০২. সাংখ্যীয় ব্রহ্মাণ্ডতত্ত্ব

দুইটি শব্দ রহিয়াছে-ক্ষুদ্র ব্রহ্মাণ্ড ও বৃহৎ ব্রহ্মাণ্ড ; অন্তঃ ও বহিঃ। আমরা অনুভূতি দ্বারা এই উভয় হইতেই সত্য লাভ করিয়া থাকি- আভ্যান্তর অনুভূতি ও বাহ্য অনুভূতি। আভ্যান্তর অনুভূতি দ্বারা সংগৃহীত সত্যসমূহ-মনোবিজ্ঞান, দর্শন ও ধর্ম নামে পরিচিত ; আর বাহ্য অনুভূতি হইতে জড়বিজ্ঞানের উৎপত্তি। এখন কথা এই, যাহা পূর্ন সত্য, তাহার সহিত এই উভয় জগতের অনুভূতিরই সামঞ্জস্য থাকিবে। ক্ষুদ্র ব্রহ্মাণ্ড বৃহৎ ব্রহ্মাণ্ডের সত্যসমূহে সাক্ষ্য প্রদান করিবে, সেইরূপ বৃহৎ ব্রহ্মাণ্ডও ক্ষুদ্র ব্রহ্মাণ্ডের সত্যে সাক্ষ্য দিবে। বর্হিজগতের সত্যের অবিকল প্রতিকৃতি অন্তর্জগতে থাকা চাই, আবার অন্তর্জগতের সত্যের প্রমানও বর্হিজগতে পাওয়া চাই। তথাপি আমরা কার্যতঃ দেখিতে পাই, এই-সকল সত্যের অধিকাংশই সর্বদা পরস্পর বিরোধী। পৃথিবীর ইতিহাসের একযুগে দেখা যায়, ‘অন্তর্বাদী’র প্রধান্য হইল’; অমনি তাঁহারা ‘বহির্বাদী’র সহিত বিবাদ আরাম্ভ করিলেন। বর্তমান কালে ‘বহির্বাদী’ অর্থাৎ বৈজ্ঞানিকেরা প্রাধান্য লাভ করিয়াছেন, আর তাঁহারা মনস্তত্ত্ববিৎ ও দার্শনিকগনের অনেক সিদ্ধান্ত উড়াইয়া দিয়াছেন। আমার ক্ষুদ্র জ্ঞানে আমি যতটুকু বুঝিয়াছি, তাহাতে দেখতে পাই, মনোবিজ্ঞানের প্রকৃত সারভাগের সম্পূর্ণ সামঞ্জস্য আছে।
প্রকৃতি প্রত্যেক ব্যক্তিকেই সকল বিষয়ে বড় হইবার শক্তি দেন নাই; এজন্য একই জাতি সর্বপ্রকার বিদ্যার অনুসন্ধানে সমান শক্তি সম্পন্ন হইয়া উঠে নাই। আধুনিক ইউরোপীয় জাতিগুলি জড়বিজ্ঞানের অনুসন্ধানে সুদক্ষ, কিন্তু প্রাচীন ইউরোপীয়গন মানুষের অন্তর্জগতের অনুসন্ধানে তত পটু ছিলেন না। অপর দিকে আবার প্রাচ্যেরা বাহ্য জগতের তত্ত্বানুসন্ধানে তত দক্ষ ছিলেন না, কিন্তু অন্তর্জগতের গবেষনায় তাঁহারা খুব দক্ষ দেখাইয়াছেন। এজন্যই আমরা দেখিতে পাই, জড়জগৎ-সম্বন্ধীয় কতগুলি প্রাচ্য মতবাদের সহিত পাশ্চাত্য পদার্থ বিজ্ঞানের মিলে না, আবার পাশ্চাত্য মনোবিজ্ঞান প্রাচ্যজাতির ঐ-বিষয়ক উপদেশের সহিত মিলে না। পাশ্চাত্য বৈজ্ঞানিকগণ প্রাচ্য জড়বিজ্ঞানীদের সমালোচনা করিয়াছেন। তাহা হইলেও উভয়ই সত্যের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত, আর আমরা যেমন পূর্বেই বলিয়াছি, যে-কোন বিদ্যাতেই হউক না, প্রকৃত সত্যের মধ্যে কখন পরস্পর বিরোধ থাকিতে পারে না, আভ্যন্তর সত্যসমূহের সহিত বাহ্য সত্যের সমন্বয় আছে।
ব্রহ্মাণ্ড সম্বন্ধে আধুনিক জ্যোতির্বিদ ও বৈজ্ঞানিকদের মতবাদ কি, তাহা আমরা জানি; আর ইহাও জানি যে, উহা প্রাচীন ধর্মতত্ত্ববাদিগণের কিরুপ ভয়ানক ক্ষতি করিয়াছে; যেমন যেমন এক একটি নতূন নতূন বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার হইতেছে, অমনি যেন তাঁহাদের গৃহে একটি করিয়া বোমা পড়িতেছে, আর সেইজন্যই তাঁহারা সকল যুগেই এই-সকল বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান বন্ধ করিয়া দিবার চেষ্টা করিয়াছেন। প্রথমতঃ আমরা ব্রহ্মাণ্ডতত্ত্ব ও তদানুষঙ্গিক বিষয় সম্বন্ধে প্রাচ্যজাতির মনস্তত্ত্ব ও বিজ্ঞানদৃষ্টিতে কি ধারণা ছিল, তাহা আলোচনা করিব; তাহা হইলে আপনারা দেখিবেন যে, কিরূপ আশ্চর্যভাবে আধুনিক বিজ্ঞানের সমুদয় আধুনিকতম আবিষ্ক্রিয়ার সহিত উহাদের সামঞ্জস্য রহিয়াছে; আর যদি কোথাও কিছু অপূর্ণতা