১৫. পত্রাবলী ২৫৫-২৬৪

২৫৫*

আমেরিকা
২৩ জানুআরী, ১৮৯৬

প্রিয় আলাসিঙ্গা,
এতদিনে তুমি আমার প্রেরিত ‘ভক্তিযোগের’ কপি (ছাপাবার মত) যথেষ্ট পরিমাণে নিশ্চয় পেয়েছ। আমি ‘ব্রহ্মবাদিন্‌’ কাগজের ২১ ডিসেম্বর তারিখের শেষ সংখ্যা পেয়েছি।

‘ব্রহ্মবাদিন্’-এর গত কয়েক সংখ্যা পড়ে আমার একটু সন্দেহ জাগছিল, তোমরা থিওসফিষ্টদের দলে যোগ দেবে নাকি? এবারে তোমরা ওদের হাতে একেবারে আত্মসমর্পণ করেছ। তোমাদের মন্তব্যের স্তম্ভে থিওসফিষ্টদের বক্তৃতার একটা বিজ্ঞাপন প্রকাশ করলে কেন? থিওসফিষ্টদের সঙ্গে আমার কোনরকম যোগ আছে, সন্দেহ করলে ইংলণ্ড ও আমেরিকা উভয়ত্র আমার কাজের ক্ষতি হবে, আর তা হতেই পারে। সুস্থমস্তিষ্ক ব্যক্তিরা সকলেই তাদের ভ্রান্ত মনে করে; আর তারা যে এরূপ মনে করে, তা ঠিকই। তোমরা তা ভালরূপেই জান। আমার আশঙ্কা হচ্ছে, তোমরা আমার উপর টেক্কা দেবার চেষ্টা করছ। তোমরা মনে করছ, থিওসফিষ্টদের নামে বিজ্ঞাপন দিলে ইংলণ্ডে অনেক গ্রাহক পাবে। তোমরাও যেমন আহাম্মক!

আমি থিওসফিষ্টদের সঙ্গে বিবাদ করতে চাই না; কিন্তু আমার ভাব হচ্ছে, তাদের একদম আমল না দেওয়া। তারা কি বিজ্ঞাপনের জন্য তোমাদের টাকা দিয়েছিল? তোমরা আগ-বাড়িয়ে বিজ্ঞাপন দিতে গেলে কেন? আমি আবার যখন ইংলণ্ডে যাব, তোমাদের জন্য যথেষ্ট গ্রাহক যোগাড় করব।

আমি বিশ্বাসঘাতক কাকেও চাই না। আমি তোমাদের স্পষ্ট বলে রাখছি, কোন ধূর্তের পাল্লায় আমি পড়ছি না। আমার সঙ্গে কপটতা চলবে না। … আমি তোমাদের খুব স্পষ্ট কথাই বলছি। একজন—মাত্র একজন যদি আমায় অনুসরণ করে, সেও ভাল, কিন্তু সে যেন মৃত্যু পর্যন্ত বিশ্বাসী থাকে। সফলতা বা বিফলতা আমি গ্রাহ্যই করি না। সমগ্র জগতে প্রচারকার্যের বৃথা কাজে আমি ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। যখন ইংলণ্ডে ছিলাম, তখন কি তাদের কেউ আমায় সাহায্য করতে এসেছিল? পাগল আর কি! আমি হয় আমার আন্দোলনটিকে সম্পূর্ণ খাঁটি রাখব, তা না হয় মোটেই আন্দোলন চালাব না। ইতি

তোমার চিরস্নেহাবদ্ধ ভ্রাতা
বিবেকানন্দ

আমাদের শাস্ত্রে আছে—‘মদ্ভক্তানাঞ্চ যে ভক্তাস্তে মে ভক্ততমা মতাঃ।’ অর্থাৎ যারা আমার ভক্তগণের ভক্ত, তারা আমার শ্রেষ্ঠ ভক্ত। তুমি প্রভুর সেবিকা; সুতরাং আমি যেখানেই থাকি না কেন, ভগবৎপ্রেরণায় তুমি যে মহোচ্চ ব্রতে দীক্ষিত হয়েছ, তার উদ‍্‍যাপনে যে-কোন প্রকারে সহায়তা করতে পারি, শ্রীকৃষ্ণের অনুগামী আমি তৎসাধনে নিজেকে কৃতার্থ জ্ঞান করব ও তা সাক্ষাৎ প্রভুরই সেবা বলে মনে করব। ইতি

তোমার
বিবেকানন্দ

পুঃ—তোমরা কি ঠিক করলে, তা পত্রপাঠ আমায় লিখবে। আমার এ বিষয়ে মতামত একচুল নড়বার নয়। ইতি

—বি

পুঃ—‘ব্রহ্মবাদিন্’ বেদান্ত প্রচারের জন্য, থিওসফি প্রচারের জন্য নয়। তোমাদের যদি উদ্দেশ্য অন্যরূপ ছিল, তবে গোড়া থেকে আমাকে তা বলা উচিত ছিল। স্পষ্টভাবে নিজেদের অভিপ্রায় না জানিয়ে কার্যকালে অন্যরূপ করতে দেখলে আমি প্রায় ধৈর্য হারিয়ে ফেলি।

—বি

পুঃ—এই হচ্ছে জগৎ! যাদের তুমি সবচেয়ে ভালবাস এবং সবচেয়ে বেশী সাহায্য কর, তারাই তোমায় ঠকাতে চায়। ঘৃণিত সংসার!!!

