০৩. ভক্তিযোগের উপদেশ

রাজযোগ এবং শারীরিক প্রক্রিয়া সম্বন্ধে আমরা আলোচনা করিয়াছি। এখন ভক্তিযোগ সন্বন্ধে আলোচনা করিব। কিন্তু মনে রাখিতে হইবে, কোন একটি যোগই অপরিহার্য নয়। আমি তোমাদের নিকট অনেকগুলি পদ্ধতি এবং আদর্শ উপস্থাপিত করিতে চাই, যাহাতে তোমরা নিজ নিজ প্রকৃতির উপযোগী একটি বাছিয়া লইতে পার; একটি উপযোগ না হইলে অপরটি হয়তো হইতে পারে।

আমরা আমাদের চরিত্রের আধ্যাত্মিক, মানসিক এবং ব্যাবহারিক—প্রত্যেকটি দিক্ সমভাবে উন্নত করিয়া একটি সামঞ্জস্যপূর্ণ ব্যক্তিত্বে পরিণত হইতে চাই। বিভিন্ন জাতি ও ব্যক্তির মধ্যে কোন একটি ভাবের বিকাশ দেখিতে পাওয়া যায়, তাহারা তদতিরিক্ত কোন ভাব বুঝিতে পারে না। একটি ভাবেই তাহারা এরূপ অভ্যস্ত হয় যে, অন্য কোনটির প্রতি তাহাদের দৃষ্টি যায় না। সর্বতোমুখী হওয়াই আমাদের প্রকৃত আদর্শ। বস্তুতঃ জাগতিক দুঃখের কারণ—আমরা এতদূর একদেশদর্শী যে পরস্পরের প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শন করিতে পারি না। মনে কর, কোন ব্যক্তি ভূগর্ভস্থ খনি হইতে সূর্যকে নিরীক্ষণ করিল, সে সূর্যকে একভাবে দেখিবে। এক ব্যক্তি ভূপৃষ্ঠ হইতে দেখিল, একজন কুয়াশার ভিতর দিয়া এবং একজন পর্বতের উপর হইতে নিরীক্ষণ করিল। প্রত্যেকের নিকট সূর্যের বিভিন্ন রূপ প্রতিভাত হইবে। নানারূপে প্রতীয়মান হইলেও প্রকৃতপক্ষে সূর্য একই। দৃষ্টি বিভিন্ন হইলেও বস্তু এক, এবং তাহা হইল সূর্য।

প্রত্যেক মানুষের স্বভাব অনুযায়ী একটি বিশেষ প্রবণতা থাকে। সে ঐ প্রবণতা অনুযায়ী কোন আদর্শ এবং আদর্শে উপনীত হইবার কোন পথ গ্রহণ করে। লক্ষ্য কিন্তু সর্বদাই সকলের জন্য এক। রোম্যান ক্যাথলিকরা গভীর ও আধ্যাত্মিক, কিন্তু উদারতা হারাইয়াছে। ইউনিটেরিয়ানরা উদার, কিন্তু তাহাদের আধ্যাত্মিকতা নাই, তাহারা ধর্মের উপর পুরোপুরি গুরুত্ব দেয় না। আমরা চাই—রোমান ক্যাথলিকদের গভীরতা এবং ইউনিটেরিয়ানদের উদারতা। আমরা আকাশের মত উদার এবং সমুদ্রের মত গভীর হইব; আমাদের মধ্যে থাকিবে অতিশয় ঐকান্তিক উৎসাহ, অতীন্দ্রিয়বাদীর গভীরতা এবং অজ্ঞেয়বাদীর উদারতা।

