০৪. স্বামী-শিষ্য-সংবাদ ১৬-২০

১৬

স্থান—বেলুড়, ভাড়াটিয়া মঠ-বাটী
কাল—নভেম্বর, ১৮৯৮

 

বেলুড়ে নীলাম্বরবাবুর বাগানে এখনও মঠ রহিয়াছে। অগ্রহায়ণ মাসের শেষ ভাগ। স্বামীজী এই সময় সংস্কৃত শাস্ত্রাদির বহুধা আলোচনায় তৎপর। ‘আচণ্ডালাপ্রতিহতরয়ঃ’৪৩ ইত্যাদি শ্লোক-দুইটি তিনি এই সময়েই রচনা করেন। আজ স্বামীজী ‘ওঁ হ্রীং ঋতং’ ইত্যাদি স্তবটি রচনা করিয়া শিষ্যের হাতে দিয়া বলিলেন, ‘দেখিস, এতে কিছু ছন্দপতনাদি দোষ আছে কিনা।’

শিষ্য স্বীকার করিয়া উহার একখানি নকল করিয়া লইল।

স্বামীজী যে দিন ঐ স্তবটি রচনা করেন, সে দিন স্বামীজীর জিহ্বায় যেন সরস্বতী আরূঢ়া হইয়াছিলেন। শিষ্যের সহিত অনর্গল সুললিত সংস্কৃত ভাষায় প্রায় দু-ঘণ্টা কাল আলাপ করিয়াছিলেন। এমন সুললিত বাক্যবিন্যাস বড় বড় পণ্ডিতের মুখেও সে কখনও শোনে নাই।

শিষ্য স্তবটি নকল করিয়া লইবার পর স্বামীজী তাহাকে বলিলেন, ‘দেখ্‌, ভাবে তন্ময় হয়ে লিখতে লিখতে সময়ে সময়ে আমার ব্যাকরণগত স্খলন হয়; তাই তোদের বলি দেখে-শুনে দিতে।’

শিষ্য॥ মহাশয়, ও-সব স্খলন নয়—উহা আর্য প্রয়োগ।

স্বামীজী॥ তুই তো বললি, কিন্তু লোকে তা বুঝবে কেন? এই সেদিন ‘হিন্দুধর্ম কি?’ বলে একটা বাঙলায় লিখলুম—তা তোদের ভেতরই কেউ কেউ বলছে, কটমট বাঙলা হয়েছে। আমার মনে হয়, সকল জিনিষের মত ভাষা এবং ভাবও কালে একঘেয়ে হয়ে যায়। এদেশে এখন ঐরূপ হয়েছে বলে বোধ হয়। ঠাকুরের আগমনে ভাব ও ভাষায় আবার নূতন স্রোত এসেছে। এখন সব নূতন ছাঁচে গড়তে হবে। নূতন প্রতিভার ছাপ দিয়ে সকল বিষয় প্রচার করতে হবে। এই দেখ্‌ না—আগেকার কালের সন্ন্যাসীদের চালচলন ভেঙে গিয়ে এখন কেমন এক নূতন ছাঁচ দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। সমাজ এর বিরুদ্ধে বিস্তর প্রতিবাদও করছে। কিন্তু তাতে কিছু হচ্ছে কি?—না আমরাই তাতে ভয় পাচ্ছি? এখন এ-সব সন্ন্যাসীদের দূরদূরান্তরে প্রচারকার্যে যেতে হবে—ছাইমাখা অর্ধ-উলঙ্গ প্রাচীন সন্ন্যাসীদের বেশভূষায় গেলে প্রথম তো জাহাজেই নেবে না; ঐরূপ বেশে কোনরূপে ওদেশে পৌঁছলেও তাকে কারাগারে থাকতে হবে। দেশ, সভ্যতা ও সময়ের উপযোগী করে সকল বিষয়ই কিছু কিছু change (পরিবর্তন) করে নিতে হয়। এরপর বাঙলা ভাষায় প্রবন্ধ লিখব মনে করছি। সাহিত্যসেবিগণ হয়তো তা দেখে গালমন্দ করবে। করুক, তবু বাঙলা ভাষাটাকে নূতন ছাঁচে গড়তে চেষ্টা করব। এখনকার বাঙলা-লেখকেরা লিখতে গেলেই বেশী verb (ক্রিয়াপদ) use (ব্যবহার) করে; তাতে ভাষায় জোর হয় না। বিশেষণ দিয়ে verb (ক্রিয়াপদ)-এর ভাব প্রকাশ করতে পারলে ভাষার বেশী জোর হয়—এখন থেকে ঐরূপে লিখতে চেষ্টা কর্ দিকি। ‘উদ্বোধনে’ ঐরূপ ভাষায় প্রবন্ধ লিখতে চেষ্টা করবি।৪৪ ভাষার ভেতর verb (ক্রিয়াপদ)-গুলি ব্যবহারের মানে কি জানিস?—ঐরূপে ভাবের pause (বিরাম) দেওয়া; সেজন্য ভাষায় অধিক ক্রিয়াপদ ব্যবহার করাটা ঘন ঘন নিঃশ্বাস ফেলার মত দুর্বলতার চিহ্নমাত্র। ঐরূপ করলে মনে হয়, যেন ভাষার দম নেই। সেইজন্যই বাঙলা ভাষায় ভাল lecture (বক্তৃতা) দেওয়া যায় না। ভাষার উপর যার control (দখল) আছে, সে অত শীগগীর শীগগীর ভাব থামিয়ে ফেলে না। তোদের ডালভাত খেয়ে শরীর যেমন ভেতো হয়ে গেছে, ভাষাও ঠিক সেইরূপ হয়ে দাঁড়িয়েছে; আহার চালচলন ভাব-ভাষাতে তেজস্বিতা আনতে হবে, সব দিকে প্রাণের বিস্তার করতে হবে—সব ধমনীতে রক্তপ্রবাহ প্রেরণ করতে হবে, যাতে সকল বিষয়েই একটা প্রাণস্পন্দন অনুভূত হয়। তবেই এই ঘোর জীবনসংগ্রামে দেশের লোক survive করতে (বাঁচতে) পারবে। নতুবা অদূরে মৃত্যুর ছায়াতে অচিরে এ দেশ ও জাতিটা মিশে যাবে।

শিষ্য॥ মহাশয়, অনেক কাল হইতে এ দেশের লোকের ধাতু এক রকম হইয়া গিয়াছে; উহার পরিবর্তন করা কি শীঘ্র সম্ভব?

স্বামীজী॥ তুই যদি পুরানো চালটা খারাপ বুঝে থাকিস তো যেমন বললুম নূতন ভাবে চলতে শেখ না। তোর দেখাদেখি আরও দশজনে তাই করবে; তাদের দেখে আরও ৫০ জনে শিখবে—এইরূপে কালে সমস্ত জাতটার ভেতর ঐ নূতন ভাব জেগে উঠবে। আর বুঝেও যদি তুই সেরূপ কাজ না করিস, তবে জানবি তোরা কেবল কথায় পণ্ডিত—practically (কাজের বেলায়) মূর্খ।

শিষ্য॥ আপনার কথা শুনিলে মহা সাহসের সঞ্চার হয়, উৎসাহ বল ও তেজে হৃদয় ভরিয়া যায়।

স্বামীজী॥ হৃদয়ে ক্রমে ক্রমে বল আনতে হবে। একটা ‘মানুষ’ যদি তৈরী হয়, তো লাখ বক্তৃতার ফল হবে। মন মুখ এক করে idea (ভাব)-গুলি জীবনে ফলাতে হবে। এর নামই ঠাকুর বলতেন ‘ভাবের ঘরে চুরি না থাকা।’ সব দিকে practical (কাজের লোক) হতে হবে। থিওরীতে থিওরীতে দেশটা উৎসন্ন হয়ে গেল। যে ঠিক ঠিক ঠাকুরের সন্তান হবে, সে ধর্মভাবসকলের practicality (কাজে পরিণত করবার উপায়) দেখাবে, লোকের বা সমাজের কথায় ভ্রূক্ষেপ না করে আপন মনে কাজ করে যাবে। তুলসীদাসের দোঁহায় আছে, শুনিসনি?—

হাতী চলে বাজারমে কুত্তা ভোঁকে হাজার।
সাধুন্‌কো দুর্ভাব নেহি যব্ নিন্দে সংসার॥

এই ভাবে চলতে হবে। লোককে জানতে হবে পোক। তাদের ভালমন্দ কথায় কান দিলে জীবনে কোন মহৎ কাজ করতে পারা যায় না। ‘নায়মাত্মা বলহীনেন লভ্যঃ’—শরীরে-মনে বল না থাকলে আত্মাকে লাভ করা যায় না। পুষ্টিকর উত্তম আহারে আগে শরীর গড়তে হবে, তবে তো মনে বল হবে। মনটা শরীরেরই সূক্ষ্মাংশ। মনে-মুখে খুব জোর করবি। ‘আমি হীন, আমি হীন’ বলতে বলতে মানুষ হীন হয়ে যায়। শাস্ত্রকার তাই বলেছেন—

মুক্তাভিমানী মুক্তো হি বদ্ধো বদ্ধাভিমান্যপি।
কিম্বদন্তীতি সত্যেয়ং যা মতিঃ সা গতির্ভবেৎ॥

যার ‘মুক্ত’-অভিমান সর্বদা জাগরূক, সেই মুক্ত হয়ে যায়; যে ভাবে ‘আমি বদ্ধ’, জানবি জন্মে জন্মে তার বন্ধনদশা। ঐহিক পারমার্থিক উভয় পক্ষেই ঐ কথা সত্য জানবি। ইহ জীবনে যারা সর্বদা হতাশচিত্ত, তাদের দ্বারা কোন কাজ হতে পারে না; তারা জন্ম জন্ম হা হুতাশ করতে করতে আসে ও যায়। ‘বীরভোগ্যা বসুন্ধরা’—বীরই বসুন্ধরা ভোগ করে, এ-কথা ধ্রুব সত্য। বীর হ—সর্বদা বল্ ‘অভীঃ, অভীঃ।’ সকলকে শোনা ‘মাভৈঃ মাভৈঃ’—ভয়ই মৃত্যু, ভয়ই পাপ, ভয়ই নরক, ভয়ই অধর্ম, ভয়ই ব্যভিচার। জগতে যত কিছু negative thoughts (নেতিবাচক ভাব) আছে, সে-সকলই এই ভয়রূপ শয়তান থেকে বেরিয়েছে। এই ভয়ই সূর্যের সূর্যত্ব, ভয়ই বায়ুর বায়ুত্ব, ভয়ই যমের যমত্ব যথাস্থানে রেখেছে—নিজের নিজের গণ্ডীর বাইরে কাউকে যেতে দিচ্ছে না। তাই শ্রুতি বলছেন,

ভয়াদস্যাগ্নিস্তপতি ভয়াৎ তপতি সূর্যঃ।
ভয়াদিন্দ্রশ্চ বায়ুশ্চ মৃত্যুর্ধাবতি পঞ্চমঃ॥৪৫

যেদিন ইন্দ্র চন্দ্র বরুণ ভয়শূন্য হবেন, সব ব্রহ্মে মিশে যাবেন; সৃষ্টিরূপ অধ্যাসের লয় সাধিত হবে। তাই বলি—‘অভীঃ, অভীঃ।’—বলিতে বলিতে স্বামীজীর সেই নীলোৎপল-নয়নপ্রান্ত যেন অরুণরাগে রঞ্জিত হইয়াছে। যেন ‘অভীঃ’ মূর্তিমান্ হইয়া গুরুরূপে শিষ্যের সম্মুখে সশরীরে অবস্থান করিতেছেন।

স্বামীজী আবার বলিতে লাগিলেনঃ এই দেহধারণ করে কত সুখে-দুঃখে—কত সম্পদ-বিপদের তরঙ্গে আলোড়িত হবি। কিন্তু জানবি, ও-সব মূহূর্তকালস্থায়ী। ঐ-সকলকে গ্রাহ্যের ভেতর আনবিনি, ‘আমি অজর অমর চিন্ময় আত্মা’—এই ভাব হৃদয়ে দৃঢ়ভাবে ধারণ করে জীবন অতিবাহিত করতে হবে। ‘আমার জন্ম নেই, আমার মৃত্যু নেই, আমি নির্লেপ আত্মা’—এই ধারণায় একেবারে তন্ময় হয়ে যা। একবার তন্ময় হয়ে যেতে পারলে দুঃখ- কষ্টের সময় আপনা-আপনি ঐ ভাব মনে পড়বে, চেষ্টা করে আর আনতে হবে না। এই যে সেদিন বৈদ্যনাথ দেওঘরে প্রিয় মুখুয্যের বাড়ী গিয়েছিলুম, সেখানে এমন হাঁপ ধরল যে প্রাণ যায়। ভেতর থেকে কিন্তু শ্বাসে শ্বাসে গভীর ধ্বনি উঠতে লাগল—‘সোঽহং সোঽহং’; বালিশে ভর করে প্রাণবায়ু বেরোবার অপেক্ষা করছিলুম৪৬ আর দেখছিলুম—ভেতর থেকে কেবল শব্দ হচ্ছে ‘সোঽহং সোঽহং’—কেবল শুনতে লাগলুম ‘একমেবাদ্বয়ং ব্রহ্ম, নেহ নানাস্তি কিঞ্চন!’

