১১. পত্রাবলী ২১৫-২২৪

২১৫

[স্বামী অখণ্ডানন্দকে লিখিত]

C/o E. T. Sturdy
রিডিং, ইংলণ্ড
১৮৯৫

কল্যাণবরেষু,
তোমার পত্রে সবিশেষ অবগত হইলাম। তোমার সঙ্কল্প বড়ই উত্তম। কিন্তু তোমাদের জাতির মধ্যে Organization (সঙ্ঘবদ্ধ হইয়া কার্য করিবার) শক্তির একেবারেই অভাব। ঐ এক অভাবই সকল অনর্থের কারণ। পাঁচজনে মিলে একটা কাজ করিতে একেবারেই নারাজ। Organization—এর (সঙ্ঘজীবনের) প্রথম আবশ্যক এই যে, obedience (আজ্ঞাবহতা), যখন ইচ্ছা হল একটু কিছু করিলাম, তারপর ঘোড়ার ডিম—তাতে কাজ হয় না—plodding industry and perseverance (স্থির ধীর ভাবে পরিশ্রম ও অধ্যবসায়) চাই। Regular correspondence (নিয়মিত পত্রব্যবহার) অর্থাৎ কি কাজ করছ—কি ফল হল, প্রতিমাসে বা মাসে দুইবার রীতিমত লিখিয়া পাঠাইবে। একজন উত্তম ইংরেজী ও সংস্কৃত-জানা সন্ন্যাসী এখানে (ইংলণ্ডে) আবশ্যক। আমি এখান হইতে শীঘ্রই পুনরায় আমেরিকা যাইব, আমার অবর্তমানে সে এখানে কার্য করিবে। শরৎ ও শশী এই দুইজন ছাড়া আমি তো আর কাকেও দেখছি না। শরৎকে টাকা পাঠিয়েছি ও পত্রপাঠ চলে আসতে লিখেছি। রাজাজীকে৮২ লিখেছি যে, তাঁর বোম্বের agent (ভারপ্রাপ্ত কর্মচারী) যেন শরৎকে দেখে শুনে জাহাজে চাপিয়ে দেয়। আমি লিখতে ভুলে গেছি, তুমি যদি মনে করে পার—শরতের সঙ্গে এক বস্তা মুগের ডাল, ছোলার ডাল, অড়র ডাল ও কিঞ্চিৎ মেথি পাঠিয়ে দিবে।৮৩ পণ্ডিত নারায়ণ দাস, শ্রীশঙ্করলাল, ওঝাজী, ডাক্তার ও সকলকে আমার প্রণয় বলিবে। গোপীর চোখের ওষুধ এখানে কি আছে? পেটেণ্ট ওষুধ সব জুয়াচুরি সর্বত্র। তাকে আমার আশীর্বাদ দেবে ও আর আর সব চেলাগুলোকে। যজ্ঞেশ্বরবাবু মীরাটে একটা কি সভা করেছেন ও আমাদের সঙ্গে যোগ দিয়ে কাজ করতে চান। ভাল, তাঁর একটা কি কাগজও আছে, কালীকে সেখানে পাঠিয়ে দাও, কালী যদি পারে মীরাটে একটা centre (কেন্দ্র) করুক এবং সেই কাগজটা যাতে হিন্দী ভাষাতে হয়, এমন চেষ্টা করুক—আমি কিছু কিছু টাকা পাঠিয়ে দেব। কালী মীরাট গিয়ে আমাকে যথাযথ রিপোর্ট করলে আমি টাকা পাঠিয়ে দেব। আজমীরে একটা centre (কেন্দ্র) করবার চেষ্টা কর। … সাহারানপুরে পণ্ডিত অগ্নিহোত্রী কি একটা সভা করেছেন। তাঁরা আমাকে এক চিঠি লেখেন। তাঁদের সঙ্গে correspondence (পত্রব্যবহার) রাখিবে। সকলের সঙ্গে মেলামেশা etc., work, work (কাজ কাজ)। এই রকম centre (কেন্দ্র) করতে থাক। কলিকাতায়—মান্দ্রাজে already (পূর্ব হইতেই) আছে, যদি মীরাটে ও আজমীরে পার তো বড়ই ভাল হয়। ঐপ্রকার ধীরে ধীরে জায়গায় জায়গায় centre (কেন্দ্র) করতে থাক। এখানে আমার সকল চিঠিপত্র C/o মিঃ ই. টি. স্টার্ডি, হাইভিউ, কেভার্শ্যাম, রিডিং, ইংলণ্ড। আমেরিকায় C/o মিস ফিলিপ‍্‍স্ 19 W. 38th St., নিউ ইয়র্ক। ক্রমে দুনিয়া ছাপিয়ে ফেলতে হবে। Obedience (আজ্ঞাবহতা) প্রথম দরকার। আগুনে ঝাঁপ দিতে তৈয়ার হতে হবে—তবে কাজ হয়। … ঐ-রকম রাজপুতানায় গ্রামে গ্রামে সভা কর etc. কিমধিকমিতি—

