০৪. প্রাণের আধ্যাত্মিক রূপ (চতুর্থ অধ্যায়)

যোগিগণের মতে মেরুদন্ডের মধ্যে ইড়া ও পিঙ্গলা নামক দুইটি স্নয়বীর শক্তিপ্রবাহ ও ‘সুষুম্না’ নামে একটি শূন্য নালী আছে। এই শূন্য নালীর নিম্নপ্রান্তে ‘কুন্ডলিনী পদ্ম’ অবস্থিত, যোগীরা বলেন, উহা ত্রিকোণাকার। যোগীদের রূপক ভাষায় ঐ স্থানে কুন্ডলিনী শক্তি কুন্ডলাকৃতি হইয়া বিরাজমানা। যখন এই কুন্ডলিনী জাগরিতা হন, তখন তিনি এই শূন্য নালীর মধ্য দিয়া পথ করিয়া উঠিবার চেষ্টা করেন, এবং যতই তিনি এক-এক সোপান উপরে উঠিতে থাকেন, ততই মনের যেন স্তরের পর স্তর খুলিয়া যাইতে থাকে; আর সেই যোগীর নানারূপ অলৌকিক দৃশ্য দর্শন ও অদ্ভুত শক্তি লাভ হইতে থাকে। যখন সেই কুন্ডলিনী মস্তিষ্কে উপনীত হন, তখন যোগী সম্পূর্ণরূপে শরীর ও মন হইতে পৃথক্ হইয়া যান এবং তাঁহার আত্মা স্বীয় মুক্তভাব উপলদ্ধি করে।

আমরা জানি সুষুম্নাকান্ড (Spinal cord) এক বিশেষ প্রকারে গঠিত, ৪-এই অক্ষরটিকে যদি লম্বালম্বি ভাবে (∞) লওয়া যায়, তাহা হইলে দেখা যাইবে যে, উহার দুইটি অংশ রহিয়াছে এবং ঐ দুইটি মধ্যদেশে সংযুক্ত। এইরূপ অক্ষর, একটির উপর আর একটি সাজাইলে যেরূপ দেখায়, সুষুম্নাকান্ড কতকটা সেইরূপ। উহার বামভাগ ‘ইড়া’, দক্ষিণ ভাগ ‘পিঙ্গলা’ এবং যে শূন্য নালী সুষুম্না-কান্ডের ঠিক মধ্যস্থল দিয়া গিয়াছে-তাহাই ‘সুষুম্না’। কটিদেশের নিকট মেরুদন্ডের কতকগুলি অস্থির পরেই সুষুম্নাকান্ড শেষ হইয়াছে, কিন্তু তাহা হইলেও একটি অতিসূক্ষ্ম তন্তু বরাবর নিম্নে নামিয়া আসিয়াছে। সুষুম্না নালী ঐ তন্তুর মধ্যেও অবস্থিত, তবে অতি সূক্ষ্ম হইয়াছে মাত্র। নিম্নদিকে ঐ নালীর মুখ বন্ধ থাকে। উহার নিকটেই কটিদেশস্থ স্নায়ুজাল (Sacral plexus) অবস্থিত। আধুনিক শারীরবিজ্ঞানের (Physiology) মতে-উহা ত্রিকোণাকৃতি। বিভিন্ন স্নায়ুজালের কেন্দ্র সুষুম্নার মধ্যে অবস্থিত; ঐগুলিকেই যোগিগণের ভিন্ন ভিন্ন পদ্মরূপে গ্রহণ করা যাইতে পারে।

যোগী কল্পনা করেন, সর্বনিম্নে মূলাধার হইতে আরম্ভ করিয়া মস্তিষ্কে সহস্রার বা সহস্রদল পদ্ম পর্যন্ত কতকগুলি কেন্দ্র আছে। যদি আমরা ঐ পদ্মগুলিকে পূর্বোক্ত স্নায়ুজাল (Plexus) বলিয়া মনে করি, তাহা হইলে আধুনিক শারীরবিজ্ঞানের ভাষায় অতি সহজে যোগীদিগের কথার ভাব বুঝা যাইবে। আমরা জানি, আমাদের স্নায়ুমধ্যে দুই প্রকারের প্রবাহ আছে; তাহাদের একটিকে অন্তর্মুখ ও অপরটিকে বহির্মুখ, একটিকে সংবেদাত্মক (sensory) ও অপরটিকে চেষ্টাত্মক (motor), একটিকে কেন্দাভিগ ও অপরটিকে কেন্দ্রাতিগ বলা যাইতে পারে। উহাদের মধ্যে একটি মস্তিষ্কের অভিমুখে সংবাদ বহন করে, অপরটি মস্তিষ্ক হইতে বাহিরে সমুদয় অঙ্গে সংবাদ লইয়া যায়।

