০৭. পত্রাবলী ৪৩৫-৪৪৪

৪৩৫*

[মিস মেরী হেলকে লিখিত]

রিজলি ম্যানর
৩ অক্টোবর, ১৮৯৯

স্নেহের মেরী,
তোমার অত্যন্ত সহৃদয় কথাগুলির জন্য ধন্যবাদ। এখন আমি অনেক ভাল আছি এবং দিন দিন আরও ভাল হচ্ছি। কাল বা পরশু মেয়েকে নিয়ে মিসেস বুলের আসার কথা। সুতরাং আবার কিছুকাল ভাল কাটবে বলে মনে হয়—তোমার অবশ্য সব সময়ই ভাল কাটছে। ফিলাডেলফিয়া যাচ্ছ জেনে খুশী হয়েছি, কিন্তু সে-বারের মত এবারে ততটা নই, সে-বার দিগন্তে ক্রোরপতি দেখা দিয়েছিল। সর্ববিধ ভালবাসা জেন।

সতত তোমার স্নেহশীল ভ্রাতা
বিবেকানন্দ

৪৩৬*

[মিস মেরী হেলকে লিখিত]

রিজলি ম্যানর
৩০ অক্টোবর, ১৮৯৯

স্নেহের আশাবাদী ভগিনী,
তোমার চিঠি পেয়েছি। স্রোতে-ভাসা আশাবাদীকে কর্মে প্রবৃত্ত করবার মত কিছু একটা যে ঘটেছে, তার জন্য আনন্দিত। তোমার প্রশ্নগুলি দুঃখবাদের গোড়া ধরে নাড়া দিয়েছে, বলতে হবে। বর্তমান ব্রিটিশ ভারতের মাত্র একটাই ভাল দিক্‌ আছে, যদিও অজান্তে ঘটেছে—তা ভারতকে আর একবার জগৎমঞ্চে তুলে ধরেছে, ভারতের উপর বাইরের পৃথিবীকে চাপিয়ে দিয়েছে জোর করে। সংশ্লিষ্ট জনগণের মঙ্গলের দিকে চোখ রেখে যদি তা করা হত—অনুকূল পরিবেশে জাপানের ক্ষেত্রে যা ঘটেছে—তাহলে ফলাফল ভারতের ক্ষেত্রে আরও কত বিস্ময়কর হতে পারত। কিন্তু রক্তশোষণই যেখানে মূল উদ্দেশ্য, সেখানে মঙ্গলকর কিছু হতে পারে না। মোটের উপর, পুরানো শাসন জনগণের পক্ষে এর চেয়ে ভাল ছিল, কারণ তা তাদের সর্বস্ব লুঠ করে নেয়নি এবং সেখানে অন্ততঃ কিছু সুবিচার—কিছু স্বাধীনতা ছিল।

কয়েক-শ অর্ধশিক্ষিত, বিজাতীয় নব্যতন্ত্রী লোক নিয়ে বর্তমান ব্রিটিশ ভারতের সাজান তামাশা—আর কিছু নয়। মুসলমান ঐতিহাসিক ফেরিস্তার মতে দ্বাদশ শতাব্দীতে হিন্দুর সংখ্যা ছিল ৬০ কোটি, এখন ২০ কোটিরও নীচে।

ইংরেজ-বিজয়ের কালে কয়েক শতাব্দী ধরে যে সন্ত্রাসের রাজত্ব চলেছিল, ব্রিটিশ শাসনের অবশ্যম্ভাবী পরিণামরূপে ১৮৫৭ ও ১৮৫৮ খ্রীষ্টাব্দে যে বীভৎস হত্যাকাণ্ড ঘটেছে এবং তার চেয়েও ভয়ানক যে-সকল দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছে, (দেশীয় রাজ্যে কখনও দুর্ভিক্ষ হয়নি) তা লক্ষ লক্ষ লোককে গ্রাস করেছে। তা সত্ত্বেও জনসংখ্যা অনেক বেড়েছে, কিন্তু মুসলমান শাসনের আগে দেশ যখন সম্পূর্ণ স্বাধীন ছিল, এখনও সেই সংখ্যায় পৌঁছয়নি। বর্তমান জনসংখ্যার অন্ততঃ পাঁচগুণ লোককে সহজেই ভরণপোষণ করার মত জীবিকা ও উৎপাদনের সংস্থান ভারতে আছে—যদি সব কিছু তাদের কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া না হয়।