থাকে, তাহা আধুনিক বিজ্ঞানের দিকেই। ইংরেজীতে আমারা সকলে Nature (নেচার) শব্দ ব্যবহার করিয়া থাকি। প্রাচীন হিন্দুদার্শনিকগণ উহাকে দুইটি বিভিন্ন নামে অভিহিত করিতেন; প্রথমটি ‘প্রকৃতি’-ইংরাজী Nature শব্দের সহিত উহা প্রায় সমার্থক; আর দ্বিতীয়টি অপেক্ষাকৃত বৈজ্ঞানিক নাম-‘অব্যক্ত’, যাহা ব্যক্ত বা প্রকাশিত বা ভেদাত্মক নয়, উহা হইতেই সকল পদার্থ উৎপন্ন হইয়াছে, উহা হইতে অণু-পরমাণু সমুদয় আসিয়াছে, উহা হইতেই জড়বস্তু ও শক্তি, মন ও বুদ্ধি-সব আসিয়াছে। ইহা অতি বিস্ময়কর যে, ভারতীয় দার্শনিকগণ অনেক পূর্বেই বলিয়া গিয়াছেন, মন সুক্ষ্ম জড়মাত্র। ‘দেহ যেমন প্রকৃতি হইতে প্রসূত, মনও সেরূপ’- ইহা ব্যতীত আমাদের আধুনিক জড়বাদীরা-আর অধিক কি দেখাইবার চেষ্টা করিতেছেন? চিন্তা সম্বন্ধেও তাই; ক্রমশঃ আমরা দেখিব, বুদ্ধিও সেই একই অব্যক্ত প্রকৃতি হইতে প্রসূত।
প্রচীন আচার্যগণ এই অব্যক্তের লক্ষণ নির্দেশ করিয়াছেনঃ তিনটি শক্তির সাম্যাবস্থা। তন্মধ্যে একটির নাম সত্ত্ব, দ্বিতীয়টি রজঃ এবং তৃতীয়টি তমঃ। তমঃ-সর্বনিম্নতম শক্তি, আকর্ষণস্বরূপ; রজঃ তদপেক্ষা কিঞ্চিত উচ্চতর-উহা বিকর্ষণস্বরূপ; আর সর্বোচ্চ শক্তি এই উভয়ের সংযমস্বরূপ-উহাই সত্ত্ব।
অতএব যখনই এই আকর্ষণ ও বিকর্ষন শক্তিদ্বয় সত্ত্বের দ্বারা সম্পূর্ণ সংযত হয় বা সম্পূর্ণ সাম্যাবস্হায় থাকে, তখন আর সৃষ্টি বা বিকার থাকে না ; কিন্তু যখনই এই সাম্যাবস্হা নষ্ট হয়, তখনই উহাদের সামঞ্জস্য নষ্ট হয়, এবং উহাদের মধ্যে একটি শক্তি অপরগুলি অপেক্ষা প্রবলতর হইয়া উঠে; তখনই পরিবর্তন ও গতি আরম্ভ হয় এবং এই সমুদয়ের পরিনাম চলিতে থাকে। এইরূপ ব্যাপার চক্রের গতিতে চলিতেছে। অর্থাৎ এক সময় আসে, যখন সাম্যাবস্হা ভঙ্গ হয়, তখন এই বিভিন্ন শক্তিসমূদয় বিভিন্নরূপে সম্মিলিত হইতে থাকে, এবং তখনই এই ব্রহ্মাণ্ড বাহির হয়। আবার এক সময় আসে, যখন সকল বস্তুই সেই আদিম সাম্যাবস্হায় প্রত্যাবৃত্ত হইতে চায়, আবার এমন সময় আসে, যখন সকল অভিব্যাক্তির সম্পূর্ণ অভাব ঘটে। আবার কিছুকাল পরে এই অবস্হা নষ্ট হইয়া যায় এবং শক্তিগুলি বহির্দিকে প্রসৃত হইবার উপক্রম করে, আর ব্রহ্মাণ্ড ধীরে ধীরে তরঙ্গাকারে বহির্গত হইতে থাকে। জগতের সকল গতিই তরঙ্গাকারে হয়-একবার উত্থান, আবার পতন।
প্রাচীন দার্শনিকগণের মধ্যে কাহারও কাহারও মত এই যে, সমগ্র ব্রহ্মাণ্ডই কিছুদিনের জন্য একেবারে লয়প্রাপ্ত হয় ; আবার অপর কাহারও মত এই যে, ব্রহ্মাণ্ডের অংশবিশেষেই এই প্রলয় ব্যাপার সংঘটিত হয়। অর্থৎ মনে করূন, আমাদের এই সৌরজগৎ লয়প্রাপ্ত হইয়া অব্যাক্ত অবস্হায় ফিরিয়া গেল, কিন্তু সেই সময়েই অন্যান্য সহস্র সহস্র জগতে তাহার ঠিক বিপরীত কাণ্ড চলিতেছে। আমি দ্বিতীয় মতটির অর্থাৎ প্রলয় যুগপথ সমগ্র জগতে সংঘটিত হয় না, বিভিন্ন অংশে বিভিন্ন ব্যাপার চলিতে থাকে-এই মতটিরই অধিকপক্ষপাতী। যাহাই হউক, মূল কথাটা উভয়ত্রই এক, অর্থাৎ যাহা কিছু আমরা দেখেতেছি, এই সমগ্র প্রকৃতিই ক্রমান্বয়ে উত্থান-পতনের নিয়মে অগ্রসর হইতেছে। এই সম্পূর্ণ সাম্যাবস্হায় গমনকে ‘কল্পান্ত’ বলে। সমগ্র কল্পটিকে এই ক্রমবিকাশ ও ক্রমসংকোচকে-ভারতের ঈশ্বরবাদিগন ঈশ্বরেরে নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের সহিত তুলনা করিয়াছেন। ঈশ্বর নিঃশ্বাস ত্যাগ করিলে তাহা হইতে যেন