১২. শিষ্যের সাধনা

[১৯০০ খ্রীঃ ২৯ মার্চ সান ফ্রান্সিস্কো শহরে প্রদত্ত।]

আমার বক্তব্য বিষয়—শিষ্যত্ব। জানি না, আমার বক্তব্য আপনারা কি ভাবে গ্রহণ করিবেন। আপনাদের পক্ষে এই ভাব গ্রহণ করা কিছু কঠিন হইবে—আমাদের দেশের গুরু-শিষ্যের আদর্শ ও এদেশের গুরু-শিষ্যের আদর্শের মধ্যে অনেক প্রভেদ। ভরতবর্ষের এক প্রাচীন প্রবাদবাক্য আমার মনে পড়িতেছেঃ গুরু মিলে লাখ লাখ, চেলা নাহি মিলে এক। এই প্রবাদবাক্যটি সত্য বলিয়াই মনে হয়। আধ্যাত্মিকতা লাভের পথে শিষ্যের মনোভাবই বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। যথার্থ মনোভাব থাকিলে জ্ঞানলাভ সহজেই ঘটিয়া থাকে।

সত্যলাভ করিতে হইলে শিষ্যের কি কি গুণ থাকা প্রয়োজন? জ্ঞানী মহাপুরুষগণ বলেন, এক নিমেষেই সত্যলাভ করা যায়—ইহা তো শুধু জানার ব্যাপার। স্বপ্ন ভাঙিয়া যায়—ভাঙিতে কতক্ষণ লাগে? এক মুহূর্তেই স্বপ্ন শেষ হইয়া যায়। ভ্রান্তি দূর হইতে কতক্ষণ লাগে? চক্ষের পলক মাত্র। যখন সত্যকে জানিতে পারি, তখন কেবল মিথ্যাজ্ঞান তিরোহিত হয়, আর কিছুই হয় না। রজ্জুকে সর্প ভাবিয়াছিলাম, এখন দেখিতেছি—ইহা রজ্জু। সমগ্র ঘটনাটি আধ সেকেণ্ডের ব্যাপার মাত্র। ‘তুমি সেই’—তুমিই সত্যস্বরূপ—ইহা জানিতে কতক্ষণ লাগে? যদি আমরা ব্রহ্মই এবং সর্বদাই ব্রহ্মস্বরূপ, তবে ইহা না জানাই সর্বাপেক্ষা আশ্চর্য। ইহা জানিতে পারাই তো স্বাভাবিক। আমরা বরাবর কি ছিলাম, বর্তমানেই বা আমাদের স্বরূপ কি, তাহা জানিতে নিশ্চয়ই যুগযুগান্ত লাগিবে না।

তবু এই স্বতঃসিদ্ধ সত্যটি উপলদ্ধি করা কঠিন বলিয়া মনে হয়। ইহার অতি ক্ষীণ আভাস লাভ করিতেই যুগযুগান্ত কাটিয়া যায়। ঈশ্বরই জীবন; ঈশ্বরই সত্য। এ-বিষয়ে আমরা গ্রন্থ লিখিয়া থাকি; আমাদের অন্তরের অন্তরে আমরা ইহা অনুভব করি যে, ঈশ্বর ব্যতীত আর সবই মিথ্যা; আজ এ-কথা অনুভব করি, কাল এ-ভাব থাকিবে না, তবু সারাজীবন আমাদের অধিকাংশই পূর্বে যেমন ছিলাম সেইরূপই থাকিয়া যাই। আমরা অসত্যকে আঁকড়াইয়া থাকি এবং সত্যের প্রতি বিমুখ হই। আমরা সত্যলাভ করিতে চাই না। আমরা চাই না যে, কেহ আমাদের স্বপ্ন ভাঙিয়া দেয়। তবেই দেখিতেছ, কেহ গুরুর প্রয়োজন বোধ করে না। শিখিতে চায় কে? কিন্তু যদি কেহ মায়ার বন্ধন ছিন্ন করিয়া সত্য উপলব্ধি করিতে চায়, যদি কেহ গুরুর নিকট সত্যলাভ করিতে চায়, তাহাকে খাঁটি শিষ্য হইতেই হইবে।

শিষ্য হওয়া সহজ নয়; তাহার জন্য অনেক প্রস্তুতি প্রয়োজন। অনেক নিয়ম পালন করিতে হয়। বৈদান্তিকগণ চারিটি প্রধান সাধনের কথা বলিয়াছেন। প্রথম সাধন এই—যে-শিষ্য সত্য জানিতে চায়, তাহাকে ইহ-পরজীবনে সমস্ত লাভের আকাঙ্ক্ষা ত্যাগ করিতে হইবে।

আমরা যাহা দেখিতেছি, তাহা সত্য নয়। যতক্ষণ পর্যন্ত আমাদের মনের মধ্যে কোনরূপ বাসনা থাকে, ততক্ষণ যাহা দেখি তাহা সত্য নয়। ঈশ্বরই সত্য, জগৎ সত্য নয়। যতক্ষণ পর্যন্ত আমাদের মনে সংসারের জন্য বিন্দুমাত্র আসক্তি থাকে, ততক্ষণ সত্য লাভ হইবে না। ‘আমার চারিদিকে জগৎ ধ্বংস হইয়া যাক—আমি ভ্রূক্ষেপ করি না’—পরলোক সম্বন্ধেও ঠিক এই প্রকার মনোভাব পোষণ করিতে হইবে; আমি স্বর্গে যাইতে চাই না। স্বর্গ কি?—এই জগতেরই অনুবৃত্তিমাত্র। যদি স্বর্গ না থাকিত—এই অসার পার্থিব জীবনের কোন অনুবৃত্তি যদি না থাকিত, আমরা আরও ভাল হইতাম; যে ক্ষণিকের মিথ্যা স্বপ্নে আমরা মগ্ন, সে-স্বপ্ন আরও শীগ্র ভাঙিয়া যাইত। স্বর্গে যাইয়া আমরা শুধু আমাদের দুঃখজনক মোহকে দীর্ঘতর করিয়া তুলি।

স্বর্গে যাইয়া কি লাভ হইবে? দেবতা হইয়া অমৃত পান করিবেন, আর বাতব্যাধিগ্রস্ত হইয়া পড়িবেন। পৃথিবী অপেক্ষা সেখানে দুঃখ যেমন কম, সত্যও তেমনি কম। অতিশয় দরিদ্র অপেক্ষা ধনী ব্যক্তি অনেক কম সত্য বুঝিতে পারে। ‘ধনী ব্যক্তির স্বর্গরাজ্যে প্রবেশ করা অপেক্ষা সূচের ছিদ্র দিয়া উটের যাতায়াত করা বরং সহজ।’১৫ নিজের ধন-ঐশ্বর্য ক্ষমতা সুখ-সুবিধা ও বিলাস-ব্যসন ব্যতীত ধনী ব্যক্তির অন্য কিছু চিন্তা করিবার সময় নাই। ধনী ব্যক্তিরা অতি অল্পই ধার্মিক হয়। কেন? কারণ তাহারা মনে করে, ধার্মিক হইলে তাহাদের জীবনে আর কোন আমোদ-প্রমোদ থাকিবে না। ঠিক তেমনি স্বর্গে ধার্মিক হইবার আশা খুবই কম। আরাম ও ভোগ সেখানে অত্যন্ত বেশী—স্বর্গের অধিবাসীরা তাহাদের আমোদ-প্রমোদ ত্যাগ করিতে অনিচ্ছুক।