দাম্ভিক ব্যক্তির নিকট ‘পরধর্ম-সহিষ্ণুতা’ শব্দটি এক অপ্রীতিকর মনোভাবের সহিত যুক্ত হইয়া রহিয়াছে। সে নিজেকে উচ্চাসনে বসাইয়া স্বজাতীয়দের করুণার চোখে দেখিয়া থাকে। উহা মনের এক ভয়াবহ অবস্থা। আমরা সকলেই একই পথে একই লক্ষ্যের দিকে অগ্রসর হইতেছি, কেবল ভিন্ন ভিন্ন মানসিক প্রবৃত্তি অনুযায়ী বিভিন্ন পন্থা অবলন্বন করিতেছি। আমাদের মধ্যে বহু ভাবের সমাবেশ থাকিবে। চরিত্রে আমরা অবশ্যই বিকাশশীল হইব। আমাদের কেবল অপরের মতগুলি সহ্য করিলেই চলিবে না, উহা অপেক্ষা কঠিনতর কার্য করিতে হইবে—আমাদিগকে সমবেদনা প্রকাশ করিতে হইবে, অপরের অবলন্বিত পথে প্রবেশ করিয়া তাহার আকাঙ্ক্ষা ও ঈশ্বরান্বেষণ-প্রচেষ্টার সহিত সহানুভূতিশীল হইতে হইবে। প্রত্যেক ধর্মের দুইটি ভাব আছে—ইতিবাচক ও নেতিবাচক। উদাহরণ-স্বরূপ বলা যাইতে পারে, যখন আপনারা খ্রীষ্টধর্মের অবতারবাদ, ত্রিত্ববাদ, যীশুর মাধ্যমে মুক্তিলাভ ইত্যাদি বলেন, তখন আমি আপনাদের সহিত একমত। আমি বলিব—অতি উত্তম, আমিও উহা সত্য বলিয়া জানি। কিন্তু যখনই আপনারা বলিতে থাকিবেন, ‘আর কোন প্রকৃত ধর্ম নাই, ঈশ্বরের আর কোন প্রকাশ নাই’, তখন আমি বলিব—থামুন, আমি আপনাদের সঙ্গে একমত নই। প্রত্যেক ধর্মেরই প্রচার করিবার, মানুষকে শিক্ষা দিবার মত বাণী আছে। কিন্তু যখনই ধর্ম প্রতিবাদ করিতে আরম্ভ করে, অন্যকে উত্তেজিত করার চেষ্টা করে, তখনই উহা নেতিবাচক ও ভয়াবহ মনোভাব অবলন্বন করে এবং কোথা হইতে আরম্ভ করিবে, কোথায় বা শেষ করিবে—জানে না।

শক্তি-মাত্রই আবর্তিত হয়। যে শক্তিকে আমরা ‘মানুষ’ বলি, তাহা অনন্ত ঈশ্বর হইতে যাত্রা শুরু করে এবং তাঁহাতেই ফিরিয়া আসিবে। ঈশ্বর-সমীপে প্রত্যাবর্তনের জন্য দুইটি পন্থার একটিকে গ্রহণ করিতে হইবে—প্রকৃতির সঙ্গে মন্থর গতিতে ভাসিয়া চলা, অথবা অন্তর্নিহিত শক্তির সাহায্যে গতিপথে থামিয়া যাওয়া; এই অন্তঃ-শক্তি অপ্রতিহত থাকিলে আমাদিগকে চক্র-পথে ঈশ্বর-সমীপে ফিরিয়া লইয়া যাইবে, এবং যেন প্রবলবেগে ঘুরিয়া সল্পদূরত্বের পথে ঈশ্বর-দর্শন করাইবে। যোগীরা এই পথেই গিয়া থাকেন।

আমি বলিয়াছি, প্রত্যেক ব্যক্তি তাহার প্রকৃতি অনুযায়ী আদর্শ নিরূপণ করিবে। এই আদর্শকে তাহার ‘ইষ্ট’ বলা হয়। ইহাকে অবশ্যই পবিত্র—অতএব গোপনীয় রাখিতে হইবে এবং ঈশ্বরের উপাসনা করিলে ইষ্টভাবেই করিবে। ঐ বিশিষ্ট পন্থা নিরূপণের উপায় কি? ইহা অতীব দুরূহ, কিন্তু উপাসনায় অধ্যবসায়ী হইলে উহা আপনা হইতে প্রকাশ পাইবে। মানুষের নিকট ভগবানের তিনটি বিশেষ দান আছে—মনুষ্যত্ব, মুমুক্ষুত্ব, মহাপুরুষ-সংশ্রয়।