ঐ স্পন্দন-প্রবাহগুলি শেষ পর্যন্ত মস্তিষ্কের সহিত সংযুক্ত। পরবর্তী ব্যাখ্যা সুগম ও স্পষ্ট করিবার জন্য আমাদের অন্যান্য কয়েকটি বিষয় স্মরণ রাখিতে হইবে। সুষুম্নাকান্ড মস্তিষ্ক-মজ্জায় একটি কন্দে (bulb) শেষ হইয়াছে; কিন্তু উহা মস্তিষ্কের সহিত যুক্ত নয়, মস্তিষ্কের অন্তর্গত তরল পদার্থে ভাসমান। মাথায় যদি কোন আঘাত লাগে, তবে ঐ আঘাতের শক্তি ঐ তরল পদার্থেই ব্যয়িত হইয়া যায়, কন্দ আহত হয় না। ইহা মনে রাখা বিশেষ প্রয়োজন। দ্বিতীয়তঃ আরও জানিতে হইবে, সমুদয় চক্রের মধ্যে সর্বনিম্নস্থ মূলাধার, মস্তকস্থ সহস্রদল-পদ্ম ও নাভিদেশে অবস্থিত মণিপুর চক্র-এই তিনটির কথা মনে রাখা বিশেষ আবশ্যক।

এইবার পদার্থবিজ্ঞানের একটি তত্ত্ব আমাদিগকে বুঝিতে হইবে। আমরা সকলেই তড়িৎ ও তৎসম্পর্কে অন্যান্য বহুবিধ শক্তির কথা শুনিয়াছি। তড়িৎ কি, তাহা কেহই জানে না; তবে আমরা এই পর্যন্ত জানি যে, তড়িৎ একপ্রকার গতিবিশেষ। জগতে অন্যান্য নানাবিধ গতি আছে, তড়িতের সহিত উহাদের প্রভেদ কি? মনে কর, একটি টেবোল নড়িতেছে-যে পরমাণুগুলি দ্বারা উহা গঠিত, সেগুলি বিভিন্ন দিকে আন্দোলিত হইতেছে। যদি উহাদিগকে অনবরত একদিকে সঞ্চালিত করা যায়, তাহা হইলে তাহা তড়িৎশক্তির দ্বারাই সম্ভব হইবে। তড়িৎপ্রবাহই কোন পদার্থের পরমাণুগুলিকে একদিকে গতিশীল করে। এই গৃহে যে বায়ুরাশি রহিয়াছে, তাহার সব পরমাণুগুলিকে একদিকে গতিশীল করে। এই গৃহে যে বায়ুরাশি রহিয়াছে, তাহার সব পরমাণুগুলিকে যদি ক্রমাগত একদিকে সঞ্চালিত করা যায়, তাহা হইলে ঘরটি এক বিরাট বিদ্যুদাধারযন্ত্রে (Battery) পরিণত হইবে।

শারীরবিজ্ঞানের একটি তত্ত্ব আমাদিগকে স্মরণ রাখিতে হইবে। তত্ত্বটি এইঃ যে স্নায়ুকেন্দ্র শ্বাসপ্রশ্বাস-যন্ত্রগুলি নিয়মিত করে, স্নায়ুপ্রবাহগুলির উপরও তাহার একটু প্রভাব আছে; ঐ কেন্দ্র বক্ষোদেশের ঠিক বিপরীত দিকে মেরুদন্ডে অবস্থিত, উহা শ্বাসপ্রশ্বাস নিয়মিত করে এবং অন্যান্য যে-সকল স্নায়ুচক্র আছে, তাহাদের উপরেও কিঞ্চিৎ প্রভাব বিস্তার করে।