জগৎ বাহির হয়, আবার উহা তাহাতে প্রত্যাবর্তন করে। যখন প্রলয় হয়, তখন জগতের কি অবস্হা হয়? তখনও উহা বর্তমান থাকে, তবে সূক্ষতররূপে বা কারণাবস্হায় থাকে। দেশ-কাল-নিমিত্ত সেখানেও বর্তমান, তবে উহারা অব্যাক্ত ভাব প্রাপ্ত হইয়াছে মাত্র। এই অব্যাক্তাবস্হায় প্রত্যাবর্তনকে ক্রমসঙ্কোচ বা প্রলয়’ বলে। প্রলয় ও সৃষ্টি বা ক্রমসংকোচ ও ক্রমাভিব্যাক্তি অনন্তকাল ধরিয়া চলিয়াছে, অতএব আমরা যখন আদি বা আরম্ভের কথা বলি, তখনআমরা এক কল্পের আরম্ভকেই লক্ষ্য করিয়া থাকি।
ব্রহ্মাণ্ডের সম্পূর্ণ বহির্ভাগকে-আজকাল আমরা যাহাকে স্থূল জড় বলি, প্রাচীন হিন্দু মনস্তত্ত্ববিদগণ(পঞ্চ)’ভূত’ বলিতেন। তাঁহাদের মতে ঐগুলিরই একটি অবশিষ্টগুলির কারণ, যেহেতু অন্যান্য সকল ভূত এই এক ভূত হইতেই উৎপন্ন হইয়াছে। এই ভূত ‘আকাশ’ নামে অভিহিত। আজকাল ‘ইথার’ বলিতে যাহা বুঝায়, ইহা কতকটা তাহারই মতো, যদিও সম্পূর্ণ এক নয়। আকাশই আদিভূত- উহা হইতেই সমুদয় স্থূল বস্তু উৎপন্ন হইয়াছে আর উহার সঙ্গে ‘প্রাণ’ নামে আর একটি বস্তু থাকে-ক্রমশ আমরা দেখিব, উহা কি। যতদিন সৃষ্টি থাকে, ততদিন এই প্রাণ ও আকাশ থাকে। তাহারা নানা রূপে মিলিত হইয়া এই-সমুদয় স্থূল প্রপঞ্চ গঠন করিয়াছে, অবশেষে কল্পান্তে ঐগুলি লয়প্রাপ্ত হইয়া আকাশ ও প্রাণের অব্যক্তরূপে প্রত্যাবর্তন করে। জগতের প্রাচীনতম ধর্মগ্রন্থ ঋগ্বেদে সৃষ্টিবর্ণনাত্মক একটি সূক্ত ১ আছে, সেটি অতিশয় কবিত্বপূর্ণঃ ‘যখন সৎ ও ছিল না, অসৎ ও ছিল না, অন্ধকারের দ্বারা অন্ধকার আবৃত ছিল, তখন কি ছিল?’
আর ইহার উত্তর দেওয়া হইয়াছেঃ ‘ইনি-সেই অনাদি অনন্ত পুরুষ-গতিশূন্য বা নিশ্চেষ্টভাবে ছিলেন।’
প্রাণ ও আকাশ তখন সেই অনন্ত পুরূষে সুপ্তভাবে ছিল, কিন্তু কোনরূপ ব্যক্ত প্রপঞ্চ ছিল না । এই অবস্থাকে ‘অবক্ত্য’ বলে-উহার ঠিক শব্দার্থ স্পন্দন-রহিত বা অপ্রকাশিত। একটি নূতন কল্পের আদিতে এই অব্যক্ত স্পন্দিত হইতে থাকে, আর প্রাণ আকাশের উপর ক্রমাগত আঘাতের পর আঘাত করে, আকাশ ঘনীভূত হইতে থাকে, আর ক্রমে আকর্ষণ-বিকর্ষণ-শক্তিদ্বয়ের বলে পরমাণু গঠিত হয়। এইগুলি পরে আরও ঘনীভূত হইয়া দ্ব্যণুকাদিতে পরিণত হয় এবং সর্বশেষে প্রাকৃতিক প্রত্যেক পদার্থ যে যে উপাদানে নির্মিত, সেই-সকল বিভিন্ন স্থূল ভূতে পরিণত হয়।
আমরা সাধারণতঃ দেখিতে পাই, লোকে এইগুলির অতি অদ্ভুত ইংরেজী অনুবাদ করিয়া থাকে। অনুবাদকগণ অনুবাদের জন্য প্রাচীন দার্শনিকগণের ও তাঁহাদের টীকাকারগণের সহায়তা গ্রহণ করেন না, আর নিজেদেরও এত বেশী বিদ্য নাই যে, নিজে-নিজেই ঐগুলি বুঝিতে পারেন। তাঁহারা ‘পঞ্চভূতে’র অনুবাদ করিযা থাকেন বায়ু, অগ্নি ইত্যাদি। যদি তাঁহারা ভাষ্যকারগণের ভাষ্য আলোচনা করিতেন, তবে দেখিতে পাইতেন যে, ভাষ্যকারগণ ঐগুলি লক্ষ্য করেন নাই। প্রাণের বারংবার আঘাতে আকাশ হইতে বায়ু বা আকাশের স্পন্দনশীল অবস্থা উপস্থিত হয়, উহা হইতেই বায়বীয় বা বাষ্পীয় পদার্থের উৎপত্তি হয়। স্পন্দন ক্রমশঃ দ্রূত হইতে দ্রূততর হইতে থাকিলে উত্তাপ বা তেজের উৎপত্তি হয়। উত্তাপ ক্রমশঃ কমিয়া শীতল হইতে থাকে, তখন ঐ বাষ্পীয় পদার্থ তরল ভাব ধারন করে, উহাকে ‘অপ্’ বলে ; অবশেষে উহা কঠিনাকার প্রাপ্ত হয়, তাহার নাম ‘ক্ষিতি’ বা পৃথিবী। সর্ব প্রথমে আকাশে স্পন্দনশীল অবস্থা, তারপর উত্তাপ, তারপর উহা তরল হইয়া যাইবে, আর