১০. ভক্তির সাধন

ভক্তিলাভের উপায় ও সাধনসম্বন্ধে ভগবান্ রামানুজ তাঁহার বেদান্তভাষ্যে লিখিয়াছেনঃ

‘বিবেক, বিমোক, অভ্যাস, ক্রিয়া, কল্যাণ, অনবসাদ্ ও অনুদ্ধর্ষ হইতে ভক্তিলাভ হয়।’ ‘বিবেক’ অর্থে রামানুজের মতে খাদ্যাখাদ্যবিচার। তাঁহার মতে খাদ্যদ্রব্যের অশুদ্ধির কারণ তিনটিঃ (১) জাতিদোষ অর্থাৎ খাদ্যের প্রকৃতিগত দোষ, যথা—রশুন, পেঁয়াজ প্রভৃতি স্বভাবতঃ অশুচি খাদ্যের যে দোষ; (২) আশ্রয়দোষ অর্থাৎ পতিত ও অভিশপ্ত ব্যক্তির হস্তে খাইলে যে দোষ; (৩) নিমিত্তদোষ অর্থাৎ কোন অশুচি বস্তুর, যথা-কেশ, ধূলি আদি সংস্পর্শজনিত দোষ। শ্রুতি বলেন, ‘আহার শুদ্ধ করিলে চিত্ত শুদ্ধ হয়, চিত্ত শুদ্ধ হইলে ভগবান্‌কে সর্ব্বদা স্মরণ করিতে পারা যায়।’৪০  রামানুজ ছান্দোগ্য উপনিষদ্ হইতে এই বাক্য উদ্ধৃত করিয়াছেন।

এই খাদ্যখাদ্যবিচার ভক্তিমার্গাবলম্বিগণের মতে চিরকালেই একটি গুরুতর বিষয় বলিয়া পরিগণিত হইয়াছে। অনেক ভক্তসম্প্রদায় এ-বিষয়টিকে অত্যন্ত অস্বাভাবিক করিয়া তুলিয়াছেন বটে, কিন্তু ইহার মধ্যে যে একটি গুরুতর সত্য নিহিত আছে, তাহা অস্বীকার করা যায় না। আমাদের মনে রাখা উচিত, সাংখ্যদর্শনের মতে সত্ত্ব, রজঃ তমঃ—এই তিন গুণের সাম্যাবস্থা প্রকৃতি, এবং বৈষম্যাবস্থা প্রাপ্ত হইলে উহারাই জগদ্রূপে পরিণত হয়; এগুলি প্রকৃতির গুণ ও উপাদান দুই-ই; সুতরাং ঐ সকল উপাদানেই প্রত্যেকটি মানুষের দেহ নির্মিত। উহাদের মধ্যে সত্ত্বগুণের প্রাধান্যই আধ্যাত্মিক উন্নতির পক্ষে অত্যাবশ্যক। আমরা আহারের দ্বারা শরীরের ভিতর যে উপাদান গ্রহণ করি, তাহাতে আমাদের মানসিক গঠনের অনেক সাহায্য হয়, সুতরাং আমাদিগকে খাদ্যাখাদ্যবিষয়ে বিশেষ দৃষ্টি রাখিতে হইবে। কিন্তু অন্যান্য বিষয়ের ন্যায় এ বিষয়েও শিষ্যেরা চিরকাল যে গোঁড়ামি করিয়া থাকে, তাহা যেন আচার্যগণের উপর আরোপিত না হয়।

বাস্তবিক খাদ্যের শুদ্ধি-অশুদ্ধি বিচার গৌণমাত্র। পূর্বোদ্ধৃত ঐ বাক্যটিই শঙ্কর তাঁহার উপনিষদ্ভাষ্যে অন্যরূপে ব্যাখ্যা করিয়াছেন। ঐ বাক্যস্থ ‘আহার’ শব্দটি যাহা সচরাচর খাদ্য অর্থে গৃহীত হইয়া থাকে, তাহা তিনি অন্য অর্থে ব্যাখ্যা করিয়াছেন। তাঁহার মতে ‘যাহা আহৃত হয়, তাহাই আহার। শব্দাদি বিষয়ের জ্ঞান ভোক্তার অর্থাৎ আত্মার উপভোগের জন্য ভিতরে আহৃত হয়। এই বিষয়ানুভূতিরূপ জ্ঞানের শুদ্ধিকেই ‘আহারশুদ্ধি’ বলে। সুতরাং আহারশুদ্ধি অর্থে আসক্তি-দ্বেষ- বা মোহ-শূন্য হইয়া বিষয়ের জ্ঞান আহরণ। সুতরাং এইরূপ জ্ঞান বা ‘আহার’ শুদ্ধ হইলে এইরূপ ব্যক্তির সত্ত্ব অর্থাৎ অন্তরিন্দ্রিয় শুদ্ধ হইয়া যাইবে। সত্ত্বশুদ্ধি হইলে অনন্ত পুরুষের যথার্থ স্বরূপজ্ঞান ও অবিচ্ছিন্ন স্মৃতি আসিবে।’৪১ 

