০৫. পত্রাবলী ৪১৫-৪২৪

৪১৫*

[খেতড়ির মহারাজকে লিখিত]

মঠ, বেলুড়
২৬ অক্টোবর, ১৮৯৮

মহামান্য মহারাজ,
আপনার স্বাস্থ্যের জন্য আমি খুবই উদ্বিগ্ন। আমার খুব ইচ্ছা ছিল নাবার পথে আপনাকে দেখে যাব, কিন্তু আমার স্বাস্থ্য এমনভাবে ভেঙে পড়ল যে, একটুও দেরী না করে আমাকে সমতলে ছুটে আসতে হল। ভয় হচ্ছে, আমার হৃদযন্ত্রে কিছু গোলযোগ হয়েছে।

যা হোক, আপনার শারীরিক অবস্থা জানবার জন্য আমি খুবই ব্যগ্র। যদি আপনি ইচ্ছা করেন—খেতড়িতে আপনাকে দেখতে যাব। আপনার কল্যাণের জন্য আমি দিবারাত্র প্রার্থনা করছি। বিপদ কিছু ঘটলে হতাশ হবেন না, ‘মা’ই আপনাকে রক্ষা করবেন। আপনার বিস্তারিত সংবাদ আমাকে লিখবেন। … কুমার সাহেব কেমন আছে?

সর্ববিধ ভালবাসা ও চিরন্তন আশীর্বাদ।

সতত প্রভুসমীপে আপনার
বিবেকানন্দ

৪১৬*

[খেতড়ির মহারাজকে লিখিত]

মঠ, বেলুড়, হওড়া
নভেম্বর (?), ১৮৯৮

মহামান্য মহারাজ,
আপনার ও কুমারের স্বাস্থ্য ভাল আছে জেনে খুব আনন্দিত হলাম। এদিকে আমার হৃদ্‌যন্ত্রটা খুবই দুর্বল হয়ে পড়েছে। বায়ু-পরিবর্তনে আমার আর কোন উপকার হবে বলে মনে হয় না—গত চৌদ্দ বৎসর ধরে আমি এক-নাগাড়ে কোথাও তিনমাস থেকেছি বলে মনে পড়ে না। মনে হয় যদি কোন ক্রমে বেশ কয়েক মাস ধরে এক স্থানে থাকিতে পারি, তবেই আমার পক্ষে ভাল হবে। তার জন্য আমার কোন মাথাব্যথা নেই। যা হোক, আমি বুঝতে পারছি, এ জীবনে আমার কাজ শেষ হয়েছে। ভাল ও মন্দ, বেদনা ও আনন্দের মধ্য দিয়ে আমার জীবন-তরী বয়ে গিয়েছে। তার ফলে যে মহৎ শিক্ষাটি আমি লাভ করেছি, তা হল—জীবনটা দুঃখময়, দুঃখ বৈ আর কিছুই নেই। ‘মা’ই জানেন কোন্‌টি শ্রেয়। আমরা সকলেই কর্মের অধীন; কর্ম তার নিজের পথ করে নেয়—এর কোন ব্যতিক্রম নেই। জীবনে একটিমাত্র বস্তুই আছে, যা যে-কোন উপায়ে লাভ করতে হবে, সেটি হচ্ছে ভালবাসা। বিপুল ও অনন্ত ভালবাসা, আকাশের মত উদার ও সমুদ্রের মত গভীর—সেই হল জীবনে একটি বড় লাভ। যে তা পায়, সে ধন্য।

সতত প্রভুসমীপে আপনার
বিবেকানন্দ

৪১৭*

৫৭, রামকান্ত বসু ষ্ট্রীট, কলিকাতা
১২ নভেম্বর, ১৮৯৮

স্নেহের জো,
আগামীকাল রবিবার কয়েকজন বন্ধুকে সান্ধ্যভোজে নিমন্ত্রণ করেছি। … চায়ের সময় তোমাকে আশা করছি। তখন সব কিছুই প্রস্তুত থাকবে।

শ্রীমা আজ সকালে নূতন মঠ দেখতে যাচ্ছেন। আমি সেখানে যাচ্ছি। আজ বিকাল ৬টায় নিবেদিতা সভাপতিত্ব করবে। যদি তোমার ভাল লাগে এবং বুলও যদি ইচ্ছা করেন, তা হলে চলে এস।

