০১. সমাধি-পাদ (প্রথম অধ্যায়)

অর্থ যোগানুশাসনম্।।১।।

সূত্রার্থ-এখন যোগ ব্যাখ্যা করা যাইতেছে।

যোগশ্চিত্তবৃত্তিনিরোধঃ ।।২।।

সূত্রার্থ-চিত্তকে বিভিন্ন প্রকার বৃত্তি অর্থাৎ আকার বা পরিণাম গ্রহণ করিতে না দেওয়াই যোগ।

ব্যাখ্যা-এখানে অনেক কথা বুঝাইতে হইবে। প্রথমতঃ আমাদিগকে বুঝিতে হইবে, চিত্ত কি ও বৃত্তিগুলিই বা কি। আমার এই চক্ষু আছে। চক্ষু বাস্তবিক দেখে না। মস্তিষ্কে অবস্থিত স্নায়ুকেন্দ্রটি-দর্শনেন্দ্রিয়-অপসৃত কর, তখন তোমার চক্ষু থাকিতে পারে, চক্ষের অক্ষিজাল অক্ষত থাকিতে পারে, আর চক্ষের উপর যে-ছবি পড়িয়া দর্শন হয়, তাহাও পড়িতে পারে, তথাপি চক্ষু দেখিতে পাইবে না। চক্ষু কেবল দর্শনের গৌণ যন্ত্রমাত্র। উহা প্রকৃত দর্শনেন্দ্রিয় নয়। দর্শনেন্দ্রিয় মস্তিষ্কের অন্তর্গত একটি স্নায়ুকেন্দ্রে অবস্থিত। কেবল চক্ষু-দুইটিই যথেষ্ট নয়। কখন কখন লোকে চক্ষু খুলিয়া নিদ্রা যায়। আলো (এবং দর্শনেন্দ্রিয়) রহিয়াছে, বাহিরে চিত্র রহিয়াছে, কিন্তু তৃতীয় একটি বস্তুর প্রয়োজন, মন ইন্দ্রিয়ে সংযুক্ত হওয়া চাই। সুতরাং দর্শনক্রিয়ার জন্য চক্ষুরূপ বহির্যন্ত্র, মস্তিষ্কস্থ স্নায়ুকেন্দ্র ও মন-এই তিনটি জিনিসের আবশ্যক। রাস্তা দিয়া গাড়ি চলিয়া যাইতেছে, কিন্তু তুমি উহার শব্দ শুনিতে পাইতেছ না। ইহার কারণ কি? কারণ তোমার মন শ্রবণেন্দ্রিয়ে সংযুক্ত হয় নাই। অতএব প্রত্যেক অনুভবক্রিয়ার জন্য চাই-প্রথমতঃ বাহিরের যন্ত্র, তারপর ইন্দ্রিয় এবং তৃতীয়তঃ উভয়েতে মনের যোগ। বিষয়াভিঘাত-জনিত বেদনাকে মন আরও অভ্যন্তরে বহন করিয়া নিশ্চয়াত্মিকা বুদ্ধির নিকট অর্পণ করে। তখন বুদ্ধি হইতে প্রতিক্রিয়া হয়। এই প্রতিক্রিয়ার সহিত অহংভাব জাগিয়া উঠে। আর এই ক্রিয়া ও প্রতিক্রিয়ার সমষ্টি, পুরুষের (বা প্রকৃত আত্মার) নিকট অর্পিত হয়। তিনি তখন এই মিশ্রণটিকে একটি বস্তুরূপে উপলব্ধি করেন। ইন্দ্রিয়গণ, মন, নিশ্চয়াত্মিকা বুদ্ধি ও অহংকার মিলিত হইয়া যাহা হয়, তাহাকে ‘অন্তঃকরণ’ বলে। উহারা মনের উপাদান-চিত্তের ভিন্ন ভিন্ন প্রক্রিয়াস্বরূপ। চিত্তের অন্তর্গত এই-সকল চিন্তাতরঙ্গকে বৃত্তি (আক্ষরিকভাবে আবর্ত বা ঘূর্ণি) বলে। এখন জিজ্ঞাস্য-চিন্তা কি? ম্যাধ্যাকর্ষণ বা বিকর্ষণ-শক্তির ন্যায় চিন্তাও একপ্রকার শক্তি। প্রাকৃতিক শক্তির অক্ষয় ভান্ডার হইতে চিত্ত-নামক যন্ত্রটি কিছু শক্তি সংগ্রহ করিয়া অঙ্গীভূত করে এবং চিন্তারূপে প্রেরণ করে। খাদ্য হইতে আমাদের এই শক্তি সংগৃহীত হয়। ঐ খাদ্য হইতেই শরীর গতিশক্তি প্রভৃতি লাভ করে। অন্যান্য সূক্ষ্মতর শক্তিও খাদ্য হইতেই চিন্তারূপে উৎপন্ন হয়। সুতরাং মন চৈতন্যময় নয়, অথচ চৈতন্যময় বলিয়া বোধ হয়। এইরূপ হইবার কারণ কি? কারণ চৈতন্যময় আত্মা উহার পশ্চাতে রহিয়াছেন। তুমিই একমাত্র চৈতন্যময় পুরুষ-মন কেবল একটি যন্ত্র, ইহাদ্বারা তুমি বহির্জগৎ অনুভব কর। এই পুস্তকখানির কথা ধর, বাহিরে উহার পুস্তকরূপ কোন অস্তিত্ব নাই। বাহিরে যাহা আছে, তাহা অজ্ঞাত ও অজ্ঞেয়; উহা কেবল উত্তেজক কারণ মাত্র। উহা মনে আঘাত করে, মনও পুস্তকরূপে প্রতিক্রিয়া করে। তেমনি জলে একটি প্রস্তরখন্ড নিক্ষেপ করিলে জলও তরঙ্গাকারে ঐ প্রস্তরখন্ডকে প্রতিঘাত করে; সুতরাং বাস্তব বহির্জগৎ মানসিক প্রতিক্রিয়ার উত্তেজক কারণ মাত্র। পুস্তকাকার, গজাকার বা মনুষ্যকার কোন পদার্থ বাহিরে নাই; বাহিরের ইঙ্গিত বা উত্তেজক কারণ হইতে মনের মধ্যে যে প্রতিক্রিয়া হয়, কেবলমাত্র তাহাই আমরা জানিতে পারি। জন স্টুয়ার্ট মিল বলিয়াছেন, ‘ইন্দ্রিয়ানুভূতির নিত্য সম্ভাব্যতার নাম জড়পদার্থ।’ বাহিরে ঐ প্রতিক্রিয়া উৎপন্ন করিয়া দিবার উত্তেজক কারণ মাত্র রহিয়াছে। উদাহরণস্বরূপ একটি শুক্তি লওয়া যাক। তোমরা জানো, মুক্তা কিরূপে উৎপন্ন হয়। এক বিন্দু বালুকণা, কীটাণু বা আর কিছু উহার ভিতর প্রবেশ করিয়া উহাকে উত্তেজিত করিয়া থাকে; তখন সেই শুক্তি ঐ বালুকার চতুর্দিকে এক প্রকার এনামেল-তুল্য আবরণ দিতে থাকে; তাহাতেই মুক্তা উৎপন্ন হয়। অনুভূতির এই জগৎ যেন আমাদের নিজেদের এনামেলস্বরূপ; বাস্তব জগৎ ঐ বালুকণা বা অন্যকিছু। সাধারণ লোকে কখন ইহা বুঝিতে পারিবে না, কারন যখনই সে বুঝিতে চেষ্টা করিবে, তখনই বাহিরে এনামেল নিক্ষেপ করিবে ও নিজের সেই এনামেলটিই দেখিবে। এখন আমরা বুঝিতে পারিলাম, বৃত্তির প্রকৃত অর্থ কি। মানুষের প্রকৃত স্বরূপ মনেরও অতীত। মন তাঁহার হস্তে একটি যন্ত্রতুল্য। তাঁহারই চৈতন্য মনের ভিতর দিয়া আসিতেছে। তুমি যখন মনের পশ্চাতে দ্রষ্টারূপে থাকো, তখনই উহা চৈতন্যময় হইয়া উঠে। যখন মানুষ এই মনকে একেবারে ত্যাগ করে, তখন উহা খন্ডবিখন্ড হইয়া যায়, উহার অস্তিত্বই থাকে না। ইহা হইতে বুঝা গেল-চিত্ত বলিতে কি বুঝায়। উহা মনের উপাদানস্বরূপ-বৃত্তিগুলি উহার তরঙ্গস্বরূপ, যখন বাহিরের কতকগুলি কারণ উহার উপর কার্য করে, তখনই উহা ঐ তরঙ্গস্বরূপ, যখন বাহিরের কতকগুলি কারণ উহার উপর কার্য করে, তখনই উহা ঐ তরঙ্গরূপ ধারণ করে। এই বৃত্তিগুলিই আমাদের জগৎ।

আমরা হ্রদের তলদেশ দেখিতে পাই না, কারণ উহার উপরিভাগ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র তরঙ্গে আবৃত। যখন তরঙ্গগুলি শান্ত হয়, জল স্থির হইয়া যায়, তখনই কেবল উহার তলদেশের ক্ষণিক দর্শন পাওয়া সম্ভব। যদি জল ঘোলা থাকে বা উহা ক্রমাগত নড়িতে থাকে, তাহা হইলে উহার তলদেশ কখনই দেখা যাইবে না। যদি উহা নির্মল থাকে এবং উহাতে একটিও তরঙ্গ না থাকে, তবেই আমরা উহার তলদেশ দেখিতে পাইব।

হ্রদের তলদেশ আমাদের প্রকৃত স্বরূপ-হ্রদটি চিত্ত এবং উহার তরঙ্গগুলি বৃত্তিস্বরূপ। আরও দেখিতে পাওয়া যায়, এই মন ত্রিবিধ ভাবে অবস্থান করে; প্রথমটি অন্ধকারময় অর্থাৎ তমঃ, যেমন পশু ও মূর্খদিগের মন; উহার কার্য কেবল অপরের অনিষ্ট করা; এইরূপ মনে আর কোনপ্রকার ভাব উদিত হয় না। দ্বিতীয়, মনের ক্রিয়াশীল অবস্থা রজঃ-এ অবস্থায় কেবল প্রভূত্ব ও ভোগের ইচ্ছা থাকে; আমি ক্ষমতাশালী হইব ও অপরের উপর প্রভূত্ব করিব, তখন এই ভাব থাকে। তারপর যে অবস্থা, তাহাকে বলা হয় ‘সত্ত্ব’-ইহা শান্ত; এ অবস্থায় সকল তরঙ্গ থামিয়া যায়, মন-রূপ হ্রদের জল নির্মল হইয়া যায়-ইহা নিষ্ক্রিয় নয়, বরং অতিশয় ক্রিয়াশীল অবস্থা। শান্ত ভাব শক্তির উচ্চতম বিকাশ; ক্রিয়াশীল হওয়া তো সহজ। লাগাম ছাড়িয়া দিলে অশ্বেরা তোমাকে সুদ্ধ লইয়া ছুটিতে থাকিবে।

যে-কেহ এরূপ করিতে পারে; কিন্তু যিনি এইরূপ লম্ফমান অশ্বকে থামাইতে পারেন, তিনিই মহাশক্তিধর পুরুষ। ছাড়িয়া দেওয়া ও বেগ সংযত করা-ইহাদের মধ্যে কোন্‌টিতে অধিকতর শক্তির প্রয়োজন? শান্ত ব্যক্তি অলস ব্যক্তির মতো নয়। সত্ত্বভাবকে জড়তা বা অলসতা মনে করিও না। যিনি মনের এই তরঙ্গগুলি নিজের আয়ত্তে আনিতে পারিয়াছেন, তিনিই শান্ত পুরুষ। ক্রিয়াশীলতা নিম্নতর শক্তির ও শান্তভাব উচ্চতর শক্তির প্রকাশ।

এই চিত্ত সর্বদাই উহার স্বাভাবিক পবিত্র অবস্থা ফিরিয়া পাইবার চেষ্টা করিতেছে, কিন্তু ইন্দ্রিয়গুলি উহাকে বাহিরে আকর্ষণ করিতেছে। চিত্তকে দমন করা, উহার বাহিরে যাইবার প্রবৃত্তিকে নিবারণ করা ও উহাকে প্রত্যাবৃত্ত করিয়া সেই চৈতন্যঘন পুরুষের নিকটে যাইবার পথে ফিরানো-ইহাই যোগের প্রথম সোপান; কারণ, কেবল এই উপায়েই চিত্ত উহার প্রকৃত পথে যাইতে পারে।

যদিও উচ্চতম হইতে নিম্নতম সকল প্রাণীর মধ্যেই এই চিত্ত রহিয়াছে, তথাপি কেবল মনুষ্যদেহেই উহাকে আমরা বুদ্ধিরূপে বিকশিত দেখিতে পাই। চিত্ত যতদিন না বুদ্ধির আকার ধারণ করিতেছে, ততদিন উহার পক্ষে এই-সকল বিভিন্ন সোপান অতিক্রম করিয়া আত্মাকে মুক্ত করা সম্ভব নয়। গোরু বা কুকুরের পক্ষে সাক্ষাৎ মুক্তি সম্ভব নয়, কারণ যদিও উহাদের মন (চিত্ত) আছে, উহা এখনও বুদ্ধির আকার ধারণ করিতে পারে নাই।

এই চিত্ত অবস্থাভেদে নানা রূপ ধারণ করে, যথা-ক্ষিপ্ত, মূঢ়, বিক্ষিপ্ত ও একাগ্র। মন এই চারি অবস্থায় চারি প্রকার রূপ ধারণ করিতেছে। প্রথম ‘ক্ষিপ্ত’-যে অবস্থায় মন চারিদিকে ছড়াইয়া যায়, যে অবস্থায় কর্মবাসনা প্রবল থাকে। এইরূপ মনের চেষ্টা-কেবলই সুখ দুঃখ এই দ্বিবিধ ভাবে প্রকাশিত হওয়া। তারপর ‘মূঢ়’ অবস্থা-উহা তমোগুণাত্মক; উহার চেষ্টা কেবল অপরের অনিষ্ট করা। ‘বিক্ষিপ্ত’ অবস্থায় মন কেন্দ্রের দিকেই যাইবার চেষ্টা করে। এখানে টীকাকার বলেন, বিক্ষপ্ত অবস্থা দেবতাদের ও মূঢ়াবস্থা অসুরদিগের স্বাভাবিক। ‘একাগ্র’ অবস্থায় চিত্তই কেন্দ্রীভূত হইতে চেষ্টা করে, এই অবস্থাই আমাদিগকে সমাধিতে লইয়া যায়।


১ এখানে নিরুদ্ধ অবস্থার কথা বলা হয় নাই, কারণ ঐ অবস্থাকে প্রকৃতপক্ষে চিত্তবৃত্তি বলা যাইতে পারে না।

 

তদা দ্রষ্টুঃস্বরুপেহবস্থানম্ ।।৩।।

-তখন (অর্থাৎ এই নিরোধের অবস্থায়) দ্রষ্টা (পুরুষ) নিজের (অপরিবর্তনীয়) স্বরূপে অবস্থিত।

যখনই তরঙ্গগুলি শান্ত হইয়া যায় ও হ্রদ শান্তভাব ধারণ করে, তখনই আমরা হ্রদের তলদেশ দেখিতে পাই। মন সম্বন্ধেও এরূপ বুঝিতে হইবে; যখন উহা শান্ত হইয়া যায়, তখনই আমরা আমাদের স্বরূপ বুঝিতে পারি; তখন আমরা ঐ তরঙ্গগুলির সহিত নিজেদের মিশাইয়া ফেলি না, কিন্তু নিজের স্বরূপে অবস্থিত থাকি।

বৃত্তিসারূপ্যমিতরত্র ।।৪।।

-অন্যান্য সময়ে (অর্থাৎ এই নিরোধের অবস্থা ব্যতীত অন্য সময়ে) দ্রষ্টা চিত্তবৃত্তির সহিত একীভূত হইয়া থাকেন।

যেমন কেহ আমার নিন্দা করিল, ইহা এক প্রকার পরিণাম-এক প্রকার বৃত্তি-আমি উহার সহিত নিজেকে মিশাইয়া ফেলিতেছি; উহার ফল দুঃখ।

বৃত্তয়ঃ পঞ্চতষ্যঃ ক্লিষ্টাহক্লিষ্টাঃ ।।৫।।

-বৃত্তি পাঁচ প্রকার-(কয়েকটি) ক্লেশ-যুক্ত ও (অপরগুলি) ক্লেশ-শূন্য।

প্রমাণ-বিপর্যয়-বিকল্প-নিন্দা-স্মৃতয়ঃ ।।৬।।

-প্রমাণ, বিপর্যয়, বিকল্প, নিন্দা ও স্মৃতি অর্থাৎ সত্যজ্ঞান, ভ্রমজ্ঞান, শব্দভ্রম, নিন্দা ও স্মৃতি-বৃত্তি এই পাঁচ প্রকার।

প্রত্যক্ষানুমানাগমাঃ প্রমাণানি ।।৭।।

-প্রত্যক্ষ অর্থাৎ সাক্ষাৎ অনুভব, অনুমান ও আগম অর্থাৎ আপ্ত বা বিশ্বস্ত লোকের বাক্য-এগুলিই প্রমাণ।