শঙ্কর ও রামানুজের ব্যাখ্যা দুইটি আপাতবিরোধী বলিয়া বোধ হইলেও উভয়টিই সত্য ও প্রয়োজনীয়। সূক্ষ্ম শরীর বা মনের সংযম স্থূল শরীরের সংযম হইতে উচ্চতর কাজ বটে, কিন্তু সূক্ষ্মের সংযম করিতে হইলে অগ্রে স্থূলের সংযম বিশেষ আবশ্যক। অতএব আহার সম্বন্ধে গুরুপরম্পরা যে-সকল নিয়ম প্রচলিত আছে, প্রবর্তকের পক্ষে সেগুলি পালন করা আবশ্যক। কিন্তু আজকাল ভারতীয় অনেক সম্প্রদায়ে এই আহারাদি বিচারের এত বাড়াবাড়ি, এত অর্থহীন নিয়মের বাঁধাবাঁধি, এত গোঁড়ামি দেখা যায় যে, মনে হয় ধর্ম যেন রান্নাঘরে আশ্রয় লইয়াছে। কখন যে ধর্মের মহান্ সত্যসমূহ সেখান হইতে বাহির আসিয়া আধ্যাত্মিকতার সূর্যালোকে উদ্ভাসিত হইবে, তাহার কোন সম্ভবনা নাই। এরূপ ধর্ম একপ্রকার জড়বাদমাত্র। উহা জ্ঞান নয়, ভক্তি নয়, কর্মও নয়। উহা এক বিশেষ প্রকার পাগলামি মাত্র। যাহারা এই খাদ্যাখাদ্যের বিচারকেই জীবনের সার বলিয়া স্থির করিয়াছে, তাহাদের গতি ব্রহ্মলোকে না হইয়া সম্ভবতঃ বাতুলালয়ের দিকেই হইবে। সুতরাং ইহা যুক্তিসিদ্ধ বোধ হইতেছে যে, খাদ্যাখাদ্যের বিচার মনের স্থিরতারূপ উচ্চাবস্থালাভের জন্য কিছুটা আবশ্যক, অন্যথা এই স্থিরতা সহজে লাভ করা যায় না।

তারপর ‘বিমোক’। বিমোক অর্থে ইন্দ্রিয়গুলির বিষয়াভিমুখী গতি নিবারণ ও উহাদিগকে সংযত করিয়া নিজ ইচ্ছার অধীনে আনয়ন এবং ইহা সকল ধর্মসাধনেরই কেন্দ্রীয় ভাব।

তারপর ‘অভ্যাস’ অর্থাৎ আত্মসংযম ও আত্মত্যাগের অভ্যাস। কিন্তু সাধকের প্রাণপণ চেষ্টা ও প্রবল সংযমের অভ্যাস ব্যতীত ঈশ্বর ও আত্মবিষয়ক অনুভূতি কখনই সম্ভব নয়। মন যেন সর্বদাই সেই ঈশ্বরের চিন্তায় নিবিষ্ট থাকে। প্রথম প্রথম ইহা অতি কঠিন বোধ হয়, কিন্তু অধ্যবসায়-সহকারে চেষ্টা করিতে করিতে এরূপ চিন্তা করার শক্তি ক্রমশঃ বর্ধিত হয়। শ্রীকৃষ্ণ গীতায় বলিয়াছেন, ‘হে কৌন্তেয়, অভ্যাস ও বৈরাগ্যের দ্বারা মন নিগৃহীত হইয়া থাকে।’৪২

