০৬. অবতার

যেখানে লোকে তাঁহার (ঈশ্বরের) নামকীর্তন করে, সেই স্থান পবিত্র; আর যে-ব্যক্তি তাঁহার নাম করেন, তিনি আরও কত পবিত্র! আর যাঁহার নিকট আধ্যাত্মিক আলোক প্রাপ্ত হই, তাঁহার নিকট কতই না ভক্তির সহিত অগ্রসর হওয়া উচিত! ঐরূপ শ্রেষ্ঠ ধর্মাচার্যের সংখ্যা খুব বিরল বটে, কিন্তু জগৎ একেবারে এই-সকল আচার্য-বিরহিত হয় না। যে মুহূর্তে পৃথিবী একেবারে আচার্যশূন্য হয়, সেই মুহূর্তেই উহা এক ভয়ানক নরককুণ্ডে পরিণত হয় ও বিনাশের দিকে ধাবিত হয়। আচার্যগণই মানবজাতির সুন্দরতম প্রকাশস্বরূপ এবং ‘অহেতুকদয়াসিন্ধু’।২৭

শ্রীকৃষ্ণ ভাগবতে বলিয়াছেন, ‘আমাকে আচার্য বলিয়া জানিও।’২৮ অর্থাৎ সাধারণ গুরুশ্রেণী অপেক্ষা উন্নততর আর এক শ্রেণীর গুরু আছেন—ঈশ্বরের অবতারগণ। ইহারা স্পর্শ দ্বারা, এমন কি—কেবল মাত্র ইচ্ছা দ্বারাই অপরের ভিতর ভগবদ্ভাব সঞ্চার করিয়া দিতে পারেন। তাঁহাদের ইচ্ছায় অতি দুশ্চরিত্র ব্যক্তিও মুহূর্তের মধ্যে সাধু হইয়া যায়। ইঁহারা গুরুরও গুরু, মানুষের ভিতর ভগবানের শ্রেষ্ঠ অভিব্যক্তি; আমরা তাঁহাদের ভিতর দিয়া ব্যতীত অন্য উপায়ে ভগবানকে দেখিতে পারি না। মানুষ তাঁহাদিগকে উপাসনা না করিয়া থাকিতে পারে না; আর বাস্তবিক এই আচার্যগণকে উপাসনা করিতে আমরা বাধ্য।