—বি

২৫৬

[স্বামী যোগানন্দকে লিখিত]

228W. 39th St., নিউ ইয়র্ক
২৪ জানুআরী, ১৮৯৬

যোগেন ভায়া,
অড়হর দাল, মুগের দাল, আমসত্ত্ব, আমসি, আমতেল, আমের মোরব্বা, বড়ি, মসলা সমস্ত ঠিক ঠিকানায় পৌঁছিয়াছে। Bill of Lading-এতে (মাল-চালানের বিলে) নাম সহি করিবার ভুল হইয়াছিল ও invoice (চালান) ছিল না; তজ্জন্য কিঞ্চিৎ গোল হয়। পরে যাহা হউক ভালয় ভালয় সমস্ত দ্রব্য পৌঁছিয়াছে। বহু ধন্যবাদ! এক্ষণে যদি ইংলণ্ডে স্টার্ডির ঠিকানায়—High View, Caversham, Reading-এতে—ঐ প্রকার দাল ও কিঞ্চিৎ আমতেল পাঠাও তো আমি ইংলণ্ডে পৌঁছিলেই পাইব! ভাজা মুগদাল পাঠাইবার আবশ্যক নাই। ভাজা দাল কিছু অধিক দিন থাকিলে বোধ হয় খারাপ হয়ে যায়। কিঞ্চিৎ ছোলার দাল পাঠাইবে। ইংলণ্ডে duty (শুল্ক) নাই—মাল পৌঁছিবার কোন গোল নাই। স্টার্ডিকে চিঠি লিখিয়া দিলেই সে মাল লইবে।

তোমার শরীর এখনও সারে নাই, বড়ই দঃখের বিষয়। খুব ঠাণ্ডা দেশে যেতে পার, শীতকালে যেখানে বরফ বিস্তর পড়ে—যথা দার্জিলিঙ? শীতের গুঁতোয় পেটভায়া দুরস্ত হয়ে যাবে, যেমন আমার হয়েছে। আর ঘি ও মসলা খাওয়া একদম ছেড়ে দিতে পার? মাখন ঘির চেয়ে শীঘ্র হজম হয়। অভিধান পৌঁছিলেই খবর দিব। আমার বিশেষ ভালবাসা জানিবে ও সকলকে জানাইবে। নিরঞ্জনের খবর এখনও ঠিকানা করিতে পার নাই? গোলাপ-মা, যোগীন-মা, রামকৃষ্ণের মা, বাবুরামের মা, গৌর-মা প্রভৃতি সকলকে আমার প্রণামাদি জানাইবে। মহেন্দ্রবাবুর স্ত্রীকে আমার প্রণাম দিবে।

তিনমাস বাদে আমি ইংলণ্ডে আসিতেছি, পুনরায় হজুগের বিশেষ চেষ্টা দেখিবার জন্য। তারপর আসছে শীতে ভারতবর্ষে আগমন। পরে বিধাতার ইচ্ছা। সারদা যে কাগজ বার করতে চায়, তার জন্য বিশেষ যত্ন করিবে। শশীকে যত্ন করিতে বলিবে ও কালী প্রভৃতিকে। কাহারও এক্ষণে ইংলণ্ডে আসিবার আবশ্যক নাই। আমি ভারতে যাইয়া তাদের তৈয়ার করিব। তারপর যেথায় ইচ্ছা যাইবে। কিমধিকমিতি—

বিবেকানন্দ

পুঃ—নিজেরা কিছু করে না এবং অপরের কিছু করিতে গেলে ঠাট্টা করে উড়িয়ে দেয়—এই দোষেই আমাদের জাতের সর্বনাশ হইয়াছে। হৃদয়হীনতা, উদ্যমহীনতা সকল দঃখের কারণ। অতএব ঐ দুটি পরিত্যাগ করিবে। কার মধ্যে কি আছে, কে জানে প্রভু বিনা? সকলকে Opportunity (সুযোগ) দাও। পরে প্রভুর ইচ্ছা। সকলের উপর সমান প্রীতি বড়ই কঠিন; কিন্তু তা না হলে মুক্তি হবে না। ইতি

—বি

২৫৭*

[মিস মেরী হেলকে লিখিত]

228W. 39th St., নিউ ইয়র্ক
১০ ফেব্রুআরী, ১৮৯৬

প্রিয় ভগিনী,
তুমি এখন পর্যন্ত আমার চিঠি পাওনি জেনে অবাক হলাম। তোমার চিঠি পাবার ঠিক পরেই আমি চিঠি লিখেছিলাম এবং নিউ ইয়র্কে আমার তিনটি বক্তৃতাসংক্রান্ত কিছু পুস্তিকা পাঠিয়েছিলাম। এই সভায় প্রদত্ত রবিবারের বক্তৃতাগুলি আজকাল সাঙ্কেতিক লিপিতে নেওয়া হচ্ছে, পরে ছাপা হবে। তিনটি বক্তৃতা নিয়ে দুটি পুস্তিকা হয়েছে, যার অনেকগুলির অনুলিপি আমি তোমাকে পাঠিয়েছিলাম। নিউ ইয়র্কে আরও দু সপ্তাহ থাকব, তারপর ডেট্রয়েট যাব, সেখানে থেকে দু-এক সপ্তাহের জন্য আবার বোষ্টন ফিরে আসব।

নিরন্তর কার্য করার ফলে এ বৎসর আমার স্বাস্থ্য খুবই ভেঙে গেছে। স্নায়ুগুলি খুব দুর্বল হয়ে পড়েছে। এই শীতে আমি একরাত্রিও ভালভাবে ঘুমাইনি। আমি নিশ্চয়ই জানি যে, আমার খাটুনি খুব বেশী হচ্ছে, এখনও ইংলণ্ডে এক বৃহৎ কার্য বাকী আছে।

আমাকে তা সম্পূর্ণ করতে হবে এবং তারপর আশা করি ভারতে ফিরে বাকী জীবনটা বিশ্রাম করে কাটাতে পারব।

এখন আমি বিশ্রামের আকাঙ্ক্ষা করছি। আশা করি, তা কিছুটা পাব এবং ভারতের লোকেরা আমাকে রেহাই দেবে। খুব ইচ্ছা হয়, কয়েক বছরের জন্য বোবা হয়ে যাই এবং একেবারে কথা না বলি!

এই সকল পার্থিব সংগ্রাম ও দ্বন্দ্বের জন্য আমি জন্মাইনি। স্বভাবতঃ আমি স্বপ্নচারী এবং শান্তিপ্রিয়। আমি আজন্ম আদর্শবাদী, স্বপ্নজগতেই আমার বাস, বাস্তবের সংস্পর্শ আমার স্বপ্নের বিঘ্ন ঘটায় এবং আমাকে অসুখী করে তোলে। ঈশ্বরের ইচ্ছাই পূর্ণ হোক্!

