০৪. পত্রাবলী ৪০৫-৪১৪

৪০৫*

[নৈনিতালের মহম্মদ সর্ফরাজ হোসেনকে লিখিত]

আলমোড়া
১০ জুন, ১৮৯৮

প্রীতিভাজনেষু,
আপনার পত্রের মর্ম বিশেষভাবে উপলব্ধি করিলাম, ইহা জানিয়া যার-পর-নাই আনন্দিত হইয়াছি যে, ভগবান্‌ সকলের অগোচরে আমাদের মাতৃভূমির জন্য অপূর্ব আয়োজন করিতেছেন।

ইহাকে আমরা বেদান্তই বলি আর যাই বলি, আসল কথা এই যে, অদ্বৈতবাদ ধর্মের এবং চিন্তার শেষ কথা, এবং কেবল অদ্বৈতবাদ হইতেই মানুষ সকল ধর্ম ও সম্প্রদায়কে প্রীতির চক্ষে দেখিতে পারে। আমার বিশ্বাস যে, উহাই ভাবী শিক্ষিত মানবসমাজের ধর্ম। হিন্দুগণ অন্যান্য জাতি অপেক্ষা শীঘ্র শীঘ্র এই তত্ত্বে পৌঁছানোর কৃতিত্বটুকু পাইতে পারে, কারণ তাহারা হিব্রু কিম্বা আরব-জাতিগুলি অপেক্ষা প্রাচীনতর; কিন্তু কর্মপরিণত বেদান্ত (Practical Advaitism)—যাহা সমগ্র মানবজাতিকে নিজ আত্মা বলিয়া দেখে এবং তদনুরূপ ব্যবহার করিয়া থাকে—তাহা হিন্দুগণের মধ্যে সর্বজনীনভাবে এখনও পুষ্টিলাভ করে নাই।

পক্ষান্তরে আমাদের অভিজ্ঞতা এই যে, কখনও যদি কোন ধর্মের লোক দৈনন্দিন ব্যাবহারিক জীবনে এই সাম্যের কাছাকাছি আসিয়া থাকে, তবে একমাত্র ইসলামধর্মের লোকেরাই আসিয়াছে; এইরূপ আচরণ যে গভীর অর্থ এবং ইহার ভিত্তিস্বরূপ যে-সকল তত্ত্ব বিদ্যমান, সে সম্বন্ধে হিন্দুগণের ধারণা পরিষ্কার, এবং ইসলামপন্থিগণ সে-বিষয়ে সাধারণতঃ সচেতন নয়।

এইজন্য আমাদের দৃঢ় ধারণা যে, বেদান্তের মতবাদ যতই সূক্ষ্ম ও বিস্ময়কর হউক না কেন, কর্মপরিণত ইসলাম-ধর্মের সহায়তা ব্যতীত তাহা মানব-সাধারণের অধিকাংশের নিকট সম্পূর্ণরূপে নিরর্থক। আমরা মানব জাতিকে সেই স্থানে লইয়া যাইতে চাই—যেখানে বেদও নাই, বাইবেলও নাই, কোরানও নাই; অথচ বেদ, বাইবেল ও কোরানের সমন্বয় দ্বারাই ইহা করিতে হইবে। মানবকে শিখাইতে হইবে যে, সকল ধর্ম ‘একত্বরূপ সেই এক ধর্মে’রই বিবিধ প্রকাশ মাত্র, সুতরাং যাহার যেটি সর্বাপেক্ষা উপযোগী সেটিকেই বাছিয়া লইতে পারে।

আমাদের নিজেদের মাতৃভূমির পক্ষে হিন্দু ও মুসলমান ইসলামধর্মরূপ এই দুই মহান্ মতের সমন্বয়ই—বৈদান্তিক মস্তিষ্ক ও ইসলামীয় দেহ—একমাত্র আশা।

