিবার অবসর পান নাই এবং সেজন্য অপেক্ষাও করেন নাই।তাঁহারা বস্তুর গভীরতম প্রদেশে উপনীত হইতেই ব্যগ্র ছিলেন। এই জগতের অতীত কিছুই যেন তাঁহাদিগকে আকর্ষণ করিতেছিল, তাঁহারা যেন আর অপেক্ষা করিতে পারিতেছিলেন না। বস্তুতঃ উপনিষদের মধ্যে ইতস্ততোবিক্ষিপ্ত আধুনিক বিঞ্জানে আলোচিত বিশেষ সিদ্ধান্তগুলি অনেক সময়ে ভ্রমাত্মক হইলেও উহাদের মূলতত্ত্বগুলির সহিত বিঞ্জানের মূলতত্ত্বের কোন প্রভেদ নাই। একটি দৃষ্টান্ত দেখানো যাইতেছে। আধুনিক বিঞ্জানের ইথর (ether)বা আকাশ-বিষয়ক অভিনব তত্ত্ব উপনিষদের মধ্যে রহিয়াছে। এই আকাশতত্ত্ব আধুনিক বৈঞ্জানিকের ইথর অপেক্ষা সমধিক পরিপুষ্ট ভাবে বিদ্যমান। কিন্তু ইহা মূলতত্ত্বেই পর্যবসিত ছিল। তাঁহারা এই আকাশতত্ত্বের কার্য ব্যাখ্যা করিতে গিয়া অনেক ভ্রমে পতিত হইয়াছিলেন। জগতের যাবতীয় শক্তি যাহার বিভিন্ন বিকাশমাত্র, সেই সর্বব্যপী প্রাণ-তত্ত্ব বেদে-উহার ব্রাহ্মণাংশেই পাওয়া যায়। সংহিতার একটি দীর্ঘ মন্ত্রে সকল জীবনীশক্তির অভিব্যক্তি প্রাণের প্রশংসা আছে। এই প্রসঙ্গে আপনাদের মধ্যে কাহারও কাহারও হয়তো জানিয়া আনন্দ হইতে পারে যে, আধুনিক ইউরোপীয় বৈঞ্জানিকদিগের মটানুযায়ী এই পৃথিবীতে যে ভাবে জীব-সৃষ্টি হইল,তাহা বৈদিক দর্শনেও পাওয়া যায়। আপনারা সকলেই নিশ্চয় জানেন যে, জীব অন্য গ্রহাদি হইতে পৃথিবীতে আসিয়াছে-এইরূপ একটি মত প্রচলিত আছে। জীব চন্দ্রলোক হইতে পৃথিবীতে আসে-কোন কোন বৈদিক দার্শনিকের স্থির বিশ্বাস।


১ আমাদের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য সমুদয় জগৎ আমাদের মনেরই বিভিন্ন অনুভূতিমাত্র, উহাদের বাস্তব সত্তা নাই-এই মতকেই বিজ্ঞানবাদ বা Idealism বলে।
২ জগৎ আমাদের মনের অনুভতিমাত্র নহে উহার বাস্তব সত্তা আছে-নাই-এই মতকে বাস্তববাদ বা Realism বলে।

মূলতত্ত্ব সম্বন্ধে আমরা দেখিতে পাই, তাঁহারা সাধারন তত্ত্বসকল বিস্তৃতভাবে বিবৃত করিতে অতিশয় সাহস ও আশ্চর্য নির্ভীকতা দেখাইয়াছেন। বাহ্য জগৎ হইতে এই বিশ্ব-রহস্যের মর্মোদ্ঘাটনে যথাসম্ভব উত্তর তাঁহারা পাইয়াছিলেন। আর তাঁহারা ঐরূপে যে-সকল মূলতত্ত্ব আবিষ্কার করিয়াছিলেন, তাহাতে যখন জগৎ-রহস্যের প্রকৃত মীমাংসা হইল না, তখন আধুনিক বিঞ্জানের বিশেষ প্রমানসকল উহার মীমাংসায় যে অধিকতর সহায়তা করিবে না, ইহা বলা বা্হুল্য। যদি পুরাকালে আকাশ-তত্ত্ব বিশ্বরহস্য উদ্ঘাটনে অক্ষম হইয়া থাকে, তাহা হইলে উহার বিস্তারিত অনুশীলন দ্বারা আমরা সত্যের অভিমুখে অধিক অগ্রসর হইতে পারিব না। যদি এই সর্বব্যাপী প্রান-তত্ত্ব বিশ্বতত্ত্ব-নির্ণয়ে অক্ষম হইয়া থাকে, তাহা হইলে ইহার বিস্তারিত অনুশীলন নিরর্থক ; কারণ তাহা বিশ্বতত্ত্ব সম্বন্ধে কোন পরিবর্তন সাধন করিতে পারিবেনা। আমি বলিতে চাই তত্ত্বানুশীলনে হিন্দু দার্শনিকগণ আধুনিক পণ্ডিতদিগের ন্যায় এবং কখন কখন তাঁহাদের অপেক্ষাও অধিকতর সাহসী ছিলেন। তাঁহারা এমন অনেক ব্যাপক সাধারন নিয়ম আবিষ্কার করিয়া গিয়াছেন, যেগুলি আজও সম্পুর্ন নূতন; এবং তাঁহাদের গ্রন্থে এইরূপ অনেক মতবাদ আছে, যেগুলি বর্তমান বৈঞ্জানিকগণ আজও মতবাদরূপে চিন্তা করিতে পারেন নাই। দৃষ্টান্তস্বরূপ দেখানো যাইতে পারে যে, তাঁহারা কেবল আকাশ-তত্ত্বে উপনীত হইয়াই ক্ষান্ত হন নাই, আরও তাহার উচ্চে অধিকতর সূক্ষ্ম আকাশ প্রাপ্ত হইয়াছেন। কিন্তু ইহাতে কিছুরই মীমাংসা হইল না। এই-সকল তত্ত্ব রহস্যের উত্তরদানে অক্ষম।

ব্যর্থ জগদ্বিষয়ক জ্ঞান যতদূরই বিস্তৃত হউক না কেন, এ রহস্যের উত্তর দিতে পারিবে না। মনে হয় যেন কিছুটা জানিতে পারিয়াছি, কয়েক সহস্র বৎসর আরও অপেক্ষা করা যাউক, ইহার মীমাংসা হইবে। বেদান্তবাদী মনের সসীমতা নিঃসংশয়ে প্রমাণ করিয়াছেন, অতএব উত্তর দেন, ‘না, সীমার বহিরে যাইবার শক্তি আমাদের নাই। আমরা দেশ-কাল নিমিত্তের বা্হিরে যাইতে পারি না।’ যেরূপ কেহই স্বকীয় সত্তা অতিক্রম করিতে সক্ষম নহেন, সেইরূপ দেশ ও কালের নিয়ম যে-সীমা নির্দিষ্ট করিয়াছে, তাহা অতিক্রম করিবার সাধ্য কাহারও নাই। দেশ-কাল-নিমিত্ত-সম্বন্ধীয় রহস্য নির্নয় করিবার চেষ্টা বিফল, যেহেতু এরূপ চেষ্টা করিতে গেলে এই তিনেরই সত্তা স্বীকার করিতে হইবে। অতএব ইহা কিরূপে সম্ভব? জগতের অস্তিত্ব সম্বন্ধে তাহা হইলে কি বলা যায়? ‘এই জগতের অস্তিত্ব নাই।’ এ কথা বলার অর্থ কি? ইহার নিরপেক্ষ অস্তিত্ব নাই, ইহাই অর্থ। আমার,তোমার ও অপর সকলের মনের সম্বন্ধে ইহার আপেক্ষিক অস্তিত্ব আছে। আমরা পঞ্চেন্দ্রিয় দ্বারা এই জগৎকে যে রূপ প্রত্যক্ষ করিতেছি, যদি আমাদের আর একটি ইন্দ্রিয় অধিক থাকিত, তাহা হইলে আমরা ইহাতে আরও কিছু অভিনব প্রত্যক্ষ করিতাম এবং ততোধিক ইন্দ্রিয়সম্পন্ন হইলে ইহা আরও বিভিন্নরূপে প্রতীয়-মান হইত অতএব ইহার বাস্তব সত্তা নাই-সেই অপরিবর্তনীয় অচল অনন্ত সত্তা ইহার নাই। কিন্তু ইহাকে অস্তিত্বশূন্যও বলা যাইতে পারে না; কারন ইহা বিদ্যমান রহিয়াছে, এবং ইহার সহিত মিশ্রিত হইয়াই আমাদিগকে কাজ করিতে হইতেছে। ইহা সৎ ও অসতের মিশ্রন।