তোমাদের চার বোনের কাছে আমি চিরদিন কৃতজ্ঞ; এ দেশে আমি যা কিছু পেয়েছি তার জন্য তোমাদের কাছে ঋণী। তোমরা নিরন্তর পবিত্র ও সুখী হও। আমি যেখানেই থাকি না কেন, তোমাদের সর্বদা গভীরতম কৃতজ্ঞতা ও আন্তরিক ভালবাসার সঙ্গে স্মরণ করব। আমার সমগ্র জীবনটাই স্বপ্নের পর স্বপ্নের সমাবেশ। সচেতন স্বপ্নচারী হওয়া আমার উচ্চাভিলাষ, বস্। সকলকে আমার ভালবাসা—ভগিনী জোসেফিনকে।

সতত তোমার স্নেহবদ্ধ ভ্রাতা
বিবেকানন্দ

২৫৮*

[মিঃ স্টার্ডিকে লিখিত]

228W.39th St., নিউ ইয়র্ক
১৩ ফেব্রুআরী, ১৮৯৬

স্নেহাশীর্বাদভাজনেষু,
ভারতবর্ষ থেকে যে সন্ন্যাসী আসবেন, তিনি তোমাকে অনুবাদের কাজে এবং অন্য কাজেও সাহায্য করবেন নিশ্চয়। অতঃপর আমি যখন (ওখানে) যাব, তখন তাঁকে আমেরিকায় পাঠিয়ে দেব। আজ আর একজন সন্ন্যাসীকে তালিকাভুক্ত করা হল। এবারের আগন্তুকটি একজন পুরুষ; সে খাঁটি আমেরিকান এবং ধর্মপ্রচারক হিসাবে এদেশে তার কিছু খ্যাতি আছে। তার নাম ছিল ডাঃ ষ্ট্রীট; এখন সে যোগানন্দ, কারণ যোগের দিকেই তার সব ঝোঁক।

আমি এখান য়েকে ‘ব্রহ্মবাদিন্‌’-পত্রিকায় নিয়মিতভাবে কার্যবিবরণ পাঠাচ্ছি। সে-সব শীঘ্রই প্রকাশিত হবে। ভারতে কিছু পৌঁছাতে কি দীর্ঘ সময়ই না লাগে! আমেরিকায় কাজ সুন্দরভাবে গড়ে উঠছে। শুরু থেকেই কোন ভোজবাজি না থাকায় আমেরিকার সমাজের সেরা লোকদের দৃষ্টি বেদান্তের দিকে আকৃষ্ট হচ্ছে। ফরাসী অভিনেত্রী সারা বার্নহার্ড এখানে ‘ইৎশীল’ (lziel) অভিনয় করেছেন। এটি কতকটা ফরাসী ধাঁজে উপস্থাপিত বুদ্ধজীবন। এতে রাজনর্তকী ইৎশীল বোধিদ্রুম-মূলে বুদ্ধকে প্রলুব্ধ করতে সচেষ্ট; আর বুদ্ধ তাকে জগতের অসারতা উপদেশ দিচ্ছেন। সে কিন্তু সারাক্ষণ বুদ্ধের কোলেই বসে আছে। যা হোক, শেষ রক্ষাই রক্ষা—নর্তকী বিফল হল! মাদাম বার্নহার্ড ইৎশীলের ভূমিকায় অভিনয় করেন।

আমি এই বুদ্ধ-ব্যাপারটা দেখতে গিয়েছিলাম। মাদাম কিন্তু শ্রোতৃবৃন্দের মধ্যে আমায় দেখতে পেয়ে আলাপ করতে চাইলেন। আমার পরিচিত এক সম্ভ্রান্ত পরিবার এই সাক্ষাতের ব্যবস্থা করলেন। তাতে মাদাম ছাড়া বিখ্যাত গায়িকা মাদাম মোরেল এবং শ্রেষ্ঠ বৈদ্যুতিক টেস‍্‍লা ছিলেন। মাদাম (বার্নহার্ড) খুব সুশিক্ষিতা মহিলা এবং দর্শনশাস্ত্র অনেকটা পড়ে শেষ করেছেন। মোরেল ঔৎসুক্য দেখাচ্ছিলেন; কিন্তু মিঃ টেস‍্‍লা বৈদান্তিক প্রাণ ও আকাশ এবং কল্পের তত্ত্ব শুনে মুগ্ধ হলেন। তাঁর মতে আধুনিক বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে কেবল এই তত্ত্বগুলিই গ্রহণীয়। আকাশ ও প্রাণ আবার জগদ্ব্যপী মহৎ, সমষ্টি মন বা ঈশ্বর থেকে উৎপন্ন হয়। মিঃ টেস‍্‍লা মনে করেন, তিনি গণিতের সাহায্যে দেখিয়ে দিতে পারেন যে, জড় ও শক্তি উভয়কে অব্যক্ত শক্তিতে পরিণত করা যেতে পারে। আগামী সপ্তাহে এই নূতন পরীক্ষামূলক প্রমাণ দেখবার জন্য তাঁর কাছে আমার যাবার কথা আছে।

তা যদি প্রমাণিত হয়ে যায়, তবে বৈদান্তিক সৃষ্টিতত্ত্ব দৃঢ়তম ভিত্তির উপর স্থাপিত হবে। আমি এক্ষণে বেদান্তের সৃষ্টিতত্ত্ব ও পরলোকতত্ত্ব নিয়ে খুব খাটছি। আমি স্পষ্টই আধুনিক বিজ্ঞানের সঙ্গে বেদান্তের ঐ তত্ত্বগুলি সম্পূর্ণ ঐক্য দেখছি; তাদের একটা পরিষ্কার হলেই সঙ্গে সঙ্গে অপরটাও পরিষ্কার হয়ে যাবে। পরে প্রশ্নোত্তরাকারে এই বিষয়ে একখানা বই লিখব মনে করছি।৯২ উহার প্রথম অধ্যায়ে থাকবে সৃষ্টিতত্ত্ব—তাতে বেদান্তমতের সঙ্গে আধুনিক বিজ্ঞানের সামঞ্জস্য দেখান হবে।

ব্রহ্ম
|
= নিরপেক্ষ পূর্ণসত্তা
মহৎ বা ঈশ্বর = আদ্যা সৃষ্টিশক্তি
প্রাণ ও আকাশ শক্তি ও জড়