সগুণ ঈশ্বর ব্যতিরেকে আমাদের ভক্তিভাব আসিতে পারে না। প্রেমিক এবং প্রেমাস্পদ দুই-ই প্রয়োজন। ঈশ্বরকে অনন্তগুণসম্পন্ন মানব বলা যাইতে পারে। তিনি এরূপ হইতে বাধ্য, কারণ যতক্ষণ আমরা মনুষ্যদেহধারী, আমাদের ঈশ্বরও মনুষ্যরূপী হইবেন। সগুণ ঈশ্বরের চিন্তা না করিয়া আমরা পারি না। ভাবিয়া দেখুন, জগতের কোন বস্তুকেই আমরা সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র বস্তুরূপে চিন্তা করিতে পারি না। সর্বত্রই আমরা বস্তুর সঙ্গে স্বীয় মনকে সংযুক্ত করিয়া লই। বস্তুতঃ প্রকৃত চেয়ার হইতেছে—চেয়ার ও মনের উপর চেয়ার-বস্তুটির প্রতিক্রিয়ার সংযোগ। প্রতিটি বস্তুকে প্রথমে মনের দ্বারা রঞ্জিত করিতে হইবে, উদাহরণস্বরূপ—সাদা, চারকোণা, উজ্জ্বল, শক্ত বাক্সটি কেহ তিনটি ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে দেখিল, কেহ চারিটি ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে, অপর একজন পাঁচটি ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে দেখিল। শেষোক্ত ব্যক্তিই বস্তুর পুঙ্খানুপুঙ্খ রূপ দেখিতে পাইবে। প্রত্যেকে ক্রমে ক্রমে একটি অধিক গুণ-সমন্বিত দেখিতে পাইল। এইরূপে যদি কোন ব্যক্তি ছয়টি ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে সেই একই বাক্সটি দেখে, সে উহাতে অতিরিক্ত আর একটি গুণ দেখিতে পাইবে।

আমি প্রেম ও জ্ঞান দেখিতে পাইতেছি বলিয়াই জানি যে, জগৎ-কারণ সেই প্রেম ও জ্ঞান প্রকাশ করিতেছেন। যাহা আমার মধ্যে প্রেম সৃষ্টি করিল, তাহা কিরূপে প্রেমশূন্য হইতে পারে? জগৎ-কারণকে আমরা মনুষ্যগুণবর্জিত চিন্তা করিতে পারি না। সাধনার প্রথম সোপান হিসাবে ঈশ্বরকে পৃথগ্‌ভাবে দেখার আবশ্যকতা আছে। ঈশ্বরকে তিনভাবে চিন্তা করা যায়ঃ নিম্নতম ভাব—যখন আমরা ঈশ্বরকে আমাদেরই মত দেহধারী দেখিতে পাই, রোমক শিল্পকলা দেখুন; উচ্চতর ভাব—যখন ঈশ্বরের মধ্যে মানবের গুণাবলী আরোপ করি এবং এইভাবে চলিতে থাকি। সর্বশেষ উচ্চতম ভাব—তাঁহাকে ঈশ্বররূপে দেখি।

কিন্তু মনে রাখিতে হইবে, এই সকল ধাপেই আমরা ঈশ্বর এবং কেবল ঈশ্বরকেই দেখিতেছি। সেখানে কোন মিথ্যা কল্পনা বা ভ্রান্তি নাই। যেমন সূর্য বিভিন্ন দূরত্ব হইতে দৃষ্ট হইলেও তাহা সূর্যই—চন্দ্র বা অন্য কোন পদার্থ নয়।