যখন আমাদের দুইটি অনুভূতি পরস্পরের বিরোধী না হয়, তখন তাহাকেই ‘প্রমাণ’ বলে। আমি কোন বিষয় শুনিলাম; যদি উহা পূর্বানুভূত কোন বিষয়ের বিরোধী হয়, তবে আমি উহার বিরুদ্ধে তর্ক করিতে থাকি, যখনই উহা বিশ্বাস করি না। প্রমাণ আবার তিন প্রকার। সাক্ষাৎ অনুভব বা ‘প্রত্যক্ষ’-ইহা এক প্রকার প্রমাণ। যদি আমরা কোনপ্রকার চক্ষুকর্ণের ভ্রমে না পড়িয়া থাকি, তহা হইলে আমরা যাহা কিছু দেখি বা অনুভব করি, তাহাকে প্রত্যক্ষ বলা যাইবে। আমি এই জগৎ দেখিতেছি, উহার অস্তিত্ব সম্বন্ধে ইহাই যথেষ্ট প্রমান। দ্বিতীয় ‘অনুমান’-তুমি কোন চিহ্ন বা লিঙ্গ দেখিলে, তাহা হইতে উহা যে-বিষয়ের সূচনা করিতেছে, তাহা জানিতে পারিলে। তৃতীয়তঃ ‘আগম’ বা আপ্তবাক্য-যাঁহারা প্রকৃত সত্য দর্শন করিয়াছেন, তাঁহাদের প্রত্যক্ষানুভূতি। আমরা সকলেই জ্ঞানলাভের জন্য ক্রমাগত চেষ্টা করিতেছি। কিন্তু তোমাকে আমাকে উহার জন্য কঠোর চেষ্টা করিতে হয়, বিচাররূপ দীর্ঘকালব্যাপী বিরক্তিকর রাস্তা দিয়া অগ্রসর হইতে হয়, কিন্তু শুদ্ধসত্ত্ব যোগী এই সকলের পারে গিয়াছেন। তাঁহার মনশ্চক্ষুর সমক্ষে ভূত ভবিষ্যৎ বর্তমান-সব এক হইয়া গিয়াছে, তাঁহার পক্ষে সবই যেন একখানি পাঠ্যপুস্তক। আমাদের মতো জ্ঞানলাভের কষ্টকর প্রণালীর ভিতর দিয়া তাঁহকে যাইতে হয় না। তাঁহার বাক্যই প্রমাণ, কারণ তিনি নিজের ভিতরেই জ্ঞানস্বরূপকে উপলব্ধি করেন। এইরূপ ব্যক্তিগণই শাস্ত্রের রচয়িতা, আর এই জন্যই শাস্ত্র প্রমাণ বলিয়া গ্রাহ্য। যদি বর্তমান সময়ে এরূপ কেহ জীবিত থাকেন, তবে তাঁহার কথা অবশ্যই প্রমাণরূপে গণ্য হইবে, অন্যান্য দার্শনিকেরা এই আপ্তবাক্য-সম্বন্ধে অনেক বিচার করিয়াছেন। তাঁহারা প্রশ্ন তুলিয়াছেন, আপ্তবাক্য সত্য কেন? আপ্তবাক্যের প্রমাণ-উহা তাঁহাদের প্রত্যক্ষ অনুভূতি। যেমন পূর্বজ্ঞানের বিরোধী না হইলে তুমি যাহা দেখ বা আমি যাহা দেখি, তাহা প্রমাণ বলিয়া গ্রাহ্য হয়, আপ্তবাক্যের প্রমাণ বলিয়া গ্রাহ্য হয়, আপ্তবাক্যের প্রামাণ্য সেইরূপ বুঝিতে হইবে। ইন্দ্রিয়ের অতীত জ্ঞান লাভ করা সম্ভব; যখন ঐ জ্ঞান যুক্তি ও মানুষের পূর্ব অভিজ্ঞতা খন্ডন না করে, তখন সেই জ্ঞানকে প্রমাণ বলা যায়। একজন উন্মত্ত ব্যক্তি আসিয়া বলিতে পারে, ‘আমি চারিদিকে দেবতা দেখিতে পাইতেছি’-উহাকে প্রমাণ বলা যাইবে না। প্রথমতঃ উহা সত্যজ্ঞান হওয়া চাই; দ্বিতীয়তঃ উহা যেন আমাদের পূর্বজ্ঞানের বিরোধী না হয়; তৃতীয়তঃ সেই ব্যক্তির চরিত্রের উপর উহা নির্ভর করে। অনেককে এরূপ বলিতে শুনিয়াছি এরূপ ব্যক্তির চরিত্র কিরূপ-দেখিবার আবশ্যক নাই, সে কি বলে, সেইটি জানাই বিশেষ আবশ্যক-সে কি বলে, তাহা আগে শুনিতে পাইবে। অন্যান্য বিষয়ে এ-কথা সত্য হইতে পারে; কোন লোক দুষ্ট-প্রকৃতি হইলেও সে জ্যোতিষ-সম্বন্ধে কিছু আবিষ্কার করিতে পারে, কিন্তু ধর্ম-বিষয়ে স্বতন্ত্র কথা; কারণ কোন অপবিত্র ব্যক্তিই ধর্মের প্রকৃত সত্য লাভ করিতে পারিবে না। এই কারণেই আমাদের প্রথমতঃ দেখা উচিত, যে ব্যক্তি নিজেকে ‘আপ্ত’ বলিয়া ঘোষণা করিতেছে, সে ব্যক্তি সম্পূর্ণরূপে নিঃস্বার্থ ও পবিত্র কিনা। দ্বিতীয়তঃ দেখিতে হইবে, সে অতীন্দ্রিয় জ্ঞান লাভ করিয়াছে কিনা। তৃতীয়তঃ আমাদের দেখা উচিত সে ব্যক্তি যাহা বলে, তাহা মনুষ্যজাতির পূর্ব অভিজ্ঞতার বিরোধী কিনা। কোন নূতন সত্য আবিষ্কৃত হইলে উহা পূর্বের কোন সত্য খন্ডন করে না, বরং পূর্ব সত্যের সহিত ঠিক খাপ খাইয়া যায়। চতুর্থতঃ অপরের পক্ষেও ঐ সত্য প্রত্যক্ষ করা সম্ভব। যদি কোন ব্যক্তি বলে, আমি এক অলৌকিক দৃশ্য দর্শন করিয়াছি, আর সঙ্গে সঙ্গে বলে যে, তোমার উহা দেখিবার কোন অধিকার নাই, আমি তাহার কথা বিশ্বাস করি না। প্রত্যেক ব্যক্তিই নিজে

দেখিতে পারে, উহা সত্য কিনা। যিনি নিজের অর্জিত জ্ঞান বিক্রয় করেন, তিনি কখনই আপ্ত নন। এই-সকল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া আবশ্যক। প্রথমেই দেখিতে হইবে সেই ব্যক্তি পবিত্র, এবং তাঁহার কোন স্বার্থপূর্ণ উদ্দেশ্য নাই, তাঁহার লাভ অথবা যশের আকাঙ্খা নাই। দ্বিতীয়তঃ তাঁহাকে দেখাইতে হইবে, তিনি জ্ঞানাতীত ভূমিতে আরোহণ করিয়াছেন। তাঁহার আমাদিগকে এমন কিছু দেওয়া আবশ্যক, যাহা আমরা ইন্দ্রিয় হইতে লাভ করিতে পারি না ও যাহা জগতের কল্যাণকর। তৃতীয়তঃ দেখিতে হইবে যে, উহা অন্যান্য সত্যের বিরোধী না হয়; অন্যান্য বৈজ্ঞানিক সত্যের বিরোধী হইলে তৎক্ষণাৎ উহা পরিত্যাগ কর। চতুর্থতঃ সেই ব্যক্তিই যে কেবল ঐ বিষয়ের অধিকারী, আর কেহ নয়, তাহা হইবে না। অপরের পক্ষেও যাহা লাভ করা সম্ভব, তিনি নিজের জীবনে তাহা কেবল কার্যে পরিণত করিয়া দেখাইবেন। তাহা হইলে প্রমাণ তিন প্রকারঃ প্রত্যক্ষ ইন্দ্রিয়ানুভূতি, অনুমান ও আপ্তবাক্য। এই ‘আপ্ত’ কথাটি ইংরেজীতে অনুবাদ করিতে পারিতেছি না। ইহাকে ‘inspired’ (অনুপ্রাণিত) শব্দের দ্বারা প্রকাশ করা যায় না; কারণ এই অনুপ্রেরণা বাহির হইতে আসে বলিয়া মনে হয়, আর ঐ জ্ঞান ভিতর হইতে আসে। ‘আপ্ত’-শব্দের আক্ষরিক অর্থ-যিনি পাইয়াছেন।

বিপর্যয়ো মিথ্যাজ্ঞানমতদ্রূপপ্রতিষ্ঠম্ ।।৮।।

-বিপর্যয় অর্থে মিথ্যা-জ্ঞান, যাহা সেই বস্তুর প্রকৃত-স্বরূপে প্রতিষ্ঠিত নয়।

আর এক প্রকার বৃত্তি এই যে, এক বস্তুতে অন্য বস্তুর ভ্রান্তি। ইহাকে ‘বিপর্যয়’ বলে; যাহা শুক্তিতে রজত-ভ্রম।

শব্দজ্ঞানানুপাতী বস্তুশূন্যো বিকল্পঃ ।।৯।।

-কেবলমাত্র শব্দ হইতে যে এক প্রকার জ্ঞান উৎপন্ন হয়, অথচ সেই শব্দপ্রতিপাদ্য বস্তুর অস্তিত্ব যদি না থাকে, তাহাকে বিকল্প অর্থাৎ শব্দ-জাত ভ্রম বলে।

বিকল্প-নামে আর এক প্রকার বৃত্তি আছে। একটা কথা শুনিলাম, তখন আর আমরা উহার অর্থবিচার করিবার জন্য অপেক্ষা না করিয়া তাড়াতাড়ি একটা সিদ্ধান্ত করিয়া বসিলাম। ইহা চিত্তের দুর্বলতার চিহ্ন। সংযম-বিষয়ক মতবাদটি এখন বেশ বুঝা যাইবে। মানুষ যত দুর্বল হয়, তাহার সংযমের ক্ষমতা ততই কম। সর্বদা এই সংযমের মানদন্ড দ্বারা আত্মপরীক্ষা করিবে। যখন তোমার ক্রুদ্ধ অথবা দুঃখিত হইবার ভাব আসিতেছে, তখন বিচার করিয়া দেখ যে, কোন একটি সংবাদ তোমার নিকট আসিবামাত্র কেমন করিয়া তোমার মন একটি বৃত্তিতে পরিণত হইতেছে।

অভাব-প্রত্যয়ালম্বনা বৃত্তির্নিদ্রা ।।১০।।

-যে বৃত্তি শূন্যভাবকে অবলম্বন করিয়া থাকে, সেই বৃত্তিই নিদ্রা।

আর এক প্রকার বৃত্তির নাম ‘নিদ্রা’-স্বপ্ন ও সুষুপ্তি। আমরা যখন জাগিয়া উঠি, তখন আমরা জানিতে পারি যে, আমরা ঘুমাইতেছিলাম। অনুভূত বিষয়েরই কেবল স্মৃতি হইতে পারে। যাহা আমরা অনুভব করি না, আমাদের সেই বিষয়ের কোন স্মৃতি আসিতে পারে না। প্রত্যেক প্রতিক্রিয়াই চিত্তহ্রদের একটি তরঙ্গ। নিদ্রায় যদি মনের কোন প্রকার বৃত্তি না থাকিত, তাহা হইলে ঐ অবস্থায় আমাদের ভাবাত্মক বা অভাবাত্মক কোন অনুভূতিই থাকিত না, সুতরাং আমরা উহা স্মরণও করিতে পারিতাম না। আমরা যে নিদ্রাবস্থাটি স্মরণ করিতে পারি, ইহা দ্বারাই প্রমাণিত হইতেছে যে, নিদ্রাবস্থায় মনে এক প্রকার তরঙ্গ ছিল। ‘স্মৃতি’ আর এক প্রকারের বৃত্তি।

অনুভূতবিষয়াসম্প্রমোষঃ স্মৃতিঃ ।।১১।।

-অনুভূত বিষয়সকল যখন আমাদের মন হইতে চলিয়া না যায় (যখন সংস্কারবশে জ্ঞানের আয়ত্ত হয়), তাহাকে স্মৃতি বলে।

পূর্বে যে চারি প্রকার বৃত্তির বিষয় কথিত হইয়াছে, তাহাদের প্রত্যেকটি হইতেই স্মৃতি আসিতে পারে। মনে কর, তুমি একটি শব্দ শুনিলে। ঐ শব্দটি যেন চিত্তহ্রদে নিক্ষিপ্ত প্রস্তর-তুল্য; উহাতে একটি ক্ষুদ্র তরঙ্গ উৎপন্ন হয়। সেই তরঙ্গটি আবার আরও অনেকগুলি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র তরঙ্গমালা উৎপন্ন করে। ইহাই স্মৃতি। নিদ্রাতেও এই ব্যাপার ঘটিয়া থাকে। যখন নিদ্রা-নামক তরঙ্গবিশেষ চিত্তের ভিতর স্মৃতিরূপ তরঙ্গপরস্পরা উৎপন্ন করে, তখন উহাকে ‘স্বপ্ন’ বলে। জাগ্রৎকালে যাহাকে ‘স্মৃতি’ বলে, নিদ্রাকালে সেইরূপ তরঙ্গকেই ‘স্বপ্ন’ বলে। জাগ্রৎকালে যাহাকে ‘স্মৃতি’ বলে, নিদ্রাকালে সেইরূপ তরঙ্গকেই ‘স্বপ্ন’ বলিয়া থাকে।

অভ্যাসবৈরাগ্যাভ্যাং তন্নিরোধঃ ।।১২।।

-অভ্যাস ও বৈরাগ্যের দ্বারা এই বৃত্তিগুলির নিরোধ হয়।

এই বৈরাগ্য লাভ করিতে হইলে মন বিশেষরূপে নির্মল, সৎ ও বিচারপূর্ণ হওয়া আবশ্যক। অভ্যাস করিবার আবশ্যক কি? কারণ প্রত্যেক কার্যই হ্রদের উপরিভাগে কম্পনশীল স্পন্দনস্বরূপ। এই কম্পন কালে মিলাইয়া যায়; থাকে কী? সংস্কারসমূহই অবশিষ্ট থাকে। মনে এইরূপ অনেক সংস্কার পড়িলে সেগুলি একত্র হইয়া অভ্যাসরূপে পরিণত হয়। ‘অভ্যাসই দ্বিতীয় স্বভার’-এইরুপ কথিত হইয়া থাকে; শুধু দ্বিতীয় স্বভাব নয়, উহা প্রথম স্বভাবও বটে-মানুষের সমুদয় স্বভাবই ঐ অভ্যাসের উপর নির্ভর করে। আমরা এখন যেরুপ প্রকৃতিবিশিষ্ট হইয়াছি,তাহা পূর্ব অভ্যাসের ফল। সমুদয় অভ্যাসের ফল জানিতে পারিলে আমাদের মনে সান্ত্বনা আসে, কারণ যদি আমাদের বর্তমান স্বভাব কেবল অভ্যাসবশেই হইয়া থাকে, তাহা হইলে আমরা যখন ইচ্ছা ঐ অভ্যাস দূর করিতেও পারি। আমাদের মনের ভিতর দিয়া যে

চিন্তাস্পন্দগুলি চলিয়া যায়, তাহাদের প্রত্যেকটি এক-একটি দাগ রাখিয়া যায়, সংস্কারগুলি তাহাদের সমষ্টি। আমাদের চরিত্র এই-সকল সংস্কারের সমষ্টিস্বরূপ। যখন কোন বিশেষ বৃত্তিতরঙ্গ প্রবল হয়, তখন মানুষ সেই ভাবে ভাবান্বিত হয়। যখন সদগুণ প্রবল হয়, তখন মানুষ সৎ হইয়া যায়; যদি মন্দভাব প্রবল হয়, তবে মন্দ হইয়া যায়। যদি আনন্দের ভাব প্রবল হয়, তবে মানুষ সুখী হইয়া থাকে। অসৎ অভ্যাসের একমাত্র প্রতিকার-তাহার বিপরীত অভ্যাস। যত কিছু অসৎ অভ্যাস আমাদের চিত্তে সংস্কারবদ্ধ হইয়া গিয়াছে, কেবল সৎ অভ্যাসের দ্বারা সেগুলি নিয়ন্ত্রিত করিতে হইবে। কেবল সৎকার্য করিয়া যাও, অবিরতভাবে পবিত্র চিন্তা কর; অসৎ সংস্কার-নিবারণের ইহাই একামাত্র উপায়। কখনও বলিও না, অমুকের আর কোন আশা নাই; কারণ অসৎ ব্যক্তি কেবল একটি বিশেষ প্রকারের চরিত্রের পরিচয় দিতেছে। চরিত্র কতকগুলি অভ্যাসের সমষ্টিমাত্র, নূতন ও সৎ অভ্যাসের দ্বারা ঐগুলিকে দূর করা যাইতে পারে। চরিত্র কেবল পুনঃপুনঃ অভ্যাসের সমষ্টিমাত্র। পুনঃপুনঃ অভ্যসই চরিত্র সংশোধন করিতে পারে।

তত্র স্থিতৌ যত্নোহভ্যাসঃ ।।১৩।।

-ঐ বৃত্তিগুলিকে সম্পূর্ণরূপে বশে রাখিবার যে নিয়ত চেষ্টা, তাহাকে ‘অভ্যাস’ বলে।

অভ্যাস কাহাকে বলে? চিত্তরূপী মনকে দমন করিবার চেষ্টা অর্থৎ উহার তরঙ্গাকারে বহির্গমন নিবারণ করিবার চেষ্টাই অভ্যাস।

স তু দীর্ঘকালনৈরন্তর্যসৎকারাসেবিতো দৃঢ়ভূমিঃ ।।১৪।।

-দীর্ঘকাল সর্বদা তীব্র শ্রদ্ধার সহিত (সেই পরম-পদ-প্রাপ্তির) চেষ্টা করিলেই অভ্যাস দৃঢ়ভূমি হইয়া যায়।

