১৪. হিন্দুধর্মের সার্বভৌমিকতা

[চিকাগো ধর্মমহাসভায় স্বামীজীর সাফল্য-সংবাদে আনন্দিত মান্দ্রাজবাসীদের অভিনন্দন-পত্রের উত্তরে (১৮৯৪ সেপ্টেম্বরে) লিখিত।]

মান্দ্রাজবাসী স্বদেশী, স্বধর্মাবলম্বী ও বন্ধুগণ—

হিন্দুধর্ম-প্রচারকার্যের জন্য আমি যতটুকু যাহা করিয়াছি, তাহা যে তোমরা আদরের সহিত অনুমোদন করিয়াছ, তাহাতে আমি পরম আহ্লাদিত হইলাম। এই আনন্দ, আমার নিজের বা সুদূর বিদেশে আমার প্রচারকার্যের ব্যক্তিগত প্রশংসার জন্য নয়। আমার আহ্লাদের কারণ—তোমরা হিন্দুধর্মের পুনরুত্থানে আনন্দিত তাহাতে ইহাই স্পষ্ট দেখা যাইতেছে যে, যদিও হতভাগ্য ভারতের উপর দিয়া কতবার বৈদেশিক আক্রমণের ঝঞ্ঝা বহিয়া গিয়াছে, যদিও শত শতাব্দী ধরিয়া আমাদের নিজেদের উপেক্ষায় এবং আমাদের বিজেতাগণের অবজ্ঞায় প্রাচীন আর্যাবর্তের মহিমা স্পষ্টই ম্লান হইয়াছে, যদিও শত শত শতাব্দীব্যাপী বন্যায় হিন্দুধর্মরূপ সৌধের অনেকগুলি মহিমময় স্তম্ভ, অনেক সুন্দর সুন্দর খিলান ও অনেক অপূর্ব ভিত্তিপ্রস্তর ভাসিয়া গিয়াছে, তথাপি উহার ভিত্তি অটলভাবে এবং উহার সন্ধিপ্রস্তর অটুটভাবে বিরাজমান; যে আধ্যাত্মিক ভিত্তির উপর হিন্দুজাতির ঈশ্বরভক্তি ও সর্বভূতহিতৈষণারূপ অপূর্ব কীর্তিস্তম্ভ স্থাপিত, তাহা পূর্ববৎ অটুট ও অবিচলিতভাবে বর্তমান।

ভারতে ও সমগ্র জগতে যাঁহার বাণীপ্রচারের ভারপ্রাপ্ত হইয়া ধন্য হইয়াছি, তাঁহার অতি অনুপযুক্ত দাস আমি। তোমরা তাঁহাকে আদরপূর্বক গ্রহণ করিয়াছ; তোমরা তোমাদের স্বাভাবিক অন্তর্নিহিত আধ্যাত্মিক শক্তিবলে তাঁহাতে এবং তাঁহার উপদেশে সেই মহতী আধ্যাত্মিক বন্যার প্রথম অস্ফুট ধ্বনি শুনিয়াছ, যাহা নিশ্চয়ই অনতিবিলম্বে দুর্দমনীয় বেগে ভারতে উপনীত হইবে, অনন্ত শক্তিস্রোতে যাহা কিছু দুর্বল ও দোষযুক্ত, সব ভাসাইয়া দিবে আর হিন্দুজাতির শতশতাব্দীব্যাপী নীরব দুঃখভোগের পুরস্কারস্বরূপ তাহাদিগকে অতীত অপেক্ষা উজ্জ্বলতর গৌরবে ভূষিত করিয়া তাহাদের বিধিনির্দিষ্ট উচ্চপদবীতে উন্নীত করিবে এবং সমগ্র মানবজাতির মধ্যে উহার যে বিশেষ ব্রত অর্থাৎ আধ্যাত্মিক-প্রকৃতিসম্পন্ন মানবজাতির বিকাশসাধন, তাহাও সম্পাদন করিবে।

দাক্ষিণাত্যবাসী তোমাদের নিকট আর্যাবর্তবাসিগণ বিশেষভাবে ঋণী, কারণ ভারতে আজ যে-সকল শক্তি সক্রিয়, তাহাদের অধিকাংশেরই মূল দাক্ষিণাত্য। শ্রেষ্ঠ ভাষ্যকারগণ, যুগপ্রবর্তনকারী আচার্যগণ, যথা শঙ্কর, রামানুজ ও মধ্ব—ইঁহারা সকলেই দাক্ষিণাত্যে জন্মিয়াছিলেন। যে মহাত্মা শঙ্করের নিকট জগতের প্রত্যেক অদ্বৈতবাদীই ঋণী; যে মহাত্মা রামানুজের স্বর্গীয় স্পর্শ পদদলিত পারিয়াগণকেও আলওয়ারে পরিণত করিয়াছিল, সমগ্র ভারতে শক্তিসঞ্চারকারী আর্যাবর্তের সেই একমাত্র মহাপুরুষ শ্রীকৃষ্ণচৈতন্যের অনুবর্তিগণও যে মহাত্মা মধ্বের শিষ্যত্ব স্বীকার করিয়াছিলেন—তাঁহাদের সকলেরই জন্মস্থান দাক্ষিণাত্য। বর্তমানকালেও বারাণসীধামের শ্রেষ্ঠ গৌরব-স্বরূপ মন্দিরসমূহে দাক্ষিণাত্যবাসীরই প্রাধান্য, তোমাদের ত্যাগই হিমালয়ের সুদূরবর্তী চূড়াস্থিত পবিত্র দেবালয়সমূহ নিয়ন্ত্রণ করিতেছে। অতএব মহাপুরুষগণের পূতশোণিতে পূরিতধমনী, তথাবিধ আচার্যগণের আশীর্বাদে ধন্যজীবন, তোমরা যে ভগবান্ শ্রীরামকৃষ্ণের বাণী সর্বপ্রথম বুঝিবে ও আদরপূর্বক গ্রহণ করিবে, তাহাতে আর বিস্ময়ের কি আছে!

দাক্ষিণাত্যই চিরদিন বেদবিদ্যার ভাণ্ডার, সুতরাং তোমরা বুঝিবে যে, হিন্দুধর্ম-আক্রমণকারী অজ্ঞ সমালোচকগণের পুনঃপুনঃ প্রতিবাদ সত্ত্বেও এখনও শ্রুতিই হিন্দুধর্মের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মেরুদণ্ডস্বরূপ।

জাতিতত্ত্ববিৎ বা ভাষাতত্ত্ববিৎ পণ্ডিতদিগের নিকট বেদের সংহিতা ও ব্রাহ্মণভাগের মূল্য যতই হউক, ‘অগ্নিমীলে’, ‘ইষেত্বোর্জে ত্বা’, ‘শন্নোদেবীরভীষ্টয়ে’ প্রভৃতি বৈদিকমন্ত্র উচ্চারণ সহকারে ভিন্ন ভিন্ন রূপে বেদীযুক্ত বিভিন্ন যজ্ঞে নানাবিধ আহুতি দ্বারা প্রাপ্য ফলসমূহ যতই বাঞ্ছনীয় হউক, এই-সব কিছুরই একমাত্র উদ্দেশ্য ভোগ। এগুলি মোক্ষজনক—এ কথা বলিয়া কেহ কখনও তর্ক করে নাই। সুতরাং আধ্যাত্মিকতা ও মোক্ষমার্গের উপদেশক জ্ঞানকাণ্ড, যাহা আরণ্যক বা শ্রুতিশির বলিয়া কথিত হয়, তাহাই ভারতে চিরকাল শ্রেষ্ঠ আসন অধিকার করিয়াছে এবং চিরকাল করিবে।

সনাতন ধর্মের নানা মতমতান্তররূপ গোলকধাঁধায় দিগ‍্ভ্রান্ত, একমাত্র যে ধর্মের সর্বজনীন উপযোগিতা তৎপ্রচারিত ‘অণোরণীয়ান্ মহতো মহীয়ান্’ ব্রহ্মের অবিকল প্রতিবিম্ব-স্বরূপ—পূর্ব হইতেই প্রতিকূল চিন্তায় আচ্ছন্ন থাকায় তাহার মর্মবোধে অক্ষম, এবং জড়বাদসর্বস্ব জাতির নিকট ঋণসূত্রে প্রাপ্ত আধ্যাত্মিকতার মনাদণ্ড অবলম্বন করিয়া অন্ধকারে অন্বেষণপরায়ণ আধুনিক হিন্দুযুবক বৃথাই তাহার পূর্বপুরুষগণের ধর্ম বুঝিতে চেষ্টা করে এবং হয় ঐ চেষ্টা একেবারে পরিত্যাগ করিয়া ঘোর অজ্ঞেয়বাদী হইয়া পড়ে, অথবা স্বাভাবিক ধর্মভাবের প্রেরণায় পশুজীবন-যাপনে অসমর্থ হইয়া প্রাচ্যগন্ধী বিবিধ পাশ্চাত্য জড়বাদের নির্যাস অসাবধানে পান করে, এবং শ্রুতির এই ভবিষ্যদ্বাণী সফল করেঃ পরিযন্তি মূঢ়া অন্ধেনৈব নীয়মানা যথাঽন্ধাঃ। তাঁহারাই কেবল বাঁচিয়া যান, যাঁহাদের আত্মা সদ‍্গুরুর জীবনপ্রদ স্পর্শবলে জাগ্রত হয়।

ভগবান্ ভাষ্যকার ঠিকই বলিয়াছেনঃ

দুর্লভং ত্রয়মেবৈতৎ দেবানুগ্রহহেতুকম্‌। মনুষ্যত্বং মুমুক্ষুত্বং মহাপুরুষসংশ্রয়ঃ॥১০