শিষ্য॥ (স্তম্ভিত হইয়া) মহাশয়, আপনার সঙ্গে কথা কহিলে, আপনার অনুভূতিসকল শুনিলে শাস্ত্রপাঠের আর প্রয়োজন হয় না।

স্বামীজী॥ না রে! শাস্ত্রও পড়তে হয়। জ্ঞানলাভের জন্য শাস্ত্রপাঠ একান্ত প্রয়োজন। আমি মঠে শীঘ্রই class (ক্লাস) খুলছি। বেদ, উপনিষদ্, গীতা, ভাগবত পড়া হবে, অষ্টাধ্যায়ী পড়াব।

শিষ্য॥ আপনি কি অষ্টাধ্যায়ী পাণিনি পড়িয়াছেন?

স্বামীজী॥ যখন জয়পুরে ছিলুম, তখন এক মহাবৈয়াকরণের সঙ্গে দেখা হয়। তাঁর কাছে ব্যাকরণ পড়তে ইচ্ছা হল। ব্যাকরণে মহাপণ্ডিত হলেও তাঁর অধ্যাপনার তত ক্ষমতা ছিল না। আমাকে প্রথম সূত্রের ভাষ্য তিন দিন ধরে বোঝালেন, তবুও আমি তার কিছুমাত্র ধারণা করতে পারলুম না। চার দিনের দিন অধ্যাপক বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘স্বামীজী! তিন দিনেও আপনাকে প্রথম সূত্রের মর্ম বোঝাতে পারলুম না! আমাদ্বারা আপনার অধ্যাপনায় কোন ফল হবে না বোধ হয়।’ ঐ কথা শুনে মনে তীব্র ভর্ৎসনা এল। খুব দৃঢ়সঙ্কল্প হয়ে প্রথম সূত্রের ভাষ্য নিজে নিজে পড়তে লাগলুম। তিন ঘণ্টার মধ্যে ঐ সূত্রভাষ্যের অর্থ যেন ‘করামলকবৎ’ প্রত্যক্ষ হয়ে গেল, তারপর অধ্যাপকের কাছে গিয়ে সমস্ত ব্যাখ্যার তাৎপর্য কথায় কথায় বুঝিয়ে বললুম। অধ্যাপক শুনে বললেন, ‘আমি তিন দিন বুঝিয়ে যা করতে পারলুম না, আপনি তিন ঘণ্টায় তার এমন চমৎকার ব্যাখ্যা কেমন করে উদ্ধার করলেন?’ তারপর প্রতিদিন জোয়ারের জলের মত অধ্যায়ের পর অধ্যায় পড়ে যেতে লাগলুম। মনের একাগ্রতা থাকলে সব সিদ্ধ হয়—সুমেরুও চূর্ণ করতে পারা যায়।

শিষ্য॥ মহাশয়, আপনার সবই অদ্ভুত।

স্বামীজী॥ অদ্ভুত বলে বিশেষ একটা কিছুই নেই। অজ্ঞানতাই অন্ধকার। তাতেই সব ঢেকে রেখে অদ্ভুত দেখায়। জ্ঞানালোকে সব উদ্ভিন্ন হলে কিছুরই আর অদ্ভুতত্ব থাকে না। এমন যে অঘটন-ঘটন-পটীয়সী মায়া, তা-ও লুকিয়ে যায়! যাঁকে জানলে সব জানা যায়, তাঁকে জান্— তাঁর কথা ভাব—সেই আত্মা প্রত্যক্ষ হলে শাস্ত্রার্থ ‘করামলকবৎ’ প্রত্যক্ষ হবে। পুরাতন ঋষিগণের হয়েছিল, আর আমাদের হবে না? আমরাও মানুষ। একবার একজনের জীবনে যা হয়েছে, চেষ্টা করলে তা অবশ্যই আবার অন্যের জীবনেও সিদ্ধ হবে। History repeats itself—যা একবার ঘটেছে, তাই বার বার ঘটে। এই আত্মা সর্বভূতে সমান। কেবল প্রতি ভূতে তাঁর বিকাশের তারতম্য আছে মাত্র। এই আত্মা বিকাশ করবার চেষ্টা কর্। দেখবি— বুদ্ধি সব বিষয়ে প্রবেশ করবে। অনাত্মজ্ঞ পুরুষের বুদ্ধি একদেশদর্শিনী। আত্মজ্ঞ পুরুষের বুদ্ধি সর্বগ্রাসিনী। আত্মার প্রকাশ হলে দেখবি, দর্শন বিজ্ঞান সব আয়ত্ত হয়ে যাবে। সিংহগর্জনে আত্মার মহিমা ঘোষণা কর্, জীবকে অভয় দিয়ে বল্—‘উত্তিষ্ঠত জাগ্রত প্রাপ্য বরান্ নিবোধত’—Arise! Awake! And stop not till the goal is reached. (ওঠ, জাগো, লক্ষ্যে না পৌঁছান পর্যন্ত থামিও না।)

 

১৭

স্থান—বেলুড়, ভাড়াটিয়া মঠ-বাটী
কাল—১৮৯৮

 

আজ দু-দিন হইল শিষ্য বেলুড়ে নীলাম্বরবাবুর বাগানবাটীতে স্বামীজীর কাছে রহিয়াছে। কলিকাতা হইতে অনেক যুবক এ-সময় স্বামীজীর কাছে যাতায়াত করায় মঠে যেন আজকাল নিত্য-উৎসব। কত ধর্মচর্চা, কত সাধনভজনের উদ্যম, কত দীনদুঃখমোচনের উপায় আলোচিত হইতেছে!

আজ স্বামীজী শিষ্যকে তাঁহার কক্ষে রাত্রে থাকিবার অনুমতি দিয়াছেন। এই সেবাধিকার পাইয়া শিষ্যের হৃদয়ে আজ আনন্দ আর ধরে না। প্রসাদ-গ্রহণান্তে সে স্বামীজীর পদসেবা করিতেছে, এমন সময় স্বামীজী বলিলেনঃ

এমন জায়গা ছেড়ে তুই কিনা কলিকাতায় যেতে চাস—এখানে কেমন পবিত্র ভাব, কেমন গঙ্গার হাওয়া, কেমন সব সাধুর সমাগম! এমন স্থান কি আর কোথাও খুঁজে পাবি?

শিষ্য॥ মহাশয়, বহু জন্মান্তরের তপস্যায় আপনার সঙ্গলাভ হইয়াছে। এখন যাহাতে আর না মায়ামোহের মধ্যে পড়ি, কৃপা করিয়া তাহা করিয়া দিন। এখন প্রত্যক্ষ অনুভূতির জন্য মন মাঝে মাঝে বড় ব্যাকুল হয়।

স্বামীজী॥ আমারও অমন কত হয়েছে। কাশীপুরের বাগানে একদিন ঠাকুরের কাছে খুব ব্যাকুল হয়ে প্রার্থনা জানিয়েছিলুম। তারপর সন্ধ্যার সময় ধ্যান করতে করতে নিজের দেহ খুঁজে পেলুম না। দেহটা একেবারে নেই মনে হয়েছিল। চন্দ্র সূর্য, দেশ কাল আকাশ—সব যেন একাকার হয়ে কোথায় মিলিয়ে গিয়েছিল, দেহাদি-বুদ্ধির প্রায় অভাব হয়েছিল, প্রায় লীন হয়ে গিছলুম আর কি! একটু ‘অহং’ ছিল, তাই সে সমাধি থেকে ফিরেছিলুম। ঐরূপ সমাধিকালেই ‘আমি’ আর ‘ব্রহ্মের’ ভেদ চলে যায়, সব এক হয়ে যায়, যেন মহাসমুদ্র—জল জল, আর কিছুই নেই, ভাব আর ভাষা সব ফুরিয়ে যায়। ‘অবাঙ‍্‍মনসোগোচরম্’ কথাটা ঐ সময়েই ঠিক ঠিক উপলব্ধি হয়। নতুবা ‘আমি ব্রহ্ম’ এ-কথা সাধক যখন ভাবছে বা বলছে তখনও ‘আমি’ ও ‘ব্রহ্ম’ এই দুই পদার্থ পৃথক্ থাকে—দ্বৈতভান থাকে। তারপর ঐরূপ অবস্থালাভের জন্য বারংবার চেষ্টা করেও আনতে পারলুম না। ঠাকুরকে জানাতে বললেন, ‘দিবারাত্র ঐ অবস্থাতে থাকলে মা-র কাজ হবে না; সেজন্য এখন আর ঐ অবস্থা আনতে পারবি না, কাজ করা শেষ হলে পর আবার ঐ অবস্থা আসবে।’

শিষ্য॥ নিঃশেষ সমাধি বা ঠিক ঠিক নির্বিকল্প সমাধি হইলে তবে কি কেহই আর পুনরায় অহংজ্ঞান আশ্রয় করিয়া দ্বৈতভাবের রাজত্বে—সংসারে ফিরিতে পারে না?

স্বামীজী॥ ঠাকুর বলতেন, ‘একমাত্র অবতারেরাই জীবহিতে ঐ সমাধি থেকে নেবে আসতে পারেন। সাধারণ জীবনের আর ব্যুত্থান হয় না; একুশ দিন মাত্র জীবিত থেকে তাদের দেহটা শুষ্ক পত্রের মত সংসাররূপ বৃক্ষ হতে খসে পড়ে যায়।’

শিষ্য॥ মন বিলুপ্ত হইয়া যখন সমাধি হয়, মনের কোন তরঙ্গই যখন আর থাকে না, তখন আবার বিক্ষেপের—আবার অহংজ্ঞান লইয়া সংসারে ফিরিবার সম্ভাবনা কোথায়? মনই যখন নাই, তখন কে কি নিমিত্তই বা সমাধি-অবস্থা ছাড়িয়া দ্বৈতরাজ্যে নামিয়া আসিবে?

স্বামীজী॥ বেদান্তশাস্ত্রের অভিপ্রায় এই যে, নিঃশেষ নিরোধ-সমাধি থেকে পুনরাবৃত্তি হয় না; যথা—‘অনাবৃত্তিঃ শব্দাৎ।’ কিন্তু অবতারেরা এক-আধটা সামান্য বাসনা জীবহিতকল্পে রেখে দেন। তাই ধরে আবার super conscious state (জ্ঞানাতীত ভূমি) থেকে conscious state-এ—‘আমি তুমি’-জ্ঞানমূলক দ্বৈতভূমিতে আসেন।

শিষ্য॥ কিন্তু মহাশয়, যদি এক-আধটা বাসনাও থাকে, তবে তাহাকে নিঃশেষ নিরোধ-সমাধি বলি কিরূপে? কারণ শাস্ত্রে আছে, নিঃশেষ নির্বিকল্প সমাধিতে মনের সর্ব বৃত্তির, সকল বাসনার নিরোধ বা ধ্বংস হইয়া যায়।

স্বামীজী॥ মহাপ্রলয়ের পরে তবে সৃষ্টিই বা আবার কেমন করে হবে? মহাপ্রলয়েও তো সব ব্রহ্মে মিশে যায়? তারপরেও কিন্তু আবার শাস্ত্রমুখে সৃষ্টিপ্রসঙ্গ শোনা যায়—সৃষ্টি ও লয় প্রবাহাকারে আবার চলতে থাকে। মহাপ্রলয়ের পরে সৃষ্টি ও লয়ের পুনরাবর্তনের মত অবতার-পুরুষদিগের নিরোধ এবং ব্যুত্থানও তেমনি অপ্রাসঙ্গিক কেন হবে?

শিষ্য॥ আমি যদি বলি, লয়কালে পুনঃসৃষ্টির বীজ ব্রহ্মে লীনপ্রায় থাকে এবং উহা মহাপ্রলয় বা নিরোধ-সমাধি নহে, কিন্তু সৃষ্টির বীজ ও শক্তির—আপনি যেমন বলেন potential (অব্যক্ত) আকার-ধারণ মাত্র?