এই সংযম একদিনে আসে না, দীর্ঘকাল নিরন্তর অভ্যাস করিলে পর আসে।

দৃষ্টানুশ্রবিকবিষয়বিতৃষ্ণস্য বশীকারসংজ্ঞা বৈরাগ্যম্ ।।১৫।।

-দৃষ্ট অথবা শ্রূত সর্বপ্রকার বিষয়ের আকাঙ্ক্ষা যিনি ত্যাগ করিয়াছেন, তাঁহার নিকট যে একটি অপূর্ব ভাব আসে, যাহাতে তিনি সমস্ত বিষয়বাসনাকে দমন করিতে পারেন, তাহাকে ‘বৈরাগ্য’ বা অনাসক্তি বলে।

দুইটি শক্তি আমাদের সমূদয় কার্যপ্রবৃত্তির নিয়ামক-(১) আমাদের নিজেদের অভিজ্ঞতা, (২) অপরের অভিজ্ঞতা। এই দুই শক্তি আমাদের মনোহ্রদে নানা তরঙ্গ উৎপন্ন করিতেছে। বৈরাগ্য এই শক্তিদ্বয়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করিবার ও মনকে বশে রাখিবার শক্তিস্বরূপ। সুতরাং আমাদের প্রয়োজন-এই কার্যপ্রবৃত্তির নিয়ামক শক্তি-

দ্বয়কে ত্যাগ করিবার শক্তি লাভ করা। মনে কর, আমি একটি পথ দিয়া যাইতেছি, একজন লোক আসিয়া আমার ঘড়িটি কাড়িয়া লইল। ইহা আমার নিজের প্রত্যক্ষানুভূতি, আমি নিজে দেখিলাম, উহা আমার চিত্তকে তৎক্ষণাৎ ক্রোধরূপ বৃত্তির আকারে পরিণত করিল। ঐ ভাব আসিতে দিবে না। যদি উহা নিবারণ করিতে না পারো, তবে তোমার কোনই মূল্য নাই। যদি নিবারণ করিতে পারো, তবেই তোমার বৈরাগ্য আছে, বুঝা যাইবে। আবার সংসারী লোক যে বিষয়ভোগ করে, তাহাতে আমরা এই শিক্ষা পাই যে, বিষয়ভোগই জীবনের চরম লক্ষ্য। এগুলি আমাদের ভয়ানক প্রলোভন। ঐগুলিকে অস্বীকার করা ও ঐগুলি লইয়া মনকে বৃত্তির আকারে পরিণত হইতে না দেওয়াই বৈরাগ্য। স্বানুভূত ও পরানুভূত বিষয় হইতে আমাদের যে দুই প্রকার কার্যপ্রবৃত্তি জন্মায়।, সেগুলিকে দমন করা ও এইরূপে চিত্তকে উহাদের বশীভূত হইতে না দেওয়াকে বৈরাগ্য। স্বানুভূত ও পরানুভূত বিষয় হইতে আমাদের যে দুই প্রকার কার্যপ্রবৃত্তি জন্মায়, সেগুলিকে দমন করা ও এইরূপে চিত্তকে উহাদের বশীভূত হইতে না দেওয়াকে বৈরাগ্য বলে। প্রবৃত্তিগুলি যেন আমার আয়ত্তে থাকে, আমি যেন উহাদের আয়ত্তাধীন না হই-এই প্রকার মানসিক শক্তিকে বৈরাগ্য বলে; এই বৈরাগ্যই মুক্তির একমাত্র উপায়।

তৎপরং পুরুষখ্যাতের্গুণবৈতৃষ্ণ্যম্ ।।১৬।।

-যে তীব্র বৈরাগ্য লাভ হইলে আমরা গুণগুলিতে পর্যন্ত বীতরাগ হই ও উহাদিগকে পরিত্যাগ করি, তাহাই পুরুষের প্রকৃত স্বরূপ প্রকাশ করিয়া দেয়।

যখন এই বৈরাগ্য আমাদের গুণের প্রতি আসক্তিকে পর্যন্ত পরিত্যাগ করায়, তখনই উহাকে শক্তির উচ্চতম বিকাশ বলা যায়। প্রথমে পুরুষ বা আত্মা কী ও গুণগুলিই বা কী, তাহা আমাদের জানা উচিত। যোগদর্শনের মতে সমুদয় প্রকৃতিতে তিনটি শক্তি বা গুণ আছে; ঐ গুণগুলির একটির নাম তমঃ অপরটি রজঃ ও তৃতীয়টি সত্ত্ব। এই তিন গুণ বাহ্যজগতে অন্ধকার বা অলসতা, আকর্ষণ বা বিকর্ষণ ও উহাদের সামঞ্জস্য-এই ত্রিবিধ ভাবে প্রকাশ পায়। প্রকৃতিতে যত বস্তু আছে।, যাহা কিছু আমরা দেখিতেছি, সবই এই তিন শক্তির বিভিন্ন সমবায়ে উৎপন্ন। সাংখ্যেরা প্রকৃতিকে নানাপ্রকার তত্ত্বে বিভক্ত করিয়াছেন; মনুষ্যের আত্মা ইহাদের সবগুলির বাহিরে-প্রকৃতির বাহিরে; উহা স্বপ্রকাশ, শুদ্ধ ও পূর্ণস্বরূপ; আর প্রকৃতিতে যে কিছু চৈতন্যের প্রকাশ দেখিতে পাই, তাহা প্রকৃতির উপরে আত্মার প্রতিবিম্ব মাত্র। প্রকৃতি নিজে জড়। এটি স্মরণ রাখা উচিত যে, প্রকৃতি বলিতে উহার সহিত মনকেও বুঝাইতেছে। মনও প্রকৃতির ভিতরে। চিন্তাও প্রকৃতির অন্তর্গত। চিন্তা হইতে অতি স্থূলতম ভূত পর্যন্ত সবই প্রকৃতির অন্তর্গত-প্রকৃতির বিভিন্ন বিকাশ মাত্র। এই প্রকৃতি মনুষ্যের আত্মাকে আবৃত রাখিয়াছে; যখন প্রকৃতি ঐ আবরণ সরাইয়া লয়, তখন আত্মা স্ব-মহিমায় প্রকাশিত হন। পঞ্চদশ সূত্রে বর্ণিত এই বৈরাগ্য দ্বারা প্রকৃতি বশীভূত হয় বলিয়া উহা আত্মার প্রকাশের পক্ষে অতিশয় সাহায্যকারী। পরের সূত্রে সমাধি অর্থাৎ পূর্ণ একাগ্রতার লক্ষণ বর্ণনা করা হইয়াছে। উহাই যোগীর চরম লক্ষ্য।

বিতর্কবিচারানন্দাস্মিতানুগমাৎ ‘সম্প্রজ্ঞাতঃ’ ।।১৭।।

-যে সমাধিতে বিতর্ক, বিচার, আনন্দ ও অস্মিতা অনুগত থাকে, তাহাকে সম্প্রজ্ঞাত বা সম্যক্ জ্ঞানপূর্বক সমাধি বলে।

সমাধি দুই প্রকার। একটিকে ‘সম্প্রজ্ঞাত’ ও অপরটিকে ‘অসস্প্রজ্ঞাত’ বলে। এই সম্প্রজ্ঞাত সমাধিতে প্রকৃতিকে বশীভূত করিবার সমুদয় শক্তি আসে। সম্প্রজ্ঞাত সমাধি আবার চারি প্রকার। প্রথম প্রকারকে ‘সবিতর্ক সমাধি’ বলে। এই সমাধিতেই মনকে অন্যান্য বিষয় হইতে সরাইয়া বিষয়বিশেষের পুনঃপুনঃ অনুধ্যানে নিযুক্ত করিতে হয়। এই প্রকার চিন্তা বা ধ্যানের বিষয় দুই প্রকারঃ (১) চতুর্বিংশতি (জড়) তত্ত্ব ও (২) চেতন পুরুষ। যোগের এই অংশটি সম্পূর্ণরূপে সাংখ্যদর্শনের উপর স্থাপিত। এই সাংখ্যদর্শনের বিষয় তোমাদিগকে পূর্বেই বলিয়াছি। তোমাদের স্মরণ থাকিতে পারে, মন বুদ্ধি অহঙ্কার- ইহাদের এক সাধারণ ভিত্তিভূমি আছে। উহাকে ‘চিত্ত’ বলে, চিত্ত হইতেই উহাদের উৎপত্তি। এই চিত্ত প্রকৃতির ভিন্ন ভিন্ন শক্তি গ্রহণ করিয়া উহাদিগকে চিন্তারূপে পরিণত করে। আবার শক্তি ও ভূত উভয়েরই কারণস্বরূপ এক পদার্থ আছে, ইহা অবশ্যই স্বীকার করিতে হইবে। ইহাকে ‘অব্যক্ত’ বলে-উহা সৃষ্টির প্রাক্কালীন প্রকৃতির অপ্রকাশিত অবস্থা। কল্পান্তে সমুদয় প্রকৃতিই উহাতে প্রত্যাবর্তন করে, আবার কিছুকাল পরে পরকল্পে উহা হইতেই সব পুনরাবির্ভূত হয়। এই সমুদয়ের অতীত প্রদেশে চৈতন্যঘন পুরুষ রহিয়াছেন। জ্ঞানই প্রকৃত শক্তি। কোন বস্তুর সম্বন্ধে জ্ঞানলাভ হইলেই আমরা উহার উপর ক্ষমতা লাভ করি। এইরূপে যখনই আমাদের মন এই সমুদয় ভিন্ন ভিন্ন বিষয় ধ্যান করিতে থাকে, তখনই উহাদের উপর ক্ষমতা লাভ করিয়া থাকে। যে প্রকার সমাধিতে বাহ্য স্থূল ভূতগণই ধ্যেয় হয়, তাহাকে সবিতর্ক বলে। ‘বিতর্ক’ অর্থে প্রশ্ন-‘সবিতর্ক’ অর্থে প্রশ্নের সহিত। যে প্রকার ধ্যানে ভূতসমূহ উহাদের অন্তর্গত সত্য ও উহাদের সমুদয় শক্তি ঐরূপ ধ্যানপরায়ণ পুরুষকে প্রদান করে-যেন এইজন্যই ভূতগুলিকে প্রশ্ন করা-তাহাকে ‘সবিতর্ক’ বলে। কিন্তু শক্তি লাভ করিলেই মুক্তি লাভ হয় না। উহা কেবল ভোগের জন্য চেষ্টা মাত্র। আর এই জীবনে প্রকৃত ভোগসুখ হইতেই পারে না। ভোগসুখের অন্বেষণ বৃথা, ইহাই জগতে অতি প্রচীন উপদেশ; কিন্তু মানুষের পক্ষে ইহা ধারণা করা অতি কঠিন। যখন সে ইহার ধারণা করিতে পারে, তখন সে জড় জগতের অতীত হইয়া যায়। যেগুলিকে সাধারণতঃ গুহ্যশক্তি বলে, তাহা লাভ করিলে ভোগের বৃদ্ধি হয় মাত্র, কিন্তু পরিশেষে তাহা হইতে আবার যন্ত্রণাও বৃদ্ধি পায়। বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে দেখিয়া পতঞ্জলি এই গুহ্যশক্তিলাভের সম্ভাবনা স্বীকার করিয়াছেন। কিন্তু এই-সকল শক্তির প্রলোভন হইতে আমাদিগকে সাবধান করিয়া দিতেও তিনি ভুলেন নই।


১ পাঠান্তরঃ বিতর্কবিচারানন্দাস্মিতারূপানুগমাৎ

আবার সই ধ্যানেই যখন ঐ ভূতসমূহকে দেশ ও কাল হইতে পৃথক্ করিয়া ঐগুলির স্বরূপ চিন্তা করা করা যায়, তখন সেই সমাধিকে নির্বিতর্ক সমাধি বলে। যখন ধ্যান আর এক সোপান অগ্রসর হয় এবং তন্মাত্রগুলিকে ধ্যানের বিষয় করিয়া উহাদিগকে দেশকালের অন্তর্গত বলিয়া চিন্তা করা যায়, তখন ঐ ধ্যানকে ‘সবিচার সমাধি’ বলে। আবার ঐ সমাধিতে যখন ঐ সূক্ষ্মভূতগুলিকে দেশকাল-বিবর্জিত উহাদের স্বরূপে চিন্তা করা যায়, তখন তাহাকে ‘নির্বিচার সমাধি’ বলে। পরবর্তী সোপানে সূক্ষ্ম ও স্থূল উভয় প্রকার ভূতের চিন্তাই পরিত্যাগ করিয়া অন্তঃকরণকে-মনকেই ধ্যানের বিষয় করিতে হয়। যখন অন্তঃকরণকে রজস্তমোগুণ হইতে পৃথক্ করিয়া চিন্তা করা হয়, তখন উহাকে ‘সানন্দ সমাধি’ বলে। যখন মনই ধ্যানের বিষয় হয়, যখন ঐ সমাধি একাগ্র ও পরিপক্ক হইয়া যায়, যখন স্থূল সূক্ষ্ম সমুদয় ভূতের চিন্তা পরিত্যক্ত হইয়া মনের স্বরূপাবস্থাই ধ্যেয় বিষয় হইয়া দাঁড়ায়, অন্যান্য বিষয় হইতে পৃথক্‌কৃত হইয়া কেবল সাত্ত্বিক অহঙ্কার মাত্র বর্তমান থাকে, তখন উহাকে ‘অস্মিতা-সমাধি’ বলে। এই অবস্থাতেও সম্পূর্ণরূপে মনের অতীত হওয়া যায় না। যে ব্যক্তি ঐ অবস্থা লাভ করিয়াছেন, তাঁহাকে বেদে ‘বিদেহ’ বলিয়া থাকে। তিনি নিজেকে স্থূলদেহশূন্যরূপে চিন্তা করিতে পারেন বটে, কিন্তু তাঁহার নিজেকে সূক্ষ্মশরীরধারী বলিয়া চিন্তা করিতে হইবেই। যাঁহারা এই অবস্থায় থাকিয়া সেই পরমপদ লাভ না করিয়া প্রকৃতিতে লয়প্রাপ্ত হন, তাঁহাদিগকে ‘প্রকৃতিলীন’ বলে; কিন্তু যাঁহারা ইহাতেও সন্তুষ্ট নন, তাঁহারাই চরমলক্ষ্য মুক্তি লাভ করেন।

বিরাম-প্রত্যয়াভ্যাসপূর্বঃ সংস্কারশেষোহন্যঃ ।।১৮।।

-অন্যপ্রকার সমাধিতে সর্বদা সমুদয় মানসিক ক্রিয়ার বিরাম অভ্যাস করা হয়, কেবল চিত্তের দৃঢ় সংস্কার-মাত্র অবশিষ্ট থাকে।

ইহাই পূর্ণ জ্ঞানাতীত ‘অসম্প্রজ্ঞাত সমাধি’; ঐ সমাধি আমাদিগকে মুক্তি দিতে পারে। প্রথমে যে সমাধির কথা বলা হইয়াছে, তাহা আমাদিগকে মুক্তি দিতে পারে না-আত্মাকে মুক্ত করিতে পারে না। এক ব্যক্তি সমুদয় শক্তি লাভ করিতে পারে, কিন্তু তাহার পুনরায় পতন হইবে। যতক্ষণ না আত্মা প্রকৃতির অতীত অবস্থায় (সম্প্রজ্ঞাত সমাধিরও বাহিরে) যাইতে পারে, ততক্ষণ পতনের ভয় থাকে। যদিও এই ধ্যানের প্রণালী খুবই সহজ বলিয়া বোধ হয়, কিন্তু ইহা লাভ করা অতি কঠিন। ইহার প্রণালী এইঃ মনকেই ধ্যানের বিষয় কর; যখনই মনে কোন চিন্তা আসিবে, তখনই উহা দমিত কর; মনের ভিতর কোন প্রকার চিন্তা আসিতে না দিয়া উহাকে সম্পূর্ণরূপে শূন্য কর। যখনই আমরা যথার্থরূপে ইহা সাধন করিতে পারিব, সেই মুহুর্তেই আমরা মুক্তি লাভ করিব। পূর্ব সাধন যাহাদের আয়ত্ত হয় নাই, তাহারা যখন মনকে শূন্য করিতে চেষ্টা করে, তখন তাহাদের চিত্ত অজ্ঞানস্বভাব তমোগুন দ্বারা আবৃত্ত হইয়া যায়, তমোগুণ তাহাদের মনকে অলস ও অকর্মণ্য করিয়া ফেলে। তাহারা কিন্তু মনে

করে-আমরা মনকে শূন্য করিতেছি। ইহা ঠিকঠিকভাবে সাধন করিতে পারা উচ্চতম শক্তির প্রকাশ- সংযমের চূড়ান্ত। যখন এই অসম্প্রজ্ঞাত অর্থাৎ জ্ঞানাতীত অবস্থা লাভ হয়, তখন ঐ সমাধি নির্বীজ হইয়া যায়।-ইহার অর্থ কি? সম্প্রজ্ঞাত সমাধিতে চিত্তবৃত্তিগুলি দমিত হয় মাত্র, উহারা সংস্কার বা বীজাকারে থাকে, আবার সময় আসিলে পুনরায় তরঙ্গাকারে প্রকাশিত হয়। কিন্তু যখন সংস্কারগুলিকে পর্যন্ত ধ্বংস করা হয়, যখন মনও প্রায় বিনষ্ট হইয়া আসে, তখনই সমাধি নির্বীজ হইয়া যায়। তখন মনের ভিতর এমন কোন সংস্কার-বীজ থাকে না, যাহা হইতে এই জীবন-লতিকা পুনঃপুনঃ উৎপন্ন হইতে পারে-যাহা হইতে এই অবিরাম জন্মমৃত্যু আবর্তিত হইতে পারে।