সতত প্রভুসমীপে তোমার
বিবেকানন্দ

৪১৮*

[খেতড়ির মহারাজকে লিখিত]

মঠ, বেলুড়
১৫ ডিসেম্বর, ১৮৯৮

মহামান্য মহারাজ,
মিঃ দুলিচাঁদের নামে ৫০০-র অর্ডার সহ আপনার সহৃদয় লিপিখানি পেলাম। আজকাল আমি কিছুটা ভাল আছি। জানি না (স্বাস্থের) এই উন্নতি স্থায়ী হবে, কি না।

শুনলাম এই শীতে আপনি কলিকাতায় আসছেন। এ কথা কি সত্যি? নূতন বড়লাটাকে সম্মান জ্ঞাপন করতে অনেক রাজা আসছেন। কাগজ দেখে জানলাম শিখরের (Sikar) মহারাজা ইতোমধ্যেই এখানে এসেছেন।

আপনার ও আপনার স্বজনদের জন্য সর্বদা প্রার্থনা জানাই।

সতত প্রভুসমীপে আপনার
বিবেকানন্দ

৪১৯*

বেলুড়মঠ
১৫ ডিসেম্বর, ১৮৯৮

প্রিয়—,
… ‘মা’ই আমাদের একমাত্র পথপ্রদর্শক। আর যা কিছু ঘটছে বা ঘটবে, সে-সকল তাঁরই বিধানে।

তোমাদের
বিবেকানন্দ

৪২০*

[মিসেস ওলি বুলকে লিখিত]

বৈদ্যনাথ ধাম, দেওঘর
২৯ ডিসেম্বর, ১৮৯৮

প্রিয় ধীরামাতা,
আমি যে আপনার সহযাত্রী হতে পারব না, তা আপনি আগেই জেনেছেন। আপনার সঙ্গে যাবার মত শারীরিক শক্তি আমি সংগ্রহ করতে পারছি না। বুকে যে সর্দি জমেছিল তা এখনও আছে, আর তারই ফলে এখন আমি ভ্রমণে অক্ষম। মোটের উপর এখানে আমি ক্রমে সেরে উঠব বলেই আশা করি।

জানলাম, আমার ভগ্নী গত কয়েক বৎসর যাবৎ বিশেষ সংকল্প নিয়ে নিজের মানসিক উন্নতি সাধনের চেষ্টা করছে। বাঙলা সাহিত্যের ভেতর দিয়ে যা কিছু জানা সম্ভব—বিশেষ করে অধ্যাত্মবাদ সম্বন্ধে, সে-সবই সে শিখেছে, আর তার পরিমাণও বড় কম নয়। ইতোমধ্যে সে নিজের নাম ইংরেজী ও রোমান অক্ষরে সই করতে শিখেছে। এখন তাকে অধিকতর শিক্ষাদান বিশেষ মানসিক পরিশ্রম-সাপেক্ষ; সুতরাং সে কাজ থেকে আমি বিরত হয়েছি। আমি শুধু বিনা কাজে সময় কাটাতে চেষ্টা করছি এবং জোর করেই বিশ্রাম নিচ্ছি।

কয়েকদিনের জন্য আমি দূরে চলে গিয়েছিলাম। এখন আমি মহিলাদের সঙ্গে যোগ দিতে যাচ্ছি। তারপর যাত্রিদলটি যাচ্ছে কোন পাহাড়ের পিছনে এক বনের মধ্যে একটি শান্ত সুন্দর পরিবেশ, যেখানে কুলকুল করে ছোট নদী বয়ে চলেছে। সেখানে তারা দেবদারু গাছের নীচে বুদ্ধের মত আসন করে গভীর ও দীর্ঘস্থায়ী ধ্যানে নিমগ্ন হয়ে থাকবে।

এ-যাবৎ আমি আপনাকে কেবল শ্রদ্ধাই করেছি, কিন্তু এখন ঘটনা পরম্পরায় মনে হচ্ছে যে, মহামায়া আপনাকে আমার দৈনন্দিন জীবনযাত্রার প্রতি লক্ষ্য রাখার জন্য নিযুক্ত করেছেন; সুতরাং এখন শ্রদ্ধার সঙ্গে প্রগাঢ় বিশ্বাস যুক্ত হয়েছে। এখন থেকে আমি আমার নিজের জীবন এবং কর্মপ্রণালী বিষয়ে মনে করব যে, আপনি মায়ের আজ্ঞাপ্রাপ্ত; সুতরাং সকল দায়িত্ববোধ নিজের কাঁধ থেকে ঝেড়ে ফেলে আপনার ভেতর দিয়ে মহামায়া যে নির্দেশ দেবেন, তাই মেনে চলব।