বিবেকানন্দ

২১৬*

[মিঃ স্টার্ডিকে লিখিত]

C/o E. T. Sturdy, রিডিং,
ইংলণ্ড
১৭ সেপ্টেম্বর, ১৮৯৫

প্রিয় মিসেস বুল,
মিঃ স্টার্ডি এবং আমি ইংলণ্ডে সমিতি গঠন করিবার জন্য অন্ততঃ দুই-চার জন সেরা দৃঢ়চেতা ও মেধাবী লোক চাই, অতএব আমাদিগকে ধীরে ধীরে অগ্রসর হইতে হইবে। আমাদিগকে প্রথম হইতে সতর্ক হইতে হইবে—যাহাতে কতকগুলি ‘খেয়ালী’ লোকের পাল্লায় না পড়ি। আপনি বোধ হয় জানেন, আমেরিকাতেও আমার উদ্দেশ্য এইরূপ ছিল। মিঃ স্টার্ডি কিছুদিন ভারতবর্ষে আমাদের সন্ন্যাসীদের সহিত তাহাদের রীতিনীতি মানিয়া বাস করিয়াছিলেন। তিনি একজন শিক্ষিত, সংস্কৃত ভাষায় অভিজ্ঞ এবং অতীব উদ্যমশীল লোক। এ পর্যন্ত উত্তম।

পবিত্রতা, অধ্যবসায় এবং উদ্যম—এই তিনটি গুণ আমি একসঙ্গে চাই। যদি এইরূপ ছয়জন লোক এখানে পাই, আমার কাজ চলিতে থাকিবে। এইরূপ দুই-চারজন লোক পাইবার সম্ভাবনা আছে। ইতি—

বিবেকানন্দ

২১৭*

[স্বামী ব্রহ্মানন্দকে লিখিত]

C/o E. T. Sturdy, রিডিং, ইংলণ্ড
সেপ্টেম্বর, ১৮৯৫

প্রিয় জো জো,
তোমাকে শীঘ্র চিঠি না দেওয়ার জন্য সহস্র ক্ষমা চাইছি। লণ্ডনে নির্বিঘ্নে পৌঁছেছি। বন্ধুর সন্ধান পেয়েছি, তাঁর বাড়ীতে বেশ আছি। চমৎকার পরিবার। স্ত্রীটি তাঁর বাস্তবিকই দেবীতুল্য, আর তিনি নিজে যথার্থ ভারতপ্রেমিক। সাধুদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে মেলামেশা করে তাঁদেরই মত খেয়ে-দেয়ে তিনি ভারতে দীর্ঘকাল কাটিয়েছেন। কাজেই তাঁর এখানে আমি খুব আনন্দে আছি। এর মধ্যেই ভারত থেকে ফেরা অবসরপ্রাপ্ত কয়েকজন উচ্চপদস্থ সৈনিককে দেখলাম; তাঁরা আমার সঙ্গে বেশ ভদ্র ব্যবহার করলেন। ‘শ্যামবর্ণ ব্যক্তিমাত্রই নিগ্রো’—আমেরিকানদের এই অদ্ভুত ধারণা এখানে মোটেই দেখা যায় না। রাস্তায় কেউ আমার দিকে হাঁ করে তাকিয়েও থাকে না। ভারতের বাহিরে আর কোথাও এরূপ সুস্থির বোধ করিনি। ইংরেজরা আমাদের বোঝে, আমরাও তাদের বুঝি। এদেশের শিক্ষা, সভ্যতা বেশ উচ্চ স্তরের; সেজন্য এবং বহুদিনের শিক্ষার ফলে এতটা পার্থক্য।