অনেকে বলেন, স্বর্গে আর অশ্রুপাত করিতে হইবে না। যে কখনও কাঁদে না, তাহাকে আমি বিশ্বাস করি না। দেহের যেখানে হৃদয় থাকা উচিত, তাহার সেইখানে একটি বৃহৎ কঠিন প্রস্তরখণ্ড রহিয়াছে। ইহা তো স্পষ্টই বোঝা যায় যে, স্বর্গবাসীদের বেশী সহানুভূতি নাই। স্বর্গবাসীর সংখ্যা তো অনেক, আর আমরা এই ভয়ানক পৃথিবীতে দুঃখযন্ত্রণা ভোগ করিতেছি। ইচ্ছা করিলে তাঁহারা আমাদের টানিয়া তুলিতে পারেন, কিন্তু তাঁহারা তো ঐরূপ কিছুই করেন না। তাঁহারা কাঁদেন না। স্বর্গে কোন দুঃখ-কষ্ট নাই, সুতরাং তাঁহারা কাহারও দুঃখ গ্রাহ্য করেন না। তাঁহারা অমৃত পান করেন, নৃত্য চলিতে থাকে—সুন্দরী পত্নী লইয়া নানাবিধ সুখে তাঁহাদের দিন কাটে।

এ-সকলের উর্ধ্বে উঠিয়া শিষ্যকে বলিতে হইবে, ‘ইহজীবনে আমার কোন কিছুই কাম্য নয়, স্বর্গ বলিয়া যদি কিছু থাকে, সেখানেও আমি যাইতে চাই না। শরীরের সহিত তাদাত্ম্যমূলক কোন প্রকার ইন্দ্রিয়-জীবন আমি চাই না। বর্তমানে আমার ধারণা—এই বিপুল মাংসস্তূপ দেহটাই আমি। আমি বিশ্বাস করিতে চাই না যে, আমি সত্যই ঐরূপ।’

পৃথিবী ও স্বর্গ ইন্দ্রিয়দ্বারা সীমাবদ্ধ। ইন্দ্রিয় না থাকিলে এই পৃথিবীকে তুমি গ্রাহ্যই করিতে না। স্বর্গও একটা জগৎ। পৃথিবীতে স্বর্গে অন্তরীক্ষে যাহা কিছু আছে, সব মিলিয়া একটি নাম—পৃথিবী বা সংসার।

সুতরাং শিষ্য অতীত ও বর্তমানকে জানিয়া, ভবিষ্যতের বিষয় চিন্তা করিয়া উন্নতি কাহাকে বলে, সুখ কাহাকে বলে—এগুলি সব জানিয়া বুঝিয়া ত্যাগ করিবে এবং একমাত্র সত্যের সন্ধান করিবে। ইহাই প্রথম শর্ত বা সাধন।

দ্বিতীয় সাধন এই যে, শিষ্যকে অবশ্যই অন্তরিন্দ্রিয় ও বহিরিন্দ্রিয়সমূহ সংযত রাখিতে সমর্থ হইতে হইবে এবং অন্যান্য অধ্যাত্ম সম্পদে প্রতিষ্ঠিত হইতে হইবে।

শরীরের বিভিন্ন অংশে অবস্থিত দৃশ্যমান যন্ত্রগুলি বহিরিন্দ্রিয়; অন্তরিন্দ্রিয়গুলি আমাদের ধরা-ছোঁয়ার বাহিরে। বাহিরে আমাদের চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা প্রভৃতি রহিয়াছে, ভিতরে অনুরূপ অন্তরিন্দ্রিয় রহিয়াছে। আমরা সর্বদা উভয়প্রকার ইন্দ্রিয়গুলির আজ্ঞাধীন হইয়া আছি। ইন্দ্রিয়সমূহের সহিত ইন্দ্রিয়ভোগ্য বিষয়গুলির যোগাযোগ রহিয়াছে। যদি ইন্দ্রিয়ভোগ্য বিষয়গুলি কাছে আসে, ইন্দ্রিয়সমূহ আমাদিগকে ঐগুলি গ্রহণ করিতে বাধ্য করে। আমাদের নিজস্ব পছন্দ বা স্বাধীনতা নাই। প্রকাণ্ড একটি নাসিকা রহিয়াছে। সামান্য একটু সুগন্ধ আসিতেছে, আমাকে ঐ ঘ্রাণ গ্রহণ করিতেই হইবে। যদি কোন দুর্গন্ধ আসিত, তবে আমি বলিতাম, ‘এই ঘ্রাণ গ্রহণ করিও না’; কিন্তু প্রকৃতি বলিবে ‘গ্রহণ কর’। আমি এই ঘ্রাণ গ্রহণ করি। একবার ভাবিয়া দেখুন, আমরা কি হইয়াছি। আমরা নিজেদের বাঁধিয়া ফেলিয়াছি। আমার চক্ষু আছ, ভাল-মন্দ যাহা কিছু চক্ষুর সুমুখ দিয়া যাক না কেন, আমাকে দেখিতেই হইবে। শ্রবণযন্ত্রের ব্যাপারটিও এইরূপ। যদি কেহ বিরক্তির সহিত আমার সঙ্গে কথা বলে, আমাকে শুনিতেই হইবে। আমার শ্রবণেন্দ্রিয় আমাকে উহা শুনিতে বাধ্য করে এবং শুনিয়া আমি মনে মনে কত কষ্টই না ভোগ করি। নিন্দা বা প্রশংসা যাহাই হউক, মানুষকে শুনিতেই হইবে। এমন বধির লোক আমি অনেক দেখিয়াছি, যাহারা সাধারণতঃ শুনিতে পায় না, কিন্তু তাহাদের সম্বন্ধে কিছু বলা হইলে তাহারা সব শুনিতে পায়।

এই আন্তর ও বাহ্য ইন্দ্রিয়নিচয় সাধক বা শিষ্যের বশে থাকিবে। যে অবস্থায় মন অনায়াসে ইন্দ্রিয়ের বিরুদ্ধে, স্বভাবের আদেশের বিরুদ্ধে, দাঁড়াতেই পারে, কঠোর অভ্যাসের দ্বারা সাধক শিষ্য সেই অবস্থায় উন্নীত হইতে পারে। সে নিজের মনকে আদেশ করিতে সমর্থ হইবে, ‘তুমি আমার। আমি তোমায় আদেশ করিতেছি, কোন কিছু দেখিও না বা বলিও না।’ তৎক্ষণাৎ মন আর কিছু দেখিবে না বা শুনিবে না। কোন রূপ বা শব্দ মনের উপর প্রতিক্রিয়া করিবে না। সে-অবস্থায় ইন্দ্রিয়গুলির আধিপত্য হইতে মন মুক্ত এবং ইন্দ্রিয়গুলি হইতে মন বিচ্ছিন্ন। শরীর ও ইন্দ্রিয়গুলির সহিত ইহা আর সংযুক্ত থাকে না। বাহিরের বস্তু-সকল আর এখন মনকে আদেশ করিতে পারে না। মন ঐগুলির সহিত যুক্ত হইতে অস্বীকার করে। সম্মুখে সুন্দর গন্ধ রহিয়াছে; শিষ্য মনকে বলিল, ‘ঐ ঘ্রাণ গ্রহণ করিও না।’ মন আর গন্ধ আঘ্রাণ করিতে পারে না। যখন এই স্তরে পৌঁছিয়াছ, তখন জানিবে তুমি ঠিক ঠিক শিষ্য হইতে শুরু করিয়াছ। এইজন্যই যখন কেহ বলে, ‘আমি সত্য জানিয়াছি,’ তখন আমি বলি, ‘যদি সত্য জানিয়া থাক, তবে নিশ্চয়ই তোমার আত্মসংযম হইয়াছে। ইন্দ্রিয়গুলি বশীভূত করিয়া সংযমশক্তির পরিচয় দাও।’