এই তো অবস্থা—শিক্ষাবিস্তারও বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা অপহৃত, (অবশ্য আমাদের নিরস্ত্র করা হয়েছে অনেক আগেই) যেটুকু স্বায়ত্তশাসন কয়েক বছরের জন্য দেওয়া হয়েছিল, অবিলম্বে তা কেড়ে নেওয়া হয়েছে। দেখছি, আরও কী আসে! কয়েক ছত্র সমালোচনার জন্য লোককে যাবজ্জীবন দ্বীপান্তরে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে, বাকীরা বিনা বিচারে জেলে। কেউ জানে না, কখন কার ঘাড় থেকে মাথা উড়িয়ে দেওয়া হবে।

ভারতবর্ষে কয়েক বছর ধরে চলছে ত্রাসের রাজত্ব। ব্রিটিশ সৈন্য আমাদের পুরুষদের খুন করেছে, মেয়েদের মর্যাদা নষ্ট করেছে, বিনিময়ে আমাদেরই পয়সায় জাহাজে চড়ে দেশে ফিরেছে পেনসন ভোগ করতে। ভয়াবহ নৈরাশ্যে আমরা ডুবে আছি। কোথায় সেই ভগবান্‌? মেরী, তুমি আশাবাদী হতে পার, কিন্তু আমি কি পারি? ধর, এই চিঠিখানাই যদি তুমি প্রকাশ করে দাও—ভারতের নূতন কানুনের জোরে ইংরেজ সরকার আমাকে এখান থেকে সোজা ভারতে টেনে নিয়ে যাবে এবং বিনা বিচারে আমাকে হত্যা করবে। আর আমি জানি তোমাদের সব খ্রীষ্টান শাসকসম্প্রদায় ব্যাপারটা উপভোগ করবে, কারণ আমি যে ‘হিদেন’। এর পরেও আমি নিদ্রা যাব, আর আশাবাদী থাকব? পৃথিবীর সবচেয়ে বড় আশাবাদীর নাম নীরো (Nero)। হায়, সেই ভয়ঙ্কর অবস্থার কথা তারা সংবাদ হিসাবেও লিখবার উপযুক্ত মনে করে না। নেহাতই যদি দরকার হয়, রয়টারের এজেণ্ট এগিয়ে এসে ‘আদেশ-মাফিক তৈরী’ ঠিক উল্টো খবরটি বাজারে ছাড়বে। হিদেন-হনন খ্রীষ্টানদের পক্ষে অবশ্যই ন্যায়সঙ্গত অবসর-বিনোদন। তোমাদের মিশনারীরা ভারতে ঈশ্বরের মহিমা প্রচার করতে যায়, কিন্তু ইংরেজদের ভয়ে সেখানে একটি সত্য কথা উচ্চারণ করতে পারে না; যদি করে, পরদিন ইংরেজরা তাদের দূর করে দেবে।

পূর্বতন শাসকেরা শিক্ষার জন্য যে-সব জমি ও সম্পত্তি দান করেছিলেন, সে সকলই গ্রাস করে নেওয়া হয়েছে, এবং বর্তমান সরকার শিক্ষার জন্য রাশিয়ার চেয়েও কম খরচ করে—আর সে কী শিক্ষা! মৌলিকতার সামান্য চেষ্টাও টুঁটি টিপে মারা হয়।

মেরী, আমাদের কোন আশা নেই, যদি না সত্যি এমন কোন ভগবান্‌ থাকেন, যিনি সকলের পিতাস্বরূপ, যিনি বলবানের বিরুদ্ধে দুর্বলকে রক্ষা করতে ভীত নন, এবং যিনি কাঞ্চনের দাস নন। তেমন কোন ভগবান্‌ আছেন কি? কালেই তা প্রমাণিত হবে।

হ্যাঁ, আশা করছি—কয়েক সপ্তাহ পরে চিকাগো যেতে পারব এবং তখন সব কথা খুলে বলব।

সর্ববিধ ভালবাসা-সহ সতত তোমার ভ্রাতা
বিবেকানন্দ

পুনঃ—ধর্মীয় সম্প্রদায় হিসাবে ‘—’ এবং অন্যান্য সম্প্রদায় কতকগুলি অর্থহীন সংমিশ্রণ; ইংরেজ প্রভুদের কাছে আমাদের বাঁচতে দেবার প্রার্থনা নিয়ে এরা গজিয়ে উঠেছে। আমরা এক নূতন ভারতের সূচনা করেছি—যথার্থ উন্নত ভারত, পরের দৃশ্যটুকু দেখবার অপেক্ষায় আছি। নূতন মতবাদে আমরা তখনই বিশ্বাসী, যখন জাতির তা প্রয়োজন এবং যা আমাদের পক্ষে যথার্থ সত্য হবে। অন্যদের সত্যের পরীক্ষা হল ‘আমাদের প্রভুরা যা অনুমোদন করেন’; আর আমাদের হল, যা ভারতীয় জ্ঞানবিচারে বা অভিজ্ঞতায় অনুমোদিত, তাই। লড়াই শুরু হয়ে গিয়েছে, ‘—’ ও আমাদের মধ্যে নয়, … শুরু হয়েছে আরও কঠিন ও ভয়ঙ্কর শক্তির বিরুদ্ধে। ইতি