এইবার আমরা প্রাণায়াম-ক্রিয়া সাধনের কারণ বুঝিতে পারিব। প্রথমতঃ নিয়মিত শ্বাসপ্রশ্বাসের দ্বারা শরীরের সমুদয় পরমাণুই একদিকে গতিসম্পন্ন হইবার প্রবণতা লাভ করিবে। যখন মন দৃঢ় ইচ্ছাশক্তিরূপে পরিণত হয়, তখন সমুদয় স্নায়ুপ্রবাহও এক প্রকার তড়িৎ-শক্তিতে পরিবর্তিত হয়; কারণ, দেখা গিয়াছে-স্নায়ুগুলির উপর তড়িৎপ্রবাহের প্রভাবে স্নায়ুর উভয় প্রান্তে বিপরীত শক্তিদ্বয়ের উদ্ভব হয়। ইহাতেই প্রমাণিত হয় যে, যখন ইচ্ছাশক্তি স্নায়ুপ্রবাহরূপে পরিণত হয়, তখন উহা তড়িতের মতো কোন শক্তিতে পরিবর্তিত হয়। যখন শরীরের সমুদয় গতি সম্পূর্ণ সমতালে চালিত হয়, তখন শরীরে যেন ইচ্ছাশক্তির এক প্রবল বিদ্যুদাধার-স্বরূপ হইয়া পড়ে। এই প্রবল ইচ্ছাশক্তি লাভ করাই যোগীর উদ্দেশ্য। প্রাণায়াম-ক্রিয়াটি এইরূপে শারীরবিজ্ঞানের সাহায্যে ব্যাখ্যা করা যাইতে পারে। উহা শরীরের মধ্যে ছন্দের মতো একপ্রকার গতি উৎপাদন করে ও শ্বাসপ্রশ্বাসকেন্দ্রের উপর আধিপতা বিস্তার করিয়া শরীরস্থ অন্যান্য কেন্দ্রগুলিকেও বশে আনিতে সাহায্য করে। এস্থলে প্রাণায়ামের লক্ষ্য- মূলাধারে কুন্ডলাকারে অবস্থিত কুন্ডলিনী শক্তির উদ্বোধন করা।

আমরা যাহা কিছু দেখি বা কল্পনা করি অথবা যখন স্বপ্ন দেখি,সবই আকাশে অনুভব করিতে হয়। এই পরিদৃশ্যমান আকাশ, যাহা সাধারণতঃ দেখা যায়, তাহার নাম মহাকাশ। যোগী যখন অপরের মনোভাব প্রত্যক্ষ করেন বা অতীন্দ্রিয় বস্তুসমূহ অনুভব করেন, তখন তিনি ঐগুলি আর এক প্রকার আকাশে-চিত্তাকাশে বা মানস আকাশে দেখিতে পান। আর যখন আমাদের অনুভূতি বিষয়শূন্য হয়, যখন আত্মা নিজ স্বরূপে প্রকাশিত হন, তখন উহার নাম ‘চিদাকাশ’ বা জ্ঞানের আকাশ। যখন কুন্ডলিনী শক্তি জাগরিত হইয়া সুষুম্না-নাড়ীতে প্রবেশ করেন, তখন যে-সকল বিষয় অনুভূত হয়, সেগুলি চিত্তাকাশেই হইয়া থাকে। ঐ নালীর শেষ সীমা মস্তিষ্কে উপনীত হইলে চিদাকাশে এক বিষয়শূন্য জ্ঞান অনুভূত হইয়া থাকে।

এইবার তড়িৎ-শক্তির উপমা আবার লওয়া যাক। আমরা দেখিতে পাই যে, মানুষ কেবল তার-যোগে কোন তড়িৎপ্রবাহ এক স্থান হইতে অপর স্থানে প্রেরণ করিতে পারে। কিন্তু প্রকৃতি তাহার নিজের প্রচন্ড শক্তিপ্রবাহ প্রেরণ করিতে কোন তারের সাহায্য গ্রহণ করে না। ইহা দ্বারা প্রমাণিত হয়, প্রবাহ চালাইবার জন্য তারের বাস্তবিক কোন আবশ্যকতা নাই, তবে আমর উহা ছাড়া কাজ করিতে পারি না বলিয়াই আমাদের তার প্রয়োজন।