তারপর ‘ক্রিয়া’ অর্থাৎ যজ্ঞ। পঞ্চ মহাযজ্ঞের নিয়মিতরূপ অনুষ্ঠান করিতে হইবে।

‘কল্যাণ’ অর্থে পবিত্রতা, আর এই পবিত্রতারূপ একমাত্র ভিত্তির উপর ভক্তিপ্রাসাদ প্রতিষ্ঠিত। বাহ্যশৌচ অথবা খাদ্যাখাদ্য-সম্বন্ধে বিচার—এ উভয়ই সহজ, কিন্তু অন্তঃশুদ্ধি ব্যতিরেকে উহাদের কোন মূল্য নাই। রামানুজ অন্তঃশুদ্ধিলাভের উপায়স্বরূপ নিম্নলিখিত গুণ গুলির কথা বর্ণনা করিয়াছেনঃ সত্য, আর্জব—সরলতা, দয়া—নিঃস্বার্থ পরোপকার, দান, অহিংসা—কায়মনোবাক্যে অপরের হিংসা না করা, অনভিধ্যা—পরদ্রব্যে লোভ, বৃথা চিন্তা ও পরকৃত অনিষ্টাচারণের ক্রমাগত চিন্তা-পরিত্যাগ। এই তালিকার মধ্যে অহিংসা গুণটির সম্বন্ধে বিশেষভাবে কিছু বলা আবশ্যক। ভক্তকে সকল প্রাণিসম্বন্ধে এই অহিংসাভাব অবলম্বন করিতেই হইবে। কেহ কেহ মনে করেন, মনুষ্যজাতির প্রতি অহিংসাভাব পোষণ করিলেই যথেষ্ট, অন্যান্য প্রাণিগণের প্রতি নির্দয় হইলে কোন ক্ষতি নাই; অহিংসা বাস্তবিক তাহা নয়। আবার কেহ কেহ যেমন কুকুর-বিড়ালকে লালন পালন করেন বা পিপীলিকাকে চিনি খাওয়ান, কিন্তু মানুষ-ভ্রাতার গলা কাটিতে দ্বিধা বোধ করেন না, অহিংসা বলিতে তাহাও বুঝায় না। বিশেষ লক্ষ্য করিবার বিষয় এই যে, পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি মহৎ ভাবই শেষ পর্যন্ত

===========

বিরক্তিকর হইয়া যাইতে পারে, ভাল রীতিনীতিও যদি অন্ধভাবে অনুষ্ঠান করা হয়, তবে শেষ পর্যন্ত সেগুলিও অকল্যাণের কারণ হইয়া দাঁড়ায় এবং দুঃখের বিষয়, অহিংসানীতিও এ নিয়মের ব্যতিক্রম নয়। কতকগুলি ধর্মসম্প্রদায়ের অপরিষ্কার সাধকেরা স্নান করে না, পাছে তাহাদের গায়ের পোকা মরিয়া যায়, কিন্তু সেজন্য তাহাদের

মিসিং
===========

অনুষ্ঠানগুলিকে মরণ-কামড়ে ধরিয়া থাকে, কোনমতে ছাড়িতে চায় না। যদি ঐ অনুষ্ঠানগুলি আধ্যাত্মিক জীবনের পরিচায়ক হয়, তবেই উহাদের উপযোগিতা আছে বলিতে হইবে। প্রাণশূন্য হইলে উহাদিগকে নির্দয়ভাবে উৎপাটন করিয়া ফেলা উচিত।

