১২. পরমত-সহিষ্ণুতার জন্য অনুনয়

‘মেমফিস্ কমার্শিয়াল’, ১৭ জানুআরী, ১৮৯৪

বেশ কিছু-সংখ্যক শ্রোতা গতরাত্রে প্রসিদ্ধ হিন্দু সন্ন্যাসী স্বামী বিবে কানন্দের হিন্দুধর্ম- বিষয়ক ভাষণ শুনিবার জন্য শহরের বক্তৃতাগৃহে সমবেত হইয়াছিলেন।

বিচারপতি আর. জে. মর্গ্যান বক্তাকে পরিচিত করিয়া দিতে গিয়া একটি সংক্ষিপ্ত কিন্তু তথ্যপূর্ণ ভাষণে মহান্ আর্যজাতির ক্রমপ্রসারের বিবরণ দেন। তিনি বলেন, ইওরোপীয়গণ এবং হিন্দুরা উভয়েই আর্যজাতির শাখা, অতএব যিনি আজ তাঁহাদের কাছে বক্তৃতা দিবেন, তাঁহার আমেরিকাবাসীর সহিত জাতিগত আত্মীয়তা রহিয়াছে।

প্রাচ্যদেশের এই খ্যাতিমান্ পণ্ডিতকে বক্তৃতাকালে ঘন ঘন করতালি দ্বারা অভিনন্দিত করা হয়। সকলেই আগাগোড়া বিশেষ মনোযোগের সহিত তাঁহার কথা শুনেন। বক্তার শারীরিক আকৃতি বড় সুন্দর, গায়ের রঙ ব্রোঞ্জবর্ণ, দেহের অঙ্গসৌষ্ঠবও চমৎকার। তাঁহার পরিধানে ছিল কোমরে কালো কটিবন্ধ-বেষ্টিত পাটলবর্ণের আলখাল্লা, কালো পেণ্টালুন এবং মাথায় কমনীয় ভাবে জড়ান ভারতীয় রেশমের পীতবর্ণ পাগড়ি। বক্তার বলিবার ধরন খুব ভাল এবং তাঁহার ব্যবহৃত ইংরেজী ভাষা শব্দনির্বাচন, ব্যাকরণের শুদ্ধতা এবং বাক্যগঠনের দিক্‌ দিয়া উৎকৃষ্ট। তাঁহার উচ্চারণের ত্রুটি শুধু কখনও কখনও যৌগিক শব্দের যে অংশে জোর দিবার কথা নয়, সেখানে জোর দেওয়া। তবে সম্ভবতঃ মনোযোগী শ্রোতারা সব শব্দই বুঝিতে পারিয়াছিলেন। মৌলিক চিন্তায় ভরা, তথ্যপূর্ণ এবং উদার জ্ঞানে অনুস্যূত বক্তৃতাটি শুনিয়া তাঁহাদের এই প্রখর মনোযোগ নিশ্চিতই সার্থক হইয়াছিল। এই ভাষণটিকে যথার্থই বিশ্বজনীন পরধর্ম-সহিষ্ণুতার সপক্ষে একটি ‘অনুনয়’ বলা যাইতে পারে। এই বিষয়ে বক্তা ভারতীয় ধর্মসংক্রান্ত নানা মন্তব্য উদ্ধৃত করেন। তিনি বলেন, পরমত-সহিষ্ণুতা এবং প্রেমই হইল প্রধান প্রধান ধর্মের মুখ্য উদ্দীপনা। তাঁহার মতে ইহাই যে-কোন ধর্মবিশ্বাসের শেষ লক্ষ্য হওয়া উচিত।

তাঁহার ভাষণে হিন্দুধর্মের পুঙ্খানুপুঙ্খ অবতারণা ছিল না। ঐ ধর্মের কিংবদন্তী বা আচার-অনুষ্ঠানের বিশদ চিত্র উপস্থাপিত না করিয়া তিনি উহার অন্তর্নিহিত ভাবধারার একটি বিশ্লেষণ দিতে চেষ্টা করিয়াছিলেন। অবশ্য হিন্দুধর্মের কয়েকটি বিশেষ মতবাদ ও ক্রিয়াকর্মের তিনি উল্লেখ করিয়াছিলেন, তবে এইগুলির অতি স্পষ্ট সরল ব্যাখ্যা তিনি দিয়াছিলেন। বক্তা হিন্দুধর্মের অতীন্দ্রিয় উপলব্ধির একটি হৃদয়গ্রাহী বিবরণ দেন। জন্মান্তরবাদ—যাহা অনেক সময়ে অপব্যাখ্যাত হয়—এই অতীন্দ্রিয় উপলব্ধি হইতেই উদ্ভূত। বক্তা ব্যাখ্যা করিয়া বুঝাইয়া দেন, কিভাবে তাঁহার ধর্ম কালের বৈচিত্র্যকে উপেক্ষা করিয়া সর্বকালে বর্তমান মানবাত্মার সত্যকে প্রত্যক্ষ অনুভব করিতে পারেন। সব মানুষই যেমন আত্মার বর্তমান ও ভবিষ্যৎ অস্তিত্বে বিশ্বাসী, ব্রাহ্মণ্যধর্ম তেমনি আত্মার অতীত অবস্থাও স্বীকার করেন। বিবে কানন্দ ইহাও স্পষ্ট ভাবে বলেন যে, খ্রীষ্টধর্মে যাহাকে ‘আদিম পাপ’ বলা হয়, হিন্দুধর্মে উহার কোন স্থান নাই। মানুষ যে পরিপূর্ণতা লাভ করিতে পারে—এই বিশ্বাসের উপর হিন্দুধর্ম মানুষের সকল চেষ্টা ও আকাঙ্ক্ষাকে স্থাপন করে। বক্তার মতে উন্নতি এবং শুদ্ধি আশার উপর স্থাপিত হওয়া বিধেয়। মানুষের উন্নতির অর্থ তাহার স্বাভাবিক পূর্ণতায় ফিরিয়া যাওয়া। সাধুতা এবং প্রেমের অভ্যাস দ্বারাই এই পূর্ণতার উপলব্ধি হয়। ভারতবাসী যুগ যুগ ধরিয়া এই গুণগুলি কিভাবে অভ্যাস করিয়াছে—যুগ যুগ ধরিয়া ভারতবর্ষ কিভাবে নিপীড়িত জনগণের আশ্রয়ভূমি হইয়াছে, বক্তা তাহা নির্ণয় করেন। উদাহরণস্বরূপ তিনি বলেন যে, রোম সম্রাট্ টাইটাস যখন জেরুসালেম আক্রমণ করিয়া য়াহুদীদের মন্দির ধ্বংস করেন, তখন হিন্দুরা য়াহুদীদের সাদরে আশ্রয় দিয়াছিল।