আমি মানসচক্ষে দেখিতেছি, এই বিবাদ-বিশৃঙ্খলা ভেদপূর্বক ভবিষ্যৎ পূর্ণাঙ্গ ভারত বৈদান্তিক মস্তিষ্ক ও ইসলামীয় দেহ লইয়া মহা মহিমায় ও অপরাজেয় শক্তিতে জাগিয়া উঠিতেছে।

ভগবান্‌ আপনাকে মানবজাতির, বিশেষ করিয়া আমাদের অতি হতভাগ্য জন্মভূমির সাহায্যের জন্য একটি মহান্ যন্ত্র-রূপে গঠিত করুন, ইহাই সতত প্রার্থনা। ইতি

ভবদীয়া স্নেহবদ্ধ
বিবেকানন্দ

৪০৬*

[মিঃ ই. টি. স্টার্ডিকে লিখিত]

কাশ্মীর
৩ জুলাই, ১৮৯৮

প্রিয় স্টার্ডি,
উভয় সংস্করণেই আমার সম্মতি ছিল, কারণ আমাদের মধ্যে ব্যবস্থা হয়েছিল যে, আমার বইগুলি যে-কেউ প্রকাশ করতে চাইলে আমরা আপত্তি করব না। মিসেস বুল এ সম্বন্ধে সব জানেন; তিনি তোমাকে লিখছেন।

মিস সুটার (Miss Souter)-এর কাছ থেকে সেদিন একখানা সুন্দর চিঠি পেয়েছি। তিনি আগের মতই বন্ধুভাবাপন্ন।

শিশুদের, মিসেস স্টার্ডিকে ও তোমাকে ভালবাসা।

সতত প্রভুসমীপে তোমার
বিবেকানন্দ

৪০৭

[স্বামী ব্রহ্মানন্দকে লিখিত]

শ্রীনগর
১৭ জুলাই, ১৮৯৮

অভিন্নহৃদয়েষু,
তোমার পত্রে সমস্ত অবগত হইলাম। … সারদার সম্বন্ধে যাহা লিখিয়াছ, তদ্বিষয়ে আমার বক্তব্য এই মাত্র যে, বাঙলা ভাষায় magazine (পত্রিকা) paying (লাভজনক) করা মুশকিল, তবে সকলে মিলিয়া দ্বারে দ্বারে ফিরিয়া subscriber (গ্রাহক) যদি যোগাড় করা যায় তো সম্ভব বটে। এ বিষয়ে তোমাদের যে প্রকার মত হয়, করিবে। সারদা বেচারা একেবারে ভগ্নমনোরথ হইয়াছে। যে লোকটা এত কাজের এবং নিঃস্বার্থ, তার জন্য এক হাজার টাকা যদি জলেও যায় তো ক্ষতি কি? ‘রাজযোগ’ ছাপা হইবার কি হইল? উপেনকেই না হয় দাও on certain shares (কিছু লাভে)। টাকাকড়ি সম্বন্ধে যাহা লিখিয়াছি, তাহাই শেষ। অতঃপর দেওয়া-থোওয়া সম্বন্ধে তুমি যেমন বিবেচনা করিবে, তাহাই করিবে। … আমি বেশ দেখতে পাচ্ছি যে, আমার policy (কার্যধারা) ভুল, তোমারটা ঠিক—about helping others (অপরকে সাহায্য করা সম্বন্ধে), অর্থাৎ একেবারে বেশী দিলে লোকে grateful (কৃতজ্ঞ) না হইয়া উল্টা ঠাওরায় যে, একটা বোকা বেশ পাওয়া গেছে। I always lost sight of the demoralising influence of charity on the receiver. (দানের ফলে গ্রহীতার যে নৈতিক অবনতি হয়, সেদিকে আমার দৃষ্টি থাকে না)। দ্বিতীয়তঃ ভিক্ষের পয়সা যে উদ্দেশ্যে লোকে দেয়, তাহা হইতে একটুও এদিক-ওদিক করিবার আমাদের অধিকার নাই। কাশ্মীরের প্রধান বিচারপতি ঋষিবর মুখোপাধ্যায়ের বাড়ীর ঠিকানায় দিলেই মিসেস বুল মালা পাইবেন। মিত্র মহাশয় এবং জজ সাহেব ইহাদের অত্যন্ত যত্ন করিতেছেন। কাশ্মীরের জমি এখনও পর্যন্ত পাওয়া যায় নাই, শীঘ্রই হইবার সম্ভবনা। এখানে তুমি একটা শীত কাটাইতে পারিলেই শরীর নিশ্চিত শুধরাইয়া যাইবে। যদি উত্তম ঘর হয় এবং যথেষ্ট কাঠ থাকে এবং গরম কাপড় থাকে, বরফের দেশে আনন্দ বৈ নিরানন্দ নাই। এবং পেটের রোগের পক্ষে শীতপ্রধান দেশ ব্রহ্মৌষধ। যোগেন-ভায়াকেও সঙ্গে আনিও; কারণ এদেশ পাহাড় নয়, এঁটেলমাটি বাঙলা দেশের মত।

