০৯. ভারতীয় নারী—তাহাদের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ

[‘প্রবুদ্ধ ভারত’, ডিসেম্বর, ১৮৯৮]

ভারতের নারীগণের অবস্থা ও অধিকার এবং তাহাদের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে স্বামী বিবেকানন্দের মতামত জানিবার জন্য হিমালয়ের একটি সুন্দর উপত্যকায় তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিলাম। স্বামীজীর নিকট যখন আমার আগমনের উদ্দেশ্য বিবৃত করিলাম, তখন তিনি বলিলেন, ‘চলুন, একটু বেড়াইয়া আসা যাক।’ তখনই আমরা বেড়াইতে বাহির হইলাম।

কিছুক্ষণ পরে তিনি মৌনভঙ্গ করিয়া বলিতে লাগিলেন, ‘নারীর সম্বন্ধে আর্য ও সেমিটিক আদর্শ চিরদিনই সম্পূর্ণ বিপরীত! সেমাইটদের মধ্যে স্ত্রীলোকের উপস্থিতি উপাসনার ঘোর বিঘ্নস্বরূপ বলিয়া বিবেচিত। তাহাদের মতে স্ত্রীলোকের কোনরূপ ধর্মকর্মে অধিকার নাই, এমন কি, আহারের জন্য পক্ষী বলি দেওয়াও তাহাদের পক্ষে নিষিদ্ধ। আর্যদের মতে সহধর্মিণী ব্যতীত পুরুষ কোন ধর্মকার্য করিতে পারে না।

আমি এইরূপ অপ্রত্যাশিত ও স্পষ্ট কথায় আশ্চর্যান্বিত হইয়া বলিলাম, ‘কিন্তু স্বামীজী, হিন্দুধর্ম কি আর্যধর্মেরই অঙ্গবিশেষ নহে?’

স্বামীজী ধীরে ধীরে বলিলেন, ‘আধুনিক হিন্দুধর্ম পৌরাণিক-ভাববহুল, অর্থাৎ উহার উৎপত্তিকাল বৌদ্ধধর্মের পরবর্তী। দয়ানন্দ সরস্বতী দেখাইয়া দিয়াছেনঃ গার্হপত্য অগ্নিতে আহুতিদানরূপ বৈদিক ক্রিয়ার অনুষ্ঠান যে সহধর্মিণী ব্যতীত হইতে পারে না, তাহারই আবার শালগ্রামশিলা অথবা গৃহদেবতাকে স্পর্শ করিবার অধিকার নাই; ইহার কারণ এই যে, এই-সকল পূজা পরবর্তী পৌরাণিক যুগ হইতে প্রচলিত হইয়াছে।’

‘তাহা হইলে আমাদের মধ্যে নরনারীর যে অধিকার-বৈষম্য দেখা যায়, তাহা আপনি সম্পূর্ণরূপে বৌদ্ধধর্মের প্রভাবসম্ভূত বলিয়া মনে করেন?’

স্বামীজী বলিলেন, ‘যদি কোথাও বাস্তবিকই অধিকার-বৈষম্য থাকে, সেক্ষেত্রে আমি ঐরূপই মনে করি। পাশ্চাত্য সমালোচনার আকস্মিক স্রোতে এবং তুলনায় পাশ্চাত্য নারীদের অবস্থাবৈষম্য দেখিয়াই যেন আমরা আমাদের দেশে নারীদের হীন দশা অতি সহজেই মানিয়া না লই। বহু শতাব্দীর বহু ঘটনা বিপর্যয়ের দ্বারা নারীদিগকে একটু আড়ালে রাখিতে আমরা বাধ্য হইয়াছি। এই সত্যের প্রতি লক্ষ্য রাখিয়াই আমাদের সামাজিক রীতিনীতি পরীক্ষা করিতে হইবে, স্ত্রীজাতির হীন অবস্থা বিচার করিয়া নহে!’

‘তাহা হইলে স্বামীজী, আমাদের সমাজে নারীগণের বর্তমান অবস্থায় কি আপনি সন্তুষ্ট?’