পরমাণু, দ্ব্যণুক, ত্রসরেণু প্রভৃতি সম্বন্ধীয় অপূর্ব সিদ্ধান্তপ্রসূ বৈশেষিকদের সূক্ষ্ম বিচারসমূহই হউক, অথবা নৈয়ায়িকদের জাতিদ্রব্যগুণসমবায় প্রভৃতি বস্তুসম্বন্ধীয় অপূর্ব বিচারবলীই হউক, অথবা পরিণামবাদের জনকস্বরূপ সাংখ্যদিগের তদপেক্ষা গভীরতর চিন্তাগতিই হউক, অথবা এই বিভিন্নরূপ বিশ্লেষণাবলীর সুপক্ক ফলস্বরূপ ব্যাসসূত্রই হউক, মনুষ্য-মনের এই-সকল বিবিধ সংশ্লেষণ ও বিশ্লেষণের একমাত্র ভিত্তি শ্রুতি। এমন কি বৌদ্ধ বা জৈনদিগের দার্শনিক গ্রন্থাবলীতেও শ্রুতির সহায়তা পরিত্যক্ত হয় নাই, আর অন্ততঃ কতকগুলি বৌদ্ধ সম্প্রদায়ে এবং জৈনদের অধিকাংশ গ্রন্থে শ্রুতির প্রামাণ্য সম্পূর্ণরূপে স্বীকৃত হইয়া থাকে; তবে তাঁহারা শ্রুতির কোন কোন অংশকে ব্রাহ্মণগণ কর্তৃক প্রক্ষিপ্ত বলিয়া ‘হিংসক’ শ্রুতি আখ্যা দেন—এবং সেগুলির প্রামাণ্য স্বীকার করেন না। বর্তমান কালেও স্বর্গীয় মহাত্মা স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতীও এবম্বিধ মত পোষণ করিতেন।

যদি কেহ জিজ্ঞাসা করেন, প্রাচীন ও বর্তমান সমুদয় ভারতীয় চিন্তাপ্রণালীর কেন্দ্র কোথায়, যদি কেহ নানাবিধ শাখাপ্রশাখাবিশিষ্ট হিন্দুধর্মের প্রকৃত মেরুদণ্ড কি, জানিতে চান, তবে অবশ্য ব্যাসসূত্রকেই এই কেন্দ্র, এই মেরুদণ্ড বলিয়া দেখাইতে হইবে।

হিমাচলস্থিত অরণ্যানীর হৃদয়স্তব্ধকারী গাম্ভীর্যের মধ্যে স্বর্ণদীর গভীর ধ্বনিমিশ্রিত অদ্বৈতকেশরীর ‘অস্থি-ভাতি-প্রিয়’-রূপ১১বজ্রগম্ভীর রবই কেহ শ্রবণ করুন, অথবা বৃন্দাবনের মনোহর কুঞ্জসমূহে ‘পিয়াপীতম্’ কূজনই শ্রবণ করুন, বারাণসীধামের মঠসমূহে সাধুদিগের গভীর ধ্যানেই যোগদান করুন, অথবা নদীয়াবিহারী শ্রীগৌরাঙ্গের ভক্তগণের উদ্দাম নৃত্যেই যোগদান করুন, বড়গেলে তেঙ্গেলে১২ প্রভৃতি শাখাযুক্ত বিশিষ্টাদ্বৈতমতাবলম্বী আচার্যগণের পাদমূলেই উপবেশন করুন, অথবা মাধ্ব সম্প্রদায়ের আচার্যগণের বাক্যই শ্রদ্ধাসহকারে শ্রবণ করুন, গৃহী শিখদিগের ‘ওয়া গুরুকি ফতে’-রূপ১৩ সমরবাণীই শ্রবণ করুন, অথবা উদাসী ও নির্মলাদিগের গ্রন্থসাহেবের১৪ উপদেশই শ্রবণ করুন, কবীরের সন্ন্যাসী শিষ্যগণকে সৎসাহেব১৫বলিয়া অভিবাদনই করুন, অথবা সখীসম্প্রদায়ের ভজনই শ্রবণ করুন, রাজপুতানার সংস্কারক দাদুর অদ্ভুত গ্রন্থাবলী বা তাঁহার শিষ্য রাজা সুন্দরদাস ও তাঁহা হইতে ক্রমশঃ নামিয়া ‘বিচারসাগর’-এর বিখ্যাত রচয়িতা নিশ্চলদাসের গ্রন্থই (ভারতে গত তিন শতাব্দী ধরিয়া যত গ্রন্থ লিখিত হইয়াছে, তন্মধ্যে এই বিচারসাগর-গ্রন্থের প্রভাব ভারতীয় জনসমাজে সর্বাপেক্ষা অধিক) পাঠ করুন, এমন কি আর্যাবর্তের ভাঙ্গী মেথরগণকে তাঁহাদের লালগুরুর উপদেশ বিবৃত করিতেই বলুন—তিনি দেখিবেন, এই আচার্যগণ ও সম্প্রদায়সমূহ সকলেই সেই ধর্মপ্রণালীর অনুবর্তী, শ্রুতি যাহার প্রামাণ্য গ্রন্থ, গীতা যাহার ভগবদ্বক্ত্র বিনিঃসৃত টীকা, শারীরক ভাষ্য১৬ যাহার প্রণালীবদ্ধ বিবৃতি আর পরমহংস পরিব্রাজকাচার্যগণ হইতে লালগুরুর মেথর শিষ্যগণ পর্যন্ত ভারতের সমুদয় বিভিন্ন সম্প্রদায় যাহার বিভিন্ন বিকাশ।

অতএব দ্বৈত, বিশিষ্টাদ্বৈত, অদ্বৈত এবং আরও কতকগুলি অনতিপ্রসিদ্ধ ব্যাখ্যাযুক্ত এই প্রস্থানত্রয়১৭ হিন্দুধর্মের প্রামাণ্য গ্রন্থস্বরূপ, প্রাচীন নারাশংসীর১৮ প্রতিনিধিস্বরূপ পুরাণ উহার উপাখ্যানভাগ এবং বৈদিক ব্রাহ্মণভাগের প্রতিনিধিস্বরূপ তন্ত্র উাহার কর্মকাণ্ড।

পূর্বোক্ত প্রস্থানত্রয় সকল সম্প্রদায়েই প্রামাণ্য গ্রন্থ, কিন্তু প্রত্যেক সম্প্রদায়ই পৃথক্‌ পৃথক্‌ পুরাণ ও তন্ত্রকে প্রমাণরূপে গ্রহণ করিয়া থাকেন।

আমরা পূর্বেই বলিয়াছি, তন্ত্রগুলি বৈদিক কর্মকাণ্ডেরই একটা পরিবর্তিত আকারমাত্র, আর কেহ উহাদের সম্বন্ধে হঠাৎ একটা অসম্বন্ধ সিন্ধান্ত করিবার পূর্বেই তাঁহাকে আমি ব্রাহ্মণভাগ, বিশেষতঃ অর্ধ্বযু-ব্রাহ্মণভাগের সহিত মিলাইয়া তন্ত্র পাঠ করিতে পরামর্শ দিই; তাহা হইলে তিনি দেখিবেন, তন্ত্রে ব্যবহৃত অধিকাংশ মন্ত্রই অবিকল ব্রাহ্মণ হইতে গৃহীত। ‘ভারতবর্ষে তন্ত্রের প্রভাব কিরূপ?’— জিজ্ঞাসা করিলে বলা যাইতে পারে, শ্রৌত বা স্মার্ত কর্ম ব্যতীত হিমালয় হইতে কন্যাকুমারী পর্যন্ত সমুদয় প্রচলিত কর্মকাণ্ডই তন্ত্র হইতে গৃহীত, আর উহা শাক্ত, শৈব, বৈষ্ণব প্রভৃতি সকল সম্প্রদায়েরই উপাসনা-প্রণালীকে নিয়মিত করিয়া থাকে।

অবশ্য আমি এ কথা বলি না যে, সকল হিন্দুই সমগ্রভাবে তাঁহাদের ধর্মের এই-সকল মূল বিষয় অবগত আছেন। অনেকে—বিশেষতঃ নিম্নবঙ্গে—এই-সব সম্প্রদায় ও প্রণালীর নাম পর্যন্ত শুনেন নাই; কিন্তু জ্ঞাতসারেই হউক বা অজ্ঞাতসারেই হউক, পূর্বোক্ত তিন প্রস্থানের উপদেশানুসারে সকল হিন্দুই চলিয়াছেন।

অপর দিকে যেখানেই হিন্দীভাষা কথিত হয়, তথাকার অতি নীচজাতি পর্যন্ত নিম্নবঙ্গের অনেক উচ্চতম জাতি অপেক্ষা বৈদান্তিক ধর্ম সম্বন্ধে অধিক অভিজ্ঞ।

ইহার কারণ কি?

মিথিলাভূমি হইতে নবদ্বীপে আনীত শিরোমণি গদাধর, জগদীশ প্রভৃতি মনীষিগণের প্রতিভায় সযত্নে লালিত ও পরিপুষ্ট, কোন কোন বিষয়ে সমগ্র জগতের অন্যান্য সমুদয় প্রণালী অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ অপূর্ব সুনিবদ্ধ বাক্‌শিল্পে রচিত তর্কপ্রণালীর বিশ্লেষণস্বরূপ বঙ্গদেশীয় ন্যায়শাস্ত্র হিন্দুস্থানের সর্বত্র শ্রদ্ধার সহিত পঠিত হইয়া থাকে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, বেদের চর্চায় বঙ্গবাসীর যত্ন ছিল না, এমন কি, কয়েক বর্ষ মাত্র পূর্বে পতঞ্জলির মহাভাষ্য১৯ পড়াইতে পারেন—এমন কেহ বঙ্গদেশে ছিলেন না বলিলেই হয়। একবার মাত্র এক মহতী প্রতিভা সেই ‘অবচ্ছিন্ন অবচ্ছেদক’২০ জাল ছেদন করিয়া উত্থিত হইয়াছিলেন—ভগবান্ শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য। একবার মাত্র বঙ্গের আধ্যাত্মিক তন্দ্রা ভাঙিয়াছিল; কিছু দিনের জন্য উহা ভারতের অপরাপর প্রদেশের ধর্মজীবনের সহভাগী হইয়াছিল।

একটু বিস্ময়ের বিষয় এই, শ্রীচৈতন্য একজন ভারতীর নিকট সন্ন্যাস লইয়াছিলেন, সুতরাং ভারতী২১ ছিলেন বটে, কিন্তু মাধবেন্দ্রপুরীর শিষ্য ঈশ্বরপুরীই প্রথম তাঁহার ধর্মপ্রতিভা জাগ্রত করিয়া দেন।