আলমোড়ায় কাগজটা বাহির করিলে অনেক কাজ এগোয়; কারণ সেভিয়ার বেচারা একটা কাজ পায় এবং আলমোড়ার লোকেও একটা পায়। সকলকে একটা একটা মনের মত কাজ দেওয়াই বড় ওস্তাদি। কলিকাতায় নিবেদিতার বালিকা বিদ্যালয়টি যেমন করে হোক খাড়া করে দিতে হবে। মাষ্টার মহাশয়কে কাশ্মীরে আনা এখনও অনেক দূরের কথা; কারণ এখানে কলেজ হতে এখনও ঢের দেরী। তবে তিনি লিখিয়াছেন যে, তাকে প্রিন্সিপাল করে কলিকাতায় একটা কলেজ করা। হাজার টাকা initial expense (প্রারম্ভিক ব্যয়) হলেই চলবে। সে বিষয়ে নাকি তোমাদেরও বিশেষ মত। তাহাতে যাহা ভাল বিবেচনা করিবে, তাহাই করিও। আমার শরীর বেশ আছে। রাত্রে প্রায় আর উঠিতে হয় না, অথচ দু-বেলা ভাত আলু চিনি—যা পাই তাই খাই। ওষুধটা কিছু কাজের নয়—ব্রহ্মজ্ঞানীর শরীরে ঔষধ ধরে না। ও হজম হয়ে যাবে—কিছু ভয় নাই।

মেয়েরা সকলে আছে ভাল ও তোমাদের ভালবাসা জানাইতেছে। শিবানন্দজীর দুইটি চিঠি আসিয়াছে। তাঁহার অষ্ট্রেলিয়ান শিষ্যেরও এক পত্র পাইয়াছি। কলিকাতায় শুনিতেছি নাকি প্লেগ একেবারে বন্ধ হইয়া গিয়াছে।

ইতি বিবেকানন্দ

৪০৮

[স্বামী ব্রহ্মানন্দকে লিখিত]

