১৯. একটি অপরূপ পত্রালাপ

[এই পত্রালাপটি যথাযথভাবে উপভোগ করিতে হইলে পাঠকদের জানিতে হইবে, কোন্ ঘটনাকে কেন্দ্র করিয়া এই পত্রালাপ শুরু হয় এবং পত্র ব্যবহারকারীদের মধ্যে কী সম্বন্ধ ছিল। প্রথম পত্রের গোড়ার দিকে স্বামীজী লিখিয়াছেন, তিনি জোড় আঘাত দিয়াছেন। সেটা আর কিছু নয়, নিজ আচরণের সমর্থনে ১৮৯৫ খ্রীঃ ১ ফেব্রুয়ারী একটি অত্যন্ত কড়া চিঠি তিনি পত্রোদ্দিষ্টাকে লিখিয়াছিলেন। সেই অপূর্ব পত্রটিতে স্বামীজীর সন্ন্যাসী-সত্তা অগ্নিবৎ জ্বলিয়া উঠিয়াছে। এই কবিতাকার পত্রগুচ্ছ পড়িবার পূর্বে সেই পত্রটি পড়া প্রয়োজন। পত্রোদ্দিষ্টা মেরী হেল মিঃ ও মিসেস হেলের (স্বামীজী যাঁহাদের ফাদার পোপ ও মাদার চার্চ বলিতেন) দুই কন্যার একজন। ঐ দুই হেল-ভগিনী এবং তাঁহাদের সম্পর্কিত আরও দুই ভগিনীকে স্বামীজী নিজের ভগিনীর মত দেখিতেন, এবং তাঁহারাও স্বামীজীকে পরম শ্রদ্ধা ও ভালবাসার সঙ্গে গ্রহণ করিয়াছিলেন। স্বামীজীর কয়েকটি মূল্যবান্ চিঠি এই ভগিনীদের উদ্দেশে লেখা।

বর্তমান পত্রালাপে স্বামীজীকে এক নূতন আলোকে দেখা যায়—রঙ্গপ্রিয় অথচ একান্ত গম্ভীর পরিহাসের মধ্যেও তাঁহার জীবনের মূলভিত্তি ব্রহ্মজ্ঞান ফুটিয়া উঠিয়াছে। এই পত্রালাপের প্রথম চিঠিটি নিউ ইয়র্ক হইতে ১৮৯৫ খ্রীঃ ১৫ ফেব্রুয়ারী লেখা। সম্পাদক]

শোন আমার বোনটি মেরী,
হয়ো না দুখী—যদিও ভারী
ঘা খেয়েছ, তবুও জান
জান বলেই বলিয়ে নাও—
আমি তোমায় ভালবাসি
সারাটা এই হৃদয় দিয়ে।

বলতে পারি বাজি রেখে—
সেই শিশুরা বন্ধু আমার
রইবে চির দুঃখে সুখে,
আমিও তাদের বন্ধু তেমন,
জান তুমি মেরী-শিশু
ভালভাবেই জান তাহা।

*সর্প যদি পদাহত ধরে তার ফণা,
অগ্নি যদি সমুদ্যত—শিখা লক্‌‍লক্,
প্রতিধ্বনি ঘুরে ফিরে রিক্ত মরুভূমে
দীর্ণবক্ষ সিংহ যবে গর্জে ঘোর রোষে।

বিদ্যুতের বাণবিদ্ধ মহামেঘরাশি
বন্যাশক্তি উন্মোচন করে বজ্রস্বরে,
সেইমত মহাপ্রাণ মুক্ত মহাদানে
আত্মা যবে আলোড়িত সত্তার গভীরে।

ম্লান হোক আঁখি-তারা, প্রাণ হোক ক্ষীণ,
বন্ধু নাই, প্রেম হোক অবিশ্বাসে লীন,
ভয়ঙ্কর ভাগ্য যদি হানে মৃত্যুভয়,
ঘনীভূত অন্ধকারে রুদ্ধ যদি পথ,

প্রকৃতি বিরূপ যদি ভ্রুকুটি-কুটিল
তব ধ্বংস চায় তবু জেন—তুমি সেই।
তুমি দিব্য, ধাও ধাও, সম্মুখেতে শুধু,
ধাও নিজ লক্ষ্য পানে নিত্যগতি ধরি।

দেব নহি, আমি নহি পশু কিম্বা নর,
দেহ নহি, মন নহি, নারী বা পুরুষ,
শাস্ত্র স্তব্ধ সবিস্ময়ে আমা পানে চাহি,
আমার প্রকৃতি ঘোষে—‘আমি সেই’ বাণী।