বোধহয় বঙ্গদেশের আধ্যাত্মিকতা জাগাইতে পুরী-সম্প্রদায় বিধাতা কর্তৃক নির্দিষ্ট। ভগবান্ শ্রীরামকৃষ্ণ তোতাপুরীর নিকট সন্ন্যাস গ্রহণ করেন।

শ্রীচৈতন্য ব্যাসসূত্রের যে ভাষ্য লিখেন, তাহা হয় নষ্ট হইয়াছে, না হয় এ পর্যন্ত পাওয়া যায় নাই। তাঁহার শিষ্যেরা দাক্ষিণাত্যের মাধ্ব-সম্প্রদায়ের সহিত যোগ দিলেন। ক্রমশঃ রূপ-সনাতন ও জীবগোস্বামী প্রভৃতি মহাপুরুষগণের আসন বাবাজীবন অধিকার করিলেন। তাহাতে শ্রীচৈতন্যের মহান্ সম্প্রদায় ক্রমশঃ ধ্বংসাভিমুখে যাইতেছিল, কিন্তু আজকাল উহার পুনরুজ্জীবনের চিহ্ন দেখা যাইতেছে। আশা করি, শীঘ্রই উহা আপন লুপ্তগৌরব পুনরুদ্ধার করিবে।

সমুদয় ভারতেই শ্রীচৈতন্যের প্রভাব লক্ষিত হয়। যেখানেই ভক্তিমার্গ পরিজ্ঞাত, সেখানেই লোকে তাঁহার বিষয় সাদরে চর্চা করে ও তাঁহার পূজা করিয়া থাকে। আমার বিশ্বাস করিবার যথেষ্ট কারণ আছে যে, সমুদয় বল্লভাচার্য সম্প্রদায় শ্রীচৈতন্য-প্রতিষ্ঠিত সম্প্রদায়ের সংশোধিত শাখা মাত্র। কিন্তু তাঁহার তথাকথিত বঙ্গীয় শিষ্যগণ জানেন না, তাঁহার প্রভাব এখনও কিভাবে সমগ্র ভারতে সক্রিয়। কি করিয়াই বা জানিবেন? তাঁহারা গদিয়ান হইয়াছেন, কিন্তু তিনি নগ্নপদে ভারতের দ্বারে দ্বারে প্রচার করিয়া ফিরিতেন, আচণ্ডালকে অনুনয় করিতেন, যাহাতে সকলে ভগবানকে ভালবাসে।

যে অদ্ভুত ও অশাস্ত্রীয় কুলগুরুপ্রথা বিশেষভাবে বঙ্গদেশেই প্রচলিত, তাহাও ভারতের অন্যান্য প্রদেশের ধর্মজীবন হইতে বঙ্গদেশ যে বিচ্ছিন্ন হইয়া আছে, তাহার আর একটি কারণ। সর্বপ্রধান কারণ এই যে, বঙ্গদেশ এখন পর্যন্ত ভারতীয় আধ্যাত্মিক সাধনার সর্বশ্রেষ্ঠ প্রতিনিধি ও ভাণ্ডারস্বরূপ মহান্ সন্ন্যাসি-সম্প্রদায়ের জীবন হইতে শক্তি লাভ করে নাই।

উচ্চবর্ণেরা বাঙালীরা ত্যাগের ভাব পচ্ছন্দ করেন না, তাঁহাদের ঝোঁক ভোগের দিকে। তাঁহারা কেমন করিয়া আধ্যাত্মিক বিষয়ে গভীর অন্তর্দৃষ্টি লাভ করিবেন? ‘ত্যাগেনৈকে অমৃতত্ত্বমানশুঃ।’২২ অন্যপ্রকার কিরূপে সম্ভব?

অপর দিকে ক্রমান্বয়ে অনেক সুদূরবিস্তারি-প্রতিভাসম্পন্ন মহা মহা ত্যাগী আচার্যগণ সমুদয় হিন্দীভাষী ভারতের মধ্যে বেদান্তের মত প্রতি গৃহে প্রবিষ্ট করাইয়া দিয়াছেন। বিশেষতঃ পঞ্জাবকেশরী রণজিৎ সিংহের রাজত্বকালে ত্যাগের যে মহিমা প্রচারিত হয়, তাহাতে অতি নিম্নশ্রেণীর লোকেও বেদান্তদর্শনের উচ্চতম উপদেশ পর্যন্ত শিক্ষা পাইয়াছে। যথোচিত গর্বের সহিত পঞ্জাবের কৃষকবালিকা বলিয়া থাকে, তাহার চরকা পর্যন্ত ‘সোঽহম্ সোঽহম্’ ধ্বনি করিতেছে। আর আমি হৃষীকেশের জঙ্গলে সন্ন্যাসিবেশধারী ত্যাগী মেথরদিগকে বেদান্ত পাঠ করিতে দেখিয়াছি। অনেক গর্বিত অভিজাত ব্যক্তিও তাঁহাদের পদতলে বসিয়া আনন্দের সহিত উপদেশ পাইতে পারেন। কেনই বা না এইরূপ হইবে? ‘অন্ত্যাদপি পরং ধর্মং’—নীচ জাতির নিকট হইতেও শ্রেষ্ঠ ধর্ম গ্রহণ করিবে।

অতএব উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল ও পঞ্জাববাসীরা বঙ্গদেশ, বোম্বাই ও মান্দ্রাজের অধিবাসিগণ অপেক্ষা ধর্মবিষয়ে অধিক শিক্ষিত। দশনামী, বৈরাগী, পন্থী প্রভৃতি বিভিন্ন সম্প্রদায়ের ত্যাগী পরিব্রাজকগণ প্রত্যেকের দ্বারে দ্বারে ধর্মভাব লইয়া যাইতেছেন; মূল্য এক-টুকরা রুটিমাত্র। আর তাঁহাদের মধ্যে অনেকে কি মহৎ ও নিঃস্বার্থচরিত্র! স্বাধীন বা কাচুপন্থী সম্প্রদায়ের (যাঁহারা নিজেদের কোন সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত মনে করেন না) একজন সন্ন্যাসী আছেন। তাঁহারই চেষ্টায় সমগ্র রাজপুতানায় শত শত বিদ্যালয় ও দাতব্য আশ্রম স্থাপিত হইয়াছে। তিনি জঙ্গলের ভিতর হাসপাতাল খুলিয়াছেন, হিমালয়ের দুর্গম গিরিনদীর উপরে লৌহসেতু নির্মাণ করাইয়াছেন, কিন্তু তিনি কখনও মুদ্রা স্পর্শ করেন না; তাঁহার একখানি কম্বল ছাড়া সাংসারিক সম্বল আর কিছুই নাই, এইজন্য তাঁহাকে লোকে ‘কম্ব্‌লী স্বামী’ বলিয়া ডাকে—তিনি দ্বারে দ্বারে ভিক্ষা করিয়া আহার সংগ্রহ করেন। তাঁহাকে কখনও একাদিক্রমে একই বাড়িতে পুরা ভিক্ষা করিতে দেখি নাই, পাছে গৃহস্থের কোন ক্লেশ হয়। আর এরূপ সাধু—তিনি একা নহেন, এরূপ শত শত সাধু রহিয়াছেন। তোমরা কি মনে কর, যতদিন এই ভূদেবগণ ভারতে জীবিত থাকিয়া তাঁহাদের দেবচরিত্ররূপ দুর্ভেদ্য প্রাচীর দ্বারা সনাতন ধর্মকে রক্ষা করিতেছেন, ততদিন এই প্রাচীন ধর্মের বিনাশ হইবে?

এই দেশে (আমেরিকায়) পাদরিগণ বৎসরের মধ্যে মাত্র ছয় মাস প্রতি রবিবার দুই ঘণ্টা ধর্মপ্রচারের জন্য ত্রিশ, চল্লিশ, পঞ্চাশ—এমন কি নব্বই হাজার টাকা পর্যন্ত বেতন পাইয়া থাকেন। আমেরিকাবাসিগণ তাঁহাদের ধর্মরক্ষার জন্য কত লক্ষ লক্ষ মুদ্রা ব্যয় করিতেছেন, আর বাঙালী যুবকগণ শিক্ষা পাইয়াছেন, ‘কম্ব্‌লী স্বামী’র ন্যায় দেবতুল্য সম্পূর্ণ নিঃসার্থ ব্যক্তিগণ অলস ভবঘুরে মাত্র! ‘মদ্ভক্তানাঞ্চ যে ভক্তাস্তে মে ভক্ততমা মতাঃ’২৩ —আমার ভক্তদের যাহারা ভক্ত, তাহারাই আমার শ্রেষ্ঠ ভক্ত, এই আমার মত।

একটি চূড়ান্ত দৃষ্টান্ত লও—একজন অতি অজ্ঞ বৈরাগীর কথা ধর। তিনি যখন কোন গ্রামে গমন করেন, তিনিও তুলসীদাস বা চৈতন্যচরিতামৃত হইতে যাহা জানেন, অথবা দাক্ষিণাত্যে হইলে আলওয়ারদিগের নিকট যাহা শিখিয়াছেন, তাহা শিখাইতে চেষ্টা করেন। ইহা কি কিছু উপকার করা নয়? আর এই সমুদয়ের বিনিময়ে তাঁহার প্রাপ্য এক-টুকরা রুটি ও একখণ্ড কৌপীন। ইঁহাদিগকে নির্দয়ভাবে সমালোচনা করিবার পূর্বে ভ্রাতৃগণ, চিন্তা কর— তোমরা তোমাদের স্বদেশবাসীর জন্য কি করিয়াছ, যাহাদের ব্যয়ে তোমরা শিক্ষা পাইয়াছ, যাহাদিগকে শোষণ করিয়া তোমাদের পদগৌরব রক্ষা করিতে হয়, এবং ‘বাবাজীগণ ভবঘুরে মাত্র’ এই শিক্ষার জন্য তোমাদের শিক্ষকগণকে বেতন দিতে হয়।