শ্রীনগর
১ অগষ্ট, ১৮৯৮

অভিন্নহৃদয়েষু,
তোমার বরাবর একটি বুঝিবার ভ্রম হয় এবং ‘—’ এর প্রবল বুদ্ধির দোষে বা গুণে সেটি যায় না। সেটি এই যে, যখন আমি হিসাব-কিতাবের কথা বলি, তোমার মনে হয় যে, আমি তোমাদের অবিশ্বাস করছি। … আমার কেবল ভয় এই যে, এখন তো একরকম খাড়া করা গেল। অতঃপর আমরা চলে গেলে যাতে কাজ চলে এবং বেড়ে যায়, তাহাই দিনরাত্র আমার চিন্তা। হাজারও theoretical knowledge (তাত্ত্বিক জ্ঞান) থাকুক—হাতে-হেতড়ে না করলে কোন বিষয় শেখা যায় না। Election (নির্বাচন) এবং টাকাকড়ির হিসাব discussion (আলোচনা) এর জন্য বারংবার আমি বলি, যাতে সকলে কাজের জন্য তৈয়ার হয়ে থাকে। একজন মরে গেলে অমনি একজন (দশজন if necessary—প্রয়োজন হলে) should be ready to take it up (কাজে লাগবার জন্য প্রস্তুত থাকা উচিত)। দ্বিতীয় কথা—মানুষের interest (আগ্রহ) না থাকিলে কেউ খাটে না; সকলকে দেখান উচিত যে, everyone has a share in the work and property, and a voice in the management (প্রত্যেকেরই কাজে ও সম্পত্তিতে অংশ আছে এবং কার্যধারা সম্বন্ধে মতপ্রকাশের ক্ষমতা আছে)—এই বেলা থেকে। Alternately (পর্যায়ক্রমে) প্রত্যেককেই responsible position (দায়িত্বপূর্ণ কাজ) দেবে with an eye to watch and control (নিয়ন্ত্রণের প্রতি দৃষ্টি রেখে), তবে লোক তৈয়ার হয় for business (কাজের জন্য)। এমন machine (যন্ত্র)-টি খাড়া কর যে, আপনা- আপনি চলে যায়, যে মরে বা যে বাঁচে। আমাদের ইণ্ডিয়ার ঐটি great defect (প্রধান দোষ), we cannot make a permanent organisation (আমরা স্থায়ী প্রতিষ্ঠান গড়তে পারি না), and the reason is because we never like to share power with others and never think of what will come after we are gone. (আর তার কারণ এই যে, আমরা অপরের সঙ্গে কখনও ক্ষমতা ভাগ করে নিতে চাই না, এবং আমাদের পরে কি হবে, তা কখনও ভাবি না)।

প্লেগ সম্বন্ধে সব লিখেছি। মিসেস বুল ও মূলার প্রভৃতির মত যে, যখন পাড়ায় পাড়ায় হাসপাতাল হয়ে গেল, তখন মিছে কতকগুলো টাকা খরচ কেন? We will lend our services as nurses etc. Those that pay the piper must command the tune (আমরা শুধু সেবক হিসাবে কাজ করব। যারা টাকা দেয় তাদের কথা শুনতে হয়)।

কাশ্মীরের রাজা জমি দিতে রাজী। জমি দেখেও এসেছি। এখন দু-চার দিনের মধ্যে হয়ে যাবে—প্রভুর যদি ইচ্ছা হয়। এখানে একটি ছোট বাড়ি করে যাব এইবারেই। যাবার সময় leave it in the charge of Justice Mukherjee (বিচারপতি মুখোপাধ্যায়ের তত্ত্বাবধানে রেখে যাব)। আর তুমি না হয় এসে এখানে শীত কাটিয়ে যাও with somebody else (অপর কাকেও সঙ্গে নিয়ে); শরীরও সেরে যাবে এবং কাজও হবে। যে টাকা press (ছাপাখানা)-এর (জন্য) রেখে এসেছি, তা হলেই হবে।—তুমি যেমন বিবেচনা কর। এবার N. W. P (উত্তর-পশ্চিমপ্রদেশ), রাজপুতানা প্রভৃতিতে কতকগুলি টাকা পাব—নিশ্চিত। ভাল কথা কয়েকজনকে … এই ভাবে টাকা দিও। এই টাকা আমি মঠ থেকে কর্জ নিচ্ছি এবং পরিশোধ করব to you with interest (তোমার কাছে সুদ সমেত)। …

আমার শরীর এক রকম ভালই আছে। বাড়ী-ঘর আরম্ভ হয়েছে—বেশ কথা। সকলকে আমার ভালবাসা দিও। ইতি

