০৫. পত্রাবলী ১৫৫-১৬৪

১৫৫*

[স্যার এস. সুব্রহ্মণ্য আয়ারকে লিখিত]

৫৪১, ডিয়ারবর্ন এভিনিউ, চিকাগো
৩ জানুআরী, ১৮৯৫

প্রিয় মহাশয়,
প্রেম, কৃতজ্ঞতা ও বিশ্বাসপূর্ণ হৃদয়ে অদ্য আপনাকে পত্র লিখিতে প্রবৃত্ত হইলাম। প্রথমেই বলিয়া রাখি—আমার জীবনে এমন অল্প কয়েকজনের সহিত সাক্ষাৎ হইয়াছে, যাঁহাদের হৃদয় ভাব ও জ্ঞানের অপূর্ব সমম্বয়ে পূর্ণ, সর্বোপরি যাঁহারা মনের ভাবসমূহ কার্যে পরিণত করিবার শক্তি রাখেন, আপনি তাঁহাদের মধ্যে একজন। বিশেষতঃ আপনি অকপট, তাই আমি আপনার নিকট আমার কয়েকটি মনের ভাব বিশ্বাস করিয়া প্রকাশ করিতেছি।

ভারতের কার্য বেশ আরম্ভ হইয়াছে, আর উহা শুধু যে কোনক্রমে বজায় রাখিতে হইবে, তাহা নহে, মহা উদ্যমের সহিত উহার উন্নতি ও বিস্তারসাধন করিতে হইবে। এই সময়। এখন আলস্য করিলে পরে আর কার্যের সুযোগ থাকিবে না। কার্যপ্রণালী সম্বন্ধে নানাবিধ চিন্তা করিয়া নিম্নলিখিত প্রণালীতে উহা সীমাবদ্ধ করিয়াছিঃ প্রথমে মান্দ্রাজে ধর্মতত্ত্ব শিক্ষা দিবার জন্য একটি বিদ্যালয় স্থাপন করিতে হইবে, ক্রমশঃ উহাতে অন্যান্য অবয়ব সংযোজন করিতে হইবে; আমাদের যুবকগণ যাহাতে বেদসমূহ, বিভিন্ন দর্শন ও ভাষ্যসকল সম্পূর্ণরূপে শিক্ষা পায়, তাহা করিতে হইবে; উহার সহিত অন্যান্য ধর্মসমূহের তত্ত্বও তাহাদিগকে শিখাইতে হইবে। সঙ্গে সঙ্গে ঐ বিদ্যালয়ের মুখপত্রস্বরূপ একখানি ইংরেজী ও একখানি দেশীয় ভাষার কাগজ থাকিবে।

প্রথমেই এটি করিতে হইবে; আর ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ব্যাপার হইতেই বড় বড় বিষয় দাঁড়াইয়া থাকে। কয়েকটি কারণে মান্দ্রাজই এক্ষণে এই কার্যের সর্বাপেক্ষা উপযুক্ত ক্ষেত্র। বোম্বাইয়ে সেই চিরদিনের জড়ত্ব; বাঙলায় ভয়—এখন যেমন পাশ্চাত্য ভাবের মোহ, তেমনি পাছে তাহার বিপরীত ঘোর প্রতিক্রিয়া হয়। মান্দ্রাজই এক্ষণে এই প্রাচীন ও আধুনিক উভয় জীবন-প্রণালীর যথার্থ গুণ গ্রহণ করিয়া মধ্যপথ অনুসরণ করিতেছে।

সমাজের যে সম্পূর্ণ সংস্কার আবশ্যক—এ বিষয়ে ভারতীয় শিক্ষিত সমাজের সহিত আমি সম্পূর্ণ একমত। কিন্তু ইহা করিবার উপায় কি? সংস্কারকগণ সমাজকে ভাঙ্গিয়া-চুরিয়া যেরূপে সমাজসংস্কারের প্রণালী দেখাইলেন, তাহাতে তাঁহারা কৃতকার্য হইতে পারিলেন না। আমার প্রণালী এইঃ আমি এখনও এটা মনে করি না যে, আমার জাতি এতদিন ধরিয়া কেবল অন্যায় করিয়া আসিতেছে; কখনই নহে। আমাদের সমাজ যে মন্দ, তাহা নহে—আমাদের সমাজ ভাল। আমি কেবল চাই—আরও ভাল হোক। সমাজকে মিথ্যা হইতে উচ্চতর সত্যে যাইতে হইবে, মন্দ হইতে ভালয় নয়; সত্য হইতে উচ্চতর সত্যে, ভাল হইতে আরও ভালয়—আরও ভালয় যাইতে হইবে। আমি আমার স্বদেশবাসীকে বলি—এতদিন তোমরা যাহা করিয়াছ, তাহা বেশ হইয়াছে; এখন আরও ভাল করিবার সময় আসিয়াছে। এই জাতিবিভাগের কথাই ধরুন—সংস্কৃতে ‘জাতি’ শব্দের অর্থ শ্রেণীবিশেষ। এখন সৃষ্টির মূলেই ইহা বিদ্যমান। বিচিত্রতা অর্থাৎ জাতির অর্থই সৃষ্টি। ‘একোঽহং বহু স্যাম‍্’ (আমি এক—বহু হইব)—বিভিন্ন বেদে এইরূপ কথা দেখা যায়। সৃষ্টির পূর্বে এক থাকে—বহুত্ব বা বিচিত্রতাই সৃষ্টি। যদি এই বিচিত্রতাই না থাকে, তবে সৃষ্টিই লোপ পাইবে।

যতদিন কোন শ্রেণীবিশেষ সক্রিয় ও সতেজ থাকে, ততদিন তাহা নানা বিচিত্রতা প্রসব করিয়া থাকে। যখনই উহা বিচিত্রতা উৎপাদনে বিরত হয়, অথবা যখন উহার বিচিত্রতা বন্ধ করিয়া দেওয়া হয়, তখনই উহা মরিয়া যায়। মূলে ‘জাতির’ অর্থ ছিল প্রত্যেক ব্যক্তির নিজ প্রকৃতি, নিজ বিশেষত্ব প্রকাশ করিবার স্বাধীনতা। সহস্র সহস্র বর্ষ ধরিয়া এই অর্থই প্রচলিত ছিল—এমন কি, খুব আধুনিক শাস্ত্রগ্রন্থসমূহেও বিভিন্ন জাতির একত্র ভোজন নিষিদ্ধ হয় নাই; আর প্রাচীনতর গ্রন্থসমূহের কোথাও বিভিন্ন জাতিতে বিবাহ নিষিদ্ধ হয় নাই। তবে ভারতের পতনের কারণ কি? জাতি সম্বন্ধে এই ভাব পরিহার। যেমন গীতা বলিতেছেন, জাতি বিনষ্ট হইলে জগৎও বিনষ্ট হইবে। ইহা কি সত্য বলিয়া বোধ হয় যে, এই বিচিত্রতা বন্ধ করিয়া দিলে জগৎও নষ্ট হইয়া যাইবে? বর্তমান বর্ণবিভাগ (caste) প্রকৃত ‘জাতি’ নহে, বরং উহা জাতির উন্নতির প্রতিবন্ধক। উহা যথার্থই জাতির অর্থাৎ বিচিত্রতার স্বাধীন গতি রোধ করিয়াছে। কোন বদ্ধমূল প্রথা বা জাতিবিশেষের জন্য বিশেষ সুবিধা বা কোন আকারের বংশানুক্রমিক শ্রেণীবিভাগ প্রকৃত ‘জাতি’কে অব্যাহত গতিতে অগ্রসর হইতে দেয় না, যখনই কোন জাতি আর এইরূপ নানা বিচিত্রতা প্রসব করে না, তখনই উহা অবশ্যই বিনষ্ট হইবে। অতএব আমি আমার স্বদেশবাসিগণকে ইহাই বলিতে চাই যে, ‘জাতি’ উঠাইয়া দেওয়াতেই ভারতের পতন হইয়াছে। প্রাণহীন অভিজাত অথবা সুবিধাভোগী শ্রেণীমাত্রই ‘জাতি’র প্রতিবন্ধক—উহা জাতি নহে। জাতি নিজ প্রভাব বিস্তার করুক, জাতির পথে যাহা কিছু বিঘ্ন আছে, সব ভাঙিয়া ফেলা হউক—তাহা হইলেই আমরা উঠিব। এক্ষণে ইওরোপের দিকে দৃষ্টিপাত করুন। যখনই উহা জাতিকে সম্পূর্ণ স্বাধীনতা দিতে সমর্থ হইল—প্রত্যেক ব্যক্তির নিজ নিজ ‘জাতি’ গঠন করিতে যে-সকল বাধা আছে, সেই সকল বাধার অধিকাংশই দূর করিয়া দিল—তখনই ইওরোপ উঠিল। আমেরিকায় প্রকৃত ‘জাতি’র বিকাশের সর্বাপেক্ষা অধিক সুবিধা—সেইজন্য তাহারা বড়। প্রত্যেক হিন্দুই জানে যে, জ্যোতিষীরা বালকবালিকার জন্মমাত্র জাতি নির্বাচন করিতে চেষ্টা করিয়া থাকেন। উহাই প্রকৃত ‘জাতি’—প্রত্যেকের ব্যক্তিত্ব; আর জ্যোতিষ ইহা মানিয়া লইয়াছে। ইহা যদি পুনরায় পুরাপুরিভাবে চালু হয়, তবেই আমরা উঠিতে পারিব। এই বৈচিত্র্যের অর্থ বৈষম্য বা কোন বিশেষ অধিকার নয়।

আমার কার্যপ্রণালীঃ হিন্দুদের দেখান যে, তাহাদিগকে কিছুই ছাড়িতে হইবে না, কেবল ঋষি-প্রদর্শিত পথে চলিতে হইবে ও শত শত শতাব্দীব্যাপী দাসত্বের ফলস্বরূপ এই ‘জড়ত্ব’ দূর করিতে হইবে। অবশ্য মুসলমানগণের অত্যাচারের সময় আমাদের উন্নতি বন্ধ হইয়াছিল; তাহার কারণ তখন ছিল জীবনমরণের সমস্যা, উন্নতির সময় ছিল না। এখন আর সেই অত্যাচারের ভয় নাই; এখন আমাদিগকে সম্মুখে অগ্রসর হইতেই হইবে—স্বধর্মত্যাগী ও মিশনরীগণের উপদিষ্ট ধ্বংসের পথে নয়—আমাদের নিজেদের ভাবে, নিজেদের পথে। প্রাসাদের গঠন অসম্পূর্ণ বলিয়াই উহা বীভৎস দেখাইতেছে। বহু শত শতাব্দীর অত্যাচারে প্রাসাদ-নির্মাণ বন্ধ রাখিতে হইয়াছিল। এখন নির্মাণ-কার্য শেষ করা হউক, তাহা হইলে সবই যথাস্থানে সুন্দর দেখাইবে। ইহাই আমার কার্যপ্রণালী। এ বিষয়ে আমার বিন্দুমাত্র সন্দেহ নাই।

প্রত্যেক জাতির জীবনে একটি করিয়া মূল প্রবাহ থাকে। ধর্মই ভারতের মূল স্রোত; উহাকে শক্তিশালী করা হউক, তবেই পার্শ্ববর্তী অন্যান্য স্রোতগুলিও উহার সঙ্গে সঙ্গে চলিবে। ইহা আমার ভাবধারার একটা দিক্। আশা করি, যথাসময়ে আমার সমুদয় চিন্তারাশি প্রকাশ করিতে পারিব। কিন্তু বর্তমানে দেখিতেছি, এই দেশেও আমার বিশেষ কাজ রহিয়াছে। অধিকন্তু কেবল এখান হইতেই সাহায্যের প্রত্যাশা করি। কিন্তু এ পর্যন্ত কেবল আমার ভাবপ্রচার ব্যতীত আর কিছু করিতে পারি নাই। এখন আমার ইচ্ছা—ভারতেও একটা চেষ্টা করা হউক। মান্দ্রাজেই সফলতার সম্ভাবনা আছে। আ—ও অন্যান্য যুবকগণ খুব খাটিতে পারে, কিন্তু তাহা হইলেও তাহারা ‘উৎসাহী যুবক’ মাত্র। এই কারণে আমি তাহাদিগকে আপনার নিকট সমর্পণ করিতেছি। যদি আপনি তাহাদের পরিচালক হন, আমার নিশ্চিত ধারণা—উহারা কৃতকার্য হইবে। জানি না—কবে ভারতে যাইব। তিনি যেমন চালাইতেছেন, আমি সেইরূপ চলিতেছি; আমি তাঁহার হাতে।