তারপর মনকে শান্ত করিতে হইবে। মন চঞ্চল হইয়া ছুটিয়া বেড়ায়। যে মুহূর্তে আমি ধ্যান করিতে বসি, তৎক্ষণাৎ জগতের ঘৃণ্যতম বিষয়গুলি মনে আসিয়া উপস্থিত হয়। সমগ্র ব্যাপারটি অত্যন্ত বিরক্তিকর। আমি যেন মনের দাস। মন যতক্ষণ চঞ্চল এবং আয়ত্তের বাহিরে, ততক্ষণ কোনরূপ আধ্যাত্মিক জ্ঞান সম্ভব নয়। শিষ্যকে মনঃসংযম শিক্ষা করিতে হইবে। অবশ্য মনের কার্যই চিন্তা করা। কিন্তু শিষ্যের অনভিপ্রেত হইলে মন নিশ্চয়ই চিন্তা করিবে না; যখনই সে আদেশ করিবে, তখনই মনকে চিন্তা বন্ধ করিতে হইবে। উপযুক্ত শিষ্য হইতে গেলে মনের এরূপ অবস্থা অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।

সহিষ্ণুতার প্রচণ্ড শক্তিও শিষ্যকে আয়ত্ত করিতে হইবে। যখন চারিপাশে সব কিছুই ভাল চলে, তখন জীবন বেশ আরামপ্রদ বোধ হয়, মনও ভাল থাকে। কিন্তু অপ্রীতিকর কিছু ঘটিলেই সঙ্গে সঙ্গে মনের স্থৈর্য নষ্ট হইয়া যায়। উহা ভাল নয়। সকল দুঃখকষ্ট বিনা অভিযোগে, এতটুকু দুঃখী না হইয়া, এতটুকু প্রতিরোধ প্রতিশোধ বা প্রতিকারের চেষ্টা না করিয়া সহ্য কর। ইহাই যথার্থ সহিষ্ণুতা। ইহাই তোমাকে অর্জন করিতে হইবে।

পৃথিবীতে ভাল ও মন্দ চিরকালই আছে। মন্দটির অস্তিত্ব অনেকে ভুলিয়া যায়—অন্ততঃ ভুলিবার চেষ্টা করে; যখন মন্দ আসে, তখন তাহারা উহা দ্বারা সহজে অভিভূত হইয়া পড়ে এবং বিরক্তি বোধ করে। আবার কেহ কেহ কোনরূপ মন্দের অস্তিত্বই স্বীকার করে না এবং সব কিছুকেই ভাল বলিয়া মনে করে। উহাও একটি দুর্বলতা, উহাও মন্দ জিনিষের প্রতি ভীতি হইতে সঞ্জাত। যদি কোন দুর্গন্ধ দ্রব্য থাকে, গোলাপ-জল ছিটাইয়া তাহাকে সুগন্ধ বলা কেন? হ্যাঁ, জগতে ভাল-মন্দ দুই-ই আছে। ভগবান্ মন্দ জিনিষ জগতে রাখিয়াছেন। কিন্তু তোমাকে তাহার উপর চুনকাম করিতে হইবে না। কেন মন্দ রহিয়াছে, সে-সম্বন্ধে তোমার মাথা-ঘামানো প্রয়োজন নাই। ভগবানে বিশ্বাস রাখো এবং চুপ করিয়া থাক।

আমার গুরুদেব শ্রীরামকৃষ্ণ অসুস্থ হইয়া পড়িলে জনৈক ব্রাহ্মণ রোগমুক্তির জন্য তাঁহাকে তাঁহার প্রবল মনঃশক্তি প্রয়োগ করিতে বলিয়াছিল। তাহার মতে—আচার্যদেব যদি দেহের রোগাক্রান্ত অংশটির উপর তাঁহার মন একাগ্র করেন,—তবে অসুখ সারিয়া যাইবে। শ্রীরামকৃষ্ণ বলিলেন, ‘কি! যে-মন ঈশ্বরকে দিয়াছি, সেই মন এই তুচ্ছ শরীরে নামাইয়া আনিব?’ দেহ এবং রোগের কথা তিনি ভাবিতে চাহিলেন না। তাঁহার মন সর্বদা ঈশ্বরে তন্ময় হইয়া থাকিত। সে-মন সম্পূর্ণরূপে ঈশ্বরে অর্পিত হইয়াছিল। তিনি এই মন অন্য কোন উদ্দেশ্যে ব্যবহার করিতে রাজী ছিলেন না।

স্বাস্থ্য, সম্পদ, দীর্ঘজীবন প্রভৃতি তথাকথিত ভাল ভাল জিনিষের জন্য এই আকাঙ্ক্ষা—মায়া বা ভ্রম ভিন্ন আর কিছুই নয়। এগুলি পাইবার জন্য মনোনিবেশ করিলে ভ্রম দৃঢ় করা হয়। ইহজীবনে আমাদের এ-সকল স্বপ্ন ও মায়া আছে, এবং পরলোকে—স্বর্গে যাইয়া আমরা এগুলি আরও বেশী পরিমাণে পাইতে চাই। মায়া বাড়িয়া যায়। মন্দের প্রতিরোধ করিও না; তাহার সম্মুখীন হও। তুমি মন্দ বা অশুভ অপেক্ষা অনেক বড়।

জগতে এই দুঃখ আছে, একজনকে তো তাহা ভোগ করিতে হইবেই। কাহারও অনিষ্ট না করিয়া তুমি কোন কাজ করিতে পার না। আর যখন তুমি পার্থিব শুভ কামনা কর, তখন শুধু আর একটি অশুভই এড়াইয়া যাও। সেই অশুভ অপর কাহাকেও ভোগ করিতে হইবে। মন্দটি সকলেই অন্যের ঘাড়ে চাপাইতে চায়। সাধক বলিবে, ‘জগতের সকল দুঃখ আমার নিকটে আসিতে দাও। আমি এগুলি সহ্য করিব। অপরকে মুক্ত হইতে দাও।’

ক্রুশবিদ্ধ মহামানবকে স্মরণ কর। জয়লাভ করিবার জন্য তিনি অসংখ্য দেবদূত আনিতে পারিতেন। কিন্তু তিনি প্রতিরোধ করিলেন না। যাহারা তাঁহাকে ক্রুশে বিদ্ধ করিল, তাহাদিগকে তিনি করুণা করিলেন। তিনি সকল দুঃখকষ্ট ও অপমান সহ্য করিলেন। সকলের ভার তিনি নিজের স্কন্ধে গ্রহণ করিলেন। ‘তোমরা যাহারা অতিশয় দুঃখ ভারাক্রান্ত, তাহারা আমার নিকটে আইস। আমি তোমাদের দুঃখ দূর করিব এবং শান্তি দিব।’১৬ ইহাই যথার্থ সহনশীলতা। তিনি এই জীবনে কত ঊর্ধ্বে ছিলেন—এত ঊর্ধ্বে যে, আমরা ক্রীতদাসগণ তাহা ধারণাও করিতে পারি না! আমার গালে কেহ চড় মারিলেই আমার হাত সশব্দে আর একটি চড় মারিয়া দেয়! আমি কিরূপে সেই মহিমময় পুরুষের মহত্ত্ব ও চিত্তের প্রশান্তি ধারণা করিতে পারি? তাঁহার মহিমা আমি কি বুঝিব?

