১৪. আমাদের উপস্থিত কর্তব্য

[এই বক্তৃতা ট্রিপ্লিকেন সাহিত্য সমিতিতে প্রদত্ত হয়। এই সমিতির সভ্যদের চেষ্টাতেই স্বামীজী চিকাগোর ধর্মমহাসভায় হিন্দুধর্মের প্রতিনিধিরূপে প্রেরিত হন।]

পৃথিবী যতই অগ্রসর হইতেছে, ততই দিন দিন জীবন-সমস্যা আরও গভীর ও ব্যাপক হইতেছে। অতি প্রাচীনকালে যখন সমগ্র জগতের অখণ্ডত্ব-রূপ বৈদান্তিক সত্য প্রথম আবিষ্কৃত হয়, তখন হইতেই উন্নতির মূলমন্ত্র ও সারতত্ত্ব প্রচারিত হইয়া আসিতেছে। সমগ্র জগৎকে নিজের সঙ্গে না টানিয়া জগতের একটি পরমাণু পর্যন্ত নড়িতে পারে না। সমগ্র বিশ্বকে একই সঙ্গে উন্নতিপথে অগ্রসর না করাইয়া পৃথিবীর কোন স্থানে কোনরূপ উন্নতি সম্ভব নহে। আর প্রতিদিনই স্পষ্ট হইতে স্পষ্টতররূপে বুঝা যাইতেছে যে, শুধু জাতীয় বা কোন সঙ্কীর্ণ ভিত্তির উপর নির্ভর করিয়া কোন সমস্যার সমাধান হইতে পারে না। যে-কোন বিষয়—যে-কোন ভাব হউক, উহাকে উদার হইতে উদারতর হইতে হইবে, যতক্ষণ না উহা সার্বভৌম হইয়া দাঁড়ায়; যে-কোন আকাঙ্ক্ষাই হউক, উহাকে ক্রমশঃ এমন বাড়াইতে হইবে, যেন উহা সমগ্র মানবজাতিকে, শুধু তাহা নয়, সমগ্র প্রাণিজগৎকে পর্যন্ত নিজ সীমার অন্তর্ভুক্ত করিয়া লয়।

ইহা হইতে বুঝা যাইবে, প্রাচীনকালে আমাদের দেশ যে উচ্চাসনে আরূঢ় ছিল, গত কয়েক শতাব্দী যাবৎ আর তাহা নাই। যদি আমরা এই অবনতির কারণ অনুসন্ধান করি, তবে দেখিতে পাই, আমাদের দৃষ্টির সঙ্কীর্ণতা—আমাদের কার্যক্ষেত্রের সঙ্কোচনই ইহার অন্যতম কারণ।

জগতে দুইটি আশ্চর্য জাতির আবির্ভাব হইয়া গিয়াছে। একই মূল জাতি হইতে উৎপন্ন, কিন্তু বিভিন্ন দেশকালঘটনাচক্রে স্থাপিত, নিজ নিজ বিশেষ নির্দিষ্ট পন্থায় জীবন-সমস্যার সমাধানে নিযুক্ত দুইটি প্রাচীন জাতি ছিল—আমি হিন্দু ও গ্রীক জাতির কথা বলিতেছি। উত্তরে হিমাচলের হিমশিখরসীমাবদ্ধ, পৃথিবীর প্রান্তবৎ প্রতীয়মান অন্তহীন অরণ্যানী ও সমতলে প্রবহমান সমুদ্রবৎ বিশাল স্বাদুসলিলা স্রোতস্বতী-বেষ্টিত ভারতীয় আর্যের মন সহজেই অন্তর্মুখ হইল। আর্যজাতি স্বভাবতই অন্তর্মুখ, আবার চতুর্দিকে এই-সকল মহাভাবোদ্দীপক দশ্যাবলীতে পরিবেষ্টিত হইয়া তাঁহাদের সূক্ষ্মভাবগ্রাহী মস্তিষ্ক স্বভাবতই অন্তর্দৃষ্টিপরায়ণ হইল, নিজের মন বিশ্লেষণ করাই ভারতীয় আর্যের প্রধান লক্ষ্য হইল। অপর দিকে গ্রীকজাতি জগতের এমন এক স্থানে বাস করিত, যেখানে গাম্ভীর্য অপেক্ষা সৌন্দর্যের বেশী সমাবেশ—গ্রীক দ্বীপপুঞ্জের অন্তর্বর্তী সুন্দর দ্বীপসমূহ—চতুর্দিকের নিরাভরণা কিন্তু হাস্যময়ী প্রকৃতি—তাহার মন সহজেই বহির্মুখ হইল, উহা বাহ্য জগতের বিশ্লেষণ করিতে চাহিল। ফলে আমরা দেখিতে পাই, ভারত হইতে সর্বপ্রকার বিশ্লেষণাত্মক এবং গ্রীস হইতে শ্রেণীবিভাগপূর্বক বিশ্বজনীন সত্যে উপনীত হইবার বিজ্ঞানসমূহের উদ্ভব।

হিন্দু মন নিজ বিশিষ্ট পথে চলিয়া অতি বিস্ময়কর ফল লাভ করিয়াছিল। এখনও হিন্দুদের যেরূপ বিচারশক্তি, ভারতীয় মস্তিষ্ক এখনও যেরূপ শক্তির আধার, তাহার সহিত অন্য কোন জাতির তুলনা হয় না। আর আমরা সকলেই জানি, আমাদের যুবকগণ অন্য যে-কোন দেশের যুবকগণের সহিত প্রতিযোগিতায় সর্বদাই জয়ী হইয়া থাকে; তথাপি যখন, সম্ভবতঃ মুসলমানকর্তৃক ভারতবিজয়ের দু-এক শতাব্দী পূর্বে জাতীয় প্রাণশক্তি স্তিমিত হইয়া পড়িয়াছিল, তখন জাতির এই বিশেষত্বটিকে—বিচারশক্তিকে লইয়া এত বাড়াবাড়ি করা হইল যে, উহারও অবনতি হইল। আর আমরা ভারতীয় শিল্প, সঙ্গীত, বিজ্ঞান—সকল বিষয়েই এই অবনতির কিছু না কিছু চিহ্ন দেখিতে পাই। শিল্পের আর সেই উদার ধারণা রহিল না, ভাবের উচ্চতা ও বিভিন্ন অঙ্গের সামঞ্জস্যের চেষ্টা আর রহিল না। সকল বিষয়েই প্রচণ্ড অলঙ্কারপ্রিয়তার আবির্ভাব হইল, সমগ্র জাতির মৌলিকত্ব যেন অন্তর্হিত হইল। সঙ্গীতে প্রাচীন সংস্কৃতের হৃদয়-আলোড়নকারী গভীর ভাব আর রহিল না, পূর্বে যে প্রত্যেকটি সুর স্বতন্ত্র থাকিয়াও অপূর্ব ঐকতানের সৃষ্টি করিত, তাহা আর রহিল না; সুরগুলি যেন নিজ নিজ স্বাতন্ত্র্য হারাইল। আমাদের সমগ্র আধুনিক সঙ্গীতে নানাবিধ সুরের তালগোল পাকাইয়া গিয়াছে। কতকগুলি মিশ্রসুরের বিশৃঙ্খল সমষ্টি হইয়া দাঁড়াইয়াছে; ইহাই সঙ্গীতশাস্ত্রে অবনতির চিহ্ন। তোমাদের ভাবরাজ্যের অন্যান্য বিষয়গুলি বিশ্লেষণ করিলেও এইরূপ অলঙ্কারপ্রিয়তার প্রাচুর্য এবং মৌলিকতার অভাব দেখিতে পাইবে, আর তোমাদের বিশেষ কর্মক্ষেত্র—ধর্মের ঘোর ভয়াবহ অবনতি হইয়াছিল। যে-জাতি শত শত বৎসর যাবৎ এক গ্লাস জল ‘ডান হাতে খাইব, কি বাঁ হাতে খাইব’—এইরূপ গুরুতর সমস্যাগুলির বিচারে ব্যস্ত রহিয়াছে, সেই জাতির নিকট আর কি আশা করিতে পার? যে-দেশের বড় বড় মাথাগুলি শত শত বৎসর ধরিয়া এই স্পৃশ্যাস্পৃশ্য-বিচারে ব্যাস্ত, সেই জাতির অবনতি যে চরম সীমায় পৌঁছিয়াছে, তাহা কি আর বলিতে হইবে? বেদান্তের তত্ত্বসমূহ, জগতে প্রচারিত ঈশ্বর ও আত্মা-সম্বন্ধীয় সিদ্ধান্তগুলির মধ্যে মহত্তম ও গৌরবময় সিদ্ধান্তসমূহ প্রায় বিলুপ্ত হইল, গভীর অরণ্যে কয়েকজন সন্ন্যাসীর দ্বারা রক্ষিত হইয়া লুক্কায়িত রহিল, অবশিষ্ট সকলে কেবল খাদ্যখাদ্য স্পৃশ্যাস্পৃশ্য প্রভৃতি গুরুতর প্রশ্নসমূহের সিদ্ধান্তে নিযুক্ত রহিল। মুসলমানগণ ভারতবিজয় করিয়া—তাহারা যাহা জানিত, এমন অনেক ভাল বিষয় শিখাইয়াছিল। কিন্তু তাহারা আমাদের জাতির ভিতর শক্তিসঞ্চার করিতে পারে নাই।