এই-সকল নররূপধারী ঈশ্বর ব্যতীত ভগবান‌‌্‌কে দেখিবার আমাদের আর অন্য কোন উপায় নাই। আমরা যদি আর কোন রূপে তাঁহাকে দেখিতে ইচ্ছা করি, তবে আমরা একটা কিম্ভূতকিমাকার বস্তু গঠন করি এবং উহাকেই প্রকৃত ঈশ্বর বলিয়া মনে করি। গল্প আছে—এক আনাড়ীকে শিব গড়িতে বলা হয়; অনেক দিন চেষ্টা করিয়া সে একটি বানর গড়িয়াছিল। সেইরূপ ভগবানকে নির্গুণ পূর্ণস্বরূপে যখনই আমরা ভাবিতে যাই, তখনই আমরা শোচনীয়ভাবে বিফল হই; কারণ যতদিন আমরা মানুষ, ততদিন তাঁহাকে মানুষভাবে ছাড়া অন্যভাবে কখনই ভাবিতে পারিব না। অবশ্য এমন সময় আসিবে, যখন আমরা মনুষ্যপ্রকৃতি অতিক্রম করিয়া তাঁহার স্বরূপবোধে সমর্থ হইব, কিন্তু যতদিন সীমাবদ্ধ মানুষ থাকিব, ততদিন মানুষের ভিতর ও মানুষরূপেই তাঁহাকে উপাসনা করিতে হইবে। যাই বল না কেন, যতই চেষ্টা কর না কেন, ভগবানকে মানব-ভাবে ছাড়া আর কোন ভাবেই চিন্তা করিতে পার না। ঈশ্বর সম্বন্ধে বা জগতের অন্যান্য বস্তু সম্বন্ধে খুব যুক্তিতর্ক-সমন্বিত বক্তৃতা দিতে পার, খুব যুক্তিবাদী হইতে পার, আর ভগবানের এই-সকল মনুষ্য-অবতারের কথা সব ভ্রমাত্মক—এ-কথা নিজের সন্তোষজনকভাবে প্রমাণ করিতে পার, কিন্তু ‘সহজ’ বুদ্ধিতে কি বলে তাহা একবার পরীক্ষা করিয়া দেখা যাক। এই প্রকার অসাধারণ বুদ্ধিবৃত্তির পশ্চাতে কি আছে? কিছুই নাই—শূন্য, কেবল কতকগুলি বাক্যাড়ম্বর মাত্র। তারপর যখন দেখিবে, কোন লোক এইরূপ অবতারপূজার বিরুদ্ধে মহাযুক্তিতর্কের সহিত বক্তৃতা করিতেছে, তাহাকে ধরিয়া জিজ্ঞাসা করঃ ঈশ্বর সম্বন্ধে তোমার নিজের ধারণা কি? ‘সর্বশক্তিমত্তা’, ‘সর্বব্যাপিতা’ ও এইরূপ শব্দগুলি দ্বারা কি বোঝ? দেখিবে, ঐগুলির বানান ব্যতীত সে আর অধিক কিছু বোঝে না। এ-সকল শব্দের দ্বারা তাহার মনে কোন অর্থেরই বোধ হয় না, এমন কোন ভাব দ্বারা সে ঐগুলি ব্যক্ত করিতে পারে না, যাহা তাহার মানবীয় প্রকৃতি দ্বারা প্রভাবিত হয় নাই। এই বিষয়ে রাস্তার যে লোকটা একখানা পুঁথিও পড়ে নাই, তাহার সহিত এ ব্যক্তির কিছুমাত্র প্রভেদ নাই। তবে সে লোকটা শান্তপ্রকৃতি, জগতের শান্তিভঙ্গ করে না, আর এই বক্তা সমাজে অশান্তি ও দুঃখ সৃষ্টি করে। বাস্তবিক প্রত্যক্ষানুভূতিতেই ধর্ম, সুতরাং শূন্যগর্ভ বক্তৃতা ও প্রত্যক্ষানুভূতির মধ্যে আমাদের বিশেষ প্রভেদ করা আবশ্যক। আত্মার গভীরতম প্রদেশে আমরা যাহা অনুভব করি, তাহাকেই প্রত্যক্ষানুভূতি বলে। এই বিষয়ে ‘সহজ’ জ্ঞান যত দুর্লভ, আর কিছুই তত দুর্লভ নয়।

আমাদের বর্তমান প্রকৃতি যেরূপ, তাহাতে আমরা সীমাবদ্ধ; ভগবানকে আমরা মনুষ্য-রূপে দেখিতে বাধ্য। মনে কর, মহিষদের ভগবানকে পূজা করিবার ইচ্ছা হইল—তাহাদের স্বভাব অনুযায়ী তাহারা ভগবানকে একটি বৃহৎ মহিষরূপে দেখিবে। মৎস্য যদি ভগবানের আরাধনা করিতে ইচ্ছা করে, তবে তাহাকে ভাবিতে হইবে, ভগবান্ একটি বৃহৎ মৎস্য। মানুষকেও ভাবিতে হইবে, ভগবান্ মানুষ; আর ঐ-সকল সীমাবদ্ধ বিভিন্ন ধারণা বিকৃত-কল্পনাসম্ভূত নয়। মানুষ, মহিষ, মৎস্য—এগুলি যেন ভিন্ন ভিন্ন পাত্রস্বরূপ, সবগুলি ভগবৎ-সমুদ্রে নিজ নিজ ধারণ-শক্তি ও আকৃতি অনুসারে পূর্ণ হইয়াছে। মানুষে ঐ জল মানুষের আকার ধারণ করিল, মহিষে মহিষের আকার ও মৎস্যে মৎস্যাকার ধারণ করিল। প্রত্যেক পাত্রে সেই এক ঈশ্বর-সমুদ্রের জল রহিয়াছে। নিজ মনের প্রকৃতি ও শক্তি অনুযায়ী যদি কেহ ঈশ্বর সম্বন্ধে কোন ধারণা করে, আমরা তাহাকে দোষ দিতে পারি না। সুতরাং ঈশ্বরকে মানুষরূপেই উপাসনা করা ছাড়া আমাদের আর অন্য কোন পথ নাই।