কিন্তু আদর্শকে আমি নীচে নামাইয়া আনিব না। আমি অনুভব করি, আমি দেহ; আমি অন্যায়ের প্রতিরোধ করি। আমার মাথা ধরিলে তাহা সারাইবার জন্য সারা পৃথিবী ঘুরিয়া বেড়াই, দুই হাজার শিশি ঔষধ খাই। কেমন করিয়া আমি এ-সকল অপূর্ব চরিত্র বুঝিতে পারিব? আদর্শ আমি দেখিতে পারি—কিন্তু আদর্শের কতটুকু? এই দেহের কোন চেতনা, কোন তুচ্ছ অহং-ভাব, কোন আনন্দ-বেদনা, সুখ-দুঃখ সেই স্তরে পৌঁছিতে পারে না। সর্বদা শুধু চৈতন্যবিষয়ক চিন্তা করিয়া এবং মনকে জড়বস্তুর ঊর্ধ্বে রাখিয়া আমি সেই আদর্শের আভাসমাত্র পাইতে পারি। জড়বস্তুর চিন্তা এবং ইন্দ্রিয়-জগতের রীতিনীতির কোন স্থান সেই আদর্শে নাই। ঐগুলি হইতে মন তুলিয়া আত্মায় সমাহিত কর। তোমার জীবন ও মৃত্যু, সুখ ও দুঃখ, নাম ও যশ সব ভুলিয়া যাও এবং অনুভব কর—তুমি শরীর বা মন নও, তুমি শুদ্ধ আত্মা।

আমি যখন ‘আমি’ বলি, তখন এই চৈতন্য বা আত্মাকেই বুঝি। যখন তুমি নিজের ‘আমি’ সম্বন্ধে চিন্তা কর, তখন চক্ষু মুদ্রিত করিয়া দেখ—কোন্ ছবি ফুটিয়া উঠে। তোমার দেহচিত্র কি মনে জাগিতেছে? অথবা মনের প্রকৃতি? যদি তাই হয়, তবে তুমি এখনও সত্য ‘আমি’কে জানিতে পার নাই। এমন সময় আসিবে, যখন ‘আমি’ বলিতে বলিতে সমগ্র জগৎ—সেই অনন্ত সত্তা উদ্ভাসিত দেখিতে পাইবে। তখন তুমি নিজের সত্য স্বরূপকে দেখিতে পাইবে এবং নিজের অনন্ত সত্তাকে উপলব্ধি করিবে। তুমি চৈতন্যময়, তুমি জড়পদার্থ নও—ইহাই সত্য। ভ্রম বলিয়া একটি অনুভূতি আছে—এক বস্তুকে আর এক বস্তু বলিয়া ভ্রম হয়—জড়কে চৈতন্য এবং চৈতন্যকে জড় বলিয়া মনে হয়। ইহাই প্রচণ্ড ভ্রম। ইহা দূর করিতে হইবে।

গুরুর প্রতি শিষ্যকে শ্রদ্ধাবান্ হইতে হইবে—ইহাই পরবর্তী সাধনা। পাশ্চাত্য গুরু শিষ্যকে শুধু বুদ্ধিগ্রাহ্য শিক্ষা দিয়া থাকেন। গুরুর সহিত শিষ্যের সম্পর্ক জীবনের শ্রেষ্ঠ সম্পর্ক। গুরু আমার নিকটতম ও প্রিয়তম আত্মীয়, তারপর মাতা, তারপর পিতা। গুরুর প্রতিই আমার শ্রদ্ধা সর্বপ্রথমে নিবেদিত। যদি পিতা বলেন, ‘ইহা কর’ এবং গুরু বলেন, ‘ইহা করিও না’—আমি তাহা করি না। গুরু আমার আত্মার মুক্তিসাধন করেন। পিতামাতা আমায় শরীর দিয়াছেন, কিন্তু গুরু আমাকে আত্মার মধ্যে নবজন্ম দান করিয়াছেন।

আমাদের কতকগুলি অদ্ভুত বিশ্বাস আছে। একটি এই—অতি অল্প কয়েকটি অসাধারণ আত্মা আছেন, যাঁহারা নিত্যমুক্ত এবং যাঁহারা জগতের কল্যাণের নিমিত্ত মানবরূপে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁহারা মুক্তই আছেন; নিজেদের মুক্তির জন্য তাঁহারা গ্রাহ্য করেন না, অপরকে সাহায্য করিতে চান। তাঁহাদের কিছু শিখিবার প্রয়োজন নাই। শৈশব হইতে তাঁহারা সব জানেন। ছয়মাসের শিশু হইয়াও তাঁহারা পরমসত্যের বাণী বলিতে পারেন।

এই মুক্তাত্মাদের উপরেই মনুষ্যজাতির উন্নতি নির্ভর করে। তাঁহারা যেন প্রথম প্রজ্বলিত দীপের ন্যায়—এই দীপটি হইতে অপর দীপগুলি জ্বলিয়া উঠে। ইহা সত্য যে, সকলের অন্তরের আলোক রহিয়াছে, কিন্তু অধিকাংশ ব্যক্তির অন্তরেই ইহা প্রচ্ছন্ন। মহাপুরুষগণ প্রথম হইতেই এই আলোকে ভাস্বর। যাহারা তাঁহাদের সংস্পর্শে আসে, তাহাদের হৃদয়দীপও যেন প্রজ্বলিত হইয়া উঠে। ইহা দ্বারা প্রথম দীপটির কোন ক্ষতি হয় না, প্রথম দীপটি অপর দীপগুলিতে আলোক সঞ্চার করে। কোটি কোটি দীপ প্রজ্বলিত হয়, কিন্তু প্রথম দীপটি পূর্বের মতই অনির্বাণ তেজে জ্বলিতে থাকে। প্রথম দীপটি গুরু। যে দীপটি এই প্রথম দীপের শিখা হইতে প্রজ্বলিত হয়, সে শিষ্য। ক্রমে এই দ্বিতীয় ব্যক্তিও গুরু হন—এই ভাবে চলিতে থাকে। যাঁহাদের আপনারা অবতারপুরুষ বলিয়া থাকেন, সেই মহাপুরুষগণ বিপুল অধ্যাত্মশক্তির আধার। তাঁহারা সাক্ষাৎ শিষ্যদের মধ্যে ঐ শক্তি সঞ্চার করেন এবং শিষ্য-পরম্পরা এক বিরাট অধ্যাত্মশক্তির প্রবাহ প্রবর্তন করেন।