যখন আরও ঘনীভূত হইবে, তখন উহা কঠিন জড়পদার্থের আকার ধারন করিবে। ঠিক ইহার বিপরীতক্রমে সব কিছু অব্যাক্ত অবস্থা প্রাপ্ত হয়। কঠিন বস্তুসকল তরল পদার্থে পরিনত হইবে, তরল পদার্থ কেবল উত্তাপ বা তেজোরাশিতে পরিণত হইবে, তাহা আবার ধীরে ধীরে বাষ্পীয় ভাব ধারন করিবে, পরে পরমাণুসমূহ বিশ্লিষ্ট হইতে আরম্ভ হয় এবং সর্বশেষে সমূদয় শক্তির সামঞ্জস্য-অবস্হা উপস্হিত হয়। তখন স্পন্দন বন্ধ হয়- এইরূপে কল্পান্ত হয়। আমরা আধুনিক জ্যোতিষ হইতে জানিতে পারি যে, আমাদের এই পৃথিবী ও সূর্যের সেই অবস্হা-পরিবর্তন চলিয়াছে, শেষে এই কঠিনাকার পৃথিবী গলিয়া গিয়া তরলাকার এবং অবশেষে বাষ্পাকার ধারন করিবে।
আকাশের সাহায্য ব্যতীত প্রাণ একা কোন কার্য করিতে পারে না। প্রান সম্বন্ধে আমরা এইটুকু জানি যে, উহা গতি বা স্পন্দন। আমরা যা কিছু গতি দেখিতে পাই, তাহা এই প্রাণের বিকার, এবং জড় বা ভূত-পদার্থ যা কিছু আমরা জানি, যা কিছু আকৃতিযুক্ত বা বাধাদান করে, তাহাই এই আকাশের বিকার। এই প্রাণ এককভাবে থাকিতে পারে না বা কোন মাধ্যম ব্যাতীত কার্য করিতে পারে না, আর উহার কোন অবস্হায়-উহা কেবল প্রাণরূপেই বর্তমান থাকুক অথবা মহাকর্ষ বা কেন্দ্রাতিগা শক্তিরূপ প্রাকৃতিক অন্যান্য শক্তিতেই পরিণত হউক-উহা কখন আকাশ হইতে পৃথক থাকিতে পারে না। আপনারা কখন জড় ব্যাতীত শক্তি বা শক্তি ব্যাতীত জড় দেখেন নাই। আমরা যাহাদিগকে জড় ও শক্তি বলি, সেগুলি কেবল এই দুইটির স্থুল প্রকাশমাত্র, এবং ইহাদের অতি সূক্ষ অবস্থাকেই প্রচীন দার্শনিকগণ ‘প্রান’ ও ‘আকাশ’ নামে অভিহিত করিয়াছে। প্রাণকে আপনারা জীবন শক্তি বলিতে পারেন, কিন্তু উহাকে শুধু মানুষের জীবনের মধ্যে সীমাবদ্ধ করিলে অথবা আত্মার সহিত অভিন্ন ভাবে বুঝিলেও চলিবে না। অতএব সৃষ্টি প্রাণ ও আকাশের সংযোগে উৎপন্ন, এবং উহার আদিও নাই, অন্তও নাই ; উহার আদি-অন্ত কিছুই থাকিতে পারে না, কারন অনন্ত কাল ধরিয়া সৃষ্টি চলিয়াছে।
তারপর আর একটি অতি দুরহ ও জটিল প্রশ্ন আসিতেছে। কয়েকজন ইউরোপীয় দার্শনিক বলিয়াছেন, ‘আমি’ আছি বলিয়াই এই জগৎ আছে, এবং ‘আমি’ যদি না থাকি তবে এই জগৎও থাকিবে না। কখন কখন ঐ কথা এইভাবে প্রকাশ করা হইয়া থাকে-যদি জগতের সকল লোক মরিয়া যায়, মনুষ্যজাতি আর না থাকে, অনুভূতি ও বুদ্ধিশক্তি সম্পন্ন কোন প্রাণী যদি না থাকে, তবে এই জগৎপ্রপঞ্চও আর থাকিবে না। এ কথা অসম্ভব বলিয়া বোধ হইতে পারে, কিন্তু ক্রমে আমরা স্পষ্ট দেখিব যে, ইহা প্রমান করা যাইতে পারে। কিন্তু ঐ ইউরোপীয় দার্শনিকগণ এই তত্ত্ব জানিলেও মনোবিজ্ঞানঅনুসারে ইহা বাখ্যা করিতে পারেন না। তাঁহারা এই তত্ত্বের আভাসমাত্র পাইয়াছেন।
প্রথমতঃ আমরা এই প্রাচীন মনস্তত্ত্ববি‍‍‍‍‍‍দগণের আর একটি সিন্ধান্ত লইয়া আলোচনা করিব-উহাও একটু অদ্ভুত রকমের-তাহা এই যে, স্থূল ভূতগুলি সুক্ষ্ম ভূত হইতে উৎপন্ন। যাহা কিছু স্থূল, তাহাই কতকগুলি সুক্ষ্ম বস্তুর সমবায়। অতএব স্থূল ভূতগুলিও কতকগুলি সুক্ষ্মবস্তুগঠিত-ঐগুলিকে সংস্কৃত ভাষায় ‘তন্মাত্রা’ বলে। আমি একটি পুষ্প আঘ্রাণ করিতেছি; উহার গন্ধ পাইতে গেলে কিছু অবশ্য আমার নাসিকার সংস্পর্শে আসিতেছে। ঐ পুষ্প রহিয়াছে-উহা যে আমার দিকে আসিতেছে, এমন তো দেখিতেছি না; কিন্তু কিছু যদি আমার নাসিকার সংস্পর্শে না আসিয়া থাকে, তবে আমি গন্ধ পাইতেছি কিরূপে?