স্বামীজী॥ তা হলে আমি বলব, যে ব্রহ্মে কোন বিশেষণের আভাস নেই—যা নির্লেপ ও নির্গুণ—তাঁর দ্বারা এই সৃষ্টিই বা কিরূপে projected (বহির্গত) হওয়া সম্ভব হয়, তার জবাব দে।

শিষ্য॥ ইহা তো seeming projection (আপাতপ্রতীয়মান বহিঃপ্রকাশ)! সে কথার উত্তরে তো শাস্ত্র বলিয়াছে যে, ব্রহ্ম হইতে সৃষ্টির বিকাশটা মরুমরীচিকার মত দেখা যাইতেছে বটে, কিন্তু বস্তুতঃ সৃষ্টি প্রভৃতি কিছুই হয় নাই। ভাব-বস্তু ব্রহ্মের অভাব বা মিথ্যা মায়াশক্তিবশতঃ এইরূপ ভ্রম দেখাইতেছে।

স্বামীজী॥ সৃষ্টিটাই যদি মিথ্যা হয়—তবে জীবের নির্বিকল্প-সমাধি ও সমাধি থেকে ব্যুত্থানটাকেও তুই seeming (মিথ্যা) ধরে নিতে পারিস তো? জীব স্বতই ব্রহ্মস্বরূপ; তার আবার বন্ধের অনুভূতি কি? তুই যে ‘আমি আত্মা’ এই অনুভব করতে চাস, সেটাও তা হলে ভ্রম, কারণ শাস্ত্র বলছে, You are already that (তুমি সর্বদা ব্রহ্মই হয়ে রয়েছ)। অতএব ‘অয়মেব হি তে বন্ধঃ সমাধিমনুতিষ্ঠসি’—তুই যে সমাধিলাভ করতে চাচ্ছিস, এটাই তোর বন্ধন।

শিষ্য॥ এ তো বড় মুশকিলের কথা; আমি যদি ব্রহ্মই, তবে ঐ বিষয়ের সর্বদা অনুভূতি হয় না কেন?

স্বামীজী॥ Conscious plane-এ (‘তুমি- আমি’র দ্বৈতভূমিতে) ঐ কথা অনুভূতি করতে হলে একটা করণ বা যা দ্বারা অনুভব করবি, তা একটা চাই। মনই হচ্ছে আমাদের সেই করণ। কিন্তু মন পদার্থটা তো জড়। পেছনে আত্মার প্রভায় মনটা চেতনের মত প্রতিভাত হচ্ছে মাত্র। পঞ্চদশীকার তাই বলেছেন, ‘চিচ্ছায়াবশতঃ শক্তিশ্চেতনেব বিভাতি সা’-চিৎস্বরূপ আত্মার ছায়া বা প্রতিবিম্বের আবেশেই শক্তিকে চৈতন্যময়ী বলে মনে হয় এবং ঐ জন্যই মনকেও চেতনপদার্থ বলে বোধ হয়। অতএব ‘মন’ দিয়ে শুদ্ধ চৈতন্যস্বরূপ আত্মাকে যে জানতে পারবি না, এ-কথা নিশ্চয়। মনের পারে যেতে হবে। মনের পারে তো আর কোন করণ নেই—এক আত্মাই আছেন; সুতরাং যাকে জানবি, সেটাই আবার করণস্থানীয় হয়ে দাঁড়াচ্ছে। কর্তা কর্ম করণ—এক হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এজন্য শ্রুতি বলছেন, ‘বিজ্ঞাতারমরে কেন বিজানীয়াৎ।’ ফল-কথা conscious plane-এর (দ্বৈতভূমির) উপরে একটা অবস্থা আছে, সেখানে কর্তা-কর্ম-করণাদির দ্বৈতভান নেই। মন নিরুদ্ধ হলে তা প্রত্যক্ষ হয়। অন্য ভাষা নেই বলে ঐ অবস্থাটিকে ‘প্রত্যক্ষ’ করা বলছি; নতুবা সে অনুভব-প্রকাশের ভাষা নেই! শঙ্করাচার্য তাকে ‘অপরোক্ষানুভূতি’ বলে গেছেন। ঐ প্রত্যক্ষানুভূতি বা অপরোক্ষানুভূতি হলেও অবতারেরা নীচে নেবে এসে দ্বৈতভূমিতে তার আভাস দেন। সেজন্যই বলে, (আপ্তপুরুষের) অনুভব থেকেই বেদাদি শাস্ত্রের উৎপত্তি হয়েছে। সাধারণ জীবের অবস্থা কিন্তু ‘নুনের পুতুলের সমুদ্র মাপতে গিয়ে গলে যাওয়ার’ মত; বুঝলি? মোট কথা হচ্ছে যে, ‘তুই যে নিত্যকাল ব্রহ্ম’ এই কথাটা জানতে হবে মাত্র; তুই সর্বদা তাই হয়ে রয়েছিস, তবে মাঝখান থেকে একটা জড় মন (যাকে শাস্ত্রে ‘মায়া’ বলে) এসে সেটা বুঝতে দিচ্ছে না; সেই সূক্ষ্ম, জড়রূপ উপাদানে নির্মিত মনরূপ পদার্থটা প্রশমিত হলে—আত্মার প্রভায় আত্মা আপনিই উদ্ভাসিত হন। এই মায়া বা মন যে মিথ্যা, তার একটা প্রমাণ এই যে, মন নিজে জড় ও অন্ধকার-স্বরূপ। পেছনে আত্মার প্রভায় চেতনবৎ প্রতীত হয়। এটা যখন বুঝতে পারবি, তখন এক অখণ্ড চেতনে মনের লয় হয়ে যাবে; তখনই অনুভূতি হবে— ‘অয়মাত্মা ব্রহ্ম।’

অতঃপর স্বামীজী বলিলেন, ‘তোর ঘুম পাচ্ছে বুঝি?—তবে শো।’ শিষ্য স্বামীজীর পাশের বিছানায় শুইয়া নিদ্রা যাইতে লাগিল। শেষ রাত্রে সে এক অদ্ভুত স্বপ্ন দেখিয়া নিদ্রাভঙ্গে আনন্দে শয্যা ত্যাগ করিল। প্রাতে গঙ্গাস্নানান্তে শিষ্য আসিয়া দেখিল স্বামীজী মঠের নীচের তলায় বড় বেঞ্চখানির উপর পূর্বাস্য হইয়া বসিয়া আছেন। গত রাত্রের স্বপ্ন-কথা স্মরণ করিয়া স্বামীজীর পাদপদ্ম অর্চনা করিবার জন্য স্বামীজীর অনুমতি প্রার্থনা করিল। তাহার একান্ত আগ্রহে স্বামীজী সম্মত হইলে সে কতকগুলি ধুতুরা পুষ্প সংগ্রহ করিয়া আনিয়া স্বামি-শরীরে মহাশিবের অধিষ্ঠান চিন্তা করিয়া বিধিমত তাঁহার পূজা করিল।

পূজান্তে স্বামীজী শিষ্যকে বলিলেন, ‘তোর পূজা তো হল, কিন্তু বাবুরাম (প্রেমানন্দ) এসে তোকে এখনি খেয়ে ফেলবে! তুই কিনা ঠাকুরের পুজোর বাসনে (পুষ্পপাত্রে) আমার পা রেখে পুজো করলি?’ কথাগুলি বলা শেষ হইতে না হইতে স্বামী প্রেমানন্দ সেখানে উপস্থিত হইলেন এবং স্বামীজী তাঁহাকে বলিলেন, ‘ওরে, দেখ্, আজ কি কাণ্ড করেছে! ঠাকুরের পুজোর থালা বাসন চন্দন এনে ও আজ আমায় পুজো করেছে।’ স্বামী প্রেমানন্দ মহারাজ হাসিতে হাসিতে বলিলেন, ‘তা বেশ করেছে; তুমি আর ঠাকুর কি ভিন্ন?’ কথা শুনিয়া শিষ্য নির্ভয় হইল।

শিষ্য গোঁড়া হিন্দু; অখাদ্য দূরে থাকুক কাহারও স্পৃষ্ট দ্রব্য পর্যন্ত খায় না। এজন্য স্বামীজী শিষ্যকে কখনও কখনও ‘ভট‍্‍চায’ বলিয়া ডাকিতেন। প্রাতে জলযোগসময়ে বিলাতী বিস্কুটাদি খাইতে খাইতে স্বামীজী সদানন্দ স্বামীকে বলিলেন, ‘ভট‍্‍চাযকে ধরে নিয়ে আয় তো।’ আদেশ শুনিয়া শিষ্য নিকটে উপস্থিত হইলে স্বামীজী ঐ-সকল দ্রব্যের কিঞ্চিৎ তাহাকে প্রসাদস্বরূপে খাইতে দিলেন। শিষ্য দ্বিধা না করিয়া তাহা গ্রহণ করিল দেখিয়া স্বামীজী তাহাকে বলিলেন, ‘আজ কি খেলি তা জানিস? এগুলি ডিমের তৈরী!’ উত্তরে সে বলিল, ‘যাহাই থাকুক আমার জানিবার প্রয়োজন নাই। আপনার প্রসাদরূপ অমৃত খাইয়া অমর হইলাম।’ শুনিয়া স্বামীজী বলিলেন, ‘আজ থেকে তোর জাত, বর্ণ, আভিজাত্য, পাপপুণ্যাদি, অভিমান জন্মের মত দূর হোক—আশীর্বাদ করছি।’

অপরাহ্নে স্বামীজীর কাছে মান্দ্রাজের একাউণ্টেণ্ট জেনারেল বাবু মন্মথনাথ ভট্টাচার্য উপস্থিত হইলেন। আমেরিকা যাইবার পূর্বে মান্দ্রাজে স্বামীজী কয়েক দিন ইঁহার বাটীতে অতিথি হইয়াছিলেন এবং তদবধি ইনি স্বামীজীকে বিশেষ ভক্তি-শ্রদ্ধা করিতেন। ভট্টাচার্য মহাশয় স্বামীজীকে পাশ্চাত্য দেশ ও ভারতবর্ষ সম্বন্ধে নানা কথা জিজ্ঞাসা করিতে লাগিলেন। স্বামীজী তাঁহাকে ঐ-সকল প্রশ্নের উত্তর প্রদান করিয়া এবং অন্য নানারূপে আপ্যায়িত করিয়া বলিলেন, ‘একদিন এখানে থেকেই যান না।’ মন্মথবাবু তাহাতে রাজী হইয়া ‘আর একদিন এসে থাকা যাবে’ বলিয়া বিদায় গ্রহণ করিলেন।

 

১৮

স্থান—বেলুড়, ভাড়াটিয়া মঠ-বাটী
কাল—১৮৯৮

 

শিষ্য আজ প্রাতে মঠে আসিয়াছে। স্বামীজীর পাদপদ্ম বন্দনা করিয়া দাঁড়াইবামাত্র স্বামীজী বলিলেন, ‘কি হবে আর চাকরি করে? না হয় একটা ব্যবসা কর্।’ শিষ্য তখন এক স্থানে একটি প্রাইভেট মাষ্টারি করে মাত্র। সংসারের ভার তখনও তাহার ঘারে পড়ে নাই। আনন্দে দিন কাটায়। শিক্ষকতা-কার্য-সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করায় স্বামীজী বলিলেনঃ

অনেক দিন মাষ্টারি করলে বুদ্ধি খারাপ হয়ে যায়; জ্ঞানের বিকাশ হয় না। দিনরাত ছেলের দলে থেকে ক্রমে জড়বৎ হয়ে যায়। আর মাষ্টারি করিস না।

শিষ্য॥ তবে কি করিব?

স্বামীজী॥ কেন? যদি তোর সংসারই করতে হয়, যদি অর্থ-উপায়ের স্পৃহাই থাকে, তবে যা—আমেরিকায় চলে যা। আমি ব্যবসায়ের বুদ্ধি দেব। দেখবি পাঁচ বছরে কত টাকা এনে ফেলতে পারবি।

শিষ্য॥ কি ব্যবসা করিব? টাকাই বা কোথা হইতে পাইব?