খ্রীষ্টান বিশপ হস্তদ্বারা কাহারও মস্তক স্পর্শ করিয়া নিজে পূর্বগ বিশপের নিকট যে শক্তি লাভ করিয়াছিলেন, সেই শক্তি সঞ্চার করিয়াছেন বলিয়া দাবী করেন। বিশপ বলেন, যীশু তাঁহার সাক্ষাৎ শিষ্যদের মধ্যে নিজের শক্তি সঞ্চার করিয়াছিলেন, শিষ্যগণ আবার অপরের মধ্যে সেই শক্তি সঞ্চার করেন। এইভাবেই পরম্পরাক্রমে খ্রীষ্টের শক্তি তাঁহার নিকট আসিয়াছে। আমরা বিশ্বাস করি, শুধু বিশপগণ নন, আমাদের প্রত্যেককেই সেই শক্তি লাভ করিতে হইবে। আপনারা প্রত্যেকেই সেই প্রচণ্ড অধ্যাত্মশক্তির আধার হইতে পারেন। কেন হইতে পারিবেন না? না হইবার কোন কারণ নাই।

কিন্তু প্রথমে আপনাকে একজন গুরু—যথার্থ গুরু খুঁজিয়া লইতে হইবে। মনে রাখিতে হইবে যে, তিনি সামান্য মানব মাত্র নন। আপনি একজন দেহধারী গুরু লাভ করিতে পারেন, কিন্তু প্রকৃত গুরু দেহের মধ্যে নাই। চোখে যেমন দেখিতেছেন, গুরু সেইরূপ দেহধারী মানুষ নন। গুরু আপনার নিকট মানবরূপে আসিতে পারেন এবং আপনি তাঁহার নিকট শক্তিলাভও করিতে পারেন। কখনও কখনও তিনি স্বপ্নে দেখা দিয়া শক্তি সঞ্চার করেন। গুরুর শক্তি আমাদের নিকট নানাভাবে আসিতে পারে। কিন্তু আমাদের জন্য—মর্ত্য মানবের জন্য গুরু অবশ্যই আসিবেন। তাঁহার আবির্ভাব-ক্ষণ অবধি আমাদের প্রস্তুতি চলিবে।

আমরা বক্তৃতা শুনি, পুস্তক পড়ি, ঈশ্বর আত্মা ধর্ম ও মুক্তি সম্বন্ধে তর্কবিতর্ক করি। এগুলি আধ্যাত্মিকতা নয়, কারণ আধ্যাত্মিকতা পুস্তকে দর্শনে বা মতবাদে নাই। ইহা বিদ্যা বা বিচারে নাই, অন্তরের প্রকৃত বিকাশে নিহিত। তোতাপাখিও বুলি মনে রাখিয়া আওড়াতেই পারে। যদি আপনি বিদ্বান্ হইয়া থাকেন, তাহাতে কি আসে যায়? গর্দভেরা সমগ্র গ্রন্থাগারটি পৃষ্ঠে বহন করিয়া লইয়া যাইতে পারে। সুতরাং যখন যথার্থ আলোক আসিবে, তখন পুঁথিগত বিদ্যার আর প্রয়োজন হইবে না। নিজের নামটি পর্যন্ত সই করতে অক্ষম ব্যক্তিও ধার্মিক হইতে পারেন, আবার পৃথিবীর যাবতীয় গ্রন্থাগারের জ্ঞানরাশি যাঁহার মস্তকে পুঞ্জীভূত আছে, তিনিও পারেন না। আধ্যাত্মিক উন্নতি পুঁথিগত বিদ্যার অপেক্ষা রাখে না। পাণ্ডিত্যের উপর আধ্যাত্মিকতা নির্ভর করে না। গুরুর স্পর্শ—শক্তি-সঞ্চার দ্বারা আপনার হৃদয় জাগ্রত হইবে। তারপরই আধ্যাত্মিক উন্নতির আরম্ভ। উহাই যথার্থ অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষা। আর থামিতে হইবে না, আপনি ক্রমেই অগ্রসর হইবেন।

কয়েক বৎসর পূর্বে আমার এক বন্ধু খ্রীষ্টান ধর্মযাজক আমাকে জিজ্ঞাসা করেন, ‘তুমি কি খ্রীষ্টে বিশ্বাসী?’ আমি উত্তর দিলাম, ‘হ্যাঁ, বোধ হয় একটু অধিক শ্রদ্ধার সহিত বিশ্বাসী?’ ‘তাহা হইলে খ্রীষ্টধর্মে দীক্ষিত হও না কেন?’ ‘কেমন করিয়া দীক্ষিত হইব? কাহার দ্বারা?’ যথার্থ দীক্ষাদাতা কোথায়? দীক্ষা কি? ইহা কি কতকগুলি বাঁধা-ধরা মন্ত্র আওড়াইয়া জল ছিটান, না জোর করিয়া ধরিয়া জলে ডুবান?

দীক্ষা হইতেছে সাক্ষাৎভাবে আধ্যাত্মিক জীবনে প্রবেশ। যথার্থ দীক্ষালাভ করিলে জানিবেন—আপনি দেহ নন, আপনি আত্মা। যদি পারেন, তবে সেই দীক্ষা আমায় দিন; যদি তাহা না পারেন, তবে তো আপনারাই খ্রীষ্টান নন। তথাকথিত দীক্ষালাভের পরেও আপনারা তো পূর্বের মতই রহিয়া গিয়াছেন। খ্রীষ্টের নামে আপনারা দীক্ষিত হইয়াছেন—এ-কথা বলার অর্থ কি? শুধু কথা আর কথা—আর জগৎকে নিজ নিজ মূর্খতার দ্বারা বিরক্ত করিয়া তোলা! ‘অজ্ঞান-অন্ধকারে আচ্ছন্ন থাকিয়াও নিজেদের জ্ঞানী ও বিদ্বান্ মনে করিয়া মূর্খেরা অন্ধচালিত অন্ধের ন্যায় যত্র তত্র ঘুরিয়া বেড়াইতেছে।’১৭ সুতরাং এ-কথা বলিবেন না যে, আপনারা খ্রীষ্টান; আর দীক্ষা (Baptism) প্রভৃতির মত তত্ত্ব লইয়া বাগাড়ম্বর করিবেন না।

অবশ্য যথার্থ দীক্ষা আছে, জগতে আসিয়া যীশু যখন প্রথম তাঁহার বাণী প্রচার করিয়াছিলেন, তখন দীক্ষা ছিল। যুগে যুগে যে-সকল মুক্তাত্মা মহাপুরুষ আবির্ভূত হন, আমাদের নিকট অতীন্দ্রিয় জ্ঞান প্রকাশ করিবার শক্তি তাঁহাদের আছে। ইহাই যথার্থ দীক্ষা। আপনারা দেখিতেছেন, প্রত্যেক ধর্মের বিধি ও অনুষ্ঠানাদি প্রচলিত হইবার পূর্বেই সর্বজনীন সত্যের বীজ বিদ্যমান রহিয়াছে। কালক্রমে এই সত্য লোকে ভুলিয়া যায়; বাহ্য অনুষ্ঠানাদি যেন ইহার শ্বাসরোধ করিয়া ফেলে। বাহিরের পদ্ধতিগুলি বজায় থাকে, কিন্তু ভিতরের ভাবটি চলিয়া যায়। শুধু বাহিরের আধারটি আমরা দেখিতে পাই। দীক্ষার বাহ্য রূপটি আছে।

কিন্তু অতি অল্প ব্যক্তিই ইহার অন্তর্নিহিত শক্তি উদ্ধুদ্ধ করিতে পারেন। বাহ্য আচারই যথেষ্ট নয়। আমরা যদি প্রত্যক্ষ সত্যের সাক্ষাৎ জ্ঞান লাভ করিতে চাই, তবে আমাদিগকে ঐ বিষয়ে যথার্থভাবে দীক্ষিত হইতে হইবে। ইহাই আদর্শ।

