০৭. জগৎ(১)

[নিউইয়র্কে প্রদত্ত বক্তৃতা ১৯শে জানুআরি, ১৮৯৬]

সুন্দর কুসুমরাশি চতুর্দিকে সুবাস ছড়াইতেছে, প্রভাতের সূর্য অতি সুন্দর লোহিতবর্ণ ধরিয়া উঠিতেছে। প্রকৃতি নানা বিচিত্র বর্ণে সজ্জিত হইয়া পরম রমণীয় হইয়াছে। সমগ্র জগৎই সুন্দর, আর মানুষ পৃথিবীতে আসিয়া অবধি এই সৌন্দর্য সম্ভোগ করিতেছে। গম্ভীরভাবব্যঞ্জক ও ভয়োদ্দীপক শৈলমালা, খরস্রোতা সমুদ্রগামিনী স্রোতস্বিনী, পদচিহ্নহীন মরুদেশ, অনন্ত অসীম সাগর, তারকামণ্ডিত গগন—এ-সকলই গম্ভীরভাবপূর্ন ও ভয়োদ্দীপক, অথচ মনোহর; প্রকৃতি-নামক সমুদয় সত্তা স্মরণাতীত কাল হইতে মানবমনের উপর কাজ করিতেছে,মানব চিন্তার উপর ক্রমাগত প্রভাব বিস্তার করিতেছে, আর ঐ প্রভাবের প্রতিক্রিয়াস্বরূপ ক্রমাগত মানবহৃদয়ে এই প্রশ্ন উঠিতেছে-এগুলি কি? এবং ঐগুলির উৎপত্তিই বা কোথায়? মানবের অতি প্রাচীন রচনা বেদের প্রাচীনতম ভাগেও এই প্রশ্ন জিজ্ঞাসিত হইয়াছে দেখিতে পাই। কোথা হইতে ইহা আসিল? যখন ‘অস্তি, নাস্তি’ কিছুই ছিলনা, ‘অন্ধকার দ্বারা অন্ধকার আবৃত’ ছিল, তখন কে এই জগৎ সৃষ্টি করিল? কেমন করিয়াই বা করিল? কে এই রহস্য জানে? বর্তমান সময় পর্যন্ত এই প্রশ্ন চলিয়া আসিয়াছে; লক্ষ লক্ষ বার এই প্রশ্নের উত্তর দিবার চেষ্টা হইয়াছে, আরও লক্ষ লক্ষ বার উহার উত্তর দিতে হইবে। ঐ প্রত্যেক উত্তরই যে ভ্রমপূর্ণ, তাহা নহে। প্রত্যেক উত্তরে কিছু না কিছু সত্য আছে-কালের আবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ঐ সত্যও ক্রমশঃ বল সংগ্রহ করিতেছে। আমি ভারতের প্রাচীন দার্শনিকগণের নিকট ঐ প্রশ্নের উত্তর সংগ্রহ করিয়াছি, তাহা বর্তমান কালের জ্ঞানের সহিত মিলাইয়া আপনাদের সমক্ষে স্থাপন করিবার চেষ্টা করিব।