পরলোকতত্ত্ব কেবল অদ্বৈতবাদের দিক্ থেকে দেখান হবে। অর্থাৎ দ্বৈতবাদী বলেন—মৃত্যুর পর আত্মা প্রথমে আদিত্যলোকে, পরে চন্দ্রলোকে ও সেখান থেকে বিদ্যুল্লোকে যান; সেখানে একজন পুরুষ এসে তাঁকে ব্রহ্মলোকে নিয়ে যায়। (অদ্বৈতবাদী বলেন, তারপর তিনি নির্বাণপ্রাপ্ত হন।)

এখন অদ্বৈতবাদীর মতে আত্মার যাওয়া-আসা নাই, আর এই যে-সব বিভিন্ন লোক বা জগতের স্তরসমূহ—এগুলি আকাশ ও প্রাণের নানাবিধ মিশ্রণে উৎপন্ন মাত্র। অর্থাৎ সর্বনিম্ন বা অতি স্থূল স্তর হচ্ছে আদিত্যলোক বা এই পরিদৃশ্যমান জগৎ—এখানে প্রাণ জড়-শক্তিরূপে ও আকাশ স্থূলভূতরূপে প্রকাশ পাচ্ছে। তারপর হচ্ছে চন্দ্রলোক—তা আদিত্যলোককে ঘিরে আছে। এ আমাদের এই চন্দ্র একেবারেই নয়, এ দেবগণের আবাসভূমি—অর্থাৎ এখানে প্রাণ মনঃশক্তিরূপে এবং আকাশ তন্মাত্র বা সূক্ষ্মভূতরূপে প্রকাশ পাচ্ছে। এরও ওপর বিদ্যুল্লোক—অর্থাৎ এমন এক অবস্থা, যেখানে প্রাণ আকাশের সঙ্গে প্রায় অভিন্ন বললেই হয় আর তখন বলা কঠিন যে, বিদ্যুৎ জিনিষটা জড় না শক্তি। তারপর ব্রহ্মলোক—সেখানে প্রাণও নেই, আকাশও নেই; সেখানে এই উভয়ই মূল মন বা আদ্যাশক্তিতে সম্মিলিত হয়েছে। আর এখানে প্রাণ বা আকাশ না থাকায় (ব্যষ্টি) জীব সমস্ত বিশ্বকে সমষ্টিরূপে অথবা মহতের বা বুদ্ধির সংহতিরূপে কল্পনা করে। এঁকেই পুরুষ বলে বোধ হয়—ইনি সমষ্টি আত্মাস্বরূপ, কিন্তু ইনিও সেই সর্বাতীত নিরপেক্ষ সত্তা নন—কারণ এখানেও বহুত্ব রয়েছে। এইখান থেকেই জীব শেষে তার চরম লক্ষ্যস্বরূপ একত্বকে অনুভব করে। অদ্বৈতমতে জীবের আসা-যাওয়া নেই। এই দৃশ্যগুলি ক্রমাম্বয়ে জীবের সামনে আবিভূর্ত হতে থাকে; আর এই যে বর্তমান দৃশ্যজগৎ দেখা যাচ্ছে, তাও এইরূপেই সৃষ্ট হয়েছে। সৃষ্টি ও প্রলয় অবশ্য এই ক্রমেই হয়ে থাকে—তবে প্রলয় মানে পূর্বাবস্থায় ফিরে যাওয়া, আর সৃষ্টি মানে বাইরে নিক্ষিপ্ত হয়ে আসা।

আর যখন প্রত্যেক জীব কেবল নিজের জগৎ মাত্র দেখতে পায়, তখন ঐ জগৎ তার বন্ধন অবস্থার সঙ্গে সঙ্গে সৃষ্ট হয়, এবং তার মুক্তির সঙ্গে সঙ্গে চলে যায়—যদিও অন্যান্য বদ্ধ জীবের পক্ষে ঐ জগৎ থেকে যায়। নাম-রূপ হচ্ছে জগতের উপাদান। সমুদ্রের একটা তরঙ্গকে ততক্ষণই তরঙ্গ বলি, যতক্ষণ তা নাম-রূপের দ্বারা সীমাবদ্ধ। তরঙ্গ শান্ত হলে তা সমুদ্রই হয়ে যায়, আর সেই নাম ও রূপ তখনই চিরকালের মত অন্তর্হিত হয়। সুতরাং যে জলটা নাম-রূপের দ্বারা তরঙ্গাকারে পরিণত হয়েছিল, সেই জল ছাড়া তরঙ্গের নাম-রূপের কোন স্বতন্ত্র অস্তিত্ব নেই, অথচ নাম-রূপকেও তরঙ্গ বলা চলে না। তরঙ্গ জলে পরিণত হলেই নাম-রূপ ধ্বংস হয়ে যায়। তবে অন্যান্য তরঙ্গগুলির অন্যান্য নাম-রূপ থাকে বটে। এই নাম-রূপকেই বলে মায়া, আর জলই ব্রহ্ম। তরঙ্গ জল ছাড়া আর কিছুই ছিল না; অথচ তরঙ্গরূপে তার নাম-রূপ ছিল। আবার এই নাম-রূপ এক মুহূর্তের জন্য তরঙ্গ থেকে পৃথক্‌ ভাবে থাকতে পারে না, যদিও জলস্বরূপে সেই তরঙ্গটি চিরকালই নাম-রূপ থেকে পৃথক্‌ থাকতে পারে। কিন্তু যেহেতু তরঙ্গ থেকে নাম-রূপকে কখনই পৃথক্‌ করা চলে না, সেইহেতু তারা যে ‘আছে’ তা বলা যেতে পারে না। কিন্তু তারা একেবারে যে শূন্য, তাও নয়—একেই বলে মায়া।

আমি এই সকল ভাবকে সাবধানে রূপ দিতে চাই; তুমি নিশ্চয় এক নিমেষেই বুঝে নেবে, আমি ঠিক পথ ধরেছি। মন চিত্ত বুদ্ধি ইত্যাদির তত্ত্ব আরও ভাল করে দেখাতে গেলে শারীর-বিজ্ঞান (Physiology) আরও বেশী করে আলোচনা করতে হবে। উচ্চতর ও নিম্নতর কেন্দ্রগুলির সম্বন্ধে আলোচনা করতে হবে। তবে আমি এখন এ বিষয়ে এমন স্পষ্ট আলোক দেখতে পাচ্ছি, যা সমস্ত ভোজবাজি থেকে মুক্ত। আমি শুষ্ক সুকঠিন যুক্তিকে প্রেমের মধুরতম রসে কোমল করে তীব্র কর্মের মসলাতে সুস্বাদু করে এবং যোগের পাকশালায় রান্না করে পরিবেশন করতে চাই, যাতে শিশুরা পর্যন্ত তা হজম করতে পারে। আমার আশীর্বাদ ও ভালবাসা জানবে। ইতি