অবশ্য তোমরা জিজ্ঞাসা করিতে পারো, যেখানে জ্ঞান থাকিবে না, যেখানে মন থাকিবে না, সে আবার কি প্রকার অবস্থা? যাহাকে আমরা ‘জ্ঞান’ বলি, তাহা ঐ জ্ঞানাতীত অবস্থার সহিত তুলনায় এক নিম্নতর অবস্থামাত্র। এইটি সর্বদা স্মরণ রাখা উচিত যে, কোন বিষয়ের সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন প্রান্তদ্বয় প্রায় একই প্রকার দেখায়। ইথারের কম্পন মৃদুতম হইলে উহাকে ‘অন্ধকার’ বলে, মধ্য অবস্থায় ‘আলোক’, উহার উচ্চতম কম্পন আবার অন্ধকার। কিন্তু ঐ দুই প্রকার অন্ধকারকে কি এক বলিতে হইবে? উহার একটি- প্রকৃত অন্ধকার, অপরটি-অতি তীব্র আলোক, তথাপি উহারা দেখিতে একই প্রকার। এইরূপে অজ্ঞান সর্বাপেক্ষা নিম্নাবস্থা, জ্ঞান মধ্যাবস্থা, আর ঐ জ্ঞানের অতীত একটি উচ্চ অবস্থা আছে। কিন্তু অজ্ঞানাবস্থা ও জ্ঞানাতীত অবস্থা দেখিতে একই প্রকার। আমরা যাহাকে ‘জ্ঞান’ বলি, তাহা এক উৎপন্ন দ্রব্য-উহা একটি মিশ্র পদার্থ, উহা প্রকৃত সত্য নয়।

এই উচ্চতর সমাধি ক্রমাগত অভ্যাস করিলে কি ফল হইবে? উহার ফলে আমাদের অস্থিরতা ও জড়ত্বের দিকে মনের যে একটা প্রবণতা ছিল, তাহা তো নষ্ট হইবেই, সঙ্গে সঙ্গে সৎপ্রবৃত্তিরও নাশ হইয়া যাইবে। অপরিষ্কৃত সুবর্ণ হইতে উহার খাদ বাহির করিবার জন্য কোন রাসায়নিক দ্রব্য মিশাইলে যাহা হয়, এ ক্ষেত্রেও ঠিক তাহাই হইয়া থাকে। যখন খনি হইতে উত্তোলিত ধাতুকে গলানো হয়, তখন যে রাসায়নিক পদার্থগুলি উহার সঙ্গে মিশানো হয়, সেগুলি ঐ খাদের সহিত গলিয়া যায়। এই প্রকারেই সর্বদা সংযম-শক্তিবলে প্রথমে পূর্বতন অসৎ প্রবৃত্তিগুলি ও সৎপ্রবৃত্তিগুলিও চলিয়া যাইবে। এইরূপে সদসৎ প্রবৃত্তিদ্বয় পরস্পরকে অভিভূত করিয়া ফেলিবে, ভালমন্দ সর্ববন্ধনবিমুক্ত হইয়া আত্মা স্ব-মহিমায় সর্বব্যাপী, সর্বশক্তিমান্ ও সর্বজ্ঞরূপে অবস্থান করিবেন। সমুদয় শক্তি ত্যাগ করিয়া আত্মা সর্বশক্তিমান্ হন; জীবনে অভিমান ত্যাগ করিয়াই জীবাত্মা মৃত্যু অতিক্রম করেন, কারণ তখন তিনি মহাপ্রাণরূপে অবস্থান করেন। তখনই জীবাত্মা জানিতে পারিবেন, কোনকালে তাঁহার জন্মমৃত্যু ছিল না, তাঁহার কখনই স্বর্গ বা পৃথিবী কিছুরই প্রয়োজন ছিল না। তখন তিনি বুঝিবেন, তিনি কখনও আসেন নাই, কোথাও যান নাই, আসা-যাওয়া-কেবল প্রকৃতির। আর প্রকৃতির ঐ গতিই আত্মার উপর প্রতিবিম্বিত হইয়াছিল। দর্পণ

হইতে প্রতিবিম্বিত আলোক দেওয়ালের উপর পড়িয়াছে ও নড়িতেছে। দেওয়াল যেন ভাবিতেছে, আমিই নড়িতেছি! আমাদের সকলের সম্বন্ধেই এইরূপ; চিত্তই ক্রমাগত এদিক ওদিক যাইতেছে, উহা নিজেকে নানারূপে পরিণত করিতেছে, কিন্তু আমরা মনে করিতেছি, আমরা এই বিভিন্ন আকার ধারণ করিতেছি। এই সমুদয় অজ্ঞানই চলিয়া যাইবে। সেই সিদ্ধাবস্থায় মুক্ত আত্মা যখন যাহা আজ্ঞা করিবেন-প্রার্থনা বা ভিক্ষা নয়, আজ্ঞা করিবেন-তিনি যাহা ইচ্ছা করিবেন, তৎক্ষণাৎ তাহাই পূর্ণ হইবে; তিনি যাহা চাহিবেন, তাহাই করিতে সমর্থ হইবেন। সাংখ্যদর্শনের মতে ঈশ্বরের অস্তিত্ব নাই। এই দর্শনের মতে জগতের ঈশ্বর কেহ থাকিতে পারেন না, কারণ যদি কেহ থাকেন, তাহা হইলে তিনি নিশ্চয়ই আত্মা, আবার আত্মা হয় বদ্ধ, না হয় মুক্ত। যে আত্মা প্রকৃতিদ্বারা বদ্ধ বা বশীভূত, তিনি কিরূপে সৃষ্টি করিতে পারেন? তিনি তো নিজেই ক্রীতদাস। অপর পক্ষে আত্মা যদি মুক্তই হন, তবে মুক্ত আত্মা কেন সৃষ্টি করিবেন, কেনই বা এই সমুদয় জগতের ক্রিয়াদি নির্বাহ করিবেন? উঁহার কোন বাসনা নাই, সুতরাং উঁহার সৃষ্টি করিবার কোন প্রয়োজন থাকিতে পারে না। দ্বিতীয়তঃ এই সাংখ্যদর্শন বলেন যে, ঈশ্বর সম্বন্ধে কোন মতবাদ অনাবশ্যক। প্রকৃতি স্বীকার করিলেই যখন সমুদয় ব্যাখ্যা করা যায়, তখন ঈশ্বরের আর প্রয়োজন কি? তবে কপিল বলেন, অনেক আত্মা এরূপ আছেন, যাঁহারা সিদ্ধাবস্থার প্রায় নিকটবর্তী হইয়াছেন, কিন্তু অলৌকিক শক্তি ও বাসনা সম্পূর্ণরূপে ত্যাগ করিতে না করিতে না পারায় সিদ্ধ হইতে পারিতেছেন না। তাঁহাদের মন কিছুকাল প্রকৃতিতে লীন থাকে; তাঁহারা প্রকৃতির প্রভুরূপে পুনরাবির্ভূত হন। এরূপ ঈশ্বর আছেন বটে। আমরা সকলেই এক সময়ে এরূপ ঈশ্বরত্ব লাভ করিব। সাংখ্যদর্শনের মতে বেদে যে ঈশ্বরের বর্ণনা আছে, তাহা এইরূপ একজন মুক্তাত্মার বর্ণনা মাত্র। ইহা ব্যতীত নিত্যমুক্ত, আনন্দময় বিশ্ব-সৃষ্টিকর্তা কেহ নাই। আবার এদিকে যোগীরা বলেন, ‘না, ঈশ্বর একজন আছেন, অন্যান্য সমুদয় আত্মা-সমুদয় পুরুষ হইতে পৃথক্ একজন বিশেষ পুরুষ আছেন; তিনি সমগ্র সৃষ্টির নিত্য প্রভু, নিত্যমুক্ত, সকল গুরুর গুরু।’ সাংখ্যেরা যাঁহাদিগকে ‘প্রকৃতিলীন’ বলেন, যোগীরা তাঁহাদেরও অস্তিত্ব স্বীকার করেন। তাঁহারা বলেন যে, ইঁহারা অসিদ্ধ বা অসম্পূর্ণ যোগী। কিছুকালের জন্য তাঁহারা বলেন যে, ইঁহারা অসিদ্ধ বা অসম্পূর্ণ যোগী। কিছুকালের জন্য তাঁহাদের চরমলক্ষ্য-প্রাপ্তি ব্যাহত হয়, তাঁহারা সেই সময়ে জগতের অংশবিশেষের নিয়ন্তারূপে অবস্থান করেন।

ভব-প্রত্যয়ো বিদেহ-প্রকৃতিলয়ানাম্ ।।১৯।।

-(এই সমাধি পর-বৈরাগ্যের সহিত অনুষ্ঠিত না হইলে) তাহাই দেবতা ও প্রকৃতিলীনদিগের পুনরুৎপত্তির কারণ।

ভারতীয় ধর্ম ও দর্শনশাস্ত্রে দেবতা অর্থে কতকগুলি উচ্চপদস্থ ব্যক্তিকে বুঝায়। ভিন্ন ভিন্ন জীবাত্মা ক্রমান্বয়ে ঐ পদে পূর্ণ করেন। কিন্তু ইঁহাদের মধ্যে কেহই পূর্ণ নন।

শ্রদ্ধাবীর্যস্মৃতিসমাধিপ্রজ্ঞাপূর্বক ইতরেষাম্ ।।২০।।

-অপর কাহারও কাহারও নিকট শ্রদ্ধা অর্থাৎ বিশ্বাস, বীর্য অর্থাৎ মনের তেজ, স্মৃতি, সমাধি বা একাগ্রতা ও প্রাজ্ঞা অর্থাৎ সত্য বস্তুর বিবেক হইতে এই সমাধি উৎপন্ন হয়।

যাঁহারা দেবত্বপদ অথবা কোন কল্পের শাসনভার প্রার্থনা করেন না, তাঁহাদেরই কথা বলা হইতেছে। তাঁহারা মুক্তিলাভে করেন।

তীব্রসংবেগানামাসন্নঃ ।।২১।।

-যাঁহারা অত্যন্ত আগ্রহযুক্ত বা উৎসাহী, তাঁহারা অতি শ্রীঘ্রই যোগে কৃতকার্য হন।

মৃদুমধ্যাধিমাত্রত্বাৎ ততোপি বিশেষঃ ।।২২।।

-আবার মৃদু চেষ্টা, মধ্যম চেষ্টা, অথবা অত্যন্ত অধিক চেষ্টা অনুসারে যোগিগণের সিদ্ধির বিশেষ বা ভেদ দেখা যায়।

ঈশ্বরপ্রণিধানাদ্বা ।।২৩।।

-অথবা ঈশ্বরের প্রতি ভক্তি দ্বারাও (সমাধি লাভ হয়)।

ক্লেশকর্মবিপাকাশয়ৈরপরামৃষ্টঃ পুরুষবিশেষ ঈশ্বরঃ ।।২৪।।

-এক বিশেষ পুরুষ, যিনি দুঃখ কর্ম কর্মফল অথবা বাসনা দ্বারা অস্পৃষ্ট, তিনিই ঈশ্বর (পরম নিয়ন্তা)।

আমাদের এখানে পুনরায় স্মরণ করিতে হইবে যে, পাতঞ্জল যোগশাস্ত্র সাংখ্যদর্শনের উপর স্থাপিত, সাংখ্যদর্শনে ঈশ্বরের স্থান নাই; যোগীরা কিন্তু ঈশ্বর স্বীকার করিয়া থাকেন। যোগীরা ঈশ্বরের স্বীকার করিলেও সৃষ্টিকর্তৃত্বাদি ঈশ্বরসন্বন্ধীয় বিবিধ ভাবের কোন প্রসঙ্গ উত্থাপন করেন না। যোগীদিগের ‘ঈশ্বর’ অর্থে জগতের সৃষ্টিকর্তা ঈশ্বর সূচিত হন নাই, বেদমতে কিন্তু ঈশ্বর জগতের সৃষ্টিকর্তা। বেদের অভিপ্রায় এই -জগতে যখন সামঞ্জস্য দেখা যাইতেছে, তখন জগৎ অবশ্য একজনের ইচ্ছাশক্তিরই বিকাশ হইবে।

যোগীরা ঈশ্বরাস্তিত্ব স্থাপনের জন্য তাঁহাদের নিজস্ব এক নূতন ধরনের যুক্তির অবতারণা করেন। তাঁহারা বলেন-

তত্র নিরতিশয়ং সর্বজ্ঞত্ববীজম্ ।।২৫।।

-অন্যেতে যে সর্বজ্ঞত্বের বীজ (মাত্র) আছে, তাহা তাঁহাতে নিরতিশয় অর্থাৎ অনন্ত ভাব ধারণ করে।

অতি বৃহৎ ও অতি ক্ষুদ্র এই দুইটি চূড়ান্ত ভাবের ভিতর মনকে ভ্রমণ করিতেই হইবে। তুমি অবশ্য সীমাবদ্ধ দেশের বিষয় চিন্তা করিতে পারো, কিন্তু উহা চিন্তা

করিতে গেলেই উহার সঙ্গে সঙ্গে তোমাকে অনন্ত দেশের চিন্তা করিতে হইবে। চক্ষু মুদ্রিত করিয়া যদি একটি ক্ষুদ্র দেশের বিষয় চিন্তা কর, তাহা হইলে দেখিতে পাইবে, যে মুহুর্তে ঐ দেশরূপ ক্ষুদ্রবৃত্ত দেখিতে পাইতেছ, সেই মুহূর্তেই উহার চতুর্দিকে অনন্ত-বিস্তৃত আর একটি বৃত্ত রহিয়াছে। কাল সম্বন্ধেও ঐ কথা। মনে কর, তুমি এক সেকেন্ড সময়ের বিষয় ভাবিতেছ, সঙ্গে সঙ্গে তোমাকে অনন্তকালের কথা চিন্তা করিতে হইবে। জ্ঞান সম্বন্ধেও ঐরূপ, মানুষে কেবল জ্ঞানের বীজ-ভাব আছে। কিন্তু ঐ ক্ষুদ্র জ্ঞানের চিন্তা করিতে হইলেই সঙ্গে সঙ্গে অনন্ত জ্ঞানের বিষয় চিন্তা করিতে হইবে। সুতরাং আমাদের নিজ মনের গঠন হইতেই বেশ প্রতিপন্ন হয় যে, এক অনন্ত জ্ঞান রহিয়াছে। যোগীরা সেই অনন্ত জ্ঞানকেই ঈশ্বর বলেন।

স পূর্বেষামপি গুরুঃ কালেনানবচ্ছেদাৎ ।।২৬।।

-তিনি পূর্ব পূর্ব (প্রাচীন) গুরুদিগেরও গুরু, কারণ তিনি কাল দ্বারা সীমাবদ্ধ নন।

আমাদের ভিতরেই সমুদয় জ্ঞান রহিয়াছে বটে, কিন্তু অপর এক জ্ঞানের দ্বারা উহাকে জাগরিত করিতে হইবে। জানিবার শক্তি আমাদের ভিতরেই আছে বটে, কিন্তু উহাকে জাগাইতে হইবে। আর যোগীরা বলেন, ঐরূপে জ্ঞানের উন্মেষ কেবল অপর একটি জ্ঞানের সাহায্যেই সম্ভব। প্রাণহীন অচেতন জড়ের প্রভাবে কখন জ্ঞানের স্ফুরণ হইতে পারে না- কেবল জ্ঞানের শক্তিতেই জ্ঞানের বিকাশ হইয়া থাকে। আমাদের ভিতরে যে জ্ঞান আছে, তাহার উন্মেষের জন্য জ্ঞানী ব্যক্তিগণের আমাদের নিকট থাকা প্রয়োজন, সুতরাং এই গুরুগণের প্রয়োজন সর্বদাই ছিল। পৃথিবী কখনও এই প্রকার আচার্য-বিরহিত হয় নাই। তাঁহাদের সহায়তা ব্যতীত কোন জ্ঞানই সম্ভব নয়। ঈশ্বর সকল গুরুর গুরু, কারণ এই-সকল গুরু যতই উন্নত হউন না কেন, তাঁহারা দেবতাই হউন, অথবা দেবদূতই হউন সকলেই বদ্ধ ও কাল দ্বারা সীমাবদ্ধ, কিন্তু ঈশ্বর কাল দ্বারা বদ্ধ নন।

যোগীদিগের এই বিশেষ সিদ্ধান্ত দুইটিঃ প্রথমটি এই যে, সান্ত বস্তুর চিন্তা করিতে গেলেই মন বাধ্য হইয়াই অনন্তের চিন্তা করিবে। আর যদি ঐ মানসিক অনুভূতির এক অংশ সত্য হয়, তবে উহার অপর অংশও সত্য হইবে। কারণ-দুইটিই যখন সেই একই মনের অনুভূতি, তখন দুইটি অনুভূতির মূল্যই সমান। মানুষের অল্প জ্ঞান আছে অর্থাৎ মানুষ অল্পজ্ঞ। তাহা হইলে বুঝা যাইতেছে যে, ঈশ্বরের অনন্ত জ্ঞান আছে-যদি এই দুইটি অনুভূতির একটিকে গ্রহণ করি, তবে অপরটিকেও গ্রহন করিব না কেন? যুক্তি বলে-উভয়কে গ্রহণ কর, নতুবা উভয়কে পরিত্যাগ কর। যদি বিশ্বাস করি যে, মানব অল্পজ্ঞানসম্পন্ন, তবে অবশ্যই স্বীকার করিতে হইবে যে, তাহার পশ্চাতে একজন অসীমজ্ঞানসম্পন্ন পুরুষ আছেন। দ্বিতীয় সিদ্ধান্ত এই যে, গুরু ব্যতীত কোন জ্ঞানই হইতে পারে না। বর্তমান কালের দার্শনিকগণ যে বলিয়া