সুক্ষ্মতত্ত্ব হইতে আরহ্ম করিয়া জীবনের সাধারণ দৈনন্দিন স্থুলকার্য পর্যন্ত আলোচনা করিলে আমরা দেখিতে পাই যে, আমাদিগের সমস্ত জীবনই এই সৎ ও অসৎরূপ বিরুদ্ধভাবের সংমিশ্রন। আমাদের জ্ঞানলাভ-বিষয়েও এই বিরুদ্ধভাব বর্তমান। এইরূপ মনে হয়, যেন মানুষ জিঞ্জাসু হইলেই সমগ্র জ্ঞানলাভে সক্ষম হইবে; কিন্তু কয়েক পদ অগ্রসর না হইতেই এরূপ দুর্ভেদ্য প্রাচীর দেখিতে পায়, যাহা অতিক্রম করা তাহার সাধ্যাতীত। তাহার সমস্ত কার্য একটি বৃত্তের মধ্যে সীমাবদ্ধ; এবং সেই বৃত্তসীমা তাহার পক্ষে লঙ্ঘন করা সম্ভব নহে। তাহার অন্তরতম ও প্রিয়তম রহস্যসকল তাহাকে দিবারাত্র উত্তেজিত করিতেছে, মীমাংসার জন্য তাহাকে প্রতিদিন আহ্বান

করিতেছে, কিন্তু ইহার উত্তর দিতে সে অক্ষম; কারন নিজ বুদ্ধির সীমা অতিক্রম করিবার সাধ্য তাহার নাই। তথাপি বাসনা তাহার অন্তরে গভীর-ভঅবে নিহিত; কিন্তু এই-সকল উত্তেজনা দমন করাই যে মঙ্গলকর, তাহাও আমরা অবগত আছি।

আমাদের হৃৎপিণ্ডের প্রত্যক স্পন্দন প্রতি নিঃশ্বাসের সহিত আমাদিগকে স্বার্থপর হইতে বলিতেছে। অপরদিকে এক অমানুষী শক্তি বলিতেছে যে , শুধু নিস্বার্থতাই মঙ্গলকর। প্রত্যেক বালাক জন্ম হইতেই আশাবাদী ; সে সুখের স্বপ্নই দেখে। যৌবনে সে অধিকত্বর আশাবাদী হয়। মৃত্যু, পরাজয় বা অপমান বলিয়া কিছু আছে- কোন যুবকের পক্ষে ইহা বিশ্বাস করা কাঠিন। বৃদ্ধাবস্থা আসিল-জীবন ধ্বংসরাসিতে পরিনত হইল, সুখস্বপ্ন আকাশে বিলীন হইল ; বৃদ্ধ নিরাশাবাদ অবলম্বন করিয়াছেন। এইরূপে আমরা প্রকৃতি-তাড়িত হইয়া আশাশূন্য ও উদ্যেশ্যহীনের মতো এক প্রান্ত হইতে অপর প্রান্তে ধাবিত হইতেছি এ সম্বন্ধে ‘ললিতবিস্তরে’ লিখিত বুদ্ধচরিতের একটি প্রসিদ্থ সঙ্গিত মনে পড়ে। এইরূপ বর্নিত আছেঃ বুদ্ধদেব মানবের পরিত্রাতারূপে জন্মগ্রহন করেন, কিন্তু তিনি রাজবাটীর বিলাসিতায় আত্মবিস্মৃত হওয়ায় তাহাকে প্রবুদ্ধ করিবার জন্য দেবকন্যাগন একটি সঙ্গিত গাহিয়াছিলেন। সে সঙ্গিতের মর্মার্থ এই-‘আমরা স্রোতে ভাসিয়া যাইতেছি, অবিরত পরিবর্তন হইতেছি-নিবৃত্তি নাই, বিরাম নাই।’ এইরূপ আমাদের জীবন বিরাম জানে না-অবিরত চলিয়াছে। এখন উপায় কি ? যাঁহার অন্নপানের প্রাচুর্য আছে, তিনি আশাবাদী হইয়া বলেন, ‘ভীতি-উৎপাদক দুঃখের কথা কহিও না। সংসারের দুঃখ ও ক্লেশের কথা শুনাইও না।’ তাঁহার নিকট গিয়া বলো-‘সকলেই মঙ্গল।’ তিনি বলেন, ‘সত্যই আমি নিরাপদে আছি ; এই দেখ, কেমন সুন্দর অট্টালিকায় বাস করিতেছি! আমার শীতের ভয় নাই, অন্নের অভাব নাই! অতএব আমার সম্মুখে এ ভয়াবহ চিত্র আনিও না।’ কিন্তু অপরদিকে শীতে ও অনাহারে কত লোক মরিতেছে! যাও, তাহাদিগকে শিখাও যে সমস্তই মঙ্গল। কিন্তু ঐ যে একজন এ জীবনে ভীষণ ক্লেশ পাইয়াছে, সে তো সুখের সৌন্দর্যের মঙ্গলের কথা শুনিবে না। সে বলিতেছে, ‘সকলকেই ভয় দেখাও ; আমি যখন কাঁদিতেছি, তখন অপরে কেন হাসিবে? আমি সকলেই আমার সহিত কাঁদাইব ;

কারণ আমি দুঃখ-পীড়িত, সকলেই দুঃখ-পীড়িত হউক-ইহাতেই আমার শান্তি।’ এইরূপে আমরা আশাবাদ হইতে নিরাশাবাদে যাইতেছি। অতঃপর মৃত্যুরূপ ভয়াভহ ব্যাপার-সমগ্র সংসারেই মৃত্যুর মুখে যাইতেছে ; সকলেই মরিতেছে। আমাদিগের উন্নতি, বৃথা আড়ম্বরপূর্ণ কার্যকলাপ, সমাজসংস্কার, বিলাসিতা, ঐশ্বর্য, জ্ঞান-মৃত্যুই সকলের শেষ গতি। একমাত্র ইহাই সুনিশ্চিত। নগরাদি হইতেছে, যইতেছে ; সাম্রাজ্যের উত্থান ও পতন হইতেছে-গ্রহাদি খণ্ড খণ্ড হইয়া ধুলির মতো চূর্ণ হইয়া বিভিন্ন গ্রহের বায়ুমণ্ডলে ইতস্তত বিক্ষিপ্ত হইতেছে। অনাদি কালই এইরূপ চলিতেছে। ইহার লক্ষ্য কি? মৃত্যুই সকলের লক্ষ্য। মৃত্যু জীবনের লক্ষ্য, সৌন্দর্যের লক্ষ্য, ঐশ্বর্যের লক্ষ্য, শক্তির লক্ষ্য, এমন কি ধর্মেরও লক্ষ্য। সাধু ও পাপি মরিতেছে, রাজা ও ভিক্ষুক মরিতেছে-সকলেই মৃত্যুর পথে ধাবমান। তথাপি জীবনের প্রতি এই বিষম আসক্তি রহিয়াছে। জানি না, কেন আমরা এ জীবনের প্রতি আসক্ত, কেন ইহা পরিত্যাগ করিতে পারি না। ইহাই মায়া।