স্বামীজী॥ পাগলের মত কি বকছিস? ভেতরে অদম্য শক্তি রয়েছে। শুধু ‘আমি কিছু নই’ ভেবে ভেবে বীর্যহীন হয়ে পড়েছিস। তুই কেন?—সব জাতটা তাই হয়ে পড়েছে! একবার বেড়িয়ে আয়—দেখবি ভারতেতর দেশে লোকের জীবন-প্রবাহ কেমন তরতর করে প্রবল বেগে বয়ে যাচ্ছে। আর তোরা কি করছিস? এত বিদ্যা শিখে পরের দোরে ভিখারীর মত ‘চাকরি দাও, চাকরি দাও’ বলে চেঁচাচ্ছিস। জুতো খেয়ে খেয়ে—দাসত্ব করে করে তোরা কি আর মানুষ আছিস! তোদের মূল্য এক কানাকড়িও নয়। এমন সজলা সফলা দেশ, যেখানে প্রকৃতি অন্য সকল দেশের চেয়ে কোটিগুণে ধন-ধান্য প্রসব করছেন, সেখানে দেহধারণ করে তোদের পেটে অন্ন নেই, পিঠে কাপড় নেই! যে দেশের ধন-ধান্য পৃথিবীর অন্য সব দেশে civilization (সভ্যতা) বিস্তার করেছে, সেই অন্নপূর্ণার দেশে তোদের এমন দুর্দশা? ঘৃণিত কুক্কুর অপেক্ষাও যে তোদের দুর্দশা হয়েছে! তোরা আবার তোদের বেদবেদান্তের বড়াই করিস! যে জাত সামান্য অন্নবস্ত্রের সংস্থান করতে পারে না, পরের মুখাপেক্ষী হয়ে জীবনধারণ করে, সে জাতের আবার বড়াই! ধর্মকর্ম এখন গঙ্গায় ভাসিয়ে আগে জীবনসংগ্রামে অগ্রসর হ। ভারতে কত জিনিষ জন্মায়। বিদেশী লোক সেই raw material (কাঁচা মাল) দিয়ে তার সাহায্যে সোনা ফলাচ্ছে। আর তোরা ভারবাহী গর্দভের মত তাদের মাল টেনে মরছিস। ভারতে যে-সব পণ্য উৎপন্ন হয়, দেশবিদেশের লোক তাই নিয়ে তার ওপর বুদ্ধি খরচ করে, নানা জিনিষ তয়ের করে বড় হয়ে গেল; আর তোরা তোদের বুদ্ধিটাকে সিন্দুকে পুরে রেখে ঘরের ধন পরকে বিলিয়ে ‘হা অন্ন, হা অন্ন’ করে বেড়াচ্ছিস!

শিষ্য॥ কি উপায়ে অন্ন-সংস্থান হইতে পারে, মহাশয়?

স্বামীজী॥ উপায় তোদেরই হাতে রয়েছে। চোখে কাপড় বেঁধে বলছিস, ‘আমি অন্ধ, কিছুই দেখতে পাই না!’ চোখের বাঁধন ছিঁড়ে ফেল, দেখবি মধ্যাহ্নসূর্যের কিরণে জগৎ আলো হয়ে রয়েছে। টাকা না জোটে তো জাহাজের খালাসী হয়ে বিদেশে চলে যা। দিশী কাপড়, গামছা, কুলো, ঝাঁটা মাথায় করে আমেরিকা-ইওরোপে পথে পথে ফেরি করগে। দেখবি—ভারত-জাত জিনিষের এখনও কত কদর! আমেরিকায় দেখলুম, হুগলী জেলার কতকগুলি মুসলমান ঐরূপে ফেরি করে করে ধনবান্ হয়ে পড়েছে। তাদের চেয়েও কি তোদের বিদ্যাবুদ্ধি কম? এই দেখ্ না—এদেশে যে বেনারসী শাড়ী হয়, এমন উৎকৃষ্ট কাপড় পৃথিবীর আর কোথাও জন্মায় না। এই কাপড় নিয়ে আমেরিকায় চলে যা। সে দেশে ঐ কাপড়ে গাউন তৈরী করে বিক্রী করতে লেগে যা, দেখবি কত টাকা আসে।

শিষ্য॥ মহাশয়, তারা বেনারসী শাড়ীর গাউন পরিবে কেন? শুনেছি, চিত্রবিচিত্র কাপড় ওদেশের মেয়েরা পছন্দ করে না।

স্বামীজী॥ নেবে কিনা, তা আমি বুঝব এখন। তুই উদ্যম করে চলে যা দেখি! আমার বহু বন্ধুবান্ধব সে দেশে আছে। আমি তোকে তাদের কাছে introduce (পরিচিত) করে দিচ্ছি। তাদের ভেতর ঐগুলি অনুরোধ করে প্রথমটা চালিয়ে দেব। তারপর দেখবি—কত লোক তাঁদের follow (অনুসরণ) করবে। তুই তখন মাল দিয়ে কুলিয়ে উঠতে পারবিনি।

শিষ্য॥ করিবার মূলধন কোথায় পাইব?

স্বামীজী॥ আমি যে করে হোক তোকে start (আরম্ভ) করিয়ে দেব। তারপর কিন্তু তোর নিজের উদ্যমের উপর সব নির্ভর করবে। ‘হতো বা প্রাপ্স্যসি স্বর্গং জিত্বা বা ভোক্ষ্যসে মহীম্’—এই চেষ্টায় যদি মরে যাস তা-ও ভাল, তোকে দেখে আরও দশ জন অগ্রসর হবে। আর যদি success (সফলতা) হয়, তো মহাভোগে জীবন কাটবে।

শিষ্য॥ আজ্ঞে হাঁ। কিন্তু সাহসে কুলায় না।

স্বামীজী॥ তাইতো বলছি বাবা, তোদের শ্রদ্ধা নেই—আত্মপ্রত্যয়ও নেই। কি হবে তোদের? না হবে সংসার, না হবে ধর্ম। হয় ঐ-প্রকার উদ্যোগ উদ্যম করে সংসারে successful (গণ্য মান্য সফল) হ—নয় তো সব ছেড়ে-ছুড়ে দিয়ে আমাদের পথে আয়। দেশ-বিদেশের লোককে ধর্ম উপদেশ দিয়ে তাদের উপকার কর। তবে তো আমাদের মত ভিক্ষা মিলবে। আদান-প্রদান না থাকলে কেউ কারুর দিকে চায় না। দেখছিস তো আমরা দুটো ধর্মকথা শোনাই, তাই গেরস্তেরা আমাদের দুমুঠো অন্ন দিচ্ছে। তোরা কিছুই করবিনি, তোদের লোকে অন্ন দেবে কেন? চাকরিতে গোলামিতে এত দুঃখ দেখেও তোদের চেতনা হচ্ছে না, কাজেই দুঃখও দূর হচ্ছে না! এ নিশ্চয়ই দৈবী মায়ার খেলা! ওদেশে দেখলুম, যারা চাকরি করে, parliament-এ (জাতীয় সমিতিতে) তাদের স্থান পেছনে নির্দিষ্ট। যারা নিজের উদ্যমে বিদ্যায় বুদ্ধিতে স্বনামধন্য হয়েছে, তাদের বসবার জন্যই front seat (সামনের আসনগুলি)। ও-সব দেশে জাত-ফাতের উৎপাত নেই। উদ্যম ও পরিশ্রমে ভাগ্যলক্ষ্মী যাঁদের প্রতি প্রসন্না, তাঁরাই দেশের নেতা ও নিয়ন্তা বলে গণ্য হন। আর তোদের দেশে জাতের বড়াই করে করে তোদের অন্ন পর্যন্ত জুটছে না। একটা ছুঁচ গড়বার ক্ষমতা নেই, তোরা আবার ইংরেজদের criticize (দোষগুণ-বিচার) করতে যাস—আহম্মক! ওদের পায়ে ধরে জীবন-সংগ্রামোপযোগী বিদ্যা, শিল্পবিজ্ঞান, কর্মতৎপরতা শিখগে। যখন উপযুক্ত হবি, তখন তোদের আবার আদর হবে। ওরাও তখন তোদের কথা রাখবে। কোথাও কিছুই নেই, কেবল Congress (কংগ্রেস—জাতীয় মহাসমিতি) করে চেঁচামিচি করলে কি হবে?

শিষ্য॥ মহাশয়, দেশের সমস্ত শিক্ষিত লোকই কিন্তু উহাতে যোগদান করিতেছে।

স্বামীজী॥ কয়েকটা পাস দিলে বা ভাল বক্তৃতা করতে পারলেই তোদের কাছে শিক্ষিত হল! যে বিদ্যার উন্মেষে ইতর-সাধারণকে জীবনসংগ্রামে সমর্থ করতে পারা যায় না, যাতে মানুষের চরিত্রবল, পরার্থতৎপরতা, সিংহসাহসিকতা এনে দেয় না, সে কি আবার শিক্ষা? যে শিক্ষায় জীবনে নিজের পায়ের উপরে দাঁড়াতে পাড়া যায়, সেই হচ্ছে শিক্ষা। আজকালকার এই সব স্কুল-কলেজে পড়ে তোরা কেমন এক প্রকারের একটা dyspeptic (অজীর্ণ রোগাক্রান্ত) জাত তৈরী হচ্ছিস। কেবল machine (কল)-এর মত খাটছিস, আর ‘জায়স্ব ম্রিয়স্ব’ এই বাক্যের সাক্ষিস্বরূপ হয়ে দাঁড়িয়েছিস। এই যে চাষাভুষো, মুচি-মুদ্দাফরাশ—এদের কর্মতৎপরতা ও আত্মনিষ্ঠা তোদের অনেকের চেয়ে ঢের বেশী। এরা নীরবে চিরকাল কাজ করে যাচ্ছে, দেশের ধন-ধান্য উৎপন্ন করছে, মুখে কথাটি নেই। এরা শীঘ্রই তোদের উপরে উঠে যাবে! Capital (মূলধন) তাদের হাতে গিয়ে পড়ছে—তোদের মত তাদের অভাবের জন্য তাড়না নেই। বর্তমান শিক্ষায় তোদের বাহ্যিক হাল-চাল বদলে দিচ্ছে, অথচ নূতন নূতন উদ্ভাবনী শক্তির অভাবে তোদের অর্থাগমের উপায় হচ্ছে না। তোরা এই-সব সহিষ্ণু নীচ জাতদের ওপর এতদিন অত্যাচার করেছিস, এখন এরা তার প্রতিশোধ নেবে। আর তোরা ‘হা চাকরি, জো চাকরি’ করে করে লোপ পেয়ে যাবি।

শিষ্য॥ মহাশয়, অপর দেশের তুলনায় আমাদিগের উদ্ভাবনী শক্তি অল্প হইলেও ভারতের ইতর জাতিসকল তো আমাদের বুদ্ধিতেই চালিত হইতেছে। অতএব ব্রাহ্মণ-কায়স্থাদি ভদ্র জাতিদিগকে জীবনসংগ্রামে পরাজিত করিবার শক্তি ও শিক্ষা ইতর জাতিরা কোথায় পাইবে?

স্বামীজী॥ তোদের মত তারা কতকগুলো বই-ই না-হয় না পড়েছে। তোদের মত শার্ট-কোট পরে সভ্য না-হয় নাই হতে শিখেছে। তাতে আর কি এল গেল! কিন্তু এরাই হচ্ছে জাতের মেরুদণ্ড—সব দেশে। এই ইতর শ্রেণীর লোক কাজ বন্ধ করলে তোরা অন্নবস্ত্র কোথায় পাবি? একদিন মেথররা কলিকাতায় কাজ বন্ধ করলে হা-হুতাশ লেগে যায়, তিন দিন ওরা কাজ বন্ধ করলে মহামারীতে শহর উজাড় হয়ে যায়! শ্রমজীবীরা কাজ বন্ধ করলে তোদের অন্নবস্ত্র জোটে না। এদের তোরা ছোট লোক ভাবছিস, আর নিজেদের শিক্ষিত বলে বড়াই করছিস?

জীবনসংগ্রামে সর্বদা ব্যস্ত থাকাতে নিম্নশ্রেণীর লোকদের এতদিন জ্ঞানোন্মেষ হয়নি। এরা মানববুদ্ধি-নিয়ন্ত্রিত কলের মত একই ভাবে এতদিন কাজ করে এসেছে, আর বুদ্ধিমান চতুর লোকেরা এদের পরিশ্রম ও উপার্জনের সারাংশ গ্রহণ করেছে; সকল দেশেই ঐ-রকম হয়েছে। কিন্তু এখন আর সে কাল নেই। ইতরজাতিরা ক্রমে ঐ-কথা বুঝতে পারছে এবং তার বিরুদ্ধে সকলে মিলে দাঁড়িয়ে আপনাদের ন্যায্য গণ্ডা আদায় করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়েছে। ইওরোপ-আমেরিকায় ইতরজাতিরা জেগে উঠে ঐ লড়াই আগে আরম্ভ করে দিয়েছে। ভারতেও তার লক্ষণ দেখা দিয়েছে, ছোটলোকদের ভেতর আজকাল এত যে ধর্মঘট হচ্ছে, ওতেই ঐ-কথা বোঝা যাচ্ছে। এখন হাজার চেষ্টা করলেও ভদ্র জাতেরা ছোট জাতদের আর দাবাতে পারবে না। এখন ইতরজাতদের ন্যায্য অধিকার পেতে সাহায্য করলেই ভদ্র জাতদের কল্যাণ।

তাই তো বলি, তোরা এই mass (জনসাধারণ)-এর ভেতর বিদ্যার উন্মেষ যাতে হয়, তাতে লেগে যা। এদের বুঝিয়ে বলগে, ‘তোমরা আমাদের ভাই, শরীরের একাঙ্গ; আমরা তোমাদের ভালবাসি, ঘৃণা করি না।’ তোদের এই sympathy (সহানুভূতি) পেলে এরা শত- গুণ উৎসাহে কার্যতৎপর হবে। আধুনিক বিজ্ঞানসহায়ে এদের জ্ঞানোন্মেষ করে দে। ইতিহাস, ভূগোল, বিজ্ঞান, সাহিত্য—সঙ্গে সঙ্গে ধর্মের গূঢ়তত্ত্বগুলি এদের শেখা। ঐ শিক্ষার বিনিময়ে শিক্ষকগণেরও দারিদ্র্য ঘুচে যাবে। আদানপ্রদানে উভয়েই উভয়ের বন্ধুস্থানীয় হয়ে দাঁড়াবে।

শিষ্য॥ কিন্তু মহাশয়, ইহাদের ভিতর শিক্ষার বিস্তার হইলে ইহারাও তো আবার কালে আমাদের মত উর্বরমস্তিষ্ক অথচ উদ্যমহীন ও অলস হইয়া উহাদিগের অপেক্ষা নিম্নশ্রেণীর লোকদিগের পরিশ্রমের সারাংশ গ্রহণ করিতে থাকিবে?