আমাদের কতকগুলি স্বদেশী বঙ্গবাসী হিন্দুধর্মের এই পুনরুত্থানকে হিন্দুধর্মের ‘নূতন বিকাশ’ বলিয়া সমালোচনা করিয়াছেন। তাঁহারা উহাকে ‘নূতন’ আখ্যা দিতে পারেন। কারণ হিন্দুধর্ম সবেমাত্র বাঙলা দেশে প্রবেশ করিতেছে; এখানে এতদিন ধর্ম বলিতে কেবল আহার বিহার ও বিবাহ সম্বন্ধীয় কতকগুলি দেশাচারমাত্রকেই বুঝাইত।

রামকৃষ্ণ-শিষ্যগণ হিন্দুধর্মের যে-ভাব সমগ্র ভারতে প্রচার করিতেছেন, তাহা সৎশাস্ত্রের অনুমোদিত কিনা, এই ক্ষুদ্র পত্রে সেই গুরুতর প্রশ্ন বিচার করিবার স্থান নাই। তবে আমি আমাদের সমালোচকগণ কয়েকটি সঙ্কেত দিব, যাহাতে তাহারা আমাদের মত আরও ভালরূপে বুঝিতে পারে।

প্রথমতঃ আমি কখনও এরূপ তর্ক করি নাই যে, কৃত্তিবাস ও কাশীদাসের গ্রন্থ হইতে হিন্দুধর্মের যথার্থ ধারণা হইতে পারে, যদিও তাঁহাদের কথা ‘অমৃত-সমান’ এবং যাঁহারা উহা শুনেন, তাঁহারা ‘পুণ্যবান্’। হিন্দুধর্ম বুঝিতে হইলে বেদ ও দর্শন পড়িতে হইবে এবং সমুদয় ভারতের প্রধান প্রধান ধর্মাচার্য এবং তাঁহাদের শিষ্যগণের উপদেশাবলী জানিতে হইবে। ভ্রাতৃগণ, যদি তোমরা গৌতমসূত্র হইতে আরম্ভ করিয়া বাৎস্যায়ন-ভাষ্যের আলোকে ‘আপ্ত’২৪ সম্বন্ধে গৌতমের মতবাদ পাঠ কর, শবর ও অন্যান্য ভাষ্যকারগণের সাহায্যে যদি মীমাংসকগণের মত আলোচনা কর, ‘অলৌকিক প্রত্যক্ষ’ ও ‘আপ্ত’ সম্বন্ধে এবং সকলেই ‘আপ্ত’ হইতে পারে কিনা এবং এইরূপ আপ্তদিগের বাক্য বলিয়াই যে বেদের প্রামাণ্য, এই- সকল বিষয়ে তাঁহাদের মত যদি অধ্যয়ন কর, যদি তোমাদের মহীধরকৃত যজুর্বেদভাষ্যের উপক্রমণিকা দেখিবার অবকাশ থাকে, তবে তাহাতে দেখিবে—মানবের আধ্যাত্মিক জীবন ও বেদের নিয়মাবলী সম্বন্ধে আরও সুন্দর সুন্দর বিচার আছে। তাঁহারা তাই সিদ্ধান্ত করিয়াছেন, বেদ অনাদি অনন্ত।

‘সৃষ্টির অনাদিত্ব’ মত সম্বন্ধে বক্তব্য এই, ঐ মত কেবল হিন্দুধর্মের নয়, বৌদ্ধ ও জৈনধর্মেরও একটি প্রধান ভিত্তি।

এখন—ভারতীয় সমুদয় সম্প্রদায়কে মোটামুটি জ্ঞানমার্গী বা ভক্তিমার্গী বলিয়া শ্রেণীবদ্ধ করা যাইতে পারে। যদি তোমরা শ্রীশঙ্করাচার্যকৃত শারীরিকভাষ্যের উপক্রমণিকা পাঠ কর, তবে দেখিবে—সেখানে জ্ঞানের ‘নিরপেক্ষতা’ সম্পূর্ণভাবে বিচার করা হইয়াছে, আর এই সিদ্ধান্ত করা হইয়াছে যে, ব্রহ্মানুভুতি ও মোক্ষ কোনরূপ অনুষ্ঠান, মত, জাতি বা সম্প্রদায়ের উপর নির্ভর করে না। যে-কোন ব্যক্তি ‘সাধনচতুষ্টয়’-সম্পন্ন, সে-ই ইহার অধিকারী। সাধনচতুষ্টয় সম্পূর্ণ চিত্তশুদ্ধিকর কতকগুলি অনুষ্ঠানমাত্র।

ভক্তিমার্গ সম্বন্ধে বক্তব্য এই, বাঙালী সমালোচকগণও বেশ জানেন যে, ভক্তিমার্গের কোন কোন আচার্য বলিয়াছেন, মুক্তির জন্য জাতি বা লিঙ্গে কিছু আসে যায় না, এমন কি মনুষ্যজন্ম পর্যন্ত আবশ্যক নয়; একমাত্র প্রয়োজন—ভক্তি।

জ্ঞান ওই ভক্তি সর্বত্র নিরপেক্ষ বলিয়া প্রচারিত হইয়াছে। সুতরাং কোন আচার্যই এরূপ বলেন নাই যে, মুক্তিলাভে কোন বিশেষ মতাবলম্বীর, বিশেষ বর্ণের বা বিশেষ জাতির অধিকার। এ বিষয়ে ‘অন্তরা চাপি তু তদ্দৃষ্টেঃ’২৫—এই বেদান্তসূত্রের উপর শঙ্কর, রামানুজ ও মধ্ব-কৃত ভাষ্য পাঠ কর।

সমুদয় উপনিষদ্ অধ্যয়ন কর, এমন কি সংহিতাগুলির মধ্যে কোথাও অন্যান্য ধর্মে মোক্ষের যে সঙ্কীর্ণ ভাব আছে, তাহা পাইবে না। অপর ধর্মের প্রতি সহানুভূতির ভাব সর্বত্রই রহিয়াছে, এমন কি অধ্বর্যুবেদের সংহিতাভাগের চত্বারিংশৎ অধ্যায়ের তৃতীয় বা চতুর্থ শ্লোকে আছে—(যদি আমার ঠিক স্মরণ থাকে) ‘ন বুদ্ধিভেদং জনয়েদজ্ঞানাং কর্মসঙ্গিনাম্‌।’২৬ এই ভাব হিন্দুধর্মের সর্বত্র রহিয়াছে।

যতদিন কেহ সামাজিক নিয়ম পালন করিয়া চলিয়াছে, ততদিন ভারতে কেহ কি কখনও নিজ ইষ্টদেবতা নির্বাচনের জন্য, নাস্তিক বা অজ্ঞেয়বাদী হইবার জন্য নিগৃহীত হইয়াছে? সামাজিক নিয়মভঙ্গের অপরাধে সমাজ যে-কোন ব্যক্তিকে শাসন করিতে পারেন, কিন্তু কোন ব্যক্তি—এমন কি অতি নীচ পতিত পর্যন্ত কখনও হিন্দুধর্ম-মতে মুক্তির অনধিকারী নয়। এই দুইটি একসঙ্গে মিশাইয়া গোল করিও না। ইহার উদাহরণ দেখ। মালাবারে একজন চণ্ডালকে একজন উচ্চবর্ণের লোকের সঙ্গে এক রাস্তায় চলিতে দেওয়া হয় না, কিন্তু সে মুসলমান বা খ্রীষ্টান হইলে তাহাকে অবাধে সর্বত্র যাইতে দেওয়া হয়, আর এই নিয়ম একজন হিন্দু রাজার রাজ্যে কত শতাব্দী ধরিয়া রহিয়াছে! ইহা একটু অদ্ভুত রকমের বোধ হইতে পারে, কিন্তু অতিশয় প্রতিকূল অবস্থার ভিতরও অপরাপর ধর্মের প্রতি হিন্দুধর্মের সহানুভূতির ভাবও ইহাতে প্রকাশিত হইতেছে।

হিন্দুধর্ম একটি বিষয়ে জগতের অন্যান্য ধর্ম হইতে পৃথক্, একটি ভাব প্রকাশ করিতে সাধুগণ সংস্কৃতভাষার সমুদয় শব্দরাশি প্রায় নিঃশেষিত করিয়াছেন যে, মানুষকে এই জীবনেই ব্রহ্ম উপলব্ধি করিতে হইবে, এবং অদ্বৈতবাদ আর একটু অগ্রসর হইয়া বলেন যে, ‘ব্রহ্মবিদ্ ব্রহ্মৈব ভবতি’—এ কথা খুব যুক্তিসঙ্গতও বটে।

এই মতের ফলস্বরূপ প্রেরণার অতি উদার ও মহৎ ভাব আসিতেছে—ইহা শুধু বৈদিক ঋষিগণ বলিয়াছেন, তাহা নয়; শুধু বিদুর, ধর্মব্যাধ২৭ ও অপরাপর প্রাচীন মহাপুরুষেরা ইহা বলিয়াছেন, তাহা নয়, কিন্তু সেদিন সেই দাদূপন্থী-সম্প্রদায়ভুক্ত ত্যাগী নিশ্চলদাসও নির্ভিকভাবে তাঁহার ‘বিচারসাগর’ গ্রন্থে ঘোষণা করিয়াছেনঃ

যো ব্রহ্মবিদ্ ওই ব্রহ্ম, তাকু বাণী বেদ।
সংস্কৃত ঔর ভাষামে করত ভ্রমকি ছেদ॥

যিনি ব্রহ্মবিৎ, তিনিই ব্রহ্ম; তাঁহার বাক্যই বেদ। সংস্কৃত অথবা দেশীয় যে-কোন ভাষায় তিনি বলুন না কেন, তাহাতেই লোকের অজ্ঞান দূর হয়।

অতএব দ্বৈতবাদ অনুসারে ঈশ্বরকে লাভ করা এবং অদ্বৈতবাদ মতে ব্রহ্মভাবাপন্ন হওয়াই বেদের সমুদয় উপদেশের লক্ষ্য, এবং অন্য যাহা কিছু শিক্ষা বেদে আছে, তাহা সেই লক্ষ্যে পৌঁছিবার সোপানমাত্র। ভগবান্ ভাষ্যকার শঙ্করাচার্যের এই মহিমা যে, তিনি নিজ প্রতিভাবলে ব্যাসের ভাবগুলি অপূর্বভাবে বিবৃত করিয়াছেন।