জননী সন্তানকে সযত্নে লালন করিতেছেন। তাঁহার সমস্ত মন, সমস্ত জীবন ঐ সন্তানের প্রতি আসক্ত। বালক বয়ঃপ্রাপ্ত হইল এবং হয়তো কুচরিত্র ও পশুবৎ হইয়া প্রত্যহ মাতাকে পদাঘাত ও তাড়না করিতে লাগিল। জননী তথাপি পুত্রের প্রতি আসক্ত। যখন তাঁহার বিচারশক্তি জাগরিত হয়, তখন তিনি পুত্রকে স্নেহের আবরনে আবৃত্ত করিয়া রাখেন। তিনি কিন্তু জানেন না, ইহা স্নেহ নহে-এক অজ্ঞেয় শক্তি তা্ঁহার স্নায়ুমণ্ডলী অধিকার করিয়াছে। তিনি ইহা পরিত্যাগ করিতে পারেন না। তিনি যতই চেষ্টা করুন না, এ বন্ধন ছিন্ন করিতে পারেন না। ইহাই মায়া।

আমরা সকলেই কল্পিত সুবর্ণলোমের অন্বেষণে ছুটিয়া চলিয়াছি, প্রত্যেকেরই মনে হয়, আমিই ইহা পাইব ; জ্ঞানবান ব্যাক্তিমাত্রেই বুঝিতে পারেন, এই সুবর্নলোম লাভের সম্ভাবনা তাঁহার হয়তো বিশ লক্ষের মধ্যে এক। তথাপি প্রত্যেকেই উহার জন্য কঠোর চেষ্টা করেন ; ইহাই মায়া।

ইহসংসারে মৃত্যু দিবারাত্র সগর্বে বিচরন করিতেছে ; আমাদের বিশ্বাস-আমরা চিরকাল জীবিত থাকিব। কোন সময়ে রাজা যুধিষ্টিরকে জিজ্ঞাসা করা হয় : এই পৃথিবীতে সর্বাপেক্ষা আশ্চর্য কি? রাজা উত্তর দিয়াছিলেন, ‘প্রত্যহই চারিদিকে মানুষ মরিতেছে, তথাপি মানুষ মনে করে, সে কখনই মরিবে না।’ ইহাই মায়া।


১ Golden Fleece : গ্রীকপুরানে ইহা Argonautic Expedition নামে খ্যাত।

আমাদের বুদ্ধি জ্ঞান ও জীবনের প্রতি ঘটনার মধ্যে সর্বত্রই এই বিষম বিরুদ্ধভাব রহিয়াছে। একজন সংস্কারক আবির্ভূত হইয়া জাতি-বিশেষের দোষসমূহ প্রতিকার করিবার জন্য যত্নবান্ হইলেন; প্রতিকারের পূর্বেই অপর দিকে অন্য সহস্রপ্রকার দোষ দেখা দিল। এ যেন পতনোন্মুখ অট্টালিকার মতো, এক স্থানে জীর্ণসংস্কার করিতে করিতে অপরদিকে ভাঙন ধরে। ভারতীয় নারীগণের বাধ্যতামূলক বৈধব্য-জনিত দুঃখ প্রতিকারের জন্য আমাদের সংস্কারকগণ প্রচার করিতেছেন। পাশ্চাত্যে বিবাহ না হওয়াই প্রধান দোষ। একস্থানে কুমারীদের সাহায্য করিতে হইবে, তাহারা দু্ঃখ পাইতেছে ; অন্য স্থানে বিধবাদের সাহায্য করিতে হইবে,তাহারা কষ্ট পাইতেছে। দেহের পুরাতন বাতব্যাধির মতো মাথা হইতে তাড়িত হইয়া ইহা শরীরের অন্য স্থান আশ্রয় করিতেছে; আবার সেখান হইতে পাদদেশ আক্রমন করিতেছে। সংস্কারক আসিয়া সাধারনের মধ্যে প্রচার করিলেন-বিদ্যা ধন কৃষি কয়েকজনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকিবে না, তাহারা এইগুলি সকলের আয়ত্তের মধ্যে আনিবার চেষ্টা করিলেন। ইহাতে কেহ কেহ এক হিসাবে কতকটা সুখী হইল বটে, কিন্তু জ্ঞানানুশীলন যতই বেশী লাগিল, শারীরিক সুখ ততই হয়তো অন্তর্হিত হইতে লাগিল। এখন সুখের জ্ঞান হইতেই যে দুঃখের জ্ঞান আসিতেছে! কোন পথে যাইব? আমরা যে সামান্য সুখ ভোগ করিতেছি, অন্য কোথাও সেই পরিমান দুঃখ উৎপন্ন হইতেছে। ইহাই নিয়ম। যুবকেরা হয়তো ইহা স্পষ্ট বুঝিতে পারিবে না। কিন্তু যাঁহারা দীর্ঘদিন জীবিত আছেন, অনেক যন্ত্রণা ভোগ করিয়াছেন, তাঁহারা ইহা উপলব্ধি করিতে পারিবেন। ইহাই মায়া।

দিবারাত্র এই-সকল ব্যপার ঘটিতেছে, কিন্তু এই সমস্যার সমাধান অসম্ভব। এইরূপ হইবার কারণ কি? এ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া অসম্ভব। কারণ প্রশ্নটি যুক্তিসঙ্গতভাবে উথ্থাপিতই হইতে পারে না; যাহা ঘটিতেছে তাহার না আছে ‘কেন’, না আছে ‘কি ভাবে’ ; আমরা শুধু জানি ইহা ঘটিতেছে, আমরা

আর কিছুই করিতে পারি না। আমরা ইহাকে এক মুহূর্তও স্থির রাখিতে পারি না-প্রতি মুহূর্তে ইহা আমাদের হাতের বাহিরে চলিয়া যাইতেছে। এ অবস্থায় কি ভাবে আমরা এ সমস্যার সমাধান করিব-আমরা যে কখন কখন নিঃস্বার্থভাবে কাজ করিয়াছি পরোপকারের চেষ্টা করিয়াছি সেইগুলি স্মরন করিয়া ভাবিতে পারি-কেন, ঐ কাজগুলি তো আমরা বুঝিয়া-সুঝিয়া ভাবিয়া-চিন্তিয়া করিয়াছিলাম, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে আমরা সে গুলি না করিয়া থাকিতে পারি নাই বলিয়াই ঐরূপ করিয়াছিলাম। আমাকে এই স্থানে দাঁড়াইয়া বক্তৃ্তা দিতে হইতেছে আর আপনাদিগকে বসিয়া উহা শ্রবন করিতে হইতেছে-ইহাও আমরা না করিয়া থাকিতে পারি না বলিয়াই করিতেছি। আপনারা গৃহে ফিরিয়া যইবেন, হয়তো কেহ ইহা হইতে যৎসামান্য শিক্ষালাভ করিবেন, অপরে হয়তো মনে করিবেন লোকটা অনর্থক বকিতেছে। আমি বাড়ি যাইয়া ভাবিব, আমি বক্তৃতা দিয়াছি। ইহাই মায়া।

অতএব এই সংসারগতি-বর্ননার নামই মায়া। সাধারণতঃ লোকে এ কথা শুনিয়া ভয় পায়। আমাদিগকে সাহসী হইতে হইবে। অবস্থার বিষয় গোপন করিলে রোগের প্রতিকার হইবে না। কুকুর দ্বারা অনুসৃত হইয়া শশক যেরূপ মাটিতে মাথা লুকাইয়া নিজেকে নিরাপদ মনে করে, আমরা আশবাদী বা নিরাশাবাদী হইয়া অবিকল সেই শশকের মতো কাজ করিতেছি। ইহা রোগ মুক্তির ঔষধ নহে।