অবশেষে আমাদের সৌভাগ্যবশতই হউক বা দুর্ভাগ্যক্রমেই হউক, ইংরেজ ভারত জয় করিল। অবশ্য পরদেশ-বিজয় মাত্রেই মন্দ, বৈদেশিক শাসন নিশ্চয়ই অশুভ। তবে অশুভের মধ্য দিয়াও কখনও কখনও শুভ সংঘটিত হইয়া থাকে। ইংরেজের এই ভারত-বিজয়ে বিশেষ শুভ ফল হইয়াছে। ইংলণ্ড ও সমগ্র ইওরোপ সভ্যতার জন্য গ্রীসের নিকট ঋণী; ইওরোপের সব-কিছুর মধ্যে গ্রীসই যেন কথা বলিতেছে; উহার প্রত্যেক গৃহে প্রত্যেকটি আসবাবপত্রে পর্যন্ত যেন গ্রীসের ছাপ; ইওরোপের বিজ্ঞান শিল্প—সর্বত্র গ্রীসের ছায়া। আজ ভারতক্ষেত্রে সেই প্রাচীন গ্রীক ও প্রাচীন হিন্দু একত্র মিলিত হইয়াছে। এই মিলনের ফলে ধীরে ও নিঃশব্দে একটা পরিবর্তন আসিতেছে, আমরা চতুর্দিকে যে উদার জীবনপ্রদ পুনরুত্থানের আন্দোলন দেখিতেছি, তাহা এই-সব বিভিন্ন ভাবের একত্র সংমিশ্রণের ফল। মানবজীবন সম্বন্ধে আমাদের ধারণা প্রশস্ততর হইতেছে। আমরা উদারভাবে সহৃদয়তা ও সহানুভূতির সহিত মানবজীবনের সমস্যাসমূহের প্রতি দৃষ্টিপাত করিতে শিখিতেছি, আর যদিও আমরা প্রথমে ভ্রান্তিবশতঃ আমাদের ভাবগুলিকে একটু সঙ্কীর্ণ করিতে চেষ্টা করিয়াছিলাম, কিন্তু এখন বুঝিতেছি যে, চতুর্দিকে যে-সব উদার ভাব দেখা যাইতেছে, সেগুলি এবং জীবনের এই প্রশস্ততর ধারণাগুলি আমাদেরই প্রাচীন শাস্ত্রনিবদ্ধ উপদেশের স্বাভাবিক পরিণতি। আমাদের পূর্বপুরুষগণ অতি প্রাচীনকালেই যে-সকল তত্ত্ব আবিষ্কার করিয়াছিলেন, সেই ভাবগুলি যদি ঠিক ঠিক কার্যে পরিণত করা যায়, তবে আমরা উদার না হইয়া থাকিতে পারি না। আমাদের শাস্ত্রোপদিষ্ট সকল বিষয়েরই লক্ষ্য—নিজ ক্ষুদ্র গণ্ডি হইতে বাহির হইয়া সকলের সহিত মিলিয়া মিশিয়া, পরস্পর ভাব আদানপ্রদান করিয়া উদার হইতে উদারতর হওয়া—ক্রমশঃ সার্বভৌম ভাবে উপনীত হওয়া। কিন্তু আমরা শাস্ত্রোপদেশ না মানিয়া ক্রমশঃ নিজেদের সঙ্কীর্ণতর করিয়া ফেলিতেছি—বিচ্ছিন্ন করিয়া ফেলিতেছি।

আমাদের উন্নতির পথে যত বিঘ্ন আছে, সেগুলির মধ্যে একটি এই গোঁড়ামি যে— ‘জগতে আমরাই একমাত্র শ্রেষ্ঠ জাতি।’ ভারতকে আমি প্রাণের সহিত ভালবাসি, স্বদেশের কল্যাণের জন্য আমি সর্বদাই বদ্ধপরিকর, আমাদের প্রাচীন পূর্বপুরুষগণকে আমি বিশেষ ভক্তিশ্রদ্ধা করি, তথাপি পৃথিবীর নিকট আমাদের যে অনেক কিছু শিখিতে হইবে—এ ধারণা আমি ত্যাগ করিতে পারি না। আমাদিগকে সকলের পদতলে বসিয়া শিক্ষালাভের জন্য সর্বদা প্রস্তুত থাকিতে হইবে, কারণ এটি বিশেষভাবে লক্ষ্য করিও যে, সকলেই আমাদিগকে কিছু শিক্ষা দিতে পারে। আমাদেরই শ্রেষ্ঠ স্মৃতিকার মনু বলিয়াছেনঃ

শ্রদ্দধানঃ শুভাং বিদ্যামাদদীতাবরাদপি |
অন্ত্যাদপি পরং ধর্মং স্ত্রীরত্নং দুষ্কুলাদপি ||২৩

অর্থাৎ শ্রদ্ধাবান্ হইয়া নীচ জাতির নিকট হইতেও হিতকর বিদ্যা গ্রহণ করিবে, অতি অন্ত্যজ ব্যক্তির নিকট হইতেও শ্রেষ্ঠ ধর্ম শিক্ষা করিবে ইত্যাদি।

সুতরাং যদি আমরা মনুর উপযুক্ত বংশধর হই, তবে তাঁহার আদেশ আমাদিগকে অবশ্যই পালন করিতে হইবে, যে-কোন ব্যক্তি আমাদিগকে শিক্ষা দিতে সমর্থ, তাহার নিকট হইতেই ঐহিক বা পারত্রিক বিষয়ে শিক্ষা লইবার জন্য প্রস্তুত থাকিতে হইবে।

পক্ষান্তরে ভুলিলে চলিবে না যে, আমাদেরও জগৎকে বিশেষ কিছু শিক্ষা দিবার আছে। ভারতের বাহিরের দেশগুলির সহিত আমাদের সংস্রব না রাখিলে চলিবে না। আমরা যে একসময়ে অপরের সহিত সংস্রব না রাখিবার কথা ভাবিয়াছিলাম, তাহা শুধু আমাদের নির্বুদ্ধিতা, আর তাহারই শাস্তিস্বরূপ আমরা সহস্র বৎসর যাবৎ দাসত্বশৃঙ্খলে বদ্ধ রহিয়াছি। আমরা যে অন্যান্য জাতির সহিত নিজেদের তুলনা করিবার জন্য বিদেশে যাই নাই, আমরা যে জগতের গতি লক্ষ্য করিয়া চলিতে শিখি নাই, ইহাই ভারতীয় মনের অবনতির এক প্রধান কারণ। আমরা যথেষ্ট শাস্তি পাইয়াছি, আর যেন আমরা ভ্রমে না পড়ি। ভারতবাসীর ভারতের বাহিরে যাওয়া অনুচিত—এ-সব আহাম্মকের কথা, ছেলেমানুষি। এ-সব ধারণা সমূলে বিনষ্ট করিতে হইবে। তোমরা যতই ভারত হইতে বাহির হইয়া পৃথিবীর অন্যান্য জাতির সহিত মিশিবে, ততই তোমাদের ও দেশের কল্যাণ। তোমরা পূর্ব হইতেই—শত শত বৎসর পূর্ব হইতেই—যদি ইহা করিতে, তবে আজ এরূপ হইত না—যে-কোন জাতি তোমাদের উপর প্রভুত্ব করিতে ইচ্ছা করিয়াছে, তাহারই পদানত হইতে না। জীবনের প্রথম স্পষ্ট চিহ্ন—বিস্তার। যদি তোমরা বাঁচিতে চাও, তবে তোমাদিগকে সঙ্কীর্ণ গণ্ডি ছাড়িতে হইবে। যে-মুহূর্তে তোমাদের বিস্তার বন্ধ হইবে, সেই-মুহূর্ত হইতেই জানিবে মৃত্যু তোমাদিগকে ঘিরিয়াছে, বিপদ তোমাদের সম্মুখে। আমি ইওরোপ-আমেরিকায় গিয়াছিলাম, তোমরাও সহৃদয়ভাবে তাহা উল্লেখ করিয়াছ। আমাকে যাইতে হইয়াছিল, কারণ এই বিস্তৃতিই জাতীয় জীবনের পুনরভ্যুদয়ের প্রথম চিহ্ন। এই পুনরভ্যুদয়শীল জাতীয় জীবন ভিতরে ভিতরে বিস্তৃত হইয়া আমাকে যেন দূরে নিক্ষেপ করিয়াছিল, আরও সহস্র সহস্র ব্যক্তি এইরূপে নিক্ষিপ্ত হইবে। আমার কথা অবহিত হইয়া শ্রবণ কর, যদি এই জাতি আদৌ বাঁচিয়া থাকে, তবে এরূপ হইবেই হইবে। সুতরাং এই বিস্তার জাতীয় জীবনের পুনরভ্যুদয়ের সর্বপ্রধান লক্ষণ; এই বিস্তারের সহিত মানবের জ্ঞানভাণ্ডারে আমাদের যাহা দিবার আছে, সমগ্র পৃথিবীর উন্নতিবিধানে আমাদের যেটুকু দেয় আছে, তাহাও ভারতের বাহিরে যাইতেছে।