তড়িৎপ্রবাহ যেমন তারের সাহায্যে প্রেরিত হয়, ঠিক তেমনি স্নায়ুতন্তুরূপ তারের সাহায্যে শরীরের সর্ববিধ সংবেদন মস্তিষ্কে প্রেরিত হইতেছে ও মস্তিষ্ক হইতে কর্মপ্রচেষ্টা বহিরিন্দ্রিয়ে প্রেরিত হইতেছে। সুষুম্না-মধ্যস্থিত জ্ঞানাত্মক ও কর্মাত্মক স্নায়ুতন্তুগুলিই যোগিগণের ইড়া ও পিঙ্গলা নাড়ী। প্রধানতঃ ঐ দুইটি নাড়ীর ভিতর দিয়াই পূর্বোক্ত অন্তর্মুখ ও বহির্মুখ শক্তিপ্রবাহদ্বয় চলাচল করিতেছে। কিন্তু কথা হইতেছে, কোন তারের সাহায্য ব্যতীত মন কেন সংবাদ প্রেরণ করিতে পারিবে না অথবা প্রতিক্রিয়া করিবে না? প্রকৃতিতে তো এরূপ ব্যাপার ঘটিতে দেখা যাইতেছে। যোগীরা বলেন, এরূপ করিতে পারিলেই জড়ের বন্ধন অতিক্রম করা যাইতে পারে। ইহা করিবার উপায় কি? যদি মেরুদন্ডমধ্যস্থ সুষুম্নার ভিতর দিয়া স্নায়ুপ্রবাহ চালাইতে পারো, তাহা হইলেই এই সমস্যার সমাধান হইবে। মনই এই স্নায়ুজাল নির্মাণ করিয়াছে, মনকেই ঐ জাল ছিন্ন করিতে হইবে। কোনরূপ তারের সাহায্য ছাড়াই কাজ করিতে হইবে। তখনই সমুদয় জ্ঞান আমাদের আয়ত্ত হইবে, দেহের বন্ধন আর থাকিবে না। এই জন্যই সুসুম্না নাড়ীকে জয় করা আমাদের এত প্রয়োজন। যদি এই শূন্য নালীর মধ্য দিয়া নাড়ীজালের সাহায্য ব্যতিরেকেই মানসিক প্রবাহ চালাইতে পারি, যোগীরা বলেন, তাহা হইলে এই সমস্যার সমাধান হইয়া গেল। যোগীরা আরও বলেন, ইহা করিতে পারা যায়।


