১৮. পত্রালাপে প্রশ্নোত্তর

[ভগিনী নিবেদিতার কয়েকটি প্রশ্ন ও স্বামীজীর সংক্ষিপ্ত উত্তরঃ ১৯০০ খ্রীঃ ২৪ মে, সান্ ফ্রান্সিস্কো]

প্রশ্ন—পৃথ্বীরায় ও চাঁদ যখন কান্যকুব্জে স্বয়ম্বরে যেতে মনঃস্থ করেন, তখন তাঁরা কাদের ছদ্মবেশ ধারণ করেছিলেন—তা মনে করতে পারছি না।

উত্তর—উভয়েই চারণের বেশে গিয়াছিলেন।

প্র—পৃথ্বীরায় যে সংযুক্তাকে বিবাহ করতে চেয়েছিলেন, তা কি এই জন্য যে, সংযুক্তা ছিলেন অসামান্যা রূপসী এবং তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বীর দুহিতা? সংযুক্তার পরিচারিকা হবার জন্য তিনি কি নিজের একজন দাসীকে শিখিয়ে পাঠিয়েছিলেন এবং এই বৃদ্ধা ধাত্রীই কি রাজকুমারীর মনে পৃথ্বীরায়ের প্রতি ভালবাসার বীজ অঙ্কুরিত করেছিল?

উ—পরস্পরের রূপগুণের বর্ণনা শুনে ও আলেখ্য দেখে তাঁরা একে অন্যের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন। আলেখ্য-দর্শনে নায়ক-নায়িকার মনে পূর্বরাগের সঞ্চার ভারতবর্ষের একটি প্রাচীন রীতি।

প্র—কৃষ্ণ যে গোপবালকদের মধ্যে প্রতিপালিত হয়েছিলেন, তার কারণ কি?

উ—এরূপ ভবিষ্যদ্বাণী ছিল যে, কৃষ্ণ কংসকে সিংহাসনচ্যুত করবেন। পাছে জন্মের পর কৃষ্ণ কোথাও গোপনে লালিত পালিত হন, সেই ভয়ে দুরাচার কংস কৃষ্ণের পিতামাতাকে (যদিও তাঁরা ছিলেন কংসের ভগ্নী ও ভগ্নীপতি) কারাগারে নিক্ষেপ করেছিল এবং এই আদেশ দিয়েছিল যে, সেই বৎসরে রাজ্যের মধ্যে যত বালক জন্মাবে, সকলকেই হত্যা করা হবে। অত্যাচারী কংসের হাত থেকে বাঁচাবার জন্যই কৃষ্ণের পিতা কৃষ্ণকে গোপনে নদী পার করেছিলেন।

প্র—তাঁর জীবনের এ অধ্যায় কিভাবে শেষ হয়?

উ—অত্যাচারী কংসের দ্বারা আমন্ত্রিত হয়ে তিনি নিজে ভাই বলদেব ও পালক-পিতা নন্দের সঙ্গে রাজসভায় যান। অত্যাচারী তাঁকে বধ করবার ষড়যন্ত্র করেছিল। তিনি অত্যাচারীকে বধ করলেন, কিন্তু নিজে রাজ্য অধিকার না করে কংসের নিকটতম উত্তরাধিকারীকে সিংহাসনে বসালেন। কর্মের ফল তিনি নিজে কখনও ভোগ করতেন না।

প্র—এই সময়কার কোন চমকপ্রদ ঘটনার কথা বলতে পারেন কি?

উ—কৃষ্ণের এই সময়কার জীবন অলৌকিক ঘটনায় পরিপূর্ণ। শৈশবে তিনি বড়ই দুরন্ত ছিলেন। দুষ্টামির জন্য তাঁর গোপিনী মাতা একদিন তাঁকে মন্থনরজ্জু দিয়ে বাঁধতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সমস্ত রজ্জু একত্র জুড়েও তার দ্বারা তিনি তাঁকে বাঁধতে পারলেন না। তখন তাঁর চোখ খুলে গেল, আর তিনি দেখলেন যে, যাঁকে তিনি বাঁধতে যাচ্ছেন, তাঁর দেহে সমগ্র ব্রহ্মাণ্ড অধিষ্ঠিত। ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে তিনি ভগবানের স্তুতি আরম্ভ করলেন। ভগবান্‌ তখন তাঁকে আবার মায়া দ্বারা আবৃত করলেন; আর তিনি শুধু বালকটিকেই দেখতে পেলেন।

পরব্রহ্ম যে গোপবালক হয়েছেন, এ-কথা দেবশ্রেষ্ঠ ব্রহ্মার বিশ্বাস হল না। তাই পরীক্ষা করবার জন্য একদা তিনি ধেনুগুলি ও গোপবালকদিগকে চুরি করে এক গুহার মধ্যে ঘুমপাড়িয়ে রেখে দিলেন। কিন্তু ফিরে এসে দেখেন যে, সেই-সব ধেনু ও বালক কৃষ্ণকে ঘিরে বিরাজ করছে! তিনি আবার সেই নতুন দলকে চুরি করলেন এবং লুকিয়ে রাখলেন। কিন্তু ফিরে এসে দেখেন, তারা যেমন ছিল, তেমনি সেখানেই রয়েছে। তখন তাঁর জ্ঞাননেত্র উন্মীলিত হল, তিনি দেখতে পেলেন—অনন্ত কোটি ব্রহ্মাণ্ড এবং সহস্র সহস্র ব্রহ্মা কৃষ্ণের দেহে বিরাজমান।

কালীয় নাগ যমুনায় জল বিষাক্ত করছিল বলে তিনি ফণার উপর নৃত্য করছিলেন। ইন্দ্রের পূজা তিনি বারণ করাতে ইন্দ্র কুপিত হয়ে এরূপ প্রবলবেগে বারিবর্ষণ আরম্ভ করলেন যেন সমস্ত ব্রজবাসী বন্যার জলে ডুবে মরে, তখন কৃষ্ণ গোবর্ধন ধারণ করেছিলেন। কৃষ্ণ একটিমাত্র অঙ্গুলি দ্বারা গোবর্ধন পর্বতকে ছাতার মত ঊর্ধ্বে তুলে ধরলেন, আর তার নীচে ব্রজবাসিগণ আশ্রয় গ্রহণ করল।

শৈশব থেকেই তিনি নাগপূজা ও ইন্দ্রপূজার বিরোধী ছিলেন। ইন্দ্রপূজা একটি বৈদিক অনুষ্ঠান। গীতার সর্বত্র ইহা স্পষ্ট যে, তিনি বৈদিক যাগযজ্ঞের পক্ষপাতী ছিলেন না।

জীবনের এই সময়েই তিনি গোপীদের সঙ্গে লীলা করেছিলেন। তখন তাঁর বয়স পনর বৎসর।