‘এই জগতে ধনের সন্ধান করিতে গিয়া তোমাকেই শ্রেষ্ঠ রত্নরূপে পাইয়াছি; হে প্রভো, তোমারই নিকট আমি নিজেকে বলি দিলাম।’

‘ভালবাসার পাত্র খুঁজিতে গিয়া একমাত্র তোমাকেই ভালবাসার পাত্র পাইয়াছি। তোমারই নিকট আমি নিজেকে বলি দিলাম।’৪৭

প্রভু আপনাকে চিরকাল আশীর্বাদ করুন।

ভবদীয় চিরকৃতজ্ঞ
বিবেকানন্দ

১৫৬

[স্বামী ব্রহ্মানন্দকে লিখিত]

১৮৯৫

প্রিয়তমেষু,
তোমার পত্রে টাকা-পঁহুছান ইত্যাদি সংবাদ পাইয়া অতিশয় আনন্দিত হইলাম। … দেশে আসিবার কথা যে লিখিয়াছ, তাহা ঠিক বটে; কিন্তু এদেশে একটি বীজ বপন করা হইয়াছে, সহসা চলিয়া গেলে উহা অঙ্কুরে নষ্ট হইবার সম্ভাবনা, এজন্য কিঞ্চিৎ বিলম্ব হইবে। খেতড়ির রাজা, জুনাগড়ের দেওয়ান প্রভৃতি সকলেই দেশে আসিতে লেখেন। সত্য বটে; কিন্তু ভায়া, পরের ভরসা করা বুদ্ধিমানের কার্য নহে। আপনার পায়ের জোর বেঁধে চলাই বুদ্ধিমানের কার্য। সকলই হইবে ধীরে ধীরে; আপাততঃ একটা জায়গা দেখার কথাটা বিস্মৃত হইও না। একটা বিরাট জায়গা চাই—১০ হাজার থেকে ২০ হাজার [টাকা] পর্যন্ত—একদম গঙ্গার উপর হওয়া চাই। যদিও হাতে পুঁজি অল্প, তথাপি ছাতি বড় বেজায়, জায়গার উপর নজরটা রাখবে। একটা নিউ ইয়র্কে, একটা কলিকাতায় এবং একটা মান্দ্রাজে; এখন এই তিনটা আড্ডা চালাতে হবে, তারপর ধীরে ধীরে যেমন প্রভু যোগান।

যে যা করে, করতে দিও (উৎপাত ছাড়া)। টাকাখরচ বিলকুল তোমার হাতে রেখো। … অধিক কি বলিব? তুমি ইদিক ওদিক যাওয়াটা বড় একটা ত্যাগ কর। ঘর জাগিয়ে বসে থাক। … স্বাস্থ্যটার উপর বেজায় নজর রাখা চাই—পরে অন্য কথা। তারকদাদা দেশপর্যটনে উৎসুক—বেশ কথা, তবে এ সব দেশে বড়ই মাগগি, ১০০০ টাকার কমে মাসে চলে না (ধর্মপ্রচারকের)। … এদের দেশের বাঘভাল্লুকে পাদ্রী-পণ্ডিতদের মুখ হতে রুটি ছিনিয়ে নিয়ে খেতে হবে—এই বুঝ। অর্থাৎ বিদ্যের জোরে এদের দাবিয়ে দিতে হবে, নইলে ফু করে উড়িয়ে দেবে। এরা না বোঝে সাধু, না বোঝে সন্ন্যাসী, না বোঝে ত্যাগ-বৈরাগ্য; বোঝে বিদ্যের তোড়, বক্তৃতার ধুম আর মহা উদ্যোগ। আমার মতে কিন্তু যদি তারকদাদা পাঞ্জাব বা মান্দ্রাজে কতকগুলি সভা ইত্যাদি স্থাপন করে বেড়ান ও তোমরা একত্রিত হয়ে organised (সঙ্ঘবদ্ধ) হও তো বড়ই ভাল হয়। নূতন পথ আবিষ্কার করা বড় কাজ বটে, কিন্তু উক্ত পথ পরিষ্কার করা ও প্রশস্ত সুন্দর করাও কঠিন কাজ। আমি যেখানে যেখানে প্রভুর বীজ বপন করে এসেছি; তোমরা যদি সেই সেই স্থানে কিয়ৎকাল বাস করে উক্ত বীজকে বৃক্ষে পরিণত করতে পার, তাহা হইলেও আমার অপেক্ষা অনেক অধিক কাজ তোমরা করবে। উপস্থিত যারা রক্ষা করতে পারে না, তারা অনুপস্থিতে কি করিবে? তৈয়ারী রান্নায় একটু নুন-তেল যদি দিতে না পার, তাহলে কেমন করে বিশ্বাস হয় যে, সকল যোগাড় করবে? না হয় তারকদাদা আলমোড়ায় একটা হিমালয়ান মঠ স্থাপন করুন, এবং সেথায় একটা লাইব্রেরী করুন; আমরা দু-দণ্ড ঠাণ্ডা জায়গায় বাস করি এবং সাধনভজন করি। যা হোক, প্রভু যাকে যেমন বুদ্ধি দেন, আমার তাতে আপত্তি কি? অপিচ Godspeed—শিবা বঃ সন্তু পন্থানঃ। তারকদাদার হৃদয়ে মহা উৎসাহ আছে; এজন্য তাঁহা হতে আমি অনেক আশা করি। তারকদাদার সহিত এক থিওসফিষ্টের মূলাকাত হয়। সে লণ্ডন হতে আমাকে এক চিঠি লেখে। তারপর আর তো তার খবরাখবর নাই। সে ব্যক্তি ধনী বটে, সে তারকদাদার উপর শ্রদ্ধাবানও বটে। তার নামটা ভুলে গেছি। সে তাঁকে লণ্ডনাদি ভ্রমণ করাইতে পারে; এবং আমি যে কার্য করিতে চাই, তাহা সমাধানের জন্য তোমাদের কয়েকজনকে ইওরোপ ও আমেরিকা দেখাইয়া লওয়া অবশ্য কর্তব্য। একচক্র ভ্রমণের পর হৃদয় উদার হবে, তখন আমার idea (ভাব) বুঝতে পারবে ও কাজ করতে পারবে। তবে আমার হাতে টাকা নাই, কি করি? শীঘ্রই প্রভু রাস্তা খুলে দেবেন—এমন ভরসা আছে। এ সকল খবর ও আমার হৃদয়ের ভালবাসা তারকদাদাকে দিও, ও আলমোড়ায় একটা কিছু আড্ডা স্থাপনে বিশেষ যোগাড় দেখতে বলবে।

রাখাল, ঠাকুরের দেহত্যাগের পর মনে আছে, সকলে আমাদের ত্যাগ করে দিলে—হাবাতে গরীব ছোঁড়াগুলো মনে করে; কেবল বলরাম, সুরেশ, মাষ্টার ও চুনীবাবু এরা সকলে বিপদে আমাদের বন্ধু। অতএব এদের ঋণ আমরা কখনও পরিশোধ করতে পারব না। মাভৈঃ! খুব আনন্দ করতে বল—তাঁর আশ্রিতের কি নাশ আছে রে, বোকারাম?

ইতি সদৈকহৃদয়ঃ
নরেন

১৫৭*

চিকাগো
১১ জানুআরী, ১৮৯৫

প্রিয় জি. জি.,
তোমার ৩রা ডিসেম্বরের পত্র এইমাত্র পেলাম। ঐ সঙ্গেই আলাসিঙ্গার ও মহীশূরের মহারাজার পত্র পেলাম। নরসিংহ যে আমেরিকা এসেছিল, সে ভারতে ফিরে সেখান থেকে মিসেস হেগকে একখানা পত্র লিখেছে—তাতে হিন্দুদের বর্বর আখ্যা দিয়েছে, আর আমার সম্বন্ধে একটা কথাও লেখেনি। আমার আশঙ্কা হচ্ছে, তার মাথার কিছু গোলমাল হয়েছে। যাতে সে আরোগ্যলাভ করে, তার চেষ্টা কর। চিরদিনের জন্য কিছুই নষ্ট হয় না।

ডঃ ব্যারোজ তোমার পত্রের জবাব কেন দিলেন না, জানি না; কলিকাতার লোকদের যা উত্তর দিয়েছেন, তাও দেখিনি।

এখানকার ধর্মমহাসভার উদ্দেশ্য ছিল সব ধর্মের মধ্যে খ্রীষ্টান ধর্মের শ্রেষ্ঠতা প্রমাণ করা, কিন্তু তা সত্ত্বেও দার্শনিক হিন্দুধর্ম আপন মর্যাদা রক্ষা করতে সমর্থ হয়েছিল। ডঃ ব্যারোজ ও ঐ ধাঁজের লোকেরা বেজায় গোঁড়া—তাদের সাহায্য আমি চাই না, প্রভুই আমার সহায়। প্রভু এদেশে আমায় যথেষ্ট বন্ধু দিচ্ছেন, আর তাদের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে। যারা আমার অনিষ্ট করবার জন্য চেষ্টা করেছে, তারা এখন হয়রান হয়ে ছেড়ে দিয়েছে। প্রভু ওদের মঙ্গল করুন।

ডঃ ব্যারোজ ও ঐ ধরনের অন্যান্য লোকদের সম্বন্ধে এই পর্যন্ত জেনে রাখ, ওদের সঙ্গে আমার কোনপ্রকার সংস্রব নাই। বাল্টিমোরের ঘটনা নিয়ে যে বাজে গুজব রটেছিল, সে সম্বন্ধে বক্তব্য এই, সেখানে এখন আমার অনেক ভাল ভাল বন্ধু রয়েছেন, এবং বরাবরই সেখানে আরও অধিকসংখ্যক বন্ধু পাব। আমি এক মুহূর্তও অলসভাবে কাটাচ্ছি না, এদেশের দুটি প্রধান কেন্দ্র—বন ও নিউ ইয়র্কের মধ্যে দৌড়ে বেড়াচ্ছি। এর মধ্যে বোষ্টনকে ‘মস্তিষ্ক’ ও নিউ ইয়র্ককে ‘টাকার থলি’ বলা যেতে পারে। এই উভয় স্থানেই আমার কাজ আশাতীতভাবে সফল হয়েছে। যদি সংবাদপ্রেরকগণ তোমাদের নিকট ও-সম্বন্ধে কিছু না পাঠিয়ে থাকে, তাতে আমার কিছু দোষ নেই। যা হোক, বৎসগণ, আমি এই খবরের কাগজের হুজুগে বিরক্ত হয়ে গেছি, আর যে আমি তোমাদের নিকট ওগুলো পাঠাব, সে আশা করো না। কাজ আরম্ভ করবার জন্য একটু হুজুগ দরকার ছিল, এখন যথেষ্ট হয়ে গেছে।

মণি আয়ারকে চিঠি লিখেছি এবং তোমাকে আমার নির্দেশ পূর্বেই জানিয়েছি। এখন আমাকে দেখাও, তোমরা কি করতে পার। আহাম্মকের মত বাজে বকলে চলবে না, এখন আসল কাজ আরম্ভ করতে হবে। কিভাবে কাজ আরম্ভ করতে হবে, তা তোমাদের আগেই জানিয়েছি; আয়ারকেও পত্র লিখেছি। হিন্দুরা যে বড় বড় কথা বলে, তার সঙ্গে আসল কাজ দেখাতে হবে। তা যদি না পারে, তবে তারা কিছুই পাবার যোগ্য নয়। ব্যস‍্, এই কথা।তোমাদের নানাবিধ খেয়ালের জন্য আমেরিকা টাকা দিতে চাচ্ছে না। কেনই বা দেবে? আমার সম্বন্ধে বক্তব্য এই, আমি যথার্থ সত্য শিক্ষা দিতে চাই; তা এখানেই হোক আর অন্যত্রই হোক—আমি গ্রাহ্যের মধ্যে আনি না।