তোমাদের
বিবেকানন্দ

২৫৯*

১৭ ফেব্রুআরী, ১৮৯৬

প্রিয় আলাসিঙ্গা,
এইমাত্র তোমার পত্র পেয়ে এবং তোমরা সকলে সঙ্কল্পে দৃঢ়ব্রত আছ জেনে খুব খুশী হলাম। আমার চিঠিগুলিতে খুব কড়া কথা ব্যবহার করেছি; সেজন্য তুমি কিছু মনে করো না, কারণ তুমি জানই তো মাঝে মাঝে আমার মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। কাজটি ভয়ানক কঠিন, আর যতই তা বাড়ছে, ততই কঠিনতর হয়ে দাঁড়াচ্ছে। আমার দীর্ঘ বিশ্রামের প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। অথচ এখনই আমার সম্মুখে ইংলণ্ডে বিস্তর কাজ পড়ে আছে। তোমায় অত্যন্ত পরিশ্রম করতে হচ্ছে জেনে আমি বড়ই দুঃখিত হলাম।

ধৈর্য ধরে থাক, বৎস! কাজ এত বাড়বে যে, তুমি ভাবতেও পার না। আমরা আশা করছি, এখানে শীঘ্রই বহু সহস্র গ্রাহক সংগ্রহ করতে পারব, আর আমি ইংলণ্ডে গেলে সেখানেও অনেক পাব। স্টার্ডি ‘ব্রহ্মবাদিন্’-এর জন্য তোড়জোড় করছে। সবই সুন্দর, খুব সুন্দর চলছে। তুমি পত্রিকাখানিকে একটা কমিটির হাতে দেবার যে সঙ্কল্প করেছ, আমি তা মোটেই অনুমোদন করি না। ও-রকম কিছু করো না। পত্রিকার সমস্ত পরিচালনা নিজ হাতে রাখ এবং তুমিই স্বত্বাধিকারী থাক। পরে কি করা যায় দেখা যাবে। তুমি ভয় পেও না। আমি তোমায় কথা দিচ্ছি—যেমন করেই হোক, আমি ব্যয় নির্বাহ করব। কমিটি করা মানে—নানা রুচির লোক আসবে তাদের বিভিন্ন খেয়াল প্রচার করতে, আর অবশেষে সবটা পণ্ড করবে। তোমার ভগ্নীপতি পত্রিকাখানি সুন্দরভাবে সম্পাদনা করছেন, তিনি বিজ্ঞ পণ্ডিত ও অদম্য কর্মী। তাঁকে আমার অশেষ শ্রদ্ধা জানাবে এবং আর সব বন্ধুকেও জানাবে। সকল কাজেই কৃতকার্য হবার পূর্বে শত শত বাধা-বিঘ্নের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হতে হয়। যারা লেগে থাকবে, তারা শীঘ্রই হোক আর বিলম্বেই হোক আলো দেখতে পাবে।

১| এ এই যে আমি তোমায় চিঠি লিখছি, এরই সঙ্গে সঙ্গে গত রবিবারের বক্তৃতার ফলে আমার সব কয়খানি হাড়ে ব্যথা চলেছে। আমি এক্ষণে মার্কিন সভ্যতার কেন্দ্রস্বরূপ নিউ ইয়র্ককে জাগাতে সমর্থ হয়েছি; কিন্তু এর জন্য আমাকে ভয়ানক সংগ্রাম করতে হয়েছে। গত দু-বৎসর এক পয়সাও আসেনি। হাতে যা-কিছু ছিল, তা প্রায় সবই এই নিউ ইয়র্ক ও ইংলণ্ডের কাজে ব্যয় করেছি। এখন এমন দাঁড়িয়েছে যে, কাজ চলে যাবে।

তারপর ভাব দেখিঃ হিন্দুভাবগুলি ইংরেজী ভাষায় অনুবাদ করা, আবার শুষ্ক দর্শন, জটিল পুরাণ ও অদ্ভুত মনোবিজ্ঞানের মধ্য থেকে এমন ধর্ম বের করা, যা একদিকে সহজ সরল ও সাধারণের হৃদয়গ্রাহী হবে, আবার অন্যদিকে বড় বড় মনীষিগণের উপযোগী হবে! এ যারা চেষ্টা করেছে, তারাই বলতে পারে—কি কঠিন ব্যাপার! সূক্ষ্ম অদ্বৈততত্ত্বকে প্রাত্যহিক জীবনের উপযোগী জীবন্ত ও কবিত্বময় করতে হবে; অসম্ভবরূপ জটিল পৌরাণিক তত্ত্বসকলের মধ্য থেকে জীবন্ত প্রকৃত চরিত্রের দৃষ্টান্তসকল বের করতে হবে; আর বিভ্রান্তিকর যোগশাস্ত্রের মধ্য থেকে বৈজ্ঞানিক ও কার্যে পরিণত করবার উপযোগী মনস্তত্ত্ব বের করতে হবে, আবার এগুলিকে এমন ভাবে প্রকাশ করতে হবে যাতে একটি শিশুও বুঝতে পারে। এই আমার জীবনব্রত। প্রভুই জানেন, আমি কত দূর কৃতকার্য হব। কর্মে আমাদের অধিকার, ফলে নয়। বড়ই কঠিন কাজ, বৎস, বড়ই কঠিন। যতদিন না অপরোক্ষানুভূতি ও পূর্ণ ত্যাগের ভাব ধারণা করবার উপযুক্ত একদল শিষ্য তৈরী হচ্ছে, ততদিন এই কামকাঞ্চনের ঘূর্ণিপাকের মধ্যে আপনাকে স্থির রেখে নিজ আদর্শ ধরে থাকা প্রকৃতই কঠিন ব্যাপার। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ, এরই মধ্যে অনেকটা কৃতকার্য হওয়া গেছে। আমাকে না বুঝবার জন্য আমি মিশনরীদের বা অন্যদের আর দোষ দিই না; তারা এ ছাড়া আর কি করতে পারত? তারা তো জীবনে পূর্বে কখনও এমন লোক দেখেনি, যে কামিনীকাঞ্চনের মোটেই ধার ধার না। প্রথমে যখন তারা দেখলে, তারা বিশ্বাস করতে পারলে না—পারবেই বা কিরূপে? তুমি যদি কখনও ভেবে থাক যে, ব্রহ্মচর্য ও পবিত্রতা সম্বন্ধে পাশ্চাত্যজাতিদের ধারণা ভারতীয়দেরই অনুরূপ, তাহলে তুমি নিতান্তই ভ্রান্ত। তাদের অনুরূপ শব্দ হচ্ছে বীর্য ও সাহস (virtue and courage)। তাদের সাধুত্বের আদর্শ ঐ পর্যন্ত। তাদের মতে বিবাহাদি স্বভাবসিদ্ধ ধর্ম—এর অভাবে মানুষ অসাধু; আর যে ব্যক্তি সম্ভ্রান্ত মহিলাদের সম্মান না করে সে তো অসৎ। … এখন লোকেরা দলে দলে আমার কছে আসছে। এখন শত শত লোক বুঝেছে যে, এমন লোক আছে, যারা নিজেদের কামবৃত্তিকে সত্যই সংযত করতে পারে; আর সাধুতা ও সংযমের প্রতি তাদের ভক্তিশ্রদ্ধাও বাড়ছে। যারা ধৈর্য ধরে থাকে, তাদের সব কিছুই জুটে যায়। তুমি আমার অফুরন্ত আশীর্বাদ জানবে। ইতি