‘অনবসাদ’ বা বল ভক্তিলাভের পরবর্তী সাধন। শ্রুতি বলেন, ‘বলহীন ব্যক্তি তাঁহাকে লাভ করিতে পারে না।’৪৩ এখানে শারীরিক বা মানসিক উভয় প্রকার দৌর্বল্য লক্ষিত হইয়াছে। ‘বলিষ্ঠ, দ্রঢ়িষ্ঠ’৪৪ ব্যক্তিই প্রকৃত শিষ্য হওয়ার উপযুক্ত। দুর্বল, শীর্ণকায়, জরাজীর্ণ ব্যক্তি কী সাধন করিবে? শরীর ও মনের মধ্যে যে অদ্ভূত শক্তিসমূহ লুক্কায়িত আছে কোনরূপ যোগাভ্যাসের দ্বারা তাহারা কিঞ্চিৎ পরিমাণে জাগ্রত হইলেও দুর্বল ব্যক্তি একেবারে খণ্ড খণ্ড হইয়া যাইবে। যুবা, সুস্থকায়, সবল ব্যক্তিই সিদ্ধ হইতে পারেন। সুতরাং সিদ্ধি লাভের জন্য মানসিক বল যে পরিমাণে প্রয়োজন, শারীরিক বলও সেই পরিমাণে চাই। ইন্দ্রিয়সংযমের প্রতিক্রিয়া খুব সবল দেহই সহ্য করিতে পারে। অতএব ভক্ত হইতে যাঁহার সাধ, তাঁহাকে সবল ও সুস্থকায় হইতে হইবে। যাহারা দুর্বল তাহারা যদি কোনরূপ যোগাভ্যাসের চেষ্টা করে, তবে হয় তাহারা কোন দুশ্চিকিৎস্য ব্যাধিগ্রস্ত হইবে, নতুবা মনকে ভয়ানক দুর্বল করিয়া ফেলিবে। ইচ্ছাপূর্বক শরীরকে দুর্বল করা ভক্তি-বা জ্ঞান লাভের অনুকূল ব্যবস্থা নয়।

যাহার চিত্ত দুর্বল, সেও আত্মলাভে কৃতকার্য হয় না। যে ভক্ত হইতে ইচ্ছুক, সে সর্বদা প্রফুল্ল থাকিবে। পাশ্চাত্যে অনেকের কাছে ধার্মিক এর লক্ষণ—সে কখনও হাসিবে না, তাহার মুখ সর্বদা বিষাদমেঘে আবৃত থাকিবে, তাহার চোয়াল বসা ও মুখ লম্বা হওয়া আবশ্যক। শুষ্কশরীর ও লম্বামুখ লোক ডাক্তারের তত্ত্বাবধানের যোগ্য বটে, কিন্তু তাহারা কখনও যোগী হইতে পারে না। প্রফুল্লচিত্ত ব্যক্তিই অধ্যবসায়শীল হইতে পারে। দৃঢ়চেতা ব্যাক্তিই সহস্র বাধা-বিঘ্ন অতিক্রম করিয়া যাইতে পারে। মায়াজাল ছিন্ন করিয়া বাহিরে যাওয়া—যোগ সাধন করা মহা কঠিন কার্য, দৃঢ় ইচ্ছাশক্তিসম্পন্ন বীরগণের দ্বারাই ইহা সম্ভব।


৪০ আহারশুদ্ধৌ সত্ত্বশুদ্ধিঃ সত্ত্বশুদ্ধোঃধ্রুবা স্মৃতিঃ।—ছান্দোগ্য উপনিষদ্, ৭।২৬২
৪১ আহ্নিয়তে ইত্যাহারঃ শব্দাদিবিষয়জ্ঞানম্ ভোক্তুর্ভোগায়াহ্রিয়তে। তস্য বিষয়োপলব্ধিলক্ষণস্য বিজ্ঞানস্য শুদ্ধিরাহারশুদ্ধিঃ রাগদ্বেষমোহদোষৈরসংসৃষ্টং বিষয়বিজ্ঞানামিত্যর্থঃ। তস্যামাহারশুদ্ধৌ সত্যাং তদ্বতোহন্তঃকরণস্য সত্ত্বস্য শুদ্ধির্নৈল্যাং ভবতি; সত্ত্বশুদ্ধৌ চ সত্যাং যথাবগতে ভূমাত্মনি ধ্রুবাবিচ্ছিন্না স্মৃতিরবিস্মরণং ভবতি।—শাঙ্করভাষ্য, ছান্দোগ্য উপনিষদ, ৭।২৬
৪২ অভ্যাসেন তু কৌন্তেয় বৈরাগ্যেণ চ গৃহ্যতে। —গীতা, ৬।৩৫
৪৩ ‘নায়মাত্মা বলহীনেন লভ্যঃ।’ —মুণ্ডক উপ., ৩।২।৪
৪৪ আশিষ্ঠো দ্রঢ়িষ্ঠো বলিষ্ঠঃ।’ —তৈত্তি. উপ., ২।৮।১