সূর্য চন্দ্র নক্ষত্রের জন্মিবার আগে
ছিনু আমি, যবে নাহি ছিল পৃথ্বী ব্যোম্‌,
নাহি ছিল মহাকাল, ‘সেও’ নাহি ছিল,
ছিলাম, রয়েছি আমি, রব চিরকাল।

এ পৃথিবী অপরূপা, এ সূর্য মহান্
চন্দ্রমা মধুর এত, তারকা আকাশ—
কার্য-কারণেতে বাঁধা সৃষ্টি সকরুণ
বন্ধনে জীবন তার, বন্ধনে মরণ।

মন তার মায়াময় জাল ছুঁড়ে দেয়,
বেঁধে ফেলে একেবারে নির্মম নিষ্পেষে;
পৃথিবী, নরক, স্বর্গ—ভাল ও মন্দের
চিন্তা আর ভাবনার ছাঁচ গড়ে ওঠে।

জেন কিন্তু—এ সকলই ফেনপুঞ্জবৎ
স্থান কাল পাত্র আর কার্য ও কারণ,
আমি কিন্তু ঊর্ধ্বচারী ইন্দ্রিয় মনের
নিত্য দ্রষ্টা সাক্ষী আমি এই সৃষ্টি মাঝে।

দুই নয়, বহু নয়, এক—শুধু এক,
তাইতো আমার মাঝে আছে সব ‘আমি’,
অনিবার তাই প্রেম,—ঘৃণা অসম্ভব;
‘আমি’ হতে আমারে কি সরান সম্ভব?

স্বপ্ন হতে জেগে ওঠ, বন্ধ কর নাশ
হও অভী, বল বীরঃ নিজ দেহ-ছায়া
ভীত আর নাহি করে, ওগো মৃত্যুঞ্জয়
আমি ব্রহ্ম, এই চির সত্য জ্যোতির্ময়।*

আমার কবিতা এই পর্যন্ত। আশা করি তোমরা সকলে কুশলে আছ। মাদার চার্চ এবং ফাদার পোপকে ভালবাসা জানিও। আমি এত ব্যস্ত যে মরবার সময় নেই, এক ছত্র লেখবার পর্যন্ত সময় নেই। অতএব ভবিষ্যতে যদি লিখতে দেরী হয় ক্ষমা কর।

তোমাদের চিরকালের
বিবেকানন্দ

মিস্‌ মেরী হেল উত্তরে লিখে পাঠালেনঃ

‘কবি হব আমি’ এই সাধনায়
সন্ন্যাসী মহাবীর
সুর ভেঁজে যান প্রাণ পণ রেখে,
নিতান্ত গম্ভীর।

ভাবে ও বচনে অজেয় যে তিনি
সন্দেহ কিছু নাই,
গোল এক শুধু ছন্দ নিয়েই
কেমন যে সামলাই!

কোন ছত্রটি অতি দীর্ঘ যে
কোনটি অতীব হ্রস্ব,
রূপ মেলে নাকো ভাবের সহিত—
কবিতা হয় না অবশ্য।

মহাকাব্য না গীতিকাব্য সে
কিম্বা চৌদ্দপদী?
সেই ভাবনায় খেটে খেটে হায়
হল অজীর্ণব্যাধি।

যতদিন থাকে ঐ কবি-ব্যাধি
অরুচি খাদ্যে তাঁর,
সে খাদ্য যদি নিরামিষ হয়,
লিয়ন৭ রাঁধুনী যার।

তবুও চলে না, চলিতে পারে না;
স্বামীজী ব্যস্ত অদ্য,
সযতনে রাঁধা খানা পড়ে থাক,
লিখিছেন তিনি পদ্য।

একদিন তিনি সুখাসীন হয়ে
একান্ত ভাবমগ্ন,
সহসা আলোক আসিয়া তাঁহার
চারিপাশে হল লগ্ন।

‘শান্ত ক্ষুদ্র কণ্ঠ’ একটি
নাড়া দিল ভাব তাঁর
শব্দ জ্বলিতে লাগিল যেমন
জ্বলন্ত অঙ্গার।

সত্যই তারা অঙ্গার যেন
আমার উপরে হায়
বর্ষিত হল, অনুতাপে মরি,
বোনটি যে ক্ষমা চায়।

ভর্ৎসনা-ভরা পত্রের তরে
দুঃখের সীমা নাই,
বারবার বলি, ক্ষমা চাই আমি
চাই, চাই, ক্ষমা চাই!

