০১. রামায়ণ

[১৯০০ খ্রীঃ ৩১ জানুআরী ক্যালিফোর্নিয়ার অন্তর্গত প্যাসাডেনায় ‘সেক্সপীয়র ক্লাবে’ প্রদত্ত বক্তৃতা]

সংস্কৃত ভাষায় দুইখানি প্রাচীন মহাকাব্য আছে; অবশ্য আরও শত শত বীরত্বব্যঞ্জক কাব্য বিদ্যমান। যদিও প্রায় দুই সহস্র বর্ষের উপর হইল সংস্কৃত আর কথোপকথনের ভাষা নাই, তথাপি সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্য সেই প্রাচীন কাল হইতে বর্তমান কাল পর্যন্ত অবিচ্ছিন্নভাবে চলিয়া আসিয়াছে। আমি আপনাদের সমক্ষে সেই রামায়ণ ও মহাভারত নামক অতি প্রাচীন কাব্যদ্বয়ের বিষয় বলিতে যাইতেছি। ঐ দুইটিতেই প্রাচীন ভারতবাসিগণের আচার, ব্যবহার, সভ্যতা, তদানীন্তন সামাজিক অবস্থা প্রভৃতি লিপিবদ্ধ আছে। উহাদের মধ্যে আবার রামায়ণ প্রাচীনতর, উহাকে রামের জীবনচরিত বলা যায়। রামায়ণের পূর্বেও ভারতে পদ্য-সাহিত্য ছিল। হিন্দুদের পবিত্র শাস্ত্রগ্রন্থ বেদের অধিকাংশ ভাগ একপ্রকার ছন্দে রচিত; কিন্তু ভারতে সর্বসম্মতিক্রমে এই রামায়ণই আদিকাব্য বলিয়া পরিগণিত হইয়া থাকে।

রামায়ণের কবির নাম মহর্ষি বাল্মীকি। পরবর্তী কালে অপরের রচিত অনেক আখ্যানমূলক কবিতা, ঐ প্রাচীন কবি বাল্মীকির পরিচিত নামের সহিত জড়িত হইয়াছে। শেষে এমন দেখা যায় যে, অনেক শ্লোক বা কবিতা তাঁহার রচিত না হইলেও সেগুলি তাঁহারই বলিয়া মনে করা একটা প্রথা হইয়া দাঁড়াইয়াছিল। এই সকল প্রক্ষিপ্ত অংশ থাকিলেও আমরা এখন উহা যে আকারে পাইতেছি, তাহাও অতি সুন্দরভাবে গ্রথিত, জগতের সাহিত্যে উহার তুলনা নাই।

* * *

অতি প্রাচীন কালে এক স্থানে জনৈক যুবক বাস করিত। সে কোনরূপে পরিবারবর্গের ভরণপোষণ করিতে পারিত না। তাহার শরীর অতিশয় দৃঢ় ও বলিষ্ঠ ছিল। আত্মীয়বর্গের ভরণপোষণের উপায়ান্তর না দেখিয়া সে অবশেষে দস্যুবৃত্তি অবলম্বন করিল। পথিমধ্যে কাহাকেও দেখিতে পাইলেই সে তাহাকে আক্রমণ করিয়া তাহার যথাসর্বস্ব লুণ্ঠন করিত এবং ঐ দস্যুবৃত্তিলব্ধ ধন দ্বারা পিতা-মাতা স্ত্রী-পুত্র-কন্যাদির ভরণপোষণ করিত। এইরূপে বহুদিন যায়—দৈবক্রমে একদিন দেবর্ষি নারদ সেই পথ দিয়া যাইতেছিলেন; দস্যু তাঁহাকে দেখিবামাত্র আক্রমণ করিল। দেবর্ষি দস্যুকে জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘তুমি কেন আমার সর্বস্ব লুণ্ঠন করিতে প্রবৃত্ত হইয়াছ? তুমি কি জান না দস্যুতা ও নরহত্যা মহাপাপ? তুমি কি জন্য আপনাকে এই পাপের ভাগী করিতেছ?’ দস্যু উত্তরে বলিল, ‘আমি এই দস্যুবৃত্তিলব্ধ ধন দ্বারা আমার পরিবারবর্গের ভরণপোষণ করিয়া থাকি।’ দেবর্ষি বলিলেন, ‘আচ্ছা, তুমি কি মনে কর, তুমি যাহাদের জন্য এই ঘোর পাপাচরণ করিতেছ, তাহারা তোমার এই পাপের ভাগ লইবে।’ দস্যু বলিল, ‘নিশ্চয়ই, তাহারা অবশ্যই আমার পাপের ভাগ গ্রহণ করিবে।’ তখন দেবর্ষি বলিলেন, ‘আচ্ছা, তুমি এক কাজ কর। আমাকে এখানে বাঁধিয়া রাখিয়া যাও, তাহা হইলে আমি আর পলাইতে পারিব না। তার পর তুমি বাড়ি গিয়া পরিবারবর্গকে জিজ্ঞাসা করিয়া আইসঃ তাহারা যেমন তোমার ধনের ভাগ গ্রহণ করে, তেমনি তোমার পাপের ভাগ গ্রহণ করিতে প্রস্তুত কিনা?’ দেবর্ষির বাক্যে সম্মত হইয়া দস্যু তাঁহাকে সেই স্থানে বাঁধিয়া রাখিয়া গৃহাভিমুখে প্রস্থান করিল। গৃহে পৌঁছিয়াই প্রথমে পিতাকে জিজ্ঞেসা করিল, ‘পিতা, আমি কিরূপে আপনাকে ভরণপোষণ করি, তাহা কি আপনি জানেন?’ পিতা উত্তর দিলেন, ‘না আমি জানি না।’ তখন পুত্র বলিল, ‘আমি দস্যুবৃত্তি দ্বারা আপনাদের ভরণপোষণ করিয়া থাকি। আমি লোককে মারিয়া ফেলিয়া তাহার সর্বস্ব অপহরণ করি।’ পিতা এই কথা শুনিবামাত্র ক্রোধে আরক্তনয়ন হইয়া বলিয়া উঠিলেন, ‘কি! তুই এইরূপে ঘোরতর পাপাচরণে লিপ্ত থাকিয়াও আমার পুত্র বলিয়া পরিচয় দিতে সাহস করিস্, এখনই আমার সম্মুখ হইতে দূর হ। তুই পতিত, তোকে আজ হইতে ত্যাজ্য পুত্র করিলাম।’ তখন দস্যু তাহার মাতার নিকট গিয়া তাঁহাকেও ঐ প্রশ্ন করিল। সে কিরূপে পরিবারবর্গের ভরণপোষণ করে, তৎসম্বন্ধে মাতাও পিতার ন্যায় নিজ অজ্ঞতা জানাইলে দস্যু তাঁহাকে নিজের দস্যুবৃত্তি ও নরহত্যার কথা প্রকাশ করিয়া বলিল। মাতা ঐ কথা শুনিবামাত্র ভয়ে চীৎকার করিয়া উঠিয়া বলিলেন, ‘উঃ, কি ভয়ানক কথা!’ দস্যু তখন কম্পিতকণ্ঠে বলিল, ‘শোন মা, স্থির হও। ভয়ানকই হউক আর যাহাই হউক, তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞাস্য আছে—তুমি কি আমার পাপের ভাগ লইবে?’ মাতা তখন দশ হাত পিছাইয়া অম্লান বদনে বলিলেন, ‘কেন, আমি তোর পাপের ভাগ লইতে যাইব কেন? আমি তো কখনও দস্যুবৃত্তি করি নাই।’ তখন সে তাহার পত্নীর নিকট গমন করিয়া তাহাকেও পূর্বোক্ত প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিল; বলিল, ‘শোন প্রিয়ে, আমি একজন দস্যু; অনেক কাল ধরিয়া দস্যুবৃত্তি করিয়া লোকের অর্থ অপহরণ করিতেছি, আর সেই দস্যুবৃত্তিলব্ধ অর্থ দ্বারাই তোমাদের সকলের ভরণপোষণ করিতেছি; এখন আমার জিজ্ঞাস্য—তুমি কি আমার পাপের অংশ লইতে প্রস্তুত?’ পত্নী মুহূর্তমাত্র বিলম্ব না করিয়া উত্তর দিল, ‘কখনই নহে। তুমি আমার ভর্তা, তোমার কর্তব্য আমার ভরণপোষণ করা। তুমি যেরূপেই আমার ভরণপোষণ কর না কেন, আমি তোমার পাপের ভাগ কেন লইব?’