তোমার
বিবেকানন্দ

২৬০*

[মিঃ স্টার্ডিকে লিখিত]

228W., 39th St., নিউ ইয়র্ক
২৯ ফেব্রুআরী, ১৮৯৬

স্নেহাশীর্বাদভাজনেষু,
সম্ভব হলে মে মাসের আগেই আমি যাচ্ছি। এর জন্য তোমায় উদ্বিগ্ন হতে হবে না। পুস্তকাটি সুন্দর হয়েছে। খবরের কাগজের অংশগুলি পেলে পাঠিয়ে দেব।

পুস্তক-পুস্তিকাগুলি এখানে এভাবেই প্রকাশিত হয়েছে। নিউ ইয়র্কে একটি সমিতি গঠিত হয়েছে। তারাই সাঙ্কেতিক লেখার ও ছাপার যাবতীয় খরচা দিয়েছে, এই শর্তে যে বইগুলির স্বত্বাধিকার তাদের থাকবে। সুতরাং এই পুস্তিকা ও পুস্তকগুলি তাদের। একখানা বই—‘কর্মযোগ’ ইতোমধ্যেই প্রকাশিত হয়েছে; তার চেয়ে অনেক বড় ‘রাজযোগ’ ছাপা চলছে; ‘জ্ঞানযোগ’ পরে প্রকাশিত হতে পারে। কথা-বলার ভাষা হবার ফলে বইগুলি জনপ্রিয়তা লাভ করবে, পূর্বেই তা লক্ষ্য করেছ। আপত্তিকর যা কিছু ছিল—সব ছেঁটে দিয়েছি, এবং এঁরা বইগুলি বার করতে সাহায্য করেছে। বইগুলি সমিতির সম্পদ, মিসেস ওলি বুল এর প্রধান পৃষ্ঠপোষক, মিসেস লেগেটও আছেন।

এখন বইগুলি যে তাঁদের হবে, এটা তো ন্যায়সঙ্গত। তাঁরাই প্রকাশক বলে অন্য প্রকাশকদের হস্তক্ষেপের কোন ভয় নেই।

যদি ভারত থেকে বই আসে, তবে সেগুলি রেখে দেবে।

সাঙ্কেতিক লেখক গুডউইন একজন ইংরেজ; সে আমার কাজে এতটা আগ্রহান্বিত হয়ে পড়েছে যে, আমি তাকে ব্রহ্মচারী করে নিয়েছি, সে আমার সঙ্গে ঘুরছে, আমরা একসঙ্গে ইংলণ্ডে যাব। সে বরাবরের মত আমার খুব কাজে লাগবে।

আশীর্বাদ সহ তোমাদের
বিবেকানন্দ

২৬১

বোষ্টন
(১ম সপ্তাহ) মার্চ, ১৮৯৬

Dear Sarada (প্রিয় সারদা),৯৩
তোমার পত্রে সবিশেষ অবগত হইলাম। মহোৎসব উপলক্ষে আমি এক cable (তার) পাঠাই, তাহার কোন সংবাদ তো লিখ নাই দেখিতেছি। কয়েক মাস পূর্বে শশী যে সংস্কৃত অভিধান পাঠাইয়াছিল, তাহা তো আজিও পৌঁছে নাই। … আমি শীঘ্রই ইংলণ্ড যাইতেছি। শরতের এখন আসিবার কোনই আবশ্যক নাই; কারণ আমি নিজেই ইংলণ্ড যাইতেছি। যাদের মনের ঠিকানা করতে ছ-মাস লাগে, তাদের আমার দরকার নাই। তাকে ইওরোপ বেড়াবার জন্য আমি ডাকিও নাই এবং টাকাও আমার নাই। অতএব তাকে আসতে বারণ করবে, কাউকেই আসতে হবে না।

টিবেটের (তিব্বতের) সম্বন্ধে তোমার পত্র পাঠ করে তোমার বুদ্ধির উপর হতশ্রদ্ধা হল। প্রথম—নোটোভিচ-এর বই সত্য—nonsence (বাজে কথা)! তুমি কি original (মূল গ্রন্থ) দেখেছ বা India-য় (ভারতে) এনেছ? দ্বিতীয়—Jesus এবং Samaritan Woman-এর (যীশু ও সামারিয়া-দেশীয় নারীর) ছবি কৈলাসের মঠে দেখেছ। কি করে জানলে সে যীশুর ছবি, ঘিষুর নয়? যদি তাও হয়, কি করে জানলে যে, কোন ক্রিশ্চান লোকের দ্বারা তাহা উক্ত মঠে স্থাপিত হয় নাই? টিবেটিয়ানদের (তিব্বতীদের) সম্বন্ধে তোমার মতামতও অযথার্থ। তুমি heart of Tibet (তিব্বতের ভিতরটা) তো দেখ নাই—only a fringe of the traderoute (শুধু বাণিজ্য-পথের ধারে ধারে একটুখানি দেখিয়াছ)। ঐসকল স্থানে কেবল dregs of nation (জাতের নিকৃষ্ট ভাগটাই) দেখতে পাওয়া যায়। কলকেতার চীনেবাজার আর বড়বাজার দেখে যদি কেউ বাঙালীমাত্রকে চোর বলে, তা কি যযার্থ হয়?