অপর পক্ষে-ইহজীবনে প্রাচুর্য, সুখ ও স্বাচ্ছান্দ্য-ভোগিগণ এই মায়াবাদ সম্বন্ধে বিস্তর আপত্তি উত্থাপন করেন। এদেশে-ইংলণ্ডে নিরাশাবাদী হওয়া কঠিন। সকলেই আমাকে বলিতেছেন-জগতে কাজ কি সুন্দররূপে সম্পন্ন হইতেছে! জগত কি রূপ উন্নতিশীল! কিন্তু তাঁহারা নিজেদের জীবনকেই তাঁহাদের জগৎ বলিয়া জানেন। পুরাতন প্রশ্ন উঠিতেছে-খ্রীষ্টধর্মই পৃথিবী-মধ্যে একমাত্র ধর্ম কারন খ্রীষ্টধর্মাবলম্বী জাতিমাত্রেই সমৃদ্ধিশালী। কিন্তু এইরূপ উক্তি স্ববিরোধী। যেহেতু অখ্রীষ্টান জাতিদের দুর্ভাগ্যই খ্রীষ্টান-জাতির সৌভাগ্যের কারণ। শোষণযোগ্য কতকগুলি জাতি যে চাই। সমস্ত পৃথিবী খ্রীষ্টধর্মাবলম্বী হইলে, শিকার স্বরূপ অখ্রীষ্টান জাতির অস্তিত্ব না থাকিলে খ্রীষ্টানজাতিগুলিই দরিদ্র হইয়া যাইবে। সুতরাং এ যুক্তি নিজেকেই খণ্ডন করিয়াছে। উদ্ভিজ্জ পশ্বাদির খাদ্য, মনুষ্য পশ্বাদির ভোক্তা, এবং

সর্বাপেক্ষা গর্হিত ব্যাপার- মনুষ্য পরস্পরের, দুর্বল বলবানের ভক্ষ হইয়া রহিয়াছে। এইরূপ সর্বত্রই বিদ্যমান। ইহাই মায়া।

এ রহস্যের তুমি কী মীমাংসা কর? আমরা প্রত্যহই অভিনব যুক্তি শুনিয়া থাকি। কেহ বলিতেছেন, চরমে কেবল মঙ্গলই থাকিবে। স্বীকার করিয়া লইলাম এরূপ সম্ভব, কিন্তু এইরূপ পৈশাচিক উপায়ে মঙগল উৎপন্ন হইবার কারণ কি? পৈশাচিক রীতি ব্যতীত শুধু মঙ্গলের মধ্য দিয়া কি মঙ্গল সাধিত হয় না? মানবজাতির ভবিষ্যৎ বংশধরগণ সুখী হইবে, কিন্তু এখন কেন এই ভয়ানক দুঃখ যন্ত্রনা! ইহার মীমাংসা নাই। ইহাই মায়া।

এরূপ শোনা যায়, দোষাংশের ক্রমপরিহার ক্রমবিকাশবাদের একটি বিশেষত্ব; সংসার হইতে ক্রমাগত এইরূপ দোষভাগ পরিত্যক্ত হইলে অবশেষে কেবল মঙ্গলই থাকিবে। ইহা শুনিতে অতি সুন্দর। এ সংসারে যাহাদের প্রাচুর্য আছে, যাহাদের প্রত্যহ কঠোর যন্ত্রণা সহ্য করিতে হয় না, যাহাদিগকে তথাকথিত ক্রমবিকাশের চক্রে নিষ্পেষিত হইতে হয় না, এরূপ সিদ্ধান্ত তাহাদের দাম্ভিকতা বাড়াইতে পারে। সত্যই ইহা তাহাদের পক্ষে অতিশয় হিতকর ও শান্তিপ্রদ। সাধারণ লোকেরা যন্ত্রনা ভোগ করুক-তাহাদের ক্ষতি কি? সাধারণ লোকেরা মারা যায়-সেজন্য তাহাদের কি? বেশ কথা, কিন্তু এ যুক্তি আগাগোড়া ভ্রমপূর্ণ। প্রথমতঃ তাহারা বিনা প্রমানে স্বীকার করিয়া লয় যে, জগতে অভিব্যক্ত মঙ্গল ও অমঙ্গলের পরিমান নির্দিষ্ট আছে। দ্বিতীয়তঃ ইহা অপেক্ষা দোষাবহ এ কথা স্বীকার করা যে, মঙ্গলের পরিমান ক্রমবর্ধমান, এবং অমঙ্গলের পরিমান নির্দিষ্ট। অতএব এমন সময় উপস্থিত হইবে, যখন অমঙ্গল-ভাগ এইরূপে ক্রমশঃ পরিত্যক্ত হইয়া একেবারে নিঃশেষিত হইবে, তখন কেবল মঙ্গলই থাকিবে। এরূপ বলা অতি সহজ। কিন্তু অমঙ্গল যে ক্রমশঃ কমিতেছে, ইহা কি প্রমান করা যায়? অমঙ্গল কি ক্রমশই বাড়িতেছে না? একজনঅরণ্যবাসী মানুষ, যে মনোবৃত্তি-পরিচালনায় অনভিজ্ঞ-একখানি পুস্তকপাঠেও অসমর্থ,হস্তলিপি কাহাকে বলে তাহা শোনে নাই, আজ তাহাকে ক্ষতবিক্ষত কর, কাল সে সুস্হ হইয়া উঠিবে। শাণিত অস্ত্র তাহার শরীরের মধ্যে প্রবেশ করাইয়া বাহির করিয়া আনো, তথাপি সে শীঘ্রই


১ Darwin’s Theory of Evolution

আরোগ্যলাভ করিবে; কিন্তু পথ চলিতে একটু আঁচড় লাগিলেই আমরা মরিয়া যাই। শিল্পযন্ত্র দ্রব্যাদি সুলভ করিতেছে, উন্নতি ও ক্রমবিকাশ হইতেছে; কিন্তু একজন ধনী হইবে বলিয়া লক্ষ লোককে নিষ্পেষিত করিতেছে; একজন ধনশালী হইতেছে, একইকালে সহস্র সহস্র ব্যক্তি দরিদ্র হইতে দরিদ্রতর হইতেছে,দলকে দল মানুষ ক্রীতদাসে পরিণত হইতেছে। এইভাবেই চলিয়াছে। পশুমানবের অনুভূতি ইন্দ্রিয়েই আবদ্ধ; যদি সে প্রচুর আহার না পায়,কিংবা যদি তাহার শারীরিক অসুস্থতা ঘটে, সে দুর্দশাগ্রস্ত হয়। ইন্দ্রিয়েই তাহার সুখ-দুঃখের আরম্ভ ও শেষ। যখন এরূপ ব্যক্তির উন্নতি হইতে থাকে, সুখের সীমারেখার বিস্তৃতির সঙ্গে সঙ্গে তাহার দুঃখের পরিধিও সমপরিমাণে বর্ধিত হয়। অরণ্যবাসী মানুষ ঈর্ষা জানে না, বিচারালয় জানে না, নিয়মিত কর দিতে জানে না, সমাজকর্তৃক নিন্দিত হইতে জানে না, পৈশাচিক মানব-প্রকৃতি-সম্ভূত যে ভীষণ শাসনযন্ত্র প্রত্যেকটি মানুষের মনের গোপন কথাও জানিয়া লইতে চায়, তাহা দ্বারা সে দিবারাত্র শাসিত হইতে জানে না। সে জানে না-ভ্রান্ত গর্বিত মানুষ কিরূপে পশু অপেক্ষাও সহস্রগুণে পৈশাচিকস্বভাব প্রাপ্ত হয়। এইরূপে আমরা যখনই স্থূল ইন্দ্রিয়ানুভূতির ঊর্ধ্বে উঠিতে থাকি, আমাদের সুখানুভবের উচ্চতর শক্তির উন্মেষের সহিত দু্ঃখানুভবের শক্তি ও বিকশিত হয়। স্নায়ুমন্ডল সূক্ষ্মতর হইয়া অধিক যন্ত্রনা অনুভব করিতে সমর্থ হয়। শক্তিও বিকশিত হয়। সকল সমাজেই ইহা অহরহঃ দেখা যাইতেছে যে,মূর্খ সাধারণ মানুষ তিরস্কৃত হইলে বেশী দুঃখ অনুভব করে না, কিন্তু প্রহারের আতিশয্য হইলে ক্লিষ্ট হইয়া থাকে। শিক্ষিত ভদ্রলোক কিন্তু একটি কথার তিরস্কারও সহ্য করিতে পারেন না, তাঁহার স্নায়ুমন্ডল এত সূক্ষ্ম হইয়াছে! তাঁহার সুখানুভূতি সহজ হইয়াছে বলিয়া তাঁহার দুঃখও বাড়িয়াছে। দার্শনিক পণ্ডিতগণের-ক্রমবিকাশবাদীদের মত ইহার দ্বারা বিশেষ প্রমাণিত হয় না। আমাদের সুখী হইবার শক্তি যতই বৃদ্ধি পায়, যন্ত্রনাভোগের শক্তি সেই পরিমাণে বর্ধিত হইয়া থাকে। কখন কখন আমার মনে হয়, আমাদের সুখী হইবার শক্তি যদি সমযুক্তান্তর শ্রেণীর নিয়মে অগ্রসর হয়, অপর দিকে অসুখী হইবার শক্তি সমগুণিতান্তর শ্রেণীর নিয়মে বর্ধিত হইবে। অরণ্যবাসী মানুষ সমাজ সম্বন্ধে বেশী অভিজ্ঞ নহে। কিন্তু উন্নতিশীল আমরা জানি, যতই আমরা উন্নত হইব, ততই আমাদের সুখদুঃখের অনুভবশক্তি তীব্র হইবে। ইহাই মায়া।