বি

৪৩৭*

C/o F. Leggett Esq.
রিজলি ম্যানর
আলস্টার কাউণ্টি নিউ ইয়র্ক

প্রিয় স্টার্ডি,
ঠিকানায় অসম্পূর্ণতার জন্য তোমার শেষ চিঠিখানা কয়েক জায়গা ঘুরে আমার কাছে এসে পৌঁছেছে।

হতে পারে তোমার সমালোচনার অনেকখানি অংশ সঙ্গত ও সত্য, আবার এও সম্ভব যে, কোন একদিন তুমি দেখবে, এ-সকলই কতকগুলি লোকের প্রতি তোমার বিরাগ থেকে প্রসূত, আর আমি হয়েছি অপরের কৃত অপরাধের ফলভোগী (scapegoat)।

যা হোক, এ-সব নিয়ে তিক্ততার প্রয়োজন নেই, যেহেতু আমি যা নই, তার ভান কখনও করেছি বলে মনে পড়ে না। আর তা করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়, কারণ আমার ধূমপান, খারাপ মেজাজ ইত্যাদি ব্যাপার—আমার সঙ্গে ঘণ্টাখানেক কাটালে যে-কেউ সহজে জানতে পারে। ‘মিলন-মাত্রেরই বিচ্ছেদ আছে’—এই হল প্রকৃতির নিয়ম। তার জন্য আমার নৈরাশ্যের ভাব আমার মধ্যে জাগে না। আশা করি, তোমার মনে কোন তিক্ততা থাকবে না। কর্মই আমাদের মিলিয়ে দেয়, আবার কর্মই আমাদের বিচ্ছিন্ন করে।

জানি তুমি কেমন লাজুকস্বভাব এবং অপরের মনোভাবে আঘাত করতে কতখানি অপছন্দ কর। আমি খুবই বুঝতে পারছি, সম্পূর্ণ ভিন্ন আদর্শের লোকদের নিয়ে কাজ চালিয়ে যাবার জন্য যখন তোমাকে যুঝতে হচ্ছিল, তখন মাসের পর মাস তোমাকে কি-রকম মানসিক যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছিল। এমন যে হবে, তা পূর্বে অনুমান করতে পারলে তোমাকে অনেক অনাবশ্যক মানসিক অশান্তি থেকে অব্যাহতি দিতে পারতাম। এও আবার সেই ‘কর্ম’।

হিসেবপত্র পূর্বে পেশ করা হয়নি, কারণ কাজ এখনও সমাপ্ত হয়নি; সমস্ত ব্যাপারটাকে চুকে গেলে দাতার কাছে সম্পূর্ণ হিসেব দাখিল করব, ভেবেছিলাম। টাকার জন্য দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করার ফলে কাজ মাত্র গত বছর শুরু হতে পেরেছে এবং আমার নীতি হল, টাকার জন্য হাত না পেতে স্বেচ্ছায় দানের জন্য অপেক্ষা করা।

আমার সমস্ত কাজে এই একই নীতি মেনে চলি, কারণ আমার স্বভাব যে অনেকের কাছেই নিতান্ত অপ্রীতিকর, সে সম্বন্ধে আমি খুবই সচেতন এবং যতক্ষণ না কেউ আমাকে চায়, ততক্ষণ আমি অপেক্ষা করে থাকি। মুহূর্তের মধ্যে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করবার জন্যও প্রস্তুত থাকি। আর এই বিচ্ছেদের ব্যাপারে আমার কখনও মন খারাপ হয় না কিম্বা সে-সম্বন্ধে বেশি কিছু চিন্তাও করি না, কারণ আমার নিত্য ভ্রাম্যমাণ জীবনে এ জিনিষ আমাকে সব সময়ই করতে হচ্ছে। তবে অনিচ্ছা সত্ত্বেও এর দ্বারা অন্যকে যে কষ্ট দিই, সেই আমার দুঃখ। তোমার ঠিকানায় আমার নামে কোন ডাক থাকলে দয়া করে পাঠিয়ে দেবে কি?