শশীর সঙ্গে বিশেষ পরামর্শ করে article (প্রবন্ধ) প্রভৃতি লিখবে … । ইতি

নরেন্দ্র

২৬২*

[মিঃ স্টার্ডিকে লিখিত]

নিউ ইয়র্ক
১৭ মার্চ, ১৮৯৬

প্রেমাস্পদেষু—,
এইমাত্র তোমার শেষ চিঠিখানা পেলাম, খুব ভয় পেয়ে গেছি।

বক্তৃতাগুলি হয়েছিল কয়েকজন বন্ধুর উদ্যোগে, তাঁরা সাঙ্কেতিক লিপির এবং অন্য সব কিছুর খরচ দেন—এই শর্তে যে একমাত্র তাঁদেরই সেগুলি প্রকাশ করার অধিকার থাকবে। সেইমত তাঁরা ইতোমধ্যেই রবিবারের বক্তৃতাগুলি এবং রাজযোগ, কর্মযোগ ও জ্ঞানযোগ বিষয়ে তিনটি বই ছাপিয়েছেন। বিশেষতঃ ‘রাজযোগে’র অনেকখানি পরিবর্তন করা হয়েছে এবং পতঞ্জলির ‘যোগসূত্রে’র অনুবাদসহ ঢেলে সাজান হয়েছে। রাজযোগ লংম্যানদের হাতে। বইগুলি ইংলণ্ডে ছাপানর কথায় এখানকার বন্ধুরা খুব চটে গিয়েছেন; যেহেতু আইনতঃ আমি সেগুলি তাঁদের দিয়ে দিয়েছি। এখন কি করা যায়—বুঝতে পারছি না। পুস্তিকাগুলি প্রকাশের ব্যাপারটা গুরুতর নয়, কিন্তু পুস্তকগুলির এত পুনর্বিন্যাস ও পরিবর্তন করা হয়েছে যে, আমেরিকান সংস্করণ দেখে ইংরেজী সংস্করণ চেনাই যাবে না। এখন অনুরোধ করছি—এই বইগুলি প্রকাশ করো না, অন্যথা আমি বড় অপ্রস্তত হয়ে যাব এবং অফুরন্ত ঝগড়ার সৃষ্টি হয়ে আমার আমেরিকার কাজ পণ্ড হয়ে যাবে।

ভারতের শেষ চিঠিতে জেনেছি যে, একজন সন্ন্যাসী ভারত থেকে রওনা হয়েছেন। আমি মিস মূলারের কাছ থেকে একখানা সুন্দর চিঠি পেয়েছি, মিস ম্যাকলাউডের কাছ থেকেও একখানা; লেগেট পরিবার আমার প্রতি খুব অনুরক্ত হয়ে পড়েছে।

আমি মিঃ চ্যাটার্জি সম্পর্কে কিছুই জানি না। অন্য সূত্র থেকে শুনতে পেলাম যে, তাঁর হল অর্থকষ্ট—থিওসফিষ্টরা তাঁকে টাকা দিতে পারছে না। তাছাড়া ভারত থেকে একজন অপেক্ষাকৃত শক্তিমান্ লোক আসছে, তার তুলনায় তিনি আমাকে যেটুকু সাহায্য করতে পারবেন, তা যৎসামান্য। তাঁর সঙ্গে ঐ পর্যন্তই। আমাদের তাড়াহুড়ো করার প্রয়োজন নেই।

তোমাকে আবার অনুরোধ করছি, এই পুস্তক প্রকাশের ব্যাপারটা ভেবে দেখো, এবং মিসেস বুলকে কয়েকটি চিঠি লেখো ও তাঁর মাধ্যমে আমেরিকার বেদান্তের বন্ধুদের মতামত জিজ্ঞেস কর। মনে রেখো আমাদের প্রচারিত নীতি ‘সকল প্রাণীর একত্ব’; আর জাতীয়তামূলক সমস্ত ভাবই দুষ্ট কুসংস্কার মাত্র। অধিকন্তু আমার নিশ্চিত ধারণা যে, যিনি অপরের মতে সায় দিতে প্রস্তুত, শেষে তিনি তাঁর নিজ মতেরই জয় প্রত্যক্ষ করেন। সর্বদা নতিস্বীকারই শেষ পর্যন্ত জয়লাভ করে। আমাদের সকল বন্ধুকে ভালবাসা।

ভালবাসা ও আশীর্বাদসহ তোমাদের
বিবেকানন্দ

পুনঃ—আমি মার্চ মাসেই যত তাড়াতাড়ি পারি নিশ্চয় যাচ্ছি।

২৬৩*

[মিস মেরী হেলকে লিখিত]

প্রিয় ভগিনী,
আমার ভয় হচ্ছে—তুমি ক্ষুণ্ণ হয়েছ, তাই আমার একটি চিঠিরও জাবাব দাওনি। তা এখন হাজার ক্ষমা চাইছি। সৌভাগ্যক্রমে কমলা রঙের কাপড় পেয়ে গেছি এবং যত শীঘ্র পারি একটি কোট তৈরী করে নিচ্ছি। শুনে আনন্দিত হলাম যে, মিসেস বুলের সঙ্গে তোমার দেখা হয়েছিল। তিনি সত্যি মহীয়সী নারী এবং সহৃদয় বন্ধু। একটি কথা ভগিনী, ঘরে দুটি খুব পাতলা সংস্কৃত পুস্তিকা আছে। যদি অসুবিধা না হয়, সেগুলি দয়া করে পাঠিয়ে দিও। ভারত থেকে বইগুলি নিরাপদে এসে পৌঁছেছে এবং তার জন্য আমাকে কোন শুল্ক দিতে হয়নি। কম্বলগুলি ও গালিচা এখনও এসে পৌঁছয়নি জেনে আমি অবাক হয়েছি। মাদার টেম্পলের সঙ্গে আর দেখা করতে যেতে পারিনি; সময় পাইনি। যখনই একটু সময় পাই গ্রন্থাগারে কাটাই।