১ পাঠক স্মরণ রাখিবেন, বেতার-আবিষ্কারের পুর্বে ইহা লিখিত।

সাধারণ লোকের শরীরে সুষুম্না নিম্নদিকে বন্ধ; উহার দ্বারা কোন ক্রিয়াই হয় না। যোগীরা বলেন, এই সুষুম্নাদ্বার উদ্ঘাটিত করিয়া উহার মধ্য দিয়া স্নায়ুপ্রবাহ চালাইবার নির্দিষ্ট প্রণালী আছে। সেই সাধনে কৃতকার্য হইলে স্নায়ুপ্রবাহ উহার মধ্য দিয়া চালাইতে পারা যায়। বাহ্য বিষয়স্পর্শে উৎপন্ন প্রবাহ যখন কোন কেন্দ্রে উপনীত হয়, তখন ঐ কেন্দ্র হইতে এক প্রতিক্রিয়া (reaction) উপস্থিত হয়। স্বয়ংক্রিয় কেন্দ্রগুলিতে ঐ প্রতিক্রিয়ার ফলে গতি উৎপন্ন হয়; চৈতন্যময় কেন্দ্রগুলিতে (conscious centres) কিন্তু প্রথমে অনুভব, পরে গতি উৎপন্ন হয়। সমুদয় অনুভূতিই বাহির হইতে আগত ক্রিয়ার প্রতিক্রিয়া মাত্র। তবে স্বপ্নে অনুভূতি হয় কিরূপে? তখন তো বাহিরের কোন ক্রিয়া নাই, তবে বিষয়াভিঘাত-জনিত স্নায়বীয় গতিগুলি শরীরের কোথাও কুন্ডলীকৃতভাবে অবস্থান করে। মনে কর, আমি একটি নগর দেখিলাম; সেই নগরের বহির্বস্তুরাজির আঘাতের প্রতিঘাতেই আমার সেই নগরের অনুভূতি অর্থাৎ সেই নগরের বহির্বস্তুনিচয় দ্বারা আমার অন্তর্বাহী স্নায়ুমন্ডলীর মধ্যে যে গতিবিশেষ উৎপন্ন হয়, তাহাদ্বারা মস্তিষ্কমধ্যস্থ পরমাণুগুলির ভিতর গতিবিশেষ উৎপন্ন হইয়াছে। এখন-অনেক দিন পরেও ঐ নগরটি মনে করিতে পারি। স্মৃতিতেও ঠিক ঐ ব্যাপারই ঘটিয়া থাকে, তবে মৃদুতরভাবে। কিন্তু যে ক্রিয়া মস্তিষ্কের ভিতর অনুরূপ মৃদুতর স্পন্দন তোলে, তাহাই বা কোথা হইতে আসে? উহা সেই প্রথম সংবেদন-জনিত, তাহা কখনই বলা যায় না। তাহা হইলে স্পষ্টই প্রতীত হইতেছে যে, ঐ সংবেদন-জনিত গতিপ্রবাহগুলি শরীরে কোথাও কুন্ডলীকৃত হইয়া রহিয়াছে, এবং উহাদের অভিঘাতের ফলে স্বপ্নকালীন অনুভূতিরূপ মৃদু প্রতিক্রিয়ার উদ্ভব হয়।

যে কেন্দ্রে সংবেদনগুলির অবশিষ্টাংশ বা সংস্কারসমষ্টি যেন সঞ্চিত থাকে, তাহাকে ‘মূলাধার’ বলে, আর ঐ কুন্ডলীকৃত ক্রিয়াশক্তিকে ‘কুন্ডলিনী’ বলে। সম্ভবতঃ চেষ্টাশক্তির অবশিষ্টাংশও এই স্থানেই কুন্ডলীকৃত হইয়া সঞ্চিত রহিয়াছে; কারণ, বাহ্যবস্তুর দীর্ঘকাল চিন্তা ও গভীর অধ্যয়নের পর শরীরের যে স্থানে ঐ মূলাধার চক্র (সম্ভবতঃ ত্রিকাস্থি-স্নায়ুজাল=Sacral Plexus) অবস্থিত, তাহা উষ্ণ হইতে দেখা যায়। যদি এই কুন্ডলিনী শক্তিকে জাগরিত করিয়া ক্রিয়াশীল করা যায়, তারপর জ্ঞাতসারে সুষুম্না-নালীর ভিতর দিয়া লইয়া যাওয়া যায়, তবে উহা যেমন যেমন এক কেন্দ্রের পর আর এক কেন্দ্রের উপর ক্রিয়া করিবে, অমনি প্রবল প্রতিক্রিয়ার উৎপত্তি হইবে। যখন কুন্ডলিনী-শক্তির অতি সামান্য অংশ কোন স্নায়ুতন্তুর মধ্য দিয়া প্রবাহিত হইয়া বিভিন্ন কেন্দ্র হইতে প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে, তখন তাহাই স্বপ্ন অথবা কল্পনা নামে অভিহিত হয়। কিন্তু যখন ঐ দীর্ঘকালসঞ্চিত বিপুল শক্তিপুঞ্জ দীর্ঘকালব্যাপী তীব্র ধ্যানের শক্তিতে সুষুম্নামার্গ অতিক্রম করিতে থাকে, তখন যে প্রতিক্রিয়া হয়, তাহা অতি প্রবল। তাহা স্বপ্ন বা কল্পনাকালীন প্রতিক্রিয়া হইতে অনন্তগুণে শ্রেষ্ঠ তো বটেই, জাগ্রৎকালীন বিষয়জ্ঞানের প্রতিক্রিয়া হইতেও অনন্তগুণে প্রবল।