ঐ পুষ্প হইতে যাহা আসিয়া আমার নাসিকার সংস্পর্শে আসিতেছে, তাহাই তন্মাত্রা, ঐ পুষ্পেরই অতি সূক্ষ্ম পরমাণু; উহা এত সূক্ষ্ম যে, যদি আমরা সারাদিন সকলে মিলিয়া উহার গন্ধ আঘ্রাণ করি, তথাপি ঐ পুষ্পের পরিমাণের কিছুমাত্র হ্রাস হইবে না। তাপ, আলোক এবং অন্যান্য সকল বস্তু সম্বন্ধেও ঐ একই কথা। এই তন্মাত্রাগুলি আবার পরমাণুরূপে পুনর্বিভক্ত হইতে পারে। এই পরমাণুর পরিমাণ লইয়া বিভিন্ন দার্শনিকগণের বিভিন্ন মত আছে; কিন্তু আমরা জানি-ঐগুলি মতবাদ-মাত্র, সুতরাং বিচারস্থলে আমরা ঐগুলিকে পরিত্যাগ করিলাম। এইটুকু জানিলেই আমাদের পক্ষে যথেষ্ট-যাহা কিছু স্থূল তাহা অতি সূক্ষ্ম পদার্থদ্বারা নির্মিত। প্রথম আমরা পাইতেছি স্থূল ভূত-আমরা উহা বাহিরে অনুভব করিতেছি; তার পর সূক্ষ্ম ভূত-এই সূক্ষ্ম ভূতের দ্বারাই স্থূল ভূত গঠিত, উহারই সহিত আমাদের ইন্দ্রিয়গণের অর্থাৎ নাসিকা, চক্ষু ও কর্ণাদির স্নায়ুর সংযোগ হইতেছে। যে ইথার-তরঙ্গ আমার চক্ষুকে স্পর্শ করিতেছে, তাহা আমি দেখিতে পাইতেছি না, তথাপি জানি-আলোক দেখিতে পাইবার পূর্বে চাক্ষুষ স্নায়ুর সহিত উহার সংযোগ প্রয়োজন। শ্রবণ-সম্বন্ধেও তদ্রূপ। আমাদের কর্ণের সংস্পর্শে যে তন্মাত্রাগুলি আসিতেছে, তাহা আমরা দেখিতে পাইতেছি না, কিন্তু আমরা জানি-সেগুলি অবশ্যই আছে। এই তন্মাত্রাগুলির আবার কারণ কি? আমাদের মনস্তত্ত্ববিদগণ ইহার এক অতি অদ্ভূত ও বিস্ময়জনক উত্তর দিয়াছেন। তাঁহারা বলেন, তন্মাত্রাগুলির কারণ ‘অহংকার’-অহং-তত্ত্ব বা ‘অহং-জ্ঞান’। ইহাই এই সূক্ষ্ম ভূতগুলির এবং ইন্দ্রিয়গুলিরও কারণ। ইন্দ্রিয় কো‍‍‍‍‍ন‍গুলি? এই চক্ষু রহিয়াছে, কিন্তু চক্ষু দেখে না। চক্ষু যদি দেখিতে, তবে মানুষের যখন মৃত্যু হয় তখন তো চক্ষু অবিকৃত থাকে, তবে তখনও তাহারা দেখিতে পাইত। কোনখানে কিছুর পরিবর্তন হইয়াছে। কোন-কিছু মানুষের ভিতর হইতে চলিয়া গিয়াছে, আর সেই কিছু, যাহা প্রকৃতপক্ষে দেখে, চক্ষু যাহার যন্ত্রস্বরূপ মাত্র, তাহাই যথার্থ ইন্দ্রিয়। এইরূপ এই নাসিকাও একটি যন্ত্রমাত্র, উহার সহিত সম্বন্ধযুক্ত একটি ইন্দ্রিয় আছে। আধুনিক শারীর-বিজ্ঞান আপনাদিগকে বলিয়া দিবে, উহা কি। উহা মস্তিষ্কস্থ একটি স্নায়ুকেন্দ্র মাত্র। চক্ষুকর্ণাদি কেবল বাহ্যযন্ত্র। অতএব এই স্নায়ুকেন্দ্র বা ইন্দ্রিয়গণই অনুভূতির যথার্থ স্থান।
নাসিকার জন্য একটি, চক্ষুর জন্য একটি, এইরূপ প্রত্যকের জন্য এক-একটি পৃথক স্নায়ুকেন্দ্র বা ইন্দ্রিয় থাকিবার প্রয়োজন কি? একটিতেই কার্য সিদ্ধ হয় না কেন? এইটি স্পষ্ট করিয়া বুঝানো যাইতেছে। আমি কথা কহিতেছি, আপনারা শুনিতেছেন ; আপনাদের চতুর্দিকে কি হইতেছে, তাহা আপনারা দেখিতে পাইতেছেন না, কারন মন কেবল শ্রবনেন্দ্রিয়েই সংযুক্ত রহিয়াছে, চক্ষুরিন্দ্রিয় হইতে নিজেকে পৃথক করিয়াছে। যদি একটি মাত্র স্নায়ুকেন্দ্র বা ইন্দ্রিয় থাকিত, তবে মনকে একই সময়ে দেখিতে, শুনিতে ও আঘ্রান করিতে হইত। অতএব প্রত্যেকটির জন্য পৃথক পৃথক স্নায়ুকেন্দ্রের প্রয়োজন। আধুনিক শরীর-বিজ্ঞানও এ বিষয়ে সাক্ষ দিয়া থাকে। অবশ্য আমাদের পক্ষে একই সময়ে দেখা ও শুনা সম্ভব, কিন্তু তাহার কারন-মন উভয় কেন্দ্রেই আংশিকভাবে যুক্ত হয়। তবে যন্ত্র কোনগুলি? আমরা দেখিতেছি, উহারা বাহিরের বস্তু