বিবেকানন্দ

৪০৯*

কাশ্মীর
২৫ অগষ্ট, ১৮৯৮

প্রিয় মার্গট,
গত দু-মাস যাবৎ আমি অলসের মত দিন কাটাচ্ছি। ভগবানের দুনিয়ার জমকালো সৌন্দর্যের যা পরাকাষ্ঠা হতে পারে, তারই মধ্য দিয়ে প্রকৃতির এই নৈসর্গিক উদ্যানে মনোরম ঝিলামের বুকে নৌকায় ভেসে বেড়াচ্ছি, এখানে পৃথিবী বায়ু ভূমি তৃণ গুল্মরাজি পাদপশ্রেণী পর্বতমালা তুষার-রাশি ও মানবদেহ—সবকিছুর অন্ততঃ বাহিরের দিকটায় ভগবানেরই সৌন্দর্য বিচ্ছুরিত হচ্ছে। নৌকাটিই আমার ঘরবাড়ী; আর আমি প্রায় সম্পূর্ণ রিক্ত— এমন কি দোয়াত-কলমও নেই বলা চলে; যখন যেমন জুটছে, খেয়ে নিচ্ছি—ঠিক যেন একটি রিপ ভ্যান উইঙ্কল্-এর ছাঁচে ঢালা তন্দ্রাচ্ছন্ন জীবন!

কাজের চাপে নিজেকে মেরে ফেলো না যেন। ওতে কোন লাভ নেই; সর্বদা মনে রাখবে, ‘কর্তব্য হচ্ছে যেন মধ্যাহ্ন-সূর্যের মত—তার তীব্র রশ্মি মানুষের জীবনীশক্তি ক্ষয় করে।’ সাধনার দিক্‌ দিয়ে ওর সাময়িক মূল্য আছে বটে, তার বেশী করতে গেলে ওটা একটা দুঃস্বপ্ন মাত্র। আমরা জগতের কাজে অংশগ্রহণ করি আর নাই করি, জগৎ নিজের ভাবে চলে যাবেই। মোহের ঘোরে আমরা নিজেকে ধ্বংস করে ফেলি মাত্র। এক-জাতীয় ভ্রান্ত ধারণা আছে, যা চরম নিঃস্বার্থতার মুখোস পরে দেখা দেয়; কিন্তু সবরকম অন্যায়ের কাছে যা মাথা নোয়ায়, সে চরমে অপরের অনিষ্টই করে। নিজেদের নিঃস্বার্থপরতা দিয়ে অপরকে স্বার্থপর করে তোলার কোন অধিকার আমাদের নেই। আছে কি?

তোমাদের
বিবেকানন্দ

৪১০*

[মিস মেরী হেলকে লিখিত]

শ্রীনগর, কাশ্মীর
২৮ অগষ্ট, ১৮৯৮

স্নেহের মেরী,
তোমাকে চিঠি লেখার কোন সুযোগ ইতোমধ্যে করে উঠতে পারিনি, আর তোমারও চিঠি পাবার কোন তাগিদ ছিল না; তাই বাজে অজুহাত দেখাব না। শুনলাম মিসেস লেগেটকে লেখা মিস ম্যাকলাউডের চিঠি থেকে তুমি কাশ্মীর ও আমাদের সম্বন্ধে সমস্ত সংবাদ জানতে পারছ, সুতরাং এ সম্বন্ধে আর কথা বাড়ানোর প্রয়োজন নেই।

কাশ্মীরে হাইন‍্‍সহোল্ড (Heinsholdt)-এর ‘মাহাত্মা’-সন্ধান সম্পূর্ণ ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে; প্রথমেই প্রতিপন্ন করতে হবে যে, সমগ্র ব্যাপারটা একটি বিশ্বাসযোগ্য সূত্র থেকে আসছে, প্রচেষ্টা খুব তাড়াতাড়ি আরম্ভ করা হয়েছে। মাদার চার্চ ও ফাদার পোপ কেমন আছেন? তোমরা কেমন আছ? একজন দল থেকে সরে পড়াতে৭ পুরানো খেলা আরও উৎসাহ সহকারে চলছে কি? ফ্লোরেন্সের কোন প্রতিমূর্তির মত যার চেহারা, সে কেমন আছে (নামটা ভুলে গিয়েছি)?