সকল শুভাশিস তোমাদের চিরসাথী হোক—বিবেকানন্দের নিরন্তর এই প্রার্থনা।

বিবেকানন্দ

৪৩৮*

রিজলি
১ নভেম্বর, ১৮৯৯

প্রিয় ,
… মনে হচ্ছে তোমার মনে যেন কি একটা বিষাদ রয়েছে। তুমি ঘাবড়িও না, কিছুই তো চিরস্থায়ী নয়। যাই কর না কেন, জীবন কিছু অনন্ত নয়! আমি তার জন্য খুবই কৃতজ্ঞ। জগতের মধ্যে যারা শ্রেষ্ঠ ও সবচেয়ে সাহসী, যাতনাই তাহাদের বিধিলিপি; যদিও বা এর প্রতিকার সম্ভব হয়, তবু তা না হওয়া অবধি, ভাবী বহু যুগ পর্যন্ত এ জগতে এ ব্যাপারটা অন্ততঃ একটা স্বপ্নভঙ্গের শিক্ষারূপেও গ্রহণীয়। আমার স্বাভাবিক অবস্থায় আমি তো নিজের দুঃখ-যন্ত্রণাকে সানন্দেই বরণ করি। কাউকে না কাউকে এ জগতে দুঃখভোগ করতেই হবে; আমি খুশী যে, প্রকৃতির কাছে যারা বলিপ্রদত্ত হয়েছে, আমিও তাদের একজন।

তোমাদের
বিবেকানন্দ

৪৩৯*

নিউ ইয়র্ক
১৫ নভেম্বর, ১৮৯৯

প্রিয় ,
… মোটের উপর আমার শরীরের জন্য বিশেষ উদ্বেগের কোন কারণ আছে বলে মনে করি না। এ-জাতীয় স্নায়ুপ্রধান ধাতের শরীর কখনও বা মহাসঙ্গীত-সৃষ্টির উপযোগী যন্ত্রস্বরূপ হয়, আবার কখনও বা অন্ধকারে কেঁদে মরে।

তোমাদের
বিবেকানন্দ

৪৪০*

C/o E. Guernsey, M.D.
The Madrid, 180 W. 59
১৫ নভেম্বর, ১৮৯৯

প্রিয় মিসেস বুল,
শেষ পর্যন্ত—এখনই কেম্ব্রিজে যাওয়া স্থির করেছি। যে-সব গল্প শুরু করেছিলাম, তা শেষ করতেই হবে। প্রথমটি আমাকে ফেরত দিয়েছে বলে মনে হয় না।

আগামী পরশু আমার পোষাক তৈরী হয়ে যাবে, তারপরই যাত্রার জন্য প্রস্তুত হতে পারব; শুধু ভয় এই—সমস্ত শীতকালটা অবিরত পার্টি আর বক্তৃতার ফলে সেখানে বিশ্রাম হবে না, উপরন্তু স্নায়ুগুলি দুর্বল হয়ে পড়বে।

যা হোক, বোধ হয় আপনি কোথায়ও একটি ঘরের ব্যবস্থা করে দিতে পারবেন, যেখানে ঐ-সব ব্যাপার থেকে গা-ঢাকা দিয়ে একান্তে থাকতে পারব।

যে ভাবেই হোক, এই সপ্তাহে পোষাক তৈরী হয়ে গেলেই আমি চলে আসছি। আমার জন্য আপনার নিউ ইয়র্কে আসবার প্রয়োজন নেই। যদি আপনার নিজের কাজ থাকে, তা হলে আলাদা কথা। মণ্টক্লেয়ারের মিসেস হুইলারের কাছ থেকে খুব সহৃদয় আমন্ত্রণ পেয়েছি। বষ্টনে রওনা হবার আগে কয়েক ঘণ্টার জন্য অন্ততঃ মণ্টক্লেয়ারে ঘুরে যেতে হবে।

অনেক ভাল বোধ করছি এবং সুস্থ আছি। দুর্ভাবনা ছাড়া আর কিছু বালাই নেই; এবারে তাও নিশ্চয়ই সমুদ্রে ছুঁড়ে ফেলে দেব।

ভারতে লেখা আপনার চিঠিপত্রে পরোক্ষভাবেও আমার সম্বন্ধে যেন কোন সংবাদ না থাকে—আপনার কাছে শুধু এটিই চাই; কিন্তু পাব কিনা সে-বিষয়ে আমার আশঙ্কা আছে। কিছু সময়ের জন্য অথবা চিরদিনের মত আমি গা-ঢাকা দিতে চাই। অভিশপ্ত হোক আমার প্রসিদ্ধির দিনটি!