এবং স্হুলভূতে নির্মিত-এই আমাদের চক্ষু কর্ন নাসা প্রভৃতি। আর এই স্নায়ুকেন্দ্রগুলি কিসে নির্মিত? উহারা সুক্ষতর ভূতে নির্মিত ; যেহেতু উহারা অনুভূতির কেন্দ্রস্বরূপ, সে জন্য উহারা ভিতরের জিনিস। যেমন প্রাণকে বিভিন্ন স্হুল শক্তিতে পরিনত করিবার জন্য এই দেহ স্হুলভূতে গঠিত হইয়াছে, তেমনি এই শরীরের পশ্চাতে যে স্নায়ুকেন্দ্রসমূহ রহিয়াছে, তাহারাও প্রাণকে সুক্ষ অনুভূতির শক্তিতে পরিনত করিবার জন্য সূক্ষতর উপাদানে নির্মিত। এই সমুদয় ইন্দ্রিয় এবং অন্তঃকরনের সমষ্টিকে একত্রে লিঙ্গ(বা সূক্ষ) শরীর বলে। ‍
এই সূক্ষ শরীরের প্রকৃতপক্ষে একটি আকার আছে, কারন যাহা কিছু জড় তাহারই একটি আকার অবশ্যই থাকিবে। ইন্দ্রিয়গনের পশ্চাতে মন অর্থাৎ বৃত্তিযুক্ত চিত্ত আছে, উহাকে চিত্তের স্পন্দনশীল বা অস্থির অবস্থা বলা যাইতে পারে। যদি স্থির হ্রদে একটি প্রস্তর নিক্ষেপ করা যায়, তাহা হইলে প্রথমে উহাতে স্পন্দন বা কম্পন উপস্থিত হইবে, তারপর উহা হইতে বাধা বা প্রতিক্রিয়া উত্থিত হইবে। মুহূর্তের জন্য ঐ জল স্পন্দিত হইবে, তারপর উহা ঐ প্রস্তরের উপর প্রতিক্রিয়া করিবে। এইরূপ চিত্তের উপর যখনই কোন বাহ্যবিষয়ে আঘাত আসে, তখন উহা একটু স্পন্দিত হয়। চিত্তের এই অবস্থাকে মন বলে। তারপর উহা হইতর প্রতিক্রিয়া হয়, উহার নাম ‘বুদ্ধি’। এই বুদ্ধির পশ্চাতে আর একটি জিনিস আছে, উহা মনের সকল ক্রিয়ার সহিতই বর্তমান, উহাকে ‘অহঙ্কার’ বলে; এই অহঙ্কার অর্থে অহংজ্ঞান, যাহাতে সর্বদা ‘আমি আছি’ এই জ্ঞান হয়। তাহার পশ্চাতে মহৎ বা বুদ্ধিতত্ত্ব, উহা প্রাকৃতিক সকল বস্তুর মধ্যে শ্রেষ্ঠ। ইহার পশ্চাতে পুরুষ, ইনিই মানবের যথার্থ স্বরূপ—শুদ্ধ, পূর্ণ; ইনিই একমাত্র দ্রষ্টা এবং ইহার জন্যই এই সমুদয় পরিণাম। পুরুষ এই সকল পরিণাম-পরম্পরা দেখিতেছেন। তিনি স্বয়ং কখনই অশুদ্ধ নন, কিন্তু অধ্যাস বা প্রতিবিম্বের দ্বারা তাঁহাকে ঐরূপ দেখাইতেছে, যেমন একখণ্ড স্ফটিকের সমক্ষে একটি লাল ফুল রাখিলে স্ফটিকটি লাল দেখাইবে, আবার নীল ফুল রাখিলে নীল দেখাইবে। প্রকতপক্ষে স্ফটিকটির কোন বর্ণই নাই। পুরুষ বা আত্মা অনেক, প্রত্যেকেই শুদ্ধ ও পূর্ণ। আর এই স্থূল, সূক্ষ্ম নানাপ্রকারে বিভক্ত পঞ্চভূত তাঁহাদের উপর প্রতিবিম্বিত হওয়ায় তাঁহাদিগকে নানাবর্ণে রঞ্জিত দেখাইতেছে। প্রকৃতি কেন এ-সকল করিতেছেন? প্রকৃতির এই-সকল পরিণাম পুরুষ নিজের মুক্ত স্বভাব জানিতে পারেন। মানুষের সমক্ষে এই জগৎপ্রপঞ্চরূপ সুবৃহৎ গ্রন্থ বিস্তৃত রহিয়াছে, যাহাতে মানুষ ঐ গ্রন্থ পাঠ করিয়া পরিণামে সর্বজ্ঞ ও সর্বশক্তিমান্ পুরুষরূপে জগতের বাহিরে আসিতে পারেন। আমাকে এখানে আবশ্যই বলিতে হইবে যে, আপনারা যে অর্থে সগুণ বা ব্যক্তিভাবাপন্ন ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন, আমাদের অনেক বড় বড় মনস্তত্ত্ববিদ্ সেই অর্থে তাঁহাতে বিশ্বাস করেন না। মনস্তত্ত্ববিদগনের পিতাস্বরূপ কপিল সৃষ্টিকর্তা ঈশ্বরের অস্তিত্ব অস্বীকার করেন। তাঁহার ধারণা এই যে, সগুণ ঈশ্বর স্বীকার করিবার কোন প্রয়োজন নাই; যাহা কিছু ভাল, প্রকৃতিই তাহা করিতে সমর্থ। তিনি তথা-কথিত ‘কৌশলবাদ’(Design Theory) খণ্ডন করিয়াছেন। এই মতবাদের ন্যায় ছেলে মানুষী মত জগতে আর কিছুই প্রচারিত হয় নাই। তবে