আমরা ঈশ্বরকে আমাদেরই অনুরূপ না দেখিয়া পারি না—তাঁহাকে আমাদের অপেক্ষা অনন্তগুণসম্পন্ন দেখিলেও আমাদেরই মত ধরিয়া লই। আমরা নিরপেক্ষ অনন্ত ঈশ্বরের চিন্তা করিতে চেষ্টা করিলেও তাঁহাকে ভালবাসিবার জন্য আপেক্ষিক ভূমিতে নামিয়া আসি।

প্রত্যেক ধর্মেই ভগবানের প্রতি ভক্তি দুই ভাগে বিভক্ত; এক প্রকারের ভক্তি—মূর্তি আচার-অনুষ্ঠান ও শব্দের মাধ্যমে, অন্যরূপ ভক্তি—প্রেমের ভিতর দিয়া প্রকাশ পাইয়া থাকে। এই জগতে আমরা নানা নিয়মে বদ্ধ, আর এই নিয়ম ভঙ্গ করিয়া আমরা মুক্ত হইবার জন্য সর্বদা চেষ্টা করিতেছি, প্রকৃতিকে অমান্য করিতে এবং পদদলিত করিতে সর্বদা চেষ্টা করিতেছি। উদাহরণস্বরূপ—প্রকৃতি আমাদের বাসস্থান দেয় না, আমরা উহা নির্মাণ করিয়া লই। প্রকৃতি আমাদিগকে অনাবৃতভাবেই সৃষ্টি করিয়াছে, আমরা বস্ত্রদ্বারা নিজেদের আবৃত করিয়াছি। মানুষের লক্ষ্য হইল মুক্ত হওয়া; যে পরিমাণে আমরা প্রকৃতির নিয়ম লঙ্ঘন করিতে অসমর্থ, সেই পরিমাণে আমাদের কষ্ট ভোগ করিতেই হইবে। নিয়মের বাহিরে যাইবার জন্যই আমরা প্রথমে নিয়ম মানিয়া চলি, নিয়ম মানিয়া না চলাই হইল সমগ্র জীবনের সংগ্রাম। এই কারণেই আমি ‘ক্রিশ্চান সায়াণ্টিস্ট’দের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করিয়া থাকি; তাঁহারা মানবের স্বাধীনতা ও আত্মার দেবত্ব সম্বন্ধে শিক্ষা দিয়া থাকেন। আত্মা সর্বপ্রকার পারিপার্শ্বিকতার ঊর্ধ্বে। ‘এই জগৎ আমার পিতার রাজ্য, আমিই ইহার উত্তরাধিকারী’—এই ভাবটি মানুষকে গ্রহণ করিতে হইবে। ‘আমার নিজ আত্মা সকলকে জয় করিতে পারে।’

মুক্তি লাভ করিবার পূর্বে আমাদিগকে নিয়মের ভিতর দিয়া অগ্রসর হইতে হইবে। বাহিরের সাহায্য, প্রণালী, আচার-অনুষ্ঠান, মত, পথ প্রভৃতির নির্দিষ্ট স্থান রহিয়াছে; যতদিন না আমরা সাধনায় দৃঢ়প্রতিষ্ঠ হই, ততদিন এগুলি আমাদের সাহায্য করিবে এবং শক্তি দিবে। পরে আর ঐগুলির প্রয়োজন থাকে না। এগুলি যেন আমাদের ধাত্রীস্থানীয়, অতএব শৈশবে অপরিহার্য। গ্রন্থাদিও ধাত্রীর কাজই করিয়া থাকে, কিন্তু আমাদের চেষ্টা করিয়া সেই অবস্থায় উপনীত হইতে হইবে, যেখানে মানুষ উপলব্ধি করিবে, সে তাহার শরীরের প্রভু। গাছ-গাছড়া, ঔষধ প্রভৃতির প্রভাব আমাদের উপর ততক্ষণই থাকে, যতক্ষণ আমরা ঐগুলির সাহায্য স্বীকার করি; সবল হইলে বাহিরের নিয়ম-পদ্ধতির কোন আবশ্যকতা থাকে না।