দস্যুর তখন জ্ঞাননেত্র উন্মীলিত হইল। সে ভাবিলঃ এই তো দেখিতেছি সংসারের নিয়ম! যাহারা আমার পরম আত্মীয়, যাহাদের জন্য আমি এই দস্যুবৃত্তি করিতেছি, তাহারা পর্যন্ত আমার পাপের ভাগী হইবে না। এই রূপ ভাবিতে ভাবিতে দেবর্ষিকে যেখানে বাঁধিয়া রাখিয়া আসিয়াছিল, সেখানে উপস্থিত হইয়া অবিলম্বে বন্ধন মোচন করিয়া দিল এবং তাঁহার পদতলে পতিত হইয়া সকল কথা তাহার নিকট বর্ণনা করিল। পরে সে কাতরভাবে তাঁহার নিকট বলিল, ‘প্রভো, আমায় উদ্ধার করুন, বলে দিন—আমি কি করিব।’ তখন দেবর্ষি তাহাকে বলিলেন, ‘বৎস, তুমি এই দস্যুবৃত্তি পরিত্যাগ কর। তুমি তো দেখিলে পরিবারবর্গের মধ্যে কেহই তোমায় যথার্থ ভালবাসে না, অতএব ঐ পরিবারবর্গের প্রতি আর মায়া কেন? যতদিন তোমার ঐশ্বর্য থাকিবে, ততদিন তাহারা তোমার অনুগত থাকিবে; আর যে-দিন তুমি কপর্দকহীন হইবে, সেই দিনই উহারা তোমায় পরিত্যাগ করিবে। সংসারে কেহই কাহারও দুঃখ কষ্ট বা পাপের ভাগী হইতে চায় না, কিন্তু সকলেই সুখের বা পুণ্যের ভাগী হইতে চায়। একমাত্র যিনি সুখদুঃখ, পাপপুণ্য সকল অবস্থাতেই আমাদিগের সঙ্গে সঙ্গে থাকেন, তুমি তাঁহারই উপাসনা কর। তিনি কখনও আমাদিগকে পরিত্যাগ করেন না, কারণ যথার্থ ভালবাসায় বেচাকেনা নাই, স্বার্থপরতা নাই, যথার্থ ভালবাসা অহেতুক।’

এই সকল কথা বলিয়া দেবর্ষি তাহাকে সাধনপ্রণালী শিক্ষা দিলেন। দস্যু তখন সর্বস্ব ত্যাগ করিয়া এক গভীর অরণ্যে প্রবেশ করিয়া দিবারাত্র প্রার্থনায় ও ধ্যানে নিযুক্ত হইল। ধ্যান করিতে করিতে ক্রমে দস্যুর দেহজ্ঞান এতদূর লুপ্ত হইল যে, তাহার দেহ বল্মীকস্তূপে আচ্ছন্ন হইয়া গেলেও সে তাহার কিছুই জানিতে পারিল না। অনেক বর্ষ এইরূপে অতিক্রান্ত হইলে দস্যু শুনিল, কে যেন গম্ভীরকণ্ঠে তাহাকে সম্বোধন করিয়া বলিতেছে, ‘মহর্ষি ওঠ।’ দস্যু চমকিত হইয়া বলিল, ‘মহর্ষি কে? আমি তো দস্যুমাত্র।’ গম্ভীরকণ্ঠে আবার উচ্চারিত হইলঃ তুমি এখন আর দস্যু নহ। তোমার হৃদয় পবিত্র হইয়াছে, তুমি এখন মহর্ষি। আজ হইতে তোমার পুরাতন নাম লুপ্ত হইল। এখন তুমি ‘বাল্মীকি’ নামে প্রসিদ্ধ হইবে, যেহেতু তুমি ধ্যানে এত গভীর ভাবে নিমগ্ন হইয়াছিলে যে, তোমার দেহের চারিদিকে যে বল্মীকস্তূপ হইয়া গিয়াছিল, তাহা তুমি লক্ষ্য কর নাই।—এইরূপে সেই দস্যু মহর্ষি বাল্মীকি হইল।

এই মহর্ষি বাল্মীকি কিরূপে কবি হইলেন এখন সেই কথা বলিতেছি। একদিন মহর্ষি পবিত্র ভাগীরথীসলিলে অবগাহনের জন্য যাইতেছেন, দেখিলেন এক ক্রৌঞ্চমিথুন পরস্পরকে চুম্বন করিয়া পরমানন্দে ঘুরিয়া বেড়াইতেছে। মহর্ষি ক্রৌঞ্চমিথুনের দিকে একবার চাহিয়া দেখিলেন, তাহাদের আনন্দ দেখিয়া তাঁহারও হৃদয়ে আনন্দের উদ্রেক হইল, কিন্তু মুহূর্ত মধ্যেই এই আনন্দের দৃশ্যটি শোকদৃশ্যে পরিণত হইল, কোথা হইতে একটা তীর তাঁহার পার্শ্ব দিয়া দ্রুতবেগে চলিয়া গেল। সেই তীরে বিদ্ধ হইয়া পুংক্রৌঞ্চটি পঞ্চত্বপ্রাপ্ত হইল। তাহার দেহ ভূমিতে পতিত হইবামাত্র ক্রৌঞ্চী কাতরভাবে তাহার সঙ্গীর মৃতদেহের চতুর্দিকে ঘুরিতে লাগিল। মহর্ষির অন্তর এই শোকদৃশ্য দেখিয়া পরম করুণার্দ্র হইল। কে এই নিষ্ঠুর কর্ম করিল, তাহা জানিবার জন্য তিনি ইতস্ততঃ নিরীক্ষণ করিবামাত্র এক ব্যাধকে দেখিতে পাইলেন।

তখন তাঁহার মুখ হইতে যে শ্লোক নির্গত হইল তাহার ভাবার্থঃ

ওরে ব্যাধ, তুই কি পাষণ্ড, তোর একবিন্দুও দয়ামায়া নাই! ভালবাসার খাতিরেও তোর নিষ্ঠুর হস্ত এক মুহূর্তের জন্যও হত্যাকার্যে বিরত নহে!

শ্লোকটি উচ্চারণ করিয়াই মহর্ষির মনে উদিত হইল, ‘এ, কি? এ আমি কি উচ্চারণ করিতেছি! আমি তো কখনও এমন ভাবে কিছু বলি নাই।’ তখন তিনি এক বাণী শুনিতে পাইলেনঃ বৎস ভীত হইও না, তোমার মুখ হইতে এইমাত্র যাহা বাহির হইল, ইহার নাম ‘শ্লোক’। তুমি জগতের হিতের জন্য এইরূপ শ্লোকে রামের চরিত বর্ণনা কর।—এইরূপে কবিতার প্রথম আরম্ভ হইল। আদিকবি বাল্মীকির মুখ হইতে প্রথম শ্লোক করুণাবশে স্বতই নির্গত হইয়াছিল। ইহার পর তিনি পরম মনোহর কাব্য রামায়ণ অর্থাৎ রামচরিত রচনা করিলেন।

* * *

ভারতে অযোধ্যা নামে এক প্রাচীন নগরী ছিল, উহা এখনও বর্তমান। এখনও ভারতের যে প্রদেশে ঐ নগরীর স্থান নির্দিষ্ট হয়, তাহাকে আউধ বা অযোধ্যা প্রদেশ বলে এবং আপনারাও অনেকে ভারতের মানচিত্রে ঐ প্রদেশ লক্ষ্য করিয়া থাকিবেন। উহাই সেই প্রাচীন অযোধ্যা। অতি প্রাচীন কালে সেখানে দশরথ নামে এক রাজা রাজত্ব করিতেন। তাঁহার তিন রাণী ছিলেন, কিন্তু কোন রাণীরই সন্তান-সন্ততি হয় নাই। তাই ধর্মনিষ্ঠ হিন্দু আচারের অনুবর্তী হইয়া রাজা ও রাণীগণ সন্তানকামনায় ব্রতোপবাস, দেবারাধনা প্রভৃতি নিয়ম প্রতিপালন করিতে লাগিলেন। যথাসময়ে তাঁহাদের চারটি পুত্র জন্মিল, সর্বজ্যেষ্ঠ রাম। ক্রমে এই রাজপুত্রগণ মনোহর কাব্য ‘রামায়ণ’ অর্থাৎ রামচরিত রচনা করিলেন।

জনক নামে আর একজন রাজা ছিলেন, তাঁহার সীতা নামে এক পরমাসুন্দরী কন্যা ছিল। সীতাকে একটি শস্যক্ষেত্রের মধ্যে কুড়াইয়া পাওয়া গিয়াছিল, অতএব সীতা পৃথিবীর কন্যা ছিলেন, জনক-জননী ছাড়াই তিনি ভূমিষ্ঠ হন। প্রাচীন সংস্কৃতে ‘সীতা’ শব্দের অর্থ হলকৃষ্ট ভূমিখণ্ড। তাঁহাকে ঐরূপ স্থানে কুড়াইয়া পাওয়া গিয়াছিল বলিয়াই তাঁহার এই নামকরণ হইয়াছিল। ভারতের প্রাচীন পৌরাণিক ইতিহাসে এরূপ অলৌকিক জন্মের কথা অনেক পাঠ করা যায়। কাহারও পিতা ছিলেন, মাতা ছিলেন না; কাহারও মাতা ছিলেন, পিতা ছিলেন না। কাহারও বা পিতামাতা কেহই ছিলেন না, কাহারও জন্ম যজ্ঞকুণ্ড হইতে, কাহারও বা শস্যক্ষেত্রে ইত্যাদি ইত্যাদি—ভারতের পুরাণে এ-সকল কথা আছে।