সর্ববিধ ভালবাসা সহ
বিবেকানন্দ

৪৪১*

C/o F. H. Leggett
21 West 34th St., New York
নভেম্বর, ১৮৯৯

প্রিয় স্টার্ডি,
আমার আচরণ সমর্থনের জন্য এ চিঠি নয়। যদি আমি অন্যায় কিছু করে থাকি, তবে তা কথা দিয়ে মোছা যাবে না, বা কোন বিরূপ সমালোচনা করে আমাকে সৎকাজ থেকে বিরত করা যাবে না।

বিলাসিতা, বিলাসিতা—গত কয় মাস থেকে কথাটি বড্ড বেশী শুনতে পাচ্ছি, পাশ্চাত্যবাসীরা নাকি তার উপকরণ যুগিয়েছে, আর সর্বক্ষণ ত্যাগের মহিমা কীর্তন করে ভণ্ড আমি নাকি নিজে সেই বিলাসিতা ভোগ করে আসছি। এই বিলাস-ব্যসনই নাকি আমার কাজের পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে, অন্ততঃ ইংলণ্ডে। আমি এই বিশ্বাসের কুহকে পড়েছিলাম যে, আমার জীবনের ঊষর মরুতে অন্ততঃ ছোট্ট একটি মরুদ্যান আছে; সমগ্র জীবনের দুঃখ ও অন্ধকারের মধ্যে আলোর একটু চিহ্ন, কঠোর পরিশ্রম ও কঠোরতর অভিশাপের জীবনে এক মুহূর্তের আরাম—সেই মরুদ্যান, সেই চিহ্ন, সেই মুহূর্তটি শুধু একটু ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য সুখের ব্যাপার!!

আমি খুশীই ছিলাম, সেটুকু পেতে যাঁরা আমাকে সাহায্য করেছেন, তাঁদের দিনে শতবার আশীর্বাদ করেছি, কিন্তু এমন সময় আকস্মিকভাবে তোমার চিঠিখানা হাতে এল, আর আমার স্বপ্নও কোথায় মিলিয়ে গেল। তোমাদের সমালোচনায় আমার আর কোন আস্থা নেই—এ-সব বিলাসব্যসনের কথায় আর কান দিই না, স্মৃতিতে জেগে উঠেছে অন্য এক দৃশ্য সেই কথাই লিখছি। উপযুক্ত মনে করলে এ চিঠি বন্ধুদের কাছে একে একে পাঠিয়ে দিও এবং কোথাও ভুল লিখে থাকলে শুধরে দিও।

ক্যাপ্টেন ও মিসেস সেভিয়ারের কথা বাদ দিলে ইংলণ্ড থেকে আমি রুমালের মত একটুকরো বস্ত্র পেয়েছি বলে মনে পড়ে না। অথচ অপর পক্ষে ইংলণ্ডে আমার শরীর ও মনের উপর অবিরত পরিশ্রমের চাপের ফলেই আমার স্বাস্থ্য ভেঙে যায়। তোমরা— ইংরেজরা আমাকে এই তো দিয়েছ, আর মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছ অমানুষিক খাটিয়ে। এখন আবার বিলাস-ব্যসন নিয়ে নিন্দা করা হচ্ছে!! তোমাদের মধ্যে কেউ আমাকে একটি কোট দিয়েছ, বলতে পার? কেউ একটা সিগার? এক-টুকরা মাছ বা মাংস? তোমাদের মধ্যে এ-কথা বলবার দুঃসাহস কার আছে যে, তোমাদের কাছে আমি খাবার, পানীয়, সিগার, পোষাক বা টাকা চেয়েছি? জিজ্ঞেস কর, … ঈশ্বরের নামে বলছি, জিজ্ঞেস কর তোমার বন্ধুদের জিজ্ঞেস কর এবং সবচেয়ে আগে জিজ্ঞেস কর তোমার নিজের ‘অন্তর্যামী ভগবানকে—যিনি কখনও ঘুমান না।’

আমার কাজের জন্য তোমরা যে টাকা দিয়েছ, তার প্রতিটি পেনি সেখানেই আছে। তোমাদের চোখের সামনে আমার ভাইকে পাঠিয়ে দিতে হয়েছে, সম্ভবতঃ মৃত্যুর প্রতীক্ষায়; কিন্তু তাকে আমি একটি কানাকড়িও দিইনি, কারণ আমার ব্যক্তিগত সম্পত্তি ছিল না।

আর অন্য দিকে ক্যাপ্টেন ও মিসেস সেভিয়ারের কথা মনে পড়ে—শীতের সময় তারা আমাকে বস্ত্র দিয়েছেন, আমার নিজের মার চেয়েও যত্নে আমার সেবা করেছেন, ক্লান্তি ও দুঃখের দিনে আমার সমব্যথী হয়েছেন; এবং তাঁদের কাছ থেকে আশীর্বাদ ছাড়া আর কিছুই পাইনি। সেই মিসেস সেভিয়ার মান-মর্যাদার পরোয়া করেননি বলেই আজ হাজার হাজার লোকের পূজনীয়া। তাঁর লোকান্তরের পর লক্ষ লক্ষ মানুষ তাঁকে মনে রাখবে দরিদ্র ভারতবাসীর একজন অকৃত্রিম শুভার্থিনীরূপে। তাঁরা কখনও আমাকে বিলাসিতার জন্য নিন্দা করেননি, যদিও আমার ইচ্ছা বা প্রয়োজন হলে বিলাসিতার উপকরণ যোগাতে তাঁরা প্রস্তুত।