আমরা দেখিতে পাই; এই প্রাচীনতম প্রশ্নের কতকগুলি বিষয় পূর্বেই মীমাংসিত হইয়াছে। প্রথম বিষয় এই : এমন এক সময় ছিল, ‘যখন অস্তি-নাস্তি কিছুই ছিল না, জগৎ ছিল না, এই গ্রহ-জ্যোতিষ্কগণ, সাগর মহাসাগর ,নদী শৈলমালা, নগর গ্রাম ,মনুষ্য ইতরপ্রাণী উদ্ভিদ, বিহঙ্গসহ আমাদের জননী বসুন্ধরা, এই অনন্ত বিচিত্র সৃষ্টি ছিল না—এ বিষয় পূর্ব হইতেই জানা ছিল। আমরা কি এ বিষয়ে নিঃসন্দিগ্ধ? কি করিয়া মানুষ এই সিদ্ধান্তে উপনীত হইল, তাহা আমরা বুঝিতে চেষ্টা করিব। মানুষ নিজের চতুর্দিকে কি দেখে? একটি ক্ষুদ্র উদ্ভিদ লও। মানুষ দেখে, উদ্ভিদটি ধীরে ধীরে মাটি ঠেলিয়া উঠিতেছে, বাড়িতে বাড়িতে অবশেষে হয়তো একটি প্রকাণ্ড বৃক্ষ হইয়া দাঁড়ায়,আবার মরিয়া যায়-রাখিয়া যায় কেবল বীজ।উহা যেন ঘুরিয়া ফিরিয়া একটি বৃত্ত সম্পূর্ণ করে।বীজ হইতে উহা আসে,বৃক্ষ হইয়া দাঁড়ায়, অবশেষে বীজে উহার পুনঃপরিণতি। একটি পাখিকে দেখ, কেমন উহা ডিম হইতে জন্মায়, সুন্দর পাখির রূপ ধরে, কিছুদিন বাঁচিয়া থাকে, পরে আবার মরিয়া যায়, রাখিয়া যায় কেবল কতকগুলি ডিম, ভবিষ্যৎ পক্ষিকুলের বীজ। তির্যগ‍্জাতি সম্বন্ধেও এইরূপ, মানুষ সম্বন্ধেও তাহাই। প্রত্যেক পদার্থেরই যেন কতকগুলি বীজ—কতকগুলি মূল উপাদান—কতকগুলি সূক্ষ্ম আকার হইতে আরম্ভ, এগুলি স্থূল হইতে স্থূলতর হইতে থাকে, কিছুকালের জন্য ঐরূপে চলে , পুণরায় সূক্ষ্মরূপে চলিয়া গিয়া উহাদের লয় হয়। বৃষ্টির ফোঁটাটি, যাহার মধ্যে সুন্দর সূর্যকিরণ খেলা করিতেছে, বাতাসে অনেক দূরে চলিয়া গিয়া পাহাড়ে পৌঁছায়, সেখানে বরফে পরিণত হয়, আবার জল হয়, আবার শত শত মাইল ঘুরিয়া উহার উৎপত্তিস্থান সমুদ্রে মিলিত হয়। আমাদের চারিদিকের প্রকৃতির সকল বস্তু সম্বন্ধেই এইরূপ; আর আমরা জানি বর্তমানকালে হিমশিলা ও নদীগুলি বড় বড় পর্বতের উপর কাজ করিতেছে, ধীরে অথচ নিশ্চিতরূপে পর্বতগুলি চূর্ণ করিতেছে, গুঁড়াইয়া বালি করিতেছে, সেই বালি আবার সমুদ্রে বহিয়া চলিতেছে-সমুদ্রতলে স্তরে স্তরে জমিতেছে, পরিশেষে আবার পাহাড়ের মতো শক্ত হইতেছে, স্তূপীকৃত হইয়া ভবিষ্যতে পর্বত হইবে।আবার উহা পিষ্ট হইয়া গুঁড়া হইবে-এইরূপ চলিবে। বালুকা হইতে এই শৈলমালার উদ্ভব, আবার বালুকায় পরিণতি। বড় বড় জ্যোতিষ্ক সম্বন্ধেও এই কথা; আমাদের এই পৃথিবীও নীহরিকাময় পদার্থ হইতে আসিয়াছে—ক্রমশঃ শীতল হইতে শীতলতর হইয়া বিশেষ আকৃতিবিশিষ্ট আমাদের ভবিষ্যতে উহা আবার শীতল হইতে শীতলতর হইয়া নষ্ট হইবে , খণ্ড খণ্ড হইবে, শেষে সেই মূল নীহারকাময় সূক্ষ্মরূপে পরিণত হইবে। প্রতিদিন আমাদের সম্মুখে ইহা ঘটিতেছে। স্মরণাতীত কাল হইতেই ইহা ঘটিতেছে।স্মরণাতীত কাল হইতেই ইহা হইতেছে। ইহাই মানুষের ইতিহাস , ইহাই প্রকৃতির সমগ্র ইতিহাস।ইহাই জীবনের সমগ্র ইতিহাস।নিবাস-ভূমি হইয়াছে।


১ ঋগ্বেদ—নাসদীয় সূক্ত

যদি ইহা সত্য হয় যে, প্রকৃতি সর্বত্রই একরূপ; যদি ইহা সত্য হয় এ পর্যন্ত কোন মনুষ্যজ্ঞানই ইহা খণ্ডন করে নাই—যে, একটি ক্ষুদ্র বালুকণা যে-প্রণালী ও যে-নিয়মে সৃষ্ট, প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড সূর্য তারা এমন কি সমুদয় ব্রহ্মাণ্ডও সেই একই প্রণালীতে—একই নিয়মে সৃষ্ট; ইহা যদি সত্য হয় যে, একটি পরমাণু যে কৌশলে নির্মিত, সমুদয় জগৎও সেই কৌশলে নির্মিত; যদি ইহা সত্য হয় যে, একই নিয়ম সমুদয় জগতে প্রতিষ্ঠিত, তবে প্রাচীন বৈদিক ভাষায় আমরা বলিতে পারি—’একখন্ড—মৃত্তিকাকে জানিয়া আমরা জগতের সমস্ত মৃত্তিকাকে জানিতে পারি।’ একটি ক্ষুদ্র উদ্ভিদ লইয়া উহার জীবন-চরিত আলোচনা করিলে আমরা ব্রহ্মাণ্ডের স্বরূপ জানিতে পারি। একটি বালুকণার গতি পর্যবেক্ষণ করিলে সমুদয় জগতের রহস্য জানিতে পারা যাইবে। সুতরাং আমাদের পূর্ব আলোচনার ফল সমগ্র ব্রহ্মাণ্ডের উপর প্রয়োগ করিয়া প্রথমতঃ ইহাই পাইতেছি যে, আদি ও অন্ত প্রায় সদৃশ্য। পর্বতের উৎপত্তি বালুকা হইতে, বালুকায় আবার উহার পরিণতি; নদী বাষ্প হইতে আসে, আবার বাষ্পে যায়; উদ্ভিদ‍্জীবন আসে বীজ হইতে, আবার বীজেই যায়; মনুষ্যজীবন আসে জীবাণু হইতে, আবার জীবাণুতেই ফিরিয়া যায়। নক্ষত্রপুঞ্জ, নদী, গ্রহ-উপগ্রহ নীহারিকাময় অবস্থা হইতে আসিয়াছে,আবার সেই নীহারিকায় লয় পায়। ইহা হইতেই আমরা শিখি কি? শিখি এই যে, ব্যক্ত আর্থাৎ স্থূল অবস্থা—কার্য; আর সূক্ষ্মভাব—উহার কারণ। সর্ব দর্শনের জনকস্বরূপ মহর্ষি কপিল অনেক দিন পূর্বে প্রমাণ করিয়াছেন, ‘নাশঃ কারণলয়ঃ’।