পৃথিবীর দুহিতা সীতা নিষ্কলঙ্কা ও পরম শুদ্ধস্বভাবা ছিলেন। রাজর্ষি জনকের দ্বারা তিনি প্রতিপালিত হন। তাঁহার বিবাহযোগ্য বয়ঃক্রম হইলে রাজর্ষি তাঁহার জন্য উপযুক্ত পাত্রের অনুসন্ধান করিতে লাগিলেন।

ভারতে প্রাচীনকালে স্বয়ম্বর নামক এক প্রকার বিবাহপ্রথা ছিল—তাহাতে রাজকন্যাগণ নিজ নিজ পতি নির্বাচন করিতেন। ভারতের বিভিন্ন স্থান হইতে বিভিন্নদেশীয় রাজপুত্রগণ নিমন্ত্রিত হইতেন। সকলে সমবেত হইলে রাজকন্যা বহুমূল্য বসন-ভূষণে বিভূষিত হইয়া বরমাল্যহস্তে সেই রাজপুত্রগণের মধ্য দিয়া গমন করিতেন। তাঁহার সঙ্গে সঙ্গে একজন ভাট যাইত। সে পাণিগ্রহণার্থী প্রত্যেক রাজকুমারের গুণাগুণ বংশমর্যাদাদি কীর্তন করিত। রাজকন্যা যাঁহাকে পতিরূপে মনোনীত করিতেন, তাঁহারই গলদেশে ঐ বরমাল্য অর্পণ করিতেন। তখন মহাসমারোহে পরিণয়ক্রিয়া সম্পন্ন হইত। এই সকল স্বয়ম্বরস্থলে কখনও কখনও ভাবী বরের বিদ্যা-বুদ্ধি-বল পরীক্ষার জন্য বিশেষ বিশেষ পণ নির্দিষ্ট থাকিত।

অনেক রাজপুত্র সীতাকে লাভ করিবার আকাঙ্ক্ষা করিয়াছিলেন। ‘হরধনু’ নামক এক প্রকাণ্ড ধনু যে ভাঙিতে পারিবে, সীতা তাঁহাকেই বরমাল্য প্রদান করিবেন, এ স্বয়ংবরে ইহাই ছিল পণ। সকল রাজপুত্রই এই বীর্যপরিচায়ক কর্ম সম্পাদনের জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করিয়াও অকৃতকার্য হইলেন। অবশেষে রাম ঐ দৃঢ় ধনু হস্তে লইয়া অবলীলাক্রমে দ্বিখণ্ডিত করিলেন। হরধনু ভগ্ন হইলে সীতা রাজা দশরথের পুত্র রামচন্দ্রের কণ্ঠে বরমাল্য অর্পণ করিলেন। মহামহোৎসবে রাম-সীতার পরিণয় সম্পন্ন হইল। রাম বধূকে লইয়া অযোধ্যায় ফিরিলেন।

কোন রাজার অনেকগুলি পুত্র থাকিলে রাজার দেহান্তে যাহাতে সিংহাসন লইয়া রাজকুমারগণের মধ্যে বিরোধ না হয়, সেজন্য প্রাচীন ভারতে রাজার জীবদ্দশাতেই জ্যেষ্ঠ রাজপুত্রকে যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত করিবার প্রথা প্রচলিত ছিল। রামচন্দ্রের বিবাহের পর রাজা দশরথ ভাবিলেনঃ আমি এক্ষণে বৃদ্ধ হইয়াছি, রামও বয়ঃপ্রাপ্ত হইয়াছে। অতএব এক্ষণে রামকে যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত করিবার সময় আসিয়াছে। এই ভাবিয়া তিনি অভিষেকের সমুদয় আয়োজন করিতে লাগিলেন। সমগ্র অযোধ্যা এই অভিষেক-সংবাদে মহোৎসবে প্রবৃত্ত হইল। এই সময়ে দশরথের প্রিয়তমা মহিষী কৈকেয়ীর জনৈকা পরিচারিকা—বহুকালপূর্বে রাজা রাণীকে যে দুটি বর দিতে চাহিয়াছিলেন, তাহার কথা তাঁহাকে স্মরণ করাইয়া দিল। এক সময়ে কৈকেয়ী রাজা দশরথকে এতদূর সন্তুষ্ট করিয়া ছিলেন যে, তিনি তাঁহাকে দুইটি বর দিতে প্রতিশ্রুত হন। রাজা দশরথ কৈকেয়ীকে বলিয়াছিলেন, ‘তুমি যে-কোন দুইটি বর প্রার্থনা কর, যদি আমার সাধ্যাতীত না হয়, আমি তোমাকে তৎক্ষণাৎ উহা দান করিব!’ কিন্তু কৈকেয়ী তখন রাজার নিকট কিছুই প্রার্থনা করেন নাই। তিনি ঐ বরের কথা একেবারে ভুলিয়াই গিয়াছিলেন। কিন্তু তাঁহার দুষ্টস্বভাবা দাসী তাঁহাকে এক্ষণে বুঝাইতে লাগিল, রাম সিংহাসনে বসিলে তাঁহার কোন ইষ্ট সিদ্ধ হইবে না; বরং তাঁহার পুত্র ভরত রাজা হইলে তঁহার সুখের অন্ত থাকিবে না। এইরূপে সে কৈকেয়ীর হিংসাবৃত্তি উত্তেজিত করিতে লাগিল। দাসীরা পুনঃ পুনঃ মন্ত্রণায় রাণীর হৃদয়ে প্রবল ঈর্ষার উদ্রেক হইল, তিনি অবশেষে ঈর্ষাবশে উন্মত্তপ্রায় হইলেন। তখন সেই দুষ্টা দাসী রাজার বরদান-অঙ্গীকারের বিষয় স্মরণ করাইয়া দিয়া বলিল, ‘সেই অঙ্গীকৃত বর-প্রার্থনার ইহাই উপযুক্ত সময়। তুমি এক বরে তোমার পুত্রের রাজ্যাভিষেক ও অপর বরে রামের চতুর্দশ বর্ষ বনবাস প্রার্থনা কর।’

বৃদ্ধ রাজা রামচন্দ্রকে প্রাণতুল্য ভালবাসিতেন। এদিকে কৈকেয়ী যখন রাজার নিকট ঐ দুইটি অনিষ্টকর বর প্রার্থনা করিলেন, তখন রাজা বুঝিলেন, তিনি কখনও নিজ সত্য ভঙ্গ করিতে পারিবেন না। সুতরাং তিনি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হইয়া পড়িলেন। কিন্তু রাম আসিয়া তাঁহাকে এই উভয়সঙ্কট হইতে রক্ষা করিলেন। রাম পিতৃসত্য রক্ষার জন্য স্বয়ং স্বেচ্ছাপূর্বক রাজ্যত্যাগ করিয়া বনগমনে প্রস্তুত হইলেন। এইরূপে রাম চতুর্দশ বর্ষের জন্য বনে গমন করিলেন, সঙ্গে চলিলেন প্রিয়তমা পত্নী সীতা ও প্রিয় ভ্রাতা লক্ষ্মণ। ইঁহারা কিছুতেই রামের সঙ্গ ছাড়িতে চাহিলেন না।

আর্যগণ সে-সময় ভারতের গভীর অরণ্যের অধিবাসিগণের সহিত বিশেষ পরিচিত ছিলেন না। তখন তাঁহারা বন্য জাতিদিগকে ‘বানর’ নামে অভিহিত করিতেন। আর এই তথাকথিত ‘বানর’ অর্থাৎ বন্য জাতিদের মধ্যে যাহারা অতিশয় বলবান্‌ ও শক্তিশালী হইত, তাহারা আর্যগণ কর্তৃক ‘রাক্ষস’ নামে অভিহিত হইত।