থাকেন, মানুষের জ্ঞান তাহার নিজের ভিতর হইতেই বিকাশিত হয়-এ-কথা সত্য বটে, সমুদয় জ্ঞানই মানুষের ভিতরে রহিয়াছে, কিন্তু ঐ জ্ঞানের উন্মেষের জন্য কতকগুলি অনুকূল পরিবেশ প্রয়োজন। গুরু ব্যতীত আমরা কোন জ্ঞানলাভ করিতে পারি না। এখন কথা হইতেছে, যদি মনুষ্য দেবতা বা স্বর্গীয় দূতবিশেষ আমাদের গুরু হন, তাহা হইলে তাঁহারা সকলেই তো সসীম; তাঁহাদের পূর্বে কে গুরু ছিলেন? বাধ্য হইয়া আমাদিগকে এই চরম সিদ্ধান্ত স্থির করিতেই হইবে যে, এমন একজন গুরু আছেন, যিনি কালের দ্বারা সীমাবদ্ধ বা অবিচ্ছিন্ন নন। সেই এক অনন্তজ্ঞানসম্পন্ন গুরু, যাঁহার আদিও নাই, অন্তও নাই, তাঁহাকেই ‘ঈশ্বর’ বলে।

তস্য বাচকঃ প্রণবঃ ।।২৭।।

-প্রণব অর্থাৎ ওঙ্কার তাঁহার প্রকাশক শব্দ।

তোমার মনে যে-কোন ভাব আছে, তাহারই একটি প্রতিরূপ শব্দও আছে; এই শব্দ ও ভাবেকে পৃথক্ করা যায় না। একই বস্তুর বাহ্যভাগটিকে ‘শব্দ’ ও অন্তর্ভাগটিকে চিন্তা বা ‘ভাব’ আখ্যা দেওয়া হইয়া থাকে। বিশ্লেষণবলে কেহই চিন্তাকে শব্দ হইতে পৃথক্ করিতে পারে না। কতকগুলি লোক একত্র বসিয়া কোন্ ভাবের জন্য কি শব্দ প্রয়োগ করিতে হইবে, এইরূপ স্থির করিতে করিতে ভাষা উৎপন্ন করিয়াছে-এইরূপ অনেকের মত; কিন্তু ইহা যে ভ্রমাত্মক, তাহা প্রমাণিত হইয়াছে। যতদিন মানুষ সৃষ্টি হইয়াছে, ততদিন শব্দ ও ভাষা দুইই রহিয়াছে। ভাব ও শব্দের মধ্যে সম্বন্ধ কি? যদিও আমরা দেখিতে পাই যে, একটি ভাবের সহিত একটি শব্দ থাকা চাই-ই চাই, কিন্তু এক ভাব যে একটি মাত্র শব্দের দ্বারা প্রকাশিত হইবে, তাহা নয়। কুড়িটি ভিন্ন দেশে ভাব একরূপ হইতে পারে, কিন্তু ভাষা সম্পূর্ণ পৃথক্ পৃথক্। প্রত্যেক ভাব প্রকাশ করিতে গেলে অবশ্য একটি না একটি শব্দের প্রয়োজন হইবে, কিন্তু এই একভাব-প্রকাশক শব্দগুলিকে যে এক প্রকার ধ্বনিবিশিষ্ট হইতেই হইবে, তাহার কোন প্রয়োজন নাই। ভিন্ন ভিন্ন জাতির ভাষায় শব্দের ধ্বনি ভিন্ন ভিন্ন হইবে। সেইজন্য আমাদের টীকাকার বলিয়াছেন, ‘যদিও ভাব ও শব্দের পরস্পর সম্বন্ধ স্বাভাবিক, কিন্তু এক শব্দ ও এক ভাবের মধ্যে যে একেবারে এক অনতিক্রমণীয় সম্বন্ধ থাকিবে, তাহা বুঝাইতেছে না। এই সমস্ত শব্দ ভিন্ন ভিন্ন হয় বটে, তথাপি শব্দ ও ভাবের পরস্পর সম্বন্ধ স্বাভাবিক। যদি বাচ্য ও বাচকের মধ্যে প্রকৃত সম্বন্ধ থাকে, তবেই ভাব ও শব্দের মধ্যে পরস্পর সম্বন্ধ আছে বলা যায়, তাহা না হইলে সেই বাচক শব্দ কখনই সাধারণভাবে ব্যবহূত হইতে পারে না। বাচক বাচ্য-পদার্থের প্রকাশক। যদি সে বাচ্য বস্তুর অস্তিত্ব পূর্ব হইতে থাকে, আর আমরা যদি পুনঃপুনঃ পরীক্ষা দ্বারা দেখিতে পাই যে, ঐ বাচক শব্দটি ঐ বস্তুকে অনেকবার

বুঝাইয়াছে, তাহা হইলে আমরা বুঝিতে পারি যে, ঐ বাচ্য-বাচকের মধ্যে যথার্থ একটি সম্বন্ধ আছে। যদি ঐ পদার্থগুলি উপস্থিত নাও থাকে, সহস্র সহস্র ব্যক্তি উহাদের বাচকের দ্বারাই সেগুলি সম্বন্ধে জ্ঞানলাভ করিবে। বাচ্য ও বাচকের মধ্যে স্বাভাবিক সম্বন্ধ থাকা অবশ্যম্ভাবী; অতএব যখন ঐ বাচক শব্দটি উচ্চারণ করা হইবে, তখনই উহা ঐ বাচ্য-পদার্থটির কথা মনে জাগাইয়া দিবে। সূত্রকার বলিতেছেন, ‘ওঙ্কার ঈশ্বরের বাচক’। কেন তিনি এই শব্দটির উপর জোর দিলেন? ‘ঈশ্বর’ ভাবটি বুঝাইবার জন্য তো শত শত শব্দ রহিয়াছে। একটি ভাবের সহিত সহস্র সহস্র শব্দের সম্বন্ধ থাকে। ঈশ্বর-ভাবটি শত শত শব্দের সহিত সম্বন্ধ রহিয়াছে, উহার প্রত্যকটিই তো ঈশ্বরের বাচক। বেশ কথা, কিন্তু তাহা হইলেও ঐ শব্দগুলির মধ্যে একটি সাধারণ শব্দ বাহির করা চাই। ঐ বাচকগুলির একটি সাধারণ অধিষ্ঠান-সাধারণ শব্দ-ভূমি বাহির করিতে হইবে, আর যে বাচক শব্দটি সধারণ বাচক হইবে, সেই শব্দটিই সর্বশেষ্ঠ বলিয়া পরিগণিত হইবে, আর সেইটিই সকলের প্রতিনিধিরূপে উহার যথার্থ বাচক হইবে। কোন শব্দ উচ্চারণ করিতে হইলে আমরা কন্ঠনালী ও তালুকে শব্দোচ্চারণের আধাররূপে ব্যাবহার করিয়া থাকি। এমন কি কোন শব্দ আছে, অপর সমুদয় শব্দ যাহার প্রকাশ, যাহা সর্বাপেক্ষা স্বাভাবিক শব্দ?-‘ওঁ’ (অউম্) এই প্রকার শব্দ; উহাই সমুদয় শব্দের ভিত্তি-স্বরূপ। উহার প্রথম অক্ষর ‘অ’ সমুদয় শব্দের মূল-উহাই সমুদয় শব্দের কুঞ্চিকাস্বরূপ, উহা জিহ্বা অথবা তালুর কোন অংশ স্পর্শ না করিয়াই উচ্চারিত হয়। ‘ম’-বর্গীয় শব্দের শেষ শব্দ, উহার উচ্চারণ করিতে হইলে ওষ্ঠদ্বয় বন্ধ করিতে হয়। আর ‘উ’ এই শব্দ জিহ্বামূল হইতে মুখ-মধ্যবর্তী শব্দাধারের শেষ সীমা পর্যন্ত যেন গড়াইয়া যাইতেছে। এইরূপে ‘ওঁ’ শব্দটি দ্বারা সমুদয় শব্দোচ্চারণ-ব্যাপারটি প্রকাশিত হইতেছে। এই কারণে উহাই স্বাভাবিক বাচক শব্দ-উহাই ভিন্ন ভিন্ন শব্দের জননী-স্বরূপ। যত প্রকার শব্দ উচ্চারিত হইতে পারে-আমাদের ক্ষমতায় যত প্রকার শব্দ-উচ্চারণের সম্ভাবনা আছে, উহা সেই সকলেরই সূচক।

এই-সকল আনুমানিক গবেষণা ছাড়িয়া দিলেও দেখা যায়, ভারতরর্ষে যত প্রকার বিভিন্ন ধর্মভাব আছে, সব এই ওঙ্কারকেই কেন্দ্র করিয়া, বেদের বিভিন্ন ধর্মভাবসমূহও এই ওঙ্কারকে আশ্রয় করিয়া রহিয়াছে। এখন কথা হইতেছে, ইহার সহিত আমেরিকা, ইংলন্ড ও অন্যান্য দেশের কি সম্বন্ধ? ইহার সহজ উত্তর এই-সর্বদেশে এই ওঙ্কারের ব্যবহার চলিতে পারে; তাহার কারণ এই যে, ভারতরর্ষে যত বিভিন্ন ধর্মভাবের বিকাশ হইয়াছে, ‘ওঙ্কার’ তাহার প্রত্যেক সোপানেই পরিরক্ষিত হইয়াছে ও উহা ঈশ্বর-সম্বন্ধীয় ভিন্ন ভিন্ন ভাব বুঝাইবার জন্য ব্যবহৃত হইয়াছে। অদ্বৈতবাদী, দ্বৈতবাদী, দ্বৈতাদ্বৈতবাদী, ভেদাভেদবাদী, এমন কি নাস্তিকগণ পর্যন্ত তাঁহাদের উচ্চতম আদর্শপ্রকাশের জন্য এই ‘ওঙ্কার’ অবলম্বন করিয়াছিলেন। যখন এই ‘ওঙ্কার’ মানব জাতির অধিকাংশের ধর্মভাব-প্রকাশের জন্য ব্যবহৃত হইয়াছে, তখন সকল দেশের সকল জাতিই

উহা অবলম্বন করিতে পারেন। ইংরেজী ‘গড্’ (God) শব্দ ধর, উহাতে যে ভাব প্রকাশ করে, তাহা নিতান্তই সীমাবদ্ধ। যদি উহার অতিরিক্ত কোন ভাব ঐ শব্দ দ্বারা বুঝাইতে ইচ্ছা কর, তবে তোমাকে বিশেষণ যোগ করিতে হইবে-যেমন সগুণ (Personal),নির্গুণ (Impersonal), পূর্ণ বা পরম (Absolute) ইত্যাদি। অন্য সব ভাষায় ঈশ্বর-বাচক যে-সকল শব্দ আছে, সে সম্বন্ধেও এই কথা খাটে; ঐগুলির অতি অল্প-ভাব প্রকাশ শক্তি আছে। কিন্তু ‘ওঁ’-শব্দে উক্ত সর্বপ্রকার ভাবই রহিয়াছে। অতএব উহা প্রত্যেকের গ্রহণ করা উচিত।

তজ্জপস্তদর্থভাবনম্ ।।২৮।।

-এই ওঙ্কারের পুনঃপুনঃ উচ্চারণ ও উহার অর্থ ধ্যান (সমাধিলাভের উপায়)।

পুনঃপুনঃ উচ্চারণের আবশ্যকতা কি? অবশ্য আমাদের সংস্কারবিষয়ক মতবাদের কথা স্মরণ আছে; সংস্কার-সমষ্টিই আমাদের মনের মধ্যে বাস করে; ক্রমশ সূক্ষ্মানুসূক্ষ্ম হইয়া তাহারা অব্যক্তভাব ধারণ করে বটে, কিন্তু একেবারে লুপ্ত হয় না, মনের মধ্যেই থাকে; উদ্দীপক কারণ উপস্থিত হইলেই ব্যক্তভাব ধারণ করে। আণবিক স্পন্দন কখনই থামিবে না। যখন এই বিশ্বজগৎ লয় পাইবে, তখন বিরাট বিরাট স্পন্দন সব অন্তর্হিত হইবে; সূর্য, চন্দ্র, তারা, পৃথিবী-সবই লয় হইয়া যাইবে; কিন্তু স্পন্দন-পরমাণুগুলির মধ্যে থাকিবে। এই বৃহৎ ব্রহ্মান্ডে যে কার্য হইতেছে, প্রত্যেক পরমাণুতে সেই কার্যই সাধিত হইতেছে। বাহ্যবস্তু সম্বন্ধে যেরুপ কথিত হইল, চিত্ত সম্বন্ধেও সেইরূপ। চিত্তের স্পন্দন যখন স্তিমিত হইবে, তখনও পরমাণু-স্পন্দন চলিতে থাকিবে, উত্তেজক কারণ পাইলেই ঐগুলি পুনঃপ্রকাশিত হইয়া পড়িবে। জপ বা পুনঃপুনঃ উচ্চারণের অর্থ এখন বুঝা যাইবে। আমাদের ভিতর যে-সকল আধ্যাত্মিক সংস্কার আছে, জপ সেগুলিকে উদ্দীপিত করিবার প্রধান সহায়। ক্ষণমাত্র সাধুসঙ্গ ভবসমুদ্রপারের একমাত্র নৌকাস্বরূপ হয়। সঙ্গের এতদূর শক্তি! বাহ্য সৎসঙ্গের যেমন শক্তি, আন্তর সৎসঙ্গেরও তেমনি শক্তি। এই ওঙ্কারের পুনঃপুনঃ উচ্চারণ ও অর্থ স্মরণ করাই নিজ অন্তরে সাধুসঙ্গ করা। পুনঃপুনঃ উচ্চরণ কর এবং সেই সঙ্গে উচ্চারিত শব্দের অর্থ ধ্যান কর, তাহা হইলে হৃদয়ে জ্ঞানালোক আসিবে এবং আত্মা প্রকাশিত হইবেন।

কিন্তু যেমন ‘ওঁ’-এই শব্দের চিন্তা করিতে হইবে, সেই সঙ্গে উহার অর্থও চিন্তা করিতে হইবে। অসৎসঙ্গ ত্যাগ কর, কারণ পুরাতন ক্ষতের চিহ্ন এখনও তোমার অঙ্গে রহিয়াছে; এই অসৎসঙ্গের প্রভাবেই আবার সেই ক্ষত পূর্ব-বিক্রমে দেখা দেয়। একই ভাবে আমাদের ভিতরে যে-সকল শুভ সংস্কার আছে, সেগুলি এখন অব্যক্ত থাকিলেও সৎসঙ্গের দ্বারা জাগরিত হইবে-ব্যক্তভাব ধারণ করিবে। সৎসঙ্গ অপেক্ষা জগতে


১ ক্ষণমিহ সজ্জনসঙ্গতিরেকা। ভবতি ভবার্ণব-তরণে নৌকা।।-মোহমুঙ্গর, শঙ্করাচার্য

পবিত্রতর কিছু নাই, কারণ সৎসঙ্গ হইতেই শুভ সংস্কারগুলি ব্যক্ত হইবার সুযোগ পায় -চিত্তহ্রদের তলদেশ হইতে উপরিভাগে আসিবার উপক্রম করে।

ততঃ প্রত্যকচেতনাধিগমোহপ্যন্তরায়াভাবশ্চ ।।২৯।।

-উহা হইতে অন্তর্দৃষ্টি লাভ হয় ও যোগবিঘ্নসমূহ নাশ হয়।

এই ওঙ্কার জপ ও চিন্তার প্রথম ফল অনুভব করিবে-অন্তর্দষ্টি ক্রমশঃ বিকশিত হইতেছে এবং মানসিক ও শারীরিক যোগবিঘ্নসমূহ দূরীভূত হইতেছে। এখন প্রশ্ন -এই যোগবিঘ্নগুলি কি কি?