নিরপেক্ষ সত্য হিসাবে ব্রহ্মই একমাত্র সত্য; আপেক্ষিক সত্য হিসাবে এই ব্রহ্মের বিভিন্ন প্রকাশের উপর প্রতিষ্ঠিত ভারতে বা ভারতের বাহিরে সকল ধর্মসম্প্রদায়ই সত্য! তবে কোন কোনটি অপরগুলি অপেক্ষা উচ্চতর, এই মাত্র। মনে কর, কোন ব্যক্তি বরাবর সূর্যাভিমুখে যাত্রা করিল। প্রতি পদক্ষেপে সে সূর্যের নূতন নূতন দৃশ্য দেখিবে। যতদিন না সে প্রকৃত সূর্যের নিকট পৌঁছিতেছে, ততদিন তাহার কাছে সূর্যের আকার দৃশ্য ও বর্ণ প্রতিমুহূর্তে নূতন হইতে থাকিবে। প্রথম সূর্যকে সে একটি বৃহৎ গোলকের ন্যায় দেখিয়াছিল। তারপর উহার আকৃতি ক্রমশঃ বড় হইতেছিল। প্রকৃতি সূর্য বাস্তবিক কখনও তাঁহার প্রথমে দৃষ্ট গোলকের মত বা পরে দৃষ্ট সূর্যসমূহের মত নয়। তথাপি ইহা কি সত্য নয় যে, সেই যাত্রী বরাবর সূর্যই দেখিতেছিল, সূর্য ব্যতীত অন্য কিছুই দেখে নাই? এইরূপে সমুদয় সম্প্রদায়ই সত্য; কোনটি প্রকৃত সূর্যের নিকটে, কোনটি বা দূরে‌! সেই প্রকৃত সূর্যই আমাদের ‘একমেবাদ্বিতীয়ম্।’

আর যখন এই সত্য নির্বিশেষ ব্রহ্মের উপদেষ্টা একমাত্র বেদ—অন্যান্য ঐশ্বরিক ধারণা যাঁহারই ক্ষুদ্র ও সীমাবদ্ধ দর্শনমাত্র, যখন ‘সর্বলোকহিতৈষিণী শ্রুতি’ সাধকের হাত ধরিয়া ধীরে ধীরে সেই নির্বিশেষ পরব্রহ্মে যাইবার সমুদয় সোপানগুলি দিয়া লইয়া যান, আর অন্যান্য ধর্ম যখন ইহাদের মধ্যে এক-একটি রুদ্ধগতি ও স্থিতিশীল সোপান মাত্র, তখন জগতের সমুদয় ধর্ম এই নামরহিত, সীমারহিত, নিত্য বৈদিক ধর্মের অন্তর্ভুক্ত।

শত শত জীবন ধরিয়া চেষ্টা কর, অনন্তকাল ধরিয়া তোমার অন্তরের অন্তস্তল অনুসন্ধান করিয়া দেখ, তথাপি এমন কোন মহৎ ধর্মভাব আবিষ্কার করিতে পারিবে না, যাহা এই আধ্যাত্মিকতার অনন্ত খনির ভিতর পূর্ব হইতেই নিহিত নাই।

হিন্দুদের তথাকথিত পৌত্তলিকতা সম্বন্ধে বক্তব্য এই, প্রথমে গিয়া দেখ—ইহা কিরূপ ভিন্ন ভিন্ন আকার ধারণ করিতেছে; প্রথমে জান, উপাসকগণ কোথায় প্রথমে উপাসনা করেন—মন্দিরে, প্রতিমায় অথবা দেহমন্দিরে।

প্রথমে নিশ্চয় করিয়া জান—তাহারা কি করিতেছে (শতকরা নিরানব্বই জনের অধিক নিন্দুকই এ-সম্বন্ধে সম্পূর্ণ অজ্ঞ), তখন বেদান্তদর্শনের আলোকে উহা আপনিই ব্যাখ্যাত হইয়া যাইবে। তথাপি এ কর্মগুলি অবশ্য-কর্তব্য নয়। বরং ‘মনু’ খুলিয়া দেখ—উহা প্রত্যেক বৃদ্ধকে চতুর্থাশ্রম (সন্ন্যাস) গ্রহণ করিতে আদেশ করিতেছে, এবং তাহারা উহা গ্রহণ করুক বা না করুক, তাহাদিগকে সমুদয় কর্ম অবশ্যই ত্যাগ করিতে হইবে।

সর্বত্রই ইহা পুনঃপুনঃ বলা হইয়াছে যে, এই সমুদয় কর্মকাণ্ডে সমাপ্ত হয়—‘জ্ঞানে পরিসমাপ্যতে।’২৮ এই-সকল কারণে অন্যান্য দেশের অনেক ভদ্রলোক অপেক্ষা একজন হিন্দু-কৃষকও অধিক ধর্মজ্ঞানসম্পন্ন। আমার বক্তৃতায় ইওরোপীয় দর্শন ও ধর্মের অনেক শব্দ ব্যবহারের জন্য কোন বন্ধু সমালোচনাচ্ছলে অনুযোগ করিয়াছেন। সংস্কৃত শব্দ ব্যবহার করিতে পারিলে আমার পরম আনন্দ হইত। উহা অপেক্ষাকৃত সহজ হইত, কারণ সংস্কৃত ভাষাই ধর্মভাব প্রকাশের একমাত্র সঠিক বাহন। কিন্তু বন্ধুটি ভুলিয়া গিয়াছিলেন যে, আমার শ্রোতা ছিলেন পাশ্চাত্য নরনারীগণ। যদিও কোন ভারতীয় খ্রীষ্টান মিশনারী বলিয়াছিলেন, হিন্দুরা তাহাদের সংস্কৃত গ্রন্থের অর্থ ভুলিয়া গিয়াছে, মিশনারীগণই উহার অর্থ আবিষ্কার করিয়াছেন, তথাপি আমি সেই সমবেত বৃহৎ মিশনারীমণ্ডলীর মধ্যে একজনকেও দেখিতে পাইলাম না, যিনি সংকৃত ভাষায় একটি পঙ‍্ক্তি পর্যন্ত বুঝেন; কিন্তু তাঁহাদের মধ্যে অনেকে বেদ, বেদান্ত ও হিন্দুধর্মের যাবতীয় পবিত্র শাস্ত্র সম্বন্ধে সমালোচনা করিয়া বড় বড় গবেষণাপূর্ণ প্রবন্ধ পাঠ করিয়াছিলেন।

আমি কোন ধর্মের বিরোধী—এ কথা সত্য নয়। আমি ভারতীয় খ্রীষ্টান মিশনারীদের বিরোধী—এ কথাও সত্য নয়। তবে আমি আমেরিকায় তাঁহাদের টাকা তুলিবার কতকগুলি উপায়ের প্রতিবাদ করি।

বালকবালিকাদের পাঠ্যপুস্তকে অঙ্কিত ঐ চিত্রগুলির অর্থ কি? চিত্রে অঙ্কিত রহিয়াছে—হিন্দুমাতা তাহার সন্তান গঙ্গায় কুমিরের মুখে নিক্ষেপ করিতেছে। জননী কৃষ্ণকায়া, কিন্তু শিশুটি শ্বেতাঙ্গরূপে অঙ্কিত; ইহার উদ্দেশ্য শিশুগণের প্রতি অধিক সহানুভূতি আকর্ষণ ও অধিক চাঁদাসংগ্রহ। একটি ছবিতে একজন পুরুষ তাহার স্ত্রীকে একটি কাষ্ঠস্তম্ভে বাঁধিয়া নিজ হস্তে পুড়াইতেছে; স্ত্রী যেন ভূত হইয়া তাহার স্বামীর শত্রুকে পীড়ন করিবে— ঐ-প্রকার ছবির অর্থ কি? বড় বড় রথ রাশি রাশি মানুষকে চাপা দিয়া মারিয়া ফেলিতেছে—এ-সকল ছবির অর্থ কি? সেদিন এখানে (আমেরিকায়) ছেলেদের জন্য একখানি পুস্তক প্রকাশিত হইয়াছে, তাহাতে একজন পাদরী ভদ্রলোক তাঁহার কলিকাতা-দর্শনের কথা বর্ণনা করিয়াছেন। তিনি বলেন, তিনি দেখিয়াছেন—কলিকাতার রাস্তায় একখানি রথ কতকগুলি ধর্মোন্মত্ত ব্যক্তির উপর দিয়া চলিয়া যাইতেছে।

মেমফিস নগরে আমি একজন পাদরী ভদ্রলোককে প্রচারকালে বলিতে শুনিয়াছি, ভারতের প্রত্যেক পল্লীগ্রামে ক্ষুদ্র শিশুদের কঙ্কালপূর্ণ একটি করিয়া পুষ্করিণী আছে।

হিন্দুরা খ্রীষ্টশিষ্যগণের কি ক্ষতি করিয়াছে যে, প্রত্যেক খ্রীষ্টান বালকবালিকাকেই শিক্ষা দেওয়া হয়—যেন তাহারা হিন্দুদিগকে ‘দুষ্ট’, ‘হতভাগা’ ও পৃথিবীর মধ্যে ভয়ানক ‘দানব’ বলিয়া অভিহিত করে? এখানে বালকবালিকাদের রবিবাসরীয় বিদ্যালয়ের শিক্ষার অঙ্গীভূত—খ্রীষ্টান ব্যতীত অপর সকলকে, বিশেষতঃ হিন্দুকে ঘৃণা করিতে শেখানো, যাহাতে তাহারা শৈশবকাল হইতেই খ্রীষ্টান মিশনে চাঁদা দিতে শেখে।