মিসেস বুল, মিসেস ম্যাকলাউড, মিঃ ও মিসেস লেগেট সম্বন্ধে তোমাকে বলা নিষ্প্রয়োজন। আমার জন্য তাঁদের ভালবাসা ও সহৃদয়তার কথা তোমার জানা আছে; মিসেস বুল ও মিসেস ম্যাকলাউড আমাদের দেশে গিয়েছেন এবং জীবনের সাধারণ সুখ-সুবিধাগুলি ত্যাগ করে আমাদের মধ্যে এমনভাবে বসবাস ও চলাফেরা করেছেন, যা কোন বিদেশী কখনও করেনি এবং তাঁরা তো আমার বিলাসিতার মুণ্ডপাত করেন না, বরং আমাকে খাওয়াতে পারলে বা আমি চাইলে দামী সিগার খাইয়ে তাঁরা আনন্দ পান। আর যখন আমি তোমাদের জন্য প্রাণপাত করছিলাম এবং নোংরা গর্তে অনাহারের মধ্যে রেখে যখন তোমরা আমার গায়ের মাংস তুলে নিচ্ছিলে ও সঞ্চয় করে রেখেছিলে বিলাসিতার এই অপবাদ, সেদিনও এই লেগেট ও বুলদের দেওয়া রুটিই আমি খেয়েছি, তাঁদের দেওয়া কাপড়ই আমি পরেছি, তাঁদের টাকাতেই আমি ধূমপান করেছি এবং বহুবার বাড়ীভাড়াটা পর্যন্ত মিটিয়েছেন তাঁরাই।

‘শরতের মেঘ গরজে বিপুল, নাহি ঢালে বারিধারা,
বর্ষার মেঘ স্তব্ধ নীরব ভাসায় বসুন্ধরা।’

তবেই দেখ …, যাঁরা সাহায্য করেছেন বা এখনও করছেন তাঁদের কাছ থেকে কোন বিরূপ সমালোচনা বা নিন্দা নেই; যারা কিছুই করে না এবং শুধুই নিজের সার্থসিদ্ধির পথ খোঁজে, তারাই কেবল নিন্দা ও সমালোচনা করে। এ রকম মূল্যহীন, হৃদয়হীন, স্বার্থযুক্ত ও নোংরা সমালোচনার চেয়ে বড় আশীর্বাদ আমার কাছে আর নেই। এইসব চূড়ান্ত স্বার্থান্বেষীদের কাছ থেকে বহু ক্রোশ দূরে থাকা আমার যতটা কাম্য, জীবনে আর কিছুই তেমন নয়।

বিলাসিতার কথা বলছ! এইসব সমালোচকদের এক এক করে ধর—দেখবে প্রত্যেকেরই মন পড়ে আছে দেহে, আত্মার উপলব্ধি কারও একবিন্দু নেই। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ, আগেই হোক, পড়েই হোক তাদের স্বরূপ বেরিয়ে পড়েছে। আর এইসব হৃদয়হীন লোকের অভিপ্রায় অনুসারে তুমি আমার আচরণ ও কর্মধারা পরিবর্তন করতে উপদেশ দিচ্ছ, আর আমি তা করছি না বলে তোমার বুদ্ধি বিভ্রান্ত!

আমার গুরুভ্রাতাদের উপর আমি যে কাজ চাপাই, তারা তাই করে। যদি তারা কখনও স্বার্থপরতা দেখিয়ে থাকে, তা আমাদের আদেশেই করেছে, নিজের খুশীমত করেনি।

লণ্ডনে আমাকে যেমন অন্ধকার গর্তটির ভেতরে রেখেছিলে এবং সর্বক্ষণ পরিশ্রম ও অনাহারের মধ্যে মেরে ফেলার উপক্রম করেছিলে, তোমার সন্তানের বেলায় তা করতে পারতে কি? মিসেস—কি তা করতে চাইবেন?