বক্তা খুব প্রাঞ্জল বর্ণনা দ্বারা বুঝাইয়া দেন যে, হিন্দুরা ধর্মের বহিরঙ্গের উপর বেশী ঝোঁক দেন না। কখনও কখনও দেখা যায়, একই পরিবারের ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তি বিভিন্ন সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত, কিন্তু প্রত্যেকেই ঈশ্বরের যে প্রধানতম গুণ—প্রেম, উহারই মাধ্যমে উপাসনা করিয়া থাকেন। বক্তা বলেন যে, সকল ধর্মেই ভাল জিনিষ আছে; সাধুতার প্রতি মানুষের যে উদ্দীপনাবোধ, সব ধর্মই হইল তাহার অভিব্যক্তি, অতএব প্রত্যেক ধর্মই শ্রদ্ধার যোগ্য। এই বিষয়টির উদাহরণস্বরূপ তিনি বেদের (?) একটি উক্তি উদ্ধৃত করেন। একটি ঝরনা হইতে জল আনিতে বিভিন্ন লোকে যেমন বিভিন্ন গঠনের পাত্র লইয়া যায়, ধর্মসমূহও সেইরূপ সত্যকে উপলব্ধির বিভিন্ন আধারস্বরূপ। পাত্রের আকার আলাদা হইলেও লোকে যেমন একই জল উহাতে ভরিয়া লয়, সেইরূপ পৃথক্ পৃথক্ ধর্মের মাধ্যমে আমরা একই সত্য গ্রহণ করি। ঈশ্বর প্রত্যেক ধর্মবিশ্বাসের মর্মবোদ্ধা। যে কোন নামে তাঁহাকে ডাকা হউক, যে কোন রীতিতেই তাঁহাকে শ্রদ্ধা করা হউক, তিনি তাহা বুঝিতে পারেন।

বক্তা বলেন, খ্রীষ্টানরা যে-ঈশ্বরের পূজা করেন, হিন্দুদেরও উপাস্য তিনিই। হিন্দুদের ত্রিমূর্তি—ব্রহ্মা, বিষ্ণু, ও শিব ঈশ্বরের সৃষ্টিস্থিতিলয়-কার্যের নির্ণায়ক মাত্র। ঈশ্বরের এই তিনটি বৈশিষ্ট্য ঐক্যবদ্ধ না করিয়া পৃথক্ পৃথক্ মূর্তির মধ্য দিয়া প্রকাশ করা অবশ্যই কিছু দুর্বলতা, তবে সাধারণ মানুষের কাছে ধর্মনীতি এইরূপ স্থূলভাবে স্পষ্ট করিয়া বলা প্রয়োজন। এই একই কারণে হিন্দুরা ভগবানের দৈবী গুণসমূহ নানা দেবদেবীর স্থূল প্রতিমার মাধ্যমে প্রকাশ করিতে চায়।

হিন্দুদের অবতারবাদ-প্রসঙ্গে বক্তা কৃষ্ণের কাহিনী বলেন। পুরুষসংসর্গ ব্যতীত তাঁহার জন্ম হইয়াছিল। যীশুখ্রীষ্টের চরিতকথার সহিত তাঁহার জীবন বৃত্তান্তের অনেক সাদৃশ্য আছে। বিবে কানন্দের মতে কৃষ্ণের শিক্ষা হইল, ভালবাসার জন্যই ভালবাসা—এই তত্ত্ব। ঈশ্বরকে ভয় করা যদি ধর্মের আরম্ভ হয়, তাহা হইলে উহার পরিণতি হইল ঈশ্বরকে ভালবাসা।

তাঁহার সমগ্র বক্তৃতাটি এখানে প্রকাশ করা সম্ভব হইল না, কিন্তু উহা মানুষে মানুষে ভ্রাতৃপ্রেম উপলব্ধির জন্য একটি চমৎকার আবেদন এবং একটি রমণীয় ধর্মবিশ্বাসের ওজস্বী সমর্থন। বিবে কানন্দের ভাষণের উপসংহার বিশেষভাবে হৃদয়গ্রাহী হইয়াছিল, যখন তিনি বলিলেন যে, খ্রীষ্টকে স্বীকার করিতে তিনি সর্বদাই প্রস্তুত, তবে সঙ্গে সঙ্গে কৃষ্ণ এবং বুদ্ধকেও প্রণিপাত করা চাই; আর যখন মানব-সভ্যতার বর্বরতার একটি পরিষ্কার ছবি আঁকিয়া তিনি বলিলেন, সভ্যতার এই-সকল গ্লানির জন্য যীশুখ্রীষ্টকে দায়ী করিতে তিনি রাজী নন।