টার্টল-ডাভেরা ফিরেছেন কি? তাঁদের ও তাঁদের স্বজনের উপর ভগবানের কৃপা সদা বর্ষিত হোক। ‘বেবী’রা কেমন আছে? আর এলবার্টা ও হলিস্টার? তাদের আমার অজস্র ভালবাসা জানাবে এবং তুমি নিজে জানবে।

বন্ধুটি সংস্কৃত ভাষায় সুপণ্ডিত। সুতরাং শঙ্কর প্রভৃতি আচার্যদের ভাষ্যপাঠে আমরা সর্বদা নিযুক্ত আছি। এখানে এখন কেবল ধর্ম ও দর্শন চলেছে, জো জো! অক্টোবর মাসে লণ্ডনে ক্লাস নেবার চেষ্টায় আছি।

চির প্রীতি-স্নেহ-শুভেচ্ছা
সহ বিবেকানন্দ

২১৮*

রিডিং, ইংলণ্ড
২৪ সেপ্টেম্বর, ১৮৯৫

প্রিয় মিসেস বুল,
মিঃ স্টার্ডিকে সংস্কৃত শিখতে সাহায্য করা ছাড়া এ পর্যন্ত আমি উল্লেখযোগ্য কোন কাজই করিনি। ভারতবর্ষ থেকে আমার গুরুভ্রাতাদের মধ্যে একজন সন্ন্যাসীকে আনবার জন্য তিনি আমায় বলেছেন। আমি আমেরিকায় চলে গেলে সেই সন্ন্যাসী তাঁকে সাহায্য করতে পারেন, আমি ভারতবর্ষে লিখেছি একজনের জন্য। এ পর্যন্ত সব ভালভাবেই চলছে। এখন পরবর্তী ঢেউয়ের জন্য অপেক্ষা করছি। ‘এড়িয়ে যেও না, খুঁজেও বেড়িও না; ভগবান্ যা পাঠান, তার জন্য অপেক্ষা কর’—এই আমার মূলমন্ত্র। আমি চিঠি খুব কম লিখি বটে, কিন্তু আমার হৃদয় কৃতজ্ঞতায় পূর্ণ। ইতি—

বিবেকানন্দ

২১৯*

রিডিং, ইংলণ্ড
৪ অক্টোবর, ১৮৯৫

স্নেহের মার্গারেট,৮৪
… পবিত্রতা, ধৈর্য ও অধ্যবসায় দ্বারা সকল বিঘ্ন দূর হয়। সব বড় বড় ব্যাপার অবশ্য ধীরে ধীরে হয়ে থাকে। … আমার ভালবাসা জানবে। ইতি—

বিবেকানন্দ

২২০

[স্বামী ব্রহ্মানন্দকে লিখিত]

C/o E. T. Sturdy
রিডিং
৪ অক্টোবর, ১৮৯৫

অভিন্নহৃদয়েষু,
তুমি অবগত আছ যে, আমি এক্ষণে ইংলণ্ডে। প্রায় এক মাস যাবৎ এস্থানে থাকিয়া পুনঃ আমেরিকা যাত্রা করিব। আগামী গ্রীষ্মকালে পুনঃ ইংলণ্ডে আসিব। এক্ষণে ইংলণ্ডে বিশেষ কিছু হইবার আশা নাই, তবে প্রভু সর্বশক্তিমান্‌। ধীরে ধীরে দেখা যাউক।