১ A.P. (Arithmetical Progression):২,৪,৬,৮,১০…
২ G.P. (Geometrical Progression):২,৪,৮,১৬,৩২…

অতএব আমরা দেখিতেছি, মায়া সংসার-রহস্যের ব্যাখ্যার নিমিত্ত মতবাদবিশেষ নহে,-সংসারের ঘটনা যেভাবে বর্তমান রহিয়াছে, তাহারই বর্ণনামাত্র। বিরুদ্ধভাবই আমাদের অস্তিত্বের ভিত্তি ; সর্বত্র এই ভয়ানক বিরুদ্ধভাবের মধ্য দিয়া আমরা চলিতেছি। যেখানে মঙ্গল সেইখানেই অমঙ্গল। যেখানে অমঙ্গল সেইখানেই মঙ্গল। যেখানে জীবন সেইখানেই ছায়ার মতো মৃত্যু তাহার অনুসরন করিতেছে। যে হাসিতেছে, তাহাকে কাঁদিতে হইবে ; যে কাঁদিতেছে, সে হাসিবে। এ অবস্থার প্রতিকারও সম্ভব নয়। আমরা অবশ্য এমন স্থান কল্পনা করিতে পারি যেখানে কেবল মঙ্গলই থাকিবে অমঙ্গল থাকিবে না। সেখানে আমরা কেবল হসিব, কাঁদিব না। কিন্তু যখন এই সকল-কারণ সমভাবে সর্বত্র বিদ্যমান, তখন এরূপ সংঘটন স্বতই অসম্ভব। যেখানে আমাদিগকে হাসাইবার শক্তি আছে, কাঁদাইবার শক্তিও সেইখানেই প্রচ্ছন্ন রহিয়াছে। সেখানে সুখোৎপাদক শক্তি বর্তমান, দুঃখজনক শক্তিও সেইখানে লুক্কায়িত।

অতএব বেদান্তদর্শন আশাবাদী বা নৈরাশ্যবাদী নহে। বেদান্ত এই দুই মতবাদ প্রচার করিতেছে ; ঘটনা সকল যে ভাবে বর্তমান, বেদান্ত সেভাবে সেগুলি গ্রহন করিতেছে ; অর্থাৎ বেদান্তমতে এ সংসার মঙ্গল ও অমঙ্গল, সুখ ও দুঃখের মিশ্রন ; একটিকে বর্ধিত কর, অপরটিও সঙ্গে সঙ্গে বৃদ্ধি পাইবে। কেবল সুখের সংসার বা কেবল দুঃখের সংসার হইতে পারে না। এরূপ ধারনাই স্ববিরোধী। কিন্তু এরূপ বিশ্লেষণ দ্বারা বেদান্ত এই একটি মহারহস্যের উদ্ঘাটন করিয়াছেন যে মঙ্গল ও অমঙ্গল দুইটি সম্পুর্ন বিভিন্ন পৃথক্ সত্তা নহে। এই সংসারে এমন একটি বস্তু নাই, যাহা সম্পুর্ন মঙ্গলজনক বা সম্পুর্ন অমঙ্গলজনক বলিয়া অভিহিত হইতে পারে। একই ঘটনা, যাহা আজ শুভজনক বলিয়া বোধ হইতেছে, কাল তাহাই আবার অশুভ বোধ হইতে পারে। একই বস্তু, যাহা একজনকে দুঃখী করিতেছে তাহাই আবার অপরের সুখ উৎপাদন করিতে পারে। যে অগ্নি শিশুকে দগ্ধ করে, তাহাই আবার অনশনক্লিষ্ট ব্যক্তির উপাদেয় আহার রন্ধন করিতে পারে।

যে স্নায়ুমণ্ডলীর দ্বারা দুঃখবোধ অন্তরে প্রবাহিত হয়, সুখবোধ ও তাহারই দ্বারা অন্তরে নীত হয়। অমঙ্গল-নিবারণের একমাত্র উপায় মঙ্গল-নিবারণ; উপায়ান্তর নাই, ইহা নিশ্চিত। মৃত্যু বারণ করিতে হইলে জীবনও বারণ করিতে হইবে। মৃত্যুহীন জীবন ও দুঃখহীন সুখ স্ববিরোধী বাক্য, কোনটিকেই একা পাওয়া যায় না। দুই-ই একই বস্তুর বিকাশ। গতকাল যাহা শুভদায়ক মনে করিয়াছিলাম, আজ তাহা করি না। যখন আমরা অতীত জীবন পর্যালোচনা করি, বিভিন্ন সময়ের আদর্শসকল আলোচনা করি, তখনই ইহার সত্যতা উপলব্ধি করি। এক সময়ে তেজস্বী অশ্বযুগল চালনা করাই আমার জীবনের আদর্শ ছিল। এখন এ রূপ চিন্তা করি না । শৈশবাবস্থায় মনে করিতাম, মিষ্টান্ন-বিশেষ প্রস্তুত করিতে পারিলে আমি খুব সুখী হইব। অন্য সময়ে মনে হইত, স্ত্রীপুত্র ও প্রচুর টাকাকড়ি হইলেই যথার্থ সুখী হইব। এখন এগুলিকে ছেলেমানুষি মনে করিয়া হাসিয়া থাকি।

বেদান্ত বলেন, এমন এক সময় আসিবেই আসিবে, যখন আমরা পিছনের দিকে তাকাইব, এবং যে সকল ভাবাদর্শের জন্য আমরা ব্যক্তিত্ব পরিহার করিতে ভয় পাইতেছি, সেগুলিকে আমরা বিদ্রূপ করিব। সকলেই নিজ দেহ বাঁচাইয়া রাখিতে ব্যগ্র, কেহই ইহা ত্যাগ করিতে ইচ্ছা করে না। এই দেহ যত কাল ইচ্ছা ততকাল রক্ষাকরিতে পারিলে অত্যন্ত সুখী হইব, আমরা এইরূপই ভাবিয়া থাকি। কিন্তু এমন সময় আসিবে, যখন এ কথা স্মরণ করিয়া করিয়া আমরা হাসিয়া উঠিব। অতএব যদি আমাদের বর্তমান অবস্থা সত্যও নয়, অসত্যও নয় উভয়ের সংমিশ্রণ-দুঃখও নয় ,সুখও নয়, উভয়ের সংমিশ্রণ-এইরূপ বিষমবিরুদ্ধ-ভাবাপন্ন হয়, তবে বেদান্তের আবশ্যকতা কি? অন্যান্য দর্শনশাস্ত্র ও ধর্মমতগুলিরই বা প্রয়োজন কি? সর্বোপরি শুভকর্ম করিবারই বা কি প্রয়োজন? এই প্রশ্ন মনে উদিত হয়। লোকে জিজ্ঞাসা করিবে- যদি অশুভ ছাড়া শুভ হয় না, যদি সুখ উৎপন্ন করিতে হইলে সর্বদা দুঃখও উৎপন্ন হয়, তবে এ সকলের আবশ্যকতা কি? ইহার উত্তরে বলা যায়-প্রথমতঃ দুঃখ লাঘব করিবার উদ্দেশ্যে তোমাকে কর্ম করিতেই হইবে, কারণ নিজেকে সুখী করিবার ইহাই একমাত্র উপায়। আমরা প্রত্যেকে নিজ নিজ জীবনে, শীঘ্র বা বিলম্বে হউক, ইহার যথার্থতা বুঝিয়া থাকি। তীক্ষ্মবুদ্ধি লোক কিছু সত্বর, জড়বুদ্ধি কিছু বিলম্বে ইহা বুঝিতে পারেন। জড়বুদ্ধি লোক উৎকট যন্ত্রণা ভোগ করিয়া, তীক্ষ্মবুদ্ধি অল্প যন্ত্রনা পাইয়া ইহা আবিষ্কার করেন। দ্বিতীয়তঃ আমাদিগকে আমাদের কর্তব্য করিয়া যাইতে হইবে, কারণ সুখদুঃখময় বিপরীতভাবপূর্ণ জীবনের বাহিরে যাইবার ইহাই একমাত্র পথ। সুখ ও দুঃখ-উভয় শক্তিই জগৎকে আমাদের জন্য জীবন্ত রাখিবে, যতদিন না আমরা স্বপ্ন হইতে জাগরিত হই এবং এই মাটির পুতুল গড়া পরিত্যাগ করি। আমাদের এ শিক্ষালাভ করিতে হইবে; আর ইহা শিক্ষা করিতে দীর্ঘকাল লাগিবে।