ব্যাধিস্ত্যানসংশয়প্রমাদালস্যাবিরতিভ্রান্তিদর্শনালব্ধ-

ভূমিকাত্বানবস্থিতত্বানি চিত্তবিক্ষেপাস্তেহন্তরায়াঃ ।।৩০।।

-রোগ, মানসিক জড়তা, সন্দেহ, উদ্যমরাহিত্য, আলস্য, বিষয়তৃষ্ণা, মিথ্যা অনুভব, একাগ্রতা লাভ না করা, ঐ অবস্থা লাভ হইলেও তাহা হইতে পতিত হওয়া-এইগুলিই চিত্তবিক্ষেপকর অন্তরায়।

ব্যাধিঃ জীবন-সমুদ্রের অপর পারে লইয়া যাইবার জন্য এই শরীরই আমাদের একমাত্র নৌকা। বিশেষভাবে ইহার যত্ন করিতে হইবে। অসুস্থ ব্যক্তি যোগী হইতে পারে না। স্ত্যানঃ মানসিক জড়তা আসিলে আমাদের যোগবিষয়ক প্রবল অনুরাগ নষ্ট হইয়া যায়; উহার অভাবে সাধন করিবার জন্য যে দৃঢ় সংকল্প ও শক্তি প্রয়োজন, তাহার কিছুই থাকে না। সংশয়ঃ আমাদের এই যোগবিজ্ঞান-বিষয়ে বিচারজনিত বিশ্বাস যতই থাকুক না কেন, যতদিন দূরদর্শন-দূরশ্রবণাদি অলৌকিক অনুভূতি না আসিবে, ততদিন এই বিদ্যার সত্যতা বিষয়ে অনেক সন্দেহ আসিবে। এইগুলির একটু একটু আভাস পাইলে মন খুব দৃঢ় হইতে থাকে, ইহাতে সাধক আরও অধ্যবসায়শীল হয়। অনবস্থিতত্বঃ কয়েক দিন বা কয়েক সপ্তাহ ধরিয়া সাধন করিবার সময় দেখিবে-মন বেশ সহজে একাগ্র ও স্থির হইতেছে; বোধ হইতেছে তুমি সাধনপথে দ্রুত উন্নতি করিতেছ। একদিন দেখিবে হঠাৎ তোমার এই উন্নতি বদ্ধ হইয়া গেল। জাহাজ চড়ায় ঠেকিলে যেরূপ অসহায় হইয়া যায়, তোমার সেইরূপ হইয়াছে। এরূপ হইলেও অধ্যবসায়শূন্য হইও না। এইরূপে বারবার উত্থান-পতন পথেই অগ্রগতি হইয়া থাকে।

দুঃখদৌর্মনস্যাঙ্গমেজয়ত্বশ্বাসপ্রশ্বাসবিক্ষেপসহভুব ।।৩১।।

-দুঃখ, মন খারাপ হওয়া, শরীর নড়া, অনিয়মিত শ্বাসপ্রশ্বাস, এইগুলি একাগ্রতার অভাবের সঙ্গে সঙ্গে উৎপন্ন হয়।


১ এই সুত্রের ব্যাখ্যার ‘প্রমাদ’, ‘আলস্য’, ‘অবিরতি’, ‘ভ্রান্তিদর্শন’, ‘অলব্ধভূমিকত্ব’ বিষয়ে কিছু বলা হয় নাই। সুত্রার্থে যাহা বলা হইয়াছে, তদনুযায়ী বুঝিতে হইবে।

যখনই একাগ্রতা অভ্যাস করা যায়, তখনই মন ও শরীর সম্পূর্ণ স্থিরভাব ধারণ করে। সাধন যখন ঠিক পথে চালিত না হয়, অথবা যখন চিত্ত যথেষ্ট সংযত না থাকে, তখনই এই বিঘ্নগুলি আসিয়া উপস্থিত হয়। ওঙ্কার জপ ও ঈশ্বরে আত্মসমর্পণ করিলে মন দৃঢ় হয়, এবং দেহে মনে নূতন শক্তি সঞ্চারিত হয়। সাধনপথে প্রায় সকলেরই এইরূপ স্নায়বীয় চাঞ্চল্য উপস্থিত হয়। ওদিকে খেয়াল না করিয়া সাধন করিয়া যাও। সাধনের দ্বারাই ওগুলি চলিয়া যাইবে, তখন আসন স্থির হইবে।

তৎপ্রতিযেধার্থমেকতত্ত্বাভ্যাসঃ ।।৩২।।

-ইহা নিবারণের জন্য ‘এক-তত্ত্ব’ অভ্যাস আবশ্যক।

কিছুক্ষণের জন্য মনকে কোন একটি বিষয়বিশেষের আকারে আকারিত করিবার চেষ্টা করিলে পূর্বোক্ত বিঘ্নগুলি চলিয়া যায়। এই উপদেশটি খুব সাধারণভাবে দেওয়া হইল। পরবর্তী সূত্রগুলিতে এই উপদেশটিই বিস্তারিতভাবে বিবৃত হইবে এবং বিশেষ বিশেষ ধ্যেয় বিষয়ে এই সাধারণ উপদেশের প্রয়োগ উপদিষ্ট হইবে। এক প্রকার অভ্যাস সকলের পক্ষে খাটিতে পারে না, এইজন্য নানাপ্রকার উপায়ের কথা বলা হইয়াছে। প্রত্যেকই নিজে পরীক্ষা করিয়া দেখিয়া লইতে পারেন-কোন্‌টি তাঁহার পক্ষে খাটে।

মৈত্রী-করুণা-মুদিতোপেক্ষাণাং সুখদুঃখপুণ্যা-
পুণ্যবিষয়াণাং ভাবনাতশ্চিত্তপ্রসাদনম্ ।।৩৩।।

-সুখী, দুঃখী, পুণ্যবান্ ও পাপীর প্রতি যথাক্রমে বন্ধুতা, দয়া, আনন্দ ও উপেক্ষার ভাব ধারণ করিতে পারিলে চিত্ত প্রসন্ন হয়।

আমাদের এই চারি প্রকার ভাব থাকাই আবশ্যক। আমাদের সকলের প্রতি বন্ধত্ব রাখা, দীনজনের প্রতি দয়াবান্ হওয়া, লোককে সৎকর্ম করিতে দেখিলে সুখী হওয়া এবং অসৎ ব্যক্তির প্রতি উপেক্ষা প্রদর্শন করা আবশ্যক। এইরূপ বিষয়গুলি যখন আমাদের সন্মুখে আসে, তখন সেইগুলির প্রতিও আমাদের ঐরূপ ভাব ধারণ করা আবশ্যক। যদি বিষয়টি সুখকর হয়, তবে উহার প্রতি ‘মৈত্রী’ অর্থৎ অনুকুল ভাব ধারণ করা আবশ্যক। এইরূপে যদি কোন দুঃখকর ঘটনা আমাদের চিন্তার বিষয় হয়, তবে যেন আমাদের অন্তঃকরণ উহার প্রতি ‘করুণা’ভাবাপন্ন হয়। যদি উহা কোন শুভ বিষয় হয়, তবে আমাদের আনন্দিত হওয়া উচিত। আর অসৎ বিষয় হইলে সেই বিষয়ে উদাসীন থাকাই শ্রেয়ঃ। ভিন্ন ভিন্ন বিষয়ের প্রতি মনের এই-সকল ভাব আসিলে মন শান্ত হইয়া যাইবে। আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অধিকাংশ গোলযোগ ও অশান্তির কারণ মনের ঐ-সকল ভাব ধারণ করিবার অক্ষমতা। মনে কর, একজন আমার প্রতি কোন অন্যায় ব্যবহার করিল, অমনি আমি তাহার প্রতিকার করিতে উদ্যত হইলাম। আর আমরা যে কোন অন্যায় ব্যবহারের প্রতিশোধ না লইয়া থাকিতে পারি না, তাহার কারণ

আমরা চিত্তকে সংযত রাখিতে পারি না। চিত্ত উহার প্রতি তরঙ্গাকারে ধাবমান হয়; আমরা তখন মনের শক্তি হারাইয়া ফেলি। আমাদিগের মনে ঘৃণা অথবা অপরের প্রতি অনিষ্টভাব-পোষণরূপ যে প্রতিক্রিয়া হয়, তাহা শক্তির অপচয়-মাত্র। আর কোন অশুভ চিন্তা বা ঘৃণাপ্রসূত কার্য অথবা কোন প্রকার প্রতিক্রিয়ার চিন্তা যদি দমন করা যায়, তবে তাহা হইতে শুভকারী শক্তি উৎপন্ন হইয়া আমাদের উপকারার্থ সঞ্চিত থাকিবে। সংযমের দ্বারা আমাদের যে কিছু ক্ষতি হয়, তাহা নয়, বরং তাহা হইতে আশাতীত উপকার হইয়া থাকে। যখনই আমরা ঘৃণা অথবা ক্রোধবৃত্তিকে সংযত করি, তখনই উহা আমাদের অনুকূল শুভশক্তিরূপে সঞ্চিত হইয়া উচ্চতর শক্তিতে পরিণত হয়।

প্রচ্ছর্দন-বিধারণাভ্যাং বা প্রাণস্য ।।৩৪।।

-যথাযথ রেচক ও কুম্ভক দ্বারা (চিত্ত স্থির হয়)।

এখানে ‘প্রাণ’ শব্দ ব্যবহৃত হইয়াছে। প্রাণ অবশ্য ঠিক শ্বাস নয়। সমগ্র জগতে যে শক্তি ব্যাপ্ত রহিয়াছে, তাহারই নাম ‘প্রাণ’। জগতে যাহা কিছু দেখিতেছ, যাহা কিছু একস্থান হইতে অপর স্থানে গমনাগমন করে, যাহা কিছু কাজ করিতে পারে, অথবা যাহার জীবন আছে, তাহাই এই প্রাণের বিকাশ। সমুদয় জগতে যত শক্তি প্রকাশিত রহিয়াছে, তাহার সমষ্টিক ‘প্রাণ’ বলে। কল্পারম্ভের প্রাক্কালে এই প্রাণ প্রায় একরূপ গতিহীন অবস্থায় (অব্যক্ত) থাকে, আবার কল্পারম্ভ-কালে প্রাণ ব্যক্ত হইতে আরম্ভ হয়। এই প্রাণই গতিরূপে প্রকাশিত হইতেছে; ইহাই মনুষ্যজাতি অথবা অন্যান্য প্রাণীতে স্নায়বীয় গতিরূপে প্রকাশিত, ঐ প্রাণই আবার চিন্তা ও অন্যান্য শক্তিরূপে প্রকাশিত হয়। সমগ্র জগৎ এই প্রাণ ও আকাশের সমষ্টি। মনুষ্যদেহেও ঐরূপ; যাহা কিছু দেখিতেছ বা অনুভব করিতেছ, সকল পদার্থ আকাশ হইতে উৎপন্ন, আর বিভিন্ন শক্তি প্রাণ হইতেই উৎপন্ন হইয়াছে। এই প্রাণকে বাহিরে ত্যাগ করা ও ধারণ করার নামই ‘প্রাণায়াম’। যোগশাস্ত্রের পিতাস্বরূপ পতঞ্জলি এই প্রাণায়াম সম্বন্ধে কিছু বিশেষ বিধান দেন নাই, কিন্তু তাঁহার পরবর্তী অন্যান্য যোগীরা এই প্রাণায়াম সম্বন্ধে অনেক তত্ত্ব আবিষ্কার করিয়া উহাকেই একটি মহতী বিদ্যা করিয়া তুলিয়াছেন। পতঞ্জলির মতে ইহা চিত্তবৃত্তিনিরোধের বহু উপায়ের মধ্যে একটি উপায় মাত্র, কিন্তু তিনি ইহার উপর বিশেষ ঝোঁক দেন নাই। তাঁহার ভাব এই যে, শ্বাস খানিকক্ষণ বাহিরে ফেলিয়া আবার ভিতরে টানিয়া লইবে এবং কিছুক্ষণ উহা ধারণ করিয়া রাখিবে, তাহাতে মন অপেক্ষাকৃত একটু স্থির হইবে। কিন্তু পরবর্তী কালে ইহা হইতেই ‘প্রাণায়াম’ নামক বিশেষ বিদ্যার উৎপত্তি হইয়াছে। এই পরবর্তী যোগিগণ কি বলেন, সে-সম্বন্ধে আমাদের কিছু জানা আবশ্যক।

এ-বিষয়ে পূর্বেই কিছু বলা হইয়াছে, এখানে আরও কিছু বলিলে তোমাদের মনে রাখিবার সুবিধা হইবে। প্রথমতঃ মনে রাখিতে হইবে, এই ‘প্রাণ’ বলিতে ঠিক শ্বাস-

প্রশ্বাস বুঝায় না; যে শক্তিবলে শ্বাসপ্রশ্বাসের গতি হয়, যে শক্তিটি বাস্তবিক শ্বাসপ্রশ্বাসেরও প্রাণস্বরূপ, তাহাকে ‘প্রাণ’ বলে। আবার সমুদয় ইন্দ্রিয় বুঝাইতেও এই ‘প্রাণ’ শব্দ ব্যবহৃত হইয়া থাকে। এই সমুদয়কেই ‘প্রাণ’ বলে। মনকেও আবার ‘প্রাণ’ বলে। অতএব দেখা গেল যে, ‘প্রাণ’=শক্তি। তথাপি আমরা ইহাকে শক্তি-নামে অভিহিত করিতে পারি না, কারণ শক্তি ঐ প্রাণের বিকাশস্বরূপ। শক্তি ও নানাবিধ গতিরূপে ইহাই প্রকাশিত হইতেছে। মনের উপাদান চিত্ত যন্ত্রবৎ চতুর্দিক হইতে প্রাণকে আকর্ষণ করে এবং এই প্রাণ হইতেই শরীর-রক্ষার হেতুভূত ভিন্ন ভিন্ন জীবনীশক্তি এবং চিন্তা, ইচ্ছা ও অন্যান্য সমুদয় শক্তি উৎপন্ন করিতেছে। এই প্রাণায়াম-ক্রিয়াদ্বারা আমরা শরীরের ভিন্ন ভিন্ন গতি ও শরীরের অন্তর্গত ভিন্ন ভিন্ন স্নায়বীয় শক্তিপ্রবাহগুলিকে বশে আনিতে পারি। আমরা প্রথমতঃ ঐগুলিকে চিনিতে আরম্ভ করি, পরে অল্পে অল্পে উহাদের উপর ক্ষমতা লাভ করি, এবং ঐগুলিকে বশীভূত করিতে সমর্থ হই।

পতঞ্জলির পরবর্তী যোগীদিগের মতে শরীরের মধ্যে তিনটি প্রধান প্রাণপ্রবাহ আছে। একটিকে তাঁহারা ‘ইড়া’ অপরটিকে ‘পিঙ্গলা’ ও তৃতীয়টিকে ‘সুষুম্না’ বলেন। তাঁহাদের মতে-পিঙ্গলা মেরুদন্ডের দক্ষিণদিকে, ইড়া বামদিকে, আর ঐ মেরুদন্ডের মধ্যদেশে শূন্য নালী সুষুম্না আছে। তাঁহাদের মতে-ইড়া ও পিঙ্গলা নামক শক্তিপ্রবাহদ্বয় প্রত্যেক মানুষের মধ্যে প্রবাহিত হইতেছে, উহাদের সাহায্যেই আমরা শরীরের ক্রিয়াদি সম্পন্ন করিতেছি। সুষুম্না সকলের মধ্যেই আছে বটে, তবে কেবল যোগীর শরীরেই উহার কাজ হয়। তোমাদের স্মরণ রাখা উচিত যে, যোগী যোগসাধনবলে নিজের দেহ পরিবর্তিত করেন। যতই সাধন করিবে, ততই তোমার দেহ পরিবর্তিত হইয়া যাইবে; সাধনের পূর্বে তোমার যেরূপ শরীর ছিল, পরে আর সেরূপ থাকিবে না। ব্যাপারটি অযৌক্তিক নয়; ইহা যুক্তি দ্বারা ব্যাখ্যা করা যাইতে পারে। আমরা যাহা কিছু নূতন চিন্তা করি, তাহাই যেন আমাদের মস্তিষ্কের মধ্য দিয়া একটি নূতন প্রণালী নির্মাণ করিয়া দেয়। ইহা হইতে বুঝা যায়, মনুষ্যস্বভাব এত স্থিতিশীলতার পক্ষপাতী কেন; মানুষের স্বভাবই এই যে, উহা পূর্বাবর্তিত পথে ভ্রমণ করিতে ভালবাসে, কারণ উহা অপেক্ষাকৃত সহজ। দৃষ্টান্তস্বরূপ যদি মনে করা যায়-মন একটি সূচি আর মস্তিষ্ক উহার সন্মুখে একটি কোমল পিন্ডমাত্র, তাহা হইলে দেখা যাইবে যে, আমাদের প্রত্যেক চিন্তাই মস্তিষ্কমধ্যে যেন একটি পথ প্রস্তুত করিয়া দিতেছে, আর মস্তিষ্কমধ্যস্থ ধূসর পদার্থ ঐ পথটিকে পৃথক্ রাখিবার জন্য উহার একটি সীমানা প্রস্তুত করিয়া দেয়। যদি ঐ ধূসরবর্ণ পদার্থটি না থাকিত, তাহা হইলে আমাদের কোন স্মৃতি সম্ভব হইত না, কারণ স্মৃতির অর্থ-পুরাতন পথে ভ্রমণ, একটি চিন্তার উপর দাগা বুলানো। হয়তো তোমরা লক্ষ্য করিয়া থাকিবে, যখন আমি সকলের পরিচিত কতকগুলি বিষয় গ্রহণ করিয়া ঐগুলিরই ঘোরফের করিয়া কিছু বলিতে প্রবৃত্ত হই, তখন তোমরা সহজেই আমার কথা বুঝিতে পারো; ইহার কারণ

আর কিছুই নয়-এই চিন্তার পথ বা প্রণালীগুলি প্রত্যেকেরই মস্তিষ্কে বিদ্যমান আছে, কেবল ঐগুলিতে ফিরিয়া আসিতে হয়, এইমাত্র। কিন্তু যখনই কোন নূতন বিষয় আমাদের সন্মুখে আসে, তখনই মস্তিষ্কের মধ্যে নূতন প্রণালী নিমাণ করিতে হয়; এইজন্য তত সহজে উহা বুঝা যায় না। এইজন্য মস্তিষ্ক-মানুষেরা নয়, মস্তিষ্কই -অজ্ঞাতসারে এই নূতন ধরনের ভাব দ্বারা পরিচালিত হইতে অস্বীকার করে, উহা যেন উহার গতিরোধ করে। প্রাণ নূতন নূতন প্রণালী করিতে চেষ্টা করিতেছে, মস্তিষ্ক তাহা করিতে দিতেছে না। মানুষ যে স্থিতিশীলতার এত পক্ষপাতী ইহাই তাহার গূঢ় রহস্য। মস্তিষ্কের মধ্যে এই প্রণালীগুলি যত অল্প পরিমাণে থাকে, আর প্রাণরূপ সূচি উহার ভিতর যত অল্পসংখ্যক পথ প্রস্তুত করে, মস্তিষ্ক ততই রক্ষণশীল হইবে, ততই উহা নূতন প্রকার চিন্তা ও ভাবের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করিবে। মানুষ যতই চিন্তাশীল হয়, মস্তিষ্কের ভিতরের পথগুলি ততই অধিক ও জটিল হইবে, ততই সহজে সে নূতন নূতন ভাব গ্রহণ করিবে ও বুঝিতে পারিবে। প্রত্যেক নূতন ভাব সম্বন্ধে এইরূপ জানিবে। মস্তিষ্কে একটি নূতন ভাব আসিলেই মস্তিষ্কের ভিতর নূতন প্রণালী নির্মিত হয়। এইজন্য যোগ-অভ্যাসের সময় আমরা প্রথমে এত শারীরিক বাধা প্রাপ্ত হই, কারণ যোগ নূতন চিন্তা ও ভাবের সমষ্টি। এইজন্যই আমরা দেখিতে পাই, ধর্মের যে অংশ প্রকৃতির জাগতিক ভাব লইয়া বেশী নাড়াচড়া করে, তাহা বহু লোকের গ্রাহ্য হয়, আর উহার অপরাংশ অর্থাৎ দর্শন বা মনোবিজ্ঞান, যাহা কেবল মানুষের অন্তঃপ্রকৃতি লইয়া ব্যাপৃত, তাহা সাধারণতঃ অবহেলিত হয়।