স্বামীজী॥ তা কেন হবে? জ্ঞানোন্মেষ হলেও কুমোর কুমোরই থাকবে, জেলে জেলেই থাকবে, চাষা চাষই করবে। জাত-ব্যবসা ছাড়বে কেন? ‘সহজং কর্ম কৌন্তেয় সদোষমপি ন ত্যজেৎ’—এই ভাবে শিক্ষা পেলে এরা নিজ নিজ বৃত্ত ছাড়বে কেন? জ্ঞানবলে নিজের সহজাত কর্ম যাতে আরও ভাল করে করতে পারে, সেই চেষ্টা করবে। দু-দশ জন প্রতিভাশালী লোক কালে তাদের ভেতর থেকে উঠবেই উঠবে। তাদের তোরা (ভদ্র জাতিরা) তোদের শ্রেণীর ভেতর করে নিবি। তেজস্বী বিশ্বামিত্রকে ব্রাহ্মণেরা যে ব্রাহ্মণ বলে স্বীকার করে নিয়েছিল, তাতে ক্ষত্রিয় জাতটা ব্রাহ্মণদের কাছে তখন কতদূর কৃতজ্ঞ হয়েছিল—বল্ দেখি? ঐরূপ sympathy (সহানুভূতি) ও সাহায্য পেলে মানুষ তো দূরের কথা, পশুপক্ষীও আপনার হয়ে যায়।

শিষ্য॥ মহাশয়, আপনি যাহা বলিতেছেন, তাহা সত্য হইলেও ভদ্রেতর শ্রেণীর ভিতর এখনও যেন বহু ব্যবধান রহিয়াছে বলিয়া বোধ হয়। ভারতবর্ষের ইতর জাতিদিগের প্রতি ভদ্রলোকদিগের সহানুভূতি আনয়ন করা বড় কঠিন ব্যাপার বলিয়া বোধ হয়।

স্বামীজী॥ তা না হলে কিন্তু তোদের (ভদ্র জাতিদের) কল্যাণ নেই। তোরা চিরকাল যা করে আসছিস—ঘরাঘরি লাঠালাঠি করে সব ধ্বংস হয়ে যাবি! এই mass (জনসাধারণ) যখন জেগে উঠবে, আর তাদের ওপর তোদের (ভদ্রলোকদের) অত্যাচার বুঝতে পারবে—তখন তাদের ফুৎকারে তোরা কোথায় উড়ে যাবি! তারাই তোদের ভেতর civilization (সভ্যতা) এনে দিয়েছে; তারাই আবার তখন সব ভেঙে দেবে। ভেবে দেখ্—গল-জাতের হাতে অমন যে প্রাচীন রোমক সভ্যতা কোথায় ধ্বংস হয়ে গেল! এই জন্য বলি, এইসব নীচ জাতদের ভেতর বিদ্যাদান জ্ঞানদান করে এদের ঘুম ভাঙাতে যত্নশীল হ। এরা যখন জাগবে—আর একদিন জাগবে নিশ্চয়ই—তখন তারাও তোদের কৃত উপকার বিস্মৃত হবে না, তোদের নিকট কৃতজ্ঞ হয়ে থাকবে।

এইরূপ কথোপকথনের পর স্বামীজী শিষ্যকে বলিলেনঃ ও-সব কথা এখন থাক; তুই এখন কি স্থির করলি, তা বল। যা হয় একটা কর। হয়, কোন ব্যবসায়ের চেষ্টা দেখ, নয় তো আমাদের মত ‘আত্মনো মোক্ষার্থং জগদ্ধিতায় চ’ যথার্থ সন্ন্যাসের পথে চলে আয়। এই শেষ পন্থাই অবশ্য শ্রেষ্ঠ পন্থা, কি হবে ছাই সংসারী হয়ে? বুঝে তো দেখছিস সবই ক্ষণিক—‘নলিনীদলগতজলমতিতরলং তদ্বজ্জীবনমতিশয়চপলম্’৪৭। অতএব যদি এই আত্মপ্রত্যয় লাভ করতে উৎসাহ হয়ে থাকে তো আর কালবিলম্ব করিস নে। এখুনি অগ্রসর হ। ‘যদহরেব বিরজেৎ তদহরেব প্রব্রজেৎ।’ পরার্থে নিজ জীবন বলি দিয়ে লোকের দোরে দোরে গিয়ে অভয়বাণী শোনা—‘উত্তিষ্ঠত জাগ্রত প্রাপ্য বরান্ নিবোধত।’

 

১৯

স্থান—বেলুড়, ভাড়াটিয়া মঠ-বাটী ও নূতন মঠভূমি
কাল—৯ ডিসেম্বর, ১৮৯৮

 

আজ নূতন মঠের জমিতে স্বামীজী যজ্ঞ করিয়া শ্রীশ্রীঠাকুর-প্রতিষ্ঠা করিবেন। শিষ্য পূর্বরাত্র হইতেই মঠে আছে; ঠাকুর-প্রতিষ্ঠা দর্শন করিবে—এই বাসনা।

প্রাতে গঙ্গাস্নান করিয়া স্বামীজী ঠাকুর-ঘরে প্রবেশ করিলেন। অনন্তর পূজকের আসনে বসিয়া পুষ্পপাত্রে যতগুলি ফুল-বিল্বপত্র ছিল, সব দুই হাতে এককালে তুলিয়া লইলেন এবং শ্রীরামকৃষ্ণদেবের শ্রীপাদুকায় অঞ্জলি দিয়া ধ্যানস্থ হইলেন—অপূর্ব দর্শন। তাঁহার ধর্মপ্রভা-বিভাসিত স্নিগ্ধোজ্জ্বল কান্তিতে ঠাকুর-ঘর যেন কি এক অদ্ভুত আলোকে পূর্ণ হইল! প্রেমানন্দ ও অন্যান্য সন্ন্যাসিগণ ঠাকুর-ঘরের দ্বারে দাঁড়াইয়া রহিলেন।

ধ্যানপূজাবসানে এইবার মঠভূমিতে যাইবার আয়োজন হইতে লাগিল। তাম্রনির্মিত কৌটায় রক্ষিত শ্রীরামকৃষ্ণদেবের ভস্মাস্থি স্বামীজী স্বয়ং দক্ষিণ স্কন্ধে লইয়া অগ্রগামী হইলেন। অন্যান্য সন্ন্যাসিগণসহ শিষ্য পশ্চাৎ পশ্চাৎ চলিল। শঙ্খ-ঘণ্টারোলে তটভূমি মুখরিত হওয়ায় ভাগীরথী যেন ঢল ঢল ভাবে নৃত্য করিতে লাগিল। যাইতে যাইতে স্বামীজী শিষ্যকে বলিলেনঃ

ঠাকুর আমায় বলেছিলেন, ‘তুই কাঁধে করে আমায় যেখানে নিয়ে যাবি, আমি সেখানেই যাব ও থাকব। তা গাছতলাই কি, আর কুটীরই কি।’ সেজন্যই আমি স্বয়ং তাঁকে কাঁধে করে নূতন মঠভূমিতে নিয়ে যাচ্ছি। নিশ্চয় জানবি, বহু কাল পর্যন্ত ‘বহুজনহিতায়’ ঠাকুর ঐ স্থানে স্থির হয়ে থাকবেন।

শিষ্য॥ ঠাকুর আপনাকে কখন এই কথা বলিয়াছেন?

স্বামীজী॥ (মঠের সাধুগণকে দেখাইয়া) ওদের মুখে শুনিসনি?—কাশীপুরের বাগানে।

শিষ্য॥ ওঃ! সেই সময়েই বুঝি ঠাকুরের গৃহস্থ ও সন্ন্যাসী ভক্তদের ভিতর সেবাধিকার লইয়া দলাদলি হইয়াছিল?

স্বামীজী॥ ‘দলাদলি’ ঠিক নয়, একটু মন-কষাকষি হয়েছিল। জানবি, যাঁরা ঠাকুরের ভক্ত, যাঁরা ঠিক ঠিক তাঁর কৃপা লাভ করেছেন—তা গৃহস্থই হোন আর সন্ন্যাসীই হোন—তাঁদের ভেতর দল-ফল নেই, থাকতেই পারে না। তবে ওরূপ একটু-আধটু মন-কষাকষির কারণ কি তা জানিস? প্রত্যেক ভক্ত ঠাকুরকে আপন আপন বুদ্ধির রঙে রাঙিয়ে এক একজনে এক এক রকম দেখে ও বোঝে। তিনি যেন মহাসূর্য, আর আমরা যেন প্রত্যেকে এক এক রকম রঙীন কাঁচ চোখে দিয়ে সেই এক সূর্যকে নানা রঙ-বিশিষ্ট বলে দেখছি। অবশ্য এই কথাও ঠিক যে, কালে এই থেকেই দলের সৃষ্টি হয়। তবে যারা সৌভাগ্যক্রমে অবতারপুরুষের সাক্ষাৎ সম্পর্কে আসে, তাদের জীবৎকালে ঐরূপ ‘দল-ফল’ সচরাচর হয় না। সেই আত্মারাম পুরুষের আলোতে তাদের চোখ ঝলসে যায়; অহঙ্কার, অভিমান, হীনবুদ্ধি সব ভেসে যায়। কাজেই ‘দল-ফল’ করবার তাদের অবসর হয় না; কেবল যে যার নিজের ভাবে হৃদয়ের পূজা দেয়।

শিষ্য॥ মহাশয়, তবে কি ঠাকুরের ভক্তেরা সকলেই তাঁহাকে ভগবান্ বলিয়া জানিলেও সেই এক ভগবানের স্বরূপ তাঁহারা ভিন্ন ভিন্ন ভাবে দেখেন এবং সেজন্যই তাঁহাদের শিষ্য-প্রশিষ্যেরা কালে এক একটি ক্ষুদ্র গণ্ডীর ভিতরে পড়িয়া ছোট ছোট দল বা সম্প্রদায়সকল গঠন করিয়া বসে?

স্বামীজী॥ হাঁ, এজন্য কালে সম্প্রদায় হবেই। এই দেখ্ না, চৈতন্যদেবের এখন দু-তিনশ সম্প্রদায় হয়েছে; যীশুর হাজার হাজার মত বেরিয়েছে; কিন্তু ঐ-সকল সম্প্রদায় চৈতন্যদেব ও যীশুকেই মানছে।

শিষ্য॥ তবে শ্রীরামকৃষ্ণদেবের ভক্তদিগের মধ্যেও কালে বোধ হয় বহু সম্প্রদায় হইবে?