আমার বা তোমার পক্ষে বা বিপক্ষে কে কি বলে, সে দিকে আর কান দিও না। সিংহবিক্রমে কাজ করে যাও, প্রভু তোমাদের আশীর্বাদ করুন। যতদিন না আমার দেহত্যাগ হচ্ছে, অবিশ্রান্ত ভাবে কাজ করে যাব; আর মৃত্যুর পরও জগতের কল্যাণের জন্য কাজ করতে থাকব। অসত্যের চেয়ে সত্যের প্রভাব অনন্তগুণে বেশী; সাধুতারও তাই। তোমাদের যদি ঐ গুণগুলি থাকে, তবে ওরা নিজেদের শক্তিতেই পথ করে নেবে।

থিওসফিষ্টের সঙ্গে আমার কোন সংস্রব নেই। বলছ তারা আমায় সাহায্য করবে। দূর! তোমরা যেমন আহাম্মক! তোমরা কি মনে কর, এখানে লোকে তাদের সঙ্গে আমাকে একদরের মনে করে? এখানে কেউ তাদের গ্রাহ্যের মধ্যে আনে না, আর হাজার হাজার ভাল লোক আমার প্রতি শ্রদ্ধাসম্পন্ন। এইটি জেনে রাখ, এবং প্রভুর প্রতি বিশ্বাসসম্পন্ন হও।

খবরের কাগজে হুজুগ আমাকে যতটা না বাড়াতে পেরেছে, তার চেয়ে এদেশে আমি লোকের ওপর ধীরে ধীরে অনেক বেশী প্রভাব বিস্তার করছি। গোঁড়ারা এটা প্রাণে প্রাণে বুঝেছে, তারা কোনমতে এটা ঠেকিয়ে রাখতে পারছে না; তাই যাতে আমার প্রভাবটা একেবারে নষ্ট হয়ে যায়, তার জন্য চেষ্টার কিছুমাত্র ত্রুটি করছে না। কিন্তু তারা তা পেরে উঠবে না—প্রভু এ-কথা বলছেন।

এটা হচ্ছে চরিত্রের ও পবিত্রতার প্রভাব, ও ব্যক্তিত্বের শক্তি। যতদিন এগুলি আমার থাকবে, ততদিন নিশ্চিন্ত থেকো, কেউ আমার মাথার কেশাগ্রও স্পর্শ করতে পারবে না। প্রভু বলেছেন, যদি কেউ চেষ্টা করে, সে ব্যর্থ হবে।

বইপত্র—বাজে জঞ্জাল লিখে কি হবে? লোকের অন্তর স্পর্শ করতে হলে জীবন চাই, সেইটিই হচ্ছে একমাত্র উপায়; ব্যক্তির ভেতর দিয়ে ভাবের আকর্ষণ অপরের প্রাণে সঞ্চারিত হয়ে যায়। তোমরা তো এখনও ছেলেমানুষ। প্রভু আমাকে প্রতিদিনই গভীর হতে গভীরতর অন্তর্দৃষ্টি দিচ্ছেন। কাজ কর, কাজ কর, কাজ কর।

ওসব বাজে বুকনি ছেড়ে দাও, প্রভুর কথা কও। ভণ্ড ও মাথাপাগলা লোকদের কথা নিয়ে আলোচনা করবার সময় আমাদের নেই—জীবন যে ক্ষণস্থায়ী।

সদাসর্বদা তোমাদের এটি মনে রাখা বিশেষ দরকার যে, প্রত্যেক জাতকে এবং প্রত্যেক ব্যক্তিকে নিজ নিজ চেষ্টায় নিজের উদ্ধারসাধন করতে হবে। সুতরাং অপরের কাছে সাহায্যের প্রত্যাশা করো না। আমি খুব কঠোর পরিশ্রম করে মাঝে মাঝে কিছু কিছু টাকা পাঠাতে পারি—এই পর্যন্ত। যদি তার ওপর ভরসা করে তোমাদের থাকতে হয়, তবে বরং কাজকর্ম বন্ধ করে দাও। আরও জেনে রাখ যে, আমার ভাব বিস্তার করবার এটি বিশেষ উপযুক্ত জায়গা; আমি যাদের শিক্ষা দেব, তারা হিন্দুই হোক, মুসলমানই হোক, আর খ্রীষ্টানই হোক, আমি তা গ্রাহ্য করি না। যারা প্রভুকে ভালবাসে, তাদেরই সেবা করতে আমি সর্বদাই প্রস্তুত, জানবে।

আমাকে বাজে খবরের কাগজ আর পাঠিও না, ও দেখলেই আমার গা আঁতকে ওঠে। আমাকে নীরবে ধীরভাবে কাজ করতে দাও—প্রভু আমার সঙ্গে সর্বদা রয়েছেন। যদি ইচ্ছা হয় তো সম্পূর্ণ অকপট, সম্পূর্ণ নিঃস্বার্থ, সর্বোপরি সম্পূর্ণ পবিত্র হয়ে আমার অনুসরণ কর। আমার আশীর্বাদ তোমাদের ওপর রয়েছে। এই ক্ষণস্থায়ী জীবনে পরস্পর প্রশংসা-বিনিময় করবার সময় আমাদের নেই। যখন এই জীবনযুদ্ধ শেষ হয়ে যাবে, তখন প্রাণভরে কে কতদূর কি করলাম, তুলনা করব ও পরস্পরের সুখ্যাতি করব। এখন কথা বন্ধ কর; কেবল কাজ—কাজ—কাজ। ভারতে তোমরা স্থায়ী কিছু করেছ, তা তো দেখতে পাচ্ছি না। তোমরা কোন কেন্দ্র স্থাপন করেছ, তাও দেখতে পাচ্ছি না। তোমরা কোন মন্দির বা হল প্রতিষ্ঠা করেছ—তাও তো দেখছি না। অপর কেউ তোমাদের সঙ্গে যোগ দিচ্ছে, তাও কিছু দেখছি না। কেবল কথা কথা কথা—‘আমরা খুব বড়, আমরা খুব বড়’—পাগল! আমরা ক্লীব—তা ছাড়া আমরা আর কি?

এই জঘন্য নাম-যশ ও অন্যান্য বাজে ব্যাপার—ওগুলিতে আমার কি হবে? ওগুলি কি আমি গ্রাহ্যের মধ্যে আনি? আমি দেখতে চাই—শত শত ব্যক্তি এসে প্রভুর আশ্রয় নেবে। কোথায় তারা? আমি তাদের চাই—তাদের দেখতে চাই। তোমরা তো এরূপ লোক আমার কাছে এনে দিতে পারনি—তোমরা আমায় কেবল নাম-যশ দিয়েছ। নাম-যশ চুলোয় যাক। কাজে লাগ, সাহসী যুবকবৃন্দ, কাজে লাগ। আমার ভেতরে যে কি আগুন জ্বলছে, তার সংস্পর্শে এখনও তোমাদের হৃদয় অগ্নিময় হয়ে ওঠেনি। তোমরা এখন পর্যন্ত আমায় বুঝতে পারনি। তোমরা এখনও আলস্য ও ভোগের পুরাতন রাস্তাতেই চলেছ। দূর করে দাও যত আলস্য, দূর করে দাও ইহলোক ও পরলোকে ভোগের বাসনা। আগুনে গিয়ে ঝাঁপ দাও এবং লোককে ভগবানের দিকে নিয়ে এস।

ভগবৎসমীপে প্রার্থনা করি, আমার ভেতরে যে আগুন জ্বলছে, তা তোমাদের ভেতর জ্বলে উঠুক, তোমাদের মন মুখ এক হোক—ভাবের ঘরে চুরি যেন একদম না থাকে। তোমরা যেন জগতের যুদ্ধক্ষেত্রে বীরের মত মরতে পার—ইহাই সর্বদা বিবেকানন্দের প্রার্থনা।

পুঃ—আলাসিঙ্গা, কিডি, ডাক্তার বালাজী এবং আর আর সকলকে আমার ভালবাসা জানাবে এবং বলবে—রাম শ্যাম যদু আমাদের পক্ষে বা বিপক্ষে কি বলছে, এই নিয়ে তারা যেন দিনরাত মাথা না ঘামায়, তারা যেন তাদের সমস্ত শক্তি একত্র করে কাজে লাগায়। জগতে যত রাম শ্যাম আছে, সকলকে আশীর্বাদ কর, তারা তো শিশু মাত্র, আর তোমরা কাজে লেগে যাও। ইতি—

বি

পুঃ—সংবাদপত্রের রিপোর্ট সম্বন্ধে বক্তব্য এই, খুব সাবধানে তাদের কথা গ্রহণ করতে হবে। কারণ যদি কোন রিপোর্টারকে দেখা সাক্ষাৎ করতে না দেওয়া হয়, তবে সে গিয়ে যা তা কতকগুলি স্বকপোলকল্পিত বাজে গল্প লিখে ছাপিয়ে দেয়। সেইজন্যই তো তোমরা বাল্টিমোর-সংক্রান্ত বাজে খবরগুলো পেয়েছ। লোকগুলি কি করে ঐসব লেখবার উপাদান পেলে, আমি তো নিজেই তা জানি না। আমেরিকার কাগজগুলো কোন ব্যক্তির সম্বন্ধে যা খুশী তাই লেখে। বক্তৃতার রিপোর্টগুলোও বার আনা বাজে কথায় ভরা। রিপোর্টারেরা নিজেদের কল্পনা থেকে অনেক জিনিষ পূরণ করে দেয়। আমেরিকার কাগজ থেকে কিছু তুলে ছাপবার সময় খুব সাবধান। ইতি—

বি

১৫৮*

আমেরিকা
১২ জানুআরী, ১৮৯৫

প্রিয় আলাসিঙ্গা,
আমি গতকল্য জি. জি-কে পত্র লিখেছি, কিন্তু আরও কতকগুলি কথা বলা দরকার হচ্ছে—তাই তোমায় লিখছিঃ

প্রথমতঃ আমি পূর্বে কয়েকখানি পত্রে তোমাদের লিখেছি যে, বই-টই বা খবরের কাগজ প্রভৃতি আর আমায় পাঠিও না, কিন্তু তবু তোমরা পাঠাচ্ছ—এতে আমি বিশেষ দুঃখিত। কারণ আমার ঐগুলি পড়বার এবং ঐগুলি সম্বন্ধে খেয়াল করবার মোটেই সময় নেই। অনুগ্রহ করে ওগুলি আর পাঠিও না। আমি মিশনরী থিওসফিষ্ট বা ঐ ধরনের লোকদের মোটেই আমল দিই না—তারা সবাই যা পারে তা করুক। তাদের কথা নিয়ে আলোচনা করতে গেলেই তাদের দর বাড়ান হবে। মান্দ্রাজ-অভিনন্দনের উত্তরটা মিসেস—কে পাঠিয়ে ঠিক করনি। তিনি একজন গোঁড়া খ্রীষ্টান, সুতরাং গোঁড়াদের সম্বন্ধে ওতে আমি যে সমালোচনা করেছি, তা তাঁর ভাল লাগবে না। যাই হোক, সব ভাল যার শেষ ভাল।

এখন তোমরা চিরদিনের জন্য জেনে রাখ যে, আমি নাম-যশ বা ঐরূপ বাজে জিনিষ একদম গ্রাহ্য করি না। আমি জগতের কল্যাণের জন্য আমার ভাবগুলি প্রচার করতে চাই। তোমরা খুব বড় কাজ করেছ বটে, কিন্তু কাজ যতদূর হয়েছে, তাতে শুধু আমার নাম-যশই হয়েছে। কেবল জগতের বাহবা নেবার জন্যই জীবন ব্যয় করা অপেক্ষা আমার কাছে আমার জীবনের আরও বেশী মূল্য আছে বলে মনে হয়। ঐসব আহাম্মকির জন্য আমার মোটেই সময় নেই, জানবে। তোমরা ভারতের ভাবগুলি প্রচারের জন্য ও সঙ্ঘবদ্ধ হবার উদ্দেশ্যে কি কাজ করেছ?—কই, কিছুই না।

একটি সঙ্ঘের বিশেষ প্রয়োজন—যা হিন্দুদের পরস্পর পরস্পরকে সাহায্য করতে ও ভাল ভাবগুলি আদর করতে শেখাবে। আমাকে ধন্যবাদ দেবার জন্য কলিকাতার সভায় ৫০০০ লোক জড়ো হয়েছিল—অন্যান্য স্থানেও শত শত লোক সভায় মিলিত হয়েছে—বেশ কথা, কিন্তু তাদের প্রত্যেককে চারটি করে পয়সা সাহায্য করতে বল দেখি—অমনি তারা সরে পড়বে। বালসুলভ নির্ভরতাই আমাদের জাতীয় চরিত্রের বৈশিষ্ট্য। যদি কেউ তাদের মুখের কাছে খাবার এনে দেয়, তবে তারা খেতে খুব প্রস্তুত; কারও কারও আবার সেই খাবার গিলিয়ে দিতে পারলে আরও ভাল হয়। আমেরিকা তোমাদের কিছু টাকা-কড়ি পাঠাতে পারবে না—কেনই বা পারবে? যদি তোমরা নিজেরা নিজেদের সাহায্য করতে না পার, তবে তো তোমরা বাঁচবারই উপযুক্ত নও। তুমি যে জানতে চেয়েছ—আমেরিকার কাছ থেকে বছরে কয়েক হাজার টাকা পাবার নিশ্চিন্ত ভরসা করা যেতে পারে কিনা, তাই পড়ে আমি একেবারে হতাশ হয়ে গেছি। এক পয়সাও পাবে না। সব টাকা কড়ি নিজেদেরই যোগাড় করে নিতে হবে—কেমন, পারবে?