কয়েকদিনের জন্য আমি দূরে চলে গিয়েছিলাম। এখন আমি মহিলাদের সঙ্গে যোগ দিতে যাচ্ছি। তারপর যাত্রিদলটি যাচ্ছে কোন পাহাড়ের পিছনে এক বনের মধ্যে একটি শান্ত সুন্দর পরিবেশ, যেখানে কুলকুল করে ছোট নদী বয়ে চলেছে। সেখানে তারা দেবদারু গাছের নীচে বুদ্ধের মত আসন করে গভীর ও দীর্ঘস্থায়ী ধ্যানে নিমগ্ন হয়ে থাকবে।

এ-রকম প্রায় মাসখানেক চলবে; তারপর যখন আমাদের সৎকর্মের ফলভোগ শেষ হবে, তখন আবার স্বর্গ থেকে মর্ত্যে পতন হবে। তারপর কয়েক মাস কর্মফল সঞ্চয় করব ও দুষ্কর্মের জন্য আবার নরকে যেতে হবে—চীনে, এবং আমাদের কুকর্ম ক্যাণ্টন ও অন্যান্য নগরের দুর্গন্ধের মধ্যে আমাদের নিমজ্জিত করবে। তারপর জাপানের নরকে। তারপর আবার যুক্তরাষ্ট্রের স্বর্গলোকে।

কত না সুন্দর সুন্দর জিনিষ তোমাকে পাঠাতে আমার ইচ্ছা, কিন্তু হায়! শুল্ক-তালিকার কথা ভাবলে আমার আকাঙ্ক্ষা ‘মেয়েদের যৌবন ও ভিখারীদের স্বপ্নের মত’ মিলিয়ে যায়।

কথাপ্রসঙ্গে বলছি, আমি খুশী যে, দিনদিন আমার চুল পাকছে। তোমার সঙ্গে পরবর্তী সাক্ষাতের পূর্বেই আমার মাথাটি পূর্ণ-বিকশিত একটি শ্বেত পদ্মের মত হবে।

আহা! মেরী যদি তুমি কাশ্মীর দেখতে—শুধুই কাশ্মীর! পদ্ম ও হাঁসে ভরা চমৎকার হ্রদগুলি (হাঁস নেই, রাজহংসী আছে—এটুকু কবির স্বাধীনতা) এবং বায়ু সঞ্চালিত সেই পদ্মগুলিতে বড় বড় কালো কালো ভ্রমর বসবার চেষ্টা করছে (আমি বলতে চাই যে পদ্মগুলি মাথা নেড়ে আপত্তি জানাচ্ছে—ইতি কবিতা)—এই দৃশ্য যদি তুমি দেখতে, তা হলে মৃত্যু শয্যাতেও তোমার পুরোপুরি জ্ঞান থাকত। যেহেতু এটা ভূস্বর্গ এবং যেহেতু তর্কশাস্ত্র বলে—হাতের একটি পাখী বনের দুটির সমান, অতএব এই (ভূস্বর্গের) ক্ষণিক দর্শনও লাভজনক, কিন্তু অর্থনীতির দিক্‌ থেকে অপরটি (অর্থাৎ না-দেখাই) শ্রেয়। কোন কষ্ট নেই, পরিশ্রম নেই, কোন খরচপত্র নেই, ছেলেমানুষি ভাবপূর্ণ অতি সহজ জীবন এবং তারপর সেইটুকুই সব।