রাম, লক্ষ্মণ ও সীতা এইরূপে বানর ও রাক্ষসগণ-অধ্যুষিত অরণ্যে গমন করিলেন। যখন সীতা রামের সহিত যাইতে চাহিলেন, তখন রাম তাঁহাকে বলিয়াছিলেন, ‘তুমি রাজকন্যা হইয়া কিরূপে এই সকল কষ্ট সহ্য করিবে? অরণ্যে কখন কি বিপদ উপস্থিত হইবে, কিছুই জানা নাই। তুমি কিরূপে সেখানে আমার সঙ্গে যাইবে?’ সীতা তাহাতে উত্তর দেনঃ আর্যপুত্র যেখানে যাইবেন, সীতাও সেখানে তাঁহার সঙ্গে সঙ্গে যাইবে। আপনি আমাকে ‘রাজকন্যা’, ‘রাজবংশে জন্ম’ এ-সব কথা কি বলিতেছেন! আমাকে সঙ্গে লইতেই হইবে।—অগত্যা সীতা সঙ্গে চলিলেন। আর রামগতপ্রাণ কনিষ্ঠ ভ্রাতা লক্ষ্মণও রামের মুহূর্তমাত্র বিরহ সহ্য করিতে পারিতেন না, সুতরাং তিনিও কিছুতেই রামের সঙ্গ ছাড়িলেন না। অরণ্যে প্রবেশ করিয়া প্রথমে তাঁহারা চিত্রকূট পর্বতে কিছুদিন বাস করিলেন। পরে গভীর হইতে গভীরতর অরণ্যে গমন করিয়া গোদাবরীতীরবর্তী পরম রমণীয় পঞ্চবটী প্রদেশে কুটীর বাঁধিয়া তাঁহারা বাস করিতে লাগিলেন। রাম ও লক্ষ্মণ উভয়ে মৃগয়া করিতেন ও ফলমূল আহার করিতেন। তাহাতে তাঁহাদের জীবনযাত্রা নির্বাহ হইত। এইরূপ কিছুকাল বাস করিবার পর একদিন সেখানে এক রাক্ষসী আসিয়া উপস্থিত হইল, সে লঙ্কাধিপতি রাবণের ভগিনী। যদৃচ্ছাক্রমে অরণ্যে বিচরণ করিতে করিতে সে রামের দর্শন পাইল এবং তাঁহার রূপলাবণ্যে মোহিত হইয়া তাঁহার প্রেমাকাঙ্ক্ষিণী হইল। কিন্তু রাম মনুষ্যমধ্যে পরম শুদ্ধস্বভাব ছিলেন, তা-ছাড়া তিনি বিবাহিত; সুতরাং রাক্ষসীর প্রস্তাবে সম্মত হইতে পারিলেন না। রাক্ষসী প্রতিহিংসাবশতঃ তাহার ভ্রাতা রাক্ষসরাজ রাবণের নিকট গিয়া রামভার্যা পরমাসুন্দরী সীতার বিষয় তাহাকে সবিস্তারে জানাইল।

মনুষ্যমধ্যে রাম সর্বাপেক্ষা বীর্যবান্ ছিলেন। রাক্ষস, দৈত্য, দানব, কাহারও এত শক্তি ছিল না যে, বাহুবলে রামকে পরাস্ত করে। সুতরাং সীতাহরণের জন্য রাবণকে মায়া অবলম্বন করিতে হইল। সে অপর এক রাক্ষসের সহায়তা গ্রহণ করিল। সেই রাক্ষস পরম মায়াবী ছিল। রাবণের অনুরোধে সে স্বর্ণমৃগের রূপ ধারণ করিয়া রামের কুটীরের নিকট মনোহর নৃত্য অঙ্গভঙ্গী প্রভৃতি প্রদর্শন করিয়া ক্রীড়া করিতে লাগিল। সীতা ঐ মায়ামৃগের রূপলাবণ্য দেখিয়া মোহিত হইলেন এবং তাঁহার জন্য ঐ মৃগটিকে ধরিয়া আনিতে রামকে অনুরোধ করিলেন। রাম লক্ষ্মণকে সীতার রক্ষণাবেক্ষণে নিযুক্ত করিয়া মৃগটিকে ধরিবার জন্য বনে প্রবেশ করিলেন। লক্ষ্মণ তখন কুটীরের চতুর্দিকে একটি মন্ত্রপূত গণ্ডী কাটিয়া সীতাকে বলিলেন, ‘দেবী, আমার বোধ হইতেছে—আজ আপনার কিছু অশুভ ঘটিতে পারে। অতএব আপনাকে বলিতেছি, আপনি আজ কোনক্রমে এই মন্ত্রপূত গণ্ডীর বাহিরে যাইবেন না।’ ইতোমধ্যে রাম সেই মায়ামৃগকে বাণবিদ্ধ করিলেন, সেই মৃগও তৎক্ষণাৎ তাহার স্বাভাবিক রাক্ষসরূপ ধারণ করিয়া পঞ্চত্বপ্রাপ্ত হইল।

ঠিক সেই সময়ে কুটীরে এক গভীর আর্তনাদ শ্রুতিগোচর হইল—যেন রাম চীৎকার করিয়া বলিতেছেন, ‘লক্ষ্মণ ভাই, এস, আমায় রক্ষা কর।’ সীতা শুনিয়া অমনি লক্ষ্মণকে বলিলেন, ‘লক্ষ্মণ তুমি অবিলম্বে বনমধ্যে গমন করিয়া আর্যপুত্রকে সাহায্য কর।’ লক্ষ্মণ বলিলেন, ‘এ তো রামচন্দ্রের স্বর নহে।’ কিন্তু সীতার বারংবার সনির্বন্ধ অনুরোধে তাঁহাকে রামের অন্বেষণে যাইতে হইল। লক্ষ্মণ যেমন বাহির হইয়া কিছুদূর গিয়াছেন, অমনি রাক্ষসরাজ রাবণ ভিক্ষুর বেশ ধারণ করিয়া কুটীরের সম্মুখে আসিয়া ভিক্ষা প্রার্থনা করিল। সীতা বলিলেন, ‘আপনি কিঞ্চিৎ অপেক্ষা করুন, আমার স্বামী এখনই ফিরিবেন; তিনি আসিলেই আমি আপনাকে যথেষ্ট ভিক্ষা দিব।’ সন্ন্যাসী বলিল, ‘শুভে, আমি আর এক মুহূর্তও বিলম্ব করিতে পারিতেছি না। আমি বড়ই ক্ষুধার্ত, অতএব কুটীরে যাহা কিছু আছে, এখনই আমাকে তাহা প্রদান কর।’ এই কথায় সীতা আশ্রমে যে ফলমূল ছিল সেগুলি আনিয়া ভিক্ষুককে গণ্ডীর ভিতরে আসিয়াই তাহাকে লইতে বলিলেন। কিন্তু কপট ভিক্ষুক তাঁহাকে বুঝাইতে লাগিল—ভিক্ষাজীবীর নিকট তাঁহার ভয়ের কোন কারণ নাই, অতএব গণ্ডী লঙ্ঘন করিয়া তাহার নিকট আসিয়া অনায়াসে ভিক্ষা দিতে পারেন। ভিক্ষুর পুনঃ পুনঃ প্ররোচনায় সীতা যেমনি গণ্ডীর বাহির হইয়াছেন, অমনি সেই কপট সন্ন্যাসী নিজ রাক্ষসদেহ পরিগ্রহণ করিয়া সীতাকে বাহুদ্বারা বলপূর্বক ধারণ করিল এবং নিজ মায়ারথ আহ্বান করিয়া তাহাতে রোরুদ্যমানা সীতাকে বলপর্বক বসাইয়া তাঁহাকে লইয়া লঙ্কাভিমুখে প্রস্থান করিল। আহা! সীতা তখন নিতান্ত নিঃসহায়া, এমন কেহ সেখানে ছিল না, যে আসিয়া তাঁহাকে সাহায্য করে। যাহা হউক, রাবণের রথে যাইতে যাইতে সীতা নিজ অঙ্গ হইতে কয়েকখানি অলঙ্কার উন্মোচন করিয়া মধ্যে মধ্যে ভূমিতে নিক্ষেপ করিতে লাগিলেন।

রাবণ সীতাকে তাহার নিজ রাজ্য লঙ্কায় লইয়া গেল, সীতাকে তাহার মহিষী হইবার জন্য অনুরোধ করিল এবং তাঁহাকে সম্মত করিবার জন্য নানাবিধ প্রলোভন দেখাইতে লাগিল। কিন্তু সীতা সতীত্ব-ধর্মের সাকার বিগ্রহ ছিলেন, সুতরাং তিনি তাহার সহিত বাক্যালাপ পর্যন্ত করিলেন না। রাবণ সীতাকে শাস্তি দিবার ইচ্ছায়, যতদিন না তিনি তাহার পত্নী হইতে স্বীকৃত হন, ততদিন তাহাকে দিবারাত্র এক বৃক্ষতলে বসিয়া থাকিতে বাধ্য করিলেন।