জনসাধারণের শিক্ষা সম্বন্ধে আমার যে পরিকল্পনা ছিল, আমি উপস্থিত তা ছেড়ে দিয়েছি; ও ধীরে ধীরে হবে। এখন আমি চাই—একদল অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষিত প্রচারক। বিভিন্ন ধর্মের তুলনামূলক আলোচনা, সংস্কৃত ও কয়েকটি পাশ্চাত্য ভাষা এবং বেদান্তের বিভিন্ন মতবাদ শিক্ষা দেবার জন্য মান্দ্রাজে একটি কলেজ করতেই হবে। ওর মুখপত্রস্বরূপ ইংরেজী ও দেশীয় ভাষায় পত্রিকা হবে, সঙ্গে সঙ্গে ছাপাখানাও থাকবে। এর মধ্যে একটা কিছু কর—তাহলে জানব, তোমরা কিছু করেছ—কেবল আমাকে আকাশে তুলে দিয়ে প্রশংসা করলে কিছু হবে না।

তোমাদের জাতটা দেখাক যে তারা কিছু করতে প্রস্তুত। তোমরা ভারতে যদি এরূপ কিছু করতে না পার, তবে আমাকে একলা কাজ করতে দাও। জগৎকে দেবার জন্য আমার কাছে একটা বাণী আছে, যারা তা আদরপূর্বক নেবে ও কাজে পরিণত করবে, তাদের কাছে সেটি দিয়ে যেতে চাই। কে বা কারা সেটি নেয়, আমি গ্রাহ্য করি না। ‘যারা আমার পিতার কার্য করবে’,৪৮ তারাই আমার আপনার জন।

যাই হোক, আবার বলছি, এইজন্য বিশেষভাবে চেষ্টা করো—একেবারে ছেড়ে দিও না। আমার নাম খুব বড় করতে হবে না। আমি দেখতে চাই আমার ভাবগুলি যেন কাজে পরিণত হয়। সকল মহাপুরুষের চেলারাই চিরকাল উপদেশগুলির সঙ্গে গুরুকে অচ্ছেদ্যভাবে জড়িয়ে ফেলে, এবং অবশেষে ব্যক্তির জন্য তাঁর ভাবগুলি নষ্ট হয়ে যায়। শ্রীরামকৃষ্ণের শিষ্যগণ যেন এই প্রকার না করেন। এ বিষয়ে তাঁদের সর্বদাই সাবধান থাকতে হবে। তোমরা ভাবগুলির জন্য কাজ কর, ব্যক্তির জন্য নয়। প্রভু তোমাদের আশীর্বাদ করুন।

সদা আশীর্বাদক
বিবেকানন্দ

১৫৯

[স্বামী ব্রহ্মানন্দকে লিখিত]

ওঁ নমো ভগবতে রামকৃষ্ণায়

১৮৯৫

প্রাণাধিকেষু,
এক্ষণে বহুত খবরের কাগজ এককাট্টা হইয়া গেল। আর পাঠাইবার আবশ্যক নাই। হুজুগ এক্ষণে ভারতের মধ্যেই চলুক। বোধ করি, তোমরা এতদিনে কলিকাতায় আসিয়া থাকিবে। তারকদার পত্র শেষ, তারপর আর কোন সংবাদ নাই।

কালী কলিকাতায় থাকিয়া কাগজপত্র ছাপাইতেছে—সে বড় ভাল কথা, কিন্তু এখানে আর পাঠাইবার আবশ্যক নাই। … কিন্তু এই যে দেশময় একটা হুজুগ উঠিয়াছে, ইহার আশ্রয়ে চারিদিকে ছড়াইয়া পড়। অর্থাৎ স্থানে স্থানে branch (শাখা) স্থাপন করিবার প্রযত্ন কর। ফাঁকা আওয়াজ না হয়। মান্দ্রাজবাসীদের সহিত যোগদান করিয়া স্থানে স্থানে সভা প্রভৃতি স্থাপন করিতে হইবে। যে খবরের কাগজ বাহির হইবার কথা হইতেছিল, তাহার কি হইল? খবরের কাগজ চালাইবার তোমার ভাবনা কি আমরা জানি না; এখন লোক যে অল্প। চিঠি লিখে, ইত্যাদি করে সকলের ঘাড়ে গতিয়ে দাও; তারপর গড় গড় করে চলে যাবে। বাহাদুরি দেখাও দেখি। দাদা, মুক্তি নাই বা হল, দু-চার বার নরককুণ্ডে গেলেই বা। এ-কথা কি মিথ্যে?—

মনসি বচসি কায়ে পুণ্যপীযূষপূর্ণঃ
ত্রিভুবনমুপকারশ্রেণীভিঃ প্রীয়মাণঃ।
পরগুণপরমাণুং পর্বতীকৃত্য কেচিৎ
নিজহৃদি বিকসন্তঃ সন্তি সন্তঃ কিয়ন্তঃ॥৪৯

নাই বা হল তোমাদের মুক্তি। কি ছেলেমানষি কথা! রাম রাম! আবার ‘নেই নেই’ বললে সাপের বিষ ক্ষয় হয়ে যায় কিনা? ও ‍কোন্ দিশী বিনয়—‘আমি কিছু জানি না, আমি কিছুই নই’—ও ‍কোন্ দিশী বৈরাগ্যি আর বিনয় হে বাপ! ও রকম ‘দীনাহীনা’ ভাবকে দূর করে দিতে হবে! আমি জানিনি তো কোন্‌ শালা জানে? তুমি জান না তো এতকাল করলে কি? ও-সব নাস্তিকের কথা, লক্ষ্মীছাড়ার বিনয়। আমরা সব করতে পারি, সব করব; যার ভাগ্যে আছে, সে আমাদের সঙ্গে হুহুঙ্কারে চলে আসবে, আর লক্ষ্মীছাড়াগুলো বেড়ালের মত কোণে বসে মেউ মেউ করবে।

এক মহাপুরুষ লিখছেন, ‘আর কেন? হুজুগ খুব হল, ঘরে ফিরে এস।’ বেকুব; তোকে মরদ বলতুম, যদি একটা ঘর করে আমায় ডাকতে পারতিস। ও-সব আমি দশ বৎসর দেখে দেখে পাকা হয়ে গেছি। কথায় আর চিঁড়ে ভেজে না। যার মনে সাহস, হৃদয়ে ভালবাসা আছে, সে আমার সঙ্গে আসুক; বাকী কাউকে আমি চাই না, মার কৃপায় আমি এক লাখ আছি—বিশ লাখ হব। আমার একটি কাজ হয়ে গেলেই আমি নিশ্চিন্ত। রাখাল ভায়া, তুমি উদ্যোগ করে সেইটি করে দেবে—মা-ঠাকুরাণীর জন্য একটা জায়গা। আমার টাকাকড়ি সব মজুত; খালি তুমি উঠে পড়ে লেগে একটা জমি দেখে শুনে কেনো। জমির জন্য ৩।৪ অথবা ৫ হাজার পর্যন্ত লাগে তো ক্ষতি নাই। ঘর-দ্বার এক্ষণে মাটির ভাল। একতলা কোঠার চেয়ে মাটির ঘর ঢের ভাল। ক্রমে ঘর-দ্বার ধীরে ধীরে উঠবে। যে নামে বা রকমে জমি কিনলে অনেক দিন চলবে, তাই উকিলদের পরামর্শে করিবে। আমার দেশে যাওয়া অনিশ্চিত। সেখানেও ঘোরা, এখানেও ঘোরা; তবে এখানে পণ্ডিতের সঙ্গ, সেখানে মূর্খের সঙ্গ—এই স্বর্গ-নরকের ভেদ। এদেশের লোকে এককাট্টা হয়ে কাজ করে, আর আমাদের সকল কাজ বৈরিগ্যি (অর্থাৎ কুঁড়েমি), হিংসা প্রভৃতির মধ্যে পড়ে চুরমার।

হরমোহন, মধ্যে মধ্যে এক দিগ‍্গজ পত্র লেখেন—তা আমি অর্ধেক পড়তে পারি না, ইহা আমার পক্ষে পরম মঙ্গল। কারণ অধিকাংশ খবরই এই ডৌলের যথা—‘অমুক ময়রার দোকানে বসে অমুক ছেলেরা আপনার বিরুদ্ধে এই-সকল কথা বলিতেছিল, আর তাহাতে আমি অসহ্য বোধে তাহাদের সহিত কলহ করিলাম ইতি।’ আমার পক্ষসমর্থনের জন্য তাহাকে অনেক ধন্যবাদ। কিন্তু জেলে-মালা আমার সম্বন্ধে কে কি বলিতেছে, ইহা সবিশেষ শুনিবার বিশেষ বাধা এই যে—‘স্বল্পশ্চ কালো বহবশ্চ বিঘ্নাঃ’ (সময় অল্প, বিঘ্ন অনেক)।

একটা Organized Society (সঙ্ঘবদ্ধ সমিতি) চাই। শশী ঘরকন্না দেখুক, সান্যাল টাকাকড়ি বাজারপত্রের ভার নিক, শরৎ সেক্রেটারী হোক অর্থাৎ চিঠিপত্র সব লেখা ইত্যাদি। একটা ঠিকানা কর, মিছে হাঙ্গাম কি করছ—বুঝতে পারলে কিনা? খবরের কাগজে ঢের হয়ে গেছে, এক্ষণে আর দরকার নাই। এক্ষণে তোমরা কিছু কর দিকি দেখি। যদি একটা মঠ বানাতে পার, তবে বলি বাহাদুর, নইলে ঘোড়ার ডিম। মান্দ্রাজের লোকদের সঙ্গে যুক্তি করে কাজ করবে। তাদের কাজ করবার অনেক শক্তি আছে। এবারকার মহোৎসব এমনি হুজুগ করে করবে যে, এমন আর কখনও হয় নাই। খাওয়াদাওয়ার হুজুগ যত কম হয়, ততই ভাল। দাঁড়া-প্রসাদ, মালসা ভোগ যথেষ্ট। সুরেশ দত্ত-র ‘শ্রীরামকৃষ্ণ-জীবনী’ পাঠ করলাম। খুব ভাল; তবে … প্রভৃতি উদাহরণগুলি ছাপিয়েছেন কেন? কি মহাপাপ, ছি ছি!