আমার চিঠিটা তোমার কাছে বিরক্তিকর হয়ে উঠেছে … সুতরাং এখানে শেষ করছি (এ হল নিছক আলস্য)। বিদায়।

সতত প্রভুসমীপে তোমার
বিবেকানন্দ

আমার স্থায়ী ঠিকানাঃ
মঠ, বেলুড়
হাওড়া জেলা, বাঙলা, ভারতবর্ষ

৪১১

[শ্রীযুক্ত হরিপদ মিত্রকে লিখিত]

শ্রীনগর, কাশ্মীর
১৭ সেপ্টেম্বর, ১৮৯৮

কল্যাণবরেষু,
তোমার পত্র ও তার পাইয়া সমস্ত অবগত হইলাম। প্রভুর নিকট প্রার্থনা করি যে, নির্বিঘ্নে সিন্ধি-ভাষা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হও।

মধ্যে আমার শরীর অত্যন্ত অসুস্থ হইয়া পড়ায় কিঞ্চিৎ দেরী হইয়া পড়িল, নতুবা এই সপ্তাহের মধ্যেই পঞ্জাবে যাইবার কল্পনা ছিল। এক্ষণে দেশে অতিশয় গ্রীষ্ম বলিয়া ডাক্তার যাইতে নিষেধ করিতেছেন। অক্টোবরের শেষ সপ্তাহ নাগাদ বোধ হয় করাচি পৌঁছিব। এক্ষণে এক-রকম ভাল আছি। আমার সঙ্গে এবার কেহ নাই। দুজন আমেরিকান লেডি ফ্রেণ্ড মাত্র আছেন। তাঁহাদের সঙ্গ বোধ হয় লাহোরে ছাড়িব। তাঁহারা কলিকাতায় বা রাজপুতানায় আমার অপেক্ষা করিবেন। আমি সম্ভবতঃ কচ্ছভুজ, জুনাগড়, ভাটনগর, লিমডি ও বরোদা হইয়া কলিকাতায় যাইব। নভেম্বর ও ডিসেম্বরে চীন ও জাপান হইয়া আমেরিকায় যাইব—এই তো বাসনা। পরে শ্রীপ্রভুর হাত। আমার এখনকার সমস্ত খরচ উক্ত আমেরিকান বন্ধুরা দেন এবং করাচি পর্যন্ত ভাড়া প্রভৃতি তাঁহাদের নিকট হইতেই লইব। তবে যদি তোমার সুবিধা হয়, ৫০ টাকা টেলিগ্রাম করিয়া C/o ঋষিবর মুখোপাধ্যায়, চিফ জজ, কাশ্মীর স্টেট, শ্রীনগর—এঁর নামে পাঠাইলে অনেক উপকার হইবে। কারণ সম্প্রতি ব্যারামে পড়িয়া বাজে খরচ কিছু হইয়াছে, এবং সর্বদা বিদেশী শিষ্যদের নিকট টাকা ভিক্ষা করিতে লজ্জা করে।

সদা শুভাকাঙ্ক্ষী
বিবেকানন্দ

৪১২*

[খেতড়ির মহারাজকে লিখিত]

C/o ঋষিবর মুখার্জি
প্রধান বিচারপতি, কাশ্মীর
১৭ সেপ্টেম্বর,১৮৯৮

মহামান্য মহারাজ,
এখানে আমি দু-সপ্তাহ খুবই অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম। এখন সুস্থ হয়ে উঠেছি। আমার কিছু টাকার টান পড়েছে। যদিও আমেরিকান বন্ধুরা আমাকে সাহায্যের জন্য তাঁদের সাধ্যমত সব কিছুই করেছেন, কিন্তু সবসময়ই তাঁদের কাছে হাত পাততে সঙ্কোচ হয়, বিশেষতঃ অসুখ করলে খরচের বহর অনেক বেড়ে যায়। এই জগতে শুধু একজনের কাছেই আমার কিছু চাইতে লজ্জা হয় না এবং তিনি হলেন আপনি। আপনি দিলেন কি না দিলেন—আমার কাছে দুই সমান। যদি সম্ভব হয়, অনুগ্রহ করে কিছু টাকা পাঠাবেন। আপনি কেমন আছেন? অক্টোবর মাসের মাঝামাঝি আমি (এখান থেকে) নাবছি।