ইতঃপূর্বে শরৎকে আসিবার টাকা পাঠাইয়াছি ও পত্র লিখিয়াছি। শরৎ বা শশী দুইজনের একজন যাহাতে আইসে তাহা করিবে। শশীর রোগ যদি সম্পূর্ণ আরোগ্য হইয়া থাকে, অর্থাৎ নিশ্চিহ্ন হইয়া থাকে, তাহা হইলে পাঠাইবে। চর্মরোগ শীতপ্রধান দেশে বড় প্রবল হইতে পারে না—উহা এই দারুণ শীতে একদম সারিয়া যাইতে পারে। নতুবা শরৎকে। … Sturdy (স্টার্ডি) সাহেবের টাকা, সে যে-প্রকার লোক চায়, সেই প্রকার আনাইতে হইবে। উক্ত মিঃ স্টার্ডি আমার নিকট দীক্ষা গ্রহণ করিয়াছে এবং বড়ই উদ্যমী ও সজ্জন। থিওসফির হাঙ্গামায় পড়িয়া বৃথা সময় নষ্ট করিয়াছে বলিয়া বড়ই আপসোস।

প্রথমতঃ এরূপ লোক চাই, যাহার ইংরেজী এবং সংস্কৃতে বিশেষ বোধ। ‘—’ শীঘ্র ইংরেজী শিখিতে পারিবেন এস্থানে আসিলে, সত্য বটে, কিন্তু এদেশে শিখিতে লোক এখনও আনিতে পারি না; যাহারা শিখাইতে পারিবে, তাহাদের প্রথম চাই। দ্বিতীয় কথা এই যে, যাহারা সম্পদে বিপদে আমায় ত্যাগ করিবে না, তাহাদের আমি বিশ্বাস করি। … অত্যন্ত বিশ্বাসী লোক চাই, তারপর গোড়াপত্তন হয়ে গেলে যার ইচ্ছা গোলমাল কর, ভয় নাই।

… দাদা, না হয় রামকৃষ্ণ পরমহংস একটা মিছে বস্তুই ছিল, না হয় তাঁর আশ্রিত হওয়া একটা বড় ভুল কর্মই হয়েছে, কিন্তু এখন উপায় কি? একটা জন্ম না হয় বাজেই গেল; মরদের বাত কি ফেরে? দশ স্বামী কি হয়? তোমরা যে যার দলে যাও, আমার কোন আপত্তি নাই, কিছুমাত্রও নাই, তবে এ দুনিয়া ঘুরে দেখছি যে, তাঁর ঘর ছাড়া আর সকল ঘরেই ‘ভাবের ঘরে চুরি’। তাঁর জনের উপর আমার একান্ত ভালবাসা, একান্ত বিশ্বাস। কি করিব? একঘেয়ে বল বলবে, কিন্তু ঐটি আমার আসল কথা। যে তাঁকে আত্মসমর্পণ করেছে, তার পায়ে কাঁটা বিঁধলে আমার হাড়ে লাগে, অন্য সকলকে আমি ভালবাসি। আমার মত অসাম্প্রদায়িক জগতে বিরল, কিন্তু ঐটুকু আমার গোঁড়ামি, মাফ করবে। তাঁর দোহাই ছাড়া কার দোহাই দেব? আসছে জন্মে না হয় বড় গুরু দেখা যাবে, এ জন্ম এ শরীর সেই মূর্খ বামুন কিনে নিয়েছে।