রাম-লক্ষ্মণ কুটীরে ফিরিয়া আসিয়া যখন দেখিলেন, সেখানে সীতা নাই, তখন তাহাদের শোকের আর সীমা রইল না। সীতার কি দশা হইল, তাঁহারা ভাবিয়া কিছুই স্থির করিতে পারিলেন না। তখন দুই ভ্রাতা মিলিয়া চারিদিকে সীতার অন্বেষণ করিতে লাগিলেন, কিন্তু তাঁহারা কোনই সন্ধান পাইলেন না। অনেক দিন এইরূপ অনুসন্ধানের পর একদল ‘বানরের’ সহিত তাঁহাদের সাক্ষাৎ হইল, তাহাদের মধ্যে দেবাংশসম্ভূত হনুমানও ছিলেন। আমরা পরে দেখিব, এই বানরশ্রেষ্ঠ হনুমান রামের পরম বিশ্বস্ত অনুচর হইয়া সীতা-উদ্ধারে রামকে বিশেষ সহায়তা করিয়াছিলেন। রামের প্রতি তাঁহার ভক্তি এত গভীর ছিল যে, হিন্দুগণ এখনও তাঁহাকে প্রভুর আদর্শ সেবকরূপে পূজা করিয়া থাকেন। আপনারা দেখিতেছেন, ‘বানর’ ও ‘রাক্ষস’ শব্দে দাক্ষিণাত্যের আদিম অধিবাসিগণকে লক্ষ্য করা হইয়াছে।

এইরূপে অবশেষে ‘বানর’গণের সহিত রামের মিলন হইল। তাহারা তাঁহাকে বলিল যে, আকাশ দিয়া একখানি রথ যাইতে তাহারা দেখিয়াছিল, তাহাতে একজন ‘রাক্ষস’ বসিয়াছিল, সে এক রোরুদ্যমানা পরমাসুন্দরী রমণীকে অপহরণ করিয়া লইয়া যাইতেছিল; আর যখন রথখানি তাহাদের মস্তকের উপর দিয়া যায়, তখন সেই রমণী তাহাদের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য নিজগাত্র হইতে একখানি অলঙ্কার উন্মোচন করিয়া তাহাদের নিকট ফেলিয়া দেন। এই বলিয়া তাহারা রামকে সেই অলঙ্কার দেখাইল। প্রথমে লক্ষ্মণই সেই অলঙ্কার লইয়া দেখিলেন, কিন্তু তিনি উহা চিনিতে পারিলেন না। তখন রাম তাঁহার হস্ত হইতে অলঙ্কারটি লইয়া তৎক্ষণাৎ উহা সীতার বলিয়া চিনিলেন। ভারতে অগ্রজের পত্নীকে এতদূর ভক্তি করা হইত যে, লক্ষ্মণ সীতার বাহু বা গলদেশের দিকে কখনও চাহিয়া দেখেন নাই, সুতরাং বানরগণ-প্রদর্শিত অলঙ্কারটি সীতার কণ্ঠহার ছিল বলিয়া চিনিতে পারেন নাই। এই আখ্যানটিতে ভারতের প্রাচীন প্রথার আভাস পাওয়া যায়।

সেই সময় বানর-রাজ বালীর সহিত তদীয় কনিষ্ঠ ভ্রাতা সুগ্রীবের বিবাদ চলিতেছিল। বালী সুগ্রীবকে রাজ্য হইতে বিতাড়িত করে। রাম সুগ্রীবের পক্ষ অবলম্বন করিয়া বালীর নিকট হইতে সুগ্রীবের হৃত রাজ্য পুনরুদ্ধার করিয়া দিলেন। সুগ্রীব এই উপকারের কৃতজ্ঞতা- স্বরূপ রামকে সাহায্য করিতে সম্মত হইলেন। সীতা অন্বেষণের জন্য সুগ্রীব সর্বত্র বানর সেনা প্রেরণ করিলেন, কিন্তু কেহই তাঁহার কোন সন্ধান পাইল না। অবশেষে হনুমান এক লম্ফে সাগর লঙ্ঘন করিয়া ভারতের উপকূল হইতে লঙ্কাদ্বীপে উপনীত হইলেন। কিন্তু তথায় সর্বত্র অন্বেষণ করিয়াও সীতার কোন সন্ধান পাইলেন না।

রাক্ষসরাজ রাবণ দেব মানব সকলকে, এমন কি সমুদয় ব্রহ্মাণ্ড পর্যন্ত জয় করিয়াছিল। সে জগতের বহু সুন্দরী রমণী সংগ্রহ করিয়া বলপূর্বক তাহার উপপত্নী করিয়াছিল। হনুমান ভাবিতে লাগিলেন, ‘সীতা কখনও তাহাদের সহিত রাজপ্রাসাদে থাকিতে পারেন না। ওরূপ স্থানে বাস অপেক্ষা তিনি নিশ্চয় মৃত্যুকেও শ্রেয় জ্ঞান করিবেন।’ এই ভাবিয়া হনুমান অন্যত্র সীতার অন্বেষণ করিতে লাগিলেন। অবশেষ তিনি দেখিতে পাইলেন—সীতা এক বৃক্ষতলে উপবিষ্টা; তাঁহার শরীর অতিশয় কৃশ ও পাণ্ডুবর্ণ, তাঁহাকে দেখিয়া বোধ হইল যেন দ্বিতীয়ার শশিকলা আকাশে সবেমাত্র উদিত হইতেছে। হনুমান তখন একটি ক্ষুদ্র বানরের রূপ পরিগ্রহ করিয়া সেই বৃক্ষের উপর বসিলেন; সেখান হইতে দেখিতে লাগিলেন, রাবণপ্রেরিতা রাক্ষসীগণ আসিয়া সীতাকে নানাপ্রকার ভয় দেখাইয়া বশীভূত করিবার জন্য চেষ্টা করিতেছে, কিন্তু সীতা রাবণের নাম পর্যন্ত শুনিতেছেন না।

চেড়ীগণ প্রস্থান করিলে হনুমান নিজরূপ ধারণ করিয়া সীতার নিকটে উপস্থিত হইয়া বলিলেন, ‘দেবী, রামচন্দ্র আপনার অন্বেষণের জন্য আমাকে প্রেরণ করিয়াছেন, আমি তাঁহার দূত হইয়া এখানে আসিয়াছি।’ এই বলিয়া তিনি সীতার প্রত্যয়-উৎপাদনের জন্য চিহ্নস্বরূপ রামচন্দ্রের অঙ্গুরীয়ক তাঁহাকে দেখাইলেন। তিনি সীতাকে আরও জানাইলেন যে, সীতা কোথায় আছে জানিতে পারিলেই রামচন্দ্রের স্বসৈন্য লঙ্কায় আসিয়া রাক্ষসরাজকে জয় করিয়া তাঁহাকে উদ্ধার করিবেন। এই সকল কথা সীতাকে নিবেদন করিয়া হনুমান অবশেষে করজোড়ে বলিলেন, ‘দেবীর যদি ইচ্ছা হয় তো দাস আপনাকে স্কন্ধে লইয়া এক লম্ফে সাগর পার হইয়া রামচন্দ্রের নিকট পৌঁছিতে পারে।’ কিন্তু সীতা মূর্তিমতী পবিত্রতা; সুতরাং হনুমানের অভিপ্রায় মত কার্য করিতে গেলে পতি ব্যতীত অন্য পুরুষের অঙ্গ স্পর্শ হইবে বলিয়া তিনি হনুমানের সে কথায় কর্ণপাত করিলেন না। হনুমান যথার্থই সীতার সন্ধান পাইয়াছেন, রামচন্দ্রের এই বিশ্বাস উৎপাদনের জন্য তিনি শুধু তাঁহাকে নিজ মস্তক হইতে চূড়ামণি প্রদান করিলেন। হনুমান ঐ চূড়ামণি লইয়া রামচন্দ্রের নিকট প্রস্থান করিলেন।

হনুমানের নিকট হইতে সীতার সংবাদ অবগত হইয়া রামচন্দ্র একদল বানরসৈন্য সংগ্রহ করিয়া ভারতের সর্বশেষ প্রান্তে উপনীত হইলেন। সেখানে রামের বানরগণ এক প্রকাণ্ড সেতু নির্মাণ করিল। উহার নাম ‘সেতুবন্ধ’—ঐ সেতু ভারতের সহিত লঙ্কার সংযোগ সাধন করিয়া দিয়াছে। খুব ভাঁটার সময় এখনও ভারত হইতে লঙ্কায় বালুকাস্তূপের উপর দিয়া হাঁটিয়া পার হওয়া যায়।

অবশ্য রাম ঈশ্বরাবতার ছিলেন, নতুবা তিনি এ-সকল দুষ্কর কর্ম কিরূপে সম্প্রদান করিলেন? হিন্দুদের মতে রামচন্দ্র ঈশ্বরের অবতার ছিলেন। ভারতবাসিগণ তাঁহাকে ঈশ্বরের সপ্তম অবতার বলিয়া বিশ্বাস করিয়া থাকে।