গুরু আমাকে অবশ্যই শিক্ষাদান করিয়া আলোকের পথে পরিচালিত করিবেন এবং যে গুরুশিষ্য-পরম্পরার তিনি নিজে একটি যোগসূত্র, আমাকেও তাহার যোগসূত্র করিয়া লইবেন। যে-কোন লোক নিজেকে গুরু বলিয়া দাবী করিতে পারে না। গুরু হইবেন তিনি, যিনি সেই পারমার্থিক সত্য জানিয়াছেন—প্রত্যক্ষ করিযাছেন, যিনি নিজেকে চৈতন্যস্বরূপ বলিয়া অনুভব করিয়াছেন। শুধু কথা বলিলেই কেহ গুরু হইতে পারে না। আমার মত বাক্যবাগীশ মূর্খ অনেক কথা বলিতে পারে, কিন্তু গুরু হইতে পারে না। যথার্থ গুরু শিষ্যকে বলিবেন, ‘যাও, আর পাপ করিও না’—সে আর পাপ করিতেই পারে না। তাহার আর পাপ করিবার শক্তিই থাকে না।

আমি এই জীবনে এরূপ ব্যক্তি প্রত্যক্ষ করিয়াছি। বাইবেল প্রভৃতি শাস্ত্র আমি পড়িয়াছি। এগুলি অপূর্ব। কিন্তু পুস্তকে সেই প্রাণবন্ত শক্তির সাক্ষাৎ পাইবেন না, যে-শক্তি মু্হূর্তে জীবন পরিবর্তন করিতে পারে, তাহা শুধু জীবন্মুক্ত মহাপুরুষগণের মধ্যেই দেখিতে পাওয়া যায়; জ্ঞানের উজ্জ্বল বিগ্রহ এই মহাপুরুষগণ মাঝে মাঝে আমাদের মধ্যে আবির্ভূত হন। তাঁহারাই গুরু হইবার উপযুক্ত। তুমি আমি কেবল বৃথা বচনবাগীশ, গুরু বা আচার্য নই; শুধু কথার কোলাহলে জগৎকে বিব্রত করিতেছি, চিন্তাজগতে অশুভ কম্পনের সৃষ্টি করিতেছি। আশা, প্রার্থনা ও সংগ্রামের মধ্য দিয়া আমরা অগ্রসর হই, একদিন আমরা সত্যে উপনীত হইব, তখন আর আমাদের কথা বলিতে হইবে না।

‘গুরুর বয়ঃক্রম ষোড়শবর্ষ; তিনি অশীতিপর বৃদ্ধকে শিক্ষা দিতেছেন। গুরুর শিক্ষাপদ্ধতি নীরবতা আর শিষ্যের সমস্ত সংশয় ছিন্ন হইতেছে।’১৮ ইহাই গুরুর বর্ণনা। ভাবিয়া দেখুন, এইরূপ এক ব্যক্তিকে পাইলে তাঁহার প্রতি আপনার কিরূপ বিশ্বাস ও ভালবাসা হইবে। কারণ তিনি স্বয়ং ভগবান্‌ অপেক্ষা কিছু কম নন! এ জন্যই খ্রীষ্টের শিষ্যগণ তাঁহাকে ঈশ্বর বলিয়া পূজা করিতেন। শিষ্য গুরুকে সাক্ষাৎ ঈশ্বর বলিয়া পূজা করিবে। যতক্ষণ না মানুষ ভগবানকে সাক্ষাৎভাবে উপলব্ধি করিতেছে, ততক্ষণ সে ভগবানের যতটুকু জানিতে পারে, তাহা এই মানবদেহধারী নরদেবতারূপেই জানিতে পারে। আর অন্য কী ভাবে সে ভগবানকে জানিতে পারে?

এখানে আমেরিকায় একজন ব্যক্তি—খ্রীষ্টজন্মের উনিশ-শত বৎসর পরে জন্মগ্রহণ করিয়াছে, খ্রীষ্ট যে জাতিতে জন্মিয়াছিলেন, সে সেই য়াহুদীজাতিসম্ভূতও নয়, সে যীশু অথবা তাঁহার পরিবারবর্গকে দেখে নাই। সে বলে, ‘যীশু ছিলেন ভগবান্‌। যদি বিশ্বাস না কর, তবে নরকে যাইবে।’ আমরা বুঝিতে পারি, যীশুর শিষ্যগণ কিভাবে বিশ্বাস করিতেন, খ্রীষ্ট ভগবান্‌। তিনি তাঁহাদের গুরু ছিলেন। সুতরাং তাঁহারা যীশুকে অবশ্যই ঈশ্বর বলিয়া বিশ্বাস করিতেন। উনিশ-শত বৎসর পূর্বে আবির্ভূত মানুষটিকে লইয়া এই আমেরিকান কি করিবে? এই যুবকটি আমায় বলিতেছে, যীশুকে আমি বিশ্বাস করি না, অতএব আমাকে নরকে যাইতে হইবে। যীশু সম্বন্ধে সে কি জানে? সে পাগলা-গারদে থাকিবার উপযুক্ত। এরূপ বিশ্বাস চলিবে না। তাহাকে তাহার গুরু খুঁজিয়া বাহির করিতে হইবে।

যীশু আবার জন্মগ্রহণ করিতে পারেন, আপনার নিকট আসিতে পারেন। তখন যদি আপনি তাঁহাকে ভগবান্‌ বলিয়া পূজা করেন, ভাল কথা। গুরুর আবির্ভাব অবধি আমরা অবশ্যই প্রতীক্ষা করিব এবং গুরুকে ঈশ্বরের ন্যায় পূজা করিতে হইবে। তিনি ঈশ্বর, ঈশ্বর অপেক্ষা কিছু কম নন। গুরুকে লক্ষ্য করিলে দেখিতে পাইবে, ক্রমে তিনি লীন হইয়া যাইতেছেন। পরে কি থাকে? গুরুমূর্তি ভগবানের জন্য আসন ছাড়িয়া দেন। আমাদের নিকট আসিবার জন্য ভগবান্‌ গুরুর জ্যোতির্ময় মূর্তি ধরিয়া থাকেন। স্থিরভাবে নিরীক্ষণ করিতে থাকিলে এই মূর্তির আবরণ ক্রমশঃ খসিয়া যায়, ভগবান্‌ প্রকাশিত হন।

‘আমি গুরুকে প্রণাম করি, যিনি ব্রহ্মানন্দের মূর্ত বিগ্রহ, পরমসুখদ ও পরমজ্ঞানের প্রতিমূর্তি, যিনি পবিত্র পূর্ণ অদ্বিতীয় অনন্ত সুখ-দুঃখের অতীত অচিন্ত্য ভাবাতীত ও ত্রিগুণরহিত’।১৯ ইনিই প্রকৃত গুরু। শিষ্য যে তাঁহাকে স্বয়ং ভগবান্‌ বলিয়া মনে করিবে, তাঁহাকে বিশ্বাস করিবে, শ্রদ্ধা করিবে, এবং সন্দেহাতীত ভাবে অনুসরণ করিবে, তাহাতে আশ্চর্যের কিছু নাই। গুরু-শিষ্যের মধ্যে ইহাই সম্বন্ধ।