পেটের কথা খুলে বললুম দাদা, রাগ করো না। আমি তোমাদের গোলাম, যতক্ষণ তোমরা তাঁর গোলাম—এক চুল তার বাইরে গেলে তোমরা আর আমি এক সমান। … সমাজ-ফমাজ যত দেখছ দেশ-বিদেশে, সব যে তিনি গিলে রেখেছেন দাদা—‘ময়ৈবৈত নিহতাঃ পূর্বমেব নিমিত্তমাত্রং ভব সব্যসাচিন্।’ আজ বা কাল ও-সব তোমাদের অঙ্গে মিশিয়ে যাবে যে। হায় রে অল্প বিশ্বাস! তাঁর কৃপায় ‘ব্রহ্মাণ্ডং গোষ্পদায়তে।’ নিমকহারাম হয়ো না, ও পাপের প্রায়শ্চিত্ত নেই। নাম যশ সুকাজ—যজ্জুহোসি যত্তপস্যাসি যদশ্নাসি &c. (ইত্যাদি) সব তাঁর পায়ে সঁপে দাও। আমাদের আর কি চাই? তিনি শরণ দিয়েছেন, আবার কি চাই? ভক্তি নিজেই যে ফলস্বরূপা—আবার চাই কি? হে ভাই, যিনি খাইয়ে পরিয়ে বুদ্ধি বিদ্যে দিয়ে মানুষ করলেন, যিনি আত্মার চক্ষু খুলে দিলেন, যাঁকে দিনরাত দেখলে যে জীবন্ত ঈশ্বর, যাঁর পবিত্রতা আর প্রেম আর ঐশ্বর্য রাম, কৃষ্ণ, বুদ্ধ, যীশু, চৈতন্য প্রভৃতিতে এক কণা মাত্র প্রকাশ, তাঁর কাছে নিমকহারামি!!! তোর বুদ্ধ, কৃষ্ণ প্রভৃতি তিন ভাগ গল্প বৈ তো নয়, … অমন ঠাকুরের দয়া ভোল! … কেষ্ট, যীশু জন্মেছিলেন কিনা, তার কোনই প্রমাণ নাই; আর সাক্ষাৎ ঠাকুরকে দেখেও তোদের মাঝে মাঝে মতিভ্রম হয়! ধিক্ তোদের জীবনে!! আর আমি কি বলিব? দেশে দেশে নাস্তিক পাষণ্ডে তাঁর ছবি পূজা করছে, আর তোদের মতিভ্রম হয় সময়ে সময়ে!!! তোদের মত লাখ লাখ তিনি নিঃশ্বাসে তৈরী করে নেবেন। তোদের জন্ম ধন্য, কুল ধন্য, দেশ ধন্য যে, তাঁর পায়ের ধূলা পেয়েছিস। আমি কি করিব, আমাকে কাজেই গোঁড়া হতে হচ্ছে। আমি যে তাঁর জন ছাড়া আর কোথাও পবিত্রতা ও নিঃস্বার্থতা দেখতে পাই না। সকল জায়গাতেই যে ভাবের ঘরে চুরি, কেবল তাঁর ঘর ছাড়া। তিনি যে রক্ষে করছেন, দেখতে পাচ্ছি যে। ওরে পাগল, পরীর মত মেয়ে সব, লাখ লাখ টাকা—-এ সকল তুচ্ছ হয়ে যাচ্ছে, এ কি আমার জোরে? না, তিনি রক্ষা করছেন? তাঁর জন ছাড়া যে আমি কাউকেই একটা টাকা, একটা মেয়ে মানুষের কাছে বিশ্বাস করিনে। যার তাঁকে বিশ্বাস নাই আর মা-ঠাকুরাণীতে ভক্তি নাই, তার ঘোড়ার ডিমও হবে না, সাদা বাঙলা বললুম, মনে রেখো।

… হরমোহন দুরবস্থা জানিয়েছেন এবং শীঘ্রই স্থান-ছাড়া হতে হবে বলছেন। লেকচার চেয়েছেন—লেকচার-ফেকচার এখন কিছু নাই, তবে কিছু টাকা এখনও গাঁটে আছে—তাঁকে পাঠিয়ে দেব, ভয় নাই। পত্রপাঠ পাঠিয়ে দিতাম, কিন্তু সন্দেহ হচ্ছে যে, আমার টাকা মারা গেছে—সেজন্যই পাঠাই নাই। দ্বিতীয়তঃ কোন্ ঠিকানায় পাঠাব, তা তো জানি না। মান্দ্রাজীরা দেখছি, কাগজ বার করতে পারলে না। বিষয়বুদ্ধি হিন্দুজাতির যে একেবারেই নাই। যে সময়ে যে কাজ প্রতিশ্রুত হও, ঠিক সেই সময়ে তা করা চাই, নতুবা লোকের বিশ্বাস চলে যায়। টাকাকড়ির কথা পত্রপাঠ জবাব দিতে হয়। … মাষ্টার মশায় যদি রাজী হন, তাহলে তাঁকে কলকেতার এজেণ্ট হতে বলবে, কারণ তাঁর উপর আমার পূর্ণ বিশ্বাস এবং তিনি এই সকল বিষয় অনেক বুঝেন, ছেলেমানুষি হুড়দঙ্গুলের কাজ নয়। একটা Centre (কেন্দ্র)—ঠিকানা তাঁকে করতে বলবে, যে ঠিকানা—ঘড়ি-ঘড়ি বদলাবে না ও যে ঠিকানায় আমি কলকেতার সমস্ত চিঠিপত্র পাঠিয়ে দেব। …