আমি একটা ইংরেজীতে শ্রীরামকৃষ্ণ-জীবন very short (অতি সংক্ষিপ্ত) লিখিয়া পাঠাইতেছি। সেটা ছাপাইয়া ও বঙ্গানুবাদ করিয়া মহোৎসবে বিক্রী করিবে, বিতরণ করিলে লোকে পড়ে না। কিঞ্চিৎ দাম চাই। খুব ধূমধামের সঙ্গে মহোৎসব করিবে। কিছু collection (চাঁদা) নেবে। তাতে দু এক হাজার টাকা হতে পারবে। তাহলে মা-ঠাকুরাণীর জমির উপর দস্তুরমত ঘর-দ্বার হয়ে যাবে। ইতি

চৌরস বুদ্ধি চাই, তবে কাজ হয়। যে গ্রামে বা শহরে যাও, যেখানে দশজন লোক পরমহংসদেবকে শ্রদ্ধাভক্তি করে, সেইখানেই একটা সভা স্থাপন করিবে। এত গ্রামে গ্রামে কি ভেরেণ্ডা ভাজলে নাকি? হরিসভা প্রভৃতিগুলোকে ধীরে ধীরে ‘স্বাহা’ করতে হবে। কি বলব তোদের? আর একটা ভূত যদি আমার মত পেতুম! ঠাকুর কালে সব জুটিয়ে দেবেন। … শক্তি থাকলেই বিকাশ দেখাতে হবে। … মুক্তি-ভক্তির ভাব দূর করে দে। এই একমাত্র রাস্তা আছে দুনিয়ায়—পরোপকারায় হি সতাং জীবিতং পরার্থং প্রাজ্ঞ উৎসৃজেৎ (পরোপকারের জন্যই সাধুদিগের জীবন, প্রাজ্ঞ ব্যক্তি পরের জন্যই তা উৎসর্গ করবেন)। তোমার ভাল করলেই আমার ভাল হয়, দোসরা আর উপায় নেই, একেবারেই নেই। ‘হে ভগবান্, হে ভগবান্!’ আরে ভগবান্ হেন করবেন, তেন করবেন—আর তুমি বসে বসে কি করবে? … তুই ভগবান্, আমি ভগবান্, মানুষ ভগবান্ দুনিয়াতে সব করছে; আবার ভগবান্ কি গাছের উপর বসে আছেন? এই তো বুদ্ধির দৌড়, তারপর— … যদি কল্যাণ চাস, ওসব হিংসে ঝগড়া ছেড়ে দিয়ে কাজে লেগে যা। যারা তা করতে পারবে না, তাদের বিদায় করে দে।

বিমলা … শশী সাণ্ডেলের লিখিত এক পুস্তক পাঠিয়েছেন এবং লিখেছেন যে, শশীবাবুর সাংসারিক অবস্থা অত্যন্ত খারাপ—তাই জন্য তাঁর পুস্তকের যদি এ দেশে কেহ কেহ সহায়তা করে। দাদা, সে পুঁথি হল বাঙলা ভাষায়—এদেশের লোক কি সাহায্য করবে?—পুঁথি পড়ে বিমলা অবগত হয়েছেন যে, এ দুনিয়াতে যত লোক আছে, তারা সকলে অপবিত্র এবং তাদের প্রকৃতিতে আসলে ধর্ম হবার যো-টি নাই, কেবল ভারতবর্ষের একমুষ্টি ব্রাহ্মণ যাঁরা আছেন, তাঁদের ধর্ম হতে পারবে। আবার তাঁদের মধ্যে শশী (সাণ্ডেল) আর বিমলাচরণ—এঁরা হচ্ছেন চন্দ্রসূর্যস্বরূপ। সাবাস, কি ধর্মের জোর রে বাপ! বিশেষ বাঙলাদেশে ঐ ধর্মটা বড়ই সহজ। অমন সোজা রাস্তা তো আর নাই। তপ-জপের সার সিদ্ধান্ত এই যে, আমি পবিত্র আর সব অপবিত্র! পৈশাচিক ধর্ম, রাক্ষসী ধর্ম, নারকী ধর্ম! যদি আমেরিকার লোকের ধর্ম হতে পারে না, যদি এদেশে ধর্ম প্রচার করা ঠিক নয়, তবে তাহাদের সাহায্য-গ্রহণে আবশ্যক কি? এদিকে অযাচিত বৃত্তির ধুম, আবার পুঁথিময় আক্ষেপ, আমায় কেউ কিছু দেয় না। বিমলা সিদ্ধান্ত করেছেন যে, যখন ভারতসুদ্ধ লোক শশী (সাণ্ডেল) আর বিমলার পদপ্রান্তে ধনরাশি ঢেলে দেয় না, তখন ভারতের সর্বনাশ উপস্থিত। কারণ, শশীবাবু সূক্ষ্ম ব্যাখ্যা অবগত আছেন এবং বিমলা তৎপাঠে নিশ্চিত অবগত হয়েছেন যে, তিনি ছাড়া এ পৃথিবীতে আর কেহই পবিত্র নাই। এ রোগের ঔষধ কি? বলি, শশী- বাবুকে মালাবারে যেতে বলো। সেখানকার রাজা সমস্ত প্রজার জমি ছিনিয়ে নিয়ে ব্রাহ্মণগণের চরণার্পণ করেছেন, গ্রামে গ্রামে বড় বড় মঠ, চর্ব্য চূষ্য খানা, আবার নগদ। … ভোগের সময় ব্রাহ্মণেতর জাতের স্পর্শে দোষ নাই—ভোগ সাঙ্গ হলেই স্নান; কেন না ব্রাহ্মণেতর জাতি অপবিত্র—অন্য সময় তাদের স্পর্শ করাও নাই। এক শ্রেণীর সাধু সন্ন্যাসী আর ব্রাহ্মণ বদমাশ দেশটা উৎসন্ন দিয়েছে। ‘দেহি দেহি’ চুরি-বদমাশি—এরা আবার ধর্মের প্রচারক! পয়সা নেবে, সর্বনাশ করবে, আবার বলে ‘ছুঁয়ো না ছুঁয়ো না’—আর কাজ তো ভারি—‘আলুতে বেগুনেতে যদি ঠেকাঠেকি হয়, তাহলে কতক্ষণে ব্রহ্মাণ্ড রসাতলে যাবে?’ ‘১৪ বার হাতে-মাটি না করিলে ১৪ পুরুষ নরকে যায়, কি ২৪ পুরুষ?’—এই-সকল দুরূহ প্রশ্নের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা করেছেন আজ দু হাজার বৎসর ধরে। এদিকে 1/4 of the people are starving (সিকি ভাগ লোক না খেতে পেয়ে মরছে)। ৮ বৎসরের মেয়ের সঙ্গে ৩০ বৎসরের পুরুষের বে দিয়ে মেয়ের মা-বাপ আহ্লাদে আটখানা। … আবার ও কাজে মানা করলে বলেন, আমাদের ধর্ম যায়! ৮ বৎসরের মেয়ের গর্ভাধানের যাঁরা বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা করেন, তাঁদের কোন দেশী ধর্ম? আবার অনেকে এই প্রথার জন্য মুসলমানদের ঘাড়ে দোষ দেন। মুসলমানদের দোষ বটে!! সব গৃহ্যসূত্রগুলো পড়ে দেখ দেখি, ‘হস্তাৎ যোনিং ন গূহতি’ যতদিন, ততদিন কন্যা, এর পূর্বেই তার বে দিতে হবে। সমস্ত গৃহ্যসূত্রেরই এই আদেশ।

বৈদিক অশ্বমেধ যজ্ঞের ব্যাপার স্মরণ কর—‘তদনন্তরং মহিষীং অশ্ব-সন্নিধৌ পাতয়েৎ’ ইত্যাদি! আর হোতা পোতা ব্রহ্মা উদ্গাতা প্রভৃতিরা বেডোল মাতাল হয়ে কেলেঙ্কারী করত। বাবা, জানকী বনে গিয়েছিলেন, রাম একা অশ্বমেধ করলেন—শুনে হাঁপ ছেড়ে বাঁচলেম বাবা!

এ-কথা সমস্ত ব্রাহ্মণেই আছে—সমস্ত টীকাকার স্বীকার করেছেন। না করবার যো-টি কি!

এ সকল কথা বলবার মানে এই—প্রাচীনকালে ঢের ভাল জিনিষ ছিল, খারাপ জিনিষও ছিল। ভালগুলি রাখতে হবে, কিন্তু আসছে যে ভারত—Future India—Ancient India-র (ভবিষ্যৎ ভারত প্রাচীন ভারতের) অপেক্ষা অনেক বড় হবে। যেদিন রামকৃষ্ণ জন্মেছেন, সেইদিন থেকেই Modern India (বর্তমান ভারত)—সত্যযুগের আবির্ভাব! আর তোমরা এই সত্যযুগের উদ্বোধন কর—এই বিশ্বাসে কার্যক্ষেত্রে অবতীর্ণ হও।

তাইতেই যখন তোমরা বলো, রামকৃষ্ণ অবতার, আবার তারপরই বল, আমরা কিছুই জানি না, তখনই আমি বলি, liar (মিথ্যাবাদী), চোর, ঝুঠ বিলকুল। যদি রামকৃষ্ণ পরমহংস সত্য হন, তোমরাও সত্য। কিন্তু দেখাতে হবে। … তোমাদের সকলের ভেতর মহাশক্তি আছে, নাস্তিকের ভেতর ঘোড়ার ডিম আছে। যারা আস্তিক, তারা বীর; তাদের মহাশক্তি বিকাশ হবে। দুনিয়া ভেসে যাবে—‘দয়া দীন উপকার’—মানুষ ভগবান্, নারায়ণ—আত্মায় স্ত্রী পুং নপুং ব্রহ্মক্ষত্রাদি ভেদ নাই—ব্রহ্মাদিস্তম্ব পর্যন্ত নারায়ণ। কীট less manifested (অল্প অভিব্যক্ত), ব্রহ্ম more manifested (অধিক অভিব্যক্ত)। Every action that helps a being manifest its divine nature more and more is good; every action that retards it, is evil.

The only way of getting our divine nature manifested is by helping others do the same.

If there is inequality in nature, still there must be equal chance for all—or if greater for some and for some less—the weaker should be given more chance than the stronger.৫০

অর্থাৎ চণ্ডালের বিদ্যাশিক্ষার যত আবশ্যক, ব্রাহ্মণের তত নহে। যদি ব্রাহ্মণের ছেলের একজন শিক্ষকের আবশ্যক, চণ্ডালের ছেলের দশ জনের আবশ্যক। কারণ যাহাকে প্রকৃতি স্বাভাবিক প্রখর করেন নাই তাহাকে অধিক সাহায্য করিতে হইবে। তেলা মাথায় তেল দেওয়া পাগলের কর্ম। The poor, the down-trodden, the ignorant, let these be your God.৫১

মহা দঁক সামনে—সাবধান! ঐ দঁকে সকলে পড়ে মারা যায়—ঐ দঁক হচ্ছে যে—হিঁদুর (এখনকার) ধর্ম বেদে নাই, পুরাণে নাই, ভক্তিতে নাই, মুক্তিতে নাই—ধর্ম ঢুকেছেন ভাতের হাঁড়িতে। [এখনকার] হিঁদুর ধর্ম বিচারমার্গেও নয়, জ্ঞানমার্গেও নয়—ছুঁৎমার্গে; আমায় ছুঁয়ো না, আমায় ছুঁয়ো না, ‍ব‍্যস্। এই ঘোর বামাচার ছুঁৎমার্গে পড়ে প্রাণ খুইও না। ‘আত্মবৎ সর্বভূতেষু’, কি কেবল পুঁথিতে থাকিবে না কি? যারা এক টুকরা রুটি গরীবের মুখে দিতে পারে না, তারা আবার মুক্তি কি দিবে! যারা অপরের নিঃশ্বাসে অপবিত্র হয়ে যায়, তারা আবার অপরকে কি পবিত্র করিবে? ছুঁৎমার্গ is a form of mental disease (একপ্রকার মানসিক ব্যাধি), সাবধান! All expansion is life, all contraction is death. All love is expansion, all selfishness is contraction. Love is therefore the only law of life. He who loves lives, he who is selfish is dying. Therefore love for love’s sake, because it is only law of life, just you breathe to live.৫২ This is the secret of নিষ্কাম প্রেম, কর্ম, &c. (ইহাই নিষ্কাম প্রেম, কর্ম প্রভৃতির রহস্য)।