স্বামীজী॥ হবে বৈকি। তবে আমাদের এই যে মঠ হচ্ছে, তাতে সকল মতের, সকল ভাবের সামঞ্জস্য থাকবে। ঠাকুরের যেমন উদার মত ছিল, এটি ঠিক সেই ভাবের কেন্দ্রস্থান হবে; এখান থেকে যে মহাসমন্বয়ের উদ্ভিন্ন ছটা বেরুবে, তাতে জগৎ প্লাবিত হয়ে যাবে।

এইরূপ কথাবার্তা চলিতে চলিতে সকলে মঠভূমিতে উপস্থিত হইলেন। স্বামীজী স্কন্ধস্থিত কৌটাটি জমিতে বিস্তীর্ণ আসনোপরি নামাইয়া ভূমিষ্ঠ হইয়া প্রণাম করিলেন। অপর সকলেও প্রণাম করিলেন।

অনন্তর স্বামীজী পুনরায় পূজায় বসিলেন। পূজান্তে যজ্ঞাগ্নি প্রজ্বলিত করিয়া হোম করিলেন এবং সন্ন্যাসী ভ্রাতৃগণের সহায়ে স্বহস্তে পায়সান্ন প্রস্তুত করিয়া ঠাকুরকে নিবেদন করিলেন। বোধ হয়, ঐ দিন ঐ স্থানে তিনি কয়েকটি গৃহস্থকে দীক্ষাও দিয়াছিলেন। পূজা সমাপন করিয়া স্বামীজী সাদরে সমাগত সকলকে আহ্বান ও সম্বোধন করিয়া বলিলেনঃ

আপনারা আজ কায়মনোবাক্যে ঠাকুরের পাদপদ্মে প্রার্থনা করুন যেন মহাযুগাবতার ঠাকুর আজ থেকে বহুকাল ‘বহুজনহিতায় বহুজনসুখায়’ এই পুণ্যক্ষেত্রে অবস্থান করে একে সর্বধর্মের অপূর্ব সমন্বয়-কেন্দ্র করে রাখেন।

সকলেই করজোড়ে ঐরূপে প্রার্থনা করিলেন। পূজান্তে স্বামীজী শিষ্যকে ডাকিয়া বলিলেন, ‘ঠাকুরের এই কৌটা ফিরিয়ে নিয়ে যাবার আমাদের (সন্ন্যাসীদের) কারও আর অধিকার নেই; কারণ আজ আমরা ঠাকুরকে এখানে বসিয়েছি। অতএব তুই-ই মাথায় করে ঠাকুরের এই কৌটা তুলে মঠে নিয়ে চল।’ শিষ্য কৌটা স্পর্শ করিতে কুণ্ঠিত হইতেছে দেখিয়া স্বামীজী বলিলেন, ‘ভয় নেই, মাথায় কর, আমার আজ্ঞা।’

শিষ্য তখন আনন্দিত চিত্তে স্বামীজীর আজ্ঞা শিরোধার্য করিয়া কৌটা মাথায় তুলিয়া লইল এবং শ্রীগুরুর আজ্ঞায় ঐ কৌটার স্পর্শাধিকার লাভ করিয়া আপনাকে ধন্য জ্ঞান করিতে করিতে চলিল। অগ্রে কৌটা-মস্তকে শিষ্য, পশ্চাতে স্বামীজী, তারপর অন্যান্য সকলে আসিতে লাগিলেন। পথিমধ্যে স্বামীজী তাহাকে বলিলেন, ‘ঠাকুর আজ তোর মস্তকে উঠে তোকে আশীর্বাদ করছেন। সাবধান, আজ থেকে আর কোন অনিত্য বিষয়ে মন দিসনে।’ একটি ছোট সাঁকো পার হইবার পূর্বে স্বামীজী শিষ্যকে পুনরায় বলিলেন, ‘দেখিস, এবার খুব সাবধান, খুব সতর্কে যাবি।’

এইরূপে নির্বিঘ্নে মঠে (নীলাম্বর বাবুর বাগানে) উপস্থিত হইয়া সকলেই আনন্দ করিতে লাগিলেন। স্বামীজী শিষ্যকে এখন কথাপ্রসঙ্গে বলিতে লাগিলেনঃ

ঠাকুরের ইচ্ছায় আজ তাঁর ধর্মক্ষেত্রের প্রতিষ্ঠা হল। বার বছরের চিন্তা আমার মাথা থেকে নামল। আমার মনে এখন কি হচ্ছে, জানিস? এই মঠ হবে বিদ্যা ও সাধনার কেন্দ্রস্থান। তোদের মত ধার্মিক গৃহস্থেরা এর চারদিককার জমিতে ঘরবাড়ী করে থাকবে, আর মাঝখানে ত্যাগী সন্ন্যাসীরা থাকবে। আর মঠের ঐ দক্ষিণের জমিটায় ইংলণ্ড ও আমেরিকার ভক্তদের থাকবার ঘর-দোর হবে। এরূপ হলে কেমন হয় বল দেখি?

শিষ্য॥ মহাশয়, আপনার এ অদ্ভুত কল্পনা!

স্বামীজী॥ কল্পনা কি রে? সময়ে সব হবে। আমি তো পত্তন-মাত্র করে দিচ্ছি—এর পর আরও কত কি হবে! আমি কতক করে যাব; আর তোদের ভেতর নানা idea (ভাব) দিয়ে যাব। তোরা পরে সে-সব work out (কাজে পরিণত) করবি। বড় বড় principle (নীতি) কেবল শুনলে কি হবে? সেগুলিকে practical field-এ (কর্মক্ষেত্রে) দাঁড় করাতে—প্রতিনিয়ত কাজে লাগাতে হবে। শাস্ত্রের লম্বা লম্বা কথাগুলি কেবল পড়লে কি হবে? শাস্ত্রের কথাগুলি আগে বুঝতে হবে। তারপর জীবনে সেগুলিকে ফলাতে হবে। বুঝলি? একেই বলে practical religion (কর্মজীবনে পরিণত ধর্ম)।

এইরূপে নানা প্রসঙ্গ চলিতে চলিতে শ্রীমৎ শঙ্করাচার্যের কথা উঠিল। শিষ্য শ্রীশঙ্করের বড়ই পক্ষপাতী ছিল; এমন কি, ঐ বিষয়ে তাহাকে গোঁড়া বলিলেও বলা যাইত। স্বামীজী উহা জানিতেন এবং কেহ কোন মতের গোঁড়া হয়, ইহা তিনি সহ্য করিতে পারিতেন না। কোন বিষয়ের গোঁড়ামি দেখিলেই তিনি উহার বিরুদ্ধপক্ষ অবলম্বন করিতেন এবং অজস্র অমোঘ যুক্তির আঘাতে ঐ গোঁড়ামির সঙ্কীর্ণ বাঁধ চূর্ণবিচূর্ণ করিয়া দিতেন।

স্বামীজী॥ শঙ্করের ক্ষুরধার বুদ্ধি—তিনি বিচারক বটে, পণ্ডিত বটে, কিন্তু তাঁর উদারতাটা বড় গভীর ছিল না; হৃদয়টাও ঐরূপ ছিল বলে বোধ হয়। আবার ব্রাহ্মণ-অভিমানটুকু খুব ছিল। একটু দক্ষিণী ভট্টাচার্য গোছের ছিলেন আর কি! ব্রাহ্মণেতর জাতের ব্রহ্মজ্ঞান হবে না—এ কথা বেদান্তভাষ্যে কেমন সমর্থন করে গেছেন! বলিহারি বিচার! বিদুরের৪৮ কথা উল্লেখ করে বলেছেন—তার পূর্বজন্মের ব্রাহ্মণ-শরীরের ফলে সে ব্রহ্মজ্ঞ হয়েছিল। বলি, আজকাল যদি ঐরূপ কোন শূদ্রের ব্রহ্মজ্ঞান হয়, তবে কি তোর শঙ্করের মতে মত দিয়ে বলতে হবে যে, সে পূর্বজন্মে ব্রাহ্মণ ছিল, তাই তার হয়েছে? ব্রাহ্মণত্বের এত টানাটানিতে কাজ কি রে বাবা? বেদ তো ত্রৈবর্ণিক-মাত্রকেই বেদপাঠ ও ব্রহ্মজ্ঞানের অধিকারী করেছে। অতএব শঙ্করের ঐ বিষয় নিয়ে বেদের উপর এই অদ্ভুত বিদ্যাপ্রকাশের কোন প্রয়োজন ছিল না। আবার এমনি হৃদয় যে, কত বৌদ্ধ শ্রমণকে আগুনে পুড়িয়ে মারলেন—তাদের তর্কে হারিয়ে! আহাম্মক বৌদ্ধগুলোও কিনা তর্কে হার মেনে আগুনে পুড়ে মরতে গেল! শঙ্করের ঐরূপ কাজকে fanaticism (সঙ্কীর্ণ গোঁড়ামি) ছাড়া আর কি বলা যেতে পারে? কিন্তু দেখ্ বুদ্ধদেবের হৃদয়! ‘বহুজনহিতায় বহুজনসুখায়’ কা কথা, সামান্য একটা ছাগশিশুর জীবনরক্ষার জন্য নিজ-জীবন দান করতে সর্বদা প্রস্তুত! দেখ্‌ দেখি কি উদারতা—কি দয়া!

শিষ্য॥ বুদ্ধের ঐ ভাবটাকেও কি মহাশয়, অন্য এক প্রকারের পাগলামি বলা যাইতে পারে না? একটা পশুর জন্য কিনা নিজের গলা দিতে গেলেন!

স্বামীজী॥ কিন্ত তাঁর ঐ fanaticism (ধর্মোন্মাদ)—এ জগতের জীবের কত কল্যাণ হল—তা দেখ্! কত আশ্রম-স্কুল-কলেজ, কত public hospital (সাধারণের জন্য হাসপাতাল), কত পশুশালার স্থাপন, কত স্থাপত্যবিদ্যার বিকাশ হল, তা ভেবে দেখ্! বুদ্ধদেব জন্মাবার আগে এ দেশে এ-সব ছিল কি?—তালপাতার পুঁথিতে বাঁধা কতকগুলো ধর্মতত্ত্ব—তাও অল্প কয়েকজনের জানা ছিল মাত্র। ভগবান্‌ বুদ্ধদেব সেগুলি practical field-এ (কার্যক্ষেত্রে) আনলেন, লোকের দৈনন্দিন জীবনে সেগুলো কেমন করে কাজে লাগাতে হবে, তা দেখিয়ে দিলেন। ধরতে গেলে তিনিই যথার্থ বেদান্তের স্ফুরণমূর্তি।

শিষ্য॥ কিন্তু মহাশয়, বর্ণাশ্রমধর্ম ভাঙিয়া দিয়া ভারতে হিন্দুধর্মের বিপ্লব তিনিই ঘটাইয়া গিয়াছেন এবং সেই জন্যই তৎ-প্রচারিত ধর্ম ভারত হইতে কালে নির্বাসিত হইয়াছে—এ কথা সত্য বলিয়া বোধ হয়।

স্বামীজী॥ বৌদ্ধধর্মের ঐরূপ দুর্দশা তাঁর teaching-এর (শিক্ষার) দোষে হয় নাই, তাঁর follower (চেলা)-দের দোষেই হয়েছিল; বেশী philosophic হয়ে (দর্শনচর্চা করে) তাদের heart (হৃদয়)-এর উদারতা কমে গেল। তারপর ক্রমে বামাচারের ব্যভিচার ঢুকে বৌদ্ধধর্ম মরে গেল। অমন বীভৎস বামাচার এখনকার কোন তন্ত্রে নেই। বৌদ্ধধর্মের একটি প্রধান কেন্দ্র ছিল ‘জগন্নাথক্ষেত্র’—সেখানে মন্দিরের গায়ে খোদা বীভৎস মূর্তিগুলি একবার গিয়ে দেখে এলেই ঐ কথা জানতে পারবি। রামানুজ ও চৈতন্য-মহাপ্রভুর সময় থেকে পুরুষোত্তমক্ষেত্রটা বৈষ্ণবদের দখলে এসেছে। এখন উহা ঐ-সকল মহাপুরুষের শক্তিসহায়ে অন্য এক মূর্তি ধারণ করেছে।

শিষ্য॥ মহাশয়, শাস্ত্রমুখে তীর্থাদি-স্থানের বিশেষ মহিমা অবগত হওয়া যায়, উহার কতটা সত্য?