কিমধিকমিতি
নরেন্দ্র

২২১*

রিডিং, ইংলণ্ড
অক্টোবর, ১৮৯৫

প্রিয় জো জো,
তোমার পত্র পেয়ে বড়ই সুখী হলাম। মনে হয়েছিল, বুঝি বা আমায় ভুলে গেলে। লণ্ডনে ও লণ্ডনের কাছেপিঠে কয়েকটি বক্তৃতা দেব; ২২ তারিখে সাড়ে আটটার সময় প্রিন্সেস হলে দেব সাধারণের জন্য একটি।

এখানে চলে এসে একটা ক্লাস গড়ে ফেল না। বলতে গেলে এখানে এখনও কিছুই করে উঠতে পারিনি। কাজ ঠিকমত চালু করতে বেশ সময় লাগে। আমেরিকায় নিউ ইয়র্কে সামান্য যা হয়েছে তাতেই আমার দুই বৎসর লেগে গেল। সকলকে ভালবাসা জানাচ্ছি।

তোমাদের
বিবেকানন্দ

২২২*

রিডিং
৬ অক্টোবর, ১৮৯৫

প্রিয় মিসেস বুল,,
… আমি মিঃ স্টার্ডির সহিত ‘ভক্তি’ সম্বন্ধে একখানি পুস্তকের অনুবাদ করিতেছি, প্রচুর টীকা সমেত উহা শীঘ্রই প্রকাশিত হইবে। এই মাসে আমাকে লণ্ডনে দুইটি এবং মেডেন-হেডে একটি বক্তৃতা দিতে হইবে। ইহাতে কতকগুলি ক্লাস খুলিবার ও পারিবারিক বক্তৃতার বন্দোবস্ত হইবার সুবিধা হইবে। কতকগুলি হইচই না করিয়া চুপচাপ কাজ করিতে চাই। … আমার শুভেচ্ছাদি জানিবেন।

আপনার
বিবেকানন্দ

২২৩*

[মিসেস লেগেটকে লিখিত]

C/o E. T. Sturdy, Esq.
হাই ভিউ, কেভার্শ্যাম, রিডিং ইংলণ্ড
অক্টোবর, ১৮৯৫

মা,
ছেলেকে ভোলেননি তো? আপনি এখন কোথায়? মাসীমা ও শিশুরা? আপনার মন্দিরের ঋষিতুল্য পূজারীর খবর কি? ‘জো জো’ এত শীঘ্র ‘নির্বাণ’ লাভ করছে না, কিন্তু তার গভীর নীরবতা দেখে মনে হয় গভীর ‘সমাধি’।

আপনি কি ঘুরে বেড়াচ্ছেন? আমি ইংলণ্ডকে খুব উপভোগ করছি। আমার বন্ধুর সঙ্গে দর্শনশাস্ত্র আলোচনা করে কাটাচ্ছি—খাবার ও ধূমপান করার জন্য অল্প একটু সময় রেখে। দ্বৈতবাদ অদ্বৈতবাদ এবং তৎসংক্রান্ত যাবতীয় বিষয় ছাড়া আমাদের আর কিছু আলোচ্য নেই।

মনে হয় লম্বা ট্রাউজার পরে হলিস্টার অত্যন্ত মর্যাদাসম্পন্ন হয়েছে; এবং এলবার্টা জার্মান শিখছে।