ইহা কিছু নূতন ব্যাপার নহে। তোমাদের মধ্যে যাহারা মনে কর, হিন্দুরা চিরকাল তাহাদের দেশের চতুঃসীমার মধ্যেই আবদ্ধ, তাহারা সম্পূর্ণ ভ্রান্ত; তোমরা তোমাদের প্রাচীন শাস্ত্র পড় নাই, তোমরা তোমাদের জাতীয় ইতিহাস যথাযথ অধ্যয়ন কর নাই। যে-কোনজাতিই হউক, বাঁচিতে হইলে তাহাকে কিছু দিতেই হইবে। প্রাণ দিলে প্রাণ পাইবে, কিছু গ্রহণ করিলে উহার মূল্যস্বরূপ অপর সকলকে কিছু দিতেই হইবে। এত সহস্র বৎসর ধরিয়া আমরা যে বাঁচিয়া আছি—এ-কথা তো অস্বীকার করিবার উপায় নাই। এখন কিরূপে আমরা এতদিন জীবিত রহিয়াছি, এই সমস্যার যদি সমাধান করিতে হয়, তবে স্বীকার করিতেই হইবে—আমরা চিরকালই পৃথিবীকে কিছু না দিয়া আসিতেছি, অজ্ঞ ব্যক্তিগণ যাহাই ভাবুক না কেন।

তবে ভারতের দান—ধর্ম, দার্শনিক জ্ঞান ও আধ্যাত্মিকতা; ধর্মজ্ঞান বিস্তার করিতে, ধর্মপ্রচারের পথ পরিষ্কার করিতে সৈন্যদলের প্রয়োজন হয় না। জ্ঞান ও দার্শনিক সত্য শ্রোণিতপ্রবাহের মধ্য দিয়া লইয়া যাইতে হয় না। জ্ঞান ও দার্শনিক তত্ত্ব রক্তাক্ত নরদেহের উপর দিয়া সদর্পে অগ্রসর হয় না, ঐগুলি শান্তি ও প্রেমের পক্ষদ্বয়ে ভর করিয়া শান্তভাবে আসিয়া থাকে, আর এইরূপই বরাবর হইয়াছে। অতএব দেখা গেল, ভারতকেও বরাবর পৃথিবীকে কিছু না কিছু দিতে হইয়াছে। লণ্ডনে জনৈকা মহিলা আমাকে জিজ্ঞাসা করিয়াছিলেন, ‘তোমরা হিন্দুরা কি করিয়াছ? তোমরা কখনও একটি জাতিকেও জয় কর নাই!’ ইংরেজ জাতির পক্ষে—বীর, সাহসী, ক্ষত্রিয়প্রকৃতি ইংরেজ জাতির পক্ষে এ কথা শোভা পায়; তাহাদের পক্ষে একজন অন্যকে জয় করিতে পারিলে তাহাই শ্রেষ্ঠ গৌরব বলিয়া বিবেচিত হয়। তাহাদের দৃষ্টিতে উহা সত্য বটে, কিন্তু আমাদের দৃষ্টিতে ঠিক বিপরীত। যখন আমি আমার মনকে জিজ্ঞাসা করি, ‘ভারতের শ্রেষ্ঠত্বের কারণ কি?’ উত্তর পাই, ‘কারণ এই যে, আমরা কখনও অপর জাতিকে জয় করি নাই।’ ইহাই আমাদের গৌরব। তোমরা আজকাল সর্বদাই আমাদের ধর্মের এই নিন্দা শুনিতে পাও যে, উহা পরধর্ম-বিজয়ে সচেষ্ট নহে; আর আমি দুঃখের সহিত বলিতেছি, এমন ব্যক্তিগণের নিকট শুনিতে পাও, যাহাদের নিকট অধিকতর জ্ঞানের আশা করা যায়। আমার মনে হয়, আমাদের ধর্ম যে অন্যান্য ধর্ম অপেক্ষা সত্যের অধিকতর নিকটবর্তী, ইহাই তাহার একটি প্রধান কারণ; আমাদের ধর্ম কখনই অপর ধর্মকে গ্রাস করিতে প্রবৃত্ত হয় নাই, উহা কখনই রক্তপাত করে নাই, উহা সর্বদাই আশীর্বাণী ও শান্তিবাক্য উচ্চারণ করিয়াছে, সকলকে উহা প্রেম ও সহানুভূতির কথাই বলিয়াছে। এখানে—কেবল এখানেই পরধর্মসহিষ্ণুতা-বিষয়ক ভাবসমূহ প্রথম প্রচারিত হয়; কেবল এইখানেই পরধর্মসহিষ্ণুতা ও সহানুভূতির ভাব কার্যে পরিণত হইয়াছে। অন্যান্য দেশে ইহা কেবল মতবাদে পর্যবসিত। এখানে—কেবল এখানেই হিন্দুরা মুসলমানদের জন্য মসজিদ ও খ্রীষ্টানদের জন্য চার্চ নির্মাণ করিয়া দেয়। অতএব ভদ্রমহোদয়গণ, আপনারা বুঝিতেছেন—আমাদের ভাব পৃথিবীতে বহুবার প্রচারিত হইয়াছে, কিন্তু অতি ধীরে, নীরবে ও অজ্ঞাতভাবে। ভারতের সকল বিষয়ই এইরূপ। ভারতীয় চিন্তার একটি লক্ষণ উহার শান্তভাব, উহার নীরবতা। আবার উহার পশ্চাতে যে প্রবল শক্তি রহিয়াছে, তাহাকে বল-বাচক কোন শব্দ দ্বারা অভিহিত করা যায় না। উহাকে ভারতীয় চিন্তারাশির নীরব মোহিনীশক্তি বলা যাইতে পারে। কোন বৈদেশিক যদি আমাদের সাহিত্য-অধ্যায়নে প্রবৃত্ত হয়, প্রথমতঃ উহা তাহার নিকট অতিশয় বিরক্তিকর লাগে; উহাতে হয়তো তাহার দেশের সাহিত্যের মত উদ্দীপনা নাই, তীব্র গতি নাই, যাহাতে সে সহজেই মাতিয়া উঠিবে। ইওরোপের বিয়োগান্তক নাটকগুলির সহিত আমাদের নাটকগুলির তুলনা কর। পাশ্চাত্য নাটকগুলি ঘটনাবৈচিত্র্যে পূর্ণ, ক্ষণকালের জন্য উদ্দীপিত করে; কিন্তু শেষ হইবা মাত্র মনে প্রতিক্রিয়া আসে, স্মৃতি হইতে মুছিয়া যায়। ভারতের বিয়োগান্ত নাটকগুলি ঐন্দ্রজালিকের শক্তির মত ধীরে নিঃশব্দে কাজ করে; একবার পড়িতে আরম্ভ করিলে উহাদের প্রভাব তোমার উপর বিস্তৃত হইতে থাকে। আর কোথায় যাইবে? তুমি বাঁধা পড়িলে। যিনিই আমাদের সাহিত্যে প্রবেশ করিতে সাহসী হইয়াছে, তিনিই উহার বন্ধন অনুভব করিয়াছেন—তিনিই উহার চিরপ্রেমে বাঁধা পড়িয়াছে।

শিশিরবিন্দু যেমন নিঃশব্দে অদৃশ্য ও অশ্রুতভাবে পড়িয়া অতি সুন্দর গোলাপকলিকে প্রস্ফুটিত করে, সমগ্র পৃথিবীর চিন্তারাশিতে ভারতের দান সেইরূপ বুঝিতে হইবে। নীরবে, অজ্ঞাতসারে অথচ অদম্য মহাশক্তিবলে উহা সমগ্র পৃথিবীর চিন্তারাশিতে যুগান্তর আনিয়াছে, তথাপি কেহই জানে না—কখনও এরূপ হইল। আমার নিকট একবার কথাপ্রসঙ্গে কেহ বলিয়াছিল, ‘ভারতীয় কোন প্রাচীন গ্রন্থকারের নাম আবিষ্কার করা কি কঠিন ব্যাপার!’ ঐ কথায় আমি উত্তর দিই, ‘ইহাই ভারতীয় ভাব।’ তাঁহারা আধুনিক গ্রন্থকারগণের মত ছিলেন না। আধুনিক গ্রন্থকার অন্যান্য লেখকের গ্রন্থ হইতে শতকরা নব্বই ভাগ চুরি করে, শতকরা দশভাগমাত্র তাহার নিজস্ব, কিন্তু গ্রন্থারম্ভে একটি ভূমিকা লিখিয়া পাঠককে বলিতে ভুলে না, ‘এই-সকল মতামতের জন্য আমিই দায়ী।’