শীঘ্রই ইওরোপ কিম্বা আমেরিকায় আপনার সহিত মিলিত হতে পারব, এই আশা নিয়ে এই চিঠি শেষ করছি। ইতি

আপনার স্নেহের সন্তান
বিবেকানন্দ

৪২১*

মঠ, বেলুড়
২ ফেব্রুআরী, ১৮৯৯

স্নেহের জো,
তুমি নিশ্চই এর মধ্যে নিউ ইয়র্ক পৌঁছেছ এবং দীর্ঘ অনুপস্থিতির পরে আবার স্বজনদের সঙ্গে মিলেছ। এবারকার যাত্রায় ভাগ্য প্রতি পদে তোমার অনুকূল হয়েছে— এমন কি সমুদ্র পর্যন্ত স্থির ও শান্ত ছিল এবং অবাঞ্ছিত সঙ্গীও জাহাজে বড় কেউ ছিল না। আমার বেলায় ঠিক এর উল্টো। তোমার সঙ্গে যেতে না পেরে আমি নিরাশ হয়ে পড়েছি। বৈদ্যনাথে বায়ু পরিবর্তনে কোন ফল হয়নি। সেখানে আট দিন আট রাত্রি শ্বাসকষ্টে প্রাণ যায় যায়। মৃতকল্প অবস্থায় আমাকে কলিকাতায় ফিরিয়ে আনা হয়। এখানে এসে বেঁচে উঠবার লড়াই শুরু করেছি।

ডাঃ সরকার এখন আমার চিকিৎসা করছেন। আগের মত হতাশ ভাব আর নেই। অদৃষ্টের সঙ্গে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিয়েছি। এটা আমাদের পক্ষে বড় দুর্বৎসর। যোগানন্দ, যে মায়ের বাড়ীতে থাকত, একমাস ধরে ভুগছে এবং প্রতিদিনই মৃত্যুর প্রতিক্ষা করছে। মা-ই ভাল জানেন। আবার কাজে লেগেছি, ঠিক নিজে করছি না, ছেলেদের পাঠিয়ে দিচ্ছি সারা ভারতে আবার একটা আলোড়ন জাগাবার জন্য। সর্বোপরি তুমি তো জানই, অর্থাভাব হচ্ছে প্রধান অসুবিধা। জো, তুমি এখন আমেরিকায়, আমাদের এখানকার কাজের জন্য কিছু টাকা তুলতে চেষ্টা কর।

মার্চ নাগাদ আবার ঝাঁপিয়ে পড়ছি, এপ্রিলে ইওরোপ যাত্রা। বাকী মা-ই ভাল জানেন।

সারাটা জীবন শরীর ও মনের কষ্ট সয়েছি অনেক, কিন্তু মায়ের অপার করুণা।আমার পাওনার চেয়ে অনন্তগুণ বেশী আনন্দ ও আশীর্বাদ পেয়েছি। মায়ের কাজে অবিরাম সংগ্রাম করছি, মা দেখছেন। আমি সর্বদা লড়াই করে চলেছি এবং যুদ্ধক্ষেত্রেই আমি শেষনিঃশ্বাস ফেলব।

আমার অশেষ প্রীতি এবং আশীর্বাদ—তোমার জন্য চিরদিন।

সতত সত্যরূপে তোমার
বিবেকানন্দ

৪২২*

[ঈশ্বরচন্দ্র ঘোষকে লিখিত]

বেলুড় মঠ, হাওড়া
৬ মার্চ, ১৮৯৯

প্রিয় মহাশয়,
আপনার অত্যন্ত সানুগ্রহ আমন্ত্রণের জন্য অশেষ ধন্যবাদ। আপনার পত্রের উত্তর দিতে এত দেরী হল বলে বিশেষ দুঃখিত।

আমি সে-সময় খুব অসুস্থ ছিলাম এবং যাঁর উপর পত্রের উত্তর দেবার ভার ছিল, তিনি তা দেননি বলেই মনে হয়। আমি এইমাত্র তা জানতে পেরেছি।