তিনি এক বিশেষ প্রকার ঈশ্বর স্বীকার করেন। তিনি বলেন, আমরা সকলে মুক্ত হইবার জন্য চেষ্টা করিতেছি, এরূপ চেষ্টা করিতে করিতে যখন মানবাত্মা মুক্ত হন, তখন তিনি যেন কিছুদিনের জন্য প্রকৃতিতে লীন হইয়া থাকিতে পারেন। আগামী কল্পের প্রারম্ভে তিনিই একজন সর্বজ্ঞ ও সর্বশক্তিমান্ পুরুষরূপে আবির্ভূত হইয়া সেই কল্পের শাসনকর্তা হইতে পারেন। এই অর্থে তাঁহাকে ‘ঈশ্বর’ বলা যাইতে পারে। এইরূপে আপনি, আমি এবং অতি সামান্য ব্যক্তি পর্যন্ত বিভিন্ন কল্পে ঈশ্বর হইতে পারিব। কপিল বলেন, এইরূপ ‘জন্য ঈশ্বর’ হইতে পারা যায়, কিন্তু ‘নিত্য ঈশ্বর’ অর্থাৎ নিত্য সর্বশক্তিমান্-জগতের শাসনকর্তা কখনই হইতে পারা যায় না। এইরূপ ঈশ্বর-স্বীকারে এই আপত্তি উঠিবে : ঈশ্বর হয় বদ্ধ, না হয় মুক্ত—এই দুই-এর একতর ভাব স্বীকার করিতে হইবে ঈশ্বর যদি মুক্ত হন, তবে তিনি সৃষ্টি করিবেন না, কারণ তাঁহার সৃষ্টি করিবার কোন প্রয়োজন নাই। আর যদি তিনি বদ্ধ হন, তাহা হইলে তাহাতে সৃষ্টিকর্তৃত্ব অসম্ভব; কারণ বদ্ধ বলিয়া তাঁহার শক্তির অভাব, সুতরাং তাঁহার সৃষ্টি করিবার ক্ষমতা থাকিবে না। সুতরাং উভয় পক্ষেই দেখা গেল, নিত্য সর্বশক্তিমান্ ও সর্বজ্ঞ ঈশ্বর থাকিতে পারেন না। এই হেতু কপিল বলেন, আমাদের শাস্ত্রে-বেদে যেখানেই ঈশ্বর-শব্দের প্রয়োগ আছে, তাহাতে যে সকল আত্মা পূর্ণতা বা মুক্তি লাভ করিয়াছেন, তাঁহাদিগকে বুঝাইতেছে। সাংখ্যদর্শন সকল আত্মার একত্বে বিশ্বাসী নন। বেদান্তের মতে সকল জীবাত্মা ও ব্রহ্ম-নামধেয় এক বিশ্বাত্মা অভিন্ন, কিন্তু সাংখ্যদর্শনের প্রতিষ্ঠাতা কপিল দ্বৈতবাদী ছিলেন। তিনি অবশ্য জগতের বিশ্লেষণ যতদূর করিয়াছেন, তাহা অতি অদ্ভুত। তিনি হিন্দু পরিণামবাদীগণের জনক স্বরূপ, পরবর্তী দর্শন-শাস্ত্রগুলি তাঁহারই চিন্তাপ্রণালীর পরিণাম মাত্র।
সাংখ্যদর্শন-মতে সকল আত্মাই তাহাদের স্বাধীনতা বা মুক্তি এবং সর্বশক্তিমত্তা ও সর্বজ্ঞতা-রূপ স্বাভাবিক অধিকারে পুনঃপ্রাপ্ত হইবে। এখানে প্রশ্ন হইতে পারে, আত্মার এই বন্ধন কোথা হইতে আসিল? সাংখ্য বলেন ইহা অনাদি। কিন্তু তাহাতে এই আপত্তি উপস্থিত হয় যে, যদি এই বন্ধন অনাদি হয়, তবে উহা অনন্তও হইবে, আর তাহা হইলে আমরা কখনই মুক্তিলাভ করিতে পারিব না। কপিল ইহার উত্তরে বলেন, এখানে এই ‘অনাদি’ বলিতে নিত্য অনাদি বুঝিতে হইবে না। প্রকৃতি অনাদি ও অনন্ত, কিন্তু আত্মা বা পুরুষ যে অর্থে আনাদি অনন্ত, সে অর্থে নয়; কারণ প্রকৃতিতে ব্যক্তিত্ব নাই। যেমন আমাদের সম্মুখ দিয়া একটি নদী প্রবাহিত হইয়া যাইতেছে, প্রতি মুহূর্তেই উহাতে নূতন নূতন জলরাশি আসিতেছে, এই সমুদয় জলরাশির নাম নদী, কিন্তু নদী কোন ধ্রুব বস্তু নয়। এইরূপ প্রকৃতির অন্তর্গত যাহা কিছু, সর্বদা তাহার পরিবর্তন হইতেছে, কিন্তু আত্মার কখনই পরিবর্তন হয় না। অতএব প্রকৃতি যখন সর্বদাই পরিণাম প্রাপ্ত হইতেছে, তখন আত্মার পক্ষে প্রকৃতির বন্ধন হইতে মুক্ত হওয়া সম্ভব।