যে-সকল মহামনীষী মানবজাতির হৃদয়ে মহান্ ভাবরাশি সঞ্চারিত করিয়া গিয়াছেন, তাঁহারা গ্রন্থ লিখিয়াই সন্তুষ্ট ছিলেন, গ্রন্থে নিজেদের নাম পর্যন্ত দেন নাই, তাঁহারা সমাজকে তাঁহাদের গ্রন্থরাশি উপহার দিয়া নীরবে দেহত্যাগ করিয়াছেন। আমাদের দর্শনকার বা পুরাণকারগণের নাম কে জানে? তাঁহারা সকলেই ‘ব্যাস’, ‘কপিল’ প্রভৃতি উপাধিমাত্র দ্বারা পরিচিত। তাঁহারাই শ্রীকৃষ্ণের প্রকৃত সন্তান। তাঁহারাই যথার্থভাবে গীতার শিক্ষা অনুসরণ করিয়াছেন। তাঁহারাই শ্রীকৃষ্ণের সেই মহান্ উপদেশ—‘কর্মণ্যেবাধিকারস্তে মা ফলেষু কদাচন’ (কর্মেই তোমার অধিকার, ফলে কখনই নহে)—জীবনে পালন করিয়া গিয়াছেন।

ভদ্রমহোদয়গণ, ভারত এইরূপে সমগ্র পৃথিবীতে প্রভাব বিস্তার করিতেছে, তবে ইহার জন্য একটি পরিবেশ প্রয়োজন। পণ্যদ্রব্য যেমন অপরের নির্মিত পথ দিয়াই একস্থান হইতে অন্য স্থানে যাইতে পারে, ভাবরাশি সম্বন্ধেও সেইরূপ। এক দেশ হইতে অপর দেশে ভাবরাশি লইয়া যাইতে হইলে তৎপূর্বে পথ প্রস্তুত হওয়া আবশ্যক; আর পৃথিবীর ইতিহাসে যখনই কোন দিগ্বিজয়ী জাতি উঠিয়া পৃথিবীর বিভিন্ন দেশগুলিকে একসূত্রে গাঁথিয়াছে, তখনই সেই সূত্র অবলম্বন করিয়া ভারতের চিন্তারাশি প্রবাহিত হইয়াছে এবং প্রত্যেক জাতির শিরায় শিরায় প্রবেশ করিয়াছে। যতই দিন যাইতেছে, ততই আরও প্রমাণ পাওয়া যাইতেছে যে, বৌদ্ধদের পূর্বেও ভারতীয় চিন্তারাশি পৃথিবীর সর্বত্র প্রবেশ করিয়াছিল। বৌদ্ধধর্মের অভ্যুদয়ের পূর্বেই চীন, পারস্য ও পূর্ব দ্বীপপুঞ্জে বেদান্ত প্রবেশ করিয়াছিল। পুনরায় যখন মহতী গ্রীকশক্তি প্রাচ্যজগতের বিভিন্ন অংশকে একসূত্রে গ্রথিত করিয়াছিল, তখন আবার সেখানে ভারতীয় চিন্তারাশি প্রবাহিত হইয়াছিল; খ্রীষ্টধর্ম যে-সভ্যতার গর্ব করিয়া থাকে, তাহাও ভারতীয় চিন্তার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সংগ্রহ ব্যতীত আর কিছুই নহে। আমরা সেই ধর্মের উপাসক, বৌদ্ধধর্ম—উহার সমুদয় মহত্ত্ব সত্ত্বেও—যাহার বিদ্রোহী সন্তান এবং খ্রীষ্টধর্ম যাহার অত্যন্ত সামঞ্জস্যহীন অনুকরণমাত্র।

আবার যুগচক্র ফিরিয়াছে, আবার সময় আসিয়াছে। ইংলণ্ডের দোর্দণ্ড শক্তি পৃথিবীর বিভিন্ন অংশকে আবার একত্র করিয়াছে। ইংরেজের পথ রোমক রাজপথগুলির মত কেবল স্থলে নহে, অতলস্পর্শ সমুদ্রের সব দিকে ছুটিয়াছে। ইংলণ্ডের পথগুলি সমুদ্র হইতে সমুদ্রান্তরে ছুটিয়াছে। পৃথিবীর এক অংশ অন্য সকল অংশের সহিত যুক্ত হইয়াছে, আর বিদ্যুৎ নবনিযুক্ত দূতরূপে উহার অতি অদ্ভুত অংশ অভিনয় করিতেছে। এই-সকল অনুকূল অবস্থা পাইয়া ভারত আবার জাগিতেছে এবং জগতের উন্নতি ও সভ্যতায় তাহার যাহা দিবার আছে, দিতে প্রস্তুত হইয়াছে। ইহার ফলস্বরূপ প্রকৃতি যেন আমাকে জোর করিয়া ইংলণ্ডে ও আমেরিকায় ধর্মপ্রচারের জন্য প্রেরণ করিয়াছিল। আমাদের প্রত্যেকেরই আশা করা উচিত ছিল যে, উহার সময় আসিয়াছে। সকল দিকেই শুভচিহ্ন দেখা যাইতেছে; ভারতীয় দার্শনিক ও আধ্যাত্মিক ভাবরাশি আবার সমগ্র পৃথিবী জয় করিবে। সুতরাং আমাদের জীবনসমস্যা ক্রমশঃ বৃহত্তর আকার ধারণ করিতেছে। আমাদের শুধু যে স্বদেশকে জাগাইতে হইবে তাহা নহে, ইহা তো অতি সামান্য কথা; আমি একজন কল্পনাপ্রিয় ভাবুক ব্যক্তি, আমার ধারণা হিন্দুজাতি সমগ্র জগৎ জয় করিবে।