শশীর (সাণ্ডেল) যদি কিছু উপকার করিতে পার চেষ্টা করিবে। সে অতি উদার ব্যক্তি ও নিষ্ঠাবান, তবে সঙ্কীর্ণপ্রাণ। পরদুঃখকাতরতা সকলের ভাগ্যে হয় না। রামকৃষ্ণাবতারে জ্ঞান ভক্তি ও প্রেম। অনন্ত জ্ঞান, অনন্ত প্রেম, অনন্ত কর্ম, অনন্ত জীবে দয়া। তোরা এখনও বুঝতে পারিসনি। শ্রুত্বাপ্যেনং বেদ ন চৈব কশ্চিৎ (কেহ কেহ আত্মার বিষয় শুনিয়াও ইঁহাকে জানিতে পারে না)। What the whole Hindu race has thought in ages, he lived in one life. His life is the living commentary to the Vedas of all the nations.৫৩ ক্রমশঃ লোকে বুঝবে—আমার পুরানো বোল—struggle, struggle up to light. Onward, (প্রাণপণ সংগ্রাম করে আলোর দিকে অগ্রসর হও)। অলমিতি—দাস

নরেন্দ্র

১৬০*

[মিসেস ওলি বুলকে লিখিত]

ব্রুকলিন
২০ জানুআরী, ১৮৯৫
… আপনার পিতা যে তাঁর জীর্ণ শরীর ত্যাগ করবেন, আমি পূর্বেই তার কতকটা আভাস পেয়েছিলাম, কিন্তু যখন এরূপ সঙ্গতিহীন মায়ার তরঙ্গ কাউকে আঘাত করবার উপক্রম করে, তখন তাকে সে বিষয় লেখাটা আমার অভ্যাস নয়। তবে এই সময়গুলি জীবনের এক একটা অধ্যায় পাল্টানোর মত—আর আমি জানি, আপনি এতে সম্পূর্ণ অবিচলিত আছেন। সমুদ্রের উপরিভাগটা পর্যায়ক্রমে উঠে নামে বটে, কিন্তু যে আত্মা ধীরভাবে তা পর্যবেক্ষণ করছেন, সেই জ্যোতির তনয়ের নিকট প্রত্যেক পতন ওর ভেতর দিকটা এবং নিম্নদেশস্থ মুক্তার স্তর ও প্রবালসমূহকে বেশী বেশী করে প্রকাশিত করে। আসা যাওয়া সম্পূর্ণ ভ্রমমাত্র। আত্মা কখনও আসেনও না, যানও না। যখন সমুদয় দেশ আত্মার মধ্যেই রয়েছে, তখন সে স্থানই বা কোথায়, আত্মা যেখানে যাবেন? যখন সমুদয় কাল আত্মাতেই রয়েছে, তখন ওর দেহাভ্যন্তরে প্রবেশ করবার ও ছাড়বার সময়ই বা কোথায়?

পৃথিবী ঘুরছে, ঐ ঘোরাতেই এই ভ্রম উৎপন্ন হচ্ছে যে সূর্য ঘুরছে; কিন্তু বাস্তবিকপক্ষে সূর্য ঘুরছে না। সেইরূপ প্রকৃতি বা মায়া বা স্বভাব ঘুরছে, পরিণাম প্রাপ্ত হচ্ছে, আবরণের পর আবরণ উন্মোচন করছে, এই মহান্‌ গ্রন্থের পাতার পর পাতা উল্টে যাচ্ছে—এদিকে সাক্ষিস্বরূপ আত্মা অবিচলিত ও অপরিণামী জ্ঞানসুধাপানে বিভোর আছেন। যত জীবাত্মা পূর্বে ছিল বা বর্তমানে আছে বা ভবিষ্যতে থাকবে, সকলেই বর্তমান কালে রয়েছে, আর জড় জগতের একটি উপমা ব্যবহার করে বলা যায় যে, তারা সকলেই এক জ্যামিতিক বিন্দুতে রয়েছে। যেহেতু আত্মাতে দেশের ভাব থাকতে পারে না, সেইহেতু যাঁরা সকলে আমাদের ছিলেন, আমাদের রয়েছেন এবং আমাদের হবেন, তাঁরা সকলেই আমাদের সঙ্গে সর্বদাই রয়েছেন, সর্বদাই ছিলেন এবং সর্বদাই থাকবেন। আমরা তাঁদের মধ্যে রয়েছি এবং তাঁরাও আমাদের মধ্যে রয়েছেন।

এই কোষগুলির কথা ধরুন। যদিও এরা প্রত্যেকটি পৃথক্, তথাপি সকলেই ক ও খ (দেহ ও প্রাণ)—এই দুই বিন্দুতে সম্মিলিত রয়েছে। সেখানে তারা এক। প্রত্যেকেরই এক একটা আলাদা আলাদা ব্যক্তিত্ব রয়েছে, কিন্তু সকলেই ঐ ক-খ নামক অক্ষে (axis) সম্মিলিত। কোনটাই সেই অক্ষকে ছেড়ে থাকতে পারে না, আর ঐসকল কোষের পরিধি যতই ভগ্ন বা ছিন্নভিন্ন হোক না কেন, ঐ অক্ষে দাঁড়িয়ে আমরা এর মধ্যে যে-কোন ঘরে ঢুকতে পারি। এই অক্ষটিই ঈশ্বর (ব্রহ্ম ও শক্তি)। এইখানেই আমরা তাঁর সঙ্গে এক; এতেই সকলের সঙ্গে সকলের যোগ, আর সকলেই সেই ভগবানে সম্মিলিত।

একখানা মেঘ চাঁদের উপর দিয়ে চলে যাচ্ছে, তাতে এই ভ্রমের উৎপত্তি হচ্ছে যে, চাঁদটাই চলেছে। তেমনি প্রকৃতি, দেহ, জড়বস্তু—এইগুলি সচল, গতিশীল; এদের গতিতেই এই ভ্রম উৎপন্ন হচ্ছে যে, আত্মা গতিশীল। সুতরাং অবশেষে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, সহজাত জ্ঞান (অথবা প্রেরণা?) দ্বারা সর্বজাতির উচ্চনীচ সব রকমের লোক, মৃতব্যক্তিদের অস্তিত্ব নিজেদের কাছেই অনুভব করে এসেছে, যুক্তির দৃষ্টিতেও তা সত্য।

প্রত্যেক জীবাত্মাই এক একটা নক্ষত্রস্বরূপ, আর ঈশ্বররূপ সেই অনন্ত নির্মল নীল আকাশে এই নক্ষত্ররাজি বিন্যস্ত রয়েছে। সেই ঈশ্বরই প্রত্যেক জীবাত্মার মূলস্বরূপ, তিনি প্রত্যেকের যথার্থ স্বরূপ, প্রত্যেকের প্রকৃত ব্যক্তিত্ব তিনিই। কতকগুলি জীবাত্মারূপ তারকা—যাঁরা আমাদের দিগন্তের বাইরে চলে গেছেন, তাঁদের সন্ধানেই ধর্ম জিনিষটার আরম্ভ; আর এই অনুসন্ধান সমাপ্ত হল—যখন তাঁদের সকলকেই ভগবানের মধ্যে পাওয়া গেল এবং আমরা আমাদের নিজেদেরও যখন তাঁর মধ্যে পেলাম। সুতরাং ভিতরের কথা হচ্ছে এই যে, আপনার পিতা যে জীর্ণ বস্ত্র পরিধান করেছিলেন, তা ত্যাগ করেছেন এবং অনন্তকাল যেখানে ছিলেন, সেখানেই অবস্থিত রয়েছেন। তিনি কি এ জগতে বা অন্য কোন জগতে আর একটি ঐরূপ বস্ত্র প্রস্তুত করে পরিধান করবেন? আমি ভগবৎসমীপে হৃদয়ের সহিত প্রার্থনা করছি, যে পর্যন্ত না পূর্ণ জ্ঞানের সহিত তিনি তা না করতে পারছেন, তাঁকে যেন আর তা না করতে হয়। প্রার্থনা করি, কাউকে যেন তার নিজকৃত পূর্ব কর্মের অদৃশ্য শক্তিতে পরিচালিত হয়ে ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোথাও না যেতে হয়। প্রার্থনা করি, সকলেই যেন মুক্ত হতে পারে অর্থাৎ জানতে পারে যে, আমরা মুক্ত। আর যদি বা আবার স্বপ্ন দেখতে হয়, তবে তাদের সে স্বপ্ন যেন শান্তি ও আনন্দপূর্ণ হয়। ইতি

বিবেকানন্দ

১৬১*

নিউ ইয়র্ক
২৪ জানুআরী, ১৮৯৫

প্রিয় মিসেস বুল,
মনে হয়—এ বৎসর আমার অতিরিক্ত পরিশ্রম হচ্ছে, কারণ অবসাদ অনুভব করছি। এক দফা বিশ্রামের খুব বেশী দরকার। সুতরাং মার্চ মাসের শেষভাগে বোষ্টনের কাজে হাত দেওয়ার সম্বন্ধে আপনার প্রস্তাবটি সমীচীন বটে। এপ্রিলের শেষাশেষি আমি ইংলণ্ড যাত্রা করব।

ক্যাট‍্স‍্কিল অঞ্চলে অতি অল্পমূল্যে বিস্তীর্ণ ভূমিখণ্ড পাওয়া যেতে পারে। একশত-এক একর পরিমাণ একটি জমি আছে; মূল্য মাত্র দু-শ ডলার। অর্থ মজুত রয়েছে। কিন্তু জমি আমার নামে তো আর কিনতে পারি না। এ দেশে আপনিই আমার একমাত্র সম্পূর্ণ বিশ্বাসভাজন বন্ধু। আপনি সম্মত হলে ঐ জমিটি আপনার নামে ক্রয় করি। গ্রীষ্মকালে শিক্ষার্থীরা ওখানে গিয়ে ইচ্ছামত কুটীর নির্মাণ বা শিবির রচনা করে ধ্যানাভ্যাস করতে পারবে। পরে অর্থসংগ্রহে সক্ষম হলে তারা সেখানে পাকা ঘর নির্মাণ করতে পারবে।

কাল এ-মাসের শেষ রবিবাসরীয় বক্তৃতা। আগামী মাসের প্রথম রবিবারে বক্তৃতা হবে ব্রুকলিন শহরে, অবশিষ্ট তিনটি নিউ ইয়র্কে। এ-বৎসরের মত নিউ ইয়র্ক-বক্তৃতাবলী এখানেই শেষ করব।

প্রাণ ঢেলে খেটেছি। আমার কাজের মধ্যে সত্যের বীজ যদি কিছু থাকে, কালে তা অঙ্কুরিত হবেই। অতএব আমি নিশ্চিন্ত—সকল বিষয়েই। বক্তৃতা এবং অধ্যাপনায় আমার বিতৃষ্ণা এসে যাচ্ছে। ইংলণ্ডে কয়েক মাস কাজ করার পর ভারতবর্ষে ফিরে গিয়ে বৎসর-কয়েকের জন্য অথবা চিরতরে গা-ঢাকা দেব। আমি যে ‘নিষ্কর্মা সাধু’ হয়ে থাকিনি, সে বিষয়ে অন্তর থেকে আমি নিঃসন্দেহ। একটি লেখবার খাতা আমার আছে। এটি আমার সঙ্গে পৃথিবীময় ঘুরছে। দেখছি সাত বৎসর পূর্বে এতে লেখা রয়েছেঃ এবার একটি একান্ত স্থান খুঁজে নিয়ে মৃত্যুর অপেক্ষায় পড়ে থাকতে হবে। কিন্তু তাহলে কি হয়, এই সব কর্মভোগ বাকী ছিল! আমার বিশ্বাস, এবার কর্মক্ষয় হয়েছে, এবং ভগবান্ আমাকে প্রচারকার্য তথা শুভকর্মের বন্ধন থেকেও অব্যাহতি দেবেন।

আত্মাই এক এবং অখণ্ড সত্তাস্বরূপ আর সব অসৎ—এই জ্ঞান হয়ে গেলে কি আর কোন ব্যক্তি বা বাসনা মানসিক উদ্বেগের হেতু হতে পারে? মায়ার প্রভাবেই পরোপকার ইত্যাদি খেয়ালগুলো আমার মাথায় ঢুকেছিল, এখন আবার সরে যাচ্ছে। চিত্তশুদ্ধি অর্থাৎ চিত্তকে জ্ঞানলাভের উপযোগী করা ছাড়া কর্মের যে আর কোন সার্থকতা নেই—এ বিষয়ে আমার বিশ্বাস ক্রমশঃ দৃঢ় হচ্ছে।