যদি এই টেবিলটির নাশ হয় তো উহা কেবল উহার কারণরূপে ফিরিয়া যায় মাত্র—সেই সূক্ষ্মরূপও পরমাণুতে ফিরিয়া যাইবে, যাহাদের সম্মিলনে এই টেবিল নামক পদার্থটি উৎপন্ন হইয়াছিল। মানুষ যখন মরে, তখন যে-সকল পদার্থে তাহার দেহ নির্মিত, সেইগুলিতেই ফিরিয়া যায়। এই পৃথিবীর ধ্বংস হইলে যে পদার্থ-সমষ্টি ইহাকে এই আকার দিয়াছিল, তাহাতে ফিরিয়া যাইবে। ইহাকেই বলে নাশ-কারণে লয়। সুতরাং আমরা শিখিলাম,কার্য কারণের সহিত অভেদ-ভিন্ন নহে,কারণটিই রূপ-বিশেষ ধারণ করিয়া কার্য নামে পরিচিত হয়। যে উপাদানগুলিতে ঐ টেবিলের উৎপত্তি, তাহাই কারণ; আর টেবিলটি কার্য, এবং ঐ কারণগুলি এখানে টেবিলরূপে বর্তমান।এই গেলাসটি একটি কার্য -উহার কতকগুলি কারণ ছিল,সেই কারণগুলি এই কার্যে এখনও বর্তমান দেখিতেছি। কাচ নামক কতকটা জিনিস আর সেই সঙ্গে গঠনকারীর হাতের শক্তি নিমিত্ত ও উপাদান এই দুইটি কারণ মিলিয়া গেলাস-নামক এই আকারটি হইয়াছে। ঐ দুই কারণই উহাতে বর্তমান। যে শক্তিটি কোন যন্ত্রের চাকায় ছিল তাহা সংহতিশক্তিরূপে ইহাতে রহিয়াছে, তাহা না থাকিলে গেলাসের ঐ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র খণ্ডগুলির সব খসিয়া পড়িবে এবং উহার উপাদান কাচও ইহাতে বর্তমান। গেলাসটি কেবল ঐ সূক্ষ্ম কারণগুলির আর একরূপে পরিণতি এবং যদি এই গেলাসটি ভাঙিয়া ফেলা হয়, তবে যে শক্তিটি সংহতিরূপে উহাতে বর্তমান ছিল, তাহা ফিরিয়া নিজ উপাদানে মিশিবে, আর গেলাসের ক্ষুদ্র খণ্ডগুলি আবার পূর্বরূপ ধরিবে এবং সেই রূপেই থাকিবে, যতদিন না পুনরায় নূতন আকার লাভ করে।


১ ছান্দোগ্য উপ., ৬/১/৪

অতএব আমরা দেখিতে পাইলাম, কার্য কখন কারণ হইতে ভিন্ন নয়; উহা সেই কারণে পুনরাবির্ভাব মাত্র। তাহার পর আমরা শিখিলাম এই ক্ষুদ্র বিশেষ বিশেষ রূপ বা আকৃতি -যেগুলিকে আমরা উদ্ভিদ তির্যগ‍্জাতি বা মানব বলি, সেগুলি অনন্তকাল ধরিয়া উঠিয়া পড়িয়া ঘুরিয়া ফিরিয়া আসিতেছে। বীজ হইতে বৃক্ষ হয়, বৃক্ষ আবার বীজ হয়, আবার উহা এক বৃক্ষ হয়—আবার অন্য বীজ হয়, আবার এক বৃক্ষ হয়—এইরূপ চলিতেছে, ইহার শেষ নাই। জলবিন্দু পাহাড়ের গা বাহিয়া সমুদ্রে যায়, আবার বাষ্প হইয়া উঠে–পাহাড়ে যায়, আবার সমুদ্রে ফিরিয়া আসে। উঠিতেছি, পড়িতেছে–চক্র ঘুরিতেছে। সমুদয় জীবন সম্বন্ধেই এইরূপ—সমুদয় অস্তিত্ব, যাহা কিছু দেখিতে শুনিতে ভাবিতে বা কল্পনা করিতে পারি,

যাহা কিছু আমাদের জ্ঞানের সীমার মধ্যে তাহাই এই ভাবে চলিতেছে ঠিক মনুষ্যদেহে নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের মতো। সমুদয় সৃষ্টিই এইরূপে চলিয়াছে, একটি তরঙ্গ উঠিতেছে, একটি পড়িতেছে, আবার উঠিয়া আবার পড়িতেছে। প্রত্যেক তরঙ্গেরই সঙ্গে সঙ্গে একটি করিয়া গহ্বর, প্রত্যেক গহ্বরের সঙ্গে সঙ্গে একটি করিয়া তরঙ্গ। সর্বত্র একরূপ বলিয়া সমগ্র ব্রহ্মাণ্ডেই বিভিন্ন অংশের মধ্যে সঙ্গতি থাকার দরুন একই নিয়ম খাটিবে। অতএব আমরা দেখিতেছি যে, সমগ্র ব্রহ্মাণ্ডই যেন এককালে কারণে লীন হইতে বাধ্য;সূর্য চন্দ্র গ্রহ তারা পৃথিবী মন শরীর-যাহা কিছু এই ব্রহ্মান্ডে আছে, সকল বস্তুই যেন নিজ সূক্ষ্ম কারণে লীন বা অন্তর্হিত হইবে-আপাতদৃষ্টিতে বিনষ্ট হইবে। বাস্তবিক কিন্তু উহারা সূক্ষ্মরূপে উহাদের কারণে থাকিবে; এইসব সূক্ষ্মরূপ হইতে আবার তাহারা পৃথিবী চন্দ্র সূর্য তারা রূপে বাহির হইবে।