‘অনন্তই সান্ত হইয়াছেন’-জার্মানিতে এই সিদ্ধান্তের ভিত্তির উপর দর্শন-শাস্ত্র-প্রণয়ননের চেষ্টা হইয়াছিল। এরূপ চেষ্টা এখনও ইংল্যণ্ডে হইতেছে। কিন্তু এই-সকল দার্শনিকের মত বিশ্লেষন করিলে পাওয়া যায়-অনন্তস্বরূপ নিজেকে জগতে ব্যক্ত করিতে চেষ্টা করিতেছেন। একদিন অনন্ত নিজেকে ব্যক্ত করিতে সমর্থ হইবেন। ইহা অতি শ্রুতিমধুর এবং আমরা অনন্ত, বিকাশ অভিব্যক্তি প্রভৃতি দার্শনিক শব্দও ব্যবহার করিলাম। কিন্তু দার্শনিক পণ্ডিতেরা স্বভাবতই জিজ্ঞাসা করেন : সান্ত কিরূপে অনন্ত হইতে পারে, এ সিদ্ধান্তের ন্যায়ানুগত মূলভিত্তি কি? নিরপেক্ষ ও অনন্ত সত্তা সোপাধিক হইয়াই এই জগৎরূপে প্রকাশিত হইয়াছেন। এস্থলে সকলেই সীমাবদ্ধ থাকিবে। যাহা কিছু ইন্দ্রিয়-মন-বুদ্ধির মধ্য দিয়া আসিবে, তাহাকে স্বতই সীমাবদ্ধ হইতে হইবে; অতএব সসীমের অসীমত্ব-প্রাপ্তি নিতান্ত অসম্ভব। ইহা হইতে পারে না।

পক্ষান্তরে বেদান্ত বলিতেছেন, সত্য বটে নিরপেক্ষ বা অনন্ত সত্তা নিজেকে সান্তরূপে ব্যক্ত করিতে চেষ্টা করিতেছেন, কিন্তু এমন সময় আসিবে, যখন এই উদ্যোগ অসম্ভব বুঝিয়া তাহাকে পশ্চাৎপদ হইতে হইবে।এই পশ্চাৎপদ হওয়াই যথার্থ ধর্মের আরম্ভ। বৈরাগ্যই ধর্মের সূচনা। আজকাল বৈরাগ্য-বিষয়ে কথা বলা বড় অপ্রীতিকর। আমেরিকায় আমাকে বলিত, আমি যেন পাঁচ সহস্র বৎসর পূর্বের কোন অতীত ও বিলুপ্ত গ্রহ হইতে আসিয়া বৈরাগ্যবিষয়ে উপদেশ দিতেছি। ইংলণ্ডের দার্শনিকগণও হয়তো এইরূপই বলিবেন। কিন্তু বৈরাগ্যই সত্য এবং ধর্মলাভের একমাত্র পথ। চেষ্টা করিয়া দেখ, যদি অন্য পথ খুঁজিয়া পাও; কখনই পাইবে না। এমন সময় আসিবে, যখন অন্তরাত্মা জাগিয়া উঠিবে, এই দীর্ঘ বিষাদময় স্বপ্নদর্শন হইতে জাগ্রত হইবে; শিশু খেলা ছাড়িয়া জননীর নিকট ফিরিয়া যাইতে উদ্যত হইবে, বুঝিবে :


১ Hegel’s Absolute Mind

ন জাতু কামঃ কামানামুপভোগেন শাম্যতি।
হবিষা কৃষ্ণবর্ত্মেব ভূয় এবাভিবর্ধতে।।

-কাম্যবস্তুর উপভোগ বাসনার কখনও নিবৃত্তি হয়না, ঘৃতাহুতির দ্বারা অগ্নির মতো বাসনা বরং বাড়িতেই থাকে। এইরূপ কি ইন্দ্রিয়বিলাস, কি বুদ্ধিবৃত্তির পরিচালনাজনিত আনন্দ, কি মানবাত্মার উপভোগ্য সর্ববিধ সুখ-সবই শূন্য, সকলই মায়ার অন্তর্গত। সকলই এই সংসারজালের অন্তর্গত ,আমরা উহাকে অতিক্রুম করিতে পারিনা।আমরা মায়াজালের মধ্যে অনন্তকাল ছুটাছুটি করিতে পারি, কিন্তু শেষ পাইবনা; এবং যখনই এক কণা সুখ পাইবার চেষ্টা করিব, তখনই রাশি রাশি দুঃখ আমাদিগকে চাপিয়া ধরিবে। কি ভয়ানক অবস্থা! যখন আমি ব্যাপারটি ভাবিতে চেষ্টা করি, আমার নিঃসংশয় অনুভূতি হয়, ইহাই মায়াবাদ –সকলই মায়া; এই বাক্যই ইহার একমাত্র এবং সর্বাপেক্ষা ভালো ব্যাখ্যা। এ সংসারে কি দুঃখরাশিই না বর্তমান! যদি আপনারা বিবিধ জাতির মধ্যে পরিভ্রমন করেন, বুঝিতে পারিবেন যে, এক জাতি তাহার দোষভাগ এক উপায়ে প্রতিকার করিতে চেষ্টা করিয়াছে, অপর জাতি অন্য উপায় অবলম্বন করিয়াছে। সেই একই দোষ বিভিন্ন জাতি বিভিন্ন উপায়ে প্রতিকার করিতে চেষ্টা করিয়াছে কিন্তু কেহই কৃতকার্য হয় নাই। যদি দোষগুলি ক্রমশঃ হ্রাস করিয়া একদিকে নিবদ্ধ করা যায়, অপর দিকে রাশি রাশি অশুভ সঞ্চিত হইতে থাকে।ইহার গতিই এইরুপ। হিন্দুগন জাতীয় জীবনে কতকটা সতীত্ব-ধর্মের আদর্শ উচ্চে স্থাপন করিবার জন্য বাল্যবিবাহ দ্বারা তাহাদের সন্তানগণকে এবং ক্রমে সমগ্র জাতিকে অধঃপাতিত করিয়াছে। কিন্তু এ কথাও আমি অস্বীকার করিতে পারি না যে,বাল্যবিবাহ হিন্দুজাতিকে পবিত্রতায় ভূষিত করিয়াছে। কি চাও? যদি জাতিকে সতীত্বধর্মে সমাধিক ভূষিত করিতে চাও, তাহা হইলে এই বাল্যবিবাহ দ্বারা সমস্ত স্ত্রী-পুরুষের শরীর দুর্বল করিতে হইবে।অপর-দিকে ইংলণ্ডে তোমাদের অবস্থাই কি খুব ভাল? কখনই নয়। কারণ পবিত্রতাই জাতির জীবনী-শক্তি। তুমি কি ইতিহাসে লক্ষ্য কর নাই যে, অপবিত্রতার মধ্য দিয়াই জাতির মৃত্যুচিহ্ন দেখাদেয়?-যখন যৌন অপবিত্রতা কোন জাতির মধ্যে প্রবেশ করে, তখনই বুঝিতে হইবে উহার বিনাশ আসন্ন। এই-সকল দুঃখজনক সমস্যার মীমাংসা কোথায়? যদি পিতা-মাতা নিজ সন্তানের জন্য পাত্র বা পাত্রী নির্বাচন করেন, তাহা হইলে এই দোষ অনেকটা নিবারিত হয়। ভারতের কন্যাগণ যতটা ভাবপ্রবন তদপেক্ষা অধিক কার্যকুশল। তাহাদের জীবনে কাব্য খুবই কম।কিন্তু যদি লোকে নিজেরাই স্বামী ও স্ত্রী নির্বাচন করে, তাহাতেও অধিক সুখ হয় না। ভারতীয় নারীগণ সাধারণতঃ বেশ সুখী। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কলহ খুব বেশী হয় না। পক্ষান্তরে যুক্তরাষ্টে-যেখানে স্বাধীনতার আতিশয্য বিদ্যমান, সেখানে অসুখী পরিবার ও দুখঃকর বিবাহের সংখ্যা অনেক। আমি যে-কোন সভায় গিয়াছি, সেখানেই শুনিয়াছি-সভায় উপস্হত এক-তৃতীয়াংশ নারী তাহাদের পতিপুত্রকে দূর করিয়া দিয়াছে। এইরূপই সর্বত্র। ইহাতে কি প্রকাশ পাইতেছে? প্রকাশ পাইতেছে যে, এই-সকল আদর্শ দ্বারা অধিকতর সুখ অর্জিত হয় নাই। আমরা সকলেই সুখের জন্য আপ্রান চেষ্টা করিতেছি, কিন্তু একদিকে কিছু সুখ পাইতে না পাইতেই অন্যদিকে দুঃখ উপস্থিত হইতেছে।