স্বামীজী বলিলেন, ‘না কখনই নহে। কিন্তু নারীদিগের সম্বন্ধে আমাদের হস্তক্ষেপ করিবার অধিকার শুধু তাহাদিগকে শিক্ষা দেওয়া পর্যন্ত; নারীগণকে এমন যোগ্যতা অর্জন করাইতে হইবে, যাহাতে তাহারা নিজেদের সমস্যা নিজেদের ভাবে মীমাংসা করিয়া লইতে পারে। তাহাদের হইয়া অপর কেহ এ কার্য করিতে পারে না, করিবার চেষ্টা করাও উচিত নহে। আর জগতের অন্যান্য দেশের মেয়েদের মত আমাদের মেয়েরাও এ যোগ্যতা-লাভে সমর্থ।’

‘আপনি নারীজাতির অধিকার-বৈষম্যের কারণ বলিয়া বৌদ্ধধর্মের উপরে দোষারোপ করিতেছেন। জিজ্ঞাসা করি, বৌদ্ধধর্ম কিরূপে নারীজাতির অবনতির কারণ হইল?’

স্বামীজী বলিলেন, ‘সেই কারণের উৎপত্তি বৌদ্ধধর্মের অবনতির সময় ঘটিয়াছিল। প্রত্যেক আন্দোলনেই কোন অসাধারণ বিশেষত্ব থাকে বলিয়াই তাহার জয় ও অভ্যুদয় হয়, কিন্তু আবার উহার অবনতির সময়, যাহা লইয়া তাহার গৌরব, তাহাই তাহার দুর্বলতার প্রধান উপাদান হয়। নরশ্রেষ্ঠ ভগবান্‌ বুদ্ধের সম্প্রদায়গঠন ও পরিচালন-শক্তি অদ্ভুত ছিল, আর ঐ শক্তিতে তিনি জগৎ জয় করিয়াছিলেন। কিন্তু তাঁহার ধর্ম কেবল সন্ন্যাসি-সম্প্রদায়ের উপযোগী ধর্ম। তাহা হইতে এই অশুভ ফল হইল যে, সন্ন্যাসীর ভেক্ পর্যন্ত সম্মানিত হইতে লাগিল। আবার তিনিই সর্বপ্রথম মঠপ্রথা অর্থাৎ এক ধর্মসঙ্ঘে বাস করিবার প্রথা প্রবর্তিত করিলেন। ইহার জন্য তাঁহাকে বাধ্য হইয়া নারীজাতিকে পুরুষ অপেক্ষা নিম্নাধিকার দিতে হইল, যেহেতু বড় বড় মঠাধ্যক্ষাও নির্দিষ্ট মঠাধ্যক্ষের অনুমতি ব্যতীত কোন গুরুতর বিষয়ে হস্তক্ষেপ করিতে পারিতেন না। ইহাতে উদ্দিষ্ট আশু ফললাভ, অর্থাৎ তাঁহার ধর্মসঙ্ঘের মধ্যে সুশৃঙ্খলা স্থাপিত হইয়াছিল, ইহা আপনি বুঝিতে পারিতেছেন। কেবল সুদূর ভবিষ্যতে ইহার যে ফল হইয়াছিল, তাহারই জন্য অনুশোচনা করিতে হয়।’

‘কিন্তু বেদে তো সন্ন্যাসের বিধি আছে?’

‘অবশ্যই আছে, কিন্তু সে-সময় ঐ বিষয়ে নরনারীর কোন প্রভেদ করা হয় না। যাজ্ঞবল্ক্যকে জনক-রাজার সভায় কিরূপ প্রশ্ন করা হইয়াছিল, তাহা আপনার স্মরণ আছে তো?১০ তাঁহার প্রধান প্রশ্নকর্ত্রী ছিলেন বাক্‌পটু কুমারী বাচক্নবী। সেকালে এইরূপ মহিলাকে ‘ব্রহ্মবাদিনী’ বলা হইত। তিনি বলিয়াছিলেন, ‘আমার এই প্রশ্নদ্বয় দক্ষ ধানুষ্কের হস্তস্থিত দুইটি শাণিত তীরের মতো’; এই স্থলে তাঁহার নারীত্ব সম্বন্ধে কোনরূপ প্রশ্ন তোলা হয় নাই। আমাদের প্রাচীন আরণ্য-শিক্ষাকেন্দ্রে বালকবালিকার যে সমানাধিকার ছিল, তদপেক্ষা অধিকতর সাম্য আর কি হইতে পারে? আমাদের সংস্কৃত নাটকগুলি পড়ুন—শকুন্তলার উপাখ্যান পড়ুন, তারপর দেখুন—টেনিসনের ‘প্রিন্সেস্’ হইতে আমাদের নূতন কিছু শিখিবার আছে কিনা।’

‘স্বামীজী, আপনি বড় অদ্ভুতরূপে আমাদের অতীতের মহিমা-গৌরব সকলের সমক্ষে প্রকাশ করিতে পারেন!’