যে-কটি ছত্র পাঠায়েছ তুমি,
তোমার ভগিনীগণ
নিশ্চয় জেন স্মরণে রাখিবে
বাঁচিবে যতক্ষণ।

কারণ তাদের দেখায়ে দিয়েছ
অতীব পরিষ্কার—
‘যাহা কিছু আছে, সব কিছু তিনি’
ইহাই সত্য সার।

উত্তরে স্বামীজী লিখলেনঃ

সেই পুরাকালে
গঙ্গার কূলে—করে রামায়ণ গান
বৃদ্ধ কথক বুঝায়ে চলেন
দেবতারা সব—কেমনে আসেন যান
অতি চুপে চুপে
সীতারাম-রূপে
আর, নিরীহ সীতার—চোখের জলেতে বান!

কথা হল শেষ
শ্রোতারা সকলে ঘরে ফিরে চলে
পথে যেতে যেতে মনের মাঝেতে
ভাসিছে কথার রেশ।

তখন জনতা হতে

একটি ব্যাকুল উচ্চ কণ্ঠ লাগিল জিজ্ঞাসিতে—
‘ঐ যে সীতারাম
কিছুই না বুঝিলাম,
কারা ওঁরা তাই বলে দিন আজ, যদি বুঝি কোন মতে।’

তাই মেরী হেল, তোমাকেও বলি—
আমার শেখান তত্ত্ব না বুঝে, সকলি করিলে মাটি!
আমি তো কখনও বলিনি কাকেও—
‘সব ভগবান্‌’—অর্থবিহীন অদ্ভুত কথাটি!
এটুকু বলেছি মনে রেখে দিও
ঈশ্বরই ‘সৎ’, বাকী যা অসৎ—একেবারে কিছু নয়।
পৃথিবী স্বপ্ন, যদিও সত্য বলে তা মানতে হয়!

একটি মাত্র সত্য বুঝেছি জীবন্ত ভগবান্
যথার্থ ‘আমি’— তিনি ছাড়া কিছু নয়!
পরিণামশীল এ জড়জগৎ আমি নয়, আমি নয়।
তোমরা সকলে জানিও আমার ভালবাসা অফুরান।

বিবেকানন্দ

মিস্ মেরী হেল লিখলেনঃ

বুঝতে পেরেছি অতি সহজেই
তফাতটা কোথা রইল—
তৈল-আধার পাত্রের সাথে
পাত্র-আধার তৈল!
সে তো সোজা অতি—সোজা প্রস্তাব
একটি প্রত্যবায়—
প্রাচ্য যুক্তি বুঝতে সাধ্য
শক্তি নাইকো হায়!
যদি ‘ভগবান্ কেবল সত্য
মিথ্যা যা কিছু আর,’
যদি ‘পৃথিবীটা স্বপ্ন’ তা হলে
রইল কি বাকী আর

ভগবান্ ছাড়া? তাইতো শুধাই
তুমি যে বলেছ দাদা,
‘বহু দেখে যারা তাদের মরণ’,
এবং বলেছ সাদা—
‘একের তত্ত্ব যাহারা বুঝেছে,
মুক্তি তাদের স্থির’—
তবুও আমার সামান্য কথা
বলিতেছি অতি ধীরঃ
সব কিছু তিনি, এই কথা ছাড়া
আর কিছু নাহি জানি,
আমি যদি থাকি, তাঁহার ভিতরে
আমারও ভিতরে তিনি।

স্বামীজী উত্তরে লিখলেনঃ

মেজাজটা খর, বালা অপূর্ব,
প্রকৃতির কিবা খেয়াল মরি!
সুন্দরী নারী, সন্দেহ নেই,
দুর্লভ-আত্মা কুমারী মেরী।

গভীর আবেগে ঠেলেঠুলে ওঠে
চাপা দিতে তার সাধ্য নাই,
দেখতেই পাই মুক্ত সত্তা
আগ্নেয় তার স্বভাবটাই।

গানে বাজে তার রাসভ-রাগিণী,
পিয়ানোতে বাজে মধুর রেশ!
ঠাণ্ডা হৃদয়ে সাড়া যে পায় না
মনেতে যাদের বরের বেশ!

শুনেছি ভগিনী তাদের মুখেতে
তোমার রূপের প্রভাব ঘোর!
সাবধানে থেক, নুয়োনা, প’রোনা
যত মধুর হোক—শিকল ডোর।

শীঘ্র শুনিবে আর এক সুর
চাঁদে-পাওয়া সেই তোমার সাথী;
তার সাধে বাদ তোমার কথায়,
নিবে যাবে তার জীবন-ভাতি।

এ-কটি পঙ‍্ক্তি ভগিনী মেরী,
প্রত্যুপহার গ্রহণ কর।
‘যেমন কর্ম তেমনি তো ফল’—
সন্ন্যাসী জেন জবাবে দড়।