সত্যের খাতিরে না হইলেও অন্ততঃ তাঁহাদের সন্তানগণের নৈতিক জীবনের খাতিরেও খ্রীষ্টান মিশনারীগণের আর এরূপ ভাবের প্রশ্রয় দেওয়া উচিত নয়। বালকবালিকাগণ যে বড় হইয়া অতি নির্দয় ও নিষ্ঠুর নরনারীতে পরিণত হইবে, তাহাতে আর আশ্চর্য কি? কোন প্রচারক—যতই অনন্ত নরকের যন্ত্রণা এবং প্রজ্বলিত অগ্নি ও গন্ধকধূমের বর্ণনা করিতে পারেন, গোঁড়াদিগের মধ্যে তাঁহার ততই অধিক প্রতিপত্তি হয়। আমার কোন বন্ধুর একটি অল্পবয়স্কা দাসীকে—‘পুনরুত্থান’-সম্প্রদায়ের ধর্মপ্রচার শ্রবণের ফলে বাতুলালয়ে পাঠাইতে হইয়াছিল। তাহার পক্ষে জ্বলন্ত গন্ধক ও নরকাদির মাত্রাটি কিছু অতিরিক্ত হইয়াছিল।

আবার মান্দ্রাজ হইতে প্রকাশিত, হিন্দুধর্মের বিরুদ্ধে লিখিত গ্রন্থগুলি দেখ। যদি কোন হিন্দু খ্রীষ্টধর্মের বিরুদ্ধে এরূপ এক পঙ‍্ক্তি লেখে, তাহা হইলে মিশনারীগণ প্রতিহিংসায় বিষোদ‍্গার করিতে থাকেন।

স্বদেশবাসিগণ, আমি এই দেশে এক বৎসরের অধিক কাল; আমি ইঁহাদের সমাজের প্রায় সকল অংশই দেখিয়াছি। এখন উভয় দেশের তুলনা করিয়া তোমাদিগকে বলিতেছি, মিশনারীরা পৃথিবীর সর্বত্র বলিয়া বেড়ান, আমরা শয়তান; প্রকৃতপক্ষে আমরা শয়তান নই, আর তাঁহারাও নিজেদের দেবদূত বলিয়া দাবী করেন, তাঁহারাও দেবদূত নন। মিশনারীগণ হিন্দুবিবাহপ্রণালীর দুর্নীতি, শিশুহত্যা ও অন্যান্য দোষের কথা যত কম বলেন, ততই মঙ্গল। এমন অনেক দেশ থাকিতে পারে, যেখানকার বাস্তব চিত্রের সমক্ষে মিশনারীগণের অঙ্কিত হিন্দুসমাজের সমুদয় কাল্পনিক চিত্র নিষ্প্রভ হইয়া যাইবে। কিন্তু বেতনভুক্ নিন্দুক হওয়া আমার জীবনের লক্ষ্য নয়। হিন্দু সমাজ সম্পূর্ণ নির্দোষ—এ দাবী আর কেহ করে করুক, আমি কখনও করিব না। এই সমাজের যে-সকল ত্রুটি অথবা শত শতাব্দী-ব্যাপী দুর্বিপাকবশে ইহাতে যে-সকল দোষ জন্মিয়াছে, সে সম্বন্ধে আর কেহই আমা অপেক্ষা বেশী জানে না। বৈদেশিক বন্ধুগণ, যদি তোমরা যথার্থ সহানুভূতির সঙ্গে সাহায্য করিতে আস, বিনাশ যদি তোমাদের উদ্দেশ্য না হয়, তবে তোমাদের উদ্দেশ্য সিদ্ধ হউক, ভগবানের নিকট এই প্রার্থনা।

কিন্তু যদি এই অবসন্ন পতিত জাতির মস্তকে অনবরত—সময়ে অসময়ে ক্রমাগত গালি বর্ষণ করিয়া স্বজাতির নৈতিক শ্রেষ্ঠতা দেখান তোমাদের উদ্দেশ্য হয়, তবে আমি স্পষ্টই বলিতে পারি, যদি একটু ন্যায়পরতার সহিত এই তুলনা হয়, তবে হিন্দুগণ—নীতিপরায়ণ জাতি হিসাবে জগতের অন্যান্য জাতি অপেক্ষা অনেক উচ্চ আসন পাইবে।

ভারতে ধর্মকে কখনই শৃঙ্খলে আবদ্ধ করিয়া রাখা হয় নাই। কোন ব্যক্তিকেই তাহার ইষ্টদেবতা, সম্প্রদায় বা আচার্য মনোনয়নে কখনও বাধা দেওয়া হয় নাই; সুতরাং এখানে ধর্মের যেরূপ উন্নতি হইয়াছিল, অন্য কোথাও সেরূপ হয় নাই।

অপরদিকে আবার ধর্মের ভিতর এই নানাভাব বিকাশের জন্য একটি স্থিরবিন্দুর আবশ্যক হইল—সমাজ এই স্থিরবিন্দুরূপে গৃহীত হইল। ইহার ফলে সমাজ কঠোরশাসনে পূর্ণ ও একরূপ অচল হইয়া দাঁড়াইল। কারণ স্বাধীনতাই উন্নতির একমাত্র সহায়ক।

পাশ্চাত্য দেশে কিন্তু সমাজ ছিল বিভিন্ন ভাব বিকাশের ক্ষেত্র এবং স্থিরবিন্দু ছিল ধর্ম। প্রতিষ্ঠিত চার্চের সহিত একমত হওয়াই ইওরোপীয় ধর্মের মূলমন্ত্র ছিল, এমন কি এখনও আছে; আর যদি কোন সম্প্রদায় প্রচলিত মত হইতে কিছু স্বতন্ত্র হইতে যায়, তাহা হইলে তাহাকে অজস্র শোণিতপাতের মধ্য দিয়া অতি কষ্টে একটু সুবিধা লাভ করিতে হয়। ইহার ফল একটি মহৎ সমাজ-সংহতি, কিন্তু তাহাতে যে ধর্ম প্রচলিত, তাহা অতি স্থূল জড়বাদের উপর কখনও উঠে নাই।

আজ পাশ্চাত্য দেশ নিজের অভাব বুঝিতেছে। এখন পাশ্চাত্যে উন্নত ঈশ্বরতত্ত্বান্বেষিগণের মূলমন্ত্র হইয়াছে—‘মানুষের যথার্থ স্বরূপ ও আত্মা।’ সংস্কৃত-দর্শন-অধ্যয়নকারী মাত্রেই জানেন, এ হাওয়া কোথা হইতে বহিতেছে, কিন্তু যতক্ষণ না ইহা নব জীবন সঞ্চার করিতেছে, ততক্ষণ ইহাতে কিছুই আসিয়া যায় না।

ভারতে আবার নূতন নূতন অবস্থার সংঘর্ষে সমাজ-সংহতির নূতন সামঞ্জস্যবিধান বিশেষ আবশ্যক হইতেছে। গত শতাব্দীর তিন-চতুর্থাংশ ধরিয়া ভারত সমাজসংস্কার-সভায় ও সমাজসংস্কারকে পূর্ণ হইয়াছে। কিন্তু হায়! ইহার মধ্যে সব কয়টিই বিফল হইয়াছে। ইঁহারা সমাজসংস্কারের রহস্য জানিতেন না; ইঁহারা প্রকৃত শিক্ষণীয় বিষয় শিখেন নাই। ব্যস্ততাবশতঃ তাঁহারা আমাদের সমাজের যত দোষ, সব ধর্মের ঘাড়ে চাপাইয়াছেন। বন্ধুর গায়ে মশা বসিয়াছে দেখিয়া সেই গল্পের মানুষটি যেমন দারুণ আঘাতে মশার সঙ্গে বন্ধুকেও মারিয়া ফেলে, সেইরূপ তাঁহারা সমাজের দোষ সংশোধন করিতে গিয়া সমাজকেই একেবারে ধ্বংস করিবার উদ্যোগ করিয়াছিলেন। কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে এক্ষেত্রে তাঁহারা অটল অচল গাত্রে আঘাত করিয়াছিলেন, শেষে উহার প্রতিঘাতবলে নিজেরাই ধ্বংস হইয়াছেন। যে-সকল মহামনা নিঃস্বার্থ পুরুষ এইরূপ বিপথে চালিত চেষ্টায় অকৃতকার্য হইয়াছেন, তাঁহারা সকলেই ধন্য! আমাদের নিশ্চেষ্ট সমাজরূপ নিদ্রিত দৈত্যকে জাগরিত করিতে সংস্কারোন্মত্ততার এই বৈদু্যতিক আঘাতের বিশেষ প্রয়োজন হইয়াছিল।

আসুন, আমরা ইঁহাদের শুভকামনা করিয়া ইঁহাদের অভিজ্ঞতা দ্বারা লাভবান্ হই। তাঁহারা এটুকু শিক্ষা করে নাই, ভিতর হইতে বিকাশ আরম্ভ হয়, বাহিরে তাহারই পরিণতি হয়; তাঁহারা শিক্ষা করেন নাই, সমুদয় ক্রমবিকাশ পূর্ববর্তী কোন ক্রমসঙ্কোচের পুনর্বিকাশ মাত্র। তাঁহারা জানিতেন না, বীজ উহার চারিপাশের পঞ্চভূত হইতে উপাদান সংগ্রহ করে বটে, কিন্তু বৃক্ষটি নিজের প্রকৃতি অনুযায়ী হইয়া থাকে। যতদিন না হিন্দুজাতি একেবারে বিলুপ্ত হইয়া যায় এবং এক নূতন জাতি তাহার স্থান অধিকার করে, ততদিন প্রাচ্যে-প্রতীচ্যে যতই চেষ্টা কর না কেন, জীবিত থাকিতে ভারত কখনও ইওরোপ হইতে পারে না।