আপনাদের সানুগ্রহ আহ্বানের সুযোগ গ্রহণের জন্য আমি এখনও সম্পূর্ণ সুস্থ হইনি। এই শীতকালেই আপনাদের ঐ অঞ্চল (পূর্ববঙ্গ) দেখব বলে সঙ্কল্প করেছিলাম। কিন্তু আমার কর্মের গতি অন্যরূপ। প্রাচীন বাঙলার সভ্যতার কেন্দ্র দেখবার আনন্দ পাবার জন্য আমাকে অপেক্ষা করতে হবে।

আপনাদের সহৃদয়তার জন্য আবার ধন্যবাদ।

শুভার্থী
বিবেকানন্দ

৪২৩*

[মিস মেরী হেলকে লিখিত]

মঠ, বেলুড়, জেলা হওড়া
১৬ মার্চ, ১৮৯৯

স্নেহের মেরী,
মিসেস এডাম্‌স্‌কে ধন্যবাদ; তিনি তোমাদের—দুষ্টু মেয়েদের অবশেষে চিঠি লিখতে উদ্বুদ্ধ করেছেন। ‘চোখের আড়াল হলেই আর মনে থাকে না’—এ-কথা ভারতে যেমনি সত্য, আমেরিকাতেও তেমনি।

আচ্ছা, আমার শরীর এক রকম ভালই যাচ্ছে; যাতে কয়েক মাস যাবৎ মনে হচ্ছে, শরীরটা আরও কিছুকাল টিকবে।

ম্যাক্সমূলারের নূতন বই ‘রামকৃষ্ণঃ তাঁর জীবনী ও বাণী’ (Ramakrishna: His Life and Sayings) পড়েছ কি? যদি পড়ে না থাক পড়ে ফেল, এবং মাকে পড়তে দাও। মা কেমন আছেন? তাঁকে কি বুড়ো দেখাচ্ছে? ফাদার পোপ কেমন আছেন?

মার্কিন ও ইংরাজ বন্ধুদের ধন্যবাদ, তাঁদের সাহায্যেই গঙ্গার তীরে আমাদের একটি মঠ হয়েছে। মাকে মন দিয়ে দেখতে বল—‘পৌত্তলিক প্রচারক’দের দ্বারা তোমাদের ইয়াঙ্কি দেশকে প্লাবিত করতে চলেছি।

এ গ্রীষ্মে জো-র সঙ্গে আমেরিকায় যাবার খুব ইচ্ছা; কিন্তু মানুষ সংকল্প করে, এবং কে বিধান করেন?—সব সময়ে নিশ্চয়ই ভগবান্‌ করেন না। ভাল যা হবার তা হোক। অভয়ানন্দ (মেরী লুই) ভারতে এসেছে, বোম্বে ও মান্দ্রাজে তার খুব সম্বর্ধনা হয়েছে। আগামীকাল সে কলিকাতা আসবে, এবং আমরাও তাকে যথোচিত অভ্যর্থনা করছি।

মিস হাউ, মিসেস এডাম‍্স‍্, মাদার চার্চ ও ফাদার পোপ এবং সাত সমুদ্রের পারে অন্যান্য যে-সব বন্ধু আছে তাদের সকলকে আমার ভালবাসা জানাচ্ছি। আমরা সাত সমুদ্রে বিশ্বাস করি—দধি, দুগ্ধ, মধু, সুরা, ইক্ষুরস, লবণ, আর একটা কি—ভুলে গেছি। তোমাদের চার বোনকে মধু-সমুদ্রের উপর দিয়ে বায়ুবেগে সঞ্চালিত করছি আমার স্নেহ।

তোমাদের চিরদিনের ভ্রাতা
বিবেকানন্দ

৪২৪*

বেলুড় মঠ
১১ এপ্রিল, ১৮৯৯

প্রিয়—,
… দু-বৎসরের শারীরিক কষ্ট আমার বিশ বৎসরের আয়ু হরণ করেছে। ভাল কথা, কিন্তু এতে আত্মার কোন পরিবর্তন হয় না। হয় কি? সেই আপনভোলা আত্মা একই ভাবে বিভোর হয়ে তীব্র একাগ্রতা ও আকুলতা নিয়ে ঠিক তেমনি দাঁড়িয়ে আছে।

তোমাদের
বিবেকানন্দ