আমাদের এই জগতের সংজ্ঞা কি, তাহা আমাদের স্মরণ রাখা আবশ্যক; জগৎ আমাদের সজ্ঞানভূমিতে প্রকাশিত (প্রক্ষেপিত) অনন্ত সত্তামাত্র। অনন্তের কিয়দংশ আমাদের চেতনার স্তরে প্রকাশিত হইয়াছে, উহাকেই আমরা আমাদের ‘জগৎ’ বলিয়া থাকি। তাহা হইলেই দেখা গেল, ইন্দ্রিয়ানুভূতির বাহিরে এক অনন্ত সত্তা রহিয়াছে। এই ক্ষুদ্রপিন্ড, যাহাকে আমরা জগৎ বলি, এবং ইহার অতীত অনন্ত সত্তা-এই দুইটি বিষয়ই ধর্মের অন্তর্গত। যে ধর্ম এই উভয়ের মধ্যে কেবল একটিকে লইয়াই ব্যাপৃত, তাহা অবশ্যই অসম্পূর্ণ। ধর্মকে এই উভয় বিষয় লইয়াই আলোচনা করিতে হইবে। অনন্তের যেটুকু ভাগ আমাদের এই জ্ঞানের ভিতর দিয়া অনুভব করিতেছি, যেটুকু দেশকালনিমিত্তরূপ পিঞ্জরের ভিতর আসিয়া পড়িয়াছে, এইটুকু লইয়া ধর্মের যে অংশ ব্যাপৃত, তাহা সহজে বোধগম্য হয়, কারণ, আমরা তো পূর্ব হইতেই তাহার মধ্যে রহিয়াছি, আর এই জগতের ভাব প্রায় স্মরণাতীত কাল হইতেই আমাদের পরিচিত। কিন্তু ধর্মের যে অংশ অনন্তের বিষয় লইয়া ব্যাপৃত, তাহা আমাদের পক্ষে সম্পূর্ণ নূতন; সেইজন্য উহার চিন্তার মস্তিষ্কের মধ্যে নূতন প্রণালী গঠিত হইতে থাকে, উহাতে সমুদয় শরীরটাই যেন বিপর্যস্ত হয়; সেইজন্য সাধন করিতে গিয়া সাধারণ মানুষ প্রথমটা চিরাভ্যস্ত পথ হইতে বিচ্যুত হইয়া পড়ে। যথাসম্ভব এই বিপর্যয়ের ভাব কমাইবার জন্যই পতঞ্জলি এই-সকল উপায় আবিষ্কার করিয়াছেন; যাহাতে এগুলি

হইতে নির্বাচন করিয়া আমাদিগের সম্পূর্ণ উপযোগী একটি সাধন-প্রণালী আমরা অভ্যাস করিতে পারি।

বিষয়বতী বা প্রবৃত্তিরুৎপন্না মনসঃ স্থিতিনিবন্ধিনী ।।৩৫।।

-যে-সকল সমাধিতে কতকগুলি অলৌকিক ইন্দ্রিয়বিষয়ের অনুভূতি হয়, সেই-সকল সমাধি মনের স্থিতির কারণ হইয়া থাকে।

ধারণ অর্থাৎ একাগ্রতা হইতেই ইহা আপনা-আপনি আসিতে থাকে; যোগীরা বলেন, যদি নাসিকাগ্রে মন একাগ্র করা যায়, তবে কিছু দিনের মধ্যেই অদ্ভুত সুগন্ধ অনুভব করা যায়। এইরূপে জিহ্বামূলে মনকে একাগ্র করিলে, সুন্দর শব্দ শুনিতে পাওয়া যায়। জিহ্বাগ্রে এইরূপ করিলে দিব্য রসাস্বাদ হয়, জিহ্বামধ্যে মনঃসংযম করিলে বোধ হয়, কি এক বস্তু স্পর্শ করিলাম। তালুতে মনঃসংযম করিলে দিব্যরূপসকল দেখিতে পাওয়া যায়। কোন অস্থিরচিত্ত ব্যক্তি যদি এই যোগের কিছু সাধন অবলম্বন করিয়া উহার সত্যতায় সন্দিহান হয়, তখন কিছুদিন সাধনার পর এই-সকল অনুভূতি হইতে থাকিলে তাহার আর সন্দেহ থাকিবে না; তখন সে অধ্যবসায়-সহকারে সাধন করিতে থাকিবে।

বিশোকা বা জ্যোতিষ্মতী ।।৩৬।।

-শোকরহিত জ্যোতিষ্মান্ পদার্থের ধ্যানের দ্বারাও সমাধি হয়।

ইহা আর এক প্রকার সমাধি। এইরূপ ধ্যান কর যে, হৃদয়ের মধ্যে যেন একটি পদ্ম বহিয়াছে, তাহার পাপড়ি অধোমুখে; উহার মধ্য দিয়া সুষুম্না গিয়াছে। তারপর পূরক কর, পরে রেচক করিবার সময় চিন্তা কর যে, পাপড়ির সহিত ঐ পদ্ম ঊর্ধ্বমুখ হইয়াছে, আর ঐ পদ্মের মধ্যে মহাজ্যোতিঃ রহিয়াছে। ঐ জ্যোতির ধ্যান কর।

বীতরাগবিষয়ং বা চিত্তম্ ।।৩৭।।

-অথবা যে হৃদয় সমুদয় ইন্দ্রিয়বিষযে আসক্তি পরিত্যাগ করিয়াছে, তাহার ধ্যানের দ্বারাও চিত্ত স্থির হইয়া থাকে।

কোন সাধুপুরুষের কথা ধর। কোন মহাপুরুষ, যাঁহার প্রতি তোমার খুব শ্রদ্ধা আছে, কোন সাধু, যাঁহাকে তুমি সম্পূর্ণরূপে অনাসক্ত বলিয়া জানো, তাঁহার হৃদয়ের বিষয় চিন্তা কর। যাঁহার অন্তঃকরণ সর্ববিষয়ে অনাসক্ত হইয়াছে, তাঁহার অন্তরের বিষয় চিন্তা করিলে তোমার অন্তঃকরণ শান্ত হইবে। ইহা যদি করিতে সমর্থ না হও, তবে আর এক উপায় আছে।

স্বপ্ননিদ্রাজ্ঞানালম্বনং বা ।।৩৮।।

-অথবা স্বপ্নাবস্থায় কখন কখন যে অপূর্ব জ্ঞানলাভ হয়, তাহার (এবং নিদ্রা বা সুষুপ্তি-অবস্থায় লব্ধ সাত্ত্বিক সুখের) ধ্যান করিলেও চিত্ত প্রশান্ত হয়।

কখন কখন লোকে এইরূপ স্বপ্ন দেখে যে, তাহার নিকট দেবতারা আসিয়া কথাবার্তা কহিতেছেন, সে যেন একরূপ ভাবাবেশে বিভোর হইয়া রহিয়াছে। বায়ুর মধ্য দিয়া অপূর্ব সঙ্গীতধ্বনি ভাসিয়া আসিতেছে, সে তাহা শুনিতেছে। ঐ স্বপ্নাবস্থায় সে একরূপ আনন্দের ভাবে থাকে। জাগরণের পর ঐ স্বপ্ন তাহার অন্তরে দৃঢ়বদ্ধ হইয়া থাকে। ঐ স্বপ্নটিকে সত্য বলিয়া চিন্তা কর, উহার ধ্যান কর। তুমি যদি ইহাতেও সমর্থ না হও, তবে যে-কোন পবিত্র বস্তু তোমার ভাল লাগে, তাহাই ধ্যান কর।

যথাভিমতধ্যানাদ্বা ।।৩৯।।

-অথবা যে-কোন জিনিস তোমার নিকট ভাল বলিয়া বোধ হয়, তাহারই ধ্যান দ্বারা (সমাধি লাভ হয়)।

অবশ্য ইহাতে এমন বুঝাইতেছে না যে, কোন অসৎ বিষয় ধ্যান করিতে হইবে। কিন্তু যে-কোন সৎ বিষয় তুমি ভালবাসো-যে-কোন স্থান তুমি খুব ভালবাসো, যে-কোন দৃশ্য তুমি খুব ভালবাসো, যে-কোন ভাব তুমি খুব ভালবাসো, যাহাতে তোমার চিত্ত একাগ্র হয়, তাহারই চিন্তা কর।

পরমাণু-পরমমহত্ত্বান্তোহস্য বশীকারঃ ।।৪০।।

-এইরূপ ধ্যান করিতে করিতে পরমাণু হইতে পরম বৃহৎ পদার্থে পর্যন্ত তাঁহার মন অব্যাহত গতি লাভ করে।

মন এই অভ্যাসের দ্বারা অতি সূক্ষ্ম হইতে বৃহত্তম বস্তু পর্যন্ত সহজে ধ্যান করিতে পারে। তাহা হইলেই (মানোবৃত্তিরূপ) মনের তরঙ্গগুলিও ক্ষীণতর হইয়া আসে।

ক্ষীণবৃত্তেরভিজাতস্যের মণের্গ্রহীতৃ-গ্রহণগ্রাহ্যেষু
ততস্থ-তদঞ্জনতা-সমাপত্তিঃ ।।৪১।।

-যে যোগীর চিত্তবৃত্তিগুলি এইরূপ ক্ষীণ হইয়া যায় (বশীভূত হয়), তাঁহার চিত্ত তখন, যেমন শুদ্ধ স্ফটিক ভিন্ন ভিন্ন বর্ণযুক্ত বস্তুর সন্মুখে তৎসদৃশ বর্ণ ও আকার ধারণ করে, সেইরূপ গ্রহীতা, গ্রহণ ও গ্রাহ্য বস্তুতে (অর্থাৎ আত্মা, মন ও বাহ্য বস্তুতে) একাগ্রতা ও একীভাব প্রাপ্ত হয়।

এইরূপ ক্রমাগত ধ্যান করিতে করিতে কি লাভ হয়? আমাদের অবশ্যই স্মরণ আছে যে, পূর্ব এক সূত্রে পতঞ্জলি ভিন্ন ভিন্ন প্রকার সমাধির কথা বর্ণনা করিয়াছেন। প্রথম সমাধি স্থূল বিষয় লইয়া, দ্বিতীয়টি সূক্ষ্ম বিষয় লইয়া; পরে ক্রমশঃ আরও সূক্ষ্মানুসূক্ষ্ম বস্তু আমাদের সমাধির বিষয় হয়, তাহাও পূর্বে কথিত হইয়াছে। এই-সকল সমাধির অভ্যাস দ্বারা স্থূলের ন্যায় সূক্ষ্ম বিষয়ও আমরা সহজে ধ্যান করিতে পারি। এই অবস্থায় যোগী তিনটি বস্তু দেখিতে পান-গ্রহীতা, গ্রাহ্য ও গ্রহণ অর্থাৎ

আত্মা, বিষয় ও মন। তিন প্রকার ধ্যানের বিষয় আমাদিগকে দেওয়া হইয়াছে। প্রথমতঃ স্থূল, যথা-শরীর বা জড় পদার্থসমুদয়। দ্বিতীয়তঃ সূক্ষ্ম বস্তুসমুদয়, যথা-মন বা চিত্তাদি। তৃতীয়তঃ গুণবিশিষ্ট পরুষ অর্থাৎ অস্মিতা বা অহঙ্কার। এখানে ‘আত্মা’ বলিতে উহার যথার্থ স্বরূপকে বুঝাইতেছে না। অভ্যাসের দ্বারা যোগী এই-সকল ধ্যানের দৃঢ়প্রতিষ্ঠ হইয়া থাকেন। তখন তাঁহার এতাদৃশী একাগ্রতা-শক্তি লাভ হয় যে, যখনই তিনি ধ্যান করেন, তখনই অন্যান্য বস্তু মন হইতে সরাইয়া দিতে পারেন। তিনি যে-বিষয় ধ্যান করেন, সে-বিষয়ের সহিত এক হইয়া যান (তৎস্থিততা ও তদঞ্জনতা); যখন তিনি ধ্যান করেন, তিনি যেন একখন্ড স্ফটিকতুল্য হইয়া যান; পুষ্পের নিকট স্ফটিক থাকিলে, ঐ স্ফটিক যেন পুষ্পের সহিত প্রায় এক হইয়া যায়; যদি পুষ্পটি লোহিত হয়, তবে স্ফটিকটিও লোহিত দেখায়, যদি পুষ্পটি নীল হয়, তবে স্ফটিকটিও নীল দেখায়।

তত্র শব্দার্থজ্ঞানবিকল্পৈঃ সঙ্কীর্ণা সবিতর্কা সমাপত্তিঃ ।।৪২।।

-শব্দ, অর্থ ও তৎপ্রসূত জ্ঞান যখন মিশ্রিত হইয়া থাকে, তখনই তাহা সবিতর্ক অর্থাৎ বিতর্কযুক্ত সমাধি বলিয়া কথিত হয়।

এখানে ‘শব্দ’ অর্থে কম্পন। ‘অর্থ’ অর্থে যে স্নায়বিক শক্তিপ্রবাহ উহাকে লইয়া ভিতরে চালিত করে, আর ‘জ্ঞান’ অর্থে প্রতিক্রিয়া। আমরা এ পর্যন্ত যত প্রকার ধ্যানের কথা শুনিলাম, পতঞ্জলি এ-সবগুলিকেই সবিতর্ক বলেন। ইহার পর তিনি আমাদিগকে ক্রমশঃ আরও উচ্চ উচ্চ ধ্যানের কথা বলিবেন। এই সবিতর্ক সমাধিতে আমরা বিষয়ী ও বিষয়-এই দ্বৈতভাব রক্ষা করি; শব্দ উহার অর্থ ও তৎপ্রসূত জ্ঞানের মিশ্রণে উহা উৎপন্ন হয়। প্রথম বাহ্যকম্পন-‘শব্দ’; উহা ইন্দ্রিয়-প্রবাহদ্বারা ভিতরে প্রবাহিত হইলে তাহাকে অর্থ বলে। তারপর চিত্তে এক প্রতিক্রিয়া-প্রবাহ আসে, উহাকে ‘জ্ঞান’ বলা যায়। যাহাকে আমরা জ্ঞান (বাহ্যবস্তুর অনুভূতি) বলি, তাহা প্রকৃতপক্ষে এই তিনটির মিশ্রণ বা সমষ্টি (সঙ্কীর্ণ) মাত্র। আমরা এ পর্যন্ত যত প্রকার ধ্যানের কথা পাইয়াছি, তাহার সবগুলিতে এই মিশ্রণই আমাদের ধ্যেয়। ইহার পরে যে সমাধির কথা বলা হইবে, তাহা উচ্চতর।

স্মৃতিপরিশুদ্ধৌ স্বরূপশূন্যেবার্থমাত্রনির্ভাসা নির্বিতর্কা ।।৪৩।।

-যখন স্মৃতি শুদ্ধ হইয়া যায়, অর্থাৎ স্মৃতিতে আর কোন গুণসম্পর্ক থাকে না, যখন উহা ধ্যেয় বস্তুর অর্থ-মাত্র প্রকাশ করে, তাহাই নির্বিতর্ক অর্থাৎ বিতর্কশূন্য সমাধি।

পূর্বে যে শব্দ, অর্থ ও জ্ঞানের কথা বলা হইয়াছে, এই তিনটি একত্র অভ্যাস করিতে করিতে এমন এক সময় আসে, যখন উহারা আর মিশ্রিত হয় না, তখন আমরা অনায়াসে এই ত্রিবিধ ভাবকে অতিক্রম করিতে পারি। এখন প্রথমতঃ এই তিনটি কি, তাহা আমরা