জগমোহনের চিঠিতে কুমার (যুবরাজ) সাহেব সম্পূর্ণ সুস্থ হয়েছে জেনে সবিশেষ আনন্দিত হলাম। আমার সব খবর ভাল, আশা করি আপনার সব কুশল।

সতত প্রভুসমীপে আপনার
বিবেকানন্দ

৪১৩*

[খেতড়ির মহারাজকে লিখিত]

লাহোর
১৬ অক্টোবর, ১৮৯৮

মহামান্য মহারাজ,
আমার ‘তারে’র পরে যে চিঠিখানা গিয়েছে, তাতে আপনার অভিপ্রেত সংবাদ ছিল; সেজন্য আপনার ‘তারে’র উত্তরে আমার স্বাস্থ্যের সংবাদ দিয়ে আর কোন ‘তার’ করিনি।

এ বৎসর কাশ্মীরে অনেক রোগভোগের পর এখন আরোগ্যলাভ করেছি এবং আজ সোজাসুজি কলিকাতায় যাচ্ছি। গত দশ বছর বাঙলাদেশে দুর্গাপূজা দেখিনি, দুর্গাপূজা সেখানকার একটি ধুমধাম ব্যাপার। আশা করি, এ বছর পূজা দেখব।

পাশ্চাত্যদেশীয় বন্ধুগণ দু-এক সপ্তাহের মধ্যেই জয়পুর দেখতে যাবেন। জগমোহন যদি সেখানে থাকে, তা হলে তাকে দয়া করে নির্দেশ দেবেন, সে যেন তাঁদের একটু দেখাশোনা করে এবং শহরটি ও প্রাচীন শিল্পকীর্তিগুলি ঘুরে দেখিয়ে দেয়।

আমার গুরুভ্রাতা সারদানন্দকে নির্দেশ দিচ্ছি, জয়পুর রওনা হবার পূর্বে মুন্সীজীকে যেন লিখে জানায়।

আপনি ও যুবরাজ কেমন আছেন? যথারীতি আপনার কল্যাণের জন্য প্রার্থনা করছি।

আপনার প্রীতিবদ্ধ
বিবেকানন্দ

পুনঃ—আমার ভবিষ্যৎ ঠিকানাঃ
মঠ, বেলুড়, হাওড়া জেলা, বাঙলা।

৪১৪

[শ্রীযুক্ত হরিপদ মিত্রকে লিখিত]

লাহোর
১৬ অক্টোবর, ১৮৯৮

কল্যাণবরেষু,
কাশ্মীরে স্বাস্থ্য একেবারে ভাঙিয়া গিয়াছে এবং ৯ বৎসর যাবৎ দুর্গাপূজা দেখি নাই—এ বিধায় কলিকাতা চলিলাম। আমেরিকা যাইবার সঙ্কল্প এখন পরিত্যাগ করিয়াছি এবং শীতকালের মধ্যে করাচি আসিবার অনেক সময় হইবে।

৫০ টাকা আমার গুরুভ্রাতা সারদানন্দ লাহোর হইতে করাচি পাঠাইবেন। দুঃখিত হইও না—সকলই প্রভুর হাত। আমি এ বৎসর তোমাদের সহিত সাক্ষাৎ না করিয়া কোথাও যাইব না নিশ্চিত। সকলকে আমার আশীর্বাদ।

সদা শুভাকাঙ্ক্ষী
বিবেকানন্দ