তারা সন্ন্যাসী, তার অর্থ এই—কোন সন্ন্যাসী অকারণে শরীর ত্যাগ বা অপ্রয়োজনে কৃচ্ছ্রতা করবে না। পাশ্চাত্যদেশে এই-সকল কঠোরতা করতে গিয়ে আমরা সন্ন্যাসের নিয়মই ভঙ্গ করেছি। তারা আমার ভাই, আমার সন্তান। আমার জন্য তারা গর্তের মধ্যে মারা যাক, এ আমি চাই না। সত্য ও মঙ্গলকর সমস্ত শক্তির বলে আমি চাই না—তারা তাদের এত কষ্টের বদলে অনাহারে বা খেটে মরুক, কিম্বা অভিশপ্ত হোক।

আরও একটি কথা। যদি তুমি দেখাতে পার—কোথা আমি দেহের উপর নির্যাতনের কথা প্রচার করেছি, তা হলে খুশী হব। শাস্ত্রের কথা তুললে আমি বলি, সন্ন্যাসী ও পরমহংসদের জীবনযাপনের যে নিয়ম সেখানে লিপিবদ্ধ আছে, তা আমরা পালন করিনি, আমাদের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ নিয়ে দাঁড়াতে কোন (শাস্ত্রী) পণ্ডিত যদি সাহস করেন, (তাঁর সম্মুখীন হতে) আমি খুবই খুশী হব।

হ্যাঁ …, বেদনায় ভারাক্রান্ত হয়ে আছে আমার অন্তর। এর সবই আমি বুঝি। তোমার ভেতরটা কী, তা আমি জানি, কিন্তু তুমি এমন সব লোকের কবলে পড়েছ, যারা (তাদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য) তোমাকে ব্যবহার করতে চায়। তোমার স্ত্রীর কথা বলছি না। তিনি সরলপ্রাণা, অনিষ্টকর কিছু তাঁর দ্বারা সম্ভব নয়। কিন্তু বৎস, তোমার গায়ে আমিষ গন্ধ আছে—সামান্য কিছু টাকা আছে, শকুনিরা তাই ইতস্ততঃ ঘোরাফেরা করছে। এই হল জীবন।

প্রাচীন ভারত সম্বন্ধে তুমি অনেক কথা বলেছিলে। সেই ভারত আজও বেঁচে আছে …, এখনও সে মরেনি, আজও সেই জীবন্ত ভারত নির্ভীকভাবে ধনীর অনুগ্রহের তোয়াক্কা না রেখে তার নিজস্ব বাণী প্রচার করার মনোবল রাখে; কারও মতামতের পরোয়া সে করে না, এ দেশে—যেখানে তার পায়ে শিকল আঁটা কিম্বা শিকলের প্রান্তভাগ যারা ধরে আছে, সেই শাসনকর্তাদের মুখের সামনেও করে না। সেই ভারত আজও বেঁচে আছে …, অম্লান প্রেমের, চিরস্থায়ী বিশ্বস্ততার চিরন্তন ভারতবর্ষ—শুধু রীতিনীতিতেই নয়, প্রেমে বিশ্বাসে ও বন্ধুত্বে। সেই ভারতের একজন নগণ্য সন্তান হিসাবে আমি তোমাকে ভালবাসি ভারতীয় প্রেমে, এবং এই বিভ্রান্তি থেকে মুক্ত হতে তোমায় সাহায্য করার জন্য আমি সহস্রবার শরীরত্যাগে প্রস্তুত।

চিরদিন তোমার
বিবেকানন্দ

৪৪২*

1st East 39 St. নিউ ইয়র্ক
২০ নভেম্বর, ১৮৯৯

স্নেহের মেরী,
খুব সম্ভবতঃ কাল ক্যালিফোর্নিয়া যাত্রা করছি। পথে দু-এক দিনের জন্য চিকাগোয় থাকব। যাত্রা করে তোমাকে ‘তার’ করব। কাউকে ষ্টেশনে পাঠিও, কারণ পথে ‘ভিতর’ ও ‘বাহির’ (in and out) খুঁজে বার করতে আমি কোন দিনই পারি না, এখন তো আরওই।

তোমার চিরদিনের ভ্রাতা
বিবেকানন্দ

৪৪৩

[স্বামী ব্রহ্মানন্দকে লিখিত]

আমেরিকা
২০ নভেম্বর, ১৮৯৯

অভিন্নহৃদয়েষু ,
শরতের পত্রে খবর পেলুম। … হার-জিতের সঙ্গে আমার সম্পর্ক নেই, তোমরা এইবেলা experience (অভিজ্ঞতা) করে নাও। … আমার আর কোন রাগ নেই। আমি আবার … ঘুরতে চললুম জায়গায় জায়গায়। কুছ পরোয়া নেই, মাভৈঃ। সব উড়ে যাবে তোমাদের সামনে, খালি (অবাধ্য) হয়ো না, সব সিদ্ধি হবে। … জয় মা রণরঙ্গিণী! জয় মা, জয় মা, রণরঙ্গিণী! ওয়া গুরু, ওয়া গুরুকী ফতে!