এই উত্থান-পতন সম্বন্ধে আর একটি বিষয় জানিবার আছে। বৃক্ষ হইতে বীজ আসে। বীজ তৎখণাৎ বৃক্ষ হয় না। উহার কতকটা বিশ্রামের বা অতিসূক্ষ্ম অব্যক্ত কার্যের জন্য সময়ের প্রয়োজন। বীজকে খনিকক্ষন মাটির নীচে থাকিয়া কার্য করিতে হয়। বীজ নিজেকে খণ্ড খণ্ড করিয়া ফেলে, নিজেকে যেন খানিকটা অধঃপতিত করে, এবং ঐ অবনতি হইতে উহার পুনর্জন্ম হইয়া থাকে। অতএব এই সমগ্র ব্রহ্মাণ্ডকেই কিছু সময় অদৃশ্য ও অব্যক্তভাবে সূক্ষ্মরূপে কার্য করিতে হয়, যাহাকে প্রলয় বা সৃষ্টির পূর্বাবস্থা বলে, তাহার পর আবার সৃষ্টি হয়। জগৎপ্রবাহের একটি প্রকাশকে অর্থাৎ সূক্ষ্ম ভাবে ইহার পরিণতি, কিছুকাল সেই অবস্থায় স্থিতি এবং পুনরাবির্ভাবকে সংস্কৃতে ‘কল্প’ বলে। সমগ্র ব্রহ্মাণ্ডই এইরূপে চলিয়াছে। বিশাল ব্রহ্মাণ্ড হইতে উহার অন্তর্বর্তী প্রত্যেক পরমাণু পর্যন্ত সব জিনিসই এই তরঙ্গাকারে চলিয়াছে।

এখন আবার একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন আসিল—বিশেষতঃ বর্তমান কালের পক্ষে। আমরা দেখিতেছি সূক্ষ্মতর রূপগুলি ধীরে ধীরে ব্যক্ত হইতেছে, ক্রমশঃ স্থূল হইতে স্থূলতর হইতেছে। আমরা দেখিয়াছি যে, কারণ ও কার্য অভেদ—কার্য কারণের রূপান্তর মাত্র। অতএব এই সমগ্র ব্রহ্মাণ্ড শূন্য হইতে উদ্ভূত হইতে পারে না। কারণ ব্যতিত কিছুই আসিতে পারে না; শুধু তাহা নহে, কারণই কার্যের ভিতর আর একরূপে বর্তমান। তবে এই ব্রহ্মাণ্ড কোন‍্ বস্তু হইতে উদ্ভুত হইয়াছে? পূর্ববর্তী সূক্ষ্ম ব্রহ্মাণ্ড হইতে। মানুষ কোন‍্ বস্তু হইতে উদ্ভুত? পূর্ববর্তী সূক্ষ্মরূপ হইতে। বৃক্ষ কোথা হইতে হইল? বীজ হইতে। সমুদয় বৃক্ষটি বীজে বর্তমান ছিল—উহা ব্যক্ত হইয়াছে মাত্র। অতএব এই সমগ্র ব্রহ্মাণ্ড এই জগতেরই সূক্ষ্মাবস্থা হইতে সৃষ্ট হইয়াছে। এখন উহা ব্যক্ত হইয়াছে মাত্র। উহা পুনরায় ঐ সূক্ষ্মরূপে যাইবে, আবার ব্যক্ত হইবে। এখন আমরা দেখিলাম, সূক্ষ্মরূপগুলি ব্যক্ত হইয়া স্থূল হইতে স্থূলতর হয়, যতদিন না উহারা উহাদের চরম সীমায় পৌঁছে; চরমে পৌঁছিলে তাহারা আবার সূক্ষ্ম হইতে সূক্ষ্মতর হয়। এই সূক্ষ্ম হইতে আবির্ভাব, ক্রমশঃ স্থূল হইতে স্থূলতররূপে পরিণতি কেবল যেন উহাদের অংশগুলির অবস্থান-পরিবর্তন—ইহাকেই বর্তমানকালে ‘ক্রমবিকাশ’-বাদ বলে।ইহা অতি সত্য,সম্পূর্ণরূপে সত্য;আমরা আমাদের জীবনে ইহা দেখিতেছি; বিচারশক্তিসম্পন্ন কোন মানুষই সম্ভবতঃ এই ‘ক্রমবিকাশ’-বাদীদের সহিত বিবাদ করিবেন না। কিন্তু আমাদিগকে আরও একটি বিষয় জানিতে হইবে–তাহা এই যে, প্রত্যেক ক্রমবিকাশের পূর্বেই একটি ক্রমসঙ্কোচ-প্রক্রিয়া বর্তমান। বীজ বৃক্ষের জনক বটে, কিন্তু অপর এক বৃক্ষ আবার ঐ বীজের জনক। বীজই সেই সূক্ষ্মরূপ, যাহা হইতে বৃহৎ বৃক্ষটি আসিয়াছে, আবার আর একটি প্রকাণ্ড বৃক্ষ ঐ বীজরূপে ক্রম-সঙ্কুচিত হইয়াছে। সমুদয় বৃক্ষটিই ঐ বীজে বর্তমান। শূন্য হইতে কোন বৃক্ষ জন্মিতে পারে না, কিন্তু আমরা দেখিতেছি বৃক্ষ বীজ হইতে উৎপন্ন হয়, আর বীজবিশেষ হইতে বৃক্ষবিশেষেই উৎপন্ন হয়, অন্য বৃক্ষ হয় না। ইহাতেই প্রমাণিত হইতেছে যে, সেই বৃক্ষের কারণ ঐ বীজ—কেবল ঐ বীজমাত্র; আর সেই বীজে সমুদয় বৃক্ষটিই রহিয়াছে। সমুদয় মানুষটাই একটি জীবাণুর ভিতরে, ঐ জীবাণুই আবার ধীরে ধীরে অভিব্যক্ত হইয়া মানবাকারে পরিণত হয়। সমুদয় ব্রহ্মাণ্ডই—সূক্ষ্ম ব্রহ্মাণ্ডে ছিল। সবই কারণে-উহার সূক্ষ্মরূপে রহিয়াছে। অতএব ‘ক্রমবিকাশ’-বাদ সত্য। তবে ঐ সঙ্গে ইহাও বুঝিতে হইবে যে, প্রত্যেক ক্রমবিকাশের পূর্বেই একটি ক্রমসঙ্কোচ-প্রক্রিয়া রহিয়াছে; অতএব যে ক্ষুদ্র অণুটি পরে মহাপরুষ হইল, উহা প্রকৃতপক্ষে সেই মহাপুরুষেরই ক্রমসঙ্কুচিত ভাব, উহাই পরে মহাপুরুষরূপে ক্রমবিকশিত হয়।যদি ইহাই সত্য হয়,তবে ক্রমবিকাশবাদীদের (Darwin’s Evolution) সহিত