পৃথিবীতে অনেক বড় বড় দিগ্বিজয়ী জাতি আবির্ভূত হইয়াছে; আমরাও বরাবর দিগ্বিজয়ী। আমাদের দিগ্বিজয়ের কাহিনী ভারতের মহান্ সম্রাট্ অশোক ধর্ম ও আধ্যাত্মিকতার দিগ্বিজয়রূপে বর্ণনা করিয়াছেন। আবার ভারতকে পৃথিবী জয় করিতে হইবে। ইহাই আমার জীবনস্বপ্ন; আর আমি ইচ্ছা করি—যাহারা আমার কথা শুনিতেছ, তাহাদের সকলের মনে এই কল্পনা জাগ্রত হউক; আর যতদিন না তোমরা উহা কাজে পরিণত করিতে পারিতেছ, ততদিন যেন তোমাদের কাজের বিরাম না হয়। লোকে তোমাকে প্রতিদিন বলিবে, আগে নিজের ঘর সামলাও, পরে বিদেশে প্রচারকার্যে যাইও। কিন্তু আমি তোমাদিগকে অতি স্পষ্ট ভাষায় বলিতেছি—যখনই তোমরা অপরের জন্য কাজ কর, তখনই তোমরা শ্রেষ্ঠ কাজ করিয়া থাক। যখনই তোমরা অপরের জন্য কাজ করিয়া থাক, বিদেশী ভাষায় সমুদ্রের পারে তোমাদের ভাববিস্তারের চেষ্টা কর, তখনই তোমরা নিজেদের জন্য শ্রেষ্ঠ কাজ করিতেছ, আর এই সভা হইতেই প্রমাণিত হইতেছে—তোমাদের চিন্তারাশি দ্বারা অপর দেশে জ্ঞানালোক-বিস্তারের চেষ্টা করিলে তাহা কিভাবে তোমাদেরই সাহায্য করিয়া থাকে। যদি আমি ভারতেই আমার কার্যক্ষেত্র সীমাবদ্ধ রাখিতাম, তাহা হইলে ইংলণ্ডে ও আমেরিকায় যাওয়ার দরুন যে ফল হইয়াছে, তাহার এক-চতুর্থাংশও হইত না। ইহাই আমাদের সম্মুখে মহান্ আদর্শ, আর প্রত্যেককেই ইহার জন্য প্রস্তুত হইতে হইবে। ভারতের দ্বারা সমগ্র জগৎ জয়—ইহার কম কিছুতেই নয়; আর আমাদের সকলকে ইহার জন্য প্রস্তুত হইতে হইবে, ইহার জন্য প্রাণ পণ করিতে হইবে। বৈদেশিকগণ আসিয়া তাহাদের সৈন্যদল দ্বারা ভারত প্লাবিত করিয়া দিক—ওঠ ভারত, তোমার আধ্যাত্মিকতা দ্বারা জগৎ জয় কর। এই দেশেই এ কথা প্রথম উচ্চারিত হইয়াছিলঃ ঘৃণা দ্বারা ঘৃণাকে জয় করা যায় না, প্রেমের দ্বারা বিদ্বেষকে জয় করা যায়। আমাদিগকে তাহাই করিতে হইবে। জড়বাদ ও উহার আনুষঙ্গিক দুঃখগুলিকে জড়বাদ দ্বারা জয় করা যায় না। যখন একদল সৈন্য অপর দলকে বাহুবলে জয় করিবার চেষ্টা করে, তখন তাহারা মানবজাতিকে পশুতে পরিণত করে, এবং ক্রমশঃ ঐরূপ পশুসংখ্যা বাড়িতে থাকে। আধ্যাত্মিকতা অবশ্যই পাশ্চাত্যজাতিগুলিকে জয় করিবে। ধীরে ধীরে তাহারা বুঝিতেছে যে, জাতিরূপে যদি বাঁচিতে হয়, তবে তাহাদিগকে আধ্যাত্মিকভাবাপন্ন হইতে হইবে। তাহারা উহার জন্য অপেক্ষা করিতেছে, তাহারা উহার জন্য উৎসুক হইয়া আছে। কোথা হইতে উহা আসিবে?ভারতীয় মহান্ ঋষিগণের ভাবরাশি বহন করিয়া পৃথিবীর প্রত্যেক দেশে যাইতে প্রস্তুত—এমন মানুষ কোথায়? এই মঙ্গলবার্তা যাহাতে পৃথিবীর সর্বত্র প্রত্যেক অলিতে-গলিতে পৌঁছায়, তাহার জন্য সর্বত্যাগ করিতে প্রস্তুত—এমন মানুষ কোথায়? সত্যপ্রচারে সাহায্য করিবে—এইরূপ বীরহৃদয় মানুষের প্রয়োজন। বিদেশে গিয়া বেদান্তের এই মহান্ সত্যসমূহ-প্রচারের জন্য বীরহৃদয় কর্মী প্রয়োজন। আজ ইহার প্রয়োজন হইয়াছে, এরূপ না হইলে পৃথিবী ধ্বংস হইয়া যাইবে। সমগ্র পাশ্চাত্য জগৎ যেন একটি আগ্নেয়গিরির উপর অবস্থিত, কালই ইহা ফাটিয়া চূর্ণবিচূর্ণ হইয়া যাইতে পারে। পাশ্চাত্য লোকেরা পৃথিবীর সর্বত্র অন্বেষণ করিয়া দেখিয়াছে, কিন্তু কোথাও শান্তি পায় নাই; সুখের পেয়ালা প্রাণ ভরিয়া পান করিয়াছে, কিন্তু উহাতে তৃপ্তি পায় নাই। এখন এমন কাজ করিবার সময় আসিয়াছে, যাহাতে ভারতের আধ্যাত্মিক ভাবসমূহ পাশ্চাত্যের অন্তরে গভীরভাবে প্রবেশ করিতে পারে। অতএব হে মান্দ্রাজবাসী যুবকগণ, আমি তোমাদিগকে বিশেষভাবে মনে করাইয়া দিতেছি—আমাদিগকে বিদেশে যাইতে হইবে, আধ্যাত্মিকতা ও দার্শনিক চিন্তার দ্বারা আমাদিগকে পৃথিবী জয় করিতে হইবে, ইহা ছাড়া আর গত্যন্তর নাই; এইরূপই করিতে হইবে, নতুবা মৃত্যু নিশ্চিত। জাতীয় জীবনকে—যে জাতীয় জীবন একদিন সতেজ ছিল, তাহাকে পুনরায় সতেজ করিতে গেলে ভারতীয় চিন্তারাশি দ্বারা পৃথিবী জয় করিতে হইবে।

সঙ্গে সঙ্গে এ-কথা ভুলিলে চলিবে না যে, আধ্যাত্মিক চিন্তা দ্বারা জগ‍দ‍্‍বিজয় বলিতে আমি জীবনপ্রদ তত্ত্বসমূহের প্রচারকেই লক্ষ্য করিতেছি, বহু শতাব্দী ধরিয়া আমরা যে কুসংস্কাররাশিকে আঁকড়াইয়া রহিয়াছি, সেগুলি নহে; ঐ আগাছাগুলিকে এই ভারতভূমি হইতে পর্যন্ত উপড়াইয়া ফেলিয়া দিতে হইবে, যাহাতে ঐগুলি একেবারে মরিয়া যায়। ঐগুলি জাতীয় অবনতির কারণ, ঐগুলি হইতেই মস্তিষ্কের নির্বীর্যতা আসিয়া থাকে। আমাদিগকে সাবধান হইতে হইবে, আমাদের মস্তিষ্ক যেন উচ্চ ও মহৎ চিন্তা করিতে অক্ষম হইয়া না পড়ে, উহা যেন মৌলিকতা না হারায়, উহা যেন নিস্তেজ হইয়া না যায়, উহা যেন ধর্মের নামে সর্বপ্রকার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কুসংস্কারে নিজেকে বিষাক্ত করিয়া না ফেলে। আমাদের এখানে—এই ভারতে কতকগুলি বিপদ আমাদের সম্মুখে রহিয়াছে, উহাদের মধ্যে একদিকে ঘোর জড়বাদ, অপরদিকে উহার প্রতিক্রিয়াস্বরূপ ঘোর কুসংস্কার—দুই-ই পরিহার করিয়া চলিতে হইবে। একদিকে পাশ্চাত্যবিদ্যার মদিরাপানে মত্ত হইয়া আজকাল কতকগুলি ব্যক্তি মনে করিতেছে, তাহারা সব জানে; তাহারা প্রাচীন ঋষিগণের কথায় উপহাস করিয়া থাকে। তাহাদের নিকট হিন্দুজাতির সমুদয় চিন্তা কেবল কতকগুলি আবর্জনার স্তূপ, হিন্দুদর্শন কেবল শিশুর আধ-আধ বুলি এবং হিন্দুধর্ম নির্বোধের কুসংস্কারমাত্র! অপরদিকে আবার কতকগুলি শিক্ষিত ব্যক্তি আছেন, তাঁহারা কিন্তু কতকটা বাতিকগ্রস্ত, তাঁহারা আবার উহাদের সম্পূর্ণ বিপরীত; তাঁহারা সব ঘটনাকেই একটা শুভ বা অশুভ লক্ষণরূপে দেখিয়া থাকেন। ঐ ব্যক্তি যে জাতিবিশেষের অন্তর্ভুক্ত তাহার, তাঁহার বিশেষ জাতীয় দেবতার বা তাঁহার গ্রামের যাহা কিছু কুসংস্কার আছে, তাহার দার্শনিক আধ্যাত্মিক এবং সর্বপ্রকার ছেলেমানুষি ব্যাখ্যা করিতে তিনি প্রস্তুত। তাঁহার নিকট প্রত্যেক গ্রাম্য কুসংস্কারই বেদবাণীর তুল্য এবং তাঁহার মতে সেইগুলি প্রতিপালন করার উপরই জাতীয় জীবন নির্ভর করিতেছে। এই-সব হইতে তোমাদিগকে সাবধান হইতে হইবে।

