১৮. জীবন্মুক্তের গীতি

জীবন্মুক্তের গীতি ১৮

বিস্তারে বিশাল ফণা দলিতা ফণিনী;
প্রজ্বলিত হুতাশন যথা সঞ্চালনে,
শূন্য ব্যোম-পথে যথা উঠে প্রতিধ্বনি
মর্মাহত কেশরীর কুপিত গর্জনে।

প্লাবনের ধারা ঢালে যথা মহা ঘন,
দামিনী ঝলকে তার হৃদি বিদারিয়া,
আত্মার গভীর দেশে করিলে স্পন্দন,
মহাপ্রাণ উচ্চ তত্ত্ব দেয় প্রকাশিয়া।

স্তিমিত হউক নেত্র, অন্তর মূর্ছিত,
বিফল বন্ধুত্ব—প্রেম প্রতারণা হোক,
নিয়তি পাঠাক তার ভীতি অগণিত
পুঞ্জীকৃত অন্ধকারে পথ রুদ্ধ হোক।

রোষ-দীপ্ত মূর্তি ধরি আসুক জগৎ
চূর্ণিতে তোমায়—তবু জানিও নিশ্চয়,
হে আত্মা, তুমি হে দেব, তুমি সে মহৎ,
মুক্তিই গন্তব্য তব—অন্য গতি নয়।

নহি স্বর্গবাসী আমি—নর পশু নয়,
পুরুষ কি নারী নহি, নহি দেহ মন,
স্তম্ভিত নির্বাক যত জ্ঞান-গ্রন্থচয়,
স্বরূপ বর্ণিতে মোর—আমি সেই, ‘সোঽহম্’।

সূর্য সোম বসুন্ধরা জন্মে নাই যবে,
তারাদল ধূমকেতু জন্মেনি যখন,
কালের-ও উদ্ভব যবে হয়নি এ ভবে,
ছিলাম, আছি ও আমি থাকিব তখন।

মেদিনী সুষমাময়ী, ভাস্বর তপন,
এই শান্ত সুধাকর, উজ্জ্বল আকাশ
নিমিত্ত-অধীনে করে গমনাগমন,
জীবন তাদের-ও বদ্ধ, বন্ধনে বিনাশ।

বিশ্ব-মন বিস্তারিয়া অনিত্যের জাল
ধরিয়া তাদের রাখে দৃঢ়বদ্ধ করে,
পৃথিবী নরক স্বর্গ—মন্দ আর ভাল
সে চিন্তা-তন্তুর মাঝে উঠে আর পড়ে।

দেশ আর কাল, আর কার্য ও কারণ,
এ সকলি হয় মাত্র বহিরাবরণ!
ইন্দ্রিয়-মনের পারে মোর অবস্থান।
আমি দ্রষ্টা এ বিশ্বের—সাক্ষী সে মহান্‌!

নহে দ্বৈত, নহে বহু—অদ্বৈতের ভূমি,
একত্বে মিলিত তাই সকলি আমায়।
ভেদ ঘৃণা নাহি মোর, নহি ভিন্ন আমি,
থাকি আমি মগ্ন মাত্র প্রেমের চিন্তায়।

ভাঙ মায়া, মুক্ত হও বন্ধন হইতে,
ভীত নাহি হও—বুঝ রহস্য পরম!
নিজ প্রতিবিম্ব মোরে নারে সন্ত্রাসিতে,
জেনো স্থির—আমি সেই, ‘সোঽহং, সোঽহং’।