স্বামীজী শান্তভাবে বলিলেন—‘হাঁ, তাহার কারণ সম্ভবতঃ আমি জগতের দুইটি দিকই দেখিয়াছি। আর আমি জানি, যে-জাতি সীতা-চরিত্র সৃষ্টি করিয়াছে—ঐ চরিত্র যদি কাল্পনিকও হয়, তথাপি স্বীকার করিতে হইবে, নারীজাতির উপর সেই জাতির যেরূপ শ্রদ্ধা, জগতে তাহার তুলনা নাই। পাশ্চাত্য মহিলাদের জন্য আইনের যে-সব বজ্রবাঁধন আছে, আমাদের দেশের লোক সে-সব জানেও না। আমাদের নিশ্চয়ই অনেক দোষ আছে, আমাদের সমাজে অনেক অন্যায়ও আছে, কিন্তু এই-সকল উহাদেরও আছে। আমাদের এটি কখনও বিস্মৃত হওয়া উচিত নয় যে, সমগ্র জগতে প্রেম কোমলতা ও সাধুতা বাহিরের কার্যে ব্যক্ত করিবার একটা সাধারণ চেষ্টা চলিয়াছে, আর বিভিন্ন জাতীয় প্রথাগুলির দ্বারা যতটা সম্ভব ঐ-ভাব প্রকাশ করা হইয়া থাকে। গার্হস্থ্য ধর্ম সম্বন্ধে আমি এ-কথা অসঙ্কোচে বলিতে পারি যে, অন্যান্য দেশের প্রথাসমূহ অপেক্ষা ভারতীয় প্রথাসমূহের নানাভাবে অধিকতর উপযোগিতা রহিয়াছে।’

‘তবে স্বামীজী, আমাদের মেয়েদের কোনরূপ সমস্যা আদৌ আছে কি—যাহার মীমাংসা প্রয়োজন?’

‘অবশ্যই আছে—অনেক সমস্যা আছে—সমস্যাগুলিও বড় গুরুতর। কিন্তু এমন একটিও সমস্যা নাই, ‘শিক্ষা’—এই মন্ত্রবলে যাহার সমাধান না হইতে পারে। প্রকৃত শিক্ষার ধারণা কিন্তু এখনও আমাদের মধ্যে উদিত হয় নাই।’

‘তাহা হইলে আপনি প্রকৃত শিক্ষার কি সংজ্ঞা দিবেন?’

স্বামীজী ঈষৎ হাসিয়া বলিলেন—‘আমি কখনও কোন-কিছুর সংজ্ঞা নির্দেশ করি না। তথাপি এইভাবে বর্ণনা করা যাইতে পারে যে, শিক্ষা বলিতে কতকগুলি শব্দ শেখা নহে; আমাদের বৃত্তিগুলির—শক্তিসমূহের বিকাশকেই শিক্ষা বলা যাইতে পারে; অথবা বলা যাইতে পারে—শিক্ষা বলিতে ব্যক্তিকে এমন ভাবে গঠিত করা, যাহাতে তাহার ইচ্ছা সদ্বিষয়ে ধাবিত হয় এবং সফল হয়। এইভাবে শিক্ষিতা হইলে ভারতের কল্যাণসাধনে সমর্থ নির্ভীক মহীয়সী নারীর অভ্যুদয় হইবে। তাঁহারা সঙ্ঘমিত্তা, লীলা, অহল্যাবাঈ ও মীরাবাঈ-এর পদাঙ্ক-অনুসরণে সমর্থ হইবেন, তাঁহারা পবিত্র স্বার্থশূন্য বীর হইবেন। ভগবানের পাদপদ্মস্পর্শে যে বীর্য লাভ হয়, তাঁহারা সেই বীর্য লাভ করিবেন, সুতরাং তাঁহারা বীরপ্রসবিনী হইবার যোগ্যা হইবেন।’

‘তাহা হইলে স্বামীজী, শিক্ষার ভিতর ধর্মশিক্ষাও কিছু থাকা উচিত, আপনি মনে করেন?’