… আসল কথা, ঐ কাপুরুষত্বের চেয়ে পাপ নেই; কাপুরুষের উদ্ধার হয় না—এ নিশ্চিত। আর সব সয়, ঐটি সয় না। ওটি যে ছাড়বে না, তার সঙ্গে আমার আর সম্পর্ক চলে কি? … এক ঘা খেয়ে দশ ঘা তেড়ে মারতে হবে … তবে মানুষ। … কাপুরুষ দয়ার আধার!!১১

আমি আশীর্বাদ করছি, আজ এই মহামায়ার দিনে—এই রাত্রে মা তোমাদের হৃদয়ে নাবুন, অনন্ত শক্তি তোমাদের বাহুতে আনুন! জয় কালী, জয় কালী, জয় কালী! মা নাববেনই নাববেন—মহাবলে সর্বজয়—বিশ্ববিজয়; মা নাবছেন। ভয় কি? কাদের ভয়? জয় কালী, জয় কালী! তোমাদের এক এক জনের দাপটে ধরা কাঁপবে। … জয় কালী, জয় কালী! আবার onward, forward (এগিয়ে চল, এগিয়ে যাও)! ওয়া গুরু, জয় মা, জয় মা; কালী, কালী, কালী! রোগ, শোক, আপদ, দুর্বলতা, সব গেছে তোমাদের! মহাবিজয়, মহালক্ষ্মী, মহাশ্রী তোমাদের! মাভৈঃ মাভৈঃ। ফাঁড়া উতরে গেছে, মাভৈঃ! জয় কালী, জয় কালী!

বিবেকানন্দ

পুঃ—আমি মায়ের দাস, তোমরা মায়ের দাস—আমাদের কি নাশ আছে, ভয় আছে? অহঙ্কার–—মনে যেন না আসে, ভালবাসা—যেন না যায় মন থেকে। তোমাদের কি নাশ আছে?—মাভৈঃ! জয় কালী, জয় কালী!

৪৪৪

21 West 34 St.
নিউ ইয়র্ক
২১ নভেম্বর, ১৮৯৯

প্রিয় ব্রহ্মানন্দ,
হিসাব ঠিক আছে। আমি সে-সব মিসেস বুলের হাতে সঁপে দিয়েছি এবং তিনি বিভিন্ন দাতাকে হিসাবের বিভিন্ন অংশ জানাবার ভার নিয়েছেন। আগেকার কঠোর চিঠিগুলিতে আমি যা লিখেছি, তাতে কিছু মনে কর না। প্রথমতঃ ওতে তোমার উপকার হবে—এর ফলে তুমি ভবিষ্যতে যথানিয়মে কেতাদুরস্ত হিসাব রাখতে শিখবে এবং গুরুভাইদেরও এটা শিখিয়ে নেবে। দ্বিতীয়তঃ এই সব ভর্ৎসনাতেও যদি তোমরা সাহসী না হও, তাহলে তোমাদের সব আশা ছেড়ে দিতে হবে। আমি চাই তোমরা (কাজ করতে করতে) মরেও যাও, তবু তোমাদের লড়তে হবে। সৈন্যের মত আজ্ঞাপালন করে মরে যাও এবং নির্বাণ লাভ কর, কিন্তু কোন প্রকার ভীরুতা চলবে না।

কিছুদিনের মত আমার একটু গা-ঢাকা দেবার আবশ্যক হয়ে পড়েছে। সে সময় যেন আমায় কেউ পত্র না লেখে এবং খোঁজ না করে। আমার স্বাস্থ্যের জন্য এটি একান্ত আবশ্যক। আমার স্নায়ুগুলি দুর্বল হয়ে গেছে—এই মাত্র, আর কিছু নয়।

তোমাদের সর্বাঙ্গীণ কল্যাণ হোক। আমার রূঢ়তার জন্য মন খারাপ কর না। মুখে যা-ই থাকুক—তুমি তো আমার হৃদয় জান। তোমাদের সর্বপ্রকার শুভ হোক। বিগত প্রায় এক বৎসর আমি যেন একটা ঝোঁকে চলেছি। এর কারণ কিছু জানি না। ভাগ্যে এই নরক-যন্ত্রণা ভোগ ছিল—আর তা হয়ে গেছে। আমি সত্যই এখন আগের চেয়ে অনেক ভাল। প্রভু তোমাদের সহায় হোন! আমি চিরবিশ্রামের জন্য শীঘ্রই হিমালয়ে যাচ্ছি। আমার কাজ শেষ হয়েছে। ইতি

 

সতত প্রভুপদাশ্রিত
তোমাদের
বিবেকানন্দ

পুঃ—মিসেস বুল তোমাদের তাঁর ভালবাসা জানাচ্ছেন।