আমাদের কোন বিবাদ নাই, কারণ আমরা ক্রমশ দেখিব, যদি তাঁহারা এই ক্রমসঙ্কোচ-প্রক্রিয়াটি স্বীকার করেন, তবে তাঁহারা ধর্মের বিনাশক না হইয়া সহায়ক হইবেন।

আমরা দেখিলাম শূন্য হইতে কিছুর উৎপত্তি হয় না। সকল জিনিসই অনন্তকাল ধরিয়া রহিয়াছে এবং অনন্তকাল ধরিয়া থাকিবে। কেবল তরঙ্গের ন্যায় একবার উঠিতেছে, আবার পড়িতেছে। সূক্ষ্ম অব্যক্তভাবে একবার লয়, আবার স্থূল ব্যক্ত ভাবে প্রকাশ, সমুদয় প্রকৃতিতেই এই ক্রমসঙ্কোচ ও ক্রমবিকাশ-প্রক্রিয়া চলিতেছে। সুতরাং সমুদয় ব্রহ্মাণ্ড প্রকাশের পূর্বে অবশ্যই ক্রমসঙ্কুচিত বা অব্যক্ত অবস্থায় ছিল, এখন বিভিন্নরূপে ব্যক্ত হইয়াছে-আবার ক্রমসঙ্কুচিত হইয়া অব্যক্তভাব ধারণ করিবে। উদাহরণ স্বরূপ একটি ক্ষুদ্র উদ্ভিদের জীবন ধর। আমরা দেখি দুইটি বিষয় একত্র মিলিত হইয়াই ঐ উদ্ভিদ‍্কে এক অখণ্ড বস্তুরূপে প্রতীত করাইতেছে-উহার উৎপত্তি ও বিকাশ এবং উহার ক্ষয় ও বিনাশ। এই দুইটি মিলিয়াই উদ্ভিদ‍্-জীবন নামক এই একত্ব বিধান করিতেছে। এইরূপে ঐ উদ্ভিদ‍্-জীবনকে প্রাণ-শৃঙ্খলের একটি পর্ব বলিয়া ধরিয়া আমরা সমুদয় বস্তুরাশিকেই এক প্রাণপ্রবাহ বলিয়া কল্পনা করিতে পারি-জীবাণু হইতে উহার আরম্ভ এবং পূর্ণমানবে উহার সমাপ্তি। মানুষ ঐ শৃঙ্খলের একটি পর্ব; আর যেমন ক্রমবিকাশবাদীরা বলেন—নানারূপ বানর, তারপর আরও ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রানী এবং উদ্ভিদ্‌গণ যেন ঐ প্রাণ-শৃঙ্খলের অন্যান্য পর্ব। এখন যে ক্ষুদ্রতম কোষ হইতে আমরা আরম্ভ করিয়াছিলাম, সেখান হইতে এই সমুদয়কে এক প্রাণপ্রবাহ বলিয়া ধর, আর প্রত্যেক ক্রমবিকাশের পূর্বেই যে ক্রমসঙ্কোচ-প্রক্রিয়া বিদ্যমান, ইতঃপূর্বে লব্ধ ঐ নিয়ম এস্থলে প্রয়োগ করিলে আমাদিগকে স্বীকার করিতে হইবে যে, অতি নিম্নতম জন্তু হইতে সর্বোচ্চ পূর্ণতম মানুষ পর্যন্ত সকল শ্রেনীই অবশ্য অপর কিছুর ক্রমসঙ্কুচিত অবস্থা।কিসের ক্রমসঙ্কোচ?ইহাই প্রশ্ন।কোন পর্দাথ ক্রমসঙ্কুচিত হইয়াছিল? ক্রমবিকাশবাদী বলিবেনঃ ইহা যে ঈশ্বরের ক্রমসঙ্কুচিত অবস্থা–তোমাদের এ-ধারণা ভুল। কারণ তোমরা বলো, চৈতন্যই জগতের স্রষ্টা, কিন্তু আমরা প্রতিদিন দেখিতেছি যে, চৈতন্য অনেক পরে আসে। মানুষে ও উচ্চতর জন্তুতেই কেবল আমরা চৈতন্য দেখিতে পাই, কিন্তু এই চৈতন্য জন্মিবার পূর্বে এই জগতে লক্ষ লক্ষ বর্ষ অতীত হইয়াছে।