তোমাদের সকলকে আমার চিরদিনের ভালবাসা ও কৃতজ্ঞতা।

তোমাদের সতত স্নেহশীল ভ্রাতা
বিবেকানন্দ

পুঃ—মিঃ হাউ বরাবরই ক্লাসে আসছেন, এই শেষ ক-দিন আসেননি। মিস হাউকে আমার ভালবাসা জানাবে।

—বি

২৬৪*

বোষ্টন
২৩ মার্চ, ১৮৯৬

প্রিয় আলাসিঙ্গা,
তোমার চিঠির উত্তর আগে দিতে পারিনি; আর এখন আমায় বেজায় তাড়াতাড়ি করতে হচ্ছে। সম্প্রতি যাদের আমি সন্ন্যাস দিয়েছি, তাদের মধ্যে সত্যই একজন স্ত্রীলোক, ইনি মজুরদের নেত্রী ছিলেন; বাকী সব পুরুষ। ইংলণ্ডে আমি আরও কয়েকজনকে সন্ন্যাস দেব, তারপর তাদের আমার সঙ্গে ভারতে নিয়ে যাবার চেষ্টা করব। হিন্দুদের চেয়ে এইসব ‘সাদা মুখ’ সেখানে বেশী প্রভাব বিস্তার করবে; তা ছাড়া তাদের কাজ করবার শক্তিও বেশী, হিন্দুরা তো মরে গেছে। ভারতের একমাত্র ভরসার স্থল জনসাধারণ—অভিজাত সম্প্রদায় তো শারীরিক ও নৈতিক হিসাবে মরে গেছে।

হরমোহন সম্বন্ধে বক্তব্য এই যে, আমি দীর্ঘকাল পূর্বেই তাকে আমার বক্তৃতাগুলি ছাপাবার স্বাধীনতা দিয়েছিলাম, কারণ সে আমার পুরানো বন্ধু, সাচ্চা ভক্ত ও অত্যন্ত গরীব।

‘ব‍্রহ্মবাদিন্’-এ লম্বা লম্বা সংস্কৃত প্রবন্ধ থাকায় ইওরোপ ও আমেরিকায় উহা চলার সম্ভাবনা বড়ই অল্প। তুমি এটাকে সংস্কৃতে ছাপালেই তো পার? সংস্কৃত পারিভাষিক শব্দ এবং অফুরন্ত সংস্কৃত শ্লোকাদি উদ্ধৃত করলে হিন্দুদের ও সংস্কৃতজ্ঞ পাশ্চাত্য পণ্ডিতদের ‍হয়তো বেশ সাহায্য হতে পারে, কিন্ত সাধারণ পাশ্চাত্যবাসী তো আর তোমার হিন্দু দর্শনের ধার ধারে না! একান্ত যদি রাখতে চাও তো না হয় একটা প্রবন্ধ পাণ্ডিত্যপূর্ণ কর—বাকীগুলিতে সংস্কৃত শব্দ না থাকাই উচিত এবং লেখা হালকা হওয়া উচিত। আমার যে সাফল্য হচ্ছে, তার কারণ আমার সহজ ভাষা। আচার্যের মহত্ত্ব হচ্ছে—তাঁর ভাষার সরলতা। তুমি যদি জনসাধারণের উপযুক্ত করে বেদান্ত সম্বন্ধে লিখতে পার, তবে ‘ব‍্রহ্মবাদিন্’ এখানে জনপ্রিয় হবে—নতুবা নয়। যে কয়জন গ্রাহক হয়েছে, তারা শুধু আমার প্রতি ব্যক্তিগত শ্রদ্ধার ফলে।

শ্রীগুরু মহারাজের জন্মতিথিতে আমি ভারতে যে তার পাঠিয়েছিলাম, সেটি তারা পেয়েছে কিনা একটু খোঁজ নিয়ে দেখো তো।

আগামী মাসে ইংলণ্ডে যাচ্ছি। আমার ভয় হয়—আমার খাটুনি অত্যধিক হয়ে পড়ছে; এই দীর্ঘ একটানা পরিশ্রমে আমার স্নায়ুমণ্ডলী যেন ছিঁড়ে গেছে। তোমাদের কাছ থেকে সহানুভূতি আমি কিছুমাত্র চাই না; শুধু এইজন্য লিখছি যে, তোমরা আমার কাছ থেকে বেশী কিছু আশা করো না। যতদূর ভালভাবে সম্ভব কাজ করে যাও। আমার দ্বারা সম্প্রতি কোন বড় কাজ হবে, এমন আশা নেই বলেই মনে হয়। যা হোক সাঙ্কেতিক প্রণালীতে আমার বক্তৃতাগুলি লিখে নেবার ফলে অনেকটা সাহিত্য গড়ে উঠেছে দেখে আমি খুশী। চারিখানি বই তৈরী হয়ে গেছে। একখানি বেরিয়ে গেছে, ‘পাতঞ্জলসূত্রে’র অনুবাদ সহ ‘রাজযোগে’র বইখানি ছাপা হচ্ছে, ‘ভক্তিযোগে’র বইটা তোমার কাছে আছে, আর ‘জ্ঞানযোগে’রটা গুছিয়ে নিয়ে ছাপার জন্য তৈরী হচ্ছে। তা ছাড়া রবিবারের বক্তৃতাগুলিও ছাপা হয়ে গেছে। স্টার্ডি বিরাট কর্মী, সে সব কাজই খুব এগিয়ে দিতে পারে। যা হোক, লোককল্যাণের জন্য আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি—এই মনে করেই আমি সন্তুষ্ট; আর কাজ থেকে অবসর নিয়ে আমি যখন গিরিগুহায় ধ্যানে মগ্ন হব, তখন এ বিষয়ে আমার বিবেক সাফ থাকবে।

সকলে আমার ভালবাসা ও আশীর্বাদ জানবে। ইতি

বিবেকানন্দ