মুক্তিলাভের জন্য শিষ্যকে প্রবল আকাঙ্ক্ষা করিতে হইবে—ইহাই পরবর্তী সাধন। ইন্দ্রিয়নিচয় আমাদিগকে কেবল দগ্ধ করে, বাসনা বৃদ্ধি করে—ইহা জানিয়াও পতঙ্গের ন্যায় আমরা অগ্নিশিখায় ঝাঁপাইয়া পড়িতেছি। ‘উপভোগের দ্বারা বাসনা কখনও তৃপ্ত হয় না। ঘৃতাহুতির দ্বারা অগ্নি যেমন বৃদ্ধি পায়, তেমনি ভোগের দ্বারা ভোগ বাড়িয়াই চলে।২০ বাসনা দ্বারা বাসনা বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়। ইহা জানিয়াও মানুষ সর্বদাই ইহাতে ঝাঁপাইয়া পড়ে। জন্ম জন্ম ধরিয়া তাহারা ভোগ্য বস্তুর পশ্চাতে ধাবিত হইতেছে এবং ফলে অপরিসীম দুঃখ ভোগ করিতেছে, তথাপি বাসনা ত্যাগ করিতে পারে না। যে-ধর্ম তাহাদিগকে এই ভীষণ বাসনার বন্ধন হইতে মুক্ত করিবে, তাহাকেও তাহারা বাসনা-পরিতৃপ্তির উপায় করিয়া তুলিয়াছে। শরীর ও ইন্দ্রিয়ের বন্ধন এবং বাসনার দাসত্ব হইতে মুক্তিলাভের জন্য তাহারা ক্বচিৎ কখনও ভগবানের নিকট প্রার্থনা করিয়া থাকে। তৎপরিবর্তে তাহারা স্বাস্থ্য ও দীর্ঘজীবনের জন্য প্রার্থনা করে, ‘হে ঈশ্বর! আমার মাথার বেদনা সারাইয়া দাও। আমায় কিছু টাকাকড়ি বা অন্য কিছু দাও।’

দৃষ্টির পরিধি এত সঙ্কীর্ণ, এত নীচু, এত পশুবৎ হইয়া দাঁড়াইয়াছে! কেহই এই দেহের ঊর্ধ্বে কিছু চাহিতেছে না। হায়, কি ভয়ঙ্কর অবনতি! কি ভায়ানক দুর্দশা! এই মাংসপিণ্ড, পাঁচটি ইন্দ্রিয় আর উদর! শিশ্ন ও উদরের সমাবেশ ছাড়া জগৎটা আর কি? কোটি কোটি নরনারীর পানে চাহিয়া দেখ—তাহারা এইজন্যই জীবনধারণ করিয়া আছে। তাহাদের নিকট হইতে এই বস্তু-দুইটি সরাইয়া লও, তাহারা মনে করিবে জীবন শূন্য অর্থহীন ও অসহনীয়। আমরা এইরূপ, আর আমাদের মনও এইরূপ। এই মন সর্বদা ক্ষুধা ও কাম চরিতার্থ করিবার পথ ও উপায় খুঁজিতেছে। সর্বদাই এইরূপ চলিতেছে। দুঃখকষ্টও তেমনি অনন্ত। দেহের এই সকল তৃষ্ণা শুধু ক্ষণিক তৃপ্তি এবং অশেষ দুঃখের কারণ হয়। এ যেন পয়োমুখ বিষকুম্ভের অবস্থা। কিন্তু তথাপি আমরা এগুলির জন্য লালায়িত হই।

কি করা যায়? ইন্দ্রিয়-দমন এবং বাসনা-ত্যাগই এই দুঃখমোচনের একমাত্র উপায়। আধ্যাত্মিক জীবন লাভের জন্য বাসনা ত্যাগ করিতে হইবে। ইহা প্রকৃত পরীক্ষা। এই নিরর্থক ইন্দ্রিয়সর্বস্ব সংসার বর্জন কর। যথার্থ বাসনা মাত্র একটি আছেঃ সত্যোপলব্ধির বাসনা—অধ্যাত্মজীবনলাভের বাসনা। জড়বাদ বা অহংসর্বস্বতা আর নয়। আমাকে আধ্যাত্মিক হইতে হইবে। দৃঢ় ও তীব্র ইচ্ছা চাই। কোন ব্যক্তির হাত-পা বাঁধিয়া তাহার শরীরে এক-টুকরা জ্বলন্ত কয়লা রাখিয়া দিলে সে উহা ফেলিয়া দিতে যথাশক্তি চেষ্টা করে। যদি এই জ্বলন্ত সংসারকে দূরে সরাইয়া ফেলিতে আমার সেইরূপ তীব্র ইচ্ছা ও অবিরাম চেষ্টা চলিতে থাকে, তবেই পরম সত্যের আভাস লাভ করিবার সময় উপস্থিত হইবে।

আমাকে লক্ষ্য করুন। দুই-তিনটি ডলার সহ আমার ছোট পকেট বইটি হারাইয়া গেলে ঘরের মধ্যে বিশবার খুঁজিয়া বেড়াই। কত উদ্বেগ, কত দুশ্চিন্তা, কত চেষ্টা! যদি আপনাদের কেহ আমাকে কোন বাধা দেন, তবে কুড়ি বৎসর উহা আমার মনে থাকে, সেই ঘটনাটি ক্ষমা করিতে বা ভুলিয়া যাইতে পারি না। ইন্দ্রিয়ের অতি ক্ষুদ্র বিষয়গুলির জন্য আমি ঐরূপ চেষ্টা করিতে পারি। ভগবানের জন্য কে এইরূপ চেষ্টা করে? ‘ক্রীড়ারত শিশু সব কিছুই ভুলিয়া থাকে। যুবকগণ ইন্দ্রিয়সম্ভোগের জন্য উন্মত্ত; তাহারা অন্য কিছুর চিন্তা করে না। প্রাচীনেরা তাহাদের অতীত দুষ্কর্মের চিন্তায় মগ্ন।’২১ বৃদ্ধেরা আয় উপভোগ করিতে পারে না, তাহারা অতীতে যাহা ভোগ করিয়াছিল, তাহার কথাই ভাবিতেছে। জাবর কাটিতেই বৃদ্ধেরা খুব দক্ষ। বিষয়ভোগের জন্য মানুষ যেভাবে তীব্র আকাঙ্ক্ষা করে, ভগবানের জন্য কেহই তেমন করে না।

সকলেই বলিয়া থাকে ঈশ্বর সত্য-স্বরূপ, একমাত্র নিত্য বস্তু, আত্মাই আছে, জড় নাই। তথাপি ভগবানের নিকট তাহারা যে-যে বিষয়ে প্রার্থনা করে, সেগুলি কদাচিৎ আত্মবিষয়ক। তাহারা সর্বদাই জড়বস্তু চায়। তাহাদের প্রার্থনায় জড়বস্তু হইতে আত্মাকে পৃথক্‌ করা হয় না। ধর্মের কতদূর অবনতি ঘটিয়াছে! সমগ্র ব্যাপারটিই মেকী হইয়া দাঁড়াইয়াছে। বৎসরের পর বৎসর চলিয়া গেলেও কোন আধ্যাত্মিক উপলব্ধি হইতেছে না। মানুষ শুধু একটি জিনিষের জন্যই আকাঙ্ক্ষা করিবে—আত্মার জন্য, কারণ একমাত্র আত্মাই আছে। ইহাই আদর্শ। যদি আপনি এখনই ইহা লাভ করিতে না পারেন, তবে বলুন, ‘আমি ইহা লাভ করিতে পারিতেছি না; আমি জানি ইহাই আদর্শ, কিন্তু এখনও অনুসরণ করিতে পারিতেছি না।’ কিন্তু আপনি তো তাহা করেন না। ধর্মকে আপনারা নিম্নস্তরে নামাইয়া আনিয়া আত্মার নামে জড়বস্তু খুঁজিয়া বেড়াইতেছেন। আপনারা সকলেই নাস্তিক, ইন্দ্রিয় ব্যতীত আর কিছুতেই বিশ্বাস করেন না। ‘অমুক ব্যক্তি এইরূপ বলিয়াছিল—ইহার মধ্যে কিছু থাকিতে পারে। এস, চেষ্টা করি আর মজা দেখি। হয়তো কোন উপকার হইবে; হয়তো আমার ভাঙা পা-খানি জোড়া লাগিয়া যাইবে।’