যাহা হউক, এই ক্রমবিকাশবাদীদের আপত্তি যুক্তিযুক্ত নয়। আমরা এই মাত্র যে নিয়ম আবিষ্কার করিলাম, তাহা প্রয়োগ করিয়া দেখা যাক—কি সিদ্ধান্ত দাঁড়ায়। বীজ হইতে বৃক্ষের উদ্ভব আবার বীজে উহার পরিণাম—সুতরাং আরম্ভ ও পরিণাম একই। পৃথিবীর উৎপত্তি তাহার কারণ হইতে, আবার কারণেই উহার বিলয়। সকল বস্তু সম্বন্ধেই এই কথা-আমরা দেখতেছি, আদি অন্ত উভয়ই সমান। এই সমুদয় শৃঙ্খলের শেষ কি? আমরা জানি, আরম্ভ জানিতে পারিলে পরিণামও জানিতে পারিব। এইরূপে অন্ত জানিতে পারিলেই আদি জানিতে পারিব। এই সমুদয় ‘ক্রমবিকাশশীল’ জীব-প্রবাহের -যাহারা এক প্রান্ত জীবণু,অপর প্রান্তে পূর্ণমানব -এই-সবকে একটি জীবন বলিয়া ধর। এই শ্রেণীর অন্তে আমরা পূর্ণ মানবকে দেখিতেছি, সুতরাং আদিতেও যে তিনি অবস্থিত ইহা নিশ্চিত। অতএব ঐ জীবাণু অবশ্যই উচ্চতম চৈতন্যের ক্রমসঙ্কুচিত অবস্থা। তোমরা ইহা স্পষ্টরূপে না দেখিতে পারো, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সেই ক্রমসঙ্কুচিত চৈতন্যই নিজেকে অভিব্যক্ত করিতেছে, আর এইরূপে নিজেকে অভিব্যক্ত করিয়া চলিবে, যতদিন না উহা পূর্ণতম মানবরূপে অভিব্যক্ত হয়। এই তত্ত্ব গণিতের দ্বারা নিশ্চিতরূপে প্রমাণ করা যাইতে পারে। ‘শক্তির নিত্যতা’ নিয়ম (Low of Conservation of Energy) যদি সত্য হয়, তবে অবশ্যই স্বীকার করিতে হইবে যে, যদি তুমি কোন যন্ত্রে পূর্ব হইতেই কোন শক্তি-প্রয়োগ না করিয়া থাকো, তবে তুমি উহা হইতে কোন কার্যই পাইতে পার না। তুমি ইঞ্জিনে জল ও কয়লারূপে যতটুকু শক্তি প্রয়োগ কর, উহা হইতে ঠিক ততটুকু কার্য পাইয়া থাকো, এতটুকু বেশী নয়, কমও নয়। আমি আমার দেহের ভিতরে বায়ু খাদ্য ও অন্যান্য পদার্থরূপে যতটুকু শক্তি প্রয়োগ করিয়াছি, ঠিক ততটুকু কার্য করিতে সমর্থ হই। কেবল ঐ শক্তিগুলি অন্যরূপে পরিণত হইয়াছে মাত্র। এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে একবিন্দু জড় বা এতটুকুও শক্তি বাড়াইতে অথবা কমাইতে পারা যায় না। যদি তাই হয়, তবে এই চৈতন্য কি? যদি উহা জীবাণুতে বর্তমান না থাকে, তবে উহাকে অবশ্যই অকস্মাৎ উৎপন্ন বলিয়া স্বীকার করিতে হইবে–তাহা হইলে ইহাও স্বীকার করিতে হয় যে, ‘অসৎ’ (কিছু না) হইতে ‘সতে’র (কিছুর) উৎপত্তি হয়, কিন্তু তাহা অসম্ভব। তাহা হইলে ইহা একেবারে নিঃসন্দেহে প্রমাণিত হইতেছে যে–যেমন অন্য অন্য বিষয়ে দেখা যায়, যেখানে আরম্ভ

সেইখানেই শেষ; তবে কখন অব্যক্ত, কখন বা ব্যক্ত; সেইরূপ পূর্ণমানব, মুক্তপুরুষ, দেবমানব, যিনি প্রকৃতির নিয়মের বাহিরে গিয়াছেন, যিনি সমুদয় অতিক্রম করিয়াছেন, যাঁহাকে আর এই জন্মমৃত্যুর ভিতর দিয়া যাইতে হয় না, যাঁহাকে খ্রীষ্টানরা খ্রীষ্টমানব বলেন, বৌদ্ধগণ বুদ্ধমানব বলেন,যোগীরা মুক্ত বলেন, সেই পূর্ণমানব এই শৃঙ্খলের এক প্রান্ত, আর তিনিই ক্রমসঙ্কুচিত হইয়া শৃঙ্খলের অপর প্রান্তে জীবানুরূপে প্রকাশিত।