স্বামীজী॥ সমগ্র ব্রহ্মাণ্ড যখন নিত্য আত্মা ঈশ্বরের বিরাট শরীর, তখন স্থান-মাহাত্ম্য থাকাটার বিচিত্রতা কি আছে? স্থানবিশেষে তাঁর বিশেষ প্রকাশ—কোথাও স্বতঃ এবং কোথাও শুদ্ধসত্ত্ব মানবমনের ব্যাকুল আগ্রহে হয়ে থাকে। সাধারণ মানব ঐ-সকল স্থানে জিজ্ঞাসু হয়ে গেলে সহজে ফল পায়। এইজন্য তীর্থাদি আশ্রয় করে কালে আত্মার বিকাশ হতে পারে। তবে স্থির জানবি মানবদেহের চেয়ে আর কোন বড় তীর্থ নেই। এখানে আত্মার যেমন বিকাশ, এমন আর কোথাও নয়। ঐ যে জগন্নাথের রথ, তাও এই দেহরথের concrete form (স্থূল রূপ) মাত্র। এই দেহরথে আত্মাকে দর্শন করতে হবে। পড়েছিস না—‘আত্মানং রথিনং বিদ্ধি’৪৯ ইত্যাদি, ‘মধ্যে বামনমাসীনং বিশ্বে দেবা উপাসতে’—এই বামন-রূপী আত্মদর্শনই ঠিক ঠিক জগন্নাথদর্শন। ঐ যে বলে ‘রথে চ বামনং দৃষ্ট্বা পুনর্জন্ম ন বিদ্যতে’—এর মানে হচ্ছে, তোর ভেতরে যে আত্মা আছেন, যাঁকে উপেক্ষা করে তুই কিম্ভূতকিমাকার এই দেহরূপ জড়পিণ্ডটাকে সর্বদা ‘আমি’ বলে ধরে নিচ্ছিস, তাঁকে দর্শন করতে পারলে আর পুনর্জন্ম হয় না। যদি কাঠের দোলায় ঠাকুর দেখে জীবের মুক্তি হত, তা হলে বছরে বছরে কোটি জীবের মুক্তি হয়ে যেত—আজকাল আবার রেলে যাওয়ার যে সুযোগ! ৺জগন্নাথের সম্বন্ধে সাধারণ ভক্তদিগের বিশ্বাসকেও আমি ‘কিছু নয় বা মিথ্যা’ বলছি না। এক শ্রেণীর লোক আছে, যারা ঐ মূর্তি-অবলম্বনে উচ্চ থেকে ক্রমে উচ্চতর তত্ত্বে উঠে যায়, অতএব ঐ মূর্তিকে আশ্রয় করে শ্রীভগবানের বিশেষ শক্তি যে প্রকাশিত রয়েছে, এতে সন্দেহ নেই।

শিষ্য॥ তবে কি মহাশয়, মূর্খ ও বুদ্ধিমানের ধর্ম আলাদা?

স্বামীজী॥ তাই তো, নইলে তোর শাস্ত্রেই বা এত অধিকারি-নির্দেশের হাঙ্গামা কেন? সবই truth (সত্য), তবে relative truth different in degrees (আপেক্ষিক সত্যে তারতম্য আছে)। মানুষ যা কিছু সত্য বলে জানে, সে সকলই ঐরূপ; কোনটি অল্প সত্য, কোনটি তার চেয়ে অধিক সত্য; নিত্য সত্য কেবল একমাত্র ভগবান্। এই আত্মা জড়ের ভেতর একেবারে ঘুমুচ্ছেন, ‘জীব’নামধারী মানুষের ভেতর তিনিই আবার কিঞ্চিৎ conscious (জাগরিত) হয়েছেন। শ্রীকৃষ্ণে, বুদ্ধ-শঙ্করাদিতে আবার ঐ আত্মাই super conscious stage-এ—অর্থাৎ পূর্ণভাবে জাগরিত হয়ে দাঁড়িয়েছেন। এর উপরেও অবস্থা আছে, যা ভাবে বা ভাষায় বলা যায় না—‘অবাঙ‍মনসোগোচরম্।’

শিষ্য॥ মহাশয়, কোন কোন ভক্তসম্প্রদায় বলে, ভগবানের সহিত একটা ভাব বা সম্বন্ধ পাতাইয়া সাধনা করিতে হইবে। আত্মার মহিমাদির কথা তাহারা কিছুই বোঝে না, শুনিলেও বলে—‘ঐ-সকল কথা ছাড়িয়া সর্বদা ভাবে থাক।’

স্বামীজী॥ তারা যা বলে, তা তাদের পক্ষে সত্য। ঐরূপ করতে করতে তাদের ভেতরেও একদিন ব্রহ্ম জেগে উঠবেন। আমরা (সন্ন্যাসীরা) যা করছি, তাও আর এক রকম ভাব। আমরা সংসার ত্যাগ করেছি, অতএব সাংসারিক সম্বন্ধে মা-বাপ স্ত্রী-পুত্র ইত্যাদির মত কোন একটা ভাব ভগবানে আরোপ করে সাধনা করা—আমাদের ভাব কেমন করে হবে? ও-সব আমাদের কাছে সঙ্কীর্ণ বলে মনে হয়। অবশ্য সর্বভাবাতীত শ্রীভগবানের উপাসনা বড় কঠিন। কিন্তু অমৃত পাই না বলে কি বিষ খেতে যাব? এই আত্মার কথা সর্বদা বলবি, শুনবি, বিচার করবি। ঐরূপ করতে করতে কালে দেখবি—তোর ভেতরেও সিঙ্গি (সিংহ, ব্রহ্ম) জেগে উঠবেন। ঐ সব ভাব-খেয়ালের পারে চলে যা। এই শোন্, কঠোপনিষদে যম কি বলেছেনঃ উত্তিষ্ঠত জাগ্রত প্রাপ্য বরান্ নিবোধত।

এইরূপে এই প্রসঙ্গ সমাপ্ত হইল। মঠে প্রসাদ পাইবার ঘণ্টা বাজিল। স্বামীজীর সঙ্গে শিষ্যও প্রসাদ গ্রহণ করিতে চলিল।

 

২০

স্থান—কলিকাতা
কাল—১৮৯৮

 

আজ তিন দিন হইল স্বামীজী বাগবাজারে ৺বলরাম বসুর বাড়ীতে অবস্থান করিতেছেন। প্রত্যহ অসংখ্য লোকের ভিড়। স্বামী যোগানন্দও স্বামীজীর সঙ্গে একত্র অবস্থান করিতেছেন। আজ সিষ্টার নিবেদিতাকে সঙ্গে লইয়া স্বামীজী আলিপুরের পশুশালা দেখিতে যাইবেন। শিষ্য উপস্থিত হইলে তাহাকে ও স্বামী যোগানন্দকে বলিলেন, ‘তোরা আগে চলে যা আমি নিবেদিতাকে নিয়ে গাড়ী করে একটু পরেই যাচ্ছি।’ …

প্রায় সাড়ে চারিটার সময় স্বামীজী নিবেদিতাকে সঙ্গে লইয়া পশুশালায় উপস্থিত হইলেন। বাগানের তদানীন্তন সুপারিণ্টেণ্ডেণ্ট রায় বাহাদুর রামব্রহ্ম সান্যাল পরম সাদরে স্বামীজী ও নিবেদিতাকে অভ্যর্থনা করিয়া ভিতরে লইয়া গেলেন এবং প্রায় দেড় ঘণ্টাকাল তাঁহাদের অনুগমন করিয়া বাগানের নানা স্থান দেখাইতে লাগিলেন। স্বামী যোগানন্দও শিষ্যের সঙ্গে তাঁহাদের পশ্চাৎ পশ্চাৎ চলিলেন।

রামব্রহ্মবাবু উদ্যানস্থ নানা বৃক্ষ দেখাইতে দেখাইতে বৃক্ষাদির কালে কিরূপ ক্রমপরিণতি হইয়াছে তদ্বিষয় আলোচনা করিতে করিতে অগ্রসর হইতে লাগিলেন। নানা জীবজন্তু দেখিতে দেখিতে স্বামীজীও মধ্যে মধ্যে জীবের উত্তরোত্তর পরিণতি-সম্বন্ধে ডারুইনের (Darwin) মতের আলোচনা করিতে লাগিলেন। শিষ্যের মনে আছে, সর্প-গৃহে যাইয়া তিনি চক্রাঙ্কিতগাত্র একটা প্রকাণ্ড সাপ দেখাইয়া বলিলেন, ‘ইহা হইতেই কালে tortoise (কচ্ছপ) উৎপন্ন হইয়াছে। ঐ সাপই বহুকাল ধরিয়া একস্থানে বসিয়া থাকিয়া ক্রমে কঠোরপৃষ্ট হইয়া গিয়াছে।’ কথাগুলি বলিয়াই স্বামীজী শিষ্যকে তামাসা করিয়া বলিলেন, ‘তোরা না কচ্ছপ খাস? ডারুইনের মতে এই সাপই কাল-পরিণামে কচ্ছপ হয়েছে; তা হলে তোরা সাপই খাস!’ ইহা শুনিয়া শিষ্য ঘৃণায় মুখ বাঁকাইয়া বলিল, ‘মহাশয়, একটা পদার্থ ক্রমপরিণতির দ্বারা পদার্থান্তর হইয়া গেলে যখন তাহার পূর্বের আকৃতি ও স্বভাব থাকে না, তখন কচ্ছপ খাইলেই যে সাপ খাওয়া হইল, এ কথা কেমন করিয়া বলিতেছেন?’

শিষ্যের কথা শুনিয়া স্বামীজী ও রামব্রহ্মবাবু হাসিয়া উঠিলেন এবং সিষ্টার নিবেদিতাকে ঐ কথা বুঝাইয়া দেওয়াতে তিনিও হাসিতে লাগিলেন। ক্রমে সকলেই যেখানে সিংহ-ব্যাঘ্রাদি ছিল, সেই ঘরের দিকে অগ্রসর হইতে লাগিলেন।

রামব্রহ্মবাবুর আদেশে রক্ষকেরা সিংহব্যাঘ্রের জন্য প্রচুর মাংস আনিয়া আমাদের সম্মুখেই উহাদিগকে আহার করাইতে লাগিল। উহাদের সাহ্লাদ গর্জন শুনিবার এবং সাগ্রহ ভোজন দেখিবার অল্পক্ষণ পরেই উদ্যানমধ্যস্থ রামব্রহ্মবাবুর বাসাবাড়ীতে আমরা সকলে উপস্থিত হইলাম। তথায় চা ও জলপানের উদ্যোগ হইয়াছিল। স্বামীজী অল্পমাত্র চা পান করিলেন। নিবেদিতাও চা পান করিলেন। এক টেবিলে বসিয়া সিষ্টার নিবেদিতা-স্পৃষ্ট মিষ্টান্ন ও চা খাইতে সঙ্কুচিত হইতেছে দেখিয়া স্বামীজী শিষ্যকে পুনঃ পুনঃ অনুরোধ করিয়া উহা খাওয়াইলেন এবং নিজে জলপান করিয়া তাহার অবশিষ্টাংশ শিষ্যকে পান করিতে দিলেন। অতঃপর ডারুইনের ক্রমবিকাশবাদ লইয়া কিছুক্ষণ কথোপকথন চলিতে লাগিল।

রামব্রহ্মবাবু॥ ডারুইন ক্রমবিকাশবাদ ও তাহার কারণ যেভাবে বুঝাইয়াছেন, তৎসম্বন্ধে আপনার অভিমত কি?

স্বামীজী॥ ডারুইনের কথা সঙ্গত হলেও evolution (ক্রমবিকাশবাদ)-এর কারণ সম্বন্ধে উহা যে চূড়ান্ত মীমাংসা, এ কথা আমি স্বীকার করতে পারি না।

রামব্রহ্মবাবু॥ এ বিষয়ে আমাদের দেশে প্রাচীন পণ্ডিতগণ কোনরূপ আলোচনা করিয়াছিলেন কি?