এখানে ইংরেজরা খুবই বন্ধুভাবাপন্ন। কতিপয় এ্যাংলো-ইণ্ডিয়ান ব্যতিরেকে কেউ কালা আদমীদের ঘৃণা করে না। এমন কি রাস্তায় আমাকে লক্ষ্য করে কেউ কোন ব্যঙ্গরব করে না। মাঝে মাঝে আমি অবাক হয়ে ভাবি, তাহলে কি আমার মুখের রঙ সাদা হয়ে গিয়েছে, কিন্তু আরশিতে সত্য ধরা পড়ে; তবু এখানে সবাই খুব বন্ধুভাবাপন্ন।

আবার যে-সকল ইংরেজ পুরুষ এবং নারী ভারতবর্ষকে ভালবাসে, তারা হিন্দুদের চেয়েও বেশী ‘হিন্দু’। আপনি শুনে বিস্মিত হবেন যে, এখানে আমি নিখুঁত ভারতীয় পদ্ধতিতে প্রস্তুত প্রচুর তরিতরকারী পাচ্ছি। যখন একজন ইংরেজ একটি জিনিষ ধরে, সে তখন তার গভীরতম দেশে প্রবেশ করে। গতকাল জনৈক অধ্যাপক মিঃ ফ্রেজারের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয়েছে—তিনি এখানে একজন ঊর্ধ্বতন কর্মচারী। তিনি তাঁর অর্ধেক জীবন ভারতে কাটিয়েছেন; প্রাচীন চিন্তা ও জ্ঞানের মধ্যে তিনি এতখানি পুষ্ট হয়েছেন যে, ভারতের বাইরের কোন কিছুর জন্য তিনি মোটেই পরোয়া করেন না। শুনে আশ্চর্য হবেন যে, অনেক চিন্তাশীল ইংরেজ নরনারী মনে করে যে, হিন্দুদের জাতিবিভাগই সামাজিক সমস্যার একমাত্র সমাধান। আপনি হয়তো কল্পনা করতে পারবেন, সেই ধারণা মাথায় নিয়ে তারা সমাজতন্ত্রী ও অন্যান্য সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্রীদের কতখানি ঘৃণা করে!! আবার এখানে পুরুষেরা—অতি উচ্চশিক্ষিতেরা—ভারতীয় চিন্তাধারা সম্পর্কে গভীর আগ্রহশীল, সে তুলনায় মেয়েদের সংখ্যা খুব কম। আমেরিকার চেয়ে এখানে মেয়েদের জীবনের পরিধিও সংকীর্ণতর। এ পর্যন্ত আমার সব কিছুই ভালয় ভালয় হয়ে যাচ্ছে। পরবর্তী ঘটনাবলী জানাব। গৃহস্বামী, রাণীমাতা, জো জো এবং শিশুদের ভালবাসা।

আপনাদের চিরদিনের
বিবেকানন্দ

২২৪*

রিডিং, ইংলণ্ড
২০ অক্টোবর, ১৮৯৫

প্রিয় জো জো,
এই পত্রে লেগেটদিগকে লণ্ডনে স্বাগত জানাচ্ছি। এক হিসাবে এদেশ আমার মাতৃভূমি, সুতরাং পূর্বেই তোমাদিগকে অভ্যর্থনা জানাচ্ছি। পরে আগামী মঙ্গলবার ২২ তারিখে সন্ধ্যা সাড়ে আটটায় প্রিন্সেস হলে আমি তোমাদের অভ্যর্থনা গ্রহণ করব।

মঙ্গলবার পর্যন্ত আমি এত ব্যস্ত থাকব যে, এর মধ্যে কোনক্রমেই তোমার সঙ্গে দেখা করে উঠতে পারব না। তারপর যে-কোন দিন দেখা করব। চাই কি মঙ্গলবার দিনও গিয়ে পড়তে পারি।

চিরদিনের ভালবাসা ও আশীর্বাদ জানবে।

তোমাদের
বিবেকানন্দ