তোমরা প্রত্যেকে বরং ঘোর নাস্তিক হও, কিন্তু আমি তোমাদের কুসংস্কারগ্রস্ত নির্বোধ দেখিতে ইচ্ছা করি না; কারণ নাস্তিকের বরং জীবন আছে, তাহার কিছু হইবার আশা আছে, সে মৃত নহে। কিন্তু যদি কুসংস্কার ঢোকে, তবে বুদ্ধিনাশ হয়, মস্তিষ্ক দুর্বল হইয়া পড়ে; পতনের ভাব তাহাকে আচ্ছন্ন করিয়াছে। এই দুইটিই পরিত্যাগ করিতে হইবে। আমরা চাই নির্ভীক সাহসী লোক, আমরা চাই—রক্ত তাজা হউক, স্নায়ু সতেজ হউক, পেশী লৌহদৃঢ় হইক। মস্তিষ্ককে দুর্বল করে, এমন-সব ভাবের প্রয়োজন নাই; সেগুলি পরিত্যাগ কর। সর্বপ্রকার রহস্যের দিকে ঝোঁক ত্যাগ কর। ধর্মে কোন গুপ্তভাব নাই। বেদান্ত বা বেদে, সংহিতা বা পুরাণে কি কোন গুপ্তভাব আছে? প্রাচীন ঋষিগণ তাঁহাদের ধর্মপ্রচারের জন্য কোথাও কি গুপ্তসমিতি স্থাপন করিয়াছিলেন? তাঁহাদের আবিষ্কৃত মহান্ সত্যসমূহ সমগ্র পৃথিবীকে দিবার জন্য তাঁহারা কি কোন চাতুরী বা কৌশল অবলম্বন করিয়াছিলেন—ইহা কোথাও লিপিবদ্ধ দেখিয়াছ কি? গুপ্তভাব লইয়া নাড়াচাড়া করা ও কুসংস্কার সর্বদাই দুর্বলতার চিহ্ন, উহা সর্বদাই অবনতি ও মৃত্যুর লক্ষণ। অতএব ঐগুলি হইতে সাবধান হও, তেজস্বী হও, নিজের পায়ের উপর দঁড়াও। সংসারে অনেক অদ্ভুত ব্যাপার আছে। প্রকৃতি সম্বন্ধে আমাদের ধারণা যতদূর, তদনুযায়ী ঐগুলিকে অপ্রাকৃত বলিতে পারি, কিন্তু উহাদের কোনটি গুপ্ত নহে। ধর্মের সত্যসমূহ গুপ্ত অথবা ঐগুলি হিমালয়ের শিখরে অবস্থিত গুপ্তসমিতিসমূহের একচেটিয়া সম্পত্তি—এ কথা ভারতভূমিতে কখনই প্রচারিত হয় নাই। আমি হিমালয়ে গিয়াছিলাম, তোমরা যাও নাই। তোমাদের দেশ হইতে উহা শত শত মাইল দূরে। আমি একজন সন্ন্যাসী, গত চতুর্দশ বৎসর যাবৎ পদব্রজে চারিদিকে ভ্রমণ করিতেছি, আমি তোমাদিগকে বলিতেছি—এইরূপ গুপ্তসমিতি কোথাও নাই। এই-সকল কুসংস্কারের পিছনে ছুটিও না। তোমাদের এবং তোমাদের সমগ্র জাতির পক্ষে বরং ঘোর নাস্তিক হওয়া ভাল, কারণ নাস্তিক হইলে অন্ততঃ তোমাদের একটু তেজ থাকিবে, কিন্তু এইরূপ কুসংস্কারসম্পন্ন হওয়া অবনতি ও মৃত্যুস্বরূপ। সতেজ-মস্তিষ্ক ব্যক্তিগণ এই-সকল কুসংস্কার লইয়া তাহাদের সময় কাটায়, ঘোরতর কুসংস্কারসমূহের রূপক ব্যাখ্যা করিয়া সময় নষ্ট করে—ইহা সমগ্র মানবজাতির পক্ষে ঘোরতর লজ্জার বিষয়। সাহসী হও, প্রত্যেকটি বিষয় ব্যাখ্যা করিবার চেষ্টা করিও না। প্রকৃত কথা এই যে, আমাদের অনেক কুসংস্কার আছে, আমাদের শরীরে অনেক কালো দাগ—অনেক ক্ষত আছে, ঐগুলি একেবারে তুলিয়া ফেলিতে হইবে, কাটিয়া ফেলিতে হইবে, নষ্ট করিতে হইবে। কিন্তু তাহাতে আমাদের ধর্ম, আমাদের আধ্যাত্মিকতা, আমাদের জাতীয় জীবন কিছুমাত্র নষ্ট হইবে না। ধর্মের মূলতত্ত্বগুলি তাহাতে অক্ষতই থাকিবে; বরং এই কালো দাগগুলি যতই মুছিয়া যাইবে, ততই মূলতত্ত্বগুলি আরও উজ্জ্বলভাবে—সতেজে প্রকাশিত হইবে। ঐ তত্ত্বগুলিকে ধরিয়া থাক।

তোমরা শুনিয়াছ, পৃথিবীর প্রত্যেক ধর্মই নিজেকে সার্বভৌম ধর্ম বলিয়া দাবী করিয়া থাকে। প্রথমতঃ আমি বলিতে চাই, সম্ভবতঃ কোন ধর্মই কোন কালে সার্বভৌম ধর্মরূপে পরিগণিত হইবে না; কিন্তু যদি কোন ধর্মের এই দাবী করিবার অধিকার থাকে, তবে আমাদের ধর্মই কেবল এই নামের যোগ্য হইতে পারে, অপর কোন ধর্ম নহে; কারণ অন্যান্য সকল ধর্মই কোন ব্যক্তিবিশেষ অথবা ব্যক্তিগণের উপর নির্ভর করে। অন্যান্য সকল ধর্মই কোন তথাকথিত ঐতিহাসিক ব্যক্তির জীবনের সহিত জড়িত। ঐ-সকল ধর্মাবলম্বীরা মনে করে, ঐতিহাসিকতাই তাহাদের ধর্মের শক্তি, কিন্তু বাস্তবিক যাহাকে তাহারা শক্তি মনে করিতেছে, তাহাই প্রকৃতপক্ষে দুর্বলতা; কারণ যদি ঐ ব্যক্তির ঐতিহাসিকতা অপ্রমাণ করা যায়, তবে তাহাদের ধর্মরূপ প্রাসাদ একেবারে ধসিয়া পড়ে। ঐ-সকল ধর্মের স্থাপক মহাপুরুষদের জীবনের অর্ধেক ঘটনা মিথ্যা প্রমাণিত হইয়াছে এবং অবশিষ্ট অর্ধেক সম্পর্কে বিশেষরূপে সন্দেহ উত্থাপিত হইয়াছে। সুতরাং কেবল তাঁহাদের কথার উপর যে-সকল সত্যের প্রামাণ্য ছিল, সেগুলি আবার শূন্যে বিলীন হইবার উপক্রম হইয়াছে। আমাদের ধর্মে যদিও মহাপুরুষের সংখ্যা যথেষ্ট, কিন্তু আমাদের ধর্মের সত্যসকল তাঁহাদের কথার উপর নির্ভর করে না। কৃষ্ণ বলিয়া কৃষ্ণের মাহাত্ম্য নয়, তিনি বেদান্তের একজন মহান্ আচার্য বলিয়াই তাঁহার মাহাত্ম্য। যদি তিনি তাহা না হইতেন, তবে বুদ্ধদেবের নামের মত তাঁহার নামও ভারতের ধর্মজগৎ হইতে লুপ্ত হইয়া যাইত।

সুতরাং আমরা ব্যক্তিবিশেষের মতানুগামী নহি, আমরা চিরকালই ধর্মের তত্ত্বগুলির উপাসক। ব্যক্তিগণ সেই তত্ত্বসমূহের বাস্তবরূপমাত্র—উদাহরণস্বরূপ। যদি ঐ তত্ত্বগুলি অবিকৃত থাকে, তবে শত সহস্র মহাপুরুষের, শত সহস্র বুদ্ধের অভ্যুদয় হইবে। কিন্তু যদি ঐ তত্ত্বগুলি লোপ পায়, যদি মানুষ ঐগুলি ভুলিয়া যায়, আর সমগ্র জাতীয় জীবন তথাকথিত কোন ঐতিহাসিক ব্যক্তির মত অবলম্বন করিয়া চলিতে যায়, তবে সেই ধর্মের অবনতি অনিবার্য, সেই ধর্মের বিপদ অবশ্যম্ভাবী। কেবল আমাদের ধর্মই কোন ব্যক্তিবিশেষ বা ব্যক্তিসমূহের জীবনের সহিত অচ্ছেদ্যভাবে জড়িত নয়, উহা তত্ত্বের উপর প্রতিষ্ঠিত। অপর দিকে আবার উহাতে লক্ষ লক্ষ অবতার ও মহাপুরুষের স্থান হইতে পারে। নূতন অবতার বা নূতন মহপুরুষেরও আমাদের ধর্মে স্থান হইতে পারে, কিন্তু তাঁহাদের প্রত্যেককেই সেই তত্ত্বসমূহের জীবন্ত উদাহরণস্বরূপ হইতে হইবে—এইটি ভুলিলে চলিবে না। আমাদের ধর্মের এই তত্ত্বগুলি অবিকৃতভাবে রহিয়াছে, আর এইগুলি যাহাতে কালে মলিন হইয়া না পড়ে, সেজন্য আমাদের সকলকে সারা জীবন চেষ্টা করিতে হইবে। আশ্চর্যের বিষয়, আমাদের জাতীয় জীবনে ঘোর অবনতি ঘটিলেও বেদান্তের এই তত্ত্বগুলি কখনই মলিন হয় নাই। অতি দুষ্ট ব্যক্তিও ঐগুলি দূষিত করিতে সাহস করে নাই। আমাদের শাস্ত্রসমূহ পৃথিবীর মধ্যে অন্যান্য শাস্ত্র অপেক্ষা ভালভাবে রক্ষিত হইয়াছে। অন্যান্য শাস্ত্রের সহিত তুলনায় উহাতে প্রক্ষিপ্ত অংশ, মূলের বিকৃতি অথবা ভাবের বিপর্যয় নাই বলিলেই হয়। প্রথমে যেমন ছিল, এখনও ঠিক সেইভাবেই উহা রহিয়াছে এবং মানুষের মনকে সেই আদর্শের দিকে পরিচালিত করিতেছে।