১ বিষ্ণুপুরাণ-৪/১০/৯

তবে কি আমরা শুভ কর্ম করিব না? করিব বইকি-পূর্বাপেক্ষা বেশী উৎসাহের সহিত আমাদিগকে কাজ করিতে হইবে। কিন্তু এই জ্ঞান আমাদের উৎকট বাড়াবাড়ি ও ধর্মান্ধতা দূর করিবে। ইংরেজ আর উত্তেজিত হইয়া হিন্দুকে ‘ওঃ পৈশাচিক হিন্দু! নারীগনের প্রতি কি অসৎ ব্যাবহার করে!’-এই বলিয়া অভিশাপ দিবে না। সে বিভিন্ন জাতির রীতিনীতি মান্য করিতে শিখিবে। ধর্মান্ধতা অল্প হইবে এবং কাজ বেশী হইবে। ধর্মান্ধ লোকেরা কাজ করিতে পারে না। তাহারা শক্তির তিন-চতুর্থাংশ বৃথা ব্যয় করে। ধীর প্রশান্তচিত্ত বাস্তবজ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তিরাই কাজ করেন ; অতএব এই জ্ঞান দ্বারা কাজ করিবার শক্তি বৃদ্ধি পাইবে। অবস্থা এইরূপই জানিয়া তিতিক্ষা বৃদ্ধি পাইবে। দুঃখ ও অমঙ্গল আমাদিগকে ভারসাম্য হইতে বিচ্যুত করিতে পারিবে না এবং ছায়ার পিছনে ধাবিত করিবে না। সুতরাং সংসারগতি এইরূপ জানিয়া আমরা সহিষ্ণু হইব। ধরা যাক, সকল মানুষই

দোষশূন্য হইবে, তারপর পশুকুল ক্রমে মানবত্ব প্রাপ্ত হইবে এবং পূর্ববৎ সব অবস্থার মধ্য দিয়া অগ্রসর হইতে থাকিবে ; উদ্ভিদদিগেরও গতি ঐরূপ। কিন্তু কেবল একটা জিনিস সুনিশ্চিত-এই মহতী নদী সমুদ্রাভিমুখে প্রবল বেগে প্রবাহিত হইতেছে, উহার জলবিন্দুগুলির প্রত্যেকটি অনন্ত বারিধিবক্ষে বিলীন হইবে। অতএব সমস্ত দুঃখ ও ক্লেশ, আনন্দ হাস্য ও ক্রন্দনের সহিত জীবন যে সেই অনন্ত সামুদ্রাভিমুখে প্রবলবেগে ধাবিত হইতেছে, ইহা নিশ্চিত।–তুমি আমি, জীব উদ্ভিদ ও সামান্য জীবানুপর্যন্ত, যে যেখানে রহিয়াছে, সকলেই সেই অনন্ত জীবন সমুদ্রে উপনীত হইবে, মুক্তি বা ঈশ্বর লাভ করিবে ; ইহা কেবল সময়সাপেক্ষ ।

পুনরায় বলিতেছি, বেদান্ত আশাবাদী বা নিরাশাবাদী নহে। এ সংসার কেবল মঙ্গলময় বা কেবল অমঙ্গলময়-এইরূপ মত বেদান্ত ব্যক্ত করে না। বেদান্ত বলিতেছে, মঙ্গল ও অমঙ্গল উভয়েরই মূল্য সমান। ইহারা এইরূপে পরষ্পর সম্বন্ধ হইয়া রহিয়াছে। সংসার এইরূপ জানিয়া সহিষ্ণুতার সহিত কর্ম কর। কি জন্য কর্ম করিব? যদি সংসারের অবস্থা এইরূপ, আমরা কি করিব? অজ্ঞেয়বাদী হই না কেন, আধুনিক অজ্ঞেয়বাদীরাও জানেন, এ রহস্যের মীমাংসা নাই ; বেদান্তের ভাষায় বলিতে গেলে-এই মায়াপাশ হইতে অব্যাহতি নাই। অতএব সন্তুষ্ট হইয়া জীবন ভোগ কর। এখানেও একটি অতি মহাভ্রম রহিয়াছে। তুমি যে-জীবন দ্বারা পরিবৃত হইয়া রহিয়াছ, সেই জীবন সম্বন্ধে তোমার জ্ঞান কিরূপ? জীবন বলিতে তুমি কি কেবল পঞ্চেন্দ্রিয়ে আবদ্ধ জীবনই বুঝ? ইন্দ্রিয়জ্ঞানে আমরা পশু হইতে সামান্যই ভিন্ন। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি, এ-স্থানে উপস্থিত এমন কেহ নাই, যাঁহার জীবন কেবল ইন্দ্রিয়েই আবদ্ধ। অতএব আমাদের বর্তমান জীবন বলিতে ইন্দ্রিয় অপেক্ষা আরও কিছু বেশী বুঝায়। আমাদের সুখদুঃখের অনুভব, উচ্চাকাঙ্খা এবং চিন্তাশক্তিও তো আমাদের জীবনের প্রধান অঙ্গ ; আর সেই উচ্চআদর্শ ও পূর্ণতার দিকে অগ্রসর হইবার কঠোর চেষ্টাও কি আমাদের জীবনের উপাদান নহে? অজ্ঞেয়বাদীদের১ মতে জীবন যেভাবে আছে, সেইভাবেই উহাকে ভোগ করা কর্তব্য। কিন্তু জীবন বলিলে সর্বোপরি আদর্শ-অন্বেষণের-পূর্ণতা অভিমুখে অগ্রসর হইবার প্রবল চেষ্টাও বুঝায়। আমাদের এই আদর্শ লাভ করিতেই হইবে। অতএব আমরা অজ্ঞেয়বাদী হইতে পারি না এবং জগৎ যেভাবে প্রতীয়মান হয়, সেভাবে উহাকে গ্রহণ করিতে পারি না। অজ্ঞেয়বাদী জীবনের আদর্শভাগ বর্জন করিয়া বাকীটুকু স্বর্বস্ব বলিয়া গ্রহণ করেন। এই আদর্শ লাভ করা অসম্ভব জানিয়া তিনি ইহার অন্বেষণই পরিত্যাগ করেন। ইহাই স্বভাব, ইহাই জগৎ; ইহাই মায়া।