প্রকার লোক ভগবানকে মানুষরূপে উপাসনা করে না। প্রথম—নরপশুগণ, যাহাদের কোনরূপ ধর্মজ্ঞান নাই; দ্বিতীয়—পরমহংসগণ, যাঁহারা মনুষ্যসুলভ সমুদয় দুর্বলতা অতিক্রম করিয়া মানবপ্রকৃতির সীমা ছাড়াইয়া গিয়াছেন। সমুদয় প্রকৃতিই তাঁহাদের আত্মস্বরূপ হইয়া গিয়াছে। তাঁহারাই কেবল ভগবানকে তাঁহার স্বরূপে উপাসনা করিতে পারেন। অন্য সব বিষয়ে যেমন, এখানেও তেমনি—দুইটি চরম বিপরীত ভাব একরূপ দেখায়। অতিশয় অ-জ্ঞানী ও পরম জ্ঞানী—এ-দুয়ের কেহই উপাসনা করে না; নরপশুগণ অজ্ঞান বলিয়া উপাসনা করে না, জীবন্মুক্ত পুরুষগণ সর্বদা আত্মার মধ্যে পরমাত্মাকে অনুভব করিতেছেন বলিয়া তাঁহাদের আর স্বতন্ত্র উপাসনার প্রয়োজন হয় না। যে-ব্যক্তি এই দুই চূড়ান্তভাবের মধ্যবর্তী, অথচ বলে—আমি ভগবানকে মনুষ্যরূপে উপাসনা করিতে ইচ্ছা করি না, বিশেষ যত্নের সহিত সেই ব্যক্তির দেখাশুনা করা আবশ্যক। কঠোরতর ভাষা প্রয়োগ না করিয়াও বলিতে হয়, সে প্রলাপ বকিতেছে, সে ভুল করিয়াছে; তাহার ধর্ম বিকৃতমস্তিষ্ক ও বুদ্ধিহীন ব্যক্তিগণেরই উপযুক্ত।

ভগবান্ মানুষের দুর্বলতা বুঝেন, এবং মানুষের হিতের জন্যই মানুষরূপে অবতীর্ণ হন।২৯ ‘যখনই ধর্মের গ্লানি ও অধর্মের অভ্যুত্থান হয়, তখনই আমি নিজেকে সৃজন করি। সাধুদের রক্ষা, পাপিগণের দুষ্কৃতিনাশ ও ধর্মসংস্থাপনের জন্য আমি যুগে যুগে জন্মগ্রহণ করি।’৩০ ‘জগতের ঈশ্বর আমি,—আমার প্রকৃত স্বরূপ না জানিয়া অজ্ঞ ব্যক্তিরা মনুষ্যরূপধারী আমাকে উপহাস করে।’৩১

অবতার সম্বন্ধে গীতায় ভগবান্ শ্রীকৃষ্ণ এই কথা ঘোষণা করিয়াছেন। ভগবান্ শ্রীরামকৃষ্ণদেব বলিতেন, ‘যখন প্রবল বন্যা আসে, তখন সব ছোট ছোট নদী ও খানা কানায় কানায় ভরিয়া যায়; সেইরূপ যখন অবতার আসেন, তখন আধ্যাত্মিক তরঙ্গ জগৎকে ভাসাইয়া লইয়া যায়, সাধারণ মানুষও তখন হাওয়াতেই ধর্মভাব অনুভব করে।’


২৭ বিবেকচূড়ামণি, ৩৫
২৮ আচার্য মাং বিজানীয়াৎ….। শ্রীমদ্ভাগবত, ১১।১৭।২০
২৯ স্যাৎ পরমেশ্বরস্য অপি ইচ্ছাবশান্মায়াময়ং রূপং সাধকানুগ্রহার্থম্।
—শাঙ্করভাষ্য, বেদান্তসূত্র, ১।১।২০
৩০ যদা যদা হি ধর্মস্য গ্লানির্ভবতি ভারত।
অভ্যুত্থানমধর্মস্য তদাত্মানং সৃজাম্যহম্।।
পরিত্রাণায়া সাধূনাং বিনাশায় চ দুষ্কৃতাম্।
ধর্মসংস্থাপনার্থায় সম্ভবামি যুগে যুগে।। —গীতা, ৪।৭-৮
৩১ অবজানন্তি মাং মূঢ়া মানুষীং তনুমাশ্রিতম্। পরং ভাবমজানন্তো মম ভূত মহেশ্বরম্।। —গীতা, ৯।১১