বিভিন্ন ভাষ্যকার উহার ভাষ্য করিয়াছেন, অনেক মহান্ আচার্য উহা প্রচার করিয়াছেন এবং উহাদের উপর ভিত্তি করিয়া সম্প্রদায় স্থাপন করিয়াছেন। আর তোমারা দেখিবে—এই বেদগ্রন্থে এমন অনেক তত্ত্ব আছে, যেগুলি আপাতদৃষ্টিতে বিরোধী বলিয়া মনে হয়; কতকগুলি শ্লোক সম্পূর্ণ দ্বৈতবাদাত্মক, অপরগুলি আবার সম্পূর্ণ অদ্বৈতভাবদ্যোতক। দ্বৈতবাদী ভাষ্যকার দ্বৈতবাদ ছাড়া আর কিছুই বুঝিতে পারেন না, সুতরাং তিনি অদ্বৈত শ্লোকগুলি একেবারে চাপা দিতে চান। দ্বৈতবাদী ধর্মাচার্য ও পুরোহিতগণ সকলকেই দ্বৈতভাবে উহাদের ব্যাখ্যা করিতে চান। অদ্বৈতবাদী ভাষ্যকারগণও দ্বৈত শ্লোকগুলিকে সেইরূপ অদ্বৈতপক্ষে ব্যাখ্যা করিবার চেষ্টা করেন। কিন্তু ইহা তো বেদের দোষ নহে। সমগ্র বেদই দ্বৈতভাবের কথা বলিতেছে—এটি প্রমাণ করিবার চেষ্টা করা মূর্খোচিত কার্য। আবার সমগ্র বেদ অদৈতভাবের সমর্থক, ইহা প্রমাণ করিবার চেষ্টাও সেইরূপ নির্বুদ্ধিতা। বেদে দ্বৈত অদ্বৈত—দুই-ই আছে। আমরা নূতন নূতন ভাবের আলোকে ইহা আজকাল আরও ভালভাবে বুঝিতে পারিতেছি। এই-সকল বিভিন্ন সিদ্ধান্ত ও ধারণার দ্বারা পরিশেষে এই চরম সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় যে, মনের ক্রমোন্নতির জন্যই এই-সব মতের প্রয়োজন, আর সেজন্যই বেদ এরূপ উপদেশ দিয়াছেন। সমগ্র মানবজাতির প্রতি কৃপাপরবশ হইয়া বেদ সেই উচ্চতম লক্ষ্যে পৌঁছিবার বিভিন্ন সোপান দেখাইয়াছেন। সেগুলি যে পরস্পরবিরোধী, তাহা নহে; শিশুদিগকে প্রতারিত করিবার জন্য বেদ ঐ-সকল বৃথা বাক্য প্রয়োগ করেন নাই।

ঐগুলির প্রয়োজন আছে—শুধু শিশুদের জন্য নহে, অনেক বয়স্ক ব্যক্তিদের জন্যও বটে। যতদিন আমাদের শরীর আছে, যতদিন এই শরীরকে আত্মা বলিয়া ভ্রম হইতেছে, যতদিন আমরা পঞ্চেন্দ্রিয়ে আবদ্ধ, যতদিন আমরা এই স্থূলজগৎ দেখিতেছি, ততদিন আমাদিগকে ব্যক্তি-ঈশ্বর বা সগুণ ঈশ্বর স্বীকার করিতেই হইবে। কারণ মহান্‌ রামানুজ প্রমাণ করিয়াছেনঃ ঈশ্বর, জীব, জগৎ—এই তিনটির মধ্যে একটি স্বীকার করিলে অপর দুটিও স্বীকার করিতেই হইবে। ইহা পরিহার করিবার উপায় নাই। সুতরাং যতদিন তোমরা বাহ্যজগৎ দেখিতেছ, ততদিন জীবাত্মা ও ঈশ্বর অস্বীকার করা ঘোর বাতুলতা।

তবে মহাপুরুষগণের জীবনে কখনও কখনও এমন সময় আসিতে পারে, যখন জীবাত্মা তাহার সমুদয় বন্ধন অতিক্রম করিয়া প্রকৃতির পারে চলিয়া যায়—সেই সর্বাতীত প্রদেশে চলিয়া যায়, যাহার সম্বন্ধে শ্রুতি বলিয়াছেনঃ

‘যতো বাচো নিবর্তন্তে অপ্রাপ্য মনসা সহ।’
‘ন তত্র চক্ষুর্গচ্ছতি ন বাগ্ গচ্ছতি নো মনঃ।’
‘নাহং মন্যে সুবেদেতি নো ন বেদেতি বেদ চ।’

মনের সহিত বাক্য যাঁহাকে না পাইয়া ফিরিয়া আসে।—সেখানে চক্ষুও যায় না, বাক্যও যায় না, মনও যায় না।—আমি তাঁহাকে জানি, ইহা মনে করি না; জানি না, ইহাও মনে করি না।২৪

তখনই জীবাত্মা সমুদয় বন্ধন অতিক্রম করে; তখনই, কেবল তখনই তাহার হৃদয়ে অদ্বৈতবাদের মূলতত্ত্ব—আমি ও সমগ্র জগৎ এক, আমি ও ব্রহ্ম এক—এই ভাব উদিত হয়।

আর শুদ্ধ জ্ঞান ও দর্শন দ্বারাই এই সিদ্ধান্ত লব্ধ হয়, তাহা নহে; প্রেমবলেও আমরা ইহার কতকটা আভাস পাইতে পারি। ভাগবতে পড়িয়াছ, গোপীগণের মধ্য হইতে শ্রীকৃষ্ণ অন্তর্হিত হইলে তাঁহার বিরহে বিলাপ করিতে করিতে গোপীদের মনে শ্রীকৃষ্ণের ভাবনা এরূপ প্রবল হইল যে, তাহাদের প্রত্যেকেই নিজ দেহ বিস্মৃত হইয়া নিজেকে শ্রীকৃষ্ণ-বোধে তাঁহারই মত বেশভূষা করিয়া তাঁহারই লীলার অনুকরণ করিতে প্রবৃত্ত হইল। সুতরাং বুঝিতেছ, প্রেমবলেও এই একত্ব-অনুভূতি আসিয়া থাকে। জনৈক প্রাচীন পারস্যদেশীয় সুফীর একটি কবিতায় এই ভাবের কথা আছেঃ প্রেমাস্পদের নিকট গিয়া দেখিলাম—গৃহদ্বার রুদ্ধ। দ্বারে করাঘাত করিলাম, ভিতর হইতে প্রশ্ন হইল, ‘কে?’ উত্তর দিলাম, ‘আমি।’ দ্বার খুলিল না। দ্বিতীয়বার আসিয়া দ্বারে আঘাত করিলাম। আবার সেই প্রশ্ন ‘কে?’ আবার উত্তর দিলাম, ‘আমি অমুক।’ তথাপি দ্বার খুলিল না। তৃতীয়বার আসিলাম পরিচিত কণ্ঠস্বর আবার জিজ্ঞাসা করিল, ‘কে?’ তখন বলিলাম—‘হে প্রিয়তম, আমিই তুমি, তুমিই আমি।’ তখন দ্বার খুলিয়া গেল।

সুতরাং আমাদিগকে বুঝিতে হইবে—ব্রহ্মানুভূতির বিভিন্ন সোপান আছে; আর যদিও প্রাচীন ভাষ্যকারগণের মধ্যে—যাঁহাদিগকে আমাদের শ্রদ্ধার চক্ষে দেখা উচিত, তাঁহাদের মধ্যে—বিবাদ থাকে, তথাপি আমাদের বিবাদ করিবার কোন প্রয়োজন নাই, কারণ জ্ঞানের ইতি করা যায় না। প্রাচীনকালে বা বর্তমানকালে সর্বজ্ঞত্ব কাহারও একচেটিয়া অধিকার নহে। অতীত কালে যদি ঋষি-মহাপুরুষ জন্মিয়া থাকেন, নিশ্চয় জানিও বর্তমানকালেও অনেক ঋষির অভ্যুদয় হইবে; যদি প্রাচীনকালে ব্যাস-বাল্মীকি-শঙ্করাচার্যগণের অভ্যুদয় হইয়া থাকে, তবে তোমাদের মধ্যে প্রত্যকেই এক একজন শঙ্করাচার্য হইতে পারিবে না কেন? আমাদের ধর্মের এই বিশেষত্বটিও তোমাদের সর্বদা স্মরণ রাখিতে হইবে; অন্যান্য ধর্মেও প্রত্যাদিষ্ট পুরুষগণের বাক্যই শাস্ত্রের প্রমাণস্বরূপ কথিত হইয়াছে বটে, কিন্তু এরূপ পুরুষের সংখ্যা এক দুই বা কয়েকজন মাত্র—তাঁহাদেরই মাধ্যমে সর্বসাধারণের নিকট সত্য প্রচারিত হইয়াছে; আর সকলকে তাঁহাদের কথা মানিতে হয়। খ্রীষ্টধর্ম বলেঃ নাজারেথের যীশুর মধ্যে সত্যের প্রকাশ হইয়াছিল; আমাদের সকলকে উহাই মানিয়া লইতে হইবে, আমরা আর বেশী কিছু জানি না। কিন্তু আমাদের ধর্ম বলেঃ মন্ত্রদ্রষ্টা ঋষিগণের ভিতর সেই সত্যের আবির্ভাব হইয়াছিল—একজন দুইজন নহে, অনেকের মধ্যে ঐ সত্য আবির্ভূত হইয়াছিল এবং ভবিষ্যতেও হইবে। ‘মন্ত্রদ্রষ্টা’ শব্দের অর্থ মন্ত্র বা তত্ত্বসমূহ যিনি সাক্ষাৎ করিয়াছেন—কেবল বাক্যবাগীশ, শাস্ত্রপাঠক, পণ্ডিত বা শব্দবিৎ নহে—তত্ত্ব সাক্ষাৎ করিয়াছেন, এমন ব্যক্তি।