১ Spencer’s Agnosticism

বেদান্তমতে ইহাই প্রকৃতি। কিন্তু কি দেবোপাসনা প্রতীকোপাসনা বা দার্শনিক চিন্তা অবলম্বনপূর্বক আচরিত ধর্ম, অথবা দেবতা পিশাচ প্রেতের গল্প, সাধু ঋষি মহাত্মা বা অবতারের চরিতকথার সাহায্যে অনুষ্ঠিত অপরিণত বা উন্নত ধর্মমতগুলির উদ্দেশ্য একই। সকল ধর্মই ইহাকে-এই প্রকৃতির বন্ধনকে অতিক্রম করিবার অল্পবিস্তর চেষ্টা করিতেছে। এক কথায় সকলেই মুক্তির দিকে অগ্রসর হইতে কঠোর চেষ্টা করিতেছে। জ্ঞাতসারে বা অজ্ঞাতসারে মানুষ বুঝিয়াছে, সে বন্দী। সে যাহা হইতে ইচ্ছা করে, সে তাহা নয়। যে সময়ে-যে মুহূর্তে সে চারিদিকে চাহিয়া দেখিয়াছে, সেই মুহূর্তেই তাহাকে শেখানো হইয়াছে, তখনই সে অনুভব করিয়াছে-সে বন্দী। সে আরও বুঝিয়াছে, এই সীমাশৃঙ্খলিত হইয়া তাহার অন্তরে কে যেন রহিয়াছেন,যিনি দেহ যেখানে যাইতে পারে না, সেখানে যাইতে চাহিতেছেন। দুর্দান্ত, নৃশংস, আত্মীয়-স্বজনের গৃহসন্নিধানে গোপনে অবস্থিত, হত্যাপ্রিয় ও তীব্র সুরাপ্রিয়, মৃত পিতৃপুরূষ বা অন্য ভূত-প্রেতে বিশ্বাসী অতি নিম্ন ধর্মমতগুলিতে আমরা সেই একই প্রকার মুক্তির ভাব দেখিতে পাই। যাঁহারা দেবতার উপাসনা ভালোবাসেন, তাঁহারা সেই সকল দেবতার মধ্যে নিজেদের অপেক্ষা অধিকতর স্বাধীনতা দেখিতে পান-গৃহের দ্বার রুদ্ধ থাকিলেও দেবতারা প্রাচীরের মধ্য দিয়া আসিতে পারেন ; প্রাচীর তাঁহাদিগকে বাধা দিতে পারে না। এই মুক্তির ভাব ক্রমেই বর্ধিত হইয়া অবশেষে সগুন ঈশ্বরের আদর্শে উপনীত হয়। ঈশ্বর প্রকৃতির পারে, ঈশ্বর মায়াতীত-ইহাই সেই আদর্শের কেন্দ্রগত ভাব।

আমি যেন শুনিতেছি, সম্মুখে কোন কণ্ঠস্বর উত্থিত হইতেছে, যেন অনুভব করিতেছি-ভারতের সেই প্রাচীন আচার্যগন অরণ্যাশ্রমে এই-সকল প্রশ্ন বিচার

করিতেছেন। বৃদ্ধ ও পবিত্র শ্রেষ্ঠ ঋষিগন উহার মীমাংসা করিতে অক্ষম হইয়াছেন, কিন্তু একটি যুবক সেই সভামধ্যে দাঁড়াইয়া বলিতেছে : হে দিব্যধামবাসী অমৃতের পুত্রগন! শ্রবন কর, আমি পথ খুঁজিয়া পাইয়াছি ; যিনি অন্ধকারের পারে, তাঁহাকে জানিলেই মৃত্যুর পারে যাওয়া যায়।

শৃণ্বন্তু বিশ্বে অমৃতস্য পুত্রাঃ।
আ যে ধামানি দিব্যানি তস্থুঃ।।
*
বেদাহমেতং পুরুষং মহাম্তম্
আদিত্যবর্ণং তমসঃ পরস্তাৎ।
তমেব বিদিত্বাহতিমৃত্যুমেতি
নান্যঃ পন্থা বিদ্যতেহয়নায়।।

উপনিষদ্ হইতে আমরা এই শিক্ষাই পাইতেছি যে, মায়া আমাদের চারিদিকে ঘিরিয়া রহিয়াছে এবং উহা অতি ভয়ঙ্কর। তথাপি মায়ার মধ্য দিয়া কাজ করিতে হইবে। যিনি বলেন, ‘এই নদীতীরে বসিয়া থাকি, সমস্ত জল যখন সমুদ্রে চলিয়া যাইবে তখন নদী পার হইব’, তিনি যেমন সফল হন, আর যিনি বলেন, ‘পৃথিবী পূর্ণমঙ্গলময় হইলে পর কাজ করিব এবং জীবন উপভোগ করিব’, তিনিও সেইরূপ সাফল্য লাভ করিয়া থাকেন। মায়ার অনুকূলে পথ নাই, মায়ার বিরুদ্ধে গমনই পথ-এ কথাও শিক্ষা করিতে হইবে। আমরা প্রকৃতির সহায়ক হইয়া জন্মগ্রহন করি নাই, কিন্তু তাহার প্রতিযোগী হইয়াই জন্মিয়াছি। আমরা বন্ধনের কর্তা হইয়াও নিজদিগকে বদ্ধ করিতেছি। এই বাড়ি কোথা হইতে আসিল? প্রকৃতি ইহা দেয় নাই। প্রকৃতি বলিতেছে-‘যাও, বনে গিয়া বাস কর।’ মানব বলিতেছে-‘আমি বাটি নির্মাণ করিব, প্রকৃতির সহিত যুদ্ধ করিব।’ সে তাহাই করিতেছে। তথা কথিত প্রাকৃতিক নিয়মের সহিত অবিরাম সংগ্রামই মানবজাতির ইতিহাস এবং মানবই অবশেষে জয়ী হয়। অন্তর্জগতে আসিয়া দেখ, সেখানেও সেই সংগ্রাম চলিয়াছে, ইহা পশু-মানব ও আধ্যাত্মিক-মানবের সংগ্রাম, আলোক ও অন্ধকারের সংগ্রাম; মানুষ এখানেও বিজেতা। প্রকৃতির মধ্য দিয়া মানুষ আপনার মুক্তির পথ করিয়া লয়।


১ শ্বেতাশ্বতর উপ. ২/৫ ও ৩/৮

অতএব আমরা দেখিতেছি, এই মায়া অতিক্রম করিয়া বৈদান্তিক দার্শনিকগণ এমন কিছু জানিয়াছেন,যাহা মায়াধীন নহে; যদি আমরা সে অবস্থায় উপনীত হইতে পারি, আমরাও মায়ার পারে যাইব। ঈশ্বরবাদী সমস্ত ধর্মেরই ইহা সাধারণ সম্পত্তি। কিন্তু বেদান্তমতে ইহা ধর্মের আরম্ভমাত্র, শেষ নহে। যিনি বিশ্বের স্রষ্টা ও পাতা, যিনি মায়াধীশ, মায়া বা প্রকৃতির অধীশ্বর বলিয়া উক্ত হইয়াছেন, সেই সগুন ঈশ্বরের জ্ঞান এই বেদান্তভাবের শেষ কথা নহে। এই জ্ঞান ক্রমাগত বাড়িতে থাকে। অবশেষে বৈদান্তিক দেখেন, যাঁহাকে বাহিরে বোধ হইয়াছিল,তিনি নিজেই সেই, তিনি প্রকৃতপক্ষে অন্তরেই ছিলেন। যিনি সীমার মধ্যে আপনাকে বদ্ধ মনে করিয়াছিলেন, তিনিই সেই মুক্ত-স্বরূপ।