ভারত কি বিলুপ্ত হইবে, যে-ভারত সমুদয় মহত্ত্ব নীতি ও আধ্যাত্মিকতার প্রাচীন জননী, যে-ভূমিতে সাধুগণ বিচরণ করিতেন, যে-ভূমিতে ঈশ্বরপ্রতিম ব্যক্তিগণ এখনও বাস করিতেছেন? হে ভ্রাতৃগণ, এথেন্সের সেই জ্ঞানী মহাত্মার২৯ লণ্ঠন লইয়া তোমাদের সঙ্গে এই বিস্তৃত জগতের প্রত্যেক নগর, গ্রাম, অরণ্য অন্বেষণে যাইতে রাজী আছি, কোথাও যদি এমন লোক পাও তো দেখাও। এ কথা ঠিক যে, ফল দেখিয়াই গাছ চেনা যায়। ভারতের প্রত্যেক আমগাছের তলায় পতিত ঝুড়ি ঝুড়ি কীটদষ্ট, অপক্ক আম কুড়াও এবং তাহাদের প্রত্যেকটি সম্বন্ধে একশতটি করিয়া গবেষণাপূর্ণ গ্রন্থ রচনা কর। তথাপি তুমি একটি আমেরও সঠিক বর্ণনা লিখিতে পারিবে না। গাছ হইতে একটি সুপক্ক সরস সুমিষ্ট আম পাড়িয়া লও, তবেই তুমি আমের সকল তত্ত্ব অবগত হইবে।

এইভাবে এই ঈশ্বরকল্প মানবগণই হিন্দুধর্ম কি, তাহা প্রকাশ করেন। এই জাতি শতাব্দী দ্বারা কৃষ্টির পরিমাপ করে, যে জাতিরূপ বৃক্ষ সহস্র বর্ষ ধরিয়া ঝঞ্ঝাবাত সহ্য করিয়াও অনন্ত তারুণ্যের অক্ষয় তেজে এখনও গৌরবান্বিত হইয়া দণ্ডায়মান রহিয়াছে, এই দেবমানবদের জীবন দেখিলেই সেই জাতির স্বরূপ, শক্তি ও সম্ভাবনার বিষয় জানা যায়।

ভারত কি মরিয়া যাইবে? তাহা হইলে জগৎ হইতে সমুদয় আধ্যাত্মিকতা বিলুপ্ত হইবে; চরিত্রের মহান্ আদর্শসকল বিলুপ্ত হইবে, সমুদয় ধর্মের প্রতি মধুর সহানুভূতির ভাব বিলুপ্ত হইবে, সমুদয় ভাবুকতা বিলুপ্ত হইবে; তাহার স্থলে কাম ও বিলাসিতা যুগ্ম দেবদেবীরূপে রাজত্ব চালাইবে; অর্থ—সে পূজার পুরোহিত; প্রতারণা, পাশব বল ও প্রতিদ্বন্দ্বিতা—তাহার পূজাপদ্ধতি আর মানবাত্মা তাহার বলি। এ অবস্থা কখনও হইতে পারে না। কর্মশক্তি হইতে সহ্যশক্তি অনন্তগুণে শ্রেষ্ঠ। ঘৃণাশক্তি হইতে প্রেমশক্তি অনন্তগুণ অধিক শক্তিমান্। যাঁহারা মনে করেন হিন্দুধর্মের বর্তমান পুনরুত্থান কেবল দেশপ্রীতিজাত আবেগের একটি বিকাশমাত্র, তাঁহারা ভ্রান্ত।

প্রথমতঃ আসুন, এই অপূর্ব ব্যাপার কি, তাহা আমরা বুঝিবার চেষ্টা করি। ইহা কি আশ্চর্য নয় যে, একদিকে যেমন আধুনিক বৈজ্ঞানিক গবেষণার প্রবল আক্রমণে পাশ্চাত্য গোঁড়া ধর্মগুলির প্রাচীন দুর্গসমূহ ধূলিসাৎ হইতেছে, একদিকে যেমন বর্তমান বিজ্ঞানের হাতুড়ির আঘাত—শুধু বিশ্বাস বা চার্চ-সমিতির ভোটাধিক্যের উপর প্রতিষ্ঠিত ধর্মমতগুলি কাচপাত্রের মত চূর্ণবিচূর্ণ করিয়া ফেলিতেছে, একদিকে যেমন আক্রমণশীল আধুনিক চিন্তার ক্রমবর্ধমান স্রোতের সহিত নিজেদের মিলাইতে গিয়া পাশ্চাত্য ধর্মমতসকল কিংকর্তব্যবিমূঢ় হইয়া পড়িতেছে, একদিকে যেমন অপর সমুদয় ধর্মপুস্তকের মূলগ্রন্থগুলি হইতে আধুনিক চিন্তার ক্রমবর্ধমান তাড়নায় যথাসম্ভব বিস্তৃত ও উদার অর্থ বাহির করিতে হইয়াছে, আর তাহাদের অধিকাংশই ঐ চাপে ভগ্ন হইয়া অপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের ভাণ্ডারে স্তূপীকৃত হইয়াছে, একদিকে যেমন অধিকাংশ পাশ্চাত্য চিন্তাশীল ব্যক্তি চার্চের সঙ্গে সমুদয় সংস্রব পরিত্যাগ করিয়া অশান্তি-সাগরে ভাসিতেছেন, অপর দিকে তেমনি যে-সকল ধর্ম সেই বেদরূপ জ্ঞানের মূল প্রস্রবণ হইতে প্রাণপ্রদ বারি পান করিয়াছে অর্থাৎ কেবল হিন্দুধর্ম ও বৌদ্ধধর্মই পুনরুজ্জীবিত হইতেছে?

অশান্ত পাশ্চাত্য নাস্তিক বা অজ্ঞেয়বাদী কেবল গীতা বা ধম্মপদেই স্বীয় আশ্রয় পাইতেছেন—যেখানে তাঁহাদের মন শান্ত ও নিশ্চিন্ত হইতে পারে।

অদৃষ্টচক্র ঘুরিয়া গিয়াছে। আর যে-হিন্দু নৈরাশ্যের অশ্রুপরিপ্লুতনেত্রে তাহার প্রাচীন বাসভবন শত্রুপ্রদত্ত অগ্নিতে বেষ্টিতে দেখিতেছিল, এখন বর্তমান চিন্তার প্রখর আলোকে ধূম অপসারিত হইবার পর সে দেখিতেছে, তাহার গৃহই একমাত্র নিজ শক্তিতে দণ্ডায়মান; অপরগুলি সব—হয় ধ্বংস হইয়াছে, নয় হিন্দু আদর্শ অনুযায়ী পুনর্গঠিত হইতেছে। হিন্দু এখন অশ্রুমোচন করিয়া দেখিতে পাইতেছে, যে-কুঠার সেই ‘ঊর্ধ্বমূল অধঃশাখা অশ্বত্থ’-এর মূলদেশ কাটিতে চেষ্টা করিয়াছিল, তাহা বাস্তবিক অস্ত্রচিকিৎসকের শল্যের কার্যই করিয়াছে।

সে দেখিতেছে—তাহার ধর্মরক্ষার জন্য তাহার শাস্ত্রের বিকৃত অর্থ করিবার বা অন্য কোনরূপ কপটতা করিবার আবশ্যকতা নাই। শুধু তাই নয়, শাস্ত্রের দুর্বল অংশগুলিকে সে দুর্বল বলিতে পারে, কারণ ঐগুলি অরুন্ধতী-দর্শনন্যায়মতে নিম্নাধিকারিগণের জন্য বিহিত। সেই প্রাচীন ঋষিগণকে ধন্যবাদ, যাঁহারা এরূপ সর্বব্যাপী সদাবিস্তারশীল ধর্মপদ্ধতি আবিষ্কার করিয়াছেন, যে-পদ্ধতি জড়রাজ্যে যাহা কিছু আবিষ্কৃত হইয়াছে এবং যাহা কিছু হইবে, সে-সবই সাদরে গ্রহণ করিতে পারে। হিন্দু সেইগুলিকে নূতনভাবে বুঝিতে শিখিয়াছে এবং আবিষ্কার করিয়াছে, যে-আবিষ্কারগুলি প্রত্যেক সীমাবদ্ধ ক্ষুদ্র সম্প্রদায়ের পক্ষে এত ক্ষতিকর হইয়াছে, সেগুলি তাহার পূর্বপুরুষগণের ধ্যানলব্ধ তুরীয় ভূমি হইতে আবিষ্কৃত সত্যসমূহের—বুদ্ধি ও ইন্দ্রিয়জ্ঞানের ভূমিতে পুনরাবিষ্কার মাত্র।

এই কারণেই তাহাকে কোন ভাবই ত্যাগ করিতে হইবে না, অথবা তাহাকে অন্য কোথাও কিছু খুঁজিতেও হইবে না। যে অনন্ত ভাণ্ডার সে উত্তরাধিকারসূত্রে পাইয়াছে, তাহা হইতে কিয়দংশ লইয়া নিজ কাজে লাগাইলেই তাহার পক্ষে যথেষ্ট হইবে। তাহা সে করিতে আরম্ভ করিয়াছে, ক্রমশঃ আরও করিবে। ইহাই কি বাস্তবিক এই পুনরুত্থানের কারণ নয়?