এখন এই ব্রহ্মাণ্ডের কারণ সম্বন্ধে কি সিদ্ধান্ত হইল—আলোচনা করা যাক। জগৎ-সম্বন্ধে মানুষের চরম ধারণা কি? চৈতন্য—এক অংশের সহিত অপর অংশের সামঞ্জস্য-বিধান, বুদ্ধির বিকাশ। প্রাচীন ‘উদ্দেশ্য-বাদ’ (Design Theory) এই ধারণারই অস্ফুট আভাস । আমরা জড়বাদীদের সহিত মানিয়া লইতেছি যে, চৈতন্যই জগতের শেষ বস্তু–সৃষ্টিক্রমের ইহাই শেষ বিকাশ,কিন্তু ঐ সঙ্গে আমরা ইহাও বলিয়া থাকি যে,ইহাই যদি শেষ বিকাশ হয়, তবে আদিতেও ইহা বর্তমান ছিল। জড়বাদী বলিতে পারেন—বেশ কথা, কিন্তু মানুষ জন্মিবার পূর্বে লক্ষ লক্ষ বর্ষ অতীত হইয়াছে, তখন তো জ্ঞানের অস্তিত্ব ছিল না। এ-কথায় আমাদের উত্তর এই, ব্যক্ত চৈতন্য তখন ছিল না বটে, কিন্তু অব্যক্ত চৈতন্য ছিল—আর সৃষ্টির শেষ—পূর্ণমানবরূপে প্রকাশিত চৈতন্য;তবে আদি কি ছিল ?আদিও সেই চৈতন্য।প্রথমে সেই চৈতন্যই ক্রমসঙ্কুচিত হয়,শেষে আবার উহাই ক্রমবিকশিত হয়। অতএব এই ব্রহ্মাণ্ডে এখন যে জ্ঞানরাশি অভিব্যক্ত হইতেছে, তাহার সমষ্টি অবশ্যই সেই ক্রমসঙ্কুচিত সর্বব্যাপী চৈতন্যের অভিব্যক্তি মাত্র। এই সর্বব্যাপী বিশ্বজনীন চৈতন্যের নাম ‘ঈশ্বর’। উহাকে অন্য যে-কোন নামে অভিহিত কর না কেন, ইহাই স্থির যে, আদিতে সেই অনন্ত বিশ্বব্যাপী চৈতন্য ছিলেন। সেই বিশ্বজনীন চৈতন্য ক্রমসঙ্কুচিত হইয়াছিলেন, আবার তিনিই নিজেকে ক্রমশঃ অভিব্যক্ত করিতেছেন—যতদিন না পূর্ণমানব, খ্রীষ্টমানব বুদ্ধমানবে পরিণত হন। তখন তিনি নিজ উৎপত্তি-স্থানে ফিরিয়া আসেন। এই জন্য সকল শাস্ত্রই বলেন, ‘আমরা তাঁহাতেই জীবিত, তাঁহাতেই চলি ফিরি, তাঁহাতেই আমাদের সত্তা।’১ এই জন্যই সকল শাস্ত্রই বলেন, ‘আমরা ঈশ্বর হইতে আসিয়াছি এবং তাঁহাতেই ফিরিয়া যাইব।’ বিভিন্ন পরিভাষা দেখিয়া ভয় পাইও না–পরিভাষায় যদি ভয় পাও, তবে তোমরা দার্শনিক হইবার যোগ্য হইবে না । এই বিশ্বব্যাপী চৈতন্যকেই তত্ত্ববিদ‍্গণ ‘ঈশ্বর’ বলিয়া থাকেন।