বানরগণ সেতুবন্ধনের সময় এক একটা প্রকাণ্ড পাহাড় উৎপাটন করিয়া আনিয়া সমুদ্রে স্থাপন করিল এবং তাহার উপর রাশীকৃত শিলাখণ্ড ও মহীরূহ নিক্ষেপ করিয়া প্রকাণ্ড সেতু প্রস্তুত করিতেছিল। তাহারা দেখিল, একটা কাঠবিড়াল বালুকার উপর গড়াগড়ি দিতেছে, তারপর সেতুর উপর আসিয়া এদিক ওদিক করিতেছে এবং নিজের গা ঝাড়া দিতেছে। এইরূপে সে নিজের সামর্থ্যানুসারে বালুকা প্রদান করিয়া রামচন্দ্রের সেতু-নির্মাণকার্যে সাহায্য করিতেছিল। বানরগণ তাহার এই কার্য দেখিয়া হাস্য করিতে লাগিল। তাহারা এক-একজন একবারেই এক-একটি পাহাড়, এক-একটি জঙ্গল ও রাশীকৃত বালুকা লইয়া আসিতেছিল, সুতরাং কাঠবিড়ালটির ঐরূপ বালুকার উপর গড়াগড়ি ও গা ঝাড়া দেখিয়া হাস্য সংবরণ করিতে পারিতেছিল না। রামচন্দ্র ইহা লক্ষ্য করিয়া বানরগণকে সম্বোধন করিয়া বলিলেন, ‘কাঠবিড়ালটির মঙ্গল হইক, সে তার প্রাণপণ শক্তি প্রয়োগ করিয়া তাহার কার্যটুকু করিতেছে, অতএব সে তোমাদের মধ্যে যে শ্রেষ্ঠ, তাহার প্রমাণ।’ এই বলিয়া তিনি আদর করিয়া তাহার পৃষ্ঠে হাত বুলাইলেন। এখনও কাঠবিড়ালের পৃষ্ঠে যে লম্বালম্বি দাগ দেখিতে পাওয়া যায়, লোকে বলে উহা রামচন্দ্রের অঙ্গুলির দাগ।

সেতুনির্মাণকার্য শেষ হইলে রাম ও তাঁহার ভ্রাতা কর্তৃক পরিচালিত হইয়া সমুদয় বানরসৈন্য লঙ্কায় প্রবেশ করিল। তারপর কয়েক মাস ধরিয়া রামচন্দ্রের সহিত রাবণের ঘোরতর যুদ্ধ হইল; অজস্র রক্তপাত হইতে লাগিল; অবশেষে রাক্ষসাধিপ রাবণ পরাজিত ও নিহত হইল। তখন সুবর্ণময় প্রাসাদভূষিত রাবণের রাজধানী রামচন্দ্রের হস্তগত হইল। ভারতের সুদূর পল্লীগ্রামে ভ্রমণ করিতে করিতে সেখানকার লোকদিগকে ‘আমি লঙ্কায় গিয়াছি’ বলিলে তাহারা বলিত, ‘আমাদের শাস্ত্রে আছে যে, সেখানকার সমুদয় গৃহ সুবর্ণ-নির্মিত।’ যাহা হউক, এই স্বর্ণময়ী লঙ্কা রামচন্দ্রের হস্তগত হইল। রাবণের কনিষ্ঠ ভ্রাতা বিভীষণ যুদ্ধকালে রামের পক্ষ লইয়া তাঁহাকে যথেষ্ট সাহায্য করিয়াছিলেন। সেই সাহায্যের প্রতিদানস্বরূপ রামচন্দ্র বিভীষণকে এই সুবর্ণময়ী লঙ্কা প্রদান করিলেন এবং রাবণের স্থানে তাঁহাকে লঙ্কার সিংহাসনে বসাইলেন। বিভীষণ লঙ্কার সিংহাসনে আরোহণ করিলে সীতা ও অনুচরবর্গের সঙ্গে রাম লঙ্কা পরিত্যাগ করিলেন।

রাম যখন অযোধ্যা পরিত্যাগ করিয়া বনে গমন করেন, তখন রামের অনুজ কৈকেয়ীতনয় ভরত মাতুলালয়ে ছিলেন, সুতরাং তিনি রামের বনগমনের বিষয়ে কিছুই জানিতেন না; অযোধ্যায় আসিয়া যখন সকল কথা শুনিলেন, তখন তাঁহার আনন্দ হওয়া দূরে থাকুক, শোকের সীমা রইল না। বৃদ্ধ রাজা দশরথও এই সময়ে রামের শোকে অধীর হইয়া প্রাণত্যাগ করেন। ভরত ক্ষণকাল বিলম্ব না করিয়া অরণ্যে রামসমীপে উপনীত হইয়া তাঁহার পিতার স্বর্গগমনবার্তা নিবেদন করিলেন এবং ফিরাইয়া লইয়া যাইবার নিমিত্ত সনির্বন্ধ অনুরোধ করিতে লাগিলেন। কিন্তু রাম তাহাতে কোনমতেই সম্মত হইলেন না। তিনি বলিলেন, ‘চতুর্দশ বর্ষ বনে বাস না করিলে পিতৃসত্য কোনরূপে রক্ষিত হইবে না।’ চতুর্দশ বর্ষ পরে তিনি ফিরিয়া গিয়া রাজ্য গ্রহণ করিবেন। রামচন্দ্র ভরতকে রাজ্যপালনের জন্য বারবার অনুরোধ করিতে থাকিলে অবশেষে বাধ্য হইয়া তাঁহাকে রামের আজ্ঞা পালন করিতে হইল। কিন্তু তিনি জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার প্রতি পরম অনুরাগ ও ভক্তিবশতঃ স্বয়ং সিংহাসনে বসিতে কোনমতে সম্মত হইলেন না; সিংহাসনের উপর রামচন্দ্রের কাষ্ঠপাদুকা স্থাপন করিয়া স্বয়ং তাঁহার প্রতিনিধিরূপে রাজ্য শাসন করিতে লাগিলেন।

সীতা-উদ্ধারের পরই রামচন্দ্রের চতুর্দশ বর্ষ বনবাসের সময় পূর্ণ হইয়া আসিয়াছিল। সুতরাং ভরত তাঁহার প্রত্যাবর্তনের জন্য সাগ্রহে প্রতীক্ষা করিতেছিলেন। রামচন্দ্র অযোধ্যায় প্রত্যাবৃত্ত হইতেছেন জানিতে পারিয়া তিনি প্রজাবর্গের সহিত অগ্রসর হইয়া তাঁহার অভ্যর্থনা করিলেন এবং তাঁহাকে সিংহাসন আরোহণ করিবার জন্য সনির্বন্ধ অনুরোধ করিতে লাগিলেন। সকলের অনুরোধে রামচন্দ্র অযোধ্যার সিংহাসনে আরোহণ করিতে স্বীকৃত হইলেন। মহাসমারোহে তাঁহার অভিষেকক্রিয়া সম্পন্ন হইল। প্রাচীনকালে সিংহাসন আরোহণের সময় প্রজাগণের কল্যাণার্থে রাজাকে যে-সকল ব্রত গ্রহণ করিতে হইত, রাম যথাবিধানে সেগুলি গ্রহণ করিলেন। তখনকার রাজগণ প্রজাবর্গের সেবকস্বরূপ ছিলেন, তাঁহাদিগকে প্রজাবর্গের মতামতের অধীন হইয়া চলিতে হইত। আমরা এখনই দেখিব, এই প্রজারঞ্জনের জন্য রামচন্দ্রকে নিজ প্রাণ অপেক্ষাও প্রিয়তর বস্তুকে কেমন মমতাশূন্য হইয়া পরিত্যাগ করিতে হইয়াছিল। রাম অপত্যনির্বিশেষে প্রজাপালন করিতে লাগিলেন এবং সীতার সহিত পরম সুখে কাটাইলেন।