‘নায়মাত্মা প্রবচনেন লভ্যো ন মেধয়া ন বহুনা শ্রুতেন।’

বহু বাক্যব্যয় দ্বারা, অথবা মেধা দ্বারা, এমন কি বেদপাঠ দ্বারাও আত্মাকে লাভ করা যায় না।২৫

বেদ নিজে এ-কথা বলিতেছেন। তোমরা কি অন্য কোন শাস্ত্রে এরূপ নির্ভীক বাণী শুনিতে পাও—‘বেদপাঠের দ্বারাও আত্মাকে লাভ করা যায় না?’ হৃদয় খুলিয়া প্রাণ ভরিয়া তাঁহাকে ডাকিতে হইবে। তীর্থে বা মন্দিরে গেলে, তিলকধারণ করিলে অথবা বস্ত্রবিশেষ পরিলে ধর্ম হয় না। তুমি গায়ে চিত্র-বিচিত্র করিয়া চিতাবাঘটি সাজিয়া বসিয়া থাকিতে পার, কিন্তু যতদিন পর্যন্ত না তোমার হৃদয় খুলিতেছে, যতদিন পর্যন্ত না ভগবানকে উপলব্ধি করিতেছ, ততদিন সব বৃথা। হৃদয় যদি রাঙিয়া যায়, তবে আর বাহিরের রঙের আবশ্যক নাই। ধর্ম অনুভব করিলে তবেই কাজ হইবে। বাহিরের রঙ ও আড়ম্বরাদি যতক্ষণ পর্যন্ত আমাদের ধর্মজীবনের সাহায্য করে, ততক্ষণ পর্যন্ত সেগুলির উপযোগিতা আছে, ততক্ষণ পর্যন্ত সেগুলি থাকুক, ক্ষতি নাই; কিন্তু সেগুলি আবার অনেক সময় শুধু অনুষ্ঠানমাত্রে পর্যবসিত হইয়া যায়; তখন তাহারা ধর্মজীবনে সাহায্য না করিয়া বরং বিঘ্ন করে; লোকে এই বাহ্য অনুষ্ঠানগুলির সহিত ধর্মকে এক করিয়া বসে। তখন মন্দিরে যাওয়া ও পুরোহিতকে কিছু দেওয়াই ধর্মজীবন হইয়া দাঁড়ায়, এইগুলি অনিষ্টকর; ইহা যাহাতে বন্ধ হয়, তাহা করা উচিত। আমাদের শাস্ত্র বার বার বলিতেছেন, ইন্দ্রিয়জ জ্ঞানের দ্বারা কখনও ধর্মানুভূতি লাভ করা যায় না। যাহা আমাদিগকে সেই অক্ষর পুরুষের সাক্ষাৎ করায় তাহাই ধর্ম; আর এই ধর্ম সকলেরই জন্য। যিনি সেই অতীন্দ্রিয় সত্য সাক্ষাৎ করিয়াছেন, যিনি আত্মার স্বরূপ উপলব্ধি করিয়াছেন, যিনি ভগবানকে অনুভব করিয়াছেন, তাঁহাকে সর্বভূতে প্রত্যক্ষ করিয়াছেন, তিনি ঋষি হইয়াছেন। সহস্র বৎসর পূর্বে যিনি এইরূপ উপলব্ধি করিয়াছেন—তিনিও যেমন ঋষি, সহস্র বৎসর পরেও যিনি উপলব্ধি করিবেন, তিনিও তেমনি ঋষি। আর যতদিন না তোমরা ঋষি হইতেছে, ততদিন তোমাদের ধর্মজীবন শুরু হইবে না; ঋষি হইলে তোমাদের প্রকৃত ধর্ম আরম্ভ হইবে, এখন কেবল প্রস্তুত হইতেছ মাত্র; তখনই তোমাদের ভিতর ধর্মের প্রকাশ হইবে, এখন কেবল মানসিক ব্যায়াম ও শারীরিক যন্ত্রণাভোগ করিতেছ মাত্র। অতএব আমাদিগকে মনে রাখিতে হইবে—আমাদের ধর্ম স্পষ্ট ভাষায় বলিতেছেন, যে-কেহ মুক্তিলাভ করিতে চায়, তাহাকে এই ঋষিত্ব লাভ করিতে হইবে, মন্ত্রদ্রষ্টা হইতে হইবে, ঈশ্বরদর্শন করিতে হইবে। ইহাই মুক্তি।

আর ইহাই যদি আমাদের শাস্ত্রের সিদ্ধান্ত হয়, তবে বুঝা যাইতেছে যে, আমরা নিজে নিজেই অতি সহজে আমাদের শাস্ত্র বুঝিতে পারিব, নিজেরাই উহার অর্থ বুঝিতে পারিব, উহার মধ্য হইতে যেটুকু আমাদের প্রয়োজন তাহাই গ্রহণ করিতে পারিব, নিজে নিজেই সত্য বুঝিতে পারিব, এবং তাহাই করিতে হইবে। আবার প্রাচীন ঋষিগণ যাহা করিয়া গিয়াছেন, তাহার জন্য তাহাদিগকে সম্মান দেখাইতে হইবে। এই প্রাচীনগণ মহাপুরুষ ছিলেন, কিন্তু আমরা আরও বড় হইতে চাই। তাঁহারা অতীতকালে বড় বড় কাজ করিয়াছিলেন, আমাদিগকে তাঁহাদের অপেক্ষাও বড় বড় কাজ করিতে হইবে। প্রাচীন ভারতে শত শত ঋষি ছিলেন, এখন লক্ষ লক্ষ ঋষি হইবেন, নিশ্চয় হইবেন। আর তোমাদের প্রত্যেকেই যত শীঘ্র ইহা বিশ্বাস করিবে, ভারতের পক্ষে ও সমগ্র পৃথিবীর পক্ষে ততই মঙ্গল। তোমরা যাহা বিশ্বাস করিবে, তাহাই হইবে। তোমরা যদি নিজেদের নির্ভীক বলিয়া বিশ্বাস কর, তবে নির্ভীক হইবে। যদি সাধু বলিয়া বিশ্বাস কর, কালই তোমরা সাধুরূপে পরিগণিত হইবে; কিছুই তোমাদিগকে বাধা দিতে পারিবে না। কারণ আমাদের আপাতবিরোধী সম্প্রদায়গুলির ভিতর যদি একটি সাধারণ মতবাদ থাকে, তবে তাহা এইঃ ‘আত্মার মধ্যে পূর্ব হইতেই মহিমা, তেজ ও পবিত্রতা রহিয়াছে।’ কেবল রামানুজের মতে আত্মা কখনও সঙ্কুচিত হন ও কখনও বিকাশপ্রাপ্ত হইয়া থাকেন, আর শঙ্করের মতে ঐ সঙ্কোচ ও বিকাশ ভ্রমমাত্র। এ প্রভেদ থাকুক, কিন্তু সকলেই তো স্বীকার করিতেছেন—ব্যক্তই হউক, আর অব্যক্তই হউক, যে-কোন আকারে হউক, ঐ শক্তি ভিতরেই রহিয়াছে। আর যত শীঘ্র ইহা বিশ্বাস করা যায়, ততই তোমাদের কল্যাণ। সব শক্তি তোমাদের ভিতরে রহিয়াছে। তোমরা সব করিতে পার। ইহা বিশ্বাস কর। মনে করিও না—তোমরা দুর্বল। আজকাল অনেকে যেমন নিজেদের অর্ধোন্মাদ বলিয়া মনে করে, সেরূপ মনে করিও না। অপরের সাহায্য ব্যতীতই তোমরা সব করিতে পার। সব শক্তি তোমাদের ভিতর রহিয়াছে; উঠিয়া দাঁড়াও এবং তোমাদের ভিতর যে দেবত্ব লুক্কায়িত রহিয়াছে, তাহা প্রকাশ কর।