রুগ্নব্যক্তিরা বড় দুঃখী, তাহারা ঈশ্বরের পরম উপাসক, কারণ তাহাদের ধারণা—ঈশ্বরের নিকট প্রার্থনা করিলে তিনি তাহাদিগকে রোগমুক্ত করিয়া দিবেন। যদি এই প্রার্থনা আন্তরিক হয় এবং যদি তাহারা মনে রাখে যে, এই প্রার্থনা ধর্ম নয়, তবে এরূপ প্রার্থনা যে একেবারে মন্দ, তাহা নয়। গীতায় শ্রীকৃষ্ণ বলিয়াছেন, ‘চার প্রকার লোক আমাকে ভজনা করে—আর্ত, অর্থার্থী, জিজ্ঞাসু, ও জ্ঞানী।’২২ আর্ত মানুষ দুঃখমোচনের জন্য ভগবানের নিকট প্রার্থনা করে। অসুস্থ হইলে তাহারা আরোগ্য-কামনায় পূজা করে; সম্পদ হারাইলে পুনঃপ্রাপ্তির জন্য প্রার্থনা করে। আবার অনেকের মন কামনায় পূর্ণ বলিয়া ভগবানের নিকট নাম, যশ, সম্পদ, প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি প্রার্থনা করে। তাহাদের প্রার্থনা এইরূপঃ ‘হে মাতা মেরী! আমি যাহা চাই, তাহা পাইলে তোমার পূজা দিব। তুমি যদি আমার প্রার্থনা পূর্ণ কর, তবে আমি ঈশ্বরের পূজা করিব এবং তোমাকে সব কিছুর অংশ দিব।’ যাহারা অতটা জড়বাদী নয়, অথচ ঈশ্বরে বিশ্বাসীও নয়—এমন লোকেরা তাঁহাকে জানিতে চায়। তাহারা তত্ত্বান্বেষী। তাহারা দর্শন ও ধর্মশাস্ত্রাদি অধ্যয়ন করে, বক্তৃতাদি শ্রবণ করে, তাহারা জিজ্ঞাসু। যাহারা ভগবানের আরাধনা করে এবং তাঁহাকে জানিতে পারে—তাহারা সর্বশেষ শ্রেণীর সাধক। এই চারি স্তরের সাধকই ভাল—কেহই মন্দ নয়। তাহারা সকলেই ঈশ্বরের আরাধনা করে।

কিন্তু আমরা শিষ্য হইবার সাধনা করিতেছি। আমাদের সম্পূর্ণ উদ্দেশ্য হইবে পরমসত্যকে জানা, আমাদের লক্ষ্য উচ্চতম। ‘পরিপূর্ণ উপলব্ধি’ প্রভৃতি বড় বড় কথা আমরা বলিয়াছি। কথা অনুযায়ী কাজ করা চাই। আত্মভাবে প্রতিষ্ঠিত হইয়া আসুন আমরা আত্মার উপাসনা করি। আমাদের সাধনার ভিত্তি, সাধনার পথ ও চরম ফল সবই হউক চৈতন্যময়। কোথাও জড়-জগৎ থাকিবে না। জগৎ চলিয়া যাক্, মহাশূন্যে ঘুরিতে থাকুক—কে ইহা গ্রাহ্য করে? আত্মায় প্রতিষ্ঠিত হউন। উহাই লক্ষ্য। আমরা জানি, এখনও লক্ষ্যস্থলে পৌঁছিতে পারি নাই। কিছুই আসে যায় না; হতাশ হইবেন না। হতাশ হইয়া আদর্শকে নীচে নামাইয়া আনিবেন না। প্রয়োজনীয় কথা এইঃ নিজেকে আপনি কতটা কম এই প্রাণহীন জড়দেহ বলিয়া ভাবিতেছেন, আর কতটাই বা জ্যোতির্ময় অমর আত্মা বলিয়া চিন্তা করিতেছেন। যতই নিজেকে জ্যোতির্ময় অমর আত্মারূপে চিন্তা করিবেন, ততই দেহ ও ইন্দ্রিয়ের বন্ধন হইতে সম্পূর্ণভাবে মুক্ত হইবার জন্য ব্যাকুল হইবেন। ইহাই তীব্র মুমুক্ষুত্ব।

শিষ্য হইবার চতুর্থ এবং সর্বশেষ সাধন—নিত্যানিত্য-বিচার। ঈশ্বরই একমাত্র নিত্য বস্তু। সদাসর্বদা মন ঈশ্বরের প্রতি আকৃষ্ট থাকিবে, নিবেদিত থাকিবে। ঈশ্বরই আছেন, আর কিছুই নাই; আর সব কিছু আসে এবং চলিয়া যায়। এই সংসারের জন্য কোনরূপ বাসনাই ভ্রম, কারণ এ সংসার অনিত্য। যতক্ষণ পর্যন্ত না অন্য সব কিছু অনিত্য বলিয়া বোধ হয়, ততক্ষণ একমাত্র ঈশ্বরসম্বন্ধে ক্রমে ক্রমে—মনকে সচেতন করিয়া তুলিতে হইবে।

যিনি শিষ্য হইতে চান, তাঁহাকে এই সকল শর্ত পূর্ণ করিতে হইবে। নচেৎ তিনি প্রকৃত গুরুর সান্নিধ্যে আসিতে পারিবেন না। আর যদি সৌভাগ্যবশতঃ গুরুলাভও হয়, তথাপি গুরু যে আধ্যাত্মিক শক্তি তাঁহার মধ্যে সঞ্চার করিবেন, তাহা দ্বারা উদ্বুদ্ধ হইতে পারিবেন না। এ-সকল সাধনার মধ্যে কোন আপস চলিবে না। এই শর্তগুলি পূর্ণ করিলে এবং এইরূপ প্রস্তুতি থাকিলে শিষ্যের হৃদয়কমল বিকশিত হইয়া উঠিবে, তখনই মৌমাছি আসিবে। শিষ্য তখন জানিতে পারিবেন যে, গুরু তাঁহার দেহের মধ্যেই, তাঁহার অন্তরের অন্তস্তলেই বিরাজিত ছিলেন। তখনই তিনি বিকশিত হইয়া উঠেন, তখনই তিনি উপলব্ধি করেন। সংসার-সমুদ্র পার হইয়া তিনি জন্মমৃত্যুর অতীত হইয়া যান। এ ভয়ঙ্কর সাগর তিনি পার হইয়াছেন; কোন লাভ বা প্রশংসার কথা না চিন্তা করিয়া করুণাবশতঃ তিনি তখন অপরকেও সংসার-সাগরের পারে যাইতে সাহায্য করেন।২৩