স্বামীজী গম্ভীরভাবে বলিলেন, ‘আমি ধর্মকে শিক্ষার ভিতরকার সার জিনিষ বলিয়া মনে করি। এটি কিন্তু মনে রাখিবেন যে, আমি আমার নিজের বা অপর কাহারও ধর্মসম্বন্ধে মতামতকে ‘ধর্ম’ বলিতেছি না। আমার বিবেচনায় অন্যান্য বিষয়ে যেমন, এ বিষয়েও তেমনি শিক্ষয়িত্রী ছাত্রীর ভাব ও ধারণানুযায়ী শিক্ষা দিতে আরম্ভ করিবেন এবং তাহাকে উন্নত করিবার এমন সহজ পথ দেখাইয়া দিবেন, যাহাতে তাহাকে খুব কম বাধা পাইতে হয়।’

‘কিন্তু ধর্মের দৃষ্টিতে, ব্রহ্মচর্যকে বাড়াইয়া জননী ও সহধর্মিণী অপেক্ষা যাঁহারা এইসব সম্বন্ধ এড়াইয়া ব্রহ্মচারিণী হইয়াছেন তাঁহাদিগকে উচ্চাসন দেওয়া নিশ্চয়ই নারীর উন্নতিতে সোজাসুজি আঘাত করা?’

স্বামীজী বলিলেন—‘আপনার স্মরণ রাখা কর্তব্য যে, ধর্ম যদি নারীর পক্ষে ব্রহ্মচর্যকে উচ্চাসন দিয়া থাকে, পুরুষজাতির পক্ষেও ঠিক তাহাই করিয়াছে। আরও আপনার প্রশ্ন শুনিয়া বোধ হইতেছে, এ বিষয়ে আপনার নিজের মনেও যেন একটু কি গোলমাল আছে। হিন্দুধর্ম মানবাত্মার পক্ষে একটি—কেবল একটি কর্তব্য নির্দেশ করিয়া থাকেন—অনিত্যের মধ্যে নিত্যবস্তু সাক্ষাৎ করিবার চেষ্টা। কিন্তু ইহা কিরূপে সাধিত হইতে পারে, তাহার একমাত্র পন্থা নির্দেশ করিতে কেহই সাহসী হন না। বিবাহ বা ব্রহ্মচর্য, ভাল বা মন্দ, পাণ্ডিত্য বা মূর্খতা—যে-কোন বিষয় ঐ চরম লক্ষ্যে লইয়া যাইবার সহায়তা করে, তাহারই সার্থকতা আছে। এই বিষয়ে হিন্দুধর্মের সহিত বৌদ্ধধর্মের বিশেষ প্রভেদ বর্তমান। কারণ বৌদ্ধধর্মের প্রধান উপদেশ—বহির্জগতের অনিত্যতা উপলব্ধি, আর মোটামুটি বলিতে গেলে ঐ উপলব্ধি একটিমাত্র উপায়েই সাধিত হইতে পারে। মহাভারতের সেই অল্পবয়স্ক যোগীর কথা—আপনার কি মনে পড়ে? ইনি ক্রোধজাত তীব্র ইচ্ছাশক্তিবলে এক কাক ও বকের দেহ ভস্ম করিয়া নিজ যোগবিভূতিতে স্পর্ধান্বিত হইয়াছিলেন, তারপর নগরে গিয়া প্রথমে রুগ্ন পতির শুশ্রুষাকারিণী এক নারীর সহিত, পরে ধর্মব্যাধের সহিত তাঁহার সাক্ষাৎ হইল—যাঁহারা উভয়েই নিষ্ঠা ও কর্তব্যরূপ একই মার্গ অবলম্বনে তত্ত্বজ্ঞান লাভ করিয়াছিলেন?’১১

‘তাহা হইলে আপনি এদেশের নারীগণকে কি বলিতে চান?’

‘কেন, আমি পুরুষগণকে যাহা বলিয়া থাকি, নারীগণকে ঠিক তাহাই বলিব। ভারত এবং ভারতীয় ধর্মে বিশ্বাস কর, তেজস্বিনী হও, আশায় বুক বাঁধ, ভারতে জন্ম বলিয়া লজ্জিত না হইয়া উহাতে গৌরব অনুভব কর, আর স্মরণ রাখিও, আমাদের অপরাপর জাতির নিকট হইতে কিছু লইতে হইবে বটে, কিন্তু জগতের অন্যান্য জাতি অপেক্ষা আমাদের অপরকে দিবার জিনিষ সহস্রগুণ বেশী আছে।’