ইহাই অতীন্দ্রিয় অনুভূতি, আর এই অবস্থায় মন জ্ঞানাতীত ভূমিতে আরোহণ করিয়াছে বলা যায়। আবার যখন উহা সমুদয় জ্ঞানের-সমুদয় অনুভূতির কেন্দ্রস্বরূপ মস্তিষ্কে গিয়া উপস্থিত হয়, তখন সমুদয় মস্তিষ্ক ও উহার অনুভবসম্পন্ন প্রত্যেক পরমাণু হইতেই যেন প্রতিক্রিয়া হইতে থাকে; ইহার ফল জ্ঞানালোকের পূর্ণ প্রকাশ বা আত্মানুভূতি। কুন্ডলিনী-শক্তি যেমন যেমন এক কেন্দ্র হইতে অপর কেন্দ্রে যায়, অমনি যেন মনের এক-একটি স্তর উন্মুক্ত হইয়া যায়, এবং তখন যোগী এই জগতের সূক্ষ্ম বা কারণাবস্থাটিকে উপলব্ধি করিতে থাকেন। তখনই সংবেদন ও উহার প্রতিক্রিয়ারূপে জগতের কারণসমূহের যথার্থ জ্ঞান হইবে, সুতরাং তখনই আমাদের সর্ববিষয়ের পূর্ণ জ্ঞান হইবে। কারণটি জানিতে পারিলেই কার্যের জ্ঞান নিশ্চয়ই আসিবে।

এইরূপে দেখা গেল যে, কুন্ডলিনীকে জাগ্রত করাই দিব্যজ্ঞান-জ্ঞানাতীত অনুভূতি বা আত্মানুভূতি লাভের একমাত্র উপায়। কুন্ডলিনী জাগরণের অনেক উপায় আছেঃ কাহারও ভগবৎপ্রেমবলে, কাহারও বা সিদ্ধ মহাপুরুষগণের কৃপায়, কাহারও বা সূক্ষ্ম জ্ঞানবিচার দ্বারা। লোকে যাহাকে অলৌকিক শক্তি বা জ্ঞান বলিয়া থাকে, যখনই কোথাও তাহার কিছু প্রকাশ দেখা যায়, তখনই বুঝিতে হইবে যে, কিঞ্চিৎ পরিমাণে এই কুন্ডলিনী-শক্তি কোন মতে সুষুম্নার ভিতর প্রবেশ করিয়াছে। তবে এরূপ অলৌকিক ঘটনাগুলির অধিকাংশ স্থলেই দেখা যাইবে যে, সেই ব্যক্তি না জানিয়া হঠাৎ এমন কোন-সাধন করিয়া ফেলিয়াছে যে, তাহাতে তাহার অজ্ঞাতসারে কুন্ডলিনীশক্তির কিয়ৎপরিমাণ সুষুম্নায় প্রবেশ করিয়াছে। সর্বপ্রকার উপাসনাই জ্ঞাতসারে অথবা অজ্ঞাতসারে এই একই লক্ষে পৌঁছিয়া দেয়। যিনি মনে করেন, প্রার্থনার উত্তর পাইতেছি, তিনি জানেন না যে, প্রার্থনা-রূপ মনোবৃত্তি দ্বারা তিনি তাঁহারই দেহস্থিত অনন্ত শক্তির এক বিন্দুকে জাগরিত করিতে সমর্থ হইয়াছেন। সুতরাং মানষ না জানিয়া যাঁহাকে নানা নামে-ভয়ে ও দুঃখের ভিতর দিয়া উপাসনা করে, তাঁহার নিকট কিভাবে অগ্রসর হইতে হয় জানিলে বুঝিবে, তিনিই প্রত্যেক প্রাণীর মধ্যে প্রকৃত শক্তিরূপে কুন্ডালাকারে বিরাজমান এবং তিনি সকল সুখের জননী-যোগিগণ জগতের সমক্ষে ইহাই উচ্চকষ্ঠে ঘোষণা করেন। সুতরাং রাজযোগই প্রকৃত ধর্মবিজ্ঞান। উহাই সকল উপাসনা, সকল প্রার্থনা, বিভিন্ন প্রকার সাধনপদ্ধতি, ক্রিয়ানুষ্ঠান ও অলৌকিক ঘটনাসমূহের যুক্তিসঙ্গত ব্যাখ্যা।