স্বামীজী॥ সাংখ্যদর্শনে ঐ বিষয় সুন্দর আলোচিত হয়েছে। ভারতের প্রাচীন দার্শনিকদিগের সিদ্ধান্তই ক্রমবিকাশের কারণ সম্বন্ধে চূড়ান্ত মীমাংসা বলে আমার ধারণা।

রামব্রহ্মবাবু॥ সংক্ষেপে ঐ সিদ্ধান্ত বুঝাইয়া বলা চলিলে শুনিতে ইচ্ছা হয়। স্বামীজী॥ নিম্ন জাতিকে উচ্চ জাতিতে পরিণত করতে পাশ্চাত্য মতে struggle for existence (জীবন-সংগ্রাম), survival of the fittest (যোগ্যতমের উদ্বর্তন), natural selection (প্রাকৃতিক নির্বাচন) প্রভৃতি যে-সকল নিয়ম কারণ বলে নির্দিষ্ট হয়েছে, সে-সকল আপনার নিশ্চয়ই জানা আছে। পাতঞ্জল-দর্শনে কিন্তু এ-সকলের একটিও তার কারণ বলে সমর্থিত হয়নি। পতঞ্জলির মত হচ্ছে, এক species (জাতি) থেকে আর এক species-এ (জাতিতে) পরিণতি ‘প্রকৃতির আপূরণের’ দ্বারা (প্রকৃত্যাপৃরাৎ)৫০ সংসাধিত হয়। আবরণ বা obstacles-এর (প্রতিবন্ধক বা বাধার) সঙ্গে দিনরাত struggle (লড়াই) করে যে ওটা সাধিত হয়, তা নয়। আমার বিবেচনায় struggle (লড়াই) এবং competition (প্রতিদ্বন্দ্বিতা) জীবের পূর্ণতালাভের পক্ষে অনেক সময় প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায়। হাজার জীবনকে ধ্বংস করে যদি একটা জীবের ক্রমোন্নতি হয়—যা পাশ্চাত্য দর্শন সমর্থন করে, তা হলে বলতে হয়, এই evolution (ক্রমবিকাশ) দ্বারা সংসারের বিশেষ কোন উন্নতিই হচ্ছে না। সাংসারিক উন্নতির কথা স্বীকার করে নিলেও আধ্যাত্মিক বিকাশকল্পে ওটা যে বিষম প্রতিবন্ধক, এ কথা স্বীকার করতেই হয়। আমাদের দেশীয় দার্শনিকগণের অভিপ্রায়—জীবমাত্রই পূর্ণ আত্মা। আত্মার বিকাশের তারতম্যেই বিচিত্রভাবে প্রকৃতির অভিব্যক্ত ও বিকাশ। প্রকৃতির অভিব্যক্তির ও বিকাশের প্রতিবন্ধকগুলি সর্বতোভাবে সরে দাঁড়ালে পূর্ণভাবে আত্মপ্রকাশ। প্রকৃতির অভিব্যক্তির নিম্নস্তরে যাই হোক, উচ্চস্তরে কিন্তু প্রতিবন্ধকগুলির সঙ্গে দিনরাত যুদ্ধ করেই যে ওদের অতিক্রম করা যায়, তা নয়; দেখা যায় সেখানে শিক্ষা-দীক্ষা, ধ্যান-ধারণা ও প্রধানতঃ ত্যাগের দ্বারাই প্রতিবন্ধকগুলি সরে যায় বা অধিকতর আত্মপ্রকাশ উপস্থিত হয়। সুতরাং obstacle (প্রতিবন্ধক)-গুলিকে আত্মপ্রকাশের কার্য না বলে কারণরূপে নির্দেশ করা এবং প্রকৃতির এই বিচিত্র অভিব্যক্তির সহায়ক বলা যুক্তিযুক্ত নয়। হাজার পাপীর প্রাণসংহার করে জগৎ থেকে পাপ দূর করবার চেষ্টা দ্বারা জগতে পাপের বৃদ্ধিই হয়। কিন্তু উপদেশ দিয়ে জীবকে পাপ থেকে নিবৃত্ত করতে পারলে জগতে আর পাপ থাকে না। এখন দেখুন, পাশ্চাত্য Struggle Theory (প্রাণীদের পরস্পর সংগ্রাম ও প্রতিদ্বন্দ্বিতা দ্বারা উন্নতিলাভরূপ মত)-টা কতদূর horrible (ভীষণ) হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

রামব্রহ্মবাবু স্বামীজীর কথা শুনিয়া স্তম্ভিত হইয়া রহিলেন; অবশেষে বলিলেন, ‘ভারতবর্ষে এখন আপনার ন্যায় প্রাচ্য-পাশ্চাত্য দর্শনে অভিজ্ঞ লোকের বিশেষ প্রয়োজন হইয়াছে। ঐরূপ লোকেই একদেশদর্শী শিক্ষিত জনগণের ভ্রমপ্রমাদ অঙ্গুলি দিয়া দেখাইয়া দিতে সমর্থ। আপনার Evolution Theory-র (ক্রমবিকাশবাদের) নূতন ব্যাখ্যা শুনিয়া আমি পরম আহ্লাদিত হইলাম।’

শিষ্য স্বামী যোগানন্দের সহিত ট্রামে করিয়া রাত্রি প্রায় ৮টার সময় বাগবাজারে ফিরিয়া আসিল। স্বামীজী ঐ সময়ের প্রায় পনর মিনিট পূর্বে ফিরিয়া বিশ্রাম করিতেছিলেন। প্রায় অর্ধঘণ্টা বিশ্রামান্তে তিনি বৈঠকখানায় আমাদিগের নিকট উপস্থিত হইলেন। স্বামীজী অদ্য পশুশালা দেখিতে গিয়া রামব্রহ্মবাবুর ক্রমবিকাশবাদের অপূর্ব ব্যাখ্যা করিয়াছেন শুনিয়া উপস্থিত সকলে ঐ প্রসঙ্গ বিশেষরূপে শুনিবার জন্য ইতঃপূর্বেই সমুৎসুক ছিলেন। অতএব স্বামীজী আসিবামাত্র সকলের অভিপ্রায় বুঝিয়া শিষ্য ঐ কথাই পাড়িল।

শিষ্য॥ মহাশয়, পশুশালার ক্রমবিকাশ-সম্বন্ধে যাহা বলিয়াছিলেন, তাহা ভাল করিয়া বুঝিতে পারি নাই। অনুগ্রহ করিয়া সহজ কথায় তাহা পুনরায় বলিবেন কি?

স্বামীজী॥ কেন, কি বুঝিসনি?

শিষ্য॥ এই আপনি অন্য অনেক সময় আমাদের বলিয়াছেন যে, বাহিরের শক্তিসমূহের সহিত সংগ্রাম করিবার ক্ষমতাই জীবনের চিহ্ন এবং উহাই উন্নতির সোপান। আজ আবার যেন উল্টা কথা বলিলেন। স্বামীজী॥ উল্টো বলব কেন? তুই-ই বুঝতে পারিসনি। Animal kingdom-এ (নিম্ন প্রাণিজগতে) আমরা সত্য-সত্যই struggle for existence, survival of the fittest (জীবনসংগ্রাম, যোগ্যতমের উদ্বর্তন) প্রভৃতি নিয়ম স্পষ্ট দেখতে পাই। তাই ডারুইনের theory (তত্ত্ব) কতকটা সত্য বলে প্রতিভাত হয়। কিন্তু human kingdom (মনুষ্যজগৎ)-এ, যেখানে rationality (জ্ঞানবুদ্ধি)-র বিকাশ, সেখানে এ নিয়মের উল্টোই দেখা যায়। মনে কর, যাঁদের আমরা really great men (বাস্তবিক মহাপুরুষ) বা ideal (আদর্শ) বলে জানি, তাঁদের বাহ্য struggle (সংগ্রাম) একেবারেই দেখতে পাওয়া যায় না। Animal kingdom (মনুষ্যেতর প্রাণিজগৎ)-এ instinct (স্বাভাবিক জ্ঞান)-এর প্রাবল্য। মানুষ কিন্তু যত উন্নত হয়, ততই তাতে rationality (বিচারবুদ্ধি)-র বিকাশ। এজন্য Animal Kingdom (প্রাণিজগৎ)-এর মত rational human kingdom (বুদ্ধিযুক্ত মনুষ্যজগৎ)-এ পরের ধ্বংস সাধন করে progress (উন্নতি) হতে পারে না। মানবের সর্বশ্রেষ্ঠ evolution (পূর্ণবিকাশ) একমাত্র sacrifice (ত্যাগ) দ্বারা সাধিত হয়। যে পরের জন্য যত sacrifice (ত্যাগ) করতে পারে, মানুষের মধ্যে সে তত বড়। আর নিম্নস্তরের প্রাণিজগতে যে যত ধ্বংস করতে পারে, সে তত বলবান্ জানোয়ার হয়। সুতরাং Struggle Theory (জীবনসংগ্রাম তত্ত্ব) এ উভয় রাজ্যে equally applicable (সমানভাবে উপযোগী) হতে পারে না। মানুষের Struggle (সংগ্রাম) হচ্ছে মনে। মনকে যে যত control (আয়ত্ত) করতে পেরেছে, সে তত বড় হয়েছে। মনের সম্পূর্ণ বৃত্তিহীনতায় আত্মার বিকাশ হয়। Animal kingdom (মানবেতর প্রাণিজগৎ)-এ স্থূল দেহের সংরক্ষণে যে struggle (সংগ্রাম) পরিলক্ষিত হয়, human plane of existence (মানব- জীবন)-এ মনের ওপর আধিপত্যলাভের জন্য বা সত্ত্ব (গুণ) বৃত্তিসম্পন্ন হবার জন্য সেই struggle (সংগ্রাম) চলেছে। জীবন্ত বৃক্ষ ও পুকুরের জলে পতিত বৃক্ষচ্ছায়ার মত মনুষ্যেতর প্রাণীতে ও মনুষ্যজগতে struggle (সংগ্রাম) বিপরীত দেখা যায়।

শিষ্য॥ তাহা হইলে আপনি আমাদের শারীরিক উন্নতিসাধনের জন্য এত করিয়া বলেন কেন?

স্বামীজী॥ তোরা কি আবার মানুষ? তবে একটু rationality (বিচারবুদ্ধি) আছে, এই মাত্র। Physique (দেহটা) ভাল না হলে মনের সহিত struggle (সংগ্রাম) করবি কি করে? তোরা কি আর জগতের highest evolution (পূর্ণবিকাশস্থল) ‘মানুষ’ পদবাচ্য আছিস? আহার নিদ্রা মৈথুন ভিন্ন তোদের আর আছে কি? এখনও যে চতুষ্পদ হয়ে যাসনি, এই ঢের। ঠাকুর বলতেন, ‘মান হুঁশ আছে যার, সেই মানুষ।’ তোরা তো ‘জায়স্ব ম্রিয়স্ব’-বাক্যের সাক্ষী হয়ে স্বদেশবাসীর হিংসার স্থল ও বিদেশিগণের ঘৃণার আস্পদ হয়ে রয়েছিস। তোরা animal (প্রাণী), তাই struggle (সংগ্রাম) করতে বলি। থিওরী-ফিওরী রেখে দে। নিজেদের দৈনন্দিন কার্য ও ব্যবহার স্থিরভাবে আলোচনা করে দেখ দেখি, তোরা animal and human planes-এর (মানব এবং মানবেতর স্তরের) মধ্যবর্তী জীববিশেষ কিনা! Physique (দেহ)-টাকে আগে গড়ে তোল। তবে তো মনের ওপর ক্রমে আধিপত্য লাভ হবে। ‘নায়মাত্মা বলহীনেন লভ্যঃ।’ বুঝলি?

শিষ্য॥ মহাশয়, ‘বলহীনেন’ অর্থে ভাষ্যকার কিন্তু ‘ব্রহ্মচর্যহীনেন’ বলেছেন।

স্বামীজী॥ তা বলুনগে। আমি বলছি, the physically weak are unit for the realization of the Self (দুর্বল শরীরে আত্ম-সাক্ষাৎকার হয় না)।

শিষ্য॥ কিন্তু সবল শরীরে অনেক জড়বুদ্ধিও তো দেখা যায়।

স্বামীজী॥ তাদের যদি তুই যত্ন করে ভাল idea (ভাব) একবার দিতে পারিস, তা হলে তারা যত শীগগীর তা work out (কার্যে পরিণত) করতে পারবে, হীনবীর্য লোক তত শীগগীর পারবে না। দেখছিস না, ক্ষীণ শরীরে কাম-ক্রোধের বেগধারণ হয় না। শুঁটকো লোকগুলো শীগগীর রেগে যায়—শীগগীর কামমোহিত হয়।

শিষ্য॥ কিন্তু এ নিয়মের ব্যতিক্রমও দেখিতে পাওয়া যায়।

স্বামীজী॥ তা নেই কে বলছে? মনের ওপর একবার control (সংযম) হয়ে গেলে, দেহ সবল থাক বা শুকিয়েই যাক, তাতে আর কিছু এসে যায় না। মোট কথা হচ্ছে physique (শরীর) ভাল না হলে যে আত্মজ্ঞানের অধিকারীই হতে পারে না; ঠাকুর বলতেন, ‘শরীরে এতটুকু খুঁত থাকলে জীব সিদ্ধ হতে পারে না।’ কিছুক্ষণ পরে স্বামীজী রহস্য করিয়া উপস্থিত সকলকে বলিতে লাগিলেন, ‘আর এক কথা শুনেছেন, আজ এই ভট‍্‍চায বামুন নিবেদিতার এঁটো খেয়ে এসেছে। তার ছোঁয়া মিষ্টান্ন না হয় খেলি, তাতে তত আসে যায় না, কিন্তু তার ছোঁয়া জলটা কি করে খেলি?

শিষ্য॥ তা আপনিই তো আদেশ করিয়াছিলেন। গুরুর আদেশে আমি সব করিতে পারি। জলটা খাইতে কিন্তু আমি নারাজ ছিলাম; আপনি পান করিয়া দিলেন, কাজেই প্রসাদ বলিয়া খাইতে হইল।

স্বামীজী॥ তোর জাতের দফা রফা হয়ে গেছে—এখন আর তোকে কেউ ভট্‌চায বামুন বলে মানবে না!

শিষ্য॥ না মানে নাই মানুক। আমি আপনার আদেশে চণ্ডালের ভাতও খাইতে পারি।

কথা শুনিয়া স্বামীজী ও উপস্থিত সকলে হো হো করিয়া হাসিয়া উঠিলেন।