সাংখ্যদিগের একটি মত তাহাদের নিজস্ব, যথাঃ একটি মনুষ্য বা কোন প্রাণী যে নিয়মে গঠিত, সমগ্র জগদব্রহ্মাণ্ডও ঠিক সেই নিয়মে বিরচিত। সুতরাং আমার যেমন একটি মন আছে, সেইরূপ একটি বিশ্ব-মনও আছে। যখন এই বৃহৎ ব্রহ্মাণ্ডের ক্রমবিকাশ হয়, তখন প্রথমে মহৎ বা বুদ্ধিতত্ত্ব, পরে অহঙ্কার, পরে তন্মাত্রা, ইন্দ্রিয় ও শেষে স্থূলভূতের উৎপত্তি হয়। কপিলের মতে সমগ্র ব্রহ্মাণ্ডই একটি শরীর। যাহা কিছু দেখিতেছি, সেগুলি সব স্থূল শরীর, উহাদের পশ্চাতে আছে সূক্ষ্ম শরীর এবং তাহাদের পশ্চাতে সমষ্টি অহংতত্ত্ব, তাহারও পশ্চাতে সমষ্টি-বুদ্ধি। কিন্তু এ-সকলই প্রকৃতির অন্তর্গত, প্রকৃতির বিকাশ, এগুলির কিছুই উহার বাহিরে নাই। আমাদের মধ্যে সকলেই এই মহত্বের অংশ। সমষ্টি বুদ্ধিতত্ত্ব রহিয়াছে, তাহা হইতে আমাদের যাহা প্রয়োজন, তাহা গ্রহণ করিতেছি; এইরূপ জগতের ভিতরে সমষ্টি মনস্তত্ত্ব রহিয়াছে, তাহা হইতেও আমরা চিরকালই প্রয়োজনমত লইতেছি। কিন্তু দেহের বীজ পিতামাতার নিকট হইতে প্রাপ্ত হওয়া চাই। ইহাতে বংশানুক্রমিকতা (Heredity) ও পুনর্জন্মবাদ উভয় তত্ত্বই স্বীকৃত হইয়া থাকে। আত্মাকে দেহনির্মাণ করিবার জন্য উপাদান দিতে হয়, কিন্তু সে উপাদান বংশানুক্রমিক সঞ্চারের দ্বারা পিতামাতা হইতে প্রাপ্ত হওয়া যায়।
আমরা এক্ষণে এই প্রস্তাব উপস্থিত করিতেছি যে, সাংখ্যমতানুযায়ী সৃষ্টিপ্রণালীতে সৃষ্টি বা ক্রমবিকাশ এবং প্রলয় বা ক্রমসঙ্কোচ—এই উভয়টিই স্বীকৃত হইয়াছে। সমুদয় সেই অব্যক্ত প্রকৃতির ক্রমবিকাশে উৎপন্ন, আবার ঐ সমুদয় ক্রমসঙ্কুচিত হইয়া অব্যক্তভাব ধারণ করে। সাংখ্যমতে এমন কোন জড় বা ভৌতিক বস্তু থাকিতে পারে না, মহতত্ত্বের অংশবিশেষ যাহার উপাদান নয়। উহাই সেই উপাদান, যাহা হইতে এই সমুদয় প্রপঞ্চ নির্মিত হইয়াছে। আগামী বক্তৃতায় ইহার বিশদ ব্যাখ্যা করা যাইবে। তবে আমি এইটুকু দেখাইব, কিরূপে ইহা প্রমাণ করা যাইতে পারে। এই টেবিলের স্বরূপ কি, তাহা আমি জানি না, উহা কেবল আমার উপর একপ্রকার সংস্কার জন্মাইতেছে মাত্র। উহা প্রথমে চক্ষুতে আসে, তারপর দর্শনেন্দ্রিয়ে গমন করে, তারপর উহা মনের নিকটে যায়। তখন মন আবার উহার উপর প্রতিক্রিয়া করে, সেই প্রতিক্রিয়াকেই আমরা ‘টেবিল’ আখ্যা দিয়া থাকি। ইহা ঠিক একটি হ্রদে একখণ্ড প্রস্তর নিক্ষেপের ন্যায়। ঐ হ্রদ প্রস্তরখণ্ডের অভিমুখে একটি তরঙ্গ নিক্ষেপ করে; আর ঐ তরঙ্গটিকেই আমরা জানিয়া থাকি। মনের তরঙ্গসমূহ-যেগুলি বহির্দিকে আসে, সেগুলিই আমরা জানি। এইরূপে এই দেয়ালের আকৃতি আমার মনে রহিয়াছে; বাহিরে যথার্থ কি আছে, তাহা কেহই জানে না; যখন আমি কোন বর্হিবস্তুকে জানিতে চেষ্টা করি, তখন উহাকে আমার প্রদত্ত উপাদানে পরিণত হইতে হয়। আমি আমার নিজমনের দ্বারা আমার চক্ষুকে প্রয়োজনীয় উপাদান দিয়াছি, আর বাহিরের যাহা আছে, তাহা উদ্দীপক বা উত্তেজক কারণ মাত্র। সেই উত্তেজক কারণ আসিলে আমি আমার মনকে উহার দিকে প্রক্ষেপ করি এবং উহা আমার দ্রষ্টব্য বস্তুর আকার ধারণ করিয়া থাকে। এক্ষণে প্রশ্ন এই-আমরা সকলকেই একই বস্তু কিরূপে দেখিয়া থাকি। ইহার কারণ—আমাদের সকলের ভিতর এই বিশ্ব-মনের এক এক অংশ আছে। যাহাদের মন আছে তাহারাই ঐ বস্তু দেখিবে; যাহাদের নাই তাহারা উহা দেখিবে না। ইহাতেই প্রমাণ হয়, যতদিন ধরিয়া জগৎ আছে, ততদিন মনের অভাব—সেই এক বিশ্ব-মনের অভাব কখন হয় নাই। প্রত্যেক মানুষ, প্রত্যেক প্রাণী সেই বিশ্ব-মন হইতেই নির্মিত হইতেছে, কারণ বিশ্বমন সর্বদাই বর্তমান থাকিয়া উহাদের নির্মাণের জন্য উপাদান যোগাইতেছে।

—————
১ ঋগ্বেদ, ১০।১২৯ (নাসদীয় সূক্ত)।