বুঝিতে বিশেষ চেষ্টা করিব। চিত্তের কথা ধরা যাউক-পূর্বের সেই হ্রদের উপমার কথা স্মরণ কর; চিত্তকে হ্রদের সহিত তুলনা করা হইয়াছে, আর শব্দ বা বাক্য অর্থৎ বস্তুর কম্পন যেন উহার উপর একটি তরঙ্গের ন্যায় আসিতেছে। তোমার নিজের মধ্যেই ঐ স্থির হ্রদ রহিয়াছে। মনে কর, আমি ‘গো’ এই শব্দটি উচ্চারণ করিলাম। যখনই উহা তোমার কর্ণে প্রবেশ করিল, সঙ্গে সঙ্গে তোমার চিত্তহ্রদে একটি তরঙ্গ উত্থিত হইল। ঐ তরঙ্গটি ‘গো’শব্দ-সূচিত ভাব; আমরা উহাকেই আকার বা অর্থ বলিয়া থাকি। তুমি যে মনে করিয়া থাকো, আমি একটি ‘গো’কে জানি, উহা কেবল তোমার মনোমধ্যস্থ একটি তরঙ্গমাত্র। উহা বাহ্য ও আভ্যন্তর শব্দপ্রবাহের প্রতিক্রিয়ারূপে উৎপন্ন হইয়া থাকে, ঐ শব্দের সঙ্গে সঙ্গে তরঙ্গটিও লয় পায়। একটি বাক্য বা শব্দ ব্যতীত তরঙ্গ থাকিতে পারে না। অবশ্য তোমার মনে হইতে পারে যে, যখন কেবল ‘গো’-বিষয় চিন্তা কর অথচ বাহির হইতে কোন শব্দ কানে আসে না, তখন শব্দ থাকে কোথায়? তখন ঐ শব্দ তুমি নিজে নিজেই করিতে থাকো। তুমি তখন নিজের মনে-মনেই ‘গো’ এই শব্দটি আস্তে আস্তে বলিতে থাকো, তহা হইতেই তোমার অন্তরে একটি তরঙ্গ উত্থিত হয়। শব্দের উত্তেজনা ব্যতীত কোন তরঙ্গ উঠিতে পারে না; যখন বাহির হইতে ঐ উত্তেজনা আসে না, তখন ভিতর হইতেই উহা আসে। আর যখন শব্দটি থাকে না, তখন তরঙ্গটিও থাকে না। তখন কি অবশিষ্ট থাকে? তখন ঐ প্রতিক্রিয়ার ফলমাত্র অবশিষ্ট থাকে। উহাই জ্ঞান। এই তিনটি আমাদের মনে এত দৃঢ়সম্বন্ধ রহিয়াছে যে, আমরা উহাদিগকে পৃথক্ করিতে পারি না। যখনই শব্দ আসে, তখনই ইন্দ্রিয়গণ কম্পিত হইয়া থাকে, আর প্রবাহসকল প্রতিক্রিয়ারূপে উৎপন্ন হইয়া থাকে, উহারা একটির পর আর একটি এত শীঘ্র আসিয়া থাকে যে, উহাদের মধ্যে একটি হইতে আর একটিকে বাছিয়া লওয়া অতি কঠিন; এখানে যে সমাধির কথা বলা হইল, তাহা দীর্ঘকাল অভ্যাস করিলে সকল সংস্কারের আধারভূমি স্মৃতি শুদ্ধ হইয়া যায়, তখনই আমরা ঐগুলির মধ্যে একটি হইতে অপরটিকে পৃথক্ করিতে পারি, ইহাকেই নির্বিতর্ক অর্থাৎ বিতর্কশূন্য সমাধি বলে।

এতয়ৈব সবিচারা নির্বিচারা চ সূক্ষাবিষয়া ব্যাখ্যাতা ।।৪৪।।

-পূর্বোক্ত সূত্রদ্বয়ে যে সবিতর্ক ও নির্বিতর্ক সমাধিদ্বয়ের কথা বলা হইল, তদ্দ্বারাই সবিচার ও নির্বিচার উভয় প্রকার সমাধি, যাহাদের বিষয় সূক্ষ্মতর, তাহাদেরও ব্যাখ্যা করা হইল।

এখানে পূর্বের ন্যায় বুঝিতে হইবে। কেবল পূর্বোক্ত দুইটি ধ্যানের বিষয় স্থূল, এখানে ধ্যানের বিষয় সূক্ষ্ম।

সূক্ষ্মবিষয়ত্বঞ্চালিঙ্গ-পর্যবসানম্ ।।৪৫।।

-সূক্ষ্মবিষয় অলিঙ্গে অর্থাৎ অব্যক্ত বা প্রধানে (প্রকৃতিতে) পর্যবসিত হয়।

ভূতগুলি ও তাহা হইতে উৎপন্ন সমুদয় বস্তুকে স্থূল বলে। সূক্ষ্মবস্তু তন্মাত্র হইতে আরম্ভ হয়। ইন্দ্রিয়, মন (অর্থাৎ সাধারণ ইন্দ্রিয়, ইন্দ্রিয়, ইন্দ্রিয়ের সমষ্টিস্বরূপ), অহঙ্কার, মহত্তত্ত্ব (যাহা সমুদয় ব্যক্ত জগতের কারণ), সত্ত্ব, রজঃ তমোগুণের সাম্যাবস্থারূপ প্রধান (প্রকৃতি অথবা অব্যক্ত), এ-সবই সূক্ষ্ম বস্তুর অন্তর্গত। পুরুষ অর্থাৎ আত্মাই কেবল ইহার ভিতর পড়েন না।

তা এব সবীজঃ সমাধিঃ ।।৪৬।।

-পূর্বোক্ত সমাধিগুলি সবই সবীজ সমাধি।

এই সমাধিগুলিতে পূর্বকর্মের বীজ নাশ হয় না। সুতরাং ঐগুলি দ্বারা মুক্তিলাভ হয় না। তবে এগুলি দ্বারা কি হয়? তাহা পরবর্তী সূত্রগুলিতে ব্যক্ত হইয়াছে।

নির্বিচার-বৈশারদ্যেহধ্যাত্মপ্রসাদঃ ।।৪৭।।

-নির্বিচার সমাধিতে সত্ত্বগুণপ্রভাবে বুদ্ধি স্বচ্ছ হইলে চিত্ত সম্পূর্ণরূপে স্থির হয়-(ইহাই বৈশারদি প্রজ্ঞা)।

ঋতম্ভরা তত্র প্রজ্ঞা ।।৪৮।।

-উহাতে যে জ্ঞানলাভ হয়, তাহাকে ঋতম্ভর অর্থাৎ সত্যপূর্ণ জ্ঞান বলে।

পরসূত্রে ইহা ব্যাখ্যাত হইবে।

শ্রুতানুমানপ্রজ্ঞাভ্যামন্যবিষয়া বিশেষার্থত্বাৎ ।।৪৯।।

-যে জ্ঞান বিশ্বস্ত জনের বাক্য (আপ্ত বাক্য) ও অনুমান হইতে লব্ধ হয়, তাহা সাধারণ বস্তুবিষয়ক। পূর্বকথিত সমাধি হইতে যে জ্ঞান লাভ হয়, তাহা উহা অপেক্ষা উচ্চতর। ইহা যেখানে পৌঁছায়, বিশ্বস্ত জনের বাক্য বা অনুমান সেখানে পৌঁছাইতে পারে না।

ইহার তাৎপর্য এই যে, সাধারণ-বস্তুবিষয়ক জ্ঞান আমরা প্রত্যক্ষানুভব, তদুপস্থাপিত অনুমান ও বিশ্বস্ত লোকের বাক্য হইতে প্রাপ্ত হই। ‘বিশ্বস্ত লোক’ অর্থে যোগীরা ঋষিদিগকে লক্ষ্য করিয়া থাকেন, ‘ঋষি’ অর্থে বেদবর্ণিত ভাবগুলির দ্রষ্টা অর্থাৎ যাঁহারা সেইগুলিকে সাক্ষাৎ করিয়াছেন। তাঁহাদের মতে শাস্ত্রের প্রামাণ্য কেবল এইজন্য যে, উহা বিশ্বস্ত লোকের বাক্য। শাস্ত্র বিশ্বস্ত লোকের বাক্য হইলেও তাঁহারা বলেন, শুধু শাস্ত্র আমাদিগকে সত্য অনুভব করাইতে কখনই সমর্থ নয়। আমরা সমগ্র বেদ পাঠ করিলাম, তথাপি আধ্যাত্মিক তত্ত্বের অনুভূতি কিছুমাত্র হইল না। কিন্তু যখন আমরা সেই শাস্ত্রোক্ত সাধন-প্রণালী অনুসারে কার্য করি, তখনই আমরা এমন এক অবস্থায় উপনীত হই, যে-অবস্থায় শাস্ত্রোক্ত কথাগুলির প্রত্যক্ষ

উপলব্ধি হয়; যুক্তি, প্রত্যক্ষ ও অনুমান যেখানে ঘেঁষিতে পারে না, উহা সেখানেও প্রবেশ করিতে সমর্থ, সেখানে আপ্তবাক্যেরও কোন কার্যকারিতা নাই। এই সূত্রদ্বারা ইহাই প্রকাশিত হইয়াছে। প্রত্যক্ষ করাই যথার্থ ধর্ম, উহাই ধর্মের সার, আর অবশিষ্ট যাহা কিছু-যথা ধর্মবক্তৃতাশ্রবণ অথবা ধর্মপুস্তকপাঠ বা বিচার-কেবল ঐ পথের জন্য প্রস্তুত হওয়া মাত্র। উহা প্রকৃত ধর্ম নয়। কেবল বুদ্ধি দ্বারা কোন বিষয়ে সায় দেওয়া বা না-দেওয়া প্রকৃত ধর্ম নয়। যোগীদের মূল ভাব এই যে, আমরা যেমন ইন্দ্রিয়-গ্রাহ্য বিষয়ের সাক্ষাৎ সংস্পর্শে আসি, ধর্মও তেমনি ভাবে প্রত্যক্ষ করিতে পারি; বরং ধর্ম আরও গভীরভাবে অনুভূত হইতে পারে। ঈশ্বর, আত্মা প্রভৃতি ধর্মের যে-সকল প্রতিপাদ্য সত্য আছে, বহিরিন্দ্রিয় দ্বারা ঐগুলি প্রত্যক্ষ করা যাইতে পারে না। চক্ষুদ্বারা আমি ঈশ্বরকে দেখিতে পাই না বা হস্তদ্বারা ঈশ্বরকে স্পর্শ করিতে পারি না। আর ইহাও জানি যে, বিচার আমাদিগকে ইন্দ্রিয়ের অতীত প্রদেশে লইয়া যাইতে পারে না; উহা আমাদিগকে সম্পূর্ণ অনিশ্চিত প্রদেশে ফেলিয়া দিয়া চলিয়া যায়। সমস্ত জীবন আমরা বিচার করিতে পারি, তথাপি আধ্যাত্মিক তত্ত্ব প্রমাণ বা অপ্রমাণ করিতে পারিব না। এইরূপ বিচার তো সহস্রবর্ষ ধরিয়া চলিতেছে; আমরা যাহা সাক্ষাৎ অনুভব করিতে পারি, তাহাই ভিত্তিস্বরূপ করিয়া সেই ভিত্তির উপর যুক্তি, বিচারাদি করিয়া থাকি। অতএব ইহা স্পষ্টই বোধ হইতেছে যে, যুক্তিকে এই বিষয়ানুভূতিরূপ গন্ডির ভিতরেই ভ্রমণ করিতে হইবে; উহা তাহার বাহিরে কখনই যাইতে পারে না। সুতরাং আধ্যাত্মিক তত্ত্বানুভূতির ক্ষেত্র ইন্দ্রিয়ানুভূতির বাহিরে। যোগীরা বলেন, মানুষ ইন্দ্রিয়জ প্রত্যক্ষ ও বিচারশক্তি দুই-ই অতিক্রম করিতে পারে। নিজ বুদ্ধিকেও অতিক্রম করিবার শক্তি মানুষের আছে, আর এই শক্তি প্রত্যেক প্রাণীতে, প্রত্যেক জীবে অন্তর্নিহিত। যোগাভ্যাসের দ্বারা এই শক্তি জাগরিত হয়। তখন মানুষ বিচারের গন্ডি অতিক্রম করিয়া তর্কের অগম্য বিষয়সমূহ প্রত্যক্ষ করে।

তজ্জঃ সংস্কারোহন্যসংস্কারপ্রতিবন্ধী ।।৫০।।

-এই সমাধিজাত সংস্কার অন্যান্য সংস্কারের প্রতিবন্ধী হয় অর্থাৎ অন্যান্য সংস্কারকে আর আসিতে দেয় না।

আমরা পূর্বসূত্রে দেখিয়াছি যে, এই জ্ঞানাতীত ভূমিতে যাইবার একমাত্র উপায়-একাগ্রতা। আমরা দেখিয়াছি, পূর্বসংস্কারগুলিই কেবল আমাদিগের ঐ প্রকার একাগ্রতা লাভের প্রতিবন্ধক। তোমরা সকলেই লক্ষ্য করিয়াছ যে, যখনই তোমরা মনকে একাগ্র করিতে চেষ্টা কর, তখনই তোমাদের নানাপ্রকার চিন্তা আসে। যখনই ঈশ্বরচিন্তা করিতে চেষ্টা কর, ঠিক সেই সময়েই ঐ-সকল সংস্কার জাগিয়া উঠে। অন্য সময়ে এগুলি তত প্রবল থাকে না, কিন্তু যখনই এগুলিকে দূর করিবার চেষ্টা কর, তখনই উহারা নিশ্চয় আসিবে; তোমার মনকে যেন একেবারে ছাইয়া ফেলিবার চেষ্টা

করিবে। ইহার কারণ কি? এই একাগ্রতা-অভ্যাসের সময়েই এগুলি এত প্রবল হয় কেন? ইহার কারণ এই, তুমি ঐগুলিকে দমন করিবার চেষ্টা করিতেছ বলিয়াই উহারা সমুদয় বল প্রকাশ করে। অন্যান্য সময়ে উহারা ঐভাবে বল প্রকাশ করে না। এ-সকল পূর্বসংস্কারের সংখ্যাই বা কত! চিত্তের কোন স্থানে উহারা জড়ো হইয়া রহিয়াছে, আর ব্যাঘ্রের মতো লম্ফ দিয়া আক্রমণের জন্য যেন সর্বদা প্রস্তুত হইয়া রহিয়াছে। ঐগুলিকে প্রতিরোধ করিতে হইবে, যাহাতে আমরা যে ভাবটি হৃদয়ে রাখিতে ইচ্ছা করি, কেবল সেই ভাবটিই আসে, অন্যান্য ভাবগুলি চলিয়া যায়। তাহা না হইয়া ঐগুলি ঐ সময়েই আসিবার চেষ্টা করিতেছে। মনের একাগ্রতা-শক্তিকে বাধা দিবার ক্ষমতা সংস্কারসমূহের আছে। সুতরাং যে সমাধির কথা এইমাত্র বলা হইল, উহা অভ্যাস করা বিশেষ আবশ্যক, কারণ উহা ঐ সংস্কারগুলি দমন করিতে সমর্থ। এইরূপ সমাধি-অভ্যাসের দ্বারা যে সংস্কার উত্থিত হইবে, তাহা এত প্রবল হইবে যে, অন্যান্য সংস্কারের কার্য বন্ধ করিয়া তাহাদিগকে বশীভূত করিয়া রাখিবে।

তস্যাপি নিরোধে সর্ব নরোধান্নির্বীজঃ সমাধিঃ ।।৫১।।

(-অর্থাৎ যে সংস্কার অন্যান্য সমুদয় সংস্কারকে অবরুদ্ধ করে) তাহারও অবরোধ করিতে পারিলে সমুদয় নিরোধ হওয়াতে নির্বীজ সমাধি আসিয়া উপস্থিত হয়।

তোমাদের অবশ্য স্মরণ আছে, আমাদের জীবনের চরম লক্ষ্য-এই আত্মাকে সাক্ষাৎ উপলদ্ধি করা। আমরা আত্মাকে উপলব্ধি করিতে পারি না, কারণ উহা প্রকৃতি, মন ও শরীরের সহিত মিশ্রিত হইয়া গিয়াছে। অজ্ঞান ব্যক্তি নিজের দেহকেই আত্মা বলিয়া মনে করে। অপেক্ষাকৃত পন্ডিত ব্যক্তি মনকেই আত্মা বলিয়া মনে করেন। কিন্তু উভয়েই ভ্রান্ত। আত্মা এই-সকল উপাধির সহিত মিশ্রিত হন কেন? চিত্তে নানাপ্রকার তরঙ্গ উঠিয়া আত্মাকে আবৃত করে, আমরা কেবল এই তরঙ্গগুলির ভিতর দিয়াই আত্মার কিঞ্চিৎ প্রতিবিম্ব দেখিতে পাই। যদি ক্রোধরূপ তরঙ্গ উত্থিত হয়, তবে আমরা আত্মাকে ক্রোধযুক্ত মনে করি; বলিয়া থাকি আমি রুষ্ট হইয়াছি। যদি প্রেমের একটি তরঙ্গ চিত্তে উত্থিত হয়, তবে ঐ তরঙ্গ নিজেকে প্রতিবিম্বিত দেখিয়া মনে করি, আমি ভালবাসিতেছি। যদি দুর্বলতারূপ তরঙ্গ আসে, উহাতে আত্মা প্রতিবিম্বিত হয় এবং মনে করি আমি দুর্বল। এই সংস্কারগুলি আত্মার স্বরূপকে আবৃত করিলেই এই-সব বিভিন্ন ভাব উদিত হইয়া থাকে। চিত্তহ্রদে যতদিন পর্যন্ত একটি তরঙ্গও থাকিবে, ততদিন আত্মার প্রকৃত স্বরূপ অনুভূত হইবে না। যে পর্যন্ত না সকল তরঙ্গ একেবারে উপশান্ত হইয়া যাইতেছে, ততদিন আত্মার প্রকৃত স্বরূপ কখনই প্রকাশিত হইবে না। এই কারণেই পতঞ্জলি প্রথমেই শিক্ষা দেন, এই তরঙ্গ-রূপ বৃত্তগুলি কি; তার পর বলেন, ঐগুলি দমন করিবার শ্রেষ্ঠ উপায় কি। তৃতীয়তঃ শিক্ষা দিলেন-যেমন এক বৃহৎ অগ্নি ক্ষুদ্র অগ্নিকে গ্রাস করে, তেমনি একটি তরঙ্গকে কিভাবে এত প্রবল করা যায়, যাহাতে অপর তরঙ্গগুলি একেবারে উহাতে লুপ্ত হইয়া যায়। যখন একটি মাত্র তরঙ্গ অবশিষ্ট থাকিবে, তখন উহাকেও দমন করা সহজ হইবে। যখন উহাও চলিয়া যাইবে, তখনই সেই সমাধিকে নির্বীজ সমাধি বলে। তখন আর কিছুই থাকিবে না, আত্মা নিজ-স্বরূপে নিজ-মহিমায় অবস্থান করিবেন। আমরা তখনই জানিতে পারিব, আত্মা মিশ্র বা যৌগিক পদার্থ নন, আত্মাই জগতে একমাত্র নিত্য অমিশ্র মৌলিক পদার্থ, সুতরাং আত্মার জন্মও নাই, মৃত্যুও নাই; আত্মা অমর, অবিনশ্বর, নিত্য, চৈতন্যঘন সত্তা-স্বরূপ।