বঙ্গীয় যুবকগণ, তোমাদিগকে বিশেষভাবে আহ্বান করিয়া বলিতেছিঃ

ভ্রাতৃগণ! লজ্জার বিষয় হইলেও ইহা আমরা জানি যে, বৈদেশিকগণ যে-সকল প্রকৃত দোষের জন্য হিন্দুজাতিকে নিন্দা করেন, সেগুলির কারণ আমরা। আমরাই ভারতের অন্যান্য জাতির মস্তকে অনেক অনুচিত গালি-বর্ষণের কারণ। কিন্তু ঈশ্বরকে ধন্যবাদ, আমরা ইহা বুঝিতে পারিয়াছি, আর তাঁহার আশীর্বাদে আমরা যে শুধু নিজেদেরই শুদ্ধ করিব, তাহা নয়, সমুদয় ভারতকেই সনাতনধর্ম-প্রচারিত আদর্শ অনুসারে জীবন গঠন করিতে সাহায্য করিতে পারিব। প্রথমে এস, ক্রীতদাসের কপালে প্রকৃতি সর্বদাই যে ঈর্ষা-তিলক অঙ্কন করেন, তাহা মুছিয়া ফেলি। কাহারও প্রতি ঈর্ষান্বিত হইও না। সকল শুভকর্মব্রতীকেই সাহায্য করিতে সর্বদা প্রস্তুত থাক। ত্রিলোকের প্রত্যেক জীবের উদ্দেশ্যে শুভেচ্ছা প্রেরণ কর।

এস, আমাদের ধর্মের এক কেন্দ্রীভূত সত্য—যাহা হিন্দু বৌদ্ধ জৈন সকলেরই সাধারণ উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্য, তাহারই ভিত্তিতে, দণ্ডায়মান হই। সেই কেন্দ্রীভূত সত্যঃ এই অজ অনন্ত সর্বব্যাপী অবিনাশী মানবাত্মা, যাঁহার মহিমা স্বয়ং বেদ প্রকাশ করিতে অক্ষম, যাঁহার মহিমার সমক্ষে অনন্ত সূর্য চন্দ্র তারকা নক্ষত্রপুঞ্জ ও নীহারিকামণ্ডলী বিন্দুতুল্য। প্রত্যেক নরনারী, শুধু তাহাই নয়, উচ্চতম দেবতা হইতে তোমাদের পদতলে ঐ কীট পর্যন্ত সকলেই ঐ আত্মা—হয় উন্নত, নয় অবনত। প্রভেদ—প্রকারগত নয়, পরিমাণগত।

আত্মার এই অনন্ত শক্তি জড়ের উপর প্রয়োগ করিলে জাগতিক উন্নতি হয়, চিন্তার উপর প্রয়োগ করিলে মনীষার বিকাশ হয় এবং নিজেরই উপর প্রয়োগ করিলে মানুষ দেবতা হইয়া যায়।

প্রথমে এস, আমরা দেবত্ব লাভ করি, পরে অপরকে দেবতা হইতে সাহায্য করিব। ‘নিজে সিদ্ধ হইয়া অপরকে সিদ্ধ হইতে সহায়তা কর’—ইহাই আমাদের মূলমন্ত্র হউক। মানুষকে পাপী বলিও না; তাহাকে বল, তুমি ব্রহ্ম। যদি বা কেহ শয়তান থাকে, তথাপি ব্রহ্মকেই স্মরণ করা আমাদের কর্তব্য—শয়তানকে নয়।

ঘর যদি অন্ধকার হয়, তবে সর্বদা ‘অন্ধকার, অন্ধকার’ বলিয়া দুঃখ প্রকাশ করিলে অন্ধাকার দূর হইবে না, বরং আলো আন। জানিয়া রাখ—যাহা কিছু অভাবাত্মক, যাহা কিছু পূর্ববর্তী ভাবগুলিকে ভাঙিয়া ফেলিতেই নিয়ুক্ত, যাহা কিছু কেবল দোষদর্শনাত্মক, তাহা চলিয়া যাইবেই যাইবে; যাহা কিছু ভাবাত্মক, যাহা কিছু গঠনমূলক, যাহা কোন একটি সত্য স্থাপন করে, তাহাই অবিনাশী, তাহাই চিরকাল থাকিবে। এস, আমরা বলিতে তাকি, ‘আমরা সৎস্বরূপ, ব্রহ্ম সৎস্বরূপ, আর আমরাই ব্রহ্ম, শিবোঽহ‍ম্ শিবোঽহম্‌’—এই বলিয়া চলো—অগ্রসর হই। জড় নয়, চৈতন্যই আমাদের লক্ষ্য। যে কোন বস্তুর নামরূপ আছে, তাহাই নামরূপাতীত সত্তার অধীন। শ্রুতি বলেন, ইহাই সনাতন সত্য। আলো আন, অন্ধকার আপনি চলিয়া যাইবে। বেদান্তকেশরী গর্জন করুক, শৃগালগণ তাহাদের গর্তে পলায়ন করিবে। চারিদিকে ভাব ছড়াইতে থাক; ফল যাহা হইবার, হউক। বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থ একত্র রাখিয়া দাও, উহাদের মিশ্রণ আপনা-আপনিই হইবে। আত্মার শক্তি বিকশিত কর; উহার শক্তি ভারতের সর্বত্র ছড়াইয়া দাও; যাহা কিছু প্রয়োজন, তাহা আপনিই আসিবে।

তোমার অন্তর্নিহিত ব্রহ্মভাব বিকশিত কর, আর সব-কিছুই উহার চারিদিকে সুসমঞ্জস্যভাবে মিলিত হইবে। বেদে বর্ণিত ইন্দ্রবিরোচন- সংবাদ৩০ স্মরণ কর। উভয়েই তাঁহাদের ব্রহ্মত্ব সম্বন্ধে উপদেশ পাইলেন। কিন্তু অসুর বিরোচন নিজের দেহকেই ব্রহ্ম বলিয়া স্থির করিলেন, কিন্তু দেবতা বলিয়া ইন্দ্র বুঝিতে পারিলেন, আত্মাকেই ব্রহ্ম বলা হইয়াছে। তোমরা সেই ইন্দ্রের সন্তান; তোমরা সেই দেবগণের বংশধর। জড় কখনও তোমাদের ঈশ্বর হইতে পারে না, দেহ কখনও তোমাদের ঈশ্বর হইতে পারে না।

ভারত আবার উঠিবে, কিন্তু জড়ের শক্তিতে নয়, চৈতন্যের শক্তিতে; বিনাশের বিজয়পতাকা লইয়া নয়, শান্তি ও প্রেমের পতাকা লইয়া—সন্ন্যাসীর গৈরিক বেশ-সহায়ে; অর্থের শক্তিতে নয়, ভিক্ষাপাত্রের শক্তিতে। বলিও না, তোমরা দুর্বল; বাস্তবিক সেই আত্মা সর্বশক্তিমান্‌। শ্রীরামকৃষ্ণের দিব্য চরণস্পর্শে যে মুষ্টিমেয় যুবকদলের অভ্যুদয় হইয়াছে, তাহাদের প্রতি দৃষ্টিপাত কর। তাহারা আসাম হইতে সিন্ধু, হিমালয় হইতে কুমারিকা পর্যন্ত তাঁহার উপদেশামৃত প্রচার করিয়াছে। তাহারা পদব্রজে ২০,০০০ ফুট ঊর্ধ্বে হিমালয়ের তুষাররাশি অতিক্রম করিয়া তিব্বতের রহস্য ভেদ করিয়াছে। তাহারা চীরধারী হইয়া দ্বারে দ্বারে ভিক্ষা করিয়াছে। কত অত্যাচার তাহাদের উপর দিয়া গিয়াছে—এমন কি তাহারা পুলিসের দ্বারা অনুসৃত হইয়া কারাগারে নিক্ষিপ্ত হইয়াছে, অবশেষে যখন গভর্নমেণ্ট বিশেষ প্রমাণ পাইয়াছেন, তাহারা নির্দোষ, তখন তাহারা মুক্তিলাভ করিয়াছে।

এখন তাহারা বিংশতিজন মাত্র। কালই তাহাদের সংখ্যা দুই সহস্রে পরিণতি কর। হে বঙ্গীয় যুবকবৃন্দ, তোমাদের দেশের জন্য ইহা প্রয়োজন, সমুদয় জগতের জন্য ইহা প্রয়োজন। তোমাদের অন্তর্নিহিত ব্রহ্মশক্তি জাগাইয়া তোল; সেই শক্তি তোমাদিগকে ক্ষুধা-তৃষ্ণা শীত-উষ্ণতা—সব কিছু সহ্য করিতে সমর্থ করিবে। বিলাসপূর্ণ গৃহে বসিয়া, সর্বপ্রকার সুখ-সম্ভোগে পরিবেষ্টিত থাকিয়া একটু শখের ধর্ম করা অন্যান্য দেশের পক্ষে শোভা পাইতে পারে, কিন্তু ভারতের অন্তরে ইহা অপেক্ষা উচ্চতর প্রেরণা বিদ্যমান। ভারত সহজেই প্রতারণা ধরিয়া ফেলে। তোমাদিগকে ত্যাগ করিতে হইবে। মহৎ হও। স্বার্থত্যাগ ব্যতীত কোন মহৎ কার্যই সাধিত হইতে পারে না। পুরুষ স্বয়ং জগৎ সৃষ্টি করিবার জন্য স্বার্থত্যাগ করিলেন, নিজেকে বলি দিলেন। তোমরা সর্বপ্রকার আরাম-স্বাচ্ছন্দ্য, নাম-যশ অথবা পদ—এমন কি জীবন পর্যন্ত বিসর্জন দিয়া মানবদেহের শৃঙ্খল দ্বারা এমন একটি সেতু নির্মাণ কর, যাহার উপর দিয়া লক্ষ লক্ষ লোক এই জীবনসমুদ্র পার হইয়া যাইতে পারে।

যাবতীয় কল্যাণ-শক্তিকে মিলিত কর। তুমি কোন্ পতাকার নিম্নে থাকিয়া যাত্রা করিতেছ, সেদিকে লক্ষ্য করিও না। তোমার পতাকা নীল সবুজ বা লোহিত, তাহা গ্রাহ্য করিও না; সমুদয় রঙ্‌ মিশাইয়া প্রেমের শুভ্রবর্ণের তীব্র জ্যোতি প্রকাশ কর। আমাদের প্রয়োজন—কার্য করিয়া যাওয়া; ফল যাহা, তাহা আপনি হইবে। যদি কোন সামাজিক নিয়ম তোমার ব্রহ্মত্বলাভের প্রতিকূল হয়, আত্মার শক্তির সম্মুখে তাহা টিকিতে পারিবে না। ভবিষ্যৎ কি হইবে, তাহা দেখিতে পাইতেছি না, দেখিবার জন্য আমার আগ্রহও নাই। কিন্তু আমি যেন দিব্যচক্ষে দেখিতেছি যে, আমাদের সেই প্রাচীনা জননী আবার জাগিয়া উঠিয়া পুনর্বার নবযৌবনশালিনী ও পূর্বাপেক্ষা বহুগুণে মহিমান্বিতা হইয়া তাঁহার সিংহাসনে বসিয়াছেন। শান্তি ও আশীর্বাণীর সহিত তাঁহার নাম সমগ্র জগতে ঘোষণা কর।

কর্ম ও প্রেমে চিরকাল তোমাদেরই
বিবেকানন্দ

[সেপ্টেম্বর, ১৮৯৪, বষ্টন]