দুনিয়া তার ভাল মন্দ নিয়ে নানা রূপে চলতে থাকবে। ভাল মন্দ শুধু নূতন নামে ও নূতন স্থানে দেখা দেবে। নিরবচ্ছিন্ন প্রশান্তি ও বিশ্রামের জন্য আমার হৃদয় তৃষিত। ‘একাকী বিচরণ কর! একাকী বিচরণ কর! যিনি একাকী অবস্থান করেন, কাহারও সহিত কদাচ তাঁহার বিরোধ হইতে পারে না। তিনি অপরের উদ্বেগের হেতু হন না, অপরেও তাঁহার উদ্বেগের হেতু হন না।’ সেই ছিন্ন বস্ত্র (কৌপীন), মুণ্ডিত মস্তক, তরুতলে শয়ন ও ভিক্ষান্ন-ভোজন—হায়! এগুলিই এখন আমার তীব্র আকাঙ্ক্ষার বিষয়! শত অপূর্ণতা সত্ত্বেও সেই ভারতভূমিই একমাত্র স্থান, যেখানে আত্মা তার মুক্তির সন্ধান পায়—ভগবানের সন্ধান পায়। পাশ্চাত্যের এ-সব আড়ম্বর সর্বথা অন্তঃসারশূন্য ও আত্মার বন্ধন। জীবনে আর কখনও এর চেয়ে তীব্রভাবে জগতের অসারতা অনুভব করিনি। ভগবান্ সকলের বন্ধন ছিন্ন করে দিন—সকলেই মায়া-মুক্ত হোক, ইহাই বিবেকানন্দের চিরন্তন প্রার্থনা।

১৬২*

[মিস ইসাবেল ম্যাক্‌কিণ্ডলিকে লিখিত]

528, 5th Avenue, নিউ ইয়র্ক
২৪ জানুআরী, ১৮৯৫

প্রিয় মিস বেল,
আশা করি ভাল আছ …

আমার শেষ বক্তৃতাটা পুরুষদের দ্বারা খুব বেশী সমাদৃত হয়নি, কিন্তু দারুণভাবে সমাদৃত হয়েছে মেয়েদের দ্বারা। তুমি জান যে, ব্রুকলিন জায়গাটা নারী-অধিকার আন্দোলনের বিরোধিতা কেন্দ্র, তাই যখন আমি বললাম, মেয়েরা সর্ববিষয়ে অধিকার পাবার যোগ্য এবং তাদের তা পাওয়া উচিত, তখন বলাই বাহুল্য, পুরুষেরা সেটা পছন্দ করল না। তার জন্যে কোন চিন্তা নাই, মেয়েরা খুশীতে আত্মহারা।

আমার আবার একটু ঠাণ্ডা লেগেছে। আমি গার্নসিদের কাছে যাচ্ছি। শহরতলীতেও একটা ঘর পেয়েছি; সেখানে ক্লাস নেওয়ার ব্যাপারে কয়েক ঘণ্টা কাটাব। মাদার চার্চ নিশ্চয়ই এতদিনে সম্পূর্ণ ভাল হয়েছেন এবং তোমরা সকলে আজকালকার সুন্দর আবহাওয়া উপভোগ করছ। মিসেস এডাম‍স‍্ক‍ে আমার পর্বতপ্রমাণ ভালবাসা ও শ্রদ্ধা দিও, যখন তাঁর সঙ্গে তোমার দেখা হবে। আমার চিঠিগুলি যথারীতি গার্নসিদের কাছে পাঠিয়ে দিও।

সকলের জন্য আমার ভালবাসা।

তোমাদের সদা স্নেহবদ্ধ ভ্রাতা
বিবেকানন্দ

১৬৩*

[মিস মেরী হেলকে লিখিত]

54W. 33rd Street, N.Y
৫৪১, ডিয়ারবর্ন এভিনিউ, চিকাগো
১ ফেব্রুআরী, ১৮৯৫

স্নেহের ভগিনী,
এইমাত্র তোমার সুন্দর পত্রখানি পাইলাম। মাদার চার্চ কনসার্টে যাইতে পারেন নাই শুনিয়া অতীব দুঃখিত হইলাম। নিষ্কামভাবে কাজ করিতে বাধ্য হওয়াও সময়ে সময়ে উত্তম সাধন—যদিও তাহাতে নিজকৃত কর্মের ফলভোগ হইতে বঞ্চিত হইতে হয়।

ভগিনী জোসেফাইন লক‍্ও একখানি সুন্দর চিঠি লিখিয়াছেন। তোমার সমালোচনাগুলি পড়িয়া আমি মোটেই দুঃখিত হই নাই, বরং বিশেষ আনন্দিত হইয়াছি। সেদিন মিস থার্সবির বাড়ীতে এক প্রেসবিটেরিয়ান ভদ্রলোকের সহিত আমার তুমুল তর্ক হইয়াছিল। যেমন হইয়া থাকে, ভদ্রলোকটি অত্যন্ত উত্তেজিত ও ক্রুদ্ধ হইয়া গালাগালি আরম্ভ করিলেন। যাহা হউক, মিসেস বুল আমাকে এজন্য পরে খুব ভর্ৎসনা করিয়াছেন, কারণ এগুলি আমার কাজের পক্ষে ক্ষতিকর। তোমারও মত ঐ প্রকার বলিয়া বোধ হইতেছে।

তুমি যে এ সম্বন্ধে ঠিক এই সময়েই লিখিয়াছ, ইহা আনন্দের বিষয়, কারণ আমি ঐ বিষয়ে যথেষ্ট ভাবিতেছি। প্রথমতঃ আমি এই সকল ব্যাপারের জন্য আদৌ দুঃখিত নই; হয়তো তুমি ইহাতে বিরক্ত হইবে—হইবার কথা বটে। সাংসারিক উন্নতির জন্য মধুরভাষী হওয়া যে কত ভাল, তাহা আমি বিলক্ষণ জানি। আমি মিষ্টভাষী হইতে যথাসাধ্য চেষ্টা করি, কিন্তু যখন অন্তরস্থ সত্যের সহিত একটা ভয়ঙ্কর আপস করিতে হয়, তখনই আমি থামিয়া যাই। আমি বিনম্র দীনতায় বিশ্বাসী নহি—সমদর্শিত্বের ভক্ত!

সাধারণ মানবের কর্তব্য—তাহার ‘ঈশ্বর’—সমাজের সকল আদেশ পালন করা; কিন্তু জ্যোতির তনয়গণ কখনও সেরূপ করেন না। ইহা একটি চিরন্তন নিয়ম। একজন নিজেকে পারিপার্শ্বিক অবস্থা ও সামাজিক মতামতের সহিত খাপ খাওয়াইয়া সর্বকল্যাণপ্রদ সমাজের নিকট হইতে সর্ববিধ সুখসম্পদ পায়; অপর ব্যক্তি একাকী থাকিয়া সমাজকে তাঁহার দিকে টানিয়া লন।

সমাজের সঙ্গে যে নিজেকে খাপ খাওয়াইয়া চলে, তাহার পথ কুসুমাস্তীর্ণ, আর যে তাহা করে না, তাহার পথ কণ্টকাকীর্ণ। কিন্তু লোকমতের উপাসকেরা পলকেই বিনাশপ্রাপ্ত হয়; আর সত্যের তনয়গণ চিরজীবী।

আমি সত্যকে একটা অনন্তশক্তিসম্পন্ন জারক (corrosive) পদার্থের সহিত তুলনা করি; উহা যেখানে পড়ে, সেখানেই ক্ষয় করিতে করিতে নিজের পথ করিয়া লয়—নরম জিনিষে শীঘ্র, শক্ত গ্র্যানাইট পাথরে বিলম্বে; কিন্তু পথ করিয়া লইবেই। যল্লিখিতং তল্লিখিতম্। ভগিনী, আমি যে প্রত্যেকটি ঘোর মিথ্যার সহিত মিষ্টবাক্যে আপস করিতে পারি না, সেজন্য আমি অত্যন্ত দুঃখিত। কিন্তু আমি তাহা পারি না। সারাজীবন এজন্য ভুগিয়াছি, তবু তাহা করিতে পারি না। আমি বারবার চেষ্টা করিয়াছি, কিন্তু পারি নাই। ঈশ্বর মহিমময়, তিনি আমাকে মিথ্যাচারী হইতে দিবেন না। অবশেষে উহা ছাড়িয়া দিয়াছি। এক্ষণে যাহা ভিতরে আছে, তাহাই ফুটিয়া উঠুক। আমি এমন কোন পথ পাই নাই, যাহা সকলকে খুশী করিবে; সুতরাং আমি স্বরূপতঃ যাহা, তাহাই আমাকে থাকিতে হইবে—আমায় নিজ অন্তরাত্মার নিকট খাঁটি থাকিতে হইবে। ‘যৌবন ও সৌন্দর্য নশ্বর, জীবন ও ধনসম্পত্তি নশ্বর, নাম-যশও নশ্বর, এমন কি পর্বতও চূর্ণ বিচূর্ণ হইয়া ধূলিকণায় পরিণত হয়; বন্ধুত্ব ও প্রেম ক্ষণস্থায়ী, একমাত্র সত্যই চিরস্থায়ী।’ হে সত্যরূপী ঈশ্বর, তুমিই আমার একমাত্র পথপ্রদর্শক হও। আমার যথেষ্ট বয়স হইয়াছে, এখন আর মিষ্ট মধু হওয়া চলে না। আমি যেমন আছি, যেন তেমনই থাকি। ‘হে সন্ন্যাসী, তুমি নির্ভয়ে দোকানদারি ত্যাগ করিয়া, শত্রু-মিত্র কাহাকেও গ্রাহ্য না করিয়া সত্যে দৃঢ়প্রতিষ্ঠ থাক।’ এই মুহূর্ত হইতে আমি ইহামুত্রফলভোগবিরাগী হইলাম—‘ইহলোক এবং পরলোকের যাবতীয় অসার ভোগনিচয়কে পরিত্যাগ কর।’ হে সত্য, একমাত্র তুমিই আমার পথপ্রদর্শক হও। আমার ধনের কামনা নাই, নাম-যশের কামনা নাই, ভোগের কামনা নাই। ভগিনী, এ সকল আমার নিকট অতি তুচ্ছ। আমি আমার ভ্রাতৃগণকে সাহায্য করিতে চাহিয়াছিলাম। কিরূপে সহজে অর্থোপার্জন হয়, সে কৌশল আমার জানা নাই—ঈশ্বরকে ধন্যবাদ। আমার হৃদয়স্থিত সত্যের বাণী না শুনিয়া আমি কেন বাহিরের লোকদের খেয়াল অনুসারে চলিতে যাইব? ভগিনী, আমার মন এখনও দুর্বল, বাহ্য জগতের সাহায্য আসিলে সময়ে সময়ে অভ্যাসবশতঃ উহা আঁকড়াইয়া ধরি। কিন্তু আমি ভীত নহি। ভয়ই সর্বাপেক্ষা গুরুতর পাপ—ইহাই আমার ধর্মের শিক্ষা।