১ তৈত্তি. উপ., ৩/১

আমাকে অনেকে অনেকবার জিজ্ঞাসা করিয়াছেন : আপনি পুরাতন শব্দ ‘ঈশ্বর’ (God) ব্যবহার করেন কেন? ইহার উত্তর এই—পূর্বোক্ত বিশ্বব্যাপী চৈতন্য যত শব্দ ব্যবহূত হইতে পারে, তন্মধ্যে উহাই সর্বাপেক্ষা উত্তম। উহা অপেক্ষা ভাল শব্দ আর খুঁজিয়া পাইবে না , কারণ মানুষের সকল আশা-ভরসা, সকল সুখ ঐ এক শব্দে কেন্দ্রীভূত। এখন ঐ শব্দ পরিবর্তন করা অসম্ভব। যখন বড় বড় সাধু-মহাত্মা ঐরূপ শব্দ গড়েন, তখন তাঁহারা উহাদের অর্থ খুব ভালরূপেই বুঝিতেন। ক্রমে সমাজে যখন ঐ শব্দগুলি প্রচারিত হইয়া পড়িল, তখন অজ্ঞ লোকেরা ঐ শব্দগুলি ব্যবহার করতে লাগিল। তাহার ফলে শব্দগুলির মহিমা হ্রাসপ্রাপ্ত হইল। ‘ঈশ্বর’ শব্দটি স্মরণাতীত কাল হইতে আসিয়াছে, আর যাহা কিছু মহৎ ও পবিত্র, এবং এক সর্বব্যাপী চৈতন্যের ভাব ঐ শব্দের ভিতর রহিয়াছে। কোন নির্বোধ ঐ শব্দ-ব্যবহারে আপত্তি করিলেই কি উহা ত্যাগ করিতে বলো? একজন আসিয়া বলিবে আমার এই শব্দটি লও, অপরে আবার তাহার শব্দটি লইতে বলিবে। সুতরাং এই ধরণের বৃথা শব্দের কোন অন্ত থাকিবে না। তাই বলি, সেই প্রাচীন শব্দটিই ব্যবহার কর, কিন্তু মন হইতে কুসংস্কার দূর করিয়া দিয়া, এই মহৎ প্রাচীন শব্দের অর্থ কি-তাহা ভালোভাবে বুঝিয়া ঐ শব্দ আরও ভালোভাবে ব্যবহার কর। যদি তোমরা ‘ভাবানুষঙ্গ-বিধানে’র (Low of Association of Ideas) শক্তি সম্বন্ধে অবহিত হও, তবে জানিবে এই শব্দের সহিত নানাপ্রকার মহান‍্ ওজস্বী ভাব সংযুক্ত রহিয়াছে; লক্ষ লক্ষ মানুষ এই শব্দ ব্যবহার করিয়াছে, লক্ষ লক্ষ মানুষ ঐ শব্দের পূজা করিয়াছে, আর উহার সহিত যাহা কিছু অতি উচ্চ ও সুন্দর, যাহা কিছু যুক্তিযুক্ত, যাহা কিছু প্রেমাস্পদ, মনুষ্য-প্রকৃতিতে যাহা কিছু মহৎ ও সুন্দর, তাহাই যোগ করিয়াছে। অতএব উহা ঐ-সকল ভাবের উদ্দীপক কারণ স্বরূপ, সুতরাং উহাকে ত্যাগ করিতে পারা যায় না। যাহা হউক, আমি যদি আপনাদিগকে শুধু এই বলিয়া বুঝাইতে চেষ্টা করিতাম যে, ঈশ্বর জগৎ সৃষ্টি করিয়াছেন, তাহা হইলে আপনাদের নিকট উহা

কোনরূপ অর্থ প্রকাশ করিত না। তথাপি এই-সকল বিচারের পর আমরা সেই প্রাচীন পরম পুরুষের নিকটেই পৌঁছিলাম।

আমরা এখন দেখিলাম যে, জড় শক্তি মন চৈতন্য বা অন্যনামে পরিচিত বিভিন্ন জাগতিক শক্তি সেই বিশ্বব্যপী চৈতন্যেরই প্রকাশ। আমরা ভবিষ্যতে তাঁহাকে ‘পরম প্রভু’ বলিয়া অভিহিত করিব। যাহা কিছু দেখ, শোন বা অনুভব কর, সবই তাঁহার সৃষ্টি-ঠিক বলিতে গেলে, তাঁহারই পরিণাম—আরও ঠিক বলিতে গেলে বলিতে হয়, তিনি স্বয়ং। তিনি সূর্য ও তারকারূপে উজ্জ্বলভাবে প্রকাশ পাইতেছেন, তিনিই জননী বসুন্ধরা, তিনিই স্বয়ং সমুদ্র। তিনিই মৃদু বৃষ্টিধারারূপে পড়িতেছেন, তিনিই মৃদু বাতাস—যাহা আমরা নিঃশ্বাসের সহিত গ্রহণ করিতেছি,তিনিই দেহে শক্তিরূপে কার্য করিতেছেন।তিনিই বক্তৃতা,তিনিই বক্তা, তিনিই এই শ্রোতৃমণ্ডলী। তিনিই দেহে শক্তিরূপে কার্য করিতেছেন। তিনিই বক্তৃতাম তিনিই বক্তা, তিনিই এই শ্রোতৃমণ্ডলী। তিনিই এই বক্তৃতা-মঞ্চ—যাহার উপর আমি দণ্ডায়মান, তিনিই ঐ আলোক—যাহা দ্বারা আমি তোমাদের মুখ দেখিতেছি, এ-সবই তিনি। তিনি জগতের উপাদান ও নিমিত্ত কারণ, তিনিই ক্রমসঙ্কুচিত হইয়া অণু হন, আবার ক্রমবিকশিত হইয়া পুনরায় ঈশ্বর হন; তিনিই নীচে নামিয়া আসিয়া অতি নিম্নতম পরমাণু হন; আবার ধীরে ধীরে নিজস্বরূপ প্রকাশ করিয়া স্বরূপে পুনর্মিলিত হন—ইহাই জগতের রহস্য। ‘তুমিই পুরুষ, তুমিই স্ত্রী, তুমিই যৌবন-গর্বে ভ্রমণশীল যুবা, তুমিই কুমারী, তুমিই বৃদ্ধ—দণ্ড ধরিয়া কোনরূপে চলিতেছে, তুমিই সকল বস্তুতে – হে প্রভু, তুমিই সবকিছু’ –জগৎপ্রপঞ্চের এই ব্যাখ্যাতেই কেবল মানবযুক্তি মানববুদ্ধি পরিতৃপ্ত হয়। এক কথায় বলিতে গেলে, আমরা তাঁহা হইতেই জন্মগ্রহণ করি, তাঁহাতেই জীবিত এবং তাঁহাতেই আবার প্রত্যাবর্তন করি।


১ শ্বতাশ্ব. উপ., ৪/৩
২ তৈত্তি. উপ., ৩/১