এইরূপ কিছুকাল অবগত হইলে একদিন রামচন্দ্র চরমুখে অবগত হইলেন যে, রাক্ষস কর্তৃক অপহৃতা সমুদ্রপারনীতা সীতাকে তিনি গ্রহণ করায় প্রজাবর্গ অতিশয় অসন্তোষ প্রকাশ করিতেছে। রাবণবিজয়ের পরই রামচন্দ্র সীতাকে গ্রহণ করিবার পূর্বে সকলকে সন্তুষ্ট করিবার জন্য স্বয়ং তাঁহাকে বিশুদ্ধস্বভাবা জানিয়াও সমবেত বানর ও রাক্ষসগণের সম্মুখে অগ্নিপরীক্ষা করিয়াছিলেন। সীতা যখন অগ্নিতে প্রবেশ করিলেন, তখন রামচন্দ্র এই ভাবিয়া শোকে মুহ্যমান হইলেন—বুঝি সীতাকে হারাইলাম, কিন্তু পরক্ষণেই সকলে বিস্মিত হইয়া দেখিল, অগ্নিদেব স্বয়ং সেই অগ্নিমধ্য হইতে উত্থিত হইতেছেন। তাঁহার মস্তকে এক হিরণ্ময় সিংহাসন, তদুপরি সীতাদেবী উপবিষ্ট। ইহা দেখিয়া রামচন্দ্রের এবং সমবেত সকলের আনন্দের সীমা রইল না। রাম পরম সমাদরে সীতাকে গ্রহণ করিলেন। অযোধ্যার প্রজাবর্গ এই অগ্নিপরীক্ষার বিষয় অবগত ছিল, কিন্তু তাহারা উহা দেখে নাই, তাহারা ইহাতে সন্তুষ্ট হয় নাই। তাহারা পরস্পর বলাবলি করিত, সীতা রাবণগৃহে বহুকাল বাস করিয়াছিলেন, তিনি যে সেখানে সম্পূর্ণ বিশুদ্ধস্বভাবা ছিলেন, তাহার প্রমাণ কি? রাজা এইরূপ অবস্থায় সীতাকে গ্রহণ করিয়া ধর্মবিগর্হিত কার্য করিতেছেন; হয় সর্বসমক্ষে আবার পরীক্ষা দিতে হইবে, নতুবা তাঁহাকে বিসর্জন করাই রাজার পক্ষে শ্রেয়।

প্রজাগণের সন্তোষের জন্য সীতা অরণ্যে নির্বাসিতা হইলেন। যে স্থানে সীতা পরিত্যক্তা হইলেন, তাহার অতি নিকটেই আদিকবি মহর্ষি বাল্মীকির আশ্রম ছিল। মহর্ষি তাঁহাকে একাকিনী রোরুদ্যমানা দেখিতে পাইলেন এবং তাঁহার দুঃখের কাহিনী শুনিয়া তাঁহাকে নিজ আশ্রমে স্থান দিলেন। সীতা তখন আসন্নপ্রসবা ছিলেন; ঐ আশ্রমেই তিনি দুইটি যমজ পুত্র প্রসব করিলেন। উপযুক্ত বয়স হইলে মহর্ষি তাহাদিগকে ব্রহ্মচর্যব্রত গ্রহণ করাইয়া যথাবিধানে শিক্ষা দিতে লাগিলেন।

এই সময়ে তিনি রামায়ণ নামক কাব্য রচনা করিয়া উহাতে সুর-তাল সংযোজন করেন।

ভারতে নাটক ও সঙ্গীত অতি পবিত্র বস্তু বলিয়া বিবেচিত হইয়া থাকে। এগুলিকে লোকে ধর্মসাধনের সহিত অভিন্ন জ্ঞান করিয়া থাকে। লোকের ধারণা—প্রেমসঙ্গীতই হউক বা যাহাই হউক, সঙ্গীতমাত্রেই যদি কেহ তন্ময় হইয়া যাইতে পারে, তবে তাহার অবশ্যই মুক্তিলাভ হইয়া থাকে। তাহাদের বিশ্বাস—ধ্যানের দ্বারা যে ফল লাভ হয়, সঙ্গীতেও তাহা হইয়া থাকে।

যাহা হউক, বাল্মীকি রামায়ণে সুর-তাল সংযোগ করিয়া রামের পুত্রদ্বয়কে উহা গাহিতে শিখাইলেন।

ভারতে প্রাচীন রাজগণ মধ্যে মধ্যে অশ্বমেধাদি বড় বড় যজ্ঞ করিতেন, রামচন্দ্রও তদনুসারে অশ্বমেধ যজ্ঞ করিবার সঙ্কল্প করিলেন। কিন্তু তখন গৃহস্থ ব্যক্তির পত্নী ব্যতীত কোন ধর্মানুষ্ঠান করিবার অধিকার ছিল না, ধর্মকার্যের সময়ে পত্নী অবশ্যই সঙ্গে থাকিবে। সেইজন্য পত্নীর অপর একটি নাম সহধর্মিণী—যাঁহার সহিত একত্রে মিলিত হইয়া ধর্মকার্য অনুষ্ঠান করিতে হয়। হিন্দু গৃহস্থকে শত শত প্রকার ধর্মানুষ্ঠান করিতে হইত, কিন্তু ধর্মানুষ্ঠানকালে পত্নী সঙ্গে থাকিয়া তাঁহার কর্তব্যটুকু না করিলে কোন ধর্মকার্যই বিধিমত অনুষ্ঠিত হইত না।

যাহা হউক, সীতাকে বনে বিসর্জন দেওয়াতে রাম কিরূপে বিধিপূর্বক সস্ত্রীক অশ্বমেধ যজ্ঞ সম্পন্ন করিবেন, এখন এই প্রশ্ন উঠিল। প্রজাগণ তাঁহাকে পুনরায় বিবাহ করিতে অনুরোধ করিল। কিন্তু রামচন্দ্র জীবনে এই প্রথমবার প্রজাগণের মতের বিরুদ্ধে দণ্ডায়মান হইলেন। তিনি বলিলেন, ‘তাহা কখনও হইতে পারে না। আমি সীতাকে বিসর্জন দিয়াছি বটে, কিন্তু আমার হৃদয় সীতার নিকট পড়িয়া আছে।’ সুতরাং শাস্ত্রবিধি রক্ষা করিবার জন্য সীতার প্রতিনিধিরূপে তাঁহার এক সুবর্ণময়ী মূর্তি নির্মিত হইল। এই যজ্ঞমহোৎসবে সর্বসাধারণের ধর্মভাব ও আনন্দবর্ধনের জন্য সঙ্গীতের আয়োজনও হইয়াছিল; কবিগুরু মহর্ষি বাল্মীকি নিজ শিষ্য দুইটিকেকে সঙ্গে লইয়া যজ্ঞস্থলে উপস্থিত হইলেন। বলা বাহুল্য, উহারা রামের অজ্ঞাত তাঁহারই পুত্র লব ও কুশ। সভাস্থলে একটি রঙ্গমঞ্চ নির্মিত হইয়াছিল এবং বাল্মীকিপ্রণীত রামায়ণ-গানের জন্য সকল আয়োজন সম্পূর্ণ ছিল।

সভাস্থলে রাম ও তদীয় অমাত্যবর্গ এবং অযোধ্যার প্রজাবৃন্দ শ্রোতৃমণ্ডলীরূপে আসন গ্রহণ করিলেন। বিপুল জনতার সমাবেশ হইল। বাল্মীকির শিক্ষামত লব ও কুশ রামায়ণের গান করিতে লাগিল; তাহাদের মনোহর রূপলাবণ্য-দর্শনে ও মধুস্বর-শ্রবণে সমগ্র সভামণ্ডলী মন্ত্রমুগ্ধ হইল। সীতার প্রসঙ্গ বার বার শ্রবণ করিয়া রাম উন্মত্তপ্রায় হইয়া উঠিলেন, আর যখন সীতার বিসর্জন-প্রসঙ্গ আসিল, তখন তিনি কিংকর্তব্যবিমূঢ় ও বিহ্বল হইয়া পড়িলেন। মহর্ষি রামকে বলিলেন, ‘আপনি শোকার্ত হইবেন না, আমি সীতাকে আপনার সমক্ষে লইয়া আসিতেছি।’ এই বলিয়া বাল্মীকি সভাস্থলে সীতাকে আনিলেন। সীতাকে দেখিয়া অতিশয় বিহ্বল হইলেও প্রজাবর্গের সন্তোষের জন্য রামকে সভাসমক্ষে সীতার বিশুদ্ধতার পুনরায় পরীক্ষাদানের প্রস্তাব করিতে হইল। বারংবার তাঁহার উপর এরূপ নিষ্ঠুর অবহেলা হতভাগিনী সীতা আর সহ্য করিতে পারিলেন না। তিনি নিজ বিশুদ্ধতার প্রমাণ দিবার জন্য দেবগণের নিকট ব্যাকুলভাবে প্রার্থনা করিতে লাগিলেন, তখন হঠাৎ পৃথিবী দ্বিধা হইল। সীতা উচ্চৈঃস্বরে বলিয়া উঠিলেন. ‘এই আমার পরীক্ষা।’ এই কথা বলিয়া তিনি পৃথিবীর বক্ষে অন্তর্হিতা হইলেন। প্রজাবর্গ এই অদ্ভুত ও শোচনীয় ব্যাপার-দর্শনে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হইল। রাম শোকে মুহ্যমান হইলেন।

সীতা অন্তর্ধানের কিছুকাল পরে দেবগণের নিকট হইতে জনৈক দূত আসিয়া রামকে বলিলেন, ‘পৃথিবীতে আপনার কার্য শেষ হইয়াছে। অতএব আপনি এক্ষণে স্বধাম বৈকুণ্ঠে চলুন।’ এই বাক্যে রামের স্বরূপ-স্মৃতি জাগরিত হইল। তিনি অযোধ্যার নিকট সরিদ্বরা সরযূর জলে দেহ বিসর্জন করিয়া বৈকুণ্ঠে সীতার সহিত মিলিত হইলেন।