প্রেসবিটেরিয়ান যাজকমহাশয়ের সহিত আমার যে শেষ বাগ‍্‍যুদ্ধ এবং তৎপরে মিসেস বুলের সহিত যে দীর্ঘ তর্ক হয়, তাহা হইতে আমি স্পষ্ট বুঝিয়াছি, মনু কেন সন্ন্যাসিগণকে উপদেশ দিয়াছেনঃ একাকী থাকিবে, একাকী বিচরণ করিবে। বন্ধুত্ব বা ভালবাসামাত্রই সীমাবদ্ধতা; বন্ধুত্বে—বিশেষতঃ মেয়েদের বন্ধুত্বে চিরকালই ‘দেহি দেহি’ ভাব। হে মহাপুরুষগণ, তোমরাই ঠিক বলিয়াছ। যাহাকে কোন ব্যক্তিবিশেষের উপর নির্ভর করিতে হয়, সে সত্য-স্বরূপ ঈশ্বরের সেবা করিতে পারে না। হৃদয়, শান্ত হও, নিঃসঙ্গ হও, তাহা হইলেই অনুভব করিবে—প্রভু তোমার সঙ্গে সঙ্গে আছেন। জীবন কিছুই নহে, মৃত্যুও ভ্রমমাত্র! এইসব কিছুই নয়, একমাত্র ঈশ্বরই আছেন। হৃদয়, ভয় পাইও না, নিঃসঙ্গ হও। ভগিনী, পথ দীর্ঘ, সময় অল্প, সন্ধ্যাও ঘনাইয়া আসিতেছে। আমাকে শীঘ্র ঘরে ফিরিতে হইবে। আদবকায়দার শিক্ষা সম্পূর্ণ করিবার সময় আমার নাই। আমি যে বার্তা বহন করিয়া আনিয়াছি, তাহাই বলিয়া উঠিতে পারিতেছি না। তুমি সৎস্বভাবা, পরম দয়াবতী। আমি তোমার জন্য সব করিব; কিন্তু রাগ করিও না, আমি তোমাদের সকলকে শিশুর মত দেখি।

আর স্বপ্ন দেখিও না। হৃদয়, আর স্বপ্ন দেখিও না। এক কথায় জগৎকে আমার নূতন কিছু দিবার আছে। মানুষের মন যোগানর সময় আমার নাই, উহা করিতে গেলেই আমি ভণ্ড হইয়া পড়িব। বরং সহস্রবার মৃত্যু বরণ করিব, তবুও [মেরুদণ্ডহীন] জেলি মাছের মত জীপনযাপন করিয়া নির্বোধ মানুষের চাহিদা মিটাইতে পারিব না—তা আমার স্বদেশেই হোক অথবা বিদেশেই হউক। তুমিও যদি মিসেস বুলের মত ভাবিয়া থাক, আমার কোন বিশেষ কার্য আছে, তাহা হইলে ভুল বুঝিয়াছ, সম্পূর্ণ ভুল বুঝিয়াছ। এ জগতে বা অন্য কোন জগতে আমার কোনই কার্য নাই। আমার কিছু বলিবার আছে, উহা আমি নিজের ভাবে বলিব, হিন্দুভাবেও নয়, খ্রীষ্টানভাবেও নয়, বা অন্য কোনভাবেও নয়; আমি উহাদিগকে শুধু নিজের ভাবে রূপ দিব—এইমাত্র। মুক্তিই আমার একমাত্র ধর্ম, আর যাহা কিছু উহাকে বাধা দিতে চাহে, তাহা আমি পরিহার করিয়া চলিব—তাহার সহিত সংগ্রাম করিয়াই হউক বা তাহা হইতে পলায়ন করিয়াই হউক। কী! আমি যাজককুলের মনস্তুষ্টি করিতে চেষ্টা করিব!! ভগিনী, আমার এ-কথা ভুল বুঝিয়া তুমি ক্ষুণ্ণ হইও না। তোমরা শিশুমাত্র, আর শিশুদের অপরের অধীনে থাকিয়া শিক্ষা করাই কর্তব্য। তোমরা এখনও সেই উৎসবের আস্বাদ পাও নাই, যাহা ‘যুক্তিকে অযুক্তিতে পরিণত করে, মর্ত্যকে অমর করে, এই জগৎকে শূন্যে পর্যবসিত করে এবং মানুষকে দেবতা করিয়া তোলে।’ শক্তি থাকে তো লোকে যাহাকে ‘এই জগৎ’ নামে অভিহিত করে, সেই মূর্খতার জাল হইতে বাহির হইয়া আইস। তখন আমি তোমায় প্রকৃত সাহসী ও মুক্ত বলিব। যাহারা এই আভিজাত্যরূপ মিথ্যা ঈশ্বরকে চূর্ণবিচূর্ণ করিয়া তাহার চরম কপটতাকে পদদলিত করিতে সাহস করে, তাহাদিগকে যদি তুমি উৎসাহ দিতে না পার, তবে চুপ করিয়া থাক; কিন্তু আপস ও মনস্তুষ্টিকরারূপ মিথ্যা মূর্খতা দ্বারা তাহাদিগকে পুনরায় পঙ্কে টানিয়া আনিবার চেষ্টা করিও না।

আমি এই জগৎকে ঘৃণা করি—এই স্বপ্নকে, এই উৎকট দুঃস্বপ্নকে, তাহার গীর্জা ও প্রবঞ্চনাসমূহকে, তাহার শাস্ত্র ও বদমাশিগুলিকে, তাহার সুন্দর মুখ ও কপট হৃদয়কে, তাহার ধর্মধ্বজিতার আস্ফালন ও অন্তঃসারশূন্যতাকে—সর্বোপরি ধর্মের নামে তাহার দোকানদারিকে আমি ঘৃণা করি। কী! সংসারের ক্রীতদাসেরা কি বলিতেছে, তাহা দ্বারা আমার হৃদয়ের বিচার করিবে! ছিঃ! ভগিনী, তুমি সন্ন্যাসীকে চেনো না। বেদ বলেন, সন্ন্যাসী বেদশীর্ষ, কারণ তিনি গীর্জা, ধর্মমত, ঋষি (prophet), শাস্ত্র প্রভৃতি ব্যাপারের ধার ধারেন না। মিশনরীই হউক বা আপর কেহই হউক, তাহারা যথাসাধ্য চীৎকার ও আক্রমণ করুক, আমি তাহাদিগকে গ্রাহ্য করি না। ভর্তৃহরির ভাষায়ঃ৫৪ ইনি কি চণ্ডাল, অথবা ব্রাহ্মণ, অথবা শূদ্র, অথবা তপস্বী, অথবা তত্ত্ববিচারে পণ্ডিত কোন যোগীশ্বর?—এইরূপে নানা জনে নানা আলোচনা করিতে থাকিলেও যোগিগণ রুষ্টও হন না, তুষ্টও হন না; তাঁহারা আপন মনে চলিয়া যান। তুলসীদাসও বলিয়াছেনঃ

হাতী চলে বাজারমে কুত্তা ভোঁকে হাজার

সাধুওঁকা দুর্ভাব নহী জব্ নিন্দে সংসার।

যখন হাতী বাজারের মধ্য দিয়া চলিয়া যায়, তখন হাজার কুকুর পিছু পিছু চীৎকার করিতে আরম্ভ করে, কিন্তু হাতী ফিরিয়াও চাহে না। সেরূপ যখন সংসারী লোকেরা নিন্দা করিতে থাকে, তখন সাধুগণ তাহাতে বিচলিত হন না।

আমি ল্যাণ্ডসবার্গের (Landsberg) বাটীতে অবস্থান করিতেছি। ইনি সাহসী ও মহৎ ব্যক্তি। প্রভু তাঁহাকে আশীর্বাদ করুন। কখনও কখনও আমি গার্নসিদের (Guernseys) ওখানে শয়ন করিতে যাই। ঈশ্বর তোমাদের সকলকে চিরকালের জন্য কৃপা করুন। তিনি তোমাদিগকে শীঘ্র এই জগৎ নামক বিরাট ধাপ্পাবাজি হইতে উদ্ধার করুন। তোমরা যেন কদাপি এই জগৎরূপ জরাজীর্ণ ডাইনীর কুহকে না পড়! শঙ্কর তোমাদিগের সহায় হউন! উমা তোমাদিগের সমক্ষে সত্যের দ্বার উদ্ঘাটিত করিয়া দিন এবং তোমাদের সকল মোহ অপসারিত করুন! স্নেহাশীর্বাদসহ

তোমাদের
বিবেকানন্দ

১৬৪

[শ্রীযুক্ত বৈকুণ্ঠনাথ সান্যালকে লিখিত]

54W. 33rd St., নিউ ইয়র্ক
৯ ফেব্রুআরী, ১৮৯৫

প্রিয় সান্যাল,
তোমার এক পত্র পাইলাম, তাহাতে টাকা পৌঁছিবার সংবাদ লিখিয়াছ; কিন্তু বোষ্টন হইতে কয়েকটি বন্ধু যে টাকা পাঠান, তাহার সংবাদ এখনও পাই নাই—বোধ হয় দুই-এক সপ্তাহের মধ্যে পাইব। গোপালদাদা কাশী হইতে এক পত্র লেখে। জমির বিষয় যাহা লিখিয়াছ, তাহা কিছুই নহে। পরঞ্চ রাখাল এক পত্রে জমির বিষয় লিখিতেছেন, তাহাও কিছু বিশেষ নহে। দুটো ঘরওয়ালা যে জমির বিষয় লিখিয়াছ, তাহাতে আমার আপত্তি আছে—অর্থাৎ ঘরের জন্য জমিটার কমি না হয়। জমিটা যাহাতে বড় হয়, তাহার চেষ্টা করিবে। তোমাদের ঐ যে গোঁড়ামি, তাহাতে তোমাদের নিয়ে যে কিছু করা—তা আমার দ্বারা হবে না। পরমহংসদেব আমার গুরু ছিলেন; আমি তাঁকে যাই ভাবি, দুনিয়া তা ভাববে কেন? গুরুপূজার ভাব বাঙলাদেশ ছাড়া অন্যত্র আর নাই—তথাপি অন্য লোকে সে ভাব লইবার জন্য প্রস্তুত নহে। তোমাদের ভেতর একটা মস্ত মূর্খতা আছে যে, তোমরা একটা কি! বলি কলিকাতার দশ ক্রোশ তফাতে—না তোমাদের কেউ জানে, না তোমাদের গুরুকে কেউ জানে। আর তোমরা সেই ‘পরমহংসদেব অবতার’ নিয়ে ছেঁড়াছিঁড়ি। ফল—আমি শশী প্রভৃতিকে কিঞ্চিৎ বোঝাবার চেষ্টা করে দেখলাম যে, সে চেষ্টা নিষ্ফল। অতএব তাদের দিল্লীর লাড়ু দিয়ে সরে পড়াই ভাল।

মা-ঠাকুরাণীর জন্য জমি কিনে দিলে আমি আপনাকে ঋণমুক্ত মনে করব। তারপর আমি আর কিছু বুঝিসুঝি না। তোমরা তো আমার নামটি টেনে নেবার বেলা খুব তৈয়ার—যে আমি তোমাদেরই একজন। কিন্তু আমি একটা কাজ করতে বললে অমনি পেছিয়ে পড়, ‘মতলবকী গরজী জগ্ সারো’—এ জগৎ মতলবের গরজী।

আমি বাঙলাদেশ জানি, ইণ্ডিয়া জানি—লম্বা কথা কইবার একজন, কাজের বেলায়—০ (শূন্য)।

আমি এখানে জমিদারীও কিনি নাই, বা ব্যাঙ্কে লাখ টাকাও জমা নাই। এই ঘোর শীতে পর্বত-পাহাড়ে বরফ ঠেলে—এই ঘোর শীতে রাত্তির দুটো-একটা পর্যন্ত রাস্তা ঠেলে লেকচার করে দু-চার হাজার টাকা করেছি—মা-ঠাকুরাণীর জন্য জায়গা কিনলেই আমি নিশ্চিন্ত। গুঁতোগুঁতির আড্ডা করে দেবার শক্তি আমার নাই। অবতারের বাচ্চারা কোথায়—ছোট ছোট অবতারেরা—ওহে অবতারের পিলেগণ?

অলমিতি। তোমাদের হতে আমার কোন আশা নাই। তোমরাও আমার কোন আশা করো না। যে যার আপনার পথে চলে যাও। শুভমস্তু। এ দুনিয়া এই রকম মতলব-ভরা!

চিঠিপত্র উপরোক্ত ঠিকানায় লিখবে এখন হতে। এই ঠিকানা এখন হতে—আমার নিজের আড্ডা। যদি পার একখানা ‘যোগবাশিষ্ঠ রামায়ণ’—English translation (ইংরেজী অনুবাদ) পাঠাবে। মহিনকে দাম দিতে বলবে। ইতি

পূর্বে যে বইয়ের কথা লিখেছি অর্থাৎ সংস্কৃত নারদ-ও শাণ্ডিল্য-সূত্র, তাহা ভুলো না। ইতি

‘আশা হি পরমং দুঃখং নৈরাশ্যং পরমং সুখম্।’ ইতি

নরেন্দ্র