ভারতের প্রাচীন শ্রেষ্ঠ পৌরাণিক কাব্য রামায়ণের আখ্যায়িকা অতি সংক্ষেপে বর্ণিত হইল। রাম ও সীতা ভারতবাসীদের আদর্শ। ভারতের বালকবালিকাগণ, বিশেষতঃ বালিকামাত্রেই সীতার পূজা করিয়া থাকে। ভারতীয় নারীগণের চরম উচ্চাকাঙ্ক্ষা—পরমশুদ্ধস্বভাবা, পতিপরায়ণা, সর্বংসহা সীতার মত হওয়া। এই সকল চরিত্র আলোচনা করিবার সময় আপনারা পাশ্চাত্যের আদর্শ হইতে ভারতীয় আদর্শ কতদূর ভিন্ন, তাহা সহজেই বুঝিতে পারিবেন। সমগ্র ভারতবাসীর সমক্ষে সীতা যেন সহিষ্ণুতার উচ্চতম আদর্শ- রূপে আজও বর্তমান। পাশ্চাত্য দেশের বক্তব্য, ‘কর্ম কর, কর্ম করিয়া তোমার শক্তি দেখাও।’ ভারতের বক্তব্য ‘দুঃখকষ্ট সহ্য করিয়া তোমার শক্তি দেখাও।’ মানুষ কত অধিক বিষয়ের অধিকারী হইতে পারে, পাশ্চাত্য এই সমস্যা পূরণ করিয়াছে। মানুষ কত অল্প লইয়া থাকিতে পারে, ভারত এই সমস্যা পূরণ করিয়াছে। এই দুইটি আদর্শই এক এক ভাবের চরম সীমা। সীতা যেন ভারতীয় ভাবের প্রতিনিধিস্বরূপা, যেন মূর্তিমতী ভারতমাতা। সীতা বাস্তবিক ছিলেন কিনা, সীতার উপাখ্যানের কোন ঐতিহাসিক ভিত্তি আছে কিনা, এ বিষয় লইয়া আমরা বিচার করিতেছি না, কিন্তু আমরা জানি—সীতাচরিত্রে যে আদর্শ প্রদর্শিত হইয়াছে, সেই আদর্শ ভারতে এখনও বর্তমান। সীতাচরিত্রের আদর্শ যেমন সমগ্র ভারতে অনুস্যূত হইয়াছে, যেমন সমগ্র জাতির জীবনে—সমগ্র জাতির অস্থিমজ্জায় প্রবেশ করিয়াছে, যেমন উহার প্রত্যেক শোণিতবিন্দুতে পর্যন্ত প্রবাহিত হইয়াছে, অন্য কোন পৌরাণিক উপাখ্যানে বর্ণিত আদর্শ তেমন হয় নাই। ভারতে যাহা কিছু শুভ, যাহা কিছু বিশুদ্ধ, যাহা কিছু পুণ্য, ‘সীতা’ নামটি তাহারই পরিচায়ক। নারীগণের মধ্যে আমরা যে-ভাবকে নারীজনোচিত বলিয়া শ্রদ্ধা ও আদর করিয়া থাকি, ‘সীতা’ বলিতে তাহাই বুঝাইয়া থাকে। ব্রাহ্মণ যখন নারীকে আশীর্বাদ করেন, তিনি তাহাকে বলিয়া থাকেন, ‘সীতার মত হও’; বালিকাকে আশীর্বাদ করিবার সময়ও তাহাই বলা হয়। ভারতীয় নারীগণ সকলেই সীতার সন্তান। তাঁহারা সহিষ্ণুতার প্রতিমূর্তি, সর্বংসহা, সদা-পতিপরায়ণা, নিত্য-পবিত্র সীতার মত হইতে চেষ্টা করিয়া থাকেন। তিনি এত দুঃখ সহিয়াছেন, কিন্তু রামের উদ্দেশ্যে একটি কর্কশ বাক্যও তাঁহার মুখ দিয়া কখনও নির্গত হয় নাই। এ-সকল দুঃখকষ্ট সহ্য করাকে তিনি নিজ কর্তব্য বলিয়া ভাবিয়াছেন এবং স্থির শান্তভাবে উহা সহ্য করিয়া গিয়াছেন। অরণ্যে সীতার নির্বাসন-ব্যাপার তাঁহার প্রতি কি ঘোর অবিচার ভাবিয়া দেখুন, কিন্তু সেজন্য তাঁহার চিত্তে বিন্দুমাত্র বিরক্তি নাই। এইরূপ তিতিক্ষাই ভারতের বিশেষত্ব। ভগবান্‌ বুদ্ধ বলিয়া গিয়াছেন, ‘আঘাতের পরিবর্তে আঘাত করিলে সেই আঘাতের কোন প্রতিকার হইল না, উহাতে কেবল জগতের একটি পাপের বৃদ্ধিমাত্র হইবে।’ ভারতের এই বিশেষ ভাবটি সীতার প্রকৃতিগত ছিল, তিনি আঘাতের প্রতিঘাত করিবার চিন্তা পর্যন্ত কখনও করেন নাই।

কে জানে, এই দুইটি আদর্শের মধ্যে কোন‍্‍টি শ্রেষ্ঠ—পাশ্চাত্য-মতানুযায়ী এই আপাতপ্রতীয়মান শক্তি ও তেজ, অথবা প্রাচ্যদেশীয় কষ্টসহিষ্ণুতা ও তিতিক্ষা?

পাশ্চাত্যবাসীরা বলেন, ‘দুঃখ-কষ্টের প্রতিকার করিয়া, উহা নিবারণ করিয়া আমরা দুঃখ কমাইবার চেষ্টা করিতেছি।’ ভারতবাসী বলেন, ‘দুঃখ-কষ্ট সহ্য করিয়া আমরা উহাকে নষ্ট করিবার চেষ্টা করিতেছি। এইরূপ সহ্য করিতে করিতে আমাদের পক্ষে দুঃখ বলিয়া আর কিছু থাকিবে না, উহাই আমাদের পরমসুখ হইয়া দাঁড়াইবে।’ যাহাই হউক, এই দুইটি আদর্শের জয় কোনটিই হেয় নহে। কে জানে—পরিণামে কোন্ আদর্শের জয় হইবে? কে জানে—কোন্ ভাব অবলম্বন করিয়া মানবজাতির যথার্থ কল্যাণ সর্বাপেক্ষা অধিক হইবে? কে জানে, কোন্ ভাব অবলম্বন করিলে পশুভাবকে বশীভূত করিয়া তাহার উপর আধিপত্য করা সম্ভব হইবে? সহিষ্ণুতা বা ক্রীয়াশীলতা, অপ্রতিকার বা প্রতিকার?

পরিণামে যাহাই হউক, ইতোমধ্যে যেন আমরা পরস্পরের আদর্শ নষ্ট করিয়া দিবার চেষ্টা না করি। আমরা উভয় জাতিই এক ব্রতে ব্রতী—সেই ব্রত সম্পূর্ণ দুঃখনিবৃত্তি। আপনারা আপনাদের ভাবে কার্য করিয়া যান, আমরা আমাদের পথে চলি। কোন আদর্শকে, কোন প্রণালীকে, কোন পথকে উড়াইয়া দিলে চলিবে না। আমি পাশ্চাত্যগণকে এ কথা কখনও বলি না, ‘আপনারা আমাদের প্রণালী অবলম্বন করুন’; কখনই নহে। লক্ষ্য একই, কিন্তু উপায় কখনও এক হইতে পারে না। অতএব আমি আশা করি—আপনারা ভারতের আদর্শ, ভারতের সাধন-প্রণালীর কথা শুনিয়াই ভারতকে সম্বোধন করিয়া বলিবেন, ‘আমরা জানি, আমাদের উভয় জাতির লক্ষ্য একই, এবং আমাদের উভয়ের ঐ লক্ষ্যে পঁহুছিবার যে দুইটি উপায়, তাহাও আমাদের পরস্পরের ঠিক উপযোগী। আপনারা আপনাদের আদর্শ, আপনাদের প্রণালী অনুসরণ করুন, ঈশ্বরেচ্ছায় আপনাদের উদ্দেশ্য সফল হউক।’ আমি প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য উভয় জাতিকে বলি, বিভিন্ন আদর্শ লইয়া বিবাদ করিও না, যতই বিভিন্ন প্রতীয়মান হউক, তোমাদের উভয়ের লক্ষ্য একই। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সম্মিলন-চেষ্টাই আমার জীবনব্রত। জীবনের উপত্যকার আঁকাবাঁকা পথে চলিবার সময় আমরা যেন পরস্পরকে বলিতে পারি, ‘তোমার যাত্রা সফল হউক।’